০২. কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা

কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা

—না, মা আসবে না। কিছুতেই না। আমি কিছুতেই মায়ের সঙ্গে দেখা করব না। তোরা বারণ করে দে।

—কেন এমন করছিস? মাসিমা কয়েক মিনিটের জন্য তোকে দেখতে চাইছেন শুধু …

—বললাম তো না …

—না কেন? ছেলের সঙ্গে মা একবার শেষ দেখা করতে পারবে না? কীসের এত জেদ তোর?

—জেদ নয়, ভয়। মা যদি কান্নাকাটি শুরু করে, আমি সামলাতে পারব না নিজেকে। বোঝার চেষ্টা কর।

—তোরও বোঝার চেষ্টা করা উচিত।

—বেশ, তোরা বোঝা মা’কে। আসুক, কিন্তু কোনও কান্নাকাটি চাই না। কোনও চোখের জল নয়। আমি ওতে দুর্বল হয়ে পড়ব।

—কাঁদবেন না, আমরা বোঝাব মাসিমাকে। তুই শুধু হ্যাঁ বল …

—হুঁ …

.

জেল-চত্বরে আলোচনা হচ্ছে যথাসম্ভব নিচু গলায়। প্রায় ফিসফিস করেই।

—কী! সব বলে দেবে বলেছে? বলে দিলে যে সর্বনাশ হবে!

—সে কি আর জানি না! শেষে কিনা এইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা!

—কিন্তু খবরটা সত্যি তো? শিয়োর? স্বীকারোক্তি দেবে?

—একশো শতাংশ। ওকে বিশ্বাস করাটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। আর খবরের সত্যি-মিথ্যে? বুঝে গেছে সবাই। আলাদা ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করছে ওকে। পাছে আমরা ওর কোনও ক্ষতি করি। পাহারা বসছে সেলের সামনে।

—তাতে কী? পাহারা-টাহারা যা বসায় বসাক। গদ্দারির সাজা মৃত্যু। সবাইকে ফাঁসিয়ে পার পেয়ে যাবে এভাবে?

—কীভাবে মারা হবে? কে মারবে?

—সেটা সবাই মিলে ঠিক করতে হবে। অস্ত্র জোগাড় করাটা প্রথম কাজ।

—অত সোজা নাকি এখানে আর্মস ঢোকানো?

—সোজা তো সেভাবে দেখতে গেলে কিছুই নয়। কাজটা কঠিন, কিন্তু রাস্তা নিশ্চয়ই একটা বেরবে।

—আমার তো ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে ওর গলা টিপে ধরতে …

—ওই বোকামোটা করতে গেলে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতে কয়েক মিনিট লাগবে। মরতে হলে ওকে মেরে মরিস।

—হুঁ … মেরেই মরব। একটা রিভলভার পেলেই …

—হ্যাঁ, আর্মস চাই, যেভাবেই হোক।

.

প্রায় সবারই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ সম্পূর্ণ। লালবাজারের লক-আপ থেকে নগরপালের চেম্বারে এক এক করে পেশ করা হয়েছে অভিযুক্তদের। বাকি শুধু একজন। যাঁকে সশস্ত্র প্রহরায় ঢোকানো হয়েছে নগরপাল Fredrick Loch Halliday-র ঘরে। এই মধ্যতিরিশের লোকটি অন্যদের থেকে আলাদা, এক ঝলক দেখেই মনে হয় হ্যালিডে সাহেবের। আয়ত চক্ষু, প্রশান্ত মুখমণ্ডল। শরীরী ভাষায় উদ্বেগ নিরুদ্দেশ। নগরপাল প্রশ্ন ছুড়ে দেন সরাসরি।

—‘Aren’t you ashamed of being involved in this cowardly, dastardly activity?’

যুবক নিরুত্তাপ।

—‘What right have you to assume that I was involved?’

নগরপাল ঝাঁঝিয়ে ওঠেন।

—‘I am not assuming, I know everything.’

যুবক অবিচলিত। শান্ত উত্তর আসে।

—‘What you know or do not know is your concern. I wholly deny having any connection with these murderous acts.’

.

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, সর্বজনজ্ঞাত তথ্য, জনমানসে উৎপন্ন করেছিল তীব্র ক্ষোভ। যা অনুঘটক হয়ে দেখা দিয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষে, বিপ্লবীদের একাধিক গুপ্ত সমিতির স্থাপনে আর ‘যুগান্তর’এবং ‘বন্দে মাতরম’-এর মতো দেশাত্মবোধক প্রকাশনার পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধিতে। অত্যাচারী শাসকদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করে সশস্ত্র আক্রমণ এবং হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বিপ্লবীরা। ১৯০৭-এর শেষার্ধ থেকে ১৯০৮-এর এপ্রিলের মধ্যে একাধিক চেষ্টা হয়েছিল শাসকনিধনের।

বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন Sir Andrew Fraser। ১৯০৭-এর ৬ ডিসেম্বরে তাঁর ট্রেনযাত্রার সময় রেললাইনে বিস্ফোরণের চেষ্টা ব্যর্থ হল। চন্দননগরের তৎকালীন মেয়র L Tardivel স্বদেশি আন্দোলনকে যেনতেনপ্রকারেণ দমনের বিষয়ে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টাও ব্যর্থ হল।

উপর্যুপরি তৃতীয় ব্যর্থতা এল কলকাতার তৎকালীন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে বই-বোমা পাঠিয়ে হত্যার প্রচেষ্টায়। মোড়কসুদ্ধ বই-বোমা পাড়ি দিল কিংসফোর্ডের পরবর্তী কর্মস্থল মুজফ্‌ফরপুরে। বদলির আদেশ এসেছিল তড়িঘড়ি, সময় হয়নি প্যাকেট খোলার।

কিংসফোর্ডের ভবলীলা সাঙ্গের চেষ্টা অবশ্য অব্যাহত ছিল। দুই তরুণ, ক্ষুদিরাম বসু আর প্রফুল্ল চাকী, রওনা দিলেন মুজফ্‌ফরপুর। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের তৈরি বোমা নিয়ে।

পরের কাহিনি বহুশ্রুত, বহুপঠিত। ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিলের রাতে দুই বিপ্লবীর বোমা ছোড়া ঘোড়ার গাড়ি লক্ষ্য করে, যাতে কিংসফোর্ড নন, ছিলেন দুই ইউরোপীয় রমণী। ঘটনাস্থলেই উভয়ের মৃত্যু এবং একটু পিছনের গাড়িতে থাকা কিংসফোর্ডের ফের রক্ষা পাওয়া বরাতজোরে।

image
.

দুই নিরপরাধ শ্বেতাঙ্গের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল ব্রিটিশ প্রশাসনে। প্রবল প্রত্যাঘাতের প্রস্তুতি শুরু করল শাসক, বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে।

ঘটনার পরদিনই জরুরি বৈঠক ডাকলেন নগরপাল হ্যালিডে। উপস্থিত সিআইডি-র ডিআইজি প্লাউডেন সাহেব। উপস্থিত গোয়েন্দাবিভাগের এবং স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সমস্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। দীর্ঘ আলোচনার পর রূপরেখা প্রস্তুত হল নৈশতল্লাশির। তৈরি হল একাধিক দল, প্রতিটির নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন অফিসার এবং বিশ্বস্ত ‘ইনফর্মার’। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাকভোরে পুলিশ হানা দিল কলকাতার বিপ্লবীদের সম্ভাব্য ডেরাগুলিতে।

মানিকতলার ৩২, মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়িটি যে আদতে বিপ্লবীদের উগ্রপন্থী কার্যকলাপের সূতিকাগার, এমন তথ্য ছিলই গোয়েন্দাদের কাছে। এবং তথ্যে গরমিল ছিল না বিশেষ। অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন্দ্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই স্বাধীনতা লাভে বিশ্বাসী ছিলেন। সেই চূড়ান্ত অভীষ্টে পৌঁছনোর লক্ষ্যে তরুণ বিপ্লবীদের নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মকাণ্ড বারীন শুরু করেছিলেন মুরারিপুকুরের বাড়িটিতে। যোগশিক্ষা, গীতা-উপনিষদ পাঠের পাশাপাশি চলত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে নিয়মিত ক্লাস। লাঠিখেলা-কুস্তি-জুজুৎসু তো ছিলই, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং বিস্ফোরক তৈরির প্রক্রিয়া সিংহভাগ জুড়ে থাকত পাঠক্রমের।

২ মে-র ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। ওয়াটারলু স্ট্রিট থানার ইনস্পেকটর J L Frizzoni-র নেতৃত্বে পুলিশ হানা দিল মুরারিপুকুর রোডের বাড়িতে। তল্লাশিতে উদ্ধার হল বিপুল পরিমাণে গুলি-বন্দুক-অস্ত্রশস্ত্র-বোমা-বিস্ফোরক তৈরির সামগ্রী। গ্রেফতার হলেন বারীন ঘোষ সহ ১৪ জন। পুলিশের নৈশ অভিযান চলল ৪৮ গ্রে স্ট্রিট, ৩৮/৪ নবকৃষ্ণ স্ট্রিট, ১৫ গোপীমোহন দত্ত লেন, ১৩৪ হ্যারিসন রোড, ৩০/২ হ্যারিসন রোড এবং ২৩ স্কট লেনেও। বাজেয়াপ্ত হল পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র-বোমা-কার্তুজ, জাতীয়তাবাদী পুস্তিকা-প্রবন্ধ-নথিপত্র।

বিপ্লবীদের সহিংস কর্মকাণ্ডে যিনি ছিলেন বোমা বানানোর প্রধান কারিগর, সেই হেমচন্দ্র দাস গ্রেফতার হলেন ৩৮/৪ নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে। তল্লাশির নেতৃত্বে ছিলেন Superintendent C F Merriman. ১৩৪, হ্যারিসন রোডের একটি আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকানে বিপ্লবীরা গোপনে মজুত রাখতেন বিস্ফোরক পদার্থ। Southern Division-এর Superintendent of Police Griffith Bowen-এর তত্ত্বাবধানে তছনছ করে দেওয়া হল সেই দোকান।

অরবিন্দ ঘোষকে পুলিশ গ্রেফতার করল ৪৮ গ্রে স্ট্রিট থেকে। নগরপাল হ্যালিডের বিশেষ আস্থাভাজন Superintendent Richard Creagan ভোর পৌনে পাঁচটা নাগাদ হানা দিলেন দলবল নিয়ে। গ্রেফতারির বর্ণনা ধরা রয়েছে অরবিন্দের স্বরচিত ‘কারাকাহিনী’ বইটিতে। অংশবিশেষ তুলে দিলাম।

‘শুক্রবার রাত্রিতে আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইয়াছিলাম, ভোরে প্রায় ৫টার সময় আমার ভগিনী সন্ত্রস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিল, জাগিয়া উঠিলাম। পরমুহুর্ত্তে ক্ষুদ্র ঘরটী সশস্ত্র পুলিশে ভরিয়া উঠিল; সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্রেগান, ২৪ পরগণার ক্লার্ক সাহেব, সুপরিচিত শ্রীমান বিনোদকুমার গুপ্তের লাবণ্যময় ও আনন্দদায়ক মূর্ত্তি, আর কয়েকজন ইনস্পেক্টর, লাল পাগড়ি, গোয়েন্দা, খানাতল্লাসীর সাক্ষী। হাতে পিস্তল লইয়া তাহারা বীরদর্পে দৌড়াইয়া আসিল, যেন বন্দুক-কামানসহ একটি সুরক্ষিত কেল্লা দখল করিতে আসিল। শুনিলাম, একটি শ্বেতাঙ্গ বীরপুরুষ আমার ভগিনীর বুকের উপর পিস্তল ধরে, তাহা স্বচক্ষে দেখি নাই। বিছানায় বসিয়া আছি, তখনও অর্দ্ধনিদ্রিত অবস্থা, ক্রেগান জিজ্ঞাসা করিলেন, “অরবিন্দ ঘোষ কে, আপনিই কি?” আমি বলিলাম, “আমিই অরবিন্দ ঘোষ”। অমনি একজন পুলিশকে আমাকে গ্রেপ্তার করিতে বলেন। তাহার পর ক্রেগানের একটী অতিশয় অভদ্র কথায় দুজনের অল্পক্ষণ বাকবিতন্ডা হইল। আমি খানাতল্লাসীর ওয়ারেন্ট চাহিলাম, পড়িয়া তাহাতে সহি করিলাম। ওয়ারেন্টে বোমার কথা দেখিয়া বুঝিলাম, এই পুলিশ সৈন্যের আবির্ভাব মজঃফরপুরের খুনের সহিত সংশ্লিষ্ট। কেবল বুঝিলাম না আমার বাড়ীতে বোমা বা অন্য কোন স্ফোটক পদার্থ পাইবার আগেই body warrant এর অভাবে কেন আমাকে গ্রেপ্তার করে। তবে সেই সম্বন্ধে বৃথা আপত্তি করিলাম না। তাহার পরেই ক্রেগানের হুকুমে আমার হাতে হাতকড়ি, কোমরে দড়ি দেওয়া হইল। একজন হিন্দুস্থানী কনস্টেবল সেই দড়ি ধরিয়া পিছনে দাঁড়াইয়া রহিল। ………… ক্রেগানের কথায় ভাবে প্রকাশ পাইল যে, তিনি যেন হিংস্র পশুর গর্ত্তে ঢুকিয়াছেন, যেন আমরা অশিক্ষিত হিংস্র স্বভাববিশিষ্ট আইনভঙ্গকারী, আমাদের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করা বা ভদ্র কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। তবে ঝগড়ার পর সাহেব একটু নরম হইয়া পড়িলেন। বিনোদ বাবু তাঁহাকে আমার সম্বন্ধে কি বুঝাইতে চেষ্টা করেন। তাহার পর ক্রেগান আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আপনি নাকি বি-এ পাশ করিয়াছেন? এইরূপ বাসায় এমন সজ্জাবিহীন কামরায় মাটিতে শুইয়াছিলেন, এই অবস্থায় থাকা কি আপনার মত শিক্ষিত লোকের পক্ষে লজ্জাজনক নহে?’’ আমি বলিলাম, ‘‘আমি দরিদ্র, দরিদ্রের মতই থাকি।’’ সাহেব অমনি সজোরে উত্তর করিলেন, ‘‘তবে কি ধনী লোক হইবেন বলিয়া এই সকল কাণ্ড ঘটাইয়াছেন?’’ দেশহিতৈষিতা, স্বার্থত্যাগ বা দারিদ্র ব্রতের মাহাত্ম্য এই স্থুলবুদ্ধি ইংরেজকে বোঝান দুঃসাধ্য বিবেচনা করিয়া আমি সে চেষ্টা করিলাম না।’

শহর জুড়ে নৈশতল্লাশিতে উল্লাসকর দত্ত, কানাইলাল দত্ত এবং আরও অনেকে ধরা পড়লেন। সবারই নিশিযাপন লালবাজারের লক আপে।

পরদিন সকালে হ্যালিডে সাহেব নিজে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন আটক বিপ্লবীদের। চেষ্টা করলেন অরবিন্দ ঘোষের থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের।

—‘Aren’t you ashamed of being involved in this cowardly, dastardly activity?’

image
.

মামলার পোশাকি নাম, Emperor vs Barindra Kumar Ghosh and others, অধিক পরিচিত মানিকতলা বোমা মামলা বা আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে। বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান জারি থাকল মে মাস জুড়ে। শ্রীরামপুরের জমিদার পরিবারের নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী সক্রিয় সদস্য ছিলেন বারীনের গুপ্ত সমিতির। গ্রেফতার হলেন। সম্পর্কে অরবিন্দ-বারীনের মামা হতেন মেদিনীপুরের বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। যিনি বাংলার রেনেসাঁ-যুগের অন্যতম দিকপাল ব্যক্তিত্ব রাজনারায়ণ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। সত্যেনের মেদিনীপুরের বাড়ি থেকে একটি পুরনো বন্দুক ও কুকরি উদ্ধার করল পুলিশ। এবং অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরের পাশাপাশি তাঁকে জড়িয়ে দেওয়া হল আলিপুর মামলাতেও। প্রায় জনা চল্লিশেক বিপ্লবীর ঠাঁই হল আলিপুর জেলে, পরে যা প্রেসিডেন্সি জেল নামে পরিচিত হয়।

আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চিরকালীন দিকচিহ্ন এক। এই বহুচর্চিত মামলা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে অনেক, পূর্ণাঙ্গ বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে একাধিক বই এবং পত্র-পত্রিকায়। সে বিবরণীর বিস্তার এই লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। ইতিহাসের সড়কপথে শুধু ফিরে দেখা মামলা চলাকালীন আলিপুর জেলের অভ্যন্তরে বঙ্গজ বিপ্লবীদের এক দুঃসাহসিক কীর্তিকে, যা আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।

২৪ পরগনার তৎকালীন জেলাশাসকের কাছে জবানবন্দি নথিবদ্ধ করার কাজ চলছিল মামলার প্রাথমিক পর্বে। নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর বয়ান নথিভুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ল আলিপুর জেলে। অরবিন্দ তো বটেই, এ ছাড়াও সুবোধচন্দ্র মল্লিক, চারুচন্দ্র দত্ত সহ আরও অনেকের নাম জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন নরেন। শুধু তাই নয়, সম্মত হয়েছেন রাজসাক্ষী হতে। বিনিময়ে বেকসুর খালাস হতে চলেছেন মামলা থেকে। আপাতত জেলবন্দি বিপ্লবীদের রোষ থেকে বাঁচাতে নরেনের থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে। সর্বক্ষণের প্রহরায় নিযুক্ত হচ্ছেন হিগেনস্ নামের জেলকর্মী।

নরেন ছিলেন শ্রীরামপুরের জমিদারবাড়ির সন্তান। সম্ভ্রান্ত এবং বিত্তবান পরিবারের অসংখ্য স্বাধীনতাকামীর স্বেচ্ছায় আন্দোলনে যোগ দিয়ে অকল্পনীয় কৃচ্ছ্রসাধনের বহু উদাহরণ রয়েছে, কিন্তু নরেনের বিপ্লবী হওয়াটা বহুলাংশে হুজুগই ছিল। সাময়িক সাধ হয়েছিল বিপ্লবী হওয়ার, দীর্ঘস্থায়ী পীড়ন সহ্য করার সাধ্য ছিল না। মামলায় অভিযুক্তদের রাখা হয়েছিল জেলের ৪৪ ডিগ্রি ওয়ার্ডে। সার দিয়ে কুঠুরি চুয়াল্লিশটি, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত প্রবেশের উপর প্রাকৃতিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ সেখানে। বিলাসব্যসনে আশৈশব অভ্যস্ত নরেন দ্রুত পরাভব স্বীকার করেছিলেন ইন্দ্রিয়সুখের কাছে। বিপ্লবের থেকে কারামুক্তি অধিক কাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছিল। সে হলই বা বিশ্বাসভঙ্গের বিনিময়ে।

প্রেক্ষিতের প্রয়োজনে উল্লেখ্য, আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার জেলবন্দি বিপ্লবীদের মধ্যে পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে মতবিরোধ ছিল নরেনের স্বীকারোক্তি-উত্তর পর্যায়ে। বারীনের বরাবরের বিশ্বাস উগ্রপন্থায়। অহিংসায় তাঁর তীব্র বিরাগ। ছক কষছিলেন জেলে গুলি-বোমা-বন্দুক গোপনে আমদানি করে পালানোর। পক্ষান্তরে, সত্যেন বসু-কানাইলাল দত্ত-হেমচন্দ্র দাসের কাছে অগ্রাধিকার ছিল নরেনকে বিশ্বাসঘাতকতার চরম শাস্তি দেওয়া। ওঁরা বারীনকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিলেন না পরিকল্পনা, সাহায্য চাইলেন জেল পালানোর অস্ত্র সরবরাহে। কথোপকথন হল বারীনের অজ্ঞাতে।

—হুঁ, মেরেই মরব। একটা রিভলভার পেলেই …

—হ্যাঁ, আর্মস চাই। যেভাবেই হোক।

image
.

‘আর্মস’ জোগাড় হল। জেলে বন্দিদের সঙ্গে বন্ধুপরিজনদের সাক্ষাতের দিনটি নির্দিষ্ট ছিল প্রতি রবিবার। বহিরাগতদের আপাদমস্তক খানাতল্লাশির দায়িত্বে যে জেলকর্মীরা থাকতেন, যৎসামান্য উৎকোচের বিনিময়ে তাঁদের দলে টানলেন বারীন।

চন্দননগরের বিপ্লবী সুধাংশুজীবন রায় ২৩ অগস্ট বারীনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন সাক্ষাৎপ্রার্থী হিসাবে। প্রহরীদের প্রশ্রয়ে গরাদের মধ্য দিয়েই বারীনের হাতে চালান করে দিলেন রিভলভার। তার পরের রবিবার, ৩০ অগস্ট, একই প্রক্রিয়ায় চন্দননগরেরই শ্রীশচন্দ্র ঘোষের মাধ্যমে দ্বিতীয় রিভলভার হাতে এল বারীনের। একটি দিলেন কানাইলাল দত্তকে। অন্যটি পৌঁছল জেল হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন সত্যেন বসুর কাছে। যিনি দিনকয়েক আগে নরেনের কাছে খবর পাঠিয়েছেন, ‘এভাবে আর পারা যাচ্ছে না, আমিও রাজসাক্ষী হতে চাই’, এবং বার্তা পেয়ে নরেন দেখাও করে গিয়েছেন সত্যেনের সঙ্গে। জানিয়েছেন, ব্রিটিশ সরকার রাজসাক্ষ্যের বিনিময়ে সত্যেনকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত।

পয়লা সেপ্টেম্বর নরেনের ফের এক প্রস্থ স্বীকারোক্তির দিন ঠিক হয়েছিল। সত্যেন-কানাই সিদ্ধান্ত নিলেন, আর দেরি করা চলে না। রিভলভার হাতে আসার পর ৩০ অগস্ট সন্ধেবেলায় কানাইলাল পেটে অসহ্য ব্যথার অভিনয় করে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। অনুরূপ দাস নামে এক জেলকর্মী মারফত সত্যেন ৩০ তারিখ রাত্রেই খবর পাঠালেন নরেনকে, ‘জরুরি প্রয়োজন। কানাইও রাজসাক্ষী হতে চায়। কাল সকালে দেখা করা বিশেষ দরকার হয়ে পড়েছে।’

image
.

৩১ অগস্ট, ১৯০৮। আলিপুর জেল হাসপাতাল। ঘড়ির কাঁটায় সকাল পৌনে সাতটা।

নরেন এলেন হাসপাতালে, সঙ্গে প্রহরী হিগেনস্। সত্যেন এবং কানাই বেরিয়ে এলেন তিনতলার ওয়ার্ডের করিডরে। তিনজনে মিনিটখানেকের আলোচনা চলল, অদূরেই দাঁড়িয়ে হিগেনস্। যিনি চমকে উঠলেন হঠাৎ গুলির আওয়াজে। দেখলেন, কোমরে গোঁজা রিভলভার থেকে নরেনকে লক্ষ্য করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন সত্যেন-কানাই।

একটু দূরেই ছিল ডিসপেনসারি। রক্তাক্ত নরেন ছুটতে শুরু করলেন সেদিকে, কাতর আর্তনাদ শোনা গেল, ‘বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে!’ হিগেনস্ ধাওয়া করলেন, কানাই ফের গুলি চালালেন। লাগল হিগেনসের কবজিতে। কয়েকজন বন্দি এবং হাসপাতাল-কর্মীও চেষ্টা করলেন প্রতিরোধের। কানাই শূন্যে গুলি চালালেন এবার, ‘এক পা এগোলে সবাইকে খুন করব!’

নরেন আর হিগেনস্ তখনও মরিয়া চেষ্টা করছেন বাঁচার। আহত অবস্থাতেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে দু’জনে ছুটলেন জেল গেটের দিকে। রিভলভার হাতে পিছনে দৌড়লেন সত্যেন-কানাই। সিনেমাতেই শুধু দেখা যায় এমন দৃশ্য। জেলের চত্বরে সাতসকালে রিভলভার উঁচিয়ে গুলি চালাতে চালাতে দুই রক্তাক্ত ব্যক্তিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে তাড়া করছে দুই তরুণ।

জেল গেটের কাছাকাছি দৃশ্যটা চোখে পড়ল জেলর এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মীর। যাঁরা লিন্টন নামের এক ইউরোপিয়ান বন্দিকে নিয়ে আসছিলেন হাসপাতালের দিকে। রিভলভার তাক করে ফের হুমকি দিলেন কানাই, ‘বাধা দিলে গুলি করে মারব তোদের!’

জেলর এবং সঙ্গীরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন স্থাণুবৎ, লিন্টন ছাড়া। যিনি ধস্তাধস্তিতে জড়ালেন সত্যেনের সঙ্গে। গুলি চালালেন সত্যেন, লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। কানের পাশে গুলির শব্দ শুনলেন লিন্টন পরের মুহূর্তেই। তাকিয়ে দেখলেন, নরেন মুখ থুবড়ে পড়ছেন জেলের রাস্তা-সংলগ্ন ড্রেনে। হিগেনস্ নিরাপদ দূরত্বে পালাতে পেরেছেন ততক্ষণে।

লিন্টন ছিলেন দশাসই চেহারার, ছিল দুর্দান্ত শারীরিক সক্ষমতা। সত্যেনের রিভলভার কেড়ে নিতে সমর্থ হলেন, ছুড়ে দিলেন দূরে। কানাই ফের ট্রিগারে চাপ দিলেন, টার্গেট এবার লিন্টন। দ্রুত মাথা সরিয়ে প্রাণে বাঁচলেন লিন্টন এবং ঝাঁপালেন কানাইয়ের উপর। কানাইয়ের রিভলভারও হাতাহাতিতে ছিটকে গেল দূরে। অস্ত্রচ্যুত বিপ্লবীদের কব্‌জা করে ফেললেন জেলকর্মীরা।

নরেনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। একটি-দুটি নয়, মোট ন’টি বুলেট প্রবেশ করেছিল শরীরে। ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহে মৃত্যুর আগমন ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

নরেন-হত্যাকে স্রেফ বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি হিসাবে দেখলে ভুলই হবে একটু। ঘটনার আইনি তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। রাজসাক্ষীকে যদি জেরার সুযোগই না পান বিবাদী পক্ষের আইনজীবী, নিরর্থক হয়ে যায় বয়ান, চূড়ান্ত বিচারে মূল্যহীন হয়ে যায় জবানবন্দি। নরেনের মৃত্যুতে প্রমাণমূল্য হারিয়েছিল তার স্বীকারোক্তি। যা অরবিন্দ সহ বাকি অভিযুক্তদের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারত বিচারপর্বে।

ঘটনার বিবরণ জানিয়ে বাংলার মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখলেন নগরপাল।

Letter of the Commissioner of Police, Calcutta on the day of Alipore Jail Murder (Aug 31, 1908) Government of Bengal, Political Department, Confidential File No. 160 (1-16) of 1908 Confidential No 1876-C. dated 31st August, 1908

To

The Chief Secretary to the Government of Bengal, Calcutta.

Sir,

I have the honour to report that this morning at about 7 a.m. an under-trial prisoner named Norendra Nath Goswami, who had turned approver in the prosecution of some 34 persons now pending trial before the Sessions Judge of Alipore on charges under Sections 121. 121.A, I. P. C. etc., was shot by two co-undertrial prisoners named Kanai Lal Dutt and Satyendra Nath Bose in the Jail Hospital of the Alipore Central Jail.

It appears that the prisoner Norendra Nath Goswami who had been intentionally kept separate from the other prisoners confined in the European Ward was brought, from that ward, to the Jail Hospital by a European Convict Overseer named Higgens. Norendra Nath had apparently previously arranged to meet, at that time, in the Hospital, two fellow prisoners, who were already patients in the Jail Hospital, named Kanai Lal Dutt and Satyendra Nath Bose. He had apparently been approached by the second of these prisoners, who had pretended that he also wished to make a statement; and his visit was really in order to get this statement. Evidently it was however part of a plot to get Norendra Nath within striking distance for it appears that almost immediately on Narendra Nath’s arrival on the landing, at the head of the staircase leading to the second story of the Hospital, these two prisoners opened fire on him with two revolvers which they had secreted on their persons. Higgens the Convict Overseer attempted to arrest one of them and was shot through the wrist.

Norendra Nath although shot in several places was not mortally hit and fled down the stairs, out of the Hospital Compound and along an alley way towards the gate.

The prisoner Kanai Lal Dutt pursued him and shot him fatally through the back. He was then secured by a Eurasian Prisoner named Linton.

The District Magistrate, Mr. Marr immediately commenced a judicial enquiry in the case.

A Police investigation has been started but the accused have not as yet been questioned by the Police as to how they came into possession of the weapons.

The accused Kanai Lal Dutt is a native of Jantipara Serampore, Hooghly and Satyendra Nath Bose is a native of Midnapore where he was head of the “National Volunteers”.

A telegram has been sent to the Director, Criminal Intelligence, Simla, and a copy of this letter has also been sent to him.

A further report will be submitted.

I have the honour to be,

Sir,

your most obedient servant,

F L Halliday

Commissioner of Police, Calcutta.

image
.

নরেন হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হল যুদ্ধকালীন দ্রুততায়। জুরি তাঁদের রায়ে কানাইকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ফাঁসির সাজা শোনালেন ৯ সেপ্টেম্বর। সত্যেনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। দণ্ডাদেশ নির্ধারণে মামলা পাঠানো হয়েছিল হাইকোর্টে। উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডই বরাদ্দ করেছিল সত্যেনের জন্যও।

কানাইকে ফাঁসির সাজা শোনানোর সময় বিচারক প্রথামাফিক জানালেন, উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। কানাইয়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আবেদন? কীসের আবেদন?’

কুড়ি বছর বয়সি কানাইয়ের ফাঁসির দিন ধার্য হল ১৯০৮-এর ১০ নভেম্বর। কাকভোরে জেলে উপস্থিত হলেন খোদ নগরপাল হ্যালিডে সহ লালবাজারের পদস্থ কর্তারা। সকাল ছ’টায় কানাইলালকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে। কানাই ছিলেন অচঞ্চল, তাপ-উত্তাপহীন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে পাওয়া যায়, কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন স্মিতহাস্য।

ফাঁসির সময় উপস্থিত ছিলেন, এমন একজন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার পরে বারীনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘How many more do you have like him?’

এমন আরও কতজন আছে কানাইয়ের মতো? নিরুত্তর ছিলেন বারীন, মৃদু হেসেছিলেন শুধু।

আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার গতিপ্রকৃতি তুমুল আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল বঙ্গসমাজে। নরেন-হত্যায় অভিযুক্ত দুই যুবককে কেন্দ্র করেও সর্বস্তরে স্রোত বইছিল সহানুভূতির। যা অজানা ছিল না প্রশাসনের। কানাইলালের মরদেহ নিয়ে মূল রাজপথ দিয়ে শোভাযাত্রার অনুমতি দিলেন না নগরপাল। টালি নালার পার্শ্ববর্তী গলিঘুঁজি দিয়েই শ্মশানযাত্রা হবে, নির্দেশ জারি হল। আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে তলব করা হল রিজার্ভ ফোর্সের তিনশো জওয়ানকে।

কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে কি আর বলপূর্বক রাশ টানা যায়? গিয়েছে কখনও? মরদেহ যখন পৌঁছল গলির গলি তস্য গলি পেরিয়ে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে, মাত্রাছাড়া আকার নিয়েছে প্রতীক্ষারত জনসমাগম। আট থেকে আশি নেমে এসেছে রাস্তায়, শহিদবরণে। আশেপাশের বাড়িগুলির বারান্দা থেকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে।

মহিলারা প্রস্তুত ফুল-মালা-ঘি-চন্দন নিয়ে। বয়স্কদের অধিকাংশের হাতে ভগবদ্‌গীতা। তরুণদের সম্মিলিত ‘বন্দে মাতরম’-এর গর্জন পরিণত শব্দব্রহ্মে। শহিদের দেহ ছুঁতে চাওয়ার আকুতিতে উত্তাল অপ্রশস্ত পথপরিসর। যানচলাচল স্তব্ধ জনস্রোতে।

তুঙ্গস্পর্শী উন্মাদনাকে কোনওমতে নিয়ন্ত্রণে এনে যখন শেষকৃত্য সম্পন্ন হল যুবকের, ফের ঘটল আবেগের অগ্ন্যুৎপাত। পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া দেহের ছাইভস্ম দখলে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল উন্মত্ত জনতা। ক্রোধ-ক্ষোভ-শোকের বিরল ত্র্যহস্পর্শের সাক্ষী থাকল শ্মশানপ্রাঙ্গণ।

image
.

সত্যেনের ফাঁসির দিন নির্দিষ্ট হয়েছিল ২১ নভেম্বর। কানাইলালের শেষকৃত্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সত্যেনের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন হবে জেল প্রাঙ্গণেই। তা-ই হয়েছিল। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ছাব্বিশ।

ফাঁসির দিনকয়েক আগে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন সত্যেনের মা। সত্যেন রাজি ছিলেন না।

—না, মা আসবে না। কিছুতেই না। আমি মায়ের সঙ্গে দেখা করব না।

—না কেন?

—মা কান্নাকাটি করলে দুর্বল হয়ে পড়ব। বেশ, আসুক, কিন্তু কোনও চোখের জল নয়।

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন গর্ভধারিণী। জেলে পুত্রের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে এক বিন্দুও অশ্রুব্যয় করেননি।

image
.

মূল মামলার বিচারপর্বের চাপান-উতোরের বিবরণী দিয়ে দীর্ঘায়িত করছি না লেখা। রায় ঘোষিত হয়েছিল ১৯০৯-এর ৬ মে। মোট ৩৭ জন অভিযুক্তের মধ্যে বারীন ঘোষ এবং উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির সাজা হয়েছিল, উচ্চ আদালতে যা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে। হেমচন্দ্র দাস সহ দশজনেরও হয়েছিল দ্বীপান্তরের সাজা। চারজনের সাজা হয়েছিল দশ বছরের কারাবাসের, তিনজনের সাত বছরের। বাকিরা মুক্তি পেয়েছিলেন।

আর অরবিন্দ ঘোষ? মামলার সওয়াল-জবাব কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ অবতীর্ণ হয়েছিলেন অভিযুক্তদের প্রধান আইনজীবী হিসাবে। বিচারের অন্তিম পর্বে অরবিন্দ প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জন পেশ করেছিলেন আবেগমথিত বক্তব্য। সাধ্যমতো বঙ্গানুবাদ রইল।

‘ধর্মাবতার, আমার চূড়ান্ত আবেদন এই, অভিযুক্তের তকমা দেওয়া এই মানুষটি আজ শুধু এই আদালতের সুবিচারের প্রত্যাশী নন, তিনি মুখাপেক্ষী ইতিহাসের ন্যায়ালয়ের।

আমার আবেদন, এই মামলার বিতর্কের অভিঘাত সময়ের প্রলেপে ক্ষীণতর হয়ে পড়ার দীর্ঘদিন পরও, এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার বহুকাল পরও, এই মানুষটির প্রয়াণের দীর্ঘদিন পরও, ওঁকে মানুষ মনে রাখবে দেশপ্রেমের কাব্যরচয়িতা হিসাবে, জাতীয়তাবাদের দিকদর্শক হিসাবে। মানবতার পূজারি হিসাবে। ওঁর বাণী দেহত্যাগের বহুদিন পরও ধ্বনিত হবে দেশদেশান্তরে।

অতএব আমার আবেদন ধর্মাবতার, মানুষটি আপনার এজলাসে দাঁড়িয়ে নেই শুধু, দাঁড়িয়ে আছেন ইতিহাসের ন্যায়ালয়ে।’

বিচারকের আসনে ছিলেন Charles Porten Beachcroft, যিনি অরবিন্দের সঙ্গে একই বছরে বিলেতে Indian Civil Service পরীক্ষায় বসেছিলেন। উভয়েই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, মেধাতালিকায় অরবিন্দের স্থান ছিল বিচক্রফ্‌টের আগে। বিচক্রফ্‌ট সাহেব সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনার পর লিখেছিলেন—

I now come to the case of Arabinda Ghose, the most important accused in the case. He is the accused, whom more than any other the prosecution are anxious to have convicted and but for his presence in the dock there is no doubt that the case would have been finished long ago. It is partly for that reason that I have left his case till last of all and partly because the case against him depends to a very great extent, in fact almost entirely, upon association with other accused persons…

The point is whether his writings & speeches, which in themselves seem to advocate nothing more than the regeneration of his country, taken with the facts proved against him in this case are sufficient to show that he was a member of the conspiracy. And taking all the evidence together I am of opinion that it falls short of such proof as would justify me in finding him guilty of so serious a charge.

বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন অরবিন্দ। মুক্তিপ্রাপ্তির নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে গিয়েছিল নরেন গোস্বামীর ঘাতক-যুগলের। কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন বোস, যাঁরা ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছিলেন দশদিনের ব্যবধানে।

সে অবশ্য শারীরিক মৃত্যু মাত্র। আসলে তো ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *