1 of 2

১.০৬ আটষট্টির সন্ধিক্ষণে

আটষট্টির সন্ধিক্ষণে

গত দু তিন বছরের আর্থিক সংকট সত্ত্বেও আজ স্বীকার করা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পর এদেশ এগিয়ে গেছে। গত পনেরো বিশ বছরে খাদ্যোৎপাদন দেড় গুণ বৃদ্ধি। পেয়েছে; এদেশের মানুষের আয়ু বেড়েছে দেড় গুণ; কলেজে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হয়েছে। চার গুণ। এই উন্নতি দেশের সর্বত্র সমান প্রসারিত হয়নি এবং দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ সমভাবে এর ফল ভোগ করতে পারেনি। যা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী অসমাপ্ত আছে। তবু একথাটা আজ স্মরণ করা ভালো যে, দেশ এগিয়ে চলেছে। আয়ু বেড়েছে সারা জাতির, শুধু ওপরের এক-শতাংশ পরিবারের নয়; বর্ধিত ছাত্রসংখ্যার একটি ক্রমবর্ধমান অংশ আসছে সেই সব অঞ্চল থেকে, যেখানে শিক্ষা পূর্বে প্রবেশ করেনি; এবং নতুন একটা অধিকারবোধ ছড়িয়ে পড়েছে স্বাধীন ভারতের সাধারণ মানুষের ভিতর। দেশ বিভাগের রক্তক্ষয়, সীমান্তে দুটি যুদ্ধ, এবং মহান নেতাদের মহাপ্রয়াণ সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে চলেছে। গত বিশ বছরের সামাজিক আলোড়নের ভিতর থেকে, পরিচিত জীবনচর্যার দ্রুত অবক্ষয়ের ফলে, আমাদের মনে যে ক্লেশ ও তিক্ততা নিঃসন্দেহে জমে উঠেছে তার উর্ধ্বে উঠে দেশের দিকে একবার তাকালেই সন্দেহ থাকে না যে, আমরা আজ উপস্থিত মহৎ সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে।

অথচ দেশে এমন একটা বিলাপের সুর প্রায়ই শোনা যায় যেন গত বিশ বছর আমাদের শুধু ক্ষয়-ক্ষতিতেই কেটেছে, যেন সকল দিক থেকে আমরা শুধুই তলিয়ে যাচ্ছি, যেন স্বাধীনতা পেয়ে আমাদের কোনো লাভই হয়নি। গত পনেরো বছরে চীনে খাদ্যোৎপাদন। শতকরা যত ভাগ বেড়েছে, ভারতে তার চেয়ে কিছু কম বাড়েনি। একথা বলবার মতো তথ্য আছে। অথচ যাঁরা এবিষয়ে কিছুই জানেন না, তাঁরাও প্রায়ই অত্যন্ত প্রবলবেগে বলতে শুরু করেন যে, চীনে কৃষির আশ্চর্য উন্নতি হয়েছে এবং ভারতে কিছুই হয়নি। তথ্য সম্বন্ধে অজ্ঞতা দ্বারা এই মিথ্যা স্তুতি ও মিথ্যা বিলাপ কিছুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী অতএব আমরা নিজ দেশের সমালোচনায় মুখর। স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার অবশ্য মূল্যবান। সমালোচনার সাহায্যে আমরা যখন আমাদের দোষত্রুটি সম্বন্ধে আরও সজাগ হই, এগিয়ে যাবার পথ আরও পরিষ্কারভাবে চিনে নিতে পারি, তখন সমালোচনার মূল্য অশেষ। কিন্তু মতামতের স্বাধীনতা যখন আত্মধিক্কার ও বিলাপে পর্যবসিত হয়, আমাদের আত্মবিশ্বাসের মূলে আমরা যখন নিজেরাই ক্রমাগত কুঠারাঘাত করতে থাকি, নৈরাশ্যকেই যখন আমরা অতি বড় জ্ঞান বলে প্রচার করি তখন পরিণামে স্বাধীনতারই অপমৃত্যু আসন্ন হয়ে আসে।

আমাদের মনের একটি কোণে আমরা যেন বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, গণতন্ত্রে আমাদের প্রয়োজন নেই, সংবিধানপ্রদত্ত বিভিন্ন অধিকারে আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা যেন মনে মনে এই প্রার্থনা শুরু করে দিয়েছি যে, এবার কোনো ডিক্টেটর বা ত্রাণকতা এসে আমাদের রক্ষা করুন।

অথচ কোনো একনায়কতন্ত্রই এ দেশকে বাঁচাতে পারবে না। দ্য গল, নাসের অথবা আয়ুব খাঁর মতো নেতাদের সাফল্যের সম্ভাবনা সেই দেশেই বেশী যেখানে ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি স্বাভাবিক ঐক্যবোধ নেতা-বিশেষকে সহজে গ্রহণীয় করে তোলে। পশ্চিম পাকিস্তান যদি একটি রাষ্ট্র স্বতন্ত্র হতো, তা হলে আয়ুব খাঁর একনায়কতন্ত্র যতটা সুদৃঢ় হতে পারত, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভেদের ফলে ততটা হতে পারছে না। ভারত আয়তনে এবং ভাষা ও ধর্মগত বৈচিত্র্যে পাকিস্তানের চেয়ে আরও বৃহৎ ও বিভক্ত বলেই এদেশে কোনো স্থায়ী ও সুদৃঢ় একনায়কতন্ত্রের সম্ভাবনাও সেই পরিমাণে কম।

এদেশের বিশেষ অবস্থায় নিরঙ্কুশ একদলীয়তন্ত্রের সাফল্যও আশা করা যায় না। ভারতের কোথাও জনসংঘ প্রবল, কোথায় দ্রাবিড় দল, কোথাও কংগ্রেস, আবার কোথাও কম্যুনিস্ট দল। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিহীন, সুদৃঢ় শাসন স্থাপন করাবার মতো শক্তিশালী কোনো দল এদেশে নেই। মাদ্রাজে জনসংঘ শক্তিশালী হবে অথবা মধ্যপ্রদেশে কম্যুনিস্ট দল প্রাধান্য লাভ করবে এমন সম্ভাবনা কষ্টকল্পনা।

গণতন্ত্র এদেশে বাঁচবে কি না আমরা জানি না। শুধু জানি যে, গণতন্ত্র ছাড়া আমাদের গতি নেই। এই জানাটা যখন আমাদের অধিকাংশের মনে গভীর ও সত্য হয়ে উঠবে, তখন গণতন্ত্রকে বাঁচাবার পথও আমরা অনায়াসে চিনে নিতে পারব।

যে-মানুষ কিছু সাধন করতে চায়, সে জানে যে, নিয়ম ছাড়া কিছুই সাধন করা যায় না। আমরাও যেদিন মনেপ্রাণে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে চাই, আমাদের নেতা ও অধিনেতারা, আচার্য ও উপাচার্যের যেদিন কতিপয় লোকের হাততালি কুড়োতে কুড়োতে দেশকে রসাতলে নামাতে ব্যস্ত হবেন না, সেদিন একথা সকলের কাছেই স্পষ্ট হবে যে, নিয়মের রাজত্ব ছাড়া গণতন্ত্র রক্ষা পায় না। যেহেতু এ দেশে কোনো সর্বাধিনায়ক অথবা দলেরই নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচারিতা অধিকাংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না অতএব এখানে। নেতাবিশেষের উর্ধ্বে স্থান আবশ্যক নিয়মতন্ত্রের অনিয়মের রাজত্বকে ডেকে আনলে দেশের হবে তাতে সর্বনাশ। অরাজকতার পথ আমাদের মুক্তির পথ হতে পারে না।

এই দৃষ্টি নিয়ে তাকালে বহু অবান্তর বচসার সহজে মীমাংসা হয়। ছাত্র ও রাজনীতি নিয়ে একটা কূট তর্ক আজকাল প্রায়ই কানে আসে। একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার চেয়ে প্রধান আর কিছু হতে পারে না। বিদ্যায়তনের ভিতর ছাত্রদের কোনো “রাজনীতিক অধিকার”ই বিদ্যার্থী হিসাবে তাদের কর্তব্যের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে পারে না। অতএব মূল প্রশ্ন এই যে, রাজনীতি যেভাবে আমাদের ছাত্রদের একাংশের ভিতর আবর্তিত হয়ে উঠেছে, তাতে কি শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে? শতাব্দীর সাধনায় গড়া কলকাতার একটি শ্রেষ্ঠ মহাবিদ্যালয়কে আমরা কি ইদানীং “ছাত্র রাজনীতি’র আঘাতে জীর্ণ হতে দেখিনি? শিক্ষার শুচিতাতেই শিক্ষায়তনের শুচিতা। এই শুচিতা যদি শিক্ষকের অবহেলা অথবা ভীরুতায় ক্ষুণ্ণ হয় তা শিক্ষক নিন্দার যোগ্য; যদি কতিপয় ছাত্রের গুণ্ডামিতে বা অসদাচরণে শিক্ষা লণ্ডভণ্ড হয় তো ছাত্র নিন্দনীয় যদি সরকার অথবা পুলিশের স্বৈরাচারে একই ফলপ্রাপ্তি ঘটে তো সরকার সমভাবে অপরাধী। শুধু অন্যের প্রতি উচ্চকণ্ঠে দোষারোপে শিক্ষা রক্ষা পাবে না; নিজের দায়িত্বের কথাটাই প্রথমে চিন্তা করা ভালো।

শিক্ষার ক্ষেত্রে যে কথা সত্য বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাই। কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক নিয়ে ইদানীং বহু আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজনও আছে। কেন্দ্রের কাছ থেকে আর্থিক আনুকূল্য লাভের জন্য বিভিন্ন রাজ্যের ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নিজের ব্যর্থতার সমস্ত দায়িত্ব কেন্দ্রের উপর চাপিয়ে দিয়ে কোনো রাজ্যেরই সমস্যার সমাধান হবে না। যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্যের সামনে দেশকে গড়বার কাজটাই প্রধান, সেখানে বহু মতের সংঘাতও কাম্য। কিন্তু যে আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য কেন্দ্র ও রাজ্যের ভিতর সম্পর্ক বিষিয়ে তোলা, তাতে দেশের ঐক্যের বিনাশ ছাড়া সদর্থক আর কিছুই আশা করা যায় না।

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যা মুখ্য তাকে আমাদের মুখ্য বলে মানা চাই, যা গৌণ তাকে গৌণ বলে চেনা চাই। যদি প্রয়োজন হয় তো গণতন্ত্রে যাঁরা বিশ্বাসী গণতন্ত্রকে রক্ষা করবার জন্য তাঁদের যুক্তভাবে দাঁড়াতে হবে, যেমন দাঁড়ায় একটা জাতি সংকটের মুহূর্তে। সেই জন্য চাই গঠনমূলক কর্মসূচী। দেশ গঠনের জন্য এই মুহূর্তে আমাদেরসবচেয়ে বড় প্রয়োজন কৃষি ও শিক্ষার উন্নতি এবং দেশের ঐক্য রক্ষা। গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতর আগামী দশ বছরে এইটুকু যদি আমরা সাধন করতে পারি তো অন্যান্য সকল বাধা-বিপত্তিও অতিক্রম করা সম্ভব হবে সন্দেহ নেই। এজন্য চাই দেশের ভাষা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান, অন্তত সমস্যাটাকে নিরর্থক আরও জটিল করে না-তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা; বগাদারী ব্যবস্থার বিলোপ, গ্রামে গ্রামে শিক্ষার বিস্তার, পঞ্চায়েতী স্বায়ত্তশাসনের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন, কৃষির উন্নতির জন্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় ভূমি সংস্কার; শিক্ষাকে বৃত্তি ও বিজ্ঞানের বিবিধ ধারায় চালনা, বিদ্যা ও ব্যবহারের ভিতর পারস্পরিক যোগ স্থাপন, পরীক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন। কৃষি ও গ্রামীণ সমাজের উন্নতির জন্য শিল্পকে প্রসারিত করা আবশ্যক মহানগরী থেকে দূরে পশ্চিমবঙ্গের উপেক্ষিত জেলায় জেলায়। আগামী দশ বছরের জন্য এই কার্যক্রম দুঃসাধ্য নয় প্রয়োজন শুধু দেশ গড়বার মন ও দৃষ্টি।

এই সহজ কথাগুলি যে আমাদের কাছে সহজ নয়, ধ্বংসের চিন্তাটা যে আমাদের কাছে এতো অনায়াসে আকর্ষণীয়, তার কারণ ভবিষ্যতের পথ সম্বন্ধে আমাদের চিন্তা স্পষ্ট নয় এবং ভবিষ্যতে আমাদের বিশ্বাস নেই। এই অবিশ্বাসই আজ আমাদের প্রধান শত্রু। আমরা আত্মশক্তিতে বিশ্বাস করি না তাই দেশকে অন্ধ উত্তেজনায় বিনাশের দিকে ঠেলে দিই, আর কোনো অলৌকিক প্রক্রিয়ায় সেই বিনাশ থেকে শেষ রক্ষা হবে এই অসম্ভব দুরাশাটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরি। অথচ এই নৈরাশ্য ভিত্তিহীন। আমরা জয়ী হতে পারি যদি জয়ী হতে চাই; আমাদের পরাজিত হবার কারণ নেই যদি না পরাজয়কে আমরা গোড়াতেই অনিবার্য বলে মেনে নিই। গত বিশ বছরে আমরা যতটা এগিয়েছি, আগামী দশ বছরে তার চেয়ে বেশী এগুনো সম্ভব–যদি এই বিশ্বাসে কাজ করি।

প্রগতির পথ (১৯৬৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *