০৫. কী গো, কেমন আছ

পাঁচ

—কী গো, কেমন আছ?

—ক্‌ক্‌কে? কেএএ?…ও, তুমি! তুমি আবার এসেছ?

—এলাম।

—কেন আস?

—তোমায় দেখতে। তোমায় দেখতে যে আমার খুব ভাল লাগে। কী সুন্দর সুখী জীবন তোমার…কী নিশ্চিন্ত! বর ছেলে…আবার আর একজনও আসছে…

—রোজ এই এক কথা শোনাও কেন বল তো?

—সর্বক্ষণই মনে হয় যে। ইশ, এমন একটা জীবন তো আমারও হতে পারত।

—সে তোমার কপাল।

—তুমি কপাল মানো?

—সেভাবে মানি না। তবে চান্স ফ্যাক্টর তো মানি।

—এটা তো তোমার বরের কথা। সত্যিটা কী তুমি তো জানো।

—জানি। কিন্তু ও তো তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করেছিল। সিচুয়েশান গ্রেভ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই…

—তবু দেরি হয়ে গেল।

—সেই জন্যই তো বলছি চান্স ফ্যাক্টর। অত দূরে গেছে…একটা জরুরি কাজে…

—হুঁ। তোমার সুখ কেনার কাজ।

—ওটাও চান্স ফ্যাক্টর। দিনটা তো একুশে জানুয়ারি নাও হতে পারত। ফ্ল্যাট বুক করতে ও সেদিন নাও যেতে পারত।

—তবু গিয়েছিল তো। আর সে জন্যই আমি…

—তুমি তো বড় অবুঝ! এমনও তো হতে পারত ও তখন একটা অন্য পেশেন্ট নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে, যার অবস্থা তোমার মতোই…! কিংবা ধরো, খবর পেয়েই ছুটে যাচ্ছে, পথে গাড়ি খারাপ হয়ে গেল! হতেও তো পারত, বল?

—সে তুমি যতই সাফাই গাও, তোমার বর সেদিন তোমার জন্য সুখ কিনতে না গেলে হয়তো আমি বেঁচে যেতাম। তার কি উচিত ছিল না সব ফেলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসা?

—তুমি কি তোমার মৃত্যুর জন্য আমার বরকে দায়ি করছ? নাকি আমাকে?

—সে তোমরাই ভেবে দ্যাখো। তবে আমি কিন্তু খুব কষ্ট পেয়ে মরেছি গো।

—মৃত্যু সব সময়েই কষ্টের।

—মুখে বলা সহজ। তুমি তো আর মৃত্যুর মুখোমুখি হওনি! সে যে কী নিষ্ঠুর কালো অন্ধকার…! চেতনা লোপ পেয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যেও মনে পড়ছে বাচ্চাটার কথা। ন ন’টা মাস আমারই শরীর নিংড়ে বেঁচে রইল, অথচ সে যখন এল আমি আর তখন থাকছি না। বিশ্বাস করো, আমার ভয়ঙ্কর বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

—বোলো না, বোলো না প্লিজ।

—শুনতে খারাপ লাগছে?

—আহ্, থামো। তুমি এখন যাও।

—যাই। তবে আমার কথাটা ভেবো। তোমারও তো পেটে বাচ্চা…

—ভয় দেখাচ্ছ?

—পাগল! তুমি ভাগ্যবতী, ডাক্তারের বউ, তোমাকে নিশ্চয়ই কোনও চান্স ফ্যাক্টরের কবলে পড়তে হবে না!

—যাবে তুমি?

—যাচ্ছি। আবার আসব। তোমায় দেখতে।

রম্যাণির ঘোর ছিঁড়ে গেল।

দুপুরে মশার জন্য জানলা বন্ধ করে দিয়েছিল, বাইরে এখন রোদঝলমল পৃথিবী, ঘরের ভেতর চাপ চাপ আবছায়া। কোণে অন্ধকারটা গাঢ়, ওই আঁধারই যেন অবয়ব পেয়েছিল এতক্ষণ, ফিকে হয়ে এল সহসা।

ছুট্টে বাথরুমে গেল রম্যাণি। এই শেষ মাঘেও ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে কপালে, ভয়ানক গা গুলোচ্ছে। হুড়হুড় করে বেসিনে বমি করল খানিকটা। আহ্‌, আরাম। ঘাড়ে গলায় জল ছেটাল ভাল করে। ভেতরে যেন তাপ জন্মেছিল, নামছে আস্তে আস্তে।

ঈষৎ টলমল পায়ে ঘরে ফিরে রম্যাণি বিছানায় শরীর ছেড়ে দিল। তাতানের পাশে। আড়াআড়ি হাতে চোখ ঢেকেছে। কদিন ধরে এ কী শুরু হল? নির্জন মুহূর্তে হঠাৎ হঠাৎ মেয়েটা এসে দাঁড়াচ্ছে সামনে! কেন আসছে? এ কী বিভ্রম? মেয়েটার যে ওই সময়েই জীবনসংশয় দেখা দেবে তা তো কিংশুকের জানা ছিল না, তাও কেন মেয়েটা…? ওফ্‌, কেন যে রম্যাণি সেদিন মেয়েটাকে দেখতে গেল! সিস্টাররা পই পই করে বারণ করছিল, যাবেন না ম্যাডাম, যাবেন না ম্যাডাম…তবু রম্যাণি কী যে এক নিশির টানে ঢুকে পড়েছিল কেবিনটায়!

পায়রার খোপের মতো ছোট্ট ঘরের ফালি সম্পূর্ণ ফাঁকা তখন, পুলিশ এসে গেছে, মেয়েটার বাড়ির লোকজন বাইরে চেঁচামিচি করছে, ভেতরে সাদা বিছানায় মেয়েটা শুয়ে আছে নিথর। ফর্সা ফোলা ফোলা মুখ কাগজের মতো সাদা। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে ছিল, যেন কিছু বলতে চাইছিল। দু চোখ অর্ধেক খোলা, যেন চুরি করে দেখছে পৃথিবীকে।

না দেখলেই ভাল হত। না দেখলেই ভাল হত।

তাতান ঘুমের ঘোরে নড়াচড়া করছে। হিসু করবে বোধহয়। রম্যাণি প্রাণপণ চেষ্টা করছে অভ্যেস তৈরি করার, তবু ছেলের এখনও বিছানা ভেজানো বন্ধ হল না। ঘুমন্ত ছেলেকে টেনে বাথরুমে নিয়ে গেল রম্যাণি, হিসু সেরে আবার নেতিয়ে পড়ল তাতান। মন্টেসরিতে সারা সকাল প্রমত্ত হুল্লোড় করে, এখন বিকেল পাঁচটা অবধি ঘুমোবে।

হ্যান্ডসেটটা বাজছে। হাত বাড়িয়ে রিসিভার টানল রম্যাণি, হ্যালো?

—কী রে, তোর শরীর কেমন?

মার গলা। স্বরে অভ্যস্ত উদ্বেগ।

রম্যাণির যে আবার বাচ্চা হবে এ কথা সে নিজে মুখে ঘোষণা করেনি। বলি বলি করে বলেনি কিংশুককেও, কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। সেই যে সেদিন বলা হল না, তারপর কেমন যেন মনে হতে লাগল সুসংবাদটা ছানা কেটে গেছে। তবে তাপসীর শ্যেনদৃষ্টির কাছে কিছুই গোপন রাখার উপায় নেই। কী রে, খেতে চাইছিস না কেন! ওমা ও কী, বমি করলি নাকি! আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রচার শুরু, এখন আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি কারওরই জানতে বুঝি বাকি নেই। তাপসীর নিজস্ব কেবল চ্যানেল অত্যন্ত সক্রিয়।

মৃদু গলায় রম্যাণি বলল, ভাল। ঠিক আছে।

—তাতান কী করছে?

—নাক ডাকাচ্ছে।

—তোর বমি কমল?

—উহুঁ। এই তো হল একটু আগে।

—শাশুড়ি কোথায়?

—বেরিয়েছে। পাড়ায়। মহিলা সমিতিতে।

—খেতে পারছিস? না এখনও…?

শুরু হয়ে গেছে মার এলোপাথাড়ি প্রশ্নবান। টেলিফোনে উত্তর শোনার চেয়ে প্রশ্ন করাতেই মার আগ্রহ বেশি।

রম্যাণি হেসে ফেলল,—নেক্সট কোয়েশ্চেন?

অঞ্জলি মানুষটি ভারী সরল, প্যাঁচপোঁচ নেই। মেয়ের ঠাট্টা ধরতে পারল না। ফের জিজ্ঞেস করল, তোর শ্বশুরমশাইও ঘুমোচ্ছন?

—এখান থেকে বলা কঠিন। ঘরে বসে একা একা তাসও খেলেন।

—হ্যাঁ রে, তোদের বাড়ি কুলের আচার আছে?

—তুমিই তো পাঠিয়েছিলে। খাচ্ছি।

—বেয়ানদের মহিলা সমিতিতে কী হয় রে?

—অনেক কিছু। বৃক্ষরোপণ, বনভোজন, বৃদ্ধাবাসগমন…। আজ অবশ্য গীতার ক্লাস আছে।

—কিংশুকের আজ চেম্বার কোথায় রে?

—উফ্‌ মা, একটা লাইনে এসো।

এতক্ষণে অঞ্জলি থমকেছে। দু-এক সেকেন্ড চুপ। তারপর নিজেও হাসছে, তুই কবে আসছিস রে?

—যাবখন একদিন।

—এসে কটা দিন থাক না।

—যাব। তাতানের পরীক্ষাটা হয়ে যাক।

—নার্সারি ওয়ানের ছেলের আবার পরীক্ষা!… এই রুমি, তোকে একটা অদ্ভুত খবর দিতে পারি।

—কী?

—বেয়াই সুনুর একটা সম্বন্ধর কথা বলেছিলেন না, কাল আমি কথাটা কায়দা করে পেড়েছিলাম সুনুর কাছে। সুনু হ্যাঁ না কিছুই বলেনি, চুপ করে শুধু শুনে গেল। মেজাজও করেনি।

—তুমি বলতে চাও দিদি রাজি?

—হ্যাঁ বলব না। তবে মনে হয় বরফ গলছে।

—বাবার সঙ্গে আলোচনা করেছ?

—তোর বাবা তো কিছুই গা করে না। আমলই দিচ্ছে না। তা বলে আমি মা হয়ে তো গা ছাড়া দিয়ে বসে থাকতে পারি না।…তুই একটা কাজ করবি রুমি?

—কী?

—বেয়াইমশাইকে বল পাত্রর একটা ফটো নিয়ে আসতে। সুনুর পড়ার টেবিলে রেখে দেব।

নাহ্‌, মাকে নিয়ে আর পারা যায় না। এখনও কীসব আদিম ধ্যানধারণা পুষে রেখেছে! দিদি কি ষোলো বছরের খুকি, যে একটা ছেলের ছবি দেখেই ঝপাস করে প্রেমে পড়ে যাবে? মার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, আত্মসম্মান দয়া করুণা এ সবের গভীরতা বোঝেই না মা। সাধে কি বাবার কাছে ঝাড় খায়!

তবু মার এই সরলতাটুকু মিষ্টিই লাগে।

রম্যাণি হেসে বলল,—ঠিক আছে, ব্যবস্থা করছি। দ্যাখো তুমি গেঁথে তুলতে পারো কিনা।

অঞ্জলিকে এবার ফুটেছে কথাটা। সামান্য অভিমানভরা স্বরে বলল, আমি তো তোদের ঠাট্টারই পাত্রী।…আমি বলে মরি নিজের জ্বালায়। এক দিকে তোর দিদি, এক দিকে তোর ভাই…

—কেন, রানা কী করল?

—কিছুই করে না। সেটাই তো চিন্তা। জয়দীপদের বাড়িতে বসে সারাক্ষণ কম্পিউটার পিটিয়ে যাচ্ছে, চাকরির কোনও চেষ্টা নেই কিছুই না…

সর্বাণীর মতো রানাও লেখাপড়ায় বেশ ভাল ছিল। মাধ্যমিকে এইটিসিক্স পারসেন্ট, হায়ার সেকেন্ডারিতে স্টারমার্কস…। ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না রানার, ইচ্ছে ছিল পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়বে অনেক দূর, গবেষণা করবে।

পার্ট ওয়ানে একটা পেপার খারাপ হয়ে গেল, ফিফটিফাইভ পারসেন্টের বেশি পেল না। আদাজল খেয়ে পড়ল পার্ট টুতে, থিয়োরিটিকাল মোটামুটি ভালই দিল। শেষ প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার দিন ধুম জ্বর, ল্যাবরেটরিতে পড়ে গেল মাথা ঘুরে। অনার্স পেল, কিন্তু আরও নেমে গেল পারসেন্টেজ। এও যেন এক চান্স ফ্যাক্টর। সারা বছরের পরিশ্রম সার্থক হবে কিনা নির্ভর করে শুধু চারটে দিনের ওপর। ব্যস, রানার এম এস সি পড়ার স্বপ্নের অপমৃত্যু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ তো পেলই না, অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েও না। দু-চার জায়গায় ভর্তির লিখিত পরীক্ষায় বসল বটে, কিন্তু তখন রানার আত্মবিশ্বাস চিড় খেয়ে গেছে।

সুতরাং চিচিং বনধ।

অন্য কোনও লাইনেও আর পড়ল না রানা। শত উপরোধেও না।

এখন তো অঞ্জলির দুশ্চিন্তা হবেই। পিনাকেশ মাঝারি যন্ত্রনির্মাণের জগতে একজন নামী ইঞ্জিনিয়ার, গোটা তিন-চার প্রতিষ্ঠানে পরামর্শদাতার কাজ করে, মোটা রোজগার। কিন্তু তারও তো বয়স হচ্ছে, ষাট পেরোনোর পর থেকে ইদানীং শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। প্রেশার বেড়েছে, হার্টেও টুকটাক উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। ছেলে কোথায় বাপকে বিশ্রাম দিয়ে ধীরে ধীরে সংসারের হাল ধরবে তা নয়…

একদমই উদ্যমহীন হয়ে গেছে রানা। রমাণিও তো কত ঘেঁতিয়েছে, কর্ণপাতই করে না।

রম্যাণি সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলল,—অত ভাবছ কেন? ওর তো মাথা ভালই, হয়তো কম্পিউটার নিয়েই কিছু করবে। কম্পিউটারে এখন কত রকম স্কোপ।

—কী জানি বাবা, আমি ওসব বুঝি না।

—ওর যখন কম্পিউটারে এত ইন্টারেস্ট ওকে একটা কম্পিউটারই কিনে দাও না।

—তোর বাবাও তাই বলছিল। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলবে কে! বাড়িতেই থাকে না। যেটুকু সময় থাকে কী মেজাজ! সুনুও বলে ওকে ওর মতো থাকতে দাও মা, ঘাঁটিয়ো না

—দেখি, আমি গেলে ওর সঙ্গে কথা বলব।

মার সঙ্গে আরও দু-চারটে সুখদুঃখের কথা বলে টেলিফোন ছাড়ল রম্যাণি। রানার কথা ভেবে মনটা আবার খারাপ লাগছে। তারা তিন ভাইবোন একসঙ্গে বড় হয়েছে, দিদি ভাই কেউ খুব একটা ভাল নেই, অথচ সে নিজেকে দিব্যি এক নিশ্ছিদ্র সুখের ঘেরাটোপে স্থাপন করে নিয়েছে, এ ভাবনাটা একটু একটু যেন অপরাধবোধও জাগায় মনে। তাকে কি স্বার্থপর বলা উচিত, এর জন্যে? কীই বা সে করতে পারত? কিংশুককে বিয়ে না করে দুঃখী দুঃখী মুখে বাপের বাড়িতে বসে থাকলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যেত? বাবা মার কপালের ভাঁজ আরও একটা বাড়ত বই কমত না। যার যার জীবন তার নিজের জীবন, বইবে নিজস্ব খাতে, এটাই তো নিয়ম। অথবা এটাও সেই চান্স ফ্যাক্টর। বিজন দুপুরে ভেবে ভেবে একটু কষ্ট পাওয়া ছাড়া রম্যাণির আর কিছুই করার নেই।

হালকা বিষণ্ণতার পাশাপাশি সামান্য স্বস্তিও বোধ করছিল রম্যাণি। কিংশুকের ঝাঞ্ঝাটটা নিয়ে আর কোনও কৌতূহল প্রকাশ করল না মা। সম্ভবত ঘটনাটাকে সেভাবে মা গুরুত্বই দেয়নি। নাকি টের পেয়ে গেছে ওই নিয়ে কোনও প্রশ্ন করলে মেয়ে বিব্রত বোধ করে?

ভাবনাটার সঙ্গে সঙ্গেই বুকে এক চোরা হিমস্রোত, রম্যাণির দৃষ্টি আটকেছে ঘরের কোণে। ভাঙা ভাঙা অন্ধকারে আবার অবয়বটা ফুটে উঠছে না?

দৌড়ে গিয়ে জানলা খুলে দিল রম্যাণি। আলো আসুক। আলো আসুক।

পর্দার ওপারে গলা খাঁকারি, —কী রে, ঘুমোচ্ছিস নাকি?

রম্যাণি বেরিয়ে এল। শ্বশুরমশাই পাজামা পাঞ্জাবি পরে তৈরি।

হেসে বলল,—চা চাই বুঝি?

—করবি? কর না। তোর শাশুড়ি তো পুণ্যসঞ্চয়ে ব্যস্ত, তার অপেক্ষায় বসে থাকলে আমার মতো পাপীতাপীর নেশা চটকে যাবে।

অতীনের স্বরে কুণ্ঠামাখা অনুরোধ। যতই রম্যাণিকে মেয়ে বলে জাহির করার চেষ্টা করুক, রম্যাণি এখনও শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে পুত্রবধূই। বাবা হলে কি এক কাপ চা চাইতে এমন দ্বিধা করত? নাহ্‌, শ্বশুর শাশুড়ি, শ্বশুর শাশুড়িই, বাবা মা নয়।

মেপে এক কাপ চা করল রম্যাণি। নিজের তেমন চায়ের নেশা নেই, তবে এ সময়ে খায় একটু। আজ ভাল লাগছে না, গলাটা কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। ছেলের দুধ গরম করতে করতে রম্যাণি একবার চিন্তা করল ছবির কথা অতীনকে বলবে কিনা! থাক, দু-চারটে দিন যাক। মাঝে একবার দিদির সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।

অতীন ক্লাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর তাতানকে ঠেলে তুলল রম্যাণি। টিভি চালিয়ে দিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে। কার্টুন চ্যানেল। আধুনিক রূপকথা। দৃশ্যের শিকলে বাঁধা কল্পনার জগৎ। আজকালকার বাচ্চারা এই চ্যানেলটা নেশার মতো গেলে।

তাতানের স্থির চোখ রঙিন পর্দায়, রম্যাণির হাত ছেলের মুখে গ্লাস ধরে আছে, দরজায় করাঘাত।

বেল না বাজিয়ে দুম দুম ধাক্কা মারে কে? নির্ঘাত দোতলার মঞ্জুদি।

হ্যাঁ, যা ভেবেছে তাই। মঞ্জুদির হাতে স্টিলের বাটি, গালে ভাঙাচোরা হাসি। সুড়ৎ ঢুকে পড়ল,—অ্যাই, একটু দুধ দেবে গো? আমাদেরটা বেড়াল খেয়ে নিয়েছে। ওই যে গো, ওই মাদি বেড়ালটা। কালো-সাদা। আমি ঢেকে রাখতে ভুলে গেছিলাম। হি হি, এত নোলা বেটির। হিহি।

কথা বলার সময় মুখ দিয়ে বড্ড থুতু ছিটকোয় মঞ্জুর। হাত থেকে বাটিটা নিয়ে রম্যাণি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে। ফিরে কপালে হাত। মেঝেয় তাতানের পাশে গেঁড়ে বসেছে মঞ্জু হাঁ করে টম অ্যান্ড জেরি দেখছে। যাহ্‌, এখন আর নড়ানো যাবে না।

মঞ্জুর বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। লম্বা প্যাঁকাটির মতো চেহারা, বুক পিঠ সমান, মাথায় সামান্য কোঁকড়া পাতলা পাতলা চুল, চোখ দুটো কটা কটা। এক সময়ে প্রচণ্ড ফর্সা ছিল, সম্ভবত রক্তাল্পতার জন্য এখন কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখায়। ছোটবেলায় খারাপ ধরনের টাইফয়েড হয়েছিল মঞ্জুর, মারণব্যাধি তার মস্তিষ্ককে ঘেঁটে দিয়ে গেছে।

কার্টুন দেখতে দেখতে ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে উঠছে মঞ্জুর চোখ, হাততালি দিচ্ছে। হঠাৎ ঘাড় ফেরাল, ড্যাবড্যাব করে দেখছে রম্যাণিকে,—অ্যাই, তুমি এটা কী পরেছ গো?

—কাফতান।

—সুন্দর লাগছে। আমায় একটা এনে দেবে?

মাঝে মাঝেই রম্যাণির কাছে এসে এটা ওটা চায় মঞ্জ, হুটহাট রম্যাণির ঘরে ঢুকে পড়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে ড্রেসিংটেবিল। আপন মনে লিপস্টিক ঘষে, পাউডার বোলায়, কাজল লাগায়, গদগদ মুখে দেখে নিজেকে। রম্যাণি অনেক সময়ই টুকটাক সাজের জিনিস দিয়ে দেয় মঞ্জুকে। আহা, জড়বুদ্ধি বলে কি সাধআহ্লাদ থাকতে নেই!

রম্যাণি বাচ্চা ভুলোনোর স্বরে বলল, —দেবখন।

—আমায় মানাবে না, বলো? তোমার থেকেও সুন্দর লাগবে না?

—ঢের বেশি সুন্দর লাগবে।

মঞ্জুর মুখখানা অপার্থিব খুশিতে ভরে গেল, বুঝি বা ক্ষয়াটে মুখ একটু সুন্দরও দেখাল। মাথা দোলাচ্ছে দুদিকে।

ছোটবেলায় অসুখটা না হলে রম্যাণি না হোক রম্যাণির মতো একটা জীবন তো পেতে পারত মঞ্জু! এও তো সেই চান্স ফ্যাক্টর!

মঞ্জু ফস করে বলল, অ্যাই, তোমার নাকি আবার বাচ্চা হবে?

—হুঁ, হবে তো।

—কবে হবে গো?

—দেরি আছে। অক্টোবরে।

—এটা ফেব্ৰারি তো? বলেই কড় গুণতে শুরু করল মঞ্জু। গুলিয়ে ফেলছে। হাল ছেড়ে দিল। খপ করে রম্যাণির একটা হাত চেপে ধরে বলল, শোনো, তোমার একটা বাচ্চা আমায় দেবে?

—কেএএনোওও?

—দাও না গো। মানুষ করব। আমি সাদা-কালো বেড়ালটার দুটো বাচ্চা বড় করে দিয়েছি।…দেবে তো?

তাতান কেমন সন্দিগ্ধ চোখে দেখছে মঞ্জুকে। একটু সরে বসল।

রম্যাণি উত্তর দেওয়ার আগেই ঘণ্টাধ্বনি। তাপসী গীতা পাঠ সেরে ফিরল। মঞ্জুকে দেখেই চোখ খরখরে হয়ে গেছে, অ্যাই, তুই কী করছিস রে এখানে?

মঞ্জু বাটিটা দেখাল, দুধ নিতে এসেছি।

—নেওয়া হয়ে গেছে তো? যা এবার।

—যাচ্ছি। মঞ্জুর ওঠার লক্ষণ নেই, দুলছে অল্প অল্প।

তাপসী খেঁকিয়ে উঠল, কী, কথা কানে যাচ্ছে না? ওঠ, ওঠ বলছি। যা এক্ষুনি।

ঢিল খাওয়া আহত শ্বাপদের মতো ভয়ে ভয়ে তাকাতে তাকাতে চলে গেল মঞ্জু।

রম্যাণির ভীষণ খারাপ লাগছিল। বলেই ফেলল, তুমি ওকে ওভাবে তাড়ালে কেন?

—ঠিক করেছি। ওকে একদম ঢুকতে দিবি না। ওর এখন খুব হাতটান হয়েছে। আমার রুপোর সিঁদুর কৌটোটা খুঁজে পাচ্ছি না, কাল গিয়ে দেখি ওটা নন্দাদির টেবিলে। এত বড় মিথ্যেবাদী, মাকে বলেছে কাকিমা আমায় দিয়েছে।

—আহা, ও কি অত জেনে বুঝে নিয়েছে নাকি? ওকে একটু ভাল করে বুঝিয়ে বললেই হয়। বেচারা মনে কত আঘাত পেল!

—ছাড় তো তুই। ও আবার একটা মানুষ!

কথাটা যেন তিরের মতো বিঁধল রম্যাণিকে। একটা জ্বলজ্যান্ত রক্তমাংসের প্রাণ, হাসছে খেলছে কাঁদছে্‌, আপন খেয়ালে গলা ছেড়ে গান গাইছে, ক্ষুধাতৃষ্ণাবোধ আছে, অবদমিত যৌনপিপাসাও আছে, শুধুমাত্র তার অস্তিত্বের বিপন্নতার কথা বলতে পারে না বলে তাকে মানুষের জগৎ থেকেই খারিজ করে দেয় তাপসী?

শাশুড়ির সঙ্গে তর্কাতর্কিতে গেল না রম্যাণি। ঘরে এসে চল বাঁধল, টিপ পরল, কাফতান বদলে পরে নিল সালোয়ার কামিজ। এখন তার বৈকালিক ভ্রমণের সময়, কিংশুক তাকে এখন থেকেই নিয়ম করে হাঁটতে বলেছে।

বাড়ির অদূরে পার্ক। ভেতরে গিয়ে ছেলেকে ছেড়ে দিল রম্যাণি। তাতান দৌড়োদৌড়ি করছে। পার্কে বেশ কিছু বন্ধু আছে তাতানের, তাদের সঙ্গে যত না খেলে তার চেয়ে অনেক বেশি তিড়িং বিড়িং লাফায় তাতান।

ধীর পায়ে পার্ক বেড় দিতে দিতে বিকেলের বাতাস গায়ে মাখছিল রম্যাণি। বসন্ত প্রায় এসে গেল। হাওয়ায় তার মিঠে আমেজ টের পাওয়া যায়। গন্ধও। নিস্পত্র কৃষ্ণচূড়ার গাছে গাছে প্রাণের সবুজ বিস্তার। আকাশে আজ মেঘ নেই এতটুকু। পরশু রাতের দিকে বৃষ্টি ঝরেছিল, সামান্য, তারপর থেকে আকাশ একেবারে ধোয়ামোছা হয়ে গেছে। আকাশ বেয়ে শব্দ করে একটা এরোপ্লেন উড়ে গেল। নাগরিক কোলাহলে দ্রুত মিলিয়েও গেল আওয়াজটা।

গোটা কয়েক চক্কর মেরে রম্যাণি বেঞ্চিতে এসে বসল। ঘাম হচ্ছে অল্প অল্প। এটুকুই যথেষ্ট। বসে থাকতে থাকতেই ফিরোজা বরণ আকাশ রং বদলাল। পশ্চিমে লালচে আভা জাগল, মুছেও গেল। ম্রিয়মাণ অপরাহ্নকে চাঙা করতে জ্বলে উঠেছে পথবাতি। তরল আঁধার তবু চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছিল।

বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার মনিহারি দোকানটায় ঢুকল রম্যাণি।…তাতান স্কুলে টিফিনবক্স ভেঙে এনেছে, নতুন একটা কিনতে হবে।

তাতান পাশে করুণ মুখে তাকিয়ে। বোধহয় কিছু চাই, মাকে মুখ ফুটে বলতে সাহস হচ্ছে না।

রম্যাণি হাসি চেপে বলল, কী নিবি?

তাতানের ঘাড় নিচু, আঙুল উঠে গেছে মশলাদার চিপসের প্যাকেটের দিকে।

—অত ঝাল খেতে পারবি?

—ওর মধ্যে ট্যাজো আছে।

—সেটা কী?

—তিনটে ট্যাজোতে একটা মাসক পেগাজ দেয়।

—পেগাজ কী?

—তাও জানো না? একটা জিনিস।

অর্থাৎ তাতান নিজেও জানে না, বন্ধুদের মুখে শুনে প্রলুব্ধ হয়েছে। নাকি টিভির বিজ্ঞাপনে?

চিপসের প্যাকেট পেয়ে তাতান দে দৌড়। দাঁড়া দাঁড়া বলতে বলতে পিছনে জোর কদমে রম্যাণি। তাতান বাড়ি ঢুকে গেছে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট অফ। লোডশেডিং।

গেটের সামনে এসে রম্যাণি চলচ্ছক্তিহীন। নিকষ অন্ধকারে কী ওটা? কে দাঁড়িয়ে? ই মেয়েটা না?

রাত্রে বিছানায় শুয়ে কথাটা বলল রম্যাণি, জানো, আজ তিন তিন বার দেখলাম।

আধশোওয়া কিংশুক একটা মেডিকেল জার্নাল উল্টোচ্ছিল। সাধারণত পাশের অ্যান্টিরুমেই সে পড়াশুনোর কাজ সারে, তবে এমনি জার্নালে চোখ বোলানোর জন্য শয্যাই তার প্রিয় স্থান। চোখের সামনে অক্ষর না ধরলে কিংশুকের ঘুম আসে না।

জার্নাল থেকে চোখ না সরিয়ে কিংশুক প্রশ্ন করল, কী দেখলে?

—মেয়েটাকে।

—কে মেয়ে?

—সেই যে গো…তোমার মুনলাইটের।

সাঁ করে ঘাড় ঘুরেছে কিংশুকের। চোখ পাকিয়ে বলল, তুমি ফের ও সব আজেবাজে কথা চিন্তা করছ?

—না গো, বিশ্বাস করো। সত্যিই সে আসে।

—এ তো মহা প্রবলেম হল। জার্নাল সাইডটেবিলে রেখে চিত হয়ে শুল কিংশুক, এত আপসেট হয়ে গেছ কেন বলো তো?

—হইনি তো আপসেট। সত্যি তো মেয়েটা আসে, কথা বলে, গল্প করে, দুঃখ করে…

—কচুপোড়া আসে। ইউ নিড সাম ট্রিটমেন্ট।

—কীসের ট্রিটমেন্ট?

—অসুখের। তোমার যেটা হয়েছে তাকে বলে অ্যান্টিন্যাটাল ডিপ্রেশান। কাল ওষুধ লিখে দেব, বাবাকে দিয়ে আনিয়ে নিও।

—কীসের ওষুধ? কেন খাব? আমার তো কোনও ডিপ্রেশান নেই!

—তুমি তোমার অসুখের কী বুঝবে? প্রেগনেন্ট মেয়েদের এটা হয়। কোনও শক টক পেলে। কিংশুক বিড়বিড় করল, কালই অরিন্দমের সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে। দরকার হলে একটা দুটো কাউন্সেলিংও…

—তুমি মিছিমিছি বাড়াচ্ছ। আমার কোনও অসুবিধে নেই, কিচ্ছু হবে না।

—আমি রিসক নিতে রাজি নই। আমার স্ত্রীর সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনা আমি ঘটতে দিতে পারি না।

একটা উষ্ণ বাতাস যেন রম্যাণির ঠোঁটটাকে বেঁকিয়ে দিয়ে গেল। শ্লেষ ঝরল রম্যাণির গলায়, অর্থাৎ নিজের বউ-এর ক্ষেত্রে চান্স ফ্যাক্টরটা একেবারে মুছে ফেলতে চাও, তাই তো?

দুম করে রেগে গেল কিংশুক। উঠে বসে তর্জনী নাচাচ্ছে, একদম ফালতু কথা বলবে না তোমার ধারণাটা কী হয়েছে, অ্যাঁ? আমি আমার পেশেন্টের প্রপার কেয়ার নিই না?

—চেঁচাচ্ছ কেন? তাতান উঠে পড়বে।

—উঠুক। তুমি কেন বার বার ওই কথা আটার করবে? কেন ঘটনাটাকে তুমি অ্যাক্সিডেন্ট বলে মানবে না?

—কী হল্লা শুরু করলে বলো তো? তোমাকেই ডাক্তার দেখানো দরকার। যে রকম কথায় কথায় রেগে যাচ্ছ…তোমারই কোনও মেন্টাল ডিজিজ হয়েছে।

কিংশুক দাঁতে দাঁত চাপল। ক্রোধটাকে বুঝি সংবরণ করছে প্রাণপণে। বলল, আমি কথায় কথায় রেগে যাই?

—যাও তো। সেদিন নার্সিংহোম থেকেই…

—রুমি, আমি লক্ষ বার বলেছি, সেদিন আমার রেগে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল।

—সে তো সাজানো কারণ।

—সাজানো? কিংশুক থমকে গেল।

—সাজানোই তো। আসল সত্যি হল তুমি সেদিন নার্সিংহোমে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলে। আমরা সেটা দেখে ফেলেছি তাই…

কিংশুক সহসা নির্বাক। ঘরে অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য। তাতান পাশেই শুয়ে, তার নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দটুকুকেও যেন উচ্চকিত ধ্বনি মনে হয়।

আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল কিংশুক। তারপর ভার গলায় বলল, ভয় পাওয়াটাই তো নর্মাল ছিল রুমি। অমন তাণ্ডব চলছে, লোকগুলো পারলে আমাকে ছিঁড়ে খায়…আমি তো আর অমিতাভ বচ্চন নই, যে এক পাল রাফিয়ানের সঙ্গে একা লড়ে যাব!

—শুধু ওই ভয়ে কাঁপছিলে? আর অন্য কোনও ভয় নয়?

—আর কীসের ভয়?

—সেন্স অফ গিল্ট? অপরাধবোধে?

—তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মনে মনে তুমি মাকড়সার জাল বুনছ, আর নিজেই তাতে জড়িয়ে পড়ছ। কিংশুকের স্বর হঠাৎই শান্ত। বেডসুইচ অফ করে দিল। আলগা হাত রেখেছে রম্যাণির মাথায়। নরম গলায় বলল, ঘুমোনোর চেষ্টা করো।

ছয়

পোস্ট অফিসের কাউন্টারে যথারীতি লম্বা লাইন। চাকরি থেকে বাতিল বৃদ্ধ প্রৌঢ়ের দল সঞ্চয়ের সুদ কুড়োতে এসেছে। প্রতি মাসে এটাই তাদের সব চেয়ে জরুরি কাজ। অন্তত যতদিন তারা বেঁচে থাকবে।

একটুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল অতীন। মাসের এক তারিখেও যা, বিশ তারিখেও তাই, সে তুমি সকাল সাড়ে নটায় আসো কি বেলা একটায়, এই দু নম্বর কাউন্টারটি জীবনে ফাঁকা থাকবে না। ব্যাঙ্কে: অত ঝঞ্ঝাট নেই। মোড়ের চ্যাটার্জি বাড়ির ছেলেটার যদুবাবুর বাজার ব্রাঞ্চেই অধিষ্ঠান, কিংশুকের বাবা বলে ইদানীং তাকে মান্যিগন্যি করে খুব, ভিড়ভাট্টা ক্যাচাল যাই থাক, চেক হাতে গুঁজে দিলেই ভেতর থেকে টাকা তুলে এনে দেয়। কিন্তু এখানে কি সেটি হওয়ার জো আছে? বুড়োগুলো এত ফিচেল, ঠিক খপ করে ধরে। পিওন ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন গুহবাবু! আরে মশাই, পিওনের জোর আমাদেরও আছে, আমরাও টাকাটা সিকিটা দিই! সবাই মিলে পিওন ম্যানেজ করলে কাউন্টারের ওপারে আর একটা লাইন পড়ে যাবে যে, হে হে হে!

শালা! নেহাত পোস্ট অফিস এক দেড় পারসেন্ট সুদ বেশি দেয়, নইলে এই অসভ্য জায়গায় অতীন থোড়াই টাকা রাখত! অবশ্য আর একটা কারণও আছে, এ শালারা গণেশ উল্টোবে না।

লাইনে চেনা চেনা মুখ। অতীনের ঠিক আগেই দিবাকর সান্যাল, বয়স সত্তরের ওপারে, নামী কাগজের রিপোর্টার ছিল এক সময়ে। তার সামনে প্রাক্তন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক পরেশ হালদার, চোখে ছানি-চশমা, হাতে রংজ্বলা ছাতা। চা কোম্পানির রইস অফিসার মনোময় চন্দও আছে সারিতে, আছে রেলকেরানি সন্তোষ মিত্তির, দারোগা রতন ভৌমিক, বি টি কলেজের প্রিন্সিপাল হরেন গুপ্ত…। এখানে লাইন যেন অনেকটা শ্মশানের মতো, শ্রেণীহীন। এককালের উঁচুতে নিচুতে এখানে আলাপচারিতা চলে স্বচ্ছন্দে।

হরেন আর মনোময় কথা বলছিল। অতীনকে দেখে হাত তুলল হরেন, গুহমশাই যে? কেমন চলছে?

অতীন হাসল, পাসিং অন।

—আপনার ছেলের সেই কেসটা কী হল?

গত মাসে টাকা তুলতে এসে অতীনই গল্প করেছিল কথায় কথায়। প্রিন্সিপালসাহেব মনে রেখেছে! তখন খানিকটা উদ্বেগের মধ্যে ছিল অতীন, নিস্ফলা পুলিশি তদন্তের পর সে এখন পুরোপুরি নিঃশঙ্ক।

অতীন স্মিত মুখে বলল, ও মিটে গেছে।

—মিটে গেছে? যাক নিশ্চিন্ত।…কী আননেসেসারি প্রবলেমে জড়িয়ে পড়েছিল বলুন তো?

—কী আর করা। ওর পেশাটাই তো এরকম। সুতোর ওপর হাঁটা।

—কিন্তু এরকম হামলাবাজি চলতে থাকলে ভাল ভাল ছেলেরা ডাক্তারি পড়তে যাবে কেন, অ্যাঁ?

—যা বলেছেন। মানুষ আজকাল এমন অ্যারোগ্যান্ট হয়ে যাচ্ছে…!

—অ্যারোগ্যান্ট নয় মশাই, বলুন ভায়োলেন্ট। দিবাকর কিছুই জানে না, কিছুই শোনেনি, তবু ফস করে মন্তব্য জুড়ল, দেখেছেন আমাদের কাগজের খবরটা আজ?

—কোনটা বলুন তো?

—ওই যে ষোলো বছরের ছেলে…বাপ মাকে ঘ্যাচাং ফু।

—ও, ওই নিউজটা? সন্তোষ ঘুরে তাকাল, ও তো সব কাগজেই আছে।

—আমাদের কাগজ নিউজটা লিড় করেছে। চার কলাম জুড়ে। জব্বর কভার করেছে সুশান্ত। আমি নিজে হাতে সুশান্তকে তৈরি করেছিলাম। জেম অফ আ বয়, অনেক দূর রাইজ করবে। কী ডিটেল, আহা।

যে কোনও ছুতোয় খবরের কাগজের প্রসঙ্গ তুলে দিয়ে আত্মপ্রচার করা দিবাকরের স্বভাব। তবে আজকের খবরটা সত্যিই রোমহর্ষক। বাবা মাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অচেতন করে টুকরো টুকরো করে কেটেছে ছেলে। তারপর দিব্যি হাত টাত ধুয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নাইট শো-এ বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখতে গেছে…

অতীন বলল,—হ্যাঁ, পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ওইটুকু ছেলে নিজের বাপ মাকে মার্ডার করছে…তার ওপর অত ঠাণ্ডা মাথায়…!

এই ধরতাই টুকুনিরই বুঝি শুধু প্রয়োজন ছিল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে জোর আলোচনা। ঝাঁকে ঝাঁকে বক্তব্য উড়ে আসছে। মন্তব্যও।

—ভাবুন, এতটুকু অনুশোচনা পর্যন্ত হয়নি। নো দুঃখ, নো কান্না, নো ভয়, নো লজ্জা, পুলিশকে স্ট্রেট বলছে বেশ করেছি মেরেছি!

—মেন্টাল কেস। মেন্টাল কেস।

—কিছুটা মেন্টাল তো বটেই। নইলে বাপ মাকে রক্তে শুইয়ে ফুর্তি করতে যেতে পারে?

—ওটা তো অ্যালিবাই তৈরি করার চেষ্টা।

—কিন্তু মেন্টালি পারল কী করে? নরমাল হলে তো…

—আজকালকার ইয়ুথ এত ক্রুয়েল হয়ে গেছে। এক্কেবারে হার্টলেস।

—সংসর্গ। সংসর্গ। এই জন্যই তো ছেলেকে সব সময়ে বলি নাতিকে চোখে চোখে রাখতে। যাতে কুসঙ্গে না পড়ে।

—নাতিদের আটকাবেন কী করে দাদু? আপনাদের ছেলেমেয়েগুলোও তো খুব সুবিধের নয়। পাশের খাম পোস্টকার্ডের লাইনে দাঁড়ানো এক যুবকের তির্যক টিপ্পনী, ছেলেটার বাপমায়েরও তো ক্যারেক্টারের কিছু ঠিক ছিল না।

প্রবীণের দল বুঝি একটু ঝাঁকি খেয়ে গেল।

সন্তোষ মাথা দোলাচ্ছে, হুম। দেখছিলাম বটে বাপটার কী সব যেন দু নম্বরি বিজনেস!

—মারও তো কাঁড়ি কাঁড়ি বয়ফ্রেন্ড!

—মদ খেয়ে স্বামী স্ত্রী নাকি বেলেল্লাপনাও করত খুব। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন তো কমপ্লেনও করেছে…

—অথচ দুজনেই নাকি শিক্ষিত।

—অমন পুঁথিপড়া বিদ্যের ক্যাঁথায় আগুন…! নৈতিক চরিত্রই যদি ঠিক না থাকে….

—হাহ্‌, নৈতিক চরিত্র। যেমন নেতা তেমনি জনতা, তেমনি শিক্ষিত তেমনি অশিক্ষিত…! সমাজটা যে কোন দিকে যাচ্ছে!

—আজকাল একটা মানুষও নিজেকে ছাড়া ভাবে না মশাই!

—আয়নায় নিজেদের মুখগুলোও দেখে নিয়েছেন তো দাদুরা?

টুকুস করে কথাটা ভাসিয়ে দিয়ে তরুণটি নিমেষে হাওয়া। এক ঝাপটায় প্রতীক্ষার লাইনে তুফান বন্‌ধ। প্রত্যেকেই নিশ্চপ। যেন পরীক্ষায় টুকলি করার চোথা পকেটে রয়েছে অথচ নজরদার ঘুরছে বলে বার করতে পারছে না এমনই সব মুখভাব।

অতীনও যেন অন্যমনস্ক। মুখ ফিরিয়ে দেখছে অফিসখানা। ভেতরটায় আলো বড় কম। ময়লা ময়লা বাল্‌ব টিউব জ্বলছে বটে, তাদের বিকিরণে মোটেই উজ্জ্বলতা নেই। সিলিং থেকে ঝুলছে মেঘের মতো কালো কালো ঝুল, যে কোনও সময়ে তারা বর্ষিত হতে পারে। মরচে পড়া লোহার মতো মুখ করে চিঠিতে ছাপ মারছে ডাককর্মী, ধকধক এক শব্দ বাজছে একটানা। কানে লাগছিল।

লাইনে কথা ফুটছে একটু একটু করে। তবে ভুলেও ওই প্রসঙ্গে আর যাচ্ছে না কেউ। টাকা তুলছে, পাশবই মেলাচ্ছে, সুদের অঙ্ক নিয়ে হিসেবনিকেশ চলছে, সবই যেন কেমন নিচু গলায়।

রতন ভৌমিকের কাউন্টারের কাজ শেষ। পাশবই পকেটে রাখতে রাখতে অতীনের সামনে এসে দাঁড়াল। চাপা স্বরে বলল, যাক, এবারের বাজেটটাও কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

—যা বলেছেন। অতীনের আগে একদা-বামপন্থী ন বছর প্রাপ্য পাওনাগণ্ডার জন্য জুতোর সুকতলা খুইয়ে ফেলা পরেশ বলে উঠল, আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম স্বল্প সঞ্চয়ের ওপর সুদ বুঝি এবার কমিয়েই দিল।

অতীন অস্ফুটে বলল, দেখুন বছরের মাঝে আবার কমায় কি না।

—স্মল সেভিংসে হাত ছোঁয়ানো অত সহজ নয় মশাই। স্টেটগুলো সব চিৎকার জুড়বে না?

—চিৎকারই সার। কিছু করতে পারবে? মণিময় ঈষৎ উত্তেজিত, এই তো ব্যাঙ্ক ডিপোজিটের ইন্টারেস্ট কমল, কোন শালা কী অশ্বডিম্বটা পাড়ল শুনি? কী, ঠিক বলছি গুহবাবু?

অতীন কেঠো হাসল। একটুখানি হাসতে হয়, তাই। নইলে সুদকষায় তার তেমন আগ্রহ নেই। মাসে মাত্র পঞ্চাশ একশো টাকা হ্রাস বৃদ্ধিতে তার এখন কীই বা যায় আসে? হয়তো হাতখরচা সামান্য কমাতে হবে, কি শখের কোনও জিনিসের জন্য বাবলুকে মুখ ফুটে বলতে হবে, এই যা। তার নেশা বলতে তো শুধু সিগারেট, আর অতি নগণ্য স্টেকে ব্রিজ খেলা। ছেলেকে সে মানুষের মতো মানুষ করে দিয়েছে, খুনে বদমাশ তো গড়েনি, তার অত ভাবনাই বা কীসের!

অতীন টাকা তুলে বেরোল এগারোটা নাগাদ। গেট পেরোনোর মুখে তিনটে কমবয়েসি ছেলেমেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগছিল প্রায়, কোনওক্রমে সরে গিয়ে বাঁচাল নিজেকে। এক ঝলক তাকাল ছেলেমেয়েগুলোর দিকে, রাগ রাগ চোখে। যেন এদেরই কেউ সেই পিতামাতার হত্যাকারী। অথবা লাইনের সেই বাচাল ছেলেটা।

আজ রোদুরটা বেশ ঝাঁঝালো। ফাগুনেই বাতাস যেন আগুনে হয়ে গেছে। রোদ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে যদুবাজারের দিকটায় গেল অতীন। হাঁস মুরগি মিলিয়ে খান আস্টেক ডিম কিনল, তাপসীর নির্দেশ। বিকেলে পুডিং ফুডিং বানাবে কি? আঙুর নিল হাফকিলোটাক। তাতান খাবে, রুমিও। রুমির এ সময়ে আঙুরটা খাওয়া খুব প্রয়োজন, বড় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে রুমি। বাবলু রুমিকে রোজ মুসাম্বির রস খেতে বলেছে, বড় বড় সাইজের গোটা চারেক মুসাম্বিও কিনে নিল। আজকের ফলপাকুড়টা সংসারের বাজেটে ঢোকাবে না। মাসের এই দিনটায় একটু খরচ করতে ভাল লাগে। পাশে মাংসর দোকানে নধর রেওয়াজি খাসি ঝুলছে, জিভে জল এসে যাচ্ছে প্রায়। নেবে? নেবে? থাক, বাবলু রেডমিট দেখলে খুব বিরক্ত হয়। চর্বিওলা মাংস তো সহ্যই করতে পারে না।

অতীন বাড়ির পথ ধরল। টুকরো টাকরা চিন্তা ঘুরছে মাথায়। ভারী ভারী। হালকা হালকা। মেঘের মতো। রুমির নাকি একা থাকলে কী সব ডিপ্রেশান টিপ্রেশান হচ্ছে আজকাল, বাবলু বলছিল। কীসের অবসাদ? রুমি কি আর বাচ্চা কাচ্চা চায় না? মেয়েটা বড় চাপা, মনের ভাব টের পাওয়া মুশকিল। বাবলু জানলেও জানতে পারে। তবে মাঝখান থেকে তাপসীর আচ্ছা বাঁশ গেছে। মার ওপর হুকুম জারি করেছে বাবলু, দুপুরে যেন রুমিকে একটু চোখে চোখে রাখে মা। হা হা হা, তাপসীর পুণ্য সঞ্চয় এখন পোস্টপনড। অন্তত বাচ্চাটা না হওয়া পর্যন্ত। মহারানি অতীনের কাছে গজগজ করছিল, কিন্তু ছেলের মুখের ওপর একটিও কথা বলার সাহস নেই!…এবার কী হবে রুমির? মেয়ে হলে বেশ হয়। তাপসী তাতানটার দখল নিয়ে নিয়েছে, নাতনি থাকবে অতীনের কবজায়। আয় লড়, তোর হাতেও একটা টেক্কা, আমার হাতেও একটা টেক্কা, নো ট্রাম্পের খেলায় তুই যাবি কোথায়?…এ হে হে হে, নো ট্রাম্পের নিশ্চিত এল এসটা কাল মিস হয়ে গেল? এত সিলি ভুল কেউ করে? থার্ড হ্যান্ড মাস্ট বি হায়েস্ট, ডায়মন্ডের কিং কোন আকেলে ডাক করল অতীন? ওটাকে কি ফিনেস নেওয়া বলে?…

চিন্তায় বাধা পড়ল। সামনে নন্দা বউদির ভাইপো জয়ন্ত। তাদের বাড়ির দিক থেকেই আসছিল, দাঁড়িয়ে গেছে, কী মেসোমশাই, কোত্থেকে?

জয়ন্তকে অতীন একটুও পছন্দ করে না। মহা ধড়িবাজ ছোকরা। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, বউ বাচ্চা আছে, কাজের মধ্যে কাজ, করে অর্ডার সাপ্লাই-এর বিজনেস। অর্থাৎ ইধার কা মাল উধার। শালা, কমিশনে পেট চালায়। কিরণদা বেঁচে থাকাকালীন টিকিটি দেখা যেত না, এখন কী ধান্দায় সকাল সন্ধে পিসি পিসি করতে আসে, অতীন বোঝে না?

মুখে একটা ইলাসটিক হাসি টানল অতীন, এই…কিছু কেনাকাটা ছিল…তোমার কী খবর?

শিড়িঙ্গে লম্বা জয়ন্ত দাঁত বার করল, চলছে একরকম।…আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়ে ভালই হল। আজকালের মধ্যে আপনার কাছে যাব ভাবছিলাম।

অতীন কেমন যেন আঁশটে গন্ধ পেল। সতর্ক স্বরে বলল, কেন?

—জরুরি কথা ছিল।

—কী ব্যাপারে?

—এই, বাড়ি নিয়েই। পিসি তো গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, তাই আমাকে বলছিল…

অতীন মনে মনে বলল, ভণিতা ছেড়ে কাজের কথায় আয়।

মুখে বলল, হুঁ। বলো?

—বাড়ির কন্ডিশান তো দেখছেন, ঝুরঝুর করে সব খসে পড়ছে। এই তো, পিসি রান্না করছিল, এত্ত বড় একটা চাবড়া খসে পড়ল। জোর বেঁচে গেছে।

অতীন বলল, একতলারও তো সেই দশা। আমরা তো তাও সারিয়ে ফারিয়ে নিলাম।

—সারানো নয়, বলুন ডেকরেট করলেন। জয়ন্ত হ্যা হ্যা হাসল, পিসির তো অত পয়সা নেই, প্রাণরক্ষার জন্য যেটুকু না করলেই নয়…সেটুকুনিই করতে চায় আর কী। তা আমি বললাম, করলে একসঙ্গে গোটা বাড়িটাই করে নাও। বাইরের দিকে প্লাস্টার ফাস্টারের যা হাল হয়েছে…! মোটামুটি এস্টিমেটও করেছি। হাজার ষাট মতো পড়বে। শুনে পিসি বলল, তুই তা হলে এক কাজ কর, অতীন ঠাকুরপোর সঙ্গে কথা বল…। ওরা আধাআধি দিক, আমরা আধাআধি দিই…।

নন্দাবউদি বলেছেনা ছাই। অভিসন্ধি এই ছোকরারই। ব্যাটা মিস্ত্রি লাগিয়েও কমিশান খাবে। তাপসী তো মাঝে মাঝে যায় ওপরে, এমন কোনও বাসনা থাকলে নন্দাবউদি কি তাপসীকে বলত না? ঠারে ঠোরে কম ভাড়া নিয়ে কথা শোনায়, আর এটা চেপে গেল?

অতীন সন্তর্পণে চার ফেলল, ও বাড়ি সারাই করে কি আর লাভ আছে? একেবারে ভেঙেই ফ্যালো না।

জয়ন্তর মুখের হাসি নিবে গেল, ভাঙা যাবে না মেসোমশাই। পিসির সেন্টিমেন্টের ব্যাপার আছে। বলে শ্বশুর-শাশুড়ির ভিটে…

—বোঝাও ভাল করে। কোনওদিন জয়ন্তকে ঠিক বাগে পায় না অতীন, আজ বাড়ির কথা উঠে পড়ায় খেলাটা শুরু করে দিয়েছে। খোঁচাল আর একটু, বলো প্রোমোটার টোমোটারকে দিয়ে দিলে ঢের লাভ। ফ্ল্যাট পাবে, ক্যাশ পাবে…মঞ্জুরও ভবিষ্যতের একটা হিল্লে হয়ে যাবে…

জয়ন্ত কান এঁটো করে হাসল, আপনারাও মুফৎসে একটা ফ্ল্যাট পেয়ে যাবেন…কী বলেন?

কথাটা অতীনের গায়ে লেগে গেল। গম্ভীর ভাবে বলল, আমি তো আমাদের কথা বলিনি।

—তার মানে বাড়ি যদি ভাঙা হয় আপনারা এমনি এমনি উঠে যাবেন?

—দ্যাখো জয়ন্ত, বাঁকা বাঁকা কথা বোলো না। আটান্ন বছর ধরে এ বাড়িতে আছি, সুখে দুঃখে নন্দাবউদিদের পাশে থেকেছি, তার একটা মূল্য নেই? ফ্ল্যাট তো আমাদের একটা প্রাপ্যই।

—আপনি চটে যাচ্ছেন কেন মেসোমশাই? বললাম তো, পিসি বেঁচে থাকতে ফ্ল্যাট ট্যাট হবে না। অনেক প্রোমোটার ছিপ ফেলেছে, পিসি গলনেওয়ালি নয়। উল্টে আমায় বলে, মঞ্জুকে নিয়ে ভাবনা দেখাস না, যদ্দিন আমি আছি সেও আছে। আমি মরলে তোরা দেখবি তোদের বোনকে।

অর্থাৎ জয়ন্ত মল্লিক নিজের বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। দাদাটি সেজে এসে বাড়িটি দখল করবে। এবং তখন ফ্ল্যাট বানিয়ে ক্ষীরটা খাবে। নন্দাবউদি তো এক্ষুনি মরবে বলে মনেও হয় না। জীবনে যতই শোক তাপ পাক, শয়তানের কৃপায় শরীরস্বাস্থ্য এখনও বেশ ভালই আছে। তার মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতে হলে অতীনকে ভুশণ্ডির মাঠে গিয়ে তাঁবু গেড়ে বসে থাকতে হবে। অতীন দাঁত কিড়মিড় করল। হাসিটি বজায় রেখে বলল, তা হলে তোমার তো খুব চাপ পড়বে হে? ওই বোনের দেখভাল করা…

—কী করি বলুন? পিসেমশাইও তো এককালে আমাদের জন্য কম করেননি। জয়ন্ত একখানা দেড়মণি নিঃশ্বাস ফেলল, বোন বলে কথা। আজ নীলুটা বেঁচে থাকলে…

নীলু অর্থাৎ নীলধ্বজ নন্দার ছেলে। মঙর বড়। অনেক কাল আগে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। খুবই উড়নচণ্ডী টাইপের ছেলে ছিল, বাপের পয়সা দেদার উড়িয়ে মোচ্ছব করে বেড়াত, সেই কলেজে যাওয়ার পর থেকেই। বাপের ওপর হম্বিতম্বি করে একটা মোটর সাইকেল বাগিয়েছিল, ভড়ভড় শব্দ করে ঝড়ের মতো ছুটত সারাক্ষণ, একদিন স্টেটবাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে মিনিবাসের ধাক্কায়…। ওই ছেলে বেঁচে থাকলে বোনকে দেখত? বাড়িটাই ফুঁকে দিত না? কিরণদাও আত্মীয়স্বজনের উপকার করেছে বলে অতীন অন্তত শশানেনি কোনওদিন। তবে হ্যাঁ, মানুষটি নির্বিরোধী ছিল। তাপসীর ভাষায় যাকে বলে মেনিমুখো। কখনও অতীনদের পিছনে খিটখিট করেনি। অল্প মাল ঝাল খেত, মাঝে মধ্যে রেসের মাঠে যেত, কারওর সাতেপাঁচে থাকত না, আত্মীয়দের তো ছায়াই মাড়াত না।

ছোকরা এখন নিজের ধান্দায় খুব তোল্লাই দিচ্ছে পিসেমশাইকে! নীলুর গান গাইছে!

জয়ন্ত গলা ঝাড়ল, তাহলে মেরামতির কাজটা স্টার্ট করে দিই, কী বলেন মেসোমশাই?

—সে তোমরা যখন ঠিক করেছ…

—টাকাটা?

—অ্যাডভান্স? মাসে কত করে কাটাবে?

—আটশো টাকা তো ভাড়া, ওর থেকে কী কাটাবেন মেসোমশাই?

—তা হলে দেব কেন? বাড়ি সারানো তো তোমাদের দায়িত্ব। আমি তো নীচের তলার কাজ করানোর জন্য তোমাদের কাছে কিছু চাইনি।

—বাবলুর কাছে তিরিশ হাজার টাকা কী মেসোমশাই? হাতের ময়লা। আপনারা এতদিন মিলেমিশে আছেন…পিসি আপনাদের সঙ্গে কোনও দুর্ব্যবহার করেনি, না খেয়ে থাকছে তাও উঠে যেতে বলে না…

কিরণদা যথেষ্ট মাল্লু রেখে গেছিল, অতীন জানে। হাওড়া-স্টেশনের হেড টিকিটকালেক্টার হয়ে রিটায়ার করেছিল, কলসিতে এখনও যা পড়ে আছে মায়ে ঝিয়ে বিশ বছর ধরে গড়াতে পারবে। আর বাবলুর টাকার দিকে দৃষ্টি কেন, অ্যাঁ? তিরিশ হাজার টাকা বাবলুর হাতের ময়লা হতে পারে, কিন্তু সে ময়লা তোর কল্যাণে ঝাড়তে যাবে কেন?

অতীন গোমড়া মুখে বলল, টাকা দিতে পারব না বাবা। নিজেদের ক্ষমতায় না কুলোয়, করিও না।

—এটা কিন্তু আপনি অন্যায্য কথা বললেন মেসোমশাই।

—ন্যায্য অন্যায্য তোমার কাছে শিখব? বউদিকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বোলো। আমার যা বক্তব্য তাকেই বলব।

জয়ন্তকে টপকে হনহন হাঁটা দিল অতীন। অ্যাহ্‌, গোটা কেসটাই কেঁচে গেছে! বাবলুটা ফ্ল্যাট কিনব কিনব করছে, এটা হয়ে গেলে ব্যাপারটা একেবারে মাখন হয়ে যেত। বাবলুকে আর গ্যাঁটের কড়ি খসাতে হত না। ব্যাটা ওই অলপ্পেয়েটা এক্কেবারে হতভাগা, পিসিকে পটিয়ে ফ্ল্যাটের দিকে ঠেলতে পারল না?

নাহ্, আজ টাকা তোলার আনন্দটাই মাটি।

খিঁচড়োনো মেজাজ নিয়ে বাড়ি ঢুকেছে অতীন, তাপসী কিশোরীর মতো ধেয়ে এল, এই জানো, আজ তাতানের রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফার্স্ট হয়েছে তোমার নাতি।

চিত্তে শান্তির প্রলেপ পড়ল যেন। একটু ধাতস্থ হয়েই অতীনের মুখে খুশির ঝিলিক, তাই নাকি? কই, আমার সোনাটা কোথায়?

এইমাত্র তাতানের স্নানপর্ব সমাধা হয়েছে। স্নানের পরে উলঙ্গ থাকাই তাতানের বেশি পছন্দ, এখন তাকে প্যান্ট জামা পরানোই মুশকিল। আজ ছেলের নড়া চেপে আছে রম্যাণি, ছেলেকে সভ্য-ভদ্র করার পালা চলছে।

দাদুর আহ্বানে মার হাত ছিটকে বেরিয়ে এল তাতান। অতীন তাকে কোলে নিয়ে চুমু খেল চকাস চকাস। নাকে নাক ঘসছে।

তাপসীর হাতে নাতির প্রোগ্রেস রিপোর্ট। গদগদ মুখে বলল, দ্যাখো দ্যাখো, সবেতে ফুলমার্কস। শুধু রাইম্‌সে এক নম্বর কাটা গেছে।

—কেন, ও কি রাইম্‌স ভুল বলেছে?

—কী করে জানব! আমার কাছে তো ঠিক ঠিকই আওড়ায়। ওদের আন্টিদের তো অনেক প্যাখনা, হয়তো উচ্চারণের জন্য…

কোল থেকে নেমে পড়ল তাতান। দু হাত তুলে নৃত্য শুরু করছে, আমার এক নম্বর কাটা গেছে…এক নম্বর কাটা গেছে…

মুগ্ধ চোখে তাতানের নগ্ন নাচন অবলোকন করছে দাদু-ঠাকুমা। রম্যাণি ঘর থেকে বেরিয়ে এল, হাতে চিরুনি। ছেলেকে জোর করে দাঁড় করাল। চেপে চেপে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে।।

তাপসী হৃষ্ট মুখে বলল, তাতানটা বাবলুর চেয়েও ব্রিলিয়ান্ট হবে। নার্সারি ওয়ানে বাবলু থার্ড হয়েছিল।

—উমম্‌। অতীনের চোখে মুখেও প্রশংসা ঠিকরোচ্ছে, কোনও জিনিস একবার বলে দিলেই কী সুন্দর শিখে নেয়!

—কী অসম্ভব শার্প মেমারি। কার্টুন চ্যানেলে অত গুচ্ছের নাম… ডেক্সটার স্কুবিডু ঘোস্টবাস্টার…আমাদের মনে থাকে না, ওর সব মুখস্থ!

—দেখে নিও, বাবলুর চেয়েও রাইজ করবে।

—কোন লাইনে ওর ন্যাক বলো তো? ইঞ্জিনিয়ারিং?

—হতে পারে। আমার স্কুড়াইভারটার ওপর ওর খুব নজর!

—অঙ্কেও মাথা সাফ। কাউন্টিং-এ পুরো নম্বর পেয়েছে!

—তোমরা কী আরম্ভ করলে বলো তো? রম্যাণি ভ্রূকুটি হানল, নার্সারি ওয়ানের ওইটুকু একটা ছেলে, সে ফার্স্ট হল কি সেকেন্ড হল…।

—ওইটুকু তো কী আছে? তাপসী যেন সামান্য আহত, এই বয়স থেকেই তো ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার অভ্যেস তৈরি করতে হবে।

—ঠিক ঠিক। অতীনের মুখে প্রশান্ত হাসি, এখনই তো উচ্চাশার বীজ রোপণ করার সময় রুমি। কানের কাছে ক্রমাগত বলে যেতে হবে, তোমায় বড় হতে হবে তাতান, বড় হতে হবে…। দেখবি, একবার মাথার ভেতর ঢুকে গেলেই কেল্লা ফতে। তারপর ও নিজের চাড়েই…।

রম্যাণি কথাটা শেষ অবধি শুনল না। ছেলেকে হঠাৎ হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে ঘরে নিয়ে চলে গেছে। ধরে বেঁধে খেতে বসাবে বোধহয়।

একটুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল অতীন। জয়ন্তর সঙ্গে মোলাকাতের খবরটা তাপসীকে বলবে কি না ভাবছিল। নাকি দুপুরে বলবে? এই মুহূর্তে তাপসীর প্রফুল্লতায় চিড় ধরানোর কী দরকার!

কলিংবেল ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ করছে।

অতীন গিয়ে দরজা খুলল। পিওন। ডক্টর কিংশুক গুহর নামে রেজিষ্ট্রি চিঠি।

সই করে নিয়ে বাদামি খামটায় আলগা চোখ বোলাল অতীন। সরকারি চিঠি মনে হচ্ছে? চোখে চশমা নেই, খানিক দূরে নিয়ে গেল খামটা। প্রেরকের নামের জায়গায় রাবার স্ট্যাম্প। ছাপটা অস্পষ্ট। কী একটা কোর্ট মনে হচ্ছে যেন?

ঝোলা থেকে চশমাটা বারই করে ফেলল অতীন। অতি কষ্টে উদ্ধার করেছে হরফগুলো। কনজিউমার্স কোর্ট! মানে, ক্রেতা সুরক্ষা আদালত!

সাত

গাড়ি চালাতে চালাতে কিংশুক জিজ্ঞেস করল, কী, ফোনে এতক্ষণ দিদির সঙ্গে কী গল্প হচ্ছিল?

রম্যাণি আলগগছে জবাব দিল, তেমন কিছু না। এমনিই। ওর লাইব্রেরির কথা বলছিল।

—সর্বাণীর লাইব্রেরি চলছে কেমন?

—ভাল নয়। মেম্বারশিপ কমছে, গভর্নমেন্টের গ্রান্ট কমছে…

—তাতে সর্বাণীর কী? ও মাইনে পাচ্ছে তো ঠিকমতো?

—এখনও অবধি পাচ্ছে, তবে…। ওদের একজন স্টাফ রিটায়ার করে গেল, তার জায়গায় গভর্নমেন্ট আর লোক পর্যন্ত দেবে না বলেছে।

—গভর্নমেন্টের পয়সা কোথায়? কিংশুক আলতো হাসল, ফালতু খরচা কমানো ছাড়া উপায় কী!

—বইপত্র লাইব্রেরির পেছনে খরচ ফালতু?

—এখন আর কার অত বই পড়ার সময় আছে রুমি? জ্ঞানার্জন? তার জন্য ইন্টারনেট মজুত, সাইবার কাফে হাজির।…দ্যাখো না, দশ বিশ বছরের মধ্যে বই ব্যাপারটাই অবসোলিট হয়ে যাবে। দুনিয়ায় তখন একটা কাজের জন্যই কাগজ লাগবে। টয়লেট।

রম্যাণি সাড়াশব্দ করল না। চুপচাপ তাকিয়ে আছে বাইরে, তার উল্টোপানে, ধাবমান পৃথিবীর দিকে।

কিংশুক লঘুস্বরে বলল, সর্বাণী লাইনটা ঠিক চুজ করেনি। ওর মতো স্টুডিয়াস মেয়ে আর একটু বেটার প্রসপেক্ট ডিজার্ভ করে।

—দিদি বইপত্রের জগৎটাই ভালবাসে কিংশুক।

—মাই ডেজ অ্যামং দা ডেড আর পাস্ট, অ্যারাউন্ড মি আই বিহোল্ড। হা হা হা। কিংশুক হাসিটা ধরে রাখল, যাই বলো, তোমার দিদির কিন্তু একটু নাট লুজ আছে।

—তোমার মতো কেজো মানুষ হওয়াটাই কি একমাত্র নাট ঠিক থাকা?

কথাটা যেন কেমন তীব্রস্বরে বলল রম্যাণি। সর্বাণীকে নিয়ে মশকরা করা পছন্দ করছে না কি?

কিংশুক চটপট স্টিয়ারিং ঘোরাল। দায়িত্বশীল ভঙ্গিতে বলল, সর্বাণী সেই ছবিটা দেখেছে?

—জানি না। বলতে পারব না।

—সে কি! বাবা চেয়েচিন্তে ফটোটা নিয়ে এল, আমরা গিয়ে দিয়ে এলাম…

—তাই দিদি ফোন করলেই তাঁকে খোঁচাতে হবে?

—বাহ্‌, রেজাল্টটা জানবে না?

—আমরা নয় দিদির ব্যাপারে একটু কম ভাবলাম কিংশুক। তুমিও নয় একটু কম মাথা ঘামালে।

—যাচ্চলে! আমার শালীকে নিয়ে আমি ভাবব না?

—প্রয়োজন নেই। নিজের রুগিদের ভালমন্দ নিয়ে ভাবো, তাহলেই হবে।

রম্যাণির গলায় ব্যঙ্গ। যেন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতও আছে। কিংশুক চুপ মেরে গেল। দিনকে দিন রুমি যেন কেমনতরো হয়ে যাচ্ছে! কিংশুকের অতি তুচ্ছ কথাকেও তেড়িয়ে বেঁকিয়ে বক্র পথে নিয়ে গিয়ে ঠিক ওইখানে পৌঁছে যাবে এবং আক্রমণ শানাবে। শানাবেই। কেন এমন ঘটছে? এ কি শুধুই রুমির মানসিক অবসাদ? মাঝে কটা দিন হালকা ডোজে নার্ভের ওষুধ খেয়ে বেশ ছিল। হাসছিল, গল্প করছিল। সেই ভূত দেখার কথাও বলছে না আর। কনজিউমার কোর্টের নোটিশটা আসার পরই আবার কেমন বিগড়ে গেল!

কিন্তু কেন?

কিংশুক তো কত করে রুমিকে বুঝিয়েছে কোর্টের একটা কাগজ দেখে অত উতলা হওয়ার কিছু নেই। হ্যাঁ, কিংশুকেরও যথেষ্ট দুশ্চিন্তা হয়েছিল। তার জন্য যা করার তা তো সে করেছে। উকিলের কাছে যাওয়া, যথোচিত পরামর্শ নেওয়া…। কোত্থেকে কোন এক হরিদাস চার লাখ টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা ঠুকে দিল, অমনি ডাক্তারের বউ-এর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে? হচ্ছেটা কী? একটা অতি সামান্য ঘটনা, যা কিনা কিংশুকের দৈনন্দিন পেশার কার্যকলাপের অংশমাত্র, তার জীবনযাপনের পরিবেশটাকেই আমূল বদলে দেবে?

কত যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারে খটাখটি লাগছে!

এই তো সেদিন কিংশুকরা রম্যাণির বাপের বাড়ি গেল…দিনটা তো কত অন্য রকম হতে পারত। কিংশুক তো ভেবে রেখেছিল শালা-শালী শ্বশুর-শাশুড়ি সব্বাইকে নিয়ে কোনও ভাল হোটেলে ট্রিট দেবে, ছুটির সন্ধেটা দারুণ হইচই করে কেটে যাবে, হলটা কী?…সর্বাণী তখন ঘরে, বন্ধুর বাড়ি ফোন করে রানাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, পিনাকেশ অঞ্জলির হাতে হলেও-হতে-পারে জামাই-এর ফটোগ্রাফ…।

ছবিটা দেখতে দেখতে অঞ্জলি এমনিই প্রশ্ন করেছিল, হ্যাঁ কিংশুক, তোমার সেই ঝামেলাটা পুরোপুরি মিটে গেছে তো?

কিংশুক ঢক করে মাথা নেড়ে দিয়েছিল—হ্যাঁ।

অমনি রম্যাণি বলে উঠল, কোথায় মিটেছে? তোমার এগনস্টে তো কেস হয়ে গেছে।

অঞ্জলি শিউরে উঠল—কেস?

—হ্যাঁ মা। কনজিউমার কোর্টে। সেই মেয়েটার বর চার লাখ টাকা কমপেনসেশান চেয়েছে।

—ওমা, সেকি!…সর্বনাশ, কী হবে এখন?

কিংশুক থতমত, হ্যাঁ, নোটিশ একটা এসেছে বটে, তবে ল-ইয়ার বলেছে ওটাকে তেমন পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। বোঝেনই তো, এসব হল ভয় দেখিয়ে টাকা এক্সটর্ট করার ফিকির।

—এক্সটরশন কেন হবে? রম্যাণি তবু দমবার পাত্রী নয়, ক্ষতি তো তাদের হয়েছেই।

—কীসের ক্ষতি? রুগি অপারেশনের স্ট্রেইন নিতে পারেনি, মারা গেছে। শরীরের কলকবজা কত জটিল তোমার কোনও আইডিয়া আছে? কত কারণে একটা মৃত্যু হতে পারে তুমি জানো?

কোনওক্রমে তখনকার মতো রম্যাণিকে থামাল বটে, কিন্তু কিংশুকের সন্ধেটা একদম দরকচা মেরে গেল। সবাইকে নিয়ে গেলও হোটেলে, সুখাদ্যে আর তেমন স্বাদ পেল না।

ফেরার পথে কিংশুক বলেছিল, তুমি আমায় সকলের সামনে ওভাবে হেয় করলে?

রম্যাণি নির্বিকার, কেন, কী করলাম?

—মামলার কথাটা ওখানে না বললেই চলছিল না? আমাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করে কী সুখ হল?

—আজ নয় কাল তো জানতই। তখন তোমায় মিথ্যেবাদী ভাবত না?

—মোটেই ভাবত না। বড়জোর ভাবত ব্যাপারটা ডিসকাস করতে চাই না বলে চেপে গেছি।

অদ্ভুত এক হৃদয়ভেদী দৃষ্টি হেনেছিল রম্যাণি। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, তুমি বড্ড হিপোক্রিট হয়ে যাচ্ছ আজকাল।

তক্ষুনি টেনে একটা চড় কষাতে ইচ্ছে হয়েছিল কিংশুকের। পারেনি। হজম করেছে। সে একজন ভদ্রলোক, অমানুষ তো নয়।

নাগরিক যানজট পেরিয়ে পার্কসার্কাস কানেক্টার ধরেছে মারুতি। এবার বাইপাসে পড়বে। কিংশুক প্রাণপণে অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করছিল। একটা আনন্দের জায়গায় যাচ্ছে, বার্মিংহাম থেকে ফিরে শুভ্রাংশু আর দোলা আজ পার্টি দিচ্ছে, ব্যাচমেটদের অনেকেই আজ আসবে, যুগলে হাঁড়িমুখে সেখানে হাজির হওয়াটা মোটেই কাজের কথা নয়। বাজল কটা? নটা পাঁচ। একটু দেরি হয়ে গেল কি? নাহ্, শনিবারের পার্টি তো এই সময়েই জমে। আঃ, ভারী সুন্দর একটা হাওয়া দিচ্ছে। কী যেন নাম বাতাসটার? মলয়। হ্যাঁ, মলয়। মলয় সমীরণ…। মলয় আর সমীরণ দুজনেই ব্যাচমেট ছিল। মলয়টা সরকারি চাকরি নিয়ে কোথায় যে গেল! লাস্ট কে যেন বলেছিল কালিম্পং-এ আছে ব্যাটা। শালা নিসর্গ দেখতে দেখতে কামাচ্ছে…? সমীরণটা আজ আসবে মনে হয়। বিয়ে-থা করেনি, ফুর্তিসে আছে শালা। কত ঝুটঝঞ্ঝাট থেকে যে বেঁচে গেছে…

ওফ্‌, চিন্তাটা এসেই গেল। উগ্র কুৎসিত একটা গন্ধ ঝাপটা মারল কিংশুকের নাকে। ধাপার গন্ধ। পচা রাবিশের গন্ধ। কী মনোরম করে সাজিয়েছে জায়গাটাকে, তবু বদবুটাকে ঢাকতে পারেনি। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কটাও কি টকে যাচ্ছে? ওই এক অকিঞ্চিৎকর ঘটনার অভিঘাতে? নাকি সময়ের ভারে ঘুণ ধরছে সম্পর্কে? উত্তেজনাহীন নিস্তরঙ্গ মসৃণ সহবাস ছোট্ট একটা ঠোক্কর দিয়ে পরখ করতে চাইছে কি তাকে? কদিনেরই বা সম্পর্ক তাদের, বিয়ে হয়েছে বছর ছয়েক, প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা এখনও এক যুগও পেরোয়নি, এখনও মনে হয় এই তো সেদিন…! সোশালে সেই কমেডি কোরাসটা শেষ করে স্টেজ থেকে নেমেছে, এক দঙ্গল মেয়ের মুখোমুখি। পাশের কলেজের। হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল মেয়েগুলো, হাত বাড়িয়ে কয়েকজন অভিনন্দন জানাল কিংশুককে…। একটু পিছনে দাঁড়িয়ে রম্যাণি, একা। ভিড়ের মধ্যে একা, এক নির্জন নারী। এগিয়ে গেল কিংশুক, তুমি হাসছ না যে বড়? আমার হেঁড়ে গলা পছন্দ হয়নি? নিস্পাপ চোখে হাসল রম্যাণি, উঁহু, ভাল লেগেছে তো। ভীষণ ভাল লেগেছে। ভীঈঈষণ উচ্চারণটা কী অসম্ভব জোরালো! এতটুকু ন্যাকামো নেই তাতে! অন্য মেয়েগুলোর সঙ্গে সেদিন অনেকক্ষণ আড্ডা মেরেছিল কিংশুক, রম্যাণির সঙ্গে শুধু ওইটুকু কথাই…। অথচ তার সঙ্গেই জীবনটা জড়িয়ে গেল। দৈবক্রমে দেখা হয়ে যায় বাসস্ট্যান্ডে, কফিহাউসে, নন্দন চত্বরে…। একটু একটু করে ঘনিষ্ঠতা মুগ্ধতা প্রেম…। রুমি তাঁকে কোনওদিন মুখ ফুটে ভালবাসি বলেনি। একটি বারের তরেও না। বলতে হয়নি। শুধু পাশে এসে দাঁড়ালেই কী বিচিত্র এক মন-কেমন করা সৌরভ যে ছেয়ে যেত বুকে। রুমি কথাই বা বলত কটা? তবু একবার দেখা হওয়ার পর থেকে আর একবার দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত তার স্বর কানে বাজত, জলতরঙ্গের মতো।

সেই রুমির কণ্ঠ এখন হাকুচ তেতো। অহর্নিশ বিদ্ধ করছে, দংশন করছে, আহত করছে কিংশুককে।

এই তো বুধবার রাত্রেই…। কিংশুক লকারে টাকা তুলছিল। চেম্বার নার্সিংহোমের পুরো রোজগারটা কিংশুক ব্যাঙ্কে পাঠায় না। অস্ত্রোপচারের অর্ধেক দক্ষিণা নগদে নেয়, সে টাকাও বাড়িতেই জমে।

হঠাৎ রম্যাণি পিছনে এসে দাঁড়াল। পিত্তি জ্বলানো হাসি হেসে বলল, তোমার আজকাল কোনটা বেশি হচ্ছে? সাদা না কালো?

কিংশুক মাথা গরম করেনি। শীতল গলায় বলেছিল, কোনটা বেশি হলে খুশি হও?

—আমার খুশি হওয়া না হওয়ার ওপর কীই বা নির্ভর করে?

—করে বইকি। আমার সবই তো তোমাদের জন্যে।

—কথাটা দস্যু রত্নাকরের মতো শোনাল না?

চড়াং করে রক্ত চড়ে গেল কিংশুকের। সারাদিন গাধার মতো খেটে এসে এ লেকচার সহ্য হয়? দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আমি ডাকাতি করে রোজগার করি না রুমি। ঘুষেরও পয়সা নয়। এ আমার হক্কের ধন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলা উপার্জন। সরকারকে প্রচুর ট্যাক্স দিই। যা দিই তার বেশি দাবি করার যোগ্যতাই নেই গভর্নমেন্টের।

—তুমি ভারী সুন্দর যুক্তি সাজাতে পারো!

—রাতদুপুরে ভ্যানতাড়া শুরু করলে কেন বলো তো? ঘটাং করে আলমারি বন্ধ করল কিংশুক, দিস ইজ হাইলি আনএথিকাল রুমি। তুমি কি আমার টাকা নতুন দেখছ? নাকি আমার কোথায় কী থাকে তা তুমি জানো না?

—সবই জানি। তোমার কীই বা আমার কাছে গোপন আছে!

গোপন শব্দটা নয়, রম্যাণি যেন ফুটন্ত তেল ঢেলে দিল কানে। যেন কালো টাকার কথা তোলা নেহাতই ছল, কিংশুকের অন্তঃস্থল খুঁড়তে এসেছিল রম্যাণি। কী পেল? কী পেতে চায়?

কিংশুকের গাড়ি সল্টলেকে ঢুকেছে। অপাঙ্গে স্ত্রীকে দেখছে কিংশুক। রম্যাণি বসে আছে স্থির, যেন পাষাণপ্রতিমা। নিস্পলক চোখ দুটো যেন স্বাভাবিক নয়।

কিংশুকের হঠাৎই মনে হল রম্যাণিকে নিয়ে ভাবনাতে তার কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি এসে যাচ্ছে না? গর্ভবতী অবস্থায় মেয়েরা তো একটু বেশি স্পর্শকাতর থাকে, তার সঙ্গে ওই মানসিক ধাক্কাটা মিলেমিশে যে-কোনও ধরনের জটিল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতেই পারে। তার বোধহয় আর একটু উদার দৃষ্টিতে রম্যাণিকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। আজ হোক কাল হোক, রুমির এ দশা কেটে যাবেই, তখন সে নিজেই নিজের আচরণের জন্য লজ্জা পাবে।

কিংশুক গলা খাঁকারি দিল। অনেকক্ষণ পর কথা বলল, প্রায় স্বাভাবিক স্বরে—রুমি, তোমার সঙ্গে দোলার আলাপ আছে?

রম্যাণি যেন এই পৃথিবীতেই ছিল না। চমকে তাকিয়েছে—উঁ?

—বলছিলাম, শুভ্রাংশুর বউ-এর সঙ্গে তোমার আগে পরিচয় হয়েছিল?

—একবার দেখেছিলাম। রম্যাণি সিটে হেলান দিল—রোগা, লম্বা, মুখখানি ভারী মিষ্টি…। তোমাদের এক ক্লাস জুনিয়ার ছিল না?

—হুঁ। এখন রোগা আর নেই। বেশ মুটিয়েছে।

—শুভ্রাংশুরা ফিরে এল কেন? রম্যাণির গলাও ধীরে ধীরে সহজ অনেকটা।

—ওরা তো পার্মানেন্টলি ওখানে থাকবে না বলেই গিয়েছিল।

—যাক, তবে কথা রেখেছে।

খুবই অর্থহীন সংলাপ, তবু যেন মাঝের গুমোটটা কেটে যাচ্ছে। কিংশুকেরও মেজাজটা সমে ফিরছিল। লবণহ্রদের গাছে ঢাকা পথে এখন মায়াবি অন্ধকার, রহস্যমাখা আলো। কিংশুকের ভাল লাগছিল।

শুভ্রাংশুদের বাড়ি এসে গেছে। দোতলা বাড়ি, অনেকটা জায়গা জুড়ে। সর্বাঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যের ছাপ। শুভ্রাংশুর বাবাও ডাক্তার, কলকাতার নামী হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। এ বাড়ি তারই বানানো। বিলাস বৈভবে ঠাসা এই বাড়িখানায় বাপ ছেলের স্থানসংকুলানের কোনও অসুবিধে নেই। কিংশুক গাড়ি লক করতে করতে বাড়িটাকে দেখছিল। আহা, এমন একটা ঘ্যামচ্যাক বাড়ি তার যে কবে হবে!

কিংশুকদের দেখে শুভ্রাংশু রে রে করে এগিয়ে এল—কী রে, তোরা এত দেরি করলি?

—দেরি কোথায়? কিংশুক কাঁধ ঝাঁকাল, রাত্তির তো সবে ওয়ার্ম আপ করছে।

—আয় আয়।…দোলা, দ্যাখো কারা এসেছে।

সুবিশাল লিভিং স্পেসে প্রায় ছুটে বেড়াচ্ছিল দোলা। অতিথি অভ্যাগতদের দেখভালের দায়িত্ব তারই। শুভ্রাংশুর ডাক শুনে তরতর পায়ে চলে এল, হাত ধরে রম্যাণিকে নিয়ে গেল অন্দরে, ডাক্তারদের বউ আর মেয়ে-ডাক্তাররা মিলে মেয়েদের জন্য একটা মুক্তাঞ্চল তৈরি করেছে, সেই দিকটায়। রম্যাণি নরম পানীয়ই চাইছিল, দোলার পীড়াপীড়িতে জিন নিল সামান্য। বসেছে সুদীপ্ত আর দেবমাল্যর বউ-এর মাঝখানে।

কিংশুকের হাতে হুইস্কির গ্লাস। অলস পায়ে ঘুরছে পার্টিতে। ব্যাচমেট এসেছে প্রায় পনেরো-ষোলো জন। এদের অনেকের সঙ্গেই মোটামুটি নিয়মিত যোগাযোগ আছে কিংশুকের, এর ওর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল টুকটাক।

আলো কমিয়ে আধো-রহস্যের বাতাবরণ তৈরি করা হল ঘরে। স্টিরিওতে মৃদু বাজনা বাজছে একটানা, মাদক লয়ে। নাচছে কয়েকজন। নিজস্ব ভঙ্গিমায়। অংশগ্রহণ না করলেও উঠে দাঁড়াল সবাই, করতালি দিয়ে উৎসাহিত করছে নৃত্যরত জুড়িদের। শুভ্রাংশুর বাবা ফিরল চেম্বার সেরে, লঘু মেজাজে ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়ে গেল কিছুক্ষণ।

ছোট ছোট জটলা, মৃদু মৃদু গুঞ্জন, গেলাসের টুং-টাং ধ্বনি। পার্টি ক্রমে মদির হয়ে উঠছিল।

হাসি-মশকরার সঙ্গে কেজো কথাও চলছে এখান সেখানে। ডাক্তারের দল পেশাগত আলাপচারিতা সেরে নিচ্ছে।

দেবমাল্য কিংশুককে এক পাশে ডাকল, হ্যাঁ রে, তুই বুধ আর শুক্র ইভনিং-এ ফ্রি থাকিস?

—কটায়?

—এই ধর, ছটা থেকে আটটা? কি সেভেন টু নাইন?

—কেন?

—কটা মেয়েছেলে ঘাঁটবি। কী, ঝাঁপ খুলবি?

দেবমাল্যর মুখের ভাষাই এরকম। কিংশুক হাসতে হাসতে বলল, কোথায়?

—ফের প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন? পাছায় এমন লাথি কষাব না…

দেবমাল্যর মধ্যে এখনও যেন সেই কলেজের উত্তাপটা আছে। সার্জারির জগতে এই বয়সেই বেশ নামড়াক করে ফেলা সত্ত্বেও।

দেবমাল্য কিংশুকের কাঁধে হাত রাখল, জব্বর লোকেশান। সাদার্ন মার্কেটের কাছে। নতুন খুলছে, একটা পলিক্লিনিক মতো। মালিক আমার খুব ক্লোজ…একটা গাইনির জন্য বলছিল…

কিংশুক ঈষৎ দোটানায়। টালিগঞ্জের ক্লিনিকটায় বুধ শুক্র সন্ধেবেলাই বসার কথা। তবে ফাইনাল কিছু হয়নি এখনও। ওই ক্লিনিকটারও পজিশান খুব ভাল। প্লাস চালুও।

আবছাভাবে বলল, একটু ভাবি রে। নেক্সট উইকে জানিয়ে দেব।

সমীরণ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু আগেই সে এসেছে আজ, এর মধ্যেই তার স্বর বেশ জড়িয়ে গেছে। কিংশুকের পেটে খোঁচা মেরে বলল, —অ্যাই, তোর বউকে আজ চাম্পু লাগছে রে! পালিশ ছাড়াই হেভি জেল্লা দিচ্ছে তো!

দেবমাল্য ছদ্ম কোপে চোখ পাকাল, পরের বউ-এর দিকে নজর কেন, অ্যাঁ?

—তোর বউ-এর দিকে তো তাকাইনি।

—চেষ্টাও করিস না। চোখ গেলে দেবে।

সুদীপ্তর বউ হঠাৎ রম্যাণিকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসছে এদিকে। কিংশুকের সামনে এসে ভুরু নাচাল—অ্যাই, তোমার বউ আবার এক্সপেক্ট করছে তুমি তো বলোনি?

—অ, এই কেস? সমীরণ জিভ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল, রম্যাণি দেবীর দেহে তবে ডিম্ববতীর সুষমা?

কিংশুক আলগা চাপড় মারল সমীরণের পিঠে। স্মিত মুখে রূপশ্রীকে বলল—কেন, সুদীপ্ত তো জানে।

—আমাকে বললানি কেন? লাস্ট উইকেও জুপিটারে তোমার সঙ্গে দেখা হল…

—কারণ তো একটাই ভাই রূপু। সমীরণ ফুট কাটল, নিজের কেসের খবর ও তোমাকে জানাতে চায় না। প্রফেশনাল সিক্রেসি।

হা-হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। রূপশ্রী বোকা বোেকা মুখে হাসছে, লজ্জা মেখে রম্যাণিও।

সমীরণ গ্লাস শেষ করেই চট করে একটা ভদকা নিয়ে এসেছে। ছোট্ট চুমুক দিয়ে রম্যাণির দিকে ঝুঁকল, তোমায় একটা প্রশ্ন করব ডার্লিং? উত্তর দেবে?

রম্যাণি ঠোঁট টিপে বলল—কী প্রশ্ন?

—তোমার নাম রম্যাণি কেন? হোয়াই নট রম্যা?

দেবমাল্য ঢকাস করে পানীয় ঢালল গলায়, শালা এতকাল পরে হঠাৎ তোর ব্রেনে আজ এই প্রশ্ন জাগল?

—জেগেছে অনেকদিনই।…সত্যি রম্যাণি, তুমি শুধু রম্যা নও কেন?

দেবমাল্য চোখ টিপল, উপক্রমণিকা পড়িসনি শালা? একে বলে গৌরবে বহুবচন। রম্যাণি মানে অজস্র সুন্দর…অবশ্য কী কী সুন্দর সেটা কিংশুকই ডিটেলে বলতে পারবে।

আবার একটা পায়রা ওড়ানো হাসি। অন্যরাও ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে এদিকে, টুকুস টুকুস টিপ্পনী ছুঁড়ছে। খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি, খুকখুক হাসি, খিলখিল হাসি…

খাবারদাবার রেডি। টেবিলে আহার্য সাজিয়ে দোলা ডাকছে সবাইকে। পরিপাটি মেনু। ফ্রায়েড রাইস নান চিকেন রেজালা দহি-মাটন বাটার পনির আলুরদম ফ্রাই চাটনি মিষ্টি।

রম্যাণি চাপা স্বরে কিংশুককে বলল—চলো নিয়ে নিই। অনেক রাত হয়ে গেছে।

কিংশুক আপত্তি করল না। মাথায় বেশ ঝিমঝিম ভাব, শিরা-উপশিরায় ক্রিয়া শুরু করেছে তরল পানীয়, এখনই না খেলে খাওয়ার ইচ্ছেটা মরে যাবে।

রম্যাণি বেশি কিছু নিল না। অল্প ফ্রায়েড রাইস দুহি-মাটন আর চাটনি।

কিংশুক খেতে খেতে বলল—রেজালাও একটু নিতে পারতে। দারুণ হয়েছে।

—চিকেন খেতে ইচ্ছে করছে না। গন্ধ গন্ধ লাগে।

কিংশুক কী যেন ভেবে বলল—এবার তোমার একটা আলট্রাসোনো করে ফেলতে হবে

—হুঁ।

—নেক্সট উইকে মধুদির কাছে চলে যেও। কবে যাবে বোলো, আমি কথা বলে রাখব।

—দেখি।

—আমায় কি যেতে হবে সঙ্গে?

—নাহ্‌।

শুভ্রাংশু তদারক করতে করতে এদিকে এসেছে। রম্যাণিকে হাসিমুখে বলল, তোমার সঙ্গে আজ তো আড্ডা মারাই হল না। এত ভিড়ে কথা হয়?

—সে তো বটেই।

—একদিন চলে যাব তোমাদের ওখানে। এখন তো মোটামুটি ফাঁকাই আছি, একটা হোলডে আমরা তোমাদের সঙ্গে স্পেনড করে আসব। বলতে বলতে কিংশুকের দিকে ঘুরেছে শুভ্রাংশু, তুই কি এখনও সেই ভবানীপুরের বাড়িটাতেই আছিস?

কিংশুক ঠোঁট ওলটাল, কোথায় আর যাব!

—কিনছিস না কিছু? বাড়ি ফ্ল্যাট…? সুদীপ্ত দেবমাল্য সবাই তো শুনলাম করে ফেলেছে।

—কিংশুক তো করছে। সুদীপ্ত প্লেট হাতে এসে নাক গলাল, বুকিং হয়ে গেছে। দারুণ ফ্ল্যাট।

—হ্যাহ্, তেমন কিছু নয়। গরিবের মাথা গোঁজার সামান্য ঠাঁই।

—না রে, মোটেই সামান্য নয়। প্রায় বারোশো স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট। থ্রি-রুম ড্রয়িং ডাইনিং…

—বাহ্। কনগ্র্যাটস। কবে শিফট্ করছিস?

—দাঁড়া আগে তৈরি হোক।…প্ল্যান তো ছিল জুলাই-এ যাব…। চোখের কোণ দিয়ে রম্যাণিকে দেখাল কিংশুক, মনে হচ্ছে ডিসেম্বর জানুয়ারির আগে আর শিফট করা হবে না।

—হুঁ। সুদীপ্ত মাথা নাড়ল, বাচ্চাটা হওয়ার পরে যাওয়াই ভাল।

—মাসিমা, মেসোমশাই কেমন আছেন রে কিংশুক? মাসিমা ফ্যান্টাস্টিক দইবড়া বানাতেন, এখনও জিভে লেগে আছে।

—ভালই আছে মা বাবা। ফিট। হিল অ্যান্ড হার্টি।

—তোর ছেলেটাকে নিয়ে নিশ্চয়ই দুজনের খুব জমে?

কিংশুকের আগে রম্যাণি বলে উঠল, হ্যাঁ, দাদু ঠাকুমার কাছেই তো মানুষ হয়ে গেল। আমাকে কিছুই তেমন করতে হয়নি।

শুভ্রাংশু কিংশুককে জিজ্ঞেস করল, কত পড়ছে রে ফ্ল্যাটে?

—পনেরো। অফিশিয়ালি নাইন।… একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে আমার পক্ষে।

—বটেই তো। হোয়াইটে ন লাখ দেখানো সোজা কথা নাকি? সুদীপ্ত সায় দিল, কিছু ব্যাংক-লোন নিচ্ছিস না কেন?

—সে তো নেবই। ইনকামট্যাক্সের ছাড়টাও তো পাওয়া যাবে।

—দরকার হলে বলিস। আমার চেনা ব্যাংক ম্যানেজার আছে।

—তবু খুব চাপ পড়ে যাচ্ছে, জানিস। হাত একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে।

—আসবে আসবে, আবার আসবে। ভালই তো পশার জমিয়ে ফেলেছিস। শুভ্রাংশু বিদেশি সিগারেট ধরিয়েছে। আলতো ধোঁয়া ভাসাল,—ফার্স্ট জানুয়ারি গৃহপ্রবেশ কর, বেশ জম্পেশ। রম্যাণিও তখন ফ্রি হয়ে যাবে…বাবা মা বউ বাচ্চা নিয়ে নতুন বছর নতুন ফ্ল্যাটে…

সুদীপ্ত ঝপ করে বলে উঠল, মাসিমা মেলোমশাই তো যাচ্ছেন না, তাই না রে কিংশুক?

শুভ্রাংশু ঈষৎ বিস্মিত যেন, তাই নাকি? কেন?

উত্তর দিতে সময় নিল না কিংশুষ্ক। সুদীপ্তকে যা বলেছে তারই পুনরাবৃত্তি করে দিল, বাবা মাকে ভবানীপুর থেকে নড়ানো খুব মুশকিল রে। এতকাল ওখানে রয়েছে, বলতে পারিস শিকড় গজিয়ে গেছে। ওখানকার মায়া কাটিয়ে বাবা মার পক্ষে নতুন জায়গায় গিয়ে সেটল্‌ করা…

—হুম্‌, হয় এরকম। শুভ্রাংশু মাথা দোলাচ্ছে, আমার বাবাকেও তো দেখেছি… নিজের হাতে এ বাড়িটা বানাল, কত উৎসাহ নিয়ে…কিন্তু আসার সময়ে শ্যামপুকুরের ওই এঁদো গলির জন্য বাবার কী মন খারাপ! এখনও ও পাড়ার কেউ এলে বাবা কী খুশি হয়, বলে আমাদের পাড়ার লোক এসেছিল…!

শুভ্রাংশুর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোলাহলের মাঝেও অদ্ভুত এক নীরবতা। ক্ষণিকের জন্য কারোও মুখেই কোনও কথা নেই।

পায়ে পায়ে চলে যাচ্ছিল শুভ্রাংশু, কী মনে করে ফিরে এল। কপাল কুঁচকে বলল, তুই নাকি একটা প্রবলেমে ফেঁসে গেছিলি শুনলাম?… রূপক আর সমীরণ বলাবলি করছিল…

কিংশুকের ঘাড় পেন্ডুলামের মতো ঘুরে গেছে রম্যাণির দিকে। দূরমনস্ক মুখে খাচ্ছে রম্যাণি। দেখে মনে হয় কিছুই শুনছে না, আবার যেন শুনছেও।

ঝটিতি শুভ্রাংশুকে চোখের ইশারা করল কিংশুক। ইঙ্গিত বুঝেছে সুদীপ্ত শুভ্রাংশু। আলগা ভাবে সরে গেল খানিক তফাতে। সঙ্গে কিংশুকও। তিন বন্ধু কথা বলছে নিচু গলায়। কী হয়েছিল ঘটনাটা, এখন কী অবস্থা, অমুক তমুক…। আরও কয়েকজনও জুটে গেল। রাতুল, সর্বজিৎ, অর্জুন, সৌরাশিস…সকলেরই ভুরুতে ভাঁজ, কিংশুকের কাহানী গিলছে।

হলঘরের ও প্রান্তে সুরেলা কলরব। খেতে খেতে দরাজ গলায় গান ধরেছে সমীরণ।…পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়…! প্লেটে টোকা দিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে এককালের সহপাঠী সহপাঠিনীর দল, গানে গলা মেলাচ্ছে…। কিংশুকরাও আস্তে আস্তে এগোলে সেদিকে, সুর ভাঁজতে ভাঁজতে। নারী পুরুষের মিলিত কণ্ঠে নৈশভোজ জমজমাট।

আসর ভাঙল মাঝরাত পেরিয়ে।

ঘোরলাগা সুখ মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল কিংশুক। শুনশান পথ, প্রাণজুড়োনো হাওয়া, নেশাটা যেন আরও জমিয়ে আসছে। গুনগুন গান করছিল কিংশুক, আপন মনে। ছেঁড়া ছেঁড়া কলি।

কী ভেবে গান থামিয়ে রম্যাণিকে টেরচা চোখে দেখল, —কী, ঘুম পাচ্ছে?

—না। রম্যাণির অনুচ্চ জবাব, ঘুমের সময় তো এখনও হয়নি, কি বলো?

আবার সেই বঙ্কিম ভাষা! কিংশুক বিরক্ত হতে গিয়েও হেসে ফেলল, সরি, ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে এখন এত রাত অবধি জাগিয়ে রাখা ঠিক নয়। তোমার না আসাই উচিত ছিল।

রম্যাণি হুঁ হা কিছু করল না।

—শরীর ঠিক আছে তো?

—না, গাটা একটু গুলোচ্ছে।

—তেমন হলে বোলো। গাড়ি সাইড করব।

—বমি হবে না।

কিংশুক নিশ্চিন্ত হল। ফুরফুরে মেজাজে বলল, কাল সকালে যাবে নাকি বাড়িটায়? আই মিন ফ্ল্যাটটায়?

—হঠাৎ?

—ফ্ল্যাটের প্রোগ্রেসটা দেখে আসবে। স্বপন রায় বলছিল, মিসেসকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন না, ওঁর যদি কিছু স্পেশাল রিকোয়ারমেন্ট থাকে, জানলা দরজা গ্রিল টাইলস…! সামনের মাসে সেকেন্ড ইনস্টলমেন্ট, তার আগে তোমার তো একবার সরেজমিন করা দরকার, তাই না?

—হুঁ। আবার রম্যাণির সংক্ষিপ্ত জবাব।

সল্টলেকের সীমানা ছাড়িয়ে এসেছে গাড়ি। এত রাতে কিংশুক আর বাইপাসের রাস্তাটা ধরল না, ছিনতাই টিনতাই হতে পারে, বেলেঘাটা দিয়ে ঢুকবে।

রাস্তার দুধারে চোখ চালাতে চালাতে কিংশুক ফের বলল, কী, যাবে কাল? তাহলে স্বপন রায়কে ভোরবেলা একটা ফোন করে দেব, ওর লোক ফ্ল্যাটে থাকবে।

—বাবা মাকে জানিয়ে যাবে? নাকি না জানিয়ে?

সামনে আচমকা বাম্‌প‌, ঘ্যাঁচ করে গাড়ির ব্রেক চাপল কিংশুক। গোমড়া গলায় বলল, এ প্রশ্নের অর্থ?

—আমি কি হিব্রু বলেছি?

—বাংলাও বলোনি।

চকিতে বিদ্যুৎ হেনেছে রমাণি, এই জন্য তুমি পাঁচকান করতে বারণ করেছিলে?

—মানে?

—তুমি বাবা মাকে নতুন বাড়িতে নিয়ে যাবে না?

—কী করে নিয়ে যাব? বি প্র্যাকটিকাল রুমি। বাবা মাকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে হাত পা ছড়িয়ে থাকা যায় না। উই নিড় স্পেস। ফাঁকা জায়গা। একেবারে নিজেদের মতো করে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো শূন্যস্থান। জন্ম থেকে বাবা মা তো আষ্টেপৃষ্টে লেপটে আছে, তারা এখনও যদি ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে…। তা ছাড়া এই যে ধরো, আজ পার্টিটা হল, মদের ফোয়ারা বয়ে গেল, নাচ গান হুল্লোড়…এইসব কি বাবা মার প্রেজেন্সে চলবে?

—তোমার শুভ্রাংশুর বাড়িতে কিন্তু বাবা আছে।

—খেজুরগাছের সঙ্গে নারকোলগাছের তুলনা কোরো না তো। ওদেরটা কি ফ্ল্যাট নাকি? অট্টালিকা। প্রাসাদ। বাপ তার মহলে থাকে, ছেলে ছেলের মহলে।…এবং মনে রেখো, শুভ্রাংশুর বাবা একজন হাইলি রেপুটেড ফিজিশিয়ান। আজ ছেলে পার্টি দিচ্ছে, কাল বাপ পার্টি দেবে। দে আর প্র্যাকটিসড্‌ টু ইট রুমি।

—তুমি যেন বাড়িতে পার্টি দাওনি!

—ওকে পার্টি দেওয়া বলে না, বন্ধুদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো বলে। বোতল বার করতে গেলে সাত বার হাশহাশ হুশহুশ…ধ্যাৎ!

—তুমি কিন্তু এই রিজনগুলো বন্ধুদের দেখাওনি!

—কেন দেখাব? তারা বাইরের লোক, তুমি ঘরের লোক। আমার প্রবলেম তো তুমি বুঝবে।…আমার মা বাবাকে ছেড়ে যেতে আমারও খারাপ লাগবে, বাট…মেনে নিতে হয়। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়।… তুমি হয়তো বলবে ব্যাড এগ্‌জাম্পল, তবু বলি…তোমরা মেয়েরা বাবা মাকে ছেড়ে চলে এসে থাকো না? কেন থাকো? সামাজিক নিয়ম তাই চায়। আজ আমি যদি বিদেশে গিয়ে প্র্যাকটিস করতাম, বাবা মাকে কি কাঁধে করে ঘুরতাম? ওই যে সুদীপ্ত, ও-ও কিন্তু ফ্ল্যাটে বাবা মাকে নিয়ে যায়নি, অ্যান্ড ইউ নো ইট। বাবা মার জীবন বাবা মার জীবন, আমাদের জীবন আমাদের জীবন—লেট আস লিভ লাইক দ্যাট।

—অর্থাৎ কর্তব্য টর্তব্য বলে কিছু নেই!

—ভাবের ঘোরে চুরি কোরো না রুমি। তুমি জানো আমি কত ডিউটিফুল। আমি আমার বাবা মাকে এতটুকু অস্বাচ্ছন্দ্যে রাখিনি। রাখবও না। কিংশুকের মুখ অজান্তেই বিদ্রুপে বেঁকে গেল, খুব এখন আমার বাপ মার হয়ে ওকালতি করছ, অ্যাঁ? অথচ নিজেই তো কতবার ফোঁস ফোঁস করেছ, মার সঙ্গে থাকা যায় না, মা ভীষণ পজেসিভ, মার এতটুকু সেন্স নেই…! বড় ঠোকাঠুকি লাগার আগে পিসফুলি আলাদা হয়ে যাওয়াটা কি ভাল নয়? মস্তিষ্ক অসম্ভব সাফ হয়ে গেছে কিংশুকের, কত সুন্দর সুন্দর কথা এসে যাচ্ছে মুখে। শ্লেষমাখা গলায় বলল, আজকাল তো ছেলেমেয়ে সবই সমান, ছেলের যদি বাপ মার ওপর ডিউটি থাকে, মেয়েদেরও থাকা উচিত। তুমি কতটা কর্তব্য পালন করেছ? কতটা করো? বরের ঘরে এসে তোমরা মেয়েরা ফুলটুসি বউ সেজে বসে থাকো না? বড় বড় বুকনি মেরে বরকে অপমান করার আগে নিজেকে ভাল করে তলিয়ে দ্যাখো। বুঝলে? তলিয়ে দ্যাখো। তুমিও একটা সেলফিস সেলফসেন্টারড মেয়ে ছাড়া আর কিছু না। সামান্য দিদির বিয়েটুকু নিয়ে পর্যন্ত চিন্তা করতে রাজি নও…

রম্যাণি সম্পূর্ণ নিথর হয়ে গেছে। কিংশুক থমকে গেল। কেন বলল কথাগুলো কিংশুক? রম্যাণিকে পালটা আঘাত হানার জন্যে? নাকি কথাগুলো মনের মধ্যে জমে ছিল কোথাও?

শেয়ালদা পার হয়ে গেল কিংশুক। প্রায় যানহীন রাস্তায় যান্ত্রিক অভ্যাসে ধরে আছে স্টিয়ারিং, অ্যাক্সিলেটার…। মৌলালি অতিক্রম করে আপনা আপনি চোখ ঘুরে গেল বাঁদিকে। এন্টালিতে। মুনলাইট নার্সিংহোমের গলিটায়। ইশ, সেদিন যদি রাস্তাটা এমন ফাঁকা থাকত! আরও অন্তত আধঘণ্টা আগে পৌঁছে যেত কিংশুক। মেয়েটা কি তাহলে বেঁচে যেত?

ভাবনাটা আর একটু হলেই কিংশুককে ম্রিয়মাণ করে দিচ্ছিল, জোর করে সে চাঙা করল নিজেকে। অন্তত করতে চাইল। বিজয়ী তার্কিকের ঢঙে রম্যাণিকে বলল, কী, চুপ করে গেলে যে বড়? মনে মনে কি যুক্তিগুলোকে খন্ডানোর চেষ্টা করছ? পারবে না। পারবে না।

রম্যাণি অস্ফুটে বলল, তোমার তো সব অন্যায়েরই অ্যালিবাই তৈরি থাকে কিংশুক।

কিংশুকের চোখ সরু হল, কী অন্যায় করেছি আমি?

—কিছুই না। রমাণির স্বর দুলে গেল, সেদিন নার্সিংহোম থেকে প্রথম ফোন পেলে সওয়া চারটেয়, গিয়ে পৌঁছলে সাড়ে সাতটায়। তুমি দেরি হওয়ার জন্য সক্কলকে দায়ি করেছ। উকিলকে, প্রোমোটারকে, ট্রাফিক জ্যামকে, দিনটা একুশে জানুয়ারি হওয়াকে…। অথচ রাস্তায় প্রথম ফোনটা পেয়েই তুমি কিন্তু গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে পারতে। পারতে না? গাড়ি যে তুমি ঘোরাওনি, তার পেছনেও তোমার নিশ্চয়ই স্ট্রং যুক্তি আছে…

কিংশুকের কান্না পেয়ে গেল। নাহ্‌, আর কিছু হওয়ার নেই। তাদের সম্পর্কের মধ্যে বাসা বেঁধে ফেলেছে এক কীট। একটা মৃত্যু। কী যেন একটা খেয়ে ফেলছে পোকাটা, একেবারে ফোঁপরা করে দিচ্ছে সম্পর্কটাকে।

কী খাচ্ছে? বিশ্বাস? ভালবাসা? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু?

আট

বিশ্বজিৎদের অফিসে নিয়মানুবর্তিতা দেখবার মতন। প্রকৃতিদেবীর রাজ্যে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেও ঘটতে পারে, কিন্তু তাদের দপ্তরের কোনও সার্কলেই কখনও বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না। তুমি যদি কোনও বেগড়বাঁই না করো, জনগণের স্বার্থে, জনগণের সেবায় এই দপ্তর সদাই তিন পায়ে খাড়া।

এখানকার সেবাধর্মের ধারাটি অতি সরল। সবই শুধু ঠকাসের খেলা। যেই না তুমি কোনও কাজ নিয়ে দপ্তরে এসে আছড়ে পড়লে ওমনি তোমার সেবায় সবাই তৎপর। ফাইল বার করতে হবে? ফর্ম চাই? রিনিউয়াল? নয়া কেস? শিখে নাও ঠকাস মন্ত্র, সব মিলে যাবে। রেকর্ডরুমে গিয়ে ঠকাস করো, বেশি নয় বিশ পঁচিশ তিরিশ, ব্যস্‌ কাগজপত্র বেরিয়ে এল। দু কলম লিখবে কেরানিবাবু? ঠকাস একটা বড় পাত্তি, নোটশিট রেডি। ফাইল পৌঁছতে হবে ঈশ্বরের ঠাঁয়ে? ঠকাস পঞ্চাশ, পিওন সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ে করে দিয়ে আসবে। ভগবানের মুখোমুখি হলে অবশ্য আর একটা ঠকাস নয়, ঠকাস ঠকাস ঠকাস। যত বেশি ঠকাস, তত জলদি ফল।

কী চমৎকার সুষ্ঠু ব্যবস্থা! কে বলে এ দেশে ওয়ার্ককালচার নেই?

আজকের দিনটা বিশ্বজিতের অবশ্য একটু মন্দা যাচ্ছিল। সেবাকর্মে আজ একটু ভাঁটা চলেছে। দিনভর হাত খালি খালি, নৈবিদ্যি চড়াতে কেউ আসছে না তেমন। যাও বা আসে, অন্য সাহেবের দরবারে চলে যায়, তার সাহেবের দরজাটি ভোঁ ভাঁ। মাসের এখন শেষ সপ্তাহ, সারাটা দিনে তিনটে পার্টি এলে চলে? তাও তো একজন রেট মানল না, পকেটে মাত্র কুড়ি টাকা গুঁজে দিয়ে গেল! হারামি কাঁহিকা।

বিশ্বজিৎ লম্বা হাই তুলল একটা। আড়মোড়া ভাঙল। কাঁহাতক আর তীর্থের কাকের মতো বসে থাকা যায়? মানে মানে কেটে পড়লেই তো হয়। আজ একবার তালতলা যেতে হবে, ছেলেটাকে দেখার জন্য মন বড় আঁকুপাঁকু করে। রক্তের টান বলে কথা।

শুধু কি ছেলের টান? একা মনে দাঁত বার করে হাসল বিশ্বজিৎ। আরও একটা টান জন্মাচ্ছে যেন! নইলে তালতলার নাম করলেই বুকটা এমন পিড়িং পিড়িং করে কেন?

ধুস্‌ শালা বলে সুয়িংডোর ঠেলে সাহেবের ঘরে ঢুকেই পড়ল বিশ্বজিৎ। সাহেব গগনেন্দ্র নাথ সিংহরায়, ওরফে জি এন সিন্‌হারয় মানুষটি নামে যত ওজনদার, চেহারায় তার উল্টোটি। ল্যাকপেকে দেহ, হাইট পাঁচ এক, গলার আওয়াজটি ভাঙা কাঁসির মতো ক্যারকেরে। কাঠি কাঠি আঙুল পাথর বসানো আংটি দিয়ে ভারী করে রেখেছে। ওজন বাড়ানোর জন্য গগনন্দ্রে নাকি কোমরে এক কাঁড়ি তামার পয়সা লাগানো ঘুনসিও পরে থাকে। অফিসের পিকনিকের দিন ডোরাকাটা আন্ডারওয়্যার পরে পুকুরে স্নান করতে নেমেছিল, তখন নাকি অনেকেই স্বচক্ষে দেখেছে।

বিশ্বজিৎ সাহেবের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলালো, স্যার, আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে যাব?

টিফিনকৌটা ভর্তি করে ছানা নিয়ে আসে গগনেন্দ্র, তিন বারে খায়। তৃতীয় দফাটা শেষ হয়েছে এইমাত্র, ঠোঁট মুছছিল। পরিতৃপ্ত মুখে বলল, —যাবি?

—হ্যাঁ স্যার।…কাজকর্ম তো নেই!

গগনেন্দ্রর একটা চোখ কুঁচকে গেল, চটপট প্রসাদের কাছে থেকে একটু খইনি নিয়ে আয় তো। আচ্ছা করে মলে দিতে বলিস। ব্যাটা চুনটা আজকাল এত কম দিচ্ছে…

প্রসাদ আর এক সাহেবের পিওন। অফিসার কেরানি পিওন নির্বিশেষে যখন তখন তার কাছ থেকে খইনি হাতায়। খইনিই এই অফিসটাকে অনেকটা সাম্যবাদী করে তুলেছে।

বিশ্বজিৎ গেল আর এল। হাতের চেটোয় ধরে আনা খইনি সযত্নে ঢেলে দিল সাহেবের হাতে। নিপুণ দক্ষতায় মুখগহ্বরে চালান হয়ে গেল।

ঢুলুঢুলু হয়েছে গগনেন্দ্রর চোখ। আমেজ। সুলতানি মেজাজে সরু গলা বাজাল,

—তোর আর এখন বাড়ি ফেরার কীসের তাড়া, অ্যাঁ?

—বাড়ি নয় স্যার। শ্বশুরবাড়ি যাব। ছেলেটা এখনও ওখানেই আছে কিনা।

—কত বড় হল যেন তোর ছেলে?

—এই সবে তিন মাস পুরল। খুব খলবল করে স্যার। আমায় দেখলে ঝাঁপিয়ে আসতে চায়।

—বাপ চিনেছে?

—হ্যাঁ স্যার। মা মরা ছেলে, আমারও বড় মায়া…

—হুম্‌। গগনেন্দ্রর নাক আর ঠোঁটের মাঝখানে একটা মাছি বসে থাকে বারোমাস। যেন সেই মাছিটাকে তাড়াতেই নাকটাকে হঠাৎ হঠাৎ কাঁপায় গগনেন্দ্র। একবার নাক নাচিয়ে নিয়ে বলল, তা ছেলেটাকে কি শ্বশুরবাড়িতেই ফেলে রাখবি?

—মা তো খুব নিয়ে আসতে বলছে। বংশের একমাত্র ছেলে…। আমার বাড়ির অবস্থাটাও তো আপনি জানেন স্যার, বউদি তার তিন মেয়ে সামলেই কুল পায় না, মার গায়েগতরে ব্যথা, যখন তখন শয্যা নিচ্ছে…

—হুম। সব দিকেই প্রবলেম। টিনের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে একদলা খইনির পিক ফেলল জি এন সিনহারয়। হাতের চেটোয় মুখ সাপটে নিয়ে বলল, একটা রাতদিনের মেয়েলোক রেখে দে।

—খোঁজ নিয়েছি স্যার। খাওয়া দাওয়া ছাড়াও আটশো টাকা চায়। আমি স্যার গরিব মানুষ…

—হ্যাঁ, ওই বেটিদেরও খাঁই খুব বেড়েছে। ওর চেয়ে একটা বিয়ে করে নিলে আয় দেয়। আবার একবার মাছিটাকে ওড়ানোর চেষ্টা করে গগনেন্দ্র বলল, তোর সেই মামলাটার খবর কী রে?

—লড়ে যাচ্ছি স্যার। আবার একটা নোটিশ পাঠানো হয়েছিল স্যার, এটা আর শালা ডাক্তারটা টালতে পারেনি। সাহেবের সামনে ডাক্তারকে শালা সম্বোধন করে ফেলে জিভ কাটল বিশ্বজিৎ। স্যার আর ডাক্তার সেম-সেম ক্যাটাগরির মানুষ, তার মতো জেড ক্লাস নয়, সুতরাং গগনেন্দ্র আহত হলেও হতে পারে। তাড়াতাড়ি বলল, ডাক্তারবাবু নিজে এসেছিলেন কোর্টে।

—হিয়ারিং হয়ে গেছে নাকি?

—এক দিন হয়েছে। তিন তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিল, তাদের মধ্যে একটা আবার মেয়েছেলে। বলেই আবার নিজেকে সংশোধন করল বিশ্বজিৎ, মানে মহিলালোক স্যার।

—দূর পাঁঠা। ওদের ম্যাজিস্ট্রেট বলে না, বলে মেম্বার। একজনই থাকে শুধু জুডিশিয়ারির। বাকি দুজন সোশাল ওয়ার্কার টোয়ার্কার…

—তা হবে স্যার। তবে ওই মহিলা জোর চেপে ধরেছিলেন, হেববি কড়া কড়া প্রশ্ন করছিলেন। ডাক্তারবাবুর ফেস কাটিংটাই বদলে গেছিল।

—গেদে দে, গেদে দে। শালারা পাজির-পাঝাড়া হয়েছে। নাক আবার চঞ্চল হয়েছে গগনেন্দ্রর, আমার মিসেস, মানে তোর বউদির বুঝলি… কদিন আগে খুব মাথাব্যথা হচ্ছিল, ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম, শালা আগেই বলে স্ক্যান করিয়ে আনুন, সতেরো রকম ব্লাডটেস্ট করুন…! যত্ত সব কমিশান খাওয়ার ধান্দা।

বটেই তো। ঠিকই তো। কমিশান খেলে তো সাহেব খাবে, আর বিশ্বজিরা গুঁড়ো কুড়োবে…!

বিশ্বজিৎ মাথা দোলাল, একটা কমিটি বসে গেছে স্যার। তারা তদন্ত করবে, দেখবে খতিয়ে… ডাক্তার কোথায় কী জালি করেছিল…

—কমিটি বসাল? তার মানে তো বিশ বাঁও জলে?

—না স্যার। নব্বই দিনের মধ্যে রায় বেরোবে। এ একেবারে আইন।

—তাই নাকি? বাহ্‌ বাহ্‌। লেগে থাক। জিতলে গোটা অফিসকে মিষ্টি খাইয়ে দিস্‌।

—সে আর বলতে স্যার! বিশ্বজিৎ বিগলিত মুখে হাসল। ঘাড় চুলকোচ্ছে,তাহলে যাই স্যার?

—আয়।

একদা-লাল এখন মেটে রং অফিসবাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরাল বিশ্বজিৎ। বিটকেল আঠালো গরম চলছে, রোদ্দুরে চিড়বিড় করছে গা। কী ঘাম হচ্ছে, বাপস্‌! শরীরের সব নুন বুঝি বেরিয়ে গেল। বিশ্বজিৎ ঊর্ধ্বপানে চাইল একবার। আকাশের কোণ যেন টুকুন কালচে কালচে লাগে না? মেঘটা উঠবে কি? আহ্‌, একটু ঝড় টড় হলে বাঁচা যায়। এ বছর তেমন জম্পেশ কালবৈশাখী এল না একটাও।

সামনেই বাসস্টপ। বিশ্বজিৎ পানের দোকান থেকে একটা কোল্ডড্রিঙ্কস কিনল। ঠাণ্ডা পানীয় গলায় ঢালতে গিয়ে সহসা মন উচাটন। কবিতাটা কোল্ডড্রিঙ্কসের পোকা ছিল। পথে বেরোলে রোল আর ঠাণ্ডা চাইই। আহা রে, বেচারা ওপারে গিয়ে কিচ্ছুটি পাচ্ছে না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোতলটা শেষ করল বিশ্বজিৎ, মানিব্যাগ খুলে টাকাপয়সা গুনল মন দিয়ে। দুশো তিরিশ মতন আছে, ও বাড়িতে খুচখাচ কিছু কেনাকাটার থাকলে হয়ে যাবে। গত রোববারের আগের রোববার দু দুখানা বেবিফুড কিনে দিয়ে এসেছিল, আশা করা যায় ফুরোয়নি এখনও। ছেলেটা টানছেও খুব, হাঁই হাঁই করে খায়, মাসে চার পাঁচখানা কৌটো সাফ। উফ্‌, কী দাম এক একটা কৌটোর! কিনতে গেলে ভিরমি লেগে যায়। কবিতাটা থাকলে এ খরচাটা তো অন্তত বাঁচত। নাহ্‌, ওই শালা ডাক্তারকে ছাড়া নেই। নিরঞ্জনদা বলছিল ডাক্তারের পালানোর পথও নেই, চার লাখ ব্যাটাকে খসাতেই হবে। টাকাটা সত্যি পাবে তো? চাআআর লাখ…! ভাবলেই লোম খাড়া হয়ে যায়। শালা নিরঞ্জনদার পেটে প্যাঁচ আছে বটে, ঠিক একটা ফিকির বার করে ফেলল! ডাক্তারও টাইট, বিশ্বজিৎও খুশ। .…কী করা যায় টাকাটা নিয়ে? প্রসাদ বলছিল একটা গাড়ি কিনে অফিসে ভাড়া দিয়ে দে…! খারাপ না, হেসে খেলে মাসে চার পাঁচ হাজার তো আসবেই। বাকি টাকা দিয়ে বাড়িটা দোতলা করে নিলে হয় না? বাবুদা করপোরেশানের হেক্কড়, মাল ঝাল দিলেই প্ল্যান বার করে দেবে।…দাদাটা চশমখোর নাম্বার ওয়ান, ওর সঙ্গে আর বাস করা যায় না। দেব দেব বলেও এক পয়সা ঠেকাল না কবিতার শ্রাদ্ধে! অলরাইট, তুই সেপারেট হয়ে যা, দেখি কদ্দিন তেল থাকে! তিন তিনটে মেয়ে তোর, পার করতে করতে ল্যাংটা হয়ে যাবি। তখন পাতিস হাত, বিশ্বজিৎ মুতে দেবে। না না মুতবে কেন, দেবে টাকা, বাপ চোদ্দোপুরুষের নাম ভুলিয়ে তবে দেবে।…বেশি নয়, দুখানা ঘর বানাবে দোতলায়। রান্নাঘর, পায়খানা…। পায়খানায় কমোড বসাবে, ইংলিশ স্টাইল। স্যারের বাড়ির মতো। মা বুড়িটার হাঁটু মুড়তে কষ্ট হয়, সুবিধে হবে। আর হ্যাঁ, একখানা ব্যালকনিও চাই। ‘শ্বশুরের ঘর’ সিনেমাটায় যেমন ছিল, সেই প্যার্টানের।…হাহ্, শ্বশুরবাড়ির দৌলতেই না ছপ্পর ফুঁড়ে নামবে টাকাটা! শ্বশুর মেয়ে দিয়েছিল বলেই না…! আহা, মেয়েটা মরে গেল! বিশ্বজিতের অমন মাধুরীপানা বউটা…! নাহ্, দোতলাটা কবিতার নামেই উৎসর্গ করবে বিশ্বজিৎ। ইয়া বড় করে দরজায় লিখে দেবে—কবিতাধাম।

মিনিবাস এসে গেছে। চারটে বাজতে না বাজতে অফিস-কাটা যাত্রীতে ভরে গেছে বাস। তবু কন্ডাকটার হাঁকাহাঁকি করছে, একটি যাত্রীকেও সে ফেলে যাবে না।

বিশ্বজিৎ ঠেলেঠুলে উঠে পড়ল। প্রাণপণে সেঁধোতে চাইছে ভেতরে। একটা লোক তাকে টপকাতে গিয়ে পা মাড়িয়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে তার পাটাও চটি দিয়ে ডলে দিল বিশ্বজিৎ। ব্রিফকেস হাতে লোকটা ক্রুদ্ধ চোখে তাকাচ্ছে, বিশ্বজিৎ মুচকি হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল, ঝুঁকে বাইরেটা দেখছে। ইয়া প্রকাণ্ড এক এরোপ্লেন কোম্পানির বিজ্ঞাপন, সুন্দরী এক মেয়ে পরির মতো দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন ডাকছে এরোপ্লেনে ওঠার জন্য। টাকাটা পেলে একবার উঠলে হয়। উড়লে হয়। আকাশ থেকে দুনিয়াটাকে কেমন লাগবে কে জানে!…কবিতা দুদুবার প্লেনে চড়েছিল। নমিতাও। কোন এক পিসি নাকি দুবোনকে আগরতলা নিয়ে গিয়েছিল, ছোটবেলায়। আশ্চর্য, কবিতা কোনওদিন গল্প করেনি, নমিতাই সেদিন কথায় কথায়…। আকাশে ওড়ার কথা বলতে বলতে নমিতার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল কেমন! নমিতার চোখের সঙ্গে কাজলের চোখের বেশ মিল। রংটাও কাজলের মতো, চাপা। আগে কবিতার পাশে কেমন কেলেকুষ্টি, লাগত, এখন আর যেন ততটা মনে হয় না। দিদির ছেলে ঘাঁটতে ঘাঁটতে দিব্যি একটা মা মা ভাব এসে গেল নমিতার। মা মা? নাকি ভরা ভরা? সেই খুকি-খুকিপনাটা আর একদম নেই, বরং একটা আস্ত মেয়েছেলে মনে হয়। দিদি মরেছে বলে অভাগা জামাইবাবুর ওপর নমিতার কত মায়া। গেলেই আগে দৌড়ে চা-টা খাবারটা করে নিয়ে আসে।… মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন বিশুদা, অফিসে বুঝি খুব খাটাখাটুনি গেছে?… শুধু জল খাবে কেন, লেবু চিপে একটু শরবত করে দিই?… এমা, জামার বোতাম ছিঁড়ল কী করে? দাও, খুলে দাও বোতাম বসিয়ে দিচ্ছি…। সাধে কি বিশ্বজিতের বুক পিড়িং পিড়িং করে?

ছি ছি ছি, শালীর কথা এত ভাবা কি ঠিক হচ্ছে? বিশ্বজিৎ ধমকাল নিজেকে। বউ মরতে না মরতে এসব কী, অ্যাঁ? লোকে কী বলবে? লজ্জা করে না, কবিতা না তোর প্রাণ ছিল?

ধুস্‌, যে নেই সে নেই। কবিতার শোকে সারাজীবন কি বিধবা হয়েই থাকবে বিশ্বজিৎ? রাতগুলো যে কী করে কাটে এখন! কবিতা তাকে মেয়েছেলের হ্যাবিটটা না গড়ে দিলে তাও একটা কথা ছিল। জ্যান্ত পাশবালিশ বিনা এখন কি আর ঘুম আসে।

মিনি জিরোচ্ছে ট্রাফিক সিগনালে। বিশ্বজিতের দৃষ্টি হঠাৎ পাশে দাঁড়ানো গাড়িটায়। শালা কিংশুক গুহটা না?

মূহুর্তে বিশ্বজিতের চাঁদি আগুন। হারামির বাচ্চাটা কী কায়দা মেরে স্টিয়ারিং ধরে আছে দ্যাখো! তাকা, তাকা এদিকে, বিশ্বজিৎ থুতু ছিটিয়ে দেবে। মিনিবাস পাম্প মারছে, শালার রসগোল্লা মুখ কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। খা, খা শালা ডিজেলপোড়া, কাচ তুলে দিচ্ছিস কেন? কটা দিন যাক, তোর পয়সাতেই মারুতি হাঁকাবে বিশ্বজিৎ।

সবুজ সংকেত পেয়েই ভুস করে বেরিয়ে গেল ডাক্তারের গাড়ি। মিনিবাস চলছে টিকিটিকি। দাঁড়ায়, চলে, দাঁড়ায়, চলে, গরিবদের বেঁচে থাকার মতো।

তালতলায় নেমে বিশ্বজিতের মেজাজ ফের ফুরফুরে। বাতাস থম মেরে গেছে, আজ একটা কিছু ঘটবেই। পকেটে সিগারেট নেই, দোকান থেকে আস্ত একটা প্যাকেট কিনে নিল বিশ্বজিৎ। ছোট আয়না ঝুলছে দোকানে, ঝুঁকে দেখল নিজেকে। এহ্‌ চুলটা একেবারে ন্যাতাপ্যাতা হয়ে গেছে! আঁচড়ে নেবে? থাক। বিশ্বজিতের এই ঘাঁটা চেহারাই নমিতাকে টানে বেশি।

শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে বিশ্বজিৎ দেখল বাচ্চাটা তারস্বরে চিল্লাচ্ছে, নমিতা আর নমিতার মা তাকে থামাতে হিমশিম।

বিশ্বজিৎ শশব্যস্ত, কী হল? এত কাঁদে কেন?

আশালতা জামাইকে দেখে একটু যেন অপ্রস্তুত, কী জানি বাবা, বুঝতে পারছি না। দিব্যি ঘুমোচ্ছিল হঠাৎ হাত পা ছুঁড়ে…

—শরীর খারাপ হল নাকি?

—হতেও পারে। তোলা দুধ খায়…হয়তো পেটব্যথা…

—ওষুধ আনব? ডাক্তার ডাকব?

নমিতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না, ঘরেই তো পেট ব্যথার ওষুধ আছে। খাইয়ে দেখি আগে।

চামচ করে একটুখানি সিরাপ মুখে দিতেই ছেলে ঠাণ্ডা। নমিতা কোলে নিয়ে দোলাচ্ছে তাকে, পুচুর পুচুর চুমু খাচ্ছে। ছেলেও হাসছে খুব, ইংগা উংগা করে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে নমিতার সঙ্গে। আহা, কী ফাটাফাটি সিন! ভেতরটা আইসক্রিম হয়ে যাচ্ছিল বিশ্বজিতের।

আশালতাও দেখছে দৃশ্যটা। হাসি হাসি মুখে বলল, তুমি এখনই চলে যাবে না তো বাবা?

গদগদ গলায় বিশ্বজিৎ বলল, কেন মা?

—পঙ্কজ বলছিল জামাই এলে একটু থাকতে বোলো। তোমার সঙ্গে কী সব কথা আছে।

বিশ্বজিৎ তো থাকতেই চায়। বলল, আছি মা।

আশালতা বলল,—তোমায় এখন কটা লুচি ভেজে দিই?

এ-বাড়িতে লুচির খুব চল। কথায় কথায় লুচি। পুরো ঘটি-বাড়ি বনে গেছে। অবশ্য ফুলকো ফুলকো ময়দার লুচি বিশ্বজিতেরও মন্দ লাগে না। বলল, দিন। তবে বেশি না।

আশালতা রান্নাঘরে চলে গেল।

নমিতা এখনও ছেলে নিয়ে খেলছে। বিশ্বজিৎ টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছিল। রং ময়লা হলেও কবিতার বোন বলে খুব চেনা যায় নমিতাকে, সাইড থেকে দেখলে হঠাৎ হঠাৎ যেন কবিতা বলে ভুলও হয়।

নমিতা চোখ তুলল। মুচকি হেসে বলল, ও মশাই, এবার ছেলেটাকে একটু কোলে নেবে না?

এই এক খেলা হয়েছে রোজ। ছেলে দেওয়া-নেওয়ার ছলে একটুখানি ছোঁয়াছুয়ি হবে দুজনের, কারেন্ট খাওয়ার মতো মুখ করে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বিশ্বজিৎ, মুখ টিপে টিপে হাসবে নমিতা। বেশি ঘনও হবে না, সরেও যাবে না। ঠিক একটা মাপমতো জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে স্থির। মেয়েমানুষরা যে কত রকম রংটং জানে!

বিশ্বজিৎ বলল, দাঁড়াও তবে হাতটা ধুয়ে আসি।

—ভাল করে ধুয়ো। আমার সোনামণির যেন বাজে ছোঁয়াচ না লাগে।

চটপট কলঘর থেকে ঘুরে এল বিশ্বজিৎ। হাত বাড়িয়ে দিল নমিতার দিকে। ছেলের ঘাড় এখনও শক্ত হয়নি পুরোপুরি, বিশ্বজিতের একটু ভয় ভয়ই করে। নমিতা কোলে তুলে দিল, তবে ধরে আছে, হাত সরাচ্ছে না। শুধু ছোঁয়াটুকু নয়, নমিতার শরীরের গন্ধও টের পাচ্ছিল বিশ্বজিৎ। আস্ত একটা মেয়েমানুষের গন্ধ। মাকড়সার জালে আটকে পড়া পোকার মতো ছটফট করে উঠল ভেতরটা। বুকের মেশিনে ধপাস ধপাস শব্দ।

নমিতা খিল খিল হেসে উঠল, কী গো, আদর করো।

বিশ্বজিৎ ভ্যাবলার মতো বলে ফেলল, কাকে?

—কাকে আবার! তোমার ছেলেকে।

বিশ্বজিতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ও আর আমার ছেলে কই! ও তো এখন তোমারই…

—আহা ঢং! দুদিন বাদেই তো ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।

—যদি না নিই?

—ইল্লি রে, সারাজীবন আমি বুঝি কোকিলের ছানা পালব?

—ও কথা বলো কেন? তুমি আর তোমার দিদি কি আলাদা?

নমিতা আবার খিল খিল হেসে উঠল। ছেলে নিয়ে সরে গেছে তফাতে। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ছোড়দি কিন্তু সব দেখতে পাচ্ছে বিশুদা। সব শুনতে পাচ্ছে…

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কোত্থেকে ধেয়ে এসেছে এক বরফের মতো ঠাণ্ডা হাওয়া। সম্বিৎ ফিরতেই বিশ্বজিৎ বুঝল ঝড় উঠেছে বাইরে। উথাল পাথাল নাচছে বাতাস, দুমদাম শব্দ বাজাচ্ছে। দ্যাখ না দ্যাখ বৃষ্টি নেমে গেল। ঝড় আর বৃষ্টি জোর ছেনালি শুরু করে দিয়েছে।

নমিতা ছুটে ছুটে জানলা বন্ধ করছিল। বিশ্বজিৎ বসে আছে ঝুম। ছেলের খাটের কোণে, জড়োসড়ো হয়ে। একটু বেশি কথা কি বলে ফেলেছে আজ? নমিতা কি তাকে হ্যাংলা ভাবল?

পঙ্কজ আর হরিসাধন ফিরল সাড়ে আটটা নাগাদ। বিশ্বজিৎ রাতের খাওয়া খেয়ে যাবে, আশালতা ব্যবস্থা করে ফেলেছে, হাত মুখ ধুয়ে শালা আর শ্বশুর জামাইকে নিয়ে খেতে বসল। মা মেয়ে পরিবেশন করছে, খাতিরদারি করছে জামাই-এর। পদ খুব বেশি নেই। ভাত ডাল আলুপটলের তরকারি পোনামাছের ঝোল। বিশ্বজিতের জন্য আলাদা করে কটা ডিমের বড়াও ভেজেছে আশালতা।

খেতে খেতে পঙ্কজ বলল, হ্যাঁ, যা বলব বলছিলাম। নিরঞ্জনদা পরশু ফোরামে গিয়েছিল। ক্রেতা সুরক্ষা ফোরাম বলছে, তারা তো আমাদের হয়ে লড়বেই, তবে সঙ্গে আলাদা করে একটা উকিল লাগালেও ভাল হয়।

বিশ্বজিৎ সামান্য ঘাবড়ে গেল, আবার উকিল কেন দাদা? ওরাই তো বেশ সওয়াল করছিল।

—ভুলে যেও না বিশ্বজিৎ, আমরা ডাক্তারের সঙ্গে লড়ছি। ও শালা জবরদস্ত উকিল দিয়েছে। দাঁড়ালেই পাঁচ হাজার নেয়৷ নিরঞ্জনদা বলছিল। ফোরামের লোেক যদি তার সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারে, গড়া মাল কেঁচে যাবে।

—কিন্তু উকিল তো দাদা শকুনের জাত। আমার হাড়মাংস সুন্ধু চুষে নেবে।

—আরে না না, কদিনই বা শুনানি হবে? এক দিন দু দিন…। এ কেস তো ব্যাটাদের টানার সুযোগ নেই।

হরিসাধন চুপচাপই ছিল। ছোট্ট মন্তব্য করল, জিতলে তো মামলার খরচা মজুরি সবই দিতে হবে ডাক্তারকে, তাই না?

—অবশ্যই। আর এই মামলা তো আমরা জিতবই। পঙ্কজ ভাত মুখে পুরে হাত চাটছে, দেখলেই তো সেদিন ডাক্তারের কী হাল! খুব রোয়াব দেখিয়ে আমাদের অ্যারেস্ট করিয়েছিল, আর সেদিন কোর্টে একেবারে পুরো চুহা।

—ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আশালতা জামাই-এর পাতে মাছের বাটি উপুড় করে দিল, তিনি আছেন, তিনি ঠিক বিচারই করবেন।

পঙ্কজ খাওয়া থামাল হঠাৎ। ঘুরে বলল, টাকাটা পাওয়া গেলে কী করা হবে কিছু ঠিক করেছ?

—আগে পাই তো!…

—ও ধরো পাওয়া গেছে। ধরে নাও টাকাটা এখন আমাদের সিন্দুকে।…

বিশ্বজিৎ মনোবাসনাটা ভাঙল না। সব কথা ব্যাকব্যাক করে জানাতে নেই। টাকার ব্যাপারে দুনিয়ায় কোনও শালাই আপন নয়।

গলা ঝেড়ে বলল, না মানে…এখনও তেমন…

—আমার একটা পরামর্শ শুনবে? টাকাটা আমাদের উড়নো পুড়নো ঠিক হবে না।

বার বার আমাদের টাকা আমাদের টাকা করে কেন? বউ মরল বিশ্বজিতের, মামলা করল বিশ্বজিৎ, এখনও পর্যন্ত যা চার-পাঁচশো খরচ হয়েছে সবই বিশ্বজিতের গ্যাঁট থেকে গেছে…শুধু জ্ঞান মারার জন্যই পঙ্কজের ভাগ এসে গেল, অ্যাঁ?

পঙ্কজ ভগ্নিপতির হাঁটুতে হাত রেখেছে, শোনো। আমি বউবাজারে একটা দোকান দেখেছি। মালিক মরে গেছে, ছেলেরা লেখাপড়া শিখেছে অনেক, বাপের ব্যবসায় আসতে চায় না…। ছোট জায়গা, বারো বাই পাঁচ। তিন লাখ পেলে ছেড়ে দেবে। দরাদরি করে আরও কিছু হয়তো কমানো যায়…। কী, শুনছ?

—হুঁ

—দোকানটা নিয়ে নিলে কেমন হয়?

—কিন্তু আমি যে সোনার কাজ জানি না দাদা।

—তার জন্য তো আমি আছি, বাবা আছে…। ফিফটি ফিফটি শেয়ারে ব্যবসা করব, ঘরে বসে তুমি লাভের টাকা পেয়ে যাবে। কবিতার নামে দোকানের নাম রাখব। কবিতা জুয়েলার্স।…কী, কেমন?

প্রস্তাবটা একেবারে হ্যাকথু করার মতো নয়, তবু যেন মন থেকে সায় পাচ্ছে না বিশ্বজিৎ। তার ঘাড় ভেঙে গোটা একটা ব্যবসা ফাঁদার কল করছে, এটা কি ন্যায্য কাজ? হঠাৎই নমিতার চোখে চোখ পড়ে গেল। সেও যেন কেমন উদ্‌গ্রীব হয়ে রয়েছে, এখনই উত্তরটা শুনতে চায়! একটু যেন মাথা নাড়ল, না বলল কি?

বিশ্বজিৎ ইতস্তত করে বলল, দেখি। মা দাদার সঙ্গে একটু পরামর্শ করে নিই।

—বলো কথা। পঙ্কজ যেন ঈষৎ থমকেছে, তবে তাঁরা মনে হয় আপত্তি করবেন না।

আর এগোল না আলোচনা। আঁচিয়ে উঠে একটা পান খেল বিশ্বজিৎ। আশালতা নয়, নমিতা সেজেছে। একটু অপটু হাতে মোড়া, তবু যেন অন্যরকম স্বাদ আছে পানটায়।

ছেলে ঘুমিয়ে কাদা। মনে সামান্য খচখচ আর এক রাশ তৃপ্তি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিশ্বজিৎ। কয়েক পা হেঁটে পা থেমে গেল অকস্মাৎ, ঘাড় ঘুরে গেছে অজান্তেই। জানলায় নমিতা। কিছুদিন আগেও ওখানটায় কবিতা দাঁড়িয়ে থাকত।

নাহ্, এখন আর কবিতা কোথ্‌থাও নেই!

নয়

জীবন কখনও কখনও মানুষকে এক বিচিত্র মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কী করবে, কোন দিকে যাবে ভেবে উঠতে পারে না মানুষ। রম্যাণিরও এখন সেই দশা।

সে রাতে পার্টি থেকে ফিরে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভেবেছিল রম্যাণি। নিজেকে খুঁড়েছিল। সে কি কিংশুকের সঙ্গে একটু বেশি রূঢ় আচরণ করছে না? কিংবা বেশি শীতল? কেন করছে?

রম্যাণির মনে কিংশুকের একটা ছবি আঁকা ছিল। সেই ছবির সঙ্গে কিংশুক খাপে খাপে মিলছে না বলেই কি?

কেমন ছিল ছবিটা?

কিংশুক সাধুসন্তদের মতো জীবন যাপন করবে?

মহৎ পেশায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজীবন কর্তব্যপরায়ণতার পরাকাষ্ঠা হয়ে থাকবে?

কিন্তু এ তো ডাহা মিথ্যে। কিংশুক তো কখনও এ রকম ভণিতা করেনি! সে যে আর পাঁচটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষের মতো জীবনে প্রতিষ্ঠা চায়, এও তো কিংশুক গোপন করেনি কখনও! সুখস্বাচ্ছন্দ্য অর্থলিপ্সার বাঁধা ছকই যে কিংশুকের কাম্য, এও তো রম্যাণির অজানা ছিল না। বরং যে ভাবে অ্যাক্সিলেটার চেপে চেপে জীবনের গতি বাড়াচ্ছিল কিংশুক, তাতে তো এ ধরনের একটা স্থলন এক রকম অনিবার্য ছিল। কই, রম্যাণিও তো সব বুঝেও কখনও সে ভাবে সরব হয়নি? এতদিন কিংশুকের কিনে দেওয়া সুখেই তো সে অভ্যস্ত ছিল! উল্লসিত ছিল! আজ হঠাৎ তার ন্যায়নীতিবোধ জেগে ওঠা কি শোভা পায়?

কেন যে এক অচেনা অজানা মেয়ের মৃত্যুর ছায়া বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে কালো মেঘে ঢেকে দিচ্ছে তাদের?

কিংশুক নিজের ফ্ল্যাটে মা বাবাকে নিয়ে যাবে না, এতেই বা কী এমন মহাপাপ হয়েছে? রম্যাণি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে তাপসী অতীন তাদের সঙ্গে নতুন ফ্ল্যাটে গেলে সে অন্তর থেকে খুশি হত? সে নিজেও কি মনে মনে একটা নিজস্ব সংসার চায়নি, শাশুড়ির কর্তৃত্ববিহীন? যেখানে আদর দিয়ে দিয়ে তার সন্তানদের মাথা খেতে পারবে না দাদু ঠাকুমা? আজ হঠাৎ শ্বশুর শাশুড়ির জন্য দরদ উথলে পড়াটা কি ভাবের ঘরে চুরি নয়?

আস্তে আস্তে কিংশুকের জন্য বড় মায়া জাগছিল রম্যাণির। আহা রে, সব থেকে প্রিয়জন যদি সর্বক্ষণ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শ্লেষে জর্জরিত করে, তা হলে মানুষ বাঁচে কী করে? কিংশুকের এক আধটা ভুল কি রম্যাণি মেনে নিতে পারে না? বিশেষ করে যে ভুল কিংশুকের অনিচ্ছাকৃত? যে ভুলে রম্যাণির প্রতি কিংশুকের ভালবাসাই মিশে আছে?

সারাটা রাত সেদিন ঘুমন্ত কিংশুককে ছুঁয়ে ছিল রম্যাণি। অনেক দিন পর।

পরদিন থেকে রম্যাণি প্রায় স্বাভাবিক। কথা বলছে এটা ওটা নিয়ে, কিংশুকের খাওয়ার সময়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, দিনে এক আধবার ফোন করে খবর নিচ্ছে কিংশুকের, রাতে কিংশুক ফিরে এলে তার ব্রিফকেস খুলে টাকা তুলে রাখছে লকারে, অ্যান্টিরুমে বসে যখন কিংশুক বই উল্টোচ্ছে, বসছে গিয়ে পাশে…। মনে হচ্ছিল মেঘটা যেন সরছে ক্রমশ।

যেতে যেতেও মেঘ ফিরে এল।

রম্যাণি সেদিন কিংশুকের সঙ্গে ফ্ল্যাটের প্রগতি দেখতে গিয়েছিল। বাড়ি প্রায় তৈরি এখন, পার্টিশান ওয়াল উঠেছে, জানলা দরজা বসে গেছে, শুধু ফিনিশিংটুকু বাকি। মেঝের মোজাইক, রান্নাঘরের টুকিটাকি, ইলেকট্রিক লাইন, দেওয়ালে প্লাস্টার অফ প্যারিস, রং, এই সব। স্বপন রায়ের কাজের গতি অত্যন্ত দ্রুত, দেখে মনে হয় মাস দুয়েকের মধ্যেই ফ্ল্যাটটা পুরোপুরি বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।

একজন কাঠের মিস্ত্রি পাঠিয়ে দিয়েছিল স্বপন রায়, কোথায় কী প্যানেল হবে, কোথায় আলমারি ক্যাবিনেট তাক, কিংশুক সব বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল লোকটাকে। মাপজোক নিল মিস্ত্রি, বাইরে দাঁড়িয়ে হিসেবপত্র করছিল কিংশুকের সঙ্গে।

রম্যাণি তখন ফ্ল্যাটে একা। ঘুরছে এ ঘর ও ঘর। পায়ে পায়ে সম্ভাব্য বেডরুমে এল একবার। দক্ষিণখোলা বড়সড় ঘর, জানলায় চোখ রাখলেই গাঢ় সবুজ, ফুরফুরে বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বেশ লাগছিল রম্যাণির। বিয়ের পর থেকে কী এক অন্ধকূপে বাস, আলো-বাতাসহীন স্যাঁতসেঁতে বাড়ি, মশা মাছি ইঁদুর আরশোলা…এই চারতলায় এবার দিব্যি আরামে থাকা যাবে। কিংশুকের চটজলদি সিদ্ধান্তটা খারাপ হয়নি।

তখনই হঠাৎ শিরদাঁড়া বেয়ে বরফের স্রোত। ঝকঝকে দিবালোকেও সংলগ্ন বাথরুমের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা! চোখ দুটো অল্প খোলা, যেন সরু চোখে রম্যাণিকেই দেখছে! ঠোঁট ফাঁক সামান্য, যেন কিছু বলতে চায় রম্যাণিকেই!

রম্যাণির নিঃশ্বাস আটকে এল, ক্‌ক্‌কী…কী…কী চাও?

—তোমার ফ্ল্যাট দেখতে এলাম। মেয়েটার ঠোঁটে চিলতে হাসি, খাসা হয়েছে।

—তাতে তোমার কী?…তুমি তো চলে গেছিলে, আবার এসেছ কেন?…যাও।

—যাও বললেই কি যাওয়া যায়? তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি না যে।

—কেন পারো না? কেন ছাড়ছ না?

—কত বার এই কেনর জবাব দিই বলো তো?

—আর ওই এক ঘ্যান ঘ্যান কোরো না প্লিজ। দোহাই, আমার মাথা বিগড়ে দিও না। আমার স্বামী কোনও অন্যায় করেনি।

—তাই বুঝি?

—হ্যাঁ, তাই।

—ভাল করে নিঃশ্বাস নাও তো দেখি। দ্যাখো তো, এই ফ্ল্যাটে কোনও গন্ধ পাচ্ছ কি? না?

—কীসের গন্ধ? চুন? বালি? সিমেন্ট?

—উঁহু, মৃত্যুর।

—কক্ষনো না। রম্যাণির গলা ফ্যাসফেসে হয়ে গেল। আমি কোনও গন্ধ পাচ্ছি না, পাচ্ছি না, পাচ্ছি না।

—জোরে নাক টানো।…এ কি, শ্বাস নিচ্ছ না কেন? ভয় পাচ্ছ?

—ন্‌ন্‌ন্‌না।

রম্যাণির গলা থেকে আর্তনাদ ঠিকরে এল। মুহূর্তে মেয়েটা অদৃশ্য।

কিংশুক হাঁচোরপাচোর করে দৌড়ে এসেছে, —অ্যাই, কী হয়েছে তোমার? চিৎকার করে উঠলে কেন?…কী কাণ্ড, এত ঘামছ কেন?

রম্যাণির স্বর ফুটছিল না। যেন কেউ রুমাল গুঁজে দিয়েছে মুখে। মুখমণ্ডল কাগজের মতো সাদা, যেন কেউ রক্ত নিংড়ে নিয়েছে।

কিংশুক রম্যাণির হাত ধরল। পালস দেখছে। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী অসুবিধে হচ্ছে রুমি?

রম্যাণি কোনওক্রমে মুখ থেকে সরাল রুমাল। আঙুল বাথরুমের দিকে। হাঁপাচ্ছে, এসেছিল…আবার এসেছিল!

—কে?

—সেই মেয়েটা। বলছিল এই ফ্ল্যাটে নাকি ওর মৃত্যুর…

রম্যাণির কবজি ছেড়ে দিল কিংশুক। চোখ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর, দৃষ্টি রম্যাণি থেকে সরছে না। এক সময়ে ভারী গলায় বলল, চলো, ফেরা যাক।

ব্যস্‌, গোটা পথ কিংশুকের চোয়াল শক্ত। গুম।

আবার সেই নিরানন্দ ভুবন। অবসাদ। বিষন্নতা। আর ক্রমশ নিজের ভেতর নিজে গুটিয়ে যাওয়া। কথা বলে দুজনে, কথায় কোনও উত্তাপ থাকে না। কিংবা একটা গনগনে আঁচের আভাস ফুটে ওঠে, কিন্তু আগুনটা দেখা যায় না। এরই মধ্যে শরীরে শরীরও মিলল কয়েক বার। দাঁত মাজার মতো। চুল আঁচড়ানোর মতো। সঙ্গমের মুহূর্তেও দুজনেই স্পষ্ট বুঝতে পারে তারা এখন নেহাতই দুটো বরফের চাঙড়, তাদের মধ্যিখানে বিরাজ করছে এক প্রায় অচেনা মেয়ের শবদেহ।

এ ভাবেও বেশি দিন চলল না। জ্বলেই উঠল আগুনটা। সেদিন হঠাৎ সন্ধে সন্ধে বাড়ি ফিরে এল কিংশুক। থমথমে মুখ, কারোও সঙ্গে একটি কথা নেই, বাইরের পোশাকেই সটান বিছানায়।

রম্যাণি তখন সবে তাতানকে নিয়ে পার্ক থেকে ফিরেছে। তাপসী তাকে ডেকে বলল, দ্যাখ তো গিয়ে কী হয়েছে বাবলুর! মেজাজ একেবারে টং হয়ে আছে…

পায়ে পায়ে ঘরে এল রম্যাণি, অসময়ে চলে এসেছ যে বড়? চেম্বার নেই?

হাতের পিঠে চোখ ঢেকে শুয়ে ছিল কিংশুক। নড়ল না।

—জ্বর টর এল নাকি?

কিংশুক নীরব।

রম্যাণির মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আবার কোনও প্রবলেমে পড়লে নাকি?

ঝাং করে উঠে বসল কিংশুক, আমি ঝামেলায় পড়লেই তো তুমি খুশি হও। আবার বেশ বিবেকের ভূমিকায় অ্যাক্টিং করার চান্স পেয়ে যাবে!

থমকে গেল রম্যাণি। কয়েক পল স্থির দেখল স্বামীকে, আজ বুঝি তোমার কেসের ডেট ছিল?

—তুমি কি আজকাল গোয়েন্দাগিরিও শুরু করেছ নাকি?

—না।…মনে হল। তুমি তো আমায় কিছুই বলো না।

—কেন বলব? তুমি কি দাঁড়াবে আমার পাশে? সাহস দেবে? ভরসা জোগাবে?

—কীসের সাহস?

কিংশুকের নাকের পাটা ফুলে উঠল। একটুক্ষণ চুপ থেকে গরগরে গলায় বলল, আন্দাজ যখন করেছই, শুভসংবাদটাও শুনে নাও। আজ আমার মোটামুটি বাম্বুই গেছে। আমার লইয়ার কোর্টকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, কোর্ট কেসটা স্টেট মেডিকেল কাউন্সিলে রেফার করেছে। তিনজন ডাক্তার ইনভেস্টিগেট করে রিপোর্ট দেবে।

—ও।

—আর কী, এবার নাচো। আহ্লাদে লাফাও। কিংশুকের গলা চড়ে গেল, বলো, কী আনন্দ কী আনন্দ, সত্যের ধ্বজা উড়েছে…

—অমন করে বলছ কেন? খারাপ তো কিছু হয়নি। ডাক্তাররাই তো রিপোর্ট দেবেন…। রম্যাণি কিংশুককে শান্ত করার চেষ্টা করল, তাঁরা তোমার দোষ নাও পেতে পারেন।

—তা হলে তো তুমি একেবারেই ভেঙে পড়বে। কিংশুক ভেংচে উঠল, চার লাখ টাকা গুণাগার দিয়ে নাঙ্গা ফকির হয়ে গেলে তবেই তো আমার পাপ স্খালন হয়, তাই না?

রম্যাণি বলতে না চেয়েও বলে ফেলল, তুমি তা হলে পাপ করেছ বলে মনে করো?

—ফের লেকচার? ফের লেকচার?

—সত্যি শুনে গায়ে ফোস্‌কা পড়ছে?

—শাট আপ। কিংশুক বিকৃত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, অনেক বরদাস্ত করেছি, আর নয়… তাপসী ছুটে এসেছে দরজায়। পিছন পিছন তাতানও, জুল জুল চোখে দেখছে বাবা মাকে।

তাপসী বলল, হয়েছেটা কী? এত চেঁচামিচি কীসের?

কিংশুক তর্জনী নাচাল, ওকে আমার সামনে থেকে সরে যেতে বলো মা। আমি ওকে স্ট্যান্ড করতে পারছি না।

—আহ্‌, বাবলু…! মাথা গরম করিস না। হলটা কী বলবি তো?

—তা জেনে তোমার কী হবে? কিংশুক বিশ্রীভাবে খেঁকিয়ে উঠল, যাবে তোমরা সামনে থেকে যাবে? উইল ইউ প্লিজ লিভ মি অ্যালোন?

তাপসী মুখ কালো করে সরে গেল। রম্যাণিও। টিভি খুলে দিয়েছে। শুনছে না কিছু, দেখছেও না, যান্ত্রিক শব্দের আবরণে ঢাকতে চাইছে অপমান। তাদের বিয়ের পর এ বাড়িতে এমন ঘটনা এই প্রথম।

কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল রম্যাণির। চোখ ফেটে জল আসছিল।

রাতভর নৈঃশব্দ্যের বর্ম পরে রইল কিংশুক। সকালবেলা গোমড়া মুখে একটা সরি ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

রম্যাণির মন খানিকটা স্থিত হয়েছিল বটে, কিন্তু ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে! এ কোন বাঁকে এসে দাঁড়াল সে? তাদের সম্পর্কে যে চিড় ধরেছে, তা সে মেরামত করবে কী ভাবে? সম্পর্কটা কি ভেঙে যাবে? একটা মাত্র ঝগড়ায়? রাগের মাথায় কিংশুক তাকে হিংস্রভাবে অপমান করেছে ঠিকই, কিন্তু অত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে সেটা বোধহয় তত জোরালো কারণ নয়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এ রকম তো হয়ই। তা ছাড়া সম্পর্কটা তো এখন আর শুধু তাদের দুজনের নয়, মাঝে তাতান আছে, আর একজনও আসছে…।

তবে একটা সত্য উপলব্ধি করতে পারছিল রম্যাণি। তার আর কিংশুকের মধ্যে কিছু মৌলিক প্রভেদ আছে। আছেই।

তাহলে এখন রাস্তাটা কী?

নিজের ভেতরের অন্য রম্যাণিটাকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আদ্যন্ত কিংশুকের ধাঁচে নিজেকে গড়ে তুলবে? পারবে কি? ওই মেয়েটা ঘাড়ের কাছে এসে ফোঁস ফোঁস করবে না?

তবে কি মূর্তিমতী বিবেক হয়ে কিংশুককে অবিরাম ঠুকরে যাওয়াই তার নিয়তি? সাংসারিক বাঁধা গতের বাইরে প্রতিটি শব্দকেই তো এখন কিংশুক দাঁত নখের আঁচড় ভাববে, নয় কি? হৃদয়ে শান্তির প্রলেপ দিতে চাইলেও বিছুটি লেগেছে বলে চেল্লাবে! রম্যাণির কষ্ট কিংশুক বুঝবেই না।

আর কী উপায়? কিংশুককে ছেড়ে কিছুদিন দূরে দূরে থাকবে রম্যাণি? শারীরিক দূরত্ব অনেক সময়ে সম্পর্কের মাধুর্যকে ফিরিয়ে আনে।

রম্যাণি শেষ পন্থাটাই বেছে নিল।

এক দুদিন বাদে কিংশুককে বলল, ভাবছি কটা দিন শিবপুর থেকে ঘুরে আসি।

কিংশুক তখন বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছিল। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়না দিয়ে দেখল রম্যাণিকে। ভাবলেশহীন স্বরে বলল, বেশ তো, যাও না।

—মাও অনেকদিন ধরে বলছে, তাতানেরও গরমের ছুটি পড়ে গেল…

—যাবে তো বাপেরবাড়ি, এত কৈফিয়ত দেওয়ার কী আছে?

—না, জানিয়ে রাখলাম। নইলে হয়তো রাতে ফিরে বাবা মার ওপর চোটপাট করবে।

—আমি অনর্থক চোটপাট করি না রুমি।

সংলাপ শেষ। জুতো মশমশিয়ে, চাবি দোলাতে দোলাতে, বেরিয়ে গেল কিংশুক। রম্যাণি কবে ফিরবে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না।

যেন রম্যাণি বিদায় হলে সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গেও কথা বলে নিল রম্যাণি। তাদের আপত্তির কোনও প্রশ্নই নেই, মেয়েরা এই সময়ে কিছুদিন বাপেরবাড়ি গিয়ে থেকে আসবে এটাই তো স্বাভাবিক।

তাপসী তবু আলাদা ডেকে বলল, হ্যাঁ রে, তুই বাবলুর ওপর রাগ টাগ করে যাচ্ছিস না তো?

—যাহ্‌, কী যে বলো!…কতকাল শিবপুরে গিয়ে থাকিনি ভাবো তো! সেই পুজোর পরে…তাও তো মাত্র তিন দিন…

—সে ঠিক আছে। যা। তবে ওই ঝগড়া টগড়াগুলো মনে রাখিস না রে। জানিসই তো বাবলু কত চাপে থাকে…তার ওপর নচ্ছারগুলো কী যে এক কেস ঠুকে দিল…!

—জানি তো।…সব মিটে যাবে মা।

—মিটলে বাঁচি। ঘটা করে একদিন বাবলুর নামে সত্যনারায়ণ দেব।

—দিও।

দুপুরবেলা খেয়ে উঠে স্যুটকেস গোছাতে বসল রম্যাণি। মাস খানেক যদি থাকে তা হলে তো বোঁচকা বুঁচকি ভালই হবে। নিজের পোশাক আশাক তো আছেই, সঙ্গে তাতানের জামাপ্যান্ট, বই খাতা, কালারিং বুক, কিছু খেলনা, রবারক্লথ কাঁথা…।

পরিপাটি করে সব সাজাচ্ছে রম্যাণি, তব গোছানোয় মন বসে কই! একটা পুরনো ছবি হানা দিচ্ছে বুকে, বার বার। ভারী হয়ে আসে হৃদয়, অজান্তেই ভিজে যায় চোখের পাতা…

স্টেজে উঠে গান ধরেছে এক উড়ু উড়ু চুল যুবক। বিটকেল গান। গলায় মোটেই সুর নেই ছেলেটার, কিন্তু কলিগুলো এত মজাদার যে পেট গুলিয়ে হাসি আসে। দলবল নিয়ে ঢোল করতাল সহযোগে চলছে এক অভাগা বালকের জীবনকাহিনী।

বাচ্চাটার তখন ভাল করে বুলি ফোটেনি, ঘেঁটি ধরে তাকে নার্সারিতে ভর্তি করে দিল বাবা মা। সন্তানের জন্য বাবা মা একটা মাছের চোখ ঝুলিয়ে রেখেছে—তাকে ডাক্তার হতে হবে। টলমল পায়ে হাঁটছে শিশু, কাঁধে ইয়া মোটা ব্যাগ…। উঁহু, ব্যাগ নয়, জোয়াল। কাঁধে জোয়াল শিশু মুখ থুবড়ে পড়ল, অমনি তাকে টেনে তুলল বাবা মা। ভারে নুয়ে পড়লে চলবে কেন বাছা, তোকে না ডাক্তার হতে হবে!

এটুকু গেয়েই হেঁড়ে গলায় কোরাস, সেই নার্সারি থেকে শুরু/পারছি না আর গুরু…

ক্রমশ বড় হচ্ছে ছেলে। নার্সারি পেরিয়ে প্রাইমারি। প্রাইমারি পেরিয়ে সেকেন্ডারি। পড়াশুনোর চাপে হাঁসফাঁস নাভিশ্বাস। বিকেলে পাড়ায় সমবয়সি বন্ধুরা ফুটবল পেটাচ্ছে, ক্রিকেট খেলছে, স্কুল থেকে বেরিয়ে টিউটোরিয়াল যাওয়ার পথে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে থাকে ছেলে। একদিন আর সংযত থাকতে পারল না, নেমে পড়ল মাঠে। ফুটবলে পা ছোঁয়াতেই সে কী উন্মাদনা! আনন্দ! আনন্দ! সঙ্গে সঙ্গে কোথথেকে উড়ে এসেছে বাবা, কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ছেলেকে। লজ্জা করে না খোকা, তুই খেলাধুলো করে সময় নষ্ট করিস? ভুলে গেলি তোকে ডাক্তার হতে হবে?

ফের সমবেত ধুয়ো, সেই নার্সারি থেকে শুরু/পারছি না আর গুরু…

মাধ্যমিকে স্টার পেল খোকা, উচ্চ মাধ্যমিকে রেজাল্ট আরও ভাল। জয়েন্টে উঁচু পজিশন পেয়ে ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে গেল ছেলে। ঘাড় গুঁজে পড়ায় ডুবে আছে, পড়ছে পড়ছে ডাক্তারি পড়ছে…। পথেঘাটে উড়ে বেড়ায় কত চঞ্চল প্রজাপতি, একবারটি ফিরে তাকানোরও জো নেই খোকার। অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি চোখ রাঙাচ্ছে অবিরাম, ডিসেকশান রুমের মড়ারা দাঁতমুখ খিঁচোচ্ছে, ভুলেও মেয়েদের দেখিস না খোকা, পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাবে! মনে রাখিস তোকে ডাক্তার হতেই হবে।

আবার দোহারকি, সেই নার্সারি থেকে শুরু/পারছি না আর গুরু…

তো শেষমেষ খোকা ডাক্তার হল। বাবা গদগদ, মা ডগমগ, এবার তো ছেলের জন্য একটা রাঙা টুকটুকে বউ আনতে হয়! খোঁজ খোঁজ খোঁজ, শুরু হয়ে গেল ঝাড়াই বাছাই। অবশেষে মিললও এক পরি, ছাদনাতলায় বউ দেখে খোকা একেবারে ফ্ল্যাট।

ফুলশয্যার রাত। খোকার বুক কাঁপে দুরু দুরু, প্রেমের প্লাবনে প্রায় বাকরোধ হওয়ার জোগাড়। অনেক বার তুতলিয়ে মুতলিয়ে বউকে বলল, তুমি আমার জীবনে প্রথম প্রেম, তুমিই প্রথম নারী…

বউ বলল, তো?

খোকা বলল, তুমি যেমন আমার প্রথম…, আমিও কি তোমার প্রথম?

শুনে বউ হেসে কুটিপাটি, পারলাম না গুরু/ সেই নার্সারি থেকে শুরু।

মেডিকেল কলেজ সোশালের সেই হুল্লোড়ে তরুণ গায়কটি এই কিংশুকই কি? ভাবা যায় না, ভাবা যায় না। সেদিন কিংশুকের গানটা শুনে মজা লেগেছিল খুব, আবার কেমন যেন মায়াও জেগেছিল রম্যাণির। আহা রে, কী অসহায় বদ্ধ জীবন! হাসি ঠাট্টার মধ্যেও কোথায় যেন একটা দীর্ঘশ্বাসও লুকিয়ে আছে!

রম্যাণি চোখ মুছল। ভুল। ভুল। ওটা নিছকই খেলা ছিল সেদিন, স্রেফ একটা মজার গান। ওই দম বন্ধ করা জীবনে আদৌ অতৃপ্ত ছিল না কিংশুক। তার মধ্যে কোনও মুক্তির পিপাসাও ছিল না। না হলে এত দ্রুত কি সে নিজেকে বদলে ফেলতে পারত?

কিংবা এ ঠিক বদলও নয়, কিংশুক এরকমই। শুধু গণ্ডিটারই তার বদল হয়েছে। রম্যাণি কিংশুককে চিনতে পারেনি।

কেন আগের মতো রইল না কিংশুক?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *