৬. মেধাবী সমাজ

৬. মেধাবী সমাজ

Wisedome is a weapon to ward off destruction; It is an inner fortress which enemies can not destroy.

— Thirukkural 421 (200BC)

প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক শিক্ষিতদের দেশ। আগ্রাসন ও উপনিবেশের ধ্বংসাত্মক শোষণে সেই ভারতবর্ষের আদি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। একই সংগে ধ্বংস হয় সম্মিলিত মানুষের বৃহত্তর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এ অঞ্চলের মানুষকে বহু বছর ধরে সুপরিকল্পিতভাবে নিম্নস্তরের সমাজে নামিয়ে আনা হয়েছে। ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার সময় আমাদের তরুণদের মনমানসিকতা এত নিম্নমুখী পর্যায়ে চলে এসেছিল যে দুটো ডালভাত খেয়ে কোন রকমে জীবনযাপন করার চেয়ে বড় কোন আকাঙ্ক্ষাই তারা করতে পারত না।

ভারত ঐতিহাসিকভাবেই আধুনিক জ্ঞানের পীঠস্থান। সেই জ্ঞানের ঐতিহ্য আবার ভারতকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। যেদিন ভারত তার গৌরবময় ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার লাভে সক্ষম হবে সেদিন একটি উন্নত দেশের সার্বভৌমত্ব, উন্নতমানের জীবন ব্যবস্থা অর্জনে ভারতবাসীকে বেশী বেগ পেতে হবে না।

শিক্ষা বা জ্ঞানের হরেক রকম আঙ্গিক, নানা ধরনের আদল রয়েছে। প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি, তথ্য সংগ্রহ, বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান লাভ করে। আমরা জ্ঞানার্জন করি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছ থেকে, লাইব্রেরী থেকে, গবেষণাপত্র থেকে, সেমিনারের আলোচনা থেকে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও কর্মক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিক, ব্যবস্থাপক, কর্মচারিদের ড্রইং, প্রসেস শীট থেকে এমনকি দোকানের মেঝে থেকেও জ্ঞান অর্জিত হতে পারে। যদিও জ্ঞান অর্জনের সাধারণ ক্ষেত্র বলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই ভাবা হয়। এর মেধাবী সমাজ পাশাপাশি শিল্পী, ভাষ্কর, হেকিম, বৈদ্য, দার্শনিক, সাধক, কবি– এদের কাছ থেকেও সমানভাবে জ্ঞান আহরণ করে মানুষ। সার্বিক জ্ঞান মানুষকে সর্বোচ্চ কৃতিত্ব প্রদর্শনে সক্ষম করে তোলে।

গ্রন্থাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন আমাদের জ্ঞান আহরণের উৎস তেমনি আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস, আমাদের প্রত্নতত্ত্ব ও মহাকাব্যও আমাদের কাছে এক একটা বিশাল লাইব্রেরী। আমাদের অজ গ্রামগুলোতেও বহু গোঁড়ামিহীন জ্ঞানের বিষয় রয়েছে। আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ, আমাদের সুবিশাল মহাসাগর, আমাদের মরুভূমি আর বৃক্ষ ও প্রাণীজগতের জীবন প্রণালীর মধ্যে সীমাহীন গুপ্ত জ্ঞানের ঐশ্বর্য রয়ে গেছে। আমাদের দেশের প্রত্যেক রাজ্যেরই নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমজ হিসেবে নিজেদের গড়ার মত অন্তস্থ যোগ্যতা রয়েছে।

উন্নতি ও ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে চিরকালই জ্ঞান অপরিহার্য অংশ হিসেবে কাজ করছে।

জ্ঞান অথবা শিক্ষার ধর্মই হল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া। পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে জ্ঞানের আদান-প্রদান চর্চা হয়ে আসছে। এ আদান-প্রদান যে শুধু গুরু-শিষ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে তা নয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আশা শিক্ষার্থীরা ভারতীয় জ্ঞান আত্মস্থ করছে। পরবর্তীতে তারা সে জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

অজস্র প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাসক্ষম পরিবেশে ভারত বহু পূর্ব থেকেই বিভূষিত। কিন্তু আমাদের এই সুযোগ সুবিধা আর প্রাকৃতিক সম্পদরাশি অবিন্যস্ত, ছড়ানো ছিটানো। গত শতকে শুধু কায়িক শ্রমনির্ভর কৃষিব্যবস্থা থেকে আধুনিক বিশ্ব শিল্প ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে যেখানে প্রযুক্তি, আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং শ্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে পণ্যের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা হয়।

প্রযুক্তি ভিত্তিক এই কৃষি ব্যবস্থাপনার সামনে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কৃষিপণ্য দাঁড়াতে পারেনি। একুশ শতকে এসে একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হচ্ছে যেখানে মূলধন এবং শ্রমের পরিবর্তে মেধাকে প্রাথমিক উৎপাদন উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদের মেধাকে সার্বিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই মেধাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়নের অন্যান্য সহযোগী বিষয়কে সমৃদ্ধ করবে। মেধাসম্পন্ন শিক্ষা অবকাঠামো সৃষ্টি এবং তা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করলে আমাদের উৎপাদনের পরিমাণও গুণগতমান বাড়বে। উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা সক্ষম পণ্য উৎপাদনের কোন বিকল্প রাস্তা নেই। একটি জাতি কতখানি মেধা সৃষ্টি করতে পারছে এবং সেই মেধাকে কাজে লাগাতে পারছে তার ওপর ভিত্তি করেই জাতিটি নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমাজ কীনা তা বিচার করা হয়।

নলেজ সোসাইটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এর একটি হলো উন্নত সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং অগ্রসর প্রজন্ম।

উন্নত সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। এগুলোর উন্নয়ন ঘটানো গেলেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো ও সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়ানো যাবে। একই সংগে গ্রামোন্নয়ন সম্ভব হবে।

দেশের জন্য অগ্রসর প্রজন্মের প্রধান কাজ দেশের বিক্ষিপ্ত সম্পদকে এ করা। নলেজ সোসাইটি হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য কয়েকটি ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে টিআইএফএসি। সেগুলো হল তথ্য প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, স্পেস প্রযুক্তি, ওয়েদার ফোরকাস্টিং, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন এবং টেলিএডুকেশন। এ সমস্ত ক্ষেত্রগুলো দাঁড়িয়ে গেলে দেশে বহুমুখী প্রযুক্তি এবং যুৎসই ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো তৈরী হবে; এ দুয়ের সম্মিলিত উদ্যোগ আমাদের নলেজ সোসাইটি গঠন করতে সক্ষম হবে।

২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে বিশ্বের শক্তিশালী মেধাবী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মিশন হাতে নিতে হবে। যখন ভারত উন্নত সমাজপ্রবর্তন ও মেধাবী প্রজন্ম গঠনের দ্বিমাত্রিক মিশনে সফল হবে তখন নলেজ সুপার পাওয়ার হিসেবে তৃতীয় আরেকটি মাত্রা যোগ হবে। তখন ভারতের মিশন হবে নলেজ প্রোটেকশন বা মেধা সংরক্ষণ এবং এটিই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ মিশন।

আমাদের কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এবং ইনফরমেশন জেনারেটরকে ইলেক্ট্রনিক বা অনলাইন হামলা থেকে রক্ষা করা চরম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক মনিটরিং।

তখন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। একইভাবে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও জ্ঞানকেও আমাদের সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।

মনিপাল একাডেমি অব হায়ার এডুকেশনের আয়োজনে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে তারা আমাকে, সবুজ বিপ্লবের জনক সি, সুব্রামানিয়াম ও খ্যাতিমান আইনজীবী এন.এ.পালখিভালাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে নব্বই বছর বয়েসি সুব্রামানিয়ামের সঙ্গে কথা বলেছিলাম তার দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব সম্পর্কে। তিনি একটা জাতীয় কৃষি ফাউন্ডেশন বিষয়ে তার স্বপ্নের কথা মেধাবী সমাজ বলেছিলেন আমাকে, যেখানে উৎপাদন করা হবে হাইব্রিড বীজ। তার ফাউন্ডেশন পৃষ্ঠপোষকতা দেবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের এবং তাদের মৃত্তিকা পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারের সুবিধা দেবে আর আবহাওয়া ও বাজার সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করবে। যাতে করে তারা উৎপাদিত ফসলের ভাল মূল্য পায় এবং অধিক পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারে। এই স্কিমের অধীনে দশ লাখ চাষীকে নিয়ে আসার লক্ষ্য তার। স্বপ্নদ্রষ্টারা বুড়ো হন না!

আরেকবার আমি কথা বলছিলাম কৈম্বাটুরের নিকটবর্তী পল্লাচিতে অবস্থিত ড. মহালিঙ্গম কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। মহান শিল্পপতি ও অ্যাকাডেমিসিয়ান ড. এন. মহালিঙ্গম বসে ছিলেন আমার পাশেই। কৃষি, রসায়ন ও টেক্সটাইল শিল্পের মাধ্যমে দেশ কীভাবে সমৃদ্ধশালী হতে পারে সে কথাই তিনি বলছিলেন আমাকে। শিল্পকারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে তার সাফল্যে অভিভূত হয়ে আমি বিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আপনার পরবর্তী মিশন কী? এ কথা বলার পর আমি উপলব্ধি করলাম যে প্রশ্নটা করছি এমন একজনকে যার বয়স প্রায় আশি বছর!

ড. মহালিঙ্গম উত্তর দিলেন, আমি তামিল পান্ডুলিপি বিশ্লেষণ করেছি যা ২৫০০ বছরের পুরনো। এখন আমি ৫০০০ বছর আগের তামিল পান্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা করতে চাই! সেবারও আমার মনে হয়েছিল স্বপ্নদ্রষ্টারা বুড়ো হন না।

শিল্পের ক্ষেত্রে, ১৯৬০ সালে, ক্ষুদ্র ও বৃহদায়তন কারখানায় যুক্ত ছিল জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। ১৯৯২ সাল পর্যন্তও এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল। যাহোক, এ সংখ্যা ২৫ শতাংশে বৃদ্ধি করতে হবে ২০২০ সালের মধ্যে, এটা মাথায় রেখে যে জিডিপির প্রবৃদ্ধি শ্লথ আর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর প্রতিযোগিতাও ক্রমবর্ধমান। কর্মসংস্থানের প্যাটার্নও একটা নতুন আকার নেবে। ১৯৬০ সালের ২৫ শতাংশ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্প ও পরিষেবায় নিয়োগ ১৯৯২ সালে বেড়েছে ২৭ শতাংশ। অবকাঠাম রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্র, আটটি খাত ও বিনোদনের চাহিদার দিক থেকে এটা আরও ৫০ শতাংশ বাড়বে। এসব বৃহৎ পরিবর্তনের ফলে প্রয়োজন হবে আরও অধিক প্রশিক্ষিত জনবল। বাণিজ্য ও শিল্পক্ষেত্রে আমাদের নেতৃস্থানীয়দের প্রস্তুত হতে হবে এই রূপান্তরের জন্য।

গ্রাম থেকে শহরে আগমনের হার থেকে এ দুয়ের জীবনমান সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয়। আদর্শিকভাবে গ্রামীণ ও শহুরে এলাকাই হতে হবে আকর্ষণীয় যাতে গ্রাম ছেড়ে শহরে আগমনের হেতু কমে। এই আগমন শূন্যের কোঠায় নেমে এলে তা হবে উন্নয়নের চিহ্ন। আমরা সুখময় সেই ভারসাম্য কীভাবে অর্জন করতে পারি? পল্লীর উন্নয়নই এর একমাত্র সমাধান। তার মানে হল জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় সব কিছু গ্রামাঞ্চলেও সুলভ করা যা এখন কেবল শহরেই পাওয়া যায়। এতে একই মাত্রায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, এবং শহরাঞ্চলের মত একই পর্যায়ে। আরেকটা চ্যালেঞ্জ হল এসব সুবিধা দিতে হবে আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রতিবেশিক খরচের ক্ষুদ্র একটা অংশ দিয়ে যা বহন করবে শহরগুলোই।

প্রত্যাশাটা হল পরিবেশের কথা মাথায় রেখে কর্মসংস্থান বিস্তৃত করার এই সমন্বয় পল্লী অঞ্চলকেও আকর্ষণীয় করে তুলবে শহরাঞ্চলের মতই, যদি না তা শহরের চেয়েও আকর্ষণীয় হয়। তারপর, পল্লী উন্নয়ন থেকে প্রত্যাশা করা যেতে পারে যে এতে শহরে আগমন বন্ধ হয়ে যাবে। এইভাবে পিইউআরএর লক্ষ্য হল ফলিত পদার্থবিদ্যাগত এবং ইলেক্ট্রনিক জ্ঞান ও অর্থনৈতিক সমন্বয়।

ভারতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে প্রতিবন্ধীরা অকিঞ্চিৎকর সমন্বয় ও ছোটখাটো বিষয়ে ভোগে। একটা রিংরোড আর উঁচু মানসম্পন্ন পরিবহন একগুচ্ছ গ্রামকে একসূত্রে গাঁথতে পারে। এভাবে সংযুক্ত গ্রামগুলো বিভিন্ন পরিষেবার সাহায্য প্রদানে একটা বড় বাজার সৃষ্টি করবে, কিন্তু এককভাবে তা সম্ভব নয়। রিংরোড আর পরিবহন একত্রে অবিলম্বে গ্রামগুলোকে একটা ভার্চুয়াল শহরে পরিণত করবে, যা হবে হাজার হাজার মানুষের একটা বাজার। এমন একটা অঞ্চল, যেখানে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও থাকবে, দ্রুত প্রবৃদ্ধির বিস্তর সম্ভাবনা ধারণ করবে- অধিক মানুষের মধ্যে যোগাযোগ থাকার ফলে অধিকহারে বিনিয়োগের আকর্ষণও তৈরি হবে, আবার অধিক বিনিয়োগে আকর্ষিত হবে অধিক সংখ্যক মানুষ ইত্যাদি। মূলত, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে একগুচ্ছ গ্রামের একটা বলয় বিনির্মাণ করা। উঁচু মানসম্পন্ন পরিবহন ও টেলিযোগাযোগ পদ্ধতি গড়ে ভোলার মাধ্যমে ওই বলয়ে গ্রামগুলোকে যুক্ত করা। আর বলয়ের মধ্যে অবস্থিত এলাকার স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য সামাজিক পরিষেবায় প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞদের আগমনে উৎসাহিত করা। এছাড়া ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসা।

এই মডেলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পল্লী অঞ্চলে উন্নত জীবন মানের একটা নকশা, আর এতে বিশেষ পরামর্শও রয়েছে শহরের জনসংখ্যার আধিক্য হ্রাসেরও। স্বাভাবিক ভাবেই এটি আমাদের সবচেয়ে উদ্বেগজনক শহুরে সমস্যা। পানি সরবরাহ আর পয়ঃনিষ্কাশন জরুরি নাগরিক চাহিদার অন্যতম। একটা ন্যূনতম আকৃতির নিচে কোথাও বসতি দৃশ্যগ্রাহ্য হয় না, আবার বিদ্যমান ভিড়াক্রান্ত শহরের সঙ্গে তুলনীয়ও নয়। একই সঙ্গে, বিদ্যমান ভিড়াক্রান্ত শহর অর্থনৈতিকভাবে নতুন একটা শহরের সঙ্গে তুলনীয় হয় না যার ন্যূনতম আকৃতি সম্প্রসারণের সীমারেখা অতিক্রম করে গেছে। এখানে হিসেবটা হচ্ছে-~~ প্রচলিত শহরের আয়তন ১০ থেকে ৬ কিলোমিটার আর আকৃতি চতুষ্কোণ, অন্যদিকে মডেলটার আকার বলয়ের মত যার মধ্যে থাকবে অন্তত আট থেকে দশটা গ্রাম, মেধাবী সমাজ আয়তন হবে ৬০ বর্গ কিলোমিটার। এতে দরকার হবে মাত্র একটা পরিবহন পথ, যা চতুষ্কোণ আকৃতির শহরের তুলনায় অর্ধেক। এতে জংশন থাকবে না, শহরাঞ্চলের আটটির বিপরীতে এতে থাকবে একটিমাত্র রুট, সুতরাং লোকজনকে একটা লাইন পরিবর্তন করে আরেক লাইনে যেতে হবে না। তাতে পরিবহনের সময় বাঁচবে। অধিকন্তু, যেহেতু সমস্ত ট্রাফিক যুক্ত থাকবে একটি মাত্র রুটে, অতি দক্ষ ব্যাপক পরিবহন পদ্ধতিও হবে সাশ্রয়ী। ফলে জনগণের খরচ কমবে।

ভারতকে জ্ঞানের পরাশক্তিতে রূপান্তরের জন্য পল্লী উন্নয়ন অপরিহার্য। নির্দিষ্ট এলাকায় উন্নয়নের রোডম্যাপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং আমাদের এ নিয়ে কাজ করতে হবে।

টাটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান মি. রতন টাটা নেমন্তন্ন করেছিলেন। পুনের টেলকো পরিদর্শনের। বিশেষ করে পুরোপুরি ভারতীয় একটি গাড়ি ইন্ডিকার ডিজাইন, উন্নয়ন ও তৈরির চ্যালেঞ্জ দেখার জন্য। পরিদর্শনের সূচি আমাকে পুলকিত করে। আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবো বলে ভাবলাম যা অনেক জায়গায় আমি জিজ্ঞাসা করেছি এর আগে।

১৯৮০ সালে আইএসআরওতে আমাদের টিম উৎক্ষেপণ করে স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেইকল আর রোহিনীকে স্থাপন করে কক্ষপথে। জাতির জন্য সেটা ছিল বিশাল ঘটনা। ৪ জানুয়ারি ২০০১ সালে আমি প্রথমবারের মত দেখি প্রটোটাইপ ফাইটার এয়ারক্র্যাফট– লাইট কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট (এলসিও)। এর ডিজাইন ও উৎপাদন করেছিল অ্যারোনটিকাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সি (এডিএ)।

যানবাহন উৎপাদন খাতে ভারতকে বিশ্বের অন্যতম দেশ হিসেবে গড়ে তোলার তার স্বপ্নের কথা বললেন রতন টাটা আমাকে সেই পরিদর্শনের সময়। তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন দেশ থেকে গাড়ি তৈরির ইউনিট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন টাটা। বর্তমানের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি উৎপাদনের দিকেই নজর দিয়েছিলেন তিনি, যাতে তা বিশ্বব্যাপি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম হয়। এটা সুন্দর একটা আইডিয়া। আমি আরেকটু যোগ করব যে, প্রথম ধাপ হিসেবে ভারতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ একটা কনসরশিয়ায় রূপান্তরিত হওয়া, তারপর তা বহুজাতিক কোম্পানি হয়ে উঠতে পারে।

আমি যেসব জাতীয় কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করেছি সেগুলোর অভিজ্ঞতা শুনতে আমাকে ও আমার টিমকে একগুচ্ছ বৈজ্ঞানিক, শিল্প, শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান দাওয়াত করত। মুম্বাইতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে আমাকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল যা আমার কানে বাজে আজও।

ড. কালাম, ভারত নিজের এসএলভি ও স্যাটেলাইট নিজেই নির্মাণ ও উৎপাদন করতে পারে দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তাছাড়া কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে পারে দেখেও আমরা আনন্দিত। আপনি কি আমাকে বলতে পারেন, ভারত কবে নিজের ইঞ্জিনযুক্ত যাত্রীবাহী বগি তৈরি আর উৎপাদন করতে পারবে? যখন আমি টেলকোতে পরিদর্শন করি আর আমাকে বলা হয় যে এ কোম্পানি বার্ষিক প্রায় ৬০ হাজার গাড়ি তৈরি করছে, তখন আমার ওই প্রশ্নটা আবার মনে পড়েছিল। শুধু যে প্রশ্নটার উত্তর প্রত্যক্ষ করছিলাম তাই নয়, বরং আমাদের দেশের প্রযুক্তিগত শক্তির ছবিটাও দেখতে পাচ্ছিলাম।

একটা ধারণার বাস্তব আকার গ্রহণ দেখার একটা সুযোগও আমি পেয়েছিলাম উইপরোর আমন্ত্রণে ব্যাঙ্গাললারে একটা ভ্রাম্যমাণ হার্ট কেয়ার ক্লিনিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে। সেটা ২০০০ সালের অক্টোবর মাসের কথা। এটা ছিল উইপরো-জিই, কেয়ার ফাউন্ডেশন ও ক্লেইনজেইডস-এর একটা সহযোগিতামূলক উদ্যোগ। আমার বন্ধু অরুণ তিওয়ারী এবং আমি এই প্রকল্পের ধারণাটা প্রথম চিন্তা করেছিলাম। উদ্বোধন শেষে আমি উইপরো-জিই সেন্টার পরিদর্শন করি–

অগ্রসর প্রযুক্তির সাহায্যে তারা তৈরি করে বিশেষায়িত চিকিৎসা সরঞ্জাম। আমি প্রবেশ করা মাত্রই এক তরুণ এগিয়ে এল আর আমার শার্টে পিন দিয়ে জাতীয় পতাকা এঁটে দিল। আমি করমর্দন করে তাকে বললাম, ওহে তরুণ, তুমি কী এই দেশের জন্য থাকবে আর কাজ করবে? . সে উত্তর দিল, ড, কালাম, ডায়াগনসিসের কাজে ব্যবহৃত চিকিৎসা

সরঞ্জামের ওপর কাজ করছি আমি। ওটাই আমার পেশা। আমি এমন এক পেশার সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ যেখানে বেদনা প্রশমনের চেষ্টা করা হয়। আমার প্রয়োজন এখানেই। আমি তার উত্তরে উৎফুল্ল হলাম।

অনুষ্ঠানের শেষে উইপনোর প্রধান আজিম প্রেমজী আমার সঙ্গে ডিআরডিওর অতিথিশালায় এলেন। আসার পথে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কর্নাটকের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতার জন্য তিনি কীরকম চেষ্টা করেছেন যাতে আরও অধিক বাচ্চা ছেলেমেয়েদের শ্রেণীকক্ষে নিয়ে আসা যায়।

অতিথিশালায় চা পান করার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যবসাজগতে উইপরো সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছল কীভাবে?

প্রেমজী স্মরণীয় উত্তর দিলেন, ড. কালাম, তিনটি বিষয় আমার মাথায় ছিল। এক : প্রজন্মের ঘাম আর টিমের কঠোর শ্রম। দুই : উইপরোতে আমরা কাজ করি ক্রেতার আনন্দের জন্য। তিন : ভাগ্য। প্রথম দুটি অর্জিত না হলে তৃতীয়টির অস্তিত্ব থাকত না।

এসব প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা একটি সুতোয় মিলে যায়। তাহল, আমরা উচ্চ প্রযুক্তি প্রচলন করতে সমর্থ। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের উপস্থিতি, মেধাবী সমাজ নেটওয়ার্কের সামর্থ আর তারুণ্যের দীপ্তিমান হৃদয় : একটা জ্ঞানের সমাজ বিনির্মাণে এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

যোগসূত্র মহাঋষি পতঞ্জলি বলেছেন, তুমি যখন কোনও মহৎ উদ্দেশ্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তখন তোমার সব ভাবনার বাধ ভেঙে যায় : তোমার মন সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যায়, সবদিকে প্রসারিত হয় তোমার চেতনা, আর তুমি নিজেকে খুঁজে পাও এক নতুন, বিশাল বিস্ময়কর বিশ্বে। ধীশক্তি আর প্রতিভা জীবন্ত হয়ে ওঠে, এবং তুমি স্বপ্নে নিজেকে যতটা বড় বলে ভাব তার চেয়েও বেশি বড় দেখতে পাও নিজেকে।

আমাদের সবার জন্যই এই বাণী। জনগণই একটা দেশকে মহান করে তোলে। তাদের চেষ্টার দ্বারা জনগণ নাগরিকে পরিণত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ দীপ্তিমান হৃদয়, আর আমাদের জাতির এক বিলিয়ন হৃদয় অবশ্যই এক বিশাল শক্তি– যা ঝংকৃত হওয়ার অপেক্ষায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *