২০. নাগা পাহাড় থেকে

২০.

নাগা পাহাড় থেকে জা কুলি মাস বিদায় নিল। পেঁজা তুলোর মতো গুড়ো গুড়ো যে তুষার। ঝরত আকাশ থেকে তা একদিন বন্ধ হল। শীত ঋতুর আয়ু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। এবার কমলা রং রোদের সওয়ার হয়ে আসবে গরমের সকাল, ঝকঝকে রোদের পাখনা মেলে উড়ে যাবে দুপুর, তারপর অপরূপ সোনালি বিকেল পশ্চিমের পাহাড়-চূড়া রাঙিয়ে দেবে।

জা কুলি মাসের পর এখন নসু কেহেঙ মাসের শুরু। দিগন্তে কুয়াশার রেখা ঘন হয়ে জমে না আজকাল। সূক্ষ্ম নীলাভ একটি কুয়াশার স্তর সুখ-সুখ শিহরনের মতো পাহাড়ের চক্ররেখাঁটিকে জড়িয়ে থাকে। কপিশ রঙের পাহাড়ী ঘাসের ফলক থেকে শিশিরের নিটোল কণাগুলি যখন বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, ঠিক তখনই আকাশ থেকে কুয়াশার স্তরটা একেবারে অদৃশ্য হয়। ঘন সবুজ বন এই নসু কেহেঙ মাসে ঝলমল করতে থাকে।

জা কুলি মাসের শেষ দিকে সিঁড়িখেতে জোয়ার বোনা হয়েছিল। টিজু নদীর বরফ-গলা জল এনে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছিল বীজ ফসলের শিকড়ে শিকড়ে। এখন, এই নসু কেহেঙ মাসের সকালে সারা মাঠ ভরে শ্যামল অঙ্কুর মাথা তুলেছে। আগামী ফসলের মাসগুলিতে পাহাড়ী খেতের ঝাপি সোনালি লাবণ্যে ভরে যাবে। শ্যামাভ শস্যের অঙ্কুরে তার গর্ভধারণের ইঙ্গিত।

পুরোপুরি জা কুলি মাসটা, তারপর নসু কেহেঙ মাসের অনেকগুলো দিন, মোরাঙের মাচানে শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিতে হয়েছে সেঙাইকে। সালুয়ালা গ্রামের অতল খাদে সেদিন অচেতন হয়ে পড়ে যাওয়ার পর সারা দেহ ফালা ফালা হয়ে ছিঁড়ে গিয়েছিল। সেই রক্তাক্ত ক্ষতগুলি টুগু আর আরেলা পাতার প্রলেপে শুকিয়ে গিয়েছে এতকাল পর।

.

আজ প্রথম মোরাঙ ছেড়ে বাইরে এল সেঙাই। সারা দেহ এতদিনের বিশ্রামে সতেজ হয়েছে, সবল হয়েছে। চামড়া টান টান হয়ে নির্ভাজ হয়েছে। আর সেই নির্ভজ চামড়ার ওপর বেশ চেকনাই ফুটে বেরিয়েছে।

মোরাঙের সামনে এই উঁচু পাথরের টিলা থেকে ফসলের সিঁড়িখেত নজরে আসে। ফসল পাহারা দেবার জন্য জমির চারিদিকে অজস্র ঘর তোলা হয়েছে। অনেক উঁচু থেকে সেগুলিকে ছোট ঘোট বিন্দুর মতো মনে হয়।

অনেক আগেই সকাল পেরিয়ে গিয়েছে। দিকে দিকে দুপুরের আভাস ফুটে বেরিয়েছে। শক্ত করে কোমরের কাপড়ে একটা গিঁট দিয়ে নিল সেঙাই।

একপাশে বসে বসে বর্শায় শান দিচ্ছে জোয়ান ছেলেরা। তাদের ভেতর থেকে ওঙলে বলল, কি রে সেঙাই, বেরিয়েছিস মোরাঙ থেকে?

হু-হু, ভালো হয়ে গেছি তত বেরুব না? কদ্দিন আর মোরাঙে শুয়ে থাকব?

আজ সিঁড়িখেতে যাবি নাকি?

যাব। বিষণ্ণ গলায় সেঙাই বলল, এবার বীজ বুনতে পারলাম না। জোয়ার না হলে গরমের দিনগুলো খাব কী, ভাবতে পারছি না।

হু-হু। সকলে মাথা নেড়ে সায় দিল।

কী যে করি! সেঙাইকে বড় অসহায় দেখাল।

তুই পাহাড়ী মরদের নাম ডুবিয়ে দিবি। প্রখর গলায় দক্ষিণ পাহাড়কে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে এবার হেসে উঠল ওঙলে, বনে মোষ নেই? হরিণ নেই? শুয়োর নেই? সম্বর নেই? বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে এনে পুড়িয়ে খাবি।

ঠিক বলেছিস। আরো খানিকটা এগিয়ে ওঙলের পাশে এসে দাঁড়াল সেঙাই। বলল, তবে ফসল না বুনলে কী চলে? ফসলের আনিজার যে তাতে গোসা হয়।

হু-হু।

তোরা কখন সিঁড়িখেতে যাবি?

দুপুর পেরিয়ে গেলে। ওঙলে বলল।

আমাকে ডেকে নিস। আমি এখন একবার কেসুঙে যাব। ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করে আসি। হন হন করে জোহেরি কেসুঙের দিকে চলে গেল সেঙাই।

পূর্ববর্তী জোহেরি কেসুঙের পেছন দিকে অর্ধগোলাকার পাথরখানার ওপর বসে ছিল বুড়ি বেঙসানু। তার চোখ দু’টি আকাশের দিকে স্থির হয়ে রয়েছে। আকাশটা আশ্চর্য নীল, আশ্চর্য নির্মল। মহাশূন্যে গুটসুঙ পাখির ঝাঁক সাঁতার কেটে চলেছে।

এমন সময় সেঙাই এল।

ঠাকুমা, এই ঠাকুমা–

কে? সেঙাই এসেছিস–আয়। মোরাঙে মেয়েদের ঢুকতে দেয় না, তাই তোকে দেখতে যাই না। কেমন আছিস? ভালো তো? ঘুরে বসল বুড়ি বেঙসানু।

সেঙাই-এর সাড়া পেয়ে ফাসাও আর নজলি বাইরের ঘর থেকে ছুটে এসেছে। ঝাঁপিয়ে পড়েছে বড় ভাইয়ের ঘাড়ে।

সেঙাই বলল, মা কোথায়?

সে মাগী কি আর এখানে আছে? সে গেছে কোহিমা। তোর বাপের কাছে।

বাপ বস্তিতে আসে নি আর?

আর এল কোথায় শয়তানের বাচ্চাটা! হুই সারুয়ামারুর বউ জামাতসুর ইজ্জত নিলে। তারপর সেই রাতেই তো কোহিমা পালাল। আমি বুড়ি শেষকালে জামাতসুর ইজ্জতের দাম দিলাম শুয়োর আর বর্শা দিয়ে। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল বেঙসানু, সেই সায়েব না কী, তাদের সঙ্গেই রয়েছে টেফঙের বাচ্চাটা। টেনে নটুঙ!

মা কার সঙ্গে কোহিমা গেল?

সারুয়ামারু কোহিমা গেল দিন সাতেক আগে, তার সঙ্গে রাতের অন্ধকারে ভেগে গিয়েছে শয়তানী। মাগীর তো আবার পুরুষের গায়ের গন্ধ না পেলে মেজাজ বিগড়ে যায়। বেঙসানু নির্বিকার ভঙ্গিতে খেউড় গাইতে শুরু করল, আহে ভু টেলো।

সেঙাইর সতেজ দেহটা অদ্ভুত উত্তেজনায় ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। থরে থরে সাজানো পেশীগুলিতে দোলানি শুরু হল, সারুয়ামারু কোথায়? কোহিমা থেকে ফিরেছে?

হু-হু, কাল সন্ধের সময় ফিরেছে বস্তিতে। এবার বিস্বাদ গলায় বেঙসানু বলল, কী খাবি সেঙাই? এবছর তো সিঁড়িখেতে জোয়ারের বীজ বোনা হল না। তুইও মোরাঙের মাচানে শুয়ে শুয়ে ভুগলি, আর হুই টেফঙের বাচ্চা সিজিটোটা কোহিমায় পালিয়ে গেল। সায়েবদের গায়ে যে কী সোয়াদ মাখা আছে, সে-ই জানে। চিন্তিত মুখে বেঙসানু বলতে লাগল, ফসল হল না এবার, খাবি কী সেঙাই?

কী আবার খাব? ললাটে পাখি মারব, হুন্টসিঙ পাখি মারব, মোষ আর হরিণ শিকার করব। শুয়োর গেঁথে আনব। শুধু মাংস খেয়ে কটা মাস কাটিয়ে দেব। যদ্দিন এই বন আর পাহাড় রয়েছে, জানোয়ার আর পাখি রয়েছে, এই দুখানা হাত রয়েছে, বর্শা আর সুচেন্যু রয়েছে, তদ্দিন না খেয়ে মারব নাকি? কী রে ঠাকুমা? সোজাসুজি বেঙসানুর দিকে তাকাল সেঙাই।

সে কথা ঠিক সেঙাই। আমরা পাহাড়ী মানুষ, জন্তু জানোয়ার পেলেই আমাদের পেট চলে যাবে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।

কী কথা আবার ভাবছিস? সেঙাই-এর কপালের টান টান চামড়ায় কয়েকটা রেখা ফুটে বেরুল। আড়াআড়ি রেখা। রেখার আঁকিবুকি।

বলছিলাম, এক বছর সিঁড়িখেতে বীজফসল পড়ল না। যদি ফসলের আনিজার রাগ এসে পড়ে, তবে তো আমাদের জমিতে আর ফসলই হবে না কোনোদিন। কত কাল আর মাংস খেয়ে কাটাবি?

আরে হবে, হবে। ফসলের আনিজার নামে একটা সম্বর বলি দিলেই হবে। তুই বোস্ ঠাকুমা, আমি একটু সারুয়ামারুকে ডাকি। অর্ধ-গোলাকার পাথরখানার ওপর উঠে দাঁড়াল সেঙাই।

ফাসাও আর নজলিও লাফিয়ে উঠে পড়েছে, এখন কোথাও যেতে হবে না। আমাদের মায়ের কাছে দিয়ে আয়।

মায়ের কাছে যাবে! দেখলি না তোদের ফেলে কোহিমা ভাগল মা আর বাপ। থাম সব। রক্তচোখে তাকাল সেঙাই। তারপর পাথরখানার থেকে নিচে নেমে চিৎকার করে উঠল, এই সারুয়ামারু, সারুয়ামারু–

মাথার ঠিক ওপরেই অতিকায় একটা মস্ত পাথরের চাই। সেটার পাশেই জোরি কেসুঙ। সেখান থেকে একটা বিরক্ত কণ্ঠস্বর তাড়া করে এল, কে? কে ডাকে? কে রে শয়তানের বাচ্চা?

আমি সেঙাই, নিচে আয় সারুয়ামারু।

যাই।

খানিক পরে জোহেরি কেসুঙে চলে এল সারুয়ামারু। তারপর অর্ধ-গোলাকার পাথরখানার ওপর জাঁকিয়ে বসল, কি রে সেঙাই, ভালো হয়ে গেছিস দেখছি।

হু-হু।

এই যে তোর বাপ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণের পনেরোটা পাহাড় ডিঙিয়ে মাও-এর রাস্তা। সেখানে পক পক গাড়ি পাবি। তাই চড়ে কোহিমা যাবি। তোর বাপ যেতে বলেছে তোকে। বলতে বলতে হাতের মুঠি থেকে একটি রুপোর মুদ্রা বার করে সেঙাইর দিকে বাড়িয়ে দিল সারুয়ামারু, এই নে।

ঝকঝকে রুপোলি মুদ্রা। রোদ লেগে শুভ্র দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে ধাতব বস্তুটির দিকে তাকিয়ে রইল সেঙাই। এ তার অচেনা। এর আগে কোনোদিনই এই গোলাকার মুদ্রাটির সঙ্গে তার পরিচয় হয়নি। বুড়ি বেঙসানুও সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে অবাক হয়ে। তার হিসাবহীন বয়সের অভিজ্ঞতায় এমন একটি পদার্থ অজানাই রয়েছে।

সেঙাই তাকাল বেঙসানুর দিকে। এখনও সে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেনি, বস্তুটি স্পর্শ করবে কি, করবে না।

বেঙসানু ভীরু গলায় বলল, এই সারুয়ামারু, এটা ধরলে আনিজার রাগ এসে পড়বে না তো? এটার নাম কী?

এই ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ। চারপাশে গহন বন। সেই বনে হিংস্র শ্বাপদের অবাধ সংসার। সেই অরণ্যে নিয়তবাহী প্রস্রবণ, কল্লোলিত জলপ্রপাত তাদের অভিজ্ঞতার সীমানায় এগুলিই সত্যি, এগুলিই গ্রাহ্য। এই পাহাড়ী পৃথিবীর বাইরে তাদের কাছে সমস্ত কিছুই সংশয়ের সীমা দিয়ে ঘেরা, অবিশ্বাস আর সন্দেহে আকীর্ণ। অস্ফুট বোধবুদ্ধি দিয়ে এই পাহাড়ী মানুষগুলি সব কিছু যাচাই করে তবেই গ্রহণ করে। নইলে অপরিচিত কোনো কিছুর মুখোমুখি হতে তারা কুণ্ঠিত হয়, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

সমস্ত কেলুরি গ্রামখানাকে চমকে দিয়ে হেসে উঠল সারুয়ামারু, কি বোকা তোরা! এর নাম হল টাকা। এটা ধরলে কিছুতেই আনিজার রাগ হবে না।

আশ্চর্য আকর্ষণ। হাতখানা বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে নিল সেঙাই। ফিসফিস গলায় বলে উঠল, এটা দিয়ে কী হয়?

কী না হয় বল? এটা দিলে সব কিছু পাওয়া যায়। অত্যন্ত বিজ্ঞ বিজ্ঞ দেখাচ্ছে এবার সারুয়ামারুকে, কোহিমা শহরে যখন যাবি তখন দেখবি কী হয় এটা দিয়ে। কালই তুই চলে যা কোহিমা। তোর বাপ তোর জন্যে কাজ ঠিক করে রেখেছে।

কাজ! কিসের কাজ?

বেত কাটার কাজ। নাগিনীমারা যেতে হবে। এবার তো আর সিঁড়িখেতে জোয়ারের বীজ বুনিসনি। ডিমাপুর হয়ে নাগিনীমারা যাবি। আমিও যাব। দোইয়াঙ আর রেঙমাপানির ওধারের বস্তিগুলো থেকেও অনেক পাহাড়ী যাবে।

নাগিনীমারা! ডিমাপুর! বিচিত্র সব নাম, বিচিত্র সব দেশ। এই রুপোলি মুদ্রার মতোই ওই নামগুলো সেঙাই কি বুড়ি বেঙসানুর অজানা। ছয় আকাশ, ছয় পাহাড় ডিঙিয়ে কোথায় কোন সুদূর দিগন্তে ওই নামের দেশগুলো পড়ে রয়েছে সে খবরও তাদের জানা নেই। শুধু এক দুর্নিবার কৌতূহল, এক দুর্বোধ্য আকর্ষণ সেঙাই-এর সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে তুলল। ডিমাপুর! নাগিনীমারা! কতদূর! কোথায় সেই সব দেশ?

হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সেঙাই। শুধু হাতের পাতায় রুপোলি মুদ্রাটা ঝকঝকে রোদে ঝিকমিক করছে।

সেঙাই আবিষ্ট গলায় বলল, কাজ করে এই টাকা পাওয়া যাবে?

হু-হু, অনেক পাওয়া যাবে। তোর বাপ ফাদারের কাজ করে অনেক টাকা পায়। তুইও পাবি। সারুয়ামারু আলোক দান করে চলল।

ইতিমধ্যে সমস্ত কেলুরি গ্রামখানা জমায়েত হয়েছে জোহেরি কেমুঙে। সারুয়ামারু, বুড়ি বেঙসানু আর সেঙাইর চারপাশে নিবিড় হয়ে দাঁড়িয়েছে সকলে।

ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ কেলুরিতে এই প্রথম রুপোর টাকার আর্বিভাব। বিস্ময়ে ভয়ে সব মেয়েপুরুষ সেঙাই-এর মুঠির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একসময় সেঙাইর থাবা থেকে ছোঁ মেরে টাকাটা তুলে নিল একজন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সন্ধানী দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। তার মুঠি থেকে আর একজন ছিনিয়ে নিল। তার মুঠি থেকে অন্য একজন নিল। এই প্রক্রিয়ায় টাকাটা মেয়েপুরুষের জটলায় হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। টাকার এই প্রথম আগমনকে বিস্ময় আর কৌতূহল দিয়ে অভ্যর্থনা জানালো কেলুরি গ্রামের মানুষেরা।

একসঙ্গে সকলে বলে উঠল, আমরা টাকা পাব?

হু-হু, পাবি। ফাদারকে নিয়ে আসব বস্তিতে। ফাদার এখানে আসতে চেয়েছে। সে এলে তোরা তাকে টাকার কথা বলবি। সকলের মুখের ওপর দিয়ে দৃষ্টিটাকে পাক খাইয়ে নিয়ে গেল সারুয়ামারু। ফিসফিস গলায় বলল, ফাদার এলে তোরা খুশি হবি তো? কেউ বর্শা দিয়ে খুঁড়বি না?

সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল। একটু ভেবে দ্বিধাভরা গলায় বলল, আমরা কি জানি, সদ্দারকে জিজ্ঞেস কর তুই।

সদ্দার আর সদ্দার! সারুয়ামারুর লাল লাল দাঁতগুলো কড়মড় করে উঠল, সদ্দার তোদের টাকা দেবে? জানিস, টাকা দিলে সব মেলে। দুনিয়ার সব কিছু পাওয়া যায়। নিমক পাওয়া যায়, ধান পাওয়া যায়, গাড়ি চড়া যায়। যা চাস তাই পাবি।

সব পাওয়া যায়! কে যেন বলে উঠল।

মানুষগুলো হতবাক হয়ে গিয়েছে। বলে কী সারুয়ামারু! ওই সাদা সাদা গোলাকার বস্তুগুলির এত মহিমা তা কি তারা জানত!

আচমকা মানুষগুলো হল্লা শুরু করে দিল, হুই তো সদ্দার, হুই তো সদ্দার এসেছে।

জোরি কেসুঙের সামনে কালো একখানা পাথর খাড়া হয়ে উঠে গিয়েছে। সেটা ডিঙিয়ে জোহেরি কেসুঙে চলে এল বুড়ো খাপেগা।

কি রে, কী ব্যাপার? হুল্লা করছিস কেন? আরে সারুয়ামারু যে! এসেছিস কখন? কোহিমার গল্প বল শুনি। এদিক সেদিক তাকাতে লাগল বুড়ো খাপেগা।

চারপাশের মানুষগুলো সমানে চিৎকার করতে লাগল, সদ্দার, টাকা টাকা

টাকা এনেছে সারুয়ামারু। টাকা এনেছে।

কই দেখি–সেঙাই-এর হাত থেকে টাকাটা তুলে বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখতে লাগল বুড়ো খাপেগা। বলল, এ দিয়ে কী হয়?

টাকার মহিমা সম্বন্ধে সারুয়ামারু আর-একবার আলোক দান করল। বলল, জানিস সদ্দার, ফাদার আমাদের বস্তিতে আসবে বলেছে। অনেক টাকা দেবে। তুই বললে তাকে নিয়ে আসব।

সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল বুড়ো খাপেগা, টাকার বদলা কী দিতে হবে?

কিছুই না। খালি যীশু যীশু বলতে হবে। দুকাঁধে, কপালে আর বুকে আঙুল ঠেকাতে হবে। আনিজার নামে শুয়োর বলি দিতে পারবি না ।

সারুয়ামারুর গলা মাঝপথে থেমে গেল। কেলুরি গ্রামের খাপেগা সর্দার হঠাৎ গর্জন করে উঠল। ঘোলাটে চোখদুটো আগ্নেয় হয়ে উঠেছে, কী বললি শয়তানের বাচ্চা! শুয়োর বলি বন্ধ করতে হবে? একেবারে বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে ফেলব না! তোর ফাদার বস্তিতে এলে আর জান নিয়ে ফিরতে হবে না। হুই সব বুকে কপালে কাঁধে আমরা হাত ঠেকাতে পারব না।

সারুয়ামারু চমকে উঠেছে। অপরিসীম ভয়ে মনটা কুঁকড়ে গিয়েছে তার, আচ্ছা, ফাদারকে আসতে বলব না। তুই যখন চাস না তখন কী আর করা।

খবদ্দার, তোর ফাদার যেন এ বস্তিতে না আসে। আমাদের টাকা চাই না।

আচ্ছা।কাঁপা গলায় বলল সারুয়ামারু। কিন্তু তার চোখ দুটো ভয়ানক ক্রুর হয়ে উঠেছে।

টাকা চাই না, টাকা চাই না। পাহাড়ী মানুষগুলো একটানা শোরগোল করতে লাগল, হো-ও-ও-ও-য়া-য়া–

একসময় বুড়ো খাপেগা বলল, নিমক এনেছিস কোহিমা থেকে?

সারুয়ামারু গোলাকার কামানো মাথা ঝাঁকাল, হু, আমার ঘরে আছে। সবাই নিয়ে যাস। এবার নিমকের দর খুব চড়া। মাধোলাল এক খুদি নিমকের বদলা এক খুদি কস্তুরী নিয়েছে কিন্তু।

আচ্ছা, আচ্ছা। এবার কোহিমার গল্প বল সারুয়ামারু। একখানা বাদামি রঙের পাথরের ওপর জাঁকিয়ে বসল বুড়ো খাপেগা। আর জোহেরি কেসুঙের চত্বরে হুটোপাটি করতে করতে বসে পড়ল কেলুরি গ্রামের বাকি মানুষগুলো।

সারুয়ামারু বলল, জানিস সদ্দার, একটা ভারি ভালো মেয়ে বেরিয়েছে কোহিমাতে। আমি তাকে দেখেছি। সে আমাদের পাহাড়েরই মেয়ে।

কী নাম তার?

গাইডিলিও। সুন্দর দেখতে, বড় বড় চোখ। রূপময়ী এক পাহাড়ী নারীর বর্ণনা দিল সারুয়ামারু।

ভালো যে, বুঝলি কী করে?

তার চারপাশে সারা নাগা পাহাড়টা ভিড় জমিয়েছে। সে যাকে ছোঁয় তার রোগ ভালো হয়ে যায়। লোটা নাগারা, সাঙটামরা, সেমারা, কোনিয়াকরা–সব জাতের মানুষই তার ভক্ত হয়েছে।

বলিস কী! সবিস্ময়ে বলল বুড়ো খাপেগা।

সত্যি কথা। একটুও মিথ্যে নয়। সেঙাই-এর বাপ সিজিটোও গাইডিলিওকে দেখেছে। তাকে জিগ্যেস করে দেখিস।

সে ছুঁয়ে দিলে রোগ সেরে যায়! বলিস কী!

হু-হু। সবাই তাকে রানী বলে। জোয়ান মেয়ে, ষোল বছর বয়েস হবে।

আচমকা সেঙাই উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি কোহিমা যাব সারুয়ামারু। তুই আমাকে নিয়ে যাবি? রানী গাইডিলিওকে দেখব।

হু-হু, যাবি। তোর বাসভাড়ার টাকা তো দিয়েই দিয়েছে সিজিটো। সারুয়ামারু বলে চলল, কোহিমা কী সুন্দর শহর। এই বস্তি ছেড়ে তোরা তো কোথাও যাবি না। গাড়ি দেখবি–

গাড়ি? সে আবার কী?

রহস্যময় গলায় সারুয়ামারু বলল, আমার সঙ্গে কোহিমা চল আগে। তোকে সব দেখাব। গাড়ি দেখবি, পাকা বাড়ি দেখবি। আরো কত কী দেখবি।

দুপুরের রোদ তীব্র হচ্ছে, তীক্ষ্ণ হচ্ছে। নসু কেহেঙ মাসের এই দুপুরে সিঁড়িখেতে ছোট ছোট বাঁশের ঘর থেকে ফসলের তামাটে অঙ্কুর পাহারা দেয় পাহাড়ী মানুষগুলো। দুষ্ট আনিজার দৃষ্টি থেকে, বুনো মোষের দাপাদাপি থেকে সিঁড়িখেত রক্ষা করতে হয়। সকলে এক এক করে উঠে পড়ল। যাবার আগে সারুয়ামারুর কাছে তারা রানী গাইডিলিওর গল্প শুনল। শুনতে শুনতে বিস্মিত হল। কখনও বা মুগ্ধ। অপরূপ রূপকথার মতো এক কাহিনি, যার নায়িকা গাইডিলিও স্বয়ং। তার ছোঁয়ায় পুনর্জন্ম হয়। তার নির্দেশে জরামৃত্যু ফেরারি হয়। গাইডিলিওর কাহিনি বাদ দিয়েও আর একটা অপূর্ব বস্তু তাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সেটা একটা রুপোর মুদ্রা। বুড়ো খাপেগার সঙ্গে সায় দিয়ে তারা যতই সারুয়ামারুর বিপক্ষে চেঁচাক, যতই হল্লা করুক, তবু টাকার কথা ভুলতে পারছে না। রানী গাইডিলিও আর টাকাটা অনেকদিন তাদের বিস্ময় আর আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে।

খানিক পরে সকলে জোহেরি কেসুঙ থেকে চলে গেল।

সামনের কালো পাথরখানায় উঠে এল সেঙাই আর সারুয়ামারু। সেঙাই বলল, কোহিমা গেলে টাকা পাব তো? ঠিক বলছিস?

হু-হু, নিশ্চয়ই পাবি। তোকে তো আগেই বলেছি। ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাতে লাগল সারুয়ামারু। ফিসফিস করে বলল, দেখলি সদ্দারটা কেমন শয়তান! ফাদারকে কিছুতেই আসতে দেবে না। আচ্ছা, আমিও দেখে নেব। যখন বন্দুক নিয়ে ফাদাররা আসবে তখন কী করে সদ্দার শয়তানটা তাদের ঠেকায়, আমিও দেখব। শেষ কথাগুলো এত আস্তে বলল যে সেঙাই শুনতে পেল না।

সারুয়ামারুর কথাগুলোর দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই সেঙাই-এর। তার সমস্ত ভাবনাকে ভরে রেখেছে দুটো অভিনব বস্তু। একটি রুপোর টাকা, অপরটি রানী গাইডিলিওর গল্প। অন্যমনস্কের মতো সেঙাই বলল, রানী গাইডিলিওকে দেখাবি তো?

দেখাব। এতক্ষণ বিড় বিড় করছিল সারুয়ামারু, এবার সোজাসুজি তাকাল, তুই কোথায় যাবি সেঙাই? আমি কিন্তু এবার আমাদের কেসুঙে ফিরব। শরীরটা বড় খারাপ লাগছে।

দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠল সেঙাই, যা যা। আমি সব বুঝি। বউয়ের কাছে না গেলে আরাম হচ্ছে না। শরীর খারাপ, অথচ বউয়ের সঙ্গে ফুর্তি তো থামাচ্ছিস না। কোহিমা থেকে ফিরেই ঘরে ঢুকেছিস। অন্য দিকে তোর মন আছে? তুই একটা আস্ত শয়তান। ভাবলাম, গাইডিলিওর কথা ভালো করে শুনব। তা না

রাত্তিরে মোরাঙে বসে গল্প বলব। তখন শুনিস। আর দাঁড়াল না সারুয়ামারু। লম্বা লম্বা পা ফেলে জোরি কেসুঙের দিকে চলে গেল।

আর কালো পাথরখানার ওপর দাঁড়িয়ে এক নজরে সারুয়ামারুর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল সেঙাই। গাইডিলিও সম্বন্ধে তার কৌতূহল মেটেনি। তার আগ্রহটা উদগ্র হয়ে রইল।

.

২১.

টেনেন্যু মিঙ্গেলু। বউপণ। সেই বউপণ এসেছে নানকোয়া গ্রাম থেকে। পাঠিয়েছে মেজিচিজুঙের বাপ রাঙসুঙ। দুটো জোয়ান ছেলে এসেছিল রেঙমাপানি নদীর ওপারে মাঝারি আকারের গ্রাম নানকোয়া থেকে। সঙ্গে চারখানা খারে বর্শা। অতিকায়। সেগুলোর গড়নের মধ্যে অতীতের ছাপ রয়েছে, প্রাচীনত্বের সুস্পষ্ট চিহ্ন ফুটে আছে। আর যৌতুক হিসেবে এসেছে কড়ির গয়না, কানের নীয়েঙ দুল, হাতির দাঁতের হার। মোষের শিঙের মুকুট, যার দু’পাশে হরিণের শিঙের বাহার। পেতলের গলাবন্ধ। আটর ফুলের সাজসজ্জা আর সাধারণ গড়নের পঞ্চাশখানা বর্শা।

সকালবেলা জোয়ান ছেলে দুটো এসে পৌঁছেছিল। মেহেলীর বাপ সাঞ্চামখাবা আদর করে, তোয়াজ করে, তাদের নিয়ে বসিয়েছে বাইরের ঘরে। টাটকা চোলাই পীতা মধু দিয়েছে বাঁশের পানপাত্র ভরে, চাকভাঙা সোনালি মধু দিয়েছে। হুন্টসিঙ পাখির মাংস দিয়ে কাবাব বানিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে কাঠের বাসনে। জোয়ান ছেলে দুটো বেশ তরিবত করে কাবাব চিবুচ্ছে। তারিয়ে তারিয়ে পীতা মধুর পাত্রে চুমুক দিচ্ছে একজন। আর একজন সোনালি মধু চুক চুক করে জিভ দিয়ে টেনে নিচ্ছে।

সমস্ত সালুয়ালাঙ গ্রামখানা পোকরি কেসূঙটার চারপাশে ভেঙে পড়েছে। সাঞ্চামখাবার বাইরের ঘরে একখানা তিনকোনা পাথরে থেবড়ে বসেছে গ্রামের বুড়ো সর্দার। সালুয়ালাঙ গ্রামের সমস্ত বংশের প্রাচীন মানুষগুলো পাশাপাশি ঘন হয়ে বসেছে। তাদের সামনেও পীতা মধুর ভরা পাত্র, পাখির মাংসের কাবাব।

এখন নসু কেহেঙ মাসের দুপুর। নিঃসীম আকাশটা পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে যেন। দুপুর জ্বলছে, কিন্তু এই পাহাড়ী পৃথিবীর রোদে জ্বালা নেই। স্নিগ্ধ মমতায় এই রোদ মনোরম, বড় আমেজ।

বুড়ো সর্দার বলল, তোরা তো সব নানকোয়া বস্তি থেকে এলি, তাই না?

জোয়ান ছেলে দুটো মাথা নাড়ল, হু-হু।

তা টেনেন্য মিঙ্গেলু (বউপণ) ঠিকমতো এনেছিস?

না, সবটা আনিনি। আজ মেয়ের জন্যে খানিকটা বায়না দিয়ে যাব। কাল সন্ধের সময় মেজিচিজুঙের পিসি আসবে। সে-ই টেকোয়েঙ কেজি (ঘটকী)। সে এসে বিয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি করেগেলে বাকি পণ দিয়ে যাব। পাখির মাংসের কাবাবে লুব্ধ কামড় দিয়ে একটা জোয়ান ছেলে বলল।

সহসা বিমর্ষ গলায় বুড়ো সর্দার বলল, আমার মেয়ে লিজোমুটার বিয়ে হয়ে যেত অ্যাদ্দিনে। জুকুসিমা বস্তি থেকে তার জন্যেও তো বউপণ এসেছিল।

হু-হু– কাবাবে লাল লাল দাঁতের কামড় বসাতে বসাতে, কি রোহি মধু গিলতে গিলতে প্রাচীন মানুষগুলো মাথা দোলাতে লাগল, হু-হু, তা হত।

বুড়ো সর্দারের বিষাদ তাদেরও যেন এই মুহূর্তে স্পর্শ করেছে।

নানকোয়া গ্রামের একটা জোয়ান বলল, কী হল তোর মেয়ের, কি রে সদার? ছেলেটার চোখমুখ আগ্রহে ঝকমক করছে।

কী যে হল, কিছুই জানি না। কেলুরি বস্তির সেঙাইকে যেদিন পোড়াই সেদিন থেকেই মেয়েটা নিখোঁজ। বাঘের পেটে গেল, না রেনজু আনিজা খাদে ফেল মারল, নাকি বুনো মোষ শিঙ দিয়ে ফুড়ে সাবাড় করল, জানতেই পারলাম না। হুই কেলুরি বস্তির শত্তুররাই বর্শা দিয়ে ফুঁড়ল কিনা তা-ই বা কে জানে। একটা অসহায় দীর্ঘশ্বাস পড়ল বুড়ো সর্দারের।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। সাঞ্চামখাবার এই ছোট বাইরের ঘরটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে রইল।

একটু পরে আবার বুড়ো সর্দার বলল, যেতে দে, যেতে দে ওসব। পাহাড়ী মানুষ আমরা। এমন করেই আমাদের জান সাবাড় হয়।

হু-হু। নানাকোয়া গ্রামের জোয়ান দুটো চেঁচামেচি করে সায় দিল।

বুড়ো সর্দার তাকাল সাঞ্চামখাবার দিকে, কি রে, মেহেলীর মামা কই? তাকে খারে বর্শা দেবে ওরা। নইলে যে ছেলেপুলে হবে না মেহেলীর।

সে তো নিমক আনতে মোককচঙ গিয়েছে। নিরুপায় গলায় বলল সাঞ্চামখাবা, তা হলে কী হবে সদ্দার?

কী আবার হবে। সে আসবে কবে?

তার কিছু ঠিক নেই।

তবে তোর নিজের খারে বর্শা দুটো নিয়ে নে।

পাহাড়ী মানুষগুলোর মধ্যে বিয়ের আগে একটি প্রথা আছে। সে প্রথাটি হল, পাত্রপক্ষ থেকে বউপণ হিসেবে দু’টি করে খারে বর্শা মেয়ের বাপ আর বড় মামাকে দিতে হয়। বড় মামা এই খারে বর্শা না পেলে, এদের বিশ্বাস, বিবাহিতা মেয়ের সন্তানের সম্ভাবনা থাকে না। অবশেষে অবৎসা নারী ডাইনি হয়।

হাত বাড়িয়ে দুটো খারে বর্শা নিয়ে নিল সাঞ্চামখাবা। অনেক দিনের পুরনো। বউপণের জন্যই এই বর্শাগুলোর প্রচলন। এগুলোকে শান দেওয়া হয় না, অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা হয় না। পরম আদরে বাঁশের খাপের মধ্যে ভরে রাখা হয়। বিয়ে ছাড়া অন্য সময় এগুলো ছোঁয়া পর্যন্ত হয় না। তাই বর্শার ফলায় লালচে জং ধরে গিয়েছে।

খারে বর্শার ফলা দুটো নিয়ে সাঞ্চামখাবা বলল, তা হলে সদ্দার, মেহেলীর মামার কী হবে?

মোককচঙে কাউকে দিয়ে খবর পাঠা। আর শোন, তোদের একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। বুড়ো সর্দার বাইরের দিকে তাকাল।

কেসুঙের সামনে সমস্ত সালুয়ালা গ্রামখানা জটলা পাকাচ্ছে। সর্দারের ডাকে একটা ঠাসবুনট ভিড় দরজার কাছে ঘন হয়ে এল, কি সদ্দার, কী বলছিস?

সেদিন সায়েবরা এসেছিল, মনে আছে?

হু-হু। সায়েবরা কত ভালো! টাকা দিয়েছে। কাপড় দিয়েছে। ভালো ভালো খাবার দিয়েছে। সালুয়ালা গ্রামের মেয়েপুরুষ একসঙ্গে শোরগোল করে উঠল।

যীশু, যীশু। মেরী, মেরী–পাহাড়ী গ্রামটা মেতে উঠতে লাগল।

দিনকয়েক আগে সালুয়ালা গ্রামে দুজন পাদ্রী এসেছিল। তারা পাহাড়ী মানুষগুলোর মধ্যে অনেক টাকা, নানা রঙের নানা আকারের বাহারি কাপড়-জামা বিলিয়ে গিয়েছে। আর সেই সঙ্গে ছড়িয়ে গিয়েছে এক অপূর্ব জ্ঞানের আলো। বেথেলহেমের এক অনির্বাণ নক্ষত্রকে এই ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ সালুয়ালাঙের আকাশে চিরস্থায়ী করে রাখার সব রকম বন্দোবস্ত করে। গিয়েছে। কোনো দিকে বিন্দুমাত্র ত্রুটি হয়নি। যীশু! এই নামটিকে আদিম পাহাড়ী মানুষগুলির হাড়ে হাড়ে উৎকীর্ণ করতে চেয়েছে পাদ্রী সাহেবরা। সকলের কানে কানে একটি অমোঘ মন্ত্র দিয়েছে। সে মন্ত্রের নাম যীশু। সকলের আঙুলের ডগায় ক্রস আঁকার কায়দা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে।

পাহাড়ী মানুষগুলোর কেউ কেউ দুই বাহুসন্ধি, বুক আর কপাল আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ক্রস আঁকতে লাগল।

বুড়ো সর্দার বলল, কাল সায়েবের লোক এসেছিল আমাদের বস্তিতে।

কই, আমরা তো জানি না। সকলে তারস্বরে চেঁচামেচি শুরু করে দিল।

তোরা তখন সিঁড়িখেতে গিয়েছিলি।

সায়েবরা আরো টাকা দিয়েছে? সুন্দর সুন্দর কাপড় দিয়ে গেছে আমাদের জন্যে, কি রে সর্দার? বলতে বলতে জনকয়েক ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

প্রশ্নগুলো শুনে বুড়ো সর্দারের ঘন ভুরুজোড়া কয়েক মুহূর্ত কঁকড়াবিছার মতো কুঁকড়ে রইল। আচমকা কালকের কথা মনে পড়ল। সকলের অগোচরে পাদ্রীসাহেবের লোকটা তার থাবায় অনেকগুলো রুপোর মুদ্রা গুঁজে দিয়ে গিয়েছিল, আর লাল রঙের একটা কাপড় দিয়েছিল। টাকার মহিমা জানে বৈকি বুড়ো সর্দার। এর আগেও অনেকবার কোহিমা আর মাও শহরে গিয়েছে সে।

পাদ্রীসাহেবের লোক। নামটা ভুলে গিয়েছে বুড়ো সর্দার। তবে মানুষটা তাদেরই মত পাহাড়ী। তাদেরই মতো তার চোখের মণি পিঙ্গল। কিন্তু পরনে সাহেবদের মতো সাদা কাপড়। হুসিঙ পাখির পালকের মতো ধবধবে। কাপড়টার নামও কী যেন বলেছিল লোকটা। সারপ্লিস শব্দটি বেমালুম ভুলে গিয়েছে বুড়ো সর্দার।

সাহেব পাদ্রীর সঙ্গী ছিল। তাদের দেশেরই পাহাড়ী পাদ্রী। বুনো সাহেব। সেই মানুষটা ফিসফিস করে বলেছিল, তোকে একবার কোহিমা যেতে হবে, ফাদার যেতে বলেছে। আরো টাকা পাবি, কাপড় পাবি, নিমক পাবি। লবণ জলের ঝরনার জল আর টক আপুফু ফল গিলে মরতে হবে না। আরো কী কী পাবি, এখন বলছি না।

টাকা! কাপড়! নিমক! শুনতে শুনতে বুড়ো সর্দার বিচলিত হয়ে পড়েছিল। বলা যায়, একেবারে ডগমগ হয়ে উঠেছিল। শব্দ তিনটে বার বার উলটে পালটে অস্ফুট গলায় উচ্চারণ করেছিল সে। জড়িত স্বরে শুধু বলতে পেরেছিল, যাব, নিশ্চয়ই যাব।

ইতিমধ্যে মানুষগুলো আবার অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, কি রে সদ্দার, বলছিস না কেন? দিয়ে গেছে টাকা? কাপড় দিয়েছে?

একটু চমকে উঠল বুড়ো সর্দার। পাহাড়ী মানুষ। মিথ্যাচার করতে বিবেক ঠিক সায় দিয়েও দিচ্ছে না। তবু মুহূর্তের মধ্যে কর্তব্য স্থির করে ফেলল সে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল, না রে শয়তানের বাচ্চারা। টাকা দিয়ে কী করবি? টাকা দিয়ে কী হয় জানিস? কোহিমা মোককচঙে কোনোদিন গেছিস টেফঙের ছায়েরা?

বুড়ো সর্দার আর মেহেলীর মামা ছাড়া সালুয়ালা গ্রামের অন্য কেউ শহরে যায় নি। টাকা দিয়ে কী নিদারুণ ভোজবাজি, কী অসম্ভব ভেলকি দেখানো যায়, তা তারা কেউ জানে না। শুধু হইচই করে উঠল পাহাড়ী মানুষগুলো, হু-হু, টাকা দিয়ে আবার কী হবে? দেওয়ালের খুঁটি ফুটো করে তার ভেতর রাখব। না হলে সিঁড়িখেতে পুঁতে দেব। সায়েব বলেছিল, টাকা হল আউই ভু (জমির উর্বরতার জন্য ভাগ্য-পাথর)। জমিতে পুঁতে দিলে সার ভালো হবে। জোয়ার ফলবে অনেক। অনেক ধান হবে।

হু-হু। শুকনো তামাকপাতার মতো হেজে যাওয়া মাথাখানা দোলাল বুড়ো সর্দার, সায়েবের লোক এসেছিল। সায়েব আমাকে কোহিমা যেতে বলেছে। টাকাকড়ি কিছু দেয়নি।

আচমকা বাইরের ঘরের সামনে আলোড়ন দেখা দিল। বুনো মোষের মতো জমায়েতটাকে ছত্রখান করে, ধাক্কা মেরে, গুতো দিয়ে, ঝড়ের বেগে একটা জোয়ান ছেলে এগিয়ে এল। রীতিমতো হাঁফাচ্ছে সে, সারা দেহ উত্তেজনায় কাঁপছে। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে।

বাইরের চত্বরে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে মানুষগুলো। ঠাসবুনন ভিড়ের মধ্যে পথ করে নিতে গিয়ে জোয়ান ছেলেটার ধাক্কায় কেউ পাথরে ছিটকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। কেউ কেউ আছড়ে পড়েছে মাটির ওপর।

উত্তেজিত গলায় জোয়ানটা বলল, সব্বনাশ হয়ে গেছে সদ্দার—

কী ব্যাপার? কী হয়েছে রে ইমটিটামজাক? বুড়ো সর্দার ভুরু কুঁচকে তাকাল।

টিজু নদীর হুই দিকে সেঙাইকে দেখে এলুম। শিকারে বেরিয়েছে। কেলুরি বস্তির আরো অনেক লোক রয়েছে তার সঙ্গে। সমানে হাঁপিয়ে চলেছে ইমটিটামজাক।

বলিস কী! সকলে চমকে উঠল।

বিস্ময়ের সুরে বুড়ো সর্দার বলল, সে কী! সেদিন তো সেঙাইকে পুড়িয়ে মারলুম!

সেঙাইকে পুড়িয়েছিস! হুই সালুনারু শয়তানী ভুল খবর দিয়েছিল। আহে ভু টেলো। কুৎসিত মুখভঙ্গি করে বলল ইমটিটামজাক।

সালুনারুকে আমি বর্শা দিয়ে ফুড়ব। ওর মুণ্ডু মোরাঙে ঝুলিয়ে রাখব। বর্শা বাগিয়ে লাফিয়ে উঠল বুড়ো সর্দার।

আর ঠিক সেই সময় বাইরের ভিড় থেকে একটা নগ্ন নারীমূর্তি সামনের ঘন জঙ্গলে দৌড়ে পালাল।

সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল উঠল, সালুনারু পালাল, পালাল।

টেমে নটুঙ। একটা কদর্য গালাগালি আউড়ে আবার পাথরখানার ওপর বসে পড়ল বুড়ো সর্দার, কেলুরি বস্তির হুই সালুনারু মাগীকে আমাদের বস্তিতে দেখলে টুকরো টুকরো করে কাটব।

হঠাৎ সাঞ্চামখাবা বলল, সেসব পরে হবে। এখন পণ নিয়ে নিই সদ্দার, কী বলিস তুই?

হু-হু। সায় দিল বুড়ো সর্দার। তারপর তাকাল নানকোয়া গ্রামের জোয়ান ছেলে দুটোর দিকে। বলল, তোদের সঙ্গে তো কুটুম্বিতে হচ্ছে। মেহেলীকে বিয়ে করবে তোদের মেজিচিজুঙ।

হু-হু। একসঙ্গে মাথা দোলাল জোয়ান দুটো।

তোরা আমাদের বন্ধু হবি, কুটুম হবি।

হু-হু–

বুঝলি, হুই কেলুরি বস্তিকে শায়েস্তা করতে হবে। ওরা আমাদের শত্রুর। বুড়ো সর্দার বাইরের ঘর থেকে আঙুল বাড়িয়ে দিল টিজু নদীর ওপারে কেলুরি গ্রামের দিকে।

হু-হু–

সর্দার গর্জে উঠল, হুই বস্তি থেকে চর রেখেছে সালুনারুকে। মাগীর মুণ্ডু ছিঁড়ে মোরাঙের সামনে গেঁথে রাখব। একটু দম নিয়ে আবার বলল, তোরা যখন আমাদের বন্ধু, আমাদের সঙ্গে একজোট হবি।

কেন?

কেন আবার। ওদের সঙ্গে যদি লড়াই বাধে, তখন লোকের দরকার হবে। সেই জন্যে আমাদের একজোট হতে হবে।

হু-হু। মাথা ঝকাল জোয়ান দুটো। বলল, আমাদের সদ্দারকে সে কথা বলতে হবে। সে বললে আমরা জান দিতে পারি। না বললে কিন্তু কিছুই করব না।

বুড়ো সর্দার রক্তচোখে তাকাল, আমাদের সঙ্গে মিলে হুই কেলুরি বস্তির সঙ্গে লড়াই না করলে কিন্তু মেহেলীর বিয়ে দেব না তোদের বস্তিতে। সিধে কথা।

উঠে দাঁড়াল বুড়ো সর্দার। তার থাবায় খরধার বর্শার ফলায় দুপুরের রোদ ঝকমক করছে। তাকে ভয়ানক দেখাচ্ছে।

.

২২.

বিকেলের দিকে নানকোয়া গ্রামের ছেলে দুটো চলে গিয়েছে। বুড়ো সর্দার আর সালুয়ালা গ্রামের প্রাচীন মানুষগুলোও পোকরি কেসুঙ থেকে বিদায় নিয়েছে। বাইরের ঘরের সামনে যে ভিড় ছিল, তাও ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। পশ্চিম পাহাড়ের চূড়ায় ধূসর ছায়া নেমে আসছে।

বাইরের ঘরে এসে ঢুকল মেহেলী আর পলিঙা। সারাদিন তারা উপত্যকায় ঘুরে ঘুরে শুকনো পাতা আর কাঠ কুড়িয়েছে। খবরটা ওরা আগেই পেয়েছে। গ্রামের অন্য একটি মেয়ে এমন মজাদার সংবাদ বেশ রসিয়ে রসিয়েই ওদের দিয়ে এসেছিল।

বুঝলি মেহেলী, নানকোয়া বস্তি থেকে তোর বিয়ের পণ এসেছে।

বিয়ের পণ কেন? চমকে উঠেছিল মেহেলী।

কেন আবার, তোর যে বিয়ে। বিরাট ভোজ হবে। তোের আর কি, এবার ঘরে মরদ পাবি, আমাদের মতো পাহাড়ে পাহাড়ে ছোঁক ছোঁক করতে হবে না। দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল যুবতী মেয়েটির। তারপরেই উৎসাহের সুরে বলেছিল, দ্যাখ গিয়ে, তোদের কেসুঙে বস্তির সব লোক জড়ো হয়েছে।

কথাগুলো যেন কানের ওপর গরম চর্বি ঢেলে দিয়েছিল। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি মেহেলী। সমস্ত শরীরটা, এই পাহাড়ী বন, অস্ফুট ভাবনা–সব যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ সামনের টিলায় উঠে গ্রামের দিকে দৌডুতে শুরু করেছিল। তারপেছন পেছন ছায়ার মতো ছুটেছিল পলিঙা। আর সেই দৌড় পোকরি কেঙের বাইরের ঘরে এসে থেমেছিল।

মাচানের ওপর বসে বেশ তারিয়ে তারিয়ে তখন রোহি মধু খাচ্ছিল সাঞ্চামখাবা। মেহেলীকে দেখে হেসে হেসে বলল, এই মেহেলী, তোর বিয়ের পণ এসেছে। হুই নানকোয়া বস্তির মেজিচিজুঙের সঙ্গে তোর বিয়ে।

মেজিচিজুঙ তো বাঘ-মামুষ। আমি হুই শয়তানকে বিয়ে করব না।

কী বললি? হুমকে উঠল সাঞ্চামখাবা। উত্তেজনায় হাতের পিঠে পুরু ঠোঁট দুটো ঘন ঘন মুছতে লাগল।

কী আবার বলব? আমি মেজিচিজুকে বিয়ে করব না। জেদী গলায় মেহেলী বলল।

ওরে ধাড়ী টেফঙ, ইজা হুবুতা! মুখখানা কদাকার করে বিশ্রী গালাগালটা উচ্চারণ করল সাঞ্চামখাবা–নির্বিবাদে এবং নির্দ্বিধায়, আমি বিয়ের পণ নিয়েছি, আর শয়তানী বিয়ে করবে না? তোর বাপ করবে। তুই তো সেদিনকার ছানা রে রামখোর বাচ্চা।

দাঁতমুখ খিঁচিয়ে মেহেলী বলল, আমি হুই কেলুরি বস্তির সেঙাইকে বিয়ে করব। ও আমার পিরিতের জোয়ান।

কান দুটো বিশ্বাসঘাতকতা করছে না তো! বলে কী মেহেলী! বর্শা দিয়ে জিভখানা উপড়ে ফেলবে নাকি মেয়েটার? সাঞ্চামখাবার চোখ দুটো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। মুখ ভেঙচে সে বলল, পিরিতের জোয়ান! সেঙাইকে বিয়ে করবি! ইজা রামখো। আজ হরিণের মতো ছাল ছাড়িয়ে ফেলব তোর—

মাচানের ওপাশ থেকে একটা বর্শা টেনে নিল সাঞ্চামখাবা। খরধার ফলা। সেই ফলায় মৃত্যু ঝিলিক দিয়ে উঠল, কিন্তু বর্শা দিয়ে তাক করার আগেই ঘর থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়ল মেহেলী, তার পেছনে পলিঙাও।

চারিদিকের বাড়িঘর এবং গাছপালার মাথায় তখনও ফিকে সোনালি রং লেগে আছে। সামনের জঙ্গলে অদৃশ্য হল দু’টি যুবতী।

টিজু নদীর কিনারায় এসে পলিঙা বলল, এবার কী করবি মেহেলী?

কী আর করব, সেঙাইকে খুঁজে বার করতে হবে। কত বার এখানে এসে ঘুরে গেছি। ওর দেখা পাইনি। কী হয়েছে, বুঝতেই পারছি না।

অনেকদিন সেঙাই এদিকে আসে না। বস্তিতে ফিরে আর কোনো জোয়ানীর সঙ্গে পিরিত জমিয়ে বসল না তো? পাহাড়ী জোয়ানের মন বোঝা দায় মেহেলী। যখন যে মাগীর গন্ধ পায়, তখন তার কথাই বলে। তোকে ভুলে গেল না তো সেঙাই? পলিঙর দুচোখে কৌতুক ঝিকমিক করছে।

বুকটা ছাঁত করে উঠল মেহেলীর। তাই তো, পাহাড়ী পুরুষের স্মৃতি। তার স্থায়িত্ব কতখানি? সে তো ঘাসের ফলায় শিশিরের আয়ু। কেলুরি গ্রামেও অনেক কুমারী মেয়ে সুঠাম দেহের রূপ মেলে পুরুষের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, বিভ্রম ছড়ায়। সেই পার্বতী যুবতীদের কেউ কি ডাইনি নাকপোলিবার মন্ত্রপড়া শিকড় দিয়ে বশ করল সেঙাইকে?

কাঁপা গলায় মেহেলী বলল, ওপারে গিয়ে একবার দেখে আসি। সেঙাইর কাছে না পালালে বাপ আমাকে ঠিক খুন করে ফেলবে। একেবারে খতম। সর্দারও বস্তিতে টিকতে দেবে না। তুই একটু দাঁড়া এখানে। আমি কিছুতেই মেজিচিজুঙকে বিয়ে করব না।

পলিঙা বলল, সাবধানে যাবি। ওরা কিন্তু আমাদের বস্তির শত্তুর।

টিজু নদী পেরিয়ে সেই নিঃশব্দ ঝরনাটার পাশে এসে দাঁড়াল মেহেলী। কেউ কোথাও নেই। মনে পড়ল, এখানেই তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল সেঙাই-এর। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল মেহেলী। ঘন বনের ফাঁক দিয়ে যখন জাফরিকাটা বোদ মিলিয়ে গেল, ঠিক তখনই কেলুরি বস্তির দিকে সে পা চালিয়ে দিল।

কর্তব্য স্থির হয়ে গিয়েছে। যেমন করে হোক, সেঙাই-এর সঙ্গে আজ দেখা করতেই হবে। সাঞ্চামখাবার বর্শার খরধার ফলা থেকে, মেজিচিজুঙের বিয়ের বাঁধন থেকে উধ্বশ্বাসে সে পালিয়ে এসেছে সেঙাই-এর আশ্রয়ের আশায়। সেঙাইকে নিয়ে দূর পাহাড়ের উপত্যকায় ঘর বাঁধবে। তার দু’টি বাহুর বেষ্টনীতে মেহেলী এই মুহূর্তে নিরাপদ শান্তি আর স্বস্তি কল্পনা করল। তার জীবনে সেঙাইকে বড় প্রয়োজন, একান্তভাবে সেঙাইকে তার চাই।

খাড়া চড়াই থেকে নিচে নামতে নামতে চেঁচামেচি শুনতে পেল মেহেলী। মানুষের গলা। চট করে সামনের বড় পাথরখানার আড়ালে সে সরে দাঁড়াল।

বাঘনখের আঁচড়ের মতো ফালি ফালি পথের রেখা। সেই পথ ধরে দুলতে দুলতে আসছে একদল মানুষ। তাদের শোরগোলে স্তব্ধ বনভূমি চকিত হয়ে উঠেছে। নিশ্চয়ই এরা কেলুরি গ্রামের লোকজন। বুকের মধ্যে নিশ্বাস আটকে গেল। নিথর হয়ে রইল মেহেলী।

একটা গলা শুনতে পাওয়া গেল, সেঙাইটাকে কোহিমার পথে দিয়ে এলুম সদ্দার। সারুয়ামারুটাও সঙ্গে গেল। কোহিমা থেকে ও ফিরবে তো?

একটা বুড়ো পাহাড়ী, নিশ্চয়ই সে দলপতি, মাথা ঝাঁকাল, হু-হু, ফিরবে। নির্ঘাত ফিরবে। হুই যে গাইডিলিওর কথা বলেছিল সারুয়ামারু, কেমনতরো মেয়ে সে, তাই দেখতেই পাঠালাম। নইলে টাকা দিয়েছে বলে কি সিজিটোর কাছে পাঠাতুম নাকি? শয়তানের বাচ্চা হুই সায়েবরা সারুয়ামারুকে বলে দিয়েছে, আনিজার নামে শুয়োর বলি দিতে দেবে না। আচ্ছা, একবার আমাদের বস্তির দিকে আসে যেন তারা।

কে একজন বলল, সায়েবরা বড় বশ করতে পারে। হুই ডাইনি নাকপোলিবার মতো। সায়েবদের কাছে সিজিটো গেল, সারুয়ামারু গেল-বস্তিতে ফিরে ওরা খালি তাদের কথাই বলে। কী মন্তর যে জানে সায়েবরা! সেঙাইটা কোহিমা থেকে আবার সেরকম না হয়ে ফেরে?

সর্দার মাথা নাড়ল, না না, সেঙাই তেমন ছেলে না।

সেঙাই তবে কোহিমা চলে গিয়েছে! বুকটা ধক করে উঠল মেহেলীর। তা হলে সে এখন কী করবে? কী সে করতে পারে? কোনোক্রমেই নিজেদের বস্তিতে আর ফিরতে পারবে না। সাঞ্চামখাবা তার চামড়া উপড়ে নেবার জন্য বর্শাটাকে নিশ্চয়ই শান দিচ্ছে এখন। আচমকা নিজের অজান্তে তার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল কথাগুলো, সেঙাই, সেঙাই কবে

আসবে?

পাহাড়ীগুলো পাথরখানার সামনাসামনি এসে পড়েছিল। মানুষের গলা শুনে থমকে দাঁড়াল, কে? কে?

তাদের থাবায় বর্শার ফলাগুলো ঝকমক করে উঠল।

একজন বলল, হুই, হুই যে। পাথরের ওধারে–

পাথরের আড়াল থেকে ভীরু গলায় গুঙিয়ে উঠল মেহলী, আমাকে মারিস না, আমাকে মারিস না। আমি মেহেলী, তোদের বস্তির সেঙাই-এর লাগোয়া লেন্য (প্রেমিকা)।

নিমেষে মেহেলীকে চার কিনার থেকে ঘিরে ধরল কেলুরি গ্রামের জোয়ান ছেলেরা। ওঙলে, পিঙলেই, পিঙকুটাঙ, এমনি অনেকে। বুড়ো সর্দার খাপেগাও রয়েছে তাদের মধ্যে।

সেঙাই আজ চলে গেল কোহিমায়। সঙ্গে গেল সারুয়ামারু। ওঙলেরা মাও-এর পথে এইমাত্র তাদের তুলে দিয়ে গ্রামে ফিরছে।

বুড়ো খাপেগা অবাক বিস্ময়ে বলল, তুই-ই মেহেলী!

হু-হু, সেঙাই-এর লাগোয়া লেন। আমাকে মারিস না তোরা। করুণ চোখে তাকিয়ে রইল মেহেলী।

হো-ও-ও-ও-য়া-য়া–তুমুল হুলস্থূল বাধিয়ে দিল মানুষগুলো।

বুড়ো খাপেগা হুমকে উঠল, থাম শয়তানের বাচ্চারা। তারপরেই মেহেলীর দিকে কোমল চোখে তাকাল, না, তোকে মারব না।

ওঙলে বলল, জেঠা, ওকে নিয়ে চল আমাদের বস্তিতে। সেঙাই কোহিমা থেকে ফিরলে বিয়ে দিয়ে দেব।

কে যেন বলল, বেশ বাগে পেয়ে গেছি।

খোঁচা-খাওয়া বাঘের মতো গর্জে উঠল বুড়ো খাপেগা, কি, বাগে পেয়ে ওকে ধরে নিয়ে বিয়ে দিতে চাস? লুেরি বস্তির ইজ্জত ডুবতে দেব না। হু-হু, তেমন সদ্দার আমি নই। লড়াই করে হুই সালুয়ালাঙ বস্তি থেকে ওকে ছিনিয়ে আনব। তারপর বিয়ে হবে। আমাদের কলিজায় রক্ত নেই? লড়াই করতে আমরা ডরাই নাকি?

ঘোলাটে চোখ দুটো রক্তাভ হয়ে উঠেছে বুড়ো খাপেগার। বুড়ো খাপেগা, কেলুরি গ্রামের অতীতকাল সে। আদিম বীরত্বের প্রতীক। বন্য আর পাহাড়ী মানুষদের দলনেতা। বুড়ো খাপেগা তাকাল মেহেলীর দিকে। বলল, তুই তোদের বস্তিতে ফিরে যা। তোদের সদ্দারকে বলিস, তোকে আমরা ছিনিয়ে এনে সেঙাই-এর সঙ্গে বিয়ে দেব। সে যেন ঠেকায়। সেঙাই-এর ঠাকুরদাকে তোরা মেরেছিস। তোদের পোকরি বংশের নিতিৎসুকে আনতে গিয়ে সেদিন আমরা হেরে গিয়েছিলাম। এবার তোকে আনতে যাব। যা মেহেলী, চলে যা। লড়াই করে না আনলে পাহাড়ী মেয়েমানুষের দাম থাকে না। বাগে পেয়ে বিয়ে করবে, সে আবার কেমন পুরুষ!

ঠিক ঠিক। হু-হু– জোয়ান ছেলেরা চেঁচাতে লাগল, মেহেলীকে আমরা ছিনিয়ে আনব সদ্দার। তুই চলে যা মেহেলী।

মেহেলী আকুল হয়ে উঠল। করুণ হল চোখমুখ। বলল, আমি আমাদের বস্তিতে আর ফিরব না সদ্দার। তুই আমার ধরমবাপ, আমাকে সালুয়ালাঙে যেতে বলিস না।

কেন? কী হয়েছে তোদের বস্তিতে? বিস্মিত গলায় জিগ্যেস করল বুড়ো খাপেগা।

আমি বস্তিতে ফিরলে আমার বাপ ছাল উপড়ে নেবে।

কেন?

আমার সঙ্গে হুই নানকোয়া বস্তির মেজিচিজুঙের বিয়ে ঠিক করেছে আমার বাপ। আমি সেঙাইকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না। তাই পালিয়ে এসেছি। কাতর গলায় বলল মেহেলী।

মেজিচিজুঙ! সে তত বাঘ-মানুষ! কী সব্বনাশ! আতঙ্কে ফিসফিস শোনাল বুড়ো খাপেগার গলা, তার সঙ্গে তোকে জুড়ে দিতে চায়!

হু-হু, অনেক বউপণ পাবে কিনা।

একটা আস্ত সাসুমেচু (ভয়ঙ্কর লোভী মানুষ) তো তোর বাপ।

হু-হু, সেই ভয়েই পালিয়ে এসেছি। তোদের বস্তিতে থাকতে দে সদ্দার। নইলে বাপ আমাকে সাবাড় করে ফেলবে। আমি বাপকে বলে এসেছি, সেঙাইকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না।

তাই হবে। তুই চল আমাদের বস্তিতে। তোকে ছিনিয়ে নিতে নিশ্চয়ই তোদের বস্তির সদ্দার আর জোয়ানরা আসবে। তখন লড়াই হবে।

হু-হু। জোয়ান ছেলেরা চারপাশ থেকে সায় দিল। তাদের হাতের থাবায় বর্শার ফলাগুলো ঝকমক করে উঠল। আসন্ন লড়াই-এর উত্তেজনায় তাদের মন, অস্ফুট চেতনা আর ভাবনা ভরে গিয়েছে।

চল এবার, রাত্তির হয়ে আসছে। ঢালু উপত্যকার দিকে নামতে নামতে বুড়ো খাপেগা বলল, যাক, বিনা লড়াইতে তো তোকে নিচ্ছি না। দস্তুরমতো লড়াই হবে তোর জন্যে, না কি বলিস মেহেলী?

সকলের সঙ্গে চলতে চলতে মেহেলী বলল, হু-হু–

.

২৩.

পাহাড়ী অজগরের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা। পাথর কাটা মসৃণ সেই পথ। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, বনময় উপত্যকার মধ্য দিয়ে, বিশাল শিলাস্তূপের বাঁকে বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। পথের বিস্তার দু’দিকেই। মাও থেকে এক দিকে কত শৈলচূড়া পাড়ি দিয়ে সে পথ ছুটে গিয়েছে মণিপুরের দিকে, উত্তর-পশ্চিম কোণে সেই পথই আবার কোহিমা শহরকে ছুঁয়ে ডিমাপুরের দিকে নেমে গিয়েছে, থেমেছে মণিপুর রোড রেল স্টেশনে।

মাও-এর পথে এসে দাঁড়াল সেঙাই আর সারুয়ামারু।

ডান পাশে পাহাড়ের অতল খাদে দোইয়াঙ নদী গর্জে গর্জে ছুটছে। পাথরে পাথরে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে ফুলকি ছড়াচ্ছে নীল জলের ধারা। খাদের ওপর উঁচু ভিতের ওপর দোকানপসার। টিনের চাল, পাথরের মেঝে। বাঁশের মাচানে নানা সম্ভার কমলালেবু, লবণ, সাকা বিড়ি, কঁচি সিগারেট। আর বিরাট বিরাট সব গুদাম-হরিণের ছাল, সম্বরের শিঙ, কস্তুরী, বাঘের ছাল, চিতার দাঁত, হাতির দাঁত দিয়ে বোঝাই। বাঁ দিকে ধাপে ধাপে পাথর কেটে অনেকটা উঁচুতে গোটা তিনেক মণিপুরী হোটেল। টিনের ঘর। সামনে টিনের পাতে মণিপুরী, ইংরেজি, অসমীয়া আর বাংলা হরফে হোটেলগুলোর নাম লেখা রয়েছে।

বাঁ দিকের লবণ আর কমলার দোকানগুলোতে অদ্ভুত ধরনের কতকগুলো মানুষ বসে রয়েছে। অপার বিস্ময়ে এই দোকানপসার, এই অপরিচিত মানুষ, ইম্ফলের দিকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া রহস্যময় পথটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল সেঙাই। অদ্ভুত সব মানুষ। (এর আগে সেঙাই কোনোদিন পাথর কাটা পথ দেখেনি। পাহাড়ী মানুষ ছাড়া এই সব সমতলের মানুষ, যেমন বাঙালি, অসমীয়া হিন্দুস্থানীদের দেখেনি। দেখেনি মণিপুরীদের, শিখদের।) তাদের ভাষা দুর্বোধ্য। আগে কোনোদিন এসব ভাষা শোনেনি সেঙাই। কেলুরি গ্রামে সে সুযোগই বা কোথায়?

ফিসফিস গলায় সেঙাই বলল, এরা সব কোন দেশের মানুষ রে সারুয়ামারু? আমাদের মতো তো নয়।

বিজ্ঞের মতো গম্ভীর শব্দ করে হাসল সারুয়ামারু, হু-হু, এরা হল আসান্যু (সমতলের বাসিন্দা)। খবদ্দার, এদের সঙ্গে কোনোদিন মিশবি না সেঙাই।

কেন?

কেন আবার, ফাদার বারণ করে দিয়েছে। এরা খুব খারাপ লোক।

তাই নাকি?

হু-হু। যেন গূঢ় কোনো খবর দিচ্ছে, মুখখানা এমন গম্ভীর দেখাল সারুয়ামারুর, চল না একবার কোহিমাতে, দেখবি ফাদার সব শিখিয়ে পড়িয়ে দেবে। এই আসান্যুদের মধ্যে বাঙালি আছে, অছমিয়া আছে, হিন্দোস্থানী আছে। ফাদার বলে দিয়েছে, ওরা সব শয়তান। সাবধান সেঙাই। কোহিমাতে গিয়ে ওদের পাল্লায় পড়বি না।

হু-হু। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সেঙাই। তারপর ইম্ফলগামী পথটার দিকে তাকাল, ওটা কী রে? সাপের মতো এঁকে বেঁকে পাহাড়ে গিয়ে উঠেছে। কী ওটা?

ওটা পথ। ইম্ফলের দিকে গেছে।

ইম্ফল! সে কোন দেশ? কতদূর? দুচোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল সেঙাই।

অনেক দূর। কিন্তু পক পক গাড়িতে সকালবেলা চড়লে সন্ধের সময় পৌঁছে দেবে।

আমি যাব ইম্ফলে।

যাবি, যাবি। ইম্ফলে যাবি, শিলঙে যাবি, গুয়াহাটি যাবি। আরো কত জায়গায় যাবি। আগে তো কোহিমা চল। সমানে বকর বকর করে চলল সারুয়ামারু। একটু পরে শুধলো, খিদে পেয়েছে সেঙাই?

হু-হু—

চল হুই মণিপুরীদের হোটেলে খেয়ে নিই। ইম্ফল থেকে পক পক গাড়ি আসতে এখনও দেরি আছে। এমন জিনিস খাওয়াব, জন্মে কোনোদিন খাসনি। সেঙাইর হাত ধরে টানতে টানতে ডান দিকের পাথর কাটা সিঁড়ির দিকে টেনে নিয়ে গেল সারুয়ামারু।

তখনও ইম্ফল-গামী পথটার দিকে, সামনের দোকানপসারগুলোর দিকে, সমতলের মানুষগুলোর দিকে তন্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেঙাই। অপরূপ অদ্ভুত অচেনা এক পৃথিবীর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সে। টিজু নদীর কিনারে বনময় উপত্যকায় কেলুরি, সালুয়ালা, নানকোয়া, জুকুমিচা–এই সব ছোট ছোট গ্রামের বাইরে ইম্ফলে যাবার এমন একটা মসৃণ পথ ছিল, এমন সব দুর্বোধ্য ভাষার কলতান ছিল, তা কি জানত সেঙাই? সমতলের মানুষগুলোর দিকে একবার তাকাল সে। কেমন একটা আকর্ষণ বোধ হচ্ছে ওদের সঙ্গে মিশবার, ওদের কথা শুনবার। কিন্তু না, একটু আগেই তাদের সম্বন্ধে মোহভঙ্গ করে দিয়েছে সারুয়ামারু।

পাথর কাটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল সেঙাই আর সারুয়ামারু। পাশের একটা ঝরনা থেকে রবারের নল দিয়ে জল আনা হয়েছে। নলের বরফশীতল জল ছড়িয়ে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে ছিটিয়ে কালো পাথরের এবড়োখেবড়ো চত্বরটার ওপর ছড়িয়ে পড়ছে। সারুয়ামারু সেই জলে হাত ধুয়ে নিল। সেঙাইকে বলল, মুখটুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নে সেঙাই। এটা শহর, একটু সভ্য হয়ে চলবি। এ তো আর হুই সদ্দারের কেলুরি বস্তি নয়। হু-হু। মাতব্বরি চালে হাসল সারুয়ামারু।

অতিকায় বর্শাটা একপাশে রেখে সারুয়ামারুর কথামতো জলে হাত-পা মুখটুখ ধুয়ে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে নিল সেঙাই। উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। নিচে জানু পর্যন্ত একটি নীল রঙের পী মুঙ কাপড় ঝুলছে।

ঘরের ভেতরে এসে টিনের চেয়ার দেখল সেঙাই, দেখল কাঠের টেবিল। যত দেখছে ততই দু’টি চোখ আর মন বিস্ময়ে ভরে উঠছে। নানা কৌতূহলে ইন্দ্রিয়গুলো আন্দোলিত হচ্ছে। পেতলের থালা আর গেলাস এল। তার ওপর মণিপুরী বামুন ভাত, এরঙ্গু (শুঁটকি মাছের তরকারি) আর সর্ষে পাতার ঝোল জাতীয় খানিকটা দিয়ে গেল। তারপর এল মাগুর মাছ ভাজা।

পরম তৃপ্তিতে সারুয়ামারু সপাসপ ভাতের গ্রাস তুলছে মুখে। আর চুপচাপ ঝকঝকে পেতলের থালা আর গেলাসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সেঙাই।

বিশাল একটা গ্রাস ঠোঁটের কাছে এনে সারুয়ামারু তাকাল সেঙাইর দিকে, কি রে, ভাত খাচ্ছিস না কেন? হুই এরঙ্গু খেয়ে দ্যাখ। বুনো মোষের আধপোড়া মাংসের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক সোয়াদ পাবি।

কিন্তু পেতলের এইসব–বাসনগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল সেঙাই। বলল, এই পেতল দিয়ে তো আমরা নীশে আর নীয়েঙ দুল বানাই, হার বানাই। এতে খেলে আনিজার গোসা হবে না তো?

আরে না, না। একটা ছাগী তুই। সবেতেই খালি আনিজা। পেতল! থু থু! তোদের হুই কেলুরি বস্তিতেই পেতলের দাম আছে। কোহিমায় গিয়ে দেখবি, ওর কোনো দাম নেই। নে নে, খেয়ে নে। এখুনি আবার পক পক গাড়ি এসে পড়বে।

সারারাত উপত্যকা আর মালভূমি, টিলা আর বন এবং অসংখ্য পাহাড়চূড়া উজিয়ে এসেছে দুজনে। দেহের জোড়ে জোড়ে গাঁটে গাঁটে ক্লান্তি যেন আঠার মতো জড়িয়ে রয়েছে। পেটের মধ্যে খিদের ময়াল পাক দিয়ে উঠছে। আচমকা সেঙাই পেতলের থালাখানায় ঝুঁকে পড়ল। নিমেষে শূন্য হয়ে গেল ভাত-তরকারি-মাছ। মণিপুরী বামুন আরো ভাত ঢালল সেঙাই-এর পাতে। তাও শেষে হল।

একসময় খাওয়ার পালা চুকে গেল। তৃপ্তির একটা বিশাল ঢেকুর তুলল সেঙাই, ভালো ভাত রাঁধে তো এরা। আমাদের ভাত একেবারে গলে গলে একশা হয়ে যায়। বস্তিতে ফিরে এমনি করে ভাত পাকাব এবার। কিন্তু এখানে মাংস নেই, মাংস না হলে কি ভাত খাওয়া যায়?

সারুয়ামারু তার জঙগুপি কাপড়ের ভাজ থেকে একটি টাকা বার করতে করতে বলল, মণিপুরীদের হোটেলে মাংস পাওয়া যায় না।

একটু পরে টাকাটা মণিপুরী মালিকের হাতে দিয়ে কিছু খুচরো ফেরত নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল দুজনে। সেঙাই বলল, টাকা দিলি যে?

বা রে, টাকা দেব না! দাম দিতে হবে না? খেলাম যে, তার দাম। এবার বুঝলি তো টাকা দিলে সব মেলে শহরে। টাকার মহিমা সম্বন্ধে নতুন করে এক প্রস্থ বকর বকর শুরু করল সারুয়ামারু।

হু-হু–মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সেঙাই। সে বুঝেছে, টাকার পরমার্থ জলের মতো তার

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

সেঙাই আবার বলতে শুরু করল, কোথায় তোর পক পক গাড়ি, এই সারুয়ামারু? কাল সমস্ত রাত হেঁটেছি, বড় ঘুম পাচ্ছে।

হুই হুই–সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল সারুয়ামারু।

অনেক দূরে পাহাড় কাটা পিচের পথ। আঁকাবাঁকা চড়াই উতরাই। সেই পথের ওপর একটা কালো বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে বাসটাকে। বলা যায়, একটা খারিমা পতঙ্গের মতো সাঁ সাঁ করে ছুটে আসছে।

সারুয়ামারু বলল, হুই–হুই হল পঁক পঁক গাড়ি–

অনন্ত বিস্ময়ে চলমান বিন্দুটির দিকে তাকিয়ে রইল সেঙাই। একসময় পাহাড়ী পথের বাঁকে বাসটা অদৃশ্য হল। তারপর আবার পাহাড় আর বনের ফাঁকে ফুটে উঠল। অনেকটা সময় ধরে বার বার দেখা দিয়ে বার বার পথের নানা বাঁকে মিলিয়ে যেতে লাগল বাসটা। তারপর একটু একটু করে স্পষ্ট হতে হতে মাও-এ এসে থামল।

সারুয়ামারু বলল, আয়, গাড়িতে উঠি—

উঠব? আনিজার গোসা লাগবে না তো? ভীরু চোখে সারুয়ামারুর দিকে তাকাল সেঙাই।

আরে দূর! তুই একেবারে বুনো। হুই বুড়ো সদ্দারের কাছে থেকে থেকে একেবারে অসভ্য হয়ে গেছিস। একটা বিরক্ত ভ্রুকুটি ফুটে বেরুল সারুয়ামারুর চোখে, হুই শয়তান সদ্দারটা ওর জন্যে বস্তির মানুষগুলো বুনোই হয়ে রইল।

আহে ভু টেলো। বাসে উঠতে উঠতে খিঁচিয়ে উঠল সেঙাই, খবদ্দার, সদ্দারকে নিয়ে খারাপ কথা বলবি না সারুয়ামারু। একেবারে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে ফেলব তা হলে।

একটু দমে গেল সারুয়ামারু। চকিতে সেঙাই-এর দিকে তাকাল। আনকোরা পাহাড়ী মানুষ। শহরের রং দিয়ে, শহরের বাহার দিয়ে, চেকনাই দিয়ে, লোভ আর লালসার উত্তেজনা দিয়ে সেঙাইকে মেজে ঘষে নতুন রূপ দিতে, নতুন ছাঁচে ঢালাই করে নিতে সময় লাগবে। মনে মনে সারুয়ামারু পাদ্রী সাহেবদের কথা ভাবল। ওরা ভোজবাজি জানে। ওদের কথায় বার্তায় ব্যবহারে জাদু আছে। সারুয়ামারু জানে, কেমন করে তার মতো ভয়াল পাহাড়ী মানুষকেও পাদ্রী সাহেবরা তীব্র আকর্ষণে কাছে টেনে নিয়েছে। সেঙাইর মতো একদিন সেও এই শহরের রাস্তায় ছিল একেবারেই নতুন।

একটু হাসল সারুয়ামারু, আচ্ছা আচ্ছা, একবার ফাদারের পাল্লায় নিয়ে ফেলি তোকে। তখন তোর এত ফোঁসফোসানি কোথায় থাকে দেখব।

নসু কেহেঙ মাসের দুপুর। ঝকঝকে রোদে আরাম লাগছে।

একসময় বাস চলতে শুরু করল। চাপা চাপা ছোট চোখ, বুকের ওপর থেকে হাঁটুর তলা পর্যন্ত কাপড় বাঁধা কয়েকটা মেয়ে চারপাশে বসে রয়েছে। পাশে বসেছে একদল পুরুষ। তাদের চোখও তেমনি চাপা আর ছোট।

সারুয়ামারু বলল, এরা সব মণিপুরী। হুই ইম্ফল থেকে আসছে।

হু-হু– মাথা নাড়ল সেঙাই। খানিক আগে সারুয়ামারু তাদের চিনিয়ে দিয়েছিল।

তাদের মতো জনকয়েক নাগাও এদিকে সেদিক ছড়িয়ে বসে রয়েছে।

ক্রমাগত বাঁক ঘুরছে বাস। বাঁ দিকে পাথর কাটা পাহাড় উঠে গিয়েছে অনেক উঁচুতে। সেই পাহাড়ের গায়ে নিবিড় অরণ্য। ডান দিকে দশ কি পনেরো হাত চওড়া পথের পর থেকে নিচের অতল খাদে নেমে গিয়েছে জটিল বন।

হঠাৎ ভয় পেয়ে সেঙাই বলল, খাদে পড়ে যাব—

আরে না, না–

অসহিষ্ণু গলায় চিৎকার করে উঠল সেঙাই, আমি নামব, আমি নামব। নামিয়ে দে আমায়। বাসের পাটাতনের ওপর লাফালাফি শুরু করে দিল সে।

গাড়ির ভেতর তুমুল শোরগোল উঠল। সারুয়ামারু দুহাত দিয়ে জোর করে সেঙাইকে নিচে বসিয়ে দিল। হয়তো আরো কিছু ঘটতে পারত, কিন্তু তার আগেই বমি করে ফেলল সেঙাই। বমির দমকে চোখমুখ লাল হয়ে উঠল তার। সারা দেহে আলোড়ন তুলে গোঙানি বেরুচ্ছে, ওয়াক-ওয়াক-ওয়াক—

বাসের দোলানিতে মাথাটা বনবন করে ঘুরছে। পাশ থেকে একটা মণিপুরী মেয়ে মাথায় ফুঁ দিতে লাগল। সারুয়ামারু জড়িয়ে ধরে রইল সেঙাইকে।

বাসটা পাক খেতে খেতে কোহিমার দিকে এগিয়ে চলেছে। সেই সমানে চেঁচাতে লাগল, আনিজা, আনিজা! বস্তিতে ফিরে একটা মুরগি বলি দিতে হবে।

.

২৪.

দুপুর পেরিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এখন রোদে কমলা রঙের আমেজ লেগেছে।

বাস থেকে কোহিমার পথে নামল সেঙাই আর সারুয়ামারু। গাড়ির দোলানিতে আর বমি করে করে কাহিল হয়ে পড়েছে সেঙাই। উজ্জ্বল তামাটে মুখখানা শুকিয়ে গিয়েছে। বাসে তোলার জন্য সারুয়ামারুর ওপর ভীষণ রেগে গিয়েছিল সেঙাই। কিন্তু সমতল থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে এই আকাশছোঁয়া শৈল নগর দেখতে দেখতে দু’টি পিঙ্গল চোখের মণি আবিষ্ট হয়ে গেল। পাহাড়ী মানুষ সেঙাই। বিস্ময়ে আর আগ্রহে সে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছে।

বাসটা তাদের নামিয়ে বাঁ দিকের পথ ধরে এখন চলে যাচ্ছে।

সারুয়ামারু বলল, হুই পক পক গাড়ি ছেড়ে দিল। ডিমাপুরে যাবে। সেখানে আর এক রকম গাড়ি আছে। বড় বড় ঘর, অনেক লম্বা। তার নাম রেলগাড়ি।

আঁকাবাঁকা পথ। উঁচুনিচু। চড়াই আর উতরাই-এর ধারে ধারে পাইনের সারি। পথের দু’পাশে সুন্দর সুন্দর বাড়ি। ওপরে ঢেউটিন কি টালির চাল। ইটের দেওয়াল। বাড়ির সীমানা ছোট ছোট গাছ আর লতাকুঞ্জ দিয়ে ঘেরা।

সেঙাই বলল, এখানকার কেসুঙগুলো ভারি সুন্দর।

হু-হু। এ কি আর তোর কেলুরি বস্তির কেসুঙ। এ হল শহর কোহিমা। সারুয়ামারু হাসল। এই শহরের যত মহিমা, যত গৌরব, যত মাধুর্য সব যেন সারুয়ামারুর সেই হাসিতে ফুটে বেরুল। এই শহরের মহিমায় যেন তারও একটা গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে।

অনেক পথ, অনেক বাঁক, অনেক বিচিত্র মানুষের জটলা, অনেক দুর্বোধ্য কোলাহল পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সেঙাই আর সারুয়ামারু।

সেঙাই বলল, তোর হুই গাড়ি-আনিজার নামে বস্তিতে ফিরে একটা মুরগি বলি দেব।

চুপ, চুপ।

চুপ কেন রে শয়তানের বাচ্চা? সেঙাইর দুটো ছোট ছোট চোখ জ্বলতে লাগল।

এটা তোর কেলুরি বস্তি নয়। এটা হল কোহিমা শহর। তোর হুই মুরগি বলি দেবার কথা শুনতে পাবে ফাদার। ফিসফিস গলায় বলল সারুয়ামারু, হুই দ্যাখ, হুই যে পুলিশ। ওদের হাতে বন্দুক রয়েছে। এক গুলিতে সাবাড় করে দেবে। অমন কথা আর বলিস না।

সামনের দিকে তাকাল সেঙাই। চোখে পড়ল পরিষ্কার সুদৃশ্য একটি বাড়ি। ওপরে ঢেউটিনের চাল। চারপাশে নানা রঙের অচেনা বাহারি ফুল ফুটে রয়েছে। সামনে নিরপেক্ষভাবে ছাঁটা ঘাসের জমি। সেই ঘাস সবুজ, কোমল আর সতেজ।

দরজার সামনে বিরাট জটলা। পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢোলা সাদা কাপড় পরেছে কেউ কেউ। (এর আগে সারপ্লিস দেখেনি সেঙাই)। আচমকা সেঙাইর চোখ দুটো কতকগুলো মানুষের মুখের দিকে আটকে গেল। গায়ের রং ধবধবে সাদা। নীল চোখ। তাদের ঘিরে ধরেছে অনেক পাহাড়ী মানুষ। আর একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরো কয়েকটা লোক। তাদের সকলের একই রকম পোশাক, হাতে একই রকমের বন্দুক। (একটু আগেই বন্দুকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সারুয়ামারু)।

সারুয়ামারু বলল, ওরা হলো আসা (সমতলের লোক)। দেখছিস না বন্দুক হাতে রয়েছে। ফাদার বলে, ওরা ভারি শয়তান। আমাদের পাহাড়ী মানুষদের ওরা বড় মারে।

হু-হু–মারলেই হল! বর্শা দিয়ে কুঁড়ে ফেলব না।

চুপ, চুপ–

হঠাৎ ঘাসের জমির ওপাশ থেকে একটা খুশি খুশি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আরে সারুয়ামারু যে। এসো, এসো–

মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ল। ধবধবে সাদা রং। তাজ্জব বনে গেল সেঙাই। তাদের ভাষা কী চমৎকারই না রপ্ত করেছে বিস্ময়কর লোকটা।

সারুয়ামারু বলল, গুড নাইট ফাদার—

হা হা করে হেসে উঠল পাদ্রীসাহবে, নাইট কোথায়? এখনও তো বিকেল হতে অনেক দেরি।

থতমত খেয়ে চুপ করে রইল সারুয়ামারু। যে ইংরেজি শব্দ দু’টি সগৌরবে সে সঞ্চয় করে রেখেছিল এবং যার জন্য তার রীতিমতো গর্ব ছিল, তার প্রয়োগে এত বড় ভুল হয়ে যাবে, এ কী জানত সে?

হু-হু, মাথা নাড়ল সারুয়ামারু।

পাদ্রীসাহেব সেঙাইকে দেখিয়ে জিগ্যেস করল, এ কে সারুয়ামারু?

এ হল সঙাই। তোর কাছে যে সিজিটো কাজ করে, তার ছেলে। সেঙাইকে এখানে নিয়ে এলাম ফাদার। সোজাসুজি পাদ্রী সাহেবের দিকে তাকাল সারুয়ামারু।

বাঃ, ভালো ভালো। এসো সেঙাই, এসো।

তিনজনে ঘাসের সবুজ জমিটায় চলে এল। একপাশে কাঠের ক্রস খাড়া হয়ে রয়েছে। ঝকঝকে সাদা রং। মানবপুত্র একদিন ক্রুশবিদ্ধ তার হয়ে পুণ্যশোণিতে এই পাপময় পৃথিবীকে স্নান করিয়েছিলেন। এই ক্রস তারই পবিত্র স্মরণচিহ্ন।

বিকেলের রং আরো ঘন হয়েছে। পশ্চিমের পাহাড়চূড়ায় স্থির হয়ে রয়েছে সূর্যটা। বিকেলের সূর্য, রক্তলাল।

কাঠের একটা বেঞ্চের ওপর জাঁকিয়ে বসেছে সারুয়ামারু। সেঙাইর দিকে তাকিয়ে সে বলল, বোসো সেঙাই।

একপাশে বর্শাটা রাখতে রাখতে সেঙাই বলল, বসব?

হু-হু। এটা তো বসবার জন্যেই। তুই কিছুই জানিস না। এটা কেলুরি বস্তি নয়। হু-হু–এটা কোহিমা শহর। শহরের আদবকায়দা সম্বন্ধে আর একবার জ্ঞান দান করল সারুয়ামারু।

ইতিমধ্যে একখানা চেয়ার এনে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে পাত্রীসাহেব। তার সঙ্গে এসেছে একটা পাহাড়ী চাকর। চাকরটার হাতে নানা ধরনের কাপড় আর অনেক রকমের খাবার। পাদ্রীসাহেব চাকরটার হাত থেকে খাবার আর কাপড়গুলো তুলে নিয়ে সেঙাইর দিকে বাড়িয়ে দিল, এই নাও সেঙাই। এগুলো তোমাকে দিলাম। কাপড় পরবে আর খাবারগুলো খাবে। কেমন?

বেঞ্চের ওপর বসে পড়েছিল সেঙাই। তার একেবারে স্পর্শের সীমানায় অদ্ভুত এক মানুষ। ধবধবে গায়ের রং। চোখের মণি নীল। পাহাড়ী সেঙাই-এর কাছে এই মুহূর্তে এই পাদ্রীসাহেবটি বড় অবিশ্বাস্য মনে হল। মনে হল, বেলাশেষের এই হলুদ রোদে কোহিমা শহরের এই সবুজ ঘাসজমি থেকে পাদ্রীসাহেব এক ভোজবাজিতে যে-কোনো সময় মিলিয়ে যেতে পারে। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে তাকে।

পাত্রীসাহেব সস্নেহে বলল, নাও সেঙাই। লজ্জা কী?

এবার সারুয়ামারুর দিকে তাকাল সেঙাই। পাদ্রীসাহেবের দেওয়া উপহার নেবে কি নেবে, বুঝে উঠতে পারছে না। সারুয়ামারু প্রেরণা দিতে শুরু করল। উৎসাহ দেবার সুরে বলল, নে, নে সেঙাই। ফাদার ভালোবেসে দিচ্ছে। এমন কাপড় জন্মেও দেখিসনি। এমন খাবার। কোনোদিন খাসনি।

কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে একটা হাত বাড়িয়ে কাপড় আর খাবার নিল সেঙাই। তারপর ফিসফিস করে পাত্রী সাহেবকে বলল, সম্বরের ছাল আনিনি, বাঘের দাঁত আনিনি, বর্শা আনিনি। কিছুই তো আনতে দিল না সারুয়ামারু। কী দিয়ে বদল করব?

কিছু দিতে হবে না। সাদা মুখখানার ওপর অপরূপ হাসি ছড়িয়ে পড়ল পাদ্রীসাহেবের। পরম বাৎসল্যে চোখ দুটো তার ভরে গিয়েছে, আমি এগুলো তোমাকে খুশি হয়ে দিলাম। আমাকে ফাদার বলে ডাকবে, বুঝলে?

হু-হু। ডাকবে বৈকি। সেঙাই-এর হয়ে সায় দিল সারুয়ামারু। দস্তুরমতে তৎপর হয়ে উঠেছে সে। বেঞ্চ থেকে উঠে পাদ্রীসাহেবের গা ঘেঁষেঅন্তরঙ্গ হয়ে দাঁড়াল। বলল, একশো বার ডাকবে ফাদার বলে।

সেঙাই বলল, আমার বাপ আর মা কই?

সিজিটো আর তার বউ তো?

হু-হু।

তারা গ্রিফিথ সাহেবের সঙ্গে গুয়াহাটি গিয়েছে। দু-চার দিন বাদে ফিরবে। তুমি এই চার্চে থাকো কয়েকদিন। ওরা ফিরলে দেখা কোরো। এবার পাদ্রীসাহেব তাকাল সারুয়ামারুর দিকে, তারপর তোমাদের বস্তির খবর কী সারুয়ামারু? আমরা যে একবার যাব তোমাদের গ্রামে। সদারকে বলেছ?

সারুয়ামারুর মুখেচোখে বিষাদ ঘনিয়ে এল, বলেছিলাম। কিন্তু সদ্দার রাজি হচ্ছে না একেবারেই।

টাকা দেব অনেক।

তাতেও রাজি নয়। সেঙাইকে জিগ্যেস করে দ্যাখ।

পাদ্রীসাহেবের সারা মুখে হাসির আলো ছড়িয়ে ছিল। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো হাসিটিও যেন তার সঙ্গে জন্ম নিয়েছে। সারুয়ামারুর কথাগুলো শুনতে শুনতে হাসি মুছে গেল। এতক্ষণ বোঝা যায়নি, এবার মনে হল, পাদ্রীসাহেবের সাদা মুখখানা ঘিরে মাকড়সার জালের মতো অজস্র কালো কালো রেখার আঁকিবুকি। যেন কতকগুলো সরীসৃপ কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। শান্ত সুন্দর পবিত্র মুখখানার আড়াল থেকে একটা ভয়ঙ্কর মুখ কালো কালো রেখার টানে ফুটে বেরুচ্ছে। একটু আগের স্নিগ্ধ মুখখানার সঙ্গে এ মুখের বিন্দুমাত্র মিল নেই।

গম্ভীর মুখে পাদ্রীসাহেব বলল, হু। তারপর মনে মনে একটা অ-মিশনারিসুলভ গালাগালি আউড়ে সঙ্গে সঙ্গে কপাল-বুক বাহুসন্ধি ছুঁয়ে ক্রস করল। আশ্চর্য সংযম। সে খিস্তিটা জিভ থেকে পিছলে সেঙাইদের কান পর্যন্ত পৌঁছুল না। অবশ্য পৌঁছুলেও বিশেষ কোনো আশঙ্কার হেতু থাকত না। কারণ শব্দগুলো বিশুদ্ধ ইংরেজি। সেঙাইদের কাছে নিতান্তই দুর্বোধ্য।

পাদ্রীসাহেব এবার কটমট করে তাকাল সারুয়ামারুর দিকে, কেন, কী জন্যে তোমাদের বস্তিতে যেতে দেবে না সর্দার?

আমি বললাম, ফাদার মুরগি-শুয়োর বলি দিতে দেবে না। ক্রস আঁকতে হবে, যীশু-মেরী বলতে হবে–তাতে সদ্দার রাজি নয়। আমাকে তো বর্শা নিয়ে তেড়ে উঠেছিল। আর শাসিয়ে দিয়েছিল, তোর ফাদার বস্তিতে এলে জান নিয়ে ফিরতে হবে না। অপরাধী গলায় কথাগুলো বলে চুপ করে গেল সারুয়ামারু।

হু-হু–ঘন ঘন মাথা দোলালো সেঙাই। ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে। বলল, হু-হু, আমাদের বস্তিতে হুই সব চলবে না। সদ্দার বলে দিয়েছে, সিধে কথা।

তির্যক চোখে একবার সেঙাইকে দেখল পাদ্রীসাহেব। তারপর সারা মুখ থেকে মাকড়সার জালটাকে মুছে ফেলল। কী এক মহিমায় হাসির চেকনাই ফুটিয়ে বলল, আচ্ছা আচ্ছা, সেসব কথা পরে হবে। এখন খাবার খাও। এতটা পথ এসেছ, অনেক কষ্ট হয়েছে। এই সারুয়ামারু, তুমি সেঙাইকে সিজিটোর ঘরে রেখে এসো। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।

সেঙাইকে নিয়ে সারুয়ামারু ডান দিকের পাথুরে পথটা ধরল।

বেতের চেয়ারখানায় বসে পাদ্রীসাহেব ভাবতে লাগল। এই পাহাড়ী পৃথিবী। ইনফিডেল আর আইডোলেট্রির দেশ। ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে পথে কেটে কেটে ক্রিশ্চানিটির আলোকিত রাজপথে এদের তুলে নিয়ে যেতে হবে। সে মিশনারি। অল্পে বিচলিত হলে চলবে না। এই পাদ্রী জীবনের নেপথ্যে যে তার একটি ভয়াল জীবন ছিল, সেই জীবনের ধূসর বাঁকে বাঁকে সব অসংযম, সব বিভ্রান্তি, সব উত্তেজনাকে নির্বাসন দিয়ে আসতে হয়েছে। সন্স অব সিনার্সদের এই পঙ্কিল পৃথিবীতে একটি শ্বেতপদ্ম ফুটিয়ে তুলবে সে, ফুটিয়ে তুলবে একটি ধ্রুবলোক। সেই শ্বেতপদ্মের নাম, সেই ধ্রুবলোকের নাম হল যীশু। নিজের রক্তে পৃথিবীর সব গ্লানি, সব অপরাধ তিনি শোধন করে দিয়ে গিয়েছিলেন।

পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি ভাবল, এত বড় লক্ষ্য নিয়ে যে এখানে এসেছে, তার অন্তত সহজে উত্তেজিত হওয়া চলে না।

একটু আগে বিড় বিড় করে একটা কদর্য গালাগালি উচ্চারণ করেছিল, সেজন্য এখন অনুতাপ হচ্ছে কি? স্নায়ুগুলো পীড়িত হচ্ছে? একটি মাত্র কর্তব্যের প্রেরণায় সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়ার এই পাহাড়ে এসে উঠেছে। এক গোলার্ধ থেকে একেবারে অন্য এক গোলার্ধে। বেথেলহেমের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে এই দেশের আকাশে স্থির করে রেখে যেতেই এই পাহাড়ে অরণ্যে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানবপুত্রের কল্যাণময় নামকে এদেশের মানুষগুলোর শিরায় শিরায় রক্তকণার মতো ছড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই।

ভাবনাটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল পাদ্রীসাহেবের। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সারুয়ামারু। পাদ্রীসাহেব বলল, সিজিটোর ঘরে রেখে এসেছ তো সেঙাইকে?

হু-হু।

বোসো। তারপর বল তোমাদের বস্তির খবর কী? অনেকদিন তোমাকে বলেছি। এবার সেখানে আমার যাওয়ার একটা ব্যবস্থা কর। শুধু শুধু রক্তারক্তি হবে, এ আমি চাই না। আমি মিশনারি। অনেক টাকা দেব তোমাদের। যা চাও, সব মিলবে। খালি তোমাদের খ্রিস্টান হতে হবে। একটু থামল পাদ্রীসাহেব। খানিক বাদে ফের বলতে শুরু করল, যাক, এর মধ্যে শুয়োর বলি দাওনি তো? ক্রস এঁকেছ? যীশু-মেরীর নাম জপেছ?

সারুয়ামারু বলল, হু-হু, সব করেছি। তবে লে কেফু মাসে সূর্যের নামে একটা মুরগি বলি দিয়েছিলাম।

নাঃ! সংযমকে আর বাঁধ দিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ধৈর্য প্রশান্তি সহিষ্ণুতা, এগুলোর একটা সীমা আছে। এই পাপাচারী পাহাড়ীগুলোর বিবেক বলে কি আউন্সখানেক পদার্থও নেই! তোতাপাখির মতো সে এই সারুয়ামারুকে পড়িয়েছে। আনিজার নামে কোনো প্রাণীহত্যা করা চলবে না। দু’টি বছর ধরে এই বুনো শয়তানের মনটাকে কত কসরতে, কত যত্নে এই প্যাগান পৃথিবী থেকে বেথেলহেমের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে পাদ্রীসাহেব। কিন্তু পাদ্রী হলেও সে মানুষ তো। ছটা রিপুর স্লেভ। চাপা গলায় তর্জন করে উঠল, ডেভিলস, সন্স অব বিচ

পাদ্রীসাহেবের গালাগালির মহিমা আছে। এত আস্তে, মুখের রেখাগুলিকে এতটুকু বিকৃত না করে গালাগালিটা সে উচ্চারণ করে, যাতে মনে হয় বুঝিবা পবিত্র প্যারাবল্ আওড়াচ্ছে।

ঠিক এমন সময় এল আর একজন মিশনারি। তার দিকে তাকিয়ে পাত্রীসাহেব উত্তেজিত হয়ে উঠল, এই যে পিয়ার্সন, দেখ–জাস্ট সী–এত করে বুঝিয়েছি, তবু ঠিক আনিজার নামে একটা মোরগ বলি দিয়ে বসে আছে। এত টাকা খরচ, এত পরিশ্রম জলে যাচ্ছে। এই বুনন পাহাড়ে এক্সাইলড হয়ে থাকার তবে অর্থ কী, একটা লোকও যদি ঠিকমতো ব্যাপটাইজড না হল!

মেজাজটা একেবারে খিঁচড়ে গিয়েছে পাদ্রীসাহেবের। বার বার তার সোনাবাঁধানো গজদাঁতটা আত্মপ্রকাশ করতে লাগল। পাদ্রীসাহেব দুজন কী এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সারুয়ামারু। ওদের ভাবগতিক বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। সারুয়ামারু কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।

পিয়ার্সন মিটিমিটি হাসছিল। মাত্র কিছুদিন আগে কোহিমা শহরে এসেছে। বছর পঁচিশ বয়স। সোনালি চুল বাতাসে উড়ছে। চোখের ঘন নীল মণিতে মহাসাগরের আভাস। থরে থরে পেশী বুক তার বাহুসন্ধির দিকে উঠে গিয়েছে। সারা দেহের ওপর সাদা সারপ্লিসটা যেন বড় বেমানান, বড় বেখাপ্পা দেখায়। সাড়ে ছ ফিট লম্বা একটা ঋজু দেহ। মেরুদণ্ডটা সরলরেখায় মাথার দিকে উঠে গিয়েছে। কোহিমার পাহাড়ে অরণ্যে, মিশনারির নিরুত্তেজ জীবনের ভূমিকা তার কাছে যেন কৌতুকের অভিনয়মাত্র। মনে হয়, ওই সাদা সারপ্লিসটার মতোই এই জীবনটাকে ঝেড়ে ফেলে আকাশ ফাটিয়ে হো হো করে হেসে উঠতে পারে পিয়ার্সন। ইংলন্ডের কোনো এক ডিউক পরিবারের ছেলে সে। কী এক দুর্বোধ্য খেয়ালে, কী এক দুর্নিবার কৌতুকে মশগুল হয়ে চার্চে চলে গিয়েছিল। কেন্দ্রিজ য়ুনিভার্সিটি থেকে সরাসরি চার্চের অলটার। সেখান থেকে মহাসমুদ্রের একটা উদ্দাম ঢেউয়ের মতো আছড়ে এসে পড়েছে কোহিমার পাহাড়ে।

এখনও সমানে মিটিমিটি হেসে চলেছে পিয়ার্সন।

এবার বিরক্ত গলায় পাদ্রীসাহেব বলল, হোয়াট ডু য়ু মীন–হাসছ কেন? সিরিয়াস ব্যাপারে হাসি ভালো না পিয়ার্সন।

আই অ্যাডমিট মিস্টার ম্যাকেঞ্জি। হাসিটা আঠার মতো এখনও আটকে রয়েছে পিয়ার্সনের পুরু রক্তাভ ঠোঁটে।

ভ্রূ দুটো কাঁকড়াবিছার মতো কুঁকড়ে গেল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির। বলল, তোমাকে অনেকবার বলেছি, আমাকে ফাদার বলে অ্যাড্রেস করবে। এটা চার্চের নিয়ম। বাট সরি টু ওয়ার্ন–তুমি সে নিয়ম মানছ না।

পারডন। আর এমনটি হবে না। হাসিটা এখনও স্থির হয়ে রয়েছে পিয়ার্সনের ঠোঁটে।

ম্যাকেঞ্জি স্থির দৃষ্টিতে পিয়ার্সনের দিকে তাকাল। ভাবখানা, ভবিষ্যতে দেখা যাবে। বলে উঠল, তুমি বিশেষ কাজকর্ম করছ না। প্রিচিঙ-এর জন্যে এত টাকা খরচ হচ্ছে এই পাহাড়ে। তোমার সেদিকে খেয়াল নেই। তুমি খালি পাহাড়-পর্বত আর ফলস্ দেখে বেড়াচ্ছ।

মুগ্ধ গলায় পিয়ার্সন বলল, বাট ইউ মাস্ট অ্যাডমিট, ভারি সুন্দর এই নাগা পাহাড়।

একটা ভ্রুকুটি ফুটে বেরুল ম্যাকেঞ্জির মুখে, ভুলে যেয়ো না পিয়ার্সন, ইউ আর নট আ পোয়েট, বাট আ মিশনারি। কাব্য করার জন্যে এখানে তুমি নিশ্চয়ই আসোনি। এই তো এতদিন এসেছি আমরা, একটা খাঁটি ক্রিশ্চান করতে পেরেছি! ডেটারমিনেশন থাকা উচিত আমাদের।

আক্ষেপ করে একটু থামল ম্যাকেঞ্জি। এই আক্ষেপ আর থামার মধ্যে যেন আত্মদর্শন হল তার। তারপরেই বলতে শুরু করল, তোমার আর কী। ডিউক ফ্যামিলির ছেলে। একটা হুইমের ঝোঁকে এ লাইনে এসে পড়েছ। ভালো না লাগলে ছেড়ে পালাবে। কিন্তু আমরা এসেছি একটা ইন্সপিরেশনের তাড়নায়, একটা ভিসনের প্রেরণায়। ক্রিশ্চানিটির আলো দিয়ে পৃথিবী থেকে প্যাগানদের আর আইডোলেট্রিকে ভাগাতে হবে। আর একটা ডেলুজ আসার আগেই আমাদের কর্তব্য হল পৃথিবীকে শুদ্ধ করে নেওয়া। ইট জি নিদার আ হুইম নর আ গেম অব একসেনট্রিসিটি। এর নাম সাধনা। মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিতে হবে। টু রিডিম—

হঠাৎ গম্ভীর হল পিয়ার্সন। থমথমে গলায় বলল, কিন্তু আমার মনে হয় এ প্রিচিঙের কোনো দাম নেই, কোনো প্রয়োজন নেই। নিজেদের ধর্মের মধ্যেই এদের বাড়তে দেওয়া উচিত। তা হলেই যথেষ্ট উপকার করা হবে। আমার তো এই কদিন পাহাড়ে ঘুরে আর এই পাহাড়ীদের দেখে দেখে তাই মনে হল।

কানের ওপর যেন খানিকটা তরল সীসা ঢেলে দিয়েছে কেউ। প্রায় আর্তনাদ করে উঠল ম্যাকেঞ্জি, বলছ কী পিয়ার্সন! আমরা লোকের উপকারই করি। এতটা ফিলানথ্রপি কিন্তু বরদাস্ত করা যায় না। তা ছাড়া, এই মানুষগুলো শয়তানের শিকার হয়ে থাকবে! জানো তো, ব্রিটিশ রাইফেল যেখানে গেছে সেখানেই বাইবেল গিয়ে হাজির হয়েছে। রাইফেল-বাইবেলে মিলন না হলে পৃথিবীজোড়া রাজ্য করা সম্ভব হত আমাদের?

আপনি কী বলছেন ফাদার! আমরা মিশনারি, আমাদের সঙ্গে রাজ্য জয়ের সম্পর্কটা কী! বিস্ময়ে গলাটা যেন চৌচির হয়ে ফেটে পড়ল পিয়ার্সনের।

ঠিক যে দৃষ্টি দিয়ে দেখছ, তার উলটো দিকে থেকে ভাবতে হবে। আমরা আগে ব্রিটিশার, তারপরে মিশনারি। এটা ভুলো না।

থতমত খেল পিয়ার্সন। বলে কী ম্যাকেঞ্জি! সেসব এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। কেস্ট্রিজ য়ুনিভার্সিটির বিশাল চত্বর কাঁপিয়ে যখন তার সাড়ে ছ ফিট দীর্ঘ ঋজু দেহটা হাঁটত তখন মিশনারি জীবন সম্বন্ধে ধারণা অন্যরকম ছিল পিয়ার্সনের। শুদ্ধাচারে মানবপ্রেমে সে জীবন অপরূপ, ক্ষমাসুন্দর। মিশনারির মন, ভাবনা, ধারণা হবে ব্যাপক, উদার এবং পক্ষপাতহীন। মিশনারির পরিচয় হল মিশনারি। আর কিছু নয়। কিন্তু কোহিমার পাহাড়ে এসে মোহভঙ্গ হচ্ছে। পিয়ার্সনের। কাঁচের বাসনের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে তার এতদিনের লালিত মিশনারি জীবনের সংজ্ঞাটা।

কঠিন গলায় পিয়ার্সন বলল, কিন্তু অপরের ধর্মে হাত দেওয়াটা কী ঠিক? সে আর এক ধরনের ইম্পিরিয়ালিজম।

নাঃ! কতক্ষণ আর সংযত হয়ে থাকা সম্ভব! হোক সে মিশনারি। ছয় রিপুর একটি মনের মধ্যে তুমুল হয়ে উঠল। ম্যাকেঞ্জির ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। এই মুহূর্তে তার দুচোখে ভয়ানক এক ছায়া দেখল পিয়ার্সন।

মিশনারি! তাদের বাদবিতণ্ডা কিছুই বুঝতে পারছে না সারুয়ামারু। তবু তার মনে হল, বুনো বাঘকে নিরীহ হরিণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় যেমন দেখায় ঠিক তেমনই দেখাচ্ছে। বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জিকে। দেখতে দেখতে ভয়ে সে আড়ষ্ট হয়ে গেল।

একটু পরে ম্যাকেঞ্জি আর পিয়ার্সনের অজান্তে একপা দু’পা করে সিজিটোর ঘরের দিকে চলে গেল সারুয়ামারু।

তীক্ষ শাসানির গলায় ম্যাকেঞ্জি বলল, সেটা তোমার দেখবার কথা নয় পিয়ার্সন। না পোষালে তোমাকে হোমে পাঠিয়ে দিতে হবে। ইউ আর নো ডাউট, আ ভেরি ডেঞ্জারাস এলিমেন্ট। তোমাকে সাবধান করতে বাধ্য হচ্ছি, এসব ব্যাপার নিয়ে, এ জাতীয় কথা বলে পাহাড়ী মানুষগুলোকে বিষাক্ত কোরো না। এর রি-অ্যাকশন খুব খারাপ। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষেও ক্ষতিকর। তুমি ছেলেমানুষ, এখনও সমঝে চল। আগুন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না।

থ্যাঙ্কস। চেষ্টা করব আপনর কথামতো চলতে।

ম্যাকেঞ্জির মনে হল, বিদ্রূপ করে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করল পিয়ার্সন। মনে হল, একরাশ তাচ্ছিল্য বুলেটের মতো এসে বিঁধল চোখেমুখে।

সামনের গেটে কাঁচ করে শব্দ হল। সেই সঙ্গে একজোড়া ভারী বুটের সদর্প আওয়াজ। এতক্ষণ মুখখানা একটা প্যাচার মতো কুটিল, ভয়ানক আর গম্ভীর হয়ে ছিল। হঠাৎ দম-দেওয়া পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠল ম্যাকেঞ্জি। হাসল। বলল, গুড ডে মিস্টার বসওয়েল। আসুন, আসুন।

সাদর অভ্যর্থনায় গদগদ হয়ে উঠল ম্যাকেঞ্জি।

গুড ডে ফাদার। উদ্ধত বুট জোড়া পাথরের ওপর খট খট শব্দ করতে করতে সামনে এসে পড়ল।

মিস্টার বসওয়েলের মুখখানা বিরাট আর ভয়ঙ্কর। উদ্ধত চোয়াল সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আছে। দু’টি কপিশ চোখ। ভুরুর রোমশ মাংস চোখ অনেকটা ঢেকে রেখেছে। কপালের অজস্র ক্ষতচিহ্ন মুখটাকে ভীষণ করে তুলেছে। সামনের বেঞ্চখানায় বসতে বসতে বসওয়েল বলল, সাম্প্রতিক খবর ফাদার। সারা ভারতবর্ষে আন্দোলন শুরু হয়েছে। দ্যাট গ্যান্ডি হাফ-নেকেড ম্যান, লোকটা জাদু জানে। একেবারে ভেলকি লাগিয়ে দিয়েছে। ইন্ডিয়ার মাটি থেকে ব্রিটিশ রুল ওভারথ্রো করে ছাড়বে, এমন মতলব। নেটিভগুলো খেপে উঠেছে।

কী সর্বনাশ! চমকে সটান খাড়া হল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি, এখানকার খবর কী? আপনি তো পুলিশ সুপার। কোনো গণ্ডগোল হবে না তো?

একটু হাসল মিস্টার বসওয়েল। সেই হাসি তার বিশাল মুখখানায় ভয়াল ক্রুরতা ফুটিয়ে তুলল, সেই জন্যেই তো আসা। আমি জানি কেমন করে এই আন্দোলনকে রাইফেলের মুখে উড়িয়ে দিতে হয়। সারা ইন্ডিয়ার অ্যাজিটেশন ঠাণ্ডা করতে চারটে ঘণ্টাও পুরো লাগে না। ওনলি ইন্ডিসক্রিমিনেট ফায়ারিং। যাক, যে কথা বলতে এসেছি ফাদার, আপনার খানিকটা হেল্প চাই–

সার্টেনলি–বলুন—

দেখুন, প্রথম প্রথম রক্তারক্তি আমি চাই না। তবে প্রয়োজন হলে–আমিও ফার্স্ট গ্রেট ওয়ার-ফেরত লোক। ইফ নেসেসিটি কমপেলস–তা হলে এই পাহাড়ীদের দাঁড় করিয়ে ওদের ওপর আমি বেয়োনেট প্র্যাকটিশ করাব। পুলিশ সুপার মিস্টার বসওয়েল প্রথম মহাযুদ্ধ ফেরত ক্যাপ্টেন। মেসোপটেমিয়া আর পানামা ক্যানেলের ওপর অজস্র রক্ত ঝরতে দেখেছে। অন্তত মানুষের প্রাণের জন্য তার মনের কোথায়ও একবিন্দু করুণা কি স্নেহ আছে, এমন একটা অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। মানুষের রক্তে রক্তে, মেশিনগান আর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গানের গর্জনে প্রথম মহাযুদ্ধ তার মন থেকে স্নেহ মমতা ভালোবাসা দয়া প্রীতি নামে ললিত বৃত্তিগুলিকে বাষ্পের মতো উড়িয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে একটা রাক্ষসের মতো দেখাচ্ছে বসওয়েলকে। তার মুখখানা ঝুঁকে পড়ল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির কানে, আই অ্যাডমিট ফাদার। ওই হাফ-নেকেড গ্যান্ডির ক্ষমতা আছে। পাহাড়-বন ডিঙিয়ে নন-কো-অপারেশনের ঢেউ এসে পড়েছে এই কোহিমা শহরে। বাট, আই অ্যাম বসওয়েল। ফার্স্ট গ্রেট ওয়ার আমি দেখেছি। ম্যাসাকার, ডেস্ট্রাকশন, আউটরেজ–এগুলোর মধ্যে আমি আনন্দ পাই, আমার স্পোর্টিং স্পিরিটকে খুঁজে পাই। অন্তত আমার কোনো সফটনেস নেই। থাকতে পারে না। দরকার হলে–

কথা শেষ না করেই গর্জে উঠল বসওয়েল।

একপাশে একটা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে পিয়ার্সন। সেদিকে এতটুকু নজর নেই। আশঙ্কায় থর থর কাঁপছে ম্যাকেঞ্জির গলা, ইয়েস, গ্যান্ডির নাম আমি শুনেছি, লোকটা সত্যি জাদু জানে। কিন্তু এই কোহিমা শহরে হঠাৎ কী হল মিস্টার বসওয়েল?

যা হবার হয়েছে। এই আনসিভিলাইজড ওয়াইল্ড পাহাড়ীগুলো পর্যন্ত কনশাস হয়ে উঠেছে। ওই যে ছুকরি গাইডিলিও, দ্যাট উইচ গ্যান্ডির কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে পাহাড়ীগুলোকে খেপিয়ে তুলছে। আর একটু ল্যাটিচ্যুড আমি দেব। আর একটু দৌড় আমি দেখব। তার হাতের মোটা রোমশ আঙুলগুলো বাতাসে কী যেন আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। বার বার বিরাট, কঠিন মুঠিটা পাকিয়ে পাকিয়ে আসছে। হয়তো গাইডিলিওর কল্পিত মুণ্ডুটা গুড়ো হয়ে যাচ্ছে তার মুঠির মধ্যে, আমি অবশ্য কড়া নজর রেখেছি, যাতে প্লেনসম্যানরা এখানে এসে এই পাহাড়ীদের তাতিয়ে তুলতে না পারে। কোহিমার ওপাশে ডিমাপুরের দিকে রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে দিয়েছি। একটু থেমে বসওয়েল বলল, আপনাকে এটা কাজ করতে হবে ফাদার–

উৎসুক চোখে তাকাল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি, কী কাজ?

ওই গাইডিলিওর অনেক ফলোয়ার, অনেক ভক্ত। উইচক্র্যাফট দেখিয়ে অনেক লোক দলে জুটিয়ে নিয়েছে শয়তানীটা। যেমন করে গোপন মন্ত্রদান করা হয় ঠিক তেমন ভঙ্গিতেই। ফিসফিস গলায় কথাগুলো বলল মিস্টার বসওয়েল। পাদ্রীর কানে নতুন ধরনের প্যারা আওড়াল, আপনারও তো অনেক ব্যাপটাইজড নাগা আছে।

আছে।

আপনি তাদের দিয়ে রটিয়ে দিন, গাইডিলিও একটা ডাইনি। গ্রামে গ্রামে হেডম্যানদের হাত করে নিতে হবে। যত টাকা দিতে হয় গভর্নমেন্ট কসুর করবে না। এই অ্যাজিটেশন ভেঙে তছনছ করে দিতে হবে। সমতলের বাসিন্দারা এই হিলি বিস্টগুলোর সঙ্গে মিললে আমাদের খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে ফাদার। বাট ডোন্ট ফরগেট ইয়োর নিউ ডিউটি, আজ থেকেই গাইডিলিও সম্বন্ধে প্রচার করে দিনও একটা ডাইনি। একটু একটু করে মুখখানা ভয়ানক হয়ে উঠল পুলিশ সুপার বসওয়েলের।

এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল পিয়ার্সন। অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ গলায় এবার সে বলল, সে কী কথা! শী ইজ আ গুড পায়াস গার্ল, আই নো। এ ভারি অন্যায়। ভারি অন্যায়।

কী অন্যায়? বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঘুরে বসল বসওয়েল।

হোয়াট ডু ইউ মীন? চোখের মণিদুটো নীল আগুনের বিন্দু হল পাদ্রী ম্যাকঞ্জির।

আমি বলছি একজনের নামে মিথ্যে অ্যাসপার্স করা কি ঠিক? অত্যন্ত শান্ত গলায় পিয়ার্সন বলল।

বসওয়েল হাসল। দু’পাটি কদাকার দাঁত অদ্ভুতভাবে আত্মপ্রকাশ করল। পিয়ার্সনের পিঠে মৃদু একটা চাপড় দিয়ে বলল, ইউ আর টু ইয়াং। আমাদের ধর্মের সঙ্গে রাজ্য বিস্তারের সম্পর্ক আছে ফাদার। সেটা এখন আপনি বুঝতে পারবেন না। ইয়াংম্যান, রক্ত এখন গরম। পুঁথিপড়া বিশ্বপ্রেম মনের মধ্যে টগবগ করছে। আই ক্যান অ্যাসিওর, ওসব ফিলানথ্রপি বেশিদিন থাকবে না। আচ্ছা, গুড ডে। আমাকে আবার গাইডিলিওর ওখানে লোক মোতায়েন করতে হবে।

সতেজ সবুজ ঘাসের জমি পেরিয়ে গেটটার কাছে চলে এসেছে পুলিশ সুপার বসওয়েল। তার পিছু পিছু বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। বসওয়েল চওড়া কাঁধখানা ঘুরিয়ে বলল, এই ইয়াং মিশনারিকে এখান থেকে সরাতে হবে ফাদার। নইলে আমাদের পক্ষে বড় ক্ষতি হবে।

ইয়েস, একটা শয়তান। এর ওষুধ আমি জানি। নিচের দাঁতগুলোর ওপর ওপরের পাটিটা নির্মমভাবে চেপে বসল পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির। আশ্চর্য সংযম। এতটুকু শব্দ হল না। শুধু চাপা। বীভৎস গলায় সে বলল, আপনি কিছু ভাববেন না। সব ব্যবস্থা আমি করব। আমার দেশের, আমার গভর্নমেন্টের ইন্টারেস্ট আগে দেখতে হবে।

ক্যাঁচ করে শব্দ হল লোহার গেটটায়। বাইরে বেরিয়ে গেল বসওয়েল। সবুজ ঘাসের জমিটা থেকে তীক্ষ্ণ ধারাল দৃষ্টিতে ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকিয়ে রয়েছে পিয়ার্সন, পলক পড়ছে না। চোখজোড়া যেন জ্বলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *