২. মহাভারতের ভারতযুদ্ধ

মহাভারতের ভারতযুদ্ধ

০১.

সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে কেউ যদি ‘সীতা কার বাপ’–এই প্রশ্ন তোলে, তার প্রতি আমরা বিরক্ত হই। তার বুদ্ধি এবং স্মরণশক্তি সম্বন্ধেও আমরা অনিশ্চিত বোধ করি। কিন্তু একইভাবে মহাভারতের কোন চরিত্রের সম্বন্ধ নির্ণয় করতে গিয়ে কেউ যদি এমন অসম্ভব প্রশ্ন করে যে, অমুক লোকটি কার বাবা, তখন হয়তো দেখা যাবে যে হাজারো চরিত্রের জঙ্গলে সঠিক বাবাটিকেও চেনা যায় না। মহাভারতের বিশাল গহনে একজনের বাবাকে অন্য একজনের বাবা বলে মনে হয়। সত্যি কথা বলতে কি মহাভারতে এসব ঘটনা ঘটে। শল্য পাণ্ডবদের আপন মামা। মহাভারতের পূর্ব পর্বগুলিতে যেহেতু তাঁকে বেশি দেখা যায়নি, তাই মহাভারতের পাঠকেরা অনেকেই তাঁকে ভাল চিনতেন না। কিন্তু যুদ্ধপর্বে মামা ভাগনের হাতে মারাই পড়লেন। অর্জুন বিয়ে করে বসলেন সুভদ্রাকে, অথচ সুভদ্রা তাঁর মামাতো বোন। মহাভারতে এই ধরনের বিসদৃশ, বিরুদ্ধ অথবা পরম্পরাহীন–ঘটনার সন্নিবেশ ঘটেছে মাঝেমাঝেই। ঘটনার গতি, বিচিত্র গল্প, তার ভেতরে গল্প–এতে করে চরিত্রগুলির স্বাতন্ত্র কিংবা কে কোথা থেকে এল, তার পূর্বপুরুষের পরিচয় কি–এ সব কিছু হারিয়ে যায়। তাই মহাভারতের মুখ্য চরিত্রগুলির মধ্যে ঢুকবার আগে তাদের পূর্বকথা, পূর্বপুরুষ এবং কুরু-পাণ্ডবের পাশাপাশি বেড়ে ওঠা অন্য রাজ্যগুলির রাজাদের সম্বন্ধেও কিছু জানা দরকার। তাতে লাভ দুটি। এককুরু-পাণ্ডবের ঝগড়া যে শুধুমাত্র ভাইতে-ভাইতে গণ্ডগোল–এই ধারণার অবসান ঘটবে। দুই-ভারতযুদ্ধ যে শুধুমাত্র কুরু-পাণ্ডবের গৃহবিবাদের পরিণতি নয়–সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপই যে শেষ পর্যন্ত ভারতযুদ্ধের রূপ ধারণ করেছে–সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। রাজনীতির বিবর্তনে ভারতযুদ্ধের সম্ভাবনা কি করে হল–সে পরের, কথা। তারও আগে দরকার স্বয়ং কুরু-পাণ্ডবদের, যাদব-কৃষ্ণ-বলরামের, জরাসন্ধ-শিশুপালের বংশমূল জানা। তাতে অনেক কিছুরই কারণ বোঝা যাবে, অনেক বিবাদ-বিগ্রহই সযৌক্তিক হয়ে উঠবে।

প্রথমেই মনে রাখা দরকার, সেকালের বড় বড় রাজবংশে যে দু-একটি মহান এবং শক্তিশালী রাজা জন্মাতেন, পরবর্তী সময়ে তাঁদের নামেই সেই সেই রাজবংশ প্রসিদ্ধ হয়ে যেত। বংশের উত্তরাধিকারে উত্তরপুরুষেরাও তাঁদের মহান পূর্বজদের নামে সম্বোধিত হতে ভালবাসতেন এবং গর্বও বোধ করতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ রাজবংশের উত্তরপুরুষেরা যখন কোন অন্যায় কাজ করার সাহস দেখিয়েছেন অথবা মন দিয়েছেম এমন কোন কাজে যা মান, মর্যাদা অতিক্রম করে, তখন তাঁদের ওপর নেমে আসত সেই পূর্বজন্মা প্রসিদ্ধ রাজনামের খাঁড়া, তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হত সেই সেই রাজার চিরন্তন কীর্তিকলাপ, কখনও বা তিরস্কারের ভাষায় বলা হত–অমুক রাজার, তমুক রাজার বংশে জন্ম নিয়ে এ তুমি কি করতে যাচ্ছ। সবচেয়ে বড় কথা, এই সব বিশেষ ক্ষেত্রে উত্ৰপুরুষকে তাঁর পূর্বপুরুষের নাম ধরেই ডাকা হত, কখনও বা সেই নামের সঙ্গে জুড়ে যেত একটি মাত্র তদ্ধিত প্রত্যয়, যার মানে হবে অমুকের ছেলে–অথচ সেই অমুক হয়তো জন্মেছে তার দশ পুরুষ আগে।

যেমন ধরুন, এই অর্জুন, দুর্যোধন, কি ধৃতরাষ্ট্র-যুধিষ্ঠিরের কথা। মহাভারতের মধ্যে এদের ‘ভারত’, ‘ভারত’, বলে সম্বোধন করা হয়েছে, ‘পৌরব’ বলা হয়েছে, আবার কতবার ‘কৌরব’ও বলা হয়েছে, ঠিক যেমন, রামায়ণের রাম-লক্ষ্মণকে একবার রঘুরাঘব, একবার ‘ইক্ষাকু একবার দাশরথি বলেও ডাকা হচ্ছে। মহাভারতের বেলায় একেবারে সাধারণ স্তরে, এইরকম একটা ধারণা আছে যে, দুযযাধন-দুঃশাসনেরাই শুধু কৌরবপক্ষ, আর পাণ্ডবেরাই পাণ্ডব। কিন্তু সত্যি বলতে কি পাণ্ডবেরাও তো কৌরব, মহাভারতের মধ্যেই অজস্রবার পাণ্ডুপুত্রদের ‘কৌরব’ বলে ডাকা হয়েছে। মহাভারতের রাজবংশগুলির কৌলীন্য বুঝতে গেলে আগে পুরুকে জানতে হবে, পাণ্ডব-কৌরবের মূলপূরুষ ভরতকে জানতে হবে, কুরুকে জানতে হবে; ঠিক যেমন জানতে হবে কৃষ্ণ-বলরামের পূর্বপুরুষ বৃষ্ণি, অন্ধক, যদুকে, জানতে হবে জরাসন্ধের পূর্বপুরুষ কিংবা চেদিপতি শিশুপালের পূর্বপুরুষকেও; নইলে মহাভারতের পাস্পরিক সামাজিক সূত্রগুলিও বোঝা যাবে না, রাজনীতির খেলাও বোঝা যাবে না।

তবে হ্যাঁ, সেরকম করে বলতে গেলে তো একবারে মনুষ্য সংসারের আদি পুরুষ মনু পর্যন্ত যেতে হয়। আমরা অত দূর যাব না এবং সত্যি বলতে কি, গেলে সুবিধেও হবে না। মনুষ সংসারে অতি পূর্বপুরুষের স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে যায়, বিশেষত যে পুরুষ অকৃতী-তিনি একেবারে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যান। আবার যিনি কৃতকমা পুরুষ, তাঁর কর্ম রাজা হিসেবে তাঁকে খ্যাতি দিতে পারে, মানুষ হিসেবেও খ্যাতি দিতে পারে। আবার বিচিত্রকর্মা পুরুষ হিসেবেও কেউ বা বিখ্যাত হতে পারেন। যেমন ধরুন যযাতি। সেই যযাতি, যাঁর স্ত্রী দেবযানী একসময় বৃহস্পতিপুত্র কচের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই যযাতি, যিনি দেবযানীর চৌকি-দেওয়া রাহুর প্রেম সহ্য করতে না পেরে দানবরাজনন্দিনী শর্মিষ্ঠার বাহুবন্ধনে ধরা দিয়েছিলেন। কৌরব-পাণ্ডবের বংশমূলে বিরাট এক রক্ত-বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল শুধুমাত্র যযাতির বিয়েতেই।

অনেক পরবর্তী সময়ে গাণ্ডীবধারী অর্জুন মহামতি কৃষ্ণের কাছে খুব বড় মুখ করে বলেছিলেন-কুলক্ষয় হলে সমাজে পুরুষ-মানুষ কমে যাবে। পুরুষ কমে গেলেই মেয়েরা নাকি সব ভারি দুষ্টু হয়ে পড়ে এবং মেয়েরা দুষ্টু হলেই নাকি সমাজে বর্ণসংকর তৈরি হয়–স্ত্রী দুষ্টাসু বাষ্ণেয় জায়তে বর্ণসংকরঃ।(১) ভগবদ্গীতার কথারম্ভেই অর্জুন অনুযোগ করে বলেছেন–এই বর্ণসংকর একবার ঘটলে আর রক্ষে থাকবে না- অনন্ত নরক জুটবে কপালে। পিতৃ-পুরুষেরা কুলঘ্ন পুত্রদের কাণ্ডকারখানা দেখে ঘেন্নায় আর তাদের দেওয়া জল স্পর্শ করবেন না–সংকরো নরকায়ৈব কুলনাং কুলস্য চ। পতন্তি পিতরো হেষাং লুপ্তপিণ্ডেদকক্রিয়াঃ।(২) অর্জুনের ধারণা বর্ণসংকর ঘটলে জাতিধর্ম, কুলধর্ম–সব উচ্ছন্নে যাবে আর এই উচ্ছন্নে-যাওয়া পুরুষদের যে চিরকালের নরকবাস অবধারিত–সে ব্যাপারে অর্জুন একেবারে নিঃসন্দেহ।

কত পুরুষ পরে আপন বংশের রক্তের বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী এক বীর পুরুষের ছেলেমানুষি দেখে যযাতি স্বর্গ থেকে, নাকি নরক থেকে, হেসে উঠেছিলেন কি না–সে খবর আমরা পাইনি, কিন্তু এক পুরুষেই সেই যযাতি যেরকম ব্রাহ্মণ-চণ্ডালে মেলবন্ধন করেছিলেন, সে খবর অর্জুন পেলে আর খামোকা যুদ্ধপর্বে হঠাৎ করে কৃপাবিষ্ট হয়ে পড়তেন না। সত্যি কথা বলতে কি, যযাতির খুব একটা উপায় ছিল না। ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী যখন বিদ্যার্থী কচের কাছে প্রত্যখ্যাত হলেন, তখন আবার মোরে পাগল করে দিবে কে–এই আশাতেই বসেছিলেন। দুভাগ্য নয়, সৌভাগ্যক্রমেই এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে শর্মিষ্ঠার একটা ঝগড়া হয়ে গেল। শর্মিষ্ঠা দানব-রাজার মেয়ে, সে দেবযানীর বাপ তুলে পাঁচ কথা তাঁকে শুনিয়ে দিল। দেবযানী বললেন–আমরা তোদের গুরুবংশ। তোর বাবা আমার বাবার শিষ্য সেই সূত্রে তুই আমারশিষ্যর মত-শিষ্যা ভূত্বা মমাসুরি। এসব গুরুগিরি শর্মিষ্ঠার সহ্য হল না। সে বললে-শিষ্যা। দিন-রাত দেখছি–উঠতে-বসতে তোর বাবা দাসবাদীর মত আমার বাবার কাছে তোষামুদি করে যাচ্ছে-আসীনঞ্চ শয়ানঞ্চ পিতা তে পিতরং মম। তুই হলি সেই তোষামুদে, যাচক এবং আমার বাবার কাছ থেকে টাকা-খাওয়া বাপের মেয়ে। আর আমি। আমি হলাম গিয়ে তার উল্টো।(৩)

শর্মিষ্ঠা রাগের চোটে দেবযানীকে একটি কুয়োয় ফেলে দিলেন এবং তার নিশ্চিত মৃত্যু জেনেই বাড়ি ফিরলেন।

সৌভাগ্য একেই বলে। মৃগয়াশ্রান্ত পিপাসু যযাতি রাজা কুয়োয় জল খেতে এসেই দেখেন কুয়োর মধ্যে আগুনপানা এক মেয়ে। রাজা প্রশ্ন করলেন–কে তুমি মেয়ে? মাজা তামার মত লাল লাল কি সুন্দর নখগুলি তোমার, সোনার মত গায়ের রঙ, কি হয়েছে তোমার, কেমন করেই বা কুয়োয়-পড়লে? রমণীর মুখ কিংবা, অন্যান্য অঙ্গ বাদ দিয়ে যযাতি যে দেবযানীর নখের প্রশংসা করলেন, তার কারণ বুঝতে পারছেন তো? বিপন্ন দেবযানী কুয়োর মধ্যে থেকে হাতখানি উঁচিয়ে কেবলই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে কাঁদছিলেন অতএব রাজারও চোখ প্রথমেই পড়েছে দেবযানীর আঙুল আর নখের ওপর। দেবযানী দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের পরিচয় দিয়ে বললেন-আমি তাঁরই কন্যা। দেবযানী ভাবলেন–তিনি বামুনের মেয়ে, রাজা ক্ষত্রিয়-যদি বেশি পিতৃপরিচয়ে রাজার দ্বিধা হয়, পতিতোদ্ধারে বিঘ্ন হয়, তাই রীতিমত অঙ্ক কষে বললেন-”এই সেই দখিন হাতখানি আমার, যে হাতের তারুচি নখগুলির প্রশংসা করছিলে তুমি–এষ মে দক্ষিণো রাজ পাণিস্তাম্র নখালিঃ–তুমি আমাকে এই হাত ধরেই কুয়ো থেকে তোল।(৪) রাজা দেবযানীর হাত ধরে কুয়োর বাইরে নিয়ে এলেন এবং ব্রাহ্মণকন্যা জেনে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন।

রাজা বিদায় নিতেই দেবযানী প্রথমে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে হিসেব চুকিয়ে নিলেন। অসুররাজ বৃষপবার নগরে তিনি ঢুকলেনই না। লোক পাঠিয়ে শুক্রাচার্যকে ডেকে এনে তাঁকে শর্মিষ্ঠার গা-জ্বালানো কথাগুলি শোনালেন। বললেন-তুমি আগে বল শর্মিষ্ঠা যা বলেছে তা ঠিক কিনা? সে বলেছে-তুমি দৈত্যরাজের মোসাহেব–দৈত্যানামসি গায়নঃ।(৫) বলেছে–আমি হলাম সেই মেয়ে, যার বাবা তোষামুদে, যাচক এবং তার বাবার নুন খায়–স্তুবতো দুহিতা নিত্যং যাচতঃ প্রতিগৃহ্নতঃ।(৬) রাগে অপমানে দেবযানী বললেন–তুমি সত্যি করে বলল পিতা। আমি শর্মিষ্ঠাকে বলেছি-সত্যিই যদি আমি তোষামুদে কিংবা যাচক পিতার মেয়ে হই, তা হলে তাকে আমিও দাসীভাবে প্রসন্ন করব। শুক্রাচার্য দৈত্যগুরু এবং কিঞ্চিৎ মেজাজী মানুষ। উল্টোপাল্টা কথা, দেবযানীর প্রতিক্রিয়া–এত সব ঘটনায় প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরিষ্কার বললেন–ঠিক উল্টোটাই সত্য দেবযানী! তুমি হচ্ছ সেই বাপের মেয়ে যাকে অনন্যরা তোষামোদ করে, সে কারও তোষামোদ করে না–অস্তোতুঃ স্কৃয়মানস্য দুহিতা দেবযান্যসি।(৭) আমার ক্ষমতার কথা জানেন স্বয়ং দৈত্যরাজ বৃষপর্ব, জানেন দেবরাজ ইন্দ্র আর জানেন পৃথিবীর রাজা নহুষপুত্র যযাতি। শুক্রাচার্য নানারকম জ্ঞান-বিজ্ঞানের তত্ত্ব স্মরণ করে দেবযানীকে বললেন–এমন শিষ্যের বাড়িতে আর এক দণ্ডও বাস নয়, বিশেষত বৃষপবার মেয়ের কথার জ্বালা আমার একটুও সহ্য হচ্ছে না। শুক্রাচার্য দৈত্যরাজ বৃষপবাকে সোজা সব জানিয়ে বললেন–আর তোমার রাজ্যে এক মুহূর্তও নয় বাপু! তোমাকে আমি সবান্ধবে ত্যাগ করলাম-ত্যক্ষ্যামি ত্বং সবান্ধবম্।(৮)

দৈত্যরাজ প্রমাদ গণলেন। ঘটনার অগ্রপশ্চাৎ কিছুই তিনি জানেন না। তবু গুরুকে বারংবার অনুনয় করলেন, পায়ে ধরলেন, শেষে বললেন–আপনি না থাকলে সমুদুরের জলে ডুবে মরতে হবে আমাকে। অটল শুক্রাচার্য বললেন–তুমি সমুদ্রের জলেই প্রবেশ কর, অথবা যেদিক ইচ্ছে চলে যাক তোমার অসুরবাহিনী, মেয়ের অপমান আমি সহ্য করব না–দুহিতুনাপ্রিয়ং সোঢ়ং শক্তো’হং দয়িতা হি মে।(৯)

দৈত্যরাজ এবারে খানিকটা বুঝলেন, বুঝলেন-ব্যাপারটা বাপের নয়, মেয়ের। শুক্রাচার্য নিজেও সে ইঙ্গিত দিয়েছেন–ভাল চাও তো, আমার মেয়েকে তুষ্ট কর-দেবযানী প্রসাদতাম্।(১০)

ওই এত্তটুকুন মেয়ে তার কাছে কারণ না জেনে ক্ষমা চাওয়া! প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় দৈত্যদের রাজা দেবযানীর কাছে নত হতে পারলেন না, আবারও তাই শুক্রাচার্যকেই বললেন–এই অসুরদের যা ধন-সম্পত্তি, হস্তী অশ্ব রথযা আছে সব আপনার। শুক্র বললেন-সব বুঝলাম, কিন্তু দেবযানী প্রসাদ্যতাম্। দেবযানী দারুণ হিসেবী এবং অঙ্ক কষা মেয়ে। তিনি বললেন বাবা! এই যে দৈত্যরাজ বলছেন সব তোমার, সে কথা আমি কিন্তু তেমন করে বুঝি নে, উনি নিজে পরিষ্কার করে বলুন সে কথা–রাজা তু বদ স্বয়ম্। দৈত্যরাজ এবার দেবযানীর দিকে মুখ ফেরাবার অবসর পেলেন, বিনা দ্বিধায় জানালেন দেবযানী যা চান তাই হবে, তিনি যা চান তাই পাবেন। রাজা, রাজ্য, পিতা, পরিবার-সবার সুখের জন্য, সবচেয়ে বড় কথা-দৈত্যদের হিতকামী গুরু ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্য যাতে রাজ্য ছেড়ে চলে না যান-তার জন্যও রাজার দুলালী শর্মিষ্ঠা দেবযানীর ইচ্ছেমত তাঁর দাসী বনে গেলেন।

হিসেবী, অঙ্ককষা দেবযানীর একটা হিসেব শেষ হল। কিন্তু মজা হল, জীবনের ক্ষেত্রে যাঁরা অঙ্ক কষে চলেন তাঁদের অনেক সময় ফলে ভুল হয়। বৃহস্পতিপুত্র কচের বেলায় দেবযানীর অঙ্ক মেলেনি। এবারে কুয়ো থেকে উঠে আগে নিজের বিপন্ন অস্তিত্বই শুধু শুধরে নেননি, পুনশ্চ অঙ্কে মন দিয়েছেন। মহারাজ যযাতিকে তিনি ভোলেননি, ভোলেননি যে, সে মানুষটা দেবযানীর তামার মত লাল আঙুলের প্রশংসা করেছিল। ভোলেননি যে, শর্মিষ্ঠার সঙ্গে বোঝাপড়ার তাগিদে সেই ক্ষণিকের অতিথিকে একটুও যত্ন করা হয়নি, তার দখিন হাতের রসজ্ঞকে আদর-যত্ন দূরে থাকুক, একটু ধন্যবাদ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। দেবযানী তাই প্রতিদিনই প্রায় সেই বনে যান-মৃগয়া-রসিক রাজা আবার যদি পিপাসু হয়ে সেইখানে আসেন। অনেকদিন পর দেবযানী তাঁর এক হাজার দাসী নিয়ে এবং অবশ্যই দাসীকৃত শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে সেই জায়গাটায় এসে উপস্থিত হলেন। সখীদের হাসাহাসি, হাল্কা পানীয়–পিবন্ত্যো মধুমাধবী-খাওয়া-দাওয়া, আলসে ফলে কামড়তার মধ্যে পুনশ্চ নাহুযো রাজা যযাতি এসে পৌঁছোলেন। ঠিক সেই জায়গায়তমেব দেশং সংপ্রাপ্তঃ–শ্রান্ত, জলার্থী। যযাতি দেখলেন, হাজার রমণীর মধ্যে স্বপ্নসুন্দরীর মত দুই মেয়ে। তার মধ্যে একজন বসে আছেন, আরেকজন তাঁর পা টিপে দিচ্ছেন-শর্মিষ্ঠয়া সেব্যমানং পাদসংবাহনাদিভিঃ।(১১) যযাতি রাজা। শতেক রাজরমণীর ঘোরে তিনি দেবযানীকে ভুলেই গেছেন হয়তো। কিন্তু শর্মিষ্ঠাকে দেখেও তাঁর দাসী বলে মনে হয়নি, তাই দুজনেরই নাম, গোত্র জিজ্ঞাসা করলেন। নামের সঙ্গে গোত্র জিজ্ঞাসা মানেই শুভ ইঙ্গিত আছে কোন। শর্মিষ্ঠা হাজার হলেও রাজার মেয়ে, তার গোত্র দেবযানীর পক্ষে বিপজ্জনক বলেই কথা বললেন দেবযানী, কারণ তিনি রাজাকে ঠিক চিনেছেন। যদিও না চেনার ভান করছেন। দেবযানী প্রথমে জাঁকিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। তারপর শর্মিষ্ঠাকে দেখিয়ে বললেন–ওটি আমার সখী এবং দাসী। ‘সখী’ কথাটায় যদি আবার কোন সম্মানের আভাস পান রাজা, তাই দাসীত্বের ভাগই যে শর্মিষ্ঠার মধ্যে বেশি সেটা প্রমাণ করার জন্য দেবযানী বললেন-ও আমার সখী এবং দাসী, আমি যেখানে যেখানে যাব, সেখানে সেখানেই ও আমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে–ইয়ঞ্চ মে সখী দাসী যত্ৰাহং তত্রগামিনী।(১২) সৌজন্যবশে রাজার সামনে শর্মিষ্ঠার একটু ঠুনকো পরিচয়ও দিলেন দেবযানী। বললেন–ও দানবরাজ বৃষপবার মেয়ে।

মনে মনে রাজার শর্মিষ্ঠাকে পছন্দ হয়েছিল। তাই তাঁর সম্বন্ধেই যযাতির কৌতূহল স্বাভাবিক। সেই কৌতূলেই রাজা বললেন–সে আবার কি কথা? এই সুন্দরী রমণী, অসুররাজার মেয়ে-অসুরেন্দ্রসুতা সুভূ-কন্যেয়ং বরবণিনী–সে তোমার দাসী হল কি করে? দেবযানী আসল কথার ধারে কাছে গেলেন না। ঘটনা, প্রশ্ন এবং কৌতূহল–এই তিনের মধ্যেই অন্তরীক্ষ লোকের অভিসন্ধি মিশিয়ে দেবযানী বললেন–সবই কপাল, রাজা! সবই কপাল। কপালের এলাকায় আর কোন প্রশ্ন নয়, রাজা! দেবযানীর কথার সুরে গুরুগিরি ছিল, রাজাকে তিনি বললেন–মেলা কথা বোল না এ ব্যাপারে-মা বিচিত্রা কথাঃ কৃথাঃ, তার চেয়ে বরং বল তুমি কে, কোত্থেকে আসছ, কেনই বা আসছ? দেবযানী চিনেও না চেনার ভান করলেন। রাজা পরিচয় দিলেন, মৃগয়াশ্রান্তিতে জলপিপাসার কারণ দেখালেন। প্রত্যুত্তরে দেবযানী তাঁর একশ কন্যা-দাসীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে নিজেকেও রাজার কাছে নিবেদন করে বললেন–তুমি আমার সখা হও, স্বামী হও-সখা ভর্তা চ মে ভব। কচের সঙ্গে বাল্যের প্রেমে দেবযানীর অভিশাপ ছিল। কিন্তু এখন তিনি অভিজ্ঞ যুবতী। দেবযানী বামুনের মেয়ে নন শুধু, গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। বুঝি এই কারণেই সেকালের রীতিতে তিনি স্বামীর দাসী হতে চাননি, তাঁকে সখার মত চেয়েছেন।

ঠিক এই রকম একটা জায়গায় মহাভারতের মান্য টীকাকার নীলকণ্ঠ আর থাকতে পারেননি। শুষ্ক টীকাকার পর্যন্ত বুঝেছেন যে, মহারাজ যযাতির তাৎক্ষণিক সমস্যা ছিল দুটি। এক, দেবযানীর থেকে দৈত্যকুমারী শর্মিষ্ঠা তাঁর বেশি মনপসন্দ। দুই, দেবযানীকে সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করলে তাঁর রাগ হবে এবং সেই রাগ তাঁর পিতা শুক্রাচার্যের মধ্যেও সংক্রামিত হবে। ফল রাজার পক্ষে ভয়ানক হতে পারে। যযাতি তাই দেবযানীর প্রস্তাব শুনে প্রথমে বললেন-আমি তোমার যোগ্য নই কন্যে, কোথায় তুমি ব্রাহ্মণ-গুরুর মেয়ে, আর কোথায় আমি ক্ষত্রিয়, এ বিয়ে হয় না দেবযানী-অবিবাহ হি রাজানো দেবযানি পিতৃস্তব। দেবযানী বললেন–তাতে কি হয়েছে, বামুনের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের, ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে বামুনের কত বিয়ে হয়েছে। বামুন-ক্ষত্রিয়ের বর্ণসংকর সমাজের বেশ চলে–সংসৃষ্টং ব্ৰহ্মণা ক্ষত্রং ক্ষত্রেণ ব্ৰহ্ম সংহিতম।(১৩) কত উচ্ছিন্ন ক্ষত্রিয়বংশ ব্রাহ্মণদের সরসতায় সজীব হয়ে উঠেছে; তাছাড়া সেরকম করে ধরতে গেলে তুমিও রাজা, ব্রাহ্মণ ঋষির ছেলে। ঋষি বুধের কল্যাণে ইলার গর্ভে জন্মালেন পুরুরবা, তার দুপুরুষ পরেই তো তুমি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তুমি আমার ঋষি, ঋষিপুত্র সব, তুমি আমায় বিয়ে কর না গো।

‘বিয়ে কর না গো’-এই শব্দগুলিতে সংস্কৃত আছে–অঙ্গ বহস্ব মাম্। বহ’ অবশ্যই বিয়ে করা বোঝায়, কিন্তু আসল অর্থ তো বহন করা। দেবযানী বুঝতে পারছিলেন না যে, রাজা শব্দটা বহন করা অর্থেই গ্রহণ করছিলেন, অথচ বোঝাটি মাথা থেকে নামাতেও পারছিলেন না। রাজা দেবযানীর গলাধরা প্রণয়বচন শুনে যুক্তির কথায় এলেন। বললেন-চতুর্বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে এক জায়গা থেকেই, সেই পরম পুরুষই আমাদের সবার মূল। তবু কি জান, তুমি বামুন ঘরের মেয়ে, তোমাদের পালনীয় ধর্ম আলাদা, শৌচ-শুদ্ধি আচারও আলাদা রকমের। আবার আমরা ক্ষত্রিয়। আমাদের ধর্মবোধ ভিন্ন, শুদ্ধির বিচারও ভিন্ন ধরনের, রুচিও ভিন্ন–পৃথগধমাঃ পৃথকৃশৌচাঃ-কাজেই এ বিয়ে হয় না। দেবযানী এবার মোক্ষম প্রশ্ন তুলে রাজাকে ফেলে দিলেন প্যাঁচে। আমি আগেই বলেছি, রাজাকে তিনি ঠিকই চিনেছিলেন এবং এখন তাঁর নাম শুনে পরিচয় পেয়ে নিশ্চিন্ত দেবযানী সেই পুরোন কথার জালে ফেলে দিলেন রাজাকে। দেবযানী বললেন-তুমি এত ধর্ম-কর্ম করছ, তুমি তোমার হাতের ধর্মটা কি মেনেছ! সেই যে তুমি আমার হাত ধরে কুয়ো থেকে টেনে তুললে, সেই কথা মনে রেখেই আমি তোমায় স্বামীত্বে বরণ করেছি। আমার মত ভদ্রঘরের মেয়েদের হাত কি স্বামী ছাড়া অন্য কেউ ধরে-কথং নু মে মনস্বিন্যাঃ পাণিমন্যঃ পুমান্ স্পৃশেৎ। রাজা তবু ব্রাহ্মণ জাতির উদ্দেশে বহু সম্মান জানালেন, তাঁরা ক্রুদ্ধ হলে সাধারণ মানুষের কত বিপদ হতে পারে সে সব জানিয়েও রাজা রেহাই পেলেন না। দেবযানী পিতা শুক্রকে সব বলে, এমনকি হাত ধরার কথাও উল্লেখ করে রাজার প্রতি তাঁর প্রণয় বাঞ্ছা ব্যক্ত করলেন। কন্যার কথায় শুক্রাচার্য বিনা দ্বিধায় ক্ষত্রিয় যাতির সঙ্গে দেবযানীর বিয়ে দিয়ে দিলেন। শুধু সাবধান বাণী তাঁর এই ছিল যে, “আমার মেয়ের সঙ্গে দাসী হিসেবে এই বৃষপবার মেয়ে শর্মিষ্ঠাও যাচ্ছে। তুমি যেন বাপু তাকে আবার আদর করে বিছানায় তুলো না–সম্পূজ্য সততং রাজন মা চৈনাং শয়নে স্বয়েঃ।(১৪)

শুক্রাচার্যের ইচ্ছায় এবং দেবযানীর উপবোধে ক্ষত্রিয় যযাতি প্ৰতিলোম বর্ণসংকরের চেঁকি গিললেন। অর্জুনের গীতোক্ত বক্তৃতা অনুসারে যযাতির নরকবাসের খবর কিছু পাওয়া যায়নি। তবে হ্যাঁ, এই পৃথিবীতেই নরকের দ্বার পর্যন্ত তিনি ঘুরে এলেন, কিন্তু তার কারণ অন্য এক স্বর্গসুখ। দেবযানী তো বিয়ের পর সোজা এসে ঢুকলেন যযাতির অন্তঃপুরে। প্রেমানন্দে তাঁর দিন কাটতে লাগল, পুত্ৰাদিও লাভ হল। ওদিকে অশোকবনের উপান্তে ঘর বানানো হল শর্মিষ্ঠার থাকার জন্য। কত কাল চলে গেল, শর্মিষ্ঠা শুধু এখন যুবতী নন, নবীন যৌবনের অকারণ অবহেলা তাকে পীড়া দেয়। রাজার ওপর তাঁর যে খুব আসক্তি ছিল তা মনে হয় না, কিন্তু তিনি ভাবলেন–দেবযানী ভাল আছে বলে আমি খারাপ থাকব কেন? তার যৌবন সফল হচ্ছে, আমার যৌবন বৃথা-বৃথাহং প্রাপ্তযৌবনা। সে পুত্র লাভ করেছে, আমার পুত্র নেই। শর্মিষ্ঠা ভাবলেন-যেমন করে দেবযানী তাঁকে বরণ করেছে, তেমনি করে আমিও তাঁকে বরণ করব–যথা তয়া বৃতো ভতা তথৈবাহং বৃণোমি তম্। শর্মিষ্ঠার একটাই সংশয়, রাজার সঙ্গে যদি একবার নির্জনে, দেবযানীর চোখের আড়ালে দেখা হত! মহাভারতকার লিখেছেন শর্মিষ্ঠা এইরকম সংশয় করছেন, আর রাজা সেই সময়েই যদৃচ্ছাক্রমে উপস্থিত হলেন অশোকবনিকার উপান্তে। আমরা বলি, এত নাটকীয়তা ভাল নয়। শর্মিষ্ঠার প্রতি রাজা পূর্বাহ্নেই আকৃষ্ট ছিলেন, রাজার ঘরের মেয়ের জন্য রাজার বেদনাবোধও ছিল। অশোকবনের এদিক-ওদিক তিনি মাঝে মাঝেই আসতেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আজকে উতলা বাতাসে শর্মিষ্ঠার ছটফটানি দেখে তিনি ধরা দিয়েছেন মাত্র। নইলে শর্মিষ্ঠা যখনই বলেছেন–রূপে, চরিত্রে কি কৃষ্টিতে আমাকে তো তুমি জান রাজা যযাতি তখনই বলেছেন–তোমার মধ্যে এক ফোঁটাও অসুন্দর নেই–রূপঞ্চ তে ন পশ্যামি সূচ্যগ্রমপি নিন্দিত–তুমিই সবচেয়ে সুন্দর।

পূর্বে আকর্ষণ না থাকলে এমন কথা আসে না। কিন্তু মুশকিল হল শুক্রাচার্যকে নিয়ে, যিনি অনেক আগেই বুঝেছিলেন যে শর্মিষ্ঠার ওপরে রাজার লোভ হতে পারে। রাজা বললেন–সবই তো বুঝলাম, কিন্তু শুক্রাচার্য যে বলেছিলেনষপবার মেয়ে শর্মিষ্ঠাকে আবার তোমার সঙ্গে শোবার জন্য ডেকে বোস না যেন–তার কি হবে! শর্মিষ্ঠা হাজার হলেও মেয়ে। যযাতি যেদিন প্রথম দেবযানীকে শর্মিষ্ঠার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেছিলেন সেদিনই দৈত্যরাজার কন্যা মনে মনে জানেন যে যযাতি তাঁকে মন দিয়ে ফেলেছেন। তিনি এও জানেন যে দেবযানীর সঙ্গে রাজার যে বিয়ে হয়েছে তার মধ্যে প্রেম নেই একটুও, আছে শুধু অভিশাপের ভয়। কিন্তু অভিশাপের ভয় দেখিয়ে কি আর অন্তহৃদয়ের গতিবেগ রুদ্ধ করা যায়। যযাতি মজেই ছিলেন, তাঁকে আরও মজানোর জন্য শর্মিষ্ঠা বললেন–তুমি জান না রাজা, অন্তত পাঁচটা ব্যাপারে মিথ্যে বললে তো দোষ নেই কোন। ধর তুমি একজনের সঙ্গে ঠাট্টা করছ, তা সেই ঠাট্টার কথায় তো মিথ্যে থাকে, তাতে কি দোষ হয়? তেমনি মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করার সময় কিংবা একজনের প্রেমে পড়েও যে মানুষ বলে–আমি ওকে ভালবাসি না–এসব মিথ্যেতে দোষ নেই কোন। লক্ষ কথার বিয়ের মধ্যেও মিথ্যে থাকে হাজারটা, তাতেও দোষ নেইন নমযুক্তং বচনং হিনস্তি ন স্ত্রী রাজন ন বিবাহকালে।(১৫) নীলকণ্ঠ টীকাকার আবার পদাবলীকারদের মত শর্মিষ্ঠার পক্ষ নিয়ে বলেছেন–বরঞ্চ যে মেয়ে ‘সপ্রেমে আহ্বান জানাচ্ছে, তাকে ত্যাগ করাটাই অন্যায়।(১৬)

শর্মিষ্ঠার যুক্তিটা হল–তাঁর এবং দেবযানীর ব্যবহার এবং উদ্দেশ্য অন্তত একটি জায়গায় এক। দুজনেই যেখানে রাজার কাছে নিজেদের নিবেদন করেছেন, সেখানে ‘দেবযানী আমার বউ আর তুমি কেউ নও’-এটা বলাটাই শর্মিষ্ঠার মতে মিথ্যাচার কেননা সেকালের দিনে বিয়ের সময় কন্যার সঙ্গে যে দাসী আসত, সে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর-পুরুষের বিবাহিতা স্ত্রী না হলেও ভোগ্যা হত, অর্থাৎ স্ত্রীর মতই ব্যবহার পেত। তাদের ছেলেমেয়েরাও কেউ অসম্মানের দায়ে পড়ত না। বিদুর, যুযুৎসু-এরাই তার বড় উদাহরণ। শর্মিষ্ঠা তাই বললেন–তুমি আমার সখীর স্বামী মানেই তো আমারও স্বামী। যেদিন আমার সখীর সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে গেল, ঠিক সেই দিন থেকে আমার সঙ্গেও তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, রাজা-সমং বিবাহমিত্যাহুঃ সখ্যা মেসি বৃতঃ পতিঃ।(১৭)

রাজা যযাতি গলতে থাকলেন। তাঁর হৃদয় অর্ধেক ধরা দেওয়াই ছিল শর্মিষ্ঠার কাছে। সেখানে শর্মিষ্ঠার যুক্তিতে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ ধরা দিয়ে বললেন-”তাহলে তুমিই বল কি করব-ত্রুহি কিং করবানি তে–অর্থাৎ রাজার নিজের আর কোন যুক্তি নেই। শর্মিষ্ঠা বললেন স্ত্রীলোকের কিংবা দাসী বাঁদীর কি নিজের বলতে কিছু আছে? আমি দেবযানীর খাই, পরি; কিন্তু দেবযানীর সমস্ত অধিকারই তো তোমার। এই যুক্তিতে দেবযানী তোমার যতখানি প্রণয় নিবেদনের যোগ্য, আমিও ঠিক ততটাই–সা চাহঞ্চ ত্বয়া রাজন ভজনীয়ে ভজস্ব মাম। শর্মিষ্ঠাকে এতদিন পরে এমন যুক্তিগ্রাহ্যভাবে লাভ করে রাজা যযাতি তাঁকে দেহ-মন সব দিলেন। মহাভারতকার ঠিক এই মুহূর্তে শর্মিষ্ঠার একটু রূপ বর্ণনা করেছেন। না, সে বর্ণনায় মহাকাব্যের আড়ম্বর জোটেনি কোন। কবি শুধু বলেছেন, রাজার সঙ্গে শর্মিষ্ঠার প্রথম সমাগমে শর্মিষ্ঠার মুখের হাসিটি হয়ে উঠেছিল মিলনুমধুর-শর্মিষ্ঠা চারুহাসিনী। এই সমাগমের তৃপ্তি একবারেই শেষ হয়ে যায়নি। একে একে তিনটি পুত্র জন্মাল শর্মিষ্ঠার : দুস্থ্য, অনু এবং পুরু। অনেক চাপাচুপি, মিথ্যে, এড়িয়ে যাওয়া, জবাব, জবাবদিহির পর শর্মিষ্ঠা দেবযানীর কাছে ধরা পড়ে গেলেন। আর কি, বাপের আহ্লাদী মেয়ে দেবযানী পিতা শুক্রাচার্যের কাছ থেকে যযাতির জন্য সেধে অভিশাপ নিয়ে এলেন। যযাতির জন্য হাজার বছরের জরার অভিশাপ বরাদ্দ হল। কিন্তু মজা হল, যে দেবযানী স্বামীর জন্য এত বড় সর্বনাশের ব্যবস্থা করলেন, রাজা কিন্তু সেই দেবযানীকে আরও আরও ভোগ করার জন্য জরারোধের উপায় খুঁজতে লাগলেন। যযাতি বললেন–দেবযানীর ব্যাপারে এখনও আমার যৌবন সফল হয়নি, আপনি দেখুন, যাতে জরা আমার শরীরে প্রবেশ না করতে পারে। শুক্রাচার্য বললেন-যা বলেছি তা হবেই। তবে তুমি যদি তোমার জরা অন্য কারও দেহে সংক্রামিত করতে পার, তাহলে তুমি তোমার যৌবন ফিরে পাবে আবার।

আমরা জানি শুক্রাচার্যের এই বিবেচনা দেবযানীর যৌবনের দিকে লক্ষ রেখেই। রাজা বলেছিলেন, “আমার যে ছেলে জরা নেবে সে শুধু পুণ্য, কীর্তি–এ সবই নয়, রাজ্যও. পাবে সেই”। মহামতি শুক্রও নিজের মেয়ের যৌবন-সাফল্য কামনায় রাজার যুক্তি মেনে নিলেন, কিন্তু দেবযানীর দুই পুত্র যদু এবং তুর্বসু ওই জরা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। অস্বীকার করলেন শর্মিষ্ঠার প্রথম দুই ছেলে দুস্থ্য এবং অনুও। শেষে শর্মিষ্ঠার শেষ সন্তান পুরু সানন্দে পিতার জরা গ্রহণ করে পিতৃকার্য সাধন করলেন। সেকালের হিসেব মত এক হাজার বছর চলে গেল। মহারাজ যযাতি দেবযানীর সঙ্গে অনেক যৌনসুখ ভোগ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে কামনা শুধু আগুনে ঘি পড়ার মত বেড়েই চলে, কমে না। আপন সন্তান পুরুর কাছে এই সত্য স্বীকার করে যযাতি জরা ফিরিয়ে নিলেন এবং যৌবন ফিরে পাওয়া পুত্রকে রাজ্যে অভিষেক করতে চাইলেন।

এই ‘পলিটিক্স’ আরম্ভ হয়ে গেল। রাজ্যের সমস্ত ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা সাধারণ প্রজাদের সঙ্গে দল পাকিয়ে ধর্মনাশের রব তুললেন। ব্রাহ্মণেরা বললেন–আপনি শুক্রাচার্যের নাতি এবং দেবযানীর গর্ভে আপনার বড় ছেলে যদুকে বাদ দিয়ে শর্মিষ্ঠার ছেলে পুরুকে রাজা করছেন কি করে? তাও সে আবার সবার ছোট। বামুনের ধারায় বড় ছেলেকে বাদ দিয়ে শর্মিষ্ঠার ঘোট ছেলেকে রাজা করা একেবারেই অধর্ম। রাজা যযাতি এবার শুক্রাচার্যের কথাই ফিরিয়ে দিলেন। তাঁর যুক্তি হল–যে ছেলে পিতার ইচ্ছে বজায় রাখার জন্য হাজার বছরের জরা আপন দেহে স্বীকার করতে পারে, সেই ছেলেই রাজ্য পাবার উপযুক্ত। তাছাড়া শুক্রাচার্যও বলে দিয়েছিলেন–তোমার যে ছেলে জরা গ্রহণ করবে তাকেই রাজ্য দেবে তুমি–পুত্রো বঃ ত্বানুবর্তেত স রাজা পৃথিবীপতিঃ।(১৮) কাজেই যযাতির রাজ্যে ছোট ছেলেই রাজা হবে–সে শর্মিষ্ঠার ছেলেই হোক আর যেই হোক।

আসলে শুক্রাচার্যের অঙ্কে গোলমাল হয়ে গেল। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন–দেবযানীর বড় ছেলেই যযাতির জরা স্বীকার করে নেবে। কিন্তু দেবযানীর ছেলেরা নিজের যৌবন নিয়েই এত ব্যস্ত যে, বাবার যৌবন নিয়ে তাঁরা কেউ মাথা ঘামাননি। অন্যদিকে যযাতি শুক্রাচার্যের কাছে নিজেকে যতই দেবযানীর যৌবনলুব্ধ বলে বর্ণনা করুন না কেন, সেটা ছিল দেবযানীকে দেখিয়ে জরা মোক্ষের অভিসন্ধি। তাঁর আসল ভালবাসাটা অসুররাজ নন্দিনী শর্মিষ্ঠার ওপরেই ছিল এবং তাঁর ছেলেকেই তিনি রাজ্য দিয়েছিলেন। অর্থাৎ শর্মিষ্ঠার ওপর রাজার যে ভালবাসা তাঁর দৃষ্টিলগ্নেই জ, নিয়েছিল, বশংবদ পুত্রের কারণে সে ভালবাসা আরও বেড়ে গেছে।

.

২.

আমরা যে বড় ঘটা করে ক্ষত্রিয় রাজা যযাতি আর অসুররাজ বৃষপবার মেয়ে শর্মিষ্ঠার প্রেমকাহিনী বর্ণনা করলাম, তার কারণ আছে। মনে রাখা দরকার-কৌরব-পাণ্ডবের বংশধারায় প্রথমেই তাহলে অসুর রক্ত চুকেছে এবং ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর মধ্যে যে ছোটভাই রাজা হলেন–এটাও তাহলে নজিরবিহীন কোন ঘটনা নয়। গীতার মধ্যে বর্ণসংকর নিয়ে অর্জুন যত মাতামাতি করেছেন, সেটা নিতান্তই বালকসুলভ, কারণ তাঁরই পূর্বতন রাজচক্রবর্তী পুরু মহারাজের কথা তাঁর জানা ছিল। আরও বালকসুলভ এই জন্যে যে, এই রাজবংশের মাথামুণ্ডু জোড়া দিলে অর্জুন কেন, কারও পক্ষেই সেটা স্বস্তিকর হবে না। পরবর্তী কালের এক রসিক কবি তো এমন মন্তব্য করেছেন যে, বাবা! আর যাই কর নদী, ঋষি আর ভরত বংশ-নদীনাঞ্চ ঋষীণাঞ্চ ভারতস্য কুলস্য চ–এই তিনের মূল কখনও খুঁজতে যেও না-মূলাম্বেযোন কর্তব্যঃ-খুঁজতে গেলে বিপদে পড়বে। এই শ্লোকটির অর্থ অনেকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন স্বয়ং পঞ্চানন তর্করত্ন, তাঁর গরুড় পুরাণের বঙ্গানুবাদে।(১৯) কিন্তু আমরা জানি পাণ্ডব-কৌরব, কৃষ্ণ ঠাকুর, ব্যাসদেব, ভরদ্বাজ-এত সব মহামতি পুরুষের বংশমূল খুঁজতে গেলে হয় দেব-দ্বিজে ভক্তি একেবারে রসাতলে যাবে, নয়তো প্রত্যেকের আপন বংশমূল সম্বন্ধে সংকর-নিশ্চয় দৃঢ়তর হবে।

শুধু ওই মহারাজ পুরু থেকে ভরত পর্যন্ত গেলেই দেখবেন পাণ্ডব-কৌরবের রক্তে আরও কত রকমের রক্ত মিশেছে। অসুরের রক্ত, ঋষির রক্ত, রাজার রক্ত, বেশ্যার রক্ত, সবই আছে। রক্তের মিশেলটা প্রথমে বলে নেওয়া দরকার এই জন্যে যে, পরবর্তী কালের পাণ্ডব-কৌরবের ‘পলিটিকসের সঙ্গে এই রক্তানুসন্ধান জড়িত। যযাতি মহারাজের তিন পুরুষ আগে পুরুরবা স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীর বাহবন্ধনে ধরা দিয়ে তাঁরই গর্ভে ছেলে পেয়েছিলেন, যার নাম আয়ু। আয়ুর ছেলে নহুষও খুব বড় রাজা ছিলেন। স্বর্গরাজ্য জয় করে ইনি ভাবলেন–আমি যখন এতই পেলাম, তাহলে ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্রাণী শচীই বা আমার ভোগ্যা হবে না কেন? ঐশ্বর্যের মোহে তিনি তখনকার সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের নিযুক্ত করলেন নিজের পাল্কি বওয়ার কাজে। স্বর্গসুন্দরী শচীর লোভ একেবারেই সামলাতে না পেরে পাল্কি-বেহারা বামুন অগস্ত্যের মাথায় লাথি মারেন–পাল্কি তাড়াতাড়ি বইবার জন্য। ফলে অভিশাপ, বিজন বনে অজগর হয়ে বসেছিলেন, শেষে যুধিষ্ঠিরের করুণায় মুক্তি লাভ করেন। নহুষের পরেই আমাদের যযাতি, যাঁর কথা আমরা এতক্ষণ বলেছি এবং আরও একটু বলতে হবে।

বস্তুত যযাতি রাজার বংশধরদের দিয়েই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস পরিষ্কারভাবে তৈরি হয়ে যায়। অনেক পণ্ডিত এমনও বলেছেন যে, যযাতির হাজার বছরের জরার গপ্পোটা অন্যভাবে ধরলে ক্ষতি কি? তাঁদের ধারণা, এই যে দেবযানীর ছেলে যদু, তুর্বসু কিংবা শমিষ্ঠার অন্য ছেলেরা দুস্থ্য কিংবা অনুরা সবাই যথেষ্ট বড় হয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জরাগ্রস্ত বুড়ো যযাতি তখনও ১৩২ শারীরিকভাবে যথেষ্ট সুস্থ। তিনি রাজ্য চালনার ব্যাপারে তখনও পুত্রদের সাহায্য নেন না। ছেলেরাও তাতে অসন্তুষ্ট। তাঁরা চাইতেন যযাতি এবার ছেড়ে দিন, আর কত? হয়তো একসময় এই ছেলেরা তাঁর বিরুদ্ধাচরণেও মন দিয়েছিল, ফলে যে ছেলে একমাত্র পিতৃপক্ষপাতী অর্থাৎ পুরু, তিনিই পিতার রাজ্য পেলেন এবং তাঁর মাধ্যমেই যেন আসল বংশের ধারাটি চলতে থাকল। পণ্ডিতের বুদ্ধিদৃষ্টি যাই হোক, বাস্তবটা ছিল অন্যরকম। বাস্তবে যযাতির অন্য ছেলেরাও রাজ্য পেলেন, তবে যযাতির আপন ভূখণ্ডে নয় যযাতি কি তাঁর অন্য ছেলেদের নিবাসন দিয়েছিলেন? যযাতির আপন স্বাধীন রাজ্যে পুরু রাজা হলেন বটে, কিন্তু তাঁর অন্য ছেলেদের বংশ ভারতযুদ্ধের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক মানচিত্রে অত্যন্ত গুরুতর।

মহাভারত বলেছে যে, দেবযানীর গর্ভে যযাতির প্রথম ছেলে যদু থেকেই বিখ্যাত যদুবংশ বা যাদবদের সৃষ্টি-যদোস্তু যাদবা জাতাঃ।(২০) যাদবেরা রাজত্ব করতেন চমতী, বেত্রবতী আর শুক্তিমতী নদীর জল-ধোয়া অঞ্চলে অর্থাৎ এখনকার দিনের চম্বল, বেতোয়া এবং কেন নদীর অববাহিকা অঞ্চলে। দেশের নাম বলতে গেলে মথুরা, ভরতপুর থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণে টিকমাগড় ছত্তরপুর পর্যন্ত ছিল যদুবংশীয়দের আধিপত্য। যযাতির দ্বিতীয় ছেলে তুর্বসুর থেকে নাকি যবনদের সৃষ্টি আর শর্মিষ্ঠার গর্ভে যযাতির পঞ্চম ছেলে অনু থেকে সৃষ্টি হলেন ম্লেচ্ছরা। সোজা কথায় তুর্বর রাজত্ব ছিল যবন দেশে আর অনুর শ্লেচ্ছ দেশে। পণ্ডিতেরা অবশ্য বলেছেন যে তুর্বসু শব্দটার সঙ্গে যেহেতু তুরানি, তুর্কি-এগুলোর মিল আছে তাই তুই ছিলেন ম্লেচ্ছদের আদিপুরুষ আর যবন শব্দটার সঙ্গে যেহেতু ‘আইওন’ শব্দের মিল আছে, অতএব অনুই ছিলেন যবনদের রাজা। অর্থাৎ পণ্ডিতদের মতে তুষ্ট্র থেকে যবনদের এবং অনু থেকে স্লেচ্ছদের উৎপত্তির কথা না বলে, উল্টে বলা উচিত অনু থেকে যবন আর তুর্বসু থেকে ম্লেচ্ছ। যবন আর ম্লেচ্ছ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব না। কারণ এরা ছিলেন ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত দেশবাসী।

যদুবংশের যাদবেরা যেমন ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিমে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তেমনি দুহু্যর ছেলে ভোজেরাও জায়গা করে নিয়েছিলেন যমুনার পশ্চিম পার থেকে চম্বলের উত্তর পর্যন্ত। বলতে পারেন–যাদবে আর ভোজে একটু যেন মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। আমরা বলব, এ মাখামাখি পূর্বেও ছিল, পরেও হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞাতি শত্রুতাও হয়েছে যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে যাদবেরা কিংবা ভোজেরা একে অন্যের বংশের বড় মানুষদের নামে আপন বংশমাহাত্ম্য খ্যাপন করেছেন বটে, তবে সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখবেন–যাদবেরা অনেক সময় ভোজবংশীয়দের দেখতে পারতেন না, আবার ভোজবংশীয়েরাও যাদবদের দেখতে পারতেন না। এই জ্ঞাতিশত্রুতার শেষ নমুনা ভোজবংশীয় কংসের সঙ্গে যদুবংশীয় কৃষ্ণের লড়াই। এসব কথা পরে আবার আসবে, আপাতত দেখুন, ভারতবর্ষের মাঝখানে বাঁকা তলোয়ারের মত যমুনার কিনভেক্স’ দিকটা অর্থাৎ পশ্চিম পার পর্যন্ত, যেখানে যাদব আর ভোজেরা রাজত্ব করছিল। কৌটিল্য লিখেছেন–ঠিক রাজা, রাজত্ব, এই সব শব্দে যা বোঝায় যাদব-ভোজেদের তা ছিল না। তিনি ভোজ-যাদবকুলের পরবর্তী পুরুষদের নাম উল্লেখ করে বলেছেন যে, এদের রাজ্যগুলি ছিল ‘রিপাবলিক বা করপোরেশনের মত, যেমন বৃষ্ণিসংঘ, অন্ধকসংঘ।(২১) এই দৃষ্টিতে স্বয়ং কৃষ্ণবাসুদেব ছিলেন ‘সংঘমুখ্য’।(২২) একটি প্রাচীন মুদ্রায় অবশ্য ‘সংঘ’ শব্দটার বদলে ‘গণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।(২৩) সত্যি কথা বলতে কি যাদব-ভোজেদের মধ্যে এই সংঘরাজ কিংবা গণরাজের ব্যাপারটা ছিল, যা কিন্তু যযাতির মূল ভূখণ্ডে ছিল না। অবশ্য এ সব অনেক পরের কথা।

হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ এসব তখন কোথায়? পুরু, অর্থাৎ, যযাতির স্বীকৃতি-দেওয়া আসল রাজা তখন রাজত্ব করছিলেন প্রতিষ্ঠান’ বলে এক ভূখণ্ডে। এই প্রতিষ্ঠান কিন্তু সাতবাহন রাজাদের রাজধানী পৈঠান নয়, জয়চন্দ্র বিদ্যালংকারের মতে এই প্রতিষ্ঠানকে বড়ো জোর এলাহাবাদের নিকটবর্তী ‘পিহান’ গ্রামের সঙ্গে একাত্ম করা যেতে পারে।(২৪) পুরুর পিতা-পিতামহ যেমন রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন, পুরুও ছিলেন তেমনি। মহাভারত এবং পুরাণের প্রমাণে কাশী থেকে আরম্ভ করে অযযাধ্যার পশ্চিমে এবং সরস্বতী নদীর উত্তর-পশ্চিম পর্যন্ত সম্পূর্ণ মধ্যদেশ তাঁর অধিকারে ছিল। আর ছিল রাজধানী প্রতিষ্ঠানের মণ্ডলবর্তী পশ্চিম, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব ভূখণ্ড। কিন্তু যযাতিপুত্র পুরু যত বড় চক্রবর্তী রাজাই হোন না কেন, তাঁর মৃত্যুর পর অন্তত নয়-দশ পুরুষ পর্যন্ত কোন বড় রাজা ছিলেন না। ফলত মহাভারত কিংবা পুরাণগুলি এমন অনেক রাজার নাম দিয়ে এই ফাঁক পূরণ করেছে, যা একেক জায়গায় একেক রকম। পণ্ডিতেরা অনেকেই মনে করেন যে, সূর্যবংশের মান্ধাতার ক্ষমতা লাভের পর থেকেই পুরুবংশীয়দের রাজ্যপাট আক্রান্ত হতে থাকে।(২৫) পুরুবংশে পুরুর পরেই নাম করতে হবে মহারাজ দুষ্যন্তের, সেই দুষ্যন্ত, যাঁকে নিয়ে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ কবিকীর্তি অভিজ্ঞান শকুন্তলের গ্রন্থনা। কিন্তু দুষ্যন্তের নাম করার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু আরেক বিপদ শুরু হয়। ব্যাপারটা ভেঙেই বলি।

সূর্যবংশে রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ মান্ধাতা এবং সগরের পরাক্রমে পুরুর বংশধরেরা রাজ্যপাট হারান। এই সময়ে বরঞ্চ যদু, তুবসু এবং অনুর বংশধরেরা অনেক বেশি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। দুষ্যন্ত, যাঁকে আমরা সবাই পুরুবংশের নামী পুরুষ বলে মনে করি, সেই দুষ্যন্তও কিন্তু মানুষ হয়েছিলেন তুর্ববংশের মরুপ্ত রাজার কাছে। দেখা যাচ্ছে যযাতি অভিশাপ দিয়ে নিজের ছেলেদের যতই আলাদা করে রাখুন না কেন, পরবর্তী বংশধরেরা সে কথা মনে রাখেননি। প্রয়োজনে তাঁরা একে অন্যকে যথেষ্ট দেখেছেন। তুর্বর ধারায় জন্মেছিলেন যে মরুত্ত রাজা, তিনি রেওয়া অঞ্চলের পার্বত্য ভূখণ্ডগুলির অধীশ্বর ছিলেন এবং তাঁর কোন বংশধর পুত্র ছিল না, ছিল শুধু এক কন্যা, নাম সম্মতা। মরু রাজার রাজ্যে দুই মহামান্য ব্রাহ্মণ ছিলেন-বৃহস্পতি এবং সংবর্ত, দুই ভাই। ভাইতে ভাইতে অবশ্য বনত না। বড় ভাই বৃহস্পতির টাকার লোভ ছিল এবং দক্ষিণা-টক্ষিণা নিয়ে বোধহয় দুই তপস্বী ব্রাহ্মণে নিরন্তর ঝগড়া হত। মহাভারত লিখেছে, ছোট ভাই সংবর্ত আর বড় দাদার তাড়না সহ্য করতে না পেরে সমস্ত টাকা-পয়সা ছেড়ে-ছুঁড়ে উলঙ্গ হয়ে বনে চলে গেলেন–অথা উৎসৃজ্য দিগবাসা বনবাসমবোয়ৎ। এদিকে বড় ভাই বৃহস্পতি মহত্তর ঐশ্বর্যের লোভে দেবরাজ ইন্দ্রের পুরোহিত হলেন এবং মরুত্ত রাজার যজ্ঞাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করতে অস্বীকার ১৩৪ করলেন। নানাজনের পরামর্শেতুৰ্ববংশীয়মরুত্ত সংবর্তকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে পৌরোহিত্য সঁপে দিলেন তাঁর হাতে। সেই পৌরোহিত্যে মরুত্ত এত খুশি হলেন যে, নিজের মেয়ে সম্মতাকে দক্ষিণা হিসেবে দান করলেন সংবর্তের হাতে। হরিবংশ বলেছে এই সম্মতাই দুষ্যন্তকে পুত্র হিসেবে লাভ করেন। এখন, সম্মতা সংবর্ত ঋষির ঔরসেই দুষ্যন্তকে লাভ করেন, নাকি অন্য কোন উপায়ে–সে কথা সমস্ত পৌরাণিক গ্রন্থগুলিতেই অস্পষ্ট, কিন্তু দুষ্যন্তের খ্যাতি ছিল পুরুবংশীয় বলেই। এমন হতে পারে যে, পুরুংশের কোন অখ্যাত পুরুষের হাতে সম্মতাকে দান করেন সংবর্ত এবং তারই ফলে দুষ্যন্ত পৌরব। কিন্তু মরুত্ত যেহেতু নামী রাজা ছিলেন, অথচ তিনি অপুত্রক, তাই দুষ্যন্তকে তিনিই পুত্ৰ-নির্বিশেষে লালন পালন করেন-দুষ্যন্তং পৌরবং চাপি লেভে পুত্ৰম অকল্মষ। ফল হল এই যে, যযাতিপুত্র তুর্বসুর বংশধারা লুপ্ত হয়ে গেল এবং তুর্বসুর বংশ একাত্ম হয়ে গেল পৌরব বংশের সঙ্গে–পৌরবং তুর্বসোর্বংশঃ প্রবিবেশ নৃপোত্তম।(২৬)

দুষ্যন্তের জন্মকাহিনী যতই রহস্যাবৃত হোক, পুরু রাজার পরে তিনিই যে একমাত্র গৌরবময় পুরুষ ছিলেন এবং পুরুবংশের দশ-এগারো জন অখ্যাত পুরুষের পরে একমাত্র দুষ্যন্তই যে সে বংশের আশা-ভরসা ছিলেন সেটা বোঝা যায় মহাভারতের একটি শব্দেই। মহাভারত বলেছে যে, দুষ্যন্ত ছিলেন পৌরবদের শিবরাত্রির সলতে-পৌরবাণাং বংশকরো দুষ্যন্তো নাম বীর্যবান্।(২৭) ক্ষমতায় বুলবুদ্ধিতে এবং রাজনীতিতে দুষ্যন্তের একান্ত পারদর্শিতাতেই মান্ধাতা-সগরের দ্বারা উৎখাত পিতৃভূমি আবার দুষ্যতের হাতে আসে। ঐতিহাসিক পারজিটার মন্তব্য করেছেন–The Pawrava claimant then was Dusyanta, for the Pawrava realm had been overthrown since Mandhatri’s time, and Dusyanta had been adopted as heir by Marutta of Turvasu’s line, but after Sagara’s death he re-established the Pawrava dynasty. মজা হল দুষ্যন্ত অনেককাল বাইরে বাইরে ছিলেন বলেই তোক কিংবা পুরুবংশের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলেই হোক, প্রতিষ্ঠানে বোধহয় আর দুষ্যন্তের রাজধানী ছিল না, যদিও তিনি উত্তর ভারতের বিশাল ভূখণ্ড আপন সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন।

যে দুষ্যন্তের নিজের পিতৃ-পরিচয় কি, তার ঠিকানা নেই, সেই দুষ্যন্ত কিন্তু কমুনির আশ্রমে মোহময়ী শকুন্তলাকে দেখে তাঁর জাত বিচার করতে লাগলেন। এদিকে শকুন্তলাকে দেখে তিনি প্রেমে পড়ে গেছেন, ওদিকে ভাবছেন মুনির এমন রূপবতী কন্যা জন্মাল কি করে? দুষ্যন্ত একসময় প্রশ্নই করে বসলেন শকুন্তলাকে–হ্যাঁগো কন্যে এমন সুন্দর চেহারা তোমার, এমন গুণের মেয়ে তুমি, তোমার পিতৃপরিচয় কি-এবং রূপগুলোপেতা কুত ত্বমসি শোভনে? প্রথম পরিচয়ে শকুন্তলা বললেন-আমি মহর্ষি কথের মেয়ে। কিন্তু দুষ্যন্ত সেকথা বিশ্বাস করবেন কেন! তিনি উল্টে বললেন–মহর্ষি কথ উর্ধরেতা পুরুষ, ব্রহ্মচারী! তাঁর আবার মেয়ে হবে কি করে? শকুন্তলা এবার সত্য পরিচয় দিয়ে বললেন–মহর্ষি মহাতেজা বিশ্বামিত্র একমসয় গভীর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। দেবরাজ তাঁর তপস্যায় উদ্বিগ্ন হলেন, ইন্দ্ৰত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি শেষে স্বৰ্গবেশ্যা মেনকাকে ধরলেন। ইন্দ্র বললেন–তুমি তোমার রূপ, যৌবন, মাধুর্য, হাসি, কটাক্ষ–যা দিয়ে পার বিশ্বামিত্রকে ভোলাও। তাঁর তপস্যা ভেঙে যাক তোমার উন্মাদক রূপ দেখে। মেনকা বললেন–সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ওই রাগী মুনি, তেমনি কড়া তাঁর স্বভাব। নিজে ক্ষত্রিয় থেকে বামুন হয়েছেন, আর শত কীর্তি স্থাপন করেছেন নিজের তপোবলে। তাঁর সামনে গিয়ে ছলাকলা দেখালে আমি মরব না? তুমি আমায় বাঁচানোর ব্যবস্থা কর, আমি যাচ্ছি। সহায় হোন আমার বায়ু দেবতা, সহায় হোন ভালবাসার দেবতা মন্মথ, আমি যাচ্ছি।

তাই ঠিক হল। মেনকা গিয়ে বিশ্বামিত্রকে সামান্য সম্ভাষণ করেই তাঁর সামনে নানা কায়দা করতে থাকলেন। এমন সময় বায়ু দেবতা জোরাল হাওয়ায় মেনকার পরনের কাপড় একেবারে উড়িয়ে নিয়ে গেলেন। এই সব স্বৰ্গবেশ্যা অপ্সরাদের কাপড় দেহের সঙ্গে কিভাবে সংলগ্ন থাকে জানি না, তবে মেনকার কাপড় একেবারে উড়েই গেল। উড়ন্ত কাপড়খানি ধরতে গিয়েই যেন মেনকা মাটিতে পড়ে গেলেন এবং তপ-উপবাস ক্লিষ্ট মুনির সামনে একেবারে বিবৃতা হয়ে পড়লেন। বেশ্যাদের বোধহয় মুখ দেখে বয়স বোঝা যায় না, কারণ বসনের অন্তরালে মেনকার্কে দেখে বিশ্বামিত্র হয়তো তার রূপ-যৌবন বুঝতে পারছিলেন না; এবারে পারলেন–অনির্দেশ্যবহোরূপাম অপশদ বিবৃতাং তদা। আর কি, বিশ্বামিত্র মোহিত হলেন, মেনকাও তাই চাইছিলেন। দুজনে পরস্পর রতিতে আসক্ত হলেন। অনেক কাল রসেরমণে কেটে গেল, তবু বিশ্বামিত্রের মনে হল যেন এই একদিন হয়েছে-যথৈক দিবসং তথা। মেনকার গর্ভে শকুন্তলার জন্ম হল। মালিনী নদীর তীরে বিজন বনে মেনকা গর্ভ মুক্ত করে স্বর্গের দিকে রওনা দিলেন। আত্মজা কন্যার ওপর মেনকারও মায়া নেই, আর মেনকার গতভৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বামিত্রেরও বোধ হয় মায়া-মোহের মুক্তি ঘটেছিল। শ্বাপদসংকুল বনে পাখিরা অসীম মমতায় যখন শকুন্তলাকে ঘিরে রয়েছে, সেই সময় আহ্নিক করতে গিয়ে শকুন্তলাকে পেলেন কম্ব। সেই থেকে তিনি কম্বের মেয়ে বলেই পরিচিত।

এই সম্পূর্ণ কাহিনী নিজের মুখে নির্দ্বিধায় জানালেন মহাভারতের শকুন্তলা। দ্বিধা হবার কথাও নয়। মা স্বৰ্গবেশ্যা বলে সেকালে কারও লজ্জা হত না। উর্বশী, মেনকা, রম্ভা অনেক অনেক বড় মানুষের মা, তাতে তাঁরা সমাজে কেউ অপাত্র ছিলেন না। তবে এই স্বর্গবেশ্যাদের সম্বন্ধে আমাদের একটা কল্পনা আছে। পাঠক সেটা মানবেন কিনা জানি না। এই যে বনবাসের সময় উর্বশীকে পূর্বপুরুষের স্ত্রী বলে অর্জুন তাঁর ভালবাসা প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বৃহন্নলা হবার অভিশাপ পেলেন–এই ঘটনাটা কি ভেবে দেখেছেন? উর্বশী ছিলেন অর্জুনের বহু পূর্বপুরুষ পুরুরবার স্ত্রীকল্পা, বিশ পঁচিশ পুরুষ পরে সেই উর্বশী কি উর্বশীই আছেন বলে আপনারা মনে করেন? আমাদের ধারণা–লৌকিক পৃথিবীতে যেমন চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত নায়ক-নায়িকাদের নামে ছেলে-মেয়েদের নামকরণ করেন বাবা-মা, যেমন বয়স্ক লোকেরাও অনেক সময় সমতুল্য কাজ করে বিখ্যাত মানুষের নামে চিহ্নিত হন তেমনি রূপ-মর্যাদা সম্পন্ন স্বৰ্গবেশ্যারাও পূর্বখ্যাতা উর্বশী, মেনকা, রম্ভার উপাধি লাভ করতেন। আর পুরাকালে যেখানে এই মর্ত্যজগতের গণিকারাই রূপে-গুণে-বৈদগ্ধ্যে সমাজের শ্রেষ্ঠা মহিলা বলেগণ্য হতেন, সেখানে স্বৰ্গবেশ্যারা তো আরও অনেক গুণে সরেস। সুযোগ পেলে মুনি, ঋষি, দেবতা, মানুষকেউই তাঁদের সঙ্গসুখ কিংবা স্বর্গসুখ থেকে বঞ্চিত হতে চাইতেন না। তবে অর্জুন উর্বশীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষের বধুকার সমাসনে আসীনা সমান পদমর্যাদার মহিলা বলে। এই মর্যাদাবোধ, সুরুচি অর্জুনের ছিল, যার জন্য স্বয়ং রতি-চিকা উর্বশীকে তিনি বলেছিলেন–আমি যে মেনকা, রম্ভা-সবার মধ্যে তোমার দিকে বেশি করে তাকিয়েছিলাম, তার কারণ আমার মন চলে গিয়েছিল সেই সুদূর অতীতে, মনে হয়েছিল, এই উর্বশীই তো প্রসিদ্ধ পৌরব বংশের জননী-ইয়ং পৌরববংশস্য জননী মুদিতেতি হ।(২৮)

অর্জুনের এই কথার প্রতিক্রিয়া হিসাবে স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীর কিন্তু একবারও পুরুরবার কথা মনে পড়েনি। বরঞ্চ উল্টে উর্বশী বলেছিলেন, আমরা বাপু সবার কাছেই মুক্ত। পুরুবংশের ছেলে, নাতি-এখানে এলে সব সমান–পূরোর্বংশে হি যে পুত্র নপ্তাররা বা ত্বিহাগতাঃ।(২৯) কিন্তু মহাভারতের উদাত্ত নায়ক উর্বশীর আসনে বসা উর্বশীকে মাতৃস্থানেই রেখেছিলেন, সম্মান দিয়েছিলেন পুরুবংশের জননী বলে। দুঃখ লাগে অর্জুন মেনকার কথাটা বলেননি বলে। অবশ্য মেনকা তাঁর কাছে রতি-প্রার্থনাও জানাননি। কিন্তু এই মেনকাও তত অর্জুনের ভাবধারায় প্রসিদ্ধ ভারতবংশের জননী। যাই হোক–সেই পুরুরবার আমলে পৌরববংশে যে স্বৰ্গবেশ্যার রক্ত মিশেছিল, সেই রক্ত বিশুদ্ধ হতে না হতেই আবার মেনকার রক্ত মিশল। দুষ্যন্ত যখন রাগের মাথায় নিজের বিবাহিতা পত্নী শকুন্তলাকে চিনেও চিনতে না পেরে গালাগালি দিয়েছিলেন, তখন স্পষ্টই শকুন্তলাকে বলেছিলেন–তোর মা মেনকা হল বেশ্যা-মেনকা নিরনুক্রোশা বন্ধকী জননী তব–তার মেয়ে বলে তোর কথাগুলোও ঠিক বেশ্যার মত–পুংলীব প্রভাষসে।(৩০) বোঝা যাচ্ছে–সময়ান্তরে স্বৰ্গবেশ্যাও বেশ্যার অসম্মানই পেয়েছেন এবং পৌরবজননী উর্বশীর সমগোত্রীয়া বলে আলাদা কোন সম্মান তো দূরের কথা, অনুপস্থিত অবস্থায় শুধুই তিরস্কার পেলেন মেনকা।

তবে মহাভারতের শকুন্তলাও কালিদাসের শকুন্তলার মত আধেক কথায় শরম-জড়িতা হবার পাত্রী নন। তিনি দুষ্যন্তকে এমন গালাগালি দিতে থাকলেন, যা আমাদের সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোকদের বিব্রত করবে। অনেকক্ষণ এটা-ওটা বলার পর শকুন্তলা ছেলেকে দেখিয়ে (পাঠক! মহাভারতের শকুন্তলা ছেলে সর্বদমনকে বেশ বড়সড় করেই নিয়ে এসেছিলেন) বললেন–রাজা! সত্য ত্যাগ কর না। এত কথার পরেও যদি তোমার মন মিথ্যের দিকেই পড়ে থাকে, তাহলে আমি নিজেই চলে যাচ্ছি এখান থেকে। তোমার মত মানুষের সঙ্গে আমি কোন সম্বন্ধই রাখতে চাই না–তাদৃশে নাস্তি সঙ্গত। এবারে নাম ধরে ডেকে শকুন্তলা বলেন-”দুষ্যন্ত! অত রাজ্যপাটের গুমোর কোর না। কপালে থাকলে তুমি ছাড়াও আমার এই ছেলে এই বিরাট পৃথিবী রাজ্য হিসেবে লাভ করবে। গমনোম্মুখী শকুন্তলা এতই ক্রোধান্বিতা ছিলেন যে, সেই মুহূর্তেই দৈববাণী নেমে এল-ভরস্থ পুত্ৰং দুষ্যন্ত-দুষ্যন্ত! তুমি ছেলেকে প্রতিপালন কর। শকুন্তলাকে অপমান কোর না। শকুন্তলা ঠিক বলেছে, তুমিই তার গর্ভাধান করেছ এবং এই ছেলে তোমারই। আমাদের কথায় যেহেতু এর ভরণ-পোষণ করা উচিত, তাই এই ছেলের নাম হোক ভরত-ভরতো নাম তে সুতঃ।

ভরতের জন্ম সম্বন্ধে এই দৈববাণী মহাভারত থেকে আরম্ভ করে সমস্ত প্রাচীন পুরাণে আছে। দৈববাণী শুনে রাজা দুষ্যন্তে বললেন–আমি নিজেও জানতাম যে, এটি আমারই ছেলে। কিন্তু সভাস্থলে শকুন্তলার কথামাত্র এই ছেলেকে ছেলে বলে মেনে নিলে, সাধারণের নানা আশঙ্কা হত। তারা ভাবত-রাজা আমাদের চোখের আড়ালে ছিল, কে না কে এই চরিত্রহীন মেয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, এবং ছেলেটাও হয়তো বা জারজ। তাই তোমাকে এই সর্ব লোকসমক্ষে শুদ্ধ করে নেবার জন্যই তোমার সঙ্গে এমন বিরূপ ব্যবহার করেছি। রাজা প্রচুর ক্ষমা-টমা চেয়ে নিলেন শকুন্তলার কাছে, প্রচুর খাওয়া-দাওয়া, গয়নাগাটি এবং কাপড়চোপড়ের ব্যবস্থা করলেন শকুন্তলার জন্য। তুর্ববংশে পালিত পৌরব রাজা দুষ্যন্তর সঙ্গে কন্বমুনির পালিতা কন্যা শকুন্তলার সম্বন্ধ পুনরুজ্জীবিত হল। সব থেকে বড় কথা–আগন্তুক ছেলেটিকে রাজা সঙ্গে সঙ্গে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। ভরতের রথচক্রের ধ্বনি সেকালের ভারতবর্ষের চতুর্দিকেই শোনা গেছে। মহাভারতকার মন্তব্য করেছেন যে, ভরত ছিলেন চক্রবর্তী রাজা, সার্বভৌম রাজা। তিনি এতটাই কীর্তিমান ছিলেন যে, তাঁর নামেই আজ পর্যন্ত এই বিশাল ভূখণ্ডের নাম ভারতবর্ষ-ভরতাদ ভারতী কীর্তি যেনেদং ভারতং কুলম–তাঁর নামেই প্রসিদ্ধ ভরত বংশ।(৩১)

ভরতের সময়েই যে আর্যগোষ্ঠীর মূল পুরুষেরা উত্তর ভারতের বিশাল ভূখণ্ড অধিকার করে নিয়েছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মহাভারত লিখেছে–একটা রাজসূয় যজ্ঞ করতেই লোকের প্রাণ বেরিয়ে যায়, ভারত সেখানে কতগুলি রাজসূয় সম্পন্ন করেছিলেন এবং সেগুলো করেছিলেন কোথায়? সবচেয়ে বড় যজ্ঞটা করেছিলেন যমুনার তীরে, দ্বিতীয়টা সরস্বতীর তীরে এবং তৃতীয়টা গঙ্গার তীরে। এই তথ্য থেকে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে সরস্বতী নদী থেকে আরম্ভ করে একেবারে গঙ্গা পর্যন্ত ছিল মহারাজ ভরতের রাজত্ব। পণ্ডিতদের মধ্যে যাঁরা আরও স্পষ্টবাদী, তাঁরা বলেন যে, পঞ্জাবের যে অঞ্চলে মোটামুটি আর্যদের বসতি তৈরি হয়েছিল, ভরতের আমলে তা বেড়ে একেবারে গঙ্গার পার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে ভরতের আমলেও কিন্তু সেই প্রসিদ্ধ হস্তিনাপুর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভরতের আরও পাঁচ পুরুষ পরে এবং যাঁর নাম এই রাজধানী প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত তাঁর নামটিই ছিল হস্তী। এই নাম থেকেই হস্তিনাপুর-হস্তী, য ইদং হস্তিনপুরং স্থাপয়ামাস।(৩২) এতদস্য হাস্তিনপুরত্ব। হস্তীর কথা পরে আসবে, আগে আমরা মহারাজ ভরতের কথাটা শেষ করে নিই।

এই বিরাট ভারত ভূখণ্ডের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ ভরত শুধু রাজ্যাধিকার নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন না, রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রজার কাছে তাঁর সততা আজও দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হয়। শোনা যায় দূরদর্শনে যে মহাভারত হয়ে গেল, তার প্রথম দিকে বংশগতভাবে রাজশক্তি পরিচালনার বিরুদ্ধে বেশ একখানি ছোটখাট বক্তৃতা সাজানো হয় ভরতের মুখে। কারণ পুত্র হলেও, অযোগ্য ব্যক্তি রাজা হয়ে রাজ্যশাসন করবেন, এই নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন ভরত। আমরা খুব বিশ্বস্ত মহল থেকে জেনেছি যে, দূরদর্শনে মহাভারত আরম্ভ হওয়ার সময় মন্ত্রী-পর্যায়ের একটি বোর্ড নাকি ভরতের মুখ থেকে এই জোরালো বক্তৃতাটি ছেটে দেয়। নিন্দুকেরা সন্দেহ করে যে, মহাভারত আরম্ভ হওয়ার সময় ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক ধারাই নাকি এই বক্তৃতাটি ঘেঁটে দেবার মূলে। গণতন্ত্রের রাজত্বে তথাকথিত জনগণের দ্বারা গঠিত প্রধানমন্ত্রীর খুশি-অখুশি নিয়ে যেখানে অন্য মন্ত্রীরা এত চিন্তা করেন, সেখানে সেইকালের দিনে রাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়েও ভরত তো তাহলে বিপ্লব করে ফেলেছিলেন বলে মনে হতে পারে।

মহাভারত যে খবর দিয়েছে, তাতে সামান্য ভুল আছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। মহাভারত একবার বলেছে–ভরত নাকি কাশীর রাজা সর্বসেনের মেয়ে সুনন্দাকে বিয়ে করেন এবং তাঁরই গর্ভে ভূমনুর জন্ম দেন। কিন্তু মহাভারতেরই অন্য এক বিবরণ অনুযায়ী ভরতের তিনটি স্ত্রী এবং তাঁদের গর্ভে তিন তিনটি করে নটি ছেলের জন্ম দেন ভরত। ছেলেরা বড় হলে তাদের মতিগতি দেখে ভরত সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ছেলেরা কেউই মানুষের মত মানুষ হয়নি এবং কেউই তাঁর মত নয়নাভ্যনন্দত তান্ রাজা নানুরূপা মমতুত। ছেলের মায়েরা ভরতের ভাব দেখে ছেলেদের মেরেই ফেললেন। রাজার পুত্ৰজন্ম বিফল হয়ে গেল। পুত্রকামনায় রাজা অনেক যজ্ঞ করে শেষে মহর্ষি ভরদ্বাজের কাছ থেকে ভূম বলে একটি পুত্রলাভ করলেন-লেভে পুত্ৰং ভরদ্বাজা ভূমনুং নাম ভারত।

মহাভারতের ভাব থেকে মনে হতে পারে যেন • ভরদ্বাজের ঔরসে নিয়োগপ্রথায় পুত্র পেলেন রাজা। ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। বিশেষত প্রাচীন পুরাণগুলি যেহেতু পুরাতন রাজবংশের কথা, কীর্তি এবং কাহিনী অনেকটাই রক্ষা করেছিল, তাই পুরাণগুলির তথ্য আমাদের খানিকটা মানতেই হবে। হ্যাঁ, এ কথাটা ঠিক যে, মহারাজ ভরত তাঁর জীবৎকালেই রাজ্যের সমৃদ্ধি এবং রাজ্য শাসনের যশ এতটাই লাভ করেছিলেন যে, আদর্শ রাজধর্মের ন্যায়-নীতি অনুযায়ী নিজের ছেলেদেরই তিনি রাজ্য শাসনের উপযুক্ত মনে করেননি। মায়েরা অকালকুষ্মাণ্ড ছেলেগুলিকে মেরে ফেলেছিলেন, এ খবরটা বাড়াবাড়ি হয়তো, কিন্তু রাজপুত্র হওয়া সত্ত্বেও যে ছেলেরা আপন পিতার কাছেই রাজ্য পাবার অনুপযুক্ত বিবেচিত হয়, সেই ছেলেরা যে বীরপ্রসবা মায়েদের কাছে মৃত বলেই গণ্য হয়, সেটা বোঝনোর জন্যই বুঝি এই মৃত্যু ঘটানোর কথা বলা হয়েছে। যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, মহারাজ ভরত বংশ-রাজত্বে বিশ্বাস করতেন না। উপযুক্ত রাজ্য শাসকের জন্য তিনি খোঁজভাঁজ আরম্ভ করলেন। মহাভারতে এবং পুরাণগুলিতে এই সংকটমুহূর্তে পুত্রকামনায় ভরতের যজ্ঞকল্পনার কথা আছে, কিন্তু আমরা বুঝি ভরত একটি উপযুক্ত ছেলে খুঁজছিলেন, যাকে তিনি পুত্ৰত্বে বরণ করবেন এবং রাজ্য দিয়ে যাবেন। যদি যজ্ঞকথায় বিশ্বাস করি, তাহলে দেখা যাবে যে, ভরতের পুত্রজন্ম বিফল হওয়ার পর তাঁর যজ্ঞকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে মরুদগণ মহর্ষি বৃহস্পতির ছেলে মহর্ষি ভরদ্বাজকে ভরতের পুত্ৰত্বে স্থাপন করেন। ছেলে পেয়ে ভরত খুব খুশি হলেন। বাস্তবে পুত্রজন্ম বিফল হওয়া সত্ত্বেও পুত্রলাভ করলেন বলে সে পুত্রের নাম হল ‘বিতথ’ অর্থাৎ বিতথ ভরদ্বাজ; বিথ মানে বিফল। মহর্ষি ভরদ্বাজ জন্মলগ্নে ব্রাহ্মণ ছিলেন, ভরতের কাছে দত্তক হিসেবে তিনি ক্ষত্রিয় হয়ে গেলেন-ব্রাহ্মণ্যাৎ ক্ষত্রিয়ো’ ভবৎ, তিনি দ্বিপিতৃক অর্থাৎ দুজনকে তাঁর বাবা বলে ডাকার কথা–একজন তাঁর জন্মদাতা বৃহস্পতি, আরেকজন তাঁর পালক পিতা ভরত। এ খবর বায়ু পুরাণের।

কিন্তু কথা হল, যে পুত্রটিকে ভরত দত্তক হিসেবে পেলেন সেই ভরদ্বাজের নামই ‘বিতথ’, নাকি তাঁর ছেলের নাম ‘বিতথ’? তারও ওপরে আরেক চিন্তা হল-মহর্ষি ভরদ্বাজ নিজেই প্রসিদ্ধ ভরত বংশে রাজা হয়ে বসলেন, নাকি তাঁর ছেলে রাজা হলেন? এ সব প্রশ্ন এবং বিভিন্ন পুরাণের লিপি প্রমাদে পণ্ডিতদের মাথা ঘুরে গেছে। মৎস্য পুরাণ লিখেছে–তারপর বিথ নামে ভরদ্বাজ রাজা হলেন’ ততন্ত্র বিতথা নাম ভরদ্বাজো নৃপো’ ভবৎ। কিন্তু তার দু লাইন পরেই আছে “বিতথ জন্মালে পরে মহারাজ ভরত স্বৰ্গত হলেন এবং পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে মহর্ষি ভরদ্বাজও স্বৰ্গস্থ হলেন।” বায়ু পুরাণের তথ্য এবং ভাষাও প্রায় একই রকম। কিন্তু ফাঁক একটা থেকেই যাচ্ছে। এই ফাঁকটা পরিষ্কার করে দিয়েছে হরিবংশ এবং অন্য পুরাণের লিপি প্রমাদও তাতে দূর হয়ে গেছে। ওই যে একটু আগে মৎস্য পুরাণের ভাষায় বলেছি–তারপর বিথ নামে ভরদ্বাজ রাজা হলেন–তা মোটেই নয়। আসলে হবে-তারপর বিথ নামে ভরদ্বাজের ছেলে হল–ভরদ্বাজসুতো ভবৎ। অথবা যদি মৎস্য পুরাণের কথাটাই রাখি তাহলে হবে বিতথ নামে ভরদ্বাজ বংশের রাজা হলেন–ভারদ্বাজা নৃপো’ ভবৎ। এরপর হরিবংশ দেখলেই বোঝা যাবে–ছেলে বিথকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করে মহিষ ভরদ্বাজ বনের পথে পা বাড়ালেন। এইটাই স্বাভাবিক। ভরতও মারা গেলেন, ভরদ্বাজও মারা গেলেন, নাটক এত তাড়াতাড়ি শেষ হলে চলে? সোজা কথায় সিদ্ধান্ত হল মহর্ষি ভরদ্বাজের ব্রাহ্মণ বংশ পৌরব-ভরতের কুলে সংক্রামিত হল আর পণ্ডিতেরা তখন পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির থেকে আরম্ভ করে অনেকেরই ব্রাহ্মণ্য ব্যবহারের তাৎপর্য খুঁজে পেলেন

The fact that Bharat’s successors in the Pawrava line were really of brahmanic origin is of the highest importance, and helps to elucidate many peculiar features in their history.

পণ্ডিতেরা যেটাকে ‘brahmanic origin’ ভেবে পুলকিত হচ্ছেন সেটাকে কিন্তু আমরা জারজের ‘অরিজিন’ও বলতে পারি। কারণ এই যে ভরদ্বাজ ভরতের পুত্রত্বে কল্পিত হলেন, ইনি কিন্তু পরিষ্কার জারজ সন্তান। পুরাণগুলি সে কথা লুকায়নি একটুও। দেবতা মরুগণ ভরদ্বাজকে যেখানে ভারতের বংশে অনুপ্রবিষ্ট করেছেন, তার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু আগে পরে বায়ু এবং মৎস্য পুরাণ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, পরে ঋষি হোন আর যাই হোন এই ভরদ্বাজ কিন্তু মহর্ষি বৃহস্পতির জারজ সন্তান। কথাটা এইরকম–সেকালে উশিজ বলে এক ঋষি ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম মমতা। বায়ু পুরাণের মতে মমতার স্বামী উশিজ মারা গিয়েছিলেন। অন্যমতে তিনি অন্যত্র বেড়াতে গিয়েছিলেন। উশিজের ভাই হলেন বৃহস্পতি। উশিজ মারাই যান আর বেড়াতেই যান, তাঁর স্ত্রী ছিলেন আসন্নগর্ভা। গর্ভবতী রমণীর সৌন্দর্যবাহুল্যে মোনালিসা প্রমাণ কিনা জানি না, বৃহস্পতি বৌদিদির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বললেন–তুমি এক্ষুনি দারুণ করে সেজে গয়নাগাটি পরে আমার সামনে এস তো দেখি আমি তোমার সঙ্গে মিলিত হব-অলংকৃত্য তনুং স্বাং তু মৈথুনং দেহি মে শুভে। দেবগুরুর কথা শুনে মমতা-বৌদি বললেন-ও আবার কি কথা! আমার পেটে তোমার দাদার ছেলে রয়েছে-অন্তর্বত্নী অস্মি তে ভ্রাতুঃ–তার ওপরে পেট যে একেবারে ভরা পেট-মহাগতভা নোচতে’তি বৃহম্পতে। আর এ পেটের ছেলেও তো আর যেমন–সেমন নয়, পেটের মধ্যেই সে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করছে। আর এখন তুমি এই সব করতে চাইছ, এ কি ধম্মে সইবে–ধর্মশ্চৈব বিগর্হিতঃ। মমতা এবার অনুনয়ের সুরে বললেন–বৃহস্পতি! আমি গর্ভবতী, আর তুমি যা চাইছ তাও নিষ্ফল হবার নয় কারণ তুমি অমোঘবীর্য, অতএব এখন তুমি আমার সঙ্গে এসব করতে পার নাম মাং ভজিতুমহসি। তুমি বরং আমার এই সময়টা পার হয়ে যেতে দাও, তারপর তুমি যা চাও তাই হবে–অস্মিন্নেব গতে কালে যথা বা মনসে বিভো।

মমতার এত অনুনয়ের কথা শুনেও দেবগুরু বৃহস্পতি নিজেকে দমিত রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন-দেখ বৌদি তুমি আমাকে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা কর না-বিনয়ো নোপদেষ্টব্যঃ ত্বয়া মম কথঞ্চন। এই বলেই বৃহস্পতি জোর করে মমতাকে জাপটে ধরে মৈথুনের উপক্রম করলেন-ধমানঃ প্রসহৈনাং মৈথুনায়োপচক্রমে। এবারে মমতার গর্ভস্থ শিশু বলাৎকারে উদ্যত বৃহস্পতিকে বাধা দিয়ে বলল-খুড়োমশাই! আমি পূর্বাহেই এই গর্ভে জায়গা করে নিয়েছি, এদিকে আপনার এই উপক্রমও ব্যর্থ হবার নয়, কিন্তু এই গর্ভে তো দুজনের স্থান সংকুলান হবে নানাবকাশ ইহ দ্বয়োঃ। গর্ভস্থ ছেলের ছোট মুখে বড় কথা শুনে বৃহস্পতি অত্যন্ত খেপে গেলেন। তাঁর উন্মাদনার চরম মুহূর্ত সমুচিতভাবে সার্থক না হওয়ায় বৃহস্পতি অভিশাপ দিলেন–সমস্ত জীবের সুখাবহ চরম এই মুহূর্তে তুই যখন আমাকে বাধা দিলি, তাই তুই অন্ধকার নিয়েই জবি অর্থাৎ অন্ধ হবি। আমাদের ধারণা বৃহস্পতির ধর্ষণের ফলেই মমতার অন্ধপুত্র জন্মাল এবং তাঁর নাম হল দীর্ঘতমা। কিন্তু ওদিকে কি হল? বৃহস্পতি মমতাকে ছাড়লেন বটে কিন্তু তাঁর আনন্দজনিত তেজ পতিত হল ভূমিতে এবং তার থেকে জন্মাল এক শিশু। মমতার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে ধর্ষণ করার ফলে বৃহস্পতির পরাবৃত্ত তেজ থেকে শিশুটি জন্মাল বলে মমতার কোন মমতা হল না শিশুটির প্রতি। উল্টে তিনি রেগে বৃহস্পতিকে বললেন–এই জারজ ছেলেকে তুমিই মানুষ কর-ভর দ্বাজ–আমি বাড়ি চললাম–ভর দ্বাজং বৃহস্পতে।(৩৩) ‘দ্বাজ’ মানে জারজ। জারজটাকে মানুষ কর-মমতা স্পষ্টই সেকথা উচ্চারণ করে বললেন। মমতা চলে গেলেন ধর্ষণে অপমানিত হয়ে। অন্যদিকে বাধা বিপত্তিতে ঠিক রতিসুখ যাকে বলে তা যেহেতু বৃহস্পতির অনুভবে আসেনি, অতএব তিনিও রেগে ছেলে ছেড়ে চলে গেলেন আরেক দিকে। মাতৃপিতৃহীন জারজ ভরদ্বাজ অকারণ অবহেলায় উন্মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন, একা।

ঠিক এই সময়েই বুঝি মহারাজ ভরতের যজ্ঞাদি ক্রিয়া চলছিল। দেবতা প্রীত হয়ে মাতৃপিতৃহীন ভরদ্বাজকে এনে দিলেন ভরতের হাতে। দেবতার দান, সে জারজ কি ঔরস, তা দেখবার দরকার হল না, কারণ তার প্রধান পরিচয়–দেবগুরু বৃহস্পতির ব্রাহ্মণ পুত্র মহারাজ ভরতের কাছে দত্তক দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুসারে তিনি এখন ক্ষত্রিয়, পুরাণকার অবশ্য ভরদ্বাজকে বলেছেন-দো-আঁশলা-দ্ব্যামুয্যায়ন, কারণ তাঁর বংশের ছেলেরা ক্ষত্রিয়ও বটে, ব্রাহ্মণও বটে-ক্ষত্রিয়গুলি ভরতের বংশে আর ব্রাহ্মণগুলি বুঝি ভরদ্বাজের বনগমনের পর, বনে বনেই।(৩৪) যাই হোক ভরতের বংশে ভরদ্বাজ মুনি একটি পুত্রের জন্ম দিয়েই তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন, যার নাম আমরা আগে বলেছি, বিতথ। এই বিতথের ছেলে হলেন ভূমন্ত যাকে মহাভারতকার একবার সরাসরি ভরতের ছেলে বানিয়েছেন, দ্বিতীয়বার ভরদ্বাজের ছেলে বানিয়ে দিয়েছেন। এই ভূমনুর নাতিই হলেন হস্তী, তিনি হস্তিনাপুর প্রতিষ্ঠা করেন।

হস্তিনাপুরের প্রতিষ্ঠা মানেই কিন্তু আমরা ভারত যুদ্ধের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি। হস্তিনাপুরের প্রতিষ্ঠা মানেই কিন্তু বুঝতে হবে যে, আর্যদের মূল প্রস্থান পঞ্জাব অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে উত্তর ভারতের অনেক দূর পর্যন্ত অর্থাৎ একেবারে গঙ্গার পশ্চিম পর্যন্ত পাকাপাকিভাবে চলে এসেছেন। পাকাপাকিভাবে এইজন্য যে, রাজা হিসেবে অন্যের ভূখণ্ড দখল করে ভোগ করা এবং শাসন করার চেয়ে, নিজের নামে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা অনেক বড় কৃতিত্ব। হস্তী তাই করেছেন। কিন্তু পৌরব-ভরত বংশের আরও বাড়বাড়ন্ত দেখার আগে আমাদের উত্তর ভারত ছাড়াও ভারতবর্ষের চার দিকটাও একটু নজরে রাখতে হবে, না হলে রাজনীতির খেলাটা পরিষ্কার বোঝা যাবে না। মনে রাখতে হবে সরস্বতী-দৃষদ্বতীর জল-ধোয়া মূল আর্যাবর্তের পরিধি এখন গঙ্গা-যমুনা ছাড়িয়ে আধুনিক মিরাট পর্যন্ত চলে এসেছে, কারণ বেশির ভাগ পণ্ডিতেরাই হস্তিনাপুর অঞ্চলকে মিরাটের কাছাকাছি একটি জায়গার সঙ্গে এক করে ফেলেছেন। এখন আমাদের দেখতে হবে, অন্য জায়গাগুলোতে কি হচ্ছে?

.

০৩.

পৌরব বংশেরই জ্যাঠতুতো যদুবংশ যে মথুরা, ভরতপুর থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণে টিকমাগড় পর্যন্ত তাঁদের রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সে কথা আমরা আগে বলেছি। আমরা বংশপরম্পরার কূটকচালিতে মন দেব না। শুধু বলব–যাদবদের মধ্যে প্রথম বড় রাজা ছিলেন শশবিন্দু, যিনি চক্রবর্তী রাজা ছিলেন বলে পৌরাণিকেরা মনে করেন। বস্তুত তিনি বোধ হয় ইক্ষাকুবংশীয় মান্ধাতার সঙ্গে একযোগে পৌরবদের রাজ্যখণ্ড অনেকটাই অধিকার করে নিয়েছিলেন। কারণ মান্ধাতার স্ত্রী ছিলেন ওই যাদব শশবিন্দুর মেয়ে। এরা দুজনেই পৌরববংশের শ্রীহীনতার কারণ হতে পারেন। পৌরববংশে দুষ্যন্ত পর্যন্ত কোন উল্লেখযোগ্য রাজা না থাকাটাই তার প্রমাণ এবং দুষ্যন্তের পূর্ববর্তী পৌরব রাজাদের রাজ্যপাট শশবিন্দুর দাপটে বিনষ্ট হয়েছিল বলেই হয়তো দুষ্যন্ত তুৰ্ববংশের মরু রাজার কাছে মানুষ হয়েছিলেন–এমনটাও হতে পারে। এ সবই অবশ্য নানা তথ্যের ওপর নির্ভর করে পণ্ডিতেরা অনুমান করেছেন মাত্র। অপরদিকে সম্রাট শশবিন্দুকে যদুবংশের একমাত্র বিরাট পুরুষ বলে মনে করাটাও ভুল হবে। কারণ যদুবংশের শাখা-প্রশাখা বিভিন্ন বংশে ছড়িয়ে গিয়েছিল। পৌরববংশের মূল ধারাটি আমরা যদি বা কোনক্রমে চিহ্নিত করতে পারি, যদুবংশে সেটা সম্ভবই নয়। এদের শাখা-প্রশাখা এত বেশি যে, কয়েক পুরুষ পরেই এদের নিজেদের মধ্যে বিয়ে-সাদিও হয়েছে। স্বয়ং পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণই এ ব্যাপারে আমাদের বড় প্রমাণ। তাঁর দুই পাটরানী রুক্মিণী এবং সত্যভামা এক অর্থে পরিষ্কারভাবে সম্পর্কে তাঁর বোন। যাই হোক, এ সব পরের কথা পরে হবে, আগে বোঝা দরকার যে, কেমন করে যাদবদের ধারায় এক একটি বংশ এক এক জায়গায় রাজত্ব গেড়ে বসেছিল।

আমরা যে শশবিন্দুর কথা বলেছি, ইনি যদুবংশের একটি বিশেষ ধারায় বিখ্যাত পুরুষ মাত্র। এই রকমভাবে যদুবংশের এক রাজা বিন্ধ্যপর্বতের পশ্চিম-পুর্বে নর্মদার অর্ধেক তীরভূমি অধিকার করে নেন, যার নাম মাহিষ্মতী। এই হৈহয় বংশের ধারাতেই জন্মেছিলেন কার্তবীর্যাজুনের মত পুরুষ যিনি লঙ্কেশ্বর রাবণের যুবক বয়সের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। রাবণ এর কাছে যুদ্ধে হেরে যান। এই বংশেই জন্মেছিলেন তালজ, যাঁর পূর্ববংশ হলেন হৈহয় পুরুষেরা। হৈহয়েরা কাশী থেকে আরম্ভ করে উত্তর ভারতের অনেক অংশই দখল করেছিল, যদিও এসব বিজয় কাহিনী পুরুবংশীয় দুষ্যস্তের পূর্ববর্তী। মোটামুটি দক্ষিণ মালবের বিস্তৃত ভূমিতেই কিন্তু ছিল হৈহয়দের প্রতিষ্ঠা। এইখান থেকেই তারা কাশী এবং উত্তর ভারতের নানা জায়গা দখলে আনবার চেষ্টা করে। আবার যদুবংশের যে ধারায় শশবিন্দু জন্মেছিলেন, সেই ধারাতেই পরবর্তী সময়ে এক রাজা জন্মান যাঁর নাম জ্যামঘ। জ্যামঘের ভাইয়েরা বিদেহ নগরীর রাজত্বভার পেয়েছিলেন। তাঁদের রাজধানী ছিল মিথিলা। এঁরা রাজ্য পেয়ে জ্যামঘকে বিতাড়িত করেন। শেষ পর্যন্ত বনবাসী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে থেকে শক্তি সঞ্চয় করে জ্যামঘ নিজের জন্য একটি রাজ্য সংগ্রহ করার কাজে নামেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জ্যামঘ নর্মদা নদীর ওপরের দিকটা দখল করে ছত্তিশগড় ছাড়িয়ে সাতপুরা পার্বত্যমালার নিম্নভূমি অধিকার করে ফেলেন। এখনকার কেন নদীর প্রাচীন নাম ছিল শুক্তিমতী-এই শুক্তিমতীর উৎসভূমির কাছাকাছি তাঁর স্থায়ী বসবাসের জায়গা হয়।

জ্যামঘের কথাটা একটু বেশি করে বলছি এই জন্য যে, তাঁর সঙ্গেই গাঁথা রয়েছে বিদর্ভ বা আধুনিক বেরারে যাদবদের ছড়িয়ে যাবার ইতিহাস। জ্যামঘের স্ত্রীর নাম ছিল শৈব্যা। এই শৈব্যা কিন্তু অত্যন্ত তেজস্বনী মহিলা ছিলেন, এতটাই তেজস্বনী যে, তাঁর নিজের সন্তান ধারণের ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও জ্যামঘ দ্বিতীয়বার একটি বিয়ে করে উঠতে পারেননি। অথচ সেকালের দিনে এরকম অবস্থায় দ্বিতীয়বার বিবাহই ছিল স্বাভাবিক। হরিবংশ কিংবা বায়ু পুরাণ তাই শৈবার বিশেষণ দিয়েছে ‘শৈব্যা বলবতী সতী’, এতটাই বলবতী যে, রাজা অন্য স্ত্রীলোকের দিকে দৃষ্টি দিতে ভয় পেতেন। মোদ্দা কথা যদুবীর জ্যামঘ বৌকে অত্যন্ত ভয় পেতেন। যাই হোক, একবার যুদ্ধজয় করার পর বিজিত রাজার এক কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি। মেয়েটি তৎকালীন চিহ্নিত আর্যগোষ্ঠীর কন্যা নাও হতে পারে, কারণ মেয়েটির নাম ছিল উপদানবী। আমাদের ধারণামেলা কিংবা সাতপুরা পার্বত্যমালার যে সব অঞ্চল জ্যামঘ নিজের অধিকারে আনেন, সে সব অঞ্চল আগে অনার্য নাগদের কিংবা অন্যান্য পার্বত্য উপজাতির দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। উপদানবী এই সব অঞ্চলের মেয়েও হতে পারে। কিন্তু উপদানবীকে পাওয়ার পরেও জ্যামঘ কিন্তু বৌয়ের ভয়ে তাঁকে বিয়ে করে ফেলতে পারেননি। তিনি তাঁকে রথে চড়িয়ে নিজের রাজধানীতে নিয়ে এলেন। ভাবলেন, যদি বা মেয়েটিকে দেখে বলবতী শৈব্যার মন গলে এবং পুত্রার্থে রাজাকে বিবাহের অনুমতি দেন। কিন্তু শৈব্যা সেসব কিছুই বললেন, বরঞ্চ মেয়েটিকে রাজার সঙ্গে আসতে দেখে নিশ্চয়ই তিনি রাগে কটমট করে তাকিয়েছিলেন। নইলে সেই মুহূর্তে রাজার কথাবার্তা সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল এবং অত্যন্ত ভয়ে, সংকোচে শৈব্যাকে তিনি বললেন–ভার‍্যা উবাচ সন্ত্রাসা-এই দ্যাখ তোমার ছেলের বৌ নিয়ে এসেছি। শৈব্যা বললেনকার ছেলের বৌ? শৈব্যার ছেলেই নেই, তাতে ছেলের বৌ! রাজা বুঝলেন, ভয়ে তাঁর কথাবার্তা সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে, তবু বাঁচবার আশায় মুহূর্তের জল্পনায় জ্যামঘ বললেন–ভবিষ্যতে তোমার গর্ভে যে ছেলে হবে, তারই সঙ্গে বিয়ে দেব এই মেয়ের-যন্তে জনিষ্যতে পুত্র স্তস্য ভার‍্যা ভবিষ্যতি।(৩৫)

শোনা যায়, পরিণত বয়েসেও শৈব্যার একটি ছেলে হল এবং তা হল উপদানবী নামে সেই মেয়ের কপালজোরে। ছেলের নাম বিদর্ভ। ছেলে তার বৌয়ের থেকে বয়সে কম হলেও এ বিয়েতে কোন বাধা হয়নি। নতুন এক রাজ্য বিদর্ভ (বেরার) যদু জ্যামঘের দখলে এল, তারই প্রতাঁকে এই গল্পের অবতারণা কিনা জানি না, তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। বিদর্ভ মানে আরও একটু দক্ষিণে, অর্থাৎ বিন্ধ্য নর্মদা পেরিয়ে তাপ্তী নদীর ওপার পর্যন্ত যাদববংশধরদের দখলে চলে এল। বিদর্ভের রাজধানীর নাম কুণ্ডিনপুর। পরবর্তী সময়ে দেখব-সুন্দরীশ্রেষ্ঠা রুক্মিণী এই কুণ্ডিনপুরের মেয়ে। আমাদের ধারণা-যদুবীর জ্যামঘ পূর্বেই বিদর্ভ দখল করেছিলেন এবং এই নতুন রাজ্যের নামেই তাঁর ছেলের নাম বিদর্ভ। আসল কথা, বিদর্ভ তো কোন নতুন রাজ্য নয়, কারণ আমরা পুরাণগুলির অনেক পুর্বে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বিদর্ভের নাম শুনেছি; জৈমিনীয় ব্রাহ্মণের কাছে জেনেছি যে, বিদর্ভে নাকি ‘মাচল’ নামে একধরনের শিকারী কুকুর পাওয়া যেত, যে কুকুর বাঘ পর্যন্ত মেরে ফেলতে পারতবিদর্ভেযু মাচলাঃ সারমেয়াঃ অপীহ শালা মারয়ন্তি।(৩৬) এও সেই বিদর্ভ। রাজা এটি দখল করেছেন এবং আপন বিজয়ের স্মারক হিসেবে ছেলের নাম রেখেছেন বিদর্ভ। বিদর্ভের দুই ছেলের, ছেলে, ক্ৰথ-কৌশিক (কৈশিক)। এই দ্বিতীয় পুত্র কৌশিকের ছেলে চেদি থেকেই চেদি দেশের সৃষ্টি। এই চেদি কিন্তু আর কিছুই নয়, সেই যে রাজ্যজয়ের প্রথম কল্পে জ্যামঘ শুক্তিমতী কিংবা কেন নদীর ধারে আপন বসত গেড়েছিলেন, চেদি কিন্তু সেই মূল জায়গাটা। আসলে জ্যামঘের রাজ্য এখন অনেক বড় হয়ে গেছে, ফলে তাঁর মূল বাসস্থানটির শাসনভার বাল তাঁর দ্বিতীয় নাতি চিদি কিংবা চেদির ওপর। চেদির ঐতিহাসিক মূল্য এখন বোঝা যাবে না, তা বোঝা যাবে ভারতযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শিশুপাল যখন চেদিরাজ হিসেবে বিখ্যাত হবেন এবং তাঁর নিজের গাঁয়ের মেয়ে কুণ্ডিনপুরের লক্ষ্মীমতী রুক্মিণীকে নিয়ে যখন অন্যান্য যাদবদের সঙ্গে তাঁর লড়াই লাগবে। যাদবদের বিষয়ে একটা কথা আপাতত বলেই আমরা অন্য প্রসঙ্গে যাব। লক্ষণীয় বিষয় হল, পঞ্জাব থেকে আরম্ভ করে সরস্বতী-দৃষদ্বতীর মধ্যভূমি আর্যাবর্তের মূল সীমারেখা যদি পৌরবদের ছত্রছায়ায় হস্তিনাপুর অর্থাৎ দিল্লির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে থাকে, তাহলেও সেটা কোনমতেই উত্তর ভারতের সীমানা পেরোয়নি অর্থাৎ কোনমতেই পৌরবেরা গঙ্গা-যমুনার ওপারে এসে দক্ষিণের দিকে যেতে পারেননি। বরঞ্চ দক্ষিণ দিকে একছত্র আধিপত্য ছিল যাদবদের। আরও একটা দেশের লোকেদের কথা আমাদের বলতে হবে যাঁরা যাদবদের সমসাময়িক অথচ তাঁদের সমানে সমানে বেড়ে উঠেছিলেন। এটি হল মৎস্যদেশ।

এখনকার পিংক সিটি বা জয়পুর দেখে যাঁরা বাহা বাহা করেন, তাঁরা জানবেন এই জয়পুর হল মৎস্যদেশের রাজধানী বিরাট, মহাভারতের বিরাট। অর্থাৎ পাণ্ডবেরা দিল্লি থেকে গিয়ে জয়পুরে লুকিয়ে ছিলেন, দুর্যোধনেরা শত চেষ্টাতেও তাঁদের ধরতে পারলেন না। এমন একটা জায়গা, যা এখনও যেমন সুন্দর, তখনও তেমনি। নইলে দেখুন মহাভারতের বিরাট-রাজার নামই আমরা জানি না, রাজধানীর নামেই তাঁর নাম-বিরাট। তবে হ্যাঁ, তাই বলে দেশটা তো আর তত ছোট নয়, মৎস্যদেশের মধ্যে ছিল আলোয়ারের খানিকটা এবং ভরতপুরেরও খানিকটা, যে ভরতপুরের খানিকটা বোধহয় যাদবদের ভাগেও পড়েছিল। আর জয়পুর তো আছেই একেবারে রাজস্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে। কৌরবদের রাজত্ব হস্তিনাপুরের দিক থেকে এটি দক্ষিণে আর যাদবনগরী মথুরার দিক থেকে মৎস্যদেশ পশ্চিমে। দক্ষিণে এটি চম্বল পর্যন্ত নেমে গেছে, আর পশ্চিমে এর সীমানা সরস্বতী পর্যন্ত। এই হল মৎস্যদেশের ঠিকানা। আমরা ভারতবর্ষের একেবারে পশ্চিম সীমান্তের কথাটা মোটামুটি বলেছি, বলেছি দক্ষিণের কথাও, উত্তরের কথা তো বটেই। কিন্তু পূর্বের কথা মোটেই বলিনি। এবারে সেটা বলতেই হবে।

প্রথমেই মনে রাখবেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার অবস্থা এখন যেমন খারাপ, তখন ততটা ছিল না। মজাটা হল, তখনও তাদের খারাপ মনে করা হত যথেষ্ট, কিন্তু খারাপ বলে তাদের দূরে রাখার উপায় ছিল না। খারাপ কতটা মনে করা হত, তার প্রমাণ এই দেশগুলির জন্মের উপাখ্যানেই। এই যে একটু আগেই বিদর্ভের জন্ম দিলেন পুরাণকারেরা কিংবা চেদিদেশের জন্ম দিলেন, কই সেখানে তো কোন মালিন্যের স্পর্শমাত্র নেই। কৃষ্ণের জন্মস্থান তো মথুরা নয়, পণ্ডিতেরা আরও সৌন্দর্য-নিষেক করে বলেন ‘মধুরা’–মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম-মধুরাপতির সকলি মধুর। কিন্তু কই এমনটি তো বাংলা বিহার ওড়িশা কিংবা আসামের ভাগ্যে জোটেনি। আমরা বাংলা কিংবা বিহারী ভাষায় নাকি এমন কিচ কিচ করেছি যা উত্তর ভারতীয় প্রভুদের কাছে পাখির ভাষার মত শুনিয়েছে। আসলে পৌরাণিকেরা সবাই উত্তর ভারতীয় এবং দক্ষিণ ভারতীয়দের সঙ্গে তাঁদের মাখামাখি বেড়েছে রাজনীতির তাগিদে। কিন্তু পূর্বদেশীয়দের কাছে উত্তর ভারতীয়দের সে দায় নেই। কাজেই আমাদের অর্থাৎ আমাদের দেশগুলির জন্ম হয়েছে বিকৃতকাম এক অন্ধ ঋষির থেকে। তবু ভাল-ঋষির নামটি ঋগবেদে পাওয়া যায় এবং সে ঋষির একটা প্রতিবাদী মন ছিল, যা এখনও বাংলা দেশের বৈশিষ্ট্য।

ভণিতার কোন প্রয়োজন নেই। সকলেরই নিশ্চয় সেই উশিজপত্নী মমতার কথা মনে আছে, যে মমতা দেওর বৃহস্পতিকে ধর্ষণে বাধা দিতে গিয়ে বিফল হন। মনে আছে নিশ্চয়ই যে, মমতার গর্ভস্থ সন্তান গর্ভে থেকে বৃহস্পতির ধর্ষণ এবং বীর্যপতনের বাদ সেধেছিল প্রতিবাদ করে এবং ফলত তাঁকে অন্ধ হয়ে জন্ম নিতে হয়েছিল। তাঁর নামও হয়েছিল দীর্ঘতমা। দীর্ঘতমা জন্মের পূর্বেই পিতা ভিন্ন পর পুরুষের ধর্ষণ উপলব্ধি করেছিলেন বলেই কিনা জানি না, কিন্তু জন্ম থেকে তিনি বিকৃতকাম। পৌরাণিকেরা বলেছেন যে, ছোটবেলা থেকেই মৈথুনের ব্যাপারে দীর্ঘতমার কোন পাত্ৰাপাত্র জ্ঞান ছিল না। মৈথুন বলতে তিনি বুঝতেন ষাঁড় আর গরুর সম্পর্ক-অনাবৃত গোধর্ম। গোধর্ম প্রয়োগ করার জন্য তিনি প্রথমে বেছে নেন তাঁর দাদার বৌ গৌতমীকে। সময় অসময়ের জ্ঞান নেই, পাত্রপাত্র জ্ঞান নেই হঠাৎ করে অন্ধ দেওরকে জড়িয়ে ধরতে দেখে ভাই-বৌ তো প্রথমেই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু দীর্ঘতমার ষাঁড়ের অভ্যাস যাবে কোথায়? তিনি ষণ্ডবৎ আবার নতুনতর উত্তেজনায় হাজির হলেন ভাই-বৌয়ের সামনে। ভাই বৌ এবার বললেন-পেয়েছ কি তুমি, এখনও ষাঁড়ের মত দাঁড়িয়ে আছ যে-অনড়বানিব বর্তসে। কার সঙ্গে কি ব্যবহার করতে হবে জান না–গম্যাগম্যং ন জানীষে, শুধু যাঁড়ের বুদ্ধিতে মেয়ের মত ভাইবৌকে খারাপভাবে চাইছ-গোধমাৎ প্রার্থয় সুতাম।

গৌতমপত্নীর একটাই সুবিধে ছিল দীর্ঘতমা চোখে দেখতে পেতেন না। তিনি তাই জোর করে তাকে ধরে বেঁধে একটা বড় কাঠের ওপর শুইয়ে ভাসিয়ে দিলেন জলে। পণ্ডিতদের ধারণা এই ধর্ষণ এবং প্রতিহিংসার ঘটনাটা ঘটেছে বৈশালী নগরীতে, পাটলিপুত্র থেকে যে নগরী আরও খানিকটা উত্তর-পশ্চিমে। এই বৈশালীতেই ছিল বৃহস্পতি, ভরদ্বাজ, সংবর্ত, দীর্ঘতমা–এই সব অঙ্গীরস বামনদের স্থায়ী ঠিকানা। এই বৈশালী থেকে দীর্ঘতমাকে গঙ্গায় ফেলে দেওয়াটা তাই কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়। পারজিটার সাহেবের ভাষায়- Hence he was expelled and set adrift in the Ganges. He was carried down stream to the Eastern Anava kingdom and was welcomed by King Bali. This incident finds support in the Rigveda (1.58. 3,5) where he speaks of having been delivered from bodily hurt and from danger in the rivers: and it is not inprobable, because these Angirasa rishis were living, as mentioned above, in the kingdom of Vaisali, so that he might easily have been put on a raft in the Ganges there and have drifted some seventy miles down to the Monghyr and Bhagalpur country which was the Anava realm. (৩৭)

পারজিটার সাহেব যাকে ‘আনব রেম’ বলছেন, সে কথাটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। আসলে অনু থেকে আনব বা আনবিক ঠিক যেমন পরমাণু থেকে পারমাণব বা পারমাণবিক। এই অনুর কথা আপনাদের মনে থাকা উচিত। এ অনু হলেন সেই অনু, যিনি যযাতি রাজার ঔরসে শর্মিষ্ঠার গর্ভে জন্মেছিলেন–অর্থাৎ যদু, তুর্বসু, কিংবা পুরুর ভাই। পৌরাণিকদের মতে তিনি পিতার অভিশাপ লাভ করেছিলেন এবং মূল ভূখণ্ড থেকেও চত হয়েছিলেন। বাস্তুচ্যুত অনুর বংশধরেরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যান এবং এই ভাগ হয় অনু থেকে সপ্তম পুরুষে মহামনসের দুই ছেলে উশীনর এবং তিতিক্ষুর আমলে। উশীনর তাঁর বংশধরদের নিয়ে পঞ্জাবের পূর্ব সীমান্তে চলে যান এবং তিনি এতই বড় মাপের রাজা ছিলেন যে, একসময় তাঁর ছেলে বিখ্যাত শিবি রাজা একমাত্র উত্তর পশ্চিম সীমান্ত ছাড়া গোটা পঞ্জাবটাই প্রায় দখল করে নেন। মহাভারতে যে মদ্ররাজ শল্যের কথা পড়ি কিংবা রামায়ণে যে কেকয় দেশের মেয়ে কৈকেয়ীর কথা শুনি–তাঁরা সব এই অনুর বংশে শিবি রাজার প্রতিষ্ঠা করা রাজ্যের ছেলে-মেয়ে। এই শিবি রাজা নিজের জাতভাই দুস্থ্যবংশীয়দের সঙ্গে লড়াই করতেও ছাড়ড়েননি, ফলে দ্রুহু্যরা আরও পশ্চিমে গান্ধারে চলে যান; এই গান্ধারের ছেলে হিসেবেই আমরা পরে শকুনিকে পাব। উশীনরের ভাই তিতিক্ষু, তাঁর সহাশক্তি বেশি বলেই তিনি তিতিক্ষু কিনা জানি না, সেই তিতিক্ষু চলে এলেন আধুনিক বিহারের পূর্বদেশে। আর্যপট্টিতে তাঁর খুব একটা পাত্তা ছিল না এবং তাঁর বংশধরের নাম দেখুন পৌরাণিক রাক্ষসরাজ বলির নামে চিহ্নিত। যাই হোক এই বলি দীর্ঘতমাকে নদী থেকে টেনে তুলে নিয়ে এলেন রাজবাড়িতে।

পুরাণগুলি যতই বলুক যে, এই বলি প্রাদের নাতি, আপনারা বিশ্বাস করবেন না, কারণ এ বলি সে বলি নন। যাই হোক, রাজ বাড়িতে এনে বলি দীর্ঘতমাকে একটি বিশেষ অনুরোধ করেন। রাজার পুত্র ছিল না, অতএব পুত্র পাবার জন্য রাজা দীর্ঘতমাকে আহ্বান জানালেন নিয়োগপ্রথায় তাঁর স্ত্রীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার জন্য। আমাদের ধারণা দীর্ঘতমাকে অনুরোধ করার কোন প্রয়োজন ছিল না, দু-এক দিন রাজবাড়িতে থাকলে আপনিই তিনি গোর্মবশে রাজরানীর কাছে উপস্থিত হতেন। যাই হোক, দীর্ঘতমার প্রতি নিযুক্তা’ হয়েও রাজরানী সুদেষ্ণা কিন্তু তাঁকে অন্ধ আর বুড়ো জেনে কাছে গেলেন না, পাঠিয়ে দিলেন নিজের শূদ্রা পরিচারিকাকে। গোধর্মী ঋষির কাছে শুভ্রা, রাজরানী সব সমান। তিনি শূদ্রার গর্ভে অনেকগুলি পুত্রেরর জন্ম দিলেন। মজা হল, তখনকার দিনে তো আর অত জাত মেনে ছেলেপিলে হত না, অতএব এরা প্রত্যেকেই ব্রহ্মবাদী, ধর্মজ্ঞ ঋষি বলে পরিচিত হলেন। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কেননা জেলেনীর গর্ভে জন্মেও পরাশরের পুত্র বেদব্যাস যেমন ঋষি, শূদ্রার গর্ভে জন্মেও দীর্ঘতমার ছেলে কাক্ষীবান তেমনই ঋষি। আবার এই পৌরব রাজবংশ, ইক্ষবাকু রাজবংশ এই সব মাকামারা ক্ষত্রিয় রাজবংশে জন্মেও তাঁদের বংশধরেরা দলে দলে ব্রাহ্মণ হয়ে গেছেন, আর পৌরাণিকেরা তাঁদের নতুন বিশেষণ দিয়েছেন-ক্ষত্রোপেতা দ্বিজাতয়ঃ। শৌনক কি গার্গ, সাংকৃত্য কি মৌদগল্য–এই ধরনের ক্ষত্রোপেতব্রাহ্মণ। এই ধরনের বর্ণমাহাত্ম্য থেকে দীর্ঘতমার শূদ্ৰাসম্ভব ছেলেদের বরং জাত অনেক উঁচু। কিন্তু এদের জাত যাই হোক, রাজা বলি এই ছেলেগুলোকে দেখে ভাবলেন–এগুলি বোধ হয় তাঁরই ছেলে। মনি দীর্ঘতমাকে তিনি বললেন কি-কি? এগুলো আমারই তো? মুনি বললেন-মোটেই নয়। তোমার কথামত নিয়োগটা মেনেছি বটে, তবে সেটা ছিল শূদ্রা দাসী, তোমার বৌ আমার কাছে আসেনি, অন্ধ বলে, বুড়ো বলে তার ঘেন্না হয়েছে, তাই সে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল তার শুদ্রা পরিচারিকাকে।

বলি রাজা এত সব কিছুই জানতেন না। পত্নী সুদেষ্ণাকে তিনি ভীষণ ভর্ৎসনা করলেন এবং আবার কুসুমে রতনে চন্দনে তাঁকে সাজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন মুনির কাছে-পুনশ্চৈনা অলংকৃত্য ঋষয়ে প্রত্যােদয়ৎ। ঋষি এবার নিয়োগপ্রথার নিয়ম মত নিজের গায়ে আচ্ছা করে দই-লবণ এবং মধু মেখে নিলেন। নিয়োগপ্রথার এই নিয়ম। যাতে সঙ্গমের সময় অপরিচিতার কোন মোহ না হয় নিযুক্ত পুরুষটির প্রতি, সেই জন্যই এই দই, লবণ আর মধু মাখার ব্যবস্থা। মনুসংহিতায় অবশ্য জ্যাবজ্যাবে করে ঘি মাখার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু দই-ঘি গায়ে মেখে যতই বিকর্ষণের ব্যবস্থা শাস্ত্রে থাকুক না কেন, মানুষ ইচ্ছে করলে তার মধ্যেও কাম চরিতার্থ করার ব্যবস্থা করে নেয়। দীর্ঘতমা বিকৃতকাম গোধর্মী মানুষ। তিনি রানী সুদেষ্ণাকে বললেন–আমার সর্ব অঙ্গনীচ থেকে ওপর পর্যন্ত এক ফোঁটা ঘেন্না না করে চাটতে থাক, রানী–লিহ মাম্ অজুগুপ্সন্তী আপাদতলমস্তকম্। সুদেষ্ণা সব শুনলেন, রাজরানীর সূক্ষ্ম রুচি বিসর্জন দিয়ে অসহায়ের মত তিনি মুনির দেহ চাটতে থাকলেন। চাটতে চাটতে সবই সম্পূর্ণ হল, কিন্তু লজ্জায় ঘেন্নায় রানী বুড়ো দীর্ঘতমার গুহ্য স্থানগুলি আর চাটতে পারলেন না। সত্যিই তো আর কত? বিকৃতকাম মুনি কিন্তু হেঁই হেঁই করে উঠলেন এবং তাঁর ওই অঙ্গ বাদ দেওয়ার জন্য বানীকে একটা ছোট-খাট অভিশাপও দিয়ে দিলেন। রানী সুদেষ্ণা অনুনয় করে বললেন–আমি যথাসাধ্য আপনার তুষ্টি বিধান করার চেষ্টা করেছি, আপনি প্রসন্ন হোন। মুনি এবার একটু সন্তুষ্ট হলেন, এতক্ষণ রাজরানীর জিহ্বার লেহনে তাঁর খানিকটা কাম-তুষ্টি হয়েছে বইকি। সেই তুষ্টির রেশেই তিনি আশীবাদ করলেন-মিষ্টি হাসির সুন্দরী গো-তুমিযেহেতুআমার লিঙ্গটি ছাড়া আর সব অঙ্গই লেহন করেছ–প্রাশিতং যৎ সমগ্ৰেযু ন সোপং শুচিস্মিতে–অতএব, পাঁচ পাঁচটি চাঁদের মত ছেলে পাবে তুমি। ছেলে হল–এই ছেলেরাই নাকি অঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, সুহ্ম এবং বঙ্গ। দেশের নামে ছেলেদের নামের ব্যাপারটা অনেকটা সেই বিদর্ভের মতই। আমাদের ধারণা, এই রাজ্যগুলি আগেই ছিল। বলি রাজা তাঁর পাঁচ ছেলেকে পাঁচ রাজ্যে অভিষিক্ত করেছিলেন মাত্র। কিন্তু ছেলেরা যতই লায়েক হোক না কেন তারা কিন্তু দানব রাজার ছেলে বলেই পরিচিত, ভারতবর্ষের পূর্বখণ্ডে এই কলঙ্ক সার্বজনীন। এদের মধ্যে অঙ্গ দেশের তবু কিছু জাত ছিল, জাত ছিল কলিঙ্গেরও, কিন্তু বঙ্গ, পুণ্ড্র কিংবা সুক্ষ দেশের মানুষজনকে কেউ মানুষ বলে মনে করত না। পরবর্তী সময়ে অঙ্গ রাজ্যটা মগধের অন্তর্ভুক্ত হলেও রামায়ণ-মহাভারতের সময়ে এই রাজ্যের পৃথক অধিষ্ঠান ছিল। পারজিটারের মতে অঙ্গ হল এখনকার মুঙ্গের এবং ভাগলপুর জেলা, উত্তরদিকে বড়ো জোর এর সীমানা কোশী নদী পর্যন্ত এবং পূর্ণিয়া জেলার পশ্চিম দিকটাও ছিল অঙ্গভূমির মধ্যে। কোশী নদীর উপরে বিভাশুক মুনির আশ্রম ছিল, যে আশ্রমে তাঁর ছেলে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে ভুলিয়েছেন অঙ্গরাজ্যের বেশ্যারা। মনে পড়ছে না, সেই রামায়ণের ঘটনাটা? দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞের জন্য যে ঋষ্যশৃঙ্গকে আনা হয়েছিল। অঙ্গরাজ্যের রাজা দশরথবন্ধু লোমোদ যাঁকে বেশ্যা দিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে এসে শান্তার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। রামায়ণের এই ভৌগোলিক সূচনা থেকেই পারজিটারের ধারণা হয়েছে যে, কোশী নদী পর্যন্ত এই রাজ্যের সীমানা। অন্য ঐতিহাসিকেরা অবশ্য বলেন যে, পারজিটারের মুঙ্গের, যা নাকি মহাভারতের আমলের মোদাগিরি এবং কৌশিকী কচ্ছ এই দুটি জায়গা মহাভারতের অঙ্গরাজ কর্ণের রাজ্যভুক্ত ছিল না, অতএব অঙ্গরাজ্য ছিল মগধ আর রাজমহল পার্বত্য অঞ্চলের মাঝখানে।

অঙ্গরাজ্যের ভৌগোলিক সীমা যাই হোক, মনে রাখতে হবে অঙ্গ, পু, কলিঙ্গ বঙ্গ-সুহ্মের মানুষেরা মূল আর্যপ্রস্থান পৌরবদের এবং অন্যদিকে যাদবদের সুনজরে ছিলেন না। আমরা মূল জায়গাটায় অর্থাৎ যদি সেই হস্তিনাপুরে আবার ফিরে আসি, তাহলে প্রথমেই স্মরণ করতে হবে যে, পুরু-ভরতবংশের কুলতিলক হস্তী হস্তিনাপুর প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হস্তিনাপুর থেকে বিদায় নিয়ে যাদবদের রাজ্যে চলে গিয়েছিলাম। আবার যাদবদের ঘরে বিদর্ভ, চেদি এই সব পুত্ৰনাম বা রাজ্যনাম শোনবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা আবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছি। এখানে যেটা বলার দরকার, সেটা হল-ভরতবংশের অধস্তনেরা যেরকম এক জায়গায় জমাটভাবে রাজত্ব করছিলেন, যাদবেরা কিন্তু তা করেননি। যাদবদের মধ্যে দেখব, মথুরাতেও তাঁদের রাজত্ব, বিদর্ভতেও তাঁদের রাজত্ব, মধ্যদেশ চেদিরাজ্যেও তাঁদের রাজত্ব। অথচ এক যাদববংশের সঙ্গে আরেকজনের তেমন মিল নেই। ফলে মাঝে মাঝে এদের এক এক বংশে প্রচণ্ড মার খেতে হয়েছে এবং এমনও হয়েছে যে, সে মার খেতে হয়েছে আপন জ্ঞাতিগুষ্টি পৌরব-ভরতবংশীয়দের কাছেই। শতপথ ব্রাহ্মণের মতপুরোনোগ্রন্থে দেখছি–মহারাজ ভরত যদুবংশীয় বীর সাত্ত্বতকে প্রচণ্ড মার দিয়েছেন এবং যে সাত্ত্বত অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তাঁর যজ্ঞের ঘোড়া পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছেন ভরত। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বিনা দ্বিধায় এই কাহিনী মেনে নিয়েছেন (পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া, পৃ ৮০, ১২৫) কিন্তু এখানে একটা বিচার করার বিষয় আছে। পুরুবংশ এবং যদুবংশের রাজ-অনুক্রম বিচার করলে দেখা যাবে মহারাজ ভরতের সময় সাত্ত্বতের জন্মই হতে পারে না। ভরত অনেক আগের মানুষ। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। আমরা আগেই বলেছি যে, কোন বংশে যদি এমন বিখ্যাত মানুষ জন্মান, যাঁর কীর্তি-শ্রুতি দিগন্ত-প্রসারী, তাঁর নামে বংশের অধস্তন এবং ঊর্ধ্বতন সব পুরুষই চিহ্নিত হন। এর প্রমাণ আছে ভূরি ভূরি। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বস্তুত ভরতের হাতেই সাতবংশীয়রা (এঁরা অবশ্যই সাত্ত্বতের ঊর্ধ্বতন পুরুষ) কোন সময় মার খেয়েছিলেন। এটা হতেই পারে, কারণ মথুরায় যাদবদের বসতি ছিল এবং ভরতের রাজ্য ছিল তার পাশেই। সাত্ত্বতের পরবর্তী বংশধরেরা যেহেতু পরে মথুরার অধিপতি ছিলেন, অতএব ভরতের হাতে মার খাওয়াটাও সাত্ত্বতের ওপরে চেপে গেল। মোদ্দা কথা হল-সাত্ত্বতের পরিচয় আমরা দিইনি, এখন দিতে হবে এবং তার চেয়েও বড় কথা হল যাদবদের সঙ্গে ভরতবংশীয়দের যে এককালে বিবাদ-বিসংবাদ ছিল এটা জলের মত পরিষ্কার।

.

০৪.

বর্তমান প্রবন্ধের সবচেয়ে ‘কুসিয়াল জায়গায় এখন আমরা উপস্থিত। দেখুন, যে হস্তীকে আমরা হস্তিনাপুরে দেখেছিলাম সেই হস্তীর তিন ছেলে। তিন ছেলের মধ্যে বড়জনকেই আমাদের দরকার, তাঁর নাম অজমীঢ়। পাঠক! আপনাকে একটু ধৈর্য ধরে অজমীঢ়ের বংশ পরিচয় শুনতে হবে, না শুনলে আপনি ভারতযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কিছু বুঝতে পারবেন না। অজমীঢ়ের তিন বৌনীলিনী, কেশিনী এবং ধূমিনী। অজমীঢ়ের ঔরসে নীলিনীর গর্ভে যে বংশধারাটা চলল, এই বংশেই চার পুরুষের মধ্যে পাঁচটি দুর্দান্ত ছেলে জন্মাল-মুগল, সৃঞ্জয়, বৃহদিযু, যবীনর এবং কৃমিলা। এই পাঁচজনই রাজ্যরক্ষার ব্যাপারে উপযুক্ত এবং যথেষ্ট সমর্থ বলে, তাঁদের নাম হয় পাঞ্চাল। ‘অলং’ মানে সমর্থ, পাঁচটা রাজ্যের সুরক্ষায় সমর্থ বলেই এদের নাম পঞ্চাল–অলং সংরক্ষণে তেষাং পঞ্চালা ইতি বিশ্রঃ।(৩৮) এই পঞ্চালের রাজ্যই হল পাঞ্চাল, আধুনিক নামে যে রাজ্যগুলিকে উত্তরপ্রদেশের ম্যাপে পাওয়া যাবে উত্তর-পশ্চিম কোণে, অর্থাৎ এখনকার বেরিলি (রায়বেরিলি নয় কিন্তু), বুদাউন, ফরক্কাবাদ, রোহিলখণ্ডের লাগোয়া জেলাগুলি এবং গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী খানিকটা অংশ। হস্তিনাপুরের হস্তীর বংশধারা অজমীঢ়ের চার পুরুষ পরেই উত্তরপ্রদেশের এক বড় অঞ্চল পাঞ্চাল দখল করে নিল। পাঠক! আবার মনে রাখবেন অজমীঢ়ের ঔরসে নীলিনীর গর্ভসূত্রে পাঞ্চালরাজ্যের প্রতিষ্ঠা। আর এই অজমীঢ়ের তৃতীয়া পত্নী ধৃমিনীর গর্ভে জন্ম নিলেন ঋক্ষ–যিনি প্রসিদ্ধ কৌরববংশের প্রতিষ্ঠাতা কুরুর ঠাকুরদাদা। অবশ্য কুরুর বাবাও খুব কম বিখ্যাত লোক নন, তাঁর নাম সংবরণ–ঋক্ষের ছেলে, অজমীঢ়ের নাতি। সেই সংবরণ, যিনি ঈপ্সিতা রমণীর জন্য দারুণ তপস্যা করেছিলেন। কল্পনা বিলাসী কবিদের তো আর ইতিহাসের দায় নেই। নইলে সংবরণের বিশ পুরুষের বড় বৃদ্ধা মাতামহী দেবযানী তাঁর প্রেমিক কচের মন পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে খোকার খোক সংবরণের উদাহরণ দিয়েছেন

পত্নীবর মাগি

করেননি সম্বরণ তপতীর আশে
 প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত?

সংবরণের কথা আমাদের একটু বলতেই হবে কারণ তাঁরই বংশে পৌরব-ভরতবংশের মূল ধারাটি চলছিল। একটি বিশেষ কারণে সংবরণের কাহিনী আমাদের কাছে প্রয়োজনীয়। মহাভারতের পাণ্ডবেরা যখন দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে যাবার জন্য প্রায় তৈরি হয়েছেন, তখন এক গন্ধর্বের সঙ্গে অর্জুনের খটাখটি বাধে। অর্জুন জেতেন এবং গন্ধর্ব তাঁকে ‘তাপত্য’ বলে সম্বোধন করেন। তাপত্য’ মানে তপতীর বংশধর। অর্জুন বললেন–”তাপত্য কেন, কৌন্তেয় বললেই বেশ হত–কৌন্তেয় হি বয়ং সাবধা। তখন গন্ধর্ব অর্জুনদের সংবরণ এবং তপতীর প্রেমকাহিনী শোনালেন। কোন এক হরিণের পেছন পেছন ধাওয়া করতে গিয়ে সংবরণের ঘোড়াটি মারা যায়। নির্জন বনে নিরুপায় রাজা তপতী, সূর্যকন্যা তপতাঁকে দেখে মুগ্ধ হন। রাজাও একা, তপতীও একা। রাজা ভাবলেন–যেন সোনার প্রতিমা বন আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। রাজার চক্ষু সার্থক হল-যেন তিন ভুবন মন্থন করে এমন রূপের সৃষ্টি করেছেন বিধাতা, যেন সূর্যের কিরণ-জাল ছিঁড়ে পড়েছে ডুয়ে। প্রথমে তো রাজার মন, চোখ এবং সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন আপন রূপে স্তম্ভিত করে ফেললেন তপতী, তারপর ক্রমে রাজার মনের বিকার আরম্ভ হলকামবাণেন পীড়িতঃ। সংবরণ বললেন কে তুমি সুন্দরী! তোমার মত এমন সুন্দর চেহারা আমার জীবনে আমি দেখিনি, তুমি কে, কার মেয়ে, এমন একা এই বনে কি করে এলে?

রমণী উত্তর দিল না, উল্টে মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের মত ঘন বনে হারিয়ে গেল। শত্রুপাতন রাজা অজ্ঞান হয়ে নিজেই পড়ে গেলেন মাটিতে। তপতীরও বোধহয় মনে কিছু হয়েছিল, অন্তত মায়া তো বটেই। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই ‘পীনায়তশ্রোণী রমণী এসে রাজাকে মধুর স্বরে ডেকে তুলল। রাজা আশ্বস্ত হলেন, মূর্ছা ভেঙে কামপীড়িত রাজার, চোখে যা পড়ল, তা হল–দদর্শ বিপুলশ্রোণীং তামেবাভিমুখে স্থিতাম। দুজনে দেখা হল বটে, তবে সমস্যা মিটল না। তাই তপস্যা, সূর্যপূজা, দেবতার তুষ্টি, ঋষি বশিষ্ঠের মধ্যস্থতা এবং শেষে বিয়ে এবং কুমারসম্ভব–মহারাজ কুরুর জন্ম। অর্জুন বুঝলেন তিনি ‘তাপত্য কেন। কিন্তু অর্জুনের বোঝার থেকেও, যেটা আমাদের বেশি বোঝা প্রয়োজন, তা হল অজমীঢ়ের এক স্ত্রীর বংশধারায় যেমন পাঞ্চালদের জন্ম, তেমনি অন্যতরার বংশধারায় কুরু কিংবা কৌরবদের জন্ম অর্থাৎ এক অর্থে পাঞ্চাল এবং কৌরবেরা কিন্তু ভাই ভাই। কিন্তু ভাই ভাই হলে হবে কি, এই সংবরণেরই বৈমাত্রেয় ভাই পাঞ্চালেরা তাঁর জীবকালেই তাঁকে হস্তিনাপুর থেকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল। মহাভারতের আদিতেই এ কথা জানিয়ে বলা হয়েছে–সংবরণের সময়ে হস্তিনাপুরের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অনাবৃষ্টি, মড়ক তো লেগেই ছিল, তার ওপরে জুটেছিল পাঞ্চালদের ভয়। আসলে মহাভারতের তপতীসংবরণের সংবাদ থেকে জানতে পারি যে রাজার ‘হনিমুনের সময়টা বড়ো বেশি হয়ে গিয়েছিল। অমন ‘বিপুলশ্রোণী ‘চারুসবানবদ্যাঙ্গী ভার‍্যা লাভ করে সংবরণ বারো বচ্ছর সেই বনে ‘হনিমুন’ করে গেলেন, সেই যে বনে তাঁদের প্রথম দেখা হয়েছিল। প্রজাপালক রাজার এত বিলাস কি রাজ্যের সহ্য হয়? ব্যাধি, মারী, অনাবৃষ্টির কথা ছেড়েই দিলাম, এই সুযোগে পাঞ্চালেরা চতুরঙ্গ বাহিনী নিয়ে ভরতবংশের রাজ্য হস্তিনাপুর আক্রমণ করলেন–অভ্যৎ তত্র পাঞ্চল্যো বিজিত্য তুরসা মহীম। তরসা মানে হঠাৎ করে। এই হঠাৎ আক্রমণের বিপর্যস্ত হয়ে সংবরণকে সপূত্র, সপরিবারে হস্তিনাপুর থেকে পালিয়ে গিয়ে সিন্ধুনদীর গিরিগুহা আশ্রয় করতে হয়েছিল। মহাভারতের ঋষি খবর দিয়ে বলেছেন যে, বহুকাল ধরে সংবরণকে ওই সিন্ধুনদীর ধারে ধারে পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে, এবং তিনি যখন সপুত্র রাজ্য থেকে তাড়িত হয়েছিলেন তখন নিশ্চয়ই কৌরবদের বংশকর কুরুকেও ছোটবেলাটা কাটাতে হয়েছে ওই অঞ্চলেই। বোঝা যাচ্ছে পাঞ্চালদের শক্তি বাড়ছিল এবং এক সময় তাঁরা পৌরব-ভরত-এবং কুরুবংশীয়দের রাজত্ব দখল করে নিয়েছিলেন। কি করে সংবরণ স্বরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেন, সে আরেক কথা। মহাভারত বলেছে যে, সংবরণের এই দুরবস্থায় বশিষ্ঠ মুনি তাঁর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন এবং তাঁরই পৌরোহিত্যে পুনরায় হস্তিনাপুর উদ্ধার করেন। আমাদের মনে হয়–পৌরোহিত্য না বলে মন্ত্রিত্ব বলাই ভাল, কারণ তাঁরই মন্ত্রণায় শক্তিসংগ্রহ করে সংবরণ আবার ফিরে আসেন নিজের জায়গায়।

সহৃদয় পাঠককুল। মনে রাখবেন ভারতযুদ্ধের বীজ বপন শুরু হয় এইখানেই। পাঞ্চালদের সঙ্গে কুরুপিতা সংবরণের যে যুদ্ধ হয়েছিল, এর ফল পুরাঘটিত বর্তমানের মত সুদূরপ্রসারী হয়েছিল ভারত-যুদ্ধ পর্যন্ত এবং অর্জুনকে যে ‘তাপত্য বলে সমোধিত হয়ে সংবরণ-তপতীর প্রেমকাহিনী শুনতে হয়েছিল, সেটাও কিন্তু অর্জুনেরা পাঞ্চালে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে যাবার পূর্বমুহূর্তে। ঐতিহাসিকতার খাতিরে এই সময়ের সংস্থানটা যথেষ্ট জরুরী। আমরা কিন্তু কতগুলি বিচ্ছিন্ন কথা মূল পর্বে যাবার আগেই সেরে নেব। সংবরণের ছেলে কুরু মহারাজ হস্তিনাপুরে রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পরেই কিন্তু কুরুবংশের অর্থাৎ প্রাচীন পুরু-ভরত-হস্তীবংশের প্রতিপত্তি আবার বেড়ে গেল। পণ্ডিতেরা মনে করেন যে পাঞ্চাল রাজার সঙ্গে সংবরণের যুদ্ধ হয় তাঁর নাম নাকি সুদাস। আপনাদের মনে আছে তো–যে পাঁচজন পাঞ্চালে রাজা হয়েছিলেন, তাঁদের প্রথম ছেলের নাম মুগল। এই মুগলেরা কিন্তু বেশির ভাগ ব্রাহ্মণ হয়ে যান, যাঁরা মৌশল ব্রাহ্মণ বলে পরিচিত। কিন্তু ব্রাহ্মণ হলে কি হবে, এরই নাতি কিন্তু মেনকার (আবার সেই মেনকা-স্বৰ্গবেশ্যা!) সঙ্গে সহবাস করে যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিলেন। ছেলের নাম দিবোদাস, আর মেয়ের নাম অহল্যা। এই অহল্যার নাতি আবার এক অঙ্গরাকে দেখে বীর্যস্খলন করে বসলেন। তাঁর তেজ গিয়ে পড়ল কতগুলি নলখাগড়া জাতীয় ঘাসের ওপর। এই তেজ থেকেই নাকি জন্ম কৃপ এবং কৃপীর। কুরুবংশের শান্তনু রাজা মৃগয়া করতে গিয়ে ঘাসের ওপর দুটি যমজ পুত্র কন্যা দেখে তাদের নাকি কৃপা করে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসেন। তাঁর কৃপাতেই এই যমজ দুটি বেঁচে যায় বলেই, তাদের নাম নাকি কৃপ-কৃপী।

আমার মত দুর্বুদ্ধি মানুষের আবার এই কল্পকাহিনী বিশ্বাস হয় না। আমাদের ধারণাকৃপকৃপী ব্রাহ্মণ-হয়ে-যাওয়া বংশ থেকে জন্মালেও তাঁরা আদতে পাঞ্চাল। অহল্যা নাম্নী মেয়ের বংশলতায় জন্মালেও তাঁর যে পাঞ্চাল রাজ্যের কোন অংশের লোভ থাকবে না, তা কি করে বলা যায়? বিশেষত দিবোদাস নামে ছেলের বংশে যার জন্ম সেই সুদাসের সঙ্গেই তো কুরুবংশীয় সংবরণের বিবাদ বেধেছিল। আমাদের ধারণা, কুরুবংশীয় শান্তনু জেনেশুনেই এই যমজ দুটিকে নিজের ঘরে মানুষ করেন এবং কৃপীর সঙ্গে তিনি যাঁর বিয়ে দেন সেই দ্রোণাচার্য ছিলেন আজন্ম পাঞ্চাল-বিরোধী। মহাভারতের যুদ্ধপর্বে দ্রোণাচার্য কৃপাচার্যেরা যে কুরুবংশের নুন খাওয়ার সুবাদে দুর্যোধনের পক্ষে থেকে গিয়েছিলেন, সেই কথাটা অত সহজে মেনে নেবেন না। অত সস্তায় রাজনীতির চাল সিদ্ধ হয় না। কৃপাচার্য এবং দ্রোণাচার্য যে কুরুপক্ষে আজীবন যুদ্ধ করে গেছেন তার অন্যতম কারণ- এদের মধ্যে কৃপাচার্য পাঞ্চালদের ঘরে জন্মেও কোন কারণে রাজ্য থেকে বিসর্জিত হওয়ায় ভয়ংকর রকমের পাঞ্চাল-বিরোধী ছিলেন, আর দ্রোণাচার্য পাঞ্চালী কৃপীকে বিয়ে করে আগে থেকেই পাঞ্চাল দ্রুপদের বিরোধী গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সারা জীবন কুরুদের সেবা করে গেছেন, কারণ কুরুরা পাঞ্চালদের জন্মশত্রু।

এসব কথা পরে সময় মত আসবে। এখন পাঞ্চাল সুদাসের কথাটা আগে বলে নিই। মুগলের ছোটভাই সৃঞ্জয়, এই সৃঞ্জয়ই আসলে পাঞ্চাল রাজ্যের সবচেয়ে উপযুক্ত রাজা হয়ে গিয়েছিলেন; কেননা পরে কুরুকুলপতি ধৃতরাষ্ট্রের মুখে বা অন্য কারও মুখে আমরা বার বার সৃঞ্জয় বংশীয়দের গুণপনা শুনেছি। আসলে কুরুর নামে যেমন কৌরবেরা বিখ্যাত হয়েছিল, সাত্বতের নামে যেমনি যাদবেরা, তেমনি সৃঞ্জয়ের নামে গোটা পাঞ্চাল বংশটাই চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। সুদাসের নাম সম্বন্ধে বিভিন্ন পুরাণগুলিতে নানা তথ্যপ্রমাদ ঘটেছে। একমাত্র বায়ু পুরাণের তথ্য যেহেতু ঋগবেদে বর্ণিত তথ্যের সঙ্গে মেলে তাই আমরা সেটাই মেনে নেব। আসলে সৃঞ্জয়ের বংশেই দিবোদাসের জন্ম হয়, সেই বংশেই চ্যবন রাজা–একে কোন কোন পুরাণ বলেছে পঞ্চজন, যদিও আসলে হবে পিজবন।(৩৯) এই চ্যবনের ছেলেই সুদাস, বেদ যাকে বলেছে সুদা, আর মনুসংহিতা একেবারে তার বাপের নামসহ হাজির করেছে–সুদা পৈজবনশ্চৈব। এই সুদার সঙ্গেই কুরুপিতা সংবরণের যুদ্ধ হয় এবং তাঁকে হঠে যেতে হয় সিন্ধুনদীর তীরে পার্বত্য অঞ্চলে। পাঞ্চালদের রাজ্য বেড়ে যায় বহুদূর পর্যন্ত।

মহামুনি বশিষ্ঠ যখন দুর্গত সংবরণের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন নাকি ভরতবংশের সবাই একসঙ্গে তাঁকে মন্ত্রিত্বে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল–অর্ঘ্যমভ্যাহরৎ তস্মৈ তে সর্বে ভারতস্তদা। আমরা বলি-ভরতবংশীয় বলতে তো শুধু সংবরণ একাই সেখানে ছিলেন, আরও আবার কারা ছিলেন ভরতবংশের? আসলে ‘ভারতাঃ বলতে এখানে ভরতবংশীয়দের বোঝাচ্ছে না, বোঝাচ্ছে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজাদের কথা যাঁরা সিন্ধু নদীর কাছাকাছি ছিলেন। রয়্যাল এশিয়াটিক সোেসাইটির এক জানালে বলা হয়েছে যে, পাঞ্চাল সুদার আক্রমণে তৎকালীন ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম দেশীয় রাজারা একজোট হয়েছিলেন। (৪০)পৌরব সংবরণের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মথুরার যাদবেরা, যযাতির আরেক ছেলে অনুবংশের ধারায় উশীনর শিবিরা, দুহ্যরা, যারা গান্ধারে রাজত্ব করছিল, মৎস্যদেশের রাজা, এবং তুরা, যারা রেওয়া অঞ্চলে ছিল। এই জোট বাঁধার ব্যাপারে বশিষ্ঠবংশীয় ব্রাহ্মণেরা মধ্যস্থতার কাজ করেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু হস্তিনাপুর আবার সংবরণের হাতে এসেছিল। সংবরণের ছেলে কুরুর আমলে হস্তিনাপুরের বাড়বৃদ্ধি চূড়ান্ত হয়। কুরু রাজা প্রয়াগ পেরিয়ে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠা করেন কুরুক্ষেত্র এবং কুরুজাঙ্গলনামক দুটি জায়গায়। মহাভারতের ভাষাতে কুরু রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল সরস্বতী নদীর তীরভূমিতে স্থিত.কাম্যক বন থেকে যমুনার কাছাকাছি খাণ্ডবপ্রস্থ পর্যন্ত এখনকার থানেশ্বর, মিরাট এবং দিল্লির কাছাকাছি অংশ এবং গঙ্গানদীর ওপর দিকে বিস্তীর্ণ দোয়াব অঞ্চল।

কুরুদের এই যে প্রতিপত্তি বাড়ল, এতে সাময়িকভাবে পাঞ্চালদের ক্ষমতা কমে এল। সুদার নাতি সোমকের আমলে দেখতে পাচ্ছি তাঁদের বংশই লুপ্ত হবার জোগাড় হয়েছিল।(৪১) সোমকের একটি মাত্র ছেলে হয়েছিল, তাঁর নাম জন্তু। একে নিয়ে বেশ মজার একটা গল্প আছে মহাভারতে। আসলে সোমকের ছেলে একটা হলে কি হবে, তাঁর বৌ ছিল একশটা। একশ মায়ের এক ছেলে, সবেধন নীলমণি, তার আদরও সাংঘাতিক। সমস্ত মায়েরা তাকে চোখে হারায়। একদিন হল কি, একটি পিঁপড়ে সেই বাচ্চা ছেলের কোমরে কামড়ে দিল, কচি মাংস বেশ ফুলে উঠল। তখন কে কাকে দেখে, সেই ছেলেও বিষ-পিঁপড়ের কামড়ে যেমনি কেঁদে উঠল, অমনি তাকে ঘিরে একশ মায়ের চিৎকার আরম্ভ হল। সে চিৎকার এমনই যে, অন্তঃপুর ভেদ করে তা রাজসভায় পৌঁছোল। রাজা খবর নিয়ে সব জেনেও বসে থাকতে পারলেন না, তাঁকে সভাভঙ্গ করে অন্তঃপুরে যেতে হল এবং বাবা-বাছা করে ছেলের চিৎকার থামাতে হল, কারণ রানীদের সম্মিলিত চিৎকার থামানোর এই ছিল একমাত্র উপায়। রাজা সোমক শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ভাবলেন-ধুর! এই এক ছেলে হওয়ার মত দুঃখ আর নেই। একশ রানীর প্রাণ যদি একটি মাত্র পুত্রের প্রতি স্নেহাতুর হয়ে ওঠে, তাহলে তার চাইতে করুণ অবস্থা আর কি হতে পারে–আসাং প্রাণাঃ সমায়ত্তা মম চাত্রৈকপুত্রকে। রাজা শেষে পুরোহিতদের সঙ্গে আলোচনা করে সেই এক পুত্রের মাংস অগ্নিতে উৎসর্গ করে যজ্ঞ করলেন 1. সোমকের একশ রানীর গর্ভে একশটি ছেলে হল। উৎসংকুল পাঞ্চালদের মধ্যে একশ ছেলে হওয়ার এতই মাহাত্ম্য ছিল যে, সোমকের নামেই পাঞ্চাল বংশ চালু হয়ে গেল। দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নকেই মহাভারতে সোমক বংশের প্রবর পুরুষসৃষ্টমঃ সোমকানাং প্রবহঃ-বলে উল্লেখ করা হয়েছে, মহারাজ দুপদকে বলা হয়েছে–সৌমকি যজ্ঞসেনঃ, অর্থাৎ সোমকদের ছেলে যজ্ঞ সেন। ধৃষ্টদান্ন দ্রুপদের কথা আগেই এসে গেল, অবশ্য এদের কথা আর দূরেও কিছু নয়। কারণ, যজ্ঞের ফলে এবার যে সোমকের একশ রানীর কোলে একশ ছেলে জন্মাল, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম পৃষত। ইনিই পরবর্তী পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের পিতা।

একটা কথা নিশ্চয়ই এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ভরতবংশীয় অজমীঢ়ের মাধ্যমে যে বংশরচনা হয়েছিল, তাদের এক ভাগ মূল ভূখণ্ড হস্তিনাপুর অঞ্চলে রাজত্ব করতে থাকল, আরেক ভাগ, তাঁরাও ভরতবংশীয়ই বটে, রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করল পাঞ্চালে। লক্ষণীয়, মহাভারতে পাঞ্চাল রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকেও ‘ভরতভ’ বলা হয়েছে। মজা হল, কৌরব-ভারতীয়দের সঙ্গে পাঞ্চাল-ভারতীয়দের কিন্তু শত্রুতা লেগেই রইল। ঠিক এইরকম একটা জায়গা থেকে আমাদের আরেকবার হস্তিনাপুরে ফিরে যেতে হবে।

ভরতবংশীয় কুরু রাজা তো নিজের নামে কুরুক্ষেত্র আর কুরুজাঙ্গল প্রতিষ্ঠা করে নিজের কীর্তি স্থাপন করলেন। এদিকে তাঁর যে চারটি পুত্র হল, তার মধ্যে দুজন দুই বংশের প্রবর্তক। কিন্তু তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের বংশটাই বাস্তুচ্যুত হয়ে চলে গেল অন্য জায়গায় এবং কনিষ্ঠপুত্রটির বংশে চার পাঁচ পুরুষ পরেই জন্মালেন মহারাজ শান্তনু, যিনি মূল পুরু-ভরত এবং কুরুবংশের ধারাটি হস্তিনাপুরে ধারণ করে রইলেন। কুরুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বাস্তুচ্যুত হলেন–এমন বলাটা ভুল, বলা উচিত তাঁর বংশের চতুর্থ পুরুষ উপরিচর বসু যাদবদের রাজা চেদি দখল করে ফেললেন-সেই চেদি যেখানে যাদব জ্যামঘের বংশধর বিদর্ভের ছেলে গিয়ে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এদিকে উত্তরে পাঞ্চালদের সঙ্গে, ওদিকে দক্ষিণে যাদবদের সঙ্গেও কুরুদের শত্রুতা আরম্ভ হল। এটা একটা সাংঘাতিক ঘটনা। কুরুবংশের চতুর্থ এক পুরুষ গিয়ে যে যাদবদের রাজ্য দখল করল, এর পর থেকেই ভারতবর্ষের ইতিহাস রীতিমত লোমহর্ষক হয়ে উঠেছে। উপরিচর বসুর অনেকগুলি ছেলে। তার মধ্যে আছেন বৃহদ্রথ, যাঁর থেকে কয়েক পুরুষ পরেই সেই বিরাট মানুষটার জন্ম হয়েছে, যাঁর নাম জরাসন্ধ। বস্তুত বৃহদ্রথ নিজেই খুব শক্তিশালী রাজা ছিলেন। মূল ভূখণ্ডের আশা ছেড়ে দিয়ে তাঁর বাবা যেমন চেদি দখল করেছিলেন, তেমনি তিনিও মগধ অধিকার করেন। প্রসিদ্ধ বাহদ্রথ বংশ সেখানেই চলতে থাকে। বৃহদ্রথেরই আরেক ছেলে কুশ বা কুশা, যার থেকে কৌশাম্বী নগরীর সৃষ্টি। তাঁরই আরেক ছেলে যদু, তিনি করূষ দেশের অধিপতি। করূষ জায়গাটা হল বিহারের শোন নদীর উত্তর পারের উপত্যকা অঞ্চল।

অনেক পৌরাণিকের মতে এই বৃহদ্রথের বাবা উপরিচর বসু স্বয়ংই মগধ দখল করেছিলেন এবং রামায়ণে তাঁর নামেই মগধের নাম বসুমতী। বৃহদ্রথের বংশে জরাসন্ধ রাজা হওয়ার পর থেকেই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে পূর্ব ভারতের রমরমা বেড়ে গেল। জরাসন্ধ নিজে একবারের তরেও তাঁর পূর্বজ কৌরবদের মূল ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা করেননি, যদিও কুরুর কনিষ্ঠ পুত্র থেকে যে বংশধারা হস্তিনাপুরে রাজত্ব করছিলেন, তাঁরা কেউই তেমন উল্লেখযোগ্য ছিলেন না। এমনকি কুলপতি ভীষ্মের পিতা শান্তনু পর্যন্ত সেই দরের রাজা ছিলেন না, যাতে করে জরাসন্ধের পক্ষে তাঁর রাজ্য দখল করে নেওয়ার কোন অসুবিধে হত। কিন্তু জরাসন্ধ সেদিকে যাননি। কারণ এক অর্থে তিনিও যে কৌরব। তিনি বরং মগধকেও এমন এক শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন যাতে সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। জরাসন্ধর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন যাদবেরা, যাদের আমরা কিছুক্ষণ আগেই সাত্ত্বতবংশ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রেখেছি। এবারে সাত্ত্বতের বংশ বিভাগ করতেই হবে।

ভরতবংশে অজমীঢ়ের পর থেকে যেমন কুরু এবং পাঞ্চালেরা ভাগ হয়ে গেল, কুরুর পরে যেমন কৌরবেরা এবং বৃহদ্রথেরা ভাগ হয়ে গেল, অনুরূপ ঘটনা যাদব সাত্ত্বতের বংশেও ঘটেছে। সাত্বতের চার ছেলে এবং চার ছেলেই এমন গুণের ছেলে যে, তাঁরা প্রত্যেকেই এক একটা বিরাট বংশের প্রতিষ্ঠাতা। এদের মধ্যে আবার অন্ধক এবং বৃষ্ণি এমন বিখ্যাত যে, তাঁদের থেকেও পৃথক পৃথক বিশাল বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেশি কথা বললে গুলিয়ে যাবে। শুধু এইটুকু জানুন যে, অন্ধকের বড় ছেলের নাম কুকুর এবং এই বংশেই কয়েক পুরুষ পরে মহারাজ উগ্রসেন এবং তাঁর ছেলে কংসের জন্ম। উগ্রসেনের দাদার নাম দেবক এবং তাঁর মেয়ে দেবকী কংসের জ্যাঠতুতো বোন, কৃষ্ণের মা। অন্যদিকে অন্ধকের আরেক ছেলের বংশে কৃতবর্মার মত বীরের জন্ম, যিনি ভারতযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন। সাত্ত্বতের আরেক ছেলে বৃষ্ণির বংশও কম উর্বর নয়। তাঁর আবার দুই বউ-এক বউ গান্ধারের মেয়ে, আরেক বউ মদ্র দেশের। গান্ধারীর গর্ভজাত বড় ছেলের ধারাতেই কৃষ্ণপ্রেয়সী সত্যভামার জন্ম, অন্যদিকে মাদ্রীর ধারায় দ্বিতীয় ছেলে দেবমীঢুষের দু পুরুষ পরেই কৃষ্ণ এবং বলরাম। মাদ্রীর প্রথম ছেলের ধারায় অর এবং তৃতীয় ছেলের ধারায় সাত্যকি–এরা সকলেই ভাইবোন।

সাত্ত্বতবংশের অধস্তন পুরুষেরা অনেকগুলি ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় এরা কে কোথায় রাজত্ব করছিলেন বলা খুব কঠিন। মথুরায় শৌরসেনী যাদবেরা ছিলেন, একথা মেগাস্থিনিস লিখেছেন, কিন্তু শুর তো হলেন কৃষ্ণের আপন ঠাকুরদাদা। কংস মারা যাবার পর হয়তো সেখানে কৃষ্ণের আপন গুষ্টির প্রতিপত্তি বাড়ে, কিন্তু তাঁর আগে কংসই ছিলেন মথুরার সর্বেসর্বা এবং তিনি ছিলেন অন্ধক-ভোজের বংশধর, যাকে পুরাণকারেরা গালাগালি দিয়ে বলেছেন–ভোজানাং কুলপাংশনঃ–ভোজবংশের কুলাঙ্গার। আমাদের ধারণা, ভোজবংশীয় কংসও মথুরায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন পরে এবং কখন সে প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা পরের কথা। আমরা আপাতত ঐতরেয় ব্রাহ্মণের মত পুরাতন গ্রন্থের প্রমাণে বলব যে, সাত্ত্বতবংশের বেশির ভাগ পুরুষ রাজ্যের লোভে হানা দিয়েছেন দক্ষিণে। ঐতরেয় বলেছে-দক্ষিণ দেশের রাজাদের সবাই ভোজ’ বলে ডাকে এবং তাঁদের রাজারা সব সাত নামেও প্রসিদ্ধ-দক্ষিণ্যং দিশি যে কে চ সাত্ত্বতাং রাজানো ভোজ্যায়ৈব তে’ভিষিচ্যন্তে ভোজেত্যেতা অভিষিক্তা আচক্ষত।(৪২)

সাত্ত্বত-পুরুষদের এই দক্ষিণমুখী অভিযানের প্রথম এবং প্রধান কারণ অবশ্যই কুরুবংশের ঊর্ধ্বতন পুরুষ ভরত, যিনি সাত্ত্বতদের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া কেড়ে নিয়েছিলেন এবং সে কথা আমরা পুর্বে উল্লেখ করেছি। কিন্তু ভোজ কিংবা সাত্বতেরা যত দক্ষিণেই যান, মথুরার অধিকার তাঁরা ছাড়েননি। উপরন্তু বিদর্ভ, চেদি, আনর্ত, অশ্বক-যেগুলিকে আজকের দিনের মধ্যদেশ, মহীশূর, গুজরাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে–এই সব রাজ্যেও যাদবেরা আস্তে আস্তে ঢুকে পড়েন। কিন্তু যাদবদের মধ্যে জাতীয় সংহতির কোন অভাব ছিল না।

সম্পূর্ণ ঘটনাটা যদি সারাৎসারে বলি তাহলে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায় সম্পূর্ণ যাদব রাজ্যখণ্ড সাত্ত্বতের চার ছেলের মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। ভজমান, দেবাবৃধ, অন্ধক এবং বৃষ্ণি–চারজনেই চার জায়গায় রাজ্য পেলেন। ভজমানের রাজ্য সম্বন্ধে মহাভারত-পুরাণে কিছু পাই না এবং তাঁর বংশধরেরাও এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। দেবাবুধের সঙ্গে যেহেতু রাজস্থানের পণশাি নীদর (এখনকার বনস) নদীর যোগ খুঁজে বার করা যায়, তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, তিনি এবং তাঁর বংশধরেরা মার্তিকাবতে রাজত্ব করতেন। মার্তিকাবত আবু পর্বতের এপার-ওধার। অন্ধক রাজত্ব করতেন আসল জায়গাটিতে–অর্থাৎ মথুরায়। অন্ধকের ছেলে কুকুর এবং ভজমান। একেবারে কংস পর্যন্ত কুকুরের বংশধারা চলেছিল এবং অন্ধককুকুরবংশজরাই চিরকাল মথুরার অধিপতি। অন্ধকের অন্য ছেলে ভজমানের বংশধরেরা অন্ধক বলেই প্রসিদ্ধ এবং পাণ্ডবদের সময়ে তাঁর বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ হলেন কৃতবর্মা। বৃষ্ণি রাজত্ব করতেন গুজরাটের দ্বারকায়, কেননা তাঁর বংশের অক্রূরের নাম এই জায়গার সঙ্গে জড়িত। এই সব জায়গা ছাড়াও আছে বিদর্ভ, অবন্তী, দশার্ণ কিংবা মাহিষ্মতী নগরী যেখানে ভোজ-সাত্বতেরা আপন আপন প্রভুত্ব বিস্তার করেছিলেন। অন্ধক, সাত-যত নামই থাকুক, ‘ভোজ’ শব্দটা সমস্ত যাদবদের প্রায় প্রতিশব্দের মত উপাধি। সেই অর্থে অন্ধকেরাও ভোজ, দেববৃধের বংশজেরাও ভোজ, উগ্রসেন-কংসও ভোজ আবার বিদর্ভদেশের রুক্মিণী-পিতা ভীষ্মক অথবা রুক্মিণীর ভাই রুক্মীও ভোজ। কৌটিল্য, মহাভারত এবং পুরাণগুলিকে বিশ্বাস করলে একথা মানতেই হবে যে, সাত্ত্বত-ভোজ কিংবা বৃষ্ণিবীরেরা কপোরেশন কিংবা রিপাবলিক’-এ বিশ্বাস করতেন এবং এইভাবেই তাঁরা সরকার চালাতেন। মনে রাখা দরকার এই সব ঘোট ঘোট যাদব ‘সংঘ’গুলির মধ্যে কায়েমী স্বার্থ বা প্রভুত্বের জন্য রেষারেষি ভালই ছিল। আবার অন্যদিকে বিভিন্ন রাজপরিবারের মধ্যে বিবাহ এবং সময়ে অসময়ে সামাজিক আদান-প্রদানও ছিল। এদের অবস্থাটা অনেকটা তুলনা করা যেতে পারে সম্মিলিত ইতালি কিংবা জামানীর পূর্বাবস্থার সঙ্গে। এখানে কৃষ্ণের ভূমিকাটা অনেকটা কাভুর কিংবা বিসমার্কের মত। তাঁর বিশেষত্ব হল–তিনি ওই পৃথক পৃথক যাদব সংঘগুলির মধ্যে এক ধরনের জাতীয় সংহতি স্থাপন করতে পেরেছিলেন, অন্তত তাঁর সমসাময়িককালে তো পেরেইছিলেন। কৃষ্ণ এই সংহতি সম্পন্ন করেন কংসপিতা উগ্রসেনকে সামনে রেখে। ঠিক এই ব্যাপারটা যে কৃষ্ণকে দারুণ সুনাম দিয়েছিল এবং জাতীয় রাজনীতিতে কৃষ্ণের পদবী সুস্থির করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে দুটি জায়গায়। মহাভারতে যেখানে পাশাখেলা চলছে সেখানে মহামতি বিদুর সামগ্রিকভাবে ভোজদের পূর্বতন সমস্যার কথা তুলেছেন। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন–মহারাজ! ভোজেদের ঘরের সমস্যা আপনার জানা আছে। আপনার জানা আছে–অন্ধক, যাদব এবং ভোজরা সবাই একযোগে কংসকে ত্যাগ করেছিলেন–অন্ধকাঃ যাদবা ভোজাঃ সমেতাঃ কংসমত্যজ (মহাভারত-২. ৬২.৭-৮)। এই যে সমস্ত যাদব কিংবা ভোজ সংঘগুলিকে কংসের বিরুদ্ধে এককাট্টা করে তোলা–এটাই ছিল কৃষ্ণের কাজ। এই কাজটা করার জন্য বর্ষীয়ান উগ্রসেনকে তিনি এমন সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছিলেন যে, ইতালির কাভুর কি জার্মানীর বিসমার্ক তাঁকে আভূমি প্রণাম করবেন। এমনকি পরের কাছে বলার সময়েও যেমন উদ্যোগ পর্বেহ ধৃতরাষ্ট্রকে কৃষ্ণ বলছেন–উগ্রসেনের ছেলে কংসকে তার বন্ধুজনেরা ত্যাগ করেছিল–পরিত্যক্তঃ স বাহ্মবৈঃ। সেই সুযোগে আমি যেমন তাকে শাস্তি বিধান করেছি, তেমনি সেই একই সুযোগে উগ্রসেনকে রাজা বানিয়ে সমস্ত যাদব, বৃষ্ণি, অন্ধকেরা এককাট্টা হয়ে সুখে আছে–সম্ভয় সুখমেধান্তে (মহাভারত, ৫, ১২৮, ৩৮-৪০)। কাজেই পরবর্তী সময়ে মহামতি কৃষ্ণের বিশেষত্ব হল যে, তিনি এই পৃথক পৃথক যাদব সংঘগুলির মধ্যে একটি সর্বদলীয় সংহতি স্থাপন করতে সফল হন। বৃষ্ণি, ভোজ, সাত্ত্বত, অন্ধক, কুকুর-ইত্যাদি সমস্ত সংঘমুখ্যেরা যে নিজেদের মধ্যে একতাসূত্রে বদ্ধ হন, সেই সূত্রটি হলেন কৃষ্ণ কৃষ্ণ হলেন একমাত্র ব্যক্তি, যাঁকে সাত্ত্বত, ভোজ, বৃষ্ণি, কুকুর কিংবা অন্ধক–এই সমস্ত উপাধিতেই ডাকা হয়েছে। পৃথক পৃথক সমস্ত যাদববংশেই তিনি সর্বসম্মত মুখ্যব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন এবং এই সর্বসম্মতি এসেছে প্রয়োজনে, কংস-জরাসন্ধের কারণে।

.

০৫.

পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির খাণ্ডবপ্রস্থ স্থাপনের সাফল্যে পুলকিত হয়ে যখন সম্রাট হতে চাইলেন, তখন যদুকুলপতি কৃষ্ণ তাঁকে মগধরাজ জরাসন্ধের গল্প বলেছিলেন। চণ্ডকৌশিক নামে মুনির জবানিতে কৃষ্ণ নিজের বক্তব্যই শোনালেন যুধিষ্ঠিরকে। পুরাণগুলির মতে যদিও জরাসন্ধ বৃহদ্রথের দু-চার পুরুষ পরের প্রজন্ম, কিন্তু মহাভারতের মতে জরাসন্ধ বৃহদ্রথের ছেলে জরাসন্ধের জন্মলগ্নেই চণ্ডকৌশিক জরাসন্ধকে যে আশীর্বাদ করেছিলেন, সেটা সম্পূর্ণ ফলে গেছে বলে পুরুষোত্তম কৃষ্ণের ধারণা। চণ্ডকৌশিক বৃহদ্রথকে বলেছিলেন–এ ছেলে তোমায় সব দেবে। পৃথিবীতে এমন কোন রাজা থাকবে না, যে এই জরাসন্ধের বলবীর্যের ধারে কাছে যেতে পারবে। সমস্ত ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নৃপতি বলতে যাঁদের বোঝায়, তাঁদেরও সবার মাথার ওপরে থাকবেন জরাসন্ধ–সর্ব মূধাভিষিক্তানাম্ এষ মূর্মি জ্বলিষ্যতি। সমস্ত আলোকের আধার সূর্যদেব যেমন অন্য সমস্ত কৃত্রিম আলোক ম্লান করে দেন, তেমনি জরাসন্ধের প্রতিভায় অন্যান্য নৃপকুলের প্রতিভা ম্লান হয়ে যাবে। উড্ডীন পতঙ্গেরা যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয়, তেমনি সমস্ত সমৃদ্ধ রাজারা একসময়ে জরাসন্ধের আগুনে ঝাঁপ দেবেন, অর্থাৎ তাঁদের নিজেদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না, সবাই হবেন জরাসন্ধের আজ্ঞাবহ–অস্যাজ্ঞবশগাঃ সর্বে ভবিষ্যন্তি নরাধিপাঃ।(৪৩)

মুনি চণ্ডকৌশিকের বক্তব্য শেষ করে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন–হ্যাঁ, জরাসন্ধ তাই করেছেন। তিনি সমস্ত ভারতবর্ষের রাজা মহারাজাকে আপন বশবর্তী করে ফেলেছেন। এটা কৃষ্ণের সিদ্ধান্ত। কৃষ্ণ জানেন যে, জরাসন্ধ বেঁচে থাকতে অন্য কোন রাজার পক্ষে সার্বভৌম চক্রবর্তী সম্রাট হওয়া সম্ভব নয়। কৃষ্ণ এবং যুধিষ্ঠিরের পারস্পরিক আলাপ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাভারতের কথক-ঠাকুর বৈশম্পায়ন তাঁর শ্রোতা জনমেজয়ের কাছে ঠিক সেই সময়ের পরিস্থিতিটি তুলে ধরলেন, যাতে বোঝা যায় জরাসন্ধের ব্যাপারটা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের থেকেও কৃষ্ণের কাছে বেশি জরুরী। বৈশম্পায়ন বললেন–হ্যাঁ, চণ্ডকৌশিকের আশীর্বাদমত জরাসন্ধ ভালই রাজত্ব করছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি বাসুদেব কৃষ্ণ কংসকে মেরে ফেলায় জরাসন্ধের সঙ্গে তার দারুণ শত্রুতা আরম্ভ হয়ে গেছে–জাতো বৈ বৈরনিবন্ধঃ কৃষ্ণেন সহ তস্য বৈ।(৪৪) বৈশম্পায়নের মুখ থেকে এইমাত্র যে খবরটা বেরিয়ে এল, সেটা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য, কিন্তু তার আগে আমাদের একবার জরাসন্ধের রাজধানী মগধে যাওয়া প্রয়োজন।

মগধ জায়গাটা আগে ভদ্রলোকের জায়গা ছিল না। ভদ্রলোক মানে তখনকার মতে আর্য প্রভুরা। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ–এই সব পূর্বাঞ্চলের ভাষাও তাঁদের ভাল লাগত না, আচার-আচরণও নয়। ফলে এ সব জায়গায় এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত আর্যদের। মূল আর্যগোষ্ঠী থেকে বেরিয়েও জরাসন্ধ যেহেতু মগধে বসতি গেড়েছিলেন সে জন্য তিনি যে অনেক আর্যগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার ওপরে তাঁর আরও দোষ, তিনি ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে অত্যন্ত সদ্ভাব রেখে চলতেন, এটা কখনোই উত্তর-ভারতীয় আর্যদের পছন্দ হতে পারে না। কিন্তু তাঁরা পছন্দ করুন, চাই নাই করুন, জরাসন্ধ যে রাজনীতিটা ভাল বুঝতেন সেটা মহাভারতে কৃষ্ণের মুখে জরাসন্ধ প্রশংসাতেই প্রমাণিত।

রাজধর্মবিৎ পণ্ডিতেরা রাজাদের থাকবার জন্য যে রকম জায়গা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, জরাসন্ধ সেইরকম একটা জায়গায় নিজের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এখনকার বিহারের দক্ষিণাঞ্চলে পাটনা আর গয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়েই তখনকার মগধ। জরাসন্ধের রাজধানীর নাম গিরিব্রজ, যেটাকে পুরনো রাজগৃহ (এখনকার রাজগিরের কাছে) বলা যায়। মহাভারতে কখনো গিরিব্রজকে রাজগৃহও বলেছে, কখনো বা বলেছে মাগধপুর, আবার কখনো জরাসন্ধের বাবার নামে বাহদ্রথপুর জরাসন্ধের মত নামী রাজার রাজধানীকে কি আর একটি মাত্র নামে ডাকা সঙ্গত হয়। গিরিব্রজ এমনই এক রাজধানী যা যে কোন দিক থেকে অতিবড় শত্রুর পক্ষেও দুর্গম–দুরাধষং সমন্ততঃ। পাঁচটা পাহাড় যেন একত্র সংহত হয়ে জরাসন্ধের রাজধনীকে দেবতার মত রক্ষা করছে। পাঁচ পাহাড়ের প্রথমটার নাম ‘বইহার। আমি এটাকে আগে ‘বিহার’ শব্দ নিষ্পন্ন ‘বৈহার ভাবতাম, বিভূতিভূষণের লবটুলিয়া বইহারও আমার কাছে স্থাননাম ছাড়া অন্য অর্থে ধরা দেয়নি। কিন্তু বৈহার’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই মহাভারতকার তার অর্থ দিয়ে বলেছেন-বৈহারো বিপুলঃ শৈলঃ, অর্থাৎ বইহার মানে বড় পাহাড়। এখানে অবশ্য বৈহার, বরাহগিরি, বৃষভগিরি, ঋষিগিরি এবং চৈত্যক–এই পাঁচ পাহাড় ঘিরে আছে জরাসন্ধের নগরী। এই চারদিকে পাহাড়, আর শীতলছায়া বড় বড় গাছ,–পর্বতঃ শীতলদুমাঃ, পিপ্পলীময় বনরাজি কিংবা লোফুলের গন্ধ-কোনটাই কিন্তু জরাসন্ধকে কবি করে তুলতে পারেনি। তাঁর বাবার বাবা উপরিচর বসু এক সময় চেদি থেকে যাদবদের খেদিয়ে দিয়ে স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার পর থেকেই যাদবদের মধ্যে অসন্তোষ চলছে। যদুবংশের জ্যামঘ রাজা যে শুক্তিমতী নদীর তীরে আস্তানা বানিয়েছিলেন, সেই শক্তিমতীর তীরেই জাঁকিয়ে বসেছিলেন উপরিচর বসু-পুরোপবাহিনীং তস্য নদীং শুক্তিমতীং গিরিঃ।(৪৫) ‘উপরিচর’ নামটা পৌরাণিকেরা অপব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, ওই রাজা নাকি আকাশে উঠে যেতে পারতেন এবং সেই জন্যই তিনি নাকি চৈদ্য উপরিচর। আমরা কিন্তু সাদা বাংলায় বুঝি যে, তিনি চৈদ্য রাজার ওপরে চড়াও হয়েছিলেন বলেই চৈদ্য উপরিচর। বস্তুত বসু রাজার আক্রমণের ধরনেই চেদিবাসী যাদব চৈদ্যদের মনে হয়েছে যেন আকাশ থেকে চড়াও হয়েছিলেন তিনি। এ দুঃখ যাদবরা ভুলবে কি করে? সেই থেকেই তারা প্যাঁচ কষছিল কিভাবে বসু মহারাজকে জব্দ করা যায়। কিন্তু কপাল মন্দ, জব্দ তো দূরের কথা, তার বদলে তাঁর ছেলে বৃহদ্রথ এবং তাঁরও ছেলে জরাসন্ধ এমন শক্তিমান হয়ে উঠলেন, যে তখন তাদের নিজেদের রাজ্য সামলানোই দায় হয়ে পড়ল। অনেক যাদব জাতভাইরাও ভিড়ে গেল জরাসন্ধের পক্ষে! কিন্তু কেন ভিড়ে গেল? আসলে সেইখানেই জরাসন্ধের রাজনীতি।

জরাসন্ধের দুটি মেয়ে ছিল–অস্তি আর প্রাপ্তি। দুজনেই বেশ যৌবনবতী, হরিবংশের ভাষার ব্যঞ্জনায় এদের কটিদেশের পশ্চাৎ ভাগে এবং বক্ষদেশে যথেষ্ট সুলতা ছিল–পীনশ্রোণীপয়োধরে। জরাসন্ধ নিজের এই মেয়ে দুটিকে দান করলেন মথুরাদেশে ভোজপুংগৰ কংসের হাতে। আমাদের ধারণা কংস যে মথুরার রাজত্ব পেয়েছিলেন, তাতে জরাসন্ধের হাত ছিল। কেননা যিনি আগে মথুরার রাজা ছিলেন, তিনি হলেন যাদবদের অনুমোদিত পুরুষ উগ্রসেন। তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই যে তাঁর ছেলে কংস মথুরার রাজত্বভার পেলেন, এর পেছনে জরাসন্ধের ইন্ধন ছিল। কেননা হরিবংশ একেবারে স্পষ্ট খবর দিয়ে বলেছে যে, কংস শৌরসেনী যাদবদের রাজা হয়েছেন যাদবদের সম্মিলিত ইচ্ছাকে অনাদর করে এবং এই অনাদর তিনি করার সাহস পেয়েছেন মগধরাজ জরাসন্ধের মদতে–সমাশ্ৰিত্য জরাসন্ধ অনাদৃত্য চ যাদবান্।(৪৬)

ভাবুন একবার, কোথায় মগধ আর কোথায় মথুরা! কিন্তু সেই সুদূর মগধে বসেই জরাসন্ধ বুঝেছিলেন যে, ভোজ বৃষ্ণিদের নিজেদের মধ্যে আন্তরিক বিসংবাদ আছে। একটা জিনিস বুঝতে হবে যে কংসের পূর্ববর্তী রাজা এবং পিতা উগ্রসেন ভোজবংশীয় পুরুষ এবং তিনি রাজত্ব চালাচ্ছিলেন। পুরাণগুলি এবং মহাভারত যে কথা ঘুণাক্ষরেও বলেনি, সেটা হল কংসপিতা উগ্রসেনের দাদা কিংবা ছোটভাই হলেন দেবক, কোনভাবেই তিনি রাজা হতে পারেননি। এই দেবক দেবকীসহ তাঁর সাত সাতটা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বসুদেবের সঙ্গে, যে বসুদেব তাঁর পালটি ঘর বৃষ্ণি বংশের ছেলে। দেবকের নিজের তো রাজা হওয়ার কোন উপায়ই ছিল না, তাঁর ছেলেদেরও সে সুযোগ ছিল না, কেননা কাল পরিণত হওয়ার আগেই কংস নিজ পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে নিজে রাজা হন। এ দিকে কৃষ্ণপিতা বসুদেবও খুব সাধারণ মানের লোক ছিলেন না। বৈষ্ণবেরা ভাগবত পুরাণ পড়ে বসুদেবকে বড় নিরীহ গোবেচারা লোক মনে করেন। কিন্তু আমরা বেশ জানি বসুদেবের মধ্যে মথুরার রাজা হবার সম্ভাবনা ছিল এবং সেইজন্যই কংসের সঙ্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এমন হতে পারে যে পূর্ববর্তী রাজা উগ্রসেন বসুদেবকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন, কারণ আমরা কংসের মুখেই শুনেছি যে, কংসের বাবাই বসুদেবকে লালনপালন করে বড় করেছেন। কংস সে কথা বসুদেবকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে–আমার বাবার খেয়ে-পরে তুমি বড় হয়েছ-মম পিত্রা বিবর্ধিতঃ। এমনও হতে পারে যে, উগ্রসেনের বসুদেবপ্রীতি তাঁর নিজপুত্র কংসের থেকেও বেশি ছিল, কারণ হরিবংশের প্রমাণে জানি উগ্রসেন তাঁর এই উদ্ধত পুত্রটিকে পছন্দ করতেন না। এমনও হতে পারে-উগ্রসেনের পর এই বসুদেবের মধ্যে রাজসম্ভাবনা দেখেই তাঁর ভাই দেবক বসুদেবকে সাত মেয়ের বর এক জামাই পছন্দ করেছেন। শুধু তাই নয়, এই মথুরায় বসে স্বয়ং রাজা না হওয়া সত্ত্বেও বসুদেব যে কতটা বড় মানুষ ছিলেন, তা বুঝবেন আরেকটি ঘটনায়। নিজের জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে দেবক না হয় বসুদেবকে মেয়ে দিয়ে আপন স্নেহবশত বেশি মর্যাদা দিয়েছেন; কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজাধিরাজ পুরু-ভরতবংশীয় শান্তনু রাজার ছোট ভাই বাহিক তাঁর পাঁচ পাঁচটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এই বসুদেবের সঙ্গেই। এ কথাটা যথেষ্ট ভাববার মত। মহারাজ শান্তনু কুরুকুলপতি ভীষ্মের পিতা। শান্তনুর ছোট ভাই বহ্রিক কিংবা তার বংশীয় অধস্তন পুরুষেরা কুরুসভায় ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিমণ্ডলীতে ছিলেন। কুরুবংশীয় বাহিকের পাঁচ মেয়ের মধ্যে সবার বড় হলেন রোহিণী, বড় ঘটা করে যাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে পৌরবী বলে, মানে পুরুবংশের মেয়ে-পৌরবী রোহিণী নাম বাহিক্য আত্মজাভবৎ।(৪৭) পুরু অথবা কুরুবংশের এই মেয়ের গর্ভেই বসুদেবের ঔরসে কৃষ্ণের দাদা বলরামের জন্ম। মাতৃবংশের ঘরের ঝগড়া বলেই কি বলরাম শেষ পর্যন্ত কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধে কোন অংশ নেননি অথবা সেই জন্য কি তাঁর প্রচ্ছন্ন পক্ষপাত ছিল কুরুবংশের নিকষিত দাবিদার কুরুরাজ দুর্যোধনের প্রতি?

বলরামের প্রসঙ্গ ছেড়ে বসুদেবের কথায় ফিরে আসি। এই যে দেবকের সাতটি মেয়ে ছাড়াও বড় ঘরানার পাঁচটি পৌরবী কন্যা বসুদেবের গললগ্না হলেন, এর মধ্যে রাজসম্ভাবনার অভিসন্ধি ছিল বলেই আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের এ বিশ্বাস জোরদার হওয়ার আরও কারণ আছে, কিন্তু সে কথাও পরে। আপাতত এইটা মনে রাখতে হবে যে, সুদুর মগধ দেশে বসেও জরাসন্ধ ভোজ বৃষ্ণি-যাদবদের ঘরোয়া বিসংবাদের সমস্ত খবর রাখতেন। উগ্রসেনের উদ্ধত ছেলে কংসকে দিয়ে তাঁর স্বকার্য সাধন হবে বুঝেই জরাসন্ধ কংসের সঙ্গে নিজের দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁকে রাজ্যলাভে সাহায্য করেছেন। জরাসন্ধের স্বার্থ হল–তিনি সোজাসুজি যাদবদের প্রধান এবং সবচেয়ে পুরাতন ঘাঁটিটি আক্রমণ না করেও তাঁর বশংবদ মানুষটিকে যাদবদের ওপর চাপিয়ে দিলেন এবং এইভাবে তাঁর নিজের আধিপত্যও চাপিয়ে দিতে সফল হলেন যাদবদের ওপর। মজা হল, যিনি মূলত অত্যাচারী এবং প্রখর স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন, তিনি যত বড় রাজাই হোন পরিণামে সফল হন না। রাজা হবার পর থেকে কংসের অত্যাচার বাড়তেই থাকল। অন্যদিকে কৃষ্ণ যতই বলুন জরাসন্ধ অমুক রাজাকে বন্দী করেছেন, একশ রাজাকে গারদে পুরেছেন, আমাদের ধারণা, এগুলি সবই তাঁর সাম্রাজ্যবৃদ্ধির উপায়। তিনি নিজে কখনোই অত্যাচারী রাজা বলে নিন্দিত হননি। কিন্তু কংস অত্যাচারী বলেই সমস্ত গ্রন্থে প্রমাণিত। কংস অসুরও নয়, দানবও নয়, পূর্বজন্মের কালনেমিও নয়, পৌরাণিক খোলস খুলে ফেললেই দেখা যাবে তিনি অত্যাচারী রাজা। জরাসন্ধ এমনটি চেয়েছিলেন কি না বলতে পারব না, কিন্তু মেয়ে কংসকে দেওয়ার ফলে তাঁর দিক থেকে সীমাবদ্ধতা কিছু থাকলেও থাকতে পারে।

ইতিহাসের দৃষ্টিতে হরিবংশ এবং অন্যান্য পুরাণগুলি বিচার করলে দেখবেন, অন্য সমস্ত যাদববৃষ্ণিমুখ্যদের মধ্যে কৃষ্ণপিতা বসুদেবের ওপরেই কংসের রাগ সবচেয়ে বেশি, এর কারণ অবশ্যই বসুদেবের মধ্যে সেই রাজসম্ভাবনা, যেটাকে কংস ভয় পেতেন। বসুদেবের ওপর কংসের ব্যক্তিগত ক্রোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, সম্ভবত সেই জন্যই বসুদেব কৃষ্ণকে কংসের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছেন এবং তাঁকে লুকিয়ে রেখেছিলেন ব্রজে। তাঁর পৌরবী পত্নী রোহিণীকে বহু পূর্ব থেকেই বৃন্দাবনে বন্ধু নন্দগোপের ঘরে রেখে দিয়েছিলেন বসুদেব। বলরাম সেখানেই জন্মেছেন, এবং কৃষ্ণকেও সেইখানেই পাঠানো হয়েছে। আরেকটা জিনিস লক্ষণীয়, সেটা হল–হরিবংশ বলেছে যে কংস জরাসন্ধকে আশ্রয় করে যাদবদের একটুও আমল না দিয়ে উগ্রসেনকে বন্দী করেন এবং রাজা হন। এর ফলে যাদবদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। সমস্ত ভোজবৃষ্ণি–অন্ধককুল যে কংসের বিরোধিতায় নেমে পড়ল, তার কারণ ক্রমাগত অত্যাচারে কংস তাঁদের আরও ক্ষেপিয়ে নিয়েছিলেন। বাসুদেব কৃষ্ণ ততদিনে মানুষ হয়ে পড়েছেন এবং তিনি কংসের প্রেরিত অনিষ্টকারী অনেককেই মেরে ফেলছেন। কৃষ্ণের প্রতিপত্তি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে যাদবদের আশা ভরসা সবই বাড়তে থাকে, উল্টোদিকে কংসের ভয়ও বাড়তে থাকে। ঠিক এইরকম একটা অবস্থায়, যখন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কংসের কোন কৌশলই আর খাটল না, তখন মথুরার এক ‘স্তিমিত-মুক’ রাত্রিতে কংস তাঁর বন্দী পিতা উগ্রসেন থেকে আরম্ভ করে যদুবংশের সমস্ত মুখ্য নেতাদের ডেকে পাঠালেন তাঁর রাজসভায়। সভায় আহৃতদের মধ্যে প্রথম নাম কিন্তু কৃষ্ণপিতা বসুদেব, তারপর আছেন কৃতবর্মা, অক্র, ভূরিশ্রবা ইত্যাদি যাদব বীরেরা এবং আছেন কংক-কংসের ছোটভাই। এরা সবাই কংসের মন্ত্রী, হরিবংশে স্বয়ং কংসের ভাষানুযায়ী ‘রাজমন্ত্ৰধরাঃ সর্বেঃ”। তার মানে, যে বসুদেবের সঙ্গে কংসের মূল বিরোধিতা, তাঁকেও কিন্তু কংস মন্ত্রিপদে বরণ না করে পারেননি।

রাজসভায় আলোচনার আরম্ভে কংস তাঁর মন্ত্রীদের যথোচিত প্রশংসা করে কৃষ্ণের কথা পাড়লেন এবং প্রথমেই অনুযোগ করলেন যে তাঁর সুযোগ্য মন্ত্রীরা থাকা সত্ত্বেও একটি গোয়ালার ছেলে তাঁর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। কংস আরও বললেন–আসলে আমার কোন সুযোগ্য মন্ত্রীই আজ আমার পাশে নেই, মন্ত্রী থেকেও আজ আমি মন্ত্রীহীন-আত্মীয়-স্বজনও আমার সহায় নয়–অমাত্যস্য শূন্যস্য। আমরা জানি, কংস রাজাই হয়েছেন এই সব যদুমুখ্যদের বিরোধিতার মুখে, এখন সেই বিরোধিতা আরও বেড়েছে। এই বিরুদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অবশ্যই বসুদেব। তাই এ কথা সে কথার পরেই কংস বসুদেবেরই মুখোস খুলে দিতে চাইলেন সবার সামনে। কংস বললেন-কাক যেমন মানুষের মাথার ওপরে বসে সেই মানুষেরই চোখ খুবলে নিতে চায়, তেমনি এই বসুদেবও আমারই খাচ্ছে, অথচ আমারই মূলোচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর-ছিনত্তি মম মূলানি ভুঙক্তে চ মম পাশ্বতঃ।(৪৮) কংসের ধারণা, বসুদেব নিজে না হলেও তাঁর ছেলে রাজা হোক মথুরায়–এটা বসুদেব চান। কংস সে আশায় জল ঢেলে দিয়ে বলেছেন কংস মরলে, আমারই ছেলে রাজা হবে মথুরায়-হতে কংসে মম সুতো মথুরাং পালায়িষ্যতি-বসুদেব! তোমার এই আশা আমি ছিন্নভিন্ন করে দেব।

কংস যতই বাগাড়ম্বর করুন না কেন, তিনি বসুদেবকে যেভাবে পরবর্তী সময়ে মর্যাদা দিয়ে কথা বলেছেন, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় বসুদেবই ছিলেন কংসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। কংস বসুদেবের বিশেষণ দিয়েছেন-যদুদের নায়ক বলে, প্রধান বলে–যদুনাং প্রথমো গুরু, যদুনাং যূথমুখ্যস্য। এ ছাড়া বসুদেবের পেছনে যে সমস্ত যাদবেরা একত্রিত হয়েছিলেন, সেটা বোঝা যায় কংসের ভাষাতেই। কংস বললেন-যদুদের বড় ঘরে তোমার জন্ম, তুমি নিজেও বিখ্যাত হয়েছকুলে মহতি বিখ্যাতঃ–এবং সেই গৌরবের জন্যই শ্রেষ্ঠ মানুষেরা তোমার কদর করে–পূজতঃ সঙিমহদ্ভিঃ ধর্মবুদ্ধিভিঃ।

কংসের এই বসুদের-প্রশংসা দু-চার পংক্তির। তার পরেই তাঁর নিন্দা আরম্ভ হয়েছে এবং কি কি ভাবে কংস তাঁকে শায়েস্তা করবেন, সে পন্থাও তাঁকে জানানো হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, প্রবল প্রতাপান্বিত রাজা হওয়া সত্ত্বেও উন্মুক্ত রাজসভায় বসুদেবের অনুকূলে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন এক অন্ধক বৃদ্ধ। কংসকে তিনি যা-ইচ্ছে-তাই কথা শোনাতেও কসুর করেননি। হরিবংশে অন্ধকবৃদ্ধের এই বক্তৃতা প্রমাণ করে যে, বসুদেব একা ছিলেন না। তার ওপরে এই বৃদ্ধের মুখে রাজনীতির চালটা এমনই হল যে, বসুদেবের দুই পুত্র বলরাম এবং কৃষ্ণের ওপরে কংস যে অত্যাচার করছেন, তার প্রথম দায়ও বতাল কংসের ওপর।

বক্তৃতা, প্রতিবক্তৃতা, শত্রুতা এবং প্রতিশত্রুতার ফল শেষ পর্যন্ত এই হল যে কংস বাঁচতে পারলেন না। যুদবৃষ্ণিদের সমর্থনপুষ্ট কৃষ্ণ-বলরাম, কংস এবং তার বন্ধুবর্গকে একেবারে যমের বাড়ি পাঠালেন। ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা অবসিংবাদিত হল। তিনি রাজনীতি এতটাই বুঝতেন যে, বসুদেবকেও তিনি রাজা করলেন না-নিজেও রাজা হলেন না। রাজপদের জন্য তিনি ফিরিয়ে আনলেন বন্দী রাজা কংসপিতা উগ্রসেনকে। এর ফলে কংস-গোষ্ঠীর অনেকেই নিশ্চয়ই খুশি হল এবং জনসমক্ষে কৃষ্ণের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হল। কৃষ্ণের মর্যাদা এখন রাজার নয়, রাজকতার-কিংমেকারের।

কংসের মৃত্যু মানেই জরাসন্ধের সঙ্গে কৃষ্ণের শত্রুতা আরম্ভ। এই শত্রুতার মধ্যে যাবার আগেই আমাদের একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে, কৃষ্ণপিতা বসুদেব কুরুরাজ শান্তনুর ভাই বাহিকের মেয়ে বিয়ে করায় নিশ্চয়ই যাদবদের সঙ্গে কৌরবদের সম্পর্ক বেড়েছিল। এ সম্পর্কটা আরও বোধহয় ঘনীভূত হয়েছে যখন স্বয়ং বসুদেবের বোনের বিয়ে হল মহারাজ পাণ্ডুর সঙ্গে। কুন্তী বসুদেবের বোন এবং তাঁর সঙ্গে পাণ্ডুর বিয়ে হয়েছে তাঁর রাজা হবার পর। পাণ্ডু নিজে কুরু বংশের লোক বলেই কুরু বংশের আরেক শাখা-বংশ জরাসন্ধের সঙ্গে তাঁর কোন সরাসরি শত্রুতা হয়নি। কিন্তু পাণ্ডুর রাজত্ব মোটেই বেশি দিন টেকেনি এবং যাদবদের সঙ্গে জরাসন্ধের শত্রুতাও বোধ হয় তার পরে আরম্ভ হয়। পাণ্ডুর সঙ্গে কুন্তীর বিয়ে হওয়ার কোন সুফল যাদবরা পেলেন না। মাঝখানে পাণ্ডু মারা যাবার পর পাণ্ডবেরা ধৃতরাষ্ট্রের রাজহমলে যে-রকম বিপদ-আপদের মধ্যে দিন কাটাতে লাগলেন, তাতে জরাসন্ধের প্রতিপত্তি আরও বেড়ে গেল। কুরুরাজ দুর্যোধন নিজেও জরাসন্ধের ওপর টেক্কা দেওয়ার কোন চেষ্টা করেননি; অন্তত জরাসন্ধ যত দিন বেঁচেছিলেন, তত দিন দুর্যোধন জরাসন্ধের সহায়তা করেছেন এবং সেটা আরও করেছেন পাণ্ডবেরা যদুবংশের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে।

জামাই কংসের মৃত্যুসংবাদে ব্যথিত এবং ক্রুদ্ধ জরাসন্ধ যে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মগধ থেকে সুদূর মথুরায় যাত্রা করেছিলেন, সেই বাহিনীর পুচ্ছভাগে ছিলেন স্বয়ং কুরুরাজ দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইয়েরা–দুর্যোধনাদয়শ্চৈব ধার্তরাষ্ট্রা মহাবলাঃ।(৪৯) জরাসন্ধের বাহিনীতে আর যাঁরা কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন, তাঁদের একজনের নাম ক্ৰথ। ইনি অবশ্যই বিদর্ভের মানুষ, যদিও বিদর্ভ ছিল পুর্বে যাদবদের জায়গা। ছিলেন করূষ দেশের রাজা দন্তবক্র, যাঁর রাজত্ব ছিল শোন নদীর অববাহিকায় করুষ দেশে। করূষ দেশে অবশই যাদবরা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং এই দম্ভবক্রের বাবা বৃদ্ধশর্মার সঙ্গে কৃষ্ণপিতা বসুদেবের আরেক বোন পৃথুকীর্তির বিয়ে হয়। করূষের পাশেই চেদি, যে চেদি আগে যাদবদের ছিল, পরে জরাসন্ধের পিতার রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। এই চেদিরাজ শিশুপালের পিতাও কিন্তু বিয়ে করেছিলেন বসুদেবের আরেক বোন শ্রুতস্রবাকে। তাহলে দেখুন বসুদেবও খুব কম লোক ছিলেন না। জরাসন্ধের পাশের রাজ্য করূষ এবং চেদিতে নিজের বোনেদের বিয়ে দিয়ে এই রাজ্যের রাজাদের নিয়ে তিনি যে জরাসন্ধের বিরুদ্ধে একটা গোষ্ঠী তৈরি করতে চেয়েছিলেন রীতিমত, তা বেশ বোঝা যায়। কিন্তু মজা হল, বসুদেব কিংবা এই যাদব নায়কের সমস্ত ‘স্কিমগুলিই ব্যর্থ হয়েছে। কৌরববংশে পৃথাকুন্তীর বিবাহের সুফলটা না হয় ব্যর্থ হয়েছে ভাগ্যদোষে, কিন্তু মগধের পাশেই করুষ আর চেদিতে যে বিয়েগুলো হল, তার সুফলটা বসুদেব কিংবা আরও পরবর্তীকালে কৃষ্ণ যে একটুও পাননি তা কিন্তু জরা: ব্ধর রাজনৈতিক বুদ্ধিতেই। যেভাবেই হোক, জরাসন্ধ তাঁর মতাদর্শ এই দুই দেশের রাজা দন্তবক্র এবং শিশুপালের ওপর চাপাতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিশেষত হরিবংশের বর্ণনামত শিশুপাল জরাসন্ধের পুত্ৰকল্প ছিলেন। পুরাণ এবং শাস্ত্রগ্রন্থগুলি দন্তবক্র এবং শিশুপালকে পূর্বজন্মের রাবণ-কুম্ভকর্ণ অথবা হিরণ্যাক্ষ-হিরণ্যকশিপু সাজিয়ে তাঁদের কৃষ্ণ-বিদ্বেষের কারণ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আমরা জানিজরাসন্ধের ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক বুদ্ধি এতই প্রখর ছিল যে, দন্তবক্ৰ-শিশুপাল দুজনেই জরাসন্ধের অন্ধ পক্ষপাতী হয়ে পড়েন। এর জন্য কোন অজুহাতেরই প্রয়োজন নেই।

কৃষ্ণের বিরুদ্ধে জরাসন্ধের বাহিনীতে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম নাম করতে হয় পৌণ্ড্রক বাসুদেবের। ইনি নামে মোটামুটি অবিভক্ত বাংলার উত্তরাধের মানে, পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা ছিলেন। হরিবংশের প্রমাণে পৌণ্ড্র বাসুদেব অঙ্গবঙ্গ কলিঙ্গ দেশের রাজা ছিলেন, তবে এসব রাজ্যে তাঁরই নিযুক্ত সামন্ত রাজারা রাজ্য শাসন করতেন বলে মনে হয়, কারণ জরাসন্ধের সঙ্গে অঙ্গ কলিঙ্গ এবং বঙ্গদেশের রাজাদেরও দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য অঙ্গরাজ্য পুরোটা পৌীকের রাজ্যভুক্ত ছিল বলে মনে হয় না,কারণ বৌদ্ধগ্রন্থ বিধুর পণ্ডিত জাতকে রাজগৃহের মত মগধরাজধানীকে অঙ্গরাজ্যের একটি নগরী বলা হয়েছে। আসলে অঙ্গদেশের কিছু অংশ নিশ্চয়ই জরাসন্ধের রাজ্যভুক্ত ছিল, আবার কিছু অংশ হয়তো কৌরব দুর্যোধনেরও বিষয়ভুক্ত ছিল, আবার কিছুটা বা পৌণ্ড্রক বাসুদেবেরও। দুর্যোধন যখন কর্ণকে অঙ্গরাজ্য দান করেন তখন কর্ণের রাজধানী ছিল চম্পা, গঙ্গা আর চম্পা নদীর ওপরেই চম্পা নগরী, এখনকার চান্দন। কানিংহাম সাহেব এখানকার ভাগলপুরের দুটি স্থান চম্পানগর আর চম্পাপুরকে পুরাতন চম্পার কাছাকাছি আনতে চান। চম্পা নদীই ছিল অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে মগধের বিভেদরেখা। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী হরিবংশের প্রমাণে বলতে চেয়েছেন যে, চম্পা নগরীর পূর্ব নামই মালিনী-চম্পস্য তু পুরী চম্পা যা মালিনী অভবৎ পুরা। কিন্তু যেহেতু মালিনীকে এখনকার কোন দেশনামের সঙ্গে একাত্ম করা যায়নি, অতএব সেটিই চম্পা, এমন বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। কারণ মহাভারতের শান্তিপর্বে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যুবক কর্ণ (তিনি তখন অবশ্যই দুযযাধনদত্ত অঙ্গরাজ্য পেয়েছেন। একবার বৃদ্ধ জরাসন্ধের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করেন। কর্ণের অসাধারণ শক্তি দেখে জরাসন্ধ তাঁকে মগধভুক্ত অঙ্গরাজ্যের ‘মালিনী নগরীটি পারিতোষিক হিসেবে দেন। এখানে পরিষ্কার বলা আছে যে, জরাসন্ধও অঙ্গরাজ্যের মালিক ছিলেন–অঙ্গে নরশাদুল স রাজাসীৎ সপত্নজিৎ।(৫০) কিন্তু তিনি যখন প্রীত হয়ে মালিনী নগরী দান করলেন তখন মহাভারতকার স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন যে, এই নগরীটি কর্ণের নতুন প্রাপ্তি, কারণ, তিনি দুর্যোধনের দেওয়া চম্পা নগরীও আলাদাভাব শাসন করছিলেন-পালয়ামাস চম্পাঞ্চ। যাই হোক, অঙ্গরাজের ওপর তখনকার তিন প্রধানের যত মালিকানার দলিল থাকুক, অঙ্গরাজ জরাসন্ধের সেনাবাহিনীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছেন–এইটাই আসল কথা।

জরাসন্ধের সঙ্গে আছেন বিদর্ভ দেশের অধিপতি ভীষ্মক, যিনি রুক্মিণীর পিতা এবং ভীষ্মকের ছেলে রুক্মী যিনি যুদ্ধে পাণ্ডব অর্জুনের সমকক্ষ বলে পরিচিত ছিলেন। ভাগবত পুরাণ পড়লে কারও মনে হতে পারে যে, ভীষ্মক যেন কৃষ্ণের অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু, অন্য প্রমাণে দেখা যায়–ভাগবতের কথা ভাবালুতা মাত্র, ভীষ্মক ‘ভোজ’ হলেও চিরকাল জরাসন্ধের পক্ষপাতী ছিলেন। দশার্ণদেশের অর্থাৎ এখনকার বুন্দেলখণ্ডের একাংশের রাজা, ইনিও যাদবগোষ্ঠীর মানুষ, কিন্তু তবু জরাসন্ধের পক্ষে যুদ্ধ করতে চলেছেন। জরাসন্ধের পক্ষে আছেন আরেক পরাক্রান্ত নামী রাজা-শান্ধ। তিনি রাজত্ব করতেন মোটামুটি উত্তর-পশ্চিম ভারতের আলোয়াড় অঞ্চলে সৌভ দেশে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মদ্ররাজ শল্য, যিনি কাশ্মীরের চন্দ্রভাগা আর ইরাবতীর মাঝখানে রাজত্ব করতেন, আছেন ত্রিগর্ত দেশের রাজা সুশমা। তিনিও কাশ্মীরেরই মানুষ, রাজত্ব করতেন বিপাশা আর শতদ্রর অন্তর্বর্তী ভূমিতে, যদিও অনেকের মতে এটা জলন্ধর। এখনকার কাবুল নদীর তীরবর্তী পেশোয়ার আর রাওয়ালপিণ্ডি জেলা মিলে যে গান্ধার রাজ্য ছিল, তার রাজা শকুনি মামার পিতা ঠাকুর সুবল, তিনিও এসেছেন জরাসন্ধের অনুকূলে। আর আছেন স্বয়ং কাশ্মীর দেশের রাজা গোন। আসলে হরিবংশ গোন বললেও আমরা জানি ইনি গোনন্দ।

কাশ্মীররাজ গোন যে জরাসন্ধের সঙ্গে যাদবদের আক্রমণ করেছিলেন, এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। রাজতরঙ্গিণীর লেখক কহনকে যদি ঐতিহাসিক বলি তাহলে দেখব শুধুমাত্র কাশ্মীররাজ গোনন্দের ঘটনা দিয়েই আমরা মহাভারতীয় রাজনীতির খানিকটা ব্যাখ্যা পাব। কলহন বলেছেন যে, এক সময় বন্ধু জরাসন্ধ কাশ্মীররাজ গোনন্দের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করেছিলেন–সাহায়াক আহূততা জরাসন্ধেন বন্ধুনা।(৫১) তাঁর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে গোন এসে কৃষ্ণের বাসস্থল মথুরাপুরী অবরোধ করেন। কলহন লিখেছেন যে, শেষ পর্যন্ত গোন যদুবীর বলরামের কাছে হার স্বীকার করেন। কিন্তু সেটা আমাদের ভাবনা নয়। আমরা শুধু সার কথাটি ধরে বলব যে, মগধের চারপাশের দেশগুলির রাজারা জরাসন্ধের কাছাকাছি হওয়ার দরুন বেশির ভাগই জরাসন্ধের আজ্ঞাবহ ছিলেন, যদিও এর মধ্যে একক ব্যতিক্রম হলেন পুণ্ড্রবর্ধন এবং বঙ্গের রাজা পৌণ্ড্র বাসুদেব। কিন্তু এই যে কাশ্মীর, ত্রিগর্ত, সৌভ, মদ্র ইত্যাদি দেশ, এই সব দেশের রাজার কাছে জরাসন্ধ যুদ্ধকালীন বার্তা পাঠিয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু এই সব রাজারা স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও কেউই কিন্তু জরাসন্ধের বিরুদ্ধে যেতে চাননি। খোদ যাদবদের মধ্যে একাংশ, যাঁরা কুরু রাজ্য এবং মগধের দক্ষিণ থেকে আরও দক্ষিণে রাজ্য প্রসারিত করেছিলেন তাঁরা তো সবাই জরাসন্ধের বশংবদই ছিলেন। যাঁরা বশংবদ ছিলেন না, তাঁরাও বেশির ভাগই জরাসন্ধকেই বন্ধু হিসেবে চাইতেন, কৃষ্ণকে নয়। অথবা কৃষ্ণের বিরুদ্ধে তাঁদেরও অভিযোগ ছিল। হরিবংশের যা বর্ণনা, তাতে কৃষ্ণ এবং বলরামের ওপর অলৌকিক ক্ষমতার আরোপ হয়ে যায় বটে, কিন্তু আমরা জানি এই সময় মথুরাবাসী যাদবদের প্রায় একা লড়তে হয়েছিল সমগ্র ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে এবং তাঁরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ জিতেছিলেন বুদ্ধির জোরে, যদিও জরাসন্ধের উপযুপরি চাপে কৃষ্ণকে সবান্ধবে মথুরা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয় দ্বারকায় এবং এটাও একটা বুদ্ধি।

ছবি। পেজ ১৬৬।

লক্ষণীয়, আমরা হরিবংশে জরাসন্ধ বাহিনীর মধ্যে পাঞ্চালদেরও নাম দেখেছি–সেই পাঞ্চালেরা, যাঁরা কুরুবংশেরই শাখা এবং যাঁদের সঙ্গে কুরুদের বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই ছিল কুরুর বাবা সংবরণের সময় থেকে। দুপদ জরাসন্ধের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন নিজেকে বশংবদ দেখানোর জন্য, ঠিক যেমন দুর্যোধনও পৃথকভাবে যোগ দিয়েছিলেন একই কারণে। মহাভারতে দেখছি–কৃষ্ণ জরাসন্ধ পক্ষপাতীদের নাম করার সময় যে নামগুলি করেছেন, সে নামগুলি মিলে যাচ্ছে হরিবংশের বর্ণনার সঙ্গে। সেখানে পাঞ্চালদের নাম নেই। কিন্তু এই সঙ্গে কৃষ্ণ আবার অনেকগুলি রাজার নাম করেন যাঁরা, জরাসন্ধের ভয়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ পাঞ্চালের লোকেরাও আছে–দক্ষিণা যে চ পাঞ্চালাঃ। মনে রাখবেন দ্রুপদের বাবা পৃষত কিন্তু ছিলেন উত্তর পাঞ্চালের রাজা এবং পরবর্তী কালে দ্রুপদও তাই। ওলটপালট যা হয়েছে তা পরের কথা। মথুরাবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে জরাসন্ধের নৈতিক জয় হয়েছিল, এবং হরিবংশ যতই বলুন জরাসন্ধের বাহিনী যথেষ্ট মার খেয়েছেন কৃষ্ণ বলরামের হাতে, আমরা তা বিশ্বাস করি না। হ্যাঁ, কিছু খুচখাচ ক্ষতি তাঁরা অবশ্যই করতে পেরেছিলেন কিন্তু জরাসন্ধের তাতে কিছুই হয়নি। দিনের পর দিন বার বার জরাসন্ধের মথুরা অবরোধ করার ফল হয়েছিল এই যে, কৃষ্ণ কংসহন্তা নায়ক হয়েও বড় ঝামেলার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। সভাপর্বে রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বকল্পে কৃষ্ণ সে কথা স্বীকারও করেছেন। কৃষ্ণ বলেছেন যে, তাঁরা জরাসন্ধের ভয়ে আত্মীয়স্বজন নিয়ে আরও পশ্চিমে পালিয়ে গেছেন–পলায়মো ভয়াৎ তস্য সসুতজ্ঞাতিবান্ধবাঃ।(৫২) কিন্তু জরাসন্ধের ভয়ে পলাতক কৃষ্ণের হতাশা যেমন কম ছিল না, তেমনি তাঁর বুদ্ধিও কম ছিল না। তখনকার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সমস্ত কুশীলবদের চরিত্র তিনি এমন সুন্দর পাঠ করে ফেলেছিলেন যে, তাঁর সামনে দরজা খুলে গেল, দরজা খুলে গেল আরেক রাজনৈতিক উত্থানের।

.

০৬.

পণ্ডিত-সাধারণের মত অনুসারে পঞ্চ পাণ্ডবেরাও কৌরব। মহাভারতের বহু জায়গায় তাঁদের কৌরব বলে ডাকাও হয়েছে। কুরুনন্দন কুরুকুলাত্মজ, কুরুভূষণ এসব উপাধিতে পাণ্ডবেরাও ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও শুধু দুর্যোধনেরা বা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরাই কৌরব নামে সমধিক পরিচিত। পঞ্চপাণ্ডবের পিতা পাণ্ডু রাজা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ছেলেদের কেন সাধারণভাবেই কৌরব নাম জোটেনি–এটা একটা প্রশ্ন। ধৃতরাষ্ট্র রাজা না হলেও কিংবা নামে রাজা হলেও, তাঁর ছেলেদের প্রধান পরিচয় কিন্তু ধার্তরাষ্ট্র নয়, কৌরবই। অন্য দিকে পাণ্ডু রাজা হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র পিতৃপরিচয়েই তাঁরা পাণ্ডব নামে সমধিক পরিচিত হলেন কেন–এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে ভারতবর্ষের জাতি-তত্ত্ব গবেষণার প্রথম উন্মেষে শ্রীযুক্ত এইচ.এইচ. রিজলে, ডঃ হর্নেল এবং গ্রিয়ার্সনের মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে বলেছিলেন যে, উত্তর ভারতের মানুষেরা মূলত ইন্দো দ্রাবিড়ীয় প্রজাতির। তাঁরা মনে করেন, ভারতবর্ষে প্রথম আর্য সভ্যতা বিকাশের পর তাঁরা যখন পঞ্জাব অঞ্চল থেকে আরম্ভ করে বিহারের গণ্ডকী পর্যন্ত আর্যায়িত করে ফেলেন, সেই সময়ে আর্যদের দ্বিতীয় আরেকটি দল ভারতবর্ষের ভিতরে প্রবেশ করে। এরা কিন্তু আর্যদের পুরা পরিচিত উত্তর-পশ্চিমের দুয়োর দিয়ে ভারতবর্ষে ঢোকেনি, ঢুকেছে অন্য পথে গিলগিট এবং চিত্রল হয়ে। রিজলেদের মতে আর্যদের এই দলটি নিদারুণ পথকষ্টের সম্ভাবনায় নিজেদের সঙ্গে স্ত্রীলোক বেশি আনেনি এবং তত্রস্থ দ্রাবিড়-জাতীয় মহিলা, যারা পরে আর্যদের চাপে আরও দক্ষিণে চলে গিয়েছিল, সেই দ্রাবিড়ীয়দের বিয়ে করেই সুখে-দুঃখে দিন কাটিয়েছে।

ভারতবর্ষের অনেক পণ্ডিতেরাই এই মত একটু অদলবদল করে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু মজা হল তাঁদের দৃষ্টিতে–আর্যদের এই দ্বিতীয় দলটির সমস্ত গতিবিধির দায় গিয়ে পড়েছে পাণ্ডবদের ওপর। তাঁরা বলেন, আর্যদের এই দ্বিতীয় দলটির ভাষা, ধর্ম কিংবা জাতি তাঁদের প্রথম দলের জাতভাইদের থেকে আলাদা নয়, অর্থাৎ কিনা যাঁরা পঞ্জাব থেকে আরম্ভ করে উত্তরোত্তর পুব দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁদের সঙ্গে এই দ্বিতীয় দলের আর্যরা কোনভাবেই অসংবদ্ধ নয়, কিন্তু তাঁরা সভ্যতার দিক দিয়ে তাঁদের পূর্বতনদের মত উজ্জ্বল ছিলেন না, উল্টো দিকে তাঁদের গায়ের জোর, স্ত্রীলোক-সংক্রান্ত শৈথিল্য এবং সমধিক সরলতা কেমন যেন একটু পাশবিক আভাস দেয়। পাণ্ডিতেরা অনেকে বলেন, এই দ্বিতীয় দলের আর্যরাই হল পাণ্ডব। এটা অবশ্য ঠিক যে, মহাভারতের মতেও, পাণ্ডবেরা অনেকানেক ব্রাহ্মণ সহযোগে হিমালয় অঞ্চল থেকে হস্তিনাপুরে উদয় হন। আপনারা বলবেন–পাণ্ড হস্তিনাপুরের রাজ্যপাট সামলিয়ে ‘নিত্যারণ্য হিমালয়ের গিরিপৃষ্ঠে ‘মহাশালবনের ভিতর একটা সাময়িক অরণ্যনিবাস বানিয়ে দুই বৌয়ের সঙ্গে একটু সুখে কাল কাটাচ্ছেন, আর মুখপোড়া পণ্ডিতদের ওমনি মনে হল–পাণ্ডবেরা সব হিমালয়ের লোক? পণ্ডিতেরা কাচুমাচু করে বলবেন-কি আর করা যাবে, এ কথা তো মহাভারতের প্রমাণেই ঠিক যে, পাণ্ডুর ছেলেগুলি হয়েছিল সব ওই হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশেই এবং তাঁর সন্তানগুলি কেউই তাঁর নিজের নয়, সবই অন্যের কারও নাম ধর্ম, কারও নাম বায়ু, কারও নাম ইন্দ্র অর্থাৎ সন্তানগুলি সবই ভগবানের দেওয়া। এই ভগবদ্দত্ত সন্তানদের নিয়ে যে হাজার হাজার বামুন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা করে পাণ্ডবদের পুত্রতা বোঝাতে এলেন, হস্তিনাপুরবাসীরা জন্মে তাঁদের দেখেনি কোন দিন। তাদের বুঝি আশ্চর্যও লেগেছিল কিছু। নইলে রাজবাড়িতে নতুন মানুষ ঢুকলে, সাধারণ বালক-বৃদ্ধ-নারীর ভিড় জমতে পারে কিন্তু এখানে তো দেখছি হস্তিনাপুরের সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণেরা পর্যন্ত তাঁদের বৌদের নিয়ে রঙ্গ দেখতে এসেছেন, অন্যান্য ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র পুরবাসীদের তো কথাই নেই। তাও যদি বুঝতাম, রাজা পাণ্ডু মারা গেছেন, তাঁর জন্য শোক প্রকট করার জন্য দলে দলে সবাই এল। তা তো নয়, সবাই এসেছে হিমালয়ের পাহাড়ী তপস্বী দেখতে–সদারাঃ তাপসা দ্রং নির্যযুঃ পুরবাসিনঃ। (৫৩) পণ্ডিতেরা সন্দেহ করেন–সমস্ত পুরবাসীদের এই দৃষ্টি হল সন্দেহের দৃষ্টি, অনভিমত আগন্তুকের ওপর যা দৃষ্টি হওয়া উচিত, এও তাই। তারও ওপরে কথা হল, ভাষা, ধর্ম, আচার-আচরণে এক বলেই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের সাময়িকভাবে মেনে নিয়েছেন বটে, কিন্তু তারপর থেকেই তিনি তাঁদের প্রতি শত্রুতা আচরণ করেছেন। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। মহামতি রিজলে হয়তো তাঁর ‘cultured inhabitants of the middle land’-এর থেকে এই পাণ্ডবীয় আর্য দলকে regarded as comparative barbarians বলবেন; অন্য পণ্ডিতেরাও হয়তো দ্রৌপদীর একার সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবদের বিয়ের প্রশ্ন তুলে, ভীমের হাতে দুঃশাসনের রক্তপানের প্রশ্ন তুলে সাধারণ মানুষকে ঝামেলায় ফেলবেন, কিন্তু আমরা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে অত শত কঠিনতর প্রশ্নে যাব না, আমরা সাধারণ মানের রাজনীতির দিকে যাব।

আমরা বলব, পাণ্ডবেরা আর্যসমাজের দ্বিতীয় দলই হোন, কিংবা হোন হিমালয়বাসী ধর্মঠাকুর, ইন্দ্ৰঠাকুর কিংবা অন্য কোন বড় মানুষের পো, মনে রাখতে হবে এদের বাবা মারা গিয়েছিলেন, যে বাবা ছিলেন পূর্বে রাজা। রাজা হওয়ার সমস্ত গুণ থাকতেও যে বড় ভাই শুধু নিশ্চক্ষুতার কারণে রাজ্য পেলেন না–ধৃতরাষ্ট্র অচক্ষুষ্ট দ রাজ্যং ন প্রত্যপদ্যত, সেই ধৃতরাষ্ট্র আপন ভাইয়ের ঔরসে জাত নয়-এমন ছেলেদের পাত্তা দেবেন কেন, তাঁর ছেলেরাই বা তা মানবে কেন? কিন্তু পাণ্ডবদের সামনে সমস্ত রাজবিরুদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পথ কেটে নিতে পারলেন শুধু দুটি কারণে। এক ধৃতরাষ্ট্র যদি খুব অল্প বয়সেই পাণ্ডবদের মেরে ফেলতে পারতেন, তাহলেও কথা ছিল। অথচ তিনি তা না করে তাঁদের অস্ত্র-শস্ত্রের শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার সময় দিয়েছেন। সেটা কৌরসভার বড় মানুষের চাপেই হোক, কিংবা জনগণের চাপে, কিন্তু এই তাঁর প্রথম ভুল। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি বলার আগেই আমাদের একবার পাঞ্চালে যেতে হবে, যে পাঞ্চালেরা চিরকাল কুরু-বিরোধী।

হ্যাঁ, দ্রোণাচার্যও এই কুরু-পাঞ্চালদের চিরন্তন বিরোধের কথা ভালভাবেই জানতেন এবং সেই বিরোধের আগুনে ঘৃতাহুতি দিতেই তিনি এসেছিলেন হস্তিনাপুরে। কথাটা আরেকটু পরিষ্কার করে বলি। দ্রোণ কিন্তু ব্রাহ্মণ এবং তিনি ভরদ্বাজের ছেলে। পাঠকের মনে আছে নিশ্চয়ই যে, দুষ্যন্ত-পুত্র মহারাজ চক্রবর্তী ভরতরাজার বংশকর কোন পুত্র ছিল না, এবং এই ভরদ্বাজের ছেলেই, যাকে আমরা পূর্বে বিতথ ভরদ্বাজ বলেছি, তিনিই কুরুকুলে রাজা হয়েছিলেন। ঠিক কথা, এ ভরদ্বাজ, সে ভরদ্বাজ নাও হতে পারে, কারণ কোথায় ভরত রাজার সময় আর কোথায় দ্রোণাচার্য। কিন্তু বামুনদের মধ্যে গোত্র বলে একটা কথা আছে, ইনি অঙ্গিরস গোত্রের দ্বিতীয় কোন ভরদ্বাজ। এই ভরদ্বাজও কম লোক কিছু নন, গঙ্গাদ্বারে বসতি করে ইনও তপস্যা করছিলেন। তপঃশ্রান্ত মুনি একদিন দুপুরবেলায় নাইতে যাচ্ছেন গঙ্গায়, এমন সময় গঙ্গার তীরভূমিতে দেখতে পেলেন অঙ্গরা ঘৃতাচীকে (পাঠক! আবার সেই অপ্সরা, স্বৰ্গবেশ্যা!)। ঘৃতাচীও তখনই নদী থেকে সদ্য স্নান করেই উঠেছিল এবং কাপড় বদলাচ্ছিল। স্বৰ্গবেশ্যা অপ্সরা ইন্দ্রলোকের প্রখ্যাতা নর্তকী রমণীর একজন, তার চলনে নটন, বলনে গান, কাজেই দেখামাত্রই ভরদ্বাজের মনে হয়েছে ঘৃতাচী বুঝি আপুতাঙ্গী। আসলে স্বৰ্গবেশ্যার ভাবগতিকেই যে আপ্লতি থাকে, তা মহর্ষি ভরদ্বাজ বোঝেননি। রূপযৌবনে রমণী আপনিই ‘মদালসা’, ‘মদদৃপ্তা হয়, তাও ভরদ্বাজ বোঝেননি। কিন্তু এত দেখেও ভরদ্বাজের ধৈর্য থাকত–আমরা জানি, থাকত। কিন্তু অপূর্বযৌবনবতী যখন ভরদ্বাজের অজান্তেই তার নটনের ভঙ্গিতে রিক্ত নদীতীরে কাপড় বদলাতে শুরু করল এবং তার ওপরে জুটল এলোমেলা হাওয়ার অভিসন্ধি, তখনই স্বর্গসুন্দরীর দেহ কুচি উন্মোচিত কচি আমোচিত এক বিধ্বংসী ব্যঞ্জনা নিয়ে ধরা দিল ভরদ্বাজের সামনে। মুনি আর থাকতে পারলেন না-ব্যাপকৃষ্টাম্বরাং দৃষ্টা–তাঁর তেজ স্খলিত হল। তেজ স্বলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুনি সেটি আর মাটিতে পড়তে দিলেন না, ধরে ফেললেন চাল মাপার কৌটোর মত একটা ত্রেতততা’স্য রেতঃ চস্কন্দ ত ঋষি দ্ৰোণ আদধে। ওই রকম একটা পাত্রের নাম দ্রোণ বলেই সেই পাত্রসম্ভব পুত্রের নাম-দ্রোণ। মনে রাখবেন অপ্সরা দেখার ফলেই হোক, আর যে ভাবেই হোক, দ্রোণ কিন্তু ভরদ্বাজ গোত্রের ব্রাহ্মণ, এবং ভরদ্বাজদের সঙ্গে কুরুদের পূর্বসম্বন্ধ আছে। এই ভরদ্বাজ অবশ্য বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন দ্রুপদের বাবা পাঞ্চাল রাজ পৃষকে এবং পাঞ্চাল রাজ্যেই ছিল তাঁর আশ্রম।

পৃষত উত্তর পাঞ্চালের রাজা, তাঁর রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র বা ছত্রবতী, এখনকার বেরিলিতে আয়োলার কাছে রামনগর অঞ্চল। দক্ষিণ পাঞ্চালে উত্তর পাঞ্চালদেরই এক শাখাবংশ নীপদের রাজত্ব ছিল কিন্তু তাঁরা তত উল্লেখযোগ্য ছিলেন না, এদের রাজধানী ছিল কাস্পিল্য(কম্পিল্য),উত্তর প্রদেশে বদাউ ও ফরাক্কাবাদের মধ্যে একটা জায়গা। দ্রুপদ কিংবা দ্রুপদপিতা উত্তর পাঞ্চালের শাসক হলেও, দক্ষিণের ওপরেও হয়তো তাঁদের যথেষ্ট অধিকার ছিল, কেননা বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে দেখা যায় যে উত্তর পাঞ্চালের রাজারা কখনও রাজসভা বসাচ্ছেন দক্ষিণ পাঞ্চালে আবার কখনও বা দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজসভা বসছে উত্তর পাঞ্চালে। যাই হোক, মূলত এই উত্তর পাঞ্চালের অধিপতি পৃষতের ছেলে দ্রুপদ কিন্তু প্রায়ই যেতেন তাঁর পিতৃবন্ধু ভরদ্বাজের আশমে এবং সেখানে তিনি বন্ধু পেয়ে গেলেন দ্রোণকে। বেশ কিছুদিন পরে রাজা পৃষত মারা গেলেন, দ্রুপদ রাজা হলেন উত্তর পাঞ্চালে। অন্যদিকে ভরদ্বাজও মারা গেলেন এবং দ্রোণের বাসনা হল বিয়ে করার; তিনি কৃপাচার্যের ভগিনী কৃপীকে বিয়ে করলেন। কুরুবংশীয় শান্তনুর পালিতা কন্যা কৃপীকে বিয়ে করার ফলে দ্রোণ কিন্তু কুরুবংশীয়দের আরও কাছাকাছি এলেন, কারণ তাঁর শালা কৃপ তো বহুকালই হস্তিনাপুরবাসী।

অনেকে ধারণা করেন যে, বাল্যকাল বন্ধু থাকার সময় দ্রুপদ বুঝি দ্রোণকে কথা দিয়েছিলেন–ভবিষ্যতে রাজ্যের অর্ধাংশ দেবেন বলে। এমন কোন প্রতিশ্রুতির কথা মহাভারতে নেই। বরঞ্চ উল্টে বলব-দ্রোণাচার্য বিয়ে করার পর থেকে পুত্ৰ-পরিবারের জন্য অকারণে অর্থলোলুপ হয়ে উঠলেন, টাকাপয়সাই হল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। আমাদের ধারণা, তিনি যে ব্রাহ্মণ হয়েও ব্রাহ্মণের বৃত্তি গ্রহণ না করে, প্রখর চাতুর্যের সঙ্গে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলেন সেটাও টাকা-পয়সা, সম্পদের লোভেই। দ্রোণাচার্যের এই লোভ, অর্থগৃধ্রুতা অপরের কাছে অপ্রকাশিত থাকেনি। ভাবতে পারেন, ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরাম যখন সব ছেড়ে-ছুঁড়ে বনে চলে যাচ্ছেন, সেই সময় তাঁর কাছে গিয়ে উপস্থিত হন দ্রোণ। দ্রোণ টাকা পয়সার লোভই পরশুরামের কাছে গিয়েছিলেন, অস্ত্র-জিজ্ঞাসু হয়ে নয়। তিনি শুনেছিলেন–পরশুরাম তাঁর জমানো টাকা পয়সা সবাইকে দিয়ে চলে যাচ্ছেন-দ্রোণো’পি রামং শুশ্রাব দিসন্তং বসু সর্বশঃ। দানের খবর শুনেই দ্রোণ সেখানে ছুটেছেন ধনের লোভে। নিজের আঙ্গিরস কুল, ভরদ্বাজ-গোত্র নিবেদন করার পর পরশুরাম যখন তাঁকে ‘দ্বিজশ্রেষ্ঠ বলে স্বাগত জানাচ্ছেন, সেই সময়ে দ্রোণাচার্য কিন্তু আর যদৃচ্ছালাভ সন্তুষ্ট’ ব্রাহ্মণ নন। দ্বিজশ্রেষ্ঠ! কি চাই–এইরকম একটা পরশুরামী জিজ্ঞাসায় দ্রোণাচার্য বললেন–আমি টাকা চাই, প্রচুর টাকা চাই–অহং ধন অনন্তং হি প্রার্থয়ে বিপুল ব্ৰত।(৫৪) পরশুরাম লজ্জিত হয়ে বললেন–আমার যা ছিল টাকা-পয়সা সব তো আমি ব্রাহ্মণদের দিয়ে দিয়েছি, বিভিন্ন ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস করে যা রাজ্যপাট পেয়েছিলাম, তাও দিয়ে দিয়েছি। এখন থাকার মধ্যে আছে আমার এই দেহ আর আছে কিছু মোক্ষম অস্ত্র–তা তুমি কোনটা চাও বল। দ্রোণ বললেন-আমি অস্ত্র চাই। সত্যিই তো পরশুরামের জীর্ণ দেহখানি দিয়ে কি করবেন দ্রোণ! বরঞ্চ পরশুরামের সংগ্রহে যে বিশাল অস্ত্র রাজি আছে, তাই পেলেই দ্রোণের লাভ। পরশুরাম তাঁর সমস্ত মহার্ঘ অস্ত্র এবং তার প্রযুক্তি-কৌশল–সব দ্রোণকে দিলেন এবং শিখিয়ে দিলেন। পরশুরাম ছিলেন সেকালের অস্ত্রগুরুদের শ্রেষ্ঠ। তাঁরই সমস্ত অস্ত্র এবং তাঁর কাছেই সে সবের অন্ধিসন্ধি জেনে দ্রোণ উপস্থিত হলেন দ্রুপদের কাছে।

উদ্দেশ্যটা বেশ বোঝা যায়। কারণ দ্রুপদ ঘাসে মুখ দিয়ে চলেন না, তিনি রাজা। মহাভারতকার ব্রাহ্মণ হিসেবে দ্রোণকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন দ্রুপদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে। দ্ৰোণ নাকি দ্রুপদের সভায় উপস্থিত হয়েই ‘বন্ধু’ সম্বোধন করেছিলেন এবং ঐশ্বর্যমদমত্ততার কারণেই নাকি দ্রুপদ তাঁকে হঠাই অপমান করেন। কিন্তু আমরা জানি, দ্রুপদের এই ক্রোধ কোন আপাতিক ঘটনা নয়। তিনি দ্রোণের উদ্দেশ্য জানতেন, বিশেষত পরশুরামের কাছে দ্রোণের প্রার্থনা এবং শেষমেশ তার কাছ থেকে বিশাল অস্ত্রসম্ভার নিয়ে ফিরে আসাটাও দ্রুপদ আমাদের মতই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছেন। দ্রুপদ দ্রোণাচার্যের সখা-সম্বোধন শোনামাত্রই বন্ধুত্ব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন-তোমার মত লোকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কিসের? বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের, বীরের সঙ্গে হিজড়ের বন্ধুত্ব হয় নকি? তোমার এত বন্ধু বন্ধু করার কিছু নেই-সখিপূর্বং কিমিষ্যতে এরকম ভেদে বন্ধুত্ব হয় না। দ্রুপদের এই কথা শোনার পর নিরপেক্ষ বক্তা বৈশম্পায়ন দ্রোণের বিশেষণ দিয়েছেন ‘ভরদ্বাজ’ বলে। কথাটা অর্থবহ। দ্রুপদের কথা শুনে মুহূর্তমাত্র চিন্তা করে ভরদ্বাজ দ্ৰোণ পাঞ্চাল দ্রুপদের ওপর প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্যই উপস্থিত হলেন কুরুমুখ্যদের নগরী ‘নাগসহায়’ অর্থাৎ হস্তিনাপুরে–স বিনিশ্চিত মনসা পাঞ্চাল্যং প্রতিবুদ্ধিমান্।(৫৫) হস্তিনাপুর ভরদ্বাজদের পুরোনো জায়গা।

মহামতি অনন্তলাল ঠাকুরের সঙ্গে আলোচনা কালে একবার তাঁকে বলতে শুনেছিলাম যে, এই দ্রোণাচার্য একেবারে ব্রাহ্মণবেশী চণ্ডাল এবং কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের জন্য তিনিই মূলত দায়ী। কথাটা একেবারে হাল্কা চালে বলা হয়েছিল বলেই হয়তো সাধারণ মৌখিকতার দায় আসবে এই ভাষায়, কিন্তু কথাটা মোটই মিথ্যে নয়। দ্রোণাচার্য তাঁর অস্ত্রবিদ্যার ইন্দ্রজালে কুরুকুমারদের মুগ্ধ করে কুরু রাজসভায় ঢুকে পড়নে এবং ছেলেদের অস্ত্রবিদ্যায় শিক্ষিত করে শোধ নিতে পাঠালেন দ্রুপদের ওপর। এটাই নাকি হবে গুরুদক্ষিণা। কৌরব-পাণ্ডবেরা একসঙ্গে উত্তর পাঞ্চালে চললেন দুপদকে মজা দেখতে এবং এই বাহিনীতে কর্ণও ছিলেন, তিনি তখন অঙ্গ দেশের রাজা হয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্যবশত মূল কুরুকুমারেরা দ্রুপদকে কিছুই করতে পারলেন না, কারণ অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষার চরম বিন্দুটি এই যুদ্ধের মধ্যেই নিহিত ছিল। অর্জুন দ্রুপদকে নাকাল করে জীবিত ধরে ফেললেন।

পরাজিতের ওপর বিজয়ীর পরাক্রম বেড়ে যায়, এই নীতিতেই মহাবলী ভীমসেন দ্রুপদের পুত্র-মিত্র এবং পাঞ্চাল বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করার জন্য এগোচ্ছিলেন। কুরুক্ষেত্রের ভাবী নায়ক অর্জুন কিন্তু এই মুহূর্তে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে থামিয়ে দিলেন ভীমকে। অর্জুন তার বিখ্যাত পূর্বজদের স্মরণ করে বললেন–দাদা! মহারাজ দ্রুপদ মহান কুরুবীরেদের সঙ্গে কৌলিক সম্বন্ধে সম্পর্কিত, তাঁর সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার কোন প্রয়োজন নেই আমাদের, তুমি শুধু গুরুদক্ষিণার কথা চিন্তা কর এবং সে কাজ মহারাজা দ্রুপদকে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়েছে। ভীম বিরত হলেন এবং দ্রুপদকে নিয়ে আসা হল দ্রোণাচার্যের কাছে। দ্রোণ দ্রুপদের পুরনো পরিহাস ফিরিয়ে দিয়ে বললেন–তোমার রাজ্য এখন বিমর্দিত, তুমিও জীবন্তই তোমার শত্রুর বশ, এখন কি বন্ধু বলে মানবে আমাকে–সখিপূর্বং কিমিষ্যতে? দ্রোণাচার্য হঠাৎ বন্দনীয় ব্রাহ্মণ্য সংস্কার স্মরণ করে বামনাই করে বললেন–আমরা বামুন মানুষ, ক্ষমাই আমাদের সব। তবে কিনা রাজার সঙ্গে সমানে সমানে রাজা না হলে তো বন্ধুত্ব হয় না, তাই তোমার অর্ধেক রাজ্য আমার,অন্য অর্ধেক তোমার। তবে তুমি রাজা হবে দক্ষিণ পাঞ্চালে, ভাগীরথীর দক্ষিণ পারে আর আমি রাজা হব উত্তর পাঞ্চালে।

দ্রুপদ মুখে আপিতবন্ধুত্বের প্রলেপ মাখিয়ে দ্রোণের প্রস্তাব মেনে নিলেন। দ্রুপদ তাঁর কথামত এতকালের পিতৃ-পিতামহের রাজ্য উত্তর পাঞ্চাল ছেড়ে দিয়ে, এতকালের সাধের রাজধানী অহিচ্ছত্র ত্যাগ করে গঙ্গার দক্ষিণ ধারে ‘মাকলী’ বলে একটি জায়গায় বসতি গড়লেন। রাজধানী হিসেবে দক্ষিণ পাঞ্চালের কাস্পিল্য নামে নগরীটি দ্রুপদের অধিকারে এল; তাঁর রাজ্যের দক্ষিণ সীমা দাঁড়াল চমতী নদী অর্থাৎ চম্বল পর্যন্ত। দ্রোণ অধিকার করে নিলেন এতকালের সমৃদ্ধ উত্তর পাঞ্চাল, আর এতকালের প্রতিষ্ঠিত রাজধানী অহিচ্ছত্র। অহিচ্ছত্রের ওপর দ্রোণের লোভ ছিল, গুরুদক্ষিণার ‘বেতন’ হিসেবে দ্রুপদের রাজধানী শুছু রাজ্যটিই তিনি চেয়েছিলেন। অন্যদিকে দ্রুপদ কাম্পিল্যে যা পেলেন, পেলেন। কিন্তু ‘মাকন্দী’ জায়গাটা ছিল একটি গ্রামমাত্র, বৌদ্ধগ্রন্থ মঝিম নিকায়ে ওই ‘মাগন্দী গ্রামে বুদ্ধকে অনেকবার দেখা গেছে এবং সেটা শুধু একটা গ্রামই। দ্রুপদের রাজ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্যের বিপুল লক্ষ্মীলাভ ঘটল, যথেচ্ছ ধনসম্পত্তিও তিনি পেলেন, তেমনি অন্যদিকে দ্রুপদ প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে- দীনমনা’–কেবলই বলবান পুত্রজন্মের অপেক্ষা করতে লাগলেন। যজ্ঞের আগুন, না প্রতিহিংসার আগুন ভগবান জানেন, কিন্তু আগুন থেকেই জন্মালেন অগ্নিবৎ ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং আগুনপানা দ্রৌপদী। তবে রাজনীতির চালে শুধু বলবান পুত্ৰজন্ম হলে কাজ ফুরিয়ে যায় না, সুযোগ সন্ধানেরও প্রয়োজন, সৈন্য সংগ্রহের প্রয়োজন। দ্রুপদ তাই করছিলেন এবং অতি ক্ষিপ্র করছিলেন। ইতিমধ্যে পাণ্ডব-কৌরবের কোন্দল বেড়ে গেছে। ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের যেরকম অধিকার দেখা গিয়েছিল এবং মহাবলী ভীমসেন যেমন দুর্ধর্ষ হয়ে উঠছিলেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্রের মনে শান্তি ছিল না। দুর্যোধন, কর্ণ এবং শকুনির মন্ত্রণায় ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বারণাবতের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারতে চাইলেন।

পাণ্ডবদের এই জতুগৃহের ছাই উড়িয়েই কিন্তু দুটি সুযোগসন্ধানী মানুষ অমূল্য রতনের সন্ধান পেলেন। একজন কৃষ্ণ, যিনি জরাসন্ধের ভয়ে পূর্বাহেই দ্বারকায় প্ৰস্থিত, অন্যজন ধ্রুপদ, যিনি প্রতিহিংসায় জ্বলছেন এবং দ্রোণের অত্যাচারে দক্ষিণে প্রস্থিত। ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে বলি। জতুগৃহে আগুন ধরানোর পরে এক মুহূর্তে খবর রটে গেল যে, পাণ্ডবেরা পুড়ে মরেছেন। সমস্ত রাজপুরুষের মধ্যে একমাত্র প্রখরবুদ্ধি মানুষ, যিনি এই খবরটা বিশ্বাস করেননি, তিনি কৃষ্ণ। আমাদের এই কথাটা ফাঁকা কোন বুলি নয়, হরিবংশের প্রমাণ দিয়ে পরিষ্কার জানাচ্ছি যে, কৃষ্ণ জতুগৃহে দাহ ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছিলেন বারণাবতে। যাদবদের মধ্যে তখন স্যমন্তক মণি এবং সুন্দরী সত্যভামার অধিকার নিয়ে বেশ গণ্ডগোল চলছিল। এই বিরাট ঝামেলার মধ্যেও কৃষ্ণ বারণাবতে এসেছিলেন এবং একটা লোকদেখানো শ্রাদ্ধক্রিয়াও করেছিলেন মৃত বলে শুত পাণ্ডবদের উদ্দেশে। কিন্তু তিনি যে এই মৃত্যু ঘটনা বিশ্বাস করেননি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল যে, শ্রদ্ধ-তর্পণ সূমাধা করেও কৃষ্ণ যদুবীর সাত্যকিকে লাগিয়ে গেলেন পাণ্ডবদের অস্থি সঞ্চয় করতে-কুল্যার্থে চাপি পানাং ন্যযোজয়ৎ স সাত্যকিম। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের পেলেন না বটে, কিন্তু দুই সুযোগসন্ধানী একই জায়গায় ধরে ফেললেন পাণ্ডবদের এবং সেদিনটা ছিল দ্রৌপদীর স্বয়ংবর।

কৃষ্ণ যে এতদিন জরাসন্ধকে এবং তাঁর সম্মিলিত বাহিনীকে বিভিন্ন উপায়ে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছেন, এতেই তাঁর প্রতিষ্ঠা তুঙ্গে উঠেছে। দ্রুপদের সভাতেও তিনি এখন মান্যগণ্য লোক। অন্যদিকে দ্রুপদের কথা বলি। অর্জুন ছেলেটাকে তাঁর পূর্বেই পছন্দ হয়েছিল। সে তাঁকে বন্দী করেছিল বটে, কিন্তু তাঁর ব্যবহার এবং একটিমাত্র স্পষ্ট বাক্য তাঁর মনে আছে।

তাঁর মনে আছে যে, যুদ্ধজয়ের মুহূর্তেও সমস্ত কুরুকুলের মুখ-উজ্জ্বল করা এই অর্জুন ছেলেটি তাঁকে কোন অপমান করেনি। অল্পবয়সী ছেলে যুদ্ধে নিষ্ণাত ব্যক্তিকে পরাজিত করলে যেরকম প্রগম্ভ হয়ে ওঠে, অর্জুন তো তা হয়ইনি, উপরন্তু যুদ্ধজয়ের মুহূর্তেও সে তার আগুয়ান ভ্রাতাকে নিষেধ করেছে যাতে সে দুপদকে অপমান না করে। সেই মুহূর্তেও অর্জুনের মনে আছে যে, কৌলিক সম্বন্ধ বিচারে দুপদ কুব্বীরদের সম্মানাই–সম্বন্ধী কুরুবীরাণাং দুপদো রাজসত্তমঃ।(৫৬) সেই থেকেই দ্রুপদ অর্জুনকে খুঁজছেন–এই ছেলেটিকে তাঁর চাই। মহাভারতকার স্পষ্ট বলেছেনপদ অর্জুনকে খুঁজছিলেন–সো’ন্বেষয়ানঃ কৌন্তেয় পাঞ্চালল্যা জনমেজয়। শুধু তাই নয় দ্রৌপদীর বিয়ের জন্য যে লক্ষ্যভেদের যন্ত্রখানি তিনি বানিয়েছিলেন–সেটাও অর্জুনের কথা মনে রেখেই। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দ্রৌপদীর সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে দেওয়া-যজ্ঞসেনস্য কামন্তু পাণ্ডবায় কিরীটিনে। কৃষ্ণাং দদ্যামিতি–কিন্তু কোথাও তিনি এ কথা প্রকাশ করেননি, ন চৈতন্ বিবৃণোতি সঃ।৭ কেন প্রকাশ করেননি, তা আমরা জানি। ওইখানেই রাজনীতি। প্রথমত মনের এই ইচ্ছা প্রকাশ করলে স্বয়ংবরসভার রীতি ব্যাহত হত, দ্বিতীয়ত এই মন্ত্রগুপ্তির মধ্যেই দ্রোণ তথা তাঁর আশ্রয়দাতা কুরুদের প্রতি তাঁর প্রতিহিংসার বাসনা নিহিত রয়েছে।

অৰ্জন ধরা পড়লেন। প্রথমে কৃষ্ণের কাছে ধরা পড়লেন। পাণ্ডবদের কথা শুনে শুনেই তাঁদের দেহাকৃতি মুখস্থ হয়ে গেছে কৃষ্ণের। দ্রুপদের রাজসভায় সমবেত রাজবৃন্দের মধ্যে তিনি দাদা বলরামকে পরিষ্কার চিনিয়ে দিলেন-ইনি ভীম, ইনি যুধিষ্ঠির, ইনি অর্জুন ইত্যাদি। সেকালের দিনের রাজারা নিজেরা পরস্পরবিরোধী হলেও স্বয়ংবর সভায় দেখা হওয়া মাত্রেই মারামারি করতেন না। জরাসন্ধ, শিশুপাল, দন্তবক্র সবাই এই রাজসভায় এসেছিলেন, কিন্তু কেউই কৃষ্ণের সঙ্গে মারামারি করেননি। জরাসন্ধ তখন বৃদ্ধ এবং লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি বলে আগেই লজ্জায় স্বয়ংবর সভা ত্যাগ করেছেন। অন্যেরাও কেউ কিছু করতে পারলেন না। ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণের বেশে-থাকা অর্জুন জিতে নিলেন দ্রৌপদীকে। এবার সবার সঙ্গে যুদ্ধ লাগল এবং এবারও অর্জুন জিতলেন। কুন্তীপুত্রেরা যখন দ্রৌপদীকে নিয়ে সেই কুমোরের বাড়িতে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁদের পেছন পেছন যিনি প্রথম সেই কুমোরপাড়ায় পৌঁছোলেন, তিনি কৃষ্ণ। এই তিনি প্রথম তাঁর আন পিসি কুন্তীর ছেলেদের সঙ্গে মিলিত হলেন। বৈশম্পায়ন লিখেছেন–কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের পায়ে হাত দিয়ে বললেন–আমি কৃষ্ণ। কিরকম যুধিষ্ঠির, না, অজমীঢ় বংশের উত্তরপুরুষ যুধিষ্ঠির। ঠিক এই মুহূর্তে পুরাতন কুরুরাজ অজমীঢ়ের কথা স্মরণ করাটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ অজমীঢ়ের থেকেই পাঞ্চাল বংশের শাখাঁটি বেরিয়েছে। কৃষ্ণ বললেন–ভাগ্যিস তোমরা জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচ্ছে, ভাগ্যিস ধৃতরাষ্ট্রের বদমায়েশ ছেলেগুলোর কূটকৌশল সফল হয়নি। কৃষ্ণ দুই পংক্তি কথা বলেছেন মাত্র, কিন্তু তার মধ্যেও তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের সম্বন্ধে উসকে দিয়েছেন পাণ্ডবদের, কারণ পাণ্ডবদের তাঁর দরকার।

কৃষ্ণের পর আরও একটি মানুষ পাণ্ডবদের খোঁজ করতে যান, তিনি দ্রুপদের ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন। সারারাত ধরে কুমোরবাড়ির বেড়ার ধারে অন্ধকারে নিলীন হয়ে রইলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন; সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবেশীদের খাওয়া-দাওয়া, ক্রিয়াকলাপ কথাবার্তা সব শুনে এসে জানালেন দ্রুপদকে। এক নিঃশ্বাসে দশটা প্রশ্ন করেও দ্রুপদ শেষ কথায় নিজের বিশ্বাস ব্যক্ত করলেন–পাণ্ডুর ছেলেগুলি নিশ্চয় জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে গেছে। ওদেরই মধ্যে ছোটটা, মানে অর্জুনই লক্ষ্যভেদ করে কৃষ্ণাকে জিতে নেয়নি তত? ধৃষ্টদ্যুম্ন পরিস্কার জানালেন–আমারও মনে হয় তাই, বাবা। রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে যে সব কথাবাতা ওরা বলছিলেন তার কোনটাই-বৈশ্য, শূদ্র কিংবা ব্রাহ্মণের মত নয়। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন–যা শুনেছি, ঠিকই, ওঁরা আগুন থেকে বেঁচে গেছেন মনে হয়।

কিন্তু মনে হলেই তো দ্রুপদের হবে না, তাঁর যে অর্জুনকেই চাই। অতএব পুরোহিতকে দিয়ে পাণ্ডবদের ঘরে খবর পাঠালেন দ্রুপদ, প্রায় নিশ্চিত ধারণায় খবর পাঠালেন রাজা পাণ্ড ছিলেন আমার পরম প্রিয় সখা। আমার চিরকালের ইচ্ছে ছিল আমার মেয়েকে স্বয়ংবরে জিতে নিক অর্জুন–য অর্জুনো বৈ পৃথুদীর্ঘবাহু ধর্মেণ বিলেত সুতাং মমৈতাম্। কিন্তু যুধিষ্ঠির কিছুই ভাঙলেন না। পুরোহিতের কথা এড়িয়ে গেলেন। ভাবলেন, যা বলার সামনাসামনি দ্রুপদকে জানাব, এখন নয়। দ্রুপদের লোকেরা অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিধিবৎ বিবাহের উদ্যোগ করে পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের এবং তাঁদের জননীকে নিয়ে যেতে এল। সবাই গেলেন এবং যুধিষ্ঠির প্রথমেই ধ্রুপদকে আশ্বস্ত করে বললেন–আমরা পাণ্ডব, আপনি ঠিকই ধরেছেন এবং আপনার ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে। নিজেদের পরিচয় দেবার সঙ্গে সঙ্গেই যুধিষ্ঠির তাঁর দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেছেন–এখন আপনি আমাদের গুরু এবং প্রধান ভরসা–ভবান্ হি গুরুরস্মাকং পরমঞ্চ পরায়ণ।(৫৮)

এই লাইনটা অত্যন্ত জরুরী। দেখুন, বৈবাহিক সম্বন্ধে শ্বশুর অবশ্যই গুরুত্ব পূজ্য; কিন্তু শশুরই প্রধান ভরসা-পরমঞ্চ পরায়ণ –এ কথা (এখনকার পুরুষ মানুষ ছাড়া!) কবে কোন পুরুষ মানুষ বলেছে? কিন্তু পাণ্ডবদের মত বীর পুরুষেরাও যে এমন একটা কথা বলে ফেললেন, তাও ভাবী শ্বশুরের সামনাসামনি, তাতে বুঝি এই বৈবাহিক সম্বন্ধ পুষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিও পুষ্ট হচ্ছে। বিয়ের কথার আগে দুপদ যুধিষ্ঠিরের কাছে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা শুনেছেন-বারণাবতে আসা থেকে কেমন করে তাঁরা পালিয়েছেন–সব। যুধিষ্ঠিরের সব কথা শুনে দ্রুপদ সেই মুহূর্তে শুধু কুরুকুলপতি ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দাই করেননি, সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাস দিয়েছেন এবং শেষে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, তাদের হৃতরাজ্য পুনরায় ফিরিয়ে দেবেন–প্রতিজজ্ঞে চ রাজ্যায় দুপদো বদতাং বরঃ।

একসঙ্গে পাঁচ ভাইয়ের বিয়ের ঘটায় জয়কারে, হুলুধ্বনিতে, উপহারে রাজনীতির এই সন্ধিপর্বটুকু, আত্মনিবেদন এবং প্রতিজ্ঞার এই পারস্পরিক মুহূর্তটুকু হয়তো হারিয়ে যায়, কিন্তু তা আবার পরিষ্কার হয়ে ওঠে বুদ্ধিমতী কুন্তীর আশীবাদে। নববধুকে-যেমনটি চাঁদের কাছে রোহিণী, যেমনটি নলের কাছে দময়ন্তী, স্বামীদের কাছে তুমিও তেমনটি হওএই কোমল আশীবাদের থেকেও–তুমি তোমার স্বামীকে আবার কুরুজাঙ্গল প্রভৃতি রাজ্যখণ্ডে অভিষেক কর–এই আশীর্বাদের ব্যঞ্জনা অনেক বেশি। কারণ এ ব্যঞ্জনা শুধু নববধুকে নয়, তাঁর পিতাকেও অন্তর্ভূত করেছে। একসঙ্গে পঞ্চ পাণ্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়ে নিয়ে দ্রুপদের কিঞ্চিৎ মানসিক ক্লেশ গেল, কিন্তু এ বিয়ের মধ্যেও যে ব্যাপারটা জোরদার হল, সেটা হল পাঁচ বীরপুরুষ প্রত্যেকেই দ্রৌপদীর মধ্যে আপন মনের মানুষ পেয়ে আরও এককাট্টা হলেন। কুরুসভায় পাণ্ডবদের মৃত্যু নিশ্চিন্ত ধৃতরাষ্ট্রের কাছে চরেরা খবর পৌঁছোল এইভাবে

পাণ্ডবদের সঙ্গে দুপদনন্দিনী কৃষ্ণার বিয়ে হয়ে গেল, মহারাজ! যিনি সেই মৎস্যচক্ষু লক্ষ্যভেদ করলেন, তিনি সর্ববিজয়ী অর্জুন। যিনি শল্য থেকে আরম্ভ করে অনেককেই ভূমিসাৎ করেছেন, সবার মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছেন, তিনি ভীম। সে যাকগে, যাক। সবাই এখন পাণ্ডব এবং কুন্তীকে দেখে এমন করছে, যেন তাঁদের নতুন জন্ম হয়েছে; আর সেখানে উপস্থিত রাজারা সব আপনাদের কি নিন্দাই না করছে, ধিক্কার দিচ্ছে কুলপতি ভীষ্মকে, নিন্দা করছে স্বৰ্গত মহারাজ কুরুর নাম ধরে–ধিক্কুম্ভ স্তদা ভীষ্মং ধৃতরাষ্ট্রঞ্চ কৌরবম্।(৫৯)

প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্রের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। ধৃতরাষ্ট্রের উদ্যমী পুত্রেরা, যাঁরা এতদিন নানারকম প্যাঁচ কষছিলেন পাণ্ডবদের বিতাড়িত করার জন্য, তাঁরা কিন্তু এবার শঙ্কিত হলেন, তাঁদের সমস্ত পরিকল্পনাও ভেস্তে গেল-ত্ৰস্তা ভগ্নসংকল্পাঃ। এই শঙ্কা কিন্তু পাণ্ডবদের জন্য যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি পাণ্ডব-পাঞ্চাল জোটের জন্য। তাঁরা বুঝলেন-দুপদ পাঞ্চালের সঙ্গে জোট বেঁধে পাণ্ডবদের শক্তি অনেক বেড়ে গেল, একেবারে মুক্ত পাণ্ডবাগ্নির শিখার ওপরে পাঞ্চাল দ্রুপদের ঘি পড়ল-মুক্তা হব্যভূজশ্চৈব সংযুক্তান্ দুপদেন চ।(৬০) বার বার কৌরবদের মাথার মধ্যে কুচকাওয়াজ করতে থাকল কতগুলি যুদ্ধদুর্মদ ব্যক্তি-পাঁচ ভাই পাণ্ডবেরা, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী এবং দ্রুপদ নিজে। এদের দোষ কি? না এরা সবাই যুদ্ধবিশারদ, শুধু তাই নয় সমস্ত রকমের যুদ্ধ জানেন এরা-সর্বযুদ্ধবিশারদান।

ধৃতরাষ্ট্রের মনে যাই থাকুক, তিনি ভাল অভিনয় করতে পারেন। কাজেই পাণ্ডবদের প্রকাশ এবং বিদুরের হর্ষিত পরামর্শের সঙ্গে সঙ্গেই তিনিও যথেষ্ট পুলক প্রকাশ করলেন। কিন্তু সেই সু-অভিনীত পুলকের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বিদুরকে বুঝিয়ে দিলেন, যে, পাণ্ডবদের অত খাতির করার প্রয়োজন কি? ধৃতরাষ্ট্র বললেন–পাণ্ডুর ছেলেরা তো আমারই ছেলে, কিন্তু আমার আরও একটু বেশি বুদ্ধি কাজ করছে-যথা চাভ্যধিক বুদ্ধিঃ, সেটা হল-পাণ্ডবেরা নিজেরা বীর এবং এখন তারা বন্ধু পেয়েছে। দ্রুপদের সম্বন্ধে অনেক শক্তিমান মানুষেরাও এখন পাণ্ডবদের সঙ্গে একজোট হবেন। ধৃতরাষ্ট্র এবারে কায়দা করে হতশ্রী পাণ্ডবদের উদ্দেশ করেই যেন বিদুরকে বললেন–পৃথিবীতে কোন রাজার যদি রাজ্যসম্পত্তি, ধনজন নাও থাকে-হতশ্রীরপি পার্থিবঃ, সেও যদি সবান্ধবে দুপদকে বন্ধুস্থানে পায়, তাহলেই সে কৃতকৃত্য হবে। বুদ্ধিমান বিদুর পাণ্ডবদের কথাটা ব্যঞ্জনায় রেখে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন–এ কথাটা আপনি বুঝলেই হবে, অন্তত শত বছর আপনার এই বুদ্ধিটুকু থাকুক, এই চাই–নিত্যংভবতু তে বুদ্ধিরেষা রাজন্ শতং সমাঃ।

ধৃতরাষ্ট্র কেন, কৌরব দুর্যোধন থেকে আরম্ভ করে সবাই বুঝেছেন–ব্যাপারটা কি হল! ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের সামনে যাই বলুন, তিনি দুর্যোধন, কর্ণ এবং শকুনি–প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে বললেন কূট পরামর্শ করতে। পাণ্ডবদের শক্তিবৃদ্ধির খবর শুনে দুর্যোধনের মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল। সুন্দরী কৃষ্ণাকে লাভ করে পাণ্ডবেরা সুখী হয়েছেন-এর থেকেও যেটা দুর্যোধনকে বেশি খোঁচাতে লাগল, সেটা হল পাণ্ডব-পাঞ্চালদের জোট। তিনি ভাবতে থাকলেন, যেন তেন প্রকারেণ কিভাবে পাণ্ডব-পাঞ্চালদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা যায়! এই বুদ্ধি থেকে তিনি যতগুলি সূত্র দিয়েছেন–সবগুলি সূত্রেরই উদ্দেশ্য এক–হয় পাণ্ডবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি কর, নয় পাঞ্চালদের মধ্যে বিভেদ তৈরি কর। দুর্যোধন বললেন–আজই কতগুলি বিচক্ষণ এবং বিশ্বস্ত বামুন পাঠাব পাঞ্চালে, যারা কুন্তীর ছেলে এবং মাদ্রীর ছেলেদের মধ্যে খটাখটি লাগিয়ে দেবে। অথবা এক কাজ করুন, মহারাজ। প্রচুর টাকা-পয়সা খাইয়ে–মহদ্ভিনসঞ্চয়েঃদ্রুপদের ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্নটাকে কিংবা দ্রুপদের মন্ত্রীগুলিকে ভাঙিয়ে আনতে হবে। আবার এমনও করা যায় যে, উপায় নিপুণ চরেরা গিয়ে পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের ঝগড়া লাগিয়ে দিক। তা ছাড়া তারা মন ভেঙে দিতে পারে একা কৃষ্ণার; এক রমণীর অতগুলি স্বামী বলে এটা করাই সোজা-বহুত্বাৎ সুকরং হি তৎ।

জোট-ভাঙার জন্য অনেকগুলি উপায় বাতলানোর পরেও দুর্যোধনের মনে তৃপ্তি হল না। পাঞ্চালদের কিংবা পাণ্ডবদের আলাদা আলাদাভাবে বাধা দেওয়া হয়তো তিনি সম্ভব মনে করেন, কিন্তু একসঙ্গে নয়। তার ওপর পাণ্ডবদের ওপর যেহেতু তাঁর রাগ বেশি, দুর্যোধন তাই বললেন–অনেকগুলি বুদ্ধিমান উপায় গুপ্তঘাতক পাঞ্চালে পাঠান, যারা ঝোঁপ বুঝে কোপ মারবে ভীমের ওপর, ওটাকেই মারা দরকার, ওটাই পালের গোদাস হি তেষাং বলাধিক। পাণ্ডবদের মধ্যে ভীমই হল সব চাইতে সাংঘাতিক, যেমন ওর গায়ের জোর, তেমনি কুর-আর ওই হল পাণ্ডবদের আসল ভরসা। সত্যি কথা বলতে কি, কোন যুদ্ধের সময় অর্জুনকে জেতাই যাবে না, যদি তার পেছনে থাকে বৃকোদর ভীম।

এই যুদ্ধের পরীক্ষা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরেই একবার হয়ে গেছে, অতএব দুর্যোধনের ধারণা–যদি কোনও রকমে ভীমকে মেরে ফেলা যায়, তাহলেই পাণ্ডবদের মনোবল একেবারে ভেঙে যাবে, এবং তারা জীবনে আর রাজ্য চাইবে না কিংবা রাজ্যের জন্য চেষ্টাও করবে না। দুর্যোধন আরও মনে করেন–ভীমকে যদি মেরে ফেলা যায়, তাহলে ওই অর্জুনটা কুরুপক্ষীয় কর্ণের নখেরও যুগ্যি নয়–রাধেয়স্য ন পাদভা।

ভীমের ওপর দুর্যোধনের পুরানো রাগ আছে। কিন্তু এত বলেও দুর্যোধন ভাবলেন, যদি ভীমকে কিছু না করা যায়! তার চাইতে, দুর্যোধন পুনরায় প্রস্তাব দিলেন-তার চাইতে এক একটা সুন্দরী মেয়েছেলে পাঠান, পাঁচ ভাইয়ের জন্য পাঁচটা। তারপর ওদের দেখে প্রত্যেকটি ভাই যখন মজে যাবে, তখন ভাবগতিক দেখে পাঞ্চালী কৃষ্ণা আপনিই বিরক্ত হয়ে ভেগে যাবে–প্রমদাভিৰ্বিলোভ্যতাম….ততঃ কৃষ্ণা বিরজ্যতাম।(৬১) দুর্যোধনের শেষ প্রস্তাব হল–পাঠানো হোক কর্ণকে। সে তাদের সমাদর করে নিয়ে আসার পথে গুপ্তঘাতক দিয়ে গুম-খুন করাবে পাণ্ডবদের।

এতগুলি প্রস্তাব দেওয়ার পরেও দুর্যোধন কিন্তু সারাৎসার জানেন। তা হল–যতদিন না নতুন বন্ধু দ্রুপদের ওপর পাণ্ডবদের বিশ্বাস গাঢ় হয়, ততদিনই পাণ্ডবদের যদি বা কিছু করা যায়, যাবে। কিন্তু একবার যদি দ্রুপদের ওপর তাদের বিশ্বাস সুবিন্যস্ত হয়, তাহলে আর কিছুই করা যাবে না–তাবদেব হি তে শ্যা ন শক্যাস্তু ততঃ পরম্।

মনে রাখতে হবে দুর্যোধনের সমগ্র প্রস্তাবগুচ্ছের মধ্যে দুবার কর্ণের নাম করা হয়েছে। অতএব তাঁরই এবার কথা বলার হক। সত্যি কথা বলতে কি, কর্ণ দুর্যোধনের প্রত্যেকটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন এবং পরিশেষে সমস্ত ভাবনাবিকল্পের অবসান ঘটিয়ে রাজনীতির সব চাইতে সরেস উপদেশটি তিনিই দিয়েছেন। কর্ণ বললেন- আমরা ধৃতরাষ্ট্রের মত মনে করি না যে, পাণ্ডবদের সঙ্গে পাঞ্চালেরা যুক্ত হলেন, আমরা বলি, পাঞ্চালদের সঙ্গে পাণ্ডবেরা জুটলেন। মহাভারতের প্লটে পঞ্চ-পাণ্ডবের কাহিনীতে উৎকর্ষ বেশি আসে বলেই তাঁরা সব সময় প্রধান ভূমিকায়, আসলে কিন্তু মনে রাখতে হবে কুরু-পাঞ্চালদের ঝগড়া রীতিমত পুরানো ব্যাপার, সেই ঝগড়াতেই একপক্ষে শামিল হয়েছেন পাণ্ডবেরা, যাতে তাঁদেরও লাভ হয়েছে। পাঞ্চালদের সঙ্গে পাণ্ডবদের জুটে যাওয়ার ফলে যে নতুন রাজনীতির সুচনা হল এবং এই জোটের ফল যে কত গম্ভীর হতে পারে তা ধৃতরাষ্ট্র যেমন খানিকটা বুঝেছিলেন, তার চেয়েও বেশি বুঝেছেন অঙ্গরাজ কর্ণ। দুর্যোধনের এক রাশ ছেলেমানুষি প্রস্তাব এক ঝাঁকাড়ে উড়িয়ে দিয়েছেন কর্ণ। বলেছেন–এ সব কিছুই সম্ভব নয়, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করাও নয়, দুপদ কিংবা তাঁর ছেলেদের টাকা খাওয়ানোও নয়, ভীমকে মারাও নয়, কিছুই নয়। কর্ণ বললেন-আমাদের এই মুহূর্তে একটাই করণীয় আছে-যতক্ষণে পাণ্ডবদের শিকড় আরও না গেড়ে যায় পাঞ্চালের মাটিতে, যাবন্ন কৃতমূলাস্তে তার আগেই প্রহার দিতে হবে তাদের। যতক্ষণ আমাদের পক্ষই বেশি বলবান আছে এবং পাঞ্চালেরা আছে দুর্বল, তার মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে পাঞ্চালদের ওপর। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ যাতে আমাদের আগেই উদ্যমী হয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়েন আমাদের ওপর, সেটাই এখন বিচার্য বিষয়। এবারে কর্ণ রাজনীতির মোক্ষম পর্যায়টি আগাম অনুমান করে দুর্যোধনকে বললেনবন্ধু পাণ্ডবদের রাজ্যলাভের জন্য যতক্ষণে না বৃষ্ণিবংশের প্রধান পুরুষ কৃষ্ণ তাঁর যাদব বাহিনী নিয়ে পাঞ্চাল ছেয়ে ফেলেন–যাবন্নায়াতি বাষ্ণেয়ঃ কর্য যাদববাহিনীমতার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে পাঞ্চাল। কারণ পাণ্ডবদের জন্য, তাঁদের রাজ্যলাভের জন্য কৃষ্ণের কিন্তু কিছুই অদেয় থাকবে না–না টাকা-পয়সা, না ভোগসুখ, না তাঁর নিজের রাজ্য-সব তিনি দিতে পারেন পাণ্ডবদের জন্য।(৬২)

কর্ণের এই অনুমান এবং পরামর্শ নিতান্তই বাস্তবানুগ এবং ধৃতরাষ্ট্র তাঁর এই মত মেনে নিয়ে অন্য কথা বলেছেন–অভিপূজ্য ততঃ পশ্চাৎ। কিন্তু কুরুসভায় ধৃতরাষ্ট্র নিজের মতেই সব সময় চলতে পারেননি, কারণ, কুরুসভার প্রবীণ মন্ত্রীদের মধ্যে পাণ্ডবদের বহু সমর্থক ছিলেন এবং বারণাবতের কুচক্রের সন্ধান এতদিনে তারা পেয়ে গেছেন। কাজেই আপাতত তাঁদের তুষ্ট করতে বধূ সমেত পাণ্ডবদের রীতিমত আরতি করে নিয়ে আসতে হল এবং শুধু তাই নয়, তাঁদের রাজ্যাধও দিতে হল। ধৃতরাষ্ট্র পাঞ্চালে পাণ্ডবদের আনতে পাঠাবার সময় কুরু-পাঞ্চাল ভাই ভাই-রব তুললেন-বৃদ্ধিং চ পরমাং ব্ৰয়াৎ বৎসংযোগোঙবাং তথা।

মনে রাখা দরকার, ধৃতরাষ্ট্র যে বড়ো নিজের ইচ্ছায় এই ‘কুরু-পাঞ্চাল ভাই ভাই রব তুললেন, তা মোটেই নয়। বলা উচিত, তিনি কুরুসভায় প্রবীণ এবং শক্তিমানদের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছেন। নইলে ভাবুন, যে দ্রোণাচার্য পাঞ্চাল দুপদকে তাঁর নিজের রাজ্য থেকে হটিয়ে কাম্পিল্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেই দ্রোণ শুধু পাণ্ডবদের রাজ্য দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করলেন তাই নয়, দ্রুপদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কুরুপতি ধৃতরাষ্ট্রকে রীতিমত সমঝে দিলেন। সেই রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করার প্রথম শ্লোগান হিসেবে দ্রোণই ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিলেন–কুরু-পাঞ্চাল ভাই-ভাই রব তোলার। দ্রোণ বললেন–এখনই দ্রুপদের উদ্দেশ্যে একজন দূত পাঠান, যে মিষ্টি করে কথা কইতে জানে। কৌরবদের তরফ থেকে বর-বধূর জন্য রত্ন, অলংকার নিয়ে দুপদকে গিয়ে সে বলবে–মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র এবং যুবরাজ দুর্যোধন এ বিয়েতে দারুণ খুশি হয়েছেন। আপনার সঙ্গে এবার বৈবাহিক সম্পর্ক হল–আমাদের মর্যাদাও বাড়ল। দ্রোণ বললেন–সেই দূত দ্রুপদ এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের কাছে বারবার বলবে-এই বিবাহ কতটা উপযুক্ত এবং ভাল হয়েছে দুই রাজ-পরিবারের পক্ষে। আর কুরু পরিবার এই বিয়েতে কতটা প্রীতি-পুলকিত হয়েছে, সেটাও দৃত জানাবে–উচিতত্বং প্রিয়ত্বঞ্চ যোগস্যাপি চ বর্ণয়েৎ।

যে কথাগুলো দূত বলবে, তা ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনের মনের মত না হলেও বলবে–অর্থাৎ বলতে হবে। কথাগুলির উদ্দেশ্য স্পষ্ট। সোজা কথায় পাণ্ডবদের এবং বিশেষত দ্রুপদ-ধৃষ্টদ্যুম্নকে একটু তেল দেওয়া। প্রয়োজনীয় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৌরবদের দিক থেকে মৌখিকতার এই খাতিরটুকু যে দ্রুপদকে একান্তই করা দরকার–এটাই দ্রোণাচার্যের মত দ্রুপদ-বিদ্বেষীও মনে করেন।

কিন্তু দ্রোণের এই কথাটা দুর্যোধন কেন, তাঁর প্রধান পারিষদ কর্ণই ভালভাবে নিলেন না। চিরকালের দ্রুপদ-বিদ্বেষী দ্রোণাচার্য আজকে হঠাৎ দ্রুপদের প্রতি সম্ভাবনায় কাতর হয়ে উঠলেন এবং এতটাই কাতর যে, দ্রুপদের বন্ধুত্বে কৌরবদেরও পরম পুলকিত বোধ করতে হবে–দ্রোণাচার্যের এই পরামর্শ কর্ণকে সংশয়িত করে তুলল। সে সন্দেহ তিনি ব্যক্ত করে ফেললেন। কর্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন–সারাজীবন কুরুকুলের খেয়ে-পরে, তাঁদের টাকা-পয়সা আর সম্মান পাওয়া সত্ত্বেও এই ভীষ্ম-দ্রোণ কিন্তু আপনাকে ভাল কথা বললেন না, ভাল পরামর্শও দিলেন না। যাদের মনের মধ্যে কু, যারা মুখে এক মনে এক-তারাও যদি আবার হিতোপদেশ দেয়, তা কি কোন ভদ্রলোকের পছন্দ হবে–দুষ্টেন মনসা যোগৈঃ প্রচ্ছন্নেনান্তরাত্মনা…।

বলা বাহুল্য, এই সমস্ত কথাগুলিই’ এখানে দ্রোণাচার্যের উদ্দেশ্যে। কর্ণ কিছুতেই বুঝতে পারছেন না–যে লোক চিরকাল দ্রুপদের বিরোধী গোষ্ঠীর মানুষ, তিনি কেন দ্রুপদকে তুষ্ট করার জন্য এত ব্যস্ত। কর্ণ জানতেন না, অথবা বলা উচিত দ্রোণাচার্য এটা ভাল জানতেন যে, উত্তর পাঞ্চাল হারাবার পর থেকেই দ্রুপদ সময়ের অপেক্ষায় আছেন এবং সেই লক্ষ্যে ক্রমে ক্রমে শক্তিমানও হয়ে উঠেছেন। স্বাভাবিক কারণেই কর্ণের অযথা আচরণে তাঁর রাগ হল এবং হয়তো দ্রুপদের শক্তির কথা মনে রেখেই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, তাঁর হিতকথা না শুনলে কুরুকুল অচিরেই উচ্ছন্নে যাবে কুরবো বৈ বিনক্ষ্যন্তি ন চিরেণৈব মে মতিঃ।

দ্রোণের অনুমান ঠিক ছিল। কারণ দ্রোণের অব্যবহিত পরেই বলতে উঠলেন বিদুর। তিনি পাণ্ডবদের পৈতৃক রাজ্যে অধিকারের প্রসঙ্গটি একবার তুলেই তাঁদের শক্তিমত্তার বিচার আরম্ভ করেছেন। পঞ্চ পাণ্ডবের মধ্যে কে কতটা শক্তি ধরে–সে কথাটা সাড়ম্বরে উল্লেখ করলেন বিদুর। কিন্তু এটা তাঁর বক্তব্যই নয়। কারণ তাঁর মতে পাণ্ডবেরা এখন শুধুমাত্র একটি বিশেষ্য পদ নয়, তাঁদের অনেক বিশেষণ জুটেছে। কিরকম পাণ্ডব? না, যে পাণ্ডবের পক্ষে রয়েছেন স্বয়ং বলরাম, কৃষ্ণ এবং অদ্বিতীয় বৃষ্ণিবীর সাত্যকি। আগেই বলেছি, কংসহা বীর হিসেবে এবং জরাসন্ধ এবং তাঁর সম্মিলিত বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখার প্রতিষ্ঠায় কৃষ্ণ-বলরামের ভাবমূর্তি তখন সর্বত্র উজ্জ্বল। কিন্তু বিদুর শুধু এটুকু বলেই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বললেন–কি রকম পাণ্ডব জান? যাদের শ্বশুর হলেন দ্রুপদ, যাঁদের শালা হলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি ভাইরা (মনে রাখবেন, দ্রুপদের একাধিক স্ত্রী ছিল এবং সব মিলে আঠেরটা ছেলে ছিল)। কাজেই যে পাণ্ডবদের সহায় হলেন বলরাম এবং কৃষ্ণ, দ্রুপদ এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, সেই পাণ্ডবদের সঙ্গে এটে ওঠার কল্পনাটা নিছক বাতুলতা বলেই–সো’শক্যতাঞ্চ বিজ্ঞায়-মনে করেন বিদুর। তা ছাড়া পদাঘাত প্রাপ্ত সর্প যেমন প্রতিহিংসায় ফুঁসতে থাকে, দ্রোণের দ্বারা আহত দ্রুপদও যে সেইভাবেই কাল কাটাচ্ছেন এবং দ্রোণের আশ্রয়দাতা কৌরবকুলও যে দ্রুপদের কাছে সমান দোষে দোষী, সে কথাটাও পরিষ্কার করে দিলেন বিদুর। তিনি দ্রোণের দেওয়া আঘাত কুরুকুলের ঘাড়ে নিয়েই বললেন–দুপদ যথেষ্ট বড় রাজা–দুপদোপি মহান রাজা, এবং পূর্বে তাঁর সঙ্গে আমরা শত্রুতা করেছি-কৃতবৈরশ্চ নঃ পুরা। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের উচিত পাণ্ডবদের তুষিয়ে তাঁকে আমাদের দলে টানা। তাতে আমাদের শক্তি বাড়বে–তস্য সংগ্ৰহণং রাজন্ স্বপক্ষস্য বিবর্ধনম্।

বিদুরের বক্তৃতা সফল হয়েছিল। পাঞ্চাল দ্রুপদের ক্ষমতা এবং কংসহন্তা কৃষ্ণের যদুবাহিনীর ভয় তিনি সাময়িকভাবে ধৃতরাষ্ট্রের মনে সংক্রামিত করতে পেরেছিলেন। ফলে ধৃতরাষ্ট্র স্বয়ং বিদুরকেই পাঠালেন পাণ্ডব এবং পাঞ্চালদের নেমন্তন্ন করে আনতে। মহা সমারোহে পাণ্ডবেরা হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন এবং সোজা কথা হল–বৃহত্তর জন সমর্থন পাণ্ডবদের প্রতি থাকায় ধৃতরাষ্ট্রকে রাজ্য ভাগ করে দিতেই হল। পাণ্ডবদের তিনি বললেন–আমাদের যেন আর ঝগড়াঝাটি না হয়–মিথোন বিগ্রহে মা ভূ-তোমরা চলে যাও খাণ্ডবপ্রস্থে, সেখানে বসতি বসিয়ে রাজ্য রক্ষা কর তোমরা। খাণ্ডবপ্রস্থ একেবারে বন্য জায়গা, শস্য হয় না মোটেই, ধৃতরাষ্ট্র এই রাজ্য পাণ্ডবদের দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহাভারতের টীকাকার মনের দুঃখে মন্তব্য করেছেন–ধৃতরাষ্ট্র একটি ঘোর বন দিলেন পাণ্ডবদের-শস্য নেই, বসতি নেই, কিছু নেই-শস্যশূন্যে দেশঃ পাণ্ডবেভ্যো দত্তঃ ইতি।(৬৩)

কৌরবদের পূর্বপুরুষ মহারাজ হস্তী হস্তিনাপুর স্থাপন করেছিলেন, মহারাজ কুরু স্থাপন করেছিলেন কুরুক্ষেত্র, কুরুজাঙ্গল এবারে আধুনিক ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লির প্রতিষ্ঠা হল খাণ্ডবপ্রস্থে। খাণ্ডবপ্রস্থ ইন্দ্রপ্রস্থে পরিণত হল এখনকার পুরনো দিল্লির ফিরোজ শা-কোটলা আর হুমায়ুনের সমাধির মাঝখানে। আমি আগেই বলেছি যে, পণ্ডিতেরা অনেকে পাণ্ডবদের কুরুবাড়ির নিজের লোক বলে মনে করেন না। তাঁরা মনে করেন, পাণ্ডবেরা কৌরবদের ‘kindred race এবং ‘very akin কিন্তু তাঁরা দ্বিতীয় আর্যদল। তাঁদের এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে ওই খাণ্ডবপ্রস্থ অঞ্চলে পাণ্ডবদের বন সাফ করে নতুন বসত বসাতে দেখে। খাণ্ডব-দহনের সময় তক্ষক নাগের বংশকে পণ্ডিতেরা ‘aboriginal race বলে মনে করেছেন, যে তক্ষক তক্কে তক্কে থেকে নয়া আর্যদের সর্বনাশ করেছিল পরীক্ষিৎকে মেরে। খাণ্ডববনের অন্যান্য পশুপক্ষীরাও যে অনাৰ্যতার অক্ষরে চিহ্নিত হবেন পণ্ডিতদের লেখনীতে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার মধ্যে আবার আরেক বিপদ করেছেন দ্রৌপদী। পাঁচ ভাই তাঁকে একসঙ্গে বিয়ে করতে চাইলে, আর্যসন্তান দ্রুপদ রাজা যেহেতু ভীষণ চমকে উঠেছিলেন তাতে পণ্ডিতদের সন্দেহ আরও বেড়েছে। তাও যদি দ্রুপদের একটু চমকানিতেই শেষ হত! দ্রুপদ সবিস্ময়ে এই গণবিবাহের সম্ভাব্যতা উড়িয়ে দিলে স্বয়ং যুধিষ্ঠির, যিনি কুলবিধি, ধর্মবিধি সব জানেন, তিনি বললেন–এই আমাদের কুলাচার, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা করেছেন, আমরা সেই পথেই যাচ্ছি–পূর্বেষা আনুপূর্বেণ যাতং বত্মানুযামহে–এতে ধর্মের কোন বিরোধ হচ্ছে বলে আমরা মনে করি না।(৬৪)

যুধিষ্ঠিরের এই কুলাচার-স্বীকারে পণ্ডিতেরা আরও সন্দেহ করেন যে, এই আর্য, সেই আর্য নয়। বিশেষত বিবাহবিধির এমন শৈথিল্য, সাধারণভাবে স্ত্রীলোক সম্বন্ধে অর্থাৎ হিড়িম্বা, উলুপী এই সব স্ত্রীলোক সম্বন্ধেও বাছ-বিচার না থাকায়, পণ্ডিতেরা বড়ই চিন্তিত। এই সব শিথিলতা নাকি পুরুবংশীয়দের মধ্যে কম। শৈথিল্য যতখানি আছে এবং যা আছে, তা পাণ্ডবের মধ্যেই অথবা শৌরসেনী, মানে কৃষ্ণের পরিবারে যাদবদের মধ্যে, কুন্তিভোজ, দশার্ণ, মৎস্য এবং মগধে। এরা সবাই নাকি ভিন্ন ভিন্ন দলের আর্য। তার মধ্যে বন কেটে বসতি গেড়ে দিল্লি প্রতিষ্ঠা করায় পণ্ডিতেরা প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, মহাভারতের যুদ্ধকে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ বল না, বল কুরু-পাঞ্চালের যুদ্ধ-অর্থাৎ পুরাতন আর্যদের পুরাতন ঝগড়া। নতুন পাণ্ডবেরা নিজেদের সুবিধের জন্য পুরনো এক বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীতে শামিল হয়েছেন মাত্র।

কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। মহাসমারোহে ইন্দ্রপ্রস্থ মানে দিল্লির প্রতিষ্ঠা হল। কিন্তু তার পরেই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীকে একান্তে প্রেম করতে দেখে ফেলায় অর্জুনকে চলে যেতে হল বনে। তাঁর নাকি ব্রহ্মচারী হয়ে বারো বছর বনে থাকার কথা। কিন্তু আমরা দেখি তিনি একটার পর একটা বিয়ে করে চলেছেন-”আমরা সন্দেহ করি এই সব বিবাহে কিছু কিছু রাজনৈতিক লাভও ঘটেছে পাণ্ডবদের। বিশেষত যাদবী সুন্দরী সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহে। অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার বিয়েতে কৃষ্ণের সেই সুবিধে হল, যে সুবিধে তিনি নিজেও পাননি বিদর্ভরাজা ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিণীকে বিয়ে করে। ভীষ্মকের মেয়ে রুক্মিণীর সঙ্গে শিশুপালের বিয়ে ঠিক করেছিলেন জরাসন্ধ, কিন্তু কৃষ্ণ মাঝপথে রুক্মিণীকে হরণ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করলেন। কিন্তু এতে জরাসন্ধের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক লাভের কথা কৃষ্ণ ভেবেছিলেন, তা মোটেই হয়নি, রুক্মিণীপিতা ভীষ্মক সেই জরাসন্ধের পক্ষেই রয়ে গেছেন। মহাভারতে রাজসূয় যজ্ঞের আগে জরাসন্ধবধের প্রস্তাবনায় কৃষ্ণ তাঁর এই মর্মান্তিক দুঃখটি যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছেন। যাই হোক সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়েতে কিন্তু দুই পক্ষেরই বিরাট রাজনৈতিক লাভ হল। মহাভারতে দেখবেন এই বিয়ের পরে পাণ্ডবদের দিল্লিতে বৃষ্ণি-অন্ধক-যদুবীরদের সাংঘাতিক যাতায়াত শুরু হয়েছে।

এর পরেই জরাসন্ধবধের পালা। তিনটি স্নাতক ব্রাহ্মণের বেশে কৃষ্ণ, অর্জুন আর ভীম গেলেন মগধপুরী গিরিব্রজে। তারপর not a drum was heard, not a funeral note, ভীমের সঙ্গে সাধারণ মল্লযুদ্ধে প্রাণ হারালেন জরাসন্ধ। কৃষ্ণের বুদ্ধির তারিফ আরম্ভ হল সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। পাণ্ডবেরা দিগবিজয়ে বেরোলেন। রাজসূয় যজ্ঞে নতুন যুগের নতুন নায়ক কৃষ্ণকে একেবারে পাদ্যঅর্থ দিয়ে বরণ করে নিলেন কুরুকুলপতি ভীষ্মকৌরবদের পুরাতন নায়ক। রাজসূয় যজ্ঞের, সভাভূমিতেই কৃষ্ণের হাতে মৃত্যুবরণ করলেন শিশুপাল। এককালে জরাসন্ধের ঘোর সমর্থক, তাঁর পুত্রকল্প রাজনৈতিক শিষ্য শিশুপাল কৃষ্ণের হাতেই মারা গেলেন। যজ্ঞশেষে মারা গেলেন পৌণ্ড্র বাসুদেব, জরাসন্ধের মিত্ৰগোষ্ঠীর আরও এক প্রবল পরাক্রান্ত নৃপতি এবং তাঁর সঙ্গেই পূর্বাঞ্চলীয় রাজশক্তির অবসান ঘটল। কৃষ্ণের আরও এক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌভদেশের রাজা শা, যিনি এককালে জরাসন্ধের মিত্রবাহিনীতে ছিলেন, তিনিও কৃষ্ণের হাতে মারা পড়লেন ঠিক সেই সময়ে, যখন কুরসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ চলছিল। কৃষ্ণ নিজেই এ কথা যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছেন বনপর্বে। আসলে পুরুষোত্তম কৃষ্ণ এখন নিজের রাজনৈতিক সত্তা সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন করার জন্য ব্যস্ত ছিলেন বলেই পাণ্ডবদের দেখভাল করার সুযোগ পাননি। অন্যদিকে পাণ্ডবেরা রাজসূয়ই করুন আর যাই করুন, রাজনৈতিকভাবে তাঁরা যেহেতু তখনও যথেষ্ট দুর্বল তাই সামান্য পাশা-খেলার অজুহাতেই তাঁদের রাজত্ব গেছে। আর পণ্ডিতদের মতে পুরাতন আর্যগোষ্ঠীর অভ্যাসই হল নতুনদের সাময়িকভাবে পুনর্বাসিত করেও তাঁদের রাজ্য কেড়ে নেওয়া। ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে এই পুরাতন আর্যগোষ্ঠীর অভ্যাসটি বজায় রয়েছে। পাণ্ডবদের তিনি বারবার স্থান দিয়েও মনে মনে কেবলই ফিকির করেছেন, কেমন করে তাঁদের তাড়ানো যায়। ফলে মিথ্যে মিথ্যি ছলচাতুরীর পাশা খেলিয়ে পাণ্ডবদের তিনি বনবাসে যেতে বাধ্য করলেন।

লক্ষ করবেন, পাঞ্চালেরা কিন্তু দ্রৌপদীর বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই কুরু-পাণ্ডবদের ঘরোয়া ব্যাপারে সোজাসুজি নাক গলাননি, ঠিক যেমন যাদবেরাও তা করেননি। তাঁরা সবাই রাজসূয় যজ্ঞে এসেছিলেন এবং সেখানে পাণ্ডবদের মোটামুটি প্রতিষ্ঠিতই দেখেছিলেন, কেননা রাজসূয় যজ্ঞ মানেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার মূলে যে ছিলেন যদুবীর কৃষ্ণ–এ কথা দ্রুপদ পাঞ্চাল অতটা অনুধাবন করতে পারেননি। মহাভারতের আদিপর্বে, সেই যখন মহামতি বিদুর পাণ্ডবদের রাজ্য দেওয়ার জন্য ওকালতি করছেন, সেই তখনই বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন–যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই জয়, এখন কৃষ্ণ যেদিকে যাবেন, সবাই সেদিকে যাবে। এ কথা যে বিদুর বড় ভক্তি থেকে বলছেন কিংবা গভীর ধর্মবোধ থেকে, তা মোটেই নয়। বিদুর বলছেন বাস্তব বুঝে, বাস্তব দেখে। কৃষ্ণের সম্বন্ধে কথা বলার আগেই বিদুর বলেছেন-দাশাহ পুরুষেরা যেমনি ক্ষমতাসম্পন্ন, তেমনি সংখ্যাতেও তাঁরা অনেকবলবন্তশ্চ দাশাহ বহব বিশাম্পতে। (দশাহ কৃষ্ণের বংশে পূর্ববর্তী এক পুরুষের নাম।)

দেখা যাচ্ছে কর্ণ যে যাদববাহিনীর ভয় দেখিয়েছেন দুর্যোধনকে, বিদুরও আরেকভাবে সেই যাদববাহিনীরই ভয় দেখাচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। কিন্তু পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থে স্থান পেয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও যে এমন বোকার মত রাজ্য হারিয়ে বসবেন–দ্রুপদ পাঞ্চাল তা কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু কৃষ্ণও যে তা কল্পনা করতে পারেননি, তা নয়। পাণ্ডবরা বনবাসে যাবার পরেই খবর চলে এসেছে পাঞ্চালে, মথুরায়, এমনকি কেকয় দেশেও। খবর পেয়ে কৃষ্ণ ভোজ, বৃষ্ণি এবং অন্ধক পুরুষদের বাহিনী নিয়ে পাণ্ডবদের খুঁজে বার করেছেন গভীর বনে–ভোজাঃ প্রব্রজিতা শুত্ব বৃষ্ণয়শ্চান্ধকৈঃ সহ। পাঞ্চাল যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্ন, কেকয় দেশের পাঁচ রাজপুত্র এবং চেদিদেশের নতুন প্রতিষ্ঠিত রাজা শিশুপালের ছেলে ধৃষ্টকেতু, যিনি শিশুপাল মারা যাবার পর অবশ্যই সেইদিকে যাচ্ছেন, যেখানে আছেন কৃষ্ণ–শিশুপালহন্তা। এরা যে সবাই পাণ্ডবদের সঙ্গে বনে দেখা করতে এসেছেন, তার কারণ শুধু সৌজন্য নয়, তাঁর কারণ পাণ্ডবদের অপমানে এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েছেন–ক্রোধামসমম্বিতাঃ। এরা সবাই অবশ্য এসেছেন বাসুদেব কৃষ্ণকে সামনে রেখে, তাঁকে পুরোধা করে-বাসুদেবং পুরস্কৃত্য। তিক্ত-বিরক্ত কৃষ্ণ এসেই যুধিষ্ঠিরকে বললেন–এমনটি যদি চলতে থাকে, তাহলে দুর্যোধন-দুঃশাসন আর কর্ণ-শকুনির রক্ত পান করবে এই বসুন্ধরা। কৌরবসভায় ওই যতগুলি লোক জুটেছে সবগুলিকে মেরে আমরা সবাই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে স্থাপন করব।

বস্তুত মহাভারতের যুদ্ধটা এই সময়েই লেগে যেতে পারত, এবং ওই যে পাঞ্চাল-কেকয় সবাই এসে ওই সময়ে জুটেছিলেন কৃষ্ণের পাশে-সে বোধহয় কৃষ্ণেরই ইশারায়। যাই হোক, সেই সময়ে অর্জুন নানা কথায়, নানা স্তুতিতে কৃষ্ণকে কোনমতে থামালেন। কিন্তু থামলেন না পাঞ্চালী কৃষ্ণা, কারণ অসহ্য এবং অসভ্য ব্যবহার প্রধানত সহ্য করতে হয়েছে তাঁকেই। তিনি কুরুসভার সমস্ত অপমান কৃষ্ণকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন–হায় হায়, পাণ্ডবরা বেঁচে থাকতে, পাঞ্চালেরা বেঁচে থাকতে এবং বৃষ্ণিবংশীয়েরা বেঁচে থাকতেও ওরা আমাকে বেশ্যার মত ভোগ করতে চাইল-জীবসু পাণ্ডুপুত্ৰেযু পাঞ্চালেষু চ বৃষ্ণিষু।

কৃষ্ণ কথা দিলেন, অর্জুন কথা দিলেন এবং পাঞ্চাল যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্নও কথা দিলেন যে, তাঁরা সবাই একযোগে এই অপমানের প্রতিকার করবেন। কিন্তু সব কিছুর পরে কৃষ্ণ জানালেন যে তিনি যদি কোনক্রমে দ্বারকায় থাকতেন তাহলেই এই পাশাখোলার অনর্থটুকু হত না–যদ্যহং দ্বারকায়াং স্যাং রাজন্ সন্নিহিত পুরা। কিন্তু কৃষ্ণ দ্বারকায় ছিলেন না। তিনি গিয়েছিলেন সৌভ দেশে শাকে শিক্ষা দেবার জন্য। আমরা এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম যে, দ্বারকায় বসেও কৃষ্ণ কিন্তু দ্রুপদের মত নিশ্চিন্ত ছিলেন না। পূর্বে যেমন তিনি মৃত বলে রটে-যাওয়া পাণ্ডবদের খুঁজে বার করবার কাজে লাগিয়েছিলেন সাত্যকিকে, তেমনি এখানেও দেখছি সাত্যকিই প্রথমে কৃষ্ণকে পাণ্ডবদের রাজ্যপাট হারানোর খবর দিচ্ছেন। কৃষ্ণ খবর পাওয়া মাত্র সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে একেবারে বনে চলে এসেছেন পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে। পাঞ্চাল কেকয়দের সংবাদ দিয়ে নিয়ে আসা-এও বোধহয় তাঁরই কাজ।, রাজসূয় যজ্ঞের পর থেকে একটা জিনিস খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেটা হল, পাণ্ডব বলুন, পাঞ্চাল বলুন–প্রত্যেকেই কিন্তু এখন যে কোন ব্যাপারে কৃষ্ণ বাসুদেবকেই মুরুব্বি ধরছেন। পাণ্ডবেরা বলছেন-কৃষ্ণ যেমনটি বলছেন, তেমনিই হবে-যথাহ মধুসূদনঃ। ধৃষ্টদ্যুম্ন বলছেন-বলরামকৃষ্ণকে আশ্রয় করে যুদ্ধ করব আমরা, জয় আমাদের হবেই-রামকৃষ্ণৌ ব্যপাশ্ৰিত্য অজেয়াঃ স্ম রণে স্বসঃ। আবার একটা কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে বাসুদেবেন। রক্ষিতঃ–অর্থাৎ আমরা যুদ্ধ করব বাসুদেব কৃষ্ণের দ্বারা রক্ষিত হয়ে অর্থাৎ তাঁরই ছত্রচ্ছায়ায়। বলা বাহুল্য বাসুদেবের এই সুরক্ষা-ছত্রের তলায় আছেন–পাঞ্চালেরা, কেকয়েরা এবং আরও অন্যেরা, যাঁরা নিজেরাও ব্যক্তিগতভাবে এক একটি বড় শক্তি। কথাটা বোঝা যাবে ঠিক পাণ্ডব-নিবাসনের পর দ্রোণাচার্যের বক্তব্যে পাণ্ডবরা একে একে বনবাসে বেরিয়ে গেলে মহর্ষি নারদ ভীষণ রেগে বললেন–আজ থেকে ঠিক চোদ্দ বছরের মুখে কৌরবেরা ধ্বংস হবে। কথাটা এমন অভিশাপের মত শোনাল যে, কুরুসভার যুবগোষ্ঠীদুযযাধন, কর্ণ এবং শকুনিরাও ভয় পেলেন এবং সাময়িকভাবে দ্রোণাচার্যের সুরক্ষায় বাঁচতে চাইলেন। এমনকি গোটা কুরু রাজ্যের পরিচালনার ভারও তাঁরা সঁপে দিলেন দ্রোণকেদ্রোণং দ্বীপম্ অমন্যস্ত রাজ্যং চাশ্মৈ নবেদয়ন।

সেই দ্রোণাচার্য, যাঁর টাকা-পয়সার লোভ ছিল। সেই দ্রোণাচার্য যিনি ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও মনে মনে বড় আশা করতেন যে, একদিন তিনি এক বিরাট রাজ্যের রাজা হবেন। তা রাজা তো তিনি আগেই হয়েছেন, দ্রুপদকে দক্ষিণ পাঞ্চালে বিতাড়িত করে তিনি তো বহু আগেই উত্তর পাঞ্চালের বামুন রাজা। কিন্তু আজকে যখন কুরু সভায় কুরু রাজ্যের পরিচালনা-ভার পেলেন দ্রোণাচার্য, তখন তাঁর মন কিন্তু লোভ এবং ভয়ের দ্বন্দ্বে আকীর্ণ। রাজ্যলোভ, বৃহত্তর সম্মান তাঁকে বলতে বাধ্য করল-তোমরা যখন আমার শরণ নিয়েছে, তখন আমি যথাশক্তি রাজ্য পরিচালনা করব। সর্বাত্মক ভক্তিতে আমার কাছে আত্মনিবেদনকারী কৌরবদের আমি যে ত্যাগ করতে পারি না, সে আমার কপাল-নোসহে’য়ং পরিত্যক্তৃং দৈবং হি বলবত্তর। কিন্তু এই সব আবেগতাড়িত মুহূর্তের পরেই দ্রোণের অন্তরে কাজ করতে থাকে গভীর এক বাস্তববোধ, যে বোধ তাঁর লোভ, সম্মান এবং আবেগকে মুহূর্তে ভেঙে দিয়ে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করে। দ্রোণ তখন কৌরবদের পরিষ্কার জানান–পাণ্ডবরা বারো বছর বনে থাকবে বটে–কিন্তু তাদের মনে থাকবে ক্রোধ এবং অপমানের জ্বালা, এর শোধ তারা তুলবেই। অন্য দিকে বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে মহারাজ দুপদকে আমি রাজ্য থেকে তাড়িয়েছি–ময়া চ ভ্রংশিতো রাজ্যাৎ দ্রুপদঃ সখিবিগ্রহে। সে আমারই মৃত্যুর জন্য পুত্রলাভ করেছে। সেই পুত্র হল ধৃষ্টদ্যুম্ন, এবং সে পাণ্ডবদের শালা।

রাজনীতির বুদ্ধিতে দ্ৰোণ বেশ বুঝতে পারছেন যে, প্রতিষ্ঠিত রাজ্য হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পাণ্ডব-পাঞ্চাল–এই দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই এককারণ নিয়ে এসেছে এবং এইটাই তাঁদের একতারও সূত্র। দ্রোণ বলছেন–আজ তাই পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন শালা-সম্বন্ধে এবং রাজ্যভ্রষ্টতার সাধারণ কারণে পাণ্ডবদের অনেক প্রিয়তর; ঠিক এই ব্যাপারটাই আমার ভয়ে করছে–পাণ্ডবানাং প্রিয়তরস্তস্মাত্মাং ভয়মাবিশৎ। দ্রোণের ধারণা, যিনি তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত, সেই মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবপক্ষে চলে যাওয়ায় দুর্যোধনে বিপদ ঘটবে ভবিষ্যতে। তাছাড়া কুরুসভায় দ্রৌপদীর যে অবমাননা হয়েছে, সে অবমাননা পাণ্ডবেরা যেমন সইবে না, তেমনি সইবে না পাঞ্চালেরা কিংবা বৃষ্ণিরা

একথা ঠিক যে, পৃথিবীতে যতগুলি বড় বড় যুদ্ধ হয়েছে, তার পেছনে যেমন অনেক রাজনৈতিক সামাজিক এবং দ্বিপাক্ষিক কারণ থাকে, তেমনি যুদ্ধ লাগার জন্য একটা তাৎক্ষণিক কারণও থাকে। ভারত যুদ্ধের ক্ষেত্রে এই কারণ হলেন দ্রৌপদী। তাঁর অপমানে পাণ্ডবেরা যেমন স্বামী হিসেবে অপমানিত, পাঞ্চালেরা তেমনি ভাই এবং পিতার সম্বন্ধ-গৌরবে, অপমানিত। আর বৃষ্ণিরা, বিশেষত বৃষ্ণিকুলের নায়ক কৃষ্ণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন দ্রৌপদীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সূত্র থাকায়। কৃষ্ণা যেমন কৃষ্ণের কাছে এ বিষয়ে ন্যায়বিচার চেয়েছেন তেমনি কৃষ্ণও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি দ্রৌপদীর ঋণ শোধ করেছেন। কাজেই দ্রোণের অনুমান মিথ্যে নয়। তাঁর ধারণা, পাণ্ডবদের বনপর্ব শেষ হলেই অর্জুন আসবেন বাসুদেবের রক্ষাকবচ গায়ে এঁটে-বাসুদেবেন রক্ষিতঃ, অর্জুন আসবেন পাঞ্চালদের বর্ম পরে–পাঞ্চালেরভিসংবৃতঃ। কাজেই চোদ্দ বছরের মুখে দুর্যোধনের বিপদ আছে। দ্রোণাচার্যের এই ভয়ের কথা সম্পূর্ণ সমর্থিত হচ্ছে স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রের মুখে। তিনি মহামতি বিদুরের বক্তব্য উদ্ধার করে সঞ্জয়কে ঠিক একই কথা বলেছেন। অর্থাৎ কৃষ্ণার অপমানে পাণ্ডব, পাঞ্চাল এবং বৃষ্ণিরা এককাট্টা হবে, তারা কেউ এই অবমাননা সহ্য করবে না-পৃষ্ণয়ো বা মহেষাসাঃ পাঞ্চালা বা মহারথাঃ। তারা সবাই আসবে বাসুদেব কৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে-বাসুদেবেন রক্ষিতাঃ।

পাণ্ডবেরা বনবাসে যাবার মুহূর্তে যে সমস্ত রাজনৈতিক সূত্রগুলি কাজ করছিল, তার একটা বিবরণ আমরা দিয়েছি। যে কারণে ভারতযুদ্ধ ত্বরান্বিত এবং অনিবার্য হয়ে উঠল, সেই দ্রৌপদীর কথাও আমরা বলেছি। যাই হোক, বনবাস পর্বেও ভারতযুদ্ধের প্রস্তুতি কিভাবে চলছিল, তারও দু-একটা সূত্র আমাদের দিতে হবে।

পাণ্ডবেরা বনে গেলেন। অনেক বনই ইন্দ্রপ্রস্থ-দিল্লীর কাছে। তবে বনবাসের অনুষঙ্গে পাণ্ডবেরা যে হাজারো তীর্থ ঘুরেছেন, সেটা একেবারে রাজনৈতিক তাৎপর্যহীন বলে মনে হয় না। কারণ দেখুন, তীর্থ করতে করতে পাণ্ডবেরা যখন প্রভাস তীর্থে এসে পৌঁছোলেন তখন মহাভারতের শ্রোতা জনমেজয় কথক-ঠাকুর বৈশম্পায়নকে জিজ্ঞাসা করলেন বৃষ্ণিরা আর পাণ্ডবেরা তো পরস্পর পরস্পরের বন্ধু-সুহৃদশ্চ পরম্পর। তা তাঁদের মধ্যে কি কথাবার্তা হল, বৃষ্ণিরাই বা কি বললেন?

বাস্তবিকপক্ষে রাজনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে এ প্রশ্নটা আমাদের তরফ থেকেও আসে। বৈশম্পায়ন বললেন–বৃষ্ণিবীরেরা সবাই পাণ্ডবদের ঘিরে বসলেন কৌতূহলে–পরিবার্যোপতস্থিরে। বৃষ্ণিদের প্রধান নায়ক বলরাম প্রথম থেকেই একেবারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমস্ত কৌরব প্রধানদের নিন্দা করতে থাকলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এবং ধৃতরাষ্ট্র কাউকেই তিনি গালাগালি দিতে বাকী রাখলেন না। বিশেষত দুর্যোধনকে নানাভাবে এর ফল ভুগতে হবে, সে কথাও বলতে দ্বিধা করলেন না। কিন্তু তাঁর সমস্ত বক্তৃতাটার মধ্যে কাজের কথার থেকে ভাবের প্রাধান্য ছিল বেশি। ভাবটা ছিল এইরকম–যেখানে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সভ্রাতৃক সানুচরে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেখানে দুর্যোধনের বাড়বৃদ্ধি ঘটছে-তবুও পৃথিবী, পাহাড়-পর্বত কেন কেঁপে উঠছে না–কথং ন সীদত্যবনিঃ সশৈলাঃ।

আগেই বলেছি বলরামের মা কিন্তু পুরুবংশের মেয়ে রোহিণী, যিনি বাসুদেবের প্রথমা স্ত্রী। এক্ষেত্রে পুরুবংশের লোকেরা যেসব কাণ্ডকারখানা করে ফেলেছেন, তাতে বলরাম সোজাসুজি তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও ঘোষণা করতে পারছেন না, আবার তাঁদের আচার-আচরণ সইতেও পারছেন না। এ অবস্থায় তাই তাঁর পক্ষে ভাবালুতা প্রকাশ করা ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু এই ভাবালুতায় অন্য বৃষ্ণিবীরদের মন ভিজবে কেন, তাঁদের কারও মা তো আর পৌরবী অর্থাৎ পুরুবংশের মেয়ে নন। স্বাভাবিকভাবে বলরামের কথা শেষ হতে না হতেই তাঁর ভাবালুতায় ঘা দিলেন সাত্যকি আমাদের এখন অনুশোচনার সময় নেই। এটা মনে রাখা দরকার, যুধিষ্ঠির কিছু বলুন চাই না বলুন, আমাদের যা করণীয় তা আমাদের করা উচিত। আসলে জগতে যাঁরা সহায়-সম্পন্ন তাঁরা নিজে নিজে কিছু করেন না। যুধিষ্ঠির মহারাজের পক্ষে আমাদের মত সহায় থাকতেও, বলরামকৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন-শাধ এবং আমরা থাকতেও যে তাঁকে অনাথের মত রাজ্য হারিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে এটা হবে কেন?

সাত্যকি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তিনি যদুবৃষ্ণিদের অন্যতম নেতাই শুধু নন, তার থেকেও তাঁর বড় পরিচয়, তিনি ধনুর্বেদে অর্জুনের প্রিয়তম শিষ্য। ভারতবুদ্ধের ব্যাপারে তিনি কারও সাহায্য চাননি। তিনি চান–এই মুহূর্তে যাদববৃষ্ণিরা ঝাঁপিয়ে পড়ুক দুশোধনের ওপর- নিতু সাধ্বদ্য দশাহসেনা। সাত্যকি বললেন-ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা সমবেত যাদব-সেনার চাপে গুঁড়িয়ে যাবে–সবান্ধবো বৃষ্ণিবলাভিভূতঃ। এই যুদ্ধে সাত্যকি আপাতত অর্জুনকে জড়াতে চান না। তার কারণ কৃষ্ণবাসুদেবের মতই অর্জুন তাঁর ভাই বন্ধু এবং গুরু-ভ্রাতা চ মে যঃ স সখা গুরুশ্চ। প্রথমত সাত্যকির ধারণা–তিনি নিজেই ওই কৌরববাহিনী ধ্বংস করতে সক্ষম, কিন্তু প্রথিতযশা বৃষ্ণিবীরদের সম্মানে তিনি একে একে প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, গদ, সারণ, চারুদেষ্ণ, অনিরুদ্ধ ইত্যাদি বহুতর বীরদের নাম করলেন যাঁদের সামনে ‘কৃপ-দ্রোণ-বিকর্ণ কণাঃ দাঁড়াতেই পারবে না। সাত্যকি চান এখনই বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধকবংশীয়দের মুখ্য যোদ্ধারা যুদ্ধে যান এবং পৃথিবীকে নির্ধার্তরাষ্ট্র অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রহীন করে তুলুন। বলরামের চিন্তাকুল মুখের ওপর এইটাই সাত্যকির উচিত জবাব।

কৃষ্ণ সব শুনলেন। কিন্তু তিনি বলরামও নন, সাত্যকিও নন। অতএব এই মুহূর্তে যুদ্ধযাত্রা করার অযৌক্তিকতাটা কাটিয়ে দিলেন সুচতুর কৌশলে। কৃষ্ণ বললেন-সাত্যকি। তুমি যা বলেছ, সব সত্য। কিন্তু আসল কথাটা কি জান, এই ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব-এরা প্রত্যেকেই বীর। মহারাজ যুধিষ্ঠির কুরুকুলের প্রধান। এরা নিজের বাহুবলে যে ভূমি জয় করতে পারছেন না কিংবা যে যুদ্ধে এই বীরদের কোন হাতের ছোঁয়া থাকবে না, সে ভূমি ওঁরা গ্রহণ করবেন কেন–স্বাভ্যাং ভুজাভ্যাম অজিতান্তু ভূমিং/নেচ্ছেৎ কুরূণাম ঋষভঃ কথঞ্চিৎ। এই কথাটা বলেই কৃষ্ণ আসল কথাটা পাড়লেন। আসলে কৃষ্ণ কোন তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাস করেন না। তিনি চান সম্পূর্ণ রাজনৈতিকভাবে ধীরে ধীরে এগোতে। ভারতযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে এমন একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনি তৈরী করতে চান, যাতে দেখা যাবে ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান সমস্ত শক্তিগুলি দুর্যোধনধৃতরাষ্ট্রের বিপক্ষে চলে গেছে। কৌরবদের বিরুদ্ধে সমস্ত বিরোধী রাজগোষ্ঠীগুলিকে জড়িয়ে নেবার জন্য তিনি সাত্যকিকে বললেন-যখন পাঞ্চাল রাজ্যের রাজা দ্রুপদ, কেকয় দেশের রাজা, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু এবং অবশ্যই আমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ব দুর্যোধনের ওপর, তখন আমাদের শত্রু বলে কেউ থাকবে না।

সত্যি কথা বলতে কি, কৃষ্ণের এই ‘ক্টটিজি’ চরমুখে ধৃতরাষ্ট্রের কানে এসে পৌঁছেছিল। তীর্থ পর্যটন করে জনমত অনুকূলে নেওয়ার থেকেও, আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল পাণ্ডবদের বনবাস-পর্বে। এই ঘটনাটি হল, অর্জুনের মারণাস্ত্র সংগ্রহ। অর্জুন শিবের কাছ থেকে পাশুপত অস্ত্র লাভ করছেন, ইন্দ্রের বাসভূমি স্বর্গ থেকে লাভ করেছেন অনেক অস্ত্র-শস্ত্রের শিক্ষা। ঋষি দ্বৈপায়ন ব্যাসের মুখে এসব খবর শুনে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে পুনরায় জিজ্ঞাসা করেছেন, যদি তিনি কিছু বিস্তারিত খবর দিতে পারেন। বস্তুত পাশাখেলার অন্যায় এবং কুলবধু দ্রৌপদীর অপমান ধৃতরাষ্ট্রের অন্তরে ভয়ঙ্কর আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছিল। দিনে-রাত তাঁর ঘুম হচ্ছিল না। পাঁচ ভাইয়ের একতা এবং ক্ষমতা, বৃষ্ণি-পাঞ্চালদের সহায়তা এবং সর্বশেষে বাসুদেব কৃষ্ণের সর্বাত্মক সুরক্ষা–এগুলি সবসময় ধৃতরাষ্ট্রকে মথিত করছে। পাণ্ডবদের বনবাসের এই মুহূর্তে তিনি হয়তো জানেন না যে, বৃষ্ণিবীর বলরাম ভবিষ্যতের ভারতযুদ্ধে যোগ দেবেন না। কিন্তু জানেন না বলেই তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে যে, বলরাম এবং কৃষ্ণের দ্বারা চালিত বৃষ্ণি-বাহিনীর আক্রমণ-বেগ ধারণ করার ক্ষমতা দুর্যোধন-দুঃশাসনদের হবে নাশ শক্যঃ সহিতুং বেগঃ সর্বৈস্তৈরপি সংযুগে। তার ওপরে চরমুখে সঞ্জয় যেসব কথা শুনেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে–সেই যে বনবাসের অব্যবহিত পরে বৃষ্ণি, পাঞ্চাল, কেকয়, বিরাট এবং চেদিদেশের লোকেরা সব যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বনে দেখা করলেন, সেসব খবর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পৌঁছেছে। সঞ্জয় খবর দিয়ে বলছেন যে, কৃষ্ণ নাকি সেখানে প্রতিজ্ঞা করে যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন–তোমার রাজসূয় যজ্ঞে ইন্দ্রপ্রস্থে যে সমৃদ্ধি দেখেছি, সেই সমৃদ্ধি যারা ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের জীবন শেষ করে আমি সেই সমৃদ্ধি আদায় করে ছাড়ব–আদায় জীবিতং তেষাম আহরিষ্যামি তামহম।

সর্বসমক্ষে কৃষ্ণের এই প্রতিজ্ঞা প্রসঙ্গে এখানে কতগুলি দেশের নাম আছে। দেশগুলির মধ্যে যেমন অঙ্গ, বঙ্গ কলিঙ্গ ইত্যাদি আছে, তেমনি আছে চোল, পহুব, যবন, কিরাত, সিংহলীরাও। এদের সবাইকে নাকি রাজসূয় যজ্ঞে পাণ্ডবেরা ক্ষমতার জোরে পরিবেশকের কাজ করিয়েছিলেন। কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা হল–ওই সমস্ত রাজাদের পরাভূত করে যে সমৃদ্ধি পাণ্ডবরা পেয়েছিলেন সেই সমৃদ্ধি এখন কৌরবেরা ছিনিয়ে নিয়েছে। কৃষ্ণ এই সমৃদ্ধি পুনরায় পাণ্ডবদের জন্য আহরণ করতে চান। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমাদের কথা হল–যাঁরা পাণ্ডবদের দ্বারা পরাভূত হয়েছিল, এবং যাঁদের দিয়ে রাজসূয় যজ্ঞে পরিবেশকের কাজ করানো হয়েছিল, তাঁরা পাণ্ডবদের ওপর ক্রুদ্ধ ছিলেন। ফলত তাঁরা যে অনেকেই ভারতযুদ্ধে কৌরব দুযযাধনের পক্ষে যোগ দেবেন, এই রাজনীতিটা কিন্তু বোঝা দরকার। এসব কথাও পরে আবার আসবে, আপাতত আমরা ধৃতরাষ্ট্রের ভীতি-প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সঞ্জয় যেমন ধৃতরাষ্ট্রকে কাম্যক বনে কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা শুনিয়েছেন, তেমনি যুদ্ধের ব্যাপারে ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাঞ্চালদের সাংঘাতিক দৃঢ়তার কথাও জানিয়েছেন। বনপর্বে কৃষ্ণের এই প্রতিজ্ঞা, সাত্যকির যুদ্ধাহানবাণী, পাঞ্চালদের দৃঢ়মুষ্টি মানসিকতা–সবই এক নতুন পরিণতি লাভ করেছে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের শেষে।

পাণ্ডবেরা বনবাসে হাজারো তীর্থ ঘুরেছেন এবং সেগুলির নাম কীর্তন করতে গেলে দেখা যাবে তাঁর গোটা ভারতবর্ষই ঘুরেছেন। বারো বছরের শেষে তাঁরা কিন্তু অজ্ঞাতবাসের জায়গা বেছে নিয়েছেন বিরাটনগরে অর্থাৎ আধুনিক জয়পুরে। দিল্লির কাছেই। যাবার আগে তাঁরা পুরোহতি ধৌম্যকে পাঠিয়ে দিয়েছেন পাঞ্চালে, দ্রুপদের কাছে, আর ইন্দ্রসেন ইত্যাদি যেসব চাকর-বাকর ছিল-তাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন দ্বারকায়, কৃষ্ণের কাছে। দুটিই বন্ধুরাষ্ট্র। অজ্ঞাতবাস শেষ হল নির্বিঘ্নে এবং অজ্ঞাতবাসের শেষ দিনে অর্জুন সমস্ত কুরুবীরদের যুদ্ধে অজ্ঞান করে দিয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার একটা আভাস দিয়ে দিলেন মাত্র। এবার ভারতযুদ্ধের উদ্যোগ পর্ব। কিন্তু তারও আগে আর একটা বড় ঘটনা ঘটে গেল। সেটা হল বিরাট রাজার মেয়ের সঙ্গে অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর বিবাহ। অভিমনুর পরিচয় শুধু অর্জুনের ছেলে বলে নয়, তার চেয়েও বড় সে কৃষ্ণের ভাগ্নে-স্বীয়ো বাসুদেবস্য…পুত্রো মম বিশাম্পতে। এই বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য দেশের সঙ্গে যাদবদের এবং পাণ্ডবদের এক বিরাট মিত্রশক্তি তেরি হয়ে গেল। ব্যাপারটা এই রকম-জরাসন্ধ-শিশুপাল মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব-মধ্যভারতীয় রাজনৈতিক শক্তির অবসান ঘটল, তেমনই ভারতযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে উত্তর পশ্চিম ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তির এক বিরাট অভ্যুত্থান ঘটল, যার নেতৃভাগে আছেন যাদব কৃষ্ণ, পাঞ্চাল দুপদ, এবং দিল্লির প্রাক্তন রাজা যুধিষ্ঠির। এইবার উদ্যোগপর্ব।

মহাভারতের উদ্যোগপর্ব হল সেকালের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উত্তরা-অভিমন্যুর বিয়ের পরদিনই বিরাট রাজার সভাগৃহে একটা জরুরী মিটিং’ বসল। এই সভার ‘প্রেসিডেন্ট ছিলেন অবশ্যই বিরাট, কারণ তাঁর সভাগৃহেই মিটিংটি বসেছে। তবে এই সভার কনভেনর ছিলেন অবশ্যই পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ। এরা দুজনেই প্রথম আসন গ্রহণ করলেন–অথাসনানি আবিশতাং পুরস্তাদ উতভা বিরাট-দুপদৌ নরেন্দ্রে। এই বিরাট মন্ত্রণাসভায় প্রথম বক্তব্য রাখলেন কৃষ্ণ। ভাবে কুশল, নিরপেক্ষ যেন। আপনারই বলুন কি করা যায়, কিসে পাণ্ডবদেরও ভাল হয়, দুর্যোধনেরও ভাল হয়-এমনি ধারা কথা প্রথম প্রথম। তারপর কুটকুট করে–পাণ্ডবদের আপন রাজ্য, বাবার রাজ্য, নিজেরাই বানিয়েছিল-সবই নিয়ে নিল-সবই আপনারা জানেন–ইত্যাদি তাৎপর্যপূর্ণ কথা। সিদ্ধান্তে কৃষ্ণ দুত পাঠাতে বললেন দুর্যোধনের কাছে, কারণ তাঁর মতটা না জানলে আলোচনার মানেই হয় না।

কৃষ্ণের কথা কেড়ে নিয়ে বলরাম–মনে রাখবেন, পৌরবী কন্যা, পুরুবংশের মেয়ে রোহিণীর ছেলে বলরাম–তিনি বললেন–হ্যাঁ সেই ভাল দূত পাঠাও। তবে দূত গিয়ে যেন বেশ প্রণিপাত করে কথা বলে, তাঁদের যেন রাগিয়ে না দেয়–সবাবস্থাসু চ তে ন কোপ্যাঃ। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে পায়ে ধরে দুর্যোধনকে মধুর ভাষায় বুঝিয়ে-সুজিয়ে যেন দূত তার কাজ আদায় করে নেয়। বলরামের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে ‘চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন সাত্যকি, শিনিশোষ্ঠীর নেতা। শিনি অন্ধকবৃষ্ণিদের ছোট ভাই, তাঁর বংশের শ্রেষ্ঠ নেতা সাত্যকি। তিনি একেবারে ভীষণ রাগে লাফিয়ে উঠলেন–সহসোৎপোত। বললেন–যেমন মানুষ তার তেমনি ভাষণ। একই বংশে বীরও জন্মায় (কথাটা কৃষ্ণের দিকে লক্ষ করে), হিজড়েও জন্মায় (বলরামের দিকে), ঠিক যেমনটি একই গাছের এক ডালে ফল ধরে আরেক ডালে ধরে না। না, না আমি বলরামকে কিছু বলছি না, কিন্তু এখানে যারা বসে আছে তারা শুনছে কি করে? এত অন্যায়ের পর আবার অত প্রণাম-ট্রনাম কিসের কথং প্রণিপতেতায়। নিজের বাপের রাজ্য নিজেরা চাইবে–তাতে আবার অত কি? বলুন তো বাণের ঘায়ে আমি সব ফটাকে এনে ফেলব যুধিষ্ঠিরের পায়ের তলায়–পাদয়োঃ পাতয়িষ্যামি কৌন্তেয়স্য মহাত্মনঃ। সাত্যকির সিদ্ধান্ত হয় তারা রাজ্য দিক, নয় মরুক।

এবারে সাত্যকির কথা সম্পূর্ণ সমর্থন করলেন দ্রুপদ। বললেন–তুমি যা বলেছ ঠিক তাই, ভাল কথা দিয়ে দুর্যোধনকে বাগ মানানো যায় না, ওর দরকার মার। দুপদ বললেন–কথায় বলে গাধার ব্যাপারে নরম, আর গরুর ব্যাপারে গরম-গর্দভে মাদবং কুর‍্যা গোষু তীক্ষং সমাচরেৎ।(৬৫) দুর্যোধনের সঙ্গে নরম করে কথা বললেই, সে তাকে দুর্বল ভাবে। অতএব দ্রুপদের সিদ্ধান্ত হল–যুদ্ধ হবেই, সেক্ষেত্রে আগেভাগে ভারতবর্ষের সমস্ত রাজাদের কাছে দূত পাঠানো হোক। যাতে দুর্যোধনের দূত পাণ্ডবদের দূতের আগে সে সব জায়গায় না পৌঁছোয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে নইলে রাজারা অন্যরকম বুঝবেন। কৃষ্ণ দ্রুপদের সব কথা মেনে নিলেন, কিন্তু কৌরবদের কাছে সুযোগ্য দূত পাঠানোর ব্যবস্থাটা দুপদকেই করতে বললেন .. শুধু তাই নয়, যুদ্ধের পূর্বকল্পে কৃষ্ণ দ্রুপদকে যে কথাগুলো বললেন, তাতে সন্দেহ থাকে না যে, ভারতযুদ্ধের প্রধান পুরুষের পদটি দেওয়া হয়েছে এই পাঞ্চাল নৃপতিকেই। কৃষ্ণ বললেন-বয়েসে এবং বুদ্ধিতে আপনিই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আপনি যা বলবেন শিষ্যের মত মেনে নেব আমরা–শিষ্যবচ্চ বয়ংসর্বে ভবামেহ ন সংশয়ঃ।

হয়তো এই কথাটা কৃষ্ণের পক্ষে বেশি বিনয়। কারণ কৃষ্ণ নিজেও জানতেন যে, ভবিষ্যৎ ভারতযুদ্ধে তাঁর মর্যাদা কতখানি, কিংবা তাঁর বাহিনীর মর্যাদা কতখানি। অর্জুনের শক্তিমত্তার মত কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তা তখন এতই বিখ্যাত হয়ে গেছে যে, তাঁর শত্রুপক্ষীয়েরা অন্য কাউকে তত মর্যাদা না দিলেও কৃষ্ণের সম্বন্ধে ভাবত যে, তিনি একাই সবসর্বলোকেষু বরেণ্য একঃ। আর মিত্রপক্ষীয়েরা ভাবত যে, কৃষ্ণের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা জেনেও কে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করবে-বুদ্ধিমত্ত্বঞ্চ কৃষ্ণস্য বুব্বা যুধ্যেত কো নরঃ। কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধের কথা থাক, এই মুহূর্তে দ্রুপদের সামনে কৃষ্ণের যে বিনয়-নম্র ভাবটুকু দেখলাম–এটাও তাঁর কূটবুদ্ধি। এই বুদ্ধির ফলেই দ্রুপদের দূত যখন কৌরব-সভায় গিয়ে ভাল-মন্দ পাঁচটা কথা বলে পাণ্ডবদের রাজ্য চাইল, তখন কর্ণ-দুর্যোধনের মত লোকেরা কৃষ্ণের কথা মাথাতেও আনলেন না। তাঁরা ভাবলেন–পাণ্ডবরা বুঝি শুধু পাঞ্চাল আর মৎস্যরাজ বিরাটের ভরসায় পৈত্রিক রাজ্য ফিরে চান-বলমাশ্ৰিত্য মৎস্যানাং পাঞ্চালনাঞ্চ পার্থিবঃ। কিন্তু কুরুসভার বৃদ্ধেরা এটা বুঝতেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এমনকি ধৃতরাষ্ট্রও যথেষ্ট বুঝতেন। সেকথা আগেও বলেছি, পরেও আবার আসবে, এই উদ্যোগপর্বেই আসবে। আপাতত দ্রুপদ কৃষ্ণের কথা শুনে কুরুসভায় দূত পাঠাবেন বলে কথা দিলেন। অন্যদিকে বিরাট রাজা ভারতবর্ষের অন্য রাজাদের উদ্দেশ্যে দূত পাঠাতে থাকলেন, পূর্বাহেই পাণ্ডব-সমর্থক জোগাড় করার জন্য। চরের মুখে সেটা শুনে দুর্যোধনও দূত পাঠাতে আরম্ভ করলেন, আর নিরপেক্ষ বক্তার মত বৈশম্পায়ন মন্তব্য করলন–সমস্ত ভারতবর্ষ তখন কুরু-পাণ্ডবের জন্য আকুল হয়ে উঠল–সমাকুলা মহী রাজ কুরুপাণ্ডবকারণা।

দ্রুপদের দূত কৌরবসভায় এল বটে, তবে সে বেশি কিছু করতে পারল না। কিন্তু একটা ব্যাপারে সে কিঞ্চিৎ সফল হল। কুরুবৃদ্ধা ধৃতরাষ্ট্রের মনে সে পাণ্ডব-পাঞ্চাল-যাদবদের জোট সম্বন্ধে একটা ভীতি তৈরি করে দিতে পারল। সঞ্জয়কে পাণ্ডসভায় দূত করে পাঠানোর সময় ধৃতরাষ্ট্রের মুখে আমরা এখন পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রুপদ নন্দন ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, বৃষ্ণিসিংহ কৃষ্ণ, সাত্যকি এবং অন্যান্যদের সম্বন্ধে প্রশংসাবাণী শুনতে পাচ্ছি।

অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রের মুখে আমরা যে এই প্রশংসাবাণী শুনতে পাচ্ছি, তার কারণও আছে। কারণ ততদিনে ভারতবর্ষের রাজারা কে কোন পক্ষে যাচ্ছেন, তার একটা হিসেব পাওয়া গেছে। আমরা সেই হিসেবের মধ্যে এখন যাব, কারণ ধৃতরাষ্ট্রের কাছেও আমরা সেই হিসেব একভাবে পাব। দ্রুপদের পুরোহিত ফিরে যাবার পর ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে দূত করে যুধিষ্ঠির-বিরাট-দ্রুপদের কাছে পাঠালেন। কিন্তু সঞ্জয়কে পাঠানোর আগেই দেখা যাচ্ছে ধৃতরাষ্ট্র ভয় পাচ্ছেন। ভীম-অর্জুনের স্মরণ মাত্রেই তাঁদের পূর্ব বীরত্ব কাহিনী ধৃতরাষ্ট্রের মনে পড়ছে। সেই সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র বলছেন–আমি শুনেছি যে, সোমকবংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ দুপদ পাত্রমিত্র, পুত্র-পরিজনসহ যোগ দিয়েছেন পাণ্ডবপক্ষে।

দ্রুপদের খবর আমরা আগেই পেয়েছি। তিনি নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা-নানাদেশ সমাগতৈঃ–এক বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে পাণ্ডবের পক্ষে যোগ দিয়েছেন। মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের বাহিনীতে যে ধরনের সৈন্যই থাকুক, তিনি কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের কতকগুলি রাজাকে পাণ্ডবদের পক্ষে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন-পার্বতীয়ে মহীপালৈঃসহিতঃ পাণ্ডবান ইয়াৎ।৬৬ ধৃতরাষ্ট্র লক্ষ করেছেন যে, সাত্যকিও পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন। কি রকম সাত্যকি? না, যিনি, দ্রোণ, অর্জুন, কৃষ্ণ, কৃপ এমনকি ভীষ্মের কাছেও অস্ত্রবিদ্যা অধিগত করেছেন। পূর্বে আমরা খবর পেয়েছি যে, সাত্যকিও যে সেনা-সংগ্রহ করেছিলেন তার মধ্যে ছিল বহু দেশের সেনা। মহাভারতকার সানুবন্ধে সাত্যকির মিশ্রসেনার বহুতর অস্ত্রশস্ত্রের . বর্ণনা পর্যন্ত দিয়েছেন, আর একটি উপমা দিয়ে বলেছেন যে, সাত্যকির সৈন্যদল যুধিষ্ঠিরের সেনাবাহিনীতে মিশে গেল, ঠিক যেমন ছোট নদী সাগরে মিশে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়, সেইরকম-সাগরং কুনদী যথা। ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু এই সাত্যকি, দ্রুপদ কিংবা বিরাটের থেকেও বেশী ভয় পান কৃষ্ণকে, কারণ পাণ্ডব-প্রধান যুধিষ্ঠিরেরও সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি–যেং স স্যান্ অগ্রণী বৃষ্ণিসিংহ।(৬৭)

কৃষ্ণকে এইরকম ভয় পাবার একটা বাস্তব কারণ আছে ধৃতরাষ্ট্রের মনে। সেটা হল, কৃষ্ণের শিশুপাল-হত্যার প্রতিক্রিয়া। ধৃতরাষ্ট্র জানেন যে, কৃষ্ণ যে শিশুপালকে পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞে মেরে ফেলেছিলেন, সে তাঁর নিজের জন্য যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি পাণ্ডবদের সুবিধের জন্য, পাণ্ডবদের যশ-মান বৃদ্ধির জন্য–যশোমানং বধয় পাণ্ডবানাং পুরাভিনচ্ছিশুপালং সমীক্ষ্য। আগে যে শিশুপালকে করুষ প্রভৃতি দেশের রাজারা উৎসাহ যোগাচ্ছিল, সেই তারাই কৃষ্ণকে শিশুপালের বিরুদ্ধে এগোতে দেখে সিংহ-দেখা হরিণের মত পালিয়ে গেল আর কৃষ্ণও শিশুপালকে মেরে ফেললেন। সেই শিশুপালহন্তার নানা ক্রিয়াকর্ম স্মরণ করে ধৃতরাষ্ট্রের মনে কোন শান্তি নেই-নাধিগচ্ছামি শান্তি। দুটি কালো মানুষ-কৃষ্ণ আর অর্জুনকে একই রথে দেখে ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয় কাঁপছে–প্রবেপতে মে হৃদয়ং ভয়েন।

কৃষ্ণ আর অর্জুন একই রথে থাকা মানে অবশ্যই বুদ্ধি আর বল এক জায়গায় হওয়া। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মত বিরাট যুদ্ধ শুধুকৃষ্ণার্জুনের ক্ষমতায় সম্পন্ন হয়েছিল, একথা বোধ হয় স্বয়ং কৃষ্ণার্জুনই স্বীকার করবেন না। কাজেই সাত্যকি, বিরাট, দ্রুপদ ছাড়াও আর কারা পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন সেটাও আমাদের জানতে হবে। আমরা আগেও একটু টের পেয়েছি যে, বিয়াস-শতদ্রর মধ্যবর্তী কেকয় দেশের রাজাদের সঙ্গে পাণ্ডবদের যোগাযোগ ছিল। বনবাসের সময় তাঁরা কৃষ্ণ-ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কথা করতেও এসেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় এই কেকা দেশের ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে লক্ষ করতে হবে। মহাভারতে যেখানে রাজারা পাণ্ডব-কৌরবের পক্ষ অবলম্বন করছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে কেকয় দেশের পাঁচ রাজপুত্র বা রাজা কৌরবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন এবং এতে কৌরবদের খুব আনন্দও হয়েছে–সংহর্ষয়ন্তঃ কৌরব্যম্‌ অক্ষৌহিণ্যা সমাদ্ৰবন।(৬৮) কিন্তু একটু পরেই দেখছি ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বলছেন-কেকয় দেশের পাঁচ ভাই পাঁচ রাজপুত্র, যাঁরা নাকি যথেষ্ট শক্তিমান বলে পরিচিত, তাঁরা কেকয় দেশের উত্তরাধিকার চান বলে, মূল রাজ্য থেকেই নির্বাসিত হয়েছেন এবং রাজ্যের অভিলাষে তাঁরা পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন–অবরুদ্ধা বলিনঃ কেকয়েলভ্যা/মহেষসা ভ্রাতরঃ পঞ্চ সন্তি। কৈকয়েভ্যো রাজ্য আকাঙক্ষমাণা/যুদ্ধার্থিনশ্চানুবসন্তি পাথান ॥(৬৯)

ব্যাপারটা একটু বোঝা দরকার। আমরা এই উদ্যোগপর্বের আগে বহু জায়গায় কেকয়দের নাম পেয়েছি পাণ্ডবদের মিত্রশক্তির মধ্যে। সেখানে হঠাৎ এই কেকয়েরা এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিলেন–এই কথাটা বিভ্রান্তিকর। আবার বিভ্রান্তিকর নয় এইজন্য যে, ধৃতরাষ্ট্র বলছেন–কেকয়দের পাঁচ রাজপুত্র কেকয় রাজ্য চান বলে কেকয় থেকে নির্বাসিত হয়েছেন–অবরুদ্ধা বলিনঃ কেকয়েভ্যঃ 1 তথা চ রাজ্য প্রাপ্তির আশাতেই তাঁরা পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে এই পাঁচ ভাই হলেন ‘ডিফেক্টর’। কিন্তু কথা হল, এরা কবে থেকে ‘ডিফেক্টর’? মনে রাখতে হবে, এদের আমরা পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে দেখেছি বনবাস কালে–কেকয়াশ্চ মহাবীয ভ্রাতরা, লোকবিতাঃ। আবার একটু আগেই দেখেছি তাঁরা, মানে সেই পাঁচ কেকয় রাজপুত্ৰই-সোদয্যাঃ পঞ্চ পার্থিবাঃ–এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে কৌরবপক্ষে যোগ দিয়েছেন। তারপর এখন ধৃতরাষ্ট্রের মুখে শশষ সংবাদ পাচ্ছি যে, তারা রাজ্যের লোভে শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন-কেকয়েভো রাজ্য আকাঙক্ষমাণাঃ। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে–কোন্ পক্ষে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করবেন, এই ভাবনা নিয়ে ওই পাঁচ ভাই শেষ পর্যন্তও একটু ভাসমান অবস্থায় ছিলেন। হয়তো প্রথমে এরা কৌরবপক্ষেই যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তারপর দুই পক্ষের চরম বলাবল নির্ণয় করে পাণ্ডবদেরই বেশি বলবান মনে করেছেন, এবং সেই পক্ষেই যোগ দিয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্রের ভাষায় তাই এক ধরনের খেদ ধ্বনিত হয়েছে, যেটা টীকাকার নীলকণ্ঠ ঠিক ধরেছেন। অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র বলছেন–কেকয়দেশের ওই বলবান পাঁচ রাজপুত্র আগে আমাদের দলেই ছিল, কিন্তু আপন রাজ্য প্রাপ্তির ব্যাপারে তাঁরা পাণ্ডব পক্ষকেই বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করে শেষ পর্যন্ত সেই পক্ষেই যোগ দিয়েছেন–কেকয়েভ্যঃ রাজ্যং প্রাপতুম ইচ্ছন্তঃ পূর্ব অম্মদীয়াঃ অপি সম্প্রতি পাণ্ডবান্ অনুবসন্তি অনুসরস্তি। তেন চ স্বপক্ষহানিঃ পরপক্ষপুষ্টি দর্শিতা।(৭০)

সত্যি কথা বলতে কি, কেকয় রাজপুত্রেরা যে কৌরবপক্ষকে শেষ পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য মনে করলেন না, তার কারণও আছে। পাণ্ডব এবং কৌরব–এই দুই রাজবংশের সঙ্গেই যাঁদের যোগাযোগ ছিল এবং যাঁরা রাজনীতি বুঝতেন, তাঁরা সবাই জানতেন যে, ভীষ্ম এবং দ্ৰোণ–এই দুই মহাবীর। যাঁদের ওপর দুযযাধন সবিশেষ নির্ভর করতেন–সেই দুই মহাবীরই পাণ্ডবদের কাউকে মারবেন না। কথাটা যুদ্ধের আগে ওই উদ্যোগ পর্বেই ভীষ্ম যেমন প্রকাশ করেছেন, দ্রোণও তেমনি প্রকাশ করেছেন। ভীষ্ম বলেছিলেন-আমি আর সব করতে পারি, কিন্তু পাণ্ডবদের কাউকে মেরে ফেলছি–সেটি আমার দ্বারা হবে না বাপুন তত্ববোসাদনীয়া পাণ্ডেঃ পুত্ৰা নরাধিপ। একইভাবে দ্রোণাচার্যও জানিয়েছেন যে, পাণ্ডবরা দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করে সুখ পাবে না মোটেই; কিন্তু দ্রোণ একবারও কথা দেননি যে তিনি পাণ্ডবদের কাউকে মারবেন। বরঞ্চ কথাটা একেবারে উহ্য রেখে দুর্যোধনকে তিনি বুঝিয়েছেন–দুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে তিনি বধ করতে পারবেন না–পাষতন্তু রণে রাজন্ ন হনিষ্যে কথঞ্চন।

এই সমস্ত কথাই সর্বসমক্ষে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন রাজমাতা গান্ধারী। দুর্যোধনকে যুদ্ধ থেকে বিরত করবার জন্য তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন-”তুমি যে ভাবছ বাছা, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ–এঁরা সব সর্বশক্তি নিয়ে তোমার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা কিন্তু আমি মনে করি না-যোস্যন্তে সর্বশক্ত্যেতি নৈত অদ্যোপপদ্যতে। গান্ধারী বলেছেন–পাণ্ডব এবং কৌরব–এই দুই পক্ষই ভীষ্ম-দ্রোণের কাছে সমান, উপরন্তু তাঁদের বাড়তি নির্ভর হল ধর্মবোধ-পাণ্ডবেযু অথ যুম্মাসু ধর্মন্তু অধিকন্ততঃ। কাজেই পাণ্ডবদের কাউকে তাঁরা মারবেন না। গান্ধারী যেমন বললেন, তেমনি ভীষ্ম-দ্রোণের এই ভাবনা তখনকার সমস্ত রাজনৈতিক মহলেও বহুল প্রচারিত ছিল। বিশেষত সবাই এটা জানতেন যে, কৌরবদের রাজসভায় বসেও ওই ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাণ্ডবদের পক্ষ হয়ে কথা বলেছেন। এমন অবস্থায় সমস্ত মানসিক পক্ষপাত নিয়েও ভীষ্ম-দ্রোণেরা পাণ্ডবদের মারবেন না–এটা গান্ধারীর মত অনেকেরই জানা ছিল। তাহলে ভীষ্ম-দ্রোণের মত প্রথিতযশা যোদ্ধারাই যদি কৌরবদের হয়ে সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধ না করেন, তাহলে তাঁদের মৃত্যুর পর কিই বা সুবিধে হবে কৌরবদের। এই বাস্তব কথাটা প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্রও জানেন, এবং জানতেন বলেই ভীষ্ম-দ্রোণের পর দুর্যোধন, কর্ণ শকুনি আর দুঃশাসন ছাড়া কোন পঞ্চম ব্যক্তির পক্ষে যে পাণ্ডবদের একটুও রোখা সম্ভব নয়, সেটা বুঝে গিয়েছিলেন–দুঃশাসন-চতুর্থানাং নানাং পশ্যামি পঞ্চমম। কিন্তু আমাদের কথা হল–এই সত্যটা শুধু ধৃতরাষ্ট্র কেন, যাঁরা রাজনীতিবিদ এবং সুযোগ সন্ধানী তাঁরা সবাই বুঝেছেন। কাজেই দুর্যোধনের পক্ষে এগার অক্ষৌহিণী সেনার বিরাট সংখ্যাটা যতই স্বস্তিবাচক হোক না কেন, বাস্তবে কিন্তু তৎকালীন ভারতবর্ষের নামজাদা রাজা-রাজপুত্রেরা সবাই ছিলেন পাণ্ডবদের পক্ষে।

ভাবনার কথা হল, এই সত্যটা ধৃতরাষ্ট্র পরে যেমন উপলব্ধি করেছিলেন, আগে তা করেননি। বিশেষত কেকয়, বিরাট কি অন্য কোন রাজার কথা ছেড়েই দিন, শুধুমাত্র বৃষ্ণিদের সঙ্গে পাণ্ডবদের কিংবা শুধুমাত্র পাণ্ডব-পাঞ্চাল জোটটাই যে কত সাংঘাতিক হতে পারে, এটা ধৃতরাষ্ট্র তেমন করে বোঝেননি। সঞ্জয় নিজেও বিরাটরাজার বাড়িতে পাণ্ডবসভা থেকে ফিরে এসে পাণ্ডব-পাঞ্চালদের ভয়ই দেখিয়েছেন। আরেকটু পরিষ্কার করে সঞ্জয় বলেছেন-মহারাজ। আজকাল মৎস্যদেশের লোকেরা আর আপনাকে পছন্দ করে না, পছন্দ করে না বিয়াস-শতদুর মাঝখানে থাকা কেকয়দেশের লোকেরাও। পাঞ্চালেরা তো আপনাকে রীতিমত অবজ্ঞা করে মৎস্যাস্তামদ্য নাৰ্চন্তি পাঞ্চালা সকেয়াঃ-শারাজার বাহিনী তো এখন কৃষ্ণের হাতে, অতএব শান্ধ এবং শৌরসেনী বৃষ্ণিরাও আপনাকে অবজ্ঞা করে–শালেয়া শূরসেনাশ্চ সর্বে তাম্। অবজানতে।(৭১)

ধৃতরাষ্ট্র কারও কথা শোনেননি, ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কারও কথা শোনেননি, কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁদের কথা বলে দুর্যোধনকে কিন্তু সাবধানও করছেন। যুদ্ধে কুরুবংশীয়দের জয়-পরাজয় নিয়ে তাঁর মনে দ্বিধা আছে এবং সেই জন্যই সঞ্জয়কে একসময় বলেছেন-বল তো সঞ্জয়! পাণ্ডবদের সমর্থনে তুমি কোন কোন রাজাকে এককাট্টা হতে দেখেছ? সঞ্জয় আবার পুরনো কথা কেঁদেছেন এবং এই মুহূর্তে আমাদেরও সেই সম্মিলিত শক্তির একটা হিসেবনিকেশ প্রয়োজন। সঞ্জয় বলেছেন–যাঁদের দেখলাম সেখানে, তাঁদের মধ্যে প্রধান হলেন অন্ধক বৃষ্ণিদের কুলতিলক কৃষ্ণ। অন্যান্য যাদববীরদের মধ্যে সাত্যকি আর চেকিতান তো আছেনই। এর পরেই সঞ্জয় নাম করেছেন পাঞ্চালদের ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডীসহ দ্রুপদ এবং তাঁর সেনাবাহিনীর। পাণ্ডবদের পক্ষে আরও যোগ দিয়েছেন বিরাট সপুত্র, সভ্রাতা। লক্ষণীয় বিষয় হল-মগধরাজ জরাসন্ধের ছেলে সহদেব, চেদিপতি শিশুপালের ছেলে ধৃষ্টকেতু–এরা সবাই পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন। বলতে পারেন, ভীমের ভয়ে, কি কৃষ্ণের ভয়েই এই দুইজন পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা জানি, শত্রু মেরে ফেলার পর তাঁর পুত্র-পৌত্রদের ওপর দয়া দেখিয়ে তাঁদের বংশব্দ করে ফেলার ব্যাপারে কৃষ্ণ ছিলেন ওস্তাদ! কাশ্মীরাধিপতি গোনন্দের বংশে একজন স্ত্রীলোককে পর্যন্ত এইভাবে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কৃষ্ণ-সেকথা রাজতরঙ্গিণীকার বড় আড়ম্বর করে বলেছেন। আমরা রাজতরঙ্গিণীর প্রমাণে পূর্বে উল্লেখ করেছি কাশ্মীরাধিপতি গোন জরাসন্ধের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাদবদের সঙ্গে যুদ্ধে করতে গিয়েছিলেন এবং তিনি বলরামের হাতে মারা পড়েন। এই গোনলের পর কাশ্মরে রাজা হন তাঁর ছেলে দামোদর। সমৃদ্ধ কাশ্মীর রাজ্য লাভ করেও তিনি কিন্তু বলরামের হাতে পিতৃবধের কথা ভেবে ভেবে মনে একটু শাস্তি পেলেন না। কলহন লিখেছেন–এই রকম মানসিক অবস্থায় গোনন্দের ছেলে দামোদর একদিন শুনতে পেলেন যে, সিন্ধুনদীর তীরে গান্ধার রাজ্যে এক কন্যা-স্বয়ংবর উপলক্ষে বৃষ্ণিবংশীয়রা আমন্ত্রিত হয়েছেন। এ কথা শুনেই দামোদরের মেজাজ গরম হয়ে উঠল। তারপর যখন যাদবেরা প্রায় গান্ধার রাজ্যের কাছাকাছি এসে পড়েছে, তখন সৈন্যবাহিনীর ঘোড়ার খুরে ঘনিয়ে-ওঠা ধুলোয় আকাশ আচ্ছন্ন করে যুদ্ধযাত্রা করলেন দামোদর। বৃষ্ণিদের সঙ্গে দারুণ যুদ্ধ হল দামোদরের এবং কৃষ্ণ-নিক্ষিপ্ত সুদর্শন চক্রের আঘাতে স্বৰ্গত হলেন দামোদর। যদুকুলের প্রধান পুরুষ কৃষ্ণ তখন মৃত দামোদরের গর্ভবতী স্ত্রী যশোবতাঁকে ব্রাহ্মণদের দ্বারা কাশ্মীর রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। একজন স্ত্রীলোকের অভিষেকে কাশ্মীর রাজ্যের মন্ত্রীরাই ভীষণ অসূয়াপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। কৃষ্ণ তখন এমন সুন্দর একটি বক্তৃতা দেন যে, সবাই যোবতাঁকে দেবতার মত দেখতে থাকেন। শেষে সময় পূর্ণ হলে যশোবতীর একটি সুন্দর ছেলে হলদগ্ধ বংশতরুর প্রথম অক্রূরের মত। এই পুত্রটিকে শিশুকালেই ব্রাহ্মণেরা রাজ্যে অভিষেক করলেন, এবং তাঁর পিতামহের নামেই তাঁর নাম হল গোন। অর্থাৎ ইনি দ্বিতীয় গোন।(৭২)

এত সব কথা বলে রাজতরঙ্গিণীকার মন্তব্য করেছেন যে, কাশ্মীরের রাজা গোন নিতান্ত শিশু অবস্থায় ছিলেন বলেই কুরু-পাণ্ডবেরা কেউই তাঁকে যুদ্ধে সহায়তার জন্য ডাকেননি। আমরা জানি, যদি ডাকা হত তাহলে তিনি অবশ্যই পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিতেন, কারণ দ্বিতীয় গোনন্দের জননী যশোবতী এবং কাশ্মীর রাজ্যের ব্রাহ্মণ-মন্ত্রীরা উৎখাত রাজকুল রক্ষার ব্যাপারে কৃষ্ণের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করতেন। পররাষ্ট্রনীতিতে কৃষ্ণের এই কুশলতার জন্যই জরাসন্ধের ছেলে সহদেব এবং জয়সেন–জারসন্ধিঃ সহদেবো জয়সেন তাবুতভী-পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন। আবার দেখুন–অন্য দিকে চেদিরাজ শিশুপালকে কৃষ্ণ নিজেই বধ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর রাজ্য অধিগ্রহণ করেননি। বরঞ্চ যে মুহূর্তে শিশুপাল কৃষ্ণের হাতে মারা পড়লেন এবং তাঁর মরদেহের সংস্কার যে মুহূর্তে শেষ হল, সেই মুহূর্তেই চেদিদেশের আধিপত্য দেওয়া হল শিশুপালের ছেলে ধৃষ্টকেতুকে-চেদীনা আধিপত্যে চ পুত্রমস্য মহীপতেঃ। অভ্যষিঞ্চৎ তদা পার্থঃ সহ তৈবসুধাধিপৈঃ।(৭৩) শুধু রাজ্য দেওয়াই নয়, পরবর্তী সময়ে চতুর্থ পাণ্ডব নকুলের সঙ্গে শিশুপালের মেয়ে অর্থাৎ ধৃষ্টকেতুর বোন করেণুমতীর(৭৪) বিয়ে হওয়ার ফলে পাণ্ডববৃষ্ণিদের সঙ্গে শিশুপালপুত্রের যোগাযোগ আরও বেড়েছে। কিন্তু এসব কিছুই যে ঘটেছে, তার পেছনে সেই বিরাট কূটনীতিবিদ কৃষ্ণের বুদ্ধি কাজ করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। একই ঘটনা ঘটেছে জরাসন্ধ বধের পরেও। জরাসন্ধের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সহদেব একটু ভয়ে ভয়ে কৃষ্ণকে নানা উপঢৌকনে তুষ্ট করতে চাইলেন। কৃষ্ণ তাঁকে একটুও অপমান না করে সাদরে তাঁর উপায়ন-আপ্যায়ন গ্রহণ করে সেই মুহূর্তেই পাণ্ডবদের সঙ্গে একযোগে জরাসন্ধপুত্র সহদেবকে মগধের রাজত্বে অভিষেক করলেন-অভ্যষিঞ্চৎ তত্রৈব জরাসন্ধাত্মজং মুদা।(৭৫) একই সঙ্গে খেয়াল করা উচিত, জরাসন্ধের মেয়েকেও বধূ করে নিয়ে আসা হয়েছিল পাণ্ডবদের ঘরে। কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেবের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সম্পূর্ণ মহাভারতে এই উপেক্ষিতা রমণীর পরিচয় পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই আশ্রমিকপর্বে যেখানে বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র বাণপ্রস্থে দিন কাটাচ্ছেন, সেইখানে আশ্রমবাসী ঋষিরা যখন আশ্রমে উপস্থিত যুধিষ্ঠির ইত্যাদির পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন, তখন একে একে বধু-পরিচয়ের সুত্রে সহদেবের তৃতীয় স্ত্রীর নামটি পাওয়া যাচ্ছে। সঞ্জয় পরিচয় দিয়ে বললেন-এই যে চাঁপা ফুলের মত গায়ের রঙ বউটিকে দেখছেন, ইনি মগধরাজ জরাসন্ধের মেয়ে-ইয়ং চ রাজ্ঞো মগধাধিপস্য সুতা জরাসন্ধ ইতি তস্য। ইনি কনিষ্ঠ পাণ্ডব মাত্ৰীপুত্র সহদেবের স্ত্রী-যবীয়সে মাদ্রবতীসুতস্য ভার‍্যা মতা চম্পকদামগৌরী।(৭৬)

আমরা যে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধকথা থেকে বৈবাহিক রসে চলে এলাম, তা এমনি এমনি নয়। আমরা বলতে চাই পরাজিতের সঙ্গে সুমধুর ব্যবহার করে, তাকে রাজ্যদান করা যাঁর স্বাভাবিক চরিত্র এবং কূটনীতির মধ্যে পড়ে, এই বিবাহ-ঘটনাগুলিও তাঁরই ইচ্ছায় ঘটেছে বলে আমরা মনে করি। অসময়ে কৃষ্ণের এই সব বুদ্ধি-ঘটনার ফলেই, আজ উদ্যোগপর্বে এসে কৌরব ধৃতরাষ্ট্র ভয় পাচ্ছেন যে, চেদিকরা ইত্যাদি দেশের সমস্ত রাজারা মহা উদ্যোগে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছেন–উপশ্রিতাশ্চেদিকরূষকা সববাদযোগে ভূমিপালাঃ সমেতাঃ। আমরা এর আগেই মহাভারতের কথক ঠাকুর, বৈশম্পায়নের কাছে যে খবর পেয়েছি, তাতে ধৃতরাষ্ট্রের ভয়ের কারণও আছে। পাণ্ডবদের সাত অক্ষৌহিণী সেনার মধ্যে এক অক্ষৌহিণী জোগাড় করে নিয়ে এসেছিলেন শিশুপালের ছেলে ধৃষ্টকেতু, আরেক অক্ষৌহিণী এনেছিলেন জরাসন্ধের ছেলে সহদেব, জয়ৎসেন।(৭৭)

মনে রাখা দরকার বৃষ্টি, কেকয়, মগধ, চেদি, করূষ, মৎস্য–যে দেশ যত শক্তি নিয়েই পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিন না কেন, পাণ্ডবদের মূল নির্ভর ছিলেন কিন্তু পাঞ্চালরাই। যুদ্ধোদ্যোগ পর্বে কার সঙ্গে কারা যুদ্ধ করবেন এই কথা যদি অতি সংক্ষেপে কোথাও বলতে হয়েছে, তাহলে পাণ্ডবদের সঙ্গে কিন্তু বেশির ভাগ সময় একটি দেশের বা একটি জাতির নামই এসেছে এবং তা হল পাণ্ডু-পাঞ্চাল বা পাণ্ডব-সৃঞ্জয় অথবা এইরকম একটা কিছু। এমন কি কৃষ্ণ যখন শেষবারের মত দূত হয়ে কৌরবসভায় যাবেন, সে সময় পাণ্ডব কূলবধু দ্রৌপদী কৃষ্ণকে বলেছিলেন-”খবরদার! কৃষ্ণ। সন্ধি কোর না, কেন না সৃঞ্জয়-পাঞ্চালেরা সঙ্গে থাকলে পাণ্ডবরা নিশ্চয়ই কৌরবদের সহজেই মোকাবিলা করতে পারবে–পাণ্ডবাঃ সৃঞ্জয়ঃ সহ। ধাৰ্তরাষ্ট্রবলং ঘোরং ক্রুদ্ধং প্রতিসমাসিতুম্ ॥ দ্রৌপদী মনে করেন পাণ্ডব-পাঞ্চালদের সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণই কৌরবদের ওপর সেই মহাদণ্ড নিক্ষেপ করুন–ত্বয়া চৈব মহাবাহো পাণ্ডবৈঃ সৃঞ্জয়েঃ সহ। আসলে দ্রৌপদী কৌরবসভায় যে ভাবে অপমানিত হয়েছিলেন, তাতে তাঁর পক্ষে সন্ধির প্রস্তাব একেবারে অসহ্য। তার মধ্যে আবার যখন তিনি দেখলেন যে, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন সবারই কেমন একটু গলা গলা ভাব, যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই–এমনধারা প্রস্তাব, তখন সুন্দরী কৃষ্ণা আর থাকতে পারলেন না। তিনি তাঁর পূর্ব অপমানগুলি পুনরায় সবিস্তারে কৃষ্ণকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন-যদি ভীম-অর্জুনের মত মানুষও সন্ধির প্রস্তাবে সম্মত হন এবং তাঁদের দয়া যদি অত উথলে ওঠে, তাহলে থাক, তাঁদের আর যুদ্ধ করতে হবে না। আমার অপমান মাথায় নিয়ে আমার বুড়ো বাবা, আমার ভাইয়েরা, আমার ছেলেরা যুদ্ধ করবে–পিতা মে যোৎস্যতে বৃদ্ধঃ সহ পুত্রৈ মহারথৈঃ।

এইটা একটা ব্যাপার। আমরা আগেই বলেছি যে, ভারতযুদ্ধের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল দ্রৌপদীর অপমান এবং হয়তো সেই কারণেই পাঞ্চালদের গুরুত্ব এখানে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া দ্রোণের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ, বংশানুক্রমিক ঝগড়া–এই সবগুলি কারণই যুধিষ্ঠিরের সাত অক্ষৌহিণী বাহিনীর মধ্যে পাঞ্চালদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। বৈবাহিক সম্বন্ধে পাথালদের সম্বন্ধ-গৌরব তো আছেই। এই কারণে পাণ্ডবপক্ষের কৃষ্ণই হোন অথবা দ্রৌপদীই হোন কিংবা কৌরব পক্ষের ধৃতরাষ্ট্রই হোন অথবা কর্ণ-দ্রোণই হোনসবাই পাণ্ডবদের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে পাঞ্চালদের নাম উল্লেখ করেন। মজা হল, পাণ্ডব পক্ষ যে সব সময় পাঞ্চালদের ঘাড়ে ভর করে আছেন, এবং এই বিরাট যুদ্ধে ক্ষতি যে শুধু পাঞ্চালদের আর কৌরবদের–এ কথাটা নেপোয় দই মারার মত পাণ্ডবেরাও জানতেন। কৌরবদের দূত হিসেবে আসা সঞ্জয়কে স্বয়ং অর্জুন গ্রহবিপ্র জ্যোতিষীদের দৈববাণী শুনিয়ে বলেছেন–এ যুদ্ধে ক্ষতি হবে শুধু কুরুদের আর সৃঞ্জয়-পাঞ্চালদের, মাঝখান জয়লাভ করবে পাণ্ডবরা-ক্ষয়ং মহান্তং কুরু সৃঞ্জয়ানাং নিবেদয়ন্তে পাণ্ডবানাং জয়ঞ্চ।(৭৮)

এটা না হয় একটা কথার কথা বললাম। এ রকম হাজার বার পাণ্ডু-সৃঞ্জয়, পাণ্ডব-পাঞ্চালদের কথা শোনা যাবে। কর্ণ ঘটোৎকচকে একাগ্নী বাণ দিয়ে মারলেন, আর ধৃতরাষ্ট্র বললেন–এ কি রকম হল! অর্জুনের জন্য রাখা বাণ দিয়ে কর্ণ ঘটোৎকচকে মারল? আহা অর্জুন যদি মরত, তাহলে পাণ্ডব-সৃঞ্জয়রা সকলেই মারা পড়ত। উত্তরে সঞ্জয় অনেক কথা বলে মন্তব্য করে বললেন-মহারাজ! দুর্যোধন, দুঃশাসন আর শকুনি প্রতিদিনই বড় আশা নিয়ে কর্ণকে বলে–সব সৈন্য বাদ দিয়ে কাল ওই অর্জুন বেটাকে মার তো, কর্ণ! তাহলে আমরা পাণ্ডব-আর সৃঞ্জয়দের চাকরের মত খাটাব–প্রেষাবৎ পাণ্ডু-পাঞ্চালা উপলোক্ষ্যামহে বয়ম্।(৭৯)

পাঠকেরা ভাবটা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন। জ্যোতিষীরা বলছে–মরবে কারা? না, কৌরবেরা আর পাঞ্চালরা। কৌরবদের আবার কেকয়, মৎস্য, চেদি, করূষকাউকে চাকর হিসেবে পছন্দ নয়, চাকর হিসেবে তাঁদের পাণ্ডবদের সঙ্গে পাঞ্চালদের চাই। কর্ণপর্বে আবার দেখা যাচ্ছে ভীষ্ম-দ্রোণ যত পাণ্ডব সৈন্য বধ করেছিলেন, তাতে সম্মানের খাতিরেও একবার পাণ্ডবদের নাম করা হচ্ছে না। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন–দশ দিন যুদ্ধের পর শান্তনুপুত্র ভীষ্ম অনেক সৃঞ্জয়-পাঞ্চালদের বধ করে শেষে শরশয্যা গ্রহণ করলেন-হত্বা সৃঞ্জয়-পাঞ্চালান্ ভীস্মোথ দশভিৰ্দিনৈঃ।(৮০) আবার দ্রোণের ব্যাপারেও সঞ্জয় বলছেন–মহাবীর দ্রোণও হাজার হাজার পাঞ্চাল সৈন্য ধ্বংস করে শেষে মারা গেলেন-পাঞ্চালানাম্ অনীকিনীম্। নিহত্য যুধি দুর্ধর্ষঃ পশ্চাদ্ রুক্সরঘো হতঃ।(৮১)

তাহলে দেখুন, কত রাজ্য থেকে কত রকমের সৈন্য এসে যোগ দিয়েছে পাণ্ডবদের দলে, কিন্তু শক্তি দেখানোর বেলাতেই হোক কিংবা মৃত্যুর গৌরবই হোক, নাম কিনেছে শুধু সৃঞ্জয়-পাঞ্চালেরা। স্বাভাবিক কারণেই আবার বলছি, কৌরবদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পাঞ্চালদের কথাটা এক বিশেষ নিরিখে দেখতে হবে। উদ্যোগ পর্বে কৃষ্ণের দৌত্য যখন বিফল হল, তখন কৃষ্ণ কর্ণকে পাণ্ডবদের পক্ষে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। সকলেই জানেন–এতকাল দুর্যোধনের পক্ষে থেকে হঠাৎ করে যে কর্ণ পাণ্ডবপক্ষে চলে আসতে পারেন না, এটা কর্ণের স্বভাবগৌরব। একই সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে, কৃষ্ণের সঙ্গে কথোপকথনের সময় কর্ণ কিন্তু ভারতযুদ্ধের বাস্তব সত্যটা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি জানতেন–এ যুদ্ধে কুরুদের সর্বনাশ হবে। কিন্তু এই কথাটা ভারি সুন্দর করে বলতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভারত-যুদ্ধকে এক বৈতনিক যজ্ঞের প্রতিরূপে উপস্থিত করেছেন কর্ণ। কর্ণ বলেছেন–মহারাজ দুর্যোধন এই যজ্ঞকর্মে দীক্ষা নিয়েছেন আর তাঁর মহতী সেনাই এখানে তাঁর পত্নী। কর্ণ এইভাবে যুদ্ধের নানা প্রয়োজনীয় দ্রব্যকে যজ্ঞের উপমায় নিবদ্ধ করলেন এবং শেষে বললেন–দুযোধনের এই যজ্ঞে দক্ষিণা হলেন পাঞ্চাল যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্ন-দক্ষিণা তৃস্য যজ্ঞস্য ধৃষ্টদ্যুম্নঃ প্রতাপবান্।(৮২)

কথাটি অত্যন্ত মূল্যবান। বস্তুত অশ্বত্থামার হাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষ পরিণতি ঘটে। ভারতযুদ্ধের পনের দিনের মাথায় পাঞ্চাল দুপদ দ্রোণের হাতে মারা পড়লেন। পাঁচ দিন যুদ্ধ করে দ্রোণ মারা পড়লেন ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে। আর স্বয়ং ধৃষ্টদ্যুম্ন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে ভীমের গদায় দুর্যোধনকে মৃত্যুমুখে পতিত দেখে নির্দ্বিধায় ঘুমোচ্ছিলেন; অকস্মাৎ মহাকালের মত কোথা থেকে উদয় হলেন অশ্বত্থামা, স্তিমিতপ্রদীপ রজনীতে বেঘোরে প্রাণ দিয়ে দুর্যোধনের যজ্ঞদক্ষিণা হয়ে রইলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। অথচ এই মহাবীর ভারতযুদ্ধের প্রথম থেকে কিই না করেছেন পাণ্ডবদের জন্য। দ্রোণকে অন্যায়ভাবে মারার পর অর্জুন তাঁকে তিরস্কার করে যা নয় তাই বলেছিলেন। ক্ষুণ্ণ সেই মুহূর্তে ধৃষ্টদ্যুম্ন এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, তিনি একার ক্ষমতাতেও যুদ্ধে নামতে রাজি ছিলেন। হয়তো এটা বাড়াবাড়ি কথা, হয়তো এটা একান্তই দম্ভোক্তি–কিন্তু তার কারণটাও পরিষ্কার। সেটা ধৃষ্টদ্যুম্ন নিজেই বলেছেন। বলেছেন–দ্রোণের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা কুলক্রমাগত-কুলক্রমাগতং বৈরং মমাচার্যেণ বিশ্রুতম।

আসলে এই শত্রুতাটা দ্রোণের সঙ্গে কোনমতেই কৌলিক নয়, মূল শত্রুতাটা পাঞ্চালদের সঙ্গে কৌরবদের। আপাতত সেটা দ্রোণের ঘাড়ে পড়েছে। ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে দ্রোণ বধের সূত্রে অর্জুন, সাত্যকি সবাই যখন শামিল হয়েছেন, তখন আসল কথাটা বেরিয়েছে সহদেবের মুখে। তিনি বলেছেন–অন্ধক বৃষ্ণি আর পাঞ্চালরা বাদে আমাদের এত বড় বন্ধু আর কেউ নেই।(৮৩) আসলে এই প্রতিজ্ঞা, এই যৌথ প্রয়াসই ভারতযুদ্ধের উদ্যোগপর্বে সবাইকে একত্রিত করেছে এবং সকলের অনুমতিক্রমে সুচিন্তিতভাবে সেনানায়ক নির্বাচিত হয়েছেন সেই পাঞ্চাল পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নই। সঞ্জয় যখন পাণ্ডবদের যুদ্ধের উন্মাদনা দেখে এসে কুরুসভায় ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সমস্ত সংবাদ পেশ করছেন, তখন তিনি অনেকের কথা বললেন। সঞ্জয় কেকয় এবং আরও দু-একটি রাজার কথা বললেন বটে, কিন্তু সবার শেষে জানালেন দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কিভাবে সবার মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা ছড়িয়ে চলেছেন-ধৃষ্টদ্যুম্ন সদৈবৈতা সন্দীপয়তি ভারত!(৮৪) ধৃষ্টদ্যুম্ন নাকি সবাইকে বলছেন–যুদ্ধ করে যাও, ভরতবংশের ছেলেরা সব! যুদ্ধে নাম, কোন ভয় নেই। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের সমর্থনে যত রাজাই আসুক, আমি একা তাদের আটকাব, একা দেখে নেব, ঠিক যেমন মহাসমুদ্রে তিমি মাছ অন্যান্য মাছেদের সর্বনাশ করে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ যেই আসুক, আমি তাঁদের আটকাব-সমুদ্রের বেলাভূমি যেমন সমুদ্রকে আটকায়। ধৃষ্টদ্যুম্নের এই কথা শুনে নাকি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মত লোক পর্যন্ত বলেছেন–শালাবাবু! সবই তোমার পক্ষে সম্ভব, তোমার ক্ষমতা তোমার ধৈর্য আমার প্রাপ্তিযোগের মধ্যে পড়ে; জেনে রাখ পাণ্ডবেরা সবাই জোট বেঁধেছে পাঞ্চালদের সঙ্গে, সবাই এখন জ্বলছে, এখন এই যুদ্ধে তুমিই আমাদের ভ্রাতা, উদ্ধারকতা হও-সংগ্রামান্নঃ সমুদ্ধর। যুধ্যমান কৌরবদের হঠানোর জন্য তুমি যা বিধান দেবে তাই আমরা করব-ভবতা যবিধাতব্যং তন্নঃ শ্রেয়ঃ পরন্তপ, কারণ তাতেই আমাদের ভাল হবে। সম্ভ্রান্ত পাণ্ডববংশের গৌরবের প্রতীক, স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের মুখে সবার হয়ে এই যে পাঞ্চালদের কাছে ‘সারেন্ডার’ এটা ভীষণই তাৎপর্যপূর্ণ।

কুরুক্ষেত্রের বিরাট যুদ্ধভূমিতে যখন কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধ বাধল, তখন কিন্তু অর্জুনের মত বীর কিংবা মহাবল ভীমসেনকে সেনাপতি হতে দেখলাম না, দেখলাম দুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকেই, যিনি পাণ্ডবপক্ষের প্রধান সেনাপতি।

যুধিষ্ঠির কিন্তু ভাইদের সবাইকেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন–কাকে সেনাপতি নিযুক্ত করা যায়, কেই বা যুদ্ধে কুরুকুলপতি ভীষ্মের মোকাবিলা করতে পারবে। তাতে ছোট ভাই সহদেব বিরাট রাজার নাম করেছিলেন। অজ্ঞাতবাস নির্বিয়ে কাটার কৃতজ্ঞতাতেই হোক, কিংবা উদ্যোগপর্বে তাঁর ওখান থেকেই পাণ্ডবদের সমস্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চলছিল বলেই হোক, সহদেব বিরাটের নাম করলেন। নকুল কিন্তু এ মত মানলেন না। তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের নাম প্রস্তাব করলেন। নকুল বললেন-দ্রুপদ ভরদ্বাজের কাছ থেকে অস্ত্রলাভ করেছেন, দ্রোণ এবং ভীষ্ম–দুজনেরই তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী বলে পরিচিত। অনেক পুত্র-পৌত্র, সাঙ্গোপাঙ্গে তিনি শত শাখা বৃক্ষের মতন। দ্রোণকে বিনাশের জন্য তিনি তপস্যাও করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, নকুল বললেন, সমস্ত ব্যাপারে দ্রুপদ আমাদের পিতার মত–পিতেবাশ্ম সমাধত্তে। অতএব সেই দিব্যাস্ত্রবিদ রাজা দ্রুপদ, যিনি আমারে শশুর–তিনিই আমাদের সেনাপতি হোন-শশুরো দুপদোস্মাকং সেনাগ্রং সম্প্রকর্ষতু।(৮৫) নকুলের মত অর্জুন মানলেন না। তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নের অসংখ্য গুণের বর্ণনা দিয়ে, তাঁর অসাধারণ পরাক্রম এবং বলদর্পিতার খবর দিয়ে তাঁকেই সেনাপতি করার পক্ষপাত জানালেন। আসলে অর্জন জানেন-ধৃষ্টদ্যুম্নকে সেনাপতি করলে দ্রুপদ, শিখণ্ডী কারোরই কিছু বলার থাকবে না। অন্যেরাও সন্তুষ্ট হবে একজন যুবক সেনাপতি লাভ করে। মধ্যম পাণ্ডব সরল মানুষ। তিনি যেহেতু জানেন যে, শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে ভীষ্ম অস্ত্রধারণ করবেন না এবং ভীষ্মই যেহেতু কৌরবদের সেনাপতি, অতএব তিনি বললেন-শিখণ্ডীকেই সেনাপতি করা হোক। যুধিষ্ঠির এবারে কৃষ্ণের মত জিজ্ঞাসা করলেন, কারণ সর্বশেষ তিনি যা বলবেন, তাই হবে। কৃষ্ণ কিন্তু নানা ভণিতা করে শেষ পর্যন্ত অর্জুনের মতে মত দিলেন। সেনাপতি হিসেবে সবারই যোগ্যতা নির্ধারণ করেও তিনি মন্তব্য করলেন পাঞ্চাল যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্নেরই আমার মতে সেনাপতি হওয়া উচিত-ধৃষ্টদ্যুম্নম্ অহং মনন্য সেনাপতি অরিন্দম।(৮৬) মহাভারতের যুদ্ধযজ্ঞের দক্ষিণা অৰ্জুনকৃষ্ণের মুখেই ঘোষিত হল।

মহাবলী অর্জন যুদ্ধভূমিতে আত্মীয়স্বজন দেখে কৃপাবিষ্ট হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে একটা রিপোর্ট দিলেন। তাতে দেখা যাচ্ছে দুর্যোধন আচার্য দ্রোণকে গিয়ে বলছেন–আচার্য! দেখুন দ্রুপদের ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন কেমন ব্যহ রচনা করেছে। ঠিক এইখানে দ্রুপদ, বিরাট–এই সব সাধারণ নাম ছাড়াও আরও দু-একটি, বড় নাম করেছেন, যেগুলি জরুরী। দুর্যোধন, বলেছেন–ওদিকে আছেন–পৃষ্টকেতু, চেকিতান এবং কাশীরাজশ্চ বীর্যবান্। এই কাশীর রাজাই কিন্তু একমাত্র কারণ, যার জন্য কুরুকুলপতি ভীষ্ম পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেননি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেই কাশীরাজের মেয়ে অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকার কথা। এঁদের বিয়ে নিয়ে কাশীরাজের সভায় ভীষ্মকে প্রচও অপমানিত হতে হয়েছিল, প্রতি-অপমানিত হতে হয়েছিল কাশীরাজকেও। কাশীরাজ যেখানে পাণ্ডবপক্ষে আছেন, সেই পক্ষে ভীষ্মের যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না, যদিও তাঁর সমস্ত স্নেহ ছিল পাণ্ডবদের প্রতি। অনুরূপভাবে যে পক্ষে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ আছেন, সে পক্ষে দ্রোণ থাকতে পারেন না। ভীষ্ম-দ্রোণের সমস্ত পক্ষপাত পাণ্ডবদের প্রতি থাকা সত্ত্বেও যে তাঁরা সে পক্ষে যেতে পারেননি, তার কারণ কৌরবদের নুন খাওয়া-টাওয়া কিছু নয়, কারণটা পুরোপুরি রাজনৈতিক। এদের মধ্যে একমাত্র দলছুট লোক–যাঁর পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেওয়া সবদিক দিয়ে উচিত ছিল, কিন্তু দিলেন না, ইনি হলেন শল্য-নকুল-সহদেবের আপন মামা শল্য। শল্য পাণ্ডবপক্ষেই যোগ দিতে আসছিলেন, কিন্তু পথের মধ্যে দুর্যোধন তাঁকে মদ্য-মাংস দিয়ে এমন আপ্যায়ন করলেন যে, তিনি দুর্যোধনকেই কথা দিয়ে বসলেন। শল্য দুর্যোধনের পক্ষেই যুদ্ধ করলেন বটে কিন্তু যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে তিনি কৌরবপক্ষে থেকেই তাঁদের ক্ষতি সাধন করেছেন। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন–অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহাবীর কর্ণ অবশ্য আপনাকে সারথি হিসেবে গ্রহণ করবেন, কারণ সবাই জানে সারথি হিসেবে মদ্ররাজ শল্য কৃষ্ণের মতই দক্ষ। কিন্তু কর্ণ যখন যুদ্ধ করতে আসবেন, তখন আপনি এমন সব কথা বলবেন যাতে কর্ণের মনোবলই ভেঙে যায়। শল্য তাই করেছিলেন এবং ভগ্ন-সংকল্প কর্ণকে মারতে অর্জুনের সুবিধে হয়েছিল। শলোর এই ধরনের সারথ্য প্রমাণ করে যে, তিনি আসলে পাণ্ডব পক্ষেই যোগ দিয়েছিলেন। শলাসারথ্য কথাটি সংস্কৃত পণ্ডিতমহলে খুবই বিখ্যাত। যখন কোন সংস্কৃত টীকাকার মূলের ওপরে টীকা রচনা করেন, তখন সকলেই মনে করে যে, মূল গ্রন্থের ওপরে টীকাকারের অগাধ শ্রদ্ধা আছে বলেই তিনি টীকা রচনা করছেন। এই সর্বসম্মত ধারণার পরেও দেখি, অনেক টীকাকার মূলের ওপরে ধ্বংসাত্মক টীকা রচনা করেন, মূল গ্রন্থের বক্তব্য কেটে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দেন। পণ্ডিতেরা এই ধরনের টীকাকে বলেন শলাসারথ্য অর্থাৎ বিশস্তের ভাব দেখিয়ে অবিশ্বাসের কাজ করা।

যাই হোক, শল্যসারথ্যের কথা থাক, আপনারা আরও একটা জিনিস লক্ষ করবেন ভারতযুদ্ধের সময়। লক্ষ করবেন, কৌরব পক্ষের প্রথম এবং প্রধান বীর ভীষ্ম যে মারা গেলেন তা কিন্তু অর্জুনের হাতেও নয়, ভীমের হাতেও নয়, ভীষ্ম মারা গেলেন শিখণ্ডীর জন্য। তিনি কিন্তু পাঞ্চালের ছেলে, মহারাজ দ্রুপদের ছেলে বলেই তিনি পরিচিত। দ্বিতীয় সেনাপতি দ্রোণ মারা গেলেন পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে, অর্থাৎ আবার দ্রুপদের কথা আসে। একমাত্র কর্ণ এবং শল্য ছাড়া কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রধান দুই নায়কই পাঞ্চালদের হাতে মারা গেলেন। রাজনৈতিক দিক থেকে এই তথ্যটা গুরুত্বপূর্ণ। কর্ণ এবং শল্যের একজন অর্জুনের হাতে, অন্যজন যুধিষ্ঠিরের হাতে মারা পড়লেও, শল্যের মারা যাওয়াটা ছিল পশ্চাত্তপ্ত মানুষের আত্মহত্যা। একমাত্র কর্ণ–দুযোধন, দুঃশাসন, শকুনি এই দুষ্টচক্রের বাহুশক্তির প্রতীক-একমাত্র কর্ণই ছিলেন পাণ্ডবদের বলি। হ্যাঁ, জয়দ্ৰথ, ভূরিশ্রবা–এই সমস্ত ছোট ছোট রাজার কথা ছেড়ে দিলে, কৌরবপক্ষে আর কেউই ছিলেন না, যিনি পাঞ্চাল-যাদব এবং পাণ্ডবদের সম্মিলিত বাহিনীর সামনে দাঁড়াতে পারেন।

আমরা একসময়ে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে জরাসন্ধের বাহিনীভুক্ত রাজাদের কিঞ্চিৎ পরিচয় দিয়েছিলাম। জরাসন্ধের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব-মধ্য ভারতীয় মিত্রশক্তির পতন ঘটেছিল ঠিকই; কিন্তু তারাই আবার অন্য নামে ফিরে এল ভারতযুদ্ধের সময়। হ্যাঁ, জোটের মধ্যে পরিবর্তন অবশ্যই কিছু ঘটেছিল, যেমন চেদি, করুষ এবং মগধের শক্তি আগে পূর্বমধ্য ভারতীয় জোটের একাংশ ছিল, এখন তারা পাণ্ডব-পাঞ্চালদের পক্ষে যোগ দিয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে দক্ষিণের সমস্ত শক্তিগুলি মাহিষ্মতী, অবন্তী-ইত্যাদি দেশের রাজারা এবং পূর্বদেশের অঙ্গরাজ কর্ণ থেকে আরম্ভ করে বঙ্গদেশের রাজা সমুদ্রসেন, চন্দ্রসেন, পুণ্ড্রবর্ধন, প্ৰাগজ্যোতিষপুর এই সমস্ত দেশের রাজারা কিন্তু কৌরব পক্ষে যোগ দিয়েছেন। Pargiter GC31651They (Pandavas) were aided by the Matsyas, Cedis, Karusas, Kasis, South Panchalas, Western Matsyas, Cedis, Magadhas and the western Yadavas from Gujarat and Surastra, and on Duryodhana’s side were all the Punjab nations and all other kingdoms of Northern India and the north of the Dekhan.

কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ সম্বন্ধে যে যাই বলুন, আমাদের মনে হয় কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ মোটেই কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ নয়। মূলত এই যুদ্ধ উত্তরের বিরুদ্ধে উত্তরের যুদ্ধ। কৌরবদের বিরুদ্ধে পাঞ্চালদের যুদ্ধ হস্তিনাপুরের দখল নিয়ে একই বংশের লতায়-পাতায় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কোন বিশেষ পক্ষে অংশগ্রহণ কিংবা পক্ষপাত নিয়ে কারও ব্যক্তিগত ক্রোধ অথবা ব্যক্তিগত মমতা কাজ করেছে, কারও কৌলিক সম্বন্ধ, কারও কাজ করেছে পুরাতন ক্রোধ আবার কারও বা কাজ করেছে ঈষা, পরশ্রীকাতরতা।

এত সব ব্যক্তিগত টানা-পোড়েনের মধ্যেও সবার ওপরে কিন্তু আছে রাজনীতি এবং সে রাজনীতি মূলত পাঞ্চাল এবং কৌরবদের রাজনীতি। দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর মহাভারতের বক্তা বৈশম্পায়ন মন্তব্য করেছিলেন-দুপদ পাঞ্চালের সঙ্গে যেদিন পাণ্ডবদের যোগ হল, সেদিন থেকে কোন দেবতার ভয়ও পাণ্ডবদের ছিল না–পাণ্ডবৈঃ সহ সংযোগং গতস্য দুপদস্য হ। ন বভূব ভয়ং কিঞ্চিৎ দেবেলভ্যা’ পি কথঞ্চন। স্বয়ং দুর্যোধন ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞ দেখে এসে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন- সবাই আজকে সম্রাট যুধিষ্ঠিরের তোষামুদি করছে এবং ভারতবর্ষের সমস্ত রাজারা রাজকর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যুধিষ্ঠিরের দরজায়। শুধু দুটি রাজ্য এই কর দেওয়ার কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছে–এক পাঞ্চালেরা, তাঁরা পাণ্ডবদের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ থাকায় করমুক্ত, আর দ্বিতীয় হল যাদব রাজ্য যাঁরা পাণ্ডবদের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ–বৈবাহিকেন পাঞ্চালাঃ সখ্যেনান্ধবৃষ্ণয়ঃ। আমরা বলব–এই পাঞ্চাল-যাদবদের জন্যই পাণ্ডবেরা ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইন্দ্রপ্রস্থ লাভ করে প্রথম রাজত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন এবং এই পাঞ্চাল-যাদবদের জন্যই শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবেরা হস্তিনাপুরের দখল পেয়েছেন। এরা পাশে না থাকলে একবার তাঁদের বারণাবতে দগ্ধ হতে যেতে হয় অথবা জুয়ো খেলে বনে যেতে হয়। ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্য পাওয়ার পর যাদব-পাঞ্চালেরা পাণ্ডবদের ওপর বেশি আস্থা রেখে ফেলেছিলেন। তার ফল জুয়ো খেলে বনবাস। কিন্তু যেই পাণ্ডবেরা বনে গেছেন তখন হৈ-হৈ করে বনেই ছুটে এসেছেন বৃষ্ণি-অন্ধক বীরেরা, পাঞ্চাল-কেকয়ের যোদ্ধারা। দ্রৌপদী সবার সামনে ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছেন–পাণ্ডব-পাঞ্চালবৃষ্ণিরা বেঁচে থাকতেও–জীবৎসু পাণ্ডুপুত্ৰেযু, পাঞ্চালেষু চ বৃষ্ণি-আমাকে এমন হেনস্থা হতে হল। কৃষ্ণ সবার হয়ে জবাব দিলেন, কি আর করা যাবে–আমি ছিলাম না দ্বারকায়, আমি থাকলে এ জিনিস হত না–অসান্নিধ্যং তু কৌরব্য••••যেনেদং ব্যসনং প্রাপ্তা। না, আর ভুল হয়নি–পাণ্ডবদের বনবাসের সময় পার হওয়ার মুহূর্ত থেকেই যুধিষ্ঠিরকে আর একা ‘ডিসিসন নিতে হয়নি। কুরুসভা থেকে সামান্য দূত এলেও এখন যুধিষ্ঠির বলেন–এখানে পাণ্ডবেরা আছেন, পাঞ্চালেরাও আছেন। আছেন বৃষ্ণিবীর সাত্যকি, যদুসিংহ কৃষ্ণ, আছেন বিরাট। ধৃতরাষ্ট্রের যা বলার আছে, এদের সামনেই বল–সমাগতাঃ পাণ্ডবঃ সৃঞ্জয়াস্ট জনার্দনো যুযুধানো বিবাটঃ।(৮৭) এই জোটই শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে প্রতিষ্ঠিত করল। মহাভারতকার দুর্যোধনের পাশে এগাররা অক্ষৌহিণী সেনা দিয়ে, প্রতি তুলনায় তাঁকে বেশি শক্তিমান দেখিয়ে ধর্মযুদ্ধে পাণ্ডবদের যতই জেতান না কেন, আমরা জানি, এই যুদ্ধের প্রধান আকর্ষণ হল যাদব-পাঞ্চালের জোট, যার মূলে আছে পুরুষোত্তম কৃষ্ণের বুদ্ধি আর ক্ষুব্ধ দ্রুপদের শক্তি। আর অন্যদিকে আছে পুরাতন রাজবংশের অহংকার, অধিকার আঁকড়ে থাকার অপচেষ্টা, যার মূর্তিমান উদাহরণ কুরুকুলপতি ধৃতরাষ্ট্র, অভিমানী দুর্যোধন। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে লাভ হয়েছে পাণ্ডবদের, যাঁরা রাজনৈতিক শক্তি বলে পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু ইতরেতরের দ্বন্দ্বে মহান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হলেন। কিন্তু ইতিহাস বো দুবার। দৈবাৎ যদি বা কোনক্রমে উত্তর ভারত ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হল, কিন্তু হাজার বছর পরেই রাজনৈতিক শক্তির মূল কেন্দ্র কিন্তু আবারও পরিবর্তিত হল পূর্ব ভারতের মগধে জরাসন্ধের মগধে নয়, মহাপদ্ম নন্দের মগধে, বিম্বিসারের মগধে। কাজেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে পূর্ব আর উত্তরের মধ্যেই আগে ক্ষমতার আবর্তন ঘটত–সে ইতিহাসে জলাঞ্জলি দিয়ে এখনকার ইতিহাস শুধু উত্তরের দিকেই চেয়ে থাকে, পাণ্ডবদের দিল্লি বা ইন্দ্রপ্রস্থের দিকেই করুণ চোখে চেয়ে থাকে।

.

গ্রন্থপঞ্জী

১. ভগবদগীতা, নলিনীকান্ত ব্ৰহ্ম-সম্পাদিত, নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৯৫, ১. ৪১।

 ২. ঐ ১. ৪২।

৩. মহাভারত, পঞ্চানন তর্করত্ন-সম্পাদিত, কলকাতা, ১৮৩০ (এর পর মহাভারতের কোন উদ্ধৃতি বা উল্লেখ মাত্রেই বুঝতে হবে তা এই বঙ্গবাসী সংস্করণ থেকে করা হচ্ছে), আদিপর্ব ৭৮, ৮-১২।

৪. মহাভারত, আদিপর্ব ৭৮. ২০

 ৫. মহা, আদি ৭৮, ৩২

৬. মহা, আদি ৭৮, ৩৪

৭, মহা, আদি ৭৮, ৩৭

 ৮. মহা, আদি ৮০. ৫

৯. মহা, আদি ৮০. ৯

১০. মহা, আদি ৮০. ১২

১১. মহা, আদি ৮১. ৭

 ১২. মহা, আদি ৮১. ১০

 ১৩. মহা, আদি ৮১, ১৯

১৪. মহা, আদি ৮১. ৩৫

১৫. মহা, আদি ৮২. ১৬

১৬. খ্রীষনৃতং ন হিনস্তি প্রত্যুত সত্যাদরেণ তত্ত্যাগ এব হিনস্তীতি। দ্রঃ নীলকণ্ঠের টীকা, মহা, আদি ৮২, ১৭,

১৭. মহ, আদি ৮২. ১৯

১৮. মহা, আদি ৮৫. ২৯

১৯. গরুড় পুরাণে পাঠ আছে, “নদীনামগিহোত্ৰাণাং ভারতস্য কুলস্য চ। মূলান্বেষো ন কর্তব্যো মূলাদ্দোষেণ হীয়তে ॥” (বঙ্গবাসী সংস্করণ, পূর্ব খণ্ড ১১৫, ৫৭)। এই শ্লোকের অর্থ তর্করত্নমশাই করেছেন এইভাবে : নদী, অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, ভারত ও কুল–ইহাদের মূল অনুসন্ধান করিবে না, যেহেতু মূল অন্বেষণ করিলে দোষ হইতে পারে। আমাদের বক্তব্য; ‘ভারতস্য কলস্য ‘ এই শব্দগুলির অং! যদি ভারত ও কুলের’ হয়, তাহলে ভারতের মূল অনুসন্ধান বলতে কি বোঝায়? আমাদের মতে এই শ্লোক লোকমুখে পরম্পরাক্রমে নেমে এসেছে এবং গরুড় পুরাণেও শ্লোকটি ধরা আছে নীতিশাস্ত্রবিষয়ক শ্লোকগুলির মধ্যে। অতএব শ্লোকের আমরা যে অর্থ করেছি সেই অর্থই যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

২০, মহাভারত, আদি ৮৫. ৩৪-৩৫

২১. কৌটিল্যীয় অর্থশাস্ত্রম, রাধাগোবিন্দ বসাক সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৯৬৪, ১ম খণ্ড, ১ম অধিকরণ, ইন্দ্রিয় জয় প্রকরণ, পৃ. ৪

 ২২. মহা, শান্তিপর্ব ৮১, ২৫

২৩. আর. সি. মজুমদার, কপোরেট লাইফ ইন অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া, ফার্মা কে, এল. এম : কলিকাতা, ১৯৬৯, পৃ. ১১৯

২৪. জয়চন্দ্র বিদ্যালংকার, ভারতীয় ইতিহাসকি রূপরেখা, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৮-২৯

২৫. এফ. ই. পারজিটার, আনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল ট্র্যাডিশন, মতিলাল বনার্সিদাস, দিল্লী, ১৯৬২, পৃ. ২৬২, ২৭২

২৬. হরিবংশ, আর্যশাস্ত্র সংস্করণ, ১. ৩১. ৮২, ৮৩

২৭. মহা, আদি ৬৮, ৩।

২৮. মহা, বনপর্ব ৪৬, ৪০

২৯, মহা, বন ৪৬. ৪৩

 ৩০, মহা, আদি ৭৩, ৭৪, ৭৬

 ৩১. মহা, আদি ৭৩. ১৩১

 ৩২. মহা, আদি ৯৫, ৩৪

৩৩. বিষ্ণুপুরাণ, আর্যশাস্ত্র, কলিকাতা, ৪. ১৯. ৭. বায়ুপুরাণ, বঙ্গবাসী সংস্করণ; ১৩১৭, ৯৯, ১৫০

৩৪, মৎস্য পুরাণ, নবভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ, ৪৯, ৩৩; বায়ুপুরাণ ভরদ্বাজকে বলেছে ‘দ্বিপিতরঃ অর্থাৎ দ্বিপিতৃক; তাঁর দুজনকে বাবা বলার কথা (৯৯, ১৫৭)। ৩৫. মৎসপুরাণ ৪৪,

৩৫, হরিবংশ (আর্যশাস্ত্র সংস্করণ) বলেছে-যস্তে জনিষ্যতে পুত্র স্তস্য ভায্যোপদানবী-১, ৩৬. ১৯।

৩৬. জানাল অব দি অ্যামেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি, খণ্ড ১৯, পৃ. ১০০।

৩৭. এফ. ই. পারজিটার, অ্যানসিয়েস্ট ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল ট্র্যাডিশন, মতিলাল বনার্সিদাস, দিল্লী, ১৯৬২, পৃ. ১৫৮।

৩৮. হরিবংশ, ১. ৩১. ২৮

 ৩৯. বায়ু পুরাণ, বঙ্গবাসী সংস্করণ, ১৩১৭, ২০৮; একই মনুসংহিতার ৭. ৪১. শ্লোকে ‘সুদাঃ পৈজবনশ্চৈব’-এইখানে বিভিন্ন পাঠ দেখা যায়। কেউ ‘সুদাসো যবনশ্চৈব, কেউ ‘সুদাপি যবনশ্চৈব’ আবার কেউ বা ‘সুদাঃ পৈজবনশ্চৈব’ পাঠ নিয়েছেন। ঋগবেদে যেখানে ‘রাজাপি চ্যবনঃ আছে, বিষ্ণুপুরাণ সেটিকে একেবারে চ্যবন বানিয়ে দিয়েছে।

 ৪০. জানাল অব দ্য রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৯১০ প, ৪৯-৫০

৪১. মহাভারত, বনপর্ব, ১২৭ অধ্যায় সম্পূর্ণ দ্রষ্টব্য।

 ৪২. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, সম্পাদক এ. কে. শাস্ত্রী, ত্রিবাঙ্কুর, ১৯৪২, ৮, ১৪.

 ৪৩. মহাভারত, সভাপর্ব ১৯. ১১-১৪।

 ৪৪. মহা, সভা ১৯, ২২।

 ৪৫. মহা, আদি ৬৩. ৩৫

৪৬. হরিবংশ, আর্যশাস্ত্র সংস্করণ, ২, ৩৪. ৭

৪৭. হরিবংশ, ১. ৩৫, ৪।

৪৮. হরিবংশ, ২. ২৩. ১৩

 ৪৯. হরিবংশ, ২, ৩৪. ২০।

৫০, মহাভারত, শান্তিপর্ব ৫. ৬

৫১. কলহন, রাজতরঙ্গিণী, সম্পাদক এম. এ. স্টাইন, মুনশীরাম মনোহরলাল, দিল্লী, ১৯৬০, ১ম খণ্ড ১, ৫৯।

 ৫২. মহাভারত, সভা ১৪. ৪৯।

৫৩, মহা, আদি ১২৬, ১২।

৫৪. মহা, আদি ১৩০. ৬০।

৫৫. মহা, আদি ১৬৬. ১৬।

 ৫৬. মহা, আদি ১৩৮, ৬১।

 ৫৭, মহা, আদি ১৮৪, ৮।

 ৫৮, মহা, আদি ১৯৫, ১২।

 ৫৯. মহা, আদি ২০০, ৭০।

৬০. মহা, আদি ২০০, ১৪।

 ৬১. মহা, আদি ২০১. ১৬।

৬২. ত্যাজ্যমস্তি কৃষ্ণস্য পাণ্ডবার্থে কথঞ্চন। মহা, আদি ২০২. ১৬।

৬৩. দ্রঃ নীলকণ্ঠের টীকা: মহা, আদি ২০৭. ২৭

 ৬৪. মহা, আদি ১৯৫. ২৯.

৬৫. মহা, উদ্যোগ পর্ব ৪. ৫

৬৬. মহা, উদ্যোগ ১৯. ১২

৬৭, মহা, উদ্যোগ ২২. ১৮

৬৮. মহা, উদ্যোগ ১৯, ২৫

 ৬৯, মহা, উদ্যোগ ২২, ২০

৭০. দ্রঃ নীলকণ্ঠের টীকা : মহা, উদ্যোগ ২২. ২০

৭১. মহা, উদ্যোগ ৫৪. ১৭-১৮

 ৭২. কলহন, রাজতরঙ্গিণী, ১. ৭০-৭৪

৭৩. মহা, সভা ৪৫, ৩৬

 ৭৪. মহা, আদি ৯৫. ৭৯

৭৫. মহা, সভা ২৪. ৪৩

৭৬. মহা, আশ্রমবাসিক পর্ব ২৫, ১৩

৭৭, মহা, উদ্যোগ ১৯, ৭, ৮ ২০৪

 ৭৮, মহা, উদ্যোগ ৪৮, ৯৯

৭৯. মহা, দ্রোণপর্ব ১৮০. ২১

 ৮০. মহা, কর্ণপর্ব ৫. ৪

 ৮১. মহা, কর্ণপর্ব ৫. ৫

 ৮২. মহা, উদ্যোগ পর্ব ১৪১, ৪৪

 ৮৩, মহা, দ্রোণপর্ব ১৯৭, ৫৪-৫৫

 ৮৪, মহা, উদ্যোগ ৫৭. ৪৭

৮৫. মহা, উদ্যোগ ১৫১. ১৬

৮৬. মহা, উদ্যোগ ১৫১. ৪৯

৮৭. মহা, উদ্যোগ ২৫, ১

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ September 30, 2022 at 11:58 am

I’ve read First 4 chapter

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *