০৮. বংশধর

০৮. বংশধর

ট্রাইটনের সাথে কথাবার্তা হল খুব সংক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলি করতে হল এমনভাবে, যেন হাঁ কিংবা না বলে উত্তর দেয়া যায়। হা হলে বড় বৃত্তটি বড় করবে, না হলে ছোট। এভাবে কথোপকথন করা খুব কষ্ট, কিন্তু তবু ওরা চেষ্টার ত্রুটি করল না। খুব বেশি লাভ হল না, কারণ ট্রাইটন হ্যাঁ কিংবা না কোনো উত্তরই বেশিক্ষণ দিতে চাইল না।

প্রথম প্রশ্ন করল লু জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাদের যেতে দেবে?

না।

তুমি আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে চাও?

কোনো উত্তর নেই।

আমাদের সভ্যতা নিয়ে তোমার কোনো কৌতূহল আছে?

কোনো উত্তর নেই।

তুমি তোমার বংশধরকে পৃথিবীতে পাঠাতে চাও?

হ্যাঁ।

কিন্তু এটা কি সত্যি নয়, যে, আমরা যদি ফিরে না যাই তুমি তোমার বংশধরকে পৃথিবীতে পাঠাতে পারবে না?

কোনো উত্তর নেই।

লু খানিকক্ষণ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাদের মেরে ফেলতে চাও?

কোনো উত্তর নেই।

আমরা কি তোমার বংশধরকে মেরে ফেলব?

না না না—

এরপর হঠাৎ করে ট্রাইটন তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া বন্ধ করে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও কোনো লাভ হল না। কি করা যায় ঠিক করার জন্যে সবাই একত্র হয়েছে লুয়ের ঘরে, ইউরী ছাড়া। সে এখনো নিউট্রিনো জেনারেটর দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে। তার বিশ্বাস, কোনোভাবে যদি তাকে জিটা নিউট্রিনোর সুপার সিমেট্রিক বোজনের ভরের সমস্যাটা বুঝিয়ে দেয়া যায়, সে তার একটা কিছু উত্তর বলে দেবে। মরতে যদি হয়ই সুপার সিমেট্রিক বোজনের ভরের মানটুকু জেনে মরতে দোষ কী?

লুয়ের ঘরটা একটু ছোট, কিন্তু সবাই তবু এখানেই এসে বসেছে। খোলামেলা জায়গায় বসতে আর কেউ নিজেকে নিরাপদ মনে করে না, কোন দিক দিয়ে ট্রাইটনের বংশধর এসে কী করে বসে, কে জানে! দরজার কাছে কিম জিবান বসেছে, হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, তিন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন রশ্মি বের হয় এটা দিয়ে, ছয় ইঞ্চি স্টেনলেস স্টিলের পাতকে ফুটো করে ফেলতে পারে এই রশ্মি, ট্রাইটনের বংশধর থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যে এর থেকে ভালো অস্ত্র আর কী হতে পারে?

দীর্ঘ সময় সবাই চুপ করে বসে থাকে, কী নিয়ে কথা বলবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। লু কয়েকবার কী-একটা বলতে গিয়ে চুপ করে যায়, ব্যাপারটি সবাই লক্ষ করেছে, কিন্তু তবু সাহস করে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। যে কথাটি লু বলতে চাইছে না, সেটি ভালো কিছু হতে পারে না। নীষা শেষ পর্যন্ত সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, তুমি কি কিছু বলবে, লু?

হ্যাঁ, কিতাবে বলব বুঝতে পারছি না।

কেন, কী হয়েছে?

লু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলেই ফেলল, আমি সিসিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তিন ঘন্টা পর সিসিয়ান উড়ে যাবে।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না।

কারো বিশেষ কিছু বলার ছিল না। সুশান একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, এখন তোমার কী করার ইচ্ছে?

তিন ঘন্টা সময় খুব অল্প, আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই সুশান।

ও সুশান এর থেকে বেশি কিছু বলার খুঁজে পেল না।

সিসিয়ানকে ধ্বংস করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। ট্রাইটনের বংশধর নিশ্চয়ই এখন আমাদের একজন একজন করে শেষ করে দেবে, সিসিয়ান তখন ভুতুড়ে একটা উপগ্রহের মতো ঝুলতে থাকবে এখানে। যারা আমাদের উদ্ধার করতে আসবে, তারা জানবে না এখানে কী হয়েছিল, খুব সম্ভব তারা না জেনেই তাদের মহাকাশযানে করে ট্রাইটনের বংশধরকে নিয়ে যাবে পৃথিবীতে। সেটা কিছুতেই ঘটতে দেয়া যায় না।

রু–টেক বলল, সিসিয়ানকে নিয়ে আমরা সবাই যদি ধ্বংস হয়ে যাই, তা হলে যারা পরে আমাদের খোঁজে আসবে, তারা আবার আমাদের অবস্থায় পড়বে না তুমি কেমন করে জান?

আমি জানি না, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। যারা আমাদের খোঁজে আসবে। তারা অন্তত জানবে এখানে রহস্যময় কিছু-একটা ঘটেছে, সিডিসির মতো একটা কম্পিউটার সিসিয়ানের মতো একটা মহাকাশযানকে বাঁচাতে পারে নি, মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এমন কখনো ঘটে নি। কাজেই তারা প্রস্তুত হয়ে আসবে, আমাদের যে-বিপর্যয় হয়েছে, তাদের সেটা হবে না।

লু একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি খুবই দুঃখিত যে, তোমাদের রক্ষা করতে পারলাম না। তোমাদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলি যে একটু আনন্দের ব্যবস্থা করব, আমার এখন তার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই।

শীষা বলল, তুমি শুধু শুধু নিজেকে অপরাধী ভেবো না, আমাদের প্রাণ বাচানোর দায়িত্ব তোমার নয়। আমি আগেই বলেছি, তোমার দায়িত্ব ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। তুমি সেটা নিয়েই। আমি তোমার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সব সময়ে ধন্য মনে করেছি।

কিম জিবান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তাই নিজে থেকে কিছু বলতে চেষ্টা করছি না। তবে নী যেটা বলেছে সেটা পুরোপুরি আমার মনের কথা।

সুশান বলল, আমারও।

রু-টেক বলল, আমি ইচ্ছে করলে অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারি, কিন্তু তার চেষ্টা করব না। কারণ নীষা যেটা বলেছে আমিও একই জিনিস অনুভব করি।

লু একটু অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলল, আমার অপরাধবোধকে কমানোর চেষ্টা করছ বলে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। তোমাদের মতো সহকর্মীর সাথে কাজ করেছি বলেই আমি এত নিশ্চিন্ত মনে মারা যেতে পারব। শেষ সময়টুকু তোমরা কে কী ভাবে কাটাতে চাও জানি না, আমি ঠিক করেছি সেটা ট্রাইটনের বংশধরকে খুঁজে বের করে কাটাব।

কিম জিবান জিজ্ঞেস করল, খুঁজে পেলে কী করবে লু?

মেরে ফেলব।

কিম জিবান শব্দ করে হেসে বলল, তোমার মনের জোর আছে লু।

এখন আর কিছু থেকে লাভ নেই, মনের জোরটাই যদি আরো কিছুক্ষণ টিকিয়ে রাখে।

লু, আমি যদি তোমার সাথে বংশধর নিধনকাজে যোগ দিই, তোমার আপত্তি আছে? ট্রাইটনকে না পেয়ে তার বংশধরের উপরেই মনের ঝালটুকু মিটিয়ে নিই।

না, আমার কোনো আপত্তি নেই। নীষা বলল, আমরা একা একা বসে থেকে কী করব, আমরাও আসি তোমাদের সাথে।

বেশ।

সুশান আস্তে আস্তে বলল, অপেক্ষা করা খুব ভয়ংকর ব্যাপার, বিশেষ করে সেটা যদি শেষ সময়ের জন্যে হয়।

কী ভাবে বংশধরকে খুঁজে বের করা হবে, সেটা নিয়ে এক দুই মিনিট কথা বলে নেয়া হল। সিসিয়ানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে মাত্র দু’টি, কাজেই একসাথে দু’টির বেশি দল যেতে পারবে না। ঠিক করা হল, এক দিকে যাবে কিম জিবান আর সুশান, অন্য দিকে লু আর নীষা। সিডিসি নেই বলে দুই দলে যোগাযোগ রাখা ভারি কঠিন ব্যাপার, রু-টেক তাই কন্ট্রোল রুমে বসে সেই দায়িত্ব পালন করার দায়িত্ব নিল। রু-টেক বংশধরকে খুঁজে বের করতে ওদের থেকে অনেক বেশি কার্যকর হত সন্দেহ নেই, কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে কেউ চুপচাপ বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতে চাইছিল না। রু-টেক রবোট, সে তার ভয়ের সুইচটি বন্ধ করে সানন্দে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে পারে।

প্রস্তুত হতে হতে ওদের আরো কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল। সিসিয়ানের মোট তিনটি স্তর রয়েছে। পল কুমের মৃতদেহ রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে, তাই ঠিক করা হল সেটাই আগে দেখা হবে। পুরো এলাকাটি অনেক বড়, খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি এবং নানা ধরনের জিনিসপত্রে বোঝাই। সিডিসি না থাকায় এই স্তরে আলো নিস্পভ, কোথাও কোথাও একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পলের মৃতদেহ যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে ওরা শুরু করে, লু নীষাকে নিয়ে রওনা দিল সামনের দিকে, কিম জিবান সুশানকে নিয়ে পিছন দিকে। ওদের মাথায় লাগানো উজ্জ্বল আলো, ইচ্ছে করলে জ্বালাতে পারে, আবার ইচ্ছে করলে নিভিয়ে দিতে পারে। কানে ছোট হেডফোনে রু-টেকের মাধ্যমে অন্য দলের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা। আপাতত নীষা আর কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দু’টি নিয়ে হাঁটছে, যেটুকু ওজন হলে অস্ত্রটি সহজে টেনে নেয়া যেত এগুলি তার থেকেও বেশ খানিকটা ভারি, তাই ঠিক করা হয়েছে কিছুক্ষণ পরে পরে হাতবদল করা হবে।

ওরা নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ায়, একজন লাথি দিয়ে আচমকা দরজা খুলে দিয়েই সরে যায়, অন্যজন বিদ্যুৎগতিতে অস্ত্র তাক করে ঘরে ঢুকে পড়ে। মাথায় লাগানো উজ্জ্বল আলোতে ঘরটা ভরে যায়, ওরা তখন লক্ষ করার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে ঘরের ভিতরে কিছু নড়ে গেল কি না, কোনো কিছু সরে গেল কি না। তন্নতন্ন করে ওরা অস্বাভাবিক কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করে। প্রাণীটা দেখতে কেমন, কত বড়, কোনো ধরনের ধারণা নেই, তাই ভালো করে ওরা জানেও না, ঠিক কী খুঁজছে। ভিতরে ভিতরে ওদের একটা অশরীরী আতঙ্ক, প্রতিবার একটা দরজা খুলে ঢোকার আগে ওদের একজনের আরেকজনকে সাহস দিতে হয়, ভিতরে ঢুকে যখন দেখে কিছু নেই, ওরা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

ঘন্টাখানেক কেটে যায় এভাবে, কিছু দেখতে পাবে তার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। এমনিতে ব্যাপারটিতে কষ্টকর কিছু নেই, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে অজানা একটা আতঙ্ক নিয়ে কাজ করা ভারি যন্ত্রণাদায়ক, মানুষ এরকম অবস্থায় খুব তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে যায়। অন্য সময় হলে ওৱা থেমে বিশ্রাম নিত, কিন্তু আজ অন্য ব্যাপার। টিকটি করে ঘড়িতে সময় বয়ে যাচ্ছে, যতক্ষণ তারা এই অমানুষিক কাজে নিজেদের ডুবিয়ে রাখতে পারে, ততক্ষণ ওদের মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করার দুরূহ কাজটি করতে হয় না। তবু হয়তো তারা খানিকক্ষণের জন্যে থামত, কিন্তু হঠাৎ করে তারা বংশধরের সাক্ষাৎ পেয়ে গেল।

সুশান ঘরের দরজাটি লাথি মেরে খুলে সরে যাবার আগের মুহূর্তে বলল, সাবধান।

কিম জিবান থমকে দাঁড়ায়। সামনে তাকিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল, ঘরটির মেঝের অংশবিশেষ কেউ খুব সাবধানে যেন কেটে নিয়েছে। কাটা অংশ দিয়ে নিচের স্তর দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না।

রু-টেকের গলার স্বর শোনা গেল, কী হয়েছে?

এখনো জানি না। ঘরটার জায়গায় জায়গায় কেউ কেটে নিয়েছে, প্রাণীটাই হবে নিশ্চয়ই।

দেখা যাচ্ছে প্রাণীটাকে?

ওরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে খোঁজার চেষ্টা করে প্রাণীটাকে, কিন্তু কোথাও কিছু নেই। কিম জিবান আস্তে আস্তে বলল, এখনো দেখছি না।

কী করবে এখন তুমি?

ভিতরে গিয়ে খুজব।

যে-প্রাণী স্টেনলেস স্টিল আর টাইটেনিয়ামের দেয়াল কেটে নিতে পারে, সেটার সাথে লড়তে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয় কিম।

তা ঠিক, কিন্তু কী করব বল? তুমি বরং লুকেও আসতে বল এদিকে।

বলছি।

কিম জিবান লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শক্ত হাতে অস্ত্রটিকে ধরে ঘরের ভিতরে এক পা ঢোকে, সাথে সাথে সরসর করে কোথায় জানি কি একটা শব্দ হল, মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ বাম দিকে সরে গেছে।

কিম জিল বাম দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবধানে আরো এক পা এগিয়ে যায়। পিছনে পিছনে সুশান এসে ঢোকে, উত্তেজনায় তার বুকের ভিতরে ঢাকের মতো শব্দ হচ্ছে, ফিসফিস করে বলল, কিছু-একটা আছে বাম দিকে।

বাম দিকে সিসিয়ানের দেয়াল, নানা ধরনের পাইপ, বৈদ্যুতিক এবং অপটিকেল তারগুলি ওদিক দিয়ে গিয়েছে। ছোটখাটো একটা যন্ত্রপাতির স্তর রয়েছে ওপাশে, তার পিছনে কিছু-একটা আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে হয়। আবছা অন্ধকার ওখানে, ভালো করে দেখা যায় না। কিম জিবান আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে সাবধানে এগিয়ে যায়, সাথে সাথে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ে সে একপাশে, কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। সাবধানে উঠে দাঁড়ায় কিম জিবান, ঘরে হলুদ রঙের ধোয়া, ঝাঁঝাল গন্ধে ঘর ভরে গেছে, খকখক করে কাশতে থাকে সে। সামনে গোলাকার আরেকটা গর্ত। একটু আগেও সেখানে কিছু ছিল না। পিছনে তাকিয়ে দেখে, সুশান ফ্যাকাসে মুখে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

কী হয়েছে কিম?

জানি না, প্রাণীটা সম্ভবত একপাশ থেকে অন্য পাশে সরে গেল।

তোমাদের কোনো ক্ষতি হয় নি তো?

না।

দেখেছ প্রাণীটাকে?

না, কিম জিবান সুশানের দিকে তাকায়, তুমি দেখেছ?

সুশান ফ্যাকাসে মুখে মাথা নাড়ে, না, লাল মতন কী একটা জানি উপরে উঠে আছড়ে পড়েছে, এত তাড়াতাড়ি হয়েছে যে কিছু বুঝতে পারি নি। একটু থেমে যোগ করল, আমার ভয় লাগছে কিম।

লাগারই কথা। ফিরে যাবে? দরকার কি জীবনের শেষ সময়টা ভয় পেয়ে নষ্ট করার?

রু-টেকের গলা শুনতে পেল আবার, কিম আর সুশান, আমি লুয়ের সাথে কথা বলেছি, সে নীষাকে নিয়ে আসছে তোমাদের দিকে। সে না আসা পর্যন্ত তোমরা নিজে থেকে কিছু কোরো না।

বেশ।

কিম জিবান অস্ত্র হাতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকে, ভয়াবহ একটা আতঙ্ক এসে ভর করেছে ওর উপর।

 

লুয়ের পিছু পিছু নীষা ছুটে আসছিল, হঠাৎ দু’জনেই থমকে দাড়াল, যেখানে কিম আর সুশান রয়েছে তার করিডোরে একটা বড় গর্ত। ওরা একটু আগেই এদিক দিয়ে গিয়েছে, তখন গর্তটা সেখানে ছিল না। হলুদ রঙের একটা ধোঁয়া ভাসছে বাতাসে, ঝাঁঝাল একটা গন্ধ সেখানে। লু থমকে দাঁড়ায়, তারপর রু-টেকের সাথে যোগাযোগ করে রু।

কি হল?

তুমি কিম আর সুশানকে বল, আমাদের আসতে একটু দেরি হবে।

সমস্যা?

হ্যাঁ, করিডোর ধরে আসার উপায় নেই, পুরোটা কেউ উধাও করে দিয়েছে।

ও।

লু নীষাকে নিয়ে অন্যদিকে ছুটে গেল, মনে মনে যে আশঙ্কাটি করছিল সত্যিই তাই ঘটেছে, অন্য পাশেও করিডোরটি উধাও করে দিয়েছে কেউ। চারদিক থেকে কিম আর সুশানকে আলাদা করে ফেলেছে প্রাণীটি, কী করবে এখন ওদের? লু আবার রু-টেকের সাথে যোগাযোগ করে রু।

বল।

কিম আর সুশান ঠিক কোথায় আছে জান?

জানি।

কত ভালো করে জান?

খুব ভালো করে, ওদের শরীরে একটা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বীপার লাগানো আছে, আমি সেটা থেকে বলতে পারি ঠিক কোথায় তারা আছে। তোমরা কোথায় আছ সেটাও জানি—

আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। রু-টেক শোন।

বল।

কিম আর সুশান যেখানে আছে, তার উপরের স্তরে কী আছে?

আর্কাইভ ঘর। প্রয়োজনীয় দলিল।

ঘরটাকে সিসিয়ান থেকে পুরোপুরি আলাদা করা যায়?

শুধু ওটাকে করা যাবে না, কিন্তু পাশাপাশি দুটি ঘরকে একসাথে করা যাবে।

চমৎকার। তুমি ঘর দু’টিকে আলাদা করে, বায়ুশূন্য করে ফেল। আমি আসছি।

লু।

বল।

তুমি কী করতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কাজটা একটু বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে না?

দু’ঘন্টা পর আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব, বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমরা খুব বেশি হলে দু’ঘন্টা সময় হারাব, বুঝতে পেরেছ?

পেরেছি।

 

কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে দাড়িয়ে আছে, তাকে পিছন থেকে খামচে ধরে রেখেছে সুশান। প্রচণ্ড আতঙ্কে সে অনেকটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো হয়ে গেছে। ঘরের কোনায় বড় বড় যন্ত্রপাতি এবং মনিটরগুলির পিছন থেকে অনেকক্ষণ থেকে কেমন জানি একটা অনিয়মিত তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছিল। হঠাৎ করে কী একটা জানি নড়ে যায়, কিন্তু ওরা ঠিক ধরতে পারে না, কী। যে-প্রাণী অবলীলায় শক্ত স্টেনলেস স্টিলের দেয়াল মুহূতে উধাও করে দিতে পারে, তার পক্ষে মানুষকে শেষ করা কঠিন কিছু নয়, কিন্তু প্রাণীটি এখনো তাদের কিছু করছে না। তাদের চারদিক থেকে আলাদা করে এনেছে, এখন কী করবে তাদের?

হঠাৎ সুশান চিৎকার করে ওঠে, ঐ দেখ—

কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে যায়, কোথাও কিছু নেই। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে সুশান?

ভয়-পাওয়া গলায় সুশান মেঝের দিকে দেখায়, ঐ দেখ।

ঘরের কোনা থেকে কী—একটা জিনিস যেন আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে, দুইতিন ইঞ্চি পুরু তরল পদার্থের মতো। উপরে হলুদ ধোঁয়ার আস্তরণ।

কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ঘুরিয়ে সেদিকে ধরতেই, হঠাৎ তরল পদার্থের মতো জিনিসটি যেন থমকে দাঁড়াল, তারপর উত্তপ্ত পানির মতো টগবগ শব্দ করে ফুটতে থাকে, সারা ঘর ঝাঁঝাল গন্ধে ভরে যায় হঠাৎ।

কী ওটা?

জানি না। আরেকটু কাছে এলেই মেগাওয়াটের পার্টিকেল বীম চালিয়ে দেব, শেষ করে দেব শুওরের বাচ্চাকে।

কিমের কথা শুনেই যেন তরল পদার্থের আস্তরণটি শীতল হয়ে গেল, টগবগ করে ফোটা বন্ধ করে সেটি আবার ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। উপরের হলুদ ধোঁয়াটি সরে যেতেই ওরা দেখতে পায়, আস্তরণটির উপরে আশ্চর্য একধরনের নকশা তৈরি হচ্ছে, দেখে কখনো মনে হয় অজস্র সরীসৃপ, কখনো মনে হয় অসংখ্য প্রেত। অস্বস্তিকর একধরনের শব্দ করতে করতে জিনিসটা এগিয়ে আসতে থাকে, চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে তাদের, কী করবে এখন?

কিম জিনিসটার মাঝামাঝি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে, নীলাভ একটা রশ্মি বের হয়ে আসে, সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। ধোঁয়া সরে যেতেই দেখে তরল পদার্থের মধ্যে জিনিসটা প্রচণ্ড শব্দ করে ফুটছে, পার্টিকেল বীম সেটির কোনোরকম ক্ষতি করেছে, তার কোনো চিহ্ন নেই।

কিম, লুয়ের গলা শুনতে পেল, কিম শুনছ?

হ্যাঁ লু, ভয়ানক বিপদে আছি আমরা, কী একটা জিনিস—

কিম, এখন তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই, তুমি আমার কথা শোন।

এগিয়ে আসছে সেটা আমাদের দিকে, আর কয়েক ফুট মাত্র বাকি।

আমার কথা শোন এখন, তুমি তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তের মেগাবাইটে সেট কর, তারপর মাথার উপর তুলে ধর, সোজা উপরের দিকে।

ধরেছি।

আমি বলামাত্রই গুলি করবে। তের মেগাওয়াট পার্টিকেল বীম প্রায় তিন ফুট ব্যাসের একটা গর্ত করে ফেলবে ছাদে। উপরের ঘরটা এখন বায়ুশূন্য, তোমার ঘর থেকে প্রবল বেগে বাতাস উঠে আসবে, শুরু হবে প্রায় ছয় শ’ কিলোমিটার দিয়ে, সেই বাতাস তোমাদের টেনে আনবে উপরে–

কিন্তু–

তোমরা হয়তো মারা যাবে প্রচণ্ড আঘাতে, কিন্তু আমরা সবাই তো মারা যাব কিছুক্ষণের মাঝে। আমি দুঃখিত, কিন্তু আর কিছু করার নেই কিম। হাত উপরে তুলে রাখ কিম আর সুশান—

লু, শোন, তুমি—

শোনার কিছু নেই, গুলি করতে প্রস্তুত হও কিম, এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে কঠিন স্বরে চিৎকার করে বলল, টানো ট্রিগার।

ভয়ানক একটা বিস্ফোরণ হল মাথার উপরে, গোল একটা গর্ত হয়ে গেল মুহূর্তে। প্রচন্ড বাতাসের ঝাপটায় কিম জিবান আর সুশান গুলির মতো উড়ে গেল উপরে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখে, তারা উড়ে যাচ্ছে বাতাসে, দু’হাতে মাথা বাচিয়ে রাখে তারা, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড গতিতে আছড়ে পড়ে সিসিয়ানের দেয়ালে, মুহূর্তে জ্ঞান হারালো দুজনেই।

 

রু-টেক কিম আর সুশানের অচেতন দেই সরিয়ে নেয় সাবধানে, সে বায়ুশুন্য পরিবেশে থাকতে পারে বলে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। মেঝের ফুটো দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বাতাস আসছে, বাতাসের চাপ সমান হওয়ামাত্রই থেমে যাবে। রু–টেক শঙ্কিত দৃষ্টিতে গর্তটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নিচের প্রাণীটি কি উঠে আসবে উপরে? সম্ভবত নয়, ঝুকি নেবে না নিশ্চয়ই।

বাতাসের চাপ সমান হতেই দরজা খুলে যায়, উদ্বিগ্ন মুখে লু আর নীষা অপেক্ষা করছে পাশের ঘরে। রু–টেককে জিজ্ঞেস করল, কি অবস্থা?

ভালো নয়। এখনো বেঁচে আছে দুজনেই। আঘাতটা মাথায় লাগে নি, কাজেই বেচৈ যাবার ভালো সম্ভাবনা ছিল।

ওদের ধরাধরি করে পাশের ঘরে সরিয়ে নিয়ে রু–টেক ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে, ছোটখাটো কয়েকটা ব্যান্ডেজ এদিকে সেদিকে লাগিয়ে দেয় যত্ন করে। ঘন্টাখানেক পরে সবাইকে নিয়ে এই মহাকাশযানটি চিরদিনের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে, তবুও চোখের সামনে আহত দু’জনকে কোনোরকম সাহায্য না করে কেমন করে থাকে? নীষা সিসিয়ানের জরুরি ঘর থেকে দু’টি স্টেনলেস স্টিলের ক্যাপসুল নিয়ে আসে, ওরা তিনজন মিলে যখন কিম আর সুশানকে সাবধানে ভিতরে শুইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছিল, ঠিক তখন কাতর শব্দ করে সুশান চোখ খুলে তাকায়, কয়েক যুহূর্ত লাগে তার বুঝতে, কী হচ্ছে। সবকিছু মনে পড়তেই সে ধড়মড় করে উঠে পড়তে চাইছিল, লু সাবধানে শুইয়ে দেয় আবার, বলে, শুয়ে থাক সুশান।

আমরা কি ফিরে যাচ্ছি?

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সে বলল, হ্যাঁ।

ট্রাইটন আমাদের যেতে দিচ্ছে?

হ্যাঁ।

আমরা তাহলে কেউ মারা যাব না?

না সুশান।

কিন্তু ট্রাইটনের বংশধর–

সেটা নিয়ে কিছু চিন্তা কোরো না, তাকে আমরা রেখে যাচ্ছি।

সত্যি?

সত্যি, তুমি এখন ঘুমাও।

সুশান সাথে সাথে বাধ্য মেয়ের মতো চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাপসুলের যন্ত্রপাতি সুশানের দায়িত্ব নিয়ে নেবে, তখন সে অনির্দিষ্টকালের মতো ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। যদি সত্যি সত্যি সুশান বিশ্বাস করে যে সে এখন পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছে, মন্দ কি? একটা সুখ-স্বপ্ন নিয়ে নাহয় কাটাক জীবনের শেষ সময়টক।

ওরা যখন কিম জিবানের অচেতন শরীরকে ক্যাপসুলের মাঝে শুইয়ে দিচ্ছিল, তখন হঠাৎ ইউরী এসে হাজির হল, তার চোখ-মুখে উত্তেজনার ছাপ, ওদের কাজে কোনোরকম কৌতূহল না দেখিয়ে বলল, ট্রাইটনের রং আস্তে আস্তে গাঢ় লাল রঙের হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল করেছ?

লোকটার উপরে রাগ করবে ভেবেও লু ঠিক রাগ করতে পারে না, একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তাই নাকি?

হ্যাঁ। ভারি মজার ব্যাপার।

মজার কী হল এখানে?

মজার হল না? আমি এখানে বসে তাকে জিজ্ঞেস করি সুপার সিমেট্রিক বোনের ভর, আর সে তার উত্তর না দিয়ে টকটকে লাল হয়ে যায়।

উত্তর হয়তো জানে না, তাই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।

লুয়ের রসিকতাটুকু ইউরী ধরতে পারল না, মাথা নেড়ে বলল, না না, লজ্জা নয়, বাড়তি উত্তাপটুকু বিকিরণ করার জন্যে গায়ের রং ওরকম গাঢ় লাল করেছে।

নীষা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাড়তি উত্তাপ কিসের?

নিউট্রিনো থেকে পাচ্ছে।

লু অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, আমাদের নিউট্রিনো জেনারেটর দিয়ে মেগাওয়াট পাওয়ার বের হয় কিনা তাতে সন্দেহ আছে, আর তুমি বলছ সেটা পুরো টাইটনের ভাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে?

ইউরী একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, না না, তুমি বুঝতে পারছ না, ট্রাইটন তার শরীরে একটা নিউট্রিনো ডিটেকটর তৈরি করেছে, তাই সে আমাদের পাঠানো সিগন্যাল দেখতে পায়। কিন্তু নিউট্রিনোর তো অভাব নেই, শুধুমাত্র সূর্য থেকে যে-পরিমাণ নিউট্রিনো বের হয় সেটার জন্যে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের শরীর দিয়ে সেকেন্ডে কয়েক লিওন করে নিউট্রিনো পার হয়ে যায়। এখানকার কথা ছেড়েই দাও। ট্রাইটনকে আমাদের অল্প কয়টা নিউট্রিনোর সাথে সাথে আরো ট্রিলিওন ট্রিলিওন নিউট্রিনো দেখতে হচ্ছে, ঐসব নিউট্রিনো থেকে যে-তাপ বের হয়, সেটা ট্রাইটনকে গরম করে ফেলতে পারে।

লু অস্বীকার করতে পারে না যে, ব্যাপারটুকু সত্যি হলে নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।

ইউরী হঠাৎ কী-একটা ভেবে বলল, ভারি মজার একটা পরীক্ষা করা যায়। আমি যদি নিউট্রিনোর সংখ্যা কমাতে থাকি, ট্রাইটনাকে তার ডিটেকটরটি আরো সংবেদনশীল করতে হবে, ফলে সে আরো বেশি নিউট্রিনে দেখবে, কাজেই পুরো ট্রাইটন আরো বেশি গরম হয়ে উঠবে। তাপ বিকিরণ করার জন্যে তখন ট্রাইটনকে হতে হবে কুচকুচে কালো।

ইউরী উঠে দাড়িয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, ঘন্টাখানেক সময়ের মাঝে তোমরা দেখবে, ট্রাইটনটি হয়েছে কুচকুচে কালো।

লু একটু ইতস্তত করে বলল, ইউরী, তোমাকে ঠিক কী ভাবে বলব বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হয় বলে দেয়াটাই উচিত, আমি পুরো সিসিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আর ঘন্টাখানেক সময়ের মাঝে আমাদের সবাইকে নিয়ে পুরো সিসিয়ান ধ্বংস হয়ে যাবে।

ইউরীর মুখ দেখে মনে হল সে ঠিক লুয়ের কথা বুঝতে পারছে না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে লুয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সিসিয়ানকে উড়িয়ে দেবে?

হ্যাঁ, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। ট্রাইটনের বংশধরকে কিছুতেই পৃথিবীতে পাঠানো যাবে না। সেটা বন্ধ করার আর কোনো উপায় নেই।

ইউরী ফ্যাকাসে মুখে ফিরে এসে একটা উঁচু মনিটরের উপরে বসে অনেকটা আপন মনে বলল, আমরা সবাই মারা যাব?

আমি দুঃখিত ইউরী।

ইউরী হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, একটা সুপারনোভা৩০ যদি কোনোভাবে তৈরি হত এখন।

কী বললে?

সুপারনোভা। একটা নক্ষত্র যখন সুপারনোভা হয়ে যায়, তখন তার থেকে অচিন্তনীয় নিউট্রিনো বেরিয়ে আসে, হঠাৎ করে যদি অসংখ্য নিউট্রিনো এসে হাজির হয়, তখন ট্রাইটনে যে-তাপের সৃষ্টি হবে, তাতে সে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।

কিন্তু এক শ’ বছরে হয়তো একটা সুপারনোভার জন্ম হয়, আমাদের হাতে সময় এখন এক ঘন্টা।

একটা পালসারও যদি থাকত আশেপাশে।

লু চমকে উঠে বলল, কী বললে তুমি? পালসার?

হ্যাঁ, পালসার। চতুর্থ মাত্রার পালসারে যখন নির্দিষ্ট সময় পরে পরে বিস্ফোরণ হয়, তখনও অসংখ্য নিউট্রিনো বেরিয়ে আসে। সুপারনোভার মতো এত বেশি নয়, কিন্তু অনেক, ট্রাইটনকে শেষ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট!

লু ইউরীর দিকে ঘুরে বলল, তুমি সত্যি বলছ?

ইউরী একটু অবাক হয়ে বলল, সত্যি না বলার কী আছে?

আমাদের খুব কাছাকাছি একটা পালসার আছে, ছয় ঘন্টা পরপর বিস্ফোরণ হয়, আমি এই পালসারটা দিয়ে আমাদের অবস্থান ঠিক করেছি।

কত দূর এখান থেকে?

বিলিয়ন কিলোমিটারের মতো।

ইউরী লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, মাত্র বিলিয়ন কিলোমিটার? আমাকে আগে বল নি কেন? কোন মাত্রার?

জানি না।

গামা রেডিয়েশানে স্পেকট্রামটা বলতে পারবে?

লু দু’এক কথায় বুঝিয়ে দিতেই ইউরী চিৎকার করে ওঠে, চতুর্থ মাত্রা! চতুর্থ। মাত্রা! আর কোনো ভয় নেই।

নীষা আস্তে আস্তে বলল, তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর যে, ট্রাইটনকে তুমি ধ্বংস করে দিতে পারবে?

অবশ্যি! নিজের হাতে সশব্দে থাবা দিয়ে ইউরী বলল, শুধু আমাকে কয়েক মিনিট সময় দাও।

রু–টেক দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, এবার ঘুরে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দুঃখিত ইউরী, কিন্তু আমাদের হাতে এখন কয়েক মিনিট সময়ও নেই।

কেন?

পাশের ঘরে ট্রাইটনের বংশধর চলে এসেছে, আমাদের এক্ষুণি সরে যেতে হবে।

সরে কোথায় যাব?

আমি ঠিক জানি না।

তুমি বুঝলে কেমন করে, প্রাণীটা এসেছে? প্রচণ্ড রেডিয়েশান হয়। কেন?

মনে হয় তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্যে কোনো একটা তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করে।

আর এই প্রাণীটাকে তোমরা উন্নত বলে দাবি কর? কত বড় নির্বোধ হলে একটা প্রাণী রেডিও একটিভিটি দিয়ে তাপমাত্রা ঠিক করে—

রু-টেক বাধা দিয়ে বলল, আমাদের এক্ষুণি সরে যেতে হবে, প্রাণীটা খুব কাছে চলে এসেছে।

ইউরী ব্যস্ত হয়ে বলল, কিন্তু আমার একটু সময় দরকার যতক্ষণ পর্যন্ত পালসারটাতে আবার বিস্ফোরণ না হচ্ছে, আমার ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগ রেখে যেতে হবে।

লু ঘরে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, সবাই স্পেসস্যুট পরে নাও, খুঁটিনাটি ব্যাপারের দরকার নেই, শুধুমাত্র বায়ুনিরোধক অংশটা ঠিক থাকলেই হল, তোমাদের ত্রিশ সেকেন্তু সময় দেয়া হল।

ইউরী মাথা নেড়ে বলল, আমি কখনো স্পেসস্যুট পরি নি, কী ভাবে পরতে হয় আমি জানি না।

লু নীষার দিকে তাকিয়ে বলল, নীষা, তুমি একটু ওকে সাহায্য কর। রু–টেক, তোমার তো কোনো স্পেসস্যুট পরতে হবে না, তুমি কিম জিবান আর সুশানের ক্যাপসুল দু’টি দেখ, সব ঠিক আছে কি না।

পুরো দলটা প্রস্তুত হতে হতে হঠাৎ করে দরজার একটা অংশ ধ্বসে পড়ল, হলুদ রংয়ের একটা ধোঁয়া বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকে। ওরা সবিস্ময়ে দেখে, মেঝের উপর দিয়ে তরল পদার্থের মধ্যে কী—একটা জিনিস এগিয়ে আসছে। ওরা ঘুরে তাকাতেই সেটি থমকে দাড়াল, তারপর হঠাৎ ফুটন্ত পানির মতো শব্দ করতে থাকে। জিনিসটির পৃষ্ঠে আশ্চর্য নকশা খেলা করছে।

ইউরী ভয় পাওয়া গলায় বলল, পালাও, সবাই পালাও—

লু শান্ত স্বরে বলল, যে যেখানে আছ দাঁড়িয়ে থাক, খবরদার নড়বে না।

তা হলে পালাব কেমন করে?

আমি ব্যবস্থা করছি। গুলি করে আমি পিছনের দেয়ালটা ধ্বসিয়ে দিচ্ছি, বাতাসের চাপে ছিটকে বেরিয়ে যাবে সবাই।

কিন্তু–

আর কোনো প্রশ্ন নয় এখন। ইউরী, নিউট্রিনো জেনারেটরটি ছেড়াে না হাত থেকে—

সবাই ঘূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকে। লু আস্তে আস্তে ঘুরে পিছনের দেয়ালের কন্ট্রোল – বক্সের দিকে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি উদ্যত করে। এই বাক্সটির ভিতরে বড় দরজাটি বন্ধ করার যন্ত্রপাতি, উড়িয়ে দিলে পুরো দেয়ালটি উড়ে যাবার কথা। লু সবাইকে একনজর দেখে ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচও একটা শব্দ হল, পরমুহূর্তে ওরা সবাই ঘরের সব জিনিসপত্রসহ ছিটকে পড়ে মহাশূন্যে।