1 of 2

৩.২২ ইতিহাস ও দর্শন

৩.২২ ইতিহাস ও দর্শন

মমতা ও মনন

(১) মানুষের প্রকৃতির একটি মূল বস্তু মমত্ববোধ। সব জিনিসকে মানুষ মমতা দিয়ে আবৃত করতে চায়। বাইরের জিনিসকে সে জয় করে, মমত্বের পরিধির মধ্যে তাকে টেনে আনে। এ যদি সে না পারে, তবে তাকে ধ্বংস করতে চায়, কখনও উপেক্ষায় কখনও হিংসায়।

অতএব মমত্ববোধ একটি স্থানু অবিকার ভাব নয়, বরং সচল শক্তির উৎস। এতে একদিকে আছে আত্মরক্ষার শক্তি, অন্যদিকে আত্মসাৎ অথবা নস্যাৎ করবার শক্তি। আমরা যাকে সচরাচর ইচ্ছাশক্তি বলি, তারও মূলে আছে একটি আত্মরক্ষাধর্মী ও আগ্রাসী মমতা অথবা সম্প্রসারণশীল অহংবোধ।

(২) মমত্বের পরিপূরক অন্য একটি মূল উপাদান আছে, যাকে বাদ দিয়ে মনুষ্যত্ব অসম্পূর্ণ এর নাম দেওয়া যেতে পারে মনন অথবা, ভারতীয় অর্থে, দর্শন। মানুষই সেই অদ্বিতীয় জীব যে নিজের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের জৈবিক অবস্থাকে দর্শন করতে পারে। সে একদিকে যেমন প্রীতিতে উৎফুল্ল ও হিংসায় দগ্ধ হয়, হর্ষে উৎক্ষিপ্ত ও বিষাদে আচ্ছন্ন হয়, গর্বে ফীত ও ব্যর্থতায় মুহ্যমান হয়, অন্যদিকে আবার এই সব জয় পরাজয়, সাফল্য ও বিফলতাকে দূর থেকে ছবির মতো অবলোকন করে এবং এই সবের উর্ধ্বে মননের দ্বারা একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অধিকারী হয়।

ফরাসী দার্শনিক পাসকালের সেই বিখ্যাত উক্তি এখানে স্মরণীয়। ‘মানুষ সামান্য তৃণমাত্র, প্রকৃতির দুর্বলতম বস্তু। তবে সে এক মননশীল তৃণ। তাকে ধ্বংস করবার জন্য প্রকৃতিকে রণসজ্জায় সজ্জিত হতে হয় না, এক ফুঙ্কারেই তাকে বিনাশ করা যায়। তবু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও মানুষ প্রকৃতির চেয়ে মহৎ। কারণ মৃত্যুকে মানুষ চেতনার দ্বারা চিনে নেয়, অথচ ঘাতক প্রকৃতি অচেতন। মননেই মানুষের মহত্ত্ব।’

মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে দাঁড়ায় মানুষ। সেই দৃষ্টিতে কোনো ভয় নেই, নৈরাশ্য নেই। তারই টানে বিভীষিকার মুখোশ ছিঁড়ে যায়। মৃত্যু হয়ে ওঠে কার্যকারণে আবদ্ধ একটি ঘটনা মাত্র, অথবা শ্যামসমান অভিরাম শুদ্ধ রহস্য। মানুষ মৃত্যুর অধীন; আবার মানুষ মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। এই বৈপরীত্যের সাযুজ্য শুধু মানুষেই সম্ভব।

মানুষের সত্তার দ্বৈত মুণ্ডকোপনিষদের একটি শ্লোকে অবিস্মরণীয় রূপে চিত্রার্পিত হয়েছে।

দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানংবৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য–
নশ্নন্নন্যো অভিচাকশীতি ॥ (৩। ১। ১)

এটি আমাদের প্রাচীন চিন্তার একটি মূল ভাব। দুটি পাখী, স্বতন্ত্র অথচ সংযুক্ত, সখারূপে একই বৃক্ষকে আলিঙ্গন করে আছে। এদের একটি জৈব জীবনের তিক্তমধুর ফল ভক্ষণ করছে; অপরটি নিস্পৃহভাবে অবলোকন করছে।

(৩) মমত্ব এবং মনন অথবা দর্শন, এই দুটিকে বিপরীত মেরু হিসেবে কল্পনা করা যথেষ্ট নয়। তা যদি করি তবে এদের পারস্পরিক সম্পর্ক, পরিপূরকতা ও ঘাতপ্রতিঘাত উপলব্ধি করা কঠিন হয়। যে-ভাবটি জীবন্ত অন্তর্দৃষ্টির সহায়ক হতে পারত, অবশেষে তা একটি নিশ্চল চিত্রকল্পে পরিণত হয়। ইতিহাসের সঙ্গে দর্শনের যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়।

মমত্ববোধের অন্তর্নিহিত গতি এবং জীবনকে কিছুটা দূর থেকে দর্শন করবার প্রবণতা, যেমন আদিতে তেমনই স্তর থেকে শুরান্তরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে, স্বতন্ত্র অথচ বিচ্ছিন্ন নয়, বরং পরস্পর সংযুক্ত। এই চিন্তায় আমাদের অন্তর্দৃষ্টি চলৎশক্তি লাভ করে। বিজ্ঞান, শিল্প এবং ধর্মের প্রকৃতি এই একই মূলতত্ত্বের আলোতে আলোচনা করা সম্ভব।

(৪) মানুষের আদিম জৈব মমত্ববোধে একটা অন্ধতা আছে। অন্ধ বলেই সে অসহায়; অসহায়ভাবে ভীত; ভীত ও ক্রুদ্ধ; ভীত ও ক্রুদ্ধভাবে জীবনের সঙ্গে আশ্লিষ্ট। এই অন্ধ মমতা আত্মরক্ষার পক্ষে, অন্তত মানুষের আত্মরক্ষার পক্ষে যথেষ্ট নয়। মানুষের ভীত। আত্মার দৃষ্টিতে প্রকৃতি একদিকে যেমন রহস্যময় অন্যদিকে তেমনই অবাধ্য, স্বেচ্ছাচারিণী, ভয়ংকরী। বিজ্ঞানের প্রথম বিকাশ আত্মরক্ষার অথবা ব্যবহারিক জীবনের সহায়ক রূপে। প্রকৃতিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখবার যে-অভ্যাস বিজ্ঞানের মূল কথা, অবাধ্য প্রকৃতি। এবং ভীত আত্মার মধ্যে সঙ্গতি স্থাপনের প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়েই তার প্রথম প্রকাশ। মমত্ব ও মনন এখানে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োজনে, জৈব ইচ্ছার যন্ত্র হিসেবে যদিবা বিজ্ঞানের আরম্ভ, তবু সেখানেই তার শেষ নয়। গণিতের একটা যাদু আছে। প্রাচীন সভ্যতার মানুষ এই দেখে আশ্চর্য হয়েছিল যে, একটি সমকোণবিশিষ্ট ত্রিকোণের হ্রস্ব বাহু দুটির পরিমাপ যদি হয় তিন এবং চার একক, তাহলে দীর্ঘ বাহুটির পরিমাপ হবে অনিবার্যভাবে পাঁচ একক। আরও আশ্চর্যের কথা, সমকোণযুক্ত একটি ত্রিকোণকে যে-ভাবেই আঁকা হোক না কেন, তার হ্রস্ব বাহু দুটির বর্গের যোগফল প্রতিবারই দীর্ঘ বাহুটির বর্গফলের সমান। আড়াই হাজার বছর আগে পিথাগোরাস সুরের সঙ্গে গাণিতিক রাশির সাযুজ্য দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। এর পর গ্রহ নক্ষত্রের কক্ষে কক্ষে গাণিতিক রাশি যখন ছড়িয়ে গেল, তখন মানুষ যেন বিশ্বচরাচর জুড়ে একটি দৈব সঙ্গীতের অনুরণন শুনতে পেল।

মমত্ব অথবা মায়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আসে ব্যবহারিক জ্ঞান। কিন্তু ব্যবহারিক জ্ঞানেই। আবার ইঙ্গিত থাকে সেই শুদ্ধ জ্ঞানের, যার রূপে আছে সামঞ্জস্য আর উপলব্ধিতে অপর-হেতু-নিরপেক্ষ আনন্দ। এই আনন্দকে মানুষ চিরকালের মতো লাভ করে না। একে বার বার আবিষ্কার করতে হয়। একদিন যা ছিল অন্তদৃষ্টি, অন্যদিন তাই হয়ে ওঠে যান্ত্রিক অভ্যাস। সেই অভ্যাসকে ভেঙ্গে আবারও নতুন করে যাত্রা শুরু হয়। মানুষের চেতনার বিবর্তনে মৌল এই ত্রিভঙ্গ ছন্দ।

শিশুর দৃষ্টিতে অকারণ আনন্দ ও ব্যবহারিক প্রয়োজনের একটা যোগ আছে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সেই যোগটিকে আমরা ফিরে পাই ঊর্ধ্বতন স্তরে। প্রকৃতিকে একটু দূর থেকে দেখবার তাগিদ যদিও আসে ব্যবহারিক প্রয়োজন থেকে, তবুও এই দৃরস্থিত দৃষ্টিতে প্রকৃতির অঙ্গে অঙ্গে এমন একটি প্রতিসাম্য, বিশ্বে এমন একটি শোভা ধরা পড়ে যে, সাধারণ জৈবিক তাড়নার ঊর্ধ্বে তাকে একটি অধরা মাধুরী বলেই মনে হয়। তখন অন্য ফল নিরপেক্ষভাবে সেই মাধুরী কাম্য হয়ে ওঠে।

কোনো এক যুগের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিশ্বের যে-ছবি ধরা পড়ে, যদিও একটি জীবন্ত প্রেরণাতেই তার জন্ম, তবু একদিন সেটি সামান্য অভ্যস্ত বিদ্যায় পরিণতি লাভ করে। এই অভ্যস্ত বিদ্যার কাঠামোই ক্রমে জ্ঞানের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীক ও মিসরীয়। বিজ্ঞান একদিন নিশ্চল হয়েছিল। একাদশ শতাব্দী থেকে পাশ্চাত্ত্য সমাজে প্রাণশক্তি যেন নতুন করে জেগে উঠল। কিছুদিন পর্যন্ত প্রাচীন বিদ্যার কাঠামোর ভিতরই নতুন জ্ঞান ও ব্যবহারিক কলাকৌশল সঞ্চিত হতে লাগল। তারপর প্রাচীন কাঠামো পরিত্যক্ত হল। রেনেসাঁসের যুগের বিজ্ঞানীরা তাঁদের বিশ্বজ্ঞানকে নতুনভাবে সাজালেন। নতুন জ্ঞানের ব্যবহারিক মহত্ত্ব কীর্তিত হল বেকনের লেখায়। আর গ্রহনক্ষত্রে পরিব্যাপ্ত বিশ্বময় সামঞ্জস্যে নিরাসক্ত দর্শকের মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন স্পিনোজা।

(৫) শিল্পের সঙ্গে কারিগরীর যোগ আছে। শুধু উপযোগিতার জন্য যখন কিছু রচনা করা যায়, তখনও তাতে একটা ব্যবহারিক সৌষ্ঠবের প্রয়োজন হয়। ধনবানদের জন্য যে কারিগরী তাতে অনেক সময়েই প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা শৌখিন চমৎকারিত্ব যোগ হয়। এইভাবে কারিগরী কলাকৌশলের উৎকর্য বৃদ্ধি পায়। কলাকৌশল শিল্পীরও প্রয়োজন হয়। অথচ শিল্পী কারিগর মাত্র নন।

সাহিত্যিক শব্দের কারিগর। কিন্তু সাহিত্যে জীবনের যে উদ্দেশ্য সাধিত হয় তার এমনই একটা বৈশিষ্ট্য আছে, কারিগরী কলাকৌশলের দ্বারা যার ব্যাখ্যা হয় না। কারণ। সাহিত্যের মূলে যে-বস্তুটিকে আমরা বিশেষভাবে পাই তা হল, মননের দ্বারা পরিশুদ্ধ মমতা অথবা আবেগ।

এই পরিশোধনেরও একটা জৈবিক প্রয়োজন আছে। ভয়, ক্রোধ, হিংসা প্রভৃতি আবেগ আত্মরক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। নখ যেমন আত্মরক্ষার অস্ত্র, হিংসাও তেমনই। অন্যান্য জন্তুর সঙ্গে এখানে মানুষের মিল আছে, আবার অমিলও আছে। মানুষের কল্পনা ও স্মৃতিশক্তি অন্যান্য জীবের চেয়ে প্রখর। হিংসাকে মানুষ অন্যান্য জীবের চেয়ে। দীর্ঘকাল জিইয়ে রাখতে পারে, তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করতে পারে, তা দিয়ে ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হতে পারে। যে-সব সঞ্চালক আবেগ বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষের আত্মরক্ষার সহায়ক, সেই সব আবেগের আধিক্য আবার মানুষকে ক্লান্ত এবং মূঢ় করে, এমন কি তার বিনাশের কারণও হয়। হিংসা ও ক্রোধ থেকে মূঢ়তা ও মৃত্যুর কথা প্রাচীনেরাও বলে গেছেন। অতএব আত্মরক্ষার জন্যই এই সব আবেগের ঊর্ধ্বে উঠবার শক্তিও মানুষের প্রয়োজন।

মানুষের স্মৃতিশক্তি যেমন দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আবেগকে কিছুটা নিরাসক্ত ভাবে দেখবার শক্তিও তেমনই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। তা যদি না হত তবে সঞ্চিত তিক্ততার অন্তদাহেই আমাদের দ্রুত মৃত্যু ঘটত। স্মৃতির যাদুর সঙ্গে আমরা সবাই অল্পবেশী পরিচিত। যে-সব ঘটনা একদিন আমাদের অত্যন্ত চঞ্চল ও উত্তেজিত করে তুলেছিল, তারাই আবার ধীরে ধীরে স্মৃতির পটে ইষৎ সহাস্য, ঈষৎ বিষণ্ণ মুখচ্ছবির মতো সারিবদ্ধ হয়। এরই সঙ্গে, সাহিত্যের জাদুরও মিল আছে।

জৈবিক আবেগ সাহিত্যে রূপান্তরিত হয়ে স্থান পায়। এই রূপান্তরে শিল্পীর অভ্যাসলব্ধ কারিগরী অথবা কলাকৌশল কাজে আসে। কিন্তু ঈষৎ ব্যবধান থেকে দর্শনটাই আরও মূল কথা। এই দর্শন আবেগশূন্য নয়। বরং একটি অখণ্ড আবেগের দ্বারা বিধৃত। সাহিত্যের এই আবেগ জৈবস্তরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েও উপনিষদে কথিত দ্বিতীয় পাখীটির মতো গুণগতভাবে ভিন্ন। ভিন্ন, অথচ সংযুক্ত। অতএব সাহিত্য একই সঙ্গে সর্বকালের, আবার যুগচিহ্নে চিহ্নিত।

প্রেমেরও ভাষা বদল হয়। ভয়েরও প্রকারভেদ আছে। যে-যুগে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ভিতর একটা সহজ ঐক্যবোধ ছিল, আর যখন সেই ঐক্যের উপলব্ধি বিধ্বস্ত এই দুই যুগের ভয় ও অনুরাগ এক বর্ণের নয়, এক ধর্মের নয়। শিল্পী স্থির দৃষ্টিতে দেখেন, এবং সৃষ্টি করেন। কিন্তু তিনি যা দেখেন তা পরিবর্তিত হয়ে চলে। আর তিনি যা দেখেন তার সঙ্গে যোগ রক্ষা করে তবেই তিনি যা সৃষ্টি করেন তা অর্থময় হয়ে ওঠে। ভূতের ভয় যে-মন্ত্রে তাড়ায়, আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গতা তাতে কাটে না। যে-সব শব্দ এবং চিত্রকল্প একদিন পরিচিত ভাব ও আবেগের সর্বস্বীকৃত প্রতিভূ ছিল, সময়ের গুণে তারাও একদিন জীর্ণ ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। নতুন যুগের কবি তাঁর অনুভূত সত্যকে প্রকাশ করেন নতুন ভাষায়।

(৬) আমাদের ব্যক্তিগত এমন কিছু খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা থাকে, যাদের আমরা সহজে বশে আনতে পারি না, যারা উপদ্রবের মতো সময়ে অসময়ে আমাদের মনে ফিরে আসে। ঐরকম এক-একটি অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যিক বশে আনেন, করুণা অথবা কৌতুক অথবা বিস্ময় কিংবা অন্য কোনো ভাবের ভিতর তাকে স্থাপন করেন। উপদ্রবটা কোনো ছোটো অথবা নেহাত ব্যক্তিগত ব্যাপার থেকে নাও হতে পারে। নিজের যুগ ও সমাজ নিয়ে ধারণাটা হয় তো স্পষ্ট হতে চাইছে। যে-অভিজ্ঞতা আমাদের অস্তিত্বের মূল কথা, তাকেই হয় তো আমরা বাঁচাতে চাইছি। অস্পষ্টতার এবং অস্থায়িতার যন্ত্রণাকে সাহিত্যিক জয় করেন প্রকাশের ভিতর দিয়ে, কোনো স্থায়ী রসের আশ্রয়ে।

ধর্ম একটি ভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। আমাদের ‘অহং’-কে নিয়েই ধর্মের প্রশ্ন, যাতে বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কে টান পড়ে। যে অস্বস্তির মূলে ধর্মজিজ্ঞাসা, শুধু শিল্পে তা আশ্বস্ত হয় না।

ছোটো সমাজের পরিধিতে, স্বজন ও প্রতিবেশীর সম্পর্কের ভিতর, মমত্ববোধ ও ব্যবহারিক প্রয়োজন হাত ধরাধরি করে থাকে। যে-বস্তুতে মমত্বের স্পর্শ লাগে, ব্যবহারিক প্রয়োজনকে অতিক্রম করে সেই বস্তু একটি অতিরিক্ত মূল্যের অধিকারী হয়। বাজারের জাম আর বাড়ীর বাগানের জামের স্বাদ এক নয়। এই অতিরিক্ত স্বাদ কোথা থেকে আসে সে-কথা ব্যাখ্যা করে বলা হয় তো সহজ নয়; কিন্তু আমাদের মনের কোনো একটি গভীর অভাব অথবা তৃষ্ণার সঙ্গে যে এর যোগ আছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ভাড়াটে বাড়ী ও নিজ বাড়ীর ভিতর একটা পার্থক্য আছে এবং সেই পার্থক্য শুধু ব্যবহারিক উপযোগিতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই বিশ্বকেও আমরা স্বগৃহ করে তুলতে চাই। অর্থাৎ একে শুধু ব্যবহারের কাজে পেয়েই আমরা সন্তুষ্ট নই, একে আমরা মমত্বের ভিতরও লাভ করতে চাই। প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে প্রকৃতির শক্তিকে আমরা ব্যবহারের কাজে পাই। কিন্তু মানুষের মন আরও কিছু চায়। যে-মমত্ববোধ সাধারণ ব্যবহারিক জীবনের পিছনে প্রেরণা অথবা শক্তিরূপে সংস্থিত, সেই মমত্ববোধ দিয়েই মানুষ দূরতম নক্ষত্র পর্যন্ত সমস্ত বস্তুকে আবৃত করে পেতে চায়।

আদিম ধর্মকে অনেকে ভয়ের ধর্ম বিবেচনা করেছেন। সে-যুগে মানুষের চোখে রক্তাক্তদস্তনখরা প্রকৃতি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ ছিল। ধর্মচেতনার ওপর সেই ভয়াবহতার। ছায়া পড়াই স্বাভাবিক। তবু একথা সহজেই অনুমেয় যে, শুধু ভয় থেকে কোনোকালেই ধর্মচেতনা আসেনি। নিছক ভয়ের ভিতর এরকম শুষ্কতা আছে যাতে গলা শুকিয়ে আসে। ধর্মচেতনার সঙ্গে এর কোথাও একটা গভীর অমিল আছে। আদিম ধর্মচেতনার ওপর অজ্ঞতার ছায়া গম্ভীর হয়ে পড়েছে, আজকের ধর্মও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু কোনো যুগের ধর্মই কেবল এই উপাদানে গড়া নয়। যে-বিশ্বকে মানুষ সম্পূর্ণ জানে না, যাকে সে ভয় করে, তবু যার সঙ্গে সে মমতায় জড়াতে চায়, সেই বিশ্বই আদিম মানুষেরও ধর্মচেতনার বিষয়।

যে-ছোটো সমাজের ভিতর মানুষের মমত্ববোধ ও ব্যবহারিক সম্পর্ক মিলে মিশে প্রত্যক্ষরূপে আছে, তার সংগঠনের সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিন্যাসের একটা মিল ভিন্ন ভিন্ন যুগের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উপলব্ধি করেছে। এমন একটা সময় আসে যখন পরিচিত যে-সব সম্পর্কের ভিতর মানুষ তার মমত্ব স্থাপন করেছিল, নতুন পরিস্থিতিতে সে-সবই। জীবনের ব্যাপ্তির পথে প্রতিবন্ধ হয়ে দাঁড়ায়। যে-সব ধ্যান-ধারণা ও কল্পনা বহুদিনের। অভ্যস্ত জগৎকে আত্মীয়ের মুখের মতো চেনা মুখ করে তুলেছিল, সেই সবই আবার নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে অথবা সমস্যার সমাধান কঠিন করে তোলে। পুরাতনকে মানুষ আঁকড়ে থাকতে চায় শুধু স্বার্থের গণনা থেকে নয়, মায়ার বন্ধন থেকেও। প্রয়োজনে সেই বন্ধনও ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়। ক্ষয় হয়, তবু একেবারে হারায় না। মমত্বকে বার বার স্থাপন করতে হয় নতুন কল্পনায়। সেই কল্পনায় পুরাতন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয় না। বরং অনেক প্রাচীন কাহিনী ও ইতিকথাকেই মানুষ নতুন করে লেখে, নতুন যুগের উপযোগী করে নেয়। ধর্ম ও ঐতিহ্যের ইতিহাসে এ ঘটনা বার বার দেখা গেছে।

ঈশ্বনোপলব্ধিকে যে-উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা হয়, পরিচিত জীবন থেকেই সে উপমা খুঁজে নিতে হয়। এই আরোহণ ও অবরোহণ মানুষের স্বভাবের বৈশিষ্ট্য। নিকট ও প্রত্যক্ষের হাত ধরে মানুষ বিশ্বচেতনায় গিয়ে পৌঁছয় আবার বিশ্বচেতনার সঙ্গে যুক্ত না করে সে নিকট ও ব্যবহারিক বস্তুকেও সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে পারে না। আর এরই ফলে ধর্মও ইতিহাসের সঙ্গে বাঁধা পড়েছে। জ্ঞানের প্রসার এবং সমাজ সংগঠনের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানুষের বিশ্বচেতনার পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন যুগের বাঁকে দাঁড়িয়ে এই চির-পুরাতন-অথচ-চির-নবীন পৃথিবীকে মানুষ যুগের উপযোগী নতুন প্রেমে জড়াবার ভাষা খুঁজেছে।

সেই প্রেম আবারও হয়েছে আরোহণকারী ও অবরোহণকারী। কারণ ধর্মের উদ্দেশ্য একই সঙ্গে সমাজকে অতিক্রম করে যাওয়া ও সমাজকে ধারণ করা স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বন্ধু কোনো সম্পর্কই ব্যবহারিক প্রয়োজন থেকে মুক্ত নয়; আবার কোনো সম্পর্কই ব্যবহারিক প্রয়োজন মাত্রে পূর্ণ হতে চায় না। সংসারকে এমন একটি বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যার মূল উর্ধ্বে। সব উপমাই অসম্পূর্ণ। আমাদের এই প্রয়োজনের সংসার প্রয়োজনে বদলায়। কিন্তু একটি আরোহী-অবরোহী প্রেমে সিঞ্চিত হয়েই সে সতেজ থাকে; নয়তো জীবন আপনার বৃন্তে স্থিত থেকেও মমতাহীন ব্যবহারিকতার রসহীন তপ্ত স্পর্শে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

.

(খ)

আত্মীয়ত, বণিকতন্ত্র ও আমলাতন্ত্র

(৭) ব্যক্তির একান্ত উল্লেখে যার নাম মমত্ব, সমাজের পটভূমিকায় তা-ই আত্মীয়তাবোধ। মননের প্রকাশ একদিকে স্বাতন্ত্র চেতনায়, অন্যদিকে ন্যায় অথবা সাম্যদৃষ্টিতে। মমত্বের বিকৃতি থেকে আসে নিষ্ঠুরতা, মননের বিকার থেকে অন্যায়।

ব্যক্তির মমত্ব কি ভাবে একটি সমষ্টিতে আশ্রিত হয়, পরিবারই তার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এখানে একের সুখ ও দুঃখ অন্যে স্বভাবত নিজের সুখ-দুঃখের অংশরূপে অনুভব করে। এখানে সহানুভূতি যুক্তি ও নিয়মকে অতিক্রম করে যায়। পিতার অজ্ঞাতেও পুত্র যে অপরাধ করে, পিতার গোচরে আসা মাত্র তিনি তাতে লজ্জিত বোধ করেন, নিজেকেই অপরাধী জ্ঞান করেন। বিদ্বান ছেলের সাফল্যে নিরক্ষর মা গর্ব অনুভব করেন। আত্ম’বোধের এই প্রসারকেই সাধারণ ভাষায় বলা যায় আত্মীয়তা অথবা আত্মীয়ভাব। রক্তের বন্ধন আত্মীয়ভাবের আদিম ভিত্তি, কিন্তু একমাত্র অবলম্বন নয়। শিষ্যের কৃতিত্বে গুরু গৌরব বোধ করেন। কর্মী সহকর্মীর সঙ্গে সহমর্মিতায় আবদ্ধ হন। এক বাঙ্গালী পৃথিবীতে সম্মানিত হলে বাঙ্গালীসাধারণ অহংকৃত হয়।

তবুও পরিবারই প্রসারিত মমত্বের প্রাথমিক উদাহরণ। পরিবারে একের সঙ্গে অন্যের বন্ধন শুধু জীবিতদের ভিতরই আবদ্ধ নয়। মৃত পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণের দ্বারা জীবিতেরা তৃপ্ত হন। যিনি মৃত তাঁর কর্ণ নেই; কিন্তু আমাদের ধ্বনি কোনো সুদূর আকাশ থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে একটি সমৃদ্ধতর সুর সহ ফিরে আসে। আমাদের ক্ষুদ্র চেতনা অথবা ক্ষুদ্র অহং যেন একটি বৃহৎ চেতনার সঙ্গে যোগ অনুভব করে।

এই যোগ কার্যকারিতাশূন্য অনুভূতিমাত্র নয়। বিশেষত প্রাচীন সমাজে পরিবারের একটি অলিখিত সংবিধান থাকে। সেই সংবিধান বহু পরিমাণে পূর্বপুরুষের রচিত। সেই অনুযায়ী এবং বর্তমান কালের প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরিবার শাসিত হয়। কর্তৃত্ব সম্বন্ধে ধারণা, পরিবারে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কর্তব্য ও অধিকার, এইভাবে নির্ধারিত হয়। এইভাবে ক্ষুদ্র অহং-এর অস্থিরতা বৃহৎ অহং-এর গাম্ভীর্যের ভিতর স্থিতি লাভ। করে। সময় বিশেষে সেই স্থিতি কারাবাসের তুল্য হয়। স্মৃতিপ্রণেতারা তাঁদের সংকীর্ণ। ভাষাকে চিরকালের বাণী বলে দাবী করেন। এই বদ্ধতা থেকে সমাজকে কিন্তু তাঁরাই মুক্তি দিতে পারেন যাঁরা ক্ষুদ্র ও বৃহৎ, বর্তমান ও অতীতের ভিতর সম্পর্কটাকে উপেক্ষা করেন না, বরং তাকে সমকালের উপযোগী করে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

পরিবার সম্প্রসারিত হয়; উপজাতি গঠিত হয়। এক উপজাতি অন্য উপজাতিকে পদানত করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী যেসব উপজাতি পাশাপাশি বাস করে, অনুকূল অবস্থায় তারা ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক মহাজাতিতে পরিণত হয়। রাজ্য ও সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। নতুন ও বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন উপজাতীয় ও জাতীয় সংগঠনকেও এক ধরনের আত্মীয়তন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

বলা বাহুল্য, আত্মীয় ভাব ও আত্মীয়তন্ত্র এক বস্তু নয়। প্রথমটি সহজ ভাব; দ্বিতীয়টি সেই ভাবের প্রলম্বনস্বরূপ একটি রচিত ভাবাদর্শ। প্রাচীন সমাজে অসাম্য ও আত্মীয়চিন্তাকে এই ভাবাদর্শের সাহায্যে একই সূত্রে বাঁধা হয়েছে। রাজা ও প্রজার ভিতর সম্পর্কের এটিই প্রাচীন আদর্শ রূপ। রাজা পিতার মতো, প্রজা সন্তানতুল্য। রাজবংশ ও জাতির উৎপত্তি পূর্বপুরুষসুত্রে স্মরণাতীতকাল অতিক্রম করে চন্দ্র, সূর্য, দেবদেবতার সঙ্গে যুক্ত। দৈব প্রেরণা অথবা দীর্ঘ ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী রাজা শাসন পরিচালনা করেন।

অর্থাৎ বৃহৎ সমাজ সংগঠনের একটি মৌল রূপ আত্মীয়তন্ত্র। চীনা দার্শনিক কুং ফু-সু বা কনফুসিয়সের চিন্তায় এর প্রখ্যাত পরিচয় পাওয়া যায়। সমাজ সংগঠনের অপর মৌলরূপ আমলাতন্ত্র। প্রাচীন সমাজে এ দুয়ের বিরোধ তেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। চীনের আমলাতন্ত্র ঐতিহাসিক খ্যাতির অধিকারী। দার্শনিক কুং কিন্তু ঐ আমলাগোষ্ঠীকেও প্রজার প্রতি আত্মীয়চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। সব আদর্শ। সমাজ কল্পনাতেই তৎকালীন অবস্থার একটি উহ্য সমালোচনা থাকে। নিষ্ঠুরতা, অন্যায় ও অরাজকতায় চিহ্নিত প্রাচীন আত্মীয়তন্ত্রের একটা বিকৃত রূপ ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়েছে। কনফুসিয়সের আদর্শ সে-যুগের উচ্চতর ঐতিহাসিক আত্মসমালোচনা। (তাঁর একটি স্মরণীয় উক্তি কি আশ্চর্য! এমন একটি লোকের দেখা পেলাম না, যিনি নিজের দোষের জন্য নিজেকে দোষী মনে করেন।)।

(৮) মধ্যযুগে সম্রাট রাজত্ব চালাতেন আমলা ও সমান্তদের সহায়তায়। সাধারণভাবে বলা যায় যে, কেন্দ্রীয় শক্তি যেখানে দৃঢ় সেখানে আধিপত্য আমলাদের; আর বিকেন্দ্রীকরণের ঝোঁকটা যেখানে শক্তিশালী সেখানে আধিপত্য সামন্তদের। মধ্য যুগের সমাজে এই দ্বিতীয় ঝোঁকটাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বণিক সম্প্রদায়ের অভূদয়ের ফলে মানুষে মানুষে সম্পর্কের একটি ভিন্ন আদর্শ স্পষ্ট হয়ে উঠল। আর সেই সঙ্গে একটি ভিন্ন সমাজ সংগঠনের ভিত্তি রচিত হল। পারিবারিক অথবা আত্মীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একের সুখে অন্যের সুখ। বাণিজ্যের অর্থাৎ কেনাবেচার সম্পর্কে দুজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি অথবা দুটি স্বতন্ত্র সংস্থা মুখোমুখি দাঁড়ায়। বাণিজ্যের ফলে হয়তো দুই দলই লাভবান হয়; কিন্তু একের লাভ অন্যের লাভের অংশ বলে গণ্য হয় না। প্রত্যেকের লাভ ও ক্ষতির হিসেব আলাদা। এই স্বাতন্ত্র্যবোধ বাণিজ্যিক সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সমাজে বণিক শ্রদ্ধার স্থান লাভ করেনি। সে যুগের ধর্মের সঙ্গে বণিকধর্মের বিরোধ ছিল মৌল।

অথচ স্বীকার করা প্রয়োজন যে, সাম্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আন্তজাতিকতা ও নিয়মের শাসনের যেসব আদর্শ মানুষের ঐতিহ্যের মূল্যবান উপাদান, সেই সব আদর্শের গঠনে বাণিজ্যের ঐতিহাসিক ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয়। নাগরিক সংস্কৃতি নামে যা পরিচিত, বণিক সভ্যতার দ্বারাই তা লালিত।

বণিক সভ্যতা যুক্তিকে বহুদূর এগিয়ে দিয়েছে। ধর্মকে বণিকশ্রেণী ত্যাগ করেনি; কিন্তু যুগের প্রভাবে ধর্ম ভিতর থেকে পরিবর্তিত হয়েছে এবং যুক্তির সঙ্গে নতুন সামঞ্জস্যে পৌঁচেছে। ব্যক্তির বহুমুখী সম্ভাবনা নতুনভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মধ্যযুগীয় আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজে উচ্চ-নীচের পার্থক্য স্বাভাবিক এমনকি দৈব আদিষ্ট বলেই স্বীকৃত ছিল। ইংরেজী ‘hierarchy’ শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দের যোগ থেকে উৎপন্ন। এর প্রথমটির অর্থ, পুত বা পবিত্র (hieros); দ্বিতীয়টির অর্থ, শাসক (arkhes)। দৈব নির্দিষ্ট ও পবিত্র ভেদ ব্যবস্থা ছিল প্রাচীন সমাজের একটি মৌল প্রত্যয়। বিভিন্ন বর্ণের ভিতর উচ্চ নীচ ভেদ ভগবানের বিধান; এই পার্থক্য অস্বীকার করা নীতিবিরুদ্ধ। অপর পক্ষে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই মৌল প্রত্যয় থেকে মুক্ত। ক্রেতা ও বিক্রেতার ভিতর কোনো পক্ষই নীতিগতভাবে উচ্চ অথবা নীচ নয় বরং নীতি ও আইনের দৃষ্টিতে উভয় পক্ষই সমপদবাচ্য। সাম্য সম্বন্ধে এই ধারণাকে কোনো মতেই পূর্ণাঙ্গ বলে মেনে নেওয়া যায় না। তবে বণিক সভ্যতাই সাম্য ও অসাম্যের প্রশ্নকে প্রাচীন অনুশাসন থেকে ছিন্ন করে ব্যবহারিক যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে।

পুরনো সমাজে স্থানীয় আচার ও প্রথার ঊর্ধ্বে সর্বদেশে স্বীকৃত কোনো আইনের ধারণা প্রায় ছিল না। কিন্তু বাণিজ্যের সূত্রে যতই নানা দেশের মানুষ পরস্পর সম্পর্কে আবদ্ধ হল ততই স্থানীয় প্রথাকে সেই বৃহত্তর কর্মকাণ্ডের সর্বসম্মত ভিত্তি হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে উঠল। এরই ফলে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দেখা দিল আইনের ‘স্বাভাবিক অথবা আদর্শ ভিত্তি স্থানীয় আচারে নয়, বরং সেই সাধারণ যুক্তিতে, বহু দেশের মানুষের কাছে যে-যুক্তি সমভাবে গ্রহণযোগ্য। রোমক সাম্রাজ্যের যুগে এই দৃষ্টিভঙ্গীর সূত্রপাত; রেনেসাঁসের যুগে এর পুনরুজ্জীবন। দুই বিপরীত চিন্তাধারা অর্থাৎ আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজের নিয়ম এবং সার্বজনীন ন্যায় সম্বন্ধে নতুন ধ্যানধারণার ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে আইনের নতুন ঐতিহ্য ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হল।

বাণিজ্য শিল্পবিপ্লবের অগ্রদূত, তবে অনিবার্যভাবে নয়। বাণিজ্যবৃদ্ধির অর্থ হল বাজারের বিস্তার। বাজারের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে একটি কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন দ্রব্য নানা। বাজারে বিক্রয় করা যায়। ফলে স্থানীয় বাজারের চাহিদার ওপর আর শিল্পের আয়তন নির্ভর করে না। এই সুযোগে যদি প্রযুক্তি বিদ্যারও যথেষ্ট উন্নতি ঘটে এবং সেই সঙ্গে পরিচালনা পটুত্বের যোগাযোগ দেখা যায়, তবেই দ্রুত শিল্পায়ন সম্ভব হয়। প্রাচীন রোমক সাম্রাজ্যের যুগে ঘটেছিল বাণিজ্যের প্রসার। কিন্তু প্রযুক্তিবিদ্যার কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি সে-যুগে ঘটে নি; অতএব কোনো শিল্পবিপ্লবও সেদিন দেখা দেয়নি। আইন প্রণয়ন ও সংকলনে রোমক যুগ খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু আইন প্রণয়নের জন্য যে বিশেষ ধরনের যুক্তিপ্রবণতা প্রয়োজন, শিল্পবিপ্লবের পক্ষে সেটাই যথেষ্ট নয়। আরও প্রয়োজন বিজ্ঞান।

(৯) সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়তান্ত্রিক, বণিকতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং সেই সঙ্গে তাদের রূপ ও চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে। কোনো এক যুগে এই সম্পর্ক কিভাবে গঠিত হয় এবং পরিবেশের পরিবর্তনের প্রভাবে নতুন সমন্বয়ে পৌঁছয়, সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকের পক্ষে এটি বিস্তৃত গবেষণার যোগ্য বিষয়বস্তু। সামাজিক ও আর্থিক ইতিহাসের একটি প্রধান ভাগ এইভাবে লেখা সম্ভব।

বাণিজ্য বিস্তারের আধুনিক যুগে আমলাতন্ত্রের সহায়তা বণিকশ্রেণীর পক্ষে বিশেষভাবে প্রয়োজন ছিল। বহু ক্ষেত্রেই সে-সহায়তা লভ্য হয়েছে। শাসনযন্ত্রের ওপর অধিকার নিয়ে অভিজাত শ্রেণীর ভিতর একটা কলহ অথবা অন্তর্দ্বন্দ্ব চলে। যুগ পরিবর্তনের সময়ে বণিকের সমর্থন নিয়ে অভিজাত শ্রেণীর একটি অংশ জয়ী হয়েছে। বিচিত্র ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মোটামুটি এই রকম পরিবর্তন দেখা গেছে ইংল্যান্ড থেকে জাপান পর্যন্ত অনেক দেশেই। শাসন পরিচালনায় অভিজাতদের একটা স্বাভাবিক পটুত্ব ছিল। শিল্পায়নের প্রথম যুগে এঁরাই বহু দেশে শাসনযন্ত্রে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বণিক এবং শিল্পপতিদের সঙ্গে নানাভাবে সহযোগিতা রক্ষা করে এঁরা শাসন চালিয়েছেন। এটাই এঁদের কাছে জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন মনে হয়েছে। দেশের আর্থিক উন্নতি এ পথে ঘটেছে।

দেশ শাসন আর বাণিজ্য বিস্তার এক ধরনের কাজ নয়। এ দুয়ের জন্য ভিন্ন জাতীয় গুণের প্রয়োজন হয়। জনগণের যিনি অধিনায়ক হবেন, ঝড়ঝঞ্জার ভিতর দিয়ে দেশকে চালিত করবেন, তাঁকে হতে হয় জাতীয় সংহতির প্রতীক। অর্থাৎ, তাঁর ভিতর বৃহৎ অর্থে একটা আত্মীয়গুণের প্রয়োজন। বণিকশ্রেণী ও শিল্পপতি এক নতুন ব্যবহারিক বুদ্ধির প্রতীক। নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী নাগরিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কিন্তু শুধু নগর নিয়েই তো দেশ নয়। দেশের কাছে পুরনো ঐতিহ্যের ও আভিজাত্যের, সেই ‘যুক্তির যুগেও, একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। পারী নগরী আর ফরাসী দেশ এক নয়। অতএব সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিভিন্ন দেশে এই ঐতিহাসিক সমন্বয় বিভিন্নভাবে ঘটেছে; অথবা কখনও সমম্বয়ের অভাবে ব্যর্থতা এসেছে। দুটি মূল ভাব এবং দুটি পরস্পর অন্তঃপ্রবিষ্ট শ্রেণী অথবা গোষ্ঠীর সহযোগিতার মাধ্যমেই অগ্রগতি স্বাভাবিক রূপ। লাভ করেছে।

(১০) সামাজিক উচ্চনীচভেদ তিন প্রকার বর্ণ অথবা জাতি ভেদ, আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজে যার সমর্থন শাস্ত্রীয়; বিত্ত অথবা শ্রেণী ভেদ, বণিকতান্ত্রিক সমাজে যার বিকাশ উল্লেখযোগ্য; পংক্তি অথবা পদাধিকারভেদ, নিয়ম ও সংগঠনের ওপর যার প্রতিষ্ঠা। বলা। বাহুল্য, এই বর্ণ-বিত্ত-পংক্তিভেদ একটি স্থাণু বিন্যাস নয়, বরং পরস্পর সন্নিবিষ্ট ও পরিবর্তনশীল। ঐতিহাসিক পরিবেশের প্রভাবে এদের রূপান্তর ঘটে। প্রতিটি জাতি, পাতি ও শ্রেণী স্বভাবত নিজেকে রক্ষা করতে আগ্রহী; কিন্তু প্রয়োজনে রূপান্তরও আত্মরক্ষার উপায় হয়। সৈনিক হয়ে ওঠে বণিক, বণিক রূপান্তরিত হয় আমলায়।

বণিকতন্ত্রের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপর তার প্রভাব দেখা যায়। উৎপাদন একদিন পারিবারিক ভিত্তিতে সংগঠিত ছিল। আধুনিক যুগে ব্যবসায়ী সংস্থার প্রাধান্য। প্রাচীনকালে ক্রীতদাসও যেন পরিবারের অংশবিশেষ ছিল। আঠার শতকের ক্রীতদাস প্রধানত বেচাকেনার সামগ্রী। ক্রীতদাস প্রথা একদিন পরিত্যক্ত হল। শ্রম নিয়ে বেচাকেনা চলল, সেই শ্রম যাকে দিন ও ঘণ্টা অনুযায়ী পরিমাপ করা যায়, অতএব উৎপাদনের প্রয়োজনে যাকে অঙ্কের হিসেবের ভিতর আনা যায়। এর ফলে শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি এবং “উদ্বৃত্ত শ্রমের” নিয়োগ বৃদ্ধি পেল। এরই নাম শোষণ; আবার আর্থিক জীবনে ব্যবহারিক যুক্তির প্রয়োগে এটা ঐতিহাসিক অগ্রগতিও বটে। ক্রমে শিল্পপতি ও শ্রমিক উভয়পক্ষেই সাংগঠনিক ভিত্তিতে দর কষাকষি শুরু হল। এই হিসেবে শ্ৰমিকসমিতিও এক ব্যবসায়িক সংস্থাবিশেষ। তবে ভাবাদর্শের প্রভাবে, সমহিংসায় ও সমস্বপ্নে, শ্রমিক আন্দোলন যুথবদ্ধ। এই আন্দোলন আজ সামাজিক সাম্যের সপক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি।

আধুনিক যুগে আমলাতন্ত্রেরও চরিত্র পালটাতে শুরু করে। আমলাতন্ত্র ক্রমে হয়ে উঠল আত্মীয়তন্ত্র ও নিয়মধর্মিতার এক অসম্পূর্ণ ও কিছুটা বিকৃত সমম্বয়। উচ্চ নীচ ভেদ আমলাতন্ত্রে অপরিহার্য। এই ভেদকে দৈব নির্দিষ্ট বলে গ্রহণ করা যতই কঠিন হয়ে উঠল, ততই একে নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন হল। এই নিয়ম ব্যক্তির পরোয়া করে না; তবে বিশেষ পদের বিশেষ কর্তব্য এবং অধিকার স্বীকার করে। পদের সঙ্গে সংযুক্ত সেই কর্তব্য ও অধিকার কিন্তু যুক্তির দ্বারা, অর্থাৎ ‘সাধারণ স্বার্থ ও যান্ত্রিক দক্ষতার বিচারে, সমর্থনীয় হওয়া প্রয়োজন। যে-আত্মীয়তন্ত্র একদিন স্বৈরাচারের বাহন হয়ে উঠেছিল তার কবল থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিক আমলাতন্ত্র এইভাবে এক নৈর্ব্যক্তিক নিয়ম ও যান্ত্রিক। যুক্তির আদর্শে আকৃষ্ট হল। সমাজের বিবর্তন ও অগ্রগতিতে যে আমলাতন্ত্রের একটা বিশেষ ভূমিকা ও অবদান আছে, একথা স্বীকার্য।

কিন্তু সেই সঙ্গে নতুন সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় আধিপত্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শাসকের সঙ্গে শাসিতের দূরত্ব অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে। শাসনযন্ত্র বিরাট ও জটিল হয়ে উঠেছে। এই জটিলতা বৃদ্ধির ফলে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভাব বিনিময় কঠিন হয়েছে। শাসনসংক্রান্ত নিয়ম ও সিদ্ধান্তের পিছনে যুক্তি থাকলেও সেই যুক্তি সাধারণের বোধগম্য হয়ে উঠছে না। এই বিযুক্তি আধুনিক সমাজের একটি মূল সমস্যা। নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাতেও এই সমস্যা থেকে যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে নিয়মতন্ত্র ত্যাগ করে এই সমস্যাকে অতিক্রম করা যাবে না। বরং কেন্দ্রীয়তা ও বিকেন্দ্রীকরণের সমন্বয় নিয়ে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এর সমাধান খুঁজতে হবে।

(১১) আমলাতন্ত্র তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রসার ও ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে রাজনীতি, অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর দখল নিয়ে লড়াই, বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এ বিষয়ে প্রসঙ্গত দুয়েকটি কথা বলা যেতে পারে।

মধ্যযুগে রাজনীতি ধর্মের অঙ্গ ছিল। আধুনিক যুগের গোড়াতেই রাজনীতিকে ধর্মের আওতা থেকে বের করে আনবার চেষ্টা শুরু হল। এর প্রয়োজন ছিল। দুটি গোষ্ঠী যখন ধর্মীয় অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক আনুগত্যে অন্ধ হয়ে পরস্পর দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয় তখন তার ফল কত ভয়াবহ, ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার রক্তাক্ত পরিচয় বার বার চোখে পড়ে।

নতুন যুগে মানুষ রাজনীতির দিকে তাকাতে চাইল নিমোহ দৃষ্টি নিয়ে। মাকিয়াভেলির চিন্তায় এর নিদর্শন পাওয়া গেল রেনেসাঁসের যুগে, সেই ষোড়শ শতকের গোড়ায় যখন। সারা সৌরমণ্ডল সম্বন্ধেই মানুষের ধারণা উলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। বৈজ্ঞানিক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপিত হল। এর ফলে কিন্তু রাজনীতি অবশেষে শুধু ধর্মনিরপেক্ষই নয়, নীতি নিরপেক্ষ হয়ে উঠল। বৈজ্ঞানিক রাজনীতির চোখে পূর্ব নির্ধারিত কোনো নীতি বড় নয়, উদ্দেশ্য সিদ্ধিটাই বড়। এতে হয় তো তেমন বিপদ ছিল না, যদি কোনো মহৎ উদ্দেশ্যকে কার্যত গ্রহণ করা যেত।

কিন্তু এ যুগে রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করাই কার্যত রাজনীতির উদ্দেশ্য। আরও বড় উদ্দেশ্যগুলো মুখের কথা হয়ে রইল। রাষ্ট্রযন্ত্র করায়ত্ত করা না গেলে সেই সব উদ্দেশ্য পূর্ণ করা যাবে না। অতএব রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করাটাই আপাতত একমাত্র অথবা মুখ্য উদ্দেশ্য। এই চিন্তাটাই প্রধান হল। অন্য সংস্কার ত্যাগ করে, অন্য বাধানিষেধ এবং ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য অবজ্ঞা করে, ক্ষমতার অম্বেষণই আধুনিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াল। শুধু একটি হৃদয়দৌর্বল্য অন্য সকল মানুষী দুর্বলতার ওপর জয়ী হল, সেটি ক্ষমতার লোভ।

বলা বাহুল্য, এই রাজনীতি অর্ধ বৈজ্ঞানিক মাত্র। সত্যের সঙ্গে অর্ধ সত্যের সাদৃশ্য যেমন, আধুনিক রাজনীতির সঙ্গে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক রাজনীতিরও তেমনই। যেন তেন প্রকারেণ রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করতে পারলেই কোনো দল তার ঘোষিত মহৎ উদ্দেশ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে অথবা সেখানে পৌঁছবার পথ পরিষ্কার হবে, এই সিদ্ধান্তে কেউই নিরাসক্ত বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাহায্যে পৌঁছাননি। গান্ধী এলেন বিপরীত সিদ্ধান্ত নিয়ে। আদর্শ সমাজের মূল চরিত্রের সঙ্গে যে-সব উপায়ের সামঞ্জস্য আছে, সেই সব উপায়ই গ্রহণযোগ্য। তার বিপরীত উপায় অবলম্বন করে ক্ষমতা দখল করা যায় বটে, কিন্তু তাতে আদর্শে পৌঁছবার পথে নতুন বাধা সৃষ্টি হয়। এই রকম একটা চিন্তা আমরা গান্ধীর কাছ থেকে পেলাম।

শেষ লক্ষ্য ক্ষমতা দখল করা নয়। আদর্শ সমাজ গড়ে তোলাই শেষ লক্ষ্য। দক্ষ মিথ্যাচরণের দ্বারা যাঁরা ক্ষমতা দখল করেন, ক্ষমতা দখলের পর তাঁরা ক্রুর সন্দেহপরায়ণ হয়ে ওঠেন। হিংসা ও অসত্যের সাহায্যে রাষ্ট্রযন্ত্র জয় করে নেওয়া যায় কিনা, সেটা প্রধান কথা নয়। এর দ্বারা আদর্শ সমাজ গড়ে তুলবার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় কিনা, সেটাই বিবেচ্য। গান্ধীর কথাটা বিনা প্রশ্নে মেনে নেবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তিনি যে প্রশ্ন তুলেছেন, সেটা বড় প্রশ্ন। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেটা মিলিয়ে দেখা আবশ্যক। গান্ধী বলছেন যে, হিংসা ও অসত্য আমাদের বৃহত্তর আত্মীয়বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে। এর পর আমরা যতই ব্যবহারিক অর্থে দক্ষ অথবা বৈজ্ঞানিক হই না কেন, তাতে বিপদের হাত থেকে ত্রাণ পাওয়া যায় না।

(১২) প্রাচীন আত্মীয়তান্ত্রিক অসাম্য থেকে আইনভিত্তিক সমানাধিকারের দিকে ইতিহাসের যেমন একটা ধারা আছে, নিয়মতন্ত্র থেকে তেমনই আবার আত্মীয়ধর্মী সাম্যের দিকেও একটা ঝোঁক লক্ষ করা যায়। বণিকসভ্যতা কোনো কালেই যথেষ্ট বিবেচিত হয়নি। আজ তার অসম্পূর্ণতা আরও প্রকট। সমাজকে শুধু স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। একটা যৌথ দায়িত্ববোধ বা আত্মীয়বুদ্ধিরও প্রয়োজন। আছে। পরিবারে যেমন রোগীর সেবা অবশ্য কর্তব্য, সমাজেও তেমনই যাঁরা রুগ্ন ও পীড়িত তাঁদের সকলের শুশ্রূষার ব্যবস্থা থাকা চাই। উচ্চনীচ ভেদ নিরপেক্ষভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা চাই, সেই শিক্ষা যা একই সঙ্গে মানুষকে জগৎ সম্বন্ধে সচেতন করে এবং সমাজের। উৎপাদিকা শক্তিকে বাড়িয়ে তোলে। বাস্তব ও সাংস্কৃতিক যে-সম্পদ সারা সমাজের সৃষ্টি, তার উত্তরাধিকার যদি প্রধানত স্বল্পসংখ্যক পরিবারেই বতায় তবে তাকে অন্যায় বলেই স্বীকার করা প্রয়োজন। সে অন্যায় প্রাচীন হলেও তাকে আর শ্রদ্ধেয় বলা যায় না। বণিকসভ্যতা সেই অন্যায়কে সহজে মেনে নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিবিধানের দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্যবাদ। যেমন সমাজে তেমনই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভিতরও সম্পর্কের পরিবর্তন আবশ্যক। যৌথ অধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতেই যৌথ উৎপাদন প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

তবু বণিকসভ্যতার অবদানকে অস্বীকার করে নয়, বরং তার ভিতর যেটুকু গ্রহণযোগ্য তাকে গ্রহণ করেই বৃহত্তর আদর্শের দিকে এগোতে হবে। রেনেসাঁসের যুগ থেকে শুরু করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও আইনের শাসনের যে-ঐতিহ্য ইয়োরোপে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে সেটা অসম্পূর্ণ হতে পারে, কিন্তু অশ্রদ্ধেয় নয়। সাম্যবাদী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে প্রধানত পৃথিবীর সেই সব অংশে যেখানে রেনেসাঁসের ধ্যানধারণার ____ পুরু হয়ে পড়েনি, প্রতিবাদী ধর্মমত ও ব্যক্তিস্বাধনীতার ঐতিহ্য যেখানে দুর্বল। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এর ফলে সাম্যবাদের নামে সৃষ্টি হয়েছে, বিশ শতকের প্রযুক্তিবিদ্যার কাঠামোর ভিতর, বিস্তৃত আত্মীয়চিন্তা ও বর্বর অসহিষ্ণুতার এক ঐতিহাসিক সংমিশ্রণ। একদলীয় শাসন এবং স্বেচ্ছাচারী আমলাতন্ত্র এর সাংগঠনিক ভিত্তি। সেই আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আজ যাঁরা নতুন করে ব্যক্তিস্বাধীনতার আদর্শ স্থাপন করতে চাইছেন, ইতিহাসের একটা অপূর্ণতাকেই তাঁরা যে পূর্ণ করে তুলতে উদ্যোগী, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অতি দুরূহ তাঁদের সাধনা।

(১৩) এদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কলহ। মধ্যবিত্তের দুটি অংশ প্রধান : এক, বাবু-মধ্যবিত্ত; দ্বিতীয়, ব্যবসায়ী মধ্যবিত্ত। বণিক ও শিল্পপতিদের নিয়ে ব্যবসায়ী মধ্যবিত্ত। এঁদের অনেকে মনে মনে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চান। বাবু-মধ্যবিত্তের কথা একটু সবিস্তারে বলা আবশ্যক। আমলাতন্ত্রকে অবলম্বন করে এক জাতীয় মধ্যবিত্ত পুরনো যুগ থেকেই এদেশে একটা বড় সামাজিক স্থান অধিকার করে আছে। এঁদের একদিন মোগল দরবারে দেখা গিয়েছিল। পরে ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে এদের পুনরাবির্ভাব ঘটে। এই সঙ্গে মাস্টারবাবু, ডাক্তারবাবু ইত্যাদি যোগ করে আজকের বাবু-মধ্যবিত্ত। এঁরাই এদেশের বুদ্ধিজীবী। এঁরাই প্রধানত শ্রমিক কৃষকের নেতা। এঁদের হাতে এদেশের প্রশাসনের ভার আবার এঁরাই শাসনব্যবস্থার সমালোচকও বটে। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাবু নির্ঞ্ঝাট জীবন পছন্দ করেন। এঁদের অধিকাংশের লক্ষ্য এমন একটি সরকারী অথবা আধা-সরকারী চাকুরী, যেখানে প্রবেশের পর অলসগতিতে ও গতানুগতিক ধারায় কয়েকটি প্রমোশনের বেশী আর কিছু কাম্য থাকে না এবং আশা করবারও থাকে না। অধস্তন কর্মচারীদের এইরকম কিছু সুবিধা যিনি করে দেন তিনি দয়ার অবতার। এই বাবু-মধ্যবিত্তই এদেশের পেশীহীন প্রশাসনের কর্তা এবং প্রতিনিধি। আর এদেশীয় সমাজতন্ত্রের এরাই ব্যাখ্যাতা।

বলা বাহুল্য, এপথ জাতীয় উন্নতির পথ নয়। বণিকের কিছু সদগুণ বাবুমধ্যবিত্ত প্রাপ্ত হলে ভালো হত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, গান্ধীর ভিতর বণিকের গুণের অভাব ছিল না এবং একথা তিনি নিজে প্রকাশ্যেই বলতেন। তিনি অবশ্য ঐ বস্তুটিকে একটা আদর্শের স্পর্শে রূপান্তরিত করে নিয়েছিলেন। হিসেবের কাজ ও খরচ সম্বন্ধে মনোযোগ জমিদারী মেজাজে ছোট কাজ; কিন্তু গান্ধী এটাকে ছোটো কাজ মনে করতেন না। বিশেষত জনসাধারণের অর্থে পুষ্ট প্রতিষ্ঠানে এর অবহেলাকে তিনি অমার্জনীয় অপরাধ মনে করতেন। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গীর কোনো মৌল বিরোধ তো নেই-ই, বরং সমাজতান্ত্রিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাফল্য এছাড়া আশা করা যায় না। বণিকের গুণ যথেষ্ট নয়, একথা অনস্বীকার্য তবে তার প্রয়োজন ফুরোয়নি। বৃহত্তর আদর্শের সঙ্গে যুক্ত করে তবেই তাকে আজ স্থাপন করতে হবে।

সেই বৃহত্তর আদর্শের মূল কথাটি সরল।

শ্রম ও বিজ্ঞানের দ্বারা মানুষ ভবিষ্যৎকে জয় করে। এরই সঙ্গে মানবতাবাদ এবং সাম্য অথবা ভ্রাতৃত্বকে যুক্ত করে পাওয়া যাবে এ যুগের আদর্শ। শ্রমেই ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ, কারণ শ্রমের ভিতর দিয়ে মানুষ মানুষের সঙ্গে গড়বার কাজে যুক্ত হয়। শ্রমকে আরও ফলবান করে তুলবার জন্য বিজ্ঞানের প্রয়োজন। শ্রম ও বিজ্ঞান ছাড়া আজ কোনো সদর্থক দেশপ্রেম নেই। একে যুগের উপযোগী বিন্যাসে স্থাপন করবার মতো নেতৃত্ব চাই, প্রতিষ্ঠান চাই। যৌথ পরিবারের ভিতর উদ্যোগহীন পরাশ্রিত আত্মীয়ের সম্পর্ককে আত্মীয়তার আদর্শ বলা চলে না। সমাজতন্ত্রের নামে আমরা যদি সমাজের আশ্রিত হবার অধিকারই শুধু দাবী করি তবে দেশের সামগ্রিক সিদ্ধিও সেই অনুযায়ী হবে।

যুগ যুগ ধরে কোনো প্রকারে টিকে থাকাটাই যথেষ্ট নয়। যে-মমতা ইচ্ছাশক্তি হয়ে নিজেকে ও অপরকে শ্রম ও বিজ্ঞানের পথে চালিত করে, তাকে ছাড়া সুখ কদাচিৎ সম্ভব, কিন্তু দেশের সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। অতএব এদেশে নতুন ঐত্যি প্রয়োজন। আমাদের মধ্যবিত্তের উদ্বৃত্ত প্রাণশক্তি যদি ছোটোবড় রাজনীতি অর্থাৎ ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে নিঃশেষিত হয়, যদি এরই পাশে পাশে নতুন ঐতিহ্য গড়বার মতো লোক যথেষ্ট সংখ্যায় খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে বলতে হবে যে, মানুষ যে শক্তিতে নতুন ইতিহাস রচনা করে আমাদের ভিতর তার অভাব আছে।

ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (১৯৭৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *