মনের মতো মন – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ – মে ২০০৩
.
উৎসর্গ
তিন বছরের ছোট বোন ফৌজিয়া খানুম ও তার স্বামী
পশ্চিম বাংলার হাওড়া জেলার বাগনান কাঁচারীপাড়া
গ্রামের মরহুম জামসের আলি বেগ, যাদের শ্রদ্ধা ও
ভালবাসার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।
.
রাত সাড়ে দশটা। এ বছর শীত পৌষ মাসের পনের তারিখ থেকে পড়েছে। তার আগে শীতকাল বলে জানাই যায় নি। বিশ বাইশ তারিখ থেকে শৈত্যপ্রবাহের ফলে হাড় কাঁপানো শীত পড়েছে। আজ এক সপ্তাহ শৈত্যপ্রবাহ চলছে। উত্তর বাংলায় গরিব, বৃদ্ধ, শিশু ও রুগীদের মধ্যে প্রায় তিন চারশর মতো মারা গেছে।
আমজাদের তেমন গরম কাপড় নেই। অনেক দিনের পুরোনো মোটা গেঞ্জি, শার্ট, হাফ হাতা সোয়েটার ও কানে মাফলার জড়িয়ে অফিস থেকে বেরোল। শাঁ শাঁ শব্দে হিমেল বাতাস গায়ে লাগতে কেঁপে উঠল। এতক্ষণ অফিসের ভিতর গরমে বেশ আরামেই ছিল।
সে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসের প্রুফরিডার। অফিসের কাছেই মসজিদ ও তার পাশে খাবার হোটেল। মসজিদে এশার নামায পড়ে হোটেলে ভাত খেয়ে যখন বেরোল তখন সাড়ে এগারোটা। তাকে এখন হেঁটে যেতে হবে পল্টন। সেখান থেকে বাসে কাওরান বাজার। তারপর প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে গণি ভাইয়ের অফিস। সেখানে সে রাত্রে ঘুমায়। গণি ভাই বলে দিয়েছেন, এখানে যে তুমি থাক বাড়িওয়ালা বা অফিসের কেউ যেন না জানে। তাই রাত বারটা একটার সময় এসে খুব সাবধানে গেট টপকে চোরের মতো ঢুকে। আর সকাল নটার আগে বেরিয়ে যায়।
এম. এ. পাশ করে যে কোনো একটা চাকরির জন্য যখন হন্যে হয়ে ঘুরছিল তখন হঠাৎ একদিন একটা অফিসের সামনে গণি ভাইকে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটার সঙ্গে কথা শেষ করে চলে যেতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে সালাম দিল।
গণি ভাই সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আরে আমজাদ যে, কি খবর?
গণি ভাই আমজাদের বাবার খালাত ভাইয়ের ছেলে। আমজাদ যখন। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয় তখন গণি ভাই মাষ্টার্সের শেষ বর্ষে। সে বছর ইলেকসানের সময় তাদের পরিচয় হয়। তারপর কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হলেও এতবছর পর তাকে যে চিনতে পেরেছেন, তাতেই আমজাদ খুশী। বলল, যে। কোনো একটা চাকরি আমার খুব দরকার। কত অফিসে ঘুরলাম, কত ইন্টারভিউ দিলাম, কিন্তু কিছুই হল না।
গণি ভাই বললেন, আজকাল চাকরি পাওয়া খুব মুস্কিল। তারপর একটা ভিজিটিং কার্ড তার হাতে দিয়ে বললেন, এখন আমি খুব ব্যস্ত। কাল বারোটার সময় আমার অফিসে এস।
পরের দিন আমজাদ সময়মতো গণি ভাইয়ের অফিসে গেল।
গণি ভাই বললেন, আপাতত একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে প্রুফ রীডারের কাজ কর। মাসে হাজার খানেক পাবে। পরে ভালো একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবে।
আমজাদ বলল, আমিতো প্রুফ দেখতে জানি না।
তাতে কি হয়েছে? অফিসে এ. টি দেব-এর বেঙ্গলী টু ইংলিশ ডিকশনারী আছে। কিভাবে প্রুফ দেখতে হয় ওটার পিছনে লেখা আছে। দুচার দিন ওটা দেখে প্রুফ দেখলে শিখে যাবে। তা ছাড়া আমি অফিসের বড় বাবুকে বলে দেব সে যেন তোমাকে সাহায্য করে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি থাক কোথায়?
মহসীন হলে এক বন্ধুর রুমের মেঝেয় থাকি, খাই হোটেলে।
তা হলে তো তোমার খুব অসবিধে হচ্ছে। এক কাজ করতে পার, আমার এই অফিসেই থাকতে পার রাতে। তারপর কিভাবে থাকবে বলে দিয়েছিলেন।
সেই থেকে আজ ছয় মাস পত্রিকা অফিসে প্রুফ রিডারের কাজ করছে আর রাতে গণি সাহেবের অফিসে ঘুমাচ্ছে।
হিমেল বাতাসে গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। শরীর গরম করার জন্য জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। শুধু চোখ দুটো ফাঁকা রেখে মাফলার দিয়ে নাক, কান ও মুখ ডেকে দিয়েছে। তবু ঠাণ্ডা মানছে না। ঠাণ্ডা ও হিমেল বাতাসের কারণে রাস্তায় কোনো লোকজনের চলাচল নেই। মতিঝিলের মতো রাস্তায়ও গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। তবে অফিসের সামনের ফুটপাতগুলোতে দু’একজন করে দেহপসারিণীকে এত ঠাণ্ডাতেও সেজেগুজে খদ্দেরের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
সেও ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিল। তাদের একজনকে পাশকেটে যাওয়ার সময় মেয়েটি বলে উঠল, এই যে ভাই, শুনুন।
আমজাদ না শোনার ভান করে হাঁটতে লাগল। মাত্র কয়েক গজ এসেছে এমন সময় আর একটা মেয়ে তার পথরোধ করে বলল, সায়লার থেকে আমার রেট কম। চলুন কোথায় নিয়ে যাবেন।
ওদের ব্যাপারে আগে আমজাদ কিছুই জানত না। এক গরমের রাতে বাসায় ফেরার সময় আদমজী জুট মিলের দারোয়ান সোলেমানের সঙ্গে পরিচয় হয়।
সে দিন কারেন্ট না থাকায় সোলেমান গেটের বাইরে টুলে বসে বিড়ি কুঁকছিল। বয়স প্রায় পঞ্চাশের মতো। তখন রাত একটা। এত রাতে আমজাদকে যেতে দেখে ডেকে আলাপ পরিচয় করে ।
আমজাদ এক সময় জিজ্ঞেস করেছিল, এত রাতে যোয়ান যোয়ান মেয়েরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকে কেন।
সোলেমান বলেছিল, ওরা দেহ বিক্রি করে টাকা রোজগার করে। আপনি ভদ্রঘরের শিক্ষিত ছেলে। খবরদার, ওদের পাল্লায় পড়বেন না।
আমজাদ তওবা নাউজুবিল্লাহ পড়ে বলেছিল, কি যে বলেন চাচা, আল্লাহর কোনো মুমিন বান্দা এরকম খারাপ কাজ করতে পারে না।
তারপর থেকে মাঝে মধ্যে সোলেমানের সঙ্গে আমজাদের দেখা হলে কিছুক্ষণ আলাপ করে।
আজ মেয়েটি পথরোধ করে এই কথা বলতে আমজাদ বলল, সরে দাঁড়াও, আমি এই লাইনের লোক নই। কথা শেষ করে পাশকেটে চলে যেতে উদ্যত হল।
মেয়েটি খপ করে তার একটা হাত ধরে বলল, যাদের পকেটে কম টাকা থাকে তারা ঐ রকম বলে। ঠিক আছে, যা আছে তাই দেবেন।
এমন সময় একটা জীপ গাড়ি এসে থামতে মেয়েটি হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটে গলিতে ঢুকে পড়ল।
গাড়ি থেকে একজন পুলিশ অফিসার নেমে এসে আমজাদকে বললেন, চল, গাড়িতে ওঠ।
কেন?
কেন? তোমাকে জামাই করব। শ্বশুরবাড়ি চল।
আশ্চর্য! আমি কোনো অন্যায় করি নি। তবু আমাকে গাড়িতে উঠতে বলছেন কেন?
অফিসার একজন সেপাইকে ইঙ্গিত করতে সে এসে আমজাদের হাত ধরে টানতে লাগল।
আমজাদ বলল, আপনি ভুল করছেন। যা ভাবছেন, সে রকম ছেলে আমি। নই।
অফিসার রেগে উঠে বললেন, ধরা পড়লে সবাই এ কথা বলে।
দেখুন, আমি পত্রিকা অফিসে কাজ করি। কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। ঐ মেয়েটি আমার পথরোধ করে। পকেটে পয়সা নেই বলে প্রতিদিন এই পথটা হেঁটে যাই।
ওসব আমরা বুঝি। ভালোভাবে চল, নচেৎ এই শীতে পিটিয়ে গা গরম করব। তারপর আবার বললেন, ঠিক আছে তুমি সামনে ওঠো, আমার পাশে বসবে। গাড়ি স্টার্ট দেয়াই ছিল। ওরা গাড়িতে উঠতেই চলতে শুরু করল।
আমজাদ বলল, আমার কথা শুনুন, থানায় নিয়ে গিয়ে আমাকে পেটান ছাড়া আপনার কোনো লাভ হবে না। আমার পকেটে পাঁচ টাকা ছাড়া কিছুই নেই। আর ঢাকাতে আমার এমন কেউ নেই যে, খবর দিলে টাকা নিয়ে ছাড়াতে আসবে। আমি গ্রামের ছেলে। হলে থেকে এ বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষার পর হল থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। চাকরির চেষ্টা করেও ভালো কিছু না পেয়ে বাধ্য হয়ে একটা পত্রিকা অফিসে সামান্য বেতনে চাকরি করছি।
আমজাদের কোয়ালিফিকেশন শুনে পুলিশ অফিসারের মন নরম হল। সেই সাথে টাকা নেই শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললেন, মেয়েদের ইন্টারভিউ নেয়া হচ্ছিল বুঝি? আজকাল ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েরা পত্রিকায় খারাপ মেয়ে। মানুষের গল্প পড়তে ভালবাসে। তা এতক্ষণ সে কথা বলেন নি কেন?
আমিতো বলতে চেয়েছিলাম, আপনি সময় দিলেন না।
যাবেন কোথায়?
কাওরান বাজার।
গত রাতেও বউনি হয় নি, আজও যদি না হয়। তা হলে … উহ্।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমজাদের হাসি পেল। হাসি চেপে রেখে ভণিতা। করে জিজ্ঞেস করল, বউনি মানে?
আরে মশায়, এই সামান্য কথাটাও বুঝতে পারলেন না? আমি সেপাইদের নিয়ে তেল পুড়িয়ে সারারাত হাওয়া খেতে বেড়াই নাকি? আমার বাড়ি মফস্বল টাউনে। সেখানকার কলেজে প্রফেসারি করতে পারতাম। তা না করে পুলিশে ঢুকেছি দু’টো পয়সা রোজগার করার জন্য। আজকাল শুধু বেতনের টাকায় কোনো শালার চলে নাকি? আমার তিন মেয়ে, দুই ছেলে। তাদের পড়াশোনার খরচ মাসে পাঁচ হাজার টাকা। তারপর মেয়েদের বিয়ের ব্যাপার আছে। সেই টাকা আসবে কোত্থেকে? অবশ্য আমার স্ত্রী খুব হিসেবী। বেতনের টাকা সবটাই ব্যাঙ্কে জমা রাখে। আর এই উপরি টাকা যা পাই তাই দিয়ে সংসার ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে।
আমজাদ হাঁ করে তার কথা শুনছিল। এবার না বলে পারল না, এরকম কথা আপনার মুখ থেকে শুনব ভাবতেই পারছি না।
কেন? আমি কি কোনো অন্যায় করছি? আজকাল কোন শালা ন্যায় পথে থেকে চাকরি করছে? আমরা তো তবু দু-চারশ কি দু পাঁচ হাজার, কিন্তু মন্ত্রী ও আমলারা তো লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা ঘুষ খায়। তাদের অনেককে ধরা পড়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। মন্ত্রী আমলা থেকে সাধারণ মানুষও দু’হাতে ঘুষ খেয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে। বাংলাদেশে কে ঘুষ খায় না বলতে পারেন? যে দেশের হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে নিম্ন আদালতের চাপরাশী দারোয়ান পর্যন্ত ঘুষ খায়। সে দেশের পুলিশ অফিসাররা ঘুষ খাবে নাতো কি বাচ্চাদের মতো বুড়ো আঙ্গুল চুষবে? এইসব বলতে বলতে তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থাতেই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন সামনের ট্যাক্সিটার গতিরোধ করে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড় করাও।
ড্রাইভার দক্ষতার সঙ্গে অফিসারের আদেশ পালন করল।
অফিসার গাড়ি থেকে নেমে ঐ গাড়ির আরোহীকে চিৎকার করে নামতে বললেন।
আমজাদ দেখল, গাড়ির পিছনের সিটে একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। অফিসার চিৎকার করে নামতে বলায় ভদ্রলোকটা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, কেন? কী হয়েছে?
কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করল না? গাড়িতে মেয়ে মানুষ তুলে প্রেমলীলা হচ্ছে? নামুন, নচেৎ ধোলাই দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।
ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে বললেন, দেখুন, আমরা স্বামী-স্ত্রী। ও অসুস্থ। তাই আমার গায়ে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। আপনি অনর্থক এসব কথা বলছেন।
স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক বললেই ছাড়া পেয়ে যাবেন ভেবেছেন? আমার চোখকে ফাঁকি দেয়া অত সহজ নয়। আপনি ওর ঘাড়ে মুখ ঘষছিলেন, মুখে কিস দিচ্ছেলেন। নিজের স্ত্রীকে কেউ গাড়িতে ওসব করে? তা ছাড়া আপনারা যে। স্বামী-স্ত্রী প্রমাণ দিতে পারবেন বলে অফিসার হাত বাড়ালেন। প্রমাণ নিয়ে কেউ। রাস্তায় বেরোয় না, বাসায় চলুন।
তাই নাকি? উঠুন জীপে। তারপর গাড়িতে বসা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই ভদ্রলোককে গাড়িতে তোলো।
ভদ্রলোক এবার খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, আমরা কিন্তু কোনো অন্যায় করি। নি।
সেটা কোর্টে গিয়ে বলবেন। রাস্তায় অশালীন আচরণ করার জন্য আপনাদের আমি গ্রেফতার করছি।
অফিসারের কথা শুনে গাড়ির ভিতরের মহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
ভদ্রলোক গাড়ির ভিতর মুখ ঢুকিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে সোজা হয়ে অফিসারকে বললেন, আমার স্ত্রী সত্যিই অসুস্থ। দয়া করে আমাদের যেতে দিন।
ঠিক আছে, স্ত্রীর অসুস্থতার কথা যখন বলছেন তখন আর কি, তবে আপনারও কিছু করা দরকার।
ভদ্রলোক পকেট থেকে পার্স বের করতে অফিসার বললেন, দু’হাজার।
এত টাকা সঙ্গে নেই, বারশ আছে।
নেই যখন বারশই দিন।
টাকাটা নিয়ে তাদের চলে যেতে বলে জীপে উঠে দু’শ টাকা পিছনের পুলিশটাকে ও দু’শ টাকা ড্রাইভারকে দিয়ে আমজাদকে বললেন, সবাইকে দিয়ে খেতে হয় বুঝলেন? একাই সব খাব কাউকে দেব না এটা করলে বেইনসাফি। করা হয়। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এসব কথা পত্রিকায় লিখবেন না কি?
লিখব কি লিখব না সেটা আমার ব্যাপার।
লিখুন আর নাই লিখুন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি ঘুষ খেয়েছি প্রমাণ করতে পারবেন না। আর ঐ ভদ্রলোকও কোর্টে কেস করে প্রমাণ করতে পারবেন না, আমি ওনার কাছে থেকে ঘুষ খেয়েছি। আপনি তো এখনো বিয়ে করেন নি। করলে জানতে পারতেন বিয়ের দশ-বার বছর পর কেউ স্ত্রীকে। বিছানায় চুমো খায় না। ঐ শালা ট্যাক্সিতে খাচ্ছিল।
আমজাদ বলল, আপনার নামটা জানতে পারি?
অফিসার হো হো করে হেসে উঠে বললেন, নামটা জানা থাকলে পত্রিকায় ঘটনা লিখতে সুবিধে হবে তাই না?
না, মানে নামটা জানলে বুঝতে পারতাম আপনি মুসলমান, না অন্য কিছু।
অফিসার হাসি থামিয়ে ভ্রুকুটি করে বললেন, যদি বলি আমি মুসলমান?
বিশ্বাস হচ্ছে না।
কেন?
কোনো মুসলমান ঘুষ খেতে পারে না। কারণ আল্লাহ্ ঘুষ খাওয়াকে হারাম করেছেন।
আরে, আপনি যে দেখছি হুজুর মানুষ। যে দেশে নব্বইভাগ মানুষ মুসলমান হয়েও আল্লাহর হুকুমের ধার ধারে না, সে দেশে আপনাদের মতো কয়েকজন হুজুর আল্লাহর হুকুম মেনে চলে দেশের কি উপকার করবেন? আল্লাহ্র হুকুমকে মানুষ গ্রাহ্য না করে নিজের খেয়াল খুশীমতো চলছে। কোনো মানুষেরই সাধ্য নেই তাদেরকে রুখবার। আপনি যদি সবার মতো কিছু না করতে পারেন, তা হলে জীবনে কোনো উন্নতি করতে পারবেন না। তারপর ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে আমজাদকে বললেন, কাওরান বাজারে এসে গেছে, নেমে পড়ন।
আমজাদ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল। রাত প্রায় সাড়ে বারটা। রাস্তায় লোকজন না থাকলেও কুকুরের অভাব নেই। তাকে দেখে অনেকগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে লাগল। তাকে রোজ দেখেও কেন যে ঘেউ ঘেউ করে আমজাদ বুঝতে পারে না। নির্দিষ্ট বাড়িটার কাছে এসে গেট টপকে ভিতরে ঢুকল।
গণি ভাইয়ের অফিসটা খুব সুন্দর। অ্যাটাচড বাথরুম। কারো নজরে যেন না পড়ে সেজন্য স্টীল আলমারীর পিছনে আমজাদের বেডিংপত্র থাকে। গণি ভাই একটা এক্সট্রা চাবি তাকে দিয়ে বলেছেন, বড় লাইট জ্বালাবে না। ডিম লাইট জ্বেলে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়বে।
আমজাদ অফিসে ঢুকে প্রথমে ডিম লাইট জ্বালাল। তারপর প্রতিদিনকার মতো গণি ভাইয়ের গদীমোড়া মুভিং চেয়ারে কিছুক্ষণ আরাম করে বসে ভাবল, এত নরম চেয়ারে বসে কাজ করার ভাগ্য আল্লাহ কি তার কপালে লিখেছেন? হঠাৎ তার পুলিশ অফিসারের কথা মনে পড়তে ভাবল, অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করা আল্লাহ্ হারাম করেছে জেনেও মুসলমানরা তা মানছে না। হারাম খেয়ে খেয়ে মানুষের মন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই মন থেকে দয়া-মায়া মমতা উঠে যাচ্ছে।
ক্লান্তিতে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসতে উঠে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে টেবিলে বিছানা পেতে গা এলিয়ে দিতে মায়ের কথা মনে পড়ল। মা বলত, তোর বাবা এ যুগে একদম অচল। অন্যায়ের সঙ্গে কখনো এতটুকু আপস করত না। আর সেই জন্যেই তাকে অকালে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হল। বাবাকে দেখে নি আমজাদ। সে মায়ের পেটে থাকতেই বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। কিশোর বয়সে মায়ের কাছে শোনা কথাটা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। বাবা ছিলেন গ্রামের হাই স্কুলের আদর্শবান মাস্টার। পৈত্রিক সূত্রে বেশ জমি জায়গা পেয়েছিলেন। তাই অবস্থা খুব স্বচ্ছল ছিল। জাব্বার খান গ্রামের সেরা ধনী। তার এক ছেলে পাশের গ্রামের একজনকে খুন করে। বাবা তখন সেই পথ দিয়ে আসছিলেন। পাশের গ্রামের ছেলের বাবা জাব্বার খানের ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। বাবা যে ঘটনাটা দেখেছেন তা খুন হওয়া ছেলের বাবা কেমন করে যেন জেনে যান। তিনি মামলায় প্রধান সাক্ষি করেন বাবাকে। সেকথা জব্বার খান জানতে পেরে বাবাকে অনেক টাকা দিয়ে মিথ্যে সাক্ষি দেয়ার জন্য হাত করতে চেয়েছিলেন। বাবা টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, মুসলমান কোনোদিন মিথ্যে সাক্ষি দিতে পারে না। আল্লাহ্ কুরআন। পাকে বলিয়াছেন,
“হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিধানসমূহ পূর্ণরূপে। প্রতিষ্ঠাকারী এবং ন্যায়ের সহিত সাক্ষ্য প্রদানকারী হও, এবং কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদিগকে ইহার প্রতি উদ্যত না করে যে, তোমরা ন্যায় বিচার না কর; ন্যায় বিচার কর। ইহা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী, আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের সমস্ত কৃতকর্ম সম্বন্ধে পূর্ণ অবগত আছেন।” [সূরা মায়েদা, আয়াত-৮, পারা-৬]
মামলার দিন কোর্টে সাক্ষি দিতে যাওয়ার পথে বাবা খুন হয়। মা বলেছিল, জাব্বার খান নিজের ছেলেকে বাঁচাবার জন্য তোর বাবাকে লোকের দ্বারা খুন করায়।
কথাটা যখনই মনে পড়ে তখনই আমজাদের চেয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠে। ভাবে, বাবার খুনের প্রতিশোধ কি সে নিতে পারবে? প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সে ক্যারেট শিখেছে। আর্মস চালনাও শিখেছে। এখন শুধু আর্থিক উন্নতি করতে পারলেই তার মনের আশা পূরণ হবে।
এইসব চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল তখন সাড়ে আটটা। ধড়ফড় করে উঠে বিছানাপত্র গুছিয়ে যথাস্থানে রাখল। তারপর বাথরুমের কাজ সেরে নটায় রুমে তালা দিয়ে বেরিয়ে এল।
কয়েকদিন আগে গণি ভাই মগবাজারের একটা ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, ত্রিশ তারিখে ওখানে গিয়ে বলবে, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি। আমজাদকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে আবার বলেছিলেন, আরে ভাই, এক হাজার। টাকায় ঢাকা শহরে কি আর একটা মানুষের চলে? তাই আমার এক বন্ধু যখন তার মেয়েকে পড়াবার জন্য একটা টিউটরের কথা বলল তখন তোমার কথা বলে ফেললাম। মেয়েটা টেনে পড়ে। বেতন যাই দিক না কেন এক হাজারের কম দেবে না।
এক হাজার টাকা বেতনে এই ছ’টা মাস আমজাদের খুব কষ্টে কেটেছে। গণি ভাইয়ের কথা শুনে বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ গণি ভাই। কি বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
থাক, কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে না। ঐ মেয়েকে যিনি পড়াতেন, তিনি চান্স পেয়ে ফরেনে চলে গেছেন। সামনে প্রিটেষ্ট। রেজাল্ট ভালো হলো বেতনও ভালো পাবে।
গতকাল অফিস যাওয়ার সময় মগবাজারে বাস থামতে গণি ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু পুলিশের পাল্লায় পড়ে সে কথা মনে ছিল না। এখন মনে পড়তে হোটেলে নাস্তা খেয়ে মগবজারে যাওয়ার জন্য বাসে উঠল। ঠিকানামতো বাড়িটার কাছে যখন পৌঁছাল তখন পৌনে দশটা। ভাবল, আটটা-নটার মধ্যে আসা উচিত ছিল, এখন কি মেয়ে বা মেয়ের বাবা বাসায় আছেন? দ্বিধাচিত্তে গেটের কলিংবেলের বোতামে চাপ দিল।
আজকাল ঢাকা শহরে কলিংবেল বাজিয়ে ডাকাতি হচ্ছে। তাই প্রায় বাড়িওয়ালা গেটের দরজার মাঝখানে ফুটো করে মোটা কাঁচ বসিয়ে দেন। ভিতরের লোক সেই কাঁচে চোখ রেখে আগন্তুককে দেখে গেট খোলে। স্বাতি দরজার ফুটোতে চোখ রেখে আমজাদকে চিনতে পারলেন না। বললেন, কে আপনি? কাকে চান?
আমি আমজাদ। গণি সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাদের মেয়েকে পড়াবার ব্যাপারে।
মেয়ে স্কুলে, মেয়ের বাবাও অফিসে। কাল সকাল নটার আগে আসুন।
ঠিক আছে, তাই আসব বলে আমজাদ চলে এল।
পরের দিন আটটার সময় আমজাদ এসে কলিংবেল বাজাল।
ভদ্রমহিলা যেন ওর অপেক্ষায় ছিলেন। দরজার ফুটোয় চোখ রেখে চিনতে পেরে গেট খুলে দিলেন।
আমজাদ সালাম দিতে গিয়ে থেমে গেল।
সদ্য স্নানকরা এক আপরূপা মহিলা। সিথিতে সির্দুর জ্বলজ্বল করছে। সুদীর্ঘ চুলকে পাশ কাটিয়ে আঁচল মাথায় দেয়। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী। বয়স পঁয়ত্রিশের কম না। কিন্তু আমজাদের মনে হল চব্বিশ পঁচিশ বছরের উদ্ভিন্ন যৌবনা এক কুমারী মেয়ে।
তাকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বাতি মৃদু হেসে বললেন, আপনিই তো কাল এসেছিলেন?
আমজাদ যেন এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না। স্বাতির কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, জি।
আসুন, ভিতরে এসে বসুন। মেয়ে ও মেয়ের বাবা নাস্তা খাচ্ছে, এখুনি এসে পড়বে। কথা শেষ করে চলে গেলেন।
গেটের রুমটাই ড্রইংরুম। আমজাদ একটা সোফায় বসে চিন্তা করল, মা যখন এতো সুন্দরী মেয়েও নিশ্চয় সুন্দরী। এরা হিন্দু গণি ভাই বলে নি। কেন বলে নি ভেবে পেল না। রুমের পরিবেশ দেখে আমজাদ খুশী হল। সব কিছু দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের যেমন টাকা আছে তেমনি রুচিজ্ঞানও আছে। উনি ব্যবসা করেন, না চাকরি করেন? ব্যবসা করলে আলাদা কথা, কিন্তু চাকরি করলে এত দামি কার্পেট ও সোফাসেট ও অন্যান্য সবকিছু করলেন কি করে? নিশ্চয় ঘুষ খান।
এমন সময় পর্দা ঠেলে একজন সুট পরা ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখে আমজাদ দাঁড়িয়ে পড়ল।
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করার সময় বললেন, আমি রজত।
আমি আমজাদ।
রজত আমজাদকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, গণি আপনার কথা বলেছে। বিথী মানে আমার মেয়ে অঙ্ক ছাড়া অন্যান্য সাবজেক্টে খুব ভালো। অঙ্কের টিচার রেখেও তেমন কোনো উন্নিতি হয় নি। আপনিও চেষ্টা করে দেখুন কতটা কি করতে পারেন।
এমন সময় স্ত্রী ও মেয়েকে নাস্তার ট্রে নিয়ে ঢুকতে দেখে আবার বললেন, আমার স্ত্রী স্বাতি আর মেয়ে বিথী।
বিথী আমজাদের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা হাত তুলল, মুখে কিছু বলল না।
স্বাতি টেট্রা টেবিলের উপর রেখে হাসিমুখে আমজাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি গণি ভাইয়ের লোক জেনেও ফিরিয়ে দিয়েছি বলে রজত কাল আমার উপর রেগে গিয়েছিল। আমি অবশ্য ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।
রজতের দিকে তাকিয়ে আমজাদ বলল, আপনার রেগে যাওয়াটা উচিত না অনুচিত হয়েছে বলব না, তবে উনি উচিত কাজই করেছেন। কারণ আজকাল ডাকাতরা অতি আপনজনের পরিচয় দিয়ে গেট খুলিয়ে ডাকাতি করছে। এরকম ঘটনা প্রতিদিন কাগজ খুললেই দেখা যায়।
রজত বলল, থাক ওসব কথা। আপনি বিথীকে কাল থেকে কখন পড়াতে আসবেন বলুন।
বিথীর নাম শুনে আমজাদ তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, এই বয়সেই মায়ের মতো সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। শুধু তাই নয়, অচেনা কেউ দেখলে স্বাতির ছোট বোন মনে করবে। দৃষ্টি সরিয়ে বলল, আপনি বোধ হয় জানেন, দুপুরের পর থেকে আমি গণি ভাইয়ের পত্রিকা অফিসে কাজ করি। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটায় আসব।
বেশ, তাই আসবেন। আর শুনুন, আগের টিচার সপ্তাহে তিন দিন পড়াতেন। তাকে এক হাজার দিতাম। যদি সময় হয় আপনি ছ’দিন পড়াবেন, দেড় হাজার দেব। আর যদি অঙ্কে ওর রেজাল্ট ভালো করাতে পারেন, তা হলে পরের মাস থেকে দু’হাজার পাবেন।
আমজাদ চিন্তা করল, গণি ভাই এক হাজারের কথা বলেছিলেন। দেড় হাজারের কথা শুনে খুব খুশী হল। বলল, আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করব।
থ্যাংক ইউ বলে রজত মেয়েকে বললেন, সকাল সাতটায় তুমি তৈরী থাকবে। তারপর আমজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর সময় দিতে পারছি না, অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
আমজাদ দাঁড়িয়ে উঠে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল।
পরের দিন ঠিক সাতটায় পড়াতে এলে কাজের বুয়া তাকে রিডিংরুমে পৌঁছে। দিল।
পাঁচ মিনিট আগে বিথী পড়তে বসেছে। আমজাদকে দেখে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা শুধু মাথা পর্যন্ত তুলল, মুখে কিছু বলল, না।
আমজাদ তাকে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর বলল, আজ পড়াব না, কাল থেকে পড়াব। আজ শুধু আলাপ পরিচয় করব। ছাত্র শিক্ষক একে অপরের পরিচয় জানা উচিত। তা না হলে আমার কাছে পড়তে তোমার যেমন ভালো লাগবে না তেমনি আমিও তোমাকে ঠিক মতো টিচিং দিতে পারব না। কাল তোমার নাম বিথী শুনেছি। ওটা নিশ্চয় ডাক নাম, ভাল নাম বল।
রাবিয়া ব্যানার্জি।
আমজাদ অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস কলল, তোমরা মুসলমান?
আমার বাবা মুসলমান, মা হিন্দু।
আর তুমি?
আমি ওনাদের মেয়ে।
তা তো জানি। জানতে চাচ্ছি তুমি কোন ধর্ম অনুসরণ কর?
কোনোটাই অনুসরণ করি না। বাবাকে বলেছেন, বড় হয়ে আমি যেন মানব ধর্ম অনুসরণ করি।
উনি খুব ভালো কথা বলেছেন। আচ্ছা, তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
আমি ঢাকাতেই জন্মেছি। মা বাবার বাড়ি কোলকাতা।
তোমরা কোলকাতা যাও না?
বাবা যান না, মা আমাকে নিয়ে প্রতি বছর পূজার সময় বেড়াতে যান। তারপর বিথী মৃদু হেসে বলল, আমার কথা তো-অনেক শুনলেন, এবার আপনার কথা বলুন।
আমজাদও মৃদু হেসে নাম বলে বলল, কয়েক মাস আগে স্থাপত্য শিল্পে মাষ্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি। দেশের বাড়ি সাতক্ষীরা। আমার কোনো ভাই বোন নেই। মায়ের পেটে থাকতে বাবাকে হারিয়েছি। তারপর থেকে মা আমাকে নিয়ে একমাত্র মামার কাছে আছেন। বাবার কিছু টাকা পয়সা ছিল। মা সেই টাকায় আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন। এখন চাকির খুঁজছি। এই হল আমার কথা।
বিথী আজ ভি-গলার মাক্সি পরেছে। ফলে বুকের দু’টো মাংসপিণ্ডের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। তাই আমজাদ তার মুখের দিকে মাঝে মধ্যে তাকিয়ে কথা বললেও বেশিরভাগ কথা দৃষ্টি টেবিলের উপর রেখে বলছে।
বিথী তা বুঝতে পেরে বলল, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না কেন?
কারণ আছে।
কি কারণ বলুন!
কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা চিন্তা করতে লাগল আমজাদ।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, বলুন না, কেন আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না?
কাল থেকে একটা চাদর বা ওড়না গায়ে দিয়ে পড়তে আসবে।
স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার কারণে এই বয়সেই বিথী পূর্ণ যুবতীর মতো। কিন্তু সেক্স সম্পর্কে যেমন এতটুকু জ্ঞান এখনো হয় নি তেমনি ছেলে মানুষিও যাই নি। তাই খুব অবাক হয়ে বলল, কেন? ওগুলোত বয়স্ক মহিলাদের গায়ে দিতে দেখেছি।
বয়স্ক মহিলাদের গায়ে ওড়না বা চাদর দেয়ার বিভিন্ন কারণ আছে। আমি তোমাকে বলছি অন্য কারণে।
কারণটা বলুন।
মায়েরা একদম ছোট ছেলেমেয়েদের জাঙ্গিয়া, গেঞ্জি বা ছোট জামা পরায়। একটু বড় হলে হাফ প্যান্ট পরায়। আরো একটু বড় হলে স্কুলে যাওয়ার সময় পায়জামা বা ফুলপ্যান্ট ও বড় জামা পরায়। এর কারণ হল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোশাকেরও পরিবর্তন হয়। তাই মেয়েরা যখন বড় হয় তখন তাদের পোশাকেরও পরিবর্তন হয়। তোমার ও হয়েছে। যেটুকু বাকি ছিল সেটাই বললাম।
মাস্টার কেমন পড়াচ্ছে জানার জন্য স্বাতি এতক্ষণ দরজার পর্দার আড়াল থেকে তাদের কথা শুনে খুশী হলেন। ভাবলেন, মাস্টার খুব চরিত্রবান ছেলে।
আমজাদের কথা শেষ হতে ভিতরে ঢুকে বললেন, আজ যখন পড়াবেন না তখন চা খেতে খেতে আলাপ করা যাক।
আমজাদ বলল, আমি চা খাই না, তবে আলাপ করা যায়।
চা না খান অন্য কিছু খাবেন। তারপর মেয়েকে বললেন, যাও, তোমার স্যারের জন্য কিছু নিয়ে এস।
আমজাদ মিনতি স্বরে বলল, দেখুন, কিছু মনে নেবেন না, আমি কিছুই খাব না।
কেন বলুনতো? আমি হিন্দুর মেয়ে, তাই বুঝি খেতে চাচ্ছেন না?
আপনার ধারণা ভুল। কয়েকদিন আগে হলে নিশ্চয় খেতাম।
কয়েকদিন আগের কথা বাদ দিন, এখন খাবেন না কেন বলুন।
কয়েকদিন আগে একটা দৈনিক পেপারে দেখলাম, দেশী-বিদেশী খাবার ও পানীয় অনেক উপাদানে শূকরের চর্বি আছে। মুসলমানদের জন্য শূকরের সব কিছু হারাম। একজন মুসলমান হয়ে তো শূকরের চর্বি মিশ্রিত কোনো খাবার খেতে পারি না?
যে সব জিনিসে শূকরের চর্বি মিশ্রত আছে, সেগুলোর নাম বলুন তো?
প্যাকেট বা টিনজাত গুড়া দুধ, ঘি, ডালডা, বিস্কুট, চানাচুর, সেমাই, লাচ্ছি বিভিন্ন সাবান, পানীয়জাত জিনিস ও প্রসাধনী দ্রব্যের মধ্যে শূকরের চর্বি রয়েছে।
পেপারে যখন লেখা হয়েছে তখন অন্যান্য মুসলমানরা, বিশেষ করে মোল্লা মৌলবীরা কি এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করেছেন?
করেছেন কি না জানি না। তবে করলে নিশ্চয় জানতে পারতাম।
এ ব্যাপারে আপনিওতো লেখালেখি করতে পারেন?
তা অবশ্য পারি। ইচ্ছাও আছে। সময় সুযোগের অভাবে ফিচারটা লিখতে পারছি না। তবে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় এ ব্যাপারে লেখালেখি হয়েছে।
(১) যেমন–১৯৮৭ সালের ২৩শে নভেম্বরে দৈনিক দিনকাল ও দৈনিক নয়া বাংলা ২২শে জানুয়ারি, ১৯৮৮ইং সালে পত্রিকা দুটিতে লিখেছিল, “সাম্প্রতিক আরও চাঞ্চল্যকর উদ্ঘাটন করেছে সিঙ্গপুরস্থ মুসলিম মিশনারী সোসাইটির মুখপত্র দৈনিক ভয়েজ অব ইসলাম। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিদেশী বিভিন্ন মহলের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, ছোট ও বড়দের তৈরী শুকনো দুধে শূকরের চর্বি মেশানো হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সত্যতা এম. ফি, খোঁজা বিরচিত বই থেকেও প্রমাণিত। প্রতি ৮৮৪ গ্রাম শুকনো দুধে ১০ গ্রাম শূকরের চর্বি থাকে।
সুইডেনের মুসলিম এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী মাহমুদ উদ্দিন ও একই মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কোথাও আপনি এমন দুধ পাবেন না, যাতে শূকরের চর্বি নেই,
(২) দৈনিক ইনকিলাব ২৫শে মে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, বিশ্ব মুসলিম অবগতির লক্ষ্যে প্রফেসার আমজাদ সরকার বৈরুতের একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (U.A.E) সরকার কর্তৃক প্রচারিত হয়েছে, যার মধ্যে অত্যধিক পরিশ্রম ও গবেষণার পর ইউরোপ ও আমেরিকার কতিপয় সামগ্রীর ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে শূকরের দেহের কোনো না কোনো অংশ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবান, ক্রীম বিভিন্ন প্রকার খাদ্য। যেমন– চকলেট, বিস্কুট, পনির, রুটি এবং বিভিন্ন ধরনের পেয়সামগ্রী।”
(৩) দৈনিক ইত্তেফাঁকে ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে লিখেছিল, জুস, আচার, জেম, জেলী ক্রেতাগণ হুঁশিয়ার, সাবধান। বহির্বিশ্বে জেল্যাটিনবিহীন কোনো জুস, জেলী ও আচার তৈরী হয় না। জেল্যাটিন শূকরের চামড়া ও হাড় থেকে প্রস্তুত।… ইহা হালাল নয়।
(৪) দৈনিক ইনকিলাবে ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে লিখেছিল, বিদেশী টিনজাত গুঁড়ো দুধ, দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রী, আইসক্রীম, মিষ্টান্ন, চকলেট, ওষুধাদি এমন সব হারাম উপাদান দিয়ে তৈরী, যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করা যায় না। সম্প্রতি কনজুমার এসোসিয়েশন অব পেনাং গাইড বিদেশী পণ্যসামগ্রী বিশেষ করে খাদ্য এবং প্রসাধনীর উপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে দেখেছে যে, অধিকাংশ বিদেশী খাদ্য এবং প্রসাধনীতে হারাম দ্রব্যসামগ্রী, যেমন–শূকরের চর্বি মেশানো থাকে।
(৫) দৈনিক ইনকিলাবে ৮ই ডিসেম্বর ২০০১ ও ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, শূকরের চর্বি দিয়ে লাচ্ছা সেমাই ভাজা হচ্ছে। রোযা শুরুর পর থেকে প্রতিদিন শতশত মণ লাচ্ছা সেমাই তৈরী হচ্ছে। এই লাচ্ছা তৈরীতে যে পশুচর্বি ব্যবহার হয়, যার ৯০ই ভাগই হল শূকরের চর্বি।
(৬) দৈনিক আজকের কাগজে ২রা ভাদ্র, ১৪০৩ বাংলা সালে, প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন বেকারীতে মিষ্টি, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাই, বাটার ওয়েল, ঘি উৎপাদনে অবাধে চর্বি ব্যবহার হচ্ছে। ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর চর্বি এদেশে আমদানী করা হয়, তা গরুর না শূকরের তাও নিশ্চিত করে। কেউ বলতে পারছে না।
এবার আমাদের দেশের একটা ডাক্তারের কথা বলছি–বোন সোসালিস্ট সালাম তালুকদার, যিনি শ্যামলীতে একটা হাসপাতল খুলেছেন। ১৯৮৫ ইং সালে আমার এক আত্মীয় তার মেয়েকে ওনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম মেরুদন্ত্রে চিকিৎসা করানোর জন্য। সে সময় উনি বলেছিলেন, “এই মেয়েকে প্রতিদিন হাফ কেজি শূকরের চর্বি খাওয়াবেন।”
মেয়ের বাবা খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, আপনি মুসলমান হয়ে এই হারাম জিনিস খাওয়াতে বলছেন?
ডাক্তার হেসে উঠে বলেছিলেন, আপনি দেখছি দুনিয়ার কোনো খোঁজই রাখেন নি। আরে মশায়, বেকারীতে যা কিছু তৈরী হচ্ছে, সবটাতেই শূকরের চর্বি আছে। যেমন, রুটি, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাই। এমনকি ডালডা, বাটারওয়েল, ঘি ও পনিরের মধ্যে শূকরের চর্বি রয়েছে।’
সেদিন ঐ ডাক্তারের কথায় মেয়ের বাবা বিশ্বাস করেন নি আর মেয়েকে শূকরের চর্বিও খাওয়ান নি। ঐ আত্মীয় গ্রামে ফিরে যখন লোকজনদের কাছে ডাক্তারের কথা বলছিলেন তখন আমি ছোট থাকলেও কথাটা শুনে মনে সন্দেহ হয়েছিল; কিন্তু বিশ্বাস করি নি।
২০০২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বরে দৈনিক ইনকিলাবে উক্ত ফিচারগুলো পড়ার পর থেকে আমি ঐ সমস্ত খাদ্যসামগ্রী খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
স্বাতি বললেন, আপনি গোঁড়া মুসলিম, তাই না?
গোঁড়া কি জিনিস জানি না। তবে মুসলমান হিসাবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্র বিধি বিধান মেনে চলার চেষ্টা করি।
কিন্তু শুধু মুসলমানরা নয়, বর্তমানে সব ধর্মের লোকেরাই তো সৃষ্টি কর্তার বিধি-বিধান মেনে চলছে না।
হ্যাঁ, আপনি অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। তবে কি জানেন, যারা সৃষ্টিকর্তার হুকুম মেনে চলে তাদেরকে মুসলমান বলে। মুসলমানের অর্থই হল (আল্লাহর হুকুম) মান্যকারী। আজকাল মুসলমানরা আল্লাহ্র হুকুম মানছে না বলে সারা পৃথিবীতে তারা লাঞ্ছিত ও উৎপীড়িত হচ্ছে। আর যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে অন্যদেরকে মেনে চালাবার চেষ্টা করছে তারা গোঁড়া, সম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী নামে আখ্যায়িত হচ্ছে।
এবার আসি ভাবি, সরি, বৌদি বলে আমজাদ দাঁড়িয়ে পড়ল।
স্বাতি মৃদু হেসে বলল, সরি বলছেন কেন? ভাবি বা বৌদি-কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই।
আমজাদও মৃদু হেসে বলল, আপনার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। তারপর বিদায় নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
সকালে নাস্তা না খয়ে পড়াতে এসেছিল। প্রচণ্ড ক্ষিধে অনুভব করে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুটো চাপাটি-ভাজি দিয়ে খেয়ে এককাপ লেমন টি খেল। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, রজতদা মুসলমান হয়ে হিন্দু মেয়েকে যখন বিয়ে করেছেন তখন নিশ্চয় লাভ ম্যারেজ। কিন্তু ইসলামেতো এভাবে বিয়ে সিদ্ধ নয়? মেয়ে যে কোনো ধর্মের হোক না কেন, বিয়ের আগে তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। ওনাদের তো হারামী গোজরান হচ্ছে। ওনাদের মেয়েকে পড়ান কি উচিত হবে?
ওয়ারলেস গেটে এসে ফারহানা ও মহিমকে দেখে বলল, কিরে, তোরা এখানে?
মহিম বলল, আর আমরা যদি বলি, তুই থাকিস কাওরান বাজারে। এখানে দেখব আশা করি নি?
তোর কাছে যাব বলে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। তা তোরা এখানে কেন বলবি তো?
সেকথা পরে শুনিস। চল, রেস্টুরেন্টে গিয়ে আগে গলা ভেজাই।
রেস্টুরেন্টে এসে ফারযানা বলল, রোজ আমি তোদেরকে খাওয়াই। আজ তোরা কেউ খাওয়াবি।
ফারনা থেমে যেতে আমজাদ বলল, এক্ষুনি চা নাস্তা খেয়েছি, আমি কিছু খাব না।
মহিম হেসে উঠে বলল, তুই শালা যা বেতন পাস তাতে তোর নিজেরই চলে না। তুই খাওয়াবি কোত্থেকে? ও যা বলার আমাকেই বলছে, তোকে বলে নি। তারপর বেয়ারাকে দু’প্লেট নাস্তা ও আমজাদের জন্য এককাপ লেমন টিয়ের অর্ডার দিয়ে বলল, তা হঠাৎ এখানে কেন?
আমজাদ ছাত্রী পড়াবার কথা বলল।
ফারযানা জিজ্ঞেস করল, বেতন কত দেবে বলেছে?
সপ্তাহে দুদিন পড়ালে দেড় হাজার।
তা হলে তো ভালোই।
ভালো হলেও কপালে বোধ হয় সইবে না।
মহিম কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন?
আমজাদ ছাত্রীর মা-বাবার ইতিহাস বলে বলল, যাদের বিয়েই সিদ্ধ হয় নি। তাদের মেয়েকে পড়াতে মন সায় দিচ্ছে না।
তুই শালা একটা বুদ্বু। আরে বাবা, মা হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক, তাতে তোর কি? তুই ছাত্রী পড়িয়ে বেতন নিবি। এতে মন সায় দেবে না কেন?
মহিম ও ফারযানা আমজাদের শুধু ক্লাসমেট নয়, অন্তরঙ্গ বন্ধুও। ক্লাস করার সময় প্রথমে মহিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আমজাদের। ফারনাকে আমজাদ খুব এড়িয়ে চলত। যখন জানতে পারল, মহিম ও ফারনার মন দেয়া-নেয়া হয়েছে এবং পাশ করে মহিম কিছু একটা রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারলেই তারা বিয়ে করবে তখন থেকে ফারনাকে আর এড়িয়ে চলে না।
এখন মহিমের কথা শুনে আমজাদ বলল, সে কথা বললে তোরা আমাকে মৌলবাদী বলবি।
তুই না বললেও আমরা তোকে মৌলবাদী বলেই জানি। শোন, আজকাল কেউ ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলে না। অল্প কয়েকজন যারা মেনে চলে। সমাজে বা দেশে তাদের কোনো ঠাই নেই। তারা জীবনে উন্নতি করতে পারে নি। তোর যদি আজ কঠিন অসুখ হয়, তুই ডাক্তার দেখাবার, ওষুধ-ইঞ্জেকশান কেনার টাকা পাবি কোথায়? কেউ তোর মুখ দেখে টাকা পয়সা দেবে? দেবে না। এই যে তুই টাকার অভাবে মেসে না থেকে গণি ভাইয়ের অফিসে চোরের মতো আছিস, সেটাতে মন বাধা দেয় নি। পড়িয়ে টাকা নিবি, চুরি চামারি তো করছিস না? খবরদার, আর কিছু একটা না হওয়া পর্যন্ত টিউশনিটা ছাড়বি না।
বাদ দে আমার কথা। তোদর কথা বল। তুই কি এখনো কিছু একটা জোগাড় করতে পারিস নি? কতদিন আর ফারনাকে ভোগাবি?
ফারযানার ভোগান্তি শেষ। খুব শিঘ্রী আমাদের বিয়ে হচ্ছে।
তার মানে তুই চাকরি পেয়েছিস?
হ্যাঁ পেয়েছি। সামনে সপ্তাহে জয়েনিং ডেট।
শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে আমজাদ বলল, এতবড় খবরটা আগে বলবি তো। তারপর ফারনাকে বলল, তোর মা বাবা তো মহিমকে পছন্দ করেন না। ওনারা মত দিয়েছেন?
ফারহানা বলল, না। আমরা কোর্ট ম্যারেজ করব। মহিমের চাকরি হয়েছে রাজশাহীতে। ওখানেই আমাদের বিয়ে হবে।
ফারনা বড়লোকের মেয়ে। সে জানে মা বাবা ও ভাইয়েরা কিছুতেই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মহিমের সঙ্গে তার বিয়ে দেবে না। মাষ্টার্স পরীক্ষার পর তারা পাত্র খুঁজছে। তারা পাত্র পেয়ে গেলে বিয়ে ঠেকানো খুব শক্ত হবে। এদিকে মহিমেরও কোনো চাকরি হচ্ছে না। মেয়েদের চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ভেবে ওদের সঙ্গে সেও রাজশাহী টেক্সটাইল মিলে অ্যাপ্লাই করেছিল। ফারযানার ইন্টারভিউ লেটার আসে নি। কারণ কোম্পানী মেয়েদের ঐ পদে পছন্দ করে নি। আমজাদ ও মহিম ভালো ইন্টারভিউ দিয়েছিল।
ফারনা জিজ্ঞেস করল, তুই কোনো চিঠি পাস নি?
আমজাদ মাথা নেড়ে বলল, না।
মহিম হেসে ফেলে বলল, চিঠি এলে তুই খবরটা পাবি কি করে? যখন এ্যাপ্লাই করেছিলি তখন তোর ঠিকানা ছিল ইউনির্ভাসিটির হোস্টেলে। চিঠি এলে তো ঐ ঠিকানায় আসবে।
ফারহানা বলল, কারেক্ট। চল, এখনই হোস্টেলে গিয়ে খোঁজ করি। হোস্টেলের পরিচালক হোসেন মধ্যবয়সী মানুষ হলেও নামায রোযা করতেন । ঠিকমতো বাড়িতেও যেতেন না। বেতনের টাকা নিয়ে জুয়া খেলতেন। আমজাদ জানতে পেরে তাকে কুরাআন-হাদিসের বাণী শুনিয়ে হোেদায়েত করেছে। এখন তিনি নিয়মিত বাড়ি যান, নামায-রোযা করতেন, দাড়িও রেখেছেন। জুয়া খেলাও ছেড়ে দিয়েছেন।
হোস্টেলে ঢুকতেই হোসেন এগিয়ে এসে হাসি মুখে সালাম বিনিময় করে আমজাদকে বললেন, কী বাবাজী, এত জলদি আমাদের ভুলে গেলেন। সেই যে গেলেন আর এলেন না। সব ভালো তো?
আমজাদ বলল, হ্যাঁ ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমার কোনো চিঠিপত্র এসেছে?
চিঠি? হ্যাঁ। দুটো চিঠি এসেছিল।
ফারযানা চেঁচিয়ে উঠে বলল, আমজাদ, নিশ্চয় তোরও জয়েনিং লেটার এসেছে।
হোসেনের দিকে তাকিয়ে আমজাদ বলল, চিঠি দুটো নিয়ে আসুন।
আপনি কোথায় আছেন জানি না। তাই সেগুলো আপনাদের বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি।
আমজাদ হতাশ কণ্ঠে বলল, ওঃ।
মহিম বলল, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সামনের সপ্তাহে জয়েনিং ডেট। হাতে চার পাঁচ দিন সময় আছে। তোর বাড়ি তো সাতক্ষীরা টাউনে। আজ রাতের বাসে চলে যা, কাল রাতের বাসে ফিরে আসতে পারবি।
হোস্টেল থেকে ফেরার পথে আমজাদ বলল, পকেট একদাম খালি। তা ছাড়া গণি ভাইকে না জানিয়ে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। কাল থেকে আবার ছাত্রী পড়াতে হবে।
ফারযানা বলল, গণি ভাইকে ফোন করে দে। চাকরি পেয়ে গেলে ছাত্রী পড়াবি কি করে? তুই তো রাজশাহী চলে যাবি। তোর যাতায়াত ভাড়া কত বল, আমি দিচ্ছি। বেতন পেয়ে শোধ করে দিবি।
যাতায়াত ছ’শ টাকা। এত টাকা তোর আছে
ফারযানা তিনটে কড়কড়ে একশ টাকার নোট তার হাতে দিয়ে বলল, আর নেই। ফেরার টাকা তোর মামার কাছ থেকে নিস।
আমজাদ টাকাটা পকেটে রেখে বলল, আল্লাহ্ তোর ভবিষ্যৎ জীবন সুখের করুক। কথা দিচ্ছি, প্রথম মাসের বেতন পেয়ে টাকাটা দিয়ে দেব। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শাহবাগের মোড়ে এসে রাস্তা পার হওয়ার সময় তার নাম ধরে কেউ ডাকছে শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে হাঁটতে উদ্যত হলে। আবার শুনতে পেল, এই আমজাদ, চলে যাচ্ছিস কেন? আমি শাহিন।
আমজাদ বাড়ি যাওয়ার কথা চিন্তা করছিল বলে প্রথম ডাকটা অনেক দূর থেকে যেন কেউ ডাকছে শুনছে। এখন শাহিনের কথা শুনে মনে হল খুব কাছে পেছন থেকে ডাকছে। ঘাড় ঘোরাবার সময় দেখতে পেল, শাহিন ডান দিকের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আজ প্রায় পাঁচ বছর পর স্কুল কলেজের বন্ধু শাহিনকে দেখে আমজাদের মন আনন্দে ছলকে উঠল। কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, তুই ঢাকায় কবে এলি? গাড়ি কার?
শাহিন ট্রাফিক সিগন্যালে ছিল। পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, আগে উঠে আয় তারপর বলব।
ততক্ষণে সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলে উঠছে। আজমাদ গাড়িতে উঠে গেট লাগিয়ে দিতে শাহিন গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছিলি?
আমার কথা বাদ দে, তোর কথা বল।
আমার কথা আর কি বলব? তুই ভার্সিটিতে পড়ার জন্য ঢাকা চলে এলি। আমি বি এ পাশ করে চাকরি না পেয়ে ড্রাইভিং শিখে গাড়ি চালাচ্ছি। তা তুই চাকরি-বাকরি কিছু পেলি?
না পাইনি, বিকেলে একটা প্রেসে প্রুফ দেখি। তা তুই ঢাকায় এলি কবে বললি না যে?
এক ট্যাক্সি ক্যাব কোম্পানীতে ড্রাইভারের চাকরি নিয়েছি। প্যাসেঞ্জার ও দু’নাম্বার মাল নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের সব মফস্বল টাউনে মাল সাপ্লাই দিতে আসি। ঢাকায় এসে মাঝে মধ্যে থাকতে হয়। ঠিকানা জানা থাকলে অনেক আগেই তোর সঙ্গে দেখা করতাম। কাল দুনাম্বার মাল নিয়ে ঢাকায় এসেছি। আজ রাতে চলে যাব। তোর বাসার ঠিকানা দে, আবার এলে দেখা করব।
আমার বাসা নেই একজনের অফিসে থাকি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চাকরির চেষ্টা করি আর বিকেলে কি করি একটু আগে তো বললাম। তা হারে, তুই দু’নাম্বার মালের কথা কি যেন বললি? ওটা তো বেআইনী কাজ। তোর মতো ছেলে এর রকম কাজ করিস ভাবতেই পারছি না।
দেখ আমজাদ, আজকাল দু’নাম্বার কাজ না করলে ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচা যায় না। তুই ধার্মিক, তাই এসব কথা বলছিস। কটা মানুষ সৎপথে রোজগার করছে বলতে পারিস? তুই তো দুনিয়ার খোঁজ খবর রাখিস না, কত দাড়ি টুপিওয়ালা নামাযীও হাজিদের দেখলাম, তাদের বেশিরভাগ দুনাম্বার ব্যবসা করে টাকার পাহাড় জমাচ্ছে। আর সাধারণ মানুষের কাছে তারা ধর্মের লেবাশ পরে কুরআন হাদিস আওড়াচ্ছে।
বাদ যে ওসব কথা, তুই আজ কটার সময় যাবি?
রাত বারোটায়।
এতরাতে কেন?
সে কথা তোর জানার দরকার নেই।
আমি আজ বাসে করে বাড়ি যাব ঠিক করেছিলাম। আমাকে তোর গাড়িতে নিতে পারবি না?
কেন পারব না?
তোর কোনো অসুবিধে হবে না তো?
কিসের অসুবিধে? বরং তুই সঙ্গে থাকলে খুব ভালো লাগবে।
হোটেল অ্যাম্বাসাডারের নিচে গাড়ি পার্ক করে শাহিন বলল, তোর তো এখন কোনো কাজ নেই। আমার রুমে চল, খেয়েদেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেব। তা হারে, রাতে যে অফিসে থাকিস, তা কোথায়?
এখান থেকে কাছেই।
তা হলে তো ভালই হল। এক ফাঁকে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আসতে পারবি।
যা পরে আছি, এর থেকে ভালো ড্রেস নেই। ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।
রাত সাড়ে নটায় খাওয়ার পর রুমে এসে শাহিন বলল, তুই একটু ঘুমিয়ে নে, আমি কাজ সেরে এসে তোকে নিয়ে গাড়িতে উঠব।
আমজাদ জিজ্ঞেস করল, এখন আবার কি কাজ?
সেকথা পরে বলব বলে শাহিন রুম থেকে বেরিয়ে এল।
আমজাদও তার পিছনে পিছনে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তুই ফিরবি কখন?
চিন্তা করিস না, বারটার আগেই ফিরব।
আমজাদ রুমে এসে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবল, ওকি দু’নাম্বার মাল নিতে গেল? যদি রাস্তায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তা হলে আমাকেও পুলিশ ছাড়বে না। বাসে যাওয়াই উচিত ছিল। কথাটা চিন্তা করে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কবে ছাড়া পাবে তার কোনো ঠিক নেই। হাত ঘড়িতে দেখল, পৌনে দশটা। এগারটা পর্যন্ত গাবতলীতে বাস পাওয়া যায়। বাসে করেই যাবে স্থির করে উঠে বসল। আবার ভাবল, ওকে না বলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে। বাথরুম থেকে অযু করে এসে এশার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইল, তিনি যেন নির্বিঘ্নে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেন, রাস্তায় যেন কোনো বিপদে না পড়ে।
শাহিন ফিরল সাড়ে এগারটায়।
আমজাদ দরজায় ছিটকিনি দিয়ে চিন্তা করছিল, বাড়িতে গিয়ে যদি চিঠিটা পাক না পাক, কাল রাতের বাসে ঢাকা ফিরে আসবে। দরজা নক হতে শুনে জিজ্ঞেস করল কে?
আমি শাহিন, দরজা খোল।
আমজাদ দরজা খুলে দিতে শাহিন ভিতরে ঢুকে বলল, পনের মিনিটের মধ্যে বেরোতে হবে। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নে।
ঠিক বারোটার সময় ওরা গাড়িতে উঠল। আরিচা পৌঁছে ফেরিতে ওঠার সময় শাহিন দেখল, দু’জন লোক ঠেলা দিয়ে একটা ট্যাক্সিকে ফেরিতে তুলছে। ভাবল, গাড়িটা নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। ফেরিতে গাড়ি পার্ক করে দেখল, খারাপ গাড়ি থেকে লতিফ নামল। লতিফও ট্যাক্সিক্যাবে চাকরি করত। সে সময় দু’জনের বন্ধুত্ব হয়। মাস ছয়েক হল লতিফ সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় আসমা ইন্ডাস্ট্রিজ মালিকের গাড়ির ড্রাইভারের চাকরি করছে, তা জানে। তার কাছে গিয়ে সালাম বিনিময় করে বলল, কিরে? গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে বুঝি?
লতিফ বলল, হ্যাঁ দোস্ত। চেকআপ করে গাড়ি বের করেছি। ঘাটে এসে। হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কিছু দোষ ধরতে পারি নি।
শাহিন বলল, ফেরি লোড হয়ে ছাড়ার পর কি হয়েছে দেখব। তারপর আমজাদকে দেখিয়ে বলল, আমরা এক সঙ্গে স্কুল কলেজে পড়েছি। তোর মতো বন্ধু।
লতিফ আমজাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, আমি লতিফ।
আমি আমজাদ বলে তার সঙ্গে হাত মোসাফাহা করল।
শাহিন জিজ্ঞেস করল, গাড়িতে কারা?
সাহেব ও সাহেবের দুই মেয়ে।
ফেরি ছাড়ার পর আসিফ সাহেব দুই মেয়েকে নিয়ে দো-তলার ক্যান্টিনে চা খেতে গেলেন।
আমজাদ মেয়ে দুটোকে দেখে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এত নিখুঁত সুন্দরী মেয়ে জীবনে দেখে নি। একজন তরুণী অন্যজন যুবতী। দু’জনেই। সালওয়ার কামিজ পরেছে। ওড়নাটা বুকের উপর দিলেও তা যথাস্থানে নেই। সূচাগ্র বক্ষ কামিজ ঠেলে রেখেছে। গোলাপী ঠোঁটে হাসির ঝিলিক লেগে রয়েছে। হাটার মধ্যে আভিজাত্যের ছাপ। পাশ থেকে যাওয়ার সময় পারফিউমের তীব্র গন্ধ আমজাদের নাকে লাগল। কোনো দিকে না তাকিয়ে বাবার পিছন দোতালায় কেবিনে উঠে গেল মেয়ে দুটি।
আরিচা থেকে দৌলতিয়া যেতে সময় লাগে ফেরিতে পৌনে এক ঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যেও শাহিন ও লতিফ গাড়ি সারাতে পারল না।
আসিফ সাহেব মেয়েদের নিয়ে ফিরে এসে লতিফকে জিজ্ঞেস করলেন, গাড়ি ঠিক হয়েছে?
লতিফ বলল, জি না।
তা হলে এখন কি উপায়? তুমিতো জান, আমাদেরকে সকাল সকাল পৌঁছাতে হবে।
লতিফ কিছু না বলতে পেরে কাচুমাচু হয়ে চুপ করে রইল। শাহিন লতিফের অবস্থা বুঝতে পেরে আসিফ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইঞ্জিনের ব্যাপার কখন কি হয় আগে থেকে জানা যায় না। আপত্তি না থাকলে আপনাদেরকে আমি লিফট দিতে পারি।
আসিফ সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন। তুমি কে? আমাদেরকে কেন লিফট দিতে চাচ্ছে?
শাহিন বলার আগে লতিফ বলল, আমরা একই জায়গার ছেলে। ও আমার বন্ধু।
আসিফ সাহেব শাহিনকে জিজ্ঞেস করলেন, গাড়ি তোমার নিজের জি না।
সাতক্ষীরা ট্যাক্সি ক্যাবের। প্যাসেঞ্জার নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম।
আসিফ সাহেব চিন্তিত মুখে শাহিনের আপাদমস্তক লক্ষ করতে লাগলেন।
লতিফ বলল, স্যার, ও আমার খুব বিশ্বস্ত বন্ধু। আপনি নিশ্চিন্তে ওর গাড়িতে যেতে পারেন। আমি গাড়ি সারিয়ে নিয়ে আসব।
এতক্ষণ আমজাদ তাদের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল আর মাঝে মাঝে আড়চোখে মেয়ে দুটোকে দেখছিল।
তাকে উদ্দেশ্য করে আসিফ সাহেব বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছ? আমজাদ কিছু না বলে শাহিনের দিকে তাকাল।
শাহিন বলল, আমার বন্ধু আমজাদ। এবছর স্থাপত্ত শিল্পে মাষ্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে। আমার সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছে। ওর বাড়িও সাতক্ষীরা।
আসিফ সাহেব চিন্তা করতে লাগলেন, একা হলে কোনো কথা ছিল না। দু’টো সেয়ানা মেয়ে নিয়ে অন্যের গাড়িতে যাওয়া কি ঠিক হবে? তা ছাড়া প্রায় একলাখ টাকার সোনার গহনা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন ভাগ্নীর বিয়েতে দেয়ার জন্য।
সাহেবের চিন্তার কথাটা লতিফ যেন বুঝতে পারল। বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। নিশ্চিন্তে শাহিনের গাড়িতে যান।
কোনো উপায় না দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, ঠিক আছে, আমরা ওর গাড়িতেই যাব। তুমি গাড়ি ঠিক করে তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
ততক্ষণে ফেরী থেকে গাড়ি নামতে শুরু করেছে। শাহিন গাড়ির পিছনের গেট খুলে দিয়ে বলল, আপনারা উঠুন। ওনারা ওঠার পর গেট বন্ধ করে আমজাদকে সামনে উঠতে বলে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসল।
মাগুরা পৌঁছাবার মাইল তিনেক আগে সামনের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে পড়তে শাহিনও গাড়ি থামাল। ওদের গাড়ির সামনে দুটো ট্যাক্সী, টাক্সী দু’টোর আগে একটা বাস। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওদের গাড়ির পিছনে ট্যাক্সী, বাস ও লরীর দীর্ঘ লাইন পড়ে গেল।
আসিফ সাহেব বিরক্তি গলায় বললেন, কি ব্যাপার? এখানে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে না কি?
কে একজন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, গাছ ফেলে বেরিকেড দিয়ে তাকাতরা বাসে ডাকাতি করছে।
কথাটা শুনে আসিফ সাহেব ভয়ার্তস্বরে বললেন, সর্বনাশ, এখন কি হবে? আমাদের গাড়িতেও যদি ডাকাতি করে? তরপর শাহিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, গাড়ি ব্যাক করে ঘুরিয়ে ঘাটের দিকে চল।
শাহিন বলল, তা সম্ভব নয়। দেখছেন না, গাড়ি ঘোরাবার কোনো পথ নেই?
আমজাদ শাহিনকে বলল, তোর কাছে পিস্তল বা রিভলবার আছে?
পিস্তল নিয়ে তুই একা কি করবি?
যাই করি, আছে কিনা বল।
না, নেই।
আমজাদের কথা আসিফ সাহেব শুনতে না পেলেও শাহিনের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, আমার রিভলবার আছে।
আমজাদ বলল, আমাকে দিন।
আসিফ সাহেব রিভলভার তার হাতে দিতে আমজাদ জিজ্ঞেস করল, লোডেড আছে তো?
আসিফ সাহেব বললেন, আছে। ছ’টা ফায়ার হবে।
ঠিক আছে বলে আমজাদ গাড়ি থেকে নামার সময় বলল, আপনারা গেটের কাঁচ বন্ধ করে দিন। আর আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।
শাহিন বলল, এত সাহস দেখাস নি আমজাদ।
আমজাদ তার কথা শেষ হওয়ার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল। রাস্তার কিনারে এসে শুয়ে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামল। নিচটা ধানি জমি। অন্ধকার রাত থাকায় সুবিধে হল। আমজাদ বুকে হেঁটে সামনের বাস বরাবর এসে একইভাবে রাস্তার উপরে উঠে এসে একটা বড় গাছের আড়ালে আত্মগোপন করে রইল।
ডাকাতরা দলে ছিল সাতজন। দুজন এল. এম. জি. হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন বাসের গেটে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে করে কোনো প্যাসেঞ্জার নামতে না পারে। বাকি চারজন প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে হাত ঘড়ি টাকা পয়সা, সোনার গহনা ও অন্যান্য দামী জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যখন একজন একজন করে নামতে শুরু করল তখন আমজাদ প্রথমে রাস্তায় দাঁড়ান। এল. এম. জি. হাতে দু’জনকে গুলি করল, আর অন্যদের দিকে তাক করে পরপর। চারটে ফায়ার করল। একটা গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও দলের পাঁচজন গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখে বাকি দু’জন সবকিছু ফেলে দিয়ে মাঠের দিকে পালাতে গেল। আমজাদ রিভলভারটা গাছের তলায় রেখে পলাতক দু’জন ডাকাতের দিকে এগিয়ে আসার সময় চিৎকার করে দু’পাশের প্যাসেঞ্জারদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা সবাই ঘিরে ফেলুন। তারপর একজন ডাকাতকে ধরে উত্তম মধ্যম দিয়ে অজ্ঞান করে অন্যকে ধরার জন্য ছুটল। কিন্তু অন্ধকার রাত থাকায় কিছুদূর ছুটেও তাকে দেখতে পেল না। তারপর গাছতলা থেকে রিভলবারটা নিয়ে গাড়ির কাছে এসে আসিফ সাহেবকে ফেরৎ দিয়ে শাহিনকে বলল, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, আমি ব্যারিকেডটা সরাবার ব্যবস্থা করে আসি। তারপর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখল, শত শত প্যাসেঞ্জার ঐ পাঁচজন আহত ডাকতদের ধোলাই দিয়ে আধমরা করে ফেলেছে। তাদেরকে বেঁধে ফেলার কথা বলে আমজাদ অন্যান্য কিছু প্যাসেঞ্জারদেরকে বলল, মাগুরা থানায় ঘটনাটা জানানো দরকার। আমার গাড়ি আছে, আমি জানাতে যাব। সবাই মিলে রাস্তার ব্যারিকেডটা সরিয়ে ফেলি আসুন।
ব্যারিকেড সরিয়ে বাসের ড্রাইভার প্যাসেঞ্জারদেরকে আমজাদ বলল, আপনারা অপেক্ষা করুন, আমি থানায় খবর দিতে যাচ্ছি। পুলিশ আসার পর যা করার করবেন।
শাহিন গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আমজাদের সাহস ও বুদ্ধির কথা চিন্তা করছিল। স্কুল-কলেজের সেই হাঁদারাম মার্কা আমজাদ যে ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হবে ভাবতেই পারছে না।
আমজাদ ফিরে এসে বলল, গাড়িতে ওঠ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।
শাহিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, তুই যা করলি ভাবতেই পারছি না।
আমজাদ বলল, ভাববার দরকার নেই, স্পীড বাড়া। মাগুরা থানায় খবরটা দিয়ে আমরা বেরিয়ে যাব।
আসিফ সাহেব আমজাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার কার্যকলাপ দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। তোমার মত সাহসী ছেলে দেশের জন্য গৌরব। তা তুমি ঢাকায় এখন কি কর?
চাকরি খুঁজছি।
আসিফ সাহেব একটা কার্ড তার হাতে দিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে দেখা করো।
কার্ডটি বুক পকেটে রেখে আমজাদ বলল, ধন্যবাদ।
যশোহরে পৌঁছাবার আগে বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। হঠাৎ মিররের দিকে চোখ পড়তে আমজাদ দেখতে পেল, তরুণী মেয়েটি একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে হাসির আভা ফুটিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর কৌতূহলবশত আবার মিররের দিকে তাকিয়ে দেখল, একইভাবে তরুণীটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমজাদ দৃষ্টি ফেরাতে যাবে এমন সময় মেয়েটি তাকে মৃদু হাসি উপহার দিল।
তরুণীর হাসি আমজাদের বুকে তীরের মতো বিঁধল। সেও মৃদু হেসে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল।
তরুণীর নাম আফরা আনান। সবাই আনান বলে ডাকে। তার বড় বোনের নাম আফরা রুমালী। ডাক নাম রুমালী।
রুমালী ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে আনানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কিরে এতক্ষণ ধরে মিররের দিকে তাকিয়ে রয়েছিস কেন?
আনান এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না। মিররে আমজাদের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছিল, দেখতে সুন্দর ও সহজ সরল ছেলেটা একা অতগুলো ঢাকাতদের ঘায়েল করল কি করে? নিশ্চয় সিভিল ড্রেসে পুলিশের লোক। আবার চিন্তা করল, তাই। যদি হয়, তা হলে বাবাকে চাকরি খোঁজার কথা বলল, কেন?
রুমালীর কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে আনানও তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ড্রাইভারের পাশের ছেলেটাকে দেখছিলাম আর চিন্তা করছিলাম, ঐ পুচকে ছোঁড়াটা কি করে এতবড় একটা ঘটনা ঘটাল।
তাই বল, আমি মনে করিছি ঐ পুচকে ছোঁড়াকে দেখে তুই মুগ্ধ হয়েছিস। যশোহর টাউনে এসে শাহিন আসিফ সাহেবকে বলল, ঠিকানাটা বলুন।
ওনাদের নামিয়ে দিয়ে সাতক্ষীরা যখন পৌঁছাল তখন বেলা আটটা। শাহিন আমজাদকে তাদের বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলে গেল, তুই যদি আজই ফিরে না যাস, তা হলে সন্ধ্যেবেলা ক্যাবে দেখা করিস।
Leave a Reply