অন্তরে পাপ ছিল (উপন্যাস)

অন্তরে পাপ ছিল (উপন্যাস)

কে যেন বলে গেছেন, খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য।

এ-কথাটা ভাবামাত্রই হেসে ফেললেন বৃদ্ধ হুনুর ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে এসিজি। কারণ, এই কথাটা কোনও মহাপুরুষ মোটেই বলে যাননি। বহু বছর ধরে খুন এবং খুনি ঘাঁটাঘাঁটি করে এই বিশ্বাসে তিনি নিজেই পৌঁছে গেছেন। একটা কথা বহুদিন ধরে বিশ্বাস করলে একসময় মনে হয়, কথাটা নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও মহাপুরুষ বলে গেছেন। নিজের বিশ্বাসের দায় তখন অনায়াসে কোনও মহাজনের ঘাড়ে চেপে যায়।

একটু আগেই একটা টেলিফোন এসেছিল। গড়পাড় থেকে কে এক দীপ্তিমান বসাক এসিজিকে ফোন করেছিলেন।

‘হ্যালো, ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত আছেন?’ একটু ভারি অথচ বেশ চমৎকার গলায় প্রশ্ন করল কেউ।

‘হ্যাঁ—বলছি।’

‘আ-আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। আ-আমাকে আপনি চিনবেন না।’ থতিয়ে-থতিয়ে বললেন দীপ্তিমান, ‘একটা জরুরি ব্যাপারে আপনার হেলপ চাইছি। যদি কাইন্ডলি আপনার সঙ্গে দেখা করার পারমিশান দেন…।’

দীপ্তিমান বসাক নামে কাউকে চেনেন না এসিজি। কী করে তিনি এসিজির ফোন-নম্বর পেলেন কে জানে! তবে ভদ্রলোকের গলা বেশ উত্তেজিত এবং নার্ভাস বলে মনে হল।

‘কী ব্যাপারে দেখা করতে চান আপনি?’ আন্তরিক গলায় জানতে চাইলেন এসিজি।

অশোকচন্দ্র একসময় রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করতেন। সেটা জেনে অনেকে ফিজিক্সের সমস্যা নিয়ে আসেন। তবে তাঁরা সবই পাড়ার লোক। আর এলাকার বাইরে থেকে অনেকে যোগাযোগ করেন ছাত্র পড়ানোর জন্য। তাতে তিনি বিব্রত হন—অনেকসময় বিরক্তও হন। কারণ, কোচিং ক্লাস তিনি অপছন্দ করেন।

দীপ্তিমান কি ছাত্র পড়ানোর ব্যাপারে দেখা করতে চান নাকি?

‘আমার খুব ক্লোজ একজন রিলেটিভ পাঁচদিন আগে মারা গেছেন। অ্যাক্সিডেন্ট। মানে, এমনিতে অ্যাক্সিডেন্ট বলেই মনে হচ্ছে। তবে…।’

এসিজি সজাগ হলেন পলকে। মাথার ধবধবে চুলের গোছায় আলতো করে কয়েকবার টান মারলেন।

‘তবে কী?’

‘আপনাকে…আপনাকে প্রমাণ করতে হবে ব্যাপারটা…ব্যাপারটা জেনুইন অ্যাক্সিডেন্ট। অন্য কিছু নয়।’ ফোনের ও-প্রান্তে দীপ্তিমানের গলা কাঁপছিল।

‘আপনার কি ধারণা ব্যাপারটা আসলে মার্ডার?

‘হতেও তো পারে!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান বসাক : ‘আবার নাও হতে পারে। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলব। আজ সন্ধে সাতটা নাগাদ গেলে আপনার অসুবিধে হবে?’

দীপ্তিমানের কথায় একটা আকুল ভাব টের পাচ্ছিলেন এসিজি। তাই কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে রাজি হলেন। বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দীপ্তিমানকে বললেন সন্ধে সাতটায় আসতে।

আর তারপরই মনে হল ওই কথাটা : খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য। কারণ, আপাতভাবে নির্দোষ যে-মানুষটা স্বাধীনভাবে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে, তার দিকে বেপরোয়া আঙুল তুলে খুনের কলঙ্কের সিলমোহর তার কপালে স্থায়ীভাবে এঁকে দেওয়া—সত্যিই খুব জঘন্য। তখন এসিজির নিজেকেই কেমন অপরাধী বলে মনে হয়।

একটা সিগারেট ধরালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর কাছে এসে দীপ্তিমান কী বলবেন কে জানে! তা ছাড়া, তাঁর ওই রিলেটিভ কোন থানার এলাকায় মারা গেছেন এসিজি জানেন না। যদি সত্যি-সত্যিই তাঁকে রহস্যভেদের কাজে নামতে হয় তা হলে ব্যাপারটা অনেকটা নাক গলানোর মতো ব্যাপার হয়ে যাবে। সেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।

সুতরাং সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন অশোকচন্দ্র। লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াডে ডায়াল করলেন।

দীপ্তিমান বসাক যখন এসিজির শ্যামবাজারে ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলেন তখন সাতটা বেজে মিনিট পনেরো হয়েছে।

রঘুপতি যাদব এসেছে অনেক আগেই। বসবার ঘরে বসে আয়েস করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল রঘুপতি। আর প্রাক্তন স্যারের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে নানান কথা শুনছিল। সম্প্রতি এসিজি পাখির ডাকের স্পেকট্রাল অ্যানালিসিস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। বিদেশে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটে এ নিয়ে গবেষণা করে সিগনাল রিকন্সট্রাকশনের মাধ্যমে কোনও-কোনও পাখির ডাকের হুবহু নকল করতে পেরেছে। এমনকী, তারা বহু স্ত্রী-পাখির ব্রিডিং কল নকল করে পুরুষ-পাখিকে গাছের আড়াল থেকে বাইরে টেনে এনেছে।

এসব রোমাঞ্চকর গবেষণার কথাই এসিজি শোনাচ্ছিলেন রঘুপতিকে। আর রঘুপতি অবাক হয়ে লম্বা ছিপছিপে মানুষটাকে দেখছিল। কোথায় ফিজিক্স, আর কোথায় পাখি! আর কোথায়ই বা গোয়েন্দাগিরি!

‘স্যার, কী করে যে আপনি এতদিকে মন লাগাতে পারেন সে আপনিই জানেন!’ কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বলল রঘুপতি।

হাতের সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে এসিজি বললেন, ‘মন তো লাগাই না! মন লেগে যায়।’

ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।

এসিজি ওঠার আগেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল রঘুপতি। প্রাক্তন স্যারের দিকে ইশারা করে বলল, ‘আপ বৈঠিয়ে…।’ এবং এগিয়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল।

‘নমস্কার। আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। জ্যামের জন্যে পনেরো মিনিট দেরি হয়ে গেল।’

এ-কথা বলে ঘরে যিনি ঢুকলেন তাঁকে ভালো করে জরিপ করলেন এসিজি।

প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে সেটা ভদ্রলোকের খুঁড়িয়ে চলা। বোধহয় ছোটবেলায় পোলিও বা ওইরকম কোনও অসুখ হয়েছিল। চৌকোনা মুখ। মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল। চোখদুটো অস্বাভাবিকরকম বড়। গাল সামান্য ভাঙা। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে আছে। পুরু ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফ। গায়ের রং ময়লা। বয়েস তেতাল্লিশ কি চুয়াল্লিশ।

চেহারায় বেঁটেখাটো দীপ্তিমানকে দেখে প্রথমেই যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা সেটা ভালো নয়। কিন্তু ওঁর গলার স্বর একেবারে হিপনোটাইজ করে ফেলার মতো।

এসিজি উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তিমানকে প্রতি নমস্কার জানালেন। তারপর একটা খালি সোফায় বসতে ইশারা করলেন।

দীপ্তিমান বসতেই এসিজি গলা চড়িয়ে বিশুকে ডাকলেন। বিশু বোধহয় ভেতরের ঘরে টিভি দেখছিল। ডাক শুনে এসে দাঁড়াল। বারো-তেরো বছরের এই ছেলেটি অশোকচন্দ্রের দিন-রাতের সঙ্গী।

‘ভালো করে তিনকাপ কফি কর দেখি—।’

অর্ডার পেয়েই বিশু ব্যস্তভাবে চলে গেল কফির আয়োজন করতে।

রঘুপতির সঙ্গে দীপ্তিমানের আলাপ করিয়ে দিলেন এসিজি। দীপ্তিমান সতর্ক চোখে রঘুপতিকে দেখলেন।

পরনে সাদা-পোশাক, তবু পুলিশ-পুলিশ ভাবটা বোঝা যায়। ফরসা মুখে বসন্তের দাগ। ছোট করে ছাঁটা চুল। কাঁচা-পাকা গোঁফ। চওড়া কাঁধ দেখেই বোঝা যায় এঁর সঙ্গে হিসেব করে মোকাবিলায় নামলে ভালো হয়।

‘বলুন, মিস্টার বসাক। যা বলার খোলাখুলি বলুন—কোনও অসুবিধে নেই। আপনারটা পুরোপুরি শোনার পর আমার ওপিনিয়ন দেব।’

এক পলক দুজনের দিকে তাকালেন দীপ্তিমান। তারপর পুরু ঠোঁটের ওপরে জিভের ডগা বুলিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে গলাখাঁকারি দিলেন। গায়ের হালকা নীল সোয়েটারটা বারকয়েক টানলেন। ওঁর ইতস্তত ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ঠিক কোথা থেকে শুরু করবেন সেটা ভেবে খানিকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর হ্যাঁচকা দিয়ে চলতে শুরু করা মোটরগাড়ির মতো কথা বলতে শুরু করলেন দীপ্তিমান।

এসিজির হাতের সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল। অবশেষটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। দীপ্তিমানকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘নিন, শুরু করুন…।’

আপনমনেই ছোট করে কয়েকবার মাথা নাড়লেন দীপ্তিমান। তারপর রেডিয়োতে শোকসংবাদ পাঠ করার মতো ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করলেন ‘ব্যাপারটা যেখানে হয়েছে সেই বাড়িটা বাদুড়বাগান স্ট্রিটে। চার নম্বর বাড়ি। আর যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম চারুবালা মজুমদার। বয়েস হয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর। তিনি ছিলেন ও-বাড়ির আশ্রিতা…।’ মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তিনি যোগ করলেন, ‘আমি ওঁকে মা বলে ডাকতাম—চারুমা। আসলে আমি অনাথ। সংসারে আমার আপন বলতে কেউ কোনওদিন ছিল না। কিন্তু বছর পনেরো আগে চারুবালার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওঁর সঙ্গে কেমন যেন স্নেহ-মায়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম।’

রঘুপতি পকেট থেকে কাগজ-পেন বের করে দরকারমতো নোট নিচ্ছিল। ও জানে, স্মৃতির ওপরে পুরোপুরি নির্ভর না করে লিখে রাখাই ভালো। ওর স্যার অবশ্য মনে-মনে মাথায় সবকিছু লিখে নেন। নিজেকে থিঙ্কিং মেশিন বলে জাহির করাটা ওঁর পক্ষেই মানায়।

বিশু কফির ট্রে নিয়ে ঘরে এল। কফির কাপ আর বিস্কুটের প্লেট তিনজনের সামনে টেবিলে সাজিয়ে দিল। এসিজিকে লক্ষ করে বলল, ‘মাসি আটটার পর এসে রান্না করে দেবে বলে গেছে।’

এসিজি ঘাড় নাড়লেন। মাসি বলতে ললিতের মা—এসিজির ঠিকে কাজের লোক।

বিশু চলে যেতেই এসিজি আর রঘুপতি কফির কাপে চুমুক দিলেন। দীপ্তিমানকে ইশারায় কফি খেতে অনুরোধ করলেন এসিজি। কিন্তু দীপ্তিমান যেন ওঁর ইশারা দেখেও দেখলেন না। কেমন এক শূন্য চোখে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

‘নিন, কফি নিন—।’ এসিজি বললেন।

‘ওঃ, হ্যাঁ—’ চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিলেন দীপ্তিমান। তারপর কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘যা বলছিলাম। চারুবালার সঙ্গে আমি স্নেহ-মায়ার সম্পর্কে কেন জড়ালাম সে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ছোটবেলায় অনাথ আশ্রম থেকে কী করে যেন আমি দেওঘরের সৎসঙ্গ আশ্রমে পৌঁছে যাই। সেখান থেকে পরে কলকাতায় আসি। গড়পাড়ে একটা বাড়িতে সিঁড়ির তলায় একটা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। আর হালসীবাগানে সৎসঙ্গের একটা ছোট ব্রাঞ্চ আছে—সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকি। ছোটবেলা থেকেই জ্যোতিষে আমার আগ্রহ ছিল। বড় হয়ে সেই জ্যোতিষচর্চা করেই আমার দিন চলতে লাগল।

‘চারুবালা হালসীবাগানের আশ্রমে যাতায়াত করতেন। সেই থেকেই আমার সঙ্গে আলাপ। খুব অল্পবয়েসে ওঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন। সেই থেকেই উনি ভাইয়ের সংসারে থাকতেন। সংসারে ভাই-ই ছিল ওঁর একমাত্র আপনজন। কিন্তু সেই ভাই—মনোহর রায়—বছরআষ্টেক আগে ক্যান্সারে মারা যান। এমনিতেই চারুবালার মনে অনেক দুঃখ-কষ্ট ছিল। আশ্রমে গিয়ে আমাকে তার কিছু-কিছু বলতেন। ভাই চলে যাওয়ার পর ওঁর দুর্দশা অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওঁর উপায় ছিল না। কপদর্কহীন বিধবা আর কোথায়-ই বা ঠাঁই পাবে! আর আমি যেখানে থাকি সেখানে আমারই জায়গা হয় না, তো চারুমা!’

চোখে কী পড়েছে এই ভান করে বোধহয় চোখের কোণ মুছে নিলেন দীপ্তিমান। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘চারুমা ঠিক কপর্দকহীন ছিলেন না। তবে ওঁর নিজস্ব চল্লিশ হাজার টাকা ওঁর বড় ভাইপো অজয়েন্দ্রর সঙ্গে জয়েন্টলি ফিক্সড ডিপোজিট করা ছিল। তার ওপরে চারুমার কোনও কন্ট্রোল ছিল না। আর, আজকের দিনে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকায় কী-ই বা হয়!

‘লাস্ট চার-পাঁচ বছর ধরে চারুমার মাথায় একটু গোলমাল দেখা দেয়। ঠিক পাগল হয়ে যাননি, তবে খানিকটা ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলা যায়। আমার কাছে এসে হঠাৎ-হঠাৎ ভাইয়ের বউ আর ভাইপোদের নামে নানান অকথা-কুকথা বলতেন। কখনও-কখনও বউমারা বা নাতি-নাতনিরাও বাদ যেত না। অনেক চেষ্টা করেও তখন ওঁকে শান্ত করা মুশকিল ছিল।

‘ব্যাপারটা আমি বয়েসের দোষ বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওঁর কোনও-কোনও কথায় বুঝতাম, পাগলামির ঝোঁকে উনি যা-যা বলেন তার অনেকটাই সত্যি। হয়তো কারও কথায় বা ব্যবহারে ব্যথা পেয়েছেন, অভিমান হয়েছে—আমার কাছে এসে চারুমা সবকিছু যেন উগরে দিতেন। আমি ওঁকে সান্ত্বনা দিতাম, শান্ত করতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার যেটা ছিল—ওঁর বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই ওঁকে পাগলের মতো ট্রিট করতেন।

আমি—।’

দীপ্তিমানকে বাধা দিয়ে এসিজি বললেন, ‘উনি কীভাবে মারা গেছেন?’

স্রোতে আচমকা বাধা পড়ায় দীপ্তিমান পলকের জন্য যেন বেসামাল হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে। আজ শুক্রবার। চারুমা মারা গেছেন শনিবার—সন্ধেবেলা।’

একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। দীপ্তিমানকে অফার করতে তিনি বললেন, ‘না, থাক। আমি কখনও-কখনও খাই।’

রঘুপতি যে সিগারেট খায় না তা এসিজি ভালো করেই জানেন।

সিগারেটে টান দিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত জানতে চাইলেন, ‘চারুবালা ছাদ থেকে পড়ে গেলেন কীভাবে?

‘ওঁদের বাড়িটা ভীষণ পুরোনো। বহুবছর ধরেই ডেঞ্জারাস কন্ডিশানে রয়েছে। রিপেয়ার-টিপেয়ার কখনও করা হয়নি। রং চটে গেছে, পলেস্তারা খসে গেছে। ছাদের পাঁচিল জায়গায়-জায়গায় ভাঙা। কড়ি-বরগার অবস্থাও ভালো নয়। ও-বাড়ির ছাদের সাউথ-ওয়েস্টের দিকটায় মেঝেতে বড় একটা ফাটল আছে। তা ছাড়া, ওদিকটার পাঁচিলও ছিল ধসে পড়া। চারুমা সাধারণত ছাদে উঠতেন না। তবু হয়তো কোনও কারণে ভুল করে ওদিকটায় চলে গিয়েছিলেন। তারপর…।’

মাথা নিচু করে আবার চোখ মুছলেন দীপ্তিমান।

‘পুলিশের কী আইডিয়া?’ প্রশ্নটা করল রঘুপতি যাদব।

কপালে হাত রেখে মাথা নাড়লেন দীপ্তিমান ‘সরাসরি কোনও আইডিয়া পাইনি। আবছাভাবে যা শুনেছি তাতে পুলিশ ব্যাপারটাকে অ্যাক্সিডেন্টই ভাবছে।’

‘আবছাভাবে শুনেছেন কেন?’ কৌতূহলী হলেন এসিজি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান। কফির কাপে ছোট চুমুক দিয়ে বললেন, ‘লুকোছাপা না করে একটা কথা আপনাকে খুলে বলি, ডক্টর গুপ্ত। ও-বাড়ির মানুষজন আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। বিশেষ করে আমার মামিমা—প্রভাবতী তো বছরদুয়েক ধরে আমাকে দেখতেই পারেন না।’

‘প্রভাবতী মানে?’

বিষণ্ণ হাসলেন দীপ্তিমান, বললেন, ‘মনোহর রায়ের বিধবা স্ত্রী। বয়েস প্রায় সত্তর। প্যারালিসিস হয়ে অনেকটাই কাবু। তবে তিনিই রায়বাড়ির শেষ কথা। সবাইকে সবসময় পায়ের আঙুলের ওপরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। ও-বাড়িতে চারুমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে মামিমা যেভাবে আমাকে কথা শোনাতেন তাতে আমার খুব খারাপ লাগত। তাই প্রায় বছরখানেক হতে চলল, আমি ও-বাড়িতে ক্বচিৎ-কদাচিৎ যেতাম। বিশেষ করে চারুমার অসুখ-টসুখের খবর পেলে তখন মামিমার অপমান সইতে হবে জেনেও যেতাম।’

‘আপনাকে এরকম ডিসলাইক করার পজিটিভ কোনও কারণ ছিল?’

আবার মলিন হাসলেন দীপ্তিমান : ‘থাকতে পারে—তবে আমার সেটা জানা নেই।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে বললেন, ‘হয়তো ভেবে থাকবেন, চারুমা ওঁর শেষ সম্বল আমাকে দিয়ে যেতে পারেন।’

‘চারুবালাদেবীর শেষ সম্বল কি অনেক কিছু ছিল?’ অশোকচন্দ্র সিগারেটে টান দিয়ে লম্বা শরীরটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘তেমন কিছু আর কোথায়! ওই চল্লিশ হাজার টাকা…আর, গলার একটা সোনার হার…চার-সাড়ে চারভরি মতন হবে…। চারুমা সবসময় ওটা গলায় পরে থাকতেন। কিছুতেই কাছ-ছাড়া করতেন না।’ মাথা নামিয়ে আলতো গলায় দীপ্তিমান আরও বললেন, ‘পাগলামির সময়েও হারটার কথা চারুমার খেয়াল থাকত। ক’বছর ধরেই খালি আমাকে বলতেন, ‘দীপ্তিরে, তর বউরে এটা আমি দিয়া যামু। আর কাওরে দিমু না।’ আমি হেসে বলতাম, ‘চারুমা, বিয়া করলে তয় না বউ আইব।’ দীপ্তিমান হাসলেন আপনমনে, বললেন, ‘দু-বছর ধরে চারুমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে একেবারে খেপে উঠেছিলেন। আমার সামান্য আয়…তার ওপরে শরীরে খুঁত আছে। আমায় কে বিয়ে করবে বলুন!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান ‘কিন্তু চারুমা কোনও কথা শুনতে চাইতেন না। যাকে সামনে পেতেন তাকেই আমার পাত্রী দেখার জন্যে রিকোয়েস্ট করতেন। ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। কিন্তু চারুমা কষ্ট পাবেন এই ভেবে তেমন করে কিছু বলতে পারিনি। যাক, এখন নিয়তিই সব সমস্যার সমাধান করে দিল।’

এসিজি চোখ ছোট করে কী যেন ভাবছিলেন। একটু ফাঁক পেতেই দীপ্তিমানকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘প্রভাবতীদেবীর সঙ্গে আপনার কখনও কথা-কাটাকাটি বা ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল?’

একটু চিন্তা করে তারপর দীপ্তিমান জবাব দিলেন, ‘না, কখনও হয়নি।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ আপনমনেই মন্তব্য করলেন এসিজি। তারপর ‘আচ্ছা, প্রভাবতী তো জানতেন চারুবালার শেষ সম্বল কতটুকু। তা হলে তার জন্যে আপনার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করবেন কেন? আপনি ভালো করে ভেবে দেখুন—নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে।’

ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মাথার ভেতরে হাতড়াতে শুরু করলেন দীপ্তিমান বসাক। এসিজি আর রঘুপতি চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর দীপ্তিমান মাথা নামালেন। এসিজির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘রায় পরিবারের অনেকেরই আমি কোষ্ঠীবিচার করেছি। পাথর-টাথরও অনেক সময় দিয়েছি। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, কখনও ওঁদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে দাম নিইনি, কিংবা ঝুটো পাথর দিয়ে ঠকাইনি। তবে মনোহরবাবুর—মানে, আমার মামার সবসময়েই একটা পেটের যন্ত্রণা হত। সেটা কমানোর জন্যে আমি একবার যজ্ঞ করেছিলাম, আর মামাকে পাথর দিয়েছিলাম। কিন্তু মামা শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারে মারা যান। এখন মনে পড়ছে…তারপর থেকেই প্রভাবতী আমার সঙ্গে একটু কোল্ড বিহেভিয়ার শুরু করেন। ধীরে-ধীরে সেটা আরও খারাপের দিকে গেছে। হয়তো আমি মামাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, এটাই আমার অপরাধ…।’ হাত উলটে হতাশার একটা ভঙ্গি করলেন দীপ্তিমান।

এসিজি একবার কাশলেন। এ-বছর শীত যাই-যাই করেও অন্তত বারদুয়েক ফিরে এসেছে। তাতেই এসিজির একটু ঠান্ডা লেগে গেছে। দীপ্তিমানের কথা তিনি যেমন মন দিয়ে শুনছেন তেমনই মনোযোগ দিয়ে ওঁর প্রতিটি অভিব্যক্তি লক্ষ করছেন। ভদ্রলোককে এসিজির বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিল।

এইবার এসিজি লাখ টাকার প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন দীপ্তিমানের দিকে।

‘চারুবালার ব্যাপারটা আপনি অ্যাক্সিডেন্ট বলে মেনে নিতে পারছেন না কেন?’

এই প্রশ্নে দীপ্তিমান কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়লেন। ওঁর মুখ যে খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল সেটা এসিজি ও রঘুপতি দুজনেরই চোখে পড়ল।

রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘আপনি তা হলে কী ভাবছেন? সুইসাইড, না মার্ডার?’

একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন দীপ্তিমান। তারপর ভেতরে-ভেতরে কোনও গোপন শক্তি সঞ্চয় করে বললেন, ‘সুইসাইডের তো কোনও প্রশ্নই নেই! চারুমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। এ-অবস্থায় কেউ সুইসাইড করে না। তা ছাড়া, ওঁর গলার হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটা হঠাৎ পাওয়া গেল চারুমা মারা যাওয়ার দিন। ছাদের ভাঙা জায়গাটার কাছেই পড়ে ছিল। কে ওটা চুরি করেছিল, কেন চুরি করেছিল, কেনই বা ওটা চারুমার মারা যাওয়ার দিন ছাদে ফিরে এল—এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই…।’

‘ফির ভি, অ্যাক্সিডেন্ট তো হতে পারে।’ রঘুপতি বলল।

রঘুপতির দিকে তাকালেন দীপ্তিমান ‘হ্যাঁ, হতে পারত—যদি না চারুমার শেষ একটা কথা আমার কানে বাজত…।’

‘কী কথা?’ এসিজি জানতে চাইলেন।

দীপ্তিমান একটু ইতস্তত করলেন। ভুরু উঁচিয়ে দু-চোখে হাত ঘষলেন। যেন কোনও কারণে তিনি ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিলেন না। তারপর দু-একটা টুকরো শব্দ করে একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘আগেই তো বলেছি, মামিমাদের বাড়িতে আমার যাতায়াতের অসুবিধে ছিল। চারুমা আশ্রমে এলে তবেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ হত। তবে ওঁর বয়েস হয়েছিল, একা-একা আসতে পারতেন না। পাড়ার একটি সাদাসিধে ছেলে—নাম, রতন—ওকে সঙ্গে করে আসতেন। কোনও খবর দেওয়ার থাকলে রতনকে দিয়ে বলে পাঠাতেন। মোটামুটি রতনই আমাদের মধ্যে অনেকটা টেলিফোনের কাজ করত।’ হাসলেন দীপ্তিমান ‘আর দরকার পড়লে আমি চারুমাকে ও-বাড়িতে ফোন করতাম। সে-নিয়েও অবশ্য চারুমাকে কথা শুনতে হত। প্রভাবতী নাকি বলতেন : ”দিদি, আপনার এত ফোন আসে কেন? এ-বয়েসে এত ফোন আসা ভালো না।” অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন!…যাই হোক, চারুমা বোধহয় কিছু একটা দেখে ফেলেছিলেন। এমন কিছু, যেটা ভালো কাজ নয়। তাই মারা যাওয়ার দিনদশেক আগে থেকেই একটা কথা ওঁর মুখে শুনতাম : ”ছি ছি ছি, এই অন্যায় আমি সইহ্য করুম না! কিয়ের লেইগ্যা সইহ্য করুম? সারাটা জীবন সংসার আমারে জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া খাইল। পাঁচকান কইর‍্যা দিলে বুঝব’অন ঠ্যালা! আমারে চিনে না।” ‘

‘কী অন্যায় তিনি পাঁচকান করে দেওয়ার কথা বলছিলেন সেটা আপনি জানতে চাননি?’

‘আমি অনেকবার চারুমাকে জিগ্যেস করেছি—কিন্তু চারুমা কোনও স্পষ্ট জবাব দেননি। বরং পাগলামির তোড়ে ভেসে গেছেন। পরে কখনও জানতে চাইলে বলতেন, ”কী কস? কুন কথা পাঁচকান করুম? আমি কইসি!” মানে, ওঁর ব্যাপারটা আর মনে পড়ত না। ও-বাড়ির সকলেই বোধহয় চারুমার এ-কথা শুনেছে। হয়তো পাগলের পাগলামি বলে উড়িয়েও দিয়েছে…’ একটু থামলেন দীপ্তিমান। তারপর সিরিয়াস গলায় বললেন, ‘…শুধু একজন ছাড়া। যে সেই অন্যায়টা করেছিল। সে ব্যাপারটাকে মোটেই পাগলের পাগলামি বলে উড়িয়ে দেয়নি। বরং ভয় পেয়েছে। ভেবেছে, পাগল বিধবাটা এই বোধহয় ব্যাপারটা ফাঁস করে দিল। আর প্রভাবতী একবার জানতে পারলেই সর্বনাশ! চরম শাস্তি দিয়ে ছাড়বেন। ওঁকে সবাই যমের মতো ভয় পায়। তাই সেই লোকটা হয়তো ভয় পেয়েই পাগল বিধবাটাকে কিছু একটা…’ দীপ্তিমানের গলা বুজে গেল। মুখে হাত চাপা দিয়ে জড়ানো গলায় তিনি কোনওরকমে বললেন, ‘ওই পাগল বিধবাটাকে আমি ”মা” ডেকেছিলাম। ঈশ্বর জানেন, ওঁর গয়না বা টাকাপয়সার জন্যে কোনও লোভ আমার ছিল না। ঈশ্বর জানেন, চারুমা মারা যাওয়ায় আমি কী কষ্ট পেয়েছি। আমি…আমি…।’

আর বলতে পারলেন না দীপ্তিমান। মাথা নিচু করে বাচ্চাছেলের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

এসিজি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। দীপ্তিমানকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, ‘আপসেট হবেন না, দীপ্তিমানবাবু…প্লিজ। যিনি চলে গেছেন তিনি তো আর ফিরবেন না!’

রঘুপতি যাদব চুপচাপ নোট নিচ্ছিল। দীপ্তিমানের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে আবার কাজে মন দিল।

হাতের সিগারেট কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এসিজি সেটা অ্যাশটেতে ফেলে দিয়ে বারকয়েক কাশলেন। মেয়ে ঊর্মিলা সামনে থাকলে নির্ঘাত সিগারেট হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিত। ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে শাসন করার মতো কেউ আর কাছে নেই। যে সবচেয়ে কাছাকাছি থাকত, সবসময় থাকত, সে চলে গেছে বছরদশেক আগে। আকাশে। সেখানে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে।

নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খুললেন দীপ্তিমান। ভাঙা গলায় বললেন, ‘ফোনে আপনাকে এসব কথা বলতে পারিনি। বুঝতেই তো পারছেন, বলা সম্ভব ছিল না। আপনি যদি কাইন্ডলি চারুমার মৃত্যুর ব্যাপারটা একটু ইনভেস্টিগেট করে দেখেন তা হলে আমি শান্তি পাব। চারুমার জন্যে আমি কর্তব্য করতে পারিনি। এমনকী মুখাগ্নিও ওরা করতে দেয়নি আমাকে। হয়তো শ্রাদ্ধের সময়েও ডাকবে না। তাই আমার খুব ইচ্ছে, ওঁর মৃত্যুতে যে শুধুমাত্র নিয়তির হাত ছিল না, সেটা প্রমাণ হোক। তা হলেই আমার শান্তি। আপনি আমাকে ফেরাবেন না…প্লিজ। আপনার ফিজ আমি দেব…হয়তো খুব বেশি পারব না…।’ জল-ভরা চোখে এসিজির হাত চেপে ধরলেন দীপ্তিমান।

‘এ কী করছেন! শান্ত হয়ে বসুন।’ এসিজি বললেন, ‘ফিজের কথা আপনাকে এখন ভাবতে হবে না। বরং ও-বাড়ির লোকজন সম্পর্কে আর যা-যা জানেন সেগুলো আমাকে বলুন। কাজে নামার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা যতটা ডিটেলে জানা যায় ততই কাজের সুবিধে। আর আপনার খোলাখুলি মতামতও বলবেন কিন্তু…।’

এরপর দীপ্তিমান বলে চললেন, আর অশোকচন্দ্র গুপ্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে আধবোজা চোখে সব শুনতে লাগলেন। রঘুপতি যথারীতি কাগজ-কলম নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ব্যস্ত হল।

বিশু ফরমাশ পেয়ে আর-একদফা কফি দিয়ে গেল।

এসিজির আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়তে লাগল। আর ঘড়ির কাঁটাও ঘুরতে লাগল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দীপ্তিমানের কথা শেষ হল।

এসিজি ওঁকে মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, ‘সম্ভবত আমি রোববার প্রভাবতীদের বাড়িতে যাব। তার আগে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি.-র সঙ্গে কথা বলে রঘুপতি ফরমালিটিগুলো সেরে রাখবে। তা না হলে ইনভেস্টিগেশানে প্রবলেম হতে পারে। আপনাকে খবর পাঠিয়ে দেব। সেদিন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’

‘তাতে মাসিমা হয়তো মাইন্ড করতে পারেন।’ দীপ্তিমান বললেন।

‘মাইন্ড করলেই হল!’ বলল রঘুপতি যাদব, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে, মিস্টার বসাক। দ্যাট ইজ মাই প্রবলেম। কী বলেন, গুপ্তাসাব?’

রঘুপতির শেষ প্রশ্নটা প্রাক্তন স্যার এসিজিকে লক্ষ করে।

এসিজি হাসলেন। রঘুপতির মেজাজ যখন-তখন হারিয়ে যায়। তাই এসিজি প্রায়ই ওকে সাবধান করে বলেন, ‘রঘুপতি, ডোন্ট লুজ ইয়োর টেম্পার। ওটা খুব দামি জিনিস।’

দীপ্তিমান চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আরও একদফা অনুরোধ করে গেলেন অশোকচন্দ্রকে।

রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘স্যার, রঙ্গলালবাবুকে কি ইনফর্ম করতে হবে?’

প্রশ্নটা শুনে এসিজির হাসি পেয়ে গেল। আজকাল এমন একটা বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে যে, তদন্তের সময় স্বভাবকবি রঙ্গলাল গোস্বামী পাশে-পাশে না থাকলে তিনি যেন ঠিক মেজাজ পান না। ‘লালমহল’-এর চুনিলালবাবুর দামি পাথর খুঁজে বের করতে গিয়ে তাঁর ভাই রঙ্গলাল গোস্বামীর সঙ্গে এসিজির প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে স্বভাবকবি রঙ্গলাল এসিজির গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন। রঙ্গলালের প্রশংসার দুটি অভিনব নমুনা মনে পড়ল এসিজির ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ’, আর ‘গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/অমর, আকবর এবং অ্যান্টনি’। এই স্বভাব-কবি কখনও এসিজির ‘তদন্তরসে’ বঞ্চিত হতে চান না।

সুতরাং, হাসতে-হাসতেই অশোকচন্দ্র গুপ্ত রঘুপতিকে বললেন, ‘ওঁকে ইনফর্ম অবশ্যই করবে, রঘুপতি। তা না হলে, ওঁর মতো স্বভাব-কবিতায় বলি—তোমার আমার মুন্ডুপাত/হয়ে যাবে অকস্মাৎ।’

রঘুপতি ঠোঁটের কোণে হাসল। তারপর এগিয়ে গেল প্রাক্তন স্যারের টেলিফোনের দিকে।

এসিজি পায়ে-পায়ে চলে এলেন জানলার গা ঘেঁষে রাখা একটা টেবিলের কাছে। এটা তাঁর পাঁচমিশেলি কাজের টেবিল। টেবিলে বই, পেন, কাগজপত্র সব এলোমেলোভাবে ছড়ানো। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটা রুবিক কিউব।

রঙিন কিউবটা হাতে নিয়ে তার একটা থাক মোচড় দিতে শুরু করলেন অশোকচন্দ্র। সাজানো রংগুলো ওলটপালট হয়ে যেতে লাগল।

আপনমনে বিড়বিড় করে এসিজি বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট, সুইসাইড, না মার্ডার?’

‘…কে দেবে তার কারেক্ট আনসার।’

প্রভাবতীদের পুরোনো পলেস্তারা-খসা বাড়িতে ঢুকতে-ঢুকতে আগের দিনের বিড়বিড় করে বলা কথাটাই জোরে-জোরে উচ্চারণ করেছিলেন অশোকচন্দ্র। প্রশ্নটা তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন সঙ্গী রঙ্গলালবাবুর দিকে। ব্যস!

রঙ্গলাল তৎক্ষণাৎ ওঁর স্বভাব-কবিতা রচনার তীব্র প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ছন্দ মিলিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।

এসিজি হেসে বললেন, ‘উত্তর দিতে হবে আমাকেই। কোনও উপায় নেই। আমাকে নিয়ে রঘুপতির অনেক গর্ব। ওর মানটা তো বাঁচাতে হবে!’

প্রভাবতীদের বাড়িটা দেখামাত্রই ফিটন গাড়ি, ভোরবেলা গঙ্গার জল দিয়ে রাস্তা ধোওয়া, ভিস্তিওয়ালা—এসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। একটা ভাঙা শ্বেতপাথরের ফলকে শুধু ‘…নিবাস’ টুকু পড়া যাচ্ছে। তিনতলা বাড়ির এখানে-সেখানে বট-অশ্বত্থের চারা মাথাচাড়া দিয়েছে। হালকা শীতের বাতাসে তাদের রোদ-চকচকে পাতা নড়ছে।

আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি. বিজন শর্মার সঙ্গে রঘুপতি কথা বলে নিয়েছিল। কেসের ফাইলের একটা কপিও রঘুপতি পৌঁছে দিয়েছে এসিজিকে। তারপর জরুরি একটা তদন্তের কাজে ওকে আচমকা ভুবনেশ্বর চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তার আগে ও সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে।

প্রভাবতীদের বাড়িতে বিজন শর্মা জানিয়ে দিয়েছেন যে, একজন ইনভেস্টিগেটর দুজন ভদ্রলোককে নিয়ে রবিবার সকাল ন’টায় প্রভাবতীদের বাড়িতে আসবেন। বাড়ির প্রত্যেকে যেন তাঁর সঙ্গে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কো-অপারেট করেন। তা না হলে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াতে পারে।

সুতরাং, রবিবার সকালে এসিজি, রঙ্গলাল ও দীপ্তিমান, পৌঁছে গেছেন প্রভাবতীদের বাড়িতে।

বিশাল সদর দরজায় বিশাল মাপের কড়া। বোঝাই যায়, কলিংবেলের ব্যাপারটা আধুনিক সংযোজন।

বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। বছর পঞ্চাশের একজন টাক-মাথা ভদ্রলোক বিগলিত হেসে এসিজিদের অভ্যর্থনা জানালেন। তবে দীপ্তিমানকে দেখামাত্রই তাঁর ফরসা কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল।

‘আসুন, আসুন, ডক্টর গুপ্ত।’ রঙ্গলালবাবুকে নমস্কার জানিয়ে বললেন তিনি, ‘থানা থেকে আমাকে সবকিছু জানিয়ে আগাম খবর দিয়ে দিয়েছে। আমার নাম অজয়েন্দ্র—অজয়—আমারই পিসিমণি অ্যাক্সিডেন্টালি ছাদ ধসে পড়ে মারা গেছেন।’

এসিজি কিছু বলার আগেই রঙ্গলাল গোস্বামী ভুল ধরিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমি হলেম রঙ্গলাল স্বভাব-কবিবর/উনি হলেন এসিজি গোয়েন্দাপ্রবর।’

কবিতার আকস্মিক দাপটে অজয়েন্দ্র কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে চেয়ে রইলেন রঙ্গলালের কীর্তনীয়াগোছের চেহারার দিকে।

এসিজি সামান্য হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, মিস্টার রায়—আমরা ওই অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে এসেছি। মানে…ব্যাপারটা তো সুইসাইডও হতে পারে। পুলিশ ঠিক সেই অ্যাঙ্গেলটা এক্সপ্লোর করে দেখেনি।’

অস্বস্তির হাসি হাসলেন অজয়েন্দ্র : ‘মানে, কেউ কি পুলিশে কোনও নালিশ-টালিশ করেছে?’

অশোকচন্দ্র লক্ষ করলেন, অজয়েন্দ্রর চোখ চট করে দীপ্তিমানকে ছুঁয়ে গেল।

‘না, নালিশ-টালিশ কেউ করেনি। পুলিশই ব্যাপারটা ভেবে দেখেছে।’ তারপর একটু শক্ত গলায় বললেন, ‘হঠাৎ আপনার নালিশের কথা মনে হল কেন?’

‘মা বলছিল এই সাধারণ ব্যাপারটাকে নিয়েই হয়তো জল ঘোলা হবে—তাই।’ গালের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে হাত বোলালেন অজয়েন্দ্র।

বসবার ঘরে ওঁদের বসাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এসিজি বাদ সাধলেন ‘কিছু মনে করবেন না, আমরা আগে ছাদে যাব। জায়গাটা ভালো করে দেখব। তারপর আপনাদের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নেব।’

‘সামান্য একটু চা-টা না খেলে কি চলে…।’ ইতস্তত করলেন অজয়বাবু।

‘সে পরে হবেখ’ন—’ জবাব দিলেন রঙ্গলাল, ‘থিতু হয়ে বসব যখন।’

ছন্দের গন্ধ পেয়ে এসিজি আড়চোখে তাকালেন রঙ্গলালের দিকে। কবিবর কাঁচুমাচু মুখ করে আকর্ণবিস্তৃত হাসলেন। দীপ্তিমান কিছু বললেন না, তবে রঙ্গলালের স্বভাব-কবিতা উপভোগ করছিলেন।

‘মা জানতে পারলে খুব রেগে যাবেন…’ বিড়বিড় করে এই কথা বলতে-বলতে অজয়েন্দ্র ওঁদের নিয়ে চললেন ওপরে।

সবসময়েই অশোকচন্দ্র গুপ্ত প্রথম অকুস্থল দেখাটা পছন্দ করেন। ওঁর মতে, আগে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পরে অকুস্থল দেখলে দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক নিরপেক্ষ থাকে না।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে এসিজি বাড়িটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিলেন।

ঢালাই লোহার রেলিং, মেঝেতে সাদা-কালো পাথর বসানো, দেওয়ালের খানিকটা পর্যন্ত সাদা টালি, লাল-নীল-সবুজ-হলদে কাচের শার্সি, বারান্দার সিলিং এর কার্নিশে গোলা পায়রার আস্তানা। তবে শুধু গোলা পায়রাগুলোই চকচকে-ঝকঝকে নতুন—বাকি সবই ময়লা, চিড় ধরা, ভাঙা।

বাড়ির ভেতরটায় যেরকম অন্ধকার-অন্ধকার ভাব ছিল, ছাদে পা দিতেই ছবিটা বদলে গেল। অকৃপণ রোদ সেখানে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে।

বিশাল ছাদ। সেখানে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে তা হল, কাপড় ছড়ানোর গোটা সাত-আট দড়ি নানান কায়দায় এ-মাথা ও-মাথা বাঁধা রয়েছে। কোনওটা নাইলনের দড়ি, কোনওটা সাদা কাপড়ের তৈরি, আর কোনওটা নিতান্তই পুরোনো শাড়ির পাড়।

ছাদের ডানদিকে প্রচুর টব। সেখানে সাধারণ সস্তার গাছ। কেউ কখনও টবগুলোর যত্ন নেয় বলে মনে হয় না। টবের সারির পিছনের পাঁচিলে দুটো কাক বসে আছে।

ছাদের মেঝেতে কম করেও তিন-চার জায়গায় ফাটল ধরেছে। আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটায় পাঁচিল ভাঙা, মেঝের খানিকটা অংশ নেই।

এসিজির নজর লক্ষ করে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘পিসিমণি ওখানটা দিয়েই পড়ে গেছেন।’

এসিজি পায়ে-পায়ে সেদিকটায় এগিয়ে গেলেন। প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই অজয়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আর যাবেন না! আর যাবেন না!’

এসিজি থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকালেন।

সে-চাউনিতে প্রশ্ন ছিল। তার উত্তরে ছাদের মেঝের দিকে আঙুল দেখালেন অজয়েন্দ্র ‘ওই দেখুন, দাগ দিয়ে সাবধান করা আছে। ওই দাগের ও-পাশে আমরা কেউ কখনও যাই না। করপোরেশান দুবার নোটিশ দিয়ে গেছে। বাচ্চাদের তো ছাদে ওঠাই বারণ—।’

এসিজি লক্ষ করে দেখলেন। সত্যিই সাদা তেল রং দিয়ে অপটু হাতে একটা চওড়া দাগ টানা আছে। দাগের ও-পাশে বেশ বড় মাপের একটা ফাটল—দেখলে ভয় হয়। সেই ফাটল ফুট তিনেক যাওয়ার পরই বড় হাঁ হয়ে গেছে। ছাদের সেই অংশটা চারুবালাকে নিয়ে ধসে পড়েছে নীচে। খোঁদল দিয়ে দোতলার একটা ঘরের অংশ নজরে পড়ছে।

এসিজিদের নজর লক্ষ করে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘ও-ঘরটায় কেউ থাকে না। এমনই স্টোররুম মতন—।’

একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। ধোঁয়া ছাড়লেন কয়েকবার। মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন।

বাড়ির কেউ ওই দাগের ও-পাশে যেত না। সবাই ব্যাপারটা জানত। তা হলে চারুবালা গেলেন কেন? সে কি ওঁর মাথায় ছিট ছিল বলেই?’

‘দাগটা কবে আঁকা হয়েছে, অজয়বাবু?’

‘প্রায় সাত-আট বছর আগে। রং চটে গেলে আমিই আবার লাগিয়ে দিই।’

‘লাস্ট কবে রং লগিয়েছেন?’

‘তা প্রায় বছরখানেক হবে।’ একটা ছোট ঢেঁকুর তুললেন অজয়েন্দ্র, পেটে বারকয়েক হাত বোলালেন।

দীপ্তিমান বলেছেন, চারুবালার মাথায় ছিট দেখা দেয় চার-পাঁচ বছর ধরে। দাগ দেওয়ার ব্যাপারটা তারও আগের—চারুবালা যখন সুস্থ ছিলেন। তা ছাড়া, ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়ার পরেও এতদিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। নাকি চারুবালা প্রায়ই ছাদের ওই বিপজ্জনক অংশে যাতায়াত করতেন? তারপর হঠাৎ একদিন ওই অংশটা ওঁকে নিয়ে ধসে পড়েছে?

‘আপনার পিসিমা ছাদে কি প্রায়ই উঠতেন?’

‘না, না।’ ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন অজয়েন্দ্র, ‘বরং বলতে পারেন ন’মাসে ছ’মাসে কখনও-কখনও রোদ পোয়াতে উঠতেন। পিসিমণির অনেক বয়েস হয়েছিল। হাঁটুতে গেঁটে বাত ছিল। ওই শনিবার…মানে, যেদিন অ্যাক্সিডেন্টটা হয়…কেন উঠেছিলেন কে জানে?’

এসিজি বেশ অবাক হয়ে গেলেন। যে-মানুষ্টা ছাদে বলতে গেলে প্রায় আসতই না, সে হঠাৎ ছাদে উঠতে গেল কেন? আত্মহত্যা করার জন্য?

সুস্থ অবস্থা থেকেই লক্ষ্মণের গণ্ডি ওই সাদা দাগ দেখে এসেছেন চারুবালা। অসুস্থ অবস্থায় ওঁর কি সেসব কিছুই মনে ছিল না?

সাদা দাগটাকে ধরে ছাদের পাঁচিলের কাছে চলে গেলেন এসিজি। লক্ষ করলেন, পাঁচিলের গায়েও সরু-সরু ফাটল। গলা বাড়িয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে নীচের গলির দিকে তাকালেন।

ঘাড় ঘুরিয়ে অজয়বাবুকে ডাকলেন এসিজি ‘অজয়বাবু, আপনার পিসিমার বডিটা কোন জায়গায় পড়েছিল দেখান তো—।’

অজয়েন্দ্র এসিজির পাশে চলে এলেন। আঙুল দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন জায়গাটা ‘ওই যে—ওইখানটায়…।’

এখান থেকে পড়লে কারও পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। কিন্তু চারুবালা যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তা হলে ছাদের ওই ভাঙা জায়গাটাকেই বা বেছে নিলেন কেন! অন্য বহু জায়গা দিয়েই তো নীচে লাফ দেওয়া যেত!

‘আপনি জানেন, আপনার পিসিমার ডানহাতের মুঠোয় একটা ক্লিপ পাওয়া গিয়েছিল?’ অজয়েন্দ্রর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আচমকা প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন এসিজি।

‘ক্লিপ!’ অজয়েন্দ্র কেমন হকচকিয়ে গেলেন।

‘হ্যাঁ—’ সিগারেটে আয়েসী টান দিয়ে এসিজি বললেন ‘কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ। লাল রঙের।’

ক্লিপের তথ্যটা এসিজি কেস-ফাইল থেকে পেয়েছেন। পুলিশ এটা নিয়ে আর এগোয়নি কেন কে জানে!

‘ন-না, আমি তো শুনিনি।’ থতমত খেয়ে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘জানলে মা হয়তো জানবে।’

‘আপনার পিসিমা কি কখনও-কখনও কাপড় ছড়াতে ছাদে উঠতেন?’

‘আগে হয়তো উঠতেন—এখন আর বয়েসের জন্যে পারতেন না। আরতিই মা আর পিসিমার সব কাজ করে দেয়।’

দীপ্তিমানের কাছে সব শুনেছেন অশোকচন্দ্র। সেরিব্রাল হেমারেজের পর প্রভাবতী প্রায় পঙ্গু হয়ে যান। তারপর ফিজিয়োথেরাপি, আকুপাংচার, আরও বহুরকম চেষ্টাচরিত্র করে ওঁর শরীর অনেকটা সচল হয়। এখন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা-চলা করতে পারেন। তবে সিঁড়ি ভাঙতে একেবারেই পারেন না। আরতি নামে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে প্রভাবতীর রাত-দিনের সঙ্গী।

এমনসময় একজন ভদ্রমহিলা ছাদে এলেন। ময়লা রং, বেঁটেখাটো চেহারা। ছাদের দরজার কাছ থেকেই তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তোমাকে মা ডাকছে—।’

অজয়েন্দ্র ওঁর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ‘যাও, যাচ্ছি।’

‘যাচ্ছি বললে হবে না—মা এক্ষুনি যেতে বলেছে।’ বলে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।

এসিজি অনুমান করলেন, ইনি অজয়েন্দ্রর স্ত্রী মনীষা।

‘আমি যাই—’ অজয়েন্দ্র এসিজিকে বললেন, ‘আপনারা কাজ সেরে দোতলায় মায়ের ঘরে আসুন।’

পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন এসিজি। তাতে ছাদের ভাঙা জায়গাটার একটা স্কেচ আঁকা ছিল। সেটা সামনে ধরে আসলের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে লাগলেন।

একটু পরে বললেন, ‘সোনার চেনটা ওইখানটায় পড়ে ছিল।’

উৎসুক দীপ্তিমান ও রঙ্গলাল এসিজির কাছে এলে ওঁর হাতের কাগজটার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। স্কেচের একটা জায়গায় একটা কাটা চিহ্ন আঁকা ছিল। সেটাতে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘ধসে পড়া পোরশানটার ঠিক পাশেই হারটা পাওয়া গেছে। চারুবালা ওটা হাতে তুলে নেওয়ারও সময় পাননি।’

‘হারটা হারানোর পর কী করে এখানে আবার ফিরে এল বলুন তো!’ দীপ্তিমান যেন আপনমনেই বললেন।

ছাদটা আরও কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে দেখার পর এসিজি বললেন, ‘চলুন, নীচে যাই।’

হাতের শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছাদে ফেলে পায়ে রগড়ে দিলেন। মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে অস্পষ্ট গলায় বললেন, ‘সে-কথাই তো ভাবছি…।’

রঙ্গলাল গোস্বামী আচমকা মন্তব্য করলেন, ‘এসিজি স্যার, এ-বাড়িতে মোট চারটে ফ্যামিলি থাকে।’

‘কী করে বুঝলেন?’ এসিজি জানতে চাইলেন।

‘অ্যান্টেনা গুনে।’ হেসে বললেন রঙ্গলাল, ‘ফ্যামিলি পিছু একটা করে অ্যান্টেনা—চারটে অ্যান্টেনা, চারটে ফ্যামিলি।’

‘দারুণ বলেছেন।’ বলেই কী যেন ভাবলেন এসিজি। তারপর দীপ্তিমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি বলেছিলেন, প্রভাবতীর দু-ছেলে—অজয়েন্দ্র, বিজয়েন্দ্র। দুটো ফ্যামিলি, দুটো অ্যান্টেনা, আর-একটা অ্যান্টেনা ধরে নিচ্ছি প্রভাবতীর। তা হলে চার নম্বরটা কার? চারুবালার?’

‘কী যে বলেন!’ হেসে ফেললেন দীপ্তিমান ‘চারুমার জন্যে আলাদা টিভি! তা ছাড়া, দোতলার গলির দিককার একটা বড় ঘরে মামিমা আর চারুমা একসঙ্গে থাকতেন। তবে ঘরের টিভিটা অন-অফ হত মামিমার কথায়। ওই বাড়তি অ্যান্টেনাটা মামিমার বড় মেয়ে সুনন্দাদির। আপনাকে সেদিন বোধহয় বলিনি—মামিমার মেয়ে-জামাই এ-বাড়িতেই থাকেন। ঘরজামাইগোছের বলতে পারেন। সুনন্দাদির হাজব্যান্ড অমলেশদা কন্সস্ট্রাকশনের কীসব বিজনেস করেন। তবে চারুমা বলতেন, সে বিজনেসে নাকি সবসময়েই লস হত। প্রায়ই নাকি ছেলেদের লুকিয়ে অমলেশদা মামিমার কাছ থেকে টাকা নিতেন। মামিমার সব পুঁজি তো এভাবেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

‘চলুন, এবার নীচে যাওয়া যাক। সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে—বিশেষ করে আপনার মামিমার সঙ্গে।’

দীপ্তিমান কাঁচুমাচু মুখ করে তাকালেন এসিজির দিকে ‘মামিমার সঙ্গে কথা বলার সময় আমি সামনে না থাকলে হয় না? উনি একদম শিওর ভাববেন আমি আপনাদের ডেকে এনে অকারণে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পাকাচ্ছি…।’

এসিজি আলতো হেসে বললেন, ‘মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন কেন! উনি কিছুই বলবেন না…।’

ওঁরা তিনজনে নীচে নামছিলেন। দীপ্তিমানের নামতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। ছাদে রোদে ঘুরে যেটুকু তেতে উঠেছিলেন, বাড়ির ছায়ায় ঢোকামাত্রই ঠান্ডা আমেজ ওঁদের ঘিরে ধরল। ড্যাম্প-ধরা, পুরোনো বাড়ির বাড়তি শীত ওঁরা টের পেলেন।

কোথাও বকবকম করে গোলাপায়রা ডাকছিল। হঠাৎই সে-আওয়াজ ছাপিয়ে ঝগড়ার রুক্ষ চিৎকার ওঁদের কানে এল।

অজয়েন্দ্র কাউকে বলছিলেন, ‘পিসিমণির ওই টাকার আবার শেয়ার কী! পিসিমণি ঠিক করেছিল টাকাটা আমাকেই দিয়ে যাবে—তাই আমার সঙ্গে জয়েন্ট ফিক্সড ডিপোজিট করেছিল। মা বললেই তোদের ভাগ দিতে হবে নাকি!’

উত্তরে কোনও মহিলার চাঁচাছোলা গলা শোনা গেল।

‘অজু, বুঝেশুনে কথা বল। তোর সঙ্গে জয়েন্ট নামে রাখা মানেই সব তোর হয়ে গেল! ওই টাকা দিয়ে পিসিমণির কাজ হবে। ও-টাকার ভাগ আমার দরকার নেই।’

দীপ্তিমান চাপা গলায় বললেন, ‘সুনন্দাদি—অজুদা-বিজুদার বড়দি।’

অজয়েন্দ্র তখন বলছেন, ‘তোর আবার ভাগ দরকার হবে কেন! তুই আর অমলেশদা তো যা পেরেছিস এর মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছিস। ভাবিস, কিছু টের পাই না, জানি না! মা-কে বশ করে আমাদের এগেইনস্টে লেলিয়ে দেওয়া! আমি বিজুকে সব বলব। তারপরে…।’

‘অজু, কী হচ্ছে! চুপ কর বলছি!’ এক বৃদ্ধার তেজী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘সুনন্দা, তুই নিজের ঘরে যা। বাড়িতে এখন বাইরের লোক এসেছে। নিজেদের মধ্যে গোলমাল যা কিছু পরে মেটানো যাবে।’

সঙ্গে-সঙ্গে সব চুপচাপ। ভয় অথবা ভক্তি ছাড়া এ-ধরনের ‘জো হুজুর’ ছেলেমেয়ে আজকের দিনে পাওয়া মুশকিল।

‘বুঝতে পারলেন তো…মামিমা!’ দীপ্তিমান চাপা গলায় আবার বললেন।

এসিজি মাথার চুলের গোছায় দু-বার টান মেরে বললেন, ‘আমাদের প্রভাবতীদেবীর কাছে নিয়ে চলুন।’

দীপ্তিমান চমকে ঘুরে তাকালেন বৃদ্ধ গোয়েন্দার দিকে। বোধহয় ‘দেবী’ শব্দটা ওঁর কানে লেগেছে।

রঙ্গলাল এতক্ষণ গুম মেরে সব শুনছিলেন। হঠাৎই বললেন, ‘লোভ অতি সর্বনাশা/চেঙ্গিস খাঁ, কামাল পাশা।’

এসিজি স্বভাব-কবিবরের দিকে তাকালেন বটে, কিন্তু কিছু বললেন না। ওঁর স্বভাব-কবিতায় উপমা, প্রতীক ইত্যাদি এতই অদ্ভুত যে, প্রথম-প্রথম শ্রোতারা একটু ধাক্কা খায়।

দীপ্তিমান হাসি চাপছিলেন, ছোট্ট করে বললেন, ‘এ-বাড়িতে লোভ একটা মেজর জায়গা নিয়ে আছে। কারণ, টাকাপয়সা, সম্পত্তি সবকিছুর কন্ট্রোল মামিমার হাতে।’

‘তা হলে সোনার হারটা ছাদ থেকে চুরি গেল না কেন?’ রঙ্গলাল এসিজিকে প্রশ্ন করলেন।

‘ওটাই তো আমার আসল খটকা।’ আনমনাভাবে অশোকচন্দ্র বললেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। চশমাটা নাকের ওপর ঠিক করে বসালেন।

ওঁরা প্রভাবতীর ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ওষুধ আর ফিনাইলের হালকা একটা গন্ধ সকলের নাক ছুঁয়ে গেল।

বৃদ্ধা একটা লম্বা সোফায় বসে ছিলেন। সামনে দুটো টেবিল। তাতে দুটো ছোট রেডিয়ো, কিছু ম্যাগাজিন, বইপত্তর, আর একটা দম দেওয়া কলিংবেল।

ঘরটা মাপে বেশ বড়। মেঝেতে পুরোনো দিনের মার্বেল পাথর। দু-প্রান্তে দুটো খাট। দেখে বোঝা যায়, একটা প্রভাবতীর—অন্যটায় চারুবালা শুতেন। দুটো আলমারি। একটা ছোট টিভি। আর একটা ড্রেসিং টেবিল।

প্রভাবতীর রোগা শরীরে সাদা শাল জড়ানো। চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা। মাথায় ঘোমটা। সামনের দিকের চুলে এখনও কালো ছোপ রয়েছে। হাতে সরু-সরু দু-গাছা চুড়ি। আর ডানহাতে একটা লাঠি।

ঘরে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে একপাশে দাঁড়িয়েছিল। এসিজি অনুমানে বুঝলেন, আরতি।

দীপ্তিমান পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবং দেওয়ামাত্রই প্রভাবতী ওঁকে অনেকটা হুকুমের সুরে বললেন, ‘তুমি এবার যেতে পারো। আমাদের কথাবার্তার সময় তোমার থাকার দরকার নেই।’ তারপর আরতির দিকে ফিরে : ‘ওদিকের জানলাটা খুলে দে। আর টেবিলের ওই ঘটি থেকে আমাকে আধগ্লাস জল দে।’

প্রভাবতীর কাছাকাছি চারুবালার খাটের কিনারায় এসিজিরা বসেছিলেন। এসিজি সূক্ষ্ম নজরে রুগ্ন ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধাকে দেখছিলেন। সারা মুখে অহঙ্কারের ছাপ। এমনকী বলিরেখাগুলোও সেই অহঙ্কারী ঢঙে সামিল হয়েছে।

এসিজির গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সিগারেটের জন্য। কিন্তু এখানে সিগারেট মানায় না। একটু কেশে নিয়ে তিনি বললেন, ‘মিসেস রায়, দীপ্তিমানবাবু আমাদের সঙ্গে থাকাটা খুব জরুরি।’

‘তার মানে! কী বলতে চান আপনি! আমাদের ফ্যামিলির কথা বাইরের কোন এক দু-পয়সার জ্যোতিষীর সামনে বলতে হবে!’ ঘাড় কাত করে ওপরওয়ালার ভঙ্গিতে এসিজির দিকে দেখলেন প্রভাবতী : ‘আপনার কাছে ও জরুরি হতে পারে, আমার কাছে নয়।’

এরপর আর কোনও কথা চলে না।

দীপ্তিমান মুখ নিচু করে বসেছিলেন। এসিজির দিকে ‘আপনাকে বলেছিলাম না!’ এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

‘চারুবালা কীভাবে মারা গেছেন বলে আপনার মনে হয়?’ এসিজি সরাসরি প্রশ্ন করলেন।

‘সবাই যা জানে তাই—’ আরতির দেওয়া জলের গ্লাসে চুমুক দিলেন ‘অ্যাক্সিডেন্ট।’ তারপর আরতিকে : ‘তোকে আধগ্লাস বললাম, এতটা দিলি! যা বাকি জলটা ঘটিতে ঢেলে রাখ। ঘটিটা ঠিকমতো ঢাকা দিবি। কোনও কাজের একটা ছিরি নেই।’

আরতি কোনও জবাব না দিয়ে হুকুম তামিল করল।

‘যদি অ্যাক্সিডেন্ট না হয় তবে আর কীভাবে চারুবালা মারা যেতে পারেন?’

বিরক্তির একটা শব্দ করে বৃদ্ধা বললেন, ‘সুইসাইড হতে পারে। পাগলের খেয়াল—কী করে বলব বলুন!’

‘খুনও হতে পারে।’

‘তার মানে! খুনের প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে! তখন তো ছাদে আর কেউ যায়নি!’

‘আপনি কী করে জানলেন?’ এসিজি হেসে প্রশ্ন করলেন। তারপর ‘আপনি শুধু আপনারটা বলতে পারেন।’

‘না, আমি জানি। দিদি যখন ছাদে যায়—ছাদ থেকে পড়ে যায়—তখন এ-ঘরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি কতকগুলো জরুরি কথা বলছিলাম। অমলেশ বাড়ি ছিল না। আপনারা যেখানে বসে আছেন, অজু-বিজু, ওদের দু-বউ, ওখানে বসেছিল। আর সুনন্দা আমার বিছানায়। আরতি নীচে কলতলায় গিয়েছিল। এরপর বাকি রইল বাচ্চারা। ওরা নিশ্চয়ই তাদের ”দিদু”কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি!’

অশোকচন্দ্রের মনে হল তিনি কোনও জজসাহেবের এজলাসে বসে আছেন। প্রভাবতীর কথা শুনে মনে হল, সব প্রশ্নের উত্তর তিনি যেন আগেভাগেই জেনে তৈরি করে নিয়েছেন।

রঙ্গলাল এসিজিকে দেখছিলেন। থিঙ্কিং মেশিনকে খানিকটা যেন নাজেহাল দিশেহারা লাগছে।

‘আপনার দিদির হাতে কাপড় ছড়ানোর একটা ক্লিপ ছিল। উনি কি তখন কাপড় ছড়াতে গিয়েছিলেন, না তুলতে গিয়েছিলেন?’

‘পাগলের কখন কী খেয়াল হয়, আমি কী করে জানব!’

এসিজি দু-হাতের দশ আঙুল মাথায় ঠেকালেন। একটু সময় নিয়ে তারপর বললেন, ‘পুলিশ এসে ছাদে কিন্তু কোনও কাপড় পায়নি।’

‘বললাম তো, পাগলের খেয়াল! হয়তো ক্লিপ হাতে এমনই ছাদে ঘুরতে গিয়েছিল।’

‘ওঁর সোনার হারের ব্যাপারটা জানেন তো!’

‘জানাজানির আবার কী আছে! ওটা হয়তো দিদির কোমরেই বরাবর গোঁজা ছিল—ছাদে কোনওভাবে খসে পড়েছে।’

‘মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে চারুবালা কারও একটা গোপন অন্যায় দেখে ফেলেছিলেন। সেটার কথা উনি মাঝে-মাঝেই বলতেন। আপনি কখনও শুনেছেন?’

‘না তো!’ তারপর আরতিকে : ‘বেলা হয়ে গেছে। তুই গিয়ে আমার স্নানের গরম জল বসিয়ে দে। কালকের মতো বেশি গরম করিস না।’

আরতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

‘ভালো করে মনে করে দেখুন, মিসেস রায়। কোনও কিছু একটা জেনে ফেলার ব্যাপারে…।’

‘আপনি কার থেকে এসব আজেবাজে কথা শুনেছেন বলুন তো!’

এসিজি ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। এও বুঝলেন, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই প্রভাবতীর কাছে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লেন।

প্রভাবতী সঙ্গে-সঙ্গে রেডিয়োর এফ. এম. চ্যানেল চালিয়ে শুনতে শুরু করলেন। গলা তুলে বললেন, ‘যাওয়ার আগে একটু চা-টা খেয়ে যাবেন—।’

একতলার দিকে নেমে-যাওয়া সিঁড়ির পাশে দীপ্তিমান অপাংক্তেয়র মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসিজি ওঁর কাছে এসে বললেন, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। এবারে ছোটভাই আর দু-ভাইয়ের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলব।’

‘হ্যাঁ, ও-ঘরে চলুন। বিজুদার ঘরে আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে।’

বিজয়েন্দ্রর ঘরে বসে চা খেতে-খেতে কথাবার্তা সেরে নিলেন এসিজি।

আলোচনাটা টাকাপয়সা আর বিষয়-সম্পত্তির দিকে চলে গেল।

এই বাড়িটা মনোহর রায়ের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তিনি স্ত্রীকে সেটা আইনমাফিক গিফট করে যান। টাকাপয়সার সবরকম দায়িত্বও প্রভাবতীর ওপরে। ফলে বিরাট বিষয়আশয়ের মালিক হয়েও ছেলেমেয়েরা মালিক নন। সবটাই মা-নির্ভর। প্রভাবতী যাঁকে পছন্দ করেন তাঁরই বাড়বাড়ন্ত। যেমন, এখন সুনন্দা আর অমলেশ প্রভাবতীর দু-নয়নের মণি। কিছুদিন পরই হয়তো অজয়েন্দ্র কিংবা বিজয়েন্দ্রর পালা আসবে। কলকাতার আশেপাশে জমিজিরেত অনেক ছিল। কিন্তু তার প্রায় সবটাই বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রির টাকা প্রভাবতী অমলেশকে দিয়েছেন—কন্সট্রাকশানের ব্যবসা দাঁড় করাতে।

এসিজি বুঝলেন, মা-কে নিয়ে দু-ছেলে আর তাঁদের স্ত্রীদের ক্ষোভের শেষ নেই। অথচ কিছু করারও নেই—কারণ, প্রভাবতীই এ-বাড়িতে শেষ কথা।

এরপর সুনন্দার সঙ্গে কথা বলে উলটো ছবি পাওয়া গেল। বড় মেয়ে মায়ের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। সারা জীবন ধরে প্রভাবতী যে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কত কষ্ট সয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত বললেন সুনন্দা। মায়ের স্নেহ-মমতা-দয়া সম্পর্কেও এত বলতে লাগলেন যে, এসিজির মনে হচ্ছিল তিনি ভগিনী নিবেদিতা অথবা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জীবনী শুনছেন।

অমলেশ বাড়িতে নেই। তিনি দু-দিন আগে ব্যবসার কাজে ভাইজাগ গেছেন—পরশু ফিরে আসবেন। তবে অমলেশ থাকলেও বোধহয় কোনও লাভ হত না। কারণ, সুনন্দার কথারই প্রতিধ্বনি বোধহয় শুনতে পাওয়া যেত।

এসিজির মনটা কেমন যেন খচখচ করছিল। চারুবালা ছাদে গেলেন কাপড় ছড়াতে অথবা কাপড় তুলতে। অথচ ছাদে কোনও কাপড় পাওয়া গেল না। দীপ্তিমান, অজয়েন্দ্র—দুজনেই বলেছেন চারুবালা সাধারণত ছাদে যেতেন না। তা হলে সেদিন হঠাৎ গেলেন কেন! অন্যান্য দিন ওঁর কাপড়খানা কে ছড়াত, কে তুলত? নিশ্চয়ই আরতি! আরতির সঙ্গে একবার আলাদা কথা বলা দরকার।

বিজয়েন্দ্রকে ডেকে এসিজি বললেন, ‘বিজয়বাবু, আরতিকে একবার ডেকে দেবেন? নীচে বসবার ঘরে ওর সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলব। তবে কেয়ারফুলি ডাকবেন—আপনার মা যেন টের না পান। টের পেলেই হয়তো রাগারাগি করবেন…।’

বিজয়েন্দ্র ওঁর স্ত্রী তুলিকাকে ডেকে চাপা গলায় কী যেন বললেন। তুলিকা চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

‘আপনারা নীচে যান—ও আসছে। তবে বেশিক্ষণ ওকে আটকে রাখবেন না। একটু পরেই মা চান করতে যাবে। তখন আরতিকে ডেকে না পেলে পরে তুলোধোনা করে ছাড়বেন।’ কথা শেষ করে অদ্ভুত হাসলেন বিজয়েন্দ্র।

নীচের বসবার ঘরে ওঁরা তিনজন সবে গুছিয়ে বসেছেন, আরতি দরজায় এসে দাঁড়াল। পরনে ছাপা শাড়ি, আঁচল কোমরে গোঁজা।

‘আমায় ডেকেছেন, দাদাবাবু?’

‘তুমি তো জানো আমরা পুলিশের লোক—’ গম্ভীর চালে কথা শুরু করে এখন একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। গায়ের শালটা বাঁ-হাতের ওপরে ঝুলে পড়েছিল, সেটা কাঁধের দিকে টেনে নিলেন।

আরতির শ্যামলা মুখ পলকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাবাবু, জানি—।’

‘তোমাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করব। একদম ঠিক-ঠিক জবাব দেবে। উলটোপালটা চালাকি করলে…।’

‘মা কালীর দিব্যি—সত্যি বই মিথ্যে কইব না।’

‘চারুবালা—মানে, তোমার পিসিমার শাড়ি-জামাকাপড় রোজ কে ছাদে শুকোতে দিয়ে আসত, আর কে তুলে নিয়ে আসত?’

‘আ-আমি?’

‘অন্য কেউ কখনও যেত না?’

‘না। তবে কিছুদিন হল মা মাঝে-মাঝে বড়দিকে পাঠাতেন। কখনও বা পিসিমাকে পাঠাতেন।’

‘পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন পিসিমার কাপড় কে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছিল?’

একটু চিন্তা করে আরতি বলল, ‘বড়দি।’

‘শনিবার, পিসিমা যখন ছাদ ভেঙে পড়ে যান, তখন সত্যি-সত্যি বড়দি, দাদাবাবুরা, বউদিরা—সবাই মায়ের ঘরে ছিল?’

আবার সময় নিল আরতি। তারপর ‘হ্যাঁ। তবে তারপরই বড়দি আবার ছাদের দিকে গেছল। আমরা তখন বারান্দা দিয়ে গলিতে দেখচি কী পড়ল, কীসের ওরকম আওয়াজ হল।’

‘পিসিমার গলার চেনটা চুরি হয়েছিল তুমি জানো?’

‘মা কালীর দিব্যি, ও-হার আমি নিইনি, দাদাবাবু।’ আরতি আর একটু হলেই এসিজির পায়ে পড়ে আর কী!

‘না, না—তুমি নাওনি আমরা জানি। তবে হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। হয়তো কোথাও হারিয়ে গিয়ে থাকবে…। তারপর—পিসিমা মারা যাওয়ার দিন—ছাদে পাওয়া গেছে।’

আরতি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

‘হারটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তুমি জানো?’ আবার প্রশ্ন করলেন এসিজি।

‘মনে হয় হারায়নি কোথাও। হয়তো মায়ের কাছটিতেই রেখে দিয়ে পিসিমা পাগলামির খেয়ালে ভুলে গেছে।’

এসিজির ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি একবার দীপ্তিমানের দিকে দেখলেন। দুজনে চোখাচোখি হল।

‘হারটা সত্যি-সত্যি হারালে মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলত। দোকান-ফেরত সামান্য চার আনা আট আনার গণ্ডগোল হলেই আমায় যেরকম মুখ করে!’

এসিজির কোঁচকানো ভুরু সোজা হচ্ছিল না। মনে-মনে নতুন একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল, চারুবালাকে শুধু নিয়তির অদৃশ্য হাত পিছন থেকে ধাক্কা দেয়নি, তারও পিছনে হয়তো মানুষেরও হাত ছিল।

এসিজি আনমনা হয়ে গেলেন। মাথার পিছনে হাত নিয়ে সাদা চুলের গোছায় টান মারতে শুরু করলেন।

তারপর হঠাৎই আরতিকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যাও। আমার সঙ্গে যেসব কথা হল কাউকে বলবে না। বললে তোমারই বিপদ হবে।’

আরতি ফ্যাকাসে মুখে মাথা নেড়ে চলে গেল।

কাজের লোকরা সত্যি-সত্যিই কাজের লোক। এটাকে কি যমক অলঙ্কার বলা চলে? আপনমনেই হাসলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর বললেন, ‘গোস্বামী রঙ্গলাল / বাদ বাকিটা হবে কাল।’

‘কী বুঝলেন, ডক্টর গুপ্ত?’ দীপ্তিমান ইতস্তত করে জিগ্যেস করলেন।

‘মোটামুটি বোধহয় বুঝতে পারছি। আপনার সন্দেহ সত্যি হলেও হতে পারে। কাল আমি আর রঙ্গলালবাবু এ-বাড়িতে আর-একবার আসব। কী, রঙ্গলালবাবু, সময় হবে তো আপনার?’

আকর্ণ হাসলেন রঙ্গলাল ‘প্রশ্নটি অতি অবান্তরম/সময় হইবে সুনিশ্চিতম।’

দিনের আলোয় যে-বাড়িটাকে জীর্ণ অসুস্থ বলে মনে হচ্ছিল, রাতের আঁধারে সেটাকে ভুতুড়ে বলে মনে হল।

অশোকচন্দ্র ও রঙ্গলাল বাড়িতে ঢুকতেই সুনন্দার সঙ্গে দেখা হল। টেলিফোনে আগাম বলা ছিল। সুতরাং অপছন্দ মুখে সুনন্দা ওঁদের দোতলায় মায়ের ঘরে নিয়ে গেলেন।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এসিজি টিভি চলার শব্দ পাচ্ছিলেন, বাচ্চাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। প্রভাবতীর ঘরে ঢুকতেই টিভির শব্দ ওঁদের কানে ধাক্কা মারল।

গতকালের গন্ধটা আরও উগ্রভাবে এসিজির নাকে এল।

প্রভাবতী সম্রাজ্ঞীর ঢঙে সেজেগুজে সোফায় বসে ছিলেন। শরীর টান-টান। মুখে প্রসাধনের সামান্য আস্তর।

আরতি ওঁর পাশে মেঝেতে বসে টিভি দেখছিল। এসিজিদের দেখেই উঠে দাঁড়াল।

প্রভাবতী ওকে বললেন, ‘টিভির আওয়াজটা একদম কমিয়ে দে।’

হুকুম তামিল হল। টিভিতে মূকাভিনয় শুরু হল।

‘বলুন, ডক্টর গুপ্ত, কী ব্যাপারে দেখা করতে চেয়েছেন?’ প্রভাবতী মাপা গলায় প্রশ্নটা করলেন। অনুমতির অপেক্ষা না করেই এসিজি রঙ্গলালকে নিয়ে চারুবালার খাটের কিনারায় বসে পড়লেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘আপনার সঙ্গে প্রাইভেট কিছু কথা ছিল।’

সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম হল : ‘আরতি, তুই এখন যা। আমি ডাকলে তবে আসবি।’

আরতি তাড়াতাড়ি পা ফেলে চলে গেল। যেন পালিয়ে বাঁচল।

সুনন্দাও চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এসিজি ওঁকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন আপনি ওঁর কাপড় ছড়াতে ছাদে গিয়েছিলেন? পরে, পিসিমা ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পরেও আপনি আবার ছাদে গিয়েছিলেন। অথচ তখন তো সকলের গলির দিকে ছুটে যাওয়ার কথা। এটা একটু এক্সপ্লেইন করবেন?’

সুনন্দা দিশেহারা চোখে মায়ের দিকে তাকালেন।

প্রভাবতী স্থির গলায় বললেন, ‘তুই যা। আমি কথা বলছি।’

সুনন্দা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এসিজির দিকে তাকিয়ে বোকা-বোকা হেসে চটপট চলে গেলেন।

‘যা বলার আমাকে বলুন, ডক্টর গুপ্ত। ওরা সব ছেলেমানুষ—।’

প্রভাবতীর গলায় সামান্য চ্যালেঞ্জের ছোঁওয়া ছিল। ঘরের জোড়া টিউব লাইটের আলোয় ওঁর বলিরেখাগুলো নিষ্ঠুর দেখাল।

এসিজির ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। মাথার চুলের গোছায় টান মেরে তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে একটা গল্প শোনাই। গল্পে হয়তো অনেক ফাঁকফোকর থাকবে—সেগুলো আপনাকেই ভরাট করতে হবে…।’

প্রভাবতীর মুখ পাথরের মতো। চোখ টিভির দিকে।

কাল সারাটা রাত ধরে বহু ভেবেছেন বৃদ্ধ হুনুর। মনে-মনে এমন একটা গল্প তৈরি করতে চেয়েছেন যেটা প্রতিটি সূত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সোনার হার, কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ, সুনন্দার ছাদে যাতায়াত—আর, সবশেষে চারুবালার নিয়তি। এখন সেই গল্পই শোনাতে এসেছেন প্রভাবতীকে।

সামান্য কেশে নিয়ে এসিজি বলতে শুরু করলেন ‘আপনি একটা চান্স নিয়েছিলেন, মিসেস রায়। চারুবালাকে আপনি নানান ছল-ছুতোয় ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গাটায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। তাই ওঁর ভেজা কাপড় ইদানীং ওই বিপজ্জনক জায়গাতেই ছড়ানো হত। কে ছড়াতেন জানি না। তবে আপনি নন। সুনন্দা হতে পারে, আরতি হতে পারে। হয়তো ছড়ানোর জন্যে ওরা লাঠি বা অন্য কিছু ব্যবহার করত—যাতে ওই লক্ষ্মণের গণ্ডির ভেতরে ঢুকে পড়তে না হয়। তা ছাড়া, আমি দেখেছি, দড়িটা লাঠি দিয়ে টেনে এনেও নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে কাপড় ছড়ানো যায়, ক্লিপ আঁটা যায়। আপনি সেই শনিবার চারুবালাকে বকাঝকা করে ওঁর শুকনো কাপড় তুলে আনতে পাঠিয়েছিলেন—আমার সেরকমই মনে হয়।

‘কিন্তু চারুবালা ছিলেন কিছুটা ছিটগ্রস্ত। তাই সবসময় হয়তো ছাদে গিয়েও ওই জায়গাটায় পা দিতেন না। হয়তো সাদা দাগটা ওঁকে পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিত—উনি সাবধান হয়ে যেতেন।

‘আপনি তখন খানিকটা সমস্যায় পড়লেন। তখন সোনার হারের টোপটা আপনার মাথায় এল। ওটা আপনি চারুবালার কাছ থেকে কোনও অজুহাতে নিয়ে লুকিয়ে ফেললেন। তারপর ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গায় হারটা রেখে দিয়ে এলেন। না, আপনি নন—আপনার হয়ে অন্য কেউ। আপনি যে সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না তা আমি জানি।

‘এইবার কাজ হল। চারুবালা ছাদে গেলেন। সোনার চেনটা দেখতে পেলেন। তারপর ঠিক কী হয়েছে জানি না। উনি শাড়ি থেকে ক্লিপটা আগে খুলেছেন, নাকি চেনটা আগে কুড়িয়ে নিয়েছেন কে জানে! চেনটা আগে নিয়ে থাকলে ওটা হয়তো আবার ওঁর হাত থেকে খসে পড়ে গেছে ছাদেই। কিন্তু ক্লিপটা হাতে থেকে গিয়েছিল…।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এসিজি। তারপর আবার খেই ধরলেন : ‘নিয়তি তার কাজ করল। চারুবালা পড়ে গেলেন। আর আপনার এ-ঘর থেকে সুনন্দা সঙ্গে-সঙ্গে ছাদে চলে গেল পিসিমণির শাড়িটা তুলে আনতে…।’

এসিজি থামলেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন প্রভাবতী। টিভির দিকে তখনও তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু ওঁর দু-চোখ থেকে ভাঙা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। টিভির আলোয় জলের রেখা চকচক করছিল।

চাপা খসখসে গলায় বললেন, ‘হারটা আমি দিদির কাছ থেকে নিইনি। দিদিই আমাকে ওটা গলা থেকে খুলে রাখতে দিয়েছিল—পরে ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য চাইলে আমিও অস্বীকার করতাম।

‘আপনার একটা গোপন অন্যায় চারুবালা দেখে ফেলেছিলেন। সেটা কী আমি আঁচ করতে পারিনি—।’

নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক গলায় প্রভাবতী বললেন, ‘এই বাড়িটা আমি সুনন্দার নামে উইল করে গেছি। অমলেশ যেদিন কাগজপত্র সই করিয়ে নেয় দিদি সেদিন দেখেছিল। তারপর থেকেই আমাকে জ্বালিয়ে মারত। বলত, ”এ তুমি ঠিক করলা না। অজু-বিজু ভিটা ছাইরা কই যাইব!” কিন্তু কী করব! সুনন্দা-অমলেশের জন্যে যতটা আমার মন টানে অজু-বিজুর জন্যে ততটা না। ওরা অনেক পেয়েছে—।’

চোখের জল তখনও গড়িয়ে পড়ছিল—।

প্রভাবতীকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে তারপর এসিজি বললেন, ‘মিসেস রায়, এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন? আপনি দু-দুটো অন্যায় করেছেন—তার মধ্যে একটা এখনও শুধরে নেওয়ার সময় আছে। আমি হলে শুধরে নিতাম…।’

‘আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বৃদ্ধা মুখ না ফিরিয়েই প্রশ্ন করলেন।

‘না—’ হেসে মাথা নাড়লেন এসিজি ‘প্রমাণ নেই। প্রমাণই কি সব! একটা কথা আপনাকে বলি। ঈশ্বর কমা, সেমিকোলন, কোলন, ড্যাশ—এইসব পাংচুয়েশান মার্ক আমাদের হাতে দেন—তবে দাঁড়িটা নিজের হাতে রাখেন। সময় হলেই আমাদের জীবনে দাঁড়ি টেনে দেন। সেই দাঁড়িটা নিজের হাতে তুলে নেওয়া মানে ঈশ্বরকে অসম্মান করা। আপনি সেটাই করেছেন। প্রমাণ না থাকুক, যে-অন্যায়টা এখনও শোধরানো যায় আপনি সেটা অন্তত শুধরে নিন…।’

‘দিদিকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু কী করব…সুনন্দাদের জন্যে পাগল-পাগল টান। কেন এমন টান কে জানে! আমার জন্যে দিদি…ছিল শুকতারা, সন্ধ্যাতারা হয়ে গেল। আমার জন্যে…।’

বৃদ্ধার মুখ ভেঙেচুরে গেল। জলভরা কাতর চোখে এসিজির দিকে তাকালেন তিনি। কিছু একটা বলতে চাইলেন।

এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘এসব কথা আমি কাউকে বলব না।’

একজন সর্বস্বান্ত রানিকে তাঁর মেকি সিংহাসনে বসিয়ে রেখে এসিজি আর রঙ্গলাল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

টিভিতে তখনও মূকাভিনয় চলছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *