১. হাসান মনে মনে ছটফট করছে

ক’দিন থেকেই হাসান মনে মনে ছটফট করছে। আজ প্রায় পাঁচ বছর হল সে মহাকাশ স্টেশন এগ্রোমিডার সর্বময় কর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এর ভিতরে পৃথিবীতে গিয়েছে মাত্র কয়েকবার শেষবার গিয়েছিল এক বছর আগে মাত্র দু’সপ্তাহের জন্যে। পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই, তাই বোধহয় পৃথিবীটাই তার খুব আপন। ছেলেবেলায় অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছিল, বড় হয়ে মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডক্টরেট করেছে। প্রথম কয়েক বছর শিক্ষানবিস হিসেবে বিভিন্ন মহাকাশ ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছে, তারপর খুব অল্প বয়েসেই তাকে এগ্রোমিডার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। মহাকাশে নিঃসঙ্গ পরিবেশে গুটিকতক বিজ্ঞানী নিয়ে রুটিনবাঁধা কাজ করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, এবারে তার ক’দিন বিশ্রাম নেয়া দরকার। পৃথিবীতে ছুটি চেয়ে খবর পাঠিয়েছিল, প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে। মঙ্গল গ্রহ থেকে যেমহাকাশযানটি আকরিক শিলা নিয়ে ফিরে আসছে, সেটি এন্ড্রোমিডাতে পৌঁছে যাবার পর তার ছুটি। মহাকাশযানটির ক্রুদের সাথে সে পৃথিবীতে ফিরে যাবে, এবারে অন্তত ছয়মাস সে পৃথিবীর মাটি-হাওয়ায় ঘুরে বেড়াবে। মাঝে মাঝে খুব নিঃসঙ্গ মনে হয়—মিষ্টিমতো কোনো মেয়ে পেলে হয়তো বিয়েও করে ফেলতে পারে।

মিষ্টি একটা মেয়ের কথা মনে হতেই তার জেসমিনের কথা মনে হল। এন্ড্রোমিডাতে শিক্ষানবিস হিসেবে সে প্রায় মাসখানেক হল এসেছে আরো দু’ জন ছেলের সাথে। মেয়েটি ভারি চমৎকার, একেবারে বাচ্চা—দেখে মনেই হয় না মহাকাশ প্রাণিবিদ্যায় ডক্টরেট করেছে। প্রথমবার মহাকাশে এসেছে, তাই ওকে সব কিছু শিখিয়ে দিতে হচ্ছে। সঙ্গের ছেলে দুটোও খুব চমৎকার। একজন পদার্থবিদ, অন্যজন মহাকাশ প্রযুক্তিবিদ। পদার্থবিদ ছেলেটির নাম জাহিদ, একটু চুপচাপ, হাসে কম, কথা বলে কম—তবে খুব কাজের। অন্যজনের নাম কামাল, ভীষণ ছটফটে সব সময় হৈচৈ করে বেড়াচ্ছে, দেখে বোঝাই যায় না যে সে নিউক্লিয়ার রি-অ্যাকটরের একজন বিশেষজ্ঞ বিশেষ।

এই তিনজন ছেলেমেয়ে এগ্রোমিডাতে আসার পর থেকে এপ্রোমিডার গুমোট দম আটকানো ভাবটা কেটে গেছে। ইদানীংহাসানও আর এতটা নিঃসঙ্গ অনুভব করে না। গত সপ্তাহে সব কয়জন টেকনিশিয়ান আর বিজ্ঞানীরা জরুরি খবর পেয়ে পাশের মহাকাশ ল্যাবরেটরিতে চলে গেছে—এত বড় মহাকাশ স্টেশনে এখন ওরা মাত্র চার জন। কিন্তু হাসানের মোটেই খারাপ লাগছে না—ছেলেমেয়ে তিনটিকে নিয়ে বেশ ফুর্তিতেই আছে।

জাহিদ, কামাল আর জেসমিন হাসানের নাম পৃথিবী থেকেই শুনেছিল। অসামান্য কৃতিত্বের জন্যে দু’বার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে বয়স ত্রিশ না পেরোতেই, তাই এখানে আসতে পেরে ওরা নিজেদের খুব ভাগ্যবান মনে করছে। হাসানের সাথে পরিচয় হবার কয়দিনের ভিতরেই বুঝতে পেরেছে, এত অল্প বয়সে একজন মানুষ কী জন্যে দু’বার জাতীয় পুরস্কার পায়। হাসানের মতো পরিশ্রমী আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। কামাল হাসানকে দেখে এত মুগ্ধ হয়েছে যে, আচার-আচরণে নিজের অজান্তেই হাসানকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছে।

পৃথিবীর হিসেবে আর ছয় দিন পর মঙ্গল গ্রহ থেকে ফেরত আসা মহাকাশযানটি এড্রোমিডাতে পৌঁছবে। তার ব্যবস্থা করার জন্যে হাসান প্রতি বারো ঘন্টা অন্তর মহাকাশযানটির সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজন হলে কম্পিউটারে ছোটখাটো হিসেব করে রাখে। রুটিনবাঁধা কাজ, এখন জাহিদ আর কামাল মিলেই করতে পারে। দু’ জনেরই খুব উৎসাহ—কেমন করে মহাকাশ স্টেশনে এসে একটি রকেট আশ্রয় নেয়—ব্যাপারটি দেখার ওদের খুব কৌতূহল।

সারা দিন ঝামেলার পর হাসান ঘুমানোর জন্যে তার কেবিনে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় যোগাযোগ-কক্ষটা ঘুরে যাওয়ার জন্যে লিফটটাকে ছয়তলায় থামিয়ে ফেলল। ঝকঝকে উজ্জ্বল করিডোর ধরে হেঁটে যোগাযোগ-ঘরে পৌঁছে সে জাহিদ, কামাল আর জেসমিনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়—কী নিয়ে জানি তুমুল তর্ক হচ্ছে। হাসান ঘরে ঢুকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, এত হৈচৈ কিসের?

স্যার কামাল হড়বড় করে বলতে থাকে—বারটা চৌত্রিশ মিনিটে যোগাযোগ করার কথা ছিল, বারটা সাঁইত্রিশ হয়ে গেছে, এখনও ওরা কথা বলছে না—

কারা?

মঙ্গল গ্রহ থেকে যারা ফিরে আসছে

হাসানের ভুরু কুঁচকে গেল, এমনটি হবার কথা নয়। বলল, যন্ত্রপাতি ঠিক আছে তো?

জ্বি স্যার।

দেখি—

হাসান মহাকাশযানটির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল, কিন্তু হেডফোনে। এক বিস্ময়কর নীরবতা ছাড়া এতটুকু শব্দ শোনা গেল না।

জাহিদ কাছে দাঁড়িয়েছিল, জিজ্ঞেস করল, স্যার, এমন কি হতে পারে, যে, ওদের ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়ে গেছে?

হতে পারে, কিন্তু সব সময়েই ডুপ্লিকেট রাখা হয়। এ ছাড়াও ইমার্জেন্সি কিট থাকে—ওরা যদি যোগাযোগ নাও করতে চায়, আমরা ইচ্ছে করলে ওদের সাথে যোগাযোগ করতে পারব।

সেটা দিয়ে চেষ্টা করে দেখবেন একটু?

দেখলাম। কোনো সাড়া নেই।

স্যার—জেসমিন এগিয়ে এসে ভীত চোখে বলল, তাহলে কী হয়েছে ওদের?

মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল হাসানের, বলল, কী হয়েছে আন্দাজ করে আর লাভ কি, বের করে ফেলি।

সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য স্বয়ংক্রিয় রাডার স্টেশন বসানো রয়েছে। মহাকাশযানটির কাছাকাছি কয়েকটা রাডার স্টেশনের সাথে যোগাযোগ করে হাসান ছবি নেবে ঠিক করল। সুইচ প্যানেলে ঝুঁকে কাজ করতে করতে একসময় অনুভব করল, জাহিদ কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাসান জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?

জ্বি স্যার।

কি?

আমার মনে হয় মহাকাশযানটি কোনো নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশানে ধ্বংস হয়েছে। হাসান চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, একথা বলছ কেন?

ঘন্টাখানেক আগে মহাকাশের তেজস্ক্রিয়তা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। হিসেব করে দেখেছি মহাকাশযানটি যতদূরে রয়েছে সেখানে কোনো ছোট পারমাণরিক বিস্ফোরণ ঘটলে এটুকু হওয়া উচিত।

হাসান বুঝতে পারল, ছেলেটা ঠিকই ধরেছে, কিন্তু এ ব্যাপারে যুক্তি দিয়ে অগ্রসর হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, যখন নিশ্চিত হবার মতো ব্যবস্থা রয়েছে।

ঘন্টাখানেক পরে একগাদা আলোকচিত্র নিয়ে হাসান তার কেবিনে ছটফট করছিল। জাহিদের ধারণা সত্যি। মহাকাশযানটি পারমাণবিক বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আটজন ক্রু নিয়ে এরকম দুর্ঘটনা গত দশ বছরে আর একটিও হয় নি। পৃথিবীতে খবর পাঠানো হয়েছে—কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটল ব্যাপারটি দেখার জন্যে একটা ছোট রকেট সিগনাস’ পাশের মহাকাশ স্টেশন থেকে রওনা হয়ে গেছে।

জাহিদ, কামাল আর জেসমিন খুব মুষড়ে পড়েছে। হাসান ওদের নানাভাবে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয় নি।

বিছানায় শুয়ে হাসান খুব ক্লান্তি অনুভব করে। তার নার্ভ আর সইতে পারছে না। কোনো এক নীল হ্রদের পাশে মাটির কাছাকাছি ঘাসে শুয়ে থেকে থেকে আকাশে সাদা মেঘ দেখার জন্যে ওর বুকটা হা-হা করতে থাকে।

পরদিন ভোরে হাসান খুব আশ্চর্য একটি খবর পেল। খবরটি প্রথমে জানাল জাহিদ। তার নিজস্ব হিসেব অনুযায়ী মহাকাশে তাদের কাছাকাছি নাকি আরও তিনটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছে।

সকালের রিপোর্ট পৌঁছুতেই দেখা গেল জাহিদের ধারণা সত্যি। গত বার ঘন্টায় সর্বমোট পাঁচটি মহাকাশযান পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে, তার ভিতরে তিনটি তাদের কাছাকাছি, লক্ষ মাইলের ভিতরে। এই পাঁচটি মহাকাশযান ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি দেশের এবং তারা ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিল। পাঁচটি মহাকাশযানে দুই শতাধিক প্রথমশ্রেণীর টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার আর বিজ্ঞানী কাজ করছিল সবাই মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে।

কন্ট্রোলরুমে হাসান চুপচাপ বসে রইল। সে চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছে, সমস্ত পৃথিবীতে কী ভয়ানক আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেছে। খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন কী সাংঘাতিক হৈচৈ শুরু করেছে। কিন্তু এরকম হচ্ছে কেন?

জেসমিন স্নানমুখে বসে ছিল—অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ধীরে ধীরে বলল, আমার ভালো লাগছে না কেন জানি মনে হচ্ছে একটা ভীষণ বিপদ ঘটতে যাচ্ছে।

হাতে মুঠি করে ধরে রাখা কাগজ খুলে কম্পিউটারের ডাটা দেখতে দেখতে জাহিদ বলল, আমার হিসেবে ভুল না হয়ে থাকলে আরো দু’টি মহাকাশযান ধ্বংস হয়েছে।

সত্যতা যাচাই করে নেবার উৎসাহ পর্যন্ত কেউ দেখাল না। বুঝতে পারল, সত্যিই তাই ঘটেছে।