কালনীর ঢেউ

কালনীর ঢেউ – শাহ আবদুল করিম
প্রথম প্রকাশ – সেপ্টেম্বর ১৯৮১
উৎসর্গ – সহধর্মিনী সরলাকে

.

কেউ বলে শাহ আবদুল করিম কেউ বলে পাগল
যার যা ইচ্ছা তাই বলে, বুঝি না আসল নকল ॥

জন্ম আমার সিলেট জেলায় সুনামগঞ্জ মহকুমায়
বসত করি দিরাই থানায় গ্রামের নাম হয় ধল ॥

ধল একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম দূরদূরান্তে আছে নাম
এই গ্রামেতে জন্ম নিলাম, নাই কোনো সম্বল ॥

স্কুল মাদ্রাসাদি শিক্ষাদীক্ষার আছে বিধি
মধ্যে বহে কালনী নদী তাতে কালো জল ॥

কালনী নদীর উত্তর পারে আছি এক কুঁড়েঘরে
পোস্ট অফিস হয় ধলবাজারে ইউনিয়ন তাড়ল ॥

পিতার নাম ইব্রাহিম আলী সোজা সরল আল্লার ওলি
পির মুর্শিদের চরণধূলি করিমের সম্বল ॥

.

মুর্শিদ মৌলা বক্স মুন্সি, দয়ার ঠাকুর
পির শাহ ইরাহিম মাস্তান মোকাম শ্রীপুর ॥

পিতার নাম ইব্রাহিম আলী মা নাইওরজান
উস্তাদ ছমরু মিয়া মুন্সি পড়াইলেন কোরআন ॥

শিখাইলেন তৈমুর চৌধুরী বাংলা বর্ণমালা
পির উস্তাদকে মান্য করি লই পদধূলা ॥

গানের উস্তাদ করমুদ্দিন ধল-আশ্রমে বাড়ি
পরে সাধক রশিদউদ্দিন, উস্তাদ মান্য করি ॥

বাউল ফকির আমি একতারা সম্বল
সরলাকে সঙ্গে নিয়া আছি উজানধল ॥

নূরজালাল নাম তার আছে এক ছেলে
ডাকনাম বাবুল তার, পড়ে সে স্কুলে ॥

আবদুল তোয়াহেদ ভাগিনা মোর ভালোবাসি তারে
আমার ভাবে সেও কিছু লিখতে চেষ্টা করে ॥

পিতামাতা আছেন আমার এখনও জীবিত
পিতামাতার চরণসেবায় আছি নিয়োজিত ॥

পির মুর্শিদ উস্তাদ আমায় করিয়াছেন মায়া
জিয়নে মরণে মাগি সেই পদছায়া ॥

.

সয়ালের দয়াল বন্ধু রে
তুমি যে সরল
তোমার লাগিয়া রে বন্ধু
ভুবন পাগল রে ॥

সয়ালের দয়াল রে বন্ধু
তুমি সর্বঘটে আছ
জীবের জীবন নাম ধরিয়া
স্বরূপে মিশেছ রে ॥

লতায় পাতায় দেখি তোমার
দয়ার পরিচয়
দয়াময় বলে তোমারে
সর্বজীবে কয় রে ॥

নিরাশ আঁধার মাঝে
আশার আলো তুমি
কাঙালের বন্ধু তুমি
তুমি অন্তর্যামী রে ॥

পাগল আবদুল করিম বলে
কী করবে শয়তানে
তুমি যারে কর দয়া
তোমার নিজ গুণে রে ॥

.

রাখ কি মার এই দয়া কর
থাকি না যেন তোমারে ভুলিয়া ॥

নিশিদিনে শয়নে-স্বপনে
পরানে পরানে মিশিয়া
এই আঁধার রাতে নেও যদি সাথে
তুমি নিজে পথ দেখাইয়া ॥

আমি তোমার পাগল, ভরসা কেবল
দীনবন্ধু তোমার নাম শুনিয়া
নেও যদি খবর হইব অমর
নামের সুধা পান করিয়া ॥

দয়াল নাম তোমার জগতে প্রচার
জীবেরে দয়া কর বলিয়া
আবদুল করিম বলে রেখ চরণতলে
দিও না পায়ে ঠেলিয়া ॥

.

তুমি বিনে মনের বেদন কারে কই?
ভালো মন্দ যা-ই করি তোমার ছাড়া তো অন্যের নই ॥

যখন যা হয় প্রয়োজন তোমার কাছে বলি তখন
আমার কে আর আছে আপন, জানি না আর তুমি বৈ ॥

জন্মের আগে নিজগুণে মায়ের বুকে দুগ্ধদানে
পুষিয়াছ জানি মনে, আমি কি আর অন্যের হই ॥

তুমি মারো তুমি বাঁচাও যা-ই করি তুমি করাও
তবে কেন ধমক দেখাও পাকা ধানে দিবা মই ॥

কিসের সুখ্যাতি-অখ্যাতি স্বৰ্গনরক সঙ্গের সাথি
করিম কয় নাই উন্নতি সুখের আশায় দুঃখ সই ॥

.

খুঁজিয়া পাইলাম না রে বন্ধু তুমি কোথায় থাক
আমি তোমায় দেখতে নারি তুমি আমায় দেখ রে বন্ধু ॥

দেখতে পাইতাম যদি হইতাম তোর ভাবের ভাবুক
মরমজ্বালা সইতে নারি বৈরী পাড়ার লোক রে বন্ধু ॥

তোমার হাতে কলম রে বন্ধু তোমার হাতে লেখো
আমি কেমনে হইলাম দোষী বুঝি না সেই ফাঁক রে বন্ধু ॥

নির্ধনের ধন রে বন্ধু আঁধারের আলোক
পাগল আবদুল করিম বলে চরণছায়ায় রাখো রে বন্ধু ॥

.

নাম সম্বলে ছাড়লাম তরী
অকূল সাগরে
কূল দাও কি ডুবাইয়া মারো
যা লয় তোমার অন্তরে ॥

দয়াল আমার ভাঙা তরী
ভবসাগরে তুফান ভারি
প্রাণ কাপে ডরে
নিদানে বান্ধব তুমি
আমি আর ডাকব কারে ॥

যাদের নায়ের মাঝি ভালো
তারা সবাই চলে গেল
প্রেমের বাজারে
ভক্তজনের বিপদ কিসের
তুমি দয়া করো যারে ॥

দয়াল তোমার নিজগুণে
পাপী-তাপী কত জনে
নিলা সে পারে
তোমার নামেতে কলঙ্ক রবে
করিম যদি ডুবে মরে ॥

.

নবি এসে দয়া করে
দাও পাপীরে পদছায়া
আমি তোমার হয়ে থাকি
প্রাণপাখি
কিসের পুত্র কিসের জায়া ॥

পাপীর আশা পুরাও যদি
হও দরদি
নিজগুণে কর দয়া
যে তোমায় চায় সে যদি যায়
পড়ে রবে মাটির কায়া ॥

আসিয়া এ সংসারে
জন্মভরে
মানুষের দরদি হইয়া
সত্য তুমি মহান তুমি
কাঙালকে করেছ মায়া ॥

তাই তো ডাকি দয়াল বলে
হৃৎকমলে
রেখেছি ছবি আঁকিয়া
আঁধারে তুমি আলো
লাগল ভালো
ভুলবে করিম কী করিয়া ॥

.

ওগো পাতকীর কাণ্ডারি
দুরুদ সালাম ভেজি
হয়ে করজোড়ি গো পাতকীর কাণ্ডারি ॥

দয়ার ভাণ্ডার তুমি আমি তো ভিখারি
কাঙাল জেনে কর দয়া
দাও হে চরণতরী গো পাতকীর কাণ্ডারি ॥

একূল সেকূল দুই কূলেতে ভরসা তোমারি
নামেতে কলঙ্ক রবে
ডুবে যদি মরি গো পাতকীর কাণ্ডারি ॥

আশিকের ধন পরশরতন তুমি হৃদয়বিহারী
খুলে দাও মোর আঁখির বন্ধন
একবার তোমায় হেরি গো পাতকীর কাণ্ডারি ॥

পাগল আবদুল করিম বলে এই মিনতি করি
দুই নয়ন ভরিয়া একবার
দেখে যেন মরি গো পাতকীর কাণ্ডারি ॥

.

১০

কে যাও রে সোনার মদিনায়
কই বিনয় করিয়া কাঙাল জানিয়া
নেও সঙ্গে করিয়া যদি মনে চায় ॥

না নিলে আমারে বলি সকাতরে
আমার সালাম কইও নবিজির রওজায়
হাসন-হোসেন দুইজনে মা জহুরার চরণে
আরও কইও সালাম আলী মর্তুজায় ॥

হজরত আবুবকর-ওসমান-ওমর
কইও সালাম মোর এ সবার পায়
ইয়ার আসহাব যত সালাম শত শত
একে একে জানাইও সবায় ॥

কাসেমের চরণে জয়নাল আবেদিনে
জানাইও সালাম বিবি সখিনায়
আবদুল করিম কয় কত যে মনে হয়
প্রাণপাখি মোর উড়ে যেতে চায় ॥

.

১১

নবি এসে ঘুচালেন আঁধার
নুরের আলো যার
লা ইলাহা ইল্লাল্লা জানো
আল্লাহকে মনিব মানো
মুক্তির বাণী করিলেন প্রচার ॥

নুরে নুরনবি পয়দা
এই নুরে জগৎ বাঁধা
নহে জুদা সবই একাকার
শতবর্ণের গাভী হলে
একই বর্ণের দুগ্ধ মিলে
সাম্যের বাণী নবি মোস্তফার ॥

পাপীতাপীর ভাগ্যাকাশে
আবদুল্লার ঔরসে
গর্ভাবাসে বিবি আমেনার
উদিত ইসলাম রবি
ধরিয়া মানছবি
দয়াল নবি পাপীর কর্ণধার ॥

তৌহিদের বাণী মুখে
আসিলেন সাহারা বুকে
সেই আলোকে নাশিল আধার
আবদুল করিম দীনহীন
ভাবে বসে নিশিদিন
দুঃখের জামিন হবেন প্রেমাধার ॥

.

১২

নাম নিলে হয় মন পবিত্র অন্তিমে কল্যাণ
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ঠিক রেখ ইমান ॥

নবি ওলিগণ
যুগে যুগে করলেন কত অসাধ্য সাধন
স্মৃতি মিটবে না কখন
কুদরতি ক্ষমতার বলে হয়ে বলিয়ান ॥

পিরানে পির
আবদুল কাদের জিলানি শাহ দস্তগির
সত্যের রাহাগির
রেখে গেলেন যে নজির ইতিহাস প্রমাণ ॥

খাজার দরবারে
আশেক যারা আপন হারা প্রেমের বাজারে
যেয়ে দেখ আজমিরে
হৃদয় খুলে প্রেমভরে গায় গুণগান ॥

বাবা শাহজালাল পির
বোরহানের আবেদনে সিলেটে হাজির
নিয়ে আল্লাহর জিকির
আল্লাহু আকবার ধ্বনি উঠিল আজান ॥

আল্লাহর ওলি যারা হয়
জন্ম-জ্বরা-যমযাতনা তাদের জন্য নয়
তারা হলেন মৃত্যুঞ্জয়
করিম কয় বুঝিবার বিষয় ওলি আউলিয়ার শান ॥

.

১৩

ফুল ফুটিল বুগদাদে বুগদাদে
ফুলের গন্ধ নিব বলে
প্রাণ আমার কাঁদে ॥

যে নিল সেই ফুলের গন্ধ
দূরে গেল নিরানন্দ
ভয় কী তার মনে
ছরকাত কবর ফুলসেরাত
আর হাশর মিজানে
ভয় নাই কোনো বিপদে ॥

সেই নুরি ফুল বুগদাদেতে
ফুটিল খোদার কুদরতে
কী শোভা শোভে
আরশ কুরসি উজ্জ্বল হইল
ফুলের সৌরভে
ভ্রমর মধু খায় অবাধে ॥

সেই ফুল পরশমনি
পাইতাম যদি হইতাম ধনী
একুল সেকুলে
করিম কয় ঘটল না রে
পোড়া কপালে
আশায় প্রাণ সদায় কাঁদে ॥

.

১৪

খাজা তোমার প্রেমবাজারে
আমি কাঙাল যেতে চাই
প্রেমলীলা প্রেমের খেলা
দেখে পোড়া প্রাণ জুড়াই ॥

অসীম ক্ষমতা তোমার
দান করেছেন পাক পরোয়ার
ঘুচাইয়া দাও মনের আঁধার
তোমায় যেন দেখতে পাই ॥

তোমার কাছে এই প্রার্থনা
পুরাও মনের বাসনা
আশাতে বঞ্চিত করো না
দেই তোমার নামের দোহাই ॥

পাপীতাপী তোমার কাছে
দয়া মায়া পাইতেছে
আবদুল করিম আশায় আছে
কী করে তোমারে পাই ॥

.

১৫

শাহজালাল বাবার দোয়াতে
কত দুঃখাতাপা মহাপাপা গেল সুপথে ॥

খেয়ে বাবার ঝরনার পানি রোগমুক্ত হয় কতজন
হাজার হাজার নারীপুরুষ আসা-যাওয়া সর্বক্ষণ
আশায় আসে ভক্তগণ বাবার দরগাতে ॥

সোনার কই শিং মাগুর মাছ ঝরনাতে ডোবে-ভাসে
সিলেটভূমি পবিত্র হয় বাবার চরণ পরশে
হুর-পরী ফেরেস্তা আসে দরগা জিয়ারতে ॥

পুকুরভরা গজার মাছ দেখতে লাগে কী সুন্দর
ঝাঁকে উড়ে ঝুঁকে পড়ে জালালি কবুতর
জলেতে ভাসিল পাথর জালালি কেরামতে ॥

তিনশো ষাট আউলিয়া সাথে সিলেটেতে আসিয়া
সুরমা নদী পার হইলেন জায়নামাজ বিছাইয়া
জিন্দা গোরে আছেন শুইয়া আজো এই সিলেটেতে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে শুদ্ধ হইল না মন
কী করে যাব সুপথে জানি না সাধন-ভজন
পাইতে জালালি রওশন এসেছি তরিকতে ॥

.

১৬

মুর্শিদ বিনে এ ভুবনে কেউ নাই আপনা
মুর্শিদ নাম পরশমণি নাই যার তুলনা ॥

সময় থাকতে ভজিলাম না মুর্শিদের চরণ
রিপুর বশে হারাইলাম মহাজনের ধন
এখন কী করিব আর
নাম সম্বলে ধরলাম পাড়ি জানি না সাঁতার
সামনে অকূল পাথার
বাঁচি কী ডুবে মরি তার খবর জানি না ॥

এ সংসারে ভোজবাজি দিয়েছে ছেড়ে
মুর্শিদ নামের ঢেউ লেগেছে যার অন্তরে
ও যার মুর্শিদ কর্ণধার
তার নৌকা কি ডুবতে পারে ঝড়তুফানে আর?
সে পেয়েছে কিনার
দয়ার বলে কিনার মিলে নইলে মিলে না ॥

যারে করেছেন দয়া মুর্শিদ দয়াময়
দূর হইয়া গেল রে তার কাল সমনের ভয়
মুর্শিদ নাম যার সার
ছরকাত কবর ফুলসেরাতে ভয় কি আছে তার
সে হয়েছে উদ্ধার
করিম কয় দূর হলো তার ভবযন্ত্রণা ॥

.

১৭

মুর্শিদ ধন হে, কেমনে চিনিব তোমারে
দেখা দেও না কাছে নেও না আর কত থাকি দূরে ॥

মায়াজালে বন্দি হয়ে আর কতকাল থাকিব
মনে ভাবি সব ছাড়িয়া তোমারে খুঁজে নিব
আশা করি আলো পাব ডুবে যাই অন্ধকারে ॥

তন্ত্রমন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই
শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ি যত আরো দূরে সরে যাই
কোন সাগরে খেলতেছ লাই ভাবতেছি তাই অন্তরে

পাগল আবদুল করিম বলে দয়া কর আমারে
নতশিরে করজোড়ে বলি তোমার দরবারে
ভক্তের অধীন হও চিরদিন থাক ভক্তের অন্তরে ॥

.

১৮

দয়াল মুর্শিদ, তুমি বিনে
কে আছে আমার?
তোমার নাম ভরসা করে
অকূলে দিলাম সাঁতার ॥

প্রথম যৌবনকালে
চরণছায়া পাব বলে
আশ্রয় নেই তোমার
ঘটল না পোড়া কপালে
তোমার চরণ সেবিবার ॥

ভবের হাটে মানিক লোটে
বৈতরণী নদীর ঘাটে
বসেছে বাজার
বেচাকেনার ভাও জানি না
বাতি নাই ঘোর অন্ধকার ॥

তুমি যার হয়ে সারথি
আঁধারে দিয়েছ বাতি
ভয় কী আছে তার?
অকূলে কূল দাও গো মুর্শিদ
বলে করিম গুনাগার ॥

.

১৯

মুর্শিদ ও, জীবনও ভরিয়া
তোমার লাগিয়া
নয়নের জল হইল সম্বল
তোমারে না পাইয়া ॥

মুর্শিদ ও, যৌবনের বসন্তকালে
মমতা করিয়া
সে কথা মোর মনে আছে
টেনে নিলা তোমার কাছে
কেমনে রই ভুলিয়া ॥

মুর্শিদ ও, সাধ করে প্রাণ সঁপে
দিলাম চরণে ধরিয়া
জ্ঞানে করে বিবেচনা
পাগল মনে বুঝ মানে না
দিল ভরা ডুবাইয়া ॥

মুর্শিদ ও, কত পাপী উদ্ধারিলা
দয়াল নাম ধরিয়া
পাগল আবদুল করিম বলে
মুর্শিদ তোমার দয়া হলে
নেও না কোলে তুলিয়া ॥

.

২০

মুর্শিদ আমারে কর পার
তুমি বৈ আর কারে ডাকি
কে আছে দরদি আর ॥

তোমার নাম ভরসা করি
অকূলে ধরেছি পাড়ি ও
আমি যদি ডুবে মরি
কলঙ্ক হবে তোমার ॥

একে আমার ভাঙা তরী
ভবসাগরে তুফান ভারি ও
তুমি বিনে নাই কাণ্ডারি ডু
বলে রবি অন্ধকার ॥

চেয়ে দেখি বেলা গেল
মুর্শিদ আমার উপায় বল ও
জাহাজ-নৌকা ডুবে মরল
না পাইয়া কূল-কিনার ॥

আবদুল করিম দীনহীনে
ডাকে তোমায় আকুল প্রাণে ও
তরাইয়া লও নিজগুণে
হয়ে তুমি কর্ণধার ॥

.

২১

[সুনামগরে উকারগ্রাম নিবাসী আমার প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ শাহ মৌলা বন্ধু মুন্সি ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৯ আষাঢ় ইন্তেকাল করেন। এ উপলক্ষে গানটি রচিত]

প্রাণের প্রাণ মুর্শিদ আমার মৌলা বক্স নাম যাহার
চরণেতে জানাই আমি সালাম হাজার হাজার ॥

যুগের শেষে এসে যখন জন্ম নিলেন এ ধরায়
জেলা হয় সুনামগঞ্জ জন্মস্থান হয় উকারগাঁয়
শরিয়তে পায়বন্দ ছিলেন তরিকতের রাহাদার
সুফি সাধক ছিলেন মারিফত করে বিচার ॥

শিষ্য ভক্ত আশেকগণ সবারে করে কাঙাল
১৩৫৮ সনে করলেন তিনি ইন্তেকাল
নুরের বাতি নিভে যেদিন হয়ে গেল অন্ধকার
আষাঢ় মাসের নয় তারিখ ছিল সেদিন রবিবার ॥

শিষ্য ভক্ত আছে যারা করে সদা গুণগান
খাঁটি প্রেমের প্রেমিক হলে তাদের জন্য বর্তমান
বাউল আবদুল করিম বলে ইজ্জতে আশেক সবার
ভরসা রেখেছি মনে পাইতে রহমত দিদার ॥

.

২২

দীনবন্ধু রে, ওরে বন্ধু দয়াল নামটি ধরো
কাঙাল জানিয়া তুমি আমায় দয়া করো, দীনবন্ধু রে ॥
একবিন্দু পানি দিয়া রে ওরে বন্ধু সৃজন করিয়া
মায়ের বুকে দুগ্ধ দিয়া রাখিলা বাঁচাইয়া, দীনবন্ধু রে ॥

মানবজন্ম পাইয়া বন্ধু রে ওরে বন্ধু বিফলে দিন গেল
অন্ধকার ঘর যে আমার হইল না আর আলো, দীনবন্ধু রে ॥

তোমায় পাব সুখী হব রে ওরে বন্ধু এই বাসনা মনে
সাধন-ভজনহীন আমি পাইব কোন গুণে, দীনবন্ধু রে ॥

রাহমান রহিম তুমি রে ওরে বন্ধু গাফুরো রহিম
তোমার কাছে পানা চাহে বাউল আবদুল করিম, দীনবন্ধু রে ॥

.

২৩

বন্ধু রে, কাঙালে কি পাইবে তোমারে?
দীনবন্ধু নাম শুনিয়া ভরসা তাই অন্তরে ॥

বন্ধু রে, তিলেকমাত্র না দেখিলে কলিজায় আগুন জ্বলে
দাউ দাউ করে মোর অন্তরে বন্ধু রে
পদছায়া আমায় দিয়া বন্ধু তুমি আমার হইয়া
পোড়া প্রাণে জল ছিটাইয়া দাও না রে শান্তি করে ॥

বন্ধু রে, এই আশা তাপিত প্রাণে তাই বলি তোমার চরণে
নিজগুণে দয়া কর মোরে ও বন্ধু রে
তুমি যে অন্তর্যামী তোমার কাছে কী বলবো আমি
আকাশ পাতাল স্বর্গভূমি তোমার কি অগোচরে ॥

বন্ধু রে, আছি শত অপরাধী তবু তোমার কাছেই কাঁদি
অপরাধী আছি নতশিরে ও বন্ধু রে
বাঁচাও তোমার দয়া হলে না হয় তো ডুবাও অকূলে
পাগল আবদুল করিম বলে যা লয় তোমার অন্তরে ॥

.

২৪

সোনা বন্ধুয়া ও, অপরাধী হলেই আমি যাব কার ধারে
তুমি জানো আমার বেদন আর বলিব কারে ॥

বন্ধু ও, অপরাধী আছি আমি দয়ার সাগর তুমি
অন্তর্যামী জানো তো অন্তরে বন্ধু রে
ক্ষমা করে অপরাধ পূর্ণ কর মনোসাধ
কুল নিয়া ঘটাইলে প্রমাদ সদায় আঁখি ঝরে ॥

বন্ধু ও, মিছা ভবে মিছা মায়ায় ভুলিয়া রয়েছি তোমায়
নিরুপায় হলেম একেবারে বন্ধু রে
পতিতপাবন নামটি তোমার পাতকীরে কর উদ্ধার
ভরসা করেছি এবার তোমারই দরবারে ॥

বন্ধু ও, তব পদে আশ্রয় নিয়া আমার আমার ছেড়ে দিয়া
তোমার হইয়া থাকব সুখের ঘরে বন্ধু রে
পাগল আবদুল করিম বলে চাই না স্বর্গ তোমায় পাইলে
কর্মফলে আছি অন্ধকারে ॥

.

২৫

বন্ধুয়া রে, তুমি আমারে দিও না ফাঁকি
তুমি আমার সর্বস্বধন তাই তোমায় এত ডাকি॥

আসিয়া এই ভবপুরে আশা ছিল পাব তোমারে
প্রেমবাজারে হবে দেখাদেখি
দাও না দেখা প্রাণসখা কর যে লুকালুকি ॥

তুমি ঘরের মূল মহাজন সবই তোমার করণকারণ
রিপু ছয়জন তোমার চালাকি
তাই তো তোমার পাই না দেখা একঘরে দুইজন থাকি ॥

পাগল আবদুল করিম বলে ঠেকছি ভব-মায়াজালে
দয়াল বলে তোমারে ডাকি
দয়া করো কি প্রাণে মারো দেখা দাও একবার দেখি ॥

.

২৬

পাপীর আশা পুরাইবায় নি তুমি
গো পরানধন মৌলা ॥

আশার ঘর আশার বাড়ি আশার এই দুনিয়া
আশা পথে চেয়ে আছি দয়াল নাম শুনিয়া ॥

আমি রইলাম তোমার আশায় আর কিছু না জানি
ঘরে-বাইরে দেশে খেশে কলঙ্কের ধ্বনি ॥

হইয়াছি জগতে দোষী তাতে নাই যে শোক
দুই নয়ন ভরিয়া যদি দেখি চান্দ মুখ ॥

কাঙালের বন্ধু তুমি সর্বশাস্ত্রে কয়
তুমি বিনে কে হইবে পাপীর দয়াময় ॥

পাতকীর উদ্ধার রে বন্ধু না বাসিও ভিন
চরণে মিনতি করে করিম দীনহীন ॥

.

২৭

আল্লাহু আল্লাহু আল্লাহু, হক নাম তোমারি
মোকাম মঞ্জিলে নাম করে দাও জারি
আমি দীনহীন তুমি না বাসিও ভিন
তুমি না করাইলে মাবুদ আমি কি পারি ॥

তোমার তজল্লি-শানে দীল রওশনে
অন্ধ আঁখি খুলে দাও তোমার নিজগুণে
তুমি দয়াবান মাবুদ আমি যে অজ্ঞান
রাখো কিবা মারো তোমার ভরসা করি ॥

তোমার নামের জোরে ইউনুস পয়গাম্বরে
চল্লিশ দিন বেঁচে রইলেন মাছের ভিতরে
তোমার নুরের তজল্লায় মাবুদ পাহাড় পুড়ে যায়
মুসা নবি বেঁচে রইলেন নাম স্মরণ করি ॥

নমরুদ পামরে অগ্নিকুণ্ড করে
হাত পা বেঁধে ফেলে দেয় ইব্রাহিম নবিরে
তোমার নামের যে কী গুণ মাবুদ নিভিল আগুন
নুহের নৌকায় জলপ্লবনে তুমি কাণ্ডারি ॥

ইউসুফ নবিরে কুয়ার ভিতরে
কে বাঁচাইল তুমি ছাড়া ডাকলো আর কারে
ইব্রাহিম খলিলে
তোমার নামে চালায় ছুরি ইসমাইলের গলে
ছুরির নিচে বাঁচাইলে দয়াল নাম ধরি ॥

দাও আমায় পানা আমি করেছি গুনা
কবিরা-সগিরা আর জানা অজানা
কয় আবদুল করিম তুমি গাফুরো রহিম
দয়া করে ক্ষমা কর দোহাই তোমারি ॥

.

২৮

তুমি আমার প্রাণসখা
তোমায় ছাড়া বাঁচে না প্রাণ
তুমি আমায় যা দিয়েছ
কী দিব তার প্রতিদান ॥

তুমি কাঙালের ধন পরশরতন
জীবের জীবন অন্ধের নয়ন
আমার প্রাণে চায় সর্বক্ষণ
গাইতে তোমার গুণগান ॥

তুমি বিনে দরদি মোর ভবে নাই
মরম বেদনা কাহারে জানাই
করিম কয় যদি তোমায় পাই
চাই না আমার মান-কুলমান ॥

.

২৯

আজব রঙের ফুল ফুটেছে
মানবগাছে
চাইর ডালে তার বিশটি পাতা
কী সুন্দর আছে ॥

আগায় কলি শিখরে ফুল
ফুলের মধ্যে রয়েছে মূল
এ ছাড়া আর পাবে না কূল
মহাজন বলছে ॥

ভ্রমর থাকে মধুর আশে
ফুটলে কলি তাতে বসে
ভ্রমরার গান ভালোবেসে
কুলমান গেছে ॥

কালো রূপের আলো দেখে
পির আউলিয়া সাধু লোকে
রূপ দেখে চুপ হয়ে থাকে
কয় না কারো কাছে ॥

সুসময়ে খুঁজলাম না ফুল
ফুলে মিলে আল্লাহ রসুল
মূল সাধনে পড়েছে ভুল
করিম ভাবছে ॥

.

৩০

মন তুই দেখ না খুঁজে দেহের মাঝে
কী ধন দিলেন মহাজনে
ধরবে যদি অধরারে মুর্শিদ ধরে
ঘরের খবর লও না জেনে ॥

কালির লেখায় আলিম হয় না মন রে কানা
অজানাকে যে না জানে
আল্লাহ নবি আদমছবি
একসুতে বাঁধা তিনজনে ॥

দেহের রত্ন করলে যত্ন
ভালোবাসে মহাজনে
মুর্শিদ যার হয় সারথি মহারথি
সে জিয়নমরণ দুজাহানে ॥

আশেক যারা পাইল তারা
আপন ঘরে আপন চিনে
হলো না মোর আপন চিনা রাং কি সোনা
ভাবছে করিম দীনহীনে ॥

.

৩১

ও মন খুঁজলে না রে মন দেখলে না রে
হৃদয়বাসরে রে মন মানুষ বিরাজ করে ॥

সে মানুষ পরশমণি পরশে হইবে ধনী
ভবজ্বালা যাবে দূরে রে
ঘরের মানুষ ঘর ছাড়িয়া যাবে তোমায় ফাঁকি দিয়া
কী বুঝিয়া রইলে বেখবরে রে ॥

কামিনী-কাঞ্চনের দেশে ভুলে রইলে নিশার বশে
এই দেশে কি থাকবে চিরতরে রে
সার হয়েছে আসা-যাওয়া সামনে ত্রিবেণির খেওয়া
পাড়ি দেওয়া অন্ধকারে রে ॥

সে মানুষ ধরিতে চাও মুর্শিদের কাছে যাও
পাবে তারে প্রেমের বাজারে রে
মুর্শিদকে দিলে প্রাণ আঁধারে মিলিবে চান
রবে না ভব অন্ধকারে রে ॥

মানুষের সেবা বিনা মানুষে মানুষ পায় না
কল-কৌশলে মানুষ মিলে না রে
আবদুল করিম দীনহীন আশাতে গেল দিন
বাসে ভিন আপন বলি যারে রে ॥

.

৩২

রঙিলা বাড়ই রে, তুমি নানান রঙের খেলা খেলো
আমি তোমার প্রেমের পাগল তোমায় বাসি ভালো ॥

বাড়ই রে, তোমার কর্ম তুমি করো মিছা দোষী আমি
পুরাইতে তোমার বাসনা দেশ-বিদেশে ভ্রমি
আমার ঘরে থাক তুমি তোমার ভাবে চলো ॥

বাড়ই রে, করাও কী করি আমি ভাবি দিবানিশি
লোকে বলে কাগায় ধান খায় বেঙের গলায় ফাঁসি
তোমার লাগি কুলবিনাশী বিফলে দিন গেলো ॥

বাড়ই রে, যাক না জাতি হোক না ক্ষতি দুঃখ নাই রে আর
সত্য করে কও রে বাড়ই তুমি নি আমার
তোমার প্রেমে আবদুল করিম মরে যদি ভালো ॥

.

৩৩

ভবে চিনলে না কেন তারে
যে জন বসি দিবানিশি খেলা করে হৃদ্‌মাঝারে ॥

হাসে কাঁদে নাচে গায় হু হু শব্দে বাঁশি বাজায়
আসা-যাওয়া করে সদায় ত্রিবেণির লহরে
যদি সাধনবলে যেতে পার শ্রীকলার বাজারে
দেখবে রে তোর মনের মানুষ ত্রিবেণিতে নড়েচড়ে ॥

পাঁচ-পাঁচা-পঁচিশের তত্ত্ব চিনে জেনে হও না মত্ত
দমের গাড়ি অবিরত চালাও নামের জোরে
ডাকেতে যার ফাঁক পড়ে না প্রেমিক বলে তারে
মদনের পঞ্চবাণ বেধে রেখো প্রেমডোরে ॥

শ্রীনগর ফুলবাগানে ফুটছে ফুল অতি সন্ধানে
ভ্রমরা আসে গোপনে দেখবে নয়ন ভরে
উপাসনায় মন হবে লিপ্ত দেখবি যখন তারে
ঘুচবে ভ্রান্তি হবে শান্তি রবে না আর অন্ধকারে ॥

আলিফ্ দাল্‌ মিম্ করো পাচান স্বরূপে রূপ হয় বর্তমান
স্বরূপেতে করো ধ্যান বসে ভাবের ঘরে
ধরায় যে জন পড়েছে ধরা তুমি ধরো তারে
নিরাকারকে দেখবে সাকার স্বরূপে রূপ মিশলে পরে ॥

ম্লানবদনে ফুটবে হাসি হয় যদি সে মনোবাসী
হতে চাই না স্বর্গবাসী চাই যে শুধু তারে
কিঞ্চিৎ নয়নে যদি বন্ধে দয়া করে
স্বদেশে বিদেশে লোকে কউক মন্দ আবদুল করিমরে ॥

.

৩৪

সাধন করো রে অভ্যাসে
সময়ে কর্ম না করিলে হয় না কর্ম বেলাশেষে ॥

এই যে তোমার দেহভাণ্ড বন্ধ করো সকল রন্ধ্র
অমাবস্যায় পূর্ণচন্দ্র দেখবে হৃদাকাশে
অনাহত দ্বাদশ দলে নয়ন যদি মিশে
করিবে স্বদেশের চিন্তা রবে না আর এ বিদেশে ॥

মূলাধার হয় গুহ্যমূলে করো জাগ্রত ঊর্ধ্বকলে
উঠবে ঝঙ্কার দলে দলে নয়ন রেখ হুঁশে
গভীর ধ্যানে বসিলে যে-রূপ চোখে ভাসে
হতে পারে প্ৰেমালিঙ্গন সূক্ষ্ম জীবের ভাগ্যবশে ॥

কুণ্ডলিনী যদি জাগে দ্বিদলে যাও অনুরাগে
সহস্রার অধোভাগে যাবে রে স্বদেশে
ষড়রিপু বশ হইবে ভক্তি-প্রেম-বিশ্বাসে
ষটচক্র অতীত হয়ে ভাসবে রে চৈতন্যরসে ॥

তত্ত্ব জেনে মত্ত হয়ে উপাসনায় রও মজিয়ে
ভবসিন্ধু পাড়ি দিয়ে যাবে অনায়াসে
আসল তত্ত্ব না জানিলে কাজ দিবে কি বেশে
উপাসনা নিষ্ফল হবে অল্প একটু অবিশ্বাসে ॥

প্রাণায়াম অভ্যাস কর এ জীবনের আশা ছাড়ো
মুক্ত জীব হইতে পার গুরুর চরণ পরশে
যে হবে তার প্রেমের প্রেমিক ধরা দিবে খোশে
ঠেকল পাগল আবদুল করিম দোষী হয়ে স্বভাবদোষে ॥

.

৩৫

আমি তোমার কলের গাড়ি তুমি হও ড্রাইভার
তোমার ইচ্ছায় চলে গাড়ি দোষ কেন পড়ে আমার ॥

চলে গাড়ি হাওয়া ভরে আজব কল গাড়ির ভিতরে
নিচ দিকেতে চাকা ঘোরে সামনে বাতি জ্বলে তার ॥

রত্নমানিক বোঝাই করা প্রহরী সব দেয় পাহারা
বাদি ছয়জন আছে তারা সুযোগে করে সংহার ॥

কলের গাড়ি কুদরতে চলে, চলে না পেট্রোল ফুরাইলে
বাউল আবদুল করিম বলে কুদরতের শান বোঝা ভার ॥

.

৩৬

আগের বাহাদুরী এখন গেল কই
চলিতে চরণ চলে না, দিনে দিনে অবশ হই ॥

মাথায় চুল পাকিতেছে মুখে দাঁত নড়ে গেছে
চোখের জ্যোতি কমেছে, মনে ভাবি চশমা লই।
মন চলে না রঙতামাশায় আলস্য এসেছে দেহায়
কথা বলতে ভুল পড়ে যায়, মধ্যে মধ্যে আটক হই ॥

কমিতেছি তিলে তিলে ছেলেরা মুরব্বি বলে
ভবের জনম গেল বিফলে, এখন সেই ভাবনায় রই।
আগের মতো খাওয়া যায় না বেশি খাইলে হজম হয় না
আগের মতো কথা কয় না, নাচে না রঙের বাড়ই ॥

ছেলেবেলা ভালো ছিলাম, বড় হয়ে দায় ঠেকিলাম
সময়ের মূল্য না দিলাম তাই তো জবাবদিহি হই।
যা হবার তা হয়ে গেছে আবদুল করিম ভাবিতেছে
এমন এক দিন সামনে আছে, একেবারে করবে সই ॥

.

৩৭

হাওয়ার পাখি ভরা আমার
মাটির পিঞ্জিরায়,
পাখি যাইতে পারে যায় না উড়ে
পিঞ্জিরার মায়ায় ॥

শুনিলাম মুর্শিদের কাছে
পাখি ধরার সন্ধান আছে
ধরতে যে জন চায়,
ধরছে যে জন সে মহাজন
মুর্শিদি লীলায় ॥

আঁখির কাছে পাখির বাসা
করে পাখি যাওয়া-আসা
দুই জানালায়,
ঘরেবাইরে ঘুরেফিরে
রয় না এক জায়গায় ॥

দেখা দিত কথা কইত
পোড়া প্রাণে শান্তি দিত
মন মনোরায়,
পাই না তারে সন্ধান করে
মনে যারে চায় ॥

পাখির সঙ্গে নাই চিনাজানা
দুই নয়নে দেখতে পাই না
কেমনে আসে যায়,
পাখি রবে নারে যাবে উড়ে
চোখের ইশারায় ॥

পাখি যদি যাবে ছাড়ি
দালানকোঠা ঘরবাড়ি
বান্‌লাম কার আশায়,
বাউল আবদুল করিম বলে
এই রঙের দুনিয়ায় ॥

.

৩৮

কই থেকে আইলাম কই বা যাইতাম
কেন বা আইলাম, ভাবিয়া না পাইলাম
কার কাছে সেই খবর লইতাম ॥

ঠেকলাম মায়াজালে দিন গেল বিফলে
বুঝে না মন-পাগলে কারে কী কইতাম।
আমার কেউ নয় লাগিয়াছে ভয়
দেশে যাইবার সময় কী লইয়া যাইতাম ॥

সদায় এই ভাবনা দুনিয়াদারি যন্ত্রণা
সহিতে পারি না কত সইতাম।
পরের বাড়ি পরের ঘর জানিলে সেই খবর
তবে কি রঙবাজারে মন বিকাইতাম ॥

ধনদৌলত পরের বুঝ হইলে করিমের
আসল মনিবের গোলাম হইতাম।
আমি আমার হইয়া আমারে লইয়া
পরের গান থইয়া আমার নিজের গান গাইতাম ॥

.

৩৯

মানুষ যদি হইতে চাও কর মানুষের ভজনা
সবার উপরে মানুষ সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা ॥

নিজলীলা প্রকাশিতে আপে আল্লাহ পাকজাতে
প্রেম করলো মানুষের সাথে তার আগে আর কেউ ছিল না ॥

প্রেম ছিল আরশ মহলে স্থান পাইল মানুষের দিলে
আসল মানুষ কারে বলে কী নাম তার কই ঠিকানা ॥

সব দেশে সব জায়গায় মানুষ প্রেমখেলাতে নারী-পুরুষ
মানুষেতে আছে মানুষ রয় না মানুষ মানুষ বিনা ॥

আবদুল করিম হুঁশে থাকো মানুষ ভালোবাসতে শিখো
অন্তরে অন্তরে মাখো রবে না ভবযন্ত্রণা ॥

.

৪০

মনের মানুষ অতি ধারে
মক্কা কাশী বৃন্দাবন নাই তার প্রয়োজন
ভক্ত যে-জন হইতে পারে ॥

হিন্দু কি মুসলমান শাক্ত বৌদ্ধ খ্রিস্টান
সকলই সমান প্রেমের বাজারে
তত্ত্বজ্ঞান জাগে যার ঘুচে যায় আঁধার
কেহ ঘোরে ভব অন্ধকারে ॥

কেহ বলে সাকার কেহ বলে নিরাকার
মীমাংসা নাই তার ভবপুরে
তত্ত্বজ্ঞানী যতজন সাধু ফকির মহাজন
সকলেই বলে সে মানুষের ঘরে ॥

মানুষের মাঝে মানুষের কাজে
মানুষের সাজে বিরাজ করে
আপনি হাসিয়া উঠে যে ভাসিয়া
ভক্তজনের হৃদয়পুরে ॥

আবদুল করিম বলে মোহমায়াজালে
পড়ে আছি অন্ধকারে
ঘুচিত আঁধার দেখিতাম দিদার
আমি আমার হইলে পরে ॥

.

৪১

মানুষ হলে মানুষ মিলে নইলে মানুষ মিলে না
মানুষের ভিতরে মানুষ সহজে ধরা দেয় না ॥

মানুষ থাকে নিগুম ঘরে সিংহাসন তার মণিপুরে
যে জন তারে ধরতে পারে শমনের ধার ধারে না ॥

সেই মানুষ ধরিতে চাও স্বরূপেতে মন মজাও
নামের বাঁশি দমে বাজাও দেখবে আজব কারখানা ॥

থাকতে মানুষ আপন ঘরে সন্ধান করে ধরো তারে
দিন গেলে আর হবে না রে ছুটলে পাখি ধরা যায় না ॥

পির আউলিয়া যারা ছিলেন মানুষ ধরে মানুষ হলেন
ইব্রাহিম মস্তানে বলেন করিমরে তুই ভুল করিস না ॥

.

৪২.

মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ পায়
নইলে মানুষ মিলে না রে বিফলে জনম যায় ॥

মানুষের ভক্ত যারা আত্মসুখ বোঝে না তারা
দমের ঘরে দেয় পাহারা মনমানুষ ধরবার আশায় ॥

যে মানুষ পরশরতন সেই মানুষ গোপনের গোপন
দেয় না ধরা থাকতে জীবন, পথে গেলে পথ ভোলায় ॥

মানুষে মানুষ আছে পাপীতাপী সবার কাছে
ফাঁদ পেতে চাঁদ যে ধরেছে চাঁদ দেখে অমাবস্যায় ॥

মানুষ আছে বিশ্বজোড়া সহজে সে দেয় না ধরা
আবদুল করিম বুদ্ধিহারা ঘর থইয়া বাইরে ঘুরায় ॥

.

৪৩

মানুষে মানুষ বিরাজে খোঁজে যে জন সে-ই পায়
পাওয়ার পথে গেলে পরে অনায়াসে পাওয়া যায় ॥

অনেকে পেয়েছে যারে কেন পাব না তারে
দেখ নিজে বিচার করে পাওয়া যায় না কোন কথায় ॥

খুঁজলে পরে পাবে দেখা সে যে কাঙালের সখা
দয়াল বলে নামটি লেখা রয়েছে লতায় পাতায় ॥

চিনে নেও আপনারে দূরে যেতে হবে না রে
পাওয়া যাবে আপন ঘরে বলছেন নবি মোস্তফায় ॥

কোরানে প্রমাণ দিতেছে শা-রগ হতে আরও কাছে
আবদুল করিম আশায় আছে, তিলেক দরশন চায় ॥

.

৪৪

ভাবছ কি মন পির বিনে নবিরে পাওয়া যায়
পিরের বাক্য কর লক্ষ্য ভেদ বুঝে নেও ইশারায় ॥

পিরের চরণ অমূল্য ধন সুসময়ে করো যতন
হলে পিরের মনের মতন প্রাণে প্রাণে মিশে যায় ॥

ফানা পির শেখ হাসিল হলে ফানা পির রাসুল মিলে
ফানা ফিল্লায় যাবে চলে থাকিলে সোজা রাস্তায় ॥

কবর হাসর ফুলসেরাতে তরবি পিরের উসিল্লাতে
আল্লাহ রসুল মিলে তাতে আকুল প্রাণে যেজন চায় ॥

পিরের পদে আশ্রয় নিলে বিনামূল্যে বিকাইলে
পাগল আবদুল করিম বলে ভজ্বালা দূরে যায় ॥

.

৪৫

গুরুর বাক্য লও রে মন বিষয়টা মধুর
নাম স্মরণে মিলবে ধ্যানে দীননাথ দয়ার ঠাকুর ॥

গুরু যারে দয়া করে তরাবে অকূল পাথারে
যাবে যদি ভবপারে সব ছেড়ে হও দিনমজুর ॥

প্রেমের তত্ত্ব প্রেমিক বিনে পাবে কই শাস্ত্ৰ-পুরাণে
ভক্তজনে তত্ত্ব জেনে নিশাতে আছে বিভোর ॥

আপন ঘরে মানুষ থইয়া বাহ্যিকে রইলে মজিয়া
ঘোর করিয়া দেখ না চাইয়া মণিকোঠায় মনচোর ॥

কালসাপিনী ধরতে পারো আসল বাদ্যার সঙ্গ করো
বাউল করিমের কথা ধরো নয়ন রাখো মাসুকপুর ॥

.

৪৬

আশেকের রাস্তা সোজা
আশেক থাকে মাশুকধ্যানে
এই তার নামাজ এই তার রোজা ॥

আশেক চায় না আবেদ হতে
আশেক চায় না স্বর্গে যেতে
আশেক চলে নেস্তি পথে
হতে চায় না বিশ্বের রাজা ॥

আশেক মৌলার খেলার পুতুল
আশেক প্রেম বাগানের বুলবুল
ফানা পির শেখ ফানায়ে রাসুল
ফানা ফিল্লায় রুহু তাজা ॥

আশেক হলে মাশুক মিলে
এই কথা ঠিক আসলে
করিম কয় তা না হলে
বেতবাগানে চন্দন খোঁজা ॥

.

৪৭

জ্ঞান হইল নুরের আলো অজ্ঞানতা অন্ধকার
জ্ঞান আলোকে আঁধার নাশে জ্ঞানের প্রদীপ আছে যার ॥

জ্ঞানে হইল মানুষ শ্রেষ্ঠ, হার মানিল ফেরেস্তায়
নত শিরে তাজিম করে পড়িয়া মানুষের পায়
সেই মানুষ এসে দুনিয়ায় বসাইল ভবের বাজার ॥

জ্ঞানের আঁখি না খুলিলে ভালোমন্দ বোঝা যায় না
তত্ত্বজ্ঞান না হইলে নিজের খবর মিলে না
স্বরূপের দেখা পায় না, পায় না সে আল্লাহর দিদার ॥

শুদ্ধ শান্ত হইতে পারলে হকিকতের নিশানি
ভাগ্যবলে যদি মিলে গায়েবে এলমে লুদুনি
যে মানে মুর্শিদের বাণী করিম কয় সৌভাগ্য তার ॥

.

৪৮

রমজানের চান যে জন দেখেছে
এক ইমানে মন বান্ধিয়া
রোজা রেখে বসেছে ॥

রোজা হয় ইমানের মূল
এ ছাড়া পাবে না কূল
আপনা হতেই ভাঙিবে ভুল
রোজা যে জন রেখেছে।
রোজা ঠিক হইবে যার
নামাজে মিলিবে দিদার
ঘুচে যাবে মনের আঁধার
রোজায় মরা বাঁচে ॥

মমিন যে জন রাখে রোজা
রোজাতে হয় ইমান তাজা
রাখিলে আছে সাজা
অবশ্য বুঝবে পাছে।
এক ইমানে রোজা থাকো
ছয় রিপুকে বশে রাখো
করিম তুমি ভেবে দেখো
রোজা নি তোর ঠিক আছে ॥

.

৪৯

কলেমা নামাজ রোজা হজ্ব যাকাতে ইমানদার
মুর্শিদ ভজে তত্ত্ব খুঁজে করো মন ভবের ব্যাপার ॥

আপন ঘরে অমূল্য ধন আগে করো তার অন্বেষণ
এসব কিন্তু নিশির স্বপন যা বল আমার আমার ॥

আপন ঘরের বিচার করো আগে মন কলেমা পড়
দিলের ভিতর নক্সা করো ভাঙবে রে ছয় রিপুর ঘাড় ॥

পড় নামাজ হুজুরি দিলে ধ্যানে দিদার মিলে
হুজুরি নামাজ পড়িলে ঘুচবে মনের অন্ধকার ॥

পলকে সজিদা করো যোগ সাধনে তারে ধর
মরিবার আগে মরো হইতে চাইলে ভব পার ॥

ওজু গোসল নামাজ রোজা বেহেস্তে যাওয়ার রাস্তা সোজা
যে করে না নফছ রোজা উপবাসে ফল কী তার ॥

গলে নিয়া মায়া ফাঁসি আবদুল করিম হইল দোষী
কোন যাকাতে আল্লাহ খুশি করিয়া দেখ বিচার ॥

.

৫০

আগে তোর মন ভালো কর
পির মুর্শিদের চরণ ধরে
নিজে কর নিজের খবর ॥

অনিত্য সংসার মাঝে
কে হবে তোর সঙ্গের দোসর
সময়ে সব চলে যাবে
পড়ে রবে শূন্য বাসর ॥

মনকে সাধু বানাইলে
নামের মধু খাইতে মিলে
বসতে পারে প্রেমফুলে
যে হয়েছে ফুলের ভ্রমর ॥

মন পবিত্র না হইলে
তন্ত্র মন্ত্র যায় বিফলে
বাউল আবদুল করিম বলে
হুজুরি ক্বালবে নামাজ পড় ॥

.

৫১

ভেদ বুঝিয়া পড়ে নামাজ মমিনে
ফাওয়াই লুল্লিল্ মুসাল্লিনা বলছেন আল্লাহ কোরানে ॥

আল্লা বলছেন নবি মানো নবি বলছেন আপন চিন
নামাজ-রোজার অর্থ জান ধরে পিরের চরণে।
মুখে মন্ত্র জুপিলে আন্তাজি সজিদা করলে
বর্জকে মন ঠিক না হলে মন ভুলাবে শয়তানে ॥

নামাজ পড়িতে চাও আলেফ সুরতে দাঁড়াও
হে হরফে রুকুতে যাও মিশিয়া দমের সনে।
দিল কাবাতে নামাজ পড় মিমেতে সজিদা করো
দাল হরফে আসন ধর মোশাহেদার ময়দানে ॥

মক্কাতে কাবার ঘর আদি কাবা আদম শহর
ফেরেশতার সজিদার খবর লেখা আছে কোরানে।
কুালবে মমিন আর্শে আল্লা বলে গেছেন রাসুলুল্লা
কোরানে ইশারা দিলা নাহনু আকরাবু শানে ॥

পূজবে কেন গাছপাথর আপন ঘরের খবর কর
আদম খোদার রঙমহল ঘর গড়ল পাঞ্জাতন শানে।
করিম কয় রাস্তা ধরো মরিবার আগে মরো
তয় সে মুক্তি পাইতে পারো জিয়নে কি মরণে ॥

.

৫২

মন আমার যায় না সুপথে
কী করি এখন
পাগল মনে বুঝ মানে না
হইল না সাধন ভজন ॥

হয়ে আমি দিশেহারা
হলো না মোর বিচার করা
আমি বা কোনজন,
রিপুর বশে বশী হয়ে
চিনিলাম না পর-আপন ॥

সুসময়ে সুকৌশলে
আপন ঘরে খুঁজলে মিলে
অমূল্য রতন,
সময় থাকতে ভজিলাম না
মুর্শিদের রাঙা চরণ ॥

কামিনী-কাঞ্চনের দেশে
বন্দি হইলাম অষ্টপাশে
ভাবি সর্বক্ষণ,
বাউল আবদুল করিম বলে
হইল না ভুল সংশোধন ॥

.

৫৩

কেন মন মজিলে রে মিছা মায়ায়
আসবে শমন বানবে যখন ঠেকবে তখন বিষম দায় ॥

আসছ ভবে যাইতে হবে চিরদিন কি ভবে রবে
এ সব কি তোর সঙ্গে যাবে যা দেখতেছ এ ধরায়
সামনে তিমির-রাতি কে আছে তোর সঙ্গীসাথি
মামলার যেদিন উঠবে নথি হবে সেদিন নিরুপায় ॥

ঘাটের তরী ঘাটে বান্ধা পাছে সার হইবে কান্দা
বেলা গেলে সন্ধ্যা হলে পাড়ি দেওয়া হবে দায়।
বেলা থাকতে নৌকা ছাড়ো ভাবের বৈঠা পাছায় ধরো
মাল্লা ছয়জন বাধ্য করো যাবে নৌকা কিনারায় ॥

সুজন বেপারী যারা পাড়ি দিয়ে গেল তারা
কত জনের লাখের ভরা ডুবাইল মাঝ দরিয়ায়।
করিম কয় মনবেপারী সামনে অকূল পাড়ি
মুর্শিদ বিনে নাই কাণ্ডারি ভবপুরের পারঘাটায় ॥

.

৫৪

মন রে পাগল ও মনা তুমি কার ভরসা করো?
কারে বাঁচাইতে গিয়া কারে তুমি মারো রে মন ॥

কে হয় কতক্ষণের সাথি নিজে বিচার করো
ধোন্ধে ফকির ধ্যানে দিদার আপন কর্ম সারো রে মন ॥

কাম ক্রোধ লোভ মোহ ছয় রিপুকে মারো
দেহমন পবিত্র করে নামাজ রোজা করো রে মন ॥

মায়ার বাঁধন করে ছেদন আমার আমার ছাড়ো
শেষের দিন ঘোর নিদানে কে করবে উদ্ধার রে মন ॥

অজানাকে জানতে চাইলে মুর্শিদচরণ ধরো
পাক দরিয়ার পানি দিয়া ওজু-গোসল করো রে মন ॥

পাগল আবদুল করিম বলে মরার আগে মরো
তবে সে পাইতে পার বন্ধুয়ার দিদারও রে মন ॥

.

৫৫

এমন এক রঙের দেশ আছে
পাগল বিনা ভালো লোক নাই
সেই দেশে যাইতে পারি না
ভববাজারে ঘুরে বেড়াই ॥

দেশের নাম হয় পাগলপাড়া
ভালো লোক নাই পাগল ছাড়া
সে দেশে বাস করে যারা
আত্মসুখে দিয়াছে ছাই ॥

সেই দেশেতে যারা থাকে
দোষী কয় বিদেশী লোকে
স্ত্রীকে মা বলে ডাকে
জাতের বিচার সেই দেশে নাই ॥

খেলে তারা পঞ্চরসে
গানবাদ্যকে ভালোবাসে
আবদুল করিম ভাবছে বসে
কী করে সেই দেশেতে যাই ॥

.

৫৬

মেয়েরূপী ফুল ফুটেছে বিশ্ব-বাগানে।
এই ফুল বেহেস্তে ফুটিয়াছিল কুদরতি শানে ॥

ঐ ফুল বেহেস্তে ছিল ঐ ফুল দুনিয়ায় আইল
ফেরেস্তা ভুলিয়া গেল ঐ ফুলের ঘ্রাণে ॥

ফুটেছে ফুল নানা বেশে ফুলকে সবাই ভালোবাসে
একটি ফুলের তিনটি রসে খেলে তিনজনে ॥

পুরুষ ভ্রমরা জাতি দেখিয়া ফুলের জ্যোতি
কেউ দিতেছে আত্মাহুতি মূল না জেনে ॥

প্রেমরস চিনে না যারা আমার মতো কর্মপোড়া
করিম কয় রসিক ছাড়া বোঝে না অন্যে ॥

.

৫৭.

শুনবে কি বুঝবে কি ওরে মন ধুন্ধা?
এই দুনিয়া মায়াজালে বান্ধা ॥

কতজন পাগল হইয়া মায়াতে মন মজাইয়া
আপনার ধন পরকে দিয়া সার হইয়াছে কান্দা
বহুরূপী রঙবাজারে মন থাকে না মনের ঘরে
রঙ দেখাইয়া প্রাণে মারে লাগাইয়া ধান্ধা ॥

ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী দিতে হবে ভবপাড়ি
চেয়ে দেখ মনবেপারী দিন গেলে হয় সন্ধ্যা
আপন যদি ভালো বোঝো সুসময়ে মুর্শিদ ভজ
জ্ঞান থাকিতে পাগল সাজ চোখ থাকতে হও আন্ধা ॥

সময়ে কাজ সাধন করো নবির মতে মনকে গড়
আপন কর্ম আপনি সারো করুক লোকে নিন্দা
কাটিয়া মায়ার বাঁধন যে হয়েছে মানুষ রতন
করিম কয় নাই তার মরণ সব সময় সে জিন্দা ॥

.

৫৮

এ সংসারে জুয়া খেলা হারজিতের কারবার
রসিক বৈ কেউ জানে না রে কী আছে ভিতরে তার ॥

মন কেন তুই পাগল হলে আসল দিয়া জুয়া খেলিলে
আপনার কপাল আপনি খাইলে এমন দিন হবে না আর ॥

তোর ঘরে মুর্শিদের ধন হেলাতে করলে না যতন
করবে যদি স্বরূপসাধন ষড়রিপুর সঙ্গ ছাড় ॥

না জানি কী নিশা খাইলাম লাভের আশায় মূল হারাইলাম
আবদুল করিম দোষী হইলাম না করে নিজের বিচার ॥

.

৫৯

নেশাপুরে এসে আমি হয়ে গেলাম নেশাখোর
মূলসাধনে ভুল করেছি ভবের নেশায় হয়ে ভোর ॥

সবাই নেশাতে পাগল আছে এতে আসল নকল
অন্তরে সরল-গরল কেউ সাধু আর কেউ যে চোর ॥

ঠেকলাম আমি মধ্যপথে দিন গেল চিন্তা-ভাবনাতে
যে পাগল আসল নেশাতে আমি বলি সে চতুর ॥

কামিনী-কাঞ্চনের ধাঁধা এই নেশাতে জগৎ বাঁধা
করিমের মন বেহুদা কাছের বস্তু ভাবে দূর ॥

.

৬০

সোনার যৌবন আমার বিফলে গেল
যৌবন জোয়ারে ভাটা দিলে পরে
আর কি উজান ধরে বলো গো বলো ॥

অঙ্কুর বয়সে ছেলেখেলায় মিশে
ভাবি অনায়াসে যৌবন এল।
যৌবনে মায়াজাল মদন মাঝি হইয়া কাল
মহাজনের মাল নদীতে ডুবাইল ॥

বন্ধু প্রেমের মহাজন তার অফুরন্ত ধন
চাহিতে কতজন আগে পাইল
আমি ভিখারি দ্বারে দ্বারে ফিরি
বুঝিতে নারি কেন নিদারুণ হইল ॥

আবদুল করিম ভাবে আর কি দেখা হবে?
একদিন দেখা দিবে আশা ছিল
থাকিতে সময় হইয়া সদয়
বন্ধু দয়াময় দেখা না দিলো ॥

.

৬১

যৌবন রে, ঠেকছি তোরে লইয়া রাখব কী করিয়া
তুমি যদি ছেড়ে যাবে রঙের খেলা ভঙ্গ হবে
দেখি যে ভাবিয়া ॥

যৌবন রে, সোনারূপা হইতায় যদি আদর করিয়া
হৃদয় সিন্দুকে ভরে রাখতাম তোরে যত্ন করে
তালা চাবি দিয়া ॥

যৌবন রে, নদীর জোয়ার ভাটা দিলে ফিরে ফিরে আয়
যৌবন জোয়ার ভাটা দিলে আষাঢ় মাস চলে গেলে
আসে না আর ফিরিয়া ॥

যৌবন রে, কত আশা ছিল মনে তোমারে পাইয়া
আগে কি আর জানি আমি ছাড়িয়া যাইবায় তুমি
করিমরে থইয়া ॥

.

৬২

কাম নদীর তরঙ্গ দেখে করে ভয়
জানতে পারে পরমতত্ত্ব
গুরুর মন্ত্র যেজন লয় ॥

নদীর নাম হয় কামালসাগর
মাসে একবার উঠে লহর
সাধুজনে রাখে খবর
যোগে মিশে সেই সময়।
না জেনে কেউ পড়লে পাকে
ঐ নদীর ঘূর্ণির্বাকে
না জানি কী জিনিস থাকে
জাহাজ নৌকা টেনে লয় ॥

নদীতে হয় নোনা পানি
কালকুম্ভিরের বসত জানি
যে হয়েছে পরশমণি
তারে দেখলে দূরে রয়।
সাধু জ্ঞানী আরিফ যারা
ঐ নদীর ভাও জানে তারা
হয়ে রাজহংসের ধারা
জল ফেলে দুধ বেছে লয় ॥

পড়িও না রিপুর ফাঁদে
ভক্তি রেখ মুর্শিদপদে
পড়বে না কোনো বিপদে
নিলে মুর্শিদ পদাশ্রয়।
আবদুল করিম মূঢ়মতি
মুর্শিদ বিনে নাই তার গতি
কাঙাল জেনে দাসের প্রতি
যদি মৌলার দয়া হয় ॥

.

৬৩

সাঁতার না জানিয়া জলে দিও না সাঁতার
মায়ানদী ছয়জন বাদি সে ঘাটে ত্রিবেণির বাজার ॥

নদীর আছে তিনটি সুতা, তিন সুতা একযোগে গাঁথা
কুম্ভীরে ভাঙ্গিবে মাথা বায়ুসাধন নাই রে যার ॥

দমকলেতে দিয়া চাবি উদয় করো জ্ঞানের রবি
ঠিক রাখিও ধ্যানের ছবি দেখবে লীলা চমৎকার ॥

ঝোঁক বুঝিয়া গেলে রে মন মণিমুক্তা মিলে তখন
কেউ কিনে অমূল্য রতন কেউ করে ভবের ব্যাপার ॥

তিন দিনে তিন মহাজনে মাল বিকায় অতি সন্ধানে
খরিদ করে ভক্তজনে অভক্তের নাই অধিকার ॥

করিম কয় সংসারেতে আসা-যাওয়া একই পথে
মন চলে না গুরুর মতে কারে কী বলিব আর ॥

.

৬৪

পাই না তোমার ঠিক-ঠিকানা
নাম শুনে হলেম পাগল
যার-তার ভাবে সবাই বলে
বুঝি না আসল নকল ॥

কেহ ডাকে নামাজ রোজায়
কেহ ডাকে সন্ধ্যাপূজায়
সপ্তাহে কেউ গির্জাতে যায়
সার করছে কেউ বনজঙ্গল ॥

বেদ বাইবেল ত্রিপিটকে
তৌরাত জবুর দেখে
কেহ কোরানের আলোকে
যার তার ভাবে চায় মঙ্গল ॥

আকাশ বাতাস ত্রিজগতে
মসজিদ গির্জা সমাধিতে
তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
হয়ে গেলাম রসাতল ॥

জ্ঞান হলো না রিপুর চাপে
দিন কাটাইলাম অন্ধকূপে
নিজ নামে নিজরূপে
আছ তুমি উজানধল ॥

তোমায় চিনা হলোনা আর
আবদুল করিম ভাবছে এবার
তাই তো ধরল না আমার
প্রেমের গাছে প্রেমের ফল ॥

.

৬৫

গান গাইতে হইলে পড়ে যন্ত্রের প্রয়োজন
তরকারি খাওয়া যায় না, না দিলে লবণ ॥

বোলে-তালে-স্বরে-তারে কণ্ঠস্বরকে সাহায্য করে
ভাসিয়া ভাবের সাগরে ভাবের গান গাওন ॥

এশকে মজে জজবা হালে গাও গান সুর তালে
বেতালা কী সংসার চলে বোঝো আশেকগণ ॥

যন্ত্রের মর্ম বোঝে যারা হৃদ্যন্ত্র বাজায় তারা
নামের সাজে দম দোতারা বাজায় সর্বক্ষণ ॥

গান গেয়েছেন জ্ঞানী গুণী বোঝে যে জন তত্ত্বজ্ঞানী
গানের যে নিগূঢ় মায়নি বুঝলে হয় সুজন ॥

গানে খোলে তজল্লির দ্বার অন্ধ দিল হয় পরিষ্কার
ভাবশূন্য হৃদয় যার কী বুঝবে সেজন ॥

গরিবে নেয়াজ খাজা বুঝাইলেন গানের মজা
বাউল করিমের দোষের বোঝা যাবজ্জীবন ॥

.

৬৬

আমরা ধন্য গাইয়া যাই
পুবের বাড়ির মোড়ল বেটার গুণের সীমা নাই ॥

পুবের বাড়ির মোড়ল বেটা বড় ভাগ্যবান
পান-সন্দেশ খাবাইয়া পাঁঠা করলা দান ॥

পুবের বাড়ির মোড়ল বেটার মুখে ছাপদাড়ি
লাল ঘোড়া দৌড়াইয়া যাইন সাহেবের কাছারি ॥

ধনাই মিয়ার লম্বা নাও মধ্যে মধ্যে গোড়া
ইশারা করিলে নাও শূন্যে করে উড়া ॥

বৈঠা বাও সারি গাও করতাল বাজাও
বাউল আবদুল করিম বলে মনরঙে বাও ॥

.

৬৭

নাও বানাইল নাও বানাইল রে
কোন মেস্তরি কোন সন্ধানে বানাইল নাও বুঝিতে না পারি
নাও বানাইল রে কোন মেস্তরি ॥

সুজন মেস্তরি পাইয়া ঐ নাও দিয়াছে গঠন করিয়া
বত্রিশ বান্ধের নৌকাখানা পাইক সারিসারি ॥

চাইর রঙ্গে রঙ লাগাইয়া ঐ নাও দিয়াছে সুন্দর করিয়া
যে জন হয় সুজন নাইয়া রাখে যত্ন করি ॥

আবদুল করিম কয় ভাবিয়া ঐ নাও যাবে যখন পুরান হইয়া
ঘাটের নৌকা ঘাটে থইয়া যাইবে বেপারী ॥

.

৬৮

কোন মেস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায় ॥

চন্দ্র সূর্য বান্ধা রাখছে নায়েরই আগায়
দুরবিনে দেখিয়া পথ মাঝি-মাল্লায় বায় ॥

রঙ-বেরঙের কত নৌকা ভবের তলায় আয়
রঙবেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায় ॥

হারা-জিতার ছুবের বেলা কার পানে কে চায়
মদন মাঝি বড় পাজি কত নাও ডুবায় ॥

বাউল আবদুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়
কোথা হতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায় ॥

.

৬৯

মহাজনে বানাইয়াছে ময়ূরপঙ্খি নাও
সুজন কাণ্ডারি নৌকা সাবধানে চালাও ॥

বাইচ্ছা বাইচ্ছা পাইক তুলিয়া নাওখানা সাজাও
ঝোঁক বুঝিয়া ছাড়ো নৌকা সুযোগ যদি পাও ॥

অনুরাগের বৈঠা বাইয়া প্রেমের সারি গাও
রঙিলা বন্ধুর দেশে যাইতে যদি চাও ॥

বাউল আবদুল করিম বলে বুঝিয়া নায়ের ভাও
লক্ষ্য ঠিক রাখিয়া বাইও যাইতে সোনার গাঁও ॥

.

৭০

হাওয়ায় দৌড়ে রে আমার ময়ূরপঙ্খি নাও
মাশুকপুরে যাবে নৌকা বাওরে শীঘ্র বাও ॥

বৈঠা বাও সারি গাও করতাল বাজাও,
সুজন কাণ্ডারি নৌকা সাবধানে চালাও ॥

অকূল সাগরের পাড়ি সোজা রাস্তায় যাও
বেলা থাকিতে নৌকা কিনারা ভিড়াও ॥

জীবনরবি ডুবে যাবে বেলার দিকে চাও
আবদুল করিম বলে নৌকার না বুঝিলাম ভাও ॥

.

৭১

নৌকা বাইও সাবধান হইয়া রে মাঝি ভাই
বাইও সাবধান হইয়া
আল্লাহ নবির নাম রে মাঝি ভাই স্মরণ রাখিয়া ॥

তিন তক্তারই নৌকা রে মাঝি ভাই মধ্যে মধ্যে জোড়া
বিপাকে পড়িলেরে মাঝি ভাই নৌকা যাবে মারা ॥

বাতাসে চালায় রে নৌকা আজবও গঠন
গলইয়ে ভরিয়া রে দিছে অমূল্যরতন ॥

শরিয়তের পাইক রে মাঝি ভাই মারিফতের নাও
মায়া নদীর বাঁকে রে নৌকা উজান বাইয়া যাও ॥

গাব-কালি লাগাইয়া রে নৌকা যত্ন করে বাও
নোনা জলে খাইলে রে তক্তা ভাঙিয়া পড়ে নাও ॥

নায়ের মাঝে আছেন রে মাঝি ভাই নায়ের মহাজন
করিম কয় না চিনিলে বিফলও জীবন ॥

.

৭২

মনমাঝি ভাই বাও রে নৌকা যাইও না রে পথ ভুলে
আকাশেতে নাই বেলা আমার নৌকা রইল অকূলে ॥

মাঝিমাল্লা ষোলো জনা কেউ কারও কথা শোনে না
যার-তার ভাবে সকলি চলে
ও কেউ জল সিচে না বৈঠা বায় না আমার সময় গেল গোলমালে ॥

নায়েতে অমূল্য রতন ধার চিনিয়া নৌকা বাওন
বাও নৌকা সাহসের বলে
যারও নায়ের মাঝি ভালো সে তো বাইয়া গেল সকালে ॥

বাঁচি কি ডুবিয়া মরি এই ভাবনা সদায় করি
বাউল আবদুল করিমে বলে
জানি না দারুণ বিধি আমার কী লেখেছে কপালে ॥

.

৭৩

মনমাঝি তুই হইস নারে বেভুল
দিবে যদি ভব পাড়ি বেলা থাকতে নৌকা খোল ॥

যাবে যদি পাড়ি দিয়া হাইলের কাটা ঠিক রাখিয়া রে
দমে নামে মিল করিয়া ভক্তির বাদাম নৌকায় তোল ॥

ভবনদীর তুফান ভারি নাম সম্বলে ধর পাড়ি রে
মুর্শিদ হলে কাণ্ডারি অকূলে মিলিবে কূল ॥

কামিনী-কাঞ্চনের দেশে ভুলে রইলে নিশার বসে রে
ঠেকবে রে তুই বেলাশেষে হারাবে একূল সেকূল ॥

বন্দি হলে মায়াজালে ছুটবে বলো কোন কৌশলে রে
বাউল আবদুল করিম বলে আসলে হয় ভক্তি মূল ॥

.

৭৪

আল্লাহর নাম নবির নাম লইয়া রে
নাও বাইয়া যাও রে ॥

মনপবন সোয়ারি নাও নাম সম্বলে বাইয়া যাও
হাইল ধরেছে মনুয়া বেপারী রে, নাও বাইয়া যাও রে ॥

অকূল সাগরের পাড়ি বেলা আছে দণ্ড চারি
ডুবলে রবি পড়বে অন্ধকারে রে, নাও বাইয়া যাও রে ॥

মনুয়া হেলিলে পরে ঠেকবে নৌকা বালুচরে
মাঝি-মাল্লা সব যাইবে ছাড়ি রে, নাও বাইয়া যাও রে ॥

আসিয়াছি অনেক দূরে যাইতে হবে নিজ ঘরে
বাও নৌকা না করিয়া দেরি রে, নাও বাইয়া যাও রে ॥

দিনমণি ডুবিতেছে কালো মেঘে সাঁঝ করেছে
ভাবছে করিম এখন কিবা করি রে, নাও বাইয়া যাও রে ॥

.

৭৫

ও মনমাঝি রে, কিনারা ভিড়াইয়া রে বাইও নাও
বেলা থাকতে ধরো পাড়ি যদি বন্ধুর দেশে যাইতে চাও কিনারা
ভিড়াইয়া রে বাইও নাও ॥

হাইলের কাঁটা ঠিক রাখিয়া সাবধানে নৌকা চালাও
পাইকের হাতে বৈঠা দিয়া দয়াল নামের সারি গাও ॥

হীরামন মাণিক্যে ভরা মনপবন কাষ্ঠেরই নাও
বাউল আবদুল করিম বলে উজান পানি বাইয়া যাও ॥

.

৭৬

অকূল নদীর ঢেউ দেখে ডরাই
অসময় ধরিলাম পাড়ি আকাশেতে বেলা নাই ॥

সঙ্গী নাই আমি একেলা ধরছি পাড়ি সন্ধ্যাবেলা রে
ভরসা মুর্শিদ মৌলা দেই দয়াল নামের দোহাই ॥

সামনে ভীষণও নিদান এ বিপদে কে করবে ত্রাণ রে
সাঁঝ করে আসিবে তুফান, নাম বিনে ভরসা নাই ॥

আবদুল করিম দায় ঠেকেছে দরদি কে ভবে আছে রে
দেও সংবাদ মুর্শিদের কাছে মরণকালে চরণ চাই ॥

.

৭৭

ঝোঁক বুঝিয়া ছাড় নৌকা বেলা বয়ে যায়
কৃষক মজুর জেলে তাঁতি আয় রে সবাই আয় ॥

নব রঙের পাইক সাজে জনগণের নায়
নব রঙে বাজনা বাজে সারি গান গায় ॥

কেউ নায়ে জল সিচে কেউ বৈঠা বায়
কেউ যায় প্রাণপণে, কেউ তামশা চায় ॥

ঝড় তুফানে ভয় করি না পাইকে যদি বায়
বাউল আবদুল করিম বলে যাব সোনারগায় ॥

.

৭৮

গান শুনিয়া চমকে উঠে প্রাণ
কই যাওরে ভাটিয়াল নাইয়া
ললিত সুরে গাইয়া গান ॥

বাঁকা তোমার মুখের হাসি
দেখে মন হইল উদাসী রে
হইতায় যদি দেশের দেশী,
সোনার যৌবন করতাম দান ॥

নৌকায় তোমার কী মাল ভরো
কোন দেশে মাল চালান কর রে
উজান-ভাটি কেন কর
বুঝি না রে তার সন্ধান ॥

আবদুল করিম কয় কাঁদিয়া
বলি ও সুজন নাইয়া রে
আমারে তোর নায় তুলিয়া
তোমার দেশে দেও চালান ॥

.

৭৯

আমার নাম কে তোরে শিখাইল রে ওরে বাঁশি
ডাকো নিজনাম ধরিয়া মন করলে উদাসী রে ॥

বাঁশি রে তুই কাল হইলে কুলবধূর কুল মজাইলে রে
বসিয়া সদা নিরলে নয়নজলে ভাসি রে ॥

বাঁশি তোরে বাজায় যে জন দেখলে জুড়ায় পোড়া নয়ন রে
না দেখলে বাঁচে না জীবন কী বলিব বেশি রে ॥

বাঁশি রে তোর ভাগ্যগুণে স্থান পাইলে চাঁদ বদনে রে
থাকব আমি সে চরণে হইয়া চিরদাসী রে ॥

বাঁশির গানে প্রাণের টানে ছাই দিয়াছি কুলমানে রে
আবদুল করিম এ জীবনে ত্রিজগতে দোষী রে ॥

.

৮০

ও রঙিলা নাইয়া রে রঙে বৈঠা বাইয়া রে
কোন দেশে যাও রে মাঝি
আমারে যাও কইয়া রে ॥

ভাটিয়াল পানি বাইয়া মাঝি
ভাটিয়ালি গান গাইয়া রে
ভাটিয়াল হাওয়ায় ভাটিয়াল বাদাম দিয়াছ টানিয়া রে
লিলুয়া বাতাসে তোর নাও চলছে ধাইয়া-ধাইয়া রে ॥

ময়ূরপঙ্খি নাওখানা তোর
মধ্যে দিলা ছেয়া রে ॥

চন্দ্রসম রূপ রে মাঝি তোমারই বদনে রে
রূপের ছটা বিষম লেঠা লাগিল নয়নে রে
একটু টিকে যাও রে মাঝি নৌকাখান ভিড়াইয়া রে
তোর দেশে প্রাণ যাইতে চায়
তোর নৌকায় উঠিয়া রে ॥

কিসের ভাই কিসের বন্ধু কিসের দয়ামায়া রে?
এই দুনিয়া পুতুল খেলা দেখিনু ভাবিয়া রে
মনমানুষকে ধরব বলে মনে আশা নিয়া রে
করিম কয় আশার আশে
দিন গেল ফুরাইয়া রে ॥

.

৮১

ভাবিলে কী হবে গো যা হইবার তা হইয়া গেছে
জাতি-কুল-যৌবন দিয়াছি প্রাণ যাবে তার পাছে গো
যা হইবার তা হইয়া গেছে ॥

কালার সনে প্রেম করিয়া কালনাগে দংশিছে
ঝাড়িয়া বিষ নামাইতে পারে এমন কি কেউ আছে গো ॥

পিরিত পিরিত সবাই বলে পিরিত যে করিয়াছে
পিরিত করিয়া জ্বইল্যা পুইড়্যা কতজন মরেছে গো ॥

আগুনের তুলনা হয় না প্রেম-আগুনের কাছে
নিভাইলে নিভে না আগুন কী করে প্রাণ বাঁচে গো ॥

বলে বলুক লোকে মন্দ কুলের ভয় কি আছে
আবদুল করিম জিতে মরা বন্ধু পাইলে বাঁচে গো ॥

.

৮২

সখি রে, মন থাকে না ঘরে বন্ধুর বাঁশির সুরে
প্রাণবন্ধুর বাঁশির গানে মনপ্রাণ সহিতে টানে
মনকে পাগল করে বন্ধুর বাঁশির সুরে ॥

সখি রে, প্রাণবন্ধে বাঁশি বাজায় বসিয়া কদম্বতলায়
বাজায় বাঁশি দিনের দ্বিপ্রহরে
জল ভরিবার ছল করিয়া মনে লয় যাইতাম চলিয়া
প্রাণবন্ধুরে ধারে
বন্ধুর বাঁশির সুরে ॥

সখি রে, শুনিয়া বশির ধ্বনি মন হইল উদাসিনী
উদাস মনে বাইরম বাইরম করে
মনে লয় যাইতাম উড়িয়া পোড়া প্রাণ জুড়াইতাম গিয়া
দেখিয়া বন্ধুরে
বন্ধুর বাঁশির সুরে ॥

সখি রে, বাঁশিতে কী মধুভরা বাজায় আমার মনচোরা
এই বাঁশি কে শিখাইল তারে
করিম কয় মন সরলা বসিয়া কাঁদে নিরালা
কাল ননদির ডরে
বন্ধুর বাঁশির সুরে ॥

.

৮৩

বসন্ত বাতাসে ও সই গো বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে
সই গো বসন্ত বাতাসে ॥

বন্ধুর বাড়ি ফুল বাগানে নানা বর্ণের ফুল
ফুলের গন্ধে মনানন্দে ভ্রমরা আকুল
সই গো বসন্ত বাতাসে ॥

বন্ধুর বাড়ি ফুলের টঙ্গি বাড়ির পূর্বধারে
সেথায় বসে বাজায় বাঁশি মন নিল তার সুরে
সই গো বসন্ত বাতাসে ॥

মন নিল তার বাঁশির গানে রূপে নিল আঁখি
তাই তো পাগল আবদুল করিম আশায় চেয়ে থাকি
সই গো বসন্ত বাতাসে ॥

.

৮৪

সখি কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
মনে চায় প্রাণে চায় দিলে চায় যারে–
সখি কুঞ্জ সাজাও গো ॥

বসন্ত সময়ে কোকিল ডাকে কুহু স্বরে
যৌবনের বসন্তে মন থাকতে চায় না ঘরে ॥

নয়ন যদি ভোলে সই গো মন ভোলে না তারে
প্রেমের আগুন হইয়া দ্বিগুণ দিনে দিনে বাড়ে ॥

আতর গোলাপ চুয়াচন্দন আনো যত্ন করে
সাজাও গো ফুলের বিছানা পবিত্র অন্তরে ॥

আসে যদি প্রাণবন্ধু দুঃখ যাবে দূরে
আমারে যে ছেড়ে যায় না প্রবোধ দিও তারে ॥

আসিবে আসিবে বলে ভরসা অন্তরে
করিম কয় পাই যদি আর ছাড়িব না তারে ॥

.

৮৫

পরান কান্দে বন্ধুয়ার পানে চাইতে
বন্ধু বিনে একা আমি পারি না আর রইতে ॥

প্রথম পিরিতের কালে থাকতাম দূরে দূরে
তখন আমি ছিলাম ভালো বসে আপন ঘরে ॥

সাধে সাধে ঠেকছি ফাঁদে উপায় কিবা করি
এখন কি আর ভুলতে পারি মন করেছে চুরি ॥

জাতি-কুল-যৌবন দিলাম লোকের হইলাম বৈরী
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম ঠেকছি হইয়া নারী ॥

উড়াইল পিঞ্জিরার পাখি রাখিতে না পারি
করিম কয় মরণ ভালো দেখে যদি মরি ॥

.

৮৬

বন্ধুয়া রে, কুলমান সঁপিলাম তোমারে
কূল দাও কি ডুবাইয়া মার যা লয় তোমার অন্তরে ॥

যেদিন হতে তোমার প্রেমে সঁপেছি পরান
সে দিন হতে ছেড়ে দিছি লাজ-কুলমান
আমার বাচন-মরণ দু-ই সমান তুমি বিনে সংসারে ॥

হাত বান্ধা যায় পাও বান্ধা যায় মন বান্ধা তো যায় না
দারুণ বিচ্ছেদের আগুন জল দিলে নিবে না
পাগল মনে বুঝ মানে না ছটফট ছটফট করে ॥

পাগল আবদুল করিম কয় তোমারে যদি পাই
লোকের নিন্দন পুষ্পচন্দন তাতে ক্ষতি নাই
তোমার কলঙ্কের মালা যদি পাই গ্রহণ করবো সাদরে ॥

.

৮৭

বন্ধুয়া রে, যত দোষী তোমার লাগিয়া
তোমার কি দয়া লাগে না আমার দুঃখ দেখিয়া ॥

তুমি কি জানো না রে বন্ধু কী সুখে যায় দিন?
দিনে দিনে সোনার তনু হইতেছে মলিন
তুমি যদি বাসরে ভিন প্রাণ জুড়াব কই গিয়া ॥

ইউসুফের প্রেমে পাগল বিবি জ্বলেখায়
সোনার যৌবন ছাই করিল ইউসুফের আশায়
শেষে একদিন পাইয়া রাস্তায় দিল যৌবন ফিরাইয়া ॥

দোষী কউক জগতের লোকে তাতে দুঃখ নাই
করিম কয় তোমার কাছে মায়া যদি পাই
নইলে বলো মরিয়া যাই কী ফল আমার বাঁচিয়া ॥

.

৮৮

তোমার পিরিতে বন্ধু রে, বন্ধু কী হবে না জানি
তুমি আমারে করবায় নাকি
মিছা কলঙ্কিনী রে, বন্ধু কী হবে না জানি ॥

আমি তোমার প্রেমে পাগল রে বন্ধু
কাঁদি দিনরজনী
কোন পরানে ভিন্ন বাসো
কহ কহ শুনি রে বন্ধ কী হবে না জানি ॥

যে দিন হতে তোমার প্রেমে রে
বন্ধু সঁপেছি পরানি
সেই দিন হইতে বারণ হয় না
দুই নয়নের পানি রে, বন্ধু কী হবে না জানি ॥

পাগল আবদুল করিম বলে রে
আমার যাবে পেরেশানি
অন্তিমকালে পাই যদি তোর
রাঙা চরণখানি রে, বন্ধু কী হবে না জানি ॥

.

৮৯

বন্ধু রে, কী বলব তোমারে, ছেড়ে যেও না দূরে
তুমি বিনে অভাগীরে কে রাখবে আদরে–
ছেড়ে যেও না দুরে ॥

বন্ধু রে, তোমায় নিয়া গৌরব করি আমি অভাগিনী
কে আমার দুঃখ বুঝিবে আমার কে আর আছে
ভবে দুঃখ বলব কারে–
ছেড়ে যেও না দূরে ॥

বন্ধু রে, কুল ছেড়ে কলঙ্কী হইলাম তোমার লাগিয়া
তুমি যদি বাসো ভিন অভাগী আর বাঁচব কয়দিন
ধরল চিন্তা-জ্বরে–
ছেড়ে যেও না দূরে ॥

বন্ধু রে, দুঃখে দুঃখে জনম গেল আর কত দুঃখ বাকি
প্রাণে আর সহিবে কত বনপোড়া হরিণের মতো
আবদুল করিম ঘোরে–
ছেড়ে যেও না দূরে ॥

.

৯০

কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি
কেমনে রাখিব তোর মন আমার আপন ঘরে বাঁধি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবায় যদি ॥

পাড়া-পড়শি বাদি আমার, বাদি কাল ননদি
মরম জ্বালা সইতে নারি দিবানিশি কাঁদি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবায় যদি ॥

কারে কী বলিব আমি নিজেই অপরাধী
কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বহাইলাম নদী রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবায় যদি ॥

পাগল আবদুল করিম বলে হলো এ কী ব্যাধি?
তুমি বিনে এ ভুবনে কে আছে ঔষধি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবায় যদি ॥

.

৯১

কত দুঃখ সহিব তোর পিরিতে
আরও কি রহিল বাকি আমারে কাঁদাইতে ॥

আপন জেনে সরল মনে প্রাণ দিলাম তোর হাতে
কুল গেলো কলঙ্কী হইলাম দাগ লাগাইলাম জাতে ॥

ছেড়ে গেলা সোনা বন্ধু নিলা না তোর সাথে
তুমি যদি ভালো আমি পারি না ভুলিতে ॥

মন মানে না ঘরে থাকতে পারি না বুঝাইতে
উড়ু উড়ু করে পরান উড়িয়া যাইতে ॥

তোমার বিচ্ছেদের আগুন আমার কলিজাতে
জল ঢালিলে দ্বিগুণ জ্বলে পারি না নিভাইতে ॥

বনপোড়া হরিণের মতো শান্তি নাই জগতে
পাগল আবদুল করিম বলে আর পারি না সইতে ॥

.

৯২

প্রাণ খুলিয়া প্রাণ বন্ধু রে
করলাম না আদর
তাই তো তার দয়া হইল না
লয় না সে আমার খবর ॥

বন্ধু আমার দয়ার সিন্ধু
দীনজনার বন্ধু পরশপাথর
লোহাতে পরশ লাগিলে
স্বর্ণ হয়ে যায় সত্যুর ॥

দেওয়া হলো না ষোলো আনা
তাই তো আমার এই লাঞ্ছনা জন্ম-জন্মান্তর
প্রাণবন্ধুর দয়া বিনা
কেমনে তরি ভবসাগর ॥

পাই না বন্ধুর খবরবার্তা
মনে বাড়ে দ্বিগুণ ব্যথা রইল কার বাসর
বাউল আবদুল করিম বলে
জুড়ায় না পোড়া অন্তর ॥

.

৯৩

আইলায় না আইলায় না রে বন্ধু করলায় রে দেওয়ানা
সুখবসন্ত সুখের কালে শান্তি তো দিলায় না রে
বন্ধু, আইলায় না রে ॥

অতি সাধের পিরিত বন্ধু রে, ওরে বন্ধু নাই রে যার তুলনায়
দারুণ বিচ্ছেদের জ্বালা আগে তো জানি না রে
বন্ধু, আইলায় না রে ॥

গলে মোর কলঙ্কের মালা রে, ওরে বন্ধু কেউ ভালোবাসে না
কুলমান দিয়া কী করিব আমি তোমারে যদি পাই না রে
বন্ধু, আইলায় না রে ॥

আবদুল করিম কুলমানহারা রে, ওরে বন্ধু তুমি কি জান না
সুসময়ে সুজন বন্ধু দেখা তো দিলায় না রে
বন্ধু, আইলায় না রে ॥

.

৯৪

বাঁচি না বাঁচি না রে বন্ধু পরানে বাঁচি না
তোমার প্রেমে এত জ্বালা
আমি আগে তো জানি না রে বন্ধু, বাঁচি না রে ॥

কে বা না পিরিতি করে রে
ওরে বন্ধু কার এত লাঞ্ছনা
কোন বা দোষে হইলাম দোষী
তুমি একদিন তো কইলায় না রে বন্ধু, বাঁচি না রে ॥

জাতি-কুল-যৌবনও দিলাম রে
ওরে বন্ধু জানিয়া আপনা
প্রাণ থাকিতে না পাই যদি
আমি মরণে আর চাই না রে বন্ধু, বাঁচি না রে ॥

পাগল আবদুল করিম বলে রে
ওরে বন্ধু অন্তরের বেদনা
তোমার কাছে কী বলিব
তুমি কি জানো না রে বন্ধু, বাঁচি না রে ॥

.

৯৫

পিরিতি করিয়া রে গিয়াছ ছাড়িয়া রে
পোড়া প্রাণ জুড়াবো আমি কার মুখ চাইয়া রে ॥

শুইলে না আসে নিদ্রা আহার না চায় মনে রে
দিবানিশি পোড়ে অঙ্গ বিচ্ছেদের আগুনে রে
পিপাসী চাতকির মতো তোমারও লাগিয়া রে
পিঞ্জিরা ছাড়িয়া পাখি যাইতে চায় উড়িয়া রে ॥

ভ্রমর থাকে ফুলে ফুলে মধুর সন্ধান করে রে
গুন গুন স্বরে গান গায় বাগানে বাগানে রে
মধু পানে তুমি তারে রাখ শান্তি দিয়া রে
আমারে কি কাঁদাবে তুই জনম ভরিয়া রে ॥

আমি তোমার তুমি আমার জানিয়াছি মনে রে
নইলে কী আর প্রাণ সঁপিতাম তোমারই চরণে রে
পাগল আবদুল করিম বলে তুমি আমার হইয়া রে
পোড়া প্রাণে দাও না শান্তি একবার দেখা দিয়া রে ॥

.

৯৬

আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা
কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া ॥

না আসিলে কাল ভ্রমর কে হবে যৌবনের দোসর
সে বিনে মোর শূন্য বাসর আমি জিয়ন্তে মরা ॥

কুলমানের আশা ছেড়ে মনপ্রাণ দিয়েছি তারে
এখন যে কাঁদায় আমারে এই কী তার প্রেমধারা ॥

শুইলে স্বপনে দেখি ঘুম ভাঙিলে সবই ফাঁকি
কত ভাবে তারে ডাকি তবু সে দেয় না সাড়া ॥

আশা পথে চেয়ে থাকি তারে পাইলে হবো সুখী
এ করিমের মরণ বাকি, রইল সে যে অধরা ॥

.

৯৭

আমার বন্ধুরে কই পাব গো সখী আমারে বলো না
বন্ধুবিনে পাগল মনে বুঝাইলে ঝুঝে না গো সখি
আমারে বলো না ॥

সাধে সাধে ঠেকছি ফাঁদে দিলাম ষোলোআনা
প্রাণপাখি উড়ে যেতে চায় আর ধৈর্য মানে না গো সখি
আমারে বলো না ॥

কী আগুন জ্বালাইল বন্ধে নিভাইলে নিভে না
জল ঢালিলে দ্বিগুণ জ্বলে উপায় কী বলো না গো সখি
আমারে বলো না ॥

পাগল আবদুল করিম বলে অন্তরের বেদনা
সোনার বরন রূপের কিরণ না দেখলে বাঁচি না
আমারে বলো না ॥

.

৯৮

প্রেম শিখাইয়া সোনা বন্ধে ঠেকাইল পিরিতের ফান্দে
মন কান্দে প্রাণ কান্দে তার লাগিয়া গো
আসি বলে চলে গেল আর তো ফিরে না আসিল গো
প্রাণসখি গো, কার কুঞ্জে সে রহিল ভুলিয়া গো ॥

সখি গো, মোহন বাঁশি হাতে লইয়া নিজ নাম ধরিয়া
বাজাইত কদম তলায় বইয়া গো
শুনে বন্ধের বাঁশির গান সঁপে দিলাম মনপ্রাণ গো
প্রাণসখি গো, কুল ছাড়িলাম কুল পাইবার লাগিয়া গো ॥

সখি গো একে আমি কুলবালা শাশুড়ি ননদির জ্বালা
অঙ্গ কালা ভাবিয়া চিন্তিয়া গো
আজ আসবে কাল আসবে কইয়া মনরে রাখি বুঝাইয়া গো
প্রাণসখি গো, দিন যায় না রাত পোহায় না কাঁদিয়া গো ॥

সখি গো, বুঝি আমার কর্মদোষে আপন বন্ধে ভিন্ন বাসে
আশার আশে আছি পথ চাইয়া গো
পাগল আবদুল করিম বলে প্রাণ থাকিতে না আসিলে গো
প্রাণসখি গো, আসবে কি আর যাই যদি মরিয়া গো ॥

.

৯৯

কার কাছে যাব কারে জানাব
অন্তরের বেদনা
সহিতে না পারি জ্বলেপুড়ে মরি
প্রাণ বন্ধুয়ায় দুঃখ বোঝে না ॥

নতুন ফাগুনে নতুন যৌবনে
পাগল মনে বুঝ মানে না
মনের বসন্ত হয় যদি অন্ত
ফিরে তো আর আসিবে না ॥

সুসময়ে সুজন হইয়া আপন
স্বরূপে যখন দেখা দিল না
বিনে প্রাণসখা বসে কাঁদি একা
কপালে কী লেখা জানি না ॥

সরল জানিয়া পিরিতি করিয়া
কাঁদিয়া দিন ফুরায় না
আবদুল করিম বলে অন্তিম কালে
চরণ পাইব বলে বাসনা ॥

.

১০০

বন্ধু বিনে একা ঘরে ভালো লাগে না
কার কাছে কই মনের দুঃখ কে আপনা ॥

ছোটবেলা প্রেম করিলাম আনন্দ মনে
যৌবনে ছাড়িয়া যাবে আগে কে জানে?
গেলে জোয়ানি
যৌবন ফুরাইয়া গেলে আর আসিবে নি
যৌবন জোয়ারের পানি গেলে ফিরে না ॥

মন কান্দে প্রাণ কান্দে বন্ধুয়া বিনে
শুইলে না ঘুম আসে দুই নয়নে
বসে কাঁদি নিরালা
মন-প্রাণ দিয়াছি যারে যায় না গো ভোলা
নারীর বিরহ জ্বালা সে জানে না ॥

প্রাণ থাকিতে আসে যদি আমার প্রাণধন
বুকে রাখিয়া তারে জুড়াব জীবন
বন্ধু না আসিলে
ঝাঁপ দিয়া মরিব আমি যমুনার জলে
পাগল আবদুল করিম বলে প্রাণে সহে না ॥

.

১০১

প্রাণসখি রে,
আমি বন্ধু বিনে প্রাণে বাঁচি না
তারে একবার এনে দেখাও না ॥

প্রেম করা নয় প্রাণে গো মরা
জাতি-সাপের লেজে ধরা
সখি আমি আগে জানি না
কালের বিষে যে মন্ত্র মানে না ॥

প্রেম করিয়া হইলাম গো দোষী
জাতি কুলমান গেল ভাসি
ঘরে বাইরে সকলের জানা
আমার মতো মরতে যাইও না ॥

তবু যদি প্রেম করতে চাও
জীবিত প্রাণে মরিয়া যাও
এ জীবনের আশা রেখ না
শুধু মুখের কথায় পিরিতি হয় না ॥

আবদুল করিম কয় গো সখি
এইভাবে কতদিন থাকি
প্রাণপাখি আমার হইল না
আমার পাগল প্রাণে ধৈর্য মানে না ॥

.

১০২

প্রাণ জ্বলে মোর বিচ্ছেদের অনলে গো সখি
মনের আগুন নিভে না জল দিলে ॥

কোন দেশে মোর বন্ধু গেল গো সখি আমায় দাও না বলে
নইলে জলে ঝাঁপ দিব কলসি বেঁধে গলে গো সখি ॥

প্রাণবন্ধুরে হারা হয়ে গো সখি ভাসি নয়নজলে
বুঝি না দারুণ বিধি কী লেখল কপালে গো সখি ॥

বন্ধুর প্রেমে কলঙ্কিনী গো সখি হইলাম গোকুলে
কুলে পড়ক ছাই তাতে ক্ষতি নাই
বন্ধু আমার হইলে গো সখি ॥

পাগল আবদুল করিম বলে গো আমি ভাসিলাম অকূলে
কী সুখে যায় দিনরজনী বোঝে না কেউ কইলে গো সখি ॥

.

১০৩

হাত বান্ধিব পাও বান্ধিব মন বান্ধিব কেমনে
তোমরা যে বুঝাও গো সখি মনে কি মানে ॥

লোকে বলে কলঙ্কিনী কলঙ্কের ভয় নাই মনে
বিনামূল্যে বিকাইলে নি প্রাণবন্ধে আমায় কিনে ॥

আহারও না চায় গো মনে নিদ্রা নাই দুই নয়নে
কী সুখে যায় দিনরজনী তন জানে আর মন জানে ॥

সোনার অঙ্গ পুড়ে অঙ্গার বন্ধুর প্রেমের আগুনে
জল ঢালিলে দ্বিগুন জ্বলে নিভাব আর কেমনে ॥

পাগল আবদুল করিম বলে প্রাণ কাঁদে বন্ধু বিনে
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম ছাই দিয়া কুলমানে॥

.

১০৪

প্রেম করিয়া সুখ হইল না পোড়া কপালে
আশায় আশায় সোনার যৌবন গেল বিফলে ॥

আপন বলতে এই জগতে আমার কেহ নাই
মনে বড় আশা ছিল দেখে প্রাণ জুড়াই
বন্ধু নির্ধনিয়ার ধন অন্ধের নয়ন, বন্ধু পরশরতন
বন্ধু জীবনের জীবন
পাইল যে জন ধনী সে জন একুল সেকুলে ॥

সাধ করে প্রাণ সঁপে দিলাম জেনে আপনা
দারুণ প্রেমে এত জ্বালা আগে জানি না
এখন বিচ্ছেদের আগুন অন্তরে জ্বলেছে সদা হইয়া দ্বিগুণ
বন্ধু হলো নিদারুণ
নিভে না পিরিতের আগুন জল ঢালিলে ॥

কার কুঞ্জে ভুলিয়া রইল করে না স্মরণ
জাতি কুল যৌবন দিয়া পাইলাম না তার মন
সখি উপায় বলো না বন্ধু বিনে অভাগিনী প্রাণে বাঁচি না
প্রাণে ধৈর্য মানে না
করিম কয় পাব কি না মরণকালে ॥

.

১০৫

আসি বলে চলে গেল আর তো ফিরে এলো না
আজ আসবে কাল আসবে বলে গো
আমার দিন যায় না রাত পোহায় না ॥

বাঁশিতে ভরিয়া মধু গো বাঁশি বাজাইত কালো সোনা
যেদিন হতে ছেড়ে গেল গো কালার বাঁশির গান আর শুনি না ॥

ভুলি ভুলি মনে করি গো ভুলিলেও ভোলা যায় না
নয়ন যদি ভোলে তারে গো আমার পাগল মনে ভোলে না ॥

যৌবনে পেয়েছি যারে গো তারে অন্তিমে কি পাব না
পাগল আবদুল করিম বলে গো আমার পাগল মনে বোঝে না ॥

.

১০৬

তোমরা নি দেখেছো মনচোরা গো সখি তোরা
যার কারণে নিশিদিনে নয়নে বয় ধারা গো ॥

একা ছিলাম ছিলাম ভালো কেন বন্ধে প্রেম শিখাইল গো
প্রাণপাখি উড়াইয়া নিল দিয়া কোন ইশারা গো ॥

হইলাম কলঙ্কের ভাগী বিনা রোগে হইলাম রোগী গো
না হইলে সর্বস্বত্যাগী দেয় না বন্ধে ধরা গো ॥

আবদুল করিম কয় গো সখি এইভাবে কতদিন থাকি গো
এনে দাও মোর প্রাণপাখি নইলে যাব মারা গো ॥

.

১০৭

সোনার অঙ্গ পুড়ে ছাই করিলাম গো কার লাগিয়া
আমি পাই না তারে প্রাণ বিদারী কত থাকি সইয়া গো ॥

বন্ধু যদি হইত আপন তবে কি আর এই জ্বালাতন গো
মনের দুঃখ হয় না বারণ কারে কই বুঝাইয়া গো ॥

সয় না প্রাণে দারুণ জ্বালা সোনার অঙ্গ হইল কালা গো
শোনো গো সখি সরলা আমি যাই যদি মরিয়া গো ॥

আমি মরলে তাই করিও তমাল ডালে বেঁধে থইও গো
বন্ধু আইলে তুমি কইও বন্ধু রে বুঝাইয়া গো ॥

যদি বন্ধুর মনে চায় আমারে যে দেখিয়া যায় গো
পাগল আবদুল করিমে গায় অকূলে ভাসিয়া গো ॥

.

১০৮

প্রাণবন্ধের পিরিতে সই গো কী জ্বালা হইল
মন মানে না ঘরে থাকতে সই গো আমার উপায় বলো ॥

প্রেম না করে ছিলাম সুখে দোষ দিত না পাড়ার লোকে
সবাই বাসত ভালো
প্রেম করিলাম কুল মজাইলাম কলঙ্কের ঢোল বেজে উঠল ॥

একে আমি কুলবালা ঘরে জ্বালা বাইরে জ্বালা
উপায় কী বলো
জ্বালার উপর দ্বিগুণ জ্বালা বন্ধু জানি কই রইল ॥

অন্তরে বিচ্ছেদের আগুন জ্বলছে সদায় হইয়া দ্বিগুণ
পুড়ে ছাই করিল
বাউল আবদুল করিম বলে পোড়ায় পোড়ায় জনম গেল ॥

.

১০৯

শ্যামলও সুন্দরও রূপ আমি যেদিন হইতে হেরি গো
পাগল মনে আমার লয় না ঘরবাড়ি ॥

আমি কি আর দুঃখ ছেড়ে সই গো সুখের আশা করি
মনপ্রাণ দিয়াছি যারে আমি কেমনে পাশরি গো ॥

পিপাসী চাতকির মতো সই গো অহরহ ঝুরি
মনে লয় যোগিনীর বেশে আমি হইতাম দেশান্তরী গো ॥

ধনে হীন মানে হীন আমি কাঙাল বেশে ঘুরি
দয়া নি করিবা বন্ধে আমায় জানিয়া ভিখারি গো ॥

বাউল আবদুল করিম বলে বন্ধু অকূলের কাণ্ডারি
বন্ধের নামেতে কলঙ্ক রবে আমি ডুবে যদি মরি গো ॥

.

১১০

যে গুণে বন্ধু রে পাব সে গুণ আমার নাই গো
যে গুণে বন্ধু রে পাব ॥

প্রাণপাখি মনের আনন্দে ঠেকেছে পিরিতের ফান্দে
তবে কেন নিরানন্দে কেঁদে দিন কাটাই গো ॥

যে গুণে আনন্দ বাড়ে আদর করে রাখে ধারে
গুণ নাই আমি করজোড়ে চরণছায়া চাই গো ॥

হইতাম যদি গুণে গুণী পাইতাম গো সেই পরশমণি
করিমের দিনরজনী আর ভাবনা নাই গো ॥

.

১১১

যে দুঃখ অন্তরে গো সখি কওনও না যায়
আর কতকাল গাঁথব মালা প্রাণবন্ধুর আশায় গো
সখি কওনও না যায় ॥

আমার কুঞ্জে আসবে বলে গো আমি আছি তার আশায়
পুষ্পচন্দন ছিটাই কত ফুলের বিছানায় গো ॥

আসবে বলে আশা দিয়া গো বন্ধে আমারে কাদায়
না জানি কার কুঞ্জে থেকে কার আশা পুরায় গো ॥

দারুণ বসন্তকালে গো আমি মরি প্রেমজ্বালায়
কোকিলার কুহু রবে পোড়া প্রাণ পুড়ায় গো ॥

বাউল আবদুল করিম বলে গো আমি হইলাম নিরুপায়
দেশান্তরী করবে মোরে প্রাণের বন্ধুয়ায় গো ॥

.

১১২

সখি গো বন্ধু রে দেখিবার মনে চায়
দুঃখ রবে জন্মান্তরে যদি অদর্শনে প্রাণ যায়
বন্ধুরে দেখিবার মনে চায় ॥

অনেক দিন হয় বন্ধু ছাড়া হলেম পাগলিনীর ধারা গো
ভাঙা কপাল লয় না জোড়া হইলাম আমি নিরুপায় ॥

ভাইবন্ধু-পাড়াপড়শি সবার কাছে হইলাম দোষী গো
প্রাণবন্ধুরে ভালোবাসি প্রাণ সঁপিয়া রাঙা পায় ॥

আমায় করে কুলবিনাশী প্রাণবন্ধু হইল বিদেশী গো
একদিন তো দেখল না আসি কী সুখে মোর দিন যায় ॥

যার জ্বালা সে জানতে পারে অন্যে জানবে কেমন করে গো
পাই না তারে প্রাণবিদারী কাঁদি বসে নিরালায় ॥

প্রেম করা যে প্রাণে মরা আগে তো কইলায় না তোরা গো
ঘরে পোড়া বাইরে পোড়া পোড়ায় পোড়ায় দিন যায় ॥

প্রাণ হয়েছে উড়োপাখি কেমনে বুঝাইয়া রাখি গো
এইভাবে কতদিন থাকি করি আমি কী উপায় ॥

পিপাপী চাতকির মতো আর আশায় কাদিব কত গো
করিম কয় আমার মতো দুঃখী নাই আর এ ধরায় ॥

.

১১৩

মন কান্দে প্রাণ কান্দে গো, কান্দে আমার হিয়া
দেশের বন্ধু বিদেশ গেল আমারে ভুলিয়া গো ॥

বৈশাখ মাসেতে সই গো বৎসর নবীন
প্রেম করিলাম বন্ধুর সনে ছিল শুভদিন
জ্যৈষ্ঠ মাস ভালোই গেল কী বলিব আর
কুক্ষণে আসিল সই গো দারুণ আষাঢ় গো ॥

আষাঢ় মাসেতে সই গো দুঃখ এল মনে
আপন বন্ধে প্রেম করিল বিদেশীর সনে
শ্রাবণ মাসেতে বন্ধুর পাই না গো আর দেখা
অভাগিনী দিনরজনী বসে কাঁদি একা গো ॥

ভাদ্র মাসে ওগো সখি গাছে পাকা তাল
দুঃখের উপরে দুঃখ যৌবন হইল কাল
আশ্বিন মাসেতে সই গো বরিষা হয় শেষ
আমি রইলাম একাকিনী বন্ধুয়া বিদেশ গো ॥

কার্তিক মাসে গোয়ারাঙ্গী অগ্রহায়ণে ধান
গৃহস্থ ভাই মাঠে যায় আনন্দে গায় গান
পৌষ মাসে অভাগিনী কাঁদি নিরালায়
মাঘ মাসের দারুণ জারে ধরল কলিজায় গো ॥

ফাল্গুন মাসেতে সই গো কোকিল করে গান
অভাগিনীর বন্ধু গেল, গেল কুলমান
চৈত্র মাসেতে সই গো বৎসর পূরণ
করিমের মনের দুঃখ হইল না বারণ গো ॥

.

১১৪

পিরিতি মধুর মিলনে স্বর্গ শান্তি আসে
পোড়া প্রাণ জুড়াবে কিসে
বন্ধু নাই যার দেশে গো–
পিরিতি মধুর মিলনে ॥

সোনা বন্ধু আসিলে আমার বাড়ি থাকিলে
বনফুল তুলিয়া
বিনা সুতে হার গাঁথিয়া গলেতে পরাইয়া গো ॥

ফুল বিছানা সাজাইয়া আতর গোলাপ ছিটাইয়া
মোমবাতি জ্বালাইয়া
প্রেমের বালিশ প্রেমের তোষক মশারি টাঙ্গাইয়া গো ॥

বন্ধু আমার রসিক চান বাটাতে সাজাইয়া পান
লং এলাচি দিয়া
আদর করে বন্ধুর মুখে দিব পান তুলিয়া গো ॥

পাইলে সোনা বন্ধুরে সকল জ্বালা যায় দূরে
আদরে বসাইয়া
করিম কয় মরণ ভালো বন্ধুরে দেখিয়া গো ॥

.

১১৫

পিরিতি কি সকলে জানে
পিরিতি যার ফলে সিদ্ধি হয় দুই কুলে
অকূলে কূল মিলে বলে মহাজনে ॥

পিরিতি রতন জেনে করো যতন
মাশুক কী ধন আশেকে জানে
তয়মুসের বালিকা নামে বিবি জ্বলেখা
একদিন ইউসুফের দেখা পাইল স্বপনে ॥

স্বপনে দেখিল, রূপ নয়নে লাগিল
পাগল হয়ে গেল সেই রূপধ্যানে
পাগলিনীর প্রায় যথা তথা যেতে চায়
বাপে বেড়ি দিয়া রাখে সাবধানে ॥

পাগল হয়ে গেল হুঁশবুদ্ধি হারালো
নিদ্রা নাই আর দুই নয়নে
অঘোর চিন্তায় একদিন ধরিল নিদ্রায়
সেই রূপ এসে দেখা দিল স্বপনে ॥

জিজ্ঞাসা যায় করিয়া আকুল হইয়া
কাঁদো গো জ্বলেখা কী কারণে
ইউসুফ আমার নাম পরিচয় দিলাম
মিশরে বাড়ি আমি থাকি সেখানে ॥

স্বপন দেখিল বিবি ভালো হয়ে গেল
বিবাহ বসিতে কয় নিজের জবানে
স্বপনের ইশারা-মতে মিশরের ইউসুফের সাথে
শাদি বসিল বিবি আনন্দ মনে ॥

জুলেখা দেখে চাহিয়া মিথ্যা বলিয়া
এখনও ইউসুফ রহিল গোপনে
কাঁদে জ্বলেখায় জানি না কিসের দায়
দেশ-খেশ ছাড়াইয়া মারিলে প্রাণে ॥

স্বপনে আসিয়া গেল শান্তি দিয়া
উজিরের ঘরে থাকো যতনে ॥

উজিরের ঘরে থাকো আমারে মনে রাখো
দিন পুরিলে পাবে সামনে ॥

একদিন শোনে জ্বলেখায় মানুষে বলে যায়
চাঁদ উঠেছে যেমন জমিনে
বিদেশী এক সওদাগরে ইউসুফ নামে এক জনেরে
বিক্রি করতে আনিল এখানে ॥

জুলেখা শুনিয়া বলে ধনরত্ব দিয়া
ইউসুফকে কিনিব যতনে।
যদি ধনরত্নে না কুলায় আমি ইউসুফের পায়
বিকাইয়া যাব আমার জিয়ন-মরণে ॥

ইউসুফরে কিনিল সপ্তমখানা বানাইল
কত কিছু করিল ইউসুফের কারণে
জ্বলেখা যত চায় ইউসুফ দূরে দূরে পলায়
প্রেমের আগুন হয়ে দ্বিগুণ বাড়ে দিনে দিনে ॥

এত কাদা কাঁদিল নয়ন অন্ধ হইল
ছাই পড়িয়া গেল রূপযৌবনে
একদিন কর্ণে শুনিল ইউসুফ রাস্তায় চলিল
পড়িয়া রহিল ঘোড়ার সামনে ॥

ইউসুফে দেখিয়া জিজ্ঞাসা যায় করিয়া
রাস্তার উপরে গো বুড়ি কী কারণে
বলে জ্বলেখায় পড়ে আছি রাস্তায়
ইউসুফকে দেখিতে বাসনা মনে ॥

ইউসুফ পরিচয় পাইয়া জিজ্ঞাসা যায় করিয়া
এখনও কি সে কথা তোর রয়েছে মনে
জ্বলেখা বলে তার পরীক্ষা চাহিলে
হাতের চাবুক ধরো আমার মুখের সামনে ॥

পরীক্ষার লাগিয়া হাতের চাবুক নিয়া
ধরে ছিল জ্বলেখার মুখের সামনে
জ্বলেখা ইউসুফ ইউসুফ বলিয়া উঠিল কাঁদিয়া
হাতের চাবুকে গিয়া ধরিল আগুনে ॥

ইউসুফে দেখিয়া সাথি সঙ্গী নিয়া
প্রার্থনা করিলেন জ্বলেখার কারণে
দোয়া কবুল হইল জ্বলেখার দুঃখ দূরে গেল
সাজিল বুড়ি আবার নবযৌবনে ॥

নির্মল প্রেমে মজেছিল জগতে ধন্য রইল
প্রশংসা লেখিল কোরানে
আবদুল করিম বলে প্রেমে প্রাণ দিলে
ভয় কী রে জিয়ন-মরণে ॥

.

১১৬

কলসি লইয়া কে গো জল ভরিতে যাও
বারে বারে কেন তুমি ফিরে ফিরে চাও ॥

ভ্রমরের বর্ণ জিনি কালো মাথার কেশ
শ্যামল বরন রূপে পাগল করলা দেশ
ঠমকে ঠমকে হাঁট মুনির মন ভুলাও ॥

পরেছ নীলাম্বরি বাতাসে দোলায়
পরান কাড়িয়া নিলে চোখ ইশারায়
কেমনে পাব তোমায় আমায় বলে দাও ॥

তুমি আমার আমি তোমার দুইয়ে এক জোড়া
মধুভরা ফুল তুমি আমি ভ্রমরা
করিম তোমার প্রেমে মরা তুমি গো বাঁচাও ॥

.

১১৭.

সখি তোরা প্রেম করিও না পিরিত ভালো না
পিরিত করছে যে জন জানে সে জন পিরিতের কী বেদনা ॥

প্রেম করে ভাসল সাগরে অনেকে পাইল না কূল
জগৎ জুড়ে বাজে শোনো পিরিতের কলঙ্কের ঢোল
দিতে গিয়ে প্রেমের মাশুল মান-কুলমান থাকে না ॥

লাইলি-মজনু শিরি-ফরহাদ ওদের খবর রাখ
নিন ইউসুফের প্রেমে জ্বলেখার হয় কত পেরেশানিতে
নবির প্রেমে ওয়াসকরনি যার প্রেমের নাই তুলনা ॥

পিরিত পিরিত সবাই বলে পিরিতি সামান্য নয়
কলঙ্ক অলঙ্কার করে দুঃখের বুঝা বইতে হয়
কাম হইতে হয় প্রেমের উদয় প্রেম হইলে কাম থাকে না ॥

প্রেমিকের প্রেম-পরশে হয় শুদ্ধ প্রেমের উদয়
প্রেমিক যে জন সে মহাজন নাই তার ঘৃণা লজ্জা ভয়
বাউল আবদুল করিমে কয় অপ্রেমিকে বোঝে না ॥

.

১১৮

সরল তুমি শান্ত তুমি নূরের পুতুলা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা ॥

যেদিন তোমারে প্রথম নয়নে হেরি
সেদিন হতে তোমার কথা ভাবনা করি
পাগল-বেশে ঘুরি ফিরি বাজাই বেহালা ॥

শুইলে তোমারে সদা স্বপনে দেখি
ঘুম ভাঙ্গিলে মনে হয় সকলি ফাঁকি
আমি তোমার ছবি আঁকি বসে নিরালা ॥

আমার হয়ে তুমি আমার কাছে আসিলে
আদর করে তোমাকে লইয়া কোলে
সুবাসিত বনফুলে পরাব মালা ॥

আমি তোমারে কী বলিব প্রিয়া
মনে রেখো গো তুমি আপন জানিয়া
করিমের খবর নিও থাকিতে বেলা ॥

.

১১৯

সরলা গো, কার লাগিয়া কী করিলাম
আপনার ধন হারাইয়া ধনের কাঙাল সাজিলাম ॥

ছেলেবেলা ছিলাম ভালো মনেতে আনন্দ ছিল
যৌবন আলো তার পরে পাইলাম
তোমারে আপন জানিয়া সঙ্গিনী করে নিলাম ॥

বুঝ মানে না পাগল মনে ঘুরলাম কত বনে বনে
কুলমানে জলাঞ্জলি দিলাম
সরল মনে দিয়া ব্যথা তোমারেও কাঁদাইলাম ॥

বাসনা কামনা নিয়া রিপুর বশে বশী হইয়া
এখন ভাবি কী করিলাম
বাউল আবদুল করিম বলে কই যাবো কেন আইলাম ॥

.

১২০

শাহজালালের আবাস ভূমি সিলেট জেলা হয়
এর লাগিয়া এই জেলারে জালালাবাদ সবে কয় ॥

ধান সরিষা পাট ফলে সিমেন্ট চুনাপাথর মিলে
সার ফলে গ্যাস মিলে চা পাতা সিলেটে হয় ॥

সিঙ্গেল পাথর বালু মিলে সিলেটেতে বাঁশ ফলে
ছাতকে পেপার মিলে পাবে তাহার পরিচয় ॥

সিলেটে ভাসা পানি বর্ষায় হয় নাও দৌড়ানি
মাছের ফলন ভালো জানি আছে অনেক জলাশয় ॥

নদীনালা খালে বিলে অনেক জাতের মাছ মিলে
বাউল আবদুল করিম বলে মাতৃভূমি স্বৰ্গৰ্ময় ॥

.

১২১

ফুরু থাকতে যে খেইল খেলাইতাম
পুয়া-পুড়ি বইয়া হাততালি দিয়া
কেমন সুন্দর বিয়ার গান গাইতাম ॥

ধুলা-বালু লইয়া ঠুলি-ঠালি দিয়া
উন্দাল কাটিয়া রান্ধা বওয়াইতাম
বিরুন ভাত রানতাম দামান খাবাইতাম
তেনার কন্যা বানাইয়া দানে বিয়া দিতাম ॥

মামুর বাড়ি যাইতাম দুধ-কলা খাইতাম
রাইত অইলে নানির কোছো ঘুমাইতাম
লুকালুকি খেলাইতাম আমি যখন লুকাইতাম
তুকাইয়া না পাইলে টুলুক দিতাম ॥

বয়স যখন নয় দাঁত পড়বার সময়
কাউয়ায় দেখলে দাঁত উঠে না বিশ্বাস করতাম
পড়া দাঁত নিয়া নানিরে দেখাইয়া
কইলার তলে দাঁত গাড়িয়া থইতাম ॥

পানিতে লামিতাম সাঁতার খেলিতাম
সাঁতার শিখবার লাগি পোকড়া আম খাইতাম
আবদুল করিম বলে ইশকুলো গেলে
মাস্টরসাব মরবার লাগি দোয়া করিতাম ॥

.

১২২

যাও যদি আও দলে দলে উঠেছে বেলা
পয়লা ফাগুনে আইলো ধলের মেলা ॥

যাইতে মেলা বাজারে রাস্তাতে নদী পড়ে
আগে যারা রাস্তা ধরে যায় বড় ভালা ॥

ঠিক রাখিও মনের গতি জুয়া খেলায় দিও না মতি
ভাই রে ভাই দিনে ডাকাতি তিন তাসের খেলা ॥

দেখবে কত সার্কাসবাজী দেখলে মন হয় যে রাজি
হাতে যদি থাকে পুঁজি খাবে রসগোল্লা ॥

করিমের পয়সা নাই রসগোল্লা খাই না খাই
রস বিলাইতে আমি যাই ওগো সরলা ॥

.

১২৩

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম ॥

বর্ষা যখন হইত গাজীর গাইন আইত
রঙ্গে-ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম
বাউলা গান ঘাটুগান আনন্দের তুফান
গাইয়া সারিগান নাও দৌড়াইতাম ॥

হিন্দু বাড়িত যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
কে হবে মেম্বার কে হবে গ্রামসরকার
আমরা কি তার খবর লইতাম ॥

বিবাদ ঘটিলে পঞ্চাইতের বলে
গরিব কাঙালে বিচার পাইতাম
মানুষ ছিল সরল ছিল ধর্মবল
এখন সবাই পাগল বড়লোক হইতাম ॥

করি ভাবনা সেদিন আর পাব না
ছিল বাসনা সুখী হইতাম
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম ॥

.

১২৪

চাল ছানিত্ কামলা চাচা দিলায় না
মাইয়ে করলা মুরুগ জবো
আইয়া তুমি খাইলায় না ॥

চাইচ্চে হিদিন মুরুগ লইয়া
মাইর লগে ঝগড়া করিয়া
গোসা করি গেছইন কইয়া
তোমরার বাড়িত যাইতাম না।
বন্দেপাত্রে থাকি আমরা
ঝগড়া করলা তারা তারা
এই বিষয়ে ভালাবুরা
আমি কুন্তা জানি না ॥

আরিপরি মিইল্যা খাওন
ভালা-বুরায় খবর লওন
বেহুদ্দা ঝগড়া করন
ইতা আমি ভালা পাই না।
পারি না মাইরে বুঝাইয়া
তাইন কিছু বেনারাইয়া
যেছা একটা কথা লইয়া
ধরলে কথা ছাড়ইন না ॥

আমি ইতা কানো লই না
আনাকামে মাত্ বেশাই না
পরের কথায় ফাল মারি না
ঝগড়া ফসাদ ভালা না।
মন থাকি ইতা ছাড়ি দিও
করিমরে মন্দ কইও
বিয়ালে চাচা বেড়ানিত্‌ যাইও
দুইন্যাই বেটা কুন্তা না ॥

.

১২৫

পুরুষ : খালি বাড়ি থইয়া নাইওর যাইতে দিব না

নারী : তুমি ইতা কিতা কও, আমি কিছু বুঝি না
আষাঢ় মাসে নাইওর যাইতে কে করে মানা ॥
আদিলকিলা কথা কইলে গায়ে আমার আগুন জ্বলে
জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস আইলে কোন বেটি নাইওর যায় না
আষাঢ় মাসে নাইওর যাইতে কে করে মানা ॥

পুরুষ : তুমি আমি দুইজন মাত্র ঘর ভরা জিনিসপত্র
মোরগরে কে গুড়া দিত, আমি ইতা পারি না
খালি বাড়ি থইয়া নাইওর যাইতে দিব না ॥

নারী : আম খাইমু কাঁঠাল খাইমু নয়া একখান কাপড় পাইমু
ভাই-বইনরে দেইখ্যা আইমু আমার কি মনে চায় না?
আষাঢ় মাসে নাইওর যাইতে কে করে মানা ॥

পুরুষ : নাইওর যদি যাইতে চাও কুনদিন আইবায় কইয়া যাও
নারী : আনতে যদি তুমি না যাও আমি ইবার আইতাম না
আষাঢ় মাসে নাইওর যাইতে কে করে মানা ॥

.

১২৬

ও বুবাইজি আমার দুঃখ কার ঠাঁই গো কইতাম
তোমরা কি দোয়া কর অউলাখান দিন কাটাইতাম ॥

মা-বাপে বিয়া দিলা মান ইজ্জতর দায়
তাইন করইন আবুল-তাবুল মনে যেতা চায়
আমারে ঠেকাইছে আল্লায়
আমি কও কিতা করতাম ॥

আমারে হুনাইন না কুনতা মনে মনে ঘুরইন
বুঝর কথা কইলে আরো রাগ-গোসা করইন
পুয়া পুড়িরে মারইন-ধরইন
মনর ভাব কিতা বুঝতাম ॥

কাম না করি ভাত খাওয়া ওই যে মনোভাব
ইতা তো সংসারখান নষ্ট করবার স্বভাব
হেষে যদি পড়ে অভাব
মান ইজ্জত কি হারাইতাম ॥

বাউল আবদুল করিম বলে সবারে জানাই
কাম করো হালাল করে খাও দশ নউকর কামাই
থাকতে আমার তনু-তনাই
পরর হগ্‌দা কেনে খাইতাম ॥

.

১২৭

ভালা মানুষ পাগল হইলাম
বউ ঘরে আইন্যা
বিয়া করিলাম গো না জাইন্যা ॥

ভালা-মন্দ না বুঝিয়া
জমি বেইচ্যা করলাম বিয়া
পাঁচ ছেলে ছয় মাইয়া
ছোটলার নাম মইন্যা
বিয়া করিলাম গো না জাইন্যা ॥

বাড়ি ভরা পুয়া-পুড়ি
খাইতে শুইতে হুড়াহুড়ি
আগে করতাম বেটাগিরি
এখন চলি মাইন্যা
বিয়া করিলাম গো না জাইন্যা ॥

একা ছিলাম ছিলাম ভালো
বিয়ার কী দরকার ছিল
আমারেনু ভূতে পাইল
পরের কথা হুইন্যা
বিয়া করিলাম গো না জাইন্যা ॥

আবদুল করিম ভাবে এখন
আগের কথা করে স্মরণ
আমরা যখন ছিলাম দুইজন
এণ্ডা খাইতাম ভুইন্যা
বিয়া করিলাম গো না জাইন্যা ॥

.

১২৮

লাউ কুমড়া লাগাইও গো, ওগো ভাবী সময় আইছে
পেট ভরে খাইতে পারি না দুঃখে কি জান বাঁচে গো
ওগো ভাবী সময় আইছে ॥

পাই না আনাজ-তরকারি আকাল পড়ে গেছে
ফলাইয়া সব খাইতে হবে আগের দিন কি আছ গো ॥

মাছ মাংসের অভাব ছিল না দিন গেছে পাছে
দুই আনা দুধের সের বাড়িত আইন্যা দিছে গো ॥

দুধ-মাটার অভাব দেখিয়া ঘাসি-ঘি বারইছে
দুই আনার দুধ ছয়-সাত টেকা ভেজাল দিয়া বেচে গো ॥

আনারস কমলা লেবুর নামটি মাত্র আছে
আম-কাঠালের দামে যেন আগুন লাইগ্যা গেছে গো ॥

পিছের খান গনে না মানুষ টেকার তালে নাচে
টেকা-টেকা কইরা মানুষ পাগল হইয়া গেছে গো ॥

বাউল আবদুল করিম বলে আর কী হবে পাছে
জীবনে দেখছি না যে আল্লায় দেখাইতাছে গো ॥

.

১২৯

আল্লায় যেন কর্জের লাগি কেউর বাড়িত নেয় না
মজুরি করিয়া খাইমু ভাত যদি খাইতে পাই না ॥

আগে যে কর্জ আনতাম সুদ-বাট্টা দিতাম না
এখন বড় বেইজ্জতি সুদ লাগে তিন চাইর দোনা ॥

সময় মতো না দিলে আর মান ইজ্জত বাঁচে না
আর কিতা দেখাইবা আল্লায় আইছে কলির জমানা ॥

সাক্ষাৎ চাচার ঘরর ভাই চশম-ভরম করে না
যাই যদি কুন্তার লাগি কথা কয় উনা-হুঁকনা ॥

বাপর খালি জমিন থাকতে নিজর বুঝখান বুঝলাম না
সময় থাকতে এই বুঝখান আমারে কেউ দিল না
করিম কয় এখন বুঝি, এই বুঝ আগে ছিল না ॥

.

১৩০

রঙিন টাকা, ও রঙিলা টাকা রে
তুমি রঙে রঙে খেল
টাকা রে, তোমার যে ধন্য জীবন সবাই বাসে ভালো রে ॥

যার হাতে যাও তার কথা কও এই যে তোমার রীতি
টাকা রে, তোমার ভালোবাসা যেমন কালো মাইয়ার পিরিতি রে ॥

কত জ্ঞানী কত গুণী তোমার প্রেমে পড়ে
টাকা রে, তোমারে পাইবার আশায় কতকিছু করে রে ॥

তুমি যার কাছে থাকো তারে করো ধনী
টাকা রে, তোমারে না পাইলে যেমন মণিহারা ফণী রে ॥

তোমার ভক্ত এ সংসারে প্রতি ঘরে ঘরে
টাকা রে, ভক্তিপূর্ণ অন্তরে তোর আরাধনা করে রে ॥

মানুষ যারা দিছে তারা তোমার মুখে ছাই
টাকা রে, মিছা ভবে তোমায় নিয়া মাতালের বড়াই রে ॥

যে তোমায় ভালোবাসে না তারে কয় পাগল
টাকা রে, করিমের দেনার খাতায় হইল না উসল রে ॥

.

১৩১

আমি ঠেকলাম ভরের বুঝা লইয়া
দিবানিশি অবসর নাই জীবন ভরিয়া ॥

বার মাস কিন্যা খাই তেল আনলে কয় লবণ নাই
কী করে যে ইজ্জত বাঁচাই পাই না আর ভাবিয়া ॥

বউয়ের কী আমিরানা জর্দা ছাড়া পান খায় না
আমারে বিশ্বাস করে না নানান্তা যায় কইয়া ॥

আমারও দোষ আছে চিন্তা করে দেখি পাছে
ভালা মাথা পাগল হইছে ভবের নিশা খাইয়া ॥

পুয়ার বয়স ষোল্ল বছর পিন্দিতে চায় টেডি কাপড়
হে তো জানে না খবর খায় যে কই থাকিয়া ॥

একী জঞ্জালে পাইল দিনে দিনে দিন ফুরাইল
করিম কয় যারা গেল আইলো না ফিরিয়া ॥

.

১৩২

দিরাই থানায় বসত করি হাওর এলাকায়
অবস্থা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা দায় ॥

হাড়ভাঙা খাটনির বলে জমিতে যে ফসল ফলে
হয়তো নেয় বন্যার জলে নইলে নেয় খরায় ॥

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বছরে এক ফসল মিলে
সে ফসল নষ্ট হইলে প্রাণে বাঁচা দায় ॥

আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি
গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায় ॥

ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না
বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায় ॥

বাউল আবদুল করিম ভাবে গরিব যারা ঠেকছে ভবে
বিপদে দরদি হবে মিলে না ধরায় ॥

.

১৩৩

চৈত্র মাসে বৃষ্টির জলে নিল বোরো ধান
ভেবে মরি হায় কী করি বাঁচে কি না প্রাণ ॥

হাওর এলাকায় থাকি আমরা কৃষাণ
হাড়ভাঙা পরিশ্রম করি ফলাই বোরো ধান
এসে বন্যার জল অকালে ডুবাইয়া নিল
হাওরের ফসল মানুষ হয়েছে পাগল
গরিবের নাই সহায় সম্বল বড়ই নিদান ॥

দারুণ সমস্যা এসে দাঁড়ালো হঠাৎ
ঘাস বিনে মরিবে গরু মানুষের নাই ভাত
বাড়ির ঘাটেতে পানি গরিবের ভাঙা ঘর
চালে নাই ছানি ভাবে দিন রজনী
কার দুঃখ কেবা শুনি সবাই পেরেশান ॥

স্ত্রী বলে, ওগো আমি বলো কোথায় যাই
লবণ মরিচ পিঁয়াজ রসুন কেরোসিন তৈল নাই
জানো তো খবর একেবারে ছিঁড়ে গেছে মোর
পরনের কাপড় এবার সমস্যা বিস্তর
স্বামী বলে, নৌকা নাই মোর বড়ই নিদান ॥

এই দেশেতে ফসল রক্ষা বড়ই বিভ্রাট
দেশের যত নদী নালা হয়েছে ভরাট
বৃষ্টি হইলে কূল ডুবাইয়া নদীর পানি
হাওরে চলে–ফসল নিল সমূলে
নদী খনন না হইলে নাই সমাধান ॥

যে পানিতে সোনার ফসল ডুবাইয়া নিল
স্বচক্ষে দেখেছো পানি কোন পথে আইলো
ফিরে আসবে বারেবার যমে চিনেছে বাড়ি
হও হুঁশিয়ার নইলে উপায় নাই যে আর
ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার খোঁজে নেও সন্ধান ॥

আর কোনো ভরসা নাই করি এক ফসল
বারে বারে নষ্ট করে এসে বন্যার জল
দুর্বলতা ছাড়ো বাঁচার জন্য কাজ করে যাও
নিজে যাহা পারো কোদাল শক্ত করে ধর
করিম বলে চেষ্টা করো হইবে কল্যাণ ॥

.

১৩৪

গানের ভিতর প্রাণের কথা বলবার মনে চায়
এই দেশের গরিব কাঙাল হলো নিরুপায় ॥

গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের শুনলাম কত গান
ধর্মের নামে অধর্ম তাই ঘটল অকল্যাণ
কত কিছু শুনি
আসলে দিনে দিনে বাড়ে পেরেশানি
জীবন নিয়ে টানাটানি প্রাণে বাঁচা দায় ॥

গরিব কৃষকের কথা কী আর বলি
মহাজনের ঋণ শোধিতে হয়ে যায় খালি
আছে নিদারুণ শোষণ
সুদ-ঘুষের কবলে পড়ে গরিবের মরণ
চলে যায় হাড়ভাঙা ধন মহাজনের গোলায় ॥

গ্রামের বিপন্ন মানুষ দিনমজুর যারা
অগাধ বর্ষার দিনে কী করবে তারা
যদি না খেয়ে মরে
শাসক হইবে দায়ী নিজের বিচারে
শান্তিতে এই দেশের মানুষ বেচে থাকতে চায় ॥

আবদুল করিম বলে আমার মন যাহা চায় গাই
আমি অতি মূঢ়মতি বিদ্যাবুদ্ধি নাই
আমি বাংলা মায়ের সন্তান
দেশকে ভালোবাসি বলে গাই স্বদেশী গান
শোষণহীন সমাজব্যবস্থা আমার মনে চায় ॥

.

১৩৫

ওরে চাষি ভাই, শক্ত হাতে লাঙ্গল ধরা চাই
যত্ন গুণে রত্ন ফলে পরিশ্রমে প্রাণ বাঁচাই ॥

উৎপাদনের প্রয়োজনে চলো এবার সর্বজনে
মাটির সনে মনেপ্রাণে আমরা করি লড়াই ॥

কৃষক মজুর সবাই মিলে আছি বাংলামায়ের কোলে
পরিশ্রমে সোনা ফলে তবে কেন দুঃখ পাই ॥

মাছ ফলাও গাছ লাগাও যত পারো শবজি ফলাও
পাট ফলাও তুলা ফলাও ধান সরিষা বুট কালাই ॥

কাজ করে যাও মনোবলে কৃষক মজুর তাঁতি জেলে
বাউল আবদুল করিম বলে এ ছাড়া আর উপায় নাই ॥

.

১৩৬

ও ভাই জোর জুলুমি ছাড়ো
মানুষ যদি হইতে চাও মানুষের সেবা করো ॥

স্রষ্টায় সৃষ্টি করেছে সবাই বলো স্রষ্টা আছে
পরিণাম রয়ে গেছে এখন যাহা করো
কলেমা নামাজ রোজা ইমান হইল বড়
ইমান যদি ঠিক না থাকে কিসের নামাজ রোজা করো ॥

মানুষ খোদার প্রিয় পাত্র তারে না ভাবিয়া মিত্র
টাকা পয়সা জমি জুত্র তাই ভেবেছ বড়
স্বার্থ নিয়া দলাদলি ভাইয়ে ভাইরে মারো
দুর্বলেরে দায় ঠেকাইয়া বলপূর্বক ডাকাতি করো ॥

আজ যা আছে কাল রবে না টাকা পয়সা যতই কও না
শক্তি বল যৌবন থাকে না অবশেষে মরো
মরলে কিছু সঙ্গে যায় না নিজেই বুঝতে পারো
তুমি বা কার কে-বা তোমার আগে নিজের বিচার করো ॥

মানুষ হওয়ার ইচ্ছা থাকলে মানুষের সেবা করিলে
বাউল আবদুল করিম বলে মানুষ হইতে পারো
হিংসা নিন্দা দিলের গুমান লোভ লালসা ছাড়ো
ছয় রিপুকে বাধ্য করে প্রেমবাজারে ব্যাপার করো ॥

.

১৩৭

জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বলো ওগো সই
এ জীবনে যত দুঃখ কে দিয়াছে বল তাই ॥

দোষ করিলে বিচার আছে সেই ব্যবস্থা রয়ে গেছে
দয়া চাই না তোমার কাছে আমার উচিত বিচার চাই
দোষী হলে বিচারে সাজা দিবা তো পরে
এখন মারো অনাহারে কোন বিচারে জানতে চাই ॥

এই কি তোমার বিবেচনা কেউরে দিলা মাখন ছানা
কেউর মুখে অন্ন জুটে না ভাঙা ঘরে ছানি নাই
জানো শুধু ভোগবিলাস জানো গরিবের সর্বনাশ
কেড়ে নেও শিশুর মুখের গ্রাস তোর মনে কি দয়া নাই ॥

তোমার এসব ব্যবহারে অনেকে মানে না তোমারে
কথায় কথায় তুচ্ছ করে আগের ইজ্জত তোমার নাই
রাখতে চাইলে নিজের মান সমস্যার করো সমাধান
নিজের বিচার নিজেই করো আদালতের দরকার নাই ॥

দয়াল বলে নাম যায় শোনা কথায় কাজে মিল পড়ে না
তোমার মান তুমি বোঝ না আমরা তো মান দিতেই চাই
তুমি আমি এক হইলে পাবে না কোনো গোলমালে
বাউল আবদুল করিম বলে আমি তোমার গুণ গাই ॥

.

১৩৮

ওরে মেলা দিতে জ্বালা কার মন্ত্রণা পাইলে
এই দেশে কেন বা তুই আইলে ॥

প্রথম ফাল্গুন মাসে আসিলে নবীন বেশে
ধনীরে ভালোবেসে গরিবরে কাঁদাইলে ॥

আছে যাদের টাকাকড়ি মেলায় যাবে তাড়াতাড়ি
গরিবের মাথায় বাড়ি পড়িয়া ভেজালে ॥

ঘরে বেটার খাওন নাই অতিথ আইল মেয়ের জামাই
কুলমানে দিতে ছাই বড়-ই সুযোগ পাইলে ॥

মেলা তোরে করি মানা এই বেশে তুই আর আসিস না
গরিবরে দুঃখ দিস না আবদুল করিম বলে ॥

.

১৩৯

দয়াময় নামটি তোমার গিয়াছে জানা
গরিব যারা হয় তারা কি তোমার নয়
তবে কেন দয়াময় দয়া হয় না ॥

থাকে ভাঙা ঘরে কত কষ্ট করে
অনাহারে মরে অন্ন জোটে না
হলে দারুণ ব্যাধি নাই তার ঔষধি
দারুণ বিধি তোমার ভাব বুঝি না ॥

কেহ ভিক্ষা করে ফিরে দ্বারে দ্বারে
তবু স্মরণ করে নাম ভোলে না
দীনহীন জনে ডাকে আকুল প্রাণে
দুঃখের আগুনে একটু জল ছিটাও না ॥

নিরুপায় যারা ডেকে ফিরে তারা
দাও না তুমি সাড়া, করো ঘৃণা
বুঝিলাম এখন গরিব তোমার দুশমন
কাঁদিয়া ডাকিলে যখন মন গলে না ॥

আবদুল করিম বলে তব দয়া হলে
অকূলে কূল মিলে দুঃখ রয় না
তুমি দয়ার সিন্ধু দাও না একবিন্দু
কাজে তুমি ধনীর বন্ধু, গরিবের না ॥

.

১৪০

ঈদ আসলে কি দুঃখ দিতে?
আপন পর বেছে নিলে আসলে না সবার বাড়িতে ॥

কেউ খাবে আজ মাখন ছানা কেউ করিবে আমিরানা
অনেকে খাইতে পাবে না কাঁদিবে মনের আঘাতে ॥

এত বৈষম্য কেন তুমি নি তার খবর জান?
নইলে আমার কথা মানে আসিও না এই দেশেতে ॥

কেউ হাসে কারো কাদা দেখে দুঃখ লাগে ভাঙাবুকে
আবদুল করিম মনের শোকে চায় তোমায় মন্দ বলিতে ॥

.

১৪১

মনের দুঃখ কার কাছে জানাই মনে ভাবি তাই
দুঃখে আমার জীবন গড়া তবু দুঃখরে ডরাই ॥

গরিবকুলে জন্ম আমার আজও তা মনে পড়ে
ছোটবেলা বাস করিতাম ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে
দিন কাটিত অর্ধাহারে রোগে কোনো ঔষধ নাই ॥

একসঙ্গে জন্ম যাদের তেরশো বাইশ বাংলায়
আনন্দে খেলে তারা ইস্কুলে পড়িতে যায়
আমার মনের দুর্বলতায় একা থাকা ভালো পাই ॥

পিতামাতার ছেলে সন্তান একমাত্র আমি ছিলাম
জীবন বাঁচাবার তাগিদে প্রথম চাকুরিতে গেলাম
মাঠে থাকি গরু রাখি ঈদের দিনেও ছুটি নাই ॥

সবসময় গান গাইতাম মনের এই স্বভাব ছিল
আমাকে নয় গানকে তখন অনেকে বাসত ভালো
রাগ-রাগিনি ভালো ছিল রচনা করিয়া গাই ॥

চাকুরি তখন ছেড়ে দিলাম হাতে নিলাম একতারা
দিবারাত্র গান গাই লোকেলে বেসরা
উদাস মনের চিন্তাধারা মন যাহা চায় তাই গাই ॥

গ্রামের মুরুব্বি আর মোল্লা সাহেবের মতে
ধর্মীয় আক্রমণ এল ঈদের দিনে জামাতে
দোষী হই মোল্লাজির মতে পরকালেও মুক্তি নাই ॥

নিষেধ বাধা না মানিয়া কুলের বাহির হইলাম
একতারা সঙ্গে নিয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে দিলাম
ঘর ছাড়া বাউল সাজিলাম সকলেরই করিম ভাই ॥

.

১৪২

সালাম আমার শহীদ স্মরণে
দেশের দাবি নিয়া দেশপ্রেমে মজিয়া
প্রাণ দিলেন যে সব বীর সন্তানে ॥

ভাষার দাবি লইয়া আপনহারা হইয়া
স্মৃতি গেলেন রাখিয়া বাঙালির মনে
সালাম বরকত জব্বার প্রিয় সন্তান বাংলার
ভুলিবার নয় ভুলিব কেমনে ॥

জন্ম নিলে পরে সবাই তো মরে
স্বাভাবিক মরা এই ভুবনে
দেশের জন্য প্রাণ যারা করে দান স্মরণ করি আজ ব্যথিত মনে ॥

জন্ম নিলে পরে সবাই তো মরে
স্বাভাবিক মরা এই ভুবনে
দেশের জন্য প্রাণ যারা করে দান
স্মরণ করি আজ ব্যথিত মনে ॥

লভিব অধিকার ঘুচাবো আঁধার
শপথ বারেবার মনপ্রাণে
আবদুল করিম বলে শোষণমুক্ত হলে
হাসি ফুটিবে সবার বদনে ॥

.

১৪৩

দারুণ দুর্ভিক্ষের আগুন
লাগলো কলিজায় রে
প্রাণে বাঁচা দায়
প্রাণে বাঁচা দায় রে ॥

এ দেশের দুর্দশার কথা
কহনও না যায়
পেটের ক্ষুধায় কত লোকে
লতাপাতা খায় রে ॥

এ দেশের গরিব কাঙাল
চেষ্টা করে বাঁচতে চায়
ভালো চাইলে মন্দ ফলে
কোন শয়তানে পথভোলায় ॥

জুলুমের বিরুদ্ধে যখন
জনতা রুখে দাঁড়ায়
দালালগোষ্ঠী নেমে আসে
বিভ্রান্তি ঘটায় রে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
ঠেকছি ভবযন্ত্রনায়
উচিত কথা বলি যদি
শোষক দলে চোখ রাঙায় ॥

.

১৪৪

কোন দেশে যাই বলো
সুখের আশায় দুঃখের বুঝা
বওয়া সার হইল ॥

ভাইরে ভাই, অবিচারে রাজ্য নষ্ট
জ্ঞানী গেছেন বলে
দেশ করেছে লক্ষ্মীছাড়া
স্বার্থভোগীর দলে
কত অঘটন ঘটাইল
ভালো করবে বলে মাথায়
কুড়ালি মারিল ॥

ভাইরে ভাই, সাবধানে চালাইও নৌকা
সত্যের হাল ধরিয়া
কত ভালোলোকের জাতি গেল
কুসঙ্গ করিয়া ।
অমানুষে সোনার দেশে
এই দুর্দিন আনিল
এখনও সময় আছে
বিচার করে চল ॥

ভাইরে ভাই, বাউল আবদুল করিম বলে
আমার এই মিনতি
কু-মানুষের সঙ্গে কভু
করো না পিরিতি।
নিজের দেশের মানুষ তোদের
চিনা-জানা ভালো
দরদি সেজে যারা
তোদের কাছে এল ॥

.

১৪৫

বলো ভোট দিব আজ কারে?
ভোট দিব যে দেশের সেবক ভোট দিব না যারে-তারে ॥

যারা মোদের ভোট নিয়া ভোটের বলে নেতা হইয়া
গরিবের খুন বিকাইয়া নিজের স্বার্থ করে
এমন মানুষ যারা যারা এসেছে নজরে
ভোট দেওয়া তো দূরের কথা দেশের শত্রু বলি তারে ॥

দেশের সেবক হবে যারা ভোটের অধিকারী তারা
ধোকাবাজি করে যারা তারা থাকুক দূরে
মানুষ হয়ে মানুষের দরদ নাই যার অন্তরে
এই দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথায় ভুলিবে না এবারে ॥

আবদুল করিম বিনয় করে থাকবেন সবাই বুঝের ঘরে
ভোট দিবে না যারে-তারে প্রলোভনে পড়ে
নিজের দোষে দোষী হলে দোষ দিবা আর কারে
কত দুষ্ট লোক ইলেকশনে পাস করতে চায় টাকার জোরে ॥

.

১৪৬

মোদের কেউ নাই রে কৃষক মজুর ভাই
হাড়কুটা পরিশ্রম করি খাইতে নাহি পাই ॥

সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদ সামন্তবাদ মিলে
দেশের সম্পদ লুটে নিল তিন ডাকাতের দলে ॥

উচিত কথা কইতে গেলে জেল জুলুমের ডর
পেটে ভাত রোগে ঔষধ নাই, পরার নাই কাপড় ॥

স্কুলেতে ধনীর ছেলে ধনীর পড়া পড়ে
গরিবের ছেলে মেয়ে অনাহারে মরে ॥

ডাক্তারখানায় ডাক্তারগণ আছেন দলে দলে
গরিব কি ঔষধ পাবে পয়সা ছাড়া গেলে ॥

কোর্ট-কাছারি খোলা আছে হইতেছে বিচার
গরিবে কি বিচার পাবে পয়সা নাই যাহার ॥

শোষিত গরিব যারা হলো নিরুপায়
শোষকের শোষণের পালা চলছে সর্বদায় ॥

দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে করিয়া কৌশল
বৎসরে বৎসরে আসে দারুণ বন্যার জল ॥

বাড়ি ভাঙে ফসল নেয় বন্যার পানি আসে
জোতদার সুদখোর মহাজন সুযোগ দেখে হাসে ॥

বাড়ি জমি অল্প দামে কিনবে মহাজন
সুদের বাধন গলে বাধবে গরিব কৃষকগণ ॥

খাজনা-ট্যাক্সের চাপ দিয়েছে চেয়ারম্যান তহশিলদার
লোটা বাটি ক্রোক করে উপায় নাই তো আর ॥

শোষকের ইমারত গড়তে নেতারা পাগল
রঙবেরঙে বের হয়েছে ভোটশিকারী দল ॥

কেহ বলে জাগো বাঙালি উড়াও জয় নিশান
কেহ বলে ধর্ম গেল জাগো মুসলমান ॥

কৃষক মজুরের কেহ গায় গুণগান
আসলে ধাপ্পাবাজি ভোট নেওয়ার সন্ধান ॥

বাউল আবদুল করিম বলে সূক্ষ্ম রাস্তা ধরো
শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে বাঁচার উপায় করো ॥

.

১৪৭

পল্লীগ্রামের কবি আমি পল্লীর গান গাই
স্বাধীন দেশে শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চাই
তাই তো মনে পড়ে ॥

মনে পড়ে, বারেবারে ভুলিতে না পারি
শোষক আর শোষিতে লাগিল মারামারি
জাগো সর্বহারা ॥

সর্বহারা, শোষিত যারা আমরা ভাই ভাই
এবার করিতে হবে মুক্তির লড়াই
মানুষ মুক্তির তরে ॥

মুক্তির তরে, চলছে জোরে জীবন করে পণ
দেশে দেশে চলছে রোষে মুক্তিযুদ্ধের রণ
মুক্তির আলোকে ॥

মুক্তির আলোকে, লাখে লাখে লড়ছে বীরের দল
সমাজতন্ত্রের ঝড় উঠেছে হইয়া প্রবল
সারা বিশ্বজোড়া ॥

বিশ্বজোড়া, সর্বহারা জাগিল এবার
শোষকের ইমারত ভেঙে হবে চুরমার
অতি তাড়াতাড়ি ॥

তাড়াতাড়ি, নাই দেরি শোনো সমাচার
জনসমুদ্রে এল বিপ্লবী জোয়ার
শোষকের বাঁধ ভাঙিয়া ॥

বাঁধ ভাঙিয়া, চলছে ধাইয়া সারা দুনিয়ায়
আফ্রিকা এশিয়া এবং লেটিন আমেরিকায়
এবার পাকিস্তানে ॥

পাকিস্তানে, শোষকগণে বিপদ দেখিয়া
আইয়ুব-মোনায়েমকে নিল সরাইয়া
বসে গোলটেবিলে ॥

গোলটেবিলে, সবে মিলে পরামর্শ করে
আইয়ুবের আসনে বসায় ইয়াহিয়ারে
অতি কৌশল করে ॥

কৌশল করে, ইয়াহিয়ারে সামনে এনে ধরে
পুরান মদ নতুন বোতলে দিল ভরে
নতুন রঙ ধরিল ॥

রঙ ধরিল, আশা দিল গণতন্ত্র দিবে
এবার ভাবছে ভোটের ফাঁদে মোদেরে ঠেকাবে
খালি ধোঁকাবাজি ॥

ধোঁকাবাজি, কী কারসাজি দেখ না ভাবিয়া
ভোটের মাঠে নেমে গেল সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়া
যারা ভোটশিকারী ॥

ভোট শিকারী, তাড়াতাড়ি দেরি না করিয়া
ভোটের বাজার গরম করল ঢাক-ঢোল পিটাইয়া
দালাল টাউট যারা ॥

দালাল যারা, এবার তারা মহা সুযোগ পাইয়া
দেশদরদি সাজল তারা স্বার্থের ছালা লইয়া
পকেট গরম হইল ॥

গরম হইল, লেগে গেল ভোটের লড়াই
কেউ বলে বাঙালি জাগো স্বাধীন বাংলা চাই
লাগল মারামারি ॥

মারামারি, ঢাকার বুকে ভোটার লিস্টি লইয়া
বিহারী আর বাঙালিতে রায়ট গেল হইয়া
বাজার জমল ভালো ॥

জমল ভালো, নৌকায় দিল রঙিন বাদাম
শেখ মুজিব টাইটেল পাইলেন বঙ্গবন্ধু নাম
মনে আশা ছিল ॥

আশা ছিল, পূর্ণ হইল বাড়লো মনোবল
ধর্মের জিকির লয়ে হাজির হলেন আরেক দল
ও ভাই ধর্ম গেল ॥

ধর্ম গেল, সমাজতন্ত্র আসে যদি ভাই
সমাজতন্ত্রের মধ্যে কোন ধর্মাধর্ম নাই
আসবে দুর্নীতি ॥

দুর্নীতি, হবে ক্ষতি ধর্ম রবে না
তারা আরম্ভ করলেন এসব তালবাহানা
গরিবের উপায় নাই আর ॥

উপায় নাই আর, বাঁচার জোগাড় নাই কোনো মতে
গরিবের উপায় কেবল জীবনরক্ষার পথে
বলছেন ধর্ম রয় না ॥

ধর্ম রয় না, মাখন ছানা ধনী যদি খায়
গরিব মরে অনাহারে ধর্মে ভালো পায়
বড় মজার ব্যাপার ॥

মজার ব্যাপার, ধনতন্ত্রের নীতি থাকলে পরে
ধর্ম বড় তাজা থাকে আমেরিকার জোরে
এই তো মূলমন্ত্র ॥

মূলমন্ত্র, সমাজতন্ত্র আসে যদি ভাই
ধনীদের চলে যাবে জীবনের কামাই
তাইতো মাথায় বাড়ি ॥

মাথায় বাড়ি, মারামারি যার-তার স্বার্থ নিয়া
ভোট শিকার করিবে এবার ধর্মের ভাওতা দিয়া
এই তো মূল কথা ॥

মূল কথা, ধর্মের ভাওতা তাহার লাগিয়া
কেহ এলেন লেলিনবাদের মুখোশ পরিয়া
তারা কৃষক দরদি ॥

কৃষকদরদি, মজুরদরদি লীলার অন্ত নাই
তারা বলে ভোট দাও সংগ্রাম করতে যাই
গিয়া এ্যাসেমব্লিতে ॥

এ্যাসেমব্লিতে, শোষকের সাথে করিব সংগ্রাম
এজন্য আমরা এবার ভোটে দাঁড়াইলাম
বলছেন কৌশল করে ॥

কৌশল করে, জোরেসোরে দাদা বড় মুনি
পাহাড়েতে বাঁশ কাটেন বাড়ি থেকে শুনি
খালি ধোকাবাজি ॥

ধোঁকাবাজি, মূল পুঁজি ভোট নেওয়া ভাই
ভোট শিকারীর পথেরে গরিবের মুক্তি নাই
দেখ ইতিহাসে ॥

দেখ ইতিহাসে, মুক্তি আসে কোন পথে ভাই
ধোকাবাজের সঙ্গ ছাড়ো নইলে মুক্তি নাই
একমাত্র বিপ্লব ছাড়া ॥

বিপ্লব ছাড়া, সর্বহারা বাঁচার উপায় নাই
তিন ডাকাত হয় দেশের কর্তা জানোতো সবাই
বড়টা সাম্রাজ্যবাদ ॥

সাম্রাজ্যবাদ, বড় প্রমাদ সকলেরই জানা
মধ্যম জন শহর বন্দরে করে আমিরানা
ধনের মালিক হইয়া ॥

মালিক হইয়া, মানুষ লইয়া পুতুল খেলা খেলে
কৃষক-মুজুরের রক্ত টানে পূজির বলে
পরে ছোটো জনে ॥

ছোট জনে, নিশিদিনে করতেছে শোষণ
আমলা মুৎসুদ্দি আর জোতদার মহাজন
তার শোষণেতে ॥

শোষণেতে, কোনো মতে বাঁচার নাই জোগার
দিবানিশি সার করেছে জুলুম অত্যাচার
দুঃখ কইতে নারি ॥

কইতে নারি, সইতে নারি এ কী জ্বালাতন
তার হাতে গ্রাম বাংলার গরিবের মরণ
গরিব ঠেকছে ফেরে ॥

ঠেকছে ফেরে, বাঁচবে নারে টাকা আছে যার
মানুষ মারার কল-কৌশল সকলেই যে তার
সে শাসন ক্ষমতায় ॥

শাসন ক্ষমতায়, আছে সদায় নানা রঙ্গ ধরে
মেহনতি মজুরকে সে পশুর মত মারে
স্বার্থের আঘাত হইলে ॥

স্বার্থের আঘাত হইলে, সে মারিলে নাই কোনো বিচার
তার হাতে শাসনক্ষমতা সকলেই যে তার
এবার রুখতে হবে ॥

রুখতে হবে, বাঁচতে হবে সবারে জানাই
শোষণমুক্ত না হইলে শান্তির আশা নাই
জাগো সর্বহারা ॥

.

১৪৮

বলো স্বাধীন বাংলা মোদের
মাতৃভূমির জয়
প্রাণপণে প্রতিজ্ঞা কর
ছেড়ে দাও মরণের ভয় ॥

পাকিস্তান আসার পরে
যা ঘটিল তেইশ বৎসরে
মনের দুঃখ বলবো কারে
এই দুঃখ আর বলবার নয়।
আজও তারা শক্তির বলে
দারুণ শোষকের দলে
বিনাশিতে চায় সমূলে
আর বা কত প্রাণে সয় ॥

বাঙালি যুবকের দল
চল মুক্তির সংগ্রামে চল
তোরাই দেশের সহায়-সম্বল
পাছে হটার সময় নয়।
ধরো ধরো অস্ত্র ধরো
বাংলা মোদের মুক্ত করো
মনের দুর্বলতা ছাড়ো
আমাদের জয় সুনিশ্চয় ॥

ভেবেছিল শত্রু দলে
জুলুম অত্যাচারের বলে
রাখিবে পায়ের তলে
মনিব রবে সব সময়।
বীর বাঙালি বীরবিক্রমে
জেগে উঠল ধরাধামে
ইয়াহিয়া ছিল ভ্রমে
পেয়েছে ঠিক পরিচয় ॥

শপথ নেও বাঙালি যত
বাঁচলে বাঁচব বাঁচার মতো
আর আমরা হবো না নত
যদি হয় বিশ্বপ্রলয় ॥

কত ভাই বোন মুক্তির তরে
প্রাণ দিয়েছে অকাতরে
চিরদিন কেউ বাঁচে না রে
বাউল আবদুল করিম কয় ॥

.

১৪৯

বাংলা স্বাধীন হইল রে বীর বাঙালি ভাই
শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা চাই ॥

স্বাধীন হবে সুখে রবে বাংলা মায়ের সন্তান
এর জন্যে দিয়েছে কত লক্ষ লক্ষ প্রাণ ॥

কত নারী হলো স্বামীহারা ঝরে চোখের জল
পুত্রহারা হয়ে কত মা হলেন পাগল ॥

শোষিত বাঙালি আর ভুলবে না কখন
এই দেশে শাসনের নামে চলবে না শোষণ ॥

রক্তের বিনিময়ে এলো বাংলার স্বাধীনতা
ভুলিব না ভুলিবার নয় অন্তরের ব্যথা রে ॥

বাংলা মোদের জন্মভূমি রে বাংলা মোদের দেশ
বাংলা মায়ের সেবা করে হোক না জীবন শেষ ॥

রাখতে বাংলার স্বাধীনতা রাখতে বাংলার মান
ধন্য তারা দিল যারা দেশের জন্য প্রাণ ॥

বাংলার সার্বভৌমত্ব রাখতে যদি চাও
শোষণের বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে দাঁড়াও ॥

স্বাধীন মাতৃভূমি মোদের স্বর্গ মনে করি
বাউল আবদুল করিম গায় স্বাধীন বাংলার জারি ॥

.

১৫০

আমি বাংলা মায়ের ছেলে
জীবন আমার ধন্য যে হায়
জন্ম বাংলা মায়ের কোলে ॥

বাংলা মায়ের মুখের হাসি
প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি
মায়ের হাসি পূর্ণ শশী
রত্নমানিক জ্বলে।
মায়ের তুলনা কি আর
ধরণীতে মিলে
মা আমার শস্যশ্যামলা
সুশোভিত ফলে-ফুলে ॥

গাছে গাছে মিষ্ট ফল
মাঠে ফলে সোনার ফসল
রয়েছে সুশীতল জল
নদী-নালা খাল-বিলে
কোকিল ডাকে কুহু স্বরে
বুলবুল নাচে ডালে
শুক-সারি গান গায়
মা যেন থাকেন কুশলে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
জীবন লীলা সাঙ্গ হলে
শুয়ে থাকব মায়ের কোলে
তাপ-অনুতাপ ভোলে।
মাকে ভুলে না মায়ের
খাঁটি সন্তান হলে
মা বিনে আর কী আছে তার
সুখে দুঃখে মা-মা বলে ॥

.

১৫১

এসো প্রাণ খুলে মিলে সকলে
গাই রে বাংলার গুণগান
গাই রে বাংলার গুণগান ॥

বাংলা মোদের মা জননী
আমরা ভাই ভগিনী
ভেদ নাই হিন্দু মুসলমান
বাঙালি বাংলা জবান ॥

শোষণের বিরুদ্ধে ভাই
প্রাণপণে করে লড়াই
গেল লক্ষ লক্ষ প্রাণ
চাই বাংলা মায়ের কল্যাণ ॥

শান্তিকামী বাংলাবাসী
সবার মুখে ফুটুক হাসি
শোষণের হোক চির-অবসান
এ আদর্শ সামনে রেখে হও আগুয়ান ॥

জন্ম নিয়ে ইহলোকে
মানুষের দুঃখ দেখে
আবদুল করিম মনের শোকে ম্রিয়মাণ
চায় সদা শান্তি, সমাজবিধান ॥

.

১৫২

নাইয়া রে, বাংলার নাও সাজাইয়া যাব আমরা বাইয়া
মোদের গতি রোধ হবে না ঢেউ তুফানের ভয় রাখি না
থাকিতে সুজন নাইয়া যাব আমরা বাইয়া ॥

নাইয়া রে, স্বাধীন বাংলার সারি গেয়ে রঙিন পাল উড়াইয়া
কৃষক মজুর সবাই মিলে বাও নৌকা কৌতূহলে
সত্যের হাল রাখিয়া ॥

নাইয়া রে, পূর্বে রবি রাঙা ছবি উদয় গেল হইয়া
সোনার বাংলা গড়তে এবার কৃষক মজুর হও হুঁশিয়ার
যাইও না ভুলিয়া ॥

নাইয়া রে, সাগর পাড়ি দিয়ারে নাও কিনারা ভিড়াইয়া
বাউল আবদুল করিম বলে হাসবো একদিন সবাই মিলে
পরান খুলিয়া ॥

.

১৫৩

শোষক তুমি হও হুঁশিয়ার চল এবার সাবধানে
তুমি যে রক্তশোষক বিশ্বাসঘাতক তোমারে অনেকে চিনে ॥

প্রাণে আর ধৈর্য মানে না দেখে তোর নীতি বিধান
মুসলিম লীগ নাম ধরিয়া গড়েছিলে পাকিস্তান
ভিতরে ঢুকিল শয়তান গরিবকে মারলে প্রাণে ॥

স্বার্থসিদ্ধি করবে বলে করেছিলে শয়তানি
না বুঝিয়া ভাইয়ে ভাইয়ে করেছি হানাহানি
কণ্ঠাগত হলো প্রাণী তোমার নিষ্ঠুর শোষণে ॥

মুসলিম লীগের নাও ডুবাইয়া যুক্তফ্রন্টে আসিলে
আইয়ুবের ছত্রচ্ছায়ায় বেশ কয়েকদিন কাটাইলে
তারপরে ইয়াহিয়ার কোলে ছিলে অতি সন্ধানে ॥

বাংলা স্বাধীন হইলে পরে আবার দেখি তোমারে
বাঙালির দরদি সেজে আসলে তুমি ছল করে
আর কী করবে তাহার পরে ভাবতেছি মনে মনে ॥

বড় শয়তান সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন ফন্দি আঁটে
মধ্যম শয়তান পুঁজিবাদ বসে বসে মজা লোটে
সামন্তবাদ জালিম বটে দয়া নাই তাহার মনে ॥

তিন শয়তানের লীলাভূমি শ্যামল মাটি সোনার বাংলার
গরিবের বুকের রক্তে রঙিন হলো বারেবার
সোনার বাংলা করলো ছারখার সাম্রাজ্যবাদ শয়তানে ॥

স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে মজা মারলো শোষকে
এখন সবাই বুঝতে পারে চাবি ঘুরছে কোন পাকে
মধু হয় না বল্লার চাকে বাউল আবদুল করিম জানে ॥

.

১৫৪

খবর রাখনি
উন্দুরে লাগাইছে শয়তানি ॥

চাটি কাটে পাটি কাটে কাপড় চোপর আর
দিন রাত ঘরের মাঝে উন্দুরের দরবার ॥

বাড়িত কাটে বাড়ির বস্তু ক্ষেতে কাটে ধান
ঘরের ধন বাইরে নেয় ঘটাইছে নিদান ॥

ধান খায় চাউল খায় কাটে ঘরের বেড়া
কাটতে কাটতে গৃহস্থেরে করে বাড়ি ছাড়া ॥

বাউল আবদুল করিম বলে উন্দুর আছে ঘরে
বিলাইয়ে ধরে না উন্দুর দুঃখ বলব কারে ॥

.

১৫৫

কেবা শত্রু কেবা মিত্র
বুঝে উঠা দায়
তাই তো দেশের অবনতি
সাধুর নিশান চোরের নায় ॥

স্বার্থপর শত্ৰুদলে
দেশে দিছে আগুন জ্বেলে
উচিত কথা বলতে গেলে
তারা আবার চোখ রাঙায় ॥

কেউ হইল কালোবাজারি
কেউ করতেছে মজুতদারি
কেউ করতেছে রিলিফ চুরি
যে যেভাবে সুযোগ পায় ॥

শান্তি পেতে আশা করি
আসলে বিপাকে পড়ি
স্বার্থ নিয়ে মারামারি
শেষ হয় না তাদের বেলায় ॥

গরিবের প্রশ্নই নাই
বাঁচি কি-বা মরিয়া যাই
আবদুল করিম বলে রে ভাই
সোনা বর্ষে সোনার গায় ॥

.

১৫৬

গরিবের দুঃখের কথা
কেউ শোনে না
অরণ্যে রোদন বৃথা
বুঝিয়াছি তার নমুনা ॥

সমাজের নাই সুব্যবস্থা
গরিবের নাই বাঁচার রাস্তা
চৌদিকে পরেছে খাস্তা
হারালেম ষোলো আনা ॥

সুবিধাবাদি ধনী যারা
ভবের মজা মারছে তারা
ব্যক্তিস্বার্থে আত্মহারা
অন্য কিছু বোঝে না ॥

গরিবের রক্ত খেয়ে
নিশাতে বিভোর হয়ে
লোভ-লালসা বুকে নিয়ে
ঘুরছে সদায় দেওয়ানা ॥

মাংস খাওয়ার সুযোগ পাইলে
ভিড় জমায় শকুনের দলে
ঘটাইয়াছে কালে কালে
মানুষের এই লাঞ্ছনা ॥

আবদুল করিম চিন্তা করে
ঘুরলাম কত ধোকায় পড়ে
মানব রূপে রাক্ষস ঘোরে
সকলে তা চিনে না ॥

.

১৫৭

গরিবের কী মান-অপমান দুনিয়ায়?
গরিবের নাই স্বাধীনতা পরাধীন সে সর্বদায় ॥

ভোট নেওয়ার সময় আসিলে নেতা সাহেব তখন বলে
এবার আমি পাস করিলে কাজ করবো গরিবের দায়
পরে লাইসেন্স পারমিট দেওয়া ধনীর বাড়ি খাসি খাওয়া
সালাম দেওয়া নৌকা বাওয়া এইমাত্র গরিবে পায় ॥

অস্থিচর্ম সার হয়েছে রক্ত মাংস চলে গেছে
প্রাণটি শুধু বাকি আছে কখন জানি চলে যায়
আবদুল করিম ভাবছে মনে কার দুঃখ কেবা শোনে
স্বার্থের ব্যাপার যেখানে দয়ামায়া নাই সেথায় ॥

.

১৫৮

বেহেস্ত ধনীর জন্য রয় গরিবের নাই অধিকার
স্বচক্ষে দেখিলাম যাহা–গরিব হলে দোযখ তাহার ॥

গরিবের নাই পাকাবাড়ি চেয়ার-টেবিল-টোল-আলমারি
গরিবের নাই পালঙ পিড়ি ভাঙা ঘর ভাঙা যে দ্বার ॥

সাহেব বাবু গরিবরা নয় কুলি-মজুর গরিবরা হয়
দুঃখ কষ্ট গরিবে সয় করে না জুলুম অত্যাচার ॥

ধনীদের আমিরানা বলেন গরিব ভালো না
হারাম-হালাল বোঝে না ধার ধারে না নামাজ-রোজার ॥

গরিব হয় খোদার দুশমন, না হলে কি এই জ্বালাতন?
আবদুল করিম বলে রে মন টাকা ভবে হয় মূলাধার ॥

.

১৫৯

ভোট দিবায় আজ কারে?
ভোটশিকারি দল এসেছে নানা রঙ্গ ধরে
ভোট দিবায় আজ কারে ॥

দেশে আইল ভোটাভুটি পরে হবে বাটাবাটি
তারপরে লুটালুটি যে যেভাবে পারে ॥

কেউ দিতেছে ধর্মের দোহাই কেউ বলে সে গরিবের ভাই
আসলে গরিবের কেউ নাই গরিব ঠেকছে ফেরে ॥

কেহ বলে ধন্য আমি, আমি দেশের মঙ্গলকামী
দেশ হবে পবিত্রভূমি, ভোট যদি দাও মোরে ॥

যার-তার ভাবে বলাবলি করছে কত গালাগালি
স্বার্থ নিয়া ঠেলাঠেলি বুঝবায় কয়দিন পরে ॥

নিজের জ্ঞান থাকে যদি বুঝে নেও তার গতিবিধি
শোষকের প্রতিনিধি মালা পরাও যারে ॥

আবদুল করিম কয় ভাবিয়া ভালো মন্দ না বুঝিয়া
অনর্থ বিভ্রান্ত হইয়া গরিব কাঙাল মরে ॥

.

১৬০

ধর্মাধর্ম নাই রে শোষকের নাই বিবেচনা
লোভ লালসা বুকে নিয়া ঘুরেছে দেওয়ানা রে ॥

মুসলমানে সুদ খায় না কোরানেতে মানা
নয়া মুসলমান হইলে গরু খায় তিনদুনা রে ॥

সুদখোর ঘুষখোর মজুতদারের কত আমিরানা
নিদারুণ শোষকের দেশে গরিব আর বাঁচবে না রে ॥

গরিব মরে অনাহারে রুজি-রোজগার পায় না
শতকরা আশি ঘরের লাগিয়াছে কিনা রে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে উপায় আর দেখি না
দিনে দিনে বাড়ে আগুন জল দিলে নিভে না রে ॥

.

১৬১

মাগো আমি কিসে দোষী?
গরিবের দুঃখ বুঝি বলে মা গরিব কে তাই ভালোবাসি ॥

তোমার গর্ভে জন্ম সবার ছেলে মেয়ে সবই
তোমার তোমার কাছে সমান অধিকার পাইতে প্রত্যাশী
একি মা তোর উচিত বিচার মা তোমায় জিজ্ঞাসী
কেউরে দিলি মাখনছানা–কেউ কেন মা উপবাসী ॥

ধনী মানী ভবে যারা শাসন-শোষণ করে তারা
তাইতো কেউ সর্বহারা কেউ যে স্বর্গবাসী
এ কি মা তোর ভালোবাসা ওগো সর্বনাশী
গাইতে দিলি আমারে মা গরিবের বারোমাসি ॥

এমন দিন মা আসবে কবে সকল বন্ধন খসে যাবে
এক যোগে ফুটে উঠবে সবার মুখে হাসি
করিম বলে বাঁচতে দে মা দাও না যদি বেশি
বাঁচার অধিকার নিয়ে মা লড়াই করছি দিবানিশি ॥

.

১৬২

অভাবে পড়িয়া কাঁদে মনপাখি আমার
ভাব নাই মনে নিশিদিনে ভাবিতেছি অনিবার ॥

ভাবিলে কী হইবে লাভ চৌদিকে পড়েছে অভাব
দুঃখের কথা কী বলিব আর
স্বার্থ নিয়া ব্যস্ত সবাই কে দুঃখ শুনিবে কার ॥

অসতের মাত্রা বেড়েছে সতোর অভাব পড়েছে
অভাব পড়ল মানবতার
রক্ষক ভক্ষক সেজেছে মিলে না আমানতদার ॥

‘হুজুর’ বলে ঘুষ খাইলে, সুদ খাইলে মহাজন বলে
জামানার হাল চমৎকার
কী করিব কোথায় যাব ভেবে করিম বেকারার ॥

.

১৬৩

কর্মফেরে বারে বারে ঘোর আঁধারে পড়ে যাই
আমরা দেশের মজুর চাষি স্বাধীনতা নাই ॥

আড়ইশত বৎসর গেল ব্রিটিশের শাসনে ভাই
ব্রিটিশ গেল স্বরাজ এলো গরিবের কপালে ছাই ॥

পথ ভুলিয়া ধর্ম নিয়া মারামারি লেগে যাই
দুইয়েরই হইল ক্ষতি কার দুঃখ কারে জানাই ॥

মুসলিম লীগ হয়ে যখন পাকিস্তানি স্বাধীন পাই
শাসন-শোষণ করতে তখন আসিলেন মুসলমান ভাই ॥

খ্রিস্টান গেল মুসলিম এলো কাজে কোন প্রভেদ নাই
মুসলিম লীগের ভাঙা লেন্টন তখন যে আমরা নিভাই ॥

কাড়াকাড়ি মারামারি চলিল স্বার্থের লড়াই
সামরিক শাসনে তখন আরো দশ বৎসর কাটাই ॥

তারপরে ইয়াহিয়া এলো দাজ্জালের ছোটো ভাই
লাখো লাখো মানুষ মারে মা-বোনের আর ইজ্জত নাই ॥

মুজিবের নেতৃত্বে তখন চলিল পাল্টা লড়াই
মানুষের নয় শোষিতের নয় বাংলার স্বাধীনতা পাই ॥

জন্ম নিয়েছি যখন সবাই মিলে বাঁচতে চাই
করিম কয় দুঃখের বিষয় গরিবের গান আমি গাই ॥

.

১৬৪

কৃষক মজুর পড়েছে ঘোর আঁধারে
কী করা যায় উপায় বুদ্ধি
মিলে না আর বিচারে ॥

সুদখোর ঘুষখোর মজুদদারের
দালাল টাউট বাটপারে
আগুন দিয়াছে মোদের ঘরে
তারা হয়েছে বাবু
গরিবকে করেছে কাবু
বিনয়ে মানে না তবু
মরারে আরো মারে ॥

দিন হতে দিন আসে কঠিন
এইভাবে আর বাঁচব কয়দিন
আবদুল করিম ভাবতেছে অন্তরে
হয়ে গেলাম নিরুপায়
দুঃখের বোঝা বাড়ছে সদায়
পড়েছি শয়তানি ধোকায়
তিন শয়তানের বাজারে ॥

.

১৬৫

গরিব বাঁচবে কেমন করে কার কাছে তা জিজ্ঞেস করি
গরিবের বাঁচার সম্বল নাই ধনীরা স্বার্থের পূজারি ॥

হাওরেতে জমি নাই অনেকের নাই ভিটে বাড়ি
দিনরাত মজুরি খেটে তবু অনাহারে মরি ॥

কৃষক মজুরের সমস্যা বাড়ছে অতি তাড়াতাড়ি
অল্প জমির মালিক যারা তারা হবে দীন ভিখারি ॥

ক্ষেত খামার কলকারখানায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করি
তার উপর জুলুম অত্যাচার মুখ খোলে না বলতে পারি ॥

খরচ বিনা বিচার পাই না কোর্টে যদি মামলা করি
আইন আদালত গরিবের নয় মিছে এ ভরসা করি ॥

ঔষধ ডাক্তার তাদের জন্য আছে যাদের টাকা কড়ি
তাদের জন্য মৌজুদ আছে হসপিটালের পালঙ্ক সিঁড়ি ॥

 আমাদের দেশ কি করে কই আমরা দেশে চাকরি করি
দেশের মালিক তারা কয়জন যারা করে সাহেবগিরি ॥

কৃষিঋণ বলে যাহা ঋণ দেওয়া হয় সরকারি
গরিব কৃষক পায় না তাহা কে করবে এই খবরদারি ॥

যেসব কাণ্ডকারখানা মুখ খুলে না বলতে পারি
দেশের মালিক হলো যারা আছে তাদের বাড়ি গাড়ি ॥

তাদের প্রয়োজনে আছে স্কুল কলেজ কোর্ট কাঁচারি
তাদের হুকুমে চলে বন্দুক-কামান অস্ত্রধারী ॥

শোষকের শাসন ব্যবস্থা যেখানে রয়েছে জারি
ভোটে মুক্তি আসিবে না শুঁটকির নায় বিড়াল ব্যাপারি ॥

ভোট নিয়ে অধিকার পেয়ে গরিবের দেয় মাথার বাড়ি
ভোট নেওয়া নয় ধোকা দেওয়া কাজে বলি ভোট শিকারি ॥

গরিব কাঙাল কৃষক মজুর এক যদি সব হতে পারি
বাউল আবদুল করিম বলে দুঃখের সাগর দিব পাড়ি ॥

.

১৬৬

অতীত বর্তমানে কি আর মিল আছে?
নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নাই ঘুরছে সব স্বার্থের পাছে ॥

ভালোর যে আদর ছিল সেদিন কি আর আছে বলো
দুগ্ধ নয় মদ খাইয়া আনন্দে মানুষ নাচে
দেখি এই নতুন জামানায় দেশ পাগল সিগারেট গাঁজায়
বলে নারিকেলের হুক্কায় আমার দিন চলে গেছে ॥

পুরুষ পাগল এই দুনিয়ায় কামিনী-কাঞ্চনের নেশায়
মেয়েরা স্বাধীনতা চায় যুগে সুযোগ দিয়াছে
এখন পত্র পত্রিকায় উলঙ্গ ছবি দেখা যায়
মন দিয়ে পড়ে ছেলেরায় পথ ভুলে কই যাইতেছে ॥

ব্যবসায়ী যত জনা সত্য কথা বলতে চায় না
খাঁটি জিনিস পাওয়া যায় না ভেজাল মিশাইয়া বেচে
মজুতদারে মুচকি হাসে দেশ পেয়েছে সুদে-ঘুষে
উচিত কইলে পাবে দোষে বলব দুঃখ কার কাছে ॥

মিথ্যা কথায় বাজায় ডঙ্কা রাক্ষস হয় গিয়ে লঙ্কা
রাজনীতি নেতার সংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে গেছে
মনে মনে চিন্তা করি রাজনীতি নয় দোকানদারী
স্বার্থ নিয়া মারামারি–ধর্মাধর্ম সব গেছে ॥ বাউল করিমের বাণী শুনেন যত জ্ঞানী গুনী
মনে মনে আমি গণি সরিষারে ভূতে পাইছে
কখন কী হয় না জানি ভাবি তাহা দিনরজনী
চৌদিকে অস্ত্রের ঝনঝনি শুনিয়া ভয় হইতেছে ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *