০৬. নীষা

. নীষা

আমি চোখ খুলে তাকালাম। ধবধবে সাদা একটা ঘরে আমি শুয়ে আছি। এটা কি স্বপ্ন? আমি চোখ বন্ধ করে আবার খুলি, না, এটা স্বপ্ন না, সত্যি আমি সাদা একটা ঘরে শুয়ে আছি, আমার শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা। ঘরে কোনো শব্দ নেই, খুব কান পেতে থাকলে মৃদু একটা গুঞ্জন শোনা যায়, আমার ডান দিক থেকে আসছে শব্দটা। কিসের শব্দ এটা? মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইলাম আমি, সাথে সাথে কোথায় জানি অসহ্য যন্ত্রণা করে ওঠে। ছোট্ট একটা আর্তনাদ করে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, চোখের সামনে হলদে আলো খেলা করতে থাকে, দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটাকে কমে আসতে দিয়ে আবার সাবধানে চোখ খুলি আমি। আমার উপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে, কী সুন্দর মেয়েটি! আমাকে তাকাতে দেখে মেয়েটি মিষ্টি করে হাসে আর হঠাৎ আমি তাকে চিনতে পারি–নীষা।

হ্যাঁ, আমি নীষা। পৃথিবীতে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি কিম জুরান!

আমি পৃথিবীতে। কী হয়েছিল আমার?

আপনি মহাকাশযানে করে ফিরে এসেছেন, ক্যাপসুলের ভেতরে আপনার তাপমাত্রা ছিল শূন্যের নিচে দুই শত বাহাত্তর দশমিক আট ডিগ্রী।

সত্যি?

হ্যাঁ।

কেমন করে হল?

জানি না। মেয়েটি মিষ্টি করে হাসে, কেউ জানে না। মহাকাশযানের যে কম্পিউটার ছিল সেটির মেমোরি পুরোটা কীভাবে জানি উধাও হয়ে গেছে। কেউএকজন যেন ঝেড়ে-পুছে নিয়ে গেছে।

লুকাস! আমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, নিশ্চয়ই লুকাস!

মেয়েটি এবারে আমার উপরে আরো ঝুঁকে আসে, আমি তার শরীরের মিষ্টি গন্ধ পাই। মেয়েটি চোখ বড় বড় করে বলল, আপনাকে কয়েকটা জিনিস বলে দিই, আর কখনো সুযোগ পাব না। আপনার জ্ঞান ফিরে আসছিল বলে আমি প্রাজমো কিটোগ্রাফটা চালু করেছি, এটা চালু থাকলে এই ঘরের শব্দ বাইরে যেতে পারে না, আমরা তাই নিরিবিলি কথা বলতে পারব। বেশিক্ষণ নয়, তাই এখনই বলে দিচ্ছি, খুব জরুরি কয়েকটা কথা।

কি?

এক নম্বর বিষয় হচ্ছে, আপনার নিজের নিরাপত্তা। আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তার শাস্তি হিসেবে আপনি রুকুন গ্রহপুঞ্জ থেকে ঘুরে এসেছেন, আইনত এখন আপনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য। তাই আপনি মুক্তি পাবেন। কী অবস্থায় পাবেন সেটি হচ্ছে কথা। বেশিকিছু আশা করবেন না আগেই বলে রাখছি। নীষা একটু হাসার ভঙ্গি করল।

কর্তৃপক্ষের কাছে আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন, কিছুই আসে যায় না। কারণ, আপনাকে কী করা হবে সেটি আপনি ফিরে আসামাত্রই ঠিক করা হয়ে গেছে।

কী করা হবে?

সময় হলেই জানবেন। নীষা আমার প্রশ্নটি এড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল, আপনি কর্তৃপক্ষের কাছে যা ইচ্ছে বলতে পারেন, শুধুমাত্র দু’টি ব্যাপার ছাড়া। এক, মহাকাশযানে আপনার সাথে লুকাসের যোগাযোগ হয়েছিল। দুই, আমি লুকাসকে অনুরোধ করেছিলাম আপনাকে রক্ষা করতে। এটি জরুরি, আমার নিজের নিরাপত্তার জন্য।

আমাকে দিয়ে জোর করে কিছু বলানোর চেষ্টা করবে না?

আপাতত নয়। প্রথমে আপনাকে নিয়ে আবার একটা বিচারের প্রহসন হবে।

আবার?

হ্যাঁ। কিম জুরান, আমাদের নিরিবিলি কথা বলার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, মনে রাখবেন আমি কী বললাম।

রাখব। একটু থেমে বললাম, নীষা।

কি?

তুমি আমাকে বাঁচালে কেন?

যে যান্ত্রিক গুঞ্জনটা এতক্ষণ আমাদের কথাবার্তাকে আড়াল করে রেখেছিল, সেটা হঠাৎ থেমে যায়। নীষা তাই কথা না বলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে। আমার বুকের ভেতর নড়েচড়ে যায় হঠাৎ, একজন মানবী, কী আশ্চর্য একটা অভিজ্ঞতা।

নীষা চোখের সামনে থেকে সরে যায়, আমি তার গলার স্বর শুনতে পাই, কাকে যেন বলল, কিম জুরানের জ্ঞান ফিরে এসেছে।

সাথে সাথে কার যেন উত্তেজিত গলার স্বর শুনতে পেলাম, এসেছে?

হ্যাঁ।

কখন?

এইমাত্র।

আমি আসছি।

আসতে পারেন, কিন্তু এখন তার সাথে কথা বলতে পারবেন না।

কেন?

নীষা অসহিষ্ণু স্বরে বলল, এই মানুষটি এক বছরের মতো সময় একটা ছোট ক্যাপসুলে ঘুমিয়ে ছিলেন। যখন তাকে উদ্ধার করা হয়েছে তখন তাঁর তাপমাত্রা অ্যাবসলিউট শূন্যের কাছাকাছি, কতদিন থেকে কেউ জানে না। তাঁকে পুরোপুরি পরীক্ষা না করে আমি কারো সাথে কথা বলতে দেব না।

লোকটি বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান, কিম জুরান মৃত্যুদণ্ডের আসামী?

আসামী ছিলেন। তাঁকে যে-শাস্তি দেয়া হয়েছিল তিনি সেটা ভোগ করে এসেছেন, এখন তিনি আর কোনোকিছুর আসামী নন।

সেটা বিচারকের সিদ্ধান্ত, তাঁরা ঠিক করবেন। আমি বিচারক নই, আমি জানি না।

আমিও বিচারক নই, কিন্তু আমি জানি।

লোকটি একটু থেমে বলল, তুমি দেখছি কিম জুরানের প্রাণ বাঁচাতে খুব ব্যস্ত!

হ্যাঁ, আমি ডাক্তার। আমি সারাজীবন মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করে এসেছি, আপনার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগতে পারে, কিন্তু এটাই আমার কাজ।

নীষা সুইচ টিপে কী-একটা বন্ধ করে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, আপনাকে একটা ইনজেকশান দিয়ে দিচ্ছি, আপনি একটু ঘুমান। হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে নীষা ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে তাকায়, তারপর হঠাৎ আলতোভাবে আমার কপালে ঠোট স্পর্শ করে। আহা, কতকাল পরে আমাকে একজন রক্তমাংসের মানুষ স্পর্শ করল।

আমার হঠাৎ একটা আশ্চর্য জিনিস মনে হল, নীষা কি মানুষ, নাকি একটা রবোট্রন?

আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, হাতে সুচের স্পর্শ পেয়ে গাঢ় ঘুমে ঢলে পড়লাম মুহূর্তে।

 

আমি একটা হুইল চেয়ারে বসে আছি। চেষ্টা করলে আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে পারি, কিন্তু তবুও এখন বেশিরভাগ সময়েই হুইল চেয়ারে চলাফেরা করছি। ধীরে ধীরে আমার হাতে-পায়ে বল ফিরে আসছে, দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আশ্চর্য শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল। আমার পাশে বসে আছে নীষা, আশেপাশে আরো অনেক লোকজন, তাই আমার প্রতি তার আচার-আচরণ হিসেব করা। আমার ডাক্তার হিসেবে নীষা এই কমিশনে আসতে পেরেছে, স্বাভাবিক অবস্থায় তার এখানে থাকার কথা নয়। বড় ঘরের অন্য পাশে কালো টেবিলে চারজন লোক বসে আছে, অত্যন্ত উচ্চপদস্থ লোক এরা, দেখেই বোঝা যায়। অসুখী মানুষের মতো রাগী রাগী চেহারা। চুপচাপ বসে আছে, নিজেদের ভেতরেও কথা বলছে না। ডান পাশে একটা কালো টেবিলে বসে আছে বিজ্ঞানীরা, এদের দেখেও বোঝা যায় এরা বিজ্ঞানী। সবাই উশখুশ করছে, একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে, কাগজে কিছু লিখছে, চাপা স্বরে হাসছে। বসে থেকে থেকে আমি অধৈর্য হয়ে পাশে বসে থাকা নীষাকে বললাম, আর কতক্ষণ?

এই তো শুরু হল বলে।

অপেক্ষা করছি কী জন্যে?

ক্রুগো কম্পিউটারের জন্যে। প্রোগ্রাম লোড করছে। কোনটা লোড করে কে জানে, ম্যাগমা ফোর না করলেই হয়।

কেন, ম্যাগমা ফোর হলে কী হবে?

হবে না কিছুই, ম্যাগমা ফোর একটু কাঠখোট্টা ধরনের, রসবোধ কম।

আমি নীষার দিকে ঘুরে তাকালাম, এই পরিবেশেও সে একটি রসবোধসম্পন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রাম আশা করছে!

আমি কি-একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তক্ষুণি ক্রুগো কম্পিউটারের গলার স্বর শোনা গেল। একঘেয়ে গলার স্বরে এই কমিশনের নিয়ম-কানুন, উপস্থিত সদস্যদের পরিচয় ইত্যাদি শেষ করে আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করে।

আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল?

না, আমি মাথা নেড়ে বললাম, দেয়া যেতে পারে কি না সেটা নিয়ে তর্ক করতে পারি, কিন্তু দেয়া হয়েছিল কী না জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করতে পারব না।

ক্রুগো কম্পিউটার এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে যে, আপনাকে ঠিক যা জিজ্ঞেস করা হবে তার উত্তর দেবেন। এই কমিশন অবান্তর আলোচনায় উৎসাহী নয়।

তোমার তাই ধারণা? যারা হাজির আছে জিজ্ঞেস করে দেখ তোমার কচকচি শুনতে কারো মাথাব্যথা আছে কী না।

ক্রুগো কম্পিউটার আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, আপনাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে রুকুন গ্রহপূঞ্জে পাঠাননা হয়েছিল, সেখানে থেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে এলেন কেমন করে?

তুমি না এত বড় কম্পিউটার, সারা পৃথিবীতে এত নামডাক, তুমিই বল। মহাকাশযানের কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করে দেখ, তার সব জানার কথা।

আপনাকে যা জিজ্ঞেস করা হয়েছে তার উত্তর দিন। আপনি সুস্থ অবস্থায় কীভাবে ফিরে এলেন?

আমি উচ্চস্বরে একবার হাসার মতো শব্দ করে বললাম, বলতে লজ্জা হচ্ছে নাকি যে তোমার এত সাধের কম্পিউটার পুরোপুরি ধসে গিয়েছিল? মহাকাশযানের কম্পিউটারের পুরো মেমোরি কিভাবে লোপাট হয়েছিল, কমিশনকে বোঝাও দেখি!

বিজ্ঞানীদের ভেতর খানিকটা উত্তেজনা দেখা গেল, কিন্তু গো কম্পিউটার প্রশ্ন করা শেষ করার আগে তাদের কথা বলার অধিকার নেই।

মহাকাশযানের কম্পিউটারের মেমমারি কীভাবে মুছে গিয়েছে আপনি কি জানেন?

আমাকে ঘুম পাড়িয়ে পাঠানো হয়েছিল, তুমি কি আশা কর আমি স্বপ্নে সব খবরাখবর পাব?

চারজন উচ্চপদস্থ লোকের একজনের কাছে একটা হাতুড়ি আছে খেয়াল করি নি, সে সেটা দিয়ে টেবিলে দু বার শব্দ করে রাগী গলায় বলল, আপনি যদি সহযোগিতা করেন এই কমিশন বন্ধ করে দেয়া হবে, সেটি আপনার ভবিষ্যতের জন্য আশাপ্রদ নাও হতে পারে।

আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। নীষা আমাকে বলেছে আমি যা খুশি বলতে পারি, আমাকে কী করা হবে সেটা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে, কাজেই আমার ভয় পাবার নূতন কিছু নেই। কিন্তু কমিশন বন্ধ করে দেয়া হোক সেটা আমার ইচ্ছে নয়, বিজ্ঞানীদের সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই।

বললাম, বেশ, সহযোগিতা করব, কিন্তু অবান্তর প্রশ্ন করে লাভ নেই, উত্তর পাবেন না।

ক্রুগো কম্পিউটার এবারে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস জিজ্ঞেস করতে শুরু করে, আপনার এত আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এসেছে?

আমি থতমত খেয়ে বললাম, কিসের আত্মবিশ্বাস? আপনি জানেন আপনার আর কোনো ভয় নেই, সেটি কোথা থেকে এসেছে?

আমি আড়চোখে নীষার দিকে তাকালাম, সেও চোখ সুরু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন আমি কী উত্তর দিই সেটি তার জানার খুবই প্রয়োজন।

আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হিসেবে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে পাঠানো হয়েছিল, আমি সেখান থেকে ফিরে এসেছি, আমার শাস্তি ভোগ করেছি, এখন আমাকে তোমাদের মুক্তি দিতেই হবে। আমি এখন আর আসামী নই, আমি স্বাধীন মানুষ।

রুকুন গ্রহ থেকে আপনি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন, এর আগে কেউ আসে নি। কাজেই যতক্ষণ আমরা জানতে না পারছি কীভাবে আপনি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন, ততক্ষণ আপনাকে পৃথিবীর নিরাপত্তার খাতিরে অন্তরীণ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে।

আমি অনুভব করতে পারি ধীরে ধীরে আমার ভেতরে ক্রোধের জন্ম হচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, কম্পিউটারকে যেদিন মিথ্যা কথা বলা শেখানো হয়েছে, সেদিনই এই পৃথিবীকে খরচের খাতায় লেখা হয়ে গেছে।

আপনি কী বলতে চাইছেন?

আমি বলতে চাইছি তুমি একটা মিথ্যাবাদী ভণ্ড প্রতারক।

আপনি কেন আমাকে মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং প্রতারক বলে দাবি করছেন?

কারণ আমাকে অন্তরীণ করে রাখার একটামাত্র কারণ, আমি যেন বাইরের পৃথিবীকে বলতে না পারি আমাকে কীভাবে প্রতারণা করে একটা মহাকাশযানে পাঠানো হয়েছিল–

হঠাৎ নীষা আমার হাত চেপে ধরে, আমি থামতেই সে ঘুরে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, কিম জুরানের রক্তচাপ হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে, তাঁর বর্তমান অবস্থায় এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমি আপাতত এই কমিশন বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ করছি।

ক্রুগো কম্পিউটার শান্ত গলায় বলল, কমিশন সমাপ্ত হয়েছে। আমার আর কিছু প্রশ্ন করার নেই, আমার যা জানার ছিল তা জেনে নিয়েছি।

একজন বিজ্ঞানী হাত তুলে বলল, আমাদের কিছু জিনিস জিজ্ঞেস করার ছিল।

নীষা মাথা নেড়ে বলল, আজ আর সম্ভব নয়।

হাতুড়ি হাতে উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি বলল, তাহলে এখন কি কমিশনের সিদ্ধান্ত জানতে পারি?

হ্যাঁ। ক্রুগো কম্পিউটার একঘেয়ে গলায় বলল, কিম জুরানকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হিসেবে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে পাঠানো হয়েছিল, তিনি সেই শাস্তি ভোগ করে এসেছেন, কাজেই তাঁকে মুক্তি দেয়া হল।

আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পরলাম না, আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে নীষার দিকে তাকালাম। নীষা গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখে হাসি নেই। জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?

পুরোটা শুনুন আগে।

ক্রুগো কম্পিউটার আবার শুরু করে, কিম জুরান এই কমিশনে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি এই মহাকাশ অভিযানের অনেক তথ্য জানেন, যা আমাদের সাথে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক। তাঁর অস্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসের প্রধান কারণ সম্ভবত কোনো-এক ষড়যন্ত্রী দলের সাথে যোগাযোগ। আপাতত সেই ষড়যন্ত্ৰী দলকে আমি রবোট্রনের কোনো-এক দল হিসেবে সন্দেহ করছি। এইসব কারণে আমাদের কিম জুরানের পুরো স্মৃতিটুকু জানা প্রয়োজন। আমি তাঁর মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করে পুরো স্মৃতিটুকু সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।

স্ক্যানিং? আমার মাথা ঘুরে ওঠে, কী বলছে ক্রুগো কম্পিউটার। মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করবে মানে?

কিম জুরানের মস্তিস্ক স্ক্যানিং করার উদ্দেশ্য দু’টি। এক, তাঁর স্মৃতি থেকে আমরা যাবতীয় গোপন জিনিস জানতে পারব। বিজ্ঞানীরা রুকুন গ্রহপুঞ্জ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাবেন। দুই, তাঁর নিজের স্মৃতি পুরোপুরি অপসারণ করা হবে বলে তাঁর জীবনের দুঃখজনক ইতিহাসকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে নূতন জীবন শুরু করতে পারবেন।

আমি অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রেখেছিলাম, আর পারলাম না, একেবারে বোমার মতো ফেটে পড়লাম, এর চেয়ে আমাকে মেরে ফেল না কেন? আমার পুরো স্মৃতি যদি ধ্বংস করে দাও, তাহলে আমার আর এই চেয়ারটার মাঝে পার্থক্য কী? আমাকে মুক্তি দিয়ে তাহলে কি লাভ? আমি কি শুধু হাত-পা আর শরীর?

আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন কিম জুরান, ক্রুগো কম্পিউটার শান্ত স্বরে বলল, আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। সমাজের ভালমন্দের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব আছে।

আমি রাগে আত্মহারা হয়ে বললাম, চুপ কর বেটা বদমাইশ। জোচ্চোর কোথাকার–

নীষা আমার উপর ঝুঁকে পড়ে, আমি আমার হাতে সিরিঞ্জের একটা খোঁচা অনুভব করলাম, সাথে সাথে হঠাৎ চোখের উপর অন্ধকার নেমে আসে। জ্ঞান হারানোর পূর্বমুহূর্তে নীষার চোখের দিকে তাকালাম, শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটিতে আতঙ্ক নয়, কৌতুক।