১. চাণক্য সূত্র – প্রথম অধ্যায়

চাণক্য সূত্র – প্রথম অধ্যায়

সাশ্রীর্বোহব্যাত্ ॥ ১ ॥
সুখস্য মূলং ধর্মঃ ॥ ২॥
ধর্মস্য মূলমর্থঃ ॥ ৩॥
অর্থস্য মূলং রাজ্যমঃ ॥৪॥

অনুবাদ : সেই সুপ্রসিদ্ধ শ্রীদেবতা তোমাদের পালন করুন ॥১॥

মর্মার্থ : সূত্রকার নীতি বিশারদ চাণক্য গ্রন্থারম্ভের প্রথমেই সকল সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী শ্রীদেবতার নিকটে নির্বঘ্নে গ্রন্থ সমাপ্তি ও সকলের কল্যাণের নিমিত্ত প্রার্থনা করেছেন। সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণের দ্বারাই শ্রীদৈবত সম্পদের স্থায়িত্বও বৃদ্ধি সম্ভব ॥১॥

অনুবাদ : সুখের মূল বা প্রধান কারণ হলো ধর্ম, অর্থাৎ ধর্ম থেকেই সুখ উৎপন্ন হয় ॥২॥

মর্মার্থ : যে ধর্ম জগৎকে ধারণ করে আছে, সেই ধর্মই সুখের প্রধান কারণ, ধর্ম না হলে সুখ হয় না। অতএব স্বীয় স্বীয় ধর্মানুষ্ঠান করে মানব কীর্তিও সুখ লাভ করে। অধর্মে পাপ ও লোভ সমাজে অশান্তি ও দুঃখ বুদ্ধি পায়, দুঃখ ও পাপ বৃদ্ধিতে লোক সমাজ ক্রমে ধ্বংসের মুখে পতিত হয় ॥২॥

অনুবাদ : ধর্মের মূল বা প্রধান কারণ অর্থ। অর্থাৎ ধৰ্মার্জনের প্রধান উপাদান অর্থ ॥৩॥

মর্মার্থ : পূর্বে সুখের মূল ধর্ম ইহা বলা হয়েছে। এই সূত্রে ধর্মের মূল অর্থ বলা হচ্ছে যে, অর্থ না থাকলে মানবের সংসারযাত্রা নির্বাহ করা দুষ্কর হয়। অর্থ দ্বারা পরোপকার দান, তীর্থ সেবা, জ্ঞানার্জন প্রভৃতি অনায়াসে হয়ে থাকে। দীনব্যক্তি অর্থাভাবে উৎসাহ, উদ্যম, অধ্যবসায় শূন্য হয়ে কার্যক্ষম হয় ॥৩॥

অনুবাদ : অর্থ লাভের একমাত্র মূল রাজ্যই ॥৪॥

মর্মার্থ : রাজা সুশাসনে স্বীয় রাজ্য শাসন করতে পারলে প্রচুর অর্থাগম হয়, রাজ্য হতেই অর্থ লাভ, অর্থ বুদ্ধি ও কোষাগারে অর্থ সঞ্চিত হয়ে থাকে। সেই অর্থ দ্বারা রাজ্যরক্ষা ও তার উন্নতি বিধান করা হয়, অতএব অর্থই রাজার প্রধান সহায়, কখনো অর্থের অপব্যয় করা উচিত নয়। অর্থোবন্ধুমহীনরূজাম’ মহারাজভোজদেব বলিয়াছেন–অর্থই রাজাদের বন্ধু ॥৪॥

রাজ্য মূলমিন্দ্রিয়জয়ঃ ॥ ৫॥
ইন্দ্রিয়-জয়স্য মূলং বিনয়ঃ ॥ ৬ ॥
বিনয়স্য মূলং বৃদ্ধোপসেবা ॥ ৭ ॥
বৃদ্ধ-সেবায়া বিজ্ঞানম্ ॥ ৮ ॥

অনুবাদ : রাজ্য পালনের মূল প্রধান সহায় রাজার স্বীয় ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করা। ৫।

মর্মার্থ : নীতি ও দর্শন শাস্ত্রের অনুশীলন দ্বারা, রাজা নিজের ইন্দ্রিয়ণগকে স্ববশে আনবে। ইন্দ্রিয় দুই প্রকার কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়। বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ এগুলো কার্য্যের বিশেষ সাধন বলে কন্মেন্দ্রিয়, চক্ষু, বর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, এরা জ্ঞানের সাক্ষাৎ সাধন বলে জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন এই উভয় ইন্দ্রিয়ের অধ্যক্ষ, সুতরাং মনও জ্ঞানেন্দ্রিয় বা অন্তরিন্দ্রিয়, যার ইন্দ্রিয় অসংযত তার কর্তব্য অকর্তব্য বিষয়ের বিবেক নেই, বিবেকহীন নৃপতির রাজ্য পালন করা অসম্ভব, অতএব রাজ্য রক্ষার মূল ইন্দ্রিয় জয় ॥৫॥

অনুবাদ: ইন্দ্রিয় সকলকে জয় করার মুখ্য উপাদান বিনয় ॥৬॥

মর্মার্থ; ধৈর্য ও স্থ্যৈবান ব্যক্তি প্রকৃত বিনয়ের পাত্র হয়ে থাকে, বিনয় বা শিষ্টাচার বিনাবিবাদে কাৰ্যসিদ্ধির প্রধান উপায়, অবিমূশ্যকারিতা ও ক্রোধ এই দুই বিনয়-বিনাশের হেতু; অবিনয়ী ব্যক্তিরা কার্যহানি ও কাৰ্য ক্ষেত্র বিবাদের সম্ভাবনা অধিক। কেউ কেউ বলে থাকেন বিনয় কাপুরুষতার লক্ষণ, তা সংগ্রামস্থলে এবং কার্য বিশেষে হতে পারে কিন্তু সাধারণকার্যে বা ব্যবহারে নয়। কৌশলে কার্যসাধন করতে হলে, সুশিক্ষিত স্বজনের ও বিনয় একান্ত প্রয়োজন। অতএব বিনয় ব্যতীত যেমন ইন্দ্রিয় জয় সম্ভব হয় না, সেরূপ আবার ইন্দ্রিয় জয় ব্যতীত রাজ্য রক্ষাও করতে পারে না ॥৬॥

অনুবাদ : বিনয় লাভের মূল বৃদ্ধ জনের সেবা করা ॥৭॥

মর্মার্থ : বিদ্যা ও বয়সে পরিণত-স্বজনকে বৃদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়, এইরূপ বৃদ্ধ ব্যক্তির নিকটে বিনয় অর্জন করতে হয়। বিনয় বা শিষ্টতা দ্বারা বহু কঠিন কার্য অনায়াসে সাধন করতে পারা যায়। কেবল বয়োবুদ্ধি ও কেশপক্কতাহেতু বৃদ্ধ হয় না, যে যুবক হয়েও সুশিক্ষিত সদ্‌গুণযুক্ত সংযত, তাকেই দেবগণ বৃদ্ধ নামে আখ্যাত করেছেন। বৃদ্ধ সেবা দ্বারা গুণ লাভ হয়, কবল বিদ্যা দ্বারা হয় না। কৌটিল্যও বলেছেন–প্রজা ও সকল ভূতের হিতপরায়ণ, বিদ্যাযুক্ত, বিনয়-সম্পন্ন রাজা একাধিপত্য স্থাপনপূর্বক পৃথিবী ভোগ করতে সমর্থ হয় ॥৭॥

অনুবাদ : বৃদ্ধজনের সেবা থেকে বিজ্ঞান লাভ হয়। ৮।

মর্মার্থ : বিজ্ঞানলাভেচ্ছু ব্যক্তি, বয়স-বিদ্যা-ধর্মে যে বৃদ্ধ অর্থাৎ বিশেষভাবে পারদর্শী তার সেবা করতে হয়, তার দ্বারা নিজের নীতি, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, স্থাপত্য, ভাস্কৰ্য্য, গোরক্ষা, পূত্ত, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞান বা নির্দোষ সূক্ষ্মা, দূরদর্শিতা জ্ঞান জন্মায়। এরূপ নানা জ্ঞানের অধিকারী হলে বৈষয়িক কার্যে বিফল মনোরথ ও বিপন্ন হতে হয় নাঃ সংসারে অজ্ঞানই দুঃখের কারণ, প্রজ্ঞাই সুখের মূল। ৮।

বিজ্ঞানেনাত্মানং সম্পাদয়েং ॥৯॥
সম্পাদিতাত্মা জিতাত্মা ভবতি ॥১০
জিতাত্মা সর্বার্থৈ সংযুজ্যতে ॥১১

মর্মার্থ : ইন্দ্রিয়জয় বিনয় শিক্ষা, বুদ্ধ- সেবা ও শাস্ত্রোক্ত (অর্থাৎ হিত, অহিত, ন্যায়, অন্যায়, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি) জ্ঞান, দ্বারা আত্মরক্ষা ও কার্য সম্পাদনে কুশলতা জন্মায়, সেরূপ জ্ঞান যার না থাকে, তাকে আত্মরক্ষণে ও ব্যবহারিক কাজে প্রতিপদে স্খলিত ও বিপন্ন হতে হয়। চৌষট্টি কলাবিদ্যাজনিত জ্ঞানই বিজ্ঞান। চৌষষ্ট্রি কলা বিদ্যার উল্লেখ শৈবতন্ত্রে ও বাৎস্যায়নের কামসূত্রের টীকাতে স্পষ্ট উল্লিখিত আছে। ॥৯॥ যথা–

অনুবাদ : আত্ম-জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি জিতাত্মা (প্রশস্তচিত্ত) হয় ॥১॥

মর্মার্থ : ইন্দ্রিয় বশীভূত হলে, মনও নিজের আয়ত্তে থাকে, মন ধৈর্য লাভ করলে বিবেক বৃদ্ধি পায়, বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি নির্বাধে সফল কার্যসম্পাদন সমর্থ হয়, এরূপ নির্মাত্মাই জিতাত্মা বা প্রশস্তমনা (মহামতি) নামে খ্যাত হয়। ভগবানও গীতায় বলেছেন প্রশান্তামনা জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি অলৌকিক পরমার্থ লাভ হয় ।১০l

অনুবাদ : জিতচিত্ত ব্যক্তি সর্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হয়, অর্থাৎ সকল কার্য সম্পাদন করতে সমর্থ হয়। তখন সর্বার্থ তার করতলগত হয় ॥১১৷

মর্মার্থ : সুশিক্ষা সৎসঙ্গ প্রভৃতিতে ইন্দ্রিয়গণ স্ববশে থাকে। ইন্দ্রিয় বশীভূত হলে মনও নিজের আয়ত্তে আসে। সংযতচিত্ত পুরুষ সেরূপ শক্তিমান হতে পারে যে, তা দৃশ শক্তিমান, ব্যক্তি মহামতিরূপে সকল কার্য সাধনে বিশেষ যোগ্য বলে অভিহিত হয় ॥১১

স্বামি-সম্পত, প্রকৃতিসম্পদংকরোতি ॥১২
প্রকৃতিস্পদ্য হ্যনায়কমপি রাজ্যং নীয়তে ॥১৩
প্রকৃতি কোপঃসৰ্বকোপেভোগ্যাগরীয়ান ॥১৪
অবিনীত স্বামী ভাবাদস্বামিলাভঃ শ্রেয়ান ॥১৫
সম্পাদ্যাত্মানমন্বিচ্ছেৎ সহায়ান্ ॥১৬

অনুবাদ : রাজ সম্পদ প্রজাগণের সম্পত্তি বৃদ্ধি করে ।১২।

মর্মার্থ : রাজার রাজ্য সুশাসিত ও নিরুপদ্রব থাকলে প্রজার সম্পদ, সুখ, শান্তি বৃদ্ধি পায়। রাজ-সম্পদের কোনোরূপ বিঘ্ন উপস্থিত হলে প্রজায় সম্পদের বিশেষহানি হয়, অতএব রাজ-সম্পদ, দ্বারাই প্রজাগণের সম্পদ উৎপন্ন হয় এবং রাজ্য সমৃদ্ধ হয় ।১২।

অনুবাদ : প্রজার সম্পদ প্রজারূপ সম্পদ বা প্রজারূপ সম্পদ দ্বারা রাজ্যহীন রাজ্য পরিচালনা করতে পারে ॥১৩।

মর্মার্থ : রাজা সকল সময়ে প্রকৃতি-সম্পদের যাতে বৃদ্ধি হয়, তার প্রতি দৃষ্টি রাখবে, যেহেতু কখনো রাজশক্তি বিপন্ন হলে প্রজা সম্পদের দ্বারা রাজ্য পরিচালিত হতে পারে এবং নায়কশূন্যরাজ্য ও প্রকৃতি সম্পদ দ্বারা রক্ষিত হবে ॥১৩

অনুবাদ : রাজার প্রতি সকল প্রকার কোপ অপেক্ষা প্রজাবর্গের ক্রোধই প্রবল অনিষ্টকর ॥১৪।

মর্মার্থ : শত্রুর আক্রোশ, উৎপাত, উপদ্রব, বিপদ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির আক্রমণ অপেক্ষা প্রজাবর্গের ক্ষোভ বা আক্রোশ অতিমাত্রায় প্রবল। সুতরাং দুর্ভিক্ষ, ভূকম্প, মহামারি, জল প্লাবনা দিতে প্রজা বিপন্ন হয়। তখন প্রজাদিগের সুখশান্তি বিধান করার জন্য রাজার বিশেষ সচেষ্ট হওয়া উচিত। অন্যথায় রাজায় প্রবল অনিষ্টকর প্রজাদের বিক্ষোভ জন্মায় ॥১৪০

অনুবাদ :নীতিবিহীন-রাজা অপেক্ষা, রাজা-শূন্য রাজ্য লাভও ভালো। ১৫।

মর্মার্থ : রাজা প্রকৃতি রঞ্জক হলেন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনই রাজ্য সুশাসনের নিয়ম, নীতিজ্ঞ, ন্যায়-অন্যায় বিবেকসম্পন্ন রাজা-প্রজামণ্ডলীর হিতাকাক্ষী, এতাদৃশ রাজার অভাব ঘটলে সম্মিলিত প্রকৃতির যোগ্য প্রতিনিধি দ্বারা রাজ্য শাসন করা উচিত। তথাপি নীতি জ্ঞানীহীন দৃষ্ট ব্যক্তির হাতে রাজদণ্ড তুলে দেওয়া উচিত নয়। তাহলে রাজ্যে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, শৃঙ্খলার পরিবর্তে অশান্তি, উপদ্রব, দস্যু ও তস্করের প্রাবল্য ঘটতে পারে ॥১৫

অনুবাদ : রাজ্য নীতি শাস্ত্রানুশীলন দ্বারা আত্মশক্তিসম্পন্ন হয়ে যথোপযুক্ত সহায় ইচ্ছা করবে ॥১৬৷

নাহসহায়স্য মন্ত্র নিশ্চয়ঃ ॥১৭
নৈক্য চক্রং পরিভ্রমতি ॥১৮
সহায়ঃ সমুদুঃখসুখয়োঃ ॥১৯০
মানী প্রতিপত্তিমানাত্ম-দ্বিতীয়ং মন্ত্রিণমূৎপাদয়েং ॥২০l

মর্মার্থ : মন: প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করে আত্মযোগ্যতা সম্পাদকপূর্বক সহায় সমূহের অনুধাবন করবে। নীতিশাস্ত্রানুশীল দ্বারা আত্মশক্তি বৃদ্ধি পায়, সেরূপ শক্তিমান, হয়ে কার্য-সমর্থ সহায় সংগ্রহ করে কর্মক্ষেত্রে সুদৃঢ় হওয়া সমীচীন। ॥১৬

অনুবাদ : সহায়-শূন্য রাজার মন্ত্র নিশ্চয় অর্থাৎ সক্ষম হয় না ॥১৭

মর্মার্থ : কার্যের গুরুত্বহেতু, রাজা মন্ত্রিগণের সঙ্গে রহস্যে যে আলোচনা অর্থাৎ রাজ্যের ও নিজের হিতাহিত চিন্তা করেন তাহাই মন্ত্রণা, তার অবধারণ করা মন্ত্রনিশ্চয়ং এই মন্ত্রনিশ্চয় মন্ত্রী প্রভৃতি সহায়শূন্য রাজার একাকীভাবে হতে পারে না। রাজা একাকী শুভাশুভ চিন্তা করলে তাতে সন্দেহ, ভ্রম ও ত্রুটি থাকতে পারে, তার দ্বারা কার্যের ব্যাঘাত ঘটবার সম্ভাবনাই বেশি। অতএব মন্ত্রনিশ্চয়কার্যে সহায় অমাত্যাদি একান্ত অবশ্যক ॥১৭

অনুবাদ : এক ঢাকা বিশিষ্ট রথ চলে না। কথাটির গুঢ়ার্থ হলো–যেরূপ একটি চাকার দ্বারা রথ চলতে পারে না, সেরূপ সহায়হীন রাজা রাজ্য পরিচালনে সমর্থ হয় না ॥১৮

মর্মার্থ : কেবল রাজার দ্বারা চক্র (রাষ্ট্র) পরিচালিত হতে পারে না, রাজার সঙ্গে মন্ত্রী, পরিষদবর্গ, সৈন্য সামন্ত, দুর্গাদির একান্ত প্রয়োজন, বহুকর্তৃক যে কার্য সম্পন্ন হয়, তাহা একের দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে না। ।১৮

অনুবাদ : যে ব্যক্তি রাজার সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখি হয়ে থাকে, সে ব্যক্তিই রাজার (প্রকৃত) সহায়। ১৯॥

মর্মার্থ : শক্তি বৃদ্ধি কিংবা কার্যের বিশেষ গুরুত্বহেতু সহায়কের আবশ্যক হয়। যে রাজার অথবা ব্যক্তির সুখে-দুঃখে সমানভাবে সুখী ও দুঃখিত হয়, সেই ব্যক্তিই যথার্থ সহায় একার দ্বারা সাধ্য কার্যে সহায়ের প্রয়োজন না হলেও বহু কর্তৃক সাধ্য কার্যে সাহায্যে নিতান্ত প্রয়োজন হয়। তবে গুণাগুণ বিচার করে সহায় হিসাবে গ্রহণ করা আবশ্যক ॥১৯

অনুবাদ : শৌর্যযুক্ত প্রতিপত্তিশালী, খ্যাতিমান্ রাজা আপনার অনুরূপ গুণযুক্ত মন্ত্রী নিযুক্ত করবেন ॥২০।

মর্মার্থ : স্বয়ং গুণজ্ঞ না হলে অন্যের গুণ নিশ্চয় করা কঠিন, অতএব সূত্রকার মানী খ্যাতিমান ঈদৃশ রাজাই নিজের অনুকূল মন্ত্রী নির্বাচন করতে সমর্থ বলে নির্দেশ করেছেন। অমাত্য বা মন্ত্রীর গুণ বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অন্যত্র উল্লেখ আছে মন্ত্রী ভক্ত শুচি (নির্মলচিত্ত) শক্তিমান, অনুকরণশীল, বুদ্ধিমান-ক্ষমাযুক্ত, আন্বীক্ষিকী প্রভৃতি শাস্ত্রজ্ঞ নিপুণ, বিষয় পরিচ্ছেদকারী, প্রসিদ্ধ দেশে জাত হবে। ।২০

অবিনীতং স্নেহমাত্রেণ নমন্ত্রে কুর্ব্বীতি ॥ ২১৷
মন্ত্রমূলাঃ সৰ্বারম্ভা ॥২২
মন্ত্রসম্বরণে কাৰ্য্যসিদ্ধর্ভবতি ॥২৩
মন্ত্রনিস্রাবঃ সৰ্ব্বং বিনাশয়তি ॥২৪৷

অনুবাদ : বিনয়বিহীন অমাত্যকে কেবল বাত্সল্য দ্বারা (সাধারণ) কার্যে নিযুক্ত করবে, মন্ত্রণা কার্যে (কখনো) নিযুক্ত করবে না ॥২১

মর্মার্থ : মন্ত্রণাকার্যে বিশ্বস্ত মন্ত্রীর যোগ্য গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করতে হয়। অবিনীত অবিশ্বস্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রণাকার্যে নিযুক্ত করলে পরে মন্ত্র প্রকাশ ও কার্যের ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা; অতএব অবিনীত (উদ্ধত) ব্যক্তিকে একেবারে ত্যাগ না করে সামান্য কার্যে নিয়োগ করা উচিত ॥২১

অনুবাদ : সকল কার্যের (উপক্রম) সূচনা মন্ত্রপূর্বক হওয়া উচিত ॥২২৷

মর্মার্থ : গুপ্তভাবে রাজ্যের হিতাহিত, মন্ত্রীগণের সহিত আলোচনা করাই মন্ত্রণা, সকল কার্য এই মন্ত্রণপূর্বক হবে, তাতে ভাবী অনিষ্টের আশঙ্কা থাকে না, কার্যও সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মন্ত্রহীন কার্য অনিয়ন্ত্রিত ও বিশৃঙ্খল হয়। ঋষি উশনা বলেন ‘শুভাশুভ বিষয়ের চিন্তাপূর্বক গোপনে ভাষণের নাম মন্ত্র। এই মন্ত্র যাতে কার্য সমাপ্তির পূর্বে প্রকাশ না পায়, সে বিষয়ে সর্বদা যত্নবান হবে। মুখ্যত: প্রতিটি কাজই অমাত্যদের সঙ্গে পরিচালনা করা উচিত ॥২২॥

অনুবাদ : যত্নপূর্বক মন্ত্রগোপন করলে সকল কার্য সিদ্ধি হয় ॥২৩

মর্মার্থ : মন্ত্র গোপন করলে কার্য সাধনে অপর ব্যক্তি কর্তৃক কোনো বিঘ্ন উপস্থিত হতে পারে না, কার্য সম্পাদনের পূর্বে মন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়লে কার্য সম্পন্ন হতে পারে না, সেরূপ কার্যে পরাজয়ও অবশ্যভাবী। অতএব সহায় সম্পন্ন রাজারও উচিত, অতি যত্নে মন্ত্রগোপন, মন্ত্রগুপ্তি ও একটি অন্যতম সহায় অবলম্বন করা ॥২৩

অনুবাদ : মন্ত্র প্রকাশ সকল কার্য নাশ করতে সমর্থ হয় ॥২৪৷

মর্মার্থ : এমন লোকের সহিত মন্ত্রণা করবে, যাতে মন্ত্র প্রকাশ না হয়, প্রকাশিত হলে শত্রু দ্বারা সকল কার্য নাশের সম্ভাবনা, বৃহস্পতিমতে মন্ত্র তিন প্রকার, উত্তম মধ্যম অধম, অর্থ পর লোকের সহিত মন্ত্রণা করে ঐকমত্যে যা আরম্ভ করা হয়, তাহা উত্তম। কার্যে ভাবী দোষ ও গুণের সন্দেহ করে বুদ্ধিমান্দ্যতা নিবন্ধন যা আরম্ভ করা হয়, তা অধম। যে মন্ত্রণায় পূর্বে নানামত থেকে পরে সকলের ঐকমত্য ঘটে তা মধ্যম। এই সকল সূত্রের বিস্তারিত অর্থ বৃহস্পতি সূত্রের ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে ॥২৪

প্রমাদাদ্‌ দ্বিষতাং বশমুপযাস্যতি ॥২৫॥
সৰ্ব্বদ্বারেভ্যো মন্ত্রো রক্ষিতব্যঃ ॥২৬॥
মন্ত্রসম্পদাহি রাজ্যং বিবর্ধতে ॥২৭॥
শ্রেষ্ঠতমাংমন্ত্রগুপ্তিমাহূঃ ॥২৮॥

অনুবাদ : মন্ত্র অনবধানতাহেতু শত্রুর গোচরে প্রকাশ পেতে পারে। ২৫ ॥

মর্মার্থ : নিপুণতা সহকারে মন্ত্র রক্ষা করতে না পারলে, তা শত্রুর কর্ণগোচর হয় এবং নিজের ভ্ৰম, প্রমাদ, লোভ, ইন্দ্রিয়ের অসংযত ভাবহেতু ও অনেক সময় (মন্ত্র) শত্রুর বশিভূত হয়। অতএব খুব প্রণিধান সহকারে আত্মরক্ষা ও মন্ত্ররক্ষা করা উচিত। ॥২৫॥

অনুবাদ : সকল দ্বার (দিক) হতে মন্ত্র রক্ষা করবে, অন্যথা শত্রুগণ জ্ঞাত হলে বিশেথষ অনিষ্ট হবে। ২৬॥

মর্মার্থ : এমন স্থানে বিশ্বস্ত লোকের সহিত মন্ত্রণা করবে যাতে, মন্ত্রিত্ব বিষয় শত্রু বা অন্য কেউ জানতে না পারে। শত্রু গুপ্ত থেকে মন্ত্র জানবার সন্ধান করে স্বার্থান্ধ দণ্ডিত, নিগৃহীত লোক, শুক, সারি প্রভৃতি দ্বারা মন্ত্রিত বিষয় বাইরে প্রকাশ হয়। যৌগিগণ যেমন ইন্দ্রিয় দ্বার সকল বিষয় দেশ হতে অবরোধ করে নিরুপদ্রবে অবস্থান করে, সেরূপ রাজা সকল দিক হতে মন্ত্র গোপনপূর্বক অবস্থান করবে। ।২৬।

অনুবাদ : মন্ত্রগুপ্তি রক্ষারূপ সম্পদ দ্বারা রাজ বৃদ্ধি লাভ করে। ২৭

মর্মার্থ : মন্ত্রণা দ্বারা যে হেতু রাজ্য পরিচালিত হয়, সে নিমিত্ত মন্ত্রসম্পদ দ্বারা রাজ্যের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। অতএব যাতে মন্ত্রসম্পদ শ্ৰেষ্ঠাকার ধারণ করে ও লোক হিতকর হয় তাই বিধেয়। নিজের মন্ত্রিত্ববিষয় অন্যের অজ্ঞাতভাবে রাখবে, শত্রুর কার্যচ্ছিদ্র জ্ঞাত হবে, নিজের মন্ত্রিত্ব বিষয়কে কুমশরীরের ন্যায় সংগোপন করবে’ এটিই উত্তমনীতি। ২৭

অনুবাদ : প্রাচীন সুধীগণ সকল নীতি অপেক্ষা মন্ত্রগুপ্তিকে প্রশস্তনীতি বলেছেন। ২৮

মর্মার্থ : রাজা, মন্ত্রণাকার্যে সুদক্ষ এরূপ মন্ত্রিগণের সঙ্গে মন্ত্রণা করবে, না হলে মন্ত্রগুপ্তি না হয়ে মন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়বে। মুখ দুশ্চরিত্র, উগ্র স্বভাব, অহংকারী, হঠাৎ ক্ৰদ্ধ, শিশু–এই সকল মন্ত্রকার্যে অনুপযুক্ত। এদের সঙ্গে মন্ত্রণা করলে মন্ত্র প্রকাশ হবার বিশেষ সম্ভাবনা, এটি ঋষি বৃহস্পতিরও অভিমত। ২৮

কাৰ্য্যাকাৰ্য প্ৰদীপোমন্ত্রঃ ॥২৯।
মন্ত্রচক্ষুষ্য পরচ্ছিদ্ৰাণ্যবলোকয়ন্তি ॥৩০
মন্ত্রকালে ন মৎসরঃ কওঁবৎ ॥৩১০
ত্রয়াণামেকবাক্যে সম্প্রত্যয়ঃ ॥৩২

অনুবাদ : কোন কাজ করা উচিত এবং কোন কাজ করা উচিত নয় সে। বিষয়ে মন্ত্র প্রদীপের মতো কাজ করে। ॥২৯

মর্মার্থ : মানবের ভুলভ্রান্তি প্রায়ই হয়ে থাকে, অতএব স্বয়ং সন্দিগ্ধচিত্ত হলে মতিমান, সূক্ষ্মাদর্শীর সঙ্গে মন্ত্রণা করে কাজ করা একান্ত কর্তব্য। প্রদীপ যেমন অন্ধকারাবৃত সকল বস্তুকে প্রকাশ করে, সেরূপ মন্ত্রও সন্ধিগ্ধ, অজ্ঞেয়, দুঃসাধ্য কার্যসমূহকে বুদ্ধি বিকাশ দ্বারা সহজবোধ্য করে দেয়। মন্ত্রণাবিহীনকার্য জলে কাঁচামাটির ঘটের মতো সহজ ভঙ্গুর হয়। মন্ত্রণা শুদ্ধ কার্য পাকা (দগ্ধ) ঘটের মতো সুদৃঢ় হয়। ॥২৯ ॥

অনুবাদ : (নৃপতিগণ) মন্ত্ররূপ চক্ষুর সাহায্যে শত্রুর দোষগুলো দর্শন করেন। ৩০৷

মর্মার্থ : আপনার দোষ পরিহার ও ঢেকে রাখা, এবং পরের ছিদ্র অনসুন্ধান করা নীতির একটি উচ্চ অঙ্গ। নৈতিককার্য নির্দোষ হওয়া দুরূহ মহর্ষি বৃহস্পতি বলেন, ‘নীতি নদীর তীরস্থির তরু ন্যায়’ (১-১০২) নিজের ভ্ৰমাদি অনিবার্য বলে মন্ত্রণা চক্ষু দ্বারা শত্রুর ছিদ্রান্বেষণ করবে; তা না হলে অন্যের গুপ্তরহস্য জানতে পারা কঠিন। শত্রু জয় করতে হলে শত্রুর ছিদ্র জানা প্রথম কর্তব্য ॥৩০৷

অনুবাদ : মন্ত্রণার সময় মাৎসর্য প্রকাশ করা উচিত নয়। ॥৩১

মর্মার্থ : মন্ত্রণাকালে মাসর্য প্রকাশ করলে মন্ত্রের বিশেষ হানি হন, ধৈৰ্য্যচ্যুতি হলে মন্ত্রণা কার্যের ব্যাঘাত করে। পরের উৎকর্ষতায় অসহিষ্ণুতাই মাসর্য। ঋষি বৃহস্পতি বলেছেন, কার্যে গুণ ও দোষের সম্ভাবনা নিশ্চয় করে মূর্খতার প্রাচুর্যহেতু যে মন্ত্রণা আরম্ভ করা হয়, তা অধম মন্ত্র। বিচক্ষণ দণ্ডনীতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যে মন্ত্র, সকলের ঐকমত্যে আরম্ভ করা হয়, তাই উত্তম মন্ত্র।’ (৪॥৩২,৩৩) মাৎসর্যযুক্ত ধৈর্যহীন ব্যক্তির সহিত মন্ত্রণা করবে না। ৩১

অনুবাদ : মন্ত্রীগণের মধ্যে বিচক্ষণ-তিনজনের মতো এক হলে তা গ্রহণীয়। ৩২

মর্মার্থ : মন্ত্রীগণের মধ্যে সকলের ঐকমত্য হওয়া খুব কমই সম্ভব, (১) তাদের মধ্যে দূরদর্শী তিন জনের মতের ঐক্য ঘটলে তা গ্রাহ্য হবে; তার দ্বারা কার্য সম্পন্ন হওয়াও সম্ভব। মতামত প্রবল দুর্বল, ভেবে অনুকূল মতে কাজ করা উচিত। ৩২॥

অকামবুদ্ধয়োমন্ত্র তত্ত্বার্থদার্শিনোমন্ত্ৰিণঃ ॥৩৩৷
ষট্‌কর্ণোমন্ত্রশিছদ্যতে ॥৩৪
আপাতসু স্নেহসংযুক্ত মিত্রম্ ॥৩৫॥
মিত্র সংগ্রহণে বলং সম্পদ্যতে ॥৩৬

অনুবাদ : লোভ মাৎসর্য, স্বার্থ বুদ্ধিশূন্য, মন্ত্ররহস্য বেত্তা বুদ্ধি-বৃদ্ধ, যোগ্য ব্যক্তিগণই মন্ত্রী পদের যোগ্য। ৩৩

মর্মার্থ : স্বার্থ বুদ্ধি, লোপ, ঈর্ষাদি থাকলে দূরদর্শী হতে পারে না। দূরদর্শী হলে যোগ্য মন্ত্রদানে সক্ষম হয় না। তাই স্বার্থবুদ্ধিহীন, দূরদর্শী, মন্ত্রণা কার্যে নিপুর্ণ, মন্ত্রিলক্ষণযুক্ত শক্তিমান দৃঢ় হৃদয়ই মন্ত্রী পদের যোগ্য। মন্ত্রীলক্ষণ পূর্বে বিংশতি সূত্রের টীকাতে উক্ত হয়েছে। ৩৩৷

অনুবাদ : মন্ত্র যদি ষট্‌কর্ণগোচর হয় তবে তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ৩৪।

মর্মার্থ : তিন জনের কর্ণগোচর হলে অর্থাৎ দুইজনের মন্ত্রণা অপর একজনে শুনতে পেলে তা ষট্‌কর্ণ গোচর হয়, তদ্বারা মন্ত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু মন্ত্রণাযোগ্য তিন জন মন্ত্রীদ্বারা মন্ত্রিত্ব বিষয়কে ষটখর্ণাধীন মন্ত্র–ভেদযোগ্য বলা যায় না; দুইজনে মন্ত্রণা করাই প্রশস্তু। এই বিষয়ে শুক্রাচার্য বলেন, যে ব্যক্তি কোনো বিষয়ে মন্ত্রণা করে, সে বিষয়ে কার্যানুষ্ঠান করে না, তাহার সে মন্ত্রণা ব্যর্থ হয়ে যায়, যেমন প্রমাদগ্রস্ত ছাত্রের অধীত বিষয় সময়ে অপঠিত বিষয়ের ন্যায় হয়। তাহার প্রমাণ যথা–

স তস্য ব্যর্থতাংঘাতি ছাত্রস্যেব প্রমাদিনঃ
যো মন্ত্র মন্ত্রয়িত্বাতু নানুষ্ঠানং করোতি চ ॥৩৪

অনুবাদ : আপকাল উপস্থিত হলে যে স্নেহ সহানুভূতিশীল হয়, সেই মিত্র। ॥৩৫

মর্মার্থ : বিপদকালে অর্থাৎ রোগ, বিবাদ, যুদ্ধাদি প্রভৃতি বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য মিত্রের প্রতি বিশেষ প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করা উচিত। উভয়ে প্রীতিপূর্বক একভাবে সমকৰ্মা হলেই মিত্র নামে চিহ্নিত হয়। যাহার সঙ্গে সৎ বন্ধু জনের নিয়তবাস, তার ন্যায় পুণ্যবান লোক বিরল অকপট প্রীতিপূর্বক ব্যবহার দ্বারা মিত্রকে নীতি কৌশল ও বলের শত্রুকে বশীভূত করা উচিত–এই নীতিই সুধীগণের অভিপ্রেত। ৩৫

অনুবাদ : যথার্থ মিত্র সংগ্রহ দ্বারা রাজা বলসম্পন্ন হয় ॥৬॥

মর্মার্থ : প্রকৃত মিত্র দ্বারা বল বৃদ্ধি পায় নীতিশাস্ত্রের সঙ্কেত অনুসারে (বল শব্দার্থ), হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতিসৈন্য এই চারটি সেনাঙ্গকে বলনামে অভিহিত করা হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে সৈন্যমাত্রকে কেবল বল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। রাজা অমাত্যাদি যুক্ত হলেও হস্ত্যাদি বল সংগ্রহ করবে। মিত্ররূপ সাহায্যও বল বুদ্ধির উপায়। অন্যমতে স্বামী, মন্ত্রী, চিত্র, রাজ্য, দুর্গ, সৈন্য কোনো (ধনাগার) এই সকল বলবাচক। ৩৬

বলবান্ অলব্ধলাভে প্রযতেত ॥৩৭
অলব্ধলাভো নালসস্য ॥৩৮ ॥
অলসস্য লব্ধমপি রক্ষিতুং ন শক্যতে ॥৩৯ ॥
ন চালস্য যুক্তস্য রক্ষিতৎ বিবর্ধতে ॥৪০৷

অনুবাদ : বলযুক্ত রাজার অলব্ধ লাভের নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করা উচিত। ॥৩৭

মমার্থ : নীতিশাস্ত্রানুসারে বল শব্দার্থ, স্বামী, অমাত্য প্রভৃতি পূর্বোক্ত সকলকে বোঝায়, সে সমুদয়ের দ্বারা সমৃদ্ধ রাজা অলব্ধ বিষয় লাভের নিমিত্ত বিশেষভাবে চেষ্টিত হবে। অন্যত্র উক্ত আছে যে, যে বল দ্বারা শত্রু, নির্জিত না হয়, সে বল দ্বারা ফল কী? বলবান ও বসত রাজাকে শত্রুগণ দ্রুয় করে বলের দ্বারা অলব্ধলাভ যেরূপ হয়, দ্রুপ লব্ধ বিষয়েরও সম্যক রক্ষা হয়। বল রাজার পক্ষে গীতোক্ত ‘যোগক্ষেম’ ৩৭।

অনুবাদ : অলস ব্যক্তির অলব্ধ বিষয়ের লাভ করারও ক্ষমতা থাকে না। ৩৮।

মমার্থ: আলস্য হেতু মানব অলব্ধবস্তু লাভ করতে সমর্থ হয় না। সেরূপ লব্ধবস্তু রক্ষা করতেও পারে না। অলসত মানব শরীরের আন্তঃ শত্রু, বাইরের শত্রু নয়। উন্নতিকামী পুরুষ এই ছয়টি দোষ অবশ্য পরিহার করবে-নিদ্রা, তন্দ্রা, ভয়, ক্রোধ, আলস্যও দীর্ঘসূত্রতা। আলস্যই চিত্ত ও শরীরের গুরুত্ব বোধ, নষ্ট করে দিয়ে দেহে ও মনে ক্রমশ অনুৎসাহ ও অবসাদ এনে দেয়। ৩৮।

অনুবাদ : অলস ব্যক্তির প্রাপ্তবস্তুও রক্ষা করার ক্ষমতা থাকে না। ৩৯।

মমার্থ : অলস ব্যক্তি দৈবাৎ কিংবা অতি পরিশ্রমে কোনো দ্রব্য লাভ করলে, আলস্য নিবন্ধন তাও রক্ষা করতে সমর্থ হয় না। নীতিজ্ঞগণ বলেছেন–অলস মন্দবুদ্ধি, সুখী, রোগগ্রস্ত, নিদ্রাসক্ত ও কামুক এই ছয়জন কর্ম সম্পাদনে অযোগ্য। ৩৯।

অনুবাদ : অলস ব্যক্তির রক্ষিত বা সঞ্চিত দ্রব্য বৃদ্ধি পায় না। ৪০।

মমার্থ : অলস বা মন্দমতির দৈবাৎ কোনো বস্তু সঞ্চিত হলেও তা বৃদ্ধি পায় — সূত্রে পাঠান্তরের এই রূপ অর্থ, অলস ব্যক্তি যদিও লব্ধবস্তু রক্ষা করতে পারে, তথাপি তা বৃদ্ধি পায় না। সুতরাং পুরুষ এই ছয়টি গুণ সর্বদা অর্জন করবে-সত্য, দান, শক্তি, আলস্যহীনতা, ক্ষমা, ধৈর্য-এই বিষয় বিদুরনীতিতে স্পষ্ট উল্লিখিত হয়েছে। ৪০।

ন ভূত্যান্‌, পোষয়তি ॥ ৪১ ॥
ন তীর্থং প্রতিপাদয়তি ॥ ৪২ ॥
অলব্ধলাভাদি চতুষ্টয়ং রাজ্য তন্ত্রম্ ॥ ৪৩ ॥
রাজ্য তন্ত্রায়ত্ত নীতিশাস্ত্রম্ ॥ ৪৪ ॥

অনুবাদ : অলস নৃপতি ভূতগণকে ও পোষণ করতে পারে না। ৪১।

মর্মার্থ : আলস্য মানবের এমনই শত্রু যে, ইহা মানুষকে অকর্মণ্য করে ফেলে, স্বীয় ভূত্যগণকে ও পালন বা পোষণ করতে অক্ষম করে তোলে ভৃত্য (কর্মচারী) প্রতিপালিত না হলে কার্য সাধন হয় না, কার্যের অভাবে রাজ্য পরিচালনার বিশেষ হানি হয়। ৪১।

অনুবাদ : অলস ব্যক্তি তীর্থ যাত্রাদি কাজও সম্পাদন করতে পারে না। ৪২।

মর্মার্থ : আলস্যহেতু অষ্টাদশসংখ্যক অর্থাৎ সেনাপতি প্রভৃতি আঠার জন, ইহাদিগকে এবং কাশী প্রভৃতি তীর্থ, মান্যজন ও তাহাদিগের কার্য পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হয় না। শক্তিমান, সুধী, আলস্যশূন্য ব্যক্তিই সমস্ত কাজে দক্ষ হয়। ৪২।

অনুবাদ : অলব্ধ বস্তু, লাভ, লন্ধবস্তু ও তাহার রক্ষা–এই চারটি রাজার প্রধান কর্ম। ৪৩।

মর্মার্থ : সাম, দান, দন্ড, ভেদ এই চারটি উপায় দ্বারা রাজা অর্থ লাভ করে, জলদ ব্যয় প্রভৃতি হতে নিয়মিত সদ্ব্যয় দ্বারা তাহার রক্ষা করে। সেই রক্ষিত দ্রব্য কুসীদাদি ব্যবহার দ্বারা বৃদ্ধি করবে। সোমদেব সুরির মতে ইহা অর্থানুবন্ধ, এই অর্থানুবন্ধ পাত্রকে তীর্থ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অর্থ সমুদ্দেশ প্রকরণে তিনি বলেছেন যে, যে ধর্ম সমবায়ী ও অর্থ সমবায়ী পুরুষগণই তীর্থ নামে আখ্যাত। যাদের নিকট হতে ধর্ম নিরূপিত হয় তারা ধর্ম সমবায়ী। যাদের নিকট হতে প্রধান কার্য সম্পন্ন হয়, তারা কার্য সমবায়ী, অপর বিষয়সমূহ নীতি বাক্যমৃতের অর্থ– সমুদ্দেশ প্রকরণে বর্ণিত হয়েছে। ৪৩।

অনুবাদ : নীতিশাস্ত্র রাজতন্ত্রের অধীন (অর্থা নীতি শাস্ত্রানুসারেই রাজ্য সম্বন্ধী সকল কার্য পরিচালিত হয়ে থাকে। ৪৪।

মর্মার্থ : পূর্বকালে গুরু, শুক্র, ভরদ্বাজ, মনু প্রভৃতি ঋষিগণ নীতিশাস্ত্র বর্ণনা করেছেন, তদনুসারে যুগে যুগে কার্য পরিচালিত হয়ে থাকে। মহামতি কৌটিল্য গুরু প্রভৃতির গ্রন্থ সকল হতে সার সংকলন করে পুনঃ নীগ্রিন্থ প্রণয়ন করেছেন। এই নীতিশাস্ত্র রাজ্যতন্ত্রের অধীন, রাজতন্ত্রানুসারেই নীতিশাস্ত্রের নিয়ম পালনীয় দেশ কাল, পাত্র, অবস্থানুসারে নীতিশাস্ত্রের নিয়মের আংশিক পরিবর্তন লঘুত্ব ও গুরুত্ব দেখা যায়। ৪৪।

রাজ্য তন্ত্রেস্বায়র্ত্তৌ মন্ত্রাবাপৌ ॥ ৪৫ ॥
মন্ত্রং স্ববিষয়েকৃত্যেস্বায়ত্তম্‌ ॥ ৪৬ ॥
আবাপো মণ্ডলে সন্নিবিষ্টঃ ॥ ৪৭ ॥
সন্ধি-বিগ্রহয়োর্যোনি মণ্ডলম্‌ ॥ ৪৮ ॥
নীতিশাস্ত্রানুগো রাজা ॥ ৪৯ ॥

অনুবাদ : মন্ত্র ও আবাপ এই দুটি রাজ্যতন্ত্রের অধীন। ৪৫।

মমার্থ : রাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় কার্যসমূহ তাহার অনুগত মন্ত্র ও আবাপশু ও তাহার কার্য চিন্তা, শত্রুর কার্যকলাপ তার গতি অনুসন্ধান রাজ্যের শুভাশুভ চিন্তাতে মন্ত্রণা এবং আবাপ তার অধীন হয়। ॥৪৫।

অনুবাদ : পূর্বোক্ত মন্ত্র, রাজার কর্তব্যকর্মের সকল অধীন হয়ে থাকে। ৪৬।

মমার্থ : মন্ত্র (গুহ্য বাদ), রাজা যে সকল কার্য করবেন, সে সমুদয় কার্য মন্ত্রণা ভিন্ন সম্পন্ন হবে না। সোমদেব সুরি তদীয় নীতি বাক্যমূতে বলেছেন, মন্ত্রপূর্বকই রাজার কার্যসমূহের আরম্ভ হয়। পূর্বে কার্যের সূচনা হয়, তাহার পর সেই কাৰ্য্যসমূহ কিরূপে সম্পন্ন হবে, এরূপ সমালোচনা করতে হয় বলে মন্ত্র রাজার কার্যসমূহের অধীন হয়। কোনো আদর্শ পুস্তকে ‘তন্ত্র সম্পর্কে এরূপ পাঠও আছে। যে, তাতে স্বাদেশ কার্য সকলের অধীন, তাই তন্ত্র শব্দের অর্থ এখানে বুঝতে হবে। ॥৪৬

অনুবাদ : আবাপ (রাজা বা শত্রু চিন্তা) কার্য মণ্ডলের অন্তর্গত। ৪৭

মর্মার্থ : দ্বাদশ সংখ্যক রাজ ঘটিত সভাকে মণ্ডল বা মণ্ডলী বলে। আবাপ শত্রু ও তার কার্য চিন্তা। এই আবাপ উক্ত মণ্ডলের মধ্যেই সন্নিবিষ্ট এবং অমাত্য রাষ্ট্র, দুর্গ, কোষ, দণ্ড মিত্র রাজা, সাতটিকে সপ্ত প্রকৃতি বলে আবাপ। ইহাই অন্তর্গত বলে নীতিবিৎ পণ্ডিত বৃহস্পতির অভিমত। ৪৭

অনুবাদ : (প্রকৃতি) মন্ডল হলো সন্ধি ও বিগ্রহের কারণ। ॥৪৮৷

মমার্থ : ধনাদি দান দ্বারা অথবা বন্ধু দ্বারা যে প্রতি উৎপাদন পূর্বক মিত্রতা করা হয়, তাহার নাম সন্ধি। পরমণ্ডলে দাহ লুণ্ঠন উচ্ছেদদিকে বিগ্রহ বলে। এই উভয়ের কারণ মণ্ডল। মণ্ডল দ্বাদশ জন রাজা দ্বারা কিংবা সাত জন রাজা দ্বারা গঠিত হয়। নানা প্রকার মন্ডলের বিষয় কামন্দকনীতি এবং কৌটিল্যর্থ শাস্ত্রের বাড়গুণ্যসমুদ্দেশ প্রকরণে উক্ত আছে। নীতিবাক্য মৃতে ও সন্ধির বিষয় কথিত আছে। ভোজরাজকৃত যুক্তিকল্পতরুতে সন্ধি বিগ্রহের কথা উল্লিখিত ও বর্ণিত আছে। ৪৮

অনুবাদ : রাজা নীতিশাস্ত্রের নিয়মানুগামী কিংবা নীতিজ্ঞ হবেন। ॥৪৯৷

মর্মার্থ : রাজার রাজ্য শাসনে দক্ষতা প্রদর্শন করতে হলে, তাকে নীতিজ্ঞ হতে কিংবা নীতিশাস্ত্রোক্ত নিয়মানুসারে চলতে হবে; যেহেতু নীতিশাস্ত্র জ্ঞানহীন বেণরাজ প্রভৃতি বুদ্ধিভ্রংসতা কারণ বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছে। মহারাজ ভোজদেব বলেছেন, যত্নপূর্বক নৃপতিগণ নীতিশাস্ত্র শ্রবণ করবে। নীতি বা ন্যায় প্রতিপাদক শাস্ত্রই নীতিশাস্ত্র। এই বিষয়ে প্রাচীন নীতি বিশারদগণের মতভেদ দেখা যায় বৃহস্পতি বলেন বার্তা (কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য, দণ্ডনীতি। মহর্ষি উশনার মতে দণ্ডনীতিই একবিদ্যা। কৌটিল্য মতে–চার প্রকার নীতি আন্বীক্ষিকী (তর্কশাস্ত্র) ত্রয়ী (ঋক, সাম, যজ্জঃ) বার্তা ও দণ্ডনীতি। ॥৪৯৷

অনন্তর প্রকৃতিঃ শত্রুঃ ॥৫০॥
একান্তরিতং মিত্রমিষ্যতে ॥৫১৷
হেতুতঃ শত্রু মিত্রে ভবিষ্যতেঃ ॥৫২৷

অনুবাদ : এক রাজার নিকটস্থ অপরাজা শত্রু বলে পরিগণিত হয় ॥৫০৷

মমার্থ : কামন্দক মতে এক নৃপতির নিকটবর্তী, অপর নৃপতি, অনন্তর প্রকৃতি নামে খ্যাত। অপর নীতিবিদের মতে অন্তরঙ্গ করদাতাপ্রজাই শত্রু নামে প্রসিদ্ধ। শত্রু নানা প্রকার সমাভিজন (দায়াদ) সহজ শত্রু (১), বিরাধ কিংবা বিরাধয়িতাকে কৃত্রিম শত্রু বলে, (২) যে শত্রু বিরোধে প্রবৃত্ত হয় তাকে বিরাধ বলে। উপায়ের দ্বারা নিবৃত্তই কৃত্রিম শত্রু। (৩)। আশ্রয়হীন, দুর্বলের আশ্রয় প্রাপ্ত শত্রুকেও উচ্ছেদ করবে। সোমদেব মতে অনন্তর সীমাধিপতি শত্রু হবে, তাহার অনন্তর সীমাধিপতি মিত্র হয়ে যে, এরূপ কোনো নিয়ম নেই, যেহেতু কার্য বা ব্যবহারবশতঃই শত্রু ও মিত্র হয়, কার্যবশত অনন্তর সীমাপতি ও মিত্র হতে পারে। অনন্তর শত্রুবেকান্তরং মিত্রমিতি নৈষ একান্ত। ৫০

অনুবাদ : রাজার একান্তরিত অপর ভূপতি (স্বদেশের অব্যবহিত দেশস্থ অপর রাজা) কে মিত্র জানবে। ৫১

মর্মার্থ : যে ব্যক্তি সম্পদে, বিপদে সমান সুখি, দুঃখি হয়, সে প্রকৃত মিত্র। নীতিশাস্ত্রের নিয়মে স্বদেশের অব্যবহিত দেশস্থিত রাজ্যকে মিত্র নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই মিত্র তিন প্রকার নিত্য মিত্র, সহজমিত্র, কৃত্রিমমিত্র, নিঃস্বার্থভাবে রক্ষণীয় কিংবা রক্ষক যে হয়, সে নিত্যমিত্র। যার সঙ্গে পুরুষ পরম্পরাক্রমে সম্বন্ধবশত সৌহার্দ জন্মে, সে সহজমিত্র। যে জীবিকার জন্য বৃত্তিগ্রহণপূর্বক সৌহার্দ প্রদর্শন করে, অর্থাৎ স্বার্থনিবন্ধন বন্ধু হয়, সে কৃত্রিম মিত্র। t৫১।

অনুবাদ : কারণবশতঃ অর্থাৎ ব্যবহার ও কার্যানুসারে এক রাজা অপর রাজার শত্রু বা মিত্র হয়। ৫২

মর্মার্থ : এই সংসারে কোনো মানব কোনো মানবের স্বাভাবিক শত্রু বা মিত্র হয় না। সদ্ব্যবহারে মিত্র, অসদ্ব্যবহারে শত্রু হয়ে থাকে। এই নিয়মেই এক রাজা। অপর রাজার শত্রু হয়, অধিকৃত বিষয় বা স্বার্থই তাহার মূল। পূর্বসূত্রে জন্তর প্রকৃতিশত্রু (নিজ দেশের অব্যবহিতদেশস্থ অধিপতি), তদন্তরিত বা তাহার পরবর্তী দেশপতিই মিত্র। মহর্ষি নারদের অভিমত আপকাল উপস্থিত হলে কিংবা মহষ্কার্য সময়ে কোনো অশুভ কারণ প্রকাশ পেলে, যে প্রীতি ইচ্ছা করে ও আকৃষ্ট হয় না, সেই প্রকৃত গুণযুক্ত মিত্র। ৫২

হীয়মানেন ন সন্ধিং কুৰ্ব্বীত ॥৫৩।
তেজোহি সন্ধানহেতু স্তদর্থিনাম্ ॥৫৪
নাতপ্ত লোহং লোহেন সন্ধত্তে ॥৫৫।

অনুবাদ : হীয়মান পরাভূত কিন্তু বিজিগীষু রাজার সহিত সন্ধি করবে না। ৫৩

মর্মার্থ : সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধ, সংশয়–এই ছয়টির নাম ষাড়গুণ্য। সন্ধি পণবন্ধ। বিগ্রহ–অপরাধ। বান অভ্যুদয়। আসন–উপেক্ষা। সংশ্রয়–অপরকে আত্ম সমর্পণ। (১) যদি কোনো দ্রব্য গ্রহণপূর্বক শত্রুর সহিত পণ বন্ধ করা হয়, শত্রুর তাদৃশ কার্যকে পণবন্ধ বলে, এবং তদ্বদ্বারা সন্ধি হয়। (২) যে সময়ে যে বিজিগীষুর কেউ কোনো অপরাধ করে তাতে বিগ্রহ হয়। (৩) যে সময় শত্রুকে লঙ্নপুর্বক গমন করে কিংবা শত্রুকে প্রবল জেনে অন্যত্র গনম করে, তাহা বান সংজ্ঞায় কথিত হয়। (৪) যে সময় শত্রু আক্রমণ উদ্দেশ্যে আসতে উদ্যত হলে, তখন হঠাৎ সে স্থান ত্যাগ করা অথবা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া নাম আসন। (৫) যে সময়ে প্রবল শত্রু আসছে দেখে স্বীয় অবস্থানের সম্ভাবনা নাই, এইরুপে শত্রুকে আত্মনিবেদন ও শপথাদি দ্বারা বশীভূত স্বীয় রাজ্যরক্ষা করার নাম সংশ্রয়। (৬) যে সময় শক্রুদ্বয় উপস্থিত হয় সে সময় একের সহিত বিগ্রহ, অপরের সঙ্গে সন্ধিপূর্বক বিগ্রহ করা উচিত, একসঙ্গে উভয়ের সহিত বিগ্রহ করা অনুচিত এর নাম দ্বৈধীভাব। ৫৩।

অনুবাদ : সন্ধিকামিগণের পক্ষে অপর রাজার প্রভাবই সন্ধির একমাত্র হেতু। ৫৪।

মর্মার্থ : অন্য রাজার বিপুল প্রতাপ ও অটুট শক্তি দেখলে তাহার সঙ্গে সে সন্ধি করতে হয়, তার কারণ একমাত্র তার অধিক প্রভাব। যে স্থলে বিরোধ উপস্থিত হয়, সে স্থলে প্রবল দুর্বলকে পরাজিত করে–অতএব প্রবলের সহিত দুর্বলের সন্ধি করা একান্ত উচিত। প্রতাপ, প্রভাব, তেজ একার্থবাচক রাজার ধনাগার ও দণ্ড বা সৈন্যাদি হতে তা উৎপন্ন হয়। ৫৪।

অনুবাদ : অতগুলৌহ (কখনো) অপর লৌহের সঙ্গে মিশে না। ৫৫।

মমার্থ : উভয় বিজিগীষুর মধ্যে এক প্রবল হলে অপর হীনশক্তি হেতু সন্ধিপূর্বক মিলিত হয়, সমান শক্তিতে তাহা হয় না, যেমন অতপ্ত (অন্ধ) লৌহ অপর লৌহের সঙ্গে মিশে না। পূর্বে বলা হয়েছে তেজই সন্ধির অর্থাৎ মিলনের হেতু। ৫৫।

বলবান্ হীনেন বিগৃহ্নীয়াত্ ॥৫৬।
ন জ্যায়সা সমেন বা ॥৫৭
হস্তিনঃ পাদযুদ্ধ মিব বলবদ্বিগ্রহঃ ॥৫৮
আমপাত্রং আপেন সহ বিনশ্যতি ॥৫৯।

অনুবাদ : প্রবল ভূপতি, পরাজিত অথবা দুর্বলের সহিত বিগ্রহ করবে। ৫৬।

মর্মার্থ : এই সূত্রের অর্থ অন্য রূপও হয়, যথা–প্রবলশক্তি, শত্রুহীন দুর্বল হলে তার সহিত বিগ্রহ করবে না। অথবা বলবান দুর্বলের সহিত স্বঃতই বিগ্রহ করবে। বিগ্রহ- পরমণ্ডলে দাহ, লুণ্ঠন, উচ্ছেদাদি। অর্থশাস্ত্রে উক্ত আছে যে, হীনশক্তির সহিত বিগ্রহ করবে না। বিগ্রহ তিন প্রকার–প্রকাশ বিগ্রহ, কূট বিগ্রহ, তৃষ্ণী বিগ্রহ—নীরবে বিগ্রহ করা। ৫৬।

অনুবাদ : প্রবল শক্তির কিংবা সমান শক্তির সহিত বিগ্রহ করবে না। ৫৭।

মর্মার্থ : প্রবল শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হলে পরাজয় সম্ভাবনা, সমান শক্তিতেও জয় বা পরাজয় অনিশ্চিত। বিক্রম, বল উৎসাহ এই তিন শক্তি। বিক্রম-পরাক্রম। বল সৈন্যাদি। উৎসাহ-প্রকৃষ্টোদ্যম। উক্ত শক্তিত্রয়ের দ্বার সমুপচিত হলে হীন। কোষ (ধনভাণ্ডার) দণ্ড বল (সৈন্য) এই তিনটি প্রভুশক্তি। ৫৮।

অনুবাদ : প্রবল দুই রাজার সংগ্রাম হলো হস্তীদ্বয়ের পায়ের পরস্পর সংগ্রামের ন্যায়। ৫৮।

মর্মার্থ : তাৎপর্য এই যে, সমান বল ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যে অথবা সমান শক্তি-দুই রাজার মধ্যে বিবাদ বা সংগ্রাম হলে কারও জয়, কারও বা পরাজয় হয় না, প্রত্যুত সমানই থাকে। বিরোধ উপস্থিত হলে বলবান, দুর্বলকে পরাজিত করে ইহা মহর্ষি জৈমিনির ন্যায়েও উক্ত হয়েছে। সমবলে কার্যফল সমান হওয়ার সম্ভাবনা তবে অবস্থানুসারে কোনো কোনো স্থানে ব্যতিক্রমও হতে পারে, পরন্তু উভয়েরই ক্ষতি হয়, লাভ কিছু হয় না। ৫৮।

অনুবাদ : অপকৃপাত্রে জল রাখলে সে পাত্র জলের সঙ্গে বিনষ্ট হয়ে যায়। ৫৯।

মর্মার্থ : মূল বিষয় দৃঢ় করে সকল কার্য করতে হয়, মূল বিষয় শিথিল হলে তার আশ্রিত কার্য সম্পন্ন হয় না, তার উদাহরণস্বরুপ এই সূত্রে বলেছেন, যেমন কাঁচা মাটির পাত্রে জল রাখলে সে পাত্র জলসাৎ হয়ে যায়, সেরূপ অকালে, অপাত্রে, অবস্থানে কার্যপ্রয়োগ করা উচিত নয়। ৫৯।

অরি প্রযত্নমভিসমীক্ষ্যাত্মরক্ষয়া বসেৎ ॥ ৬০ ॥
শক্তিহীনো বলবন্তমাশ্রয়েৎ ॥ ৬১ ॥
দুৰ্বললাশ্রেয়ো হি দুঃখমাবহতি ॥ ৬২ ॥
অগ্নিবদ্রাজানমাশ্রয়েৎ ॥ ৬৩ ॥
রাজ্ঞঃ প্রতিকূলং নাচরেত্ ॥ ৬৪ ॥

অনুবাদ : শত্রুগণের দুরভিসন্ধানের প্রতি বিশেষ লক্ষ রেখে আত্মরক্ষাপূর্বক অবস্থান করা উচিত। ৬০।

মর্মার্থ : শত্রুর স্বভাব এরূপ যে, সে স্বতঃই অন্যের ছিদ্রান্বেষী হয়, অতএব অতিশয় যত্ন সহকারে শত্রুর গতিবিধির প্রতি বিশেষ লক্ষ রেখে বিচক্ষণ ব্যক্তি আত্মরক্ষা অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষাপূর্বক অবস্থান করবে। ৬০।।

অনুবাদ : শক্তিহীন ব্যক্তি প্রবল শক্তিমানের আশ্রয় গ্রহণ করবে। ৬১।

মর্মার্থ : এরূপ নিয়ম দেখতে পাওয়া যায় যে, দুর্বল শক্তিহীন ব্যক্তি আত্মরক্ষার নিমিত্ত শক্তিমান, লোকের আশ্রয় গ্রহণ করে। অন্যথা প্রবলের আক্রমণে দুর্বলের হানি অবধারিত। বিরোধে বলীয়সা দুর্বলং বাধতে। বিবাদ উপস্থিত হলে বলবান দুর্বলকে পরাভূত করে। সকল প্রকার বল হতে মানবের বুদ্ধিবলই শ্রেষ্ঠ। তাই সর্বদা বুদ্ধিপূর্বক বলবানের আশ্রয় গ্রহণ করা বিধেয়। বিশেষ করে বিজিগীষু রাজাদের এ নীতি অনস্বীকার্য। ৬১।

অনুবাদ : (বিপদে) দুর্বলের আশ্রয় গ্রহণ করা দুঃখজনক। ৬২।

মর্মার্থ : বিপৎ সময়ে স্বীয়শক্তি বুঝে প্রবল শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করলে বিপদুত্তীর্ণ হওয়া যায়, বিপরীত পক্ষে দুর্বলের আশ্রয় নিলে বিপদুদ্ধারের কথা দূরে থাকুক, প্রত্যুত দুঃখভাগী হতে হয়। বিপদকালে ধৈর্য, কৌশল, প্রবলের আশ্রয় বিশেষ আবশ্যক। ৬২।

অনুবাদ : অগ্নির ন্যায় প্রতাপ সম্পন্ন রাজার আশ্রয় গ্রহণ করবে। ৬৩।

নদেবচরিতিং চরেত্ ॥ ৬৫ ॥
নোদ্ধত বেষধর: স্যাৎ ॥ ৬৬ ॥
দ্বয়োরপীৰ্ষতে দ্বৈধী ভাবং কুর্ব্বীত ॥ ৬৭ ॥
ন ব্যসন পরস্য কাৰ্য্যাবাপ্তিঃ ॥ ৬৮ ॥

মর্মার্থ : বিপন্ন ব্যক্তি অসীম শক্তিমানের আশ্রয় গ্রহণ করলে তার বিপদে হতে উদ্ধার পায় এবং অন্য দ্বারা ঘৃণিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ৬৩।

অনুবাদ : কখনো রাজার প্রতিকূলতা আচরণ করবে না। ৬৪।

মর্মার্থ : সোমদেবসুরি বলেন, রাজা সুরক্ষিত হলে সকল বিষয় সুরক্ষিত হয়, অতএব নিজ ও অপর দ্বারা নিত্যই রাজা রক্ষণীয়। এই বিষয়ে নীতি বিশারদ রৈভ্য বলেছেন–

‘রক্ষিতে ভূমিনাথেতু আত্ময়েভ্যঃ সদৈবহি।
পরেভ্যশ্চ যতো স্তস্য রক্ষাদেশস্য জায়তে’

নিজ ও অপর দ্বারা সকল সময়ে রাজা রক্ষিত হলে সমগ্র দেশ রক্ষিত হয়। অতএব রাজার প্রতিকূল আচরণ করে প্রকৃতিপুঞ্জ রাজাকে বিপন্ন করলে অবশেষে নিজেদেরও বিপন্ন হতে হয়। তাই প্রকৃতিপুঞ্জের কর্তব্য রাজার অনুকূল আচরণ করা। ৬৪।

অনুবাদ : দেবতা ও রাজ্যর চরিত্রের অনুরূপ আচরণ করবে না। ৬৫।

মমার্থ : অলৌকিক, অনন্তশক্তি সম্পন্নদেবতা স্বয়ং যা করেছেন, মানুষ তা। করবে না, এবং রাজা রাজ্যরক্ষা ও প্রজা পালনের নিমিত্ত প্রাণ দণ্ডাদি কার্যের অনুষ্ঠান করেন, তৎসমুদয় জনসাধারণ করবে না। জনসাধারণের তাদৃশ শক্তি নেই, অতএব দেবোচিত ও রাজোচিত কার্য করতে গেলে অনেক সময় হিত না হয়ে আত্মনাশও ঘটতে পারে। দেবতা ও রাজার আদেশ, উপদেশ মানবের কল্যাণকর বলে তা পালনীয় দেবগণ বিষপান ও সমুদ্রমন্থন করেছেন, তা মানবের পক্ষে সম্ভব নয়। ৬৫।

অনুবাদ : কখনো উৎকট পরিচ্ছদধারী হবে না। (পোশাক ধারণ করবে না)। ৬৬।

মর্মার্থ : যা সমাজের কিংবা শিষ্টজনের অপ্রীতিকর অথবা রাজা, দেবতার পক্ষে সেরূপ এতাদৃশ বেশ, ভূষা করবে না। পরিচ্ছদ দ্বারা স্বীয় শোভা সৌষ্ঠব প্রকাশ পায়, তা যদি উকট হয়, তার দ্বারা নিজের সুষমা প্রকাশের কথা দূরে থাকুক, নূপ প্রভৃতির অপ্রীতিকর ও অশিষ্ট চরণ বোধহয়; তাতে কার্যসিদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে। ৬৬।

অনুবাদ : ঈষা পরায়ণ দুই রাজার মধ্যে দ্বৈধীভাব অবলম্বন করা উচিত। ৬৭।

মর্মার্থ : সোমদেবের মতে, যে সময়ে শক্রুদ্বয় উপস্থিত হয়, সে সময় এক শত্রুর সহিত বিগ্রহ করা উচিত। অপর প্রবল শত্রুর সহিত প্রথমে সন্ধি করে পরে বিগ্রহ করবে। উভয়ের প্রতি অবহেলা (তুচ্ছবোধ) পূর্বক বিগ্রহ করবে না, ইহাই দ্বৈধী ভাবের যথার্থ লক্ষণ। এই দ্বৈধীভাব চার প্রকার, তা কামন্দকনীতিতে উল্লিখিত আছে। ৬৭।

অনুবাদ : বাসন পরায়ণ ব্যক্তি কার্যফলে বঞ্চিত হয়। ৬৮।

মর্মার্থ : বাসনাসক্ত ব্যক্তি নিজের ও অন্যের অনিষ্টসাধন করে ঐহিক অনুতাপ, ক্লেশ, রোগ, পারত্রিক পাপ নিবন্ধন নরক ভোগ করে। ব্যসন কামজাত ও কোপজাত দোষ। কামজ দোষ-মৃগয়া, অক্ষক্রীড়া (পাশা খেলা), মদ্য পানাদি। কোমজ দোষ-দুর্বাক্য বলা, কঠোরতা বা বিনাপরাধে দন্ড প্রদান, অর্থ দোষ প্রভৃতি। অত্যধিক স্ত্রীলোক–প্রসক্তি ব্যসন। মহর্ষি মনুর মতে ব্যসন আঠার প্রকার। এই ব্যসনাক্ত জনের কার্য তৎপরতার অভাবে কোনো কার্যে ফললাভ হয় না। ৬৮।

ইন্দ্রিয়বশবর্তিনো নাস্তিকাৰ্য্যা বাপ্তিঃ ॥ ৬৯ ॥
নাস্তি কাৰ্য্যং দ্রুতঃ প্রবৃত্তস্য ॥ ৭০ ॥
মৃগয়াপরস্য ধৰ্ম্মার্থেী বিনশ্যতঃ ॥ ৭১ ॥
অর্থেষু পান-ব্যসনীন গণ্যতে ॥ ৭২ ॥

অনুবাদ : ইন্দ্রিয়পরায়ণ পুরুষের কোনো কার্যে সাফল্য লাভ হয় না। ৬৯।

মর্মার্থ : যার ইন্দ্রয়িগুলো স্ব-স্ব বিষয়ে ভোগলোলুপ, তাদের কার্যসিদ্ধির কথা দূরে থাকুক স্বীয় জীবনও বিপন্ন হয়। ইন্দ্রিয়ের বশীভূত লোকের অর্থাৎ বিষয়াভিমুখে ধাবিত ইন্দ্রিয়গণের অনুগত যাদের মন, তাদের বুদ্ধিকে অজ্ঞতাই অপহরণ করে। যেমন প্রবল বায়ু কর্তৃক সাগরে পরিচালিত নৌকা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেখানে সেখানে চলে বা ডুবে যায়। মনীষী কৌটিল্য বলেন, চতুরঙ্গ (হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতি সৈন্য) বলে বলবান ব্যক্তিও ইন্দ্রিয়াসক্ত হলে নিশ্চয় বিনাশ প্রাপ্ত হয়। ৬৯।

অনুবাদ : যে ব্যক্তি অচিন্তিত ও অবিচারিতভাবে কার্যে প্রবৃত্ত হয়, তার কার্য সিদ্ধ হয় না। ৭০।

মর্মার্থ : কার্যারম্ভের পূর্বে তার শুভাশুভ ও ফলনিষ্পত্তি বিষয় আলোচনা না করে যে ব্যক্তি হঠাৎ কার্যারম্ভ করে, তার কার্য অবিমূশ্যকারিতাহেতু সম্পন্ন হয় না। কবিগণ বলেছেন যা চিন্তা করে বলা যায় এবং যাহা সম্যক বিচারপূর্বক করা যায়, তা অতি দীর্ঘকালেও বিকারপ্রাপ্ত (বিনষ্ট) হয় না। বরং তার অনায়াসে কার্য সম্পন্ন হয় ও তার ফল স্থায়ী হয়। ৭০।

অনুবাদ : মৃগয়াপরায়ণ ব্যক্তির ধর্ম ও অর্থ বিনষ্ট হয়। ৭১।

মর্মার্থ : মৃগয়া ব্যাধ ও রাজার কার্য। কিন্তু রাজা রাজকার্য সতত তৎপর না। থাকলে, তাতে আসক্তি বৃদ্ধি পায়। পূর্বে মৃগয়া ব্যসনের মধ্যে সাধারণভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে। এই সূত্র দ্বারা ব্যাধ ও রাজা ভিন্ন অন্য সাধারণের প্রতি পাপজনক ও অতি আসক্তিজনক বলে নিষিদ্ধ হলো। বৈধহিংসা শাস্ত্রবিহিত। অবৈধ হিংসা শাস্ত্র নিষিদ্ধ হেতু ধর্ম বিরুদ্ধ অতএব তা পরিহার্য। ৭১।

অনুবাদ : আর্থিক কার্যসমূহে সুরাপানাসক্ত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করবে না। ৭২।

মর্মার্থ : ধনাদির আদান-প্রদান কার্যে কিংবা অর্থনীতি শাস্ত্রোক্ত কার্যে মদ্যপানাসক্ত ব্যক্তিকে অথবা স্ত্রীসেবা তৎপর লোককে নিযুক্ত করা উচিত নয়। যেহেতু পানাসক্ত ও কামান্ধ ব্যক্তির বুদ্ধিভ্রংশতা জন্মে। তার ফলে তা দ্বারা কার্যের বিশেষ হানি হয়। অন্ধ, বধির, চিররুগ্ন, আবদ্বানদনকে কার্যে নিযুক্ত করা এর দ্বারা নিষেধ জানতে হবে। কারণ এদের মধ্যেও সদসৎ বিচারবৃদ্ধির অভাব দেখা যায়।

ন কামাসক্তস্য কাৰ্যানুষ্ঠানম্ ॥ ৭৩ ॥
অগ্নিদাহাদপি বিশিষ্টং বাষ্পরূষাম্‌ ॥ ৭৪ ॥
দণ্ডপারুষ্যাৎ সর্বজনন্বেষ্যো ভবিত ॥ ৭৫ ॥
অর্থদুষকং শ্ৰীঃ পরিত্যজতি ॥ ৭৬ ॥

অনুবাদ : কামাসক্ত ব্যক্তির কার্যারম্ভে কোনো ফল হয় না। ৭৩।

মর্মার্থ : যখন যা করতে হবে, তখন সে কার্যের প্রতি মনের একাগ্রতা থাকা, চাই, তদ্ভিন্ন কার্যারম্ভ কার্য সম্পাদন এবং তার ফলে বঞ্চিত হতে হয়। কামুক ব্যক্তির অধৈর্য ও ইন্দ্রিয় চঞ্চলতাহেতু সকল কার্যেই বিফল মনোরথ হতে হয়। মহর্ষি বলেছেন কামাসক্তের কাম্যবস্তু উপভোগে কখনো কামের শান্তি হয় না, যেমন জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি প্রদান করলে (তাহা নির্বাপিত না হয়ে) দ্বিগুণ জ্বলে উঠে, তদ্রূপ অবস্থা কামাসক্তের হয়। এ স্থলে কামশব্দার্থ বিষয় বাসনা। ৭৩।

অনুবাদ : অগ্নিদাহ হতেও দুর্বাক্য প্রয়োগ কঠোর দুঃখজনক হয়। ৭৪।

মর্মার্থ : দুর্বাক্য প্রয়োগ, অগ্নিদাহ হতেও অধিকক্লেশ দান করে। কবি বলেন, বাগ মাধুৰ্য্যাৎ সর্বলোক-প্রিয়ত্ব। যার বাক্য অতি মধুর, সে সকল লোকের প্রিয়পাত্র হয়। কঠোর বাক্য মর্মবিদারক বলে তাদৃশ বাক্যপ্রয়োগ বাগদণ্ড নামে অভিহিত হয়। পুরুষ রুক্ষ বাক্য প্রয়োগ অপেক্ষা মধুর ভাষণই উত্তম। নীতিশাস্ত্রে আছে প্রিয়বাক্য প্রদানের সর্বেক্ষ্যক্তি জন্তুবঃ। অর্থাৎ প্রিয়বাক্য দ্বারা সকল জন্তুই তুষ্ট হয় মানুষ তো হবেই। ৭৪।

অনুবাদ : কঠোর দণ্ড প্রদানহেতু (দণ্ডদাতা) সকল লোকের অপ্রিয় হয়। ৭৫।

মর্মার্থ : প্রজাস্থিতির নিমিত্ত রাজা দণ্ড প্রদান করবে, সেই দণ্ড ন্যায্য হওয়া একান্ত উচিত। দণ্ড নীতিশাস্ত্রি বিরুদ্ধ হলে জনসমূহে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং দণ্ডদাতার অবিবেক ও শক্তিহীনতা প্রকাশ পায়। দণ্ড নানাবিধ–মানসিক, শারীরিক, আর্থিক সামাজিক, দৈব, অভিশাপ প্রভৃতি। দন্ড প্রয়োগ কালে বিশেষভাবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বিষয়ে চিন্তা করতে হয়। ৭৫।

অনুবাদ : অর্থ ব্যবহারে (সর্বদা অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে) শ্ৰী পরিত্যাগ করে থাকে। ৭৬।

মর্মার্থ : জগতে অর্থ অনেকের থাকে কিন্তু তার সদ্ব্যবহার করতে জানা বড়ই কঠিন। স্বোপার্জিত ও অনার্জিত অর্থে অর্থবান ব্যক্তি ধীর, স্থির সূক্ষ্মাদর্শী, নীতিজ্ঞ হলে, তবে সে অর্থের রক্ষা ও সদ্ব্যবহার করতে সমর্থ হয়। উক্ত গুণগুলো না থাকলে সে ব্যক্তিকে অর্থাধিষ্ঠাত্রী শ্রী পরিত্যাগ করে থাকেন। কারণ সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, অর্থ যেমন একদিকে সর্বাথসাধক, সেরূপ আবার অপরদিকে অর্থই অনর্থের মূল। ৮৬।

অমিত্রো দণ্ডনীতামায়ত্তঃ ॥ ৭৭ ॥
দন্ডনীতিনৃমনুতিষ্ঠন প্রজাঃ সংরক্ষতি ॥ ৭৮ ॥
দণ্ডঃ সৰ্ব্ব সম্পদ বোজয়তি ॥ ৭৯ ॥
দণ্ডাভাবে ত্রিবর্গাভাবঃ ॥ ৮০ ॥

অনুবাদ : শত্রু দণ্ডনীতির কৌশলে অধীনে থাকে। ৭৭।

মর্মার্থ : অন্য উপায় দ্বারা শত্রু বশীভূত না হলে দণ্ডনীতি দ্বারা বশীভূত করতে হয়। তা না হলে, শত্রু দ্বারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ অনিষ্ট সাধনের বিশেষ কারণ থাকতে পারে। যে নীতি বা ন্যায়ের দ্বারা দণ্ডপ্রয়োগ করা হয়, তাই দণ্ডনীতি নামে অভিহিত। যে মিত্র নয়, বিরোধী সে ব্যক্তি অমিত্র। ৭৭।

অনুবাদ : রাজা, দণ্ডনীতি অবলম্বনপূর্বক প্রজাগণকে সুশাসনে রাখেন। ৭৮।

মর্মার্থ : মানব প্রকৃতি যে কেবল ন্যায় পথেই ধাবিত হয়, এমন নয়, অন্যায় পথেই অধিক পরিমাণে ধাবিত হয়। অন্যায় পথগামীদিগকে ন্যায় পথে পরিচালিত করতে হলে দণ্ডপ্রণয়ন আবশ্যক, অন্যথা প্রজাদিগের মধ্যে পরস্পর বিরোধে তাদের উচ্ছেদের সম্ভাবনা। এই হেতু অপরাধীর প্রতি দণ্ডপ্রয়োগ বিশেষ আবশ্যক। ইহাই প্রজাপালনের প্রকৃষ্টনীতি। ৭৮।

অনুবাদ: দণ্ড রাজাকে সকল সম্পদের সহিত যোজিত করে দেয়। ৭৯।

মর্মার্থ : যে কার্যে যখন বিবাদ উপস্থিত হওয়া সম্ভব, তখন অপরাধী পক্ষের বিবাদে দন্ড প্রয়োজন। বিচার, হাট, বাজার, ক্রয়, বিক্রয়, ঋণদান ও ঋণগ্রহণ, ঘট্টরক্ষা করাদান প্রভৃতি বিষয়ে স্বার্থ নিবন্ধন অসাধুতার একান্ত সম্ভাবনাহেতু তার নিবৃত্তির জন্য দণ্ড প্রয়োগ আবশ্যক। তার দ্বারা শান্তি ও শৃঙ্খলা থাকে। ৭৯।

অনুবাদ : যথাযোগ্য দণ্ডের অভাব হলে ত্রিবর্গেরও অভাব হয়। ৮০।

মর্মার্থ : অপরাধীকে বিচারপূর্বক দণ্ডপ্রদান না করলে তার দুষ্কার্য বৃদ্ধি পায়। সমাজে বিশেষ অশান্তির সৃষ্টি করে এবং তা লোক স্থিতির বিরুদ্ধ হয়। শিষ্টের রক্ষা দুষ্টের নিগ্রহ একান্ত আবশ্যক। প্রকৃত দণ্ডের অভাব হলে ত্রিবর্গের অভাব ঘটে। (ক) ত্রিবর্গ-ধর্ম, অর্থ ও কাম। (খ) ত্রিবর্গ, ক্ষয়, স্থান ও বৃদ্ধি; দ্বিতীয় ত্রিবর্গ নীতিবিদগণের পক্ষে প্রশস্ত। অপর নীতিবিদের মতে অষ্টবর্গ কৃষি, পথ, দুর্গ সেতু হস্তীবন্ধন, খনি, আকর, বলাদান। ক্ষয়-অষ্টবর্গের অপচয়। স্থান–উপচয় অপচয়ের অভাব, বৃদ্ধি–অষ্টবর্গের উপচয়। ৮০।

দণ্ড ভয়াদকাৰ্যণি ন কুৰ্বন্তি ॥ ৮১ ॥
দন্ডনীত্যাগমায়ত্তমাত্মরক্ষণম্ ॥ ৮২ ॥
আত্মীন রক্ষিতে সর্বিং রক্ষিতং ভবতি ॥ ৮৩ ॥
আত্মায়ত্তৗ বৃদ্ধি বিনাশৌ ॥ ৮৪ ॥
দণ্ডনীত্যাদি বিজ্ঞানে প্রণীয়তে ॥ ৮৫ ॥

অনুবাদ : লোক দণ্ডভয়ে নীতি ও ধর্ম বিরুদ্ধ কার্য করে না। ৮১।

মর্মার্থ : দণ্ড নিয়মানুসারে রাজশাসনে অপরাধীর প্রতি প্রযুক্ত শাস্তি। দন্ড না থাকলে অজ্ঞ, দস্যুৎ তস্কর, পাপী, প্রতারকগণ দেশে স্বীয় দুষ্কার্য দ্বারা নানা অশান্তি, উপদ্রব এমনকি লোকের প্রাণহানি পর্যন্তও ঘটাতে পারে। অতএব যথাযোগ্য দণ্ড একান্ত প্রয়োজন। দণ্ড ভয়ে লোক অকার্য হতে বিরত হয়। ৮১।

অনুবাদ : রাজার আত্মরক্ষা করা দণ্ডনীতির অধীন হবে। ৮২।

মর্মার্থ : দন্ডনীতি প্রণয়ন দ্বারা রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়। এমন কি, রাজার যে, আত্মরক্ষা করা, তাও দণ্ডনীতির অধীন। দন্ডনীতি প্রণীত না হলে

অজ্ঞলোক কর্তৃক রাজশক্তির বিশেষ হানি ঘটবার সম্ভাবনা। ৮২।

অনুবাদ : আত্মা সুরক্ষিত হলে সবকিছু সুরক্ষিত হয়। ৮৩।

মর্মার্থ : মানব আত্মরক্ষায় নিমিত্ত এই সংসারে পাপ, তাপ, ক্লেশ, অনন্ত দুঃখ সহ্য করে। আত্মার্থে এই সংসার, সংসারের জন্য আত্মা নয়। আত্মরক্ষিত হলে দৃশ্য জগতের সকল বিষয়ই রক্ষিত হবে, এই নিমিত্ত সূত্রকার চাণক্য বলেছেন– ‘আত্মা রক্ষিত হলে সকল রক্ষিত হয়’। কুরক্ষার নিমিত্ত একজনকে ত্যাগ করবে, একখানি গ্রাম (বহুজন অধ্যুষিত স্থান) লাভ হলেও কুলও ত্যাগ করতে পারা যায়। জনপদ লাভের নিমিত্ত গ্রাম ত্যাগ করা যায়। আত্মরক্ষার নিমিত্ত পৃথিবী ত্যাগ করবে। ৮৩।

অনুবাদ : বিষয়ের বৃদ্ধি ও উচ্ছেদ আত্মার অধীন হয়। ৮৪।

মর্মার্থ : আত্মা সত্তার বা অস্তিত্বের যতকাল অনুভূতি থাকে, ততকাল পর্যন্ত এই দৃশ্য জগতের সত্তাও বিদ্যমান থাকে। অতএব বিষয়ের বিস্তার ও বিনাশ আত্মোন্না তিসাপেক্ষ। উন্নত আত্মপুরুষ বিষয়ের বিস্তার ও রক্ষা করতে সমর্থ আত্মোন্নতিবিহীন মানবদ্বারা বিষয়ের উচ্ছেদ সাধিত হয়। নীতিবিদগণের মতে মনই আত্মা। ৮৪।

অনুবাদ : দণ্ডনীতি প্রভৃতি বিশেষ জ্ঞান দ্বারা প্রযুক্ত হয়। ৮৫।

মর্মার্থ : কে দণ্ডাই কে দণ্ডের অযোগ্য–তা বিশেষ বিচারপূর্বক নির্ধারণ করা উচিত, তা হলে নিরপরাধেরও দণ্ড হতে পারে। দণ্ডনীতি প্রয়োগ প্রজার স্থিতির নিমিত্ত হয়, তা প্রজার অশান্তির জন্য নয়। এই নিমিত্ত সূত্রকার, বলেছেন বিজ্ঞান বিশেষ জ্ঞান অর্থাৎ নীতি নৈপুণ্য দ্বারা দণ্ড প্রণীত হবে, তাতে বিশেষ অন আবশ্যক। ক্ষিপ্ৰকারিতা, হঠকারিতা, অবিমূশ্যকারিতা প্রভৃতি থাকবে না। ৮৫।

দুর্বলোহপি রাজা নাবমন্তব্য: ॥ ৮৬ ॥
নাস্ত্যগ্নেদৌর্বল্যম্ ॥ ৮৭ ॥
দন্ডেন প্ৰণীয়তে বৃত্তিঃ ॥ ৮৮ ॥
বৃত্তিমূলোহৰ্থলাভঃ ॥ ৮৯ ॥

অনুবাদ : রাজা শক্তিহীন হলেও তার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করবে না। ৮৬।

মর্মার্থ : সকলের শ্রেষ্ঠহেতু রাজা প্রজাগণের রক্ষক, বিপত্‌ত্রাতা হয়েছে। তার অবমাননা করা অনুচিত। মহর্ষি মনু বলেন, সুরেন্দ্রগণের আটটি শক্তি দ্বারা রাজার দেহ সংগঠিত সেইহেতু সকল জীবকে পরাভূত করে রাজা নিজ প্রভাব দ্বারা সকলের উপরে বিরাজ করেন। রাজশক্তি লাঞ্ছিত ও অপমানিত হলে প্রজাগণের মধ্যে উঁচুনীচ তারতম্যের অভাবহেতু নানারূপ উপদ্রব, অশান্তি ঘটে। রাজশক্তি প্রতাপসম্পন্ন থাকলে প্রজামন্ডলে কোনো উপদ্রব ঘটতে পারে না। ৮৬।

অনুবাদ : অগ্নি স্ফুলিঙ্গরুপ হলেও কখনো তার দুর্বলতা দেখা যায় না। ৮৭।

মর্মার্থ : রাজশক্তি স্বতঃই যে প্রবল, তা এই সূত্রে উদাহরণের সাহায্যে বুঝান হলো। যেমন একটি ফুলিঙ্গস্বরূপ অগ্নি তৃণাদির সঙ্গে যোগ হয়ে দাবানলে পরিণত হয়। সেরূপ বাইরের দৃষ্টিতে রাজশক্তি ক্ষুদ্র হলেও অন্তঃশক্তিও সাধন্দ্ৰব্য বলে বলবান হয়ে প্রজাশক্তি হতে প্রতাপসম্পন্ন হয়। স্বাভাবিকই প্রজাশক্তি হতে রাজশক্তি অগ্নিতুল্য শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ অগ্নি পরিমাণে অল্প হয়েও তার দাহশক্তির প্রকাশ, পাঁচকতা প্রভৃতি নিত্য বর্তমান থাকে, সেরূপ নৃপশক্তিও তার তুল্য। ৮৭।

অনুবাদ : ন্যায় অনুসারে দণ্ডপ্রয়োগ হলে তার দ্বারা প্রজাস্থিতি বৃদ্ধি পায়। ৮৮।

মর্মার্থ : অপরাধীকে যথাযোগ্য দণ্ডপ্রদান না করলে লোকসমাজে অন্যায় ও অপরাধ বৃদ্ধি পেয়ে শান্তি ও সমাজ শৃঙ্খলা নষ্ট করে। ন্যায্য দণ্ড প্রদানে লোকস্থিতি ও লোকবৃদ্ধি হয়ে থাকে। দণ্ড দ্বারা রাজশক্তি ও তার গৌরব অক্ষুণ্ণ থাকে। ৮৮।

অনুবাদ : অর্থলাভ করা প্রজাস্থিতিমূলক হয়ে থাকে। ৮৯।

মর্মার্থ : অর্থোপার্জন বা ক্রয়-বিক্রয়াদিকার্য প্রজাস্থিতিমূলক হয়। যদি শান্তি ও নিরুপদ্রবে প্রজাস্থিতি না হয়, তবে প্রজাদিগের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় অর্থার্জন হয় না; বৃত্তি প্রজাগণের নির্বিঘ্নে অবস্থান, ইহাই অর্থলাভের প্রধান কারণ। ৮৯।

অর্থমূলৌ ধর্মকামৌ ॥৯০॥
অর্থমূল্যং কাৰ্য্যম্ ॥৯১॥
যপ্রযত্নাৎ কাৰ্য্য সিদ্ধির্ভবতি স উপায়ঃ ॥৯২॥
উপায়পূৰ্ব্বং কার্যং ন দুষ্ককরং স্যাৎ ॥৯৩॥

অনুবাদ : ধর্ম ও কাম সাধনের অর্থই মূলহেতু ॥৯০।

মর্মার্থ : সদুপায়ে অর্জিত অর্থ দ্বারা এবং বিষয়কার্য সম্পাদিত হয়। অর্থ না থাকলে ধৰ্মার্জন করতে অর্থাৎ তীর্থসেবা, দান, ব্রত, পরহিত সাধন হয় না। সেরূপ সংসারযাত্রা নির্বাহ, বিদ্যাশিক্ষা, বিদ্যাপ্রদান প্রভৃতি করতে পারা যায় না। সাংসারিক সকল কার্য সাধনের অর্থই একরূপ মূল সাধনরুপে দেখা যায়। অর্থ দ্বারা পরোপকার, ঈশ্বরাধনা, আনুষ্ঠানিক ধর্ম সমুদয়ও সাধিত হয়। ধনবান সকল প্রকার ধৰ্মার্জনে সমর্থ হয়। ৯০।

অনুবাদ : সাংসারিক সকল কার্যের মূল অর্থ। ৯১।

মর্মার্থ : অর্থ দ্বারা সকল কার্য সম্পাদিত হয়, অর্থ না থাকলে দরিদ্রের বহু আশা ও কার্য সম্পন্ন হয় না। অর্থাভাবে অনেক গুণিজনের গুণ প্রকাশ পায় না। এমনকি অর্থ দ্বারা পারত্রিক কার্যও সাধিত হয়। অতএব সদুপায় অর্জিত অর্থ সদভাবেই ব্যয় ও রক্ষা করতে হয়। অর্থার্জনে বিদ্যা, বুদ্ধি, সাহস, শক্তি সততা ও পরিশ্রম একান্ত প্রয়োজন। ৯১

অনুবাদ : যে চেষ্টা প্রভৃতি দ্বারা কার্য সম্পন্ন হয়, তাকেই উপায় বলে। ৯২।

মর্মার্থ : নীতিশাস্ত্রে উপায় বললে সাম, দান্যদি চতুষ্টয়কে বোঝায়। অন্যের মতে উপায় সাতটি–সাম, দান, দণ্ড, ভেদ, মায়া (কপটতা) উপেক্ষা, ইন্দ্রজাল। অপর কেউ বলেন, যে আশ্রয় দ্বারা কার্য সম্পন্ন হয়, তাকে উপায় বলে। মতান্তরে উপায় কার্য সম্পাদনের উপযুক্ত বস্তু। অসদুপায় ও অযোগ্য বস্তু দ্বারা কার্য সম্পন্ন হয় না। উপায়ং চিন্তয়ন প্রাজ্ঞস্তথাইপায়ঞ্চ চিন্তয়ে। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি উপায় ও অপায় এই উভয়ের চিন্তা করবে। ৯২।

অনুবাদ : উপায় অবলম্বনপূর্বক যে কার্য আরম্ভ করা হয়, তা সম্পাদন করা কঠিন হয় না। ৯৩।

মর্মার্থ : কার্যের পূর্বে যদি উপযুক্ত সাধন সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়, তবে সে সামগ্রী দ্বারা কার্য অনায়াসে সম্পন্ন হয়। কার্যের প্রতি সাধন বস্তু যেমন প্রয়োজনীয়, সেরূপ কার্যের প্রতি উদ্যম, অধ্যবসায়, উৎসাহ; অভিজ্ঞতা ও সাধনযোগ্যতা একান্ত আবশ্যক। ৯৩।

অনুপায়পূৰ্ব্বং কাৰ্য্যং কৃতমপি বিনশ্যতি ॥ ৯৪ ॥
কাৰ্য্যার্থিনামুপায় এব সহায়ঃ ॥ ৯৫ ॥
কাৰ্য্যৎ পুরুষকারেণ লক্ষ্যং সম্পদ্যতে ॥ ৯৬ ॥
পুরুষকার মনুবর্ততে দৈবম্ ॥ ৯৭ ॥
দৈবং বিনা অতিপ্ৰযত্নং করোতি যত্তদ্বিফলম্ ॥ ৯৮ ॥

অনুবাদ : উপায়বিহীন কার্য অনুষ্ঠিত হলে তা বিনষ্ট বা নিষ্ফল হয়। ৯৪।

মর্মার্থ : কার্যের পূর্বে উৎসাহ নৈপূণ্যের যেরুপ প্রয়োজন দ্রুপ কার্যের উপযোগী উপায় অনুষ্ঠান করাও একান্ত আবশ্যক, যেহেতু উপায় শূন্য কার্য অনুষ্ঠিত হলেও তা বৃথা হয়। সেরূপ সংগ্রামস্থলে সৈন্য প্রভৃতি সুদক্ষ থাকলেও সুতীক্ষ অস্ত্রশস্ত্রাদির বিশেষ আবশ্যক। ৯৪।

অনুবাদ : কার্যার্থিগণের কার্য সাধনে উপায়ই একমাত্র সহায়। ৯৫।

মর্মার্থ : যার যে কার্য সাধন করা প্রয়োজন হবে, যে কার্য সাধনসামগ্রীই উপায়রূপে একমাত্র সহায় হয়, সেই সহায়ের আশ্রয়ই প্রথম প্রয়োজন। ৯৫।

অনুবাদ : যে কার্য লক্ষ করা হয়, সে উদ্দেশ্য ভূতকার্য পুরুষকার দ্বারা সম্পন্ন হয়। ৯৬।

মর্মার্থ : পূর্বে যে কার্য হিতকর বলে লক্ষ করা হয় তা উদাম, উৎসাহ, অধ্যবসায় প্রভৃতি দ্বারা সম্পন্ন হয়, পুরুষ-শক্তি চেষ্টা কৌশল, কার্যোপযোগী বস্তু সংগ্রহ যোগ্যতা প্রভৃতি পুরুষকার বা পুরুষ সামর্থ্য। তার দ্বারা কার্য নিষ্পন্ন হয় দৈবপরায়ণতা, আলস্য, বাচলতা প্রভৃতি দ্বারা কার্য সম্পন্ন হয় না। যে ব্যক্তি উৎসাহযুক্ত, দীর্ঘসূত্রতাহীন, কার্য রহস্যবেত্তা, বাসনবর্জিত শুর, কৃতজ্ঞ, বহু, বন্ধুযুক্ত্য তার কার্য অনায়াসে সিদ্ধ হয়। ৯৬।

অনুবাদ : দৈব (অদৃষ্ট) পুরুষকারের অনুসরণ করে। ৯৭।

মর্মার্থ : নীতিবিদগণের মতে দৈব বা অদৃষ্ট অর্থাৎ যে পূর্বজন্ম অনুষ্ঠিত কর্মফল তা পুরুষকারের অনুগামী হয় দৈব অপেক্ষা পুরুষকার প্রবল। দৈব পরোক্ষভাবে প্রকাশ পায়, পুরুষকার প্রত্যক্ষভাবে দৃষ্ট হয়। দেখতে পাওয়া যায়, যে সকল কার্যে পুরুষের চেষ্টা, উদ্যম, উৎসাহ, যোগ্যতা, কৌশল প্রভৃতি দ্বারাই কার্য সম্পাদিত হয়, দৈব স্বয়ং লোকসমাজে এসে কোনো কার্য সম্পাদন করে না, কার্যের প্রতি তা সাধারণ কারণ মাত্র। বৃহস্পতি, চার্বাক প্রভৃতির ও ইহাই অভিপ্রায় । ৯৭।

অনুবাদ : কোনো কার্যে বিশেষ যত্ন করলেও তা দৈব ভিন্ন সম্পন্ন হয় না। ৯৮।

মর্মার্থ : পূর্বসূত্রে পুরুষকার প্রবল ইহা কথিত হয়েছে, এই সূত্র দ্বারা দৈব ভিন্ন কেবল পুরুষকারের দ্বারা কার্য সিদ্ধ হয় না, তাও উক্ত হলো। অতএব উভয়সূত্রের তাৎপর্য এই যে, কেবল দৈব দ্বারা কার্য সাধিত হয় না, তার সঙ্গে প্রবল পুরুষ্যকারও চাই। দৈব অপেক্ষা পুরুষকার প্রধান ইহাই সূত্রকারের উদ্দেশ্য, দৈবখণ্ডন করা তায় অভিপ্রায় নয়। এই সূত্র দ্বারা মহামতি কৌটিল্যের সম্পূর্ণ আস্তিকতা সূচিত হয়েছে। ৯৮।

অনীহমানস্য বৃত্তির্ন সম্পদ্যতে ॥ ৯৯ ॥
পূৰ্ব্বং নিশ্চিতা পশ্চাৎ কাৰ্যমারভেত ॥ ১০০ ॥
ইতি চাণক্যসূত্রে নীতিদর্শনাত্মকে প্রথমোহধ্যায়ঃ ॥ ১ ॥

অনুবাদ : যার কার্য চেষ্টা নাই, তার জীবিকা অর্জন হয় না। ৯৯।

মর্মার্থ : যার কোনোরূপ চেষ্টা দেখা যায় না, তার জীবিকা অর্জন কার্যসিদ্ধি হয় না, চেষ্টা উদ্যম, অভিলাষ, অধ্যবসায় উৎসাহাদি গুণ মানবের সকল কার্যে সাফল্য লাভের প্রধান হেতু; উল্লিখিত গুণাবলি না থাকলে কার্যফল ও সংসারে অবস্থিতি অতি দুষ্কর হয়। ৯৯।

অনুবাদ : পূর্বে নিশ্চয় করে পরে কার্য আরম্ভ করা উচিত। ১০০।

মর্মার্থ : আগে কার্যের হিতাহিত চিন্তা করে পরে যে কার্য আরম্ভ করতে হয়, কার্য সম্পন্ন করে পরে তার শুভাশুভ চিন্তা করা উচিত নয়। তাতে কোনো ফল হয় না, বরং কৃতকার্য না হলে অনুতাপ বৃদ্ধি পায় মাত্র। লোকপ্রবাদেও তাই উক্ত হয়েছে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। যা দ্বারা অনিষ্ট হয়, সেরূপ কার্যে প্রবৃত্ত হবে না। ১০০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *