১০. জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি

১০.

জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি এবার বৃষ্টি এসে গেল কলকাতায়। সকাল নেই, দুপুর নেই, সময় নেই, অসময় নেই, যখন তখন মেঘেরা দখল করে নিচ্ছে আকাশ। পথে-ঘাটে ট্রামে-বাসে সর্বত্র শুরু হয়ে গেছে আলোচনা, বর্ষার এই অকাল আগমনের হেতু কী! কেউ বলে এল্‌-নিনো, কেউ বলে পরিবেশ দূষণ। কেউ বা বলে এরকম নাকি প্রতি পাঁচ দশ বছর পর পরই হয়, এমনটাই তারা দেখে আসছে ছোটবেলা থেকে! দু চারজন অবশ্য মেঘবাহিনীর আক্রমণের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও খুঁজে পেয়েছে, বাদলা দিনে মিটিং মিছিল প্রতিবাদ সভার ঘোর অসুবিধে!

সে যাই হোক, মৌসুমি বায়ুর ঝাপটায় কলকাতার নাগরিক জীবন বেশ বিপর্যস্ত। ঘরে ঘরে এখন জ্বর সর্দি কাশি।

নন্দিতার সংসারেও ইন্‌ফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ। তন্নিষ্ঠা কদিন জ্বরে ভুগে উঠল, শুভেন্দু ঘং ঘং কাশছে, নন্দিতারও মাথা টিপটিপ, নাক সুড়সুড়। এর মধ্যেই রন্টুর ফোন, চিন্ময়ীও কাত।

আজ অফিস ছুটির পর মাকে দেখতে বাপের বাড়ি ছুটল নন্দিতা। গিয়ে দেখল মাতৃদেবী টলোমলো বটে, তবে এখনও পুরোপুরি শয্যাশায়ী নন। টুকুসের আগেই ফ্লু হয়েছিল, সেই নাকি অসুখটা চালান করেছে ঠাকুমাকে, এই বলে বিস্তর অভিযোগ জানালেন চিন্ময়ী। টুকুসকে নাকি সাত বার ডেকেও তাঁর ঘরে ঢোকাতে পারেন না, অথচ জ্বর হওয়ার পর টুকুস নাকি সারাক্ষণ ঠাকুমার খাটে শুয়ে থাকত, হঠাৎ তার ঠাকুমার আদর খাওয়ার শখ উথলে উঠল, ইত্যাদি ইত্যাদি। রন্টু আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছে, মাকে নিয়ে ভাই বোনে হাসাহাসি করল এক চোট, খাওয়া-দাওয়া হল, গল্প গুজব হল…

উঠতে উঠতে নন্দিতার আটটা বেজে গেল। সেলিমপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে, আকাশের দিকে আড়ে তাকাতে তাকাতে একটা ট্যাক্সির জন্য আঁকুপাকু করছে, তখনই নির্মলের সঙ্গে দেখা।

নির্মলই পিছন থেকে ডাকছে, —কি গো মেমসাহেব, দেখতেই পাচ্ছ না যে?

নির্মলকে তেমন একটা পছন্দ করে না নন্দিতা। প্রথমত, এই লোকটা শুভেন্দুর পাগলামির স্যাঙাৎ, দ্বিতীয়ত তার পারিবারিক জীবনের কোনও গূঢ় তথ্যই নির্মলের অজানা নেই।

তবু অনেককাল পর নির্মলকে দেখে একটু বুঝি খুশিই হল নন্দিতা। হেসে বলল, —সত্যিই দেখতে পাইনি।…আপনি আমার বাপের বাড়ির পাড়ায় কেন?

ইয়া বড় কাঁধঝোলা ব্যাগটাকে দেখাল নির্মল, —এই যে, দিনগত পাপক্ষয়! হেড এগ্‌জামিনারের কাছে এসেছিলাম। খাতা নিতে।

—ও।…তারপর বাড়ির খবর কী? মঞ্জরী…?

—কেউই ভাল নেই, কেউই খারাপ নেই, সবাই আছে একরকম। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারার নির্মল স্বচ্ছ হাসল। রসিক ভঙ্গিতে বলল, —তোমরা তো মেরে দিলে!

—কী মারলাম?

—তিন্নির জন্য জব্বর পাত্র ঠিক করে ফেলেছ!

—আমি করেছি। নন্দিতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল।

—হ্যাঁ, তুমিই করেছ। সাহেবও তাই বলেছে। নির্মল মৃদু হাসল, বিয়ের বাজার-টাজার কি শুরু হয়ে গেছে?

—চলছে। এবারও নির্মলকে একটু ঠেস দেওয়ার লোভ সামলাতে পারল না নন্দিতা, —একা একা যতটা যা করতে পারি। আপনার বন্ধুকে তো কিছু বলার উপায় নেই, তিনি এখন ভলান্টারি রিটায়ারমেন্টের শোকে রয়েছেন…

—হ্যাঁ, সাহেব খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। তার ওপর গ্রুপটাও ভেঙে গেল…

—সমিধ ভেঙে গেছে? নন্দিতা ভীষণ চমকেছে।

—নাহ্‌, সমিধ ভাঙেনি। নির্মল স্থির চোখে নন্দিতাকে দেখল, আমি আর সাহেব সমিধ ছেড়েছি।

—হঠাৎ?

—বাসবেন্দ্রর সঙ্গে মতে মিলছিল না। ও দলে এক ধরনের অটোক্রেসি চালাচ্ছে, রীতিফিতি কিছুই মানছে না। কাউকে না কাউকে তো প্রোটেস্ট করতেই হবে, কী বলো? একটু থামল নির্মল। বলল, একটা ভাল নাটকের প্রোপোজাল দিয়েছিলাম, বাসবেন্দ্র স্ট্রেট রিজেক্ট করে দিল! সমিধ এখন কমার্শিয়াল হয়ে গেছে, সস্তায় বাজার কিনতে চায়। সো উই আর আউট।

নন্দিতা অস্ফুটে প্রশ্ন করল, —কবে হয়েছে এসব? কদ্দিন?

—তা ধরো, মাস খানেকের ওপর।…সাহেব তোমায় কিচ্ছু বলেনি?

নন্দিতা ঈষৎ অস্বচ্ছন্দ বোধ করল। আমতা আমতা করে বলল, —না, আমিও ফেরার পরে খুব টায়ার্ড থাকি, ও’ও কী সব লেখালিখি করে, বিশেষ একটা কথাও হয় না…

—উঁউ। নির্মল চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল, —সাহেব একদম ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে। কত বার করে বললাম, এসো একটা নতুন গ্রুপ তৈরি করি, সাহেবের কোনও চাড়ই নেই। তিন চারটে ছেলেমেয়ে পেয়েওছিলাম, কিন্তু আর তো ওদের ধরে রাখা যাচ্ছে না…। টোটাল ভ্যাকুয়ম নিয়ে কী করে যে থাকবে! ওর মতো একজন স্ট্রং এনারজেটিক মানুষ…!

একটু একটু করে রহস্য পরিষ্কার হচ্ছিল নন্দিতার কাছে। কদিন আগে মিনিবাসের জানলা থেকে দেখেছে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে কার্জন পার্কের ধারে দাঁড়িয়ে আছে শুভেন্দু, মাত্র ছ সাত হাত দূরে থামল বাসটা, নন্দিতা একদম কাছেই, শুভেন্দু দেখতেই পেল না! সেদিন মনে হয়েছিল ইচ্ছে করে দেখেনি, বাড়ি ফিরে লোকটাকে জিজ্ঞেস করতেও নন্দিতার মানে লেগেছিল, আজ বুঝতে পারছে…! শুভেন্দু আজকাল বাড়িতেও যেচে কথা বলে না একদম, এমনকী তিন্নির সঙ্গেও না!

নির্মল বুঝি নন্দিতার ক্ষণিক অন্যমনস্কতা লক্ষ করেছে, আর শুভেন্দুর প্রসঙ্গে গেল না। জিজ্ঞেস করল, —তোমার জামাই নাকি দিল্লিতে ভাল চাকরি পেয়েছে?

নন্দিতা আলগা হাসল, —পায়নি এখনও, পাব পাব স্টেজে আছে। এই তো পরশু আবার দিল্লি গেল, ফাইনাল ইন্টারভিউ দিতে।

—তিন্নির স্লেটের ইন্টারভিউ কবে কিছু জানতে পারল?

—না। বলছিল তো, পুজোর আগে হতে পারে।

—হ্যাঁ, ইংলিশের বোর্ড বোধহয় ওই সময়ই বসবে।…কিন্তু তিন্নি তো দিল্লিই চলে যাবে।

—তা ঠিক। বর গেলে ওকে তো যেতেই হবে।

—হুম্‌। তোমরাও খুব একা হয়ে যাবে তখন।

নির্মলের কথায় কি অন্য কোনও ইঙ্গিত আছে? নন্দিতা সতর্ক হতে চাইল। তবু আপনা থেকেই অভিমান ফুটে উঠেছে গলায়, —আমি তো চিরকালই একা নির্মলদা।

নির্মল দু এক সেকেন্ড নিশ্চুপ। ঠোঁট টিপে ঘাড় নাড়ছে। হঠাৎ সোজা তাকাল, —মানুষ তো একাই মেমসাহেব। আমরা শুধু একত্রে বাসই করি। স্বামী স্ত্রী ছেলে মেয়ে ভাই বোন মা বাবা…নানা রকম সম্পর্কের বৃত্ত তৈরি করে একা হয়ে থাকাটাকে সহনীয় করে রাখতে চাই। কিন্তু আলটিমেট্‌লি কী থাকে বলো? প্রেম ভালবাসা ঝগড়া অশান্তি মনোমালিন্য কিসুই কিস্যু না। লাইফের ফ্যাগ এন্ডে এসে আবার আমরা যে একা সে একাই। এটাই সত্য। এটাই বাস্তব। তবু তার মধ্যেও মানুষ কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার রসদ খোঁজে। একদম নিজের মতো করে। এটাকে তুমি তার প্যাশান বলতে পারো, নেশা বলতে পারো, শখ বলতে পারো, বদখেয়াল বলতে পারো…। কিন্তু সেটুকুও চলে গেলে মানুষ একেবারে নিরবলম্ব হয়ে যায়। হি সিজেস্‌ টু বি আ ম্যান। বলতে বলতে হঠাৎ গলা নামিয়েছে নির্মল, —সাহেবের জন্য রিয়েলি আমার ভয় হচ্ছে…

নির্মল চলে যাওয়ার পরে বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল নন্দিতা। নিঝুম। নির্মলও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে জ্ঞান দিয়ে গেল। আশ্চর্য, নন্দিতাকে কেউ কোনওদিনই বুঝল না! নন্দিতাও তো আঁকড়ে ধরার কিছু চেয়েছিল!…ভরা মাস, যে কোনওদিন পৃথিবীতে আসবে তিন্নি, বেমালুম তাকে ফেলে নর্থ বেঙ্গল শো করতে চলে গেল শুভেন্দু! ভাবনা কীসের, তোমার বাড়ির লোক, আমার বাড়ির লোক, সবাই তো রইল! বিভাবতী মেটারনিটি হোমের বেডে শুয়ে আছে নন্দিতা, পাশে সদ্যোজাত তিন্নি, একের পর এক আত্মীয় পরিজন আসে, একজনই শুধু নেই! বিবাহবার্ষিকী ভুলে গেল, রিহার্সালে মত্ত! মেয়েকে ভর্তি করতে হবে স্কুলে, শুভেন্দু দিব্যি চলে গেল আসানসোল! স্কুলে ইন্টারভিউয়ের সময়ে পেরেন্টস্‌দের দুজনকেই থাকতে হবে, শুনেই কী রাগ! অমন কায়দার স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করার দরকার কী! অফিসের পিকনিকে সব মহিলা কলিগের বর যাচ্ছে, শুভেন্দু নেই! শ্যালো লোকজনদের সঙ্গে আমার পোষাবে না, সারাক্ষণ শুধু প্রোমোশানের কথা, ইনক্রিমেন্টের গল্প…! কবে কোন্‌ দিন কখন নন্দিতার পাশে থেকেছে শুভেন্দু? কোন সাধ পূর্ণ করেছে? প্রতিটা ঠোক্করই তো তিলে তিলে নন্দিতার আবেগকে হত্যা করেছে। কে কবে কখন তাকে বলেছে, আহা নন্দিতা তুমি কী একা!

তবু এই মুহূর্তে শুভেন্দুর জন্য কষ্ট হচ্ছে বইকী। যে নাটক নিয়ে তাদের এত সংঘাত, যে নাটকের বাতিক চরম অসুখী করেছে নন্দিতাকে, সেই নাটকের সঙ্গে শুভেন্দুর সংস্রব ঘুচে যাওয়ার জন্য নন্দিতার তো আজ কণামাত্র হলেও উল্লসিত হওয়া উচিত। কিন্তু তেমনটা হচ্ছে না কেন? নন্দিতার মনের কোন্ গোপন কন্দরে এখনও শুভেন্দুর জন্য ভালবাসার বাষ্প সঞ্চিত আছে?

হা ঈশ্বর, ভালবাসা কি তবে মরে না!

কম্পাউন্ডের গেটে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে ধীর পায়ে সিঁড়ি ভাঙছিল নন্দিতা। দোতলার ল্যান্ডিংয়ে তাদের কোঅপারেটিভের সেক্রেটারি দীপক ষড়ঙ্গী।

নন্দিতাকে দেখে দীপকের মুখে পরিমিত হাসি, —ম্যাডাম খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছে? স্যাটারডে ইভনিংয়ের কথা স্মরণে আছে তো?

—কী ব্যাপারে বলুন তো?

—কোঅপারেটিভের অ্যানুয়াল মিটিং আছে না! মেন্টেনেন্স নিয়ে একটু প্রবলেম হচ্ছে, তারপর সিকিউরিটি গার্ডটিকেও বদলানোর কথা চলছে…। দেখলেন তো, রায়বাবুর ফ্ল্যাটে দিনদুপুরে কেমন চুরিটা হয়ে গেল!

—হুঁ। আসব।

—মিস্টার দাশগুপ্তকেও ধরে আনবেন।…উনি তো এখন মোটামুটি ফ্রি, ওঁকে কিন্তু এবারে দায়িত্ব নিতে হবে।

—বলব।

পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নন্দিতার কপালে ভাঁজ। শুভেন্দুর বেকার হয়ে যাওয়ার খবর এর মধ্যেই চাউর হয়ে গেছে? তিন্নি মোটেই বলে বেড়ানোর মেয়ে নয়, অন্তত বাবার ব্যাপারে সে যথেষ্ট স্পর্শকাতর। শুভেন্দুও নিশ্চয়ই ডেকে ডেকে জানায়নি! আশ্চর্য, কোন্ রন্ধ্রপথে যে প্রতিবেশীদের কানে সব সংবাদ পৌঁছে যায়!

দীপকের প্রস্তাবে মনে মনে একটু হাসিও পেল নন্দিতার। চাকরি নাটক ছেড়ে এখন এই ফ্ল্যাটবাড়ির কোঅপারেটিভের পাণ্ডা হবে শুভেন্দু? কল পায়খানা জলের পাম্পের তত্ত্বাবধান করবে?

ফ্ল্যাটের দরজা খুলেছে তন্নিষ্ঠা। পরনে একটা ঝাপ্পি ঝুপ্পি কাফ্‌তান। মুখের শুকনো শুকনো ভাব এখনও মিলোয়নি।

চটি ছাড়তে ছাড়তে নন্দিতা জিজ্ঞেস করল, —তোর বাবা ফিরেছে?

—ফিরে বেরিয়েছে। কাল এখানে বাজার বন্ধ। কোন্ এক দোকানদার মারা গেছে…। টুকিটাকি কী সব কিনতে গেল।

—ও। সকালে কখন বেরিয়েছিল?

—যখন বেরোয়। আজ অফিস গেছিল তো।

মেয়েকে ঝলক নিরীক্ষণ করে নিল নন্দিতা। সত্যি বলছে কি না তিন্নি বোঝা মুশকিল। বাবার দিকেই টেনে কথা বলে মেয়ে, চিরকাল। অশান্তি এড়ানোর চেষ্টা!

ঘরে এসে জামাকাপড় না বদলেই আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল নন্দিতা। একটু গায়ে জল ঢাললে ভাল লাগত, সাহস হচ্ছে না। মাথাটা কেমন ইট হয়ে আছে, চাপ চাপ ভাবটা ফিরে আসছে। তিন্নিকে ডেকে একটা ট্যাবলেট ফ্যাবলেট দিতে বলবে? থাক গে।

চোখটা জড়িয়ে এসেছিল। হঠাৎই আলোর ঝলকানিতে ঘোর ছিঁড়েছে। শুভেন্দু। তাকে দেখেই আলো নিবিয়ে শুভেন্দু তড়িঘড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিল, নন্দিতাই ডাকল, —শোনো।

শুভেন্দু দরজায় দাঁড়াল, —কী?

—এদিকে এসো। কথা আছে।

আলো জ্বেলে চেয়ারে এসে বসল শুভেন্দু।

নন্দিতা নিচু স্বরে প্রশ্ন করল, —তুমি সমিধ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছ, বলোনি তো?

শুভেন্দু উত্তরও দিল না, পাল্টা প্রশ্নও করল না। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের দেওয়াল দেখছে।

—নির্মলদার সঙ্গে আজ দেখা হয়েছিল।

—আন্দাজ করছি।

—নির্মলদা বলছিল তুমি নাকি আর নতুন গ্রুপ করাতে ইন্টারেস্টেড্‌ নও? জবাব নেই।

—কারণটা কী জানতে পারি?

—এটা আমার পারসোনাল ব্যাপার।

—না, পারসোনাল ব্যাপার নয়। স্বাভাবিক থাকতে চেয়েও নন্দিতা গলা সামান্য চড়িয়ে ফেলল, —সারাজীবন আমায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে এখন এ কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না?

—যদ্দূর সম্ভব কম্‌পেন্‌সেট করার চেষ্টা করছি। এখন সংসারের কোন্ কাজ আমি করি না?

—থাক, তোমার কাজের অপেক্ষায় আমার সংসার কোনওদিন বসে থাকেওনি, থাকবেও না। নাটক ছেড়ে দিয়ে এখন তুমি ঘরের কাজ দেখাচ্ছ?

শুভেন্দু বিমূঢ় চোখে তাকাল, —তুমি হঠাৎ আমার নাটক ছাড়া নিয়ে পড়লে কেন?

—আলবত পড়ব। হাজার বার বলব। এখন নাটক ছেড়ে তুমি আমার কোন স্বর্গে বাতিটা দেবে, শুনি? নন্দিতা উত্তেজিত মুখে উঠে বসেছে, —ছাড়বেই যদি, তো পঁচিশ বছর আগে ছাড়োনি কেন?

—ভুল হয়েছে।

—ব্যস্‌, ভুল হয়েছে বললেই সব চুকে গেল? ফিরবে আমার পঁচিশটা বছর?

—তাহলে এখন আমি কী করতে পারি, বলো? রোজ একশো হাত করে নাকখৎ দেব? তিনশো বার করে কান ধরে উঠ্‌ বোস্‌ করব? শুভেন্দুও তেতে উঠেছে, —কী করলে তোমার শান্তি হবে বলো, তাই করব।

—আমার শান্তি তোমায় কে দেখতে বলেছে? ন্যাকা সেজো না, তুমি খুব ভাল মতোই বোঝো তোমার এখন কী করা উচিত।

তন্নিষ্ঠা ঘরে ঢুকল, —কী ব্যাপার, তোমরা হঠাৎ চিল্লামিলি শুরু করলে কেন?

—এই দ্যাখ্‌ না তোর বাবা…! সারাটা জীবন মাছ ঘেঁটে এখন বিধবা সাজছে!

তন্নিষ্ঠা একবার নন্দিতার দিকে তাকাচ্ছে, একবার শুভেন্দুর দিকে। শুভেন্দু তীব্র এক দৃষ্টি হেনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। একটুক্ষণ ফ্যালফ্যাল দাঁড়িয়ে থেকে তন্নিষ্ঠাও। লিভিং রুমে বাপ মেয়েতে কথা হচ্ছে, অনুচ্চ স্বরে, আওয়াজ পাচ্ছিল নন্দিতা।

ধপ করে নন্দিতা শুয়ে পড়ল আবার। মাথার পিছনটা দপদপ করছে। একটা দুনিয়া তছনছ করে দেওয়া ক্রোধ নেহাই পিটছে ক্রমাগত। তার জীবনের এতগুলো বছর মিথ্যে হয়ে গেল? এত কষ্ট সহ্য করেছে, ফাটাফাটি করেছে, সবই কি শুধু তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে? আর কোনও কারণ ছিল না? নাটক ছেড়ে দিয়ে তার এতদিনকার সংগ্রামকে শূন্যগর্ভ করে দিচ্ছে লোকটা? তার অহংকে এভাবে চূর্ণ করে দিতে চায়?

নন্দিতার তাহলে আর কী রইল?

তন্নিষ্ঠা খাবার দাবার গরম করে ফেলেছে। ডাকছে খেতে। বাথরুম ঘুরে এসে ডাইনিং টেবিলে বসল নন্দিতা। নিঃশব্দে গলাধঃকরণ করছে নৈশাহার। বাবা মা মেয়ে তিনজনই যেন যন্ত্রমানব এখন।

খাওয়া দাওয়ার পর অভ্যাস মতো নন্দিতা বোকা বাক্সের সামনে বসল একবার। ফাঁকা চোখ, বোধহীন মুখ। টিভিতে খেলার চ্যানেল। কার রেসিং শেষ হয়ে শুরু হয়েছে বক্সিং। অসহ্য খেলা, একটা লোককে একটানা পিটিয়ে যাচ্ছে আর একজন, গলগলিয়ে রক্ত ছুটছে লোকটার মুখ দিয়ে, লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে। অন্য দিন চ্যানেল ঘুরিয়ে দেয় নন্দিতা, আজ রিমোট পর্যন্তও হাত এগোচ্ছে না। লোকটার থ্যাঁতলানো মুখ দেখে চিনচিন করছে বুক। আশ্চর্য, বার বার পড়ে গিয়েও ওঠে লোকটা, দশ গোনার আগেই..!

নন্দিতা পায়ে পায়ে ঘরে ফিরল। ড্রয়ার হাতড়ে হাতড়ে মাথা ধরার ট্যাবলেট পেল একটা, ওষুধটা খেয়ে শুয়ে পড়েছে। অ্যানালজেসিকের প্রভাবে স্নায়ু স্তিমিত ক্রমশ।

বাইরে কাশির ঘং ঘং আওয়াজ। আবছা ঘুম ভেঙে গেল নন্দিতার। পাশে শুভেন্দু নেই। এখনও শোয়নি লোকটা?

নন্দিতা খাট থেকে নেমে লিভিং রুমের অন্ধকারে এসে দাঁড়াল। ব্যালকনির রেলিঙে হেলান দিয়ে সিগারেট টেনে চলেছে শুভেন্দু, আর বুকে হাত চেপে কাশির দমক সামলাচ্ছে। কী শীর্ণ দেখাচ্ছে মানুষটাকে! কী ভীষণ কুঁজো কুঁজো লাগে!

বুকের ভেতর একটা কান্না উথলে উঠল নন্দিতার। ঝগড়া বিবাদ করে তবু একটা মানুষের সঙ্গে সহবাস করা যায়, কিন্তু অক্ষম পরাজিত অর্ধমৃত ওই শুভেন্দুর সঙ্গে সে ঘর করবে কী করে!

ফিসফিস করে নন্দিতা ডাকল, —শুনছ..? অ্যাই…? এখনও সময় আছে… শুভেন্দু শুনতে পেল না।

.

১১.

রবিবার সাতসকালে বীথিকার ফোন। স্বামী পুত্র সমভিব্যাহারে ছেলের ভাবী শ্বশুরবাড়িতে আসছে বীথিকা। আজই। দশটা নাগাদ। শুভেন্দু নন্দিতার সঙ্গে কী যেন জরুরি দরকার আছে।

তন্নিষ্ঠাই টেলিফোনটা ধরেছিল। পল্টন-সহ বীথিকার হঠাৎ আগমনের কারণটা অনুমান করার চেষ্টা করছিল সে। কী হতে পারে? ছেলে চাকরিটা পেয়ে গেছে বলে মিষ্টি খাওয়াতে আসছে? সে জন্য তো বাবা মাকেই ও বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে পারে! ছেলে বিশ হাজার থেকে তিরিশ হাজারি হয়ে গেল বলে প্রত্যাশা কিছু বাড়ল কি? খাট যখন দিচ্ছই, সিক্স বাই সেভেন কেন, বারো বাই চোদ্দোই কিনো! ফ্রিজ যদি দাও একশো পঁয়ষট্টি নয়, তিনশো লিটারটা…! কিন্তু না। শৌনকের দাপুটে বাবার দেমাক আছে খুব, যেচে ওরকম কিছু বলতে ছুটে আসবে বলে মনে হয় না। আর কী কারণ থাকতে পারে? অচানক তন্নিষ্ঠাকে বাতিল করল?

অজান্তেই তন্নিষ্ঠার বুক বেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এল। উঁহু তার কপালে এমনটা লেখা নেই।

শৌনক দিল্লি থেকে ফিরেছে বুধবার। পরশু সন্ধেবেলাই এ বাড়ি ঘুরে গেছে। হইহই করছিল খুব। কোনও খিঁচ থাকলে শৌনকের মুখে চোখে তা প্রকাশ পেতই। শৌনক নিপুণ অভিনেতা নয়। সর্বোপরি বিয়ে ভাঙতে শৌনককে কেন সঙ্গে আনবে শৌনকের বাবা মা?

তাহলে?

বিজবিজ ভাবনাটা মাথায় নিয়েই ঘরদোর ঝাড়াঝুড়িতে হাত লাগিয়েছে তন্নিষ্ঠা। নন্দিতার হুকুম। নন্দিতাও মহা ব্যস্ত এখন। মেয়ের কাজকর্মে তার আস্থা কম, মেয়ে ডাস্টার বোলানোর পরও নিজের হাতে ঘষে ঘষে মুছছে সোফা ক্যাবিনেট শোকেস সেন্টার টেবিল। চোখটাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র করে ধূলিকণা খুঁজছে জানলার গ্রিলে, মেঝেয়। শুভেন্দু সকাল থেকে তিন বার দৌড়ল বাজারে। ভেট্‌কি মাছের ফিলে কিনে আনল, বার্গার আনল, পেস্ট্রি আনল, কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলও। অবশ্য কিছুই খাবেন না ডাক্তার সুকুমার রায়চৌধুরী, তবু প্লেট তো সাজাতে হবে। দুটো বেডরুমেরই চাদর পর্দা পাল্টে ফেলেছে নন্দিতা। বলা যায় না, যদি বীথিকাদি ঘরে ঢোকে। গৃহসজ্জার জন্য এসে গেল ফুল, ইয়া মোটা মোটা রজনীগন্ধা। হাইব্রিড। দেখতে ভারী মনোহর, তবে প্রায় গন্ধহীন।

রায়চৌধুরী পরিবার পৌঁছল কাঁটায় কাঁটায় নটা চুয়ান্নয়। সম্ভবত ওই রকমই যাত্রার যোগ ছিল আজ। সুকুমার ষাট ছুঁই ছুঁই, হাইট খুব বেশি নয়, কষা চেহারা, মাথায় একটা দুটো রুপোলি ছিট থাকলেও বাকি চুল এখনও কুচকুচে কালো। তুলনায় বীথিকা একটু বেশি শুভ্রকেশী, চেহারাটাও তার বেশ লম্বাচওড়া, সাজপোশাকে একটা আভিজাত্য আছে। নিয়মিত পার্লারে যায়। মুখমণ্ডলে তার ছাপ স্পষ্ট। পাকা চুলের অভিনব বিন্যাসেও।

বাবা মার পাশে শৌনক আজ সুবোধ বালক। লাল টুকটুকে টিশার্ট আর জিনসে তাকে ভারী বাচ্চা বাচ্চা দেখাচ্ছে।

শুভেন্দু দেঁতো হেসে আপ্যায়নে বসল। এলোমেলো টপিক নিয়ে গল্প জুড়েছে। আবহাওয়া বর্ষা অ্যান্টিবায়োটিক ম্যালেরিয়া দুর্নীতি রাজনীতি…

নন্দিতা রান্নাঘরে। ফ্রাই ভাজছে। তন্নিষ্ঠা মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছিল, তার মধ্যেই সুকুমারের হাঁক শুনতে পেল,—ব্যাপারখানা কী, অ্যাঁ? আপনারা গেলেন কোথায়?

তন্নিষ্ঠা তাড়াতাড়ি মাকে বলল,—তুমি যাও। আমি সব ঠিকঠাক করে নিয়ে আসছি।

—পারবি তো? ফ্রাইয়ের সঙ্গে কিন্তু সস্‌ দিস।

—হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। আমি কি একেবারেই অলবড্ডি?

খাবারের প্লেট সাজিয়ে কমলার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিল তন্নিষ্ঠা। নিজে এসেছে কোল্ড ড্রিঙ্কসের ট্রে নিয়ে। বসার আগে শৌনককে আর একবার টেরচা চোখে দেখল। তার নিজের পরনেও আজ টুকটুকে লাল পিওর সিলক্‌।

সুকুমার যথারীতি গাঁইগুঁই শুরু করেছে। অনেক সাধাসাধির পর শুধু ফ্রাইটুকু তুলে নিল। বীথিকার মিষ্টি বারণ, মিষ্টিতেই লোভ, পেস্ট্রিতে কামড় বসিয়েছে সে। শৌনক প্রায় এ বাড়িরই ছেলে, সে পুরো প্লেটই টেনে নিল কাছে। ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দিচ্ছে কোল্ড ড্রিঙ্কসে।

ফিশফ্রাই চিবোতে চিবোতে সুকুমার কাজের কথা পাড়ল,—বুঝলেন শুভেন্দুবাবু, আমার ছেলেটি তো আমাদের মহা ঝামেলায় ফেলে দিল।

—কেন? কী হল?

—ওই যে, চাকরিটা পেয়ে গেছে! ওই নিয়েই তো ঝঞ্ঝাট। ওকে জয়েন করতে হবে…টেন্টেটিভ্‌লি যা ঠিক হয়েছে, অগস্টের গোড়ায়…

নন্দিতা বলল, —হ্যাঁ, জানি তো। শৌনক বলেছে।

—ওটা নিয়েই তো…। কাল বাবুই ওর মার কাছে খুব কাঁই কাঁই করছিল। অগস্টে জয়েন করলে নভেম্বরে নাকি আর বিয়ে করতে আসতে পারবে না…। এলেও কোনও মতে তিন দিনের ছুটি নিয়ে উড়ে আসবে, উড়ে ফিরবে, ব্যস্‌। নামী কোম্পানি তো, ওরা বিয়ে টিয়েকে আমল দেয় না।

—ওটাই যে একমাত্র কারণ, তা নয়। বীথিকা ফিক ফিক হাসছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল, —কী রে বাবুই, আসল কারণটা বলব?

শৌনক কাঁধ ঝাঁকাল।

বীথিকা নন্দিতার দিকে তাকিয়ে বলল, —বাবুই তোমার মেয়েকে না নিয়ে কলকাতা ছেড়ে নড়তে রাজি নয়।

নন্দিতা এখনও পুরোটা বুঝতে পারেনি। বলল, —তো?

শুভেন্দু হেসে ফেলল, —বিয়েটা আপনারা এগোতে চাইছেন, তাই তো? …কিন্তু দাদা, আপত্তি তো আপনাদেরই…

—হ্যাঁ অ্যা। সুকুমার মাথা চুলকোল,—কিন্তু ছেলে এমন বায়না জুড়েছে…। ওর কথার অবশ্য যুক্তিও আছে। একা একা ওখানে ও খুব লোন্‌লিও ফিল করবে। …তাই আমি প্রায়শ্চিত্তের বিধানটার কথা ভাবছিলাম…

তন্নিষ্ঠা ক্রমশ হাঁ হয়ে যাচ্ছিল। শৌনকের মনে এই বাসনা ছিল, কই পরশুও তো একবারও বলেনি? চাপা একটা অস্বস্তিও হচ্ছিল তন্নিষ্ঠার। কেন অস্বস্তি?

সুকুমার বলে চলেছে, —আমাদের বাড়ির পুরোহিতের সঙ্গে কাল রাতেই টেলিফোনে কথা বলেছি। সে বলল, হয়ে যাবে। ষান্মাসিক কাজ তো করা হল, সেটাই তো অনেকটা অশৌচ খণ্ডে দিয়েছে। মোর দ্যান ফিফ্‌টি পারসেন্ট। সো উই ক্যান ফিক্স এ ডেট অ্যাট শ্রাবণ। সতেরোই জুলাই, সম্ভবত দোসরা শ্রাবণ পড়ছে, ওই ডেটটা আমার খুব পছন্দ।

নন্দিতা বলল, —মানে আর মাত্র দেড় মাস?

—খুব প্রবলেম হবে?

বীথিকা বলল, —ঘাবড়াচ্ছ কেন নন্দিতা? তোমার তো মোটামুটি আয়োজন সব করাই আছে।

শুভেন্দু বলল, —তা আছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বিয়েবাড়ি পাওয়া…! খাট টাটগুলোও এখনও অর্ডার দেওয়া হয়নি…!

নন্দিতা ঝটপট বলে উঠল, —বাড়ি নিয়ে খুব সমস্যা হবে না। ও বাড়ি যদি নাও পাই, অন্য বাড়ি নেব। তিন্নিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে, খাট আলমারি ফ্রিজ টিজ এখনই বুক করে দিলে দেড় মাসে কি পাব না?

—অ্যাই নন্দিতা, তুমি ওসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ কেন? আমি তো অন্য কথা ভাবছিলাম।

—কী বীথিকাদি?

—তুমি যদি ফার্নিচার আদৌ না কেনো…মানে এখান থেকে না কেনো…দিল্লিতে আমরা দুই বেয়ানে গিয়ে ওদের সংসার সাজিয়ে দিয়ে আসব। তখন তুমি ওখান থেকে যা প্রাণ চায় কিনো। মিছিমিছি এখান থেকে সব প্যাক করে পাঠাবে, তার ট্রান্সপোর্টেশান খরচা নেই? এটা বরং অনেক ইকনমিক হবে, প্র্যাকটিকালও হবে। দিল্লিতেও খুব সুন্দর সুন্দর ডিজাইন পাবে। বলতে বলতে তাকিয়েছে তন্নিষ্ঠার দিকে, —তুমি কী বলো, আমার আইডিয়াটা খারাপ?

তন্নিষ্ঠার শ্রবণেন্দ্রিয় প্রায় অসাড় হয়ে গেছে। কোনওক্রমে মাথা নাড়ল শুধু।

তন্নিষ্ঠার মুখ দেখে বীথিকার বুঝি সন্দেহ হল। জিজ্ঞেস করল, —তোমার কি শরীর খারাপ নাকি?

কষ্ট করে ঠোঁটে হাসি টানল তন্নিষ্ঠা, —না, মানে একটু…

সুকুমার বলল, —যাও, তুমি ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। এসব ট্রিভিয়াল কথায় তোমায় থাকতে হবে না।

তন্নিষ্ঠা উঠে পড়ল। বীথিকা ভুল বলেনি, সত্যিই শরীরটা কেমন যেন আনচান করছে, জিভ বিস্বাদ, পৃথিবী ধোঁয়া ধোঁয়া। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? শৌনকের সঙ্গে তার বিয়ে হবে এ তো জানা কথাই, হঠাৎ বিয়েটা এগিয়ে আসায় কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?

ঘরে এসে খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে সবে বসেছে তন্নিষ্ঠা, শৌনক হাজির। পর্দা টান করে দরজা একটু যেন ভেজিয়ে দিল। চেয়ার টেনে বসেছে পাশে। গোঁফ নাচিয়ে হাসছে, —বাবা মার সামনে আজ হঠাৎ লাজুকলতা বনে গেলে যে?

তন্নিষ্ঠা চেষ্টা করেও হাসতে পারল না। খাটের ওপর আলগা পড়ে থাকা তন্নিষ্ঠার হাতখানা হাতে তুলে নিল শৌনক।

মণিবন্ধে মৃদু চাপ দিল, —পালস্ বেশ ইর‍্যাটিক দেখছি? নার্ভাস লাগছে?

তন্নিষ্ঠার গলার কাছে কী যেন আটকে যাচ্ছে। শব্দ ফুটছে না।

শৌনকের ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসি, —বিশ্বাস করো, আমার ট্রু ফিলিংটা আমি মাকে জানিয়েছি। পরশু বাড়ি ফিরেই আমি ভেবে দেখলাম, তোমায় ছেড়ে দিল্লিবাস আমার পক্ষে অসম্ভব। এক দিনের জন্যও। সে তুমি আমাকে হ্যাংলা ভাবতে পারো, এনিথিং ভাবতে পারো…। মোর ওভার, আরও একটা চিন্তা আমায় মাথায় রাখতে হচ্ছে। কী বলো তো?

তন্নিষ্ঠা শুকনো চোখে তাকাল, —কী?

—হোয়াট উইল হ্যাপেন টু আওয়ার হানিমুন? কোম্পানি তিন দিনের ছুটি দেবে কি না তাই ভেবেই হৃৎকম্প হচ্ছে… তারা আমায় দশ দিনের জন্য উড়ে বেড়াতে দেবে? ইমপসিবল্‌। সো, বিয়েটা নভেম্বরে হলে হানিমুনটাই চৌপাট হয়ে যেত।

শৌনকের হাত থেকে হাতটা আলতো করে ছাড়িয়ে নিল তন্নিষ্ঠা। বলল, —হুঁ।

শৌনক চেয়ার আর একটু কাছে টানল। আরও ঘন স্বরে বলল, —তাহলে আমরা হানিমুনে যাচ্ছি কোথায়? নভেম্বরে তো কোনও প্রবলেম ছিল না, যেখানে ইচ্ছে যাওয়া যেত। কিন্তু শ্রাবণের ক্ষেত্রে জায়গা চুজ করা মুশকিল। জঙ্গল চলবে না, পাহাড় চলবে না..! অবশ্য পাহাড়ে যাওয়া যায়, পাহাড়ে বৃষ্টি খুব খারাপ লাগবে না। আমরা তো আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবও না, সাইট সিয়িংও করব না, কী বলো?

তন্নিষ্ঠা আবার ছোট্ট করে বলল, —হুঁ।

—কী হয়েছে তোমার বলো তো? খালি হুঁ হুঁ করছ কেন? এতক্ষণে চেতনা হয়েছে শৌনকের। তন্নিষ্ঠার থুতনি অল্প তুলে ধরল দু আঙুলে, —লুকিং সো অ্যাবসেন্ট-মাইন্ডেড?

ফস্ করে তন্নিষ্ঠা বলে ফেলল, —আমার দিল্লি যেতে ভাল লাগছে না।

—কেন? দিল্লি কী দোষ করল?

—আমার ইচ্ছে করছে না।

—অনিচ্ছের একটা কারণ তো থাকবে।

কারণটা যদি তন্নিষ্ঠাই ঠিক ঠিক বুঝত এই মুহুর্তে! শুধু টের পাচ্ছে একটা অচেনা দুঃখ কুনকুন করছে বুকে।

ঢোঁক গিলল তন্নিষ্ঠা, —দিল্লি গেলে আমার কলেজের চাকরির কী হবে?

—সে তো এখনও পাওনি।

—অগস্ট সেপ্টেম্বরেই তো ইন্টারভিউ। তন্নিষ্ঠা মরিয়া গলায় বলল।

—ও, এই জন্য মন খারাপ? ঝট করে উঠে তন্নিষ্ঠার নাকে নাক ঘষে দিল শৌনক, —এক্কেবারে বোকা মেয়ে। দিল্লি গেলে তোমার তো আরও ভালই। স্লেট ফ্লেট গুলি মারো, কোথায় রায়গঞ্জ, কি ধূপগুড়িতে চাকরি পাবে তার ঠিক আছে? ওখানে তোমার সারা দিন অখণ্ড অবসর, নেট ফেটে লড়ে যেও। দিল্লিতে আচ্ছা আচ্ছা টিউটোরিয়াল আছে, ওরা নোট দিয়ে তোমায় একেবারে চোস্ত বানিয়ে দেবে। আর নেট যদি নাও লাগে, কুছ পরোয়া নেই। টুসকি বাজালে দিল্লিতে স্কুলের চাকরি পেয়ে যাবে। এই তো আমার পিসতুতো বোন, আমারই বয়সী… বিয়ে করে দিল্লি গেল, এখানে কাঠ বেকার ছিল, ওখানে ড্যাং ড্যাং করে স্কুলে ঢুকে গেছে। সিক্স থাউজেন্ড প্লাস পায়। মন্দ কী বলো, হাতখরচা হিসেবে?

তন্নিষ্ঠা নিচু স্বরে বলল, —হুঁ, তা বটে।

—আরও একটা প্র্যাকটিকাল ব্যাপার আছে। এখানে না থাকার কী সুবিধে জানো? এখানে চাকরিটা জুটলেও তোমার ক্যাডাভারাস অবস্থা হতে পারে। ইউ নো মাই পিতৃদেব। তিনি কেমন গোঁড়া ধরনের লোক তুমি জানো? আমার মা এক সময়ে কলেজে চাকরি পেয়েছিল, বাবা অ্যালাও করেনি। বলেছিল ঘর সামলাও, ছেলেটাকে মানুষ করো…। অফ কোর্স বাবা এখন অনেক চেঞ্জড্‌ ম্যান। সম্বন্ধ করে ব্রাহ্মণ বদ্যি বিয়ে দিচ্ছে। শুধু তোমাকে আমার আর মার পছন্দ হয়েছে বলে। কালাশৌচটা পর্যন্ত ঝেড়ে ফেলল…। স্টিল, বিয়ের পরে পরেই তোমার চাকরি নিয়ে সুকুমার রায়চৌধুরী কী রিঅ্যাক্ট করবে প্রেডিক্ট করা কঠিন। তুলনায় দিল্লিতে তোমার টোটাল আজাদি। মাথার ওপর গার্জেনগিরি নেই, কেউ ফালতু জ্ঞান মারার নেই, তুমিও মস্তিতে চাকরি করবে, আমিও মস্তিতে চাকরি করব। শৌনক গাল টিপল তন্নিষ্ঠার, —আরে বাবা, আমি তোমাকে টোটাল স্বাধীনতা দিয়ে দেব। খুশি? এবার হাসো।

কী নিচ্ছিদ্র যুক্তি শৌনকের, কোনও ফাঁক নেই! সব সমস্যার সমাধান কী নিখুঁত ভাবে করে ফেলে শৌনক! কী উদারচেতা! কত অবলীলায় স্বাধীনতা দান করে দিল ভাবী স্ত্রীকে!

তন্নিষ্ঠা ম্লান হাসল। কিংবা হাসল না, শৌনকের ওরকমই মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে খুশিতে চলকে উঠেছে, —এই তো মেঘের কোলে রোদ হেসেছে!…এবার মুখ ফুটে বলো তো, কোথায় বুকিং করব? মেয়েরা তো বেশির ভাগ শুনেছি সি-সাইড লাইক করে, তুমিও কি সেই দলে ? বলো বলো বলো?

ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটা দিচ্ছে শৌনক, অসহায় সুপুরি গাছের মতো দুলছে তন্নিষ্ঠা। নিরক্ত স্বরে বলল, —এক্ষুনি জানাতে হবে?

—বললে ভাল হয়। তন্নিষ্ঠার কাঁধে হাত রাখল শৌনক। আকর্ষণ করছে কাছে। চোখে চোখ রাখল তন্নিষ্ঠার, —হানিমুন জীবনে এক বারই হয়। ফিরেই আমাকে আবার কাজে ডুবতে হবে। বিয়ের পর ওই আট দশটা দিনে আমরা পরস্পরকে চিনব, জানব…

দরজায় মৃদু করাঘাত। ত্রস্ত পাখির মতো নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তন্নিষ্ঠা।

নন্দিতার গলা শোনা গেল, —তিন্নি, ওঁরা চলে যাচ্ছেন।

তন্নিষ্ঠা দ্রুত খাট থেকে নামতে যাচ্ছিল, শৌনক নিচু গলায় বলল,—তুমি কিন্তু দু একদিনের মধ্যে আমায় জানিয়ে দাও। আমায় সেই মতো টিকিট কাটতে হবে, হোটেল বুক করতে হবে….। মোটামুটি ন দিনের ট্রিপ, বাই থারটিয়েথ্‌ আই শ্যাল লিভ ফর ডেল্‌হি। ফার্স্ট অগস্ট আমায় জয়েন করতেই হবে। উইদাউট ফেল্‌।

শৌনকরা চলে যাওয়ার পর উল্লাসে উদ্বেল হয়ে পড়েছে নন্দিতা। সঙ্গে সঙ্গে ফোন হয়ে গেল সেলিমপুরে, শর্মিলার সঙ্গে দশ মিনিট ধরে কলকল করল। এ ঘর ছুটছে, ও ঘর ছুটছে, বয়স যেন কমে গেছে বিশ বছর।

শুভেন্দু সোফায় বসে বড় বড় টান দিচ্ছে সিগারেটে। নন্দিতা ধপ করে বসল তার পাশে,—এই বেশ ভাল হল, না?

—হুম্‌। শুভস্য শীঘ্রম। কিন্তু এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে অনেক কাজ করতে হবে।

—প্রথমে আসল কাজটা করো। এক্ষুনি ভোপালে তোমার দাদা বউদিকে একটা চিঠি লিখে দাও। ওঁরা তো নভেম্বরের জন্য প্রিপেয়ারড্‌, এক্ষুনি খবর না পেলে দাদা হয়তো ছুটি ম্যানেজ করতে পারবেন না।

—চিঠি কেন, ফোন করব। আজ রাতেই।

—আমাকেও একটা করতে হবে, জামশেদপুরে।

—নেমন্তন্নর লিস্টটা কি আজই বসে করবে?

—হ্যাঁ, কার্ডও তো ছাপতে দিতে হবে। কেটারারটা কিন্তু তোমার রেসপন্‌সিবিলিটি।

—বাড়িও দেখছি। মধুবনের পাশে একটা আছে, ওটারও অ্যাকোমোডেশন বেশ ভাল। যদি আগের বাড়িতে ডেট অ্যাডজাস্টমেন্ট না করা যায়…

—হুঁ। অ্যাডভান্সের টাকাগুলো চোট যাবে। কী আর করা, বিয়েতে তো কত বাজে খরচই হয়।

—আমার টাকাটা এ মাসের মাঝামাঝি পাব। দু লাখ তোমায় দিয়ে রাখব….

—নাহ্, ওটা তোমার হাতেই থাক। তুমি খরচা কোরো। মোটা একটা ধাক্কা যাবে বিয়ের পর, এটা বুঝছ তো?

—হুম। আজকেই এস্টিমেটে বসতে হবে।….কমলা, ভাল করে গরম গরম এক কাপ চা খাওয়াও তো। যে মালগুলো পড়ে আছে তার থেকে একটা দুটো দাও….

একটা স্বপ্নিল পরিবেশ তৈরি হয়েছে ফ্ল্যাটে। নন্দিতা হেসে হেসে কথা বলছে শুভেন্দুর সঙ্গে, শুভেন্দু চুটকি রসিকতা করছে। হাসিতে হাসিতে মুখর হয়ে উঠেছে চার দেওয়াল। বিমোহিত চোখে তন্নিষ্ঠা দৃশ্যটা দেখছিল।

শুধু তন্নিষ্ঠার বিয়ে হবে বলে এতকালের বিভেদ মুছে গেল বাবা মার! এমনই একটা ছবিই তো কল্পনা করে এসেছে ছোটবেলা থেকে, তবু আজ তার মনে সুর বাজে না কেন?

তন্নিষ্ঠা নিঃসাড়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরছে, সকালটা হঠাৎ কেমন মলিন এখন। রাধাচূড়া গাছে ফুল ফোটার দিন ফুরিয়ে এল, মাটিতে ছড়িয়ে আছে শেষ হলুদ পাঁপড়ি।

তন্নিষ্ঠার বুকটা মুচড়ে উঠল সহসা। রাধাচূড়া গাছ আবছা হয়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছে। সেখানে এখন এক দাড়িঅলা যুবকের মুখ।

.

১২.

সুপ্রিয় খুটিয়ে খুটিয়ে সরকারি ফর্মখানা দেখছিল। চোখ ঘুরছে এ পাতায়, ও পাতায়। সবুজ ফাইল খুলে ঝলক পড়ল অভিমন্যুর ব্যালান্সশিট। ভুরু কুচকোচ্ছে।

সামনে উপবিষ্ট নিশ্চল অভিমন্যু আশঙ্কিত গলায় বলল,—কিছু ভুল আছে নাকি রে?

—নাহ্, ভুল কিছু নেই। সুপ্রিয় ইনকাম ট্যাক্সের ফর্মটা টেবিলে রাখল, —তুই কিন্তু ফালতু ফালতু বেশি ট্যাক্স দিচ্ছিস! প্রফিটের অ্যামাউন্টটা তিরানব্বই হাজার দেখাতে গেলি কেন?

—বারে, ওই অ্যামাউন্টই তো হয়েছে। ব্যালান্সশিটেও আমার তাই দেখানো আছে।

—তোকে তো বলেছিলাম ব্যালান্সশিটটা একটু অ্যাডজাস্ট করে নিস্‌। তোর কারখানার রেন্ট সাতশো টাকা, এটা স্বচ্ছন্দে দেড় হাজার শো করা যায়। যা হোক একটা রেন্ট বিল ধরিয়ে দিতিস, ওরা থোড়াই চেক করতে আসত! প্রিন্টিং স্টেশনারিটাও একটু এদিক ওদিক করলে….মেটিরিয়ালসটা তো করাই যায়।…কনভেন্সটাও তুই ইজিলি আরও পাঁচ সাত হাজার…..

—এই দাঁড়া দাঁড়া। ওসব ছোটখাটো চুরিচামারি করার জন্য কি নেমেছি ব্যবসায়? এতে মনটা নিচু হয়ে যাবে না? অভিমন্যু দাড়িতে হাত বোলাল,—রোজগার হয়েছে, কটা টাকা নয় ট্যাক্স দেব।

—তুই শালা ট্যাক্স দিয়েই মর। গভর্নমেন্ট তোকে ট্যাক্সরত্ন উপাধি দেবে। সুপ্রিয় হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল,—যাই রে। নটা বাজল…

—আমিও উঠছি। কারখানায় একটা ঢুঁ মেরে ব্যাম্বুভিলায় ছুটব।

—যা, শালা যা। ব্যাম্বু খা।

হাসতে হাসতে অভিমন্যু ফাইলপত্র গোছাচ্ছিল, হাঁ হাঁ করে ছুটে এসেছে মালবিকা। হাতে চায়ের কাপ, ওমলেটের প্লেট। উচ্ছল সুরে বলল,—আরে বসুন বসুন। এই ব্যালেন্সশিটের সুবাদে তাও আপনার মুখ দেখা গেল। আমাদের ওপর আপনার কেন এত অ্যালার্জি বুঝি না বাবা!

—ছি ছি, অ্যালার্জি কেন হবে!….একদম সময় পাই না।

—এত কীসের সময়ের অভাব ? আপনি তো আপনার বন্ধুর মতো টাইমের বাবু নন!

সুপ্রিয় উঠে পড়েছে। মালবিকাকে কী একটা ইশারা করছিল, সঙ্গে সঙ্গে মালবিকা কটকট করে উঠল,—বলতে হবে না স্যার, মা তোমার ভাত বাড়ছেন। আর হ্যাঁ, মনে করে আজ বাবার চশমাটা নিয়ে যেও। ডাঁটি ভেঙে গেছে বলে বাবা বেচারার পড়াশুনো বন্ধ হয়ে গেছে…

—ব্রিফকেসে দিয়ে দাও। প্রত্যুষ আজ ব্যাংকে আসবে, ওর সঙ্গে ধর্মতলায় যাব, তখনই….

—মাথায় রেখো, তাহলেই হবে। বাবা সারা সন্ধে মুখ হাঁড়ি করে বসে থাকবেন, আমার একটুও ভাল লাগে না।

অভিমন্যু চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিটিমিটি হাসছিল। কদিনেই পাকা ঘরনী হয়ে উঠেছে মালবিকা। বিয়ের আগে সুপ্রিয়া বেশ উড়ু উড়ু ছিল, সিনেমা থিয়েটার ফাংশান দেখে বেড়াত খুব, এখন অনেকটা ঘরমুখো হয়েছে। মালবিকার গুঁতোয়। মালবিকার রুচিবোধও আছে বেশ। সুপ্রিয়দের এই প্রকাণ্ড বাইরের ঘর আগে ন্যাতাপ্যাতা হয়ে থাকত। সম্ভবত সুপ্রিয়র মা একটু কুঁড়ে ধরনের মহিলা বলেই। এখন সোফারা সমকোণে, সেন্টার টেবিল সাইড টেবিল তকতক করছে, সাবেকি স্ট্যান্ডল্যাম্প দুটোর পুরনো ঢাকনিরও বদল ঘটেছে, কোণের বনেদি মিনে করা ফুলদানিতে পুষ্প সমারোহ, কাচের আলমারির পুতুলগুলো পর্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো। দিব্যি লক্ষ্মীশ্রী এসেছে ঘরে।

সুপ্রিয় স্নানে যাওয়ার পর গুছিয়ে বসেছে মালবিকা। উদ্বিগ্ন মুখে বলল, —সুপ্রিয় বলছিল আপনার মার নাকি শরীরটা খারাপ?

—হুঁ, প্রবলেম হচ্ছিল। এখন বেটার।

—কাকে দেখাচ্ছেন?

—এই তো, বেহালাতেই বসেন। ডক্টর পাকড়াশি।

—আমার বাবার একজন সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধু আছেন, যদি চান তো একবার দেখিয়ে নিতে পারেন।

—বলব দরকার হলে। অভিমন্যু প্রসঙ্গটা থেকে সরতে চাইল। সচেতন আলগা গলায় বলল, —তোমার বন্ধুদের সব কী সমাচার? পর্ণা আঁখি….

কথাটা শেষ করতে পারল না অভিমন্যু, মালবিকা হই হই করে উঠেছে, —ওমা, কী ঝামেলা হয়ে গেছে জানেন না? আমার দুই বন্ধুর বিয়ে এক দিনে পড়ে গেল। শ্রাবণে।

—তাই নাকি?

—কোনও মানে হয়, বলুন? পর্ণার তো জুলাইতে ঠিকই ছিল, তনুরটা কেন যে দুম করে এগিয়ে আনল! আমরা এখন কোনটা ছেড়ে কোনটায় যাই?

অভিমন্যুর চা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, কোনও গতিকে সামলাল। প্রাণপণে স্বর অচঞ্চল রেখে বলল, —তন্নিষ্ঠার অগ্রহায়ণে বিয়ে হওয়ার কথা না?

—তাই তো কথা ছিল। ওর শ্বশুর পালটি খেয়ে গেছে। সুপ্রিয় বিয়ের রাতে বলল না, প্রায়শ্চিত্ত করার কথা, সেটাই করছে। তাই যদি করবি, তাহলে বৈশাখেই করতে পারতিস।….শৌনক নাকি দিল্লিতে চাকরি পেয়েছে, তাই এই তাড়াহুড়োর ধুম।

বুকের ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল অভিমন্যুর। যেন একটা হু হু তেপান্তরের মাঠ। দিন দশেক আগেও তন্নিষ্ঠা এসেছিল তার কারখানায়, সদ্য জ্বর থেকে উঠেছে, মুখখানা ভারী শুকনো লাগছিল। কত কী এলোমেলো গল্প করল, সেদিন তো কিছু বলল না?

মালবিকা মাথা দোলাচ্ছে,—তনুটা বজ্জাতের ধাড়ি হয়ে গেছে, কাউকে ফোন করে জানায়নি। বাইচান্স সেদিন কোয়েল শেখররা ওর বাড়ি গিয়েছিল…

অভিমন্যুর আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না। কী নির্বোধের মতো মুখটাকে হাসি হাসি করে রাখতে হচ্ছে! অসহ্য।

মালবিকার কথার মাঝেই অভিমন্যু দুম করে বলে উঠল,—আজ আমি চলি। একটু তাড়া আছে।

—আপনার শুধু তাড়া….! পারেনও বটে। মালবিকা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল অভিমন্যুকে,—আবার আসবেন কিন্তু, আপনার কিন্তু আপনার বন্ধু যা কর্মবাগীশ! সময় পায় না। আপনার সঙ্গেই যাব একদিন মাসিমাকে দেখতে।

আবছা হাত নেড়ে হনহনিয়ে হাঁটা দিল অভিমন্যু। সিগারেট বার করল, লাগিয়েছে ঠোঁটে, পকেট হাতড়াচ্ছে, দেশলাই নেই। অসহ্য। রাস্তায় ফেলে দিল সিগারেট, পা দিয়ে দিয়ে পিষছে, ছেতরে যাওয়া তামাক মিশিয়ে দিচ্ছে পথের কাদায়। তন্নিষ্ঠা বলল না কেন? অভিমন্যুর দুর্বলতাটা টের পেয়ে গিয়েছিল কি? মজা করতে আসত?

পিঠে আলগা চাপড়। চমকে ফিরল অভিমন্যু। ননী সেন। উজ্জ্বল হাসিমাখা দাঁতগুলোকে ছ্যাৎলা পড়া লাগছে আজ।

ননী সেন বলল,—মেসোমশায়ের পেনশানের কেসটা কদ্দূর রে?

অভিমন্যু কেটে কেটে বলল,—কদ্দূর আবার কী? হয়নি।

—জানতাম হবে না। কত বার করে মেসোমশাইকে বললাম আমার সঙ্গে সুবোধদার কাছে চলুন, রোজই মেসোমশাই আজ না কাল করে কাটিয়ে দিচ্ছেন। আরে বাবা, ঠিক লোককে ধরতে না পারলে তাড়াতাড়ি কাজ হয়? সুবোধদা একবার ফোন তুলে বলবে, ওমনি হুড়হুড়িয়ে পেনশন বেরিয়ে যাবে।

নেতার টেলিফোন কি সাপোজিটারি? পেনশন কি মল?

অভিমন্যু রুক্ষ স্বরে বলল,—বাবাকে আমিই বারণ করেছি।

ননী থমকাল একটু,—আমার আর মেসোমশাই-এর মধ্যে কথা হয়েছে, তার মাঝে তুই নাক গলাতে গেছিস কেন?

—কারণ, তোমার মেসোমশাই আমার বাবা। অভিমন্যু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,—তোমাদের ওই সাপ হইয়া দংশাও ওঝা হইয়া ঝাড়ো, এই নীতিটাকে আমি ঘেন্না করি। ওই সুবোধবাবুরাই একদিন কাগজে বিবৃতি দেয়নি, যারা ষাটের বদলে পঁয়ষট্টির অপশন দিচ্ছে তাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে? এখন তাদেরই পায়ে পড়ে বাবাকে পেনশান জোটাতে হবে? ওরকম পেনশানে আমি পেচ্ছাপ করি। বাবাকে দু মুঠো ভাত জোগানোর পয়সা অভিমন্যু মজুমদারের আছে।

অতর্কিত আক্রমণে মুহূর্তের জন্য থতমত ননী সেন, পরক্ষণেই চোখ লাল,—খুব চালবাজি বেড়েছে, অ্যাঁ? খুব রোয়াব, অ্যাঁ?…জানিস তোর ওই কারখানা আমি তিন ঘণ্টায় তুলে দিতে পারি?

—যাও যাও, ওসব রুস্তমি তুমি ভেড়াদের ওপর ফলিও।

চারপাশে ভিড় জমছে। ননী সেনের চ্যালাচামুন্ডারাও উদিত হচ্ছে একে একে। সব চেনা মুখ, বেকার ছেলে, লুম্পেনে পরিণত হচ্ছে, আপাতত ননী সেনের ক্রীড়নক। ননী সেন একবার লু বললেই শেকল ছেঁড়া কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে সকলে।

ননী অবশ্য রাগ বশে এনে ফেলল। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, —নিজের ভাল পাগলেও বোঝে অভি। তুই বুঝিস না।

—বুঝতে চাইও না। অভিমন্যু মাথা ঝাঁকাল,—দয়া করে তোমার উপকার করার উপদ্রবগুলো কমাও।

—তাই হবে। আমারই বোঝা উচিত ছিল তোদের ফ্যামিলির স্ক্রুটা ঢিলে আছে।

জ্বলন্ত চোখে ননী সেনকে একবার দেখে নিয়ে দুপদাপ হাঁটতে শুরু করল অভিমন্যু। বাড়ির সামনে দিয়ে খ্যাপা মোষের মতো চলে গেল, ফিরেও তাকাল না। তেপান্তরের মাঠে হাওয়া বইছে সাঁই সাঁই। ঠাণ্ডা হাওয়া, বরফের মতো শীতল। এত ঠাণ্ডাতেও কী করে যে বুকের ভেতরটা পুড়ে যায়!

অফিস ঘরে ঢুকেই হাতের ফাইল টেবিলে আছড়ে ফেলল অভিমন্যু। চেঁচাচ্ছে,—গোবিন্দ, অ্যাই গোবিন্দ?

গোবিন্দ কারখানায় এসেছে এইমাত্র। ধরাচুড়া ছেড়ে কাজের পোশাকে বদলাচ্ছিল নিজেকে, দৌড়ে এল,—কী হয়েছে অভিদা?

—স্যাম্পল জারটা নিয়ে আয় তো।

—কোন জারটা?

—ওই তো, কোণেরটা। যে নতুন পারফিউমটা বানাচ্ছিলাম…

গোবিন্দ জারটা আনতেই ঢাকা খুলে একবার শুঁকল অভিমন্যু। মুখটা ক্রমে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।

হুকুম ছুঁড়ল,—যা, এটা বাইরের নর্দমায় ঢেলে দিয়ে আয়।

গোবিন্দর চোখ কপালে,—কী বলছেন অভিদা? কদ্দিন ধরে এটা বানাচ্ছেন…!

—তাতে তোর কী? যা বলছি কর। ফেলে দিয়ে আয়।

গোবিন্দ তবু ইতস্তত করছে। অভিমন্যু ধমকে উঠল,—কথা কানে যাচ্ছে না?

গোবিন্দ আবার মিনমিন করে বলল,—অভিদা, আর একবার ভেবে দেখুন। ফেললে তো চুকেই গেল…

—ফের তর্ক? ঢেলে দিয়ে এসে কালকের কাজগুলো দেখা।

জার শূন্য করে ফিরেছে গোবিন্দ। বাক্স বোঝাই পারফিউম এনে রাখল টেবিলে। অভিমন্যু একটা একটা শিশি বার করছে বাক্স থেকে, টেনে টেনে দেখছে সিল্‌ করা ক্যাপ। দুটো সিল খুলে এল, সঙ্গে সঙ্গে গর্জন,—এটা কী ধরনের কাজ হচ্ছে, অ্যাঁ? আমাকে ডোবানোর মতলব?

গোবিন্দর মুখ কাচুমাচু হয়ে গেছে,—বিশ্বাস করুন অভিদা, কাল মেশিনটা একটু…

—কাউকে বিশ্বাস করি না, কাউকে বিশ্বাস করি না। বেইমানের ঝাড় সব। যাকে যত বিশ্বাস করব, যার কথা যত ভাবব, সেই তত সর্বনাশ করবে।

—আমি এক্ষুনি আবার করছি। গোবিন্দ বাক্সগুলো তুলে দৌড়ে ও ঘরে চলে গেল।

ঘটাং ঘটাং আওয়াজ করে আলমারি খুলল অভিমন্যু। গোটা তিনেক বক্স ফাইল বার করল। কাগজপত্র উল্টোচ্ছে। মাথাটাকে বাগে আনতে চাইছে প্রাণপণ, পারছে না, কোত্থেকে যেন বুনো ঘোড়ার রক্ত ঢুকে পড়েছে শরীরে, দাপাদাপি করছে শিরায় উপশিরায়।

হুড়মুড়িয়ে রনি আর টুম্পা ঢুকল অফিসঘরে,—অভিদা অভিদা, কালকের কথা মনে আছে তো?

রনি টুম্পা বিজ্ঞানমঞ্চের দুই উৎসাহী সৈনিক। সদ্য ফার্স্ট ইয়ার।

চোখ সরু করে তাকাল অভিমন্যু,—কী কথা?

—বা রে, বলেছিলাম না, কাল অবনী পাঠাগারে লৌকিক অলৌকিকের ওপর সেমিনার আছে? একজন জ্যোতিষীও আসছে, জানো তো? মিহিরাচার্য। অ্যাসট্রোলজিকাল সোসাইটিতে ক্লাস নেয়…..! টুম্পা কলকল করে উঠল, ওকে কিন্তু কাল খুব কড়া করে টাইট দিতে হবে। তুমি ছটায় পৌঁছে যেও।

অভিমন্যু তেতো মুখে বলল,—আমি যাব না। তোরা অন্য কাউকে দ্যাখ্‌।

—সে কী! তুমি ছাড়া হয় নাকি?

—হয় হয়, সব হয়। কারুর জন্য কিছু বসে থাকে না। তোরা কেউ সেমিনারে বল।

—কোথায় তুমি, কোথায় আমরা! টুম্পা মিনতির সুরে বলল,—অভিদা প্লিজ….

—আহ্‌, কেন বিরক্ত করছিস? বলছি তো আমি যাব না।

রনি অবাক চোখে তাকাল,—তুমি কথা দিয়ে কথার খেলাপ করবে অভিদা?

—কথা দিয়েছি বলে কি দাসখত লিখে দিয়েছি নাকি? আমার নিজের কাজ নেই? ব্যবসা নেই? ধান্দা নেই? বিশ্বসংসারে কে কোন বুজরুকিতে বিশ্বাস করল তাতে আমার কী এসে যায়?

টুম্পা রনিকে চাপা স্বরে বলল কী যেন। ফার্স্ট ইয়ারের দুই তরুণ তরুণী নীরবে বেরিয়ে যাচ্ছে, অভিমন্যুর দিকে তাকাতে তাকাতে।

দুজনের স্তম্ভিত দৃষ্টি তিরের মতো বিঁধছিল অভিমন্যুকে। ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। ঠেলে সরিয়ে দিল বক্স ফাইল। সেলস্‌ম্যানের জন্য বিজ্ঞাপনের একটা মুসাবিদা করেছিল, হিংস্র আক্রোশে কুচিয়ে কুচিয়ে ছিঁড়ল। সমীরণ নর্থবেঙ্গল ট্যুর সেরে এসেছে, কাল একটা রিপোর্ট মতন লিখে রেখে গেছে অফিসে, কাগজটা ফেলে দিল দলা পাকিয়ে। কপাল টিপে ধরেছে।

বিড়বিড় করছে নিজের মনে,—হুঁহ্‌, কথা! কথা দেখাচ্ছে। এই দুনিয়ায় কে কার কথা রাখে? কে কার কথা বোঝে? কে শোনে?

মালতী উঁকি দিচ্ছে ঘরে। বোধহয় দরকারি কথা আছে কিছু। হেঁকে উঠল অভিমন্যু—কী চাই?

ত্রস্ত পায়ে পালিয়েছে মালতী।

অভিমন্যু আবার রগ টিপে ধরল। হৃৎপিণ্ড দ্রুত ওঠানামা করছে তার। আগুন ছুটছে নিশ্বাসে। আচমকাই ননী সেনের শেষ কথাগুলো আছড়ে পড়ল মস্তিষ্কে।

একী! হল কী অভিমন্যুর? অভিমন্যু কি উপমন্যু হয়ে যাচ্ছে?

.

১৩.

নির্মলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কলেজের করিডোর ধরে হাঁটছিল শুভেন্দু। চারটে বাজে, এর মধ্যেই কলেজ প্রায় শূন্যপুরী। অনেক ঘরেই তালা পড়ে গেছে, একটা দুটো ক্লাসরুমে অনার্সের ছেলেমেয়েদের কিচির মিচির।

কলেজের গেটে এসে থামল নির্মল। নাটুকে ভঙ্গিতে বলল,—তাহলে আমাদের যাত্রা হল শুরু?… এখন ওগো কর্ণধার…

শুভেন্দু হেসে ফেলল,—ঠাট্টা রাখো। আমি কর্ণধার টার নই। আমরা বাসবেন্দ্রর মতো করে গ্রুপ চালাব না। আমিও যতখানি, তুমিও ততখানি।

—কিন্তু সময়টা তো তুমিই বেশি দিতে পারবে হে। শুভেন্দুর আপাদমস্তক জরিপ করল নির্মল,—তোমার আজ যা উৎসাহ দেখছি….আমি শুধু ঠেকা দিয়ে গেলেই হবে।

—এই চিন্তাটাই ক্ষতিকর। আমাদের ইনভলভ্‌মেন্টে ফাঁক ছিল বলেই না বাসবেন্দ্র আজকের বাসবেন্দ্র হয়ে গেল! লোকে যে আজ বাসবেন্দ্রর সমিধ বলে, এতে কি আমাদের ত্রুটি নেই?…..তুমি বুকে হাত দিয়ে বলো।

—হা হা। রসিকতাও বোঝ না?

দুই বন্ধু নেমে পড়েছে রাস্তায়। পায়ে পায়ে কলেজ স্ট্রিট মোড়ের দিকে। কাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছিল, ফুটপাতের ধার ঘেঁষে এখনও তার চিহ্ন বর্তমান। আকাশে আজও মেঘ আছে বটে, তবে নীলও আছে। চড়া নীল।

নির্মল যেতে যেতে বলল,—এক্ষুনি এক্ষুনি আমাদের ঘর নেওয়ার দরকার নেই, বুঝলে। আপাতত রিহার্সালটা আমার বাড়িতেই শুরু করা যাক।

—তোমার ছেলেমেয়ের অসুবিধে হবে না?

—পুজো পর্যন্ত টেনে দেওয়া যাবে। ইতিমধ্যে তুমি সাউথের দিকে খোঁজ খবর করো, আমি শ্যামবাজার বাগবাজারটা দেখছি।…। মাস চারেকের মধ্যে ছ সাতশো টাকায় একটা ঘর জোগাড় করতে পারব না, কী বলো? আমাদের তো ফারনিশড্‌ ফ্ল্যাট লাগবে না! একটা মোটামুটি বড় ঘর, মাথার ওপরটা ঢাকা, চারপাশে দেওয়াল আছে…প্লাস, বড়জোর একটা বাথরুম।

—হুঁ, পেয়ে যাব মনে হয়।

—তাহলে বিশ্বজিৎ সুকান্তদের খবর দিই? বিশাখাকেও? তুমি একদিন নাটকটা পড়ো, মেরিটস্‌ ডিমেরিটস্‌ নিয়ে আলোচনা হোক।…কবে নাগাদ বসবে? বাই এন্ড অব জুলাই?

—এত দেরি?

—বাহ্, মাঝে তোমার মেয়ের বিয়ে আছে না?

—তিন্নির বিয়ের সঙ্গে নাটককে জড়াচ্ছ কেন? শুভেন্দু পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল,—একটা ইভেন্ট শেষ না হলে আর একটা প্রসেস শুরু করা যাবে না, এ ভাবনাটা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। মাঝে হয়তো কদিন আমি আসতে পারব না, হয়তো বসাটা কদিন কম হবে….। কিন্তু অপেক্ষা করে থাকাটা আমার মনঃপূত নয়।

—তুমি যে দেখি টগবগ করে ফুটছ হে! কদিন আগে তো পুরোপুরি দ মেরে ছিলে! তোমার এই ট্রান্সফর্মেশানটা ঘটল কী করে, অ্যাঁ?

—ট্রান্সফর্মেশান নয়, বলো সেলফ্‌ রিয়্যালাইজেশন। আত্মোপলব্ধি। যেদিন শেষ অফিস করে ফিরলাম, সেদিন রাতে অনেক যুদ্ধ করলাম নিজের সঙ্গে। লাস্ট ব্যাট্‌ল্‌। বার বার নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, কী চাও শুভেন্দু? কাল থেকে কী ভাবে জীবনযাপন করবে? অ্যান অ্যানিম্যাল লাইফ, অর এ হিউম্যান লাইফ?… কনফিডেন্সের অভাব তো ছিলই, কিন্তু প্রশ্নগুলোই আমাকে এই নিয়তির দিকে ঠেলতে লাগল…

—আসল কথা বলো না, নাটককে তুমি সত্যিই ভালবাস!

—জানি না ভাই। হয়তো বাসি। শুভেন্দু সামান্য উদাস,—বার বার সেদিন খুব চ্যাপলিনের কথা মনে পড়ছিল। সেই যে, লাইমলাইটের সেই বুড়ো ক্লাউন….! বলেছিল, আই হেট্‌ ব্লাড, বাট ইটস্ ইন্‌ মাই ভেইনস্! সত্যিই ভাই। ওই চড়া আলোর নীচে মেকআপ নিয়ে দাঁড়ানোর নেশা একবার যাকে ধরে ফেলে, তার আর মুক্তি নেই। তুমিও তো মানো এ কথা। আমার ঘৃণা ভালবাসায় আর কিচ্ছু আসে যায় না। নাটক আমার মজ্জায় মিশে গেছে।….তোমারও।

নির্মলের মুখের হাল্‌কা ভাবটা উধাও। লম্বা বাতাস ভরল ফুসফুসে, ধীর লয়ে ছাড়ল। একটুক্ষণ নীরব হাঁটল পাশাপাশি।

হঠাৎই অনুচ্চ স্বরে প্রশ্ন করল,—নন্দিতা জানে তুমি আবার গ্রুপ গড়ছ?

—জেনে যাবে।

—ওর কী রিঅ্যাকশান?

—কীসের?

—তোমার এই সমিধ থেকে বেরিয়ে আসা…? নাটক ছেড়ে অ্যাদ্দিন বসে রইলে…..?

—নাটক ছাড়াটাও বোধহয় পুরোপুরি মন থেকে মানতে পারেনি। সামথিং ইজ প্রিকিং হার।

—কিছু বলেছে তোমায়? নির্মল আরও গলা নামাল।

—মেজাজই করছিল, তবে সুরটা যেন একটু অন্য রকম। শেষ টান দিয়ে সিগারেটের টুকরোটা টোকা দিয়ে রাস্তার ধারে ফেলল শুভেন্দু। বলল, — আমাদের সম্পর্কটা এখন কেমন জান নির্মল? কোনও চেনা গলিতে তুমি বহু বহু বছর পর গিয়েছ কোনওদিন? কেমন ফিলিং হবে আন্দাজ করতে পারো? মনে হবে না, চিনি চিনি, কিন্তু যেন পুরো চেনা নয়? অনেক কিছু স্মৃতি থেকে মুছে গেছে…আবার কিছু আছেও পড়ে, ছড়ানো ছেটানো?…আমার আর নন্দিতার রিলেশানটাও এখন ওই রকম। আমি ঠিক ওকে বুঝতে পারি না।

নির্মল ঝলক তাকিয়ে দেখল শুভেন্দুকে। হাসল আলগা, বুঝি বা বন্ধুকে একটু নির্ভার করতে চাইল। বলল,—অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক এখনও একটা আছে?

—হয়তো আছে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না।… তিন্নির বিয়েটা হয়ে গেলে হয়তো আবার একটু চেনাজানা হবে, কিংবা হয়তো আরও দূরের মেরুতে সরে যাব…

কলেজ স্ট্রিট পার হয়ে গেছে দুজনে। মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে এগোচ্ছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকে। কাছেই অধ্যাপক সমিতির অফিস, নির্মল দাঁড়িয়ে গেল,—আমাকে আজ এখানে একটু হাজিরা দিতে হবে। তুমি আসবে সঙ্গে?

—নাহ্, চলি।

—যাবে কোথায়?

—আপাতত পাতাল প্রবেশ।

—মর্তে উঠবে কোথায়? টালিগঞ্জে?

—না, কালীঘাট। এক আর্টিস্ট বন্ধুর কাছে যাওয়া দরকার। তিন্নির বিয়ের কার্ডের ডিজাইন করে দিচ্ছে। যাই, গিয়ে তাগাদা লাগাই।

সন্ধের আগেই রাসবিহারী পৌঁছে গেল শুভেন্দু। ইন্দ্রনাথের বাড়ি গিয়ে হতাশ। নেই ইন্দ্রনাথ। কাল শান্তিনিকেতন গেছে, সোমবার ফিরবে। বিয়ের মাসখানেকের ওপর বাকি, তবু শুভেন্দু সামান্য ভাবিত হল। নন্দিতা যা টেনশান করছে, এখন প্রসন্ন মুডে থাকে বটে, কিন্তু চটতে কতক্ষণ!

বাসস্টপের দিকে পা বাড়াচ্ছিল, চকিতে আর একটা কাজের কথা মনে পড়েছে। ধনঞ্জয়ের কাছে যেতে হবে একবার। রন্টুর সঙ্গে বসে বসে সেদিন হিসেব করছিল নন্দিতা, নিমন্ত্রিতের সংখ্যা হু হু বাড়ছে, ধনঞ্জয়কে আগে ভাগে জানিয়ে দেওয়া উচিত।

ধনঞ্জয় শুভেন্দুর কলেজের সহপাঠী। ডেকরেটিংয়ের পারিবারিক বিজনেস আছে, কেটারিংটা চালু করেছে ধনঞ্জয়ই। এই লাইনে বছর কুড়ি হয়ে গেছে ধনঞ্জয়ের, বাজারে তার যথেষ্ট সুনাম।

লেকমার্কেটের পিছনে ধনঞ্জয়ের গোডাউন কাম অফিস। ধনঞ্জয় অফিসেই ছিল, শুভেন্দুকে দেখে তার মুখে এক গাল হাসি,—কী রে, আইটেম আবার পাল্টাতে এসছিস্ তো?

শুভেন্দু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বসল,—না, তা নয়…। তোকে নিমন্ত্রিতের সংখ্যা কত বলেছিলাম মনে আছে?

—দুশো পঁচাত্তর।

—ওটা সওয়া তিনশোয় পৌঁছে গেছে। আরও বাড়তে পারে।

—জানি। আমার সাড়ে তিনশো ধরাই আছে। এগ্‌জ্যাক্ট নাম্বারটা বিয়ের সাত দিন আগে আমায় বলে দিস। ধনঞ্জয় সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল, নেব না নেব না করেও নিল শুভেন্দু। ধনঞ্জয় নিজেও একটা ধরিয়েছে। চোখ টিপে বলল,—তোর গিন্নি জীবনে যত লোকের বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়েছে তাদের প্রত্যেককে ইনভাইট করতে চায়, তাই তো?

—তুই কী করে জানলি?

—ওটা জানাই তো আমার পেশা। বাঙালি এই সব অনুষ্ঠানের সময়ে এমন কাছখোলা হয়ে যায়…! অবশ্য না হলে আমার ব্যবসাই বা কী করে বাড়বে বল?….কিছু মনে করিস না, বিয়ের এক মাস আগে যারা হেড বলে যায়, তাদের প্রায় সবারই কেস এক রকম।

শুভেন্দু আবার মাথা চুলকোল,—আর একটা কথা ছিল রে।

—বলে ফ্যাল্‌।

—আমার শালার বউ বলছিল চিকেন বাটার মসালা না করে চিকেন রেশমি কাবাব করা যায় না?

—তোর শালার বউ যখন বলেছে, নিশ্চয়ই যায়। তবে মাইন্ড ইট, লোকে কিন্তু অনেক বেশি টানবে।

—অর্থাৎ মিটারও চড়বে?

—আরে দূর, তোর সঙ্গে আমার কীসের ব্যবসা!…প্লেট পিছু তোর নাইনটি থ্রি ধরা আছে, ওটা তুই পুরো একটা পাত্তি করে দিস।

—একটু বেশি হয়ে গেল না?

—অন্য কেউ হলে একশো পঁচিশ নিতাম। দু রকম মাছ, চিকেন,…মাছ আবার যে সে নয়, আমি দিশি ভেটকিই দিই। আইসক্রিম আছে…সঙ্গে তোর সকালের খাওয়া দাওয়া…

শুভেন্দুর একটু খারাপ লাগল। মুখে ধনঞ্জয় যতই বন্ধু বন্ধু করুক, ব্যবসায়ে সে একেবারে পাক্কা প্রফেশনাল। হয়তো এটাই জীবনে সফল হওয়ার প্রথম শর্ত। এই নিরাবেগ দৃষ্টিভঙ্গি যদি শুভেন্দু পেতে পারত কোনওদিন!

ধনঞ্জয়ের কাছে বেশিক্ষণ বসল না শুভেন্দু। চা বিস্কুট আনিয়েছিল ধনঞ্জয়, খেয়েই বেরিয়ে পড়ল। মনে মনে গণনা করতে করতে চলেছে। শৌনকদের বাড়ি থেকে বরযাত্রী বলেছে মোটামুটি ষাট, ওটাও যদি গোটা দশ পনেরো বাড়ে…. তিন্নি এখনও বন্ধুদের লিস্ট ফিস্ট কিছু দেয় নি, নন্দিতা বলছিল ওটা বোধহয় জনা পঁচিশ মতো হবে….

হঠাৎ সামনে একটা বচসা শুনে শুভেন্দুর আটকে গেল। পরিচিত গলা! পিল্লাই না? ফুটপাতের সবজিঅলার সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া করছে?

আস্তে করে পিল্লাইয়ের পিঠে টোকা দিল শুভেন্দু,—কী হল? অত রাগারাগি করছ কেন?

আচমকা শুভেন্দুকে দেখে উত্তেজিত পিল্লাই পলকের জন্য ঠাণ্ডা হয়েও চড়ে গেছে,—লুক, লাস্ট থারটিফোর ইয়ারস্ আমি ক্যালকাটায় আছি, আর এ লোকটা আমাকে ঠকাচ্ছে!

—কেন? হলটা কী?

—কাল আমি লঙ্কা নিয়ে গেছি শ’ গ্রাম আড়াই টাকা, আজ বলে কি না দেড় টাকা? এক দিনে এক টাকা বেড়ে গেল? আবার বলে আমি নাকি বাংলা বুঝি না! দাম নাকি কমে গেছে! বলেই লোকটার দিকে ফিরে হাত ছুড়ছে,—আমি তোমাকে আড়াই টাকার এক পয়সা বেশি দেব না…

শুভেন্দু ব্যাপারটা বুঝে গেছে। হা হা হাসল। গলা নীচের সা-তে নামিয়ে পিল্লাইকে বলল,—তুমি আড়াই টাকাই দাও। বলতে বলতে সবজিঅলার দিকে ফিরছে,—বাবু যা বলছে, তাই নে। কোনও কথা নয়।

একটা এক টাকার কয়েন আর একটা আধুলি সব্‌জিঅলার হাতে গুঁজে দিয়ে বিজয়গর্বে সরে এল পিল্লাই। ঢক ঢক মাথা নাড়ছে,—ভাগ্যিস তুমি এসে গেলে দাস্‌গুপ্তা, নইলে আমায় আরও কতক্ষণ চিল্লাতে হত…!

শুভেন্দুর মজা লাগছিল। কিন্তু একটা অন্য কথাও মনে হচ্ছিল সঙ্গে সঙ্গে। সামান্য একটু বোঝাবুঝির অভাবে এক জনের কথা অন্যজনের কাছে কী বিরক্তিকর ঠেকে! সহিষ্ণুতার অভাবে ঝগড়া বেধে যায়, সম্পূর্ণ বিনা কারণে। দুজনেই ঠিক, অথচ দুজনেই ভুল, এ কথাটা কেউ কিছুতেই মানতে পারে না। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও কি এখান থেকেই আলগা হতে শুরু করে?

পিল্লাই হাত ধরেছে শুভেন্দুর। চাকরিজীবন ইতি হওয়ার পর এই তাদের প্রথম সাক্ষাৎকার।

পিল্লাই জিজ্ঞেস করল,—এখন কী কর দাস্‌গুপ্তা? ভ্যারেন্ডা ফ্রায়িং?

—এখনও সেই স্টেজ আসেনি। মেয়ের বিয়ে নিয়েই মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল হয়ে আছি। শিগ্‌গিরই একদিন আসব, তোমায় নেমন্তন্ন করতে।

—এসো।

—তুমি কী করছ এখন?

—জুলাইয়ে কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি হচ্ছি।

—অ্যাট দিস্‌ এজ? শুভেন্দু ঈষৎ চমকাল।

—কেন দাস্‌গুপ্তা, তুমিই তো বলেছিলে, ইউ ক্যান স্টার্ট অ্যাফ্রেশ! পিল্লাই দক্ষিণী ভঙ্গিতে ঘাড় দোলাল, —আমার ছেলেই আমায় অ্যাডভাইসটা দিল। সোমু বলল, আপ্পা তুমি তো অ্যাকাউন্টস জানোই, কম্পিউটার লেসন্ নিয়ে নিলে তুমি আমি জয়েন্টলি ঘরে বসে কাজ শুরু করে দেব। পাঁচ ছটা ছোট ছোট কোম্পানির অ্যাকাউন্টস্‌ ধরে নিলে উই ক্যান আর্ন এ প্রেটি লিটল্‌ সাম্।

শুভেন্দু চমৎকৃত। বেঁড়ে প্ল্যান ভেঁজেছে তো পিল্লাই!

পিল্লাই বলল,—একটাই খারাপ লাগছে। যে কোম্পানির কাজ করব, সে তো তার অ্যাকাউন্ট্‌সের লোককে ছুটি করে দেবে। আরও কিছু আনএমপ্লয়েড বেড়ে গেল….! বলতে বলতে হাত ওল্টাল,—কী করব, আমাকেও তো সারভাইভ্‌ করতে হবে। এ তো এখন ব্রাদার অ্যানিম্যাল কিংডম, কী বলো?

—হুম।

শুভেন্দু ম্লান হাসল। সত্যিই এ শহর এখন শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য, মানুষের জগতের নিয়ম এখানে খাটবে না। শুধু এই শহর কেন, দুনিয়াটাই তো এখন এরকম। এমনকী তার সেই সাধের সমিধও। বাসবেন্দ্রকে কি বাঘ বলা যায়?

পিল্লাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা বাড়ি ফিরল শুভেন্দু। কম্পাউন্ডের গেট থেকে সাঁঝ আঁধারেও দেখতে পেল তিন্নি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। খোলা চুলে দূর থেকে কেমন যেন উদাসিনী উদাসিনী লাগছে মেয়েটাকে। কদিন ধরেই মেয়ে যেন বেশ মনমরা! কেন? চেনা পরিবেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে? নাকি বাবা মার জন্য….?

ভাবতেই শুভেন্দুর বুক টনটন। ওই তিন্নির মায়াই বার বার বেঁধেছে শুভেন্দুকে, তিন্নি ছাড়া শুভেন্দুই বা থাকবে কী করে?

তন্নিষ্ঠাও দেখেছে শুভেন্দুকে। দরজা খুলে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, শুভেন্দু ডাকল,—এই শোন্‌, এদিকে আয়।

তন্নিষ্ঠা ঘুরে দাঁড়াল। এই বর্ষা ঋতুতেও তার মুখমণ্ডলে শীতের রুক্ষতা। দেখে মনে হয় কান্নাকাটি করছিল।

শুভেন্দু চোখ কুঁচকে তাকাল,—ভরসন্ধেবেলা টিভি ফিভি না দেখে ভূতের মতো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

—এমনি।

—তোর মা আজ গয়নার দোকানে গেছে না?

—বোধহয়।

—বোধহয় কেন! সকালেই তো তোকে ওর অফিসে চলে যাওয়ার জন্য সাধাসাধি করছিল…! গেলি না কেন?

—ভাল্লাগছে না।

—সে কী কথা! মেয়েরা তো গয়না বলতে অজ্ঞান, আর তুই…? ব্যাপারটা কী রে?

তন্নিষ্ঠা কথাটা যেন শুনেও শুনল না। ভুরু বেঁকিয়ে প্রশ্ন করল, —চা খাবে বাবা?

—না। এখানে আয়। মেয়েকে টেনে এনে সোফায় বসাল শুভেন্দু, —তোর কী হয়েছে খুলে বল তো? ঘর থেকে বেরোচ্ছিস না, বন্ধুবান্ধবের কাছে যাচ্ছিস না, সারাক্ষণ বসে বসে শুকোচ্ছিস…! এত মন খারাপের কী আছে?

কয়েক পল তন্নিষ্ঠা নীরব। হঠাৎ চোখ তুলেছে,—শৌনককে তোমার কেমন লাগে বাবা?

—ভাল তো। ভালই। আজকালকার ছেলে যেমন হয়….। লাইফফোর্স আছে, কেরিয়ার বোঝে….। বলতে বলতে শুভেন্দুর কেমন খটকা লেগেছে। পাল্টা প্রশ্ন করল,—হঠাৎ এখন এ কথা তুলছিস কেন?

—এমনি।…..জাস্ট মনে হল।

—উঁহু, কিছু একটা হয়েছে…! শৌনকের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে তোর?

—নাহ্।

—শৌনক কিছু বলেছে তোকে?

—না।

শুভেন্দু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। চোখের সামনে তিল তিল করে বড় হয়ে ওঠা মেয়েটাকে যেন এই মুহূর্তে ঠিক চিনতে পারছে না। মনে হচ্ছে মেয়ের মনে কোথায় যেন একটা কাঁটা বিঁধে আছে।

মেয়েকে সহজ করার চেষ্টা করল শুভেন্দু। বলল, —টেস্ট ম্যাচটা এগিয়ে এল বলে তোর নার্ভ ফেল করে গেল নাকি?

উত্তর তো দিলই না, উল্টে এক আজব প্রশ্ন করে বসেছে তন্নিষ্ঠা, —আচ্ছা বাবা, মা তোমায় কী দেখে পছন্দ করেছিল?

শুভেন্দু হকচকিয়ে গেল, —ম্‌ম্‌‌মানে?

—মানে তোমার কোনও গুণ দেখে মা অ্যাট্রাক্টেড হয়েছিল?

—আআআমার আবার কী গুণ? শুভেন্দু তোতলাতে লাগল, —ওই নাটক করতাম, সেখানে আমার অভিনয় দেখে…

—অথচ ওই গুণটাই সারা জীবন মা’র চোখে দোষ হয়ে থেকেছে, তাই না?

—হ্যাঁ, কিছুটা তা তো বটেই।

—তার মানে বিয়ের আগে যে কোয়ালিটি দেখে মেয়েরা আকৃষ্ট হয়, বিয়ের পর সেটা তাদের চোখে আর তত সুন্দর না থাকতেও পারে, তাই তো?

—এটা ডিপেন্ড করে মেয়েটার মেন্টাল ফ্রেমের ওপর। তোমার মার পৃথিবীতে আরও অন্য চাহিদা অনেক প্রবল ছিল যা আমার সঙ্গে মেলেনি…। তোমার মা যদি আমার ভাললাগা আত্মস্থ করে নিতে পারত, কিংবা আমি তোমার মার, তাহলে হয়তো…

শুভেন্দু চুপ করে গেল। মেয়ের সঙ্গে সে খোলামেলাভাবে মেশে বটে, প্রায় বন্ধুর মতো। কিন্তু এরকম আলোচনা কখনও হয়নি। একটু অসহজ লাগছিল।

তন্নিষ্ঠা যেন শুভেন্দুর উত্তরে খুশি নয়। মাথা নিচু করে বসে আছে। আঙুলে আঙুল খুঁটছে।

হঠাৎ আবার বলল, —তবু তোমরা একসঙ্গে যখন এতকাল আছ, কিছু একটা তো নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আছে?

শুভেন্দুর বলতে ইচ্ছে করল, ফাটা কাচের গ্লাস আস্তই দেখায়। টোকা খেয়ে ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত। বলল না। ভার গলায় সন্দেহটা নিরসনের চেষ্টা করল,—তোর শৌনককে কি কোনও কারণে পছন্দ হচ্ছে না?

—এ কথা এখন আর বলার কোনও মানেই হয় না। তন্নিষ্ঠা দু দিকে মাথা নাড়ল।

—তাহলে আর গোমড়ামুখ করে বসে আছ কেন? বি চিয়ারফুল, বি মেরি।

—ইচ্ছে করছে না যে। আমি কী করব?

শুভেন্দু আরও গম্ভীর হল, দ্যাখো তিন্নি, পৃথিবীতে কোনও ম্যাচই হানড্রেড পারসেন্ট পারফেক্ট হয় না। বাবা মা পছন্দ করে দিলেও না, নিজেরা পছন্দ করলেও না। তবু তারই মধ্যে কিছুটা কাটছাঁট করে নিতে হয়। তাতে অনেক অপছন্দের জিনিসও সহনীয় হয়ে ওঠে।…তা সত্ত্বেও আমি বলি, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু কোরো না। ডোন্ট গো এগেন্‌স্ট ইওর কনসেন্স।

পলকে তন্নিষ্ঠার চোখ জ্বলজ্বল, —এখনও তাহলে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া যায়?

—বিয়ে ভাঙার কথা আসছে কেন? শুভেন্দু চোখ ঘোরাল, —জানো, এখন কিছু একটা হচপচ হয়ে গেলে তোমার মা কতটা হার্ট হবে?

—আর তুমি?

—আমার কথা বাদ দাও। আমি এখানে একজন নন-এনটিটি। …তা ছাড়া শৌনককে তুমি তো অপছন্দ করো না তিন্নি, আমি দেখেছি।

তন্নিষ্ঠার চোখে আবার ছায়া ঘনিয়েছে। নিথর বসে রইল একটুক্ষণ। তারপর অন্যমনস্কভাবে বাবার সামনে দুটো আঙুল দোলাচ্ছে।

শুভেন্দু বিস্মিত চোখে বলল, —কী হল?

তন্নিষ্ঠার চোখে অনুনয়, —ধরো না একটা আঙুল।

—কেন? কী হবে?

তন্নিষ্ঠা মিনতি করল, —ধরো না, প্লিজ।

খপ্‌ করে মেয়ের তর্জনী চেপে ধরল শুভেন্দু। আরও মলিন হয়ে গেল তন্নিষ্ঠার মুখ। যেন আষাঢ়ের আকাশ। আঙুল ছাড়িয়ে শিথিল পায়ে উঠে যাচ্ছে।

শুভেন্দু মেয়েকে কোনও প্রশ্ন করতে পারল না। সাহস হচ্ছিল না।

.

১৪.

এক মনে কাজ করে চলেছে অভিমন্যু। টেবিলময় ফাইল কাগজ বিলবই চালান জাবেদা, ঘাড় নিচু করে লিখছে কী যেন। এতই তন্ময়, যে তন্নিষ্ঠা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়, খেয়ালই করছে না।

তন্নিষ্ঠা আর একটুক্ষণ নির্নিমেষ দেখল অভিমন্যুকে। তারপর আধফোটা স্বরে বলল, —আমি এসেছি।

চমকে তাকিয়েছে অভিমন্যু। ক্ষণিকের জন্য কী একটা খেলে গেল তার চোখে। বিদ্যুৎও নয়, তুফানও নয়, তার চেয়েও তীব্র কিছু। ক্ষণপরেই পুরু কাচের ওপারে কালো চোখের মণি দ্যুতিহীন।

ডটপেন বন্ধ করে অভিমন্যু শান্ত স্বরে বলল, —ও, তুমি! এসো।

একটু আগে পৃথিবী আঁধার করে বৃষ্টি নেমেছিল। বেশ খানিক ঝরিয়ে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে আকাশ। মাটি থেকে ভাপ উঠছে একটা। গরম ভাপ। বাতাস নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

তন্নিষ্ঠা চেয়ার টেনে বসল। টেবিলফ্যানের ঠিক সামনেটায়। কে জানে কেন, তন্নিষ্ঠা শাড়ি পরেছে আজ। গাঢ় নীল ঢাকাই। আঁচল তুলে কপাল মুছল একটু, ছোট্ট একটা শ্বাস নিল।

গলা ঝেড়ে বলল, —কী বিশ্রী ওয়েদার। ভেবেছিলাম আজও আসা হবে না।

অভিমন্যু মৃদু হাসল, —এলে কেন?

—তোমায় একটা খবর দেওয়ার ছিল।

—জানি। তোমার অঘ্রাণ শ্রাবণে সরে এসেছে, তাই তো?

—তুমি জানো?

—হুঁ। মালবিকা বলেছে।

তন্নিষ্ঠা সামান্য উত্তেজিত স্বরে বলল, —হঠাৎ কী করে যে হয়ে গেল! বিশ্বাস করো, আমার একদম মত ছিল না।

—কীসে? বিয়েতে?

—হ্যাঁ মানে…না মানে…তন্নিষ্ঠা নিজেকে গোছানোর চেষ্টা করল, —মানে, এই এগিয়ে আসাটায়।

—ও, তাই বলো।

অভিমন্যুর হাসিতে কৌতুক ঝিকঝিক। এ কি শুধু কৌতুক, নাকি কৌতুকের আবরণে বিষাদ? তন্নিষ্ঠা ঠিক ঠিক পড়তে পারল না।

ঢোক গিলে বলল, —বিশ্বাস করো, সবাই এমন একবাক্যে রাজি হয়ে গেল! শৌনক দিল্লি যাচ্ছে বলে…

—তুমি এত কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন? তন্নিষ্ঠাকে হকচকিয়ে দিয়ে অভিমন্যু হঠাৎ হো হো হেসে উঠেছে, — ভালই তো হল, দুজনে একসঙ্গে দিল্লি যাবে। তোমাদের আর অঘ্রান অব্দি বসে থাকতে হল না।

তন্নিষ্ঠা ভেতর থেকে ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। অভিমন্যুর সহজ স্বাভাবিক হাসি ঠং ঠং বাজছে কানে। মনে মনে কত কথাই না সাজিয়ে এনেছিল আজ, সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। একটি শব্দও আর খুঁজে পাচ্ছে না তন্নিষ্ঠা।

অভিমন্যু চেয়ারে হেলান দিয়েছে, —বলো, আজ কী খাবে?

দ্রুত দুদিকে মাথা নাড়ল তন্নিষ্ঠা, —কিছু না।

—তা বললে হয়? শুভ সংবাদ দিতে এসেছ…আজ অন্তত একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস্ খাও।

—প্লিজ অভিমন্যু, থাক না।

—থাক তবে। জোর করছি না। বলেই সামান্য গলা তুলেছে অভিমন্যু, —আসল কাজটা তাহলে সেরে ফ্যালো।

—কাজ?

—আকাশ থেকে পড়লে যে? তুমি আমায় নেমন্তন্ন করবে না?

তন্নিষ্ঠার গলা প্রায় বুজে এল, —করলে যাবে তুমি?

—কেন যাব না? নিশ্চয়ই যাব। কব্‌জি ডুবিয়ে খাব। অভিমন্যুর স্বরে মজা। চোখ নাচাচ্ছে, —বিয়েতে কী নেবে বলো?

টেবিলফ্যানের মুখ তন্নিষ্ঠার দিকেই ফেরানো, তবু ঘামতে শুরু করেছে তন্নিষ্ঠা। সত্যি গলা শুকিয়ে গেল, জিভ যেন ব্লটিংপেপার।

অভিমন্যু আবার চোখ নাচাচ্ছে, —বলো, কী গিফ্‌ট তোমার পছন্দ?

আহত গলায় তন্নিষ্ঠা বলল,—আমাকে গিফ্‌ট দেওয়ার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন?

—বাহ্‌, উপহার দেব না? এমনি এমনি খেয়ে আসব?

—যা চাইব, তাই দেবে?

—আকাশের চাঁদ পেড়ে দিতে বললে হয়তো পারব না।

—সেই পারফিউমটা দিও। যেটা তুমি বানাচ্ছিলে।

নিমেষে মিইয়ে গেছে অভিমন্যু। তন্নিষ্ঠার দিকে স্থির তাকিয়ে রইল দু এক পল। চকিতে চোখ নামিয়ে নিল, —ওটা নেই। ফেলে দিয়েছি।

—সে কী! ফেলে দিলে? কেন?

—অত দামি সুগন্ধ আমার চলবে না।

—তা বলে তৈরি হওয়ার আগেই…?

—ওটা হত না।

—কী করে বলছ?

—বুঝে গেছি। ওই গন্ধ আমার জন্য নয়।

—এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি।

—হতে পারে। অভিমন্যু অন্যমনস্ক স্বরে বলল, —ভাবছি, পারফিউমের ব্যবসাটাই এবার তুলে দেব।

—কেন?

—আর পোষাচ্ছে না। প্রতিবেশীরাও আপত্তি জানাচ্ছে…। আমার পারফিউমের চড়া গন্ধ কারুর সহ্য হয় না।…

—তো কী করবে এখন?

—চাকরি করব। দশটা পাঁচটার ঘানিতে যুতে দেব নিজেকে।

—আর তোমার সেই স্বপ্নের সুগন্ধি?

—স্বপ্ন হয়েই থাকবে। ইচ্ছে হয়ে। মনের মধ্যে।

—ও।

তন্নিষ্ঠা মুখ ঘুরিয়ে নিল। কান্না পাচ্ছে হঠাৎ। উথাল পাথাল করছে বুক, হৃৎপিণ্ড ফুসফুস সব যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। অভিমন্যু কি একটি বারের জন্যও বলতে পারে না, এ বিয়ে তুমি কোরো না তন্নিষ্ঠা? এক বারও বলবে না, এসো আমরা দুজনে মিলে পৃথিবীতে সেই সুগন্ধটা আনি? তীব্র দাহের পর প্রথম বৃষ্টির ছোঁওয়ায় বুনো লতায় যে গন্ধ ওঠে…?

কলেজে দেখা খ্যাপা ম্যাজিশিয়ানকে কী নিষ্ঠুর প্রতারক মানে হচ্ছে এখন!

ফেটে পড়বে তন্নিষ্ঠা? ভেঙে পড়বে?

কিছুই করল না তন্নিষ্ঠা। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ল। পায়ের জোর কমে গেছে, হাঁটু কাঁপছে থরথর, তবু প্রাণপণে অচঞ্চল রাখছে নিজেকে। বেরিয়ে আসছে খুরপি ঘরখানা ছেড়ে। আর ফিরে তাকাবে না।

পারল না। দরজা পেরোতে গিয়েও থেমে গেল সহসা। আচমকা টান পড়েছে। আঁচলে, কোথায় যেন আটকে গেছে শাড়ি।

তন্নিষ্ঠা কি আঁচলটাকে ছাড়িয়ে নেবে?

অভিমন্যু কি এখনও উঠে আসবে না?

তখনই কোত্থেকে যেন এক মায়াবী কোকিল ডেকে উঠল। এই ঘোর আষাঢ়েও। ডাকছে…ডাকছে…। আশ্চর্য এক বনগন্ধে ভরে গেল মেঘলা দুপুর।

বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। রিমঝিম রিমঝিম।

_____

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *