৭. কাফি হৌস

কাফি হৌস

‘আরে, আরে, আসুন আসুন। ইস্‌ কতদিন পরে দেখা। তারপর কী খবর? কেমন আছেন? সব ভাল তো? অমুকের খবর কী, তমুক কী করছেন আজকাল?’ ইত্যাদি।

ভদ্রলোক উত্তর দিতে দিতেই বসলেন।

‘হ্যাঁ রে, বাইরের ঘরে আর একটা চা দিতে বল।’ তার পর ‘ওঃ আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়নি বুঝি?’ আমার উপস্থিতি এতক্ষণে মনে পড়ল গৃহকর্তার। আলাপ করিয়ে দিলেন। দু’জনেই তাঁরা সাহিত্যিক। বাংলাদেশে দু’জনেই খ্যাতনামা ব্যক্তি।

সাহিত্যিক সাহিত্যিকে আলাপ। সুতরাং দ্বিতীয় প্রশ্নটিই হল, তার পর, কী লিখছেন ইদানীং। ‘আঃ, আপনার সেই লেখাটি আজও’…

ভদ্রলোক বাধা দিলেন, ‘রেখে দিন ওসব লেখার কথা। আপাতত আপনাদের এদিকে একখানা বাড়ির সন্ধানে এসেছি। লেখা-টেখার পাট উঠে যাওয়ারই মতন হয়ে এসেছে। আপনি কী লিখছেন, তাই শুনি।’

‘আর লেখা।’ এ ভদ্রলোকের কণ্ঠেও রীতিমত খেদ। হঠাৎ অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে উঠলেন তিনি। ‘লিখব কী ভাই, লেখা আসবে কোথা থেকে বলুন, আড্ডার সুখ পাই না আজ কত কাল।’ বলার ভঙ্গিটি এমন, যেন পুত্রশোক পেয়েছেন আড্ডার অভাবে।

আমি আর পারলাম না। হেসে উঠলাম।

‘কী, হাসলে যে তুমি?’ রীতিমত সমবেদনা নিয়েই সাহিত্যিক বললেন, ‘তুমি লেখটেখ? তবে জেনে রেখো, আড্ডা সুখ সর্ব সুখের মূল।’ ঠিকই বলেছেন উনি। আড্ডা না পাওয়ার যে কী দুঃখ, তা একবার যে আড্ডা সুখ পেয়েছে, সেই জানে। বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে —।

অতঃপর আড্ডা প্রসঙ্গেই জমে উঠল সেই দুই প্রবীণ সাহিত্যিকের আড্ডা। সেই আড্ডা এত গভীর এবং এমন ঐতিহাসিক যে, আমার মতো তরুণ তাতে খেই পায় না। সুতরাং শ্রোতা হয়েই রইলাম। কথায় কথায় অবশেষে নামলেন তাঁরা কফি হাউসে। ভদ্রলোক অবশ্য বলছিলেন ‘কাফি হৌস’। কিছুটা ইংরেজি এবং কিছুটা হিন্দি মেজাজে।

‘কী, তুমি যাও না বুঝি কাফি হৌসে? তবে কিছু হবে না। ইয়ং বেঙ্গল কফি খায়নি। তারা দুধ বাতিল করে মদ খেয়েছে।’

‘আর ১৯০৫-এর বাংলা খেয়েছে মদ বর্জন করে দুধ। তাই না?’ ফোড়ন কাটলেন অন্যজন।

‘দুধ, তাও খায়নি। ওঁরা গঙ্গাজল খেয়েছেন, আর গীতা পাঠ করেছেন। নয়তো ব্রহ্মবান্ধব অরবিন্দ এঁরা এমন হন?’

‘তবে নিও-বেঙ্গল চা না কফিতে আসক্ত সেটা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক হতে পারে। এই ধরুন আমরা, আমরা কিন্তু ছোকরা বয়সে কফি পাইনি। এনতার চা লুটেছি।’

‘কিন্তু সে ঘাটতি পুষিয়ে নিয়েছিও তেমনি বুড়ো বয়সে। আচ্ছা ভাই, কফি হাউস কি সত্যিই তুলে দেবে?’

এবার সুযোগ পেয়ে আমি বললাম, ‘তা-ই তো দেখছি কাগজে।’

‘আরে কাগজে তো আমিও দেখেছি। সে কথা হচ্ছে না। আমার মনে হয়, এমন অপকর্ম ওরা করবে না। তোমরা নিয়মিত যাতায়াত করো তো, ওখানে কেমন শুনছ? স্পট নিউজ চাই।’

বললাম, ‘উঠে যাবে বলেই তো শুনেছি সেখানেও।’

খেপে উঠলেন ভদ্রলোক, ‘শুনছি। শুনছ তো বসে আছ কেন? দল বেঁধে ছুটে যাও। গিয়ে হাতটি চেপে ধরো। বলো গিয়ে, ছোট ছোট টুকিটাকি রেল লাইনগুলো যখন তুলে দিলে, কিছু বলিনি। নয়া পয়সা বার করলে, তাও কিছু বলিনি। দণ্ডকারণ্যে পাঠাচ্ছ। তাও কিছু বলছি না। কিন্তু ‘কাফি হৌস’ নেই ছোড়েঙ্গা।’

‘When gossiping stops, democracy dies!’ বাধা দিলেন অন্যজন। তার চেয়ে বরং বলো গিয়ে, আচ্ছা বাবা সব ব্যবসাই যদি দেখো লোকসানের, তবে এমন লোকসানের রাজত্বটা সেধে নিলে কেন? ছেড়ে দিলেই পারো।’

টি. এস. এলিয়ট যখন বলেন : ‘Have known the evenings, mornings, afternoons. I have measured out my life with coffee spoons.’ তখন হয়তো গভীর অর্থেই তা বলেন। সকাল, সন্ধ্যা কফির চেয়ে চামচটাই হয়তো মুখ্য সেখানে। কিন্তু যে দু’জন বাঙালি লেখকের আলাপ আপনাদের শুনালাম আমি, এখানে তারাও কম গভীর নন। তাতেও অনেক বেদনা। এলিয়টের কফির চামচের মতো কফিটাই তাঁদের কাছে উপলক্ষ মাত্র। লক্ষ্য : কাফি হৌস। কফি হাউসের স্বাধীনতা, কফি হাউসের জীবনাদর্শ, কফি হাউসের স্বচ্ছন্দচারিতা এঁদের ধ্যান-কল্প। শুধু এই দু’জনেরই নয়, ভিন্নার্থে শুধু সাহিত্যিকদেরই নয়, কফি হাউস কলকাতার হাজারো লোকের ধ্যান, স্বপ্ন, সাধ। তার মধ্যে সাহিত্যিক শিল্পীরা আছেন। ছেলে-ছোকরা, ছাত্র-ছাত্রীরা আছে, বেকার আছে, কেরানি সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি, আন্ডার সেক্রেটারিরা আছেন। আছেন পাখোরাজ দালাল, হবু অভিনেতা, ডিরেকটার, প্রোডিউসার, বিজনেস স্পেকুলেটার, সকলেই। কফি হাউস তাই চেহারায় এত বিচিত্র, এত সুন্দর, এত ভিন্ন। পাড়ার ‘সিদ্ধেশ্বরী কাফে’র এই চরিত্র নেই, নেই বোধহয় কোনও ‘বারে’রও। কফি হাউসের মেজাজ বারের টিমটিমে আলোয় আসে না। স্থান এবং দ্রব্য মাহাত্মে সেখানকার আবহাওয়া ভিন্ন। অনেক বেশি সিরিয়াস। বোধ হয়, একমাত্র ‘যোগী’-দেরই তা মানায়। সিদ্ধেশ্বরী কেবিন আবার বেশি মাত্রায় তরল। বিশেষ করে রকের ছেলেরা যখন মাঝে মাঝে একটু আড়ভাঙার জন্য উঠে আসে এখানে, ডাবল-হাফ চা অথবা ডিমের ডেভিল-এর অর্ডার দেয় তখন আর টেকা যায় না। পাড়ার কবি-কবি ভাবের ছেলেটিকে তখন উঠে আসতেই হয় কাফি হৌসে। কফি হাউস একমাত্র সান্ত্বনা আজকের নগরের। রুচিসম্পন্ন মধ্যবিত্তের যৌবনের একমাত্র মরূদ্যান।

কাফি হৌস। কলকাতার কফি হাউস এ নগরের প্রায় জন্ম থেকেই। আজকের মতো কফিবোর্ড তখন ছিল না, সুতরাং আজকের কফি হাউসগুলোর কথা হচ্ছে না। এগুলো নিতান্তই হালের। কিন্তু কফি-পানশালা তখনও ছিল। ছিল মানে, ফোর্ট উইলিয়মের মতোই তখনকার কফি হাউস ছিল এ নগরের প্রাণ। রাজত্বের প্রসার, ব্যবসায়ের শ্রীবৃদ্ধি, তথা টুকিটাকি কালচার সবই স্বপ্ন ছিল তার। বিশেষ করে সাধারণ চায়ের বা মদের কিংবা খাবারের দোকানের সঙ্গে কফি হাউসের যে স্বাতন্ত্র, সেটার সূত্রপাতও সে যুগেই। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকে।

কলকাতার সবচেয়ে পুরানো যে কফি হাউসটির সন্ধান পেয়েছি আমরা, তার জন্ম ১৭৬২ সালে। অবশ্য সেটি একটি পুরো কফি হাউস নয়, একটি ‘কফি রুম’ মাত্র। তবে আজকের কফি হাউসের লক্ষণাদি সবই ছিল তার।

১৭৬২ সালের ২১ জুনের খবর। উইলিয়ম পার্কেস নামে এক সাহেব কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেকটারদের কাছে এক আবেদনে জানাচ্ছেন যে, তিনি অত্র শহরে একখানা বাগানবাড়ি কিনেছেন। তার ইচ্ছে, বাড়িখানাকে তিনি ভদ্র এবং মহাশয় ব্যক্তিদের খানাপিনা এবং আমোদ-আহ্লাদের কেন্দ্রে পরিণত করেন। এই মহৎ উদ্দেশ্যে তিনি কোম্পানির সম্মতি প্রার্থনা করছেন।

কোম্পানি পার্কেস সাহেবের প্রস্তাব শুনে অবশ্যই আহ্লাদিত হলেন। কারণ, কলকাতায় তখন হোটেল, ট্যাভার্ন ইত্যাদির বিশেষ অভাব। কিন্তু চিন্তার বিষয়ও আছে বইকী। তারা তো আর নাচগানের জন্যে এদেশে আসেননি। এমনিতেই ছেলে-ছোকরাদের যা মতিগতি, শেষে এমন হোটেল পেয়ে দিন-রাত্তির সেখানেই না মজে থাকে। তা হলে যে গণেশ উল্টে যাবে। তারা তাই অনেক ভেবেচিন্তে পার্কেকে বললেন : দেখো, তোমার বাগানবাড়ির আড্ডাখানা তুমি খুলতে পারো, কিন্তু একটি শর্ত আছে। সকালে অর্থাৎ আপিস টাইমে ওটিকে বন্ধ রাখতে হবে। (‘It was not to be open in the morning as the Board were afraid that it would be the means of keeping people from doing their duty.) বোধ হয়, এই ভাবনা থেকেই কফিবোর্ডও তাদের কফি হাউসগুলো বন্ধ করে দেন রাত আটটায়। নয়তো মধ্যবিত্তের ঘরে রকমারি নতুন সমস্যার সম্ভাবনা।

যা হোক, সাহেব তাতেই রাজি হয়ে তাঁর বাগানবাড়িকে হোটেল করলেন। নাম হল তার ‘লন্ডন হোটেল’। কফি-রুমও করা হল সেখানে একটি। প্রাইস ১৭৮০ সালে এই হোটেলের বিবরণে লিখছেন : হোটেলটির খাবার বেশ সস্তা। মদ্যাদি বাদ দিলে খানাপিছু খরচ পড়ে মাত্র এক মোহর। মদের দাম আলাদা। হোটেলে একটি ‘কফি-রুম’ও আছে। সেখানে এক কাপ কফির দাম এক সিক্‌কা টাকা। তবে তার কিছুটা নেওয়া হয় অন্য কারণে। ইংল্যান্ডে কফি হাউসগুলোতে যেমন থাকে, এখানেও তেমনি ইংরেজি খবরের কাগজ প করে রাখা হয়। কফির দামের কিছুটা যায় তার চাঁদা বাবদ। অর্থাৎ শুধু কফি গিলতে কেউ সেখানে যেতেন না। যেতেন কাগজ পড়তেও। ‘কফি হৌসের’ এটাই বৈশিষ্ট্য।

এ বৈশিষ্ট্য লন্ডন-আগত কোম্পানির ছেলে-ছোকরারা কিন্তু খুশি হল না। এ আবার একটা কফি হাউস? গোটা একখানা কফি হাউস চাই আমাদের। এইটুকু একটা ঘর, মন খুলে একটু আড্ডা দেব, তারও জো নেই। ছেলেদের এই মৌন অথচ অন্যদিকে ন্যায্য দাবির কথা বুঝেই যেন ১৭৮৮তে জন্ম হল ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জ কফি হাউসের (Calcutta Exchange Coffee House)। এখন সে বাড়িটাকে বলে ‘রয়াল এক্সচেঞ্জ’। ক্যালকাটা এক্সচেঞ্জের বিজ্ঞাপনে জানানো হল : এ কফি হাউসটি ভদ্রলোক, বণিক এবং ব্যবসায়ীদের জন্যে (Gentlemen merchants and traders)। ছাত্ররা নেই আমন্ত্রণ-তালিকায়, কারণ কলকাতায় তখন ছাত্রই নেই। এক্সচেঞ্জ কফি হাউসের নিয়ম অন্য রকম। ওখানে কফি খেতে হলে মেম্বার হতে হয়। মাসে চাঁদা চার টাকা। তবে সে তুলনায় ব্যবস্থাদিও কম নয়। কলকাতা এবং মাদ্রাজের যাবতীয় ইংরেজি খবরের কাগজ এবং লন্ডনের কিছু কিছু কাগজ ও রাজনৈতিক প্রচার-পত্রাদি রাখা হত ওখানে। সদস্যরা সেগুলো পড়তেন, বিতর্ক বা হই-হট্টগোল করতেনও বলা বাহুল্য।

অর্থাৎ এক্সচেঞ্জ কফি হাউস ছিল ক্লাবের মতো। যারা যেতেন সেখানে, তারা হয়তো জীবিকায় ভিন্ন কিন্তু কফি হাউসের সদস্য হিসেবে জীবনে এক। সন্দেহ নেই, ডালহৌসির এই বিরাট বাড়িটি কাঁপিয়ে তুলতেন তাঁরা কফির কাপ হাতে নিয়ে। আজ মেম্বারশিপের ব্যবস্থা নেই বটে, কিন্তু কফি হাউসগামীদের অন্তরের ঐক্য বোধহয় এখনও আছে। বোধহয়, আজও একই প্রতিষ্ঠানের সেবায়েত হিসেবে তাঁদের সকলেরই মনে মনে গর্ব। মনে মনে বন্ধুত্ব।

কিন্তু এক্সচেঞ্জ কফি হাউস আড্ডা হিসাবে জমল যেমন, ব্যবসা হিসাবে ঠিক তেমন নয়। এক বছর যেতে না যেতেই হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে বের হল : এক্সচেঞ্জ কফি হাউস বিক্রি হবে। অনেক ঋণ হয়ে গেছে নাকি মালিকের, তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হাউসটিকে আর রাখা সম্ভব হল না।

খবর শুনে আজকের মতোই ফ্যানদের তখন মানসিক অবস্থা। তবে তারা খবরের কাগজে দুঃখ করে চিঠি লিখলেন না, সোজা চলে গেলেন মালিকের ওখানে। সরাসরি অভিযোগ জানালেন:

‘এ কী করছেন আপনি? আমাদের কী গতি হবে?’

মালিকেরা আজকের মতো এত হৃদয়হীন ছিলেন না বোধহয়। তাই খদ্দেরদের সঙ্গে বসে নতুন সিদ্ধান্ত নিলেন হাউস-মালিক। লটারি করা হবে। কফি হাউসটিকে বাঁচানোর জন্যে শেষ চেষ্টা হবে এবার। লটারি তখন খুব জনপ্রিয় উদ্যোগ, ঠিক হল, এক্সচেঞ্জ কফি হাউসও লটারি করবে। একশো টাকা করে টিকিট। আর ষোল হাজার টিকিট থাকবে।

লটারির ফলে কফি হাউসটি বেঁচে ছিল কি না জানি না। তবে সমসাময়িক কালের আর একটি কফি হাউসের খবর আমরা জানি। তার নাম জেরুজালেম কফি হাউস। ‘জেরুজালেম কফি হাউস’ নামটির একটি ইতিহাস আছে। সে সময়ে লন্ডনে একটি কফি হাউস ছিল এই নামে। কবি কুপারের পিতৃনিবাস ক্যুপারস্ কোর্টে’ ১৮৮৮ সাল অবধিও ছিল ওটি। জেরুজালেম কফি হাউসটি কিন্তু লন্ডনের আর-পাঁচটা কফি হাউসের মতো ছিল না। উইলিয়াম হিকি লিখেছেন : ওটি ছিল ভারতবর্ষ নিয়ে যাদের কারবার, তাদেরই আড্ডাখানা।

হিকি নিজেও ভারতে আসার আগে ওখানে বসে বসে ভারতের কাহিনী শুনেছেন ভারত-ফেরত নাবিক, সৈনিক এবং সিভিলিয়ানদের মুখে। ভারতবর্ষের শেষ খবর, ভারতের হালচাল জানতে আগ্রহীরা ভিড় জমাতেন ওখানে। কোন জাহাজ কবে ছেড়েছে, কোন জাহাজ কবে পৌঁছাবে— এসব জানারও একমাত্র বেসরকারি স্থান ছিল ওটি। সুতরাং ভারতের সঙ্গে যাদের যোগ ছিল, তাদের পরিচয় ছিল জেরুজালেম কফি হাউসের সঙ্গেও।

কিন্তু কলকাতায় নবাগতদের ঠিক এ ধরনের আড্ডাখানা ছিল না। নাবিকেরা গঙ্গায় জাহাজ ভিড়িয়ে উসখুস করতেন। লন্ডনে সেই ‘জেরুজালেমে’ কফি গিলে উঠেছেন, আর এই এখানে যদি মনের মতো একটা কফি হাউসও থাকত! এ কী রাজ্যি বাবা।

১৭৯০ সালের কথা। জন ম্যাকডোনাল্ড নামে এক নাচের মাস্টার কলকাতায় পা দিয়েই বুঝতে পারলেন, এখানে ‘জেরুজালেমের’ অভাব। তিনি স্থির করলেন, ওই নামেই একখানা কফি হাউস খুলবেন কলকাতায়।

ম্যাকডোনাল্ড বাড়ি কিনলেন একখানা ডালহৌসি স্কোয়ারে। কাউনসিল হাউস স্ট্রিট যেখানটায় মিলেছে ডালহৌসি স্কোয়ারে সেখানটায়। জেরুজালেম কফি হাউস খোলা হল। কিন্তু এও তেমন জমল না। ওয়েলেসলি সাহেব তখন ম্যাকডোনাল্ডের কাছে ভাড়া চাইলেন বাড়িটি। সিভিলিয়ানদের জন্যে ওখানে কলেজ করবেন তিনি। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। ম্যাকডোনাল্ড রাজি হয়ে গেলেন। হিকি লিখেছেন: ‘McDonald’s speculation did not answer his expectation and he was glad to obtain so good a tenant.’

সুতরাং ফুরিয়ে গেল জেরুজালেম কফি হাউসও। ১৮০০ সালে কফি হাউসের বাড়িতে বসল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। কফি হাউসের কবরে জন্ম নেওয়া কলেজ। আর আজ বহু যুগের এপারে দাঁড়িয়ে এক ব্যস্ত সমস্ত ব্যাঙ্ক ওখানে। হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাঙ্কের বাড়ি ওটি এখন। জেরুজালেম কফি হাউস উঠে গেল বটে, কিন্তু কলকাতার ইংরেজ একবার তার স্বাদ পেয়েছে লন্ডনে। সুতরাং ‘জেরুজালেমের’ নেশা কাটল না তাদের।

১৮৫৬ সালে আলেকজান্ডারের ‘ইস্ট ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনে’ (Alexender’s East India Magazine) তাঁদের উৎফুল্ল করে বের হল আর এক সংবাদ। স্পেন্সেস হোটেলের কর্তৃপক্ষ স্থির করেছেন, লন্ডনের জেরুজালেম কফি হাউসের মতো তারাও একটা কফিরুম খুলবেন।

লন্ডনের জেরুজালেম কফি হাউসের মতো সেখানেও খবরের কাগজ পাওয়া যাবে, জাহাজ আসা-যাওয়ার খবর মিলবে। ডাকের থলিও ওখানেই বাঁধা হবে। অর্থাৎ লন্ডনে চিঠি পাঠাতে হলে কিংবা তাড়াতাড়ি পেতে হলে ওখানে আসা দরকার।

স্পেন্সেস হোটেল তখন ছিল লন্ডন বিল্ডিংসে। লন্ডন বিল্ডিংটি ছিল গভর্নমেন্ট প্লেস ওয়েস্ট এবং হেস্টিংস স্ট্রিটের মোড়ে, আগে যেখানটায় ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের দফতরখানা এবং ট্রেজারি। এখন বোধহয়, ওখানে ইনকামট্যাক্সের আপিস।

স্পেন্সেসের পর কলকাতায় স্থাপিত হল আর এক বিরাট হোটেল। তার নাম অকল্যান্ড হোটেল। ১৮৫৮তে অকল্যান্ড হোটেলের জন্ম। আর জন্মের পর থেকেই এর অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়াল ‘জেরুজালেম রুম’ বা কফি-ঘরটি। বিজ্ঞাপনে হোটেলটির পরিচয় দিয়ে কর্মকর্তারা খদ্দেরদের প্রলোভন দেখাচ্ছেন: The Calcutta Jerusalem subscription assembly and reading rooms, for merchants, brokers and captains of ships. অর্থাৎ আড্ডাখানা আছে, পড়বার ঘরও আছে। কফি হাউস আড্ডাপীঠ, কফি হাউস কালচারের নাট-মন্দিরও বটে।

কেমন আড্ডা জমাতেন সেকালের দালালেরা বা সি-বয়েরা, আমরা তা জানি না। কিন্তু নিজেদের দিয়ে এটুকু অনুমান করি, তার বহর আমাদের চেয়ে খাটো ছিল না।

চায়ের আসরের একটু বর্ণনা রেখে গেছেন মিস সোফিয়া গোল্ডবোর্ন। ১৭৮৯ সালের আড্ডার বর্ণনা। তাই দেখে কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারি কফিরুমের অবস্থা। সোফিয়া মেমসাহেব লিখছেন : ‘দেখো, আমরা এখানে অর্থাৎ কলকাতায় চা খাই দল বেঁধে। ইংল্যান্ডের মতো দলছাড়া হয়ে নয়। এখানকার কায়দা কানুনও অন্য রকম। তুমি চা খেতে বসলে বেয়ারা এসে দিয়ে যাবে একটি কাপ। ধীরে সুস্থে খাও। ওটি ফুরিয়ে যেতে না যেতে আবার সে এসে ভরে দিয়ে যাবে কাপটি। তোমাকে নড়তেও হবে না, কাপটিকেও হাতছাড়া করতে হবে না। এমনি মজা।’ শেষে লিখছেন, ‘I think, I was never so pleased with any one article so polite etiquette in my whole life.’ স্পেন্সেসের কিংবা অকল্যান্ডের কফিখানায় অনেক ‘সোফিয়াই হয়তো অনুচ্চ গলায় সাগরফেরা নাবিকের কানে কানে এই কথাটিই বলেছে বার বার।

অকল্যান্ড হোটেল ক্রমে নাম নিল উইলসন হোটেল। ইয়ং বেঙ্গল ভিড় জমাল সেখানে। এবং সেখানেই সব শেষ। বলতে গেলে, শাক্ত মতের নব্য সাধকের দল ওঁরা। কফি তো তাঁদের কাছে নিরামিষ ঠেকবেই। অর্থাৎ ধারণাটা এমন:

কফি হাউসের কামনা কলকাতার আজন্ম। কলকাতা জন্মও দিয়েছে অনেক কফি হাউস। কিন্তু কেউ টেকেনি। বলতে পারেন, শুধু খদ্দেরের উৎসাহে তো আর ব্যবসা চলে না।

আমি অনন্যোপায় হয়ে তাই সেই প্রবীণ সাহিত্যসেবীকে বলেছিলাম, ‘লাভই যদি হবে তবে বন্ধ করবে কেন তারা?’

হ্যাঁ, দরকার হলে তাই করে তারা। বজ্রগম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন ভদ্রলোক, ‘Because they know ideas can’t thrive in vacuum! And they are afraid of ideas!’

ঠিক এতখানি গুরুতর কি কলকাতার ‘কাফিহৌস’গুলো? বোধহয় না।

অরণ্যে রোদন

ছোটবেলায় যখন গ্রামে ছিলাম, তখন শুনতাম, কলকাতায় গাছ নেই। গাছ তো দূরের কথা, একখানা দূর্বাঘাসও নেই। সারা শহর বাঁধানো। পথ-ঘাট, দাওয়া, মাঠ, সব। সব ঠন্‌ঠনা ‘পাক্কি জমি’। শুনতাম আর হাঁ হয়ে ভাবতাম দূর, তাও কি হয়। সত্যি বলতে কি ট্রামগাড়ি নয়, বায়স্কোপও নয়, এই গাছ না-থাকাটাই ছিল আমার কাছে এ শহরের সবচেয়ে আজব ব্যাপার।

তারপর যখন কলকাতায় এলাম, দেখলাম গাছ আছে। চেনা অচেনা, নাম জানা-না-জানা অনেক গাছ। চারতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে দেখলাম, এ শহর গাছে গাছময়। কিন্তু আশ্চর্য বনময় নয়। গাছ এখানে এলোপাথাড়ি নেই, ইচ্ছেমত নেই, গাছের এখানে বন নেই। মনে হল, এই তো ভাল। বনবাদাড়ের দেশে লালিত আমার কিশোর মন ভালবাসল কলকাতার এই সভ্য বৃক্ষকুলকে। গাছ আমার এ নগরে প্রথম ভালবাসা।

লোকে ভালবাসার জনকে নিয়ে কাঁদে, আমিও ওদের জন্যে একটু কাঁদব। হোক না অরণ্যে-রোদন। যদি আমার চোখের জলে একটি বকুল কিংবা নিম অথবা নারকেল-চারাও খুশি হয়, আমার কাছে সেই বা কম কী? আমি তা হলেই খুশি।

গাছ। কলকাতার গাছ বলতে নাগরিক কাছ। এ শহরে আছে এরা প্রকৃতির নিয়মে নয়, মানুষের আইনে। মানুষ গাছ লাগায় আজ এখানে আইনমত। (বলা বাহুল্য, বন-মহোৎসব ঠিক আইন না হলেও প্রায়-আইন। ‘ল’ না হলেও ওপরওয়ালার সার্কুলার।)

যা হোক, গাছ এখানে আইনে জন্মায় যেমন, খাবারও তার তেমনি রেশন। বরাদ্দমত সার পায়, জল পায়। জাত বুঝে বয়স বুঝে তার গোড়ায় দেওয়া হয় সালফেট অব অ্যামোনিয়া কিংবা সুপার-ফসফেট। বৃদ্ধিও তার আইন মাফিক। বংশবৃদ্ধি তো বটেই। এসপ্ল্যানেডের গাছগুলোকে একটু নজর করে দেখবেন, শীর্ণ লিকলিকে গাছগুলো বুকে বুকে ধরে রয়েছে টিনের প্ল্যাকার্ড। পরিবার-নিয়ন্ত্রণ কোম্পানির বিজ্ঞাপন। নিজেরা বাধ্য হয়ে সভ্যতার বুলি মুখস্ত করে আজ মানুষকে শেখানোর কাজে সাহায্য করছে বেচারারা।

দেহস্ফীতির অধিকারও তাদের বংশবৃদ্ধির মতো। বাড়তে চাইলেই বাড়তে দিতে রাজি নয়, শহর, সভ্যতা। ছাগলে মুড়িয়ে দিয়ে যায়। দুর্গাপূজার পাগলেরা বিসর্জনের লরিতে ঢাক-ঢোলক বাজি-বারুদের সঙ্গে দা রাখে একখানা। পাছে মায়ের যাত্রাপথে বিঘ্ন ঘটে। পাছে ব্যাঘাত জন্মায় স্বচ্ছন্দ গতায়াতে, ট্রাম কোম্পানিও মাঝে মাঝে তাই দুর্বিনীত কর্মীর মতো ছাঁটাই করে লাইনের ধারের ডালপালা।

অঙ্গহানির সঙ্গে প্রাণহানির নিকট সম্পর্ক। সুতরাং গাছ এখানে মরে। নানা নাগরিক-কারণে গাছ এখানে সভ্যতার সঙ্গে না পেরে উঠে নিঃশব্দে বিলুপ্ত হয়ে যায়। সম্ভবত এ শহরে এদের জন্মের চেয়ে মৃত্যুর হারই আজকাল উচ্চতর। দুঃখের বিষয়, এ ব্যাপারে সেন্সস রিপোর্ট সম্পূর্ণ নীরব, ততোধিক নির্বাক খবরের কাগজের রিপোর্টাররা। খবরের কাগজে সচিত্র বন-মহোৎসব সংকীর্তন আমি দেখেছি। মাঝে-মাঝে বৃক্ষবন্দনা বিষয়ক গবেষণামূলক প্রবন্ধাদি পড়ার সৌভাগ্যও হয়েছে, কিন্তু মৃত্যু- সংবাদ কদাপি না। তাই বলে ভাববেন না, গাছ মরে না এ শহরে, কিংবা মরলেও শোকের মতো সংবাদ তৈরি করে মরে না। মনে করে দেখবেন, আপনিও দেখেছেন। শুধু ‘মরে’ নয়, ‘মরে’, ‘মরিয়াছিল’, ‘মরিতেছে’, ‘মরিবে’, ‘মরিতে থাকবে’ ইত্যাদি নানা অবস্থায় আমি প্রতিদিন তাদের দেখছি। নিজের চোখে এই কলকাতা শহরে, এই চৌরঙ্গিতে আমি দেখেছি, গাছ মরে, অল্প বয়সে মরে, অসুখে মরে—এমন কী, আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। নয়তো আজ যাকে দেখলাম, তরুণ বনস্পতি—রাতারাতি শেষ পাতাটিসহ সে শুকিয়ে যায় কী করে। বিজ্ঞ লোকেরা হয়তো বলবেন, বাজ পড়ে কিংবা ওষুধ প্রয়োগেই এবংবিধ মৃত্যু সম্ভব। অর্থাৎ তাঁদের মতে, দৈব অথবা মানুষই তার জন্যে দায়ী। দুঃখের বিষয়, ময়না তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসম্মত।

যাক সে কথা। গাছ মরে এবং আমাদের মতো আত্মহত্যাও করে—এ দুটো সংবাদের সঙ্গে আমাদের জীবনের ঐক্য সুস্পষ্ট। তবে এক বিষয়ে ওরা আমাদের চেয়ে কিঞ্চিৎ ভাগ্যবান বলেই আমার ধারণা। আমাদের মতে, মরলেই ওদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয় না অন্যদের জন্যে। শহুরে মানুষের পক্ষে এই ঔদার্যটুকু যেন কেমন একটু অপ্রত্যাশিত। তাই একদিন কৌতূহলী হয়ে এক কর্পোরেশন ম্যানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এর কারণ। তিনি বলেছিলেন, ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু হতে টাইম লাগে কিনা, তাই। অর্থাৎ ‘রেড টেপইজম’ তথা সরকারি লাল ফিতের দৌলতেই মরেও ওরা উনুনস্থ হয় না, রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আমার ধারণা একটু ভিন্ন। নন-অফিসিয়াল হিসেবে আমার অভিমত : পৌর-কর্তাদের সৌন্দর্যবোধ বা এসথেটিক সেনস্‌ই মরা গাছকে দাঁড় করিয়ে রাখে রাস্তায়। বোধহয়, অনেকের মতো তাদেরও বিশ্বাস : মরা গাছ অনেক সময় জ্যান্ত গাছের চেয়েও সুন্দর, অনেক বেশি নয়নাভিরাম। মনে মনে একটু তাকিয়ে দেখুন:

তিরিশ ফুট নীচে কচুরিপানায় ভরা বিস্তীর্ণ জলা। তার ওপরে বাঁশের মাচা। তার ওপরে এলোপাথাড়ি হোগলার ছাউনি, জনবসতি। মানুষ এবং গোরু একসঙ্গে বাস করে এখানে। স্বভাবতই জলাটি পূতিগন্ধময়। এমন অবস্থায়, এই ছবিটির দিকে প্রথম দৃষ্টিপাতেই আপনার চোখে পড়বে যে জিনিসটি, তা হচ্ছে বিশালাকায় গুটি-তিন শকুন। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীচের দিকে, আগামী কালই বা আগামী মাসে মরবে যে গো-বৎসটি, তার দিকে।

দৃশ্যটি একটু ভাল করে কল্পনা করুন। দেখবেন, এই গাছ দু’খানা মরা না হয়ে জ্যান্ত হলেই শকুনেরা উড়ে যায়, আর সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ লঘু হয়ে যায় আপনার ভাবনাও। আমার জনৈক ফটোগ্রাফার বন্ধুর অন্তত তাই অভিমত। তিনি বলেন: এই পারিপার্শ্বিক গাছগুলো জ্যান্ত হলেই এমন সাধের ল্যান্ডস্কেপটি মাটি হয়ে যায়। কম্পোজিশান থাকে না।

শুধু এই একটি জায়গাতেই নয়, জ্যান্ত এবং মরা গাছ না থাকলে কম্পোজিশান নষ্ট হয়ে যায় গোটা শহরের। গাছ না থাকলে কয়েক হাজার মানুষের জীবনই থাকে না। মুচি, পরামাণিক, সাধু, ভিখারি, জ্যোতিষী এবং ব্যাগাবণ্ডরা নাগরিক হতে পারে না। নগর-জীবনের রঙ থাকে না। আশ্রয় পায় না বানর-নাচওয়ালা, ভেলিক বাজিওয়ালারা। এদের জন্যে অক্সিজেন বরাদ্দ নেই শহরে, বে-আইনিভাবে মোটা মোটা গাছের গোড়া জড়িয়ে ধরে তাই এরা শ্বাস টানে। গাছ এদের একমাত্র আশ্রয়। পুরুষানুক্রমে কৃপণ শহরে অকৃপণভাবে গাছ তাই আজও পালন করছে এই পুণ্য কর্তব্য। শাখায় শাখায় আজও সে আশ্রয় দিয়ে আসছে শ্রীমর্কটদের এবং তলে যুগপৎ তাদের উত্তর পুরুষ তথা ভক্তদের। ‘ভক্তদের’ বললাম এজন্যে যে, পিতৃ সম্বন্ধ ছাড়াও শ্রীরামচন্দ্রের অনুচরদের সঙ্গে অদ্যাবধি আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান। কলকাতাবাসী যে-কোনও চক্ষুষ্মন ব্যক্তি একটু নজর করলেই বুঝতে পারবেন, এ শহরের শতকরা ৮০টি পাবলিক স্কাল্পচার বা প্রকাশ্য প্রতিমূর্তি তাদের বিশ্ববিনিন্দিত দেহের প্রতিমূর্তি এবং তন্মধ্যে শতকরা ৯৯টি স্থাপিত এবং পূজিত বৃক্ষতলে। যেখানে তা নয় বলে মনে হয়, সেখানেও একটু বিশেষভাবে লক্ষ করলে দেখতে পাবেন বাইরে থেকে বাড়ি বা মন্দির বলে মনে হলেও, শ্রীহনুমানজির পাদপীঠ আসলে বৃক্ষমূলেই সংস্থাপিত। অদ্ভুত উপায়ে এ-সব ক্ষেত্রে কলকাতার মানুষ অ্যাডজাস্ট করেছে গাছপালাকে। গাছকে নির্মূল করে, তারা বাসা বাঁধেনি। গাছের অসভ্য অবস্থিতিকে স্বীকার করেই গড়ে উঠেছে তাদের আস্তানা। ফলে কোথাও হয়তো দেখবেন পরিমাণমতো টিনের চালা কুঁড়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে নারকেল গাছ, কিংবা ইটের দেওয়াল ভেদ করে অশ্বথের শাখা। কলকাতা ছাড়া অন্য কোনও প্রথম শ্ৰেণীর শহরে এমন জিনিস সম্ভব হয়েছে বলে আমি শুনিনি। এমনকী, লর্ড ক্লাইভের হুকুমে পর্যন্ত কলকাতাবাসী হাত তোলেনি এদের গায়ে। শোনা যায়, সিরাজউদ্দৌলাকে হারানোর পর লর্ড ক্লাইভ তাঁর দ্বিতীয় যুদ্ধ ঘোষণা করেন কলকাতার বৃক্ষকুলের ওপর। সে বছরই (১৭৫৭) নাকি খুব বড় রকমের একটা মহামারি হয় কলকাতা শহরে। শহরের স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় ক্লাইভ ঢেরা পিটিয়ে দিলেন শহরে—গাছ কাটো, যার যত খুশি। অদ্য থেকে অত্র কোম্পানির এলাকায় যে কেহ নিজ ব্যয়ে কমলালেবু এবং অন্যান্য ফলকর উদ্ভিদ ভিন্ন অন্য যে-কোনও গাছ কাটাইয়া নিতে পারে। কোম্পানির তাতে আপত্তি নাই। লোকে গাছ কাটল, কিন্তু প্রচুর গাছ কাটল না। টিকে গেল আম, নারকেল আর অশ্বথ। ধর্ম তাদের বাঁচাল। আজও কলকাতার লোক ধর্মের নামে তাদের রক্ষা করে। যদি তা না করত, তবে পাতাবাহার ছাড়া কোথায়ও অন্য গাছ চোখে পড়ত না আজ।

কিন্তু গাছ ব্যক্তি হিসেবে বাঁচলেও জাতি হিসেবে বাঁচে না তাতে। বিশেষ করে কলকাতায় যে মহাজাতিরূপে অধিষ্ঠিত ছিল এরা, তার বিন্দুমাত্র গৌরব রক্ষিত হয় না এই দু-চারটে গাছে। কলকাতার বৃক্ষ-যুগের একটু নমুনা দেওয়া যাক। তা হলেই বোঝা যাবে, এ নগরের অতীত বৃক্ষ-গৌরব কতখানি কী ছিল। চার্নকের ক’বছর পরের কথা বলছি। ১৭০৭ সালের কথা। কোম্পানির কলকাতাকে তখন ভাগ করা হত চারটে অঞ্চলে। গোবিন্দপুর, সুতানটি, বড়বাজার এবং শহর কলকাতা। এর মধ্যে শুধু শহর কলকাতার কথাই ধরা যাক। তখনকার সময়ে এই খোদ শহর এলাকায় কী পরিমাণ গাছপালা ছিল, আশা করি তার একটা মোটামুটি অনুমান করতে পারবেন নীচের হিসেবটি থেকে।

বাড়ি ঘর২৪৮ বিঘা৬ কাঠা
ধানখেত৪৮৪ বিঘা১৭ কাঠা
কলাগাছ১৬৯ বিঘা১৮ কাঠা
তরিতরকারি৭৭ বিঘা১৮ কাঠা
তামাক৩৮ বিঘা১৭ কাঠা
বাগান৭০ বিঘা১ কাঠা
তুলা১৯ বিঘা১৫ কাঠা
ঘাস১৫ বিঘা৯ কাঠা
বাঁশ১ বিঘা৬ কাঠা
ফুল৬ বিঘা২ কাঠা
খাল০ বিঘা৯ কাঠা
জঙ্গল৩৬৩ বিঘা১৫ কাঠা
এবং অন্যান্য২৭ বিঘা৩ কাঠা
পতিত জমি  

বাঁশকে ‘ঘাস’ ধরে, দূর্বা থেকে হিসেব শুরু করলে, শহর কলকাতার যে বৃক্ষ পরিস্থিতি দাঁড়ায়, নগরের অন্য তিন খণ্ডের হিসাবও তার অনুরূপ। আজকের এই ময়দানের কথাই ধরুন। তৎকালে এটি ছিল গোবিন্দপুরের অন্তর্ভুক্ত। অথচ সীমা ও জনসংখ্যা বিচারে গোবিন্দপুর ছিল এই বিরাট ভূমিখণ্ডের এক কোণে একটি জীর্ণ গ্রাম মাত্র। মাত্র ৫৭ বিঘা জমিতে ছিল তার এলাকার সীমা। অথচ ময়দানের মোট ভূমি পরিমাণ ১১৭৮ বিঘা। আজ যেখানে গড়, সেখানে ছিল সেদিনের গ্রামটি। আর বাদবাকি জমি জুড়ে ছিল ধান খেত আর বন। বাঘ, শেয়াল, সাধু আর ডাকাতের আস্তানা। কোম্পানির লোকেরা বড় একটা আসত না এ অঞ্চলে। পলাশীর যুদ্ধের পর মিরজাফরের সেলামির টাকায় গোবিন্দপুরের জনবসতি উঠিয়ে তৈরি হয় তাদের গড়। তারপর ১৭৫৭ থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে ‘গড়ের মাঠ’। বনকে মাঠ কী করে করা হল তার পদ্ধতি আগেই বলেছি।

মনে রাখবেন বৃক্ষ হিসাবে স্বাভাবিক কাজ (যথা ঘর-বাড়ির উপাদান কিংবা হেঁসেলের ইন্ধন) ছাড়াও কলকাতার গাছ বিশেষ শহিদের মর্যাদা পাবার অধিকারী। তারা হাড়িকাঠ হয়েছে কালীঘাটে, চিৎপুরে এবং এখানে ওখানে। তারা চড়কের চড়ক-গাছ হয়েছে, আবার ফাঁসির সময়ে ফাঁসিকাঠ। এমনিভাবে অনভিপ্রেত মনুষ্য সমেত বহুবিধ প্রাণীকে শহর থেকে বিদূরিত করে, আপাত নির্বাক গাছপালাই কিন্তু পত্তন করেছে মহানগরীর। এখানেই শেষ নয়। বণিকের কলকাতা এবং সংস্কৃতির কলকাতা—এই দুই কলকাতারই মূল তারা। শোনা যায়, চার্নকের সিদ্ধি ছিল সুতানটির একটি গাছ, তৎকালীন বই-পাড়ারও তাই।

চার্নক সাহেব নাকি একখানা ঢিলে কামিজ আর পাজামা পরে উল্লেখিত বটতলায় বসে গড়গড়া টানতেন আর দরদস্তুর করতেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তার ‘ক্যায়া ভাও’ শুরু হয়েছিল ওখানেই। এমন কী চার্নকের কাউন্সিলও নাকি বসত এই বটগাছের তলেই। ওটাই ছিল তার বৈঠকখানা। বলা বাহুল্য, হালের ঐতিহাসিকদের অভিমত এই যে : বট থেকেই নাম হয়েছে বটে আজকের বৈঠকখানার। তবে গাছটি ছিল বউবাজার আর সার্কুলার রোডের মোড়ে অর্থাৎ শিয়ালদহে। শোনা যায়, ১৭৯৯ সালে ওয়েলেসলি সাহেব বউবাজার স্ট্রিট গড়তে গিয়ে কাটিয়ে ফেলেন ওটিকে এবং তাঁর এই কাজে যারপর নাই খেপে গিয়েছিল দেশীয় লোকেরা। কারণ, তাদের মতে এতে নেটিভের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এতকাল চলতি ইতিহাস তাই বলে আসছে আমাদের। কিন্তু সম্প্রতি আমার চোখে অন্য একটি তথ্য পড়ছে। একজন গবেষক জানিয়েছেন চার্নকের প্রিয় গাছটি ছিল নিম গাছ, বট গাছ নয় এবং ওখানা ছিল বেনিয়াটোলা আর শোভাবাজারের মাঝামাঝি জায়গায়, গঙ্গার ধারে। অর্থাৎ নিমতলায়। এখানেই ছিল চার্নকের তথাকথিত বৈঠকখানা। ওই গাছটি চার্নকের মৃত্যুর পরেও বহুদিন ওখানে ছিল। ১৭৭৯-৮০ সালে ওটিকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ‘কেন’ বা ‘কে’ পুড়িয়ে ফেলল, অতশত তিনি লেখেননি। তবুও এ লেখকের মতকে গ্রহণ করতে আমি রাজি। কারণ এতে বৈঠকখানার গৌরব কমে না, অথচ নিমতলাও স্থান পায়। আজকের মহাশ্মশানকে যদি প্রমাণ করতে পারি এককালের এ শহরের প্রাণভূমি তবে ইতিহাসকে কিছু কেটে ছেঁটে বদলাতে হলেও আমি তাতে সম্মত। তেমনি বটতলার খ্যাতির আজ যদি দাবিদার হয়ে ওঠে কোনও বেল কিংবা শ্যাওড়া, তা হলেও আপত্তি করব না আমি।

যা হোক, কলকাতার গাছপালা সম্বন্ধে আমার এই এলোপাথাড়ি বক্তব্য শুনে যদি হঠাৎ গাছ-গাছ প্রাণ হয়ে ওঠেন তা হলে আপনাদের অনুরোধ করব একটু ধৈর্য ধরতে। বন মহোৎসবের দরকার নেই। হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন মাত্র দশটি বছর। দেখবেন, গুটিসুটি করে আবার ফিরে আসছে চার্নকের কাল, এ শহর হয়ে উঠছে অরণ্য-নগর।

যদি তাতে রাজি না হন, তবে এটুকু অন্তত করুন। মনে মনে শুধু একবার কদমতলায় কদম, বেলতলায় বেল, বাঁশতলায় বাঁশ—এই সূত্র ধরে বট, আমড়া, নিম, নেবু বাদাম এবং তাল লাগিয়ে যান। লাগিয়ে যান কলাবাগানে কলা, ফুলবাগানে পুল, হরিতকি বাগানে হরিতকি, সূর্তি বাগানে তামাক এবং নারকেলডাঙ্গায় নারকেল। দেখবেন, এ শহর অরণ্যে পরিণত এবং আমরা ‘গৃহী হইয়াও বনবাসী।’

কোম্পানির লেখক

জনৈক ব্রিটিশ এম. পি. এসেছেন ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষে তখন কোম্পানির রাজত্ব। এদেশের নামডাক তিনি শুনেছেন। তদুপরি এ দেশের রহস্যময় প্রকৃতি, এ দেশের বিচিত্র মানুষের বিস্ময়কর রীতি-নীতির কথা কিছু কিছু তিনি পড়েছেনও। ভারতবর্ষকে তাই দেখতে চান তিনি নিজের চোখে। শুধু দেখা নয়, ভারতবর্ষের অন্তরকে অন্তর দিয়ে জানতে চান তিনি।

উত্তম কথা। কিন্তু হায়। ‘ফৌজদারি’ কাকে বলে, কার নাম ‘বন্দোবস্ত’, বাঙালিবাবু আর পাঠানে কী ফারাক—কিছুই তিনি জানেন না। তা হলেও যাকে পান, তাকেই ধরে ভারতবর্ষ নিয়ে আলোচনা জুড়ে বসেন। খুব গা বাঁচিয়ে না চললে তাঁর থেকে রেহাই পাবার জো নেই কারও। তিনি যে একজন ভারতবিদ, যাকে বলে—‘প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ।’

হপ্তাখানেক যেতে-না-যেতেই ভদ্রলোক বসে পড়লেন হিন্দুদের ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য ও ইতিহাস বিষয়ে একখানা প্রমাণ-সাইজের বই লিখতে। এবার তিনি লিখতে পারেন বইকি। ভারতবর্ষকে তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। এখনও দেখছেন। ওই তো ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় তাঁকে দেখা যাচ্ছে। মন দিয়ে ফরবেসের ‘হিন্দুস্থানি ম্যানুয়েল’ পড়ছেন। অবশ্যই এখন তিনি আর্যদের ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক অধ্যায়টি লিখছেন।

ব্যঙ্গরচনায় সিদ্ধহস্ত ইংরেজ লেখক ‘সার আলিবাবা’, ওরফে G. Aberigh Mackay তাঁর ‘টোয়েন্টি ওয়ান ডেজ ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে ভারত বিশেষজ্ঞদের এই চিত্রটি এঁকেছিলেন। বলা বাহুল্য, সার উইলিয়ম জোনস্ কোলব্রুক কিংবা প্রিন্সেপ সাহেবের মতো মানুষ এ ব্যঙ্গের লক্ষ্য নয়। মুষ্টিমেয় ভারতসন্ধানীদের বাদ দিলে যে অসংখ্য তথাকথিত ভারতবিশারদ আবির্ভূত হয়েছিলেন কোম্পানির আমলে তাঁদেরই পরিচিত করতে চেয়েছিলেন তিনি তাঁর দেশবাসীর কাছে।

ভারতবর্ষে সব ইংরেজই ভারত-বিশেষজ্ঞ। সবাই এখানে লেখক। যিনিই আসছেন, তিনিই কিছু না কিছু লিখছেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ধি-চুক্তি, হাতি চড়া, কিংবা বাঘ-শিকারের মতো লেখাও এখানে অতি সহজ ব্যাপার, স্বাভাবিক ঘটনা। ওই এম পি-র মতো পণ্ডিতদের কথা বাদই দিচ্ছি। ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন ছাড়া অন্যবিধ রচনাই কি কম? লেফটেন্যান্ট গভর্নর থেকে সাব-অলটার্নের গিন্নি পর্যন্ত কেউ বাদ নেই। গবেষণামূলক রচনা সম্ভব না হয়, গল্প উপন্যাস, কবিতা, ‘বেলে-লেটার’ তথা মার্জিত রসসাহিত্য (যথাসম্ভব আর কি), নিদেনপক্ষে খান কয় লম্বা চিঠি, নয়তো একখানা জার্নাল অন্তত লেখা চাই-ই চাই। গোরা সৈন্যের যুদ্ধসজ্জার মতো এও যেন লেখার প্যারেড, লেখকের কুচকাওয়াজ। বিরামহীন চলেছে তো চলেছেই। দুশো বছরে তার যোগফলের অংকটা বোধহয়, আমাদের অনেক আঞ্চলিক সাহিত্যের চেয়েই হিসাবে বড়। ইংরেজি সাহিত্যেও এ একটা স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ শাখা, ভিন্ন জমির ফসল। যেন বা একরাশ বুনোফুল। বৈচিত্র্যের কারণে ঘরে ঠাঁই পেয়েছে বটে, কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের খাস বৈঠকখানায় ভারতবর্ষ বিষয়ক এই লেখককুলের ভাগ্যে কোনও স্থান জোটেনি। দু’একজনের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। এদিকে ভারতবর্ষের মনেও যে তাঁদের জন্যে ফুলকাটা কাশ্মীরি আসন বিছানো, এমন নয়। আসলে তথাকথিত বিদেশিরা নিজেরাই এই অনাদর ডেকে এনেছিলেন। দেশে এবং বিদেশে রচনা-পরবর্তী কোনও পরিণামের কথা চিন্তা না করেই তাঁরা লিখেছেন। এ দেশের জমিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কলম হাতে তুলে নিয়েছেন এবং এ দেশ ছেড়ে গিয়েও তাঁরা আজও তা হাতেই রেখেছেন।

বোধ হয়, না লিখে উপায় ছিল না বলেই ভারতবর্ষের ইংরেজরা এমন বেপরোয়াভাবে লিখেছেন। নির্বাসনের যাতনা এ রচনার প্রথম উৎস। গুটিকয়েক অস্থিরমতি স্পেকুলেটর ব্যবসায়ী আর একটা ঠুনকো গভর্নমেন্টের ছত্রচ্ছায়ায় এই বিরাট দেশের অসহ্য দহন, অফুরন্ত আনন্দ সহ্য করা যায় না, ভোগ করা যায় না। হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান স্বদেশ ও স্বগৃহ কাঁটা হয়ে অন্তরে নিয়ত খোঁচা দেয়। ভারতবর্ষকে মুঠোয় পেয়েও দেশকে ভোলা যায় না।

তার উপর অবসর। অফুরন্ত অবসর এখানে। দুপুর এখানে বড় মন্থর কাটে না। রাত্রি বড় দীর্ঘ। জীবন অলস। সুতরাং লেখা যায়। লিখে দেশের লোককে দুঃখের কথা জানানো যায়। নিজের মনের কথা খুলে বলা যায়। আপকান্ট্রির কোনও হিলস্টেশনের পাশে বাংলোর ঘরে মশালের আলোয় বসে সিভিলিয়ান তাই হাঁকেন ‘জোসেফ। কলম লে আও। দোয়াত লে আও।’ কিন্তু শুধু দোয়াত কলমে তো আর লেখা হবে না।

‘Good! A fresh chillum; saturate tatties with goolaub, scatter little fountains of roses, chumpah and baubul blossoms about the room; bring me a vast seral of iced sherbet, pure juice of pomegranate. —you understand!’

তারপর শুরু হল ‘ওরিয়েন্টাল টেলস’। বিষয়বস্তুর অভাব কী? যুদ্ধ বিগ্রহ আছে, নবাব বাদশা বা রাজা-উজিরদের দরবার কিংবা অন্দর আছে। সাপ-বাঘ জঙ্গল, নাচ-গান-কেলেংকারি-কেচ্ছা কোনটির অভাব ভারতবর্ষে? ভারতবর্ষে যা আছে, সে তো আছেই, নিজেরা সঙ্গে করে এনেছেনও কম নয়। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজে বৈপরীত্যের অভাব নেই। বৈচিত্র্যও প্রচুর। সুতরাং লেখো। ব্যঙ্গ করো, বিদ্রুপ করো নিজেকে, নিজের ভাগ্যকে, প্রতিবেশীর সৌভাগ্যকে, উপরওয়ালার মাহাত্ম্যকে। স্থানাভাব নেই। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মাসিক কাগজগুলো আছে। কবিদের জন্যে সেখানে আছে ‘পোয়েট’স কর্নার। কোনও মতে ছন্দ মিলিয়ে যা খুশি লেখো। ‘এডুইন আরনল্ড’ বা ‘রিচার্ডসন’ হওয়ার দরকার নেই। কোনও মেয়ের পোশাক, কোনও রাইটারের কেচ্ছা, যা খুশি বিষয়বস্তু হতে পারে। উপন্যাস, কাহিনীর পাঠকও কম নয়। হাজার হাজার মাইল দূরে, বহু সাগর পেরিয়ে স্বদেশে হাজার হাজার মানুষ সাগ্রহে বসে আছে এ দেশের কাহিনী শোনার জন্যে। তাঁরা এর আগেও ভারতের কথা শুনেছেন। বায়রন সকলকে চমকে দিয়ে একদিন ঘোষণা করেছিলেন:

‘Look to the East, where Ganges’ Swarthy race

Shall shake your tyrant empire to its base

Lo! There Rebellion rears her ghastly head,

And glares the Nemesis of Native dead.

(Curse of Minerva)

সিপাহী-বিদ্রোহের আগেকার কথা। বায়রন ভারতবর্ষে যাননি কোনও দিন। কোথায় পেলেন তিনি এ অমঙ্গলের সংবাদ? ভারতবর্ষে যাননি এমন লেখক আছেন ইংল্যান্ডে। জনসন ভারতবর্ষ নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন সার ওয়াল্টার স্কট এবং অন্যরাও। ডিকেন্সের লেখায়ও ভারতবর্ষের কিছু কিছু কথা আছে। কিন্তু এঁরা লেখক। কোনটা সত্য, কোনটা কল্পনা, বোঝা কঠিন। ইংল্যান্ডের লোক প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখা চায়। তাদের চোখে দেখা সাক্ষ্যে এঁদের লেখা মিলিয়ে নিতে চায়। তা ছাড়া, যত নগণ্য লোকের রচনাই হোক, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের মজা তুলনাহীন।

সুতরাং দু’ হাতে শুরু হল লেখা। একদিকে ভারতবর্ষের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কাগজগুলো, অন্যদিকে ইংল্যান্ডের দুঃসাহসী প্রকাশকরা—দুয়ে মিলে লালন করে চললেন ভারতের বেপরোয়া লেখককুলকে। তাঁদের সাকুল্য পরিচয় এখানে অসম্ভব, শুধু নামোল্লেখেই এ প্রবন্ধের পরিধির ধৈর্যসীমা পেরিয়ে যাবে। আমরা তাই শুধু অপেক্ষাকৃত উল্লেখযোগ্য ক’টি উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিকের কথাই সংক্ষেপে আলোচনা করছি এখানে।

কালের দিক থেকে ভারতবর্ষে ইংরেজের লেখা উপন্যাসকে ভাগ করা যায় চার ভাগে। ইংরেজ রাজত্বের সূচনা থেকে সিপাহি-বিদ্রোহ অবধি প্রথম অধ্যায়ের কালসীমা। দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা কোম্পানির রাজত্বের অবসানে এবং সমাপ্তি মহারানির মৃত্যু তথা ১৯০৫ সালে কিপলিংয়ের ‘কিম’-এর প্রকাশে। ১৯৩৭ সালে এডোয়ার্ড টমসনের ‘ফেয়ারওয়েল টু ইন্ডিয়া’র প্রকাশে তৃতীয় পর্যায়ের শেষ। তার পর থেকে জন মাস্টারস পর্যন্ত, অর্থাৎ অদ্যাবধি চলেছে নতুন যুগ। প্রথম যুগের খ্যাতিমান লেখক হকলে এবং মেডাস টেলর, দ্বিতীয় যুগের রাডিয়ার্ড কিপলিং, তৃতীয় যুগে ই এম ফর্স্টার এবং এডোয়ার্ড টমসন। বর্তমান যুগে এই কৃতিত্বের অধিকারী। দাবিদার ডব্লিউ ডি আরনল্ড, সার হেনরি কানিংহাম, এডমন্ড ক্যান্ডলার প্রমুখ ক’জন সম্বন্ধে এ দাবি নিঃসন্দেহে যৌক্তিকতাপূর্ণ।

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বা ইঙ্গ-ভারতীয় উপন্যাসের সূচনা বলা চলে ডব্লিউ বি হকলের হাতে। তাঁর ‘পাণ্ডুরাং হরি’ (১৮২৬) যোগ্যার্থে এই বিচিত্র সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। এর আগে সোফিয়া গোল্ডবোনের হার্টলি হাউস, মিস সিড়নি ওয়েনসনের ‘দ্য মিশনারি দি ইংলিশ হোমস ইন ইন্ডিয়া’ এমনি কয়টি বর্ণনামূলক কাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাদের উপন্যাস বলা চলে না। একটা ক্ষীণ কাহিনীর বাঁধন থাকলেও এগুলো ভ্রমণবিবরণ বিশেষ। অবশ্য হাকলের বইটিও অনেকের মতে নিছক অনুবাদ মাত্র। দক্ষিণের জনৈক হিন্দু এ দেশের ভাষায় লিখিত বইটি নাকি তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে।

তা হলেও হাকলের যে লেখবার ক্ষমতা ছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, এর পরও তিনি ‘টেলস্‌ অব জেনানা’ (১৮৫৭) এবং ‘দ্য ফেটাল জুয়েলস্‌’ নামে দুখানা জনপ্রিয় উপন্যাস রচনা করেছিলেন।

হাকলের পর ঔপন্যাসিকদের মধ্যে খ্যাতির ব্যাপ্তিতে উল্লেখযোগ্য মেডোস টেলার। ক্ষমতায় এবং কর্মপ্রতিভায় তিনি হাকলের চেয়ে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতর। এমনকী, ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি বোধ হয় আজও সার্থকতম ঔপন্যাসিক। টেলার ভারতে কোম্পানির কর্মচারী হিসাবে অবতরণ করেন ১৮২৪ সালে, আর তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘কনফেসনস্‌ অব আ ঠক’ প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ সালে। সুতরাং ভারতবর্ষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় মামুলি লেখকদের মতো ছিল না বলা চলে। ‘স্টোরি অব মাই লাইফ’ নামে তাঁর একখানা আত্মজীবনীও আছে। ১৮৪০ থেকে ১৮৫৩ সাল অবধি তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে ‘টাইমস’-এর প্রতিনিধিও। ভারতবর্ষ এবং ভারতবাসী সম্পর্কে টেলার ছিলেন তাঁর পূর্বতন লেখকদের চেয়ে অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। এদেশের নারী-পুরুষের অন্তরেও, সৎ প্রবৃত্তি, মহত্ত্ব কিংবা মানবতাবোধ আছে, তাঁর উপন্যাসে তা তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন। পূর্বসূরিদের থেকে তাঁর ভারত-পরিচিতির এই ভিন্নতাকে অনেক ইংরেজ সমালোচক টেলারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, টেলার ভারতীয় পাত্রপাত্রী নিয়ে লিখলেও তাঁর মনে ছিল ইউরোপীয় আদর্শে তৈরি নরনারী। তারাই তাঁর ‘সীতা’ বা ‘তারা’ চরিত্রের রূপ ধরে বইয়ের পাতায় নেমে এসেছে। বলা বাহুল্য, ভারতবাসীর কাছে এই যুক্তিটা সত্য বলে মনে হবে না। টেলার ভারতবর্ষকে অপেক্ষাকৃত সত্যরূপে চিত্রিত করেছেন—এই ধারণাই এ দেশে টেলারের জনপ্রীতির কারণ।

মেডাস টেলারের জনপ্রিয় বই ‘কনফেশনস অব আ ঠক’ বা জনৈক ঠগের আত্মস্বীকৃতি। ঠগী দস্যুদের এই চাঞ্চল্যকর কাহিনী তৎকালে যথেষ্টে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল এ দেশে এবং ইংল্যান্ডে। রাশি রাশি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান উপন্যাসের মধ্যে সামাজিক কর্তব্য সম্পাদনের একক কৃতিত্ব এই বইখানারই প্রাপ্য। ভবানী-শিষ্য জনৈক আমির আলি এ বইয়ের নায়ক। নিজের জবানিতে সে তার এবং তাদের দলের লোকদের লোমহর্ষক কাহিনী বিবৃত করেছে। গলায় রুমাল জড়িয়ে সাত শো লোককে আমির আলি হত্যা করেছে নিজের হাতে। তার দুঃখ, হার্জারে নিয়ে তুলতে পারল না অঙ্কটাকে।

টেলারের অন্যান্য বই : ‘টিপু সুলতান’, ‘এ নোবেল কুইন,’ ‘তারা’, ‘রালফ ডারনেল’ এবং ‘সীতা’।

তার মধ্যে ‘তারা’, ‘রালফ ডারনেল’ এবং ‘সীতা’ এই তিনটি বই-ই তিন শতকের কাহিনী। প্রতিটি উপন্যাসই আকারে বিরাট এবং তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ। ‘তারা’র পটভূমি দক্ষিণ-ভারত। ১৬৫৭ সালে বিজাপুরের যুদ্ধে শিবাজীর জয় এবং দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তি এ কাহিনীর অন্তর্ভূমি। ‘রালফ ডারনেল’য়ের কাহিনী ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজের বিজয় এবং দাক্ষিণাত্যে মারাঠা প্রভুত্ব উচ্ছেদের অধ্যায়কে কেন্দ্র করে, আর ‘সীতা’র উপজীব্য ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহ।

এখানে একটা কথা বলা আবশ্যক। সিপাহি-বিদ্রোহের মতো ইংরেজ আমলের অন্যান্য কোনও ঘটনাই ইঙ্গ-ভারতীয় উপন্যাসের তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। বস্তুত, এঁদের উপন্যাসের বৃহত্তম অংশই তাদের কেন্দ্র করে। সামাজিক উপন্যাস বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা নিতান্তই কম। যা আছে, তাও সত্য ঘটনার যথাযথ চিত্রণের চেষ্টার ফলে পীড়িত। ঘটনার বিবরণই মুখ্য। এমনকী, এই সব ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি যেন কিছুতেই মুছে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না ইংরেজ লেখক-লেখিকাদের পক্ষে। সিপাহি-বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় গ্রন্থাগারে যে পুস্তক প্রদর্শনীর আয়োজন হয়, তাতে প্রদর্শিত হয়েছিল প্রায় পনেরোটি ছোট-বড় উপন্যাস, বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত কাহিনী। তার মধ্যে প্রথমটির রচনাকাল ১৮৫৯; আর শেষটি একশো বছর পরে ১৯৫৭ সালে।

প্রথমটির নাম ‘দ্য ওয়াইফ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ড’ অথবা ‘লাইফস এরর’ (১৮৫৯) আর শেষটি মেরি মার্গারেট কেরির ‘শ্যাডো অব দ্য মুন’ (১৯৫৭)।

এগুলো উপন্যাস বলে কথিত হলেও বস্তৃত ইতিহাসপদবাচ্য। এর মধ্যে তৎকালে সর্বাধিক খ্যাতি ছিল টেলারের সুবৃহৎ উপন্যাস ‘সীতা’র। কিন্তু সমসাময়িক কালের একটা মোটামুটি পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক তাকে যে পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছেন, আধুনিক কালের পাঠক তাকে সুখপাঠ্য ইতিহাস বলে যদি ভুল করেন, তবে তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না। টেলারের পরেই সিপাহি বিদ্রোহের উপন্যাস হিসাবে খ্যাত ফ্লোরা অ্যানি স্টিলের ‘অন দ্য ফেস অব দ্য ওয়াটারস’ (১৮৯৭) নামে বইখানা। কিন্তু পড়লে মনে হয়, লেখিকার খ্যাতির কারণ অন্যত্র।

শুধু সিপাহি-বিদ্রোহ নয়, সতীদাহ, ঠগীদের অত্যাচার, বঙ্গভঙ্গ ও বাংলার সন্ত্রাসবাদ, নীলকর ইত্যাদি আরও আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে একাধিক লেখক গ্রহণ করেছেন তাঁদের উপন্যাসের উপাদান তথা পটভূমি হিসেবে। এর মধ্যে ক্রিসটাইন ওয়েস্টেনের ‘ইন্ডিগো’ (১৯২৪), সিসিল লেসলির ‘দ্য ব্লু ডেভিল’ (১৯৫১), লেসলি বেরেসফোর্ডের ‘দ্য সেকেন্ড রাইজিং’ (১৯১০), এডমন্ড কেন্ডলারের ‘শ্রীরাম দ্য রেভলিউশনারি’ (১৯১২) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

যা হোক, প্রথম যুগের শেষে আবির্ভূত হলেন কিপলিং। কিপলিং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহিত্যে একটি নতুন যুগের সূচনা তো বটেই, তিনি নিজেই একটি সম্পূর্ণ যুগ। তাঁর ‘কিম’ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহিত্যে সর্বজনস্বীকৃত শ্রেষ্ঠ পুস্তক এবং এ বইয়ের লেখক কিপলিং ভারতবর্ষের ইংরেজ লেখকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ লেখক। প্রতিভা, সমস্যা এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে রাডিয়ার্ড কিপলিং স্বতন্ত্র আলোচনার দাবিদার। এখানে তার সুযোগ নেই। শুধু এটুকু উল্লেখ করলেই চলবে যে, কিপলিং প্রথমবারের মতো ইঙ্গ-ভারতীয় সাহিত্যে স্পষ্টত দুটো সমস্যার আমদানি করলেন। প্রথমটি ইংরেজ এবং ভারতীয়ের সম্পর্ক, দ্বিতীয়টি ইংরেজ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের পারস্পরিক সম্পর্ক। প্রথম সমস্যাটি ইতিপূর্বে অস্পষ্টভাবে হলেও ছিল। কোনও লেখক ভারতীয়দের প্রতি কর্কশ হয়েছেন বা অবিচার করেছেন, কেউ হয়তো অপেক্ষাকৃত উদারতারও (?) পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু কিপলিং যখন সমস্ত সংগত কারণ এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ‘কিমে’র হরিচন্দর মুখার্জিকে উপন্যাসের দ্বিতীয় ব্যক্তিতে পরিণত করলেন, তখন শাসক এবং শাসিতের পার্থক্য সাহিত্যেও আত্মপ্রকাশ করে বসল। সাম্রাজ্যবাদী গর্বেও উদ্ধত কিপলিং শ্বেতচর্মের ‘প্রভুত্ব’কে সংগত এবং স্থায়ী বলে প্রতিপন্ন করতে চাইলেন। আর এদিকে ভারতবর্ষে জন্মানোর অপরাধে পাছে তাঁর সেই শ্বেতমাহাত্ম্যের খর্বতা দেখা দেয়, এই ভয়ে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজকে ঠেলে দিলেন নিজের থেকে দূরে। ভারতে জন্মালেই লোক আংলো-ইন্ডিয়ান হয় না, যদি তার পিতামাতার দুই-ই থাকেন ইউরোপিয়ান, তবে সন্তানও ইউরোপিয়ান। রাডিয়ার্ড কিপলিং ইউরোপিয়ান। তিনি ভারতবর্ষে প্রভূকুলে জাত এবং তিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কুল থেকে স্বতন্ত্র।

কিপলিংয়ের এই জীবনদর্শন এবং উপন্যাস হিসেবে ‘কিম’-এর সাফল্যের উত্তর-ফল হিসেবে একদিকে দেখা গেল অনাবশ্যক জাতিদ্বেষের পীড়নে পড়েছেন এদেশের ইংরেজ লেখক-লেখিকারা, অন্য দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে চলেছে উপন্যাস রচনার উদ্যোগও। আরও একটি কাজ করেছিলেন কিপলিং—সেটি ভারতীয়দের মনে ইংরেজি উপন্যাস সম্পর্কে বিরাগের সৃষ্টি।

এ বিরাগ সর্বপ্রথম কাটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন যিনি, তিনি ই এম ফস্টার। তাঁর ‘এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ (১৯২৪) এবং এডোয়ার্ড টমসনের ‘অ্যান ইন্ডিয়ান ডে’ (১৯২৭) এবং ‘ফেয়ারওয়েল টু ইন্ডিয়া’ (১৯৩৭) নবযুগের নতুন উপন্যাস। টমসন কুড়ি বছর ভারতবর্ষে ছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের সঞ্চার, স্বাধীনতার আন্দোলন, সত্যাগ্রহ তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন এবং সমসাময়িক ভারতবর্ষের সত্য-চিত্র উপস্থিত করেছেন তাঁর লেখায়। কিম-এর হরিচন্দরের পিছনে যদি থেকে থাকে শরৎচন্দ্র দাসের প্রেরণা, তবে ‘ফেয়ারওয়েল টু ইন্ডিয়া’য় ছিল শ্রীঅরবিন্দের ধারণা। কিন্তু ভারতীয় পাঠক যেমন ‘কিম’ পড়ে ব্যথিত হন অন্তরে, টমসনের রচনায় সে ব্যথার কারণ নেই। ইংরেজি উপন্যাসের কুসংস্কার কাটিয়ে তুলেছিলেন টমসন এবং ফর্স্টার। এখানেই তাঁদের বিশেষ সার্থকতা।

’৩৭-এর পরের বিখ্যাত ইংরেজি উপন্যাস ‘রিভার’-এর লেখিকা রিউমার গডেনের ‘ব্ল্যাক নার্সিসাস’ (১৯৩৯), হিলডা সেলিম্যানের ‘হোয়েন পিককস্‌ কলড্‌’ (১৯৪০), হিলডা ওয়েবনারের ‘দ্য ল্যান্ড অ্যান্ড দ্য ওয়াল’ (১৯৪৭), ইথেল ম্যানিনের ‘অ্যাট সানডাউন দ্য টাইগার’ (১৯৫১) এবং জন মাস্টারসের বইগুলো।

এদের মধ্যে জন মাস্টারসের পাঠক-পরিধি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বিস্তৃত। এদেশেও তিনি জনপ্রিয় লেখক। ‘ভবানী-জংশন’-এর লেখক হিসেবেই সর্বাধিক খ্যাত হলেও, ‘ভবানী-জংশন’ মাস্টারস-এর শ্রেষ্ঠ রচনা নয়। মাস্টারস আধুনিক লেখক। তার লেখার শুরু ১৯৫১ সালে। ইতিমধ্যে ছ’খানা বইয়ের গ্রন্থকার তিনি। তাঁর পরিকল্পনা, ভারতের সঙ্গে ইংরেজের তিনশো পঞ্চাশ বছরের যোগাযোগ নিয়ে ৩৫ খানা বই লেখা। প্রতি একশো বছরের জন্য দশখানা বই। পরিকল্পনাটি অনেকটা টেলরের মতো। যাই হোক, পরিকল্পনা অনুসারে ইতিমধ্যেই বেরিয়ে গিয়েছে কয়েকখানা : ‘করমণ্ডল’, ‘দ্য ডিসিভারস’, ‘নাইট রানারস অব বেঙ্গল’, ‘দ্য লোটাস’, ‘অ্যান্ড দ্য উইন্ড’, ‘ভবানী-জংশন’ ইত্যাদি।

‘করমণ্ডলে’র পটভূমি ভারতে ইংরেজের পদাপর্ণ, ‘ডি সিভারস’ অর্থাৎ ঠগ দস্যু। ‘নাইট রানারস অব বেঙ্গল’ সিপাহি বিদ্রোহ, ‘লোটাস অ্যান্ড দ্য উইন্ড’ ১৮৭৯-৮১ সালে আশঙ্কিত রুশ আক্রমণের পটভূমিতে রচিত, এবং ‘ভবানী-জংশন’-এর বিষয়বস্তু এবং কাল দুই-ই ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অবসান (১৯৪৭)।

এই সব উপন্যাস ছাড়াও মাস্টারসের আরও একখানি বই আছে ‘বিউগলস্‌ অ্যান্ড আ টাইগার’। এটি তাঁর আত্মজীবনী।

মাস্টারসের জন্মও কিপলিংয়ের মতোই ভারতবর্ষে, ১৯১৪ সালে কলকাতায়। ভারতবর্ষে তাঁর পরিবারের বাস সুদূর ১৮০৫ সাল থেকে। পিতার ঠাকুরদা ছিলেন প্রথম কলকাতার লা মার্টিনা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, তারপর কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যাপক। মাস্টারস নিজে ছিলেন সৈন্যবিভাগে।

সুতরাং ভারতবর্ষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় পুরুষানুক্রমিক। তবুও ভারত স্বাধীন হওয়ার পর মাস্টারস ভারত ত্যাগ করেছেন। ‘ভবানী-জংশন’-এর নায়কের মতো তার লেখকও আজ ভারতের বাইরে, নিজের দেশের বাসিন্দা। এদেশে তিনি পরবাসী।

‘And a foreigner was a man who did not guard the past, and foster the future; above all who did not love.’

কিন্তু মাস্টারস ভারতবর্ষকে ভালবাসেন। কিপলিংকে শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে স্বীকার করেও, তাঁর তথাকথিত আভিজাত্য তিনি বরদাস্ত করতে পারেননি। ভারতপ্রেমিক হিসেবে তিনি কিপলিংয়ের রচনায় ব্যথিত বলে আত্মজীবনীতে বলেছেন। ভারতবর্ষ তাঁর কাছে একটা দেশ—এমন দেশ, যেখানে ভাল এবং মন্দ দুই-ই আছে, যেমন পৃথিবীর সর্বত্রই থাকে। ফ্লোরেন্স মারিয়াতের মতো ভারতবর্ষ নার্সারি অব বিগ ট্রি প্রেজুডিস অ্যান্ড স্মল-মাইন্ডেডনেস বা ভারতবর্ষ ‘দ্য জগরনাট অব ইংলিশ ডোমেস্টিক লাইফ’ নয় মাস্টারসের কাছে। ভারতবর্ষ ইংল্যান্ড আমেরিকার মতোই দেশ।

‘I have never had the attitude of the average civilian tourist, so I do not think India as quiant, picturesque, exploited, inscrutable or otherworldly. I thought India was ugly, beautiful, smelly, predictable, and as material as the West. It was inhabited not by yogis and saints, but by people—knaves, giants and dwarfs and plain people.’

জন মাস্টারসের রচনা পড়লে এ ভাষণের সত্যতা সবাই হয়তো সমান পরিমাণে খুঁজে পাবেন না, কিন্তু মাস্টারস যে এ কালের ইঙ্গ-ভারতীয় ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম, এ বিষয়েও বোধহয় কারও দ্বিমত থাকবে না।

কোম্পানির চিত্রকর

কলকাতা তথা গোটা হিন্দুস্থানে তখন শিল্পীর হাট। ইংরেজ চিত্রকরদের বাজার। ১৭৭০ সাল থেকে ১৮২০—আধা শতক। পুরো পঞ্চাশ বছর। পঞ্চাশ বছরে ষাটজন পেশাদার ইংরেজ শিল্পী এসেছিলেন আমাদের দেশে। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে একজনেরও বেশি। বলা বাহুল্য, যে কারণে লিন্ডেন স্ট্রিট থেকে সেদিন কলকাতা অবধি ছুটে এসেছিলেন ইংরেজ ব্যবসায়ীরা, এঁদেরও সেই একই কারণে আসা। ব্যবসায়ের কারণে। টাকার জন্য। ভারতবর্ষে তখন কোম্পানির পাকা কারবার। সুতরাং কাঁচা পয়সার ছড়াছড়ি এখানে। সিনিয়র হোক, বা জুনিয়র, মার্চেন্ট, রাইটার, ফ্যাকটার সবাই লাখপতি। তা ছাড়া, ভারতবর্ষ নবাবদের দেশ। এদেশে ঘরে ঘরে নবাব। তাঁরা সোনার থালায় হিরের ভাত খান। তাঁদের জেনানা-মহলে তিনশো করে বিবি, আস্তাবলে তিন হাজার করে ঘোড়া। তদুপরি ইংরেজ শুনলেই মূৰ্ছা যান ওঁরা। কখনও ভয়ে, কখনও পুলকে। সুতরাং ছবি এঁকে পয়সা রোজগার করতে হয় তো রং-তুলি নিয়ে চলো ভারতবর্ষে।

অবশ্য সেকালের ভারতবর্ষে ইংরেজদের এই ব্যাপক চিত্রচর্চার পিছনে অন্য একটি কারণও ছিল। সেটি জানতে হলে আমাদের তাকাতে হবে অপেশাদার শিল্পীদের তালিকার দিকে। সে তালিকা দীর্ঘতর। শিল্পীরা সেখানে সংখ্যায় অনেক। প্রায় অগণিত। তাদের কেউ সিভিলিয়ান, কেউ মিলিটারি কেউ বা আটপৌরে গৃহস্থপত্নী। এমনকী, মফস্বলের কোনও কালেকটার কিংবা সাব-অলটার্নের ঘরের বউ পর্যন্ত।

মিসেস লিউইনের ছেলে কোম্পানির ফৌজে কাজ করেন। মা চিঠি লিখছেন: ‘বাছা, আমি আশা করে আছি, তুমি ওই অদ্ভুত দেশের, ওখানকার নেটিভদের, তোমার নিজের এবং তোমার বাংলো, ঘোড়া ইত্যাদির ছবি এঁকে পাঠাবে আমায়।’ কোলসওয়ার্দি গ্রান্টের মা নিজের দেশে। ছেলে কলকাতায়। কলকাতার সচিত্র বিবরণ দিয়ে গ্রান্ট চিঠি লেখেন মাকে। সে চিঠি সুন্দর একখানা চিত্রিত বই। (An Anglo-Indian Domestic Sketch.) গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ডের বোন এমিলি ইডেনের চিঠিও নিজের হাতে আঁকা ছবিতে বোঝাই। পাতায় পাতায় ছবি বিশপ হেবারের নোট বইয়ে।

চিত্র-চর্চায় এমনি সর্বজনীন আগ্রহের কারণ খোদ সেকালের ইংল্যান্ড। আমরা যাকে লঘুভাবে বলি ‘সাংস্কৃতিক’, ইংল্যান্ডে তখন সে ধরনের ক্রিয়াকাণ্ডের খুব খাতির। সাহিত্য, চিত্রকলা, ইত্যাদিতে আগ্রহ ছিল তখন মার্জিত বৈদগ্ধ্যের অঙ্গ। যদি কেউ তাঁর এক্তিয়ারের বাইরে পা বাড়িয়ে আকর্ষণ দেখাতেন পারসিক আরবি বা হিব্রুর মতো দূরবর্তী কোনও ভাষায় অথবা প্রাচীন গ্রিক স্থাপত্য কিংবা দূর দ্বীপের প্রকৃতিবিজ্ঞানে, তবে সামাজিক প্রতিষ্ঠা বেড়ে যেত তাঁর। যেমন গিয়েছিল জোনস, কোলব্রুক প্রভৃতি সরকারি কর্মচারীদের। উইলিয়ম জোনস ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, উইলকিন্স সিভিলিয়ান, উইলসন মিন্টমাস্টার। তা ছাড়া আরও একটা পরিবর্তন ঘটেছিল সেকালের ব্রিটিশ দ্বীপে। সেটি মানসিক রুচির। সাজানো ফুটফুটে বাগানের চেয়ে বন্য প্রকৃতিতে তখন বেশি মন মানুষের। লন্ডনের চেয়ে বেশি আকর্ষণ লেক ডিস্ট্রিক্ট এবং আপসেনর। সালংকার স্থাপত্যের স্থান দখল করেছে তখন সাদাসিধে নতুন ধরনের ঘরবাড়ি। আভিজাত্যের জৌলুস কাটিয়ে শিক্ষিতের মন জুড়ে বসেছে তখন সাধারণ মানুষের জীবনাচার লৌকিক ক্রিয়াকর্ম। মোট কথা, অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ইংল্যান্ড এক নতুন দেশ। অষ্টপ্রহর সে সুন্দর খোঁজে, নতুন দেখে। কী প্রকৃতিতে কিংবা মানুষের আঁকা পটে। ছবি দেখা তখন তার ব্যামো। ছবি আঁকার নেশা ইংরেজদের মধ্যে মহামারির মতো। যা দেখেছি, তা আঁকতে হবে। হয় কলমে, না হয় তুলিতে। অসম্ভব না হলে দুয়েতেই। দেখাটা কালচারের লক্ষণ, আঁকা বা লেখাটা তার হাতেনাতে প্রমাণ।

এ ধরনের একটা তৈরি মন নিয়েই অষ্টাদশ শতকের ইংরেজরা পা দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের মাটিতে। উদ্দেশ্য তাঁদের সম্পূর্ণ অন্য। একান্ত সাধারণ। দুটো পুরো ‘মিল’ দু’ গণ্ডা পয়সা। কিন্তু আর যায় কোথা। জনসন ছিলেন কোম্পানির নৌবাহিনীর একজন সার্জেন্ট। ভারতবর্ষের এলায়িত দেহটা চোখে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার: দ্য সিনারি ইজ ট্রুলি রোমান্টিক। লেডি ফকল্যান্ড উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলেন: ‘What bits to sketch! What effects here, ‘What colouring there’,… What exquisite foregrounds for Ruysdad or Hobbima! What splendid lights and solemn musky shades for Rembrandt! What brutal filthy clowns for Tiniers!’

মিসেস পোস্টানের মনে হয় এখানকার প্রতিটি লোক যেন তাঁর স্কেচের জন্যেই তৈরি হয়েছে। শুধু মানুষ কেন, ঘটনারই বা অভাব কী ভারতবর্ষে। সতীদাহ আছে, শিকার-চড়ক-মহরত আছে। আছে হিন্দু-মুসলমানের বিয়ের মিছিল, দরবারি নাচ। খেপে উঠলেন কোম্পানির শৌখিন শিল্পীরা।

মে মাসের রোদ্দুরকে তুচ্ছ করে মিসেস পোস্টান বেয়ে বেয়ে উঠলেন গুজরাতের এক পর্বতচূড়ায়। জৈন মন্দির আঁকবেন তিনি। সাতদিন কেটে গেল সে কাজে। অগাস্টা ডিন নামে এক মহিলাও বাঘ, ডাকাত এবং খরস্রোতা নদীর বিপদকে অগ্রাহ্য করে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ছবির সন্ধানে। কিছু ‘রোমান্টিক ভিউ’ আঁকতে চান তিনি। এমা রবার্টস তাঁরও ওপরে। শুধু একটি পেটিকোট আর বনেট চাপিয়ে তিনি চললেন হিমালয়ের পথে। কখনও কোমর অবধি ডুবে যায় বরফে। তবুও ফিরবার কথা ওঠে না। এমা লিখছেন: ‘আমরা আগেই জানতাম, এমন ঘটতে পারে। খিধে, ঠাণ্ডা এবং অনুচরদের বিদ্রোহ বিপদে ফেলতে পারে।’

‘But our ardour in the pursuit of the picturesque led us to think lightly of such things.’

জনৈক কালেক্টর গিন্নি ফ্যান পার্কস এই একই কারণেই বেপরোয়াভাবে দীর্ঘ তেইশ বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষে। লেখালিখির সঙ্গে ছবি আঁকা ছিল তাঁর নেশা।

কেউ কেউ নিছক সময় কাটানোর জন্যেও (to whiling away a solitary hour) আঁকতেন। ফলে আঁকিয়ের আর অভাব ছিল না তখন। ক্যাপ্টেন ইলিয়ট, ক্যাপ্টেন গোল্ড, সার চার্লস ডয়লি, প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস প্রিন্সেপ, উইলিয়ম বেলি হেবার, এমেলি ইডেন ইত্যাদি মিলিয়ে সে এক দীর্ঘ মিছিল। প্রায় দেড়শো বছরের ভারতবর্ষের খুঁটিনাটি বিবরণের এক বিচিত্র অ্যালবাম।

অনেক ক্ষেত্রেই এ সব শৌখিন চিত্রীদের ছবির চিত্রমূল্য হয়তো তেমন কিছু নেই। কারণ, সমসাময়িক কেউ কেউ এঁদের আখ্যা দিয়েছেন নেহাত আঁকিয়ে মাত্র, আর কিছু নয়। কারও কারও মতে আবার এঁদের ছবির সব গুণই আছে, নেই শুধু সৌন্দর্য’ (Every merit except beauty)। সুতরাং এঁরা হচ্ছেন—‘mere fashionable screen-sketcher and murderer of the Picturesque!’

তবুও এই সব শিক্ষাহীন, অপেশাদার শিল্পীরা ভারতে ইংরেজ চিত্রকলার ইতিহাস প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। অন্তত আমাদের পক্ষে। অন্যান্য ফলাফলের কথা বাদ দিলেও হাতে-হাতে ক্যামেরার কাজ করে রেখে গেছেন ওঁরা আমাদের জন্য। এঁরা তুলি না ধরলে, দেড়শো বা দুশো বছর আগেকার কলকাতার চেহারাটাই যে শুধু অস্পষ্ট থেকে যেত আমাদের কাছে তা নয়, অগোচরে থেকে যেত রাজপ্রাসাদ, রাজকীয় ঘটনা থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের মাঠে-ঘাটে, বাজারে, দরবারে সাধারণ-অসাধারণ মানুষের বিচিত্র জীবনাচারের অনেকখানি। সেকালের ভারতবর্ষের চাক্ষুষ পরিচয়লাভের আজও যে সুযোগ পাওয়া যায়, তা কিছু পরিমাণে হলেও ওই সব শৌখিন শিল্পীদেরই কৃতিত্বে।

শৌখিন শিল্পীরা সংখ্যায় অনেক হলেও, চিত্রকলার ইতিহাসে স্থান তাঁদের অল্প। কারণ তাঁরা প্রথমত এবং প্রধানত কোম্পানির কর্মচারী, নেশায় কিংবা অবসরে শিল্পী। এদিকে ইতিহাস গড়েন মূলত তাঁরাই যাঁরা যোল আনা শিল্পী। কৃতিত্ব বা অকৃতিত্বের আসল দায় তাঁদেরই। সেদিক থেকে কোম্পানির আসল শিল্পী স্বাধীন পেশাদার চিত্রকরেরা। ভারতবর্ষের দিকে কোনও শোখিন মানসিক আকর্ষণে নয়, কোম্পানির সাফল্যে লুব্ধ হয়ে বৈষয়িক কারণেই যাঁরা ছুটে এসেছিলেন এদেশে, তাঁরাই কোম্পানির আসল চিত্রকর। ভারতবর্ষে ইংরেজ শিল্পীর ইতিহাস বলতে বোঝায় তাঁদেরই বিচিত্র জীবন-কথা।

এ তরফের ইতিহাসের শুরু ১৬৬৯ সালের জুন মাসে মাদ্রাজে টিলি কিটলের পদার্পণে আর এর শেষ ১৮২০-তে, জর্জ চিনারির ভারত ত্যাগে। কিটল থেকে চিনারি অবধি মোট ষাট জন শিল্পীকে ভাগ করতে পারি আমরা তিন ভাগে। অর্থাৎ তিনটি ভিন্ন শ্রেণীতে। টেকনিক্যাল শ্রেণী। তেল রং, মিনিয়েচারিস্ট এবং ওয়াটার কালারিস্ট বা জলরংয়ের কারবারি।

প্রথম দলের বিখ্যাতদের মধ্যে আছেন কিটল, জোনান জোফেনি (১৭৮৩-৮৯), আর্থার ডেভিস (১৭৮৫-৯৫), টমাস হিকি প্রভৃতি প্রখ্যাত ইংরেজ প্রতিকৃতি শিল্পীরা। দ্বিতীয় দল হাতির দাঁতে মিনিয়েচার আঁকতেন। তাঁদের মধ্যে জন স্মার্ট (১৭৮৫-৯৫), ওজিয়াস হামফ্রে (১৭৮৫-৯৭), স্যামুয়েল এলডাস (১৭৯১-১৮০৭), ডায়না হিল (১৭৮৬-১৮০৪), জর্জ চিনারি (১৮০২-২৫) প্রভৃতি খ্যাতিমান। তৃতীয় দল আকারে আর দু’ দলের চেয়ে বড়। এক অর্থে এঁরা মোটামুটি শৌখিনদের দলেরই সম্প্রসারণ মাত্র। তবে পার্থক্য এই: এই শিল্পীরা শৌখিন নন, শিক্ষিত শিল্পী। এবং মা বাবা বা বন্ধুর কাছে লেখা চিঠির অলংকরণ নয়, এঁদের ছবির উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশবাসীর ভারত-আগ্রহকে কিঞ্চিৎ পয়সার মূল্যে মিটানো। এই শ্রেণীর শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন উইলিয়াম হজেস (১৭৮০-৮৩) এবং দুই ডানিয়েল—টমাস ডানিয়েল এবং তাঁর ভাইপো উইলিয়ম ডানিয়েল।

টিলি কিটল লন্ডনেও জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। তাঁর প্রতিকৃতিকে অনেক সময় লোকে ভুল করত জোশুয়া রোনাল্ডের বলে। স্বভাবতই কাজের অভাব ঘটত না তাঁর। তবুও কিটল কোম্পানির কাছে অনুমতি চাইলেন ভারতবর্ষে আসার। কোম্পানি ছাড়পত্র দিলেন তাঁকে। কিটল এসে নামলেন মাদ্রাজে। দু’ বছর সেখানে থেকে লখনউয়ে সুজাউদ্দৌলার দরবারে। সুজাউদ্দৌলার একটি প্রতিকৃতি আঁকলেন তিনি। এক হাজার গিনিতে মিসেস হেস্টিংস সে ছবি কিনে উপহার দিলেন নবাবকে। পরবর্তী কালে ক্রিস্টির নিলামঘরে সাত গিনিতে বিক্রি হয়েছিল সেটি। সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, কেন লন্ডনের খাতির ছেড়ে কিটল পাড়ি জমিয়েছিলেন এই দূর দেশে। ১৭৭৩-এ চলে এলেন কলকাতায়। তিন বছর পরে দেশে ফিরে যাওয়া অবধি এখানেই ছিলেন তিনি। কলকাতায় তাঁর ফি ছিল চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। সুতরাং রাজার হালে থাকতেন। শোনা যায়, এ শহরে তাঁর বিবিও ছিল একটি। অবিবাহিতা স্ত্রী। তার দুটি ছেলেমেয়েকে ইচ্ছেমত বখশিস দিয়ে কিটল যখন দেশে ফিরেছেন, তখনও তাঁর পকেটে রাশি রাশি টাকা। এ টাকায় একখানা বাড়ি করলেন তিনি, আর করলেন বিয়ে। তারপরই শুরু হল দুর্ভাগ্য। ১৭৮৮তে শোনা গেল কিটল দেউলে এবং অর্থের সন্ধানে আবার দেশত্যাগ করেছেন। এবারও পুবের পথে। হয়তো কলকাতায়ই ফিরে আসতেন কিটল। কিন্তু মেসোপোটেমিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে গিয়ে এলিপো এবং বসরার মাঝামাঝি কোনও জায়গায় জীবনাবসান ঘটে তাঁর। ঠিক কোথায় বা কবে, তা আজও জানা যায়নি।

কিটলের সাফল্য দেখে জোফেনিও দরখাস্ত করলেন কোম্পানির কাছে। ‘আমাকে অনুমতি দাও, আমিও যাব ভারতবর্ষে’। দিন যায়, কিন্তু উত্তর আর আসে না। অবশেষে জানা গেল, কোম্পানি খারিজ করে দিয়েছেন তাঁর আবেদনপত্র। পুরো নামঞ্জুর নয়, কোম্পানির বক্তব্য: যেতে পারো, তবে আমাদের কোনও জাহাজের যাত্রী হিসেবে নয়। অর্থাৎ সাদা কথায় যেতে পারো না। কারণ, ভারতবর্ষে কোম্পানির মনোপলি কারবার। সুতরাং ইংল্যান্ড থেকে কোম্পানির জাহাজ ছাড়া সে দেশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

জোফেনি কৈফিয়ত চাইলেন না, তিনি অপেক্ষা করে রইলেন। তাঁর দেহে বোহেমিয়ান রক্ত। জাতিতে তিনি জার্মান, যদিও তাঁর বাস ইংল্যান্ডে এবং জাতীয়তায় তিনি পুরো ইংরেজ। তিনি দিন গুনতে লাগলেন।

অবশেষে ১৭৮৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কলকাতায় ‘গার্ড’ ম্যাকার্নে জাহাজের ক্যাপ্টেন আবিষ্কার করলেন, তাঁর জাহাজে জোহান জোফেনি নামে একটি লোক ছিল, সে এখন নেই। কোথায় গেল সেই রহস্যময় যাত্রী।

পকেটে কোম্পানির টিকিট ছিল না বলেই জোফেনি পালিয়ে নেমে গিয়েছিলেন ডায়মন্ডহারবার থেকেও কুড়ি মাইল দূরে খেজুরিতে। অবশেষে কলকাতা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির রাজধানী বিনা প্রশ্নে লুফে নিল তাঁকে। গভর্নর জেনারেল, চিফ জাস্টিস প্রভৃতির সঙ্গে খানাপিনায় চাপা পড়ে গেল ছাড়পত্রের প্রশ্ন। বিশেষ বিশেষ শিল্পীদের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন উঠত না তখন বড় একটা। আর্থার ডেভিডও পিছনের দরজা দিয়েই ঢুকেছিলেন। কর্তৃপক্ষ বললেন, ‘তুমি শিল্পী বটে, কিন্তু কোম্পানির অনুমতি না আসা অবধি আপাতত তোমার ছবি আঁকা বারণ।’ তবুও দশ বছর এদেশে ছবি এঁকে গিয়েছেন ডেভিড। ইচ্ছে ছিল, ‘দ্য আর্টস ম্যানুফ্যাকচার অ্যান্ড এগ্রিকালচার ইন বেঙ্গল’ নাম দিয়ে ছবির একখানা অ্যালবামও বার করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর টাকার অভাবে তা হয়ে ওঠেনি। ১৭৯৫-তে ডেভিড ফিরে গেলেন দেশে। কোম্পানির অনুমতি কিন্তু আসেনি তখনও।

আসলে শিল্পীদের সম্পর্কে কোম্পানি তত কড়া ছিলেন না বলেই মনে হয়। বস্তুত একবার স্পষ্টতই তাঁরা বলেছিলেন: শিল্পীদের ভারতবর্ষে যেতে দিতে আমাদের আপত্তি নেই, আপত্তি শুধু এই জন্যেই যে, শিল্পী পরিচয়ের আবরণে দুষ্ট লোকেরাও তো চলে যেতে পারে ওদেশে। স্বাধীন ব্যবসায়ীদের ভীষণ ভয় করতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেকটররা।

যা হোক, এদিকে জোফেনিকে পেয়ে কলকাতা ‘মহা খুশি’। কারণ, জোফেনি ইংল্যান্ডের নামজাদা শিল্পী। তিনি গেরিকের বন্ধু। তাঁর পৃষ্ঠপোষণায় লন্ডনের বনেদি পাড়ায় জোফেনির তখন ভীষণ খাতির। রয়াল আকাদেমি অব আর্টস-এর জন্ম থেকেই তিনি তার সদস্য। রাজা তৃতীয় জর্জ নিজে ছত্রিশজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের তালিকায় জুড়ে দিয়েছিলেন জোফেনির নাম।

সুতরাং আকাডেমিসিয়ান জোফেনির ইজেলের সামনে এসে বসলেন একে একে গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস, লাটগিন্নি মিসেস হেস্টিংস, প্রধান বিচারপতি ইলাইজা ইম্পে প্রমুখ কলকাতার অপ্রতিদ্বন্দ্বী বড় মানুষেরা। ছবি করানোর এই তো সুযোগ। মিসেস হেস্টিংস অবশ্য ঠোঁট বাঁকালেন। তাঁর তত ভাল লাগল না নিজের ছবিটা। ভঙ্গিটা যেন কেমন নাটুকে, থিয়েট্রিক্যাল পোজ। কিন্তু রাশি রাশি খদ্দের জুটে গেল হেস্টিংসের ছবির। মূল ছবির নয়, তার প্রিন্টের। ক্যালকাটা গেজেটে (২৯ জুলাই, ১৭৮৪) জনৈক এনগ্রেভার জানাচ্ছেন: জোফেনির আঁকা হেস্টিংসের বিখ্যাত ছবির প্রিন্ট বিক্রির জন্যে তৈরি তাঁর কাছে। ‘প্রতিটি ছবি বাঁধানো এবং জেল্লা দেওয়া। দাম মাত্র দুই গোল্ড মোহর।’

আর ক’দিন পরেই কাগজে বের হল জোফেনির দ্বিতীয় সংবাদ। সেন্ট জন চার্চের অলটারপিসের জন্যে ‘শেষ ভোজ’ বা ‘লাস্ট সাপারের’ ছবি আঁকছেন তিনি, দ্রুত এগিয়ে চলেছে সেই কাজ।

সেন্ট জন চার্চ নিয়ে যেমন হইচই পড়ে গিয়েছিল তেমনি উত্তেজনা কলকাতায় জোফেনির ছবি নিয়ে। ১৭৮৭ সনের ৯ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি চার্চ কর্তৃপক্ষকে উপহার দিলেন ছবিখানা। আগামী জুন মাসে চার্চের উদ্বোধন। স্বভাবজ গাম্ভীর্যের সঙ্গে জোফেনির উপহার গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ বললেন:

‘We should do a violence to your delicacy, were we to express or endeavour to express in such terms as the occasion calls for our sense of the favour you have conferr’d upon the settlement by presenting to their place of worship so capital a painting that it would adorn the first church in Europe, and should excite in the breasts of its spectators those sentiments of virtue and piety which are so happily portrayed in its figure.

কিন্তু ছবির মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে কলকাতার লোকেদের ধারণা হল অন্য। প্রতিটি মানুষকে পরিষ্কার চিনতে পারলেন তাঁরা। ওই তো প্রভুর আসনে বসে আছেন গ্রিক বিশপ পার্থেনিও। আরে, জুডাস তো দেখছি আমাদের মিস্টার টুলা। টুলা (Tulloh) তখন কলকাতার সবচেয়ে নামজাদা ব্যবসায়ী। ইউরোপিয়ান সওদা কিনতে হলে যেতেই হবে তাঁর দোকানে, নিলাম ঘরে। প্রচুর পয়সাওয়ালা লোক তিনি। কী জানি, কী মনে করে জোফেনি কুখ্যাত জুডোসের ভূমিকা দিলেন তাঁকে। অথচ আশ্চর্য এই, টুলা আগাগোড়া জানেন, জোফেনিকে সাধু জনের ছবির জন্যেই সিটিং দিচ্ছেন তিনি। আর এখন, কোথায় এপসল জন আর কোথায় জুড়োস ইকক্রাইস। লোকেরা মুখে রুমাল দিয়ে হাসে বটে, কিন্তু মি. টুলা রেগে আগুন। জনশ্রুতি এই: জোফেনির বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও নাকি দায়ের করেছিলেন তিনি।

এক বছরও হয়নি, জোফেনি কলকাতায় নেমেছেন। এরই মধ্যে এত কাণ্ড। কলকাতা ছেড়ে জোফেনি এবার হেস্টিংস সাহেবের সঙ্গে চললেন লখনউ। যাওয়ার আগে গভর্নর জেনারেলের টানা পাখাটির দু’দিকে দুটি ছবি এঁকে দিয়ে গেলেন। শিকারের দৃশ্য। এ দুটোও জোফেনির উল্লেখযোগ্য কাজ।

লখনউতে আসফউদ্দৌলার দরবার অভিযাত্রী বিদেশিদের স্বর্গ। নবাবের রাজনৈতিক এবং সামরিক উপদেষ্টা তখন বিখ্যাত ফরাসি ভাগ্যান্বেষী জেনারেল ক্লদ মার্তিন। চার-চারটি বিবি, অগণিত দাসদাসী নিয়ে দ্বিতীয় নবাবের মতো থাকেন তিনি। পুরো সাত দিন লেগে যায় তাঁর বাড়িখানা ভাল করে দেখতে। সে এক যাদুঘর। জোফেনির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল ফরাসি সাহেবের। দু বছর ছিলেন তিনি ওখানে। হাজার টাকা ফি তাঁর। কিন্তু তবুও কাজের অভাব নেই। ১৮১০ সালে মার্টিন মারা গেলে তাঁর সম্পত্তি যখন নিলাম হয়, তখন তার মধ্যে একা জোফেনির ছবিই ছিল চল্লিশখানা।

জোফেনির অন্যতম বিখ্যাত ছবি হচ্ছে ‘হাইদরবেগ এমবেসি’ (The Embassy of Hyderback)। অযোধ্যার উজির সদলবল কলকাতায় আসছেন লর্ড কর্নওয়ালিসের সঙ্গে দেখা করতে। পথে পাটনায় সহসা খেপে উঠল হাতি। মাহুত তার গুঁড়ে। পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অসহায় আরোহীরা। বিরাট নাটকীয় ছবি। জোফেনি সহ সবসুদ্ধ সাঁইত্রিশটি চরিত্র আছে ছবিটিতে। প্রত্যেকটি চরিত্র ভিন্ন। কিন্তু জীবন্ত।

’৫৭ সনের সিপাহি বিদ্রোহে লখনউ থেকে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায় ছবিটি। আর বহুদিন পরে ওয়েট দ্বীপের একটি কুটিরে আবার আবির্ভাব ঘটে তার। স্যার রাজেন মুখার্জির অর্থে এবং আগ্রহে অবশেষে আজ এটি কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সম্পত্তি।

জোফেনি ভারতবর্ষে ছিলেন মাত্র সাত বছর। সাত বছরেই দশ হাজার পাউন্ড জমিয়েছিলেন তিনি। অবশেষে ১৭৯০ সালে দেশের পথে জাহাজে চড়লেন শিল্পী। এবার একটি ফরাসি জাহাজে। পথে আন্দামানে জাহাজডুবি হল। জীবন বাঁচাতে গিয়ে জোফেনিরা মৃত সৈনিকের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি। কিন্তু আসলে সেটা গল্প বলেই অন্যদের ধারণা। না হলে গাদা-গাদা ছবি নিয়ে লন্ডনে নামতে পারতেন না তিনি। অথচ জোফেনি নিজে বলেছেন, ভারতবর্ষ থেকে নিজের আঁকা বহু ছবি নিয়ে ফিরেছেন তিনি।

ক’ বছর পরে আবার এদেশে আসার কথা ওঠে তাঁর। কোম্পানির কাগজপত্র বলে জোফেনিকে ভারতবর্ষে ফিরবার অনুমতি দিয়েছিলেন তাঁরা ১৭৯৮ সালের মার্চে।

বিনা অনুমতিতেই এককালে কলকাতায় নেমেছিলেন জোফেনি৷ কিন্তু এবার অনুমতি পেয়েও আসা হল না তাঁর। কারণ তিনি তখন প্রায় পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ। শরীর মিলতে পারছে না তার বেপরোয়া মনের সঙ্গে। অবশেষে ১৮১০ সালে মিডলসেকসে পরিণত বয়সে মারা যান তিনি।

জোফেনির পরে এদেশে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের অধিকাংশই মিনিয়েচার শিল্পী। তৈলচিত্রের চেয়ে হাতির দাঁতের ওপর চিকন কাজ বা মিনিয়েচারই ভারতবর্ষে তখন চলত বেশি। যদিও চিত্রশিল্পের এই বিশেষ শাখায় আমাদের দেশের ঐতিহ্য অনেক দিনের, তবুও তৎকালের ইংল্যান্ডেও এ কাজে শিল্পীর অভাব ছিল না। হিলার্ড ছিলেন সেকালের নামজাদা মিনিয়েচারিস্ট।

নানা কারণে ভারতবর্ষ তখন মিনিয়েচারের বাজার। মিনিয়েচার কোম্পানির কর্মীদের ফ্যাশন। সাহেবরা মিনিয়েচারে টেবিল সাজান, বিবিরা গলায় মিনিয়েচারের লকেট পরেন। এটাই স্টাইল।

বিলেত থেকে কলকাতায় প্রথম মিনিয়েচার শিল্পী যিনি আসেন, তিনি একজন ইহুদি মহিলা। নাম ইসাকস। কলকাতায় পৌঁছান তিনি ১৭৭৮ সালে। কিন্তু এক বছরও আঁকা হয়নি তাঁর। নামতে না নামতেই কোম্পানির একজন সম্পন্ন কর্মচারীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ছবি আঁকাও।

তারপর এলেন হামফ্রে—বিখ্যাত ওজিয়াস হামফ্রে। হামফ্রে ভারতে আসেন ১৭৮৫ সালে। সে বছরই বোম্বাইতে নামলেন জন স্মার্ট। হামফ্রে গরিবের ছেলে। বাবা ছিলেন লেস-ব্যবসায়ী। একটা মদের দোকানও ছিল তাঁর। কিন্তু বছরে বিক্রি ছিল মোটে দু’তিন পিপে। সুতরাং ‘টাকা’ ‘টাকা’ জপতে জপতে হামফ্রে এসে নামলেন কলকাতায়। সৌভাগ্যক্রমে গভর্নর জেনারেল ম্যাকফারসন স্বয়ং পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়ালেন তাঁর। পনেরো দিনের মধ্যেই তাঁর আনুকূল্যে হামফ্রে দেশে তাঁর ভাইপোকে লিখলেন, “এরই মধ্যে ২০০ পাউন্ড করে ফেলেছি। দু’ বছরে নির্ঘাত পাঁচ হাজার পাউন্ড করব আমি।’

তখনকার সময়ে হামফ্রে যে খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখিয়েছিলেন এমন কথা বলতে পারি না আমরা। জোফেনির কথা তো আগেই বলেছি। চার্লস স্মিথ নামে একজন শিল্পী ক’বছরে কুড়ি হাজার পাউন্ড নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন। টমাস হিকিও কম করেননি। তাঁর চার্জ ছিল ২৫০ পাউন্ড। কলকাতা এবং মাদ্রাজে ক’ বছরে অনেক রোজগার করেছেন তিনি। প্রথমবার দেশে গিয়ে আবার ফিরে আসেন ভদ্রলোক। এরপর আর ফেরা হয়নি। মৃত্যু অবধি চব্বিশ বছর এ দেশেই কাটিয়ে গেছেন সপরিবার। তাঁর সমসাময়িক শিল্পী উইলসন জমিয়েছিলেন পনেরো হাজার পাউন্ড। জন টমাস সিটনের পকেটে ছিল বার হাজার পাউন্ড। কলকাতায় তখনকার দিনে তেত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে বাড়ি করেছিলেন এই শিল্পীটি।

সুতরাং হামফ্রে অত্যধিক কিছু কামনা করেননি। বিশেষত তিনি সমর্থ শিল্পী। মিনিয়েচারের জন্য তাঁর মজুরি পাঁচশো সিক্কা টাকা আর বড় ছবি হলে হাজার। তাও দিব্যি কাজ পান। পাঁচশো টাকা তাঁর বাড়ি ভাড়া।

এমন সময় ম্যাকফারসন পরামর্শ দিলেন, ‘তুমি লখনউ থেকে ঘুরে এসো। দেখবে, বেশি টাকা পাবে। আমি চিঠি দিয়ে দিচ্ছি নবাবকে।’ হামফ্রে বললেন, ‘কলকাতায় সপ্তাহে হাজার টাকা রোজগার আমার। লখনউতে কি তেমন হবে?’ ম্যাকফারসন বললেন, ‘কেন হবে না, যাও না তুমি একবার।’

শেষ পর্যন্ত লখনউয়ে এলেন হামফ্রে। জোফেনি তখনও সেখানে। মাদ্রাজ থেকে এসেছেন স্মার্টও। তবুও গভর্নর জেনারেলের চিঠি। খাতিরে কোনও ত্রুটি দেখালেন না নবাব। তিনি হামফ্রেকে সিটিং দিলেন। মোট পাঁচখানা ছবি হল।

কিন্তু গোলমাল বাধল তার দাম নিয়ে। লখনউ পৌঁছেই, হামফ্রে চিঠি লিখেছিলেন ম্যাকফারসনকে: ‘ছবি তো আঁকছি, টাকার কী হবে?’ ম্যাকফারসন অভয় দিলেন, ‘টাকার জন্যে ভেবো না, কাজ করে যাও।’

‘এবার কাজ শেষ হয়েছে। টাকা দাও।’ নবাবের কাছে বিল উপস্থিত করলেন হামফ্রে। সাড়ে তেইশ সপ্তাহ আছেন তিনি লখনউ। সপ্তাহে হাজার টাকা করে ধৱলে, তাঁর প্রাপ্য দাঁড়ায় সাড়ে তেইশ হাজার টাকা। হামফ্রে এর দ্বিগুণ চান। তাঁর দাবি সাতচল্লিশ হাজার টাকা। আরকটের দরবারে এই কায়দায়ই নাকি বিল করতেন উইলসন। এটাই রীতি। নবাব আপত্তি করলেন না। পাঁচ হাজার টাকা তক্ষুনি দিয়ে দিলেন তাঁকে। আর বাকি বিয়াল্লিশ হাজার টাকার জন্যে দিলেন একখানা হ্যান্ডনোট। আসছে ফসলি মরসুমে তা মিটিয়ে দেওয়া হবে।

হামফ্রে বদমেজাজি। কলকাতায় এসেই আদালতে নালিশ করে বসলেন তিনি ম্যাকফারসনের নামে। ক্ষতিপূরণের মোকদ্দমা। যদিও সরকারি ডাকের পালকিতেই লখনউ গিয়েছিলেন তিনি, তবুও রাহাখরচ ধরলেন বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। তার উপর ছবির মজুরি, বাকি টাকার সুদ ইত্যাদি মিলিয়ে বিরাট দাবি তাঁর। বলা বাহুল্য, মোকদ্দমায় হেরে গেলেন তিনি। উলটো এবার ম্যাকফারসনকে টাকা দিতে হয় তাঁর। অবশ্য ম্যাকফারসন সে টাকা দাবি করেননি। হামফ্রের ঔদ্ধত্যকে উদারতায় ক্ষমা করেছিলেন তিনি।

তবুও আর কলকাতায় থাকা হল না তাঁর। ইতিমধ্যে নতুন প্রতিযোগী একজন আবির্ভূত হয়েছেন শহরে। তিনি মিসেস ডায়েনা হিল। দুটি শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বিধবা হিল কলকাতা নামা মাত্র হামফ্রে দেশে চিঠি লিখলেন ‘All the male artists of England are better than this female. দেখবে, এবার চুটিয়ে কারবার করবে এই মহিলা।’

কথাটা সত্য। ডায়না হামফ্রের ছেড়ে যাওয়া বাড়িটাই ভাড়া নিলেন। হু-হু করে বেড়ে চলল তাঁর পসার। ক্রমে বেঙ্গল নেটিভ আর্মির একজন অফিসারের সঙ্গে আবার বিয়েও হল তাঁর।

হামফ্রে তখন প্রায় উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায়। ক’ বছর আগে রয়াল আকাডেমির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু চোখের অবস্থা ভাল নয়। তবুও রাজার একজন প্রতিকৃতি (crayon) শিল্পী হিসাবে কোনওমতে হয়তো দিন চলে যেত তাঁর। কিন্তু ছিটগ্রস্ত হামফ্রে এখন প্রায় উন্মাদ। হিকির সঙ্গে রাস্তায় দেখা। অবাক হয়ে দেখেন, হামফ্রের গায়ে শার্টের ওপর ছ’ খানা ওয়েস্ট কোট, তার ওপর আবার কোট। কী ব্যাপার। না, ডাক্তার নাকি তাঁকে বলেছে, একমাত্র এভারে গরমে থাকতে পারলেই তাঁর পেটের ব্যামো সারবে। শেষ পর্যন্ত অন্ধ অবস্থায় ১৮১০ সালে মারা গেলেন হামফ্রে।

মৃত্যুর আগে ভাইপোকে ডেকে বললেন, তাঁর শেষ নিশ্বাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সে ছুটে গিয়ে ‘সান’ কাগজের এডিটর মি. টেলরকে দিয়ে আসে খবরটা। আর বেনজামিন ওয়েস্টকে। ওঁরা নিশ্চয়ই অখ্যাত অবস্থায় মরতে দেবেন না ওঁকে।

হামফ্রে চলে যাওয়ার পর কলকাতায় সবচেয়ে জনপ্রিয় মিনিয়েচারিস্ট হয়ে দাঁড়ান রবার্ট হোম আর মিসেস ডায়না হিল। হোম সাহেবও জোফেনির মতো পালিয়েই এসেছিলেন ভারতবর্ষে। প্রথম দিকে তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল মাদ্রাজ। মাদ্রাজে পাঁচ বছর কাটিয়ে হোম চলে এলেন কলকাতায়। তখনকার কলকাতায় তিনি একজন বিশিষ্ট নাগরিক। এশিয়াটিক সোসাইটির তিনি একজন প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। সোসাইটি-প্রধানদের অনেক ছবি এঁকেছেন হোম। তার কিছু কিছু আজও রয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটিতে। শোনা যায়, হোম সাহেবের বাঁ হাতখানা ছিল সম্পূর্ণ অবশ। ছেলেবেলায় অসুখে সেটি নষ্ট হয়ে যায়। হোম নাকি বলতেন, এতে সুবিধেই হয়েছে আমার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিব্যি রঙের প্লেট ধরে রাখতে পারি। হাতে ব্যথা ধরে না।’

ভালই চলছিল হোমের কাজকর্ম। এমন সময় কলকাতায় এসে হাজির হলেন জর্জ চিনারি। চিনারি ভারতবর্ষে শেষ বিখ্যাত ইংরেজ শিল্পী। তিনি আসার সঙ্গে সঙ্গে হোম চলে গেলেন লখনউ। নবাবের কাজ নিলেন। চৌদ্দ বছর ছিলেন তিনি সে কাজে। তারপর ১৮৩৪ সালে ৮২ বছর বয়সে লখনউতেই শেষ নিশ্বাস পড়ে তাঁর। হোম বিয়াল্লিশ বছর ছিলেন আমাদের দেশে।

চিনারিও একেবারে কম দিন ছিলেন না। মাদ্রাজ আর কলকাতা মিলিয়ে প্রায় একুশ বছর ছিলেন তিনি ভারতবর্ষে। তার মধ্যে পনেরো বছর কলকাতাতেই।

চিনারির বাবা ছিলেন ভারতবাসী। মাদ্রাজে তাঁর একটা কারখানা এবং এজেন্সি হাউস ছিল। ১৮২২ সালে সে সব উঠে যায়। তার বহু আগেই বিলেত থেকে তরুণ চিত্রকর পুত্র জর্জ এসে যোগ দিয়েছেন বাবার সঙ্গে। সেটা ১৭৯৭ সালের প্রথম দিককার কথা। দু’বছর পরে মাদ্রাজেই আর এক শিল্পীর বোনকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের তিন বছর পর ফিরে গেলেন স্বদেশে। রয়াল আকাডেমিতে সে বছর প্রদর্শিত হল তাঁর ছবি। কিন্তু চিনারি সে বছরই আবার ফিরে এলেন মাদ্রাজে। কোম্পানি আপত্তি জানিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু চিনারি সে আপত্তি শুনলেন না। ভারতবর্ষে তাঁর পরিবারের ব্যবসা আছে। সুতরাং ওদেশে তিনি যাবেন বই কি।

যা হোক, ক’বছর মাদ্রাজে কাটিয়ে চিনারি ফের চলে এলেন কলকাতায়। সেটা ১৮০৮ সালের কথা। দু’ বছর কলকাতা থেকে চলে গেলেন ঢাকা। সেখান থেকে দু’ বছর পরে আবার কলকাতা।

কলকাতায় তাঁর স্টুডিও ছিল ‘Eastward of Mrs. Fairlie, Ferguson & Co.’ স্যার চার্লস ডয়লি ছিলেন তাঁর ছাত্র। ঢাকায় কালেকটার থাকা কালে চিনারির কাছে ছবি আঁকা শিখেছিলেন তিনি। ডয়লির মতে চিনারি ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শিল্পী (A best liner of the land’). তিনি একটা সুন্দর বিবরণ রেখে গেছেন গুরুদেবের স্টুডিওর।

ঘরভর্তি এদিক-ওদিক ছড়ানো রং, স্কেচ-বুক, উকিলের চিঠি, নেমন্তন্নের চিঠি। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই হুঁকো টানতে টানতে একমনে কাজ করেন চিনারি। কখনও যা আঁকেন, তা আবার নষ্ট করে ফেলেন নিজে ইচ্ছে করেই। একটু খ্যাপাটে ধরনের মানুষ ছিলেন তিনি। ইয়া লম্বা চুল ছিল তাঁর মাথায়। ঝুঁটি করে হাড়ের চিরুনি দিয়ে শিখদের মতো চুল বাঁধতেন তিনি। খেতেনও নাকি প্রচুর। তবে মদ বাদ দিয়ে। চিনারির নেশা ছিল তামাক।

পাগলাটে ধরনের মানুষ হলেও চিনারির কাজের অভাব হত না। বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করতেন তিনি। খরচের হাতও ছিল তেমনি। নিজের হিসেবেই ১৮২২ সালে তাঁর ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ হাজার পাউন্ড।

সুতরাং আর কলকাতা নয়। চিনারি প্রথমে পালিয়ে গেলেন ডেন-রাজ্য শ্রীরামপুরে, তারপর আরও দূরে, পর্তুগিজদের ম্যাকাও দ্বীপে। উদ্দেশ্য ঋণ এড়াবেন, এবং সেই সঙ্গে স্ত্রীকেও। বিলেত থেকে সে মহিলা চার বছর আগে কলকাতায় এসে ধরে ফেলেছেন ওঁকে।

তিনি ম্যাকাও অবধি ধাওয়া করতে পারেন শুনে চিনারি চলে গেলেন ক্যান্টনে। শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের প্রবেশের ছাড়পত্র ছিল না ওখানে। ক্যান্টন থেকে চিনারি লিখছেন ‘দিব্যি আছি এখানে।’

‘What a kind providence is this Chinese Government that it forbids the softer sex from coming and bothering us here!’

ক্যান্টন থেকে দু’ বছর পরে আবার তিনি চলে আসেন ম্যাকাও। সেখানেই ১৮৫২ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। চিনারা বলে একশো বছর বেঁচে ছিলেন তিনি।

অনেকে বলেন, চিনারি তরুণ বয়স থেকেই একটু ছিটগ্রস্ত। লন্ডনে বিশেষ একজন মহিলার কাছে নাকি প্রায় বারোশো পেন্সিল স্কেচ ছিল চিনারির আঁকা। তাদের পিছনে পিছনে অদ্ভুত হরফে কী সব হিজিবিজি লেখা। সে লেখার কী অর্থ, কেউ বার করতে পারেননি আজও। অবশ্য, সে মহিলা পেরেছিলেন কি না ঈশ্বরই জানেন।

যদিও কলকাতা ছাড়ার সময় তাঁর স্টুডিওতে মোট কুড়িখানা ছবিই পাওয়া গিয়েছিল অসম্পূর্ণ অবস্থায়, তবুও বহু ছবি যে শেষ করেছিলেন তিনি এখানে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তখনকার কলকাতার বাঙালি বড়মানুষেরাও ছিলেন তাঁর অন্যতম খদ্দের, পৃষ্ঠপোষক।

সব ইংরেজ শিল্পী সম্বন্ধে সমান শ্রদ্ধা ছিল না বাঙালিদের। চিনারি সম্পর্কে তাঁদের মনে ছিল ভয়। লোকে বলত ওঁর সামনে বসলে অকালমৃত্যু নিশ্চিত। ধনবান বাঙালিরা এজন্যে সযত্নে এড়িয়ে চলতেন চিনারির স্টুডিও। প্রথম দুঃসাহসী (!) ভারতীয়, যিনি চিনারিকে সিটিং দেন, তিনি এডোয়ার্ড হুইটলারের স্বনামধন্য বেনিয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুর। ভাইরা কিছুতেই বসতে দেবেন না তাঁকে, কিন্তু গোপীমোহন বসবেনই। শেষ পর্যন্ত বসলেনও। শুধু তিনি নন, তাঁর পুত্রদেরও ছবি করালেন তিনি চিনারিকে দিয়ে। মহারাজা প্রদ্যোৎকুমারের কাছে এগুলো সহ আরও অনেক ছবি ছিল তাঁর।

চিনারির আর একটি বিখ্যাত ছবি—বর্ধমানের রাজকুমারের ছবি। মহারাজ তেজচন্দ্রের পুত্র প্রতাপচন্দ্রের একটা প্রতিকৃতি করেছিলেন চিনারি। চৌদ্দ বছর নিখোঁজ থাকার পর প্রতাপচাঁদের আবির্ভাবে যখন বিখ্যাত জাল-প্রতাপের মোকদ্দমা শুরু হয়, তখন হুগলির আদালতে অন্যতম সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায় চিনারির ছবিটি। ছবির এমনি আদালতি স্বীকৃতি সেকালে এই প্রথম ঘটনা।

ভারতে শেষ বিখ্যাত শিল্পী চিনারি। তবে তাঁর ভারত ত্যাগের আগে আরও ক’জন এমনই শিল্পী এসেছিলেন আমাদের দেশে, যাঁদের কাহিনী উল্লেখ করার মতো। এঁরা সকলেই জলরংয়ের শিল্পী। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাত উইলিয়ম হজেস এবং দুই ডানিয়েল।

হজেস এক কর্মকারের পুত্র ছিলেন। দক্ষিণ সাগরে ক্যাপ্টেন কুকের দ্বিতীয় অভিযানে ড্রাফটসম্যান হিসাবে সঙ্গী ছিলেন তিনি। এদেশের ছাড়পত্রও পেয়েছিলেন তিনি ড্রাফটসম্যান হিসাবেই। মাদ্রাজে আসেন তিনি ১৭৮০ সালে। তিন বছর মোট ছিলেন তিনি ভারতবর্ষে। ১৭৮৪ সালে লন্ডনে বের হয় তাঁর সচিত্র ভারত-ভ্রমণ কাহিনী। তার গ্রাহক মিললেও, অর্থাভাবে পড়লেন হজেস। বস্তুত সকলেই যে ভারতে সমান টাকা পেতেন তা নয়। বহু শিল্পী রিক্ত অবস্থায়ও মারা গেছেন এখানে। আলেফাউন্ডার নামে এক শিল্পী ১৭৯৪ সালে আত্মহত্যা করেন কলকাতায়। তাঁর পোর্ট্রেটের দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ গোল্ড মোহর। কলকাতার বিখ্যাত ম্যাপ-আঁকিয়ে আপজন যখন ১৮০০ সালে মারা যান, তখন ঋণের ভয়ে এক বন্ধুগৃহে পলাতকের জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি।

অবশ্য আবার এমন ভাগ্যবান শিল্পীও ছিলেন, যাঁরা কলকাতায় বাস না করেও প্রভূত অর্থ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন দেশে। যেমন জর্জ কার্টার। ১৭৮৬ সালের কলকাতা গেজেটের বিজ্ঞাপনে জানা যায়, কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে লটারি করছেন কার্টার সাহেব। তাঁর ছবির লটারি। প্রতিখানা টিকিটের দাম একশো সিক্‌কা টাকা। তবুও ভিড় হয়েছিল। গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিস নিজে পর্যন্ত গিয়েছিলেন তাঁর সেই প্রদর্শনীতে।

তবে হজেসের দুর্ভাগ্যের কারণ তিনি নিজে। পর পর তিনটে বিয়ে করেছিলেন তিনি। পাঁচটি ছেলেমেয়ে হয়েছিল তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভে। ছবি আঁকায় তখন আর সংসার চলে না। হজেস ব্যাংক খুললেন। এবং ব্যাংকের টাকা ভেঙে শেষে আত্মহত্যা করলেন বিষ খেয়ে। লন্ডনে তখনও বিক্রি হচ্ছে তাঁর ভারতীয় চিত্রের বই। চার খণ্ডে মোট ২৪টা প্লেট। এক এক খণ্ডের খুচরো দাম ৩০ শিলিং। সব খণ্ড একসঙ্গে মিলিয়ে নিলে, সাধারণ সংস্করণ ১৮ পাউন্ড। বাঁধানো ২০ পাউন্ড।

কলকাতায় সে বই বিকোচ্ছে তখন জলের দরে। হজেস চলে যাওয়ার ক’ বছর পরে ডানিয়েলরা এসে জানাচ্ছেন— হামফ্রে যে সব প্রিন্ট রেখে গিয়েছিলেন কলকাতায়, কিছুতেই ওঁরা বিক্রি করতে পারছেন না সেগুলো। বড় দুর্দিন পড়েছে ব্যবসায়ে। বাজার ভর্তি প্রিন্টে (‘a commonest Bazar is full of prints’) গাড়ি গাড়ি বিক্রি হচ্ছে হজেসের ছবি। কাচে বাঁধানো এবং জেল্লা দেওয়া প্রিন্ট, কিন্তু যে দরে বিক্রি হচ্ছে, তাতে কাচের দামটা উঠবে কিনা সন্দেহ।

বাজারের এমনি অনিশ্চয়তার মধ্যেই ১৭৮৬ সালে ডানিয়েলরা এসে নামলেন ভারতবর্ষে। টমাস আর তাঁর ভাইপো উইলিয়ম ডানিয়েল। টমাসের বয়স তখন ৩৬ বছর, উইলিয়ামের ১৬।

টমাস বারো বছর ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার হিসেবে কাজ করেছেন লন্ডনে। নামজাদা না হলেও তিনি অভিজ্ঞ শিল্পী। উইলিয়ম শিক্ষানবীশ। কাকার এনগ্রেভিংয়ের প্লেট ঠিক করে দেন, এটা-ওটা সাহায্য করেন। তখন সবে এচিংয়ে ওয়াশের ফল আনার প্রক্রিয়া বা অ্যাকুয়াটিন্ট প্রথা আবিষ্কৃত হয়েছে বিলেতে। টমাসের কাছে উইলিয়ম তাও শিখেছেন।

কলকাতায় নেমেই ডানিয়েলরা ঘোষণা করলেন, কলকাতার বারোখানা চিত্রের একখানা অ্যালবাম বার করবেন তাঁরা। দু’বছর কেটে গেল সেই উদ্যোগে। বের হল ওঁদের বিখ্যাত— ‘Twelve Views of Calcutta.’

একখানা পানসিতে চড়ে ডানিয়েলরা অতঃপর চললেন উত্তর ভারতের দিকে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল হয়ে গঙ্গা ধরে এগিয়ে চলল তাঁর নৌকো। বেনারসে এসে পালকি ধরলেন। তারপর পালকিতে কানপুর, আগ্রা, দিল্লি। অবশেষে গাড়োয়ালের শ্রীনগর। কলকাতা থেকে প্রায় হাজার মাইলের পথ। এ পথে উল্লেখযোগ্য যা কিছু দর্শনীয় পড়েছে, সবই দেখেছেন ওঁরা। এঁকেছেন প্রায় সব। সঙ্গে একটা করে ডায়েরিও রেখেছিলেন দু’জনে।

ফিরবার সময়ে ধরলেন নতুন পথ। লখনউ জৌনপুর হয়ে এক বছর কাটালেন ভাগলপুরে। তারপর আবার কলকাতা। কলকাতায় এক বছর বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লেন দুই ডানিয়েল। এবার দক্ষিণ ভারতের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন দু’জন। ইচ্ছে ছিল, বোম্বাই হয়ে মিশরের মধ্য দিয়ে দেশে ফেরেন। কিন্তু ওদিকে তখন নানা গোলযোগ। সুতরাং সিংহলের দিকে চললেন ওঁরা। মারিয়া গ্রাহাম নামে সেকালে এক জনপ্রিয় লেখিকা ছিলেন কলকাতায়। সিংহলে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ডানিয়েলদের। ডানিয়েলরা তখন একটা গ্রামে আছেন। ঘুরে বেড়াবার নেশা তখনও কাটেনি ওঁদের। মারিয়া লিখছেন: এই হতচ্ছাড়া জীবনযাপনের ফলে শরীরের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, ডানিয়েল এজন্যে ভীষণ তামাক খান। রাত্তিরে তাঁবুর বাইরে এবং ভিতরে আগুন জ্বালিয়ে গরম থাকেন তিনি। গ্রামাঞ্চলে কত মাইল ঘুরেছেন তিনি, ইতিমধ্যে তার হিসেব থাকত তাঁর প্যারামবুলেটরে। চাকা কত বার আবর্তিত হল, তাই গুনে দূরত্বের হিসাব।

বস্তুত ডানিয়েলদের মতো এমন করে ভারতবর্ষ দেখেননি কোনও শিল্পী। ভ্রমণের উদ্দেশ্যও ছিল তাঁর কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। বৈজ্ঞানিকেরা এশিয়ার এই ভূখণ্ডে এমনই এসেছেন মানুষ হত্যার জন্য নয়, বিজ্ঞানের তথ্য আবিষ্কার করার জন্যে। এসেছেন এমনই নির্দোষ উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্মযাজক এবং দার্শনিকেরাও। তবে শিল্পীরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন?

ডানিয়েলদের মতো এ কাজ এমন গুরুত্ব সহকারে এবং এমন সাফল্যের সঙ্গে বোধ হয় আর কেউ করেননি কোনও দিন। দেশে ফিরবার পরেই ১৭৯৫ সালে বের হল তাঁদের ভারত ভ্রমণের প্রথম ফসল, ‘Oriental Scenery’-র প্রথম খণ্ড। ২৪খানা ছবি। লম্বায় প্রতিটি ২৬ ইঞ্চি, চওড়ায় ১৯ ইঞ্চি। ভারতে তার দাম ২০০ সিক্‌কা টাকা। পরবর্তী বারো বছরে বের হল একই আকারের আরও পাঁচ খণ্ড। সেকালের লন্ডনে দুশো পাউন্ডেও খদ্দেরের অভাব হয়নি এই বইটির।

ডানিয়েলের বই ছাড়া সেকালে আরও কয়টি জনপ্রিয় ছবির বই ছিল আমাদের দেশে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বালথাজার সলভিন (Balthasar Solvyn)-এর আঁকা ২৫০টি প্লেটের বই: Manner and Customs and Dresses of the Natives of Bengal. বইটির দাম ছিল ২৫০ টাকা। জেমস মোফার্টের Views of Calcutta (১৮০৫) নামে বইটিরও ভাল বিক্রি ছিল। এ ছাড়া বিজ্ঞাপনে দেখা যায় রবার্ট ম্যাবন ৩০ টাকায় ‘ওরিয়েন্টাল ম্যানার্স’ বিষয়ে ২০টি প্লেটের একখানা বই বিক্রি করেছিলেন এখানে। বেইলির বইও বিজ্ঞাপনে বিক্রি হত। তাঁর বইটিতে শুধু কলকাতার ছবিই ছিল। প্রত্যেকটি ছবি লম্বায় ১৩ ইঞ্চি, চওড়ায় সাড়ে ন’ ইঞ্চি। মোট কুড়িখানা ছবি, দাম ৫০ টাকা। অ্যালফাউন্ডারের কথা ছিল এমন একখানা বই বের করবার। কিন্তু টাকার অভাবে আর তা পারেননি তিনি। তাঁর আগেই আত্মহত্যা করেছিলেন বেচারা।

ডানিয়েলের চিঠিতেই শোনা গিয়েছিল বাজারের মন্দার খবর। এ খবর যে সাময়িক নয়, সেটি বোঝা গেল আর ক’ বছর পরে। ১৮২৮ সালে ডানকান বিচি নামলেন এসে কলকাতায়। তিনি আকাডেমিসিয়ান উইলিয়ম বিচির ছেলে। নিজেও ভাল শিল্পী। কলকাতা তাঁকে সমাদরে কোনও ত্রুটি দেখাল না বটে, কিন্তু বিচি চলে গেলেন লখনউতে। একখানা উপহার ছবির জন্যে কলকাতা কর্তৃপক্ষ ৭০০ পাউন্ড দিয়েছিলেন তাঁকে, কিন্তু তবুও কলকাতাকে নির্ভর করতে পারলেন না বিচি। তিনি লখনউয়ে আস্তানা পাতলেন। হোম সাহেবের মৃত্যুর পরে লখনউর দরবারি শিল্পীর সম্মানজনক আসনটি তখনও ফাঁকা। বিচিকে সাদরে তাতে প্রতিষ্ঠিত করলেন নবাব। এর পর বিচি আর লখনউ ছাড়েননি। সেখানেই ১৮৫২ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। বিচি একটি হিন্দুস্তানি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁকে নিয়েই সংসার পেতেছিলেন তিনি লখনউয়ে। তাঁর ওই স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে সহ নিজের একখানা প্রতিকৃতি আজও ঝুলছে এশিয়াটিক সোসাইটির দেওয়ালে। ছবিটার নাম ‘A Hindustani Family’. কিন্তু বিশেষজ্ঞরা প্রমাণ করেছেন, নবাবের বেশে ওই ইউরোপিয়ানটি বিচি নিজে। লোকে বলে, এই ‘নবাব-বিচি’র ভূত বহুদিন অবধি ঘুরে বেড়িয়েছে তাঁর লখনউয়ের বাড়িতে। অবশ্য বাড়িটার পরবর্তী কোনও ইংরেজ বাসিন্দার সঙ্গে কোনও দিন মাঝরাত্তিরে দেখা হয়নি তাঁর। হিন্দুস্তানি চাকরেরাই শুধু দেখতে পেত ‘বিচি সাহেবের ভূত’।

যা হোক, মোটামুটিভাবে লখনউয়ে ডানকান বিচির ভূতই ভারতে শেষ উল্লেখযোগ্য চিত্রকর। উল্লেখযোগ্য মানে, তবুও নবাব সরকারের একটা কাজ পেয়েছিলেন তিনি। এরপর কী কলকাতা, কী লখনউ কোথাও শিল্পীদের কাজ পাওয়ার যেন সম্ভাবনা রইল না আর। দিন পালটাচ্ছে নয়, যুগ যেন সত্যিই পালটে গেছে ভারতবর্ষে। ১৮৩১ সালে খবরের কাগজের সংবাদ: মাত্র একজন মিনিয়েচার শিল্পী আছেন কলকাতায়। জনৈক মিস জেন ড্রামন্ড (Jane Drummond)। ভদ্রমহিলার হাত ভাল। কিন্তু তাঁর পৃষ্ঠপোষক নেই কলকাতায়। মিনিয়েচার আজ আর করাতে চায় না কেউ। অথচ এই কলকাতা ক’বছর আগেও (১৮১০) ১৩০ সিক্‌কা টাকা করে দেদার মিনিয়েচার আঁকিয়েছে মি. বেলনসকে দিয়ে। মিস জেনের ব্যর্থতায় বোঝা গেল, সে দিন বিগত। ১৮৩৪ সালে কোম্পানি সাড়ম্বরে ঘোষণা করলেন: ‘শিল্পিগণ। তোমরা এবার ইচ্ছে করলে আসতে পারো কলকাতায়। ভারতবর্ষের যেখানে তোমাদের ইচ্ছে। কোনও পারমিট চাইব না আর আমরা তোমাদের কাছে।’

কিন্তু কেউ এল না আর। এমন আমন্ত্রণেও সাড়া দিলেন না কেউ। কোম্পানির চিত্রকরদের নাতিদীর্ঘ ইতিহাসটা আরম্ভ হতে হতেই যেন শেষ হয়ে গেল হঠাৎ।

কিন্তু কেন? এ অঘটনের ভিতরে আসলে কারণ ছিল অনেক। প্রথম কারণ: ভারতবর্ষ এবং ব্রিটেনের মধ্যে মনোভঙ্গির ক্রম-দূরত্ব। প্রথম যুগের ব্যবসায়ীদের ঔদার্যের স্থানে ধীরে ধীরে আসছে তখন দুই জাতির স্পষ্ট ব্যবধান। শাসক আর শাসিতের এই শ্রেণীভেদ এবং জাতিভেদ পূর্ণ এবং প্রবলতর হল এসে সিপাহি বিদ্রোহে। বিদ্রোহের পরে রাজনৈতিক দিক থেকে যেমন কোম্পানির রাজত্বের অবসান, সামাজিক দিক থেকেও তেমনি অবসান ঘটল ইংরেজ আর ভারতীয়দের মধ্যে যাবতীয় আদান-প্রদানের। এককালের ব্যক্তিগত যোগাযোগ হারিয়ে ক্রমে যন্ত্রে পরিণত হতে চললেন বিদেশি সরকার। চিত্রকলা ইত্যাদির প্রতি পৃষ্ঠপোষণা দেখালেন তাঁরা আর্ট স্কুল স্থাপন করে। শিক্ষক ছাড়া আর বিদেশি শিল্পীদের এদেশে আসার প্রশ্ন ওঠে না তখন। আগে কোম্পানির কর্মচারীদের ‘হার্টফোর্ড লেজার’ রাখার কৌশল শেখার সঙ্গে শিখতে হত ছবি আঁকাও। কিন্তু হেইলবেরিতে তার দরকার নেই। স্বশিক্ষিত শিল্পীরাও এখন তুলি ধরতে ভয় পান রীতিমত। ছবি সম্পর্কে ইংল্যান্ডের অষ্টাদশ শতকী মতামতে পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেক। রাসকিনের কলমে নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে সেখানে। তা ছাড়া, আঁকবেনই বা কার জন্যে। ভারতবর্ষ যতদিন আয়ত্তের বাইরে ছিল ততদিনই ছিল অদ্ভুত আকর্ষণীয় দেশ। পুরোপুরিভাবে এদেশটাকে হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে গেল সেই পুরনো আগ্রহ।

তারপর শৌখিন শিল্পীদের পূর্বেকার অবসরও আর নেই আজ। নৌকো বা পালকিতে চড়ে যেতে যেতে থামতে হত স্থানে স্থানে। সে সময়টা কাটানো যেত ছবি এঁকে। কিন্তু এখন রেল বসেছে। আর রেলের কামরায় বসে অন্তত মাঝরাত্তিরে বেনারসের স্নানের ঘাটের স্কেচ হয় না।

এর উপর অবশেষে এল ক্যামেরা। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ক্যামেরা এসে পৌঁছল ভারতবর্ষে। ১৮৭০ সালে এদেশ পুরোপুরি চলে গেল তার দখলে। ক্রমে এল ছবি গ্রহণের সহজ প্লেট ‘ওয়েট প্লেট’। পাটনার এল সুলতান বাহাদুর গোটা ভারতবর্ষের হয়ে গ্রহণ করলেন ওটিকে।

ভারতের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং আর লেডি ক্যানিং স্থির করলেন, গোটা ভারতবর্ষের একটা ফটো অ্যালবাম করবেন তাঁরা।

সুতরাং ওয়ারেন হেস্টিংস বা জোহান জোফেনির যুগ যে ইতিহাসে পরিণত, সে বিষয়ে অতঃপর আর সংশয় রইল না কারও।

সহসা আধুনিক হয়ে গেল ভারতবর্ষ।

অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে একটা। এই যে আধা শতক ধরে ছোট-বড় শৌখিন এবং পেশাদার এতগুলো চিত্রকর বেপরোয়া চিত্রচর্চা করলেন ভারতর্ষের মাটিতে বসে, এদেশের চিত্র-স্বভাবে কি কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি তার? আমরা জানি, গ্রিক আক্রমণের কাল থেকে পারসিক মুঘল যত বিদেশি শিল্পধারা এসেছে ভারতবর্ষে সকলেই কমবেশি আপসরফা করে মিলেছে এদেশের শিল্পকলার ঐতিহ্যে। ইংরেজ চিত্রকরদের অভিযান কি সে দিক থেকে পুরোপুরি নিষ্ফল?

প্রশ্নটা যেমন সংগত, তেমনি গুরুতর। এর সঠিক উত্তর দিতে হলে আমাদের তৎকালীন ঘরোয়া চিত্রজগতের হালচাল একটু খতিয়ে দেখতে হয়। দিল্লির দরবারি মুঘল স্কুল তখন ভেঙে গেছে। উদ্বাস্তু শিল্পীরা পৃষ্ঠপোষকের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গোটা ভারতময়। কখনও মুর্শিদাবাদে, কখনও পাটনায়। কেউ লখনউতে, কেউ বা দিল্লিতে। সুদিনের স্বপ্ন দেখেছেন পতিত রাজধানীকে আঁকড়ে। কেউ কেউ আবার ছিটকে এসে পড়েছিলেন সুদূর কলকাতায়ও।

এমিলি ইডেন লিখছেন: (১৮৩৬) একদিন বালিগঞ্জ বেড়াতে যাওয়ার পথে সহসা ছোট একখানা কুটিরে নজর পড়ে আমাদের। পাতায় ছাওয়া একটি ঘর, চারপাশে ক’খানা নারকেল গাছ। দেখি, দরজার ওপর ঝুলছে একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ‘পীর বক্স’, মিনিয়েচার পেইন্টার’। আমি আর জর্জ (লর্ড অকল্যান্ড) ভেবে অবাক হয়ে গেলাম, আলো-বাতাসহীন এই বদ্ধ কুটিরে না জানি কী মিনিয়েচারই আঁকছে পির বক্স। ওর ঘরটা ছিল বডিগার্ডদের ব্যারাকের পাশেই। আমরা চলে আসার পর বডিগার্ডদের একজন অফিসার ঢুকলেন ওর ঘরে। আর পীর বক্স সত্যিই একটা সুন্দর প্রতিকৃতি করে ফেলল তাঁর। একটু স্টিফ বটে, কিন্তু ফিনিশিং খুবই চমৎকার।’

পির বক্স ছাড়াও তখন (১৮৪০-৪৫) কলকাতায় উদ্বাস্তু ভারতীয় শিল্পী ছিলেন একজন। তাঁর নাম সৈয়দ মহম্মদ আমির। আমির সাহেবের বাস ছিল শহরতলিতে, কড়োয়ায় বা আজকের পার্ক সার্কাসে। তিনি ছবি এঁকে এঁকে শহরে এনে বিক্রি করতেন। কখনও কখনও সাহেবরা কিনতেন। ফ্যানি পার্কস কিছু কিনেছিলেন। আমির সাহেবের ক’টা ছবির প্রতিলিপি তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে। বইখানার নাম: ‘Wanderings of a Pilgrim in search of Picturesque.’

এসব ছবিকে বলা হত ফিরকা (Firka)। আজকের দিনে ট্যুরিস্টরা যেমন ফটোর সেট কেনেন, সেকালে সাহেবরাও তেমনি কিনতেন ফিরকা সেট। অর্থাৎ নানা ধরনের, নানা পেশার দেশি লোকের ছবি। গঙ্গার ধারে ধারে, সাহেবদের আনাগোনার পথে দেশি চিত্রকরেরা ফেরি করে বেড়াতেন এসব সেট। দাম খুবই সস্তা। বারোখানা ছবির একটি প্যাকেট মাত্র দু’ টাকা দশ আনা।

কী করবেন দেশি চিত্রকররা। সস্তা ছবির এই পশরা নিয়ে বেরিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না তখন তাঁদের সামনে। মুর্শিদাবাদ বা পাটনায় যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের উপনিবেশও উদ্বাস্তু শিবিরের মতোই সাময়িক আস্তানা। দেউলে নবাবেরা চিরকালের জন্যে আশ্রয় দিতে পারলেন না তাঁদের। সুতরাং ওঁরা ট্যুরিস্টদের কাছে ছবি বেচতে বের হলেন।

কেউ কেউ কোম্পানির সাহেবদের ঘরে চাকরিও পেলেন। কিন্তু সে শ্রমজীবীর কাজ, চিত্রকরের নয়। তাঁরা এসে কোম্পানির কুঠি সাজান, পাখায় নকশা কাটেন। কেউ কেউ ড্রাফটসম্যান হিসাবে ম্যাপ আঁকার চাকরিও পেলেন। কেউ নিযুক্ত হলেন বোটানি বইয়ের আলংকারিক। শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে রয়েছে তার অজস্র এবং অনবদ্য নমুনা।

এ ধরনের কাজে স্বভাবতই তাঁদের চিরাচরিত চিত্রাদর্শের ব্যাপক কোনও পরিবর্তন আশা করা যায় না। এসব ছবিকে একালে বলা হয়—‘কোম্পানি পেইন্টিং’ বা ‘কোম্পানি ড্রয়িং’, বিদেশিদের জন্য তাঁদের ফরমাশ অনুযায়ী ভারতীয় শিল্পীদের আঁকা তাঁদের পছন্দের ছবি।

পরিবর্তন যেটুকু হয়েছিল, সে নিতান্তই পদ্ধতিগত। স্বচ্ছ রাসায়নিক জলরঙের ব্যবহার ছাড়াও ইংরেজসংসর্গে কতকগুলো বিশেষ টেকনিক্যাল জ্ঞান লাভ করলেন আমাদের শিল্পীরা। যেমন কপার এনগ্রেভিং বা এচিং।

প্রিন্সেপ সাহেবের বেনারসের ছবির বইয়ে (Benares Illustrated, 1880-83) কিছু কিছু ছবি এনগ্রেভ করেছিলেন কলকাতার বাঙালি শিল্পী কাশীনাথ। প্রিন্সেপের প্রথম পছন্দ হয়নি তাঁর কাজে। তিনি ছবির নোট দিতে গিয়ে লিখছেন: The state of art in Calcutta would not allow an attempt in shading.’ তারপর কাশীনাথ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: ‘He has much to learn in perfection, both aerial and liner; in other respects the plates are creditable enough to the progress of the Arts in Calcutta.’ এটা ১৮৮০ সালের কথা।

ক’বছর পরে, ১৮১৮-১৯ সালের কলকাতা স্কুল বোর্ড সোসাইটির বিবরণে জানা যায় যে, কাশীনাথ কপার এনগ্রেভিংয়ে বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। ছাপা ছবির মতো চিত্রকলার যান্ত্রিক দিকে এই দক্ষতাও নিঃসন্দেহে ইংরেজ শিল্পীদের দান।

বলা বাহুল্য, ইংরেজ চিত্রশিল্পীরা কোনও দিন এদেশে না এলেও বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষ এসব যান্ত্রিক বিদ্যায় চিরকাল অজ্ঞ থেকে যেত না নিশ্চয়ই। সুতরাং ইংরেজ চিত্রকরদের সাক্ষাৎ সংসর্গে মাত্র এটুকুই যদি পাওনার ঘরে এসে থাকে আমাদের, তবে এ যোগাযোগ ব্যর্থ হয়েছে বলেই ঘোষণা করা সংগত।

কিন্তু তা করতে পারি না আমরা। কারণ, অল্পবিস্তর হলেও মুর্শিদাবাদ, দিল্লি, পাটনা, লখনউ এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন স্থানে আমাদের ঘরোয়া চিত্রকলা বিলেতি হাওয়া পেয়েছিল কিছু কিছু। কথাটা স্পষ্ট বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হয় ঘরের কাছাকাছি কালীঘাটের দিকে।

কলকাতার মাটিতে ইংরেজদের পা পড়ার আগেও কালীঘাট ছিল সত্য, কিন্তু সে কালীঘাটে অধুনা বিখ্যাত কালীঘাটের পট ছিল না। কালীঘাটে পটের জন্মকাল ঊনবিংশ শতকের আরম্ভে। মনোযোগ দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, যে কোনও সূত্রেই হোক, বাংলার নিজস্ব পটচিত্রে কিছু না কিছু ইংরেজ-প্রভাবে এসে পড়েছে এই সব এক আনা থেকে এক পয়সা দামের পটে। প্রথমত কাগজের কথাই ধরা যাক। শস্তা এবং হালকা যে কাগজে কালীঘাটের স্ফূর্তি তা বিলেতি কাগজ। দ্বিতীয়ত, লক্ষণীয় কালীঘাটের শিল্পীরা কিন্তু ছবি আঁকতেন স্বচ্ছ জলরঙে। অথচ ভারতের ঐতিহ্যসম্মত রং হচ্ছে টেম্পেরা, অস্বচ্ছ ঘন জল রং। তৃতীয়ত, ছবিগুলোর আকৃতি। ভারতে মিনিয়েচার ছবির মাপ ছিল সাধারণত দৈর্ঘ্যে ১৭ ইঞ্চি, চওড়ায় ১১ ইঞ্চি। কালীঘাটের ছবির মাপ এর চেয়ে বড়। তার মানে এই নয় যে, অন্য মাপের ছবি ছিল না। ছিল, তবে কম। প্রকৃতিবিজ্ঞান চর্চায় সাহেবরা এদেশি শিল্পীদের দিয়ে যেসব ছবি আঁকিয়েছিলেন, সেগুলোর মতো তেমনি ফাঁকা কাগজে আঁকা। অথচ চিত্রপট রঙে ভরে দেওয়াই আমাদের দেশে সাধারণত রীতি।

তবে কালীঘাটে ইংরেজ প্রভাবের সবচেয়ে বড় প্রমাণ তার বিষয়বস্তু এবং ছায়াসম্পাতের কৌশল। বাংলার পটে বিষয় ছিল সাধারণত ধর্মীয় বা পৌরাণিক। ইংরেজ আমলেই দেখি পটে ঠাঁই করে নিচ্ছে সমসাময়িক ঘটনা ও মানুষের ব্যবহারিক জীবন। তৎকালীন কলকাতার সমাজের বিস্তৃত এবং বিশস্ত ছবি আঁকা হয়েছে কালীঘাটের পটে। এই সব ঘটনা ইঙ্গিতে বলে আদিগঙ্গার ধারের এই কুটিরগুলোতে সেদিন বইছিল পশ্চিমী হাওয়া। ঠাকুর দেবতাদের পাশাপাশি নগরজীবন শিল্পীর প্রিয় বিষয়।

সুতরাং যদি ভারতের চিত্র ঐতিহ্যে এসব স্থানীয় ঘরানার দান থেকে থাকে কিছু, তবে অবশ্যই কোম্পানির চিত্রকরেরা বলতে পারেন, ‘আমরা শুধু গ্রহণই করিনি, তোমাদের দিয়েছিও কিছু কিছু।’

লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এ প্রাপ্তিযোগে আমরা ঠকেছি কি জিতেছি, সে অবশ্য অন্য কথা।

কালীঘাটে একদিন

স্থান কালীঘাট। মন্দিরের আশেপাশে কোনও এক গলিপথের ডাইনে কি বাঁয়ে, কোনও এক পুতুলের দোকান। সময় গত শতকের দ্বিতীয় ভাগে কোনও এক আলোকোজ্জ্বল সকাল। হয়তো তখন এমনি বর্ষার দিন। হয়তো তখন বসন্ত কিংবা গ্রীষ্মকাল। শীত নয়। কেননা, যত গরিবই হোক, বুড়ো কারিগর কিছুতেই তবে এই সাতসকালে আদুর গায়ে ছেলেকে দোকানে বসিয়ে নিজে মাটি ছানতে চলে যেত না। হয়তো ভুল বলছি। হয়তো ছেলেটির বাবা নেই। সংসারে শুধু ওর মা-ই আছে। ছেলে যখন দোকানে বসেছে, মা তখন পাশেই বস্তির আর একটি ঘরে মাটির মেঝেতে পা ছড়িয়ে পরীদের পিঠে পাখা বসাচ্ছেন আর মনে মনে ভাবছেন, নীলমণি আমার এই মানুষ হয়ে এল বলে।

সেদিনও নিশ্চয় কালীঘাটের এই গলিপথে ভক্ত যাত্রীর আনাগোনার বিরাম ছিল না। তাঁদের ভিড়েই এক সময় সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এক বিদেশি আলোকচিত্রী। বালকের হাতে আস্ত একখানা রঙিন পরী খুঁজে দিয়ে ক্যামেরা তাক করে একচোখে কাচের মধ্য দিয়ে আবার দোকানটির দিকে তাকিয়েছিলেন। মাটির দেওয়াল, কাঠের খুঁটি, বাঁশের ঠেকা, কাপড়ের ভাঁজ—কিছুই চোখ এড়ায়নি তাঁর। ভয়ে হাত পা আড়ষ্ট হয়ে এসেছে বালকের, মাথাটা ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছে নীচের দিকে। না, আর নয়। সাহেব ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তারপরই—ওয়ান, টু, থ্রি। সম্ভবত সেটা ১৮৬০ কিংবা ১৮৮০ সাল। অথবা তার মাঝামাঝি কোনও বছর। কেননা, যে প্লেটে ছবিটা পাওয়া গেছে, সেই বিশেষ ধরনের ফটোপ্লেট ১৮৮০ সালের পর আর ব্যবহৃত হয়নি এবং সেগুলো চালু হয়েছিল ১৮৬০ সালে।

তার ক’বছর পরের কাহিনী। কালীঘাটের পথে দেখা দিলেন আর এক বিদেশি আগন্তুক। মাথায় টপ-হ্যাট, গায়ে লম্বা কোট, পায়ে চিনেবাজারের জুতো, হাতে ছাতা, নাকের তলায় গোঁফ, চোখে চশমা। ঘুরতে ঘুরতে তিনি একটা পুতুলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কে জানে হয়তো এই দোকানটিই বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল তাঁকে। হয়তো এ বালক তখন পরিণত যুবক। হয়তো ঘরে তার বউ এসেছে। কারিগরের ঘরে কারিগর বউ। মা আর বউ কাজ করে, নীলমণি তখনও দোকানে বসে। সাহেব দেখলে আর হাত পা আড়ষ্ট হয়ে আসে না তার। আশ্চর্য এই, এ সাহেব পুতুলের দর জানতে চাইলে না। চোখের চশমাটা ঠিক মতো বসিয়ে একদৃষ্টে তিনি তাকিয়ে রইলেন নীচে বাঁয়ের এক কোণে কাগজে আঁকা ছবিটির দিকে। তার পর তাকের শেষ মাথায় যেখানে সার সার এমনি আরও ছবি ঝুলছে, সেদিকে। উজ্জ্বল রং বলিষ্ঠ টান। ক্যামেরাধারী সাহেবও নিশ্চয় এগুলো দেখেছেন। কিন্তু তাঁর মন মেতে ছিল পুতুলে। ছবিগুলো তাই ক্যামেরার চোখ এড়িয়ে গেছে। নীচের ‘নিতাই-গৌর’ রি না বাদ দিলে ওপরের প্রায় গোটা পটটাই কাটা গেছে। ‘বাবু’ যেখানে গলবস্ত্র ‘বিবি’র মানভঞ্জনের চেষ্টা করছে, সে দৃশ্যটা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। ফিরিঙ্গি বেশে বঙ্গীয় যুবকের নিম্নাঙ্গের আভাসটুকুই পাওয়া যাচ্ছে মাত্র, আর সব উধাও। এ দর্শক তাতে রাজি হলেন না। একগাদা ছবি কিনে তবে তিনি কালীঘাট থেকে বিদেয় হলেন। নীলমণির সেদিন সে কি বিস্ময়।

অবশ্য তার চেয়েও বেশি বিস্ময় জমা ছিল সম্ভবত পরের শতকের পৃথিবীর মানুষদের জন্য। সম্ভবত দুনিয়ার নজর প্রথম এদিকে আকর্ষণ করেছিলেন একজন বাঙালি চিত্ররসিকই (১৯২৬)। তারপর ক্রমে অন্যরা এবং এভাবেই ধীরে ধীরে সমগ্র পৃথিবী। কালীঘাটের পট নিয়ে সেদিন সে কি উত্তেজনা, গবেষণা। কালীঘাটে পট এখনও বিকোয় কি? কোথায় এখন সেই শিল্পীরা? বেঁচে থাকার সময়ে পশ্চিম দুনিয়া তাঁদের চিনেছিল কি? সেই গবেষণাসূত্রেই লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের তাক থেকে বের হয়েছিল একটি বান্ডিল। যা দান করেছেন কোনও রসিক। দানের তারিখ, ১৯১৭। দাতার নাম রাডিয়ার্ড কিপলিং। নীলমণি জেনে যেতে পারেনি তার দোকানে কিপলিং নামে এক বিখ্যাত সাহেবও এসেছিল একদিন।

তারপর ক্রমে অবশ্য অন্য খবরও জানা গেছে। আর্চার এবং অন্যদের আলোচনা, গবেষণায় কালীঘাটের পট ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট ঘটনা এবং ঘরানা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এখানকার পটের নিজস্বতাও আজ সর্বজনস্বীকৃত। বিশেষজ্ঞদের মতে কালীঘাটের পটের জীবনে চারটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ধাপে (১৮০০-৫০) শিল্পীরা বিদ্যাটাকে নিজস্ব করার চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয় ধাপে (১৮৫০-৭০) শিল্পে নিজস্বতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কালীঘাটের হাট ছবিতে ছেয়ে গেছে। যাঁরাই এখানে তীর্থ করতে এসেছেন, তাঁরাই ফেরার পথে কালীঘাটের পুতুলের সঙ্গে দু’একখানা পট কিনে নিয়ে গেছেন। পুতুলেও তখন কালীঘাটের নিজস্বতা সুপ্রতিষ্ঠিত। ছবির পুতুলগুলোর দিকে তাকালে কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায় তার। প্ল্যাস্টিকের খেলনা তো নেই-ই, কাঠের কিংবা টিনের কোনও যান্ত্রিক খেলনাও নেই তখন নীলমণির দোকানে। সব ছাঁচের পুতুল। পশ্চিমী হাওয়া আদি গঙ্গার ধারে এই গলিতেও সে সময়ে, বলা বাহুল্য, পৌঁছেছে। গণেশঠাকুরের ভিড়েই ভেনাস কিংবা বিলিতি পরীরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বাঙালি বাবুরা। মাথায় টেরি, পরনে শান্তিপুরী ধুতি, হাতে ছাতা। গ্রামে গ্রামে এই পুতুলই সেদিন বয়ে নিয়ে যেত শহর কলকাতার বাঙালির হালচাল। দাম ১৭ × ১১ ইঞ্চি মাপের এক-একখানা ছবির জন্য এক পয়সা থেকে এক আনা। কালীঘাটের তৃতীয় অধ্যায়ে (১৮৭০-৮৫) শিল্পীদের অন্যতম উপজীব্য এই কলকাতার সমাজ-জীবন। কালীঘাট সেদিন হুতোমের মতো তীক্ষ্ণ দর্শক, ভবানীচরণের মতো নিমর্ম সমালোচক। পাণ্ডা পুরোহিত থেকে ‘বাবু’—তার তুলিতে কারও জন্যেই ক্ষমা নেই।

কালীঘাটের শেষ যুগ ১৮৮৫ থাকে ১৯৩০ সাল। ক্যামেরা খবরের কাগজ নানা যান্ত্রিক ও সামাজিক পরিবর্তন ধীরে ধীরে পটো-পাড়ায় শেষ দিনের খবর বয়ে নিয়ে এল। প্রথমে পট উধাও হল। তারপর ক্রমে শিল্পীরা। ১৯২০ সালের একে একে প্রায় সব শিল্পী বিদায় নিলেন। নীলমণি দাস, বলরাম দাস, গোপাল দাস। দশ বছর পরে শেষ নিশ্বাস ফেললেন। শেষ দু’জনও, অর্থাৎ নবীনচন্দ্র ঘোষ এবং কালীচরণ ঘোষ। তাঁদের দুজনেরই বয়স তখন আশির ওপর। তারপরও অবশ্য বছর কয় আগে শোনা গিয়েছিল একজন জীবিত শিল্পীর নাম। শুনে কৌতুহলী হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে শিল্পী কালীঘাটে থাকেন না। তা ছাড়া, আঁকতে জানলেও তিনি আর নিজে থেকে পট আঁকেন না। কোথায় পাবেন তিনি সেদিনের কালীঘাটের সেই আশ্চর্য আবহাওয়া। কোথায় এলোকেশী? কোথায় নবীন?

ছবির সেই বালক কি দেখেছিল? কত বয়স তখন ওর? এ ছেলে কি তার সত্যিই নীলমণি দাস? অথবা নবীনচন্দ্র ঘোষ? কী নাম ছিল ওর? কিপলিংয়ের ছেলে তো প্রথম মহাযুদ্ধে মারা গেছেন। কিন্তু কী করে এখন এই ছবির বালকের ছেলে কিংবা নাতিরা? কোথায় তারা?

জার্নালিস্ট

‘Before he will bow, cringe or fawn to any of his oppressors…he would compose ballads and sell them through the streets of Calcutta as Homer did.’ বলেছিলেন কলকাতার এক দীন সাংবাদিক। হেস্টিংস ইম্পের মদমত্ত অট্টহাসির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্পর্ধা-উন্নত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন তিনি, ভাঙব, তবুও মচকাব না। রক্তচক্ষুর ভয়ে বিকিয়ে দেব না আমার স্বাধীনতা। তৎকালীন কলকাতার ইংরেজ নরনারী চমকে উঠেছিলেন তাঁর কথা শুনে। এ কি উন্মাদ? সামান্য রাস্তার লোক হয়ে লড়তে চায় গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে। ‘হ্যাঁ, তাই।’ উত্তর দিয়েছিলেন সেই দুঃসাহসী সাংবাদিক। কাগজে কলমে উত্তর। ভীতিবিহ্বল হয়ে কলকাতাবাসী পড়ে গেল, তিনি লিখেছেন: ‘পাঠক, আজ আমার হারাবার মতো জিনিস আছে মাত্র তিনটি। প্রথম আমার কাগজ, আমার সম্মান, দ্বিতীয় আমার স্বাধীনতা এবং শেষ আমার জীবন। শেষের দুটোকে আমি আজ হেলায় বিসর্জন দিয়ে দিতে পারি প্রথমটির জন্যে। আমার কাগজের জন্যে।

তা, তিনি সত্যিই দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা এবং জীবন দুই-ই অকৃপণভাবে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, প্রথমটিকে তবুও বাঁচাতে পারেননি। কাগজ তাঁর বাঁচেনি। বাঁচাতে পারেননি তিনি নিজেকেও। বেঙ্গল গেজেটের মতো তার সম্পাদককেও মরতে হয়েছে। অকালে। হোমারের মতো কলকাতার পথে পথে গান গেয়ে বেড়াবার আগেই এককালের অত্যাচারীদের কাছে ‘Your Obedient Servant’ বলে দরখাস্ত লিখতে লিখতে মৃত্যু বরণ করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতার মূল্যেও বাঁচাতে পারেননি তাকে। হিকি ভারতের সাংবাদিকতার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ট্র্যাজেডি।

হিকি। জেমস অগস্টাস হিকি, হিকি দ্য প্রিন্টার, ভারতবর্ষের আধুনিক সাংবাদিকতার পিতা (The Papa of the Press)। তাঁর কাগজ ‘বেঙ্গল গেজেট’ ভারতবর্ষে প্রথম কলে-ছাপা কাগজ, প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র। ছাপার কল সে সময়ে গুটি তিন ছিল ভারতবর্ষে। কিন্তু কাগজ ছিল না। সংবাদ আদানপ্রদানের রেওয়াজও ছিল, কিন্তু সংবাদপত্র ছিল না। হিকির সময়ে কলকাতায় ছিল একটা মাত্র খবরের কাগজ। তবে হাতে লেখা কাগজ। বোল্টস নামে এক ভদ্রলোক বার করেছিলেন সেটি। পাঠকেরা তাঁর বাড়ি গিয়ে পড়ে আসত। কিন্তু বেশি দূর এগুবার আগেই বন্ধ হয়ে গেল তা। নানা কারণে কর্তৃপক্ষ তাড়িয়ে দিলেন বোল্টসকে কলকাতা থেকে।

এগিয়ে এলেন হিকি। কাগজ বার করবেন তিনি। বোল্টসের মতো হাতে লেখা কাগজ নয়, ছাপা পত্রিকা। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি শনিবার বের হল তাঁর প্রথম কাগজ। ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ‘ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাড্‌ভারটাইজার’। সম্পাদক, প্রকাশক এবং মুদ্রাকর হিকি।

হিকি। জেমস অগস্টাস হিকি। কে তিনি? কলকাতাবাসীর মুখে মুখে জিজ্ঞাসা। এমন সুন্দর ছাপা কাগজ বের করতে পারল যে কে সেই লোক। হিকি জানালেন আমি জেমস অগাস্টাস হিকি, মহামান্য কোম্পানি বাহাদুরের প্রথম এবং ভূতপূর্ব মুদ্রাকর। কাগজ বার করার আমার বিশেষ রকমের কোনও নেশা নেই, এদিকে আমার যে খুব ঝোঁক আছে, তাও নয়, তা ছাড়া খুব কঠিন জীবনেও আমি অভ্যস্ত নই। তবুও যে আজ এই শ্রমসাধ্য কাজে নিজেকে নিয়োগ করছি, তার কারণ, আমি মন এবং আত্মার স্বাধীনতা চাই (in order to purchase freedom of mind and soul)। নিজেই অতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন তিনি তাঁর কাগজের উদ্দেশ্য: আমার কাগজ হচ্ছে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সাপ্তাহিক। সমস্ত দলের জন্যে খোলা এর পাতা, কিন্তু প্রভাবিত নয় কারও দ্বারাই।

হু হু করে কলকাতার ইংরেজ নরনারী গ্রাহক হতে লাগল বেঙ্গল গেজেটের। হিকির কাগজের। দু’ সপ্তাহেই জনপ্রিয় সাংবাদিক হয়ে উঠলেন হিকি। জনপ্রিয় কাগজের জনপ্রিয় সম্পাদক তিনি।

কিন্তু হিকি বরাবর সাংবাদিক ছিলেন না। তিনি নিজেই বলেছেন, এর আগে তিনি ছিলেন ছাপাখানার লোক মাত্র। অর্থাৎ প্রিন্টার। কিন্তু ইতিহাস বলে: প্রিন্টার হওয়ার আগে তিনি ছিলেন ডাক্তার। চিকিৎসক। নেটিভদের মধ্যে ডাক্তারি করে কোনও মতে পেট চালাতেন তিনি। আবার কেউ কেউ বলেন হিকি ছিলেন কেরানি। সার্জেন্ট ডেভি নামে জনৈক আইনজীবীর গোমস্তা ছিলেন তিনি। অর্থাৎ হিকি ছিলেন এক বিচিত্র পেশার মানুষ। এবং যতদূর জানা যায়, তাতে নিঃসন্দেহে এ মানুষটির জীবন রীতিমতো রোমাঞ্চকর।

ভদ্রলোক জাতিতে ছিলেন আইরিশ। বাপ-ঠাকুরদার খবর বড় একটা পাইনি। কোনও মতে বাবার নামটুকুই জানা গেছে। তাঁর নাম ছিল উইলিয়ম হিকি। বৃদ্ধ উইলিয়ম ছেলেকে শিক্ষানবিশ রূপে রেখে এসেছিলেন লন্ডনের স্টেশনারস হলে। সেখান থেকেই তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। শোনা যায়, আসার পথে জাহাজ অবধি তিনি ছিলেন জনৈক ডাক্তারের পার্শ্বচর। কারণ সে জাহাজের যাত্রীর তালিকায় তাঁর নাম নেই। ১৭৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর জাহাজ এসে পৌঁছল। বাংলায়, কলকাতায়। জাহাজের খালাসি হিকি, ডাক্তারের ভৃত্য হিকি, কিন্তু জাহাজ থেকে নেমেই হয়ে গেলেন নিজে ডাক্তার। এন্টালি অঞ্চলে বাড়ি নিলেন একখানা। তারপর শুরু করলেন রীতিমতো রোগী দেখাশোনার কাজ। অবশ্য তাঁর রোগীরা সবই ছিল নেটিভ। ডাক্তারি চলল। হিকি দেখলেন, শহরে ছাপাখানা নেই। চট করে তিনি রাতারাতি হয়ে উঠলেন প্রিন্টার। কেমন করে কে জানে, হিকি কিছু টাইপ সংগ্রহ করেন এবং একটি কাঠের ছাপাখানা তৈরি করে শুরু করলেন ছাপার কাজ। তাতে দিব্যি ছাপা চলে তাঁর কলে। মোটামুটি হ্যান্ডবিল, ফর্ম এবং বিজ্ঞাপন। কাজের অভাব ছিল না। অনেক কাজ পেয়ে গেলেন হিকি। একদিকে অনেক রোগী, অন্যদিকে অনেক ছাপার কাজ। হিকির আনন্দের সীমা নেই। কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে দেশে অর্ডার দিয়ে বসলেন একটা নতুন ছাপার মেশিন এবং সেই সঙ্গে কিছু ওষুধপত্তরের।

যথাসময়ে ছাপার কল এসে পৌঁছাল। এবার আর ডাক্তারি নয়। পুরোপুরি প্রিন্টার হয়ে উঠলেন হিকি। খ্যাতনামা মুদ্রাকর। সরকারি কাজও পেতে লাগলেন। প্রধান সেনাপতি স্যার আয়ার কুট একটা বিরাট কাজ করতে দিলেন তাঁকে। সৈন্যদলের নিয়মকানুন ছাপাতে হবে। পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি টাকার কাজ। হিকির আনন্দ আর ধরে না। টাকা তাঁর চাইই। বেচারার টাকার অভাব লেগেই আছে।

শোনা যায়, ইতিমধ্যে ঋণের দায়ে কিছুকাল কারাবাসও নাকি করতে হয়েছে তাঁকে। হিকি নামেই আর এক জজ সাহেব (আইনজীবী উইলিয়ম হিকি) তাঁকে দেখেছিলেন কয়েদখানায়। ১৭৭৭ সালে। হিকির কারাজীবনের তখন তৃতীয় বর্ষ।

যা হোক, সরকারি কাজ শেষ করে হিকি নামলেন কাগজ বের করতে। ছাপাখানা ছাড়া হাজার দুই টাকা তখন সম্বল ছিল। সেটুকু মূলধন বের হল বেঙ্গল গেজেট। লোকে বলে ‘হিকির গেজেট’।

কাগজ হিসেবে ‘হিকির গেজেট’ সামান্য কাগজ। অন্তত আজকালকার কাগজের তুলনায়। দুই সিট কাগজ। দৈর্ঘ্যে বারো ইঞ্চি, চওড়ায় আট ইঞ্চি। খুদে খুদে হরফে ছাপা বেশির ভাগ জায়গাই বিজ্ঞাপনে বোঝাই। তবুও বেঙ্গল গেজেট নিয়ে হই-চই পড়ে গেল শহরে। শুধু কলকাতা শহরে নয়, সারা ভারতবর্ষে। কারণ, প্রথম সংখ্যা থেকেই হিকি প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন শাসকদের বিরুদ্ধে। সামাজিক ন্যায় অন্যায় সম্পর্কে তিক্ত মতামত, তীব্র কশাঘাত চালিয়ে গেলেন তিনি।

অবশ্য এটা ঠিক, এ ব্যাপারে হিকি তাঁর কালের রুচিকে অতিক্রম করতে পারেননি। তিনিও যে কিয়ৎ পরিমাণে স্কুল রুচির মানুষ ছিলেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তা ছাড়া, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ক সংবাদপত্রের প্রতিশ্রুতি দিলেও, হিকি তাঁর সমস্ত অধ্যবসায় নিযুক্ত করেছিলেন প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে। নামজাদা ব্যক্তিদের পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে বিশেষ বিশেষ মহিলার চালচলন ইস্তক কিছুই বাদ দিতেন না তিনি। দু’ একখানা নমুনা দিলেই বোঝা যাবে তাঁর কৌশলটি। ‘Public notice: Lost on the course, last Monday evening, Buxey Clumsey’s heart, which he stood simpering at the footstep of Hooka Turban’s carriage: as it is supposed to be in her possession, she is desired to return it immediately, or to deliver up her own as a proper acknowledgement.’

বলা বাহুল্য, নাম দু’টি কিয়ৎ পরিমাণে বিকৃত হলেও ঘটনাটি মূলত সত্য। কারণ হিকির রিপোর্টাররা সামাজিক মেলামেশার স্থানে রীতিমতো খুঁজে বেড়াত এমনি সব ঘটনা। তারপর এমনই রসিকতা করে হিকি ছেপে দিলেন তার বিবরণ। একবার জনৈক মহিলার পোশাক লক্ষ করে হিকি লিখলেন:

‘If Eve in her innocence could not be blamed,

Because going naked she was not ashamed,

Whoe’er views the ladies, as ladies now dress

That again they grow innocent sure will confess,

And that artfully, too, they retaliate the evil-

By the devil once tempted they now tempt

the devil.’

এর পর সে মহিলাই শুধু নয়, সমস্ত ‘সোসাইটি লেডি’-রাই যে আনন্দে-উৎসবে তাঁদের বেশভূষা সম্পর্কে সতর্ক হয়েছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

অবশ্য এখানেই শেষ নয়। বিবাহের সম্ভাবনা, পাত্রীর দেহশ্রী কিংবা পাত্রের পৌরুষ ইত্যাদিও বাদ যেত না বেঙ্গল গেজেটের পাতায়। কবিতার পর কবিতা ছাপা হত পত্রিকার Poets’ Corner বিভাগে। এমনি সব কবিতা:

Oh lovely Su-,

How sweet though art,

Than sugar thou art sweeter ইত্যাদি।

এই ‘Su’ ছিল কোনও নামের আদি দুটি শব্দ। এদিকে তৎকালীন ইংরেজদের সমাজ ছিল ছোট। সুতরাং পাঠকেরা অতি সহজেই চিনে ফেলতেন উপলক্ষ মানুষটিকে। হিকি সেটা জানতেন। কিন্তু জেনেও এ সব নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার ছাপাতে দিতেন কবিতা হিসাবে। হয়তো তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হত না। নিজ নিজ ঘর সামলে পাঠকেরা শনিবারে শনিবারে নিয়মিত পরচর্চার আস্বাদ পেতেন মাত্র। কিন্তু হিকির কাগজের এটা ছিল এক দিক। তাঁর সমস্ত ব্যঙ্গের লক্ষ্য ছিল আসলে বড় ঘর, প্রধান আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল উঁচু চেয়ার। তাদের জীবনে কেলেংকারির অভাব ছিল না। বরং কেলেংকারি, কেচ্ছাই ছিল তাদের সমাজ, তাদের জীবন। বেঙ্গল গেজেটের পাতায় হিকি চেপে ধরলেন তাঁদের। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস, বিচারপতি ইলাইজা ইম্পে ইত্যাদি হোমরা-চোমরা সব মানুষকে তিনি দাঁড় করালেন তাঁর কাঠগড়ায়। অবশ্য এও করতেন তিনি তাঁর নিজস্ব স্টাইলেই। ছোট ছোট নাটক লিখতেন তিনি ব্যঙ্গের উপলক্ষটিকে কেন্দ্র করে। তারপর আসল নামগুলো একটু বিকৃত করে সেই সব রথী-মহারথীকে হাজির করাতেন সেখানে পাত্রপাত্রী হিসেবে। পাঠকের বুঝতে কষ্ট হত না অবশ্যই, বুঝতে পারতেন শাসনকর্তারাও। না বোঝার কারণ নেই। একটু নমুনা দিচ্ছি।

একবার হিকির গেজেটে টুকরো খবর বের হল দুই বন্ধুর কথোপকথনের সারাংশ নিয়ে। তাতে একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করছে ‘আচ্ছা ভাই, বল তো দেখি, একটা ভাল রকমের চাকরি পাওয়া যায় কী করে?’ বন্ধু উত্তরে বললেন, ‘আলিপুরবাসিনী মারিয়ন সমীপে ধর্না দাও কিংবা পুল-বন্দির কাজে নিজ দেহমন সমর্পণ করো।’ পাঠক পড়েই বুঝে গেলেন, প্রথম ইঙ্গিতটি হেস্টিংস-গিন্নি সম্পর্কে এবং দ্বিতীয়টি স্যার ইলাইজা ইম্পেকে লক্ষ করে বলা। পুলবন্দি বা ব্রিজ মেরামতি ইত্যাদির কাজে তখন পয়সা ছিল। শোনা যায়, ইম্পে একবার তাঁর কোনও আত্মীয় মিঃ ফ্রেজারের বেনামিতে সে কাজের কনট্রাকট্‌ নিয়ে বেশ কিছু পয়সা করেছিলেন।

গভর্নর জেনারেল কিংবা প্রধান বিচারপতির মতো মানুষ এমনি আক্রমণ দিনের পর দিন সইবেন কেন? ১৭৮০ সালের ১৪ নভেম্বর অর্থাৎ জন্ম-বছরেই তাই বেঙ্গল গেজেটের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল জেনারেল পোস্ট অফিসের পথ। সরকারি আদেশে ডাক ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হল বেঙ্গল গেজেট। কারণ হিসেবে বলা হল, এ কাগজে যা তা ছাপা হয় এবং হচ্ছে। এতে জনগণের রুচিকে বিকৃত করা হচ্ছে এবং অত্র শহরের শান্তিকে রীতিমতো বিঘ্নিত করা হচ্ছে।

হিকি কিন্তু এতে বিন্দুমাত্র দমলেন না। তিনি ঘোষণা করলেন, গভর্নর জেনারেলের এই কাজ হচ্ছে ‘অত্যাচারী শাসকবর্গের ক্ষমতার অপপ্রয়োগের শ্রেষ্ঠতম প্রমাণ।’

পাঠকেরা সবিস্ময়ে দেখতে পেল বেঙ্গল গেজেট পর-সপ্তাহে শুধু যে বের হচ্ছে তাই নয়, তার পূর্বচরিত্র বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত না করেই বের হচ্ছে। বরং আরও তীব্র হয়ে উঠেছে হিকির আক্রমণ। গভর্নর জেনারেলকে ছাড়িয়ে ক্রমে আরও বিস্তৃত হচ্ছে তার পরিধি।

এবার তিনি ধরলেন রেভারেন্ড কিরনান্ডেরকে। কিরনান্ডের কলকাতার মিশন চার্চের প্রতিষ্ঠাতা। হিকি লিখলেন, ভদ্রলোক গভর্নর জেনারেলকে চার্চখানা বিক্রি করে দেবার চেষ্টায় আছেন। আর যায় কোথা? পরদিনই গভর্নর জেনারেল কাগজেকলমে লিখে দিলেন, এ সংবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা। পাদরি সাহেব সেই কাগজখানা হাতে করে হাজির হলেন আদালতে। মানহানির মোকদ্দমা দায়ের করলেন তিনি হিকির নামে। বিচারে জেল হয়ে গেল হিকির। চার মাসের কারাদণ্ড এবং সেই সঙ্গে পাঁচশো টাকা নগদ জরিমানা। এ তো গেল এক মামলার রায়, এদিকে হেস্টিংসও তাঁর নামে রুজু করে রেখেছেন আরও দু’টো মোকদ্দমা।

হিকি এ সব তুচ্ছ করে ঘোষণা করলেন: মিঃ হিকির মতে কোনও ইংরেজ পুরুষ কিংবা স্বাধীন গভর্নমেন্ট সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচতে পারে না। প্রত্যেকটি প্রজার নিজ নিজ আদর্শ এবং মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে এবং যে তাতে অন্তরায় সৃষ্টি করে, সে নিঃসন্দেহে অত্যাচারী।

এর পর রাজকর্তব্যে আর শিথিল হলে চলে না। হেস্টিংস তখন কলকাতায় নেই। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শনে গেছেন। অস্থায়ী গভর্নর সিপাই পাঠিয়ে দিলেন হিকিকে ধরে আনতে। অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে চারশো লোক চলল এন্টালি অভিমুখে। হিকির বাড়ির দিকে। সাদায় কালোয় মেশানো চারশো সিপাই। শক্তিহীন এক দরিদ্র গৃহস্থ সাংবাদিক কিনা তাদের লক্ষ্য। সরকারের কাণ্ড দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেল হিকির। অবশেষে গায়ে হাত দেবে সাংবাদিকের? খেপে গেলেন হিকি। সামনে ছিল ছাপাখানার সাজ-সরঞ্জাম, তাই নিয়েই নেকড়ের মতো তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন চারশো লোকের সেই বিরাট বাহিনীর ওপর। মুহূর্তে ছত্রখান হয়ে গেল মাইনে-করা সিপাই-বাহিনী।

এবার আইনের কথা স্মরণ হল হিকির। জামাকাপড় পরে সরকারের আইন রক্ষার্থে নিজেই রওনা হলেন সুপ্রিম কোর্টের দিকে। গিয়ে দেখেন, কোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। ফেরার পথে পা বাড়ালেন, কিন্তু আর ফেরা হল না। কোর্ট না খোলা অবধি আটক করে রাখা হল তাঁকে।

হিকি চললেন কয়েদখানায়। কিন্তু মোটেই দমলেন না। দু’দিন বাদেই পাঠকদের বিস্মিত করে বের হল বেঙ্গল গেজেট এবং তার পৃষ্ঠায় তখনও সম্পাদকের বলদৃপ্ত ঘোষণা: এই সব অত্যাচারীর দল যদি আমাকে আমার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে জেলে পুরে রাখে, তা হলেও আমি চিরকালের মতো চালিয়ে যাব আমার কাগজ।

কথা রাখলেন হিকি। জেলখানা থেকেই ছাপিয়ে গেলেন তাঁর কাগজ, এক মেজাজে। পরের বছর (১৮০২) জানুয়ারিতে হেস্টিংস ফিরে এলেন কলকাতায়। এবং অনিবার্য ফল হিসাবে শুরু হল হিকির বিচার। হেস্টিংসের প্রথম মোকদ্দমায় রায় হল এক বছর কারাদণ্ড এবং দু’ হাজার টাকা জরিমানা। আর দ্বিতীয় মোকদ্দমায় ৫০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ। হেস্টিংস দয়া দেখালেন। জরিমানা এবং ক্ষতিপূরণের টাকা তিনি মুকুব করে দিলেন। হাত দিলেন না হিকির ছাপাখানায়। জেল থেকেই হিকি ধন্যবাদ জানালেন তাঁকে তাঁর এই উদারতার জন্য। হিকির জেলবাসে আপত্তি নেই। কিন্তু কাগজ বন্ধ হয়ে গেলে কী নিয়ে বাঁচবেন তিনি? তাই জেল থেকেই লিখলেন, ‘By protecting the types they have protected the liberty of the press.’

কিন্তু শুধু স্বাধীনতায় কাগজ বাঁচে না। তাই ১৮০২ সালে একদিন বন্ধ হয়ে গেল বেঙ্গল গেজেট। হিকি তখনও জেলে। তার পর ছাড়া পেয়ে দেখেন এবার নিজেকে বাঁচানোই দায় তাঁর পক্ষে। চারদিকে ঋণ আর ঋণ। বিরাট পরিবার। চিরস্থায়ী অভাব। কী উপায় করবেন তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের রক্ষা করতে?

অবশ্য উপায় তাঁর ছিল না এমন নয়, কিন্তু ক্ষমতা বড় নির্মম। তারা সহজে প্রতিশোধের সুযোগ ছাড়তে চায় না। আগেই বলেছি, কাগজ বার করার আগে হিকি সরকারি কাজ করেছিলেন। অনেক টাকা প্রাপ্য সরকারের কাছে। প্রায় ৩৫,০৯২ টাকা। কলকাতায় তিনিই প্রথম মুদ্রাকর। তাঁর ছাপাখানাই উত্তর-পূর্ব ও উত্তর এবং মধ্য ভারতে প্রথম ছাপাখানা। হিকি সরকারি তহবিল থেকে তাঁর প্রাপ্য সে টাকার সঙ্গে জুড়লেন শতকরা বার্ষিক ৮ টাকা হারে দু-তিন বছরের সুদ। মোট অঙ্ক দাঁড়াল ৪৩,৫১৪ টাকা ১ আনা ৩ পাই। অনেক টাকা। স্বচ্ছন্দে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারেন তিনি। চাই কী, কাগজও বার করতে পারেন আবার।

কিন্তু কোম্পানির কর্তৃপক্ষ সেটা জানতেন। তাই শুরু হল গড়িমসি। চিঠির পর চিঠি লিখছেন হিকি। এমনি করে চলে গেল দীর্ঘ ষোল বছর। কোম্পানি অবশেষে সম্মত হল। ‘দিচ্ছি তোমায়’, কর্তৃপক্ষ জানালেন তাঁকে। ‘তবে এত টাকা কে দেবে? আমরা মঞ্জুর করেছি তোমার নামে মোট ৬,৭১১ টাকা।’

‘কোন হিসেবে?’ খেপে গেলেন হিকি। এই আমার হিসাব, এই তার ভাউচার, এই এই বাবদ কোম্পানির কাছে আমার আইনসম্মত প্রাপ্য টাকা। ন্যায্য পাওনা কেন দেবে না? ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৭৯৪ সালের চিঠিতে তিনি কোম্পানির কাছে ব্যাখ্যা চাইলেন তাদের ব্যবহারের। কিন্তু হায় অভাবের কী করাল গ্রাস। ঠিক দু’দিন বাদেই আবার লিখলেন তিনি (২৭ ফেব্রুয়ারি) ‘দাও টাকা, ও টাকাই নেব আমি। অনুগ্রহ করে, আজই দাও।’

পরের দিন কম্পিত হাতে ন্যায্য সময়ের ষোল বছর পরে, প্রাপ্য টাকার এক সামান্য ভগ্নাংশ হাতে পেয়েই তিনি লিখে দিতে বাধ্য হলেন, ‘সাকুল্য প্রাপ্য বুঝে পেলাম।’ সুতরাং সহজেই বুঝতে পারা যায়, শাসকবর্গ তখনও ক্ষমা করেননি তাঁকে। তখনও বেচারার উপর চলেছে তাঁদের প্রতিশোধ।

এর পর হিকিকে আমরা দেখতে পাই আরও ক’বছর পরে। ১৭৯৭ সালে। একটি অসহায় পরিবারের কর্তারূপে ভূতপূর্ব সাংবাদিক চিঠি লিখছেন তখন বিলেতে। ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে। ‘আমার শিশু সন্তানদের রক্ষা করুন। বাজার-তদারকের কাজ অন্তত একটা জুটিয়ে দিন আপনি আমায়, নয়তো কোনও দেশমুখী জাহাজের সার্জেনের কাজ। নিদেন পক্ষে স্বদেশের মাটিতে মরতে পারব তাহলে।’ ইত্যাদি।

বলা বাহুল্য, এ চিঠির কোনও উত্তর আসেনি। তারপর, তিন বছর পরে আবার লিখছেন তিনি হেস্টিংসকে। ‘বিষয়-আশয় যা ছিল, সব চলে গেছে। এবার একমাত্র ভরসা ঈশ্বর, ভরসা আপনি।’

উত্তর এল না এ চিঠিরও। অবশেষে তিন বছরের মধ্যেই (১৮০২) এক অমোঘ পরিণতির মতো চোখ বুজলেন হিকি। জেমস অগস্টাস হিকি। হিকি দ্য প্রিন্টার, পাপা অভ দ্য প্রেস। কলকাতার প্রথম সাংবাদিক। কলকাতা থেকে দূর চিনের পথে ‘আজেক্স’ নামক জাহাজে ১৮০২ সালের ডিসেম্বরে মারা যান ডাঃ জে অ্যা হিকি। জাহাজে ফের তিনি ডাক্তার, চিকিৎসক। মৃত্যুর পর তাঁর বিষয়আশয় নিলামে তোলা হয় কলকাতায়। বিক্রির তালিকায় ছিল আজকের ওয়েলেসলি, তৎকালের কলিঙ্গ এলাকায় একটি বাড়ি, কয়েকটি জমি, একটি সোনার ঘড়ি, কিছু বইপত্র ও ডাক্তারি সরঞ্জাম। আর ছিল ব্যবহারের অযোগ্য একটি ভাঙা ছাপাখানা, ৫৪০ পাউন্ড টাইপ, আর ছাপার কাজে ব্যবহৃত কিছু টুকিটাকি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *