৯. পলাশির পরিণাম: সুদূরপ্রসারী প্রভাব

পলাশির পরিণাম: সুদূরপ্রসারী প্রভাব

প্রায়-সমসাময়িক ঐতিহাসিক করম আলি পলাশির পরিণতি খুব সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছেন: ‘পলাশির পরে ইংরেজরা বাংলায় তাদের নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল।’ মঁসিয়ে জাঁ ল’-ও বলেছেন যে পলাশি সমগ্র বাংলাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। এমনকী ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টন ঠিক পলাশি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই, যখন মীরজাফর মসনদেও বসেননি, মন্তব্য করেছেন যে এখন ‘সারা বাংলা আমাদের হাতের মুঠোয়।’ বস্তুতপক্ষে সম্প্রতি দেখানো হয়েছে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নবাবি আমলে বাংলায় যে আর্থিক ও শিল্পবাণিজ্যে শ্রীবৃদ্ধি দেখা গেছে, পলাশির পর তা ধীরে ধীরে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। এই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজ কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের দৌলতে বাংলার অর্থনৈতিক অবক্ষয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় প্রায়-সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও পর্যটক আলেকজ্যান্ডার ডো-র (Alexander Dow) লেখায়। তিনি লিখেছেন: ‘যে দিন থেকে বাংলা বিদেশিদের অধীনে চলে যায় সেদিন থেকেই বাংলার অর্থনৈতিক অধোগতির সূত্রপাত।’. এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পলাশির পর বাংলায় এক ‘অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ’ শুরু হয়ে যায়, যার চরিত্র ছিল অত্যন্ত নির্মম। রাজনৈতিক দিক থেকে বলা যায় যে, পলাশির পর ইংরেজরা বাংলায় পুরোপুরি আধিপত্য বিস্তার করে এবং এখান থেকেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনের পথ সুগম হয়।

পলাশির পর ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের কাছে অবাধ লুঠপাটের সব দরজা খুলে যায় এবং তারাও দু’হাতে লুঠতরাজ শুরু করে দিল বলে একজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের যে বক্তব্য তাতে কোনও অতিরঞ্জন নেই। পলাশির পরেই যে লুঠ শুরু হয় তার অনুরূপ কিছু পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জোর করে অগাধ টাকাপয়সা ও ধনরত্ন আদায় করে নেওয়ার এমন দৃষ্টান্ত খুব কমই দেখা গেছে। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বাংলা থেকে এভাবে সংগৃহীত অপরিমেয় ধনসম্পদ সব বাংলার বাইরে পাঠিয়ে দেয় এবং এভাবে শুরু হয় বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের এক অবাধ প্রক্রিয়া। এই ধন নিষ্ক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়ে এবং তার ফলে দেশের ও মানুষের অবস্থা অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থাৎ পলাশি-উত্তর ৪২-৪৩ বছরে বাংলা থেকে কী বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ বাংলার বাইরে চলে যায় তার সঠিক হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়, যদিও এ-সম্বন্ধে কিছুটা আন্দাজ মাত্র করা যেতে পারে। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা নানা উপায়ে বাংলা থেকে প্রচুর ধনসম্পদ আহরণ করেছিল। ধন নিষ্ক্রমণের সঠিক হিসেব করতে গেলে এ-সবগুলি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কোনও কোনও বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মনে করেন যে কোম্পানির কর্মচারীদের (যারা ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল) অপরাধী ধরে নিয়ে তাদের সর্বজনীন একটা নিন্দার পাত্র বলে গণ্য করা সমুচিত হবে না। সেই যুগের মাপকাঠি দিয়ে তাদের বিচার করতে হবে; তাদের নৈতিকতাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিসমষ্টি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাও অনুচিত। মনে রাখতে হবে, তারা ভারতবর্ষে এসেছিল প্রধানত ধনসম্পদ আহরণ করে ধনবান হওয়ার জন্য আর তা ছাড়া ইংরেজ জাতির যদি কিছু হিতসাধন করা যায় তার জন্য। তারা যা করছে তা আদৌ যুক্তিসঙ্গত কি না সে-প্রশ্ন নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায়নি এবং তারা যা করছে তা নিয়েও তাদের কোনও অলীক ধারণা ছিল না। এ-বক্তব্য নিয়ে তর্ক না তুলেও এটা বলা অনুচিত হবে না যে, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের নানা কাজকর্মের ফলে ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে তার অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছিল তার সম্যক বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন।

কোম্পানি ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০-এর মধ্যে মীরজাফরের কাছ থেকে ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা পেয়েছিল।১০ তা ছাড়া মীরজাফর কোম্পানির কর্মচারীদের নগদ পুরস্কার ও দান হিসেবে ৫৯ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে পলাশি কোম্পানির কর্মচারীদের দ্রুত ব্যক্তিগত লাভের অনেক পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলায় রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়ে মীরজাফর ও অন্যান্যদের কাছ থেকে আনুমানিক ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা পেয়েছিল। এই টাকার মধ্যে কিন্তু বিপ্লব সংগঠিত করে কোম্পানির নিজস্ব লাভের পরিমাণ অন্তর্ভুক্ত নয়। ওই সময়ের মধ্যে এর পরিমাণ নগদ ৮ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা এবং ভূমিরাজস্ব বাবদ ৫৬ লক্ষ টাকা।১১

পলাশি বিপ্লবের ফলে ব্যক্তিগতভাবে ক্লাইভই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলেন। তবে বিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ ফৌজের সাধারণ স্তরের একজন সৈনিকও কম করে ২৪,০০০ টাকা করে পেয়েছিল।১২ পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ক্লাইভ তাঁর পিতাকে লেখেন যে মীরজাফর তাঁকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে মোট ২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হয়েছেন এবং তাঁর বদান্যতায় ওই টাকা পেলে ‘আমি দেশে গিয়ে এমন আরামে থাকতে পারব যা কোনওদিন কল্পনাই করতে পারিনি।’১৩ কোম্পানির আরেক কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন যে, পলাশির ফলে ‘ইংরেজ জাতির ৩০ লক্ষ পাউন্ড লাভ হয়েছিল।’ তা ছাড়া বাংলার নবাবের কাছ থেকে যা টাকা পাওয়া গেছে ‘তার সবটাই শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে চলে এসেছে, কারণ বাংলায় যে টাকাটা পাওয়া গেছে তা দিয়ে চিন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ছাড়াও সারা ভারতবর্ষের বাণিজ্যই আমরা তিন বছর চালিয়েছি, ইংল্যান্ড থেকে এক আউন্স রুপোও নিয়ে আসার প্রয়োজন হয়নি।’১৪ এ-সব নগদ টাকা ছাড়াও কোম্পানিকে যে ভূখণ্ড দেওয়া হয়েছিল তা থেকে, ক্লাইভের অনুমান অনুযায়ী, বছরে আয়ের পরিমাণ হবে ১২ লক্ষ টাকা।১৫

পলাশির পরে কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের হাতে এভাবে অঢেল টাকাপয়সা আসার ফলে কোম্পানিকে আর ইংল্যান্ড থেকে রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে এসে বাংলা থেকে রফতানি পণ্য কিনতে হয়নি। বাংলায় সংগৃহীত অর্থ দিয়ে শুধু বাংলার বাণিজ্য নয়, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের, এমনকী চিনদেশের সঙ্গে বাণিজ্য এবং কোম্পানির অন্যান্য খরচপত্র মেটানোও সম্ভব হয়েছিল। প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় পণ্য সংগ্রহের জন্য যে পরিমাণ টাকার দরকার হত, তার প্রায় শতকরা আশি থেকে নব্বই ভাগই ইংল্যান্ড থেকে সোনা-রুপো হিসেবে আসত। কিন্তু পলাশির পর ইংল্যান্ড থেকে সোনা-রুপো আসা একদম বন্ধ হয়ে গেল। কোম্পানির যাবতীয় বাণিজ্য ও খরচপত্র বাংলার রাজস্ব ও কোম্পানি এবং তার কর্মচারীদের বাংলায় সংগৃহীত অর্থেই চলত। এভাবেই বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের সূত্রপাত হল।১৬ বস্তুতপক্ষে, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ এই দশ বছরে বাংলা থেকে রফতানি পণ্যের মোট যে মূল্য তা থেকে বাংলায় আমদানি পণ্যের মোট মূল্য বাদ দিয়ে পণ্যসামগ্রী ও সোনা-রুপো মিলিয়ে যে ধন নিষ্ক্রমণ হয়েছিল তার পরিমাণ দাঁড়ায় আনুমানিক ৪ কোটি টাকা।১৭

জেমস গ্যান্টের (James Grant) হিসেব অনুযায়ী ১৭৮৬ সালে বাংলা থেকে যে পরিমাণ ধন নিষ্ক্রমণ হয় তার পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। এই হিসেবে অবশ্য বাংলা থেকে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে যে পরিমাণে অর্থ চলে যাচ্ছিল তা ধরা হয়নি। কোম্পানির পরিচালক সমিতির হিসেব অনুযায়ী এর পরিমাণ বছরে ২০ লক্ষ টাকা।১৮ হোল্ডেন ফারবারও (Holden Furber) অন্যভাবে হিসেব করে গ্যান্টের মতোই সিদ্ধান্ত করেছেন যে, সমগ্র ভারতবর্ষকে ধরে ১৭৮৩-৮৪ থেকে ১৭৯২-৯৩ পর্যন্ত এই ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ বছরে ১ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকার মতো।১৯ ইরফান হাবিব কিন্তু মনে করেন, পণ্যসামগ্রীর ক্রয়মূল্য ধরে হিসেব করলেও ওই হিসেব নিতান্তই কম। তাঁর অনুমান, ১৭৮০ ও ১৭৯০-এর দশকে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে বাৎসরিক যে ‘ট্রিবিউট’ বা অর্থ যেত তার পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টাকার মতো।২০ যদি তাই হয়, তবে এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না যে এর আগের দু’ দশকে অর্থাৎ ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি ছিল কারণ তখনই বাংলায় কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা, উপঢৌকন ও দপ্তরের (নানা উপরি পাওনা) মাধ্যমে প্রচর অর্থ সংগ্রহ করেছিল এবং তার প্রায় সবটাই বিভিন্ন পথে বাইরে চলে যেত। বাংলার নবাব ও অন্যান্যদের কাছ থেকে কর্মচারীরা নানাভাবে যে অর্থ আদায় করত তার কোনও হিসেবপত্র নেই। ফলে এ ভাবে যে অর্থ সংগৃহীত হয় তার পরিমাণ সম্বন্ধে কোনও সঠিক ধারণা করা সম্ভব নয়। তবে যে-সব অর্থপ্রাপ্তির রসিদপত্র পাওয়া যায় তা থেকে এটা বলা যায় যে, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সালের মধ্যে (যখন উপহার, পারিবারিক দস্তুর, ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিল) ইংরেজরা শুধু ব্যক্তিগত ভাবেই যে অর্থ পেয়েছিল তার মোট পরিমাণ আনুমানিক ৫ কোটি টাকার মতো হবে।২১

কোম্পানির কর্মচারীদের আয়ের সবচেয়ে লোভনীয় উৎস ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসা। তারা বেপরোয়াভাবে যে বিশাল পরিমাণ অন্তর্বাণিজ্য করতে শুরু করল তা এর আগে কোথাও দেখা যায়নি। এটা তাদের প্রাপ্ত উপহার, দান, দস্তুর প্রভৃতির চেয়েও দেশের পক্ষে অনেক বেশি ক্ষতিকারক ছিল। তাদের এভাবে দেশের অন্তর্বাণিজ্যকে কুক্ষিগত করাটা দেশের ‘অর্থনীতি লুঠে’র সামিল বলে গণ্য করা চলে। তা ছাড়া এর ফলে যে-সব ভারতীয় ও এশীয় বণিক প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তারা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল এবং এভাবে বাংলার সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যগত স্থলপথে বহির্বাণিজ্য নষ্ট হয়ে যায়।২২ ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীরা কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিল তার কোনও সঠিক হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা শুধু কোম্পানির কয়েকজন কর্মচারী তাদের নিজস্ব ব্যবসার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ রোজগার করেছিল তার একটা আন্দাজ দিতে পারি যা থেকে সাধারণভাবে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করত তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।

মুর্শিদাবাদ দরবারের ইংরেজ প্রতিনিধি সাইকস (Sykes) মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য জেলায় সোরা, কাঠ ও রেশমের একচেটিয়া ব্যবসা করে দু’বছরে ১২ থেকে ১৩ লক্ষ টাকা রোজগার করেছিলেন প্রতি বছরে।২৩ আরেকজন কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts) ব্যক্তিগত ব্যবসা করে ৬ বছরে ৭ লক্ষ ২০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা এভাবে যে পরিমাণ টাকাপয়সা উপার্জন করত তার প্রায় সবটাই বিলস অব এক্সচেঞ্জ (Bills of Exchange) বা হুণ্ডির মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও ইউরোপে পাঠিয়ে দিত। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টারি কমিটির একটি অনুমান অনুযায়ী কোম্পানির কর্মচারীরা পলাশি বিপ্লবের পর এক দশকে ইংরেজ ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ওপর হুণ্ডির মাধ্যমে প্রতি বছর ৮০ লক্ষ টাকা ইংল্যান্ড ও ইউরোপে পাঠিয়েছিল। এই হিসেবের মধ্যে অবশ্য কোম্পানির কর্মচারী নয় এমন ইংরেজ ও ইউরোপীয়দের চিন দেশে রফতানির মূল্য ধরা হয়নি। সেখানে রফতানি পণ্য বিক্রি করে টাকাটা সোজা ইংল্যান্ড বা ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হত। ১৭৮৩ সালের একটি পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী এভাবে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা ইংল্যান্ডে পাঠায়। কোম্পানির অনেক কর্মচারী আবার হিরে রফতানির মাধ্যমে বাংলা থেকে টাকা পাচার করত—হিরেগুলি চোরাইচালান করা হত ইউরোপে৷২৪

শুধু ইংরেজ কোম্পানি নয়, বাংলায় অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিরও পলাশির পরে ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো এনে বাংলায় রফতানি পণ্য কেনার প্রয়োজন হত না। প্রাক্-পলাশি যুগে ইংরেজদের মতো তাদেরও ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো/নগদ টাকাপয়সা এনে বাংলায় পণ্যসংগ্রহ করতে হত। কিন্তু পলাশির পরে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের সংগৃহীত অর্থ এ-সব কোম্পানিকে দিত যা দিয়ে কোম্পানিগুলি বাংলায় পণ্য কিনত আর ওই অর্থের সমপরিমাণ টাকা হুণ্ডির মাধ্যমে এ-সব কর্মচারীদের নামে ইউরোপে চলে যেত। ফলে কোম্পানিগুলিকে আর ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো আনতে হত না। এটা বাংলা থেকে একরকম ধন নিষ্ক্রমণেরই সামিল। ১৭৬৮ সালেও কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল জানিয়েছিল যে, ডাচ ও ফরাসিদের তহবিলে টাকা উপচে পড়ছে যা দিয়ে আগামী তিন বছর তাদের রফতানি পণ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য খরচ সহজেই মেটানো যাবে।২৫ বারওয়েলের (Barwell) অনুমান অনুযায়ী ১৭৫৬ ও ১৭৬৭ সালের মধ্যে ডাচ ও ফরাসিদের মাধ্যমে যে অর্থ ইউরোপে চালান যায় তার পরিমাণ কম করে ৯৬ লক্ষ টাকা।২৬

প্রাক্-পলাশি বাংলা থেকে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানির রফতানির মোট মূল্য প্রতি বছর গড়ে ৬২ লক্ষ টাকার মতো ছিল।২৭ এর সঙ্গে ফরাসি ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের বাণিজ্য যোগ করলে গড়মূল্য বছরে ৭০ লক্ষ টাকার মতো দাঁড়ায়। এই রফতানি বাণিজ্যের পণ্যসংগ্রহের জন্য প্রায় পুরো টাকাটাই ইউরোপ থেকে সোনা-রুপোর মাধ্যমে আনতে হত।কিন্তু পলাশির পরে বাংলায় এই সোনা-রুপোর আমদানি একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং এটা বাংলা থেকে যে ধন নিষ্ক্রমণ হয় তার একটা বড় অংশ। ইংরেজ কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী (যিনি পরে বাংলার গভর্নরও হয়েছিলেন) ভেরেলস্ট (Verelst) মন্তব্য করেছেন যে ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সালের মধ্যে বাংলায় সোনা-রুপো আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এখান থেকে ধনসম্পদ বাইরে চলে যাওয়া—এই দুটো মিলে বাংলার ৬ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার লোকসান হয়।২৮ একটি আনুমানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী পলাশির পর এক দশকে বাংলা থেকে কোম্পানিগুলির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ইউরোপীয় ও ইংরেজদের হিরের চোরাচালান ও চিনদেশে রফতানি বাদ দিয়ে যে ধনসম্পদ বাইরে চলে যায় তার মূল্য হবে ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। বাংলার রাজস্ব বছরে ২ কোটি ২৪ লক্ষ ধরে পলাশির পর এক দশকে বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক রাজস্বের ৬১ শতাংশ। এটা রক্ষণশীল অনুমান। প্রকৃতপক্ষে ৬৬ শতাংশের মতো হবে।২৯ সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পলাশির পর বাংলা থেকে এক বিশাল আকারের ধন নিষ্ক্রমণ শুরু হয় এবং তাতে বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

কোনও কোনও ঐতিহাসিক কিন্তু বাংলা থেকে এই যে ধন নিষ্ক্রমণ এবং তার ফলে অর্থনীতিতে যে অবক্ষয় দেখা যায় তা স্বীকার করতে নারাজ। এঁদের বক্তব্য, এর জন্য প্রথমে চাই ‘ধন-নিষ্ক্রমণের একটি যথার্থ সংজ্ঞা এবং এই নিষ্ক্রমণের যে পরিমাণ তার সঙ্গে বাংলার মোট আয়ের (income) একটা তুলনামূলক হিসেব।’৩০ বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণ ও অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন রকমের অনুমান ও মতামত আছে। একটি মত হচ্ছে, এই নিষ্ক্রমণের ফলে বাংলার সম্পদের ৫ থেকে ৬ শতাংশ লোকসান হয়। আবার অন্য একটি মতে সম্পদ শুধু একতরফা স্থানান্তরিত হওয়ায় ভারতীয় অর্থনীতিতে অবক্ষয় দেখা গেছে, এ-কথা বলা যায় না।৩১ এই মতের সপক্ষে যুক্তি, কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের ইউরোপে অর্থ পাঠাবার তাগিদের ফলে একদিকে রফতানি অনেক বেড়ে যায় এবং এ-রফতানির প্যাটার্নেও অনেক পরিবর্তন হয়। আরও যুক্তি, বাংলায় ইংরেজ শাসনের প্রবর্তন না হলে ইংল্যান্ড থেকে আমদানি বস্ত্রের প্রতিযোগিতার সামনে বাংলা থেকে মিহিবস্ত্রের রফতানি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলেও, রেশম ও আফিং-এর রফতানির পরিমাণ খুব কমই থেকে যেত এবং তা বাড়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকত না। তা ছাড়া নীল রফতানির প্রশ্নই আসত না।৩২ এ-সব যুক্তি দেখিয়ে বলা হচ্ছে যে কোম্পানির সরকার কর বাবদ কৃষক ও কারিগরদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ আদায় করছিল, তার একটা অংশ কোম্পানি এভাবে (রফতানি বৃদ্ধি করে) তাদের ফেরত দেয়। আর প্রাক্-পলাশি বাংলার শ্রীবৃদ্ধিতে যে-সব দেশীয় বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কার-মহাজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, উত্তর-পলাশি যুগে তাদের পতনের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে যে, কোম্পানির আমলে যে-সব নতুন সুযোগসুবিধের সৃষ্টি হয় তাতে এক নতুন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং এরাই পূর্বতন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ীর অভাব পূরণ করে, ফলে তেমন কিছু ক্ষতি আসলে হয়নি।৩৩

কিন্তু ওপরের যুক্তিগুলি গ্রহণ করা কঠিন। এ-ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে, উত্তর-পলাশি পর্বে ইংল্যান্ড থেকে কোনও সোনা-রুপো না এনেই বাংলা থেকে সব পণ্য সংগ্রহ করে রফতানি করা হয়েছে, যা আগে কখনও হয়নি৷ ইরফান হাবিব ৩৪ একটি প্রবন্ধে এ-বিষয়ে বলেছেন যে, পলাশির পরে ভারতবর্ষ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বাইরে চালান করা হয়েছিল, তার সব যদি একদিকে জেমস গ্র্যান্ট ও জন শোরের (John Shore) প্রদত্ত৩৫ বাংলার মোট জাতীয় উৎপাদনের সঙ্গে এবং অন্যদিকে ব্রিটেনে ব্রিটিশ জাতীয় আয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা হলে এদেশ থেকে ধন নিষ্ক্রমণের প্রভাব সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকবে না। এই থেকেই স্পষ্ট হবে ধন নিষ্ক্রমণ ভারতীয় অর্থনীতিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্রিটেনকে কতটা সমৃদ্ধ করেছিল। ইংরেজ কোম্পানি বাংলার রফতানি পণ্য প্রায় কুক্ষিগত করার ফলে, ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য বাদ দিলে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য যে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না।৩৬ উত্তর-পলাশি পর্বে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার চিরাচরিত স্থলবাণিজ্য প্রচণ্ড মার খায় অথচ মধ্য-অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত স্থলপথে বাংলার এই বহিবাণিজ্যের পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রফতানি বাণিজ্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশিই ছিল.৩৭

আবার উত্তর-পলাশি পর্বে বাংলার রফতানি আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায় বলে যে-বক্তব্য তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতদিন প্রাক্‌-পলাশি যুগে বাংলার রফতানি বাণিজ্য বলতে আমাদের দৃষ্টি সাধারণত ইউরোপীয় বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতীয় ও অন্যান্য এশীয় বণিকরা বাংলা থেকে যে রফতানি বাণিজ্য করত তা আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিইনি, মুখ্যত এই কারণে যে এ-বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও তথ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং তেমন কোনও পরিসংখ্যানও আমাদের হাতে ছিল না। কিন্তু এখন আমরা তথ্যপ্রমাণ ও পরিসংখ্যান দিয়ে এটা দেখাতে পেরেছি যে, মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে বস্ত্র রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়রা ইউরোপীয়দের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিল। শুধু তাই নয়, বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের কাঁচা রেশম রফতানির পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রফতানির চার-পাঁচগুণ বেশি ছিল। এই তথ্যগুলি মনে রাখলে উত্তর-পলাশি পর্বে রফতানি বৃদ্ধির ফলে পূর্বতন এশীয় রফতানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে দিয়েছিল বলে যে-বক্তব্য তা অসার হয়ে পড়ে। তা ছাড়া, পলাশির পরে অনেক সুযোগসুবিধে সৃষ্টি হওয়ায় নতুন এক ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় বলে যে বক্তব্য, সে-সম্বন্ধে এটা বলা যায় যে, এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনও তুলনাই হয় না। প্রাক্-পলাশি এবং উত্তর-পলাশি এই দুই পর্বের মধ্যে আসমান-জমিনের ফারাক। আগে শিল্পবাণিজ্যের যে সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশ ছিল তা দেশীয় ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কারদের উদ্ভব ও শ্রীবৃদ্ধির যথেষ্ট সহায়ক ছিল। কিন্তু উত্তর-পলাশি পর্বে কোম্পানির শাসনকালে তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, তার ফলে এ সময় জগৎশেঠ, খোজা ওয়াজিদ বা উমিচাঁদের মতো কোনও বণিকরাজার আবির্ভাব হয়নি বা ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে আসা কোনও প্রভাবশালী সওদাগরও আর চোখে পড়ে না। এমনকী নবাবি আমলের বড় বড় দাদনি বণিকদের মতো (যেমন কলকাতার শেঠ ও বসাক, কাশিমবাজারের কাটমা পরিবার, ইত্যাদি) কারও সাক্ষাৎও মেলে না।৩৮ এদের মধ্যে অনেকেই কোম্পানিগুলির সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করতে পারত, কোম্পানির সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিল সমানে-সমানের। কিন্তু পলাশির পরে যে বণিক ব্যাঙ্কার-গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় তাদের বেশির ভাগই ছিল কোম্পানির বশংবদ এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কোম্পানির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল—যা প্রাক্-পলাশি যুগের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।

অন্যদিকে উত্তর-পলাশি পর্বে কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা কৃষক, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের কাছ থেকে কর বাবদ যা আদায় করেছিল তার একটা অংশ তাদের অন্যভাবে (রফতানি বাণিজ্যের উন্নতি ঘটিয়ে) ফিরিয়ে দিয়েছিল বলে যে যুক্তি, তা এ সময় তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা যে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল, তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। পলাশির পরবর্তী সময় এরা তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার ও শোষণ চালায় এবং তার ফলে বাংলার সুপ্রাচীন সব শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।এতে তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে, তাদের দুঃখদুর্দশার সীমা থাকে না। অথচ নবাবি আমলে তাঁতিদের এতটা স্বাধীনতা ছিল যে, তারা ইচ্ছেমতো কাপড় তৈরি করতে পারত এবং তারা এই কাপড় তাদের ইচ্ছেমতো যে-কোনও ক্রেতাকে বিক্রি করতে পারত। কিন্তু পলাশির পর তাদের এই স্বাধীনতা পুরোপুরি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা তাঁতি-কারিগরদের ওপর নিজেদের ‘প্রভুত্ব’ স্থাপন করে।তারা তাঁতিদের বাধ্য করল তাদের নির্দেশ মতো শুধু যে ধরনের ও যে পরিমাণ কাপড় তারা বুনতে বলবে তাই তাঁতিদের বানাতে হবে, তার অন্যথা করা চলবে না। এজন্য তাদের খুশিমতো দাম তারা তাঁতিদের নিতে বাধ্য করত, যদিও ওই দাম খোলা বাজারের দামের চেয়ে অনেক কমই হত। কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের গোমস্তারা তাদের ‘প্রভু’দের সাহায্যে, বলতে গেলে, এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর একদিকে শারীরিক নির্যাতন ও নানা নিপীড়ন এবং অন্যদিকে মাত্রাহীন শোষণ চলতে থাকে। এদের এখন একেকজন নির্দিষ্ট গোমস্তার কাছে নাম লেখাতে বাধ্য করা হল। একজন তাঁতি যে গোমস্তার কাছে নাম লেখাতে বাধ্য হল, সে সেই গোমস্তা ছাড়া অন্য কারও জন্য কাপড় বুনতে পারবে না, এ নিয়ম চালু হল। আবার এক গোমস্তার খাতায় নাম লেখানো তাঁতিকে অন্য গোমস্তার কাছে ‘ক্রীতদাসের’ মতো ‘হাতবদল’ও করা হত।

প্রাক্-সমসাময়িক একটি পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা এক ইংরেজ লেখক মন্তব্য করেছেন যে তাঁতি-কারিগরদের (উত্তর-পলাশি যুগে) দুর্দশা বর্ণনাতীত।৩৯ ১৭৬৯ সালে কোম্পানির এক কর্মচারী, রিচার্ড বেচার, যিনি প্রাক্-পলাশি বাংলায় ছিলেন, অন্য এক কর্মচারী, ভেরেলস্টকে লেখেন: ‘কোম্পানি দেওয়ানি পাওয়ার (১৭৬৫) পর থেকে এ দেশের লোকজনের অবস্থা আগের চেয়ে (প্রাক্-পলাশি) অনেক খারাপ হয়েছে…. আমার বিশ্বাস এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যে ভাবে এখন কোম্পানির রফতানি পণ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে’ এবং ‘প্রতিবছর কোনও সোনা-রুপো আমদানি না করেই যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ বাইরে চালান করা হচ্ছে, তাতেই এদেশের এমন দুরবস্থা।৪০ ভেরেলস্ট৪১ এবং বোল্টস৪২ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, বাংলার আর্থিক দুর্দশার সূত্রপাত উত্তর-পলাশি যুগে। শুধু তাই নয়, প্রায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডো’-ও মন্তব্য করেছেন যে বাংলার দুর্ভাগ্য ও দুর্দশার শুরু, সিরাজদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর বাংলায় যে-সব রাজনৈতিক বিপ্লব ও পরিবর্তন হয় তা থেকেই।৪৩

অবশ্য কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলছেন যে যদিও বাংলা থেকে বেশ বড় রকমের ধন নিষ্ক্রমণ হয়েছিল তাকে শুধু লক্ষ লক্ষ মানুষের শোষণ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না—সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে ইউরোপীয় এবং ইংরেজদের বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টা ও উদ্যোগ ভারতীয় অর্থনীতির উন্নতির সহায়ক হয়েছিল। এটাও বলা হয় যে ইংরেজদের ও ইউরোপীয়দের এ-সব প্রচেষ্টার ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে অর্থনৈতিক যোগসূত্র অনেক ঘনীভূত হয়। এটাও হয়তো সম্ভব যে এদের বিভিন্ন প্রচেষ্টার ফলে ১৭৮৩ থেকে ১৭৯৩-এর মধ্যে ভারতবর্ষের ধনসম্পদ হ্রাস হওয়ার পরিবর্তে বৃদ্ধিই পেয়েছিল। এই যুক্তিও দেখানো হয় যে ইংরেজ ও ইউরোপীয়রা বাংলা থেকে বস্ত্র রফতানি বন্ধ করলে বাংলার তাঁতি ও কাটুনিদের (spinners) এক ষষ্ঠাংশ বেকার হয়ে যেত।৪৪ কিন্তু এ-সবই শুধু জল্পনা-কল্পনা ও অনুমানমাত্র, কোনওটাই তথ্যপ্রমাণ দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য করে পরিবেশিত হয়নি। অন্যদিকে এখন আমরা দেখাতে পেরেছি যে নবাবি আমলে বাংলার বস্ত্র ও রেশমের রফতানি বাণিজ্যের যে শ্রীবৃদ্ধি এবং যার সিংহভাগই এশীয় বণিকদের হাতে ছিল (ইউরোপীয়দের নয়), অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। তার ফলে বাংলার অসংখ্য তাঁতি, কাটনি ও অন্যান্য কারিগররা শোচনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়ে। সুতরাং বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি ও মানুষের যে ক্ষতি হয় তা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের আগমনের ফলে যে স্বল্প লাভ হয় তা দিয়ে পূরণ হয়েছিল এ-কথা কিছুতেই বলা যায় না।

পলাশির রাজনৈতিক প্রভাব তার অর্থনৈতিক পরিণতির চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে মীরজাফর ও ইংরেজদের মধ্যে যে চুক্তি হয় তা অনেকটা রক্ষণশীল (conservative)। এতে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের আলিনগরের যে চুক্তি হয়েছিল (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) তার বাইরে নতুন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও শর্ত ছিল না।৪৫ কিন্তু এ-বক্তব্য মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আসলে এই চুক্তিতে এমন কিছু নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সংযোজিত হয় যাতে নবাবের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। নবাবকে ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত করা হয়েছিল, তাঁর সামরিক শক্তিকে পঙ্গু করে দিয়ে তাঁকে পুরোপুরি ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি হয়।৪৬

মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির যে শর্ত, ‘ইংরেজদের শত্রু আমার শত্রু, তা সে ভারতীয় বা ইউরোপীয় যেই হোক না কেন,’ তা শুধু সম্পূর্ণ নতুন নয়, খুব গুরুত্বপূর্ণও বটে। এটা নবাবের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপও বটে। এর ফলে নবাব ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল একটি পতলে পর্যবসিত হন এবং তাতে প্রয়োজনে, ইংরেজদের সঙ্গে বনিবনা না হলে, ফরাসি বা অন্য কোনও ইউরোপীয় বা এমনকী কোনও ভারতীয় শক্তির সঙ্গেও আঁতাত করার কোনও স্বাধীনতা তাঁর আর থাকল না। পলাশির কিছুদিন পরেই মীরজাফর এটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন। তা ছাড়া, চুক্তির অন্য আরেকটি শর্ত—নবাবকে ফরাসিদের ও তাদের সব সম্পত্তি ইংরেজদের হাতে সমর্পণ করতে হবে এবং তাদের বাংলা থেকে বরাবরের মতো বহিষ্কার করতে হবে—ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব ও ফরাসিদের মধ্যে ভবিষ্যতে কোনও আঁতাতের সম্ভাবনাকে একেবারে নির্মূল করে দেয়। তার ফলে ইংরেজদের শক্তিবৃদ্ধিতে বা বাংলার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপের যে প্রচেষ্টা তাতে বাধা দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই নবাবের থাকল না। তিনি অসহায় দর্শকে পর্যবসিত হলেন।

তা ছাড়াও, চুক্তির আরেকটি শর্ত অনুযায়ী যখনই নবাবের ইংরেজ ফৌজের সাহায্য প্রয়োজন হবে, তখন তাঁকে এই ফৌজের সব খরচপত্র বহন করতে হবে। এতে বাংলায় পাকাপাকিভাবে ইংরেজ ফৌজ বহাল রাখার একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল এবং ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব কিছু করার মতো সাহস ও শক্তি হারালেন। শুধু তাই নয়, এই ফৌজ পরে বাংলার আশেপাশে ইংরেজদের প্রতিপত্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। তাই পলাশির ঠিক পরেই ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লেখেন: ‘আমার দৃঢ় ধারণা বাংলায় আপনাদের যে উপনিবেশ গড়ে উঠছে তার গুরুত্ব চিন্তা করে আপনারা যে শুধু তাড়াতাড়ি বেশি সংখ্যক সৈন্যসামন্ত এবং উপযুক্ত কর্মচারী পাঠাবেন তা নয়, এখানকার শাসন চালানোর জন্য যোগ্য তরুণদের পাঠাতে ভুলবেন না।’৪৭ তিনি যে বাংলার শাসন পরিচালনার জন্য উপযুক্ত তরুণদের চেয়ে পাঠালেন, তা থেকে মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তিনি সেটা ভালভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। সবশেষে, চুক্তিতে অন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল। তাতে মীরজাফর প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি হুগলির নীচে কোনও দূর্গ তৈরি করবেন না। এটা নবাবের সার্বভৌমত্বের ওপর ইংরেজদের হস্তক্ষেপের সামিল এবং এতে সামরিকভাবে নবাবকে একেবারে পঙ্গু করে দেওয়া হল। ওই শর্তের ফলে নবাবের পক্ষে কোনও কারণেই আর ইংরেজদের চ্যালেঞ্জ জানাবার অবকাশ থাকল না এবং এর পরেই ইংরেজরা কলকাতায় বিশাল দুর্গ তৈরির ব্যবস্থা করল।৪৮

পলাশি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৭৭২ সালে একটি পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ক্লাইভের সাক্ষ্য থেকে:৪৮

পলাশির যুদ্ধজয় আমাকে কী অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছিল তা একবার চিন্তা করে দেখুন।একজন নবাব আমার অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল; একটি সমৃদ্ধ নগরী আমার দাক্ষিণ্যপ্রার্থী; এই নগরীর ধনীশ্রেষ্ঠ মহাজন ও সওদাগরেরা আমাকে খুশি করতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। [নবাবের] কোষাগার শুধু আমার জন্যই খুলে দেওয়া হয়েছে—আমি দু’পাশের স্তূপীকৃত সোনা ও হিরে-জহরত দেখে যাচ্ছি। সভাপতি মহাশয়, এই মুহূর্তে আমি আমার বিনয় দেখে বিস্মিত হচ্ছি।

সুতরাং ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পলাশির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ফলাফল বাংলার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়েছিল। পলাশির পরেই ইংরেজরা বাংলার আর্থিক সম্পদ করতলগত করে ও বাংলায় তাদের রাজনৈতিক প্রভত্বের বিস্তার করে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলেই একদা সমৃদ্ধ বাংলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত।

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. মুজফ্ফরনামা, পৃ. ৭৮।

২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 212.

৩. Scrafton, Reflections, p. 98.

৪. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, Chapters, 7,8,9 & 10; See also, N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1; D.B. Mitra, Cotton Weavers of Bengal; Hameeda Hussain, Company Weavers of Bengal; Tapan Raychaudhuri and S. Bhattacharya in Cambridge Economic History of India, vol. II.

৫. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, p. lxxvii.

৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 126.

৭. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1. p. 221.

৮. বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের পুরো বৃত্তান্তের জন্য, ঐ, পৃ. ২২১-২৪০; Holden Furber, John Company at Work, pp. 304-07; Irfan Habib, ‘The Eighteenth Century in Indian Economic History’, pp. 110-113.

৯. Holden Furber, John Company, Appendix A, p. 327.

১০. তখন পাউন্ড আর টাকার বিনিময় হার ছিল মোটামুটি এক পাউন্ডে আট টাকা।

১১. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 127.

১২. Hill,I, p. ccx; III, p. 362.

১৩. ক্লাইভ তাঁর পিতাকে, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360.

১৪. Scrafton, Reflections, p. 130.

১৫. বেলচিয়ারকে ক্লাইভের চিঠি, Hill, III, p. 361; স্ক্র্যাফ্টন কিন্তু ওই ভূখণ্ডের রাজস্বের পরিমাণ বছরে ৮ লক্ষ টাকা বলে অনুমান করেছিলেন, Scrafton, Reflections, p. 130.

১৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 127.

১৭. ঐ,পৃ. ১২৭-২৮।

১৮. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, p. 236-এ উদ্ধৃত।

১৯. Holden Furber, John Company, p. 310, OF 471C Fiep (drain in goods) বলেছেন।

২০. Irfan Habib, ‘The Eighteenth Century in Indian Economic History’, p. 111.

২১. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, p. 221-22.

২২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, Chaps. 5,7,8

২৩. বারওয়েল, তাঁর পিতাকে, N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, P, 223-26 0961.

২৪. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 129-30.

২৫. লন্ডনে কোম্পানির পরিচালকদের লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি, Fort William-India House Correspondence, vol. 5, quoted in N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, p. 230.

২৬. ঐ।

২৭. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 42-43.

২৮. H. Vereist, English Government in Bengal, pp. 85-86.

২৯. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 130-31.

৩০. P. J. Marshall, Bengal, p. 165.

৩১. A. K. Bagchi, Political Economy, p. 81; K. N. Chaudhuri, ‘India’s International Economy in the Nineteenth Century’, MAS, II (1968), p. 47, both quoted in Marshall, Bengal, p. 165.

৩২. P. J. Marshall, Bengal, pp. 165-66.

৩৩. ঐ, পৃ. ১৬৬-৬৭।

৩৪. Irfan Habib, ‘Studying a Colonial Economy’, MAS, 19, 3 (1985), pp. 357-58.

৩৫. James Grant in Fifth Report, ed., Firminger, vol. II., p. 276 and John Shore in Ibid, pp. 27-28.

৩৬. Steuart cited is S. Bhattacharyya in Cambridge Economic History of India, vol. II, p. 289.

৩৭. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 202-11, 249-58.

৩৮. ঐ, অধ্যায় ৫,৭ ও ৮।

৩৯. Mss. Eur. D. 283, ff. 37-38.

৪০. W. K. Firminger, Historical Introduction to the Fifth Report, p. 183.

৪১. উদাহরণস্বরুপ, H. Verelst to Court of Directors, 2 April 1769, BPC., vol. 44, f. 434. para 6.

৪২. William Bolts, Considerations, p. 200.

৪৩. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, lxxxii.

৪৪. Holden Furber, John Company, pp. 310-12.

৪৫. P. J. Marshall, Bengal, p. 79; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 15. মার্শাল অবশ্য তাঁর বক্তব্যে একটা নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা বলেছেন। সেটা হচ্ছে পরিবর্তিত অবস্থায় নতুন সংযোজন শুধু বাংলায় ক্লাইভের ফৌজের উপস্থিতি। এ-কথা অবশ্য পরে কুমকুম চট্টোপাধ্যায়ও বলেছেন, যদিও সবাই জোর দিয়েছেন যে-বক্তব্যে তা হল পলাশির পর চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনও নতুন শর্ত যোগ করা হয়নি।

৪৬. মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তির শর্তাবলীর জন্য, Hill, II, pp. 56-57, 373-74, 442

৪৭. লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II. p. 461.

৪৮. P. J. Marshall, Bengal, p. 81.

.

উপসংহার

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ ও বিচারবিশ্লেষণের সমাবেশ করা হয়েছে তা থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, ইংরেজদের বাংলা বিজয় কোনওক্রমেই ‘আকস্মিক’ বা ‘অনিচ্ছাকৃত’ ঘটনা নয়। পলাশির বিপ্লব বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকটের ফলও নয়। এটাকে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে নবাবের বিরোধের ফলে উদ্ভূত ঘটনাও বলা যায় না। অনুরূপভাবে, পলাশি সম্বন্ধে ‘কোলাবোরেশন’ থিসিসও অচল—যাতে বলা হয়, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে (বিশেষ করে ইংরেজদের সঙ্গে) বাংলার ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার শ্রেণীর স্বার্থ এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যে তারা, নবাব বাংলা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করবেন, এটা কোনওমতেই সহ্য করতে পারেনি এবং সেজন্যই নবাবকে তাড়াতে তারা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। আসলে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এইসব কর্মচারীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে প্রভূত ধনোপার্জন করা এবং তা নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে তোফা আরামে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। কিন্ত মধ্য-অষ্টাদশ শতকে এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য চরম সংকটের সম্মুখীন হয় এবং ফলে এই বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কমে যায়। আর এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করার জন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা সাব-ইম্পিরিয়ালিজম (sub-imperialism) বা স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ তারা নিজেদের কার্য ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাংলায় কোম্পানির আর্থিক ও সামরিক শক্তিকে কাজে লাগায় এবং তার ফলেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় সম্ভব হয়।

ইংরেজরাই যে মূলত পলাশি বিপ্লব সংগঠিত করেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে বাংলায় পাঠাবার সময় মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল যে-নির্দেশ তাঁদের দিয়েছিল তার মধ্যেই পলাশি বিপ্লবের বীজ নিহিত ছিল এবং তাতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা খুলে গিয়েছিল। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করা যায় না যে, মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নবাবের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল। তবে এ-ব্যাপারে যেটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হল, ইংরেজদের মদতেই এই চক্রান্ত চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং তাদের সক্রিয় অংশ ছাড়া এই ষড়যন্ত্র পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটাতে পারত না। ইংরেজরাই নবাবের বিরুদ্ধে দরবারের অমাত্যদের একটা বড় অংশকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তাদের নিজেদের পরিকল্পিত বিপ্লব সফল করতে ওই অভিজাতবর্গকে নিজেদের দলে টেনে আনে। পলাশি যুদ্ধের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল, যাতে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠানোয় স্থিরসংকল্প থাকে। তা ছাড়া পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি সফল করা যায় তার জন্য ইংরেজরাই ভারতীয় যড়যন্ত্রকারীদের চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। সুতরাং এটা ঠিক নয় যে, পলাশির ষড়যন্ত্র ‘দেশীয় ষড়যন্ত্র’। স্থানীয় চক্রান্তকারীরা ইংরেজদের পরিকল্পনার পুরো ছকের তাৎপর্য উপলব্ধিই করতে পারেনি এবং সেই নির্বুদ্ধিতার জন্য অচিরেই তাদের বিরাট মূল্য দিতে হয়েছিল। নতুন বিজেতাদের হাতে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ধনেপ্রাণে মারা পড়ল, ভবিষ্যতের কোনও আশাও রইল না।

এ-প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়—মুর্শিদাবাদ দরবারের প্রভাবশালী একটি বেশ বড় অংশ নবাবের বিরুদ্ধে গেল কেন এবং কেনই বা তারা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাল? তার মূল কারণ, খামখেয়ালি ও দুঃসাহসী তরুণ সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ায় উপরোক্ত অমাত্যগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠীতে ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার, জমিদার ও অভিজাত সেনানায়করাও ছিল। এরাই নবাবি আমলে এতদিন সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত ছিল। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর এরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে যে এদের অবিরত সম্পদ আহরণের মূল উৎসগুলি সিরাজ বন্ধ করে দিতে পারেন এবং ফলে এদের বৈভবের পথে তিনি এক মূর্তিমান বাধা।

ব্যাপারটা একটু বিশদ করে বললে বুঝতে সুবিধে হবে। জগৎশেঠদের বিপুল ঐশ্বর্য নানারকম একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে সঞ্চিত হয়েছিল। এগুলি হল, টাঁকশালের প্রায় একচ্ছত্র অধিকার, পুরনো মুদ্রাকে নতুন মুদ্রায় পরিবর্তিত করার একচেটিয়া ব্যবসা, বাট্টা নিয়ে অন্য জায়গার মুদ্রা বিনিময় করা, রাজস্ব আদায়ের অধিকার ইত্যাদি। সিরাজের পূর্ববর্তী বাংলার নবাবরাই এই বিশেষ সুযোগসুবিধেগুলি তাঁদের ব্যক্তিগত দাক্ষিণ্য ও অনুগ্রহ হিসেবে জগৎশেঠদের প্রদান করেছিলেন এবং এগুলির মাধ্যমেই শেঠদের বিপুল সমৃদ্ধি। ঠিক এভাবেই উমিচাঁদ পেয়েছিলেন সোরা, শস্য ও আফিং-এর একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার। আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের লবণ ও সোরার একচেটিয়া ব্যবসাও নবাবের দাক্ষিণ্যে। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর এইসব বণিকরাজাদের আশঙ্কা হল যে, তাঁরা নবাবদের দাক্ষিণ্যে এতদিন যে-সব সুযোগসুবিধে ভোগ করছিলেন এবং যার জন্য তাঁদের এত সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে, সেগুলি থেকে সিরাজ এখন তাঁদের বঞ্চিত করতে পারেন। মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লতিফের মতো অভিজাত সেনানায়ক ও ভূস্বামী শ্রেণী, যাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার শ্ৰেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁরাও শঙ্কিত হলেন যে, তাঁদের পক্ষে অনুকূল ক্ষমতার যে কায়েমী ব্যবস্থা চলে আসছে তরুণ নবাব তার আমূল পরিবর্তন করতে পারেন। এক কথায় বলতে গেলে, মুর্শিদাবাদ দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ, যার মধ্যে বণিক-ব্যাঙ্কার থেকে জমিদার ও অভিজাত সেনানায়ক পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল, সিরাজদ্দৌল্লাকে তাদের সমৃদ্ধি অক্ষুন্ন ও অব্যাহত রাখার পক্ষে বিপজ্জনক বাধা হতে পারে ভেবে আশঙ্কিত হয়ে পড়ে।

তাদের আশঙ্কা যে খুব অমূলক নয় এবং তাদের সামনে যে বিপদ তার স্পষ্ট সংকেত পাওয়া গেল মীরবক্সির পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণ, রাজা মাণিকচাঁদের কারাদণ্ড এবং সর্বোপরি বাংলা থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ হাকিম বেগের বিতাড়নের মধ্যে। একদিকে এই সব ঘটনা এবং অন্যদিকে নতুন ও উদীয়মান একটি গোষ্ঠীর—যার মধ্যে মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আব্দুল হাদি খান প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং যাঁরা এখনও পর্যন্ত সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত হয়ে পড়েননি—সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দেওয়াললিখন স্পষ্ট দেখতে পেল। হাকিম বেগকে অপসারণ করায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সিরাজ নবাব আলিবর্দির একান্ত ঘনিষ্ঠ অমাত্যদের ওপরও আঘাত হানতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। হাকিম বেগ ছিলেন আলিবর্দির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং মুর্শিদাবাদের পরাক্রমশালী ‘পাচোত্রা দারোগা’ (শুল্ক বিভাগের দারোগা)। তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস ছিল আলিবর্দির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। নানারকমের জোরজুলুম ও একচেটিয়া ব্যবসা করে তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী ও কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। এত প্রভাবশালী ও পূর্ববর্তী নবাব আলিবর্দির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এমন একজন অমাত্যকে সিরাজদ্দৌল্লা দেশ থেকে বিতাড়ন করায় দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

আবার মীরবক্সির পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণের ফলে ওই গোষ্ঠীর মনে নবাবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহই রইল না। রায়দুর্লভ কোনও মতেই মেনে নিতে পারলেন না যে মোহনলাল তাঁর কাজকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করবেন। অন্যদিকে খাজা আব্দুল হাদি খান মীরজাফরের পদে নিযুক্ত হওয়ায় স্বভাবতই তা তাঁর অসহ্য মনে হয়েছিল। জগৎশেঠ ও অন্য দুই বণিকরাজা উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের আশঙ্কা হল তাদের বিপুল উপার্জনের প্রধান উপায় একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাবে এবং যে বিশেষ সুযোগসুবিধেগুলি তাঁরা এতদিন ভোগ করে আসছিলেন সেগুলি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তরুণ ও বেপরোয়া নবাব সিরাজদ্দৌল্লা থাকলে তাঁদের কায়েমী স্বার্থ ও ক্ষমতার সৌধ বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেজন্য সিরাজকে হঠানো দরকার, যাতে তাঁদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের উপায়গুলি রুদ্ধ না হয়ে যায়, যাতে মোহনলাল ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে যে নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব হচ্ছে তাদের হাতে ক্ষমতা চলে না যায়, যাতে নবাবের ঘনিষ্ঠ এই নতুন গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ওপর আঘাত হানতে না পারে।

তা সত্ত্বেও ইংরেজদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া পলাশির বিপ্লব সম্ভব হত না। সিরাজদ্দৌল্লার উত্থান ইংরেজদের পক্ষেও বিপজ্জনক ছিল, বিশেষ করে, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের স্বার্থের দিক থেকে, যদিও কোম্পানির দিক থেকে ততটা নয়। তরুণ নবাব কোম্পানির কর্মচারীদের অসদুপায়ে অর্থোপার্জনের যে কল্পতরু— একদিকে বেআইনিভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যদিকে দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার—তার মূল ধরে সজোরে নাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের বিপুল উপার্জনের এই দুটি সহজ পথ থেকে সরে আসতে কোনওমতেই রাজি ছিল না। তার ওপর সিরাজ এ-সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুললেন এমন সময় যখন কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য এক নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। তরুণ নবাব ইংরেজদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি আগেকার নবাবদের মতো দস্তকের অপব্যবহার বা কর্মচারীদের বেআইনি ব্যক্তিগত বাণিজ্য কোনওটাই বরদাস্ত করবেন না। এ-সব কর্মচারীরা এশীয় বণিকদের কাছে দস্তক বিক্রি করত যা দেখিয়ে এশীয় বণিকরা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে পারত। দস্তক বিক্রি করে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর উপার্জন করত। তবে নবাব এটা বন্ধ করে দিতে পারেন বলে তারা খুব একটা ভয় পায়নি—তাদের আরও অনেক বেশি ভয়ের কারণ ছিল নবাব যদি তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। সেটা নিয়েই তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। কারণ বাংলায় তাদের ধনোপার্জনের সবচেয়ে বড় উপায় ছিল এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই তাদের কাছেও সিরাজদ্দৌল্লা ছিলেন বিপজ্জনক। ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ও ক্লাউন্সিলের সদস্যসহ কোম্পানির সব কর্মচারীই ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে ধনসম্পদ আহরণের এমন লোভনীয় উপায় বন্ধ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক ছিল না। সুতরাং তারা সবাই নবাবকে হঠাতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠল।

অবশ্য ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে মুর্শিদাবাদ দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তাদের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় সামিল করতে না পারলে বিপ্লব করা সম্ভব হবে না। এই কারণেই কলকাতা আসার কিছুদিন পরে এবং চন্দননগরের পতনের আগেই ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির সঙ্গে একযোগে কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন যথাসাধ্য চেষ্টা করে যান যাতে জগৎশেঠ পরিবার আমাদের স্বার্থের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন।’ তা ছাড়াও নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ সদস্যদের সমর্থন ও সাহায্য পাওয়ার জন্য ইংরেজরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দরবারের অধিকাংশ অমাত্যই ছিল চুপচাপ, সুযোগের সন্ধানে—পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা যাকে বলে বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, কিছুমাত্রও এগিয়ে আসেনি। খুব সম্ভবত তাদের পরিকল্পনা ছিল, শেষপর্যন্ত যে-দল জিতবে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া অর্থাৎ ইংরেজরা নবাবকে পরাজিত ও বহিস্কৃত করলে একমাত্র তখনই তারা ইংরেজদের স্বাগত জানাবে কারণ নবাব ইংরেজদের মতো তাদেরও স্বার্থের পরিপন্থী। কিন্তু পাছে নবাবের জয় হয় এবং সেক্ষেত্রে তাঁর রোষানলে পড়ার ভয়ে প্রায় কেউই সামনাসামনি ইংরেজদের সমর্থন করতে এগিয়ে আসেনি।

অন্যদিকে ইংরেজদের পক্ষে নবাবের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না কারণ এই নবাব রাজত্ব করতে থাকলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের, যেটা তখন খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল, পুনরুদ্ধার কোনওমতেই সম্ভব ছিল না। একমাত্র সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারলে তা সম্ভব হবে। তাই সিরাজদ্দৌল্লার পর কে নবাব হবে বা কে হলে ভাল হয় তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। ভালমন্দ যে কেউ নবাব হলেই চলবে, যদি সে সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। সেইজন্য যখন ইয়ার লতিফকে নবাব পদে প্রার্থী হিসেবে পাওয়া গেল, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু না জেনে বা খোঁজখবর না নিয়ে তারা তাঁকে লুফে নিল। এমনকী ক্লাইভ ইয়ার লতিফের প্রার্থীপদ অনুমোদন করলেও লতিফ হিন্দু না মুসলমান, ব্যক্তি হিসেবে ভাল না মন্দ, এ-সব কিছুই জানতেন না। তারপর যখন ইংরেজরা জানল যে মীরজাফর নবাব হতে আগ্রহী তখন সঙ্গে সঙ্গে তারা ইয়ার লতিফকে বাতিল করে তাঁকেই নবাব পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করল। কারণ, মীরজাফর যোগ্যতর ব্যক্তি বলে নয়, তিনি ইয়ার লতিফের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী, নবাবের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ এবং অনেক বেশি জোরালো প্রার্থী। অবশ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তিনি জগৎশেঠদের খুব কাছের লোক। ইংরেজরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিল যে, জগৎশেঠদের অনুমোদন ছাড়া বাংলায় কোনও বিপ্লব সম্ভব নয় এবং সেজন্যই তাদের ইয়ার লতিফকে ছেড়ে মীরজাফরকে প্রার্থী করতে হল। আবার এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ইংরেজরা পলাশি বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য শুধু নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ অমাত্যদের ওপর নির্ভর করে বসে ছিল না। সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে তারা এতটাই আগ্রহী এবং অস্থির হয়ে পড়েছিল যে, যদি কোনও কারণে মুর্শিদাবাদের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সাহায্যে তারা বিপ্লব সংগঠিত করতে না পারে, তা হলে তারা বাংলা বিজয়ের জন্য মারাঠা অথবা দিল্লির বাদশাহের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য নেওয়ার পরিকল্পনাও করেছিল।

সুতরাং আমাদের চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজদের এবং মুর্শিদাবাদ দরবারের অমাত্যদের একটা বড় অংশের, উভয়ের স্বার্থেই, সিরাজদ্দৌল্লার সিংহাসনচ্যুতি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল এবং সেজন্যই পলাশি বিপ্লব। ইংরেজরাই পলাশি চক্রান্তের মূল উদ্যোক্তা, ষড়যন্ত্রে তাদেরই মুখ্য ভূমিকা। তারাই নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পিত বিপ্লবের ষড়যন্ত্রে টেনে আনে এবং এভাবে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটায়। সেই পতনে শেষপর্যন্ত কারা এবং কী পরিমাণ লাভবান হয়েছিল ভারতবর্ষের পরবর্তী দু’শো বছরের ইতিহাস তার সাক্ষী।

.

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

ORIGINAL SOURCES (মূল সূত্র)

A. MANUSCRIPT SOURCES (পাণ্ডুলিপি)

1. India Office Records, British Library, London

Bengal Public Consultations

Bengal Letters Received

Bengal Secret and Military Consultations

Coast and Bay Abstracts

Despatch Books

European Manuscripts

Factory Records

Home Miscellaneous Series

Mayor Court’s Records, Calcutta

Original Correspondence

Orme Manuscripts

2. ALGEMEEN RIJKSARCHIEF, THE HAGUE, NETHERLANDS

Verenigde Oostindische Compagnie (VOC)

Overgekomen brieven en papiers and Inkomend briefbook, 1720-57 (Select Volumes)

Hoge Rgering van Batavia, 246 (Taillefert’s ‘Memorie’, 17 Nov. 1763)

3. Stadsarchief Antwerpen, Antwerp, Belgium

General Indische Compagnie (The Ostend Company), 5768

B. PRINTED SOURCES (মুদ্রিত আকরগ্রন্থ)

1. PERSIAN WORKS (ফারসি গ্রন্থ)

Gholam Hossein Khan, Seir Mutagherin, vol. II, trans. Haji Mustafa, Second Reprint, Lahore, 1975.

Gulam Husain Salim, Riyaz-us-Salatin, trans. Maulavi Abdus Salam, Calcutta, 1904.

Karam Ali, Muzaffarnamah, in J. N. Sarkar, Bengal Nawabs, Calcutta, 1952.

Salimullah, Tarikh-i-Bangala, trans. Gladwin, Calcutta, 1788.

Yusuf Ali Khan, Tarikh-i-Bangala-i-Mahabatjangi, trans. Abdus Subhan, Calcutta, 1982.

2. WORKS IN EUROPEAN LANGUAGES (ইউরোপীয় ভাষায় লেখা গ্রন্থ)

(A) Published sources

Datta, K. K., ed., Fort William—India House Correspondence, vol. I (1748-56), Delhi, 1956.

Firminger, W. K., ed., The Fifth Report from the Select Committee of the House of Commons of the Affairs of the East India Company, 1812, 3 vols., Calcutta, 1917-18.

—, Historical Introduction to the Fifth Report, Calcutta, 1917.

Hill, S.C., Bengal in 1756-57, 3 vols., London, 1905.

Martin, Francois, Memories de Francois Martin, 1665-1696, ed., A. Martineau, Paris, 1931.

Records of Fort St. George: Diary and Military Consultations, Madras, 1912-25.

Sinha, N. K., ed., Fort William—India House Correspondence, vol. V (1767-9), Calcutta, 1959.

Wilson, C. R., ed., The Early Annals of the English in Bengal, 3 vols., London, 1895-1917.

Yule, H., ed., The Diary of William Hedges, 3 vols., London, 1887-9.

Van Dam, Pieter, Beschrijvinge vande Oost-Indische Compagnie, ed., F.W. Stapel & others, 4 books in 7 parts, The Hague, 1927-54.

(B) Travellers’ Account, Memoirss. etc. (পর্য্যটকদের বিবরণ, স্মৃতিকথা ইত্যাদি)

Bernier, F., Travels in the Mogul Empire, 1656-1658, ed. A. Constable, Oxford, 1934.

Bolts, William, Considerations on Indian Affairs, London, 1772.

Bowrey, Thomas, A Geographical Account of Countries Round the Bay of Bengal, 1669-1679, ed., R.C. Temple, Cambridge, 1905.

Dow, Alexander, History of Hindostan, vol. III, London, 1770.

Orme, Robert, Historical Fragments of the Mogul Empire, London, 1805.

—, History of the Military Transactions of the British Nation in Indostan, 3 vols., London, 1803.

Scrafton, Luke, Reflections on the Government of Indostan, London, 1763.

Stavorinus, J. S., Voyage in the East Indies, trans. S. H. Wilcoke, 3 vols., London, 1798.

Tavernier, Jean-Baptiste, Travels in India, 1640-1667, trans. V. Ball, London, 1889.

Vansittart, H., A Narrative of the Transactions in Bengal from 1760-1764, London, 1766.

Verelst, H., A View of the Rise, Progress and Present State of the English Government in Bengal, London, 1772.

Watts, William, Memoirs of the Revolution in Bengal, London, 1760.

(C) Secondary works (প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ)

(১) বাংলা

আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, ঢাকা, ১৯৭৭।

অক্ষয়কুমার মৈত্র, সিরাজদৌল্লা, কলিকাতা, ১৮৯৮।

কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি, ১ম খণ্ড, কলিকাতা, ১৩৮০।

তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়, পলাশীর যুদ্ধ, কলিকাতা, ১৯৫৩

নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, কলিকাতা, ১৯০২।

—, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, কলিকাতা, ১৯০৩।

—, জগৎশেঠ, কলিকাতা, ১৯১২।

প্রতিভারঞ্জন মৈত্র, মুর্শিদাবাদ চর্চা, কলিকাতা, ১৩৮০।

ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা, ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী, কলিকাতা, ১৯৬৩।

সোমেন্দ্রলাল রায়, মুর্শিদাবাদের কথা ও কাহিনী, কলিকাতা, ১৯৬০।

শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সিরাজদ্দৌল্লা, কলিকাতা, ১৯৪২।

শ্রীপারাবাত, মুর্শিদকুলী খাঁ, কলিকাতা, ১৯৯০ ।

(২) ইংরেজি

Arasaratnam, S., Merchants, Companies and Commerce on the Coromandel Coast, 1650-1740, New Delhi, 1986.

—, ‘The Indian Merchants and their Trading Methods’, Indian Economic and Social History Review, 3 (1966), 85-95.

Bagchi, A. K., The Political Economy of Underdevelopment, Cambridge, 1982.

—, ‘Reflections on Pattems of Regional Growth in India during the Period of British Rule’, Bengal Past and Present, XCV, 1976.

Bayly, C. A., The Imperial Meridian: The British Empire and the World, 1780-1830, London, 1988.

—, Indian Society and the Making of the British Empire, Cambridge, 1987.

Bayly, C.A., and Sanjay Subrahmanyam, ‘Portfolio Capitalists and the Political Economy of Early Modern India’, Indian Economic and Social History Review, 25, 4 (1988), 403-24.

Bence-Jones, M., Clive of India, London, 1974.

Bhadra, Gautam, ‘The Role of Pykars in the Silk Industry of Bengal, 1765- 1830’, Studies in History, 3, no. 2 (1987), 137-85; 4, nos. 1 & 2 (1988), 1-35.

Bhattacharya, S., The East India Company and the Economy of Bengal from 1704 to 1740, London, 1954.

Boxer, C. R., The Dutch Seaborne Empire, New York, 1965.

Bruijn, J. R., F. S. Gaastra and I. Schoffer, Dutch-Asiatic Shipping, 3 vols., The Hague, 1979-87.

Calkins, P. B. ‘The Formation of a Regionally Oriented Ruling Group in Bengal, 1700-1740’, Journal of Asian Studies, vol. XXIX, no. 4 (August 1970), 799-806.

—, ‘The Role of Murshidabad as a Regional and Sub-Regional Centre in Bengal, in R. L. Park, ed., Urban Bengal, East Lansing, 1969.

Chandra, Satish, ed., The Indian Ocean: Explorations in History, Commerce and Politics, New Delhi, 1985.

Chatterjee, Kumkum, Merchants, Politics and Society in Early Modern India, Bihar: 1733-1820, Leiden, 1996.

—, ‘Trade and Durbar Politics in the Bengal Subah, 1733-1757’, Modern Asian Studies, 26 (1992), 233-73.

Chatterjee, Tapan Mohan, The Road to Plassey, Bombay, 1960.

Chaudhuri, K, N., Asia before Europe, Cambridge, 1990.

—, Trade and Civilization in the Indian Ocean: An Economic History from the Rise of Islam to 1750, Cambridge, 1985.

—, The Trading World of Asia and the English East India Company, Cambridge, 1978.

—, ‘India’s International Economy in the Nineteenth Century’, Modern Asian Studies, II (1968).

—, ‘The Structure of the Indian Textile Industry in the Seventeenth and Eighteenth Centuries’, Indian Economic and Social History Review, XI (June-Sept. 1974), 127-82.

Chaudhury, Sushil, and Michel Morineau, eds., Merchants, Companies and Trade: Europe and Asia in Early Modern Era, Cambridge, 1999.

Chaudhury, Sushil, ‘Trading Networks of a Traditional Diaspora, Armenians in Indian Trade’, paper presented at the XIII International Economic History Congress, Buones Aires, Argentina, July 2002 and now being published.

—, ‘Armenians in Bengal Trade, circa. mid-Eighteenth Century’, paper presented at the International Seminar on ‘Armenians in Asian Trade, 16th-18th Century’, Paris, October 1998. Now being published by MSH, Paris.

—, ‘The Inflow of Silver to Bengal in the Global Perspective, c. 1650- 1757’, paper presented at the XIIth International Economic History Congress, Madrid, August 1998, Session B-6, ‘Monetary History in Global Perspective, 1500-1808’, and now published in Global Connections and Monetary History, ed., Flynn, et al, Ashgate, 2003.

—, ‘Was there a Crisis in Mid-Eighteenth Century Bengal?’, in Rethinking Early Modern India, ed., Richard B. Barnett, New Delhi, 2002.

—, The Prelude to Empire: Plassey Revolution of 1757, New Delhi, 2000.

—, From Prosperity to Decline: Bengal in the Eighteenth Century, New Delhi, 1995.

—, ‘International Trade in Bengal Silk and the Comparative Role of Asians and Europeans, circa. 1700-1757’, Modern Asian Studies, 29, 2 (1995), 373-86.

—, ‘European Companies and Bengal Textile Industry in the Eighteenth Century: The Pitfalls of Applying Quantitative Techniques’, Modern Asian Studies, 27, 2 (May 1993), 321-40.

—, ‘Sirajuddaula and the Battle of Plassey’, History of Bangladesh, vol. 1, Dhaka, 1992, 93-130.

—, ‘Trade, Conquest and Bullion: Bengal in the mid-Eighteenth Century’, Itinerario, vol. 15, no. 2 (1991), 21-32.

—, ‘Khwaja Wazid in Bengal Trade and Politics, Indian Historical Review, vol. XVI. nos. 1-2, 137-48.

—, ‘The Imperatives of Empire—Private Trade, Sub-Imperialism and the British Attack on Chandernagore, March 1757’, Studies in History, vol. VIII, no. 1 (Jan.-June 1992), 1-12.

—, ‘General Economic Conditions in Nawabi Bengal, 1690-1757’, History of Bangladesh, vol. 2, Dhaka, 1992, 30-66.

—, ‘European Trading Companies and Bengal’s Export Trade, 1690-1757’, History of Bangladesh, vol. 2, Dhaka, 1992, 183-224.

—, ‘Continuity or Change in the Eighteenth Century? Price Trends in Bengal, circa, 1720-1757’, Calcutta Historical Journal, vol. XV., nos. 1-2 (July 1990-June 1991), 1-27.

—, ‘Sirajuddaullah, English Company and the Plassey Conspiracy—A Reappraisal’, Indian Historical Review, vol. XXIII, nos. 1-2 (July 1986-Jan. 1987), 111-34.

—, ‘Merchants, Companies and Rulers: Bengal in the Eighteenth Century’, Journal of the Economic and Social History of the Orient, vol. XXXI (Feb. 1988), 74-109.

—, Trade and Commercial Organization in Bengal, 1650-1720, Calcutta, 1975.

—, ‘The Rise and Decline of Hughli-A Port in Medieval Bengal’, Bengal Past & Present, (Jan.-June 1967), 33-67.

Chicherov, A. I. India: Economic Development, Moscow, 1971.

Colebrook, H. T., Remarks on the Husbandry and Commerce of Bengal, Calcutta, 1804.

Curley, David, ‘Fair Grain Markets and Mughal Famine Policy in Eighteenth Century Bengal, Calcutta Historical Journal, 2 (1977), 1-26. Das Gupta, Ashin, Merchants of Maritime India, Varorium, 1994.

—, Indian Merchants and the Decline of Surat, c. 1700-1750, Wiesbaden, 1979.

—, ‘Trade and Politics in 18th Century India’, in D. S. Richards, ed., Islam and the Trade of Asia, Oxford, 1967.

—, and M.N. Pearson, eds., India and the Indian Ocean, 1500-1800, Calcutta, 1987.

Datta, K.K., Alivardi and His Times, 2nd edn., Calcutta, 1963.

—, Survey of India’s Social Life and Economic Conditions in the Eighteenth Century, 1707-1813, Calcutta, 1961.

—, Studies in the History of Bengal Suba, 1740-1760, Calcutta, 1936.

Dimock, Edward C. Jr., ‘Hinduism and Islam in Medieval Bengal’, in Rachel van M. Baumer, ed., Aspects of Bengali History and Society, Honolulu, 1975.

Eaton, Richard M., The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760, Delhi, 1994.

Edwardes, Michael, The Battle of Plassey and the Conquest of Bengal, London, 1963.

—, Plassey: The Founding of an Empire, London, 1969.

Feldbaeck, Ole, ‘Cloth Production and Trade in Late Eighteenth Century Bengal’, Bengal Past & Present, vol. LXXXVI (July-Dec. 1967), 124-41.

Foster, William, ‘Gabriel Boughton and the Trading Privileges in Bengal’, Indian Antiquary, 40 (1911).

Furber, Holden, Rival Empires of Trade in the Orient, 1600-1800, Minneapolis and Oxford, 1976.

—, ‘Asia and West as Partners before “Empire” and After’, Journal of Asian Studies, 28 (1969).

— John Company at Work, Cambridge, 1961.

—, Bombay Presidency in the mid-Eighteenth Century, Bombay, 1965.

urber, Holden, and Kristof Glamann, ‘Plassey: A New Account from the Danish Archives’, Journal of Asian Studies, vol. XIX, no. 2 (February 1960).

Gaastra, F.S., ‘The Dutch East India Company and its Intra-Asian Trade in Precious Metals’, in W. Fischer, R.M. McInnis and J. Schneider, eds., The Emergence of a World Economy, pt. I, 1500-1800, Wiesbaden, 1986, 97-112.

Ghoshal, H. R., Economic Transition in the Bengal Presidency, 1793-1833, Patna, 1950.

Glamann, Kristof, Dutch Asiatic Trade, 1620-1740, Copenhagen, The Hague, 1958.

—, ‘Bengal and the World Trade about 1700’, Bengal Past & Present, vol. LXXVI, no. 142 (1957), 30-9.

Gupta, Brijen K., Sirajuddaullah and the East India Company, 1756-57, Leiden, 1962.

Habib, Irfan, ‘Merchant Communities in Pre-Colonial India, ‘ in J. D. Tracy, ed., The Rise of Merchant Empires: Long Distance Trade in the Early Modern Period, 1350-1750, Cambridge, 1990, 371-99.

—, ‘Studying a Colonial Economy—Without Perceiving Colonialism’, Modern Asian Studies, 19, 3 (1985), 355-81.

—, ‘The Technology and Economy of Mughal India’, Indian Economic and Social History Review, vol. XXVII, no. 1 (Jan.-March 1980), 1-34.

—, ‘Changes in Technology in Mughal India’, Studies in History, II, 1, 15 39.

—, Potentialities of Capitalistic Development in the Economy of Mughal India’, Journal of Economic History, 29 (March 1969).

—, The Agrarian System of Mughal India, Bombay, 1963.

Hill, S.C., Three Frenchmen in Bengal, London, 1905.

Hossain, Hameeda, The Company Weavers of Bengal, Delhi, 1988.

Irwin, J. and P. R. Schwartz, Studies in Indo-European Textile History, Ahmedabad, 1966.

Karim, Abdul, Murshid Quli and His Times, Dacca, 1963.

Khan, A. M., The Transition in Bengal, Cambridge, 1969.

Krishna, Bal, Commercial Relations between India and England, London, 1924.

Kumar, Dharma, ed., The Cambridge Economic History of India, vol. 2.

Little, J. H., The House of Jagat Seths, Calcutta, 1956.

Marshall, P. J., Bengal—The British Bridgehead, Cambridge, 1987.

—, East Indian Fortunes, Oxford, 1976.

—, ‘Private British Investment in Eighteenth Century Bengal, Bengal Past & Present, 86 (1967), 52-67.

Mclane, John, R., Land and Local Kingship in Eighteenth Century Bengal, Cambridge, 1993.

Meilink-Roelofz, M. A. P., Asian Trade Revolution and European Influence in the Indonesian Archipelago between 1500 to about 1630, The Hague, 1962.

Mitra, D. B., The Cotton Weavers of Bengal, Calcutta, 1978.

Mohsin, K. M., A Bengal District in Transition: Murshidabad, Dacca, 1973.

Moosvi, Shireen, The Economy of Mughal Empire, Delhi, 1987.

—,’The Silver Influx, Money Supply, Prices and Revenue Extraction in Mughal India’, Journal of the Economic and Social History of the Orient, XXX (1988), 47-94.

Nichol, J. D., ‘The British in India, 1740-63: A Study of Imperial Expansion into Bengal’, unpublished Ph. D. thesis, University of Cambridge, 1976.

Pearson, M. N., Merchants and Rulers in Gujarat, Berkeley and Los Angeles, 1976.

Perlin, Frank, ‘Proto-Industrialization and Pre-Colonial South Asia’, Past and Present, 98 (1983), 30-95.

—, ‘Pre-Colonial South Asia and Western Penetration in the Seventeenthto Nineteenth centuries: A Problem of Epistemological Status’, Review, 4(1980).

Prakash, Om, The European Commercial Enterprise in Pre-Colonial India, Cambridge, 1998.

—, ‘On Estimating the Employment Implications of European Trade for Eighteenth Century Bengal Textile Industry-A Reply’, Modern Asian Studies, 27, 2 (1993), 341-56.

— The Dutch East India Company and the Economy of Bengal, Princeton, 1985.

—, ‘Asian Trade and European Impact: A Study of the Trade from Bengal, 1630-1729’, in Blair Kling and M. N. Pearson, eds., The Age of Partnership: Europeans in Asia before Dominion, Honolulu, 1979.

—, ‘Bullion for Goods: International Trade in the Economy of Early Eighteenth Century Bengal’, Indian Economic and Social History Review, XIII (1976), 159-87.

Ray, Indrani, ‘Dupleix’s Private Trade in Chandernagore’, Indian Historical Review, I (1974), 279-94.

—, ‘The French Company and the Merchants of Bengal, 1680-1730’, Indian Economic and Social History Review, 7 (1970).

Ray, Rajat Kanta, ‘Colonial Penetration and Initial Resistance: The Mughal Ruling Class, the English East India Company and the Struggle for Bengal’, Indian Historical Review, 12 (July 1985-Jan. 1986). 1-105.

Raychaudhuri, T. and Irfan Habib, eds., The Cambridge Economic History of India, vol. 1, Cambridge, 1982.

Richards, J. F., Precious Metals in Late Medieval and Early Modern Worlds, Durham, 1983.

—, ‘Mughal State Finance and the Pre-Modern World Economy’, Comparative Studies in Society and History, 23 (1981).

Sarkar, J. N., ed., History of Bengal, vol. II, Dhaka, 1948.

—, trans. and ed., Bengal Nawabs, Calcutta, 1952.

Saxe, Elizabeth Lee, ‘Fortune’s Tangled Web: Trading Networks of English Enterprises in Eastern India, 1657-1717’, unpublished Ph.D. Dissertation, Yale University, 1979.

Seth, M. J., Armenians in India from Earliest Times to the Present Day, Reprint, Calcutta, 1973.

Sinha, N. K., The Economic History of Bengal, 3 vols., Calcutta, 1958-65.

—, ed., History of Bengal, 1757-1905, Calcutta, 1967.

Steensgaard, Niels, ‘Asian Trade and World Economy from the 15th to the 18th Centuries’, in T. R. de Souza, ed., Indo-Portuguese History, New Delhi, 1984.

—, The Asian Trade Revolution of the Seventeenth Century, Chicago, 1974.

Subrahmanyam, Sanjay, The Portugese Empire in Asia, London, 1992.

—, The Political Economy of Commerce: Southern India, 1500-1650, Cambridge, 1990.

Taylor, J., A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca, Calcutta, 1840.

Thompson, Virginia M., Dupleix and His Letters, 1742-54, New York, 1933.

Tracy, J.D., ed., The Rise of Merchant Empires, Cambridge, 1990.

Van Leur, J. C., Indonesian Trade and Society, The Hague, 1955.

Van Santen, H. W., De Verenigde Oost-Indische Compagnie in Gujarat en Hindusthan, 1620-60, Leiden, 1982.

Wallerstein, Immanuel, The Modern World System, II: Mercantilism and the Consolidation of the World Economy, 1600-1750, New York, London, 1980.

Wink, Andre, ‘Al-Hind: India and Indonesia in the Islamic World- Economy, c. 700-1800’, in Itinerario, Special Issue, The Ancient Regime in India and Indonesia, 1988, 33-72.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *