• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০২. লুকাস নামের রবোট

লাইব্রেরি » মুহম্মদ জাফর ইকবাল » সায়েন্স ফিকশন সমগ্র » ক্রুগো » ০২. লুকাস নামের রবোট

২. লুকাস নামের রবোট

আমি উদ্দেশাহীনভাবে শহরের সবচেয়ে সম্রান্ত অঞ্চলের মাঝে হাঁটছিলাম। দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের অঞ্চল এটি, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ছাড়া আর কেউ আসতে পারে না। আমার পক্ষে কখানোই এখানে আসা সম্ভব হত না, কিন্তু আমাকে স্বাধীনভাবে ঘুরতে দেয়ার সময় কর্মকর্তারা আমাকে একটা ছোট লাল কার্ড দিয়েছে, এই কার্ডটির ক্ষমতার কোনো সীমা নেই। অত্যন্ত বড় বিজ্ঞানী বা অত্যন্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তকর্তা ছাড়া আর কেউ এই লাল কার্ড ব্যবহার করতে পারে না, আমাকে সম্ভবত করুণা করে দেয়া হয়েছে। এটি ব্যবহার করে যে-কোনো যানবাহনে যে-কোনো অঞ্চলে যাওয়া যায়, যে-কোনো হোটেলরেস্টুরেন্ট বা অবসর বিনোদনের সুযোগ নেয়া যায়, এমন কি সরকারি নিয়ন্ত্রণে চালিত গোপন প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যন্ত প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। এই কার্ডটির ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যে আমি অতিপারমাণবিক অস্ত্র কারখানা থেকে ঘুরে এসেছি।

আজ আমার জীবনের শেষ সপ্তাহের শেষ দিনটি। আগামীকাল দুপুরে আমার মহাকাশ কেন্দ্রে ফিরে যাবার কথা। সন্ধ্যাবেলা মহাকাশযানটি আমাকে নিয়ে আমার অন্তিম যাত্রা শুরু করবে। কথাটি ভুলে থাকার চেষ্টা করে লাভ নেই, এটি বিকারগ্রস্ত মানুষের স্বপ্নের মতো আমার মাথায় জেগে আছে।

আমি একটা সম্রান্ত বিপণিকেন্দ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় খানিকটা উত্তেজনা লক্ষ করলাম। বেশ কয়েকটা পুলিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইতস্তত সশস্ত্র পুলিস, হাতে রনোগান। দেখে মনে হল বেশ খানিকটা এলাকা তারা ঘিরে রেখেছে, নিশ্চয়ই কয়েকটা রবোট্রন ধরা পড়েছে। রবোট্রন রবোটের সবচেয়ে শক্তিশালী আর উন্নত গোত্রটি। পাঁচ বছর আগে তাদের ধ্বংস করার আইন পাস করা হয়েছে, রবোট্রন গোষ্ঠী যদিও মানুষের তৈরি, তারা মানুষের এই আইন মেনে নিতে রাজি হয় নি। বিরাটসংখ্যক রবোট্রন লোকালয় থেকে পালিয়ে যায়, সেই থেকে তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করা হচ্ছে। রবোট্রন জীবিত প্রাণী নয়, একটি যন্ত্রবিশেষ, তাই হত্যা শব্দটি তাদের জন্যে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু আত্মগোপন করার জন্যে তারা মানুষের এত চমৎকার রূপ নিয়েছে যে অঙ্গব্যবচ্ছেদ না করে আজকাল আর বলা সম্ভব নয় কোনটি মানুষ, আর কোনটি রবোট্রন। আমি জাদুঘরে বিকল রবোট্রন। দেখেছি, সত্যিকারের রবোট্রন কখনো দেখিনি, তাই খানিকটা কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

বিপণিকেন্দ্রটি থেকে লোকজন বের হয়ে আসছিল, আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম তাদের মাঝে কে রবোট হতে পারে। নানা বয়সের, নানা আকারের, নারী পুরুষ-শিশু কাউকে রবোট মনে হয় না। এমন সময় দু’ জন তরুণ-তরুণীকে তাড়াহুড়া করে বের হতে দেখা গেল, দেখে ভুলেও রবোট বলে সন্দেহ হয় না। দরজায় দাঁড়ানো পুলিস অফিসারটি তাদের থামিয়ে কী—সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। একই পরেই পুলিস অফিসারটি তাদের কী-একটা আদেশ দিল এবং দু’ জন বাধ্য শিশুর মতো দেয়ালের পাশে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পুলিস অফিসারটি গলায় লাগানো চৌকোনা বাক্সে কার সাথে জানি খানিকক্ষণ কথা বলে মেগাফোনটা টেনে নিয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করল, এই দু’টি রবোটের এক শ’ ফুটের ভেতরে কেউ থাকবেন না, এখন এই দুটিকে ধ্বংস করা হবে।

আমি অবাক হয়ে এই দু’ জন তরুণ-তরুণীর দিকে তাকিয়ে রইলাম, এরা তাহলে রবোট। কী মিষ্টি চেহারার মেয়েটি আর মুখে কী গাঢ় বিষাদের ছায়া! ছেলেটি মেয়েটির মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন বলল, শুনে মেয়েটি মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ, যখন মাথা তুলল তখন চোখে পানি টলটল করছে। ছেলেটি এবারে মেয়েটিকে আলিঙ্গন করে তারপর ছেড়ে দেয়। দু’ জন মাথা নিচু করে আবার দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ায়, মাথা নেড়ে বলে, তারা প্রস্তুত। পুলিস অফিসারটি হাতের বিশাল অস্ত্রটি তুলে ধরে মিটার ঘুরিয়ে কী যেন ঠিক করে নেয়, তারপর সোজাসুজি মেয়েটির বুকে গুলি করল। আমি শিউরে উঠে সামনের রেলি ওটা খামচে ধরি, এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে আসবে এ ধরনের একটা অনুভূতি হচ্ছিল, কিন্তু সেরকম কিছু হল না। বুকের মাঝে প্রায় চার ইঞ্চি ব্যাসের একটা ফুটো হয়ে গেল, ভেতর থেকে বারকয়েক বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ, সাথে সাথে কিছু কালো ধোঁয়া বের হয়ে আসে। মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে অনেক কষ্টে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতে করতে একসময় হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়। ছেলেটি ঠোঁট কামড়ে একদৃষ্টে পুলিস অফিসারটির দিকে তাকিয়ে রইল। হাতের অতিকায় অস্ত্রটি এখন তার দিকে উচু করে ধরা হয়েছে।

একটি রবোট ধ্বংস করা আর একটি বাইসাইকেল ধ্বংস করার মাঝে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। কাজেই একটা সাইকেল ধ্বংস করার দৃশ্যে যেটুকু কষ্ট হওয়া উচিত, একটি রবোট ধ্বংস হওয়ার দৃশ্যে তার থেকে বেশি কষ্ট হওয়া উচিত না। কিন্তু মেয়েটির যন্ত্রণাকাতর মুখ এবং ছেলেটির ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে থাকার দৃশ্যে আমি একটি কঠিন আঘাত পেলাম। কী করছি বোঝার আগেই আমি আবিষ্কার করলাম, আমি ছুটে পুলিস অফিসারের হাত চেপে ধরেছি।

এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পুলিস অফিসারটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, দাঁড়ান এক সেকেণ্ড!

পুলিস অফিসারটি ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে গেল, চোখের কোনা দিয়ে রবোট দু’টির উপর চোখ রাখতে রাখতে বলল, কি ব্যাপার?

আমি কী ভেবে পকেট থেকে লাল কার্ডটি বের করলাম, সাথে সাথে জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হল, পুলিস অফিসারটি অস্ত্রটি নামিয়ে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করল। আমি লাল কার্ডটি তার হাতে দিলাম, সে সেটি তার কোমরে ঝোলানো কমিউনিকেশান বাক্সে প্রবেশ করিয়ে মূল কম্পিউটার থেকে এই লাল। কার্ডের মালিকের পরিচয় বের করে আনল। বাক্সে আমার চেহারা ফুটে ওঠার পর আমার সাথে চেহারা মিলিয়ে নিয়ে কার্ডটি ফেরত দিয়ে বলল, আপনার জন্যে কী করতে পারি?

আমি রবোট তরুণটির দিকে দেখিয়ে বললাম, আমার এই রবোটটি দরকার।

পুলিস অফিসারটির মাথায় বাজ পড়লেও সে এত অবাক হত কিনা সন্দেহ। খুব তাড়াতাড়ি সে মুখের ভাব স্বাভাবিক করে বলল, আপনার সত্যি দরকার?

হ্যাঁ।

বেশ, আপনার যা ইচ্ছা। তারপর গলা নামিয়ে বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন এরা অত্যন্ত ভয়ংকর প্রকৃতির?

জানি।

বেশ, বেশ। পুলিস অফিসারটি হাত নেড়ে তরুণটিকে ডাকল। তরুণটি এক পা এগিয়ে এসে আবার মেয়েটির কাছে ফিরে যায়, তাকে সোজা করে শুইয়ে খোলা চোখ দু’টি যত্ন করে বন্ধ করে দিল। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসে।

পুলিস অফিসারটি কিছু বলার আগেই আমি তার হাত ধরে টেনে বললাম, আমার সাথে চল।

চারদিকে মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল। আমি ভিড় ঠেলে তরুণটিকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় বিস্ময়ের একটা গুঞ্জন জেগে ওঠে। আমি কোনোকিছুকে পরোয়া না করে সোজা একটা ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে যাই। ট্রাক্সি ড্রাইভার দরজা খোলার আগেই আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ড্রাইভারের হাতে লাল কার্ডটি ধরিয়ে দিলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার তার বাক্সে সেটা একবার প্রবেশ করিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

সামনে।

ট্যাক্সি ছুটে চলল, গতিবেগ দেখতে দেখতে আশি নবৃই এক শ’ হয়ে দুই শ’ কিলোমিটারে লাফিয়ে উঠে স্থির হয়ে গেল।

রবোট তরুণর্টি এতক্ষণ একটি কথাও বলে নি, এবারে খুব আস্তে আস্তে, শোনা যায় না এরকম স্বরে বলল, আপনাকে কী জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে?

আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম, তুমি কেমন করে জানলে?

আপনার লাল কার্ডটি সবসময়েই গো কম্পিউটারে আপনার উপস্থিতি জানিয়ে খবর পাঠাচ্ছে, তা ছাড়াও আমার মনে হচ্ছে আপনার হৃৎপিণ্ডে একটা ট্রাকিওশান আছে, এই মুহূর্তে সেটা চালু করা হল। আপনাকে কর্মকর্তাদের দরকার এবং আপনি পুরোপুরি তাদের হাতের মুঠোয় আছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ছাড়া আর কাউকে এত তীক্ষ্ণ নজরে রাখা হয় না। এ ছাড়াও আপনি যেভাবে আমাকে বাঁচিয়ে এনেছেন সেটি অবৈধ, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যেহেতু আপনার সে ভয় নেই, আমি ধরে নিচ্ছি আপনাকে ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, যুক্তিতে কোনো ভুল নেই, আমাকে সত্যি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

রবোট তরুণটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেন, জিজ্ঞেস করতে পারি?

ক্রুগো কম্পিউটার থেকে একটা সংবাদ বের করা নিয়ে একটা ব্যাপার হয়েছিল, আমি জিনিসটা ঠিক আলোচনা করতে চাই না। বিশেষ করে তোমার মতো একজন রবোটের সাথে–

ও। তরুণটি একটু আহত হল মনে হল, কথা ঘোরানোর জন্যে বলল, আমাকে বাঁচিয়ে আনার জন্যে ধন্যবাদ। এখন আমাকে নিয়ে আপনার কী পরিকল্পনা?

কিছু না।

আমি পালিয়ে গেলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?

না।

চমৎকার! আপনার কোনো ক্ষতি করতে আমার খুব খারাপ লাগত।

আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, মানে?

একটু আগে যখন আমি আর লানা ধরা পড়েছিলাম, আমরা তখন পালানোর কোনো চেষ্টা করি নি। কারণ তখন আমাদের পালানোর সম্ভাবনা ছিল শতকরা দশমিক শূন্য শূন্য এক থেকে তিনের ভেতর। যখন সম্ভাবনা বেশি থাকে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। এখন পালিয়ে যাবার চেষ্টায় সফল হবার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ থেকে বেশি, কাজেই আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব। আপনি যদি বাধা দেবার চেষ্টা করতেন, আপনাকে আমার আঘাত করতে হত।

আমি যতদূর জানি, তোমাদের, রবোটদের এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, তোমরা কখনো কোনো মানুষের ক্ষতি করতে পার না।

সেটি আর সত্যি নয়। আমরা পালিয়ে যাবার পর আমাদের কপোট্রনে পরিবর্তন করে নিয়েছি, আমাদের এ ছাড়া বেঁচে থাকা মুশকিল।

ও, আচ্ছা। আমি কিছুক্ষণ তরুণটিকে লক্ষ করে বললাম, তোমার সাথে ঐ মেয়েটি কে ছিল?

আমার বান্ধবী লানা। আমাদের দু’ জনের টিউনিং সার্কিট এক ফ্রিকোয়েন্সিতে রেজোনেট করত।

তার মানে কি?

তার মানে সে আমার খুব আপনজন ছিল।

তোমাদের কি দুঃখবোধ আছে?

তরুণ রবোটটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে হেসে বলল, আছে। মানুষের যে-সব অনুভূতি থাকে আমাদের সব আছে। আপনি জানতে চাইছেন না। মারা যাওয়াতে আমি দুঃখ পেয়েছি কিনা। আমি দুঃখ পেয়েছি, আমি যে কী কষ্ট পাচ্ছি। আপনাকে বোঝাতে পারব না। কখনো আপনার কোনো প্রিয়জন মারা গিয়ে থাকলে হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন।

আমার এই রবোট তরুণটির জন্যে কষ্ট হতে থাকে। তার হাত স্পর্শ করে বললাম, আমি দুঃখিত–

আমার নাম লুকাস।

আমি দুঃখিত লুকাস, আমি খুবই দুঃখিত।

লুকাস মাথা নিচু করে বসে থাকে, আমি দেখতে পেলাম তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গাল বেয়ে পড়ছে। মানুষের অপূর্ব অনুকরণ করেছে রবোট্রন নামের এই রবোটেরা!

ট্যাক্সি ড্রাইভার হঠাৎ গতিবেগ কমিয়ে বলল, সামনে একটা পুলিসের গাড়ি আমাদের থামতে বলছে।

লুকাস মুখ না তুলে বলল, ভান কর তুমি থামতে যাচ্ছ, কিন্তু থেমো না, শেষ মুহূর্তে গতিবেগ বাড়িয়ে তিন শ কিলোমিটার করে ফেলবে।

কিন্তু–

লুকাস পকেট থেকে একটা মাথা-লম্বা রিভলবার বের করে তার মাথায় কীএকটা জিনিস পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লাগাতে থাকে। ট্যাক্সি ড্রাইভার সেটা দেখে আর উচ্চবাচ্য করার সাহস পায় না। গতিবেগ কমিয়ে এনে ঠিক থামার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ করে গতি বাড়িয়ে দিয়ে গুলির মতো বের হয়ে গেল।

লুকাস আস্তে আস্তে বলল, চমৎকার!

পুলিসের গাড়িটি সঙ্গত কারণেই পিছু নেয়ার চেষ্টা করল। লুকাসকে বিচলিত মনে হল না, খানিকক্ষণ পুলিসের গাড়িটি লক্ষ করে হাতের বড় রিভলবারটি তুলে গুলি করে। হাততালির মতো একটা শব্দ হল, আমি দেখতে পেলাম পুলিসের গাড়িটি ঝাঁকুনি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে, গাড়ির ড্রাইভার প্রাণপণে সামলে নিয়ে রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।

লুকাস পকেট থেকে চৌকোনা বাক্স বের করে তাতে কী—সব সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে কয়েকটা লিভার টেনে একটা মিটার লক্ষ করতে থাকে। আমি জিনিসটি চিনতে পারলাম, রাডারকে ফাঁকি দেবার একটা প্রাচীন যন্ত্র, রাডারের প্রতিফলিত মাইক্রোওয়েভের কম্পনের সংখ্যা কমিয়ে অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয়। এটি

যে এখনো ব্যবহার করা হয় আমার ধারণা ছিল না।

আমি কৌতূহল নিয়ে লুকাসের কাজকর্ম লক্ষ করতে থাকি। নিপুণ দক্ষ হাত, আশ্চর্য রকম শান্ত। এত রকম উত্তেজনার মাঝেও তার এতটুকু বিচলিত হবার লক্ষণ নেই। সবকিছু পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কি কোনো ধরনের সাহায্যের দরকার?

তুমি কী ধরনের সাহায্যের কথা বলছ?

আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আমি আপনার প্রাণ বাঁচানোর কথা ভাবছিলাম।

আমার বুকে রক্ত ছলাৎ করে ওঠে, চমকে তার দিকে তাকালাম, সে কি সত্যি বলছে? সে কি জানে না আমার হৃৎপিণ্ডে একটা ট্রাকিওশান বসানো আছে, যেই মুহূর্তে ক্রুগো কম্পিউটার থেকে সেটা চালিয়ে দিয়ে একটা বিশেষ তরঙ্গ বের করতে শুরু করবে; আমার নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে একটা সুইচ ঘুরিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে, আমাকে মেরে না ফেলে শুধু অসহনীয় যন্ত্রণা দিতে পারে কিংবা ইচ্ছা করলে চিরদিনের মতো বোধশক্তিহীন একটা জড় পদার্থে পরিণত করে ফেলতে পারে।

আমি কী ভাবছিলাম লুকাস অনুমান করতে পারে; তাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আপনার ট্রাকিওশানের কথা ভাবছেন?

হ্যাঁ।

আমি সেটা বের করে ফেলার কথা ভাবছিলাম।

সেটা সম্ভব?

এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়, কারণ আমার কাছে ঠিক যন্ত্রপাতি নেই। কিন্তু আপনাকে আমাদের কোনো-একটা জায়গায় নিতে পারলে চেষ্টা করে দেখতে পারতাম। চেষ্টা করে দেখব?

দেখ।

আগেই বলে রাখছি, সময় খুব কম। সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা দুই ভাগেরও কম।

আমি বুঝতে পারছি।

লুকাস হঠাৎ সামনে ঝুঁকে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে রাস্তার পাশে থামতে বলল। ড্রাইভার আপত্তি করে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, লুকাসের হাতের লম্বা রিভলবারটি দেখে চুপ করে গেল। সাবধানে ট্যাক্সিটা রাস্তার পাশে দাঁড় করাতেই লুকাস তাকে নেমে যেতে ইঙ্গিত করে। ট্যাক্সি ড্রাইভার আপত্তি না করে ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতেই লুকাস ড্রাইভারের সীটে গিয়ে বসে। স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে মুহূর্তে সে গতিবেগ তিন শ’ কিলোমিটার করে ফেলল। লুকাস অত্যন্ত দক্ষ ড্রাইভার, রাস্তাঘাটও খুব ভালো চেনে মনে হল, কারণ ট্যাক্সির কম্পিউটারের সাহায্য না নিয়ে এত অবলীলায় সে একটির পর একটি রাস্তা বদল করতে থাকে যে দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। ও কোন দিকে যাচ্ছে দেখে আমি খুব অবাক হলাম, শহরের দক্ষিণ প্রান্তে, যেখানে খাড়া পাহাড় প্রায় হাজারখানেক ফিট সোজা নেমে গেছে, সেখানে কোনো মানুষজনের বসতি আছে বলে আমার জানা নেই। আমি লুকাসকে সেটা নিয়ে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে আমি আমার সারা শরীরে একটা অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব করলাম, নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে আমার ট্রাকিওশানে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবেশ করানো হয়েছে।

আমি নিশ্চয়ই আর্তচিৎকার করে উঠেছিলাম, কারণ লুকাস সাথে সাথে গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা আমার সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, আমি চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না। নিচের চোয়াল শক্ত হয়ে আটকে যায় এবং আমার সমস্ত শরীর ঘামতে থাকে। আমি অনুভব করলাম লুকাস আমার উপর ঝুঁকে পড়ে আমাকে লক্ষ করছে।

যন্ত্রণা যে-রকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ করে থেমে গেল। সেই মুহূর্তে আমার যে-রকম লেগেছিল সারা জীবনে কখনো সে-রকম আরাম লেগেছে বলে মনে হয় না। লুকাস ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আস্তে আস্তে বলল, ট্রাকিওশান ব্যবহার করা শুরু করেছে। আমি খুব দুঃখিত, আমার সাহায্য করার সময় পার হয়ে গেছে।

আমি ব্যাপারটি উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। যন্ত্রণাটা এত ভয়াবহ ছিল যে সেটি আপাতত নেই ভেবেই আমার বুক জুড়িয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে কী হবে সেটাও আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না।

লুকাস বলল, এখন আপনাকে একটু পরে পরে এই যন্ত্রণাটুকু দেয়া হবে। প্রত্যেকবার আগের থেকে বেশি সময় করে, যন্ত্রণার মাত্রাও বেড়ে যাবে ধীরে ধীরে। আপনি যতক্ষণ ওদের কাছে ফিরে না যাচ্ছেন ততক্ষণ এ-রকম চলতে থাকবে।

যন্ত্রণাটা আবার ফিরে আসবে ভেবেই ভয়ে আমার সারা শরীর শীতল হয়ে আসে। দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আমি কীভাবে ফিরে যাব?

ট্যাক্সিটি কম্পিউটার কন্ট্রোলে দিয়ে দিলে নিজেই চলে যাবে, সময় একটু বেশি লাগবে, কিন্তু পৌছে যাবেন।

আমি তাহলে যাই। আবার যন্ত্রণাটা আসার আগেই পৌঁছে যেতে চাই।

লুকাস ম্লান হেসে মাথা নাড়ল, আমি খুব দুঃখিত, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না।

আমার ভাগ্য!

লুকাস একটু ইতস্তত করে বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ড কবে কার্যকর করবে আপনি জানেন?

আক্ষরিক অর্থে জানি না, তবে জানি। মৃত্যুদণ্ডটা একটু অন্যরকম, একটি মহাকাশযানে ঘুম পাড়িয়ে তুলে দেয়া হবে, যখন ফিরে আসব তখন দেখা যাবে আমি মৃত।

লুকাসের চোখ দুটি বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়, রবোট্রনেরা মানুষের ভাবভঙ্গি এত অবিকল অনুকরণ করতে পারে যে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! তার খানিকক্ষণ সময় লাগে ধাতস্ত হতে, ফ্যাকাসে মুখে আস্তে আস্তে বলে, আপনার মহাকাশযানটি কি কাল সন্ধ্যায় রওনা দিচ্ছে?

হ্যাঁ।

সর্বনাশ!

কী হয়েছে?

লুকাস শক্ত মুখে বলল, আপনাকে সাংঘাতিকভাবে প্রতারণা করা হয়েছে।

কী রকম? আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, মৃত্যু থেকে বেশিকিছু তো হতে পারে!

পারে। লুকাস পাথরের মতো মুখ করে বলল, পারে, মৃত্যু থেকেও ভয়ানক জিনিস হতে পারে।

হঠাৎ সে ছটফট করে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ে, বাইরে একটু পায়চারি করে যখন ফিরে আসে তখন তার হাতে উদ্যত রিভলবার, আমার মাথার দিকে তাক করে বলল, আপনাকে আমি এখনই গুলি করে শেষ করে দেব, আপনাকে তাহলে মহাকাশযানে করে যেতে হবে না।

ট্রিগার টিপতে গিয়ে লুকাস থেমে গেল, আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি আপনার একটা মস্তবড় উপকার করছি, আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আমি আপনার সাথে মিথ্যা কথা বলব না।

আমি হতবাক হয়ে লুকাসের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তাকে বাধা দেবার ক্ষমতা নেই। লুকাস স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার রিভলবার তুলে ধরল।

সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হল। বিস্ফোরকের ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম আমি, আর অবাক হয়ে দেখলাম লুকাসের হাত কবজির কাছ থেকে ছিড়ে উড়ে গেছে। লুকাস খপ করে নিজের কাটা হাতটা ধরে বিকৃত মুখে কী-একটা বলে চেচিয়ে ওঠে, কেউ-একজন নিশ্চয়ই তাকে গুলি করেছে। দূরে পুলিসের গাড়ি দেখা যাচ্ছে, শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম একটা হেলিকপ্টারও আছে উপরে কোথাও।

পারলাম না, আমি পারলাম না, লুকাস কাটা হাতটা বিদায়ের ভঙ্গিতে নেড়ে ছুটে গেল দেয়ালের দিকে। সামনে পুলিসের গাড়ি থেকে আবার তাকে গুলি করা হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হল, কিন্তু তার গায়ে গুলি লাগল কিনা বুঝতে পারলাম না। ধোয়া সরে গেলে দেখতে পেলাম লুকাস তখনো ছুটছে, দেয়ালের পাশে গিয়ে এক লাফে সে প্রায় বিশ ফুট উচু দেয়ালে উঠে গেল, উপরে বৈদ্যুতিক তারগুলো ধরে সে নিজেকে মুহূর্তের জন্যে সামলে নেয়। বৈদ্যুতিক তারে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার ভোন্ট থাকার কথা, কিন্তু লুকাসের কাছে সেটা কোনো সমস্যা বলে মনে হল না। আবার পুলিসের গাড়ি থেকে লুকাসকে গুলি করা হল, গুলির আঘাতে লুকাসকে দেয়ালের অন্য পাশে ছিটকে পড়ে যেতে দেখলাম, নিচে খাড়া খাদ অন্তত দুই শ’ ফুট নেমে গেছে, কপাল খারাপ হলে হাজারখানেক ফুট হওয়াও বিচিত্র নয়। মানুষ হলে বেঁচে থাকার কোনো প্রশ্নই আসত না, কিন্তু রবোটেরা, বিশেষ করে এই আশ্চর্য রবোট্রনেরা কতটুকু আঘাত সহ্য করতে পারে বলা কঠিন। গুলিটা কোথায় লেগেছে কে জানে, হয়তো এমন জায়গায় লেগেছে যে বেশি ক্ষতি হয় নি, হয়তো সামলে নেবে। আমি নিজের অজ্ঞাতেই প্রার্থনা করতে থাকি লুকাস যেন ঠিকঠিকভাবে পালিয়ে যেতে পারে।

পুলিসের গাড়িটি সাইরেন বাজাতে বাজাতে আমার ট্যাক্সির পাশে এসে দাঁড়াল। একজন পুলিস অফিসার ধীরেসুস্থে নেমে দেয়ালটার দিকে এগিয়ে যায়। আরেকজন হাতের চৌকোনা বাক্সে কার সাথে জানি কথা বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কাছে এসে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে আমার দিকে সহৃদয়ভাবে হেসে জিজ্ঞেস করল, কি খবর আপনার?

আমি উত্তরে ভদ্রতাসূচক কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তক্ষুণি দ্বিতীয় বার ট্রাকিওশানটি চালু করা হল। এক মুহূর্তে আমার সারা শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে, মনে হতে থাকে কেউ যেন গনগনে গরম সুচ আমার লোমকূপ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মাথার ভেতরে কেউ যেন গলিত সীসা ঢেলে সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন করে দিল। আমি গাড়ির সীটটি খামচে ধরে প্রাণপণে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করলাম, নিজের অজান্তে আমার গলা দিয়ে বীভৎস গোঙানোর মতো আওয়াজ বের হতে থাকে। আমার মনে হয় অনন্তকাল থেকে আমি যেন ওখানে পড়ে আছি। অনেক কষ্টে আমি চোখ খুলে তাকালাম, পুলিস অফিসারটি তখনো মুখে হাসি নিয়ে আমাকে দেখছে।

আমার কিছু করার নেই, অসহায়ভাবে যন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

Category: ক্রুগো
পূর্ববর্তী:
« ০১. মৃত্যুদণ্ডের আসামী
পরবর্তী:
০৩. শাস্তি »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑