১৫. আধঘণ্টা ভূগোল পড়িয়ে

॥ পনেরো ॥

ক্লাস সিক্সের তেরোটা মেয়েকে আধঘণ্টা ভূগোল পড়িয়ে এসে কাঠের নড়বড়ে চেয়ারটায় বসেছিল মিতুল। চন্দ্রনাথ মেমোরিয়াল স্কুলের অফিসঘরের কোণটিতে। এখানেই তাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে একটা টেবিল, চারটে চেয়ার আর একটা আধভাঙা আলমারি, এটাই এখন মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়ের অফিস কাম টিচারস রুম।

পলাশপুরের এই স্কুলটা অবশ্য বেশ বড়সড়ই। পেল্লাই সাইজের দোতলা বিল্ডিং আছে একখানা, আছে একটা পুরনো একতলা বাড়িও। আগে পুরনোটাতেই স্কুল বসত, এখন সেখানে প্রধান শিক্ষকের ঘর, স্টাফরুম, লাইব্রেরি, অফিস। দোতলা বাড়িটায় ছেলেদের ক্লাস হয় বলে মিতুলদের সেখানে ঠাঁই মেলেনি, একতলা বাড়ির ছোট ছোট দুটো ঘর পরিত্যক্ত পড়ে ছিল, ওই ঘরদুটোই জুটেছে মেয়েদের কপালে। সংসারে যেমন জোটে আর কী! একটায় ফাইভ, অন্যটায় সিক্স। স্কুলের মেয়াদ মাত্র দু’ঘণ্টা। এগারোটা থেকে একটা। চন্দ্রনাথের টিফিনটাইম একটা চল্লিশ, তার আগেই পাততাড়ি গুটোতে হয় মিতুলদের। চন্দ্রনাথের কর্তৃপক্ষ এরকমই চুক্তি করেছে সনৎ ঘোষের সঙ্গে।

তা যাই হোক, নেই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভাল। স্কুল অস্থায়ী হোক আর যাই হোক, হাটে-মাঠে ফ্যা ফ্যা করে ঘোরাটা তো বন্ধ হয়েছে। কেরামতি দেখাল বটে সনৎ ঘোষ। প্রমাণ করে দিল রাজনীতির লোক চাইলে কিছু ভাল কাজও করতে পারে। পিছনে উদ্দেশ্য যাই থাক, ক্ষমতা প্রদর্শন কী প্রতিপত্তি বাড়ানো, পঞ্চায়েত অফিসে নোটিস টাঙিয়ে, গ্রামে গ্রামে লিফলেট বিলি করে, হাটে হাটে মাইকে প্রচার চালিয়ে, মাত্র কদিনে বত্রিশটা মেয়ে জোগাড় করে ফেলল তো। ভাঙা বছরে এতগুলো ছাত্রী জোটানো মুখের কথা? বামুনঘাটা মুন্সিডাঙা গিয়ে পড়াশুনো চালানো যাদের পক্ষে সম্ভব নয় তারাই উৎসাহভরে যোগ দিয়েছে স্কুলে। এসেছে জনা বারো পুরনো ছাত্রীও। যখন সোনাদিঘিতে স্কুল বসত, সেই তখনকার। ফাইভ-সিক্সের তুলনায় বয়সটা হয়তো তাদের একটু বেশিই, তবে কী আর করা, মাঝের বছরগুলো নষ্ট হওয়ার জন্য তারা তো আর দায়ী নয়।

মুনমুন আর অপর্ণা ক্লাস নিচ্ছে এখন। দুটো তো মোটে শ্রেণী, দু’জন পড়াতে গেলে একজনকে তো গালে হাত দিয়ে বসে থাকতেই হয়। বসে বসে তালবেতাল ভাবছিল মিতুল। শো-কজ নোটিস হাতে আসার পর থেকে বাবা যেন কেমন গুম মেরে গেছে। মনের জোর বাবার চিরকালই কম, কী যে করবে এখন কে জানে! বাবার জায়গায় মিতুল হলে দেখে নিত একহাত। …মা’র মুখেও কদিন ধরে হাসি নেই। বাবার চিন্তায়? তার জন্য মিতুলের সঙ্গে ভাল করে কথা বলে না কেন? রাত্রে অকারণে মিতুলের ঘরে ঢুকে বই গোছাচ্ছে, অথচ প্রশ্ন করলে বেসুরো উত্তর! দিদি এসেছিল মঙ্গলবার, মাকে কিছু উলটোপালটা লাগিয়ে গেছে নাকি? কাঁথাস্টিচের শাড়ি দুটো নিয়েই বা মা তেমন উচ্ছ্বাস দেখাল না কেন?… নাহ্, ভেবে ভেবে থই পাচ্ছে না মিতুল।

টেবিলের অপর পারে রেখা সেনগুপ্ত। ভুরু কুঁচকে কী যেন হিসেব কষছে। বেচারা বড়দিদিমণিটির দশা সবচেয়ে সঙ্গিন। ডি-আই অফিস কি কলকাতা যেতে হল তো ভাল, নইলে সারাক্ষণ বসে কেরানির কাজ করো, নয় মন দিয়ে খবরের কাগজ মুখস্থ।

কাজ থামিয়ে চোখ পিটপিট করল রেখা। হিসেবটা মিতুলকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, —এই, এটা একবার চেক করে দ্যাখো তো।

কাগজে আলগা চোখ বুলিয়ে মিতুল বলল,—কী এত যোগ বিয়োগ করেছেন?

—দেখছিলাম, আজ পর্যন্ত স্কুলের কত আয় হল। ভরতি হয়েছে মোট বত্রিশজন… অ্যাডমিশন ফি বাবদ মাথা পিছু একশো… মানে বত্রিশশো। প্লাস বিল্ডিং ফি পঞ্চাশ টাকা করে মোট ষোলোশো। মাইনে কুড়ি ইনটু বত্রিশ… ছশো চল্লিশ। তা হলে মোট হল গিয়ে…

—সত্যি রেখাদি, পারেনও বটে। রোজ রোজ এই এক হিসেব কেন যে করেন?

—না ভাবছিলাম… স্কুলের অ্যাপ্রুভাল যতদিন না আসে… স্কুলের ইনকাম থেকে যদি তোমাদের অন্তত শ’দুই করেও দেওয়া যায়…! ওই ছাত্রীদের মাইনের টাকা থেকে যতটুকু হয় আর কী। ফরমাল অ্যাপ্রুভাল পেয়ে গেলে তখন তো আর ছাত্রীদের মাইনে থাকবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই টাকাটা এভাবে যদি ইউটিলাইজ করি…

হায় রে, কোথায় ন’ হাজার প্লাস পাওয়ার কথা, সেখানে দুশো…!

মিতুল টেরচা গলায় জিজ্ঞেস করল,—দেবেন যে, সনৎ ঘোষের পারমিশান নিয়েছেন?

রেখা মুখটাকে গ্রাম্ভারি করল,—সব বিষয়ে সেক্রেটারির অনুমতির তো প্রয়োজন নেই সুকন্যা।

—কী জানি, সনৎ ঘোষের টোন শুনে তো মনে হয় আমরা ওর বাড়ি ঝি খাটতে এসেছি। কাজের লোক মাইনে পাবে, কর্তার স্যাংশান লাগবে না?

রেখা আরও ভারী করল মুখটাকে,—শোনো সুকন্যা, হেডমিস্ট্রেসের নিজস্ব কিছু ফিনানশিয়াল পাওয়ার থাকে। আপাতত তোমাদের গাড়িভাড়া বাবদ এ-টাকা আমি গ্রান্ট করতেই পারি। পরে যদি কোনও সমস্যা হয়, তোমাদের মাইনের টাকা থেকে কেটে নিলেই হবে।

—থাক না রেখাদি, মিছিমিছি জটিলতায় যাওয়ার দরকার কী?

—পুজোর মুখ তো…। অপর্ণাও বলছিল। জাস্ট একটা সাময়িক বন্দোবস্ত।

—এই ব্যবস্থাই যে পারমানেন্ট হয়ে যাবে না সে গ্যারান্টি আপনি করতে পারেন?

—অত নিরাশ হচ্ছ কেন? দেখছ তো সনৎ ঘোষ কেমন উঠে পড়ে লেগেছে। এবার কিছু একটা নিশ্চয়ই হবে।

—কিন্তু সনৎ ঘোষ যেভাবে চাইছে, আমি তো সেভাবে এগোতে রাজি নই রেখাদি। ও যে শাগরেদকে দিয়ে ঠারেঠোরে শোনাচ্ছে, দিদিমণিরা মিলে হাজার পঞ্চাশ টাকা দিলেই অ্যাপ্রুভাল বেরিয়ে যাবে… ও পাঠশালায় তো আমি পড়ব না।

কথায় কথায় গলা ঈষৎ চড়ে গেছিল মিতুলের, আড়চোখে ঘরের বাকি লোকগুলোকে দেখে নিল একবার। চন্দ্রনাথ মেমোরিয়ালের তিনজন স্টাফ বসে এ-ঘরে। মিতুলদের বাক্যালাপ শোনার জন্য সর্বক্ষণ সজাগ হয়ে থাকে তাদের কান এখনও একজন তাকাচ্ছে টেরিয়ে টেরিয়ে। মিতুন ঝুঁকল সামান্য, স্বর খাদে নামিয়ে বলল,—একটা কথা বলব রেখাদি?

—কী?

—এখন কিন্তু স্কুলের অ্যাপ্রুভাল আসাটাই আমার কাছে আর মুখ্য ব্যাপার নয়। ভোগান্তি তো অনেক গেল, না হয় আরও যাবে। আমি দেখতে চাই এই সিস্টেমে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, সমস্ত আইনকানুন মেনে চাকরি পেয়েও, কোনও অসাধু পন্থা অবলম্বন না করে সার্ভিসলাইফ শুরু করা যায় কিনা।

—কিন্তু সুকন্যা, সরকারের গন্ধ যেখানে আছে সেখানেই তো…। সরকারি চাকরি পাওয়ার ব্যাপারটাই ধরো না। পুলিশ ভেরিফিকেশানের জন্য কিছু গচ্চা যায় না?

—আমি ওসব জানতে চাই না। আমি নিজেকে দিয়ে দেখতে চাই।

রেখা হেসে ফেলল। মিতুলকে সে এতদিনে মোটামুটি চিনে গেছে। স্মিত মুখেই বলল,— আমি তো বলছি না তুমি টাকা দাও। জাস্ট উদাহরণ দিলাম।… সত্যি বলতে কী, আমার সন্দেহ আছে সনৎ ঘোষ আদৌ টাকা নিয়ে ডি আই অফিসে ঢালবে কিনা। বড় জোর স্কুলের একটা ফান্ড বানাবে। আজ হোক, কাল হোক, বিল্ডিং বানানোর খরচা তো গভর্নমেন্ট দেবেই, তার আগে ফান্ডের টাকায় একটা-দুটো ঘর হয়তো তুলে নেবে। পরে যখন গ্র্যান্ট এল, ওই টাকা ফিরে গেল ফান্ডে। আর যাতায়াতটুকুর মধ্যে কিছু অ্যামাউন্ট হয়তো এদিক-ওদিক… মানে এ পকেট-সে পকেট…। আরও মজার কথা শুনবে? আমার কাছে তো সরাসরি চাইতে পারে না, তাই সেদিন ইনিয়েবিনিয়ে বলছিল, ম্যাডাম, গ্রামে মেয়েদের জন্য স্কুল করা তো মহৎ কাজ, এম এল এ সাহেবকে বলুন না কিছু ডোনেশান তুলে দিতে।

—বলেছে আপনাকে?

—তা হলে আর বলছি কী। আমিও ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে দিয়েছি। বলেছি, আপনি সরাসরি গিয়ে ধরুন।

—ভাবুন তা হলে, লোকটা কী ধান্দাবাজ!

—তবু কিন্তু বলছি লোকটা অ্যাপ্রুভালের জন্য আপ্রাণ লড়বে। নিজের তাগিদেই। ওর এখন সাপের ছুঁচো গেলার হাল। বিশ্বম্ভর তো মুখিয়ে আছে। সনৎ যদি স্কুল পাকাপাকি ভাবে দাঁড় করাতে না পারে, বিশ্বম্ভর ওর ভুট্টিনাশ করে ছেড়ে দেবে না? শুধু এই স্কুল ইস্যুতেই গরম হয়ে যাবে সামনের পঞ্চায়েত ইলেকশান। গ্রামের রাজনীতি কী জিনিস তা তো জানো না…!

খুব জানে মিতুল। সে তো বালিতে মুখ গুঁজে নেই। শহুরে রাজনীতি যদি জিলিপি হয়, গ্রামে চলে অমৃতির প্যাঁচ। স্বাদ অতিশয় কিটকিটে।

মিতুল মাথা দুলিয়ে বলল,—সে এখানে যা চলে চলুক, আমি কিন্তু আর বেশি দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকব না। অনেক সহ্য করেছি, স্ট্রেট এবার কোর্টে কেস ঠুকে দেব। চাকরি দিয়েছে, মাইনে দেবে না, স্কুল নেই… মামদোবাজি নাকি? প্রথম যেদিন জয়েন করেছি, সেদিন থেকে পুরো স্যালারি আমার চাই। সব্বাইকে জড়িয়ে দেব মামলায়। শিক্ষা দপ্তর, স্কুল সার্ভিস কমিশন, ডি আই অফিস, ম্যানেজিং কমিটি, সনৎ বিশ্বম্ভর কাউকে আমি ছাড়ব না।

—বাচ্চাদের মতো কথা। রেখা হাসছে—আইনের দরজা খোলা আরও কঠিন সুকন্যা। কড়া নাড়তে নাড়তে আঙুল খসে পড়ে যাবে। সরকারি লোক যত অন্যায়ই করুক, তার তো ব্যক্তিগত দায় নেই। সে ঠ্যাং নাচাবে, তার হয়ে তো লড়বে গভর্নমেন্ট। সরকারি উকিল। খরচাও তার নয়, সরকারের। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তোমার আমার। এদিকে তোমাকে কিন্তু গাঁটের কড়ি খরচ করে ক্রমাগত ফুলিয়ে যেতে হবে তোমার উকিলবাবুর পেট। বছরের পর বছর কোর্টে দৌড়োদৌড়ি করবে। কম করে বদলাতে হবে একশোটা চপ্পল। হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে দু’তরফের উকিলে কেমন লুকোচুরি চলে। এ প্রেজেন্ট তো ও অ্যাবসেন্ট, ও হাজির তো এ বেপাত্তা। দু’জনেই উপস্থিত তো জজসাহেব ছুটি নিয়েছেন। তোমার উকিল কিন্তু ডেট পড়লেই ফিজ্‌টি বুঝে নেবে, অথচ কে এগোবে শামুকের গতিতে। রায় বেরোলে অবশ্যই গভর্নমেন্ট হারবে, তবে তাতেও তোমার কোনও লাভ নেই। সরকার তখন তোমাকে নাকে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে উচ্চতর ন্যায়ালয়ে। সেখানে হারলে আরও উঁচুতে। আবার হারলে আরও উঁচুতে। শেষ পর্যন্ত যদি তোমার দম থাকে, এবং তুমি যদি জিতেও যাও, তখনও দেখবে যে লোকগুলোর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তুমি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলে তারা কিন্তু হারেনি। হেরেছে গভর্নমেন্ট। অর্থাৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই তুমি আমি। আর সেই লোকগুলো তখনও একভাবে ঠ্যাং নাচিয়ে চলেছে। কী বুঝলে?

মিতুল থতমত মুখে বলল,—তা হলে বলছেন কোথাও গিয়ে লাভ নেই? কিছু করার নেই? এত বড় একটা অবিচার হজম করে নিতে হবে?

—কী করা যাবে বলো সুকন্যা, এটাই আমাদের সিস্টেম। গ্রানাইট পাথরের মতো শক্ত। হৃদয়হীন। আমার হাজব্যান্ডকেও আমি কথাটা বলি। এককালে তো খুব বড় বড় বুলি কপচাত। বলত, সিস্টেমে ঢুকে সিস্টেমটাকে ভেঙে দেবে! এখন নিজেরাই চাকায় ঢুকে গেছে।

—শুনে কী বলেন?

—কখনও অন্যমনস্ক হয়ে যান। কখনও গম্ভীর। বুঝতে পারি, ভেতরে খচখচ থাকলেও উনি এখন নেশায় পড়ে গেছেন। অজস্র রকম সুযোগ সুবিধে, স্তাবকরা সবসময়ে দাদা দাদা করছে, সাধারণ মানুষ দরজায় এসে হাত কচলায়, যাকে তাকে হম্বিতম্বি করতে পারেন… এ সবের মোহ যে কী মারাত্মক। সিস্টেমটা মনুষ্যত্বকে নিংড়ে নেয় সুকন্যা।

রেখার মুখচোখ কেমন উদাস হয়ে গেছে। উদাস? না করুণ? মিতুল রেখাকে দেখছিল। নিঃসন্তান এই মহিলা স্বামীর কাছ থেকেও কত দূরে সরে গেছে! একাকীত্বের তাড়নাতেই বুঝি মাইনেকড়ি না পেয়েও এই স্কুলটা গড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে রেখাদি। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এভাবেই ভুলতে চায়। বেচারা।

ড্রয়ারে কাগজপত্র ঢুকিয়ে রাখছে রেখা। দুঃখ মাখানো হাসি হেসে বলল,—তোমার ক্লাস তো শেষ, তুমি এবার রওনা দাও না।

—আর একটু ওয়েট করি। একটা বাজুক। সবাই নয় একসঙ্গেই বেরোব।

—বোসো তা হলে। আমি একটু মুনমুন অপর্ণার ক্লাসে রাউন্ড মেরে আসি।

—যান।

রেখা চলে যেতে টেবিলে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা টানল। চোখ বোলাচ্ছে বাঁধাধরা সংবাদে। আমেরিকার একতরফা ইরাক আক্রমণের টুকিটাকি। প্রায় বিনা বাধায় দখল হয়ে যাচ্ছে একটা দেশ…! কাশ্মীরে ফের জঙ্গি হানা। দুই প্রতিবেশী দেশের রেষারেষি বাড়ানোর নিষ্ঠুর রাজনৈতিক লীলাখেলা…! মসজিদ মন্দির নিয়ে চাপান উতোর চলছে অযোধ্যায়। ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষকে খেপিয়ে তোলার চরম নোংরামি…! বিহারে কন্যাসন্তানদের মেরে ফেলা হচ্ছে আঁতুড়ে। কুশিক্ষা আর কুপ্রথার কী ভয়ংকর ছবি…! রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বাস থামিয়ে গণধর্ষণ। মধ্যযুগীয় বর্বরতা! সময় এগোচ্ছে, না পিছোচ্ছে…!

—নমস্কার দিদিমণি।

মিতুল কাগজ থেকে দৃষ্টি সরাল। যমগোদা এক ব্রিফকেস হাতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বছর চল্লিশেকের একটি লোক। মুখে বেশ গদগদ ভাব।

কাগজ মুড়ে রাখল মিতুল,—বলুন?

—আমি কলকাতার প্রতিমা পাবলিশার্স থেকে আসছি। শুনলাম মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয় আবার চালু হয়েছে…আমাদের কোম্পানির পাঠ্যপুস্তকগুলি যদি আপনারা একটু দেখেন… সব বিষয়ের বই আছে আমাদের…ইতিহাস ভূগোল অঙ্ক প্রকৃতিবিজ্ঞান জীববিজ্ঞান কর্মশিক্ষা… আমাদের বই এ অঞ্চলের অনেক স্কুলেই চলছে… চন্দ্রনাথ মেমোরিয়ালের বুকলিস্টেও আপনি আমাদের ঘরের বই পাবেন… আমরা কোনও ভুঁইফোড় প্রকাশক নই, পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান… আপনার যদি বিশ্বাস না হয়, আমি কয়েকটা স্কুলের পুস্তকতালিকাও এনেছি…

খোনা সুরে গড়গড় করে বলে চলেছে লোকটা। কালও এরকম এক প্রকাশকের লোক এসেছিল। সেও প্রায় একই সংলাপ আউড়ে গেছে। ক্লাস শুরু হওয়ার এক-দেড় সপ্তাহের মধ্যে কী করে যে এরা খবর পেয়ে গেল কে জানে!

মিতুল বলল,—দাঁড়ান দাঁড়ান, আমাদের তো এখনও স্কুল সেভাবে তৈরি হয়নি।

—তবু দেখুন না একবার। আপনাদের তো বই লাগবেই।

চন্দ্রনাথ মেমোরিয়ালের তালসিড়িঙ্গে টাইপিস্টটা বলে উঠল,—দেখতে পারেন দিদিমণি। এরা আমাদের চেনা লোক।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটার মুখে বিগলিত হাসি। ব্রিফকেস রাখল টেবিলের ওপর। খুলে বই বার করতে করতে বলল,—শুধু ফাইভ-সিক্সই এনেছি, পছন্দ আপনার হবেই। বলেই গলা নামিয়েছে,—পছন্দ না করিয়ে আমরা ছাড়িই না।

মিতুলের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। মাটিকুমড়ায় পড়াতে এসে কত কিছুই না জানতে পারছে। কলকাতার প্রকাশকদের এইসব প্রতিনিধিরা নাকি এভাবেই চক্কর মারে স্কুলে স্কুলে। নিজেদের ছাপানো পাঠ্যপুস্তক স্কুলে ধরানোর জন্য নাকি কিঞ্চিৎ লেনদেনেরও প্রথা আছে। যতগুলো বই বুকলিস্টে তুলতে পারবে, তত ইন্‌টু একশো-দুশো করে থোক একটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে যাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। ভাগাভাগিতে বহু জায়গায় প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারও নাকি বখরা থাকে। আশ্চর্য, এইসব প্রকাশকরা কি লোক লাগিয়ে চিরুনি তল্লাশি চালায়? নইলে এই অসময়ে এদের কাছে খবর পৌছোয় কী করে? ডি আই অফিসই বলে দেয় নাকি? কে জানে এখান থেকেও তাদের হয়তো টু পাইস আমদানি হয়!

রেখা এসে গেছে। মিতুল হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বলল,—এই তো বড়দিদিমণি। …ওঁর সঙ্গে কথা বলুন।

রেখা লোকটাকে জরিপ করতে করতে বসল চেয়ারে। ঠোঁটে একটা চোরা হাসি টেনে বলল, —আমাদের স্টুডেন্টসংখ্যা এখন কত জানেন? কত কষ্ট করে অত দূর থেকে সব আসছেন, পড়তায় পোষাবে তো আপনাদের?

লোকটার তাম্বুল রঞ্জিত বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে গেল,—আজ কম আছে, কাল বেড়ে যাবে। প্রথম থেকেই আমাদের বই যদি স্কুলে চালু থাকে…

—বুঝলাম।

—বইগুলো একবার দেখুন না বড়দিমণি। ভূগোল বইটা লিখেছেন এক অধ্যাপক। কলকাতার কলেজের। এই স্ট্যান্ডার্ডের বই আপনি পশ্চিমবাংলার কোনও প্রকাশকের ঘরে পাবেন না।

—বটে?

রেখা বইটা হাতে নিল। চশমা ঠিক করে পাতা উলটোচ্ছে। তখনই দরজায় চন্দ্রনাথের পিয়োন,—সুকন্যাদিদিমণি, আপনাকে একজন খুঁজছেন।

—আমাকে?

—আপনার নামই তো বললেন। হাতে বড় ফোলিওব্যাগ আছে।

মিতুল হকচকিয়ে গেল। কে রে বাবা? তার চেনাজানা কেউ পাঠ্যবইয়ের প্রকাশনা খুলেছে নাকি? না বন্ধুবান্ধব কেউ প্রকাশকের ঘরে চাকরি নিল?

টানা লম্বা বারান্দাটায় এসে মিতুল হতবাক। অতনুদা! দাঁড়িয়ে আছে ঘাসবিহীন ফুটবল মাঠটার এক পাশে।

সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে অতনু আর যোগাযোগ করেনি। হঠাৎ অ্যাদ্দিন পর এত দূরে এসে হাজির হয়েছে যে?

মিতুলকে দেখেছে অতনু। বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই এগিয়ে এল। একগাল হেসে বলল, —তুমি যে এর মধ্যেই স্থানান্তরিত হয়ে গেছ বুঝতে পারিনি। খুব ঘুরপাক খেলাম যাহোক। প্রথমে গেলাম মাটিকুমড়া, সেখানে গিয়ে দেখি সব ভোঁ ভাঁ। এক বুড়ো বলল তোমরা নাকি আরও দু’কিলোমিটার সরে গেছ। ভাগ্যিস সঙ্গে ভ্যানরিকশাটা ছিল, ধানখেতের হাওয়া খেতে খেতে সোজা চলে এলাম এখানে।

—কী কাণ্ড! তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে…?

—বামুনঘাটায় এসেছিলাম। ডিলারের কাছে। হঠাৎ মনে হল তুমি তো কাছাকাছি আছই… একটা চান্স নিয়ে দেখি…

—ও। পিয়োন ছেলেটা ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে, তার কৌতূহলটাকে ঝলক দেখে নিয়ে মিতুল বলল,—একটু দাঁড়াও। আসছি।

রেখাকে বলে, ভ্যানিটিব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, বেরিয়ে এল মিতুল। দোতলা বিল্ডিংটায় ছেলেদের জোর হল্লাগুল্লা চলছে। বারান্দাতেও দাপাদাপি করছে ছেলেরা। একদল হইহই করে নেমে এল ন্যাড়া মাঠে, ফুটবল নিয়ে দৌড়োচ্ছে। মাঠটা পেরিয়ে এসে মিতুল বলল, —ভ্যানরিকশা আছে? না ছেড়ে দিয়েছ?

—মাথা খারাপ! এই ঢোলগোবিন্দপুরে এসে ওই বাহন হাতছাড়া করি! এখানে আসতে আসতে তোমার পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছিল। এতটা ভেতরে তুমি রোজ আসো, বাপস্!

—না স্যার। মাটিকুমড়া ঘুরে এসেছ বলে ওরকম মনে হচ্ছে। এখান থেকে বাসরাস্তার একটা শর্টকাট রুট আছে। হেঁটেই মেরে দেওয়া যায়।

স্কুলের সামনে দিয়ে মেঠো পথ চলে গেছে গ্রামের ভেতর। রাস্তার ধারে ঝাঁকড়া আমগাছ রয়েছে বেশ কয়েকটা। একটা গাছের ছায়ায় অপেক্ষা করছিল তেচাকা, কথা বলতে বলতে মিতুল গিয়ে উঠে পড়ল পাটাতনে। দিব্যি অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বাবু হয়ে গুছিয়ে বসেছে। মুখে অনাড়ষ্ট ভাব, কিন্তু ভেতরে কুলকুল করছে অস্বস্তি। অতনুদা এখানে কেন? শুধুই বামুনঘাটায় এসেছিল, তাই…? সেদিন দিদি চলে যাওয়ার পর যেন পাথরের স্ট্যাচু বনে গিয়েছিল অতনুদা। খানিকক্ষণ পর মাথা নিচু করে বলেছিল, আমি চলি। মিতুলের বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, দিদির বিষতিরকে আমল দিয়ো না। দিদিকে মিথ্যে প্রমাণ করার জন্য স্বচ্ছন্দ হও, স্বাভাবিক হও। কিন্তু ওই মুহূর্তে বলা কি যায়?

এতদিনে তা হলে ধাক্কাটা সামলাতে পারল অতনুদা?

গড়াতে শুরু করেছে ত্রিচক্র যান। চালককে কোন রাস্তায় যেতে হবে তার নির্দেশ দিয়ে মিতুল বলল,—খুব জোর সারপ্রাইজ দিয়েছ কিন্তু…

অতনু বসেছে পা ঝুলিয়ে। সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছে। পরপর তিনটে কাঠি নষ্ট করল, সফল হয়েছে চতুর্থ বারে। লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল,—তোমাকে চমকাতে গিয়ে জোর ফ্যাসাদে পড়েছিলাম।

মিতুল গ্রীবা হেলাল,—কী রকম?

—ভুল করে ছেলেদের স্কুলের স্টাফরুমে ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে সুকন্যা মুখার্জির নাম বলতেই যেভাবে পনেরো জোড়া চোখ আমায় অ্যাটাক করল। তারপর তো শুরু হল সি বি আই-এর জেরা। অন্তত পাঁচজন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেম প্রশ্ন করে যাচ্ছে!… কে আপনি? কোত্থেকে আগমন? সুকন্যা মুখার্জি আপনার কে হয়? তাকে আপনি কদ্দিন চেনেন? তিনিই কি আপনাকে ডাক পাঠিয়েছিলেন, নাকি স্বইচ্ছায় এসেছেন?

মিতুল হাসতে হাসতে বলল,—ওফ্, ও ঘরটা তো একটা চিড়িয়াখানা! যা এক একটা স্যাম্পল্ ওখানে! আমাদের চারজনকে নিয়ে ওদের যে কত কিউরিয়োসিটি!

—আহা, ওদের নিস্তরঙ্গ জীবনে তোমরা ঊর্মিমালা হয়ে এসেছ…

—কাব্য কোরো না। পিত্তি জ্বলে যায়। আমাদের পাস্ট প্রেজেন্ট আর ফিউচারই ওদের একমাত্র গবেষণার টপিক। আমাদের হেডমিস্ট্রেসের যে বাচ্চা হয়নি তাই নিয়েও ওরা ভেবে আকুল। একদিন ইনডাইরেক্টলি রেখাদিকে জিজ্ঞাসাও করেছিল রেখাদি ডাক্তার টাক্তার দেখিয়েছে কিনা।

—তা ওই সব কৌতূহলী বেড়ালরা সব একসঙ্গে স্টাফরুমে বসে কেন? একটা বাজার আগেই টিফিনটাইম?

—আরে না। ওটা একটা অন্য কেস। চন্দ্রনাথের টিচাররা এখন আর ক্লাস নিচ্ছে না। বিশ্বকর্মাপুজোর দিনই ছেলেদের বলে দিয়েছে, যা তোদের পুজোর ছুটি হয়ে গেল।

—যাহ্। এরকম বলা যায় নাকি?

—বলেছে। স্টাফরুমে বসে বসে ওরা গেঁজায়, তর্কাতর্কি চেঁচামিচি দলাদলি করে, যে যার পার্টির হয়ে গলা ফাটায়, তারপর সময়মতো কেটে পড়ে।

—আর ছাত্ররা হুল্লোড় করে? নেচে বেড়ায়?

—এরকমই তো চলছে। অফিসিয়ালি পুজোর ছুটি পড়েনি, তাই স্কুলই এখন ওদের মৌজমস্তির জায়গা।

—বাহ্, বাহ্। হেডমাস্টারও কিছু বলেন না?

—তিনি ভয়ে জুজু। তিন মাস মাইনে পায়নি টিচাররা, তিনি স্টাফরুমে উঁকি দিলেই মাস্টাররা বেত নিয়ে তেড়ে আসবে।

—তাই বলো। তিন মাস উইদাউট পে। তা হলে তো ক্লাস না নেওয়াই স্বাভাবিক। …কিন্তু মাইনে পায়নি কেন?

—আসেনি, তাই। এরকমই তো আজকাল রেওয়াজ। গভর্নমেন্টের টাকা নেই। যখন আসবে, তখন পাবে। বামুনঘাটা থেকে বাসে আসতে আসতে একদিন একজন সিনিয়র টিচার বলছিল, চাকরি পেতে গুনে গুনে এক লাখ টাকা দিতে হয়েছিল দিদিমণি, তিন বিঘে জমি বেচতে হয়েছিল বাবাকে, ঠিকঠাক মাইনে না পেলে পড়াব কেন!

—বটেই তো। লেজিটিমেট গ্রিভান্স। পেটে কিল মেরে পড়ানো যায়?

—তুমি যা ভাবছ তা নয়। দু’-চারজনকে বাদ দিলে বেশির ভাগ স্যারেরই স্কুলটা সাইড ইনকাম। পেট চালানোর জন্য চাষবাস আছে, জমিজমা আছে, দোকানপাট আছে, কেউ বা শ্যালো ভাড়া দেয়, কেউ ভাড়া খাটায় ট্র্যাক্টর…। আর মাদুর চাটাইয়ের ব্যবসা তো আছেই।

—মাদুর? সে তো মেদিনীপুর বাঁকুড়ার কুটিরশিল্প! এ অঞ্চলেও হয়?

মিতুল হেসে গড়িয়ে পড়ল। বুঝি বা একটু বেশিই হাসছে। বেশি প্রগল্ভ। বলল,—এ-মাদুর বাংলার সর্বত্র হয় অতনুদা। মাদুর ইজ আ টেকনিকাল টার্ম। মানে প্রাইভেটে ছাত্র পড়ানো। কম সংখ্যায় পড়ালে মাদুর, বেশি ছাত্র পড়ালে চাটাই।

—ওহ্ হো, তাই বলো!

পলাশপুরের মাটির রাস্তা ছেড়ে সুরকি বিছোনো পথে উঠেছে ভ্যানরিকশা। চলছে খানাখন্দে ঠোক্কর খেতে খেতে। পলাশপুরের এদিকটায় পাটের চাষ হয় খুব, ক’দিন আগেও রাস্তার দু’ধার উঁচু উঁচু গাছে প্রায় ঢাকা পড়েছিল। পাট কেটে নেওয়ার পর মাঠগুলো ফাঁকা ফাঁকা। দূরে দেখা যায় ধানখেত। ধানগাছের সবুজ ফিকে হয়েছে খানিকটা। এখন সেখানে ফুটে আছে কাশফুল, দোল খাচ্ছে হাওয়ায়। পথে ছোট্ট একটা জলাভূমি পড়ল, জলার পাড়ে কাশের জঙ্গল এত ঘন যে জায়গাটা পুরো সাদা হয়ে গেছে। পিড়িং পিড়িং পাখি উড়ছে এলোমেলো। দোয়েল ফিঙে শালিক চড়ুই ডাকছে। পিক পিক পিক। এই সময়ে, শরতের এই নির্জন দুপুরে পৃথিবীটাকে কী যে মেদুর লাগে!

চারপাশটা দেখতে দেখতে অতনুর সঙ্গে গল্প করছিল মিতুল। অতনুই প্রশ্ন করছে। মিতুলের স্কুল নিয়ে। হাত মুখ নেড়ে নেড়ে উত্তর দিচ্ছে মিতুল। বাসস্টপে এসে ভ্যানরিকশা থেকে নামতেই সহসা ফুরিয়ে গেল কথা। আকাশ দেখছে অতনু। ছেঁড়া ছেঁড়া ফেনা মাখা আশ্বিনের আকাশ। মিতুলের চোখ দূরে। বহু দূরে। নিউ মার্কেটের সামনে।

অসহজ ভাবটা ফিরে আসছিল মিতুলের। কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে এসেছে অতনু। যেন এতক্ষণ ধরে শুধু উপক্রমণিকা ভাঁজছিল। কী বলতে পারে? তোমার দিদির আচরণের জন্য আমি দুঃখিত? লজ্জায় তোমায় একটা ফোনও করতে পারিনি? কাকে বলবে? দিদিরই বোনকে? নাকি শুনতে চায় দিদির বেচালপনায় কতটা মরমে মরে আছে মিতুল?

বাস এসে গেল। উঠেছে দু’জনে। নীরবে। মুন্সিডাঙায় হাট ছিল আজ, বাসে বেশ ভিড়। তার মধ্যেই বসার জায়গা পেয়ে গেল মিতুল, অতনু ঠায় দণ্ডায়মান।

বামুনঘাটায় নেমেই আবার সিগারেট ধরাল অতনু। বাসস্টপের উলটো দিকে বামুনঘাটা থানা। বড়সড় এক চা-দোকান আছে থানার দোরগোড়ায়। সাইনবোর্ড ঝুলছে, কেষ্ট কেবিন। অতনু চোখের ইশারায় দেখাল দোকানটাকে,—গলা ভেজাবে নাকি?

মিতুল লঘু গলাতেই বলল,—কেন, ধোঁয়াতে গলা ভিজছে না?

অতনু যেন সামান্য অপ্রস্তুত। আমতা আমতা করে। বলল,—আমি কি বেশি সিগারেট খাচ্ছি?

—খাচ্ছই তো। হেঁয়ালি আর পছন্দ হচ্ছিল না মিতুলের। সরাসরি বলল,—এনি টেনশান?

—না, এমনি। অতনু ঢোঁক গিলল। কী একটা কথা বলতে গিয়েও চলে গেল অন্য কথায়,—তোমার বাবার ব্যাপারটা কী হল? মিটেছে?

মিতুল চোখ ঘুরিয়ে তাকাল, —তুমি জানো ঘটনাটা?

—একদিন কাগজে দেখেছিলাম।

—তখন ডিটেলে জানতে ইচ্ছে হয়নি?

—না মানে…

—ইজিলি একটা ফোন করতে পারতে। মিতুল গম্ভীর হল, —দ্যাখো অতনুদা, এসব সংকোচের আমি মানে বুঝি না। সেদিন দিদি যা করেছে তার জন্য দিদিরই লজ্জিত হওয়া উচিত। তুমি কুঁকড়ে আছ কেন?

অতনু নার্ভাস মুখে বলল, —সরি।

—সরি-ই বা কীসের জন্য? অতনুর কাচুমাচু মুখ দেখে মিতুল হেসে ফেলল, —তোমার ফোন না করাটাও তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং ওই মুহূর্তে আমাদের এমব্যারাস না করে তুমি হয়তো ভালই করেছ।

অতনু থম মেরে রইল একটুক্ষণ। বুঝি এবার কী বলবে ভাবছে। সিগারেট ফেলে দিল। পা দিয়ে চেপে চেপে নেবাচ্ছে। আচমকা বলে উঠল, —জানো, তোমার দিদি আমায় ডেকেছিল৷

—বলো কী? কবে?

—পরশু রাত্রে হঠাৎ ফোন। প্রথমে একপ্রস্ত কিছু মনে কোরো না, কিছু মনে কোরো না। তারপরই ঝুলোঝুলি, প্লিজ কাল দুপুরে একবার আমার বাড়িতে এসো, তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে।

—তার মানে অনুতপ্ত হয়েছে?

—অনুতাপ শব্দটা তোমার দিদির অভিধানে নেই মিতুল।

—তা হলে হঠাৎ ডাকাডাকি কেন? সামনাসামনি আর এক প্রস্ত গালিগালাজ করতে?

—না বাড়িঘর দেখাতে। নিজের ঐশ্বর্য দেখাতে। আমাকে বিয়ে না করে ও যে কত সুখে আছে, সেটাই শো করতে। স্রেফ বোঝাতে চাইছিল তাকে ওই প্রাচুর্যে রাখার ক্ষমতা আমার ছিল না, হবেও না কোনওদিন। বোঝানো কেন, মুখের ওপর শুনিয়েও তো দিল।

—অদ্ভুত তো! কী লাভ হল তোমায় শুনিয়ে?

—ওর কতটা লাভ হল জানি না, তবে আমার হয়েছে। অতনু মৃদু হাসল, —অনেক দিন মনে মনে একটা ধন্দ ছিল, তোমার দিদি কি আমায় আদৌ ভালবাসত কোনওদিন? জবাবটা কাল পেয়ে গেলাম। বাসত। ভালবাসত বলেই ভেতর থেকে জ্বলছে। নিজেকে জোর করে সুখী প্রতিপন্ন করে আমায় জ্বালাতে চাইছিল। যাকে ও একদিন ঘেঁড়া রুমালের মতো ফেলে দিয়েছে, সে যে এখন আর তার বিরহে কাতর নয়, এই নির্মম সত্যিটা ও কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। সেদিন আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখার পর থেকে হিংসে ওকে তাড়িয়ে মারছে।

একে কি ভালবাসা বলে? নাকি অধিকারবোধ? হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ক্ষোভ?

মিতুল মাথা নাড়ল, —হুম। দিদিটা বোকা আমি জানি। কিন্তু এত বোকা আমার ধারণা ছিল না। কী করে ভাবতে পারল তোমার আমার মধ্যে সেরকম কোনও সম্পর্ক হয়েছে?

—হয়নি, না?

কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে অতনু। কিছুতেই আর মিতুলের চোখে চোখ রাখছে না। তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। ভান করছে অন্যমনস্কতার। দেখছে গাছপালা, দেখছে রাস্তা, দেখছে চলমান মানুষ অথবা কিছুই না।

মিতুলের কাছে একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছিল ছবিটা। নিউ মার্কেটের সামনে অবাঞ্ছিত কাণ্ডটা ঘটে যাওয়ার পর অতনুর দীর্ঘ নীরবতা, কাল দিদির বাড়ি গিয়েই ছুটতে ছুটতে এই দেখা করতে আসা, জোর করে অস্বচ্ছন্দ ভাব কাটানোর প্রয়াস, এই মূহুর্তের অপ্রতিভ ভঙ্গি, সবই যেন এক সুতোয় গাঁথা। কী বলে ওই সুতোয় গাঁথা মালা?

মিতুল কষে ধমকাল নিজেকে। এইসব ন্যাকা ন্যাকা রোম্যান্টিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া তোমায় মানায় না মিতুল। কী চাও তুমি, অ্যাঁ? রামবুদ্ধু দিদিটার সন্দেহ কি সত্যি প্রমাণ করে ছাড়বে?

আশ্চর্য, ধমকটায় তেমন জোর ফোটে না কেন? দুটো অকিঞ্চিৎকর শব্দ বেজেই চলেছে মিতুলের বুকে। জলতরঙ্গের মতো। নাকি ও কোনও অচিন পাখির ডাক? বুঝতে পারছে না মিতুল। সত্যিই কিছু বুঝতে পারছে না। নিজেকে কেন যে হঠাৎ অচেনা লাগছে এখন?

হয়নি, না? নাকি হয়েছে?

.

॥ ষোলো ॥

ট্রেন থেকে নেমে শান্ত পায়ে হাঁটছিল সোমনাথ। অনেকদিন ছুটিতে কাটল, প্রায় তিন সপ্তাহ, আর কত বিশ্রাম নেওয়া যায়! আজ ক্লাস হয়ে পুজো ভেকেশান পড়বে, আজ তো জয়েন না করলেই নয়।

সোমনাথ এখন অনেকটাই সুস্থ। বুকের চাপ ভাবটা নেই, ব্যথাও নেই বললেই চলে, দুর্বলতাও না থাকারই মতো। ডাক্তার এখন তাকে হাঁটতে বলেছে নিয়মিত। দিনে অন্তত মাইল দুয়েক। হৃদয়ের কলকবজা মোটামুটি ঠিকই আছে, তবু ওই হাঁটাটা নাকি বুড়িয়ে আসা হৃদযন্ত্রের জন্য অতি মূল্যবান পথ্য।

ডাক্তার দেখানো নিয়ে নাটক কিছু হল বটে বাড়িতে। মৃদুলার বোন ভগ্নিপতির সঙ্গে হাতিবাগানের এক কার্ডিওলজিস্টের দারুণ চেনাজানা, জামাইবাবু কাম প্রাক্তন মাস্টারমশাইকে দেখতে এসে মন্দিরা প্রায় টানতে টানতে সোমনাথকে নিয়ে গেল তার চেম্বারে। শুনেই তুতুলের মুখ হাঁড়ি। প্রতীক যে এদিকে পাঁচশো টাকা ভিজিটের সুবোধ সেনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলেছে তার কী হবে! অগত্যা মেয়ের মান ভাঙাতে সুবোধ সেনের কাছেও ছোটো। হাইফাই মেয়েজামাইয়ের হাইফাই বন্দোবস্তে মন থেকে সায় না পেলেও। আহা মেয়ে তার যেমনই হোক, সন্তান তো বটে। বাবাকে নিয়ে তার উদ্বেগটাও তো খাঁটি। তা ছাড়া ইচ্ছেঅনিচ্ছে, ভাললাগা মন্দলাগা, তৃপ্তিঅতৃপ্তি, সব মিলিয়েই তো সংসার। এ এক অনন্ত আপস, নিরন্তর বোঝাপড়া। তুতুল প্রতীকের জীবনধারা তো সোমনাথ চাইলেই বদলে যাবে না। সুতরাং নিজের পছন্দ অপছন্দগুলো বুঝিয়ে দেওয়া, আর মনে মনে কষ্ট পাওয়া ছাড়া সোমনাথের আর কীই বা ভূমিকা থাকতে পারে এখন?

পথের দু’ধারে দোকানপাটে ভালই ভিড়। এগারোটা বাজতে না বাজতে জমে উঠেছে পুজোর বাজার। হবেই তো, চতুর্থী বলে কথা, তার ওপর রবিবারটা মাটি হয়েছে বৃষ্টিতে। টানা ঝিলের ওপারে ফাঁকা মাঠ, সেখানে প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে জোর। গির্জা বানাচ্ছে। সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালের অনুকরণে। এখানেও পৌঁছে গেল কলকাতার ঢেউ!

ঝিলটা পেরিয়ে এসে সোমনাথের চোখ আটকেছে সামনে। অভিজিৎ আসছে! একা। সোমনাথকে দেখেই রাস্তা টপকে ওপারে চলে গেল। ঘাড় ঝুঁকিয়ে হাঁটছে।

কী যে হয়ে গেল সোমনাথের, গলা উঠিয়ে ডাকল, — অভিজিৎ?

চমকে মাথা তুলেছে ছেলেটা। ফ্যাকাশে মুখে তাকাল।

সোমনাথ ফের ডাকল, —এদিকে শোনো।

পায়ে পায়ে এল অভিজিৎ। চোখ তুলছে না। খারাপ লাগল সোমনাথের। তার সঙ্গে চরম অসভ্যতা করেছে বটে ছেলেটা, তবু ছাত্র তো। শত্রু তো নয়।

সোমনাথ স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করল, —পার্ট ওয়ানের মার্কশিট এসেছে কলেজে?

— হ্যাঁ স্যার। অভিজিৎ ঢক করে মাথা নাড়ল, —কাল এসেছে।

—তোমার ইতিহাস অনার্স না?

—হ্যাঁ স্যার।

—কেমন হল রেজাল্ট?

—ভাল নয়। অভিজিতের ফের ঘাড় হেঁট, —ফরটি-থ্রি পারসেন্ট।

—এত কম?

—থার্ড পেপারটা খুব খারাপ হয়েছিল স্যার। এতক্ষণে আড়ষ্ট অভিজিৎ খানিকটা সহজ যেন,—কিচ্ছু কমন পাইনি। মাত্র তিনটে কোয়েশ্চেন অ্যাটেমপ্ট করেছিলাম।

সারাক্ষণ ইউনিয়নবাজি করলে এই হালই হয়। আজকাল তো সেরা ছেলেরা বড় একটা ইউনিয়ন নিয়ে মাতে না, এখন কলেজের মাঝারি বা ওঁচারাই লিডার। পতঙ্গের মতো এরা ঝাঁপ দেয় রাজনীতির আগুনে। আশায় থাকে রাজনীতির সুবাদে আখের গুছিয়ে নেওয়ার। কিন্তু সেই সৌভাগ্যই বা ক’জনের কপালে জোটে? পুড়ে ছাই হওয়াটাই এদের নিয়তি। অভিজিৎও নেহাতই সাধারণ মানের ছাত্র, স্টাফরুমে শুনেছে সোমনাথ। এই ছেলেটার কপালে কী আছে? মায়া হয় ভাবলে, বড্ড মায়া হয়।

নিজের ক্ষণিকের ভাবনায় নিজেই চমকাল সোমনাথ। এ কার ভাষায় চিন্তা করছে সে? নির্মল! হঠাৎ নির্মল কথা বলে ওঠে কেন?

সোমনাথ গলা ঝেড়ে বলল,—ভাল করে খাটো। পার্ট-টুতে পারসেন্টেজ না বাড়াতে পারলে চলবে?

আবার ঢক করে মাথা নাড়ল অভিজিৎ। সোমনাথ আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করেছে। কী যেন মনে হতে ঘুরে তাকাল একবার। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সোমনাথের আহ্বানটা এখনও বোধহয় পরিপাক করতে পারেনি। আজ অভিজিৎ এত সভ্য, এত শালীন, যে বিশ্বাসই হয় না ওই ছেলেই অমন উগ্র আচরণ করেছিল! দলের মধ্যে থাকলেই কি অভিজিৎদের রূপ পালটে যায়? নৈতিকতা মূল্যবোধ সংস্কার ঝাপসা হয়ে আসে? একা মানুষের হৃদয়বৃত্তি ভোঁতা করে দেওয়ার জন্যেই কি দলের উদ্ভব? ওই অভিজিৎই যে কলেজে সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে পড়লে অন্য মূর্তি ধারণ করবে তাতে কোনও সংশয়ই নেই। দল থাকলেই নেতা জন্মাবে। নেতা মানেই ক্ষমতা। যত ছোট গণ্ডির মধ্যেই হোক, অভিজিৎ খানিকটা ক্ষমতা হাতে পেয়েছে তো। ওই হাতিয়ারই তো রং বদলে দেয় মানুষের।

আশ্চর্য, এও তো সেই নির্মলেরই কথা! নির্মলের ভূত কি আজ ঘাড়ে চেপে বসল সোমনাথের?

ভাবতে ভাবতে কলেজ গেট। ভাবতে ভাবতে স্টাফরুম। পরিচিত চেয়ারে বসতেই একটা চোরা অস্বস্তি। মনে পড়ে গেল শো-কজের চিঠিটা ঘাপটি মেরে আছে ফোলিওব্যাগের গুহায়। আজ, ছুটির আগের দিন, ওই নিয়ে আর উচ্চবাচ্য হবে কি?

স্টাফরুম আজও চাঁদের হাট। কে নেই! সোমনাথকে দেখেই কুশল প্রশ্নের ঝড় বয়ে গেল যেন। সঙ্গে শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি উপদেশ। মুখে একটা হাসি ধরে রেখে উত্তর দিচ্ছিল সোমনাথ। ফাঁকে ফাঁকে চলছে লেখা, জয়েনিংয়ের চিঠি।

তথাগত পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝুঁকে নিচু গলায় বলল,—রাস্তায় আপনাকে তখন অভিজিৎ ধরেছিল কেন সোমনাথদা?

সোমনাথ কলম থামাল। আলগাভাবে বলল,—ধরেনি তো। আমিই ওকে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করছিলাম ওর রেজাল্ট কেমন হল। …আপনি দেখলেন কোত্থেকে?

—রিকশায় পাস করছিলাম।

—ও।

তথাগত আরও ঝুঁকল। প্রায় কানে কানে বলল,—গুড ট্যাক্টিকাল মুভ। বাবা বাছা করে সম্পর্কটা ইজি করে ফেলুন। অভিজিৎ আর ক’টা দিনই বা থাকবে, জাস্ট কায়দা করে টাইমটা পাস করিয়ে দিন।

এরকম একটা গূঢ় বাসনা নিয়েই কি সোমনাথ ডেকেছিল অভিজিৎকে? নাহ্, সোমনাথ মানতে পারল না। ঝোঁকের মাথাতেই তো হঠাৎ…। অবশ্য কারণ ছাড়া কার্য হয়, একথা কে-ই বা বিশ্বাস করবে!

তবে তথাগতর পরামর্শ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, কলেজে এখন এই খাতেই বইছে আলোচনা। নইলে স্বপনই বা সেদিন এক সুরে গাইবে কেন?

গত রবিবার বাড়িতে এসেছিল স্বপন। সোমনাথকে দেখতে। বলছিল, কেন এত দুর্ভাবনা করছেন? পরিস্থিতি এখন মোটামুটি পিসফুল, ছেলেমেয়েরা দিব্যি ক্লাসটাস করছে, পুজোর আগে মুখটা দেখিয়ে আসুন, ছুটির পর তানানানা করে আরও কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিন। পুজোর পর দুটো মাস পার করে দিতে পারলেই তো ব্যস, এসে যাবে ইউনিয়নের ইলেকশান। ছাত্র সংসদের বডি চেঞ্জ হবে, অভিজিৎও উইল বি আউটগোয়িং অ্যান্ড নোহোয়ার। বুঝছেন তো ব্যাপারটা? আপনার কেসও তখন কফিনে। আরে, বোফর্স বাবরির মতো ঘ্যামা ঘ্যামা কমিশনের কবরে ঘাস গজিয়ে গেল, আর এ তো তুচ্ছ একটা চড় মারার ঘটনা!

নাহ্‌, জবাবটা লিখে না আনা বোধহয় সোমনাথের খুব একটা মূর্খামি হয়নি। পুজোটা তো শান্তিতে কাটুক, তারপর নয় দেখা যাবে।

বাইরে এখন প্রবল শরৎ। আমেজটা ছড়িয়ে আছে স্টাফরুমেও। পুজো পুজো গন্ধে ম ম করছে ঘর। ছেলেমেয়েরা প্রায় আসেইনি কলেজে, ক্লাসে যাওয়ারও আদৌ চাড় নেই অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের। চলছে। এলোমেলো গুলতানি। প্রতিমা নিয়ে, প্যান্ডেল নিয়ে, পুজোর বাজার নিয়ে, বেড়াতে যাওয়া নিয়ে…। এসে পড়ছে সদ্য প্রকাশিত পার্ট ওয়ানের রেজাল্টের প্রসঙ্গও।

রবিকে ডেকে জয়েনিং লেটারখানা অফিসে পাঠিয়ে দিল সোমনাথ। হেলান দিয়েছে চেয়ারে। তেষ্টা পাচ্ছে অল্প অল্প। জলের জগ শর্মিলার সামনে। চাইল।

এগিয়ে দিয়ে শর্মিলা বলল, —কোথাও একটু ঘুরে আসুন না সোমনাথদা। চেঞ্জ হবে। আপনি কিন্তু বেশ রোগা হয়ে গেছেন।

সোমনাথ হাসল, —এখন হবে না। পুজোয় ভাই আসছে। …আপনি যাচ্ছেন নাকি কোথাও?

—উপায় নেই। মেয়ের সামনে মাধ্যমিক…। খেলতে গিয়ে ওর অনেকগুলো দিন বরবাদ হয়েছে। ভাবছি সামনের বছর আন্দামান যাব।

—আন্দামান জায়গাটা খুব সুন্দর। পাহাড় জঙ্গল সমুদ্র…

—গেছেন আপনি?

—নাহ্। দেখি যদি রিটায়ারমেন্টের পর সম্ভব হয়…

রবি ফিরেছে স্টাফরুমে। সোমনাথকে বলল,—মাইনের চেকটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন। ক্যাশ আজ জলদি বন্ধ হয়ে যাবে।

—হুম, যাই। মাইনেটা তো পড়েই আছে।

সোমনাথ উঠল। অফিসে ঢুকেই পুলকেশের মুখোমুখি। বড়বাবুকে কী যেন বোঝাচ্ছিল পুলকেশ, সোমনাথকে দেখেই তার চোখ বড় বড়,—আপনি এসেছেন? কই, আমার ঘরে এলেন না তো?

সোমনাথ সাদা মিথ্যে বলল,—এই তো, মাইনেটা নিয়েই যাচ্ছিলাম।

—আসুন। আমি ঘরে আছি।

সোমনাথ একটু চাপে পড়ে গেল। পুলকেশের মুখ না দেখে দিনটা তা হলে পার করা গেল না? কোনও মানে হয়?

সোজা প্রিন্সিপালের ঘরে অবশ্য গেল না সোমনাথ। চেক নিয়ে স্টাফরুম। ফোলিওব্যাগে ঠিক করে রাখল চেকটা। তারপর ব্যাগটা তুলে নিয়ে পুলকেশের চেম্বারে।

এক তাড়া কাগজে সই করছিল পুলকেশ। মুখ তুলে বলল,—শরীর এখন পুরোপুরি ফিট?

পাশের চেয়ারে ব্যাগ রেখে বসল সোমনাথ,—আছি একরকম। বেটার।

আবার পুলকেশের স্বাক্ষরে মন। কলম চলছে দ্রুত। শেষ করে বেল বাজাল। সুরথ এসে নিয়ে গেল কাগজপত্র। সদ্য কেনা পুরু গদি মোড়া রিভলভিং চেয়ারখানা ঈষৎ কোনাচে করে বসল পুলকেশ। বলল,—এনেছেন তো চিঠিটা? দিন।

সোমনাথ অপ্রস্তুত মুখে বলল,—না মানে… আজই কি…?

—আপনি তো আচ্ছা ইরেসপনসিবল লোক মশাই। পুলকেশ অপ্রসন্ন হল,—চিঠিতে লেখা ছিল সাতদিনের মধ্যে জবাব দিতে হবে, আপনি অসুস্থ বলে গভর্নিং বডিতে আমি আপনার হয়ে প্লিড করলাম, আপনিও ওভার টেলিফোন কথা দিলেন জয়েন করেই উত্তর দিয়ে দেবেন…!

বলব না বলব করেও সোমনাথ বলে ফেলল,—আর কি রিপ্লাই দেওয়ার দরকার আছে?

—নেই? সিনিয়র টিচার হয়ে এ কী বলছেন আপনি? অফিসিয়ালি আপনাকে শো-কজ করা হয়েছে, গভর্নিং বডিকে আপনি উত্তরই দেবেন না? ইউ আর ডিফায়িং ইয়োর এমপ্লয়ার? এ তো ইনসাবর্ডিনেশান!

—না না, তা বলছি না। ভাবছিলাম সিচুয়েশান তো কুল ডাউন করে গেছে…

—সে তো সমুদ্রে গর্জনতেল ঢেলে রেখেছি বলে। ওটা সমুদ্রের আসল চেহারা নয়। কীভাবে ওদের ঠান্ডা করা হয়েছিল তা যদি জানতেন! কলকাতা থেকে ফোন না এলে থোড়াই ওরা বয়কট তুলত। ওই ফোনটি করানোর জন্য আমাকে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে জানেন! রাজ্য কমিটির নেতাকে দিয়ে ওদের অল ইন্ডিয়া প্রেসিডেন্টকে বলিয়ে…। যাক গে, এসব কথা তো আপনার শুনে লাভ নেই। একটা সিম্পল কথা অন্তত বুঝুন। আপনি উত্তর না দিলে গভর্নিং বডিকে অগ্রাহ্য করা তো হয়ই, প্লাস আমাকেও ফলস্ পজিশানে ফেলা হয়। যাঁরা আমার রিকোয়েস্টে মধ্যস্থতা করে সাময়িক ভাবে ব্যাপারটা মিটিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে আমার মান থাকবে? পুলকেশ থমকাল। রগ টিপছে। অস্ফুটে বলল, বোঝেন না আমার অবস্থাটা?

এই প্রথম বুঝি পুলকেশের ওপর করুণা জাগছিল সোমনাথের। অত দামি কুর্সিতে বসেও কী অসহায়! যারা তাকে চেয়ারটা উপহার দিয়েছে, তাদের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে বেচারা। এমন কম্পমান দশায় রাখা যাবে বলেই কি পুলকেশ কুন্ডুদের বসানো হয় এইসব পদে? আসল ক্ষমতা থাকবে অন্যত্র, দড়ি বাঁধা পুতুল হয়ে নাচবে পুলকেশরা! অভিজিৎরা!

ওফ্, আবার নির্মল! আজ কি নির্মল কিছুতেই ছাড়বে না সোমনাথকে?

সোমনাথ বড় করে শ্বাস টানল। ফুসফুসে খানিকটা বাতাস ভরে নিয়ে বলল, —দিন তবে কাগজ। এখনই চুকিয়ে দিই।

—এই তো। বি সেন্সেবল্। পুলকেশের গলা পলকে নরম। ড্রয়ার থেকে খান তিন-চার সাদা পাতা বার করে দিয়ে মোলায়েম স্বরে বলল,—আমি আপনাকে ছোট হতে বলছি না। লিখে দিন সেদিন শরীরটা ভাল ছিল না, সাডেনলি মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল, আকস্মিক উত্তেজনায়…অ্যান্ড ইউ আর সরি ফর দ্যাট ইনসিডেন্ট। ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের বয়ানে জাস্ট কয়েকটা লাইন। একটা ফরমাল রেকর্ড থাকবে, এই মাত্র।

সোমনাথ কলম খুলে মাথা নামাল কাগজে। কী লিখবে? কী ভাবে লিখবে? হঠাৎই মিতুলের মুখ ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। কাল রাত্তিরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মিতুলকে প্রশ্নটা করেছিল সোমনাথ। ত্বরিত জবাব দিয়েছিল মিতুল, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন বাবা, নিজেকে প্রশ্ন করো। তোমার কনসেন্স যা বলবে, তাই করবে।

কলমে আঙুল চাপল সোমনাথ। ইংরিজি নয়, শুদ্ধ বাংলায় সম্ভাষণ করল পরিচালন সমিতির সভাপতিকে।…মাননীয় মহাশয়, বিগত চোদ্দোই সেপ্টেম্বরের অনভিপ্রেত ঘটনাটির জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। তবে আমি কণামাত্র অনুতপ্ত নই। কারণ আমি বিশ্বাস করি দুর্বিনীত ছাত্রকে শাসন করার অধিকার শিক্ষকের আছে। অভিজিৎ ছাত্র সংসদের সম্পাদক হতে পারে, কিন্তু আমার চোখে সে ছাত্রই। ভবিষ্যতে আবার কোনও ছাত্র যদি ওই ধরনের অবিনয়ী উদ্ধত আচরণ করে, আমি তাকে তখন একই শাস্তি দেব। শ্রদ্ধা সহ…

চিঠির শেষে নিজের নামটি লিখে তারিখ বসাল সোমনাথ। এগিয়ে দিল পুলকেশকে।

পড়তে পড়তে পুলকেশ হাউমাউ করে উঠেছে,—এসব কী আজেবাজে কথা লিখেছেন?

সোমনাথ স্থির চোখে তাকাল—ভুল তো কিছু লিখিনি। আমি যা বিশ্বাস করি…

—হ্যাং ইওর বিশ্বাস। পুলকেশ দাঁত কিড়মিড় করছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,—জানেন এর ফল কী হতে পারে?

—জানি। ইউনিয়ন হয়তো আবার ক্লাস বয়কটের ডাক দেবে।

—তা হলে? জেনেও আপনি…?

সোমনাথ চুপ।

পুলকেশের চোখ তীক্ষ্ণ হল,—সেই বিশৃঙ্খল অবস্থার দায়িত্ব কিন্তু সম্পূর্ণ আপনার থাকবে সোমনাথবাবু।

—তখন নয় আবার প্রেসকে ডেকে চিঠিটা দেখাবেন। প্রেস ছাপুক। আপনারা তো জনগণে বিশ্বাস করেন, জনগণই নয় বিচার করবে ঠিক করেছি, না ভুল করেছি।

—এটা কি একটু বেশি হিরোইজম্ হয়ে যাচ্ছে না সোমনাথবাবু? ভুলে যাচ্ছেন, সামনে আপনার রিটায়ারমেন্ট? গভর্নিং বডিকে চটালে কী কী হতে পারে আন্দাজ করতে পারছেন? পেনশান পেপার পড়ে থাকবে, লিভ রিফিউজডের টাকাটাও পাবেন না…। ইউনিয়ন যদি গণ্ডগোল না-ও করে, গভর্নিং বডি এই চিঠি প্রসন্ন মনে নেবে? আপনার কি মগজে আছে, স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে অভিজিৎ গভর্নিং বডির মেম্বার?

সোমনাথ উত্তর দিল না। ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে। শুনতে পেল পিছনে গজরাচ্ছে পুলকেশ,—আচ্ছা ঢ্যাঁটা লোক তো! নিজের ক্ষতিটাও বুঝছে না! একটা বছর পর যখন পেনশানের জন্য ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে হবে, তখন টের পাবে।

সোমনাথের ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠল। বিষন্ন, কিন্তু নির্ভার হাসি৷ সারাটা জীবন তো লাভই খুঁজেছে সোমনাথ। শামুকের খোলে গুটিয়ে থেকে। প্রতি পদে মুখ বুজে আপস করে করে।

এবার নয় তার মাশুল চোকাবে সোমনাথ। একবার আপস না করে। অন্তত একটি বার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *