০৪. যোগাযোগ : প্রথম পর্ব

০৪. যোগাযোগ : প্রথম পর্ব

অপেক্ষা করার মতো ভয়ংকর জিনিস আর কিছু নেই, বিশেষ করে যদি জানা না থাকে ঠিক কিসের জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে। সিসিয়ানের সবাই এখন এই ভয়ংকর অবস্থার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সময় কাটানো নিয়ে অবশ্যি সে-রকম সমস্যা নেই, ট্রাইটনের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেই একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। এখন সবাই জানে এই গ্রহে কোনো একধরনের প্রাণী আছে, যার বুদ্ধিমত্তা অসাধারণ। সবাই চেষ্টা করছে তাদের খুঁজে বের করতে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, পুরো গ্রহ ভন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো প্রাণী, তাদের ঘরবাড়ি বা সভ্যতা, কোনোকিছুই পাওয়া যায় নি। সিসিয়ানে যেসব যন্ত্রপাতি আছে সেগুলি ব্যবহার করে গ্রহের ভিতরে মাটির নিচে অনেকদূর পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা যায়, কিন্তু সবরকম চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয় নি, প্রাণীগুলি যেন বাতাসে উবে গেছে।

পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টা এভাবেই কেটে গেল। প্রথম প্রথম সবাই লু’য়ের কথা বিশ্বাস করেছিল, ভেবেছিল সত্যি পল কুম আর রু-টেককে নিয়ে স্কাউটশিপটা ফেরত আসবে। প্রথম চার ঘন্টা পর স্কাউটশিপের মতো কী-একটা সত্যি সত্যি দেখাও গিয়েছিল, কিন্তু সিডিসি ভালো করে দেখে জানিয়েছে, যে-যান্ত্রিক গোলযোগ, স্কাউটশিপজাতীয় কোনোকিছু নেই। এই সুদীর্ঘ সময়ে কেউ কিছু করতে পারে নি, অপেক্ষা করার সময় কেন জানি কোনো কাজ করা যায় না। যোগাযোগের সবরকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নীষা আবার তার ভাষা তৈরি করার কাজে ফিরে গেছে। কিম জিবান ট্রাইটনে কী ভাবে আঘাত করা যায় সেটার চিন্তা ভাবনা করতে থাকে, কী পরিমাণ বিস্ফোরক আছে খোঁজখবর নিতে গিয়ে একটা আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করে, বিস্ফোরক যেটুকু থাকার কথা, তার থেকে অল্প একটু কম রয়েছে। এমন কিছু জরুরি ব্যাপার নয়, কিন্তু কী ভাবে কমেছে কিম জিবান সেটার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। কিম জিবান জিনিসটা ল’কে জানিয়ে রাখল, কিন্তু লু খুব বেশি বিচলিত হল বলে মনে হল না, গত কয়েকদিনে যেসব অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটেছে, তার তুলনায় এটা কিছুই না।

নীষা তার ভাষায় নতুন ধরনের ক্রিয়াপদের নিয়মকানুনগুলি ঠিক করে কফি খাওয়ার জন্যে উঠে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ট্রাইটন থেকে প্রথমবার একটা সংকেত এসে হাজির হয়। প্রথমে একবার তারপর বারবার; অনেকবার। দুর্বোধ্য ইলেকট্রনিক সংকেত, সেটাকে বোধগম্য ভাষায় অনুবাদ করার জন্যে সে পাগলের মতো চেষ্টা করতে থাকে। অচেনা ভাষাকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করার রুটিনবাঁধা পদ্ধতি আছে, কিন্তু উত্তেজনায় সহজ জিনিসগুলি নীষার ওলট-পালট হয়ে যেতে থাকে।

নীষা।

সিডিসির গলার স্বর শুনে চমকে ওঠে নীষা, কি হল?

তোমাকে অনুবাদ করতে হবে না, রু-টেক ট্রাইটন থেকে কথা বলছে।

বিস্মিত নীষা সুইচ টিপে দিতেই সত্যি সত্যি রু-টেকের গলার স্বর শুনতে পায়, আমি রু– টেক বুলছি। সিসিয়ান সাড়া দাও। আমি রু– টেক বলছি। সিসিয়ান সাড়া দাও।

আমি নীষা, রু–টেক, আমি নীষা। তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?

স্কাউটশিপের ভিতর থেকে।

স্কাউটশিপটা কোথায়?

জানি না, তোমরা বলতে পারবে নিশ্চয়ই।

নীষা উত্তর দেবার আগেই সিডিসি কথা বলল, রু–টেক, তোমরা ট্রাইটনের পৃষ্ঠে আছ, আমি যেটুকু দেখছি তাতে মনে হচ্ছে স্কাউটশিপটার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু এখনো ব্যবহার করা সম্ভব। ইনজিন চালু করে দিলেই ওখান থেকে বেরিয়ে আসবে, আমি বাকি সবকিছু ব্যবস্থা করে নেব।

দিচ্ছি।

নীষাকে ঘিরে সিসিয়ানের সবাই এসে দাঁড়িয়েছে, নীষা ল’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল, লু, তুমি কথা বলবে?

লু মাথা নাড়ে, তুমিই বল।

নীষা মাইক্রোফোনটা টেনে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, পল কেমন আছে রু-টেক?

এক মহত ইতস্তত করে রু-টেক উত্তর দিল, জ্ঞান নেই শরীরে কিছু খারাপ রকমের জখম আছে, অবস্থা কত খারাপ বলতে পারছি না। এখানে বাতাসের চাপ ঠিক নেই, তাই পলকে স্পেসস্যুট থেকে বের করতে পারছি না।

নীষা ব্যস্ত হয়ে বলল, বের করার কিছু দরকার নেই, যেমন আছে সে-রকম থাকতে দাও। দেখতে পারি ওকে? ক্যামেরাটা চালু করতে পারবে?

কয়েক মুহূর্ত পর মনিটরের নীলাভ স্ক্রিনে আবছা একটা ছবি ফুটে ওঠে। ক্যামেরা বা স্ক্রিন কোথাও কিছু-একটা সমস্যার জন্যে ছবিটা বেশি স্পষ্ট হল না, যেটুকু হল সেখানে নীল রংয়ের প্রাধান্যটাই একটু বেশি হয়ে থাকল। এর মাঝেই সবাই দেখতে পায়, রু-টেক আর পল ভেসে বেড়াচ্ছে, ক্যামেরাটা সরিয়ে ওরা পলের মুখের দিকে দেখতে চেষ্টা করে, অচেতন মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝা গেল না। এই মানুষটিকে ট্রাইটনের প্রাণীরা টুকরো টুকরো করে খুলে আবার তৈরি করেছে, ব্যাপারটা চিন্তা করে নীষার কেমন জানি শরীর খারাপ হয়ে যেতে চায়।

লু এগিয়ে এসে বলল, রু-টেক, তুমি স্কাউটশিপটাকে কাছাকাছি নিয়ে এস, তারপর কথা বলা যাবে, তোমাদের কোনো ভয় নেই, সিডিসি তোমাদের সাহায্য করছে।

বেশ। রু-টেকের গলায় জোর নেই, কেমন যেন নিজীব মানুষের মতো গলা।

 

রু-টেক, তোমার সাথে একটু জরুরি কথা বলতে চাই।

স্কাউটশিপটা সিসিয়ান থেকে তিন শ’ কিলোমিটার দূরে এসে স্থির হওয়ামাত্রই লু রু-টেকের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। রু–টেক খানিকটা আন্দাজ করতে পারে লু কি বলবে, ঠাণ্ডা গলায় বলল, বল লু।

তুমি নিশ্চয়ই জান, কি বলব।

খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি। অবশ্যি অনেক কিছুই বলার আছে, এই মুহূর্তে কোনটা বলবে ঠিক জানি না।

না, খুব বেশি কিছু বলার নেই। লু একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের এখন আমরা সিসিয়ানে ফেরত আসতে দিতে পারব না।

জানতাম।

তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমাদের কোনো উপায় নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে জানতে না পারছি ট্রাইটনের অধিবাসীরা তোমাদের ঠিক কী করেছে ততক্ষণ আমরা তোমাদের আসতে দিতে পারব না।

আমি বুঝতে পারছি লু।

আমি খুব দুঃখিত রু-টেক।

তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই লু, আমি অবস্থাটা বুঝতে পারছি।

গত আটাশ ঘন্টায় কি হয়েছে তোমার কিছু মনে আছে?

না।

কিছুই মনে নেই?

না, কিছুই মনে নেই।

লু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ভারি অবাক ব্যাপার। তোমার কি মনে হয় পলের কিছু মনে থাকবে?

রু-টেক ইতস্তত করে বলল, ট্রাইটনের প্রাণীরা আমাদের আবার নতুন করে তৈরি করে ফেরত পাঠিয়েছে, তারা যদি চায় আমরা কিছু মনে রাখি, তা হলে নিশ্চয়ই আমাদের কিছু একটা মনে থাকবে। আমি রবোট বলে আমাকে হয়তো বেশি গুরুত্ব দেয় নি, পলকে নিশ্চয়ই অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ওর কিছু একটা হয়তো মনে থাকতেও পারে। সোজাসুজি মনে না থাকলেও হয়তো অবচেতন মনে কিছু-একটা মনে থাকবে।

লু একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না, অনেকক্ষণ থেকে জিনিসটা ওকে বিব্রত করছে, কিন্তু সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। স্বর পাল্টে বলল, রু–টেক, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, তোমার এখন অনেক দায়িত্ব?

বুঝতে পারছি।

প্রথমে তোমাকে স্কাউটশিপটাকে ঠিক করতে হবে।

হ্যাঁ।

আমরা এখান থেকে যন্ত্রপাতি পাঠাচ্ছি। তুমি নিশ্চয়ই জান আমরা এখান থেকে যা ইচ্ছা তোমাদের কাছে পাঠাতে পারি, কিন্তু তুমি কখনোই আমাদের কিছু পাঠাবে না।

জানি।

স্কাউটশিপটা ঠিক করে, প্রথমে বাতাসের চাপটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আস। তারপর তোমাকে কয়েকটা অস্ত্রোপচার করতে হবে।

রু-টেক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমাকেই করতে হবে?

আর কে করবে? আমরা এখন সুশানকে পাঠাতে পারি না। সুশান রাজি আছে কিন্তু আমরা তাকে এ অবস্থায় পাঠাতে পারি না।

কিন্তু লু, আমি ডাক্তারির কিছু জানি না। হাত কেটে গেলে আমি ব্যান্ডেজ পর্যন্ত করতে পারি না, তুমি তো জান, আমি পলিমারের তৈরি, আমার হাত কখনো কাটে না।

তুমি সেটা নিয়ে ভেবো না, লু রু-টেককে আশ্বাস দেয়, আমাদের ভাগ্য ভালো যে তুমি আমাদের সাথে আছ।

কেন?

শুধু তোমাকেই প্রয়োজন হলে একজন ডাক্তার বানিয়ে দেয়া যায়। সিডিসি তোমার জন্যে একটা সফটওয়ারের প্যাকেট তৈরি করছে, তোমার কপোট্রনে সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে সার্জারি, প্যাথোলজি, নিউরোলজি সবকিছু আছে। তোমার ডাক্তার হতে সময় নেবে মাইক্রোসেকেন্ড। ভালো কথা, তোমার কপোট্রনে কতটুকু মেমোরি খালি আছে?

রু-টেক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে বলে, বেশি খালি নেই, বার টেরাবাইট।

মাত্র বার টেরাবাইট?

সিডিসির সফটওয়ারের প্যাকেটটা কত বড়?

আট থেকে নয়ের ভিতরে হবে, কি কি দেয়া হবে তার উপর নির্ভর করে। যদি তোমার মাত্র বার টেরাবাইট বাকি থাকে, তা হলে এই সফটওয়ার নেয়ার পর কাজ করার জন্যে তোমার মাত্র তিন টেরাবাইট বাকি থাকবে। তুমি তো দেখি কোনো কাজই করতে পারবে না। জটিল কোনো অস্ত্রোপচার করতে হলে–

লু, তুমি এসব খুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিও না, প্রয়োজন হলে আমি আমার খানিকটা মেমোরি সিডিসিকে পাঠিয়ে জায়গা করে নেব।

কিন্তু তোমার এত মেমোরি খরচ হল কেমন করে? তুমি তো এর মাঝে কোনো কিছুই কর নি।

লু তোমার এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

লু তুবুও মাথা নেড়ে বলে, ভারি আশ্চর্য। সত্যি তোমার কিছু মনে নেই? গত আটাশ ঘন্টায় কি হয়েছে তোমার একটুও মনে নেই?

না।

আশ্চর্য!

রু-টেক লুয়ের বিস্ময়টুকু এড়িয়ে গিয়ে বলল, এখন আমাকে বল কি করতে হবে?

স্কাউটশিপটা আগে ঠিক করে নাও, বাতাসের চাপ, তাপমাত্রা এইসব ছোটখাটো কিন্তু জরুরি ব্যাপারগুলির ব্যবস্থা কর। সিডিসির সফটওয়ারের প্যাকেটটা পাওয়ার পর পলকে পরীক্ষা করে আমাদের একটা রিপোর্ট দাও। আমার মনে হয়, বেশ বড় ধরনের জখম থাকতে পারে। এখানে সব ধরনের ব্যবস্থা নেই, কাজেই তুমি কতটুকু কি করতে পারবে জানি না, কিন্তু তোমাকেই চেষ্টা করতে হবে। আমাদেরকে বল সিসিয়ান থেকে আরো কিছু পাঠাতে হবে কি না। তোমার পলের জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে হবে, এর আগে আমরা কিছুই করতে পারব না।

জ্ঞান ফিরিয়ে আনার পর?

পলের সাথে কথা বলতে হবে। পলের সাথে কথা বলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এরপর কি করা যায়। হয়তো ট্রাইটনের উন্নত প্রাণীরা পলকে দিয়ে আমাদের কাছে কোনো একটা খবর পাঠিয়েছে, কে জানে।

রু-টেক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যদি দেখা যায় আমার মতন পলের কিছু মনে নেই?

তাহলে ওকে পরীক্ষা করতে হবে, যতটুকু সম্ভব। ট্রাইটনের অধিবাসীরা ওর শরীরে কিছু-একটা দিয়ে দিয়েছে কি না, সেটা বের করতে হবে, আমি জানি না সিসিয়ানে সেরকম যন্ত্রপাতি আছে কি না।

যদি না থাকে?

যদি না থাকে তা হলে আমাদের কিছু করার নেই, ওর তাপমাত্রা মিলি কে২০ ডিগ্রিতে নামিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

মিলি কে! এত কম? জৈবিক কাজকর্ম বন্ধ করতে তো এত কম তাপমাত্রায় যেতে হয় না।

হ্যাঁ, কিন্তু আমরা জানি না ট্রাইটনের অধিবাসীরা পলের ভিতরে কোনো ধরনের পরিবর্তন করে দিয়েছে কি না। সেটা যদি জৈবিক ব্যাপার না হয়? আমরা এখন কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে পারি না। যদি তাপমাত্রা মিলি কে-তে নামিয়ে নিই তাহলে পারমাণবিক পদ্ধতিগুলিও বন্ধ হয়ে থাকবে। কোনোভাবে যদি পলকে কেন্দ্রীয় মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে হাজির করতে পারি, তা হলে ওরা সবকিছু বের করে নেবে।

রু-টেক খানিকক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপ করে থেকে বলল, লু।

কি?

আমার কেমন জানি ভয় করছে লু।

আমি জানি রু-টেক। ভয় আমাদের সবারই করছে, কিন্তু কী করব বল? তোমাদের দুজনকে এরকম নির্জন একটা স্কাউটশিপে ফেলে রাখতে আমাদের খুবই খারাপ লাগছে—

আমি জানি, তোমার খুব খারাপ লাগছে লু আমার কথা শুনে তোমার নিশ্চয়ই আরো বেশি খারাপ লাগবে, কিন্তু কী করব বল? এরকম অবস্থায় মানুষের মন দুর্বল হয়ে পড়ে, আমি মানুষ নই, কিন্তু আমাকে তো প্রায় মানুষের মতোই তৈরি করা হয়েছে। মন দুর্বল হলে কারো সাথে কথা বলে মনটা হালকা করতে ইচ্ছা করে। তাই তোমাকে বললাম।

আমি বুঝতে পারছি রু, আমি সবসময় তোমার সাথে যোগাযোগ রাখব, যখন আমি থাকব না, তখন অন্য কেউ তোমার সাথে থাকবে, কেউ না কেউ সবসময় তোমার সাথে কথা বলবে।

রু-টেক খুশি হয়ে বলল, হ্যাঁ, খুব ভালো হয় তা হলে।

লু একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার ভয়ের একটা সুইচ আছে না? বেশি ভয়। পেলে সেটা বন্ধ করে দিতে পার।

হাঁ, মনে আছে আমার, কিন্তু এখন যতক্ষণ পারি সেটা ছুঁতে চাই না, ভয় পুরোপুরি চলে গেলে আমার কাজকর্ম অন্যরকম হয়ে যায়, অনেক অকারণ ঝুকি নিয়ে ফেলি, এই অবস্থায় সেটা বোধহয় ঠিক হবে না।

তা ঠিক, লু মাথা নাড়ে, তা তুমি ঠিকই বলেছ।

ঠিক আছে, ল, তুমি এখন যন্ত্রপাতি পাঠানোর ব্যবস্থা কর, আমি স্কাউটশিপটা ঠিক করি।

 

সিডিসির সাথে দাবা নিয়ে বসে আছে লু। ওর এখন বিশ্রাম নেবার কথা, কিন্তু পুরো স্নায়ু এত উত্তেজিত হয়ে আছে যে, বিশ্রাম নোর চেষ্টা করে লাভ নেই। দাবা খেলায় খুব মগ্ন হয়ে গেলে মাঝে মাঝে সে সবকিছু ভুলে যেতে পারে, সেটা মাঝে মাঝে বিশ্রামের মতো কাজে দেয়। আজ অবশ্যি কিছুই কাজ দিচ্ছে না, খানিকক্ষণের মাঝেই সিডিসি সেটা বুঝে ফেলে বলল, খেলায় মন নেই মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে নাকি?

হ্যাঁ, তুমি তো জান সবকিছু।

তা জানি, কিন্তু ঠিক কোনটা তোমাকে বিব্রত করছে বুঝতে পারছি না, গত কয়েকদিনে তো অনেক কিছু হল।

আমাকে যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি বিব্রত করছে সেটা হচ্ছে একটা সম্ভাবনা। যদি এখন দেখি ট্রাইটন থেকে এখন আরেকটা স্কাউটশিপ বের হয়ে আসছে আর তার ভিতরে আছে আরেকজন পল এবং আরেকজন রু, তা হলে আমি কী করব? একই সাথে দু’ জন পল তো থাকতে পারে না, তখন আমি কি একজন পলকে ধ্বংস করে দেব?

এটি তুমি একটা সম্ভাবনার কথা বলছ, এটি বাস্তবায়িত হবার আগে এটা নিয়ে বিব্রত হয়ে তোমার কী লাভ?

এটি মোটেও একটা আজগুবি সম্ভাবনা নয়, খুবই বাস্তব সম্ভাবনা। প্রথমবার জৈবিক পদার্থগুলি তৈরি করতে ট্রাইটনের অধিবাসীদের চারবার চেষ্টা করতে হয়েছে, আর পলকে তারা একবারে তৈরি করে ফেলবে, সেটা একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা হল?

কিন্তু তারা তো তৈরি করেছে। হয়তো জৈবিক পদার্থগুলি তৈরি করার সময় তারা তাদের পদ্ধতিগুলি উন্নত করে এনেছে, এখন তারা একবারে তৈরি করে নিতে পারে।

লু একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, কিন্তু যদি তারা আরো ভালো করে তৈরি করতে চায়, আর এখন আরেকটা স্কাউটশিপ বের হয়ে আসে?

সিডিসি কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

কিছু একটা বল সিডিসি।

আমার কিছু বলার নেই লু। তবে—

তবে কি?

তোমার অবস্থা আমি পুরোপুরি অনুভব করতে পারছি লু। তোমাকে খুব কাছে থেকে দেখার পর থেকে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে, এটা হয়তো আমার সৌভাগ্য যে আমি একজন মানুষ হয়ে জন্ম নিই নি, মানুষের জীবন অনেক কঠিন। যাই হোক, আমি যদি বলি, ট্রাইটনের অধিবাসীরা সম্ভবত পলকে দ্বিতীয়বার তৈরি করবে না, তুমি কি একটু সান্ত্বনা পাবে?

লু ভুরু কুঁচকে সিডিসির দিকে তাকায়, কিন্তু সিডিসি একজন মানুষ নয় যে তার চোখের দিকে তাকিয়ে মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবে। ছোট্ট মাইক্রোফোন, যেটা দিয়ে সিডিসি কথা বলে, সেটার দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝার উপায় নেই। লুয়ের কয়েক মুহূর্ত লাগে কথা বলতে, পাথরের মতো মুখ করে সে বলল, সিডিসি, তুমি কি কিছু-একটা জান, যেটা আমি জানি না?

সিডিসি একটু হাসির মতো শব্দ করে বলল, আমি সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার, আমাকে সবকিছু জানতে হয়, সেসব তোমার জানার কথা নয়, জানার প্রয়োজনও নেই।

সিডিসি, তুমি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করো না, তুমি খুব ভালো করেই জান আমি কী বলতে চাইছি। তুমি কি কিছু-একটা জান, যেটা আমি জানি না?

আমি দুঃখিত লু, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না।

রু-টেক কি কিছু একটা জানে, যেটা আমি জানি না? তার মেমোরি হঠাৎ করে খরচ হয়ে গেল কেমন করে? কী আছে সেখানে?

আমি দুঃখিত ল, আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারব না। তাছাড়া রু-টেক চতুর্থ মাত্রার রবোট, তার মেমোরিতে কী আছে সেটা কারো জানার অধিকার নেই, তাকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

গত আটাশ ঘন্টায় কি পলকে একাধিকবার তৈরি করা হয়েছে, যা তোমরা আমাদের জানাও নি?

আমি দুঃখিত লু, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।

লু হতবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, যখন কথা বলে তখন রাগে তার মুখ থমথম করছে, সিডিসি, তুমি জান আমি হচ্ছি সিসিয়ানের দলপতি, তুমি একটা সাধারণ কম্পিউটার, এখানে সিদ্ধান্ত নিই আমি, তুমি শুধু আদেশ পালন কর।

আমি জানি লু। আমি খুবই দুঃখিত যে তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার করার কিছু নেই–

লু চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমাকে যদি সবকিছু জানতে না দাও তাহলে তুমি জানবে কি করে কোন কোন কাজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে না?

তোমার যা জানার প্রয়োজন সবকিছু আমি তোমাকে জানাই।

পল আর রু-টেককে নিয়ে প্রথম প্রথম যে স্কাউটশিপগুলি বেরিয়েছিল তুমি সেসব উড়িয়ে দিয়েছ, আমাকে কি তুমি তা জানিয়েছ?

আমি একবারও বলি নি যে আমি স্কাউটশিপ ধ্বংস করেছি।

কিন্তু তুমি তা অস্বীকারও কর নি, করেছ?

আমি দুঃখিত, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না।

টেবিলে প্রচণ্ড থাবা দিয়ে লু বলল, এক শ’ বার দিতে হবে, আমি এখানকার দলপতি।

আমি দুঃখিত লু যে তুমি ব্যাপারটিকে এভাবে দেখছ। সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার হিসেবে আমাকে অসংখ্য জিনিস করতে হয়, সবকিছু তোমাকে বলা সম্ভব নয়, যেসব বলা প্রয়োজন সবসময়েই তোমাকে বলে থাকি। কোনটা বলা প্রয়োজন, কোনটা প্রয়োজন নয় সেটার সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আমার, আমাকে সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। তোমাকে শুধু একটি জিনিস বলে রাখি, কখনো যদি কোনো জিনিস তোমার কাছে গোপন করা হয়, সেটা তোমার ভালোর জন্যেই করা হয়, আমার এই কথাটি শুধু তুমি বিশ্বাস কর।

লু আপন মনে মাথা নাড়ে, সেজন্যেই বিস্ফোরকের হিসেব মিলছে না, স্কাউটশিপগুলি ওড়াতে গিয়ে বিস্ফোরক খরচ হয়েছে, হিসেব মিলবে কেমন করে? – টেককে নিশ্চয়ই তুমি ব্যবহার করেছ, তার মেমোরি এক স্কাউটশিপ থেকে আরেক স্কাউটশিপে পাঠানো তো তোমার কাছে ছেলেখেলা। রু-টেক আর তুমি জান কি হয়েছে, আর কেউ জানে না। আমাকে না জানিয়ে এরকম একটা কাজ তুমি করতে পারলে, তোমাকে এত বড় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে? তুমি জান, তুমি মানুষ খুন করেছ? তুমি জান, মানুষ খুন করা কত বড় অপরাধ?

সিডিসি কিছু বলার আগে হঠাৎ করে দরজা খুলে কিম জিবান ঝড়ের মতো এসে ঢোকে, থমথমে মুখে বলে, লু তোমার সাথে কথা আছে।

কী কথা?

তুমি নাকি রু-টেককে বলেছ, সে কিংবা পল, দু’ জনের কেউ এখন সিসিয়ানে আসতে পারবে না?

বলেছি।

কিম জিবান অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, তুমি বলেছ?

হ্যাঁ, বলেছি।

তুমি জান সিসিয়ানে জীবনরক্ষাকারী ক্যাপসুল আছে, পলকে তার মাঝে এনে রাখলে সে বেঁচে যাবে?

জানি।

তবু তুমি তাকে এখানে আনছ না, রু-টেককে বলেছ ডাক্তার সেজে তার উপর অস্ত্রোপচার করতে? সে জীবনে একফোঁটা রক্ত পর্যন্ত দেখে নি!

তা সত্যি।

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে কিম জিবান খানিকক্ষণ লু’য়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার মুখে কথা ফুটতে চায় না। অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে বলে, তোমাকে ভেবেছিলাম একজন খাঁটি মানুষ। আসলে তুমি খাঁটি মানুষ নও, খাঁটি মানুষের নিজের প্রাণের জন্যে এত মায়া থাকে না, যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করতে করতে তোমার অনুভূতি এখন যন্ত্রের মতো হয়ে গেছে, এখন তুমি যন্ত্রের মতো চিন্তা কর। পলের জন্যে তোমার কোনো অনুভূতি নেই, সে মরে গেলে তোমার কিছু আসে-যায় না। যতক্ষণ অন্য সবাইকে নিয়ে তুমি বেঁচে থাকতে পার, ততক্ষণ তুমি খুশি।

লু’য়ের মাথার মাঝে একটা অন্ধ রাগ দানা বাঁধতে থাকে। কিম জিবানের মুখে প্রচণ্ড আঘাত করে তাকে থামিয়ে দেয়ার ইচ্ছাটাকে অনেক কষ্ট করে সে আটকে রাখে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে কিম জিবানের উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ছেলেমানুষি মুখটা দেখতে দেখতে ওর রাগটা আস্তে আস্তে কমে আসে। বরং হঠাৎ করে ওর ভিতরে কেমন জানি একটি আশ্চর্য দুঃখবোধ জেগে উঠতে থাকে।

কিম জিবান মাথা নেড়ে বলতে থাকে, যখন ফিরে যাব, আমি তখন কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে তোমার বিরুদ্ধে নিজের মুখে নালিশ করব, মহাকাশযানের নেতা হতে হলে তার দলের লোকজ্জনের জন্যে অনুভূতি থাকতে হয়, যার সে অনুভূতি নেই, সে দলের নেতা হতে পারে না।

লু একটি কথা না বলে বিষণ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিম জিবান রুক্ষ গলায় বলল, কি হল, তোমার কিছু বলার নেই?

লু আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, সত্যি আমার কিছু বলার নেই কিম, তুমি যা বলেছ তার প্রত্যেকটা কথা সত্যি তোমাকে নালিশ করতে হবে না, আমি নিজেই কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে বলব, আমাকে যেন অবসর দেয়া হয়।

কিম জিবান হঠাৎ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, কি বলবে বুঝতে পারে না। লু এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, আমি দুঃখিত কিম, ব্যাপারটা তোমাকে এত বিচলিত করছে, কিন্তু তুমি নিজেকে আমার জায়গায় বসিয়ে দেখ এরকম পরিস্থিতিতে তুমি কী করতে। আমি নিজের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারি, কিন্তু অন্যদের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারি না। যেটুকু করে ফেলেছি সেটাও বেশি করেছি, তোমাদের মতো হৃদয়বান লোকজন আছে বলেই করেছি।

কিম জিবান খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বলল, লু, আমি দুঃখিত তোমাকে এভাবে এসে আক্রমণ করেছি, সব মিলিয়ে মাথার ঠিক নেই। তুমি কিছু মনে করো না।

আমি কিছু মনে করি নি। তোমার জায়গায় হলে আমিও সম্ভবত এরকম একটাকিছু করতাম।

দু জন খানিকক্ষণ সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে থাকে, কি বলবে ঠিক বুঝতে পারে না। কিম জিবান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, লু তোমাকে কেন দলপতি করা হয়েছে আমি খানিকটা বুঝতে পারছি। তুমি ভীষণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি।

লু মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি। সেটাই হচ্ছে আমার মুশকিল।

কিম জিবান হেসে বেরিয়ে যেতেই সিডিসি বলল, আমি কখনো মানুষকে বুঝতে পারব না, যখন মনে হল তুমি উন্মত্ত রাগে কিম জিবানকে আঘাত করবে তখন তুমি তার সব কথা মেনে নিজের দোষ স্বীকার করে নিলে।

লু মাথা নেড়ে বলল, কেন শুধু শুধু মানুষকে বুঝতে চেষ্টা কর সিডিসি? আমরা মানুষ হয়েই মানুষকে বুঝি না, তুমি কেমন করে বুঝবে? আর মানুষ কেন, আমি একটা কম্পিউটারকেই বুঝতে পারি না, স্কাউটশিপের ভিতরে জলজ্যান্ত মানুষ নিয়ে তাদের ধ্বংস করে দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যদি কম্পিউটার গোপন করে ফেলে—

সিডিসি বাধা দিয়ে বলল, সত্যি করে বল তো আমার কাছে, যদি সত্যিই আমি তা করে থাকি, তুমি কি সে জন্যে আমার কাছে কৃতজ্ঞ হবে না?

লু দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বলল, হব সিভিলি। তুমি ঠিকই বলেছ।

সিডিসি একটু হাসির মতো শব্দ করে বলল, সব সময় হয়তো মানুষকে আমি বুঝতে পারি না, কিন্তু কখনো কখনো সত্যি বুঝতে পারি।

লু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাই তো দেখছি।