০৫. জেনানা ফাটকের এক বন্দিনী

০৫.

জেনানা ফাটকের এক বন্দিনী একদৃষ্টে জেলের বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিল।

ও রোজ সকালে গাছে জল দেয়। গাছেদের দেখভাল করে। এটাই ওর ডিউটি। নারীটির হাতে জাদু আছে। ওর স্পর্শ পেয়ে গাছগুলোর বড় আরাম হয়েছে। তারা সবুজে সবুজে ক্রমাগতই লাবণ্যময় হয়ে উঠেছে। সদ্য লাগানো চারাগাছগুলোও যেন যত্ন পেয়ে বেড়ে ওঠার জন্য উন্মুখ!

অথচ যার হাতের ছোঁয়ায় গাছগুলো হেসে ওঠে, তার নিজের মুখে হাসি নেই। যন্ত্রচালিতের মতো কাজ করে যায় সে। তার আশেপাশের মেয়েরা তার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েও অদ্ভুত একটা শীতলতায় বাধা পেয়ে সরে এসেছে। মেয়েটা যেন মানবী নয়– মূর্ত হিমশৈল! জল তার বুকে অনেক গভীরে বরফ হয়ে বাসা বেঁধেছে। ওপর থেকে সেই হিমশৈলের শীতল আঁচ পাওয়া যায় মাত্র। কিন্তু তার গভীরতা আঁচ করা দুষ্কর। অন্যদের কৌতূহল, প্রশ্ন সেই নীরব হিমশিখরে প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়। জাগতিক কোনও কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করতে পারে না! বাগানের এককোণে নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা কামিনীগাছ। ফুলে ফুলে উপচে পড়েছে। সবুজ পাতার পোশাক পরা ডালের মাথায় রাজমুকুটের মতো সাদা সাদা ফুলগুলো হাওয়ায় দুষ্টুমি করে নড়ছে। যেন ইশারা করে বলছে, আয় না কাছে আয়! কাছে আয়…!

সে আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়ায় কামিনী গাছের কাছে। একটা দুষ্টু হাওয়ার ঝাঁপট। সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল হাসির মতো ঝরঝর করে বেশ কিছু কামিনী ফুল মাটিতে ঝরে পড়ল! সে ফুলগুলোকে কুড়িয়ে নিয়েছে। দুহাত ফুলে ভরে গেল। নারীটি মুখ ডুবিয়ে দেয় ফুলের কোমল দেহে। ফুলের গন্ধ নিতে নিতে ও আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কানের ভিতরে, মস্তিষ্কের সুদূর থেকে ভেসে এল ঝাপসা সুর।

আজি নূতন রতনে, ভূষণে, যতনে প্রকৃতি সতীরে সাজিয়ে দাও
আজি সাগরে, ভুবনে, আকাশে, পবনে নূতন কিরণ ছড়িয়ে দাও…!

লায়লা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। বাদল একটু আগেই খেয়ে বেরিয়ে গেছে স্কুলে। রূপসা এখন দ্বিতীয় দফার ঘুম দিচ্ছে। ভোরে একবার উঠেছিল। বাবার বাজারের ব্যাগ তদন্ত করে দেখাটা তার প্রাত্যহিক অভ্যাস। রূপসার শরীরটা একদমই ভাল যাচ্ছে না। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার বারবার বলেছেন পুষ্টিকর খাবার খেতে। কিন্তু রূপসা মাছ মাংস খেতে চায় না। এর মধ্যেই মেয়ের মাথায় ঢুকেছে যে মাছ-মাংস খাওয়া মানে অকারণে প্রাণীহত্যা। বাদল আজ বাজার থেকে জিওল মাছ এনেছিল। কিন্তু রূপসা তক্ষুনি মাছগুলোকে বাজারের ব্যাগ থেকে জলভরা বালতিতে ফেলে দেয়। তারপর বালতিসুদ্ধ মাছগুলোকে পাশের পুকুরে ছেড়ে আসতে দৌড়োয়! বাদল মেয়ের কাণ্ড দেখে হেসেই খুন। হাসতে হাসতে বলে, ওই যে আমার কেজি দরে কেনা মাছ জলে সাঁতরাতে যাচ্ছে!

সদ্য কেনা আস্ত শিঙি, কই মাছগুলোর এমনতর সদগতি দেখে ভুরু কুঁচকে যায় লায়লার, আদিখ্যেতা দেখো! একজন অতগুলো টাকার জিনিস জলে ফেলতে ছুটল, আরেকজন তাই দেখে হেসেই বাঁচে না! মেয়েটাকে লাই দিয়ে আর ওর মাথা খেয়ো না! কোথায় জিওল মাছ খেয়ে গায়ে একটু রক্ত হবে, তা নয়, প্রাণীহত্যা ঠেকাচ্ছে! ওরে, আপনি বাঁচলে তবে প্রাণীর নাম!

বাদল সে কথা শুনে আরও জোরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই গোসলঘরের দিকে গেছে। তার হাসি দেখে আরও রেগে যায় সে, বলি এভাবে রোজ প্রাণীহত্যা ঠেকাতে গিয়ে যে আনিসুর দাদারা লাল হচ্ছে সে খেয়াল আছে! আগে ওদের পুকুরে মাছই ছিল না। এখন শিঙি, কই, মাগুর, শোল গিজগিজ করছে! এক মাইল দূর থেকেও তার ঘাই শোনা যায়!

গোসলঘর থেকে আরও উচ্চস্বরে হাসির শব্দ ভেসে আসে। লায়লা গজগজ করতে করতে নিজের কাজ করে, দিনে দিনে হিন্দু বামুনবাড়ির বিধবাদের মতো হাবভাব হচ্ছে মেয়ের! জিওল মাছ জলে ফেলে দেবে। রুই মাছ বা মাংস পাতে দিলে হাপুশ নয়নে কাঁদতে শুরু করবে! তবু ভাল, ডিমটা এখনও খায়। এভাবে চললে সুস্থ হবে কী করে মেয়ে?

এর মধ্যেই অবশ্য রূপসা নিজের কাজটি সুসম্পন্ন করে এসে শোবার ঘরে ঢুকে গেছে। এবার সে দ্বিতীয় দফার ঘুম দেবে। বাদল স্নান করে বেরিয়ে এসে দেখে লায়লার মুখ তখনও হুঁড়ি!

সে মুচকি হেসে বলে, বললে হবে? ও কি সাধারণ মানুষ? ও যে আমার চম্পক ঈশ্বরী! ওকে কি বোঝানো যায়? তার চেয়ে বরং অন্য হুকুম দাও!

হ্যাঁ। কলসি-দড়ি এনে দিয়ে! কাজল চোখের জ্বলন্ত চাউনিতে বাদলকে চিংড়িপোড়া করে দেয় লায়লা, আমি জ্বালা জুড়াই!

কোথা পামু কলসি কইন্যা, কোথা পামু দড়ি? লায়লার থুতনি ধরে মুখটা নেড়ে দেয় বাদল, তুমি হও গহিন গাং, আমি ডুইব্যা মরি?

মরণ! লায়লা মুখ বাঁকায় বুড়ো বয়েসে ভীমরতি নাকি?

বাদল হেসে ফেলে, মহা মুশকিল! মেয়েকে আদর করলে আদিখ্যেতা! নিজের বিবিকে আদর করলে ভীমরতি! কোথায় যে যাই!

হয়েছে! লায়লা হাসি চাপতে না পেরে এবার ফিক করেই হেসে ফেলেছে– কোথাও যেতে হবে না। নাশতা করে ইস্কুলে যাও।

নাশতা বলতে সকালে ফেনাভাতের সঙ্গে আলুসেদ্ধ আর ডিমসেদ্ধ! বাদল এক পেট ভাত তৃপ্তি করে খেয়ে স্কুলে চলে গেল। রূপসার নাশতার বন্দোবস্তও অনুরূপ। ভাগ্যিস এখনও ডিমের পিছনের প্রাণী হত্যার ইতিহাস জানতে পারেনি সে। তাই মাছ-মাংস না খেলেও ডিম খায়।

মোটামুটি সকালের খাবার তৈরি করে দ্বিপ্রহরিক রান্নার বন্দোবস্ত করছিল সে। বঁটিতে সাবধানে শাক কুটছিল। এর মধ্যেই আচমকা রূপসার চিৎকার–

মা, ওমা! মা-গো! মা-আ-আ-আ!

লায়লার বুকটা কেঁপে ওঠে! এই সাতসকালে এমন চেঁচাচ্ছে কেন মেয়ে? শরীরটা তার মোটেই ভাল যাচ্ছে না! মাঝেমধ্যেই কেমন অবশ হয়ে যায়, চোখ উলটে যায়, দম নিতে পারে না! স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চেক আপেও উন্নতি হচ্ছে না। বরং মেয়ে শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে যাচ্ছে।

ও মা-আ-আ! মা-আ-আ!

ডাকটা পুকুরপাড় থেকে আসছে না? রূপসা কি ঘুম থেকে উঠেই পুকুরপাড়ে ছুটেছে? সেখানে গিয়ে কি ফের অসুস্থ হয়ে পড়ল! রান্নার প্রস্তুতি মাথায় উঠল। শাকের চুপড়ি ফেলে তখনই পুকুর পাড়ের দিকে ছুটেছে লায়লা। তার মাথায় তখন একটাই আশঙ্কা! মেয়ে ঠিক আছে তো?…

অবশ্য লায়লার আশঙ্কা অমূলক ছিল। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে দিব্যি হাসছে রূপসা। তাকে দেখে বিন্দুমাত্রও অসুস্থ মনে হচ্ছে না। বরং এত সুস্থ তাকে আগে কখনও মনে হয়নি। লায়লার বুকের মধ্যে তখনও কাঁপছে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কী হয়েছে মা?

রূপসা তাকে কামিনীগাছটা দেখায়! আশ্চর্য! এতদিন কামিনীগাছটা কেমন মরকুটে ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। কখনও ওর গায়ে একটাও সবুজ পাতা দেখা যায়নি। বরং শুকিয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগতই! অথচ আজ গাছটা সবুজ কচিপাতায় ভরে গেছে! এই গাছটার জন্য রূপসার বড় দুঃখ ছিল। কিন্তু আজ নতুন প্রাণ পেয়ে যেন গাছটা নতুন উদ্যমে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে।

লায়লা বিস্মিত হয়ে কুদরতের এই অদ্ভুত করিশমা দেখে! এখন গাছটা সকালের রোদে সোনালি হয়ে গেছে। সদ্য গজানো নরম সবুজ রঙের পাতাগুলো ভোরের শিশির মেখে লাজুক হাসছে! তার প্রতিবিম্ব পুকুরের জলে পড়ে চিকচিক করে। একে আজুবা ছাড়া আর কী বলা যায়?

মা আল্লার কৃপায় গাছটা বেঁচে গেছে! রূপসার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। সে হাততালি দিয়ে ওঠে আল্লা আমার কথা শুনেছেন! মেহেরবান হয়েছেন!

লায়লার মনে হল আজ সকালটা অদ্ভুত সুন্দর! কোনও কারণ ছাড়াই সে মনের আনন্দে গেয়ে ওঠে–

আজি পুরানো যা কিছু দাও গো ঘুচিয়ে, মলিন যা কিছু ফেলো গো মুছিয়ে
শ্যামলে, কোমলে, কনকে হীরকে ভুবন ভূষিত করিয়ে দাও!

তালে তালে রূপসা হাত পা নেড়ে নাচের ভঙ্গি করে। কখন ও মায়ের সঙ্গে গলা মেলায়। এই গানটা সে জানে। বাবা তাকে শিখিয়েছে–

আজি বীণায় মুরজে শননে গরজে জাগিয়া উঠুক গীতি গো
আজি হৃদয় মাঝারে জগৎ বাহিরে ভরিয়া উঠুক প্রীতি গো
আজি নূতন আলোকে, নূতন পুলকে, দাও গো ভাসায়ে
ভূলোকে দ্যুলোকে নূতন হাসিতে বাসনারাশিতে জীবন-মরণ ভরিয়ে দাও।

গাইতে গাইতে রূপসার মনে হয়, হাত-পা যেন আবার অবশ হয়ে আসছে…! সে অসুস্থতাকে ঘৃণা করে। তাই জোর করে স্বাভাবিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু শরীরটা বিদ্রোহ করছে! দম বন্ধ হয়ে আসে। সুরের বদলে সজোরে কাশি উঠে আসছে গলা বেয়ে। রূপসা হাসার চেষ্টা করে। হাসিটা ঠিকমতো এল না। শুধু টের পেল সে দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে! তার দেহটাকে অদৃশ্য কোনও শক্তি যেন হাওয়ায় ছুঁড়ে দিল! কানে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। বুঝতে পারল তাকে কেউ ধরে ফেলেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের মুখ! মা কিছু বলছে? কী বলছে? সে শুনতে পাচ্ছে না কেন? তার গলা টিপে ধরেছে কি কেউ! শ্বাস নিতে বড় কষ্ট! …ওঃ!

তার চোখের সামনে ফের অন্ধকার কালো পরদা ছড়িয়ে দিয়েছে!

.

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন। বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর বাঁকে বাঁকে, নদীও নর্তকী হয়…

বাদল তখন স্কুলে ইতিহাসের ক্লাস নিচ্ছিল। বিষয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি। ব্ল্যাকবোর্ডে তখন পঞ্জাব, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ম্যাপ শোভা পাচ্ছে। ইতিহাসের শিক্ষক হলেও ভূগোলে তার অপরিসীম দক্ষতা! ভুরু কুঁচকে সে উদাত্ত কণ্ঠে বলে চলেছে বাংলাভাগের অমোঘ সত্যকে। তারপর কীভাবে একটি ভাষাকে আশ্রয় করে মানুষ বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দাঁড়াল। জন্ম দিল এক নতুন দেশের যে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সেই ইতিহাস বলতে বলতে রুদ্ধ হয়ে এল তার কণ্ঠস্বর।

এক ছাত্র বিভোর হয়ে শুনছিল। মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, বন্দুক দেখে ওদের ভয় করল না?

ভয়? হেসে উঠল বাদল। হাসতে হাসতেই উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে, ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে/তা

থৈ তা থৈ থৈ, দিমি দিমি দ্রম দ্রম, ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে…!

ক্লাস মন্ত্রমুগ্ধ। মুকুন্দদাসের এই গানটা সবাই জানে। তারাও গলা মেলায় শিক্ষকের সঙ্গে। তাদের সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ক্লাসঘরে মুকুন্দদাসের গান–

দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে ॥
সাজ রে সন্তান হিন্দু-মুসলমান
থাকে থাকিবে প্রাণ, না হয় যাইবে প্রাণ ॥
ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে ॥

বাংলার ইতিহাস জমে গেছে। হয়তো আরও একটু এগোত কিন্তু তার আগেই ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হাসে, বাকিটা কাল বলব আজ এই পর্যন্তই থাক।

বই গুছিয়ে নিয়ে সে ক্লাসের বাইরে চলে এসেছে। পিছন পিছন ছাত্র-ছাত্রীরাও। এখনও তাদের তৃপ্তি হয়নি। এখনও মাস্টারমশাইয়ের কাছে অনেক কিছু জানার আছে। প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার। বাদলকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন হেডস্যার হেমন্ত বাগচী। ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, এখন স্যারকে ছেড়ে দাও। বাকিটা তো কালই শুনতে পাবা। তোমরা এখন ক্লাসে যাও।

হেডস্যারের আলতো ধমক খেয়ে ভিড়টা সুড়সুড় করে ফের ক্লাস অভিমুখী হয়েছে। হেমন্তবাবু তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়েই বললেন, তুমি আমায় বড় বিভ্রান্ত করো বাদল!

আমি! বাদল প্রায় আকাশ থেকে পড়ে, আমি কী করেছি দাদা!

তুমি আসলে কোন বিষয়টা পড়াও বলো দেখি! হেমন্তবাবুর ঠোঁটে মৃদু হাসি, কাল একটা ক্লাসে মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়াচ্ছিলা। সেখানে দেখি ভারতবর্ষের ম্যাপ এঁকে মোঘলদের রাজ্যের সীমা পয়েন্ট করে রেখেছ! আবার আবুল ফজলও আওড়াচ্ছিলা! আজ দেখছি বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ম্যাপ পয়েন্টিং করেছ! শামসুর রহমান আওড়াচ্ছ! মুকুন্দদাস গাইছ? ব্যাপারটা কী? তুমি কী পড়াও? ইতিহাস? ভূগোল? না সাহিত্য? না সংগীতও তোমার শিক্ষার বিষয়!

বাদল হেসে ফেলল, পড়ানোর কি কোনও নির্দিষ্ট বিষয় আছে দাদা? সব বিষয়ই পরস্পর নির্ভরশীল! একটাকে টানলে আরেকটা চলে আসে…!

আর কী চলে আসে জানি না, তবে তোমার টানে অন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরাও চলে আসে। তিনি হাসলেন– সেদিন দেখি অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের ক্লাসে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরাও ঢুকে পড়েছে!

তাই বলেন! তার চক্ষু চড়কগাছ, তাই ভাবি ক্লাসঘরে জায়গা হয় না কেন! ছাত্রছাত্রীরা সব দাঁড়িয়ে থাকে, বেচারিদের বসার জায়গাও নেই।

হেমন্তবাবু মিটিমিটি হাসেন। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাধা পড়ল। আচমকা দুজনেই লক্ষ করলেন দূর থেকে বাদলের প্রতিবেশী আনিসুর পাগলের মতো দৌড়োত দৌড়োতে আসছে। বাদলের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে। আনিসুর অমন ভাবে ছুটে আসছে কেন?

ভাইজান!…ভাইজান! আনিসুর হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, এখনই বাড়ি চলো। রূপসা…রূপসা…!

ঠিক এই ভয়টাই ছিল বাদলের। রূপসার কী হয়েছে তা বিশদে শোনার অপেক্ষা করে না সে। হাতের বইপত্র ঝুপ করে পড়ে গেল মাটিতে। বাদল তিরবেগে দৌড়েছে বাড়ির দিকে। আনিসুরও তার পিছন পিছন দৌড়োল। হেমন্তবাবুও তার সঙ্গ নিলেন। তিনি লাফ মেরে সাইকেলে চেপে বসলেন। বাদল তখনও বেশিদূর যেতে পারেনি। তিনি দ্রুত প্যাডেল মেরে ধরে ফেললেন তাকে।

বাদল, সাইকেলে উঠে পড়ো। হেমন্তবাবু বলেন, তাড়াতাড়ি হবে।

বাদল বিনাবাক্যব্যয়ে তাঁর সাইকেলের পেছনে উঠে বসে। তার গলা শুকিয়ে আসে। রূপসার কী হল? রূপসা…আজ সকালেও তো ঠিক ছিল…তবে…!

.

০৬.

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাণ শুকিয়ে আসে বাদল ও লায়লার। তিনি গম্ভীরভাবে রূপসাকে পরীক্ষা করছেন। রূপসা একটা ঘোরের মধ্যে! মাঝেমধ্যেই হাত দিয়ে বুক চেপে ধরছে। অর্থাৎ বুকে ব্যথা হচ্ছে! ডাক্তার দিদিমণি স্টেথোস্কোপ দিয়ে তখন থেকেই তার হৃৎস্পন্দন শুনছেন। যত শুনছেন ততই তাঁর মুখ গম্ভীর হচ্ছে! কপালে ভাঁজ পড়ছে! শেষমেষ ভদ্রমহিলা স্টেথোস্কোপ সরিয়ে নিয়ে বললেন, না, অ্যানিমিয়া নয়! হার্ট ডিজিজ। আমি ভাল বুঝছি না। ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে!

হা-স-পাতা-ল! বাদল ও লায়লার মাথায় বাজ পড়ে। এতদিন শুনে এসেছে মেয়ের রক্ত কম! এখন শুনছে হার্টের অসুখ!

লায়লা ধপ করে বসে পড়ে! এ কী বিষম বিপদ! হৃৎযন্ত্র বিকল হয়ে গেল ওইটুকু মেয়ের! বাদল প্রথমে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে ফেলেছিল। মুহূর্তের মধ্যেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

রূপসার কী হয়েছে?

আমি কী করে বলব? ডাক্তার দিদিমণি ভাবলেশহীন মুখে উত্তর দেন। হাসপাতালে নিয়ে যান। অনেকগুলো পরীক্ষা করাতে হবে। এখানে সে ব্যবস্থা নেই।

বাদলের চোখে হিংস্র রাগ। কণ্ঠস্বরে চাপা ক্রোধ। সে ফের বলল, রূপসার কী হয়েছে?

আমি কী করে…?

কী হয়েছে আমার মেয়ের? হিংস্র হিসহিসে স্বরে সে তৃতীয়বার প্রশ্নটা করে। হেমন্তবাবু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার কাঁধে হাত রাখতেই সে সজোরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রত্যাখ্যান করে।

এবার ডাক্তার থমকালেন। চশমার কাঁচ মুছে বললেন, দেখুন, নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। অনেকগুলো পরীক্ষা করে তবেই নিশ্চিত হতে হবে। তবু বলছি, এটা সিরিয়াস হার্ট ডিজিজ! এর আগেও ওকে আমি পরীক্ষা করেছি কিন্তু এমন মারাত্মক হার্ট মার্মার আমি দেখিনি। রূপসার হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক নয়! ইসিজি, এম আর আই আর এক্স-রে ছাড়া কিছু বলা যাবে না। ওকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যান। দেরি করবেন না। যত দেরি করবেন, তত অবস্থা খারাপের দিকে যাবে!

বাদল আর কথা না বাড়িয়ে রূপসাকে কোলে তুলে নেয়। এই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে পাথরে তৈরি মানুষ। লায়লাকে সামলাচ্ছেন হেমন্তবাবু। আনিসুর চিন্তান্বিত।

স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসে আনিসুর বলে, তবে ভাইজান, সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করি?

দাঁড়াও হেমন্তবাবু তাকে বাধা দেন। একটু নিচুস্বরে বাদলকে বলেন, বাড়ি চলো, কথা আছে।

আনিসুর অধৈর্য, কেন? এখনই সাতক্ষীরায় গেলেই তো হয়…!

সাতক্ষীরায় গেলে যদি না হয়? হেমন্তবাবু কটমট করে তার দিকে তাকাচ্ছেন, তুমি কি জানো ওখানে হার্টের ট্রিটমেন্ট ভাল হয় কি না?

আনিসুর চুপ করে যায়। বাদল একবার হেমন্তবাবুর মুখের দিকে তাকায় আরেকবার রূপসার দিকে। মেয়েটা এখনও বুক খামচে ধরে আছে! যন্ত্রণায় মুখ নীল!

মানুষগুলো চুপচাপ বাড়িতে ফিরে আসে। রূপসাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই লায়লা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হেমন্তবাবুর দিকে তাকায় বাদল, বলেন দাদা।

সাতক্ষীরায় যাওয়ার চেয়ে তুমি বরং ইন্ডিয়ায় চলে যাও বাদল।

হেমন্তবাবু এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন। সম্ভবত এই কথার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই এই বিরতি। লায়লা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে আনিসুরের ভুরু কুঁচকে গেছে। কথাটা সম্ভবত তার পছন্দ হয়নি। বাদল বিস্মিত হতবাক। কোনওমতে চেতনা ফিরে পেয়ে বলল, ইন্ডিয়া! কিন্তু সে যে অনেক সময় লাগবে! পাসপোর্ট ভিসা…!

গুলি মারো তোমার পাসপোর্ট-ভিসা। হেমন্তবাবু উত্তেজিত। ইচ্ছামতী পেরোলেই সামনে টাকি হাসপাতাল! সেখানেই নিয়ে চলে যাও রূপসাকে।

আনিসুর প্রতিবাদ করে, সে তো বেআইনি! আপনি কি বাদলকে চুরি করে বেআইনি ভাবে ইন্ডিয়ায় ঢোকার দুর্বুদ্ধি দিচ্ছেন? ইন্ডিয়ার হাসপাতালেই বা যেতে হবে কেন? সাতক্ষীরা হাসপাতাল কী দোষ করল?

কোনও দোষ করেনি। তিনি বলেন, ডাক্তারের কথা শুনলে না? সিরিয়াস রোগ। যদি অপারেশনের দরকার হয়? ইন্ডিয়ায় অনেক ভাল ভাল হার্ট সার্জেন আছেন। সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। তাঁরাও যদি না পারেন তখন ওদের হাসপাতাল বিদেশ থেকে নামী দামি ডাক্তারকে নিয়ে আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত লড়বে ওরা! তোমার সাতক্ষীরা হাসপাতাল পারবে লন্ডন, আমেরিকা থেকে স্পেশ্যালিস্ট আমদানি করতে? তা ছাড়া আমার পেসমেকারও তো ওরাই বসিয়েছে। গতবছরই আমি কলকাতার হাসপাতাল থেকে অপারেশন করিয়ে এসেছি। ওদের চিকিৎসা সম্পর্কে আমার ধারণা আছে।

কিন্তু আপনি তো ভিসা নিয়ে গিয়েছিলেন। আনিসুর কিছুতেই মানবে না, বাদল এখন ভিসা পাবে কী করে? অন্তত বাহাত্তর ঘণ্টা লাগবে। মেয়ের অবস্থা দেখছেন। এখনই নীল হয়ে গেছে। চব্বিশ ঘণ্টাও সময় দেবে না…!

চব্বিশ ঘণ্টা লাগবে না। হেমন্তবাবু বললেন। আমার জানাশোনা লোক আছে বর্ডারে। আমার পরিচিত এক অফিসার সব সেট করে দেবে। তা ছাড়া সুদীপ্তও তত টাকিতে থাকে। একবার বর্ডার ক্রস করতে পারলেই সুদীপ্ত ওদের নিয়ে যাবে নিজের বাড়িতে। ওই সব বন্দোবস্ত করে দেবে। তারপর থেকে বাদল সুদীপ্তরই আত্মীয়। টাকিতে সুদীপ্তর ভাল হোল্ড আছে। কেউ ওর কথার ওপর কথা বলবে না।

আর যদি ধরা পড়ে যায়? আনিসুর তেড়েফুঁড়ে ওঠে, যদি হাসপাতালের বদলে জেলে যায়? জেলে কি আপনি ওদের বাঁচাতে যাবেন? না সুদীপ্তবাবু বাঁচাবেন?

এতক্ষণ দুজনের খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে বাদল নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিল। সে এবার আনিসুরকে হাত তুলে থামায়। দুহাত জোড় করে হেমন্তবাবুর সামনে জানু পেতে বসে পড়ে, রূপসার জন্য আমি জেলে কেন, দোজখেও যাব দাদাভাই। কিন্তু রূপসা ঠিক হয়ে যাবে তো?…আমার রূপসা…!

বাকি কথাগুলো বোঝা যায় না। তার কথাগুলো কান্নায় বিকৃত হয়ে গেছে। শুধু একটা কথাই বারবার বোঝা যাচ্ছে রূপসা!…আমার রূপসা…আমার চম্পক ঈশ্বরী!… কথাগুলো বলার সঙ্গে দরদর ধারায় তার দুচোখ বেয়ে জল পড়ে।

রূপসা ঘোরের মধ্যেই বিড়বিড় করে– যাব না আমি যাব না। কেন ওরা আমাদের তাড়িয়ে দিল? আমি যাব না!…

মেরো আল্লাহ মেহেরবান
কোই বিগাড় সকত নেহি তেরো
মন লিজে তু ঠান
মেরো আল্লাহ মেহেরবান।

ভারতবর্ষের সীমান্তরক্ষীরা হয়তো ট্রানজিস্টারে গান শুনছিল। শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর এই শেষরাতে আচমকা কানে এল বাদলের। সে সজল দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়।

ভোররাতে বাদল ও লায়লা গুরুতর অসুস্থ রূপসাকে নিয়ে নৌকোয় ভারতবর্ষের দিকে পাড়ি দেয়। হেমন্ত বাগচী সবরকম ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন। তিনি গ্রামীণ ফোনের মাধ্যমে সুদীপ্তবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এমনকী যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যেও সমঝোতা করে ফেলেছেন। মানবিক কারণেই দুই দেশের রক্ষীরা রাজি হয়ে গিয়েছে। নৌকোয় ওঠার আগে বাদলের হাতে একতাড়া নোটও দিয়ে দিয়েছেন হেমন্ত। বাদল অবাক, এ কী!

রেখে দাও এগুলো। ওখানে বাংলাদেশি টাকা চলবে না। ভারতীয় নোট কিছু সঙ্গে রাখো। সীমান্ত আইন ক্রমাগতই কড়া হচ্ছে। তোমার কাছে বাংলাদেশি নোট দেখলেই ধরবে।

বাদল বিপন্ন বোধ করে, তা হলে কী হবে দাদা? টাকাকড়ি যা নিয়েছি, সবই তো বাংলাদেশের!

ওগুলো পরে চোরাপথে এক্সচেঞ্জ করে নেওয়া যাবে। হেমন্তবাবু আশ্বস্ত করেন, সুদীপ্ত ওসব জানে। চিন্তা কোরো না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো।

লায়লা একটা পুঁটুলিতে তার যাবতীয় গয়না নিয়ে নিয়েছে। সে শুনেছে ইন্ডিয়ায় চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা লাগে। তাই নিজস্ব স্ত্রী-ধন টুকুও নিতে ভোলেনি।

অন্ধকারে সবার অজান্তে রূপসাকে কোলে নিয়ে নৌকোয় চড়ে বসল ওরা। হেমন্তবাবু হাতটা কপালে ঠেকিয়েছেন। অস্ফুটে বললেন, দুগ্‌গা! দুগ্‌গা!

রাতের আবছা অন্ধকারে ক্লান্ত তারারা মিটমিটিয়ে তাকিয়ে। চাঁদটাও সারা আকাশ গড়িয়ে ক্লান্ত। এখন তারও যাবার পালা। উলটো দিকের আকাশ গোলাপি হয়ে উঠেছে। একটু পরেই সূর্যোদয় হবে। নদীবক্ষের হাওয়া হু হু করে গায়ে এসে আছড়ে পড়ছে। বাদল রূপসাকে তার বুকে টেনে নেয়,

মেরো আল্লাহ মেহেরবান…!

ভারতবর্ষের সীমান্তের কাছাকাছি আসতেই সার্চলাইটের আলো একবার নৌকোর ওপর আলতো চোখ বুলিয়ে গেল। তারপরই সব চুপচাপ। এখন শুধু দাঁড়ে জল কাটার ছপ ছপ শব্দ। আর দূর থেকে ফজরের আজানের স্নিগ্ধ সুর ভেসে আসছে!

ঔলিয়া পির পয়গম্বর ধাবে। আলি নবী কো রুত উয়ো পাবে। হাসান হুসেন হ্যায় প্যারে জিনকে। মুঝকো দিজো ইমান/ মেরো আল্লাহ মেহেরবান…!

ঠিক তখনই আকাশে নানা রঙের শামিয়াঁনা টাঙিয়ে দিল বালার্ক!

.

লোকটা বৃদ্ধের মতোই হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই জেলার সাহেবের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কৌতুকের সঙ্গে বলল, এই দেশে, হুগলির পাড়ে ছিল! কয়েক দশক নয়, কয়েক শতক ধরে এখানে বাস। আগে হয়তো হিন্দু ছিলাম। আমাদের কোনও এক পূর্বপুরুষ তুর্কি আক্রমণের সময়ে ধর্ম পরিবর্তন করেন। বলাই বাহুল্য, নিজের প্রাণ ও পরিবারকে বাঁচাতে ধর্মান্তরিত হন। তুর্কি আক্রমণ বোঝেন? কত খ্রিস্টাব্দ যেন?

১২০৫ খ্রিস্টাব্দ। জেলারসাহেব মুখ নিচু করেন।

হ্যাঁ, মানুষটা আত্মমগ্ন ভাবেই বলে, ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ কত হল?

সাতশো বেয়াল্লিশ সাল বোধহয়।

ন্যূনতম সাতশো বেয়াল্লিশ বছর ধরে এই দেশটা আমারই দেশ ছিল। ভাগীরথীর তীরে বাড়ি… লোকটা আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেছে, আর সাতষট্টি বছর আগে আমারই দেশ, বিদেশ হয়ে গেল। কোনটা বেশি সময় বলুন তো? কোনটা পাল্লায় ভারী? সাতশো বেয়াল্লিশ বছর না সাতষট্টি বছর? আমি আজকাল আর অঙ্ক কষতে পারি না!

জেলার সাহেবের মাথা নিচু হয়ে যায়। এই লোকটা তাঁকে পদে পদে লজ্জিত করে তাঁকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। কী যে বলবেন ভেবে পান না!

সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ, সে মাটি সোনার বাড়া,। দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনই লক্ষ্মীছাড়া! মানুষটা সজোরে হেসে ওঠে। আমরা তো লক্ষ্মীছাড়াই। ঠিকই বলেছেন কবিগুরু! আমরা নিজের মাকে বেচে দিয়েছি। তাই সাতশো বেয়াল্লিশ বছরের অধিকারও হেরে যায়। পড়ে থাকে মাত্র সাতষট্টি বছর। যেটা বাপ-পিতেমোর ভিটে ছিল, আজ সেখানেই চুপিচুপি চোরের মতো আসতে হয়! আমার দেশে আমিই অনুপ্রবেশকারী! ট্রেসপাসার! বলতে বলতেই হো হো করে অট্টহাসি হেসে ওঠে সে।

জেলার ভয় পেয়ে যান। মানুষটার মাথা কি সত্যিই বিগড়েছে? শোকে, তাপে ও কি মানসিক ভারসাম্য হারাল!

হাসতে হাসতে লোকটার চোখে জল এসে পড়েছিল। সে হাসতে হাসতে চোখের জল মুছছে, ট্রেসপাসার! বুঝলেন, আমরা ট্রেসপাসার! বেআইনি পথে এসে পড়া চোর!

আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে–/ তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!

বলতে বলতেই সমস্ত সেল কাঁপিয়ে হা হা করে হেসে উঠেছে সে। জেলার সাহেব আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেলেন না। একরকম পালাতে পালাতেই শুনতে পেলেন লোকটা হাসতে হাসতেই বলে চলেছে, তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে…হাঃ হাঃ হাঃ!

তিনি কার প্রতি যেন অদ্ভুত রাগে মুষ্টিবদ্ধ হাতে নিজের টেবিলে ঘুষি মারলেন, ড্যাম্‌!

.

০৭.

সুদীপ্তবাবুর পূর্বপুরুষ কোনও একসময় সম্পন্ন ভূস্বামী ছিলেন। সুদীপ্তবাবুর বাবা ও মেজ জেঠু জমিদারির পুঁজিবাদকে ঘৃণা করতেন। তাই ওঁরা পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন না। দুজনে যৌবনেই স্বদেশি আন্দোলনে নাম লিখিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন। তখন থেকেই ইচ্ছামতীর প্রান্তবর্তী বাদলদের গ্রামেই থাকতেন সুদীপ্তবাবুর বাবা। জেঠু চলে গেলেন বরিশালে। সুদীপ্তর বাবার বিবাহ, পুত্রসন্তানের জন্ম– সব কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অধুনা বাংলাদেশ। কিন্তু সেই প্রাণের বাংলাই যখন দুভাগে ভাগ হয়ে গেল তখন ঘটনাটা মেনে নিতে পারেননি ভদ্রলোক। তাই বাংলা ভাগ হওয়ার খবর পাওয়া মাত্রই সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। সুদীপ্তবাবুর বিধবা মা একমাত্র পুত্রসন্তানের হাত ধরে চলে এলেন শ্বশুরবাড়িতে। অর্থাৎ টাকির বাড়িতে। সেই থেকে এখানেই বেড়ে ওঠা তাঁর। এখন অবশ্য জমিদারবাড়ি বলে এটাকে আর চেনা যায় না। হানাবাড়ি বললেই বোধহয় মানানসই হয়! একদিকটা তো পুরোটাই ভেঙে-ধ্বসে-মজে গেছে। অন্যদিকটা অবশ্য এখনও বাসযোগ্য। সেদিকেই কয়েকটা ঘর নিয়ে থাকেন সুদীপ্তবাবু ও তাঁর পরিবার।

সুদীপ্তবাবু সংক্ষেপে নিজের ইতিহাস বলে শেষ করলেন। বাদলের দিকে তাকিয়েছেন তিনি, এখন থেকে তোমরা এখানেই থাকবে যতদিন না রূপসা সুস্থ হচ্ছে, ততদিন এটা তোমাদেরও বাড়ি।

বাদল মুখ নিচু করে বসে আছে। কোনওমতে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

আর বউমা, তোমাকে কিন্তু হিন্দু গেরস্ত ঘরের বউদের মতো থাকতে হবে। তিনি লায়লাকে উদ্দেশ করে বলেন, হিদু বউদের মতো শাঁখা, সিঁদুর পরতে হবে। জানি, ওসব অভ্যেস নেই। তবু মেয়ের জন্য এইটুকু করতেই হবে।

বাদল চমকে তাকায়। নম্র অথচ বিপন্ন কণ্ঠে বলে, কিন্তু দাদাভাই, হিন্দু কেন হতে হবে? এখানেও তো অনেক মুসলিম পরিবার থাকে! তবে এ ছদ্মবেশ কেন?

এখানে যেসব মুসলিম আছে তারা কেউ আমার আত্মীয় নয়। তিনি ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেন, আমি হেমন্তর ফোন পাওয়ামাত্রই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রেখেছি যে আমার এক ভাইপোর মেয়ে গুরুতর অসুস্থ। তার জন্য যেন একটা বেড খালি রাখা হয়। ওরা রাজি হয়েছে। কিন্তু তুমি যদি মুসলিম হও তবে কোনওভাবেই আমার ভাইপো হতে পারো না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করবে। আর পুলিশ মাঝেমধ্যেই এখানে রেড মারে। ওরা জানে, অনেক বাংলাদেশের মানুষ এই পথে ভারতে অনুপ্রবেশ করে। বর্ডার এরিয়া তো! নিরাপত্তার কড়াকড়ি আছে তাই…!

ঠিক আছে দাদাভাই। বাদল দ্বিরুক্তি করে না। সুদীপ্তবাবুর যুক্তিটা সে বুঝেছে।

এখন থেকে তুমি আর মুনতাসীর চৌধুরী বাদল নও। শুধু বাদল চৌধুরী। কপালগুণে আমারও সারনেম চৌধুরী। তাই কোনও অসুবিধে হবে না। লায়লা– লীলা চৌধুরী। রূপসা– রূপসা চৌধুরী! এই নামই হাসপাতালের ফর্মে লিখবে। কান্ট্রি– ইন্ডিয়া, কাস্ট– হিন্দু, ব্রাহ্মণ। এগুলো আগেই বলে রাখলাম। আর হ্যাঁ, ভুলেও মুখ ফসকে এটাকে ইন্ডিয়া বলবে না। আল্লাহ, পানি জাতীয় শব্দ একদম উচ্চারণ করবে না। বাকিটা আমি দেখছি। তিনি তাড়া দেন, নাও, মুখ হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আর দেরি করা ঠিক হবে না।

লায়লাকে নিয়ে সুদীপ্তবাবুর স্ত্রী, মেয়ে চলে যায়। বাদল ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন থমকে যায়। তার মনের মধ্যে তখন তীব্র দ্বন্দ্ব! পরিচয় পালটাতে হবে! শেষপর্যন্ত নিজের পরিচয় পালটে ফেলে এ দেশের নাগরিক হয়ে উঠতে হবে! আজ পর্যন্ত সে কখনও মিথ্যে বলেনি। মিথ্যেবাদীদের ঘৃণা করেছে। ছাত্রদের বারবার বলেছে, নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া মিথ্যে বলবা না। মিথ্যে কথা হচ্ছে তাসের ঘরের মতো। সত্য যখন এসে একটা টোকা দেয়, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে!

সেই বাদল আজ নিজেই মূর্তিমান মিথ্যে! মিথ্যের একটা বিশাল বুদবুদের ওপর দাঁড়াতে হবে তাকে। যদি কোনওমতে একটা খোঁচা খেয়ে সে বুদবুদ ফেটে যায়, তবে কোথায় দাঁড়াবে সে!

শুনছ? লায়লা এসে দাঁড়িয়েছে। বাদল তার দিকে তাকায়। লায়লার মুখে উদ্বেগের চিহ্ন! তার চোখে কাতর মিনতি, একটু শুনবা?

বাদল উঠে তার কাছে যায়। লায়লা হাত তুলে দেখাল। তাকে হাতে শাঁখা-পলা পরিয়ে দিয়েছে এ বাড়ির মেয়েরা। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে বিরাট পাপ করে ফেলেছে।

কী হয়েছে?

বলছি… সে আমতা আমতা করে বলে, ওরা বলছে সিঁদুরও পরতে হবে। কিন্তু আমি মোছলমান! গুনাহ হবে…!

বাদলের চোখে মুহূর্তের মধ্যে সংশয় ভেসে ওঠে। কিন্তু আচমকা চোখটা রূপসার দিকে চলে গেল। রূপসা তখনও নিস্তেজ। ছোট্ট শুকনো দেহটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। যন্ত্রণায় ক্রমাগত নীল হয়ে যাচ্ছে সে।

বাদল এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল। বোধহয় কিছু স্থির করার চেষ্টা করছে। তার কপালের শিরা ফুলে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে দ্বিধা, কুণ্ঠা সৎ সাঁৎ করে ছাপ ফেলে গেল তার মুখে। তারপর যখন চোখ খুলল তখন অদ্ভুত একটা স্থির জেদ দৃষ্টির মধ্যে প্রকট। সে কিছু না বলে সিঁদুরের কৌটো নিয়ে এসে খানিকটা সিঁদুর আঙুলে তুলে লায়লার সিঁথিতে দিয়ে দিল!

একটা চিৎকার লায়লার গলা দিয়ে বেরোতেই যাচ্ছিল। কিন্তু সে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বিধ্বস্ত, ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন বলতে চাইছে, কী করলে!…এ কী করলে…!

বাদল একটা সজোর শ্বাস টানে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, আজ বাংলায় যত বাঙালি মুসলমান আছে, তার বেশির ভাগই তুর্কি আক্রমণের আগে হিন্দু ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষও হিন্দু ছিলেন। কিন্তু তুর্কি আক্রমণের সময় নিজের ও নিজের পরিবারের প্রাণ বাঁচাতে সবাই হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম নিয়েছিলেন! তোমাকে হিন্দু হতে কেউ বলছে না। কিন্তু রূপসার জন্য তুমি কি সিঁদুরও পরতে পারবা না!

লায়লা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে থরথর করে কাঁপছে। সম্ভবত উদগত অশ্রুকে থামানোর চেষ্টা করছে। বাদলের চোখ-মুখের পেশি তখনও কাঁপছিল। তবু জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল, এখন তুমি মুসলমানের বিবি নও। তুমি রূপসার মা। ওটাই তোমার ধর্ম! আল্লা দোষ নেবেন না। কোনও গুনাহ হবে না। কোনও গুনাহ হবে না!

শেষ কথা দুটো সে বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে গেল। যেন একা লায়লাকে নয়, নিজেকেও একই কথা বোঝাচ্ছে!

রূপসাকে হাসপাতালে ভরতি করতে অবশ্য অসুবিধে হল না। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সুদীপ্তবাবুর এখানে বেশ পরিচিতি আছে। এই হাসপাতাল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ওঁর প্রপিতামহের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। তার ওপর ওঁর বাবা স্বদেশি করতেন। ফলে একটা ভক্তিমিশ্রিত সম্ভ্রমের জায়গা এখনও আছে। তাই ওঁর সঙ্গে বাদলরা পৌঁছোতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিন্দুমাত্র বাক্যব্যয় না করে রূপসাকে ভরতি করে নিল। প্রায় নিমেষেই শুরু হয়ে যায় ট্রিটমেন্ট! অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হল তাকে। ড্রিপও চলতে শুরু করল।

বাদলের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করছিল লায়লা। মানুষটা চিরকালই খুব দৃপ্ত চরিত্রের। তার প্রতিটি পদক্ষেপ, চলাফেরা, আচার ব্যবহারে অদ্ভুত একটা শক্তির ছাপ আর আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব যেন ইচ্ছামতীর ওপারেই ভুল করে ফেলে এসেছে বাদল। এখন তার জায়গায় যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে আগের বাদল নয়! বরং কুণ্ঠিত, বিব্রত একজন মানুষ। হাসপাতালের লোকদের যে-কোনও প্রশ্নেই কুঁকড়ে যাচ্ছে কোনও অনুরোধ করতে বিব্রত বোধ করছে। হাসপাতালের রেজিস্টারে নিজের নাম সই করতে গিয়ে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। নাম সই করার সময় হাত কেঁপেও গেল তার! দেখলে মনে হচ্ছে অনেক বড় পাপ করে ফেলেছে সে৷ যেন অন্যের ধন চুরি করেছে বা করতে চলেছে।

রূপসার তখনও ঘোর কাটেনি। সে ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকায়। ড্রিপের ফোঁটার দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। তার ক্লান্ত চোখ বোধহয় কিছুই টের পাচ্ছে না। বিড়বিড় করে বলল, কেন তাড়িয়ে দিল ওদের? কেন তাড়িয়ে দিল আমাদের? কেন জোড়া লাগল না? আমি যাব না…!

জুনিয়র ডাক্তার ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কথাগুলোর মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করছে হয়তো। রূপসা তখনও বহুদূর থেকে একটা ভেঙে যাওয়া দেশের দিকে তাকিয়ে আপনমনে কান্না জড়ানো গলায় প্রশ্ন করে চলেছে, কেন ভেঙে গেল? কেন ভেঙে গেল…জোড়া লাগিয়ে দাও না…!

বাদল ভয়ে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রূপসা প্রলাপের মধ্যে যদি উলটোপালটা বলে বসে! জুনিয়র ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল উৎকণ্ঠায়, ভয়ে মানুষটা বিবর্ণ হয়ে গেছে।

চিন্তা করবেন না কনফিউশন হচ্ছে। তরুণ ডাক্তারটি আশ্বস্ত করে, হার্টের প্রবলেমে এমনই হয়। ঠিক হয়ে যাবে।

বারো বছরের বালিকা তখনও হয়তো ভাঙা হৃদয়টাকে জোড়া লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। অনেক প্রচেষ্টার পরও জোড়া লাগছে না। সেটা কান্না মাখা কণ্ঠে কোন অজ্ঞাতের উদ্দেশে সে বলেই চলেছে, জোড়া লাগে না যে! কিছুতেই জোড়া লাগছে না!…

.

জেনানা ফাটকের বন্দিনীর রাতে ঘুম হচ্ছিল না। বহুদিন হল ঘুমোয়নি সে। ঘুমের নামে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেছে। অনেক রাত। বারবার নিজের মনকে খুঁড়ে চলেছে। বারবার প্রশ্ন করে চলেছে পরম করুণাময়কে। কী অন্যায় হয়েছে তার? কোন অপরাধে এত বড় শাস্তি দিলেন আল্লাহ! কী গুনাহ করেছে সে? মানুষ হয়ে জন্মে যতটুকু পুণ্য করা সম্ভব, ততটা করার চেষ্টা করেছে। ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করেছে। নিরুপায়, বিপন্ন মানুষকে সাধ্যমতো সাহায্য করেছে। সে এক আদর্শ পত্নী ছিল! এক আদর্শ মা!…তবে?…

না! আমি ওকে চিনি না!

আচমকা কয়েকটা শব্দ এসে যেন সপাটে চাবুক মারল তাকে। কেঁপে উঠল সে। গুনাহ হয়েছে! হ্যাঁ, গুনাহ হয়েছে! সে অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য! মেয়েটি হা হা করে কেঁদে ওঠে! হায় আল্লা! এই অপরাধের এত বড় শাস্তি! শুধু কথাগুলো বিচার করেই নিদান দিলি নিষ্ঠুর! বারবার কপালে করাঘাত করতে করতে সে মাটির ওপরেই লুটিয়ে পড়ে।

…সেই সত্য হল! সে যে মিথ্যা কতদূর
তখনি শুনে কি তুমি বোঝ নি ঠাকুর!
শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা!
শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা।

তখন ভরদুপুর। বাদল আর লায়লা হাসপাতালের ওয়েটিং হলে বসে ছিল সুদীপ্তবাবু কিছুসময়ের জন্য বাড়ি গিয়েছিলেন কোনওমতে দুটো ভাত নাকে-মুখে গুঁজে আবার চলে এসেছেন। ওদের জন্যও টিফিন ক্যারিয়ারে করে ভাত, ডাল, ডিম-আলুসেদ্ধ নিয়ে এসেছেন। বাদল প্রথমে কিছুতেই খেতে রাজি হয়নি।

সে বলেছে, যার সন্তান হাসপাতালে খাবি খায়, সেই বাপ-মার। মুখে কি ভাত ওঠে দাদাভাই?

বুঝি। সুদীপ্তবাবু বলেন, কিন্তু এখন তোমাদেরও সুস্থ থাকতে হবে। কাল থেকে না খেয়ে আছ। সকালেও কিছু খাওনি। না খেয়ে তোমরাও যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো। তবে রূপসার জন্য লড়াই করবে কে?

বহু অনুনয়-অনুরোধ-উপরোধের পর বাদল দুমুঠো ভাত খেল। লায়লাকেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুগ্রহণ করানো হল। প্রাথমিক কর্তব্য সমাপন করে একটু চা-সিগারেট খেতে বাইরে বেরিয়ে গেলেন সুদীপ্ত। বাদলরাও চেয়ারে গিয়ে বসল! তখনই আচমকা কোথা থেকে এক বিপদ এসে হাজির! হঠাৎ ওদের চোখের সামনে দিয়ে এক ভারতীয় সীমান্ত প্রহরী দ্রুতবেগে হাসপাতালে ঢুকল। বাদল আঁতকে ওঠে। তার হাত থেকে ভাতের বাটিটা মেঝেতে পড়ে যায়। গোল বাটিটা গড়িয়ে ঢুকে গেল চেয়ারের নীচে!

ইধার এক ছোটি সি লড়কি অ্যাডমিট হুই হ্যায় না? ভারতীয় জওয়ান প্রশ্ন করছে এনকোয়ারিতে, শায় আজ হি সুবহ কো উয়ো অ্যাডমিট হো চুকি হ্যায়। উয়ো লড়কি কিধর হ্যায়?

ওদের তিনজনেরই বুকের ভিতরটা ধড়াস করে ওঠে। লোকটা কি রূপসার খবর নিচ্ছে? কী সর্বনাশ! তবে কি এই বেআইনি অনুপ্রবেশের কথা ওপরমহল জেনে ফেলেছে! জানল কী করে? ওরা তো যথেষ্ট সাবধানে এসেছে। তবে? নিশ্চয়ই কেউ কিছু সন্দেহ করেছে। নয়তো শুকে শুঁকে বের করল কী করে?

এনকোয়ারিতে থাকা লোকটি অবাক হয়ে জওয়ানের দিকে তাকায়। কেন ভাই, কোনও গড়বড় আছে নাকি? নাম কী পেশেন্টের?

নাম হাম কো মালুম না আছে। সীমান্তরক্ষী ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে, আজ সুবহ কো আয়ি হ্যায়। শায়দ ছোট লড়কি!

এনকোয়ারির লোকটা একবার সন্দেহজনক দৃষ্টিতে উঁকি মেরে বাদলদের দিকে তাকাচ্ছে। বাদল কুঁকড়ে গেছে। যেন এইমুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলে বাঁচে। লায়লা ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকেছে।

দেখুন তো ওই বাচ্চা মেয়েটা কি না৷ এনকোয়ারির লোকটা বলল, লেফট সাইডের থার্ড ঘরটার ফাস্ট বেড।

জওয়ান গটগটিয়ে সেদিকেই চলে গেল। আর অদ্ভুত উৎকণ্ঠা নিয়ে ওরা অপেক্ষা করছে। এই বুঝি লোকটা ফিরে এল! ফিরে এসেই তাদের অনুপ্রবেশকারী বলে ধরিয়ে দেবে নিশ্চিত!

অসম্ভব ভয়ে দুজনেরই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কাউন্টারের লোকটা কুটি করে কী যেন ভাবছিল। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে বলল, শুনুন।

বাদল আরও কুঁকড়ে গেল। লায়লা স্থান, কাল পাত্র ভুলে খপ করে চেপে ধরেছে তার হাত। দুজনের হাতই ঘেমে নেয়ে একসা!

লোকটা এগিয়ে এসেছে। বাদল চোখ কুঁচকে তাকে দেখছে। ভদ্রলোকের ভুরুতে সন্দেহের ভাঁজ, আপনারা কি সত্যিই সুদীপ্তবাবুর আত্মীয়?

চট করে এত বড় মিথ্যে কথা বলতে পারে না সে। তার কণ্ঠার হাড় নড়ে ওঠে। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোতে চাইছে না! বরং সে অপরাধী, কুণ্ঠিত দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

বাই এনি চান্স, আপনারা বাংলাদেশ থেকে আসেননি তো? অ্যাঁ? তার গলায় গাঢ় সন্দেহ, ওই জওয়ানের কাছে খবর আছে যে কাল রাতে একটা ট্রেসপাসিং হয়েছে। আর বাংলাদেশি মেয়েটি এখানেই অ্যাডমিটেড। আজ সকালেই নাকি ভরতি হয়েছে। আজ সকালে তো একমাত্র আপনার মেয়েই…!

লায়লা কেঁপে ওঠে। ভারতীয় জওয়ান দেখেই তার গলা শুকিয়ে এসেছিল। প্রাণ ধড়ফড় করছে! বাদল কিছু বলার আগেই সে যন্ত্রের মতো তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল, না… বাংলাদেশের কোনও মেয়েকে আমি চিনি না। আমি চিনি না!

বাদল লায়লার হাত ছেড়ে দেয়। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সরে দাঁড়িয়েছে সে! যেন চোখের সামনে ফণা তোলা সাপ দেখেছে! দুচোখে প্রবল বিস্ময়ের সঙ্গে প্রচণ্ড তিরস্কার! প্রবল ভৎর্সনার সঙ্গে লায়লাকে দেখছে! তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এই লায়লাকে সে চেনে না।

.

অর্জুন সিং রাওয়াতের কাছে সত্যিই খবর ছিল যে কাল রাতে একটা বে-আইনি অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ওপরমহল থেকে অর্ডার এসেছে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার। যদিও টিপটা সত্যি কি মিথ্যে জানা ছিল না। তবু সাহেবদের আদেশ যখন এসেছে, তখন পালন করতেই হবে।

টাকি হাসপাতালে পা রেখেই সে বুঝে গিয়েছিল খবরটা সত্যি। অন্তত বাইরে এই মুহূর্তে যে দুজন দাঁড়িয়ে আছে তাদের ফ্যাকাশে মুখ নজর এড়ায়নি তার। তবু সম্পূর্ণ ঘটনাটা না বুঝে, ঠিকমতন যাচাই না করে কোনওরকম সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। তাই সে গটগটিয়ে এগিয়ে গেল হাসপাতালের নির্দিষ্ট ঘরের দিকে। বাঁ দিকের তৃতীয় ঘরটার প্রথম বেডটার দিকে কৌতূহলী চোখে একঝলক তাকাল অর্জুন!…

সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল, গোটা আকাশটা তার মাথায় ভেঙে পড়েছে। বিস্মিত, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ছোট্ট অচেতন দেহটার দিকে! অপলক, নির্বাক! বিস্ময়ে তার মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোয় না! কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় অর্জুন সিং রাওয়াত! বুকের ভিতরে যেন কিছু ভেঙে যাওয়ার শব্দ! এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখছে। তার দেহ যেন কিছুক্ষণের জন্য স্খলিত হয়ে যায়। মনে হয় বোধহয় পড়ে যাবে। পরক্ষণেই সামলে নেয় সে। বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে অবশেষে ফেরার পথ ধরে! কিন্তু যে অহংকারী, উদ্ধত ছন্দে হেঁটে গিয়েছিল, অবিকল তার বিপরীত ভঙ্গিতে সে ফিরছে। মনে হচ্ছে পা দুটো কয়েকমন ভারী! যেন কোনওমতে শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে অতিকষ্টে চলেছে মানুষটা।

অদ্ভুত একটা বিভাজনের কেন্দ্রস্থল মনে হচ্ছিল নিজেকে। একদিকে বিশ্বস্ত সিপাইয়ের কর্তব্য, অন্যদিকে মানবিকতার হাহাকার! মিট্টি অসুস্থ। সে যে বাংলাদেশের মেয়ে, অনুপ্রবেশকারী, তা তার চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। বাংলাদেশি জঙ্গিদের বিস্ফোরণে ও নানাবিধ আক্রমণে পর্যুদস্ত ভারতের বিশ্বস্ত সৈনিক হিসাবে তার কর্তব্য, এখনই এই অনুপ্রবেশকারীদের বামালসমেত চিহ্নিত করা ও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া!

কিন্তু মিট্টি? তার কী হবে? ব্যথায়, যন্ত্রণায় মেয়েটা যে নীল হয়ে গেছে। তার অসুস্থতা যে রীতিমতো সিরিয়াস। তা এইমুহূর্তেই নিজের চোখে দেখে এল অর্জুন। যদি ধরা পড়ে তা হলে তার পরিণতি কী? জেলের হাসপাতালে কি শেষে পুঁকতে ধুঁকতে মরবে? ওইটুকু মেয়েটা জানবেও না কোন অপরাধে এতবড় শাস্তি হল! আর সেই দণ্ডাদেশ কি বয়ে নিয়ে আসবে তার মিতা? অর্জুন কি নিজের হাতে লিখে দিতে পারে মিট্টির মৃত্যুর পরোয়ানা!

ভাবতেই শিউরে উঠল সে। বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। সে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দেওয়ালে অবসন্নের মতো পিঠ ঠেকিয়ে ব্যথিত দৃষ্টিতে ভাবছে, কী করবে। মিথ্যে কথা বললে ভারত সরকারের কাছে অবিশ্বস্ততার দায় বইতে হবে আজীবন। সত্যি কথা বললে ওই পুঁচকি সন্তানসম মেয়েটার কাছে অপরাধী…! কী করবে? কী করবে?

অর্জুন সজোরে নিশ্বাস টানে। স্থলিত মুহূর্তগুলো সামলে নেয়। কী করবে সে ভেবে নিয়েছে। দ্রুত ছন্দ ফিরে পায়। গটগট করে এগিয়ে যায় করিডর বেয়ে। তার কানে তখনও বাজছে তারই নিজের কণ্ঠস্বর। সে নিজের দেশের প্রতি আমৃত্যু বিশ্বস্ত থাকার শপথ নিয়েছিল!

.

বাদল তখনও কাউন্টারের লোকটার প্রশ্নবাণে জর্জরিত! সুদীপ্ত তার কে হয়, টাকিতে কেন এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। পুলিশের মতো ছড়বেছড় প্রশ্ন করে চলেছে। বাদল একটাও জবাব দিতে পারছে না। ফলস্বরূপ ক্রমাগত সন্দেহ বেড়ে চলেছে লোকটার।

আপনার বাড়ি কোথায়?

বাদল ঢোঁক গিলল। কোনওমতে বলল, হুগলিতে।

এ কথাটা মিথ্যে নয়। একসময় তাদের আদিবাড়ি হুগলিতেই তো ছিল। লোকটা বাঁকা চোখে তাকায়, হুগলিতে বাড়ি তো চিকিৎসার জন্য টাকিতে এসেছেন কেন? হুগলিতে ভাল হাসপাতাল নেই?

বলাই বাহুল্য বাদল অসহায়ের মতো তাকায়। এই প্রশ্নের কী জবাব দেবে? সুদীপ্ত দাদাভাই কাছে থাকলে তবু কিছু জবাব দিতে পারতেন। কিন্তু তিনিও যে ঠিক এই মুহূর্তেই কোথায় গেলেন…!

আপনাদের আই ডি কার্ড দেখান তো। বাদল বুঝতে পারল সে একেবারে খাদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। পিছনে আর কিছু নেই! অন্তহীন অন্ধকারে ডুবে যেতে চলেছে তার, লায়লার ও রূপসার ভবিষ্যৎ! সে সভয়ে সম্বলহীনের মতো তাকিয়ে থাকে।

ভাইসাব।

পিছন থেকে গটগট করে আর্মি বুটের শব্দ এগিয়ে এল। পরক্ষণেই অর্জুন সিং রাওয়াতের কণ্ঠস্বর। বাদলের বুকে দামামা বাজছে। এখনই ধরিয়ে দেবে লোকটা। এখনই বলবে ও অনুপ্রবেশকারী।

ভারতীয় জওয়ান সামনে এসে দাঁড়াল। বাদলদের দিকে ফিরে তাকালও না। কাউন্টারের লোকটার দিকে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে বলল, সব ঠিক হ্যায়, ইয়াহা পে কোই ট্রেসপাসার নেহি হ্যায়। শায়দ ইনফরমেশন গলত থি।

কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়েই গটগট করে চলে গেল সে। একবার ফিরেও তাকাল না। বাদল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার গমনপথের দিকে।

.

০৮.

বিকেলে বাড়ি ফিরে সুদীপ্ত আর একটি কথাও বলেননি। বরং বিকেল থেকেই মদ্যপান করতে শুরু করেছেন। অন্ধকার ঘরে বসে থম হয়ে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনছেন। হেমন্তবাবুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুর এই একটিই মিল। দুজনেই শাস্ত্রীয়সংগীত শুনতে ভালবাসেন। তবে হেমন্তবাবুকে আজ পর্যন্ত মদ্যপান করতে দেখেনি বাদল। সুদীপ্ত সেদিক দিয়ে বন্ধুকে টেক্কা দিয়েছেন।

বাদল সুদীপ্তকে যত দেখছিল ততই অবাক হচ্ছিল। হেমন্তবাবুর সঙ্গে তাঁকে যেমন দেখেছিল, ঠিক তেমন নন। প্রথম প্রথম তাঁকে উদার বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, লোকটি একটু একটু করে অন্যরূপ ধরছেন! অদ্ভুত খামখেয়ালি মানুষ! প্রথমে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই বাদলের মিথ্যে কথা না বলতে পারার জন্য লম্ফঝম্প শুরু করলেন। উত্তেজিত হয়ে বললেন, তোমরা কিছুতেই শুধরোবে না। বারবার বলে দিলাম এখানে প্রায়ই রেড হয়। বর্ডার এরিয়া। তার ওপর জামাত জঙ্গিদের বিস্ফোরণের জন্য আইন কানুন আরও কড়া হয়ে গেছে। তবু আরেকটু হলেই ধরা পড়ছিলে। তুমি যেরকম সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, তাতে ডোবানোর জন্য তুমি একাই যথেষ্ট। মিথ্যে কথাটাও ঠিকমতো বলতে পারো না! নেহাত জওয়ানটার চিনতে ভুল হয়ে গেছে। তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলে!

বাদল জানত, চিনতে ভুল করেনি জওয়ান। ঠিকই চিনেছে। কিন্তু অজানা কারণে সত্যিটাকে সে চেপে গেল। কেন গেল তা এখনও অজানা!

তারপর থেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন ভদ্রলোক। বাদল শুধু আড়চোখে লক্ষ করল। বাড়িতে ঢুকেই তিনি টিফিন ক্যারিয়ারটা তাঁর স্ত্রীকে ধরিয়ে দিয়েই বললেন, এটা মেজে একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিয়ো!

বাদল ও লায়লা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এঁটো করেছে বলেই কি গঙ্গাজলের ব্যবস্থা হল? বাদল সামান্য অপমান বোধ করলেও প্রকাশ করে না।

যাও, জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে নাও। সুদীপ্ত বললেন, আজকের মতো আর কিছু করার নেই। কাল সকালে ভিজিটিং আওয়ার্সে ফের যেতে হবে। বলেই শেষ কথাটা জুড়লেন, আর শোনো, ডানদিকের সেকেন্ড ঘরটায় তোমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। কিন্তু ভুলেও পরের ঘরটায় ঢুকবে না। ওখানে আমার রাধা গোবিন্দ আছেন।

যে কেউ এতে চূড়ান্ত অপমানিত বোধ করবে। কিন্তু এখন ওদের সমস্ত সূক্ষ্ম বোধগুলো বোধহয় ভোঁতা হয়ে আসছে। এখনও পর্যন্ত রূপসার অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। সে ঘোরের মধ্যে রয়েছে। আগে তবু বিড়বিড় করছিল। এখন একদম চুপ। বিকেলে তার পীতাভ যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে বাদলের ভীষণ কান্না পেয়ে গিয়েছিল। রূপসা এক ফাঁকে চোখ খুলে তাকিয়েছিল। কিন্তু সে দৃষ্টিতে কী ভয়ংকর শূন্যতা! কাউকে চিনতে পারেনি। তারপর আবার পরম ক্লান্তিতে চোখ বুজে ফেলেছিল।

বাদল এখনও রূপসার সেই শূন্য দৃষ্টি ভুলতে পারছে না! কী অসহায়তা ছিল তার চোখে! ডাক্তার-নার্সদের গম্ভীর মুখ দেখে থেকে থেকে তার বুক কেঁপে উঠছিল। নিজেকে কী প্রচণ্ড অক্ষম মনে হচ্ছে! অপেক্ষা করা ছাড়া তার কি কিছুই করার নেই। থেকে থেকে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠছে। আবার তীব্র হতাশা ঘিরে ধরছে তাকে! তাই এখন মান-অপমান বোধটুকুও আর অবশিষ্ট নেই তার।

লায়লাও হাসপাতাল থেকে ফেরার পর গুম মেরে গেছে। আনমনে কী যেন ভেবে চলেছে। সুদীপ্তবাবুর স্ত্রী একটু আগেই থালায় করে নৈশাহার দিয়ে গেছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউই খাবারের থালা স্পর্শ করেনি। বিছানায় বসে দুজনেই দুরকম চিন্তায় মগ্ন। লায়লা চুপ করে বসে আছে। বাদল হেমন্তবাবুর দেওয়া টাকাগুলো গুনছে। রূপসাকে ভরতি করতেই টাকার অধিকাংশ খরচ হয়ে গেছে। কাল যদি আবার ওষুধের খরচ বাবদ টাকা দিতে হয় তবে সমস্যায় পড়বে। ইন্ডিয়ান নোট খুব কমই আছে। এখন বাংলাদেশি টাকাই ভরসা।

বাদলের কপালে ভাঁজ। এই টাকায় হবে না। হেমন্তবাবু বলেছিলেন সুদীপ্ত টাকা এক্সচেঞ্জ করিয়ে দিতে পারেন। চিন্তায়, উদ্বেগে জর্জরিত হয়ে এতক্ষণ সে প্রসঙ্গ তুলতে পারেনি। কিন্তু এখন ওঁর সঙ্গে কথা বলতেই হবে।

সুদীপ্ত তখন নিজের ঘরে বসে মালকোষ শুনছিলেন। ঘর অন্ধকার। শুধু ভদ্রলোকের রকিং চেয়ারসুদ্ধ আবছা ছায়া দেখা যাচ্ছে। এই প্রাচীন বিরাট ঘরে তাঁকে অতৃপ্ত প্রেতাত্মার মতো দেখাচ্ছিল! বাদল কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। এখন কিছু বলা উচিত কি না বুঝে উঠতে পারছে না।

কিছু বলবে?

গম্ভীর নেশাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন এল। বাদল একটু ইতস্তত করে বলল, একটু দরকার ছিল দাদাভাই।

প্রসিড।

নিজের সমস্যার কথা খুলে বলল সে। সুদীপ্ত অপ্রকৃতিস্থ ভাবে হেসে ওঠেন, হেমন্ত বলেছে যে আমি টাকা এক্সচেঞ্জ করিয়ে দিতে পারি। এটা বলেনি যে বাংলাদেশি টাকা চোরাপথে এক্সচেঞ্জ করাতে গেলে অনেক কমে যায়? কত টাকা এনেছ শুনি?

বাদল টাকার অঙ্কটা বলল। তিনি আবার হাসলেন, কিস্যু হবে না। ইন্ডিয়ায় চিকিৎসার খরচ সম্বন্ধে তোমার কোনও ধারণাই নেই। দেখতে না দেখতেই নোটের বদলে হাতে হারিকেন এসে যাবে। তার ওপর যে টাকা এনেছ, হাফ হয়ে যাবে। কিস্যু হবে না ওতে… এত সামান্য পুঁজি নিয়ে এখানে আসা কেন বাপু? তোমাদের দেশে হাসপাতাল নেই? ডাক্তার নেই?

সে কী বলবে ভেবে পায় না! সুদীপ্ত একটু থেমে বলেন, একসময় সবই ছিল। ভাল ডাক্তার, ভাল চিকিৎসা ব্যবস্থা– সব ছিল। কিন্তু এখন নেই। কেন নেই জানো?

বাদল নিরুত্তর। সুদীপ্তকে অন্ধকারে দেখা যায় না। কিন্তু অদ্ভুত এক উম্মা, আক্রোশ তাঁর কণ্ঠস্বর চুঁইয়ে পড়ল, কারণ নিজের হাতে তাদের কেটে সাফ করেছ তোমরা! ইউ ফিলদি অ্যানিমলস! ব্লাডি মুসলিমস! ব্রাইট ও প্রমিসিং ডাক্তারদের খাড়া হাতে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছ! কখনও বরিশালের দাঙ্গায়, কখনও নোয়াখালিতে! তাদের একমাত্র অপরাধ তারা হিন্দু ছিল! বাংলাদেশের মাটি ভাসিয়ে দিয়েছ কতগুলো নিরপরাধ ইয়ং, ব্রাইট ছেলের রক্তে! তোমাদের কখনও ভাল হতে পারে? কোনওদিন হবে না! বাংলাদেশ ইজ আ কার্সড ল্যান্ড! আর তার জন্য দায়ী তোমরা। ইয়েস, ইউ। ওনলি ইউ! ইউ মুসলিম!

বাদল হতবাক। এই আচমকা আক্রমণের উত্তরে কী বলবে ভেবে পায় না। পুরোপুরি অপ্রস্তুত! স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কী অদ্ভুত রাগ ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে! চাপা আক্রোশে হিসহিস করে বললেন, হিটলার ইহুদিদের কচুকাটা করেছিলেন কেন জানো? হিটলার তো নিমিত্তমাত্র। ইট ওয়াজ দেয়ার ফেট! জেসাস ক্রাইস্টের খুনের দায়ভার নিয়েছিল তারা। দে ওয়াজ কার্সড লাইক ইউ! হিটলার ওদের কিলোদরে খুন করে যিশুর রক্তের শোধ তুলেছিলেন। বেশ করেছিলেন। তোমাদেরও তাই করা উচিত! কী করতে বাকি রেখেছে তোমাদের পূর্বপুরুষেরা! ধর্মের ঝান্ডা তুলে বাংলাদেশকে মুসলিমপ্রধান দেশ ঘোষণা করতে চেয়েছে! জানো? জানো কী করেছ তোমরা? উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। নেশায় অল্প অল্প টলছেন। অথচ বাদলকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চললেন ভেতরের দিকে। যে রাধাগোবিন্দের ঘরে ঢুকতে একটু আগেই নিষেধ করেছিলেন, সেই রাধাগোবিন্দের ঘরের দরজা একধাক্কায় খুলে দিয়ে বললেন, দেখো! দেখো!

রাধাগোবিন্দের মূর্তির সামনে এক মহিলা স্থির হয়ে বসেছিলেন। তাঁকে দেখলেই গা শিরশির করে। অবিকল প্রাচীন ডাইনিবুড়ির মতো দেখতে তাঁকে! শনের দড়ির মতো সাদা চুল! লোলচর্ম বৃদ্ধা! চোখে সম্ভবত একেবারেই দেখতে পান না। দরজা খোলার শব্দ শুনেই সাদা চোখের মণি কাঁপল তাঁর! কাঁপা গলায় বললেন, মানিক, আইসো বাবা?

বাদল বুঝতে পারছিল না কে এই ভদ্রমহিলা! এবং মানিকটাই বা কে?

ইনি আমার জ্যেঠাইমা! সুদীপ্ত অসম্ভব রাগে থরথর করে কাঁপছেন। নেশায় আরক্ত চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, আমার মা ভাগ্যবতী ছিলেন। আমাকে নিয়ে এ পারে চলে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু আমার জেঠু পারেননি। বরিশালে তোমরা মুখোশ পরে, ঘুঙুর পরে নেচে নেচে কেটেছ ওদের! সেরাতে জেঠুকে তোমরা এক কোপে কেটেছিলে! জেঠাইমাকে নিয়ে কোনওমতে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল মানিক। আমার জেঠতুতো দাদা। ব্রাইট ডাক্তার ছিল সে। খুব পশার ছিল! বেঁচে থাকলে তার প্রচুর নামডাক হত। সেই মানিককেও ছাড়োনি তোমরা! জেঠাইমাকে পুকুরে ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকতে বলে সে প্রাণ বাঁচাবার জন্য গাছের মগডালে চড়ে বসেছিল। সেই গাছ থেকে তাকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে খণ্ড খণ্ড করে কেটেছ। তারপর তার মুন্ডু তরোয়ালের ডগায় উঁচিয়ে ধরে নির্লজ্জ পিশাচের মতো নেচেছিলে! কী দোষ ছিল তার? সে তো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার চিকিৎসা করত! তোমাদেরই সুস্থ করে তুলত সে! আমার জেঠু স্বদেশি আন্দোলনে জেল খেটেছিলেন। বাংলাদেশের মাটির জন্য তাঁরা নিজেদের ঘাম, রক্ত, বিদ্যা বুদ্ধি সব দিয়েছিলেন! তবু তাঁদের কচুকাটা করলে তোমরা! হোয়াই? হোয়াই? তাঁদের কী পাপ? তাঁরা হিন্দু বংশে জন্মে কী এমন অপরাধ করেছিলেন? তবে কেন? হোয়াই? হোয়াই?

বলতে বলতেই হা হা করে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন সুদীপ্ত! অন্ধ ভদ্রমহিলা ফের চোখ পিটপিট করে ডেকে উঠলেন, মানিক? অ মানিক? আইলি?

ওঁর প্রশ্নের জবাব দাও। টেল হার দ্যাট ইউ কিলড হার ওনলি সান! জড়ানো, বিকৃত গলায় বললেন সুদীপ্ত। পরের দিন সকালে একদল পলায়নরত হিন্দু উদ্বাস্তু উদ্ধার করে ওঁকে। তখনও উনি ছেলের অপেক্ষায় বসে আছেন। মানিক বলে গিয়েছিল, একটু পরেই আসছি মা! সেই আশ্বাসকে বেদবাক্য করে উনি আজও মানিকের জন্য অপেক্ষা করেন! এখনও আমি কিছুতেই ওঁকে বোঝাতে পারি না যে মানিক আর কখনও আসবে না! বয়েস একশো বছর ছাড়িয়েছে। কিন্তু মানিকের আসার আশায় আজও মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রেখেছেন! মরার বয়েস হয়েছে বহুদিন হল, কিন্তু শান্তিতে মরতেও পারছেন না! তুমি পারবে বোঝাতে? পারবে বলতে যে ওঁর ছেলেকে টুকরো টুকরো করে কেটেছ তুমি? বলতে পারবে যে…! সুদীপ্ত আর কথা বলতে পারেন না। বাদল ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতে পারছে না! সুদীপ্তর কণ্ঠস্বরের জ্বালা তাকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিল!!

ভদ্রমহিলা আবার কঁকিয়ে ওঠেন, অ মানিক!

ইউ ফিলদি অ্যানিমল্‌স্‌! তিনি এবার দরজাটা বন্ধ করে উদ্যত তর্জনী উঁচিয়ে ধরেন বাদলের দিকে, কী করে ভাবলে এ দায়ভার থেকে তোমরা রক্ষা পাবে? ইউ আর কার্সড! এই রক্তের দাম তোমরাও বংশানুক্রমে শোধ করবে! রক্ষা পাবে না! কেউ পার পাবে না। কেউ না!

পাথরের মূর্তিবৎ বাদলকে ওখানেই ছেড়ে টলতে টলতে চলে গেলেন সুদীপ্ত! বাদল ওখানেই বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল দাদামশাইয়ের বন্ধু আবদুল গণির লেখা শব্দগুলো।

…স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি সমগ্র বাঙালি জাতি দুইটি নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ হইয়া গেল। বাঙালি বলিতে আর কেহ রহিল না। রহিল হিন্দু, এবং রহিল মুসলমান।

সেইদিন ভোররাতে দুটো প্রাণী ওই বাড়ি থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছিল। বোঁচকা কুঁচকি নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল টাকি হাসপাতালের ওয়েটিং হলে। নিঃসঙ্গ, একা, বিপন্ন! দুটো নিরাশ্রয় মানুষ স্খলিত দেহে, অসহায়ের মতো মাথাটুকু খুঁজেছিল হাসপাতাল চত্বরে। তখন হাসপাতালের সুইপার সবে হাসপাতাল পরিষ্কার করতে শুরু করেছে, আর মেঝে মুছতে মুছতেই আপনমনে গাইছে।

দোষ কারও নয় গো মা…!

…দোষ কারও নয় গো মা/ আমি স্বখাতসলিলে ডুবে মরি শ্যামা…

লোকটা জেলারের দিকে সকৌতুকে তাকায়, স্বখাতসলিল বোঝেন? সেই স্বখাতসলিলেই ডুবে গেল দেশটা। সুদীপ্তবাবুকে দোষ দিতে পারি না। তিনি জানতেন না, এই বাংলায় এসেও আমরা নিরাশ্রয় কেন! আমার দাদামশাই তাঁর বন্ধুর উপদেশ মেনেছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্য ভাইয়েরা আশায় ছিলেন, ভাঙা দেশ আবার জোড়া লাগবে। তাই এই মাটি ছেড়ে যেতে চাননি। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার বাস্তবতাকে স্বীকার করতে পারেননি তাঁরা! ফলস্বরূপ কলকাতার মারাত্মক দাঙ্গায় হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী কিছু উন্মাদের হাতে মারা গেলেন সবাই। ভাঙা দেশ আর জোড়া লাগল না! সুতরাং সুদীপ্তবাবু আর আমি, দুজনেই একরকমের হতভাগা! বলতে বলতেই সে হাসল, আজ হিন্দুরা দেশবিভাগের জন্য মুসলিমদের দায়ী করে, আর মুসলিমরা হিন্দুদের। দুদলের দাঙ্গায় জওহরলাল বা জিন্না বা আজাদের কিছু হয়নি! মরেছি শুধু আমরা! বিহারে হিন্দুরা মুসলিমদের কাটল, পঞ্জাবে মুসলিমরা শুরু করল, তার উত্তরে খালসা শিখরাও নেমে পড়ল তরোয়াল হাতে। কলকাতায় আর বাংলাদেশে আমরা নিজেরাই নিজেদের কাটলাম!

লোকটা যেন ক্লান্তি বোধ করছে। সে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বুজল। জেলার সাহেব চুপ করে থাকেন। তিনি জানেন ও নিজের মর্জিমতো আবার নিজেই কথা বলবে।

সে কিন্তু আর কথা বলল না। চোখ বন্ধ করেই গেয়ে উঠেছে, আপনি কেটেছে আপনার মূল। না জানে সাঁতার, নাহি পায় কূল। স্রোতে যায় ভেসে, ডোবে বুঝি শেষে। করে দিবানিশি টলমল…!

গাইতে গাইতে তার দীর্ঘ দেহ জেলের লম্বা বিষণ্ণ করিডর বেয়ে উদাসীন, অন্যমনস্ক ছায়া ফেলে নিজের সেলের দিকে চলে গেল। তার কণ্ঠস্বর তখনও কারাগারে কারাগারে, দেওয়ালে, ছাতে অনুরণিত হয়ে বেজে চলেছে–

সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল/ তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল…!

.

০৯.

আমি ভাল হয়ে গেলে না ওই আকাশে ঘুড়ি উড়াব। কচি কণ্ঠ বলে ওঠে, মা-বাবা বলে, মেয়েরা নাকি ঘুড়ি উড়ায় না! বা-রে! মেয়েরা কেন ঘুড়ি উড়াবে না? মামাবাড়ি নাকি!

ঘুড়ি! উয়ো কী চিজ আছে? যাকে কথাটা বলা হল, সে মাথা চুলকে বলল, ঘোড়ার বিবি?

দূর মাউড়া! ঘুড়ি জানো না? ওই যে আকাশে ওড়ে। বিশ্বকর্মা পুজোর সময় দেখোনি? লাল নীল কত রংবাহারে ঘুড়ি!

এইবার ঘুড়ির আসল অর্থ বোঝা গেল, মানুষটা হেসে ফেলে, ও! পতঙ্গ!

ছোট মানুষটা কপাল চাপড়াল, হায় আমার কপাল! পতঙ্গ কেন হবে? তুমি কি স্কুলে পড়োনি? মশা, মাছি, প্রজাপতি– এগুলো হল পতঙ্গ। ঘুড়ি কেন পতঙ্গ হতে যাবে? মিতা, তুমি কিছু জানো না!

হাঁ! মিতা সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে একমত হয়ে যায়, উয়ো তো ঠিক বাত! হামি কিছু জানে না! একদম বেওকুফ আদমি আছি!

হি হি..! ছোট মেয়েটা হেসে বলল, হেমন্ত দাদাভাই থাকলে বলত, গণ্ডমুখ!

বেচারি মুখ লম্বাটে করেছে, হাঁ! সহি কঁহা! তারপর শোনো না! অবিকল কুলের আচার চেখে চেখে খাওয়ার মতো দুষ্টু দুষ্টু ভঙ্গিতে ছোট্ট মানুষটা বলে, আমি আমাদের মাটি থেকে তোমাদের আকাশে ঘুড়ি ওড়াব। এদেশ থেকে ওদেশ পর্যন্ত সব আকাশে ঘুড়ি উড়বে! আকাশের তো আর বর্ডার নেই! তাই না? বাবা বলেছে। পাখিদের পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। আর আমার বাবা কখনও মিথ্যে বলে না! তা হলে তো ঘুড়িরও পাসপোর্ট ভিসা লাগবে না, তাই না?

ভিজিটিং আওয়ার্সে ঢুকে রূপসাকে দেখে চোখ ছানাবড়া বাদলের। আপাতত সে একাই এসেছে। লায়লা এখনই আসতে চায়নি। কারণ এই মুহূর্তে তার সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখা-পলা। নতুন সাজে মাকে দেখে রূপসা আলটপকা কী মন্তব্য করে বসবে কে জানে! সেই ভয়েই সে প্রথমে আসেনি বরং বাদলকেই আগে পাঠিয়েছে।

এই মুহূর্তে অবশ্য রূপসা বিছানায় শুয়ে নেই। বরং উঠে বসেছে। সাময়িক অক্সিজেন খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার সেটা নয়। তার সামনে বসে আছে সেই ভারতীয় জওয়ান! আজ তার পরনে উর্দি নেই। স্বাভাবিক পোশাক। একজন সিভিলিয়ানের মতোই দেখতে এসেছে রূপসাকে। সে একব্যাগ ফল নিয়ে এসে হাজির। বাদলের কানে আসে সে নিচু স্বরে বলছে, আচ্ছা আচ্ছা ঘুড়া-ঘুড়ি সব উড়ানো হোবে। অভি বোলো, লাডো ক্যায়া খায়েগি?…এ-ফর অ্যাপল, বি-ফর বাত, সি ফর চাটনি, ডি ফর দাল…ক্যায়া খাবি? পি ফর পিয়ারা?

রূপসা খিলখিল করে হাসছে, ধুড় মাউড়া। ডি-এর পর পি আসে নাকি?

মাউড়া শব্দটা শুনে পুরো দৃশ্যটা এবার দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হল বাদলের কাছে। রূপসা বলেছিল তার এক মিতার কথা। সে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী। রূপসা তার জন্য রুমাল সেলাই করেছিল। তার সঙ্গে পানিত্তারের মেলায় বেড়াতেও গিয়েছিল। লোকটা নাকি মাউড়া। এবার বাদল বুঝল, এই সেই রূপসা বর্ণিত মিতা৷ আর এইজন্যই সেদিন সঠিক পরিচয় জেনেও সে গোপন করে গিয়েছিল। চুপ করে এই অনুপ্রবেশের কথা হজম করেছিল শুধু রূপসার জন্য!

সীমান্তরক্ষীর মুখ গম্ভীর, হামকো তো ইতনা হি মালুম! ডি কে বাদ কী আসে? অ্যাম ফর মা?

বাদলের মুখেও অদ্ভুত একটা হাসি ভেসে ওঠে। এতক্ষণের ভয়, জড়তা কেটে যায় এক নিমেষে। এই অদ্ভুত অথচ নিবিড় বন্ধুত্বকে ঈশ্বরও অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু মানুষ নিজের স্বার্থে করে।

মিতা, আমি এখানে থাকব না। রূপসা মুখ লম্বা করেছে, এটা বিচ্ছিরি জায়গা! বাড়ি যাব।

ঘর যাওগি না! পেহলে ঠিক তো হো যাও।

রূপসা অনিচ্ছাসূচক মুখভঙ্গি করে। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় সে। তার চোখ এতক্ষণে বাদলের ওপর পড়েছে। উফুল্ল হয়ে হেসে বলল, বাবা! এই দেখো মিতা!

অর্জুন সিং রাওয়াত পিছনে ফিরে বাদলকে দেখে বিব্রত বোধ করে। সে ওঠার উপক্রম করতেই বাদল তার হাত চেপে ধরেছে। তার চোখে অপরাধবোধ ও অনুনয়। অর্জুন চোখের ইশারায় বোঝায় ঠিক আছে। সে এতখানি বোকা নয় যে সংকটটা বুঝবে না। সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপ বৈঠিয়ে। ম্যায় থোড়া টহলকে আতা হু।

রূপসার জন্য মিষ্টি এনেছিল বাদল। কিন্তু রূপসার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে যতই উচ্ছল হোক, ক্লান্তিটা এখনও কাটেনি। বলল, খাব না। ভাল লাগছে না। আমি বাড়ি যাব। এখানে থাকব না বাবা!

তার পাশে কর্তব্যরত নার্সটি হেসে বলে, রেখে দিন, পরে খাবে। আর আপনাকে ডক্টর দত্ত একবার দেখা করতে বলেছেন। ভিজিটিং আওয়ার্সের পর ওঁর সঙ্গে দেখা করে যাবেন।

আচ্ছা। সে রূপসার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

কেসটা ক্রিটিক্যাল। ডক্টর দত্তর মুখ গম্ভীর, আপনার মেয়ের ইমিডিয়েট ভালভ রিপ্লেসমেন্ট দরকার।

বাদল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তারবাবু কি হিব্রু ভাষায় কথা বলছেন? নয়তো সে একবর্ণও বুঝতে পারছে না কেন? মূর্খের মতো ফ্যালফ্যাল করে দেখছে ডাক্তারবাবুর হাতে ধরা রিপোর্টগুলো। তার নাজেহাল অবস্থা হয়তো ডাক্তারবাবু বুঝলেন। একটু থেমে বললেন, আপনার মেয়ের হার্টের একটা ভালভ ঠিকমতো কাজ করছে না এবং ভালভটির গঠন অস্বাভাবিক। এটা ওর জন্মগত ত্রুটি। দিস কলড কনজেনিটাল ভালভ ডিফেক্টস। এই ত্রুটি নিয়েই ও বেড়ে উঠেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক দেরিতে এটা ধরা পড়ে। কিন্তু আপনি লাকি। অনেক আগেই ত্রুটিটা ধরা পড়ে গেছে। এখন যা অবস্থা, তাতে এখনই অপারেশন ছাড়া গতি নেই। অবস্থা খুব খারাপ। আপনাকে কলকাতার বড় হসপিটালে যেতে হবে। মেজর অপারেশন। এখানে হবে না!

বাদল বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অপারেশন! সে যে অনেক টাকার ব্যাপার! অত টাকা এই স্বল্পসময়ের মধ্যে জোগাড় করবে কী করে সে? তার কণ্ঠার হাড় নড়ে ওঠে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। শুধু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অপারেশন করতে হবে!

হ্যাঁ। এবং সেটা খরচসাপেক্ষ। ড. দত্ত জানালেন, অক্সিজেন আর। ওষুধে সাময়িক কাজ হয়েছে। কিন্তু অপারেশন না করালে এ রোগ যাবে না। আর সেটা এই টাকিতে সম্ভব নয়। আপনি যদি চান আমরা কেসটা রেফার করে দিতে পারি। কলকাতার আর এন টেগোর বেশ নামকরা হাসপাতাল। যদি আপনার সম্মতি থাকে তবে আমরা ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। কাল সকালেই এখান থেকে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। আপনি কি রাজি?

বাদল উত্তর দেয় না। সে তখনও ভেবে চলেছে টাকার বন্দোবস্ত কী করে হবে! বাংলাদেশি টাকাগুলোকে কীভাবে ভারতীয় টাকায় রূপান্তরিত করবে! সুদীপ্তবাবুর ভরসায় এখানে এসেছিল। কিন্তু কাল যা ঘটল তাতে তাঁর ওপরও ভরসা করা যাচ্ছে না। তবে টাকা বদল করবে কী করে? কাকে দিয়ে করাবে? তাতেও যদি কাজ না হয়? যদি আরও টাকা লাগে? লায়লাকে কী বলবে?

কী হল? আপনি কি রাজি?

বাদল আবার কুঁকড়ে যায়। একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ডাক্তারের দিকে। কোনও উত্তর জোগায় না তার মুখে।

কী হল স্যার? এনি প্রবলেম?

সে আস্তে আস্তে উঠে পড়ে। ডাক্তারের কোনও কথার উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে ভূতে পাওয়া মানুষের মতো হেঁটে চলে যায়।

ডা. দত্ত অবাক! এমন পেশেন্ট পার্টি তিনি আগে কখনও দেখেননি। একটাই শব্দ উচ্চারিত হল তার ঠোঁট বেয়ে।

স্ট্রেঞ্জ!

অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এল বাদল। ভিজিটিং আওয়ার্স এখনও শেষ হয়নি। লায়লা সম্ভবত মেয়ের কাছে আছে। তাই বাদলের অবস্থা, মানসিক উদ্বেগ ভাগ করে নেওয়ার কেউ ছিল না।

তার তখনও কোনওরকম হুশ নেই! সে হাঁ করে চতুর্দিকটা দেখতে থাকে। আশ্চর্য। একই গাছপালা! একইরকম মানুষ! একইরকম পুকুর! একইরকম প্রকৃতি! পার্থক্য একটাই। এটা অন্যদেশ! এবং তারা অনুপ্রবেশকারী! একেই ধরা পড়ার ভয় প্রতিমুহূর্তে বাজপাখির মতো মাথার ওপর চক্কর কাটছে, তার ওপর অদ্ভুত অসহায়তা! নিজের দেশ হলে এতক্ষণে নিজের বাস্তু-ভিটে বিক্রি করেও টাকার ব্যবস্থা করত সে! পাশে হেমন্তবাবু, আনিসুর থাকত দরকার পড়লে তাদের কাছেও হাত পাতত বাদল। কিন্তু এখানে কার কাছে হাত পাতবে? এখানে সে একা। তার কেউ নেই! আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-প্রতিবেশী কেউ নেই! এই স্বজনহীন দেশে একা কী করে লড়বে বাদল!

আমি কোথা যাব কাহারে শুধাব, নিয়ে যায় সবে টানিয়া।
একেলা আমারে ফেলে যাবে শেষে অকূল পাথারে আনিয়া।
সুহৃদের তরে চাই চারিধারে, আঁখি করিতেছে ছলছল।
আপনার ভারে মরি যে আপনি, কাঁপিছে হৃদয় হীনবল।
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল,
তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *