1 of 2

৩.১০ যুক্তি ও প্রতিষ্ঠান

৩.১০ যুক্তি ও প্রতিষ্ঠান

ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিকে বিচিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করে সমাজ ক্রমাগত বিবর্তনের পথে চলেছে। এই বিবর্তনের প্রতি স্তরে তার যেমন একটা ভিতরের রূপ আছে, যেটা তার চেতনার রূপ, তেমনি একটা বাইরের রূপ আছে, যেটা তার প্রতিষ্ঠানের রূপ। উভয়কে যখন একসঙ্গে মিলিয়ে দেখি তখনই এদের সঙ্গে পরিচয়টা আরও গম্ভীর হয়। মানুষে মানুষে কিছু সম্পর্ক প্রতিষ্ঠানের ভিতর ধরা দেয় না; আমাদের এই আলোচনাতে স্বভাবত তাদের স্থান হবে না।

যে-সব প্রতিষ্ঠান প্রাকৃত চেতনার বৈশিষ্ট্রে চিহ্নিত, সাধারুণভাবে তাদের আত্মীয়তান্ত্রিক আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বাস্তব অথবা কল্পিত একটা আত্মীয়বন্ধনের ছাঁচে ঢালা। সমাজ ও চেতনার বিবর্তনের পরবর্তী স্তরে বাণিজ্যের প্রসারের একটা বড় ভূমিকা ছিল। এই স্তরের প্রতিভূ প্রতিষ্ঠান বণিকতান্ত্রিক। বণিকতন্ত্রে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থবুদ্ধি। যুক্তিধর্মী নাগরচেতনার ঐতিহাসিক বিবর্তনে এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। নাগর সভ্যতার আরও একটি অবলম্বন, আইন ও আমলাতন্ত্র। আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য আমাদের যুগে বেড়ে চলেছে। এর তাৎপর্য যথাস্থানে আলোচনা করা যাবে।

প্রাকৃত চেতনার স্তরে আত্মীয়ত, নাগর চেতনার স্তরে বণিকতন্ত্র ও আমলাতন্ত্র, বিবর্তনের ধারায় সামাজিক প্রতিষ্ঠানের এই প্রধান গড়নধরন। আরও এক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ আবশ্যক, যাকে বলা যেতে পারে বান্ধবসমিতি, আত্মীয়তন্ত্রের সঙ্গে যার কিছুটা সাদৃশ্য আবার মৌল পার্থক্য আছে। নতুন ধর্মের গোড়ায় বান্ধসমিতির উদাহরণ। চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য, আত্মীয়তন্ত্র সমেত প্রতি ধরনের প্রতিষ্ঠানের আবার রূপভেদ। আছে। আর বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব এবং সংমিশ্রণও অনিবার্য।

.

যুক্তিধর্মিতায় চিহ্নিত প্রতিষ্ঠান নিয়েই আমাদের প্রধান আলোচনা। কিন্তু তার পটভূমিকা হিসেবে আত্মীয়তান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে প্রথমে কিছু বলে নেওয়া আবশ্যক।

আত্মীয়তান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের আদিরূপ স্বভাবতই পরিবার। একই সূত্র ধরে আমরা সহজেই যৌথ পরিবার থেকে উপজাতিতে গিয়ে পৌঁছই। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। প্রাচীন যুগের রাজ্য সাম্রাজ্য সব কিছুরই আদলটা সাধারণভাবে আত্মীয়তান্ত্রিক। রাজার সঙ্গে প্রজার সম্পর্কের আদর্শরূপ পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক অবলম্বিত।

আত্মীয়তান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুয়েকটি বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখযোগ্য। আত্মীয়তন্ত্র সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। পরিবারের ভিতর একটা স্বাভাবিক অসাম্য আছে। যেমন বয়োজ্যেষ্ঠরা স্বাভাবিকভাবেই কনিষ্ঠদের চেয়ে উঁচুতে। পিতামাতা সন্তানের ওপরে, একই নিয়মে পিতামহ পিতার ওপরে। সে যুগের বৃহত্তর সমাজেও দেখি, কিছুটা পরিবর্তিত আকারে, একই নিয়ম। পরিবারের ভিতর পিতা সন্তানকে রক্ষা করেন এবং শিক্ষা দেন। বৃহত্তর সমাজে শিক্ষা দেন গুরু ও ব্রাহ্মণ, রক্ষা করেন রাজা এবং তাঁর অধীনে রাজপুরুষেরা। শিক্ষা, এক অর্থে, রক্ষারও অধিক। যিনি শুধুই রক্ষক তিনি রক্ষা করেন সাময়িকভাবে, আর শিক্ষা রক্ষা করে স্থায়ীভাবে। সেকালে শিক্ষার ভিতর দিয়ে হস্তান্তরিত হত, এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, সেই ঐতিহ্য, সনাতন ঐতিহ্য অথবা স্বধর্ম, সমাজকে যুগ যুগ ধরে যেটা রক্ষা করে চলত। অন্তত সমাজে এই ধারণাই প্রচলিত ছিল। অতএব ব্রাহ্মণ ও ধর্মকে রক্ষা করাই প্রজাপালক রাজার শ্রেষ্ঠ কর্তব্য বলে স্বীকৃত হয়েছিল।

আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজের অসাম্য শুধু স্বাভাবিকই নয়, দৈবনির্দিষ্ট। যদিও দণ্ডনীতির কঠিন ভিত্তিতে এর প্রতিষ্ঠা, তবু এই অসাম্য আত্মীয়তাবোধের বিরোধী নয় বরং পরিপূরক বলেই সেদিন বিবেচিত হত। যুগধর্মের সঙ্গে না মিলিয়ে বিষয়টা বোঝা যায় না। দাস্যভাবের উদাহরণ ধরা যাক। বণিকযুগের দাসব্যবস্থা ব্যবসায়ের অঙ্গ; প্রাচীন যুগের দাস কিন্তু হীন হলেও আত্মীয়ভাবের অঙ্গ। দাস্যভাব নিয়ে ভগবানের আরাধনার চিন্তা সে-যুগের দৃষ্টিতে স্বাভাবিক। স্বধর্ম পালনের ভিতর দিয়ে দাসও মুক্তি পায়, এমন কি অপরের আরাধ্য হয়। উনিশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও গৃহযুদ্ধ, সেটা এক বস্তু। আর হনুমান যে দাস্যের ভাবমূর্তি, সেটা অন্য বস্তু। প্রাচীন, ইতিহাসে, এ দুয়ের মাঝামাঝি, দাসপ্রথার আরও বিভিন্ন রূপ সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।

.

দাসকে যদিও আত্মীয়তন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা গিয়েছিল, বণিককে প্রাচীন সমাজব্যবস্থার ভিতর আঁটা কখনই সহজ ছিল না। যতদিন ঐ সম্প্রদায় আকারে ছোট ছিল এবং বাণিজ্য প্রধানত দেশের ভিতর আবদ্ধ ছিল, ততদিন বণিককে একটি আলাদা প্রকোষ্ঠে রেখে এবং সেটিকে তৃতীয় শ্রেণী বলে চিহ্নিত করে কোনো প্রকারে অবস্থা আয়ত্তে রাখা গিয়েছিল। তারপর সেটা আর আয়ত্তের ভিতর রইল না।

আসলে প্রাচীন সমাজের স্থায়ী ভাবের সঙ্গে বণিকবৃত্তির একটা মৌল পার্থক্য ছিল। বণিক বলতে এখানে অবশ্য আমরা তাদেরই বোঝাচ্ছি, বাণিজ্য অথবা ব্যবসায় যাদের পেশা। নয় তো মাঝে মাঝে প্রয়োজনে এক জিনিসের পরিবর্তে অন্য জিনিস সংগ্রহ অনেকেই করে থাকে। পাড়াপ্রতিবেশীর ভিতর শাকের বদলে মূলো অথবা উপহারের পরিবর্তে উপহারের প্রাপ্তিযোগ হামেশাই ঘটে। সাধারণত অর্থের ব্যবহার ছাড়াই এই রকম দ্রব্য বিনিময় চলে। বলা বাহুল্য, একে আমরা ব্যবসায়ের সংজ্ঞার ভিতর ধরছি না। জীবিকার ভিত্তি হিসেবে নিয়মিত দ্রব্য বিনিময়, প্রধানত অর্থের মাধ্যমে, যারা করে থাকে তাদেরই বণিক বলা চলে।

প্রাচীন সমাজের অভ্যস্ত আচরণের সঙ্গে বণিকবুদ্ধির পার্থক্য এইখানে। বণিকবুদ্ধি চলে স্বার্থ গণনার ভিত্তিতে। বণিকের সামনে একটা লক্ষ্য আছে। সেই লক্ষ্যটা এমন যে, ব্যক্তিগত গণনা বা হিসেবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন হয়। বলা বাহুল্য এই গণনা লাভক্ষতির গণনা। প্রাচীন সমাজ চলে আচার এবং শাস্ত্রের অনুশাসন অনুযায়ী। এই আচারের কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই এমন নয়। কিন্তু অনেক কালের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অভ্যাসের ভিতর দিয়ে আচার একটা স্থিরতা লাভ করে। ব্যক্তি তার পৃথক অভিজ্ঞতার গণ্ডির ভিতর নতুন করে আচার ও অনুশাসনের মূল্য যাচাই করতে উদ্যত হয়। না। বরং আচারের মূল্য তার ঐতিহ্যবাহিতায় বা শাস্ত্র প্রামাণ্য।

লাভক্ষতির ব্যবসায়িক গণমার ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগের যুক্তিধর্মিতার প্রাথমিক প্রকাশ। এর ফলে ব্যক্তি তার স্বতন্ত্র স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন হয়। ব্যবসায়িক গণনার ভিতর দিয়ে যুক্তিতে একজাতীয় তথ্যনিষ্ঠতা আসে। আত্মা অথবা মোক্ষ সম্পর্কিত চিন্তায় এই প্রকার তথ্যনির্ভরতা সহজে আসে না। সাবধানী ও পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেবের অভ্যাসের ফলে যুক্তি বাস্তবধর্মী হয়। সমাজে যুক্তির বিবর্তনে এটা একটা প্রয়োজনীয় অধ্যায়।

বাণিজ্য যখন বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে তখন দেশাচারকে আপেক্ষিক দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয়। বণিকের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে দেশের কৌতূহলী মানুষের চিন্তার পরিধির ভিতর সঞ্চিত হয়। ফলে প্রাচীন আচার ও অনুশাসনকে আর অনিবার্য মনে করা যায় না। বরং তুলনামূলক বিচারের দিকে একটা ঝোঁক দেখা যায়। এই আপেক্ষিক দৃষ্টিতে বিচারের মুক্তি ঘটে, চিন্তার স্বাধীনতার যুগ শুরু হয়। বাণিজ্যের ফলে সাংসারিক বস্তুনির্ভর অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায়। এই অনুসন্ধানী মনোবৃত্তির পিছনে যদিও ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকে, তবু এর একটা বৃহত্তর তাৎপর্যও আছে।

দেশাচার ছোট ছোট গোষ্ঠীতে আবদ্ধ। বাণিজ্য যখন বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে তখন। এমন কিছু আইনকানুনের প্রয়োজন দেখা দেয়, বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে যেটা সমভাবে গ্রহণযোগ্য। বর্ণ ও উপজাতিতে বিভক্ত সমাজের স্থিতিরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট আচারবিচারের উদ্দেশ্য এক, আর ব্যবসায়িক চুক্তি রক্ষার জন্য যে আইনের প্রয়োজন তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। কাজেই বাণিজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আইনের ক্ষেত্রে একটা নতুন আন্দোলন, দেখা দেয় এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গী অনেক বেশি যুক্তি আশ্রিত। উপরন্তু একটা বিশেষ অর্থে এই নতুন আইন সমদৃষ্টিসম্পন্ন।

আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক অসাম্যবোধের কথা আগেই বলেছি। বণিকের দৃষ্টির কেন্দ্রস্থলে যে-সম্পর্কটা আছে, সেটা হল ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্পর্ক। ক্রেতা ও বিক্রেতার ভিতর কাউকেই প্রথম দৃষ্টিতে বড় অথবা ছোট মনে করা যায় না। অর্থাৎ, বাণিজ্যের মূল সম্পর্কটা, অন্তত তত্ত্বের দিক থেকে, সমানে সমানে সম্পর্ক। পার্থক্য বস্তুত দেখা দেয়। তবুও তাত্ত্বিক প্রশ্নটা মূল্যবান। আইনের চোখে বাদী বিবাদী উভয় পক্ষই সমান, বণিক সংস্কৃতির এই রকম একটা ঝোঁক আছে, প্রাচীন সমাজের অসাম্যের সংস্কার থেকে যেটা উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। সব মিলিয়ে যুক্তির ঐতিহাসিক বিবর্তনে বণিক সংস্কৃতির একটা বড় অবদান অস্বীকার করা যায় না। বাণিজ্য যখন বহির্মুখী ও প্রসারশীল, তখনই এই অবদান সম্ভব হয়েছে। ধর্মের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিকভাবেই এর একটা প্রভাব পড়েছে। চেতনার এতো বড় একটা আন্দোলন যদি প্রতিষ্ঠিত ধর্মকে স্পর্শ না করত, তবে সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার হত।

আমলাতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে পুরনো ইতিহাসে আবারও একটু ফিরে যেতে হয়।

প্রাচীন সাম্রাজ্যে আমরা লক্ষ করেছিলাম, আত্মীয়তন্ত্রের একটা সম্প্রসারিত গঠন। মধ্যযুগে সাম্রাজ্যের সংগঠিত মূর্তির প্রধান উদাহরণ, সামন্ততন্ত্র। সামন্ততন্ত্রেরও আবার নানা রূপ আছে এবং এদের ভিতর পার্থক্য কম নয়। কাজেই এ বিষয়ে কোনো সাধারণ মন্তব্যই সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একরূপে সামন্তরাজা অথবা সুবেদারগণ নিজ নিজ বজ্যে প্রায় সর্বের্সবা। প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের ভার তাঁদের হাতে, তাঁরাই প্রজাদের রক্ষক এবং দণ্ডদাতা। তাঁদের ক্ষমতা সচরাচর পুরুষানুক্রমে অব্যাহত থাকে। সম্রাট যদিও তাঁদের কাছ থেকে রাজস্বের একাংশ লাভ করেন এবং সেই সঙ্গে পান আনুগত্যের অঙ্গীকার, তবু পুরুষানুক্রমিক অধিকারের ফলে সামন্তরাজারা প্রায়শ বিশেষ ক্ষমতাবান।

এই বিকেন্দ্রিক সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের পিছনে একটা যুক্তি আছে। সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় যুদ্ধ জয়ের ভিতর দিয়ে, যদি-না আক্রান্ত দেশ বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধ জয়ের পর অনেক ক্ষেত্রেই একটা সামরিক শাসন কিছু কালের জন্য চলে। কিন্তু সম্রাট মুখ্যত আকাঙ্ক্ষা করেন যশ এবং রাজস্ব। দূর দেশ থেকে নিয়মিত রাজস্ব আদায় সহজ নয়। অনুগত কোনো রাজপুরুষ যদি সেখানে রাজা হয়ে বসেন এবং রাজস্বের একাংশ যথা সময়ে সম্রাটকে পাঠান তবেই সমস্যার সমাধান হয়। সামন্তরাজার আনুগত্যের অঙ্গীকার থেকে সম্রাট লাভ করেন যশ, প্রয়োজনে সামরিক সহায়তা নিয়মিত রাজস্ব এবং উপঢৌকনে আসে সমৃদ্ধি।

কিন্তু এই বিকেন্দ্রিক সামন্ততন্ত্রের একটা বিপদও আছে। সামন্তরাজারা নিজ নিজ রাজ্যে শক্তিশালী। সম্রাটের প্রতি তাঁদের আনুগত্য চিরকাল অটুট থাকে না। বিকেন্দ্রিক সামন্ততন্ত্রে কখনও কেন্দ্র দুর্বল হয়ে পড়ে; সেই সুযোগে সামন্তরাজারা বিদ্রোহে প্রলুব্ধ হন। সম্ভবত এই সমস্যার সমাধান হিসেবেই দেখা দেয় সামন্ততন্ত্রের এক বিকল্প রূপ। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এবার শাসন চালান মনোনীত রাজপুরুষেরা। প্রয়োজন মতো এঁদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানানরিত করা হয়, যাতে এরা না কোথাও স্থায়ীভাবে শিকড় গাড়তে পারেন। অর্থাৎ এটা হয়ে ওঠে বদলির চাকুরি। চীনে রাজপুরুষদের নির্বাচনের জন্য সরকারী পরীক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। তা ছাড়া কেন্দ্রের অধীনে গুপ্তচরবাহিনী দেশে বিদেশে খবর সংগ্রহ করে বেড়ায়, সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে।

সামন্ততন্ত্রের এই দুই রূপের ভিতর প্রভেদ বিস্তর। বস্তুত দ্বিতীয় রূপে আমরা পাচ্ছি, প্রাচীন সমাজের ভিতর থেকে আমলাতন্ত্রের উদ্ভব। তবে এই আমলাতন্ত্রও পরিবারভিত্তিক বা আত্মীয়তান্ত্রিক চিন্তা ভাবনার কাঠামোর ভিতর প্রতিষ্ঠিত। প্রসিদ্ধ চীনা দার্শনিক কুং-এর চিন্তা থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

বর্ধিষ্ণু বণিকতন্ত্রের সঙ্গে সংযোগের ফলে আমলাতন্ত্র ক্রমে তার আধুনিক রূপে পরিণত হল। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের যুগেও কয়েকটি ব্যাপারে আমলাতন্ত্রের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যাতে আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজের ভাবাদর্শ থেকে তার একটা স্বতন্ত্র চেহারা ফুটে ওঠে। যুক্তিধর্মিতার একটা বিশেষ দিকের বিকাশও সেই সঙ্গে লক্ষ করা যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ঐ দিকটি পরিস্ফুট। গুপ্তচর বাহিনীর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এর সংগঠনে ও নিয়ন্ত্রণে যে পরিকল্পিত কূটনীতির সন্ধান মেলে, সেটা আধুনিক যুগের মেজাজকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, দরবারী সমাজ এবং রাজনীতিক ক্ষমতার লড়াই যুক্তিধর্মিতার বিবর্তনে স্পষ্ট ছাপ রেখে গেছে।

আরও একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখযোগ্য। রাজস্ব আদায়ের জন্য সম্রাট নির্ভর করতেন সামন্তরাজা ও রাজকর্মচারীদের ওপর। এখানে প্রচুর কারচুপির সম্ভাবনা ছিল। কাজেই প্রাচীন আমলাতন্ত্রের মধ্য থেকেই ধীরে ধীরে হিসেব পরীক্ষার পদ্ধতি উদ্ভাবিত হল। সরকারী নিরীক্ষকদের নিযুক্ত করা হল হিসেব পরীক্ষার জন্য। কখনও কখনও। আবার আমলারা বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত হলেন। সরকারী উদ্যোগে শিল্প পরিচালনা চালু হল। বণিকের সংস্কৃতি আর আমলা সংস্কৃতির ভিতর অন্তত আংশিক যোগাযোগ শুরু হয়ে যায় প্রাচীনকাল থেকেই।

আধুনিক আমলাতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য আছে, যার উল্লেখ ছাড়া যুক্তিধর্মিতার বিবর্তনে আমলাতন্ত্রের বিশেষ অবদান বোঝা সম্ভব নয়। আত্মীয়তন্ত্র দয়া স্নেহ শ্রদ্ধার ওপর স্থাপিত; আমলাতন্ত্র নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আত্মীয়দের নিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গঠিত হতে পারে। কিন্তু আমলাতন্ত্রের গঠন অন্যপ্রকার। আমলারা সরকারী নীতি নির্ধারণ করেন না, কিন্তু প্রয়োগ করেন। তাঁদের কাজ প্রধানত অনাত্মীয় সহকর্মীদের নিয়ে অনাত্মীয় জনসাধারণের জন্য। এ অবস্থায় নিরপেক্ষভাবে, নিয়ম মান্য করে, কাজ চালিয়ে। যাওয়া আমলার ধর্ম। এখানেই আত্মীয়তন্ত্রের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের মৌল পার্থক্য। কোনো আমলা স্বধর্মচ্যুত হতে পারেন, তাঁর পদস্খলন হতে পারে, সেটা অন্য কথা। মূল কথাটা স্বধর্ম নিয়ে। আত্মীয়তন্ত্রে, এমন কি বণিকতন্ত্রে, যদি কেউ আত্মীয়ের প্রতি পক্ষপাত দেখান তবে সেটা তার স্বধর্মের বিরুদ্ধে যায় না। নৈব্যক্তিক ও নিরপেক্ষ ব্যবহার আত্মীয়ধর্মের অঙ্গ নয়। কিন্তু এটাই আমলার আচরণবিধির অঙ্গ। আদর্শ আমলার আচরণে সৌজন্যের সঙ্গে একটা নৈর্ব্যক্তিকতা ও নিয়মানুগত থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে এটা যুক্তিধর্মিতার একটা বিশিষ্ট প্রকাশ।

বণিক সংস্কৃতি ও আমলা সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য সংমিশ্রণ ঘটেছে একালের অতিকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানের আকার যেখানে বৃহৎ, সেখানে প্রশাসনে অনিবার্যভাবে আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য অল্পবেশি ফুটে ওঠে। আবার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গুণাগুণও কিছুটা থেকে যায়। বৃহৎ শিল্পের অপর বৈশিষ্ট্য বৈজ্ঞানিক গষেণার প্রতি ঝোঁক। বড় শিল্পগুলির ভিতর যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে, তাতে বিজ্ঞানের সহায়তা সাফল্যের জন্য প্রয়োজন। দীর্ঘকালীন ও ব্যাপক দৃষ্টিতে অনিবার্য সিদ্ধান্ত এই যে, বিজ্ঞানই শিল্পের শ্ৰেষ্ঠ সহায়।

বিজ্ঞানের দুটি দিক আছে। এক তার বিশুদ্ধ জ্ঞানের দিক। যুক্তিধর্মী মন বিশ্বপ্রকৃতিকে যতক্ষণ না জানতে পারছে নিয়মের ভিতর দিয়ে, ততক্ষণ তার জানাটা। অসম্পূর্ণ, সেই অসামঞ্জস্যের কাঁটা মনে বিঁধে তাকে করে রাখে অসুখী। কিন্তু বিজ্ঞানের ভিতর দিয়ে মানুষ শুধু জানবার সুখ চায়নি, আরও চেয়েছে করবার শক্তি। এটাই সেই দ্বিতীয় দিক, যেখানে বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিবিদ্যা। জ্ঞানই শক্তি। প্রযুক্তিবিদ্যার শক্তিতে মানুষ পৃথিবীকে বদলে চলেছে, গড়ে তুলেছে নতুন শিল্প এবং সেই সঙ্গে গড়বার। ও ধ্বংস করবার আরও নানা উপাদান। সাধারণ মানুষের ভিতর বিজ্ঞানের আজ যে মর্যাদা, তার একটা বড় কারণ প্রযুক্তিবিদ্যার এই ব্যহারিক শক্তি। আধুনিক যুগ শুধু বিজ্ঞানধর্মী নয়; প্রাচীন যুগকে সে পিছনে ফেলে এসেছে অদম্য প্রয়োগধর্মিতায়।

এ যুগের যুক্তিধর্মিতার ভিত্তিতে আছে, একদিকে যেমন বণিক সংস্কৃতি ও রাজনীতি, আইন ও আমলাতন্ত্র, অন্যদিকে তেমনি সব কিছুকে পরিব্যাপ্ত করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার সহায়তায় শাসনযন্ত্র ও আমলাতন্ত্র আজ আরও বেশি শক্তিশালী। বণিকতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানেরও চরিত্র এবং সংগঠন বদলে চলেছে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভাবে। সাংগঠনিক দৃষ্টিতে, বণিকতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের ভিতর পার্থক্য। অনেক ক্ষেত্রে কমে আসছে। মোটের ওপর আমাদের যুগ রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাধান্যের যুগ।

.

যুক্তিধর্মিতার পরিমণ্ডলে যে-সব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তাদের বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ করেছি। এবার কয়েকটি সমস্যা আলোচনা করা আবশ্যক। মানুষকে যেমন আমরা চিনতে পারি তার বিশেষ গুণে ও বিশেষ দুর্বলতায়, মানুষের প্রতিষ্ঠানকেও চেনা যায় তেমনিভাবে। আর আজকের সমস্যার ভিতর দিয়ে বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ সম্বন্ধে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আত্মীয়তান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে যেমন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি সংযুক্ত হয় রক্তের বন্ধনে ও আত্মীয়তার বাস্তব অথবা কল্পিত ধারণায়, বণিকতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে তেমনি বিভিন্ন ব্যক্তি পারস্পরিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হয় স্বার্থ ও ব্যবহারিক প্রয়োজনের যুক্তিতে। অন্তত আধুনিক যুক্তিধর্মী প্রতিষ্ঠানের এটাই আদর্শ রূপ। মধ্যযুগীয় ধারণায় রাজা রাজ্যশাসন করতেন দৈব অধিকারে। কিন্তু সতেরো ও আঠারো শতকে এই রকম একটা মত প্রচলিত হল যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সামাজিক চুক্তিতে। চুক্তির পিছনে সাধারণত একটা স্বার্থের যুক্তি থাকে, সেটা বাণিজ্যিক চুক্তিই হোক আর রাজনীতিক চুক্তিই হোক।

রাজশক্তির উৎপত্তি সম্বন্ধে সামাজিক চুক্তির তত্ত্বে নতুন যুক্তিধর্মী চেতনার প্রকাশ পরিস্ফুট। এই নতুন যুগধর্ম সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে, যেমন ব্যবসায়িক ও আমলাতান্ত্রিক এমনকি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানেও, সংক্রামিত হয়েছে। সমাজের সব সম্পর্কই যেন আজ দাঁড়িয়ে আছে, লিখিত অথবা অলিখিত চুক্তির ওপর।

চুক্তি দুপক্ষই স্বেচ্ছায় মেনে নেয়, নয় তো সেটা চুক্তিই নয়। এটাই চুক্তির সংজ্ঞা। যেহেতু এতে দু’পক্ষেরই সম্মতি আছে অতএব, কোনো নাকোনো অর্থে, চুক্তিতে উভয় পক্ষেরই স্বার্থ আছে। কিন্তু সেই অর্থটা একপক্ষের কাছে নিদারুণ হতে পারে। দরিদ্র। মানুষ সামান্যতম মজুরীতে সারাদিন খাটবার চুক্তি স্বেচ্ছায় মেনে নিতে পারে, কারণ তা নইলে তাকে অনাহারে মরতে হবে। অনাহারের চেয়ে অধাহার ভালো, এমনকি অপমানজনক শর্ত সত্ত্বেও সেটাই ভালো মনে হতে পারে। চুক্তিটা এখানে পারস্পরিক স্বার্থের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বটে। তবু ওটা ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকৃত হবে, এমন কথা নেই। ন্যায়ের জন্য পারস্পরিক স্বার্থের চেয়ে আরও বেশি কিছু প্রয়োজন। দুই পক্ষের সুবিধার বণ্টনে একটা “সাম্য থাকা চাই। চুক্তিটা যুক্তিসঙ্গত হওয়া চাই। বণিকতন্ত্রের কাঠামোর ভিতর এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া কঠিন। যেখানে দু’পক্ষের শক্তির তারতম্য বড়, সেখানে চুক্তি দুর্বল পক্ষের বিরুদ্ধে যাবেই।

এ ছাড়া আরও সমস্যা আছে। মজুরীর প্রশ্ন যদিও জরুরী, তবু সেটাও একমাত্র প্রশ্ন নয়। আজকের সমাজে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলি প্রাধান্য লাভ করছে। সরকারী প্রতিষ্ঠান বৃহৎ। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যারও যেন ঝোঁক আছে বৃহৎ শিল্প গঠনের দিকে। এই সব বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সংগঠন ‘আমলাতান্ত্রিক’।

আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নিয়মের ওপর চলে। এই নিয়মগুলো হয়তো কখনও যুক্তিসঙ্গত, হয়তো কখনও নয়। কিন্তু যেখানে নিয়মটা যুক্তিসঙ্গত, সেখানেও প্রত্যেকটি কর্মীর কাছে সেই যুক্তি পরিষ্কার নয়। কারণ, যুক্তিটা দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানের জটিল ও সামগ্রিক প্রয়োজনের ওপর। কর্মীবিশেষ সমগ্র প্রয়োজনটা দেখছেন না; তিনি প্রয়োজনকে দেখছেন তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ছোট পরিধির ভিতর। কাজেই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম যেখানে যুক্তিসঙ্গত, সেখানেও কর্মীকে অনেক সময় সেটা মেনে নিতে হয় যুক্তি ছাড়াই। অর্থাৎ, তাঁকে কাজ করতে হয়, ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে, ওপর থেকে চাপানো একটা “যুক্তিহীন’ নিয়মের কাঠামোর ভিতর। ফলে কর্মীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের মনের যোগ ছিন্ন হয়ে যায়, প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে একটা অর্থহীন প্রাণহীন যন্ত্র। এটা কঠিন সমস্যা। সমগ্রের বাইরে অংশবিশেষের অর্থ কখনও স্পষ্ট নয়। বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক প্রয়োজনের একটা ছবি মনের ভিতর ধারণ করা অথবা প্রত্যেকের কাছে স্পষ্ট করে তোলা, সদিচ্ছা থাকলেও, দুরূহ ব্যাপার।

নিয়ম এবং পরিকল্পনা যুক্তিসঙ্গত হলেও ঐ সমস্যাটা থাকে। না হলে সমস্যা আরও জটিল। বলা বাহুল্য, নিয়মের পিছনে সব সময় একটা সম্পূর্ণ জীবন্ত যুক্তি থাকে না। প্রাণহীন নিয়ম অপ্রয়োজনে দুই পক্ষের ভিতর ব্যবধান সৃষ্টি করে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যোগ হয় প্রশাসনিক দুর্নীতি, ভ্রষ্টাচার নামে যেটা আজ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

আরও বিঘ্ন আছে। সমাজে সর্বক্ষণ ক্ষমতার একটা দ্বন্দ্ব চলছে। নিয়ম ও পরিকল্পনা সেই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত নয়। যাঁরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ব্যাপৃত তাঁরাই নানা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরাই পরিকল্পনা রচনা করেন। কোনো সমাজই এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। সাম্যবাদী সমাজেও ক্ষমতার প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বের ভিতর থেকেই পরিকল্পনা বেরিয়ে আসে। বৃহত্তর সমাজেই তোক আর বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেই হোক, এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই; আছে, এমন আশা করাটাই ভুল।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা আমাদের পরিপার্শ্বের চেহারা পালটে দিচ্ছে। কিন্তু এর ভিতরও নানা জটিলতা আছে। একটি বিশেষ সমস্যার উল্লেখ প্রয়োজন। আজকের প্রযুক্তিবিদ্যা প্রধানত নগরভিত্তিক। পিছিয়ে-পড়া দেশ ধার করছে উন্নত দেশের কাছ থেকে। বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে প্রধানত নগরে, যেখানে উচ্চ শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের সমাবেশ, আধুনিক সভ্যতার নানা উপকরণ যেখানে সহজে লভ্য। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ থেকেই আবার একটা জটিলতার সৃষ্টি। নগর ও পল্লীর ভিতর ব্যবধান বেড়ে চলেছে, যেমন বেড়েছে উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলির ভিতর ব্যবধান। নগরের চিকিৎসক বা যান্ত্রিক নগর ছেড়ে গ্রামে বেশি দিন তিষ্ঠতে পারেন না যে-চিকিৎসাবিদ্যা বা যন্ত্রবিদ্যা তাঁর আয়ত্তে, নাগরিক উপকরণ হাতের কাছে না পেলে তিনি সেটা যুতমতো ব্যবহার করতে পারেন না। সমস্যাটা আরও গভীর। নগর ও পল্লী যে শুধু হাত ধরাধরি করে চলেনি তাই নয়; উভয়ের সম্পর্ক সংঘাতের রূপ নিয়েছে। বৃহৎ শিল্পের আঘাতে গ্রামের শিল্প। ভেঙ্গে পড়েছে। আবার গ্রামের অর্ধ বেকারের দল শহরে ভিড় করে সেখানকার জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

নগর শুধু শিল্প ও বিজ্ঞানের কেন্দ্রই নয়, রাজনীতিরও কেন্দ্র। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতাপ ও কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির গুরুত্ব বেড়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব আজকের সমাজে এক কঠিন দ্বন্দ্ব। বৃহৎ শিল্পকে কি করে রাষ্ট্রায়ত্ত করতে হয়, এতদিনে আমরা তা জানি। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব তাতে কমে না। এই দ্বন্দ্বকে বশে আনবার অথবা। সভ্য করে তুলবার পদ্ধতি এখনও আমাদের আয়ত্ত হয়নি। বরং ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতাবোধ, নগর ও পল্লীর ভিতর ব্যবধানের সঙ্কট, আর প্রয়োগধর্মী জীবনাদর্শের সব ব্যর্থতা যেন ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মাদকতায় বারবার একটা মিথ্যা পরিত্রাণ খুঁজছে।

যুক্তি থেকে পিছু হটে এসে এই সব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, এমন মনে করা ভুল। যুক্তিধর্মিতার চেয়ে যুক্তি বড়; কারণ, প্রথমটি হল একটা বিশেষ যুগের ধর্ম, দ্বিতীয়টি মানুষের ধর্ম। যুক্তিকে খুঁজে নিতে হবে ভবিষ্যতের নতুন দিগন্ত। নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে প্রতিষ্ঠানেরও রূপ বদলে চলবে।

সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল অংশের মানুষদের সংগঠন প্রয়োজন অন্যায় সামাজিক “চুক্তির সংশোধনের জন্য। এদেশের গ্রামাঞ্চলে এটা বিশেষ জরুরী। বণিক পযায় থেকেও আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে নতুন যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী। বণিক সংস্কৃতি আমাদের হিসেব রাখতে শিখিয়েছে, সেটা লাভ। গান্ধী নিজেকে বানিয়া বলতে দ্বিধা করেননি। জনসাধারণের প্রতিষ্ঠানে হিসেব প্রয়োজন, তিনি জানতেন। আমলাতন্ত্র যদি অনাত্মীয়ের সঙ্গে কাজেকর্মে কিছু পরিমাণে নিয়মের শিক্ষা দিয়ে থাকে তো সেটাও লাভ। বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে নিয়মানুগতার প্রয়োজন আছে। নিয়ম রচনার কাজে কর্মীদের কীভাবে কতটা যুক্ত করা যায়, সেটাই এখন প্রশ্ন। ইতিমধ্যেই শিল্প পরিচালনায় কর্মপ্রতিনিধিরা অংশ গ্রহণ করছেন একাধিক দেশে, যুগোস্লাভিয়ার নাম এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

বৃহত্তর সমাজে প্রয়োজন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এর লক্ষ্য শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা তুলে নিয়ে শাসনযন্ত্রের আরও একটু নীচুস্তরে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা নয়। রাজনীতির বাইরে যে-সব প্রতিষ্ঠান আছে, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরও নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সরকারী এবং দলীয় আধিপত্যের বাইরে তাদেরও নিজ নিজ অধিকারের একটা ক্ষেত্র থাকা প্রয়োজন। রাজনীতির প্রাধান্যটাই আজ ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণের বড় লক্ষণ। আজকের রাজনীতির কাঠামো দলীয়, উদ্দেশ্য যে-কোনো প্রকারে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া। এতে বিপর্যয় ঠেকানো যাচ্ছে না, বরং বিপত্তি বাড়ছে। এরই উসকানিতে বিচ্ছিন্ন মানুষের সব ব্যর্থতা একটা যৌথ আক্রোশের আকার ধারণ করছে, তত্ত্বে বিধৃত বিদ্বেষের বিষ ছড়াচ্ছে। সমাজের মূলে সেই সব স্বায়ত্তশাসিত ও যথাসম্ভব নির্দলীয় সমিতিকে আজ শক্তিশালী করা আবশ্যক, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যেখানে পারস্পরিক নৈকট্যের ওপর স্থাপন করা সম্ভব।

আর আবশ্যক, পল্লী ও নগরের ভিতর সমন্বয়ের চেষ্টা। সমন্বয় চাই, যেমন আর্থিক তেমনি সাংস্কৃতিক। নাগর সংস্কৃতি ও পল্লী সংস্কৃতির ভিতর একটা স্বাভাবিক ও সৃজনধর্মী দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্ভব। লোকসঙ্গীত উঠে আসে দরবারে, যেখানে সে নতুন রূপ পায়, আবার দরবারী সঙ্গীত ফিরে যায় পল্লীতে নতুন প্রাণের সন্ধানে। এই প্রক্রিয়াটা যখনই বন্ধ হয়েছে তখনই ক্ষতি হয়েছে দু’পক্ষেরই। পল্লী সংস্কৃতিতে একটা সহজ মানবিকতার ভিত্তি আছে, যার ওপর যুগে যুগে আচার, অনাচার, ভয় ও অজ্ঞতায় আশ্রিত নানা বিচিত্র সংস্কার, জমে উঠেছে পরতে পরতে। সেই সহজ মানবিকতাকে পুনরুদ্ধার করা সহজ নয়। তবু তারই সঙ্গে যোগে যুক্তিরও মুক্তি। চৈতন্যের স্তরের মতো সংস্কৃতিরও স্তরভেদ থাকবে। সেই বিভিন্ন স্তরের ভিতর একটা আরোহণ অবরোহণের ধারা অক্ষুণ্ণ না রাখলেই অমঙ্গল।

শুরুতে বান্ধবসমিতির সামান্য উল্লেখ ছিল। এবার সেই প্রসঙ্গ ধরেই আলোচনা সমাপ্ত করব। বান্ধবসমিতি এবং আত্মীয়গোষ্ঠীর ভিতর প্রভেদ আছে। বান্ধবসমিতি গঠিত হয়। প্রতিবেশীকে নিয়ে। অথবা আমরা যাদের মনে মনে কাছের মানুষ বলে জানি তাদের নিয়ে। আত্মীয় ও প্রতিবেশীর ভিতর একটা মৌল পার্থক্য আছে। প্রতিবেশীকে আমি আমার চেয়ে স্বতন্ত্র বলেই জানি। স্বতন্ত্র জেনেও তাকে আমি বন্ধুরূপে পেতে চাই। সেই বন্ধুত্ব অর্জিত ধন, তাকে রক্ষা করতে হয়। আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আমার অর্জিত ধন। নয়। তাকে আমরা স্বতন্ত্র বলে মানি না। তার ওপর আমাদের দাবি সহজাত। যে সমাজ একবার যুক্তিধর্মিতার স্তরে পৌঁচেছে, অখণ্ড আত্মীয়তন্ত্রে সে আর ফিরে যেতে পারে না, চাইলেও নয়। তাকে তখন একটা বিকল্পে উত্তীর্ণ হতে হয়। বান্ধবসমিতি সেই বিকল্প। সমবায় সমিতিকে বলা যেতে পারে ব্যবসায়িক সংস্থা ও বান্ধবসমিতির এক বিশেষ সংমিশ্রণ।

প্রতি যুগেরই নিজস্ব একটা আদর্শ থাকে, যুগের চেতনার প্রান্তে যেটা প্রতিষ্ঠিত। এ যুগের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, সব প্রতিষ্ঠানেরই বিকৃতি সম্ভব। তবু মানুষের একটা আদর্শকল্পনা থাকে। বান্ধবসমিতি ভবিষ্যতের দিগন্তসংলগ্ন সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠান। আত্মীয়তন্ত্রের দৈবনির্দিষ্ট অসাম্য সেখানে নেই; ব্যক্তিস্বাতন্ত্র আছে কিন্তু বণিকতন্ত্রের। স্বার্থসর্বস্বতা নেই; সমবায় সেখানে পদাধিকারে অযথা খণ্ডিত নয়; যুক্তি সেখানে শুভাকাঙ্ক্ষী।

প্রতিযুগ নতুন করে যাত্রা শুরু করে। রুশ বিপ্লবের পর দুই প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতাকে পদে পদে জ্ঞানের অংশ করে নেওয়া যুক্তির কাজ। এ যুগের প্রধান প্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র। এইখান থেকে আজকের যাত্রা শুরু। এইখানে দাঁড়িয়ে আমরা ইতিহাসকে নতুন করে দেখছি। লক্ষ্য সহসা বদলায় না, কিন্তু পথ অথবা পদ্ধতি কিছুই অপরিবর্তনীয় নয়।

ব্যক্তি যুক্তি সমাজ (১৯৭৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *