০৬. অবাক পোকা

৬. অবাক পোকা

সেদিন আমাদের স্কুল ছুটি। ছোট খালা বল্টু আর মিলিকে নিয়ে বর এক বন্ধুর জন্মদিনে বেড়াতে গিয়েছেন। আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এসব জায়গায় আজকাল আর আমার যাওয়ার ইচ্ছা করে না। কাউকে চিনি না, কিছু না যাওয়ার পর বল্ট প্রথমেই সবাইকে ডেকে বলবে, এই যে এ হচ্ছে বিলু। এর বাবা পাগল, তাই গ্রাম থেকে আমাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে এসেছে।

তখন সবসময়েই কেউ-না-কেউ জানতে চায় আমার বাবা কেমন করে পাগল হলেন, কী রকম পাগলামি করেন, বেঁধে রাখতে হয় কি না, এইসব। আমার খুব খারাপ লাগে। আমি যেতে চাই না শুনে ছোট খালা বেশি জোর করলেন না, বল্টু আর মিলিকে নিয়ে চলে গেলেন। ছোট খালু সকালেই কী-একটা কাজে বের হয়ে গেছেন, তাই বাসায় থাকলাম আমি একা আর বাসার কাজের ছেলেটা।

আমি প্রথমে টেলিভিশনটা চালিয়ে দেখলাম, সেখানে কিছু নেই, তাই রেডিওটা চালিয়ে দেখলাম সেখানে যন্ত্রসংগীত হচ্ছে, আমার যন্ত্রসংগীত একেবারেই ভালো লাগে না, তাই রেডিওটা বন্ধ করে দিচ্ছিলাম, কিন্তু ঠিক তখন খবর শুরু হল। প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে কী রকম যুদ্ধ-বিগ্রহ হচ্ছে সেটা বলে খুব একটা আশ্চর্য খবর বলল। গত কয়েক দিন থেকে নাকি পৃথিবীর সব মানমন্দিরে আশ্চর্য এবং রহস্যময় কিছু সংকেত ধরা পড়ছে। সংকেতগুলো থেকে মনে হয় রহস্যময় কোনো-এক মহাকাশযান পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। রাডার বা মহাকাশের টেলিস্কোপ দিয়ে সেটাকে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু দেখা সম্ভব হয় নি। দুদিন আগে সেই রহস্যময় সংকেতু হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, সেই মহাকাশযান পৃথিবীর কোনো নির্জন এলাকায় নেমেছে কিংবা নামার চেষ্টা করে ধ্বংস হয়ে গেছে।

খবরটা সত্যি বলছে নাকি ঠাট্টা করে বলছে, বুঝতে পারলাম না। খবরে তো আজগুবি জিনিস বলার কথা নয়। আজকাল অবশ্যি কিছুই বলা যায় না, সেদিন একটা পত্রিকায় দেখেছি কে নাকি চোখের দৃষ্টি দিয়ে আকাশের মেঘকে দুই ভাগ করে ফেলে। আরেক জায়গায় দেখেছি কে নাকি যোগ সাধনা করে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। কে জানে এটাও হয়তো সেরকম কিছু হবে। আমি রেডিওটা বন্ধ করে আমার ঘরে গেলাম। স্টোররুমের জিনিসপত্র সরিয়ে সেখানে আমার জন্যে একটা বিছানা পেতে দেওয়া হয়েছে। ঘরটা ভালোই, একটা ছোট জানালা দিয়ে খানিকটা আকাশ দেখা যায়। আমি এখানে রাতে ঘুমাই, কিন্তু পড়তে বসি বল্টু আর মিলির সাথে এক টেবিলে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রথমে আমি মাকে একটা চিঠি লিখলাম। বাবাকেও একটা লিখব ভেবে অনেকক্ষণ কাগজ-কলম নিয়ে বসে রইলাম, কিন্তু কী লিখব ঠিক বুঝতে পারলাম না। তার পাঠানো দাঁড়কাকটা এসেছিল, একটা কুকী বিস্কুট খেতে দিয়েছি, আমার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করেছে—এসব তো আর চিঠিতে লিখতে পারি না। বাবার কথা মনে পড়ে খানিকক্ষণ আমার মন খারাপ হয়ে থাকল, তখন ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা হাতে নিয়ে আমি ছাদে উঠে গেলাম। ম্যাগনিফাইং গ্লাসের আরো একটা জিনিস এতদিনে আবিষ্কার করেছি, চোখ থেকে একটু দূরে ধরে রেখে আব্লো দূরের কোনো জিনিসের দিকে তাকালে সেটাকে সব সময় উল্টো দেখায়। ছাদে বসে রাস্তাঘাট বাড়িঘর সব মানুষকে উল্টো করে দেখতে বেশ মজাই লাগে আমার।

অনেকক্ষণ ছাদে বসে কাটালাম আমি। ছাদের রেলিং দিয়ে একটা পিঁপড়ার সারি চলে গেছে, খুব বস্তি হয়ে কোথায় জানি যাচ্ছে সবগুলো পিঁপড়া। কে জানে পিঁপড়ার কোনো ভাষা আছে কি না বাবাকে জিজ্ঞেস করলে সবসময় বলবেন, আছে। কিন্তু আসলেই কি আছে? আমি ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দিয়ে রোদটাকে একবিন্দুতে একত্র করে গোটা দশেক পিঁপড়াকে পুড়িয়ে মেরে ফেললাম, সাথে সাথে পুরো সারিটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আবার কিছু মারব কি না ভাবছিলাম, তখন বাবার কথা মনে পড়ল। বাবা দেখলে খুব রাগ করতেন, মশা পর্যন্ত মারেন না বাবা। ধরে ধরে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে মশারির বাইরে ছেড়ে দেন।

খামোকা আর কোনো পিঁপড়াকে না মেরে আমি দেখতে শুরু করলাম সারিটা, কোথায় যাচ্ছে, রেলিং বেয়ে একবার নিচে নেমে আবার উপরে উঠে এল, একটা ফুটো দিয়ে একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে আবার রেলিঙের উপরে উঠে এল। পিঁপড়াগুলো সারি বেঁধে এসে এক জায়গায় গোল হয়ে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। বৃত্তের ঠিক মাঝখানে ছোট কালো মতন একটা পোকা, সেটা পিঁপড়া থেকেও ছোট। পিঁপড়াকে আমি আগেও মরা ঘাসফড়িং বা তেলাপোকা টেনে টেনে নিয়ে যেতে দেখেছি, কিন্তু এত ছোট পোকাকে এভাবে ঘিরে থাকতে দেখি নি। পোকাটাকে ধরতে যাচ্ছেনা কেন বুঝতে পারলাম না। যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে মাঝখানের ছোট পোকাটা খুজলির মলম বিক্রি করার চেষ্টা করছে আর সবগুলো পিঁপড়া গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে।

আমি ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দিয়ে পোকাটা দেখার চেষ্টা করলাম, খুবই ছোট পোকা, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়েও সেটাকে খুব ভালো দেখা গেল না। ভালো করে দেখে মনে হল এটা ঠিক পোকা নয়, ছোট গাড়ি কিংবা ট্যাঙ্ক কিংবা পেন। কিংবা যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি কোনো-একটা জিনিস। আমি আগেও লক্ষ করেছি, খুব সাধারণ জিনিসকেও ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখতে খুব বিচিত্র দেখায়। আমি আরো ভালো করে পোকাটা দেখার চেষ্টা করলাম, আর তখন হঠাৎ মনে হল সেটার একটা দরজা খুলে গেল, আর ভিতর থেকে আরো ছোট একটা কিছু বের হয়ে এল। সেটি এদিকসেদিক তাকিয়ে একটা গুড় উপরে তুলে কী করল, আর সাথে সাথে একটা পিঁপড়া এগিয়ে এল তার দিকে। পরিষ্কার মনে হল কিছু কথাবার্তা হল পিঁপড়াটার সাথে, তারপর সেই ছোট জিনিসটা ভিতরে ঢুকে গেল, তার আর কোনো চিহ্ন নাই।

আমি হাঁটু গেড়ে বসে আরো ভালো করে পোকাটা দেখার চেষ্টা করলাম। যতই দেখি জিনিসটাকে ততই যন্ত্রপাতির মতো মনে হয়। অত্যন্ত ছোট কিন্তু অত্যন্ত জটিল একটা যন্ত্র। মনে হচ্ছে উপর থেকে কিছু তামার নল বের হয়ে এসেছে, নিচে দিয়ে মনে হল একটু লাল রঙের আলো বের হচ্ছে। পিছন দিয়ে স্পিঙের মতো ধাতব একটা জিনিস। কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দেখব কি না ভাবছিলাম, তখন হঠাৎ মনে হল যে এটাকে আমার ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে কড়া একটা ছ্যাকা দিয়ে দেখি!

আমি ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা ধরে সূর্যের আলোকে একবিন্দুতে একত্র করে ছোট পোকাটার মাঝে আগুন ধরানোর চেষ্টা করলাম, আর কী আশ্চর্য, হঠাৎ মনে হল জিনিসটা থেকে একঝলক নীল আলো বের হয়ে এল, পিঁপড়াগুলো হঠাৎ ছত্রভঙ্গ হয়ে ছোটাছুটি আরম্ভ করে দিল। আমি আবার ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম, মনে হল আবার ছোট একটা দরজা খুলে গেল, আর ভিতর থেকে আরো ছোট কী-একটা বের হয়ে শুড় উঁচু করে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ ঝিঁঝি পোকার ডাকের মতো শব্দ শুনতে পেলাম, তার মাঝে পরিষ্কার গলায় কে জানি বলল, না–না—গরম দিও না।

আমি ভীষণ চমকে আশেপাশে তাকালাম। কে বলল কথাটা? কেউ তো নেই ছাদে। আবার আমি তাকালাম ভালো করে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দিয়ে। ছোট পোকাটি যেটি শুড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাকে মনে হল খুব ছোট একটা মানুষের মতো। মনে হল তার বড় একটা মাথা, এমন কি দুটি চোখও আছে। যেটাকে শুড় ভাবছি সেটা শুড় হতে পারে, হাতও হতে পারে। আমি আরো ভালো করে দেখার জন্যে কাছে এগিয়ে যেতেই জিনিসটা আবার নড়ে উঠল, ঝিঁঝি পোকার মতো একটা শব্দ হল তার মাঝে আমি পরিস্কার শুনতে পেলাম, না, না, কাছে এসো না।

আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাবার মতো আমিও কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? পোকামাকড়ের কথা শুনতে পাচ্ছি? কী সর্বনাশ।

খানিকক্ষণ আমি ছাদে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বিচিত্র পোকাটাকে একটা রাম-থাবড়া দিয়ে চ্যাপ্টা করে ফেলৰ কি না ভাবলাম একবার। কিন্তু করলাম না, নিচে থেকে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি নিয়ে এলাম। পোকাটাকে ঘিরে পিঁপড়াগুলো এখনো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তবে মনে হল তাদের মাঝে উত্তেজনা অনেক বেড়েছে। আমি একটা কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে জিনিসটাকে শিশির ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করলাম। ব্যাপারটা সোজা নয়, মনে হল সেটা থেকে কিছু আগুনের ফুলকি বের হয়ে এল। আর তার থেকেও বিচিত্র ব্যাপার, কে জানি বলল, ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও আমাকে।

আমি ছেড়ে দিলাম না, সেই বিচিত্র পোকাটিকে হোমিওপ্যার্থিক শিশির মাঝে ভরে ফেললাম।

পোকাটির কথা কাউকে বলার ইচ্ছা করছিল। প্রথমে বল্টুকে বলার চেষ্টা করলাম, বললাম, ছাদে একটা পোকা দেখেছি আমি। দেখলে অবাক হয়ে যাবে।

কেন?

পোকাটা কথা বলে—বলতে গিয়ে থেমে গেলাম আমি, বাবার কথা মনে পড়ল হঠাৎ।

বললাম, নিচে দিয়ে আগুন বের হয়। ও।

এটার নাম জোনাকি পোকা।

না, জোনাকি পোকা না, জোনাকি পোকা আমি চিনি। জোনাকি পোকা থেকে অনেক ছোট।

জোনাকি পোকার বাচ্চা।

কাছে মিলি দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, ইয়াক থুঃ, পোকা। ছিঃ ছিঃ।

কাজেই আলাপ বেশি দূর এগুতে পারল না। দুলাল থাকলে হত। বিচিত্র ব্যাপারে তার খুব উৎসাহ। দুই মাথাওয়ালা বাছুর হয়েছে শুনলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে সে দশ মাইল হেঁটে দেখতে যায়। বাবা থাকলেও হত, পোকামাকড়ের কথা এমনিতেই শুনতে পান, এটার কথা নিশ্চয়ই আরো ভালো করে শুনতেন।

রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যি আমি মোটামটি পোকাটার কথা ভুলে গেলাম। একটা পোকা কথা বলছে, সেটা তো হতে পারে না। ত রাস্তায় অন্য কোনো মানুষ কারো সাথে কথা বলেছে, আর আমার মনে হয়েছে আমার সাথে কথা বলেছে। বাতি নেতানোর জন্যে যখন উঠেছি, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালাম, রাস্তায় বাসার সামনে দুটি মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে এখানে। মাইক্রোবাস করে কে এসেছে কে জানে!