২৫. বেলাশেষের বিষণ্ণ রোদ

২৫.

পশ্চিমের পাহাড়চূড়ায় বেলাশেষের বিষণ্ণ রোদ আটকে রয়েছে।

সিজিটোর ঘরে এল সারুয়ামারু। একপাশে বাঁশের একটা মাচান। তার ওপর সেঙাই বসে রয়েছে। এর মধ্যে খাবারগুলো শেষ করে ফেলেছে সে।

ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার।

সারুয়ামারু বলল, কি রে সেঙাই, সব খাবার গিলেছিস? আমার জন্যে রাখিসনি?

না, সব খেয়ে ফেলেছি। বড্ড খিদে পেয়েছিল।

হু-হু, ঠিক আছে। ফাদারের কাছ থেকে আবার চেয়ে নেব’খন।

সারুয়ামারু বলল, চল, কোহিমা শহর তোকে ঘুরিয়ে আনি। মাধোলাল মাড়োয়ারির দোকান, ভূষণ ফুকনের দোকান-যেখান থেকে আমরা নিমক নিই, সব দেখিয়ে আনব। তোকে। সমস্ত কিছু চিনিয়ে দেব।

এবার উৎসাহিত হয়ে উঠল সেঙাই। মাচান থেকে লাফিয়ে নিচে নামল, সেই যে বলেছিলি, রানী গাইডিলিও বলে কে আছে, তাকে দেখাবি না? তুই বলেছিলি, তার ছোঁয়ায় নাকি সব রোগ সেরে যায়। তামুন্যুর (চিকিৎসক) চেয়েও সে বড়। সদ্দার তাকে দেখে যেতে বলেছে।

হু-হু, নিশ্চয়ই দেখাব। চল, বেরিয়ে পড়ি।

চার্চের সামনে সবুজ ঘাস-জমিটার কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে একটা ডাক ভেসে এল। নির্ঘাত পাত্রীসাহেব। ফিরে তাকাল দুজন।

এই সারুয়ামারু, এই সেঙাই–কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

ঘাস-জমির ওধারে বেতের চেয়ারে বসে হোলি বাইবেলের বিশেষ একটা অধ্যায়ে মনটাকে ডুবুরির মতো নামিয়ে দিয়েছিল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। সেঙাইদের বেরুতে দেখে মুখ তুলল।

গুটি গুটি সামনে এসে দাঁড়াল সারুয়ামারু। ফিসফিস গলায় বলল, সেঙাইকে একটু শহর দেখাব। হুই মাধোলালের দোকান যেখান থেকে আমরা নিমক নিই, সেই আস্তানাটাও দেখিয়ে দেব। দরকার হলে বস্তি থেকে এসে ও নিমক নিয়ে যাবে।

আর কোথায় যাবে? উৎসুক চোখে তাকাল ম্যাকেঞ্জি।

আর হুই যে রানী গাইডিলিও আছে, তাকে একবার দেখব।

রানী গাইডিলিও! সাপের ছোবল পড়ল যেন ম্যাকেঞ্জির কানে। হাতের বাইবেলখানা সশব্দে বন্ধ করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে, খবরদার, ওদিকে কেউ যাবে না। গাইডিলিও একটা ডাইনি। সর্বনাশ করে ছাড়বে।

ডাইনি! চমকে উঠল সারুয়ামারু। তার মুখেচোখে একটা সন্ত্রস্ত ছায়া পড়ল।

ইতিমধ্যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেঙাই। সেও বলল, ডাইনী!

হ্যাঁ—হ্যাঁ–লালচে চুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে, কটা চোখের মণি ঘুরিয়ে দু’টি পাহাড়ী মানুষকে যাচাই করতে লাগল ম্যাকেঞ্জি। ডাইনি! দেখতে লাগল, ওই একটি শব্দ কেমন করে তাদের মুখেচোখে কী প্রতিক্রিয়া ফুটিয়ে তুলছে। নিপুণ শিল্পীর মতো কথার তুলিতে, উচ্চারণের ঢংয়ে একটা ভয়ের ছবি আঁকতে লাগল ম্যাকেঞ্জি। বার বার সেঙাই আর সারুয়ামারুর কানের কাছে মুখখানা ঘনিষ্ঠ করে পরম শুভার্থীর মতো বলতে লাগল, খবরদার, জানের মায়া থাকলে গাইডিলিওর কাছে যেয়ো না তোমরা। গাইডিলিও একটা খারাপ আনিজা। বুকের রক্ত শুষে শুষে সাবাড় করে ফেলবে তোমাদের।

কাঁপা গলায় সেঙাই বলল, ডাইনি যখন, নিশ্চয়ই বশীকরণ ওষুধ জানে গাইডিলিও?

হ্যাঁ হ্যাঁ, জানে। খুব সাবধান। দু’টি পাহাড়ী মানুষের মনে গাইডিলিও সম্পর্কে একটা ভয়াবহ ধারণা গড়ে তুলতে লাগল ম্যাকেঞ্জি, এমন বশ করবে, একেবারে পোষা বাঁদর বানিয়ে ছাড়বে।

ভালোই হল। আমাদের পাশের বস্তি সালুয়ালাঙে আমার গোয়া লে আছে। তাকে আমার চাই। তার জন্যে গাইডিলিও ডাইনির কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে যাব। আমাদের হুই দিকে ডাইনি নাকপোলিবা রয়েছে। কিন্তু তার কাছে ঘেঁষতে বড় ভয় করে।

একটু থতমত খেল ম্যাকেঞ্জি। পরক্ষণে বিক্ষিপ্ত মনটাকে ঠিকঠাক করে নিল, এ ডাইনি তোমাদের ওই নাকপোলিবার চেয়েও সাআতিক। এর কাছে যেয়ো না। আমি তোমাকে সেই সালুয়ালাঙ বস্তির লগোয়া লেকে এনে দেব। তা হলে খুশি তো?

দিবি তো, দিবি তো, ও সায়েব? গভীর উৎসাহে ম্যাকেঞ্জির পাশে এসে নিবিড় হয়ে দাঁড়াল সেঙাই, তুই যদি এনে দিস তবে আর গাইডিলিওর কাছে যাব না। বলতে বলতে কয়েক মুহূর্তের জন্য ভাবনার মধ্যে তলিয়ে গেল সেঙাই। তারপর কাঁপা, ভীরু গলায় বলল, কিন্তু আমাদের সদ্দার যে গাইডিলিওকে দেখে যেতে বলেছে।

তোমাদের সদ্দার জানে না ও কত বড় শয়তানী। ওই ডাইনি গাইডিলিওর কাছে গেলে একেবারে খতম করে দেবে।

আচমকা বাঁশের গেটে ক্যাচ করে শব্দ হল। চোখ তুলে তাকাল ম্যাকেঞ্জি। তারপর খুশির গলায় অভ্যর্থনা জানালো, আরে এসো, এসো তোমরা।

গেটের ওপাশে অনেক মানুষের জটলা। পাহাড়ী মানুষ। তুমুল হুলস্থুল বাধিয়ে দিয়েছে। মাথায় মোষের শিঙের মুকুট, তাতে আউপাখির পালক গোঁজা। তামাটে দেহে অজস্র উল্কি মানুষের কঙ্কাল, বাঘের চোখ, হাতির দাঁত আঁকা রয়েছে। হাতের থাবায় লম্বা লম্বা বর্শা। সেই বর্শার ফলায় বেলাশেষের রোদ ঝিলিক দিচ্ছে।

ডেলা পাকিয়ে জটলা করতে করতে মানুষগুলো সামনের ঘাসের জমিটায় এসে বসেছে। সেঙাই একবার তাদের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিটা সকলের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে যেতে শুরু করল। নানা জাতের পাহাড়ী নাগা। লোটা, আও, সাঙটাম, কোনিয়াক, সেমা, রেঙমা। বিচিত্র ভাষায় তারা একসঙ্গে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। বিচিত্র ভাষা, অদ্ভুত অদ্ভুত উচ্চারণ আর মুখভঙ্গি। হঠাৎ একটি মুখের ওপর এসে দৃষ্টিটা শিউরে উঠল সেঙাইর। হৃৎপিণ্ডের ধকধকানি থেমে আসতে লাগল। ওই মানুষটা নির্ঘাত সালুয়ালাঙ বস্তির সর্দার।

সাঁ করে সারুয়ামারুর পেছনে এসে দাঁড়াল সেঙাই।

সারুয়ামারু বলল, কি রে সেঙাই? কী হল?

হুই দ্যাখ, সালুয়ালাঙ বস্তির সদ্দার এসেছে। তুই দাঁড়া, আমি বাপের ঘর থেকে বর্শাটা নিয়ে আসি।

কেন?

কেন আবার, যদি একটা লড়াই বেধে যায়?

আরে না, না। ফাদার রয়েছে। এখানে লড়াই চলবে না। তা হলে হুই আসান্যুরা (সমতলের মানুষ) বন্দুক হাঁকড়ে মেরে ফেলবে।

ঘাসের জমির মাঝখানে পাহাড়ী মানুষগুলোর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ম্যাকেঞ্জি। মধুর হাসিতে মুখখানা ভরে গিয়েছে তার। ম্যাকেঞ্জির হাসির পেছনে অনেক সাধনা আছে। সারা মুখে যে-কোনো সময় যে-কোনো ভঙ্গির হাসি সে অবলীলায় ফোঁটাতে পারে। সারপ্লিসটা গোছগাছ করতে করতে ম্যাকেঞ্জি বলল, এই যে সর্দারেরা, তোমরা সব এসেছ। ভালোই হল, নইলে খবর পাঠাতে হত। তোমাদের সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

হু-হু। মাথা ঝাঁকিয়ে, মোষের শিঙের মুকুট দুলিয়ে সায় দিল পাহাড়ী সর্দারেরা, কী কথা বলবি ফাদার?

ওপাশে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেঙাই আর সারুয়ামারু। সারুয়ামারু বলল, পাহাড়ী বস্তি থেকে সদ্দারেরা এসেছে। ফাদার ওদের সঙ্গে এখন কথা বলবে। চল, আমরা ভাগি। শহর। দেখে, ভূষণ ফুকন আর মাধোলাল মাড়োয়ারির দোকান দেখে, রাস্তাঘাট বাজার দেখে, ফিরব।

হু-হু, তাই চল—

সকলের আগোচরে লোহার গেটটা পেরিয়ে কোহিমার পথে এসে নামল সেঙাই আর সারুয়ামারু।

আর পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি পাহাড়ী মানুষগুলোর জটলার মাঝখানে বসে পড়ল, একান্ত অন্তরঙ্গ হয়ে।

সর্দারেরা তারস্বরে হল্লা করেছে, ফাদার, আমার বস্তিতে সকলে যীশু-মেরী করে আর কর (স) আঁকে।

আমার বস্তিতেও।

আমার বস্তিতেও।

হল্লাটা একটু একটু করে তুমুল হয়ে উঠতে লাগল।

গুড, ভেরি গুড–প্রসন্নতার একটি চিকন আভা ঝলমল করছে ম্যাকেঞ্জির মুখেচোখে, খুব খুশি হলাম।

একটু আগে সারুয়ামারুর মুরগি বলির কথা শুনে মেজাজটা যে পরিমাণ খিঁচড়ে গিয়েছিল, এই মুহূর্তে এতগুলি গ্রামের এতগুলি পাহাড়ী সর্দারের গলায় যীশু-মেরীর নাম শুনতে শুনতে তার একশো গুণ বেশি আত্মপ্রসাদ অনুভব করল ম্যাকেঞ্জি। তবে তার প্রিচিঙ একেবারে অসফল নয়, ব্যর্থ হয়ে যায় নি তার মিশনারি জীবনের কঠিন শপথ। পাহাড়ী প্রাণের শিলাফলকে যীশু-মেরীর যে নাম বার বার অবিরাম প্রেরণায় লিখতে চেয়েছে ম্যাকেঞ্জি, আজ যেন তার প্রথম সুস্পষ্ট হরফ দেখতে পেল সে। দেখে মুগ্ধ হল। সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলির ওপর একটা সুখের শিহরন খেলে গেল প্রৌঢ় ম্যাকেঞ্জির।

এবার আশ্চর্য শান্ত এবং সস্নেহ গলায় ম্যাকেঞ্জি বলল, তোমাদের নিমকের দরকার তো?

হু-হু, সেই জন্যেই তো এলুম ফাদার।

আচ্ছা, আচ্ছা–এবার অনেক নিমক দেব। টাকাও দেব। কিন্তু একটা কাজ করতে হবে তোমাদের।

হো-ও–ও–ও-য়া-আ-আ–ফাদার নিমক দেবে, টাকা দেবে।

সমতল থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে কোহিমার এই পাহাড়চূড়ায় একটা উল্লসিত শোরগোল ঝড়ের মতো ভেঙে পড়ল। সে চিৎকারে আকাশের কোনো নিঃসীম শূন্যে বেথেলহেমের একটি উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হয়তো বা চমকে উঠল। ঘাসের জমিটার এক কিনারে কাঠের শুভ্র ক্রসে সে কোলাহল থেকে খানিকটা কালিমা ছিটকে গিয়ে লাগল যেন।

ম্যাকেঞ্জি সতর্কভাবে পাহাড়ী মানুষগুলোর মুখের ওপর দিয়ে দৃষ্টিটাকে পাক খাওয়াতে খাওয়াতে চার্চের একটি জানালায় এনে স্থির করল। দেখল, দু’টি শাণিত নীল চোখ মেলে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে পিয়ার্সন। পলক পড়ছে না। একটা শিলামূর্তি যেন। বাঘের ঘরে ঘোগের আস্তানা। আচ্ছা, তার নামও ম্যাকেঞ্জি। পাদ্রী-জীবনের নেপথ্যে ব্রেটেনব্রুকশায়ারের রাঙা মাটিতে মাটিতে তার অতীতকে রেখে এসেছে সে। সে অতীতের খবর জানা নেই পিয়ার্সনের। সে অতীত মানুষের তাজা রক্তে রক্তে ভীতিকর। আশপাশের পঁচিশটা শায়ার তার নামের দাপটে সেদিন তটস্থ থাকত। একটা ভিলেজ রোগ। একটা ব্যান্ডিট। সেদিন তার নাম করে দূরন্ত ছেলেদের ঘুম পাড়াত মায়েরা। তার নামে ছড়া বেঁধেছিল অজানা গ্রাম্য কবিরা।

ব্যান্ডিট থেকে ধর্মযাজক। আশ্চর্য জন্মান্তর বটে! সেই ব্রেটনব্রুকশায়ারের রাঙা মাটি ঘোড়ার খুরে খুরে ক্ষতবিক্ষত করে, শিকারি নেকড়ের মতো একদল অনুচর নিয়ে ঘুরে বেড়াত একটা ঘৃণিত আউটল। তার ঘোড়ার খুরের শব্দে একটা আসন্ন অপঘাতের আশঙ্কায় শিউরে উঠত পঁচিশটা শায়ারের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি।

ব্যান্ডিট থেকে মিশনারি।

কী কুৎসিত সে জীবন। নিরীহ মানুষের রক্তে রক্তে, নারীর ইজ্জত শিকারে সে জীবন কী কদাকার! সেদিন কী অব্যর্থ ছিল তার রাইফেলের লক্ষ্য। রিভালভারের ট্রিগারের ওপর তর্জনীটা এতটুকু কাপত না সেদিন।

আউটল থেকে ধর্মযাজক! কত পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে ম্যাকেঞ্জিকে! সে কাহিনী অন্য সময় বলা যাবে। কিন্তু ব্রেটনব্রুকশায়ারের সেই ভয়ঙ্কর জীবন এখনও তার শিরায় শিরায় বিষাক্ত একটা রক্তকণিকার মতো মিশে রয়েছে। সেই কলুষিত জীবনে ফিরে যেতে চায় না পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। অজস্র মানুষের ধর্মবোধের ওপর প্রভুত্ব করার মধ্যে এক ধরনের মাদকতা আছে। এমন এক বিচিত্র রকমের নেশা আছে যার আকর্ষণ অতীত জীবনটা সম্বন্ধে অরুচি ধরিয়ে দেয়। কিন্তু পিয়ার্সনটা বড় একগুঁয়ে, বড় জেদী। যদি প্রয়োজন হয়–চার্চের জানালায় একটা বিরক্ত ভ্রুকুটি হেনে বিড়বিড় করে কী যেন বলল ম্যাকেঞ্জি। নিশ্চয়ই হোলি বাইবেলের মহাজন-বাণী আবৃত্তি করল না।

এবার সরাসরি পাহাড়ী মানুষগুলোর দিকে তাকাল ম্যাকেঞ্জি, একটা কাজ করতে হবে তোমাদের, বুঝলে সর্দারেরা। যত টাকা চাও, যত নিমক চাও, দেব। গাইডিলিওর নাম শুনেছ তো?

হু-হু–পাহাড়ী মানুষগুলো মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিল।

ওই গাইডিলিও একটা ডাইনি। তোমাদের বস্তিতে বস্তিতে এই কথাটা রটিয়ে দিতে হবে। যত টাকা চাও, দেব। আরো নিবিড় হয়ে বসল ম্যাকেঞ্জি।

কে ডাইনি? হুই গাইডিলিও? চোঙলি সর্দার সিনামঙ্কো হুঙ্কার দিয়ে উঠল, একথা বললে একেবারে বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে ফেলব। আমার ছেলেটাকে অঙ্গামীরা তো সুচেন্যু দিয়ে কুপিয়ে গেল। তামুন্যু বলল, ও আর বাঁচবে না। হুই গাইডিলিওর ছোঁয়ায় সে বেঁচে উঠল। তাকে ডাইনি বলছিস!

হু-হু–আও আর সাঙটাম সর্দারেরা উঠে দাঁড়াল, আমাদের বস্তির অনেক লোক ভালো হয়ে গেছে রানীর ছোঁয়ায়। তাকে ডাইনি বলতে বলছিস!

হো-ও-ও-ও-য়া-য়া–

চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল লোটা, কোনিয়াক আর রেঙমা সর্দারেরা, চাই না, চাই না তোর টাকা, তোর নিমক। যে আমাদের বাঁচাল তাকে ডাইনি বলব না।

যীশুর নাম বলব না। মেরীর নাম বলব না।

আর ক্রস আঁকব না।

হো-ও-ও-ও-য়া-য়া–

শোরগোল উদ্দাম হয়ে উঠল, রানী গাইডিলিওর সঙ্গে বেইমানি করতে বলছিস! তুই তো শয়তান আছিস।

তোর কাছে আর আসব না।

নিরুপায় আক্রোশে চোখদুটো ধকধক জ্বলছে ম্যাকেঞ্জির। সে কী জানত, এই হিদেন পাহাড়ীগুলোর মনে যীশু-মেরীর নামে যা গড়ে তুলেছিল, তার নিচে কঠিন ভিত্তি নেই! আবার তার দৃষ্টিটা চার্চের জানালায় একটা মুখের ওপর এসে পড়ল। পিয়ার্সনের মুখে সেই সূক্ষ্ম পর্দার মতো একটি বিদ্রপের হাসিই কি আটকে রয়েছে? সারা দেহের শিরায় শিরায় ব্রেটনব্রুকশায়ারের অতীত জীবন যেন চমক দিয়ে উঠল ম্যাকেঞ্জির। খ্যাপা একটা নেকড়ের মতো গর্জন করে উঠতে যাচ্ছিল ম্যাকেঞ্জি, তার আগেই ঘটে গেল ঘটনাটা। লোহার গেটে কাঁচ করে শব্দ হল।

হো-ও-ও-ও-য়া-য়া-–

চিৎকার করতে করতে কোহিমার পথে নেমে গেল পাহাড়ী সর্দারেরা।

সমস্ত মনটা যেন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে ম্যাকেঞ্জির। আগ্নেয় চোখের মণিদুটো যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কিছুই শুনছে না ম্যাকেঞ্জি। সব ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। একটা নিরাকার অন্ধকারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে তার চেতনাটা। জীবনে কোনোদিন এমন অসহায় মনে হয়নি নিজেকে।

একসময় পায়ের কাছ থেকে কয়েকটা গলা বুদ্বুদের মতো ফুটে বেরুল। তাদের মধ্যে কুকী সর্দার আছে, মিজো দলপতি আছে, আর রয়েছে সালুয়া গ্রামের বুড়ো সর্দার। তিনটে পাহাড়ী মানুষ সাপের মতো ক্রুর চোখ মেলে অনুগত কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে যেন। ফাদার, আমরা তোর নিমক খেয়েছি। ওদের মতো নিমকহারামি করব না। গাইডিলিওকে ডাইনি বলে আমাদের নিজেদের বস্তিতে আর চারপাশের বস্তিগুলোতে রটিয়ে দেব। তবে অনেক টাকা আর নিমক দিতে হবে।

দেব, নিশ্চয়ই দেব–একটা অবলম্বন পেয়েছে ম্যাকেঞ্জি, একটা আশ্রয়। এই আশ্রয়ের ওপর দাঁড়িয়ে সে ভেলকি দেখিয়ে ছাড়বে, তোমরা যা চাও, তাই দেব। সব পাবে।

আচমকা সালুয়ালা গ্রামের সর্দার বলল, ফাদার, আমাদের বস্তির মেহেলীকে কেরি বস্তির লোকেরা আটক করে রেখেছে। তাকে ফিরে পেতে হবে। হুই বস্তির সেঙাই ওকে বিয়ে করতে চায়। ইদিকে নানকোয়া বস্তি থেকে মেহেলীর জন্য টেনেন্যু মিঙ্গেলু (বউপণ) দিয়েছে। কেলুরি বস্তির লোকেরা আমাদের শত্রুর।

ঠিক আছে। চারিদিকে একবার দ্রুত দেখে নিল ম্যাকেঞ্জি। গেল কোথায় সেঙাই আর সারুয়ামারু? এই তো এখানেই ছিল একটু আগে। তবে কি অন্য পাহাড়ী সর্দারদের সঙ্গে তারাও চার্চের সীমানা পেরিয়ে চলে গিয়েছে? কুটিল একটা সন্দেহে মনটা কালো হয়ে গেল ম্যাকেঞ্জির। দাঁতে দাঁত ঘষে হুমকে উঠল সে, ঠিক আছে। মেহেলীকে তোমাদের বস্তিতে ফিরিয়ে আনব। দরকার হলে কোহিমা শহরের সব বন্দুক নিয়ে কেলুরি বস্তি মাটিতে মিশিয়ে দেব।

সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দারের চোখদুটো উল্লাসে হিংস্রভাবে জ্বলতে লাগল।

.

২৬.

কোহিমা। সমতল থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে পাহাড়ী শহর। পাথরের ভাঁজে ভাঁজে, চড়াই-উতরাই-এর ফাঁকে ফাঁকে টালি আর ঢেউটিনের বাড়ি। ময়াল সাপের মতো এঁকেবেঁকে পথের রেখা উঠে গিয়েছে, তার পরেই নিশ্চল ঢেউ-এর মতো নিচের দিকে দোল খেয়ে নেমে এসেছে।

পাথর কাটা আঁকাবাঁকা পথ। পাইন আর ওক বনের আড়ালে আড়ালে, কালো পাথরের টিলায় টিলায় ছোট ছোট বাড়ি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে সেঙাই আর সারুয়ামারু। সেঙাই-এর দুচোখে মুগ্ধ বিস্ময়। তার অস্ফুট মন এই কোহিমা শহরটাকে গোগ্রাসে গিলছে। যেন।

একসময় ডিমাপুর যাওয়ার পথটার কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে। জায়গাটা মোটামুটি সমতল। সামনের দিকে বনময় চড়াই পাহাড়ের দিকে উঠে গিয়েছে। এপাশে ঠাসবুনন দোকানপসার। ঢেউটিনের চাল, খাটসঙ কাঠের দেওয়াল, নিচে ওক কাঠের পাটাতন।

সারুয়ামারু বলল, ইস, অনেক দোকান বেড়ে গেছে। আগে তো এত ছিল না। আসান্যুরা (সমতলের লোকেরা) সব ঋক বেধে আসছে রে সেঙাই। কোহিমা শহর একবারে ছেয়ে ফেলেছে। দেখছিস?

হু-হু–

আরে সারুয়ামারু যে, এদিকে এসো। এসো আসাহোয়া (বন্ধু)। সামনের একটা দোকান থেকে সাদর ডাক ভেসে এল।

কে? ও মাধোলাল মাড়োয়ারি। চল, চল সেঙাই–সারুয়ামারু সেঙাই-এর একটা হাত চেপে ধরল। পাথর কাটা পথ থেকে নিচে নেমে দুজনে মাধোলালের দোকানের দিকে এগুতে শুরু করল।

ছোট্ট শহর এই কোহিমা। নাগা পাহাড়ের কেন্দ্রবিন্দু। সমতল থেকে বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে এসে বসেছে অসমীয়া, মাড়োয়ারি। এসেছে গুজরাটি আর ভুটিয়া। রকমারি সম্ভার, মনোহারি সামগ্রীতে নানা রঙের বাহার। আশেপাশের পাহাড় থেকে শুকনো মরিচ, আনারস আর পাহাড়ী আপেল নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী বাজার বসিয়েছে কুকীরা। এসেছে মিকিরেরা। মণিপুরীরাও এই বাণিজ্যমেলা থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেনি।

কাঁচের কঙ্কণ, লবণ, পাটনাই চালের বস্তা নিয়ে রেল স্টেশন মণিপুর রোড থেকে এই কোহিমার বাজারে আসে একটার পর একটা লরি। বাঘের ছাল, হরিণের শিঙ, কস্তুরী, ওক আর পাইন কাঠ, কমলা আর রাশি রাশি বনজ ফল ইত্যাদি নানা পণ্যভারে বোঝাই হয়ে আবার রেল স্টেশনে ফিরে যায়।

দোকানপসারের জটলা পেছনে রেখে মাথোলালের দোকানে এসে বসল সেঙাই আর সারুয়ামারু।

মাধোলাল বলল, কি সারুয়ামারু, তুমি তো আর আজকাল আসো না নিমক নিতে। তোমার বাবা, তোমার ঠাকুরদা, সবাই আমার খদ্দের ছিল। আজকাল এত দোকান হয়েছে। আসানুরা (সমতলের লোকেরা) এসে কোহিমার বাজার ঘেঁকে ধরেছে। কিন্তু আমি যখন এখানে আসি তখন আসাদের একটা দোকানও ছিল না। তোমাদের গোসা হয়েছে নাকি আমার ওপর?

না, না–সারুয়ামারু মাথা ঝাঁকাল।

তবে আসো না কেন? অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াল মাধোলাল।

আজকাল হুই ফাদার নিমক দেয়, তাই আর আসি না।

আরে রাম রাম। তাই নাকি? তা নিমকের বদলা কী দাও? আগ্রহে বুড়ো মাধোলাল আরো খানিকটা এগিয়ে এল।

কিছু না, খালি ক্রস আঁকি আর যীশু-মেরীর নাম করি। নির্বিকারভাবে বলে গেল সারুয়ামারু, হুই ফাদার বলেছে, ক্রস আঁকলে আর যীশু-মেরীর নাম করলে কিছুই দিতে হবে না।

হায় রাম–প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মাথোলাল, ওই কাম করলে তোমাদের আনিজার গোসা হবে। পাদ্রীসাহেবরা ভারি শয়তান আছে, তোমাদের ধরম নষ্ট করে দিচ্ছে। খাসিয়া। পাহাড়ে যখন ছিলাম তখন দেখেছি, খাসিয়াদের সব খেস্টান করে দিল। এবার তোমাদের। ধরেছে। হায় রাম।

আজমীড় কি মাড়োয়ারের কোনো এক দেহাতে মাথোলালের দেশ, তা আজ আর বিশেষ মনে পড়ে না তার। সূর্য ওঠার আগে আকাশের চক্ররেখায় যেমন এক আস্তর ছায়া-ছায়া রং লেগে থাকে, ঠিক তেমনই একটা অস্পষ্ট স্মৃতি মনের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে রয়েছে। জনারের খেত, কপিরং রুক্ষ মাটি, মহিষ চারণের জমি, এছাড়া আর কিছু নয়। দশ বছর বয়সে বাপ ক্ষেত্রীলালের সঙ্গে এই উত্তর-পূর্ব ভারতে এসেছে সে। রেলের চাকার নিচে অদৃশ্য হয়েছে বিহার, তারপর সুশ্যাম বাংলা মুল্লুক, তারও পর আসামের নিঃসীম সমতল পেরিয়ে খাসিয়া পাহাড়। নঙ পো, শিলং, চেরাপুঞ্জি। তারও পর হাফলঙে কিছুদিন থেকে এই কোহিমা। তাও আজ চল্লিশ বছর পার হতে চলল।

অনেক কিছু দেখেছে মাধোলাল। এই চল্লিশ বছরের স্মৃতিতে জমা হয়ে রয়েছে অনেক ঘটনা, অজস্র অভিজ্ঞতা। জীবনের এই চার দশকের প্রতিটি প্রহরের পাতায় পাতায় কত ইতিহাস লেখা রয়েছে মাধোলালের, তার শুকনো হাড়ে হাড়ে কত পাষাণলিপি আঁকা হয়েছে তার হিসেব নেই, সীমা-পরিসীমা নেই। বাপ ক্ষেত্ৰীলাল কোহিমা পাহাড়ে এই তেল-লবণ আলুর দোকান খুলেছিল। বুড়া বাঁশের মাচানের ওপর বসে দুলে দুলে সন্ত তুলসীদাসের রামায়ণ পড়ত। সেও আজ কতদিন পার হয়ে গেল। বাপ মরল একদিন। বছর দুয়েক পর কলকাতা শহর থেকে তাদের মুল্লুকের দেহাতি কিশোরী ফুলপিয়ারিকে শাদি করে আনল মাথোলাল। সেবার.কী হুজুগ আজীব শহর কলকাতায়। মিছিল, সভা, বক্তৃতা। কে এক সুরেন বানারজি না কী যেন, নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ির জঙ্গল, বাঙালিবাবুর কালিজার জোর আছে, তাগদ আছে রক্তের। তাকে নিয়ে কী মাতামাতি! একটু একটু শুনেছিল মাধালাল, তার চেয়েও কম বুঝেছিল। বাঙালিবাবুরা নাকি সাহেবদের সঙ্গে লড়াই শুরু করেছে। পঁচিশ তিরিশ বছর আগের সেসব ঘটনা মাথোলালের স্মৃতিতে ইতিহাস হয়ে রয়েছে।

শাদি করার পরের বছর পাণ্ডুতে বাড়ি তুলল মাধোলাল। শরমের কথা, তবু সত্যি বৈকি, শাদির প্রথম বছরেই বাচ্চা হল। সেই ছেলে বুধোলাল এখন পঁচিশ বছরের তাজা জোয়ান। বুনো ঘোড়ার মতো উদ্দাম। তার একটা শাদি দিতে হবে। অবশ্য শাদি একরকম ঠিকই হয়ে রয়েছে। রঙ্গিয়ার মেয়ে। নাম বিরজা। অসমিয়া মেয়ে পুত্রবধূ হবে। তাতে আপত্তি নেই মাধোলালের। এত বছর এই উত্তর-পূর্ব ভারতে রয়েছে মাধোলাল। নানা দিক থেকে আত্মীয়তার শিকড়ে বাকড়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে এই আসাম, এই খাসিয়া পাহাড়, এই নাগা মুল্লুক।

আজ দশ বছর ধরে কোহিমা পাহাড়ে স্থির হয়ে বসেছে মাধোলাল। মাঝে মাঝে মণিপুর রোড স্টেশন থেকে রেলে চড়ে পাণ্ডুর বাড়িতে যায়। দু-চার দিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসে। কোহিমার দোকানে। সমতল থেকে অনেক উঁচুতে এই পাহাড়ী শহর তাকে শত বাহু দিয়ে যেন বন্দি করে রেখেছে। বুধোলাল অনুযোগ দেয়। এই বুড়ো বয়সে এবার পাণ্ডুর বাড়িতে গিয়ে থাকলেই হয়। যে বয়সের যে ধরম। সামনেই ক্যামাখ্যা মন্দির। সেখানে গিয়ে পরকালের সুরাহা করলেও তো পারে বুড়ো মাধোলাল। আর কটা দিনই বা বাকি আছে পরমায়ুর? পরপারে যাবার সময় হল বলে। ডাক আসতে কতক্ষণ। সব বোঝে মাধোলাল। কিন্তু কোহিমা। যেন পাহাড়ী ডাইনির মতো তাকে কুহকিত করেছে। বিচিত্র তার ইন্দ্রজাল, তার বাহুর বেষ্টনী থেকে মুক্তির বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

বুধোলালই আজকাল দোকানের জিনিসপত্র আমদানি করে–আমিনগাঁ থেকে, করিমগঞ্জ থেকে, তিনসুকিয়া কি হাফলঙ থেকে রেলের ওয়াগনে করে। তারপর ডিমাপুর থেকে লরিতে চাপিয়ে এই শহর কোহিমা। আর বুড়ো ক্ষেত্ৰীলাল যেখানে বসে সন্ত তুলসীদাসের রামায়ণ পাঠ করত, যেখান থেকে একটি ভক্তিন সুরের তরঙ্গে এই পাহাড়ী পৃথিবীকে অমৃতময় করে তুলত, ঠিক সেই মাচানটির ওপর বসে বুড়ো মাধোলাল পাহাড়ী মানুষগুলোর সঙ্গে গল্প করে। আজমীড় কী মাড়োয়ারের সেই দেহাতি গ্রামটির আবছা স্মৃতি, রেলের গল্প, পাণ্ডু-আমিনগাঁ কাটিহারের গল্প, খাসিয়া আর গারো পাহাড়ের গল্প। কলকাতায় সাহেবদের সঙ্গে সেই বাঙালিবাবু সুরেন বানারজি না কার যেন সেই লড়াই-এর ইতিহাস। শিলং-চেরাপুঞ্জিতে পাদ্রী সাহেবদের কীর্তিকথা। আরো যে কত কাহিনী তার লেখাজোখা নেই। তার ষাট বছরের বিরাট অতীত জুড়ে আর দেহের প্রতিটি কুঞ্চনে যে রাশি রাশি গল্প, রাশি রাশি কাহিনি পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে সেই সব গল্প বলে মাধোলাল।

সামনে চুপচাপ বসে রয়েছে সারুয়ামারু। তার পাশে সেঙাই।

মাথোলাল বলতে লাগল, হায়, রাম রাম। এই পাদ্রীগুলো সব ধরমনাশা। নিমকের বদলা ধরম নিয়ে নেয়–

বলিস কী মাথোলাল! আমাদের ধরম নিচ্ছে হুই ফাদার?

হাঁ হাঁ, এ কথা আবার কাউকে বোলো না। তোমার ঠাকুরদা ছিল আমার আসাহোয়া (বন্ধু)। সে আমার দোকান থেকে নিমক নিত। তারপর আসত তোমার বাবা। তারও পর আসতে তুমি। তুমি তো এখন হুই পাদ্রীদের পাল্লায় গিয়ে পড়েছ। তোমাদের তিন পুরুষের সঙ্গে আমাদের কারবার। তাই সত্যি কথা বললুম। সাহেবদের কাছে আবার এসব বোলো না। তা হলে আমার দোকান তুলে দেবে।

এখানকার ভাষা কী চমৎকার আয়ত্ত করেছে মাথোলাল! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেঙাই।

না না, বলব না। আগে তো ঠিক বুঝিনি। আনিজার নামে শুয়োর বলি দিতে ফাদার বারণ করে। একেবারে বর্শা দিয়ে ফুড়ে ফেলব না! সহজ মানুষ সারুয়ামারু খুঁসে উঠল।

ফিসফিস গলায় মাধোলাল বলল, তোমাদের ওই যে রানী গাইডিলিও আছে তার কাছে জিগ্যেস কোরো। হক কথা বলবে।

না, ওর কাছে যাব না। ও তো ডাইনি। একটা সন্ত্রস্ত ছায়া এসে পড়ল সেঙাই-এর মুখেচোখে। সারুয়ামারুও চকিত হয়ে উঠেছে।

ডাইনি! কে? রানী গাইডিলিও? বিস্ময়ে গলাটা চৌচির হয়ে গেল মাথোলালের, কে বললে এ কথা?

ফাদার বলেছে।

মিছে কথা, ষোল আনা মিছে। এক আজব কাহিনির ওপর থেকে যবনিকা তুলল বুড়ো মাথোলাল, জানো সারুয়ামারু, আমাদের দেশে এক মহারাজ আছেন। তার নাম হল গান্ধিজি। এই সায়েবদের সঙ্গে তার লড়াই বেধেছে। আমার ছেলে বুধোলাল দু’দিন আগে কলকাতা থেকে ফিরেছে। সে সেই লড়াই দেখেছে।

সেঙাই বলল, এই সাহেবেরা কোত্থেকে এল?

ভিনদেশ থেকে। সাত সমুদ্র তেরো নদী ডিঙিয়ে। অনেক, অনেক দূরে সে দেশ। কোহিমা পাহাড় থেকে এক অনির্দেশ্য দিগন্তের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল মাথোলাল, আমরা তো আসান্যু (সমতলের লোক)। আমাদের দেশ থেকেও অনেক দূরে সায়েবদের দেশ।

সে দেশে তুই গেছিস?

না।

আচমকা সারুয়ামারু বলল, হুই যে বললি লড়াই বেধেছে তা বর্শা দিয়ে, সুচেন্যু দিয়ে, তীর-ধনুক দিয়ে মানুষ খুঁড়ছে তো? মাথা কেটে মোরাঙে ঝোলাচ্ছে? বেশ মজা কিন্তু, আমাদের পাহাড়ে অমন লড়াই অনেকদিন বাধেনি।

তেমন লড়াই নয়। গান্ধিজির লোকেরা সায়েবদের মারে না। সায়েবরাই তাদের মারে। এ দেশ থেকে সায়েবদের ভাগতে বলেছেন গান্ধিজি।

এ কেমন লড়াই! মার খাবে, অথচ মারবে না! তাই কখনও হয়? আমাদের পাহাড়ে লড়াই হলে সায়েবদের ছুঁড়ে ফেলতুম। উত্তেজনায় ঝকমক করছে সেঙাইর চোখ দুটো। পেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠছে।

এ লড়াই তোমরা বুঝবে না। এ বড় মজার লড়াই। আমার ছেলেটা বলল, গান্ধিজির লোকেরা মার খেয়ে খেয়ে জিতে যাচ্ছে। একটু চুপচাপ। তারপর আবার শুরু করল মাধোলাল, ওই দেখ, খালি বকেই চলেছি। এর কথা তো কিছু বললে না সারুয়ামারু। এ কে? সেঙাইর দিকে তাকাল মাধোলাল।

এ হল সেঙাই। সিজিটোর ছেলে।

ও, রাম রাম। তারপর শোন, আমাদের দেশে যেমন গান্ধিজি, তোমাদের এই পাহাড়ে তেমনই হল রানী গাইডিলিও। সাহেবদের সেও দেখতে পারে না। তার কথা শুনলে বুঝবে। এই কোহিমাতেই আছে রানী গাইডিলিও। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল বুড়ো মাথোলাল।

সেঙাই সারুয়ামারুদের প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ, সচেতন বোধ আর অনুভূতি এবং অস্ফুট ধারণার বাইরে বিস্ময়কর অনেক কিছু আছে। তার খবর দিয়েছে বুড়ো মাথোলাল।

গান্ধিজির সঙ্গে সাহেবদের লড়াই, রানী গাইডিলিও–এই অদ্ভুত নামগুলি, মাথোলালের অপরূপ সব গল্প তাদের অস্পষ্ট বন্য চেতনাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ী মনে দোলা লেগেছে।

সেঙাই শুধলো, তোদের দেশে সাহেবদের সঙ্গে লড়াইটা বাধল কেন? কী হয়েছিল? ঘরের বউ ছিনিয়ে নিয়েছিল নাকি?–এরা বিদেশি। আমাদের দেশ এসে আমাদের মারবে, আমাদের খাবার কেড়ে নেবে। কতকাল সইব? এই ধর তোমাদের বস্তি, সেখানে কেউ যদি এসে সর্দার হতে চায়, তোমাদের মারতে চায়, তাহলে সইবে?

না, না। একেবারে খতম করে ফেলব। গর্জে উঠল সেঙাই।

সায়েবরা এসেছে বিদেশ থেকে। এসেছিস যখন থাক, তা নয়, সর্দারি করতে শুরু করল। এই দেখ না তোমাদের পাহাড়েও এসেছে। সর্দারি করছে।

সারুয়ামারু বলল, তোরাও তো এসেছিস। তোরাও তো বিদেশি। তোরা আসান্যু।

হায়, রাম রাম–মাপা আধ হাত জিভ কাটল মাধোলাল, আমরা আসা, তা ঠিক কথা। কিন্তু এ দেশটা আমাদের। তোমরা আমরা এক দেশি। আমরা থাকি নিচু জমিতে, তোমরা থাকো পাহাড়ে। দুইয়ে মিলিয়ে গোটা ভারত।

তবে ফাদার যে বলে আসান্যুরা শয়তান, ওরা ভিনদেশি?

সব মিছে। তোমাদের রানী গাইডিলিওকে জিগ্যেস করে দেখো।

কোহিমার আকাশে রাত্রি নামছে। ঝাপসা রঙের কুয়াশা বাতাসে মিশে যাচ্ছে। সামনের পাহাড়চূড়া অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

সেঙাই আর সারুয়ামারু উঠে পড়ল। সারুয়ামারু বলল, এখন যাই। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। বড় শীত করছে।

গ্যাসবাতি ধরাতে ধরাতে মাধোলাল বলল, তোমরা আছ কোথায়?

ফাদারের কাছে।

ও। বিড়বিড় করে অস্ফুট গলায় কী যে বলল মাধোলাল, বোঝা গেল না। একটু পরেই সে সরব হয়ে উঠল, গান্ধিজির কথা, রানী গাইডিলিওর কথা তোমাদের ফাদারকে বোলো না কিন্তু। আর নিমক দরকার হলে আমাদের দোকান থেকে নিয়ে যেয়ো। অন্য সব দোকান থেকে দরে সুবিধে করে দেব।

আচ্ছা।

কোহিমার পথে পা বাড়িয়ে দিল সেঙাই আর সারুয়ামারু।

চলতে চলতে সারুয়ামারু বলল, মজার গল্প বলে মাথোলাল। গান্ধিজির লড়াই, রানী গাইডিলিও। কী সুন্দর গল্প! ভারি ভালো।

হু-হু– মাথা নাড়ল সেঙাই।

গান্ধিজির যুদ্ধ। রানী গাইডিলিও। সেঙাইর বন্য পাহাড়ী মনে কি পাষাণ-লেখা পড়ল? আঁকা হল দুর্বোধ্য কোনো শিলালিপি?

.

২৭.

পাহাড়ী মনের উত্তেজনা। সে তো ঘাসের ওপর শিশিরকণার পরমায়ু। রাত্রিবেলা মাচানে একটা বুনো মোষের মতো ভোস ভোঁস শব্দ করে ঘুমিয়েছে সারুয়ামারু। মসৃণ ঘুমে সে রাতটা কাবার করে দিয়েছে।

কিন্তু অনেকটা সময় পর্যন্ত ঘুমোতে পারেনি সেই। রাত যখন গভীর আর নিবিড় হয়েছিল, ঠিক সেই সময় ঢেউটিনের চালের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল সে। মোষের পিঠের মতো ঘন কালো আকাশ। অসংখ্য মিটমিটে তারা। আঁচড়ের মতো ফুটে বেরিয়েছে আবছা ছায়াপথ।

কাল সন্ধ্যায় মাধোলাল কার সঙ্গে যেন সাহেবদের লড়াইর কথা বলছিল, রানী গাইডিলিওর কথা বলছিল। গাইডিলিও নাকি ডাইনি নয়। অথচ ফাদার বলেছে, সে ডাইনি। গ্রাম থেকে আসার সময় বুড়ো খাপেগা বার বার বলে দিয়েছিল, রানী গাইডিলিওর সঙ্গে দেখা করতে। রানী গাইডিলিও আর ডাইনি গাইডিলিও–এই দুই নামের মধ্যে সেঙাই-এর পাহাড়ী মনটা অনেকক্ষণ দোল খেয়েছে। স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি–গাইডিলিওকে দেখতে যাবে, কি যাবে না।

একটার পর একটা ভাবনার ঢেউ চেতনার ওপর দিয়ে সরে গিয়েছে। কাদের যেন লড়াইয়ের কথা বলেছিল মাধোলাল। বর্শা দিয়ে ফুড়ছে না, সুচেন্যু দিয়ে কোপাচ্ছে না, মার খাচ্ছে অথচ মরছে না। আজব দেশ, সব যেন রূপকথা। কোথায় সেই দেশ, কোথায় সেই অদ্ভুত মানুষেরা? সব যেন মিথ্যে মনে হয়। বিভ্রান্তির মতো লাগে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তাদের এই পাহাড়ী পৃথিবীর বাইরে কোথায় কোন সমতলের দেশ রয়েছে, সেখানে সাহেবদের সঙ্গে লড়াই চলছে, ভাবতেও কেমন লাগে পাহাড়ী জোয়ান সেঙাইর। নাঃ, এই পাহাড়, এই উপত্যকা, এই মালভূমি, এই বন-ঝরনা-জলপ্রপাত আর এই কোহিমা শহরের বাইরে কোথাও কোনো দেশ আছে, কিংবা থাকতে পারে, তা তার ধারণার অতীত। অবিশ্বাসী বুনো মনটা প্রবলভাবে প্রতিবাদ করতে চায়।

একসময় গান্ধিজির যুদ্ধ, রানী গাইডিলিও, বুড়ো মাথোলাল, এই সুন্দর কোহিমা শহরসমস্ত কিছু মন থেকে সরে গেল সেঙাইর। মেহেলীর কথা মনে পড়ল। অনেকদিন আগে এক নিঃশব্দ ঝরনার পাশে তাকে প্রথম দেখেছিল। তারপর সালুয়ালা গ্রামে তাকে শেষবারের মতো দেখে এসেছে। বন্য, আদিম মানুষ। চিন্তাগুলি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ক্রিয়া করে। নিমেষে এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় মনটা সরে সরে যায়। সেঙাই ভাবল, মেহেলীকে তার চাই। উন্মাদ ভোগে, তীব্র কামনায় শত্রুপক্ষের মেয়েকে পেতেই হবে। কোহিমা শহরের নিঃসঙ্গ বিছানায় মেহেলীর চিন্তায় বাকি রাতটা উত্তেজিত হয়ে ছিল সেঙাই। প্রায় না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে।

কোহিমার পাহাড় তার জন্য এত সব বিচিত্র ভাবনা সাজিয়ে রেখেছিল, তা কি জানত সেঙাই!

.

২৮.

আকাশে শেষ রাত্রির আবছা অন্ধকার লেগে রয়েছে এখনও। একটা উদাত্ত সুর ভেসে এল চার্চের ভজনালয় থেকে। সেই অপূর্ব সুরের মূৰ্ছনা সমস্ত চেতনাটাকে ভরে দিতে লাগল।

পাশের মাচান থেকে সারুয়ামারু বলল, ছোট ফাদার যীশু-মেরীর গান গাইছে।

গানে কী কথা বলছে রে? সেঙাই জিগ্যেস করল।

ওদের কথা বুঝি না।

ছোট পাদ্রী অর্থাৎ পিয়ার্সন। পরম পিতার কাছে রাত-প্রভাতের প্রার্থনা জানাচ্ছে। তার একটি কথারও অর্থ বোঝে না সেঙাই, পরমার্থও তার কাছে দুয়ে। তবু পিয়ার্সনের সুললিত কণ্ঠে এমন একটা পবিত্রতা রয়েছে যাতে তার মন বিবশ হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে মেহেলীর কথা ভাবতে ভাবতে সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। এখন এই গানের শান্ত মধুর সুরে, বিচিত্র আবেশে সোই-এর অস্ফুট মন ভরে গিয়েছে। মেহেলীর ভাবনা থেকে পিয়ার্সনের এই অদ্ভুত গানটার কত তফাত! এই গানের সঙ্গে মাথোলালের গল্পের একটা আশ্চর্য সঙ্গতি রয়েছে যেন। ঠিক ধরতে পারে না সেঙাই।

একসময় পুবের পাহাড়চূড়া আলো করে সূর্য উঠল। কুয়াশা মুছে গেল। সিজিটোর ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল সেঙাই আর সারুয়ামারু। আর বেরিয়েই এই সুন্দর সকালে মনটা বিষিয়ে গেল সেঙাই-এর।

সবুজ ঘাসজমির ওপারে বসে রয়েছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। তার পায়ের কাছে এক দল পোষা কুকুরের মতো ঘন হয়ে বসেছে জনকয়েক পাহাড়ী সর্দার। তাদের সারা দেহে বিচিত্র ধরনের পোশাক আর অলঙ্কারের বাহার। মাঝখানে বসেছে সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দার।

বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি মুঠো মুঠো টাকা সর্দারদের হাতে গুঁজে দিচ্ছে। আর ফিসফিস করে কী যেন বলছে। হয়তো বা যীশু-মেরীর কোনো গূঢ় মন্ত্র। আর পাহাড়ী সর্দারদের মুখে কখনও ভীষণ হাসি, কখনও নিষ্ঠুরতা ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে।

বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির দৃষ্টি ভয়ানক সজাগ এবং ধূর্ত। সারুয়ামারু আর সেঙাইকে সে ঠিক ঠিক দেখে ফেলল, আরে সেঙাই, এই যে সারুয়ামারু–এখানে এসো।

গুটি গুটি পায়ে ঘাসের জমি পেরিয়ে ম্যাকেঞ্জির কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে। সেঙাই-এর কঠোর থাবায় বিরাট বর্শাটা ধরা রয়েছে। দুটো তীক্ষ্ণ, ধারাল এবং নির্মম চোখ মেলে নির্নিমেষে সালয়ালাঙের সর্দারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সেঙাই।

সেঙাই! নামটা শুনে চমকে উঠল সালয়ালাঙের সর্দার। আগে কখনও সে সেঙাইকে দেখেনি। সালুনারুর কথায় সেদিন খাসেম গাছের মগডালে মেহেলীর ছোট্ট ঘরখানায় তাকে পুড়িয়ে এসেছিল। পরে অবশ্য জেনেছিল সেঙাই মরেনি। কোহিমার পাহাড়ে তার জন্য এমন একটা বিপজ্জনক বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল তা কি জানত সে! মুখখানা ভয়ঙ্কর হল তার। প্রখর মুঠিতে বর্শাটা চেপে ধরল।

সেঙাই আর সালুয়ালাঙের সর্দার। দুই প্রতিপক্ষ। তিন পুরুষ ধরে পরস্পরের শত্রু। কোহিমার পাহাড়ে মুখোমুখি হল কেলুরি আর সালুয়ালাঙ। চতুর আর কুটিল হাসিতে পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির মুখখানা ভরে গেল।

ম্যাকেঞ্জি বলল, রাত্তিরে কেমন ঘুমোলে তোমরা?

ভালো, ভালল। খুশির গলায় সারুয়ামারু বলল।

ভুরু কুঁচকে বাঁ চোখটা ছোট করে সেঙাই-এর দিকে তাকাল ম্যকেঞ্জি, মেহেলীকে বিয়ে করতে চাও না তুমি?

হু-হু, চাই তো। মেহেলীকে আমি ছিনিয়ে আনব হুই সালুয়ালাঙ বস্তি থেকে।

কী বললি? খুঁসে উঠল সালুয়ালাঙের সর্দার।

ততক্ষণে বর্শাটাকে বাগিয়ে তাক করেছে সেঙাই। তার দুটো পিঙ্গল চোখে হত্যার প্রতিজ্ঞা জ্বলছে, একেবারে শেষ করে ফেলব তোকে। আহে ভু টেলো!

এই এই, কী হচ্ছে! এটা চার্চ! হাঁ হাঁ করে লাফিয়ে উঠল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি।

খুনোখুনি হলে চার্চের পবিত্র চত্বরে পাহাড়ী রক্তের কলঙ্ক লাগবে! যেশাসের পুণ্যনাম কলুষিত হবে! সারপ্লিসের আড়ালে ম্যাকেঞ্জির দেহটা কেঁপে উঠল। ব্রেটব্রুকশায়ারের সেই আউটল রক্ত নিয়ে মাতামাতির খেলায় প্রেরণা দিতে পারত। সারপ্লিসের খোলস যেদিন দেহে উঠেছে তখন থেকেই অনেকটা নিরুত্তেজ হয়ে পড়েছে ম্যাকেঞ্জি। এখন তাকে অনেক সংযত থাকতে হয়।

সাঁ করে সেঙাই-এর একটি হাত চেপে ধরে টানতে টানতে তাকে সিজিটোর ঘরে রেখে। এল ম্যাকেঞ্জি। বলল, কোনো চিন্তা নেই। মেহেলীকে তোমার সঙ্গে বিয়ে আমি দেব। তবে একটা কাজ করতে হবে তোমাকে।

কী কাজ?

পরে বলব!

বাইরে বেরিয়ে সালুয়ালাঙের সর্দারের কাছে চলে এল ম্যাকেঞ্জি। তাকে নিয়ে অন্য একটি ঘরে ঢুকল।

ম্যাকেঞ্জি বলল, ভেবো না সর্দার, আমি যখন আছি তখন মেহেলীকে তোমরা পাবেই। আরো অনেক টাকা দেব। যে কাজের কথা বললাম মনে আছে তো?

হু-হু, নিমকহারামি আমরা করি না। আমরা পাহাড়ী মানুষটাকা নিয়েছি, বেইমানি করব না।

এই তো চাই। বস্তিতে গিয়ে যে কথা বলেছি তা চাউর করে দাও।

হু-হু, আমরা এবার যাই। কিন্তু তুই দেখিস ফাদার, হুই শয়তানের বাচ্চা সেঙাইটাকে একেবারে খতম করব। বলতে বলতে বাইরের ঘাসবনে নামল সালুয়ালাঙের সর্দার। সেখান থেকে কোহিমার আঁকাবাঁকা পথে।

পরের দিনও সকাল থেকে শেষ বেলা পর্যন্ত কোহিমার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল সেঙাই আর সারুয়ামারু। চড়াই উতরাইয়ে দোল খাওয়া পথ। দোকানপসার। সমতলের বাসিন্দাদের বাণিজ্যমেলা। ইম্ফল আর ডিমাপুরের দিকে প্রসারিত পথের রেখা। বিচিত্র সব মানুষ, বিচিত্রতর ভাষার হইচই।

কেলুরি গ্রামের এক পাহাড়ী যৌবন প্রথম শহরে এসে একটার পর একটা বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। সারুয়ামারু এই শহরে অনেক বার এসেছে। সে সেঙাইকে উদয়াস্ত চারিদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল।

.

সেদিন সন্ধ্যার একটু আগেই ঘটনাটা ঘটল।

বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি চার্চের একটা কাজের লোককে সেঙাই আর সারুয়ামারুকে ডেকে আনতে বলল।

কোহিমার আকাশে এখনও খানিকটা আবছা আলো লেগে রয়েছে। সবুজ ঘাসের জমিতে বেতের চেয়ারে জাঁকিয়ে বসে আছে ম্যাকেঞ্জি। দু’পাশে দুটো মণিপুরী পুলিশ। হাতে খাড়া রাইফেলের মাথায় বেয়নেটউদ্ধত হয়ে রয়েছে। বিদেশি চার্চের শান্তি এদেশি মানুষের পাহারায় নির্বিঘ্ন। বেথেলহেমের ধ্রুবতারাটি কোহিমার পাহাড়ে সুরক্ষিত রয়েছে রাইফেলের হিংস্রতায়। যেশাস। মানব-পুত্রের স্বপ্ন কি চরিতার্থ হল এই পাহাড়ী টিলার দেশে, এই বনময় শৈলশিখরে? এই রাইফেলের, এই বেয়নেটের পাহারায়? কে জানে?

ইতিমধ্যে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেঙাই আর সারুয়ামারু। সারাদিন কোহিমার পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে দুজনে। তারপর খানিক আগে সিজিটোর ঘরে ফিরে এসেছিল।

ম্যাকেঞ্জির মুখে সস্নেহ হাসি, এই যে সেঙাই, এই যে সারুয়ামারু, এসো, এসো। তারপর শহর কেমন দেখলে সেঙাই?

ভালো, খুব ভালো।

এক মুহূর্ত ভাবনার মধ্যে তলিয়ে রইল ম্যাকেঞ্জি। তারপর বলল, কী চাই তোমার বল দিকি সেঙাই? কটা কাপড়? কত টাকা?

আশেপাশেই কোথায় যেন ছিল পিয়ার্সন। বাঘের মতো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল, হোয়াটস দিস ফাদার?

কী হল পিয়ার্সন! ঘাড় ঘুরিয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল ম্যাকেঞ্জি, এত উত্তেজিত কেন?

এ ভারি অন্যায়। এভাবে লোভ দেখিয়ে ক্রিশ্চিয়ানিটি স্প্রেড করে কী লাভ? সেন্টদের সারমন আছে, লোভরিপুকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। উত্তেজনায় থরথর কাঁপছে পিয়ার্সন।

প্রায় হুমকে উঠল ম্যাকেঞ্জি, ডোন্ট ইন্টারফেয়ার। কিসে লাভ হবে, বা না হবে, আমি তোমার কাছে জানতে যাব না। লিভ দিস প্লেস অ্যাট ওয়ান্স–

থ্যাঙ্কস। উদ্ধত পা ফেলে সামনের রাস্তায় গিয়ে নামল পিয়ার্সন।

পিয়ার্সনের গমনপথের দিকে আগ্নেয় চোখে তাকিয়ে ছিল ম্যাকেঞ্জি। যখন একটা উতরাই এর আড়ালে পিয়ার্সনের দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেল ঠিক সেই সময় দৃষ্টিটাকে সেঙাই-এর মুখের ওপর এনে ফেলল সে। নাঃ, মেজাজটাকে একেবারে তিক্ত করে দিয়ে গেল লোকটা। একটা। ডেভিল। স্কাউন্ড্রেল।

কী এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছিল সাদা মানুষ দুটো। এক বিন্দুও বুঝতে পারছিল না সেঙাই কি সারুয়ামারু। অবাক এবং ভীরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তারা।

ম্যাকেঞ্জি বলল, যে কথা বলছিলাম। বুঝলে সেঙাই, যা চাইবে তাই তোমাকে দেব। কিন্তু একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

তেমন কিছু নয়। ওই আসান্যুদের (সমতলের লোক) সঙ্গে মিশবে না। ওরা লোক বড় খারাপ। সারুয়ামারুকে বলে দিয়েছি, তোমার বাবা সিজিটোকেও বলেছি। কি সারুয়ামারু, বলিনি?

হু-হু– ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাতে লাগল সারুয়ামারু, কথাটা ঠিক। হুই আসারা ভারি শয়তান। যারা ধুতি পরে তারা একেবারে শয়তানের বাচ্চা।

ঠিক, ঠিক। যা বলে দিয়েছি, তোমার সব মনে রয়েছে, দেখছি। আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটল ম্যাকেঞ্জির মুখে, যাক ও-কথা। গাইডিলিওর কাছে যাওনি তো?

না, না।

ভালো করেছ। ও ডাইনি। একেবারে জানে খতম করে ফেলবে। বিস্ময়কর কৌশলে মুখেচোখে আতঙ্কের সব কটি রেখা ফুটিয়ে তুলল ম্যাকেঞ্জি, খবরদার ওর কাছাকাছি ঘেঁষবে না তোমরা।

ডাইনি! কে বললে ডাইনি? তুই মিথ্যে বলছিস। হুই যে মাধোলাল বললে, ও হল রানী। খুব ভালো ও, ডাইনি নয়। সোজাসুজি তাকাল সেঙাই, তুই সব মিথ্যে বলিস। তুই বড় শয়তান। মাধোলাল কত কী বললে রানীর সম্বন্ধে।

মাধোলাল! চমকে উঠল ম্যাকেঞ্জি, মাধোলাল কে?

সারুয়ামারু বলল, হুই যে বড় দোকান আছে ডিমাপুর যাবার পথে, সেই দোকানের মালিক মাধোলাল। কত কথা বললে মাথোলাল। ও তো আসান্যু, ধুতি পরে। অথচ কত ভালো। আমার বন্ধু হুই মাথোলাল। আমার বাবা ওর দোকান থেকে নিমক নিত, আমার ঠাকুরদা

সারুয়ামারুকে থামিয়ে দিল ম্যাকেঞ্জি, থাম থাম। আর কী বললে মাথোলাল? উত্তেজনায় চোখের মণি দুটো যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে ম্যাকেঞ্জির।

এবার সেঙাই বলল, হু-হু, সায়েবদের সঙ্গে কোথায় যেন আসাদের লড়াই হচ্ছে। কার যেন নাম বলল মাধোলাল। কি রে সারুয়ামারু, বল না হুই আসাদের সদ্দারটার নাম। আমার মনে পড়ছে না।

সারুয়ামারু বলল, আসান্যুদের সদ্দারটার নাম গান্ধিজি। মাথোলাল বললে, ওদের মহারাজ যেমন গান্ধিজি, আমাদের তেমনই রানী গাইডিলিও।

গান্ধিজি! কী ভয়ঙ্কর একটি শব্দ! সমতলের দেশ থেকে সব বাধা, সব ব্যবধান পেরিয়ে এই বনময় গিরিচূড়ায় এসে পৌঁছেছে। এই পাহাড়ের টিলায় টিলায়, গুহা আর অরণ্যে, ওই নামটা কী এক ইন্দ্রজালে বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। গান্ধিজি। নাম নয়, একটা ভয়াল ভোজবাজি। একটা দুর্বোধ্য ভেলকি। এ ভোজবাজির রহস্য অন্তত পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির অজানা। নাম নয়, ম্যাকেঞ্জির মনে হল, বিচিত্র এক বিস্ফোরণ। কলকাতা, সবরমতী, মহারাষ্ট্র হিমালয়ের পাদপীঠ থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিশাল ভারতবর্ষের হৃৎপিণ্ড ওই একটি নামের মধ্যে উথলপাথল হয়ে যাচ্ছে। ওই একটি নাম দুর্গম নদী, বন-পাহাড়-সমতল অতিক্রম করে এই বুনো মানুষগুলির অস্ফুট চেতনায় কি অক্ষয় শিলালিপির মতো আঁকা হল? যেমন করে হোক, এই পাহাড়ী পৃথিবী থেকে, বন্য মানুষের চেতনা থেকে ওই শব্দটাকে চিরকালের জন্য মুছে দিতে হবে। নইলে উপায় নেই, রেহাই নেই। একটা দুর্বল রন্ধ্র পেলে ওই নামটা দুকুল ভাসিয়ে হু-হু–বন্যা নিয়ে আসবে। কোন অতল তলায় তলিয়ে যাবে এই উত্তুঙ্গ নাগাপাহাড়। অন্তত খবরের কাগজ এবং মাধোলালের মতো শয়তানদের মুখে মুখে সেই ভয়াবহ সংবাদই দেশের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। ম্যাকেঞ্জি ভাবল, আজই একবার পুলিশ সুপার মিস্টর বসওয়েলের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

এদিকে সেঙাই বলতে শুরু করেছে, তোরা সায়েব। মাধোলাল বলল, তোদের সবাইকে ওদের দেশ থেকে ভাগিয়ে দেবে। আমাদের রানী গাইডিলিও নাকি তোদের সঙ্গে লড়াই করবে।

আশঙ্কার পাত্রটা এবার কানায় কানায় ভরে উঠেছে। রানী গাইডিলিও! লড়াই! বলে কী সেঙাই!

ব্রেটনব্রুকশায়ারের সেই দুর্দান্ত আউটল এবং আজকের পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি জীবনে যেন প্রথম ভয় পেয়েছে। ঝাপসা গলায় সে বলল, সব মিথ্যে। আমাদের সঙ্গে তো লড়াই নয়; আমরা তোমাদের বন্ধু। ওরা, ওই সমতলের বাসিন্দারা বিদেশি।

সেঙাই বলল, মাধোলাল যে বললে, তোরা অন্য দেশ থেকে এসেছিস, তোরা বিদেশি। তোরা এখানে কী করতে এসেছিস?

মাথোলাল! নামটাকে দাঁতের ফাঁকে কড়মড় করে চিবোতে লাগল ম্যাকেঞ্জি। আচ্ছা, ওই হাফ-নেকেড গান্ধির চেলার সঙ্গে পরে দেখা হবে। বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে একটা অখ্রিস্টানসুলভ গালাগালি আওড়াল ম্যাকেঞ্জি।

সেঙাই তখনও বলছে, কী করতে এখানে এসেছিস তোরা?

এ জিজ্ঞাসার উত্তর জানা আছে ম্যাকেঞ্জির। কিন্তু সে উত্তর অন্তত এদের কাছে দেওয়া চলবে না। একটি অর্ধনগ্ন পাহাড়ী মানুষের প্রশ্ন যে এত মারাত্মক, এত জটিল, তা কি আগে জানত পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি।

ধীরে ধীরে সুকৌশলে মধুর হাসিতে মুখখানা ভরিয়ে তুলল ম্যাকেঞ্জি। বলল, আচ্ছা সেঙাই, সালুয়ালাঙ বস্তির সঙ্গে তোমাদের খুব ঝগড়া, তাই না?অন্য একটি প্রসঙ্গে সরে গেল সে।

সেঙাই মাথা নাড়ল, হু-হু, ওরা আমাদের শত্রু।

আচমকা চিৎকার করে উঠল সারুয়ামারু, কি রে সেঙাই, মাধোলাল না গান্ধিজির লড়াই আর রানী গাইডিলিওর কথা বলতে বারণ করে দিয়েছিল?

হু-হু– প্রবলবেগে মাথা দোলাতে লাগল সেঙাই। তারপরেই রক্তচোখে তাকাল ম্যাকেঞ্জির দিকে, হুই শয়তানটা সব জেনে নিল। ওর জান একেবারে খতম করে দেব। হুই শয়তানটা আমাদের বেইমান করল।

আমরা বিশ্বাসঘাতী হলাম। বেইমানি করলাম।

হু-হু, আহে ভু টেলো! আমরা পাহাড়ী মানুষ; আমাদের কেউ অন্তত বেইমান বলতে পারে না। হু-হু, আনিজার গোসা এসে পড়বে। সব হুই শয়তান সায়েবটার জন্যে। পাশ থেকে বর্শাটা তুলে নিল সেঙাই। অব্যর্থ লক্ষ্য। সাঁ করে সেটার ফলা কবজিতে গেঁথে গেল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির। এক ঝলক তাজা রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল। চার্চের চত্বরে মানবপুত্রের পবিত্র নামের ওপর এই পাহাড়ী পৃথিবী খানিকটা রক্তের কলঙ্ক মেখে দিল।

মার্ডার! মার্ডার! অ্যারেস্ট! অ্যারেস্ট–সন অব আ বিচ–আর্তনাদ করে উঠল ম্যাকেঞ্জি।

নিমেষে সেঙাইর ওপর মণিপুরী পুলিশ দুটো ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজনের বেয়নেটের আধাআধি ফলা কোমরে গেঁথে গিয়েছে সেঙাইর। রাইফেলের কুঁদো দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড এক ঘা বসিয়ে দিল অন্য জন।

আউ-উ-উ– চিৎকার করে সবুজ ঘাসবনে লুটিয়ে পড়ল সেঙাই।

চার্চের দুটো বাড়ির পর আউট-পোস্ট।

ম্যাকেঞ্জি মণিপুরী পুলিশ দুটোর দিকে তাকাল। যন্ত্রণায় তার মুখখানা বিকৃত হয়ে গিয়েছে, শয়তানটাকে আউট-পোস্টে নিয়ে যাও। পাহাড়ী তেজ সব কমে যাবে ঠিকমতো ওষুধ পড়লে।

কবজির ক্ষতের ওপর আঙুল টিপে দাঁড়িয়ে রয়েছে ম্যাকেঞ্জি। আর এক পাশে বোধহীন, ভাবহীন, অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে সারুয়ামারু। ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে সে।

আবার চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকেঞ্জি, নিয়ে যাও, হারি-ই আপ–

প্রায় অচেতন দেহ। সেঙাই-এর হাত ধরে ঘাসবনের ওপর দিয়ে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলল পুলিশ দুটো।

আচমকা নিষ্ক্রিয় অবস্থাটা কাটিয়ে উঠল সারুয়ামারু। পুলিশ দুটোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেঙাইকে ছিনিয়ে নিল সে, ইজা হুবুতা! সেঙাইকে নিয়ে যাবে! একেবারে সাবাড় করে ফেলব।

সেঙাইকে ঘাসবনে ফেলে রেখে ফোঁস ফোঁস করে বারকয়েক নিশ্বাস ফেলল সারুয়ামারু।

মার্ডার, মার্ডার! পুলিশ, পুলিশ! চার্চ থেকে ম্যাকেঞ্জির চিৎকার আউট-পোস্টের দিকে। ধেয়ে গেল।

কয়েকটি মুহূর্ত। কোহিমার পথে ভারী বুটের আওয়াজ শোনা গেল। পাহাড়ী ঝড়ের মতো বাঙালি, বিহারি আর অসমিয়া পুলিশরা চার্চের নিরাপত্তায় ছুটে এসেছে।

সেঙাইকে কাঁধের ওপর তুলে পালিয়ে যায় নি সারুয়ামারু। এতক্ষণ তার চোখে শুধু পিঙ্গল আগুন ধকধক জ্বলেছে। সেঙাই-এর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সমানে খিস্তি করে গিয়েছে সে, আহে ভু টেলো। সব টেফঙের বাচ্চা। সেঙাইকে একবার ছুঁলে সাবাড় করে ফেলব। ফাদার হয়েছে! করস আঁকব না। চাই না কাপড়। মাথোলাল ঠিক বলেছে, তোদের মতো শয়তানের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। আমাদের পাহাড়ে এসে আমাদেরই মারবে!

পরশু বিকেলে সেঙাইকে খানকয়েক রঙচঙে বাহারে কাপড় দিয়েছিল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। সিজিটোর ঘর থেকে সেগুলো নিয়ে এসে ম্যাকেঞ্জির গায়ের ওপর ছুঁড়ে মারল সারুয়ামারু। প্রবল ঘৃণায় মুখখানা কুঁকড়ে গিয়েছে তার। একদলা থুতু ম্যাকেঞ্জির মুখে ছিটিয়ে দিল, থুঃ থুঃ, এই নে তোর কাপড়। সেঙাইকে মারবে! আমাদের বস্তিতে একবার পেলে তোকে ছিঁড়ে ফেলব। থুঃ থুঃ

মুখের ওপর একদলা থকথকে বিজাতীয় তরল। ককিয়ে উঠল ম্যাকেঞ্জি, ওহ! সন্স অব ডেভিল। ব্যাস্টার্ডস। হিলি হিদেনস। আই মাস্ট সি–

এতকাল গালাগালিগুলো বিড়বিড় করে উচ্চারণ করত ম্যাকেঞ্জি। এমন মহিমা যে, কেউ শুনতে পেত না। আজ প্রথম সারপ্লিসের ছদ্মবেশ ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ব্রেটনকশায়ারের। সেই আউটল আত্মপ্রকাশ করল। প্রচণ্ড ঘুষি বাগিয়ে সারুয়ামারুর দিকে ছুটে এল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। কিন্তু যত সহজে ঘুষিটা হানা যাবে ভাবা গিয়েছিল, কাজটা আদপেই তত সহজ। নয়। বর্শাটা থাবার মধ্যে বাগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারুয়ামারু। তার দু’টি পিঙ্গল চোখের মণিতে এক বিচিত্র শিকার ছায়া ফেলেছে। হুন্টসিঙ পাখির পালকের মতো ধবধবে এক সাহেব।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ম্যাকেঞ্জি। পাহাড়ী মানুষের থাবায় বর্শার ফলা বড় বন্য, বড় আদিম এবং নিষ্ঠুর। এ সত্য তার জানা।

ভয়ানক কিছু একটা ঘটে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তার আগেই চারিদিক থেকে বিহারি, অসমিয়া আর বাঙালি পুলিশরা ঘিরে ধরেছে সারুয়ামারুকে। ঝকঝকে বেয়নেটের ফলাগুলো বুক, পিঠ-সারাদেহের দিকে হিংস্রভাবে উদ্যত হয়ে রয়েছে। অসহায় দৃষ্টিতে চনমন করে তাকাল সারুয়ামারু। পায়ের কাছে সেঙাই পড়ে রয়েছে, প্রায় অচেন। সবুজ ঘাসের জমিতে তাজা এবং ঘন, রক্ত জমে আছে। থোকা থোকা লাল টোঘুটুঘোটাঙ ফুলের মতো।

গর্জে উঠল ম্যাকেঞ্জি, শয়তানটাকে নিয়ে যাও আউট-পোস্টে। ওই ডেভিলের বাচ্চাটাকেও তুলে নিয়ে যাও। সেঙাইর দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল ম্যাকেঞ্জি, আমি একটু পরেই যাচ্ছি। শয়তানটাকে আচ্ছা করে দাওয়াইর ব্যবস্থা কর। পাহাড়ী তেজ আমি উপড়ে দিয়ে যাব, তবে আমার নাম ম্যাকেঞ্জি।

অদ্ভুত করিৎকর্মা। নিমেষের মধ্যে সেঙাই আর সারুয়ামারুর দেহ দুটো টেনে টেনে, কোহিমার রুক্ষ উঁচুনিচু পাথুরে পথের ওপর দিয়ে আউট-পোস্টের দিকে নিয়ে গেল পুলিশেরা।

.

২৯.

খানিকটা পরেই আউট-পোস্টে এল ম্যাকেঞ্জি। কবজির ওপর বিরাট ব্যান্ডেজ।

আসুন, আসুন ফাদার–পুলিশ সুপার বসওয়েল এখনও তার কোয়ার্টারে ফিরে যায়নি। ম্যাকেঞ্জিকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, কী ব্যাপার, পুলিশরা সব রিপোর্ট দিয়েছে। ব্লাডশেড ইন দ্য চার্চ! এ তো বড় সাংঘাতিক ঘটনা! এই হিদেনগুলো সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

কবজিটা সামনে তুলে ধরল ম্যাকেঞ্জি। বিবর্ণ মুখে হাসল, এই দেখুন, বর্শা দিয়ে আমাকে কুঁড়েছে।

চার্চে গিয়ে মিশনারির গায়ে হাত দেওয়া, এ আমি বরদাস্ত করব না। দরকার হলে নাগা হিলস থেকে পাহাড়ী শয়তানদের চিহ্ন মুছে দেব। হাউ ডেঞ্জারাস! অব্যক্ত একটা আর্তনাদ করল বসওয়েল।

ডেঞ্জারাস, সত্যি ডেঞ্জারাস। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা। বাছা বাছা সব জাঁদরেল লোককে গভর্নমেন্ট পাঠিয়েছে এই নাগা পাহাড়ে। এই দেখুন, আপনি ফাস্ট গ্রেট ওয়ারে কর্নেল ছিলেন। আমার অতীত জীবনটা নিশ্চয়ই বীডস কাউন্ট করে কাটে নি। তবু দেখুন, এই প্যাগানগুলোকে বাগে আনতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি।

দ্যাটস রাইট। কোনো সন্দেহ নেই। সরবে সমর্থন জানালো বসওয়েল।

এই দেখুন না, প্লেনসমেনদের সঙ্গে এদের মিশতে বারণ করেছি। কত সাবধান হয়ে এদের ওয়াচ করছি, কিন্তু যা হবার তা হয়েছে। চোখেমুখে হতাশা ফুটে বেরুল ম্যাকেঞ্জির।

কী হল, কী ব্যাপার? চেয়ারটাকে টেনে ম্যাকেঞ্জির কাছাকাছি অন্তরঙ্গ হয়ে বসল বসওয়েল।

ডিমাপুরের পথের ওপর যে বাজারটা রয়েছে সেখানে গ্যান্ডির এক চেলার দোকান আছে। লোকটার নাম মাথোলাল।

কী সর্বনাশ! ওহ ক্রাইস্ট! চিৎকার করে উঠল বসওয়েল, তারপর?

দ্যাট ডেভিলস সন পাহাড়ীদের মধ্যে গ্যান্ডির নন-কো-অপারেশনের খবর প্রচার করছে। গাইডিলিওকে রানী বলে সকলকে মন্ত্র দিচ্ছে। যে পাহাড়ী দুটোকে একটু আগে এই আউট পোস্টে নিয়ে এসেছে পুলিশরা, সেই শয়তান দুটো ওই সব শুনে এসেছিল। এই নিয়ে কথাবার্তা হতে হতে আমাকে বর্শা ছুঁড়ে মেরেছে সেঙাইটা।

ইজ ইট! মাথোলাল! গ্যান্ডি। গাইডিলিও! নামগুলিকে কড়মড় করে চিবিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে লাগল পুলিশ সুপার বসওয়েল, আচ্ছা, আমি জানি কেমন করে গ্যান্ডি আর গাইডিলিওকে পাহাড়ীদের মন থেকে মুছে দিতে হয়। তারপরেই চড়া, কর্কশ গলার স্বরটা

অনেক উঁচুতে উঠল বসওয়েলের, চ্যাটার্জি, চ্যাটার্জি

ছোট দারোগা বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ঘরের মধ্যে ছুটে এল। বুটে বুটে খটাখট শব্দ করে একটা সসম্ভ্রম সেলাম ঠুকল, ইয়েস স্যার–

ছোট দারোগা বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি। নাকের নিচে একজোড়া কাঁচাপাকা ঘন গোঁফ সগৌরবে বিরাজ করছে। প্রান্ত দু’টি সূক্ষ্ম এবং সূচিতীক্ষ্ণ। মোটা বদখত নাকটা সামনের দিকে ঝুলে রয়েছে। বুক আর পেটের মাঝখানে চামড়ার চওড়া বেল্ট। বেল্টের মাঝখানে পেতলের প্লেটটা ঝকমক করছে। তার ওপর কোহিমা পুলিশের নাম খোদিত রয়েছে। বেখাপ্পা চেহারা, বেটপ আকৃতি। সমস্ত শরীরে রাশি রাশি, কালো রোমশ মাংস। মাংসপিণ্ডগুলির সুষ্ঠু এবং সুসংবদ্ধ ব্যবহার হয় নি। খুশিমতো হাতে-পায়ে, বুকে-মুখে যেখানে ইচ্ছা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন।

পুলিশ সুপার বসওয়েল বলল, চার্চ থেকে যে পাহাড়ী দুটোকে ধরে এনেছে পুলিশরা, তাদের একটু দলাই-মলাইর ব্যবস্থা করতে হবে।

দলাই-মলাই!

ইয়াস। ওদের সারা গায়ে বড় ব্যথা। আই মীন, সেই বেদনার জন্যে একটু ম্যাসাজ। বুঝলে তো? অর্থপূর্ণ একটা প্রাকুটি হানল বসওয়েল।

একটু ইতস্তত করল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি। খানিকক্ষণ আমতা আমতা করে সে বলল, কিন্তু স্যার, এই পাহাড়ীরা তো বোঝে না, আপনাদের কুম আমরা তামিল করি। ওরা মনে করে, আমরাই দোষী। ওরা স্যার, আমাদের একেবারেই দেখতে পারে না। আমরা এই ইন্ডিয়ার প্লেনসম্যানরা ওদের দুচোখের বিষ।

ধক করে বসওয়েলের চোখদুটো জ্বলে উঠল। মাত্র একটি মুহূর্ত। তারপরেই বাৎসল্যের হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার বিশাল এবং ভয়ানক মুখখানায়, আইসোর! পাহাড়ীরা তোমাদের প্লেনসম্যানদের দেখতে পারে না! বোঝোই তো, এরা হল ওয়াইল্ড বীস্টস। যাক, সেদিন তুমি পাণ্ডুতে ট্রান্সফার হবার দরখাস্ত দিয়েছিলে না?

ইয়েস স্যার, তা হলে বড় ভালো হয়। আমি বেঁচে যাই। একেবারে বিগলিত হয়ে গেল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি। সেই সঙ্গে হাত কচলাতে শুরু করল।

তোমাকে মাসকয়েক পর ট্রান্সফার করব। আর ছোট দারোগা নয়, এবারে ওসি হয়ে যাবে তুমি। তির্যক দৃষ্টিতে বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জির খুশিটা জরিপ করতে লাগল পুলিশ সুপার বসওয়েল। দেখতে লাগল, কেমন করে তার কথাগুলো ওই নিগারটার সগুফ মুখখানায় একটি লোলুপ প্রতিক্রিয়া আঁকছে।

ওসি! উল্লাসে প্রায় অব্যক্ত একটা শব্দ করে উঠল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি, প্রমোশন স্যার!

ইয়াস, প্রমোশন। তার আগে ওই পাহাড়ীগুলোকে একটু শায়েস্তা করতে হবে। বেশ ভালো করে, বুঝলে তো। দলাই-মলাইর ব্যাপারে তুমি তো পাকা আর্টিস্ট। যাও, যাও উৎসাহ দিতে লাগল পুলিশ সুপার বসওয়েল, তোমার স্কিল দেখতে চাই।

রীতিমতো প্রেরণা পেয়েছে বৈকুণ্ঠ। প্রচণ্ড উৎসাহে ভারী বুটে খট খট আওয়াজ তুলে পাশের ঘরে চলে গেল। পাকা আর্টিস্ট! নাঃ, অনেকদিন পর, অনেক অনেক বছরের শীতবসন্ত পেরিয়ে শজারুর কাটার মতো কালো কালো গোঁফের প্রায় অর্ধেক পাকিয়ে ফেলেছে বৈকুণ্ঠ। কিন্তু বরাতটা এমনই খারাপ যে ছোট দারোগা হয়েই বিশ বছর কাটিয়ে ফেলল সে। অথচ প্রমোশনটা আকাশের তারার মতো নাগালের বাইরেই রয়ে গিয়েছে। পাণ্ডু থানার ওসি! ধমনীতে রক্তের কণিকাগুলি উত্তাল হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল। কোহিমা পাহাড়ের নিঃসঙ্গ গুয়াহাটি। বছরে একবার তার সেবা, আদর এবং সোহাগ পায় কি না পায়; ছুটিই মেলে না। পাঁজরের হাড়ে হাড়ে যক্ষ বিরহীর প্রাণকে বন্দি করে এক আঁজলা ছুটির তৃষ্ণায় দিনের পর দিন গুনে যায় বৈকুণ্ঠ। ছটফট করে। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় মনটা ফালা ফালা হয়ে যায় যেন। এই কোহিমা শহর, সমতল থেকে অনেক উঁচুতে এই পাহাড়চূড়া। চারপাশে চড়াই উতরাই, টিলা, গুহা আর আদিম নিবিড় অরণ্য, উপত্যকা আর মালভূমি। ঋতুতে ঋতুতে এর রংবদলের পালা, এর রূপবদল। ফুলে ফুলে, লতায় পাতায় এর মনোরম সাজসজ্জা। বৈকুণ্ঠের মনে হয়, জন্মাবধি এই পাহাড়চূড়ায় নির্বাসিত হয়ে রয়েছে। এক এক সময় সন্দেহ জাগে, সে আর রক্তমাংসের মানুষ নয়, একটা প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে কোহিমার পাহাড়ে পাহাড়ে।

শুধু নাগা আর নাগা। একটি মানুষ নেই কথা বলবার, একটি মানুষ নেই কথা শুনবার। মানুষ নয়, সব যেন পাহাড়ী বুনো জানোয়ার। তিন বছর এখানে এসেছে, তাদের ভাষা এখনও পুরোপুরি রপ্ত করে উঠতে পারে নি বৈকুণ্ঠ। এরা ছাড়া আর আছে সমতলের বেনিয়ারা। তাদের সঙ্গে আড্ডা জমানো দূরের কথা, আলাপ পরিচয় রাখতে ছোট দারোগার মর্যাদায় কোথায় যেন আঘাত লাগে। এক-এক সময় এই কোহিমা পাহাড় থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে বৈকুণ্ঠর।

আপাতত খুশিতে ফুসফুসটা বেলুনের মতো ফুলে ফুলে উঠছে। পাণ্ডু থানার ওসি! এতদিনের লালিত স্বপ্নটা হাতের মুঠোয় একটা পাহাড়ী আপেলের মতো নেমে এসেছে। তার আগে একটা কর্তব্য বাকি রয়েছে বৈকুণ্ঠর। অদ্ভুত নৈপুণ্যে অভিভূত করে ফেলতে হবে পুলিশ সুপারকে। সন্ধ্যার একটু আগে যে পাহাড়ী দুটোকে চার্চ থেকে টেনে নিয়ে এসেছে পুলিশরা, তাদের সমস্ত দেহে চাবুক এবং হান্টারের আঘাতে তার নৈপুণ্য এঁকে রাখবে। অন্তর্নিহিত বীর রসের প্রেরণায় ভারী বুটজোড়া পাথুরে মেঝের ওপর ঠুকতে লাগল বৈকুণ্ঠ। শব্দ হতে লাগল–খট খট।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *