1 of 2

৩.০৬ সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে

৩.৬ সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে

আলস্য, দুর্নীতি ও কুসংস্কার আমাদের প্রধান ব্যাধি।

একথার পর অধিকাংশ বাঙ্গালী পাঠকের প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমান করা যায়। দুর্নীতি আমাদের সমাজের একটি প্রধান ব্যাধি এ বিষয়ে অধিকাংশ পাঠক একমত হবেন; কারণ আমরা সবাই নিজেকে বাদ দিয়ে সর্বত্র দুর্নীতি দেখি। কুসংস্কারকে এই তালিকাভুক্ত। করা অনেকেরই মনঃপূত হবে না কুসংস্কার কার নেই? ওটা অপেক্ষাকৃত গৌণ সমস্যা।

যদি উদাহরণ হিসাবে অস্পৃশ্যতার কথা বলি তবু হিন্দু পাঠকদের অনেকেই ইতস্তত করবেন। বলা হবে যে, শিক্ষিতদের ভিতর অস্পৃশ্যতা বস্তুটি আজকাল প্রায় নেই। শহরে ওটা উঠে গেছে, গ্রামে অশিক্ষিতদের ভিতর সম্ভবত দেখা যায়–তাও বাংলাদেশে কমই আছে। ভারতের কোনো কোনো অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলে অস্পৃশ্যতার প্রাদুর্ভাব, তবে শিক্ষার প্রসার ও আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাও দূর হয়ে যাবে। সংক্ষেপে, ওটা নিয়ে মাথা ঘামানো অনাবশ্যক।

অথচ অস্পৃশ্যতা আমাদের সমাজে সর্বব্যাপী। এটাকে আমরা এতোই সহজে গ্রহণ করে নিয়েছি যে, এর কবল থেকে মুক্তি পেতে হলে এর অস্তিত্ব সম্বন্ধেই প্রথমে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সেটা সহজ নয়, কারণ অস্পৃশ্যতা থেকে আমরা যতটুকু মুক্ত হয়েছি তার সম্বন্ধে আমরা ততটুকুই সচেতন; যতটা অবশিষ্ট আছে, আমাদের সমগ্র সত্তার সঙ্গে সেটা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যে তাকে আলাদাভাবে চেনাই কঠিন।

হিন্দুমনের অবচেতন স্তরে অস্পৃশ্যতাবোধের রাজত্ব। এর ব্যাপ্তি ও প্রভাব উপলব্ধি করতে হলে শুধু উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুর ভিতর সম্পর্কের পর্যালোচনাই যথেষ্ট নয়। মুসলমানের প্রতি হিন্দুর ব্যবহারে অস্পৃশ্যতার লক্ষণ অস্বীকার করা যায় না। ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা যাঁরা খানিকটা সামলে নিয়েছেন তাঁদের মন থেকেও নিম্নবর্ণ ও মুসলমান সম্পর্কে একটা সূক্ষ্ম অপবিত্রতাবোধ দূর হয়নি। শিক্ষিত শহরবাসী হিন্দুও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নন।

অস্পৃশ্যতাবোধ যে স্থূল অথবা সূক্ষ্ম বিভিন্ন আকারে আমাদের হিন্দুসমাজে প্রায় সর্বব্যাপী এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এর পরও আমাদের একটি দ্বিতীয় সাফাই আছে। বর্ণহিন্দুদের বক্তব্য এই যে, বিবাহ অথবা খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে ওঁরা কতগুলো আচার পালন করেন বটে, অর্থাৎ নিম্নবর্ণের হিন্দুকে অথবা মুসলমানকে ওঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে অপবিত্র জ্ঞান করেন সত্য, কিন্তু এই অস্পৃশ্যদের প্রতি ওঁদের মনে স্নেহ অথবা প্রীতির অভাব নেই। অর্থাৎ অস্পৃশ্যতার অস্তিত্ব স্বীকার করবার পরও সমস্যা হিসাবে এর গুরুত্ব অনেকে মানতে চান না।

প্ল্যাটো ক্রীতদাস প্রথার সমর্থক ছিলেন, ক্রীতদাসদের তিনি নীচ মনে করতেন; তবে এই নীচ মানুষদের প্রতি প্রভুদের স্নেহভাব রক্ষা করা উচিত এটাও তিনি বিশ্বাস করতেন। আমরা বর্ণহিন্দুরা সমাজের একাংশকে শুধু নীচ নয়, অপবিত্র মনে করি। তারপর দাবি করি যে, ওদের প্রতি আমাদের মনোভাব প্রীতিপূর্ণ। এই দাবিটা মিথ্যা নয়, আবার সত্যও নয়। ওদের প্রতি আমাদের হিংসা নেই, প্রীতিও নেই, আছে শুধু তাচ্ছিল্য। কিন্তু যদি আমাদের মনে প্রীতিভাব থাকতো তবু সেটা আজকের দিনে যথেষ্ট হত না। শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের “নীচ” জাতিরা প্রীতির অধিক কিছু চাইরে। মানুষ হিসাবে সাম্যের ভিত্তিতে স্বীকৃতি চাইবে। তা যদি না পায় তা প্রীতিও রক্ষা করা যাবে না। শিক্ষার বিস্তার ও আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অস্পৃশ্যতাজনিত তিক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া আশ্চর্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চাশ বছর আগের তুলনায় আজ কৃষ্ণাঙ্গদের ভিতর শিক্ষার ও আর্থিক মানের উন্নতি হয়েছে, আবার অসাম্যজনিত তিক্ততাও সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে।

মার্কিন দেশের শ্বেতাঙ্গরা জানেন যে, ওঁরা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অসম ব্যবহার করছেন। এ নিয়ে ওঁদের অনেকেই আজ চিন্তিত। আমাদের হিন্দুদের নিয়ে মুশকিল এই যে, আমরা চিন্তার কোনো এক স্তরে জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে মিশিয়ে দিই, সমস্ত জীবের ভিতর সাম্য কল্পনা করি; তারপর আচারে ও ব্যবহারে কোনো প্রকার অসাম্যই আমাদের আর বিচলিত করে না। এটা কিন্তু আজ সমাজকে রক্ষা করার পথ নয়। অন্তত ভারতের কোনো কোনো অংশে অবস্থা ইতিমধ্যেই আশংকাজনক।

বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের ভিতর অসাম্য (অথবা অসম উন্নতি) যে তিক্ততার কারণ হয় এ নিয়ে আজ আর তর্কের অবকাশ নেই। তবু যে-কথাটা জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন তা হল এই যে, শুধু সংবিধানের কয়েকটি ধারা দিয়ে এই অসাম্য দূর করা যাবে না। অতএব এ বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

আর্থিক উন্নতির চেষ্টাও যথেষ্ট নয়। জাতিভেদ যে-জীবনদর্শনের অঙ্গ তারই পুনর্বিচার প্রয়োজন। বহুদিন আগে রামমোহন লিখেছিলেন।

“The distinction of castes, introducing innumerable divisions and sub-divisions among them (the Hindus), have entirely deprived them of patriotic feeling.”

কথাটার ভিতর খানিকটা অত্যুক্তি আছে। কিন্তু জাতিভেদ যে আমাদের জাতীয় সংহতির পথে অন্তরায় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

উপরন্তু এদেশে যে-সামাজিক পরিমণ্ডলে জাতিভেদ সজীব আছে, তাই আবার। আমাদের বিজ্ঞানবিমুখ করেছে। বিজ্ঞানকে আমরা গবেষণাগারের সামগ্রী হিসাবে মনে করি, বাস্তবজীবনে তাকে সহায় বলে প্রায়ই বিশ্বাস করি না। শুধু খাদ্যাখাদ্য বিচারে নয়, জীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটে আমাদের চিন্তার ভঙ্গীতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থাপন করা যাক। মানুষের সামাজিক চেতনার বিবর্তনে কয়েকটি স্তর আছে। যেমন, আদিমকালে মানুষ ছিল যাদুতে বিশ্বাসী ও নানাপ্রকার অতিপ্রাকৃত শক্তির উপাসানায় অভ্যস্ত। যুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তার ভঙ্গীতে পরিবর্তন দেখা দেয়। ধর্মের যে-সব প্রত্যয়ের সঙ্গে যুক্তির প্রত্যক্ষ বিরোধ আছে, সে সব প্রত্যয় তখন পরিত্যাজ্য মনে হয়। আধুনিক যুগে ফলিত বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে জাগতিক সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের মূল্য অধিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। এদেশেও জীবনের বহিরঙ্গে এর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু আমাদের মনের গভীরতর স্তরে যাদুতে বিশ্বাস এখনও সুরক্ষিত। এরই অন্যতম উদাহরণ অস্পৃশ্যতা।

সমস্যা হিসাবে অস্পৃশ্যতার গুরুত্ব স্বীকার করবার পর এর কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। অস্পৃশ্যতার মূলে আছে জাতি ও কর্মভেদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি প্রাচীন ও মূঢ় কুসংস্কার। এই কুসংস্কারটির সঙ্গে হিন্দুসমাজে প্রত্যেকেই পরিচিত। কোনো। বস্তুবিশেষ যদি আমাদের বিচারে অশুচি হয় তবে সেই বস্তু যে-পাত্রে স্থাপন করা যায় তা অপবিত্র, আবার সেই পাত্র যদি কেউ স্পর্শ করে তবে সেই ব্যক্তিও স্পর্শদোষে অপবিত্র। এই জাতীয় বিচার-যে যুক্তিহীন, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুত এভাবে যদি কেউ শেষ অবধি বিচার চালিয়ে যান তত জগতের প্রত্যেকটি বস্তুকে কোনো-না-কোনো স্পর্শদোষে অপবিত্র মনে করা ছাড়া উপায় থাকে না এবং শুদ্ধিকরণের পদ্ধতিগুলিও যুক্তিহীন প্রতিপন্ন হয়। অতএব কেউই শেষ অবধি এভাবে বিচার করেন না। তবে এই কুসংস্কারটিকে হিন্দুসমাজ যে-পরিমাণে গ্রহণ করেছে সেটাই বুদ্ধি বিভ্রাটের পক্ষে যথেষ্ট। এই বুদ্ধিবিভ্রাট শুধুই হাস্যাস্পদ হত যদি-না সমাজে এর কয়েকটি অমানুষিক ফলাফল প্রতিনিয়ত চোখে পড়ত। হাসপাতালে রোগী আকুলভাবে প্রার্থনা করেও মলাধারটি হাতের কাছে পাচ্ছেন না কারণ জমাদার কাছে নেই এবং সেবিকা সহ অন্য সবাই ঐ পাত্রটি স্পর্শ করতে দ্বিধাগ্রস্ত, এমন হৃদয়হীন ব্যাপার বোধ করি এদেশেই সম্ভব। উচ্চনীচ ভেদাভেদ সব সমাজেই অল্পবেশি দেখা যায়। কিন্তু হিন্দুর জাতিভেদে উচ্চনীচ ভেদাভেদের অতিরিক্ত কিছু আছে; সেটা হল পবিত্রতা সম্বন্ধে অতি প্রাচীন ও অন্ধ কুসংস্কার।

অস্পৃশ্যতা উদাহরণ মাত্র; আমাদের মনের যেখানে কুসংস্কারের সার্বভৌমত্ব সেখানে আলোকপাত করাই এই আলোচনার উদ্দেশ্য। আমাদের ভিতর অস্পৃশ্যতা অত্যন্ত ব্যাপক। এবং মনের গভীরে বদ্ধমূল বলেই একে দূর করাও কঠিন। ধর্মের সাধারণ ব্যাখ্যা দিয়ে একে স্পর্শ করা যায় না। মানুষের মাহাত্ম সম্বন্ধে বাণী আমরা হৃদয়ের এক অংশে গ্রহণ করি আর এই সব প্রাচীন সংস্কারকে হৃদয়ের অন্য অংশে লালন করি। এ দুয়ের মধ্যে সংঘাত সযত্নে এড়িয়ে চলি। অথচ এই বিভক্ত হৃদয় নিয়ে আজ প্রগতি ও জাতীয় সংহতি রক্ষা করা যাবে না। এ জন্য চাই বিজ্ঞাননিষ্ঠ যুক্তিবাদী চিন্তা ও জীবনদর্শনের একটা খুব বড় রকমের আন্দোলন। আরও প্রয়োজন এই আন্দোলনকে জীবনচর্যায় প্রসারিত করবার বহুমুখী উদ্যোগ।

বলা বাহুল্য যে, শুধু হিন্দুসমাজে নয়, মুসলমান সমাজেও এই ধরনের বিশাল আলোড়ন আবশ্যক। ভারতবর্ষে যে-সময়ে মুসলমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, ইসলামের ইতিহাসে সেটা একটা সৃজনধর্মী যুগ নয়। পাশ্চাত্ত্য জগতে তখন নবজাগরণ শুরু হয়েছে, আর আরব চিন্তা তখন সৃজনধর্মিতার একটা আশ্চর্য যুগ অতিক্রম করে ক্লান্ত হয়ে পিছিয়ে পড়েছে। উনিশ শতকে যখন হিন্দু সমাজে নতুনচিন্তার আলোড়ন আরম্ভ হল তখনও মুসলমান সমাজে ধর্মান্ধতার দাপট প্রবল। রামমোহন বেদ অথবা উপনিষদের সব কথা সমান সত্য মনে করতেন না। তিনি প্রয়োজনবোধে প্রাচীন শ্রুতি ও স্মৃতির কিছু গ্রহণ করেছেন, আবার কিছু বর্জন করেছেন। বাইবেল নিয়ে একই কাণ্ড করেছিলেন রামমোহনের প্রায় সমসাময়িক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জেফারসন। তিনি খৃষ্টান হয়েও ঐ ধর্মগ্রন্থের কোনো কোনো অংশ কেটে বাদ দিয়েছিলেন, আবার কিছু গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমানের ধর্মগ্রন্থের উদার ব্যাখ্যার চেষ্টা হয়েছে বটে। কিন্তু সেই ধর্মগ্রন্থের সব কিছুই। সমান সত্য নয়, এমন কথা যদি কেউ বলে থাকেন তো মুসলমান সমাজে তার স্থান হয়নি। আজ ১৯৭০ সালে যতদূর জানি ভারতের বিভিন্ন অংশে মুসলমান উঠতি তরুণদের ভিতর ধর্মীয় পূনর্যুত্থানের আন্দোলন শক্তিশালী।

মানবতার অপমান সব দেশে একই আকারে আসে না। আমাদের সমাজে অস্পৃশ্য, জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা অগণিত কাল ধরে সেই অপমানের প্রধান রূপ। এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক ধর্মের কাছে মানবধর্ম পরাজিত হবে এমন আশংকা আবারও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

অতএব চিন্তার নতুন আন্দোলন প্রয়োজন হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে। এই আন্দোলনের অনুকূল বাস্তব অবস্থাও অংশত উপস্থিত। উনিশ শতকে যখন বাংলাদেশে নবজাগরণ দেখা দিয়েছিল তখন শিক্ষিতের সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়, আর শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষার স্থান ছিল সংকুচিত। অতএব রামমোহন, রানাডে ও বিদ্যাসাগরের নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাব ছিল অনিবার্যভাবে সীমাবদ্ধ। আজ শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও ক্রমশ শিক্ষা ছড়াচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষার স্থান ক্রমে প্রশস্ত হচ্ছে। আর দিকে দিকে দেখা দিয়েছে একটা নতুন চাঞ্চল্য। কিন্তু এই যুগসন্ধিক্ষণে নতুন চিন্তা অনুপস্থিত। তার পরিবর্তে আবার মাথা চাড়া দিয়েছে ভেল্কিতে বিশ্বাস।

আমরা নাটকীয়ভাবে একটা বড় ফল হঠাৎ লাভে বিশ্বাসী। এই মুগ্ধ আশা এমনই আকর্ষণীয় যে, বার বার প্রতারিত হয়েও একে ত্যাগ করা যায় না। একদিন আমরা ভেবেছিলাম যে, কোনো রকমে ইংরেজকে তাড়াতে পারলেই দেশের সমস্যা অচিরাৎ দূর হবে। এখন আমরা বিশ্বাস করতে উদগ্রীব যে, সাম্যবাদের নামে কিছু শিল্প রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে অথবা সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাতে পারলেই দেশের সমস্যার সমাধান হবে।

কিন্তু এটা যুক্তির কথা নয়। কুসংস্কার যদি আমাদের মনের গভীরে মূল বিস্তার করে থাকে তো জেনে রাখা ভালো যে, শুধু বৈপ্লবিক উত্তেজনা দিয়ে অজ্ঞতাকে ধ্বংস করা যাবে না। নিরপেক্ষ দর্শকমাত্রই লক্ষ করেছেন যে, এদেশে সাম্যবাদী আন্দোলনের অসংখ্য সমর্থকদের ভিতরও অন্ধ সংস্কারের প্রকোপ কত প্রবল। বিপ্লবের পক্ষে ও বিপক্ষে খণ্ড খণ্ড সাম্প্রদায়িক, উপজাতীয় ও দলীয় আনুগত্যকে রক্তাক্ত সংগ্রামে আজ প্ররোচিত করা কঠিন নয়। ব্যর্থতার বিজ্ঞাপনই হবে ঐতিহাসিকভাবে এই রক্তপাতের সদর্থক ফল। গহযুদ্ধের বিভীষিকা ও মূল্যবোধের বিপর্যয়ের পর যুক্তি ও মানবতাবোধের আন্দোলনই আবারও শুরু করতে হবে। তবে এই দেশব্যাপী উন্মত্ততার সার্থকতা কোথায়? শ্রম, বিজ্ঞান ও মানবতাবোধ, দেশ গড়বার এই মূল উপাদান। সামাজিক মুক্তির কোনো ত্বরিত ও সহজ পথ নেই।

আমাদের সামনে উপস্থিত একদিকে অভূতপূর্ব নবজাগরণের অনুকূল বাস্তব অবস্থা। অন্যদিকে এই বাস্তব সম্ভাবনাকে কাজে পরিণত করবার মতো মানসিক প্রস্তুতির আজ। এমনই অভাব যে, আশার কথা উচ্চারণ করতেও ভয় হয়। রামমোহনের জন্মের প্রায় দুইশত বৎসর এবং বিদ্যাসাগরের দেড়শত বৎসর পর বাংলা দেশের অসমাপ্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে সমাজের সকল অঙ্গে ব্যাপ্ত করবার সংকল্প কি আমরা এখনও গ্রহণ করতে পারব?

সমাজ ও ইতিহাস (১৯৭০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *