০৫. ঠাকুমার কানের কাছে

পাঁচ

ঠাকুমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে দেয়া জিজ্ঞেস করল,—কী গো, কেমন আছ?

সুরমা শুয়ে আছেন সাবেকি খাটে। তাঁর শীর্ণ দেহকাণ্ডটি মিশে গেছে বিছানায়। এককালের টকটকে গৌরবর্ণ এখন ফ্যাটফেটে সাদা, হাড়ের ওপর চামড়াটুকুই সার। হাতের প্রতিটি শিরা উপশিরা অতি প্রকট, ডাক্তারির ছাত্ররা অনায়াসে ওই হাত নিয়ে পড়াশুনো করতে পারে। দীর্ঘকালীন পার্কিনসনস্‌ রোগের প্রভাবে পেশিগুলোও ক্রমশ অকেজো হয়ে এসেছে, ইদানীং ভাল করে চোখটাও খুলতে পারেন না সুরমা।

তবু নাতনির গলা পেয়ে বোজা চোখ ফাঁক হল সামান্য। এককালের রিনরিনে স্বর খসখসে। বললেন,—ভাল। তুই ভাল আছিস? নাতজামাই?

দেয়ার ভারী বিচিত্র লাগে। ঠাকুমাকে কখনও খারাপ আছি বলতে শুনল না। গত বছর শীতে শ্বাস ওঠার মতো অবস্থা হয়েছিল, অক্সিজেনও চলেছে বেশ কয়েক দিন। অত কষ্টের মধ্যেও এক উত্তর দিয়ে গেছে ঠাকুমা, ভাল আছি! এত যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি যে মানুষটা কোথ্‌থেকে পায়? দেয়া তো পেট ব্যথা হলেই চোখে অন্ধকার দেখে।

আর একটু ঝুঁকে দেয়া বলল, —সব্বাই ভাল।

—নাতজামাই আসে না কেন?

—আসবে। আমার সঙ্গে ওর ডিউটির টাইম ম্যাচ করছে না তো..একা একা আসতে লজ্জা পায়।

সুরমা দুদিকে মাথা নাড়লেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন, —তোদের বুঝি না বাপু। তোর এক সময়ে কাজ, তার এক সময়ে অফিস…তোদের বর বউ-এ দেখা হয় কখন?

জ্ঞান এখনও টনটনে! দেয়া হেসে ফেলল,—হয় কখনও সখনও।

—কী যে দিনকাল এল! সুরমা চোখ বন্ধ করেছেন,—সন্তুর বউ বলছিল তার বোন চাকরি করছে শিলিগুড়ি, তার বর চলে গেছে ভুবনেশ্বর…এভাবে সংসার হয়?

—খুব হয়। তোমাদের মতো গায়ে গায়ে লেপটে থাকাটাই কি সংসার? দেয়া হাসতে হাসতে বলল,—চাকরি বাকরি তো করতে না, ছিলে বরের ছায়ায়। আমরা ওভাবে থাকব কেন? আমরা কাজের সময়ে কাজ করি, ভালবাসার সময়ে ভালবাসি। আরে বাবা, ভবিষ্যতে সুখে থাকতে গেলে দুজনকেই তো টাকা জমাতে হবে, না কী?

গৌরী পাশে দাঁড়িয়ে। বলে উঠল,—ওদের যুগটা আলাদা মা। আপনি আমি বুঝব না।

সুরমা চুপ হয়ে গেলেন। বন্ধ চোখ পিটপিট করছেন।

দেয়া হাসি মাখা মুখে একটুক্ষণ হাত বোলাল সুরমার সাদা চুলে। নরম গলায় বলল, —তোমার জন্য কাঁচাগোল্লা এনেছি ঠাকুমা। খেয়ো।

সুরমার ঠোঁটে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল। শিশুর মতো এবার অনুযোগ বেজেছে গলায়,—এরা আমায় মিষ্টি দেয় না রে।।

গৌরী বলল,—ওমা সে কী! সকালেও তো আপনি সন্দেশ খেলেন!

—কই, দাওনি তো! সুরমার চোখ আবার একটু খুলেছে,—জানিস মিমি, এরা আমায় জোর করে মুরগি খাওয়ায়।

গৌরী গলা নামিয়ে বলল,—তোর ঠাকুমার মাথাটা একদম গেছে। সন্তু স্যুপের প্যাকেট এনেছিল, ওতে মুরগি কেন, কোনও আমিষেরই নামগন্ধ নেই। ওটা খাওয়ানোর পর থেকেই এক বুলি, মুরগি খাইয়ে দিল, মুরগি খাইয়ে দিল…!

—আর দিও না স্যুপ। খেতে যখন চাইছে না…

—দেব কী? শক্ত খাবার তো ভাল করে চিবোতেও পারছে না আজকাল। গলা গলা ভাত, তাই কত কষ্ট করে খাওয়াতে হয়। পরশু আম খাবে বলে বায়না জুড়েছিল, এই একটু বুঝি দিয়েছি কি দিইনি, তাও হজম করতে পারল না। বিছানায় হেগে মেখে একসা।

—হুম্‌, প্রবলেম। পলকের জন্য দেয়ার মুখে ছায়া। ঠাকুমার বেশ কয়েক বছর ধরেই এই হাল। উন্নতি তো নেইই, বরং খারাপ হচ্ছে দিন দিন। প্রায় না খেয়েও শুধু জীবনীশক্তির জোরে টিকে আছে ঠাকুমা!

ছোট্ট শ্বাস ফেলল দেয়া। ঠাকুমা চলে গেলে এ বাড়ির কত স্মৃতি যে মুছে যাবে! বড়ি, আচার, ঘুমোনোর আগে গল্প শুনতে শুনতে ঠাকুমার শরীরের ওম…। দেয়া স্কুল থেকে ফিরে হাত না ধুয়ে ফ্রিজ খুলে মিষ্টি খেয়েছে, হাঁই হাঁই করে তেড়ে এল মা, ঠাকুমার পিছনে লুকিয়ে পড়েছে দেয়া…। কী দারুণ পায়েস বানাত ঠাকুমা, গোটা এলাচের সুঘ্রাণ এখনও যেন নাকে লেগে আছে। সত্যিই কি হারিয়ে যাবে স্মৃতিগুলো? নাকি আরও বেশি জ্যান্ত হয়ে উঠবে? হারানো দুষ্প্রাপ্য রত্নের মতো আকুল করবে দেয়াকে? জানে না দেয়া।

পাশের ঘরে এসে দেয়া বলল,—এবার দিনের বেলার জন্যও একটা আয়া রেখে দাও মা। তোমারও তো বয়স হচ্ছে, এ ভাবে আর কদ্দিন টানবে?

গৌরী ঠোঁট ওলটাল,—তোর বাবাকে বলে দ্যাখ। দেখবি কেমন খ্যাকখ্যাক করে উঠবে।

—কেন?

—রিটায়ার করে গেছে না, এখন তো র্সবসময় দুঃখের কীর্তন। পয়সা কি আমার ঝলঝলাচ্ছে? এক্সট্রা দু হাজার টাকা আমি কোথ্‌থেকে পাব?

—দাদা আছে তো, দাদা দেবে।

—সেটি হবে না। সন্তু তো দেবে বলেছিল। তিনি রাজি নন। তাঁর মার সেবাযত্ন তাঁর পয়সাতেই হতে হবে, তিনি ছেলেরটা নেবেন না।

প্রণবেশের মানসম্মানজ্ঞান একটু বেশিই প্রখর। সময়ে সময়ে তা বাড়াবাড়ির পর্যায়েও পৌঁছে যায়। দেয়ার কাকা ঠাকুরপুকুরে বাড়ি করে উঠে গেল, মায়ের খরচখরচা বাবদ মাস মাস কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল প্রণবেশ। সাফ কথা, তুই মাকে তোর কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারবি? না পারিস তো ঠিক আছে, কিন্তু টাকাপয়সার কথা তুলবি না। প্রণবেশ মিত্তির ভাগের মায়ের বিজনেস করে না। অথচ নিখিলেশ খোলা মনেই কথাটা বলেছিল, ভেবেছিল এটা তার কর্তব্য। সুরমাকে বছর তিনেক আগে প্রথম বার ভর্তি করা হয়েছিল নার্সিংহোমে, দিন পনেরো থাকতেও হয়েছিল সেখানে, খরচও তখন কম হয়নি। তখনও ভায়ের কাছ থেকে একটি পয়সা নিতে রাজি হয়নি প্রণবেশ। দাদার এই একগুঁয়েমি নিয়ে নিখিলেশের মনে চাপা দুঃখ আছে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন ছেলের রোজগারও প্রণবেশের কাছে অস্পৃশ্য।

দেয়া বলল,—তা বলে তোমাকেই ওই রোগী টেনে যেতে হবে?

—আমার কপাল। তাও তো মহুয়া যতটা পারে হাতে হাতে করে। তারও তো ছেলে সামলানো আছে। ওই দামাল ছেলে…। তবে সেও যে করবে তার উপায় আছে? পরশু আমার সঙ্গে সঙ্গে তোর ঠাকুমার পায়খানা পরিষ্কার করছিল। অমনি তোর বাবার ফোঁস। ও ছেলেমানুষ, ওকে দিয়ে ওসব করাচ্ছ কেন? বোঝ। এক বাচ্চার মা হয়ে গেল, সে ছেলেমানুষ! আসলে তোর বাবা চায় আমিই শুধু করে যাই। অন্তত তার মার সেবাটা। মুখ বুজে করে গেছি তো চিরকাল।

—করেছ কেন? প্রতিবাদ করোনি কেন? দেয়া চোখ নাচাল,—বাবা ফিরবে কখন?

—অনেকক্ষণ তো ব্যাঙ্কে গেছে। এল বলে।…সারাক্ষণ তো শুধু ব্যাঙ্ক আর পাশবই করছে এখন। হিসেব নিকেশ চলছে। বলতে বলতে ঘড়ির দিকে চোখ পড়েছে গৌরীর, —ও মা, একটা বেজে গেল? খেতে বসবি তো? মহুয়াকে ডাকি?

—তাড়া কীসের? বাবা আসুক। লক্ষ্মীদি যা ঠেসে পরোটা খাইয়েছে সকালে।

—লক্ষ্মীর জামাইটা আবার এসেছিল? টাকা নিয়ে গেছে?

—ও, শিওর।…অমন একটা টাকার গাছ…

—রিকশা কিনেছে সে?

—কে জানে! বলেছে তো কিনেছে। শাশুড়িকে নাকি একদিন রিকশা করে সোনারপুর সফর করাবে! লক্ষ্মীদিও সেই আনন্দে ডগমগ।

কথার মাঝেই থুপথুপ পায়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকেছে ফুটকু। দেয়া এসে দেখেছিল সে ঘুমন্ত, কিন্তু এখন সে প্রবল ভাবে জাগ্রত। হাতে একটা চশমার বাক্স, ঢুকেই ঠাকুমার দিকে ছোড়ার তাক করছে।

দেয়া খপ করে কেড়ে নিল,—এই দুষ্টু, এটা দাদুর না?

গৌরী হাউমাউ করে উঠল,—ওমা, তাই তো। বলতে বলতে খুলে দেখল সত্যিই চশমা আছে ভেতরে। চোখ ঘুরিয়ে বলল,—সর্বনাশ, এখন কী হবে? ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে তো তুলকালাম করবে।

এক ঝটকায় ফুটকুকে কোলে তুলে নিল দেয়া। রোগা পটকা ছেলে, গায়ে গত্তি লাগছে না কিছুতেই। যেটুকু খায়, তার থেকে অনেক বেশি ক্যালোরি খরচ করে ছুটোছুটিতে। দেড় বছর বয়সের তুলনায় রীতিমতো হালকা। পালকের মতো।

দেয়া ফুটকুর গাল টিপল,—তুই চশমাটা পেলি কোথ্‌থেকে?

—থিলো তো।…আমাল কাতে।

—হুমম্‌। আসুক দাদু, পিট্টি দেবে।

কোলে থাকা ফুটকুর ধাতে নেই, ছটফট করছে। নামিয়ে দিতেই বিদ্যুৎবেগে পালিয়ে গেল।

গৌরীও ছুটেছে পিছন পিছন, —ওফ্‌, পারি না। নির্ঘাৎ এখন রান্নাঘরে ঢুকে মাকে জ্বালাবে।

রান্নার লোক আছে এ বাড়িতে, তবু মহুয়া এখন পাকশালায়। ননদের জন্য আলাদা করে কী সব বানাচ্ছে। মাসে এক দুবার এ বাড়ি আসে দেয়া, তবু সে এলেই একটু যেন সাড়া পড়ে যায়। গৌরী সেদিন নিজের হাতে এক দুটো পদ রাঁধবেই। আজ মহুয়া করছে।

নিজেদের ঘরে গিয়ে এক মনে খাট থেকে মেঝেয় লাফানো প্র্যাকটিস করছে ফুটকু। ঠাকুমার সতর্ক প্রহরায়। বউদির বিছানায় কাঁধের দোপাট্টাটা রেখে দেয়া রান্নাঘরে এল,—কী ম্যাডাম, আজ স্পেশাল মেন্যু কী?

মহুয়া দেয়ারই সমবয়সি। গোলগাল মিষ্টি মিষ্টি চেহারা। পরনে সালোয়ার কামিজ, তার ওপরে এখন কিচেন-অ্যাপ্রন বেঁধে নিয়েছে।

ব্যস্ত মহুয়ার ঘর্মাক্ত মুখে হাসির প্রলেপ,—একটা নতুন ধরনের আইটেম করছি। আজই প্রথম। খেয়ে বলিস তো কেমন লাগে!

দেয়া চোখ টিপল,—টিভির রেসিপি?

—ঠিক ধরেছিস। কাল দুপুরে দেখছিলাম। পুরো ফাঁকিবাজির রান্না। চিকেনের। কোনও মশলা টশলা লাগে না।

—আমাকেও শিখিয়ে দিস তো। বাড়িতে ট্রাই করব।

—তুই? বরং লক্ষ্মীদিকে ফোনে বলে দিলে কাজে দেবে।

—আমাকেও কিচেনে ঢুকতে হয় ম্যাডাম। জানিসই তো, ছুটির দিনে লক্ষ্মীদির রান্না সৌম্যর মুখে রোচে না।

—তুই প্রতি রোববারই রাঁধিস? ঢপ মারিস না।

—হ্যাঁ রে। রেঁধে টেধে তবে ডিউটিতে যাই।

—বলছিস যখন মানতে হবে। আমি জানতাম তুই শুধু সৌম্যর ব্রেকফাস্টটা তৈরি করিস।

—শুধু ব্রেকফাস্ট নয়, সকালে ওই সময়ে আমায় বাঁদর নাচ নাচতে হয়। মায়ের লালটু ছেলে কিচ্ছুটি পারে না। বেরোনোর আগে খালি টেনশান আর চিল্লামিল্লি। আমার গেঞ্জি কোথায় গেল পাচ্ছিনা! রুমাল কোথায় রেখেছ!…দুধে চিনিটা পর্যন্ত মিশিয়ে দিতে হয়।

—তোর দাদাও তো তাই।

—বদনাম দিস না। রাত্তিরে ফুটকুর ন্যাপি পালটে দেয় দাদা। আমি জানি।

—সে সৌম্যও করবে। দায়ে পড়ুক, ট্যাঁ ট্যাঁ আসুক। মহুয়া ননস্টিক প্যানের ঢাকনা খুলে দেখে নিল একটু। আঁচটা কমিয়ে দিয়ে বলল, —তা হ্যাঁ রে, অনেকদিন তো উড়লি, এবার দাঁড়ে বোস। টোনাটুনির সংসারে একটা কিছু হোক।

—হবে হবে। জল্‌দবাজি কীসের?

—কদ্দিনের প্ল্যান তোদের? এর পরে কিন্তু বয়স হয়ে যাবে, প্রবলেমে পড়বি।

—দেখতেই পাবি।

রহস্যময় হাসি হেসে বড় বাটিতে রাখা মাছের চপ থেকে একখানা তুলে নিল দেয়া। খেতে খেতে বেরিয়ে এসেছে। আপনমনে হাসছে এখনও। বাড়ি গাড়ির মতো বাচ্চার ব্যাপারেও ডেটলাইন আছে সৌম্যর। চার বছর। দু বছর দশ মাস হয়েছে বিয়ের, আর ঠিক চোদ্দো মাস পর সৌম্য উঠে পড়ে লাগবে। তার আগেও নয়, তার পরেও না। হিসেব করা আছে, সৌম্যর যদি ষাট বছর বয়সে কর্মজীবন শেষ হয়, তখন বাচ্চার বয়স হবে পঁচিশ। ছেলে হোক, মেয়ে হোক, সে তখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে।

প্রণবেশ ফিরেছে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে কাগজপত্র মানিব্যাগ বার করে রাখছে আলমারিতে।

দেয়া পিছন থেকে বলল,—খুব চটিতং হয়ে ফিরেছ তো?

প্রণবেশ চমকে ফিরল,—ও, তুই এসে গেছিস!

—বহুক্ষণ।

—তুই জানলি কী করে ব্যাঙ্কে চটাচটি হয়েছে?

মায়ের ওয়াড্রোবের মাথা থেকে খাপসুদ্ধু চশমাটা হাতে নিয়ে নাড়াল দেয়া, —এটা ব্যাঙ্কে খুঁজে পাচ্ছিলে না তো?

—ধ্যাৎ, আমার তো সঙ্গে আর একটা থাকে। ওটা ঘরে পরি। রেগে গেছিলাম অন্য কারণে। আমার ইউনিট ট্রাস্টের চেকটা আমি জমা করেছিলাম গত বেস্পতিবার, ক্রেডিট হয়েছে ছ দিন পর। ধরেছি গিয়ে ম্যানেজারকে। সে আবার বলে, দুটো একটা দিনে কী আসে যায়! বসিয়ে কম্পিউটারে হিসেব কষিয়ে দেখিয়ে দিলাম ক টাকা সুদ লস হল!

দেয়া মুখ টিপল,—কত লস?

—বেশি নয়…। প্রণবেশ যেন সামান্য অপ্রতিভ, —এক টাকা চল্লিশ মতন। টাকাটা বড় কথা নয়, এটা একটা প্রিন্সিপলের কথা। আদৌ হবে কেন?

—বটেই তো। বটেই তো।

—ঠাট্টা করছিস? রিটায়ার কর, বুঝবি প্রত্যেকটি পয়সার কত দাম।

দেয়া খিলখিল হেসে উঠল,—তুমি যা পেনশন পাচ্ছ, তার তুলনায় ওই এক টাকা দু টাকার কি সত্যিই কোনও মূল্য আছে বাবা?

প্রণবেশ উত্তর দিল না। পাঞ্জাবি ছাড়ছে। মেয়ের সঙ্গে খুব একটা কথার লড়াই চালাতে পারে না প্রণবেশ, রাগতেও পারে না। দেয়াই প্রণবেশের দুর্বলতম জায়গা।

হাসি থামিয়ে দেয়া বলল, —প্রেশার চেক করিয়েছিলে?

—এ সপ্তাহে হয়ে ওঠেনি।…তোকে কে লাগাল? মা?

—কেন, আমি জিজ্ঞেস করতে পারি না? কদিন আগেই তো নীচেরটা একশো হয়ে গিয়েছিল…

—তোর মার সঙ্গে থাকলে ওটা দেড়শো হবে।

—মার পেছনে কেন এমন পড়ে থাকো বলো তো?

—আমি পড়িনি। তোমার মা পড়েছে। চাকরি থেকে বাতিল লোক তো, আমি এখন তার দু চক্ষের বিষ। আমার কোনও কথাই তার সহ্য হয় না।

—অসহ্য হওয়ার মতো কথা বলো কেন?

প্রণবেশ চোখ কুঁচকে একটুক্ষণ দেখল মেয়েকে। বুঝি আন্দাজ করতে চাইল কী কী অভিযোগ হেনেছে গৌরী। তারপর ভার গলায় বলল,—তুই তো জানিস মিমি, আমি কিছু প্রিন্সিপল মেনে চলি। ভাল মন্দ বুঝি না, কিন্তু ওগুলো আমার রক্তে মিশে আছে। আমি রিটায়ার করেছি বলে সেগুলো তো বদলাতে পারব না।

—কিন্তু মারও তো বয়স হচ্ছে। মার দিকটাও ভাবো।

—সংসারে তার এখন তো একটিই কাজ। আর সব কাজ থেকে তো সে ছুটি পেয়ে গেছে।

—সেটাই কি কম? একজন বেডরিডন রুগির অবিরাম সেবা করে যাওয়া কি সোজা কাজ?

—দ্যাখ মিমি, আমি তো বললাম কোনও ব্যাপারে আমি কোনও দিন ডিপেন্ডেন্ট হতে চাই না। এ ব্যাপারে আমার চোখে ভাইও যা, ছেলেও তাই। তোমার মা না পারে বলে দিক, আমার মার সেবা আমি করব।

—উফ্‌, তেতে যাচ্ছ কেন? না, তোমার শিওর আবার প্রেশার বেড়েছে।

প্রণবেশ গোঁজ।

দেয়া স্থির চোখে দেখছিল বাবাকে। মাস চারেক হল রিটায়ার করেছে বাবা, ইদানীং সামান্য প্রেশারের গণ্ডগোল ছাড়া শরীরস্বাস্থ্য এখনও অটুট। রেলের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের দিন মোটামুটি সব প্রাপ্যই পেয়ে গিয়েছে, তার পরিমাণও নেহাত কম নয়। তবু বাবার মনে হঠাৎ বদ্ধমূল ধারণা ঢুকে গেছে, যে কোনও মুহূর্তে বাবা বুঝি পরমুখাপেক্ষী হয়ে পড়বে। তাই বুঝি এত পাশবই ঘাঁটা, সুদের হিসেবপত্র…। আত্মনির্ভরতারও কী প্রবল অহংকার থাকে!

গৌরী খেতে ডাকছে। প্রণবেশ দেয়া এসে বসল ডাইনিং টেবিলে। বছর কুড়ি আগে এ বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিল প্রণবেশ। ছিমছাম ছড়ানো ছেটানো একতলায় অনেকটাই পরিসর। চারখানি ঘর ছাড়া খাওয়ার জায়গাটিও বড়সড়। একটাই যা ত্রুটি, এ বাড়িতে আলো বড্ড কম।

দেয়া মহুয়াকে বলল,—তুইও বসে যা না।

অন্যদিন গৌরীই পরিবেশন করে, মহুয়াও বসে যায় সঙ্গে। আজ ফুটকু পুরোদস্তুর ফর্মে, মাত্র এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে সে অসীম শক্তি সঞ্চয় করেছে। গৌরী এখন তাকে সামলাতেই হিমশিম।

মহুয়া বলল,—তুই খেয়ে উঠে ফুটকুকে ধরিস, আমি আর মা বসে যাব।…বাবা, ভাতটা ভাঙুন, ডাল দিই।

গৌরী নাতিকে এক টুকরো আম খাওয়ানোর জন্য সাধ্যসাধনা করছিল। স্বর নিক্ষেপ করল,—বেশি করে দাও। আজ তো ওর মনের মতো ডাল হয়েছে। মাছের মাথা দিয়ে…

কটমট তাকাল প্রণবেশ। গুমগুমে গলায় মহুয়াকে বলল,—না। এক হাতা। বলতে বলতে চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়েছে দেয়ার দিকে,—দেখলি তো, কী ভাষায় কথা বলে!

—কথা কানে নাও কেন? পাত্তা না দিলেই হয়।

—কতক্ষণ চুপ থাকব? সারাক্ষণই তো ঠুকছে। এই নাও চা, গুনতি করো কবার হল! রোজ চাকলা খাও কেন, একদিন আঁটি পছন্দ হয় না!

—ওফ্‌ বাবা, তোমার এই সারাদিন বাড়ি থাকাটাই গণ্ডগোল করছে। —তো কী করব? সারাদিন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকব?

—তা কেন। ঘোরো ফেরো…তুমি তো পুরনো জিনিস দেখতে ভালবাসো, কোনও দিন মিউজিয়াম গেলে, কোনও দিন ভিক্টোরিয়া গেলে…

—চিড়িয়াখানাটা বাকি থাকে কেন? আবার গৌরীর উড়ো মন্তব্য,—বাঘ সিংহরা ভয়ে পালিয়ে যাবে বলে?

—আহ্‌ মা, থামো। তুমিও তো কম নয়! গৌরীকে মৃদু ধমক দিল দেয়া। আবার কোমল গলায় প্রণবেশকে বলল,—কিংবা পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গে গল্প-গুজব করো।

—ও কাজটা তোর মার একচেটিয়া। আমার পোষাবে না। পরনিন্দা পরচর্চা…

মহুয়া ফিকফিক হাসছে। বলল,—বাবা, এবার কিন্তু আপনি ঠুকছেন।

—অ্যাই, তুই আর পলতেয় কাঠি দিস না। দেয়া প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল,—বাবা, আজ মহুয়া একটা নতুন রান্না করেছে, খেয়ে দ্যাখো।

শ্বেতপতাকা উড়েছে। প্রণবেশ খাচ্ছে অভিনিবিষ্ট হয়ে। দেয়া আর মহুয়া কথা বলছিল টুকটাক। মহুয়ার মুরগি রান্নার প্রশংসা করল দেয়া, দেয়ার চিকনকাজ সালোয়ার কামিজটার দাম জিজ্ঞেস করল মহুয়া।

কথায় কথায় মহুয়া বলল, —জানিস তো, সোমবার আমি ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। বিভূতি স্যারের সঙ্গে দেখা হল। বিভূতি রায়, আমাদের ইন্টারন্যাশনাল রিলেসশানস পড়াতেন। বলছিলেন ওঁর আন্ডারে কাজ শুরু করতে।

দেয়া হাত চাটতে চাটতে বলল,—ভালই তো, শুরু করে দে। ফুটকু তো এখন সাব্যস্ত হয়ে গেছে।

প্রণবেশ বলল,—আমিও তো বলছিলাম মহুয়াকে। বসে থেকো না, বসে থেকো না…

—কিন্তু যা চঞ্চল ছেলে, মার ওপর সারাদিন ফেলে দিয়ে কি যাওয়া যায়? এমনিই তো ঠাকুমাকে নিয়ে…

—আমিও তো আছি এখন। ফুটকুকে আমি সামলে রাখব।

—তোমার মুরোদ জানা আছে। ছেলেটাকে পাঁচ মিনিট দেখতে হলেই অধৈর্য হয়ে যাও।

মহুয়া মলিন হল সামান্য। দেয়াও সূক্ষ্মভাবে অনুমান করল মা বোধহয় এখন মহুয়ার রিসার্চ শুরু করা চাইছে না। শাশুড়ির চিরন্তন কমপ্লেক্স! তবে হ্যাঁ, এও সত্যি ফুটকুকে সামলাবে কে? মা তো আর দশভুজা নয়। মহুয়াটা লেখাপড়ায় বেশ ভাল ছিল, কান ঘেঁষে ফার্স্ট ক্লাস মিস করেছিল এম এ-তে। দাদার সঙ্গে মহুয়ার পরিচয় যাদবপুর ক্যাম্পাসেই। দাদা ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে একটা চাকরিতে ঢুকল, সেটা ছেড়ে আর একটায়, আর মহুয়া গ্র্যাজুয়েট হল, এম এ করল, এম ফিল করল, তারপর দু বাড়ির মত নিয়েই বিয়ে। তখন ঠাকুমার বেশ বাড়াবাড়ি, বিয়ের পর পরই পিএইচ ডি করার কথা তুলতে পারেনি মহুয়া। যখন ধাতস্থ হল তখন ফুটকু পেটে এসে গেছে।

মেয়েদের কত কিছুই যে ছাড়তে হয়! একদিক দিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে না থেকে দেয়া দিব্যি আছে। কিন্তু এর পর? বাচ্চা হলে কি দেয়া মুশকিলে পড়বে? আহা, লক্ষ্মীদি আছে কী করতে!

ঝট করে বুদ্ধিটা মাথায় খেলে গেল দেয়ার। বলল,—একটা কাজ করা যায় না মা? দাদা যদি একটা রাতদিনের লোক রেখে দেয়? বাচ্চা মেয়ে…ফুটকুর সঙ্গীও হবে, পাহারাদারও হবে।

—সে সন্তুর ইচ্ছে। সন্তু যা ভাল বুঝবে।

কথাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে মা ঠাকুমার ঘরে চলে গেল। দেয়া হাসল মনে মনে। কায়দা করে ছেলের কোর্টে বল ঠেলে দিল মা! কূটনৈতিক মারপ্যাঁচ মা বেশ জানে। কিংবা হয়তো ফিলজফি অনার্স নিয়ে বি.এ পাশ করে জীবনভর সংসার ঠেলতে হল বলে মার মনে কোনও গোপন বেদনা রয়ে গেছে। বউকে খাঁচায় আটকে দুঃখটা উশুল করতে চায়। নাহ্, মাকে নিয়ে একদিন বসতে হবে, আচ্ছা করে মগজধোলাই করতে হবে গৌরীদেবীর।

সত্যি, শাশুড়ি বউ-এর সম্পর্কটা যে কী আজব! এই সেদিন খুড়তুতো ননদ দেয়াকে ফোন করেছিল, বলছিল সৌম্যর মা নাকি ভাইঝি বোনঝিদের ডেকে ডেকে গয়না বিলিয়ে দিচ্ছে। এই দানযজ্ঞ নিশ্চয়ই সৌম্যর ওপর রাগ করে নয়, সৌম্য তো আর চুড়ি, নেকলেস পরবে না! কী আতঙ্ক, কী আতঙ্ক, যদি তার মৃত্যুর পর গয়না দেয়ার কবজায় চলে যায়! অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব! যাক গে যাক, দেয়ার অত ফোকটে গয়না পাওয়ার লোভ নেই।

বাপ মেয়ের খাওয়া শেষ। প্রণবেশ ফুটকুকে নিয়ে ঘরে গেল। সম্ভবত শিশু রক্ষণাবেক্ষণে তার দক্ষতা প্রমাণ করতে। গৌরী আর মহুয়া খেতে বসেছে, দেয়া এখন পরিবেশনের দায়িত্বে।

মাছের মুড়ো চুষতে চুষতে গৌরী বলল,—মহুয়া, তুমি মিমিকে বলেছ, মিমির সেই লেখাটা নিয়ে তোমার দিদি কী বলেছে?

মহুয়া সত্যিই ভাল মেয়ে, ক্ষণপূর্বের অপ্রিয় প্রসঙ্গটা ভুলে গেছে। ভাত মাখতে মাখতে বলল,—হ্যাঁ রে। মানুদি আর রঙ্গনদা রোব্বার এসেছিল, খুব প্রশংসা করছিল তোর লেখাটার।

দেয়ার লেখাটা সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছে। অফিসে, বন্ধুবান্ধবমহলে, আত্মীয়স্বজনের কাছে। সৌম্যর বাবাও একদিন এসে দেয়ার পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। এমনকী সৌম্যও পড়ে অভিনন্দন জানিয়েছে দেয়াকে। কটা দিন দেয়াও একটা সুখোচ্ছাসের ঘোরে ছিল। কিন্তু সোমবার রাতে ঋতমের ফোন পেয়ে ছবিটা একটু বদলে গেছে। একটা সরু কাঁটা যেন খচখচ করে বুকে। এ বাড়ি আসার পথেও মনটা সামান্য ভার হয়ে ছিল দেয়ার।

প্রসঙ্গটা উঠে পড়ায় দেয়া খুশি হয়েও ঠিক খুশি হতে পারল না। ঈষৎ ম্রিয়মাণ গলায় বলল,—সব লোকই তো ভাল বলছে, কিন্তু এদিকে একটা সমস্যা হয়ে গেছে রে।

—সমস্যা?

—হ্যাঁ। মেয়েটা আর মেয়েটার মা খুব অড সিচুয়েশানে পড়ে গেছে। নামটা তো চেপে গেছিলাম, কিন্তু জানাজানিটা হয়েই গেল।

গৌরী জিজ্ঞেস করল, —কী করে?

—ওই পুলিশ। পুলিশ আবার হল্লাগুল্লা পাকিয়েছে। একদিন নাকি মেয়েটার মাকে কে একটা উলটোপালটা থ্রেটনিংও করেছে।

—সেকী?

—সাংঘাতিক ঘাবড়ানোর মতো কিছু নয়। আমি খবরটা শুনেই পরশু পুলিশকে মিট করেছি। ওসিকে বললাম, মেয়েটাকে এভাবে এক্সপোজ করলেন কেন?…বার বার ডাকছিল, জেরা করছিল, কোনও মানে হয়?

—ওসি কী বলল?

—সে তো মোটামুটি রিজনেবল কথাই বলল।…দেখুন ম্যাডাম, আপনারা তো লিখে দিয়েই খালাস, আমাদের তো ওপর থেকে বাঁশ খেতে হয়। ওপর থেকে কড়া অর্ডার এসেছে ভাল করে এনকোয়্যারি করো! আমাদের গাফিলতিতেই নাকি ডিপার্টমেন্টের বদনাম হচ্ছে। অথচ ভেবে দেখুন, আমাদের গলতিটা কোথায়? মেয়ে ফিরে এসেছে, জানায়নি। কী হয়েছিল, আমরা টোটাল ডার্কে। আমরা কি হাওয়ায় কালপ্রিট ধরব?

—ঠিকই তো। এ তো উচিত কথাই। মহুয়া মাথা নাড়ল।

—আমি আর সেভাবে কিছু বলতে পারলাম না। অবশ্য ওই থ্রেটনিং-এর ব্যাপারটা নিয়ে…ঋতম যদিও আমায় বলতে বারণ করেছিল…আমি স্ট্রেট পুলিশকে সব বলে দিয়েছি।

—সর্বনাশ! গৌরী আঁতকে উঠেছে,—এতে আবার তোর কোনও বিপদ হবে না তো?

—ধুর, আমার কীসের বিপদ! আমরা নিউজপেপার অফিসের লোক মা, আমাদের কেউ টাচ করার সাহস পাবে না। যমও আমাদের ডরায়।

—তুই অফিসে সব জানিয়েছিস তো?

—অফকোর্স। রণেনদা তো বলছিলেন, ভয় যখন দেখিয়েছে, কালপ্রিট ধারে কাছেই আছে। কিংবা তার গ্যাংটা। পুলিশ যদি বি-ক্লাসি না করে ব্যাটা জালে পড়বেই।

মহুয়া চিন্তিত মুখে বলল,—কিন্তু মেয়েটার এখন কী গতি হবে?

—সে ব্যবস্থাও হবে। আমাদের শনিবারের পাতা যে করে… অনসূয়াদি…আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। অনসূয়াদির কাছে বেশ কটা হোমের ঠিকানা আছে, আমি নেক্সট উইকেই সব যোগাযোগ করছি। ইচ্ছে আছে মেয়েটার সঙ্গে গিয়েও একবার দেখা করব। দেখি, কাল পরশু কবে পারি!

—তোর আবার কী দরকার ওখানে যাওয়ার? গৌরী খাওয়া থামিয়েছে, —না না, তোর আর ওই বস্তি ফস্তিতে যাওয়ার দরকার নেই।

—এ কী বলছ মা? আমি লিখেছি বলে মেয়েটা বিপদে পড়ে গেল…তা ছাড়া আমি মেয়েটাকে কথা দিয়েছিলাম…

—তুমি তো পুলিশে জানিয়েছ, তারাই যা করার করুক।

—তা হয় না মা। আমারও একটা মরাল রেসপনসিবিলিটি আছে।

—কীসের নৈতিক দায়িত্ব? তুইই তো বলেছিলি মেয়েটার স্বভাবচরিত্র ভাল নয়, এর তার সঙ্গে প্রেম করে বেড়াত! লোকটার সঙ্গেও তো ও স্বেচ্ছায় পালিয়েছিল!

—যাহ্‌, ওভাবে বোলোআ না। আফটার অল মেয়েটা ছেলেমানুষ, ভুল করে একটা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিল…

—ও সব মেয়ে ফাঁদে পড়ার জন্যই থাকে। ও মেয়ে আর ভাল হতে চাইলেও ভাল হতে পারবে না।

—না মা। মেয়েটার সঙ্গে তো আমি কথা বলে দেখেছি, মুম্বইবাসটা ওর শক ট্রিটমেন্ট হয়েছে, ও বদলে গেছে।

—তবু মিমি আমি বলব, তোমার আর মাতামাতি না করাই শ্রেয়। বস্তিতে কত রকমের লোক আছে…তুমি ওদের নিয়ে লিখেছ, ওদের তোমার ওপর আক্রোশ থাকতে পারে। ওই মেয়েটার মা তোমায় পেলে পুজো করবে ভেবেছ?

একেবারেই যুক্তিহীন কথাবার্তা। ফিলজফি পড়লেও মার কথায় কোনও লজিক নেই। তবে দেয়া আর তর্ক বাড়াল না। মহুয়ার বিছানায় এসে গড়াল একটু। মহুয়ার সঙ্গে এলোমেলো আড্ডাও মারল খানিকক্ষণ, ফুটকুকে উস্তম খুস্তম আদর করল। ঘুম পাড়াল।

দেয়া নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল, উঠল প্রায় বিকেল পার করে। বেশিক্ষণ আর রইল না, চা খেয়ে, সুরমার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে পড়েছে। সন্ধেবেলা সৌম্য আজ তাড়াতাড়ি ফিরলেও ফিরতে পারে। যদি ফেরে, দুজনে রাত্রে বাইরে চাইনিজ খেতে যাবে। গুরুসদয় রোডে দারুণ একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট খুলেছে, একবার ওখানকার খাবার পরখ করা দরকার।

গোপালনগরের মোড়ে এ সময়ে অনেক ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে, আজ একটাও নেই। ছুটির দিনে গুঁতোগুঁতি করে আর বাসে উঠতে ইচ্ছে করছে না, দেয়া হাঁটা শুরু করল। হাজরা অভিমুখে। ওখানে নিশ্চয়ই ট্যাক্সি মিলবে।

আঁধার নামছে। আকাশ থেকে মুছে যাচ্ছে রং। একটুও বাতাস নেই, গুমোট ভাব বেড়েছে খুব। টের পাওয়া যায় বর্ষা আর বেশি দূরে নেই।

আদিগঙ্গার ব্রিজ পেরিয়ে হাঁটার গতি আপনাআপনি শ্লথ হল দেয়ার। রংচং মেখে বেরিয়ে পড়েছে নিষিদ্ধপল্লির মেয়েরা, ঘোরাফেরা করছে কালীঘাটের মুখটায়। কোনও দিন দেয়া তাকায় না ওদের দিকে, আজ কেন যেন দেখছিল। ক্ষয়াটে, ভাঙা ভাঙা মুখ, উৎকট সাজ, কোটরগত চোখ…! জ্বলছে চোখগুলো! রিরংসায় নয়, ক্ষুধায়! ওই মেয়েগুলোর মধ্যে কত শিউলি যে আছে!

সহসা কানে গরম সিসে ঢুকল যেন। একটা কংকালসার মেয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে উঠেছে,—কী দ্যাখো গো দিদি, খানকি দ্যাখো? খানকি দেখতে খুব মজা লাগে, অ্যাঁ?।

ছয়

এক তাড়া লুজশিটে পর পর সই করে যাচ্ছিল শ্রাবণী। বি এড পরীক্ষা চলছে, বড্ড বেশি কাগজ নিচ্ছে পরীক্ষার্থীরা, দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। প্রথম দফায় খান পঞ্চাশেক সই করেছিল শ্রাবণী, প্রথম ঘণ্টার বেল বাজার আগেই সাফ। মাত্র তো এক বছরের কোর্স, এত কী পড়ায় যে কাঁড়ি কাঁড়ি লিখতে হয়?

কলেজ বিল্ডিং-এর দোতলায় টানা লম্বা ক্লাসরুম। তিন সারিতে খান তিরিশেক বেঞ্চ। প্রতি বেঞ্চিতে দুজন। পরীক্ষার্থীদের বেশির ভাগই খুব একটা কমবয়সি নয়, অনেককেই শ্রাবণী স্বচ্ছন্দে দাদা দিদি বলে ডাকতে পারে।

শ্রাবণী চোখ তুলল, আলগা দৃষ্টি বোলাল ঘরে। ডান দিকের দ্বিতীয় বেঞ্চে এক মহিলা ঝড়ের গতিতে কলম চালাচ্ছে। প্রায় শ্রাবণীর ছোট মাসির বয়সি, ভূগোল দিদিমণি ভূগোল দিদিমণি চেহারা। মধ্যবয়সে কী যন্ত্রণা! ছেলেমেয়ের বদলে এখন নিজেকে বসতে হচ্ছে পরীক্ষায়! নির্ঘাৎ ইনক্রিমেন্ট আটকে যাওয়ার কেস। বেচারা। কেন যে আর একটু কম বয়সে এসব পাটগুলো চুকিয়ে ফেলেনি!

এ ঘরে আজ তিনজন নজরদার। হীরেন আর শ্রাবণী ছাড়াও আর একটি ছেলে আছে। ছেলেটা শ্রাবণীর চেয়ে এক আধ বছরের বড় বৈ ছোট নয়। শ্রাবণী মাঝে মাঝেই ছেলেটাকে দেখছিল। চিনতে পারছে না। ভারী উৎসাহ নিয়ে গোটা ঘর টহল দিচ্ছে ছেলেটা, বয়সের সঙ্গে এক্কেবারেই বেমানান ভারিক্কিভাব ফুটিয়ে রেখেছে মুখে। নতুন জয়েন করেছে কি? সায়েন্স টায়েন্সে? শ্রাবণীর তো একে আগে চোখে পড়েনি?

হীরেন এই মুহুর্তে ঘরে নেই। অর্থনীতির অধ্যাপক, পরীক্ষার ডিউটিতে তাকে কদাচিৎ নির্দিষ্ট ঘরে পাওয়া যায়। সই করতে করতে শ্রাবণী মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে দরজার দিকে, হীরেনবাবুর দেখা নেই। কোন ঘরে গিয়ে কার সঙ্গে কুটুর কুটুর চালাচ্ছে কে জানে!

ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। কয়েকটা সই করা লুজশিট তুলে নিয়েছে হাতে। শ্রাবণীর চোখে চোখ পড়তেই হাসল এই প্রথম। ঈষৎ আড়ষ্ট হাসি।

শ্রাবণী ভদ্রতা করে বলল,—এবার একটু বসুন।

—না, ঠিক আছি। ছেলেটির চোখ ঘুরছে হলে। একদম পিছনের কোণে মৃদু গুঞ্জন, সেদিকে দৃষ্টি আটকে রইল একটুক্ষণ। আবার ফিরেছে চোখ। লাজুক মুখে জিজ্ঞেস করল,—আপনি তো বাংলার ম্যাডাম, তাই না?

—হ্যাঁ।…আপনি কবে জয়েন করেছেন?

—এই মে মাসে।

—সায়েন্স?

—কেমিস্ট্রি। পার্ট টাইম।

আরও একজন আংশিক সময়ের অধ্যাপক ঢুকল তবে? শ্রাবণী মনে মনে গোনার চেষ্টা করল, কত জন তা হলে পার্ট টাইমার হল কলেজে? আটত্রিশ? চল্লিশ? নাকি আরও বেশি? সব মিলিয়ে ফুলটাইমার তারা মাত্র আঠাশজন। শ্রাবণী যখন স্লেট পরীক্ষা দিয়ে কলেজের চাকরিটা পেয়েছিল তখন কজন ছিল পার্ট টাইমার? বড় জোর আট কি নয়। মাত্র তিন বছরে ছবিটা এখন একেবারে অন্যরকম, ওরা এখন সংখ্যাতে প্রায় দেড়া। প্রায়শই ঢুকছে, ঝাঁকে ঝাঁকে। না নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের উপায়ই বা কী, গভর্নমেন্ট তো আর নতুন পোস্ট দিচ্ছে না। গত বছর হিস্ট্রির তড়িৎবাবু অবসর নিলেন, তার জায়গাতেই এখনও কেউ এল না। সরকারের লাভই লাভ, ফুল টাইমারের মাইনের টাকাটা বেঁচে যাচ্ছে। কতভাবে যে সাশ্রয় করছে সরকার। হুঁহ, রাস্তা গড়া, পুল বানানোর সময়ে চুরিতে চুরিতে হাতি গলে যায়, শুধু মাস্টার নিয়োগের বেলায় ছুঁচটি পর্যন্ত গলে না!

তিন পরীক্ষার্থীকে কাগজ দিয়ে এসে ছেলেটা ফের দাঁড়িয়েছে সামনে, —আমার নাম দ্বৈপায়ন। দ্বৈপায়ন মুখার্জি।

—আমি শ্রাবণী সেনগুপ্ত।

—জানি। আপনি এস এস।.…কাদের নাম এস এস ছিল বলুন তো?

—কাদের?

—হিটলারের পুলিশ। ইহুদিরা যাদের ভয়ে থরহরি কাঁপত।

দ্বৈপায়ন বেশ সপ্রতিভ তো! বেশির ভাগ পার্ট টাইমারই শ্রাবণীদের মতো পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে একটু সঙ্কুচিত থাকে। সম্ভবত কমপ্লেক্স। প্রায় একই যোগ্যতা নিয়ে শ্রাবণীরা দশ বিশ গুণ বেশি মাইনে পাচ্ছে, বুঝি বা সেই কারণে। শ্রাবণীদের বাংলাতেও দুটি মেয়ে পার্টটাইমার হয়ে জয়েন করেছে সম্প্রতি। কণিকা আর ধৃতি। শ্রাবণীরই সমবয়সি, কিন্তু এমনভাবে কথা বলে যেন শ্রাবণী তাদের দিদিমণি। দুই সখীতে ঘোরে একসঙ্গে, শ্রাবণীর সঙ্গে মেশেই না।

শ্রাবণী মৃদু হেসে বলল,—আমি হিটলারের সেপাই টেপাই নই। আমাকে ছেলেমেয়েরা ভয়ই পায় না।

—তার মানে আপনি পপুলার টিচার।

—কী জানি। মনে তো হয় না। পাসের ছেলেমেয়েরা তো খুব আমার ক্লাস কাটে।

—পাস ক্লাস সবাই কাটে। আপনি কাটেননি?…আমার তো মনেই পড়ে না কটা ফিজিক্সের ক্লাস করেছি।

দ্বৈপায়নের কথা বলার ভঙ্গিতে কোথায় যেন ঋতমের সঙ্গে খুব মিল। এতক্ষণে শ্রাবণী খুঁটিয়ে লক্ষ করল ছেলেটাকে। নেহাতই সাদামাটা চেহারা, তবে চোখের মণি দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। ঋতমেরই মতো। অবশ্য ঋতমের চোখে একটা আলাদা চৌম্বকশক্তি আছে, মানুষকে টেনে রাখে।

পরীক্ষার্থীরা এক মুহূর্ত তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। অহরহ কাগজের তৃষ্ণা। আবার ছুটে ছুটে কাগজ বিলোচ্ছে দ্বৈপায়ন, শ্রাবণীও আর চেয়ারে বসে থাকতে পারল না, লুজশিট হাতে ঘুরছে ঘরময়।

পাহারাদারির ফাঁকে ফাঁকে আলাপ জমে গেল। প্রথম ঘণ্টায় দ্বৈপায়ন চুপটি ছিল বটে, অপরিচয়ের আড় কেটে যেতে সে কথা বলছে বেশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বায়োডাটা জানতে বাকি রইল না শ্রাবণীর। দ্বৈপায়ন তার চেয়ে এক বছরের সিনিয়ার। ঋতমেরই মতো। এম এসসি করে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অজৈব রসায়ন নিয়ে গবেষণা করত, জানুয়ারিতে গবেষণাপত্র জমা করেছে, তারপর থেকে কাঠবেকার, বেহালার এই বিষ্ণুচরণ মজুমদার স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ে আংশিক সময়ের অধ্যাপনাই তার জীবনের প্রথম চাকরি। সরকার এদের মাইনে বেঁধে দিয়েছে দু হাজার, শ্রাবণীদের কলেজ ফান্ডের সঙ্গতি কম, হাজারের বেশি দিতে পারে না, দ্বৈপায়নের তা নিয়ে ক্ষোভ নেই তেমন, বরং অধ্যক্ষের সঙ্গে সামান্য যোগাযোগের সূত্রে কাজটা মিলে যাওয়ায় সে যথেষ্ট উদ্দীপিত। গবেষণা শেষ, এখন সে ঝাড়াহাতপা, এ বছর দ্বৈপায়ন স্লেট পরীক্ষায় বসবে।

দ্বৈপায়নের সঙ্গে টুকটাক আলাপচারিতার মাঝেই হীরেনের আবির্ভাব ঘটল। বর্ষীয়ান নাদুস নুদুস হীরেন ঢুকেই তাড়া লাগাল শ্রাবণীকে,—এই যাও যাও, অফিস থেকে ঘুরে এসো।

—কেন?

—ডি-এ-র এরিয়ার দিচ্ছে। তিন মাসের।

অর্থনীতির হীরেন তবে এতক্ষণ অর্থনৈতিক কারণে ব্যস্ত ছিল!

শ্রাবণী বেরোতে গিয়েও থমকাল,—এক্ষুনি যাব হীরেনদা? হলে কিন্তু খুব ছুটতে হচ্ছে।

—আরে যাও যাও, আমি তো আছি। ডান হাতের কাজ সবার আগে।…এই যে নতুন ছেলে, শোনো…। হাত নেড়ে দ্বৈপায়নকে ডাকল হীরেন,—দিদিমনি জরুরি কাজে যাচ্ছে, তুমি ততক্ষণ ভাল করে চরকি দাও।

শ্রাবণী মুখ টিপে হেসে বেরিয়ে গেল। হীরেনদা পার্টটাইমারদের একদম পাত্তা দেয় না,তবে তার সহজ বাগ্‌ভঙ্গির জন্য কেউ তার ওপর বেশি চটতেও পারে না। হীরেনদা এখন গ্যাঁট হয়ে বসে দ্বৈপায়নকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে, নিজে সইটা পর্যন্ত করবে না।

অফিস থেকে টাকা নিয়ে সোজা হলে ফিরল না শ্রাবণী, টয়লেট ঘুরে স্টাফরুমে এসে বসেছে একটু। পেট চুঁইচুঁই করছে, টিফিনটা খেয়ে নিচ্ছে চটাপট। শাশুড়ি আজ লুচি তরকারি দিয়েছে, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে লুচি, তবে খিদের মুখে তাই যেন অমৃত। আকাশ থেকে টুপ করে কিছু টাকা খসে পড়ল আজ। অবশ্য এরকম আসে মাঝে মাঝে। এই আলটপকা টাকা সংসারের খরচে লাগায় না শ্রাবণী। এটা ওটা কেনে কিছু, পছন্দ মতো। আগের বারে একটা দামি পারফিউম কিনেছিল। শাশুড়ি তার বেশ যত্নআত্তি করে, ইদানীং শাশুড়ির খুব পুজোআর্চায় মন, একটা ঠাকুরের সিংহাসন কিনে দিলে খুব খুশি হবে। কী রকম দাম পড়বে কাঠের জিনিসটার? টুসকির জন্য নেবে না কিছু। গত মাসে টুসকি জামা, গয়না, খেলনা প্রচুর পেয়েছে। অন্নপ্রাশনে। ছোট করে হলেও ভালই হয়েছে অনুষ্ঠানটা, টুসকির উপহার তো উপচোচ্ছে। ঋতমের জামাকাপড়ের হাল বেশ খারাপ, রোদুরে টো টো করে ঘোরে, কোনও শার্টই টেকে না বেশিদিন। ঋতম টিশার্ট পরতে ভালবাসে, খান দুয়েক সুন্দর দেখে টিশার্টও কেনা যায়। কারা যেন আবার দুটো নিলে একটা ফ্রি দিচ্ছে। ঋতমকে নীল রংটা ভারী মানায়…

ঋতমের কথা মনে হতেই শ্রাবণীর বুকে পলকা মেঘ। ঋতম কি আজকাল একটু বেশি দেয়া দেয়া করছে না? এই দেয়ার ফোন আসছে, এই দেয়াকে ফোন করছে…! মেয়েটা মহাপাজি। ঋতম যদি একগলা গঙ্গাজলে দাঁড়িয়েও বলে, দেয়া জানত না ঋতম তাকে ভালবাসত, শ্রাবণী বিশ্বাসই করবে না। মেয়েরা ছেলেদের চোখ দেখে সব ধরে ফেলতে পারে। ঋতমের দুর্বলতা আছে জেনেই না মহারানি মুনিষের মতো ঋতমকে খাটাচ্ছে। এখানে নিয়ে চল,…ওখানে যাবি চল…! কেন রে বাবা? লিখে নাম করবি তুই ঋতম তোর ল্যাংবোট হবে কেন? ঋতমটাই বা কী! পিসি মুখ করেছে বলে বাড়ি এসে ঘাড় ঝুলিয়ে বসে রইল, শ্রাবণী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিল, তাতে কী বিরক্তি, কিন্তু দেয়ারানির সঙ্গে কথা বলার সময়ে মিনমিন মিনমিন…কাজটা ভাল হয়নি রে দেয়া…তুই একটু দ্যাখ ব্যাপারটা…তুই বল আমরা কি দায়িত্ব অ্যাভয়েড করতে পারি… তোকে আমি অত করে বারণ করলাম দেয়া, তুই শুনলি না…! পিসির কাছে ঝাড় খাওয়ার ব্যাপারটা উচ্চারণ পর্যন্ত করল না!

দেয়ার মধ্যে কী পায় ঋতম? অমন উড়ু উড়ু চুলবুলে ছেলে নাচানো মেয়ে শ্রাবণী ঢের দেখেছে। বন্ধুর সঙ্গে ঢং করবে কিন্তু বিয়ে করবে সলিড। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, হ্যান্ডসাম, পাহাড়ের মতো মাইনে…!

ইউনিভার্সিটিতে দেয়ার সঙ্গে অ্যাফেয়ারটা কদ্দুর গড়িয়েছিল ঋতমের? ঋতম কি মিথ্যে বলেছিল? নাকি আধা সত্যি? কে জানে!

শ্রাবণী কি দেয়াকে হিংসে করে? কক্ষনও না। ঋতমের মূর্খামি দেখে কষ্ট হয় বলেই না…। ঋতমের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে কেউ ব্যবহার করবে, শ্রাবণী সেটা ভাল মনে হজম করবে কেন?

—তুমি বসে কেন? ডিউটি নেই?

প্রিন্সিপালের গলা শুনে চমকে তাকাল শ্রাবণী। ফাঁকা স্টাফরুমের দরজায় প্রিন্সিপাল।

শ্রাবণী ঝটিতি বন্ধ করেছে টিফিনবক্স। অপরাধী অপরাধী মুখে বলল,—খুব খিদে পেয়েছিল স্যার।

মধ্যবয়সি অধ্যক্ষের ভুরু জড়ো,—তিনটে ঘণ্টার তো ব্যাপার, শেষ হওয়ার পর খেলে পারতে। তোমরা বাচ্চা মেয়ে, তোমরাও যদি রুম ছেড়ে চলে আসো…

—যাচ্ছি স্যার। এক্ষুনি যাচ্ছি। ভাবলাম ঘরে হীরেনদা আছেন…

—অ। তাহলে তো তোমার রুম ছাড়াই উচিত হয়নি। বেরিয়ে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়েছে অধ্যক্ষ। মুচকি হেসে বলল,—অর্ডারটা তো এসে যাচ্ছে।

—কীসের অর্ডার স্যার?

—উইকে বিয়াল্লিশ ঘণ্টা কলেজে থাকতেই হবে। অফড়ে টফডে সব ক্যানসেলড। সামার কমে যাবে, পুজো কমে যাবে…

—ও। শ্রাবণী ঢোঁক গিলল,—কবে থেকে চালু হচ্ছে?

—নেক্সট সেশান। হাসিটা যেন চোরা জিঘাংসায় বদলে গেছে,—তিনটের মধ্যে কলেজ ফাঁকা হয়ে যাওয়া এবার বন্ধ হবে।

ঋতম-দেয়া শিকেয় উঠল, আকাশ ভেঙে পড়েছে শ্রাবণীর মাথায়। কাগজে অনেক লেখালিখি চলছে বটে, সত্যি সত্যি বেরোবে অর্ডারটা? ইস, টুসকিটার কী হবে? বুকের দুধ আর খায় না টুসকি, তবু ক্লাসে মনটা কেমন উচাটন থাকে সব সময়ে। মেয়েটা ঠিক ঠিক খেয়েছে তো? ঘুমিয়েছে? বিছানা থেকে পড়ে টড়ে গেল না তো? শাশুড়ি দিব্যি আগলাতে পারে, ঋতমও দুপুরে থাকে মাঝে মাঝে, তবু উৎকণ্ঠা একটা রয়েই যায়। নির্দেশনামা বেরিয়ে গেলে শ্রাবণীকে তো সকাল থেকে সন্ধে কলেজেই কাটাতে হবে! কী হবে? কী হবে?

বিশাল তিনতলা কলেজবাড়ির সাত আটটা ঘরে পরীক্ষা চলছে। নজরদারি করতে আসা অধ্যাপক অধ্যাপিকারা কেউ বা ঘরে, কেউ বা করিডোরে। দু একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে কেঠো হাসল শ্রাবণী, নিজের ঘরে ফিরেছে ভারমুখে।

হীরেন কাগজ পড়ছে। দ্বৈপায়ন টহল দিচ্ছে যথারীতি। হীরেনের পাশের চেয়ারে বসল শ্রাবণী। গোমড়া মুখে বলল,—লুজশিটে কুলিয়ে যাবে তো হীরেনদা?

হীরেন নির্বিকার,—নতুন ছেলেটাকে একটু টেনে টেনে দিতে বলো।

শ্রাবণীর রাগ হয়ে গেল একটু। ফস করে বলল,—এ কি বিয়েবাড়ির মাছ যে চেপে চেপে খাওয়াবে?

স্বরের ঝাঁঝটা টের পেয়ে হীরেন ঘুরে তাকিয়েছে। কন্যাসমা সহকর্মিণীর মুখমণ্ডল জরিপ করল। হেসে বলল,—ক্যাশ বন্ধ করে দিয়েছে নাকি?

—না।

—তাহলে? মহাপ্রভুর সঙ্গে দেখা হয়েছে বুঝি?

অধ্যক্ষের নাম নিমাই চক্রবর্তী। দেশ নবদ্বীপ। সেই সুবাদেই মহাপ্রভু।

শ্রাবণী ঢক করে ঘাড় নাড়ল,—হ্যাঁ।

—ঠুসেছে? আজ তো জনে জনে ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। বোধহয় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল, তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।

—যাহ, ঠাট্টা করবেন না। শ্রাবণী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,—এখন কী করব? আপনি তো জানেন বাড়িতে একটা ওইটুকু বাচ্চা…। ক্লাসে তো কখনও ফাঁকি দিই না হীরেনদা, যথাসাধ্য পড়াই তো।

—ওফ্‌, তোমাদের নিয়ে আর পারা যায় না। একটু কমনসেন্স অ্যাপ্লাই করবে না? সপ্তাহে বেয়াল্লিশ ঘণ্টা কলেজ হয়? কটা অব্দি মর্নিং কলেজ চলে?

—এগারোটা।

—তাহলে ডে কলেজকে কতক্ষণ অব্দি খোলা রাখতে হবে? ছটা। সম্ভব? মর্নিং-এর ক্লাস হয় সাড়ে চার ঘণ্টা, তারা সপ্তাহে বেয়াল্লিশ ঘণ্টা পাবে কোত্থেকে? মর্নিং কলেজের জন্য কি আলাদা আইন হবে?

—কিন্তু অফ-ডেটাও যদি উঠে যায়…

—ছাড়ো তো। রাধাকে নাচতে দাও, আগে থাকতে তেল পুড়িয়ো না। দু পয়সা মাইনে বাড়িয়ে সরকারের এখন খুব তেজ। এক সময়ে যে পেটে কিল মেরে থাকতাম, সে কথা তো কেউ বলে না!

হীরেনের গলা সামান্য উঠে গিয়েছিল, সামনের বেঞ্চের দেড়েল পরীক্ষার্থী হেঁকে উঠল, —আস্তে স্যার।

ঘাড় ট্যারা করে লোকটাকে দেখে নিয়ে হীরেন আবার কাগজে মন দিল। হীরেনদার আশ্বাসবাক্যে শ্রাবণীও স্বস্তি পেয়েছে যেন, লুজশিট হাতে উঠল। হাঁটছে। দ্বৈপায়নের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল। ঘরের শেষ প্রান্তে এসে থেমেছে। জানলায়। শহরের উপান্ত, এদিকে এখনও অনেক গাছপালা আছে। কলেজ পাঁচিলের ওপারে একটা বড়সড় পুকুর দেখা যায়। ঘন সবুজ জলে চরছে পানকৌড়ি। জলে মেঘের ছায়া। দেয়াকে কি এখনও ভালবাসে ঋতম? যেচে প্রেম নিবেদন করেছিল বলে কি শ্রাবণী ঋতমের চোখে কম মূল্যবান? যাকে পায় না মানুষ, তার ওপরই তো টান থাকে বেশি। সেই না পাওয়া জন যদি দিবারাত্র চোখের সামনে নেচে বেড়ায়…!

নাহ্‌, দেয়াকে হিংসে করবে না শ্রাবণী। অত ছোট সে হতে পারবে না। ঋতমের কাছ থেকে দুঃখ পাওয়াই যদি শ্রাবণীর নিয়তি হয়, তাই হবে।

দ্বৈপায়ন পরীক্ষার্থীদের সুতো দেওয়া শুরু করেছে। দ্বৈপায়নের হাত থেকে কিছু সুতো নিয়ে শ্রাবণীও বিলি করল খানিক। টেবিলে এসে দেখছে পড়ে থাকা লুজশিটের পরিমাণ।

হীরেন কাগজ ভাঁজ করল। প্রথম বেঞ্চের দেডেলটাকে টেরচা চোখে দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, —ভয়টা মেয়েদেরই বেশি দেখাচ্ছে। মহাপ্রভুর মেয়েদের ওপর একটু আক্রোশ আছে তো।

—হ্যাঁ, কথা শুনে তাই মনে হয়। কেন বলুন তো?

—মহিলা এমপ্লয়ি মানে ডবল ইনকাম গ্রুপ। এদিকে নিজের গিন্নি চাকরি করে না…

—বাহ্‌, এ কি আমাদের দোষ?

—তা নয়। তবে তোমরা তো একটু অ্যাডভান্টেজিয়াস অবস্থায় থাকোই। দিব্যি বর সংসার চালিয়ে দিচ্ছে, নিজেকেও মাদুর পাতা পার্টি বলে টিটকিরি খেতে হচ্ছে না…।

শ্রাবণীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, —কী করে বুঝলেন আমাদের সংসার চালাতে হয় না?

—না না, ঠিক তা বলিনি। আজকাল খরচখরচা বাড়ছে, দুজনের টাকাই কাজে লাগে। তবু এটা তো মানবে, মেইন কনট্রিবিউশানটা হাজব্যান্ডেরই। তোমাদের টাকাটায় বাড়তি কিছু হয়। …তোমাকেই ধরো। তোমার হাজব্যান্ড যেন কী করেন?

হীরেনকে মুখের ওপর জবাব দেওয়ার জন্য শ্রাবণী জোর গলাতেই সত্যিটা বলে দিতে পারত। কিন্তু কেন যেন জিভে এল না। ফুসফুসে শ্বাস টেনে বলল, —ও এখন একটা ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে আছে।

—সেল্‌স লাইনে না? …সেল্‌স ম্যানেজার?

—না, ঠিক ম্যানেজার র‍্যাংকে নয়…

—ঠিক আছে, অফিসার র‍্যাংকে। বলতে বলতে শ্রাবণীর মুখভাব দেখে প্রাজ্ঞ অর্থনীতির অধ্যাপক কিছু আন্দাজ করে নিয়েছে, —মে বি হি আর্নস লেস দ্যান ইউ। কথাটা ইংরেজিতে বলে যেন শ্রাবণীর কোনও লজ্জা ঢাকতে চাইল হীরেন,—কিন্তু এটা তো ঠিক, তিনি যা আর্ন করেন তাতে মোটামুটি একটা সংসার প্রতিপালন করা যায়?

শ্রাবণী ঢক করে ঘাড় নেড়ে দিল।

—আমি ঠিক এইটাই বলতে চাইছি। ওইটুকু অ্যাডভান্টেজ তোমাদের আছে। নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে হীরেনের মুখে তৃপ্তির হাসি, —তোমার মিস্টারের তো শুনেছি একটা অন্য গুণও আছে। লেখেন টেখেন।

শ্রাবণীর দম আটকে আসছিল। স্বাভাবিক হল। বলল,—হ্যাঁ, সাহিত্য করে।

—এই কিছুদিন আগে নবপ্রভাতে একটা লেখা বেরিয়েছিল না?

—গল্প। …আপনি পড়েছেন?

—আমার পড়া টড়া হয় না। ওটা তোমার বউদির নেশা। গোগ্রাসে গল্প উপন্যাস গেলে।

—ও। উনি পড়েছেন?

—আমরা তো নবপ্রভাত রাখি না। স্টাফরুমে সেদিন উর্মি বলছিল…

পুরোটা শোনা হল না, ওয়ার্নিং বেল বেজে উঠেছে। অর্থাৎ আর পনেরো মিনিট বাকি। সঙ্গে সঙ্গে কেমন বদলে গেল হীরেন। বিটকেল বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল, —প্রত্যেকে খাতা বেঁধে ফ্যালো। ফাইনাল বেল বাজলে এক সেকেন্ড সময় দেওয়া হবে না।

খাতা টাতা অফিসে বুঝিয়ে দিয়ে দ্বৈপায়নের সঙ্গে স্টাফরুমে আসছিল শ্রাবণী। দ্বৈপায়ন হাসতে হাসতে বলল, —ইনভিজিলেশানে এত খাটুনি জানা ছিল না।

—এখন খাটুন, পরে শুধু হীরেনদার মতন হুঙ্কার ছুড়বেন।

—সত্যি, গলা বটে একখানা। রেওয়াজ করা।

কথায় ছেদ পড়ল। সামনে এক স্মিতমুখ যুবক,—আমাকে চিনতে পারছেন?

শ্রাবণী মাথা নাড়ল, —না মানে…ঠিক…

—আমি ঋতমের বন্ধু। ব্যাচমেট। অনির্বাণ। …আপনার অবশ্য আমাকে মনে রাখার কথা নয়। সেই এক দিনই দেখেছিলেন। মানে আপনার বউভাতের দিন।

—ও আচ্ছা…

—আমি কিন্তু আপনাকে অনেকবার দেখেছি।…আপনি আমাদের পলসায়েন্সের ক্যাম্পাসে আসতেন না, ন্যাশানাল লাইব্রেরির গেটে ঋতমের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন।

দ্বৈপায়ন খানিক তফাতে সরে গেছে। তবু শ্রাবণী সামান্য লজ্জা পেল,—ও। তা আপনি এখানে?

—পরীক্ষা দিলাম। স্কুলের চাকরিতে যখন ঢুকেই পড়েছি, গাড্ডাটা পার করে রাখা ভাল।

—কোন স্কুলে আছেন?

—নাউল হাই স্কুল। বাগনানের কাছে।

—ও বাবা! সে তো অনেক দূর! ওখানেই থাকেন?

—না। ডেলি পাষণ্ড। যাতায়াত করেই চালিয়ে দিচ্ছি। এখন অবশ্য স্টাডি লিভে। তা ঋতম কেমন আছে এখন? একই রকম? খ্যাপা খ্যাপা?

—সে কি আর বদলায়। হাসতে হাসতে বলল বটে শ্রাবণী, কিন্তু পরবর্তী প্রশ্নটার জন্য সিঁটিয়েও রইল সামান্য।

অনির্বাণ মাথা দুলিয়ে বলল,—খুউব লিখছে এখন ঋতম। দারুণ লিখছে। আমি তো যেখানেই দেখি পড়ে ফেলি। একটাও লেখা মিস করি না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শ্রাবণী প্রস্ফুটিত হল। উচ্ছল মুখে বলল,—আপনি তো বন্ধু, আপনি তো বলবেনই।

—অনেস্টলি, ভাল লাগে খুব। ইউনিভার্সিটিতেই বুঝেছিলাম ওর মধ্যে কিছু আছে। নবপ্রভাতের জাতিস্মর গল্পটা আমায় খুব হন্ট করেছে। আপনি নিশ্চয়ই ওকে খুব ইনস্পায়ার করেন? ও আপনার কথা খুব বলত। আপনিই নাকি ওর প্রেরণা…!

শ্রাবণী ফের লজ্জা পেল। কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না।

—পাগলাকে বলবেন চালিয়ে যেতে। বলবেন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও আমার বন্ধু বলে আমি খুব প্রাউড ফিল করি।

অনির্বাণ চলে গেছে। কেমিস্ট্রির সুবীরবাবুকে দেখে দ্বৈপায়নও বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেল। বিচিত্র এক ঘোরের মধ্যে প্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে শ্রাবণী। ঋতমের লেখার কেউ প্রশংসা করলে বুকটা যেন কানায় কানায় ভরে ওঠে। মনে হয় যেন শুধু ওইটুকু শোনার জন্যই হাজার বছর ঋতমের ঘর করা যায়। কলেজের গেট পেরিয়ে পথে নামল শ্রাবণী। ঋতমের ওপর সে কি একটু বেশি নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে? সেদিন অম্বরদা আর দিদি এসেছিল, ঋতমকে জোর করছিল ছোটখাটো কোনও ব্যবসা আরম্ভ করার জন্যে। তোমার যা টেম্পারমেন্ট ঋতম, চাকরি বাকরি আর হবে না, এবার সেলফমেড হও। আমার চেনা একটা কোম্পানি পট্যাটো চিপস চানাচুর বানাচ্ছে, ওদের সাউথ ক্যালকাটার ডিসট্রিবিউটারশিপ তুমি নিয়ে নাও। দক্ষিণের পুরোটা নয়, একটা পোরশান। তাতেই তোমার মাসে হাজার কয়েক আসবে। লোকে এখন ভাতের চেয়ে আলুভাজা বেশি খায়। অম্বরদার প্রস্তাব শুনে ঋতমের সে কী হাসি। চিপস চানাচুর কেন অম্বরদা, সিগারেটের লাইনে কিছু হয় না? আমার ধূমপানের খরচটা বাঁচে। শুনে দিদি রেগে কাঁই, মা ফোঁসফোঁস করল। শ্রাবণীও তাদের তালে কম তাল দেয়নি। কেন করবে না তুমি ব্যবসা? এটা তো করতেই পারো!

সেদিনের শ্রাবণীকে এই মুহুর্তের শ্রাবণীর ঠাস ঠাস চড়াতে ইচ্ছে করছিল।

ছি ছি ছি শ্রাবণী, চিপস চানাচুর ফেরি করবে ঋতুম! নিছক পয়সা উপার্জনের জন্য কাজ করা কি ঋতমকে মানায়?

ঋতম শুধু সৃষ্টির আনন্দ নিয়ে মেতে থাকবে, এই না শ্রাবণী চেয়েছিল?

এক বেপরোয়া বেহিসেবি পুরুষ হয়ে তার জীবনে বিরাজ করবে ঋতম, এই স্বপ্নই না দেখেছিল শ্রাবণী?

আবিষ্ট শ্রাবণী তক্ষুনি তক্ষুনি বাসে উঠল না। বেহালার দোকান থেকে একটা টিশার্ট নিল ঋতমের জন্য। পছন্দসই নীলটা পেল না, তুঁতে রং হল। এটাও মন্দ নয়, চওড়াকাঁধ ঋতমকে মানাবে দারুণ। একটা লম্বাঝুল পাঞ্জাবিও কিনল, বুকে ফেব্রিকের কাজ করা। মাঝারি হাইট ছেলেদের লম্বাঝুল পাঞ্জাবিতে সুন্দর দেখায়।

বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল শেষ।

গোধূলির আলো মেখে শ্রাবণী বাড়ি ফিরে দেখল অতসী আপেলসেদ্ধ খাওয়াচ্ছে টুসকিকে। শ্রাবণীকে দেখেই আপেল মাখা টুসকির মুখে স্বর্গীয় হাসি।

ঘরে প্যাকেট আর ব্যাগ রাখতে যাচ্ছিল শ্রাবণী। হঠাৎ অতসী ডাকল,—এই শোনো শোনো, একটা কাণ্ড হয়েছে আজ।

—কী মা?

—ইন্দিরার সেই রান্নার মেয়েটা, কানন… সুইসাইড করেছে।

—সে কী? কখন?

—আজ সকালে। দুপুরে ইন্দিরার ফোন এসেছিল। বাবুয়া শুয়ে ছিল তখন, খবরটা শুনেই মুখটা একেবারে কালো হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দেয়াকে ফোন করেছে। এই তো খানিক আগে দেয়া এসেছিল। হুড়মুড় করে এসে বাবুয়াকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে চলে গেল।

আরও কী সব বলে চলেছে অতসী। কানন…কাননের মেয়ে…ইন্দিরা…।

শ্রাবণী চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে। দেয়া! শ্রাবণীর কানে আর কিছুই ঢুকছিল না।

সাত

রাস্তা রাস্তা রাস্তা। অসংখ্য রাস্তা। মাকড়সার জালের মতো। দুই সমান্তরাল পথ অনেক দূর অবধি চলল পাশাপাশি, বেঁকেচুরে মিলল এক সময়ে। আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে সরছে যে যার অভিমুখে। সরু সরু রাস্তা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরল রাজপথকে, উদাসীন দম্ভে এগিয়ে চলেছে রাজপথ। এক হ্রদের বাঁকে এসে ঘুরে গেল রাস্তা, যেতে যেতে মিশে গেল অন্য এক বাঁকে। অজস্র গলিঘুঁজি খুঁজছে গতিপথ। মিলছে তারা, সরছে, ভেঙেচুরে যাচ্ছে বার বার। অগুন্তি পথের জটিল বিন্যাসে এ যেন এক কঠিন ধাঁধা।

জাপানের কিয়োটো শহরের স্ট্রিটম্যাপ।

দিনের কাজ শেষ করে পথমানচিত্রটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল সৌম্য। এমনিই। সম্প্রতি কিয়োটো শহরের যাবতীয় পথ-নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর বরাত পেয়েছে এক নামী জাপানি সংস্থা। কাজটা বৃহৎ এবং জটিল। গোটা কাজটার একটা অংশ তারা দিয়েছে সৌম্যদের ইনফোক্যাল ইন্ডিয়াকে। সৌম্যরা শুধু শহরের ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতিটাকে আরও উন্নত আর আধুনিক করবে, যাতে সেখানে যানবাহনের গতি আরও বাড়ানো যায়।

কাজটা খুব সোজা নয়। শহরের প্রধান প্রধান রাজপথের লাল হলুদ সবুজ আলোগুলোকে দিনের বিভিন্ন সময়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বিভিন্নভাবে। সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত্রি, ক্ষণে ক্ষণে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বদলে যায়। কীভাবে বদলাচ্ছে, কেন বদলাচ্ছে, কতটা বদলাচ্ছে, সব দেখে ঠিক করতে হবে কোন আলো কোথায় কখন কতক্ষণ জ্বলবে। ছোট ছোট রাস্তাগুলোকে নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতে হবে একইভাবে, সঙ্গে সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে কোথায় কটা গলি এসে পড়ছে। হাসপাতাল, স্কুল, অফিস, কলকারখানা, ধর্মস্থান, ঘন বসতি পূর্ণ অঞ্চল, অপেক্ষাকৃত নির্জন এলাকা—এক এক জায়গার জন্য ট্রাফিক সিগন্যালের একেক বিধি, সেগুলোকে প্রোগ্রামিং-এ ঠিক মতো বিন্যস্ত করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনও অজানা বিপত্তি কোনওভাবেই না পদ্ধতির কোনও অংশকে বিপর্যস্ত করতে পারে। সব কিছু চিন্তা করেই প্রস্তুত করতে হবে সফ্‌টওয়্যার প্যাকেজ।

সৌম্য অবশ্য একা করছে না কাজটা। বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে কাজটাকে তুলছে ইনফোক্যালের চারজন ইঞ্জিনিয়ার। মাঝারি এই প্রকল্পটায় সৌম্যর কাজটাই বেশি ঝঞ্ঝাটের। প্রত্যেকের কাজ তাকে একত্র করতে হচ্ছে। সে এই প্রকল্পের ইনটিগ্রেটার। কাজটার সময়ও বাঁধা। পনেরো দিন। তার মধ্যে আট দিন চলে গেছে, কাজ এখনও অর্ধেকটাও হয়নি। তবে আশা করা যায় সময়েই শেষ হবে।

কম্পিউটার বন্ধ করে সৌম্য উঠে দাঁড়াল। লম্বা শরীরটাকে পিছনে হেলিয়ে আড়মোড়া ভাঙল একটা।

পাশের কিউবিকলে অমিতাভ। বেঁটে পার্টিশানের ওপার থেকে ঘাড় তুলে বলল, —চললি নাকি?

—হুম। যাই আজ।

—সো আর্লি? ইটস ওনলি সেভেন ফিফটিন, ম্যান।

—আই নো। বাট আই হ্যাভ টু মিট সামওয়ান।

অমিতাভ জানতে চাইল না কার সঙ্গে দেখা করতে যাবে সৌম্য। এটাই রেওয়াজ। এই অফিসের সবাই প্রায় কৌতুহলহীন মানব মানবী। এখানে কাজের বাইরে কথা হয় কম, ব্যক্তিগত কথা হয় আরও কম।

বিশাল একটা বাড়ির তিনতলার পুরোটা জুড়ে ইনফোক্যালের অফিস। নীচে এসে পার্কিংস্পেস থেকে বাহন বার করল সৌম্য। কদিন ধরে মোটরসাইকেলটা স্টার্ট নিতে বেগড়বাঁই করছে, একবার গ্যারেজে নিয়ে যাওয়ার দরকার। সময় কোথায়? এই যে আজ ঘণ্টাখানেক আগে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল, একটু কি পিছিয়ে পড়ল না সৌম্য? কাল হয়তো দশটা অবধি থেকে মেক-আপ করতে হবে। ডিউটিটাইম নিয়ে তাদের অফিসে কেউ মাথা ঘামায় না বটে, আগে পরে বেরিয়ে গেলেও কেউ খোঁজ করে না, কিন্তু বাঁধা সময়ের মধ্যে কাজ তো তুলে দিতে হবে। হবেই।

আজ মোটরসাইকেল সুবোধ বালক। দু স্ট্রোকেই গর্জন করে উঠেছে। হেলমেট চড়িয়ে সৌম্যও লবণহ্রদের রাস্তায়। দুপুরে বৃষ্টি হয়েছিল, পথঘাট এখনও ভিজে ভিজে। দুধারে গাছের সারি, স্ট্রিটলাইটের আলো আবছায়া রচনা করেছে পথে, মাঝে মধ্যে খানাখন্দও আছে, সামলে সুমলে চলতে হয়। তাতে অবশ্য সৌম্যর অসুবিধে নেই, সে কখনওই প্রচণ্ড বেগে তার রথ চালায় না। মাঝামাঝি গতিই সৌম্যর পছন্দ। বুগিদাকে সে সময় দিয়েছে আটটা, তার মধ্যে সৌম্য স্বচ্ছন্দে লিটল রাসেল স্ট্রিট পৌঁছে যাবে।

বুগিদার মুখটা মনে পড়ছিল সৌম্যর। চৌকো ফর্সা মুখ, তীক্ষ্ণ নাক, চোখে হাই-মাইনাস পাওয়ার চশমা, গোটা মুখ থেকে বুদ্ধির দীপ্তি ঠিকরোচ্ছে। কদ্দিন পর বুগিদা দেশে এল? সাত বছর? না না, আট বছর। বড়মাসি যখন মারা গেল, সৌম্যর তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার, মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি করতে সেবারই তো ভারতবর্ষে বুগিদার শেষ পদার্পণ। কী ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল বুগিদা! আত্মীয়স্বজন মহলে বুগিদা ছিল একটা নাম। হায়ার সেকেন্ডারিতে নাইনথ, খড়গপুর আই আই টি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সেকেন্ড! জি আর ই-তেও দারুণ স্কোর করেছিল বুগিদা, চলে গেল ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি। বাপ মরা ছেলে মার পরিশ্রম সার্থক করেছে। প্রথম প্রথম ফি বছর আমেরিকা থেকে আসত বুগিদা, তখন তাদের ভাইবোনদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। বুগিদা বিদেশ বাসের গল্প করে যেত অনর্গল, সৌম্যরা হাঁ করে শুনত। বুগিদা তো প্রায় আইডলই হয়ে গিয়েছিল সৌম্যর। একবার কলকাতায় এসে মিষ্টি বউদিকে বিয়ে করে নিয়ে গেল। মাকেও টিকিট পাঠিয়ে দিত বুগিদা, ছেলের কল্যাণে বার দুয়েক আমেরিকা ঘুরে এসেছিল বড়মাসি।

সেই বুগিদা এখন কলকাতায়। কিন্তু ভায়ের বাড়িতে না উঠে হোটেলে কেন? ছোটুদার সঙ্গে কি কোনও ঝামেলা হয়েছে? কী নিয়ে ঝগড়া হবে, পৈতৃক সম্পত্তি টম্পত্তিও তো কিছু নেই! তাহলে…?

টুকরো টুকরো ভাবনার মাঝেই সৌম্য বাইপাস পেরিয়ে পার্কসার্কাস কানেক্টারে। ব্রিজে হালকা জ্যাম, শম্বুক গতিতে এগোচ্ছে গাড়িঘোড়া, ফাঁক গলে গলে বেরোচ্ছে সৌম্য। পার্কসার্কাস মোড়ে এসে বিশ্রীভাবে ফেঁসে গেল। রাশি রাশি যানবাহন জ্যামে নিথর। এমন অবস্থা যে মোটরসাইকেল নিয়েও নড়াচড়া করা যাচ্ছে না। সৌম্য ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন, সময় দিয়ে সময় না রাখতে পারলে মেজাজ গরম হয়ে যায়। তার মধ্যেই একটা ট্যাক্সি ফাঁক খুঁজতে গিয়ে বিশ্রীভাবে গায়ের ওপর এসে পড়ছিল, সৌম্য দাঁত খিঁচিয়ে একটা গালাগাল ছুড়ে দিল তাকে। অশ্লীল খিস্তি মুখে আসে না, তবুও। চঞ্চল চোখ ঘুরছে এদিক ওদিক, ট্রাফিক পুলিশ কোথায় গেল? কী বিশ্রী ট্রাফিক সিস্টেম! কেন যে কেউ বদলানোর কথা ভাবে না? কিয়োটোর ভাবনা সৌম্য ভাবছে, সৌম্যর ভাবনা ভাবে কে? মরিয়া হয়ে সৌম্য একবার বাহনটাকে ফুটপাথে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করল, সুবিধে হল না।

প্রায় আধঘণ্টা ঠায় ছটফট করার পর যানজট থেকে মুক্তি। সৌম্য মাসতুতো দাদার হোটেলে পৌঁছল আটটা চল্লিশ নাগাদ। ক্লান্ত। বিধ্বস্ত।

বুগি রুমেই ছিল। দরজা খুলে সৌম্যকে জড়িয়ে ধরেছে,—এসেছিস? আমি তো ভাবলাম আর…

—কী করব বলো! দিন দিন শহরটার যা হাল হচ্ছে! এবার পাংচুয়ালিটি শব্দটা ডিকশনারি থেকে তুলে দিতে হবে।

—আরে দূর, শহরে গাড়িঘোড়া বাড়বে, জ্যাম হবে না?

—যা বলেছ। কলকাতায় হঠাৎ প্রচুর গাড়ি বেড়ে গেছে। মানুষের হাতে এখন বহুৎ পয়সা।

কথা বলতে বলতে সৌম্য রুমে ঢুকেছে। বসল সোফায়। রুমাল বার করে মুখ মুছছে।

বুগি এসি বাড়িয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, —কী খাবি? সফ্‌ট, না হার্ড?

বুগির সঙ্গে সৌম্যর বয়সের পার্থক্য প্রায় চোদ্দো বছর। বুগির কথায় সৌম্য লজ্জা পেয়েছে একটু। বলল,—যা হোক দাও।

—হুইস্কি খা তবে। …খাস তো তুই? ট্যাবু ফ্যাবু নেই তো?

—না মানে…সে সব কিছু নেই…

—তাহলে শরমাচ্ছিস কেন? খা। …উইথ সোডা তো?

—তোমার যা ইচ্ছে।

—হা হা হা, তুই খাবি হুইস্কি, আমি ইচ্ছে করব… তুই এখনও সেই বাচ্চা রয়ে গেছিস রে সোমু!

চ্যাপ্টা সোনালি বোতল এনে সেন্টারটেবিলে রাখল বুগি। ফ্রিজ থেকে সোডা বার করল। বরফের টুকরোও। গ্লাসে হুইস্কি ঢালছে। মাপ করে। সোডা মেশাল নিপুণ হাতে। দুটো গ্লাস দু হাতে উঁচু করে ধরে পরখ করে নিচ্ছে।

সৌম্যর বিস্ময় ভরা চোখ বুগিতে স্থির। বুগিদা অনেক বদলে গেছে। দিব্যি চর্বি জমিয়েছে দেহে, গলায় দ্বিতীয় চিবুক, কোমরে পাতলা টায়ার, চুল কমে কপাল অনেকটা চওড়া। বয়স বেড়েছে বেশ বোঝা যায়। চেহারার সেই ধারালো ভাবটাই নেই। একটু বুঝি খারাপও লাগল সৌম্যর। কাল যে মানুষের কত কিছু হরণ করে নেয়! তবে হ্যাঁ, কথা বলার ভঙ্গিটা এখনও একইরকম আছে। প্রাণবন্ত। আন্তরিক।

বুগির পরনে আদ্দির পাজামা-পাঞ্জাবি। লম্বা সোফায় পা ছড়িয়ে হাতলে আধশোয়া হয়েছে। ঘরোয়া মেজাজে। গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,—তারপর বল কী খবর? আছিস কেমন?

—চলছে। ফাইন।

—তোর বউকে তো আমার দেখাই হল না। সে নাকি খুব স্মার্ট, প্রিটি…?

সৌম্য হাসল, —বাড়ি এলেই দেখতে পেতে। খামোখা হোটেলে ডাকলে কেন? নাকি আমার বাড়ি যাবে না?

—না না ওসব কিছু না। তোর বাড়ি যাব না এটা হয়? …আসলে এবার এসে কোথাওই যেতে ইচ্ছে করছে না। শুধু খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমোচ্ছি আর একটু আধটু হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি এদিক ওদিক।

—শুধু এই জন্য তুমি আমেরিকা থেকে এসেছ?

—ইয়েস। রেস্ট টোটাল রেস্ট। নো আত্মীয়স্বজন, নো কচকচানি। এই জন্য তো এবার ছোটুর ওখানেও উঠিনি। এবারের আসাটাকে একদম একলা এনজয় করতে চাই রে। বুগি যেন পলকের জন্য অন্যমনস্ক, —যাক গে যাক, তোর বউ তো শুনেছি রিপোর্টার, তাই না?

—রিপোর্টার নয়, সাব-এডিটার। ওই একটা ছোট বাংলা কাগজের।

—দ্যাটস গুড। এখানকার মেয়েরা আজকাল খুব ড্যাশিপুশি হয়েছে, অড জব টব নিচ্ছে… শুনতেও ভাল লাগে। গ্রেট।

—দেয়া অবশ্য তেমন কিছু বেখাপ্পা কাজ করে না। প্রায় রুটিন জবই। সৌম্য আলগা হাসল, —বেসিকালি লাজুক টাইপ।

—স্টিল…আমাদের সময়ে কটা মেয়ে নিউজপেপারে কাজ করত?

—তুমি এমনভাবে বলছ, তুমি যেন আদ্যিকালের লোক?

—প্রায় তাইই তো। মোর দ্যান কুড়ি বছর দেশ ছেড়েছি। টোয়েন্টি ইয়ারস ইজ আ হেল অব আ টাইম। …দুনিয়াটাই বিশ বছরে কত বদলে গেছে ভাব!

—তা ঠিক।…মিষ্টি বউদির খবর কী? মিষ্টি বউদি এবার এল না যে?

—বললাম না, আমি এবার একটু একা আসতে চেয়েছি! ও হয়তো পরে আসবে। ডিসেম্বর টিসেম্বরে। ক্রিসমাসে ও লম্বা ছুটি পায় তো।

—মিষ্টিবউদি এখনও স্কুলেই চাকরি করছে?

—হুম। কাজটা ওর স্যুট করে গেছে।

—অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট টুপ টাপ? ওরা কী করছে?

—পড়ছে। খেলছে। ঘুরছে। আছে নিজেদের মতো। যেমন থাকে আমেরিকান টিনএজাররা।

—তার মানে খুব লাইভ্‌লি হয়েছে বলো!

—তা হয়েছে। ইন দেয়ার ওউন ওয়ে। উইথ অল দেয়ার ভাইসেস অ্যান্ড ভারচুজ।

সৌম্য কথাটা ঠিক ধরতে পারল না। দেখছে বুগিকে। একটু যেন অসুখী অসুখী লাগে বুগিদাকে? টুপ বা টাপ কাউকে নিয়ে কি কোনও প্রবলেম চলছে?

বুগি গা ঝাড়া দিয়েছে। হাত নেড়ে বলল, —নে নে, শুরু কর।…খাবি কিছু? আনাব?

—না না, থাক।

—থাকবে কেন? অফিস থেকে আসছিস…। বলেই ইন্টারকমে রুমসার্ভিসকে চিকেন পকোড়া আর প্রন বলের অর্ডার দিল বুগি। উঠে একটা প্লেটে ঢেলে আনল একরাশ কাজুবাদাম। আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত ডবলবেড ঘরের লাগোয়া অ্যান্টিরুম থেকে ঘুরে এল একবার। সোফায় বসে কিংসাইজ বিদেশি সিগারেট ধরিয়েছে। প্যাকেটখানা বাড়িয়ে দিল সৌম্যকে।

সৌম্য মাথা নাড়ল, —খাই না। থ্যাংকস।

—ঠিক বলছিস? নাকি লজ্জা পাচ্ছিস?

—না। সত্যিই আমার চলে না।

—বাড়া, আয়ু বাড়া। একশো বছর বেঁচে থেকে মর। বুগি ভুস ভুস ধোঁয়া ছাড়ল। হঠাৎ চোখ টেরচা, —হ্যাঁরে সোমু, তোর সঙ্গে সেজমাসির আর প্যাচআপ হল না, না?

সৌম্য সবে প্রথম চুমুকটা দিয়েছিল, বিষম খেয়ে গেল। বিরস মুখে বলল,—আমি সম্পর্কের জোড়াতালিতে বিশ্বাস করি না বুগিদা।

—তুই তো দেখছি খুব হেডস্ট্রং?

—আমি সোজা পথে চলি বুগিদা। মা যাকে ডিজলাইক করবে তাকে নিয়ে আমি মার সঙ্গে ঘর করব…বুঝতে পারছি মা আমার ওপর বিরক্ত তাও দেঁতো হেসে আমি তার সঙ্গে থেকে যাব…সরি, ও আমার দ্বারা হবে না।

—আমার খুব স্ট্রেঞ্জ লেগেছে। ছোটুর মুখে শুনে প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে পারিনি। দেখেছি তো, সেজমাসি তোকে নিয়ে কেমন জড়িয়ে থাকত। মনে আছে, একবার তোর হাম হল, সেজমাসি তোর ক্লাসমেটদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে ক্লাসে কী লেসন দিল জেনে বেড়াচ্ছে! মা খুব হাসাহাসি করেছিল। ছেলে ছেলে করে সুপুটা একদম খেপি হয়ে গেছে, ওইটুকু ক্লাস ওয়ানের বাচ্চার পড়াশুনো নিয়ে কেউ এমন উতলা হয়! আমরা তো জানতাম তোর পরীক্ষা মানেই সেজমাসির পরীক্ষা। বাড়ি থেকে বেরোন বন্‌ধ, অফিস ছুটি নিয়ে বসে আছে, কেউ ডাকলেও যাচ্ছে না, কেউ তোদের বাড়ি গেলেও মুখ হাঁড়ি। ছোটুকে নাকি একবার দরজা থেকেই হাঁকিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, পরে আসিস। তুই ছাড়া সেজমাসির তো কোনও দুনিয়াই ছিল না। অফিস আর তুই। তুই আর অফিস। সেই সেজমাসি…

—কেন আমায় এসব শোনাচ্ছ বুগিদা? তুমি কি চাইছ মা ছেলের রিকনসিলিয়েশান হয়ে যাক?

—আমি কিছু চাইছি না। জাস্ট মনে পড়ল বলে বলছিলাম।

সৌম্য ঢক করে একটা চুমুক দিল। সুরার অভিঘাতটা গ্রহণ করল মস্তিষ্কে। গোমড়া মুখে বলল, —দ্যাখো বুগিদা, আমি মাকে নিয়ে কারওর সঙ্গে ডিসকাস করি না। নেহাত তুমি এখন আমাদের মধ্যে থাকো না, তাই তোমায় বলছি। মা আমার জন্য কিস্যু করেনি। যা কিছু করেছে নিজের জন্যে। নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্যে। উইশ ফুলফিলমেন্ট। আমার ছেলে এই হবে, আমার ছেলে ওই হবে, আমার ছেলেকে আমি এভাবে চাই…। শুধু আমার। আমার। আমার। আমিটাই প্রধান, ছেলেটা নয়। ছেলে কী চায় তাই নিয়ে মার থোড়াই মাথাব্যথা ছিল। মার বাসনা ছিল আমি হব একটা পাপেট, মা রিমোটে সেই পাপেটটাকে চালাবে। আমি দেয়াকে বিয়ে করব, না হরিমতীকে বিয়ে করব, সেটা পর্যন্ত ডিসাইড করবে মা! স্ট্রেঞ্জ! আমার পছন্দকে অনার করার মতো সহনশীলতাও মার নেই! …আই ডোন্ট কেয়ার। …তুমি আমার চেয়ে অনেক বড়, জানি না তুমি কথাটাকে কীভাবে নেবে, তবু বলছি, পৃথিবীতে কোথায় কার ইগো স্যাটিসফায়েড হল না, তাই নিয়ে সৌম্য বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। সিম্পলি, আই ডোন্ট বদার।

—বাপস্‌! তুইও তো দেখছি কম ইগোয়িস্ট নোস!

—স্বাভাবিক। আমি তো সুপ্রিয়া সিন্‌হারায়েরই ছেলে। জেনেটিক ফ্যাক্টরটাও তো কাজ করে। আমগাছে কি তেঁতুল ফলবে?

—বেশ কথা শিখে গেছিস তো? আগে তো মুখে বুলিই ফুটত না! বুগির স্বরে কৌতুক,—শুনেছি প্রেমে পড়লে বোবা মানুষও বাচাল হয়, তোরও সেই কেস নাকি?

সত্যি সত্যি সৌম্য খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। মাসতুতো দাদার রসিকতায় হেসে ফেলল। বুগিদার মুখে কোনও দিনই রাখ ঢাক নেই। বিয়ের আগে দেশে এসে অবলীলায় হাঁটুর বয়সি ভাইবোনদের সঙ্গে গল্প করত, কোন মেয়ের সঙ্গে সেখানে লটর পটর চলছে, কে বুগিদাকে হাফ্‌সোল দিল…। বুগিদা এখনও একই রকম আছে।

সৌম্যও মজা করে বলল,—কথা আর আমি কী বলি! কথা বলে তো একজন। নন্‌স্টপ। দেয়ার সঙ্গে আলাপ হলে টের পাবে। তোমাকে পর্যন্ত স্পিকটি নট করে রাখবে।

খাবার এসে গেছে। ভাজাভুজির সঙ্গে বড় করে স্যালাড। প্রন আর চিকেনের সৌরভে সৌম্য টের পেল খিদে পেয়েছে জব্বর। সস মাখিয়ে কামড় দিল চিকেন পকোড়ায়। শেষ করে ছোট্ট চুমুক।

বুগির হাতে শশার চাকা। কচকচ চিবোচ্ছে। গ্লাস শেষ, আবার ঢালল সোনালি পানীয়। আগের সিগারেটের এক তৃতীয়াংশ খেয়ে নিবিয়ে দিয়েছিল, আবার ধরিয়েছে একটা। বোতলের ছিপি আটকাতে আটকাতে বলল,—তোদের কোম্পানিটা কেমন রে সোমু?

—বুঝলাম না। সৌম্য আর একটা পকোড়া তুলল, —কী জানতে চাও? মালিক কেমন? এনভায়রনমেন্ট? মাইনে? নাকি টার্নওভার?

—বল। সব কটাই বল।

—ইনফোক্যালে দুজন পার্টনার। মেজর শেয়ার এক সাউথ ইন্ডিয়ানের। হরিহরন। বহুদিন ফারইস্টে ছিল, সফ্‌টওয়্যার লাইনে পোড় খাওয়া লোক। অর্ডার টর্ডার হরিই প্রোকিওর করে। টেকনিকাল সাইডটা দেখে স্বর্ণকমল বাসু। কাজের পরিবেশ চমৎকার। নো বসিজম, নো রেডটেপিজম। যখন যা চাই অ্যাটওয়ান্স হাজির। এই তো, কালই একটা প্রিন্টার দরকার পড়ল, গলা ঝাড়তেই টেবিলে এসে গেছে। ছোট হলেও কোম্পানির একটা হার্ডওয়্যার সাপোর্ট আছে, কোম্পানির নিজস্ব।

—আসলি কথায় আয়। দেয় থোয় কেমন?

—মন্দ না। সব কিছু মিলিয়ে অ্যানুয়াল গ্রস ধরো অ্যারাউন্ড চার লাখ।

—মাত্র? তোদের কোম্পানির টার্নওভার কত?

—লাস্ট ফিনানসিয়াল ইয়ারে দশ কোটি মতন ছিল।

—তার মানে খুব বড় কোম্পানি নয়। তোদের স্টাফস্ট্রেন্থ কীরকম?

—আমরা ইঞ্জিনিয়ার আছি দশজন। আর ওই সব কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার টেন্টার থেকে পাশ করা ছেলেমেয়ে আছে জনা কুড়ি-একুশ, আর খুচরো-খাচরা কিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেশানে, ফিনান্সে…।

বুগি কী যেন হিসেব কষল মনে মনে। তার পর বলল, —তার মানে তোদের মালিক বেশ ভালই কামাচ্ছে। তারা বেশ আন্ডারস্টাফড।

—তা একটু তো বটেই, তাই খাটুনিটাও পড়ে। আটটা সাড়ে আটটার আগে বেরোতেই পারি না।

—ওফ্‌, এই ওয়ার্ককালচারটা আমি বুঝি না। তোরা, শুধু তোরা কেন, এই এশিয়ানরাই কেমন যেন টিপিকাল। আমাদের ওখানেও তো দেখি ইন্ডিয়ানগুলো জাপানিগুলো উইকএন্ডেও ঘাড় মুখ গুঁজে কাজ করে যাচ্ছে। কী? না রেসপন্সিবিলিটি রয়েছে, জব শেষ করব না? অথচ আমেরিকানদের দিয়ে শনি রোববারে তুই কেটে ফেললেও কাজ করাতে পারবি না। স্ট্রেট মুখের ওপর বলে দেয়, বলস! হোয়াই শুড আই ওয়েস্ট মাই ফান বাডি!

—না না, আমারও সানডে ছুটি, অফিস যাই না।

—বাকি দিনগুলো গাধার মতন খাটিস তো। একজনকে দিয়ে দশজনের কাজ উঠিয়ে নিচ্ছে…! শোন, তুই যদি ডিউটি আওয়ারের মধ্যে তোর কাজ শেষ না করতে পারিস তাহলে তার দুটো মানে হয়। হয় তুই ইনএফিশিয়েন্ট, নয় তুই ওভারবার্ডেনড। ভুল বলেছি?

—কী করব, আমাদের দেশে এখন এরকম সিস্টেমই চলছে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে। এত বেকার… সব সময়ে আতঙ্ক আমি না করলে আর কেউ করবে। হয়তো আমার চেয়ে কম পয়সায়…

—হুম্‌। আবার একটা শশা মুখে পুরেছে বুগি, —এখানে এসে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। সবাই তোর মতনই একটা পিকচার দিল। গ্রিম। আনহেলদি। টেরিফাইয়িং।

সৌম্য কাঁধ ঝাঁকাল। হাত বাড়িয়েছে প্রন বল-এ। খেতে খেতে বলল, তুমি কিছু খাচ্ছ না যে বড়?

—কেন, এই তো নিচ্ছি। স্যালাড। ওয়েটটা বড্ড বেড়ে যাচ্ছে, ভাজাভুজি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।

—তবু নাও একটা দুটো। আমিই তো সাফ করে ফেলছি।

—খা। আর একটা হুইস্কি দেব?

—দাও। একটাই। আমি বেশি খাই না… আবার মোটরসাইকেল চালিয়ে ফিরতে হবে…

পানীয় সোডা আর বরফে সৌম্যর গ্লাস আবার ভরে দিল বুগি। ঈষৎ কৌতুহলী সুরে বলল,—তোর তো রেজাল্ট ভাল হয়েছিল, কলকাতাতে পড়ে রইলি কেন?

—সে এক বিচ্ছিরি কাণ্ড। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে একটা বিগ হাউসে সিলেক্টেড হয়েছিলাম। ব্যাংগালোরে। জানোই তো প্লেসমেন্ট সেকশানের নিয়ম, একটা কোম্পানিতে সিলেক্টেড হয়ে গেলে আর কোথাও ইন্টারভিউ দেওয়া যায় না। আমিও খুব খুশি, অন্য ভাবে চেষ্টাও করিনি। বাট, ফাইনাল রেজাল্ট বেরোনোর পর কোম্পানিটা আমার সঙ্গে দুনম্বরি করল। শুধু আমার সঙ্গে বলা ভুল হবে, অনেককেই ওরা ঝুলিয়ে দিল। রিগ্রেট লেটার পাঠাল, সরি, আমরা এখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্টপ রাখছি।…ভয়ঙ্কর রাগ হয়ে গিয়েছিল, ধুস্‌ শালা, কোথ্‌থাও যাব না। এখানেই একটা ছোট কোম্পানিতে কাজ করলাম বছর দুয়েক, তারপর থেকে ইনফোক্যাল।

—তুই আর চেষ্টাই করিসনি অন্য কোথাও?

—বললাম তো, আমি সুপ্রিয়া সিংহরায়ের ছেলে! ওয়ান্স আই ডিসাইড, সেটাই ফাইনাল। আমার ডিসিশানের নড়চড় হয় না। আমি কোথ্‌থাও যাব না, কিছুতেই যাব না, নট ইভন ইন সিলিকন ভ্যালি। আমি যা করার এখান থেকে করেই দেখিয়ে দেব।

সৌম্য দ্বিতীয় পেগে বড় করে চুমুক দিল। অনভ্যাসের সুরা অল্প অল্প ক্রিয়া করছে মস্তিষ্কে। হালকা হালকা লাগছে। অসম বয়সের বুগিদার সঙ্গে দীর্ঘ অদর্শনের জড়তা কেটে গেছে পুরোপুরি। লঘু সুরে বলল,—তখন থেকে তো শুধু আমার কথা চলছে, নিজের কথা বলো। তোমার কাজকর্ম চলছে কেমন?

বুগি কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিথর। দৃষ্টি হোটেলের জানলায়। গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়াল, খালি পায়ে হাঁটছে নরম কার্পেটে।

সৌম্যর খটকা লাগল। জিজ্ঞেস করল,—কী হল? ভাল নয়?

জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে বুগি। চোখ বাইরের শহরে। ঈষৎ চিন্তিত স্বরে বলল, —এক কথায় বোঝানো কঠিন। ওখানে আমি স্বাধীন ব্যবসা শুরু করেছি সাড়ে ছ বছর। সিলিকন ভ্যালির মতো জায়গায় সফ্‌টওয়্যার বিজনেস। হোক না ছোট, কাজ পেয়েছি প্রচুর। হুহু করে টাকা এসেছে, চড়চড় করে দাম চড়েছে শেয়ারের। মনে হত উঠতে উঠতে স্বর্গে পৌঁছে যাব।…বছর দুয়েক আগে একটা জোর ধাক্কা খেলাম, শেয়ার মার্কেট প্রায় ক্রাশ করে যাওয়ার মতো অবস্থা। রোজ পারা নামছে নামছে নামছে…। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হত, বুঝলি। মনে হত জলের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। জলের সারফেসে। হাঁটলেই পা ডুবে যাচ্ছে, রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একটা কোল্ড ফিয়ার আমাকে গ্রাস করে ফেলছিল। চোখ বুজলেই কানে বাজত, তোমার দিন শেষ হয়ে এসেছে প্রদীপ্ত…

সৌম্য বিস্মিত মুখে বলল,—তোমার কোম্পানি কি…বন্ধ হয়ে গেছে?

বুগি জানলা থেকে ফিরল। সোফায় বসতে বসতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা,—না রে, ওটাই তো স্যাডেস্ট পার্ট অফ দা স্টোরি। কোম্পানিটা টিকে গেছে। ব্যবসা চলছে মোটামুটি, তবে আগের মতো নয়। কিন্তু ওই দিনগুলো তো মুছছে না। ওই ভয়ঙ্কর ভয়টা আমাকে এখনও কুরে কুরে খায়। চোখ বুজলেই দৈববাণীর মতো শুনতে পাই, প্রদীপ্ত, তোমার দিন শেষ! ধর, যদি ধ্বংস হয়ে যেতাম, তাহলে তো আর ভয়টা আমায় তাড়া করত না।

সৌম্য যেন কথাগুলোর গভীরতা সে ভাবে অনুধাবন করতে পারল না। হাসতে হাসতে বলল,—এ তোমার দুঃখবিলাস বুগিদা। সময় ফিরে গেছে, আবার চুটিয়ে ব্যবসা করো।

—আর পারছি না। আয়াম ফেড আপ। তোর মিষ্টিবউদিও তোর মতন করেই বলে, কিছুতেই বুঝতে চায় না আমি মেন্টালি রুইনড হয়ে গেছি। আমি আর ও দেশে থাকার যোগ্য নই।

সৌম্য চোখ পিটপিট করল,—তুমি কি ফিরে আসতে চাও নাকি?

—ফেরার ভাবনা ভাবতেই তো এবার আমার আসা। শুধু ভাবছি। ভাবছি। ভাবছি। বিপদের দিনে ওই দেশটাকে বড় বিজন বিভুঁই মনে হত রে। কান্না পেত খুব। মনে হত, এইখানে এইভাবে শেষ হয়ে যাব? এবার কলকাতায় এসে যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছি হাঁটছি…অন্য রকম একটা তৃপ্তি হচ্ছিল, জানিস! রাস্তায় যে কোনও মানুষকে দেখছি, মনে হচ্ছে এ তো আমার চেনা, জানা…এ তো আমার লোক! দেশ ছেড়ে গেছি আজ প্রায় বাইশ বছর, কিন্তু এই দেশটা যে আমার রক্তে এখনও এতটা রয়ে গেছে আগে কোনওদিন বুঝতে পারিনি। নিজের মাটি খুব সাংঘাতিক জিনিস রে।

সৌম্য ফের চোখ পিটপিট করল,—তার মানে তুমি চলে আসছ?

—বললাম তো। ভাবছি। ভাবছি সিলিকন ভ্যালিতে প্রায় এক যুগ হয়ে গেল, এখনও প্রতিদিন মনে হয় একটা অচেনা শহরে বাস করছি! শুধু ওখানে কেন, যেখানে যখন থেকেছি কখনও কি ভুলতে পেরেছি এটা অন্যের জায়গা! ঘর বেঁধে থাকছি ঠিকই, কিন্তু এ জায়গার ঘাস মাটি জল কোনওটাই আমার নয়! ওখানকার আমার নিজস্ব দোতলা বাড়িটার চেয়ে ওই মোড়ের ল্যাম্পপোস্টটাও যেন আমার অনেক বেশি আপন! কেন যে এমন মনে হয়? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি রে সোমু?

সৌম্য শব্দ করে হেসে উঠল,—আহা, অত বেশি ভাবাভাবিতে যাচ্ছই বা কেন? মন যখন চাইছে, তখন ফিরেই এসো।

—ভাবছি কি সাধে? তাতেও প্রবলেম। তোর মিষ্টিবউদি টপ টাপ…

—কেন? ওরা কেউ আসতে রাজি নয়? ওদের বলেছ?

—হিন্ট দিয়েছি। তোর বউদি ফিফটি ফিফটি। চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে আসবে, আবার মানিয়েও নেবে। কিন্তু আমার ছেলেমেয়ে…ওরা তো আভাস পেয়েই ফিউরিয়াস।

—স্বাভাবিক। ওখানে ওরা জন্মেছে, বড় হয়েছে, ওখানেই ওদের সব…

—এবং ভুলটাও আমিই করেছি। যখন ওরা ছোট ছিল, তখন ভেবেছি ওখানকার কালচারেই মানুষ হোক। বাংলা আর আমেরিকার মিশেল ঘটাতে গেলে ওরা অসুবিধেয় পড়বে। এখন ফলটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমরা মরে যাওয়ার পরে, ধর ওখানে ওরা রয়ে গেল…প্রদীপ্ত চৌধুরীর বংশধর হিসেবে ওদের ছেলেমেয়েদের, তাদের ছেলেমেয়েদের আর কি কোনও আলাদা অস্তিত্ব থাকবে? তখন ‘চাউডারিইটা’ একটা আমেরিকান টাইটেল! …দে নো নাথিং অব বেঙ্গল, নট ইভন অব রবি ঠাকুর। কোনও ইন্টারেস্টও নেই জানার। ওখানে বাঙালিদের একটা বড় মেলা মতো হল, নাচ গান থিয়েটার ইত্যাদি ইত্যাদি…ওরা গেলই না। স্ট্রেট বলে দিল, ডোন্ট বোর আস পাপা। ওসব তোমাদের ক্ল্যানের ব্যাপার, আমরা ইন্টারেস্টেড নয়। ভাব, বাঙালি ওদের কাছে শুধু একটা ক্ল্যান!

—তাহলে ওরা আসছে না?

—ফ্যাট চান্স। আমিও জোর করব না। মনে করব, এটাই আমার শাস্তি। চটক দেখে গরিব মাতৃভূমিকে ভুলেছিলাম, এ তারই পরিণাম।

বড্ড বেশি নাটুকে ডায়ালগ হয়ে যাচ্ছে না? বুগিদা কি মাতাল হয়ে গেল? সৌম্য হাত বাড়িয়ে বুগির হাঁটুতে মৃদু চাপড় দিল,—কুল কুল। শান্ত হও।

—না রে, বুকটা পুড়ছে। তোকে বলে একটু হালকা হচ্ছি। বুগি সৌম্যর হাতে আলতো চাপ দিল,—ইফ আই কাম ব্যাক, তুই আমার পাশে থাকবি?

—এটা একটা কথা হল? সবাই তোমার পাশে থাকবে।

—উঁহু, ঠিক ওরকম নয়। আয়াম প্ল্যানিং সামথিং। টাকা পয়সা তো কিছু কামিয়েইছি, নিয়ে চলে এসে যদি একটা সফ্‌টওয়্যার কোম্পানি খুলি? লাইনের ঘাঁতঘোঁত তো মোটামুটি জানি, আমার কানেকশান্‌সও আছে, তুই আর আমি মিলে ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারব না?

এমন একটা প্রস্তাবের জন্য সৌম্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না। হতভম্ব মুখে বলল,— আমি?

—হ্যাঁ। তুই। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই হয়, আর মাসতুতো ভাইরা মিলে বিজনেস করতে পারে না? নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস, তুই লুজ করবি না।

—কিন্তু আমার তো ক্যাপিটাল নেই।

—বললাম তো, আমার আছে। তোকে খাটতে হবে। ম্যান ম্যানেজমেন্ট, রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সব তোর দায়িত্ব। তখন সারা রাত খাটলেও নিজের জন্য খাটবি।

—হুঁ…তা বটে। তবে…

—কী ভাবছিস? আনসার্টেনটি? আরে, এইটেই তো রিস্‌ক নেওয়ার বয়স।… ভাব ভাব…এটা বলার জন্যই তোকে আজ ডাকা। আমি আবার অক্টোবরে আসছি, তখন তুই আর আমি বসে ডিটেলে প্ল্যানটা চকআউট করব। এর মধ্যেও আমি যোগাযোগ রাখব, তোর ই-মেল অ্যাড্রেসটা আমায় দিস। ওখান থেকে তোকে আমি কিছু কিছু ইন্সট্রাকশান দেব, তুই সেগুলো ক্যারি আউট করবি। কী রে, কী ভাবছিস?

—দেখি।

ভাবনাটাকে মাথায় নিয়েই মোটরসাইকেলে ফিরছিল সৌম্য। সত্যিই ফিরবে বুগিদা? শেকড় বাকড় উপড়ে চলে আসবে? বলছে তো ওখানে শিকড় গজায়নি। হতেও পারে। মন টিকছে না, বয়স হচ্ছে তো। মার মুখে শুনেছে বুগিদা ওখানে গ্রিনকার্ড হোল্ডার হয়ে যাওয়ার পর মাসির অভিমান হয়েছিল খুব, মারা যাওয়ার আগে অবধি কষ্টটা যায়নি মাসির। বুগিদা বুদ্ধিমান লোক, হয়তো কিছু কিছু জানেও…ওই সব পুরনো স্মৃতিই কি এখন পীড়িত করছে বুগিদাকে? হুট করে একটা ব্যবসা এখানে খোলা কি মুখের কথা? বলছে সৌম্যকে পার্টনার করে নেবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা প্রভু-ভৃত্যে গিয়ে দাঁড়াবে না তো? পুঁজির পরিবর্তে শ্রম, বুগিদা এই অঙ্গীকারটা চিরকাল মনে রাখবে কি? অবশ্য তেমন হলে সৌম্য সরে আসতেই পারে, সে তো আর অথৈ জলে পড়বে না! বিজনেস যদি সত্যিই মসৃণভাবে চলে, কোথ্‌থেকে কোথায় পৌঁছে যাবে সৌম্য! তখন ফ্ল্যাট নয়, ফ্ল্যাট নয়, বাড়ি। দেয়া ফুলগাছ ভালবাসে, ইচ্ছে মতন বাগান করতে পারবে দেয়া। মেক্সিকান ঘাসের লন বানাবে। দুজনের আলাদা আলাদা গাড়ি থাকবে। ছুটি কাটাতে যাবে কলোরাডোয়, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ানের ওপর দিয়ে হাঁটবে দুজনে। কিংবা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নীচে মোটরবোটে ঘুরবে। দেয়ার ঐতিহাসিক জায়গা দেখার খুব শখ, রোমেও যেতে পারে তারা। কিংবা গ্রিস। মেডিটেরিনিয়ান সি! নীল সমুদ্রের পাড়ে আঙুরখেত। পার্থেননের ভাস্কর্য। ছেলেকে তারা কোথায় পড়াবে? পড়াশুনো যেমনই করুক, ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবে সৌম্য। নিজের খুব ইচ্ছে ছিল ক্রিকেট প্লেয়ার হওয়ার, এ জীবনে তো তা আর হয়ে উঠল না।

আচমকাই সচকিত হল সৌম্য। এ কী ভাবছে, অ্যাঁ? নিজের অতৃপ্তিটা ছেলেকে দিয়ে মেটাবে? মার সঙ্গে তাহলে কী তফাত রইল সৌম্যর?

হালকা হয়ে যাওয়া মাথায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে বিষাদ। গলার কাছে একটা জমাট ডেলা। সৌম্য জোরে নাক টানল। সৌম্যর কথা কি এখন মার মনে পড়ে? একটুও কি মন কেমন করে সৌম্যর জন্য? শীতের শেষে কদিন খুব জ্বরে ভুগেছিল সৌম্য, বাবা এসে কাহিল সৌম্যকে দেখে গিয়েছিল, নিশ্চয়ই ফিরে বলেছিল মাকে। একটুও কি উদ্বিগ্ন হয়েছিল মা? মনে পড়েছিল কি সৌম্যর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে জ্বোরো ছেলের মাথার কাছে জেগে ছিল সারারাত? কেন এত নিষ্ঠুর হল মা? কেনই বা সৌম্যকেও এত নিষ্ঠুর বানাল?

সুকান্তসেতু পার হচ্ছে মোটরসাইকেল। নীচ দিয়ে একটা ট্রেন চলে গেল। সামনে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা। বাতাস সামান্য আর্দ্র এখন। মেঘলা আকাশে ঝুলে আছে এক পাণ্ডুর চাঁদ।

মোটরসাইকেলটা প্লাস্টিকে ঢেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে সৌম্য। দৌড়ে দৌড়ে। হালকা একটা ঘোর আছে বটে, তবে স্নায়ু এখনও পুরো নিয়ন্ত্রণে। ফ্ল্যাটের দরজায় এসে বেল বাজিয়ে ঘড়ি দেখল। ছি ছি, অনেকটা রাত হয়ে গেছে, দেয়াকে বলে যায়নি, নিশ্চয়ই দেয়া চিন্তা করছে। এমন দুম করে অফিসে বুগিদার কোনটা এসে গেল! দেয়ার ডে-শিফ্‌ট চলছে, ওকে তো অফিসেই ফোন করে দেওয়া যেত। হোটেলেও মনে পড়া উচিত ছিল। মোবাইল থাকলে এ ভুলটা হত কী? নাহ্‌, এবার সেলুলার নিতেই হবে।

লক্ষ্মী দরজা খুলে সরে দাঁড়িয়েছে। ফ্ল্যাটে ঢুকে হেলমেটটা স্বস্থানে রাখল সৌম্য। তখনই চোখে পড়ল একটা অল্পবয়সি মেয়ে বসে আছে রান্নাঘরের সামনেটায়। জড়োসড়ো হয়ে।

কে রে বাবা? লক্ষ্মীদির আত্মীয় নাকি? সৌম্য লক্ষ্মীকেই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, দেয়া বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। মেয়েটাকে দেখে নিল একবার, তারপর চাপা স্বরে বলল,—ও শিউলি।

—কে শিউলি? সৌম্যর ঠিক বোধগম্য হল না।

দেয়া ইশারায় ঘরে ডেকে নিল সৌম্যকে,—সেই মেয়েটা। বেলেঘাটার।

—এখানে কেন? সৌম্য হকচকিয়ে গেছে।

—ওর মা মারা গেছে না?

—হ্যাঁ। তো?

—ও আর ওখানে থাকতে পারছিল না।

—কেন? কী হয়েছে?

—খুব বিশ্রী সিচুয়েশান। চারদিকের ঘর থেকে আজেবাজে টিটকিরি মারছে, বাড়িঅলার শাসানি, পাড়ার ছেলেদের উৎপাত, গায়েপড়া হয়ে যে যখন পারছে ঘরে ঢুকে পড়ছে…মানুষের মনে একটু মায়াদয়াও নেই। জানো, ওর মার মরার খবর পেয়ে মাসিগুলো এসেছিল, যে যার মতো ভেগে গেছে। কেউ ওর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।

সৌম্য বিড়বিড় করল,—তাই তুমি নিয়ে চলে এলে?

—উপায় কী! যা হাল, চোখে দেখা যাচ্ছিল না।

—ও এখানেই থাকবে নাকি?

—কয়েকটা দিন তো থাক। তারপর দেখি কী ব্যবস্থা করতে পারি।

সৌম্য হতবাক। দেয়াটা হঠাৎ হঠাৎ এমন সব কাজ করে বসে।

আট

রান্নাঘরে দুটো থালায় ভাত বেড়েছে লক্ষ্মী। ভারী সোয়াদের ব্যঞ্জন আছে আজ। ইলিশমাছের তেল, ইলিশের কাঁটা দিয়ে পুঁইশাকের চচ্চড়ি, সর্ষেইলিশ, আমড়ার টক। অন্য দিন দু গাল ভাত নিয়ে কত ন্যাকর ছ্যাকর করে মিমি, আজ চেটেপুটে খেয়ে গেল। মাছটার পেটে সবে ডিমের ছাঁচ এসেছিল, প্রচুর তেলও বেরিয়েছে, এ মাছের জাতই আলাদা। ভাজার সময়ে কী সুবাসটাই না বেরোচ্ছিল! আহা।

লক্ষ্মী জল গড়িয়ে থেবড়ে বসল। গলা উঠিয়েছে, —এই মেয়ে, খাবি আয়।

কাঁটা চচ্চড়ির গন্ধ লাগছেনাকে। আঁশটে আঁশটে। জিভে জল এসে যায়। লক্ষ্মী আর এক হাতা ভাত নিল নিজের পাতে। এবারের চালটা বেশ, মিমি দেখেশুনেই এনেছে, কাঁকর তো নেইই, বরং দিব্যি মিষ্টি মিষ্টি ভাব। মিমি আর দাদার জন্য আসে গোবিন্দভোগ, ফোটার সময়ে খুব সুঘ্রাণ, ভাতও হয় ভারী ফুরফুরে, তবে খেতে কেমন ভসকা ভসকা। লক্ষ্মী চেখে দেখেছে। দিলেও ওই চালের ভাত লক্ষ্মীর মুখে রুচত না, পেটই ভরে না ওতে। তার চেয়ে লক্ষ্মীর পুরুষ্টু ঢেঁকিছাঁটা চাল ঢের ঢের ভাল।

মাছের তেলে ভাত মাখছে লক্ষ্মী। হাত থামল হঠাৎ। স্থূল দেহখানা হেলল পিছন পানে। চোখ ঘুরল এপাশ ওপাশ, —কই রে মেয়ে, গেলি কোথায়?

সাড়া নেই।

ওফ্‌, লক্ষ্মীর হয়েছে জ্বালা। একবার বসলে উঠতে প্রাণ যায়। কোথায় এখন ওই মেয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে কে জানে! দিনভর কেন যে এত গুমরোয়? যে যাওয়ার সে তো চলেই গেছে, কেঁদে কেটে তুই কি আর তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবি বাছা? লক্ষ্মীরও তো ভাই হতে গিয়ে মা মরে গেল, তখন লক্ষ্মী বারো কি তেরো, কদিন দাওয়ায় হাত পা ছড়িয়ে কেঁদেছে লক্ষ্মী? আর অঘটন যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে, মুখ ভেটকে বসে থাকলে তুই কি ফের সতী সাবিত্তির হয়ে যাবি? হাজার বার সাবানকাচা করলেও এঁটো মেয়ের কলঙ্ক ধোয় না। তাও তো কপালগুণে মিমির দর্শন পেয়ে গেলি, শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খেল না তোকে, সেই কথাটাও তো ভাব।

লক্ষ্মী বিরক্ত মুখে চেঁচাল, —এই মেয়ে, কতক্ষণ ভাত কোলে বসে থাকব? আমারও তো খিদেতেষ্টা পায়, না কী?

এবার হাঁকে কাজ হল। গুটিগুটি পায়ে এসেছে শিউলি। দরজা জুড়ে বসে থাকা লক্ষ্মীকে টপকাল সন্তর্পণে। ঘাড় নিচু করে বসেছে।

লক্ষ্মী বলল, —নে, শুরু কর।

ভাত ভাঙল শিউলি। খাচ্ছে না, খুঁটছে।

—কী হল? খা। লক্ষ্মী কাঁটা চুষতে চুষতে আড়চোখে তাকাল, —পেট বড় বালাই রে মেয়ে। পেটের জন্যই তো দুনিয়ায় যত কিছু। সুখ বল, দুঃখু বল…

লক্ষ্মীর দার্শনিক ভাষণে বড় একটা প্রতিক্রিয়া হল না শিউলির। বসেই আছে চুপচাপ।

গলা আরও মিহি করল লক্ষ্মী, —দিনরাত কী এত ভাবিস বল তো দিকি? তোর ভাবনা তো এখন দিদি ভাবছে। দেখছিস না, ছুটছে কত জায়গায়। ভাল একটা ঠাঁই তোর জুটেই যাবে। বরং যদ্দিন আছিস একটু সুখ ভোগ করে নে। দ্যাখ চেয়ে, কী দামের মাছ! দুশো টাকা কিলো! ফলটা মাছটা মাংসটা কত কী জুটছে রোজ। এ বাড়ির মানুষের মন খুব বড়, ঝি-চাকরকে সব দিয়ে খায়। দোতলার শ্যামা, দেখেছিস তো কাল দুপুরে এসেছি…শুনলি না কত গাল পাড়ছিল বাবুদের! বোগড়া বোগড়া চাল দেয় খেতে, সেদ্ধই হতে চায় না, সেদ্ধই হতে চায় না, ভাত হয় ছাগলের নাদির মতো…

লক্ষ্মীর বক্তৃতাটা শেষ হল না, শিউলি আচমকাই ফুঁপিয়ে উঠেছে।

—আ মোলো যা। ফের সাগর ভাসাস কেন?

শিউলির কান্না হু হু করে বেড়ে গেল। কেঁপে কেঁপে ফুলে ফুলে উঠছে মেয়ে, —আমি পাপী মাসি…মহাপাপী। আমার নরকেও জায়গা নেই।

—আহা, চুপ কর। পাপপুণ্যের বিচার তো তিনি করবেন। তুই কি নিজের ইচ্ছেয় পাপ কাজ করেছিলি? ভগবান কি তা দেখেননি?

—আমার জন্যই মা মরে গেল মাসি…আমার মা…আমার মা…

খিদের অন্ন সামনে নিয়ে শিউলির এই প্যাখনা ভাল্লাগছিল না লক্ষ্মীর। এসে ইস্তক মেয়েটা শুধু ম্যা ম্যা করে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। মার জন্য এই দরদ ঘর ছেড়ে ভাগার সময়ে কোথায় ছিল বাছা? ওই মা যে কী জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরেছে লক্ষ্মী কি বোঝে না? লক্ষ্মী ওই মার জায়গায় থাকলে অনেক আগেই বিষ খেয়ে মরত।

তবু একটু একটু মায়াও জাগছিল লক্ষ্মীর। হাজার হোক কচি মেয়ে, এইরকম একটা ডবকা বয়সেই তো মেয়েরা ভুলভ্রান্তি করে। সত্যি তো, মেয়েটাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়ে গেল মা।

লক্ষ্মী কথা বলে বলে শিউলিকে ভোলাতে চাইল। কথার অনেক জাদু আছে, কথায় মানুষের শোক ঝরে, পাথরবুকও হালকা হয়।

মাথা দুলিয়ে লক্ষ্মী বলল, —এই দুনিয়ায় কেউ কারুর দোষে মরে না রে মা। মানুষ মরে যে যার কর্মদোষে।

—কিন্তু আমার মা তো কোনও দোষ করেনি মাসি।

লক্ষ্মী মনে মনে বলল, করেছিল তো বটেই। তোকে পেটে ধরেছিল।

মুখে বলল, —সব দোষ কি আমরা চিনতে পারি বাছা? নিশ্চয়ই করেছিল।

—না মাসি, মাকে আমিই মেরে ফেলেছি।

—বালাই ষাট। তুই কেন নিজেকে নিমিত্তের ভাগী ভাবিস?

—তুমি জানো না মাসি, আমি সেদিন মাকে কত আকথা কুকথা বলেছি!

—হেই মা, কী বলেছিলি মাকে?

—সে আমি বলতে পারব না মাসি, আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।

—পেটে কথা চেপে রাখিস না বাছা। বল। বললে একটু লাঘব হবি।

—সেদিন মা মহাজনের ঘরে ব্লাউজ ডেলিভারি দিয়ে ফিরছিল…। শিউলি হাতের পিঠে নাক মুছল, —পথে হুলো নাটারা ধরেছিল মাকে…

—হুলো নাটা আবার কে?

—খালপাড়ে থাকে। মহা হারামি। মার সঙ্গে খচড়ামি করছিল। বলে, আর ওসব সেলাইফোঁড়াই করে কী হবে, মেয়েটাকে পাঠিয়ে দে, রানি করে রাখব.…বারোভাতারি মেয়েকে ঘরে পুষে রেখেছিস কেন…! মা ঘরে ফিরে খুব ঝাল ঝাড়ল আমার ওপর। চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল। বলছিল, ফিরলি কেন তুই? যেখানে ছিলি তো ভাল ছিলি, মরতে আমায় আবার খেতে এলি কেন? …আমারও তখন আর মাথার ঠিক ছিল না মাসি। আশপাশের ঘর থেকে সব তখন মজা দেখছে। তাদের সামনেই বলে দিলাম, মা হয়ে তুমি তো চাও আমি লাইনেই নামি! আমার গতরবেচা পয়সায় তোমার এত শখ? তাই হোক, তাই হোক। …কথাগুলো মার বুকে খুব বেজেছিল গো মাসি। আমি রাগের মাথায় বেরিয়ে গেছিলাম…বেশি দূর যাইনি গো, লেকের পাড়ে গিয়ে বসেছিলাম মনের দুঃখে …খানিক পরেই ফিরে দেখি দোর বন্ধ, মা খুলছে না …শেষে আশপাশের লোক দরজা ভেঙে ফেলল…। এতখানি টানা বলে শিউলি জোরে ডুকরে উঠেছে, —মা আমার গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছিল গো মাসি…!

লক্ষ্মী ঝুম হয়ে গেল। অদেখা সেই শিউলির মা যেন ভেসে উঠল লক্ষ্মীর মনশ্চক্ষে। কোনও অবয়ব নয়, শুধু ঝুলন্ত এক নারীদেহ!

আর খেতে পারল না লক্ষ্মী। সুস্বাদু ইলিশ কেমন পানসে পানসে ঠেকছে। ধরা ধরা গলায় বলল, —রাগ হল চন্‌ডাল রে মা। রাগ মানুষের কত সব্বোনাশ যে করে!

শিউলি চুপ। কথাটা বলতে পেরে কান্নাও থেমেছে তার। খাচ্ছে অল্প অল্প। ধীরে ধীরে।

লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করল, —দেব আর একটু ভাত? তুই খাস না বলে কমই দিয়েছি।

—নাহ্‌। কান্নার রেশে ঈষৎ কেঁপে উঠল শিউলি। আবার মাথা নামিয়েছে।

টকে চুমুক দিয়ে লক্ষ্মী উঠে পড়ল। সিঙ্কে নিজের থালা গেলাস ধুয়ে রেখে দিল জায়গায়। পায়ে পায়ে ব্যালকনিতে এল। মিমিদের বিছানার নতুন বেডকভারটা থেকে খুব রং উঠছে, মেশিনে দেওয়া যায় না, সবিতা বেলায় কেচে দিয়ে গেছে। শুকনো চাদরখানা প্লাস্টিক দড়ি থেকে নামাল লক্ষ্মী। ভাঁজ করছে। অজান্তেই ছোট্ট একটা শ্বাস পড়ল। স্বস্তির। ভাগ্যিস তার মেয়ে দুটোর সময় মতো বিয়ে দিয়ে দেওয়া গেছে! দিনরাত তো কাজের বাড়িতেই কাটত লক্ষ্মীর, মেয়েদের তেমন চোখে চোখেও রাখতে পারেনি, তবু তার মেয়েরা যে শিউলির মতো কিছু বাধিয়ে বসেনি, এও কম ভাগ্যের কথা নয়। বড় মেয়েটা একটু খলবলে মতো ছিল, এদিক ওদিক উড়ে বেড়াত, চোদ্দো পুরতে না পুরতেই তাকে ভালয় ভালয় পার করেছে লক্ষ্মী। সাধনা এখন তিন বাচ্চার মা। ছোটটার বিয়ে দিতেও খুব একটা বেগ পেতে হয়নি লক্ষ্মীকে। কল্পনার গায়ের রং পরিষ্কার, মুখখানাও ঢলঢলে, এক দেখাতেই উতরে গিয়েছিল কল্পনা। মেয়েরা কি তার সুখে আছে? যেমনই থাক, শিউলির দশাতে তো নেই।

অন্দরে টেলিফোনের ডাক। থপ থপ করে বড়ঘরে এল লক্ষ্মী। রিসিভার কানে চাপতেই মুখ হাসিতে ভরে গেছে। মিমির মা।

—কে? লক্ষ্মী? মিমি কই? ডাক, ওকে একটু গালাগাল দিই।

—সে তো অনেকক্ষণ বেরিয়ে গেছে গো বউদি। তা ধরো প্রায় এগারোটায়।

—কেন? ওর আজ বিকেলের ডিউটি না?

—বলল তো বেহালা না কোথায় ঘুরে অপিস যাবে।

—কোনও হোম টোম হয়ে?

—তাই তো বলছিল।

—ওফ্‌, মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। কোথ্‌থেকে যে এক আপদ জুটিয়ে আনল! সবাই বিরক্ত হচ্ছে, সবাই রাগ করছে…মিমির বাবা দাদা…

—এ বাড়িতেও তো তাই গো বউদি। লক্ষ্মী এদিক ওদিক দেখে নিয়ে গলা নামাল, —দাদাও একদম পছন্দ করছে না।

—না করারই তো কথা। হুট করে একটা নোংরা মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। খারাপ রোগ টোগ নিয়ে এসেছে কিনা তার ঠিক নেই…। ওপ্রান্তে গৌরীর উত্তেজিত স্বর থমকাল হঠাৎ, —মিমি নিশ্চয়ই সৌম্যর সঙ্গে এঁড়ে তর্ক করে যাচ্ছে?

—হ্যাঁ গো বউদি। দেখা হলেই দুজনের খুটুর খুটুর লাগছে।

—হুম্‌। গৌরী আবার একটু চুপ, —তা সেই মহারানি এখন কোথায়?

—সে তো খালি কেঁদেই চলেছে।

—আর মিমিও গলে যাচ্ছে? বোকার বোকা তস্য বোকা মেয়েটা। অফিসের কাজ, অফিসের ঝামেলা অফিসেই সারবে। বাড়ি এনে তুলবে কেন?

—যা বলেছ। শিউলির ওপর খানিক আগেও জেগে ওঠা দয়ামায়া বেমালুম মুছে গেল লক্ষ্মীর। গলা খাদে নামিয়ে বলল, —পাড়াতেও তো ঢি ঢি পড়ে গেছে। সবিতা তো আরও পাঁচটা ফেলাটে কাজ করে…সবিতা জানলে সন্তোষপুরে আর কারুর জানতে বাকি থাকে?

—সবিতাকে কে বলল? তুই?

লক্ষ্মী ঢোঁক গিলল। সবিতা তার মাধ্যমেই জেনেছে বটে বেশিটা, তবে মিমিও গল্প কিছু করেছে তো! মেয়েটা বিপদে পড়েছে, মেয়েটার মা মরেছে, মেয়েটাকে দেখার আর কেউ নেই…! বলেছে কি না?

গলা ঝেড়ে লক্ষ্মী অর্ধসত্য বলল, —তোমার মেয়েকে চেনো না বউদি? ও কি পেটে কথা রাখবে?

—তাও তো বটে। তিনি তো আবার যুধিষ্ঠিরের কন্যা! …তা ফ্ল্যাটের কেউ বলছে কিছু?

—মুখে বলছে না, তবে সবারই খুব জানার ইচ্ছে। এই তো সামনের বউদি…জন্মে এ বাড়ির ছায়া মাড়ায় না…কাল সকালে এসে মিমির সঙ্গে কত গপ্পো! চোখ কিন্তু সারাক্ষণ শিউলির দিকে। আমি কাল দোক্তা আনতে বেরিয়েছিলাম, নীচের তলার সিড়িঙ্গে বউটা আমায় কত প্রশ্ন যে করল!

তবেই দ্যাখ, সৌম্য রাগ করে আর না করে! ভদ্রলোকের বাড়িতে গায়ে পড়ে এসব ঝঞ্ঝাট ঢোকায় কেউ?…মিমি যত রাত্তিরেই ফিরুক, এলেই বলবি আমায় যেন একটা ফোন করে।

—বলব।…তুমি যেন আবার মেয়েকে বোলো না আমার কাছ থেকে এত কথা শুনেছ। আমায় কিন্তু তাহলে খুব বকবে।

—ঠিক আছে।…শোন, সারাক্ষণ মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখবি। চুরি টুরি করে না পালায়। কোথাকার কে তার ঠিক নেই…

বটেই তো। সত্যি তো। টেলিফোন রেখে লক্ষ্মী গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। বউদি কথাটা তো খুব ভুল বলেনি! ঘরে এত দামি দামি জিনিসপত্তর, বাবু বিবি দুজনেরই ছড়িয়ে রাখা স্বভাব…। বিশেষ করে মিমির। এই কানের দুল টেবিলে পড়ে রইল, ওই সোনার হার বাথরুমে খুলে রেখে এল…একটাও হারালে লক্ষ্মীদিরও তো বদনাম। ভাবতে পারে ওই মেয়ে আসার সুযোগ নিয়ে লক্ষ্মীদিই…!

লক্ষ্মী ধড়মড় করে রান্নাঘরে এল। শিউলি নেই। আবার কোন গর্তে গিয়ে লকোল রে বাবা? হুঁউ, যা ভেবেছে তাই। ছোটঘরে এসে শুয়ে পড়েছে। গুটিয়ে মুটিয়ে। ডিভানের সামনেটায়। লক্ষ্মী একবার ভাবল তুলে দেয় মেয়েটাকে। এ ঘরে দাদা কাজকম্মে করে, একটা জিনিস এদিক ওদিক হলে খুব রাগ করবে। তারপর ভাবল থাক, কোথাও একটা জায়গা তো দিতেই হবে। অন্তত যদ্দিন আছে এ বাড়িতে।

বড় ঘরে ফিরে লক্ষ্মী গড়িয়ে পড়ল কার্পেটে। এ সময়ে একটা ভাতঘুম আসে, চোখটা জড়িয়ে যায়।

আজ লক্ষ্মীর কে জানে কেন ঘুম আসছিল না। শিউলির মার কথা মনে হচ্ছিল। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেই পড়ল? আহা রে, বিধবা মানুষ আঘাতে আঘাতে কী জেরবারটাই না হয়েছে! কেমন দেখতে ছিল মেয়েমানুষটা? মোটাসোটা? রোগভোগা? কদ্দিন আগে মরেছে যেন শিউলির বাপ? ভাবতে গিয়ে আর একটা লোক এসে যাচ্ছে সামনে। বেঁটেখাটো লিকলিকে চেহারা, ভূঙ্গির মতো গোঁফ, ভাঁটার মতো চোখ। লোকটা সেই বনকাটি গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিল লক্ষ্মীকে। গোপালনগরের বস্তিতে। কাজ করত ব্যাটারি কারখানায়। সংসার পাতাই সার, মন পড়ে থাকত শ্মশানে। গাঁজা-ভাং খেয়ে রাতবিরেতে টং হয়ে ফিরছে, গায়ে তখন অসুরের বল, একটা কথা বললেই মেরে পাট পাট। তারপর একদিন কোন বাবার চ্যালা হয়ে কোন দেশে যে চলে গেল। দু দুটো মেয়ে নিয়ে লক্ষ্মী খেটে মরছে বাবুদের দোরে দোরে…

লোকটার কথা বুকে নিয়েই কখন যেন একটুখানি ঘুম নেমেছে চোখে। তন্দ্রার ঘোরেই ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্ন। বনকাটি গ্রামের তেঁতুলতলায় লক্ষ্মীর বিয়ে হচ্ছে। জটাজুটধারী, হাতে ত্রিশূল, মাথায় শোলার টোপর পরা বর। অট্টহাসি হাসছে বর, ত্রিশূল দিয়ে খোঁচাচ্ছে লক্ষ্মীকে। তারপরই চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল, ঢুকিয়ে দিয়েছে এক ছিটে বেড়ার ঘরে। সেখানে কিলবিল করছে শয়ে শয়ে রংমাখা মেয়ে, এক একটা পুরুষ আসে, আর তারা খিলখিল হেসে তাদের নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। একটা লোক জোর করে কাপড় খুলে দিচ্ছে লক্ষ্মীর। উলঙ্গ লক্ষ্মী প্রাণপণে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। পালাচ্ছে। দৌড়চ্ছে গোপালনগরের ট্রামরাস্তা ধরে। দৌড়তে দৌড়তেই দেখতে পেল দুই মেয়েকে। সাধনা কল্পনার গায়েও সুতোটি নেই। লক্ষ্মী চেঁচিয়ে উঠল পালা, জেলখানায় ঢুকে পড়। জেলখানার গেটে সেপাই সেজে দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ্মীর সেই মানুষটা। হাতে ত্রিশূল, মাথায় জটা, পরনে খাকি পোশাক। লোকটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল, গাঁজা লাও! লক্ষ্মী কোনওক্রমে জেলখানার ভেতরে ঢুকে পড়ল। সামনেই এক ফাঁকা মাঠ, সেখানে শূন্যে ঝুলছে ফাঁসি দেওয়ার দড়ি। লক্ষ্মী গলায় ফাঁসটা লাগিয়ে শূন্যে ঝুলে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বাজনা বেজে উঠেছে। ঝ্যাং ঝ্যাং…

পটাং চোখ খুলে গেল লক্ষ্মীর। কলিং বেল!

আধবোজা চোখে উঠল লক্ষ্মী। দরজা খুলেছে। সবিতা।

—কী গো, এত ঘুম? কত বার ধরে ঘন্টি বাজাচ্ছি!

ঘোর কাটেনি লক্ষ্মীর। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলল, বাসনগুলো ভাল করে মাজিস। নইলে আঁশটে গন্ধ বেরোবে।

রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে সবিতা চোখ নাচাল, শিউলি কোথায় গো?

—কেন?

—তখন উলটো দিকের বাড়ি থেকে ঘর মুছে বেরোচ্ছি, দেখি রাস্তায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। গুণ্ডা মতন।

—তো?

—এই ফেলাটের দিকেই দেখছিল। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই হনহন হাঁটা দিল।

লক্ষ্মীর চোখ সরু হল, কখন দেখেছিস?

—বললাম তো। বারোটা একটা। সবিতার ভুরুতে ভাঁজ, সিঙ্কে দাঁড়িয়ে বাসনের ডাঁই-এ হাত লাগাল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ চলছে, মনে হল যেন শিউলিও বারান্দায় ছিল। আমায় দেখে সরে গেল।

সবিতা অম্লান বদনে গুল মারতে পারে। লক্ষ্মী চোখ পাকাল, মিছে কথা বলিস না। মুখে কুড়িকুষ্টি হবে।

—বুঝবে বুঝবে। যেদিন ঘরে পুরুষমানুষ ঢোকাবে! তোমার গলা কেটে রেখে যাবে!

লক্ষ্মীর মুখ শুকিয়ে এতটুকু। ভয়ে ভয়ে প্রতিবাদ করল, বাজে বকিস না। ও তো কদিন বাদেই চলে যাচ্ছে।

—আগে যাক। এমন আরামের জায়গা, কর্তাগিন্নি কেউ থাকে না…। সবিতা ফিকফিক হাসছে, যদি থেকে গেল তত তোমার কপাল পুড়ল। কথায় কথায় আমায় মুখ শোনানো, মৌরুসিপাট্টা গেড়ে থাকা, সব ছুটে যাবে। অমন একটা জোয়ান ছুঁড়ি পেয়ে গেলে তোমাকে কি রাখবে বউদি? সাত জন্মে ও মেয়ের বিয়ে হবে না…কত সুবিধে বলো?

ওরকমটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। ছোট থেকে মিমিকে দেখছে লক্ষ্মী, মিমি তাকে মা মাসির মতো ভালবাসে। লক্ষ্মী চলে গেলে মিমির এই সংসার সামলাবে কে? ওই মেয়ে? হুঁহ্‌

ঘটাং ঘটাং বাসন মাজা শেষ। তুফান মেলে এসেছিল সবিতা, পঞ্জাব মেলে চলে গেল। মাঝখান থেকে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে দিয়ে গেল লক্ষ্মীর মনে। ধোঁয়াশার মতো। মুখ ঝুলিয়ে খানিক এদিক ওদিক ঘুরল লক্ষ্মী, ঘরদোর ঝাড়াঝুড়ি করল। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল খানিকক্ষণ। মেঘ মেঘ আকাশ, বৃষ্টি পড়ছে টিপ টিপ। রাস্তা সুনসান, কেউ কোথাও নেই। তবু লক্ষ্মী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল চারদিক। সবিতা কি বানিয়ে বানিয়ে বলল কথাটা? খেতে ডাকার সময়ে মেয়েটা ছিল কোথায়? বারান্দায়? মিমিকে বলবে কি আজ?

ধোঁয়াশা বাড়ছে। ছোটঘরে এসে শিউলিকে ঠেলল লক্ষ্মী, অ্যাই মেয়ে, ওঠ। এই কাঁদছিস, এই ঘুমোচ্ছিস…তোর ধরনধারণ বাপু আমি বুঝি না।

শিউলি ফোলা ফোলা চোখে উঠে বসেছে।

—গ্যাস জ্বালতে পারবি তো?

—হ্যাঁ।

—যা, গিয়ে দু কাপ চা বানা। আমারটা গেলাসে দিবি, তোরটা কাপে নিবি। ওই পুরনো কাপটা, যেটা তোর জন্য বের করে দিয়েছি।

শিউলি বাধ্য মেয়ের মতো রান্নাঘরে গিয়ে কেটলি বসিয়েছে। ইস্ত্রি করার টেবিলে দুটো সালোয়ার-কামিজ পড়ে, চোখে পড়তেই ব্যস্ত হল লক্ষ্মী। ইস্ত্রির প্লাগ লাগাতে যাচ্ছিল, ফের কলিং বেল।

দরজা খুলে লক্ষ্মী অবাক, তুমি? আজ আবার?

সুভাষ একটা ভেজা ভেজা প্লাস্টিকের পুঁটলি ধরিয়ে দিল লক্ষ্মীকে, গাছ থেকে নারকোল পেড়েছিলাম। আপনার ছোট মেয়ে নাড় বানিয়ে পাঠিয়েছে।

লক্ষ্মী মনে মনে খুশি হল। টাকাটা দিয়েছে বলে ছোট জামাই আজকাল খুব খাতির করছে। নইলে শাশুড়িকে শুধু নাড়ু খাওয়াতে সোনারপুর থেকে উজিয়ে আসার ছেলে নয় সুভাষ। লক্ষ্মী জানে কল্পনাকে সুভাষ বেশ মারধোরও করে, আকণ্ঠ গিলে এসে বাপ-মা তুলে খিস্তিখাস্তাও করে খুব।

লক্ষ্মীর মনে মনে খটকাও লাগল একটু। শিউলি এসেছে মঙ্গলবার, বুধবারই সুভাষ তাকে দেখে গেছে…! আবার শনিবারেই নাড়ু দেওয়ার দরকার পড়ল?

সুভাষের তোয়াক্কাই নেই। দিব্যি ফ্যান চালিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসেছে সোফায়। পরনে ঘিয়ে রং ফুলপ্যান্ট, ডোরাকাটা গেঞ্জি। পা নাচাচ্ছে।

লক্ষ্মী সামনে কার্পেটে বসল, এই বর্ষায় নারকোল পাড়তে গেলে কেন?

—দাদার টাইমটা ভাল যাচ্ছে না। বর্ষাকাল পড়ে গেল, এখন আর কেউ তেমন ঘরবাড়িও তুলছে না, হাতে কাজ নেই…বলল, সুভাষ নারকোলগুলো নাবা। এই বেলা ভাগাভাগি করে নিই… আপনার মেয়েও বলল, মা নাডু খেতে ভালবাসে, মাকে কেউ করে খাওয়ানোর নেই…

শিউলি রান্নাঘরের দরজায়। দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করল, মাসি, চা দেব?

সঙ্গে সঙ্গে সুভাষের দন্ত বিকশিত, কী গো, কেমন আছ? সব ঠিকঠাক তো?

শিউলি চোখ নামিয়ে নিল।

—লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমি তো তোমার জামাইবাবু। মাসির মেয়ের বর। কুটুম।

শিউলি সরে গেল।

লক্ষ্মী নিজেই উঠে নিয়ে এল চা। সুভাষকে বলল, চা খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। আকাশের অবস্থা আজ ভাল নয়।

—আকাশের সঙ্গে আমার কী মা? আমরা তো সবসময়েই জলে ভিজছি।…আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শও ছিল মা।

—কী? লক্ষ্মী আশঙ্কিত স্বরে বলল, রিকশার টাকা পুরো দিয়ে দিয়েছ?

—না না, রিকশা নয়। অন্য কথা ছিল। ভাবছি এবার পুজোর পর আমাদের ঘরের সঙ্গে আর একটা ঘর তুলে নেব। আপনার জন্যে। আপনার মেয়ে চব্বিশ ঘণ্টা দুঃখ করে, মা চিরকাল লোকের বাড়ি খেটে খেটে মরল…বুড়ো হচ্ছেন, আপনার তো এখন একটা রিটানমেন দরকার। শেষ জীবনটা নয় মেয়ে নাতি নিয়েই রইলেন আপনি…

কথাটায় বড় প্রলোভন আছে। লক্ষ্মীর বুক পলকের জন্য চলকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই সাবধানী হয়েছে। ঝানু ক্রেতার মতো জিজ্ঞেস করল, আমায় কত দিতে হবে?

—সে আপনি যা পারেন। কোনও জোর নেই।

—আর যদি না পারি?

—তাতে কী। সুভাষ যেন মিইয়ে গেল, আপনি থাকবেন সঙ্গে…

—না বাবা। আমি বেশ আছি।

লক্ষ্মী মন শক্ত করল। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, শাস্ত্রের বচন। নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে আছে। সে, কেন শুধু শুধু অনিশ্চিতের পথে যাবে? জন জামাই ভাগনা, কেউ নয় আপনার। দূরে দূরে থাকাই ভাল।

—তাহলে এখন কদিনের জন্যই চলেন। নাতনি তো আপনার কথা খুব বলে। আপনার তো আমার রিকশাতেও চড়া হয়নি।

—যাব যাব। বর্ষাটা যাক।

—গেলে কিন্তু কটা দিন থাকতে হবে।

—দেখি।

শিউলি নতমুখে কাপ নিতে এসেছে। ধীর পায়েই ফিরে যাচ্ছিল, সুভাষ ডাকল, এই যে, এক গেলাস জল খাওয়াও তো।

লক্ষ্মীর চোয়াল শক্ত হল। গোমড়া মুখে বলল, চা খেয়ে জল খেতে হবে না। অম্বল হয়ে যাবে।

সুভাষ কী বুঝল কে জানে। বুঝি সামান্য আহত হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে আজ চলি।

—এসো।

দরজা খুলেও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে সুভাষ। কী যেন ভাবছে। ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমি কিন্তু মঙ্গল বুধবার আর একবার আসতে পারি না। গাছে ভাল লাউ হয়েছে, দিয়ে যাব।

—না না, এ বাড়িতে কেউ লাউ খায় না। লক্ষ্মী ঝটপট বলে উঠল, আমারও লাউ খেলে ঠাণ্ডা লাগে।

—কিন্তু কল্পনা যেন বলছিল আপনি লাউ…

—মাকে ছেড়ে বহুকাল আছে তো, ভুলে গেছে। লাউ আমি ভালবাসতাম ঠিকই, তবে অনেককাল ছেড়ে দিয়েছি। ভালবাসলেই কি আর সব জিনিস সহ্য হয়?

ঈষৎ অপ্রস্তুত মুখে চলে গেল সুভাষ।

লক্ষ্মীর মনের ধোঁয়াশা আরও জমাট। এ কী উপদ্রব শুরু হল রে বাবা? হে ভগবান, মিমি যেন তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে চালান করতে পারে।

শিউলি বেরিয়ে খাবার টেবিলের সামনে। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, মাসি, ঘর ঝাড়াঝুড়ি করব?

লক্ষ্মী রীতিমতো রুক্ষ হল, তোর অপেক্ষায় কি কাজ পড়ে আছে?

—আটা মাখব?

—কেন রে বাছা, আমি কি অথর্ব হয়ে গেছি?

—তাহলে দিদির সালোয়ার-কামিজ দুটো ইস্ত্রি করে দিই? আমি পারি।

—না। তোমায় কোনও জিনিসে হাত দিতে হবে না। কোথায় কী হারাবে…

শিউলির মুখ ছাইবর্ণ। পা দিয়ে পায়ের নখ খুঁটছে।।

লক্ষ্মী মন দিল নিজের কাজে। মিমি হয়তো রাতে ভাত-রুটি মিশিয়ে খাবে। রুটির সঙ্গে একটা কোনও পদ রান্না করা দরকার। ছোট ছোট কটা আলু বেছে প্রেশারে বসিয়ে দিল। আলাদা করে পেঁয়াজ আদা রসুন বেটে নিল মিক্সিতে। আলুর দম চড়িয়েছে। গোটা তিনেক ল্যাংড়া আমের মুখ ছুলে ভিজিয়ে রাখল জলে। শশা পেঁয়াজ কাটল চাকা করে, প্লেটে সাজিয়ে লেবু নুন ছড়াল। দাদা আর মুনিয়া দুজনেই খুব স্যালাড ভালবাসে।

বিকেল বড় দ্রুত ঘন হয়ে আসছে। বিদায়বেলায় সূর্য আর মুখ দেখাতে পারল না।

ফ্ল্যাটের চাতালে এই সময়ে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করে, আজ তাদেরও কলকলানি তেমন শোনা যাচ্ছিল না।

হাতের কাজ সেরে লক্ষ্মী ছোটঘরে যাচ্ছিল, হঠাৎই পা আটকে গেল। মিমির শোওয়ার ঘর এফোঁড় ওফোঁড় করে দৃষ্টি গেছে ব্যালকনিতে। মিমি দাঁড়িয়ে! মিমি কখন এল?

দু তিন সেকেন্ড। সঙ্গে সঙ্গে ভুল ভেঙেছে। মিমি কোথায়, ও তো শিউলি। মিমির পুরনো সালোয়ার-কামিজটায় পিছন থেকে হুবহু মিমির মতো লাগছে।

শিউলিকে মিমি বলে ভুল হল কেন? আশ্চর্য!

নয়

—কী রে, গালে হাত দিয়ে বসে কেন?

দেয়া অন্যমনস্ক ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল সুকন্যা এসে গেছে ইভনিং ডিউটিতে। হাতের সানগ্লাস ব্যাগে ভরছে। আলগাভাবে বলল, ও, তুই!

সুকন্যা চেয়ার টেনে বসল পাশে, কী ভাবছিস এত?

দেয়া চিন্তিত মুখে বলল, কিছুতেই কিছু করতে পারছি না রে। মেয়েটাকে নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে গেলাম।

—কেন? আবার কী হল?

—ভেবেছিলাম একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। কিন্তু কোথাওই কোনও সুবিধে হচ্ছে না। তিন তিনটে হোমে গেলাম, সর্বত্রই ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! যাদের তিরিশ জনের ক্যাপাসিটি তাদের ওখানে অলরেডি চল্লিশ জন ঢুকে বসে আছে, যেখানে থাকার কথা পনেরো সেখানে আছে পঁচিশ! সকলেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অবস্থাটা দেখাল। কী করুণ দশা, গাদাগাদি করে বাস করছে সব! ডেস্টিটিউট মেয়েদের তুলনায় হোমের সংখ্যা এত কম!

—উলটোটাও বলতে পারিস। হোমের তুলনায় ডেস্টিটিউট মেয়েদের সংখ্যা এত বেশি!

সুকন্যার গলায় চপল সুর। দেয়ার ভাল লাগল না। ভার মুখে বলল, কী যে করি, আট দশ দিন হয়ে গেল…! তোর কোত্থাও চেনাশোনা নেই?

—সেদিনই তো বললাম। নেই। এসব হচ্ছে অনসূয়াদির লাইন।

—অনসূয়াদির রেফারেন্সেই তো ঘুরছি।…একটা জায়গায় অবশ্য আশার আলো দেখা গেছে। তাদের দুটো মেয়ের নাকি বিয়ে হবে শ্রাবণে, তাদের জায়গায় তখন…সেও তো প্রায় মাসখানেকের ধাক্কা।

—হুম্‌। প্রবলেম।

—সত্যিই প্রবলেম রে। এসব হোমগুলো তো সবই প্রাইভেট। হয় কিছু ইন্ডিভিজুয়াল চাঁদা টাদা তুলে চালাচ্ছে, সামান্য কিছু ডোনেশন হয়তো পায় এদিক ওদিক থেকে, নয় কোনও ট্রাস্টের আন্ডারে আছে। সবারই খুব লিমিটেড ফান্ড। কেউ কেউ হয়তো গভর্নমেন্ট থেকে কিছু গ্রান্ট পায়, তাও খুব অল্প। নোবল কজের জন্য প্রতিষ্ঠান, তেমন তো জোরাজুরিও করতে পারছি না…

—তুই ওকে উদ্ধার আশ্রমে ঢুকিয়ে দিচ্ছিস না কেন? ওর পুলিশ কেস-টেসের ব্যাপার তো আছেই…মা সুইসাইড করেছে…ওকে একসময়ে তুলে নিয়ে চলে গেছিল…এখন নিরাশ্রয়, প্রাণ বিপন্ন, এসব বলে টলে কোর্টে একটা প্রেয়ার ঠুকে দে না। ম্যাজিষ্ট্রেট যদি একটা অর্ডার করে দেয় তাহলেই ঝামেলা মিটে গেল।

—যাহ্‌, উদ্ধার আশ্রমে ওকে পাঠাব না। অনসূয়াদি পইপই করে বারণ করেছে। ওসব জায়গায় যা অ্যাটমস্‌ফিয়ার, মেয়েটার লাইফটাই শেষ হয়ে যাবে।

—তাহলে আর কি, যদ্দিন না কিছু হয় ঘাড়ে নিয়ে বসে থাক।

—আমার কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু…। দেয়া থেমে গেল।

—কিন্তু কী?

—সৌম্য ভীষণ আনইজি ফিল করছে। রোজ অফিস থেকে ফিরে এক প্রশ্ন, কী ব্যবস্থা করলে? এখনও কিছু হল না?

—সৌম্যর জায়গায় আমি থাকলে আমিও একই কথা বলতাম। বলা নেই, কওয়া নেই, তুই দুম করে একটা উটকো মেয়েকে ঘরে তুলে আনবি, সৌম্য তা দেখে হাততালি দেবে? দিস ইজ টুউ মাচ অফ এক্সপেক্টেশান দেয়া।

—উটকো কেন বলছিস? শিউলি একটা অসহায় মেয়ে। কোনও না কোনওভাবে মেয়েটার সঙ্গে আমার যখন একটা ইনভলভমেন্ট ঘটে গেছে, তখন তার দায়িত্ব নেওয়াটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এটাও সকলের বোঝা উচিত।

—তুই ভাবছিস তোর নিজের অ্যাঙ্গেলে। তোর প্রফেশনাল ফিল্ডে নাম করার জন্য তুই মেয়েটাকে নিয়ে নেচেছিলি, এখন ফেঁসে গিয়ে…। স্টিল দেয়া, ভুলে যাস না সংসারটা তোর একার নয়। মেয়েটাকে ওভাবে নিয়ে যাওয়ার আগে তোর একবার সৌম্যর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া উচিত ছিল।

হ্যাঁ, এটুকু ত্রুটি যে হয়েছে দেয়া মানে বইকি। অন্তর থেকে মানে। আর মানে বলেই সৌম্যর টেরচা চোখ দেখে মনটা খচখচ করে তার। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেল, মেয়েটা এমন কান্নাকাটি করছিল, ওই মুহূর্তে দেয়ার তখন তো আর কোনও উপায়ও ছিল না। শিউলির একটা সুষ্ঠু বন্দোবস্ত না করা পর্যন্ত সে কী করে মানসিকভাবে নিশ্চিন্ত থাকে! সৌম্যটা এত অবুঝ!

সুকন্যা উঠে তীর্থঙ্করের কাছে গেছে। নিবে যাওয়া মুখে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল দেয়া। পাশের টেবিলের কণাদকে বলল, কী রে, তোর কদ্দুর? কম্পিউটারটা ছাড়বি?

—হয়ে গেছে। এক মিনিট। কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট আউট বার করতে করতে কণাদ মুচকি হাসল, লেডি চ্যাটারবক্স কী বলছিল রে? খুব জ্ঞান মারছিল, না?

দেয়া হাত উলটোল, ওই আর কী। আমার ওই মেয়েটার কোনও অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে পারছি না, তাই নিয়ে…।

—কেসটা নিয়ে ও কিন্তু খুব জেলাস হয়ে আছে।

—কেন?

—বাহ্‌, তোর লেখাটা নিয়ে এত আলোচনা হল, রণেনদা আলাদা করে লেখাটার প্রশংসা করেছেন…

—যাহ্‌, এতে হিংসে করার কী আছে?

—ওর টাইপটাই ওরকম। কারুর প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। কালই তো তথাগতর সঙ্গে খুব হাসাহাসি করছিল, দ্যাখ রণেনদাকে তেল মেরে আবার কী অ্যাসাইনমেন্ট বাগায়! তবে এবার আর মনে হয় কোনও ঝুটঝামেলায় যাবে না! প্রিন্ট আউট হাতে নিয়ে মনিটর থেকে সরে এল কণাদ, শুনে আমার এত খারাপ লেগেছে!

কণাদের একটু কূটকচালি করার স্বভাব আছে। সুকন্যা বা তথাগত পেশাগত ঈর্ষায় ভুগতেই পারে, কিন্তু কণাদকেও বেশি আমল দেওয়াটা কাজের কথা নয়। খুচখাচ একে ওর পিছনে লাগিয়ে দিয়ে ভারী আনন্দ পায় কণাদ। নারদমুনির বংশধর! খারাপ যদি কণাদের তো প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। করেছিল কি?

কথা না বাড়িয়ে দেয়া কাজে বসল। ধানবাদ থেকে ফ্যাক্সে আসা লম্বা খবরটা কাটছাঁট করছে। কয়লাখনি অঞ্চলে মাফিয়াদের উপদ্রব নিয়ে প্রতিবেদন। বিশ সেন্টিমিটারের বেশি জায়গা পাবে না খবরটা। ধানবাদের বিশেষ সংবাদদাতা সব সময়েই গাদা গাদা লেখে! আরও একটা কপি তৈরি করতে দিয়েছে তীর্থঙ্করদা। নাকাশিপাড়ায় যুগলমৃত্যু। মাস চারেক আগে বিয়ে হওয়া দম্পতি, পুলিশ সন্দেহ করছে আত্মহত্যা। কী এমন ঘটল যে মধুচন্দ্রিমার রেশ কাটার আগেই ব্যি খেতে হল স্বামী-স্ত্রীকে? ক্ষণিকের জন্য কানন ছায়া ফেলল দেয়ার মনে, কাজ করতে করতে মিলিয়েও গেল। গোটা বার্তা বিভাগই এখন কর্মমুখর। পাঁচটা বেজেছে, এবার একটা একটা করে পাতা ছাড়া শুরু হবে। দেয়ার হাত ফাঁকা হতে না হতে আবার কাজ। পরশু রথযাত্রা, পুরীতে কী রকম যাত্রী সমাগম হচ্ছে তাই নিয়ে।

হেডিংসহ কপিগুলো যথাস্থানে জিম্ম করে পাশের ঘরে গেল দেয়া। ক্রোড়পত্রের দফতরে। বার্তা বিভাগের মতো বিশাল না হলেও এ ঘরটাও মোটামুটি বড়ই। তিনটে টেবিল, খানকতক ডেস্ক, কাজ করছে স্থায়ী অস্থায়ী মিলিয়ে জনা আটেক কর্মী। কেউ প্রুফ সংশোধন করছে, কেউ লেআউট তৈরি করছে, কেউ বা বিশেষ লেখায় মনোযোগী। নবপ্রভাতে এখন সপ্তাহে তিন দিন ক্রোড়পত্র থাকে। মঙ্গল, শুক্র, রবি। জয়শ্রী ধরাধরি করে ইদানীং মঙ্গলবারের সাময়িকীর দফতরে চলে এসেছে, এখানকার শুভময় গেছে বার্তায়। ক্রোড়পত্র বিভাগে কখনওই সাতটা সাড়ে সাতটার বেশি থাকতে হয় না।

জয়শ্রী নয়, অনসূয়ার কাছে এসেছে দেয়া। বছর পঞ্চাশের অনসূয়া মঙ্গলবারের সাময়িকীর প্রধান। এবং নবপ্রভাতের প্রায় শুরু থেকেই আছে।

দেয়াকে দেখে অনসূয়া হইহই করে উঠল, এই যে, এসো। এতক্ষণ তোমার কথাই হচ্ছিল।

উচ্ছৃসিত সম্ভাষণে দেয়া থতমত, কেন অনসূয়াদি?

—আরে, তুমিই তো এখন হট নিউজ। তোমাকে নিয়ে আগামী মঙ্গলবার খবর হচ্ছে।

—এ মা, কেন?

—হ্যাঁ গো। ওই মেয়েটার প্রতি তুমি যে নোবল জেসচার দেখিয়েছ সেটাকে আমি তুলে দিচ্ছি প্রভাতদর্পণে। জয়শ্রী তৈরি করেছে ম্যাটারটা।

জয়শ্রী কোনের ডেস্ক থেকে হাত ওঠাল। হাসিমুখে বলল, দেখে যা।

দেয়া রীতিমতো বিস্মিত। প্রভাতদর্পণ কলামে থাকে নানান রকমের টুকরোটাকরা চিত্তাকর্ষক খবর। শিল্পকলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, নগরজীবনের ছোট ছোট বিশেষ মুহুর্ত, কিংবা কোনও বর্ণময় ব্যক্তিত্ব—এসবই প্রভাতদর্পণের উপজীব্য বিষয়। নবপ্রভাতের এই অংশটি যথেষ্ট জনপ্রিয়। সেখানে কী লেখা হচ্ছে দেয়াকে নিয়ে?

জয়শ্রী পড়ে শোনাচ্ছে। হেডিং, সাংবাদিকের মহানুভবতা। শুধু লিখেই কর্তব্য শেষ করেননি তরুণী সাংবাদিক দেয়া সিংহরায়। অসহায় নির্যাতিতা কিশোরীকে নিজ গৃহে আশ্রয় দিয়ে এক মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি…

আবেগমথিত স্বরে পুরোটা পড়ল জয়শ্রী। শেষ করে মিটিমিটি হাসছে, কী রে, পছন্দ হয়েছে? কেমন লিখেছি?

দেয়া লজ্জায় লাল। অস্বচ্ছন্দ মুখে বলল, এমা, এতসব কী বিশেষণ দিয়েছিস আমার নামে!

—আমি তো কখনও এমন কিছু করতে পারব না। আমার সেই জোরই নেই। জয়শ্রীর হাসি কেমন করুণ দেখাল, ধরে নে না, এটা তোর মতো সবলকে দুর্বলের অভিনন্দন।

—যাহ্। এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি।।

—ভাল কাজ নিয়ে বাড়াবাড়ি করাও ভাল। এবার অনসূয়ার গলা, যাক গে, ওদিককার খবর কী? কিছু হিল্লে হল?

প্রতিটি হোমের বিস্তৃত সমাচার শোনাল দেয়া।

অনসূয়া ঘনঘন মাথা দোলাচ্ছে। ব্যক্তিত্বমাখা মুখে চিন্তার ভাঁজ, প্রয়োজনের সময়ে সোশ্যাল ওয়ার্কারগুলো এমন সব দর বাড়ায়! আচ্ছা দাঁড়াও, আমিই একবার কথা বলি।

বলেই ড্রয়ার থেকে সরু ডায়েরি বার করেছে অনসূয়া। ঝুঁকে দেখতে দেখতে দূরভাষ যন্ত্রের বোতাম টিপল, হ্যালো! নতুন দিগন্ত? মিসেস নিশা মৈত্র আছেন কি?…নেই? কখন ফিরবেন?…ও আচ্ছা… ফিরলে বলবেন অনসূয়া গোস্বামী ফোন করেছিল। নিউজ পেপার অফিস থেকে। নবপ্রভাত। মনে থাকবে? নবপ্রভাত। বলবেন খুব জরুরি দরকার।

বিরস মুখে রিসিভার রেখেছে অনসূয়া, তোমার কপালটাই খারাপ। আমি শিওর, নিশা মৈত্রকে বললেই কাজ হত। নিশাদি নতুন দিগন্তের প্রেসিডেন্ট। নিশাদিকে নিয়ে আমি একবার একটা পেজ করেছিলাম। কিন্তু…নিশাদি এখন দিল্লিতে, ফিরতে ফিরতে আগামী বুধবার। কটা দিন আরও ধৈর্য ধরো।

দেয়া শুকনো হাসল, আমি তো ধৈর্ষ ধরেই আছি অনসূয়াদি।

মনে মনে বলল, কিন্তু সৌম্যকে যে কী বোঝাই!

দেয়ার অভিব্যক্তি দেখে অনসূয়া কিছু বুঝি আঁচ করেছে। বলল, মেয়েটা তোমার কাছে ঠিকঠাক আছে তো?

—আছে। তবে বড় কান্নাকাটি করছে।

—ওকে যে নিয়ে এসেছ, থানায় জানানো আছে তো?

—হ্যাঁ। আমার ঠিকানা টিকানা সব দিয়ে এসেছি।

—আর তোমার লোকাল থানায়?

—ওখানে কী দরকার? ইনভেস্টিগেশান তো করছে শিউলিদের থানা!

—বাহ্‌, সেই রাফিয়ানগুলো আছে না? তাদের থাবা কত লম্বা তার কোনও ঠিক আছে! তোমরা তো সারাদিন থাকোই না, তারা যদি বাড়ি চড়াও হয়!

—তারা বাড়ি চিনবে কোত্থেকে?

পুট করে শুক্রবারের সাময়িকীর দেবনাথ বলে উঠল, কিছু কঠিন নয়। পুলিশ জালি করলেই সব জেনে যাবে। ওদের সঙ্গে পুলিশের কানেকশান থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে আর একজনের মন্তব্য, গুণ্ডাবদমাশদের নিজস্ব সোর্সও থাকে। আপনার ঠিকানা খুঁজে বার করা ওদের কাছে বাঁয়ে হাত কা খেল।

—আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা আপনার রণেনদাকে অবহিত করে রাখা উচিত।

—পারলে একবার মলয়বাবুর সঙ্গে গিয়ে লালবাজারেও ইনফর্ম করে আসুন।

জয়শ্রী সভয়ে বলল, হ্যাঁ রে, তুই শিওর তো, মেয়েটাকে যখন আনছিলি কেউ তোকে ফলো করেনি?

লক্ষ্মীদির কথাটা মনে পড়ছিল দেয়ার। কে যেন ঘুরছে বাড়ির সামনে, সবিতা নাকি দেখেছে! আচমকাই টিপটিপ করে উঠল দেয়ার বুক। নিজের জন্য? নাকি মেয়েটার জন্য? সবাই তাকে ভয় দেখাচ্ছে কি অকারণে?

ভেতরের অস্বস্তিটা তাড়াতে দেয়া জোর করে হাসল, দুর, কাগজে এত লেখালিখি হচ্ছে তার পরেও কি কারুর বাড়াবাড়ি করার সাহস হবে?

ক্রোড়পত্রের ঘরে আর বসল না দেয়া, ফিরেছে নিজের দফতরে। বিক্ষিপ্ত চিত্তে কাজ করল কিছুক্ষণ। তাকে নিয়ে বিশেষ খবর হচ্ছে, এক গোপন সুখে কুলকুল করছে মন, অন্যদিকে বিজবিজে ঘামের মতো লেগে থাকা এক উদ্বেগ—দুই অনুভূতির টানাপোড়েন দেয়াকে সুস্থিত হতে দিচ্ছিল না। বেরোনোর আগে ভাল করে মুখে চোখে জল ছেটাল, যদি শীতল স্পর্শে ভেতরটা একটু ঠাণ্ডা হয়।

বর্যা এবার সময় মতোই এসেছে। রোজই এখন আকাশের মুখ গোমড়া। মাঝে মাঝেই একঘেয়ে ক্লান্তিকর ঝরঝর ঝমঝম। আজ অবশ্য সারাদিন বৃষ্টি হয়নি, তবে লাল হয়ে আছে আকাশ। গুমোটও খুব, বাতাস নেই, যখন তখন নামতে পারে বারিধারা।

দেয়া ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। টেলিফোনের লোক ফুটপাত খুঁড়েছে, চলতে হচ্ছে সাবধানে। ঘন আকাশ অন্ধকার নামিয়েছে তাড়াতাড়ি। উজ্জ্বল পথবাতিরাও আজ কেমন মলিন-মলিন। চিন্তার ছায়া মাখা।

অস্থায়ী চায়ের দোকানটা পেরোতে না পেরোতেই দেয়ার কানের পাশে হঠাৎই এক পিলে চমকানো ডাক, পালাচ্ছেন যে বড়?

শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাওয়া একটা হিমস্রোত দেয়াকে মুহুর্তের জন্য অবশ করে দিয়েছিল। পরমুহূর্তেই বিস্ময় চলকে উঠেছে, তুই-ই?

ঋতম হা-হা হেসে উঠল, ভড়কি খেয়ে গেছিস তো?

বুকের ধুকপুকুনি পুরোপুরি থামেনি এখনও। দেয়া লম্বা শ্বাস টানল, তুই এখানে কোথায় এসেছিলি?

—নবপ্রভাত বলে এখানে একটা পত্রিকা আছে। সেখানে।

দেয়ার চোখ বড় বড়, আমাদের অফিসে? কার কাছে? কেন?

—আমার এক বান্ধবী চাকরি করে। দেয়া সিংহরায়। তার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।

দেয়া হেসে ফেলল, ফাজিল কোথাকার। গল্প লিখে লিখে কোনও কথাই আর সোজাভাবে বলতে পারিস না! ওপরে গিয়ে আমায় ডাকিসনি কেন?

—নিউজপেপার অফিসে বেশি ঢুকতে নেই। সাহিত্যিকদের ওয়েট কমে যায়।

—যদি আরও এক ঘণ্টা পরে বেরোতাম?

—অপেক্ষা করতাম। তুই এক মাস পরে বেরোলে এক মাস দাঁড়িয়ে থাকতাম। এক বছর পরে বেরোলে…

—থাম। আর বাড়িস না। দেয়া হাঁটতে হাঁটতে ঋতমকে চিমটি কাটল, বাড়ি না গিয়ে হঠাৎ এখানে হানা যে?

—তোর জন্য একটা দারুণ খবর আছে।

—কী রে?

—ধীরে বন্ধু ধীরে। খুব হুড়ুদ্দুম গেছে আজ, হেভি টায়ার্ড। আগে একটা ট্যাক্সি ধর।

—এখানে এখন ট্যাক্সি পাব কোথায়? এই অফিস টাইমে?

—সুন্দরী মেয়েরা মনে মনে চাইলেই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে যায়। চোখ বুজে একটা হলদে-কালোকে ধ্যান কর…কুন্তী যেভাবে সূর্যকে ডেকেছিল…

চটাস করে ঋতমকে চাঁটি কষাতে যাচ্ছিল দেয়া, তার আগেই সত্যি সত্যি এক ট্যাক্সির আবির্ভাব। কিমাশ্চর্যম, কলকাতার ট্যাক্সিঅলার মুখে হাসি! মাথা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে, যাবেন নাকি দিদি?

দেয়া প্রায় থতমত—হ্যাঁ, যাব। সন্তোষপুর।

অঘটন আজও ঘটে। ড্রাইভারটা পালাল না। বলল, আসুন।

পিছনের সিটে শরীর ছেড়ে দিয়েছে ঋতম। কাজ করা পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাচ্ছে। গলগল ধোঁয়া ছেড়ে বলল, শিউলির কোনও গতি করতে পারলি?

—চেষ্টা চলছে। হয়ে যাবে।

—মানে পারিসনি।…আমি কিন্তু করে ফেলেছি।

—তাই? কোথায়? দেয়া লাফিয়ে উঠল, আগে বলবি তো!

—সুসংবাদ ভাঙার একটা নিয়ম আছে। আগে বাড়ি গিয়ে সলিড কিছু খাওয়া…

—অ্যাই ঋতম, বল না, বল না।

—উঁহু, আগে কমিট কর।

—সেঁকো বিষ খাওয়াব। চলবে?

—তুই হাতে করে খাওয়ালে তাই খাব।

—তোকে বিষই দেওয়া উচিত।

—তাই তো দিয়েছ গুরু। আমাকে ল্যাং মেরে বিয়ে করলে একটা কম্পিউটারকে।

—অ্যাই…অ্যাই…!

—আমি কিন্তু খুব অপদার্থ নই। আমিও কিছু পারি।

—উফ্‌ ঋতম, লেকচার ছাড়বি? বি সিরিয়াস, প্লিজ। কাজের কথা বল।

—বলছি। বলছি। ঋতম জোর টান দিল সিগারেটে, কাল আমাদের পার্লামেন্টে শিউলির ব্যাপারটা প্লেস করেছিলাম। সেখানে কবি সত্যব্রত, মিথ্যে বলার জন্য যার নাম গিনেস বুকে চলে গেছে, আমায় একটা জায়গার সন্ধান দিল। এবং জীবনে এই প্রথমবার কবিবর তার নামের মর্যাদা রেখেছে। ওর ডিরেকশান মোতাবেক আজ ভোরেই ছুটেছিলাম ডায়মন্ডহারবারে। একেবারে প্রপার ডায়মন্ডহারবার নয়, আর একটু দক্ষিণে। প্রায় কুলপির কাছাকাছি। ওখানে মেয়েদের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান আছে। গোল্ডেন হোপ। এন.জি.ও। এক ইটালিয়ান মহিলা চালান। নামেই ইটালিয়ান, এখন একদমই পাতি হয়ে গেছে, ঝিঙেপোস্ত-ভাত খায়। বোধহয় জোর ল্যাং খেয়ে ভেসে এসেছিল, এখন গরিব মেয়েদের নিয়েই আছে। নিজের পরিচয়টা দিলাম, সাহিত্যিক বলে মেমসাহেব হেভি খাতির করল। এবং বিনয়ের সঙ্গে জানাল দুঃস্থ বিপন্ন মেয়েকে গ্রহণ করাই তার পবিত্র কর্তব্য। তবে…

—কী হবে?

—একজন স্পনসরার চাই। মহিলা ঘুরে ঘুরে কিছু ফরেন এড জোগাড় করে, তবে মেইনলি স্পনসরশিপের জোরেই চালান প্রতিষ্ঠানটা। ওকে অ্যানুয়ালি একটা থোক টাকা দিতে হবে। খুব বেশি নয়, ধর পাঁচ হাজার মতন।

—এ তো খুব ভাল। শিউলিকে আমি স্পনসর করতেই পারি। বছরে পাঁচ হাজার টাকা কী এমন!

-—খরচটা কিন্তু রেকারিং। যদ্দিন না শিউলি স্বাবলম্বী হয়।

—বললাম তো, পারব। জায়গাটা কেমন?

—দেখে তো ভালই মনে হল। বেশির ভাগই অনাথ। আবার কারওর কারওর বাবা-মা খেতে দিতে পারে না…

—শিউলির ঘটনা খুলে বলেছিস মহিলাকে?

—লুকোছাপা করব কেন? মহিলা আগ্রহ নিয়ে শুনলেন বটে তবে তেমন আমল দিলেন না। বললেন অতীতটা মুছে ফেলার জন্যই তো তাঁর এই প্রতিষ্ঠান। শিউলি নিজে থেকে গল্প না করলে কোনও সমস্যাই হবে না। ঋতম অল্প থেমে থেকে বলল, আমি জানতাম তুই রাজি হবি। আমি মহিলাকে হ্যাঁ বলে এসেছি।

—ভাল করেছিস। কবে নিয়ে যাবি বল?

—যেদিন বলবি।

শিউলিকে যত তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। দেয়ারও, শিউলিরও। কাল শনিবার, কালই নিয়ে যাবে? নাকি পরের বৃহস্পতিবার? অফ-ডে’তে? শিউলি শিউলি করে মাঝে দুটো সি.এল চলে গেছে। এক্ষুনি আর একটা ছুটি নিলে অশেষদা কথা শোনাবে। এমনিই তো সেদিন বলছিল, কাঁধে চাপ বাড়তে না বাড়তেই ডুব শুরু? শিউলির জন্য কয়েকটা জিনিসও তো কেনা দরকার। নতুন জীবন শুরু করার সময়ে নতুন জিনিস পেলে ভাল লাগবে মেয়েটার। কত কী যে টুকিটাকি লাগবে। জামাকাপড় তো আছেই, সঙ্গে তোয়ালে, চাদর, প্যান্টি, ব্রেসিয়ার…একটা ছোট সুটকেসও কিনে দিলে হয়।

ঋতম জানালা দিয়ে সিগারেটের টুকরো ছুড়ে দিল, চুপ মেরে গেলি যে?

—ভাবছি।

—আর কীসের চিন্তা? এবার তো চ্যাপ্টার ক্লোজড।

—হুঁ।

—তাহলে এবার অন্য চ্যাপ্টার খুলি? আর একটা সুসংবাদ আছে।

দেয়া ঘুরে তাকাল।

ঋতম ভুরু নাচাচ্ছে, জনপদ আমায় স্থান দিয়েছে।

দেয়ার মাথায় ঢুকল না, কীই?।

—জনপদ। দা লিডিং বাংলা লিটেরারি ম্যাগাজিন। জনপদের পুজোসংখ্যায় আমার গল্প চেয়েছে। চিঠি দিয়ে। কী বুঝছিস?..আমিও কম্পিউটারের চেয়ে কিছু ফেলনা নয় রে

—আহা রে, কে তোকে ফেলনা বলে! দেয়া চোখ টিপল, তুই তো জিনিয়াস।

—সব টিজিং ঘুচে যাবে। চারদিকে সাড়া পড়ে যাবে, বুঝলি। প্লটটা মাথায় ঘাই মারছে, খেলিয়ে খেলিয়ে তুলতে হবে। সবাই তো হাসির আড়ালে দুঃখের গল্প লেখে, আমারটা হবে দুঃখের মোড়কে হাসি। ব্ল্যাক আয়রনি। কীরকম শুনবি?…ধর একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের বিয়ে হয়েছে…

—তাই তো হয়। মেয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হয় না। অ্যাটলিস্ট এখনও।

—কাটিস না। ধর…ছেলেটা পাগল। বদ্ধ পাগল নয়, ক্যারা নড়া। বোহেমিয়ান ধরনের। এ যুগের কোনও কিছুর সঙ্গেই তার খাপ খাচ্ছে না…

—বুঝেছি। তোর আত্মজীবনী।

—সাহিত্যের ছায়াও তো মাড়াস না, জানবি কী করে! নিজের সব লেখাতেই কোনও না কোনওভাবে লেখক উপস্থিত থাকে। কখনও বা সরাসরি, কখনও বা কোনও ক্যারেক্টারের মধ্যে ঘাপটি মেরে। তারপর শোন…

বিপুল উৎসাহে গল্পের আইডিয়া শোনাচ্ছে ঋতম। বেশি দূর এগোতে পারল না, বাড়ি এসে গেছে। লাফাতে লাফাতে তিনতলায় উঠল। হেঁড়ে গলায় গান গাইছে ভুলভাল। খুশিমাখা ঋতমকে দেখে ভারী ভাল লাগছিল দেয়ার। কী অফুরন্ত জীবনীশক্তি! মুখে বলল বটে ক্লান্ত হয়েছে, কিন্তু হাবেভাবে তার চিহ্নটি নেই।

ফ্ল্যাটে ঢুকে লক্ষ্মীর সামনে দু হাত ছড়িয়ে দিয়েছে ঋতম, কতকাল রবে বলো ভারত রে, শুধু চা আর হাওয়া পথ্য করে…!

লক্ষ্মী ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। একবার দেয়াকে দেখছে, একবার ঋতমকে।

ঋতমের কণ্ঠে কীর্তনের সুর, দেশে অন্নজলের এখন ঘোর অনটন, লাও পরোটা লুচি আর মুরগি মাটন…

ঋতমের স্বমস্তিষ্ক উদ্ভাবিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে ফেলেছে লক্ষ্মী। কালো কালো দাঁত ছড়িয়ে হাসল, বুঝেছি, খিদে পেয়েছে। কিন্তু আজ যে মুরগি-মাটন নেই। আজ ট্যাংরা মাছ রান্না হয়েছে।

—অ্যাহ্, কম্পিউটার ট্যাংরা খায়?

—তুৎ। দেয়া মুচকি হাসল, ও তো মাছই খেতে চায় না। ওই হাতে গোনা কয়েকটা। চিংড়ি, ইলিশ, রুই, ব্যস। ওর জন্য তো আমি প্রায় মাছ খাওয়াই ভুলতে বসেছি। আজ মরিয়া হয়ে কটা দিশি ট্যাংরা…

—তুই একটা বেরসিক। শুভসংবাদ ট্যাংরা দিয়ে সেলিব্রেশান?

—কী শুভসংবাদ গো দাদা?

—তোমার হেলপিং হ্যান্ড তো চলল। দেয়া শিউলির বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। বলেই হাঁক পাড়ল ঋতম, অ্যাই শিউলি, কোথায় লুকিয়ে বসে আছিস? ইদিকে আয়।

শিউলি রান্নাঘরে। পায়ে পায়ে বেরিয়ে এল।

—যা যা, বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নে। ঋতম এমনভাবে তাড়া লাগাল যেন শিউলি এক্ষুনি যাচ্ছে। আঙুল নেড়ে বলল, তোর দিদির বাড়ির কোটা শেষ। অ্যাই দেয়া যাওয়ার দিনটা যেন কবে?

—আহ্ ঋতম, হচ্ছেটা কী? এত ছটফট করছিস কেন? দেয়া মৃদু ধমক দিল। লক্ষ্মীকে বলল, আগে আমাদের একটু গরম গরম কফি খাওয়াও তো দেখি।

—সঙ্গে খাদ্যও কিছু দিও। রুটি, লুচি, পরোটা, ওমলেট টোস্ট, এনি ড্যাম থিং। ট্যাংরা বাদে। পেটের ভেতর গণ্ডার লাফাচ্ছে। কথা কটা ছুড়ে দিয়েই ফের শিউলিকে নিয়ে পড়ল ঋতম, বুঝলি শিউলি, তোর দিদি তোর জন্য একটা যা জায়গা ফিট করেছে না…এ ওয়ান। নদীর ধার, ফুরফুর করছে হাওয়া, চারদিকে কত গাছপালা… প্রচুর বন্ধু পাবি। কুড়ি পঁচিশটা। সব তোরই বয়সি। নাচগান শিখবি, হাডুডু খেলবি…কোর্ট কাটা আছে।

শিউলি ভ্যাবাচ্যাকা মুখে দাঁড়িয়ে। দেয়া শিউলিকে কাছে টানল, শোন, তোর আর কোনও কষ্ট থাকবে না। পাকাপাকি হিল্লে হয়ে গেল। ওখানে গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়াটাও করবি, বুঝলি।

—সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ। মেশিনে উল বোনা, পাঁপড় বানানো, আচার তৈরি…ওখানকার মেমসাহেব আবার ওগুলো বিক্রি করে। সে পয়সাও তোর।

শিউলির চোখ দুটো হঠাৎ জলে ভরে গেল। টুপ টুপ ফোঁটা গড়িয়ে এল গাল বেয়ে।

দেয়া ব্যস্ত হল, দুর বোকা, কাঁদছিস কেন? খেলবি নাচবি গাইবি… খুব ভাল থাকবি সেখানে। আমরা যাব মাঝে মাঝে। দেখব তুই কী কী শিখলি।

শিউলি মুখ নামিয়ে নিল। নাক টানতে টানতে গাল মুছছে।

দেয়া শিউলির পিঠে হাত রাখল—যা, লক্ষ্মীমাসির কাছে যা। হাতে হাতে সাহায্য কর।

নিঃশব্দে চলে গেল শিউলি।

শিউলির অশ্রু যেন খুশির সুর কেটে দিয়েছে হঠাৎ। ঋতম দেয়া দুজনেই চুপ। সোফায় বসে প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে ঠোঁটে লাগিয়েছে ঋতম, ধরাল না, দেশলাইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অ্যাশট্রে এনে ঋতমের মুখোমুখি বসল দেয়া। আনত মুখে আঙুল চালাচ্ছে চুলে।

দেয়ার একটু একটু মনখারাপ লাগছিল। কদিনে মেয়েটার ওপর এক ধরনের মায়া পড়ে গেছে। সে যতক্ষণ বাড়ি থাকে, পাশে পাশে ঘোরে শিউলি। প্রায় ছায়ার মতো। অথবা দেয়ার ছায়াতেই বুঝি সে অনাড়ষ্ট, সহজ। দেয়া সামান্যতম কিছু করতে বললে মেয়েটা যেন সপ্রাণ হয়ে ওঠে, কীভাবে দেয়াকে খুশি করবে ভেবে পায় না। শিউলির অস্তিত্ব কদিনেই কেমন যেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এ বাড়িতে, সে চলে গেলে দেয়ার কি একটুও ফাঁকা ফাঁকা লাগবে না?

ঋতম অন্যমনস্ক স্বরে প্রশ্ন করল, মেয়েটা কাঁদে কেন রে?

ছোট্ট শ্বাস ফেলল দেয়া? বলল, বোধহয় মার কথা মনে পড়ছিল।

—তাই কী? আমার কিন্তু কেমন অন্যরকম মনে হল।

—কী রকম?

—কিছু না। থাক। ঋতমেরও যেন একটা শ্বাস পড়ল। কেমন একটা ম্লান হেসে বলল, তুই হ্যাপি তো?

মনের গভীরে তেমন কোনও আনন্দ কি খুঁজে পাচ্ছে দেয়া? যা আছে তা তো নিছকই এক নিশ্চিন্ততার অনুভূতি। কিন্তু সে কথাও এখন উচ্চারণ করা যায় কি? অন্তত ঋতমের সামনে? মেয়েটার এই দুর্গতির জন্য দেয়াই যে অনেকাংশে দায়ি এ কথাও তো ঋতমের চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। সামনের মঙ্গলবার আবার একটা জয়জয়কার হবে দেয়ার, ওই মেয়েটাকে কেন্দ্র করেই..না, এটাও ঋতমকে আর জানানোর মুখ নেই দেয়ার। ঋতম তাকে বারবার সতর্ক করেছিল, অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া সত্ত্বেও সে দেয়াকে সেভাবে দোষারোপ করেনি, বরং প্রকৃত বন্ধুর মতো স্বেচ্ছায় দায়মুক্ত করল দেয়াকে—ঋতমের এই মহত্ত্বের কাছে দেয়া কি ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে না?

দেয়ার কি ঋতমকে ধন্যবাদ জানানো উচিত? কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে সে ঋতমের কাছে?

নাহ্‌, দেয়ার মুখে ওই ধরনের কোনও শব্দও এল না। একটা অস্ফুট ধ্বনি শুধু বেজে উঠেছে, সৌম্য খুব রিলিভড় হবে রে।

মাঝরাতে বৃষ্টি নেমেছিল। ঝরছে এক তালে। এক সুরে। একটানা। দেয়াদের শয়নকক্ষে ফুলস্পিডে ঘুরছে পাখা, শীতল আরাম মেখে মৌসুমী বাতাস লুটোপুটি খাচ্ছে ঘরময়। জ্বলছে নীল রাতবাতি, স্নিগ্ধ সুখের মতো।

হঠাৎই দেয়ার ঘুম ভেঙে গেল। সৌম্য টানছে।

উলটো পাশ ফিরে শুয়ে ছিল দেয়া, চিত হল। জড়ানো গলায় বলল, কী?

দেয়ার গা থেকে পাতলা চাদরটা সরিয়ে দিল সৌম্য। মাথা তুলে মুখ গুঁজে দিয়েছে দেয়ার বুকে। আদরখেকো বেড়ালের মতো শব্দ করছে, উমমমম্‌।

শেষরাতে সৌম্যর এই আদিম আহ্বান দেয়ার ভীষণভাবে চেনা। বিছানায় শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌম্যর নাক ডাকতে শুরু করে, দেয়াকে সে তখন স্পর্শও করে না। তার নিদ্রা ভঙ্গ হয় কাঁটায় কাঁটায় রাত তিনটেয়। এবং সেই সময়েই তার দেয়াকে চাই। সুপ্রিয়া রোজ এই সময়টাতেই ঠেলে তুলে দিত ছেলেকে, পড়াশুনো করার জন্যে। রাত তিনটেয় জেগে ওঠার অভ্যেসটা সৌম্যর মস্তিষ্কের কোষে গেঁথে গেছে। আর এই সময়টাতেই যদি শুধু রিরংসা জাগে, কী করবে সৌম্য!

বিয়ের পর প্রথম প্রথম ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ করত দেয়া। আবার মাঝে মাঝে ভারী অদ্ভুতও লাগত। প্রথম রাতে দেয়ার যদি কখনও শরীর জেগে ওঠে, দেয়া যদি কামনায় চঞ্চলও হয়, সৌম্য গ্রাহ্যই করবে না। তার যে সময়টাতে দেয়াকে চাই, সেই সময়টাতেই সাড়া দিতে হবে দেয়াকে। সৌম্য বুঝতে চায় না বৈচিত্র্য যদি অভ্যাসে পরিণত হয়, তা একসময়ে ক্লান্তিকর ঠেকে।

তবে আজ দেয়ার খারাপ লাগছিল না। শরীরী পুলকে কুসুমিত হচ্ছিল। সৌম্যকে আঁকড়ে ধরেছে দু হাতে। মুখে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, —কী, সোমুসোনা এখন বুঝি লেখাপড়া করবে?

পাগলের মতো দেয়াকে চুমু খাচ্ছে সৌম্য। মুখে, ঠোঁটে, ঘাড়ে, গালে সর্বাঙ্গে। উন্মোচিত করছে দেয়ার মিহি বসন। সে কাজের মানুষ, তার এখন কথা বলার সময় নেই।

দেয়ারও উরুসন্ধিতে তীব্র তাপ৷ পুরুষগন্ধে মাথা ঝিমঝিম। দেহের প্রতিটি রোমকূপ যেন খুলে খুলে যাচ্ছে। আশ্লেষে আপ্লুত হচ্ছে দেয়া।

অভ্যস্ত রমণ অভ্যস্ত ছন্দেই শেষ।

বেশির ভাগ দিন এ সময়ে পলকে ঘুমিয়ে পড়ে সৌম্য, আবার কোনও কোনও দিন তাকে কথায় পায়। আজ সে তৃপ্ত মেজাজে আধশোওয়া। দেয়ার চুলে বিলি কাটছে। বলল, —জানো তো, বুগিদা আজ চলে গেল।

—তোমার বুগিদা কিন্তু এখানে এলেন না। তোমায় নাকি কথা দিয়েছিলেন…

—শেষদিকে নাকি খুব ছোটাছুটি করতে হয়েছে।…বুগিদার প্রোপোজালটা কিন্তু ভাল।

—হুম্।

—যদি লেগে যায়…লাইফের গিয়ারটাই বদলে যাবে। সব কটা ডেটলাইন তখন হু হু করে এগিয়ে আসবে।

দেয়া সৌম্যর গালে চুমু খেল, —বাচ্চা হওয়াটাও?

—উহুঁ, ওটা ফিক্সড। বাচ্চা তো আর হায়ার পারচেজ স্কিমে আসবে না।

—কিন্তু আমাকে তো ন মাস ইন্‌স্টলমেন্ট গুনতেই হবে স্যার। দেয়া হাসল সামান্য। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরল সৌম্যকে। ঘন স্বরে বলল, —এই…এখনই হয়ে যাক না।

—কেন?

—আমার ইচ্ছে করছে। মহুয়া বলছিল, কেন দেরি করছিস? বয়স বাড়া মানেই তো মেয়েদের কমপ্লিকেশান।

—তার জন্য ডাক্তার আছে সুইটহার্ট। হুটহাট প্ল্যান বদলানো যায় না।

—আমি চাইলেও নয়?

—উলটো পালটা আবদার তুমি করবে কেন? মা হলেই তো ভেদিয়ে যাবে, তুমি কি তখন আমার একলার থাকবে? লেট্‌স এনজয় লাইফ সুইটি।

দেয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলল। সৌম্যটা বড় অবুঝ।

দেয়ার হাতে আলগা চাপ দিল সৌম্য, —অ্যাই, আমাদের অ্যানিভার্সারি তো এসে গেল, এবার কাকে কাকে ডাকছ?

—যারা আসে তারাই।…তোমার ছোটুদাকে এবার ডাকতে পারো।

—কেন?

—বাহ্‌, বুগিদার সঙ্গে তোমার একটা ইয়ে হতে চলেছে…। প্লাস ধরো তোমার। লালিদি…

—নো। আমি আমাদের ফ্যামিলির কাউকে ডাকব না।

—এ তো অন্যায় জেদ। লালিদি সব সময়ে আমাদের খোঁজখবর নেয়, আসে মাঝে মাঝে…তুমি যাই বলো, এবার আমি লালিদিকে বলবই।

—কক্ষনও না। আমার বাড়ির লোককে ডাকার তুমি কে?

—স্ট্রেঞ্জ! আমি বুঝি তোমাদের বাড়ির বউ নই? আমার বুঝি ইচ্ছে করে না…?

—ও কে। ডেকো। আমি অ্যানিভার্সারির দিন থাকব না। সোশাল গ্যাদারিং তো, একজন না থাকলে কিছু এসে যাবে না।

দেয়া হেসে ফেলল। সৌম্যটা বড় ছেলেমানুষ। সৌম্যর নাক নেড়ে দিয়ে বলল, —তাই হবে বাবা, তাই হবে। লালিদি ভুলিদি কেউ আসবে না। খুশি?

বলতে বলতে বিছানা ছেড়ে উঠল দেয়া। বাথরুম ঘুরে এসে ড্রেসিংটেবিলে ঢাকা দেওয়া গ্লাস থেকে জল খেল দু ঢোক। বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছে, আওয়াজও বেশ কম এখন।

বিছানায় ফিরতে গিয়েও দেয়া থমকেছে। কান পেতে শুনছে কী যেন।

বলল, —এই, একটা শব্দ পাচ্ছ?

—কোথায়?

—হুঁউউ, আসছে। শোনো ভাল করে।…গোঙানির! আমাদের ফ্ল্যাটেই!

দেয়া দরজা খুলে ড্রয়িংহলে এল। আস্তে করে ছোট আলোটা জ্বালিয়েছে। সেন্টারটেবিল সরিয়ে কার্পেটে অঘোরে ঘুমোচ্ছে লক্ষ্মী…শিউলি গেল কোথায়?

দেয়া টের পেল শব্দটা আসছে রান্নাঘর থেকে। ওখানে মেয়েটা…?

হ্যাঁ, যা ভেবেছে তাই। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে গুমরে গুমরে কাঁদছে শিউলি।

দেয়া গিয়ে শিউলির মাথায় হাত রাখল, —কী রে, এখানে বসে বসে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?

দেয়ার ছোঁয়ায় চমকে মুখ তুলেছে শিউলি। বোবা দৃষ্টিতে এক পল দেখল দেয়াকে। পলকে আছড়ে পড়ে দেয়ার পা জড়িয়ে ধরেছে। আহত পশুর মতো আর্তনাদ করে উঠল, —ও দিদি গো, তোমার পায়ে পড়ি দিদি…আমায় তাড়িয়ে দিয়ো না দিদি..আমি ভাল হয়ে থাকব…তোমায় ছুঁয়ে বলছি…আমি তোমার কাছে থাকব দিদি…আমাকে আর কোথাও পাঠিও না দিদি…আমি মরে যাব দিদি…তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই দিদি…

শিউলি ঠকঠক কাঁপছে। দেয়া দাঁড়িয়ে স্থাণুবৎ। দেয়ার দু চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *