রিবিট ও কালো মানুষ – মোশতাক আহমেদ
প্রথম প্রকাশ : ফাল্গুন ১৪১৪, ফেব্রুয়ারি ২০০৮
.
রিবিট অদ্ভুত একটা ই-মেইল পেল।
প্রিয় রিবিট,
আমার নাম তিশা। আমি তোমার একজন খুব ভালো বন্ধু। আমি ধানমন্ডি লিটল মুন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। বিশেষ কারণে তোমার সাহায্য খুব প্রয়োজন। গতকাল আমার আব্দুর কাছে ‘কালো মানুষ’ নামের কেউ একজন ফোন করে দশ লক্ষ টাকা চেয়েছে। ‘কালো মানুষ’বলেছে সে খুব ভয়ঙ্কর, টাকা না দিলে সে আমাকে মেরে ফেলবে। আর পুলিশকে জানালে বেশি ক্ষতি হবে। আমার আবু-আম্মু খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এত টাকা দেয়ার মতো আর্থিক অবস্থা আমাদের নেই। রিবিট, প্লিজ আমাদের সাহায্য কর। আমি জানি একমাত্র তুমিই আমাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
তোমার প্রিয়
তিশা
রিবিট ই-মেইলটা আবার পড়ল। সে বুঝতে পারল তিশা সত্যি বিপদে আছে। ভয়, উত্তেজনা বা যে কোনো কারণেই হোক নিজের ঠিকানা পর্যন্ত লিখতে ভুলে গেছে। রিবিট মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিল সাহায্য করবে তিশাকে।
রিবিট কি শেষ পর্যন্ত পেরেছিল তিশাকে সাহায্য করতে?
.
মোশতাক আহমেদ
জন্ম ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৫, জেলা ফরিদপুর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ডিপার্টমেন্ট থেকে এম ফার্ম ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ এবং ইংল্যান্ডের লেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ক্রিমিনোলোজিতে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। কর্মজীবনে তিনি একজন চাকুরিজীবী। তাঁর লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবনে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে তিনি অধিক আগ্রহী হলেও গোয়েন্দা এবং ভৌতিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে :
সায়েন্স ফিকশন : রোবটিজম, ক্লিটি ভাইরাস, নিহির ভালোবাসা, লাল শৈবাল, পাইথিন, ক্রিকি, ক্রি, লিলিপুটের গ্রহে, পৃথিবীতে লিলিপুটেরা, রোবো, নিকি, অণুমানব, রোবটের পৃথিবী, সবুজ মানব, প্রজেক্ট ইক্টোপাস, গিগো, লালমানব।
সায়েন্স ফিকশন সিরিজ : রিবিট, কালোমানুষ, রিবিট এবং ওরা, রিবিটের দুঃখ।
ভৌতিক : অতৃপ্ত আত্মা, প্রেতাত্মা, আত্মা, রক্ততৃষ্ণা, অভিশপ্ত আত্মা, রক্ত পিপাসা।
গোয়েন্দা এবং কিশোর অ্যাডভেঞ্চার : ডাইনোসরের ডিম, লাল গ্যাং, নীল মৃত্যু, ববির ভ্রমণ।
প্যারাসাইকোলজি : মায়াবী জোছনার বসন্তে।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস : নক্ষত্রের রাজারবাগ
জকি তার জীবনধর্মী বহুলপ্রশংসিত একটি উপন্যাস।
.
.
উৎসর্গ
হাসিখুশি, প্রাণবন্ত
এবং অতিপ্রিয় ব্যক্তিত্ব
জাকির হোসেনকে
.
ভূমিকা
(যে সকল পাঠক রিবিট সিরিজের প্রথম বইটি পড়েননি শুধুমাত্র তাদের জন্য)
দীর্ঘ ত্রিশ বছর গবেষণাশেষে বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর হক মানুষের কল্যাণের জন্য ঢাকা শহরে একটি অতি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটকে মুক্ত করে দেয়। এই অতি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটটির নাম ‘রিবিট’। সকল রোবটের মতো একটি মাইক্রোচিপস রিবিটের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে রিবিটের মূল প্রোগ্রাম সংরক্ষিত আছে এবং এই মূল প্রোগ্রামের নাম ‘প্রোগ্রাম রিবিট’। ‘রিবিট প্রোগ্রাম’-ই রোবট রিবিটের নিয়ন্ত্রক বা প্রাণকেন্দ্র। রিবিটের অভ্যন্তরে ‘ইপি’ নামের অপর একটি বিশেষ প্রোগ্রাম রয়েছে। ইপি মূলত রিবিটের তথ্য বা জ্ঞানকেন্দ্র, পৃথিবীর সকল বিষয় সম্পর্কে সাধারণ তথ্যসমূহ ইপির অভ্যন্তরে সংরক্ষিত আছে। ইপির মূল কাজ হচ্ছে রিবিটকে তথ্য প্রদান করা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে নানাভাবে রিবিটকে সাহায্য করা। এছাড়া রিবিটের নিঃসঙ্গতা দূর করাও ইপির অন্যতম কাজ। উল্লেখ্য, রিবিটের কণ্ঠস্বর পুরুষালি হলেও ইপির কণ্ঠস্বর এক নারীর। রিবিট এবং ইপি যে-কোনো সময়, যে-কোনো প্রয়োজনে, যে-কোনো বিষয়ে, একে অন্যের সাথে কথা বলতে পারে। তবে এটা সত্য, ‘প্রোগ্রাম ইপি’ সবসময় ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং সকল বিষয়ে ‘প্রোগ্রাম রিবিট’-ই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এছাড়াও রিবিটের অভ্যন্তরে হাজার হাজার প্রোগ্রাম রয়েছে যেগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কিংবা ‘প্রোগ্রাম ইপির’ তুলনায় গৌণ। মাইক্রোচিপস্-এর অভ্যন্তরে এই হাজার হাজার প্রোগ্রামগুলোও ‘প্রোগ্রাম রিবিট’ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত।
রিবিটের সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হল ‘অনুভূতি’। মানুষের মতোই রিবিট সুখ দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা উপলব্ধি করতে পারে। আর এ-কারণেই মানুষের সুখে রিবিট সুখী হয়, মানুষের আনন্দে আনন্দিত হয় এবং মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হয়। রিবিট মানুষের মতোই আবেগপ্রবণ এবং সে তার নিজস্ব মর্যাদার প্রতি যথেষ্ট সচেতন। তাই যে কোনো কটুক্তি কিংবা আপত্তিজনক আচরণে রিবিট অপমানিত বোধ করে। তবে রিবিটের মধ্যে প্রতিহিংসার কোনো অনুভূতি নেই। রিবিট নিজের প্রয়োজনে কখনো প্রতিহিংসাপরয়ণ হতে পারে না। যে সামান্য রাগের অনুভূতি রিবিটের মধ্যে আছে তা শুধুমাত্র মানুষের মঙ্গলের জন্য অথবা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। রিবিট সর্বদাই সত্যবাদী। তবে মানুষের মঙ্গলের জন্য রিবিট যে-কোনো তথ্য গোপন করতে পারে কিংবা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারে। রিবিটের আচরণ নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর। মানসিকভাবে রিবিট কখনো শিশু, কখনো কিশোর, কখনো তরুণ, আবার কখনো মাঝবয়সী? তবে সাধারণত রিবিট উদ্যমী এবং পরোপকারী এক প্রাণবন্ত হাসিখুশি তরুণ, যে কিনা সবসময় মানুষের কল্যাণ এবং মঙ্গল নিয়েই চিন্তা করে।
রিবিট একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রোবট। সক্রিয় থাকার জন্য রিবিট কখনো মানুষকে বিরক্ত করে না। রিবিটের অভ্যন্তরের ব্যাটারি বা চার্জার ইলেকট্রিক কিংবা সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে চার্জ হয়। এ কারণে সূর্যের আলো থেকে রিবিট নিজেকে প্রয়োজনমতো চার্জ করে নিতে পারে। এমনকি, বিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উপরের যে কোনো তাপমাত্রার পরিবেশ থেকে রিবিট নিজেকে চার্জ করতে পারে। রিবিটের অভ্যন্ত রে আত্মরক্ষার জন্য যে-প্রোগ্রাম রয়েছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ক্ষিপ্র। ‘রাইট অব প্রাইভেট ডিফেন্স’ বা ‘ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ ব্যতীত রিবিট কখনো কোনো মানুষ বা প্রাণীকে আঘাত করে না। তবে শিশু, অন্য কোনো নিরপরাধ মানুষ কিংবা প্রাণীর জীবন রক্ষার্থে রিবিট মানুষের উপর নিয়ন্ত্রিত শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।
মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেই রিবিটকে কিছু অতিমানবীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। রিবিট প্রয়োজনে তার শক্তি পাঁচগুণ বৃদ্ধি করতে পারে, তবে এই শক্তি অবশ্যই একটি পাহাড়কে উল্টে দেয়ার মতো নয়। আধুনিক প্রযুক্তির সবকিছুই রিবিটের অভ্যন্তরে আছে। রিবিটের মূল প্রোগ্রাম সরাসরি মোবাইল, রেডিও, টেলিভিশন এবং টেলিফোন নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত। এ-কারণে রিবিট মুহূর্তেই ইন্টারনেট, ইমেইল এবং টেলিফোনের মাধ্যমে যে-কোনো স্থানে যোগাযোগ করতে পারে এবং রেডিও কিংবা টেলিভিশনের যে-কোনো অনুষ্ঠান শুনতে বা দেখতে পারে। রিবিটের নিজস্ব ই-মেইল নম্বর [email protected]। রিবিটের চোখে অত্যন্ত শক্তিশালী ডিজিটাল এবং অপটিক্যাল জুমের ভিডিওক্যাম রয়েছে। এ-কারণে রিবিট যেমন মুহূর্তেই যে-কোনোকিছুর ছবি তুলতে পারে তেমনি অনেক দূরের জিনিসও দেখতে পারে। রিবিট তার চারপাশে যা-কিছু দেখে বা শুনে তা তার অভ্যন্তরের মেমোরিতে পাঁচবছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে। আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো রিবিট তার স্মৃতি থেকে কখনোই মুছে ফেলে না, বছরের-পর-বছর সংরক্ষণ করে। ফলে রিবিট যে কোনো সময় তার পূর্বের যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিকে দেখতে পারে বা সেখান থেকে যে-কোনো স্মৃতির ভিডিও ধারণ করে বা ছবি তুলে তা প্রিন্ট করতে পারে। রিবিটের মূল প্রসেসর এতটাই শক্তিশালী যে মুহূর্তেই রিবিট মানুষের মতো যে-কোনো বিষয় বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতার কারণেই রিবিট অতি উচ্চ বুদ্ধিমাত্রার রোবটের মর্যাদা লাভ করেছে।
রিবিটের মূল কাজ হচ্ছে মানুষের কল্যাণ সাধন করা। আর এই কল্যাণসাধনের জন্যই রিবিট ঘুরে বেড়ায় বাংলাদেশের শহর-গ্রামে, পথে-প্রান্তরে, আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে। কখনো সে অসুস্থ শিশুর পাশে, কখনো হতদরিদ্র কৃষকের সাথে, কখনো দুর্ধর্ষ অপরাধীর পিছনে, কখনো অসহায় শিশু-কিশোরদের মাঝে, কখনো উত্তাল সাগরে বিপদগ্রস্ত জেলেদের সাথে, আবার কখনো সুন্দরবনে আতঙ্কগ্রস্ত পশু পাখির মাঝে। রিবিট তার এই পরোপকারী আর কল্যাণকর কাজের জন্য অল্পদিনেই মন জয় করে নেয় সবার। পথে-প্রান্তরে যে যেখানে রিবিটের সাক্ষাৎ পায় ছুটে আসে রিবিটের সাথে কথা বলতে, তার সাথে হাত মেলাতে, তাকে জড়িয়ে ধরতে, তাকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে। আর শিশু-কিশোর- তাদের কাছে রিবিট যেন এক আদর্শ, এক মহান ব্যক্তিত্ব। রিবিট বলতে তারা পাগল, তারা উন্মাদ। রিবিট যেন তাদের সুখ, শান্তি, আনন্দ, হৃদয়ের ভালোবাসা। তাই তো রিবিটের আহ্বানে তারা বারবার ছুটে আসে রিবিটকে সাহায্য করতে, সবাই মিলে অংশগ্রহণ করে মানবসেবামূলক মহান মহান কাজে।
.
১.
রাত একটা। ফার্মগেটে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিল রিবিট। হঠাৎই কী মনে করে ওভারব্রিজের উপর উঠতে শুরু করল। এই ওভারব্রিজটা রিবিটের খুব প্রিয়। মাঝে মাঝেই সে গভীর রাতে এই ব্রিজের উপর এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে উত্তর দক্ষিণে অনেকদূর পর্যন্ত রাস্তা দেখতে পায় সে। গভীর রাতেও এই রাস্তাতে অনেক গাড়ি চলাচল করে। রাতে অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইটের আলোগুলো দেখতে দারুণ লাগে তার। তাই পত্রিকা-অফিসে কাজ শেষে মাঝে মাঝেই এখানে এসে দাঁড়ায়। তারপর তাকিয়ে থাকে দূরে, অনেকদূরে- যেখান থেকে ছুটে আসছে গাড়িগুলো।
প্রফেসর হকই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছে রিবিটকে। রিবিটের অনেক ভালো ভালো চাকরি করার সুযোগ থাকলেও শেষপর্যন্ত পত্রিকা-অফিসের চাকরিটাই নেয় সে। কারণ প্রফেসর হক এমনটিই আশা করেছিল। চাকরিটা শুরু করার পর রিবিট অবশ্য বুঝতে পেরেছে প্রফেসর হকের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। কারণ সপ্তাহে তাকে মাত্র একদিন কাজ করতে হয়, আর তাও আবার সন্ধ্যার পরে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। এজন্য পুরো সপ্তাহটাই সে মানবকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। পত্রিকা অফিসে তার কাজ মূলত টাইপ করা। পত্রিকাটি সাপ্তাহিক যে ক্রোড়পত্র বের করে সেটাই তাকে টাইপ করতে হয়। তার জন্য কাজটা মোটেও পরিশ্রমের নয়। তবে বিনিময়ে সে যে-অর্থ পায় তাতে তার ভালোই চলে যায়, কিছু অর্থ হাতেও থেকে যায়। হাতে থেকে যাওয়া এই অর্থ দিয়ে সে সপ্তাহে একদিন রাস্তার কয়েকজন দরিদ্র শিশু কিশোরকে খেতে নিয়ে যায়। ওদের খাওয়া দেখতে রিবিটের খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে সে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তার চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। এদেশের হত দরিদ্র শিশুরা যে কতটা কষ্টে জীবন অতিবাহিত করে তা সে রাতে অন্ধকারে ঢাকার রাস্তায় না হাঁটলে হয়তো কোনোদিনও বুঝতে পারত না।
রিবিট, কী ভাবছ?
অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রাম ইপির ডাকে রিবিট বাস্তবে ফিরে এল। সে এতক্ষণ যেন ভিন্ন। এক জগতে ছিল। বলল : হ্যাঁ ইপি বলো।
তুমি কি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ?
কী ব্যাপার?
ঐ যে দ্যাখো, ইটভর্তি একটা ঠেলাগাড়ি আসছে। বৃদ্ধ এক লোক ঠেলাগাড়িটি ঠেলে নিয়ে আসছে।
হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। বৃদ্ধলোকটির সাথে দুটো ছেলেও আছে।
হ্যাঁ, একজন যুবক, আর অন্যজন কিশোর।
খুবই অমানবিক ব্যাপার। প্রযুক্তির এ-যুগে মানুষকে এখনো এভাবে কাজ করতে হয়।
এদেশের জন্য অবশ্য এ-দৃশ্য নতুন কিছু নয়।
আমরা কি এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারি না ইপি?
রিবিট তুমি পারো এবং করছ। তবে তোমার পক্ষে বৃহৎ কিছু করা কঠিন। কারণ বৃহৎ কিছু করার জন্য তোমাকে সৃষ্টি করা হয়নি। তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে স্বল্প পরিসরে মানুষের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে।
এটা কি আমার বিশাল সীমাবদ্ধতা নয়?
আমার বিশ্লেষণ সেরকম বলছে না। কারণ প্রাফেসর হক তোমাকে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সৃষ্টি করেছেন। আমার বিশ্বাস তার চিন্তা-চেতনায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। তোমাকে যদি বৃহত্তর মঙ্গল সাধনের জন্য সৃষ্টি করা হত তাহলে তোমাকে নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে যেত। সেক্ষেত্রে তুমি হয়তো তোমার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারতে না, সত্যিকারের মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতে না। আর…
ইপি কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই বুম শব্দের পর ধপ ধপ করে শব্দ হতে থাকল। সাথে সাথে ইপি বলল : কী হল? কী হল?
রিবিট বলল; ঠেলাগাড়ির চাকা বিস্ফোরিত হয়েছে। আর ঠেলাগাড়ির উপরের ইটগুলো নিচে গড়িয়ে পড়ছে।
রিবিট কথা শেষ করেই ওভারব্রিজের উপর থেকে দ্রুত নিচে নেমে এল। ব্রিজের ঠিক নিচে এসে থেমেছে ঠেলাগাড়িটা। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধলোকটি। সে ইটগুলোকে নিচে পড়ে যেতে দেখে হায়, হায়..করে চিৎকার করছিল। রিবিটকে দেখামাত্র সে তার চিৎকার বন্ধ করে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। আর অন্য দুজন চেষ্টা করছিল ঠেলাটাকে সোজা করতে, যেন ইটগুলো নিচে পড়ে না যায়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। ইটগুলো আগের মতোই ধপ ধপ করে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। তারা দুজনও রিবিটকে দেখে বৃদ্ধের মতোই ‘থ’ বনে গেল।
রিবিট অবশ্য প্রথমে কারো সাথেই কোনো কথা বলল না। ইপিকে শুধু বলল : ইপি, তুমি কি প্রস্তুত?
তুমি কী করতে যাচ্ছ রিবিট?
পাওয়ার অ্যাকটিভেট করো। লেভেল মিডিয়াম।
তোমার পাওয়ার অ্যাকটিভেট করা হয়েছে।
টায়ার বিস্ফোরিত হওয়ায় ঠেলাগাড়ির যে-পাশটি নিচু হয়েছিল রিবিট সরাসির সেই পাশে এসে ঠেলাগাড়িটিকে উঁচু করে ভারসাম্য রক্ষা করল। এতে ইট পড়া বন্ধ হলো ঠিকই, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হল না, কারণ ইট যা পড়ার তা আগেই নিচে পড়েছে।
কেউ কিছু করছে না দেখে রিবিট হালকা ধমকের স্বরে বলল : তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? তাড়াতাড়ি ঠেলাটির নিচে ইট দাও। আমি তো অনেকক্ষণ এভাবে ধরে রাখতে পারব না।
এবার যেন বাস্তবে ফিলে এল যুবক ছেলেটি। সে তাড়াতাড়ি কয়েকটি ইট এনে ঠেলাটির নিচে ঠেকনার মতো করে দিল। আর তাতে ঠেলাটিকে ছেড়ে দিতে পারল রিবিট। ঠেলাটি এখন প্রয়োজনীয় ভারসাম্য রক্ষা করে স্থিরভাবে একজায়গায় থাকতে পারছে।
এতক্ষণ চুপ থাকলেও আবারো বিলাপ করতে শুরু করল বৃদ্ধ : এখন আমার কী হবে গো? এই ঠেলা ঠিক কইরা কেমনে ইটগুলা উপরে উঠাব? হেরপর আবার ইট আনবার যাব? রাইতে কাম শেষ করবার পারব না গো, আমাগো না-খাইয়া থাহা লাগৰ গো…
রিবিট বুঝতে পারল এরা সবাই খুব বিপদে পড়েছে। তাই সে বৃদ্ধের দিকে। এগিয়ে এসে বলল : আপনি ভাববেন না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি আপনাদের সাহায্য করব।
বৃদ্ধ বিলাপ থামিয়ে রিবিটের দিকে তাকাল। তারপর আচমকাই বলল : আপনে কিডা?
আমি রিবিট। দশম মাত্রার একটি রোবট।
বৃদ্ধের অভিব্যক্তি দেখে মনে হল সে কিছুই বুঝতে পারেনি।
এবার কিশোর ছেলেটি বলল : বাপজান, এত কতা কইও না। কামে লাগো। আর একটা চাক্কা যেইডা আছে লাগান শুরু করো। নইলে কাম শেষ করবার পারবা না।
যুবকটি অবশ্য ইতিমধ্যে কাজে লেগে গেছে। ঠেলাগাড়ির নিচে একটি অতিরিক্ত টায়ার বিশেষভাবে বাঁধা ছিল। গাড়ি চালানোর সময় এভাবে যে টায়ার বিস্ফোরিত হতে পারে তা তারা আগে থেকেই অনুমান করে রেখেছিল। তাই এভাবে একটি অতিরিক্ত টায়ার রেখে দিয়েছে। রিটি অনুমান করল, সম্ভবত প্রত্যেক ঠেলাগাড়িতেই এরকম অতিরিক্ত টায়ার থাকে।
ঠেলাগাড়িতে চাকা লাগাতে রিবিটও সাহায্য করল। এরই ফাঁকে ফাঁকে রিবিট কথা বলেছে সবার সাথে। এরা তিনজনই একই পরিবারের সদস্য। একজন বাবা আর অন্যদুজন ছেলে। থাকে কমলাপুর বস্তিতে। ঠেলাগাড়ি চালিয়েই তাদের জীবন চলে। এত রাতে ঠেলাগাড়ি চালানোর কারণ জানতে চাইলে তারা জানায় দিনের বেলায় ঠেলা চালানো খুব কষ্ট। এমনিতেই রোদ থাকে, তার ওপর ট্রাফিক জ্যাম। অতিরিক্ত কষ্ট করতে হয়। তাছাড়া দিনের বেলায় অনেক পথ ঘুরে আসতে হয়। কারণ ভিআইপি রাস্তায় ঠেলা চালানো যায় না। এজন্য কষ্ট আরো বাড়ে।
টায়ার লাগানো শেষ হলে সবাই ঠেলাগড়িতে ইট তুলতে শুরু করল। রিবিট একাই এত ইট তুলছে যে অন্য তিনজন মিলে তা পারছে না। রিবিটের এ আচরণে সবাই খুব খুশি। অবশ্য রিবিট একটা বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে। আর তা হল তিনজনেরই কথাবলার চেয়ে কাজের প্রতিই মনোযোগ বেশি। কারণটা ঠিকই বুঝতে পারল সে। এরা সবাই ব্যস্ত কাজ শেষ করতে। কাজ শেষ না হলে প্রয়োজনীয় অর্থ আয় করতে পারবে না। আর আয় করতে না পারলে আগামীকাল হয়তো খাওয়াও হবে না।
এরই মধ্যে পুলিশের একটি ডবল কেবিন পিক-আপ এসে হাজির। পিক-আপটি থামার সাথে সাথে সামনের দরজা দিয়ে একজন পুলিশ নেমে এসে অনেকটা ধমকের স্বরে বৃদ্ধকে বলল : এ্যাই, আপনারা এখানে ঠেলাগাড়ি থামিয়েছেন কেন?
বৃদ্ধ উত্তর দেয়ার আগে রিবিটই বলল : ওনাদের ঠেলাগাড়ির টায়ারটি বিস্ফোরিত হয়েছিল।
রিবিটকে দেখে কিছুটা দমে গেল পুলিশ। এরই মধ্যে পিছনের দরজা দিয়ে সাদা পোশাক পরা অল্পবয়সী অন্য একজন পুলিশ-সদস্য নেমে এল। দেখে মনে হল
অফিসারই হবে। সে সরাসরি রিবিটের সামনে এসে বলল; রিবিট, তুমি এখানে?
হ্যাঁ, আমি ওনাদেরকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি। এতগুলো ইট তুলতে সবার অনেক সময় লেগে যাবে।
চমঙ্কার। মৃদু হেসে বলল অফিসার। তারপর বলল : আমি শাহেদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ডিবি। সবাই আমাকে এসি শাহেদ বলেই চিনে। রাতে অপারেশনে বেরিয়েছিলাম, তোমাকে দেখে থামলাম।
ধন্যবাদ।
আমি আগে সবসময় তোমাকে টেলিভিশনে কিংবা পত্রিকায় দেখেছি। বাস্তবে দেখিনি। আজই প্রথম দেখলাম! তোমার সাথে পরিচিত হয়ে আমি খুব আনন্দিত রিবিট।
আমিও তোমার মতো তরুণ অফিসারের সাথে পরিচিত হয়ে সত্যি আনন্দিত। তোমার মতো তরুণ আর উদ্যমী অফিসারদের আমি খুব পছন্দ করি।
ধন্যবাদ রিবিট। আমরা কি তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারি?
তার বোধহয় প্রয়োজন হবে না। আমরা প্রায় কাজ শেষ করে এনেছি।
রিবিট, আমার অফিসে তোমার আমন্ত্রণ রইল। তুমি এলে আমি খুব খুশি হব।
প্রয়োজন হলে অবশ্যই আসব।
তাহলে আজ বিদায়। যদি কখনো মনে হয় আমার সাহায্য তোমার প্রয়োজন, আমাকে জানিও। তোমার সাথে কাজ করতে পারলে আমি সত্যি খুব খুশি হব।
আমি অবশ্যই তোমাকে জানাব।
আমার মোবাইল নম্বরটা রেখে দিতে পারো। তোমার নম্বর অবশ্য আমার কাছে আছে।
আমার নম্বর তুমি পেলে কোথায়?
পত্রিকা থেকে। পত্রিকার লোকজন তোমার নম্বর ছেপে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস ঢাকা শহরের প্রায় সবার কাছেই তোমার নম্বর আছে।
এই বলে শাহেদ তার নম্বর বলল। তারপর রিবিটের সাথে হ্যান্ডশেক করে চলে গেল।
শাহেদ যে মিথ্যা বলেনি তা রিবিট জানে। ঢাকা শহরে সবার কাছে না-থাকলেও অধিকাংশ শিশু-কিশোরদের কাছে যে তার নম্বর আছে এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। প্রতিনিয়তই তার কাছে একটার-পর-একটা ফোন আসতে থাকে। এই ফোনগুলোর উত্তর দিতেই ইপির সময় কেটে যায়। প্রথম প্রথম এত ফোন আসত যে ইপি সেগুলো রিসিভ করার সময় পর্যন্ত পেত না। ইদানীং ফোন আসা কিছুটা কমেছে। তারপরও দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় ইপিকে ফোনের উত্তর দিতে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে কীভাবে যে নম্বরটা এভাবে ছড়িয়ে পড়ল তা সত্যিই জানা নেই রিবিটের। মিডিয়ার ভূমিকা তো আছেই। কিন্তু তারা যে কীভাবে নম্বরটা পেল আর কেনই বা এভাবে নম্বরটা সবাইকে দিয়ে দিল তার কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি রিবিট। তবে এটা সত্য, ফোন পেয়ে সে বিরক্ত হয় না। এতে বরং আরো ভালোই হয়েছে। সবাই তাকে সহজে খুঁজে পায়।
কথার ফাঁকে ফাঁকে এতক্ষণ কাজ করেছে রিবিট। রিবিটের সাহায্যের কারণেই এত অল্পসময়ে ইটগুলো ভোলা সম্ভব হয়েছে ঠেলাগাড়িতে। ইট ভোলা শেষ হলে বৃদ্ধসহ সবাই কৃতজ্ঞতার চোখে তাকাল রিবিটের দিকে। রিবিটও হাত নেড়ে কৃতজ্ঞতার জবাব দিল। তারা আর অপেক্ষা করল না। ঠেলাগাড়ি নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকল সামনের দিকে। আজ রাতে তাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে, তা না হলে আগামীকাল হয়তো ঠিকমতো খাবার জুটবে না।
.
২.
সকাল নয়টা। রিবিট উদ্দেশ্যহীনভাবে নিউমার্কেটের চারপাশ দিয়ে হাঁটছে আর কথা বলছে ইপির সাথে। নিউমার্কেটের পিছনে রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তূপ দেখে খানিকটা হতাশ হয়েই সে বলল : ঢাকার সবাই রাস্তাঘাট এভাবে নোংরা করে রাখে কেন?
এখানকার মানুষেরা সচেতন নয় এজন্য। তুমি লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে ডাস্টবিনের মধ্যে যতটা না ময়লা আছে, তার থেকে বাইরে আছে বেশি। উত্তরে বলল ইপি।
হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। সবার মধ্যে শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রবণতা কম। সকলকে এ বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে ভালো হত।
তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু অবাক ব্যাপার হল শিক্ষিত মানুষেরাও অশিক্ষিত মানুষের মতো কাজ করে। তার অন্যতম উদাহরণ হল সিটি কর্পোরেশন। তুমি লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে ডাস্টবিন বা ময়লার কন্টেইনারগুলো সব রাস্তার মাঝে। ফলে রাস্তায় যেমন এদিক-ওদিক ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে তেমনি যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ এই কন্টেইনারগুলো রাস্তার কোণায় বা সুবিধাজনক স্থানে হওয়া উচিত ছিল।
এক্ষেত্রে আমাদের কী করার আছে?
এক্ষেত্রে আমাদের অনেককিছুই করার আছে। তবে সবকিছু আমাদের হাতে নেই। যাইহোক, আমার বিশ্লেষণ বলছে এ-মুহূর্তে তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে একটা ই-মেইল পড়া। তিশা নামের একটি মেয়ে তোমাকে একটি মেইল পাঠিয়েছে।
তুমি আমাকে মেইলটি পড়ে শোনাও।
ইপি মেইলটি পড়তে শুরু করল।
প্রিয় রিবিট,
আমার নাম তিশা। আমি তোমার একজন খুব ভালো বন্ধু। আমি ‘ধানমণ্ডি লিটল মুন’ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। বিশেষ কারণে তোমার সাহায্য আমাদের খুব প্রয়োজন। গতকাল আমার আব্দুর কাছে ‘কালোমানুষ’ নামের কেউ একজন ফোন করে দশ লক্ষ টাকা চেয়েছে। ‘কালোমানুষ’ বলেছে সে খুব ভয়ংকর, টাকা না দিলে সে আমাকে মেরে ফেলবে। আর পুলিশকে জানালে বেশি ক্ষতি হবে। আমার আবু-আম্মু খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এত টাকা দেয়ার মতো আর্থিক ক্ষমতা তাদের নেই। রিবিট, প্লিজ আমাদের সাহায্য করো। আমি জানি একমাত্র তুমিই আমাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে। উল্লেখ্য, কালোমানুষ আরো বলেছে যে ঘটনাটি পুলিশকে জানালে মহাবিপদ ঘটবে। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।
তোমার প্রিয় বন্ধু
তিশা
ইপি মেইলটি পড়া শেষ করলে রিবিট বলল, ইপি, আমার এখন কী করা উচিত?
তোমার অবশ্যই উচিত তিশাকে সহায্য করা।
কিন্তু তিশার ঠিকানা তো নেই।
তা নেই, তবে স্কুলের নাম তো আছে।
হ্যাঁ আছে। কিন্তু আমি আমার প্রোগ্রামের অভ্যন্তরে ঢাকার যে ম্যাপ আছে সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি। কোথাও ধানমণ্ডি লিটল মুন স্কুল খুঁজে পেলাম না।
হতে পারে স্কুলটি নতুন। এ কারণে ম্যাপে স্কুলটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
তাহলে আমরা এখন কী করতে পারি?
আমার বিশ্লেষণ বলছে স্কুলটিকে খুঁজে পেতে আমাদের খুব একটা সমস্যা হবে না। ধানমণ্ডি এলাকায় যে-কোনো স্কুলে যেয়ে আমরা যদি লিটল মুন স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করি নিশ্চয় আমরা স্কুলের অবস্থান জানতে পারব। তারপর স্কুল খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না।
ধানমণ্ডি এসে লিটল মুন স্কুল খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হল না রিবিটের। ইপির পরামর্শ অনুসারে একটি স্কুলের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল লিটল মুন স্কুলের ঠিকানা। লিটল মুন স্কুলটি মাত্র তিনবছর পূর্বে স্থাপিত হয়েছে। এ-কারণে স্কুলের নাম ঢাকার মূল ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সহজে স্কুল খুঁজে পেলেও বিপত্তি বাধল তিশাকে খুঁজে পেতে। তিশা আজ স্কুলে আসেনি। শেষে রিবিট প্রধানশিক্ষিকার সাথে দেখা করতে তার কক্ষে প্রবেশ করল। রিবিট প্রধানশিক্ষিকার কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি বললেন : তুমিই তাহলে সেই রোবট যে কিনা দিন-রাত ছন্নছাড়ার মতো পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াও?
রিবিট খানিকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, জি..জি ম্যাডাম। আমার নাম রিবিট।
আমি তো তোমার নাম জিজ্ঞেস করিনি। তোমার নাম রিবিট না ফিবিট তা তো আমার জানার দরকার নেই।
রিবিট সত্যি আহত হল। সে আগে কারো কাছ থেকে এ-ধরনের ব্যবহার পায়নি। আর একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষিকার কাছ থেকে এ-ধরনের আচরণ সে কল্পনায়ও আশা করেনি।
প্রধানশিক্ষিকা আবার প্রশ্ন করলেন : তুমি কেন আমার কাছে এসেছ?
রিবিট সরাসরি কথা বলারই সিদ্ধান্ত নিল। সে বলল : আমি তিশা নামের একটি মেয়ের ঠিকানা জানতে এসেছি।
তিশা! জ কুঁচকে বললেন প্রধানশিক্ষিকা।
হ্যাঁ তিশা। আপনার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী।
তুমি তো জানোই তিশা পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। তাহলে ওর কাছে যাচ্ছ না কেন? আমার কাছে এসেছ কেন?
তিশা তো স্কুলে আসেনি।
তিশা স্কুলে আসেনি?
না আসেনি।
কেন আসেনি? চিৎকার করে উঠে বললেন প্রধানশিক্ষিকা। তার চিৎকারের ধরন শুনে মনে হল তিশার স্কুলে না-আসার জন্য যেন রিবিটই দায়ী।
রিবিট অবশ্য কিছু বলল না। সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। রিটিকে এভাবে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রধানশিক্ষিকা এবার আগের মতোই রুক্ষ গলায় বললেন : তিশার ঠিকানা তোমার কেন প্রয়োজন?
তিশা সমস্যায় আছে। আমি তিশাকে সাহায্য করতে চাই।
তিশার বাবা-মা আছে। তিশার সমস্যা থাকলে তারাই তিশাকে সাহায্য করবে। তুমি কেন তিশাকে সাহায্য করতে যাবে?
আমি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আপনাকে বোঝাতে পারব না ম্যাডাম। আমার তিশার ঠিকানাটা প্রয়োজন। আপনি যদি..
না না। আমি তোমাকে তিশার ঠিকানা দেব না। তুমি একটি রোবট। তোমার মতিগতি ভালো না। আমি শুনেছি তুমি বাঁদরের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াও। তোমার কোনো কাজকর্ম নেই। এরকম এক ভবঘুরে রোবট তিশাকে সাহায্য করবে তা আমার বিশ্বাস হয় না।
রিবিট সত্যি খুব আহত হল। আগে কখনো কেউ তাকে উদ্দেশ্য করে এরকম আপত্তিকর মন্তব্য করেনি। সে ঠিক করল প্রধানশিক্ষিকার সাথে আর কোনো কথা বলবে না। তাই সে বাইরে বেরিয়ে এল।
কিছুটা পথ আসতেই পিছন থেকে কেউ একজন ‘রিবিটা’ ‘রিবিট’ বলে ডেকে উঠল।
রিবিট ফিরে তাকাতে দেখে ছোটখাটো সুন্দর দেখতে একজন ভদ্রমহিলা তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভদ্রমহিলা কাছে এসে খুব মিষ্টি স্বরে বলল : রিবিট, আমি মিস পিয়াল। তিশার শিক্ষক।
আমি আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে সত্যি খুব আনন্দিত। মোলায়েম গলায় বলল রিবিট।
আমি জানতে পেরেছি আপনি তিশাকে খুঁজছিলেন।
হ্যাঁ। আমি এজন্য আপনাদের প্রধানশিক্ষিকার সাথে এ-ব্যাপারে কথা বলেছি। কিন্তু..
রিবিটকে শেষ করতে না দিয়ে মিস পিয়াল বলল : হা হা আমি শুনেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমাদের প্রধানশিক্ষিকা খানিকটা ভিন্ন মেজাজের। কিন্তু তার মনটা সুন্দর। এই স্কুলে তার অবদান অবিস্মরণীয়। যাইহোক, যা বলছিলাম- আমি আপনাকে তিশার ঠিকানা দিচ্ছি।
আপনি আমাকে ঠিকানা দেবেন! অবাক হয়ে বলল রিবিট।
হ্যাঁ আমি দেব। আমি জানি আপনি কখনোই তিশার কোনো ক্ষতি করবেন না। তিশা বিপদে আছে জেনে আমি নিজেই উৎকণ্ঠিত। আশা করছি আপনি তিশাকে সাহায্য করতে পারবেন।
এই বলে মিস পিয়াল একটু সময় নিল। তারপর বলল : আমি আসলে কলম আনতে ভুলে গেছি। আমি যে আপনাকে ঠিকানাটা লিখে দেব সেই উপায় নেই। আপনি একটু দাঁড়ান, আমি কলম নিয়ে আসছি।
না না, আপনাকে কলম আনতে হবে না। আপনি বলুন, তাতেই হবে।
আ..আপনি যদি ভুলে যান।
না ভুলব না। আমি আমার মেমোরিতে সেইভ করে রাখব।
ওহ তাই বলুন। আপনার তো বিশেষ ক্ষমতা আছে। আপনি যা একবার শোনেন তা বছরের-পর-বছর মনে রাখতে পারেন। সত্যিই রিবিট, আমি আপনার ক্ষমতায় বিস্মিত।
আমার ক্ষমতায় বিস্মিত হবেন না। সত্যি যদি বিস্মিত হতে হয়, মানুষের ক্ষমতায় বিস্মিত হবেন। মানুষই আমাকে সৃষ্টি করেছে। কাজেই আমার মধ্যে যা-কিছু আছে তা মানুষের অসাধারণ বুদ্ধির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কথাগুলো খুবই বিনয়ের সাথে বলল রিবিট।
মিস্ পিয়াল এবার চোখ বড় বড় করে বলল : আপনি সত্যিই অসাধারণ। আপনি শুধু বিশেষ ক্ষমতার অধিকারীই নন, আপনি অত্যন্ত মার্জিত এবং বিনয়ীও বটে।
আপনাকে ধন্যবাদ। এবার তিশার ঠিকানাটা দেবেন কি?
ও.. হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই বলে মিস পিয়াল রিবিটকে তিশার ঠিকানা বলল।
রিবিট ঠিকানাটা শোনার পর নিজে থেকেই একবার হুবহু বলল। তারপর বলল, ঠিক আছে?
মিস্ পিয়াল মৃদু হেসে বলল : রিবিট ভুল করতে পারে আমার বিশ্বাস হয় না।
আপনি ঠিকই বলেছেন। মেশিন সহজে ভুল করে না।
আমার বিবেচনায় আপনি কখনোই মেশিন নন। আপনি একজন পরিপূর্ণ মানুষ।
যদিও আমি মানুষ নই কিংবা মানুষের সমকক্ষ নই, তথাপি আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ মিস্ পিয়াল।
আমি আশা করছি আপনি তিশার উপকার করতে পারবেন। তিশাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন।
আমি চেষ্টা করব। আজ তাহলে আসি।
রিবিট এবং মিস্ পিয়ালের মধ্যে আর কোনো কথা হল না। রিবিট হেঁটে সরাসরি গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আর মিস্ পিয়াল একদৃষ্টিতে রিবিটের পথের দিকে তাকিয়ে থেকে ফিরে গেল নিজের ক্লাসে।
.
৩.
রিবিট যখন তিশাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তখন সকাল দশটা বাজে। বাড়ি খুঁজে পেতে তাকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। তিশাদের বাড়ি ধানমণ্ডিতেই, স্কুল থেকেও কাছে। দূরত্ব এক কিলোমিটার মতো হবে। রিবিট এই পথটুকু হেঁটেই এসেছে।
তিশাদের বাড়িটা ছোট্ট দোতলা। বাড়ির সামনে খানিকটা জায়গা থাকলেও মূল বাড়িটা বেশ ছোট, পুরাতনও বটে। বাইরের দেয়ালে অনেকদিন রঙের ছোঁয়া পড়েনি। বোঝা যাচ্ছে অনেক আগে তৈরি করা হয়েছে বাড়িটা। আর এ-বাড়িতে যে থাকে তার অবস্থা যে খুব ভালো নয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
বাইরের গেটটি লোহার। গেটের সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল রিবিট। অভ্যন্তরীণ প্রোগ্রামে বিশ্লেষণ করল ভিতরে প্রবেশ করে কীভাবে কথা বলবে বাসার সবার সাথে। তবে বেশিক্ষণ সে বিশ্লেষণ করতে পারল না। তার আগেই দেখতে পেল ভিতরের দরজা থেকে বাইরের গেটের দিকে দশ-এগারো বছরের সুন্দর একটি মেয়ে ছুটে আসছে। গেটের সামনে এসে মেয়েটি দ্রুতহাতে গেট খুলে খুপ করে রিবিটের হাত ধরে বলল : রিবিট তুমি আসবে আমি জানতাম।
রিবিট তার বিশ্লেষণী ক্ষমতায় বুঝতে পারল এই মেয়েটিই তিশা। তাই সে বলল। তুমি নিশ্চয় তিশা?
একদম ঠিক। আমি জানি রিবিট তুমি ভুল করতে পারো না।
তাই বুঝি!
হ্যাঁ। আমি এও জানি যে তুমি ছাড়া আর কেউ আমাদের সাহায্য করতে পারবে না। এজন্য আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। আমি জানতাম তুমি আসবে।
রিবিট অবাক হওয়ার ভান করে বলল : আমার উপর দেখছি তোমার অগাধ আস্থা।
শুধু আমারই, সবারই তোমার উপর অগাধ আস্থা। আমার সকল বন্ধুরা তোমাকে দারুণ ভালোবাসে। তোমার কথায় আমরা সবাই পাগল। তুমি আমাদের বাসায় এসেছ, আমি যে কী খুশি হয়েছি তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমি নিশ্চিত তুমি আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
তোমাদের সমস্যাটি কী তিশা?
আগে বাসার মধ্যে এসো, তারপর বলছি।
তোমাদের বাসায় আর কে কে আছে?
বাবা মা, দাদু সবাই। এসো, এসো।
রিবিটের হাত ধরে তিশা রিটিকে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে থাকল। রিবিটকে পেয়ে তিশার যেন উৎসাহের শেষ নেই। তার প্রতিটি আচরণে সেই বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট।
বাসার ভিতরে প্রবেশ করতে বয়স্কমতো একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তিনি রিবিটকে দেখে প্রথমে থমকে গেলেও পরে নিয়ন্ত্রণ করলেন নিজেকে। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বললেন : আ..আ..পনি রিবিট না?
হ্যাঁ আমি রিবিট। খুব স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল রিবিট।
আ..আ..আমি কল্পনা করতে পারছি না আপনি এখানে। বিস্ময়ের ভঙ্গিতে বললেন ভদ্রলোক।
আমিই তো আসতে বলেছি দাদু। আমি নিশ্চিত রিবিট আমাদের সাহায্য করতে পারবে।
বয়স্ক ভদ্রলোক এবার রিৰিটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন : আমি তিশার দাদু। আমার নাম সোবহান আহমেদ।
রিবিট সোবহান সাহেবের সাথে হ্যান্ডশেক করতে ঘরের মধ্যে আরো দুজন এসে প্রবেশ করল। রিবিট দুজনকে দেখে বুঝতে পারল, এনারাই তিশার বাবা-মা। তবে দুজনকেই খুব অল্পবয়সী মনে হল তার কাছে।
তিশার বাবা-মা তিশার দাদুর মতো অবাক হলেও পরিচয়ের পর দুজনই স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল। কিন্তু তারা পারল না। রিবিটের কাছে তাদের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপটা স্পষ্ট ধরা পড়ল। রিবিট বুঝতে পারল এ-বাসায় এমন কিছু ঘটেছে যা স্বাভাবিক নয়।
পরিচয়-পর্ব শেষে রিবিট তিশার বাবা সুমন আহমেদকে বলল : আমি যতদূর জেনেছি আপনারা সম্ভবত কোনো ঝামেলার মধ্যে আছেন। বিষয়টা যদি আমাকে একটু খুলে বলতেন।
কিসের ঝামেলা! অবাক হওয়ার ভান করে বলল সোবহান সাহেব। সোবহান সাহেব অবশ্য ছেলে সুমনকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না।
কেউ বোধহয় আপনাদের কাছে অর্থ দাবি করেছে। অর্থ দাবি?
না না। এমন কিছু ঘটেনি। জোর দিয়ে বললেন সোবহান সাহেব।
এবার তিশা বলল : টেলিফোনে কালোমানুষ….
কী বলছ তিশা! মৃদু ধমকে উঠে বলল তিশার মা মুনা।
রিবিট মুনার দিকে তাকাতে সে আবার বলল : ও ছোট মানুষ, আপনাকে কী সব বলেছে। তারপর তিশার দিকে ফিরে বলল : তুমি যা দুষ্ট হয়েছ না তিশা! রিবিট সাহেবকে এভাবে মিথ্যাকথা বলে বাসায় না-আনলেই পারতে। আমন্ত্রণ করলে রিবিট সাহেব এমনিতেই আমাদের বাসায় আসতেন।
আমি মিথ্যা বলিনি। সত্য বলেছি। জোর দিয়ে বলল তিশা।
আবারো মিথ্যাকথা! রিবিট সাহেব আপনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। আজকাল মেয়েটা যা দুষ্ট হয়েছে না! শুধু মিথ্যাকথা বলে। যাও ভিতরে যাও, আর একমুহূর্তও এদিকে থাকবে না।
তিশা অসহায় দৃষ্টিতে রিবিটের দিকে তাকাল। মুনা আবারো ধমকে উঠে বলল : যাও, ভিতরে যাও বলছি।
তিশা এবারো নড়ল না।
মুনা এবার নিজেই উঠে এসে তিশাকে অনেকটা জোর করে ভিতরে নিয়ে গেল। ব্যাপারটা ভালো লাগল না রিবিটের। সম্পূর্ণ ব্যাপারটার মধ্যে বিশেষ এক রহস্যের গন্ধ পেল সে।
তিশাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল সবাই। অবশেষে রিবিটই প্রথমে কথা বলল : তিশা আজ স্কুলে যায়নি কেন?
ইয়ে..মানে.. ওর শরীরটা ভালো নেই। আমতা-আমতা করে বললেন সোবহান সাহেব।
কিন্তু তিশাকে দেখে তো মনে হল সম্পূর্ণ সুস্থ।
আসলে গতরাতে হালকা জ্বর এসেছিল।
কিন্তু আপনি অফিসে যাননি কেন? আপনি তো কিছুক্ষণ আগে বলেছেন আপনি একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরি করেন। এবার তিশার বাবার দিকে ফিরে বলল রিবিট।
মেয়ে অসুস্থ, এজন্য যায়নি। নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল সুমন।
ও আচ্ছা। রিবিট মুখে বলল ঠিকই কিন্তু সে নিশ্চিত সুমন সত্যকথা বলছে না। কিন্তু কেন বলছে না সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
এবার প্রশ্ন করলেন সোবহান সাহেব : আপনি আমাদের বাসায় হঠাৎ কী মনে করে?
তিশা আমাকে একটি ই-মেইল পাঠিয়েছিল। ই-মেইলে লেখা ছিল আপনাদের কাছে ‘কালোমানুষ’ নামে কেউ একজন দশলক্ষ টাকা চাদা দাবি করেছে। চাদা না দিলে কালোমানুষ আপনাদের ক্ষতি করবে। এমনকি তিশাকে পর্যন্ত মেরে ফেলতে পারে। আর এ ব্যাপারে পুলিশকে জানাতে নিষেধ করেছে তারা।
না না, কী যে বলেন! আর এত টাকা আমাদের কাছে কেউ চাইবেই বা কেন? আমাদের কি এত টাকা আছে? কোনোমতে আমি এই বাড়িটা করেছিলাম। এখানেই থাকি। সুমন চাকরি করে যা পায় তাতেই আমাদের সংসার চলে। আমাদের সাথে কারো শত্রুতাও নেই। আমাদের কাছে কেউ টাকা চাইতে যাবে কেন? তাও আবার দশ লক্ষ টাকা। কী যে বলেন আপনি! হো.. হো.. হো..। হেসে প্রায় সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলেন সোবহান সাহেব।
রিবিট অবশ্য বুঝতে পারল সোবহান সাহেবের হাসিটা কৃত্রিম।
হঠাই টেলিফোন বেজে ওঠায় একই সাথে চমকে উঠল সোবহান সাহেব এবং তার ছেলে সুমন। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না রিবিটের। সোবহান সাহেব এবং তার ছেলের যে চোখাচোখি হল সেটাও বুঝতে পারল সে। টেলিফোন আসলে কখনোই স্বাভাবিক মানুষের এ-ধরনের আচরণ করার কথা নয়।
অবশেষে সোবহান সাহেবই উঠে গেলেন। ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন একনাগাড়ে কিছু কথা বলে গেল। তারপর সোবহান সাহেব যখন আবার ‘হ্যালো’ বললেন, ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দিল কেউ। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পারল রিবিট। আর এই পুরো সময়টা সুমন তার বাবার দিকেই তাকিয়ে ছিল। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। কাউকে বসিয়ে রেখে নিশ্চয় কেউ টেলিফোনে কথা বলতে থাকা অন্য কারো দিকে তাকিয়ে থাকবে না।
রিবিট লক্ষ্য করল টেলিফোনে কথা বলার পর সোবহান সাহেবের মুখটা একেবারে মলিন হয়ে গেছে। তিনি সোফায় এসে বসতে রিবিট জিজ্ঞেস করল : কী ব্যাপার, কিছু হয়েছে?
না না, কিছু হয়নি। সবকিছু ঠিকই আছে। অন্যমনস্কভাবে বললেন সোবহান সাহেব।
কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কিছু নিয়ে চিন্তিত।
চিন্তিত তো হতেই হয়। জিনিসপত্রের যে দাম, আর যে দিনকাল পড়েছে তাতে চিন্তিত না হয়ে উপায় আছে।
রিবিট বুঝতে পারল সোবহান সাহেব ইচ্ছে করেই তাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন না। তাই সেও আর জোরাজুরি করল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল : আমি তাহলে আসি।
ঠিক আছে। এবার কথা বলল সুমন।
যদি কখনো মনে করেন আমাকে আপনাদের প্রয়োজন তাহলে আমাকে ফোন করবেন। আমি আপনাদের টেবিলে আমার ফোন নম্বরটা রেখে যাচ্ছি।
আচ্ছা। নির্লিপ্ত উত্তর সুমনের।
রিবিট আর কোনো কথা বলল না। সে সরাসরি বাইরে বেরিয়ে এল। সে বুঝতে পারছে যে-কোনো কারণেই হোক তার উপস্থিতিকে তিশা ছাড়া বাড়ির অন্য কেউ ভালোভাবে মেনে নিচ্ছে না। তবে সে নিশ্চিত, বাড়ির সবাই কোনো-না-কোনো বিপদে আছে। সে ঠিক করল, যেভাবেই হোক সাহায্য করবে এই পরিবারকে।
.
৪.
রিবিট তিশাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তার মূল প্রোগ্রামে এখন ইলেকট্রনের গতি অনেক বেশি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এখন সে বিশ্লেষণ করছে। তিশাদের বাড়ির সকলের রহস্যময় আচরণের মূল রহস্য কী এ-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে ডেকে উঠল; ইপি।
সাথে সাথে সাড়া দিল ইপি। বলল : রিবিট, আমি বুঝতে পারছি তুমি কী চিন্তা করছ?
তুমি কি সত্যি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ রিবিট। আমার বিশ্লেষণ এই সিদ্ধান্ত প্রদান করছে যে তুমি তিশাদের বাড়ির সকলের আচরণের মূল রহস্য উন্মোচন করতে চেষ্টা করছ।
চমৎকার ইপি। তোমার বিশ্লেষণ একশত ভাগ সত্য। ইপি, আমার সত্যি তোমাকে হিংসা করতে ইচ্ছে করে।
আমি দুঃখিত রিবিট। তোমার কাউকে হিংসা করার ক্ষমতা নিতান্তই কম। যাইহোক, আমি কি জানতে পারি কেন আমার প্রতি হিংসা হচ্ছে তোমার?
কারণ তুমি আমার সবকিছু জেনে যাচ্ছ।
কিন্তু আমি তোমার নিয়ন্ত্রণাধীন। তুমি যেভাবে খুশি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো।
তা পারি। কিন্তু আমি তো তোমাকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করছি না। তুমি স্বাধীন।
আমি স্বাধীন নই রিবিট। আমি নির্দিষ্ট কিছু প্রোগ্রামের নির্দেশনার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারি মাত্র। সত্যিকারের অর্থে স্বাধীন হচ্ছ তুমি। তুমি মানুষের মতোই চিন্তাভাবনা করতে পারো। সীমাহীন তোমার চিন্তার ক্ষমতা।
হতে পারে। যাইহোক, যা বলছিলাম। তুমি যেমন আমার বিশ্লেষণ বুঝতে পারো তেমনি আমি চাইছিলাম মানুষের চিন্তাচেতনা বুঝতে। আমি যদি মানুষের ভাবনা বুঝতে পারতাম তাহলে তিশাদের বাড়ির কার মনে কী আছে তা আজ সত্যি জানতে পারতাম।
তুমি অলীক এবং অবাস্তব কল্পনা করছ যা তোমার মূল প্রোগ্রামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
হয়তো তাই। কিন্তু তুমি জানো আমার চিন্তার ব্যাপ্তি সীমাহীন। এই কারণেই এই চিন্তা করতে পারছি।
এ-মুহূর্তে তুমি তোমার অলীক কল্পনা থেকে বিরত থাকতে পারো। তোমার এখন উচিত তিশাদের বাড়ির মূল সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা এবং তিশাদের সাহায্য করা।
কীভাবে সাহায্য করব? তিশাদের বাড়ির কেউই তো আমার সাহায্য কামনা করছে।
আমার বিশ্লেষণ বলছে সবাই ভয় পাচ্ছে। যেহেতু কালোমানুষ হুমকি প্রদান করেছে এজন্য কেউ ভয়ে তোমার সাহায্য আশা করছে না।
কিন্তু আমি তো খুব সতর্কতার সাথে এগিয়েছি।
তা এগিয়েছ, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একমাত্র তিশা ছাড়া কেউ তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
আমি তাহলে কী করতে পারি?
যেভাবেই হোক তিশার কাছ থেকে তোমার শুনতে হবে।
কীভাবে ওর কাছে পৌঁছাব? ও ছোট মানুষ, ওর বাবা মা কিছুতেই আমার কাছে ওকে আসতে দেবে না।
তোমার কথায় যুক্তি আছে।
আমরা কি পুলিশকে জানাতে পারি না? পুলিশ নিশ্চয় ওদেরকে সাহায্য করবে। বলল রিবিট।
তা করবে। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ ব্যাপার সম্পর্কে নিশ্চিত নই।
কিন্তু তিশা কি আমাকে মিথ্যা বলবে? সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করল রিবিট।
আমার বিশ্লেষণ বলছে করবে না। কিন্তু আবার করতেও তো পারে। অনেক ছেলেমেয়েরা তো তোমার সাথে দুষ্টুমি করে।
তা করে। কিন্তু তিশাকে আমার সেরকম মনে হয়নি। তিশা কোনো দুষ্টুমিই করেনি। বরং তিশাকে আমাদের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়া, তিশার স্কুলে না-যাওয়া, তিশার বাবার অফিসে না-যাওয়া– সবই আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।
হ্যাঁ, এগুলো অস্বাভাবিকই বটে। আর এই অস্বাভাবিকতা প্রমাণের জন্য তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। গোয়েন্দাগিরিতে অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন হয়।
আমি তো গোয়েন্দা নই।
তা নও। তবে এ মুহূর্তে তুমি যে কাজটি করছ বা করতে যাচ্ছে তা গোয়েন্দাগিরির থেকে কোনো অংশে কমকিছু নয়। তুমি তাত্ত্বিক দিকে চলে যাচ্ছ ইপি।
আমি দুঃখিত রিবিট। যাইহোক যে কথা বলছিলাম, তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে।
কীভাবে এবং কীজন্য?
আমার বিশ্লেষণ বলছে তিশার দাদা কিংবা বাবা কেউই যেহেতু তোমাকে কিছু বলেনি সেহেতু পুলিশকেও তারা কিছু বলবে না। অর্থাৎ তারা কালো মানুষের সাথে সমঝোতায় আসবে।
এই কালোমানুষ আসলে কারা?
আমি ইন্টারনেটে কালোমানুষ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাইনি। হতে পারে এরা হয়তো নতুন-গড়ে-ওঠা কোনো সন্ত্রাসী দল যাদের মূলকাজই হচ্ছে মানুষকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে চাঁদা আদায় করা। নিরীহ মানুষ ভয়ে পুলিশ কিংবা অন্য কাউকে কিছু না। বলে এই কালোমানুষকে বা মানুষদেরকে চাঁদা দিয়ে দেয় এবং এভাবেই কালো মানুষেরা বেঁচে থাকে।
কিন্তু তাতে লাভ কী? কালো মানুষেরা তো ঐ একই লোকের কাছে আবারো চাদা চাইবে।
তাই তো হচ্ছে। মানুষ আজ সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে। সত্যি যদি এদেশকে সন্ত্রাসী আর চাঁদাবাজ মুক্ত করা যেত তাহলে দেশটির অনেক উপকার হত। অনেক লোক শান্তিতে বসবাস করতে পারত, অনেক..
ইপি কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই রিবিট বলল : তুমি তো দেখি এখন দর্শনের কথার দিকে ধাবিত হচ্ছ।
ঠিক আছে রিবিট। যা বলছিলাম, যদি সত্যি তিশার বাসার সবাই কালো মানুষের সাথে সমঝোতায় আসে তাহলে কী ঘটতে পারে একবার বিশ্লেষণ করে দ্যাখো। তিশার দাদা কিংবা বাবাকে মোটা অঙ্কের টাকা কালোমানুষকে দিতে হবে এবং তা খুব অল্পসময়ের মধ্যেই। নিশ্চয় তিশাদের বাসায় এত টাকা থাকবে না। সেক্ষেত্রে কী ঘটবে? তিশার দাদা কিংবা বাবা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনবে। আর এই সুযোগের অপেক্ষায়ই থাকতে হবে তোমাকে। যদি সত্যি দেখা যায় তারা টাকা তুলছে তাহলে তুমি বুঝতে পারবে তিশা তোমাকে সত্য বলেছে।
তাহলে আমার এখানে অপেক্ষা করাই সমীচীন হবে।
কিন্তু তোমার নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে।
কেন?
তোমাকে অনেকেই চিনে। তুমি যেখানেই অপেক্ষা করবে সেখানেই মানুষের একটা জটলা হয়ে যাবে। আমার বিশ্লেষণ বলছে আশেপাশে কোথাও কালো মানুষের দলের কেউ থাকবে। সে যদি তোমাকে দেখে ফেলে তাহলে অবশ্যই সে সন্দেহ করবে। তুমি যে তিশাদের বাড়ি থেকে বের হয়েছ এ ব্যাপারটাও দেখে ফেলেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। যাইহোক, এখন থেকে তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ ইপি। আমি এক কাজ করতে পারি। সামনের ঐ নির্মাণাধীন পরিত্যাক্ত তিনতলা বাড়ির দোতলায় অপেক্ষা করতে পারি।
তা পারো। তবে তোমাকে খুব দ্রুত অবস্থান নিতে হবে। আশেপাশে অনেকেই তোমাকে লক্ষ্য করতে শুরু করেছে।
রিবিট দ্রুত সামনের নির্মাণাধীন পরিত্যক্ত বাড়িটির দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তার দু একজন তাকে লক্ষ্য করলেও কেন যেন অনুসরণ করল না। বাড়িটির তিনতলায় একটা জানালার পাশে যেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রিবিট বলল : ইপি, এমন যদি হয় যে তিশার দাদা কিংবা বাবা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনো ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে?
সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমাদের তাদেরকে অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই। তারা নিশ্চয় ফিরে আসবে।
যদি এমন হয় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কালোমানুষকে দিতে যায়?
ইপি একটু সময় নিল। সেক্ষেত্রে তোমাকে ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। আর..
ইপির কথা শেষ হওয়ার আগেই রিবিটের অভ্যন্তরীণ মোবাইলে একটা ম্যাসেজ এল। মেসেজটি ওপেন করতে রিবিট দেখল তিশা পাঠিয়েছে। তাতে লেখা : রিবিট, আমি তোমাকে যে ই-মেইল পাঠিয়েছিলাম তার সবই সত্য। তুমি আমাদের সাহায্য করো।
মেইলটি পড়ে রিটি একেবারে থমকে গেল। সে বুঝতে পারল যেভাবেই হোক সাহায্য করতে হবে তিশাদের।
Leave a Reply