ভাটির চিঠি

ভাটির চিঠি

ভাটির চিঠি – শাহ আব্দুল করিম
প্রথম প্রকাশ – ২৪ এপ্রিল ১৯৯৮
উৎসর্গ – বাবা-মার স্মৃতির উদ্দেশে

.

ভাটির চিঠি

দয়াল নাম ভরসা করে আরম্ভ করলাম।
রচনায় দ্বিপদী ছন্দ ধরলাম ॥
ছন্দ যে হলো আমার জীবনের সাথি।
সুর তাল ছন্দে আমি কথার মালা গাঁথি ॥
সুর তাল ছন্দে যখন গান গেয়ে যাই।
আমার মনের কথা ছন্দে বলতে চাই ॥
বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায়।
 জন্ম নিয়ে লেগে গেলাম ভবের খেলায় ॥
ইহলোকে সুখ-দুঃখে কাঁদায়-হাসায়।
বসত করি হাওরমাতৃক ভাটি এলাকায় ॥
পল্লীগ্রামে বসত করি উজানধল ঠিকানা।
পোস্ট অফিস ধলবাজারে দিরাই হলো থানা ॥
গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম নিলাম।
জন্মগত প্রতিবাদী আমি ছিলাম ॥
তেরশো বাইশ বাংলায় জন্ম আমার।
মা বলেছেন ফাল্গন মাসের প্রথম মঙ্গলবার ॥
পিতা-মাতা রেখেছিলেন আবদুল করিম নাম।
জানি না কেন যে বিধি হলো বাম ॥
এই দুঃখ কার কাছে কী বলি বলো না।
ইশকুলে লেখাপড়া করা মোর হলো না ॥
সমাজ ব্যবস্থা আমার পক্ষে ছিল না।
তাই তো আমার খবর কেউ যে নিল না ॥
এই ভবে লক্ষ লক্ষ করিম জন্ম নিল।
এ ব্যবস্থা তাদেরেও নিঃস্ব করে দিল ॥
ভাটি অঞ্চলে হলো আমার জন্মস্থান।
গাই সদা জনগণের সুখ-দুঃখের গান ॥
বাউলরেশে এই দেশে কত গান গেয়েছি।
মানুষের ভালোবাসা-আশীবাদ পেয়েছি ॥

ভাটির চিঠি লিখবো বলে মনে যখন চায়।
মনের কথা প্রকাশ করি গ্রামের ভাষায় ॥
জ্ঞানী গুণী সুধীসমাজ যারা গণ্যমান্য।
তুলে ধরি সকলের অবগতির জন্য ॥
জন্ম নিয়ে এই অঞ্চলের খবর শুনলাম।
পূর্বে এখানে সাগর ছিল কালীদহ নাম ॥
নৌকা কুন্দা বাইয়া মানুষ করত আসা যাওয়া।
লোকে বলে, ছিল তখন লাউড়ে-গৌড়ে খেওয়া ॥
আকাশ হতে পাহাড়েতে নামে যখন ঢল।
পলি মাটি সঙ্গে নিয়ে নিচে নামে জল ॥
পাহাড়ি পলিমটি নিচে এসে পড়ে।
সাগরের তলদেশ ধীরে ধীরে ভরে ॥
জানি না কত দিনে ভরাট হয়েছে।
এখনো মধ্যে মধ্যে গভীর রয়েছে ॥
সাগর ভরাট হয়ে হইল জঙ্গল।
কৃষক মজুরের শ্রমে হইল মঙ্গল ॥

জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষক মজুরগণ।
জঙ্গল কাটিয়া করে বসতি স্থাপন ॥
উঁচু জয়গাগুলোতে হলো গ্রাম-ঘর।
নিচু স্থানগুলোর নাম হইল হাওর ॥
গ্রামের কাছে নিচু জায়গার নাম হয় ঝিল।
গভীর জলাশয়গুলোর নাম হয়েছে বিল ॥
ভরাট অঞ্চলে হলো হাজার হাজার গ্রাম।
ভাটি দেশ বলে হলো এই এলাকার নাম ॥
হবিগঞ্জ সুনামগঞ্জ জেলার ষোলোআনা।
নেত্রকোনা কিশোরগঞ্জ নিয়ে সীমানা ॥
ব্রাম্মণবাড়িয়া জেলা সঙ্গে রয়েছে।
পাঁচটি জেলার সমন্বয়ে ভাটি দেশ হয়েছে ॥
জঙ্গল কেটে আবাদ করে মেহনতি সকল।
যেখানে ফলে আজ সোনালি ফসল ॥
পলি মাটি এলাকায় মাটিতে রয় বল।
কৃষকে জমিতে পাইত ভালো ফল ॥
বসত করে কৃষক মজুর হিন্দু-মুসলমান।
এই এলাকা হয় খাদ্য উৎপাদনের স্থান ॥
বন্যার জলে ফসল নিলে কেউ কাঁদে কেউ হাসে।
সুনামগঞ্জবাসী কাঁদে পড়ে পূর্ণগ্রাসে ॥

পল্লীগ্রামে বসত করি কী অবস্থায় চলি।
এলাকার সুখ-দুঃখের খবর এখন বলি ॥
আমি বলি আমার ভাবে আমি যাহা বুঝি।
দুঃখে গড়া জীবন নিয়ে মুক্তির পথ খুঁজি ॥
মনে ভাবি শিক্ষাসম্পদ নাই যে আমার।
করতে চাই না আকাশের নক্ষত্র বিচার ॥
প্রয়োজনে ভাটির চিঠি লিখতে যখন বসি।
ভাবি, আঁধারে কবে উদয় হবে শশী ॥
ভাটি এলাকায় আমার জন্ম হয়েছে।
ছোটোবেলার কথাগুলো মনে রয়েছে ॥
পঞ্চাশ বছর পূর্বে যাহা দেখেছি নয়নে।
মনে হয় স্বপ্ন যেন হেরেছি শয়নে ॥
অনাবদি স্থানে প্রচুর ঘাস-বন ফলিত ।
গরু মহিষ ইচ্ছা মতো খাইত চলিত ॥
ছেলেরা মাঠে চড়াইত গরুর পাল।
আজো আমার মনে পড়ে সে জমানার হাল ॥
রাখাল বাজাইত বাঁশি আনন্দে তখন।
সে রাখালদের মধ্যে ছিলাম আমিও একজন ॥
দই-দুগ্ধের অভাব ছিল না ধনী কৃষকদের।
দুগ্ধ তখন বিকাইত দুই আনা সের ॥
শাক-শবজি গ্রামবাসী ফলাইয়া খাইত।
একে অন্যের কাছে চাইলেও পাইত ॥
শাক-শবজি দধি দুগ্ধ ঘৃত মাখন ছানা।
তখন খাইত মানুষ ভেজালমুক্ত খানা ॥
নদী-নালা খাল-বিল ছিল যে বিস্তর।
মাছ ধরে খাইত মানুষ সারাটা বৎসর ॥
এখনো মনে পড়ে যা দেখেছি চোখে।
কত জাতের মাছ ধরে খাইত দেশের লোকে॥
বর্ষার ভাসান জলে মাছ ধরে খাইত।
মনের আনন্দে মানুষ নানান গীত গাইত ॥
ছোটো নৌকার পাছায় বসে নৌকা বেয়েছি।
ভাইবে রাধারমণ বলে কত গান তখন গেয়েছি ॥

খেলাধুলা গান-বাজনার প্রচলন থাকায় ।
আনন্দ-পরিবেশ ছিল ভাটি এলাকায় ॥
বৈশাখ মাসে ঘরে এসে উঠলে বোরোধান।
বর্ষাতে ভাটি দেশে হইত কত গান ॥
এক সঙ্গে মিলেমিশে গ্রামের নওজোয়ান।
সম্মিলিতভাবে তখন গাইত বাউলা গান ॥
হিন্দু-মুসলিম ধনী গরিব মিলিয়া সকলে ॥
প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইত দুই গ্রামের দুই দলে ॥
ভক্তিমূলক গান গাইতেন ফকির সাধু যারা।
বাজাইয়া লাউ ডপকি একতারা দোতারা ॥
ভাবে বিভোর হয়ে গাইতেন তারা গান।
তাদের মধ্যে ছিল না কোনো বিভেদ-বিধান ॥
মহররমে জারি গান শ্রদ্ধাভরে গাইত।
একে অন্যের কাছে ভালোবাসা পাইত ॥
হিন্দু-মুসলমানে মিলে গ্রামে করি বাস।
গান বাজনার প্রচলন ছিল বারোমাস ॥
যাত্রাগান কবিগান সদানন্দ মনে।
হিন্দু বাড়িতে গাইত পূজাপার্বনে ॥
মুসলমান বন্ধু-বান্ধবকে নিমত্রণ দিত।
গেলে পরে মনপ্রাণে সেবাযত্ন নিত ॥
মাঘ মাসে সূর্যব্রত হিন্দু মেয়েরার।
উদয়-অস্ত গান গাইত প্রতি রবিবার ॥
মাঘে বৃষ্টি না হইলে ছিল এক বিধান।
ছোটো মেয়েরা গাইত বেঙ্গাবেরি গান ॥
মাঘ মাসে মিলে-মিশে গ্রামের নওজোয়ান।
সু-বৃষ্টির মানসে গাইত বাঘাই শিন্নির গান ॥
বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে চাউল পয়সা পাইত।
শিন্নি তৈয়ার করে তারা মিলে মিশে খাইত ॥
বিবাহে বিয়ের গান মেয়েরা গাইত।
মিলামিশা ভালোবাসার সুযোগ তারা পাইত ॥
বাড়ি বাড়ি কিচ্ছা নইলে পুথি পাঠ হইত।
হুক্কা চুংগা তামুক টিক্কা লইয়া মানুষ বইত ॥
বর্ষাকালে গাজির গাইন বাড়ি বাড়ি আইত।
গাজির গান গাইত ধান চাউল পাইত ॥
গাজি-কালু দুই পির নাম সবাই জানে।
জিন্দাপির বলিয়া এলাকার লোকে মানে ॥

খোল ঢোল সঙ্গে নিয়া নৌকায় আসিত।
গ্রামবাসী গাজির গানকে ভালোবাসিত ॥
খোল ঢোল বাদক যারা তারা হলেন বাইন।
গান যে জনে গায় বলতো গাজির গাইন ॥
হাতে আশা থাকত মস্তকে পাগড়ি।
গলে থাকত তসবি মালা পরনে ঘাগড়ি ॥
যার বাড়িতে যাইত গাজির গানের দল।
বাড়ির মালিক এনে দিত এক ঘটি জল ॥
জল ছিটা দিয়া স্থান পবিত্র করে নিত।
জিন্দাগাজি বলে প্রথম নামের ধ্বনি দিত ॥
হাতের আশা তার, গাজি কালু বলে।
মাটিতে গাড়িয়া থইত গান গাইতে হলে ॥
সুরতালছন্দে তখন ধরিয়া রাগিনী।
গান গাইত গাজি কালু চাম্পার জীবনী ॥
কথা বলতো রঙেঢঙে দিয়ে নানান সুর।
সঙ্গে যে বাইন থাকত সে বড় চতুর ॥
দুইজনে করত তারা কথার মারামারি।
বড় আনন্দ পাইতেন গ্রামের পুরুষ নারী ॥
গাজির গান হিন্দুদের বাড়িতেও নিত।
হিন্দু সবাই শ্রদ্ধাভরে গাজির শিন্নি দিত ॥
ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি বিপদে পড়িত।
গাজির গান গাওয়াবে বলে মানসা করিত ॥

বর্ষা গত হয়ে যখন আসত শরৎকাল।
তখন আরম্ভ হইত নৌকাবাইচের তাল ॥
নৌকা বাইচে সারিগান ভাদ্র আশ্বিন মাসে।
প্রাণ খুলে গাইত কত আনন্দ উল্লাসে ॥
রাজহংস ময়ূরপঙ্খি বিভিন্ন নামে।
দৌড়ের নৌকা ছিল তখন প্রতি গ্রামে গ্রামে ॥
এই সমস্ত নৌকা নিয়া বাইচের থলায় যাইত।
সীল-কাপ পাঠা-খাসি উপহার পাইত ॥
নৌকাতে পাইক সাজিত গ্রামের নওজোয়ান।
মনানন্দে মিলে মিশে হিন্দু-মুসলমান ॥
ঢোল করতাল নৌকায় নিয়া তালে বৈঠা বাইত।
নৌকাবাইচ সারিগান সবাই ভালো পাইতো ॥
যেখানে থলা জমাবে বাজারে ঢোল দিত।
স্থানীয় জনগণ এই দায়িত্বভার নিত ॥
নৌকাবাইচ হইত যখন বিভিন্ন স্থানে।
জনমনে আনন্দ তখন দিত সারিগানে ॥
থলাতে আসিত যে কত জাতের নাও।
দিরাই থানায় বাইচ হইত গরমা ভাটির গাঁও ॥
আজমিরীগঞ্জে নৌকাবাইচ হইত যখন।
শতাধিক দৌড়ের নৌকা আসিত তখন ॥
থলার দক্ষিণে হলো আজমিরীবাজার।
দর্শক থাকতেন সেদিন হাজার হাজার ॥
শুকনা মৌসুমে থাকত কতজাতের খেলা।
বিভিন্ন স্থানে হইত ঘোড়া দৌড়ের মেলা ॥
গ্রামে গ্রামে হইত তখন ষাঁড়ের লড়াই।
নৌকাবাইচ ঘোড়দৌড় এখন আর নাই ॥

বর্তমানে দিরাই থানা সুনামগঞ্জ জেলা।
ধল গ্রামে হইত এক ঐতিহ্যবাহী মেলা ॥
জানি না কবে থেকে আরম্ভ হয়েছে।
পূর্বে ছিল মেলা এখনও রয়েছে ॥
মেলা হয় ফারুন মাসের প্রথম বুধবার।
চারদিক থেকে লোক আসতেন হাজার হাজার ॥
পারাপারে মাঝি তখন পয়সা নিত না।
ব্যবসায়ীগণ কোনো খাজনা দিত না ॥
সমস্ত নিষ্কর ছিল দ্রব্য যাবতীয়।
মেলা ছিল দেশবাসীর সকলের প্রিয় ॥
মেলাযোগে হইত মানুষ আনন্দে বিভোর।
স্বজনে স্বজনে হইত মিলন মধুর ॥
নদীপথে যোগাযোগ ছিল পরিষ্কার।
কালনী নদী দিয়ে তখন চলতো ইস্টিমার ॥
যখন আরম্ভ হইত ধলগ্রামে এই মেলা।
ঢাকা থেকে নিয়ে আসত সার্কাসবাজি খেলা ॥
হাতী ঘোড়া বাঘ ভালুক নিয়ে আসতো সাথে।
ঘর বাঁধিয়া খেলা দেখাইত মেলাতে ॥
পরমেশ্বরী নামে হিন্দুর দেবস্থান।
হিন্দু সবাই গাইত তাদের ভক্তিমূলক গান ॥
আসতেন তখন সাধু সন্ত গায়ক বাদকগণ।
আটচলিশ ঘণ্টা হইত নাম সংকীর্তন ॥
হিন্দু ধনী মানী যারা দায়িত্বভার নিত।
দেবস্থানে পাঁঠা এবং মহিষ বলি দিত ॥
গ্রামবাসী আনন্দ পাইত মেলা আসলে পরে।
চিড়া-মুড়ি তৈয়ার হইত প্রতি ঘরে ঘরে ॥
খাঁটি দুগ্ধের ছানার মিষ্টি মেলাতে পাইত।
দধি-দুগ্ধ চিড়া-মুড়ি লইয়া তখন খাইত ॥
কারো মনে কোনো মানস থাকিলে ।
ভক্তিভাবে স্নান করতো কালনীর কালো জলে ॥
পূর্বের আনন্দ-বাতাস এখন আর বয় না।
ঘরে ঘরে চিড়া-মুড়ি তৈয়ার এখন হয় না ॥
অতীতের আনন্দের ছবি আজো মনে পড়ে।
ভুলিবার কথা নয় ভুলিব কী করে ॥

হিন্দু-মুসলিম কৃষক মজুর মেহনতিগণ।
ভ্ৰাতৃভাবে বাস করত আনন্দে তখন ॥
কাঠের কুন্দে জমিতে সেচ দিত জল।
যত্ন নিত কৃষকে পাইত ভালো ফল ॥
গরু মহিষ দিয়ে লাঙলে বাইত হাল।
মিলেমিশে চলত সবাই ছিল না ভেজাল ॥
কুঁড়েঘর করে মানুষ বাস করত যে গ্রামে।
ছন বাঁশ কেটে আনত নিজ পরিশ্রমে ॥
জালিবেতে বান দিত উলুছনে ছানি ।
ভালোভাবে ছাইতে জানলে তারে বলত জ্ঞানী ॥
অতীতের এই দিনগুলো ভাবনা করি।
বাঁশ তখন বিকাইত দশটাকা কুড়ি ॥
এক টাকায় পাওয়া যাইত ষোলোটা মুলি।
কিনতে হলে কাছে মিলতো কাদিরগঞ্জ-মাকুলি ॥
এক পয়সায় এক ছলি পান তখন পাইত।
চার আনায় এক সের সুপারি কিনে খাইত ॥
সেই সময় মানুষ ছিল সরল-সবল।
দেশ জুড়ে ছিল তখন তামুক খাওয়ার চল ॥
এক পয়সায় এক সের চিটা কিনতে পাইত।
দুই আনা দশ পয়সা সের তামুক লইয়া খাইত ॥
তামুক কুটার জন্য ছিল ছোট গাইল ছিয়া।
কুটিয়া মিশাইয়া লইত গাইলের মধ্যে দিয়া ॥
কাঠের নইচরা লাগাইত নারিকেলের ফুলে।
তার উপরে মাটির এক কলকি দিত তুলে ॥
কলকির মধ্যে ভালোভাবে তামুক সাজাইত।
তার উপরে আগুন দিয়া মিলে মিশে খাইত ॥
বটনী হুক্কায় লাগাইত বাঁশের এক নল।
হুক্কাতে ভরিয়া লইত শীতল গঙ্গার জল ॥
কোনো কোনো বাড়িতে ফসসি হুক্কা ছিল।
বৃন্দাবনি হুক্কা পরে বাহির করে দিল ॥
গ্রামের সাধারণ মানুষ কৃষক-মজুর যারা।
ছোট নারিকেলের হুক্কায় তামুক খাইত তারা ॥
নলবিহীন হুক্কা তাহা হাতে তুলে খাইত।
কাজের মানুষ কাজের বেলা সঙ্গে লইয়া যাইত ॥
কাজের ফাঁকে তামুক খাইত এক সঙ্গে বসে।
আলাপ আলোচনা তখন করত রঙ্গরসে ॥
বর্ষাকালে গ্রামের মানুষ হাট-বাজারে যাইত।
নিজের নৌকা নিত, নিজে নৌকা বাইত ॥
দাঁড় বৈঠা হুক্কা চুঙ্গা তামুক টিক্কা লইয়া।
যাতায়াত করত মানুষ নিজে নৌকা বাইয়া ॥
হুক্কা দিয়া তামুক খাইত খরচ হইত কম।
এখন খায় সিগারেট-গাঁজা ডেকে আনে যম ॥
আনন্দ পরিবেশ এই এলাকাতে ছিল।
বিচার করে দেখতে হবে কে কাড়িয়া নিল ॥

এই ছিল ভাটির অতীতের ছবি।
প্রাকৃতিক স্বভাবে গড়া কত বাউল কবি ॥
ভাটি এলাকায় মাঝির ভাটিয়ালি গান।
সবুজ বনে পাখি ডাকে নিয়তির দান ॥
কত জাতের পাখি দেশে সময়ে আসিত।
লাখ লাখ পাখি হাওর-বিলে ভাসিত ॥
রাত্র হলে পাখি চলতো করে হুমঝুম।
পাখির ডাকে তখন ভেঙে যাইত ঘুম ॥
শান্তিকামী দুনিয়াতে শান্তি সবাই চায়।
আজীবন চেষ্টা করে কয়জনে তা পায় ॥
এলাকায় জনগণ বসতি যখন নিল।
সমস্ত এলাকা জুড়ে বনজঙ্গল ছিল ॥
বর্ষাকালে বনজঙ্গল থাকতো তখন ভাসা।
দারা দিয়া নৌকায় মানুষ করত যাওয়া-আসা ॥
তখন ছিল না এই ঢেউয়ের মারামারি।
ঢেউয়ে ভেঙে নিত না গ্রামের ঘরবাড়ি ॥
এখন কোনো বনজঙ্গল নাই এলাকায়।
বর্ষা হলে হাওর যেন সাগর দেখা যায় ॥
মধ্যে মধ্যে গ্রামগুলো, চারিদিকে জল।
বর্ষার দুযোগে কারো রয় না মনোবল ॥
এই সমস্ত গ্রামে কৃষক মজুরের বসতি।
প্রাকৃতিক দুযোগে কত মানুষের দুগতি ॥
বর্ষাকালে ঝড় আসিলে উঠে যখন ঢেউ।
ভুক্তভোগী ছাড়া দুঃখ বুঝে না যে কেউ ॥
বাড়ি ভেঙে নিয়ে যায় ভেঙে পড়ে ঘর ।
কে আছে দরদি তখন কে নেয় খবর ॥
শক্ত করে বান্ধিতে হয় দিয়ে বাঁশ বন ।
নইলে বাড়ি রক্ষা হয় না শান্ত হয় না মন ॥
কর্তব্যকাজ না করিলে হয় সর্বনাশ।
একশো টাকায় মিলে না ছোটো দুইটা বাঁশ ॥
গরিব যদি কষ্ট করে বাঁশ যোগাড় করে।
বাঁশ হলেও বন মিলে না বনশূন্য হাওরে ॥
পতিত কোনো জায়গা নেই কোথায় ফলবে বন।
বন বিনে গরিবের চলে না জীবন ॥
কুড়েঘর করে গ্রামে বাস করে যারা।
ঘর করিবে কেমন করে ছন-বন ছাড়া ॥
বনশূন্য হইল যখন এই ভাটি অঞ্চল।
সাধারণ মানুষের মন হইল চঞ্চল ॥
এখন একটি কুড়েঘর করিতে তৈয়ার।
কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকার দরকার ॥
জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার উপায় নাই যার।
ঘর করিবে কই পাবে টাকা পাঁচ হাজার ॥
বাঁ হলে নৌকাযোগে পাহাড়ে লোক যাইত।
পাহাড়ের কাছে তখন ছন-বন পাইত ॥
ছন-বন কেটে আনতো নিজ পরিশ্রমে।
অবস্থা দেখে এখন পড়ে গেলাম ভ্রমে ॥
পাহাড়ের পাদদেশে যে বনজঙ্গল ছিল।
জনগণ এখন তাহা আবাদ করে নিল ॥

বনজঙ্গল পরিষ্কার হইল যখন।
আসলে সমস্যার সৃষ্টি হইল তখন ॥
জল নামে রাস্তায় কোনো বাধা বিঘ্ন নাই।
প্রচুর মাটি নেমে আসে চোখে দেখতে পাই ॥
পাহাড়ি জল নিচে নেমে নদী পথে চলে ।
এলাকা পাবিত হয় অকাল বন্যার জলে ॥
জলনিকাশে বাঁধাবিঘ্ন রয়েছে রাস্তায়।
এলাকাতে জল তখন আটকা পড়ে যায় ॥
জলের সঙ্গে মাটি আসে কথা নহে মিছে।
জলে-মিশা পলিমাটি বসে পড়ে নিচে ॥
নিচু জায়গা ভরাট হয় সমস্যা বাড়ে।
বন্যার জলে কৃষকের ফসলাদি মারে ॥
বন্যানিয়ত্রণ করা হলো মূল কারণ।
নদী খনন না হলে তা হবে না বারণ ॥
সুরমা-কুশিয়ারার তীর বেঁধে নেওয়া দরকার।
এ ছাড়া উপায় নাই এই ভাটি এলাকার ॥
নদীর তীর বেঁধে যখন উঁচ করতে পারবে।
তখন এই নদীগুলোর গভীরতা বাড়বে ॥
কল ডুবাইয়া নদীর জল হাওরে যাবে না।
অকাল বন্যার জলে ফসলকে পাবে না ॥
স্বাভাবিক অবস্থায় জল নদীপথে যাবে।
বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষা পাবে ॥
জল নিকাশে বাঁধা কোথায় বিচারে যা পাও।
বাধা বিঘ্ন দূর করে রাস্তা খুলে দাও ॥
নির্বিঘ্নে জল নেমে যাওয়া হলো দরকার।
প্রয়োজন মনে করি লোপকাটিং করার ॥
আঁকা-বাঁকা নদীপথ সোজা সরল হলে।
উপর হতে আসবে জল নিচে যাবে চলে ॥
অতি সহজে জল হইবে নিকাশ।
কৃষকগণ বারবার হবে না নিরাশ ॥
আর একটা স্থায়ী ফল জনগণ পাবে।
নদীপথে যাতায়াতের রাস্তা কমে যাবে ॥

প্রয়োজন হবে তখন সুইচ গেইট করার।
বিবেক বিচার করে যেখানে দরকার ॥
কুশিয়ারার জল নিকাশে বাধা যখন পড়ে।
তখন কুশিয়ারায় জল উল্টা রাস্তা ধরে ॥
কালনী দিয়ে কুশিয়ারার জল ঢুকে যায়।
এই জলে দিরাই শালার হাওর ডুবায় ॥
এই জল ঢুকে যখন ঘটায় বিষাদ।
এর জন্যই দিতে হয় কালনীর মুখে বাঁধ ॥
কুশিয়ারায় জল নিকাশের রাস্তা যদি পাই।
কালনী নদীর মুখে কোনো বাঁধের দরকার নাই ॥
বর্তমান অবস্থায় এবং জ্ঞানী গুনীর মতে।
এই ভাটি এলাকা এখন সাগর হওয়ার পথে ॥
এলাকার মানুষকে যদি বাঁচাইতে চাও।
পাহাড়ি জল নেমে যাওয়ার রাস্তা খুলে দাও ॥
ক্ষমতার মালিক যারা সূক্ষ্ম রাস্তা ধর।
কৃষকের ফসল রক্ষার সুব্যবস্থা কর ॥
এই দাবি ভাটি অঞ্চলের কৃষকের।
কর্ম চাই বাঁচতে চাই দাবি মজুরের ॥
কৃষক মজুর মিলে সবাই স্বদেশ ভালোবেসে।
বাঁচার মতো বাঁচতে চাই এই বাংলাদেশে ॥

ফসলের নিরাপত্তা নাই কী করে যে চলি।
মানুষের সুঃখ দুঃখের খবর এখন বলি ॥
কৃষক-মজুর নারী-পুরুষ গ্রামে যারা আছে।
ফসল উৎপাদনের ভার তাহাদের কাছে ॥
জমিতে সুফল হবে–আশায় স্বপ্ন দেখে।
গরিব কৃষক ঋণ আনে জমি বন্ধক রেখে ॥
শীলাবৃষ্টি খরা আর অকাল বন্যার জল।
অনেক সমস্যার মুখে কৃষকের ফসল ॥
ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশের সরকার।
কৃষককে ঋণ দেন যাদের দরকার ॥
ঋণ পায় অতিরিক্ত জমির মালিক যারা।
গরিব মারার কল-কৌশল করে নেয় তারা ॥
জমির অনুপাতে ঋণের বড় অংশ পায়।
অনেকেই এই টাকা সুদী লাগায় ॥
চৈত্র মাসে সুদী-লগ্নির বেড়ে যায় মান।
একশো টাকায় দিতে হয় তিনশো টাকার ধান ॥
উৎপাদনে কৃষিঋণের প্রয়োজন যার।
সহজভাবে ঋণ পাওয়ার সুবিধা নাই তার ॥
গরিব কৃষক যারা, মারা যায় মাঠে।
তিন টাকা পাওয়ার জন্য তের দিন হাঁটে ॥
হাজারে প্রায় দুইশত খরচ হয়ে যায়।
এর পরে কপালপোড়া গরিবী ঋণ পায় ॥
গরিব কৃষক বিপদ ভেবে করে আজাহারি।
দিনে দিনে ঋণের বোঝা হয় যে তার ভারি ॥
মেহনতি নারী-পুরুষ গ্রামে যারা আছে।
দিন-রাত মাটির সঙ্গে লড়াই করে বাঁচে ॥
শীত-গরম রোদ-বাদলে নাহি করে ভয়।
তাদের পরিশ্রমের ফলে উৎপাদন হয় ॥
যাদের উৎপাদনের উপর নির্ভর সবার।
তাদের পেটে ভাত নাই উপায় কী এবার ॥
কৃষক দেশের মেরুদণ্ড কৃষিপ্রধান দেশে।
কৃষককুল ধ্বংস হলে কী হইবে শেষে ॥
কৃষকের মুখে যদি অন্ন জুটে না।
মজুর বাঁচার তো কোনো প্রশ্নই উঠে না।
মজুর বলে ভিক্ষা নয় মজুরি চাই।
ভাটি অঞ্চলে তো কল-কারখানা নাই ॥
গরিব কৃষক বিক্রি করে জমি ছাড়তেছে।
ভূমিহীন ক্ষেত মজুরের সংখ্যা বাড়তেছে ॥
মজুরি নাই মজুর বাড়ে হবে কী উপায়।
 মজুরি বিনে মজুরের প্রাণে বাঁচা দায় ॥
ছোটো বড় কৃষক যত পুরান-নতুন।
ভূমিহীন ক্ষেতমজুর তাহার দ্বিগুণ ॥
জীবনের নিরাপত্তা নাই মরে হা-হুঁতাশে।
ছেলেমেয়ের শিক্ষার সুযোগ নাই তো এই দেশে ॥
ঘর করে থাকতে পারে না পরার নাই কাপড়।
রোগে কোনো ঔষধ নাই কে নেয় খবর ॥
বিভিন্ন অবস্থায় চলেছে এই দেশ।
ভাটি অঞ্চলের হয় ভিন্ন পরিবেশ ॥
শুকনা মৌসুমে হয় ইরি-বোরো চাষ।
অগাধ জলের নিচে থাকে ছয় মাস ॥
কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে জমি যখন ভাসে।
কৃষকের কৃষিকাজের সময় তখন আসে ॥
এই সমা কৃষকগণের মজুর দরকার।
মজুরদের প্রয়োজন মজুরি করার ॥
কৃষিকাজে মজুরগণে মজুরি পাইত।
লাখ লাখ মজুর তখন লাঙ্গলে হাল বাইত ॥
কাঠের কুন্দে জমিতে সিচিত যে জল।
কর্ম করে বেঁচে থাকতো মজুরের দল ॥
কৃষিতে আধুনিক যন্ত্র আসিল যখন।
ক্ষেতমজুরগণ নিরুপায় হইল তখন ॥
এখন কাঠের কুন্দে সিচতে হয় না জল।
চাষের জন্য এসেছে কলের লাঙ্গল ॥
একশো জনের কাজ এখন দুচারজনেই চলে।
গরুতে হাল টানে না এখন টানে কলে ॥
জল সিচা লাঙ্গল বাওয়া এখন আর নাই।
মজুরের কপাল পুড়ে হয়ে গেছে ছাই ॥
ফসলবোনায় কয়েক দিন মজুরি মিলে।
মাছধরাতে মালিকগণে মজুর খাটায় বিলে ॥
কেউ মেয়াদি কেউ দিনমজুরি করে।
তাও যদি না পায় অনাহারে মরে ॥
সরকারি-বেসরকারি মাটি কাটা পায়।
হেমন্ত-শীত-বসন্ত দুঃখ-কষ্টে যায় ॥
চৈত্রের শেষে নবীন বেশে আসে বৈশাখ মাস।
ধনী গরিব সবার মনে আনন্দ উল্লাস ॥
একটি ফসল মাত্র ভাটি এলাকার।
কৃষক সকলেরই মজুর দরকার ॥
এই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়।
এলাকাবাসী তখন আতঙ্কিত রয় ॥
কৃষক সবাই তখন এই চেষ্টা করে।
তাড়াতাড়ি ফসল তুলে নিতে চায় ঘরে ॥
বর্তমান অবস্থায় যাহা চোখে দেখতে পাই।
গ্রামের মজুরদের স্থায়ী মজুরি নাই ॥
মজুরগণ বেকার বিপন্ন অবস্থায়।
যেখানে মজুরি মিলে সেখানেই যায় ॥
বৈশাখ মাসে বোরো ফসল তোলার সময়।
অনেক মজুর তখন উপস্থিত হয় ॥
বিভিন্ন জেলার মজুর আসে যে তখন।
এলাকাতে রয়েছে এই প্রচলন ॥
দূর থেকে মজুরগণ নৌকায় আসে যারা।
নিজ দায়িত্বে থেকে ফসল তুলে দেয় তারা ॥
কৃষকগণ ইচ্ছামত চালাইতে পারেন।
সুবিধা পাইলে আর কেহ কি ছাড়েন ॥
তারা যখন ষোলোআনা নেয় দায়িত্বভার ।
স্থানীয় মজুর তখন হয়ে যায় বেকার ॥
আশা করে ফসল বোনে কৃষক মজুরগণ।
ভাটি এলাকায় যাদের জীবন-মরণ ॥
অকাল বন্যার জলের আক্রমণ হলে।
রক্ষা করতে চেষ্টা করে মিলিয়া সকলে ॥
ফসল তোলার মজুরি যখন তাদের ভাগ্যে নাই।
আশা-ভরসায় তখন পড়ে যায় ছাই ॥
এরপর নামে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়িয়া ঢল।
বিপদে পড়ে এই দিনমজুরের দল ॥
তখন মজুরে কোনো মজুরি পায় না।
নৌকা না থাকিলে বাড়ির বাহির হওয়া যায় না ॥
ঘরে বসে চিন্তা-ভাবনা করে সর্বদায়।
থাকলে কিছু অমূল্যে বিক্রি করে খায় ॥
বর্ষাতে হাজার হাজার নৌকা-বারকি বাইত।
মাঝি হয়ে নৌকা বেয়ে মজুরগণ খাইত ॥
নৌকাতে বসেছে এখন আধুনিক কল।
বিপদে পড়েছে এই মাঝিমাল্লার দল ॥
ভাসা-জলে মাছ ধরে বিক্রি করে খাইত।
তাও এখন পারে না সেদিন আর নাই তো ॥

অনেক জলাশয় আছে এই ভাটি অঞ্চলে।
কোটি কোটি টাকার মাছ আপনা থেকেই ফলে ॥
গরিব সমবায় সমিতি মৎস্যজীবীদের।
আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় ধনী কৃষকের ॥
ওদের মাথায় কাঁঠাল রেখে অন্যেরা খায়।
অর্থলোভী আমলা যারা তারা অংশ পায় ॥
সবাই বলি জমিদারগণ শোষণ করে নিত।
তারা যখন জলমহাল বন্দোবস্ত দিত ॥
ছোটো ছোটো খাল-নালা-ডোবা-ঝাই আর।
এগুলোতে জনগণের ছিল অধিকার ॥
বর্ষার ভাসান জলে সমস্ত হাওরে।
ধরিয়া খাইত মাছ যে যেভাবে পারে ॥
তখন কোনো নিষেধ বাঁধা ছিল না যে কার।
এ ছিল দেশবাসীর মৌলিক অধিকার ॥
এখন বন্দোবস্ত দেন দেশের সরকার।
বন্দোবস্ত দেওয়ার বাকি কিছুই রয় না আর ॥
শক্তি সম্পদের মালিক ধনী-মানী যারা।
জলমহাল বন্দোবস্ত আনেন এখন তারা ॥
হাওরে একটি বিল তাদের আনা হলে।
সমগ্র হাওর তারা নিয়ে যায় দখলে ॥
মহালের ক্ষতি হয় অজুহাত করে।
নিষেধাজ্ঞা জারি করে সম্পূর্ণ হাওরে ॥
কড়া পাহারা চলে সারা দিন-রাত ।
মাছ ধরিতে কেহ যেন জলে দেয় না হাত ॥
জাল-বঁড়শি নিয়ে কেউ নামিলে হাওরে।
জাল-বঁড়শি মানুষসহ নিয়ে যায় ধরে ॥
গরিব মানুষের মনে হয়েছে ভয়।
জালগুলো আগুনে পুড়াইয়া দেওয়া হয় ॥
মাছ ধরে খাওয়ার দিন সমাপ্ত হলো।
এখন দেখি না আর কুচা-অচু-পলো ॥
হেমন্ত কি বর্ষাকালে মাছ ধরে খাওয়ার।
কোনোখানেই জনগণের নাই অধিকার ॥
সেদিন নাই আর, মাছ ধরে খাইতে কেউ পায় না।
ভালো একটা মাছ এখন চোখে দেখা যায় না ॥
এলাকার জলাশয়ে যে মাছ ধরা পড়ে।
এলাকার মানুষ তাহা দেখে না নজরে ॥
মালিকের হিমাগারে সযতনে রয়।
কারগো বিমানে তাহা বিদেশ চালান হয় ॥
শাক-শবজি দেশের মানুষ খাইতে নাহি পায়।
ব্যবসায়ীগণ তাহা বিদেশে পাঠায় ॥
শাক-শবজি মাছের মূল্য দিন দিন বাড়ে।
ভালো কোনো মাছ মিলে না দেশের বাজারে ॥
খাঁটি দুগ্ধ পাওয়ার দিন চলে গেছে পাছে।
গুড়া দুগ্ধ কিনে খায় টাকা যাদের আছে ॥
দিনের পর দিন আসে কঠিনভাব দেখে ডরাই।
স্বাধীন হয়ে কী পেয়েছি মনে ভাবি তাই ॥
গ্রামাঞ্চলে মজুর বাঁচার উপায় যাহা ছিল।
কল এসে মজুরের মজুরি কেড়ে নিল ॥
কৃষিতে মজুরি বিনা অন্য উপায় নাই।
নিরুপায় হয়ে গেছে মজুর সবাই ॥

গরিব কৃষক ক্ষেতমজুরগণ হও হুঁশিয়ার।
দুঃখ এসেছে দেখো ঘরে আপনার ॥
চোখের সামনে সন্তানাদি দুঃখ-কষ্ট করে ।
স্ত্রী দেখো ঔষধ বিনা রোগে ভুগে মরে ॥
টাকা ছাড়া ঔষধ-ডাক্তার পাওয়ার উপায় নাই।
অনুতাপের আগুনে যে পুড়ে হবে ছাই ॥
সন্তানাদি জন্ম দেওয়া বড় কথা নয়।
শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে পরে মানুষ করতে হয় ॥
টাকা ছাড়া লেখাপড়া করাবে কী করে।
বেতন না দিলে কি পড়াবে মাস্টারে ॥
এর পরেও গৃহশিক্ষক হবে দরকার।
তা না হলে ফল পাবে না ইশকুলে পড়ার ॥
অধিকাংশ মানুষ এখন দুঃখের সাগরে।
অর্ধাহার-অনাহারে দুঃখ কষ্ট করে ॥
পেটে ভাত নাই দিন-রাত দুঃশ্চিন্তায় ভোগে।
ঔষধ-ডাক্তার মিলে না ধরে যখন রোগে ॥
গরিবের রোগ হইলে সহিতে হয় জ্বালা।
ঔষধের দাম শুনিলে কানে লাগে তালা ॥
চৌদিকে অন্ধকার দেখি কী বলিব কারে।
উপায় নাই দ্রব্যমূল্য দিনে দিনে বাড়ে ॥
মজুতদার দোকানদারগণ নাচে কৌতূহলে।
খাদ্যে ভেজাল মিশায় বানরের দলে ॥
চলমান অবস্থা দেখে মনে ভয় পাই।
চলেছে লুটপাট আজ ধর্মাধর্ম নাই ॥
মজুতদার কালোবাজারি পেয়েছে বাজার।
আছে ইজারাদারের চরম অত্যাচার ॥
সাধারণ মানুষ এখন হলো নিরুপায় ।
এই আঁধারে দেশবাসী আলো পেতে চায় ॥
সুযোগ-সন্ধানী যারা সুযোগ পেয়ে নাচে।
সাধারণ মানুষ ভাবে কী করে প্রাণ বাঁচে ॥
দেশের যত ধনী আরো ধনী হতে চায়।
গরিব যদি মরে তাদের কিবা আসে যায় ॥
পুরান এক প্রবাদ বাক্য পড়ে গেল মনে।
রাজার হয় না ধনে গৃহস্থের হয় না বনে ॥
বর্তমান অবস্থা যাহা চোখে দেখতে পাই।
মানুষের প্রতি মানুষের দয়া-মায়া নাই ॥
বিচার করে দেখ যাহা চোখে দেখা যায়।
ধনী যারা দুনিয়াটা গ্রাস করিতে চায় ॥
জোর-জুলুম-অত্যাচার দুর্বলে কি করে।
দুর্বল শুধু মাইর খায় অবশেষে মরে ॥
বিচার নয় অবিচার আর ন্যায়কে অন্যায়।
স্বেচ্ছাচারী ধনী যারা করে সর্বদায় ॥
সজ্ঞানী মানুষ যারা নীরব হয়ে রয়।
ন্যায্য কথা বলতে চায় না মান ইজ্জতের ভয় ॥


বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ এলাকাতে আছে।
চোখে দেখি সাধারণ লোক কী করে যে বাঁচে ॥
অধিকাংশ লোকে বলে করি কী উপায়।
কইতে নারি সইতে নারি বড় অসহায় ॥
উপর তলায় বসেছে রূপচান্দের বাজার।
নিচ তলাতে চলেছে জঘন্য কারবার ॥
স্বার্থপর নেতা যারা কাজে তারা জামিদার।
স্বার্থপর পদলোভী মিথ্যা কথার দোকানদার ॥
আপন নিয়ে ব্যস্ত সবাই কে কার পানে চায়।
রক্ষক যদি ভক্ষক হয় প্রাণে বাঁচা দায় ॥
যখন সুবিধা সুযোগ পেয়েছ যারা।
আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে তারা ॥
এদেশে পুরান এক প্রবাদ বাক্য রয়।
বৃক্ষ যে হয় তার ফলে পরিচয় ॥
এখন আস্থাহারা হলেন জনগণ।
খুঁজে মিলে না তাদের কে হবে আপন ॥
জীবনে কত আশার স্বপ্ন দেখলাম।
আশায়-নেশায় পড়ে কত গান লেখলাম ॥
এই দেশে কি মানুষের বাঁচার অধিকার নাই।
অনেকে জিজ্ঞাসা করে উত্তর কোথায় পাই ॥
অসহায় বিপন্ন হয়ে মা-বোন কত আছে।
অন্তরের দুঃখ-ব্যাথা বলবে কার কাছে ॥
শোষিত-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত হয় যারা।
সীমাহীন দুঃখ কষ্ট সহিতেছে তারা ॥
দলে দলে মেয়েলোক রাস্তায় মাটি কাটে।
জানি না এদের আর কী আছে ললাটে ॥
জন্ম নিলে মরতে হয় নিয়তির বিধান।
সবাই করে ধর্ম-কর্ম আমি গাই গান ॥
আমি আমার গান আমার ভাবে গাই।
জীবননদীতে নৌকা উজান বেয়ে যাই ॥
এখনো লোভ-লালসা করে পরিহার ॥
মানবতার লক্ষ্যে করো সমাজের বিচার ॥
তা যদি না করো রাখিও স্মরণ।
একদিন তোমাদের বিচার করবে জনগণ ॥

মনে পড়ে তেরশো পঁচানব্বই বাংলাতে।
কী ঘটেছিল এই ভাটি এলাকাতে ॥
তেরশো পঁচানব্বই সাল এসে দেখা দিল।
কৃষক মজুরের মনে কত আশা ছিল ॥
হঠাৎ করে এমন হবে আগে কি কেউ জানি।
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম এল অকাল বন্যার পানি ॥
ভাটি এলাকায় যা ইরি আউশ ছিল।
প্রথম ছোবলে তাহা গ্রাস করে নিল ॥
নিদারুণ বন্যার জলে দেশ করল দখল।
সমূলে বিনাশ করিল কৃষকের ফসল ॥
অধিক ফসল পাবে বলে ছিল যে বাসনা।
নিমিষে চলে গেল রহিল ভাবনা ॥
ধান নিল খড় নিল এসে বন্যার পানি।
গরিবের হলো না তো কুঁড়ে ঘরে ছানি ॥
মানুষের ভাত নিল গরুর নিল ঘাস।
ঘর-বাড়ি ভাসাইয়া কত করলো সর্বনাশ ॥
গবাদি পশু মরিল প্রবল প্লাবনে।
বিপাকে পড়ে কত মানুষ মরে প্রাণে ॥
বন্যার তাণ্ডবলীলা তখন দেখিলাম ।
অধ্বভাঙা হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম ॥
স্বচক্ষে দেখিলাম যাহা ভাটি এলাকায়।
সাধারণ মানুষ আছে হয়ে অসহায় ॥
ঘর ভাঙ্গিল ঝড়বৃষ্টিতে ঢেউয়ে ভাঙলো বাড়ি।
বিপদে পড়ে মানুষ করে আহাজারি ॥
এই মহা বিপদের খবর যখন পাইলা।
সরকারি-বিরোধী দল সবই তখন আইলা ॥
আসলেন তারা স্পীডবোট এবং ইঞ্জিন-নৌকায়।
দেখতে এলেন, কী ঘটেছে ভাটি এলাকায় ॥
বাস্তবে গ্রামগঞ্জের অবস্থা দেখিলা।
মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর ছবি তুলে নিলা ॥
দুর্গত এলাকায় যারা আসিয়াছিলেন।
সবাই তখন মুখভরা ভরসা দিলেন ॥
আশ্বাসবাণীতে তারা বলিলেন তখন।
করা হবে দুর্গতদের পুনর্বাসন ॥
সবরকম সাহায্য দেবেন সবাই বলেছিলা।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে নিলা ॥
প্রচারমাধ্যম তাহা তুলিয়া ধরিল।
দেশ-বিদেশ প্রচুর সাহায্য করিল ॥
বিভিন্ন স্থানে যারা আশ্রয় নিয়েছিল ।
ধীরে ধীরে বন্যার জল ভাটা যখন দিল ॥
হুকুম হলো ফিরে যাও যার তার জায়গায়।
ভাঙা বাড়িতে এল হয়ে নিরুপায় ॥
ঝড় প্লাবণে ঘরবাড়ি ভেঙে যাদের নিল।
ফিরে এসে অসহায় অবস্থাতে ছিল ॥
ভাঙা ভিটায় মাটি কেটে বান্ধিতে হয় ঘর।
আসলে খাবার নাই সমস্যা বিস্তর ॥
দুঃখ কষ্টে একটি বছর গত করে দিল।
কোনো কিছু পাবে বলে মনে আশা ছিল ॥
পাওয়ার আশে ছিল যারা অসহায় এতিম ।
পাবে বলে পেয়েছে কি হাতি-ঘোড়ার ডিম ॥
বিদেশী সাহায্য যখন এই দেশে আইল।
স্বার্থপরগণ স্বার্থের সুযোগ তখন পাইল ॥
ব্যক্তিস্বার্থে পাগল যারা আর কিছু বোঝে না।
স্বার্থের বেলা ভালোমন্দ তারা যে খোঁজে না ॥
নরক যাতনায় আছে গরিব কাঙাল যারা।
লুটকর ধনিক শ্রেণী মজা লুটছে তারা ॥
সাধারণ মানুষ যে অবস্থায় পড়েছে।
দিনে দিনে হতাশা নিরাশা বেড়েছে ॥
মানুষের দুঃখ দেখে কাঁদে মনপ্রাণ।
মানুষকে ভালোবাসি, গাই মানুষের গান ॥
যেভাবে যা মনে আসে করি তা প্রচার।
সাধু কি চলিত ভাষা করি না বিচার ॥
আমি যাদের গান গাই তারা যদি বোঝে।
তাদের মাঝে থাকতে চাই, তারা আমায় খোঁজে ॥
আমি বলি আমার ভাবে, আমি যাহা বুঝি।
দুঃখে গড়া জীবন নিয়ে মুক্তির পথ খুঁজি ॥

অনাবাদি জায়গা কত বিভিন্ন স্থানে।
রেকর্ডকৃত আছে তাহা ডিসির খতিয়ানে ॥
বর্তমান শাসনতন্ত্রের আইনের ধারায়।
ভূমিহীনে এসব জায়গা বন্দোবস্ত পায় ॥
খরচ করে গরিব যদি বন্দোবস্থ আনে।
এইসব জায়গায় দখল পায় না বিভিন্ন কারণে ॥
কৃষি-কর্মচারীগণ কলকৌশলে চলে।
এ সমস্ত জায়গা আছে জোতদারের দখলে ॥
গ্রামসামন্ত-জোতদার যখন গরিবকে তাড়াবে।
জোতদারের সামনে গরিব কী করে দাঁড়াবে ॥
চেষ্টা করতে গরিব যখন খালি হাতে যায়।
সালামের আলেক মিলে না উপর তলায় ॥
জন্মগত ভূমিহীন একজন ছিল।
পতিত বন্দোবস্তের জন্য দরখাস্ত দিল ॥
তিন একর পাওয়ার জন্য দরখাস্ত ছিল।
দুই একর এগারো শতক দেওয়া তারে হলো ॥
আইন মতে দশ কিস্তিতে সালামি দিয়েছে।
এ পর্যন্ত এই জমির খাজনা দিতেছে ॥
কাগজপত্রে বন্দোবস্ত পেয়েছে তো বটে।
আজো বেদখল আছে জোতদারের দাপটে ॥
সময় গেল, টাকা পয়সা গেল যে বিস্তর।
আশাতে আছে প্রায় একত্রিশ বৎসর ॥
শক্তি-সম্পদ না থাকাতে সবুর করে আছে।
ভুলিতে পারিবে কি যতদিন বাঁচে ॥
এইভাবে গরিবের মনে দেয় যারা ব্যথা।
তারাও জনদরদি তারাও আজ নেতা ॥
চোরের নৌকায় সাউধের নিশান দখিন হাওয়ায় উড়ে।
কারে কী বলিব আর সময়ে সব করে ॥

আরেক দুঃখের কথা এখন বলতে চাই।
চারদিকে পড়েছে অভাব উপায়-বুদ্ধি নাই ॥
যখন যা প্রয়োজন হয় তখন তা আনো।
রান্না করে খাইতে হয় সবাই তা জানো ॥
কালের করাল গ্রাসে কত দুঃখ সই।
বনশূন্য ভাটি এলাকা লাকড়ি পাব কই ॥
ডোবা জায়গায় গাছ লাগাব এমন স্থানও নাই।
আশি টাকা লাকড়ির মণ কিনতে যদি যাই ॥
যে কৃষকের গরু আছে ভাটি এলাকায়।
তোষের সাহায্যে গরুর গোবর জ্বালায় ॥
গরু নাই যার গোবর নাই তার কী করবে বল না।
লাকড়ির জন্য তাগিদ করেন ঘরের ললনা ॥
সারাদিন কাজ করে ডাইল চাউল আনে।
লাকড়ি বিনা রান্না হয় না পড়ে ঘোর নিদানে ॥
সমস্যা আছে বলে সমাধান চাই।
ভাটি এলাকায় তো গ্যাসের চুলা নাই ॥
এই অঞ্চলের মাটির নিচে প্রচুর গ্যাস রয়েছে।
কে কখন কাজে লাগাবেন সমস্যা হয়েছে ॥
ভাঙাগড়া দেখলাম কত লীলার অন্ত নাই।
চাচা আপন জান বাঁচা–এই দেশে তো তাই ॥
আমরা নয়-–আমি শুধু সবার মনে মনে।
জাতির উন্নতি তবে হইবে কেমনে ॥

গ্রামের কৃষক যে কৃষি কর্ম করে।
অধিকাংশ নির্ভর করে গরুর উপরে ॥
বর্তমান অবস্থায় যাহা চোখে দেখতে পাই।
গোসম্পদ রক্ষার কোনো সুব্যবস্থা নাই ॥
গ্রামের কাছে পতিত জায়গায় ছিল গরুর ঘাস।
এখন হয় এই জায়গাতে ইরি ধানের চাষ ॥
খাদ্যের অভাবে গরু পোষা হলো দায়।
চিকিৎসার সুযোগ নাই রোগের বেলায় ॥
কারে কী বলিব আমি ভাবি সর্বক্ষণ।
জেলা থানায় আছেন পশু-ডাক্তারগণ ॥
ডাক্তারগণ নিজ দায়িত্ব পালন করতে চায় না।
হালের বলদ রোগে মরে কৃষকে তো পায় না ॥
ডাক্তার আছেন কী করতেছেন আমি যদি কই।
তাহলে তো ভাগু ভেঙ্গে পড়ে যাবে দই ॥
পুরান কথা মনে পড়ে আজো তাহা ভাবি।
দশ টাকা হলে তখন কেনা যেত গাভী ॥
ধীরে ধীরে গোসম্পদের অভাব পড়ায়।
দশ টাকার গাভী এখন দশ হাজার বিকায় ॥
খাদ্যাভাবে রোগব্যধিতে গরু মরিতেছে।
হাজার হাজার গরু রোজ জবাই করিতেছে ॥
এই অবস্থা এগিয়ে যায় যদি তবে।
একটি গাভীর মূল্য পঞ্চাশ হাজার হবে ॥
সবার পক্ষে গাভী পালন সম্ভব হবে না।
সধারণ কৃষকের ঘরে গাভী রবে না ॥
কৃষক ভাইগণ শোনো এখন গাভীর খবর।
গাভী তো চলে গেছে ঢাকার শহর ॥
রঙ মাখিয়া সঙ সাজিয়া গ্রাম গঞ্জে আসে।
টিনের মধ্যে থেকে গাভী কল কল করে হাসে ॥
গাভী বলে রব না আর কৃষকের ঘরে।
এখন আমি স্থান পেয়েছি শহরে বন্দরে ॥
ক্ষুধায় খাদ্য মিলে–রোগে ঔষধ পাই।
গ্রাম্য এলাকায় বেঁচে থাকার পরিবেশ নাই ॥
ক্ষুধায় খাদ্য মিলে না রোগ ব্যাধিতে মরি।
সময়ে কৃষি কাজে পরিশ্রম করি ॥
গ্রামের কৃষকে যখন প্রাণ খুলে চায় না।
দধি দুগ্ধ মাখন ছানা তারাও এখন পায় না ॥
ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র যাব।
আশা করি সবাই মোরা শহরে স্থান পাব ॥
গাভী বলে আপাতত বিদায় নিলাম।
গ্রামবাসী সবার কাছে রহিল সালাম ॥

জানি না দেশবাসীর ভাগ্যে যে কী ছিল।
ভালোর জন্য নির্বাচন এই দেশে দিল ॥
এখন নির্বাচন আসিলে পরে।
নেতা সবাই আসেন তখন বিভিন্ন রঙ ধরে ॥
স্বার্থ সুবিধার কথা লোকেরে বোঝায়।
আসলে সবাই তখন ভোট নিতে চায় ॥
এই সময় গ্রামগঞ্জের ধনী মানী যারা।
বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তারা ॥
নিরপেক্ষ থাকে যারা সাধারণ মানুষ।
চারদিকের তাড়নায় হয়ে যায় বেহুশ ॥
একজনে পাঁচজনের মন কেমন করে রাখে।
সাধারণ মানুষ তখন পড়ে যায় বিপাকে ॥
এক গ্রামের লোক যখন পাঁচ দল হয়।
ভালোবাসা আত্মবিশ্বাস থাকার কথা নয় ॥
উশৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা চা-খাওয়ার তাল।
মিছিলে দেখি তখন বড় বড় ফাল ॥
দলাদলি মারামারি মামলা মোকদ্দমা।
কত কিছু ঘটে তখন নাই তার সীমা ॥
আমাদের কেউ নয় আসলে তা জানি।
অন্যের মরা কেন আমরা যে টানি ॥
ভোট যুদ্ধ হারা-জেতায় মীমাংসা হয়।
আগুন যদি নিভে তবে স্ফুলিঙ্গ রয় ॥
এরপরে তিন-চার বৎসর চলে যায়।
ধীরে ধীরে আগুন তখন নিভে যেতে চায় ॥
আবার নির্বাচন আসে যখন ফিরে।
পর্বের সেই স্ফুলিঙ্গ দাবানল সষ্টি করে ॥
শোষকের শাসনতন্ত্র বহাল থাকিলে।
কী কাজ হবে পার্লামেন্টে ভালো লোক দিলে ॥
শোষকের তৈরি শাসনকাঠামো যে তার।
কৃষক-মজুর শোষণের হাতিয়ার ॥
কাল যা ছিল আজো আছে ভেবে দেখ তাই ।
এই তন্ত্রে শোষিতের পক্ষে কিছুই লেখা নাই ॥
ব্রিটিশ গেল প্রকাশ্য জমিদার নাই।
পাঞ্জাবি শাসক-শোষক গেল যে সবাই ॥
কৃষক-মজুরের তো দুঃখ গেল না।
এখন ভাবি এই সমস্ত শুধু প্রতারণা ॥
কৃষক মজুর মেহনতিগণ বেঁচে যদি রবে।
শোষকের শাসনতন্ত্র ভেঙে দিতে হবে ॥
শোষনহীন সমাজব্যবস্থা গড়তে যদি চাও।
কৃষক মজুর সর্বহারা এক হয়ে দাঁড়াও ॥
অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান।
সমভাবে করতে হবে সমাজকল্যাণ ॥

বর্তমান অবস্থা লেখি আমি গ্রামের কবি।
পরিবর্তন হয়ে গেছে সমাজের ছবি ॥
সুবিধা সুযোগ দিয়েছে নতুন জামানায়।
চলে সবাই লঞ্চে নইলে ইঞ্জিনের নৌকায় ॥
হাঁটতে এখন চায় না মানুষ রিকশা গাড়ি চড়ে।
উন্নত হোটেল খোঁজে যায় যদি শহরে ॥
আধুনিক চালচলনে গরিব-কাঙাল চলে।
উদের সঙ্গে বিড়াল যেন ডুব দিতে চায় জলে ॥
এসব কথা বলি আর ভাবি তা অন্তরে।
গরম ভাতে বিড়াল বেজার কেউ যদি রাগ করে ॥
গরিব নিজের ভাল-মন্দ বুঝতে নাহি চায়।
সুদী টাকা আনে তবু চা-সিগারেট খায় ॥
চা পানের দোকান এখন রাস্তাঘাটে পাই।
শুধু ধনীরা খায় না গরিবেও খাই ॥
একজনে চা পান সিগারেট খায়।
রোজ যদি পাঁচ টাকা বাজে খরচ যায় ॥
এক বছরে যোগ দিলে কত টাকা হয়।
শোষিত মানুষ তার খবর নাহি লয় ॥
বেহিসাব খরচ করে বাধা নাহি মানে ।
অসুবিধায় পড়ে তখন সুদী টাকা আনে ॥
গ্রাম্য সুদের কবলে যখন পড়ে।
সর্বহারা হয়ে তখন আয়ু থাকতে মরে ॥
সুদখোর ঘুষখোরদের মধ্যে রয়ে গেছে মিল।
ওরা যে হয় গরিবের নগদ আজরাইল ॥
পূর্বের সুদখোরের মধ্যে ছিল কল-কৌশল।
কলমের প্যাঁচে নিত গরিবের সম্বল ॥
এখন সুদখোর যারা ব্যাঘ্র আকার ধরে।
কলম নয় তারা তাদের শক্তি প্রয়োগ করে ॥

সত্য কথা বলি যদি আমায় পাবে দোষে।
স্বার্থপরগণ টাকা দিয়া লাঠিয়াল পোষে ॥
টাউট দালাল ঘুষখোর তার লাঠিয়াল বাহিনী।
আমি আর কী বলিব এইসব কাহিনী ॥
যুক্তি নয় তারা যখন শক্তি প্রয়োগ করে।
দুর্বল আতঙ্কিত হয় মান-ইজ্জতের ডরে ॥
মিথ্যা মামলা জোর-জুলুম অত্যাচার করে।
গরিব পলায় জীবন নিয়ে ভিটা মাটি ছেড়ে ॥
মানুষে মানুষে কত ভালোবাসা ছিল।
এখন এই ঝগড়া বিবাদ কেন যে বাড়িল ॥
মামলা মোকদ্দমা নাই শান্তি ছিল দেশ।
বিবাদ হলে গ্রামের বিবাদ গ্রামেই হইত শেষ ॥
এখন মামলা-মোকদ্দমা দেশের লোকে করে।
টাকা পয়সা যায় আর দ্বন্দ্ব করে মরে ॥
ঝগড়াঝাটি মারামারি আছে সর্বদায়।
এই সুযোগে দুষ্ট লোকে স্বার্থের সন্ধান পায় ॥
আর এক কথা বলি হতে পারে দোষ।
যার কাছে যে কাজে যাও সেই চায় ঘুষ ॥
বর্তমানে সুদ-ঘুষের চরম আক্রমণে।
কৃষক মজুর দিশেহারা বাঁচিবে কেমনে ॥

গ্রামে যে বিচার ছিল তা-ও প্রায় নাই।
বর্তমান অবস্থায় যাহা চোখে দেখতে পাই ॥
দলগত গোষ্ঠীগত স্বজনপ্রীতি আছে।
সুবিচার পাওয়ার দিন চলে গেছে পাছে ॥
কোর্ট আদালত কাছে যখন মামলা হয় বেশি।
মানুষে মানুষে এখন বাড়ছে রেষারেষি ॥
গ্রামে-গঞ্জে দুর্নীতির বন্যা রয়েছে।
সাধারণ মানুষ এখন নিরুপায় হয়েছে ॥
সুযোগ সন্ধানী যারা তাদের হলো ফুল ।
গড়ে উঠছে নতুন করে টাউটের দল ॥
স্বার্থপররা দিনরাত দেয় কুমন্ত্রণা।
হিতে বিপরীত ঘটায় বাড়ায় যন্ত্রণা ॥
চারদিকে টাকার জয়, গরিবের মরণ।
চলেছে আমলাতান্ত্রিক নির্মম শোষণ ॥
আদালতের খরচ যাহা না দিলে সারে না।
মামলার খরচ বহন করতে গরিবে পারে না ॥
শক্তি সম্পদ আছে যাদের তাদের হবে জয়।
গরিব বাঁচবে কেমন করে তাই তো মনে ভয় ॥
শিক্ষা সম্পদ নাই শক্তি নাই যার ।
তাদের তো বেঁচে থাকার উপায় নেই আর ॥
জন্ম নিয়েছি যখন জীবনের গান গাই।
মানুষ মানুষের মতো বেঁচে থাকতে চাই ॥

.

বিলাতের স্মৃতি

স্বচক্ষে দেখিলাম যাহা বিলাতে
তারা সবাই বাস করে এক ভালোবাসার জগতে ॥

বিলাতে পুলিশ যারা মানুষ নয় দেবতা তারা
দিনরাত ঘোরাফেরা করতেছে পথে পথে।
খায় না ঘুষ নাই দুর্নীতি সরল শান্ত শুদ্ধমতি
জানে শুধু প্রেম প্রীতি মানুষকে ভালোবাসতে ॥

বাস করতেছে বহু জাতি নিরপেক্ষ ধর্মনীতি
হিংসা নাই কারো প্রতি ধর্ম কর্ম করিতে।
কী সুন্দর নীতি বিধান সবার অধিকার সমান
যার তার ভাবে গায় গুণগান মসজিদ মন্দির গীর্জাতে ॥

সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার আলো সবাই যে পায়
আনন্দে মন ভরে যায় এই সব কথা ভাবিতে ।
গড়ে তুলতে শিশুসন্তান তারা যে কত যত্নবান
চায় তাদের ভবিষ্যৎ কল্যাণ উত্তম সমাজ গড়িতে ॥

কোনো সময় কেউ ব্যারাম হলে ডাক্তার আসে খবর দিলে
হাসপাতালে রোগী গেলে রাখে পরম শান্তিতে।
লাগে না টাকা পয়সা সবাই পায় সুচিকিৎসা
সেবা যত্ন ভালোবাসা ভুল নাই কোন জায়গাতে ॥

অন্যায় কিছু করতে চায় না অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না
করে না প্রতারণা কোনো মানুষের সাথে।
দেশের মূল বাসিন্দা যারা মিথ্যা বলে না তারা
মানুষের উপকার ছাড়া চায় না ক্ষতি করিতে ॥

সভ্য-ভদ্র তারা সবাই এতে কোনো সন্দেহ নাই
বাস্তবে যা দেখিতে পাই আচার আচরণেতে
চলাফেরা কথাবার্তায় যদি কোনো ভুল হয়ে যায়
অমনি তারা ক্ষমা চায় অহংকার নাই মনেতে ॥

আস্তে আস্তে কথা বলে সদা মন কৌতূহলে
একাত্ম হয়ে চলে নারী পুরুষ এক সাথে।
নিরাপত্তা আছে সবার নাই কোনো জুলুম অত্যাচার
কী সুন্দর আচার ব্যবহার চমৎকার সব দেখিতে ॥

চায় সদা সৎ আনন্দ ভালো বৈ করে না মন্দ
গড় যাহা করেন পছন্দ তাই করে এ ধরাতে।
জীব সমষ্টি শান্তির আশায় আজীবন চেষ্টা করে যায়
ওরা সবাই তাই তো চায় ইসলাম যা চায় জগতে ॥

আছে জাতীয় একতা আছে তাদের মানবতা
নাই পরশ্রীকাতরতা চায় সাহায্য করিতে।
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আদান-প্রদান চলাফেরায়
পরম শান্তিশৃঙ্খলায় আছে সবাই শান্তিতে ॥

কাঁদে না কেউ পেটের ক্ষুধায় দেশের সমাজব্যবস্থায়
কুকুর বিড়াল রেশন পায় সরকার দেয় হিসাব মতে।
দেশে কেউ পাখি মারে না আইনত আছে মানা
পাখিরা ভয় করে না ডাকলে আসে কাছেতে ॥

উন্নত ধনে জ্ঞানে দেশ গঠন জাতি গঠনে
তারা কিন্তু সবাই জানে সময়ের মূল্য দিতে।
কী করেছে দেশের ভিতর কে জানে তার আসল খবর
করেছে সর্বাঙ্গীন সুন্দর বাহির ও ভিতরেতে ॥

অজস্র রাস্তা করেছে মাটির উপরে নিচে
ইঙ্গিতে লিখা আছে কে যাইবে কোন পথে।
উন্নত বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় দিন হতে রাত ভালো বুঝায়
যে দিকে চাই মন ভুলে যায় ইচ্ছা হয় চেয়ে থাকতে ॥

মাদাম তোসা এক জায়গায় নাম একদিন মাত্র গিয়েছিলাম
কী যে আশ্চর্য দেখিলাম পারি না আর ভুলিতে।
মরা মানুষ খাড়া সেথায় অবিকল জিন্দা দেখা যায়
পলক মারে চোখের পাতায় চায় যেন কথা বলতে ॥

পৃথিবীর গণ্যমান্য যারা ছিলেন স্বনামধন্য
অনেকেরে স্মৃতির জন্য গড়ে রাখছে নিজ হাতে।
এক ঘরের ভিতরে ভরা চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা
আকাশমইল তৈয়ার করা বৈজ্ঞানিক কৌশলেতে ॥

একদিন গেলাম মাটির তলে তারা আণ্ডারগ্রাউন্ড বলে
লাইন আছে ট্রেন চলে, চলে সহস্র পথে
করেছে কী আজব লীলা একতালা নয় সপ্ততালা
হাট-বাজার খেলাধুলা শান্তি শৃঙ্খলাতে ॥

টেমস নদীর নিচে দিয়া দিয়াছে রাস্তা করিয়া
গাড়ি ট্রেন এ রাস্তা দিয়া চলতেছে শতে শতে।
উপরে চলে স্টিমার কী অপরূপ দৃশ্য তাহার
আছে কত রঙের বাজার আমোদ প্রমোদ করিতে ॥

রয়েছে উন্নত স্থান আসেন সেথায় আরবিয়ান
দুনিয়ায় বেহেশতের বাগান বুঝিলাম ভাব ভঙ্গিতে।
আছে শরাবনতহুরা আছে সুন্দরী জহুরা
এসব জায়গায় ধনী ছাড়া গরিব পারে না যাইতে ॥

দেখিয়াছি রানির বাড়ি যেন এক স্বর্গপুরী
বাহির থেকে আফসোস করি দেয় না ভিতরে যাইতে।
দিল্লির ময়ূর সিংহাসন কোহিনুর পরশরতন
রেখেছে করিয়া যতন এই বাড়ির ভেতরেতে ॥

রাজনীতির নাই সহস্র দল নাই ক্ষমতালোভী পাগল
ছাত্ররা নহে চঞ্চল মারামারি করিতে।
নেতারাও তাই করে না স্বজনপ্রীতির ধার ধারে না
তারা ক্ষমতায় যায় না ধনের পাহাড় জমাইতে ॥

বাঙালি যারা আছেন বিলাতে বাস করিতেছেন
স্কুল-কলেজ গড়িতেছেন বাংলার প্রসার ঘটাইতে।
ছেলে-মেয়ে আছে যারা বুঝে না ইংরেজি ছাড়া
বাংলা বলে না তারা একে অন্যের সাথে ॥

সমষ্টির স্বার্থে কেহ নাই ব্যক্তিস্বার্থে পাগল সবাই
আস্থাভাজন মানুষ চাই জাতির নেতৃত্ব দিতে।
চাইলে জাতির উন্নতি ঠিক করতে হয় নীতি গতি
নইলে কেবল দুর্গতি ফল হয় না ভবিষ্যতে ॥

মুসলমান আলেম যারা ধর্ম-কর্মে ব্যস্ত তারা
তাদের মধ্যে দুটি ধারা চলিতেছে দ্বি-মতে।
কেউ দুয়াল্লিন কেউ জুয়াল্লিন পড়েন
ভাইয়ে-ভাইয়ে বিবাদ করেন
আসলে কেউ কি পারেন নিজকে সামাল দিতে ॥

মসজিদ মাদ্রাসা হয়েছে জানি না কী হবে পাছে
ধর্মীয় অধিকার আছে মাইকযোগে আযান দিতে।
হয়ত কেউ দিবেন গালি আসল কথা যদি বলি
চলিতেছে দলাদলি মসজিদ-মাদ্রাসাতে ॥

উনিশশো পঁচাশি সনে বিলাত থেকে কয়েকজনে
হঠাৎ ভাবিলেন মনে সিলেটের শিল্পী আনতে।
শিষ্য মোর রুহী ঠাকুর, কাজি আয়শা, শফিকুন নুর
হাফিজ উদ্দিন বড় চতুর যোগ দিবে সে তবলাতে ॥

তারা আমায় বলিল দেশ দেখতে চাও তবে চল
আমারও ইচ্ছা ছিল, চলিলাম তাদের সাথে।
বিলাতে যখন পৌঁছিলাম সর্বমোট আষ্টজন ছিলাম
দেশ এবং মানুষ দেখিলাম পড়িলাম ভাবনাতে ॥

দেখলাম যত বলব কত দেখে হলেম মর্মাহত
আমি কেন নীতিগত পারলাম না সেবক হতে।
মানুষের সঙ্গে চলি সুখ দুঃখের কথা বলি
মানবরূপী দানবগুলি মিল নাই ওদের সাথে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে সৎ এবং সরল হলে
ভবিষ্যতে শান্তি মিলে পরশ মিলে লোহাতে।
জ্ঞানের কমল যদি ফোটে আলো আসে আঁধার টুটে
বিরাজ করে প্রতি ঘটে যারে খোঁজে জগতে ॥
.

দেশের গান মানুষের গান

আমি বাংলা মায়ের ছেলে
জীবন আমার ধন্য যে হায়
জন্ম বাংলা মায়ের কোলে ॥

বাংলা মায়ের মুখের হাসি
প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি
মায়ের হাসি পূর্ণশশী
রত্বমানিক জ্বলে।
মায়ের তুলনা কি আর
ধরণীতে মিলে
মা আমার শস্যশ্যামলা
সুশোভিত ফলে-ফুলে ॥

গাছে গাছে মিষ্ট ফল
মাঠে ফলে সোনার ফসল
রয়েছে সুশীতল জল
নদী-নালা খাল-বিলে।
কোকিল ডাকে কুহু স্বরে
বুলবুল নাচে ডালে
শুক-সারি গান গায়
মা যেন থাকেন কুশলে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
জীবন লীলা সাঙ্গ হলে
শুয়ে থাকব মায়ের কোলে
তাপ-অনুতাপ ভুলে।
মাকে ভোলে না মায়ের
 খাঁটি সন্তান হলে
মা বিনে আর কী আছে তার
সুখে দুঃখে মা-মা বলে ॥

[কালনীর কূলে]

.

মনের দুঃখ কার কাছে জানাই মনে ভাবি তাই
দুঃখে আমার জীবন গড়া তবু দুঃখরে ডরাই ॥

গরিবকুলে জন্ম আমার আজও তা মনে পড়ে
ছোটবেলা বাস করিতাম ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে
দিন কাটিত অর্ধাহারে রোগে কোনো ঔষধ নাই ॥

একসঙ্গে জন্ম যাদের তেরশো বাইশ বাংলায়
আনন্দে খেলে তারা ইস্কুলে পড়িতে যায়
আমার মনের দুর্বলতায় একা থাকা ভালো পাই ॥

পিতামাতার ছেলে সন্তান একমাত্র আমি ছিলাম
জীবন বাঁচাবার তাগিদে প্রথম চাকুরিতে গেলাম
মাঠে থাকি গরু রাখি ঈদের দিনেও ছুটি নাই ॥

সবসময় গান গাইতাম মনের এই স্বভাব ছিল
আমাকে নয় গানকে তখন অনেকে বাসত ভালো
রাগ-রাগিণী ভালো ছিল রচনা করিয়া গাই ॥

চাকুরি তখন ছেড়ে দিলাম হাতে নিলাম একতারা
দিবারাত্র গান গাই লোকে বলে বেসরা
উদাস মনের চিন্তাধারা মন যাহা চায় তাই গাই ॥

গ্রামের মুরুব্বি আর মোল্লা সাহেবের মতে
ধর্মীয় আক্রমণ এল ঈদের দিনে জামাতে
দোষী হই মোল্লাজির মতে পরকালেও মুক্তি নাই ॥

নিষেধ বাধা না মানিয়া কুলের বাহির হইলাম
একতারা সঙ্গে নিয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে দিলাম
ঘর ছাড়া বাউল সাজিলাম সকলেরই করিম ভাই ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া
গান গাই আমার মনকে বোঝাই
মন থাকে পাগলপারা ॥

গানে প্রাণবন্ধুরে ডাকি
গানে প্রেমের ছবি আঁকি
পাব বলে আশা রাখি
না পাইলে যাব মারা ॥

গান আমার জপমালা
গানে খোলে প্রেমের তালা
প্রাণবন্ধু চিকনকালা
অন্তরে দেয় ইশারা।।

গানকে ভালোবেসেছিলাম
গানে মন বিকাইয়া দিলাম
দুঃখের বোঝা মাথায় নিলাম
হইলাম সর্বহারা ॥

ভাবে করিম দীনহীন
আর কি আসবে শুভদিন
জল ছাড়া কি বাঁচিবে মীন
ডুবলে কি ভাসবে ভরা ॥

.

মন মজালে ওরে বাউলা গান
যা দিয়েছ তুমি আমায় কী দিব তার প্রতিদান ॥

অন্তরে আসিয়া যখন দিলে তুমি ইশারা
তোমার সঙ্গ নিলাম আমি সঙ্গে নিয়ে একতারা
মন মানে না তোমায় ছাড়া তোমাতে সঁপেছি প্রাণ ॥

কী করে পাব তোমারে তাই ভাবি দিনরজনী
মনের কথা প্রকাশ করি কথায় দিয়া রাগিণী
এস্কে দিলদরিয়ার পানি ভাটি ছেড়ে হয় উজান ॥

তত্ত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মরমি কবি
আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি
বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তিবিধান ॥

.

কত কথা মনে পড়ে
ছোটোবেলা যা দেখেছি গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ॥
মানুষ অতি সরল ছিল মানুষকে বাসিত ভালো
লালসা সীমিত ছিল তখন মানুষের অন্তরে ॥

কেহ যদি দোষ করিত গরিবেও বিচার পাইত
গ্রামের বিচার গ্রামেই হইত দেশ চলিত সুবিচারে ॥

শাক-শবজির অভাব ছিল না, দধি দুগ্ধ ঘূত ছানা
খাবাইত দাওয়াতি খানা বিরুন ভাত আর মরিচা গুড়ে ॥

খেলাধুলা গানবাজনায় আনন্দ ছিল সর্বদায়
মানুষের ভালোবাসায় থাকতো মানুষ সমাদরে ॥

নিদারুণ শোষণে এখন আসিল অভাব অনটন
কৃষক মজুরের মরণ শোষণের ফাঁদে পড়ে ॥

স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাইলাম জীবনে কত গান গাইলাম
দুই-তিনবার স্বাধীন পাইলাম তবু থাকি অনাহারে ॥

মজতদার কালোবাজারি কেউ করে ইজারাদারি
কেহ করে রিলিফ চুরি আমলাতন্ত্রের আশ্রয় ধরে ॥

এই যুগে আর বাঁচবে না মান করিম বলে গাটুরি বান্দ
আসিবে আজলি তুফান দোহাই দিলে মানবে নারে ॥

.

ফুরু থাকতে যে খেইল খেলাইতাম
পুয়া-পুড়ি বইয়া হাততালি দিয়া
কেমন সুন্দর বিয়ার গান গাইতাম ॥

ধুলা-বালু লইয়া ঠুলি-ঠালি দিয়া
উন্দাল কাটিয়া রান্ধা বওয়াইতাম
বিরুন ভাত রানৃতাম দামান খাবাইতাম
তেনার কন্যা বানাইয়া দানে বিয়া দিতাম ॥

মামুর বাড়ি যাইতাম দুধ-কলা খাইতাম
রাইত অইলে নানির কোছছা ঘুমাইতাম
লুকালুকি খেলাইতাম আমি যখন লুকাইতাম
তুকাইয়া না পাইলে টুল্লুক দিতাম ॥

বয়স যখন নয় দাঁত পড়বার সময়
কাউয়ায় দেখলে দাঁত উঠে না বিশ্বাস করতাম
পড়া দাঁত নিয়া নানিরে দেখাইয়া
কইলার তলে দাঁত গাড়িয়া থইতাম ॥

পানিতে লামিতাম সাঁতার খেলিতাম
সাঁতার শিখবার লাগি পোকড়া আম খাইতাম
আবদুল করিম বলে ইশকুলো গেলে
মাস্টরসাব মরবার লাগি দোয়া করিতাম ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটু গান গাইতাম ॥

বর্ষা যখন হইত গাজির গাইন আইত
রঙ্গে-ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম
বাউলা গান ঘাটু গান আনন্দের তুফান
গাইয়া সারিগান নাও দৌড়াইতাম ॥

হিন্দু বাড়িন্ত যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
কে হবে মেম্বার কে হবে গ্রামসরকার
আমরা কি তার খবর লইতাম ॥

বিবাদ ঘটিলে পঞ্চাইতের বলে
গরিব কাঙালে বিচার পাইতাম
মানুষ ছিল সরল ছিল ধর্মবল
এখন সবাই পাগল বড়লোক হইতাম ॥

কবির ভাবনা সেদিন আর পাব না
ছিল বাসনা সুখী হইতাম
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

স্থান নয় আমার দালান কোঠায়
ভালো আছি গাছতলায়
এ ভবের খেলাঘরে
ভালোবাসা প্রাণে চায় ॥

ভাব-ভক্তি অন্তরে আসে
প্রাণ জুড়ায় খোলা বাতাসে
সবার সঙ্গে মিলে মিশে
আছি এই ভবের খেলায় ॥

ধানের দেশে গানের দেশে
কৃষক মজুরের দেশে
দেশকে যারা ভালোবাসে
আশায় আছি তাদের বেলায় ॥

উপায় নাই তো কৃষি ছাড়া
আসে বন্যা নইলে খরা
চৌদিকে সমস্যা ঘেরা
মন কাঁদে ভজ্বালায় ॥

জীবনলীলা সাঙ্গ হলে
জানি না কই যাব চলে
বাউল আবদুল করিম বলে
সুখ-দুঃখে কাদায় হাসায় ॥

.

১০

দিরাই থানায় বসত করি হাওর এলাকায়
অবস্থা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা দায় ॥

হাড়ভাঙ্গা খাটনির বলে জমিতে যে ফসল ফলে
হয়তো নেয় বন্যার জলে নইলে নেয় খরায় ॥

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বছরে এক ফসল মিলে
সে ফসল নষ্ট হইলে প্রাণে বাঁচা দায় ॥

আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি
গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায় ॥

ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না
বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায় ॥

বাউল আবদুল করিম ভাবে গরিব যারা ঠেকছে ভবে
বিপদে দরদি হবে মিলে না ধরায় ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

১১

তেরোশো একাশি সনে কাল হইল রে বৃষ্টির জল
নষ্ট করল বোরো ধানের ফসল ॥

আশি বাংলার চৈত্রের শেষে নামলো আষাঢ়িয়া ঢল
হাওর এলাকায় থাকি প্রাণপাখি হইল চঞ্চল ॥

নদীর তরঙ্গ দেখে ভেঙ্গে গেল মনোবল
আতঙ্কিত হয়ে গেল সম্পূর্ণ ভাটি অঞ্চল ॥

ভরাট নদী জল ধরে না কল ডুবাইয়া ছটল জল
সুনামগঞ্জের শস্যভাণ্ডার হয়ে গেল রসাতল ॥

দেখার হাওর নলুয়ার হাওর চেপটির হাওর ছন চাতল
হাওর বরাম টাংনিসহ একেবারে করল তল ॥

কী হইল কী হইবে–গ্রামগঞ্জে এই কোলাহল
কৃষিমন্ত্রীর হেলিকপ্টার করল কয়দিন চলাচল ॥

কৃষক হলো অর্ধমরা নিরুপায় মজুরের দল
বাউল কবি আবদুল করিম ভাবছে বসে উজানধল ॥

.

১২

চৈত্র মাসে বৃষ্টির জলে নিল বোরো ধান
ভেবে মরি হায় কী করি বাঁচে কি না প্রাণ ॥

হাওর এলাকায় থাকি আমরা কৃষাণ
হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করি ফলাই বোরো ধান
এসে বন্যার জল অকালে ডুবাইয়া নিল
হাওরের ফসল মানুষ হয়েছে পাগল
গরিবের নাই সহায়-সম্বল বড়ই নিদান ॥

দারুণ সমস্যা এসে দাঁড়ালো হঠাৎ
ঘাস বিনে মরিবে গরু মানুষের নাই ভাত
বাড়ির ঘাটেতে পানি গরিবের ভাঙা ঘর
চালে নাই ছানি ভাবে দিন রজনী
কার দুঃখ কেবা শুনি সবাই পেরেশান ॥

স্ত্রী বলে, ওগো আমি বলো কোথায় যাই
লবণ মরিচ পিঁয়াজ রসুন কেরোসিন তৈল নাই
জানো তো খবর একেবারে ছিঁড়ে গেছে মোর
পরনের কাপড় এবার সমস্যা বিস্তর
স্বামী বলে, নৌকা নাই মোর বড়ই নিদান ॥

এই দেশেতে ফসল রক্ষা বড়ই বিভ্রাট
দেশের যত নদী নালা হয়েছে ভরাট
বৃষ্টি হইলে কুল ডুবাইয়া নদীর পানি
হাওরে চলে, ফসল নিল সমূলে
নদী খনন না হইলে নাই সমাধান ॥

যে পানিতে সোনার ফসল ডুবাইয়া নিল
স্বচক্ষে দেখেছ পানি কোন পথে আইলো
ফিরে আসবে বারেবার যমে চিনেছে বাড়ি
হও হুশিয়ার নইলে উপায় নাই যে আর
ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার খোঁজে নেও সন্ধান ॥

আর কোনো ভরসা নাই করি এক ফসল
বারে বারে নষ্ট করে এসে বন্যার জল
দুর্বলতা ছাড়া বাঁচার জন্য কাজ করে যাও
নিজে যাহা পারো কোদাল শক্ত করে ধরো
করিম বলে চেষ্টা কর হইবে কল্যাণ ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

১৩

এবার পানি আইল রে নিদারুণ দুঃখ লইয়া
নামল বৃষ্টি থামল না আর বর্ষা গেল হইয়া রে
নিদারুণ দুঃখ লইয়া ॥

তেরোশো পঁচানব্বই সন এল রে হাসিয়া
জ্যৈষ্ঠ মাসে কর্মদোষে বিরূপ গেল হইয়া রে ॥

বন্যার জলে নিল প্রথম ইরি ধান ডুবাইয়া
আউশ-আমন আলু-বাদাম কিছুই গেল না থইয়া রে ॥

ঝড় বৃষ্টিতে দিল কত ঘর-বাড়ি ভাঙিয়া
কত অমূল্য জীবন গেল বিপাকে পড়িয়া রে ॥

হাঁস-মোরগ গরু-ছাগল কত গেল মরিয়া
বন্যার জলে নিল কত গ্রাম ঘর ভাসাইয়া রে ॥

মজুতদারে মুচকি হাসে মহা সুযোগ পাইয়া
দ্রব্যমূল্য বেড়ে উঠল ধাউ ধাউ করিয়া রে ॥

ভাটি এলাকাবাসী অবস্থা দেখিয়া
আতঙ্কিত হয়ে গেল বিপদ ভাবিয়া রে ॥

গ্রামের পর গ্রাম ঢেউয়ের জলে নিল রে ভাঙিয়া
লাখ লাখ মানুষ কাঁদে অসহায় হইয়া রে ॥

বিপদে বান্ধব নাই রে কারে কী যাই কইয়া
আপন নিয়ে ব্যস্ত সবাই হতাশায় পড়িয়া রে ॥

করিম কয় মন ভালো নয় ভবিষ্যৎ ভাবিয়া
দিনমজুরের মজুরি নাই বাঁচবে কী করিয়া রে ॥

.

১৪

মরণ ফাঁদে পড়ে কাঁদে
হাওর এলাকার লোকে
অর্ধাহার-অনাহারে ভাঙা ঘরে থেকে
হাওর এলাকার লোকে॥

মজুর ভাবে হতাশ হইয়া
প্রাণ বাঁচাবে কী করিয়া
পাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়া পড়েছে বিপাকে ॥

ফসলের নিরাপত্তা নাই
হতাশাতে কৃষক সবাই
কার দুঃখ কারে জানাই, দুঃখ সবার বুকে ॥

পরিবেশ নাই শিক্ষা-দীক্ষার
রোগ হলে নাই ঔষধ-ডাক্তার
সমাজে আর নাই সুবিচার দলাদলির ঝেকে ॥

গরুর ঘাস নাই মাছ নাই রে আর
ধরে খাওয়ার নাই অধিকার
জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার পথ দেখি না চোখে ॥

আবদুল করিম ভাবছে এবার
এমন দিন আসবে কি আর
গরিব কাঙাল দুঃখী সবার হাসি ফুটবে মুখে ॥

.

১৫

হাওর এলাকাবাসী
ভাইবোনেরা
পাড়াগাঁয়ে বসত করি
চৌদিকে সমস্যা ঘেরা ॥

হাড়ভাঙা খাটনির বলে
জমিতে যে ফসল ফলে
ডুবাইয়া নেয় বন্যার জলে
দায় হয়েছে রক্ষা করা ॥

ফসল রক্ষা না হয় যদি
বাঁচার কি আছে বিধি
গরিবের নাই দরদি
আগে মরবে গরিব যারা ॥

ফসল রক্ষা হয় যেভাবে
সেই ব্যবস্থা করতে হবে
খাইতে হবে বাঁচতে হবে
উপায় নাই তো কৃষি ছাড়া ॥

বন্যা নিরোধ হলো না রে
বিপদ আসে বারে বারে
এই দুঃখ বলিব কারে
দিনে দিনে সর্বহারা ॥

দেশপ্রেমিক সরকার বিনা
এইসব কথায় কান দিবে না
অন্যের আশায় কাজ হবে না
করিম কয় নিজের পায় দাঁড়া ॥

.

১৬

দেশে আইল ভেজাইল্যা বন্যা
কত ভেজাল বাড়াইল
শেষ হয় না গইন্যা ॥

ফসল সমূলে নিয়াছে
দুঃখীর দুঃখ বেড়েছে
সরকার সাহায্য দিতেছে
বিদেশ থেকে আইন্যা ॥

ঢেউয়ের জলে ভাঙে বাড়ি
এখন উপায় কী যে করি
হাতে নাই পয়সাকড়ি
খাইতে হয় কিইন্যা ॥

আবদুল করিম চিন্তা করে
ঠেকছে মানুষ বিষম ফেরে
সুযোগ পাইলে মজুতদারে
রক্ত নেয় টাইন্যা ॥

.

১৭

কৃষক মজুর পড়েছে ঘোর আঁধারে
কী করা যায় উপায় বুদ্ধি
মিলে না আর বিচারে ॥

সুদখোর ঘুষখোর মজুদদারে
দালাল টাউট বাটপারে
আগুন দিয়াছে মোদের ঘরে
হয়েছে সাহেব বাবু
গরিবকে করেছে কাবু
বিনয়ে মানে না তবু
মরারে আরো মারে ॥

দিন হতে দিন আসে কঠিন
এই ভাবে আর বাঁচব কয়দিন
আবদুল করিম ভাবতেছে অন্তরে
হয়ে গেলাম নিরুপায়
দুঃখের বোঝা বাড়ছে সদায়
পড়েছি শয়তানি ধোকায়
তিন শয়তানের বাজারে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

১৮

কৃষক মজুর ভাই সবারে জানাই
কী পেয়েছ রয়েছ কার আশে
শোষণের ফাঁদে পড়ে জনগণ কাঁদে
স্বৈরাচার মনানন্দে হাসে রে ॥

কী বলিব গান বাঁচিবে কি প্রাণ
রক্ষক যদি ভক্ষক হয় আপন দেশে
কপাল পোড়া দেশের গরিব যারা
পড়েছে কালের করাল গ্রাসে রে ॥

দেশের মা-বোন ঐ কাদিতেছে শোন
ক্ষুধার আগুন নিভাবে কিসে
প্রাণে বাঁচা দায় একমুঠো অন্ন নাহি পায়
মনোব্যথায় চোখের জলে ভাসে রে ॥

হিন্দু-মুসলমান এক মায়ের সন্তান
গেল কত প্রাণ বিদ্বেষে
বাঁচতে যদি চাও এক হয়ে দাঁড়াও
কৃষক-মজুর মিলে মিশে রে ॥

আবদুল করিম কয় জনগণের জয়
হইবে নিশ্চয় অবশেষে
সোনার বাংলাদেশ ভাই রে করিয়াছে শেষ
জুলুম শোষণ সুদ আর ঘুষে রে ॥

.

.

১৯

মোদের কী হবে রে কৃষক মজুর ভাই
দিন হতে দিন আসে কঠিন বাঁচার উপায় নাই
মোদের কি হবে রে ॥

ইশকুলেতে ধনীর ছেলে ধনীর পড়া পড়ে
গরিবের ছেলে-মেয়ে অনাহারে মরে ॥

ডাক্তারখানায় ডাক্তারগণ আছেন দলে দলে
গরিবে কি ঔষধ পাবে পয়সা ছাড়া গেলে ॥

কোর্ট-কাচারি খোলা আছে হইতেছে বিচার
গরিবে কি বিচার পাবে পয়সা নাই যার ॥

শোষিত বঞ্চিত যারা হলো নিরুপায়
শোষকের শোষণের পালা চলছে সর্বদায় ॥

আর কোনো ভরসা নাই করি এক ফসল
বৎসরে বৎসরে আসে দারুণ বন্যার জল ॥

বাড়ি ভাঙে ফসল নেয় বন্যার পানি আসে
জোতদার সুদখোর মহাজন সুযোগ দেখে হাসে ॥

বাড়ি জমি অল্পদামে কিনবে মহাজন
সুদের বাধন গেলে বাঁধবে গরিব কৃষকগণ ॥

শোষকের ইমারত গড়তে নেতারা পাগল
রঙবেরঙে বের হয়েছে ভোট-শিকারি দল ॥

কেহ বলে জাগো বাঙালি উড়াও জয় নিশান
কেহ বলে ধর্ম গেল জাগো মুসলমান ॥

কৃষক মজুরের কেহ গায় গুণগান
আসলে ধাপ্পাবাজি ভোট নেওয়ার সন্ধান ॥

বাউল আবদুল করিম বলে সূক্ষ্ম রাস্তা ধরো
শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে বাঁচার উপায় করো ॥

.

২০

গরিব বাঁচবে কেমন করে চিন্তা করে বুঝতে নারি
গরিবের বাঁচার সম্বল নাই ধনীরা স্বার্থের পূজারি ॥

হাওরেতে জমি নাই অনেকের নাই ভিটে বাড়ি
অসহায় অবস্থায় আছে গরিব কাঙাল পুরুষ নারী ॥

কৃষক মজুরের সমস্যা বাড়ছে অতি তাড়াতাড়ি
অল্প জমির মালিক যারা তারা হবে দীন ভিখারি ॥

কৃষিঋণ বলে যাহা ঋণ দেওয়া হয় সরকারি
গরিব কৃষক পায় না তাহা কে করবে এই খবরদারি ॥

যেসব কাণ্ডকারখানা মুখ খুলে না বলতে পারি
দেশের মালিক হলো যারা আছে তাদের বাড়ি গাড়ি ॥

তাদের প্রয়োজনে আছে স্কুল কলেজ কোর্ট কাছারি
তাদের হুকুমে চলে বন্দুক-কামান অস্ত্রধারী ॥

শোষকের শাসন ব্যবস্থা যেখানে রয়েছে জারি
ভোটে মুক্তি আসিবে না শুঁটকির নায় বিড়াল ব্যাপারী ॥

ভোট দেয়ে অধিকার পেয়ে গরিবের দেয় মাথার বাড়ি
ভোট নেওয়া নয় ধোকা দেওয়া কাজে বলি ভোট শিকারি ॥

গরিব কাঙাল কৃষক মজুর এক যদি সব হতে পারি
বাউল আবদুল করিম বলে দুঃখের সাগর দিব পাড়ি ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

২১

গানের ভিতর প্রাণের কথা বলতে মনে চায়
এই দেশের গরিব কাঙাল হলো নিরুপায় ॥

গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের শুনলাম কত গান
ধর্মের নামে অধর্ম তাই ঘটল অকল্যাণ
কত কিছু শুনি
আসলে দিনে দিনে বাড়ে পেরেশানি
জীবন নিয়ে টানাটানি প্রাণে বাঁচা দায় ॥

গরিব কৃষকের কথা কী আর বলি
মহাজনের ঋণ শোধিতে হয়ে যায় খালি।
আছে নিদারুণ শোষণ
সুদ-ঘুষের কবলে পড়ে গরিবের মরণ
চলে যায় হাড়ভাঙা ধন মহাজনের গোলায় ॥

গ্রামের বিপন্ন মানুষ দিনমজুর যারা
অগাধ বর্ষার দিনে কী করবে তারা
যদি না খেয়ে মরে
শাসক হইবে দায়ী নিজের বিচারে
শান্তিতে এই দেশের মানুষ বেঁচে থাকতে চায় ॥

আবদুল করিম বলে আমার মন যাহা চায় গাই
আমি অতি মূঢ়মতি বিদ্যাবুদ্ধি নাই
আমি বাংলা মায়ের সন্তান
দেশকে ভালোবাসি বলে গাই স্বদেশী গান
শোষণহীন সমাজব্যবস্থা আমার মনে চায় ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

২২

প্রাণে বাঁচা দায়
প্রাণে বাঁচা দায় রে
নিদারুণ ক্ষুধার আগুন
জ্বলে কলিজায় রে ॥

এ দেশের দুর্দশার কথা
কহনও না যায়
পেটের ক্ষুধায় কত লোকে
লতাপাতা খায় রে ॥

এ দেশের গরিব কাঙাল
চেষ্টা করে বাঁচতে চায়
ভালো চাইলে মন্দ ফলে
কোন শয়তানে পথভোলায় ॥

জুলুমের বিরুদ্ধে যখন
জনতা রুখে দাঁড়ায়
দালালগোষ্ঠী নেমে আসে
বিভ্রান্তি ঘটায় রে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
ঠেকছি ভবযন্ত্রণায়
উচিত কথা বলি যদি
শোষক-দলে চোখ রাঙায় ॥

.

২৩

ওরে মজুর চাষা করো কার আশা
নিজের কর্ম নিজেই করতে হবে
বাঁচতে যদি চাও এক হয়ে দাঁড়াও
নইলে বিফলে জীবন যাবে ॥

ঘটলো দুঃখের চিন জামানা কঠিন
এই ভাবে কতদিন বাঁচিয়া রবে
শোধ হবে না মহাজনের দেনা
দুঃখ বেদনা কে বুঝিবে ॥

স্বাধীনতার পর আনন্দ অন্তর
পাইলাম খবর শান্তি আসিবে
ভোট দেওয়ার বেলায় আরও কত শোনা যায়
গরিবের ভিটায় দালান উঠিবে ॥

এত দিনের পর বুঝিলাম অন্তর
গরিবের ভাঙা ঘর আরও ভাঙিবে
করিমের মন ভাবে সর্বক্ষণ
হয় যদি মরণ স্মরণ রবে ॥

.

২৪

ভোট দিবায় আজ কারে?
ভোটশিকারি দল এসেছে নানা রঙ্গ ধরে
ভোট দিবায় আজ কারে ॥

দেশে আইল ভোটাভোটি পরে হবে বাটাবাটি
তারপরে লুটালুটি যে যেভাবে পারে ॥

কেউ দিতেছে ধর্মের দোহাই কেউ বলে সে গরিবের ভাই
আসলে গরিবের কেউ নাই গরিব ঠেকছে ফেরে ॥

কেহ বলে ধন্য আমি, আমি দেশের মঙ্গলকামী
দেশ হবে পবিত্রভূমি ভোট যদি দাও মোরে ॥

যার-তার ভাবে বলাবলি করছে কত গালাগালি
স্বার্থ নিয়া ঠেলাঠেলি বুঝবায় কয়দিন পরে ॥

নিজের জ্ঞান থাকে যদি বুঝে নেও তার গতিবিধি
শোষকের প্রতিনিধি মালা পরাও যারে ॥

আবদুল করিম কয় ভাবিয়া ভালো মন্দ না বুঝিয়া
অনর্থক বিভ্রান্ত হইয়া গরিব কাঙাল মরে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

২৫

গরিবের কি মান-অপমান দুনিয়ায়?
গরিবের নাই স্বাধীনতা পরাধীন সে সর্বদায় ॥

ভোট নেওয়ার সময় আসিলে নেতা সাহেব তখন বলে
এবার আমি পাস করিলে কাজ করবো গরিবের দায়
পরে লাইসেন্স পারমিট দেওয়া ধনীর বাড়ি খাসি খাওয়া
সালাম দেওয়া নৌকা বাওয়া এইমাত্র গরিবে পায় ॥

অস্থিচর্ম সার হয়েছে রক্ত মাংস চলে গেছে
প্রাণটি শুধু বাকি আছে কখন জানি চলে যায়
আবদুল করিম ভাবছে মনে কার দুঃখ কেবা শোনে
স্বার্থের ব্যাপার যেখানে দয়ামায়া নাই সেথায় ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

২৬

গরিবের দুঃখের কথা
কেউ শোনে না
অরণ্যে রোদন বৃথা
বুঝিয়াছি তার নমুনা ॥

সমাজের নাই সুব্যবস্থা
গরিবের নাই বাঁচার রাস্তা
চৌদিকে পরেছে খাস্তা
হারালেম ষোলো আনা ॥

সুবিধাবাদী ধনী যারা
ভবের মজা মারছে তারা
ব্যক্তিস্বার্থে আত্মহারা
অন্য কিছু বোঝে না ॥

গরিবের রক্ত খেয়ে
নিশাতে বিভোর হয়ে
লোভ-লালসা বুকে নিয়ে
ঘুরছে সদায় দেওয়ানা ॥

মাংস খাওয়ার সুযোগ পাইলে
ভিড় জমায় শকুনের দলে
ঘটাইয়াছে কালে কালে
মানুষের এই লাঞ্ছনা ॥

আবদুল করিম চিন্তা করে
ঘুরলাম কত ধোকায় পড়ে
মানব রুপে রাক্ষস ঘোরে
সকলে তা চিনে না ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

২৭

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে
সালাম বরকতের বুকে
গুলি চালায় নিষ্ঠুর বেইমানে ॥

বাঙালির বাংলাভাষা
এই যে তাদের মূল ভরসা
এই আশায় বঞ্চিত হলে কি চলে
ভারত যখন স্বাধীন হলো
পাকিস্তানে চলে এলো
দেশ বিভক্ত করা হয় কৌশলে
উর্দুভাষী শোষক যারা
ধর্মের ভাওতা দিয়ে তারা
বন্দি করিল পাকিস্তানে ॥

শোষকের কবলে পড়ে
ভাবনা করি অন্তরে
লাভ হলো কি পাকিস্তান পাইয়া
ধনরত্ন নেয় কলকৌশলে
ধর্মের ভাওতা দিয়ে বলে
উর্দু সবাই লও না শিখিয়া
করিবে শাসন-শোষণ
করে রাখবে পশুর মতন
ষড়যন্ত্র করল গোপনে ॥

মুখের বোল কাড়িয়া নিবে
রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে
ঘোষণা করিল যখন
যারা বাংলামায়ের ছেলে
পরিষ্কার দিল বলে
মানব না থাকিতে জীবন
রাখতে বাংলাভাষার মান
অকাতরে দিলো প্রাণ
আমরা যে বাধা ঋণে ॥

পরে তা মানিয়া নিল
রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলো
জীবন দিল বেশ কয়েকজনে
আমরা যে বেঁচে আছি
এই বিষয়ে কী করেছি
চিন্তা কর মনে মনে
আজো বাংলার মর্যাদা নাই
এই দুঃখ কারে জানাই
ভাবি তাই বাঁধা কোনখানে ॥

কৃষক মজুর নারী পুরুষ
আমরা সাধারণ মানুষ
মহাপুরুষ নাম যারা ফলায়
তাদের মন্ত্রণা নিলাম
এক সাগর রক্ত দিলাম
স্বাধীনতা পাইবার আশায়
যাদের আছে ধনমান
তারা গায় বিদেশী গান
বুঝে না দেশের জনগণে ॥

অফিস আদালতে বাংলার
হয় যদি পূর্ণ অধিকার
প্রভূত্ব চলিবে কেমনে
নগন্য জঘন্য যারা
জানে না লেখাপড়া
উপায় নাই মাতৃভাষা বিনে
সরস বাঙালি যারা
বাংলাভাষা চায় না তারা
আবদুল করিম বুঝে অনুমানে ॥

.

২৮

সালাম আমার শহীদ স্মরণে
দেশের দাবি নিয়া দেশ প্রেমে মজিয়া
প্রাণ দিলেন যে সব বীর সন্তানে ॥

ভাষার দাবি লইয়া আপনহারা হইয়া
স্মৃতি গেলেন রাখিয়া বাঙালির মনে
সালাম বরকত জব্বার প্রিয় সন্তান বাংলার
ভুলিবার নয় ভুলিব কেমনে ॥

জন্ম নিলে পরে সবাই তো মরে
স্বাভাবিক মরা এই ভুবনে
দেশের জন্য প্রাণ যারা করে দান
স্মরণ করি আজ ব্যথিত মনে ॥

লভিব অধিকার ঘুচাবো আঁধার
শপথ বারেবার মনপ্রাণে
আবদুল করিম বলে শোষণমুক্ত হলে
হাসি ফুটিবে সবার বদনে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

২৯

বলো স্বাধীন বাংলা
মোদের মাতৃভূমির জয়
প্রাণপণে প্রতিজ্ঞা কর
ছেড়ে দাও মরণের ভয় ॥

পাকিস্তান আসার পরে
যা ঘটিল তেইশ বৎসরে
মনের দুঃখ বল কারে
এই দুঃখ আর বলাবার নয়
আজও তারা শক্তির বলে
দারুণ শোষকের দলে
বিনাশিতে চায় সমূলে
আর বা কত প্রাণে সয় ॥

বাঙালি যুবকের দল
চল মুক্তির সংগ্রামে চল
তোরাই দেশের সহায় সম্বল
পাছে হঠার সময় নয়
ধর ধর অস্ত্র ধর
বাংলা মোদের মুক্ত কর
মনের দুর্বলতা ছাড়
আমাদের জয় সুনিশ্চয় ॥

ভেবেছিল শত্রু দলে
জুলুম অত্যাচারের বলে
রাখিবে পায়ের তলে
মনিব রবে সব সময়।
বীর বাঙালি বীর বিক্রমে
জেগে উঠল ধরাধামে
ইয়াহিয়া নরাধমে
পাইবে ঠিক পরিচয় ॥

শপথ নেও বাঙালি যত
বাঁচলে বাঁচব বাঁচার মতো
আমরা হব না নত
যদি হয় বিশ্বপ্রলয়
কত ভাই বোন মুক্তির তরে
প্রাণ দিয়েছে অকাতরে
চিরদিন কেউ বাঁচে না রে
বাউল আবদুল করিম কয় ॥

.

৩০

কত মায়ে কান্দে পুত্রহারা হইয়া রে-–বুকে ব্যথা পাইয়া
কত মায়ে কান্দে পুত্রহারা হইয়া ॥

ভাই রে ভাই, পাঞ্জাবি শোষকের দলে স্বার্থসিদ্ধি করবে বলে
বাঙালিরে ধর্মের ভাওতা দিয়া
তেইশ বৎসর করিল শোষণ স্বার্থের আঘাত পড়ল যখন
এজিদের মতন গেল হইয়া রে-–বুকে ব্যথা পাইয়া ॥

ভাই রে ভাই, শোষকের দল বড় পাষাণ কাজে তার দিয়াছে প্রমাণ
বেকুফ-নাদান স্বার্থের লাগিয়া।
লাখো লাখো বাঙালিরে অন্যায়ভাবে হত্যা করে
মায়ের কোলে শিশু মারে বুলেট-গ্রেনেট দিয়া রে-–বুকে ব্যথা পাইয়া ॥

ভাই রে ভাই, ছেড়ে দাও ভয়ভীতি একে অন্যের হয়ে সাথি
ধরো অস্ত্র জয়বাংলা বলিয়া
আছেন প্রভু দয়াময় আমাদের জয় সুনিশ্চয়
বাউল আবদুল করিমে কয় শোকাকুল হইয়া রে–-বুকে ব্যথা পাইয়া ॥

.

৩১

এসো প্রাণ খুলে মিলে সকলের
গাই রে বাংলার গুণগান
গাই রে বাংলার গুণগান ॥

বাংলা মোদের মা জননী
আমরা ভাই-ভগিনী
ভেদ নাই হিন্দু-মুসলমান
বাঙালি বাংলা জবান ॥

শোষণের বিরুদ্ধে ভাই
প্রাণপণে করে লড়াই
গেল লক্ষ লক্ষ প্রাণ
চাই বাংলা মায়ের কল্যাণ ॥

শান্তিকামী বাংলাবাসী
সবার মুখে ফুটুক হাসি
শোষণের হোক চির-অবসান
এ আদর্শ সামনে রেখে হও আগুয়ান ॥

জন্ম নিয়ে ইহলোকে
মানুষের দুঃখ দেখে
আবদুল করিম মনের শোকে ম্রিয়মাণ
চায় শান্তি সমাজবিধান ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৩২

স্বাধীন বাংলায় রে বীর বাঙালি ভাই
শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা চাই
স্বাধীন বাংলায় রে ॥

স্বাধীন হবে সুখে রবে বাংলামায়ের সন্তান
এর জন্যে দিয়েছে কত লক্ষ লক্ষ প্রাণ ॥

কত নারী স্বামীহারা ঝরে চোখের জল
পুত্রহারা হয়ে কত মা হলেন পাগল ॥

রক্তের বিনিময়ে এল বাংলার স্বাধীনতা
ভুলিব না ভুলিবার নয় অন্তরের ব্যথা ॥

শোষিত বাঙালি আর ভুলবে না কখন
এই দেশে শাসনের নামে চলবে না শোষণ ॥

বাংলা মোদের জন্মভূমি বাংলা মোদের দেশ
বাংলা মায়ের সেবা করে হউক না জীবন শেষ ॥

রাখতে বাংলার স্বাধীনতা রাখতে বাংলার মান
ধন্য তারা দিল যারা দেশের জন্য প্রাণ ॥

বাংলার সার্বভৌমত্ব রাখতে যদি চাও
শোষণের বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে দাঁড়াও ॥

স্বাধীন মাতৃভূমি মোদের স্বর্গ মনে করি
বাউল আবদুল করিম গায় স্বাধীন বাংলার জারি ॥

.

৩৩

মনের দুঃখ বলবো কারে
কেন যে বারে বারে পরে যাই ঘোর আঁধারে ॥

ভারত বিভক্ত হলো পাকিস্তান চলে এল
স্বৈরাচারে সুযোগ নিল ষড়যন্ত্র করে
রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে তাহার পরে
ছাত্রগণ করে জীবনপণ ভাষার জন্য লড়াই করে ॥

পরে এল আইয়ুব শাসন সুখ-দুঃখ করে বরণ
তখন দেশের জনগণ ছিল ধৈর্য ধরে
বিভেদ বৈষম্যনীতি মন যাহা চায় করে
আসিল গণআন্দোলন উনিশশো উনসত্তরে ॥

পাকসেনার আগ্রাসন এল লাখ লাখ জীবন গেল
সোনার বাংলা স্বাধীন হলো নয় মাস যুদ্ধের পরে
বুক ভরা ভরসা ছিল দেশবাসীর অন্তরে
স্বৈরাচার চেপে বসলো শহীদদের রক্তের উপরে ॥

নিদারুণ স্বৈরশাসনে সীমাহীন নির্যাতনে
হতাশা এসেছে মনে প্রতারণায় পড়ে
বাংলার সাধারণ মানুষ নিরাশার আঁধারে
প্রতারক দল করে কৌশল দুঃখ দিল বারে বারে ॥

জনগণের মূল মন্ত্র সবাই চায় গণতন্ত্র
আসবে বলে ডাক পড়েছে মানুষের অন্তরে
পাখি ডাকে রাত পোহাবে আঁধার যাবে দূরে
ঊষালগ্নে জেগে উঠো মা বলে আঁখি খোল রে ॥

গণতন্ত্রে উত্তরণে দেশপ্রেমিক সর্বজনে
চলতে হবে খাঁটি মনে ধৈর্য ধারণ করে
ঐক্য শান্তি আইন-শৃংখলা শক্ত করে ধরে
সাহস করে চলতে হবে এই কঠিন কর্ম-উদ্ধারে ॥

দোদুল্য মনোভাব ছাড় নিজে নিজের দেশকে গড়ো
গণতন্ত্র কায়েম কর দুঃখ যাবে দূরে
এছাড়া যে উপায় নাই আর পড়েছি আঁধারে
আর কতদিন থাকবে করিম শোষকের কারাগারে ॥

.

৩৪

দিন গেলে গোলমালে, মোদের দিন গেল গোলমালে
ঠেকছে বাঙাল–যারা কাঙাল লাভ হলো না মূলে ॥

পাড়াগাঁয়ে বসত করা চৌদিকে সমস্যা ঘেরা
কৃষক মজুর দিশেহারা শান্তি নাই আসলে
গরিব কাঙালের পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে
হিতে বিপরীত ঘটাল লেজ-কাটা বানরের দলে ॥

যারা উৎপাদন করে তারা থাকে ভাঙা ঘরে
অর্ধাহার অনাহারে ভাসে নয়নজলে
রক্ত দিয়ে স্বাধীন হলাম মুক্তি পাব বলে
শোষিতের নাই স্বাধীনতা আছে শোষকের কবলে ॥

বলবো দুঃখ কার কাছে দুঃখীর দুঃখ বেড়েছে
স্বাধীনতার ফল নিয়েছে স্বার্থপর মহলে
অন্যকিছু মানতে চায় না স্বার্থের আঘাত হলে
নির্বিচারে গুলি চলে ছাত্র-জনতার মিছিলে ॥

এখন যাহা দেখিতে পাই চলেছে ক্ষমতার লড়াই
আসলে খবর নাই দেশ কী করে চলে
স্বার্থ নিয়ে পাগল সবাই যে যাহাই বলে
দিনে দিনে অবনতি দেশ গেল রসাতলে ॥

শোষিত জনগণ হতাশা-নিরাশায় এখন
ভাবিতেছে হবে মরণ পড়ে জাঁতাকলে
করিম বলে শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে হলে
শোষিত সব এক হয়ে যাও কৃষক মজুর সবাই মিলে ॥

.

৩৫

শোষক তুমি হও হুশিয়ার চল এবার সাবধানে
তুমি যে রক্ত-শোষক বিশ্বাসঘাতক তোমারে অনেকে চিনে ॥

প্রাণে আর ধৈর্য মানে না দেখে তোর নীতি বিধান
মুসলিম লীগ নাম ধরিয়া গড়েছিলে পাকিস্তান
ভেতরে ঢুকিল শয়তান গরিবকে মারলে প্রাণে ॥

স্বার্থসিদ্ধি করবে বলে করেছিলে শয়তানি
বুঝিয়া ভাইয়ে ভাইয়ে করেছি হানাহানি
কণ্ঠাগত হলো প্রাণী তোমার নিষ্ঠুর শোষণে ॥

মুসলিম লীগের নাও ডুবাইয়া যুক্তফ্রন্টে আসিলে
পরে আইয়ুবের ছত্রচ্ছায়ায় বেশ কয়েকদিন কাটাইলে
তারপরে ইয়াহিয়ার কালে ছিলে অতি সন্ধানে ॥

বাংলা স্বাধীন হইলে পরে আবার দেখি তোমারে
বাঙালির দরদি সেজে আসলে তুমি ছল করে
আর কী করবে তাহার পরে ভাবতেছি মনে মনে ॥

বড় শয়তান সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন ফন্দি আঁটে
মধ্যম শয়তান পুঁজিবাদ বসে বসে মজা লোটে
সামন্তবাদ জালিম বটে দয়া নাই তাহার মনে ॥

তিন শয়তানের লীলাভূমি শ্যামল মাটি সোনার বাংলার
গরিবের বুকের রক্তে রঙিন হলো বারে বার
সোনার বাংলা করলো ছারখার সাম্রাজ্যবাদ শয়তানে ॥

স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে মজা মারলো শোষকে
এখন সবাই বুঝতে পারে চাবি ঘুরছে কোন পাকে
মধু হয় না বলার চাকে বাউল আবদুল করিম জানে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৩৬

শোষকের মন্ত্রণা বিষম যন্ত্রণাল
প্রাণে সহে না দুঃখ বলবো কারে
ভেবেছিলাম একদিন দেশ হলো স্বাধীন
এখন শুভদিন আসতে পারে ॥

মনে ভাবি তাই শাস্তি সবাই চাই
তবে কেন পড়ে যাই অন্ধকারে
শান্ত নহে মুন দেশের জনগণ
অসহায় এখন একেবারে ॥

যার যাহা পছন্দ নাই ভালো-মন্দ
স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব চরম আকারে
ভালো নয় মতিগতি দিনে দিনে অবনতি
দেশ জুড়ে দুর্নীতি দেখো বিচারে ॥

আমলাতন্ত্রের অত্যাচার জোতদার ইজারাদার
সুযোগ পেয়েছে এবার মজুতদারে
অসৎ ব্যবসায়ীগণ মজুতদারের আপনজন
দালাল টাউটের মন রঙবাজারে ॥

সুদ-ঘুষে লিপ্ত যারা মনানন্দে আত্মহারা
কৃষক মজুর যাবে মারা অনাহারে
একি সর্বনাশ ডাকাতি সন্ত্রাস
নাই কোনো বিশ্বাস কে কারে মারে ॥

স্বাধীনতা কার নাম ভাবনায় পড়িলাম
কী যে তার পরিণাম কে বলতে পারে
করিম কয় আসলে ভুল তাই তো মিটে না গোল
আশার বাগানে ফুল ফোটে না রে ॥

.

৩৭

ধর্মাধর্ম নাই রে শোষকের নাই বিবেচনা
লোভ লালসা বুকে নিয়া ঘুরেছে দেওয়ানা রে ॥

মুসলমানে সুদ খায় না কোরানেতে মানা
নয়া মুসলমান হইলে গরু খায় তিনদুনা রে ॥

সুদখোর ঘুষখোর মজুতদারের কত আমিরানা
নিদারুণ শোষকের দেশে গরিব আর বাঁচব না রে ॥

গরিব মরে অনাহারে রুজি-রোজগার পায় না
শতকরা আশি ঘরের লাগিয়াছে কিনা রে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে উপায় আর দেখি না
দিনে দিনে বাড়ে আগুন জল দিলে নিভে না রে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৩৮

অনেকে বলে আমারে গাও না একটা তেল-চোরার গান
তেল-চোরা নয় বিষম চোরা সে যে অনেক ক্ষমতাবান ॥

দেখরে ভাই বিচার করে তেল-চোরা রয়েছে ঘরে
সুকৌশলে চুরি করে–চোরে জানে চুরির সন্ধান ॥

ভু-তত্ত্ব বিজ্ঞানী যারা চিন্তা ভাবনা করেন তারা
মনে প্রাণে চেষ্টা করা এই যে তাদের কর্ম বিধান ॥

বহু খোঁজাখুঁজির পরে তেল মিলেছে হরিপুরে
আনন্দ সবার অন্তরে যারা বাংলা মায়ের সন্তান ॥

হরিপুরে হরির লুট কেন দেশবাসী কি খবর জানো
তেল-চোরায় তেল নিলো শোনো এ দেশকে করতে চায় শ্মশান ॥

এই ভাবে তেল দেওয়া যায় না দেশবাসী তা মানতে চায় না
করেন সবাই বিবেচনা এই তেল মায়ের দুধের সমান ॥

দেশের সম্পদ দেশবাসীর হয় ব্যক্তিগত মালিক কেউ নয়
রয়েছে তেল-চোরার ভয় দেশবাসী হও সাবধান ॥

দেশের সম্পদ রক্ষা করো মনের দুর্বলতা ছাড়ো
নিজের কর্ম নিজে করো চোরে চায় না দেশের কল্যাণ ॥

বাউল আবদুল করিম গায় পড়েছি বিষম ধাঁধায়
সাধু জন অসুবিধায় বেড়ে গেছে তেল-চোরার মান ॥

.

৩৯

খবর রাখনি উন্দুরে লাগাইছে শয়তানি
চাটি কাটে পাটি কাটে কাপড় চোপর আর
দিন রাত ঘরের মাঝে উন্দুরের দরবার ॥

বাড়িত কাটে বাড়ির বস্তু ক্ষেতে কাটে ধান
ঘরের ধন বাইরে নেয় ঘটাইছে নিদান ॥

ধান খায় চাউল খায় কাটে ঘরের বেড়া
কাটতে কাটতে গৃহস্থেরে করে বাড়ি ছাড়া ॥

বাউল আবদুল করিম বলে উন্দুর আছে ঘরে
বিলাইয়ে ধরে না উন্দুর দুঃখ বলব কারে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৪০

উন্দুর মারো রে দেশের জনগণ
উন্দুরে করিতেছে বড় জ্বালাতন
ও ভাই, উন্দুর মারো রে ॥

উন্দুরে ফসলের ক্ষতি করে নিশিদিন
দেশেতে খাদ্যের অভাব করিতে হয় ঋণ
ও ভাই, উন্দুর মারো রে ॥

উন্দুরের সংখ্যা বাড়িলে হইবে বিপদ
উন্দুর মারো রক্ষা কর জাতীয় সম্পদ
ও ভাই, উন্দুর মারো রে ॥

কত কঠিন রোগ জীবাণু উপুরে ছড়ায়
রোগে ভুগে কত মানুষ দুঃখ কষ্ট পায়
ও ভাই, উন্দুর মারো রে ॥

উন্দুর মারো পুণ্য করো আবদুল করিম বলে
উন্দুর হয় মানুষের শত্রু মারো কলকৌশলে
ও ভাই, উন্দুর মারো রে ॥

.

৪১

কেবা শত্রু কেবা মিত্র
বুঝে উঠা দায়
তাই তো দেশের অবনতি
সাধুর নিশান চোরের নায় ॥

স্বার্থপর শত্ৰুদলে
দেশে দিছে আগুন জ্বেলে
উচিত কথা বলতে গেলে
তারা আবার চোখ রাঙায় ॥

কেউ হইল কালোবাজারি
কেউ করতেছে মজুতদারি
কেউ করতেছে রিলিফ চুরি
যে যেভাবে সুযোগ পায় ॥

শান্তি পেতে আশা করি
আসলে বিপাকে পড়ি
স্বার্থ নিয়ে মারা-মারি
শেষ হয় না তাদের বেলায় ॥

গরিবের প্রশ্নই নাই
বাঁচি কি-বা মরিয়া যাই
আবদুল করিম বলে রে ভাই
সোনা বর্ষে সোনারগাঁয় ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৪২

কোন দেশে যাই বল
সুখের আশায় দুঃখের বুঝা
বওয়া সার হইল ॥

ভাই রে ভাই, অবিচারে রাজ্য নষ্ট
জ্ঞানী গেছেন বলে
দেশ করেছে লক্ষ্মীছাড়া
স্বার্থভোগী দলে
কত অঘটন ঘটাইল
ভালো করবে বলে মাথায়
কুড়ালি মারিল ॥

ভাই রে ভাই, সাবধানে চালাইও নৌকা
সত্যের হাল ধরিয়া
কত ভালোলোকের
জাতি গেল কুসঙ্গ করিয়া।
অমানুষে সোনার দেশে
এই দুর্দিন আনিল
এখনও সময় আছে
বিচার করে চল ॥

ভাই রে ভাই, বাউল আবদুল করিম বলে
আমার এই মিনতি
কু-মানুষের সঙ্গে কভু
কর না পিরিতি
নিজের দেশের মানুষ তোদের
চিনা জানা ভালো
দরদি সেজে যারা
তোদের কাছে এল ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৪৩

অভাবে পড়িয়া কাঁদে মনপাখি আমার
ভাব নাই মনে নিশিদিনে ভাবিতেছি অনিবার ॥

ভাবিলে কি হইবে লাভ চৌদিকে পড়েছে অভাব
দুঃখের কথা কী বলিব আর
স্বার্থ নিয়া ব্যস্ত সবাই কে দুঃখ শুনিবে কার ॥

অসতের মাত্রা বেড়েছে সতোর অভাব পড়েছে
অভাব পড়ল মানবতার
রক্ষক ভক্ষক সেজেছে মিলে না আমানতদার ॥

‘হুজুর’ বলে ঘুষ খাইলে সুদ, খাইলে মহাজন বলে
জামানার হাল চমৎকার
কী করিব কোথায় যাব ভেবে করিম বেকারার ॥

.

৪৪

ওই ভাই জোর জুলুমি ছাড়ো
মানুষ যদি হইতে চাও মানুষের সেবা করো ॥

স্রষ্টায় সৃষ্টি করেছে সবাই বলো স্রষ্টা আছে
পরিণাম রয়ে গেছে এখন যাহা করো
কলেমা নামাজ রোজা ইমান হইল বড়
ঈমান যদি ঠিক না থাকে কিসের নামাজ রোজা কর ॥

মানুষ খোদার প্রিয়পাত্র তারে না ভাবিয়া মিত্র
টাকা-পয়সা জমি জুত্র তাই ভেবেছ বড়
স্বার্থ নিয়া দলাদলি ভাইয়ে ভাইরে মার
দুর্বলেরে দায় ঠেকাইয়া বলপূর্বক ডাকাতি করো ॥

আজ যা আছে কাল রবে না টাকা পয়সা যতই কও না
শক্তি-বল-যৌবন থাকে না অবশেষে মর
মরলে কিছু সঙ্গে যায় না নিজেই বুঝতে পার
তুমি বা কার কে-বা তোমার আগে নিজের বিচার করো ॥

মানুষ হওয়ার ইচ্ছা থাকলে মানুষের সেবা করিলে
বাউল আবদুল করিম বলে মানুষ হইতে পার
হিংসা নিন্দা দিলের গুমান লোভ-লালসা ছাড়
ছয়রিপুকে বাধ্য করে প্রেমবাজারে ব্যাপার কর ॥

[কালনীর ঢেউ]
.

৪৫

অতীত বর্তমানে কি আর মিল আছে?
নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নাই ঘুরছে সব স্বার্থের পাছে ॥

ভালোর যে আদর ছিল সেদিন কি আর আছে বল
দুগ্ধ নয় মদ খাইয়া আনন্দে মানুষ নাচে
দেখি এই নতুন জামানায় দেশ পাগল সিগারেট গাঁজায়
বলে নারিকেলের হুক্কায় আমার দিন চলে গেছে ॥

পুরুষ পাগল এই দুনিয়ায় কামিনী-কাঞ্চনের নেশায়
মেয়েরা স্বাধীনতা চায় যুগে সুযোগ দিয়াছে
এখন পত্রপত্রিকায় উলঙ্গ ছবি দেখা যায়
মন দিয়ে পড়ে ছেলেরায় পথ ভুলে কই যাইতেছে ॥

ব্যবসায়ী যত জনা সত্য কথা বলতে চায় না
খাঁটি জিনিস পাওয়া যায় না ভেজাল মিশাইয়া বেচে
মজুতদারে মুচকি হাসে দেশ পেয়েছে সুদে-ঘুষে
উচিত কইলে পাবে দোষে বলব দুঃখ কার কাছে ॥

মিথ্যা কথায় বাজায় ডঙ্কা রাক্ষস হয় গিয়ে লঙ্কা
রাজনীতি নেতার সংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে গেছে
মনে মনে চিন্তা করি রাজনীতি নয় দোকানদারি
স্বার্থ নিয়া মারামারি-–ধর্মাধর্ম সব গেছে ॥

বাউল করিমের বাণী শুনেন যত জ্ঞানী গুণী
মনে মনে আমি গনি সরিষারে ভুতে পাইছে
কখন কী হয় না জানি ভাবি তাহা দিনরজনী
চৌদিকে অস্ত্রের ঝন্‌ঝনি শুনিয়া ভয় হইতেছে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৪৬

জনসমুদ্রে নতুন জোয়ার এল রে
স্বৈরাচারের সিংহাসন আজ ভেসে গেল রে ॥

বাংলার গণজাগরণে
গণতন্ত্রের আগমনে
সচেতন বাঙালির মনে সাড়া দিল রে ॥

যারা চায় স্বাধীনতা
জাগলো আজ সেই জনতা
সবার মুখে একই কথা সামনে চল রে ॥

কৃষক-মজুর ভাই ভাই
হিন্দু-মুসলিম প্রভেদ নাই
বাঁচার মতো বাঁচতে চাই, সবাই বল রে ॥

যাইতে লক্ষ্যস্থলে
দেশপ্রেমিক সকলে মিলে
জনগণের ঐক্যের বলে বিজয় হলো রে ॥

ঐক্য যদি থাকে অটল
হইবে কর্ম সফল
কৃষক-মজুর মেহনতিদল আশায় ছিল রে ॥

শোষণমুক্ত হলো না তো
ভাবছে করিম অবিরত
বাঙালি বারেবার কত রক্ত দিল রে ॥

.

৪৭

শান্ত মনে ভোট দাও এবার
দেশের জনগণ
বহু সমস্যার পরে
আসিয়াছে নির্বাচন ॥

উচ্ছশৃঙ্খলা বিশৃঙ্খলার
আমাদের আর নাই যে দরকার
যে আদেশ করেছেন সরকার
সবাই তা কর পালন ॥

মনে রেখো ভোটার আমি
হইও না কেউ উগ্রগামী
যেজন দেশের মঙ্গলকামী
সে আমাদের আপনজন ॥

আসলে ভোট দেওয়া চাই
এ ছাড়া অন্য উপায় নাই
অধিকার আদায়ের লড়াই
শান্তি সবার প্রয়োজন ॥

আমাদের ভোটের দ্বারা
নির্বাচিত হবেন যারা
এ দেশকে চালাবেন তারা
আসিবে আইনের শাসন ॥

ভোট দাও নিজে বিচার করে
ভুলিও না ধোঁকায় পড়ে
মিষ্টভাষী স্বার্থপরে
দিবে কত প্রলোভন ॥

শান্তির যদি আশা করো
সৎ মানুষের সঙ্গ ধর
শোষণমুক্ত সমাজ গড়ো
করিমের এই নিবেদন ॥

.

৪৮

এবার ভোট কারে দিবে
ভোট দেওয়া দায়িত্ব মোদের ভোট যখন দিতে হবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা হলে পরিষ্কার
হবে না জুলুম অত্যাচার নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া যাবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

ভোট দাও সুবিচারের বলে, যে ভোটে সুফল ফলে
স্বৈরাচার উৎখাত হলে খাঁটি গণতন্ত্র পাবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

উৎখাত হলে স্বৈরাচার আসবে জনতার অধিকার
শোষকের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করে নিবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

দেশে গণতন্ত্র চাই অন্য কোনো কথা নাই
অধিকার আদায়ের লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আজো সেই যুদ্ধে আছি
অধিকার বঞ্চিত হয়েছি, সেই অধিকার পাব কবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

দেশপ্রেমিক শোষিত সবে একযোগে যখন চলিবে
শোষণমুক্ত সমাজ হবে, সবাই তখন সুখে রবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

টাউট দালালের কথায় ভুলিও না লোভলালসায়
শত্রু যদি সুযোগ পায় বিশৃঙ্খলা ঘটাইবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

করিম কয় নাই জ্ঞাতিগোত্র, যারা বাংলা মায়ের পুত্র
কেবা শত্রু কেবা মিত্র বিচার করে চলতে হবে
এবার ভোট কারে দিবে ॥

.

৪৯

শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু সবাই কয়
বন্ধু ছিলেন সত্য বটে
আসলে শত্রু নয় ॥

স্বার্থের জন্য স্বার্থপরে
ভারতকে বিভক্ত করে
তেইশ বছর শোষণের পরে
বাঙালি সচেতন হয় ॥

শোষণমুক্তি চেয়েছিলেন
শেখ মুজিব দায়িত্ব নিলেন
জনগণ সমর্থন দিলেন
ছাড়িয়া মরণের ভয় ॥

গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র
এই ছিল তার মহামন্ত্র
ধর্ম নয় শোষণের যন্ত্র
নিরপেক্ষ সমুদয় ॥

এনে দিলেন স্বাধীনতা
তাই তো বলে জাতির পিতা
সাক্ষী বিশ্বের জনতা
এই কথা যে মিথ্যে নয় ॥

গোপন ষড়যন্ত্র করে
মুজিবকে সপরিবারে
অন্যায়ভাবে হত্যা করে
বিচার যে তার বাকি রয় ॥

দীর্ঘ একুশ বছর পরে
আজ বাংলার ঘরে ঘরে
আশার সঞ্চার হলো রে
হলো নতুন ভাব উদয় ॥

যারা বাংলা মায়ের ভক্ত
মনকে করে নিল শক্ত
লাখো লাখো শহীদের রক্ত
বৃথা যাবে না নিশ্চয় ॥

শুনি জ্ঞানীগুণীর কথা
শ্রেষ্ঠ হয় মানবতা
শেখ মুজিব জাতির পিতা
করিম বলে নাই সংশয় ॥

.

৫০

বর্তমান সমাজের
ভাব দেখে ভয় পাই
স্বার্থ নিয়ে মারামারি
দয়ামায়া নাই ॥

স্বার্থের কথা বলব কত
ব্যক্তিগত দলগত
চলেছে অবিরত
স্বচক্ষে যা দেখিতে পাই ॥

ধর্মকথা মুখে বলি
স্বার্থ হলে আগে চলি
কথাবার্তায় আলার ওলি
আসলে ঠগের গোসাই ॥

দেশের ধনীমানীগণ
মানুষ হয় তারা কয়জন
জনগণ মিলে সর্বক্ষণ
তাদেরই গুণগান গাই ॥

টাকা হলে সব কিছু হয়
এছাড়া অন্য কিছু নয়
টাকা হলো মূল বিষয়
সবাই যখন টাকা চাই ॥

.

৫১

স্বাধীন দেশে মানুষের
স্বাধীনতা নাই
শোষকের হয়েছে বিজয়
শোষিতগণ বাঁচতে চাই ॥

শোষিত বঞ্চিত যারা
কৃষক মজুর সর্বহারা
নিরাশার আঁধারে তারা
বাস্তবে যা দেখতে পাই ॥

ঘুষ দূর্নীতি স্বজনপ্রীতি
চলছে বৈষম্যনীতি
সন্ত্রাস চুরি ডাকাতি
অবাধে চলেছে তাই ॥

শোষণমুক্তি চেয়েছিল
ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিল
স্বৈরাচারে সুযোগ নিল
গরিবের কপালে ছাই ॥

পড়েছি ঘোর আঁধারে
দিনে দিনে দুঃখ বারে
মনের দুঃখ বল কারে
করিম বলে কোথায় যাই ॥

.

৫২

গরিবের স্বাধীনতা আসবে কখন
ধনী নাচে মন-আনন্দে
গরিব-কাঙালের মরণ ॥

জন্ম যারা নিল ধরায়
সবাই তো বেঁচে থাকতে চায়
মানুষ মানুষের রক্ত খায়
রাক্ষসের লক্ষণ ॥

রাক্ষস হয় স্বার্থপর সবাই
অন্তরে দয়া মায়া নাই
স্বচক্ষে যা দেখিতে পাই
ভাবি সর্বক্ষণ ॥

গরিবকে দুঃখ দিয়া
ধনীর দ্বন্দ্ব স্বার্থ নিয়া
আবদুল করিম কয়
ভাবিয়া কী করি এখন ॥

.

৫৩

স্বাধীন দেশে থাকি
আমরা স্বাধীন দেশে থাকি
খাবার বেলা ভাত মিলে না
আল্লা বলে ডাকি॥

গরিব কাঙাল সবাই বলে
জানি না কোন কর্মফলে
পেটের ক্ষুধায় অঙ্গ জ্বলে
ঝরে দুটি আঁখি।
কুঁড়েঘর চালে ছানি নাই
দুঃখ কষ্টে থাকি
মনে বড় ভয় হইতেছে
আর যে কত আছে বাকি॥

গরিব মরে অনাহারে
এই দুঃখ বলিব কারে
ধনীরা মজা মারে
গরিবরে দেয় ফাঁকি।
কথায় কাজে মিল পড়ে না
শুধু যে চালাকি
করিম বলে গানে আমার
সুখ-দুঃখের ছবি আঁকি ॥

.

৫৪

আমরা সবাই মিলে বাঁচতে চাই
আমার মতো গরিব যারা
আমি তাহাদের গান গাই ॥

শোষিত বঞ্চিত যারা
কৃষক মজুর মেহনতিরা
কেউ হয়েছে সর্বহারা
একেবারে উপায় নাই ॥

যারা জন্ম নিয়াছে
বাঁচার অধিকার আছে
মানুষ মানুষের কাছে
তাই তো এই দাবি জানাই ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
শোষিতগণ বাঁচতে হলে
করতে হয় মিলে সকলে
জীবন বাঁচার লড়াই ॥

.

৫৫

এই সব নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন
কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান
তুমি মানুষ আমিও মানুষ
সবাই এক মায়ের সন্তান ॥

সৃষ্টিকর্তা সবার একজন
শত্রু নয় সে সবার আপন
তার ইচ্ছাতে জন্ম-মরণ
সে যে সবার প্রাণের প্রাণ ॥

আসা-যাওয়া একা একা
মিলে মিশে কয়দিন থাকা
মনকে করো প্রেমে মাখা
ছেড়ে দিয়ে অভিমান ॥

কেউ হরি কেউ আল্লা বলো
যার-তার ভাষায় বলা হলো
সরল সোজা পথে চলো
কর্মক্ষেত্রে হও সাবধান ॥

অন্যায় অনাচার ছাড়ো
ধর্ম কর যত পার
একে যে অন্যেরে মারো
এই কি হয় ধর্মবিধান ॥

করিম বলে কাঙাল-বেশে
জন্ম নিয়েছি দেশে
মানুষকে ভালোবেসে
হোক না জীবন অবসান ॥

.

৫৬

হারা জিনিস ফিরে পাবে
একযোগে সব চল রে চল
চল রে কৃষাণ চলবে মজুর
চল রে সর্বহারার দল ॥

সোনার বাংলা শস্যশ্যামলা
তোমরাই ফলাও সোনার ফসল
আজ কেন রে উপবাসে
ঝরে তোদের চোখের জল ॥

তোরা যে মায়ের খাঁটি সন্তান
তোদেরই সব শক্তিবল
হাড়খুটা পরিশ্রম করো
সহ্য করে রোদ-বাদল ॥

বাঁচতে হলে সবাই মিলে
মনকে করে নেও সরল
এক হলে আর নাই ভাবনা
বলে রে করিম পাগল ॥

.

৫৭

স্বাধীন দেশে মানুষের
অধিকার চাই
সমানভাবে দেখতে হবে
নারী-পুরুষ প্রভেদ নাই ॥

জীবন পায় মায়ের উদরে
ভবে আসে তাহার পরে
সেবাযত্ন মায়ে করে
স্বচক্ষে যা দেখতে পাই ॥

সেবাতে মহাপুণ্য হয়
আঘাত করলে পাপ যে নিশ্চয়
সর্বধর্মে একই কথা কয়
বিচার করে দেখ তাই ॥

সেবক হয় নারী জাতি
সবসময় সেবাতে ব্রতী
বিদ্বেষ কেন তাদের প্রতি
বলো এবার জানতে চাই ॥

পুরুষ অহংকার করে
নারীর উপর এসিড মারে
অপহরণ ধর্ষণ করে
পত্রিকাতে খবর পাই ॥

শিক্ষাদীক্ষা পালন করা
হয় না মাতাপিতা ছাড়া
অকৃতজ্ঞ হবে যারা
করিম বলে মুক্তি নাই ॥

.

৫৮

বড় ভাবী গো, আমারে ঠেকাইছন আলায়
আমি খালি চিন্তা করি আমি কিছু করবার নায়
একে তো অভাবের সংসার জমানা কঠিন
খাইয়া বাইচ্চা চলা যায় না করিতে হয় ঋণ ॥

মা-বাপ যেমন পাগল রাতদিন
ভাবেন খালি আমার দায়
মা-বাপের গলার কাঁটা আমি অভাগিনী
জন্মিয়া মরলাম না কেনে ভাবি দিনরজনী
দামান্দের যে দাম শুনি
শুনলে কানে ধুমা যায় ॥

ইদিগেও তিন-চারখানো বাবাজান গেলা
কম-দামেনি জামাই মিলে খুঁজিয়া চাইলা
ছনের ঘরে থাকে জামাই
তবু টেলিভিশন চায় ॥

কী পাপ করলাম গো ভাবী মাইয়া জন্ম লইয়া
মা-বাপের ডাকাতি করলাম জনমের লাগিয়া
জমি বেইচ্চা দিলে বিয়া
শেষে তাদের কী উপায় ॥

নারী-পুরুষ সমান অধিকার শুনি শুনার শোনা
এই ব্যাপারে কী করা যায় তাই করি ভাবনা
করিম কয় দুঃখের বিষয়
মাইয়ার বাপ যে নিরুপায় ॥

.

৫৯

ভয় করো না এক হয়ে যাও
মজুর চাষির দল
জুলুম শোষণ দূর করিতে
প্রতিজ্ঞাতে হও অটল ॥

কৃষক মজুরের বলে
সোনার দেশে সোনা ফলে
চুষে নেয় শোষকের দলে
জানে কত কলকৌশল ॥

স্বার্থভোগী শোষক যারা
মানবরূপী রাক্ষস তারা
হইয়া সর্বস্বহারা
গরিব হইল রসাতল ॥

একতার বল বুকে নিয়া
করিম বলে চল আগাইয়া
আল্লা-ভগবান বলিয়া
ঢালিস না আর চোখের জল ॥

.

৬০

মনে মনে ভাবিতেছি
এখন আমি কোথায় যাই
অষ্টপাশে বাধা আছি
মরণ বিনে মুক্তি নাই ॥

জন্ম নিয়া আসলে পরে
বাঁচতে সবাই আশা করে
তথাপি সকলেই মরে
স্বচক্ষে যা দেখতে পাই ॥

দুঃখে গড়া জীবন আমার
তাই তো দুঃখ গেল না আর
গান গাওয়া হয়েছে সার
এ ছাড়া যে উপায় নাই ॥

যতই বাঁচতে চেয়েছি
ততই দুঃখ পেয়েছি
দুঃখের কত গান গেয়েছি
শুনবে কে, সেই মানুষ নাই ॥

দেখলাম কত ধনী-মানী
মন জানে আর আমি জানি
মুখে বলে মিষ্ট বাণী
আসলে ঠগের গোসাই ॥

করিমের মনের কথা
বলতে চাই না যথা তথা
নিজে খাইলাম নিজের মাথা
অন্তিম কালে মুক্তি চাই ॥

.

৬১

রক্ত দিয়ে স্বাধীন হলেম
দুর্দশা কেন যায় না?
শোষিতগণ বেঁচে থাকুক
শোষক তাহা চায় না ॥

কৃষক-মজুরের বলে
এই দেশে সোনা ফলে
তারা ভাসে চোখের জলে
ক্ষুধায় অন্ন পায় না ॥

চেয়েছিলাম প্রেমপ্রীতি
পেয়েছি ভয়-ভীতি
চলেছে বৈষম্যনীতি
কেউ খায় কেউ খায় না ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
স্বার্থপর শোষক দলে
ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে চলে
সমষ্টির গান গায় না ॥

.

৬২

শক্তিসম্পদ আছে যাদের
দেশের মালিক তারাই হয়
মনে মনে ভাবি দেশ গরিবের নয়
দুঃখের বিষয় ॥

কৃষক মজুর মেহনতিগণ
যাদের শ্রমে হয় উৎপাদন
নিরাশার আঁধারে এখন
কত দুঃখ কষ্ট সয় ॥

ভাঙাগড়া দেখলাম কত
দেখে হলেম মর্মাহত
মিষ্ট বাণী বলুক যত
লঙ্কা গেলেই রাক্ষস হয় ॥

চলেছে জুলুম অত্যাচার
নাই ধর্ম নাই সুবিচার
আবদুল করিম ভাবছে এবার
চারিদিকে টাকার জয় ॥

.

৬৩

এ দেশে স্বার্থপরদের
চলেছে রঙের খেলা
কোনো কাজে গেলেই বলে
ঘুষ দেলা, কী জ্বালা ॥

ঘুষের লেনা দেনা ভাই
গোপনে হইত তাই
এখন কোনো ভয়ভীতি নাই
চলছে ঘুষ খোলামেলা ॥

সুদ-ঘুষে লিপ্ত যারা
স্বর্গসুখে আছে তারা
কৃষক মজুর মেহনতিরা
উপায় নাই তাদের বেলা ॥

আছে যারা স্বার্থের নেশায়
স্বার্থের সন্ধান তারাই পায়
অবৈধ স্বার্থ যারা চায়
তারা শয়তানের চেলা ॥

স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাইলাম
জীবনে কত গান গাইলাম
সুখের আশায় দুঃখ পাইলাম
এখন যে আর নাই বেলা ॥

বাউল আবদুল করিম ভাবে
জনগণ অধিকার পাবে
অসুরশক্তি নিপাত যাবে
আসবে রে ভীষণ ঠেলা ॥

.

৬৪

বেহেস্ত ধনীর জন্য রয় গরিবের নাই অধিকার
স্বচক্ষে দেখিলাম যাহা গরিব হলে দোযখ তার ॥

গরিবের নাই পাকাবাড়ি চেয়ার-টেবিল-টোল-আলমারি
গরিবের নাই পালঙ পিঁড়ি ভাঙা ঘর ভাঙা যে দ্বার ॥

সাহেব-বাবু গরিবরা নয় কুলি-মজুর গরিবরা হয়
দুঃখ কষ্ট গরিবে সয় করে না জুলুম অত্যাচার ॥

ধনীদের আমিরানা বলেন গরিব ভালো না
হারাম-হালাল বোঝে না ধার ধারে না নামাজ-রোজার ॥

গরিব হয় খোদার দুশমন, না হলে কি এই জ্বালাতন
আবদুল করিম বলে রে মন টাকা ভবে হয় মূলাধার ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৬৫

কর্মফেরে বারে বারে ঘোর আঁধারে পড়ে যাই
আমরা দেশের মজুর চাষি স্বাধীনতা নাই ॥

আড়াইশত বৎসর গেল ব্রিটিশের শাসনে ভাই
ব্রিটিশ গেল স্বরাজ এল গরিবের কপালে ছাই ॥

পথ ভুলিয়া ধর্ম নিয়া মারামারি লেগে যাই
দুইয়েরই হইল ক্ষতি কার দুঃখ কারে জানাই ॥

মুসলিম লীগ হয়ে যখন পাকিস্তানি স্বাধীন পাই
শাসন-শোষণ করতে তখন আসিলেন মুসলমান ভাই ॥

খ্রিস্টান গেল মুসলিম এল কাজে কোনো প্রভেদ নাই
মুসলিম লীগের ভাঙা লেন্টন তখন যে আমরা নিভাই ॥

কাড়াকাড়ি মারামারি চলিল স্বার্থের লড়াই
সামরিক শাসনে তখন আরো দশ বৎসর কাটাই ॥

তারপরে ইয়াহিয়া এল দাজ্জালের ছোটো ভাই
লাখো লাখো মানুষ মারে মা-বোনের আর ইজ্জত নাই ॥

মুজিবের নেতৃত্বে তখন চলিল পাল্টা লড়াই
মানুষের নয় শোষিতের নয় বাংলার স্বাধীনতা পাই ॥

জন্ম নিয়েছি যখন সবাই মিলে বাঁচতে চাই
করিম কয় দুঃখের বিষয় গরিবের গান আমি গাই ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৬৬

ঈদ এসেছে দুঃখ দিতে
গরিবের মনে
ধনী সবাই সাজবে নতুন
বেশভূষণে ॥

জবাই করবে গরু-খাসি
ধনীর মুখে ফুটবে হাসি
গরিব কাঙাল উপবাসী
কাঁদবে গোপনে ॥

বসত করে ভাঙা ঘরে
অর্ধাহার-অনাহার করে
ছিঁড়া বসন অঙ্গে পরে
দুঃখের দিন গনে ॥

দেখে এই বৈষম্যনীতি
ভালো নয় মতিগতি
করিমের দুঃখের আরতি
কেবা তা শোনে ॥

.

৬৭

ঈদ আসলে কি দুঃখ দিতে?
আপন পর বেছে নিলে আসলে না সবার বাড়িতে ॥

কেউ খাবে মাখন ছানা কেউ করিবে আমিরানা
অনেকে খাইতে পাবে না কঁদিবে মনের আঘাতে ॥

এত বৈষম্য কেন তুমি নি তার খবর জান?
নইলে আমার কথা মান আসিও না এই দেশেতে ॥

কেউ হাসে কারো কাদা দেখে দুঃখ লাগে ভাঙাবুকে
আবদুল করিম মনের শোকে চায় তোমায় মন্দ বলিতে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৬৮

ওরে মেলা দিতে জ্বালা কার মন্ত্রণা পাইলে
এই দেশে কেন বা তুই আইলে ॥

প্রথম ফারুন মাসে আসিলে নবীন বেশে
ধনীরে ভালোবেসে গরিবরে কাঁদাইলে ॥

আছে যাদের টাকাকড়ি মেলায় যাবে তাড়াতাড়ি
গরিবের মাথায় বাড়ি পড়িয়া ভেজালে ॥

ঘরে বেটার খাওন নাই অতিথি আইল মেয়ের জামাই
কুলমানে দিতে ছাই বড়-ই সুযোগ পাইলে ॥

মেলা তোরে করি মানা এই বেশে তুই আর আসিস না
গরিবকে দুঃখ দিস না আবদুল করিম বলে ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৬৯

নূতন বৈশাখ মাসে
শুভ দিন আসবে বলে সবাই ছিল আশার আশে ॥

নূতন দিন নুতন বাণী নূতন গান নূতন রাগিনি
নূতন ভাবে সাজবে সবাই নূতন পরিবেশে
হাওর দেখ কী শোভাময় নূতন ধানের শীষে
আশায় সবাই বুক বেঁধেছে উদয় রবি ভাগ্যকাশে ॥

কৃষকের পেরেশানি আসলে ফসলহানি
জীবন নিয়ে টানাটানি প্রাণ বাঁচাবে কিসে
যাদের সম্বল ছিল লাঙল–হলো হারা দিশে
দিন মজুরের মজুরি নাই তারা মরে উপবাসে ॥

হাড়ভাঙা খাটনির বলে জমিতে যে ফসল ফলে
শিলাবৃষ্টি বন্যার জলে সমূলে বিনাশের
কালবৈশাখীর ঝড় আসিবে কৃষক মরে ত্রাসে
মজুতদার কালবাজারী তারা তখন মুচকি হাসে ॥

বাংলার মাটি আজো সিক্ত বৃথা গেল এত রক্ত
হলেম না শোষনমুক্ত মরি হা-হুতাশে
বাঁচার লড়াই করতে হবে শপথ নেও সাহসে
শান্তি আনতে চাও যদি হতভাগা বঞ্চিত দেশে ॥

বাঁচতে হলে রাস্তা ধরো শোষণমুক্ত সমাজ গড়ো
প্রাণপণে চেষ্টা কর কৃষক মজুর মিশে
শোষিত বঞ্চিত যারা চলো এক বিশ্বাসে
করিম বলে হইবে জয় মুক্তি অবশেষে ॥

.

৭০

মাগো আমি কিসে দোষী
গরিবের দুঃখ বুঝি বলে মা গরিবকে তাই ভালোবাসি ॥

তোমার গর্ভে জন্ম সবার ছেলে মেয়ে সবই তোমার
তোমার কাছে সমান অধিকার পাইতে প্রত্যাশী
একি মা তোর উচিত বিচার মা তোমায় জিজ্ঞাসী
কেউরে দিলি মাখনছানা-–কেউ কেন মা উপবাসী ॥

ধনী মানী ভবে যারা শাসন-শোষণ করে তারা
তাই তো কেউ সর্বহারা কেউ যে স্বর্গবাসী
একি মা তোর ভালোবাসা ওগো সর্বনাশী
গাইতে দিলি আমারে মা গরিবের বারমাসি ॥

এমন দিন মা আসবে কবে সকল বন্ধন খসে যাবে
এক যোগে ফুটে উঠবে সবার মুখে হাসি
করিম বলে বাঁচতে দে মা-দাও না যদি বেশি
বাঁচার অধিকার নিয়ে মা লড়াই করছি দিবানিশি ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৭১

জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বলো ওগো সাঁই
এ জীবনে যত দুঃখ কে দিয়াছে বল তাই ॥

দোষ করিলে বিচার আছে সেই ব্যবস্থা রয়ে গেছে
দয়া চাই না তোমার কাছে আমরা উচিত বিচার চাই
দোষী হলে বিচারে সাজা দিবা তো পরে
এখন মারো অনাহারে কোন বিচারে জানতে চাই ॥

এই কি তোমার বিবেচনা কেউরে দিলা মাখনছানা
কেউরে মুখে অন্ন জোটে না ভাঙা ঘরে ছানি নাই
জানো শুধু ভোগবিলাস জানো গরিবের সর্বনাশ
কেড়ে নেও শিশুর মুখের গ্রাস তোর মনে কি দয়া নাই ॥

তোমার এসব ব্যবহারে অনেকে মানে না তোমারে
কথায় কথায় তুচ্ছ করে, আগের ইজ্জত তোমার নাই
রাখতে চাইলে নিজের মান সমস্যার কর সমাধান
নিজের বিচার নিজেই করো আদালতের দরকার নাই ॥

দয়াল বলে নাম যায় শোনা কথায় কাজে মিল পড়ে না
তোমার মান তুমি বোঝ না, আমরা তো মান দিতেই চাই
তুমি আমি এক হইলে পাবে না কোনো গোলমালের
বাউল আবদুল করিম বলে আমি তোমার গুণ গাই ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৭২

দয়াময় নামটি তোমার গিয়াছে জানা
গরিব যারা হয় তারা কি তোমার নয়
তবে কেন দয়াময় দয়া হয় না ॥

থাকে ভাঙা ঘরে কত কষ্ট করে
অনাহারে মরে অন্ন জোটে না
হলে দারুণ ব্যাধি নাই তার ঔষধি
দারুণ বিধি তোমার ভাব বুঝি না ॥

কেহ ভিক্ষা করে ফিরে দ্বারে দ্বারে
তবু স্মরণ করে নাম ভোলে না
দীনহীন জনে ডাকে আকুল প্রাণে
দুঃখের আগুনে একটু জল ছিটাও না ॥

নিরুপায় যারা ডেকে ফিরে তারা
দাও না তুমি সাড়া, করো ঘৃণা
বুঝিলাম এখন গরিব তোমার দুশমন
কাঁদিয়া ডাকিলে যখন মন গলে না ॥

আবদুল করিম বলে তব দয়া হলে
অকূলে কূল মিলে দুঃখ রয় না
তুমি দয়ার সিন্ধু দাও না এক বিন্দু
কাজে তুমি ধনীর বন্ধু, গরিবের না ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৭৩

আজ প্রথম মে দিবসে
পুরান নতুন দুঃখ ব্যথা
কত কথা মনে আসে ॥

দেখ সবাই বিচার করে
নূতন হিসাব নূতন করে
ফিরে আসে বারে বারে
বিশ্বের ইতিহাসে।
মজুর গড়ে দিল প্রাসাদ
থেকে উপবাসে
কৃষক ধরিয়া লাঙ্গল
সৃজিল ধন আপন দেশে ॥

দুর্বলের যা সম্বল ছিল
প্রতারক তা কেড়ে নিল
এখন কী করিবে বলো
দাঁড়াবে কার পাশে
লড়াই করে বাঁচতে হবে
হবে না আপোসে
মুক্তিকামী আছ যারা
চলতে হবে সৎসাহসে ॥

এই মাটিতে হবে চাষ
লড়াই ছাড়া নাই অবকাশ
শোষণের নাগপাশ
কাটবে নইলে কিসে।
প্রভাতের পূর্বে আঁধার
ঘন হয়ে আসে
করিম বলে তাহার পরে
আকাশে লাল সূর্য ভাসে ॥

.

৭৪

দেশ এবং মানুষের যদি চাও উন্নতি
গ্রামে গ্রামে গড়ো সমবায় সমিতি ॥

বিভেদ ভুলে যাও একে অন্যের হয়ে সাথি
এক হয়ে দাঁড়াও দেশের সম্পদ বাড়াও
সমবেত কণ্ঠেতে গাও সমবায় গীতি ॥

মৌমাছির দলে মৌচক্র তৈয়ার করে
অতি কৌশলে তারা এক যোগে মিলে
মধুর সন্ধান ফুলে ফুলে করে দিবারাতি ॥

একতার কী বল জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে যখন
আসে নতুন জল তখন পিপীলিকার দল
একযোগে ভাসে সকল নিয়ে প্রেমপ্রীতি ॥

ওরে দিনমজুরের দল মিলে মিশে চেষ্টা কর
হইবে মঙ্গল তোদের একতাই সম্বল
গ্রহণ কর হয়ে সরল সমবায় পদ্ধতি ॥

আবদুল করিম কয় কোন পথে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল
খুঁজে নিতে হয় নইলে যায় না কালের ভয়
অজ্ঞানতার অন্ধকারে জ্বালাও জ্ঞানের বাতি ॥

.

৭৫

সুদিন আসবে
সুদিন আসবে রে কাজ করিলে
মর্ম বুঝে কর্ম কর
মিলিয়া সকলে ॥

এই স্বাধীন বাংলার মাটি
সোনা হতে আরো খাঁটি
বুঝে দেখ মোটামুটি
যত্নে রত্ন ফলে ॥

ধান সবিয়া পাড় হইতেছে
আলু বাদাম মাটির নিচে
চা-বাগান অনেক রয়েছে
আখ ফলে গম ফলে ॥

নারিকেল সুপারি আছে
মাছ ফলে জলের নিচে
কত খনিজসম্পদ পাওয়া গেছে
তেল মিলে গ্যাস মিলে ॥

বালি পাথর সিমেন্ট আছে
বন বাঁশে কাগজ হইতেছে
সুষম বণ্টনের অভাব
আবদুল করিম বলে ॥

.

৭৬

ওরে চাষি ভাই শক্ত হাতে লাঙ্গল ধরা চাই
যত্ন বলে রত্ন ফলে পরিশ্রমে প্রাণ বাঁচাই ॥

উৎপাদনের প্রয়োজনে চলো এবার সর্বজনে
মাটি সনে মনে প্রাণে আমরা করি লড়াই ॥

কৃষক মজুর সবাই মিলে আছি বাংলা মায়ের কোলে
পরিশ্রমে সোনা ফলে তবে কেন দুঃখ পাই ॥

মাছ ফলাও গাছ লাগাও যত পারো শবজি ফলাও
পাট ফলাও তুলা ফলাও ধান সরিষা বুট কালাই ॥

কাজ করে যাও মনোবলে কষক মজুর তাঁতি জেলে
বাউল আবদুল করিম বলে এ ছাড়া আর উপায় নাই ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৭৭

সুসময়ে ছাড়ো নৌকা বেলা বয়ে যায়
কৃষক মজুর জেলে তাঁতি আয় রে সবাই আয় ॥

নব রঙের পাইক সাজে জনগণের নায়
হাইল ধরিও সুজন মাঝি ইমানের বৈঠায় ॥

কেউ নায়ে জল সিচে কেউ বৈঠা বায়
রঙবেরঙের বাজনা বাজে সারিগান গায় ॥

ভয় করি না ঝড় তুফানে পাইকে যদি বায়
বাউল আবদুল করিম বলে যাব সোনার গাঁয় ॥

.

৭৮

নাও বাইয়া যায় রে পাইক সারি সারি
হারা জিতা চুবের বেলা দুই নৌকায় জুড়ি
নাও বাইয়া যায় রে ॥

ধনাই মনাই দুই ভাই দুই জনের দুই নাও
মনাইর নৌকা হারে কেন বুঝি না তার বাও
নাও বাইয়া যায় রে ॥

ধনাই মিয়ার সুন্দর নাও সারি সারি গোড়া
ইশারা করিলে নাও শূন্যে করে উড়া
নাও বাইয়া যায় রে ॥

এক থলায় দুই নৌকা সারি সারি বায়
কেউ হারে কেউ জিতে কেউ তামশা চায়
নাও বাইয়া যায় রে ॥

বাইতে বাইতে মনাই মিয়ার তনু হইল শেষ
করিম বলে মনাই কোন দিন যায় নিজ দেশ
নাও বাইয়া যায় রে ॥

.

৭৯

নাইয়া রে, বাংলার নাও সাজাইয়া যাবো আমরা বাইয়া
মোদের গতি রোধ হবে না ঢেউ তুফানের ভয় রাখি না
থাকিতে সুজন নাইয়া যাব আমরা বাইয়া ॥

নাইয়া রে, স্বাধীন বাংলার সারি গেয়ে রঙিন পাল উড়াইয়া
কৃষক মজুর সবাই মিলে বাও নৌকা কৌতূহলে
সত্যের হাল রাখিয়া ॥

নাইয়া রে, পূর্বে রবি রাঙা ছবি উদয় গেল হইয়া
সোনার বাংলা গড়তে এবার কষক মজর হও হুঁশিয়ার
যাইও না ভুলিয়া ॥

নাইয়া রে, সাগর পাড়ি দিয়া রে নাও কিনারা ভিড়াইয়া
বাউল আবদুল করিম বলে হাসব একদিন সবাই মিলে
পরান খুলিয়া ॥

[কালনীর ঢেউ]

.

৮০

শাকশবজি ফলাইও গো
কই গো মা-বইন সবার কাছে
ফলাইয়া সব খাইতে হবে
আগের দিন কি আছে গো ॥

শাকশবজি আনাজ-তরকারির
অভাব পড়িয়াছে
পেট ভরে খাইতে পারি না
দুঃখে কি জান বাঁচে গো ॥

মাছে ভাতে হয় বাঙালি
প্রবাদ বাক্য আছে
মাছের দেশে মাছ মিলে না
কী বলবো কার কাছে গো ॥

দই দুগ্ধের অভাব ছিল না
সে দিন গেছে পাছে
গরিব যারা সর্বহারা
চাইলে তখন পাইছে গো ॥  

বাউল আবদুল করিম বলে
আর কী হবে পাছে
জীবনে দেখছি না যেতা
আল্লায় দেখাইতেছে গো ॥

.

৮১

বৃক্ষ নিয়ে ভাবছি এবার বাউল সবাই
আমরা হই চারণ বাউল গণমানুষের গান গাই ॥

হয়েছে গাছ হবে আরো লাগাও সবাই যত পারো
বৃক্ষ নিধন বন্ধ করো সবার কাছে বলে যাই ॥

গাছে কত ফল ধরে মানুষে খায় সমাদরে
ঔষধাদি তৈয়ার করে রোগ হলে আমরা খাই ॥

দেখ না আপন বিচারে অক্সিজেন দেয় সবারে
গাছ বিনা জীব বাঁচে না রে জ্ঞাণী গুণী বলেন তাই ॥

স্বার্থপরগণ স্বার্থের তরে কলের বোমা তৈয়ার করে
বোমা ছাড়ে মানুষ মারে আমরা সবাই বাঁচতে চাই ॥

ভুলিও না মনের হেলায় বাউল আবদুল করিমে গায়
বৃক্ষ মোদের জীবন বাঁচায় এ ছাড়া যে উপায় নাই ॥

.

৮২

মনের বেদনা
তুমি তো জান রে বন্ধু ওরে বন্ধু
অন্যে জানে না
যা ইচ্ছা তা করো মোরে
কে করবে মানা ॥

জন্ম দিলা এ সংসারে
গরিব কৃষক পরিবারে
দারিদ্র্যের কবলে পড়ে কত লাঞ্ছনা
জানি না কী ইচ্ছা তোমার
দিলা অর্ধাহার-অনাহার
শিক্ষাদীক্ষা নেওয়া আমার
ভাগ্যে হলো না ॥

বসত করি কুঁড়েঘরে
কত কথা মনে পড়ে
বেঁচে থাকব কেমন করে করি ভাবনা
বাধ্য আছি তোমার মতে
চাই না আমি রাজা হতে
উজানধল গাছতলাতে
আছে ঠিকানা ॥

যা ইচ্ছা তা করো তুমি
তোমারে কী বলবো আমি
তুমি তো অন্তর্যামী সব তোমার জানা
বাউল আবদুল করিম বলে
এ জীবন অন্ত কালে
চরণছায়া পাব বলে
মনে বাসনা ॥

.

৮৩

জ্ঞানী গুনী সবাই বলেন
মুক্তি আসে মানবতায়
মানবতা বিনে রে মন
ধর্ম-কর্ম বিফলে যায় ॥

মানুষ হয় সৃষ্টির সেরা
তার তুলনা পাবে কোথায়
সেই মানুষকে আঘাত করে
লাভ হবে কি উপাসনায় ॥

আসল কথা ভুলে গিয়ে
দিন গেল মোর অবহেলায়
আমি আমার মূল্য দেই না
ঠেকছি ভবের লোভ লালসায় ॥

জংলি পাখি পোষ মানে না
বন্দি নয় সে ভবের মায়ায়
দুদিন পরে যাবে উড়ে
খাঁচার পাখি রয় না খাঁচায় ॥

থাকতে ঘরে চিনলে না রে
মুল হারালে ভবের নেশায়
আবদুল করিম ভাবছে বসে
ভবের জনম বিফলে যায় ॥

.

৮৪

আমার দেশে কেন আমি
কাঙাল হলেম রে
নাই কেন মোর সহায় সম্বল
সদায় ভাবি রে ॥

নাই কেন মোর স্বাধীনতা
বুকে নিদারুণ ব্যথা
কার কাছে কই দুঃখের কথা
কে শুনিবে রে ॥

এই দেশে জন্ম আমার
আমার কেন নাই অধিকার
জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার
উপায় নাই রে ॥

দুঃখে গড়া জীবন নিয়া
চির দুঃখের অধীন হইয়া
দুঃখের বারোমাসি গাইয়া
জীবন গেল রে ॥

গরিবের দুঃখ যত
কার কাছে বলিবে কত
করিম বলে আমিও তো
মানুষ ছিলাম রে ॥

.

৮৫

তিনশো ষাইট আউলিয়ার দেশ
সিলেট ভূমি রে
এই দেশের জলবায়ুতে
গড়া আমি রে ॥

সাধক আউলিয়া দরবেশ
মরমি কবিগণের দেশ
মানুষ যারা তারা দেশের
মঙ্গলকামী রে ॥

ফুলে ফুলে শোভিত দেশ
ধানের দেশ গানের দেশ
কৃষক মজুরের দেশ
এই শ্যামল ভূমি রে ॥

তোমার দেশ আমার দেশ
হলো না মুক্ত পরিবেশ
শোষণের হলো না শেষ
মিছে ভ্রমি রে ॥

আজ আছি কাল থাকব না তো
জন্ম মরণ ঢেউয়ের মতো
কী বুঝিয়া করিম এত
পাগল তুমি রে ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *