০১. শেখ মুজিব নেই

শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি / আবুল ফজল

.

১৫ আগস্টের ভোররাত্রির নির্মমতা কারবালার নির্মমতাকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে। কারবালায় দু’পক্ষের হাতে অস্ত্র ছিল, তারা ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আর সে হত্যা কোনো অর্থেই ঠাণ্ডা রক্তে ছিল না। সৈনিকের পেশা শত্ৰুনিধন, তার হাতের অস্ত্র উত্তোলিত হয় শত্রর বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে। সে যখন হত্যা করে, তখন তা নৈতিক নিয়ম-কানুনের আওতায় থেকেই তা করে। সৈনিক তো খুনি নয় তার হাতের অস্ত্র নির নিরপরাধের ওপর উদ্যত হয় না। অথচ গত ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের বাড়িতে তা-ই ঘটেছে। এ দিনের অপরাধ আর পাপ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে আমাদের আতঙ্কটা বেশি, কারণ বৃহৎ অপরাধ আর বৃহৎ পাপ বিনা দণ্ডে যায় না। বাংলার মানুষকে সে দণ্ড একদিন একভাবে না একভাবে ভোগ করতেই হবে। এটিও আমার এক বড় রকমের আতঙ্ক।

– আবুল ফজল

.

সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের জন্ম চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়, ১ জুলাই ১৯০৩। সমাজ ও সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনীতি, সাহিত্য ও শিক্ষা বিষয়ে তাঁর সাহসী ও খোলামেলা লেখার জন্য তাকে ‘বাংলার বিবেক’ আখ্যা দেওয়া হয়। দীর্ঘকাল শিক্ষকতায় নিযুক্ত থাকা ছাড়াও আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম জীবনে কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম জীবন ও সমাজের অন্যতম রূপকার যা রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। উত্তরজীবনে আবুল ফজল মূলত প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ। রাষ্ট্র ও সমাজ বিষয়ে তাঁর প্রাগ্রসর ভাবনা তাঁকে দিয়েছিল সর্বজনের শ্রদ্ধার আসন। গল্প-উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা দিনলিপি, ভ্রমন ও জীবনকাহিনি, অনুবাদ ও সম্পাদনা ইত্যাদি মিলিয়ে আবুল ফজল রচিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশের মতো। বাংলাসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক, আবদুল হাই সাহিত্য পদক ও স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে প্রদান করে সম্মানসূচক ডি.লিট.। ৪ মে ১৯৮৩ আবুল ফজল মৃত্যুবরণ করেন।

.

নতুন সংস্করণের ভূমিকা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন নিহত হন তখন বাবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বঙ্গবন্ধুরই আগ্রহে অবসর গ্রহণের পনের বছর পরে প্রায় সত্তর বছর বয়সে তিনি একটি প্রায় অচল হয়ে পড়া ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কাজটাতে অল্পদিনেই তিনি সফলও হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক হত্যাকাণ্ড এবং এর নির্মমতা তাঁকে খুবই বিচলিত করেছিল।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরপরই তিনি ডায়েরিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া লিখেছেন। সেই সময় সব ঘটনা ছিল রহস্যাবৃত, তাঁর মত অরাজনৈতিক নিঃসঙ্গ বয়োবৃদ্ধ মানুষের পক্ষে তা ভেদ করা সম্ভব ছিলনা। অনেক সময় তখনকার বাজারচালু অনেক কথাবার্তা, যার অনেকগুলোই ছিল স্বাধীনতার পরে ঘাপটি মেরে সুযোগের সন্ধানে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের প্রচারণা, তা ধরতে পারেননি তিনি। তবে সামগ্রিকভাবে প্রজ্ঞা ও অন্তর্জানের ভিত্তিতে তিনি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও অবস্থান তুলে ধরতে পেরেছেন। শেষাংশে সংযুক্ত শেখ কামালের স্মৃতিচারণ এই অকালপ্রয়াত তরুণটি সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ একটি লেখা।

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বর্তমান সংস্করণে ‘দায়মুক্তি ও দায়বদ্ধতা বঙ্গবন্ধু ও আবুল ফজল’ শিরোনামে আমার একটি নিবন্ধ সংযোজন করা হলো।

এই হত্যাকাণ্ডের ফলে দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। বরাবরের বিবেকবান উদার মনের সরল মানুষটি এসময় কিছু বন্ধুজনের অনুরোধে তাদের সাথে বিচারপতি সায়েমের উপদেষ্টামণ্ডলীতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ন্যায়নীতি রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এ সরকারের মাধ্যমে অসম্ভব মনে হলে তিনি দেড় বছরের মাথায় উপদেষ্টা পদ ছেড়ে অবসর জীবনে ফিরে আসেন।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড তাঁকে বরাবর ভাবিয়েছে এবং জাতির একজন হিসেবে তিনি বিবেকের দংশনেও ভুগেছেন। তার প্রমাণ মেলে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালেই তাঁর লেখা আলোচিত ‘মৃতের আত্মহত্যা’ ও এ সময়ের আরও কয়েকটি গল্পে। কথাসাহিত্যিকের দায় পালনের পাশাপাশি একজন বিবেকবান চিন্তাবিদের দায়ও এড়াতে পারেন নি বাবা। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে অল্প দিন পরেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখেন স্মৃতিকথা-বঙ্গবন্ধু, তাকে যেমন দেখেছি। এ লেখা ১৯৭৭-এর দিকে সাপ্তাহিক ‘মুক্তিবাণী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আর ১৯৭৮ সনে প্রথম বই আকারে তারাই প্রকাশ করে।

বাংলাদেশ আজ যতই এগিয়ে যাচ্ছে, বিশেষত বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদের শাসনকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন ঘটছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর মহড়া ও অর্জন আরও বড় হয়ে ধরা পড়েছে। ফলে তাঁকে নিয়ে ভাবাবেগের বিস্তার যেমন ঘটছে তেমনি ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা ও অবদান মূল্যায়নের আগ্রহ ও প্রয়োজনও বাড়ছে। সেদিক থেকে আজ বইটির চাহিদা তৈরি হয়েছে নতুনভাবে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ বেছে নিতে বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশের জুড়ি নেই। সম্ভবত এ বইটি এসময়ে পুনঃপ্রকাশের সিদ্ধান্ত তার এ গুণটিকেই প্রমাণ করবে।

আবুল মোমেন
চট্টগ্রাম, জানুয়ারি ২০১৬

.

কৈফিয়ৎ

আমি মনে করি আমার একটা দায়িত্ব আছে। ঠিক শেখ মুজিবের প্রতি নয়, আমার নিজের প্রতিও। আমার বিশ্বাস সব লেখকেরই কোনো না কোনো দায়িত্ব রয়েছে। সব রচনারই উৎস দায়িত্ববোধ, দায়িত্ব-চেতনা। নিজের দেশের প্রতি, নিজের যুগের প্রতি, সেই সঙ্গে নিজের বিবেক আর লেখকসত্তার প্রতিও এ দায়িত্ব বর্তায়। কোনো খাঁটি লেখকই এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। এ ক্ষুদ্র রচনাটি আমার সে দায়িত্ব পালন। আমার বিবেক আর অনুভূতিকে প্রকাশের এ সুযোগটুকু না দিলে আমি চিরকাল দায়ী হয়ে থাকবো আমার বিবেকের কাছে।

এ রচনা আমার দায়মুক্তির একটি ক্ষুদ্র সনদ।

শেখসাহেবের হত্যার পর পরই এর খসড়া তৈরি হয়েছিল। কোনো কোনো ঘটনা ও সংলাপের জন্য স্মৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। তাই তারিখ আর আলাপ-আলোচনার ভাষায় কিছুটা ভুলভ্রান্তি ঘটা অসম্ভব নয়। তবে বলতে পারি সজ্ঞানে মিথ্যা দিয়ে অতিরঞ্জনের আশ্রয় নেইনি। আবেগ তো লেখকের চিরসহযাত্রী।

এ রচনার সব বক্তব্যের জন্য আমি দায়ী। এর সঙ্গে আমার বর্তমান কি অতীত পদের কোনো সংযোগ নেই। এ স্রেফ আমার সাহিত্য-কর্মের অঙ্গ।

আমি এ-ও মনে করি আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের শেখ মুজিবের জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এতখানি সুযোগ-সুবিধা পেয়েও তিনি কেন জাতিকে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারলেন না, তা জানার এবং জেনে তার থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন রয়েছে সবার। চোখ-মন বন্ধ করে থাকলে আগামী দিনের নেতৃত্বকেও ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হবে। তাই সঠিক রাজনীতির পথ খুঁজে নেওয়ার জন্যও শেখ মুজিবের জীবনকে জানার ও অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে।

আবুল ফজল

.

০১.

শেখ মুজিব নেই। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওইদিন ভোর সাড়ে ছ’টায় হত্যাকারীদের এক মুখপাত্র ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করেছে : ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’। যাকে বলে এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। সারা দেশ স্তব্ধ ও হতবাক। মন বিশ্বাসই করতে চায় না-বাংলাদেশে, যে বাংলাদেশের স্রষ্টা স্বয়ং শেখ মুজিব, এমন অকল্পনীয় ঘটনা ঘটতে পারে। সারা দেশ বোবা, বিস্মিত, হতবুদ্ধি।

শেখ মুজিব না থাকাটা যে বাংলাদেশের জন্য কত বড় শূন্যতা তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। তিনি ছিলেন সারা দেশের সামনে ঐক্যের প্রতীক ও ঐক্য রক্ষাকারী এক মহাশক্তি। সে প্রতীক, সে শক্তি আততায়ীর গুলিতে আজ ধুলায় লুণ্ঠিত। এ নির্মম ঘটনায় যন্ত্রণাবিদ্ধ আমরা সবাই। সে যন্ত্রণা ভাষার অতীত। তাই তার বহিঃপ্রকাশ নেই কোথাও। সবাই ছটফট করছে ভিতরে ভিতরে। বিবেকী মানুষদের বিবেক কাতরাচ্ছে অহরহ।

আমাদের সামনে আজ এমন কোনো মহৎ কবি নেই, যে কবি বাংলাদেশের অন্তরের এ নীরব কান্নাকে ভাষায় কিংবা ছন্দে রূপ দিতে পারেন।

বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনি শুধু নির্মাতা নন, তার প্রধান নায়কও। ঘটনাপ্রবাহ ও নিয়তি তাঁকে বার বার এ নায়কের আসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলা যায়, যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের গত পঁচিশ বছরের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। শত চেষ্টা করেও তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয় না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ নিজে করে না ছেদন। শেখ মুজিব ইতিহাসের তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশের শুধু নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরও। কারণ ইতিহাস অখণ্ড। সুনামে-দুর্নামে, অসাধারণ সাফল্য ও শোচনীয় ব্যর্থতার জন্য ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

এ অমর মানুষটির সঙ্গে আমার যে সামান্য ব্যক্তিগত পরিচয় আর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার কিছুটা স্মৃতিচারণ আমি এখানে করতে চাই। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের মেয়াদ অবশ্য খুবই সংক্ষিপ্ত। মাত্র তিন বছর কয়েক মাস। ২০ মার্চ, ১৯৭৩ এ পরিচয়ের সূত্রপাত আর ১৫ জুলাই, ১৯৭৫ তার সমাপ্তি। এটুকু সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে কারো জীবন কিংবা কর্মের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় বা মূল্যায়ন সম্ভব নয়। শেখ মুজিবের রাজনীতি, রাজনৈতিক সাফল্য আর প্রশাসনিক সাফল্যের যোগ্য বিচারক আমি নই। তাই তা থেকে আমি বিরত থাকবো। অধিকন্তু আমি রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক কর্মী নই বলে আমার সঙ্গে দেশের কোনো রাজনৈতিক নেতার তেমন কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কোনোদিন। তেমন সুযোগও আসেনি, এলেও তা আমি পরিহার করে চলেছি সব সময়। সব সময় দূরে থেকেছি রাজনীতি থেকে। কলকাতা কিংবা ঢাকা কখনো আমার প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল না বলে রাজনীতির উত্তাপ আর তার দ্বন্দ্ব-কোলাহল থেকে দূরে থাকা আমার পক্ষে তেমন কিছু কঠিনও হয়নি। এমনকি আমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক নেতাদের থেকেও আমি যে যথাসম্ভব দূরে থাকতাম তার এক বড় প্রমাণ স্বাধীনতার আগে শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার একবারও সাক্ষাৎ ঘটেনি। জীবনে জনসভায় তাঁর বক্তৃতা শুনেছি একবার মাত্র। ওই সভায় আমাকে সভাপতিত্ব করতে হয়েছিল বলে তার অন্যথা হওয়ার জো ছিল না। আর তা-ও স্বাধীনতার পরে।

তাই শেখের ঘটনাবহুল জীবনের যথাযথ পরিচয় আর মূল্যায়ন আমার দ্বারা হওয়ার কথা নয়। অধিকন্তু আমি তাঁর কাছে ঋণী। অবসর জীবন থেকে ডেকে এনে তিনিই আমাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের পদে নিয়োগ করেছিলেন। এ-ও তাঁর এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত। কারণ ইতিপূর্বে বা পরেও আমার অবস্থার লোক কেউই স্থায়ী ভাইস চ্যান্সেলর হননি। যারা হয়েছেন প্রায় সবাই আমার চেয়ে উন্নততর পদ আর ডিগ্রির অধিকারী। কাজেই তার সম্পর্কে পুরোপুরি নিরপেক্ষ হতে পারবো তেমন দাবিও আমার নেই। তবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তিনি সম্পূর্ণভাবে বাঙালি চরিত্রের প্রতিভূ ছিলেন। ছিলেন বাঙালির সব রকম সবলতা-দুর্বলতার প্রতীক। একদা মরহুম মুনীর চৌধুরী কথাচ্ছলে আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখুন, আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, সুযোগ পেলে আমি উপরে উঠতে চাইবো, এ তো খুবই স্বাভাবিক।’ তাঁর এ কথাটা কি সত্য? কোনো কোনো ব্যাপারে মুনীর আয়ুব খাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। হয়তো অবস্থার চাপে বাধ্য হয়েই করেছিলেন। এ সম্পর্কে আমার অসন্তোষ অনুমান করেই বোধ করি অযাচিতভাবে ওই স্বীকারোক্তি তিনি করেছিলেন আমার সামনে। আজ আমাদের এ স্বনামধন্য অধ্যাপক-লেখকটিও ঘাতকের অস্ত্রের মুখে হারিয়ে গেছেন।

শেখ মুজিব এবং তাঁর সহকর্মী আর মন্ত্রিসভার সদস্যরা সবাই মধ্যবিত্ত ঘর থেকেই এসেছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেরই সুযোগ-সুবিধার সহজ শিকারে পরিণত হতে হয়তো বাধেনি। তারা উপরে উঠতে চেয়েছেন। মধ্যবিত্তের এ স্বভাব-দুর্বলতার জন্যই বোধ করি শেখ মুজিবের দীর্ঘদিনের স্নেহপুষ্ট বিশ্বস্ত অনেক সহকর্মীর পক্ষে তাঁর রক্তাক্ত স্মৃতির উপর দাঁড়িয়ে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। তারা যখন শপথ নিচ্ছেন তখনো শেখের রক্ত শুকায়নি। অকৃতজ্ঞতা মধ্যবিত্তের আর একটি চারিত্র্য-লক্ষণ। আমি যে আজো ভাইস চ্যান্সেলর রয়েছি তারও পেছনে কি এ গূঢ় কারণটি নিহিত নেই? আমিও ওই শ্রেণি থেকে এসেছি।

আজ সবই রহস্যময় মনে হচ্ছে। মানবস্বভাবটাই বোধ করি এমনি রহস্যময়। এর তল পাওয়া মুশকিল।

.

০২.

বলেছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার কখনো সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগ ঘটেনি। তবে ১৯৬৯-এর শেষের দিকে তাঁর কাছ থেকে আমি তাঁর নিজের হাতে লেখা দু’খানা চিঠি পেয়েছিলাম। তখন তিনি বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও সর্বপ্রধান রাজনৈতিক তথা বিরোধী দলের নেতা। চিঠি দু’খানি নিম্নে উদ্ধৃত হলো। দু’খানি চিঠিই তাঁর ব্যক্তিগত মুদ্রিত প্যাডেই লেখা।

শেখ মুজিবুর রহমান
ফোন : ২৪ ২৫ ৬১ ৬৭৭
ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা
রোড নং ৩২, ঢাকা
তারিখ : ১৭-১১-৬৯ ইং

জনাব অধ্যাপক সাহেব,

আমার ছালাম গ্রহণ করবেন। আশা করি ছহি-ছালামতে আছেন।

সম্প্রতি ইত্তেফাকে প্রকাশিত আপনার প্রবন্ধ ‘শক্ত কেন্দ্র কেন ও কার জন্য’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। আপনার সাবলীল লেখনী নিঃসৃত সৃজনশীল এই প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে অধিক সংখ্যক মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারলে নির্যাতিত মানুষের পরম কল্যাণ সাধিত হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। প্রবন্ধটি আমি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করতে মনস্থ করেছি। আপনার অনুমতি পেলে কৃতার্থ হব।

আপনার স্নেহের
শেখ মুজিব

অনেকের হয়তো এখনো মনে থাকতে পারে আয়ুব সরকার একদা পাকিস্তানের জন্য Strong centre অর্থাৎ শক্ত কেন্দ্রের প্রয়োজন–এ ধুয়া তুলে এর সপক্ষে জোর প্রচারণা শুরু করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আমি ‘শক্ত কেন্দ্র কেন এবং কার জন্য’-এ শিরোনামায় এক প্রবন্ধ লিখি। সে প্রবন্ধটি দুই কিস্তিতে ‘ইত্তেফাকে’ ছাপা হয়েছিল। শেখসাহেব সে প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে ছেপে বিলি করতে চেয়েছেন। উক্ত প্রবন্ধটি আমার ‘সমকালীন চিন্তা নামক বইতে দেখতে পাওয়া যাবে। বলাবাহুল্য তাঁকে অনুমতি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি চিঠি দিয়েছিলাম। তারপর তাঁর কাছ থেকে আমি দ্বিতীয় চিঠিটি পাই। সেটিও নিমে। উদ্ধৃত হলো। এটিও তাঁর মুদ্রিত চিঠির প্যাডে লেখা।

শেখ মুজিবুর রহমান
ফোন : ২৪ ২৫ ৬১ ৬৭৭
ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা
রোড নং ৩২, ঢাকা
তারিখ : ২-১২-৬৯ ইং

জনাব অধ্যাপক সাহেব,

আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন। আপনার চিঠি পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত হয়েছি। আপনার মত জ্ঞানী, গুণী এবং দেশপ্রেমিকের সাথে দেখা করতে পারলে খুবই আনন্দিত হতাম। আবার যখন চট্টগ্রাম যাব, ‘সাহিত্য নিকেতনে’ যেয়ে নিশ্চয়ই আপনার সাথে দেখা করব। আপনার লেখা ‘রাজধানী’ বের হলেই ‘শক্ত কেন্দ্রের’ সাথে এক করে পুস্তিকাকারে বের করার চেষ্টা করব।

পূর্ব বাংলার অবস্থা আপনি ভালভাবেই জানেন। আমি আমার কর্তব্য করতে চেষ্টা করছি। এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছে; তাদের রক্তের সাথে যেন বেঈমানী না করি দোয়া করবেন। আপনার স্নেহ ও ভালবাসা আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকুক।

ইতি

আপনার স্নেহের
মুজিব

‘কেন্দ্রীয় রাজধানী বনাম পূর্ব পাকিস্তান’–এ নামেও তখন আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেটিও তখন ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছিল। এ লেখাটিও আমার ‘সমকালীন চিন্তা’য় দেখতে পাওয়া যাবে। শেখসাহেব তাঁর চিঠিতে ‘রাজধানী’ অর্থে এ লেখাটিই বোঝাতে চেয়েছেন।

শেখসাহেব ’৭০-এর গোড়ার দিকে একবার চাটগাঁ এসেছিলেন। মাস-তারিখ মনে নেই, কোথাও টোকাও নেই। আওয়ামী লীগের জোয়ারে তখন সারা দেশ প্লাবিত। শেখ তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষদেশে। সামনে সাধারণ নির্বাচন, তিনি এবার এসেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। জনতার ঢল নেমেছে সারা শহরে, লোকজন এসেছে গ্রাম ভেঙে। এম এ আজিজ আর তার সহকারী এম এ হান্নান তখনো বেঁচে। দক্ষ ও দুঃসাহসী কর্মী ও সংগঠক হিসেবে এম এ আজিজের তুলনা হয় না।

চট্টগ্রামে রাজনৈতিক জনসভা সাধারণত লালদিঘির ময়দানেই হয়ে থাকে। আগে থেকে রাস্তা-ঘাটে জনতার জোয়ার দেখে লালদিঘির মাঠে স্থান সংকুলান হবে না আশঙ্কা করে এবার সভার আয়োজন করা হয়েছে পলোগ্রাউন্ডে তথা রেলওয়ে মাঠে। ওই দিনই সকালের ফ্লাইটে শেখসাহেব ঢাকা থেকে চাটগা এসে পৌঁছেছেন। রাস্তায় রাস্থায় জনস্রোত, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে শহর মুখরিত। আমি আমার বাড়ির সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলাম। হঠাৎ ওই সময় দু’জন আওয়ামী লীগ কর্মী, তার মধ্যে একজন আমার পরিচিত, অত্যন্ত হন্তদন্ত হয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে ছুটে এসে আমাকে বলল–

: আজিজসাহেব আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। শেখসাহেব প্লেন থেকে নেমেই আজিজসাহেবকে বলেছেন, তিনি এবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান, সে ব্যবস্থা যেন করা হয়।

জানতে চাইলাম—

: কোথায় কীভাবে দেখা হতে পারে?

তাঁরা জানালো–

পথে পথে যে রকম জনতার ভিড়, হোটেলে পৌঁছতেই তাঁর হয়তো এগারো-বারোটা হয়ে যেতে পারে। শুনছি তিনি নাকি আবার শেষ ফ্লাইটে চলেও যাবেন। তার চেয়ে আপনি যদি পলোগ্রাউন্ডের সভায় আসেন তাহলে ভালো হয়। আমরা ওখানে প্যাভিলিয়নের ছাদে বসার ব্যবস্থা করেছি। শেখসাহেব ওখান থেকেই ভাষণ দেবেন।

আমি তখন অবসরপ্রাপ্ত। রাজনৈতিক সভায় যাওয়ায় আমার পক্ষে বাধা থাকার কথা নয়। তবু বললাম–

আমি কোনো রকম রাজনৈতিক সভায় যেতে চাই না। অন্য কিভাবে দেখা হতে পারে তা বরং বলো। জানতে চাইলাম তিনি কোথায় উঠবেন। ‘শাহজাহান হোটেল’। তারা জানালো।

চট্টগ্রামের একটি মধ্যবিত্ত হোটেল। সদরঘাট রোডের ধারে। আমি এক-আধবার গিয়েছি ওই হোটেলে। ‘ইত্তেফাকের’ মানিক মিয়া যখন একবার চাটগাঁ এসেছিলেন, ওই হোটেলেই তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন হয়েছিল, তাতেও আমাকে উপস্থিত থেকে সভাপতিত্ব করতে হয়েছিল। কাজেই ওই হোটেল আমার চেনা।

তারা বলে, যদিও সভার সময় বেলা দু’টা দেওয়া হয়েছে, আমাদের বিশ্বাস, শেখসাহেব খেয়ে-দেয়ে খানিকটা বিশ্রাম করে সভায় যেতে অন্তত তিনটা হয়ে যাবে। সভাশেষে তিনি হয়তো সোজা এয়ারপোর্টে চলে যাবেন। তিনি সভায় রওয়ানা হবার আগে যদি আপনি হোটেলে আসতে পারেন তাহলে দেখা হতে পারে। তথাস্তু। আমি তাতেই রাজি হলাম। বললাম–

: আমি দুটো-আড়াইটার মধ্যেই পৌঁছে যাবো।

তারা বিদায় নিলো।

আমি খেয়ে-দেয়ে বেবিটেক্সি নিয়ে বেলা দুটোর সময় আমার বাসা থেকে রওয়ানা হলাম। জনতার ব্যুহ ভেদ করে হোটেল শাহজাহানে পৌঁছতে আড়াইটার কিছু বেশি হয়ে গেলো।

খুঁজে পেতে তার রুমে গিয়ে দেখি রুম খাঁ খাঁ করছে। বিছানাপত্র, টেবিল-চেয়ার সব ছত্রখান। ইতস্তত ছড়িয়ে আছে এন্তার সিগারেটের গোড়ালি। পাশের রুমে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি এম এ হান্নান কয়েকজন কর্মীর সাথে বসে আলাপরত। আমি জিজ্ঞাসা করতেই বললেন–

শেখসাহেব সভায় চলে গেছেন। খবর এসেছে সভা লোকে টইটম্বুর। জনতা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। গোলমাল হচ্ছে। শুনেই শেখসাহেব কালবিলম্ব না করে রওয়ানা হয়ে গেছেন সভার উদ্দেশ্যে।

আমি কিছুটা নিরাশ হয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

তখন সান্ধ্যভ্রমণ আমার দৈনন্দিন অভ্যাস ছিল। ওইদিনও যথারীতি মাগরেবের পর আমি বেরিয়ে গেছি সান্ধ্যভ্রমণে। ফিরে এসে স্ত্রীর মুখে শুনলাম শেখসাহেব এসেছিলেন দেখা করতে। রাস্তার পাশে বাড়ি। গাড়ি থেকে খবর নিয়েছেন আমি আছি কিনা। নেই শুনে ফিরে গেছেন। হয়তো আমার মতো তিনিও কিছুটা নিরাশ হয়েছিলেন সেদিন।

সভা থেকে হোটেলে ফিরে এসে যখন শুনলেন আমি দেখা করতে এসেছিলাম তখন সঙ্গে সঙ্গেই আবার গাড়িতে গিয়ে উঠে যেসব কর্মী আমার বাসা চেনে তাদের দু’একজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আমার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিয়েছিলেন।

কাজেই এবারও তার সঙ্গে আমার দেখা কিংবা পরিচয় হলো না।

সে পরিচয় হয়েছে স্বাধীনতার পর, তিনি যখন পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তখন।

.

০৩.

আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমরা বাংলাদেশের বাইরের কারো কাছে যদি এককভাবে ঋণী হয়ে থাকি, তা হলে তিনি হচ্ছেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এ দুঃসাহসী ও দূরদর্শিনী মহিলার সার্বিক সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ না হলে আমাদের স্বাধীনতা যে শুধু বিলম্বিত হতো তা নয়, বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্গতিরও সীমা থাকতো না। মাত্র ন’মাসে যে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি তার প্রধান কারণ ভারতের সহায়তা ও সশস্ত্র হস্তক্ষেপ। সে হস্তক্ষেপ মানে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী–এ যুগের বিশ্ব-ইতিহাসের এক অসামান্যা নারী।

শেখসাহেবের আমন্ত্রণে সে ইন্দিরা গান্ধী এলেন বাংলাদেশ সফরে। এলেন ১৯৭২, ১৭ মার্চ। ফিরে গেলেন ২০ মার্চ সকালে।

১৯ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে বঙ্গভবনে এক রাষ্ট্রীয় ভোজ তথা ব্যাংকোয়েটের ব্যবস্থা করেছেন। বিরাট ভোজসভা, ঢাকার গণ্যমান্য সবাই আমন্ত্রিত।

এর দুদিন আগে হঠাৎ চট্টগ্রামের তদানীন্তন জেলা প্রশাসক মি. এম এ সামাদ আমাকে ডেকে বললেন: প্রধানমন্ত্রীর ব্যাংকোয়েটে আপনি আমন্ত্রিত। তাঁর ইচ্ছা আপনি যেন তাঁর ভোজসভায় শরিক হন।

উত্তরে আমি তাকে জানালাম–

আমার পক্ষে ট্রেনে কিংবা বাসে যাওয়া সম্ভব নয়। গেলে বিমানেই যেতে হয়। কিন্তু এক বেলা খাওয়ার জন্য আমি একশ’ কুড়ি টাকা (তখন বিমানে এক দিকের ভাড়া ছিল ষাট টাকা খরচ করতে রাজি না।।

তিনি তবুও নাছোড়বান্দা। বললেন–

দেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে না যাওয়াটা বড্ড খারাপ দেখাবে।

আরো অনেক কথা বলার পরও যখন আমি রাজি হচ্ছি না দেখে অগত্যা তিনি বললেন–

আপনার যাতায়াতের ব্যবস্থা আমরাই না হয় করে দেবো। তবুও আপনি যান।

এ অবস্থায় রাজি না হওয়ার কোনো মানে হয় না।

ডি.সি. যথাসময়ে বিমান টিকিট পাঠিয়ে দিলেন আমার বাসায়। সাবেক লাটপ্রাসাদ, স্বাধীনতার পর যার নাম হয়েছে বঙ্গভবন, তার বিরাট হলঘর অভ্যাগত আমন্ত্রিতে টইটম্বুর। অতিথি ও অন্যান্য লোকজনে গিজগিজ করছে সারা হল।

আমরা ক’জন আসন নিলাম পেছনের দিকে একটা টেবিল ঘিরে। আমাদের টেবিলে ছিলেন কবি জসীম উদ্‌দীন ও তাঁর স্ত্রী, শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কবি সুফিয়া কামাল ও তার স্বামী কামাল উদ্দীন খান–এমন সমমনা আরো দু’একজন।

ভোজের পর জসীমউদ্দীনের ‘নকসী কাঁথার মাঠ’-এর নাট্যমঞ্চায়নও দেখা গেল। এটির ব্যবস্থা হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে। এমন জনাকীর্ণ পরিবেশে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা কিংবা পরিচিত হওয়া সম্ভব নয়। অতএব তার এ ভোজসভায়ও তার সঙ্গে দেখা হলো না আমার। হলো না কোনো রকম আলাপ-পরিচয়।

পরদিন ২০ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী সফর শেষে ফিরে গেলেন সকাল ১০টায়।

নীলক্ষেতে ৩১/ই বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক গৃহে আমার মেয়ে-জামাই থাকে। ঢাকায় এলে আমি ওখানেই উঠি। হঠাৎ ওইদিন দুপুরে এম আর আখতার (মুকুল), তথ্য বিভাগের তদানীন্তন যুগ্ম সচিব বাহাউদ্দীন আহমদ, সঙ্গে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরীও রয়েছেন, ওই বাসায় এসে হাজির। জানালেন–

: শেখসাহেব পাঠিয়েছেন।

: কী ব্যাপার! কেন?

: কী করে যেন শেখসাহেবের কানে গেছে আপনি এসেছেন।

আপনার সঙ্গে তিনি আলাপ করতে চান। আমরা পাঁচটার সময় গাড়ি নিয়ে আসবো। তিনি বলে দিয়েছেন আপনাকে যেন নিয়ে যাই। আপনি তৈয়ার থাকবেন। এ বার্তা দিয়ে তারা চলে গেলেন।

পাঁচটার কিছু আগে তারা গাড়ি নিয়ে ফের এলেন। আমার দ্বিতীয় ছেলে আবুল মঞ্জুরও আমাদের সঙ্গী হলো। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কোলকাতায় থাকতে কে বা কারা তাকে নাকি বলেছিলেন–

আপনারা যখন রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ গানটিকে আপনাদের জাতীয় সংগীত করে নিয়েছেন, তখন রবীন্দ্রনাথের অনুমোদিত সঠিক সুরেই তা গাওয়া উচিত। এখন যে সুর গাওয়া হচ্ছে তা ভুল। কবির ভাইঝি ইন্দিরা চৌধুরানী যে সুর দিয়েছেন সেটিই সঠিক এবং রবীন্দ্রনাথের অনুমোদিত। কাজেই ওই সুরেই গাওয়ার কথা শেখসাহেবকে বলবেন।

বিজয়ের পর কোলকাতা ছেড়ে আসার সময় ওরা তার হাতে কিছু স্বরলিপির বই ও সংশ্লিষ্ট ম্যাগাজিন ইত্যাদিও দিয়েছিল। এবং অনুরোধ জানিয়েছিল এগুলো যেন শেখসাহেবের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। এ সুযোগে ওইগুলো শেখসাহেবের হাতে দেয়ার জন্য সে-ও আমাদের সঙ্গে এলো।

তখন শেখসাহেব বসতেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হাউজে। নতুন গণভবনের সাজসজ্জা আর মেরামত ইত্যাদির কাজ তখনো শেষ হতে বাকি। আমরা যখন পৌঁছলাম তখনও তিনি এসে পৌঁছাননি নিজের বাসা থেকে। একান্ত সচিব রফিকউল্লাহ চৌধুরীর কক্ষে গিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেখসাহেব এসে গেলেন। দক্ষিণের দীর্ঘ বারান্দায় দু’সারি হয়ে দর্শনার্থীরা বসে আছেন বহু আগে থেকেই। আমি এসেছি খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়ে দিলেন। আমি বারান্দার মাঝপথে থাকতেই তিনি তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তিনি নিজেও বসলেন পাশে। হুকুম করলেন চায়ের। মুহূর্তে এক অসাধারণ উষ্ণ হৃদয়ের যেন পরশ পেলাম।

প্রথাগত কুশল জিজ্ঞাসাবাদের পর উপরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন–

উপরে এসে থাকুন না আপনি। বসে বসে লিখবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো। আপনাকে আলাদা রুমও দিয়ে দেবো।

শুনে আমি হাসলাম। ভিতরে ভিতরে মুগ্ধ হলাম তার আন্তরিকতায়–গুণগ্রাহিতায়।

আমার ছেলে মঞ্জু কলকাতা থেকে আনা স্বরলিপির পত্র-পত্রিকাগুলো তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললো–

: ওরা এ সবের প্রাপ্তি স্বীকার আশা করে।

সহকারী সচিব বা কে একজনকে ডেকে এগুলো তাঁর হাতে দিয়ে বলে দিলেন একটা প্রাপ্তিস্বীকার যেন পাঠিয়ে দেয়া হয় ওদের ঠিকানায়। তারপর শুদ্ধ আর অশুদ্ধ স্বরলিপি সম্পর্কে মন্তব্য করলেন–

দেখুন, যে সুরে এ গান জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ও প্রচারিত হয়ে গেছে, যার সঙ্গে জনগণের পরিচয় অনেক দিন ধরে, একেবারে বিশুদ্ধ না হলেও, তা এখন পরিবর্তন করতে গেলে যথেষ্ট জটিলতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে এ সুর যন্ত্রায়িতও হয়েছে। সামরিক বাহিনীর ব্যান্ডে তা বাজানো হয়। এখন রদবদল করতে গেলে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। নতুন করে শেখানো সে-ও তো কম ঝামেলার কথা নয়।

চা এলো, সঙ্গে ছোট ছোট সিঙ্গাড়া আর পুদিনার সস্।

মঞ্জু’র কাছে জানতে চাইলেন—

: তুমি এখন কী কর?

সে উত্তরে বললো

: কিছু না।

তখন তিনি বললেন–

: কী করতে চাও বলো। আমি বলে দিই।

মঞ্জু বললো—

: আমি চাকুরি করবো না।

: তবে কী করবে?

: ব্যবসা করবো।

তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হেসে বললেন–

ব্যবসা-টেবসা হবে-টবে না। আমরা সব জাতীয়করণ করে নেবো।

অনেকক্ষণ ধরে নানা বিষয়ে আলাপ হলো। ফিরে এলাম এক অসাধারণ মানবিক উষ্ণতার স্পর্শ নিয়ে। এ উষ্ণতা অত্যন্ত আন্তরিক ও অকৃত্রিম এবং স্বতঃস্ফূর্ত।

আমাদের দেশের এ যুগের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এভাবেই আমার প্রথম সাক্ষাৎকার ও প্রথম আলাপ।

শালপ্রাংশু দেহ শেখ মুজিবের মুখের দিকে চেয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ ধরে। ওই মুখে কোনো রুক্ষতা কি কর্কশতার চিহ্ন ছিল না। তার হাসি ছিল অপূর্ব, অননুকরণীয়। এমন হাসি অন্য কারও মুখে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কে একজনকে আদেশ করলেন

এঁর জন্য গাড়ি আছে তো? এঁকে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করো।

.

০৪.

তাঁর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার চট্টগ্রামে।

মাস-তারিখ মনে নেই। ১৯৭২-এর শেষের দিকে অথবা তিয়াত্তরের প্রথমার্ধেই হবে। স্বাধীনতার পর এই সর্বপ্রথম তার চট্টগ্রামে আগমন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম শুভাগমন। স্বভাবতই সরকারি ও বেসরকারি মহলে ব্যস্ততা আর সমারোহের অন্ত নেই। সারা দেশ ভেঙে জনতা ভিড় জমিয়েছে শহরে।

সরকারি আর বেসরকারি লোক নিয়ে গঠিত হয়েছে অভ্যর্থনা কমিটি। আমার অনুপস্থিতিতে আমাকেই নির্বাচিত করা হয়েছে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। স্থির হয়েছে হেলিকপ্টার যোগে তিনি অবতরণ করবেন সার্কিট হাউসের সামনের খোলা জায়গায়। সেখানে তাঁকে মাল্যভূষিত করে জানানো হবে প্রাথমিক অভ্যর্থনা। বিকেলে জনসভা পলোগ্রাউন্ড বা রেলওয়ে ময়দানে। অসম্ভব ভিড়। স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের একটি অগ্রভূমিকা রয়েছে। যার নাম মুখে নিয়ে তারা সংগ্রাম করেছে তাকে অভ্যর্থনার ব্যাপারে স্বভাবতই তারা পেছনে পড়ে থাকতে নারাজ। অন্য দর্শনপ্রার্থীরাও অধীর। হেলিকপ্টার মাটি স্পর্শ করতে না করতেই পুলিশ কর্ডন তছনছ, প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল কার আগে কে তাকে মাল্যভূষিত করবে। মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে জহুর আহমদ চৌধুরীরও অগ্রাধিকার রয়েছে। এ হট্টগোলের মধ্যে আমিও কোনোরকমে মালা একটি পরিয়ে দিলাম তার গলায়। তারপর তিনি আমার হাত ধরে উপরে উঠে এলেন-হাঁটতে হাঁটতে বিশৃংখল জনতাকে কিছুটা ভৎর্সনাও করলেন। আমাকে বললেন–

আপনার দুর্দশা দেখেই আমি তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। প্রোটোকলের অপেক্ষা করলাম না।

উঠে এসে সার্কিট হাউসের দোতলার বারান্দায় বসে পড়ে তিনি যেমন আমরাও তেমনি হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচলাম। জনাব এ.কে. খানও ওখানে প্রতীক্ষায় ছিলেন। হেলিকপ্টারের অপেক্ষায় অনেকক্ষণ ধরে রোদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফলে খুবই ক্লান্তবোধ করছিলাম। এখনকার মতো বিদায় নিলাম তাঁকে বলে। বললাম–

: বিকেলে সভায় ফের দেখা হবে।

তিনি বললেন–

: এখান দিয়ে আসুন না। একসঙ্গে যাওয়া যাবে।

বললাম–

: না। আমার কিছু আগে যেতে হবে। আমি সোজা সভায় চলে যাবো, আপনার তো অনেক সাঙ্গপাঙ্গ, তারা আপনার সঙ্গ নেবে।

তিনটার মধ্যেই আমি সভায় গিয়ে হাজির হলাম। রেলওয়ে ময়দানের প্যাভেলিয়নের ছাদের উপর আমাদের আসন পাতা হয়েছে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে এসে বসেছেন সারিবদ্ধ চেয়ারে। সামনে বিরাট মাঠে তিল ধারণের স্থান নেই। হঠাৎ কয়েকজন উত্তেজিত ছাত্র মঞ্চে উঠে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো

যারা দালাল তাদের স্থান হবে না এ মঞ্চে, তারা নেমে যাক মঞ্চ থেকে।

ইত্যাদি আরো কী কী সব কঠোর কথা বলছিল ওরা। সবাই অসম্ভব উত্তেজিত, প্রায় মারমুখো। সব এখন আর মনে নেই। যারা বসেছিলেন তাঁদের অনেকে চেয়ার ছেড়ে সুরসুর করে নেমে গেলেন। এঁদের মধ্যে দু’একজন স্থানীয় এমপি-ও ছিলেন। নিমন্ত্রিত হয়ে এভাবে অপমানিত হওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই তারা সসম্মানে সরে পড়লেন। আমি মনে মনে দুঃখিত হলাম।

অল্পক্ষণের মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরী আর কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে শেখসাহেব এসে পড়লেন। জনতা জয়ধ্বনি ও নানা শ্লোগানে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে তুলল। তিনি চারদিকে ঘুরে ঘুরে দুহাত তুলে জনতার অভিবাদন গ্রহণ করলেন আসন নেয়ার আগে। তিনি আসন নিতেই জাতীয় সংগীত শুরু হলো। উঠে দাঁড়ালাম সবাই। সংগীত শেষে অভিনন্দনপত্র পাঠ করলেন জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব হান্নান। তারপর জহুর আহমদ চৌধুরী আর সভাপতি হিসেবে আমি স্বাগত সম্ভাষণ জানালাম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি আমাকে বললেন–

বক্তৃতায় গত মুক্তিযুদ্ধে এবং অন্যভাবে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের জন্য দোয়া করবো, তাঁদের রূহের মাগফেরাত কামনা করবো, আপনি কিছু মনে করবেন না তো?

বললাম—

: আমি কেন কিছু মনে করতে যাবো? দোয়া করবেনই তো?

স্বাধীনতার সূচনায় ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ সেকুলারিজম কথাটা একটু বেশি মাত্রায় সোচ্চার হয়ে উঠেছিল! কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার ফলেই বোধকরি তিনি ওই রকম একটা কথা বললেন– আমাকে। উঠে দাঁড়িয়েই তিনি সর্বাগ্রে সব শহীদের জন্য খোদার রাহে মাগফেরাত কামনা ও মুনাজাত করে তবে বক্তৃতা শুরু করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *