১৪. সংস্কৃত সাহিত্য

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – সংস্কৃত সাহিত্য

মধ্যযুগীয় বাংলা দেশের সংস্কৃত সাহিত্যকে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে :

(ক) স্মৃতিশাস্ত্র, (খ) নব্যন্যায় ও দর্শনশাস্ত্রের অন্যান্য শাখা, (গ) তন্ত্র, (ঘ) কাব্য, (ঙ) নাট্যসাহিত্য, (চ) পুরাণ, (ছ) গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও ভক্তিতত্ত্ব, (জ) অলঙ্কার, ছন্দ, নাট্যশাস্ত্র ও বৈষ্ণবরসশাস্ত্র, (ঝ) ব্যাকরণ, (ঞ) অভিধান, (ট) বিবিধ।

স্মৃতিশাস্ত্র

বাংলার মধ্যযুগীয় সংস্কৃত সাহিত্যের প্রধান কীর্তিস্তম্ভ তিনটি,–নব্যস্মৃতি, নব্যন্যায় এবং তন্ত্র। বাংলা দেশের স্মৃতিনিবন্ধকারগণের মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রঘুনন্দন; তিনি স্মার্ত ভট্টাচার্য নামে সুধীসমাজে সুপরিচিত। তাঁহার পরেও এই দেশে বহু স্মৃতিকার জন্মিয়াছিলেন; তবে তাঁহাদের রচিত গ্রন্থাবলী তেমন প্রসিদ্ধ নহে এবং বিশেষ কোন মৌলিক চিন্তার সাক্ষ্য বহন করে না। বঙ্গীয় প্রসিদ্ধ স্মৃতিকারগণের গ্রন্থে, বিশেষত রঘুনন্দনের অষ্টাবিংশতি তত্ত্বে, স্বাধীন চিন্তা ও সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণের পরিচয় পাওয়া যায়। এই দেশের স্মৃতিনিবন্ধগুলিতে অসংখ্য স্মৃতিকার ও স্মৃতিগ্রন্থের উল্লেখ আছে; তন্মধ্যে অনেক স্মৃতিকার মৈথিল। বঙ্গীয় স্মৃতি সম্প্রদায়ের ন্যায় মৈথিল স্মৃতিসম্প্রদায়ও সবিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল এবং এই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব বিদ্যমান। স্মৃতিশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয় প্রধানত তিনটি–আচার, প্রায়শ্চিত্ত ও ব্যবহার। এই সকল বিষয়েই বঙ্গীয় পণ্ডিতগণ স্মৃতি-নিবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ প্রাচীন স্মৃতির উল্লেখযোগ্য টীকাও রচনা করিয়াছিলেন।

‘সাহুড়িয়ান’ শূলপাণি প্রাক-রঘুনন্দন যুগের অন্যতম খ্যাতনামা স্মৃতিনিবন্ধকার। তিনি সম্ভবত চতুর্দ্দশ শতকের শেষ পাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার গ্রন্থসমূহের নাম ‘বিবেক’-অন্ত। তাঁহার বিবিধ-বিষয়ক গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘প্রায়শ্চিত্তবিবেক’ ও ‘শ্রাদ্ধবিবেক’ সমধিক প্রসিদ্ধ। যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতির ‘দীপকলিকা’ নামক টীকা শূলপাণির নামাঙ্কিত।

রঘুনন্দন সশ্রদ্ধভাবে যাহাদের নামোল্লেখ করিয়াছেন, ‘রায়মুকুট’ উপাধিধারী বৃহস্পতি তাঁহাদের অন্যতম। রাজা গণেশের পুত্র যদু বা জলালুদ্দীনের সমকালীন বৃহস্পতি খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের প্রথমভাগে তাঁহার স্মৃতিরত্নহার ও ‘রায়মুকুটপদ্ধতি’ নামক গ্রন্থদ্বয় রচনা করিয়াছিলেন।

শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণি ছিলেন রঘুনন্দনের অধ্যাপক। শূলপাণির কতক গ্রন্থের, জীমূতবাহনের ‘দায়ভাগ’-এর এবং নারায়ণ-রচিত ছন্দোগ-পরিশিষ্টপ্রকাশ এর টীকা ছাড়াও শ্রীনাথ বহু নিবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন; নিবন্ধগুলির নামের অন্ত ভাগ হিসাবে এইগুলিকে ‘অর্ণব’-বর্গ, ‘দীপিকা’-বর্গ, ‘চন্দ্রিকা’-বর্গ ও ‘বিবেক’-বর্গে শ্রেণীভুক্ত করা যায়। তাঁহার ‘কৃত্যতত্ত্বার্ণব’ ও ‘দুর্গোৎসববিবেক’ সমধিক প্রসিদ্ধ।

বঙ্গের স্মার্তকুলতিলক নবদ্বীপ-গৌরব রঘুনন্দন ১৫০০ হইতে ১৬০০ খ্রষ্টাব্দের অন্তর্বর্তী লেখক। প্রসিদ্ধ অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব ছাড়াও তিনি ‘দায়ভাগটীকা’, ‘তীর্থতত্ত্ব’ ‘যাত্ৰাতত্ত্ব’, ‘গয়াশ্রাদ্ধপদ্ধতি’, ‘রাসযাত্ৰাপদ্ধতি’, ‘ত্রিপুষ্করশান্তিতত্ত্ব’ ও ‘গ্রহযাগতত্ত্ব’ নামক গ্রন্থসমূহ রচনা করিয়াছিলেন। আলোচ্য বিষয়সমূহের বৈচিত্র্যে এবং ন্যায় ও মীমাংসাশাস্ত্রের সাহায্যে সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণে এই ‘স্মার্ত ভট্টাচার্য’ ছিলেন অদ্বিতীয়।

বাগড়ি (= ব্যাঘ্রতটী) নিবাসী গোবিন্দানন্দ কবিকঙ্কণাচার্য ছিলেন সম্ভবত রঘুনন্দনের সমসাময়িক অথবা কিঞ্চিৎ পূর্ববর্তী। ‘দানক্রিয়াকৌমুদী’, ‘শুদ্ধিকৌমুদী’, শ্রাদ্ধক্রিয়াকৌমুদী’ ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ ও ‘ক্রিয়াকৌমুদী’ নামক নিবন্ধাবলী ছাড়াও গোবিন্দানন্দ শূলপাণির ‘প্রায়শ্চিত্তবিবেক’-এর ‘তত্ত্বার্থকৌমুদী’ এবং শ্রীনিবাসের ‘শুদ্ধিদীপিকা’র অর্থকৌমুদী নামক টীকা রচনা করিয়াছিলেন। শূলপাণির ‘শ্রাদ্ধবিবেকে’র একখানি টীকাও সম্ভবত গোবিন্দানন্দ রচনা করিয়াছিলেন।

রঘুনন্দন ও গোবিন্দানন্দের পরে এই দেশে স্মৃতিশাস্ত্রের অবনতির সূত্রপাত হয়। বিভিন্ন স্থানে রক্ষিত পুঁথিসমূহ হইতে মনে হয়, সত্তর জনেরও অধিক সংখ্যক লেখক এই যুগে নিবন্ধ বা টীকা রচনা করিয়াছিলেন। এই সকল গ্রন্থে বিশেষ কোন মৌলিকতার পরিচয় নাই; ইহাদের মধ্যে কতক পূর্ববর্তী নিবন্ধসমূহের, বিশেষত রঘুনন্দনের প্রখ্যাত নিবন্ধাবলীর সারসংকলন অথবা টীকা-টিপ্পনী। কোন কোন গ্রন্থে আছে অশৌচাদির ব্যবস্থা বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি। এই যুগের নিবন্ধকারগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গোপাল ন্যায়পঞ্চানন। ইঁহার রচিত গ্রন্থসমূহের সংখ্যা অষ্টাদশ এবং নাম ‘নির্ণয়ান্ত’; যথা-‘অশৌচনিৰ্ণয়’, ‘সম্বন্ধনির্ণয়’ ইত্যাদি। টীকাকারগণের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেন কাশীরাম বাচস্পতি এবং শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার; কাশীরাম রঘুনন্দনের অনেক তত্ত্বে’র টীকা করিয়াছেন এবং শ্রীকৃষ্ণ জীমূতবাহনের দায়ভাগে’র এবং শূলপাণির শ্রাদ্ধবিবেক’-এর টীকা রচনা করিয়াছেন।

দত্তকপুত্র-সংক্রান্ত ব্যাপারে বাংলা দেশে ‘দত্তকচন্দ্রিকা’ নামক গ্রন্থখানি সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক বলিয়া গণ্য হয়। ইহা কুবেরের নামাঙ্কিত; এই কুবের সম্ভবত রঘুনন্দনের পূর্ববর্তী। কেহ কেহ মনে করেন যে, গ্রন্থখানি অর্ব্বাচীন এবং নদীয়ায় রাজগুরু রঘুমণি বিদ্যাভূষণ কর্ত্তৃক রচিত; এই গ্রন্থের অন্তিম শ্লোকের প্রথম ও দ্বিতীয় পংক্তির আদ্য ও অন্ত বর্ণগুলি একত্র করিলে ‘রঘুমণি’ নামটি পাওয়া যায়।

নব্যন্যায় ও দর্শনশাস্ত্রের অন্যান্য শাখা

বাঙালীর বহুমুখী মনীষা দর্শনশাস্ত্রের কঠিন আবরণ ভেদ করিয়া উহার গভীরে প্রবেশ করিতে প্রয়াসী হইয়াছিল; এই কথা অবশ্য নব্যন্যায়ের ক্ষেত্রেই সর্বাধিক প্রযোজ্য, দর্শনের অন্যান্য শাখায় বাঙালীর কীর্তি তেমন উল্লেখযোগ্য নহে।

প্রাচীন ন্যায় ও নব্যন্যায়ের প্রভেদ এক কথায় বলিতে গেলে এই যে, প্রথমটি পদার্থশাস্ত্র এবং দ্বিতীয়টি প্রমাণশাস্ত্র। নব্যন্যায়ে প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের সংজ্ঞা বা লক্ষণ অব্যাপ্তি, অতিব্যাপ্তি ও অসম্ভব প্রভৃতি দোষমুক্ত করিবার উদ্দেশ্যে লেখকগণ ছিলেন সতর্ক। প্রমাণসমূহের স্বরূপ বিশ্লেষণে তাঁহারা সূক্ষ্ম বিচারশক্তির পরিচয় দিয়াছেন।

বাংলার নবান্যায়ে নবদ্বীপের রঘুনাথ শিরোমণি সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাকে কেন্দ্রস্থলে রাখিয়া এই শাস্ত্রকে তিনটি যুগে বিভক্ত করা যায় : প্রাক্-শিরোমণি যুগ, শিরোমণি-যুগ ও শিরোমণি-উত্তর যুগ। এই দেশে নব্যন্যায়ের চর্চ্চা কত প্রাচীন তাহা ঠিক বলা যায় না। প্রাক্-শিরোমণি যুগে যাহার নাম আমরা সর্বপ্রথম জানিতে পারি তিনি বিখ্যাত বাসুদেব সার্বভৌম। আনুমানিক খ্রষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের তৃতীয় দর্শকে তাঁহার জন্ম হয়। তিনি উৎকলরাজ পুরুষোত্তমদেব ও প্রতাপরুদ্রদেবের সভা-পণ্ডিত ছিলেন। পুরীতে চৈতন্যের সঙ্গে সার্বভৌমের বেদান্ত সংক্রান্ত বিচারের উল্লেখ আছে কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ (মধ্যলীলা–ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)। বাসুদেবের ‘অনুমানমণি পরীক্ষা’ মৈথিল গঙ্গেশের ‘তত্ত্বচিন্তামণি’র অনুমানখণ্ডের টীকা।

বাসুদেব সার্বভৌমের পুত্র জলেশ্বর বাহিনীপতি মহাপাত্র ভট্টাচার্য সম্ভবত খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার ‘শব্দালোকোদ্দ্যোত’ পক্ষধর মিশ্রের ‘শব্দালোকে’র টীকা।

জলেশ্বর-পুত্র স্বপ্নেশ্বরও বোধহয় নব্যন্যায়ের গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন।

আনুমানিক খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের শেষভাগের লেখক কাশীনাথ বিদ্যানিবাস ‘তত্ত্বমণিবিবেচন’ নামক একখানি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন; ইহা উল্লিখিত ‘তত্ত্বচিন্তামণি’র টীকার প্রত্যক্ষখণ্ডের অংশমাত্র।

এই যুগের শ্রীনাথ ভট্টাচার্য চক্রবর্তী, বিষ্ণুদাস বিদ্যাবাচস্পতি, পুণ্ডরীকাক্ষ বিদ্যাসাগর, পুরুষোত্তম ভট্টাচার্য, কবিমণি ভট্টাচার্য, ঈশান ন্যায়াচার্য, কৃষ্ণানন্দ বিদ্যাবিরিঞ্চি এবং শূলপাণি মহামহোপাধ্যায় (বঙ্গীয় স্মৃতিনিবন্ধকার?) প্রভৃতিও নব্যান্যায়ের গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন বলিয়া গ্রন্থান্তরে সন্ধান পাওয়া যায়; কিন্তু ইঁহাদের কোন গ্রন্থ আবিষ্কৃত হয় নাই।

খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে (?) আবির্ভূত রঘুনাথ ছিলেন যুগন্ধর পুরুষ। ‘তত্ত্বাচিন্তামণি’র প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দখণ্ডের উপর, রঘুনাথ-রচিত টীকার নাম যথাক্রমে প্রত্যক্ষমণিদীধিতি’, ‘অনুমানদীধিতি’ এবং ‘শব্দমণিদীধিতি’। তাঁহার অন্যান্য গ্রন্থের নাম ‘আখ্যাতবাদ’, ‘নঞবাদ’, ‘পদার্থখণ্ডন’, ‘দ্রব্যকিরণাবলীপ্রকাশদীধিতি’, ‘গুণকিরণাবলীদীধিতি’, ‘আত্মতত্ত্ববিবেকদীধিতি’, ‘ন্যায়লীলাবতীপ্রকাশদীধিতি’, ‘কৃতিসাধ্যতানুমান’, ‘বাজপেয়বাদ’ ও ‘নিযোজ্যান্বয়বাদ’।

শিরোমণি-যুগের অপর একজন উল্লেখযোগ্য নৈয়ায়িক জানকীনাথ খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। ‘ন্যায়সিদ্ধান্তমঞ্জরী’ ও ‘আম্বীক্ষিকীতত্ত্ব’ বিবরণ জানকীনাথ-রচিত। প্রথমোক্ত গ্রন্থে তিনি স্বরচিত মণিমরীচি ও ‘তাৎপর্যদীপিকা’র উল্লেখ করিয়াছেন।

জানকীনাথের শিষ্য কণাদ তর্কবাগীশের গ্রন্থ ‘ভাষারত্ন’ এবং ‘তত্ত্বচিন্তামণি’র অনুমানখণ্ডের টীকা; প্রথমোক্ত গ্রন্থে তিনি স্বরচিত ‘তর্কবাদাৰ্থমঞ্জরী’র উল্লেখ করিয়াছেন।

শিরোমণি-উত্তর যুগে বঙ্গীয় নৈয়ায়িকগণের প্রতিভার তেমন সমুজ্জ্বল স্ফুরণ দেখা যায় না। এই যুগকে টীকা-যুগ ও পত্রিকা-যুগে বিভক্ত করা যায়। এই যুগে মৌলিক গ্রন্থ যে রচিত হয় নাই, তাহা নহে; তবে শিরোমণি-যুগের গ্রন্থাবলীর ন্যায় ইহারা উচ্চকোটির নহে। টীকা-যুগের লেখকগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হরিদাস ন্যায়ালঙ্কার ভট্টাচার্য, কৃষ্ণদাস সার্বভৌম, রামভদ্র সার্বভৌম, শ্রীরাম তর্কালঙ্কার, ভবানন্দ সিদ্ধান্তবাগীশ, গুণানন্দ বিদ্যাবাগীশ, মথুরানাথ তর্কবাগীশ, জগদীশ তর্কালঙ্কার এবং গদাধর ভট্টাচার্য চক্রবর্তী। ইঁহাদের মধ্যে শেষোক্ত লেখকত্রয় বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন।

মোটামুটিভাবে খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ হইতে উনবিংশ শতকের প্রথম দর্শক পর্যন্ত কালকে পত্রিকা-যুগ বলা যায়। এই যুগের নৈয়ায়িকগণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মথুরানাথ, জগদীশ ও গদাধরের সর্বাধিক প্রচলিত গ্রন্থসমূহে অনুপপত্তি উত্থাপন করিয়া তাঁহার সমাধান। তাঁহাদের এইরূপ রচনাগুলি পত্রিকা নামে পরিচিত। পত্রিকাগুলি প্রধানতঃ শিরোমণির দীধিতি’ গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত হইলেও অনুমানখণ্ডের চর্চ্চাই এগুলিতে প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। এই যুগেও কিছু কিছু টীকা-টিপ্পনী রচিত হইয়াছিল।

খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকেই কাশীধামে নব্যন্যায়চর্চ্চার সূত্রপাত করেন বাঙালী নৈয়ায়িক। তদবধি বহু বাঙালী নৈয়ায়িক যুগে যুগে ভারতীয় সংস্কৃতির এই কেন্দ্রে জীবনযাপন করেন ও গ্রন্থাদি প্রণয়ন করেন। ইঁহাদিগকে প্রধানতঃ তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা যায়; যথা–প্রগল্ভ-সম্প্রদায়, শিরোমণি-সম্প্রদায় এবং চূড়ামণি সম্প্রদায়।

‘প্রশস্তপাদভাষ্যে’র উপর প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক জগদীশ-রচিত টীকার নাম ‘দ্রব্যসূক্তি’। গুণসূক্তি’ নামক টীকাও জগদীশ-রচিত বলিয়া সন্ধান পাওয়া যায়। কেহ কেহ মনে করেন, তর্কামৃত’ নামক বৈশেষিক প্রকরণ গ্রন্থখানি জগদীশের রচনা। ময়মনসিংহ জিলার চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার (১৮৩৬-১৯০৯ খ্রী) বৈশেষিক দর্শন সম্বন্ধে তত্ত্বাবলি’ নামক পদ্যগ্রন্থ ছাড়াও কণাদের বৈশেষিক দর্শনের এবং উদয়নের কুসুমাঞ্জলি’র টীকা রচনা করিয়াছিলেন। গঙ্গাধর কবিরাজ (১৭৯৮ ১৮৮৫ খ্রী) বৈশেষিক সূত্রের ভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন।

মহামহোপাধ্যায় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের মীমাংসাগ্রন্থের নাম ‘অধিকরণকৌমুদী’। ইনি খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের পূর্ববর্তী লেখক নহেন। খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের আদিভাগের চন্দ্রশেখর বাচস্পতির ‘ধর্মদীপিকা’ ও ‘তত্ত্বসংবোধিনী’ নামক দুইখানি মীমাংসাগ্রন্থ আছে। আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতকের কাশীবাসী নৈয়ায়িক রঘুনাথ বিদ্যালঙ্কার মীমাংসারত্ন’ নামক গ্রন্থে প্রমাণ ও মেয়ের আলোচনা করিয়াছেন।

কিম্বদন্তী এই যে, সাংখ্যদর্শনের প্রবর্তক কপিল ছিলেন বাংলা দেশের গঙ্গা সাগরসঙ্গমবাসী। নৈয়ায়িক জলেশ্বর বাহিনীপতি-পুত্র স্বপ্নেশ্বরের সাংখ্যগ্রন্থের নাম ‘সংখ্যাতত্ত্বকৌমুদীপ্রভা। সাংখ্যকারিকা’র উপর সাংখ্যবৃত্তিপ্রকাশ’ (বা ‘সাংখ্যতত্ত্ববিলাস’) এবং ‘সাংখ্যকৌমুদী’ যথাক্রমে তর্কবাগীশ ও রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য রচিত। শ্রীনাথ ভট্টাচার্যের নামাঙ্কিত গ্রন্থ সাংখ্যপ্রয়োগ’। নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভা-পণ্ডিত রামানন্দ রচনা করেন সাংখ্যপদার্থমঞ্জরী’, ভট্টপল্লীর পঞ্চানন তর্করত্ত্ব ‘সাংখ্যকারিকা’র ‘পূর্ণিমা’ নামক ব্যাখ্যার রচয়িতা। খ্রীষ্টীয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞানভিক্ষুর নামাঙ্কিত গ্রন্থ সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য’ ও ‘সাংখ্যসার’। সাংখ্যসূত্রের টীকাকার অনিরুদ্ধ কাহারও কাহারও মতে বল্লালসেনের গুরু, কেহ বা তাহাকে খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতকের লেখক বলিয়া মনে করেন। গঙ্গাধর কবিরাজ সাংখ্যসূত্রের ভাষ্য রচনা করেন।

যোগদর্শনে উক্ত বিজ্ঞানভিক্ষুর ‘যোগবার্তিক’ এবং গঙ্গাধর কবিরাজের ‘পাতঞ্জলসূত্রভাষ্য’ উল্লেখযোগ্য।

বিজ্ঞানভিক্ষু-রচিত ‘বিজ্ঞানামৃতভাষ্য’ ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা। আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার অন্তর্গত উনশিয়া গ্রামে আবির্ভূত মধুসূদন সরস্বতী আকবরের সভায় সম্মানিত হইয়াছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। মধুসূদন-রচিত দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ ও টীকাসমূহের সংখ্যা দ্বাদশ; ইহাদের মধ্যে ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ বেদান্তদর্শনে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘প্রস্থানভেদ’ নামক গ্রন্থে মধুসূদন সমস্ত বিদ্যার সারোল্লেখপূর্বক বেদান্তের প্রাধান্য প্রতিপাদন করিয়াছেন। নবদ্বীপের মহানৈয়ায়িক বাসুদেব সার্বভৌম লক্ষ্মীধরকৃত ‘অদ্বৈত-মকরন্দ’ নামক গ্রন্থের টীকা রচনা করিয়াছিলেন। বাংলা দেশের স্বল্পজ্ঞাত বেদান্ত-বিষয়ক গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গৌড়পূৰ্ণানন্দ কবিচক্রবর্তীর তত্ত্বমুক্তাবলী-মায়াবাদ শতদূষণী’, গদাধরের নৈয়ায়িক?) ব্রহ্মনির্ণয়’, সম্ভবত মধুসূদনের সমসাময়িক গৌব্রহ্মানন্দের ‘অদ্বৈতসিদ্ধান্তবিদ্যোতন’, রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতির ‘বেদান্ত রহস্য’, পদ্মনাভ মিশ্রের (আ খ্রী ১৬ শতক), ‘খণ্ডনপরাক্রম’, নন্দরামতর্কবাগীশের (খ্রী ১৭শ শতক) ‘আত্মপ্রকাশক। কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত রামানন্দ বাচস্পতি বা রামানন্দ তীর্থ বেদান্তবিষয়ে অদ্বৈতপ্রকাশ’ ও ‘অধ্যাত্মবিন্দু’ প্রভৃতি সাত আটখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। অধ্যাত্মবিন্দুতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদর্শনের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়ের উল্লেখপূর্বক ইনি বেদান্তমতের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। তত্ত্বসংগ্রহ নামক গ্রন্থে রামানন্দ বেদান্ত ও সাংখ্য মতের সাহায্যে বিভিন্ন দেবদেবীর অস্তিত্ব ও মাহাত্ম প্রতিপাদন করিয়াছেন। এই স্বল্পজ্ঞাত লেখকগণের মধ্যে কেহ কেহ শারীরিকসূত্র ও গীতা প্রভৃতির টীকাও রচনা করিয়াছিলেন।

তন্ত্র

কোন কোন পণ্ডিতের মতে বাংলা দেশেই সর্বপ্রথম তন্ত্রশাস্ত্রের উদ্ভব হয়। ইহা বিতর্কের বিষয় হইলেও এই দেশের ধর্মজীবনে যে তন্ত্রের প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত সেই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। বাংলা দেশের পূজাপার্ব্বণে এবং স্মৃতিনিবদ্ধগুলিতে তান্ত্রিক প্রজাব সুস্পষ্ট। এই দেশে পূৰ্ণানন্দ, রামকৃষ্ণ পরমহংস, গোঁসাই ভট্টাচার্য, বামাক্ষ্যাপা ও অর্ধকালী প্রভৃতি বহু তান্ত্রিক সাধক ও সাধিকার আবির্ভাব হইয়াছিল। তাহা ছাড়া, অনেক তন্ত্রগ্রন্থও বাঙালী পণ্ডিতগণ রচনা করিয়াছিলেন। তন্ত্রশাস্ত্র প্রধানতঃ হিন্দু ও বৌদ্ধ ভেদে দ্বিবিধ। হিন্দুতন্ত্র প্রধানতঃ শৈব, শাক্ত অথবা বৈষ্ণব; প্রথম দুই শ্রেণীর গ্রন্থের সংখ্যাই অধিকতর।

আনুমানিক ১৪শ শতকের পরিব্রাজকাঁচার্য ‘কাম্যযন্ত্রোদ্ধার’ নামক নিবন্ধে তান্ত্রিক যন্ত্রসমূহ সংগ্রহ করিয়াছেন। চৈতন্যের সমকালীন বা কিঞ্চিৎ পরবর্তী কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এই শাস্ত্রে যুগন্ধর পুরুষ। তৎপ্রণীত তন্ত্রসার’-এ হিন্দুতন্ত্রের সকল সম্প্রদায়েরই সার লিপিবদ্ধ আছে। ইহাতে তন্ত্রশাস্ত্রের প্রধান বিষয়গুলির আলোচনা ছাড়াও বিভিন্ন দেবদেবীর স্তবস্তোত্র লিপিবদ্ধ আছে। বাংলা দেশে প্রচলিত কালীমূর্ত্তির কল্পনা ও পূজার প্রবর্তন নাকি কৃষ্ণানন্দেরই কীর্তি। অমৃতানন্দ ভৈরব ও রামানন্দ তীর্থ তন্ত্রসারের’ পৃথক পৃথক্‌ রূপ প্রস্তুত করিয়াছিলেন। শ্ৰীতত্ত্বচিন্তামণি’ কৃষ্ণানন্দের নামাঙ্কিত অপর একখানি তন্ত্রগ্রন্থ। ‘সর্বোল্লাস’ নামক গ্রন্থ ত্রিপুরা জিলার মেহার গ্রামনিবাসী সর্ববিদ্যা’ উপাধিধারী খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের সর্বানন্দের নামাঙ্কিত। আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতকের প্রথম বা মধ্যভাগে ব্রহ্মানন্দ গিরি শাক্তানন্দতরঙ্গিণী’ ও ‘তারারহস্য’ নামক গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। ইহার শিষ্য ময়মনসিংহ জিলার কাটিহালী গ্রামনিবাসী পূৰ্ণানন্দ পরমহংস পরিব্রাজক নিম্নলিখিত তন্ত্রগ্রন্থসমূহের রচয়িতা: শ্যামারহস্য’, শাক্তক্রম’, শ্ৰীতত্ত্বচিন্তামণি’, তত্ত্বানন্দতরঙ্গিণী, ষটকর্মোল্লাস’ ও ‘কালিকাদিসহস্রনামস্তুতিরত্নটীকা’ ষট্‌চক্র বা ষট্‌চক্রভেদ’, ‘গদ্যবল্লরী’, আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের গৌড়ীয় শঙ্করে নামাঙ্কিত গ্রন্থ ‘তারারহস্যবৃত্তি’, ‘শিবার্চনমহারত্ন’, ‘শৈবরত্ন’, কুলমূলাবতার’ ও ‘ক্রমস্তব’। অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘রাধাতন্ত্র’ সম্ভবত বাংলা দেশে রচিত। রাধার সহিত শক্তির উপাসক কৃষ্ণের মিলনেই সিদ্ধিলাভ–ইহাই এই তন্ত্রের প্রতিপাদ্য।

উক্ত গ্রন্থসমূহ ব্যতীত পঞ্চাশটিরও অধিকসংখ্যক তন্ত্রগ্রন্থ বাঙালী রচয়িতৃগণের নামাঙ্কিত; এই রচয়িতৃগণের নাম অনেকের নিকট অজ্ঞাত বা অল্পজ্ঞাত। এই গ্রন্থগুলি প্রায়ই মৌলিকতাবিহীন; ইহাদের মধ্যে অনেকগুলি প্রসিদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থের অথবা তান্ত্রিক স্তবস্তুতির টীকাটিপ্পনী। এই শ্রেণীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে রামতোষণ বিদ্যালঙ্কারের প্রাণতোষিণী’ উল্লেখযোগ্য। গ্রন্থকার ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বৃদ্ধপ্রপৌত্র। ২৪ পরগণা জিলার খড়দহের প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাসের আনুকূল্যে এই গ্রন্থ রচিত হয়।

কাব্য

বঙ্গে তুর্কী আক্রমণের পর প্রায় দুইশত বৎসর পর্যন্ত এই দেশে রচিত কোন কাব্যগ্রন্থের সন্ধান মিলে না। চৈতন্যপ্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম্মের প্রভাবে কাব্যশ্রীর আসন এই দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। বাংলা দেশে রচিত কাব্যগুলি আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্যময়। বাঙালী পণ্ডিতগণ যেমন একদিকে কাব্য রচনা করিয়াছেন, তেমনই অপরদিকে মহাকাব্যাদির অভিনব টীকাটিপ্পনীও প্রণয়ন করিয়াছেন। মধ্যযুগে এই দেশে রচিত কাব্যগুলিকে নিম্নলিখিত শ্রেণীভুক্ত করা যায় :

(১) বৈষ্ণবকাব্য, (২) ঐতিহাসিক কাব্য, (৩) স্তবস্তোত্র, (৪) কোশ কাব্য, (৫) দূতকাব্য, (৬) গদ্যকাব্য ও চম্পূ।

১। বৈষ্ণবকাব্য : আলোচ্য যুগে রাধাকৃষ্ণের লীলা, কৃষ্ণবিষয়ক আখ্যান উপাখ্যান বা চৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে বহু কাব্য রচিত হইয়াছিল। এই কাব্যগুলির মধ্যে নানা শ্রেণীর রচনা বিদ্যমান; যথা–মহাকাব্য, গীতিকাব্য, দূতকাব্য, চম্পূ ইত্যাদি।

মধ্যযুগের প্রারম্ভে বা তাঁহার কিছু পূর্বে রচিত লক্ষ্মীধরের ‘চক্রপাণিবিজয়’ নামক মহাকাব্যের বিষয়বস্তু বাণাসুরের কন্যা ঊষার সহিত কৃষ্ণপৌত্র অনিরুদ্ধের বিবাহ, বাণকর্ত্তৃক অনিরুদ্ধের নিগ্রহের সংকল্প, বাণের সহিত কৃষ্ণের তুমুল সংগ্রাম, শঙ্কর এবং কার্তিকের বাণের সহায় থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণের হস্তে তাঁহার পরাজয় ও পৌত্র এবং পৌত্রবধূ সহ কৃষ্ণের দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন।

কৃষ্ণের জন্ম হইতে কংসবধ পর্যন্ত লীলা চতুর্ভুজের (খ্রষ্টীয় ১৫শ শতক) ‘হরিচরিত’-এর বিষয়বস্তু। রূপ ও সনাতনের ভ্রাতুষ্পুত্র জীবগোস্বামী (১৬শ-১৭শ শতক) ‘সংকল্পকল্পদ্রুমে’ কৃষ্ণের প্রকট ও অপ্রকট নিত্যলীলা বর্ণনা করিয়াছেন। জীবের ‘মাধবমহোৎসব’ কাব্যখানির বর্ণনীয় বিষয় কৃষ্ণকর্ত্তৃক রাধার বৃন্দাবনেশ্বরী রূপে অভিষেক ও তদুপলক্ষ্যে আনন্দোৎসব। বৃন্দাবনে কৃষ্ণের নিত্যলীলা অবলম্বনে চৈতন্যশিষ্য কবিকর্ণপুর বা পরমানন্দ সেনের ‘কৃষ্ণাহ্নিককৌমুদী’ কাব্য রচিত। ‘হরিবংশ’, ‘বিষ্ণুপুরাণ’ ও ‘ভাগবতো’ক্ত পারিজাতহরণের আখ্যান কবিকর্ণপুরের ‘পারিজাতহরণ’ নামক কাব্যের উপজীব্য। রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা অবলম্বনে চৈতন্যশিষ্য প্রবেধানন্দ সরস্বতী রচনা করিয়াছিলেন সঙ্গীতমাধব’; ইহা ‘গীতগোবিন্দের আদর্শে রচিত। চৈতন্যের সমসাময়িক ও বৃন্দাবনের ফটগোস্বামীর অন্যতম রঘুনাথদাস ‘দানকেলিচিন্তামণি’ নামক কাব্য সম্ভবত রূপগোস্বামীর দানকেলিকৌমুদী অবলম্বনে রচনা করেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের (খ্রীষ্টীয় ১৬শ ১৭শ শতক) গোবিন্দলীলামৃত’ বঙ্গীয় বৈষ্ণব কাব্যের মধ্যে বৃহত্তম। কৃষ্ণের অষ্টকালিক নিত্যলীলা অবলম্বনে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী (খ্রষ্টীয় ১৭শ শতক), ‘শ্রীকৃষ্ণভাবনামৃত’ রচনা করিয়াছিলেন।

চৈতন্যের সমকালীন মুরারিগুপ্ত কড়চা’ বলিয়া পরিচিত ‘শ্রীকৃষ্ণ’চৈতন্যচরিতামৃত’ বা ‘‘চৈতন্যচরিতামৃত’ নামক কাব্যে চৈতন্যের জীবনী বর্ণনা করিয়াছেন। কবি-কর্ণপুরের ‘‘চৈতন্যচরিতামৃত’ নামক কাব্যে চৈতন্যকে কৃষ্ণের অবতাররূপে কল্পনা করিয়া তাহাকে নায়ক করা হইয়াছে।

বৈষ্ণবদূতকাব্যগুলির মধ্যে কতক কাব্যে দূতপ্রেরক কৃষ্ণ এবং উদ্দেশ্য গোপীগণ; কোন কোন কাব্যে ইহার বিপরীত ব্যাপারও লক্ষিত হয়। আবার কোন কোন কাব্যে ভক্ত প্রেরক ও কৃষ্ণ উদ্দেশ্য। এই কাব্যগুলির আখ্যানাংশে বৈষ্ণব পুরাণাদির, বিশেষত ভাগবতে’র প্রভাব সুস্পষ্ট। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর বিষ্ণুদাস ‘মনোদূত’-এর রচয়িতা; ইহাতে আছে ভক্তকর্ত্তৃক কৃষ্ণসমীপে স্বীয় মনকে দূতরূপে প্রেরণ। বিষ্ণুদাসের বংশধর রামরাম শর্মার মনোদূতে’ প্রেরক ও দূতের উক্তি-প্রত্যুক্তি রহিয়াছে। রূপগোস্বামী রচিত দূতকাব্য ‘হংসদূত’ ও ‘উদ্ধবসন্দেশ। প্রথমটির বিষয়বস্তু ললিতা কর্ত্তৃক মথুরায় কৃষ্ণের নিকট রাধার বিরহজ্বালা প্রশমিত করিবার অনুরোধ সহ হংসকে দূতরূপে প্রেরণ। মথুরা হইতে বৃন্দাবনে কৃষ্ণকর্ত্তৃক প্রধানা গোপীগণের, বিশেষত রাধার উদ্দেশ্যে উদ্ধবের মাধ্যমে সন্দেশ প্রেরণ ‘ভাগবতো’ক্ত এই ব্যাপার দ্বিতীয়টির উপজীব্য। শ্রীকৃষ্ণ সার্বভৌমের (১৭শ-১৮শ শতক) পদাঙ্কদূত’-এর বিষয়বস্তু কৃষ্ণের বিরহবিধুর গোপীগণ কর্ত্তৃক তৎপদাঙ্কসমূহকে মথুরায় দূতরূপে গমনের অনুরোধ। একই নামের অপর কাব্য অম্বিকাঁচরণ-রচিত।

জনৈক জয়দেবের শৃঙ্গারমাধবীয়চ’ নামক একখানি কাব্য আছে। জীবগোস্বামীর ‘গোপালচ’র পূর্বার্ধে কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা এবং উত্তরার্ধে মথুরাও দ্বারকালীলা বর্ণিত হইয়াছে। কবিকর্ণপুরের ‘আনন্দবৃন্দাবনচম্পূ’ নামক বিশাল কাব্যের বিষয়বস্তু কৃষ্ণের বৃন্দাবনস্থ নিত্যলীলা। রঘুনাথদাসের মুক্তাচরিত্র’ নামক চম্পুকাব্যের উপজীব্য কৃষ্ণের নৈমিত্তিক লীলার অন্তর্গত দানলীলা। চিরঞ্জীবের (১৭শ-১৮শ শতক) মাধবচ’তে বর্ণিত ঘটনাবলী এইরূপকৃষ্ণের মৃগয়াগমন, বনে কলাবতী নাম্নী নারীর দর্শন ও পরস্পরের প্রতি আসক্তি, স্বয়ংবরে কলাবতাঁকে কৃষ্ণের পত্নীরূপে লাভ, কলাবতীসহ প্রত্যাবর্তনকালে রাক্ষসগণের সহিত কৃষ্ণের যুদ্ধ ও জয়লাভ, মধুপুরে কলাবতীসহ তাঁহার বাস, নারদের অনুরোধে কৃষ্ণের দ্বারকাগমন, বিরহক্লিষ্টা কলাবতীর শোচনীয় অবস্থা, কলাবতীকর্ত্তৃক হংসকে দূতরূপে প্রেরণ এবং দ্বারকা হইতে কৃষ্ণের মধুপুরে প্রত্যাবর্তন। বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের (১৭শ-১৮শ শতক) চিত্ৰচতে বর্ধমানাধিপতি চিত্রসেনের রাজত্বকালে মহারাষ্ট্ররাজ সাহুর বঙ্গদেশ আক্রমণ, রাজা কর্ত্তৃক ষট্‌চক্রভেদ প্রভৃতি কর্ত্তৃক ধর্মকার্যের অনুষ্ঠান, রাজার অদ্ভুত স্বপ্নবৃত্তান্ত, স্বপ্নে বৈষ্ণবমতে বেদান্ততত্ত্ব সম্বন্ধে রাজার জ্ঞানলাভ প্রভৃতি বর্ণিত হইয়াছে। মনে হয়, চৈতন্যপ্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম অনুসারে জীবাত্মার মুক্তিলাভের উপায় বর্ণনা কবির মুখ্য উদ্দেশ্য। বর্ধমান জিলার রঘুনন্দন গোস্বামীর (১৮শ শতক) গৌরাঙ্গচ’তে ‘আস্বাদ’ নামক বত্রিশটি পরিচ্ছেদে চৈতন্যের জন্ম হইতে জীবনের যাবতীয় কার্যকলাপ বর্ণিত হইয়াছে।

২। ঐতিহাসিক কাব্য : ১৬শ-১৭শ শতকের চন্দ্রশেখর ‘শূৰ্জনচরিত’ মহাকাব্যে স্বীয় পৃষ্ঠপোষক শূৰ্জুনের জীবনী বর্ণনা করিয়াছেন। এই শূর্জন ছিলেন প্রসিদ্ধ চৌহান পৃথ্বীরাজের ভ্রাতা মাণিক্যরাজের বংশধর এবং সম্রাট আকবরের মিত্র। চন্দ্রশেখর নিজেকে গৌড়ীয় এবং অম্বষ্ঠকুলে জাত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ইহা হইতে কেহ কেহ অনুমান করেন যে তিনি বাঙালী বৈদ্যজাতীয় ছিলেন। কিন্তু ইহা কতদূর সত্য বলা যায় না।

৩। স্তবস্তোত্র : বাংলা দেশের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে কেহ কেহ প্রধানত রাধাকৃষ্ণের ও চৈতন্যের লীলা অবলম্বনে স্তবস্তোত্র রচনা করিয়াছেন। মধুররসাশ্রিত আধ্যাত্মিকতা এই সকল স্তবস্তোত্রের জনপ্রিয়তার কারণ; কিন্তু, ইহাদের সাহিত্যিক মূল্য খুব বেশি নহে। এই জাতীয় রচনাগুলিকে স্তোত্র, গীত ও বিরুদ এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।

সিংহল-প্রবাসী বাঙালীরামচন্দ্র কবিভারতী (খ্রষ্টীয় ১৩শ শতক) ভক্তিশতক’ নামক গ্রন্থের ভক্তিতত্ত্ব অনুসারে বুদ্ধদেবের স্তুতিগান করিয়াছেন। চৈতন্যের সমকালীন নৈয়ায়িক বাসুদেব সার্বভৌম চৈতন্য সম্বন্ধে কতক স্তোত্র রচনা করিয়াছেন। প্রায় একই সময়ে রচিত প্রবোধানন্দ সরস্বতীর ‘চৈতন্যচন্দ্রাতের বিষয়বস্তুও অনুরূপ। এই কবির বৃন্দাবনমহিমামৃত’ কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা অবলম্বনে রচিত বিশাল গ্রন্থ। চৈতন্যের সমসাময়িক রঘুনাথদাস রচিত বহু স্তোত্রের মধ্যে কয়েকটির নাম এইরূপ—’চৈতন্যাষ্টক’, ‘গৌরাঙ্গস্তবকল্পবৃক্ষ’, ব্রজবিলাসস্তব। দাস্যভাবে রাধার সেবা করিবার সঙ্কল্প বিলাপকুসুমাঞ্জলি’তে ব্যক্ত হইয়াছে। ‘স্বসঙ্কল্পপ্রকাশ’-এ রাধা-উপাসনা ব্যতীত কৃষ্ণলাভ হয় না, কবির এই বিশ্বাস প্রমাণিত হইয়াছে। জীবগোস্বামীর ‘গোপালবিরুদাবলী’ কাব্যের বিষয়বস্তু কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা।

রূপ গোস্বামী বহু স্তোত্র, বিরুদ ও গীত রচনা করিয়াছিলেন। স্তোত্রগুলির মধ্যে কতক চৈতন্যবিষয়ক, অপরগুলির উপজীব্য রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা। স্তোত্রগুলির মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য কুঞ্জবিহাষষ্টক’, মুকুন্দমুক্তাবলী’, ‘উকলিকাবল্লরী ও ‘স্বয়মুৎপ্রেক্ষিতলীলা। গোবিন্দবিরুদাবলী’ ও ‘অষ্টাদশচ্ছন্দঃ’ রূপরচিত দুইটি উল্লেখযোগ্য বিরুদ। কৃষ্ণজন্ম’ ‘বসন্তপঞ্চমী’ ‘দোল’ ও ‘রাস’ এই চারিটি প্রসঙ্গ রূপের ‘গীতাবলি’র বিষয়বস্তু; ইহাতে ৪১টি গীত গীতগোবিন্দের অনুকরণে রাগসম্বলিত হইয়াছে। দার্শনিক মধুসূদন সরস্বতীর (১৬শ শতক) আনন্দ মন্দাকিনী’তে আছে শার্দূলবিক্রীড়িত ছন্দে কৃষ্ণের স্তুতি। নিকুঞ্জকেলিবিরুদাবলী’ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী (১৭শ শতক) কর্ত্তৃক রচিত। বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের (১৭শ ১৮শ শতক) কতক স্তোত্র গ্রন্থের নাম হনুমৎস্তোত্র, শিবশতক, তারাস্তোত্র ও কাশীশতক।

৪। কোশকাব্য : এই শ্রেণীর কাব্যরচনার ইতিহাসে বাংলা দেশের দান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপলভ্যমান কোশকাব্যসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘সুভাষিতরত্নকোষ’। বাংলার জগদ্দলবিহারের বৌদ্ধ পণ্ডিত বিদ্যার (আ ১১শ-১২শ শতক) ইহা সংকলন করিয়াছিলেন। ইহারই খণ্ডিতরূপ পূর্বে ‘কবীন্দ্রবচন সমুচ্চয়’ নামে প্রকাশিত হইয়াছিল। কোশকাব্যে থাকে বিভিন্ন কবির বিবিধ বিষয়ক শ্লোকসমূহের সংকলন; পরস্পরনিরপেক্ষ এই শ্লোকসমষ্টি নানা প্রকরণে গ্রথিত হয়। লক্ষ্মণসেনের সভাসদ শ্রীধরদাস রচিত ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’র কথা প্রথমভাগে উল্লিখিত হইয়াছে। রূপগোস্বামীর ‘পদ্যাবলী’তে আছে শুধু কৃষ্ণলীলা ও কৃষ্ণভক্তিবিষয়ক শ্লোকসমষ্টি; শ্লোকগুলির মধ্যে কতক রূপের স্বরচিত। ‘সূক্তিমুক্তাবলী’ বিশ্বনাথ সিদ্ধান্তপঞ্চানন (১৫শ-১৬শ শতক) কর্ত্তৃক সঙ্কলিত। গোবিন্দদাস মহামহোপাধ্যায়ের ‘সৎকাব্যরত্নাকরে ৩১৪৬টি শ্লোক আছে; গ্রন্থকার ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ববর্তী।

৫। দূতকাব্য : রুদ্র ন্যায়বাচস্পতির (১৫শ-১৬শ শতক) ভ্রমরদূতের আখ্যানভাগ এই যে, রাবণহৃতা সীতাদেবীর নিকট হইতে অভিজ্ঞানমণিসহ আগত হনুমানের দর্শনে আকুল রামচন্দ্র পর্বতে ভ্রমণকালে একটি ভ্রমর দেখিতে পান এবং উহাকে সীতাসমীপে গমনার্থে দূত নিযুক্ত করেন। দায়ভাগ’-এর টীকাকার শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারের (১৮শ শতক) চন্দ্রদূত’-এর বিষয়বস্তু রামচন্দ্রকর্ত্তৃক লঙ্কাস্থিত সীতাদেবীর নিকট চন্দ্রকে দূতরূপে প্রেরণের প্রয়াস।

এই শ্রেণীর অন্যান্য দূতকাব্য ‘পদ্মদূত’ বকদূত’ ‘বাতদূত এবং ‘মেঘদৌত্য’। কালীপ্রসাদ-রচিত ‘ভক্তিদূত’-এর বিষয়বস্তু ভক্তকর্ত্তৃক তৎপ্রিয়া মুক্তির সমীপে ভক্তিকে দূতরূপে প্রেরণ।

৬। গদ্যকাব্য ও চম্পূ: ‘হিতোপদেশ’-রচয়িতা নারায়ণকে (১৩৭০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ববর্তী) বাঙালী বলিয়া মনে করা হয়। ইহা ‘পঞ্চতন্ত্রের একটি রূপ (Verson) মূলগ্রন্থের পাঁচটি প্রসঙ্গের স্থলে ইহাতে চারিটি প্রসঙ্গ সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। পদ্মনাভ মিশ্রের (ষোড়শ শতক) বীরভদ্রদেবচম্পূতে তদীয় পৃষ্ঠপোষক বঘেলবংশীয় বীরভদ্রের (বা রুদ্রদেবের) কীর্তিকলাপ বর্ণিত আছে। কাল্পনিক প্রেমিক ও প্রেমিকার প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে কোটালীপাড়ার কৃষ্ণনাথের (সপ্তদশ শতক) ‘আনন্দলতিকাঁচ রচিত। চিরঞ্জীবের (সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতক) ‘বিদ্বন্মোদতরঙ্গিণী’ নামক চম্পুকাব্যে বিভিন্ন আস্তিক ও নাস্তিক দর্শনের মূল মতবাদ এবং বৈষ্ণব, শাক্ত প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক ধর্ম্মের তত্ত্ব সংক্ষেপে অথচ সরল ও সরস ভাষায় লিপিবদ্ধ আছে।

নাট্যসাহিত্য

কাব্যের তুলনায় বাংলা দেশে রচিত নাট্যগ্রন্থের সংখ্যা অল্প। মদনের (১২শ-১৩শ শতক) পারিজাতমঞ্জরী’ বা ‘বিজয়শ্রী গুজরাটরাজ জয়সিংহের সহিত যুদ্ধে পরমাররাজ অর্জুনবর্ম্মার জয়লাভের স্মারকগ্রন্থ স্বরূপে রচিত হইয়াছিল। মধুসূদন সরস্বতীর (ষোড়শ শতক) নাট্যগ্রন্থের নাম কুসুমাবচয়’। রূপগোস্বামীর নাট্যগ্রন্থ তিনটি–দানকেলিকৌমুদী’, ‘বিদগ্ধমাধব’ ও ললিতমাধব’। সানুচর কৃষ্ণকর্ত্তৃক রাধাসহ গোপীগণের নিকট শুল্ক দাবী করিয়া তাঁহাদের পথরোধ এবং অবশেষে পৌর্ণমাসী কর্ত্তৃক রাধাকে শুল্করূপে দানের প্রস্ত বি ভাণিকা শ্রেণীর গ্রন্থ ‘দানকেলিকৌমুদী’র বিষয়বস্তু। পূর্বরাগ হইতে আরম্ভ করিয়া সংক্ষিপ্ত সঙ্কীর্ণ সম্ভোগ পর্যন্ত রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলাকে নাট্যরূপ দেওয়া হইয়াছে সপ্তাঙ্ক ‘বিদগ্ধমাধবে। দশাঙ্ক ললিতমাধব’-এ কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা এবং মথুরা ও দ্বারকার জীবন বর্ণিত হইয়াছে। সম্ভবত কৃষ্ণমিশ্রের ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়ের আদর্শে রচিত কবিকর্ণপুরের দশাঙ্ক নাটক ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয়ে’ চৈতন্যের জীবনের প্রধান ঘটনাবলীকে নাট্যরূপ দেওয়া হইয়াছে। বারভুঞার অন্যতম নোয়াখালির ভুলুয়ার লক্ষ্মণমাণিক্যের (মোড়শ শতক) দুইখানি নাটক পাওয়া যায় ‘বিখ্যাতবিজয়’ ও ‘কুবলয়াশ্বচরিত’। বিখ্যাতবিজয়’ মহাভারতের কর্ণবধ অবলম্বনে রচিত। মহাভারতের মদালসা ও কুবলয়াশ্বের আখ্যান কুবলয়াশ্বের উপজীব্য। লক্ষ্মণমাণিক্যের পুত্র অমরমাণিক্য বাণাসুরকন্যা ঊষার কাহিনী অবলম্বনে বৈকুণ্ঠবিজয়’ রচনা করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণ-মাণিক্যের সভাপতি কবিতার্কিক ‘কৌতুকরত্নাকর” নামক প্রহসনে পুণ্যবর্জিত নামক নগরের দুরিতার্ণব নামক রাজার নির্বুদ্ধিতার চিত্র অঙ্কন করিয়াছেন। কৌতুকসর্বস্ব’ নামক প্রহসনে গোপীনাথ চক্রবর্তী কলিবৎসল নামক রাজার বিশৃঙ্খলাময় রাজ্যশাসন এবং ব্রাহ্মণগণের উপর অত্যাচার বর্ণনা করিয়াছেন। সম্ভবত বঙ্গে তুর্কী আক্রমণের পরবর্তী শ্রীহর্ষ বিশ্বাসের পুত্র রামচন্দ্র যযাতির পৌরাণিক আখ্যান অবলম্বনে ‘ঐন্দবানন্দ’ নাটক রচনা করেন। চন্দ্রাভিষেক’ নামক নাটকটি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার (১৭শ-১৮শ শতক) কর্ত্তৃক রচিত।

পুরাণ

পুরাণ ও উপপুরাণশ্রেণীর কতক গ্রন্থ বাংলা দেশে রচিত বলিয়া কেহ কেহ মনে করেন। কতক যুক্তিপ্রমাণ বইতে এইগুলির উৎপত্তিস্থল বঙ্গদেশ বলিয়া মনে হয়। আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে বা তৎপূর্ববর্তীকালে রচিত বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণের বিষয়বস্তু বিবিধ পৌরাণিক আখ্যান-উপাখ্যান, বর্ণাশ্রমধর্ম, স্ত্রীধর্ম, পূজাব্রত, জাতিনিরূপণ, সঙ্করজাতি, দানধর্ম, কৃষ্ণের জন্ম ও লীলা প্রভৃতি। ইহাতে ছত্রিশ সঙ্করজাতির এবং ‘রায়’, ‘দাস’, ‘দেবী’, ‘দাসী’ প্রভৃতি পদবীর উল্লেখ বাংলা দেশে প্রচলিত কালীমূর্ত্তির বর্ণনা, বাংলা দেশের নদী পদ্মাবতী (= পদ্মা) ও ত্রিবেণীর (= মুক্তবেণী) উল্লেখ, গীতগোবিন্দে’র প্রভাব, বাঙালী কবির প্রিয় ‘চৌত্রিশা’ নামক রচনাপদ্ধতি প্রভৃতি হইতে ইহা বাংলা দেশে রচিত বলিয়া মনে হয়। এই পুরাণোক্ত শারদীয়া পূজা এবং রাসযাত্রা বাংলা দেশে অদ্যাবধি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ইহার অদ্যাবধিপ্রাপ্ত পুঁথিগুলির প্রায় সবই বঙ্গদেশে প্রাপ্ত ও বঙ্গাক্ষরে লিখিত। আনুমানিক চতুর্দ্দশ শতকের বা তৎপরবর্তী কালের বৃহন্নান্দি কেশ্বরপুরাণে’র অদ্যাবধি আবিষ্কৃত সকল পুঁথিই বাংলা দেশে প্রাপ্ত এবং বঙ্গাক্ষরে লিখিত; নন্দিকেশ্বরপুরাণের ক্ষেত্রেও ইহা প্রযোজ্য। এই দুই পুরাণোক্ত দুর্গাপূজা একমাত্র বাংলা দেশেই প্রচলিত। এই সকল কারণে এই দুই গ্রন্থ বাংলা দেশে রচিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়।

আনুমানিক এয়োদশ-চতুর্দ্দশ শতকে রচিত মহাভাগবতপুরাণ’-এর আলোচ্য বিষয়সমূহের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য দেবী কর্ত্তৃক দশমহাবিদ্যার রূপধারণ, দক্ষযজ্ঞনাশ, একান্নটি মহাপীঠের উৎপত্তি, পদ্মানদীর উৎপত্তি, শারদীয়া পূজায় দেবীর অকালবোধন, রাম কর্ত্তৃক তাড়কাবধ হইতে রামরাবণের যুদ্ধ পর্যন্ত রামায়ণ-বর্ণিত ঘটনাবলী ইত্যাদি। ইহাতে ভাগীরথী ও পদ্মা নদীর সহিত নিবিড় পরিচয়, এই পুরাণবর্ণিত শারদীয়া পূজার সহিত বর্তমান বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজার সাদৃশ্য, ইহাতে প্রযুক্ত ‘গর্বচূর্ণ’, ‘লোকলজ্জা’ প্রভৃতি শব্দের বর্তমান বাংলা ভাষায় প্রতিরূপ প্রভৃতি হইতে ইহা বাংলা দেশে রচিত বলিয়া মনে হয়। এই পুরাণের প্রায় সকল পুঁথিই বাংলা দেশে প্রাপ্ত এবং বঙ্গাক্ষরে লিখিত।

বর্তমান ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’-এর আদিম রূপের উদ্ভব হয় আনুমানিক খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকে; দশম হইতে ষোড়শ শতকের মধ্যে, বোধ হয়, ইহার নবরূপায়ণ হইয়াছিল। এই পুরাণ চারিটি খণ্ডে বিভক্ত–ব্রহ্মখণ্ড, প্রকৃতিখণ্ড, গণপতিখণ্ড ও কৃষ্ণজন্মখণ্ড। ইহার প্রধান আলোচ্য বিষয় কৃষ্ণের মাহাত্ম ও লীলা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনের উপরে এই পুরাণের প্রভাব গভীর। ইহাতে বাংলা দেশে বর্তমান সঙ্করবর্ণসমূহের বিবরণ, বৈদ্য উপবর্ণের উল্লেখ, কৈবর্তগণের উদ্ভবের সবিস্তার বর্ণনা প্রভৃতি হইতে ইহাকে বাংলা দেশের রচনা বলিয়া মনে করা হয়।

উল্লিখিত গ্রন্থগুলি ছাড়া ‘কল্কিপুরাণ’ (অষ্টাদশ শতকের পূর্ববর্তী) কোন কোন যুক্তিবলে বাংলা দেশে রচিত হইয়াছিল বলিয়া অনুমান করা হয়।

গৌড় দরবারের জনৈক কর্মচারী কুলধর, গোবর্ধন পাঠকের সাহায্যে, ‘পুরাণ সর্বস্ব’ নামে পুরাণ ও স্মৃতিবিষয়ক সংগ্রহগ্রন্থ সংকলন করিয়াছিলেন ১৪৭৪-৭৫ খ্রীষ্টাব্দে। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সাক্ষ্য অনুসারে ইহাতে ইতিহাস, ভূগোল, রাজ্য শাসনপদ্ধতি ও পূজাপদ্ধতি সম্বন্ধে বিভিন্ন পুরাণ হইতে শ্লোকসমূহ উদ্ধৃত ও ব্যাখ্যাত হইয়াছে।

নদীয়ারাজ রুদ্ররায় কর্ত্তৃক সপ্তদশ খ্রীষ্টাব্দে ১৪০০০-এরও অধিকসংখ্যক শ্লোকে ‘পুরাণসার রচিত হইয়াছিল। এই জাতীয় অপর একখানি গ্রন্থ রাধাকান্ত তর্কবাগীশরচিত ‘পুরাণার্থপ্রকাশক’; ইহাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে পুরাতন রাজবংশের বর্ণনা আছে।

পুরাণ এবং পুরাণের সারসংকলন ছাড়াও কতক বাঙালী পণ্ডিত ‘চণ্ডী” ও ‘ভাগবত’-এর ব্যাখ্যা রচনা করিয়াছেন। কেহ কেহ পূজাপদ্ধতিও প্রণয়ন করিয়াছেন।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও ভক্তিতত্ত্ব

প্রাচীন হিন্দুদর্শনের সহিত তুলনায় বৈষ্ণবদর্শনের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বহু। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ষড়দর্শনের মধ্যে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে মতভেদ থাকিলেও প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ–এই চারিটি প্রমাণ সর্ববদিসম্মত। বৈষ্ণবদর্শনে একমাত্র শব্দপ্রমাণই স্বীকৃত হইয়াছে। প্রাচীন দর্শনে শব্দপ্রমাণে শ্রুতি বা বেদ গৃহীত হইয়াছে; বৈষ্ণবগণের মতে, বৈষ্ণব পুরাণ, বিশেষত ভাগবত’, শব্দপদবাচ্য। পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার একীভাব প্রাচীন দর্শনে চরম লক্ষ্য বলিয়া পরিগণিত। বৈষ্ণবদর্শনে কৃষ্ণই পরম দেবতা এবং কৃষ্ণপ্রাপ্তি ভক্তের চরম লক্ষ্য। নবদ্বীপের বৈষ্ণবগণের মতে, চৈতন্য একাধারে কৃষ্ণ ও রাধা এবং তিনিই চরম সত্তা ও পরম উপেয়–ইহাই গৌরপারম্যবাদ।

বাসুদেব সার্বভৌম তত্ত্বদীপিকা’ গ্রন্থে বৈষ্ণবদর্শনের কিছু আলোচনা করিয়াছেন। বৃহদ্ভাগবতামৃত’ নামক গ্রন্থে সনাতন ভক্তিতত্ত্ব বিশ্লেষণ পূর্বক কৃষ্ণলীলা ও কৃষ্ণপ্রাপ্তির উপায় আলোচনা করিয়াছেন। সনাতন ভাগবতে’র দশম স্কন্ধের বৈষ্ণবতোষণী’ নামক ব্যাখ্যা রচনা করেন। বৃহদ্ভাগবতামৃতের সংক্ষেপণ স্বরূপ রূপগোস্বামী ‘সংক্ষেপ (বা, লঘু-) ভাগবতামৃত’ রচনা করিয়াছেন; ইহাতে কৃষ্ণের স্বরূপ বর্ণনার পরে ভক্তের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণীবিভাগ আছে। রূপ ও সনাতনের ভ্রাতুষ্পুত্র জীবগোস্বামীর ছয়টি দর্শনগ্রন্থ ষট্‌সন্দর্ভ নামে পরিচিত; ইহাদের নাম ‘তত্ত্বসন্দর্ভ, ভগবৎসন্দর্ভ’, ‘পরমাত্মসন্দর্ভ’, শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’,

ভক্তিসন্দর্ভ’, ও ‘প্রীতি-সন্দর্ভ’। প্রথম তিনটি সন্দর্ভের পরিশিষ্টস্বরূপ জীব। ‘সর্বসংবাদিনী’ নামক গ্রন্থখানিও রচনা করিয়াছিলেন। সন্দৰ্ভগুলিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শন পরিচ্ছন্নরূপে আলোচিত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে গ্রন্থকারের মৌলিক চিন্তা ও রচনার পারিপাট্য উল্লেখযোগ্য। উক্ত ‘বৈষ্ণবতোষণী’র ‘লঘুতোষণী’ নামক সংক্ষিপ্তসার জীব-প্রণীত। ভাগবতে’র ‘ক্রমসন্দর্ভ টীকা, অগ্নি ও পদ্মপুরাণের অংশবিশেষ টীকা ‘গোপালতাপনী’ উপনিষদ ও ব্রহ্মসংহিতা’র টীকা এবং কৃষ্ণার্চনার পদ্ধতিস্বরূপ কৃষ্ণার্চাদীপিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থও জীবরচিত।

‘ভাগবতে’র ও ‘ভগবদগীতা’র টীকা ছাড়াও বিশ্বনাথ চক্রবর্তী রাগবচন্দ্রিকা ও মাধুর্যকাদম্বিনী’ প্রভৃতি দশখানি গ্রন্থ বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শন অবলম্বনে রচনা করিয়াছিলেন। ঈশ্বর ও সখা প্রভৃতি রূপে কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর সাধ্যসাধনকৌমুদী’র প্রতিপাদ্য বিষয়। গৌরগণোদ্দেশদীপিকা’য় কবিকর্ণপুর বিশিষ্ট বৈষ্ণবগণের জীবনী প্রসঙ্গে অনেক তত্ত্বের আলোচনা করিয়াছেন। সম্ভবত খ্র ১৭শ শতকের রূপ কবিরাজের ‘সারসংগ্রহ’ বৈষ্ণব দর্শনে একখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের আচার ও ধর্ম্মানুষ্ঠান সম্বন্ধে সর্বাপেক্ষা প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘হরিভক্তিবিলাস’। কেহ কেহ মনে করেন, ইহা বা অন্তত ইহার কাঠামোটি, সনাতনরচিত। কাহারও কাহারও মতে, ইহা গোপালভট্ট কর্ত্তৃক রচিত বা পরিবর্ধিত; এই গোপালভট্ট বৃন্দাবনের ষট্‌গোস্বামীর অন্যতম কিনা বলা যায় না। গোপালভট্টের নামাঙ্কিত ‘সৎক্রিয়াসারদীপিকা’ উক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্টস্বরূপ; ইহাতে গৃহানুষ্ঠানাদি আলোচিত হইয়াছে। গোপালদাসের (১৬ শতক) ভক্তিরত্নাকর’-এ মুক্তিলাভের উপায় স্বরূপ কৃষ্ণভক্তির প্রাধান্য এবং ভাগবতে’র প্রামাণিকতা প্রতিপাদনের প্রয়াস রহিয়াছে। বলদেব বিদ্যাভূষণের (১৮শ শতক) ‘প্রমেয়রত্নাবলী’ গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম সম্বন্ধে প্রামাণ্য গ্রন্থ। বেদান্তসূত্রের বলদেবরচিত ব্যাখ্যার নাম ‘গোবিন্দভাষ্য’; ইহারই সংক্ষিপ্তসার তাঁহার রচিত ‘সিদ্ধান্তরত্ন’ বা ‘ভাষ্যপীঠক’। ভগবদগীতা এবং দশোপনিষদের টীকাও বলদেবরচিত। উড়িষ্যার লোক হইয়া থাকিলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সহিত বলদেবের সম্বন্ধ ছিল ঘনিষ্ঠ। শান্তিপুরের রাধামোহন গোস্বামী ভট্টাচার্যের ‘ভাগবততত্ত্বসার’ বৈষ্ণব শাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কৃষ্ণভক্তিসুধার্ণব’, ‘কৃষ্ণতত্ত্বার্ণব’, ‘ভক্তিরহস্য প্রভৃতি নয়খানি নিবন্ধ ও টীকা রাধামোহন রচিত।

অলঙ্কার, ছন্দ, নাট্যশাস্ত্র ও বৈষ্ণবরসশাস্ত্র

অলঙ্কার, ছন্দ ও নাট্যকলা বিষয়ে বাংলা দেশের দান সামান্য। এই সকল শাস্ত্র সম্বন্ধে বাঙালী-রচিত যে কয়খানি গ্রন্থ আছে, উহাদের মধ্যে বিশেষ মৌলিকতা নাই। বৈষ্ণবরসশাস্ত্রে বাঙালীর কীর্তি গৌরবের বিষয়।

কবিকর্ণপুরের ‘অলঙ্কারকৌস্তুভ’ মম্মটের কাব্যপ্রকাশ’ অনুসরণে রচিত। বিশেষত্ব এই যে, ‘অলঙ্কারকৌস্তুভে’র অধিকাংশ উদাহরণশ্লোক কৃষ্ণস্তুতিবিষয়ক। ইহাতে ভক্তি, বাৎসল্য ও প্রেম রসরূপে পরিগণিত হইয়াছে। খ্ৰীষ্টীয় ১৭শ শতকের কবিচন্দ্র ‘কাব্যচন্দ্রিকা’ নামক গ্রন্থে অলঙ্কারশাস্ত্রের মোটামুটি বিষয় এবং নাট্যশাস্ত্র আলোচনা করিয়াছেন। একই শতকের রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতি ‘কাব্যরত্নাবলী’ নামক অলঙ্কারগ্রন্থের রচয়িতা। বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রণয়ন করিয়াছিলেন কাব্যকুম্ভভ। রামদেব (বা, বামদেব) চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের ‘কাব্যবিলাস’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ইনি চমৎকারিত্বকে কাব্যের প্রধান লক্ষণ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। মায়ারস এবং বৈষ্ণবগণের বাৎসল্য, ভক্তি প্রভৃতি রস তদীয় গ্রন্থে স্বীকৃত হয় নাই। অলঙ্কারসমূহের উদাহরণশ্লোক চিরঞ্জীবের স্বরচিত।

উল্লিখিত গ্রন্থাবলী ছাড়াও প্রাচীন অলঙ্কারগ্রন্থাদির, বিশেষতঃ ‘কাব্যপ্রকাশ’ এবং ‘সাহিত্যদর্পণে’র কয়েকখানি টীকা বাঙালী রচিত। তন্মেধ্যে পরমানন্দ চক্রবর্তীর কাব্যপ্রকাশবিস্তারিকা’, জয়রামের ‘কাব্যপ্রকাশ-তিলক’ এবং রামচরণ তর্কবাগীশের সাহিত্যদর্পণটীকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

‘ছন্দোমঞ্জরী’র রচয়িতা গঙ্গাদাস বৈদ্য বলিয়া আত্মপরিচয় দেওয়ায় তিনি বাঙালী ছিলেন বলিয়া মনে হয়। তাঁহার গ্রন্থে একটি অবহট্ঠ শ্লোক উদ্ধৃত হওয়ায় তাঁহার জীবনকালের ঊর্ধ্বসীমারেখা খ্রীষ্টীয় চতুর্দ্দশ শতকের শেষ দিকে টানা যায়। ইহাতে সন্নিবিষ্ট উদাহরণশ্লোকগুলির অধিকাংশই গ্রন্থকারের রচনা এবং কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলাবিষয়ক। বৃত্তমালা’ নামক দুইখানি গ্রন্থের মধ্যে একখানি কবিকর্ণপুরের নামাঙ্কিত এবং অপরটি রামচন্দ্ৰ কবিভারতী প্রণীত। চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের বৃত্তরত্নাবলী’ নামক গ্রন্থে উদাহরণস্বরূপ সুজাউদ্দৌলার সময়ে ঢাকার নায়েব দেওয়ান যশোবন্ত সিংহের প্রশস্তিসূচক শ্লোক আছে। চন্দ্রমোহন ঘোষের ‘ছন্দঃসারসগ্রহ’ একখানি সঙ্কলনগ্রন্থ। কাশীনাথ চৌধুরী (অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক) ‘পদ্যমুক্তাবলী’ নামক ছন্দগ্রন্থের রচয়িতা।

রূপগোস্বামীর নাটকচন্দ্রিকা ছাড়া বাংলা দেশে নাট্যশাস্ত্র সম্বন্ধে স্বতন্ত্র কোন গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় না। দশটি রূপকের মধ্যে একমাত্র নাটক ইহাতে আলোচিত হইয়াছে। এই গ্রন্থের অধিকাংশ উদাহরণ বৈষ্ণব গ্রন্থসমূহ হইতে গৃহীত।

তুলনায় বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়। প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রের সাহিত্যিক রসের পরিবর্তে বৈষ্ণবগণ ঐ শাস্ত্রের ভক্তিনামক ভাবকে রস বলিয়া প্রতিপন্ন করিলেন; এই রসের স্থায়িভাব কৃষ্ণরতি এবং ইহার আস্বাদ করিবেন অলঙ্কারশাস্ত্রের সহৃদয়ের পরিবর্তে ভক্ত। প্রাচীনতর শাস্ত্রের আটটি (শান্ত সহ নয়টি) রসের স্থলে বৈষ্ণবগণ পাঁচটি মুখ্য ভক্তিরস স্বীকার করিলেন; যথা–শান্ত, প্রীত, প্রেয়, বাৎসল্য ও মধুর। শৃঙ্গাররসের নাম ইঁহারা দিলেন মধুর, উজ্জ্বল বা শৃঙ্গার ভক্তিরস; এই রস ভক্তিরসরাজ এবং আলম্বন বিভাগ স্বয়ং কৃষ্ণ। উক্ত মুখ্য ভক্তিরস ছাড়াও তাঁহারা সাতটি গৌণ ভক্তিরস স্বীকার করিয়াছেন, যথা–বীর, বীভৎস, রৌদ্র, হাস্য, ভয়ানক, করুণ ও অদ্ভুত।

বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে রূপগোস্বামীর অক্ষয় কীর্তি ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ও ‘উজ্জ্বলনীলমণি’। প্রথমোক্ত গ্রন্থে রূপ ভক্তিরসের বিশ্লেষণ করিতে গিয়া ভাব ও বিভাব প্রভৃতির সংজ্ঞানির্দেশ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিভাগ করিয়াছেন। রসশাস্ত্রে উজ্জ্বলরসের প্রাধান্যহেতুই, বোধ হয়, রূপগোস্বামী শুধু এই রসের বিশ্লেষণে ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ রচনা করিয়াছিলেন। ইহাতে কৃষ্ণকে ‘নায়কচূড়ামণি’, এবং রাধাকে তাঁহার ‘তন্ত্রে প্রতিষ্ঠিতা’ হ্লাদিনী শক্তিরূপে কল্পনা করা হইয়াছে, নায়িকার শ্রেণীভাগ ও সম্ভোগ এবং বিপ্রলম্ভশৃঙ্গারের নানা অবস্থার বিশ্লেষণ করা হইয়াছে। উক্ত গ্রন্থদ্বয়ের সংক্ষিপ্তসার রচনা করিয়াছেন বিশ্বনাথ চক্রবর্তী যথাক্রমে ভক্তিরসামৃতসিন্ধুবিন্দু এবং উজ্জ্বলনীলমণিকিরণ’ নামক গ্রন্থে। রূপের গ্রন্থদ্বয়ের ব্যাখ্যা করিয়াছেন জীবগোস্বামী; ব্যাখ্যাগ্রন্থ দুইখানির নাম যথাক্রমে– ‘দুর্গমসংগমনী, এবং ‘লোচনরোচনী”। রূপের দুইটি গ্রন্থের পরিশিষ্টস্বরূপ ‘রসামৃতশেষ’ নামক গ্রন্থও সম্ভবত জীবরচিত।

ব্যাকরণ

টীকাকার সৃষ্টিধরের সাক্ষ্য অনুসারে পুরুষোত্তমদেব লক্ষ্মণসেনের আদেশে ‘অষ্টাধ্যায়ী’র ‘ভাষাবৃত্তি’ নামক ব্যাখ্যা রচনা করিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া, পুরুষোত্তমের গ্রন্থে বর্গীয় ‘ব’ ও অন্তঃস্থ ‘ব’ এর কোন ভেদ দেখা যায় না। একটি সূত্রের ব্যাখ্যায় বৃত্তিকার পদ্মাবতী (= পদ্মা) নদীর উল্লেখ করিয়াছেন। এই সকল কারণে তাঁহাকে বাঙালী মনে করা হয়। বৌদ্ধ বলিয়াই সম্ভবত পুরুষোত্তম ‘অষ্টাধ্যায়ী’র বৈদিক অংশ বর্জন করিয়াছেন। ভাষাবৃত্তি সংক্ষিপ্ত অথচ সহজবোধ্য। ‘দুর্ঘটবৃত্তি’-রচয়িতা শরণদেব ও লক্ষ্মণসেনের সভাকবি শরণ, কাহারও কাহারও মতে অভিন্ন। যে সকল প্রয়োগ আপাতদৃষ্টিতে অপাণিনীয় উহাদের শুদ্ধিবিচার এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। রূপগোস্বামীর (মতান্তরে সনাতনের বা জীবের) সংক্ষেপ-(বা, লঘু-) হরিনামামৃতব্যাকরণের বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে সংজ্ঞা ও উদাহরণগুলি রাধাকৃষ্ণের বা কৃষ্ণলীলার নামাঙ্কিত। ইহার অধিকাংশ সূত্রে বিষ্ণুর বা তাঁহার সহিত সংশ্লিষ্ট দেবদেবীর নাম আছে। জীবগোস্বামীর ‘হরিনামামৃত ব্যকরণ বৃহত্তর গ্রন্থ এবং একই উদ্দেশ্যে রচিত। স্বরচিত ব্যাকরণের পরিশিষ্টস্বরূপ ইনি ‘ধাতুসংগ্রহ’ বা ‘ধাতুসূত্রমালিকা’ (?) নামক গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন।

‘অষ্টাধ্যায়ী’র সংক্ষিপ্তরূপ সংক্ষিপ্তসার’ নামক ব্যাকরণের প্রণেতা ক্রমদীশ্বর (পঞ্চদশ শতক?) কাহারও কাহারও মতে ছিলেন বাঙালী। পুণ্ডরীকাক্ষ বিদ্যাসাগর (ষোড়শ শতকের পূর্ববর্তী?) দুর্গসিংহের ‘কাতন্ত্রবৃত্তিটীকা’র ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ‘কাতন্ত্রপ্রদীপ’ গ্রন্থে। ইহা ছাড়া, ‘ন্যাসটীকা’, ‘কারককৌমুদী’, ‘তত্ত্বচিন্তামণিপ্রকাশ’ ও ‘কাতন্ত্রপরিশিষ্টটীকা’ পুণ্ডরীকাক্ষরচিত। বলরাম পঞ্চাননের ‘প্রবোধপ্রকাশ’ শৈব সম্প্রদায়ের ব্যাকরণ; ইহাতে স্বরবর্ণের নাম ‘শিব’ ও ব্যঞ্জনবর্ণসমূহ অভিহিত হইয়াছে শক্তি’ নামে। ধাতুপ্রকাশ’ নামক ধাতুপাঠ বলরামের নামের সহিত যুক্ত।

উল্লিখিত গ্রন্থাবলী ছাড়া বাঙালী পণ্ডিতগণ বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থ ও টীকাটিপ্পনী রচনা করিয়াছিলেন। এই জাতীয় গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভরত সেন বা ভরত মল্লিকের ‘দ্রুতবোধব্যাকরণ’, ‘সুখলেখন এবং তারানাথ তর্কবাচস্পতির ‘আশুবোধব্যাকরণ’। টীকাটিপ্পনীসমূহের মধ্যে ত্রিলোচন দাসের কাতন্ত্রবৃত্তিপঞ্জিকা উল্লেখযোগ্য। এই জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে কাতন্ত্রব্যাকরণের সংক্ষিপ্তসার বা টীকার সংখ্যাই অধিকতর। অনেক বাঙালী নৈয়ায়িক ব্যাকরণের নানা বিষয় সম্বন্ধে বহু বাদগ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন।

১০

অভিধান

বাঙালী পণ্ডিতগণ শুধু প্রসিদ্ধ অভিধানের টীকা রচনা করিয়াই নিবৃত্ত হন নাই। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ অভিধানগ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন। এই অভিধানগুলির মধ্যে অভিনব কয়েকটি প্রণালীতে রচিত।

সম্ভবত বৈয়াকরণ পুরুষোত্তমদেবের সহিত অভিন্ন পুরুষোত্তমদেবের ‘ত্রিকাণ্ডশেষ’ বিখ্যাত অভিধান। ‘নামলিঙ্গানুশাসন’ বা ‘অমরকোষে’র অপূর্ণ অংশ পূরণ করাই অভিধানকারের উদ্দেশ্য-ইহা তিনি এই গ্রন্থে (১১।২) নিজেই বলিয়াছেন। পুরুষোত্তমের অপর অভিধানগুলির নাম ‘হারাবলী’, ‘বর্ণদেশনা’ ও ‘দ্বিরূপকোষ’। প্রথম গ্রন্থটিতে সাধারণত অপ্রচলিত প্রতিশব্দ ও সমধ্বনিবিশিষ্ট ভিন্নার্থক শব্দসমূহ সংগৃহীত হইয়াছে। দ্বিতীয়টিতে আছে বিভিন্নরূপ বর্ণবিন্যাসবিশিষ্ট শব্দসমুহের সংগ্রহ। ইহাতে সংগৃহীত শব্দগুলির বর্ণবিন্যাসপদ্ধতি দ্বিবিধ। ‘একাক্ষরকোষ’ নামক অভিধানও ইহার নামাঙ্কিত। চাটুগ্রাম (= চট্টগ্রাম?) নিবাসী জটাধর (পঞ্চদশ শতক?) অভিধানতন্ত্র নামক গ্রন্থের রচয়িতা। পঞ্চদশ শতকের বৃহস্পতি রায়মুকুট রচনা করিয়াছিলেন ‘অমরকোষে’র বিস্তৃত টীকা ‘পদচন্দ্রিকা। বর্তমান গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ইহার সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে। ভরত মল্লিকের (আ সপ্তদশ শতক) অভিধান দুইটি-একবর্ণার্থসংগ্রহ’ ও ‘দ্বিরূপধ্বনিসংগ্রহ। তাঁহার মুগ্ধবোধিনী’ ‘অমরকোষে’র টীকা। লিঙ্গাদিসংগ্রহ’ নামক গ্রন্থে তিনি ‘অমরকোষ’-ধৃত শব্দগুলির লিঙ্গ নির্দেশ করিয়াছেন।

সপ্তদশ শতকের মথুরেশ বিদ্যালঙ্কার শব্দরত্বাবলী’ নামক অভিধান রচনা করিয়াছিলেন; নানার্থশব্দ’ ইহারই অংশ। এই মথুরেশ সম্ভবত ‘অমরকোষে’র ‘সারসুন্দরী’ নামক টীকাটিও রচনা করিয়াছিলেন। মথুরেশের গ্রন্থের রচনাকাল দেখা যায় ১৫৮৮ শকাব্দ ( = ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ)। ‘শব্দরত্নাবলী’তে গ্রন্থকারের পৃষ্ঠপোষকস্বরূপ মূর্ছা খা’র উল্লেখ আছে। ইহাকে ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খা বলিয়া কেহ কেহ মনে করেন। প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাসের আনুকূল্যে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গুরু রামানন্দ ন্যায়ালঙ্কারের পুত্র রঘুমণি বিদ্যাভূষণ ‘প্রাণকৃষ্ণ-শব্দাক্কি’ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। রঘুমণির অপর অভিধানের নাম ‘শব্দমুক্তামহার্ণব’।

১১

বিবিধ

বাঙালী-রচিত এমন কতক সংস্কৃত গ্রন্থ আছে যেগুলিকে পূর্ব্বোক্ত কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। এইরূপ বিবিধ বিষয়ক গ্রন্থ বর্তমান প্রসঙ্গে আলোচ্য।

রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতি বা সিদ্ধান্তবাচস্পতি (খ্রী ১৭শ শতক) এবং রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য কতক বৈদিক মন্ত্রের ভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন। চিরঞ্জীব (১৭শ-১৮শ শতক) বিদ্বনন্মাদতরঙ্গিনী’ নামক গ্রন্থে তদীয় পিতা রাঘবেন্দ্র শতাবধান-রচিত মন্ত্ৰার্থদীপ’ (মন্ত্রদীপ?) নামক গ্রন্থের উল্লেখ করিয়াছেন; ইহাতে আছে কতক বৈদিক মন্ত্রের ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত। কাত্যায়নের ‘ছন্দোগপরিশিষ্টে’র ‘ছন্দোগপরিশিষ্টপ্রকাশ’ নামক টীকার রচয়িতা নারায়ণ স্বীয় পরিচয় প্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে, তাঁহার পূর্বপুরুষ ছিলেন উত্তররাঢ়ের অধিবাসী। ‘ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত’-এ নবদ্বীপরাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষগণের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। অনঙ্গরঙ্গ’ নামক গ্রন্থ কল্যাণমল্লভূপতির নামের সহিত যুক্ত; এই কল্যাণমন্ত্র সম্ভবত ভরত মল্লিকের (১৭শ শতক?) পৃষ্ঠপোষক এবং বর্ধমানের অন্তর্গত ভূরশুট নিবাসী ছিলেন। গোবিন্দ রায় ‘স্বাস্থ্যতত্ত্ব’ নামক সংস্কৃত গ্রন্থের প্রণেতা।

‘নাদদীপক’ নামক গ্রন্থে জনৈক ভট্টাচার্য শব্দ, নাদ ও স্বরাদির উৎপত্তি বর্ণনা করিয়া রাগরাগিণী প্রভৃতি নিরূপণের চেষ্টা করিয়াছেন। রঘুনন্দন ‘হরিস্মৃতিসুধাঙ্কুর’ এ রাগরাগিণী নিরূপণপূর্বক হরিবিষয়ক সঙ্গীত নিরূপণ করিতে প্রয়াসী হইয়াছেন।

চম্পাহট্টীয়কুলজাত ঈশানের পুত্র অর্জুন মিশ্র (পঞ্চদশ শতক) মহাভারতের ‘মহাভারতার্থপ্রদীপিকা’ বা ‘ভারতসংগ্রহদীপিকা’ নামক টীকার রচয়িতা।

বাংলা দেশে বহু কুলপঞ্জী সংস্কৃতে রচিত হইয়াছিল। সর্বক্ষেত্রে কুলপঞ্জীর বিবরণ হয়ত নির্ভরযোগ্য নহে; কিন্তু বঙ্গের সামাজিক ইতিহাসের পক্ষে এই সকল গ্রন্থের তথ্য একেবারে অগ্রাহ্য নহে। চন্দ্রকান্ত ঘটকের ‘রাঢ়ীয়কুলকল্পদ্রুম’, ধ্রুবানন্দ মিশ্রের ‘মহাবংশাবলী’, রামানন্দ শর্মার ‘কুলদীপিকা’, ভরত মল্লিকের ‘চন্দ্রপ্রভা’, ‘রত্নপ্রভা’ ও ‘বৈদ্যকুলতত্ত্ব’ এবং রামকান্ত দাসের ‘সদ্বৈদ্যকুলপঞ্জিকা’ প্রভৃতি এই শ্রেণীর উল্লেখয়োগ্য গ্রন্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *