1 of 2

১.০১ গণতন্ত্রের আধ্যাত্মিক ভিত্তি

অধ্যায় ১ – রাজনীতি

গণতন্ত্রের আধ্যাত্মিক ভিত্তি

যে-শাশ্বত ধর্মে পিতামহদের আস্থা ছিল সেই নিচ্ছিদ্র বিশ্বাস এ-যুগে দুর্লভ। এই বিশ্বাসভঙ্গের সামাজিক পটভূমিকার প্রতি সংক্ষেপে দৃষ্টি আকর্ষণ করা বর্তমান প্রবন্ধের মূল বক্তব্যের পক্ষে প্রয়োজন।

মধ্যযুগীয় ধর্ম শুধু কয়েকটি আধ্যাত্মিক তত্ত্বে সীমায়িত ছিল না; সামাজিক আচার বিচার, অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের ভিতর দিয়ে তার অস্তিত্ব ঘোষিত হয়েছে। বিভিন্ন সমাজ ও গোষ্ঠীর রীতিনীতিতে পার্থক্য যদিও প্রাচীনকাল থেকেই সুস্পষ্ট এবং ব্যবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে ও পর্যটকদের বিরণে এই পার্থক্যের প্রতি যদিও তৎকালীন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে, তবু কোনো বিশেষ সমাজের রীতিনীতিতে যতদিন পরিবর্তন প্রকট হয়ে ওঠেনি ততদিন সেই সমাজের মানুষের পক্ষে নিজস্ব আচার বিচারের শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাস স্থাপন করা কঠিন হয়নি। বরং বিশেষ ব্যক্তি বা বংশের আয়ুস্বল্পতার তুলনায় প্রাচীন বিধিনিষেধের স্মরণাতীত যুগে উৎপত্তি ও অব্যাহত প্রতিষ্ঠায় সেদিন এমনই একটা অবিনশ্বরতার অঙ্গীকার ছিল যে, শাস্ত্রীয় সত্যের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ আকাশের গায়ে থুতু দেবার মতই হাস্যকর প্রয়াস মনে হয়েছে।

একই সমাজের বিভিন্ন স্তরে রীতিনীতির পার্থক্য প্রাচীন যুগেও চোখে পড়ে। কিন্তু বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভিতর সম্পর্ক সামাজিক অনুষ্ঠানপ্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে নির্ণীত ছিল; আর একই মানুষের পক্ষে এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উত্তরণ সহজ ছিল না।

অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তিবিশেষের স্থান অথবা অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ সামান্যই ছিল। আধুনিক যুগে সামাজিক পরিবেশে যে দ্রুত পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের ভিতর যে দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান বিশেষত মধ্যযুগে গড়ে উঠেছিল আজ সে ব্যবধান ভেঙ্গে যাচ্ছে। একই লোকের পক্ষে সমাজের এক স্তরে জীবন শুরু করে বিভিন্ন স্তরে অতিক্রান্ত হওয়া আধুনিক সমাজে সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় একই লোক জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন আচারে অভ্যস্ত ও বিভিন্ন বিচারে বিশ্বাসী হবার প্রয়োজনের সম্মুখীন। সামাজিক ভাঙ্গাগড়ার যুগে আচার বিচারের সনাতনত্বের চেয়ে তার আপেক্ষিকতাই যদি ব্যক্তির চেতনায় তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে তবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

আধুনিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একটা বৈশিষ্ট্য এ-দিক থেকে লক্ষণীয়। পণ্ডিত মহলে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত নানা তর্ক-বিতর্ক সত্ত্বেও একথা বলা চলে যে, মধ্যযুগীয় বুদ্ধিজীবীশ্রেণী ঐতিহ্যের বাহক ছিলেন। শাস্ত্রের শ্রদ্ধান্বিত ব্যাখ্যা, প্রচলিত সমাজনীতির স্বপক্ষে যুক্তিতর্কের অবতারণা, এবং পাণ্ডিত্যের সহায়তায় সাধারণ মানুষের মনে এই নীতিগুলি সম্বন্ধে একটা ভীতিমিশ্রিত ভক্তির ভাব সৃষ্টি করা মধ্যযুগীয় বুদ্ধিজীবীর প্রধান কর্তব্য ছিল। মধ্যযুগীয় বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সকলেই সমাজের একই স্তরের বাসিন্দা ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ এদেশের ব্রাহ্মণ্য শ্রেণীর উল্লেখ করা যেতে পারে। এ-যুগের। বুদ্ধিজীবীরা সমাজের নানা স্তর থেকে এসেছেন। এদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সামাজিক পরিবেশ ও ঐতিহ্যগত পটভূমিকা এক নয়। এ বিষয়ে আধুনিক সমাজ-তাত্ত্বিকদের এবং বিশেষত সুপণ্ডিত মানহাইমের চিন্তাধারা অনুধাবনযোগ্য। বিভিন্ন মতবাদ ও দৃষ্টিকোণের দ্বন্দ্ব আধুনিক বুদ্ধিজীবী মহলের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগে জ্ঞানার্জনের রাজপথ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে, শ্রদ্ধা; আর আধুনিক যুগে, সন্দেহ।

এ-যুগের সন্দেহপ্রবণতা শুধু আচার বিচারের বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ নয়। সত্য, ন্যায় ইত্যাদি মৌল আদর্শ সম্বন্ধেও এ-যুগের মনে অবিশ্বাস প্রবল। অর্থাৎ, নৈর্ব্যক্তিক সত্য। এবং নিরপেক্ষ ন্যায়ের সম্ভাবনা সম্বন্ধেও অনেকে সন্দিহান। নিশ্চিত জ্ঞানের সম্ভাবনাকে সন্দেহ করেই আধুনিক দর্শনের একটি প্রধান ধারা শুরু হয়েছে। আরও লক্ষণীয় আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বিশেষ ঝোঁক। এ-যুগের মনস্তাত্ত্বিক বোঝাতে চেয়েছেন যে, ব্যক্তির বিশ্বাস ও ব্যবহার অনিবার্যভাবে তার অবদমিত বাসনা দ্বারা নানা জটিলপথে নিয়ন্ত্রিত। ব্যক্তির চিন্তায় অবচেতন কামনার প্রভাব এমনই ওতপ্রোত যে তাতে কোনো নিরপেক্ষ সত্যের প্রতিফলন আশা করা বাতুলতা। নিরপেক্ষ ন্যায় সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। ফাশিবাদী বিশ্বাস করেন যে, মানুষের ইতিহাসে প্রধান ঘটনা জাতির সঙ্গে জাতির সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যখন প্রত্যক্ষ নয়, আপাতদৃষ্টিতে যখন আন্তজাতিক শান্তি রক্ষিত, তখনও ভিতরে ভিতরে যুদ্ধেরই আয়োজন চলে। আর যুদ্ধই যদি ইতিহাসের মূল উপাদান হয় তো ন্যায়ের কোনো নিরপেক্ষ আদর্শের কথা বলা হাস্যকর। জাতীয় শক্তিবৃদ্ধির জন্য কোনো উপায়ই অন্যায় নয়। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতেও মানুষের ইতিহাস সংগ্রামেরই ইতিহাস, শ্রেণীসংগ্রামের। প্রতিটি শ্রেণী সেই নীতির দ্বারাই চালিত হয়ে থাকে যাতে তার স্বার্থ রক্ষিত হয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ন্যায়ের কোনো শাশ্বত আদর্শের কথা বলা ভাবালুতা। সত্য সম্বন্ধে মার্ক্সীয় দর্শনে একটা দ্বিধা লক্ষ করা যায়। কার্যক্ষেত্রে যে-মতটির প্রভাব বেশি তা এই যে, প্রতিটি শ্রেণী সত্য হিসাবে তাই গ্রহণ করে থাকে যাতে তার স্বার্থ সিদ্ধ হয়; এবং এই দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে কোনো নিঃশ্রেণীয় সত্যের কল্পনা, বিশেষত সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, ছলনা মাত্র।

.

এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সত্যের যে-রূপ ব্যক্তিবিশেষের কাছে প্রত্যক্ষ তা। সেই ব্যক্তির মানসিক গড়ন ও সামাজিক পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে থাকে। আর। যদিও একই শ্রেণীভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির মানসিক ও আধ্যাত্মিক সমস্যা বিভিন্ন তবু একথা স্বীকার্য যে, ব্যক্তির বৈষয়িক স্বার্থ বহু পরিমাণে শ্ৰেণীস্বার্থের অন্তর্ভুক্ত এবং ব্যক্তির দৃষ্টিকোণে শ্ৰেণীয় দৃষ্টিকোণের প্রভাব প্রায়শ লক্ষণীয়।

কিন্তু “শ্রেণীসত্য” বলে কোনো সত্য নেই। এ-বিষয়ে সিডনি হুকের মন্তব্য স্মরণীয়। শ্রেণীসত্য বলে কোনো বস্তু নেই; শ্রেণীগত স্বার্থে সত্যের বিকৃতি বা অপলাপ আছে মাত্র। যেমন সত্যের শ্রেণীগত বিকৃতি আছে, ন্যায়েরও তেমনই। কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের এই শ্রেণীগত বিকৃতি স্বীকার করতে হলেও শ্রেণীস্বার্থের ঊর্ধ্বে সত্য ও ন্যায়ের একটি আদর্শগত প্রতিষ্ঠা স্বীকার করা প্রয়োজন। ফাশিবাদ অথবা উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ, যেমন শ্ৰেণীস্বার্থে তেমনই জাতীয় স্বার্থেও সত্য ও ন্যায়ের অপলাপ সম্ভব, কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের আদর্শগত প্রতিষ্ঠা জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে। হিটলারের অস্ট্রিয়া দখলে জাতীয় ন্যায়ের কোনো নূতন আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়নি ন্যায়ের আদর্শ জাতীয় স্বার্থ দ্বারা অপমানিত হয়েছে মাত্র। স্বেচ্ছাচারীর স্বেচ্ছাচারিতায় ন্যায়ের অপলাপ ঘটে মাত্র, ব্যক্তিগত ন্যায়ের কোনো নূতন উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত হয় না। মানুষ হিসাবে প্রতি মানুষের আত্মোন্নতির সমানাধিকারের যে-নীতি যুগ-যুগ ধরে দুর্বলের দুর্বলতা ও ক্ষমতাবানের ক্ষমতা দ্বারা খণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও সর্বযুগের আদর্শবাদীদের চিন্তায় বার বার ফিরে এসেছে, সেই সর্বমানবিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যের পরিমাপেই কোনো বিশেষ স্থান-কাল নিবদ্ধ বা রাজশক্তি নির্ধারিত বিধির নৈতিক মূল্যায়ন সম্ভব।

ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সংস্কার অথবা স্বার্থ নিরপেক্ষভাবে সত্য ও ন্যায়ের একটা শাশ্বত প্রতিষ্ঠা আছে, এ-বিশ্বাস যে-সমাজে চূর্ণ হয়ে যায় সে-সমাজ ক্রমশ চূড়ান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা অথবা রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের দিকে এগিয়ে যায়। যদি ব্যক্তিনিরপেক্ষ কোনো সত্য না থাকে। প্রতিটি ব্যক্তিই তবে অভিজ্ঞতার এমন একটি দ্বীপ যার সঙ্গে অন্য কোনো দ্বীপের কোনো সেতুবন্ধন নেই। এমনই একটা ধারণার বশে আধুনিক শিল্পসাহিত্যের কোনো কোনো মহলে একটা অহংকেন্দ্রিক দুর্বোধ্যতার দিকে দুর্নির্বার ঝোঁক লক্ষণীয়। শিল্পের ক্ষেত্রে এই ঝোঁক যে-যে সমাজে বেশীদূর ব্যাপ্ত হয়েছে সাধারণত সেই সেই সমাজে আবার এক। ধরনের “বোহেমীয়” বিশৃঙ্খলার দিকেও ঝোঁক দেখা গেছে।

সমস্যা অবশ্য এখানেও শেষ হয় না। মানুষের সঙ্গে মানুষের মনের সম্পর্ক স্থাপন শুধু ব্যবহারিক স্বার্থের খাতিরে নয়, মনের স্বাস্থ্য ও সমগ্রতার জন্যই একান্ত প্রয়োজন। সমাজে পারস্পরিক সাহিত্যের ভিত্তি যখন চূর্ণ হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন আদিম বন্য সংহতির ভিতর আশ্রয়হীন মানুষের মনকে আহ্বান করা সহজ হয়। এমনই একটা হিংস্র সংহতির অভিব্যক্তি হিসাবেই জার্মানীতে নাৎসীবাদের আবির্ভাব। আধুনিক একনায়কতন্ত্র শুধু শাসনব্যবস্থার একটা বিশেষ রূপ নয়। সত্য ও ন্যায়ের স্বরূপ সম্বন্ধে একটি বিশেষ ধারণার উপর আধুনিক সার্বিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।

গান্ধীজী আইন অমান্য আন্দোলন করেছিলেন, কারণ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে ন্যায়ের প্রতি আনুগত্যকেই তিনি উচ্চতর কর্তব্য বলে বিশ্বাস করতেন। রাষ্ট্রের বিশেষ বিধিকে অতিক্রম করেও সত্য, ন্যায় ইত্যাদির একটা স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠা আছে বলেই অবস্থা বিশেষে রাষ্ট্রকে অমান্য করবার নৈতিক অধিকারও আমাদের আছে। আধুনিক সার্বিক রাষ্ট্রে সত্য ও ন্যায়ের এই আদ্য প্রতিষ্ঠা অস্বীকৃত। অবশ্য আইন অমান্য করবার অধিকার আত্মরক্ষার খাতিরে কি সার্বিক, কি গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রই স্বীকার করে নিতে পারে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিবেকভিত্তিক আপত্তি বা অসহযোগ (“conscientious objection”) গ্রাহ্য করবার এবং রাজনৈতিক বন্দীদের সাধারণ অপরাধীদের তুলনায় একটা বিশেষ মর্যাদা দেবার দিকে যে ঝোঁক আছে, আধুনিক সার্বিক রাষ্ট্রে তার বিপরীত ঝোঁকই প্রকট। রাজনৈতিক বন্দীরাই সার্বিক রাষ্ট্রে ধিকৃততম অপরাধী। এবং বিরোধীদের সকল নৈতিক মর্যাদা কেড়ে নিয়ে তাঁদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করবার সযত্ন চক্রান্ত আধুনিক সার্বিক আন্দোলনের নীতিবিশেষ। বলা বাহুল্য যে, বহু তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও আজ সার্বিক আন্দোলনের এই ঘৃণ্য নীতির প্রভাবে আক্রান্ত।

এ-প্রসঙ্গে আরও লক্ষ করা যায় যে, সার্বিক রাষ্ট্রের অধিনেতারা নিজেদের স্বার্থ। অনুযায়ী “সত্য” উদ্ভাবন করতে দ্বিধা করেন না। নাৎসী জার্মানীর অন্যতম অধিনেতা হিমলারের একটি উক্তি এখানে উদ্ধৃত করা অসঙ্গত হবে না। হিমলার বলেছিলেন

“We don’t care a hool whether this or something else was the real truth….science proceeds from hypotheses that change every year or two. So there is no earthly reason why the party should not lay down a particular hypothesis as the starting point, even if it runs counter to current scientific opinion. The one and the only thing that matters is to have ideas of history….that strengthen the people in their necessary national pride.”

হিমলার এখানে সত্যের বাস্তবতা সম্বন্ধে আধুনিক অবিশ্বাসকেই সত্যের ইচ্ছাকৃত বিকৃতির স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করছেন। বৈজ্ঞানিকেরাও যখন সত্যজ্ঞানে পৌঁছতে পারেন না, তাঁদের পূর্বকল্পিত ধারণার যখন কিছুদিন পর পরই পরিবর্তন ঘটে, তখন বিজ্ঞানবিরোধী একটা তত্ত্বকে, অর্থাৎ মিথ্যা বলে প্রমাণিত একটা তত্ত্বকেও, জাতীয় স্বার্থে সত্য বলে স্বীকার করে নিতে ক্ষতি কি! কম্যুনিস্ট শাসিত সোভিয়েত দেশেও একই। দুর্লক্ষণ বার বার দেখা গেছে। ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে ইতিবৃত্তকে মিথ্যা ভাষণে পরিণত করতে কম্যুনিস্ট নেতারা ইতস্তত করেননি। উপরে উদ্ধৃত শেষ বাক্যটিতে national শব্দের স্থানে ‘ckass’ শব্দটি বসালে বহু কম্যুনিস্ট নেতারই ঐ বাক্যটিতে কার্যত গভীর আপত্তি থাকবে না।

পোলানীর একটি স্মরণীয় উক্তি দিয়ে এই অধ্যায়টি শেষ করা যেতে পারে।

“the totalitarian form of the State arises logically from the denial of reality of this realm of transcendent ideas. When the spiritual foundations of all freely dedicated human activities –of the cultivation of science and scholarship, of the vindication of justice, of the profession of religion, of the pursuit of free art and free political discussion–when the transcendent grounds of all these free activities are summarily denied, then the State becomes, of necessity, inheritor to all ultimate devotion of men. For if truth is not real and absolute, then it may secm proper that the public authorities should decide what should be called the truth.” (Michael Polanyi, The Logic of Liberty), অর্থাৎ যদি রাষ্ট্রের উর্ধ্বে এমন কোনো আদর্শ না থাকে যে-আদর্শের সেবায় জীবন উৎসর্গ করা যায়, তা হলে সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে রাষ্ট্রের শরণার্থী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আর সত্যের যদি কোনো তৎপ্রতিষ্ঠা না থাকে, তা হলে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী “সত্য নির্ধারিত করা অযৌক্তিক বিবেচিত নাও হতে পারে।

.

সত্যের সাশ্রয়ী প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস এক জিনিস; আর সেই সত্য কোনো শাস্ত্রবিশেষে সীমায়িত অথবা কোনো বিশেষ সমাজ-ব্যবস্থায় সিংহাসনারূঢ়, এ-সিদ্ধান্ত ভিন্ন জিনিস। এই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তই মধ্যযুগীয় বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। এই মধ্যযুগীয় বিশ্বাসে ফিরে যাওয়া। আজ না-প্রয়োজনীয়, না-বাঞ্ছনীয়।

এ-কথা স্বীকার করে নিতে বাধা নেই, বরং স্বীকার করে নেওয়াই বাঞ্ছনীয় যে, সত্যের প্রকাশ বিচিত্র এবং তার আংশিক উপলব্ধিও মিথ্যার প্রলেপে আচ্ছন্ন হবার নিয়ত সম্ভাবনা। আধুনিক মনোবৈজ্ঞানিক ও সমাজবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এ-দিক থেকেই আমাদের আত্মজ্ঞান ও সত্যজ্ঞান বাড়াবার পথে সহায়ক। যে-কোনো ব্যক্তির সত্যোপলব্ধিতে সত্যানৃতের মিশ্রণ অবশ্যম্ভাবী বলেই স্বাধীন মতপ্রকাশ ও আলোচনার গণতান্ত্রিক অধিকার সত্যের পথে সহায়ক। অর্থাৎ, যেহেতু কোনো সাময়িক সিদ্ধান্তেই সমগ্র সত্য বিধৃত হতে পারে না, অতএব বিভিন্ন, এমনকি পরস্পরবিরোধী, নানা সিদ্ধান্তের সহসত্তা এবং ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে পূর্ণতর সত্যের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টাই সুস্থ সমাজে প্রত্যাশিত ও বাঞ্ছনীয়।

ধনতান্ত্রিক সমাজেও যেমন সমাজতান্ত্রিক সমাজেও তেমনই মিথ্যাকে রোধ করবার নামে স্বাধীন আলোচনার পথ রুদ্ধ করলে তাতে সত্যকেই রোধ করা হবে। অনুন্নত উপজাতীয় (tribal) সমাজব্যবস্থায় একটা স্বতস্ফূর্ত সামাজিক ঐক্যবোধ লক্ষ করা যায়। এই উপজাতীয় একতাবোধের প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে। বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানে আবারও আমরা দ্বন্দ্বমুক্ত সেই সহজ ঐক্যভাবে বা তার কোনো বিকল্পরূপে ফিরে যেতে পারব। কিন্তু সামাজিক ও মানসিক দীর্ঘ বিবর্তনের ফলে মানুষ আজ কর্মে ও চিন্তায়, সাধ্যে ও অনুশীলনে এতে বিভক্তীকৃত যে, উপজাতীয় ঐক্যের আদর্শে প্রত্যাবর্তন আজ অসম্ভব। আধুনিক সমাজে তাই শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি এবং জীবনচর্চার অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতার বিচিত্র ও বিভিন্নমুখী প্রকাশ স্বাভাবিক। বিভিন্ন বৃত্তি, পরিস্থিতি অথবা চৈতন্যের বিভিন্ন স্তরে যাঁদের অবস্থান তাঁদের ভিতর মত ও নীতির মোলিক দ্বন্দ্ব আজকের জটিল সমাজে অস্বাস্থ্যের। নয়, বরং স্বাভাবিক স্বাস্থ্যেরই লক্ষণ। ভয়ে, সাময়িক উত্তেজনায়, অথবা আত্মবিশ্বাসের একান্ত অভাবে যখন মানুষ চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে, তখনই শুধু এই দ্বন্দ্বের সাময়িক নিবর্তন সম্ভব। যদি গণতান্ত্রিক অধিকার বাহ্যত স্বীকৃত থাকা সত্ত্বেও কোনো সমাজে আজ। নীতির ক্ষেত্রে মতৈক্য ও বিচারের ক্ষেত্রে মৌলিক দ্বন্দ্ব উচ্চারিত না হয়, তা হলে সে সমাজ অসুস্থ সমাজ আর যে-রাষ্ট্র মতের মৌলিক দ্বন্দ্ব উচ্চারণ করবার অধিকার কেড়ে নিয়েছে সে-রাষ্ট্র সমাজের নৈতিক ভিত্তিকেই বিপন্ন করেছে।

দ্বন্দ্বের অধিকার মৌলিক; কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাসেরও স্থান আছে। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার আধ্যাত্মিক ভিত্তি হিসাবে ঐক্য বাঞ্ছনীয় এই একটি বিশ্বাসে যে, সমস্ত দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্নমুখী অন্বেষণের লক্ষ্য হিসাবে এমন একটি সত্য বস্তু আছে যা অনন্তরূপী হয়েও স্বপ্রতিষ্ঠিত। কারণ, এ বিশ্বাস যদি না থাকে তা হলে সমস্ত বাদ-প্রতিবাদই শুধু নিরর্থক কোলাহল; এবং এমন একটা নিরর্থক ব্যাপার যদি কোনো রাষ্ট্র সাময়িক স্বার্থের প্ররোচনায় অত্যন্ত উপেক্ষার সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত করতে উদ্যত হয় তো তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

বস্তুত আধুনিক একদলীয় বা অধিনায়কত্মন্ত্রিক সমাজে সত্য ও ন্যায়ের আদর্শের প্রতি দু’টি বিপরীত ধারণার যুগ্ম প্রতিষ্ঠা দেখা যায়। সাধারণ কর্মীকে এই প্রাচীন উপজাতীয় বিশ্বাসে দীক্ষিত করা হয় যে, গোষ্ঠীর নেতা অথবা নেতৃস্থানীয় শাসকমণ্ডলী অভ্রান্ত, সত্যদ্রষ্টাস্বরূপ; আর নেতৃস্থানীয়েরা বিশ্বাস করেন যে সত্য বলে কোনো বস্তু নেই, রাষ্ট্রের স্বার্থ অনুযায়ী সত্য-মিথ্যার নির্ধারণই সঙ্গত রাজনীতি। গণতান্ত্রিকের কর্তব্য এই দুই ভ্রান্তির অবিরাম বিরোধিতা। সত্যের ভিত্তি সাময়িক স্বার্থে নয়; আবার সত্য, কোনো নেতৃবিশেষে মূর্তিমান বা শাস্ত্রবিশেষে সীমায়িতও নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের

স্বাজাত্যবোধের যে-প্রেরণা মানুষের প্রকৃতিগত, সেই এষণা আজ পরিতৃপ্ত হতে পারে শুধু এমন কোনো সাম্যবাদী সমাজে যেখানে মানুষের ঐক্যের প্রতিষ্ঠা-ভূমি কোনো প্রত্যক্ষ শাস্ত্রে অথবা সর্বস্বীকৃত নেতৃত্বে নয়, বরং মানুষের সঙ্গে মানুষের সমান অধিকারের স্বীকৃতিতে এবং এই মৌল উপলব্ধিতে যে, যে সত্যকে বহু মানুষ বহুভাবে অন্বেষণ করছে। সেই সত্যই মানুষকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, শ্রেণী অথবা জাতি হিসাবে বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ধার করে একটি বৃহৎ সামান্যে প্রতিষ্ঠিত করে।

গণযুগ ও গণতন্ত্র (১৯৬৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *