৬০. পুরো এলাকাটা জনমানবশূন্য প্রায়

অধ্যায় ৬০

পুরো এলাকাটা জনমানবশূন্য প্রায়। বৃষ্টির তোড় এখন একটু কমে এসেছে। তবে আকাশ এখনও মেঘাচ্ছন্ন। যেকোনো সময় শুরু হয়ে যেতে পারে প্রবল বর্ষণ।

মেঘলা দূর থেকে দেখতে পেলো লেকের পাড়ে কংক্রিটের একটি বেঞ্চে বসে আছে একজন। একেবারে পাথরের মূর্তির মতোই স্থির। যেনো ধ্যানমগ্ন হয়ে সেই বৃষ্টি মেখে নিজেকে শুদ্ধ করে নিচ্ছে।

বাবলু!

মাথার উপর ছাতাটা তুলে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো তার দিকে।

একটু আগেও ভেবেছিলো এতোদূর এসে বুঝি বাবলুর সাথে আর দেখা হবে না। তার মন ভেঙে গেছিলো। কিন্তু ম্যানেজার ভদ্রলোক বৃষ্টির মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। তাকে দেখেই চিনতে পারে। এইতো গত সপ্তাহে মিস্টার এবং মিসেস চৌধুরি সপরিবারে এখানে এসেছিলেন। ম্যানেজার বুঝতে পারে, তার কাছে ফোন করে তওফিক সাহেবকে এই মহিলাই চাচ্ছিলো।

“ও কোথায়?”

মেঘলার এ প্রশ্নের জবাবে ম্যানেজার লোকটি কেবল ইশারা করে দূর থেকে দেখিয়ে দেয় লেকের এদিকটা।

কংক্রিটের বেঞ্চটার কাছে আসতেই বাবলু টের পেয়ে পেছন ফিরে তাকালো। তার চোখেমুখে সীমাহীন অবিশ্বাস। যেনো সত্যিকারের কিছু দেখছে না-মরীচিকা, স্বপ্ন কিংবা বিভ্রম!

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।

মেঘলা দেখতে পেলো বাবলুর নাকের নীচটা ফোলা, বাম চোখের নীচে কালচে দাগ।

“তুমি!” আস্তে করে বলেই উঠে দাঁড়ালো সে।

মেঘলা বুঝতে পারলো না তার চোখ বেয়ে কেন নীরব অশ্রুপাত হচ্ছে। নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্নাটাকে দমন করলো সে।

তারপরই শিশুদের মতো নিষ্পাপ হাসি ফুটে উঠলো বাবলুর ঠোঁটে।

মেঘলা এগিয়ে এসে তাকে ছাতার নীচে নিয়ে নিলো। “তোমার কি হয়েছিলো?” বাবলুর এক হাত ধরে ফেললো সে। “আমার সাথে আর যোগাযোগ করো নি কেন? তুমি ঠিক আছো তো?”

“ঠিক আছি,” দু’হাতে মেঘলার মুখটা ধরে বললো বাবলু। “ভয় পেয়ে গেছিলে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

নিঃশব্দে হেসে ফেললো বাবলু। “তোমার মেয়ে এখন কেমন আছে?”

“ভালো আছে…” কম্পিত কণ্ঠে বললো মেঘলা। “আজ সকালে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়েছে ওকে।”

তার চোখ দিয়ে অশ্রুপাত হচ্ছে। বাবলু চেয়ে রইলো সেই চোখের দিকে। একটু কাছে এগিয়ে এসে মেঘলার চোখের জল মুছে দিলো হাত দিয়ে।

“তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে,” বললো সে। “আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছে।”

একটু লজ্জা পেলো মেঘলা। তার চোখ ঘুরে বেড়ালো বাবলুর মুখের উপর। “তোমার কি হয়েছিলো?”

“তেমন কিছু না।”

“কালরাতে আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম কিন্তু ফোনটা অন্য একজন ধরেছিলো। সে কে?”

চুপ মেরে রইলো বাবলু। সে বুঝতে পারছে ফোনটা ধরেছিলো জেফরি বেগ। “দিহানকে উদ্ধার করার পর ছোটোখাটো একটা ঝামেলা হয়ে গেছিলো,” অবশেষে বললো সে, যদিও সত্যি কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে না।

“ঝামেলা?”

“হুম। ওকে নিয়ে বের হবার সময় দেখি পুলিশ রেইড দিচ্ছে। তারাও কিডন্যাপারদের ধরার জন্য গিয়েছিলো।”

“কিন্তু আমরা তো পুলিশকে কিছু জানাই নি,” বললো মেঘলা। “ওরা কিভাবে…”

“হুম…ড্রাইভারের খুনের তদন্ত করতে গিয়ে সব জেনেছে,” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “আমি পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেছিলাম।”

“কি!” আৎকে উঠলো মেঘলা।

“ওরা ভেবেছে আমিই দিহানকে কিডন্যাপ করেছি।”

“আপা?” দূর থেকে ক্যাব ড্রাইভার হাঁক দিলো। বৃষ্টির কারণে বেশ জোরেই ডাকতে হলো তাকে।

মেঘলা চম্‌কে উঠে বাবলুর কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো।

“গ্যাস শ্যাষ হয়া গেছে…সামনে একটা পাম্প আছে…আমি গ্যাস ভইরা আনতাছি।”

“ঠিক আছে,” মাথা নেড়ে সায় দিলো মেঘলা। বাবলুর দিকে ফিরে বললো, “তারপর?”

“তারপর আর কি, অ্যারেস্ট করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।”

মেঘলার চোখেমুখে অসংখ্য জিজ্ঞাসা আর উদ্বেগ একসাথে ভর করেছে। “ওরা…ওরা তোমাকে ছেড়ে দিলো?”

“না।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সে।

“আমি পালিয়ে এসেছি।”

মেঘলার চোখ দুটো স্থির হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পলক পড়লো না।

“এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না,” হেসে বললো বাবলু।

“পুলিশ তোমাকে খুঁজছে?”

“হুম।”

“এখানে যদি চলে আসে?” উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো সে।

“আরে না,” হেসে বললো বাবলু। “এখানে ওরা কোনোদিনই আসতে পারবে না। এই রিসোর্টে হুটহাট করে পুলিশ ঢুকতে পারবে না। ঢোকার চেষ্টা করলেই আমি জেনে যাবো।”

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মেঘলা। সে হয়তো পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না।

“তুমি এখানে কেন থাকো?”

“লম্বা গল্প,” আস্তে করে বললো সে। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো। “তোমার মেয়েটা দেখতে ঠিক তোমার মতো হয়েছে।”

“তাই?”

মুচকি হেসে সায় দিলো সে।

বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসকে ভুলে তারা দু’জন এখন দাঁড়িয়ে আছে লেকের পাড়ে, একই ছাতার নীচে। বাতাস বইতে শুরু করেছে, বৃষ্টির প্রকোপও বেড় গেছে আবার কিন্তু সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই।

“আমি খুব ভয়ে ছিলাম, তোমার বুঝি খারাপ কিছু হয়েছে।”

“সেজন্যে এখানে ছুটে এসেছো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মেঘলা।

বাবলু শুধু হাসলো।

“বিয়ে করো নি কেন?” আস্তে করে বললো সে।

একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বাবলুর ভেতর থেকে। “আমার মতো কেউ বিয়ে করবে, সংসারি হবে সেটা ভাবলে কি করে।”

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মেঘলা। “তাহলে এসব ছেড়ে দিলেই পারো।”

“ছেড়েই তো দিয়েছি…”

“সত্যি?”

“হুম,” জোর দিয়ে বললো বাবলু।

খুশিতে মেঘলার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। “এবার বিয়ে করে সংসারি হও, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসো।”

চুপ মেরে রইলো বাবলু। “পছন্দের কেউ নেই?”

“না।” মিথ্যেই বললো। যদিও তার কাছে মনে হচ্ছে সে সত্যি বলেছে। কারণ উমা এখন সত্যিই নেই।

“এতোদিনেও…” নিজে থেকেই চুপ মেরে গেলো মেঘলা। পাশ ফিরে তাকালো সে।

ইয়েলো ক্যাবটা ফিরে এসেছে। তাদের থেকে বিশ-বাইশ গজ দূরে থামলো সেটা।

বাবলুও চকিতে দেখে নিলো। তারপর বললো, “এরকম খারাপ আবহাওয়ায় এতোদূর আসার দরকার ছিলো না। পরে আসলেও পারতে।”

চুপ মেরে রইলো মেঘলা।

“পরে এলেও তো হতো।”

“সেই দিন আর নাও আসতে পারে,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।

অবাক হলো বাবলু।

“আমরা আমেরিকায় চলে যাচ্ছি।” তার গলাটা যেনো ধরে এলো। “চিরজীবনের জন্য।”

বাবলু স্থিরচোখে চেয়ে রইলো।

“আমি ভেবেছিলাম ইচ্ছে করে আমার সাথে যোগাযোগ করছে না তুমি। দেরি করলে হয়তো তোমার সাথে আর দেখা হবে না।”

মেঘলার মুখটা দু’হাতে ধরলো বাবলু। “এখনও আমাকে হারানোর ভয় পাও?”

চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো। তারপর চোখেচোখ রেখে বললো, “পাই! কারণ এখনও তোমাকে…”

কথাটা শেষ করার আগেই তার চোখে কিছু একটা ধরা পড়লে পাশ ফিরে তাকালো। দেখতে পেলো ট্যাক্সি ক্যাবটার সামনে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের একজনও ক্যাব ড্রাইভার নয়!

ব্যাপারটা বাবলুও টের পেয়েছে। সে যেনো বরফের মতো জমে গেলো দৃশ্যটা দেখে।

মেঘলার হাত দুটো কেঁপে উঠলো, ছাতা ধরা হাতটা একটু আলগা হতেই বাতাসের তোড়ে সেটা উড়ে পেছনের জলরাশির উপর পড়লো।

যে দু’জন লোক ক্যাবটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের হাতে অস্ত্র। তা করে রেখেছে বাবলুর দিকে। মেঘলা এদেরকে চেনে না। বাবলুর দিকে তাকালো। চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। মনে হলো তার ঠোঁটে বাঁকা হাসির আভাস।

“পালানোর চেষ্টা করবে না!” চিৎকার করে বললো অস্ত্রধারী একজন।

অধ্যায় ৬১

অমূল্য বাবুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বাবলু হঠাৎ করে এমন করছে কেন! ছেলেটার মাথা কি খারাপ হয়ে গেলো নাকি?

সাবেক প্রেমিকার শিশু সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে গতকাল রাতে হোমিসাইডের জেফরি বেগের হাতে ধরা পড়ে গেছিলো। সেখান থেকে আবার পালিয়ে আজ সকালে ভুতের মতো তার বাড়িতে এসে হাজির হয়, ভড়কে দেয় তাকে।

রিসোর্টে পাঠানোর আগে অমূল্য বাবু বেশ জোর দিয়ে বলে দিয়েছে, অন্তত কয়েকটা সপ্তাহ যেনো ওখান থেকে বাইরে না যায়। আর এখন কিনা তার ঐ সাবেক প্রেমিকা রিসোর্টে গিয়ে হাজির!

একটু আগে ম্যানেজার তাকে ফোন করে জানায় এটা। ঐ মহিলার ট্যাক্সিটা রিসেপশনের সামনে না থেমে সোজা ভেতরে চলে গেলে নিজের অফিস থেকেই দৃশ্যটা দেখতে পায় ভদ্রলোক। নতুন কিংবা পুরনো গেস্ট হোক, বাইরে থেকে গাড়ি কিংবা ক্যাব নিয়ে এলে সেটা তার অফিসের সামনে পার্কিংলটে থামবে। শুধুমাত্র গেস্টদের নিজস্ব গাড়ি সরাসরি লজের সামনে চলে যেতে পারে। এটাই এই রিসোর্টের নিয়ম।

তার একটু সন্দেহ হলে অফিসের বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ক্যাবটা চলে যাচ্ছে তওফিক সাহেবের লজের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে রেইনকোটটা গায়ে চাপিয়ে সেখানে গিয়ে দেখে এক ভদ্রমহিলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাকে দেখেই চিনতে পারে সে। মিসেস চৌধুরি। এহসান চৌধুরির স্ত্রী। গত সপ্তাহে স্বামী আর সন্তানসহ রিসোর্টে দু’ দিন থেকে গেছে।

ম্যানেজার আরো বলেছে, সে একদম নিশ্চিত মিসেস চৌধুরিই গতকাল তাকে ফোন করে বাবলুকে চেয়েছিলো; আজ সকালেও একবার ফোন করে জেনে নেয় বাবলু রিসোর্টে আছে কিনা। ম্যানেজার তার কাছে সত্যি কথাই বলেছে, কারণ সে মনে করেছে এই ভদ্রমহিলা তওফিক সাহেবের খুবই ঘনিষ্ঠ কেউ হবে। তবে আজকে ফোন করলেও তওফিক সাহেবকে ডেকে দেবার জন্য অনুরোধ করে নি। ব্যাপারটা ম্যানেজারের কাছে সন্দেহজনক মনে হলেও কথাটা বাবলুকে জানায় নি। কেন জানায় নি সে ব্যাখ্যাও দিয়েছে তার কর্তাকে।

সকালে রিসোর্টে ফিরে আসার পর লজের দরজা বন্ধ করে রাখে বাবলু। তারপর এক সময় বৃষ্টির মধ্যেই দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকে লেকের পাড়ে। তার আচার আচরণ একটু অন্যরকম ছিলো।

ম্যানেজারকে খবরটা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে সে বলে দিয়েছে চোখকান একটু খোলা রেখে ওদের দিকে নজর রাখতে। তবে এই ব্যাপারটা নিয়ে রিসোর্টের কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই।

ম্যানেজারের ফোন পাবার পর থেকেই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছে আর ভেবে যাচ্ছে অমূল্য বাবু।

মিসেস চৌধুরি কেন রিসোর্টে গেলো?

এমন সময় আবারো তার মোবাইলফোনের রিং টোনটা বেজে উঠলো। অমূল্য বাবুর মনে হলো অমঙ্গলের ঘণ্টা বাজছে যেনো!

.

পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে জেফরি বেগ, তার সাথে আছে সৈকত। তাদের দু’জনের অস্ত্র বাবলুর দিকে তাক করা। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে রিসোর্টের লেকের পাড়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাদের দিকে চেয়ে আছে বাবলু। মেঘলা যেনো বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

বাবলুর অবস্থাটা বুঝতে পারছে জেফরি। সে ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি এখানে এ সময়ে এমনভাবে তারা হানা দেবে। সত্যি বলতে, মাত্র দেড় ঘন্টা আগে সে নিজেও এরকম কোনো কিছুর কথা কল্পনাও করতে পারে নি।

গতরাতে হোমিসাইডের হেডকোয়ার্টার থেকে বাবলু পালিয়ে যাবার পর বাকি রাতটুকু ঘুমাতে পারে নি ঠিকমতো। ভোরের দিকে একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর আর ঘুম আসে নি। বিমর্ষ আর পরাজিতের মতো সকালে অফিসে ঢোকে সে। চুপচাপ নিজের ডেস্কে বসেছিলো অনেকক্ষণ। তারপরই সহকারী জামান এসে জানায় বাবলু এখন কোথায় আছে সেটা জানা যাবে। দ্রুত ব্যবস্থা নিলে গতকালের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত খুব সুন্দরভাবেই করা সম্ভব।

জেফরি ঠিক তাই করেছে।

অপরাধবোধে ভুগতে থাকা জামান আজ সকালে অফিসে এসে চুপচাপ কমিউনিকেশন্স রুমে বসেছিলো। নিজের বোকামির জন্য সে যারপরনাই লজ্জিত। ওখানে বসে থাকতে থাকতেই তার মনে পড়ে যায়, বাবলুর মোবাইলফোনে মাত্র একটা ইনকামিং এবং আউটগোয়িং নাম্বার ছিলো। এটা যে মিসেস চৌধুরির নাম্বার সেটা বোঝার জন্য তাদেরকে কোনো রকম ট্র্যাকডাউন করতে হয় নি। আন্ডারস্ট্রাকশন ভবনের বাইরে একটি প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে হাত-পা-মুখ বাধা অবস্থায় সবুজ নামের কাজের লোকটিকে উদ্ধার করার পর তার কাছ থেকে জেনে নেয় ঘটনা কি ছিলো।

জামানের মনে আশা জেগে ওঠে, ঐ নাম্বারটা ট্র্যাকড্রাউন করলে কিছু একটা পাওয়া যেতেও পারে। ভদ্রমহিলা হয়তো মোবাইলফোন ট্র্যাকডাউন করার আধুনিক পদ্ধতির কথা জানে না।

নাম্বারটা ট্র্যাকডাউন করতে গিয়েই সে দেখে ওটা থেকে একটা কল করা হয়েছে একটু আগে। তার মানে তার ধারণাই ঠিক। মহিলা এসব ব্যাপারে মোটেও সচেতন নয়। কোথায় কল করা হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখতেই অবাক হয় সে।

একটা ট্যাক্সিক্যাব কোম্পানিতে? ঐ মহিলা কেন ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করতে যাবে? তাদের তো নিজেদেরই গাড়ি আছে। নড়েচড়ে বসে সে। ট্যাক্সি কোম্পানিতে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে জেনে নেয় মিসেস চৌধুরি এইমাত্র যে ট্যাক্সিটা ভাড়া করেছে সেটার গন্তব্য ঢাকার অদূরে একটি রিসোর্টে।

রিসোর্টে।

যার মেয়ে গতকাল রাতে কিডন্যাপারদের হাত থেকে মুক্ত হলো, আজ সকালে হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলো সে কেন ঐ রিসোর্টে যাবে? তাও আবার ট্যাক্সি ভাড়া করে?

প্রশ্নগুলো জামানকে যতোটা না ভাবায় তারচেয়ে বেশি আশান্বিত করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় তার বসের রুমে। জেফরি বেগ তখন মাত্র অফিসে ঢুকেছে।

সহকারীর কাছ থেকে সব শোনার পর ঝড়ো আবহাওয়ার মধ্যেই হোমিসাইডের একটি প্রাইভেটকার নিয়ে রওনা হয় জেফরি, সঙ্গে নেয় সৈকতকে। জামান তার সঙ্গে আসতে চাইলেও তাকে নেয় নি। ছেলেটা গতকাল রাতে আহত হয়েছিলো। তাছাড়া এরকম অপারেশনে সৈকত অনেক বেশি কার্যকরি। সে একজন দক্ষ শুটার। জামানের চেয়ে তার অ্যাসল্ট অপারেশনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।

রওনা দেবার আগেই ক্যাব কোম্পানিতে ফোন করে জেনে নেয় ড্রাইভারের মোবাইলফোন নাম্বারটি। মিসেস চৌধুরি আপ-ডাউন হিসেবে ট্যাক্সিটা ভাড়া করায় দারুণ সুবিধা হয়। তার মানে ট্যাক্সিসহ ড্রাইভার রিসোর্টের ভেতরেই আছে। হয়তো সে এও জানে, তার মহিলা প্যাসেঞ্জার কোন্ লজে ঢুকেছে। রিসোর্টের বাইরে এসে ইয়েলোক্যাবের ড্রাইভারকে ফোন করে সে। নিজের পরিচয় জানিয়ে সংক্ষেপে খুলে বলে ঘটনাটি। তবে ড্রাইভারের বিশ্বাস অর্জনের জন্য তার কোম্পানিকে ফোন করে বলে দেয় তারা যেনো তাদের ড্রাইভারকে সব ধরণের সহযোগীতা করার নির্দেশ দেয়। কোম্পানি থেকে ফোন পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাইভার সহযোগীতা করতে শুরু করে, তাদেরকে জানিয়ে দেয় মিসেস চৌধুরি এখন কোথায় আছে, কার সাথে আছে।

এরপর সে ড্রাইভারকে শিখিয়ে দেয় কি করতে হবে।

গ্যাস ভরার কথা বলে ড্রাইভার চলে আসে রিসোর্টের বাইরে। তারপর জেফরি আর সৈকত ড্রাইভারকে রেখে সেই ক্যাবে করে ঢুকে পড়ে রিসোর্টের ভেতরে।

ড্রাইভারের কথামতো জায়গায় আসতেই তারা দেখতে পায় মিসেস চৌধুরি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে লেকের পাড়ে। আর একই ছাতার নীচে দাঁড়িয়ে আছে বাবলু।

তাদেরকে দেখে মিসেস চৌধুরি অবাক হলেও বাবলুর বিস্ময় এতোটাই তীব্র যে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছে কয়েক মুহূর্তের জন্য।

“আপনি সরে যান, মিসেস চৌধুরি!” বৃষ্টির কারণে চিৎকার করে বলতে হলো জেফরি বেগকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সৈকত। “মিসেস চৌধুরি, সরে দাঁড়ান! আমরা পুলিশের লোক,” আবারো বললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।

জেফরি এক পা এগোনোর চেষ্টা করতেই মেঘলা চিৎকার করে বলে উঠলো, “না! আমি ওকে ধরা পড়তে দেবো না!”

তার পেছনে বাবলু এখনও বরফের মতো জমে আছে। সে বুঝতেই পারছে না এ দু’জন কিভাবে এখানে চলে এলো! মেঘলা যে ট্যাক্সি ক্যাবটা নিয়ে এখানে এসেছে সেই ক্যাব ড্রাইভার কি তাহলে পুলিশের লোক? কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? কোনোভাবেই হিসেব মেলাতে পারছে না।

“ও আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছে…কিডন্যাপারদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে…” কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো মেঘলা। “আপনারা ওকে ভুল বুঝছেন!”

“আমি জানি, মিসেস চৌধুরি,” জেফরি বেগ বললো। “সবটাই জানি।”

“…ও ভালো হয়ে গেছে। আর কোনোদিন ওসব কাজ করবে না, বিশ্বাস করুন। ও ভালো হয়ে গেছে। ওকে ভালো হবার সুযোগ দিন, প্লিজ!”

“এরকম সুযোগ দেবার ক্ষমতা কিংবা এক্তিয়ার আমার নেই। আমি সামান্য একজন ইনভেস্টিগেটর।”

“প্লিজ,” হাত জোড় করে বললো মেঘলা।

“গতকাল রাতে ও আমাদের হেফাজত থেকে পালিয়েছে।”

মেঘলা দুপাশে মাথা দোলাতে লাগলো।

“আপনি সরে দাঁড়ান। ওর কাছে অস্ত্র থাকতে পারে!” জেফরি বেগ লক্ষ্য করলো বাবলু আস্তে করে কী যেনো বললো মেঘলাকে। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠলো সে।

“মিসেস চৌধুরি!”

বাবলু আস্তে করে এক পা পিছিয়ে ডান দিকে সরে গেলো। “মেঘলা, তুমি চলে যাও।”

বিশগজ দূর থেকেও প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কথাটা শুনতে পেলো জেফরি আর সৈকত।

মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার সাবেক প্রেমিকের দিকে।

“বাবলু! পালানোর চেষ্টা কোরো না!” চিৎকার করে বললো জেফরি বেগ। প্লিজ?”

মেঘলা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো। যেনো তার নড়াচড়া করার শক্তি লোপ পেয়ে গেছে।

আস্তে করে আরো ডানে সরে গেলো বাবলু কিন্তু তার দৃষ্টি আটকে আছে বিশগজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রধারী দু’জনের উপর। “মেঘলা, তুমি কাফেশন চলে যাও!” বেশ শান্তকণ্ঠেই বললো এবার।

“মিসেস চৌধুরি, আপনি সরে দাঁড়ান,” জেফরিও তাড়া দিলো তাকে।

একবার বাবলুর দিকে আরেকবার অস্ত্রধারী দু’জনের দিকে তাকালো মেঘলা। “না!” চিৎকার করে বললো সে। দু’হাত সামনের দিকে তুলে। আকুতি জানালো, “ওকে গুলি করবেন না, প্লিজ! ওকে গুলি করবেন না!”

“আপনি সরে দাঁড়ান, আমরা গুলি করবো না।” জেফরি দেখতে পেলো মিসেস চৌধুরি আবারো বাবলুকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। দু’পা সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে সে। চিৎকার করে বললো জেফরি, “এখান থেকে পালাতে পারবে না তুমি। খামোখা বোকামি কোরো না। আমাদেরকে গুলি করতে বাধ্য কোরো না।”

.

অমূল্য বাবু টেলিফোনটা কানে চেপে রেখেছে। ওপাশ থেকে ম্যানেজার যা বলছে তা একেবারেই অবিশ্বাস্য। যে ক্যাবে করে মিসেস চৌধুরি এসেছে। সেই একই ক্যাবের ভেতরে দু’জন অস্ত্রধারী ছিলো। তারা এখন পিস্তল বের করে বাবলুর দিকে তাক করে রেখেছে। যেকোনো মুহূর্তে রিসোর্টের ভেতরে গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। এ মুহূর্তে ম্যানেজার তার অফিসরুমের তিনতলার উপর একটি ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বহু দূরে লেকের পাড়ের দৃশ্যটা দেখছে আর ফোনে তার সাথে কথা বলছে।

ভদ্রলোক রিসোর্টের রেপুটেশন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেও অমূল্য বাবু সে-সব নিয়ে মোটেও ভাবছে না। তবে একটু আগে ম্যানেজারকে যে নির্দেশ দিয়েছে সেটা ঠিকমতো করা গেলে ছেলেটা এ যাত্রায় বেঁচে যাবে।

চোখ বন্ধ করে গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো বাবু।

“স্যার, ঐ দু’জন কারা?” উদ্বিগ্ন ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলো।

অমূল্য বাবু কিছু বললো না। সে এখনও বুঝতে পারছে না, ওই দুই অস্ত্রধারী কারা। পুলিশ কিংবা হোমিসাইডের হলে তো ইয়েলোক্যাবে করে আসতো না, তাও আবার মিসেস চৌধুরির সাথে।

“পরিস্থিতি তো ভালো মনে হচ্ছে না,” বললো ম্যানেজার। এখানে যদি গোলাগুলি হয় তাহলে বুঝতে পারছেন কি হবে?”

ম্যানেজারের উদ্বিগ্নতাকে আমলে নিলো না অমূল্য বাবু। “ঐ ছেলেটার যেনো কিছু না হয়।”

“জি, স্যার। আমি সেভাবেই বলে দিয়েছি।” একটু থেমে আবার বললো, “পাঁচ-ছয়জনকে পাঠিয়েছি…ওদের সবার কাছে অস্ত্র আছে…”

ফোনের ওপাশে শুধুই মৌনতা।

.

“স্যার!” উদ্বিগ্ন হয়ে বললো সৈকত। সেও বুঝে গেছে বাবলু কি করতে যাচ্ছে।

অবিশ্বাসের সাথে জেফরি দেখতে পেলো আস্তে করে এক পা পিছু হটে গেলো বাবলু।

“না!” চিৎকার করে বললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “বাবলু…প্লিজ!”

বাবলুর মধ্যে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আবারো পিছু হটলো সে।

“বাবলু!” জেফরির চিৎকারটার সঙ্গি হলো একটা গুলির শব্দ।

লেকের পাড়ে হুরমুরিয়ে পড়ে গেলো বাবলু।

সৈকত গুলি চালিয়েছে।

শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে মুহূর্তেই আবার উঠে দাঁড়ালো সে।

ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে গেলো জেফরি। কিছু বলার আগেই দ্বিতীয় গুলিটা করে বসলো সৈকত।

“না!” সৈকতের উদ্দেশ্য চিৎকার করে বলে উঠলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “গুলি কোরো না!”

বাবলুর শরীরটা গড়িয়ে পড়ে গেলো লেকের পানিতে।

দু’হাতে কান চেপে ধরে বসে পড়লো মেঘলা। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিলো সে।

জেফরি আর সৈকত দৌড়ে চলে এলো লেকের পাড়ে। নীচের জলরাশির দিকে তাকালো তারা। বাবলুকে দেখা যাচ্ছে না। তলিয়ে গেছে নীচে। সৈকত পিস্তলটা তাক করে রাখলো সেদিকে ভেসে উঠলেই গুলি চালাবে।

মেঘলা কেঁদেই চলেছে।

সৈকত তাকালো জেফরির দিকে। ইনভেস্টিগেটর এখনও পানির দিকে তাকিয়ে আছে।

“প্রথমটা পায়ে…” বললো সৈকত। “…পরেরটা মনে হয় বুকে লেগেছে।”

জেফরি বেগ শুধু তাকালো সঙ্গির দিকে, কিছু বললো না। যেনো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

মেঘলার কান্না এবার ফোপানিতে পরিণত হলো।

জেফরি আবারো লেকের পানির দিকে তাকালো কিন্তু বাবলু আর ভেসে উঠলো না।

সৈকত কিছু একটা টের পেয়ে পেছন ফিরে দেখতে পেলো একদল অস্ত্রধারী বৃষ্টির মধ্যেই তাদের দিকে দৌড়ে আসছে। ওদের সবার হাতে অস্ত্র।

“স্যার!”

সৈকতের কথায় জেফরি তাকালো, তারপরই দেখতে পেলো দৃশ্যটা। সঙ্গে সঙ্গে হাতের পিস্তলটা মাটিতে রেখে দিয়ে বাম হাতটা তুলে অস্ত্রধারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো। “সৈকত, অস্ত্র নামাও!” চাপাকণ্ঠে বললো সে।

সৈকত তার অস্ত্রটা নামিয়ে রাখার আগেই একদল অস্ত্রধারী তাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেললো।

“এরা কারা?” দু’হাত উপরে তুলে চাপাকণ্ঠে বললো সৈকত।

জেফরি বেগ তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অস্ত্রধারীদের উদ্দেশ্যে বললো, “আমরা পুলিশ।”

উপসংহার

সারাদিন বৃষ্টির পর সন্ধ্যা থেকে খারাপ আবহাওয়া কেটে গেছে। এখন রীতিমতো তারাভরা আকাশ। ফুরফুরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। কিছু মেঘ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালেও বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই।

কতোক্ষণ ধরে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে আছে সে জানে না। লেকের পাড়ে সারি সারি গাছপালা। ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। আশেপাশের ঝোঁপঝাড় থেকে দুয়েকটা ব্যাঙের ডাকও ভেসে এলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে বুঝি গ্রামের পুকুর পাড়ে বসে আছে। তার গ্রামের শৈশবটা অতো দীর্ঘ ছিলো না। কিন্তু এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ভেতর থেকে। শান্ত-সুস্থির জলের দিকে একমনে চেয়ে রইলো সে।

ছেলেটার লাশ পাওয়া যায় নি।

এখানে যখন গোলাগুলি হয় তখন ম্যানেজারের সাথে টেলিফোন লাইনে ছিলো, রিসোর্টের নিজস্ব সিকিউরিটি গার্ডদের মুভ করার আদেশ দিলেও দেরি হয়ে যায়। সিকিউরিটি গার্ডরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে ঘিরে ফেলে দু’জন অস্ত্রধারীকে। তারা নিজেদেরকে পুলিশের লোক বলে পরিচয় দেয়। পরে দেখা যায়, ঐ দু’জন আসলে হোমিসাইডের কর্মকর্তা। তাদের একজন জেফরি বেগ। যে কিনা অনেক দিন থেকেই বাবলুর পেছনে লেগে ছিলো।

সিকিউরিটি গার্ডরা ঐ দু’জনকে বাধ্য করে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে যেতে। জেফরি বেগ অবশ্য খুব একটা জোরাজুরি করে নি। সে চেয়েছিলো বাবলুর লাশটা উদ্ধার করতে। কিন্তু তার নির্দেশ পেয়ে ম্যানেজার ঐ ইনভেস্টিগেটরকে জানায়, এ কাজটা তারাই করবে। কোনো রকম পুলিশী কর্মকাণ্ড আর বরদাশত করা হবে না এখানে। পারলে তারা উপর মহলের সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারে।

মি: বেগ আর তার সঙ্গি কথা না বাড়িয়ে চলে যায় মিসেস চৌধুরিকে সঙ্গে নিয়ে।

ওরা চলে যাবার পর ম্যানেজারকে ডুবুরি এনে বাবলুর লাশটা পানি থেকে তুলতে বলে সে। বিকেল থেকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ডুবুরিরা লাশটা খুঁজে পায় নি। তারা জানিয়েছে, লাশ খুঁজে পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। এই লেকটার সাথে সংযোগ রয়েছে কাছের মেঘনা নদীর। রঙধনুর মতো বাঁকা হয়ে লেকের দুটো প্রান্ত মিশে গেছে মেঘনার সাথে। কৃত্রিম লেক হলেও নদীর মতোই স্রোত থাকে এখানে। বৃষ্টির সময় স্রোত ছিলো। সেই স্রোতে লাশটা ভেসে গেছে নদীতে।

পরিহাসের ব্যাপার হলো, এই লেকটা তার নিজের পরিকল্পনায় বানানো হয়েছিলো। সে চেয়েছিলো চমৎকার একটি লেখ থাকবে এই রিসোর্টে। কৃত্রিমভাবে বানানো হলেও দেখে যেনো বোঝার উপায় না থাকে। সেজন্যে নিকটবর্তী মেঘনার সাথে সংযোগ করা হয় দুদিক থেকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তবে কি এটাই ছেলেটার নিয়তি?

অমূল্য বাবু জানে না। সন্তান হারানোর বেদনা কেমন তাও জানা নেই তারা। অকৃতদার মানুষ সে, সন্তান তো দূরের কথা, মা-বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে আপন ভাই-বোনের অভিজ্ঞতাও নেই। তবে এখন মনে হচ্ছে, তার যদি সন্তান থাকতো তাকে হারিয়ে হয়তো ঠিক এমন অনুভূতিই হতো।

অনেকদিন পর আশ্চর্য হয়ে টের পেলো তার চোখ দিয়ে আস্তে করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। সে-জল হাত দিয়ে মুছলো না। শুধু চোখ দুটো ক্ষণিকের জন্য বন্ধ করে রাখলো।

.

বাবলু হাত থেকে ফসকে যাবার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলো জেফরি বেগ, অদ্ভুত ব্যাপার হলো ছেলেটা নিহত হবার পরও তার একই রকম অনুভূতি হচ্ছে। যদিও সৈকত আর জামান মনে করছে তাদের ব্যর্থতার উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করা গেছে এর মাধ্যমে কিন্তু জেফরি মধ্যে অদ্ভুত এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।

বাবলুর লাশটা ভেসে ওঠার অপেক্ষা করছিলো যখন তখনই একদল অস্ত্রধারী ছুটে আসে তাদের দিকে। প্রথমে সৈকত আর সে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছিলো কিন্তু পরক্ষণেই জেফরি বুঝতে পারে এরা রিসোর্টের নিজস্ব সিকিউরিটি। মারমুখি অস্ত্রধারীদের সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। নিজেদের পরিচয় দেবার পরও তারা আশ্বস্ত হতে পারছিলো না। অস্ত্রের মুখে তাদের দুজনকে আটকে ফেলে তারা। অবশেষ ম্যানেজার ভদ্রলোক এলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। জেফরি তাকে সব খুলে বলার পর ভদ্রলোক তাদেরকে রিসোর্ট থেকে চলে যেতে বলে।

সে চেয়েছিলো ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি এনে বাবলুর লাশটা উদ্ধার করতে কিন্তু ম্যানেজার কোনো কথাই শোনে নি। অবশেষে মিসেস চৌধুরিকে নিয়ে রিসোর্ট থেকে চলে আসে তারা।

ওখান থেকে ফিরে আসার পর এক রকম চুপচাপই আছে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এমনকি রেবা ফোন করে দেখা করতে বলেছিলো, সে রাজি হয় নি। বলেছে তার শরীরটা একটু খারাপ। বিশ্রাম নেবে। এ কথা শুনে রেবা তার বাসায় আসতে চেয়েছিলো কিন্তু তাতেও রাজি হয় নি। বলেছে দরকার নেই। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। আগামীকাল দেখা করবে তারা। আসলে সে একটু একা থাকতে চাইছে। এখন।

হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদকে সব ঘটনা খুলে বলার পর তাকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক একদম ভিন্ন আচরণ করে। বাবলু তাদের হাত থেকে ফসকে গেছে, এটার চেয়েও তার কাছে জরুরি অধস্তনদের নিরাপত্তা। প্রাণহানি হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলো, তা যে হয় নি সেটাই বড় কথা। কেউ দশ বার পালিয়ে গেলে তারা দরকার হলে দশবারই তাকে ধরতে পারবে কিন্তু জীবন তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

এমন প্রতিক্রিয়ায় ফারুক আহমেদের প্রতি জেফরির শ্রদ্ধা অনেক গুন বেড়ে গেছে।

বাবলুর মেঘলা, মিসেস চৌধুরির মুখটা মনে পড়ে গেলো তার। যখন জানতে পারলো তার সাবেক প্রেমিক আর বেঁচে নেই তখন মহিলা পাথরের মতো জমে গিয়েছিলো। যেনো বাবলুর মৃত্যুর জন্যে সে-ই দায়ি। তার কারণেই আজ বাবলুকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হলো।

জেফরি নিজে মিসেস চৌধুরিকে গাড়িতে করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। তাকে কোনোরকম পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় নি। তার স্বামী সন্তান আর সংসার আছে, এসব ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে সমস্যা হতে পারে, এই বিবেচনা কা- করেছে জেফরির মধ্যে।

ঘড়ির দিকে তাকালো সে। রাত দুটো বেজে গেছে। ঘুমের লেশমাত্র নেই চোখে। এতোক্ষণ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসবই ভেবে যাচ্ছিলো। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো এবার। দু’চোখ বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করলো কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো বাবলুর মুখটা। ছেলেটার জন্যে খুব মায়া হলো তার। এরকম একটা জীবন সে ইচ্ছে করে বেছে নেয় নি।

তারা দুজনেই রাস্তায় পড়ে ছিলো, দু’জন ভিন্ন প্রকৃতি আর ভিন্ন শ্রেণীর মানুষ তাদেরকে কোলে তুলে নেয়। পরম মমতায় লালন-পালন করে। অথচ পরিবেশ আর পরিস্থিতি বাবলুকে বাস্টার্ড বানিয়েছে। স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে তাকে। আর জেফরি বেগের বেলায় ঘটেছে ঠিক উল্টো ঘটনা-সুরক্ষিত শৈশব, নিশ্চিত জীবনযাপন, নীতি আদর্শ, শিক্ষা সবই পেয়েছে।

ভাবলো, তার জায়গায় বাবলু আর বাবলুর জায়গায় সে হলে কি হতো-জেফরি বেগ খুন করে বেড়াতে আর তাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতো বাবলু!

এই প্রথম জেফরি বেগ বিশ্বাস করতে শুরু করলো, হয়তো নিয়তি বলে সত্যি কিছু আছে তবে সেটা কিভাবে তৈরি হয় সে এখনও জানে না।

.

ওদিকে ঢাকা শহরের অন্যপ্রান্তে ঠিক একই সময় ঘুমহীন রাত কাটাচ্ছে মেঘলা। বৃষ্টিতে ভিজে নাকি প্রচণ্ড শোকে সে জানে না, বাড়ি ফিরে আসার পর থেকেই তাকে জ্বরে পেয়ে বসে, সেইসাথে তীব্র মাইগ্রেনের ব্যথা।

রিসোর্ট থেকে ফিরে আসার পর তার মায়ের বাড়ির কেউ কিছু বুঝতে পারে নি। হয়তো ভেবেছে একটু মুডঅফ। তবে তার স্বামী এহসান চৌধুরি যখন সন্ধ্যার পর এসেছিলো তখন স্ত্রীর ভাবভঙ্গি দেখে কিছু একটা বুঝতে পারলেও মুখ ফুটে কিছু বলে নি। তার স্ত্রী যেনো অন্য ভুবনে চলে গেছে। চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন একজন। উদাস আর বিষণ্ণ।

আজরাতে দিহানের বাবা শ্বশুরবাড়িতে থাকলেও স্বামীকে এড়িয়ে যাবার জন্য মেয়ের সাথে ঘুমাচ্ছে মেঘলা, অজুহাত হিসেবে বলেছে, দিহান নাকি একা একা ঘুমাতে ভয় পাচ্ছে।

তারা এখন এক বিছানায় শুয়ে আছে কিন্তু মেঘনার দু’চোখে ঘুম নেই। মেয়ের দিকে তাকালো। টেডি বিয়ারটা আকড়ে ধরে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ফুলের মতো ফুটফুটে একটা মেয়ে। হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে দিহান মুচকি হেসে উঠলো। হয়তো ঘুমের মধ্যে কোনো মজার স্বপ্ন দেখছে।

তাই দেখুক। যে দুঃস্বপ্নের মধ্যে সে ছিলো সেটা যেনো ভুলেও তার স্বপ্নে হানা না দেয়, মনে মনে এই কামনাই করলো সে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো মেঘলা।

দিহানকে ফিরে পাবার জন্যে বাবলুকে ব্যবহার করেছিলো। ছেলেটা তাকে কথা দিয়েছিলো তার মেয়েকে তার কোলে ফিরিয়ে দেবে। বাবলু তার কথা রাখলেও এরজন্যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

তার মুখটা আবারো ভেসে উঠলো চোখে। মিটিমিটি হাসছে। সেই মুখটায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে কিন্তু কী নিষ্পাপ শিশুর মতোই না দেখাচ্ছিলো তাকে।

তারপরই আরেকটা দৃশ্য ভেসে উঠলো।

গুলি খেয়ে পড়ে গেলো বাবলু, তবুও বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা। সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, লেকটা পাড়ি দিয়ে চলে যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না। প্রাণঘাতি বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়লো তার দেহটা।

মাথা ঝাঁকিয়ে এসব ভাবনা থেকে মুক্তি পেতে চাইলো মেঘলা কিন্তু তীব্র যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেলো। মাইগ্রেনের ব্যথায় মাথার শিরাগুলো যেনো ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। সহ্য করতে পারলো না। বিছানা থেকে উঠে ভ্যানিটি ব্যাগটার খোঁজ করলো। তার ব্যাগে সব সময় মাইগ্রেনের ওষুধ থাকে।

ডিমলাইটের আলোয় ঘরের এককোণে কফি টেবিলের উপর ব্যাগটা দেখতে পেলো। স্বল্প আলোতে ওষুধের কৌটাটা হাতরাতে গিয়ে মোবাইলফোনটা পেয়ে গেলো সে। এটা সেই মোবাইলফোন যেটা দিয়ে বাবলুর সাথে যোগাযোগ করতো। বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার কারণে ফোনটা আর বন্ধ করা হয় নি।

ফোনটা হাতে তুলে নিলো মেঘলা। পাওয়ার বাটনটা অফ করতে গিয়ে থমকে গেলো। একটা ইনকামিং মেসেজ এসেছে তার ফোনে!

সারা গা কাটা দিয়ে উঠলো তার। এটা কখন এসেছে সে জানে না। তার এই ফোনটা সাইলেন্স মোডে ছিলো।

ওপেন করলো মেসেজটা। মাত্র একটা শব্দ?

মেঘ?

কেঁপে উঠলো মেঘলা। এ নামে তাকে কেউ ডাকে না শুধু একজন। ছাড়া। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, সে কি স্বপ্ন দেখছে?

না। এটা স্বপ্ন নয়। দু’চোখ বন্ধ করে আবার চোখ খুলে মেসেজটার দিকে তাকালো। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো এক শব্দের মেসেজটার দিকে। তারপর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো, সেইসাথে এক অনির্বচনীয় আনন্দে ঠোঁটে ফুটে উঠলো হাসি। চিৎকার করে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করলো : হ্যাঁ। আমি তোমার মেঘলা!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *