১০. কলেজ অডিটোরিয়ামে

॥ দশ ॥

কলেজ অডিটোরিয়ামে নির্মলের শোকসভা চলছে এখনও। ডায়াসে বড় টেবিলে পাতা হয়েছে সাদা চাদর, তার ওপরে নির্মলের বাঁধানো ফটোগ্রাফ। ছবিটা এত জ্যান্ত যে এক্ষুনি মনে হয় নির্মল কথা বলে উঠবে। কৌতুক মাখানো হাসিটাও লেগে আছে ঠোঁটে। ছবিতে মালা, ছবির দু’পাশে পেতলের ফুলদানিতে হাইব্রিড রজনীগন্ধা, সামনে ফুলের স্তবক, পাশে ফুলের স্তবক …। ফুলে ফুলে প্রায় ঢেকে গেছে নির্মল। আজ ফুল কিছু জুটল বটে নির্মলের কপালে। অথচ সোমনাথ যদ্দূর জানে ধূপ আর ফুলের গন্ধে নির্মলের অ্যালার্জি ছিল।

সভা থেকে খানিক আগে বেরিয়ে এসেছে সোমনাথ। বসে আছে ফাঁকা স্টাফরুমে। ঝুম হয়ে। ভাল্লাগছে না। একটা চোরা বিবমিষা পাক খাচ্ছে শরীরে। কাঁহাতক আর বাঁধা গতের বুলি বরদাস্ত করা যায়! নির্মল এই ছিল, নির্মল ওই ছিল, নির্মলের মতো মহৎ প্রাণ মানুষ আজকাল আর দেখা যায় না, নির্মল বন্ধুবৎসল, নির্মল পরোপকারী, নির্মলের মতো প্রতিবাদী চরিত্র আজকের দিনে বিরল, নির্মলের মতো প্রখর যুক্তিবাদী লাখে একটা মেলে, নির্মল এই কলেজে এক জাজ্বল্যমান আদর্শের প্রতীক, নিজে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতি করা সহকর্মীদের কাছে তার এক বিশেষ আসন ছিল …। সব ঠিক। প্রতিটি প্রশংসাই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। কিন্তু সবার মুখে সব কথা মানায় কি? আর কেউ না জানুক সোমনাথ তো জানে কারা পছন্দ করত নির্মলকে, কারা করত না। গত মাসেই তো সমিতির চাঁদা দেওয়া নিয়ে দীপেনের সঙ্গে নির্মলের জোর কথা কাটাকাটি হয়েছিল। নির্মল চোখের আড়াল হতেই নির্মলের সম্পর্কে নিন্দে না করে ওই দীপেন কলেজে এক গ্লাস জল পর্যন্ত খেত না, স্রেফ নির্মলের বন্ধু বলে সোমনাথের মতো নির্বিরোধী মানুষের পিছনেও কাঠি করার চেষ্টা করেছে। আজ সেও কেমন নির্মলের শোকে গলা কাঁপায়! শুধু কুম্ভীরাশ্রু, শুধুই কুম্ভীরাশ্রু। শোকসভাটাই একটা ফার্স। দুম করে ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেল, পড়িমড়ি করে পালাচ্ছে ছেলেমেয়েরা, কলেজের গেট বন্ধ করে যে ক’টাকে পারল গলায় দড়ি বেঁধে সভায় টেনে আনল ছাত্র ইউনিয়নের পাণ্ডারা। প্রিন্সিপালের নির্দেশ, ভিড় বাড়াতে হবে সভার! সদ্যমৃত সহকর্মীকে স্মরণ করে দু’মিনিট নীরবতা পালন করবে সেটুকুনিতেও তো কারুর ধৈর্য নেই! তিরিশ সেকেন্ড যেতে না যেতেই সবাই উসখুস করছে, ঘড়ি দেখছে, হাই তুলছে! এমন প্রহসনের দরকারটা কী?

সোমনাথের আর কলেজেই থাকতে ইচ্ছা করছিল না, হাত বাড়িয়ে জলের জগটা টানল, জল খেল খানিকটা। উঠে টয়লেটে গেল। ঘুরে এসে দেখল শর্মিলাও ফিরে এসেছে স্টাফরুমে। সোমনাথ কথা বলল না শর্মিলার সঙ্গে, চুপচাপ ফ্যোলিওব্যাগখানা টেবিল থেকে নিয়ে হাতে ঝুলিয়েছে।

শর্মিলাই জিজ্ঞেস করল, —চলে যাচ্ছেন?

—যাই।…ওখানে শেষ হতে আর কত দেরি?

—হয়ে এসেছে। অভিজিৎ ছাত্রদের তরফ থেকে বলছে, তারপর বোধহয় প্রিন্সিপাল আর একবার…

—ও।

—আপনি আজ কেন কিছু বললেন না সোমনাথদা? নির্মলদা আপনার এত বন্ধু ছিলেন…?

—আজ তো নির্মলের অনেক বন্ধু। সোমনাথের গলা দিয়ে শ্লেষটা বেরিয়েই এল, —তারা যা বলছে তাতেই নির্মলের আত্মার শান্তি হয়ে যাবে।

শর্মিলা আর প্রশ্ন করল না। সোমনাথের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বলল,—চলুন, আমিও যাই। বসে থাকলেই মনখারাপটা বাড়বে।

শর্মিলার সঙ্গে করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সোমনাথ পিছন ফিরে তাকাল একবার। সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছে। মনে হল এক্ষুনি যেন গমগমে গলায় হেঁকে উঠবে নির্মল, কী হে, আমাকে ফেলে কাটছ!

সোমনাথ ছোট্ট শ্বাস ফেলল। নাহ্, নির্মলের অনুপস্থিতিটা এখনও রপ্ত হয়নি।

কলেজগেটে এসে রিকশা নিয়েছে শর্মিলা। সোমনাথও উঠল। মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে রিকশায় ওঠার খুব একটা অভ্যেস নেই, সামান্য অস্বস্তি হচ্ছিল সোমনাথের।

কোলের ওপর ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে শর্মিলা বলল,—ঠিকঠাক বসেছেন তো সোমনাথদা? অসুবিধে হচ্ছে না?

সোমনাথ তাড়াতাড়ি বলল,—না না, ঠিক আছে।

—নির্মলদা বলতেন তোমার সঙ্গে আর রিকশায় বসা যায় না, যা মোটাচ্ছ! শর্মিলার ঠোঁটে চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল,—সত্যি, নির্মলদা নেই এ যেন বিশ্বাসই হয় না, তাই না?

—হুম।

—নির্মলদা কিন্তু নিজেই নিজের মৃত্যুটা ডেকে আনলেন। এত মুঠো মুঠো সিগারেট খাচ্ছিলেন আজকাল!

—হুম্। সোমনাথ বিড়বিড় করে বলল,—কারুর কথা শুনলে তো।

—নির্মলদার ছেলেও তো সেদিন বলছিল, কত বার বাবাকে বলেছি এবার একটা থরো চেকআপ করাও… নির্মলদা নাকি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেন। বলতেন, এই বয়সে চেকআপ করালে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ধরা পড়বে, আর ডাক্তাররা ওমনি একগাদা রেসট্রিকশান চাপিয়ে দেবে। ওতে আমি নেই!

আচমকা সোমনাথের মনে পড়ে গেল সেদিনের বুক ব্যথাটার কথা। কী বিশ্রী একটা চাপ ছিল হৃৎপিণ্ডে। কোনও বড়সড় বিপদের পূর্বলক্ষণ ছিল না তো? পরদিন ভোরে নির্মলের বদলে সোমনাথও তো মরে যেতে পারত। নিজে মরে নির্মল কি সোমনাথকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল?

শর্মিলা বলেই চলেছে,—সত্যি, নির্মলদা বড্ড বেপরোয়া ছিলেন। সব ব্যাপারেই। কত শত্রুও যে বেড়ে গেছিল তার জন্যে! সোজা কথা মুখের ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং বলে দিতেন, কাউকে রেয়াত করতেন না। আমায় ফিক্সেশানটা যে কী করে বার করেছিলেন। ডিপিআই অফিস তো ইচ্ছে করে এক বছর আটকে রেখেছিল। অকারণে। নির্মলদা শুনে বললেন, চলো তো দেখি। চেনেন তো ওখানকার লোকগুলোকে, কী কুৎসিত ব্যবহার। বিশেষ করে ওই স্টাফটা…অজিত সরখেল না কী যেন নাম। লোকটা তো স্ট্রেট বলে দেয়, পারব না এখন! হবে না! তিন মাস পরে আসুন! বারবার তাড়া লাগালে আরও বেশি দেরি হবে! মনে হয় কলেজের টিচাররা ওর চাকরবাকর। আমাদের এক্স-প্রিন্সিপালকে পর্যন্ত বেমালুম শুনিয়ে দিয়েছিল, কোত্থাও চুকলি খেয়ে লাভ হবে না, জানেন অধ্যাপকদের প্রাপ্য আটকে আমি গভর্নমেন্টের বিশ কোটি টাকা বাঁচাচ্ছি! কোন অফিসারের ঘাড়ে কটা মাথা আছে আমার কাছে কৈফিয়ত চায়! ভাবা যায়, ওই লোকটাকে একেবারে শুইয়ে দিয়েছিলেন নির্মলদা। কী ঝাড় ঝেড়েছিলেন, বাপস্। কাজ না ক’রে সিটে বসে ঠ্যাং নাচিয়ে নাচিয়ে খুব রোয়াব মারা হচ্ছে, অ্যাঁ? আপনাকে মাইনে দিয়ে কেন পোষা হয়েছে জানেন তো? আমাদের কাজ করার জন্য। মনে রাখবেন গভর্নমেন্ট মানে কয়েকটা আমলা মন্ত্রী নয়, তার মধ্যে আমরাও পড়ি। কোনও বাহানাতেই আপনি আমাদের কাজ ফেলে রাখতে পারেন না। সাতটা দিন সময় দিয়ে যাচ্ছি, এরপর কিন্তু এই অফিসের মধ্যে আপনাকে বাঁশপেটা করে যাব। দেখি তখন আপনার কোন ইউনিয়নের খুঁটি এসে আপনাকে বাঁচায়। সরকারের টাকা বাঁচানো দেখাচ্ছেন? নিজের হকের টাকা হলে এভাবে ফেলে রাখতেন? …আমি তো নির্মলদার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁপছি। বেরিয়ে বললাম, কী সর্বনাশ হল নির্মলদা, এ তো এবার আমায় মৃত্যু পর্যন্ত বিশ বাঁও জলে ডুবিয়ে রাখবে! নির্মলদা বললেন, দাঁড়াও না, দেখি ওর কত মুরোদ। সবাই ওর সামনে হাত কচলায় বলেই তো ও এত বেড়েছে। এই ধরনের মানুষগুলো ফিজিকাল অ্যাসল্টকে খুব ডরায়।…বিশ্বাস করবেন না, এক সপ্তাহের মধ্যেই চিঠি চলে এল। শর্মিলার গলা ভারী হয়ে এল,—নির্মলদার মতো মানুষের এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কোনও মানে হয়? আমাদের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টটা একদম কানা হয়ে গেল। সাবজেক্ট অ্যালটমেন্ট, ম্যাগাজিন পাবলিশ করা, রিইউনিয়ন… ডিসেম্বরে তো আবার ডিপার্টমেন্টের টোয়েন্টিফাইভ ইয়ারস সেলিব্রেশান… নির্মলদা পারতেন, আমি যে কী করে সামলাব!

বুকের ব্যথাটাকে ফের মনে পড়ে গেল সোমনাথের। নির্মলের বেঁচে থাকাটা কত জরুরি ছিল। সেদিন সোমনাথ মরে গেলে নির্মল হয়তো বেঁচে থাকত।

স্টেশন এসে গেছে। রিকশা থেকে নেমে সোমনাথ টাকা বার করতে যাচ্ছিল, শর্মিলা জোর করে মিটিয়ে দিল ভাড়াটা। প্ল্যাটফর্মে উঠতে উঠতে আঙুল তুলে বলল,—ওই দেখুন সোমনাথদা, ওখানে কেমন নির্মলদার অনারে একটা সভা চলছে!

স্টেশনের বাইরেটায় এক ফুচকাওয়ালা, তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে এক দল মেয়ে। কলকল করছে খুশিতে। হাসিতে ভেঙে ভেঙে পড়ছে।

শর্মিলা বলল,—সব ক’টা আমাদের কলেজের।

বটেই তো। ওদের মধ্যে একজনকে তো খুব ভালমতোই চিনেছে সোমনাথ। সেই মেয়েটা, যে অ্যাডমিশনের দিন ইউনিয়নের সঙ্গে তর্ক করছিল। এ ক’দিনে বেশ ঝলমলে হয়েছে মেয়েটা, রুখুসুখু ভাবটা যেন আর নেই। সোমনাথের সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যায় এক-আধ দিন। করিডোরে। হাসে আলগাভাবে। পাসে সায়েন্স পড়ছে। মেয়েটা কি সেদিন চাঁদাটা দিয়েছিল শেষপর্যন্ত? এখনও কি ওরকমই প্রতিবাদী আছে? বোঝা যায় না দেখে। আর জিজ্ঞেসও করেনি সোমনাথ।

প্ল্যাটফর্মে এসে শর্মিলা বলল,—পরশু তো নির্মলদার কাজ।

আনমনে সোমনাথ বলল,—হুঁ।

—আপনি যাচ্ছেন তো?

—সকালে যাব। আপনারা?

—আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবাই সকালেই যাবে। আমার সকালে হবে না। মেয়েটা সেদিন দুপুরে হায়দ্রাবাদ রওনা দিচ্ছে। ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তারপর…

—ও। মেয়ে খেলতে যাচ্ছে বুঝি?

—হ্যাঁ। ওদের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হচ্ছে নেক্সট উইক থেকে।

—কাগজে দেখেছি। আপনার মেয়ে তো এবার জুনিয়ার সিনিয়ার দুটোতেই সিডেড?

—জুনিয়রে সেকেন্ড, সিনিয়রে সিক্সথ। সিড পাওয়ায় সুবিধেও হয়েছে। কোয়ার্টার ফাইনালের আগে তেমন টাফ অপোনেন্ট নেই।

—টেবিলটেনিস খেলাটা কিন্তু খুব ভাল! বডি খুব ফিট থাকে।

—শুধু প্লেয়ারেরই নয়। বাড়ির লোকজনেরও। মেয়ের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে মেয়ের বাবার তো পাঁচ কেজি ওয়েট কমে গেল।

সোমনাথ হেসে ফেলল। হাসতে ভালও লাগল, মনের গুমোট যেন কাটল কিছুটা। নির্মলের প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে খানিকটা যেন স্বচ্ছন্দও হয়েছে। এটা ওটা আলোচনা করছে। শরীরচর্চা ছেলেমেয়ে…। স্টলে দাঁড়িয়ে লেবু চা-ও খেল দুজনে। সিগনাল ডাউন হতে শর্মিলা চলে গেল লেডিজ কম্পার্টমেন্টের দিকে।

ট্রেনে উঠেও নির্মলের চিন্তাটাকে ফিরতে দিল না সোমনাথ। এটা ওটা ভাবছে। মৃদুলার থাইরয়েডের ডোজে গণ্ডগোল হচ্ছে বোধহয়, মাথা জ্বালা খুব বেড়েছে, শরীরের ফোলা ফোলা ভাবটাও। ডাক্তারকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইতে হবে। খুকুর বাড়িতেও একটা টেলিফোন করা দরকার। খোঁজ নিতে হবে কেরালা বেড়িয়ে ফিরল কিনা। মজায় আছে খুকু আর রণজিৎ। বুবলির বিয়ে দিয়েই স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নিল রণজিৎ, এখন খুব ভারতভ্রমণে বেরোচ্ছে স্বামী স্ত্রী। দক্ষিণে যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছিল। বলছিল, বুবলি ভীষণ ডাকাডাকি করছে, সামনের বছর হয়তো মেরিল্যান্ডে গিয়ে মেয়ে জামাইয়ের কাছে কাটিয়ে আসবে কয়েকটা মাস। আহা, সোমনাথও যদি অমন একটা ডানামেলা জীবন পেত! তার তো শুধুই টেনশান, শুধুই সমস্যা। ক’দিন ধরেই ফ্ল্যাটের পাম্পে জল উঠছে না, মৃদুলা আজ সকালেও খ্যাচখ্যাচ করছিল। দোতলার রজতবাবুর সঙ্গে দেখা করে অবিলম্বে ফ্ল্যাট কমিটির মিটিং ডাকার জন্য বলতে হবে। আজই। ছ্যাকরা ছাকরা সারানো নয়, তেমন হলে পাম্পের খোলনলচেই বদলাতে বলবে সোমনাথরা।

বিচ্ছিরি একটা ধাক্কা খেয়ে চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল সহসা। সোমনাথ ঘুরে দেখল পাশে বসা লোকটা অসভ্যর মতো ঠেলছে। সোমনাথের চোখে চোখ পড়তেই খেঁকিয়ে উঠল,—তাকাচ্ছেন কী? সরে বসুন। এটা কি আপনার বৈঠকখানা যে হাত পা এলিয়ে দিয়েছেন?

আশ্চর্য, দপ করে জ্বলে উঠল সোমনাথ। গলা থেকে বেরিয়ে এসেছে কর্কশ স্বর,—ওভাবে বলছেন কেন? ভদ্রভাবে কথা বলুন। কোথায় সরব? জায়গা আছে?

—দেখছেন না আমি পড়ে যাচ্ছি?

—তো আমি কী করব? নিজেকে ভাঁজ করে রাখব? এই সিটে চারজন বসলে অসুবিধে তো হবেই। না পোষালে উঠে দাঁড়িয়ে থাকুন।

—শুনলেন? শুনলেন দাদা? বছর চল্লিশের লোকটা আশপাশের যাত্রীদের সাক্ষী মানছে, —দেখুন, দেখুন কী সেলফিশ!

—অ্যাই, একদম উলটোপালটা কথা নয়। সব্বাই শুনেছে আপনি কী ভাষায় বলছিলেন। আর একটু জায়গার দরকার সেটা ভালভাবে বললেই তো হয়। গুঁতোনোর তো প্রয়োজন দেখি না। সোমনাথ মুখ বেঁকাল,—অভদ্রতা করাটা আপনাদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।

বেশির ভাগ সহযাত্রী সোমনাথের পক্ষে। টুকটাক মন্তব্য ছুড়ছে। লোকটা মিইয়ে গেল। অন্যমনস্কতার ভান করে চোখ মেলেছে জানলার বাইরে।

ছোট্ট যুদ্ধটা জিতেও কেমন যেন একটা লাগছিল সোমনাথের! নিজের আকস্মিক আচরণে নিজেই বিস্মিত হয়েছে। হঠাৎ অমন অধৈর্য হয়ে পড়ল কেন? নির্মলের মৃত্যু কি তার সহিষ্ণুতার পুরু খোলসটায় চিড় ধরিয়ে দিল!

মাথা দপদপ করছে। নিজেকে সুস্থিত করার জন্য দমদমে নেমে আবার এক কাপ চা খেল সোমনাথ। ধীরেসুস্থে। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। প্ল্যাটফর্মের স্টলে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন উলটোল কিছুক্ষণ। মিতুল আবার কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসার তোড়জোড় করছে, মিতুলের কথা ভেবেই কারেন্ট অ্যাফেয়ারের একখানা পত্রিকা কিনে নিল। কলেজে পিক সিজন শুরু হয়ে গেছে, কাল সওয়া দশটায় ক্লাস, সকালে তাড়াহুড়োর মাথায় বাজার যেতে পারবে কিনা ঠিক নেই, স্টেশনের বাইরে এসে আলু কিনল কেজি খানেক। সঙ্গে শসা টোম্যাটো পেঁয়াজ। সবজি কিছু আছে ফ্রিজে। ফ্ল্যাটের সামনে একটা মাছওয়ালা বসছে ইদানীং, তার কাছ থেকে সকালে কাটাপোনা কিনে নিলেই চলে যাবে কালকের দিনটা।

স্বপ্ননিবাসের গেটে এসেই চমক। একটি মরালশুভ্র মারুতি দণ্ডায়মান। আনকোরা গাড়ি, এখনও মোটর ভেহিকল্‌সের নাম্বার প্লেট লাগেনি। বনেটে জ্বলজ্বল করছে গোলা সিঁদুরের স্বস্তিকা চিহ্ন, ঝুলছে জবাফুলের মালা। স্টিয়ারিংয়ে এক ছোকরা ড্রাইভার। ঢুলছে।

কাদের গাড়ি? তুতুলদের নাকি? সোমনাথের মনের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। এর মধ্যে এসে গেল রথ?

ভার ভার ভাবটা আবার ফিরে আসছে। পা টেনে টেনে তিনতলায় উঠল সোমনাথ।

ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যেতেই রুপাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে গায়ে, —দাদুন এচেচে, দাদুন এচে গেচে…

রুপাইয়ের চুল ঘেঁটে দিতে দিতে সোমনাথ দেখল ড্রয়িংস্পেসে সবাই মজুত। প্রতীকও। গাড়ি কেনার আনন্দে অফিস ডুব?

প্রতীকের সামনে সেন্টার টেবিলে সাজানো রয়েছে প্রচুর খাদ্য। কেক প্যাটিস পিৎজা লাড্ডু…। ওরাই এনেছে নিশ্চয়ই! গাড়ি কেনার আনন্দে মোচ্ছব? তুতুলের পরনে লালপাড় গরদ, প্রতীক পরেছে ঘিয়ে রং সিল্কের চুস্ত পাঞ্জাবি। দু’জনেরই কপালে সিঁদুরের লম্বা তিলক। গাড়ি কেনার আনন্দে দু’জনের পোশাকের রং এক হয়ে গেছে আজ?

তুতুল প্লেট থেকে একখানা লাড্ডু তুলে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে এল। রুপাইয়ের হাতে লাড্ডুটা দিয়ে বলল,—দাদুনকে খাইয়ে দাও, দাদুনকে খাইয়ে দাও…

সোমনাথ হালকা আপত্তি জুড়ল,—আহা, এখন কেন? আগে হাতমুখটা ধুয়ে নিই।

—উঁহু, কোনও কথা নয়। প্রথমে মিষ্টিমুখ, তারপর অন্য কিছু। হাঁ করো।

রুপাইও বায়না ধরেছে, —হাঁ কলো না দাদুন…

অগত্যা খেতেই হয়। রুপাইয়ের হাত থেকে লাড্ডুর খানিকটা ভেঙে মুখে পুরল সোমনাথ। বিস্বাদ হয়ে গেল জিভটা। মিষ্টিও কখনও কখনও এত তেতো লাগে?

তুতুল চোখ নাচাল, —গাড়িটা দেখলে?

—হুম।

—কেমন লাগল? পছন্দ হয়েছে?

মেয়ের খুশিতে খুশি হওয়াই তো নিয়ম। সোমনাথ হাসি ফুটিয়ে বলল,—খাসা রং। খুব সুন্দর।

—রংটা তোমার জামাইয়ের চয়েস। সাদা রঙে নাকি গ্ল্যামার বেশি। অ্যারিস্টোক্রেসি আছে। আমার ইচ্ছে ছিল ডিপ কালার। চেরি রেড, কিংবা ডিপ ব্লু। কলকাতায় সাদা রং কি মেনটেন করা যায়, বলো?

—সে তো বটেই। চারদিকে যা পলিউশন। বলে ফেলেই সচকিত হয়েছে সোমনাথ। ঝটপট কথা ঘোরাল,—তোরা বুঝি পুজো দিয়ে এলি?

—ওমা, পুজো না দিয়ে কেউ গাড়ি রাস্তায় বের করে নাকি? কাল থেকেই ড্রাইভার ফিট করা ছিল, গাড়ি ডেলিভারি নিয়েই সোজা গেলাম কালীঘাট, সেখান থেকে স্ট্রেট এ-বাড়ি। তোমার জামাই বলল আগে তোমাকে দেখিয়ে তবে গাড়ি বরানগর যাবে।

মৃদুলা জামাইয়ের জন্য আলাদা প্লেটে পিৎজা তুলছিল। গদগদ মুখে বলল,—প্রতীক কত খাবারও এনেছে দ্যাখো।

লাজুক মুখে প্রতীক বলল,—কিচ্ছু বেশি নয় মা। আজ একটা স্পেশাল ডে, সবাই মিলে হইচই করব, দু’মিনিটে খাবার উড়ে যাবে।

—বলছ তো, কিন্তু কিছুই তো মুখে তুলছ না!… কী রে মিতুল, তোর প্রতীকদাকে খাওয়া জোর করে।

মিতুল বসে আছে প্রতীকের উলটোদিকের সোফায়। পরনে এখনও বাইরের শাড়ি। এইমাত্র ফিরেছে বোধহয়, মুখে চোখে ক্লান্তির কালো ছোপ স্পষ্ট। সে ঠাট্টার গলায় বলল,—কিচ্ছু জোর করতে হবে না মা, প্রতীকদা আজ নিজেই খাবে। আমি বরং একটু চা বানিয়ে আনি।

মৃদুলা বলল,—তুই বোস না, আমি করছি।

—না না, তুমি কথা বলো।… বাবা, তুমি খাবে তো চা?

অনেকক্ষণ পর অনাবিল হাসল সোমনাথ,—আমি কি কখনও চায়ে না বলি? প্রতীক, তুমিও খাবে তো?

প্রতীক যেন আজ একটু বেশি প্রগল্ভ। হেসে বলল,—শ্যালিকার হাতের চা তো খেতেই হয়।

মিতুল চলে গেল রান্নাঘরে। রুপাইও লাফাতে লাফাতে গেছে তার পিছন পিছন। সোমনাথ মিতুলের জায়গায় বসল,—ছোট গাড়ি কিনে ভালই করেছ প্রতীক। তোমাদের মতো ছোট ফ্যামিলির পক্ষে ছোট গাড়িই আইডিয়াল।

প্রতীক বিনীত স্বরে বলল,—গাড়ি তো শুধু আমাদের কথা ভেবে কিনিনি বাবা। গাড়ি সকলের। আপনাদেরও। যখনই প্রয়োজন হবে বলবেন, গাড়ি দরজায় লেগে যাবে।

তুতুল গরবিনীর ভঙ্গিতে প্রতীকের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আলতো ঠেলল প্রতীককে, —এই, বাবাকে তোমার প্রোপোজালটা বলো না।

আবার প্রোপোজাল? সোমনাথ চোখ পিটপিট করল, —কী রে?

—প্রতীকের খুব ইচ্ছে এখন একটা জয়রাইডে বেরোনোর। সবাই মিলে।

—ভালই তো। ঘুরে আয়।

—ঘুরে আয় মানে? তোমার জন্যই তো আমরা অপেক্ষা করছি৷

—আআআমি? আমি গিয়ে কী করব?

—চড়বে গাড়িটা। দেখবে কেমন চলছে। টেস্ট করবে এসিটায় কেমন ঠান্ডা হচ্ছে। চলো চলো, বেশি দূর যাব না। এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের কাছে একটা দারুণ ধাবা আছে, ওখানে ডিনার করে তোমাদের নামিয়ে দিয়ে আমরা ব্যাক।

মিতুল রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল,—আমাকে কিন্তু হিসেবের বাইরে রাখ।

তুতুলও গলা ওঠাল,—কেনওওও?

—তোদের গাড়ি কি দাদুর দস্তানা? বাবা উঠবে, মা উঠবে, প্রতীকদা, রুপাই, তারপর তুই দেড়মণি লাশটা ঢোকাবি…, প্রথম দিনই তোদের গাড়ির স্প্রিংপাত্তি বসে যাবে।

—আহা, তুই বসলে কী এমন ওয়েট বাড়বে শুনি? ওই তো হাড়গিলে চেহারা!

—ওইটুকুনিও তোর গাড়ির সইবে নারে। মিতুল রান্নাঘরের দরজায় এল,—শরীরটা আজ আর চলছে না রে দিদি। ভাবছি কিছুক্ষণ মড়ার মতো শুয়ে থাকব।

সঙ্গে সঙ্গে সোমনাথও অনুনয়ের সুরে বলল,—প্রতীক, আমাকেও আজ বাদ দাও।

—কেন বাবা? চলুন না, ভাল লাগবে।

—আজ আমার মনটা ভাল নেই। শুনেছ নিশ্চয়ই, আমার এক কলিগ সম্প্রতি…তার আজ কনডোলেন্স ছিল…

—ও। তা হলে তো…। প্রতীক মৃদুলার দিকে তাকাল,—মা, আপনি?

মৃদুলা দৃশ্যতই দোটানায় পড়ে গেছে। সোমনাথকে বলল,— চলোই না। ওরা বলছে এত করে।

—আমাকে ছেড়েই দাও। তুমি বরং ঘুরে এসো।

তুতুলের মুখ থমথমে হয়ে গেছে। অভিমানী স্বরে বলল,—ঠিক আছে থাক, তোমাদের কাউকে যেতে হবে না। আর কাউকে আমি সাধব না। মা, তুমি কি যাবে? না তুমিও যাবে না?

—রাগ করছিস কেন? আমি কি বলেছি যাব না?

বাসনা আর অস্বাচ্ছন্দ্যের দোলাচলে ভুগতে ভুগতে শাড়ি বদলাতে গেল মৃদুলা। মিতুল চা এনেছে। প্রতীকের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে টেবিল থেকে একখানা প্যাটিজ তুলে নিল মিতুল। নিজে খাচ্ছে, রুপাইয়ের মুখেও দেওয়ার চেষ্টা করছে ভেঙে ভেঙে। রুপাইয়ের প্যাটিজে আগ্রহ নেই, তার নজর কেক-পেস্ট্রির ওপরকার ক্রিমে। আঙুল দিয়ে ক্রিম তুলে তুলে চাটছে। প্রতীক পলকের জন্য চোখ পাকাল, পরমুহূর্তে আবার ভাবলেশহীন করে ফেলেছে মুখখানা। তার মুখে খুশি অসন্তোষ কিছুই ফোটে না চট করে, সে মনের ভাব চমৎকার গোপন করতে জানে।

চায়ের কাপ-প্লেট হাতে সোমনাথ নিরীক্ষণ করছিল প্রতীককে। হঠাৎ বলল,—তোমার দিদির সঙ্গে সেদিন দেখা হল।

প্রতীক অভিব্যক্তিহীন স্বরে বলল,—তাই বুঝি? কবে?

—এই তো, দিন আট-দশ আগে। দমদম স্টেশনে। দেওরের শাশুড়ি মারা গেছেন, ইছাপুর যাচ্ছিল…

—হ্যাঁ, সীমাবউদির মা গত হয়েছেন। শ্রাদ্ধে আমাদের বলেছিল।

—সেদিন তোমার দিদি বলেনি আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

—আমরা কাজের দিন যেতে পারিনি।

—ও।… তোমার দিদির কথা শুনে মনে হল খুব লোন্‌লি হয়ে গেছে।

—কেন! লোন্‌লি কীসের?

—তোমার ভাগনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল, তোমার জামাইবাবুও তত বোধহয় ট্যুরে ট্যুরে থাকে…

তুতুল চুলটুল ঠিক করতে ঘরে ঢুকেছিল। ফিরেছে। ফস করে বলল, ওর দিদির আবার একটু লোনলিনেসের বাতিক আছে। আমি তো সব সময়ে বলি, দুপুর বিকেলে চলে এসো! আড্ডা মারতে পারে, আমার সঙ্গে মার্কেটিং টার্কেটিংয়ে যেতে পারে…

—তুইও তো দুপুর বিকেলের দিকে ওর বাড়ি একটু যেতে পারিস।

—যাই তো। মাঝে মাঝেই যাই। তা বলে আমাদের পক্ষে তো আর রোজ রোজ গিয়ে সঙ্গ দেওয়া সম্ভব নয়।

প্রতীক বলল,—দিদির কথা বাদ দিন। দিদিটা আজকাল বড্ড ঘরকুনো হয়ে গেছে।

সোমনাথ আর কথা বাড়াল না, চুপ করে গেল। কেন যে অতি তুচ্ছ ব্যাপারেও মিথ্যে বলছে তুতুলরা? অরুণার সঙ্গে তুতুলরা সম্পর্ক রাখবে কি রাখবে না, রাখলে কতটুকু রাখবে, না রাখলে কেন রাখবে না, এসব তো তুতুলদের নিতান্তই পারিবারিক সমীকরণ। এর মধ্যেও অকারণে ছলনা আনে কেন? অপরাধবোধ না থাকলে তো মানুষ মিছিমিছি মিথ্যের আশ্রয় নেয় না?

মৃদুলাকে নিয়ে তুতুল প্রতীক চলে যাওয়ার পর বাথরুমে ঢুকল সোমনাথ। শরীরটা জ্বালা জ্বালা করছে, স্নান করতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু ঋতু বদলের সময়, এখন গায়ে জল ঢালা কি সমীচীন হবে? থাক, ভাল করে নয় হাত পা মুখ ধুয়ে নিক, তাতেই যতটুকু মালিন্য দূর হয় হোক।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোমনাথ ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। তাদের স্বপ্ননিবাস একেবারে বড় রাস্তার ওপর নয়, সামান্য ভেতরে। সামনের রাস্তার অধিকাংশ টিউব লাইটই জ্বলছে না। কবেই বা জ্বলে? একটা-দুটো ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আঁধার পুরোপুরি কাটেনি, আলো আর অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। ফ্ল্যাটের গেটের মুখটায় একটা ছোট গর্ত তৈরি হয়েছে অনেক দিন। কাল রাতে অল্প বৃষ্টি হয়েছিল, তাতেই জলে ভরে গেছে গর্তটা। একটা চলন্ত ট্যাক্সির চাকা পড়ে নোংরা জল ছিটকোল গর্ত থেকে। ছড়িয়ে গেল রাস্তাময়। কোথাও এক পাল কুকুর ডেকে উঠল। উৎকট স্বরে চেঁচাচ্ছে। কানে লাগে।

পাশে ছায়া পড়েছে একটা। সোমনাথ ফিরে তাকাল। মিতুল।

কোমল গলায় সোমনাথ বলল, —কী রে, তুই উঠে এলি যে? শুয়ে থাকবি বলছিলি না?

—ধুস্, ওটা তো ওদের কাটানোর বাহানা।

—কেন রে? গেলেই তো পারতিস। তুতুলটার ভাল লাগত।

—আমার ভাল লাগত না বাবা।

—কেন?

—তুমি জানো না?

সোমনাথের বুকে ধক করে লাগল কথাটা। তুতুল-প্রতীকের গাড়ি কেনার প্রক্রিয়াটা তা হলে শুধু সোমনাথকেই আহত করেনি!

সোমনাথ ম্লান গলায় বলল, —তুতুলদের শুধু দোষ দিয়ে কী লাভ? চারপাশটাই তো এখন এরকম। আমরা কে আর কতটুকু খাঁটি আছি বল?

—প্লিজ বাবা, ওদের আর ডিফেন্ড কোরো না। অন্তত একটা দিনের জন্যও প্রোটেস্টটা থাকুক। ওরা বুঝুক ওরা চাইলেই সবাই ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হ্যাহ্যা হিহি করবে না।

সোমনাথের বুক থেকে একটা ভারী নিশ্বাস গড়িয়ে এল, —তোর দিদিটা কেমন বদলে গেছে, না রে?

আবছায়াতেও মিতুলের কালো চোখের মণি চিকচিক করে উঠল, —না বাবা, দিদি যেমন ছিল তেমনই আছে। বাবা-মা তো নিজের সন্তানের ত্রুটি দেখতে পায় না। তোমরাও চিরকাল মনকে চোখ ঠেরে এসেছ।

মিতুলের কথার কি প্রতিবাদ করা উচিত? কেন জোর পাচ্ছে না সোমনাথ? কেন মনে হচ্ছে মিতুল ভুল বলেনি? চিরকাল তুতুলের চাওয়াটা ছিল বড্ড বেশি বেশি। কখনও সস্তার জিনিসে তুতুলের মন উঠত না, বহু সময়ে সাধ্যের বাইরে গিয়েও বড়মেয়ের বায়না মিটিয়েছে সোমনাথ। তুতুলের বিয়ের সময়ে মৃদুলা নিজের জড়োয়ার সেটটা দিয়ে দিতে চেয়েছিল, মেয়ের পছন্দ হল না, নতুন করে গড়াতে হল সেট, বেরিয়ে গেল চল্লিশ হাজার। সেরা খাট চাই, সেরা আলমারি চাই, সেরা বেনারসিটা চাই— নিজে ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে দিচ্ছে কোনটা পছন্দ, সোমনাথ না দিয়ে পারে কী করে! অথচ মিতুলটার চাহিদা কত কম। দিদির চাই চাইয়ের বহর দেখেই বুঝি আপনা থেকেই নিজেকে সংকুচিত করে ফেলেছে মিতুল। একই মায়ের পেটে জন্মে দু’বোন কী করে এমন বিপরীত মেরুর হয়? হলেও তার পিছনে বাবা-মা’র কিছু অবদান কি থেকে যায় না? মৃদুলা এসেছিল অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবার থেকে, তুতুল হওয়ার পর কিছুটা বা তার শখ শৌখিনতা মেটাতে, কিছুটা বা প্রথম সন্তানের প্রতি বিশেষ অপত্য স্নেহে, মেয়েকে দামি দামি খেলনা, দামি দামি জামাকাপড় কিনে দিয়েছে সোমনাথ। মিতুলের বেলায় ঠিক ততটা আর হয়নি। তাকে তো কত সময়ে পরানো হয়েছে দিদির ছোট হয়ে যাওয়া জামা জুতো, দেওয়া হয়েছে দিদির পুরনো বই, পুরনো খেলনা…। তখন থেকেই কি তফাতটা তৈরি হয়ে গেছে? তুতুলের ক্ষেত্রে সোমনাথের কি আগে থেকেই রাশ টেনে ধরা উচিত ছিল?

মিতুলের পিঠে হাত রাখল সোমনাথ, —তুই তো বেশ কথা শিখে ফেলেছিস। দিব্যি পুটুস পুটুস শোনাতে পারিস!

—বাধ্য হয়ে শিখেছি বাবা। মিতুল হাসল, —আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটছি না?

—কেন? তোর প্রবলেম তো অনেকটা সল্‌ভ হয়ে গেছে। বড় ঝামেলাটাই তো ওভার।

—তুমি সেক্রেটারির ব্যাপারটা বলছ?

—হ্যাঁঅ্যা। তুইই তো বললি সনৎ ঘোষ রাজ্যপাট পেয়ে গেছে!

—তাতে আমাদের কী লাভ? আমরা তো যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি।…সনৎ ঘোষ কাজ করছে না যে তা নয়। করছে। শিগগিরই বোধহয় ক্লাসও শুরু হবে। রেখাদি সনৎবাবুকে সঙ্গে নিয়ে পলাশপুর গ্রামে গিয়েছিলেন। ওখানে চন্দ্রনাথ মেমোরিয়াল বয়েজ স্কুলের সঙ্গে কথাবার্তাও হয়ে গেছে, ওরা মাটিকুমড়া বালিকা বিদ্যালয়কে দুটো ক্লাসরুম ছেড়ে দেবে। ওখানেই আমরা আপাতত ফাইভ-সিক্স শুরু করব। সনৎ ঘোষের তো চমৎকার পলিটিকাল নেটওয়ার্ক আছে, পার্টির ছেলেদের দিয়েই আশপাশের গ্রামে স্কুল শুরু হওয়ার সংবাদটা ছড়িয়ে দেবে। লোকাল লোকের কাছ থেকে চাঁদা তুলে স্কুল বিল্ডিংও নাকি তৈরি করা শুরু হবে এবার।

—কোথায় করবে? বিশ্বম্ভর দাসের সেই জমিতে?

—অবভিয়াসলি। ওই জমি তো এখন স্কুলেরই। বিশ্বম্ভর দাসকে কিল খেয়ে কিল হজম করতেই হবে।

—তা হলে আর মন খারাপ করছিস কেন? সব তো ভাল দিকেই এগোচ্ছে!

—আমাদের আর ভাল কোথায়? আগের জয়েনিংটা তো কেঁচে গেল। দু’মাস ধরে এত ছোটাছুটি করলাম, এই পিরিয়ডের মাইনেটা দেবে বলে তো মনে হচ্ছে না। অবশ্য ক্লাস নিয়েও মাইনে পাব কিনা ঠিক নেই। রেখাদি বলছিলেন, অ্যাপ্রুভাল না পৌঁছোনো পর্যন্ত মাইনের নো চান্স।

—তা হলে অ্যাপ্রুভালের ব্যাপারটাতেই বেশি জোর দে।

—আমরা জোর দেওয়ার কে বাবা? রেখাদি নিজের মতো করে চেষ্টাচরিত্র করছেন। সনৎ ঘোষও হয়তো করছে। আমরা একমাত্র যে পথে এগোতে পারি, সে পথটা আমি অন্তত ধরব না। মরে গেলেও না। মাইনে পাওয়ার জন্য টাকা খাওয়াব, এ আমি পারব না বাবা। লাগুক দু’মাস, লাগুক চার মাস, লাগুক ছ’ মাস… দেখি কত দিন ভোগাতে পারে। মিতুলের চোয়াল শক্ত হল, —আমি ঠিকই করে ফেলেছি, এই দু’মাসের মাইনেও আমি আদায় করব। একবার মাইনেটা পেতে শুরু করি, তারপরেই আমি কেস করব। আমি ছাড়ব না।

—কোর্ট…উকিল…মামলা…তুই এসব পারবি করতে?

—পারতেই হবে। যেখানে যা খুশি হয়ে যাবে, কোথাও কোনও প্রতিবাদ হবে না? সহ্যেরও তো একটা সীমা থাকা উচিত, না কী?

সোমনাথ নিশ্চুপ হয়ে গেল। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে সহসা। কেন যে দিচ্ছে!

.

॥ এগারো ॥

—অ্যাই তুতুল, দাদাকে আর একটু ইলিশমাছের তেল দাও।

—না রে পল্টু, আর নয়। তেল দিয়ে সব ভাত মেখে ফেললে বাকি পদ খাব কী করে!

—বেশি আইটেম তো হয়নি দাদা। শুধু ইলিশমাছ আর খাসির মাংস। তোমার জন্য আজ একটু চিংড়ি খুঁজেছিলাম, ভাল কোয়ালিটির গলদা বাজারে পেলামই না।

—বাপস, এর ওপর আবার চিংড়ি! এই হজম করতে পারি কিনা তার ঠিক নেই।

—খুব পারবে। নাও একটু তেল। তোমার তো ইলিশমাছের তেল খুব ফেভারিট।

—আজকাল আর ভরসা পাই না রে। ইলিশ খাওয়ার অভ্যেসটাও তো প্রায় ছেড়েই গেছে। যা গলাকাটা দাম!…এত তেল বেরোল, কী রকম সাইজ ছিল রে মাছটার?

—পৌনে দু’কেজি মতন।

—কত করে নিল?

দাদার এই এক স্বভাব, সব জিনিসেরই দাম জানা চাই! প্রতীক রাখঢাক না করেই বলল, —তিনশো করে বেচছিল। আমার চেনা মাছঅলা… খুব খাতির করে আমায়… দুশো আশিতে দিল।

—তাও তো অনেক পড়েছে রে! প্রায় পাঁচশো! অত দাম দিয়ে আনতে গেলি কেন?

—অত দাম দাম কোরো না। একদিন এসেছ, খাও।

আড়াইটে বাজে। শনিবার প্রতীকের ছুটির দিন, দ্বিপ্রাহরিক আহার পর্ব চুকতে দেরিই হয় শনি রোববার। আজ অনেক রান্নাবান্না ছিল, বেলা একটু বেশিই গড়িয়েছে। চম্পাকে পাশে নিয়ে পরিবেশন করছে তুতুল। চেয়ারে শেফালি। তার নিরামিষ ভোজন অবশ্য আগেই সাঙ্গ হয়েছে, পরিতৃপ্ত মুখে শুনছে দুই ছেলের বাক্যালাপ।

কাল রাতে বহরমপুর থেকে এসেছে প্রণব। মাস তিনেক আগে তার ছোটছেলে ফুটবল খেলতে গিয়ে চোট পেয়েছিল, এখনও একটা পিঠের যন্ত্রণায় ভুগছে খুব। বহরমপুরের ডাক্তাররা বলছে হাড় নয়, সম্ভবত স্নায়ুর অসুখ। রোগটা ঠিকমতো ধরতে পারছে না। স্থানীয় চিকিৎসায় উন্নতিও হচ্ছে না তেমন। তাই বড় ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে প্রণবের এই কলকাতায় আসা। সকালে বেরিয়ে কাজটা চুকিয়ে এসেছে, হপ্তা দুয়েক পরে ছেলেকে এনে দেখাবে কলকাতায়।

পুঁইশাকের কাঁটাচচ্চড়ি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে ভাইপোর অসুখের প্রসঙ্গটা তুলল প্রতীক। বলল, —গুবলুর কপাল ভাল। তিন মাসের আগে দেবোপম গুপ্তর তো ডেটই পাওয়া যায় না।

—এমনি এলে আমিও পেতাম না। প্রণব ইলিশমাছের ডিমটা মুখে পুরল,— নেহাত সঙ্গে অমিতাভ নন্দীর চিঠি ছিল… অমিতাভ নন্দী ওর ছাত্র তো…

—তা নন্দী কেসটা ছেড়ে দিল যে বড়?

—অমিতাভ নন্দী একটু অন্য রকম, বেশি দিন রোগী হাতে রাখে না।

—তাও তো নয় নয় করে তিন মাস ধরে রাখল। প্রতীক কাঁটা চুষছে, —নিজের দোহন করার পালা শেষ, এবার পেশেন্টকে চ্যানেলে ঢুকিয়ে দিল।

—মানে?

—আজকাল মফস্সলের ডাক্তাররা তো বেশির ভাগই আড়কাঠি। কলকাতার নামী নামী ডাক্তারদের পেশেন্ট সাপ্লাই করাটাও তাদের একটা ইনকাম। দ্যাখো, দেবোপম গুপ্ত হয়তো বহরমপুরের মুরগি ধরার জন্য নন্দীকে ফিট করে রেখেছে।

—যাহ্, অমিতাভ ছেলে ভাল। বহরমপুরে দারুণ পপুলার। কত গরিবদুঃখীকে বিনা পয়সায় দেখে।

—সবই ইমেজ তৈরির খেলা দাদা। তোমাদের নন্দী রোগ না ধরতে পারুক, একগাদা টেস্ট নিশ্চয়ই করিয়ে নিয়েছে?

—হ্যাঁ, তাতে তো প্রায় হাজার দুয়েক মতো গেল।

—তার কিছুই কি নন্দীর পকেটে আসেনি? এবার দেখো, দেবোপম আবার নতুন করে সব ক’টা টেস্ট করাবে। সঙ্গে কয়েকটা লেজুড়ও জুড়ে দেবে। মোটা মোটা। ভারী ভারী। এবং সেগুলো তার পছন্দসই জায়গা থেকেই করাতে হবে। প্রতীক চোখ টিপল, —বুঝছ তো ব্যাপারটা? সব্বার কমিশান চাই।

শেফালি বলে উঠল, —বলছিস কী রে পল্টু? ডাক্তারও কমিশান খায়?

এমনভাবে কথা বলছে মা, যেন এটা সত্যযুগ! এইসব খাওয়াখাওয়ির ব্যাপার কিছুই যেন মা বোঝে না! অথচ বাবা যখন বহরমপুর কোর্টে চাকরি করত, তখন তারও টু পাইস আমদানি ছিল। বাবা ঘাড় মটকে আদায় করত না বটে, তবে ভাগের বখরা তো মিলতই। সেই এক্সট্রা পয়সা দিয়ে মা হার গড়াচ্ছে, দুল গড়াচ্ছে… এসব তো প্রতীকের স্বচক্ষে দেখা!

শেফালির দিকে একবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকিয়ে নিয়ে প্রতীক বলল, —কমিশান খাওয়াটা তো আদ্যিকালের দস্তুর দাদা। এখন তার অষ্টোত্তর শত নাম। কেউ বলে কাটমানি, কেউ বলে স্পিডমানি, কেউ বলে ডিসকাউন্ট, কেউ বলে নজরানা…। ভাবো তুমি, ডাক্তাররা কী লাখ লাখ টাকা কামায়, তবু তাদের আরও চাই, আরও চাই। যেখান থেকে যেভাবে পারবে খামচেখুমচে নিচ্ছে। তোমরা বলবে, সরকারি লোকগুলো সব বজ্জাত ঘুষখোর, কিন্তু এদের তুলনায় তো তারা নাঙ্গা ফকির। সমাজের মহান মহান ব্যক্তিরাও আর কেউ সাধুপুরুষ নেই। আদর্শ ধুয়ে জল খাওয়ার দিন শেষ। চুনোপুঁটিরা খায় খাম, আর রাঘব বোয়ালরা খায় আস্ত ব্রিফকেস।

একসঙ্গে এতগুলো কথা বলা প্রতীকের স্বভাবে নেই। তবু বলে ফেলে বেশ একটা আরাম বোধ করছিল। প্রতীকের সচ্ছলতা দেখে দাদা দিদি আজকাল বড্ড নাক কুঁচকোয়। এ বাড়ি এলেই ভিজিল্যান্স অফিসারদের মতো খর চোখে সমীক্ষা চালাচ্ছে প্রতীক কী ভাবে থাকছে, কী খাচ্ছে, কী কী গ্যাজেট কিনে ফেলল…! দাদা তাও চোখ টেরচা করে আর আলটপকা টিপ্পনী কেটেই থেমে থাকে, দিদি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোনায় জামাইবাবু কোন অফিসে অডিট করতে গিয়ে কোন দু’নম্বরিটা কী কায়দায় ধরেছে, কোন অসাধু লোকটাকে ফাঁসিয়েছে…! ওই সব গপ্পো শোনানোর মর্মার্থ কি বোঝে না প্রতীক? আজ দাদাকে শুনিয়ে রাখল, এবার সুযোগ পেলে একদিন দিদিকে ঝাড়তে হবে।

তুতুল হাতায় মাছ তুলেছে। মিষ্টি করে প্রণবকে বলল, — আপনাকে আগে কালোজিরের ঝোল দিই দাদা? ভাপাটা পরে খাবেন?

প্রণব বুঝি ঈষৎ অন্যমনস্ক। বাঁ হাতে চশমা ঠিক করছে। বলল, —দাও।

—পেটি গাদা দু’রকমই দেব? না শুধুই পেটি?

—দুটো পারব না। যে-কোনও একটা।

শেফালি বলল, —খা না খোকন। তুইই তো বলছিলি ইলিশমাছ খাওয়া হয় না!

সরল মনে বলা কথাও কখনও কখনও আহত করে মানুষকে। প্রণবের মুখ ক্ষণিকের জন্য ম্রিয়মাণ। পরক্ষণেই হেসে বলল, —খেতে পাই না বলে সারা বছরের খাওয়া এক দিনেই খেয়ে নেব?

—তা কেন। অনন্যা আজ নিজের হাতে রাঁধল তো!

এটাও একটা বেফাঁস কথা। প্রতীকের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল, —কেন মা, তুতুল কি রাঁধে না? কালও তো তোমার জন্য পনির করেছিল।

—সে তো করেই। এই তো গত হপ্তায় কী সুন্দর নারকোল দিয়ে লাউ বেঁধেছিল। এক তরকারিতেই আমার গোটা ভাত খাওয়া হয়ে গেল।

এও বেফাঁস কথা। তুতুল মুখটা ভার করে বলল, —কবে আপনাকে এক তরকারি দিয়ে খেতে দেওয়া হয় মা?

—ওমা না না, আমি সেকথা বলিনি। সঙ্গে সর্ষে পটল ছিল, মুগ ডাল ছিল, ভিন্ডি ছিল, চাটনি ছিল…। আমি বলছিলাম রান্নাটা এত ভাল ছিল যে একটা তরকারিতেই আমার…। শেফালি সন্ত্রস্ত যেন, —আসলে রোজ রোজ সুষমার রান্না খেয়ে কেমন মুখ মেরে গেছে তো..

আবার বেফাঁস বাক্যি। তুতুলের মুখ আরও ভারী, —আমি তো রোজই আপনার রান্নাটা করে দিতে পারি মা। আপনিই তো বলেন, পয়সা দিয়ে লোক রেখেছ… তুমি কেন রোজ হেঁশেলে ঢুকবে!

উপর্যুপরি আক্রমণে চুপসে গেছে শেফালি। টুঁ শব্দটি করছে না আর। প্রণব খাচ্ছে মাথা নিচু করে। মাছের পালা চুকিয়ে থমকে রইল একটুক্ষণ। যেন মাংসের বাটি টানবে কিনা ভাবছে। সামান্য ইতস্তত করে চামচে এক টুকরো মাংস তুলে ঠেলে সরিয়ে দিল বাটিটা।

তুতুলও বসে পড়েছিল খেতে। হাঁ হাঁ করে উঠল, —ও কী দাদা, ওইটুকু মাংস দিয়েছি তাও…?

—আর পারছি না অনন্যা। এই খেয়েই রাত অবদি পেট আইঢাই করবে। রুনুর বাড়িতে রাত্তিরে আর খেতেই পারব না।

—সে কী? ওবেলা এখানে খাবেন না?

—উপায় নেই গো। রুনু বার বার বলে দিয়েছে। ঝিমলি আজ খড়্গপুর থেকে এসেছে, তারও কড়া ফরমান বড়মামাকে রাত্তিরে ও বাড়িতে থাকতে হবে।

—অ। প্রতীক বলল, —তার মানে তুমি ওখান থেকেই বহরমপুর চলে যাবে?

—হ্যাঁ। কাল দুপুরের লালগোলা ধরব ভাবছি। দুটো কুড়ি।

—ভাল। আবার যেন আসছ কবে?

—ওই তো, সামনের বেষ্পতিবারের পরের বেষ্পতিবার। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। শুক্কুরবার ডাক্তার দেখিয়ে, যদি কিছু টেস্ট করতে বলে তো করিয়ে, রোববার গুবলুকে নিয়ে ব্যাক। ভাবছি ওই দিনই মাকেও নিয়ে যাব।

শেফালি জিজ্ঞেস করে উঠল, —ওই দিন কী তিথি পড়ছে?

একসঙ্গে তিন জোড়া চোখ ঘুরে গেল। প্রণব বলল, — তিথি? তিথি দিয়ে কী হবে? কী রে পল্টু, মা কি তোর দেখাদেখি তিথি ক্ষণ মানা শুরু করেছে?

প্রতীকের এই ধরনের ঠাট্টাবিদ্রুপ পছন্দ নয়। তবে তার পরিপাকযন্ত্রটি যথেষ্ট শক্তিশালী, হজম করে নিল নীরবে।

শেফালি বলল, —আমি জানতে চাইছি মহালয়াটা কবে?

—মহালয়ার তো এবার ঢের দেরি। সেই অক্টোবরের গোড়ায়।

—তা হলে আমি অত তাড়াতাড়ি গিয়ে কী করব? পল্টুরা তো বেড়াতে বেরোবে সেই অষ্টুমির দিন। তুই বরং আমায় পঞ্চুমি টঙ্কুমির দিন এসে নিয়ে যাস।

—আবার একদিন আমায় দৌড় করাবে মা? নয় ক’দিন আগেই আমাদের কাছে গেলে। নয় কষ্ট করে ক’দিন বেশিই আমাদের কাছে থাকলে।

—তুই বরং আর একদিন কষ্ট করে আয় না বাবা।

—বুঝেছি। কলকাতার আরাম ছেড়ে তোমার আর মফস্সলে যেতে প্রাণ চায় না।

—আহা, ওখানে আমায় এক মাস মতন তো থাকতেই হবে। যাওয়ার আগে কলকাতার সুন্দর সুন্দর প্যান্ডেলগুলো একবার দেখে যাব না?

মা আর দাদার সূক্ষ্ম দড়ি টানাটানি খুব উপভোগ করছিল প্রতীক। তার ওপর মা’র যে একটা অন্ধ স্নেহ আছে তা সে ছোট থেকেই জানে। রান্না হত তিনটে ডিম, গোটা ডিম প্রতীকের জন্য, বাকি দুটো চার ভাগ করে বাবা-মা-দাদা-দিদি। মাছের পেটিটা, দুধের সরটা তোলা থাকত প্রতীকেরই জন্য। দিদির আট বছর বয়সে পৃথিবীতে এসেছে প্রতীক, দাদা তখন দশ, কোলপোঁছা ছেলের খাতিরদারি একটু বেশি তো হবেই। সুন্দর অজুহাত দিত মা, পল্টুটা তো শাকসবজি কিচ্ছু খায় না, ওরও তো পুষ্টি চাই..! অবশ্য শুধু স্নেহের বশেই মা এখানে আছে তা নয়, এখানকার স্বাচ্ছন্দ্যে বিলাসে রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে গেছে মা। কুটোটি নাড়তে হয় না, সারাদিন বসে বসে টিভি দেখছে, এখন তো মাঝে মাঝেই গাড়ি গিয়ে নামিয়ে আসছে দিদির বাড়িতে…। এরপর কি এল-আই-সির টাইপিস্ট প্রণব চ্যাটার্জির কাছে থাকতে ভাল লাগে? মা এই হিসেবগুলো ভালই বোঝে। দাদার ওই লোকদেখানো আদিখ্যেতায় মা ভুলবেই না। ওদিকে দাদাও দাদার হিসেবটা ঠিক রাখছে। বহরমপুর থাকার ওপেন অফার দিয়ে রাখছে মাকে। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। কেউ কখনও বলতে পারবে না প্রণব চ্যাটার্জি মা’র দায়িত্ব নিতে চায়নি।

মাংস না খেলেও দইটা চেটেপুটে খেল প্রণব। রসগোল্লা নিল মাত্র একটা। উঠে কুলকুচি করছে বেসিনে। শব্দ করে। যত দিন যাচ্ছে তত যেন গেঁয়ো হচ্ছে দাদাটা!

প্রতীক মুখ ধুয়ে দাদাকে জিজ্ঞেস করল, —তুমি কখন যাবে দিদির বাড়ি? সন্ধেবেলা?

—না। ঘণ্টাখানেক পর বেরোব। চারটে নাগাদ। একটুখানি গড়িয়ে নিই।

—মা’র ঘরে গিয়ে তা হলে শুয়ে পড়ো। বালিশ দিয়ে দিচ্ছি, এখানেও গড়াতে পারো। ডিভানে।

শেফালি খাবার টেবিল থেকে সোফায় এসেছে। জুলজুল চোখে বলল, —হ্যাঁ রে পল্টু, তোরা কি বিকেলে কোথাও বেরোবি?

—কেন মা?

—না ভাবছিলাম…ঝিমলিটা এল, মেয়েটার সঙ্গে দু’-তিন হপ্তা দেখা হয়নি, আজ আমিও রুনুর ওখানে রাত্তিরটা থেকে আসি।

বোঝো মহিলার অবস্থা। গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব! ষোলোআনা সুখ চাই! প্রতীক বেজার মুখে বলল, —আজ না গেলেই নয়? তুতুল পুজোর বাজার করতে যাবে, আমিও সন্ধেবেলা দক্ষিণেশ্বর যাব…

—না না, মা যান। থেকে আসুন একদিন। তুতুল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এসেছে, —চম্পা তো আছে, রুপাইকে দেখবে। আমি আজ বেশি মার্কেটিং করব না, আটটার মধ্যে ফিরে আসব।

—ও কে। মধু তা হলে আগে দাদাদের নামিয়ে আসুক। তারপর তুমি বেরিয়ে।

প্রণব দাঁত খোঁচাচ্ছিল। হাঁ হাঁ করে উঠল, —আহা, গাড়ি কেন? টবিন রোড আর কত দূর? আমি মাকে নিয়ে টুকটুক করে রিকশায় চলে যাব।

—যাও না গাড়িতে। রয়েছে যখন।

—কী দরকার রে পল্টু? এটুকু রাস্তা রিকশাতেই তো ভাল।

—অ। ঠিক আছে। যা তোমার ইচ্ছা।

প্রতীক গোমড়া হয়ে গেল।

রুপাই এখনও ঘুমিয়ে আছে বলে ফ্ল্যাটটাও যেন ঝিমোচ্ছে। শেষ দুপুরে কোথায় যেন একটা পাখি ডাকছিল। বোধহয় নীচের কম্পাউন্ডের কোনও গাছগাছালিতে। তুতুলের চোখ জানলায় গাঁথা। দেখছে নীচটাকে। আনমনে।

হঠাৎই ঘুরে ডাকল, —এই? শুনছ?

প্রতীক বিছানায়। রুপাইয়ের পাশে। চোখ খুলল, —বলছ কিছু?

—তোমার বেআক্কেলেপনার বহরটা ভাবছি। কী দরকার ছিল দাদা এসেছেন বলে গদগদ হয়ে অত্ত বাজার করার?

—আমি আমার কর্তব্য করেছি। আদরযত্নের ত্রুটি রাখিনি।

—তোমার দাদা আদরযত্নের মর্ম বোঝেন? সেই তো বোন বোন করে ছুটছেন। অথচ ওই বোন দাদার কী কম্মে আসে? বিপদ-আপদে সেই তো এসে হাত পাতবেন ছোট ভায়ের কাছে।

—কী আর করা যাবে? যার যেখানে প্রাণের টান।

—ব্যাপারটা বোঝো। মাথায় রেখো, আর একটা এক্সট্রা ঝঞ্ঝাট কিন্তু চাপল ঘাড়ে। মাঝে মাঝেই এখন ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় দেখাতে আসবেন। তখন কিন্তু গুবলুকে নিয়ে দিদির বাড়িতে উঠবেন না, এখানেই বডি ফেলবেন। তুমি দেখে নিয়ো।

—আমি আমার যথাসাধ্য করে যাব। প্রতীক একটা শ্বাস ফেলল, —দিদির বাড়ি যখন এক বছর ছিলাম, তখন কম করেছি দিদির জন্যে? জামাইবাবুর গলব্লাডার অপারেশান হল, ডাক্তার নার্সিংহোম সর্বত্র তো আমিই ছুটেছি। সেই দিদির এখন আর আমায় পছন্দ হয় না।

—চেনো তোমার আপনজনদের। তুতুল ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে বসল। চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলল, —তোমার দাদাও কেমন অপমানটা করলেন দেখলে তো? আমাদের গাড়িতে চড়লে উনি যেন ক্ষয়ে যেতেন! আমিও দেখব গুবলুকে যখন ডাক্তার দেখাতে আসবেন, তখন গাড়ি লাগে কিনা। তখন কিন্তু আমি অকারণে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাব, আগে থেকে কিন্তু বলে রাখছি। তোমার যদি তখন খুব প্রেম জাগে, দাদার হাতে ট্যাক্সিভাড়া ধরিয়ে দিয়ো।

প্রতীক উত্তর দিল না। পাশ ফিরে শুয়ে ভাবছে কী যেন।

তুতুল মন দিল সাজে। সরু কাজলের রেখায় উদ্ভাসিত করল আয়ত আঁখি, লিপ লাইনারের টানে প্রস্ফুটিত করল অভিমানী ঠোঁট। হালকা ব্রাশ অন ছোঁয়াবে কি গালে? থাক, এই ঘামে গরমে মানাবে না। তার চেয়ে হালকা করে কমপ্যাক্টের স্পর্শই ভাল। শাড়ি পরবে? না সালোয়ার কামিজ? শাড়ি পরলে বেশ একটা গিন্নি গিন্নি ভাব আসে, দোকানবাজারে শাড়িই চলুক। ওয়ার্ড্রোব খুলে আকাশি নীল জর্জেটখানা বার করল তুতুল, সঙ্গে ম্যাচিং স্লিভলেস ব্লাউজ।

আয়নায় দাঁড়িয়ে ঘেমো ব্লাউজ ছেড়ে ব্রেসিয়ার বদলাতে গিয়ে তুতুল থামল হঠাৎ। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কী যেন সংকেত পাঠাচ্ছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আয়নায় দেখতে পেল উপুড় হয়ে কেমন ঘোর লাগা চোখে তার আদুড় গায়ের পানে তাকিয়ে আছে প্রতীক।

তুতুল আদুরে গলায় ধমক দিল, —অ্যাই? কী গিলছ? মুখ ঘোরাও।

প্রতীকের দৃষ্টি সরল না।

তুতুল লজ্জা পেল একটু। লজ্জা? না লজ্জার ভান? তুতুল নিজেও ঠিক জানে না। তবে এটা বেশ বুঝতে পারে তার এই ব্রীড়াটুকু এখনও প্রতীকের চোখে তাকে খানিকটা রহস্যময়ী করে রেখেছে। মুচকি হেসে শাড়িতে আড়াল করল দেহলতা, কায়দা করে পরল জামা। তুতুল জানে এই আড়ালটুকু পুরুষমানুষের খিদে বাড়িয়ে দেয়।

সযত্নে শাড়ি পরে আঁচলখানা হাতের ওপর মেলে ধরল তুতুল। ব্যালেরিনার মতো এক পাক ঘুরে গিয়ে নিশ্চল হল পেশাদার মডেলদের ভঙ্গিমায়। নেশা ধরানো গলায় বলল, —দ্যাখো তো কেমন লাগছে?

প্রতীকের মুখে শব্দ নেই। দু’আঙুলে মুদ্রা ফোটাল শুধু। তুমি সত্যিই অনন্যা।

তুতুল খিলখিল হেসে উঠল, —তাও তো এখনও টিপ পরিনি। বলেই টিপের পাতা থেকে তুলে ছোট্ট একটা নীল ফুল ফুটিয়ে দিয়েছে দুই ভ্রপল্লবের মধ্যিখানে। মদির হেসে বলল, —এবার?

প্রতীকের ঠোট কেঁপে উঠল, —লর্ড, আই অ্যাম নট ওয়ার্দি, লর্ড আই অ্যাম নট ওয়ার্দি…

—কীই?

—এলিয়টের ভাষায় বলছি। আমি তোমার যোগ্য নই।

—নও’ই তো। সাত জন্ম তপস্যা করলেও এর চেয়ে ভাল বউ তোমার মিলত না, বুঝেছ মশাই?

পেনসিল হিল পায়ে গলিয়ে ফের তুতুল আয়নায় দেখছে নিজেকে। আপনা গন্ধে আপনি বিভোর হয়ে। কস্তুরী মৃগের মতো।

ছন্দ কেটে গেল অকস্মাৎ। ডোরবেল বাজছে। টকটক শব্দ তুলে ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেসে এল তুতুল। দরজা খুলে দেখল মধু এসেছে। তাকে গাড়ি বার করতে বলে গ্রীবা হেলিয়ে নিরীক্ষণ করল ডিভানে অর্ধশায়িত প্রণবকে। গলা মধুর করে বলল, —গেলে পারতেন। নামিয়ে দিয়ে যেতাম।

প্রণব উঠে বসেছে। একটু অপ্রস্তুত মুখে বলল, —কেন মিছিমিছি কষ্ট করবে? আমাদের কিছু অসুবিধে হবে না।

ভেতরটা চিড়বিড়িয়ে উঠল তুতুলের। মহা ঢ্যাঁটা। অবশ্য প্রতীকের এই দাদাটিকে একা দোষ দিয়ে কী লাভ? তার নিজের বাড়ির লোকরা কী করল সেদিন? মিতুল? বাবা? প্রতীককে একটু সাহায্য করতে হয়েছে বলে ওই আচরণ? গাড়িতে চড়বে না তো চড়বে না। তুতুলের ভারী বয়েই গেল।

রুপাই ঘুম থেকে ওঠার পর কী কী করতে হবে চম্পাকে তার নির্দেশ দিয়ে তুতুল নেমে এসেছে মাটিতে। কাঁধে খাঁটি ইটালিয়ান ভ্যানিটি ব্যাগখানা ঝুলিয়ে। এখনও মোড়ক না খোলা মারুতির কোমল গদিতে বসল রাজেন্দ্রাণীর মতো। শীত বিলোনো যন্ত্রটাকে চালু করে দিয়েছে মধু, হালকা আমেজে শিরশির করে উঠল শরীর।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মধু জিজ্ঞেস করল, —কোন দিকে যাব ম্যাডাম?

শকটের মালকিন হওয়ার পর থেকে অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব জেগেছে তুতুলের। গলায় সেই দাপটটাকে ফুটিয়ে বলল, —নিউ মার্কেট।

রাস্তায় প্রচুর জ্যামজট। সম্ভবত দুপুরে কোনও মিছিল বেরিয়েছিল, এখনও তার ফল ভুগছে শহর। পথ আটকে হেনো চাই তেনো চাই বলে শির ফুলিয়ে লোকগুলোর যে কী লাভ হয় তুতুলের মাথায় ঢোকে না। কাজ না করে দাবিতে দাবিতে আকাশ ফাটানো লোকগুলোর যেন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এই যানবাহনের জঙ্গল টপকে তুতুল যে এগোয় কী করে!

নিউ মার্কেট পৌঁছোতে ঘণ্টা দেড়েক লেগে গেল। পুজোর ভিড় শুরু হয়েছে সবে, এখনও তেমন জমেনি, ঝলমলে শোরুমে এখনও শান্তিতে পা রাখা যায়। তবে তুতুলের আজ কেনাকাটার বড় একটা স্পৃহা নেই, আজ সে এসেছে ঘুরে ঘুরে ঘ্রাণ নেওয়ার বাসনায়। শান্তাবউদি একদিন একসঙ্গে বেরোবে বলছিল, হয়তো সামনের সপ্তাহে আবার একবার এ চত্বরে আসতে হবে। তাও খালি হাতে কি ফেরা যায়, রুপাইয়ের জন্য আপাতত জামাপ্যান্টের সেট কিনল গোটা তিনেক। বাচ্চা মেয়েদের কত রকম পোশাক যে বেরিয়েছে! বাহারি ফ্রক, সুন্দর সুন্দর স্কার্ট ব্লাউজ, স্মার্ট ক্যাপ্রি, মিষ্টি প্যারালাল্স…। ইস রুপাইটা যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হত। উইনডো শপিং করতে করতে ম্যানেকুইনকে পরানো একখানা সালোয়ার কামিজ দেখে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিনে ফেলতে যাচ্ছিল প্রায়, শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলাল। থাক, আর কোথায় কী নতুন ডিজাইন এসেছে দেখা যাক। পরিচিত কস্‌মটিকসের দোকানটায় দু’-তিন রকমের বিদেশি মেকআপ বক্স এসেছে, দোকানদার প্রায় জোর করে গুছিয়ে দিল একটা সেট। প্রতীকের জন্য একখানা মোরামরঙা টিশার্ট কিনে যখন নিউ মার্কেটের গেটে এল ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে সাতটা ছুঁইছুঁই।

পার্কিং লটে এসে তুতুল গাড়িটা খুঁজছিল। এত রকম গাড়ির মাঝে কোথায় যে লুকিয়ে আছে তার দুধসাদা মারুতি! ইতিউতি চোখ চালাতে চালাতে সহসা স্থির হয়ে গেছে তুতুলের চোখের মণি। ওপারে ফলের রসের বিপণির সামনে ওরা দু’জন কে দাঁড়িয়ে? শরবতের গ্লাস হাতে হাসির ফোয়ারা ছোটাচ্ছে? স্ট্র-এ ঠোঁট লাগাতে গিয়ে ঠেকে যাচ্ছে পরস্পরে মাথা?

অতনু আর মিতুল! মিতুল আর অতনু!

বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে উঠতেই মাথাটা দপ করে উঠল তুতুলের। ত্বরিত পায়ে পার হল রাস্তা। সোজা গিয়ে দাঁড়িয়েছে মিতুল-অতনুর মাঝখানে।

ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে মিতুল। অতনু যেন তড়িৎস্পৃষ্ট।

ওরা কিছু বলার আগেই তুতুলের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে, —বাহ্ বাহ্, দু’জনের জোর পিরিত জমেছে দেখছি! চমৎকার!

—আহ্‌, দিদি, কী আজেবাজে বকছিস? আমি অতনুদার নাটক দেখতে গিয়েছিলাম।

—নাটকটা কোথায় হচ্ছিল? ভিক্টোরিয়ায়? না গঙ্গার পাড়ে?

—কী হচ্ছে কী দিদি? অসভ্যর মতো কথা বলিস না।

তুতুল বোনকে আমলই দিল না। তীব্র দৃষ্টিতে অতনুকে পুড়িয়ে দিয়ে বলল, —তোর অতনুদার তো শোকে মূৰ্ছা যাওয়ার চেহারা দেখছি না? দিব্যি তো রসেবশে আছে!

আশপাশের লোকজন তুতুলের তীক্ষ্ণ স্বরে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। অতনু চাপা গলায় বলল, —প্লিজ তুতুল, পাবলিক প্লেসে সিন ক্রিয়েট কোরো না।

—থাক, বড় মুখ করে আর কথা বোলো না। আমি জানি তুমি লম্বা লম্বা ডায়ালগ ঝাড়তে পারো। তোমায় ছাড়া বাঁচব না… আমায় ছেড়ে যেয়ো না… হাহ্! তুতুল ভেংচে উঠল, —ভাল নাটক করতে পারো। গুড অ্যাক্টর। আমায় নাচিয়ে এখন আমার বোনের সঙ্গে লীলায় মেতেছ!

—দিদি, তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। একটা সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্ককে তুই…

—চুপ। বুলি কপচাস না। তোকে চেনা হয়ে গেছে। ছিঃ।

বলেই আর দাঁড়াল না তুতুল। হনহনিয়ে চলে এল এপারে। উদভ্রান্তের মতো খুঁজছে গাড়িখানা। পেয়েই মধুকে ধমক, —থাকো কোথায়, অ্যাঁ? সামনে দেখতে পাই না!

মধু কাচুমাচু মুখে বলল, —ফাঁকা পেলাম বলে এদিকে রেখেছি।

—এখন চলো দয়া করে।

হাতের প্যাকেটগুলো গাড়িতে ছুড়ে দিল তুতুল। সিটে বসে ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলছে। শ্বাস? না হল্‌কা? মধু কখন গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে, পথে কোথায় কী কী পড়ল, ক’বার ট্রাফিক সিগনালে আটকাল কিছুই টের পেল না তুতুল। গাড়ির ভেতরের চড়া ঠান্ডাতে স্বস্তি নেই। ঘামছে। তীব্র এক ক্রোধ মত্ত কুরঙ্গীর মতো পাক খাচ্ছে বুকের কন্দরে। ক্রোধ, না ঈর্ষা? ক্রোধ, না অভিমান? ক্রোধ, না পরাজয়ের গ্লানি?

বাড়ি ঢুকতেই তুতুলকে দেখে চম্পা চমকে উঠেছে, —এ কী বউদি, তোমার মুখচোখ এমন কেন? শরীর খারাপ?

—ন্যাকামো মারিস না। তুতুল খেঁকিয়ে উঠল, —রুপাইকে খাইয়েছিস?

—এই তো মাংসর স্টু দিয়ে রুটি খাওয়াচ্ছিলাম। খেতেই চাইছে না।

—অপদার্থ। দূর করে দেব, দূর করে দেব।

ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল না তুতুল। ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিছানায়। ঠিকরে আসছে কান্না, ভিজে যাচ্ছে চোখ। মিতুল তাকে হারিয়ে দিল? অতনুর মন থেকে মুছে দিল তুতুলকে?

চম্পা দরজায় দাঁড়িয়ে, খেয়ালও নেই তুতুলের। কাঁদছে তুতুল। রুপাই কক্ষনও মাকে কাঁদতে দেখেনি, সে থতমত মুখে খাটে উঠে বসেছে। ঝুঁকে পড়ল মায়ের গায়ে, —ও মা, কানচো কেনো? কান্‌চো কেন?

তুতুলের একটু একটু করে সংবিৎ ফিরছিল। নাক টানছে জোরে জোরে। অশ্রু নিশ্চিহ্ন ক্রমশ। আবার চোখ জ্বলছে তুতুলের। বাঘিনীর মতো।

.

॥ বারো ॥

ফার্স্ট ইয়ার পাসের ক্লাস শেষ করে কলেজ লাইব্রেরিতে এসেছিল সোমনাথ। চারখানা বই ফেরত দেবে। কাল সন্ধেবেলা বুকসেলফ গোছগাছ করতে গিয়ে হঠাৎই চোখ পড়েছিল বইগুলোর ওপর। পাস কোর্স ইতিহাসের বই, সেই কোনকালে নিয়ে গিয়েছিল তুতুলের জন্য, জমা না দেওয়াটা নিছকই গড়িমসির ফল।

গ্রন্থাগারের কাউন্টারে যথারীতি ভিড়। ছাত্রছাত্রীদের। প্রয়োজনীয় বইয়ের জন্য তারা স্লিপ পাঠাচ্ছে। ঘেঁটেঘুটে বার করে আনছে গ্রন্থাগারের কর্মীরা। স্টাফদের বিব্রত না করে সরাসরি লাইব্রেরিয়ানের টেবিলে এসে বসল সোমনাথ, —কী ধনঞ্জয়বাবু, খুব ব্যস্ত নাকি?

ধনঞ্জয় পাত্র প্রবীণ মানুষ, বছর পঞ্চান্ন বয়স। কথাবার্তায় কখনও সখনও বাঁকা সুর থাকলেও সোমনাথের সঙ্গে সম্পর্কটা ভাল। হেসে বলল, —এই একটু। নতুন ক’টা বই এসেছে, স্টকে এন্ট্রি করছি। অনেকদিন পর কিন্তু এলেন লাইব্রেরিতে।

—আসি তো মাঝে মাঝে। আপনি কাজে থাকেন, ডিসটার্ব করি না।

—চাপ তো থাকবেই মাস্টারমশাই। মাত্র পাঁচজন স্টাফ নিয়ে এত বড় লাইব্রেরি চালানো, বিশেষ করে এই পিক্ সিজনে…। প্রিন্সিপালকে কতবার বলছি আরও একটা-দুটো হেড দিন, শুনলেই অন্যমনস্ক হয়ে যান। বেশি তাগাদা দিলে বলেন যেভাবে পারছেন সেভাবেই চালান, নতুন পোস্ট আর মিলবে না! কথার ফাঁকেই ধনঞ্জয় দেখে নিয়েছে সোমনাথের হাতের বইগুলো। হাঁক দিয়ে অধ্যাপকদের জাবদা খাতাখানা আনাল। পাতা উলটে বার করল সোমনাথের নাম। বইগুলো জমা করতে করতে বলল, —চা খাবেন নাকি একটু?

—পেলে মন্দ হয় না। …থাক, কে আবার আনতে যাবে।

—ওটা আমার ব্যাপার। ধনঞ্জয় গলা ওঠাল, —বিজয়, ক্যান্টিনে দুটো চা বলে আয় তো। লিকার। বলেই আবার জাবদা খাতায় চোখ, —শুনেছেন তো, জি-বি মিটিংয়ে কী ডিসিশান হয়েছে?

—কী ব্যাপারে?

—রিগার্ডিং লাইব্রেরি, এখন থেকে নিয়ম হচ্ছে রিটায়ারমেন্টের সময়ে লাইব্রেরির ক্লিয়ারেন্স লাগবে। সব ক’টা বই বুঝে না পেলে কোনও অধ্যাপকেরই পেনশান পেপার প্রসেসড হবে না।

—তাই নাকি? সর্বনাশ! আমার কাছে তো অনেকগুলো আছে!

ধনঞ্জয় ঝটপট গুনে ফেলল সোমনাথের নেওয়া বইয়ের সংখ্যা। বলল, —আপনার কাছে মোট বাষট্টিটা বই আছে।

সোমনাথ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এত বই রয়েছে তার কাছে? অবশ্য হলেও হতে পারে। এই কলেজে তিরিশ বছর শিক্ষকতার জীবনে অন্যের জন্যও বই নিয়েছে কত। বুবলির জন্যই তো ফিজিক্সের কয়েকটা বই নিয়েছিল, সে বই বুবলি ফেরতও দেয়নি। খুকুর বাড়িতে সেগুলো কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? কাজটা মোটেই উচিত হয়নি, কলেজের বই নিয়ে এভাবে দানছত্র করাটা খুব অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু যা করে ফেলেছে তা পূরণ হবে কী করে?

ধনঞ্জয় মিটিমিটি হাসছে, —কী ভাবছেন? আরে, আপনার চেয়ে অনেক বড় বড় ওস্তাদ আছে কলেজে। কারুর কাছে আশিটা, কারুর কাছে নব্বই, কেউ কেউ সেঞ্চুরি করে ফেলেছে।

—ও। তা হঠাৎ এমন কড়াকড়ি হচ্ছে যে?

—কেউ একজন জি-বি প্রেসিডেন্টের কানে তুলে দিয়েছে কথাটা। কলেজের মাস্টাররা নাকি শয়ে শয়ে বই গাপ করে দিচ্ছে। কথাটা অবশ্য খুব ভুলও নয়। মনে আছে, নির্মলবাবু বলতেন আমরা মাস্টাররা হলাম ছ্যাঁচড়ার ছ্যাঁচড়া? গাঁটের কড়ি খরচা করে বই কিনি না, কলেজের লাইব্রেরিটাকে বাপের জমিদারি ভেবে নিই! ধনঞ্জয় একটু গলা নামাল, —তবে আর একটা ইনফরমেশানও আপনাকে দিতে পারি। আমাদের জি-বি প্রেসিডেন্টও তো একসময়ে কলেজের শিক্ষক ছিলেন … দুর্জনেরা বলে তাঁর বাড়িতেই নাকি নিজের কলেজ লাইব্রেরির দেড়শো বই মজুত আছে। এখনও। রিটায়ারমেন্টের ছ’ বছর পরেও। তা তিনি হলেন বড় গাছের মোটা গুঁড়ি, তাঁর তো কোনও পাপ নেই!

সোমনাথ মনে মনে বলল, একেই বলে চোরের মায়ের বড় গলা!

মুখে বলল, না না, আমি দিয়ে দেব। একমাত্র যদি হারিয়ে টারিয়ে গিয়ে থাকে …

—দাম দিয়ে দেবেন। … এই দেখুন না, কী অপ্রিয় কাজ করতে হচ্ছে। নির্মলবাবুর নামে গোটা বারো-তেরো বই ইস্যু করা ছিল, সেগুলো চেয়ে বাড়িতে চিঠি পাঠাতে হবে।

কথায় ছেদ পড়ল। প্রিন্সিপালের পিয়োন সুরথ এসে ডাকছে সোমনাথকে, —স্যার, আপনার ফোন।

—আমার?

—হ্যাঁ স্যার। আপনার বাড়ি থেকে। প্রিন্সিপালের ঘরে। এক্ষুনি আসুন।

—চা খাওয়াটা আমার কপালে নেই। সোমনাথ উঠে দাঁড়াল, —চলি।

দ্রুত পায়ে প্রিন্সিপালের চেম্বারে এসে টেবিলে নামিয়ে রাখা রিসিভার তুলেছে সোমনাথ। সামান্য চিন্তিত মুখে। হঠাৎ বাড়ির ফোন কেন?

ওপ্রান্তে মৃদুলার তরল স্বর, —অ্যাই, তুমি আজ বাড়ি ফিরছ কখন?

স্বস্তি পেল সোমনাথ। যাক, তেমন কিছু নয়! স্বাভাবিক স্বরে বলল, —কেন?

—আমি খেয়েদেয়ে উঠে একটু বেরোব। তুতুল এক্ষুনি ফোন করেছিল। ও গাড়ি নিয়ে আসছে। আমায় তুলে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর আদ্যাপীঠ বেলুড় যাবে। ওর শাশুড়িও থাকছে সঙ্গে।

অজান্তেই গলাটা বিরস হয়ে গেল সোমনাথের, —ও।

—আমাদের ফিরতে কিন্তু সাড়ে সাতটা-আটটা। বেলুড়মঠের সন্ধ্যা আরতি না দেখে আসব না।

—হুঁ।

—পাশে সর্বাণীদের ফ্ল্যাটে চাবি রেখে যাচ্ছি। মিতুলের আগে ফিরলে ওখান থেকে চাবি নিয়ে নিয়ো।

—আর মিতুল যদি আগে আসে?

—ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। ওরা মিতুলকে ডেকে চাবি দিয়ে দেবে।

—ও।

—রান্নাঘরে কৌটোয় চিঁড়েভাজা আছে, বের করে নিয়ো।

—ঠিক আছে।

—ইস, ক’দিন ধরেই মনটা বেলুড় দক্ষিণেশ্বর করছিল। … রাখছি।

ফোন নামাতেই পুলকেশের সঙ্গে চোখাচোখি। কোথাও বেরোচ্ছে বোধহয়। উঠে দাঁড়িয়েছে।

জিজ্ঞেস করল, —এনি সিরিয়াস নিউজ?

—নাহ্।

—আপনাকে কি ক্লাস থেকে ডেকে আনল?

—না। লাইব্রেরিতে ছিলাম।

—এখন বুঝি অফ পিরিয়ড?

—হ্যাঁ। এরপর টানা তিনটে ক্লাস আছে। তিনটেই অনার্সের।

পুলকেশকে আর কিছু জিজ্ঞাসার অবকাশ না দিয়ে তার সাজানো গোছানো চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল সোমনাথ। মেজাজ আচমকাই খিঁচড়ে গেছে খানিকটা। কল্পচক্ষে দেখতে পাচ্ছে মেয়ের গাড়ি চড়ে ঘোরার আনন্দে কেমন ডগমগ হয়ে আছে মৃদুলা। যেন তুতুলের কল্যাণে এই প্রথম বেলুড়মঠ দর্শনের সুযোগ জুটল! অথচ ফি-বছর বার দুয়েক তো যায়ই, এই মাস কয়েক আগেও মৃদুলাকে বেলুড় দক্ষিণেশ্বর ঘুরিয়ে এনেছে সোমনাথ। তুতুলের গাড়ি নিয়ে এত আদিখ্যেতা করছে কেন? পরশুই তো গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল তুতুল, মহারানির মতো বাপের বাড়ি ঘুরে এল মৃদুলা। সম্ভবত দাদা বউদিকে সমঝে দিয়ে এল, গাড়ি শুধু তাদের একার নেই। কী নির্লজ্জের মতো মেয়ের কাছে চাইল গাড়িটা। হয়তো আজও নিজেই যেচে …। সোমনাথ তো স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে তুতুলদের অন্যায় আবদারে সে যথেষ্ট আহত, তার পরও মৃদুলার এই আদেখলেপনা কি সোমনাথকে ছোট করা নয়?

সোমনাথ স্টাফরুমে এসে বসল। অপ্রিয় প্রসঙ্গটা মন থেকে তাড়াতে ব্যাগ খুলে একটা বই বার করেছে। চোখ বুলাচ্ছে বইয়ের পাতায়। অনার্স পিরিয়ডের প্রস্তুতি। লেকচার পুরো তৈরি না করে ক্লাসে যেতে সোমনাথের এখনও অস্বস্তি হয়।

পাঠে তবু মন বসাতে পারছে না সোমনাথ। মৃদুলাকে ছেড়ে এবার তুতুল প্রবেশ করেছে মাথায়। বড়মেয়ে ভালমতোই বুঝে গেছে বাবার অসন্তোষটা, সেদিনের পর থেকে আর আসছে না এ-বাড়ি। নিয়মিত টেলিফোন করে মাকে, একদিন সোমনাথের সঙ্গেও কথা বলেছে, কিন্তু গলায় কেমন যেন আড়ষ্ট ভাব। রুপাইকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে সরে গেল। মিতুলের ওপরও খুব চটেছে মনে হয়। সোমনাথ সেদিন আগ্রহ করে মিতুলের স্কুলের প্রসঙ্গ তুলতে গেছিল, তুতুল নিষ্প্রাণ স্বরে জানিয়ে দিল, মিতুলের ব্যাপার মিতুল বুঝুক, তার জানার কোনও কৌতূহল নেই। দু’বোনে তেমন গভীর সখিত্ব না থাকলেও মাঝে মাঝে ফোনাফুনি চলত, এখন তাও বন্ধ। মিতুলটাও তেমনি জিদ্দি, কিছুতেই যেচে কথা বলে না। এই ধরনের ঘরোয়া মন কষাকষি সোমনাথের ভাল লাগে না। কিন্তু কী করা যাবে? তুতুলের তালে তাল দেওয়াও তো সবসময়ে সম্ভব নয়। আপাতত তুতুলের মান ভাঙাতে সোমনাথ হয়তো কৃত্রিম উচ্ছ্বাস দেখিয়ে মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে একটা সন্ধি করে নিতে পারে। কিন্তু সেই বা এগোবে কেন? প্রথম পদক্ষেপ তো তুতুল প্রতীকেরই নেওয়া উচিত। তাদের স্বীকার করা উচিত পন্থাটা তাদের সঠিক হয়নি। অবশ্য তাতেই বা কী? তুতুলদের জীবন যাপনের ধারা কি বদলাবে?

সীতাংশুর উত্তেজিত স্বরে চিন্তা ছিঁড়ে গেল। নির্মলকে নিয়ে কী যেন বলছে সীতাংশু। সোমনাথ বই থেকে মুখ তুলল, —কী হল সীতাংশুবাবু? এত রাগারাগি করছেন কেন?

—রাগ নয়, কী ঝঞ্ঝাটে পড়লাম, তাই বলছি। সীতাংশুর স্বর তেতো, —নির্মল আগ বাড়িয়ে সার্ভিস বুকের কাজগুলো নিয়েছিল … কী করে গেছে, কতটুকু করে গেছে, কিছুই জানি না। এখন দেখছি আমার সার্ভিস বুকটা কোথায় তারই হদিশ নেই।

—অফিসে দেখেছেন?

—সব দেখা হয়ে গেছে। একমাত্র বাকি নির্মলের ওই লকার।

মৃগাঙ্ক বলে উঠল, —তা নির্মলদার লকার খুলে দেখলেই তো হয়।

—তার চাবি থাকলে তো! বড়বাবু বলল শুধু নির্মলের লকারেরই ডুপ্লিকেট চাবি নেই।

—তা হলে নির্মলদার বাড়িতে ফোন করতে হবে।

—যদি বাড়িতেও না পাওয়া যায়?

—আগেই বলে দিচ্ছেন কেন? খোঁজ নিয়ে দেখুন না। যদি একান্তই না পাওয়া যায় তো লকার ভাঙতে হবে।

—যদি লকারে না থাকে? যদি মিসপ্লেসড হয়ে গিয়ে থাকে? নির্মলের তো অভ্যেস ছিল সব কাজ একা করে দেখিয়ে দেওয়ার। কোথায় কী রাখছে কাউকে তো বলেওনি।

একা সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নির্মলের কাজ করে ফেলার অসামান্য দক্ষতায় সীতাংশু না উচ্ছ্বসিত ছিল সেদিনের শোকসভায়? আজ সামান্য উৎকণ্ঠার মুখোমুখি হয়েই নির্মলের গুণটা সীতাংশুর চোখে দোষ হয়ে গেল? একটু ভাল করে খোঁজার ধৈর্য নেই, অবলীলায় পালটি খেয়ে সমালোচনা করছে মৃত সহকর্মীর?

অবশ্য সীতাংশু ঘোষ তো এই টাইপেরই। চাকরির প্রথম দিন থেকেই তো দেখছে সোমনাথ। যেমনি ধান্দাবাজ, তেমনি সুবিধেবাদী। রং পালটানোয় গিরগিটিকেও হার মানায়। এককালে ঘোর দক্ষিণপন্থী ছিল, এখন হাওয়ার সঙ্গে সাঁতরে সাঁতরে নদীর বাঁ পাড়ে। পড়ানোয় কোনও দিনই কণামাত্র উৎসাহ নেই, সিলেবাস আউড়ে আর সাজেশান দিয়ে কোর্স শেষ করে দেয়, অনবরত চেষ্টা চালিয়ে গেছে কী করে হোস্টেল সুপারের পোস্টটি বাগিয়ে কিংবা এন এস এস অফিসার হয়ে বাড়তি কিছু রোজগার করা যায় …। আগের দুই অধ্যক্ষের অতি বশংবদ ছিল সীতাংশু, এখন সে পুলকেশের প্রায় আজ্ঞাবহ ভৃত্য। নির্মল রসিকতা করে বলত, এদের চিনে রাখো সোমনাথ, এরাই হচ্ছে খাঁটি দল মতের ঊর্ধ্বের মানুষ। চিরটাকাল এরা বাঁধা থাকে চেয়ারের সঙ্গে।

জেনেশুনেও কেন যে নির্মল এর কাজটা হাতে নিয়েছিল? সোমনাথ অপ্রসন্ন মুখে বলল, —বি সেন্সিবল সীতাংশুবাবু। নির্মল শুধু আপনারই কাজ করছিল না, আমাদের বেশ কয়েকজনের সার্ভিস বুকও নির্মল হ্যান্ডল্ করছিল।

—তারাও ভুগবে। টেরটি পাবে।

—চমৎকার দৈববাণী করলেন তো। সোমনাথের গলায় হঠাৎ শ্লেষ ফুটেছে। চোখা স্বরে বলে উঠল, —আমি তো নির্মলকে একটু একটু চিনতাম, আমি জানি নির্মল অত দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিল না। প্রতিটি সার্ভিস বুকই ও যত্ন করে রেখেছিল। এবং সব ওর লকারেই আছে।

—আপনি যখন নির্মলের হয়ে গ্যারান্টি দিচ্ছেন তা হলে হয়তো আছে। না থাকলে তো ব্যাম্বু।

এই মুহূর্তে সীতাংশুর বাকভঙ্গি অসম্ভব অশালীন মনে হল সোমনাথের। লোকটার সঙ্গে আর কথা বলার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। চোয়ালে চোয়াল কষে মুখ নামিয়ে নিল বইয়ের পৃষ্ঠায়। টের পাচ্ছিল গরম হচ্ছে কান, তপ্ত হচ্ছে মাথা। বেল পড়তেই উঠে গেল টেবিল ছেড়ে।

বর্ষা এবার তাড়াতাড়ি চলে গেছিল। ভাদ্রের শেষে আবার যেন সেজেগুজে উঁকিঝুকি মারছে। সকাল থেকেই আকাশ আজ মনমরা। একটু বুঝি থমথমেও।

সোমনাথ আকাশ দেখতে দেখতে করিডোর ধরে হাঁটছিল। হাতে অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার আর চক-ডাস্টার। হঠাৎই সামনে পথ রোধ করেছে এক জোড়া ছাত্রছাত্রী।

সোমনাথ দাঁড়াল, —কিছু বলবে?

ছেলেটি বলল, —স্যার, আপনি কি পড়াচ্ছেন?

ক্ষণপূর্বের বিরক্তি ভুলে সোমনাথ হাসল, —পড়ানোই তো আমার কাজ। পড়াতেই তো আমি কলেজে আসি।

মেয়েটি কুণ্ঠাহীন স্বরে বলল, —ও পড়ানোর কথা বলছি না স্যার। জিজ্ঞেস করছিলাম আপনি প্রাইভেট পড়াবেন?

প্রশ্নটা সরাসরি এসে বিঁধল সোমনাথকে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেকটাই বদলে গেছে। কী অকপটে প্রস্তাব রাখে প্রাইভেট পড়ানোর! মাত্র ক’বছর আগেও এরা সরাসরি জিজ্ঞেস করার সাহসই পেত না। অন্য যারা প্রাইভেট পড়ত, তাদের মাধ্যমে আসত ছাত্রছাত্রীরা। এখন আর কোনও সংকোচ নেই। ভাবটা এমন, কড়ি ফেলে তেল মাখব, এতে আর লজ্জা কীসের!

অবশ্য এদের দুষে কী লাভ! প্রশ্রয় তো সোমনাথরাই দিয়েছে। এখন যে সোমনাথ প্রাইভেটে পড়াচ্ছে না, তার যতটা না নীতিবোধে তার চেয়ে বেশি তো ভয়ে। এই কুৎসিত সত্যিটাকে সোমনাথ মন থেকে অস্বীকার করে কী করে? তা ছাড়া এখনও যারা চোরাগোপ্তা টিউশ্যনি চালিয়ে যাচ্ছে তারা যে কী স্তরের নোংরামি করে তাও তো সোমনাথের অজানা নয়। এই স্বপনই তো প্রতি মাসে পড়ানোর জায়গা বদলায়, পাছে কেউ ধরে ফেলে। অংশুমান তো আরও সরেস। থোক নোট দিয়ে থোক টাকা নিয়ে নেয়। সৌরীন তো প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে হাবভাবে বুঝিয়ে দেয় তার সঙ্গে আড়ালে যোগাযোগ না করলে পরিণাম খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নির্মল দেবব্রত তথাগতদের মতো ক’জনই বা সারাটা জীবন প্রাইভেট টিউশ্যন না করে চালাতে পেরেছে? মহিলা শিক্ষকরাও অবশ্য অনেকটাই পরিষ্কার। একে ডবল ইনকাম গ্রুপ, তার ওপর ক্লাস সেরেই সংসার করতে ছোটার তাড়না, কেনই বা তারা এ বোঝা নেবে!

যাই হোক, এই ছাত্রছাত্রীদের ওপর অসন্তুষ্ট হওয়া সোমনাথের সাজে না। সোমনাথ স্মিত মুখে জিজ্ঞেস করল, —তোমরা নিশ্চয়ই ফার্স্ট ইয়ার?

—হ্যাঁ স্যার।

—শোনো, আমি একসময়ে পড়াতাম। এখন ছেড়ে দিয়েছি। তোমরা নিয়মিত আমার ক্লাস করো, মনে হয় তোমাদের অসুবিধে হবে না। অন্তত আমার পেপারে।

দু’জনের একজনেরও মনে ধরল না কথাটা। মেয়েটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, —আপনার কোনও প্রবলেম হবে না স্যার। আমরা বাড়ি গিয়ে পড়ে আসব। কাউকে জানাবই না।

—আহ্। সোমনাথ ঈষৎ উষ্ণ গলায় বলল, —তোমাদের তো বললাম, আমি পড়াই না।

ছেলেটা বলল, —তা হলে আর কে পড়ান স্যার? এস ডি? পি কে?

সোমনাথের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। শুধু এ-বছরই নয়, গত বছরও প্রায় এরকমই ভাষায় প্রাইভেট পড়ানোর আবেদন জানিয়েছিল ছাত্রছাত্রীরা, কিন্তু এই দু’জনের প্রত্যাশা যেন লাগামছাড়া। এদের টিউটর জোগাড় করে দেওয়াও কি সোমনাথের কাজ?

সোমনাথ রুক্ষ গলায় বলল,—বিহেভ ইয়োরসেলফ। ডোন্ট আস্ক সিলি কোয়েশ্চেনস।

আশ্চর্য, তেমন কোনও বিকার নেই ছেলেমেয়ে দুটোর। কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে গেল শুধু। সোমনাথ ঘুরে ঘুরে দেখছিল তাদের। ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই ধরনের মানসিকতা গড়ে ওঠার জন্য কি শুধু শিক্ষকরাই দায়ী? পরিবারেরও কি কোনও ভূমিকা নেই? সমাজের? রাষ্ট্রের? মিডিয়ার? দুনিয়া এখন এমন এক বাজার যেখানে সব কিছুকেই দেখা হবে কেনা বেচার নিরিখে! শিক্ষাও! সম্পর্কও!

ঝিমঝিমে মাথায় ক্লাসরুমে এল সোমনাথ। চেয়ারে বসে নিজেকে স্থিত করার চেষ্টা করল কিছুটা। সাধারণত সে রোল কল করে ক্লাসের শেষে, আজ কাজটা শুরু করল গোড়াতেই। দীর্ঘ শিক্ষকজীবনের অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে এতে খানিকটা মাথা ঠান্ডা হয়।

সেকেন্ড ইয়ার অনার্সের ক্লাসে আজ পঁয়ত্রিশজন মতন উপস্থিত। ছাত্রীই বেশি, ছাত্র আছে গোটা দশেক। রোল কল সেরে ব্ল্যাকবোর্ডে গেল সোমনাথ, লিখল আজকের বিষয়। মতাদর্শের প্রকৃতি বিচার।

গলা ঝেড়ে নিয়ে ডায়াসের সামনে এল সোমনাথ। স্পষ্ট উচ্চারণে বলতে শুরু করল, —মতাদর্শের প্রকৃতি বিচারের আগে আমাদের বুঝতে হবে মতাদর্শ কাকে বলে। মতাদর্শ হল বিশেষ ধরনের মূল্যবোধ বা বিশ্বাসের সমষ্টি। যখন একটা বিশেষ সমাজ বিশেষ কিছু বিশ্বাস বা নিয়মকে সমাজের পক্ষে কল্যাণকর বলে ধরে নিয়ে মেনে চলতে শুরু করে, তখন আমরা তাকে বলি সামাজিক মূল্যবোধ। একই ধরনের ধারণা থেকে আমরা বলতে পারি, রাজনীতির ক্ষেত্রে যদি এরকম কোনও মূল্যবোধ বা বিশ্বাসকে মেনে চলার ব্যাপারে কিছু মানুষ অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তখন আমরা বলি এই মানুষগুলো ওই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুগামী। যত ধরনেরই রাজনৈতিক মতাদর্শ থাক না কেন, তাদের আমরা মূলত তিনটে ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত দক্ষিণপন্থী, যারা বর্তমান ব্যবস্থা বজায় রাখতে চায়। দ্বিতীয়ত বামপন্থী, যারা পরিবর্তন আনতে চায়। আর তৃতীয়টি হল মধ্যপন্থী। যারা পরিবর্তনও চায়, আবার বর্তমান ব্যবস্থার অল্পস্বল্প পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রধানত বর্তমান কাঠামোটাকে বজায় রাখতে চায়।

থার্ড বেঞ্চ থেকে একটি ছাত্রী উঠে দাঁড়িয়েছে, —স্যার, একটা প্রশ্ন করব?

—বলো।

—স্যার আমাদের রাজ্যে তো পঁচিশ বছর ধরে একই ধরনের গভর্নমেন্ট রয়েছে। মানে একই মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু দলের সরকার। কোনও রাজনৈতিক দল যদি এই ব্যবস্থাটার পরিবর্তন ঘটাতে চায় তাকে কি আমরা বামপন্থী বলব? অথবা যারা দীর্ঘকাল সরকার চালানোর সুবাদে একটা সিস্টেম কায়েম করেছে, এবং সেই অবস্থাটাকেই বজায় রাখতে চায়, তাদের কি আমরা দক্ষিণপন্থী বলতে পারি?

বিটকেল প্রশ্ন! এ ধন্দ তো সোমনাথেরও মনে জাগে। সামান্য থমকে থেকে সোমনাথ বলল, —বর্তমান ব্যবস্থা বলতে আমরা কিন্তু শুধু কে গভর্নমেন্টে আছে, কে গভর্নমেন্টে নেই, এ-কথা বলছি না। রাজনৈতিক মতাদর্শ তার চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার। একটা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কাঠামো কী ভাবে চলবে, বা কী রকম হবে, তা নির্ধারণ করাই রাজনৈতিক মতাদর্শের কাজ। এই কাঠামোটাকে যারা টিকিয়ে রাখতে চায় তারাই মূলগত অর্থে দক্ষিণপন্থী। কোন পার্টি এটাকে চালাচ্ছে সেটা বড় কথা নয়। কাঠামোটাকে যারা রাখতে চায় তারাই দক্ষিণপন্থী, আর যারা ভেঙে ফেলতে চায় তারা বাম। অর্থাৎ এই বিচারে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি দলই কিন্তু দক্ষিণপন্থী। কারণ এরা প্রত্যেকেই মূল কাঠামো, অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্রটাকে বজায় রাখায় বিশ্বাসী। অবশ্য ঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক দলই সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না বলে ঘোষণা করে, যদিও তারা পুরোমাত্রায় সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রধান গুরুত্ব …

—একটু আসছি স্যার।

পড়ানোয় জোর হোঁচট খেল সোমনাথ। ক্লাসরুমের দরজায় অভিজিৎ দেবলীনার সঙ্গে গোটা চারেক ছেলেমেয়ে।

সোমনাথের অনুমতির অপেক্ষা না করেই অভিজিৎ সদলবলে ঢুকে পড়েছে ঘরে। তড়বড় করে বলল— শারদোৎসব নিয়ে ছাত্রবন্ধুদের কিছু বলার ছিল স্যার। বলে নিই?

সোমনাথ আহত স্বরে বলল, —তুমি ক্লাস চলার সময়ে দুম করে ঢুকে পড়লে?

—ঢোকার আগে বলে নিলাম তো।

ইদানীং স্নায়ু যেন আর কিছুতেই বশে থাকছে না সোমনাথের। চড়াং করে গরম হয়ে গেল মাথা। গমগমে গলায় বলল, —আমি তো তোমাদের অ্যালাও করিনি। তোমরা এখন বাইরে যাও। যা বলার ক্লাস শেষ হওয়ার পরে এসে বলবে।

—অতক্ষণ তো অপেক্ষা করা যাবে না স্যার। অভিজিৎ উড়িয়ে দিল সোমনাথকে, —খুব আরজেন্ট ব্যাপার।

—ক্লাসের টাইমে ক্লাসের চেয়ে আরজেন্ট কোনও কাজ নেই। আমি আবার বলছি, গো আউট।

—কেন ঝামেলা করছেন স্যার? তিন মিনিটের একটা বক্তব্য রাখব, এতে আপনার কী অসুবিধে হবে? বলেই অভিজিৎ ছাত্রছাত্রীদের দিকে ঘুরেছে, —বন্ধুগণ, প্রতি বছরের মতো এবারও দুর্গাপুজোর আগে ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে শারদোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে …

সোমনাথ রাগে কাঁপছে ঠকঠক। বদলে গেছে পুরোপুরি। পা ঠুকে চেঁচিয়ে উঠল, —উইল ইউ প্লিজ শাট আপ? আমি তোমাদের ক্লাসের বাইরে যেতে বলেছি না? এক্ষুনি বেরোও। ইমিডিয়েটলি।

অভিজিৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলল, —চোখ রাঙাবেন না স্যার। আমি ছাত্র সংসদের সম্পাদক। আমি যে-কোনও সময়ে আমার ছাত্রবন্ধুদের সঙ্গে মিট করতে পারি। আপনি আমার সেই গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ আমরা কিন্তু বরদাস্ত করব না।

সোমনাথ ক্রোধে তোতলাচ্ছে, —তোতোতোতোমরা বাইরে যাবে না?

—না। মাথায় রাখবেন ছাত্র ইউনিয়ন একটা স্ট্যাটিউটরি বডি। অভিজিৎ ফের বক্তৃতা শুরু করেছে, —বন্ধুগণ, ওই শারদোৎসবে আমরা ছাত্র সংসদের তরফ থেকে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে চলেছি। গান নাটক গীতিআলেখ্য…। প্রতিটি ক্লাসের ছেলেমেয়েকেই আমরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। যারা যারা অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারা ইউনিয়ন অফিসে এসে অবিলম্বে…

কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে সোমনাথের। পলকের জন্য মনে হল সে বুঝি বধির হয়ে গেছে। পরক্ষণেই যেন সামনে বসা পঁয়ত্রিশটা ছেলেমেয়ে কানের কাছে খলখল হেসে উঠল। সবাই একসঙ্গে আঙুল নাচাচ্ছে, —তুই একটা ভাঁড়। তুই একটা জোকার। একটা নপুংসক।

সোমনাথ জ্ঞান হারাল। জন্ম থেকে বুকের ভেতর জমে থাকা তুষের আগুন পলকে জ্বলে উঠল দাউদাউ। ঝাঁপিয়ে পড়েছে অভিজিতের ওপর। চুলের মুঠি ধরে চড় কষাল সপাটে। হতচকিত অভিজিৎ বাধা দেওয়ার সুযোগ পেল না। আবার চড় মারল সোমনাথ। আবার।

গোটা ক্লাসরুম স্তব্ধ। নিষ্পলক।

.

॥ তেরো ॥

…বন্ধুগণ, আমি বলতে চাই অভিজিতের ওপর আক্রমণটা কোনও ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। এই আক্রমণের লক্ষ্য ছাত্র সংসদ। ছাত্রসমাজ। একজন অভদ্র অধ্যাপক আমাদের প্রিয় সম্পাদককে আক্রমণ করে আমাদের পুরো ছাত্রসমাজকে অপমানিত করেছেন। আমরা কি বুঝি না এই ধরনের ন্যক্কারজনক আচরণের কী অর্থ। কিছুকাল ধরেই আমরা লক্ষ করছি, অধ্যাপকদের একটা অংশ আমাদের মোটেই সুনজরে দেখছেন না। কারণও আছে। আমরা তাঁদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত করেছি। কলেজে না পড়িয়ে তাঁরা যেভাবে প্রাইভেট টিউশ্যনি করে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করেন তাতে আমরা বাধা দিয়েছি। তাঁরা যাতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমাদের বঞ্চিত করতে না পারেন, তার জন্য আমরা সতর্ক প্রহরায় থেকেছি। একটা হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে বা মেয়ে কত কষ্ট করে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় কলেজে পড়তে আসে তা বোঝার ক্ষমতা এইসব অধ্যাপকদের নেই। তাঁরা বসে আছেন টাকার পাহাড়ে, কলেজ তাঁদের মুনাফা লোটার জায়গা…

কলেজ গেটে আজ তুমুল উত্তেজনা। এতক্ষণ ছাত্র ইউনিয়নের মুহূর্মুহূ স্লোগানে কেঁপে কেঁপে উঠছিল দশ দিক। এখন শুরু হয়েছে বক্তৃতার পালা। ক্লাসরুম থেকে টেবিল নিয়ে গিয়ে অস্থায়ী এক মঞ্চ বানানো হয়েছে গেটের মুখে। মঞ্চের সামনে বড়সড় জটলা, জনা পঞ্চাশ-ষাট ছেলেমেয়ের জমায়েত। তাদের বেশির ভাগের চোখেই মজা দেখার কৌতূহল। একের পর এক বক্তা উঠছে মঞ্চে। কেউ বা কলেজেরই পড়ুয়া, কেউ বা স্থানীয় ছাত্রনেতা। মাইক্রোফোনে চলছে জ্বালাময়ী ভাষণ। এখন বলছে দেবলীনা। তার ধারালো চিৎকারে মুখরিত গোটা কলেজ চত্বর।

দেবলীনার গলা চড়ছে ক্রমশ, —প্রিয় বন্ধুগণ, অধ্যাপকরা যতই ক্ষিপ্ত হোন, আমরা সাফ জানিয়ে দিচ্ছি এ জিনিস চলতে দেব না। আজ একজন প্রতিক্রিয়াশীল অধ্যাপক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে আমাদের ওপর আঘাত হেনেছেন। কাল হয়তো আরও বড় আক্রমণ আসবে, তবু আমাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। হয়তো অনেক অধ্যাপকের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ মেলে না, তা বলে ছোটখাটো অজুহাতে তাঁরা আমাদের ওপর দমন পীড়ন চালাবেন এ তো হতে পারে না। আমরা পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি, ওই উদ্ধত অধ্যাপক যতক্ষণ না নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছেন, ততক্ষণ আমাদের ক্লাস বয়কট চলছে চলবে…

বক্তৃতার মাঝেই স্লোগান বেজে উঠল, —আমরা ক্লাস করছি না করব না। অধ্যাপক সোমনাথ মুখার্জিকে ক্ষমা চাইতে হবে চাইতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল অধ্যাপকদের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও…

পুলকেশ গরগর করে উঠল, —শুনছেন? শুনতে পাচ্ছেন? কানে যাচ্ছে কিছু?

সোমনাথ নীরব। দু’আঙুলে কপাল টিপে বসে আছে উলটো দিকের চেয়ারে। পাশে দেবব্রত মৃগাঙ্ক আর দীপেন। এই শেষ ভাদ্রেও তাদের মুখে আষাঢ়ের মেঘ।

পুলকেশ জোরে জোরে মাথা নাড়ল, —ইস, কী কুক্ষণে যে কাল বেরিয়ে গেলাম। আমি থাকলে এত দূর গড়াতেই দিতাম না।

দেবব্রত বলল, —আমি কিন্তু থামাতে গেছিলাম। মৃগাঙ্ক স্বপন তথাগতরাও সঙ্গে ছিল। সবাই মিলে বললাম, আলোচনায় বসো। সোমনাথ স্যারের সঙ্গে কথা বলো। ওরা আমাদের পাত্তাই দিল না। প্রত্যেকটা ক্লাস থেকে ছেলেমেয়েদের বার করে দিয়ে যা একটা সিন করল!

—অল বিকজ অফ দিস সোমনাথবাবু। আমি বুঝতে পারছি না সোমনাথবাবুর মতো একজন সিনিয়র টিচার কী করে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেন।

সোমনাথ ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, —কী? অভিজিৎ যেভাবে আমাকে অগ্রাহ্য করে…

—অভিজিৎ যাই করুক, সে ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি। বেআক্কেলের মতো তাকে আপনি চড় কষিয়ে দিলেন? রিপারকেশানের কথাটা একবার ভাবলেন না?

ভেবেছে বই কী সোমনাথ। কাল সারা রাত ছটফট করেছে বিছানায়। অত মাথা গরম করে ফেলল কেন হঠাৎ? মানসিক অশান্তির কারণে? ছোট ছোট বিরক্তিগুলো জমা হয়েই কি ওই চকিত বিস্ফোরণ? বারবার মনে হয়েছে আজ কলেজে এসে মিটিয়ে নেবে। কেন যে পারছে না? কোথায় যে বাধছে?

সোমনাথের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, —সবই তো আপনাকে বললাম। আপনার ক্লাসে কেউ ওরকম অসভ্যতা করলে আপনি কী করতেন?

—অন্তত এমন কিছু ঘটতে দিতাম না। আঠারো বছর ধরে ছাত্র পড়িয়েছি, আই নো হাউ টু ট্যাকল দা স্টুডেন্টস।

সোমনাথের অন্দরে ঘাপটি মেরে থাকা অন্য একটা সোমনাথ নিঃশব্দে বলল, তোমার মতন মেরুদণ্ডহীন মানুষ কদ্দূর কী পারে তা আমি খুব জানি। তোমার কাছে ট্যাকল মানে তো ম্যানেজ। যেভাবে ম্যানেজ মাস্টারি করে জুলজির অধ্যাপক হয়েও তুমি এ-কলেজে জুলজি নেই বলে পরিবেশবিজ্ঞানের মাস্টার সেজে প্রিন্সিপালের পোস্টখানা ম্যানেজ করেছ, তেমনই কোনও তেলবাজির খেলা খেলতে নিশ্চয়ই!

মৃগাঙ্ক অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল। হঠাৎ নিচু স্বরে বলে উঠেছে, —সোমনাথদাও তো তিরিশ বছর ধরে পড়াচ্ছেন স্যার। আগে কখনও সোমনাথদার সঙ্গে কোনও ছাত্র-ছাত্রীর সামান্যতম গণ্ডগোল হয়েছে কি? আমি তো অন্তত শুনিনি। সোমনাথদার মতো ভালমানুষ যখন এক্সাইটেড হয়েছেন, তখন নিশ্চয়ই যথেষ্ট প্রোভোকেশান ছিল!

—আহ্, এখন আর ওসব কাটাছেঁড়া করে কোনও লাভ আছে? দীপেন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, —একটা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের এখন যেমন করে হোক তার মোকাবিলা করতে হবে। অ্যাজিটেটেড ছাত্রছাত্রী নিয়ে তো কলেজ চালানো যাবে না।

—কী করা উচিত বলে আপনার মনে হয়?

—সোমনাথবাবুকেই তা ভাবতে হবে। আফটার অল উনিই উত্তেজনার কারণ।

সোমনাথের মনে পড়ে গেল চণ্ডীনগরের চপলানন্দ মহাবিদ্যালয়ে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল মাস দুয়েক আগে। ইউনিয়নের পাণ্ডা দেরি করে ক্লাসে ঢুকেছিল বলে ইংরিজির অধ্যাপক বিধান চক্রবর্তী তাকে প্রবেশের অনুমতি দেননি, কড়া গলায় ধমকে তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে তুলকালাম, একই রকম অসভ্যতা, ক্লাস বয়কট, ঘেরাও…। এই দীপেনই সেদিন প্রিন্সিপালের ঘরে বসে ফোন করেছিল চপলানন্দ মহাবিদ্যালয়ে, অধ্যাপকদের পরামর্শ দিয়েছিল পুলিশ ডাকার জন্য। চপলানন্দ মহাবিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ানের রং আলাদা ছিল বলেই কি তাদের জন্য আলাদা দাওয়াই? নির্মল ঠিকই বলত। এই কলেজেরও আর চপলানন্দ মহাবিদ্যালয়ে পরিণত হতে বেশি দেরি নেই। তখন দেখবে কিছু একটা ঘটলেই আমাদের সমিতির প্রাথমিক শাখার আহ্বায়কমশাই কেমন একশো আশি ডিগ্রি ডিগবাজি খায়! আজই কি সেই দিন?

পুলকেশ ঝুঁকেছে সামনে। বলল, —কী সোমনাথবাবু, এক্ষুনি তো ইউনিয়ন আমার কাছে ডেপুটেশন দিতে আসবে। কী বলব তাদের?

সোমনাথ নিরুত্তর।

—আমি কি বলব আপনি নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে রাজি আছেন?

এবারও সোমনাথের উত্তর নেই। বুকের ভেতরকার অচেনা সোমনাথটা গাঁক গাঁক চেঁচাচ্ছে। ধমকাচ্ছে সোমনাথকে। মুখে একটা শব্দও ফুটতে দিচ্ছে না। কী যে করে সোমনাথ?

পুলকেশ অধৈর্যভাবে বলল, —কিছু একটা তো বলুন।

দীপেন পাশ থেকে বলল, —অত মানসম্মানের কথা ভাবলে চলবে না সোমনাথদা। মুখে একটা সরি বললে কী এসে যাবে? স্বয়ং চাঁদসদাগরও মা মনসাকে বাঁ হাতে ফুল ছুড়ে দিয়েছিল। তাতে কি চাঁদসদাগরের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে? এটা তো জাস্ট একটা ট্যাক্টিকাল মুভ। ছেলেমেয়েদের ঠান্ডা করার কৌশল। দেখছেন তো, ওদের না থামালে কত অপ্রিয় প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে! ওরা যা নয় তাই বলছে অধ্যাপকদের নামে…!

এবারও সোমনাথ রা করল না। একবার দেবব্রতকে দেখছে, একবার মৃগাঙ্ককে। যেন অনুভব করতে চাইছে কতটা পাশে আছে তারা। কিংবা আদৌ আছে কিনা।

নাহ্, তেমন একটা ভরসা পেল না সোমনাথ। উঠে পড়ল বিমর্ষ মুখে। দরজা অবধি পৌঁছোনোর আগে পুলকেশের স্বর শুনতে পেল, —আপনি কিন্তু কিছু বলে গেলেন না?

লুকিয়ে থাকা সোমনাথ ঠেলে উঠল স্বরযন্ত্রে, —আমার আর কিছু বলার নেই।

—ক্ষমা তা হলে চাইছেন না?

—দেখি। ভাবি একটু।

অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বেরিয়ে কয়েক পা গিয়েছে সোমনাথ, সামনে এক তরুণ। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, গালে সযত্নচর্চিত দাড়ি। সোমনাথকে পেরিয়ে চলে গিয়েছিল ছেলেটা, ঘুরে এসেছে, —আপনিই তো সোমনাথ স্যার?

সোমনাথের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। এ আবার কে? স্থানীয় রাজনীতির কেউ?

আড়ষ্টভাবে সোমনাথ বলল, —হ্যাঁ। কেন?

—আমি আপনাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। আমার ভাই… স্পন্দন রায়… আপনার কাছে পল সায়েন্স পড়তে যেত… নাইন্টিফোরে এই কলেজ থেকেই পাশ করেছে…

—ও।

—আমি চন্দন। দৈনিক সমাচারের লোকাল করেসপন্ডেন্ট।

বুকটা ধক করে উঠল সোমনাথের। খবরের কাগজের লোকও চলে এল?

চন্দন বলল, —কালকের ঘটনাটা নিয়ে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই স্যার। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের মুখে শুনেছি, এখন আপনার তরফের বক্তব্যটা যদি…

সোমনাথ এক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, —কিছু মনে কোরো না ভাই, আমি ওই ব্যাপারে কিছুই বলব না। প্রিন্সিপালের কাছে যাও, যা বলার উনিই বলবেন।

—তবু… আপনিই তো ফোকাল পয়েন্ট…! ইউনিয়ন বলছিল ওদের সঙ্গে নাকি এর আগেও কয়েকবার আপনার ক্ল্যাশ হয়েছে?

—ওরা তাই বলল?

—হ্যাঁ। বলছিল ছাত্র ভরতির সময়েও ওদের সঙ্গে নাকি একবার মন কষাকষি হয়েছিল? আরও বলল আপনি নাকি এর আগেও একদিন অভিজিৎকে অপমান করেছিলেন? ক্লাস না নিয়ে স্টাফরুমে বসেছিলেন, অভিজিৎ আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে গেছিল…?

—অভিজিৎরা ঠিক বলেনি। …যাই হোক, আমি তো বলেই দিয়েছি কিছু বলব না! তুমি বরং প্রিন্সিপালের সঙ্গে গিয়েই দেখা করো।

—সে তো যাব। তবে আপনার মুখ থেকে একবার শুনতে পেলে…

—শুনেছ তো। ছেলেমেয়েরাই বলেছে তো।

—আমরা দু’পক্ষের ভারসানই ছাপতে চাই স্যার। পাঠক যাতে পড়ে বুঝতে পারে আসল ঘটনাটা কী।

বারবার চন্দন দু’পক্ষ বলে কেন? ছাত্র আর শিক্ষক কি পরস্পরের প্রতিপক্ষ? মিডিয়া কি একটা বিতর্ক তুলে দিয়ে মজা দেখবে? পাবলিককে খাওয়ানোর ট্যাক্‌টিস?

চন্দনের চোখ যেন চকচক করছে। সোমনাথের মুহূর্তের জন্য মনে হল সে যেন একটা শকুনের সামনে দাঁড়িয়ে। আহত প্রাণীর যন্ত্রণা কি উপলব্ধি করতে পারে শকুন? সোমনাথের হৃদয়ে এই মুহূর্তে যে কী ভয়ানক তোলপাড় চলছে তা কখনও ছেলেটা বুঝবে না, তথ্যগুলোকে সরস অক্ষরে সাজিয়ে দিয়েই তার দায়িত্ব খালাস।

সোমনাথ ব্যথিত মুখে বলল, —না ভাই, বলছি তো আমি কিছুই বলব না। কেন ওই কাসুন্দি আবার ঘাঁটাবে? বাদ দাও। যা শুনেছ তাই লেখো।

চন্দনকে অতিক্রম করে মন্থর পায়ে স্টাফরুমে এল সোমনাথ। প্রায় প্রতিটি চেয়ারই পূর্ণ আজ। চাপা স্বরে কী নিয়ে যেন তর্কবিতর্ক চলছিল ঘরে, সোমনাথকে ঢুকতে দেখেই থেমে গেছে অকস্মাৎ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য গোটা ঘরে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য। প্রায় সেই নির্মলের শোকসভার মতো। ঘরের সব ক’টা চোখ একসঙ্গে আটকেছে সোমনাথে। চোখ, না সার্চলাইট? সোমনাথ যেন ধাঁধিয়ে গেল।

একরাশ সিল্যুয়েটের মাঝে এসে বসল সোমনাথ। আবছাভাবে শুনতে পেল দেবল ডাকছে, —সোমনাথদা?

—উঁ?

—প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা হল?

—হুঁ।

—কী বললেন উনি? কী সিদ্ধান্ত হল?

সোমনাথ ভারী একটা শ্বাস ফেলল, —জানি না।

দেবব্রত আর মৃগাঙ্কও চলে এসেছে স্টাফরুমে। দেবব্রত বলল, —কোনও ডিসিশনই হয়নি। প্রিন্সিপাল দুটোর সময়ে বসছেন ইউনিয়নের সঙ্গে…

জয়িতা বলল, —কেন? দুটো অবদি ওয়েট করবেন কেন? এখনই তো বসতে পারেন।

—এখন কয়েকটা ফোনটোন করবেন আর কী। মৃগাঙ্ক অর্থপূর্ণ চোখে হাসল, —বোঝেনই তো, ইউনিয়নেরও তো বাবা-জ্যাঠা আছে, তাদের সঙ্গে একটু কথা বলে নেবেন। যদি সেখান থেকে প্রেশার এলে ইউনিয়ন খানিকটা নরম হয়।

তথাগত অস্ফুটে বলল, —ওফ্, আবার সেই রাজনীতির খেলা?

মৃগাঙ্ক বলল, —রাজনীতি তো এসেই যাবে তথাগতবাবু। হাওয়ায় গাছের পাতা ডাইনে হেলবে, না বাঁয়ে, তাও তো এখন স্থির করে রাজনীতি। ক্লাস বয়কট আর তিনটে দিন চলুক, দেখবেন অপোজিশান পার্টির লোকাল লিডাররাও একটা ইস্যু পাওয়ার আনন্দে ধেইধেই নৃত্য শুরু করে দেবে। সোমনাথদার গায়ে বিদ্রোহীর তকমা এঁটে দিয়ে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের এগেনস্টে মিটিং মিছিল পোস্টারে গোটা অঞ্চল ভরিয়ে দেবে। সোমনাথদা যে আদৌ রাজনীতির লোকই নন, ঘটনাটার যে আদৌ কোনও পলিটিকাল কালার নেই, এই সত্যিটা তারাও ভুলিয়ে দিতে চাইবে। অ্যান্ড দিস ইজ দা কালচার অফ আওয়ার টাইম। রাজনীতির লোকরা ছোঁক ছোঁক করছে কোত্থেকে কী ভাবে একটু ফায়দা তোলা যায়। সে কীই বা সরকার, কীই বা অপোজিশান। একদল পাওয়ারের নেশায় গুলি ফোলাচ্ছে, একদল পাওয়ারের আশায় মুঠো পাকাচ্ছে।

—লেকচারটা দারুণ হয়েছে। জয়িতা টিপ্পনী কাটল, —এবার কাজের কথাটা বলুন।

—কীই?

—ক্লাসটাস যদি নাই হয়, তবু কি কলেজে আসতে হবে?

তথাগত হেসে ফেলল, —কলেজ তো ছুটি ডিক্লেয়ার করেনি দিদিমণি।

—এ তো ভারী অন্যায় কথা। জয়িতার মুখে স্পষ্ট অসন্তোষ, —বয়কটের নামে তো ছুটিই চলছে। ছেলেমেয়েদের। এমনিই তো অর্ধেক স্টুডেন্ট ক্লাসে আসে না, আন্দোলনের নামে বাকি অর্ধেকরও এখন পোয়াবারো। কলেজে ঢুকতে না পেরে সব তো গিয়ে চিত্রবাণীতে লাইন দিয়েছে। আমাদের কেন এসে ধর্মের নামে দশটা থেকে পাঁচটা বসে থাকতে হবে?

সীতাংশু মুচকি হাসল, —বসে আছেন কেন? চলে যান। আমার ডিপার্টমেন্টের পার্টটাইমার মেয়ে দুটো তো একটু আগে বেরিয়ে গেল।

—হ্যাঁঅ্যা, বেরোতে যাই, আর স্লোগান খেয়ে মরি।

—পেছনের গেটটা কী জন্য আছে, অ্যাঁ? ওটা খালি স্টুডেন্টদেরই কাজে লাগবে?

সোমনাথেরও আর কলেজে থাকতে ভাল লাগছিল না। এই ধরনের একটা পরিস্থিতির জন্য সে-ই যে দায়ী এ বোধটা তাকে সকাল থেকেই যথেষ্ট পীড়া দিচ্ছে। কিন্তু উঠতেও সংকোচ লাগে যে। চলে গেলেই তো ব্যঙ্গবিদ্রূপ শুরু হয়ে যাবে। ক্যাচাল বাধিয়ে কেমন কেটে পড়ল দ্যাখো! ধুৎ, কেন যে মিছিমিছি এরকম একটা বিশ্রী জট পাকিয়ে ফেলল? অভিজিতের লেকচারের সময়টাতে বাইরে গিয়ে প্রকৃতির শোভা দেখলেই তো ল্যাটা চুকে যেত। পুলকেশকে বলে আসবে সে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে? ইস, নির্মলটা থাকলে আজ সঠিক পরামর্শ দিতে পারত।

বাইরের হট্টগোল কমেছিল একটু। নতুন উদ্যমে চালু হয়েছে স্লোগান। হরেক কিসিমের প্রসঙ্গ ঘুরপাক খাচ্ছে স্টাফরুমে। সহকর্মীদের মাঝে একা হয়ে বসে চেয়ারের হাতল চেপে দোলাচলে ভুগছে সোমনাথ। করে নেবে মিটমাট? যাবে? উঠবে এখন? না বসেই থাকবে?

কানের পাশে ফের দেবলের গলা, —কী এত ভাবছেন সোমনাথদা?

সোমনাথ কেঁপে উঠল। মাথা নাড়ল সজোরে, —কিছু না।

—আমি একটা সাজেশান দেব? শুনবেন?

—বলো।

—আপনি এখন বাড়িই চলে যান।

—কিন্তু… প্রিন্সিপাল দুটোর সময়ে মিটিংয়ে বসবেন, তখন যদি আমায়…

—ওরা কখন প্রিন্সিপালের কাছে আসবে, তার জন্য আপনি কেন হত্যে দিয়ে বসে থাকবেন?

—আমি থাকলে যদি একটা মিটমাট হয়ে যায়…

—আপনি থাকলে গণ্ডগোল তো বাড়তেও পারে। ছেলেমেয়েগুলো যে রকম উগ্র মেজাজে রয়েছে! …প্রিন্সিপালের ওপর ছেড়ে দিন। মিটিংয়ে কী ডিসিশন হয় শুনে তখন নয় আপনি যা ভাল বোঝেন করবেন।

—বলছ? চলে যাব?

—হ্যাঁ, যান। আপনার মুখচোখ ভাল লাগছে না।

আরও মিনিট খানেক বসে থেকে মনের সঙ্গে যুদ্ধ চালাল সোমনাথ। তারপর নিঃশব্দে উঠে বেরিয়ে এসেছে পিছনের গেট দিয়ে। তিরিশ বছরের অধ্যাপক জীবনে এই প্রথম। চোরা একটা গ্লানি ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। ঘোরের মধ্যে স্টেশনে পৌঁছোল। আচ্ছন্নের মতো ট্রেনে চাপল। ভূতে পাওয়া মানুষের মতো এসে পৌঁছোল বাড়িতে।

মৃদুলা টিভি দেখছিল। দরজা খুলে অবাক, —কী হল? ভরদুপুরে ফিরে এলে যে?

সোমনাথ উত্তর দিল না। চটি ছেড়ে রবারের স্লিপার গলিয়ে সোজা শোওয়ার ঘর। মৃদুলা এসেছে পিছন পিছন, —তোমার কলেজের ঝঞ্ঝাট মিটল?

—নাহ্। সোমনাথ শার্ট ছাড়ছে। বলল, —এক গ্লাস জল খাওয়াবে?

—ঠান্ডা? না এমনি?

—ঠান্ডাই দাও। …বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

মৃদুলা জল নিয়ে আসার আগেই সোমনাথ বিছানায়। তীব্র এক অবসাদে ছেয়ে যাচ্ছে শরীর। মস্তিষ্ক অবশ হয়ে গেছে।

মৃদুলা ঘরে ফিরে বলল, —শুয়ে পড়লে যে?

মাথা তুলে পুরো এক গ্লাস জল নিঃশেষ করল সোমনাথ। বলল, —বড্ড টায়ার্ড লাগছে, একটু চোখ বুজে থাকি।

মৃদুলার বুঝি সন্দেহ হল। ঝুঁকে কপালটা ছুঁয়েছে, —গা তো ছ্যাঁকছ্যাঁক করছে মনে হচ্ছে?

—ও কিছু না। রোদ্দুরে এলাম তো।

—দেখো, আবার কিছু বাধিয়ো না। সিজন চেঞ্জের সময়…!

—না, না, ঠিক আছি।

—কলেজে কী হল বললে না তা?

—পরে শুনো।

সোমনাথ পাশ ফিরে শুল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জড়িয়ে এল চোখ। তন্দ্রা নামছে, আবার পিছলে পিছলে যাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড সুড়ঙ্গ দেখতে পাচ্ছিল সোমনাথ। নাকি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না? মিশমিশে অন্ধকারকে সুড়ঙ্গ বলে ভ্রম হচ্ছে তার? অনেককাল আগে রানিগঞ্জে বেড়াতে গিয়েছিল সোমনাথ, এক বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধুর সঙ্গে নেমেছিল এক কয়লাখনির খাদানে। মাথায় আলো বেঁধে। অন্ধকার কী নিকষ হতে পারে বোঝানোর জন্য বন্ধু কয়েক সেকেন্ড নিবিয়ে দিয়েছিল আলোটা। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল বুঝি সে অন্ধ হয়ে গেল। এই সুড়ঙ্গসদৃশ অন্ধকারেও অবিকল সেই অনুভূতি। দৃষ্টিহীন সোমনাথ ঠেলে ঠেলে পেরোচ্ছে অন্ধকার। কালো। আরও কালো। আরও আরও কালো। অন্তহীন পথ। অন্তহীন আঁধার। হাঁপিয়ে যাচ্ছে সোমনাথ। এগোতে পারছে না আর। দূরে, বহু দূরে, একটা আলোর ফুটকি দেখা যায় কি? পা চলছে না সোমনাথের। থেমে গেছে। বসে পড়ল। আলোর বিন্দুর ওপার থেকে একটা পরিচিত হাসি ভেসে আসছে। নির্মল! হাসতে হাসতে নির্মল বলল, কাম অন সোমনাথ, থেমে গেলে কেন? সোমনাথ কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল আবার। গাঢ় তমিস্রা ভেদ করে হাঁটছে। টলে টলে। অন্ধকার যেন একটু তরল হল। তবু বেশি দূর যেতে পারল না সোমনাথ। পা কাঁপছে ভীষণ। পড়েই গেল মুখ থুবড়ে। এবার খুব কাছাকাছি কোথাও মিতুলের স্বর, —বাবা ওঠো। বাবা ওঠো।

সোমনাথ কষ্ট করে চোখ খুলল। প্রথমে আবছা আবছা, ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে মিতুল। আলো জ্বলছে ঘরে। এখন সন্ধে? না রাত?

আবার মিতুলের গলা, —সন্ধেবেলা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ কেন?

সোমনাথ বিড়বিড় করল, —তুই কখন এলি?

—অনেকক্ষণ। ওঠো ওঠো, তোমার ফোন আছে।

—কার ফোন?

—তোমাদের প্রিন্সিপালের। বললেন খুব আরজেন্ট।

কোনওক্রমে উঠে বসল সোমনাথ। বিছানা হাতড়ে চশমা খুঁজে পরল চোখে। ড্রয়িং স্পেসে যাচ্ছে। নিজের শরীর নিজের কাছেই এত ভারী ঠেকছে কেন? অসময়ে ঘুমোনোর ফল?

দুর্বল হাতে রিসিভার তুলল সোমনাথ, —বলুন?

—আপনি তো স্ট্রেঞ্জ লোক মশাই! দিব্যি আমাকে না জানিয়ে কলেজ থেকে হাওয়া হয়ে গেলেন? এখন পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন?

—না… মানে… এই… জাস্ট একটু…

—কাজের কথা শুনুন। ওদের সঙ্গে বসেছিলাম। প্রচুর লড়ালড়ি হয়েছে। ইউনিয়নকে আমি অনেকটা সজুত করেছি। বলেছি, নো মোর কেঅস্, কাল থেকে ক্লাস। তবে হ্যাঁ, কিছু পেতে গেলে কিছু তো ছাড়তেও হয়। আমি ওদের কথা দিয়েছি আপনি ক্ষমা চাইবেন। যদি আপনি এক্ষুনি ক্ষমা না চান তা হলে গভর্নিং বডির তরফ থেকে আপনাকে একটা শোকজ করা হবে। পুলকেশের গলা একটুক্ষণ থেমে রইল। আবার ফিরল দূরভাষে, —না, না, শোকজ শুনে নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। ওটা সাপও যাতে মরে লাঠিও না ভাঙে এমন একটা স্টেপ। আপনার মান বাঁচানোর জন্য। গভর্নিং বডি জাস্ট জানতে চাইবে আপনি অমন কাজ করেছেন কেন। আপনি জবাবে লিখে দেবেন মুহূর্তের উত্তেজনায় ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলেছেন, এবং তার জন্য আপনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ব্যস, চ্যাপটার উইল বি ক্লোজড। …কী, শুনলেন তো?

—হুঁ।

—ওফ, এই বার্গেনিংটুকু করতে আমার কালঘাম ছুটে গেছে। যাক গে, বাইগনস্ আর বাইগন্‌স। কাল কলেজে আসুন, তখন ডিটেলে কথা হবে।

—আচ্ছা।

—আশা করি আমায় ডোবাবেন না। সলিউশনটা ক্যারি আউট করবেন। রাখছি।

টেলিফোন কেটে গেল। সোমনাথ তবু দাঁড়িয়ে আছে স্থাণুবৎ।

সামনে মিতুল। মুখে চোখে ঘোর উৎকণ্ঠা, —কী বলছিলেন প্রিন্সিপাল? কালকের ব্যাপারটা…?

—হুঁ। কোনও না কোনও ফর্মে ক্ষমা আমাকে চাইতে হবে।

—তুমি চাইবে ক্ষমা?

সোমনাথ আর্তনাদ করে উঠল, —না চেয়ে উপায়ই বা কী?

মিতুল কেমন অদ্ভুত চোখে দেখছে বাবাকে। এগিয়ে এসে সোমনাথকে ছুঁল।

ছুঁয়েই আঁতকে উঠেছে, —এ কী? তোমার গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

মেয়ের হাতটা চেপে ধরে সোফায় বসে পড়ল সোমনাথ। হাসল একটু। বিবর্ণ মুখে। ভেতরে এত তাপ, বাইরে কি একটুও তা ফুটে বেরোবে না?

.

॥ চোদ্দো ॥

দুপুরবেলা স্বপ্ননিবাসে এসেছে তুতুল। একাই। বাবার শরীর নিয়ে ক’দিন ধরেই সে ভারী উদ্বিগ্ন ছিল, সকাল বিকেল খোঁজ নিয়েছে টেলিফোনে, বাড়িতে ভাসুর টাসুর এসে পড়ায় দেখে যেতে পারেনি সোমনাথকে। কাল ছেলে নিয়ে বহরমপুর ফিরে গেছে প্রণব, আজ তাই খেয়ে উঠেই সোজা এবাড়ি।

ড্রয়িংস্পেসে বসে কথা বলছিল মা মেয়ে। সোমনাথ ঘুমোচ্ছে, ডাকেনি তাকে। নাতির অদর্শনে মনটা একটু খুঁতখুঁত করছিল মৃদুলার। বলল, —রুপাইটাকে আনলেই পারতিস। ওকে দেখলেই তোর বাবার সব রোগ সেরে যেত।

—খেপেছ! ওকে নিয়ে এলে শান্তিতে দু’দণ্ড বসা যায়? এমনিই বাবার শরীর খারাপ, তার ওপর এসে বাবার ওপর অত্যাচার করবে…

দিব্যি পাকা গিন্নিবান্নির ঢঙে আজকাল কথা বলে তুতুল। দেখতে মজাই লাগে মৃদুলার। হেসে বলল, —তো কী আছে? তোর বাবা কি শয্যাশায়ী নাকি? হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, জ্বরটাও পরশু থেকে আর নেই… শুধু একটু দুর্বল, এই যা।

—প্রেশারের গণ্ডগোলটা তো আছে মা। বুকের ব্যথাটা তো পুরো যায়নি।

—হুম, ওগুলো নিয়েই তো চিন্তা। বয়সটাও তো ভাল নয়। তার ওপর দুম করে নির্মলবাবু ওভাবে চলে গেলেন, সেটাও মনের ওপর খুব চাপ ফেলেছে…

—আজ সকালে ডাক্তারবাবুর আসার কথা ছিল না?

—দেখে গেছেন। উনি তো একই রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছেন। ভয়ের কিছু নেই। টেনশান থেকে প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করছে। পেনটাও সম্ভবত অ্যানজাইনার। ওষুধে আস্তে আস্তে কমে যাবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে উত্তেজনাটা যেন না বাড়ে।

—যোগেন সরকারের ওপর অত ভরসা রাখা ঠিক নয় মা। একটা ভাল কার্ডিওলজিস্ট কনসাল্ট করা উচিত।

—কিন্তু ইসিজিতে তো তেমন কিছু পাওয়া যায়নি!

—তবুও… রিস্ক নেওয়ার দরকারটা কী?

—মিতুলও অবশ্য সে কথাই বলছিল…

—কিন্তু একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে উঠতে পারেনি?

—আহা, ও বেচারার সময় কোথায়! সেই সক্কালবেলা বেরিয়ে যায়, হাক্লান্ত হয়ে ফেরে, এসেই আবার টিউশ্যনিতে ছুটছে…

—এখনও টিউশ্যনি করছে? স্কুল টিচারদের না প্রাইভেট পড়ানো বারণ?

—হুঁহ্, মাইনের দেখা নেই, তার আবার বারণ! এই তো, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকে অন্য কোন এক স্কুলে ঘর নিয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে, কিন্তু আসল ব্যাপারটি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই।

—ঠিকই আছে। তোমার মেয়ে তো বেগার খাটতেই ভালবাসে। …তবে খুব নীতির বড়াই করে তো, তাই আইনটা মনে পড়ে গেল আর কী।

—তুই দেখছি মিতুলের ওপর এখনও খুব চটে আছিস? সেদিন সত্যিই ও খুব টায়ার্ড ছিল রে।

—থাক মা, তোমার ছোটমেয়ের হয়ে আর সাফাই গেয়ো না। আমরা মোটেই ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। ও যে আমাদের পছন্দ করে না সেটা আমরা খুব বুঝি। তুতুল গাল ফোলাল, —আমাদের তো সবই খারাপ। আমাদের গাড়িতে চড়লে পাপ হয়, আমাদের সঙ্গে বেড়াতে গেলে সম্মানহানি হয়, আমাদের বাড়িতে যেতে ঘেন্না করে…

—বাড়াবাড়ি করিস না তুতুল। মিতুল তোদের খুবই ভালবাসে। কিন্তু ওর সময় কোথায় বল?

—সত্যিকারের টান থাকলে সময় ঠিক বেরিয়ে যায় মা। তুতুল উঠে ফ্রিজ থেকে একটা ঠান্ডা জলের বোতল বার করে আনল। গলায় একটু জল ঢেলে বলল, —প্রতীক সেদিন সত্যিই খুব দুঃখ পেয়েছিল।

ঘুরে ফিরে তুতুল খালি ওই একই প্রসঙ্গে যায় কেন? অপরাধবোধ? নাকি নিজেকে আর নিজের বরকে ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না তুতুল? এ-বাড়ির কারুর কোনও মনোকষ্ট নিয়েই সে বুঝি আর ভাবতে রাজি নয়! অন্তত তাদের আচরণে এ-বাড়ির কেউ যে দুঃখ পেতে পারে, এ যেন তুতুলের মগজেই আসে না। নাহ্, সত্যিই তুতুলটা পর হয়ে গেছে।

মাঝখান থেকে মৃদুলার হয়েছে যত জ্বালা। দুনিয়ার যার যত রাগ অভিমান সব এসে বর্ষাবে মৃদুলার ওপর। মৃদুলার কাজ হবে শুধু ব্যালান্স করে যাওয়া। একবার এদিককে আড়াল করো, একবার ওদিককে। আজ নয়, চিরকাল। বিয়ের পর থেকেই তো চলছে এই খেলা। একসময়ে দেওরকে নিয়ে কী অশান্তিটাই না গেছে। একটা পাঞ্জাবি মেয়েকে পছন্দ করে বসল দীপু, জানতে পেরেই শাশুড়ি রেগে কাঁই। সোজা ঘোষণা করে দিলেন, আমি থাকতে ওই মেয়ের সঙ্গে দীপুর বিয়ে দেব না, তাতে দীপু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় তো যাক। ওদিকে দীপুও গুলি ফোলাচ্ছে, আমি কি কারুর পরোয়া করি? চিরটাকাল কি মা’র তাঁবে থাকব? দু’জনের কেউই এক ইঞ্চি সমঝোতায় যেতে রাজি নয়। ছেলে মা’র সঙ্গে কথা বলছে না, মা ছেলের মুখদর্শন করতে চাইছেন না, সে এক বিদিকিচ্ছিরি অবস্থা। সোমনাথ তাদের বোঝাবে কী, সে নিজেই কেঁপেমেপে একসা। শেষ পর্যন্ত মাঠে নামতে হল মৃদুলাকেই। শাশুড়ির কাছে গিয়ে রোমিলার গুণকীর্তন করছে, দেওরকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সমঝাচ্ছে কোথায় বাধছে মা’র। দু’জনের কাছেই তখন যথেষ্ট অপ্রিয় হয়েছে মৃদুলা, দু’জনেই মেজাজ করত মৃদুলার ওপর। তারপর তো বিয়েটাও হল, আমে দুধে মিলেও গেল, মৃদুলার চেষ্টাটার কথা কেউ মনেও রাখল না।

তা সে নয় অন্য ধরনের ভারসাম্য বজায় রাখা। তুতুল মিতুল সোমনাথের ব্যাপারটা তো একেবারেই আলাদা। এরা মৃদুলার একান্তই আপনার জন। সোমনাথ তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, তুতুল মিতুল তার শরীরের অংশ। এদের মধ্যে কাকে ফেলবে মৃদুলা? ফেলা কি যায়? মৃদুলার কখনওই মনে হয় না তুতুল প্রতীকই সঠিক, সোমনাথ মিতুল অযৌক্তিক কিছু বলছে। কিংবা সোমনাথ মিতুলই ন্যায়ের ধ্বজাধারী, তুতুল প্রতীক ডুবে আছে পাঁকে। প্রতীক যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। দায়িত্বশীলও। সে যা করে বুঝে শুনেই করে। নিজের পিঠ বাঁচিয়ে করে। সবাই যেখানে করেকম্মে খাচ্ছে, ওরাই বা বসে বসে আঙুল চুষবে কেন? যষ্মিন দেশে যদাচার। সবচেয়ে বড় কথা, তুতুল খুব ভাল আছে, সুখে আছে। এতে মৃদুলা অখুশি হবেই বা কেন? আবার সোমনাথেরও যে কোথায় বেঁধে, মৃদুলা টের পায় না তা তো নয়। সংসারের মুখ চেয়ে তুচ্ছ টিউশ্যনিতে নেমে যে সোমনাথ মনে মনে অপরাধী হয়ে থাকত, অলীক বিপদের আশঙ্কায় প্রথম সুযোগেই ও পাট চুকিয়ে দিয়ে যে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে, লাখ-দু’লাখ দেওয়া নেওয়ার খেলায় তার তো বাধো বাধো ঠেকবেই। যার যেমন প্রকৃতি। আর মিতুল তো বরাবরই বাপের পোঁ ধরা, বাপের মানে লাগলে সেও সে তিড়িংবিড়িং লাফাবে, এও তো অস্বাভাবিক নয়।

অতএব মৃদুলাকে হাইফেন হতেই হয়। তুতুলকে তুষ্ট করার সুরে মৃদুলা বলল, —পুরনো কথা কেন বারবার মনে করিস বল তো? সেদিন এসে আমি তো মিতুলকে বকাবকি করেছি। তোর বাবাকেও কম কথা শোনাইনি। সংসারে ওরকম অনেক ছোট বড় ঘটনা ঘটে, সব কি পুষে রাখলে চলে?

তুতুল কী বুঝল কে জানে, চুপ করে গেছে। গোঁজ মুখে একটুক্ষণ বসে থেকে বলল, —প্রতীকও কিন্তু বড় ডাক্তারের কথা বলছিল। যদি চাও তো ও একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে পারে।

—চাওয়া চাওয়ির কী আছে। বাবা তো তোরও। তুই কর না।

—দ্যাখো, তাতে আবার কারুর যেন ইগোতে না লেগে যায়। বলতে বলতে চেন লাগানো বিগশপারটা খুলছে তুতুল। দু’খানা শাড়ি বার করে বলল, —তোমাদের কাঁথাস্টিচগুলো পড়েই ছিল। ফল্‌স লাগিয়ে দিয়েছি।

গোটা শাড়িতে ছোট ছোট মাছ আর মঙ্গলঘটের খুদে খুদে নকশাওয়ালা তসরের শাড়িখানা আগে খুলল মৃদুলা। আঁচলেও ঠাসা কাজ, মানানসই সুতোয় বোনা। খুবই পছন্দ হয়েছে মৃদুলার, তবু না বলে পারল না, —এত গরজাস শাড়ি আমাকে কি আর মানায় রে তুতুল?

—কেন নয়? এখনও তোমার ফিগার বেশ ভাল আছে।

—ছাই আছে। কী মুটোচ্ছি দেখেছিস, থাইরয়েডে স্কিনটাও কেমন খসখসে হয়ে যাচ্ছে…

—তোমায় একটা আয়ুবের্দিক লোশন এনে দেব। দাম দেখে চমকিয়ো না, মেখো। স্কিনের উপকার হবে।

—দূর, এই বয়সে আর চামড়া দিয়ে কী হবে? যেমন চলছে চলুক।

—সত্যি, তুমি না মা… ! একদিন আমার সঙ্গে পারলারে চলো, দেখবে তোমার চেয়ে অনেক বেশি বয়সের মহিলারা কেমন ভুরু প্লাক করছে, ওয়্যাক্সিং করছে, চুলের ট্রিটমেন্ট করাচ্ছে, স্কিনের ট্রিটমেন্ট করছে…। সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে জানাটাও একটা আর্ট।

মৃদুলা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। দেখতে সুন্দর বলে এককালে মনে মনে যথেষ্ট অহংকার ছিল তার, কিন্তু বিয়ের পর সেই রূপ ধরে রাখার আর সুযোগ রইল কই? কিংবা সময়? তখন পারলারই বা ছিল ক’টা? তার ওপর ওই জাঁদরেল শাশুড়ি নিয়ে ঘর করা, তিনি তো লিপস্টিক মাখলেও ভুরুতে ভাঁজ ফেলতেন। হয়তো অল্প বয়সে স্বামী মারা যাওয়ার জন্যে তাঁর মনেও কোনও কমপ্লেক্স ছিল। আর তাঁর ছেলে? তিনি তো সাজলেও তাকাতেন না, না সাজলেও না। মেয়ে দুটো হয়ে যাওয়ার পর মৃদুলাই বা রূপচর্চার মতো বিলাসিতার অবসর পেয়েছে কই? এখন তুতুলের কথাটথা শুনে মনে হয়, গেলে হয় একবার। কপালের হালকা বলিরেখাগুলো ঢেকে গেলে মন্দ দেখাবে না মৃদুলাকে। এখনও।

গোপন সাধ গোপন রেখে মিতুলের শাড়িখানা খুলল মৃদুলা। চকচকে চোখে বলল, —বাহ্, এটাও তো চমৎকার রে! রংটা কী ঝলমল করছে!

তুতুল সামান্য ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,—তোমার ছোটমেয়েকে বোলো, যদি ইচ্ছে হয় যেন পরে।

—পরবে না কেন? তুই ভালবেসে দিচ্ছিস…

—দ্যাখো আবার কী বাহানা জোড়ে। বলবে হয়তো রংটা ক্যাটকেটে।… তোমার ছোটমেয়েকে যত সহজ ভাবো তত সহজ কিন্তু নয় মা। মুখে এক, পেটে এক। তুতুলের ঠোঁট আরও একটু বেঁকল, —তুমি জানো, মিতুল এখন একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরছে!

—যাহ্। কে বলল?

—আমি নিজের চোখে দেখেছি। নিউ মার্কেটের সামনে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেটার গায়ে একেবারে ঢলে ঢলে পড়ছিল।

—তাই নাকি? কে ছেলেটা?

—আমার মুখ দিয়ে বলিয়ো না মা। তোমার শুনতে ভাল লাগবে না।

—তুই চিনিস ছেলেটাকে?

—হাড়ে হাড়ে চিনি। বাজে ছেলে। চাকরি বাকরি কিছু করে না, নাটক করে বেড়ায়…। একসময়ে আমার পেছনে খুব লেগেছিল। এখন মিতুল তারই সঙ্গে হবনবিং চালাচ্ছে। আমি তো সেদিন তোমার মেয়েকে হাতেনাতে ধরেছি।

মৃদুলার তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। বলল,—কী বলছিস রে তুই? আমি তো ভাবতেই পারছি না। সারাক্ষণ তো দেখি স্কুল স্কুল করে মাথা খারাপ করছে! বন্ধুদের ফোন এলেও তাদের সঙ্গে ওই একই গল্প! তা ছাড়া ছুটির দিনেও তো তেমন একটা বেরোতে টেরোতে দেখি না!

—বললাম তো, ও মুখে এক, পেটে এক। খুব চালু মেয়ে।… যাক গে যাক, তুমি আবার মিতুলকে এসব বলতে যেয়ো না। এমনিই তো আমাকে আজকাল ওর সহ্য হয় না, আরও খেপে যাবে। বলবে দিদি এসে চুকলি খেয়ে গেছে।

—কিন্তু… বলছিস ছেলেটা ভাল নয়…কোথায় কার পাল্লায় পড়ছে…

কথা শেষ হল না। টেলিফোন বাজছে। মৃদুলা উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল, ফোনটা, —হ্যালো?

ও প্রান্তে পুরুষ কণ্ঠ,—একটু প্রফেসার সোমনাথ মুখার্জির সঙ্গে কথা বলতে পারি?

—উনি তো এখন ঘুমোচ্ছেন। আপনি…?

—আমি পুলকেশ কুন্ডু।

—ও আচ্ছা, নমস্কার।…উনি একটু আগেই খেয়ে শুয়েছেন। ডাকব?

—না না, দরকার নেই। সোমনাথবাবুর শরীর এখন কেমন?

—মোটামুটি। আগের চেয়ে ভাল। তবে খুব উইক হয়ে পড়েছেন। এখনও বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। নতুন কিছু কমপ্লিকেশানসও দেখা দিয়েছে।

—তাই নাকি? ডাক্তার দেখছেন?

—হ্যাঁ, আজও তো…। আরও কদিন ফুল রেস্ট দরকার।

—ও।… মোটামুটি কবে নাগাদ উনি জয়েন করবেন?

—তা তো ঠিক বলতে পারব না। হয়তো সেই পুজোর মুখে মুখে…

—ও। পুলকেশ একটু থেমে থেকে বলল,—আসলে ওঁকে একটা চিঠি দেওয়ার ব্যাপার ছিল… গভর্নিং বডির… খুব আরজেন্ট চিঠি…

মৃদুলা বুঝতে পেরে গেছে। বিরস গলায় বলল,—পাঠিয়ে দিন। ওঁর পক্ষে তো এখন গিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়…।

—ও কে। আমি তা হলে স্পেশাল মেসেঞ্জার দিয়ে…। সোমনাথবাবুকে বলবেন, এমনি কোনও তাড়াহুড়ো নেই, চিঠিটা জাস্ট ওঁর কাছে পৌঁছে দেওয়াটা জরুরি ছিল। উনি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠুন…। যদি কোনও প্রয়োজন হয় নিঃসংকোচে আমায় বলবেন।

টেলিফোন রাখার পর মৃদুলার মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঢ্যামনামো! অতি কষ্টে সামলাল নিজেকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,—কী পাষণ্ড রে তোর বাবার কলেজের প্রিন্সিপালটা। নির্মলবাবু ঠিকই বলতেন। এইসব চামচে টাইপের লোকরা সাপের চেয়েও বিষাক্ত।

তুতুলের চোখ সরু,—কেন? কী হয়েছে?

—প্রিন্সিপাল স্বয়ং ফোন করে জানাচ্ছেন সোমনাথবাবুকে তিনি শো-কজের চিঠিটা পাঠাবেন! তাঁর নাকি হাত পা বাঁধা, না পাঠিয়ে উপায় নেই!

—সে কী? বাবা এত অসুস্থ, তার মধ্যে… ?

—বোঝ, কী টাইপ!

—সেদিন টিভিতে ইন্টারভিউ দেখেই আমার মনে হয়েছে লোকটা সুবিধের নয়। কী রকম কায়দা করে জানিয়ে দিল, বাবা একসময়ে প্রাইভেট পড়াত। স্টুডেন্টদের সঙ্গে নাকি বাবার সম্পর্ক ভাল ছিল না! বাবাই নাকি স্টুডেন্টদের প্রোভোক করেছে, ছেলেমেয়েরা সব ধোওয়া তুলসীপাতা…!

—নিউজ পেপারে ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা যা স্টেটমেন্ট দিয়েছিল, হুবহু তার রিপিটেশান। টিভিতে শুনে তো মনে হচ্ছিল পুলকেশই বুঝি ছাত্রনেতা! কী এমন হয়েছে যে টিভি নিউজপেপারে বেরিয়ে গেল!

—কিচ্ছু করার নেই মা। খবরওয়ালারা আজকাল সব মুখিয়ে থাকে। কোথায় কোন স্যার কোন ছাত্রকে চোখ রাঙিয়েছে, তার জন্য একটু অ্যাজিটেশান হল কি হল না, ওমনি নিউজ। রং চড়িয়ে, গপ্পো ফেঁদে, পাবলিককে তাতানোর ধান্দা।

—পাবলিকও তো তেমনি! কতটুকুনি একটা খবর বেরিয়েছিল, কারুর চোখে পড়ার কথা নয়, তবু যারা নজর করার ঠিক করে নিয়েছে। চারতলার নন্দগোপালবাবু তো বাড়ি বয়ে এসে কোয়্যারি করে গেল। ঠিক কী ঘটেছিল বলুন তো? সোমনাথবাবুর মতো শান্ত মানুষ হঠাৎ ছাত্র পেটাতে গেলেন কেন! কত যে ফোন এল সেদিন! একবার মিতুল তুলছে, তো একবার আমি। তোর বাবার যে তখন উঠে ফোন ধরারও ক্ষমতা নেই, এ-কথাও অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না। কী সব কমেন্ট, যেন তোর বাবা খুন করে গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে!… খুব ভাল করেছেন বউদি, এখন ক’দিন সোমনাথবাবুকে ফোনের ধারে কাছে আসতে দেবেন না!… সোমনাথবাবুর এখন বাইরের লোকের সামনে বেশি বেরোনো ঠিক নয়, কদিন ওঁকে আটকে রাখুন!… তুইই বল, তোর বাবার মতো ভালমানুষের এটাই কি প্রাপ্য ছিল?

—এইটেই প্রাপ্য ছিল মা। তুতুল জোর দিয়ে বলল,—প্রতীক তো বলে, এটা ভালমানুষির দুনিয়া নয়। মানুষ সোজা রাস্তায় চললেই গাড়ি চাপা পড়বে। এটা হল যেমন কুকুর তেমন মুগুরের যুগ। মুগুর না ধরতে জানলেই তুমি বোকা বনে থাকবে।

—হুম্‌, তাই তো দেখছি। মৃদুলা একটা শ্বাস ফেলল, —যাক গে, বাবা উঠলে তুই আবার শোকজ টোকজের কথা তুলিস না। পরে চিঠি এলে দেখা যাবে।

—কী হবে বলো তো মা? তুতুলকেও একটু যেন ম্রিয়মাণ দেখাচ্ছে এবার, —ওই বজ্জাত ছেলেমেয়েগুলোর কাছে বাবাকে কি তা হলে ক্ষমা চাইতেই হবে?

—মনে তো হচ্ছে। তোর বাবা তো ঝগড়াঝাঁটি চালিয়ে যাওয়ার লোক নয়। তা ছাড়া সামনে রিটায়ারমেন্ট, এ সময়ে প্রিন্সিপাল, গভর্নিংবডিকে চটালে তো ওর চলবেও না। তোর পিসেমশাইও বলছিল, শত্রুতা জিইয়ে রেখে লাভ নেই। একটা অ্যামিকেবল সেটলমেন্ট হয়ে যাওয়াই ভাল।

—তা ঠিক। মিটিয়ে নেওয়াই মঙ্গল। পিসিরা কী বলছে? প্রসঙ্গ ঘুরে গেল সামান্য। উঠে পড়ল তুতুলের পিসি পিসেমশায়ের কেরালা সফরের গল্প। সেখান থেকে তুতুলদের আসন্ন রাজস্থান ভ্রমণের প্রস্তুতির কথা। কোথায় কোথায় যাবে, ক’দিন করে থাকবে, মনে মনে তার একটা চার্ট করে ফেলেছে তুতুল, সবিস্তারে শোনাল মৃদুলাকে। শুনতে শুনতে মৃদুলার মনে হল রাজস্থানটা তার যাওয়া হয়নি, সোমনাথ অবসর নিলে তাকে ধরে বেঁধে একবার বেরিয়ে পড়তে হবে। পুজোর বাজার করা নিয়েও কথা হল খানিক। মৃদুলা জানাল কাল দুর্গাপুর থেকে ফোন এসেছিল, পুজোর সময়ে তুতুলের কাকা কাকিমারা এখানে এলেও আসতে পারে।

হালকা কাশির শব্দে গল্পে ছেদ পড়ল। সোমনাথ উঠে এসেছে ঘর থেকে। সাড়ে আটান্ন বছরের দীর্ঘদেহ একটু যেন নুয়ে পড়েছে। কাঁচাপাকা চুল উসকোখুসকো, গালে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি।

তুতুলকে দেখেই সোমনাথের চোখ জ্বলে উঠেছে,—এ কী রে, তুই কতক্ষণ?

—বহুক্ষণ। তুতুল হাসল,—তোমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় বসে আছি।

—ওমা, আমি তো জেগেই ছিলাম। অল্প অল্প গলাও পাচ্ছিলাম। ভাবলাম পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস রায় বুঝি তোর মা’র কাছে এসেছেন। বলতে বলতে সোমনাথ মৃদুলার দিকে ফিরল,—একটা ফোন বাজল না? কার ফোন ছিল?

—ওই একটা আজেবাজে। মৃদুলা দ্রুত বলে উঠল,—রং নাম্বার। তুমি এখন ফল খাবে? মুসুম্বির রস করে দেব?

—ধ্যাৎ, চা দাও। বেশ কড়া করে বানাও দেখি। কী রে তুতুল, তুইও তো খাবি?

—খাই। তুতুল ঘড়ি দেখল, —চা খেয়েই উঠব। ছেলেটা এতক্ষণে কী ধুন্দুমার করছে ভগবান জানে!

—তা তুই ওকে আনলি না কেন?

—এই নিয়েই তো ওকে বকাবকি করছিলাম। মৃদুলা বলল,—রুপাইকে আনলে আরও কিছুক্ষণ বসতে পারত।

—হুম। ছেলেটাকে কতদিন দেখিনি। সোমনাথ গিয়ে বসেছে বড় সোফায়। মেয়ের পাশটিতে, —মাঝে একদিন ওর হাঁটুতে লেগেছিল না? তোর মা বলছিল?

—ওর তো দিনরাত সর্বাঙ্গ ছড়ছে বাবা। হাঁটু কনুই থুতনি কপাল…কোথাও না কোথাও ব্যান্ডএড আছেই। এবার থেকে ভাবছি ওকে চেন দিয়ে বেঁধে রাখব।

সোমনাথ হো হো হেসে উঠল। অনেকদিন পর হাসছে জোরে জোরে। এ যেন সেই হাসি, যাতে রোগ সেরে যায়, টেনশান দূর হয়, আপনা থেকেই সুস্থ হয়ে ওঠে দেহমন।

মৃদুলা উঠে রান্নাঘরে যাচ্ছিল। খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,—এই দ্যাখো, তোমার জন্য তোমার মেয়ে কী এনেছে আজ!

—কী?

তুতুল ফিক করে হাসল,—তোমার প্রিয় মিষ্টি। সরভাজা।

—কেন রোজ রোজ এসব আনিস রে তুতুল? সোমনাথের গলায় অনুযোগের সুর, —তুই কি এখানে পরের বাড়িতে আসিস? সব সময়ে ফরম্যালিটি করার কোনও মানে হয়?

সঙ্গে সঙ্গে তুতুলের মুখে ছায়া ঘনিয়েছে, —তোমাদের ভালবাসি বলেই আনি। আপত্তি থাকলে আর আনব না।

—আহা, এক-আধ দিন তো বাপের বাড়ি খালি হাতেও আসা যায়!

—অল রাইট। নেক্সট দিন তাই হবে।

আবার আঁধার নামছে নাকি? মৃদুলা ঝটপট ঢাল ধরল, —তুমি কী গো? মেয়েটা বড় মুখ করে তোমার জন্য এনেছে…

—আহা, আমি কি খাব না বলেছি? সোমনাথ মেয়েকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছে,—আমি তো খালি ওকে খ্যাপামো করতে বারণ করেছি।

আদরে গলেছে তুতুল। সোমনাথের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,—আমি কিন্তু আর একটা খ্যাপামো করব বাবা।

—কী রকম?

—মা’র সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। আমি একজন ভাল কার্ডিওলজিস্টের ডেট নিচ্ছি। কোনও বাহানা চলবে না, তোমায় কিন্তু যেতে হবে।

—প্রয়োজন ছিল না রে। অ্যানজাইনা কিছু সিরিয়াস অসুখ নয়। অ্যানজাইনার সহজে কেউ মরে না।

—মরার কথা বলবে না। কোথায় কী বাধিয়ে রেখেছ তার ঠিক আছে? প্রতীক বলছিল তোমার একটা থরো চেকআপ দরকার।

—করা যা খুশি। যাবে নয় কিছু অর্থদণ্ড। তবে কিছুই ডিটেক্টেড হবে না, আমি কিন্তু গ্যারান্টি করতে পারি।

যাক, বাপ মেয়ের মধ্যেকার মেঘটা কেটে যাচ্ছে। নিশ্চিন্ত হয়ে মৃদুলা সরে গেল। গ্যাসে কেটলি চড়িয়ে নিজের মনেই মুখ টিপে টিপে হাসছে। তুতুল আর প্রতীকে খুব ভাব। ভাব? না মিল? কথা বলার ধাঁচটাও এক রকম হয়ে গেছে আজকাল। দুটো বাক্য উচ্চারণ করেই প্রতীকের উদ্ধৃতি শোনায় তুতুল। প্রতীকও কথায় কথায় বলে, আপনাদের মেয়ে বলছিল…! রাজযোটক!

চায়ের সঙ্গে তুতুলের জন্য পোট্যাটো চিপ্‌স একটু চানাচুর নিয়ে এল মৃদুলা। কাপ শেষ করেই আবার ঘড়ি দেখছে তুতুল। একটু যেন ছটফটও করছে। মোবাইল বার করে ঝপ করে একটা ফোনও করে নিল বাড়িতে। উঠেও পড়েছে।

তুতুল ব্যাগ কাঁধে নিতেই সোমনাথ হাঁ হাঁ করে উঠল, —আর দু’-চার মিনিট বোস না। মিতুলের সঙ্গে দেখা করে যা। এক্ষুনি এসে পড়বে।

—আজ নয় বাবা, নেক্সট দিন এসে অনেকক্ষণ থাকব। রুপাইটা ঠাকুমাকে খুব জ্বালাচ্ছে।

—কবে আসবি?

—দেখি। যে-কোনও দিন চলে আসব। প্রতীকও বলছিল, তোমায় দেখতে আসবে একদিন।

—আয় তবে।

তুতুল যাওয়ার পর মৃদুলার প্রথমেই মনে হল মিতুলের কথাটা সোমনাথকে বলবে কি? তুতুল যা বলে গেল তা তো বেশ আশঙ্কাজনক। মিতুলের যা বুনো ঘোড়ার গোঁ, জেদ ধরলে ওই ছেলেকেই ও বিয়ে করবে। কারুর আপত্তিতে কান দেবে না। তুতুলের দেওয়া সংবাদ পৌঁছোলে সোমনাথের উদ্বেগ উত্তেজনা বেড়ে যাবে না তো? যোগেন ডাক্তার পই পই করে বলেছে শান্ত রাখুন…। শো-কজের চিঠি কাল হোক, পরশু হোক, পৌঁছে যাবে। তখন একটা টেনশান তো হবেই। তার সঙ্গে আবার এই একটা! তার চেয়ে বরং মিতুলকেই আজ ধরবে সরাসরি। তাতেও সমস্যা। তুতুল তো আবার বলতে নিষেধ করে গেল। ক’দিন খর নজর রাখবে মেয়ের ওপর? প্রেমে পড়েও এতটুকু চিত্তবৈকল্য ঘটবে না, মিতুল কি সেই ধাতের মেয়ে? কিছুই কি আঁচ করা যাবে না? অবশ্য ছেলেমেয়ে কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে, বাবা মা’র পক্ষে সবসময়ে আন্দাজ করাও কি সম্ভব?

সোমনাথ ঘরে গিয়ে আধশোওয়া হয়েছে। হাতে একখানা বাংলা উপন্যাস। মিতুল পাড়ার লাইব্রেরি থেকে এনে দিয়েছে। রান্নাঘরে কাপডিশ নামিয়ে প্লেটে দু’খানা সরভাজা নিয়ে মৃদুলা ঘরে এল। খাটের কোণে বসে বলল,—তুতুল কী সুন্দর দুটো শাড়ি এনেছে গো।

সোমনাথ বই থেকে চোখ তুলল। দেখছে মৃদুলাকে।

মৃদুলা চোখ নাচাল,—কোনওটাই হাজার দু’-আড়াইয়ের কম নয়।

—হুম্‌।

মৃদুলা প্লেট বাড়িয়ে দিল,— নাও, মেয়ের আনা মিষ্টি একটা খাও।

সোমনাথ তেমন উৎসাহ দেখাল না। বলল,—ভাজা মিষ্টি, আমার কি সহ্য হবে?

—এক-আধটা খেতেই পারো। মৃদুলা সরভাজায় কামড় বসাল,—উমস্‌, খাঁটি গাওয়া ঘি। দারুণ টেস্ট। অমৃত।

—বয়স তো অনেক হল। সোমনাথের চোখ ফের বইয়ের পাতায়। মন্দ্রস্বরে বলল, —এবার লোভটা একটু কমাও।

কথাটা যেন জোর ঝাপটা মারল মৃদুলাকে। কেঁপে গেল মৃদুলার হাত। প্লেটটা আস্তে করে নামিয়ে রাখল বিছানায়। সোমনাথ তাকে ওই ভাবে বলল? ওই ভাবে? সোমনাথ? বত্রিশ বছর একসঙ্গে ঘর করার পরও? মৃদুলার লোভ? আচমকা বাষ্পে ছেয়ে যাচ্ছে চোখ। কী লোভ তার মধ্যে দেখেছে সোমনাথ? কবে শাড়ি গয়নার জন্য আবদার জুড়েছে সে? বিয়ের সময়ে ক’পয়সা সোমনাথ মাইনে পেত? হাসিমুখে তার হাঁড়ি ঠেলেনি মৃদুলা? ছোট ছোট শখগুলোকেও তো গলা টিপে মেরে ফেলেছে। আলাদা সংসার করার কী তীব্র আকাঙক্ষা ছিল তখন, মুখ ফুটে প্রকাশ করেছে কোনওদিন? একান্তেও? শাশুড়ি নিয়ে, দেওর ননদ নিয়ে, তাদের সমস্ত বায়নাক্কা মিটিয়ে, কাটায়নি দিনের পর দিন? দেওর ননদ নয় চলে গেছে বহুদিন, কিন্তু শাশুড়ি? তাঁর দাপটের কাছে নিজের ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোকেও কি বিসর্জন দেয়নি মৃদুলা? কত অজস্র শৌখিন জিনিস আজীবন হাতছানি দিয়ে এসেছে, জোর করে চোখ বুজে থেকেছে সে। যেটুকু স্বাচ্ছন্দ্য চেয়েছে, সে তো সোমনাথের মেয়ে দুটোর জন্যই? সন্তানের জন্য মায়ের চাওয়াটা কি লোভ? বিয়ের পরেই শাশুড়ি বলেছিলেন, আমার ছেলেটা একটু গেঁতো, তাকে ঠেলে ঠেলে চালাতে হয়…। সোমনাথকে ধাক্কা মেরে মেরে, সাহস জুগিয়ে, মাথার ওপর একটা ছাদের ব্যবস্থা করেছে মৃদুলা, এও কি লোভ? মেয়েরা কষ্ট না পাক, সুখে থাক, এইটুকু প্রার্থনা বুকে বয়ে বেড়ানোও কি লোভ? সেদিন তাকে বেলুড়মঠ নিয়ে যাওয়ার সময়ে তুতুলের চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছিল, ওই আনন্দটুকু উপভোগ করার বাসনাও কি লোভ?

সোমনাথ তো সব জানে। সব। তবু সোমনাথ এই রকমটা ভাবে।

সোমনাথ বইতে মগ্ন। মৃদুলা ধীর পায়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। রেলিং ধরে দেখছে আকাশ। শরতের নীলে মেঘ জমছে। পাঁশুটে মেঘ।

লম্বা একটা শ্বাস পড়ল মৃদুলার। মানুষটা তাকে চিনলই না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *