০৯. সোনার আংটি

৯. সোনার আংটি

মহাকাশের আগন্তুক টুকুনজিল সত্যি আছে, সে সুদূর এন্ড্রোমিড়া নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে পৃথিবীতে এসেছে, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা পাগলের মতো তাকে খুঁজছে, সারা পৃথিবীর মাঝে শুধু আমি জানি সে সত্যি আছে এবং কোথায় আছে। শুধু আমার সাথে তাঁর যোগাযোেগ হয়েছে, শুধু আমি জানি সে দেখতে কেমন। সে কথা আমি কাউকে বলতে পারছি না, ডাক্তার চাচাকে বলেছিলাম, তিনি বিশ্বাস তো করেনই নি, উল্টো ধরে নিয়েছেন আমিও আমার বাবার মতো পাগল! একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, কারণ যতক্ষণ টুকুনজিল তার মহাকাশযান ঠিক করতে না পারছে ততক্ষণ সে চায় না অন্য কেউ জানুক সে কোথায় আছে। আমাকে তাই বলেছে, সারা পৃথিবীর মাঝে আমি তার একমাত্র বন্ধু, আমি যদি তার কথা না শুনি কে শুনবে? কাজেই আমার পেটের মাঝে এত বড় খবরটা ভুটভুট করতে থাকে, কিন্তু আমি বের করতে পারছি না।

টুকুনজিল এক টুকরা সোনা বা প্রাটিনামের জন্যে একেবারে জান দিয়ে ফেলছে। সকালে উঠে ঠিক করলাম আজ তাকে সেটা জোগাড় করে দেব। প্লাটিনাম কোথায় পাব আমি, তবে সোনা হয়তো পাওয়া যেতে পারে। ছোট খালার শরীর-ভরা গয়না, হাতে কয়েকটা আংটি, কানে দুল, হাতে চুড়ি। কোনো-একটা কি আর কিছুক্ষণের জনে সরিয়ে নেয়া যাবে না? টুকুনজিল নেবে মাত্র ছয় দশমিক তিন মিলিগ্রাম সোনা, ছোট খালা জানতেও পারবেন না।

সকালে নাস্তা করার সময় দেখতে পেলাম ছোট খালার আঙুলে আংটিগুলো নেই, তার মানে নিশ্চয় খুলে রেখেছেন। খুলে রাখার জায়গা খুব বেশি নেই, হয় শোয়ার ঘরে, ড্রেসিং টেবিলের উপরে, নাহয় লাগানো বাথরুমে। আমি ব্যবহার করি বল্টু আর সীমার বাথরুম, কাজেই কোনোরকম সন্দেহ সৃষ্টি না করে শোওয়ার ঘরে বাথরুমে যাওয়া সহজ নয়। তবে কপাল ভালো থাকলে হয়তো বাথরুম পর্যন্ত যেতে হবে না, ড্রেসিং টেবিলের উপরেই পাওয়া যাবে। কিন্তু সে জন্যে আমাকে শোওয়ার ঘরে যেতে হবে। কী ভাবে যাওয়া যায়?

ছোট খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ছোট খালা, আজকের পেপার কি এসেছে?

এসেছে নিশ্চয়ই। কেন?

আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে বলেছে তার চাচার একটা খবর উঠবে আজকে। সরল মুখ করে একটা নির্দোষ মিথ্যা কথা বললাম।

কী খবর?

অবিরাম সাইকেল চালনা। ছিয়াত্তর ঘন্টা নাকি হয়েছে। মিথ্যা কথা বলার এই হচ্ছে সমস্যা, একটা বললে শেষ হয় না; সেটাকে সামলে নেবার জন্যে একটানা মিথ্যা বলে যেতে হয়।

কোথায় সাইকেল চালাচ্ছে?

নরসিংদি। ছোট খালুর কি পড়া শেষ হয়েছে খবরের কাগজ?

জানি না, দেখ গিয়ে।

সাথে সাথে আমি শোওয়ার ঘরে ঢুকে গেলাম, ছোট খালু নিশ্চয়ই বাথরুমে, ঘরঘর শব্দ করে গলা পরিষ্কার করছেন। বিছানার উপর খবরের কাগজটা পড়ে আছে, সেটা তুলে নেবার আগে ড্রেসিং টেবিলের উপর তাকালাম, কী কপাল! সত্যি সত্যি ছোট খালার সোনার আংটি দুইটা। চট করে একটা তুলে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম, আগে এরকম বড় জিনিস কখনো চুরি করি নি, বুকটা ধকধক্ করে শব্দ করতে থাকল।

খাবার টেবিলে বসে মিছেই খবরের কাগজটা দেখার ভান করতে থাকলাম। বল্টু জিজ্ঞেস করল, উঠেছে খবরটা?

নাহ্‌।

আমি তখনই বুঝেছিলাম গুলপট্টি। তিন দিন কোনো মানুষ একটানা সাইকেল চালাতে পারে? পিশাব-পাইখানা?

আমার ঘরে এসে আমি ফিসফিস করে ডাকলাম, টুকুনজিল—

সোনা এনেছ?

হ্যাঁ। চুরি করে এনেছি, ধরা পড়লে একেবারে জান শেষ হয়ে যাবে।

জান শেষ হয়ে যাবে? মেরে ফেলবে তোমাকে? হৃৎস্পন্দন থেমে রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাবে? স্নায়ু—

ওটা একটা কথার কথা। জান শেষ হবে মানে মহা বিপদ। এই আংটিটা আমি ঘুলঘুলির উপর লুকিয়ে রাখি। তুমি যেটুকু ব্যবহার করতে চাও ব্যবহার কর, তারপর ফিরিয়ে দিতে হবে ধরা পড়ার আগে।

ফিরিয়ে দিতে হবে কেন?

সোনার আংটি ফিরিয়ে দিতে হবে না? কতক্ষণ লাগবে তোমার?

তিন ঘন্টা তেত্রিশ মিনিট বারো সেকেন্ড।

এতক্ষণ লাগবে? খামচি মেরে একটু সোনা নিয়ে আংটিটা ফেরত দিতে পারবে না?

না। আমার মহাকাশযানের বৈদ্যুতিক যোগাযোগে অনেক বড় সমস্যা। এই জন্যে স্বর্ণ প্রয়োজন। বৈদ্যুতিক সুপরিবাহী মৌলিক পদার্থ। তিন ঘন্টা তেত্রিশ মিনিট বারো সেকেন্ড।

বল্ট বাইরে থেকে ডাকে, বিল, ড্রাইভার এসে গেছে।

আমি চেয়ারে পা দিয়ে ঘুলঘুলির উপর সোনার আংটিটা রেখে বের হয়ে এলাম।

গাড়িতে ওঠার সময় শুনলাম ছোট খালা বলছেন, ড্রেসিং টেবিলের উপর আংটিটা রেখেছিলাম, কোথায় গেল?

আমি না শোনার ভান করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। মনে হয় আমার কপালে বড় দুঃখ আছে আজ।

 

বল্টু আর মিলিকে স্কুলে নামিয়ে দেবার পর ড্রাইভার আমাকে আমার স্কুলে নামিয়ে দেয়। আজকাল প্রায়ই আমি বল্টুর স্কুলে নেমে পড়ি, সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে আমার স্কুলে আসি। ড্রাইভার বেশ খুশি হয়েই আমাকে নামিয়ে দেয়, সকালের ভিড় ঠেলে গাড়ি চালাতে আরও বেশি ভালো লাগে না মনে হয়। তা ছাড়া আমাকে নামিয়ে দিয়ে সে রাস্তা থেকে কিছু লোক তুলে একটা খেপ দিয়ে কিছু বাড়তি পয়সা বানিয়ে নেয়। হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে আমার বেশ লাগে। কত রকম মানুষজন, কত রকম দোকানপাট দেখা যায়।

স্কুলে যাবার সময় কয়দিন থেকে আমার একটা আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছে। শুধু মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। টুকুনজিলের সাথে ভাব হবার পর আজকাল অবশ্যি আর কিছুতেই বেশি অবাক হই না। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে মহাকাশের এক আগন্তুক এই পৃথিবীতে এসে শুধু আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, জিনিসটা চিন্তা করতেই আমার বুকের ভিতর কেমন জানি শিরশির করতে থাকে। ইস! কাউকে যদি বলা যেত, কী মজাটাই-না হত!

কিন্তু এই অনুসরণের ব্যাপারটা অন্যরকম। সাদা রঙের একটা মাইক্রোবাস আমি প্রায়ই দেখি। ড্রাইভারের পাশে একজন লাল রঙের বিদেশি বসে থাকে। আমার কেন জানি মনে হয় মাইক্রোবাসটা আমার পিছু পিছু যেতে থাকে। হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমি যদি পিছনে ঘুরে তাকাই, মনে হয় মাইক্রোবাসটা থেমে যায় আর লাল রঙের মানুষটা চট করে আমার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। আমি কেমন জানি নিঃসন্দেহ হয়ে যাই যে টুকুনজিলের সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে, কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে কী করা যায় সেটা শুধু বুঝতে পারছিলাম না।

ক্লাসে এসে দেখি দেয়ালে একটা নূতন দেয়াল পত্রিকা লাগানো হয়েছে। বিশেষ মহাকাশের প্রাণীসংখ্যা। বড় বড় করে লেখা “সম্পাদক ও মুস্তাফিজুর রহমান লিটন।” সেখানে মহাকাশের প্রাণী সম্পর্কে ভয়াবহ সমস্ত তথ্য দেয়া হয়েছে। বিদেশি ম্যাগাজিন থেকে মহাকাশের প্রাণীর কাল্পনিক ছবি কেটে লাগানো হয়েছে, সেইসব ছবি দেখলে পিলে চমকে যায়। একটা প্রাণীর তিনটে চোখ, আরেকটা প্রাণীর লকলকে লাল জিব, একজন মানুষকে ধরে চিবিয়ে খাচ্ছে, আরেকটা মাকড়সার মতো দুইটা পা দিয়ে ভয়ানক একটা অস্ত্র ধরে রেখেছে। সেখানেই শেষ হয় নি, মহাকাশের প্রাণী পৃথিবীতে এসে কীরকম ভয়ানক তাণ্ডবলীলা শুরু করবে, সেটার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে। সেই প্রাণী থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে কি কি সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে, সেটাও লিটন অনেক খেটেখুটে লিখেছে।

স্যার ক্লাসে এসে দেয়াল পত্রিকা দেখে চুপ মেরে গেলেন। লিটন খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে, স্যার?

স্যার অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ভালো হয়েছে।

আমেরিকায় তয়ের একটি পত্রিকা বের হয়, সেখান থেকে ছবিগুলো নিয়েছি।

বেশ বেশ।

সম্পাদকীয়টা পড়েছেন, স্যার?

পড়েছি।

কেমন হয়েছে, স্যার?

ভালোই হয়েছে–তবে তুই ধরে নিয়েছিস মহাকাশের প্রাণী হবে খুব ভয়ঙ্কর। সেটা তো না-ও হতে পারে।

কিন্তু স্যার, আমি একটা সিনেমা দেখেছি, সেখানে দেখিয়েছে—

ধুর। সিনেমা তো সবসময়ে গাঁজাখুরি হয়।

 

স্যার ক্লাসে পড়ানো শুরু করলেন। পড়াতে পড়াতে হঠাৎ থেমে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা সবাই আর্কিমিডিসের সূত্র জানিস?

দেখা গেল সবাই জানে না। স্যার তখন বেশ সময় নিয়ে আমাদের আর্কিমিডিসের সূত্রটা বুঝিয়ে দিলেন। আর্কিমিডিস প্রথম যখন সূত্রটা ভেবে বের করেছিলেন, তখন যে ন্যাংটো হয়ে রাস্তায় ছুটতে শুরু করেছিলেন, সেই গল্পটাও বললেন। গল্পটা আগেই জানতাম, কিন্তু ন্যাংটো হয়ে গোসল করার দরকারটা কী ছিল, সেটা কখনোই আমি বুঝতে পারি নি।

আর্কিমিডিসের সূত্রটা বুঝিয়ে দিয়ে স্যার বললেন, এবার তাহলে তোদর একটা প্রশ্ন করি, তোরা তার ঠিক উত্তর ভেবে বের করতে পারিস কি না দেখি। এক সপ্তাহ সময় দেব। একটা বড় চৌবাচ্চার মাঝে একটা নৌকা ভাসছে, সেই নৌকায় তুই বসে আছিস। নৌকায় তোর সাথে আছে একটা বড় পাথর। চৌবাচ্চাটা একেবারে কানায় কানায় ভরা। এখন তুই পাথরটা নৌকা থেকে তুলে চৌবাচ্চার মাঝে ছেড়ে দিলি। পানি কি চৌবাচ্চা থেকে উপচে পড়বে? একই থাকবে? নাকি পানির লেভেল একটু কমে যাবে?

স্যার একটু হেসে বললেন, যদি উত্তরটা ভেবে বের করতে না পারিস, মনখারাপ করিস না, অনেক বাঘা-বাঘা প্রফেসরও পারে নি।

উত্তরটা ভেবে বের করার জন্যে স্যার এক সপ্তাহ সময় দিয়েছেন, কিন্তু আমি ভুখন তখনই ভুরু কুঁচকে ভাবতে শুরু করলাম। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে ভাবতে আমার খুব ভালো লাগে। স্যার ক্লাসে আবার পড়ানো শুরু করেছেন, কিন্তু আমি আর মন দিতে পারছি না। ঘুরেফিরে শুধু মনে পড়ছে একটা ভরা চৌবাচ্চায় একটা নৌকা—নৌকার মাঝে আমি বসে আছি পাথরটা নিয়ে।

উত্তরটা কি হবে আমি প্রায় সাথে সাথেই বের করে ফেললাম। আর্কিমিডিস যখন তাঁর সূত্র বের করেছিলেন তখন তার যেরকম আনন্দ হয়েছিল, আমার প্রায় ঠিক সেরকম আনন্দ হল, লাফিয়ে উঠে হাত তুলে বললাম, আমি বলব স্যার, আমি বলব–

স্যার অবাক হয়ে বললেন, কি বলবি?

চৌবাচ্চার পানির লেভেল বাড়বে না, কমবে–

স্যার চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন, তুই উত্তরটা বের করে ফেলেছিস!

জ্বি স্যার আমি উত্তেজনায় ঠিক করে কথা বলতে পারছিলাম না, হড়বড় করে কোনোমতে উত্তরটা বললাম।

স্যার অবাক হয়ে আমার উত্তরটা শুনলেন, তার মুখে একটা আশ্চর্য হাসি ফুটে উঠল, তারপর হেঁটে এসে আমার পিঠে থাবা দিয়ে বললেন, ভেরি গুড। ভেরি ভেরি গুঙ। ভেরি ভেরি ভেরি গুড। আমার একজন প্রফেসর বন্ধু আছে, কলেজে ফিজিক্স পড়ায়, সেও পর্যন্ত এর ঠিক উত্তর দিতে পারে নি। তাই দিয়ে দিলি—

খুশিতে আমার চোখে একেবারে পানি এসে গেল। স্যার বললেন, বিলু, আজ থেকে তুই হলি ক্লাস ক্যাপ্টেন। আমি লিটনের দিকে তাকালাম, তার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা, মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। হিংসে কার না হয়? সবারই হয়, কিন্তু সেটা চেহারায় প্রকাশ করে সবাইকে জানিয়ে দেয়াটা তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। লিটন ক্লাসের ফার্স্ট বয় এবং ক্লাস ক্যাপ্টেন। সে দেয়াল পত্রিকার সম্পাদক এবং ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন। সবকিছুতেই সে আছে, ফাস্ট বয়রা যেটা খুশি সেটা করতে পারে। কিন্তু আজ তার ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্বটা নিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে আমাকে, ক্লাসে সবার সামনে, আনন্দে আমার বুকটা ভরে গেল। কিন্তু আমি লিটনের মতো এত বোকা নই, তাই মহানুভব মানুষের মতো বললাম, স্যার, আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন হতে চাই না, স্যার।

কেন?

ক্লাস ক্যাপ্টেনদের সবার উপর সর্দারি করতে হয় বলে কেউ তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না।

সর্দারি?

জ্বি স্যার, ক্লাসে দুষ্টুমি করলে নাম লিখে স্যারদের কাছে নালিশ করতে হয় খু্–খারাপ কাজ স্যার।

স্যার মনে হয় খুব অবাক হলেন শুনে, ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, বিলু কি ঠিক বলছে?

সবাই মাথা নাড়ল, ঠিক স্যার, একেবারে ঠিক।

আমি বললাম, স্যার, নিয়ম করে দেন একেক সপ্তাহে একেকজন ক্লাস ক্যাপ্টেন হবে। তাহলে ক্যাপ্টেন আর মিছেমিছি নাম লিখবে না, কারণ যার নাম মিছেমিছি লিখবে, সে যখন ক্যাপ্টেন হবে সে শোধ নেবে—

মিছেমিছি? মিছেমিছি কি নাম লেখা হয়?

সবসময় হয় না স্যার, মাঝে মাঝে হয়। কারো কারো নাম বেশি লেখা হয়, কারো কারো নাম কম লেখা হয়–

সত্যি?

পুরো ক্লাস আবার মাথা নাড়ল, লিটন ছাড়া। সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্যার খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্লাসের মাঝখানে, তারপর বললেন, ঠিক আছে আজ থেকে তাই নিয়ম। একেক সপ্তাহে একেকজন ক্লাস ক্যাপ্টেন।

ক্লাসের সবাই একটা আনন্দের মতো শব্দ করল। আমার বুকটা মনে হল দশ হাত ফুলে গেল সাথে সাথে।

ঘন্টা পড়ার পর স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে যাবার পর ভেবেছিলাম লিটন চোখ লাল করে আমার কাছে ছুটে আসবে। কিন্তু সে মুখ গোঁজ করে নিজের জায়গায় বসে রইল। তারিক আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, তুই মহা ফিঞ্চুরাস মানুষ।

ফিঞ্চুরাস? সেটা মানে কি?

যার মাথায় ফিচলে বুদ্ধি এবং যে হচ্ছে ডেঞ্জারাস, সে হচ্ছে ফিঞ্চল্লাস। কী সুন্দর লিটনের মাথাটা ক্লাসের সামনে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলি।

পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলাম?

হ্যাঁ, যখন চৌবাচ্চার উত্তরটা দিলি, মনে হল হিংসায় লিটনের একেবারে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।

তারিককে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খুব খুশি দেখা গেল। গলা নামিয়ে বলল, আমাদের ব্ল্যাক মার্ডার দলের মেম্বার হবি?

কী করতে হবে?

আঙুল থেকে এক ফোঁটা রক্ত দিয়ে রক্ত শপথ করতে হবে।

ঠিক আছে। কখন?

পরশুদিন ব্ল্যাক মার্ডারের মিটিং কোথায়?

স্কুলে।

স্কুলে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পরশুদিন ছুটি না?

তারিক গম্ভীর হয়ে হাসে। সার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, মিটিং করার জন্যে ক্লাসঘর খুলে দেয় কালীপদ। স্যার আর কালীপদ তাই আমাদের ব্ল্যাক মার্ডার দলের বিশেষ সদস্য।

শুনে আমি চমৎকৃত হলাম।

দুপুরে সুব্রত জানাল, তার কাছে “চকিত হিয়া” নামে একটা বড়দের উপন্যাস আছে, আমি পড়তে চাইলে নিতে পারি। বড়দের উপন্যাস পড়তে আমার খুব ভালো লাগে, খুশি হয়ে নিলাম আমি। নান্টু জিজ্ঞেস করল, তার জুপিটার ফুটবল ক্লাবে সেন্টার ফরোয়ার্ডের একটা জায়গা খালি আছে, আমি খেলতে চাই কি না—আমি খুব খুশি হয়ে রাজি হলাম। মাহবুব জিজ্ঞেস করল, সে একটা টেলিস্কোপ তৈরি করছে, আমি তার সাথে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে চাই কি না। আমি আগে কখনো গবেষণা করি নি, কিন্তু মাহবুব যদি করতে পারে আমিও নিশ্চয়ই পারব, তাই রাজি হয়ে গেলাম। মোট কথা, হঠাৎ করে ক্লাসে আমার অনেক বন্ধু হয়ে গেল।