০৫. পৌষ ফুরোনোর আগে

০৫.

পৌষ ফুরোনোর আগেই এবার ঝুপ করে কমে গেল শীতটা। প্রায়দিনই এখন মেঘ করে থাকে, বৃষ্টিও হচ্ছে ঘন ঘন। মুষলধারে কিছু নয়, ঝিরঝির ঝিরঝির। সৃষ্টিছাড়া এই মেঘের পল্টন কোত্থেকে যে এল! লাভের মধ্যে লাভ বোজ বাজারে সবজিঅলারা শাসাচ্ছে এরকম চললে ফুলকপি বাঁধাকপির দর নাকি বেড়ে যাবে চার গুণ। ঘরে ঘরে অসুখ-বিসুখও বেড়েছে হঠাৎ। একটু ভিজলেই সর্দি কাশি জ্বর।

তাতাইয়েরও কাল থেকে অল্প অল্প গলা ব্যথা। গ্ল্যান্ড ফুলেছে। রাত্রে শুধু দুধরুটি খেল আজ। অন্য সময়ে অদিতিকে কতবার বলতে হয়, আজ খেয়ে উঠেই বাধ্য ছেলের মতো গলায় মাফলার পেঁচিয়েছে তাতাই। অদিতির শাল গায়ে জড়িয়ে টিভি খুলে বসেছে।

টেনিস চলছে টিভিতে। কোন এক টুনামেন্টের সেমিফাইনাল। আন্দ্রে আগাশি আর মাইকেল চ্যাং। এ কোর্ট ও কোর্ট, ও কোর্ট এ কোর্ট, র‍্যালি চলছে জোর।

তাতাই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছুড়ল শূন্যে— কামঅন্ আগাশি, কিল হিম।

হাঁটু ঝোলা জিনসের ওপর মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি চড়িয়ে ভাইয়ের পাশে এসে বসল পাপাই। রঙিন পর্দায় চোখ রেখে বলল,—কী স্কোর চলছে রে?

হলদেটে টেনিস বলের সঙ্গে চোখের মণি ঘুরে চলেছে তাতাইয়ের। ঘুরন্ত চোখেই বলল,— যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আগাশি ইজ উইনিং। ফার্স্ট সেট পেয়ে গেছে।

—ও তো হেরে যাবে। পাপাই সেন্টার টেবিলে পা তুলে দিল।

—কেন?

—অত প্লেবয়গিরি করে টেনিস খেলা হয় না। টেনিসে অনেক মেন্টাল ডিসিপ্লিন লাগে।

—তুই আগাশির র‍্যাঙ্কিং জানিস! কোথায় আগাশি, কোথায় চ্যাং!

—র‍্যাঙ্কিং দিয়ে সব হয় না। চ্যাং-এর টেনাসিটি অনেক বেশি। চাইনিজ অরিজিন আছে তো …

তাতাই ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়েছে,— আগাশি জিতবে না বলছিস?

—নো চান্স। চ্যাং-এর দম অনেক বেশি। স্পিডও বেশি।

পাপাই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিপ্র চিতাবাঘের মতো কোর্টের শেষ প্রান্ত থেকে নেটে ছুটে এসেছে চ্যাং। দুরন্ত একটা স্ম্যাশ করল লাফিয়ে। চোয়াল শক্ত করে র‍্যাকেট মাথার ওপর তুলে ঝাঁকাচ্ছে। দর্শকদের চিৎকার আর হাততালিতে কানে তালা লাগার জোগাড়। গমগম শব্দ বেজে উঠল। গেম টু চ্যাং।

তাতাই গুম্।

পাপাই নির্বিকার স্বরে বলল,— এই শুরু হয়ে গেল। এবার দ্যাখ…

এবার স্থির চোখে দাদাকে দেখছে তাতাই। চোখ ছোট করে বলল,— তুই কি আমাকে রাগাতে চাইছিস?

—নাআ। যা ফ্যাক্ট তাই বলছি।

তাতাই আরও কয়েক সেকেন্ড দেখল দাদাকে। হঠাৎই তার মুখমণ্ডল ভরে গেছে অপার্থিব হাসিতে। বলল,— আমি আজ রাগব না রে দাদা। চেঁচাতে গেলে ভীষণ কাশি আসছে।

সুপ্রতিম হেসে ফেলল। দাঁত মাজতে মাজতে এতক্ষণ বেসিনের আয়নায় সে দেখছিল ছেলেদের। রাতে দাঁত মাজা তার দীর্ঘকালের অভ্যাস, খেয়ে উঠে দাঁতে একবার ব্রাশ না চালালে কেমন অপবিত্র অপবিত্র লাগে নিজেকে। বেশ কয়েকবার কুলকুচি করেও তৃপ্তি হচ্ছিল না সুপ্রতিমের, দাঁতের গোড়ায় জিভ চালাচ্ছে।

গলা উঁচিয়ে সুপ্রতিম ডাকল,— অ্যাই শুনছ?

রান্নাঘরের সিঙ্কে বাসন নামাচ্ছিল অদিতি। সেখান থেকেই সাড়া দিয়েছে,— কী?

—এদিকে শোনে না।

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এল অদিতি,— হল কী?

—একটা কাঠি দাও তো দেখি। দাঁতের ফাঁকে কইমাছের কাঁটা ফুটে গেছে।

—নিজের দেশলাই থেকে নিয়ে নাও না।

—আমার মোম দেশলাই। ও দিয়ে খোঁচানো যায় না।

বেজার মুখে রান্নাঘর থেকে গুনে গুনে দুটো কাঠি এনে দিল অদিতি। সুপ্রতিম দাঁত খোঁচাচ্ছে। হালকা উদ্বেগ নিয়ে দেখছে অদিতি,— বেরোল?

—বেরোবে। দাঁতের গোড়ায় আবার জিভ বোলাল সুপ্রতিম,— তোমার কাজকর্ম হল? কী পড়বে বলছিলে, পড়বে না?

অদিতির বুকটা ধক করে উঠল। ছোট্ট নিশ্বাস নিয়ে দমন করল ভেতরের উত্তেজনাটাকে। সুপ্রতিভ থাকার চেষ্টা করে বলল,— হ্যাঁ, পড়ব তো। রান্নাঘরটা একটু গুছিয়ে আসি।

—তাড়াতাড়ি করো। আজ একটু আর্লি শুয়ে পড়ব। কাল সাড়ে সাতটার মধ্যে বেরোতে হবে।

—একটু বসে টিভি দ্যাখো না, আমি এক্ষুনি আসছি।

রান্নাঘরে এসে অবশ্য কাজে হাত দিল না অদিতি, চুপটি করে দাঁড়িয়েই রইল। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনিটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। স্কুলে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগে যেমনটি হত, ঠিক সেই অনুভূতি। লজ্জাও লাগছে খুব। অদিতি কি সেই জোড়াবিনুনি বাঁধা কিশোরী হয়ে গেল! পড়বে গল্পটা? হাসবে না তো সবাই?

হেমেনমামা চলে যাওয়ার পরদিনই কাগজ-কলম নিয়ে বসেছিল অদিতি। নিরালা দুপুরে। উফ, সে কী কষ্ট। মাথার ভেতর ভেঁজে নিয়েছে গল্পটাকে, কিন্তু কিছুতেই শুরু আর হয় না। যেভাবেই আরম্ভ করে সেটাকেই যেন বেঠিক মনে হয়। এক লাইন লেখে, কেটে দেয়। আবার লেখে, আবার কেটে দেয়। আপ্রাণ জেদে যদি প্রথম দুটো বাক্য লেখা গেল, তৃতীয় বাক্যটি আর কোত্থাও নেই। ঘরে, ড্রয়িং স্পেসে, রান্নাঘরে, খাবার জায়গায়, ব্যালকনিতে, বাথরুমে, মস্তিষ্কে, কোথাও নেই। কত চুল ছিঁড়ল অদিতি, কাগজ ছিঁড়ল, ব্রহ্মতালু জ্বলতে লাগল রাগে, তবু কলমে এল না বাক্য। প্রতিদিন যে দুপুরটা কচ্ছপের পিঠ হয়ে মড়ার মতো চোখের সামনে পড়ে থাকে, সেটা যেন কোন জাদুতে অলিম্পিকের দৌড়বীর হয়ে গেল! মাঝখান থেকে হলটা কী? মলিনার মা এসে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! এ কী করেছ গো বউদি! ঘরময় এত কাগজ ছিঁড়েছ কেন! কচি ছেলের মতো।

তারপর আর বসাই হয় না, বসাই হয় না। পরের দিনই সকালে ছোট ননদ এল বাড়িতে। তার দুই মেয়ের দুটিই কনভেন্টের ছাত্রী, স্কুলে সদ্য ক্রিসমাসের দুটি পড়েছে তাদের, বড়মামার বাড়ি ডে-স্পেন্ট করবে তারা। করলও বটে। সারা দুপুর ধরে হইহল্লা, সারা বিকেল লাফালাফি। গেল যখন, অদিতির তখন সব শক্তি নিঃশেষ, পরদিনও আর শরীর চলল না। তারপর তো ছুটিছাটার মরশুমই এসে গেল বাড়িতে। বড়দিন, একত্রিশে ডিসেম্বর, নিউ ইয়ার্স ডে। এ সময়ে বাপ-ছেলেদের জিভটাও চাগিয়ে ওঠে। দুপুরে বাড়ি থাকুক না থাকুক, ছেলেদের হুকুম চলছে অবিরাম। আজ বলে চকোলেট কেক বানাও, কাল বলে ফ্রুট কেক বানাও। কোনওদিন বিরিয়ানি চাই, তো কোনওদিন নবরতন পোলাও। সবই দোকান থেকে আনা যায়, তবে অদিতির হাতে না হলে কারও মন ওঠে না। এরই মধ্যে একদিন প্রেম জাগ্রত হল সুপ্রতিমের, নববর্ষের থিকথিকে ভিড়ে বউকে নিয়ে ঘুরে এল ডায়মন্ডহারবার। কী উচ্ছাস! আহ্, শীতের গঙ্গাটা কী ফাইন! জলে রোদুর পড়ে রঙটা কী লাগছে দ্যাখো, ঠিক যেন আমাদের বডি ম্যাসাজ অয়েল! ইস, এই গঙ্গার মতো যদি প্রোডাকশান দিতে পারতাম আমরা…!

তা এ-সব তো থাকবেই। সংসারধর্ম বলে কথা! সব কিছু কাটিয়ে-কুটিয়ে আবার একদিন বসল অদিতি। নিরালা দুপুরে। লেখে, কাটে, ছেঁড়ে, লেখে, শামুকের গতিতে এগোয় লেখা। বাপস্, এ কি সহজ কাজ। এ যে সৃষ্টি। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের সংগম ঘটিয়ে জন্ম দেওয়া। সন্তান গর্ভে ধরার মতো ধারণ করো চরিত্রদের, হৃদয় মন বুদ্ধি দিয়ে রক্তমাংসে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করো, ভাষার কারুকাজে বাঁধ তাদের— এ এক শরীর নিংডানো সাধনা। দীর্ঘ অনভ্যাসে যা আরও বেশি দুরূহ। শব্দের পর সঠিক শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না, বাক্যের গঠন মনোমতো হয় না সহজে। দু পাতা লেখার পর গোঁয়ার ছেলের মতো গল্প ছছাটে অন্য দিকে, তখন ভুলিয়ে ভালিয়ে ফিরিয়ে আনো তাকে, সাজিয়ে গুছিয়ে বসাও কাগজে। একদিন তো অদিতি ফাঁকা ফ্ল্যাটে পা ছড়িয়ে কাঁদতেই বসে গেল। নিজেদের নিয়ে গল্প বানানোও এত কঠিন! কী কুক্ষণে যে হেমেনমামাকে কথা দিল অদিতি!

তা লেখা শেষ অবধি বেরোল একটা। বর্ণনায় সংলাপে সেজেগুজে। এবার এটা শোনানো যায় কাকে? লজ্জার মাথা খেয়ে অদিতি স্বামী ছেলেদেরই ধরল শেষমেশ। শুনবে?

মাইকেল চ্যাং সেকেন্ড সেট জিতে গেছে। তৃতীয় সেটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে দুই খেলোয়াড়ের। টুং। টাং। টুং। টাং। টাক্। অদিতির ফ্ল্যাটময় প্রতিধ্বনিত হল স্কোয়ারের স্বর। ফিফ্টিন লাভ।

অদিতি ফুলস্কেপ কাগজের গোছাটা নিয়ে সোফায় এসে বসল। নিপুণ অভিনেত্রীর মতো মনের ভাব ফুটতে দিচ্ছে না মুখে। একবার সুপ্রতিমকে দেখল, একবার পাপাইকে, একবার তাতাইকে। সামান্য গলা ঝেড়ে বলল,— পড়ব?

—না পড়ে কি ছাড়বে? হা হা করে প্রশ্রয়ের হাসি হাসল সুপ্রতিম,— পড়ো। পড়েই ফ্যালো।

অদিতি লেখাটা খুলতে যাচ্ছিল, তাতাই বলে উঠল,— এক সেকেন্ড মা। এই গেমটা শেষ হয়ে যাক।

—দেখে নে। অদিতি ওপর ওপর চোখ বোলাচ্ছে প্রথম পাতাটাতে, একবার শুনে দেখে নিল সব পাতা,— বেশি নয়, সওয়া দশ পাতা।

গেমটা ডিউসে চলে গেল। দুই পক্ষ সমান সমান। একবার আগাশির দিকে ঢলে পড়ে, একবার চ্যাং-এর দিকে। অ্যাডভানটেজ আগাশি। … ডিউস। অ্যাডভানটেজ চ্যাং। … ডিউস। অ্যাডভানটেজ … অ্যাডভানটেজ … অ্যাডভানটেজ …।

চলছে … চলছে … চলছে। এ যেন অদিতির বিজন দুপুর, শেষ আর হয় না।

সুপ্রতিম আড়চোখে দেখে নিল অদিতিকে। নিঃশব্দে হাসছে।

—গেম তো মনে হচ্ছে শেষ হবে না রে।

—এক্ষুনি হয়ে যাবে, তুমি দ্যাখো না।

—অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে রে তাতাই, আমাকে শুতে হবে।

—বাবা প্লিজ …

আগাশির সার্ভিস গেম ছিনিয়ে নিল চ্যাং। বিপুল করতালি। পাপাই টুক করে উঠে টিভি বন্ধ করে দিল,— পড়ো তো মা। সুপ্রতিম কোলে অ্যাশট্রে টেনে সোফায় হেলান দিল। সিগারেট ধরিয়েছে। বলল,— তোমার হেমেনমামা তা হলে তোমাকে লিখিয়েই ছাড়লেন, কি বলো?

—হ্যাঁ, এমন করে হেমেনমামা বলতে লাগল …

—কথা তা হলে ভদ্রলোক ভালই বলেন? তোমাকে কনভিন্স করে ফেলেছেন? তোমাকে বোঝাতে বেচারা সেলস গার্লগুলোর ঘণ্টা কাবার হয়ে যায়!

—যাহ্, আমি তো ওদের সঙ্গে এমনিই গল্প করি। অদিতির লেখাতেই চোখ এখনও। তুলল চোখ,— হেমেনমামা কী সুন্দর কথা বলে পাপাই জানে। এই পাপাই, বল না।

—বিগ বোর। পাপাইয়ের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য।

—সে কী রে! তুই সেদিন অতক্ষণ ধরে … হেমেনমামা বলল তুই নাকি খুব গল্প করছিলি!

—করছিলাম কোথায়? শুনছিলাম। শুধু সাহিত্য নিয়ে ভ্যাজারং ভ্যাজারং! যেন আর কিছু নেই দুনিয়ায়!

—ও। সেকেন্ডের লক্ষ ভগ্নাংশ সময়ে পাপাইয়ের সেদিনের মুখটা মনে পড়ল অদিতির। কী ভালোমানুষের মতো বসেছিল হেমেনমামার সামনে! মনের ভাব লুকোতে এত দক্ষ হয়ে গেছে পাপাই! একটু ক্ষু্ণ্ণ স্বরে অদিতি বলল,— যে যা নিয়ে থাকতে ভালবাসে।

তাতাই অধৈর্য মুখে বলল,— তোমরা কি শুধু বকবক করবে? তা হলে আমি টিভিটা চালিয়ে দিই।

—আহ্ তাতাই। কোমল ধমক দিয়ে সুপ্রতিম তাকাল অদিতির দিকে। মোটর রেস স্টার্ট করার ভঙ্গিতে হাতের চেটো দোলালো,— শুরু করো। চালাও।

অদিতি ঈষৎ ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিল। গুজরাতি চাদর সাপটে নিয়ে আবার গুছিয়ে বসেছে। সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল,— পড়ি তবে। গল্পটার নাম ফাটল।

—অ্যাহ্, নামটা ভাল হয়নি। সুপ্রতিম চোখ বুজে টান দিচ্ছে সিগারেটে,— অন্য নাম দাও।

—আহা গল্পটা তো শোনো আগে। দেখবে নামটা গল্পের সঙ্গে খাপ খেয়ে গেছে।

—কী নাম বললে? ফাটোল্‌। ফাআটোল্? ছুঁচোল ঠোঁটে তাতাই উচ্চারণ করছে শব্দটা,— তুমি কি আঁতু গল্প লিখেছ নাকি মা?

—আরে না না, শোন না। ঘরোয়া গল্প।

এবার সত্যি সত্যি পড়তে শুরু করেছে অদিতি। পড়ছে। দুই ভাই বোনের গল্প। দাদার বড় অভাবের সংসার। তার মধ্যে আরও বিপদ, কলতলায় পিছলে পড়ে মাথা ফেটেছে দাদার। অনেকটা পথ উজিয়ে বোন দেখতে গেছে দাদাকে। বহুকাল পর। বোনের অবস্থা বেশ ভাল। বর ডাক্তার, ভাল পশার তার। দাদার বাড়িতে পৌঁছে বোনের হঠাৎ খেয়াল হল, হাতে করে একট ফল মিষ্টি আনা হল না তো? এমনই লৌকিকতার সম্পর্ক এখন দাদার সঙ্গে …

টেলিফোন বাজছে।

মুহূর্তে বাজপাখির মতো উড়ে গেছে পাপাই। ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিল। মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে বলল,— এক মিনিট মা।

অদিতি হোঁচট খেয়েও হাসল। আলগা মুড়ল গল্পটাকে। ঠিক এই সময়ে প্রায়দিনই পাপাইয়ের ফোন আসছে। একটা মেয়ের ফোন। অদিতি ধরলে মেয়েটা কাঁপা কাঁপা গলায় পাপাইকে ডেকে দিতে বলে, সুপ্রতিম ধরলে কট করে কেটে দেয় লাইন। কলেজের সহপাঠিনী হলে তো এমনটি হওয়ার কথা নয়! পাপাইও চাতকের মতো ফোনের কাছে ঘুরে বেড়ায় এই সময়ে।

ভুরু কপালে তুলে তাতাই প্রশ্ন করল,— আমরা কি দাদার জন্য অপেক্ষা করব?

অদিতি চোখে হাসল,— দাঁড়া, কথা বলে নিক।

—হুঁহ্, দাঁড়িয়েই থাকতে হবে তা হলে।

—ছটফট করছিস কেন? দু-চার মিনিট দ্যাখ।

তাতাই অস্থির মুখে হাতে হাত ঘষছে। ঘাড় উঁচু করে ফোলা গ্ল্যান্ডে আঙুল বোলালো,— চট করে একবার স্কোরটা জেনে নেব? বলেই কারও অনুমতির অপেক্ষা না করে দৌড়ে টিভিটা চালিয়ে দিল। ঝুঁকে পড়ে দেখছে খেলা।

পাপাই নিবিষ্ট মনে কথা বলে চলেছে। অত্যন্ত নিচু স্বরে, এত নিচু যে ঠোঁট নড়া ছাড়া আর কিছুই বোঝা যায় না। ভাবলেশহীন মুখে হঠাৎ হঠাৎ হাসি ফুটে উঠছে পাপাইয়ের। মুছে গিয়েও মুছছে না হাসি, ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট।

সুপ্রতিম আস্তে করে ঠেলল অদিতিকে। চোখের ইশারায় দেখাল পাপাইকে।

অদিতিও চোখে ইঙ্গিত করল, চুপ। তারপর গলা ঝেড়ে বলল,— কেমন লাগছে গল্পটা?

—এখন কি বলা যায়? দেখি, কেমন ভাবে খেলাও।

—না মানে, আরম্ভটা কেমন লাগল?

—মন্দ কি। ভাই … বোন … বেশ একটা ফ্যামিলি ড্রামা আছে। টেনশন ফেনশান রেখেছ তো?

—শেষ অবধি শোনোই না।

সুপ্রতিম সেন্টার টেবিলে পড়ে থাকা খবরের কাগজ তুলে নিয়ে শেয়ারের পাতায় চলে গেছে। চশমা নেই, চোখের একদম কাছে নিয়ে দেখছে কাগজটা। অদিতি হাতে পেন নিয়ে বসেছিল, তার কাছ থেকে পেনটা নিল দাগ দিচ্ছে। ভুরুতে ভাঁজ।

আগাশি থার্ড সেট জিতে নিল। গোটা কোর্ট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাতাইয়ের চোখের মণি খুশিতে উজ্জ্বল। বুড়ো আঙুল দেখাল দাদাকে।

অদিতি অন্তরের উৎসাহটিকে নিবতে দিল না। একটু ঢোক গিলে পাপাইকে ডাকল,—কীরে, তোর হল?

পাপাই হাত তুলল,— এক মিনিট।

সুপ্রতিম হাই তুলে কাগজ রেখে দিল,— তুমি পড়ে ফেলল তো। আমার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।

—পাপাই তা হলে শুনবে না?

—পরে শুনে নেবেখন। নয়তো তোমার মামার কাগজ থেকে পড়ে নেবে।

—ভাল না হলে হেমেনমামা ছাপবে কেন?

—ছাপবেন না মানে? তোমাকে দিয়ে লেখালেন? না না, ঠিক ছেপে দেবেন। নাও, শুরু করে দাও। জলদি জলদি। বললাম না আমাকে কাল সকাল সকাল উঠতে হবে?

তাতাই করুণ মুখে অদিতিকে বলল,— মা, সাউন্ড অফ করে টিভিটা চালিয়ে রাখলে তোমার পড়তে অসুবিধে হবে?

—কেন, তোর বুঝি শুনতে ভাল লাগছে না?

—শুনছি তো। শুনব। চোখ দেখবে, কান শুনবে। দুটো দু কাজের জন্য তৈরি, দুটোকেই সেপারেটলি ফাংশন করানো উচিত। বিশ্বাস না হয়, শেষ করে ধোরো আমাকে। পুরোটা গড়গড় করে বলে দেব।

তাতাই টিভির শব্দ বন্ধ করে এল।

খেলার মূকাভিনয় চলছে পর্দায়। অদিতি গল্প পড়ছে। টেলিফোন কানে দাঁড়িয়ে আছে এক মুগ্ধ শ্রোতা ও কথক। অদিতি পড়ে চলেছে। ধোঁয়ার বৃত্ত তৈরি করছে সুপ্রতিম। তাতাইয়ের চোখ টিভি-তে মগ্ন। অদিতি পড়ছে। দুই ভাই-বোনের ভালবাসার গল্প। দুই ভাই-বোনের ভালবাসায় ভাঙন ধরার গল্প। স্বার্থ এসে প্রিয় মানুষকে অচেনা করে দিল। আত্মসুখ পর করল পরস্পরকে। সন্দেহ পাঁচিল তুলে দাঁড়াল। তবু কি কিছু রইল না …?

শেষের দিকে এসে অদিতির গলা ধরে আসছিল। উত্তেজনা আর আবেগের এক গাঢ় মিশ্রণে ডুবে যাচ্ছিল সে। যেন তার সামনে অমনোযোগী শ্রোতারা নেই, রঙিন টিভিতে কোনও মরণপণ যুদ্ধ নেই, কেউ শুনছে কি শুনছে না তার পরোয়াও নেই অদিতির।

সে শুধু পড়ছিল।

পাঠ সমাপ্ত। নিজের অজান্তে ভেজা চোখের পাতা মুছে নিল অদিতি। ভারী গলায় বলল,— শেষ।

.

০৬.

অনেকক্ষণ ধরে চিৎকার করে ডেকে চলেছে পাখিটা। রোজই চেঁচায় আজকাল এই দুপুরবেলায়। অদিতি কাগজ-কলম নিয়ে বসলেই এই এক ঢঙ শুরু করে টিয়া, গলা ফাটিয়ে ডাকাডাকি।

এমনিতে টিয়ার ইদানীং বেশ উন্নতি হয়েছে। হাবে ভাবে চালচলনে মাত্রাছাড়া বুনো স্বভাব কমে এসেছে অনেক। মুখে বুলি ফোটেনি, কিন্তু বাড়ির মানুষদের চিনে গেছে মোটামুটি। সুপ্রতিম কাছে গেলে যেন কিছুই দেখছে না এমন একটা অন্যমনস্ক চোখে লক্ষ করে সুপ্রতিমকে। পাপাই তাতাইকে সামনে দেখলে খানিকটা আত্মরক্ষামূলক আচরণ শুরু করে দেয়, কখনও তাদের মন পাওয়ার জন্য খাঁচাময় ঘুরে ঘুরে নানান কসরত দেখায়। জিমন্যাস্টিক ট্রাপিজ, ব্যাক-ভল্‌ট। তবে সব থেকে বেশি বুঝি টিয়া অদিতিকেই চিনেছে। অদিতি ছোলা দিতে গেলে আর ক্যাঁ ক্যাঁ করে তেড়ে আসে না, বরং ভারী শান্ত বুঝদার এক ভঙ্গি করে, কখনও বা দাঁড় বেয়ে টুক টুক এগোয় অদিতির দিকে। শুধু এই দুপুরবেলাতেই কেন যে পাখিটা এত জংলি হয়ে যায়!

চৈত্র মাস পড়ে গেছে। রোদ্দুরের তাতও বেড়েছে খুব। ভরদুপুরে ব্যালকনিতে এলে ঝাঁ করে গায়ে হল্‌কা লাগে, যেন অতিকায় এক তোলা উনুন প্রকৃতিময় আঁচ ছড়াচ্ছে। এ বছর এখনও কালবৈশাখী আসেনি, এলে হয়ত তাপ একটু কমত।

অদিতি কলম বন্ধ করে ব্যালকনিতে এল।

ছোট ছোট ঘূর্ণি উঠছে বাতাসে, তিনতলার ব্যালকনিও ভরে গেছে ধুলোয়, মোজাইক মেঝেতে পাউডারের মতো ধুলোর আস্তরণ। কোথ্থেকে এক টুকরো সেলোফেন হাওয়ার তাড়া খেয়ে গ্রিল দিয়ে ঢুকে পড়ল। ভাসছে।

ভাসমান সেলোফেনটা খপ্ করে মুঠোয় চেপে খাঁচার সামনে দাঁড়াল অদিতি। টিয়ার দিকে ঝুঁকে বলল, —কী রে, চেঁচাস কেন? গরম লাগে?

অদিতির দর্শন পাওয়া মাত্রই টিয়া চুপ। পিট পিট তাকাচ্ছে।

—তোমার মতলব আমি বুঝেছি। সারাটি দুপুর তোমার সামনে আমাকে সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, তাই তো?

টিয়া লাজুক মুখে ঘাড় নামাল।

—ওটি হচ্ছে না বাপধন। আমার হাতে এখন অনেক কাজ। গল্পটা শেষ করতেই হবে। কাল বাদে পরশু সাহিত্যসভায় নিয়ে যাবে হেমেনমামা। লেখাটা না হলে বুড়োর কাছে কে বকুনি খাবে, তুমি?

গলা দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল টিয়া। কঁক কঁক।

—বায়না করে লাভ নেই। তোমার সঙ্গে মোটেই এখন কথা বলব না।

—কঁক কঁক।

—চোপ্। একদম স্পিকটি নট্। বলেই সেলোফেনটা গ্রিলের বাইরে ছুড়ে দিল অদিতি। ঘরে ফিরতে গিয়েও দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। হাওয়ায় উড়ছে সেলোফেন, মাটিতে পড়ছে না, ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে বহু দূর।

যাক্, যেখানে খুশি ভেসে যাক।

অদিতি ঘরে ফিরে আবার লেখাটা নিয়ে বসল। ঠিক বসল না, উপুড় হয়ে শুল। মাটিতে। বুকের নিচে বালিশ রেখে। খাটে শুয়ে লিখতে পারে না অদিতি, চেয়ার টেবিলে বসেও না। মাটিতে শরীর ছড়িয়ে দিলে তার মনে হয় লেখার সঙ্গে এক প্রবল শারীরিক ও মানসিক নৈকট্য গড়ে উঠছে, যেন অদিতি ছুঁতে পারছে লেখাটাকে। তার লিখন ভঙ্গিমাতেও এক ধরনের আবেশ মিশে থাকে। মুখের ওপর ঘন ঘন চুল এসে পড়ে, বুকের আঁচল খসে থাকে মাটিতে, হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের পাতা দুটি শূন্যে দোলায় সে। লেখার সময়ে ক্ষণে ক্ষণে তার ভাবপরিবর্তন হতে থাকে। কখনও বা মুখ হাসি হাসি, কখনও ভ্রূ কুঞ্চিত, কখনও বা আপন মনে মুখ বিকৃত করে চলেছে। শেষ বিকেলের আকাশের মতো মুহুর্মুহু অজস্র রঙের ছটা খেলে যায় তার মুখে চোখে। বিড়বিড় করতে করতে কখনও গড়াগড়ি খায়, পরমুহূর্তে লেখায় ফিরে এসে সন্দিগ্ধ চোখে নিরীক্ষণ করে নিজের লেখাকে। এ সময়ে যদি কোনও ভিডিও ক্যামেরায় তার অঙ্গভঙ্গির ছবি তোলা যায়, তবে তাকে নিঃসংশয়ে পাগল প্রমাণ করা যাবে।

সত্যিই এই নির্জন দুপুরে আজকাল পাগলই হয়ে যায় অদিতি। কিংবা পাগলিনী।

অদিতির প্রথম গল্প ফাটল বেরিয়েছে গত মাসে। তার হেমেনমামার পত্রিকায়। গল্প লেখা নিয়ে মনে যে দোলাচল ছিল, তা এখন পুরোপুরি কেটে গেছে অদিতির। তার প্রথম গল্পই বেশ সুনাম অর্জন করেছে। হেমেনের পরিচিতের গণ্ডিটি রীতিমতো বড়, অনেক সমঝদার লোককেই লেখাটি জোর করে পড়িয়েছেন তিনি। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই মতে গল্পটি নাকি কোনও লেখিকার প্রথম প্রকাশিত রচনা বলে মনেই হয় না। ভাষা বেশ পরিণত, অনুভূতির গভীরতা আছে, সব চেয়ে বড় কথা গল্পের শেষে একটি সুন্দর উত্তরণও ঘটেছে। হেমেনের সঙ্গে হেমেনের এক বন্ধু এসে তো খুব পিঠ চাপড়ে গেলেন অদিতির। বহুকাল এমন হৃদয়স্পর্শী গল্প পড়িনি। আপনি এত দিন লেখেননি কেন? আপনার কাছ থেকে আরও অনেক অনেক ভাল লেখা আমরা আশা করি।

শুনতে শুনতে অদিতির বুক শিরশির করছিল। কদিন ধরে অবিরল ভেবেছে সত্যিই তো কেন এত কাল লেখেনি সে? সংসারের সুখে মগ্ন থেকেই কি লেখার কথা ভুলে গিয়েছিল? সত্যিই কি সে সুখী ছিল এতদিন? আজ কি সে অসুখী? কিন্তু তা তো নয়। স্বামী ছেলেদের সঙ্গে তুচ্ছ কারণে মনোমালিন্য হয়েছে, বিবাদ ঘটেছে, কখনও কখনও মনঃকষ্টেও ভুগেছে অদিতি, কিন্তু সেগুলোকে তো ঠিক অ-সুখ বলা যায় না। সে তো সাংসারিক জীবনের ছোটখাটো খাঁজখোঁজ, চড়াই উৎরাই, যা না থাকলে জীবনধারণটাই অর্থহীন হয়ে পড়ত। বরং স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা, গৃহের লক্ষ্মীশ্রী, সবকিছু মিলিয়ে তাকে সুখী বলাটাই সত্যের অনেক কাছাকাছি হয়। আরও গভীরভাবে ভাবতে গেলে সে বোধহয় সুখী বা অসুখী কোনওটাই ছিল না। মাটিতে জল যেভাবে গড়ায়, সেভাবেই তার জীবনটা গড়িয়ে গেছে। এই প্রবাহ কখন কোন্ মুখী হবে এই বিষয়ে তার কোনও সচেতন ভূমিকাই নেই। আরও দুঃখের কথা, এই বোধহীন অচৈতন্য স্তরে থাকার বোধটুকুও বুঝি তার ছিল না, তার চিন্তাশক্তিই কেমন যেন ভোঁতা মেরে গিয়েছিল। মনের ভেতর কুয়ো তৈরি করে সেই কুয়োতে ডুবে বসেছিল অদিতি, লেখার জগৎ কি সেখানে রোদ্দুরের ঝলক নিয়ে এল?

নাকি এ-সব কিছুই নয়, অদিতি একটা খেলনা খুঁজে পেয়েছে? যে সময়টাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল অদিতি, সেই সময়টাকে পার করার একটা বিনোদন পেল আজ?

নাকি এ সাময়িক নেশা? ক্ষণিক উত্তেজনা? হৃদয়ে তরঙ্গ তুলে কদিন আলোড়িত করবে অদিতিকে, আবার এক মোহনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়বে অদিতি?

অদিতি জানে না। মনে মনে প্রশ্নগুলোর সমাধানও খুঁজে পায়নি অদিতি। কিন্তু লেখার অভ্যাসটা তার পুরো মাত্রায় ধরে গেছে। সে যে একটা কিছু পারে, একটা বিশেষ কিছু, স্বামী সন্তান সংসার প্রতিপালনের গণ্ডির বাইরেও তার যে এক স্বতন্ত্র গুণ আছে— মনের ভাবকে ভাষার তুলিতে আঁকার ক্ষমতা, এই উপলব্ধি যেন সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে অদিতিকে। বাড়ি ফাঁকা হলেই কাগজ-কলম নিশির ডাকের মতো টানতে থাকে তাকে। আগে নির্জনতায় ছটফট করত অদিতি, এখন নির্জন হওয়ার জন্য সে উতল। প্রতি দুপুরেই মনে হয় কত অজস্র মধ্যাহ্ন অপচয় করেছে সে, আর একটি অলস দুপুরও অদিতি হাতছাড়া করতে রাজি নয়। অনুভবকে ভাষায় বেঁধে ফেলায় যে এত আনন্দ তা কে জানত!

লিখছে অদিতি।

চৈত্র-দুপুরে ঘরের জানলা সব বন্ধ, টিউবের আলো জ্বলছে, মাথার ওপর পাখা ঘুরছে বনবন। অদিতি লিখছে। আলগা কাগজ হাওয়ায় বড় উড়ে যায়, সুপ্রতিমের বালিশ দিয়ে পাতাগুলোকে চেপে রেখেছে অদিতি। আনমনে বালিশটা একটু টানতেই একটা লেখা পাতা ফর্‌র্‌ করে খাটের নিচে ছুটে গেল। হাঁইহাই হামাগুড়ি দিয়ে পাতাটাকে তাড়া করেছে অদিতি।

টেলিফোন। এই সময়েই বাজল?

খাটের তলা থেকে পাতাটাকে টেনে বার করল অদিতি। বালিশে চাপা দিয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে ফোন ধরতে ছুটেছে।

সুপ্রতিম।

—কী ব্যাপার, ফোনের পাশে বসেছিলে নাকি?

—না তো। কেন?

—না, তোমার ফোন ধরতে অনেক সময় লাগে তো।

—কী বলবে, তাড়াতাড়ি বলল।

—অত তাড়া কীসের? করছটা কী? রান্নাবান্না কিছু বসিয়ে এসেছ নাকি?

—নাহ্।

—বুঝেছি। লিখছিলে। সুপ্রতিম খুক খুক হাসল, —সুখে আছ বটে। কাজকম্মো নেই, বসে বসে গল্প ফাঁদছ।

অদিতি ধৈর্য হারাচ্ছিল— কী বলবে বলে ফেলো না।

সুপ্রতিম যে কতক্ষণ সময় নিল! বোধহয় কয়েক ঘণ্টা। ঘড়ির হিসেবে কয়েক সেকেন্ড। অবশেষে কাজের কথায় এসেছে, —শোনো, আমাকে আজ বিকেলের স্টিলে জামশেদপুর যেতে হচ্ছে।

—হঠাৎ?

—কাজ আছে ম্যাডাম। তোমার মতো বসে বসে গপ্পো ফাঁদলে তো আর পেট চলবে না। আমার জামশেদপুর এখনও টার্গেট রিচ করতে পারল না…। সামনেই ইয়ার ক্লোজিং…। লাস্ট টাইমে গিয়ে দেখি, ডিসকাউন্ট ইনসেন্‌টিভ বাড়িয়ে সিচুয়েশানটা যদি ম্যানেজ করা যায়। আমার দুটো ছেলে ওখানে যা ফ্লপ্ করে গেছে না…। তুমি চেনো। সেই পুষ্পল আর সমীর। ওদের এগেনস্টে এজেন্টেরও কমপ্লেন আছে। আমি একবার ঘুরে না এলে…

—ফিরছ কবে?

—আমি? কথার মাঝে আকস্মিক প্রশ্নে সামান্য থমকেছে সুপ্রতিম, —পসিব্‌লি টুমরো নাইট। কোনও কারণে ফেল করলে ওখান থেকে ফোন করে দেব।

—বাড়ি এসে যাবে তো?

—তা হলে আর ফোন করছি কেন? হাতে পাহাড়প্রমাণ কাজ জমে আছে। অফিস থেকেই স্ট্রেট হাওড়া চলে যাব।

এরকম সুপ্রতিম মাঝেমধ্যেই করে থাকে। অফিস থেকেই হঠাৎ হঠাৎ ছোটখাটো ট্যুর। কোনও কোনওদিন এসে বুড়িটা ছুঁয়ে যায়, কখনও কখনও তাও করে না। গত মাসে দুবার অফিস থেকে ভুবনেশ্বর চলে গিয়েছিল। সুপ্রতিমের এই টুর ব্যাপারটা এত নিত্যনৈমিত্তিক, এত গা সওয়া, তবু এখনও প্রতিবারই সুপ্রতিম বাইরে গেলে এক ধরনের উদ্বেগ বোধ করে অদিতি। কিছু খেয়েদেয়ে সুপ্রতিম অসুস্থ হয়ে পড়ল কিনা, টেনশান করে প্রেশার বাড়িয়ে বসল কিনা, লু লাগাল, না সর্দিকাশি বাধাল…। তেমন গভীর কিছু দুশ্চিন্তা নয়, পাপাই তাতাইকে স্কুলে পাঠিয়ে যতটুকু উদ্বিগ্ন থাকত অদিতি, প্রায় সেরকমই। এই মায়াময় উদ্বেগে প্রেমের চেয়ে বাৎসল্যের ভাবই বেশি।

আজ সেটুকুনি উদ্বেগও যেন আসছিল না অদিতির মনে। বরং যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত লাগছিল। যাক্, দুপুরে শেষ না হলে রাতেও আজ গল্পটা নিয়ে বসা যাবে।

প্রতিবারের মতোই অদিতি বলে উঠল, —সাবধানে যেয়ো। ছাড়ি?

—ছটফট করছ কেন? বর বিদেশবিভুঁই-এ চলে যাচ্ছে, দু মিনিট বরের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?

অদিতি হেসে ফেলল,— জামশেদপুর কবে থেকে তোমার কাছে বিদেশবিভুঁই হল? তুমিই তো বলো ভুবনেশ্বর জামশেদপুর যাওয়া আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ি যাওয়ার থেকে সোজা।

—ওই হল। গৃহসুখ তো আর সেখানে নেই। সুপ্রতিম কথা বাড়িয়েই চলেছে, তারপর? কী লিখছ আজ?

খুবই সাধারণ প্রশ্ন, হাল্‌কা জিজ্ঞাসা, তবু ঘরের মানুষের আগ্রহে একটু নাড়া খেল অদিতি। খুশিও হল কি! বলল, —ওই হেমেনমামাদের সাহিত্যসভায় একটা গল্প পড়তে হবে, সেটাই…

—ভাল। লেখো। বাই দা ওয়ে, এবার কাকে ধরেছ?

—মানে?

—বাহ্, আগের গল্পে তোমার দাদাকে তুমি জব্বর টাইট দাওনি? ভুলিয়ে ভালিয়ে বোনকে ঠকিয়ে নিয়েছে দাদা, বোন খুব দুঃখ পেয়েছে…ঠিকই লিখেছ। উচিত কথাটা লেখার দরকার ছিল।

অদিতি নীরব। সুপ্রতিমের বদ্ধমূল ধারণা, গল্পটা অলকেশকে নিয়েই লেখা। কিছুতেই তাকে বোঝানো যায়নি ওটা শুধু অদিতি অলকেশের কথা নয়, ভাই বোনের চিরন্তন সম্পর্কের কাহিনী। যে সম্পর্ক সাংসারিক বিষয়বুদ্ধিতে বিষিয়ে যায়, কিন্তু মরে না, চিড় ধরে যাওয়া সম্পর্কেও কোথায় যেন একটা চোরা টান থেকেই যায়, ফল্গুনদীর মতো বইতে থাকে হৃদয়ে। গল্পের দাদা ঘুড়ি ওড়ালে বোন লাটাই ধরে থাকত, জিত্‌তাল খেলে জেতা গুলি বোনের কাছে জমা রাখত দাদা—এ-সব তো অদিতির জীবনে সত্যি নয়। আসলে বোধহয় গল্পটা থেকে ওইটুকুই রস পেয়েছে সুপ্রতিম। মাঝখান থেকে সুপ্রতিমের কথা শুনতে শুনতে অদিতির মনেও কেমন দ্বিধা এসে গেল, কিছুতেই গল্পটা তুলতুলিকে পড়াতে পারল না। অদিতি এতদিন পর আবার গল্প লিখেছে শুনে অলকেশও কী খুশি, পত্রিকাটা চেয়েও পাঠিয়েছিল, অদিতি বেমালুম বলে দিল হারিয়ে গেছে! তাতেই যেন সুপ্রতিম আরও মজা পেয়ে গেল।

সুপ্রতিম অদিতির নীরবতার তোয়াক্কা করল না। হাসছে, —দাদার নামটাও বেড়ে দিয়েছিলে। রামকৃষ্ণ। বিষয়জ্ঞান টনটনে, কিন্তু মুখে কত দরদ!

অদিতি রুক্ষভাবেই বলল, —তোমার হাতে অনেক কাজ জমে আছে বলছিলে না?

—দাদার কথায় গায়ে ফোস্‌কা পড়ছে? হা হা। ঠিক আছে, রাখলাম।

টেলিফোন যথাস্থানে রেখে কয়েক পল স্থির দাঁড়িয়ে রইল অদিতি। তারপর শিথিল পায়ে ফ্রিজের সামনে এল, বোতল খুলে ঢকঢক ঠাণ্ডা জল ঢালল গলায়, ঘাড়ে মুখে শীতল জলের ছোঁয়া দিল। ফোন ধরতে এসে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেছে, বাঁধতে সময় লাগবে। অস্থির পায়ে ড্রয়িংস্পেসে খানিক পায়চারি করল অদিতি। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।

বেলা গড়িয়েছে। পায়ে পায়ে পিছু হঠছে রোদ্দুর। কম্পাউন্ডে ছায়া। আশপাশের ফ্ল্যাটের কয়েকটি মেয়ে এই মাত্র কলকল করতে করতে স্কুল থেকে ফিরল, ঘাসজমিতে জড়ো হয়ে হিহি হাহা করছে। শিপ্রার শাশুডি শীর্ণ শরীরে চৈত্রের তাপ নিচ্ছে। গেটের গুলমোহর গাছে ফুলেরা দুলছিল। টিয়া ঘাড় গুঁজেছে পিঠে। ঘুমোচ্ছে। শেষ দুপুরেই।

গল্পটা নিয়েই ভাবার চেষ্টা করছিল অদিতি। মনের ভেতর এক আজব কাটাকুটি খেলা চলছে।

…ভাড়া বাড়ি বদলাতে বদলাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এক মধ্যবিত্ত দম্পত্তি। কোথাও দু বছর গেলেই জল নিয়ে ঝামেলা শুরু করে বাড়িঅলা, কোথাও দেওয়ালে একটা পেরেক ঠুকলে বাড়ির মালিক হাঁ হাঁ করে ওঠে, কোথাও ফিরতে একটু রাত হলে ঠারেঠোরে কথা শোনায়, কোথাও বা বেশি দিন থাকতে চাইলেই উঠে যাওয়ার হুকুম জারি হয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে নির্বিরোধী দম্পতি নিজস্ব একটা আস্তানার জন্য মরিয়া, গেছে এক প্রোমোটারের কাছে, যদি কোনওভাবে ছোটখাটো ফ্ল্যাট কিনে ফেলা যায়। দুটো নেকড়েসদৃশ অ্যালসেশিয়ান দু পাশে নিয়ে বসে আছে প্রোমোটার, মুখে তার বরাভয়। ডোন্ট ওরি, আপনাদের বাজেটের মধ্যে তৈরি করে দেব। উইদিন টুয়েলভ্ মানথস্। সঞ্চয় উজাড় করে ফ্ল্যাট বুক করল আশা আর পরেশ। পরেশের অফিস থেকে লোন, আশার গয়না বিক্রি, কোঅপারেটিভ থেকে দেনা—প্রাণপণে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে দুজনে। বাড়ি শুরু হল। দিন যায়, মাস যায়, দুজনে রোজ একবার ছুটে গিয়ে দেখে আসে নির্মাণ। বাড়ি উঠছে। নিজস্ব আশ্রয়ে যাওয়ার স্বপ্নে আশা পরেশ বিভোর। মনোমতে ঘর সাজানোর স্বপ্নে স্বামী-স্ত্রী মশগুল। খাঁচা ঢালাই হয়ে হঠাৎ বাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে গেল। করপোরেশান কী ঝামেলা করেছে। এক বছর গেল, দেড় বছর গেল, আশা পরেশের মুখ শুকিয়ে এতটুকু। দু বছরের মাথায় আবার শুরু হয়েছে কাজ। নতুন করে আশা ফুটছে স্বামী-স্ত্রীর। ঠিক তখনই প্রোমোটারের ভাষা বদলে গেল। ও দরে আর পারব না দাদা। লাখখানেক বেশি লাগবে। লোন চান তো বলুন দিয়ে দিচ্ছি। টোয়েন্টি পারসেন্ট ইন্টারেস্ট। শোধ করে ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে নেবেন। আশা পরেশের মাথায় হাত। ক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে তারা, আরও ধার করলে ছেলেমেয়ে নিয়ে খাবে কী? আশা পরেশ এখন কী যে করে? আরও ধার বাড়াবে? প্রোমোটারের কাছ থেকে টাকা ফেরত নিয়ে নেবে? আবার সেই হীনম্মন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা? অন্যের বাড়িতে? মুখ গুজে? মুখ শুনে?…

পাশের ফ্ল্যাটের কল্যাণী জল দিচ্ছে টবে। বারান্দার বাগানের পরিচর্যা থামিয়ে ডাকছে অদিতিকে, —কী দিদি, আজকাল যে আপনার দেখাই পাওয়া যায় না?

আশা পরেশের সমস্যায় অদিতি গভীর চিন্তামগ্ন। নিরুত্তর।

কল্যাণী আবার ডাকল, —আপনার শরীর খারাপ নাকি দিদি?

বিমনা অদিতি ফিরেছে এবার। আলতো ঘাড় নাড়ল। না।

—পাপাইয়ের পার্ট টু তো এসে গেল, তাই না?

—হুঁ।

—কবে থেকে শুরু?

অদিতি চট করে মনে করতে পারল না। আজ কত তারিখ? এটা যেন কী মাস? নিজেতে ফিরতে কয়েক লহমা সময় লাগল অদিতির। সামান্য গলা তুলে বলল, —এখনও মাস দেড়েক বাকি। মে-র গোড়াতে শুরু হবে।

—বেশ মজা আপনার। দুটো ছেলেই বড় হয়ে গেল। আমার ওই গুণ্ডাটা যে কবে মানুষ হবে! ছেলের পেছনে দৌড়তে দৌড়তে জান বেরিয়ে গেল।

—সামনের বার মাধ্যমিকটা দিক, দেখবেন হু-হু করে সময় চলে যাবে। অদিতি ছোট্ট করে হাসল।

স্তোকবাক্যটা যেন ঠিক কানে গেল না কল্যাণীর। গ্রিলের কিনারে এসে গলা নামিয়েছে, —কাল রাত্তিরে গোপাদের ফ্ল্যাটের হল্লা শুনেছিলেন?

অদিতির ক্ষীণ মনে পড়ল দোতলায় কাল একটা গণ্ডগোল হচ্ছিল বটে। অদিতিরা তখন খেতে বসেছে। কী একটা যেন চটুল মন্তব্যও করেছিল সুপ্রতিম! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সুপ্রতিম বলছিল, ওই আবার গানবাজনা শুরু হল। সুপ্রতিম কথাটা বলল, না তাতাই?

অদিতি নির্লিপ্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, —কী হয়েছিল?

—ওমা জানেন না? গোপা তো বরের অফিসে গিয়ে বরের এগেনস্টে কমপ্লেন করে এসেছে। সিদ্ধার্থবাবু নাকি সংসারে টাকাপয়সা দেয় না, সেই মহিলাকে সব দিয়ে আসে। সেই যে যার সঙ্গে এখন চলছে। কল্যাণী ইঙ্গিতপূর্ণ চোখ টিপল, —মেয়েছেলেটার নাকি খুব খাঁই।

কল্যাণীর কথা থেকে মনকে বিযুক্ত করার চেষ্টা করল অদিতি। পরেশরা যদি প্রোমোটারের কাছ থেকে টাকা ফেরত চায়ও, প্রোমোটার কি সহজে ফেরত দেবে? অদিতিদের এই ফ্ল্যাট কেনার সময়ও কী কম টালবাহানা হয়েছিল? গোড়ায় বলল আড়াই লাখ, বাড়তে বাড়তে সওয়া তিন। তবে সে টাকা জোগাড় করেছিল সুপ্রতিম। দুটো ইনসিওরেন্সের পলিসি বাঁধা রেখে। তাতেও কুলোয়নি, বড় ভগ্নীপতির কাছ থেকে বেশ কিছু ধার নিয়েছিল। পরেশের কি সেরকমও কেউ নেই?

অদিতির নীরবতা কল্যাণীকে দমাতে পারেনি। প্রবল উৎসাহে ফিসফিস করে চলেছে, —গোপা সিদ্ধার্থবাবুর অফিসে গিয়েছিল বলেই তো ফাটাফাটি।

—যাওয়াই তো উচিত। ঠিক করেছে। অদিতি মুখ ফসকে বলে ফেলল।

সঙ্গে সঙ্গে কথাটা লুফে নিয়েছে কল্যাণী, —উচিত তো বলছেন, গোপাকে কে মদত দিচ্ছে জানেন? ওই যে লোকটা আসে ওদের বাড়িতে…গোপা বলে ওর মামাতো ভাই…। কাল তো ওকে নিয়েও যাচ্ছেতাই কথা বলছিল সিদ্ধার্থবাবু। কল্যাণী নীচের ফ্ল্যাটের দিকে তাকাচ্ছে ঘন ঘন, আরও অনুচ্চ স্বরে বলল, —ওটা নাকি সত্যি সত্যি মামাতো ভাই নয়, মামার বন্ধুর ছেলে। গোপার নাকি বিয়ের আগে তার সঙ্গে একটা ইয়ে ছিল। রোজ রোজ বাড়িতে বউয়ের প্রেমিক এসে বসে থাকলে কোন্ পুরুষের বউতে মন থাকে? আমার কর্তা তো শুনে ফায়ার হয়ে গেছে। বলছিল এরকম বস্তিবাড়ির দশা চললে ফ্ল্যাট বেচে চলে যাব। ওদের ছেলেপিলেরা কী দেখছে বলুন তো? ছি ছি…

অদিতির এ-সব কেচ্ছাকাহিনী শুনতে ভাল লাগে না, আজও লাগছিল না। আশা পরেশকে বিপদসাগরে ফেলে সে এখন হাঁসফাঁস করছে।

সহসা মুক্তিদূতের মতো ডোরবেল বেজে উঠেছে। মলিনার মা।

বাসন মাজতে এসে বিকেলের দিকে রাজ্যের গল্প জোড়ে মলিনার মা। কোনও কোনওদিন মন দিয়ে শোনে অদিতি, আজ চটপট ভাগিয়ে দিল। মাথাটা ভার হয়ে আছে, এক কাপ চা করে খেল আগে। আবার লেখাটা নিয়ে বসেছে। সবিতা আসার আগে দু-চার লাইন যদি আরও লিখে ফেলা যায়।

পারল না। সবিতার আগে আজ পাপাই এসে গেছে। পিছন পিছন তাতাইও। পাপাই জলখাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল, রাত নটায় তাকে ডেকে দিতে হবে। তাতাই বসে গেল টিভিতে।

অদিতি ছটফট করছিল। ছেলেরা বাড়ি থাকলে এত ভাল লাগে তার, আজ কেন অসহ্য লাগছে? মাথার ভেতর গুবরে পোকার মতো ঘুরছে গল্পটা, তাই কি? তাতাই সন্ধেবেলা বাড়ি থাকলে অদিতির কি একটুও সুস্থিত থাকার জো আছে? পরের পর হুকুম চলছে তাতাইয়ের। পিৎজা ব্রেড এনে দিচ্ছি, একটু চিজ্ পিৎজা করে দাও না। উফ্ কী গরম লাগছে, মা একটু শরবত করে দেবে? ওকী, শুধু ঠাণ্ডা জলে করছ কেন, দু-চারটে আইসকিউব ফেলে দাও। অদিতি একবার বলেই ফেলল, তোর সাঙ্গোপাঙ্গরা আজ তোকে পরিত্যাগ করল নাকি! শুনে ছেলের কী হাসি। নো ডিয়ার মাম্মি, চিরন্তন মজুমদারই আজ সবাইকে ছুট্টি দিয়েছে। আজ আমি মাথাটাকে একটু রেস্ট দিচ্ছি।

আজই? কেন?

অনেক রাতে, পাড়া যখন নিশুত, সংসার থেকে পুরোপুরি ছাড়ান পেল অদিতি। একা ঘরে দরজা বন্ধ করে আবার আশা পরেশ। টাকাটা যদি প্রোমোটার ফেরত দিয়েই দেয়, পরেশ কী করবে? আরেকটু ছোট ফ্ল্যাটের জন্য চেষ্টা চালাবে কোথাও? মানুষের স্বপ্ন কি সম্পূর্ণ সফল হয় কখনও? তার চেয়ে স্বপ্নটাকেই যদি ছেঁটেকেটে ছোট করে নেওয়া যায়, যদি সেটাকেই মানুষ রাঙিয়ে নিতে পারে, তা হলে কি…?

নাহ্ গোছানো যাচ্ছে না। দুপুরে সুপ্রতিমের ফোনটা আসার পর থেকেই গল্পটার যেন খেই হারিয়ে গেছে।

আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল অদিতি, ঘুম আসে না। জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে অদিতি, ঘুম আসে না। ছোট্ট একটা ঝড় উঠে রাতটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, অদিতির ঘুম আসে না। ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসছে অদিতির, ঘুম আসে না।

নীল অন্ধকারে জেগে আছে অদিতি। গল্পের শেষটুকু চাই। মস্তিষ্ক অদৃশ্য আঁকিবুকি কেটে চলেছে শূন্যে। শেষটুকু চাই। শেষটুকু।

.

০৭.

হেমেন এলেন পাঁচটা নাগাদ। অদিতি তখন বিকেলের চা করছিল। সকাল থেকে বুকের ভেতর যে সূক্ষ্ম কম্পন চলেছে, হেমেনকে দেখেই তা বেড়ে গেল সহস্রগুণ। জীবনে প্রথম কোনও সাহিত্যসভায় যাবে অদিতি, একরাশ অচেনা মানুষের সামনে বসে নিজের লেখা গল্প পড়বে—ভাবনাটা অদিতির পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সটাকে কেমন টলমলে করে দিচ্ছিল। একুশ বছরের তরুণীর পক্ষে বয়সের প্রখর তেজে যা অনায়াসসাধ্য, অদিতির মতো আটপৌরে গৃহবধুর পক্ষে তা কি চরম বেমানান নয়? হঠাৎ ঝোঁকের বশে হেমেনমামার কথায় রাজি হয়ে গিয়ে কি ভুল করল অদিতি?

হেমেন আজ বেশ সেজেগুজে এসেছেন। পাটভাঙা ধুতি, মিহি আদ্দির পাঞ্জাবি, পায়ে কোলাপুরী চপ্পল। কুঁজোটে বৃদ্ধ চেহারা আজ অনেক ঋজু, টানটান। তোবড়ানো গালেও চকচকে আভা।

ফ্ল্যাটে ঢুকেই তাড়াহুড়ো শুরু করে দিয়েছেন হেমেন, —কী হল, তুমি এখনও তৈরি হওনি?

অদিতি কাঁচুমাচু মুখে বলল, —না গেলে হয় না হেমেনমামা?

—কেন, তোমার কি গল্প লেখা হয়নি?

—তা কোনও মতে একটা খাড়া করেছি…

—বাড়িতে কোনও বিশেষ কাজ আছে?

—তাও ঠিক নয়…অদিতি অসহায় চোখে সুপ্রতিমের দিকে তাকাল, —অ্যাই, তুমি বলো না…

রবিবারের বিকেল। সোফায় গা ছড়িয়ে আয়েশ করে চা খাচ্ছিল সুপ্রতিম। হেমেনকে দেখে পা নামিয়েছে। বলল, —আপনার ভাগ্নী আজ সকাল থেকে হরিনাম জপ করছে। ও বাবা গো, কী হবে গো, সবাই মিলে আমাকে খেয়ে ফেলবে গো…

—আমি কি তাই বলেছি? লঘু প্রতিবাদ করল অদিতি—এত বছর ধরে ঘরসংসার করছি…যাওয়ার মধ্যে যাওয়া আত্মীয়দের বাড়ি, নয় তোমার কোনও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি…এরকম জায়গায় আগে গিয়েছি কখনও?

—তা বললে চলবে কেন, অ্যাঁ? তুমি এখন লেখিকা হতে চাইছ, এ-সব গ্যাদারিং-এ তো তোমাকে যেতেই হবে। যে লাইনের যা নিয়ম। সব কিছুর তো একটা চ্যানেল চাই। সুপ্রতিম শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালা-পিরিচ সেন্টার টেবিলে রাখল, —বুঝলেন মামা, আমি যখন প্রথম সেলস লাইনে আসি, থোড়াই তখন এ লাইনের ঘাঁতঘোত জানতাম। ছোট্ট একটা কোম্পানিতে ঢুকেছি, ট্রেনিং বলে কিস্যু নেই, চোখে অন্ধকার দেখছি। …সেই সময়ে লাইনের কয়েকটা ছেলের সঙ্গে আলাপ। রোজ সন্ধেবেলা দল বেঁধে আমরা ডেকার্স লেনে বসতাম। সেই গ্যাদারিং থেকেই আমার শিক্ষা, সেই গ্যাদারিং-এই আমার কাজকর্মে হাতেখড়ি। লাইনে সাকসেসফুল হতে গেলে মিক্সিং ইজ মাস্ট। দিবে আর নিবে, মেলাবে মিলিবে…কি বলেন মামা?

সুপ্রতিমের কথায় এমন এক সহজ কর্তৃত্বের সুর থাকে যার প্রতিবাদ করা কঠিন। যেন সে যা বলছে, তাই পৃথিবীতে ধ্রুব সত্য। তেল সাবান বেচা আর সাহিত্য করার মধ্যে যে আদতে কোনও ফারাক নেই, এ কথা তুড়ি মেরে যাকে তাকে বুঝিয়ে দিতে পারে সুপ্রতিম।

হেমেন চায়ের কাপ হাতে হাসছেন মৃদু মৃদু। অদিতিকে বললেন, —এরকম একজন উৎসাহী স্বামী পেয়েছ, তোমাকে এত প্রেরণা দেয়, তোমার তো গর্বিত হওয়া উচিত অদিতি।

—আপনি আমাকে আর লজ্জা দেবেন না মামা। যদ্দিন জানতাম না, জানতাম না। এখন অ্যাদ্দিন পর যখন একটা গুণ বেরিয়েই পড়েছে, কেন আমি প্যাট্রোনাইজ করব না? আফটার অল সবার বউ তো আর লেখিকা হয় না! এই তো, আজ সন্ধেবেলাতেই আমার এক বন্ধু বউ নিয়ে আসতে চাইছিল। আমি স্ট্রেট বলে দিলাম, আজ এসো না ভাই, আজ আমার বউ সাহিত্যসভায় যাবে।

হেমেন বললেন, —এর পরও তুমি এখনও তৈরি হওনি? যাও যাও। আমাদের কিন্তু ঠিক ছ’টায় পৌঁছতে হবে।

অদিতি ঘরে এসে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। সুপ্রতিম সত্যিই বড় সাদা মনের মানুষ। মালিন্যহীন। সঙ্কীর্ণতাবিহীন। এই বয়সে অদিতিকে হঠাৎ লেখায় পেয়ে বসল বলে রঙ্গরসিকতা করে ঠিকই, আবার পাঁচজনের কাছে স্ত্রীর কথা গর্ব করে বলতেও ছাড়ে না। গত রবিবার কস্তুরীরা কতাগিন্নি এসেছিল এ বাড়ি, তাদের পত্রিকা দেখিয়ে অদিতির গল্প পড়িয়ে কী হইচই না শুরু করল সুপ্রতিম! দেখেছ ছেলেরা বড় হয়ে গেছে বলে আমার বউ শুয়ে বসে সময় কাটায় না! কী ফাইন একটা পাসটাইম খুঁজে নিয়েছে!

উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে সুপ্রতিম। হেমেনমামার ভারী কণ্ঠস্বরও শোনা যায় মাঝে মাঝে। কী যে বিষয় তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে সুপ্রতিম আর হেমেনমামা কথা শুরু করলে বিষয়ের স্থিরতাও থাকে না, অনবরত প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যায় দুজনে। সুপ্রতিমই অবশ্য কথা বলে বেশি।

অদিতি দ্রুত হাতে অল্প প্রসাধন সেরে নিল। তার ত্বক একদম গরম সহ্য করতে পারে না, এখনই দু-চারটে ঘামাচি বেরিয়ে গেছে। ঘাড়ে গলায় আলগা পাউডার বোলালো অদিতি, মুছেও নিল। ছোট্ট একটা টিপ কপালে লাগাতে লাগাতে গলা ওঠাল একটু, —এই, একবার শুনে যাও তো।

সুপ্রতিম তক্ষুনি এল না, এল মিনিট দু-তিন পরে, —কী বলছিলে?

অদিতি ঢোক গিলে বলল, —তুমি আমার সঙ্গে চলো না।

—আমি গিয়ে কী করব?

—বাড়িতে বসে থেকেই বা কী করবে? গেলে কত নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ হত। সুপ্রতিমের দিকে ঘুরল অদিতি, —তুমি গেলে আমিও একটু ভরসা পেতাম।

সুপ্রতিম হেসে ফেলল, —মামার ওপর ভরসা হচ্ছে না?

—তা নয়, তুমি থাকলে…

—না রে ভাই, সভাটভায় যাওয়া আমার পোষাবে না। ভাবছি একটু দীপকের কাছ থেকে ঘুরে আসি।…তুমি ফিরছ কখন?

—হেমেনমামা যখন ফেরত আনবেন। অদিতি ছোট শ্বাস ফেলল।

—বেশি রাত কোরো না। পাপাই তাতাই ফিরে আসবে…আমি থাকব না…। রোববার বলে আবার বাসফাসের ধান্দা কোরো না যেন। ট্যাক্সিতে যাতায়াত কোরো। টাকা আছে কাছে, না দিয়ে দেব?

—আছে। অদিতি ইতস্তত করে বলল, —হেমেনমামা কি আমাকে ভাড়া দিতে দেবেন? মাঝখান থেকে ওঁরই গাঁটগচ্চা।

সুপ্রতিম দরজায় উঁকি দিয়ে ড্রয়িংস্পেসটা দেখে নিল একবার। রবিবারে এ বাড়িতে একটা করে বাংলা কাগজ আসে, হেমেন কাগজের ক্রোড়পত্র পড়ছেন। মুখ ফিরিয়ে খুক খুক হাসল সুপ্রতিম। গলা নামিয়ে বলল, —আরে না না, উনি দেবেন কেন? রিটায়ার্ড মানুষ…তুমি একজন সলভেন্ট ভাগ্নী…। তা ছাড়া…

—তা ছাড়া কী?

—পুরুষমানুষের অনেক সিক্রেটই তুমি জানো না ম্যাডাম। বেশি মাঞ্জা দেওয়া লোকেদের পকেটে মালকড়ি থাকে না। তুমি ভাড়া দিলে মামা বর্তে যাবে।

—শুধু ফাজলামি। শুধু ফাজলামি। অদিতি আলমারি খুলল, —কী শাড়ি পরা যায় বলো তো?

সুপ্রতিম ওয়ার্ড্রোবে চোখ বোলালো। আঙুল নেড়ে বলল, —ওই বটল গ্রিন সিল্ক কলাক্ষেত্রমটা পরো।

—এই গরমে সিল্ক! ওই গরজাস শাড়ি! বিয়েবাড়ি যাচ্ছি নাকি?

—তো কী হয়েছে? একটা জায়গায় প্রথম যাচ্ছ, একটু তো সেজেগুজে যাওয়াই ভাল। লেখিকার গ্লেজ দেখে পাবলিক চমকে যাবে।

—থাক, অত চমকিয়ে লাভ নেই। কী কপালে আছে কে জানে। অদিতি একটা সাদা খোলের তাঁতের শাড়ি বার করল, —গরমের দিনে এই ভাল, কি বলো?

সুপ্রতিম নাক কুঁচকেছে, —বেশি যোগিনী যোগিনী হয়ে যাচ্ছে না?

—এখন যোগিনী সাজারই বয়স। রাধিকা সাজার বয়স নয়।

—নিজের পছন্দমতোই সাজবে যখন, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?

সুপ্রতিম ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, অদিতি আবার ডাকল, —তুমি হঠাৎ আজ দীপকদার বাড়ি যাচ্ছ?

—যাই। বেচারা একা একা আছে।

দরজা ভেজিয়ে শাড়ি পরছে অদিতি। আঁচল কাঁধে ছুড়ে বলল, —শর্মিলা কি একেবারেই চলে গেল?

—তাই তো মনে হচ্ছে।

—ছেলেটাও দীপকদার কাছে আসে না?

—ওই নিয়েই তো ঝামেলা। শর্মিলা নাকি ছেলেমেয়েদের আসতে দেয় না। শুনলে না সোমেন বলছিল দীপক খেপে ফিউরিয়াস হয়ে আছে।

—আর মদ গিলছে।

—মানুষকে তো একটা কিছু নিয়ে থাকতে হবে, নাকি? পুরুষ মানুষ হয়ে লোকের কাছে কেঁদে কেঁদে বেড়াবে? কোর্টে গেলে তখন শর্মিলা টাইট হবে। অত অ্যাডামেন্ট অ্যাটিচিউড…

শর্মিলার মতো শান্ত ধীর স্থির মেয়েকে একগুঁয়ে ভাবতে অসুবিধা হয় অদিতির। তবে এই মুহূর্তে শর্মিলাকে নিয়ে সে তেমন ভাবছিলও না। যেন সুপ্রতিমের সঙ্গে কথা বলে বলে নিজেকে সহজ করতে চাইছিল। কুঁচি কোমরে গুঁজে বলল, —দীপকদা দেবদাস হয়েছে বলে তুমি যেন আবার চুনীলাল হতে যেয়ো না।

সুপ্রতিম সশব্দে হেসে উঠল, —আরে বাবা, দীপক একাই দেবদাস হতে পারে, ওর জন্য চুনীলাল লাগে না।

গম্ভীর মুখে অদিতি বলল, —কথাটা কেন বলেছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ?

—আরে বাবা হ্যাঁ। তুমি ঠোঁট নাড়লে তোমার পেটের কথা আমি টের পেয়ে যাই।

—কথাটা মনে রেখো। ওখানে গিয়ে গ্লাস নিয়ে বসে যেয়ো না।

সুপ্রতিম হঠাৎ যেন তেতে গেল একটু, —তুমি আমাকে কী মনে করো বলো তো? বাড়িতে তো বোতল রাখাই থাকে! পাপাই তাতাই এখন যথেষ্ট ম্যাচিয়োর হয়ে গেছে, ওরা কিছু মনে করবে না, তা বলে কি আমি গেলাস নিয়ে বসি রোজ?

অদিতি কথা বাড়াল। যা ইচ্ছে করুক। নিজের শরীর নিজে বুঝবে। গত বছর যখন বুকে ব্যথা বুকে ব্যথা বলে সাতদিন বাড়িতে শুয়েছিল, তখন ডাক্তারের সতর্কবাণী শোনেনি! হার্ট-ফার্ট নিয়ে প্রবলেম নেই, কিন্তু বয়সটা আপনার ভাল নয় মিস্টার মজুমদার! বুজিং স্মোকিং সবই এখন কন্ট্রোল করার সময়! সুপ্রতিম বাড়াবাড়ি করে না ঠিকই, রোজ পান করাও তার অভ্যাস নয়, তবু এক-আধদিন তো মাত্রা ছাড়ায়ই। অদিতি আর কত খ্যাচখ্যাচ করবে!

আকাশে অল্প মেঘ করেছে। কালও করেছিল, তবে বৃষ্টি হয়নি। অস্তগামী সূর্য ঈষৎ ম্রিয়মাণ হলেও তার তাপ এখনও প্রবল। সিমেন্ট পিচ ইট লোহার অরণ্য উত্তাপ বিকিরণ করে চলেছে। সন্ধে নামলে মলয় বাতাস উঠবে একটা, তবে তার এখনও সময় হয়নি।

সাহিত্যসভায় পৌঁছে অদিতি বিস্মিত হল। সভা বলতে তার চোখে যে এক মহতী ছবি আঁকা ছিল, এ তো সেরকম কিছু নয়! চারু মার্কেটের পিছনে একটা পুরনো দোতলা বাড়ির একতলার বৈঠকখানা ঘরে ফরাস পাতা হয়েছে, জনা দশ-বারো মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন সেখানে, পরস্পরের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। কোনও নামী সাহিত্যিক তো নেইই, বরং যাঁরা বসে আছেন তাঁদের দেখে লেকের বয়স্ক আড্ডাবাজদের উপমাই মনে আসে। প্রৌঢ়দের মাঝে দুটি মাত্র কমবয়সী ছেলে, তারা অবশ্য বসে নেই, রীতিমতো ব্যস্ত-মুখে মাঝে মাঝে ঘর-বার করছে। হেমেনমামা বলেই ছিল খুবই ছোট ব্যাপার, কিন্তু এ যে নিছকই ঘরোয়া আড্ডাখানা!

হেমেন একে একে সকলের সঙ্গে অদিতির পরিচয় করিয়ে দিলেন। কেউ পেশায় শিক্ষক, কেউ অধ্যাপক, কেউ অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, কেউ গ্রন্থাগারিক। একজন ওষুধ দোকানের মালিকও আছেন। এঁদের মধ্যে দু-তিনজন অদিতির ফাটল গল্পটি পড়েছেন, আলাপের সময়ে সংক্ষিপ্ত প্রশংসাসূচক মন্তব্যও করলেন তাঁরা। একজন বললেন ফাটলের লেখিকাকে আরও প্রবীণা ভেবেছিলেন তিনি, আরেকজনের মুখ দেখে মনে হল অদিতি আরেকটু তরুণী হলে তিনি যেন খুশি হতেন।

এক বয়স্কা মহিলা, সম্ভবত এ বাড়ির কোনও গৃহিণী, হাত ধরে বসালেন অদিতিকে। তিনিও অদিতির গল্পটি পড়েছেন, অদিতি যে নতুন গল্প লেখা শুরু করেছে তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করার ফাঁকে অদিতির স্বামী পুত্র সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করে নিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল আরও দুজন মহিলার আজ আসার কথা ছিল, দুজনেই শিক্ষিকা।

অদিতির জড়তা কেটে যাচ্ছিল। কৌতুহলী কানে শুনছিল চারদিকের টুকরো-টাকরা সংলাপ। হেমেন প্রৌঢ়দের মধ্যমণি হয়ে বসে গেছেন, তিনি এখানে বেশ জনপ্রিয় বোঝা যায়, অনেকের সঙ্গেই নিজের পত্রিকা নিয়ে তিনি আলোচনা চালাচ্ছেন। মাঝে মাঝে কয়েকজন প্রখ্যাত লেখকের কথাও উঠে পড়ছে, বাংলা সাহিত্যের যে এখন বেশ বেহাল অবস্থা সে সম্পর্কেও তর্ক চলছে জোর। নব্য প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে বাংলা পড়ে না তাই নিয়েও অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। টিভির অপকারিতা সম্পর্কেও সরব অনেকে।

অদিতি এক প্রান্তে বসে আছে। সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। প্রৌঢ় গ্রন্থাগারিকটি আড্ডা ছেড়ে সেখানে এসে বসলেন। হয়তো অদিতিকে একা দেখেই। আলাপ জমালেন, —কী, আমাদের এই পরিবেশটা কেমন লাগছে?

অদিতি স্মিত মুখে বলল, —ভালই তো।

—অন্য সভার থেকে এটা অনেক ঘরোয়া না?

বাজারে সবজিঅলা নিজের কুমড়োর প্রশংসা করলে অদিতি যেভাবে হাসে, হুবহু সেই হাসি হাসল, —হুঁ। তা বটে। খুব হোমলি।

—আমাদের প্রেমতোষদা সেটাই চান। ওঁর মতে সভা হবে ঘরোয়া, আলোচনা হবে তীক্ষ্ণ। এতেই বেশ গল্পের আসরের মেজাজ আসে। আমাদের এখানে তাই কোনও রাখঢাক গুড়গুড় নেই, যার যা খুশি বলে ফেলতে পারে।

প্রেমতোষ নামটা অদিতির পরিচিত। হেমেনমামার মুখেই শোনা। ভদ্রলোকের নব্বইয়ের ঘরে বয়স, এখনও নাকি যথেষ্ট শক্তপোক্ত। পেশায় কবিরাজ, এখনও দু বেলা চেম্বারে বসেন। নেশা হল এই সাহিত্য। নিজে লেখেন না, কিন্তু লেখার একজন প্রকৃত সমঝদার। তিনিই এ বাড়ির মালিক।

অদিতি প্রশ্ন করল, —তাঁকে তো দেখছি না?

—ওপরেই আছেন, এখুনি এসে পড়বেন। স্ত্রীর অসুখটা খুব বেড়েছে, তাই নামতে একটু দেরি হচ্ছে।

—কী হয়েছে?

—বহুকাল ধরেই ভুগছেন। প্রায় তিন বছর। ক্যানসার।

ক্যানসার! অদিতি হতভম্ব হয়ে গেল। কই, হেমেনমামা তো একবারও বলেনি সে কথা! হ্যাঁ, আগের দিন বলছিল বটে প্রেমতোষবাবুর স্ত্রী নাকি অসুস্থ, কিন্তু অসুখটা যে ক্যানসার…! আশ্চর্য, তার পরেও এ বাড়িতে আজ এই সভা…হট্টগোল…!

ভদ্রলোক বললেন, —অবাক হবেন না। এ বাড়িতে সাহিত্যসভা থাকলে পৃথিবী উল্টে গেলেও তা বন্ধ হবে না। দেখলেন না প্রেমতোষদার পুত্রবধূকে? অণিমাদি? একবার করে শাশুড়ির কাছে বসছেন, একবার নীচে এসে তদারক করে যাচ্ছেন! উনিও কিন্তু খুব বড় সাহিত্যরসিক। নামী-দামি পত্রিকায় গল্প উপন্যাসের সমালোচনা করেন, মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে চিঠিপত্র লেখেন…। একটা কলেজেও পড়ান। ইংরিজি। এ বছরই বোধহয় রিটায়ার করছেন।

অদিতির সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। এখানে উপস্থিত সব কটি মানুষকেই তার যেন কেমন ভিন্ন প্রজাতির মনে হচ্ছে। কুণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাসা করল,—আপনিও কি লেখালিখি করেন?

—না না, আমি লিখি না। এখানে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বেশির ভাগই পাঠকমাত্র। সাহিত্যকে ভালবাসেন। আমিও তাই। তবে এখানে অনেক লেখকও আসেন। মাঝে মাঝে বড় বড় লেখকদেরও আমন্ত্রণ জানাই আমরা। কেউ আসেন, কেউ আসেন না। কবে থেকে এখানে এই সাহিত্যসভা চলছে জানেন?

—হেমেনমামার কাছে শুনেছি। এটা নাকি খুব পুরনো…

—পুরনো নয়, প্রাচীন বলুন। প্রায় চল্লিশ বছর বয়স হল। প্রতি দু মাসে একবার করে বসা হয়। আগে আগে কারা না এখানে এসেছেন? প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ, তারাশঙ্কর, প্রমথনাথ বিশী…। মাঝে বেশ কয়েকটা বছর প্রায় মরে এসেছিল, হেমেনদা কলকাতা ফিরে আবার আসরটাকে জমানোর চেষ্টা করছেন।

অদিতি চোখ ঘুরিয়ে একবার হেমেনমামাকে দেখে নিল। কী একটা পত্রিকা খুলে কোনও লেখা পড়ে শোনাচ্ছে দুই শিক্ষককে। আলগা হেসে অদিতি বলল,—হ্যাঁ, হেমেনমামার এ সব ব্যাপারে খুব উৎসাহ।

—শুধু হেমেনদা নিজের লেখাটাই ধরে রাখতে পারল না এই যা। অথচ এককালে হেমেনদার তীর্থযাত্রী উপন্যাসটা কী পপুলারই না হয়েছিল। আমার লাইব্রেরিতে রেগুলার ইস্যু হত।

বইয়ের নামটা যেন মনে পড়ছিল অদিতির। আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে আছেও বোধহয়। হেমেনমামা যে কেন এখনও লেখে না, এ প্রশ্ন অদিতির মনেও এসেছে, বারকয়েক হেমেনমামাকে জিজ্ঞাসাও করেছিল, সদুত্তর পায়নি। ঠাট্টার ছলে অন্য কথায় চলে যায় হেমেনমামা। নাহ্, এ বার একদিন হেমেনমামাকে চেপে ধরতেই হবে।

প্রেমতোষ নেমেছেন। সঙ্গে অণিমা। দুজনের ঠোঁটেই আপ্যায়নের হাসি। অদিতি টান টান হয়ে বসল। কোনও বিষয়ে কতটা নিবেদিতপ্রাণ হলে পারিবারিক বিপর্যয়ের ওপরে এ রকম হাসির প্রলেপ দিয়ে রাখতে পারে মানুষ? কেনই বা পারে? ছাপার অক্ষরে নিজেদের নাম দেখার অভিলাষ নেই, সভাসমিতি করে নিজেদের প্রচার ছড়ানোও উদ্দেশ্য নয়, শুধু সাহিত্যকে ভালবেসে এ ভাবে এতগুলো মানুষ সংগোপনে এক জায়গায় জড়ো হয়? সুপ্রতিম বা পাপাই তাতাই শুনলে নির্ঘাত বলত, উন্মাদ, উন্মাদ সব।

তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বাবু হয়ে বসেছেন প্রেমতোষ। সত্যিই তাঁর শরীর এখনও ঈর্ষণীয় রকমের মজবুত, দেখে সত্তর পঁচাত্তরের বেশি মনে হয় না। আলকাতরার মতো গায়ের রঙ, ধবধবে সাদা চুল, হাত গলার চামড়া শিথিল হলেও হাঁটাচলায় এক আশ্চর্য দৃপ্ত ভঙ্গি। তুলনায় অণিমাদির শরীর অনেক ভেঙেছে, প্রেমতোষকে তাঁর শ্বশুর বলে মনেই হয় না।

সভা যত ক্ষুদ্রই হোক, তার একজন সভাপতি থাকে। প্রেমতোষ সম্ভবত এই সভার স্থায়ী সভাপতি। তবু হেমেন নিয়মমাফিক তাঁর নামটি প্রস্তাব করলেন, সমর্থনও করলেন একজন। অণিমা একটা খাতা খুলে সভার বিবরণী লিখছেন, সকলকে দিয়ে সইও করিয়ে নিলেন প্রথমে।

সভা শুরু হল।

আজকের সভায় গল্পপাঠের জন্য দুজনের নাম স্থির হয়ে আছে। অনল গুপ্ত আর অদিতি মজুমদার। অনল দুই তরুণের অন্যতম। সেই প্রথম স্বরচিত গল্প পড়ল। গল্পটি একটু জটিল ধরনের, অনলের পড়ার ভঙ্গিটিও ভারী নিষ্প্রাণ। গল্পটি অদিতি ঠিক অনুধাবন করতে পারল না। গল্প শেষ হওয়ার পর একে একে আলোচনা করলেন সকলে। প্রায় তর্কের মতো বাগযুদ্ধ চলল খানিকক্ষণ। ভাল লাগা, মন্দ লাগা মিশিয়ে বেশ প্রশংসিতই হল লেখাটা।

এবার অদিতির পালা।

কাঁপা কাঁপা হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে গল্পটা বার করল অদিতি। হঠাৎই যেন অস্বাভাবিক দ্রুত লয়ে চলতে শুরু করেছে হৃৎপিণ্ড। তালু শুকিয়ে আসছে। জিভ খরখরে। জীবনে এই প্রথম তার সামনে একরাশ মনোযোগী শ্রোতা। যাদের এই মুহূর্তে অন্য কোনও কাজ নেই। যারা শুধু অদিতির গল্প শুনতে এসেছে।

এক নিশ্বাসে গল্পটা পড়ে ফেলল অদিতি। তার আশা পরেশ শেষ পর্যন্ত ছোট বাড়িটা থেকে আরেকটা বাড়িতে উঠে গেছে। এ বাড়ির ভাড়া অনেক বেশি, চব্বিশ ঘণ্টা জল, বাড়িটাও আগের থেকে বড়। তারা যে ফ্ল্যাটের জন্য জীবন পাত করছিল, তার চেয়েও বড়। গল্পের শেষে যেন নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে কথাটা আশা বলছে পরেশকে। পরেশ নিশ্চপ। মনে মনে বলছে, এখানেও কি আমাদের পুরোপুরি ধরে যাবে আশা? প্রাণপণে চাইলেও আমরা কি কোথাও সম্পূর্ণ ধরাতে পারি নিজেদের?…।

এ গল্পটার আলোচনা তেমন জমল না। দু-তিনজন দায়সারা গোছের বললেন কিছু। একজন জানালেন, গল্পটি লেখিকার ফাটল গল্পের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। বিশেষত পরেশের আর্তি যেন তেমনভাবে ফোটেনি। প্রেমতোষ আর অণিমার মতে গল্পটির ভাষা আগাগোড়া ঝরঝরে, কিন্তু লেখিকার আরও বেশি যত্নবান হওয়া উচিত ছিল। হেমেন নীরব।

অদিতি বিষণ্ণ হয়ে গেল।

গল্পপাঠ শেষে চা বিস্কুট খাওয়া হল, টুকটাক কথাও হল খানিক, অদিতির মন বসছিল না কোনও কিছুতেই। এত কষ্ট করে, সংসারের উদ্বৃত্ত সময় কৃপণের মতো খরচ করে লেখা গল্প কত সহজে নস্যাৎ হয়ে গেল!

রাস্তায় বেরিয়েও কথা বলছিল না অদিতি। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, তা যেন একটুও লাগছে না গায়ে। কান এখনও লাল হয়ে আছে। অদিতি ঘামছিল।

হেমেন কথা শুরু করলেন, —কি, মন খারাপ হয়ে গেছে তো?

হালকা একটা শ্বাস ফেলল অদিতি, উত্তর দিল না। বাতাসে মিশে গেল নিশ্বাসটা।

হেমেন বললেন, —জীবনের প্রতিটা কাজে মানুষ একশো ভাগ সফল হতে পারে কি? চেষ্টা করাটাই হল আসল জিনিস। আমি জানি, তুমি চেষ্টা করেছ। ভুল বলছি?

নিঃশব্দে দু দিকে মাথা নাড়ল অদিতি। সে টের পাচ্ছিল তার ভেতর থেকে একটা জেদ উঠে আসছে।

অদিতি ভাঙছিল। এক পুরনো অদিতিকে।

.

০৮.

এক দিকে এক পুরুষ্ট গোঁফ দশাসই তরুণ শাড়ি পরে ঘোমটা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে টুলের ওপর। অন্য দিকে ক্ষয়াটে চেহারার তালসিড়িঙ্গে যুবকের সর্বাঙ্গ মোটা বেডকভারে মোড়া। তার উদাস ভঙ্গি দেখে মনে হয় যেন কলকাতার চিড়চিড়ে রোদ্দুরে নয়, নরম শীতের সকালে দার্জিলিং-এর ম্যালে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের শোভা দেখছে সে। উল্টো প্রান্তে মধ্যবয়সী মানুষটি গাময় লেডিজ ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্রশবিদ্ধ যীশু। পাশেই দু হাতে দু পাটি চটি গেঁথে ফটাফট বাজাচ্ছে এক তামাটে কিশোর। সেল সেল সেল সেল সেল। লিয়ে যান, লিয়ে যান, এমনটি আর পাবেন না। দুনিয়ার শেষ পিসখানা চলে গেল।

ভরদুপুরে গড়িয়াহাটে চৈত্রের মেলা কলমুখর।

খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘর্মাক্ত যুবকটি পেশাদারী চিৎকার ছুড়ল, —ও বউদি যেয়েন না…ও বউদি শোনেন…

অদিতি বেশিদূর এগোতে পারেনি, বড় জোর চার-পাঁচ পা। বিজবিজে ভিড়ে এক কদম অগ্রসর হওয়াও এখন রীতিমতো সংগ্রাম। চতুর্দিক লোকে লোকারণ্য। লোকারণ্য নয়, প্রমীলারণ্য। একে রবিবার, তায় কাল চৈত্রসংক্রান্তির দিন মেলার মেয়াদ শেষ, তামাম কলকাতার কোনও রমণীই আজ বুঝি বাড়ি বসে নেই। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন এক বিশৃঙ্খল নারীবাহিনী যুদ্ধ শেষে উদ্দাম লুটপাটে নেমে পড়েছে। এই গুঁতেগুঁতির মাঝে হাঁটা কঠিন, স্থির থাকা বোধহয় আরও কঠিন।

অদিতি দাঁড়াতে পারছিল না। কোনওক্রমে গলা উঁচু করল, —কেন পিছু ডাকছ? তুমি তো আমার দামে দেবে না।

—আহা শোনেনই না। এ দিকে আসেন, এ দিকে আসেন।

—শোনার কিছু নেই। আমি আর এক পয়সাও বাড়াব না।

—আর দশটা টাকা?

—পারব না।

—পাঁচ?

—এক টাকাও না। তোমার কাছে ছাড়া কি আর বেডশিট নেই?

—আসেন, নিয়া যান। আর ঝঞ্ঝাট ভাল্লাগে না।

অদিতি মুখ টিপে হাসল। এই ভিড়েও লোকগুলোর সঙ্গে দরদাম চালাতে কেন যে তার এত মজা লাগে! মুখগুলো ভারী টানে অদিতিকে। মাল বেচতে কেউ কেমন মরিয়া হয়ে ওঠে, কেউ বা নিরাসক্ত, কেউ সরস সংলাপে জমিয়ে দেয় পরিবেশ! কেনা নয়, কেনার এই অনুষঙ্গগুলো অদিতির বেশি পছন্দ। এই পিছু ডাকার ধরনটাও।

ফিরছে অদিতি। উজান স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছে। পাঁচ পা আসতে কালঘাম ছুটে গেল।

অদিতিকে বাগে পেয়েই হকার ছেলেটির প্রতিশ্রুতি টাল খেয়ে গেছে। ফুল ফুল বিছানার চাদরটি পাট করতে করতে বলল,—পাঁচটা টাকা আরও দেবেন বউদি।

—কেন?

—দেখলেন না, পর পর দুদিন বাজার কেমন ঝাড় খেয়ে গেল! ঝড় বৃষ্টি…পুরো লসে ঢুকে গেলাম।

অদিতি ছদ্ম কোপে তিনটে ভাঁজ ফেলল ভূরুতে, —অ্যাই, কাল তো সন্ধের পর ঝড় উঠল! তোমাদের বাণিজ্য তো হয় সব দুপুরে!

—শেষ বাজারে দুপুর সন্ধে আর থাকে না বউদি। একটা সন্ধে লস মানে ম্যানহোলে ডুবে যাওয়া। প্লিজ বউদি, পাঁচ টাকা।

ছেলেটির কুশলী অনুনয়ে সত্যি সত্যি হেসে ফেলল অদিতি,—তুমি কিন্তু কথা ভাঙছ। এ রকম করলে কিন্তু নেব না।

সঙ্গে সঙ্গে এক হাত জিভ ঝুলে গেছে ছেলেটির। দু হাতে কানের লতি চিপল,—পাঁচটা টাকা চেয়ে নিচ্ছি বউদি। আপনি পুরাতন খরিদ্দার, আপনের থিকে কি বেশি নিতে পারি? মনে করেন গরিব দেওররে ভালবেসে পাঁচটা টাকা দিলেন।

কথার প্যাঁচও জানে বটে! পুরাতন খরিদ্দার! দেওর বউদির ভালবাসা! ঝানু গৃহিণীদের কীভাবে তলতলে করে দিতে হয়, তা একেবারে ঠোঁটস্থ। কস্মিনকালে এর কাছ থেকে কিছু কিনেছে বলে অদিতির মনে পড়ে না। ওপার বাংলাকে এপার বাংলায় মিশিয়ে ভারী মিঠে এক ভাষাও বানিয়ে ফেলেছে ছেলেটা। আহা রে, সুপ্রতিমকে কখনও ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে কেনাকাটা করতে হয় না, করলে নিশ্চয়ই চমকিত হত।

দোকানবাজার থেকে কাগজের পাট প্রায় উঠেই গেছে, এসেছে এক পলিথিন যুগ। খাবার থেকে জুতো সবই এখন প্লাস্টিকের মোড়কে। ছেলেটি এক ফিনফিন প্লাস্টিকের থলিতে আঁটোসাঁটো করে ঢুকিয়ে দিয়েছে বেডশিট, প্যাকেটখানা বিগ-শপারে সাবধানে গুছিয়ে নিল অদিতি। ছিঁচকে চোর ঘুরছেই, কে কখন প্যাকেট তুলে নেয়।

এখনও অদিতির উনকোটি রকমের সওদা বাকি। এই সেলের মরশুমেই বাপ ছেলেদের বচ্ছরকার ঘরোয়া পাজামা পাঞ্জাবি কেনা হয়। গেঞ্জি জাঙ্গিয়া আন্ডারওয়্যারও। নিজেদের শৌখিন প্যান্টজামা ছাড়া আর কিছু স্বহস্তে কেনা পোষায় না ছেলেদের। গরমে পাতলা পাতলা পাঞ্জাবি পরে সুপ্রতিম, তার জন্য বেছে বেছে গোটা কয়েক নিমা পাঞ্জারি কিনতে হবে। কাজের লোকরাও ফরমায়েশ জারি করে দিয়েছে। পয়লা বৈশাখে দুজনেরই ছাপা শাড়ি চাই। পাতলা, কিন্তু জ্যালজেলে নয়। ওহো, পিলো কভারও তো কেনা দরকার। কয়েকটা কফিমগও। নিজের জন্যও কি একটা-দুটো ছাপা শাড়ি কিনবে? সময় থাকলে দেখা যাবে।

এক দিনে এত বাজার করা কি মুখের কথা? প্রতি বছর এই কেনাকাটাই অন্তত পাঁচ দিন ধরে করত অদিতি। দিনে একটা জিনিস, বড় জোর দুটো, হেঁটে দেখে চক্কর মেরেই দিব্যি কেটে যেত কয়েকটা দুপুর। তখন ছিল অনন্ত সময়, এখন দুপুর এলেই অসংখ্য চরিত্র মাথার ভেতর হুটোপুটি করতে থাকে। ভাষা দাও। ভাষা দাও। তবু সংসার বলে তো একটা কথা আছে। আর অদিতি না করলে এ সব করবেই বা কে?

এক হৃষ্টপুষ্ট মহিলা জোর তর্ক জুড়েছে দোকানদারের সঙ্গে। কী নিয়ে বিবাদ বোঝা যাচ্ছে না, তবে মহিলার হাত মুখ নেড়ে ঝগড়া করার ধরনটা ভারী মজার। এক হাত কোমরে, অন্য হাতের তর্জনী নাচছে দোকানদারের নাকের ওপর। তুমি ওভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারো না! তুমি আমাকে বাজে জিনিস নিতে বাধ্য করতে পারো না! তুমি আজ আমায় ফিরিয়ে দিতে পারো না!

মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ভঙ্গিমা যেন চেনা চেনা!

হাজার বছরের ওপার থেকে সিগনাল ভেসে আসছে বিব বিব। ধরা পড়ছে মস্তিষ্কের রাডারে। অতলান্ত গহ্বর থেকে উঠে আসছে টাইম ক্যাপসুল। মুখটা খুলে গেল। স্কুলে কে যেন অবিকল এইভাবে ঝগড়া করত?

অদিতি চেঁচিয়ে উঠল, —অ্যাই সুজাতা…

ডাক শুনেই ঘাড় ঘুরেছে মহিলার। অদিতির চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে অপলক। বিস্ময়। সংশয়। আবিষ্কার। সহসা রাগ মুছে মহিলার মুখমণ্ডল ভরে গেল নিষ্পাপ খুশিতে, —অদিতি না?

অদিতি মাথা দোলালো।

মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে সুজাতা হাত চেপে ধরেছে অদিতির, —ইস্, কত দিইইন পর দেখা হল রে।

মস্তিষ্কের ক্যালেন্ডার ওল্টাচ্ছে অদিতি। অস্ফুটে বলল, —ছাব্বিশ বছর। না না, বোধহয় আঠাশ।

—তুই আমাকে দেখলি কী করে?

—দেখতে পাইনি তো, শুনতে পেলাম। অদিতি হাসল। কিশোরীর চপল হাসি নয়, কুয়াশা মাখা হেমন্তের হাসি। সুজাতাকে আপাদমস্তক জরিপ করতে করতে বলল,—তোর চেহারাটা পাল্টেছে। মুটিয়েছিস, চশমা নিয়েছিস, কিন্তু গলাটা যাবে কোথায়? আর ওই ঝামরে ঝামরে ঝগড়া করা?

—আর বলিস না। বলেছিল শাড়িতে দাগ থাকলে পাল্টে দেবে, দ্যাখ না এখন…

—সেলের মাল বদল হয় না মাসিমা। সত্তর টাকার শাড়ি, সাত দিন পরে নিন। পিঙপিঙে দোকানদার এখনও টিটকিরি ছুড়ছে।

ঠোঁট কামড়ে কয়েক সেকেন্ড ক্রূর চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল সুজাতা। সম্ভবত দৃষ্টি দিয়ে খুন করার চেষ্টা করছিল। না পেরে অলস ঔদার্যে বলল,—যাও যাও ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতে কারও সঙ্গে এ রকম চিটিংবাজির চেষ্টা কোরো না।

অদিতি এক দৃষ্টে দেখছিল সুজাতাকে। স্কুলের সেই শ্যামলা ছিপছিপে লম্বাটে মুখ মেয়েটা এখন থপথপে গিন্নি। চুল কমে কপালে চড়া পড়েছে, জুলপির কাছে ঝুরো চুলে চিকচিক রুপোলি আভা, চশমার নীচে চোখের কোল ফোলা ফোলা, গলায় দু-তিনটে স্পষ্ট বৃত্তাকার ভাঁজ।

আঠাশ বছর সময় অদিতিকেও কি এতটা পাল্টে দিয়েছে! আয়নায় প্রতিনিয়ত যে মুখ দেখে অদিতি সে মুখের তো বড় একটা বদল হয় না! কিংবা হয়। নিঃসাড়ে। এই পরিবর্তন এত ধীর যে নিজের প্রতিবিম্বও তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারে না। অদিতির চোখে নিকটজন এবং নিকটজনের চোখে অদিতি দুটোই এমন নিত্যদিনের ছাঁচে ঢালা, যে সময়ের প্রবাহ এখানে প্রায় স্থবির। সর্বক্ষণই মনে হয় এই আমি তো সেই আমি। পনেরোয় যা ছিলাম পঁচিশেও তাই, পঁয়তাল্লিশেও। তিরিশ বছর দর্পণে নিজেকে না দেখে সহসা যদি কেউ আপন চেহারা বিম্বিত হতে দেখে, তবে কি সুজাতাকে দেখারই অনুভূতি হয়! কে জানে!

সুজাতা বুঝি অদিতির মনের কথাটা ধরে ফেলেছে। চটাস করে অদিতির কাঁধে চাপড় মেরে বলল, —তোর কিন্তু খুব একটা চেঞ্জ হয়নি। এএএকটু শুধু…রহস্যটা কী রে?

—কিছু রহস্য নেই। সংসার করছি, খাটাখাটুনি করছি, ছেলেদের পেছনে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে মোটা হওয়ার সময় পেলাম কই!

—ছোটাছুটি আমিই বা কী কম করি রে। একসঙ্গে অফিস সংসার ছেলেমেয়ে বড় করা, বরের মন জোগানো…

—ওমা, তুই চাকরি করছিস? কোথায়?

—রেলে। ফেয়ারলি প্লেসে। তুই?

অদিতি ফিক করে হাসল, —জেলে। হাজব্যান্ডস প্লেসে। আজীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত গৃহবধূ।

বয়স ভুলে দুই বন্ধু হেসে উঠল খিলখিল।

—তোকে দেখে আমার হিংসে হচ্ছে রে। ঘরে বসে থেকেও তুই মোটাসনি। আর আমি…

—মনে আছে স্কুলে মোটা মেয়ে দেখলে তুই হেসে গড়িয়ে পড়তিস? বি সেকশানের কাজল বলে একটা মেয়ে ছিল, তাকে তুই কুমড়োপটাশ বলে খেপাতিস?

—যাহ, আমি অত মোটা হইনি। এই জানিস, সেই কাজল এখন কী রোগা হয়ে গেছে। গত বছর এক্সপোতে দেখা হল…কেমন শুকনো চেহারা, কণ্ঠা বেরিয়ে গেছে…

—কাজলের বর মারা গেছে না? স্ট্রোকে?

—হ্যাঁ রে, কী স্যাড। দীপ্তিকে মনে আছে তোর…

চৈত্রমেলায় দুই বান্ধবী কথা বলে চলেছে কলকল। অতীতকে ছুঁয়ে নিচ্ছে, বর্তমানকে উগরে দিচ্ছে। তিন মিনিটে পরস্পরের ঠিকুজিকুষ্ঠি জানা শেষ। অদিতি কবে ফ্ল্যাট কিনল, সুজাতা কবে বাড়ি করেছে কসবায়, সুজাতার টাবলু ইঞ্জিনিয়ারিং-এ কোন্ ইয়ার, মুনিয়া সামনের বার উচ্চমাধ্যমিক দেবে, সুপ্রতিম মাসে কত দিন ট্যুরে যায়, কদিন বাড়ি থাকে, সুজাতার বর ব্যাঙ্কের কোন্ শাখা থেকে কোন্ শাখায় বদলি হয়েছে, ব্যাঙ্ক ইউনিয়নের পাণ্ডা বলে কত তার হাঁকডাক, পাপাই তাই কী কী ভালবাসে না, টাবলু মুনিয়া কী দেখলে নাক সিটকোয়, সব খবরই দেওয়া নেওয়া হয়ে গেল। তবু যেন কথা ফুরোয় না। আরও কথা আছে। আরও কথা।

কালকের বৃষ্টি বেশ মুষলধারেই হয়েছিল। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। রাস্তায় এখনও প্যাচপেচে কাদা। বৃষ্টির পর রোদ্দুরেরও আজ খুব মেজাজ। পশ্চিম আকাশে পৌঁছেও গলগল তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য। গা হাত পায়ে জ্বালা ধরে যায়।

ছোট্ট রেস্টুরেন্টের আরও ছোট্ট ঘেরাটোপে মুখোমুখি বসেছে দুই বান্ধবী। মাঝখানে নুন গোলমরিচ। নুনের কৌটো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে অদিতি, গোলমরিচের কৌটোয় আঙুল বোলাচ্ছে সুজাতা।

—অ্যাই, মানসীর কোনও খবর জানিস্?

—নাহ্, বহুকাল দেখা হয় না। সেই যখন এন আর এস-এ ডাক্তারি পড়ছিল, তখন একবার শেয়ালদায় দেখা হয়েছিল। বোধহয় তখন ইন্‌টার্নি। স্বাগতা বলছিল মেডিকেলেরই কোন্ ব্যাচমেটকে বিয়ে করেছে।

—স্বাগতার সঙ্গে দেখা হয়?

—মাঝে মধ্যে। ন মাসে ছ মাসে। বিশাল চাকরি করছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে। ওর লাকটা খুব ভাল। পরীক্ষা দিয়ে ঢুকেছিল, প্রোমোশান পেয়ে পেয়ে অনেক উঠে গেছে।

—লাক কেন বলছিস্? স্বাগতাই তো আমাদের মধ্যে লেখাপড়ায় সব থেকে ব্রিলিয়ান্ট ছিল। অঙ্কে কখনও নয়ের ঘরের নীচে পায়নি।

—তুই বা কী কম ছিলি রে? বাংলা ইংরিজিতে স্বাগতা কোনওদিন তোকে ছুঁতে পেরেছে? কী সুন্দর গল্প লিখতিস্, কবিতা লিখতিস্…

অদিতির বুকটা হঠাৎ টনটন করে উঠল। সে কবে কী পারত, আঠাশ বছর পরেও মনে করে রেখেছে বন্ধু, অথচ সে নিজেই ভুলে গিয়েছিল কথাটাকে। ভুলে গিয়েছিল, না ভুলে ছিল? পলকের জন্য অদিতির ইচ্ছে হল সুজাতাকে বলে ফেলে আবার সে শুরু করেছে গল্প লেখা, পর মুহূর্তে মত বদলালো। বাড়ির লোকেদের তরল ঔদাসীন্য তাও অত গায়ে লাগে না, কিন্তু চাকুরে সুজাতা যদি গৃহবধূ বান্ধবীর এই চেষ্টাকে ‘ভালই তো মন্দ কী’ গোছের বাহবা দেয়, সেটা অদিতির সহ্য হবে না।

নিশ্বাস চেপে প্রসঙ্গ ঘোরাল অদিতি। হাসতে হাসতে বলল, —তুইও তো কী ভাল তর্ক করতিস্। আমরা বলতাম সুজাতা বড় হয়ে উকিল না হয়ে যাবে না।

—ওমা, জানিস না? আমি তো উকিলই হয়েছিলাম! সুজাতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছে,—ল পাশ করলাম, হাইকোর্টে প্র্যাকটিস্ শুরু করলাম। গলায় সাদা বো বেঁধে, ফুলহাতা ব্লাউজ পরে, কালো গাউন চাপিয়ে…

—চাকরি করছিস বললি যে?

উচ্ছ্বাস মরে গিয়ে সুজাতা চকিতে মেঘলা বিকেলের মতো ম্লান। বেয়ারা দু প্লেট ফিশফ্রাই রেখে গেছে, কাঁটাচামচ দিয়ে আস্তরণটা খুঁটছে। প্লেটের দিকেই চোখ তার, তবু যেন নয়ন মেলে দিয়েছে বহু দূরে। বিড়বিড় করে বলল,—প্র্যাকটিস্‌টা ছেড়ে দিতে হল।

—কেন? জমাতে পারলি না?।

—জমানো তো কঠিনই। তবু হচ্ছিল কিছু কিছু। আমার সিনিয়ার ছিলেন দীপেশ বাগ্চি, তাঁরই ছত্রচ্ছায়ায় ছিলাম বলতে পারিস্। নিজেও দু-একটা ইনডিভিজুয়াল কেস করছিলাম…।

—তো?

—বিয়ের পর সব ভেস্তে গেল।

—কেন, তোর শ্বশুরবাড়ি কি খুব কন্জারভেটিভ্?

—এক কথায় বলা খুব কঠিন রে। তার আগে বুঝতে হবে কনজারভেটিভ্ কাকে বলে।

অদিতি হাঁ করে তাকিয়ে আছে।

সুজাতা মলিন হাসল,—বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। আমাদের বিয়েটা লাভ ম্যারেজ। বিকাশ তো ব্যাঙ্কে ঢোকার পর থেকেই ইউনিয়ন করে, মাঝে মাঝে আসত হাইকোর্টে। আমার সিনিয়ারের কাছে। তখনই আমাদের চার চোখে মিলন। হাইকোর্টের উকিল মেয়ে দেখে কেউ যে অমন পাগল হতে পারে, আমার বরকে না দেখলে তুই বিশ্বাসই করতে পারবি না। ঘন ঘন কোর্টে আসতে শুরু করল। ঘন ঘন কেন, রোজই। নিজেদের কেসের কথা আর কতটুকু থাকে, সারাক্ষণ আমি যে কোর্টে যাচ্ছি সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মতো ড্যাশিপশি স্মার্ট মেয়ে নাকি জীবনে দেখেনি! আমায় কোথায় প্রোপোজ করেছিল জানিস? চিফ জাস্টিসের কোর্টরুমে। ফাঁকা ঘরে একদম পেছনে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার হাত চেপে ধরে বলেছিল এই আইনের মন্দিরে শপথ করে বলছি, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।

—বাহ্ দারুণ রোম্যান্টিক ব্যাপার তো!

—হুঁ। শুনতে সেরকমই লাগে। এক কুচি শশা মুখে তুলে কচকচ চিবোচ্ছে সুজাতা,—তা বিয়েটা তো হয়ে গেল। শ্বশুরবাড়ির লোকেরও আমাকে নিয়ে তখন কী আহ্লাদ। পাড়াপ্রতিবেশী সকলকে ডেকে ডেকে লইয়ার বউ দেখায় আমার শাশুড়ি। শ্বশুরমশাই বাড়িঅলাকে শাসায় ঘরে উকিল বউ এসে গেছে, আর আপনাদের ভয় পাই না। এদের কি গোঁড়া বলা যায়?

—তা হলে?

—তা হলে আর কিছু নেই অদিতি দেবী, পৃথিবীটা যে গোল সেই গোলই থেকে গেল। এক বছর যেতে না যেতেই শ্বশুরের মনে হতে লাগল সিনিয়ারের চেম্বার থেকে আমি অনেক রাত করে বাড়ি ফিরছি, শাশুড়ির মনে হতে লাগল বউ সংসারের কোনও কাজই তো করে না, ব্যস্ লেগে গেল অশান্তি।

—আর বর?

—বর মুখে কিছু বলত না। প্রগতিশীল মানুষ তো, পার্টি-ফার্টি করে…। তবে তার হাবভাবে আমি টের পেতাম। আরে ভাই, প্রেম করার জন্য ড্যাশিপশি মেয়ে ঠিক আছে, ভীষণ অ্যাট্রাক্টিভ্। কিন্তু বিয়ে করলে সব পুরুষই বউকে একটু শাঁখা সিঁদুর নোলকে দেখতে ভালবাসে। নিজে বিছানায় শুয়ে ইউনিয়নের গল্প করতে পারে, বউ কোর্টকাছারির কথা বললেই মনে হবে পাশে একটা আইনের বই শুয়ে আছে। শ্বশুর শাশুড়ি বর যাকেই কোনও কথা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে যাই সেই ভাবে আইনের ধারা দেখাচ্ছি। ফেডআপ্ হয়ে প্র্যাকটিসের চেষ্টা ছেড়ে দিলাম।

—নিজেই ছাড়লি?

—অগত্যা। ঘর সামলাতে গেলে সিনিয়ার কথা শোনায়, কাজে বেশি ইনভলভড্ হলে ঘর। এর মধ্যে ছেলেটাও হয়ে গেল… পুরোপুরি ফেরে পড়ে গেলাম।

—চাকরিটা ধরলি কবে?

—ছেলে হওয়ার পর। বরই বলল ঘরে চুপচাপ বসে থেকে কী করবে, একটা সাদামাটা সরকারি চাকরির চেষ্টা করো। বয়সটা ছিল, পরীক্ষায় বসলাম, জুটেও গেল। সব দিকে শান্তি। নো অ্যাম্বিশান। নাথিং।

—অত আফসোস করছিস কেন? তাও তো তুই একটা চাকরি-বাকরি করছিস্, পাঁচ জনের সঙ্গে মিশছিস। স্বাধীন জীবন…

—স্বাধীন জীবন না হাতি। চাকরি করা মেয়েদের পায়ে শিকলটা আরও শক্ত করে বাঁধা থাকে। সকাল থেকে কুকুরের মতো দৌড়ে মরো, রান্না দেখো, বর মেয়ের টিফিন গোছাও, তবু ভাগ্য ভাল ছেলে এখন হোস্টেলে থাকে, নইলে তারও ফরমাশ থাকত। তারপর নাকে-মুখে গুঁজে ভিড় বাসে যুদ্ধ করতে করতে অফিস দৌড়োও। সেখানেও আতঙ্ক, লাল দাগ পড়ে যাবে। তার পরও কত চিমটি কাটা কথা চালাচালি হয় অফিসে। মেয়েরা কেন যে শুধু শুধু ছেলেদের ভাত মারতে অফিসে আসে! অত যদি বাড়ির চিন্তা তো বাড়ি বসে থাকলেই হয়! কাজ করবে কী, চারটে বাজতে না বাজতে বাড়ি ফেরার জন্য সব ছোঁক ছোঁক করছে!

অদিতির ভুরু জড়ো হল,—তোরা মুখ বুজে শুনিস এ-সব?

সুজাতা হেসে ফেলল, —সুখে আছিস রে ভাই, এক নৌকোয় পা দিয়ে আছিস্। ঘর বার দুটো এক সঙ্গে সামলানো হল গিয়ে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা। কন্‌টিনিউয়াস্ ব্যালান্স। সেই কোন্ যুগে চাকরিতে ঢুকেছিলাম, এখনও সার্কাসের খেলা দেখিয়ে যাচ্ছি।

চা এসে গেছে। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে মুখটা মুছল অদিতি। ঠিক বুঝতে পারছিল না কোন জীবনটা সুজাতা চেয়েছিল? ঘরের, না বাইরের? হাল্‌কাভাবে বলল,—এত কষ্ট করে এখন আর চাকরি করার দরকার কী? ছেড়ে দিলেই পারিস্?

—ওরে ব্বাস্, কী বললি রে? সংসারে আমার মাইনেটাও তো লাগে। ওটা চলে গেলে আমার কর্তার বাজেট ফেল্ মেরে যাবে না?

—তা হলে তোর বরেরও সংসারের দায়িত্ব কিছু নেওয়া উচিত। একা একা বাড়ির চিন্তা ভাবতে গেলে তোকে যে অফিসে কথা শুনতে হয়, এ কথাটাও তো তার চিন্তা করা দরকার।

—ভাবে বই কী। মনে মনে ভাবে। ইউনিয়ন মিটিং-এ লেকচার দেওয়ার সময় ভাবে। আর বাড়ি এসে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে শুয়ে পড়ে। কখন ফিরেছ? এই এলে বুঝি? গরম গরম এক কাপ চা খাওয়াও তো, বড্ড টায়ার্ড। ও, তুমিও টায়ার্ড! তা হলে আর চায়ের ঝামেলায় যেয়ো না, কফি বানাও।

সুজাতার কথায় হাসতে হাসতে অদিতি বিষম খাওয়ার জোগাড়। বলল,—এ যে দেখছি আমার বরের কার্বনকপি রে।

—সে তো হবেই। বর তো দুনিয়ায় একটাই থাকে। মানে একটা ছাঁচ। হাতের মুদ্রায় শূন্যে একটা মানুষের অবয়ব ফুটিয়ে তুলল সুজাতা,—এই একটা বর থেকেই জেরক্স হয়ে হয়ে লাখে লাখে কোটিতে কোটিতে বর বেরোতে থাকে। কেউ অদিতির বর হয়, কেউ সুজাতার, কেউ মানসীর, কেউ স্বাগতার। এ ভাই বিশ্বজনীন সিস্টেম। আমেরিকাতেও আছে, চিন জাপানেও আছে, ফ্রান্স জার্মানিতেও আছে।

—যাহ্, তুই আবার বাড়াচ্ছিস্‌। হাসতে হাসতে সখীকে চিমটি কাটল অদিতি,—আমাদের নীচের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক তো দেখি তাঁর স্ত্রীকে খুব সাহায্য করেন। যেদিন কাজের লোক আসে না, বউয়ের কুটনো কুটে দেন, ঘর ঝাড়েন, এমন কি বাসন পর্যন্ত মাজেন।

—ওগুলো জেরক্সের ডিফেক্‌টিভ কপি। দেখিস্‌নি জেরক্সে কোনও কপি তেড়া বেঁকা হলে, কী কালি বেশি কম হলে সে কপিগুলোকে ফেলে দেওয়া হয়? তারাই হল ওই সব লক্ষ্মী বর। আমাদের অফিসেও আছে দু-এক পিস। তাদের নিয়ে যা ঠাট্টাতামাশা চলে! আমরা মেয়েরাও করি। বলি জরু কা গুলাম। সুজাতা চোখ টিপল,—বাঁদি দেখে দেখে চোখ সয়ে গেছে, গোলাম দেখলে চোখে লাগে। যাক গে যাক, এ-ভাবে তো যা হোক করে কাটিয়েই দিলাম জীবনটা। আর বিশ-পঁচিশটা বছর টেনে দিতে পারব না?

হাসতে হাসতে কথা বলছে সুজাতা, তবু যেন হাসিতে কোথায় একটা চোরকাটা বিঁধে আছে। অদিতি বুঝতে পারছিল।

বাড়ি ফিরে মড়ার মতো শুয়ে রইল অদিতি। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে এতকাল পর দেখা হয়ে মনটা কোথায় নীল আকাশ হয়ে যাওয়ার কথা, তার বদলে কোত্থেকে একরাশ বাদলে মেঘ এসে জড়ো হচ্ছে মনে। উঠে কেনাকাটাগুলোও দেখতে ইচ্ছে করছে না। সুপ্রতিম আর তাতাই ড্রয়িং স্পেসে। তাদেরও দেখার কোনও চাড় নেই। খবরের কাগজ খুলে দুজনের গজল্লা চলছে। ছেলেও আজকাল শেয়ার মার্কেটে উৎসাহী হয়ে পড়েছে। বাজারের ওঠা নামা নিয়ে সপ্তাহভর গবেষণা চলে বাপ ছেলেতে। সপ্তাহ শেষে মিলোয় কার অনুমান সঠিক। তাতাই বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছে কিনা সেদিকে বাবার নজর নেই, কিন্তু অদিতির অপছন্দের এই নেশাটাকে দিব্যি ছেলের মধ্যে চারিয়ে দিচ্ছে।

খানিক পরে সুপ্রতিম ঘরে এল। বোধহয় দেশলাই-টেশলাই খুঁজতে। ঈষৎ গুমরোনো অদিতিকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল,—হল কী তোমার? এসেই শুয়ে পড়েছ কেন?

আড়াআড়িভাবে হাতে চোখ চাপা দিল অদিতি। চিত হল,—এমনিই।

—শরীর খারাপ লাগছে?

—না।

—মাথা ধরেছে? উফ্, যা রোদ্দুর ছিল আজ।

—তাতে তোমার কী এসে যায়? তুমি তো আর ছাতা নিয়ে আমার সঙ্গে যাওনি!

—আমি গেলে প্রাণভরে চষতে পারতে?

চষই বটে। হাল চষা। তবে গরু লাঙল জমি তিনটেই অদিতি, এই যা। ভারী স্বরে অদিতি বলল,—ডাইনিং টেবিলে ফিশফ্রাই-এর প্যাকেট রাখা আছে, গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নাও। যাওয়ার সময়ে আলোটা নিবিয়ে দিয়ে যেয়ো।

—কী ব্যাপার বলো তো? গল্পের প্লট-ফ্লট মাথায় ঘুরছে নাকি? সুপ্রতিম হাসছে।

অদিতি বলতে পারত আমি কি সারা দিনই গল্প ভাঁজি? তা হলে তোমাদের সংসারটা চালায় কে? বলে কী লাভ, কে বোঝে!

বাইরে মেঘ জমছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। নীল শিখায় আকাশের এক পাশ ফালা ফালা হয়ে গেল। ঝড় উঠছে বোধহয়।

.

০৯.

পাপাই হাঁক দিল,—মা, তোমার ফোন।

অদিতি স্নানে ঢুকেছিল। কী তাপ, কী তাপ, বৈশাখ মাসটা এবার পুরো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিল। সন্ধেবেলার দিকে এ সময়ে একবার গা মাথায় জল না ঢাললে শরীর কেমন অস্থির অস্থির করে।

শাওয়ার বন্ধ করে সাড়া দিল অদিতি,—কার ফোন?

—শর্মিলা কাকিমার।

—কে? অদিতি একটু অবাকই হল। হঠাৎ শর্মিলা তাকে ফোন করছে কেন? শর্মিলা তো ইদানীং অদিতিদের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না।

পাপাই প্রশ্ন করল,—এক্ষুনি বেরোবে, না পরে করতে বলব?

—ধরতে বল্। আসছি।

অদিতি গা মুছল না, ভেজা গায়েই শাড়ি ব্লাউজ চড়িয়ে নিল। যতক্ষণ গায়ে জলটা থাকে ততক্ষণই আরাম।

আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে রিসিভার তুলল অদিতি,—কীরে, তুই হঠাৎ?

—তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা ছিল। শর্মিলার গলা ভার ভার।

—আমার সঙ্গে? বল্।

—ফোনে বলা যাবে না। তুই আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবি?

—এখানে চলে আয় না।

—তোর ওখানে? শর্মিলা যেন থমকাল,—কথাটা একটু কন্ফিডেনশিয়াল। তোকেই বলতে চাই। কখন তোকে একা পাওয়া যাবে?

—দুপুরের দিকে একা থাকি।

—দুপুর? শর্মিলা আবার কী যেন ভাবছে,—ঠিক আছে। কাল থাকবি?

—থাকব। অদিতি সামান্য কৌতূহলী হল,—তোর ছেলের খবর কী?

—ভাল আছে।

অদিতি আরেকটু টোকা দিল,—তুই কি বাপের বাড়ি থেকে ফোন করছিস?

—না। পাবলিক বুথ থেকে। শর্মিলা আবার থেমে থেকে বলল,—আমি যে যাব সেটা কিন্তু কাউকে বলিস্ না। আই মিন্ সুপ্রতিমদাকে। প্লিজ।

টেলিফোন রেখে একটুক্ষণ ভাবল অদিতি। শর্মিলার ব্যক্তিগত সমস্যায় অদিতির কী করার আছে? অদিতি যত দূর শুনেছে দীপকদার সঙ্গে শর্মিলার ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটা কোর্টে চলে গেছে। সুপ্রতিমকেই বা বলতে বারণ করল কেন? সুপ্রতিম কি শর্মিলার সঙ্গে কিছু…? ধ্যাৎ, তা কি করে হয়? তেইশ বছর ঘর করে হাতের তালুর মতো চেনা মানুষটাকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবল অদিতি? ছিহ্। দীপক-শর্মিলার সঙ্গে হাজার একটা পার্টি পিকনিকে গেছে অদিতি, বছর আষ্টেক আগে একবার এক সঙ্গে দেরাদুন মুসৌরি বেড়াতে গিয়েছিল, কোনওদিন তো শর্মিলা সম্পর্কে সুপ্রতিমের তিলমাত্র অশোভন আগ্রহ দেখেনি! বরং বন্ধুপত্নীদের সঙ্গে সুপ্রতিম একটু দূরত্ব বজায় রেখেই চলে। পিছনে লাগে, ফাজলামি ইয়ার্কি করে, তবে সবেতেই খুব সচেতন, মাপা। এ ব্যাপারে বউমহলে সুপ্রতিমের বেশ সুনাম আছে। শর্মিলা কি তবে দীপকদার সঙ্গে মিটমাট করতে চায়? অদিতিকে মিডিয়াম করবে? সেটাই বা সুপ্রতিমকে গোপন করতে হবে কেন? লজ্জা? আর কী হতে পারে?

কাল্পনিক ভাবনায় চাঁদি গরম করা পোষাল না অদিতির। তার হাতে এখন অনেক কাজ। পাপাইয়ের পরীক্ষা চলছে, এ সময়ে ছেলের কিছু কিছু বাতিক সামলাতে হয় অদিতিকে। সারা দিন ধরেই। দুপুরে রাতে কখনই পাপাই এখন পেট পুরে খাবে না, তাতে নাকি ঘুম পেয়ে যায়। আবার খালিও রাখা চলবে না পেট, খিদে পেলে পাপাইয়ের মনঃসংযোগে অসুবিধা হয়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এখন খাওয়ার আয়োজন। সন্ধেবেলা একবার মিল্কশেক খাবে, আটটা নাগাদ আম। সেই আম আবার কেটে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতে হবে এখনই, যথেষ্ট ঠাণ্ডা না হলে আমে নাকি স্বাদ আসে না। এরই মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে বন্ধুরা আসছে অথবা হঠাৎ হঠাৎ ঊর্ধ্বশ্বাসে বন্ধুদের বাড়ি ছুটছে পাপাই, তাড়া তাড়া নোটস্ ধরিয়ে দিচ্ছে অদিতিকে। মা, প্লিজ চটপট জেরক্স করে এনে দাও না। নিজের লেখাই এখন শিকেয় তোলা, অন্যের ভাবনা নিয়ে গালে হাত দিয়ে বসবে অদিতি! আর সুপ্রতিমকে এক রাত কথাটা না বললে অদিতির কি পেট ফেটে যাবে। কাল দুপুর অবধি দেখাই যাক।

পরদিন দুপুরে ফুটিফাটা রোদ মাথায় করে এল শর্মিলা। পাপাইয়ের আজ থিয়োরিটিকাল পরীক্ষার শেষ দিন, কাজের লোকরাও বাড়িতে নেই, ফ্ল্যাট আক্ষরিক অর্থেই শুনশান। শর্মিলা তবু অস্বস্তি ভরা চোখে দেখছে চারদিক। প্রচণ্ড উত্তাপে মুখ থমথমে লাল। দরদর ঘামছে। ভূমিকা না করেই আসার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দিল। সুপ্রতিম নাকি দীপককে নিয়ে শর্মিলার বাপের বাড়ি গিয়েছিল, শর্মিলার অনুপস্থিতিতে শর্মিলার বাবা মাকে ভয় দেখিয়ে এসেছে। শর্মিলা যদি ছেলের হেপাজতের দাবি ছেড়ে না দেয় তা হলে কোর্টে শর্মিলাকে ব্যভিচারিণী প্রমাণ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে দীপক। শুধু এটুকুই নয়, টিনটিনের স্কুলেও নাকি বার দুয়েক হানা মেরেছে দীপক আর সুপ্রতিম। স্কুলের প্রিন্সিপালের কাছে শর্মিলার নামে প্রচুর কুৎসা রটনা করেছে, একদিন নাকি টিনটিনকে জোর করে স্কুল থেকে তুলে আনতে চেয়েছিল। দীপক অতি হীন চরিত্রের মানুষ, সে যে এরকম কিছু করবে সেটা নাকি আন্দাজ করেই আগাম থানায় খবর দিয়ে রেখেছে শর্মিলা। তার অভিযোগ, এর মধ্যে সুপ্রতিম কেন?

সবটুকু শুনে অদিতি নিথর বসে রইল কিছুক্ষণ। আশ্চর্য, সুপ্রতিম তাকে কিছুই বলেনি! সুপ্রতিমের মতো মানুষ এই ধরনের ছেলেমানুষি কাণ্ড করেছে! তাও এই বয়সে, যখন প্রায় বাণপ্রস্থে যাওয়ার সময়! এই মধ্যবয়সে সুপ্রতিমকে প্রায় এক ভাড়াটে গুণ্ডার অপবাদ দিচ্ছে একটা বাইরের মেয়ে, অদিতিকে বসে হজম করতে হচ্ছে! ছিহ্।

অদিতি শুকনো গলায় বলল,—আমাকে এ-সব না বলে তুই ডাইরেক্ট সুপ্রতিমের সঙ্গে কথা বলছিস্ না কেন?

শর্মিলা সোফায় হেলান দিয়েছে। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। দু দিকে মাথা নেড়ে বলল,—ভরসা হয়নি। দীপকের সঙ্গে সুপ্রতিমদার এত ভাব…। ভাবলাম তোকে আগে বলি। তুই তো মেয়ে, তুই নিশ্চয়ই আমার অবস্থাটা ফিল করতে পারবি।

অদিতি শর্মিলার কাঁধে হাত রাখল,—তুই একটু বোস্। …অফিস যাস্‌নি আজ?

—না। বাড়ি থেকেই আসছি।

—হাঁপাচ্ছিস খুব। দাঁড়া একটু শরবত করে আনি।

দু-এক চুমুক দিয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখল শর্মিলা, সেন্টার টেবিলে দৃষ্টি স্থির। অস্ফুটে বলল,—তোর শুনতে খুব খারাপ লাগল, তাই না রে?

খারাপ লাগা! অভিমান! ক্রোধ! অপমানবোধ! ঠিক কী অনুভূতি যে হচ্ছে অদিতি নিজেই জানে না। প্রাণপণে গলা স্বাভাবিক রেখে বলল,—আমার বর কতটা ইনভলভড্ আমি জানি না। তবে যদি কিছু করে থাকে ঠিক কাজ করেনি। কিন্তু তুই আমাকে একটা কথা বল তো? দীপকদাই বা তোর ওপর এত হিংস্র হয়ে উঠল কেন? তাও বিয়ের বিশ বছর পর?

—স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ঠিক কেমন তা কি বাইরে থেকে বোঝা যায় রে? বিশেষ করে আমাদের মতন ভদ্র বাড়িতে? শর্মিলা নিজের নিশ্বাসে নিজে কেঁপে উঠল,—ও আজ থেকে তো এরকম নয়, বরাবরই…

—তা হলে তুই আগেই ডিভোর্স করিসনি কেন?

—আমরা মেয়েরা কি চট করে সংসার ভাঙতে পারি? না ভাঙতে চাই? সব সময়ে ভাবি ফাঁকফোঁকরগুলো রিপু করে করে চালিয়ে নেব। বিয়ের পর বাচ্চা হতে দেরি হচ্ছিল, তখন কী যাচ্ছেতাই না করেছে। তুমি ইচ্ছে করে বাচ্চা চাও না! তোমার খুব রূপের অহঙ্কার! জানিস্ একদিন আমাকে গেলাস ছুড়ে মেরেছিল, একটুর জন্য চোখ বেঁচে গেছে। এক একবার তুলকালাম করে তারপরেই এমন কান্নাকাটি শুরু করে দিত…। বিয়ের আট বছর পর যখন টিনটিন পেটে এল ভাবলাম এবার অন্তত ঠাণ্ডা হবে। তখন শুরু হল সন্দেহ। ও বাচ্চা আমার নয়!

—কেন, এরকম সন্দেহ এল কেন?

—সন্দেহের কি কারণ লাগে রে?

—এমনি এমনি সন্দেহ এল! অদিতি ঈষৎ কটাক্ষ করল,—নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছিল যাতে দীপকদার বিশ্বাস ভেঙে গেছিল?

শর্মিলা আহত হল না। তার সুন্দর ডিম্বাকৃতি মুখে লালচে আভা ফুটেও মিলিয়ে গেল। হাসল, বড় শীর্ণ হাসি। শান্তভাবে বলল, —দেখ্ অদিতি, বিশ্বাস, বিশ্বাস ভাঙা, সন্দেহ এ-সব বড় আজব শব্দ। সবই মানুষের মনগড়া, কিন্তু রকমফের আছে। মানুষ গাছপালা পশুপাখি জীবজন্তু এদের মতো বিশ্বাসেরও একটা শরীর থাকে। আমাদেরই তৈরি করা, তবু আছে। তার লয়-ক্ষয় আছে, ভাঙনও আছে, মৃত্যুও আছে। কিন্তু সন্দেহ হল অশরীরী। ধোঁয়ার মতো। কুয়াশার মতো। এ এমন ধোঁয়া যা চোখে দেখা যায় না, অথচ চোখের মণিতে লেগে থাকে। ওই ধোঁয়াচোখে তাকালে সব কিছু আবছা। একে মারা যায় না, কাটা যায় না, উপড়োনো যায় না। বুঝতে পারছিস কী বলতে চাইছি? সন্দেহের জন্য কোনও উপকরণ লাগে না রে। আমাদেরই দুর্বলতার ছিদ্র দিয়ে সন্দেহ মনের ভেতর ঢুকে পড়ে। চারপাশের জগৎ থেকে উপকরণ খুঁজে নিয়ে আমরা সেটাকে মেলাতে চাই। একটা না মিললে আরেকটা উপকরণ খুঁজি, সেটা না মিললে আরেকটা। দীপক তো আমাকে বিশ্বাসই করেনি, বিশ্বাস ভাঙার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? তার তো আগাগোড়াই সন্দেহ। বাচ্চা হচ্ছে না কেন তাই নিয়ে সন্দেহ, বাচ্চা হচ্ছে কেন তাই নিয়ে সন্দেহ। আমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলে সন্দেহ, দেরিতে ফিরলে সন্দেহ। ভাবতে পারিস, আমার এখন বয়স হয়ে গেছে, একটা বারো বছরের ছেলের মা, আমাকে একটা বাচ্চা আঠাশ তিরিশ বছরের ছেলের সঙ্গে সন্দেহ করে? ছেলেটার দিদি মরে গেছে, আমাকে দিদি দিদি করে…। অথচ দেখ, ধীরাদিকে জড়িয়ে অনেকে তো ওর সম্পর্কে অনেক কথা বলে। আমি কান দিইনি, এখনও দিই না। কেন দেব বল? আমার স্থির বিশ্বাস, দীপক পৃথিবীতে নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই ভালবাসতে পারে না। ওই মানুষ করবে অ্যাফেয়ার? তা হলে আমার ধীরাদির ওপর করুণা হবে।

শান্ত মুখে শুরু করেও উত্তেজিত হয়ে গেছে শর্মিলা। টেবিল থেকে গ্লাস তুলে এক ঢোঁকে পুরো শরবতটা খেয়ে নিল। শরীর ছেড়ে দিয়েছে সোফায়। চোখ বুজেছে।

অদিতি কুণ্ঠিত মুখে বলল,—সব বুঝলাম। তবু বলি, টিনটিনকে নিয়ে টানাটানিটা কি না করলেই নয়?

—না, দীপকের শাস্তি পাওয়া দরকার। শর্মিলা হঠাৎ ফুঁসে উঠেছে,—এখন ছেলে ছেলে করে কাঁদছে, অথচ একদিন এই ছেলেকেই দীপক…। আসলে কী জানিস্, টিনটিনকে কেড়ে নিয়ে ও আমাকে জব্দ করতে চাইছে। আমি প্রাণ থাকতে টিনটিনকে ছাড়ব না। আমার এগেনস্টে ও যদি পাঁচটা অ্যালিগেশান আনে, আমি ওর এগেনস্টে পঞ্চাশটা অ্যালিগেশান আনব। অনেক ইনসাল্ট সহ্য করেছি, আর নয়। যখন কম বয়স ছিল তখন অনেক সোস্যাল বেরিয়ার ছিল, আমি এখন আর কিছুকে ভয় পাই না।

অদিতি শর্মিলাকে দেখছিল। কুড়ি বছর এক সঙ্গে ঘর করার পরও পারস্পরিক সম্পর্কে এত বিতৃষ্ণা জমতে পারে? তা হলে সম্পর্ক কথাটার অর্থ কী? শিকড়বিহীন হয়ে শুধু ডালপালা ফুলপাতা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা? অথবা দড়ির ওপর হাঁটা? ব্যালান্স্ করতে করতে? সার্কাসের খেলার মতন?

রাত্রে শোওয়ার আগে কথাটা তুলল অদিতি। সরাসরি নয়, একটু বাঁকা পথে। নিরীহ মুখে সুপ্রতিমকে জিজ্ঞাসা করল,—হ্যাঁ গো, দীপকদার সেই কেসটার কী হল?

স্নান সেরে এসে চুল আঁচড়াচ্ছিল সুপ্রতিম। বলল,—মামলা চলছে।

—কে শেষ পর্যন্ত করল মামলা? দীপকদা, না শর্মিলা?

—শর্মিলা। তবে দীপকও ছাড়নেঅলা নয়, লড়ে যাবে।

—কী নিয়ে লড়বে? ডিভোর্স নিয়ে? দীপকদা কি ডিভোর্স দিতে চায় না?

—দীপক টিনটিনকে দিতে চায় না। ছেলের কাস্টডি নিয়ে মনে হয় জোর টানাটানি চলবে।

গরমকালে রাত্রে এ বাড়িতে মশারি টাঙানোর চল নেই, রাসায়নিক ট্যাবলেট রক্তচক্ষু মেলে সারা রাত মশা তাড়ায়। নতুন একটা ট্যাবলেট যন্ত্রে গুঁজে দিল অদিতি। সুইচ অন করে বলল,—শর্মিলারই কিন্তু কাস্টডি পাওয়া উচিত।

—কেন?

—কারণ ও টিনটিনের মা। ছেলেরা মায়ের কাছে থাকাই বেশি প্রেফার করে।

সুপ্রতিম আলোর দিকে চিরুনি তুলে চুল খুঁজছে। বলল,—দেখো কে পায়।

—দীপকদা যে জেদ করছে, ছেলে নিয়ে সামলাবে কী করে? সন্ধেবেলা বোতল খুলে বসবে, ছেলের পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাবে।

—ছাড়ো তো। যার ছেলে সে বুঝবে। আমাদের মাথা ঘামানোর কী দরকার? চালশে চশমা চোখে পরছে সুপ্রতিম,—পাপাইয়ের প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা কবে?

—সোমবার ডেট দেবে। অদিতি আয়নার ভেতর দিয়ে সুপ্রতিমকে দেখছিল। চোখ না সরিয়ে বলল,—দীপকদাদের ব্যাপারে আমাদের কোনও মাথা ঘামানোর দরকার নেই বলছ? তোমার এতদিনের বন্ধু…

—কী আর করা যাবে। সম্পর্ক যদি না টেকে… বেটার পার্ট অ্যাজ্ ফ্রেন্ডস্ দ্যান লিভ টুগেদার অ্যাজ এনিমিজ।

—ওরা এখন দূরে থাকলে শত্রু, কাছে গেলেও শত্রু।

—হুঁ। ইদানীং ওদের রিলেশানটা বড় তিক্ত হয়ে পড়েছিল। সুপ্রতিম হঠাৎ যেন একটু সচকিত হল,—তোমার হঠাৎ দীপকদের ব্যাপারে এত উৎসাহ কেন?

ইঁদুরবেড়াল খেলাটা আর পছন্দ হচ্ছিল না অদিতির। খর গলায় বলে উঠল,—তোমার উৎসাহ নেই?

—আমার?

—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার। ন্যাকামি করছ কেন? শর্মিলা আজ দুপুরে এখানে এসেছিল। ঘরে বসে মুনিঋষির মতো কথা বলছ, এদিকে সাত জায়গায় শর্মিলার কুচ্ছো গেয়ে বেড়াচ্ছ, তোমার লজ্জা করে না? ছি ছি, শর্মিলা কী অপমানটাই না করে গেল আজ!

হঠাৎ মিথ্যা ধরা পড়ে গেলে অসহায় অবস্থাতেও একটা রাগ আসে। মরিয়া, কিন্তু অক্ষম রাগ। সিগারেট ধরিয়ে ফসফস টানল সুপ্রতিম, ঘষে ঘষে অ্যাশট্রেতে নেবাল,—শর্মিলা এসেছিল তুমি এতক্ষণ বলোনি কেন?

—তুমিও তো বলোনি। তুমি শর্মিলার বাড়িতে গিয়েছিলে, টিনটিনের স্কুলে গিয়েছিলে… একটা পঞ্চাশ বছরের লোক, খোকামি করে বেড়াচ্ছ…

—বাজে কথা বোলো না। শর্মিলা যা বলে গেছে সবই বুঝি ধ্রুব সত্যি?

—সত্যিটা কী তুমিই বলো না। পেটে চেপে রেখেছ কেন? আমি তো সত্যিটাই জানতে চাই।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বেড়ালের মতো খুনি চোখে তাকাচ্ছে সুপ্রতিম। নিশ্বাস ফেলছে জোর জোর। ঢকঢক করে গোটা জগের জল শেষ করল। বেডসুইচ টানল খাটের বাজুতে। পড়াত করে আলো নিবিয়ে দিল। অন্ধকারে হিস হিস করে উঠেছে,—যা করেছি, ঠিক করেছি। যা ভাল বুঝেছি, তাই করেছি। তোমার কাছে আমায় কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?

ফটাস্ করে আলো জ্বালিয়ে দিল অদিতি,—ঘর অন্ধকার করছ কেন? মুখ দেখাতে লজ্জা করছে?

স্থান কাল ভুলে হুঙ্কার দিয়ে উঠল সুপ্রতিম,—আমাকে ঘুমোতে দেবে? গাধার খাটুনি খেটে আমায় তোমাদের অন্ন জোগাতে হয়। রাত দুপুরে ইয়ে করা আমার ভাল্লাগে না।

অদিতি ঝুম হয়ে গেল। ঝুম, না নিঝুম?

পরদিন থেকে সুপ্রতিমও গুম। এক বিরক্ত বুলগের মুখোশ এঁটে ঘোরাফেরা করছে বাড়িতে। সকালবেলা বেরিয়ে যায়, রাত করে ফেরে। ছুটির দিনেও আয়েশ আরাম ফেলে টো-টো করতে চলে যায় কোথায়। ছেলেদের সঙ্গে যেচে কথা বলে না, বড় জোর চোয়াল ফাঁক করল, ব্যস্। পাপাই তাতাই বাবার এই মেজাজটা দেখেছে কয়েক বার, তারাও বাবাকে ঘাঁটাতে সাহস করে না। অদিতিকেই পুছতাছ করেছে তারা। বাবা হঠাৎ আউট অফ ফোকাস্ কেন? এবার কী নিয়ে ফাইট্‌টা হল তোমাদের? অদিতি বিরস মুখে এড়িয়ে যায় প্রসঙ্গটা। বলবেই বা কী ছেলেদের?

সুপ্রতিমের সঙ্গে ঝগড়া হলে সাধারণত অদিতিই মিটিয়ে নেয়। বাড়ির ভেতর একটা হুতুম প্যাঁচা ঘুরে বেড়াবে, এটা কি খুব দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য? তরল মেজাজের মানুষ হলেও সুপ্রতিমের মধ্যে একটা গোঁয়ার্তুমিও আছে। এ ধরনের লোকদের বাবা বাছা করে ঠাণ্ডা করতে হয়।

এবার অদিতি তা করল না। তারও বুকের হাড়পাঁজরায় এক তপ্ত বাতাস জমাট বেঁধে আছে। হয়তো সুপ্রতিম নিছক বন্ধুকে সঙ্গ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই শর্মিলার বাড়ি গিয়েছিল। বা টিনটিনের স্কুলে। দীপকদা তেমন বাক্পটু নয়, সুপ্রতিমকে হয়তো জোর করেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল দীপকদা। বন্ধুর জন্য সুপ্রতিম এ কাজ করতেই পারে। অন্যায় জেনেও। কিন্তু অদিতিকে গোপন করল কেন? সব থেকে বেশি অদিতির বুকে বেজেছে সেই রাতে সুপ্রতিমের নির্বিকার হাবভাবটা। সুপ্রতিমকে ওই স্তরের মিথ্যাচারী ভাবতে কী যে কষ্ট হচ্ছে অদিতির!

এরই মধ্যে হেমেন এলেন একদিন। সঙ্গে একটি বছর তিরিশেকের ছেলে। হেমেনের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই এক-আধটা চেলাচামুণ্ডা আসে আজকাল। এই ছেলেটি নতুন। ছিপছিপে চেহারা, রোদে পোড়া ফর্সা রঙ, গালে সযত্নে লালিত এলোমলো দাড়ি। চোখ দুটিও সুন্দর। ভাসা ভাসা। মায়া মাখানো। সাদা চোস্তের ওপর নরম হল্‌দে পাঞ্জাবি পরেছে ছেলেটি, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ।

প্রথম দর্শনেই ছেলেটিকে বেশ ভাল লেগে গেল অদিতির।

খুন্তি হাতেই ছুটে এসেছিল অদিতি, হেমেন সোফায় বাবু হয়ে বসে বললেন, —দেখো রঞ্জন, এই সেই অদিতি মজুমদার। এক হাতে খুন্তি চালায়, অন্য হাতে কলম।

অদিতি লাজুক হাসল, —যাহ্, আপনার না বাড়াবাড়ি। না ভাই, গল্প আমি সাকুল্যে গোটা চারেক লিখেছি। আর খুন্তি চালানো? আজ রান্নার লোক ছুটি নিয়েছে তাই বাধ্য হয়ে…

রঞ্জন বিনীতভাবে বলল, —আপনার ফাটল গল্পটা আমার অসাধারণ লেগেছিল।

রঞ্জনের কণ্ঠস্বরটিও ভারী উদাত্ত। পুরনো হেমেনমামাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আবৃত্তি করে নাকি!

রঞ্জন আবার বলল,—তার পরেও আপনার কী একটা গল্প পড়লাম? কী যেন নাম?

অদিতি হেসে ফেলল, —নাম মনে নেই তো? তার মানে ভাল লাগেনি।

—না না, ওই গল্পটাও ভাল। তবে এক একটা গল্প মনকে সরাসরি বিদ্ধ করে। ফাটল গল্পটা সেরকম। মনে হয় কোথায় যেন একাত্ম বোধ করতে পারছি। জানেন আমার এক কাকা গল্পটা পড়ে ভীষণ মন খারাপ করে বসে ছিল।

ক’দিন ধরে বুক কামড়ে পড়ে থাকা দমচাপা ভাবটা ক্রমশ লঘু হয়ে আসছে। অদিতি হাসি মুখে বলল, —এত প্রশংসা করলে তো আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। কী খাওয়াব বলুন, ঠাণ্ডা না গরম?

—গরম। চা। হেমেনই উত্তর দিলেন, —তোমার বড় পুত্রের পরীক্ষা শেষ হল?

—হ্যাঁহ্। নিশ্চিন্ত। গত কাল প্র্যাক্‌টিকাল হয়ে গেল।

—কী পরীক্ষা দিল আপনার ছেলে?

—পার্ট টু। বি. এস্সি।

রঞ্জন বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়েছে, —আপনার এত বড় ছেলে আছে! দেখে কিন্তু একদম মনে হয় না।

অদিতি ভ্ৰূকুটি হাসল, —একটা নয়, আমার দুটো ছেলে আছে। ছোট জন সেকেন্ড ইয়ারে উঠবে।

—বিশ্বাস করুন, আপনাকে দেখে পঁয়ত্রিশের বেশি মনেই হয় না।

হেমেন গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলেন, —এরকম একটা কমপ্লিমেন্ট পেলে, ওর চায়ে একটু বেশি করে চিনি দিয়ো।

অদিতি দ্রুত রান্নাঘরের কাজ শেষ করে চা নিয়ে এসে বসেছে। বড় প্লেটে সাজিয়ে দিয়েছে নোন্তা বিস্কুট, চানাচুর, হিমশীতল সন্দেশ।

চা খেতে খেতে হেমেন বললেন, —রঞ্জনও কিন্তু খুব ভাল লিখছে এখন। দেশ পত্রিকায় ওর দুটো গল্প বেরিয়েছে।

অদিতির ভুরুতে ভাঁজ পড়ল, —আপনিই রঞ্জন দাশগুপ্ত?

লজ্জা লজ্জা মুখে মাথা চুলকোল রঞ্জন, —বাবা মা ওই নামটাই রেখেছেন।

—দুটো গল্পই আমি পড়েছি। স্বপ্নের নৌকো, আর অঙ্ক দৌড়। ঠিক বলছি?

রঞ্জন ঘাড় নাড়ল।

অদিতি বলল, —আপনি থাকেন কোথায়? এদিকেই?

—না, একদম উল্টো দিকে। বারাসত।

হেমেন বললেন, —বারাসতে ওদের একটা গ্রুপ আছে। তরুণ লেখকদের। নিয়মিত বসে সকলে, গল্প পড়া হয়, আলোচনা হয়…। ওদের গ্রুপের আরেক জনও খুব উঠছে। আনিসুর রহমান। আনিসুরের লেখা তুমি পড়েছ অদিতি?

—নামটা শোনা শোনা। মনে হচ্ছে পড়েছি।

হেমেন বললেন, —এই রঞ্জন, আনিসুরকে একদিন এনো না এ বাড়িতে। তুমি তো চিনে গেলে।

—সে আনাই যায়। রঞ্জন অদিতিকে বলল, —আপনিও একদিন আমাদের ওখানে চলুন না।

—যাহ্, আমি কি তরুণ নাকি? জানেন এই নভেম্বরে আমি ছেচল্লিশে পড়ব?

হেমেন হাসছেন,— তারপর ক’ বছর তোমার ছেচল্লিশ চলবে?

—কেন?

—বারে, মেয়েদের তো শুনেছি তিরিশের পর থেকে দু-তিন বছর পর পর একটা করে জন্মদিন হয়!

—হেমেনমামা, আপনি না…। অদিতি হেসে বাঁচে না, —দু দুটো ছেলে তালগাছের মতো খাড়া দাঁড়িয়ে আছে, কোন ফাঁক দিয়ে বয়স লুকোব?

রঞ্জন বলল, —তাতে কিছু এসে যায় না। আপনি যখন নতুন লিখছেন, তখন আপনি তরুণই। সে আপনার আশি বছর বয়স হলেও আপনি তরুণ। কি হেমেনদা, ঠিক কিনা?

গল্পগুজবে হাসিঠাট্টায় অন্তর ধুয়ে যাচ্ছিল অদিতির। প্রথম জ্যৈষ্ঠের উষ্ণতাও আর তত প্রখর লাগছে না। খোলা জানলা দিয়ে লাজুক লাজুক বাতাস আসছে মাঝে মাঝে। স্বপ্নের কুঠুরিটা খুলে যাচ্ছে অদিতির। লেখালিখির গল্প, গল্পের গল্প রূপকথা হয়ে অদিতিকে নিয়ে চলেছে কৈশোরের দরজায়। অথবা এক প্রমত্ত যৌবনে।

হেমেন সোফায় পা নাচাচ্ছেন, —তারপর? তুমি কিছু লিখলে? অনেক দিন কিন্তু তোমার গল্প শোনা হয়নি।

অদিতি টিপ-টিপ হাসল, —পাপাইয়ের পরীক্ষার আগে একটা লিখেছিলাম। ফেয়ার করা হয়নি। পরে পড়ে শোনাব।

—পরে কেন? আজই নয় কেন? রঞ্জন নড়েচড়ে বসেছে।

অদিতি বলল, —না বাবা, আপনারা সব বড় বড় লেখক, আপনাদের সামনে আমি গল্প পড়ব না।

—এরকম বললে তো আজই শুনতে হয়।

হেমেন বললেন, —নিয়ে এসো না। চটপট শুনিয়ে দাও। রঞ্জন আবার বারাসত ফিরবে।

—গল্পটা কিছু হয়নি হেমেনমামা। আরেকবার লিখতে হবে।

—আপনি ঠিক আমার ছোট বোনের মতো করছেন। কী ভাল গান গায়, কেউ শুনতে চাইলেই বলে আইসক্রিম খেয়ে গলা ভেঙে গেছে!

চাপের মুখে অদিতিকে আনতেই হল গল্পটা। সবে পাতা খানেক পড়েছে দস্যুর মতো হাজির হল তাতাই। ঢুকেই অতিথিদের দেখে তার মুখ শুকিয়ে আমসি।

হেমেন বললেন, —কী ছোটেমাস্টার, এমন ভগ্নদূতের দশা কেন?

কেঠো হাসি হাসল তাতাই, —আপনারা টিভি খোলেননি? ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার খেলা দেখাচ্ছে।

—ওহো, তাই তো। রঞ্জন ঘড়ি দেখল, —আটটায় আরম্ভ হওয়ার কথা না?

তাতাই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, —আপনি দেখবেন?

—দেখলে হত। কিন্তু তোমার মা-র গল্পটা যে শুনছি ভাই।

তাতাই একবার আড়চোখে তাকাল অদিতির দিকে, —খেলাটা দেখে নিয়ে শুনুন।

—না। তা হলে আমার দেরি হয়ে যাবে। কাল সকালে তো রিপ্লে দেখাবে, তখন দেখে নেব।

হেলেঞ্চা পাতা খাওয়া মুখ হয়ে গেল তাতাইয়ের। গ্যাঁট হয়ে বসে পড়েছে সোফায়। উসখুস করছে। টেবিলে পড়ে থাকা চানাচুর থেকে ঘন ঘন বাদাম তুলে খাচ্ছে।

হেমনের বোধহয় প্রাণে দয়া জাগল। বললেন, —আমরা কি অন্য কোথাও বসে গল্পটা শুনতে পারি না অদিতি? ছোটেমাস্টার নয় খেলা দেখুক।

অদিতি এক মুহূর্ত চিন্তা করল। ছেলেদের ঘরে গিয়ে বসা যায়, সেখানে আবার পাপাই এসে পড়তে পারে। নিজেদের ঘরে বসবে?

তাই বসল। খাটের ওপর জমিয়ে বসেছেন হেমেন, পাশে রঞ্জন। তাদের মুখোমুখি বসে গল্পটা পড়ছিল অদিতি। পড়তে পড়তেই টের পেল সুপ্রতিম ফিরেছে, দরজায় এসে দাঁড়ালও একবার, হেমেনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সৌজন্যের হাসি হেসে সরে গেল। ছেলের পাশে বসে টিভি দেখছে।

রঞ্জন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল লেখাটার, হেমেনমামা অতটা না। রঞ্জনের মতে গল্পটা বড় কোনও পত্রিকায় পাঠানো উচিত, হেমেনমামা চান গল্পটা আরেকবার লিখুক অদিতি। পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর লেখিকা যে অনুভূতিটা নিয়ে ফিরছে সেটা আরও তীব্র হওয়া প্রয়োজন। রঞ্জন গল্পের কোনও বদল চায় না, অতি স্বাভাবিক সমাপ্তিতেই সে বেশি অভিভূত।

আলোচনা করতে করতে সময় গড়িয়ে গেল। হেমেনরা উঠলেন রাত সাড়ে নটায়।

খুশি খুশি মেজাজে খাবার থালা সাজাচ্ছে অদিতি। তখনই বিস্ফোরিত হল সুপ্রতিম। পাপাই তাতাইয়ের সামনেই।

—আমি জানতে চাই এ-সবের অর্থ কী? যে কেউ আসবে, বেডরুমে ঢুকে যাবে, আমার বাড়ির কি একটা প্রাইভেসি নেই?

অদিতি বিমূঢ়, —তাতাই খেলা দেখছিল তাই…একদিন একটু ঘরে বসে গল্প পড়েছি!…. হেমেনমামা প্রায় আমাদের ঘরের লোক…!

—ও-সব হেমেনমামা ফেমেনমামা বুঝি না। ওই যে সখী সখী চেহারার দেড়েল ছেলেটা খাটে উঠে বসেছিল, সেও কি ঘরের লোক?

অদিতি তপ্ত হল এতক্ষণে, —ঘরে কি আজ প্রথম বাইরের লোক ঢুকল? তোমার সোমেন তথাগতরা এসে কি সারাক্ষণ ড্রয়িংরুমে বসে থাকে?

—আমার বন্ধুদের সঙ্গে ওই রাস্তার হ্যাগার্ডদের তুলনা? সমস্ত বাড়াবাড়ির একটা লিমিট থাকা উচিত। ফের যদি কোনওদিন আমার ঘরে বাইরের লোক ঢোকাতে দেখেছি…

অদিতি অপমানে ম্লান হয়ে গেল। সাংসারিক তুচ্ছ কারণে বহুবার অজস্র বিবাদ হয়েছে তাদের, এইটুকু ফ্ল্যাটে পাপাই তাতাইয়ের কাছে তা সব সময়ে আড়ালও থাকে না, তা বলে এই ভাষায় কথা বলল সুপ্রতিম? এত অকিঞ্চিৎকর কারণে? চেনা মানুষ কি করে এমন অচেনা দানব হয়ে যায়?

মলিন মুখে ছেলেদের খেতে দিল অদিতি। সুপ্রতিমকেও। পাপাই তাতাই গম্ভীর, সুপ্রতিমের ভ্রূক্ষেপ নেই, খাচ্ছে সে। শব্দ করে করে স্টিলের থালায় মাংসের হাড় ঠুকল, চুষে চুষে নরম শাঁসটুকু বার করে নিল। ল্যাংড়া আমের আঁটি নিপুণভাবে শেষ করে তৃপ্তির উদ্‌গার তুলছে।

খাওয়া শেষে বিছানায় নিঃসাড়ে শুয়ে আছে অদিতি। বাইরে এক নিষ্করুণ গুমোট। ঘরেও। পাখার হাওয়াতেও ঘাম জমছে গায়ে, খসখস করছে দেহ।

আলো নিবিয়ে সুপ্রতিম ঠেলল অদিতিকে, —অ্যাই।

অদিতি কাঠ হয়ে রইল।

সুপ্রতিম টানল অদিতিকে, —খুব রাগ করেছ?

নিজেকে আরও শক্ত করল অদিতি।

অদিতির মাথা মুখের খুব কাছে নিয়ে এল সুপ্রতিম। অভ্যস্ত নিশ্বাসপ্রবাহে অভ্যস্ত উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ। কোমল জড়ানো স্বরে সুপ্রতিম বলল, —রাগ করো কেন? তুমি আমাকে একদিন অপমান করেছিলে, আমি তোমাকে কাউন্টার ইনসাল্ট্ করে দিলাম। কাটাকুটি হয়ে গেল।

অদিতির রক্তস্রোত থেমে গেছে অকস্মাৎ। নিজের মিথ্যে আর অন্যায়ের সঙ্গে অদিতির আজকের সরল উচ্ছ্বাসকে এক দাঁড়িপাল্লায় বসাতে চাইছে এ কোন্ সুপ্রতিম! তেইশ বছর পরেও পরিচিত ঘ্রাণ কেন আজ অজানা লাগে!

অদিতি ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। পাশ ফিরে শুল। ভাঙা স্বরে বলল, —ঘুমোও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *