২. অন্যান্য প্রদেশের দুর্ব্বৃত্ত জাতিরা

দ্বিতীয় ভাগ
অন্যান্য প্রদেশের যে সকল দুর্ব্বৃত্ত জাতিরা বঙ্গদেশে চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে।

সূচিপত্র

দ্বিতীয় ভাগ

  • বৈদ মুসলমান
  • বনফড়
  • বারওয়ার
  • মাড়োয়ারী বাউরিয়া
  • ভাতা
  • ভড় জাতি
  • ছত্রিশগড় চামার
  • ছাপ্‌পড় বাঁধ
  • চৈন চামার
  • ধাড়ী
  • মগাহিয়া ডোম
  • পালোয়ার দোসাদ
  • চাকাই দোসাদ
  • যাদুয়া ব্রাহ্মণ
  • কারোয়াল নট
  • কেপমারি বা ইনাকোরাবার
  • মাল্লা ও অপরাপর বোম্বেটে
  • চৈন মাল্লা
  • মিন্‌কা
  • পাশি
  • মজফঃরপুর সোণার
  • সানৌড়িয়া

.

বৈদ মুসলমান।

বাসস্থান।

বৈদ মুসলমানেরা ভ্রমণকারী প্রতারক। ইহারা যোধপুর, উদয়পুর ও রাজপুতানার অন্যান্য রাজ্য হইতে আসে। ইহারা কদাচিৎ একাকী কাৰ্য্য করে। অধিকাংশ সময়ে ইহারা দুই, তিন বা চারি জন করিয়া ছোট ছোট দল বাঁধিয়া ভ্রমণ করে, এবং অনেক সময়ে ঘুরিয়া নির্দিষ্ট স্থানে ফিরিয়া আসে।

উৎপত্তি ও জাতি।

এই সকল লোকের উৎপত্তি এখনও স্পষ্ট জানা যায় নাই। ইহারা মুসলমান ধর্মাবলম্বী, কিন্তু যে সকল স্থানে ইহাদের বাড়ি সে সকল স্থানে ইহারা বৈদ বলিয়া পরিচিত।

১৯১০ সালের ৬ই আগষ্ট তারিখে যুক্ত-প্রদেশের সি, আই, ডির গেজেটে প্রকাশিত এক মন্তব্য অনুসারে বনজরদিগের বৈদ নামক এক অন্তর্জাতি আছে। লোকের বিশ্বাস যে প্রতারক বৈদগণ এই অন্তর্জাতির লোক কিন্তু মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছে। বৈদ শব্দের অর্থ যে ওষুধ দেয় এবং বৈদ মুসলমানদের প্রকাশ্যে বৃত্তি নানারূপ রোগ আরোগ্য করা। যখন ইহারা প্রতারণাকার্যে বাহির হয় তখন হিন্দু রামানন্দী সাধুদের ন্যায় পোষাক পরে এবং সঙ্গে একটি ছোট দেবমূর্তি ও কয়েকখানি ধৰ্ম্ম পুস্তক লয়। চেহারার সাদৃশ্যহেতু ইহাদিগকে লোকে কখনও কখনও বাউরিয়া মনে করে। কিন্তু বাউরিয়ারা চোর ও ডাকাইত, আর বৈদ মুসলমানেরা প্রতারক। বৈদ বাউরিয়া উভয় জাতি বালক দাস, শঙ্কর দাস, রঘুবর দাস, হনুমান দাস প্রভৃতি নাম গ্রহণ করে।

কাৰ্য্যপ্রণালী।

বৈদ মুসলমানদের কার্যপ্রণালী অনেক বিষয়ে পাটনার যদুয়া ব্রাহ্মণদের কার্যপ্রণালীর অনুরূপ। কিন্তু বৈদ মুসলমানেরা সাধারণতঃ যে ব্যক্তিকে ঠকাইতে চাহে সে ব্যক্তি যে রোগে ভুগিতেছে সেই রোগ জানিয়া লইয়া সেই রোগ বিনা মূল্যে আরোগ্য করিব বলিয়া প্রথমে তাহার নিকটে যায়। তৎপরে কথোপকথন করিতে করিতে সেই ব্যক্তির বিশ্বাস জন্মাইয়া দেয় যে ইহারা নিকৃষ্ট ধাতুকে রূপা ও রূপাকে সোণা করিতে ও ইহাদের নিকট সোণা রাখিলে সেই সোণা দুনা করিয়া দিতে পারিবে। কোন কোন স্থলে ইহারা প্রতারিত ব্যক্তিকে খানিকটা পারা আনিতে বলে, ও এই পারা উনানের উপর একটা মুচিতে রাখিয়া তাহার উপর একটা গুড়া বা রাসায়নিক দ্রব্য পদার্থ (আরক ছিড়াইয়া দেয় এবং উহা হইতে রঙ্গীন শিখা বাহির হয়।) এইরূপ আরও কিছু যাদুক্রিয়া দেখাইয়া বৈদরা হাতের কায়দায় পাত্রস্থ পারার স্থানে একতাল আসল রূপা রাখিয়া দেয়।

এই কাৰ্য্য দেখিয়া ঐ ব্যক্তি তাহার যত সোণা রূপা আছে সব আনিয়া বৈদকে তাহার উপর যাদুক্ৰিয়া করিতে বলে। অনেক অনিচ্ছা দেখাইবার পর বৈদ রাজি হয় ও একটা শুভদিন স্থির করে এবং যতদিন না সেই দিন আসে ততদিন সেই পরিবারের ধর্ম্ম ও সাংসারিক বিষয়ে ভগবৎ প্রেরিত উদ্ধারকর্তারূপে নিজেকে দেখায়। অনবরত সে সেই বাড়িতে যায় ও তাহার নিকটে যে রামায়ণ ও অন্যান্য হিন্দুধর্ম্ম পুস্তক থাকে তাহার স্থানে স্থানে পাঠ করে। নির্দিষ্ট দিনে যাদুকাৰ্য্য আরম্ভ হয় এবং মন্ত্রাদি পড়িতে পড়িতে ও রহস্যজনক কাৰ্য্য করিতে করিতে আগুনের উপর পাত্রের সমস্ত সোণা রূপা দিবার ছলে কাৰ্য শেষ করিতে দেরী করা হয়, এমন কি সময়ে সময়ে এইরূপে দিনের পর দিন কাটিয়া যায়। একদিন সকাল বেলা প্রতারিত ব্যক্তি দেখে যে যাদুকর সরিয়া পড়িয়াছে এবং পাত্রটি পরীক্ষা করিয়া দেখে যে উহা খালি। এ পর্যন্ত তাহাকে পাত্রটি ছুঁইতে দেওয়া হয় নাই।

বৈদরা সাধারণতঃ প্রতারণার জন্য গণ্যমান্য ও ধনীলোক এবং অনেক সময়ে সরকারী কর্মচারী বাছিয়া লয়, কারণ তাহারা মনে করে যে এই সকল লোক উপহাসের ভয়ে নালিশ করিবে না।

শিক্ষিত ব্যক্তির উপর প্রতারণা করিতে হইলে উহারা কখনও কখনও বৈরাগীর বেশে তাহার দরজায় ভিক্ষা করিতে আসে এবং ভিক্ষা পাইলে আশীৰ্বাদ করিবার সময়ে তাহাকে কতকটা গুঁড়া বা ছাই দিয়া বলে যে উহার রূপাকে সোণা করিবার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। প্রতারিত ব্যক্তি প্রণালীর বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে বৈদ তাহা দেখাইয়া দিতে চায়। প্রতারিত ব্যক্তি তাহার টাকাকড়ি বাহির করিয়া লইয়া আসে ও তৎপরে অন্যান্য স্থলের ন্যায় কাৰ্য্য চলে।

১৯১০ সালে হাবড়ায় ধৃত একদল।

১৯১০ সালে হাবড়া পুলিশ একদল বৈদ মুসলমানকে ধরে। এই দলে ১০ জন লোক ছিল। হাবড়া শহরের নতুন বাজারে একটা বাড়ি ভাড়া করিয়া সেখানে ইহারা প্রতারণা কাৰ্য্য চালাইতেছিল। একস্থলে ফরিয়াদী তাহার বাড়ির সমস্ত সোণা ও রূপার গহনা উহাদিগের হাতে দিবার পর মনে সন্দেহ করে ও গোলাবাড়ির থানার দারোগাকে খবর দেয়। অতঃপর বৈদরা কাপড়ের ভিতর সম্পত্তি লুকাইয়া যেমন ঐ বাড়ি ছাড়িয়া যাইতেছিল ঐ দারোগা তাহাদিগকে গ্রেপ্তার করেন।

১৯১৪ সালে নদীয়ায় যে একটি প্রতারনা হয় তাহাকে দৃষ্টান্তরূপ লওয়া যাইতে পারে।

১৯১৪ সালে নদীয়া জেলায় গোবিন্দ সিং, ওরফে গোবিন্দ দাস ও হরিদাস নামক দুই

ব্যক্তি মেহেরপুর আসিয়া এক ঠাকুরবাড়িতে আশ্রয় লয় ও বলে যে তাহারা সাধু পুরি হইতে ফিরিতেছে। যে ব্যক্তিকে প্রতারিত করিবার জন্য ইহারা বাছিয়া লয় তিনি একজন দুরবস্থাপন্ন উকিল। তাহাকে ইহারা খানিকটা সাদাগুঁড়া দিয়া বলে যে উহাতে তাঁহার সুসময় আসিবে। কয়েক দিন পরে গোবিন্দ দাস আবার ঐ উকিলের বাড়িতে যায় এবং হাতের কায়দায় অল্প খানিকটা রূপা বাহির করিয়া বলে যে ঐ যাদুশক্তিসম্পন্ন গুঁড়ার গুণে সে ঐ রূপা বাহির করিয়াছে। পরদিন সে আবার আসিয়া উকিলকে বলে, আপনি যত সোণা, রূপা ও তামা পারেন আনিয়া দিন, আমি আমার যাদুশক্তিদ্বারা আপনার ঐশ্বৰ্য্য বাড়াইয়া দিব। সে একটি মাটির কলসী চাহিয়া লয় এবং ইহা আগুনের উপর বসাইয়া গহনাগুলি তুলায় জড়াইয়া উহার মধ্যে রাখিল এইরূপ দেখায়। তারপর গোবিন্দ দাস উকিলকে জল আনিতে বলে এবং তিনি যেমন ঐ ঘর হইতে বাহির হন অমনি চলিয়া যায় এবং যাইবার সময়ে চাকরদিগকে বলিয়া যায় যে সে কয়েক ঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিবে। তাহার অনুপস্থিতির সময়ে কেহ যেন পাত্রটি কোন কারণে না স্পর্শ করে। গোবিন্দ দাস ও তাহার সঙ্গীরা কয়েক মাইল দূরে উকিলের সমস্ত গহনাসহ গ্রেপ্তার হয়।

কাৰ্য্যক্ষেত্র।

বৈদ মুসলমানদের কার্যক্ষেত্র সমগ্র বঙ্গদেশে বিস্তৃত বলিয়া বোধ হয়। গত দুইতিন বৎসরের মধ্যে বঙ্গদেশে ইহারা ২৪-পরগণা, পাবনা, বগুড়া, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় প্রতারণা করিয়াছে বলিয়া সন্দেহভাজন হয় কিম্বা প্রতারণার মোকদ্দমায় আসামী হয়।

.

বনফড়।

সমাজ স্থান ও বৃত্তি।

বনফড় বা বনপড়েরা মাল্লা ও গড়ি জাতির একটি অন্তর্জাতি। ইহারা প্রধানতঃ বিহারে মুঙ্গের ও পাটনা জেলায় বাস করে। ইহাদের আদিম জাতীয় বৃত্তি নৌকা চালান ও মাছধরা কিন্তু বড় বড় নদী হইতে যাহারা দূরে থাকে তাহারা জমি চাষ ও কখনও কখনও ব্যবসা করে। ইহারা নীচ জাতীয় হিন্দু বলিয়া গণ্য, মদ, তাড়ি প্রভৃতি খায়।

বনফড়েরা প্রায়ই বাড়ি ছাড়িয়া বঙ্গের নিম্ন জেলাসমূহে নৌকা চালকের কার্য্য করিতে আসে। কয়েক বৎসর পূৰ্ব্বে কলিকাতায় ও হাওড়ায় উহাদের একটি রীতিমত উপনিবেশ স্থাপিত হইয়াছিল। প্রকাশ্যে হুগলী নদীতে মাল্লার কাৰ্য্য করিতে ইহারা সুবিধা পাইলেই চুরি করিত। অল্প সময়ের মধ্যে ইহাদের চোর বলিয়া বড় অখ্যাতি হইয়াছিল।

দুর্ব্বৃতার হাতহাস।

১৮৯৭ সালে কলিকাতার গার্ডেনরীচে নদীর উপর একটি ভয়ানক ডাকাইতি করার অপরাধে আটজন বনফডের সাজা হয়। ১৮৯৭ হইতে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত বনফড়গণ নদীর উপর অনেকগুলি ডাকাইতি করিয়াছে বলিয়া সন্দেহ হয়। ইহাদের মধ্যে কতকগুলির বিশেষ বিশেষ ডাকাইতির মোকদ্দমায় সাজা হয় ও অপরগুলিকে ফৌজদারী মোকদ্দমার কার্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১১০ ধারা অনুসারে মুচলেকা দিতে আদেশ হয়। ১৯০৬ সালে ২৪-পরগণার নওয়াপাড়ায় কয়েকটি ডাকাইতি হয়। হাওড়ার গোলাবাড়ির বনফড়গণ এই সকল ডাকাইতি করিয়াছে বলিয়া সন্দেহ হওয়ায় উহাদের ১৫ জনকে দুই দলে ফৌজদারী মোকদ্দমার কার্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১১০ ধারা অনুসারে মুচলেকাবদ্ধ করা হয়। ১৯০৭ সালের শেষে বনফড়েরা হুগলীতে দুইটি ডাকাইতি করে। শিবুমাল্লা নামক একজন পালাতক বনফড়ের নামে ফৌজদারী মোকদ্দমার কার্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১১০ ধারা অনুসারে ওয়ারেন্ট ছিল। সে ১৯০৮ সালে প্রধানতঃ পঞ্জাবীদের দলের দ্বারা অনুষ্ঠিত জমির উপর এক ডাকাইতিতে থাকে এবং গ্রেপ্তার হয়। সে একরার করে এবং এই একরারের অনুকূল অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০০ ধারা অনুসারে তাহার দলের প্রধান প্রধান দশজন লোকের বিরুদ্ধে ডাকাইতির মোকদ্দমা রুজু হয় ও তাহাতে তাহাদের সাজা হয়।

কাৰ্য্যক্ষেত্র।

এই দলের কাৰ্য্যক্ষেত্ৰ কলিকাতা, হাবড়া, হুগলী ও ২৪ পরগণায় বিস্তৃত ছিল এবং শিবু একরার করে যে তাহারা নদীয়াতেও একটা ডাকাইতি করে। এই দলে ৫০ জন লোক ছিল। ইহারা সকলেই দাগী কিংবা ১৮৯৭ হইতে ১৯০৮ সাল পৰ্যন্ত অনুষ্ঠিত ১১টি ডাকাইতির কোন না কোনটিতে সংশ্লিষ্ট বলিয়া সন্দেহাধীন ছিল।

দলের মধ্যে মুঙ্গের পাটনা, হাবড়া, ২৪-পরগণা, মজঃফরপুর, কানপুর, ফৈজাবাদ ও সাহাবাদের লোক ছিল কিন্তু অধিকাংশই বনফড় ছিল।

পূর্ব্ববঙ্গের নদী সকলে বনফড়গণ কতদূর কাৰ্য চালায় তৎসম্বন্ধে কোন সুনিশ্চিত সংবাদ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু লোকের বিশ্বাস যে উহার পরিমাণ খুব বেশী।

১৯০৫ সালে খুলনার একজন ব্যবসাদার বনফড় মাঝিমাল্লাসহ একখানা নৌকা ভাড়া করে। পথে ঐ মাঝিমাল্লারা তাহাকে আক্রমণ করিয়া নদীতে ফেলিয়া দেয় এবং যে সকল কাপড় ও সুতার গাঁটদ্বারা সে নৌকা বোঝাই করিয়াছিল সেই সকল লইয়া ভাগলপুর জেলার কলগাঁয় ফিরিয়া যায় ও যাইতে যাইতে রাস্তায় ঐ চোরাই মাল বেচিয়া ফেলে।

চুরি ডাকাইতি করিবার প্রণালী।

অনেক বনফড় হুগলী নদীতে বজরা, নৌকা, পানসী ও ডিঙ্গিতে মাল্লার কাৰ্য্য করে।

ইহারা রাত্রিতে মালের নৌকার চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং ইহাদের মাঝিমাল্লারা ঘুমাইয়া থাকিলে যাহা পায় চুরি করিয়া লইয়া যায়। কিন্তু ১৯০৮ সালের ডাকাইতির মোকদ্দমায় যে সকল একরার হয় সেই সকল একরার হইতে জানা যায় যে ইহারা নদীতে ডাকাইতি করিতেই বেশী পছন্দ করে এবং কখনও কখনও জমিতে ডাকাইতি করে।

চোরাই মাল বিক্রয়।

এক এক দলে ৮ হইতে ১২ জন করিয়া থাকিয়া ইহারা মাল বোঝাই নৌকা আক্রমণ করে এবং প্রয়োজন হইলে মারপিট করিয়া নিজেদের নৌকায় মাল তুলিয়া লয়। কি মাল লুট করিতেছে সে বিষয়ে ইহারা বড় একটা বাছাবাছি করে না। ঘি, চিনি, ময়দা, চাউল, তৈল, আম ও পাট এসব ইহারা লুট করে বলিয়া জানা আছে। এই সকল মাল ইহারা সহজে ও নির্বিঘ্নে পেসাদার চোরাইমাল গ্রহীতাদের নিকট কিংবা প্রকাশ্যে বাজারে বেচিয়া ফেলে। যে নৌকা ইহারা লুট করিতে ইচ্ছা অনুসারে তামাক বা আগুন চায়।

পুলিশ ও চুঙ্গির কর্মচারী সাজিয়া কার্য্য করা।

ইহারা পুলিশ বা চুঙ্গির কর্মচারী সাজিয়াও (১৯০৮ সালের ১৮নং হুগলীর স্পেশাল রিপোর্ট দেখ) নৌকা থামাইয়া উহার ভিতর অনুসন্ধান করে। ইহারা কখনও কখনও মাঝনদীতে চল্‌তী মালের নৌকা হইতে নিজেদের নৌকায় মাল সরাইয়া লইয়া চোরমাঝিদিগকে মাল চুরি করিতে সাহায্য করে। ১৯১৪ সালে একখানা বড় নৌকা হইতে এইভাবে মাল সরাইবার সময়ে পাঁচজন বনফড় ধরা পড়ে। ইহাদিগতে ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধি বিষয়ক আইনের ৪০৭ ধারা অনুসারে চালান দেওয়া হয়। সকলেরই সাজা হয়।

.

বারওয়ার

বাসস্থান ও দুর্ব্বৃত্ত জাতির বিষয়ক আইনানুসারে ঘোষণা।

গণ্ডার বারওয়ারেরা ১৮৮৪ সালের দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইন অনুসারে এবং পুনরায় ১৯১৩ সালের অক্টোবর মাসে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ঘোষিত হয়।

বারওয়ার জাতিরা ও যে শ্রেণী সাধারণতঃ গণ্ডা হরদয় ও সুলতানপুর জেলার বারওয়ার বলিয়া পরিচিত সেই শ্রেণী ১৯১১ সালের দুৰ্বৰ্ত্তজাতিবিষয়ক আইন অনুসারে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ঘোষিত হয়। (যুক্তপ্রদেশের গভর্ণমেন্টের ১৯১৩ সালের ১লা অক্টোবর তারিখের ১২৫০-৮ ১৫৮ নং ও ১৯১৩ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর ১৬৭৮-২৮ ১৫৮-১৭নং বিজ্ঞাপন দেখ)

উৎপত্তি।

ক্রুক সাহেব বলেন যে, লোকের বিশ্বাস যে বারওয়ারেরা কুৰ্ম্মি জাতির একটি শাখা। ইহারা দুর্ব্বৃত্ততার জন্য বা অন্য কোনো কারণে মূল জাতি হইতে পৃথক হইয়া পড়ে। সে যাহা হউক, ক্রুক সাহেবের মতেও বারওয়ার জাতি বড় মিশ্রিত ও অনেক শ্রেণীতে বিভক্ত। কোন কোন শ্রেণীতে পতিত ব্রাহ্মণ ও আহির পর্যন্ত আছে বলিয়া লোকে বলে।

সুতরাং বারওয়ার শব্দটি কোন বিশেষ জাতিবাচক শব্দ নহে। লোকে বলে যে সুলতানপুরে ব্রাহ্মণ হইতে চামার পর্যন্ত যে কোন জাতির বালককে বারওয়ারদের মধ্যে লওয়া হয়। ইহাদ্বারাই বুঝা যায় যে বারওয়ারদের চেহারায় কোন বিশেষত্ব থাকিতে পারে না।

চালচলন ও ছদ্মবেশ।

গণ্ডা ও হরদয়ের বারওয়ারেরা ও সুলতানপুর জেলার বারওয়ারদের অধিকাংশ দুর্ব্বৃত্ততায় পরিপক্ক। ইহারা ভারতবর্ষের সর্বত্র বিচরণ করে। ইহারা নীচ জাতীয় হিন্দু ধর্মের অনুসরণ করে, মদ খায়, এবং মাছ ও ভেড়া ও ছাগলের মাংস খায়। কেহ কেহ কপালে ফোঁটা কাটে, উপবীত পরে এবং ধর্ম্মশীল ব্রাহ্মণদের পোষাক মালা ও অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করে। ইহারা মেলায়, তীর্থস্থানে, রেল ষ্টেশনে, ষ্টীমার ঘাটে ও স্নানের ঘাটে চুরি করে। ইহারা খুব নিপুণতার সহিত তীর্থযাত্রী, সাধু ও ব্রাহ্মণ সাজে এবং কখন কখনও মহাজন, সিপাহি ও ব্যবসাদার রূপেও বাহির হয়। এই সকল সাজ সাজিতে প্রত্যেক স্থলে যে রূপ প্রয়োজন ঠিক সেই রূপ পোষাক পরে। সাধারণতঃ ইহাদের পোষাক ধুতি, মির্জ্জাই জামা, টুপি ও গায়ে জড়ান এক খানি চাদর। চাদরখানি চোরাইমাল লুকাইবার জন্য ব্যবহৃত হয়।

কার্য্যপ্রণালী

বারওয়ারেরা বড় বড় দল বাঁধিয়া বাঙ্গালায় আসে এবং তাহাদের প্রধান আড্ডার জন্য একটি নির্জন স্থান বাছিয়া লইয়া দুই বা তিন জন করিয়া এক এক দল বাঁধিয়া ভাগ হইয়া যায়। ইহারা কদাচিৎ প্রধান আড্ডার নিকটে চুরি করে এবং যাহাতে ধরা না পড়িতে হয় তজ্জন্য অনেক দূর পর্যন্ত যায়। ধরা পড়িলে ইহারা সাধারণত বলে যে ইহারা কুৰ্ম্মি দলের অন্যান্য লোকের সঙ্গে কোন সম্বন্ধ কুটুম্বিতা থাকার কথা ইহারা কখনই স্বীকার করে না।

রেল ষ্টেশনে যে ব্যক্তির উপর নজর রাখিলে লাভ হইতে পারে বলিয়া মনে করে ইহারা ষ্টেশনের বিশ্রামের স্থানে স্থিরভাবে সেই ব্যক্তির পাশে যাইয়া বসে। বারওয়ারদের চুরি করিবার একটি সাধারণ প্রণালী হইতেছে যে, একখানি চাদর ধুইয়া শুকাইতে দেয় এবং কয়েক মিনিট পরে চাদরখানি গুটাইয়া লয় ও সেই সঙ্গে জিনিষটিও তুলিয়া লয়। চতী রেল গাড়িতে চুরি করিতে বারওয়ারেরা খুব দক্ষ। ইহারা সাধারণত ঘুমন্ত যাত্রীদের মাল লইয়া রাস্তার ধারের ষ্টেশনে নামিয়া পড়ে।

অনেক সময় ৭ হইতে ১৪ বৎসর বয়সের বালকেরা দলের সঙ্গে বেড়ায়। এই সকল বালকেরা চুরি কার্য্যে খুব ভাল শিক্ষিত হয় এবং প্রায়ই দলের লোকেরা চুরিটা না করিয়া ইহাদের করিতে পাঠায়, কারণ উহারা মনে করে যে বালক যদি ধরা পড়ে তাহা হইলে জিনিষের মালিক সাধারণতঃ উহাকে মারিয়াই ছাড়িয়া দিবে দলের উপর কোন সন্দেহ পড়িবে না। দোকান হইতে চুরি করিবার সময়ে দলের দুই একজন লোক দোকানদারকে নানা রকমের জিনিষ দেখাইতে বলিয়া ব্যস্ত রাখে এবং অপরে যাহা পায় তাহাই লইয়া সরিয়া পড়ে।

লোকে বলে নিজেদের জেলায় বারওয়ারেরা চাষের ও মজুরের কাৰ্য্য করে এবং কেহ কেহ বেশ সঙ্গতিপন্ন জমিদার, কিন্তু যাহারা বাঙ্গালায় আসে তাহারা সদুপায়ে জীবিকানির্বাহ করিতে কোনরূপ চেষ্টা করে বলিয়া বোধ হয় না এবং বাঙ্গালার পুলিশের নিকট তাহারা পাকা ও নিপুণ চোর বলিয়া পরিচিত।

১৯১৩ সালে এক দল বারওয়ার গোয়ালন্দ ষ্টেশনে একখানি ইণ্ডিয়া জেনেরল ষ্টীমার হইতে ৪,০০০ টাকাসহ একটা বাক্স চুরি করে। যাহারা নিজ হাতে চুরিটা করে তাহারা গোয়ালন্দ স্টেশন হইতে বাহির হইয়া যাইতে পারিবার পূর্বেই চলিয়া যাইতে যাইতে সন্দেহে ধরা পড়ে এবং দলের অন্যান্য সর্বশুদ্ধ ১১ জন লোক নিকটেই গ্রেপ্তার হয়। নিজ হাতে যাহারা চুরি করে তাহার ভিন্ন আর কেহই সাজা পায় না। সম্ভবতঃ উহার কারণ এই যে দুর্ভাগ্য বশতঃ উহাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমায় যথাযথ কার্যপ্রণালী অবলম্বন করা হয় নাই। পুনরায় ১৯১৪ সালের ছয় জন হরদয় জেলার বারওয়ার গোয়ালন্দে ঠিক ঐরূপ চুরি করিতে যাইয়া ধরা পড়ে।

১৯০৮ সালের ঢাকায় বারওয়ার দলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা।

১৯০৮ সালে ঢাকা জেলায় ২৩ জন বারওয়ারের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০১ ধরা অনুসারে মোকদমা রুজু হয়। ঢাকার অতিরিক্ত সেসন জজ ১৯ দিন শুনানীর পর সমস্ত দলকে দোষী সাব্যস্ত করেন ও ভিন্ন ভিন্ন। কালের জন্য কারাদণ্ড দেন। এই দলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা কিরূপে রুজু হইয়াছিল তাহার ইতিহাস নিম্নে দেওয়া গেল :

“১৯০৮ সালে যুক্ত প্রদেশের লক্ষৌ জংসনে একখানি চতি ট্রেনে অনেক গভর্ণমেন্ট করেন্সী নোট ও গহনা চুরি হয়। চোরাই নোটের কতকগুলি পরে লাহোর পেপার করেন্সী অফিসে অর্পিত হইলে দেখা যায় যে উহাদের উপর ঢাকা সহরের ফরিদাবাদ পোষ্ট অফিসের সব-পোষ্ট মাষ্টারের সহি রহিয়াছে। এই সন্ধান ধরিয়া যাইয়া ঢাকা জেলায় কেরাণিগঞ্জ থানার অধীন কান্দাপাড়ায় ১২ জন বারওয়ারের এক দল আবিষ্কৃত হয়। সন্দেহ করিয়া ইহাদিগকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ইহাদের নিকট হইতে কতকগুলি গভর্ণমেন্ট করেন্সী নোট ও গহনা পাওয়া যায়। এই নোট ও গহনা ইহারা ১৯০৮ সালের মৈমনসিং জেলায় সরিষাবাড়ি থানার অধীন জগন্নাথগঞ্জ ষ্টীমার ঘাটে একজন হিন্দু বিধবার নিকট হইতে চুরি করে।”

ঐ ১৯০৮ সালে নারায়ণগঞ্জে ছয়জন, ঢাকা রেল ষ্টেশনে পাঁচজন, জামালপুরে পাঁচজন মৈমনসিং-এ এক জন এবং জগন্নাথগঞ্জ ষ্টীমার ঘাটে দুইজন বারওয়ার ধরা পড়ে। ইহাদের মধ্যে কয়েকজন বিশেষ বিশেষ চুরি বা চোরাই মাল গ্রহণ করার অপরাধে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয় এবং অবশিষ্ট লোকেরা ফৌজদারী মোকদ্দমার কাৰ্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১০৯ ধারা অনুসারে মুচলেকাবদ্ধ ও সচ্চরিত্রতার জন্য জামিন দিতে না পারায় এক বৎসরের জন্য কারাগারে প্রেরিত হয়। এই প্রদেশে এতগুলি বারওয়ারের উপস্থিতি পূৰ্ব্ববঙ্গ ও আসামের ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

তদন্ত করিতে করিতে দেখা যায় যে এই সকল বারওয়ারদের জীবিকা নির্বাহের কোন প্রকাশ্য উপায় না থাকিলেও ইহারা এক বৎসরের মধ্যে ঢাকা সহরের ফরিদাবাদ পোষ্ট অফিস হইতে হরদয় জেলায় বাওয়ান শাখা অফিসে ২৫০০০ টাকা নগদ ও প্রায় ২০০ রেজিষ্টরী করা পার্শেল পাঠাইয়াছে। প্রমাণ হয় যে বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার করা এই সব লোক মাঝে মাঝে ফরিদাবাদে একত্রিত হইত।

দলের সকলেই এক বা পাশাপাশি গ্রামের লোক ও পরস্পর পরস্পরের আত্মীয় বলিয়া জানা যায়।

হরদয় জেলার নজরবন্দীর রেজিষ্টরী বই হইতে জানা যায় যে এই প্রদেশে গ্রেপ্তার করা বারওয়ারেরা একই সময়ে বা একই সময় বরাবর দলে দলে বাড়ি ছাড়িয়াছিল এবং ভারতবর্ষের প্রায় সৰ্ব্ব প্রদেশেই সম্পত্তির বিরুদ্ধে অপরাধ হেতু ইহাদের পূৰ্ব্বে সাজা হইয়াছিল।

দলের ২৬ জনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০১ ধারা অনুসারে মোকদ্দমা রুজু করা হয়। ইহাদের মধ্যে দুই জন অভিযোগপত্র (চার্জসিট) দাখিল করিবার পূৰ্বেই জেলে মারা যায় এবং একজন বিচারের সময়ে মারা যায়। সুতরাং বাস্তবিক পক্ষে ২৩ জনের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চলে।

শোনা যায় যে বারওয়ারদের সাঙ্কেতিক ভাষা যেমন সম্পূর্ণ এমন আর কোন চোর সম্প্রদায়ের নহে। এই ভাষার দ্বারা ইহারা ভিড়ের মধ্যে সাহায্যের জন্য বা চোরাই মাল সরাইয়া ফেলিবার জন্য সঙ্গীদের সহিত কথোপকথন করে। বারওয়ার স্ত্রী লোকেরা অনেক সময়ে পুরুষের সঙ্গে চুরি কার্যে বাহির হয় এবং তীর্থস্থানে বড় বড় ভিড়ের মধ্যে ইহারা মহামূল্য পোষাক পরিয়া মন্দিরে ঢোকে ও যাহারা পূজা করে তাহাদের সম্পত্তি চুরি করে। ব্রাহ্মণীর বেশ ধরিয়া ইহারা ভারতবর্ষীয় সম্ভ্রান্ত স্ত্রী লোকদিগের অন্দরমহলে ঢোকে এবং সুবিধামত যাহা সরাইতে পারে তাহাই চুরি করে।

বাঙ্গালায় পশ্চিম অঞ্চলের অন্য কোন শ্রেণীর চোর অপেক্ষা বারওয়ারদিগকে বেশী দেখিতে পাওয়া যায়। যে সকল রেল ষ্টীমার ষ্টেশনে ভিড় হয় সেই সকল ষ্টেশনে সারা বৎসর ইহাদের জন্য বিশেষ দৃষ্টি রাখা উচিত। এ পর্যন্ত ইহাদিগকে বেশির ভাগ গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জ, জগন্নাথগঞ্জ, চাঁদপুর, দামুকদিয়া, সারাঘাট, সিরাজগঞ্জ, লালগোলাঘাট, রাণাঘাট ও খড়গপুরে দেখা গিয়াছে। বনগাঁও ও খুলনাতে ইহারা গ্রেপ্তার হইয়াছে।

.

মাড়োয়ারী বাউরিয়া।

১৯০৫ সালে হঠাৎ যে স্থানে গির বা গোঁসাইনামধারী এক দল ভ্রমণকারী ভিক্ষুক তাঁবু ফেলিয়া ছিল সেইস্থানে কতকগুলি কৃত্রিম মুদ্রা পাওয়া যায়। এই সূত্রে বঙ্গদেশে খুব বড় এক দল লোকের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় যাহাদের পেশা কৃত্রিম মুদ্রা প্রস্তুত করা। তদন্তে জানা যায় যে ইহারা মাড়োয়ার দেশের বাউরিয়া।

সাত শ্ৰেণী।

১৯০৬ সালের ৩রা আগষ্ট তারিখের “বেঙ্গল পুলিশ গেজেটের” বিশেষ পরিশিষ্টে প্রকাশিত মন্তব্যে সি, ডব্লিউ, সি, প্লাউডেন, সি, আই, ই বলেন :– “এই সকল মাড়োয়ারী বাউরিয়াদের মধ্যে সাতটা শ্ৰেণী আছে, যথা :- ১) কালোট, ২) পাৰ্ম্মার ৩) রত্নোর, ৪) দবী, ৫) আন্দনালী, ৬) সাঙ্গানি, ৭) ধিঙ্গানি।

বাসস্থান।

গত আদমসুমারীর রিপোর্টে ইহাদিগকে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলা হইয়াছে, কিন্তু প্রথম তিন শ্ৰেণী কৃত্রিম মুদ্রা প্রস্তুত করা ভিন্ন প্রায় কিছু করে না। এই সকল লোকের আর এক নাম বাগ্‌রি বা বাগারিয়া। ইহারা সকলে বরোদা বা যোধপুরের অধিবাসী।

চিনিতে পারিবার চিহ্ন

জিজ্ঞাসা করিলে, ইহারা যে বাউরিয়া সে কথা সৰ্ব্বদা লুকাইয়া রাখে, কিন্তু ইহাদিগকে সহজে চিনিতে পারা যায়। কারণ, জন্মাইবার কিছু পরে প্রত্যেক বাউরিয়ার শরীরে, প্রত্যেক স্থলেই না হইলেও সাধারণতঃ নাভির নিকটে, তিন স্থানে গরম লৌহ দিয়া পোড়াইয়া দেওয়া হয়। ইহাদের বিশ্বাস যে এইরূপ করিলে কোন রোগ হয় না। পোড়ানর দাগগুলি খুব বড় বড় সুতরাং কোনও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নাই। এই সকল চিহ্ন ছাড়া, স্ত্রীলোকদিগকে মুখে আরও পাঁচটা উকীর চিহ্নের দ্বারা চিনিতে পারা যায়। এই পাঁচটি চিহ্নের মধ্যে দুইটি দুই চোখের দুই বাহিরের দিকের কোণে, একটি বাম চোখের ভিতরের দিকে, কোণে, একটি বাম গালে ও একটি থুতনিতে থাকে।

মাড়োয়ারী বাউরিয়া যখন কার্যে বাহির হয় তখন ৪/৫ জন লোক একই মিথ্যা নাম গ্রহণ করে। ইহাতে সনাক্ত করা বড় কঠিন হয়।

সামাজিক রীতিনীতি ও পোষাক।

মাড়েয়ায়ারী বাউরিয়ারা প্রায়ই আপনাদিগকে ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচয় দেয় ও উপবীত পড়ে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে ইহারা নীচ জাতীয় এবং গরু ও শূকর ভিন্ন প্রায় সব জন্তুর মাংস ও মদ খায়। সাধারণতঃ ইহাতের বর্ণ কাল, শরীর দোহারা এবং চাচলতি ও পোষাক ময়লা হয়। পুরুষেরা একখানা পুরাতন ধুতি, কম মূল্যের সার্ট বা কোট, মাড়োয়ারী ধরণে বাঁধা পাগড়ি পড়ে। স্ত্রীলোকেরা সাধারণতঃ রংকরা ঘাগরা পরে এবং কখনও কখনও সাড়ি, বডি, রুমাল ও নানারকম গহনা পরে। ইহারা নিজেদের একরকম ভাষা বলে কিন্তু ভ্রমণ করিতে করিতে শীঘ্র হিন্দি ও অন্যান্য ভাষা শিখিয়া লয়। ইহারা সাধারণতঃ ছোট তাঁবু বা অস্থায়ী কুটীর নির্মাণ করিয়া বাস করে, কিন্তু কখনও কখনও বাড়ি ভাড়াও করে।

১৯০৬ সালের ৩রা আগষ্ট তারিখের “পুলিশ গেজেটের” বিশেষ পরিশিষ্টে (যাহা হইতে উপরে কতকটা উদ্ধৃত হইয়াছে) প্লাউডেন সাহেব ইহাদের কার্যপ্রণালীর নিম্নলিখিত বিবরণ দিয়াছেন :–

কার্য্যপ্রণালী।

“দলের এক ব্যক্তি গোঁসাই সাজিয়া ও ব্রাহ্মণ বলিয়া নিজের পরিচয় দিয়া অল্প কিছু জিনিস ক্রয় করে এবং দাম বলিয়া ফরাক্কাবাদের একটা টাকা দেয়। দোকানদার সেই টাকা লইতে অস্বীকার করিলে সে বলে যে সে বিদেশী লোক এবং সেই প্রদেশে কি টাকা চলে তাহা জানিতে চাহে। তৎপরে একটা টাকা তাহাকে দেখিতে দিলে সে উহা পরীক্ষা করে এবং হাতের কায়দায় হাতের চেটোতে লুকান একটি কৃত্রিম মুদ্রা দোকানদারকে ফেরৎ দেয়। যাহাতে কোনরূপ সন্দেহ না হইতে পারে তজ্জন্য যে হাতের মধ্যে কৃত্রিম মুদ্রা লুকান থাকে সেই হাতে সে একটী ছোট লাঠি রাখে।

জাল করিবার প্রণালী।

কৃত্রিম মুদ্রা প্রস্তুত করিতে ইহারা আগুনে পোড়ান সাধারণ মাটির ছাঁচ ব্যবহার করে না। সাধারণ টাকা অপেক্ষা ব্যাসে কিছু বড় দুইটা টিনের আংটা পাইলেই ইহারা কৃত্রিম মুদ্রা প্রস্তুত করিতে পারে। কিছু সরু মাটি সংগ্রহ করিয়া তাহার সহিত জ্বালানি তৈল বা ঘৃত মিশাইয়া ঠাসিয়া লইতে হয়। পরে এই মাটি আংটা দুইটার ভিতর চাপিয়া দিয়া একটা টাকার প্রত্যেক দিকের ছাপ লইতে হয়। তারপর আংটা দুইটাকে একত্রিত করিয়া ছাঁচের উপর হইতে একটু মাটি তুলিয়া ফেলিয়া দিতে হয়। পরে, ঝাল, তামা টিন ও কাঁসা একত্রে গলাইয়া ছাঁচের মধ্যে ঢালিয়া দিতে হয়। ছাঁচ হইতে মুদ্ৰাটী বাহির করিয়া ছুরি দিয়া উহার ধার কাটিয়া নরম অবস্থায় ঐ জাল টাকার ধারের উপর চারিদিকে একটা অকৃত্রিম নূতন টাকার ধার চাপিয়া কিরকিরা করিয়া দিতে হয়। প্রত্যেক দলে সৰ্ব্বদা একজন করিয়া পাকা জালিয়াত থাকে, সেই কাৰ্য্য করে। ছাঁচের মাটি সাধারণতঃ স্ত্রীলোকেরা ও বালকবালিকারা তৈয়ারী করে, প্রত্যেক টাকা প্রস্তত করিবার জন্য একটি করিয়া নতুন ছাঁচ প্রয়োজন।”

১৯০৫ হইতে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত জেলা মৈমনসিং, বরিশাল, খুলনা, যশোহর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, ফরিদপুর ও কলিকাতায় মাড়োয়ারী বাউরিয়াদের সাজা হয়। ১৯০৫ সালের পূর্বে বঙ্গদেশে দুই দলের সন্ধান পাওয়া যায়। এক দলের নারায়ণগঞ্জ হইতে হাবড়া পৰ্য্যন্ত অনুসরণ করিতে করিতে ও অপর দলের রামপুর বোয়ালিয়া হইতে দমদম পর্যন্ত অনুসরণ করিতে করিতে সন্ধান মিলে।

১৯১৪ সালের আগষ্ট মাসে বীরভূমে আর একটা ঘটনা। হয়। ইহাতে সাধারণ প্রণালী অবলম্বন করা হইয়াছিল।

মাড়োয়ারী বাউরিয়াদের গ্রেপ্তার করা হইলে পুলিশ সুপারিন্টেন্টেগণ সরাসরি রাজপুতনায় মাউন্ট আবুতে গবর্ণর জেনেরলের এজেন্টের ক্রিমিনাল ব্রাঞ্চের এসিষ্টান্টকে সংবাদ দিবেন।

দুর্ব্বৃত্ত জাতবিষয়ক আইন অনুসারে ঘোষণা।

আমেদনগর, পূৰ্ব্ব বা পশ্চিম খান্দেশ নাশিক, পুনা, সাতারা ও সোলাপুরে যে সকল মাড়োয়ারী বাউরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় বা বাস করে তাহাদিগকে বোম্বাই গভর্ণমেন্ট বোম্বাইয়ে ১৯১২ সালের ৩ মে তারিখের বোম্বাই গবর্ণমেন্টের ৩৪১৩ নং বিজ্ঞাপন দ্বারা দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ব্যক্ত করেন।

.

ভাঁপ্‌তা।

বাসস্থান।

ভাঁপ্‌তারা বোম্বাই প্রদেশের লোক। ইহারা প্রধানতঃ পুনা, সাতারা সোলাপুর, আমেদনগর, নাসিক, খাদেশ, বেলগাঁও ও বিজাপুর জেলায় বাস করে।

জাতি ও ধর্ম্ম।

ঠিক ভাবে দেখিতে গেলে ইহারা একটা নির্দিষ্ট জাতি নহে, কারণ ইহারা অনেক বর্ণের হিন্দু এবং এমন কি মুসলমান ও পার্শিকেও নিজেদের দলে লয়। তাহার হইলেও ইহাদের কতকগুলি নিয়ম ও আচার ব্যবহার আছে যাহা বাহির হইতে যে কোন লোক দলে আসে তাহাকে ঠিকভাবে অনুসরণ করিতে হয়। ইহারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও কালীপূজা করে। চুরি প্রভৃতি করিতে যাইবার পূর্বে ইহারা কালীর বর প্রার্থনা করিবেই।

কাৰ্য্যস্থান।

মেলা, তীর্থস্থান ও বড় বড় রেল স্টেশন প্রভৃতি ভিড়ের স্থানে তাদের অনুসন্ধান করা উচিত। ইহারা পাকা চোর ও পকেটমার এবং ছদ্মবেশ করিতে বিশেষ নিপুণ।

ইহাদের কাৰ্য্যের বন্দোবস্ত বড় সুন্দর। ইহাতে এক দলের ভিন্ন ভিন্ন লোক পরস্পরের সাহায্যে কাৰ্য্য করিতে পারে অথচ কেহ সন্দেহ করিতে পারে না যে উহারা একদলভুক্ত।

চলতি ট্রেণে চুরি।

সর্ব্বোপরি চলতি ট্রেনে চুরি করিতে ইহারা ওস্তাদ। বাঙ্গলা দেশে ইহারা প্রধানতঃ এই চুরিই করে।

কাৰ্য্যপ্রণালী।

ইহারা আট দশ জন করিয়া এক এক দল বাঁধিয়া বাড়ি ছাড়ে। প্রত্যেক দলে এক বা দুই জন স্ত্রী লোক ও বালকবালিকা থাকে। যে গ্রামে বা শহরে কাৰ্য্য করিতে ইচ্ছা হয় সেই গ্রামে বা শহরে পৌঁছিবার পর দলের সব লোক নির্দিষ্ট সময়ে পুনরায় মিলিবার জন্য একটা স্থান ঠিক করিয়া ছড়াইয়া পড়ে। বড় শহরের মধ্যে ইহারা ধর্ম্মশালায় বাসা লইয়া কিংবা একটা বাড়ি ভাড়া করিয়া মূল আচ্ছা করে। এই আচ্ছা হইতে দলের লোকদিগকে পালা করিয়া কাৰ্য্যে বাহির করা হয়। সাধারণতঃ ইহারা কেবল রাত্রেই ভ্রমণ করে। ইহারা রেল ষ্টেশনে খুব তীক্ষ্ম নজর রাখে এবং যে ব্যক্তির জিনিস চুরি করিতে পারিবে বলিয়া মনে করে তাহার সহিত টিকিট ঘরে যাইয়া সে যে দিকের ও যে শ্রেণীর টিকিট লয় সেই দিকের ও সেই শ্রেণীর টিকিট লইয়া তাহার সহিত এক কামরায় উঠে। ইহারা কথাবার্তায় খুব আমুদে, সুতরাং সহযাত্রীরা ইহাদিগকে আমুদে সঙ্গী বলিয়া গ্রহণ করে। চুরি করিবার ইহাদের একটা সাধারণ উপায় হইতেছে :– ইহাদের মধ্যে একজন অন্য যাত্রীদের জন্য স্থান করিতে ইচ্ছা করিয়া গায়ে একটা শাল বা চাদর ঢাকা দিয়ে কামরার মেজের উপর শুইয়া পড়ে। কামরায় উহার কেহ সঙ্গী থাকিলে সে আরও উহার কাৰ্য ঢাকিবার জন্য সম্মুখের বেঞ্চে পা তুলিয়া দেয়। এই রূপে ঢাকা অবস্থায় ভাঁপতা চোর তাহার মুখ হইতে একখানা ছোট বাঁকান ছুরি বাহির করে এবং তাহার দ্বারা কাম্বিস বা চামড়ার ব্যাগ কাটিয়া ফেলে। কখনও কখনও ইহারা বাটালির দ্বারা তালা দেওয়া ট্রাঙ্ক পর্যন্ত খুলিয়া ফেলে। এত আস্তে ভাঁপতা চোর এই সব কাৰ্য্য করে যে কাহারও মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় না। এই রূপে চুরি করা মাল ইহারা কখনও কখনও পূৰ্ব্বে ঠিক করা স্থানে জানালা দিয়া বাহিরে ফেলিয়া দেয় ও ইহাদের সঙ্গীরা তাহা কুড়াইয়া লয়। ইহাদিগকে এমন কি বড় বড় ট্রাঙ্ক বাহিরে ফেলিয়া দিতে এবং নিজেরা চলতি ট্রেণ হইতে লাফাইয়া পড়িতেও জানা গিয়াছে।

১৯০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের চারিদিকে একদল ভাঁপতা চুরি করিত। ইহাদের কাৰ্য্যের বর্ণনা করিতে গিয়া পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনেরল ইসি রাইলাণ্ড সাহেব বলিয়াছেন যে, এক স্থানে ইহারা একত্রে বাঁধিয়া বেঞ্চের নীচে রাখা তিনটি বাক্সের মাঝের বাক্স হইতে টাকা বাহির করিয়া লইয়াছে। চোর এই বাক্সের এক ধার খুলিয়া ফেলিয়া টাকা বাহির করিয়া লইয়া পুনরায় এই ধার ঠিক স্থানে বসাইয়া দেয়।

আর এক স্থলে ভাঁপতা চোর একটা স্টিল ট্রাঙ্কের ডালার হাতলগুলি এমন নিঃশব্দে কাটিয়াছিল যে কেহই তাহা জানিতে পারে নাই। এই সকল স্থানে, চোরাই মাল অনেক সময়ে তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ির বেঞ্চের নীচের গরাদের মধ্য দিয়া পাশের কামরায় সঙ্গীদিগের নিকট চালাইয়া দেওয়া হয়।

চুরি করিবার পর প্রথমে যেখানে গাড়ি থামে ভাঁপতারা হয় সেখানে নামিয়া কামরা বদলাইয়া ফেলে, না হয় ফেরৎ ট্রেণে ফিরিয়া আসে।

ভাঁপতারা ধরা পড়িলে সঙ্গীরা তাহাকে পলাইতে সাহায্য করে।

ইহারা রেলের সময়-তালিকা (টাইম টেবল) ভাল করিয়া পড়ে এবং ট্রেণ সম্বন্ধে সব বিষয় বেশ ভাল জানে। ভাঁপতা চোর নামিয়া যাইতে সময় পাইবার পূর্বে যদি চুরি ধরা পড়ে তাহা হইলে সে যাত্রীদের উপর সন্দেহ ফেলিতে চেষ্টা করে এবং বলে যে যে সকল যাত্রী পূৰ্বে স্টেশনে নামিয়া গিয়াছে তাহারা চুরি করিয়াছে। চুরি করিতে করিতে কোন ভাঁপতা ধরা পড়িলে তাহার সঙ্গীরা কখনও কখন উপযাচক হইয়া যে পর্যন্ত না ফরিয়াদী একজন পুলিশের লোক বা রেল কর্মচারী ডাকিয়া লইয়া আসে সে পর্যন্ত আসামীকে ধরিয়া রাখিতে চাহে কিংবা ফরিয়াদীর সহিত ঠেলাঠেলি করিয়া আসামীকে পলাইতে সাহায্য করে। ইহারা ১ম, ২য়, ৩য় ও মধ্যম সব শ্রেণীর কামরাতেই চুরি করে এবং প্রায়ই দ্বিতীয় শ্ৰেণীর যাত্রী হইয়া ভ্রমণ করে। মাইকেল কেনেডি সাহেব বলেন, যে একবার একজন ভাঁপতা “সাদার্ণ মার্হট্টা রেলওয়েতে বোম্বাই-এর শ্রীশ্রীমান্ লাট সাহেবের উজ্জ্বলভাবে আলোকিত সেলুন গাড়ি হইতে, ট্রেণ বড় একদল পুলিশের দ্বারা রক্ষিত হইতে থাকিলেও শ্রীশ্রীমানের মূল্যবান্ ভ্রমণের ব্যাগ চুরি করিয়াছিল”।

রেলষ্টেশনে ভাঁপতারা যাহার সম্পত্তি চুরি করিতে ইচ্ছা করে তাহার মন অন্যদিকে নিবিষ্ট করিবার জন্য নানারূপ কৌশল অবলম্বন করে এবং কখনও কখনও তাহারা যে সকল বাণ্ডিল বা ব্যাগ চুরি করে তাহাদের পরিবর্তে ধুলামাটি পোরা বাণ্ডিল বা ব্যাগ রাখিয়া দেয়।

ভাঁপতারা যে সকল যন্ত্র সঙ্গে রাখে।

ভাঁপতা চোরেরা সাধারণতঃ নিম্নলিখিত জিনিষগুলি সঙ্গে রাখে :–

১) পর চাবি;

২) ধারাল ছুরি;

৩) সূচ ও সূতা। যেসকল ব্যাগের মধ্য হইতে ইহারা সম্পত্তি চুরি করে সেই সকল ব্যাগ পুনরায় শেলাই করিবার জন্য সূচ ও সূতা রাখে। শেলাই করিবার প্রয়োজন এই যে শেলাই না করিলে ব্যাগের মধ্যে হইতে অন্য জিনিষ পড়িয়া গেলে লোকের নজর সেই দিকে পড়িতে পারে;

৪) একটা লোহার সরতা। ইহারা দ্বারা ইহারা সাধারণ পিতলের বা লোহার হাতল কাটিয়া ফেলিতে পারে;

৫) একটা লোহার বাটালি, ইহার দ্বারা ইহারা বাক্সের ডালা খুলিয়া ফেলে।

সাধারণতঃ ইহারা টাকা বা গহনা চুরি করে, কিন্তু কখনও কখনও মূল্যবান কাপড়ও চুরি করে।

চোরাই সম্পত্তি বিলি।

ইহারা নগদ টাকা মনি অর্ডার যোগে বাড়ি পাঠায় কিম্বা যে পৰ্য্যন্ত না একটা খুব বড় চুরি করিতে পারে সে পর্যন্ত মাটির নীচে পুতিয়া রাখে এবং একটা বড় চুরি করিতে পারিলে সব টাকা তুলিয়া লইয়া বাড়ি চলিয়া যায়। গহনা চুরি করা মাত্রই গলাইয়া ফেলা হয় এবং বস্ত্রাদি ডাক পার্শেলে বাড়ি পাঠান হয়।

ছদ্মবেশ ও যে সকল জিনিস সঙ্গে লইয়া বাহির হয়।

মান্দ্রাজের পাপুয়া রাও নাইডু মহাশয় তাহার রেলওয়ে চোরের ইতিহাস নামক পুস্তকে বলেন যে, ইহারা সস্তার মনোহারি জিনিস লইয়া বেড়ায়। ইহাদের স্ত্রীলোকেরা এই সকল জিনিস বিক্রয়ের জন্য মেলাইয়া বসে। প্রকাশ্যে ইহাই ইহাদের জীবিকানির্ব্বাহের উপায়।

ভাষা ও সঙ্কেত।

মাতৃভাষা ভিন্ন ইহারা খুব তাড়াতাড়ি হিন্দি বলিতে পারে এবং অনেকে কিছু কিছু ইংরাজিও জানে। ইহাদের নিজস্ব কতকগুলি সঙ্কেত আছে। সাবধান করিয়া দিবার সাঙ্কেতিক শব্দ “টিসকোপো”। মুখে হাত দিয়া কনুই উপর দিকে নাড়িলে বিপদ বুঝায়।

শরীর ও পোষাক।

ভাঁপতাদের চেহারার ও শরীরে কোন বিশেষত্ব নাই। কেহ কেহ গৌরবর্ণ কেহ কেহ কাল। ইহারা প্রায় সব সময়ে ভাল পোষাক পরিয়া থাকে এবং অনেক সময়ে মহারাষ্ট্রীয় ব্যবসাদার ও রেলের ঠিকাদার সাজিয়া বেড়ায়। সুতরাং ইহাদিগকে চিনিয়া রাখা সহজ নহে।

পোষাক ও ছদ্মবেশ।

ইহারা ছদ্মবেশ করিতে বড় পটু, এবং সাধারণত ছোট পাগড়ি, কুর্তা ও আলগা করিয়া বাঁধা ধুতি পরিয়া মহারাষ্ট্রীয়দিগের ন্যায় সাজ করে। কখনও কখনও ইহারা মাড়োয়ারী ও যুক্তপ্রদেশের লোকের ন্যায়ও পোষাক পরে। ইহাদিগকে সাহেবী পোষাক পরিতেও দেখা গিয়াছে। কেহ কেহ স্ত্রীলোকের সম্পত্তি চুরি করিতে হইলে স্ত্রীলোকের পোষাক পরিয়া স্ত্রীলোক সাজে এবং চুরি করিবার পরই পোষাক বদলাইয়া ফেলে।

ইহাদের স্ত্রীলোক।

ভাঁপতা স্ত্রীলোকেরাও পাকা চোর এবং স্ত্রী লোকেদের কামরায় চুরি করে। ইহারা মহারাষ্ট্রীয় স্ত্রীলোকদিগের ন্যায় পোষাক পরে এবং হাত ও মুখে খুব বেশি উল্‌কী পরে।

বাঙ্গালা দেশে ইহাদের আড্ডা।

বাঙ্গালা দেশে ভাঁপতারা রাণাঘাট, কুষ্টিয়া, সৈয়দপুর, ঢাকা, হাওড়া, রাণীগঞ্জ, গোয়ালন্দ ও খড়গপুরের ন্যায় স্থানে এবং ঢাকা ময়মনসিংহ রেলওয়েতে খুব বেশী কাৰ্য্য করিয়াছে। ঢাকা মৈমনসিং রেলওয়েতে ইহারা নারায়ণগঞ্জ হইতে কাৰ্য্য করে।

১৯০৮ হইতে ১৯১০ সাল পর্যন্ত বাঙ্গালা দেশে ইহাদের কাৰ্য্য।

১৯০৮ হইতে ১৯১০ সাল পর্যন্ত একদলে প্রায় ৩০ জন ভাঁতা কলিকাতায় আসে এবং ১১৮ নং হ্যারিসন রোড, ২২নং হোপ লেন, সুরতিবাগান ও ৩নং কাশীরাম মল্লিকের লেনে বাস করে। এই সকল বাসা হইতে ইহারা ইষ্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে, বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের এবং ইষ্টারন বেঙ্গল রেলওয়েসমূহের ট্রেণে চুরি করিত। তদন্তের সময়ে জানা যায় যে এই কয় বৎসরের মধ্যে এই ভাঁপতাদলের ভিন্ন ভিন্ন লোক সবশুদ্ধ ৮০০০ টাকার দুই শতের বেশী মণি অর্ডার বাড়িতে আত্মীয়বর্গের নিকট পাঠায়।

১৯১১ সালে সেতারা জেলায় ৪০১ ধারা অনুসারে দলের বিরুদ্ধে যে মোকদ্দমা রুজু হয়, সেই মোকদ্দমায় কলিকাতার এই দলের লোকদিগের বিচার হয়। ১৭ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয় এবং ২ জনের ৭ বৎসর করিয়া ও অপর ২ জনের ২ বৎসর করিয়া সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

দুর্ব্বৃত্ত জাতি বিষয়ক আইন অনুসারে ঘোষণা।

এই মোকদ্দমার ঠিক পরে পুনায় আর একটা দলে বিরুদ্ধে মোকদ্দমা রুজু হয় এবং তাহাতে ৫১ জন ভাতার সাজা হয়। উছলিয়া বা ঘাটিচর নামেও পরিচিত যে সকল ভাতা আহম্মদনগর, পূর্ব্ব ও পশ্চিম খান্দেশ, নাসিক, পুনা, সেতারা, সোলাপুর, ধারওয়ার, বেলগাঁও . ও বিজাপুরে বাস করে বা ঘরিয়া বেড়ায় তাহাদিগকে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ব্যক্ত করা হইয়াছে (১৯১২ সালের ৩ মে তারিখের ৩৪১৩ নং ও ১৯১৩ সালের ১৯ মে তারিখের ৩৬৯১ নং বোম্বাই গভর্ণমেন্টের বিজ্ঞাপন দেখ)।

.

ভড় জাতি।

উৎপত্তি।

ভড়েরা তাহাদের উৎপত্তিসম্বন্ধে নিজেরা বেশী কিছু বলে না।

ক্রুকের বিশ্বাস ইহারা দ্রাবিড় বংশসম্ভূত এবং পুরাকালে আৰ্য্যদিগের আক্রমণে বিধ্বস্ত কোল, চেরো ও সেরোদিগের সহিত ঘনিষ্ঠসম্বন্ধে আবদ্ধ। তিনি বলেন, “ইহাদের আকৃতি ও দেহের গঠন হইতে এই কথা প্রমাণিত হয়; বিন্ধ্য পর্ব্বতের কৈমুর উপত্যকায় যে সমস্ত অনার্য্য আদিম অধিবাসীরা বাস করে তাহাদের সহিত ইহাদের আকৃতি ও দেহের গঠন বেশ মিলে।”

অধিকাংশ ভড় যুক্ত প্রদেশের অধিবাসী; আজমগড়, বালিয়া, কাশী, ফয়জাবাদ, গাজিপুর, গোরক্ষপুর, জৌনপুর ও মির্জ্জাপুর এই জেলাগুলিতেই তাহাদের বেশি দেখিতে পাওয়া যায়। বিহারের চাম্পারণ, সারণ ও সাহাবাদ জেলায়ও কতক দেখিতে পাওয়া যায়।

পাটের কলে মজুরের কাজে সুখ্যাতি।

কলে ও অন্যান্য কারখানায় মজুরি করিবার জন্য তাহারা দলে দলে বাঙ্গালা দেশে আসিয়া থাকে, কারণ তাহারা মজুরের কাজে ভাল এবং তাহাদিগকে সকলেই মজুর রাখিতে চাহে। কতকগুলি ভড় তাহাদের পরিবার লইয়া বাঙ্গালা দেশে স্থায়িভাবে বাস করিয়াছে। কিন্তু তাহাদের অনেকেই সময়ে সময়ে তাহাদের দেশে যায় এবং তাহাদের বাঙ্গালা দেশের বাস অস্থায়ী বলিয়া মনে করে।

যেখানেই মজুরের দরকার সেখানেই তাহার দলে দলে গিয়া উপস্থিত হয়; বিশেষতঃ কলিকাতা ও ইহার চতুস্পার্শ্ববর্তী জেলায়, বর্ধমানের কয়লার খনিতে ও অন্যান্য স্থানে ঢাকা, মৈমনসিং ও ফরিদপুর জেলায়, রাজসাহীর পার্বত্য প্রদেশের বহু জেলায় এবং সমস্ত রেলওয়েতে ইহাদিগকে দেখিতে পাওয়া যায়।

ইহারা কলের মজুর, কুলি দিন মজুর, গরুর গাড়ির গাড়োয়ান, পাল্কী-বেয়ারা ও চাষার কাজ করে।

সামাজিক ও ধর্ম্মসম্বন্ধীয় আচার।

ভড়েরা আপনাদিগকে হিন্দু বলে এবং হিন্দুদিগের দেবতা কালী ও শিবের পূজা করে। কখনও কখনও ব্রাহ্মণেরা তাহাদের ধর্ম্মকাৰ্য্য সম্পাদন করে। তাহারা খুব মদ খায় এবং তাহাদের দেবতাদের নিকট বলি দিতে হইলেই মদ নিবেদন করিয়া দিতে হয়। তাহাদের মধ্যে বিধবা বিবাহ চলে।

অপরাধকারী ভড়দিগের কেন্দ্র।

যদিও ভড়েরা পরিশ্রমী ও সাধু মজুর হইতে পারে এবং প্রায়ই এই রূপ সাধু ও পরিশ্রমী মজুরের কাজ করিয়া দিন কাটায় তথাপি সাধারণতঃ সমস্ত জাতিটারই অপরাধ করিবার দিকে একটা প্রবৃত্তি আছে; এই প্রবৃত্তি উপযুক্ত পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও প্রভাবের দ্বারা প্রবল হইয়া থাকে। নিম্নলিখিত স্থানসমূহে যে সমস্ত ভড় বাস করে তাহাদের মধ্যে অপরাধ করিবার প্রবৃত্তি সৰ্ব্বদা প্রচ্ছন্নভাবে আছে এ কথা মনে করা যাইতে পারে :–

থানা মিৰ্জামুরাদ, বোরগাঁও, চোলাপুর, চৌবেপুর, শিক্‌রোল (আর্দ্দালি বাজার), রোহানিয়া, ভেলুপুর, ফুলপুর, কাশী জেলার বালুয়া। মির্জ্জাপুর জেলার বুধি থানা, জোনালপুর জেলার রায়পুর ও ফেরাকত থানা।

অন্য ভড়দিগের কাৰ্য্য দেখিয়া তাহাদের প্রকৃতি বুঝা যায়। কিন্তু অপরাধকারী ভড়েরাও বাহিরে সাধুভাবে চাকরি করিয়া তাহাদের অপরাধ প্রবৃত্তি লুকাইয়া রাখিতে চাহে এবং যদিও বাঙ্গালা দেশের শহরে এখন অনেক ভড় দেখিতে পাওয়া যায়, যাহাদের সময়ে সময়ে মজুরি করা অপেক্ষা আর কোন ভাল প্রকাশ্য জীবিকানির্বাহের উপায় দেখা যায় না। তথাপি এমন ভড়ও প্রায় দেখা যায় যাহারা সমস্ত দিন কলে বা খনিতে কাজ করে এবং রাত্রে চুরি ডাকাইতি করিয়া বেড়ায়।

তাহাদের অপমাধ।

বাঙ্গালার ভড়দিগের বদমায়েসি ১৮৭৪ সাল হইতে আরম্ভ হইয়াছে। কিন্তু ১৮৯৭ সালেই পুলিশ প্রথম বুঝিতে পারে যে তাহারা দুর্দান্ত বদমায়েস। উক্ত বৎসরে, যে সকল জেলায় কয়লা উৎপন্ন হয় সেই সকল জেলায়, ডাকাইতি খুব বাড়িয়া উঠে; এই সকল ডাকাইতির বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় এই ছিল যে, ডাকাইতেরা গ্রামবাসীদিগকে ভয় দেখাইবার জন্য প্রায়ই ডাইনামাইট ব্যবহার করিত। কৈলেশ্বর সিং নামক একজনকে সন্দেহ করিয়া ধরা হইলে সে স্বীকার করে যে, সে অন্যান্য ভড়দিগের সহিত মিলিয়া ১৮৯৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হইতে ১৮৯৭ সালের ৫ই জুন পর্যন্ত বীরভূম বর্ধমান, হুগলী ও মানভূম জেলায় ৩১টি ডাকাইতিতে যোগ দিয়াছে। তাহার স্বীকারোক্তিতে সে তাহার সহকারী ৩৪ জন ভড়ের নাম করে। এই স্বীকারোক্তির পর যে দলবদ্ধ হইয়া ডাকাইতি করা মোকদ্দমার অনুসন্ধান চলে তাহার ফলে অন্য ভড় ডাকাইতদলের আবিষ্কার হয়। ইহারা অন্য জায়গায়, বিশেষতঃ ২৪-পরগণায় ডাকাইতি করিত। ১৮৯৭ সালের অনুসন্ধানের ফলে দশ জন ভড় দোষী সাব্যস্ত হয়। তাহাদের মধ্যে ৭ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বাসের আজ্ঞা হয়। ১৮৯৮ সালের নবেম্বর মাসে ২৪-পরগণায় আবার ভড়েরা বিষম ডাকাইতি করিতে থাকে। অনুসন্ধানের ফলে কলিকাতা ও তাহার চতুর্পার্শ্ববর্তী স্থানে অনেক লোককে ধৃত করা হয় এবং ৬ জন লোক ইহাদের মধ্যে সুন্দর ভড় ভাগলু ভড়, রামদেও ভড় ও ইন্দ্র ভড় এই চারি জন ভড় ছিল–স্বীকার করিয়াছিল যে তাহারা ১৮৯৮ সালের নবেম্বর হইতে ১৯০৩ সালের জুলাই পর্যন্ত বর্ধমান, ঢাকা, ফরিদপুর, হুগলী, হাওড়া ও মেদিনীপুর, মৈমনসিং, নদীয় ও ফরাসী চন্দননগরে ৪৮টি ডাকাইতি, দুইবার ডাকাইতি করিবার চেষ্টা, একবার দস্যুতা এবং একবার সিঁধ দিয়া চুরি করিয়াছে। এই স্বীকারোক্তিতে ৪৯ জন ভড়কে দোষী করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ৪৭টি মোকদ্দমায় ভড়েরা দোষী সাব্যস্ত হয় অর্থাৎ ৮ ডাকাইতি, ১টি দস্যু, ১১টি সিঁধচুরি, ২১টি চুরি ও ৬টি সম্পত্তির বিরুদ্ধে অন্য অপরাধ যাহাতে হাজির জামিন লওয়া হয় না, এবং ৮টি মোকদ্দমায় ১৭ জন ভড়ের নিকট হইতেফৌজদারী মোকদ্দমার কাৰ্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১০৯ ও ১১০ ধারা অনুসারে মুচলেকা লওয়া হয়। উপরোক্ত স্বীকারোক্তিসমূহের বলে ১৯০৪ সালে এক মোকদ্দমা আরম্ভ করা হয়। এই মোকদ্দমায় ২১ জন ভড় দোষী সাব্যস্ত হয়, তিন জনের যাবজ্জীবন ও অবশিষ্টগণের দশ বৎসরের জন্য দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। ইহার পর কিছুকাল ভড়েরা আর ডাকাইতি করে নাই, কিন্তু ১৯০৫-০৬ সালে ১২ জন ভড় সিঁধচুরি ও চুরি মোকদ্দমায় দোষী সাব্যস্ত হয় এবং ৯ জনের নিকট হইতে ফৌজদারী মোকদ্দমার কাৰ্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১১০ ধারা অনুসারে মুচলেকা লওয়া হয়। ১৯০৭ সালের প্রারম্ভে হুগলী ও ২৪ পরগণায় ভড়েরা আবার সম্পত্তির বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ করিতে আরম্ভ করে, এবং ২৪-পরগণায় তিন দল ভড়ের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হইয়া অপরাধ করার জন্য মোকদ্দমা করা হয়। ছাত্তার ভড় গ্যাং কেশ (১৯০৭ নামে প্রসিদ্ধ মোকদ্দমায় ছাত্তার ভড়, রঘুবীর ভড় ও হরনন্দন ভড় নামে তিনজন ভড় স্বীকার করে যে তাহারা তিনটি ডাকাইতি চারিটি দস্যুতা, সাতটি সিধ এবং একটি চুরি করিয়াছে। ইহাতে তাহারা ও অপর ১৪ জন ভড় সংশ্লিষ্ট ছিল। এই মোকদ্দমায় ৬ জন ভড় দোষী সাব্যস্ত হয়। ১৯০৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি তারিখে পাঁচ জনের সাত বৎসর এবং একজনের পাঁচ বৎসর সপরিশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। দ্বিতীয় মোকদ্দমায় গভর্ণমেন্টের সাক্ষী সহদেব ভড় স্বীকার করে যে, সে একটি ডাকাইতি, আটটি সিঁধ এবং পাঁচটি চুরি করে এবং সে নিজেকে ও অপর ২৬ জন ভড়কে দোষী করে। এই মোকদ্দমায় সাত জন ভড়কে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১৯০৮ সালের ১৯শে মার্চ তারিখে তাহাদের প্রত্যেকের দুই বৎসর সশ্রম কারাবাস দণ্ডের আদেশ হয়। তৃতীয় মোকদ্দমায় গভর্ণমেন্টের সাক্ষী বুলাকি কুৰ্ম্ম স্বীকার করে যে, সে ২০টি সিঁধচুরি করিয়াছে এবং ৭ জন ভড়কে তাহার সহকারী বলিয়া দোষী করে। এই মোকদ্দমায় ১৯০৮ সালের ৪ নবেম্বর তারিখে ৫ জন ভড় দোষী সাব্যস্ত হয় এবং প্রত্যেকের দুই বৎসর সশ্রম কারাবাস দণ্ডের আদেশ হয়। উপরি উক্ত মোকদ্দমাসমূহে দণ্ডিত হইলেও ভড়েরা বাঙ্গালা দেশে অপরাধ করিতে যে বিরত হয় নাই, তাহা নিম্নলিখিত ঘটনা হইতে বুঝিতে পারা যায়। ঐ সকল মোকদ্দমা শেষ হইবার পর ৭ মাসের মধ্যে ৮ জন ভড় যাহাতে হাজির জামিন লওয়া যায় না এমন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয় এবং ৪ জন ফৌজদারী মোকদ্দমার কার্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের বিবরণসম্বন্ধীয় ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত হয়। ১৯০৯ সালের মধ্যভাগে হুগলী, হাওড়া ও ২৪-পরগণা জেলায় আবার ডাকাইতির বিষম প্রাদুর্ভাব হয়। কতকগুলি ভড়কে ধৃত করা হয়। তাহাদের মধ্যে ৪ জন স্বীকার করে যে তাহারা ১৯০৯ সালের ১২ই জুলাই হইতে ১৯১০ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হুগলী, হাওড়া, ২৪-পরগণা, যশোহর ও মোদিনীপুর জেলার মধ্যে ১০টি ডাকাইতি ও ৬টি সিঁধচুরি করিয়াছে। এই স্বীকারোক্তিতে ৩২ জন ভড়কে অপরাধে জড়ান হয়। আবার একটি মোকদ্দমা হয়; সেই মোকদ্দমায় ১৯১০ সালের ডিসেম্বর মাসে ৪ জন ভড় দোষী সাব্যস্ত হয়। ইহাদের ৩ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়।

১৯১০ সালের ডিসেম্বর মাস হইতে ১৯১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৩০টি মোকাদ্দমায় ৩২ জন ভড় দোষী সাবস্ত্য হয়, এবং ১২টি মোকাদ্দমায় বড়দিগকে অপরাধী বলিয়া সন্দেহ করা হয়।

কাৰ্য্যপ্রণালী।

ভড়দিগের কার্যপ্রণালী একরূপ নহে, তাহা অবস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হইয়া থাকে। তাহারা ডাকাইতি হইতে আরম্ভ করিয়া দোকান হইতে চুরি ও পকেট মারা পর্যন্ত সকল রকম চুরিই করিয়া থাকে। রাত্রিতে ঘরে ঢুকিয়া চুরি করিতে গিয়া তাহারা কখনও কখনও সিঁধকাটির সাহায্য গৃহে প্রবেশ করে। ডাকাইতি করিতে যাইলে, উঠান থাকিলে একজন প্রাচীর বহিয়া উঠিয়া ভিতরে প্রবেশ করে এবং সদর দরজা খুলিয়া দিয়া তাহার সঙ্গীদিগকে প্রবেশ করিতে দেয়। সিঁধচুরি ও অন্য চুরি তাহারা একা একা বা দল বাঁধিয়া করিয়া থাকে।

চুরি করিবার জন্য যাত্রা করিবার সময় তাহারা কখনও কখন মাপকাঠি ও ঝুড়ি লইয়া কন্ট্রাক্টার ও কুলি সাজিয়া বাহির হয়। ডাকাইতি করিতে গিয়া তাহার দরজা ও সিন্দুক ভাঙ্গিয়া খুলিবার জন্য প্রায়ই কুড়ালি ব্যবহার করিয়া থাকে।

ইতিপূর্বে বলা হইয়াছে যে, ১৮৯৬-৯৭ সালে যে সকল জেলায় কয়লার খনি আছে সেই সকল জেলায় ডাকাইতি করিবার সময় তাহারা গ্রামবাসীকে ভয় দেখাইবার জন্য ডাইনামাইট ব্যবহার করিত।

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক বা আইনানুসারে ঘোষণা।

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক ১৯১১ সালের আইনানুসারে যুক্ত প্রদেশের গভর্ণমেন্ট নিম্নলিখিত ভড়দিগকে দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন :

আলিগড়, কাশী, জৌনপুর ও আজমগড়ের ভড় (১৯১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখের ৩৯০নং-৮, ৩২৭, ৩২৯, ৩৩৩-৮ বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য)।

যে সকল ভড় বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সিতে বাস করে এবং যাহাতে হাজির জামিন লওয়া যায় না এমন যে বিশেষ মোকদ্দমায় দোষী সাব্যস্ত হয় বা ফৌজদারী মোকদ্দমার কার্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১১৮ ধারা অনুসারে সদাচরণের জন্য জামিন দিতে আদিষ্ট হয়, সেই সকল ভড়কে, বঙ্গীয় গভর্ণমেন্ট দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন (১৯১৫ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখের ৮পি নং গভর্ণমেন্ট বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য) ১৯১৪ সালে ইহাদের সংখ্যা বাঙ্গালা দেশের মোট ২০৬৪ জন ভড়ের মধ্যে ২৭১ জন ছিল। ইহাদের সকলেই পুরুষ। স্ত্রী লোকেরা অপরাধে যোগ দেয় বলিয়া জানা যায় নাই।

বাঙ্গালার কায্যক্ষেত্র।

ভড়দিগের অপরাধ প্রমাণিত হইবার রেকর্ড বা বিবরণী হইতে জানা যায় যে তাহারা নিম্নলিখিত জেলাসমূহে অপরাধ করিয়াছে :-২৪ পরগণা, কলিকাতা, হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর, ঢাকা, বর্ধমান, দিনাজপুর, মালদহ, রাজপুর, রাজসাহী, নদীয়া, বগুড়া ও মৈমনসিং।

.

ছত্রিশগড় চামার।

কিরূপ অপরাধ করিতে আসক্ত।

১৯১৩ সালে নৈহাটীর নিকট একটি ডাকাইতির অনুসন্ধানের সময় বিলাসপুর ও মধ্য প্রদেশের ছত্রিশগড় বিভাগের অন্যান্য স্থান হইতে বিস্তর চামার আসিয়া বাঙ্গালা দেশে বাস করিতেছে, এই বিষয়ে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। মধ্য প্রদেশে যে সমস্ত অনুসন্ধান করা হয় তাহা হইতে জানা যায় যে, তাহাদের নিজেদের দেশের এই চামারদিগের অপরাধী বলিয়া বিশেষ বদনাম আছে; তাহারা পাবলিক ওয়ার্কস বিভাগের গৃহাদি নির্মাণে, রেলওয়ে নির্মাণে, ইটের খোলায়, কলে ও ডাক মজুরের কাজ খুঁজিতে, কিছুকাল ধরিয়া দলে দলে বাঙ্গালা দেশে আসিতেছে। কালীমাটী মেদিনীপুর, খড়গপুর, হাওড়া, নদীয়া, যশোহর ও খুলনায় তাহাদিগকে কাজ করিতে দেখা গিয়াছে। ১৯১৪ সালে ১০ই জুন তারিখে মধ্য প্রদেশের ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স গেজেটের পরিশিষ্টে প্রকাশিত মন্তব্যে বলা হইয়াছে যে, সিধ দিয়া চুরি করাই ছত্রিশগড় চামারদিগের প্রধান অপরাধ, কিন্তু তাহারা সময়ে সময়ে চুরি, দস্যুতা ও ডাকাইতিও করিয়া থাকে এবং গবাদি পশু চুরি করিতে বিশেষ দক্ষ। তাহাদের কোন বিশেষ কাৰ্য্যপ্রণালী নাই, তবে তাহারা ঘর ভাঙ্গিয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করিবার জন্য সাধারণতঃ এক প্রকার গোলাকার যন্ত্র ব্যবহার করে তাহার অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ ও চেপ্টা।

মধ্য প্রদেশের গেজেটে যিনি উক্ত মন্তব্য সকল লিখিয়াছেন তিনি বলেন, “সাধারণতঃ যে দিন বাজার বসে সেই দিনেই তাহারা চুরি করে, এবং তাহারা পূৰ্ব্ব হইতেই চোরাই মাল বিক্রয় করিবার বন্দোবস্ত করিয়া থাকে।”

মাল বিক্রয়ের ব্যবস্থা।

তাহারা সাধারণতঃ চোরাই মাল স্থানীয় সোণারদিগকে ও কখনও কখনও বেনে ও কাঁসারীদিগকেও বিক্রয় করিয়া থাকে। চুরি করিতে যাইবার পূর্বে দলের কে কি কাৰ্য্য করিবে তাহা তাহারা ঠিক করিয়া লয়-একজন ঘর ভাঙ্গিয়া প্রবেশের পথ করে, অপর ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করে, বাকি লোকেরা সাধারণতঃ বাহিরে থাকিয়া চৌকি দেয়। তাহাদের সঙ্গে খড়ের প্রস্তুত এক প্রকার জামা থাকে; এই জামার সাহায্যে তাহারা বেশ কৌশলের সঙ্গে সহিত আত্মগোপন করে। বিপসূচক শব্দ শুনিলে, তাহারা পূৰ্ব্বাপেক্ষা নিকটবর্তী খড়ের গাদার নিকট দৌড়াইয়া যায় এবং আশঙ্কা দূর না হওয়া পর্যন্ত এই আবরণে শরীর ঢাকিয়া রাখে। গরু প্রভৃতি পশু চুরি করিবার সময়ও তাহারা প্রায় এই আবরণ ব্যবহার করিয়া থাকে। ইহা দ্বারা আবৃত হইয়া তাহারা পশুর দলের নিকট মাঠে শুইয়া থাকে, এবং ক্রমে ক্রমে সরিয়া গিয়া ধীরে ধীরে জদিগকে দূরে এমন নিরাপদ স্থানে লইয়া যায় যেখান হইতে তাহাদিগকে তাড়াইয় লইয়া যাইতে পারা যায়।

ঘুংচিসূই’ দ্বারা গবাদি পশুকে বিষ খাওয়ান।

গবাদি পশুকে বিষ খাওয়ানর জন্য নিজেদের দেশে চামারদিগের খুব বদনাম আছে। এই কাৰ্য্যে তাহারা প্রায়ই সূই ব্যবহার করিয়া থাকে; বিহারে এই সূইকে সূতারি বলে; ইহা একপ্রকার বিষাক্ত গজাল, প্রধানতঃ ঘুংচির বীচি হইতে প্রস্তুত; এই বীচিকে বিহারে কর্জনী বলে। এই গজালগুলি রৌদ্রে শুকাইয়া লইলে খুব শক্ত হয় এবং তাহাদিগকে বাঁশের বাঁটে লাগাইয়া দেওয়া হয়; ইহার সাহায্যে তাহাদিগকে পশুদিগের গায়ে প্রবেশ করাইয়া দেওয়া হয়; ইহার ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইহাদের মৃত্যু হয়। [এই রূপ সময়ে সময়ে মানুষের দেহেও বিষ প্রয়োগ করা হইয়া থাকে]

বিষ প্রয়োগ করিবার আরও স্থূল প্রণালী।

চামারেরা ইহাপেক্ষা স্থূল প্রণালী অবলম্বন করিয়াও গবাদি পশুর শরীরে বিষ প্রবেশ করাইয়া থাকে, অর্থাৎ তাহারা যে পশুকে মারিতে ইচ্ছা করে তাহার মলদ্বারা বিষ প্রবেশ করাইয়া দেয়। তাহাদের নিজের দেশে বিষ প্রয়োগ দ্বারা পশু বধ করায় তাহাদের লাভ আছে, গ্রামে যত গবাদি জন্তু মরে তাহাদের চামড়া চামারদেরই প্রাপ্য; সুতরাং বাঙ্গালা দেশে বিষ খাওয়াইয়া তাহারা যে প্রাণিহত্যা করিবে ইহা তত সম্ভব নহে।

মধ্য প্রদেশের মন্তব্যে উক্ত হইয়াছে যে, ইহাদের মধ্যে শতকরা অপরাধীর সংখ্যা অনেক বেশি এবং গত কয় বৎসরে ইহাদের মধ্যে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকেই চলিয়াছে। লেখক বলেন, “তাহাদের বিবেকবুদ্ধি বা সংযম আদৌ নাই। তাহাদের মধ্যে অতি অল্প লোকেরই তাহাদের গরুর প্রতি যথার্থ ভক্তি আছে। মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা, গবাদি পশু মারিয়া ফেলা এবং লোকের ঘরে আগুন দেওয়া তাহাদের নিত্য কাৰ্য। যাহারা বেশি সাহসী তাহারা সিঁধ দেয়, ডাকাতি করে ও বিষম মার পিট করে।”

চামারেরা তাহাদের সাহসের জন্য বিখ্যাত। তাহারা দেখিতে সুন্দর, লম্বা ও বলিষ্ঠ। প্রয়োজন হইলে মারামারি করিতেও প্রস্তুত।

তাহারা তাহাদের অবস্থার উন্নতি করিতেছে শুনা যায়; এবং আজকাল স্বজাতীয়দিগের অপেক্ষা অন্য জাতীয় লোকের সহিত ভ্রাতৃভাবে বেশি মিলিতে পারে। মধ্যে প্রদেশের কর্তৃপক্ষগণ মনে করেন যে, চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি দুষ্কৰ্ম্ম করিবার জন্য তাহারা সম্ভবতঃ বাঙ্গালা দেশের অন্য জাতিদিগের সহিত মিলিত হইবে, কারণ অন্য জাতীয় সুদক্ষ লোকের নেতৃত্ব স্বীকার করিতে তাহারা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।

তাহারা যে থানার এলাকায় বাস করে সেই থানা ছাড়িয়া অন্য থানার এলাকায় চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করিতে পছন্দ করে, কারণ তাহাদের বিশ্বাস সব-ইনস্পেক্টরেরা সাধারণতঃ তাহাদের এলাকার বাহিরে সংঘটিত চুরি ডাকাইতি ধরিতে বিশেষ উৎসুক নহেন। এই চামারদের অনেককেই পূৰ্ব্ব বঙ্গ ষ্টেট রেলওয়ের ব্যালাষ্ট ও মাটীর কাজে নিযুক্ত থাকিতে দেখা যায়, এবং রেলওয়ে লাইনের নিকটে অনেক সিঁধচুরি এবং অন্তত একটি ডাকাইতির জন্য দায়ী এরূপ মনে হয়।

.

ছাপ্‌পড় বাঁধ।

বাসস্থান ও দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে ঘোষণা।

ছাপ্‌পড় বাঁধেরা জাল টাকা প্রস্তুত করে ও বাজারে চালায়; তাহাদের অনেকেই বোম্বাই প্রদেশের বিজাপুর জেলায় বাস করে; সেখানে ১৯১২ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে তাহাদিগকে দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে।

ভাষা ও পোষাক পরিচ্ছদ।

ছাপ্‌পড় বাঁধেরা ভাতরবর্ষের সকল স্থানেই গমন করে এবং অনেক দিন ধরিয়া বাড়ি ছাড়া হইয়া থাকে। তাহারা মুসলমান এবং তাহাদের নামের শেষে প্রায়ই “শা” এই উপাধি থাকে। তাহারা সচরাচর মুসলমান ভিখারীর বেশে ভ্রমণ করে, কিন্তু ক্বচিৎ হিন্দু বলিয়াও চলিয়া যাইতে পারে এবং হিন্দু বলিয়া চলিয়াও থাকে। মারাট্টী তাহাদের মাতৃভাষা ইহার সহিত তাহাদের এক অপর ভাষা মিশ্রিত থাকে; তাহারা যে যে স্থানে ভ্রমণ করে সেই সেই স্থানের ভাষাও কিছু কিছু শীঘ্র শিখিয়া ফিলিতে পারে। তাহাদের দেশে তাহারা জমি চষে এবং তাহাদের স্ত্রীলোকেরা মাদুরি ও লেপ তৈয়ার করে; কিন্তু দেশ পৰ্যটনে ভিক্ষাই তাহাদের প্রকাশ্য জীবিকোপায়; দেশ পর্যটনে স্ত্রীলোকেরা পুরুষদিগের সঙ্গে যায় না।

টাকা জাল করা ও বাজারে চালান।

ঢালাই করিয়া জাল টাকা ও সিকি দুয়ানি প্রভৃতি ক্ষুদ্র রৌপ্য মুদ্রা প্রস্তুত করাই ছাপ্‌পড় বাঁধদিগের আয়ের প্রধান উপায়। বোম্বাই প্রদেশের দুর্ব্বৃত্ত জাতিদিগের উপর মন্তব্যে মাইকেল কেনেডি সাহেব বলেন যে, তাহারা সচরাচর তিন জন হইতে দশ জন পৰ্য্যন্ত লোক মিলিয়া দল বাঁধিয়া যাত্রা করে, তবে একটা দরে ৩০ জন লোকও দেখা গিয়াছে। প্রত্যেক দল সচরাচর এক এক জন বৃদ্ধ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন থাকে; ইহাকে “খাগদা” বলিয়া ডাকা হয়, ইহার আদেশ বিনা বাক্যব্যয়ে প্রতিপালন করা হয় এবং অন্য সকলে প্রত্যেকে অপরের যে অংশ পায়, এই ব্যক্তির অংশ তাহা হইতে অধিক।

জাল করিবার প্রণালী।

ছাপ্‌পড় বাঁধেরা ভ্রমণ করিতে করিতেই জাল টাকা প্রস্তুত করে, এবং এ জন্য তাহাদের কল বা দ্রব্যাদির কোন আড়ম্বর নাই; এক প্রকার মিহি আটাল কাদা হইতে তাহাদের ছাঁচ প্রস্তুত হয়। যে দেশে এ রূপ কাদা পাওয়া না যায়, ছাপড় বাঁধ যদি সেই দেশে ভ্রমণ করিতে ইচ্ছা করে তাহা হইলে দেশ হইতে বহির্গত হইবার পূর্বে সেইরূপ কাদা সংগ্রহ করিয়া লয়। এই কাদার একটা তাল লইয়া থালার ন্যায় দুইটি গোলাকার বস্তু করা হয়; একটি খাঁটি টাকায় সামান্য তেল মাখাইয়া সেই দুইটি থালার মধ্যে রাখা হয় এবং টাকার চতুর্দিকের কাদার উপর চাপ দেওয়া হয়। তারপর থালা দুইটিকে টাকার ধারের চারিদিকে আবার পৃথক করা হয়; এবং গলিত ধাতু ঢালিয়া দিবার জন্য একটি ক্ষুদ্র প্রণালী কাটা হইলে পর, টাকাটিকে সরাইয়া লওয়া হয়; থালা দুইটিকে শুকাইয়া শক্ত করা হয়, তখন ছাঁচ ব্যবহারের উপযোগী হয়। অনেক ছাঁচ প্রস্তুত করিয়া খাড়া করিয়া রাখা হয় এবং ধাতু উহার মধ্যে ঢালিয়া দেওয়া হয়। কেনেডি সাহেব বলেন, এই ধাতু তামা বা কাসা ও টিনের মিশ্রণে প্রস্তুত হয়। ঐ মুদ্রা পরে হাতে ছাঁটা হয়, ধারে দাগ করা হয় এবং পালিশ করা হয়।

তাহাদের মুদ্রা।

ছাপ্‌পড় বাঁধদের মুদ্রা খাঁটি মুদ্রার অতি নিকৃষ্ট অনুকরণ। বোধ হয়, এই জন্যই তাহারা সম্ভবপর হইলে, যে সব বৃদ্ধা স্ত্রী লোকের চোখে দোষ আছে তাহাদিগকেই ঠকাইতে চেষ্টা করে। টাকা চালাইবার যে সমস্ত উপায় তাহারা পসন্দ করে তন্মধ্যে নিম্নলিখিত উপায় একটি :

টাকা চালাইবার প্রণালী

কোন না কোন ছলে যাহাতে পরের খাঁটি টাকা তাহাদের হাতে আসে তাহারা তাহা করে, এবং হাতের কৌশলে খাঁটি টাকা সরাইয়া তাহার স্থানে নিজেদের জাল টাকা রাখে। তাহারা এই কাৰ্য্য করিতে প্রায়ই এক টাকার বদলে সতর আনার পয়সা দিতে চায়, এবং ছল করিয়া বলে যে তাহাদের এত পয়সা আছে যে তাহা বহিতে তাহাদের অসুবিধা হইতেছে। টাকা পাইলে পর ছাপ্‌পড় বাঁধ তাহা পরীক্ষা করে এবং বলে যে এরূপ টাকা তাহার দেশে চলে না; এই বলিয়া পয়সা ফেরত চাহে এ খাঁটি টাকার পরিবর্তে জাল টাকা ফিরাইয়া দেয়।

দেহের মধ্যে টাকা লুকাইয়া রাখা।

বাঙ্গালা দেশে দেখা গিয়াছে যে, ছাপড় বাঁধেরা জাল টাকা তাহাদের শরীরের গোপনীয় স্থানের নীচে লুকাইয়া রাখে। কেনেডি সাহেব বলেন যে, তাহারা ল্যাঙ্গট পরে, ইহার সম্মুখ ভাগে কাপড়ে কৌশল করিয়া একটা পকেট রাখা হয়। কোন লোকের দেহ অনুসন্ধান করিবার সময় সে পিছন দিক হইতে তাহার ল্যাঙ্গট খুলিয়া সম্মুখে ঝুলাইয়া রাখে। এই জন্য লোকে পকেট দেখিতে পায় না। এই জন্য কেনেডি সাহেব উপদেশ দেয় যে, কোন ছাপপড় বাধকে অনুসন্ধান করিবার সময় তাহার ল্যাঙ্গট একেবারে খুলিয়া লইবে এবং খুব সাবধানে তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিবে। কেনেডি সাহেব বলেন যে, এক জন ছাপ্‌পড় বাঁধকে তাহার মলদ্বারে একটি গর্তে সাত টাকা লুকাইয়া রাখিতে দেখা গিয়াছে। তিনি সেই জন্য পরামর্শ দেন যে, পুলিশের অনুসন্ধান শেষ হইবার পূৰ্ব্বে ডাক্তারি পরীক্ষা করা উচিত। ছাপ্‌পড় বাঁধেরা জাল টাকা মুখের মধ্যেও লুকাইয়া রাখে এবং ধরা পরিবার সময় কখনও কখনও তাহা গিলিয়া। ফেলে। ছাপ্‌পড় বাঁধেরা স্বচ্ছন্দে ডাকঘরের সাহায্যে তাহাদের উপায়ের টাকা দেশে পাঠাইয়া দেয়।

ছাপপড় বাঁধেরা যে পথে যায় তাহাদের পশ্চাৎ আগমণকারী সঙ্গীদিগকে সেই পথের নিদর্শন দিবার জন্য তাহারা যে প্রণালী অবলম্বন করে, কেনেডি সাহেব তাহার নিম্নলিখিত বিবরণ দিয়াছেন :–

তাহাদের সঙ্গীদিগকে কিরূপ পথের নির্দেশ করে।

“ছাপ্‌পড় বাঁধেরা তাহাদের পশ্চাদ্বর্তী স্বজাতীয়দিগকে এইরূপ তাহাদের অবলম্বিত পথের সংবাদ দিয়া থাকে; প্রত্যেক চৌ মাথায় তাহারা প্রায় ১ ফুট লম্বা, ৬ ইঞ্চি চওড়া, এবং ৬ ইঞ্চি উচ্চ কাদার বা মাটির ঢিবি প্রস্তুত করে এবং তাহারা যে দিকে গিয়াছে সেই দিকের নিদর্শনস্বরূপ এই ঢিবির সম্মুখে একটি তীর আঁকিয়া রাখে। পাছে এই রূপ কোন ঢিবি নষ্ট হইয়া যায় এই জন্য তাহারা প্রায় একশত গজ অন্তর অন্তর তিনটি এই রূপ ঢিপি প্রস্তুত করে। কিংবা রাস্তার ধারে মাটির উপর পা দিয়া মাটি জড় করিয়া ঢিবি করিয়া রাখে। এই রূপে যে চাওড়া বাগ ক্রমশ সরু হইয়া ঢিবির আকার ধারণ করে, তাহা হইতে জানা যায় কোন পথে গেলে ছাপ্‌পড় বাঁধদিগকে পাওয়া যাইবে। কখনও কখনও এই সব চিহ্নের পরিবর্তে, তাহারা যে পথ দিয়া যায় সেই পথের পার্শ্বে ধুলার উপর এমন একটি রেখা টানে যাহার এক দিক বাঁকা; অন্য পথ সকল ঢেরা চিহ্নদ্বারা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। রেখার সোজা দিকের দ্বারা অবলম্বিত পথের নির্দেশ করা হয়। আবার কোন পথের ধারে পাথরের নীচে কতকগুলি পল্পব রাখা হয়, এবং ভাঙ্গা ডাটাগুলি বাঁকা এমন দুইটি রেখা টানিয়া দল হইতে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদিগকে জানান হয় তাহারা কোন স্থানে খুঁজিলে তাহাদের সঙ্গীদিগকে পাইবে।

.

চৈন চামার।

চৈন মাল্লাদিগের সহিত চৈন চামারদিগের অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য আছে।

চৈন’ শব্দ।

ছোট ছোট চুরির কাৰ্য্যে আসক্ত যে কোন দলের প্রতি চৈন শব্দ প্রযুক্ত হইয়া থাকে এবং আমারা চৈন পাশি, চৈন দোসাদ ও চৈন মাল্লা নামও শুনিয়া থাকি। যুক্ত প্রদেশের, প্রধানতঃ গাজিপুর ও জৌনপুরের চৈন চামারেরা একটি স্বতন্ত্র বদমায়েস দল বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে।

বদমায়েসির বিবরণী।

১৯০৪ ও ১৯০৭ সালের মধ্যে দেখা গিয়াছিল যে গাজিপুর ও বালিয়ার চৈন চামারেরা, পাটনার চৈন মাল্লা ও পালোয়ার দোসাদদিগের সহিত অপরাধজনক কাজ করিয়াছে। এই তিন জাতিই ছোট ছোট চুরির কাজেই লিপ্ত ছিল। ১৯০৯ সালে যুক্ত প্রদেশের পুলিশ, গাজিপুর জেলার চৈন চামারদিগের বিরুদ্ধে এক মোকদ্দমা করে, এই মোকদ্দমার ফলে ৩০ জন অপরাধী সাব্যস্ত হয়।

বাঙ্গালা দেশের কাৰ্য্য।

চৈন চামারেরা হাওড়া ও ২৪-পরগণা ও মুর্শিদাবাদে, সাধারণতঃ ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩৭৯ ও ৪১১ ধারা অনুসারে অথবা অসদুপায়ে জীবিকানির্ব্বাহসম্বন্ধীয় ধারা অনুসারে, অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছে। চৈন চামারেরা তাহাদের চুরির কাজে সহায়তা করিবার জন্য বালকদের সাহায্য লয়। চৈন মাল্লারাও বালকদের সাহায্য লইয়া থাকে, কিন্তু এতটা নয়। চৈন চামারেরা চৈন মাল্লাদের মত সংখ্যায় এত বেশি নহে কিংবা এত বদমায়েসও নহে, এবং তাহাদের কাজও এত অধিক দূর বিস্তৃত নয়।

তাহাদের কার্যপ্রণালী।

তাহাদের একটা কৌশল এই :–তাহারা যে বাড়িতে চুরি করিতে ইচ্ছা করে সেই বাড়িতে পথিক বা ভিক্ষুকরূপে আশ্রয় লয়। তাহাদের স্ত্রীলোকেরা পাক

কায্যপ্রণালা। পাকা জুয়াচোর ও গাঁট কাটা। গত কয় বৎসরে চৈন চামারদের বহু দল ধৃত হইয়াছে : ইহাদের মধ্যে স্ত্রী, পুরুষ ও বালকবালিকা ছিল।

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনের ঘোষণা।

১৯১৩ সালে যুক্ত প্রদেশের গাজিপুর জেলার গ্রামসমূহের সমস্ত চৈন চামারেরা এবং জৌনপুর জেলার কতকগুলি গ্রামে যে চৈন চামারেরা হাজির জামিন লওয়া যায় না এমন অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছিল কিংবা যাহা দিগকে ফৌজদারী মোকদ্দমায় কাৰ্য্যপ্রণালীবিষয়ক ১৮ ধারা অনুসারে জামিন দিতে আদেশ করা হইয়াছিল। তাহারা যুক্ত প্রদেশের গভর্ণমেণ্টকর্ত্তৃক দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইন অনুসারে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ঘোষিত হইয়াছিল। ১৯১৪ সালের ৩রা জানুয়ারি তারিখের ১২৭৪ নং ৮-১৫৮-৪ ও ৬নং ৮-১৫৮ বিজ্ঞাপন।

.

ধাড়ী।

উৎপত্তি ও বাসস্থান।

ধাড়ীরা নীচ জাতীয় হিন্দু; ইহাদিগকে বিহারের কোন কোন জেলায় প্রধানতঃ পাটনা ও মুঙ্গের জেলায়, দেখিতে পাওয়া যায়। ক্রুক ও রিসূলি উভয়েই বলেন যে তাহারা দোসাদ জাতির একটি শাখা; কিন্তু ধাড়ীরা এ সম্বন্ধ অস্বীকার করে; তাহারা বলে যে তাহারা এক গোয়ালার বংশধর; এই গোয়ালা দৈবাৎ একটি গাভীকে মারিয়া ফেলিয়াছিল।

ধর্ম্ম ও আচার ব্যবহার।

ধাড়ীরা হিন্দু দেবদেবীর ও সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী প্রভৃতি প্রাকৃতিক পদার্থসমূহের এবং বীরপুরুষ ও সর্পসমেত জন্তু জানোয়ারদিগেরও পূজা করে। তাহারা সিঁধকাটিকেও বিশেষ ভক্তি করে। বিহারে ইহাকে সচরাচর সিঁধমারি বলে। এই যন্ত্রের দ্বারা সিঁধ দিয়া চুরি করিবার সময় তাহারা দেওয়ালে গর্ত করে। এই যন্ত্র কেবল শুভ দিনেই তাহার প্রস্তুত করে এবং তাহাদের বিশ্বাস যে বিশ্বকর্মা ঠাকুর তাহাদিগকে তাহাদের জীবিকা উপার্জনের জন্য ইহা দিয়াছেন। দুর্গাপূজা ও দশহরার সময় তাহারা এই যন্ত্রের নিকট ধুপ ধুনা পোড়াইয়া থাকে এবং তাহাদের বিশ্বাস যে ধাড়ী তাহার সিঁধকাটিকে অপবিত্র করে সে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হইবে। স্ত্রীলোকে স্পর্শ করিলে যন্ত্র অপবিত্র হয়।

সামাজিক অবস্থা।

ধাড়ীরা শূকর, ভেড়া ও ছাগল খায়, কিন্তু দোসাদদিগদের ন্যায় মুরগি স্পর্শ করে না। তাহারা দোসাদ, চামার, মুসাহার বোপা ও ডোম ছাড়া যে কোন জাতির ছোঁয়া খাবার খায়। ধোপারা তাহাদের কাপড় কাঁচে এবং উচ্চ জাতিরা তাহাদিগকে গ্রামের পাতকুয়া হইতে জল তুলিতে দেয়।

শারীরিক গঠন ও পোষাক পরিচ্ছদ।

ধাড়ীদের শারীরিক গঠন সুন্দর; তাহারা বহুদূর হাঁটিলেও কোন কষ্ট বোধ করে না। তাহাদের সাধারণ পোষাক এক ধুতি ও গামছা। চুরি করিতে যাইবার সময় তাহারা কখনও কখনও কুর্তা ও পাগড়ি পরে, কারণ ইহাদ্বারা লোকে তাহাদেরকে উচ্চতর জাতীয় লোক বলিয়া মনে করিলেও করিতে পারে।

কর্ণেল র‍্যাম্‌সে ১৮৮৮ সালে মুঙ্গেলের পুলিশের ডিষ্ট্রিক্ট সুপারিন্টেন্টে ছিলেন। তিনি মুঙ্গের জেলে ২০০ কয়েদীকে ডাক্তারের দ্বারা পরীক্ষা করাইয়াছিলেন। তাহার ফলে দেখা গিয়াছিল যে, কয়েদীদের মধ্যে ধাড়ীরাই সর্বাপেক্ষা অধিক হৃষ্টপুষ্ট ছিল এবং সাধারণতঃ তাহারাই সর্বপেক্ষা অধিক ক্ষমতাশালী ছিল।

নজরবন্দী ও অপরাধী।

এই বৎসরে (১৮৮৮) কর্ণেল র‍্যাম্‌সে ধাড়ীদিগের উপর এক বিশেষ প্রকারেরর নজরবন্দী প্রচলিত করিয়াছিলেন; তাহারা বাড়িতে উপস্থিত না থাকিলেই তাহা লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা হইত। ভ্রমণে তাহারা খুব মজবুত; প্রতি মাসের কৃষ্ণ পক্ষে তীর্থ করিতে যাই বলিয়া তাহারা প্রায়ই বাড়ি হইতে চলিয়া যায়; এই তীর্থযাত্রা, যে রাত্রে লোকের বাড়িতে চুরি করিতে যাইবার জন্য যাত্রা, তাহা বিশ্বাস করিবার যথেষ্ট হেতু আছে।

কর্ণেল র‍্যাম্‌সে লিখিয়া গিয়াছেন যে, সে সময়ে তাহারা প্রায়ই ৭ জনে মিলিয়া দল বাধিয়া কাজ করিত, কিন্তু তিনি কেবল মাত্র তিনটি দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন যেখানে ৭ জন করিয়া দল ধৃত হইয়াছে। কতকগুলি ধাড়ী যাহারা দোষী সাব্যস্ত হইয়াছিল, তাহাকে জানাইয়াছিল যে, তাহাদের রীতি এই যে, চুরি করিতে যাত্রা করিবার সময়, দলের প্রত্যেক লোকেই সপ্তাহের এক একটি নাম ধারণ করিতে হইবে এবং তাহাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিশেষ বল প্রয়োগের কোন কাৰ্য্য করিতে হইলে সপ্তাহের যে দিনে ঐ কায্য করিবে, যে ব্যক্তি সেই দিনের নাম ধারণ করে, তাহাকেই ইহা করিতে হইবে।

পেশা।

ধাড়ীরা গ্রাম্য চৌকিদার, মোলিয়ান বা রাত্রে মাঠে শস্যের রক্ষক ও জমিদারী চিঠিপত্র বাহকরূপে বহু পরিমাণে নিযুক্ত হইয়া থাকে। ভুমিঘটিত দাঙ্গা হাঙ্গামায় তাহারা দুর্দান্ত লাঠিয়ালের কাৰ্য্য করে। খুব সম্প্রতি তাহারা চাষবাসের কাজে কতকটা উন্নতি করিয়াছে।

সিঁধচুরি করিতে তাহারা ভালবাসে।

সিঁধচুরি কাজেই তাহারা সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক আসক্ত। তাহারা প্রায়ই সিঁধ দিয়া অর্থাৎ প্রাচীরে গর্ত করিয়া গৃহে প্রবেশ করিয়া থাকে।

ঐ জাতির মধ্যে অপরাধীর অনুপাত।

১৮৮৮ সালে মুঙ্গের জেলায় ১০০৩ জন ধাড়ীর মধ্যে ২০৯ জন সৰ্বসাকল্যে ৪৩১ বার অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছিল এবং জেল শাসনসম্বন্ধীয় রেজিষ্ট্রারে যে প্রায় ৬০ জন ধাড়ীর নাম ছিল সেই নামের সহিত সে সময়ে যে সব ধাড়ী জেলের বাহিরে ছিল বলিয়া জানা গিয়াছে তাহাদের কাহারও সম্বন্ধ নির্ণীত করিতে পারা যায় নাই।

তাহারা রাত্রে চুরি করিতে বহুদূর পর্যন্ত গিয়া থাকে; পূর্ব্ববঙ্গের জেলাসমূহ তাহাদের নিকট খুব দূর বলিয়া মনে হয় না; তবে তাহারা অন্ধকার রাত্রেই চুরি করে, এবং প্রায়ই একই গ্রামে একই রাত্রে অনেক জায়গায় চুরি করে।

তাহাদের সাহায্যকারী ও চোরাই মালের গ্রাহক।

লাঠিই তাহাদিগের আত্মরক্ষার অস্ত্র; যদি বাধা পায় তাহা হইলে তাহারা তৎক্ষণাৎ লাঠি চালায়। তাহাদের নিজ গ্রামের চতুর্দিকে যে সমস্ত জমিদার ও ক্ষুদ্র ভূম্যধিকারী থাকে, তাহারাই তাহাদের চোরাই মাল গ্রহণ করে বলিয়া বিশ্বাস। লোক ইহাও বলে যে, চৌকিদার ও দফাদারেরা, তাহাদের বাটি হইতে অনুপস্থিত থাকার কথা, থানায় না জানাইবার দরুণ প্রায়ই পুরস্কারস্বরূপ তাহাদের লাভের অংশ পাইয়া থাকে। তাহারা তাহাদের যাত্রার জন্য শুভদিন দেখাইতে ব্রাহ্মণদের নিকট যায় বলিয়া শোনা যায়। কৃতকার্য হইলে পর তাহারা তাহাদের উপাস্য দেবতার বেদীর নিকট শূকর বলি দেয় ও মদ ঢালে।

কোথায় কত ধাড়ী থাকে।

বিহার ও উড়িষ্যার কোথায় কত ধাড়ী থাকে ১৯১১ সালের আদমসুমারী অনুসারে তাহার তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হইল :–

জাতিব্রিটিশ জেলাদেশীয় রাজ্যমোট সংখ্যাপুরুষ দিগের সংখ্যা
ধাড়ীপাটনা১৮৭৬৯২০
 গয়া
 শাহীবাদ১২১২
 দ্বারভাঙ্গা৫১৪২৩২
 মুঙ্গের ১৫০৬
 ভাগলপুর৩৯৭২৩২
 পূর্ণিয়া১২

১৯১১ সারের ৩ আইন অনুসারে পাটনা, মুঙ্গের ও ভাগলপুরের ধাড়ীরা দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। (বিহার ও উড়িষ্যা গভর্ণমেন্টের ১৯১৫ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখের ৬৪৫-৬৪৭ পি বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য)।

.

মগাহিয়া ডোম।

মগাহিয়া ডোমদিগের অপরাধ করিবার প্রবৃত্তি।

ডোমদিগের বর্তমান অবনতির অবস্থায় তাহাদের হৃদয়ে সাধারণতঃ অপরাধ করিবার প্রবৃদ্ধি প্রচ্ছন্নভাবে আছে বলিয়া সকলেই মনে করেন; কিন্তু কেবল মগাহিয়া ডোমেরাই মনে করে যে অপরাধজনক কাৰ্য্য না করিলে মনুষ্যত্ব রক্ষা হয় না এমন কি ইহাকে তাহারা প্রায়ই অবশ্য পালনীয় ধৰ্ম্মকাৰ্য্য বলিয়া মনে করে। কোন প্রাপ্তবয়স্ক মগহিয়া ডোম কৃতকাৰ্য্যতার সহিত কোন চুরি বা সিঁধের কার্যের যোগ না দিয়া থাকিলে, স্বজাতীয় স্ত্রীলোকদিগের অপ্রীতিভাজন ও পুরুষদিগের অবজ্ঞার পাত্র হয়। অন্ততঃ আমি যখন ১৯০১ সালে চম্পারণের পুলিশ সুপারিন্টেন্টে থাকিয়া সে জেলার মগাহিয়া ডোমদিগের বসতির সহিত পরিচিত হই, তখন ইহাই তাহাদিগের মধ্যে সৰ্ব্ববাদিসম্মত নিয়ম ছিল। এখনও তাহাদের নীতিবুদ্ধির কোন পরিবর্তন হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাস করিবার কোন কারণ নাই।

বাসস্থান।

মগাহিয়া ডোমেরা প্রধানতঃ যুক্ত প্রদেশের গোরক্ষপুর ও আজমগড় জেলায় এবং বিহারের সারণ ও চম্পারণ জেলায় বাস করে।

যাযাবর জীবন।

সময়ে সময়ে জমি ও গোমেষাদি পশু দিয়া তাহাদিগকে এক স্থানে বাস করাইবার জন্য চেষ্টা করা হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে বিশেষ ফল পাওয়া যায় নাই। মগাহিয়া ডোমদিগের দেহে হাঘরিয়া জাতির রক্ত এত অধিক পরিমাণে আছে যে, জোর না করিলে এরূপ চেষ্টা কৃতকার্য হইতে পারে না; শীঘ্রই ক্লান্ত হইয়া পড়ে এবং ইহা ছাড়িয়া তাহাদের স্বাভাবিক যাযাবর বৃত্তি অবলম্বন করে। এখন বাঙ্গালা দেশের তাহাদের অনেককে দেখিতে পাওয়া যায় এবং কোন কোন স্থলে তাহারা মিউনিসিপালিটির ঝাড়দারের কাজে নিযুক্ত হইয়া থাকে।

মিউনিসিপালিটির কাজে তাহাদের প্রয়োজনীয়তা।

ময়লা পরিষ্কার ও মড়া ফেলাই সাধারণতঃ বাঙ্গালা দেশের ডোমদিগের জীবিকানির্বাহের  প্রকাশ্য উপায়; অপরাধকারী বলিয়া তাহারা যতই কষ্ট দিক কেন, এই সকল কাজে তাহাদের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে কাহারও সন্দেহ থাকিতে পারে না। কিন্তু মিউনিসিপালিটির কাজে নিযুক্ত থাকিয়া নিয়মমত বেতন পাইলেও, মগাহিয়া ডোমদিগের উপর পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি থাকা আবশ্যক। এইরূপ কার্যে নিযুক্ত অনেকেই পাকা বদমায়েস, বিহার ও যুক্ত প্রদেশে তাহারা পূৰ্ব্বে অপরাধী বলিয়া দণ্ডিত হইয়াছে।

অপরাধের প্রকার।

মগাহিয়া ডোমেরা সম্পত্তির বিরুদ্ধে সকল প্রকার অপরাধই করিয়া থাকে; কিন্তু এযাবৎ কেবল মাত্র একদল ১৯০৪ সালের কলিকাতার দল। বড় রকমের ডাকাইতি করার দরুণ অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছে। রাত্রিতে সিঁধচুরি ও রাহাজানিই তাহাদের প্রিয় কাজ এবং ঘরের দরজা খোলা পাইলেই তাহারা চুপি চুপি ঘরে প্রবেশ করে এবং কাপড়, গামছা ইত্যাদি হাতের কাছে যাহা পায় তাহাই লইয়া পলাইয়া আইসে।

বগলি সিঁধ।

মগাহিয়া ডোমেরা চুরি করিবার সময় খুব সাহসী হয় ও অনেকটা গোঁয়ার গোবিন্দের মত কাজ করে। বগলি সিধ কাটিয়াই তাহারা ভিতরে প্রবেশ করে। দেওয়ালে দরজার বাজুর কাছে একটি ছোট গর্ত করে, এই গর্তের মধ্যে হাত গলাইয়া দিয়া তাহারা দরজার হুড়কা বা খিল খুলিয়া ফেলে। সচরাচর তাহাদের কাছে দেশালাইয়ের বাক্স থাকে, ভিতরে প্রবেশ করিয়াই তাহারা আলো জ্বালে। তাহারা বেপরোয়াভাবে বাটীর চতুর্দিকে চুরি করিবার উপযুক্ত জিনিষ খুঁজিয়া বেড়ায় এবং নিদ্রিত স্ত্রীলোক ও শিশুদের গা হতে গহনা খুলিয়া লইবার সময় টানা হেঁচড়া করিয়া থাকে। এক বাড়িতে যদি বাড়ির লোকদিগকে না জাগাইয়া চুরি করিতে পারে তবে প্রায়ই তাহার পাশের বাড়িতে যায় এবং ভাগ্য প্রসন্ন হইলে কখনও কখনও এক রাত্রিতে একই গ্রামে পাঁচ ছয় বাড়িতে চুরি করে। লোকে পিছনে তাড়া করিলে তাহারা অনুসরণকারীদের হাত এড়াইতে বড় পটু; তখন তাহারা প্রায়ই হামাগুড়ি দিয়া শৃগালের মত ডাকিতে ডাকিতে ছুটিয়া পলায়।

মালার দানা বিক্রয় দ্বারা লোক ঠকান।

মালার দানা লইয়া লোক ঠকান নামে যে এক প্রকার জুয়াচুরি আছে মগাহিয়া ডোমেরা সে রকম জুয়াচুরিও করিয়া থাকে। পিতলের দানা সোনা বলিয়া তাহারা বিক্রয় করিতে চাহে। এই কাজ সচরাচর স্ত্রীলোকেরাই করিয়া থাকে।

উৎপত্তি।

ডোমদিগের উৎপত্তি বিষয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে; কিন্তু সার হার্বাট রিসলের মতে, কেবল কল্পনা ছাড়া ইহাই একমাত্র জোর করিয়া বলা যাইতে পারে যে তাহারা এদেশের আদিম নিবাসীদিগের শেষ বংশধর। তাহার এই মতের অনুকূলে তিনি খাঁটি মগাহিয়াদিগের আকৃতির বিবরণ দিয়াছেন, যথা- “তাহারা খর্বাকার ও কৃষ্ণবর্ণ; তাহাদের মুখ চেপ্টা এবং চক্ষু অত্যন্ত উজ্জ্বল ও চকচকে; তাহাদিগকে দেখিলেই তাহাদের চক্ষের এই বিশেষ উজ্জ্বলতাই প্রথমে লোকের নজরে পড়ে।”

আকৃতির বিবরণ।

পুলিশের পরিচিত সমস্ত মগাহিয়া ডোমের প্রতি এই বিবরণ প্রযুক্ত হইতে পারে না। তাহাদের অনেকেরই চেহারা মাঝারি রকমের, মুখের চেহারাও মন্দ নহে, কিন্তু খাঁটি মগাহিয়ারা কৃষ্ণবর্ণ, তাহাদের চুল লম্বা ও আঁচড়ান নহে এবং তাহারা প্রায়ই ভয়ঙ্কর অপরিষ্কার ও ছেঁড়া ন্যাক্‌ড়া পরিয়া থাকে।

প্রকৃতি ও ধর্ম্ম।

মগাহিয়ারা, ধোপা ছাড়া আর সকল জাতির সহিত মিলিয়া যাইতে পারে। সার হার্ব্বাট রিসলের সাধারণ বর্ণনায় এত যে বিশেষ আছে, ইহাই তাহার কারণ হইতে পারে। তাহারা পাকা মাতাল এবং তাহাদের প্রধান ঠাকুর গণ্ডক ও সমাই বা সমায়া নামে স্ত্রী দেবতাকে তাহারা মদ উৎসর্গ করিয়া ও শূকর বলি দিয়া পূজা করিয়া থাকে। চুরি ও সিঁধচুরিতে কৃতকাৰ্য্য হইলে তাহারা প্রায়ই অনেক দিন ধরিয়া মদ খাইয়া উৎসব করিয়া থাকে।

বাঁশফোড় ঢোম।

বাঁশফোড় ডোমেরা চুপড়ি বুনিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিয়া থাকে; মগাহিয়ারা যে মূল জাতি হইতে উৎপন্ন তাহার সম্ভবত সেই জাতি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। মগাহিয়ারা বলে–তাহাদের বংশের আদি পুরুষ শ্ৰীপাচের দুই স্ত্রী ছিল। প্রথম স্ত্রী পুত্র চুপড়ি বোনার কাজ করিতে থাকে; এই ব্যক্তিই বাঁশফোড়দের পূর্ব্ব পুরুষ। অপর স্ত্রীর পুত্র তাহার মাতার সহিত মগধে যায় ও সেখানে মগাহিয়া বংশের সৃষ্টি করে। দরকার নামে ডোমদিগের তৃতীয় উপবিভাগ আছে; ইহারা বাঁশফোড়দিগেরই একটি শাখা বলিয়া মনে হয়। মগাহিয়ারা এখনও যাযাবরবৃত্তি অবলম্বন করিয়া আছে; কিন্তু বাঁশফোড় ও দরকারেরা এ অভ্যাস পরিত্যাগ করিয়াছে; তাহারা বিহার ও যুক্ত প্রদেশের গ্রামসমূহের প্রান্তে সচরাচর স্থায়ীভাবে বাস। করে; সেখানে তাহারা চুপড়ি বুনিয়া ও ময়লা পরিষ্কার করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করে বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে। তাহাদের মধ্যে কতক লোক চাষবাসের কাজেও অগ্রসর হইয়াছে।

কিন্তু মগাহিয়ারা কোন উন্নতিই করিতে পারে নাই, তাহারা সকল প্রকার কাজকেই শাস্তি বলিয়া মনে করে। তাহাদের বিবেচনায় সৎপথে থাকিয়া পরিশ্রম করিলে তাহাতে চুরি অপেক্ষা কষ্টও বেশি হয় আবার আয়ও কম হয়। কিন্তু কাজে তাহাদের এত ঘৃণা থাকিলেও, তাহারা বেত্রাঘাত দণ্ড অপেক্ষা যত দিনের জনেই হোক না কেন কারাবাস দণ্ড পসন্দ করে। বেত্রাঘাত দণ্ডকে তাহারা যথার্থই ভয় করে। প্রত্যেক মগাহিয়াকে তাহার জীবনের অধিকাংশ কাল যে জেলে কাটাইতে হইবে, ইহা অনিবাৰ্য, এই জন্য ঐ জাতির মধ্যে একটি প্রথা প্রচলিত আছে যে, স্বামী যতদিন জেলে থাকিবে স্ত্রী ততদিন নিজের ও শিশুদিগের ভরণপোষণের জন্য স্বজাতীয় অন্য কোন ব্যক্তির সহিত সাময়িকভাবে বাস করিতে পারিবে, স্বামী জেল হইতে মুক্ত হইয়া ফিরিয়া আসিলে আবার তাহার কাছে যাইবে।

উহাদের স্ত্রীজাতি।

উহাদের স্ত্রীলোকদিগের গঠন ভাল এবং তাহারা প্রায়ই সুন্দরী; সচরাচর ভাল কাপড়চোপড় পরে ও অলঙ্কারে ভূষিত থাকে। তাহাদের চরিত্রবল আদৌ নাই এবং স্বজাতির বাহিরেও বেশ্যাবৃত্তি করিতে তাহাদের কোন প্রকার দ্বিধা নাই।

বাঙ্গালা দেশে তাহাদের আড্ডা।

১৯১৪ সালে ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেশন বিভাগের একজন কর্ম্মচারী বাঙ্গালা দেশের মগাহিয়া ডোমদিগের সম্বন্ধে রিপোর্ট করিবার জন্য প্রেরিত হইয়াছিলেন। তিনি তাহাদিগের ১৪৭টি আড্ডা দেখিয়াছিলেন। বাখরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও খুলনা এই কয় জেলা ছাড়া সকল জেলাতেই তাহাদিগকে দেখা গিয়াছিল। তাহাদের মোট সংখ্যা স্ত্রী পুরুষ ও বালকবালিকা লইয়া ১৭২৭ জন ছিল। ইহাদের মধ্যে ৩০১ জন হাজির জামিন লওয়া যায় না এমন মোকদ্দমায় অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছিল; এবং ইহা ছাড়া ৪৬৫ জন, যাহারা বাঙ্গালা দেশে হাজির জামিন লওয়া যায় না এমন মোকদ্দমায় অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছিল, তাহাদিগকে অনুসন্ধানকারী কর্মচারী ধরিতে পারেন নাই। এই অপরাধীদিগের মধ্যে ৩১ জন স্ত্রী লোক ছিল। হাজির জামিন লওয়া যায় না এমন অপরাধ হইতে উৎপন্ন। অসদুপায়ে জীবিকানির্বাহের মোকদ্দমায় অপরাধী ৮০ জন মগাহিয়াকে সন্ধান করিয়া বাহির করা হইয়াছিল; বাঙ্গালা দেশে ঐরূপ দোষী প্রমাণিত ৭২ জনের সন্ধান পাওয়া যায় নাই।

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে ঘোষণা।

যুক্ত প্রদেশে, কুমাওন ডোমরা ছাড়া সমস্ত ডোমই দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে  (১০৯২ নং- ৮-৩০৮ বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য) এবং বিহার ও উড়িষ্যায় ত্রিহুত বিভাগের সমস্ত মগাহিয়া ডোম ঐরূপ ঘোষিত হইয়াছে (১৯১৩ সালের ৯ই আগষ্ট তারিখের ৩২৫৭পি নং বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য)।

.

পালোয়ার দোসাদ।

উৎপত্তি।

অপরাধ হিসাবে শ্রেণীবিভাগের উদ্দেশ্যে যুক্ত প্রদেশের পালোয়ার দোসাদ ও সাধারণতঃ দোসাদ জাতির মধ্যে বিশেষ নির্দিষ্টভাবে রেখা টানা যাইতে পারে। বিহারের জেলাসমূহের দোসাদদিগের মধ্যে বিস্তর বদমায়েস, পাকা সিঁধেল ও চোর থাকিলেও সম্ভবতঃ মুঙ্গের জেলার দক্ষিণ, যেখানে চাকাই দোসাদদিগকে দেখা যায়, সেই স্থান ব্যতীত বিহারের অন্য কোন স্থানেই ঐ জাতিকে প্রকৃত বদমায়েস জাতি বলা যাইতে পারে না। প্রকৃত পক্ষে ১৯০৪ সালের কাছাকাছি সময়ে পাটনা জেলার দোসাদদিগের মধ্যে সামাজিক সংস্কারের জন্য এক প্রবল আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনের নেতা, তুলসী দোসাদ বলিয়াছিল যে, চৌৰ্য্যাপরাধে অপরাধী প্রত্যেক দোসাদকেই জাতিচ্যুত করা হইবে। কিছুকাল ঐ আন্দোলনের অত্যন্ত প্রভাব দেখা গিয়াছিল। মজুর ও গৃহকাৰ্য্যে নিযুক্ত চাকরের কাজে সাধারণ দোসাদেরা সক্ষম ও ঐরূপ কার্যে নিযুক্ত অন্যান্য জাতির ন্যায় সাধু। বালিয়ার গালোয়ার দোসাদেরা সেরূপ নহে; তাহাদের বদমায়েসি সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং ১৯১৩ সালের অক্টোবর মাসে দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইন অনুসারে তাহারা দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া বিঘোষিত হইয়াছিল (১৯১৩ সালের ১লা অক্টোবর তারিখের যুক্ত প্রদেশের গেজেটের ১২৭০-৮-১৫৮-৮নং বিজ্ঞাপন)।

উপজাতি সকল

ক্রুক সাহেবের মতে দোসাদেরা আটটি উপজাতিতে বিভক্ত; উহাদের পরস্পরের মধ্যে বিবাহ চলে না, তবে উহাদের প্রায় সকলেই একত্র বসিয়া রাধা খাবার খাইয়া থাকে। তিনি ধাড়ীদিগকেও এই উপজাতিদিগের অন্তর্গত বলেন, এই ধাড়ীদিগের বদমায়েসী করিবার প্রবৃত্তি বড় প্রবল এবং ইহাদিগকে পাটনা, মুঙ্গের ও ভাগলপুর জেলায় দেখিতে পাওয়া যায়। ইহারা কিন্তু আপনাদিগকে দোসাদ হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন জাতি মনে করেন, এবং যে সব পুলিশ কর্মচারী ইহাদের সম্বন্ধে বিশেষ অভিজ্ঞ তাঁহারাও ইহাদিগকে দোসাদ হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন জাতি মনে করেন, এবং এই উভয় জাতির প্রকৃতিগত অনেক সাদৃশ্য আছে। এই পুস্তকের দ্বিতীয় ভাগের দশম অধ্যায়ে ধাড়ীদের কথা বিবৃত হইয়াছে।

ধর্ম্ম ও সামাজিক অবস্থা।

ধর্ম্মবিষয়ে পালোয়ারেরা দোসাদদিগের অন্যান্য উপজাতি সকল হইতে বিভিন্ন নহে। তাহারা আপনাদিগকে গোড়া হিন্দু বলে ও হিন্দুদিগের দেবতাদের পূজা করে। রাহু তাহাদের প্রধান দেবতা; রাহু সূৰ্য্য ও চন্দ্রকে গিলিয়া ফেলিয়া গ্রহণের সৃষ্টি করে। যে ব্রাহ্মণ তাহাদের কাজ করিতে চায়, উহারা তাহাকেই পুরোহিত নিযুক্ত করে; কিন্তু ব্রাহ্মণ পাওয়া না গেলে, তাহাদের স্বজাতীয় কোন ব্যক্তিই পুরোহিতের কাজ করে। তাহারা নিজেদের খাদ্যের জন্য এবং বিক্রয় করিবার জন্যও শূকর পালন করে। তাহারা মুরগি ও মেঠো ইন্দুর খায় এবং অবাধে মদ খাইয়া থাকে। বোপা এবং ডোম ও চামারদিগের ন্যায় অস্পৃশ্য জাতি ছাড়া তাহারা যে কোন জাতীয় হিন্দুর হাতে খায়। তাহাদের মধ্যে বহু বিবাহ ও বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে।

ব্র্যাম্‌লি সাহেবের রিপোর্ট।

যুক্ত প্রদেশের পুলিশের ব্র্যাম্‌লি সাহেব ১৯০৪ সালে এক প্রদেশের লোককর্ত্তৃক অন্য প্রদেশে অনুষ্ঠিত অপরাধসম্বন্ধে যে রিপোর্ট লিখিয়াছিলেন সেই রিপোর্টে প্রকাশিত দোসাদদিগের সম্বন্ধে মন্তব্য ইহতে নিম্নলিখিত অংশ উদ্ধৃত হইতেছে।

পেশা।

সুতরাং এক প্রদেশের লোককর্ত্তৃক অন্য প্রদেশে অনুষ্ঠিত অপরাধের কথা বলিতে গেলে এই জাতির অন্তর্গত বালিয়ার পালোয়ার দোসাদদিগেরই আলোচনা করা প্রয়োজন। “বালিয়ার পালোয়ার দোসাদদিগের যে সুগঠিত দল সকল আছে এবং এই দলেরা যে সুপ্রণালীমত মতলব আঁটয়া কাৰ্য্য করে ইহা ১৮৯৯ সালের ৯ই মে তারিখে দলবদ্ধ দোসাদদিগের এক মোকদ্দমায় বালিয়ার দায়রা জজের বিস্তারিত রায় ও মুক্তার দোসাদের স্বীকারোক্তি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়; এই মুত্তার দোসাদ সেই মোকদ্দমায় গভর্ণমেন্টের সাক্ষী হইয়াছিল। এ সম্বন্ধে আরও প্রমাণ মালদহ ও মৈমনসিংহের মোকদ্দমার কাগজপত্র হইতে পাওয়া যায়। এই সমস্ত মোকদ্দমায় ঐ মুত্তার দোসাদ এবং আরও ১৬/২০ জন সংশ্লিষ্ট ছিল।”

বাঙ্গালা দেশে আড্ডা।

“অন্য সজাতীয় দুর্ব্বৃত্ত জাতিগণের ন্যায় পালোয়ার দোসাদেরাও বাঙ্গালা দেশে আড্ডা ও বদমায়েসির সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছে। ইহাদের মধ্যে একটি প্রধান আড্ডা মালদহ জেলায়; এখানে একশত বা শতাধিক লোক গ্রাম্য চৌকিদারের কার্যে নিযুক্ত হইয়া থাকে। শেষ আদমসুমারীতে (১৯০১) প্রকাশ পাইয়াছে যে সেখানে কেবল মাত্র ১৪৭ জন পুরুষ ও ২১২ জন স্ত্রীলোক ছিল। ইহা হইতে মনে হয় তখন মালদহে যে সকল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বাস করিতেছিল তাহাদের অনেকেরই নাম রেজিষ্টারিতে উঠে নাই। ইহাও বক্তব্য যে দিনাজপুর ও মৈমনসিংহে যে সব চুরি ডাকাইতি হইয়াছে তাহার কেন্দ্রস্থল মালদহে ছিল। মুর্শিদাবাদের পালোয়ারেরা (১৬৩) একটি ক্ষুদ্র স্থায়ী আজ্ঞা করিয়াছে।”

বাঙ্গালা দেশে তাহারা কাল্পনিক নাম গ্রহণ করে।

ব্রাম্‌লি সাহেব বলেন যে, বাঙ্গালা দেশের পালোয়ারেরা আত্মগোপন করিবার জন্য কাল্পনিক নাম যথেচ্ছা ব্যবহার করে। বাঙ্গালা দেশ হইতে বালিয়া জেলায় যে সব মনি অর্ডার প্রেরিত হয়, তাহাদের প্রায় সকলেরই বিশেষত্ব এই যে, প্রেরকের বাঙ্গালা বা বালিয়ায় কেহ জানে না বা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। কিন্তু যাহাদের নামে টাকা পাঠান হইতেছে তাহাদের নামে কোন ভুল নাই এবং সেই সকল নাম স্থানীয় দোসাদদিগের রেজিষ্টারিতে খুঁজিবামাত্র পাওয়া যায়।

কোথায় কত পালোয়ার আছে।

১৯০৪ সালে বালিয়া জেলার কতগুলি গ্রামে পালোয়ারেরা ছিল তৎসম্বন্ধে ব্র্যাম্‌লি সাহেব বলেন, বালিয়া থানার অধীনে ৩৯ গ্রাম, বেরিয়া থানার অধীনে ৬৬ গ্রাম, হলদি থানার অধীনে ২৭ গ্রাম, বাঁশদি থানার অধীনে ২৬ গ্রাম ও রেওতি থানার অধীনে ৪৯ গ্রাম।

কর্মক্ষেত্র।

বাঙ্গালা দেশের প্রায় প্রত্যেক জেলায় এবং আসাম ও কুচবিহার রাজ্যেও ইহাদের কাজ চলিয়া থাকে। পালোয়ার দোসাদেরা অধিক সংখ্যায় বাঙ্গালা দেশের কলে কাজ করে না বটে, কিন্তু তাহাদের অনেকেই কয়লার খনিতে কাজ করে এবং ইহা অপেক্ষাও অধিক লোক রেলওয়েতে এবং যেখানেই সাধারণ কুলির প্রয়োজন সেইখানে কাজ করিয়া থাকে। ১৯১৪ সালের মে মাসে কেবল কাতিহারেই ৬৫ জন রেলওয়ে কুলির কাজে নিযুক্ত হইয়াছিল। এখানে স্থানীয় ডিষ্ট্রিক্ট পুলিশ তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিবার কোন কারণ পায় নাই এবং কাতিহার শহরেও সিঁধ ও চুরি খুব বাড়ে নাই। কিন্তু কাতিহারে রেলে প্রেরিত মাল চুরি করিবার বিশেষ সুবিধা ও চুরি করিয়া প্রায়ই দণ্ড পাইবার কোন ভয় না থাকাতেই তাহারা সে আরও দূরে চুরি করিতে যাইয়া পুলিশের হাতে পড়িবার বিপদ স্বীকার করিতে চায় না, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহা সম্ভব যে রেলওয়েতে নিযুক্ত পালোয়ার দোসাদেরা ও অন্যান্য দুর্ব্বৃত্ত জাতিরা রেল লাইনের নিকটে প্রায়ই সিঁধচুরি এবং এমন কি ডাকাইতি পর্যন্ত করিয়া থাকে।

যেরূপ দুষ্কাৰ্য্যে আসক্ত।

ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স বুরোর রেকর্ড হইতে দেখা যায় যে, পালোয়ার দোসাদেরা একা একা এবং দলবদ্ধ হইয়াও কাৰ্য্য করে, তাহারা ডাকাইতি সিঁধচুরি, পকেট কাটা, গহনা ছিনাইয়া লওয়া গাঠরি চুরি করা অর্থাৎ যত রকমের চুরি থাকিতে পারে সমস্ত করিয়া থাকে।

কোন কোন স্থলে খুব জনবহুল স্থানে একদল যাইয়া কিছুদিনের জন্য বাস করিতে থাকে এবং সেই স্থানে যে যে সংবাদ জানা আবশ্যক তাহা জানিবার জন্য অল্পকাল থাকিয়া উপর্যুপরি সিঁধচুরি করিতে থাকে এবং যেমনি তাহাদের উপর লোকের সন্দেহ হইয়াছে জানিতে পারে অমনই সেস্থান ছাড়িয়া পলায়ন করে।

ব্র্যাম্‌লি সাহেবের বিশ্বাস যে, তাহাদের জেলার জমিদারেরা তাহাদের অনেকটা রক্ষা করে এবং এ কথা প্রমাণ করিবার জন্য তিনি দৃষ্টান্তও দেখাইয়াছেন।

.

চাকাই দোসাদ।

পালোয়ার দোসাদদিগের অধ্যায়ে যে চাকাই দোসাদদিগের কথা বলা হইয়াছে তাহারা, মুঙ্গের হাজারিবাগ সাঁওতাল ২৪ পরগণা, ভাগলপুর ও বীরভূম জেলার পার্বত্য প্রদেশে যে জাতিকে দেখা যায় সেই জাতিরই একটি অংশ। মুঙ্গের জেলার জামুই মহকুমার চাকাই হইতে তাহাদের নাম উৎপন্ন হইয়াছে। সি, ডবলিউ, সি, প্লাউডেন, সি, আই সাহেব, যিনি বহুকাল ধরিয়া বাঙ্গালা দেশের ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের কৰ্ত্তা ছিলেন (তখন বেহার ও বাঙ্গালা দেশের অন্তর্গত ছিল) মনে করেন যে, চাকাই দোসাদেরা বেহারের অন্যান্য দোসাদদিগের হইতে সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন। তাহার বিশ্বাস যে তাহারা বাউরিয়া, এই স্থানে বসতি স্থাপন করিয়া দোসাদ নাম লইয়াছে। পালোয়ার দোসাদদিগের মত, চাকাই দোসাদেরা প্রায়ই সমস্ত বাঙ্গালা দেশ আক্রমণ করে না। কিন্তু যে সকল স্থানে কয়লার খনি আছে তাহারা দলে দলে সেই খানে আসিয়া থাকে। এখানে তাহারা খননের কাজ করে এবং অবাধে চুরি ডাকাইতি করিয়া থাকে। কখনও কখনও বড় ও দুর্দমনীয় দল গঠন করে। ১৯০৩ সালে, তাহাদের নিজ জেলায় অর্থাৎ মুঙ্গেরে, চাকাই দোসাদদিগের একটা বড় দল অভিযুক্ত হয় এবং ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধির ৪০০ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত হয়। গভর্ণমেন্টের সাক্ষীর উক্তি অনুসারে এই দল ১৮ বা ২০ বৎসর ধরিয়া ছিল। তাহারা মাসে একবার কি দুইবার একত্র মিলিত হইত এবং পরামর্শ করিয়া অনেকগুলি ছোট দলে বিভক্ত হইয়া চতুর্দিকে চুরি করিতে যাইত। চাকাই দোসাদদিগের একটা রীতি এই যে, দলবদ্ধ হইয়া চুরি করিতে যাইবার সময়, তাহারা সন্ধ্যার পর হয় দলের একজন লোকের বাড়িতে না হয় জঙ্গলে একত্র হয়। তাহারা প্রায়ই চুরি করিতে গিয়া গুরুতর রকম মারপিট করে না, এবং ডাকাইতির চেয়ে তাহারা সিঁধচুরিই পসন্দ করে।

.

যাদুয়া ব্রাহ্মণ।

বাসস্থান।

যাদুয়া মানে যাদুকর। প্রধানতঃ পাটনা এবং মজঃফরপুর জেলার মহুয়া ও হাজিপুর থানায় যে এক সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ দেখা যায়, এই নাম তাহাদের প্রতি প্রযুক্ত হইয়া থাকে। পাটনা শহরের আলমগঞ্জ থানার অধীনে যাহারা বাস করে তাহারা সকলেই নামে পুলিশের নজরবন্দী হইয়া থাকে। তাহারা এক শ্রেণীর নীচ ব্রাহ্মণ। প্রকৃত ব্রাহ্মণেরা যে সমস্ত ধর্ম্মকাৰ্য্য করিয়া থাকে তাহারা তাহার কিছুই করে না এবং মাছ মাংস ও মদ খুব খাইয়া থাকে।

তাহাদের জুয়াচুরি করিবার প্রণালী।

তাহাদের জুয়াচুরি করিবার বিশেষ কতকগুলি প্রণালী থাকায় পুলিশের খাতাপত্রে তাহারা প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। এই সকল প্রণালী এক সময়ে প্রায় তাহাদের এক চেটিয়া ছিল। এখন অন্য অনেক দুর্ব্বৃত্ত জাতি ও শ্রেণী সেই সকল প্রণালী অবলম্বন করিয়াছে। যাদুমন্ত্রে টাকা ডবল করা বা রূপাকে সোনা করাই তাহাদের প্রধান চাতুরির কাজ এবং এই জুয়াচুরি তাহারা অনেক রকমে করিয়া থাকে। তাহারা তিন জন বা চার জনে এক এক দল তৈয়ারি করিয়া যাত্রা করে এবং যাহাকে সহজে প্রতারিত করিতে পারা যায় এমন একজন লোকের বাসস্থানাদির বিষয়ে সন্ধান লইয়া, সেই গ্রামে দলের একজনকে সন্ন্যাসীর বেশে পাঠাইয়া দেয়, দলের একজন অল্পবয়স্ক লোক কখনও কখনও চেলা হইয়া তাহার সঙ্গে যায়। ঐ সন্ন্যাসী কোন গ্রামে আচ্ছা করে এবং দেখায় যেন সে ধ্যানে মগ্ন আছে। কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন পরে, দলের অন্য লোকেরা সেই গ্রামে প্রবেশ করে। তাহারা জমিদার বা বেণে বলিয়া আপনাদের পরিচয় দেয় ও বলে যে তাহারা দূর দেশ হইতে আসিতেছে। তাহারা সেই গ্রামের লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করে যে সেখানে একজন সাধু ব্রাহ্মণকে কেহ দেখিয়াছে কি না। তাহারা বলে যে সেই সাধু তাহাদের রূপার গহনা সোনা করিয়া দিয়াছে। সেই জন্য তাঁহারা তাঁহার পূজা করিতে আসিয়াছে। যাহাকে তাহারা ঠকাইতে চায় তাহারই বাড়িতে তাহারা সাধুর বিষয়ে বিশেষ অনুসন্ধান করে। ইহাতে সে ব্যক্তির মনে লোভ জন্মে ও যাহাতে সাধু তাহার বাড়িতে আসিয়া তাহার রূপার জিনিস সমস্ত সোনা করিয়া দেয় সে জন্য সাধুকে অনুনয় করে। ব্রাহ্মণ সহজে তাহার প্রার্থনায় সম্মত হয় না ও আজকাল করিয়া বিলম্ব করে। কিন্তু শেষে বলে যে বাড়ির মধ্যে একটি ঘরে তাহাকে ও তাহার চেলাকে স্থান দিতে হইবে। এই ঘরটি প্রায়ই অন্ধকার ও ইহার মেজে মাটির হয়।

অদৃশ্য হইবার ক্ষমতা।

ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেশন বিভাগের কাগজপত্র হইতে দেখা যায় যে, যাহাকে ঠকাতে চায় যাহাতে সাধুর অদ্ভূত যোগ বলে তাহার বিশ্বাস জন্মে এই উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ অনেক কৌশল করিয়া থাকে। এক স্থলে বোকা লোকটিকে বলা হইয়াছিল “তুমি তোমার কপালে একটা টাকা রাখিয়া দরজার নিকট যাও ও পাঁচ মিনিটকাল সূর্যের দিকে চাহিয়া থাক; ফিরিয়া আসিয়া তুমি দেখিতে পাইবে যে আমি যাদুবলে অন্তর্হিত হইয়াছি।” পাঁচ মিনিট কাল সূর্যের দিতে চাহিয়া থাকিয়া অন্ধকার ঘরে ফিরিয়া আসিয়া স্বভাবতঃই সে প্রথমে কিছুই দেখিতে পায় নাই। ক্রমে চক্ষু অন্ধকার অভ্যস্ত হইলে পরই ব্রাহ্মণকে দেখিতে পাইল; কিন্তু লোকটা এত বোকা যে সে বিশ্বাস করিল যে এই অন্তর্ধান ও পুনরাবির্ভাব যাদুমন্ত্রের বলেই সাধিত হইয়াছে। কখনও কখনও বোকা লোকটাকে রাত্রে গ্রামের বাহিরে লইয়া যাওয়া হয়। ব্রাহ্মণ প্রতিজ্ঞা করিয়া বলে তোমাকে লক্ষ্মী দেখাইব।

সহচর লক্ষ্মীর সাজে।

ব্রাহ্মণের এক জন সহচর লক্ষ্মীর পোষাক পরিয়া লক্ষ্মী সাজে এবং সেই লোকটাকে বলে তুমি আজ হইতে আমার আশ্রিত হইলে, আমি তোমাকে অনেক ধন দিব। যে বোকা লোকটাকে বাছিয়া লওয়া হয় তাহার যদি অনেক সোনা থাকে তাহা হইলে বলা হয় যে ব্রাহ্মণকে জিনিষ দিলে সে তাহা ডাবল করিয়া দিতে পারে। যদি লোকটার অনেক রূপা থাকে তাহা হইলে তাহাকে বুঝান হয় ব্রাহ্মণ রূপাকে সোনা করিয়া দিতে পারে।

ব্রাহ্মণ বোকার বাড়িতে একবার আজ্ঞা করিয়া বসিলে পর, মন্ত্র ও শ্লোক পড়িয়া ডবল করিবার সাধারণ প্রণালীতে কাজ চলিতে থাকে। [ডবল করিবার চাতুরী অনেক প্রকার আছে। তাহা আমার ‘সাধারণ জুয়াচুরি ও চোরেদের চাতুরীসম্বন্ধীয় মন্তব্যে’ বর্ণিত হইয়াছে। ইহা ১৯১৪ সালের ২০শে নবেম্বর তারিখের বঙ্গীয় ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স গেজেটে, বিশেষ পরিশিষ্টরূপে, প্রকাশিত হইয়াছে।] বোকা তাহার সমস্ত জিনিস আনিয়া দেয়। ব্রাহ্মণ তাহা একটা পুঁটুলিতে বাঁধে বা কখনও কখনও সেই সময়ে মাটির যে সব ডেলা করা হয় তাহার মধ্যে লুকাইয়া রাখে। বহু চাতুরি ও হস্তকৌশলের দ্বারা দামী জিনিসগুলি পুঁটুলি বা কাদার ডেলা হইতে বাহির করিয়া লওয়া হয়, তাহার পর ঘরের কাদার মেঝেতে একটি গর্ত খুঁড়িয়া ঐ পুঁটুলি ও কাদার ডেলাগুলি পুতিয়া ফেলা হয়। কখনও কখনও ঐ সকল জিনিস প্রতারিত ব্যক্তির সম্মুখেই পুতিয়া ফেলা হয়। পরে রাত্রে লোকটা ঘুমাইলে আবার খুঁড়িয়া তোলা হয় ও জিনিসগুলি বাহির করিয়া লওয়া হয়। দামী জিনিসগুলি বাহির করে সহচরদিগের নিকট প্রেরিত হইলে এবং তাহারা গ্রাম ছাড়িয়া অনেক দূরে চলিয়া গেলে পর ব্রাহ্মণ যে স্থানে ধন পোতা আছে সেই স্থানের উপর ঘি ও ধুপ ধুনা পোড়াইয়া কাৰ্য শেষ করে এবং অনেক মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া সে প্রতারিত ব্যক্তিকে বলে- তুমি সাবধানে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন ঐ স্থানে চৌকি দাও ঠিক সময়ে খুঁড়িয়া তুলিলে তুমি নিশ্চয়ই দেখিবে যে যাদুমন্ত্র সফল হইয়াছে। প্রায়ই বোকা বর্ণে বর্ণে ব্রাহ্মণের উপদেশ পালন করে এবং সেই জন্য যখন সে তাহার ক্ষতির কথা জানিতে পারে তখন জানা যায় যে, জুয়াচোরেরা অনেক দূর পলাইয়া গিয়াছে।

বাড়িতে গুপ্তধন বাহির করা।

জুয়াচুরি করিয়া পূৰ্ব্বে, যাদুয়া ব্রাহ্মণ কখনও কখনও তাহারা প্রতারণার পাত্রকে জানায় যে লক্ষ্মী তাহার উপর বিশেষ অনুগ্রহ করেন ও সে তাহার বাড়ি হইতে গুপ্তধন বাহির করিয়া দিবে। তাহারা প্রায়ই আপনাদিগকে জগন্নাথ ও বৈদ্যনাথের পাণ্ডা বলিয়া পরিচয় দিয়া লোক ঠকায়।

.

কারোয়াল নট।

জাতিতত্ত্ব।

এই জাতির উৎপত্তি নির্ণয় করা বা কারোয়াল নট বলিতে কাহাদিগকে বুঝায় তাহা ঠিক নির্দেশ করা দুঃসাধ্য। প্রাচীন বাঙ্গালা পুলিশ কোডে কারোয়ালদিগের এই রূপ বিবরণ আছে :–

“ইহারা শিকারী ও দুর্ব্বৃত্ত জাতি। বহু বৎসর পূর্বে ইহাদের কতকগুলিকে রাজা মিত্রজিৎ সিংহ এদেশে আনিয়াছিলেন। ইহাদের কতক বংশধরেরা যাহারা টিকারিতে বসতি স্থাপন করিয়াছিল, সে দিন পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে যোগ করিয়া ডাকাইতি করিত।”

রিস্‌লি কিংবা কুক সাহেব কেহই কারোয়ালদের সম্বন্ধে কোন কথা বলেন নাই এবং গত আদমসুমারীতে “কারোয়াল নট” এই নামের নীচে কোন জাতি বা দলের নাম লেখা হয় নাই। তবে “নট” এই সাধারণ নামে বাঙ্গালা দেশে ১০,০০০ লোক গণনা করা হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে প্রায় ২৬০০ অর্থাৎ ১৩০০ পুরুষ ও ১৩০০ স্ত্রীলোক, রাজসাহী বিভাগে ছিল।

ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী।

১৯১৩ সালে, দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে কারোয়াল নটদিগের বিরুদ্ধে একটি মোকদ্দমা প্রস্তুত করিবার জন্য ডেপুটি সুপারিন্টেন্টেন্ট রায় সাহেব অনঙ্গ মোহন মুখোপাধ্যায় কারোয়াল নটদিগের প্রথম রেজিষ্টারি কারেন। সে সময় তিনি যাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন তাহারা প্রায় সকলেই বলিয়াছিল যে তাহাদের পূর্ব্ব পুরুষরা (আরা জেলা) ভোজপুর হইতে আসিয়াছিল ও তাহারা নিম্ন লিখিত উপজাতিতে বিভক্ত ছিল :– ১) হাবুয়া, ২) শাঁসিয়া, ৩) শচিরিয়া, ৪) ব্রজবাসী ও ৫) গুলগুলিয়া। এই উপজাতিদিগের প্রত্যেকই স্ব স্ব জাতির মধ্যে বিবাহ করিয়া থাকে।

কোন ব্যক্তি উল্লিখিত নামসমূহের কোন নাম ধারণ করিলেই যে সে কারোয়ালদিগের স্বজাতি হইল, এ কথা জোর করিয়া বলা যায় না। ইহারা বহু বৎসর ধরিয়া উত্তর বঙ্গকে উৎপীড়িত করিতেছে। ১৯১৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখের ৩০২৯ পি-ডি নং গভর্ণমেন্টের বিজ্ঞাপনে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বিষয়ক আইনানুসারে ইহারা দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। যেমন, ১৯১৪ সালের জুন মাসে গুলগুলিয়া নামধারী কতকগুলি লোককে মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলায় দেখা গিয়াছিল। উড়িষ্যা করদরাজ্যসমূহ বা মধ্য প্রদেশ ইহাদের উৎপত্তি স্থান বলিয়া বোধ হইয়াছিল এবং উত্তর বঙ্গে যাহাদিগকে দেখিতে পাওয়া যায় সেই কারোয়ালদিগের হইতে ইহারা সম্পূর্ণ পৃথকও বোধ হইয়াছিল।

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইন অনুসারে ঘোষণা।

যাযাবর ভিন্ন ভিন্ন জাতিদিগের মধ্যে প্রভেদ নির্ণয় করা কঠিন; এই জন্য যুক্ত প্রদেশের গভর্ণমেণ্ট দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে তাঁহাদিগের ঘোষণা সমস্ত ‘হাঘরিয়া’ দিগের প্রতি প্রযোজ্য করিয়াছেন। বঙ্গীয় গভর্ণমেন্টের ৩০২৯ পি-ডি নং বিজ্ঞাপন সাধারণ কারোয়াল নামে পরিচিত জাতির প্রতি প্রযুক্ত হয় যে নামেই এই জাতি বা এই জাতির অন্তর্গত কোন ব্যক্তি তকালে আত্মপরিচয় দিক না কেন বা উক্ত প্রেসিডেন্সির কোন স্থানে অভিহিত হইক না কেন; অর্থাৎ কারোয়াল নট বা কারোয়াল বা কাঞ্জড় বা কাজরহাতিয়া বা হাবুয়া বা শাসিয়া বা শানিচিরিয়া বা ব্রজবাসী বা গুলগুলিয়া বা ভাটু বা অন্য কোন জাতিগত নাম, বা ওরফে কোন নামেই অভিহিত হউক না কেন, তাহারা উক্ত আইনের উদ্দেশ্যে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।

সামাজিক ও ধর্ম্মসম্বন্ধীয় আচার ব্যবহার।

নটদের উৎপত্তি স্থান যেখানেই হউক না কেন তাহার যে বেদেশ হইতে বাঙ্গালা দেশে আসিয়াছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাহারা সাধারণতঃ পশ্চিম দেশীয় নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদিগের আচার ব্যবহারের অনুসরণ করে। তাহারা শূকর মাংস আদি সমস্ত মাংস খায় ও বলে যে মদ না খাইলে তাহারা বাঁচিতে পারে না; কিন্তু তাহারা মাছ খায় না। তাহারা হিন্দুদিগের দেবতা কালীর পূজা করে; ইহা ছাড়া তাহাদের নিজেদের দুইটি ছোট দেবতা আছে, তাহাদের একের নাম দেও ও অপরের নাম কুশমিলা। তাহাদের পুরোহিত নাই। ঐ জাতির একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায় এক প্রকার ভেল মুসলমান ধৰ্ম্ম মানিয়া চলে ও মুসলমান নাম লয়; কিন্তু রাজসাহী বিভাগে অনুসন্ধানের সময় রায় সাহেব অনঙ্গ মোহন সেন মহাশয় এরূপ কোন লোক দেখিতে পান নাই। তাহারা এক রকম প্রাদেশিক হিন্দুস্থানীয় কথা কহিয়া থাকে এবং তাহাদের নিজেদের কতকগুলি অপশব্দও আছে। তাহাদের রং কালো ও গঠন ভাল এবং তাহারা বিহার ও যুক্ত প্রদেশের নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদিগের ন্যায় পোষাক পরে। স্ত্রীলোকেরা লম্বা ঘাগরা পরে, ইহার মধ্যে তাহারা চুরি করিয়া যে জিনিষ পায় তাহা লুকাইয়া রাখে।

কারোয়াল দলের গঠন।

তাহারা দলে দলে বিচরণ করে ও মোটা কাপড়ের বা দরমার তাঁবুতে বাস করে; তাহাদের সঙ্গে অনেক মহিষ, ঘোড়া, গাধা ও কুকুর থাকে। এই সকল দলে তিন বা চারি হইতে ২৫ জন পর্যন্ত লোক থাকে; স্ত্রীলোকদিগের সংখ্যা পুরুষদিগের অপেক্ষা প্রায় অধিক হইয়া থাকে। দল চলিতে থাকিলে, পুরুষেরা প্রায়ই তখন দলে থাকে না, তাহারা পিছনে দূরে থাকে। যখন চলিতে থাকে তখন কারোয়াল দলের কর্তৃত্ব প্রায়ই একজন স্ত্রীলোকের উপর থাকে এবং তাঁবু পাতিয়া থাকিবার সময়ও স্ত্রীলোকেরা দলের প্রধান কর্তৃত্বভার লইয়া থাকে। এক দলের লোক প্রায়ই অপর দলে মিশিয়া থাকে, এই জন্য দলসমূহের লোক সংখ্যারও সময়ে সময়ে অত্যন্ত পরিবর্তন হইয়া থাকে।

পেশা।

ভিক্ষা ছাড়া কারোয়ালদিগের কোন প্রকাশ্য জীবিকার উপায় নাই; তবে তাহারা সময়ে সময়ে মহিষ, ছাগল ও গাধার ব্যবসা করে বলিয়া প্রকাশ করে। পুরুষেরা খাবার জন্য বন বিড়াল ও বেজি শিকার করিয়া থাকে। স্ত্রীলোকেরা কখনও কখনও নৃত্যগীতের দ্বারা ও ক্কচিৎ বেশ্যাবৃত্তি দ্বারা অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু চুরি করা তাহাদের সকলের কুলক্রমাগত ব্যবসা।

১৯০৭ সালে বেহার ও ছোটনাগপুরে ডাকাইতি, সিঁধচুরি ও চুরি প্রভৃতি অপরাধের ভয়ানক প্রাদুর্ভাব হয়; ঐ স্থানে কারোয়ালদিগের আগমন হেতু ঐরূপ ঘটিতেছে ইহা স্থির হয়। ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধি আইনের ৪০১ ধারা অনুসারে অন্ন পাঁচটি মোকদ্দমা করা হয় এই সকল মোকদ্দমায় রায় হইতে নিঃসংশয়ে বুঝা যায় যে চুরি ডাকাইতি কারোয়ালদিগের জীবিকানির্বাহের প্রধান উপায়। সম্পত্তির বিরুদ্ধে যত রকম অপরাধ হইতে পারে তাহারা পথে যাইবার সময়ে সেই সমস্ত অপরাধ করিয়া থাকে; অনুসন্ধানকারী কর্মচারীদিগের অনুসন্ধানের ফলে কোন কোন স্থলে ইহা প্রমাণিত হইয়াছে। কিন্তু তাহারা সচরাচর থালা, বাসন ও ছাগল চুরি করিয়া থাকে।

কারোয়ালেরা যেখানেই যায় সেখানেই গ্রামবাসীদের উপর অত্যন্ত উৎপাত করিয়া থাকে। তাহারা তাহাদের গরু, মহিষ প্রভৃতিকে দিয়া মাঠে শস্য খাওয়াইয়া অত্যন্ত ক্ষতি করে। তাহারা নিজেদের ও নিজেদের গোমহিষাদির খাবারের জন্য মাঠ হইতে শস্য চুরিও করে। স্ত্রীলোকেরা পুরুষদেরই মত চুরি প্রভৃতি অপরাধ করিতে মজবুত।

অপরাধকারিতা।

মোকদ্দমার খাতাপত্র হইতে জানা যায় যে, চুরি করিবার নিম্নলিখিত প্রণালী তাহারা বড়  পসন্দ করে। দশ বা বার জনে। মিলিয়া একটা দল করিয়া তাহারা চারিদিকে ভিক্ষা করিতে যায়। যদি তাহারা এমন বাড়ি দেখিতে পায় যে বাড়ি হইতে পুরুষেরা বাহির হইয়া গিয়াছে, তখন দলের জনকয়েক স্ত্রীলোক ভিক্ষা করিবার ছলে বা নাচিয়া গাহিয়া বাড়ির লোকদিগের ও প্রতিবেশিদিগের মন অন্য দিকে আকর্ষণ করে; এই সুযোগে দলের অন্য স্ত্রীলোকেরা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া গহনা, টাকা যাহা কিছু হাতের কাছে পায় চুরি করে ও চোরাই জিনিস তাহাদের লম্বা ঘাগরার নীচে লুকাইয়া রাখে।

সিঁধচুরি যদিও তাহাদের সাধারণ অপরাধ, তথাপি তাহারা সিধ দিয়া লোকের বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছে এ কথা কোথাও লিপিবদ্ধ হয় নাই।

বাধা পাইলে পাশবিক ও অশ্লীল ব্যবহার।

পুলিশ কিংবা গ্রামবাসীদিগের প্রতি কারোয়াল নটেরা প্রায়ই আক্রমণ করে ও অভদ্র ব্যবহার করে এবং এরূপ সময়ে তাহাদের আচরণ ভীষণ ও অশ্লীল হয়। পুরুষদিগের অপেক্ষা স্ত্রীলোকেরা অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করিতে ও ভীষণভাবে আক্রমণ করিতে বেশি প্রস্তুত। অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় স্ত্রীলোক ও পুরুষ উভয়েই একেবারে উলঙ্গ হয় এবং অত্যন্ত অশ্লীল ভাবভঙ্গীও আচরণ করে। এমন কি যাহাদিগকে বাধা দিতেছে তাহাদের গায়ে বিষ্ঠা পর্যন্ত নিক্ষেপ করে। তাহারা তাহাদের বালকবালিকাগণকে পর্যন্ত লইয়া ছোঁড়াছুড়ি করে এবং এক স্থলে একজন স্ত্রীলোক তাহার শিশু সন্তানকে আক্রমণের অস্ত্রস্বরূপ ব্যবহার করিয়াছিল। এমনও দেখা গিয়াছে যে নট স্ত্রীলোকেরা পশ্চাৎ দিক হইতে লোককে আক্রমণ করিয়া তাহাদিগতে মাটিতে ফেলিয়া দেয় ও বিশেষরূপে আঘাত করিবার জন্য বীচি টিপিয়া ধরে।

নটেরা প্রায়ই তাহাদের নাম বদলায় এবং তাহাদের মধ্যে যাহারা পুলিশের খুব পরিচিত তাহাদের অনেক বদনাম আছে। গত কয় বৎসরে রাজসাহী, দিনাজপুর, পুর্ণিয়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, নদীয়া, রঙ্গপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি, বগুড়া, দার্জিরিং, মুর্শিদাবাদ ও আসামের গোয়ালপাড়ায় কারোয়ালেরা অপরাধী বলিয়া দণ্ডিত হইয়াছে।

১৯১৩ সালের প্রাথমিক রেজিষ্ট্রেশনে উত্তর বঙ্গে সতরটি দর দেখা গিয়াছিল, তাহাদের মোট সংখ্যা ছিল ২৪১ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি। ১৯১৩ সালের প্রারম্ভে উত্তর বঙ্গে যে সতরটি দল দেখা গিয়াছিল, তাহাদের ১১১ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও ১৩১ জন প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীলোকের মধ্যে পুরুষের ৯৯ জন ও স্ত্রীলোকদিগের ৮৬ জন হাজির জামিন লওয়া যায় না এমন অপরাধে বা এইরূপ অপরাধ হইতে উৎপন্ন অসদুপায়ে জীবিকানির্ব্বাহকরণের মোকদ্দমায় অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছিল; অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদিগের শতকরা ৮৯ জন ও প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীলোকদিগের শতকরা ৬৬ জন, কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক মোট পুরুষ ও স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে শতকরা ৭৬ জন এইরূপ মোকদ্দমায় অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছিল।

ভারতবর্ষের গভর্ণমেন্ট এক্ষণে আদেশ করিয়াছেন যে বাঙ্গালা দেশের কারোয়াল নটদিগকে দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনের ১২ ধারা অনুসারে একস্থানে বাস করাইতে হইবে এবং এই উদ্দেশ্যে রঙ্গপুর জেলায় সৈদপুর গ্রামে একখণ্ড জমি লওয়া হইয়াছে; এই জমির উপর বসতি স্থাপনের জন্য ঘর বাড়ি প্রস্তুত হইতেছে। এই বসতি মুক্তি ফৌজের তত্ত্বাবধানে থাকিবে।

.

কেপমারি বা ইনাকোরাবার।

মান্দ্রাজের রেলওয়ে ও ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স বিভাগের পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল পি, বি টমাস সাহেব, মান্দ্রাজ গভর্ণমেন্টের জন্য মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির দুর্ব্বৃত্ত জাতিদিগের সম্বন্ধে একখানি পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছেন; তাহা হইতে কেপমারি বা কোরাবার বা ইনাকোরাবারদিগের নিম্নলিখিত বিবরণী উদ্ধৃত করিতে তিনি অনুগ্রহপূর্ব্বক অনুমতি দিয়াছেন :–

জাতিতত্ত্ব ও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর কথা।

“কেপমারিরা যে সকলেই একজাতি তাহা নহে; তাহাদের বন্ধন অনেকটা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন; কারণ যে ব্যক্তি কেপমারি হইয়া জন্মায় নাই সেও ইহাদের মধ্যে থাকিতে পারে; এবং বালিকা চুরি করা এবং এমন কি বালিকা ক্রয় করা তাহাদের একটা নিত্য অভ্যাস। কেপমারি বালকদিগের সহিত এই বালিকাদের বিবাহ দেওয়া হয়। এই বালিকারা প্রায়ই উচ্চজাতীয়া হয় এবং কখনও অস্পৃশ্য জাতি হইতে লওয়া হয় না। বালকদিগকে ক্কচিৎ চুরি করিয়া আনা হয় বা দলভুক্ত করা হয়। তাহারা সচরাচর কেপমারি, আলাগিরি, কোরাবার ও ইনাকোরাবার নামে পরিচিত। তাহারা উলিয়াকরণ, সেৰ্ব্বকরণ বা পালারকরণ নামে আপনাদের পরিচয় দেয়, কিন্তু তাহারা অনেক নামে চলিয়া থাকে। তাহারা বৃহৎ কোরাবার বংশের একটি শাখা এবং থার্সটন সাহেব প্রণীত “দক্ষিণ ভারতের জাতি ও সম্প্রদায়” নামক গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ৪৩৯ পৃষ্ঠায় এই নামেই উল্লিখিত হইয়াছে; কিন্তু তাহারা এ কথা অস্বীকার করে এবং তাহাদিগকে কোরাবার বলিলে ক্রুদ্ধ হয়।”

অপরাধকারিতা।

“সমস্ত সম্প্রদায়টাই প্রকৃত বদমায়েস এবং তাহাদের কেহই জীবিকানির্বাহের জন্য কোন কাজ করে না। লোকগুলো সিঁধেল, গাঁঠকাটা ও পাকা চোর। স্ত্রীলোকেরা সকলেই চোর এবং বালকবালিকারা সাত বৎসর বয়সেরই পাকা চোর হইয়া উঠে।”

“স্ত্রীলোকেরা বেশ্যাবৃত্তি করে না। ঐ সম্প্রদায় ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ, ইহাদের সম্বন্ধে আমরা অনেকটা সত্য খবর পাইয়াছি। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ইহাদের অপেক্ষা প্রকৃত দুর্ব্বৃত্ত জাতির উৎকৃষ্ট উদাহারণ আর নেই এবং এই সম্প্রদায়ের প্রতি দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনের প্রয়োগ যেরূপ সঙ্গত এমন আর কোন সম্প্রদায়ের প্রতি নহে।”

কেপমারি দল।

“এই সম্প্রদায় নানা দলে বিভক্ত; এই দলসমূহের মধ্যে পরস্পর বিবাহ চলে, সাধারণ যাযাবর দুর্ব্বৃত্ত দলের সহিত এই সকল দলের প্রভেদ এই যে ইহারা সকলেই কোন না কোন স্থায়ী বসতিতে বাস করে; এই সকল বসতিতে দলস্থ লোকদিগের বাড়ি আছে; নিয়মিত অন্তর অন্তর তাহারা সেই সকল বাড়িতে ফিরিয়া আসে। দলের কোন লোক প্রায়ই এই সকল বসতির নিকটে কোন স্থানে চুরি ডাকাইতি করে না; এখানে তাহারা সম্ভ্রান্ত লোক বলিয়া পরিচয় দেয়।”

রেলে চুরি।

“তাহারা শিক্ষিত ও পাকা চোর। অবাধে রেলে চড়িয়া চুরি ডাকাইতি করিবার জন্য যাতায়াত করে ও ডাক ঘরের সাহায্যে টাকা পাঠায় এবং সুবিধা পাইলেই, সমস্ত প্রেসিডেন্সিতে, রেলওয়েতে, সহরে, কোন মেলা বা উত্সবের সময় দুষ্কাৰ্য্য করিয়া থাকে।”

প্রধান আচ্ছা।

“এই সম্প্রদায়ের প্রধান আড্ডা এদয়াপত্তি, ইহা ত্রিচিনপল্লী জেলার থোগামালাই থানার অধীন। এই স্থানে ইহাদের সংখ্যা ২০৮ কিন্তু বর্তমানে কেবল ৭১ জনের অঙ্গুলির ছাপ আমরা পাইয়াছি। এদায়পত্তি গ্রামে প্রায় ২৫ খানি বাড়ি আছে; ইহার মধ্যে ১৩টা বাড়ি কেপমারিদের। অন্য গ্রামবাসীদিগের বাড়ি, আর ইহাদের বাড়ির মেধ্য কোন আকৃতিগত প্রভেদ নাই। প্রত্যেক বাড়িতে অনেকগুলি করিয়া পরিবার বাস করে এবং ঐ বাড়িতে প্রত্যেক পরিবারেরই অংশ আছে। ইহার কারণ, মোটের মাথায়, সম্প্রদায়ের অর্ধেক লোক হয় চুরি ডাকাইতির জন্য বাড়ি ছাড়া; নয় জেলে বাস করে। কোন বাড়ি কখনও খালি পড়িয়া থাকিতে দেওয়া হয় না, এক বা একাধিক অংশীদার পরিবার লইয়া তাহাতে বাস করে। পুরুষ, স্ত্রী ও বালকবালিকা লইয়া উল্লিখিত ২০৮ জন লোকের মধ্যে ১০৫ জন অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছিল, ৫২ জনের নিকট হইতে জামিন লওয়ার ধারা অনুসারে মুচলেকা লওয়া হইয়াছিল; মোট ২৬০ জন দোষী সাব্যস্ত হইয়াছিল ও ১০৭ জনের নিকট হইতে মুচলেখা লওয়া হইয়াছিল। সদাচরণের জন্য মুচলেখা দিতে হইলে, এই সকল ব্যক্তি প্রায়ই জামিন্দার পায় না। তাহারা জেলে যাওয়াই পছন্দ করে।”

পোষাক ও শিক্ষা।

“এই দলের লোকেরা দারুণ দৈন্য হেতু বা ঘটনা বলে বাধ্য হয় যে অপরাধ করে তাহা নহে। তাহারা শিক্ষিত, অতি সুন্দর পোষাক পরে ও অতি সুন্দরভাবে থাকে এবং অনেক ভাষা জানে (তেলুগু, ক্যানারিস, তামিল, হিন্দুস্থানী ও কখনও কখনও ইংরাজী অন্ততঃ তিনটি ভাষা জানে না এমন কেপমারি প্রায় দেখা যায় না)।”

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইন অনুসারে ঘোষণা।

১৯১৩ সালের জুন মাসে মাদ্রাজ গভর্ণমেণ্টকর্ত্তৃক থোগামালাই কোরাবারেরা দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে।

রেলওয়ে বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই দলের আড্ডা ও কাৰ্য্যক্ষেত্রও বিস্তৃত হইয়াছে এবং তাহাদিগকে এক্ষণে বোম্বাই, বাঙ্গালা ও যুক্ত প্রদেশে দেখিতে পাওয়া যায়। কখনও কখনও তাহারা পূজারির ও অর্শ্ব চিকিৎসকের কার্য্য করে। ৮৯৮ খৃষ্টাব্দে পুরী রেল লাইনের উপর যে বিস্তর চুরি হইয়াছিল তাহা কেপমারি বা কোরাবারেরাই করিয়াছিল বলিয়া জানা গিয়াছিল।

পুরী ও কটকে কাৰ্য্য।

১৯০৪ সালে কি ঐ রূপ সময়ে তাহাদের বড় বড় দল কটক ও পুরী জেলায় দেখা গিয়াছিল। পরে তাহাদিগকে বাঙ্গালা দেশে দেখা যায়। কিন্তু এক্ষণে বিহার উড়িষ্যা প্রদেশেও তাহাদিগকে দেখা যায়। সেখানে যখন তাহারা প্রায় আচ্ছা করে তখন তাহাদের রীতি এই ছিল যে, তাহারা দলে দলে নানা দিকে ঘুরিয়া বেড়াইত ও চোরাই মাল বিক্রয় করিবার জন্য কটকে ফিরিয়া আসিত।

মাদ্রাজ পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেন্টে পৌপা রাও নাইদু তাহার পুস্তকে “রেলওয়ে চোরদিগের ইতিহাস” ইহার প্রথম সংস্করণ ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হইয়াছিল, লিখিয়াছেন যে, তাহাদের মধ্যে কতক লোক কলিকাতা ও বোম্বাইয়ে এবং এমন কি উত্তরে পাটনা ও দিল্লীতে পর্যন্ত বসতি স্থাপন করিয়াছিল।

রেলওয়ে চুরির প্রণালী।

পৌপা রাও নাইদু তাহাদিগকে পাকা রেলওয়ে চোর বলিয়াছেন; তাহারা বিশ্রাম ঘর, প্ল্যাটফর্ম ও গাড়ি হইতে থলিয়া, পুঁটুলি ও ছোট ছোট বাক্স চুরি করে। আরোহীদিগের বহু মূল্য দ্রব্যপূর্ণ গাঁটরি সরাইয়া তাহার স্থলে সেই রূপ বাহ্য আকৃতি বিশিষ্ট অব্যবহাৰ্য্য নেকড়া পরিপূর্ণ থলিয়া বা পুঁটুলি রাখিয়া দেয়। যে ষ্টেশনের জন্য টিকিট খরিদ করা হয় সেই স্টেশনের এক স্টেশন পশ্চাতে চোরাই থলিয়াসহ নামিয়া, কোয়াবার ট্রেন চলিয়া না যাওয়া পর্যন্ত পায়খানায় লুকাইয়া থাকে এবং রেল বা পুলিশ কর্মচারীরা জিজ্ঞাসা করিলে দেখায় যেন ট্রেণে উঠিতে না পারায় তাহার বড় কষ্ট হইয়াছে। ভোলা থলিয়া কাটা ও রাত্রে গমনকালে গাড়িতে বাক্সভাঙ্গা বিষয়ে কোয়াবারেরা ভঁপতাদের প্রণালী অনুসরণ করে; কিন্তু সাধারণতঃ তাহারা বিশ্রামাগারে ও প্লাটফরমের উপর কাজ করাই পছন্দ করে।

নাইদু সাহেবের মতে, তাহারা সময়ে সময়ে ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোকের ন্যায় ভ্রমণ করে, পুরুষেরা রেশম পাড় কঞ্জিভরাম বা কইটোরের কাপড় পরে এবং তাহাদের স্ত্রীলোকেরা কোরানাদূর কাপড় ও কাঁচুলি পরে।

.

মাল্লা ও অপরাপর বোম্বেটে।

মাল্লা শব্দের অর্থ।

এখানে মাল্লা শব্দের অর্থ সম্পূর্ণরূপে ব্যবসায়গত; যাহারা নদীতে ব্যবসা, দাড়ি মাঝি বা জেলের কাজ করে তাহাদেরই বুঝায়। ইহা যে কেবল কোন বিশেষ শ্রেণীর বা বিশেষ জাতির বা কোন বিশেষ জেলা বা প্রদেশের মাল্লাদিগকে বুঝায় তাহা নহে। অনেক জাতিই এই নামের অন্তর্গত; ইহাদের অনেকেই যে স্বভাবতঃ বদমায়েস সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, অপর জাতিদিগের দুষ্কাৰ্য্য করিবার বিশেষ কোন প্রবৃত্তি নাই। অবশ্য এ কথা বলিতে হইলে আমাদিগকে, কোয়ারি সাহেব জলদস্যুদিগের সম্বন্ধে তাহার মন্তব্যে যে বলিয়াছেন যে মাল্লাদের সাধারণতঃ বদনাম আছে; এই উক্তি অগ্রাহ্য করিতে হয়।

জলদস্যুতার কথা ঠিকভাবে রিপোর্ট করা হয় না।

জলদস্যুতার সংখ্যা প্রভৃতি সম্বন্ধে পুলিশ যে হিসাব দেয় তাহা অন্য প্রকার অপরাধের হিসাবের ন্যায় তত বিলাসযোগ্য নতে। টব কারণ নির্ণয় করা সহজ। নৌকাযোগে গমনকালে কোন ব্যক্তির দ্রব্যাদি লুণ্ঠিত হইলে তিনি পুলিশে প্রায় সংবাদ দেন না; কারণ নৌকাযাত্রীরা এক স্থান হইতে অন্য স্থানে আবশ্যকীয় কাৰ্য্যানুরোধেই যাইয়া থাকেন। একে তাহার দ্রব্যাদি লুণ্ঠিত হইল, তাহার উপর আবার যদি খুব সম্ভবতঃ অতি দুরবর্তী থানায় খবর দিতে হয় ও পরবর্তী অনুসন্ধানে উপস্থিত থাকিতে হয় তাহা হইলে কার্যে বিলম্ব ঘটিয়া আবার ক্ষতি হইবে। আবার তাহার ক্ষতিপূরণের আশাও কম, যেহেতু বোম্বেটেরা ডাকাইতি করিয়া ঘটনাস্থল হইতে যতদূরে পলাইয়া যাইতে পারে প্রায় তাহারই চেষ্টা করিয়া থাকে। নদীর উপর কৃত অপরাধের আন্দাজ শতকরা ৫০টিরও রিপোর্ট হয় না। ইহা যে খুব বেশি বলা হইল তাহা আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় শতকরা ২৫ অপরাধের রিপোর্ট করা হয় না।

পশ্চিম হইতে নিয়মিতভাবে নৌকায় আমদানি।

প্রত্যেক বৎসর যুক্তপ্রদেশ ও বিহার হইতে হাজার হাজার নৌকা গঙ্গা বাহিয়া বাঙ্গালা দেশে আসিয়া থাকে। ইহাদের নাবিকদিগের মধ্যে পাশি, চামার, পালোয়ার দোসাদ, ভড় ও অন্যান্য দুর্ব্বৃত্ত জাতির লোক থাকে। যুক্তপ্রদেশ ও বিহারের যে সমস্ত জাতি দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া সর্বত্র স্বীকৃত হইয়াছে তাহাদের প্রত্যেকের বিষয় পৃথক পৃথক অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে, অতএব জলদস্যুরা কিরূপে বাঙ্গালা দেশ আক্রমণ করে ও তাহারা প্রধানত কোন কোন স্থানে যাইয়া থাকে কেবল তাহাই মোটামুটিভাবে এখানে বলা প্রয়োজন। সি ডব্লিউ সি প্লাউডেন, সি, আই, ই সাহেব ১৯১৩ সালে হিসাব করিয়া দেখিয়াছিলেন যে, অন্ততঃ ৬০০০ হাজার দুর্ব্বৃত্ত মাল্লা উত্তম-পশ্চিম প্রদেশ হইতে আসিয়া বাঙ্গালা দেশের সর্বত্র বিচরণ করিতেছে। যুক্ত প্রদেশ ও বিহার হইতে যে সমস্ত মাঝি মাল্লা আসে, তাহাদের অনেকেই সাধু ব্যবসায়ী ও মালবাহী হইলেও এমন অনেক নৌকা আসে, যাহাদের মাল্লারা বদমায়েস লোক; চুরি ডাকাইতি করাই তাহাদের নৌকাযাত্রার প্রধান উদ্দেশ্য। তবে তাহাদের কু অভিপ্রায় ঢাকিয়া রাখিবার জন্য তাহারা সম্পূর্ণরূপে সাধু ব্যবহারও করিয়া থাকে।

মাল্লারা যে পথে যায়।

তাহারা গঙ্গা বাহিয়া অনেক দূর যাইয়া থাকে, কখনও কখনও চট্টগ্রাম ও সুন্দরবন পর্যন্তও গিয়া থাকে এবং ভাগীরথী ভাগমতি ও অন্যান্য নদী বাহিয়া কলিকাতা, যশোহর ও নদীয়া, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা বাহিয়া আসাম ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী সকল বাহিয়া কুচবিহার ও আলিপুর দুয়ারের জঙ্গলে গিয়া থাকে, এখন হইতে তাহারা কাঠ আনিয়া বাঙ্গালা দেশের ডিপোতে বিক্রয় করে। এই উত্তর-পশ্চিম দেশীয় মাল্লারা প্রায়ই আগষ্ট মাসে তাহাদের বাড়ি ছাড়িয়া আসে, কিন্তু কেহ কেহ ট্রেণে করিয়া তাহাদের বাড়িতে বা বাড়ি হইতে অন্যত্র যায়। বাঙ্গালা দেশে উত্তর-পশ্চিম দেশীয় বদমায়েসদিগের যে সমস্ত আড্ডা আছে সেই খানে ইহারা নৌকায় কাজ লয় বা নৌকা ছাড়িয়া দেয়। নিম্নলিখিত আড্ডাগুলিই তাহাদের প্রিয় আড্ডা :

থামিবার স্থান।

ধুবড়ি (গোয়ালপাড়া জেলা, আসাম)।

যাত্রাপুর (রঙ্গপুর জেলা)।

ফুলছড়ি (রঙ্গপুর জেলা)।

গোয়ালন্দ (ফরিদপুর জেলা)।

পাংশা (ফরিদপুর জেলা)।

ভৈরব বাজার (ময়মনসিংহ জেলা)।

নারায়ণগঞ্জ (ঢাকা জেলা)।

সিরাজগঞ্জ (পাবনা জেলা)।

খোক্‌সা (নদীয়া জেলা)।

কুষ্টিয়া (নদীয়া জেলা)।

পোড়াদহ (নদীয়া জেলা)।

মীরপুর (নদীয়া জেলা)।

দামুকদিয়া (নদীয়া জেলা)।

সারাঘাট (পাবনা জেলা)।

আজিমগঞ্জ (মুর্শিদাবাদ জেলা)।

এই মাল্লাদের কতক লোক সারা বত্সর তাহাদের নৌকা লইয়া বাঙ্গালা দেশেই থাকে; কিন্তু অনেকেই বসন্তকালে তাহাদের দেশে ফিরিয়া যায়। বাঙ্গালা দেশের নদীতে প্রায় প্রত্যেক প্রধান আড্ডায় উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লোকদিগের অনেক দল দেখা যায় এবং এই রূপ প্রত্যেক দলে যুক্ত প্রদেশের দুর্ব্বৃত্ত জাতিদিগের প্রতিনিধি সকল থাকে। উত্তর পশ্চিম প্রদেশের বোম্বেটেরা কেবল যে জলেই দস্যুতা করে তাহা নহে। কখনও কখনও নদীতীর হইতে বহুদূর যাইয়া স্থলে ডাকাইতি করিয়া থাকে। পাশিদিগকে প্রায়ই দুর্ব্বৃত্ত মাল্লাদিগের অন্তর্গত দেখা যায়; ইহারা সিঁদ কাটিতে বিশেষ দক্ষ।

চোরাইমাল বিক্রয়।

এবং চোরাই টাকা কড়ি প্রায়ই মনি অর্ডার করিয়া দেশে পাঠাইয়া থাকে।

গহনাপত্র স্থানীয় চোরাই মালের গ্রাহকদিগকে বিক্রয় করে, অথবা ভাঙ্গিয়া টুকরা টুকরা করিয়া লুকাইয়া রাখে, পরে দেশে গিয়া সেখানকার চোরাইমালের গ্রাহকদিগকে বিক্রয় করিয়া ফেলে।

বাঙ্গালা দেশে যে সমস্ত বৈদেশিক বোম্বেটে আসিয়া চুরি ডাকাইতি করে তাহাদের অধিকাংশ যুক্তপ্রদেশ হইতে আসিলেও দুর্ব্বৃত্ত ও অত্যন্ত কষ্টদায়ক বনফড়েরা বিহার হইতে আইসে (২য় অধ্যায়, ২য় ভাগে দ্রষ্টব্য)। কিন্তু বাঙ্গালা দেশের নদীতে কেবল যে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের দুৰ্ব্বত্তেরাই চুরি ডাকাইতি করিয়া থাকে তাহা নহে। সান্দার ও গায়েনেরা (প্রথম ভাগের ৬ ও ১১ অধ্যায় দ্রষ্টব্য) একমাত্র বাঙ্গালা দেশেরই লোক; ইহারা চুরি ডাকাইতি করিয়াই জীবিকানির্ব্বাহ করে এবং সাধু ব্যবসায়ের ভান মাত্র ইহাদের নাই। বাখরগঞ্জ জেলার নদীতীরবর্তী লোকদিগের মধ্যে এমন শত শত লোক আছে, যাহাদের অন্য জীবিকার উপায় থাকিলেও তাহারা সুবিধা পাইলেই নদীতে চুরি ডাকাইতি করিয়া থাকে।

১৯১৩ খৃষ্টাব্দে পুলিশ সুপারিন্টেন্টে পি, কোয়ারি সাহেব উত্তর-পশ্চিম দেশীয় বোম্বেটেদিগের সম্বন্ধে একটি মন্তব্য প্রকাশ করেন; ইহা হইতে ইহাদের কার্যপ্রণালী ও বাঙ্গালা দেশে ইহাদের আড্ডসম্বন্ধে অনেক খবর পাওয়া যায়।

তদানীন্তন পুলিশ সুপারিন্টেন্টে পি, বি, ব্র্যামলি সাহেব বাঙ্গালা দেশের নদীতে চুরি ডাকাইতি সম্বন্ধে অত্যন্ত বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছিলেন; তাহার রিপোর্টে এ বিষয়ে অনেক আবশ্যক জ্ঞাতব্য কথা আছে।

.

চৈন মাল্লা।

বাসস্থান।

চৈন মাল্লারা প্রধানতঃ যুক্তপ্রদেশের মির্জ্জাপুর, জৌনপুর, গাজীপুর, গোরক্ষপুর, বালিয়া ও আজমগড় জেলায় বাস করে। তাহাদিগকে সেপ্টেম্বর ও হোলি উৎসবের মধ্যবর্তী সময়ে ও মার্চ মাসের শেষ হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পৰ্য্যন্ত কালের মধ্যে বাঙ্গালা দেশে দেখিতে পাওয়া যায়।

অপরাধকরণের প্রণালী।

তাহারা নানা প্রকার চুরি করিয়া থাকে; স্ত্রীলোক ও ১. শিশুদিগের গাত্র হইতে গহনা ছিনাইয়া লয় ও পকেট মারে; এই কাৰ্য্য করিবার জন্য একখানি ছোট ছুরি বা ধারাল কাঁচখণ্ড ব্যবহার করে; এই যন্ত্রের সাহায্যে তাহারা পকেট, থলিয়া বা এদেশের লোকেরা তাহাদের পরিধেয় বস্ত্রাদিতে যে ছোট ছোট গাইট করিয়া মূল্যবান দ্রব্য বাঁধিয়া রাখে সেই সমস্ত গাইট কাটিয়া ফেলে। চৈন মাল্লারা সাধারণতঃ সিঁধ দেয় না। গত কয়েক বৎসরে পুলিশের সম্মুখে এই দলের এমন লোক আনীত হইয়াছে, যাহারা বহু বর্ষ ব্যাপিয়া, বাঙ্গালা, বিহার ও যুক্তপ্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলায়, ৩৭৯ ধারা ও অসদুপায়ে জীবিকানির্ব্বাহ সম্বন্ধীয় ধারা অনুসারে উপর্যুপরি অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছে।

বাবোয়ার ও সানৌডিয়াদের সহিত সাদৃশ্য।

সি, ডব্লু, সি প্লাউডেন সি আই, ই, সাহেব বলেন যে, তাহাদের কায্যপ্রণালী বারোয়ার, সানৌড়িয়া ও ভাঁপতাগিদের ন্যায়। তাহাদের স্বভাবসম্বন্ধে তিনি বলেন :

“বাঙ্গালা দেশে যে সমস্ত চৈন মাল্লা আসে তাহাদের স্বভাব আমি যতদূর লক্ষ্য করিয়াছি তাহাতে দেখা যায় যে, তাহারা কেবল পকেট মারিয়া থাকে এবং সচরাচর একাকী কাজ করিয়া থাকে। তাহারা কোন কেন্দ্রস্থলে, যেমন নাটোর, নারায়ণগঞ্জ বা সিরাজগঞ্জে দল বাঁধিয়া আসিয়া থাকে এবং তার পর দল ভাঙ্গিয়া গমন করে। হাট বা যেখান লোক জমা সম্ভব সেইখানে যায়। ধৃত হইলে তাহারা সকল স্থানেই মিথ্যা নাম ও ঠিকানা দেয় এবং আধপাগলার ভান করে। তাহারা প্রায়ই আপনাদিগকে মুনিয়া বলিয়া পরিচয় দেয় এবং বস্তুতঃ মুনিয়াদের মধ্যে একটা উপজাতি আছে যাহারা চৈন নাম ধারণ করে। যখন একাকী ইতস্ততঃ ঘুরিয়া বেড়ায় তখন তাহারা ফাঁকা জায়গায় গাছের তলায় নিদ্রা যায়।

এক স্থলে এক জন চৈন মাল্লা ধৃত হইয়াছিল। অনুসন্ধানে জানা যায় যে, সে সহরের ঠিক বাহিরে একটা গাছের তলায় শুইয়াছিল। সেই স্থানটা খুঁড়িয়া ফেলায় মাটির নীচে একটা থলিয়া দেখা যায়, তাহার মধ্যে কিছু টাকা ও সিকি দুয়ানি ছিল।

দলে দলে যাত্রা করা।

যদিও বাঙ্গালা দেশে ইহারা একাকী কাৰ্য্য করে বলিয়া মনে হয়, তথাপি একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, একজন চৈন মাল্লা ধৃত হইলে আরও চৈন মাল্লা আছে তাহা বুঝা যায়; সুতরাং যেমনই একজন চৈন মাল্লা ধৃত হয়, অমনি সেই জেলার সমস্ত থানায় সেই সংবাদ প্রেরণ করা উচিত এবং নিকটবর্তী জেলাসমূহে ও গভর্ণমেন্ট রেলওয়ে পুলিশেও সে কথা জানান কর্তব্য এবং সকলে মিলিয়া দলের অন্যান্য লোকদিগের অনুসন্ধান করা উচিত।”

বাঙ্গালা দেশের কাৰ্য্যক্ষেত্র।

পূৰ্ব্ববঙ্গের কাগজপত্র হইতে জানা যায় যে, বাঙ্গালা দেশে যে সমস্ত চৈন মাল্লাকে ধৃত করা হয় তাহাদের অনেকেই বালিয়া জৌনপুর ও গোরক্ষপুর হইতে আসে। তাহারা বাঙ্গালা দেশে সচরাচর রাজসাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, ও ঢাকা জেলাতেই গিয়া থাকে। গঙ্গানদীর দক্ষিণে তাহাদের দণ্ড খুব কম হইয়াছে।

১৯১০ সালে বালিয়া চৈন মাল্লাদিগের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধি আইনের ৪০১ ধারা অনুসারে দলবদ্ধ হইয়া অপরাধ করার জন্য এক মোকদ্দমা আনীত হয়। সেই মোকদ্দমায় তাহাদের ৩৭ জনের অপরাধ সাব্যস্ত হয়।

১৯০৪ সালে ব্রামলি সাহেব লিখিয়াছেন :–

ঠিক একই প্রকারে দল আগ্রা, মথুরা ও আলিগড়ে বাস করে।

“মথুরা আগ্রা ও আলিগড়ের মাল্লারা ঠিক চৈন মাল্লাদের মতই বদমায়েস। তাহারা চৈন মাল্লাদিগের সহিত কোন সম্বন্ধ স্বীকার না করিলেও উভয় দলেরই পকেট মারার প্রণালীর মধ্যে অনেক সাদৃশ্য আছে এবং তাহাদের মধ্যে একটা কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, তাহারা সৰ্ব্ব প্রথমে বালিয়া হইতে আসিয়াছিল। তাহাদের কাৰ্য্যক্ষেত্র স্বতন্ত্র, যেহেতু যুক্ত প্রদেশের জেলাসমূহ ছাড়া, কলিকাতা ও তাহার চতুঃপার্শ্ববর্তী জেলাসমূহেও তাহাদের অপরাধ প্রমাণিত হইয়াছে।

মথুরা, আগ্রা ও আলিগড়ের মাল্লারা প্রায় ঠাকুর ও বেনিয়া বলিয়া চলিবার চেষ্টা করে এবং চৈন মাল্লাদের মত, ধরা পড়িলে, মিথ্যা নাম ও ঠিকানা দেয়।”

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে ঘোষণা।

১৯১৪ সালে আলিগড়, আগ্রা বুলন্দসহর ও মথুরা জেলায় কতকগুলি মাল্লা এবং বালিয়ার ও যুক্ত প্রদেশের গোরক্ষপুর ও মির্জ্জাপুর জেলায় চৈন মাল্লারা দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ঘোষিত হইয়াছিল। (১৯১৪ সালের ৩-১৫ এপ্রিল তারিখের যুক্তপ্রদেশের গভর্ণমেন্টের ৭২৮-৮-১৫৮নং বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য)।

(গোরক্ষপুর) ২৬৫-৮ ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৪।

(বালিয়া) ২৬৭-৮ ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৪।

(বুন্দেল সহর ও মথুরা) ২৬৩-৮ ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৪।

(আগ্রা) ২৫১-৮ ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৪।

(আলিগড়) ৩৯০-৮ ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯১৪।

(মির্জ্জাপুর) ২৬১-৮ ৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৪।

.

মিন্‌কা

মিনকা (স্ত্রীলিঙ্গে মিন্‌কিনী) বা মাদারিয়া হাঘরে মুসলমান সম্প্রদায়; বিহার ও উড়িষ্যার গাঙ্গপুর করদ রাজ্যে ইহাদের প্রধান আচ্ছা।

উৎপত্তি।

১৯১৪ সালের ৯ই অক্টোবর তারিখের বিহার ও উড়িষ্যার ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স গেজেটের বিশেষ পরিশিষ্টে মিনকাদিগের যে বিবরণ দেওয়া হইয়াছে, তাহা হইতে মনে হয় যে, তাহারা, প্রায় ৫০ বৎসর পূর্বে মধ্য প্রদেশের বিলাসপুর ও রায়পুর হইতে গাঙ্গপুরে আসিয়াছিল। এই দলের কতক অংশ এখনও মধ্য প্রদেশে আছে; ইহারা “মাদারি” বা “গাহরি” নামে পরিচিত।

১৯১১ সালের আদমসুমারিতে মিনকাদিগকে পৃথক শ্রেণী বলিয়া দেখান হয় নাই। সম্ভবতঃ তাহারা অন্য মুসলমানদিগেরই অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। মোটামুটি ধরলে গাঙ্গপুর রাজ্যে তাহাদের সংখ্যা বয়স্ক ২০০ ব্যক্তিরও কম। তাহারা একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়; অন্য মুসলমানদিগের সহিত ইহাদের বিবাহ চলে না।

রীতিনীতি।

তাহারা মদ খায় এবং তাহাদের স্ত্রীলোকদিগের স্বভাবচরিত্র খারাপ। পুরুষেরা প্রকাশ্যতঃ ভিক্ষাদ্বারা ও ভোজবাজি দেখাইয়া জীবিকা উপার্জন করে। কিন্তু পরিবার প্রতিপালনে তাহাদের পরিবারবর্গ বৎসরের অধিকাংশ সময়ই দূরদেশে (ঘুরিয়া বেড়ায়)। তাহাদের প্রধান আয়ের উপায় চুরি। এই কাৰ্য্যে পুরুষেরা সামান্য ভার লয়। স্ত্রীলোকেরা ও বালিকারাই পাকা চোর।

আকৃতি।

পুরুষ মিনকারা অনাৰ্য্য ধরণের, দেখিতে বুনোর মত; তাহাদের চুল লম্বা ও মুখের রং কালো; তবে কেহ কেহ চুল কাটে ও দেখিতে সাধারণ নীচ শ্রেণীর মুসলমানের ন্যায়। প্রায়ই তাহাদের গঠন বলিষ্ঠ ও সুপুষ্ট। তাহারা কখনও কখনও পূৰ্ব্ববঙ্গের মুসলমানদিগের ন্যায় লুঙ্গী ও কোট পরে এবং ভ্রমণশীল ভারতীয় ভোজ বাজিকরদিগের যে সমস্ত সাধারণ আসবাব আছে তাহা সঙ্গে লইয়া ফেরে।

স্ত্রীলোকদিগের দৈর্ঘ্য ও গঠন মাঝারিরকমের এবং তাহারা দৃঢ় ও চটপটে। তাহারা হাতে ও মুখে উঁকি পড়ে এবং সাধারণ রূপার গহনা কাঁচের চুড়ি ও গলায় মালা পরে। তাহারা বাঙ্গালী স্ত্রীলোকদিগের ধরণে, প্রায় পূর্ব্ববঙ্গের ধরণে কাপড়চোপড় পরে, এ রূপ করিবার উদ্দেশ্যে যাহাতে লোকে তাহাদিগকে বাঙ্গালী মনে করে।

ভাষা।

তাহারা আপনাদের মধ্যে অশুদ্ধ মারাঠি ভাষায় কথা কয়। কিন্তু সাধারণতঃ হিন্দী, উড়িয়া ও বাঙ্গালা ভাষায় কথাবার্তা কহিতে পারে। অধিকাংশ হাঘরে বদমায়েস জাতিদিগের ন্যায়, তাহারা দশহারার পর বাড়ি ছাড়িয়া বাহির হয় ও সচরাচর বর্ষা আরম্ভ হওয়া পর্যন্ত বাহিরে থাকে। তাহারা দশ জন বা বার জনে এক এক দল বাঁধিয়া বহুদূর ভ্রমণ করে; সম্ভব হইলে রেলে চড়িয়া যায় এবং কখনও রেল হইতে অধিক দূর যায় না। এই দশ জন বা বার জনের দল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়। তাহাদের একটি প্রধান আড্ডা থাকে যেখানে তাহারা মিলিত হয়।

কার্যপ্রণালী।

তাহারা সচরাচর রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকটেই কাজ করে এবং নিম্নলিখিত দুষ্কাৰ্য্য করিতেই ভাল বাসে, যথা :–দোকান হইতে জিনিষ চুরি, পকেট মারা ও স্নানের ঘাটে স্নানার্থীরা তীরে জিনিসপত্র রাখিয়া গেলে তাহা চুরি করা। স্ত্রীলোকেরা খুব চটপটে ও পাকা চোর। জিনিষ চুরি হইবামাত্র তাহা অবিলম্বে বিস্তর সহকারীর হাত বদল হইয়া এমন লোকের হাতে গিয়া পড়ে যাহাদের কাজ এই সব জিনিস লুকাইয়া রাখা ও বিক্রয় করা। সোনা ও রূপার গহনা চুরি করিয়া যত শীঘ্র সম্ভব বিক্রয় করা হয় বা গালাইয়া ফেলা হয়। কিন্তু চোরাই কাপড়চোপড় প্রায়ই লেপে ও দলের অন্যান্য বিছানাপত্রে সেলাই করিয়া ফেলা হয়। তাহারা সচরাচর মদের দোকানে চোরাই মালের বিনিময়ে মদ ক্রয় করে। মুসলমান হইলেও মিনকিনী স্ত্রীলোকেরা প্রায়ই হিন্দু নাম ধারণ করে।

কাৰ্য্যক্ষেত্র।

ধৃত হইলে তাহারা নিজেদের সম্বন্ধে নানা রকমের ইতিহাস দেয় এবং প্রায় গৃহহীন পথিক বলিয়া আত্মপরিচয় দিয়া থাকে। মিনকা ও মিনকিনী গাঙ্গপুর রাজ্যে কৃচিৎ দুষ্কাৰ্য্য করিয়া থাকে। কিন্তু তাহাদের কাৰ্য্যক্ষেত্র বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যা এবং আসামের অনেক স্থানে বিস্তৃত। এই দলের লোকেরা বাঙ্গালা দেশের নদীয়া, বীরভূম, হুগলী, বর্ধমান, ২৪-পরগণা, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, রাজসাহী, দার্জিলিং, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, মুরশিদাবাদ ও ময়মনসিংহ জেলায় এবং আসামের তেজপুর ও গোয়ালপাড়া জেলায় চৌর্য্য অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছে কিম্বা ১০৯ ধারা অনুসারে মুচলেকা দিতে বাধ্য হইয়াছে।

.

পাশি।

বাসস্থান ও পেশা।

পাশিরা নীচ শ্রেণীর হিন্দু; ইহাদিগকে যুক্তপ্রদেশের পূর্বাংশে, অযোধ্যায় ও বিহারের কোন কোন জেলায় দেখা যায়। তাড়ি বাহির করিবার জন্য তালগাছ কাটা তাহাদের আদি পেশা, গাছে উঠিবার সময় তাহারা যে পাশ অর্থাৎ ফাঁদ ব্যবহার করে তাহা হইতে তাহাদের জাতীয় নামের উৎপত্তি হইয়াছে। তাহাদের অনেকেই এখনও এই পেশাই করিয়া থেকে। কিন্তু কেহ কেহ চাষবাস ও বিক্রয় করে, কিংবা চাকর বা ছোট দোকানদারের কাজ করে। অন্য নীচ জাতীয় হিন্দুদিগের ন্যায় তাহারা মাংস খায়, শূকরের মাংস পর্যন্ত খায় ও মদ খায়। সাধারণতঃ তাহাদের বড়ই বদনাম আছে।

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে ঘোষণা।

১৯১৪ সালে যুক্তপ্রদেশের গভর্ণমেন্ট, রায়বেরিলি, উনাও মির্জ্জাপুর, ফয়জাবাদ, আজমগড়, জৌনপুর, এলাহাবাদ ও পাড়া বাকি

জেলার কোন কোন গ্রামে হাজির জামিন লওয়া হয় না এমন অপরাধে অপরাধী সমস্ত পাশিকে দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। (১৯১৪ সালের ৭ই মার্চ তারিখের যুক্তপ্রদেশের গেজেটের ১৬৮, ১৭৩, ১৭৮, ১৮৪, ১৮৮, ১৯৩, ১৯৮, ২১৩, ২০৮ ৮-১৫৮–৫ নং বিজ্ঞাপন দ্রষ্টব্য এবং ১৯১৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি তারিখের ১১৪–৮নং বিজ্ঞাপনদ্বারা রায়বেরিলি জেলার নয়টি গ্রামের সমস্ত পাশি, তাহারা অপরাধী হউক বা না হউক)।

বাঙ্গালা দেশে তাহাদের পেশা।

যুক্তপ্রদেশের ভড় ও অপরাপর দুর্ব্বৃত্ত জাতিদিগের ন্যায়, পাশিরা বাঙ্গালা দেশের প্রধান প্রধান কর্মস্থলে দলে দলে আসিতেছে। তাহারা কলিকাতার আশেপাশে করে বর্ধমান জেলায় কয়লার খনিতে এবং রংপুর, পাবনা, ঢাকা ও মৈমনসিং জেলার সমস্ত কৰ্ম্মের কেন্দ্রস্থলে কাৰ্য্য করে এবং বাঙ্গালা দেশের নদীতে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের নৌকায় মাল্লার কাৰ্য্য করে। তাহারা ভড় ও দোসাদদিগের ন্যয় বাঙ্গালা দেশে বহুদিন ধরিয়া প্রায় বাস করে এবং তাহারা ইহাদের অপেক্ষা আরও বদমায়েস ও দুষ্ট প্রকৃতির।

দুর্ব্বৃত্ততা ও বাঙ্গালা দেশে কার্যক্ষেত্র।

যে অধ্যায়ে জলদস্যুতার কথা বিবৃত হইয়াছে সে অধ্যায়ে পাশিয়া পাকা সিঁধেল বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। বাঙ্গালা দেশে তাহারা ডাকাইতি সিঁধচুরি ও দস্যুতা করিয়া থাকে। এই জাতির লোকেরা যশোহর, ফরিদপুর, রংপুর, নদীয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কলিকাতার আশেপাশে সমস্ত জেলায় অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছে।

২৪-পরগণার কলের সীমার মধ্যে তাহাদের বদনাম।

১৯০৩ সালে আসামে গোয়াল পাড়া জেলায় মির্জ্জাপুর পাশিরা সিঁধচুরি ও জলদস্যুতার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াছিল।

১৯০৪ ও ১৯০৯ সালের মধ্যে ২৪-পরগণা জেলায় পাশিদিগের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হইয়া দস্যুতা করিবার জন্য তিনটি মোকদ্দমা করিয়া সফল হওয়া গিয়াছিল। বারাকপুর ও নৈহাটির নিকটেই এই সকল দলের কার্যকারিতা বিশেষ পরিদৃষ্ট হইয়াছিল। এই স্থানে তাহারা কলে কাজ করিত।

বাঙ্গালা দেশে প্রায় এখন পাশি দেখা যায় না যাহার কোন প্রকাশ্য জীবিকার উপায় নাই এবং যে কোম্পানি বা রেলে তাহারা নিযুক্ত হয় সেই কোম্পানি বা রেলের কুলি লাইনে তাহার প্রায় বাস করে। তাহারা সিঁধ কাটিতে মজবুত এবং তাহাদিগকে উত্যক্ত করিলে মারপিটও করিয়া থাকে।

তাহাদের সাহায্যকারী।

যদিও তাহারা কখনও কখনও কলিকাতার ও তাহার পাশেপাশে স্থানীয় চোরাই মালের গ্রাহকদিগকে চোরাই মাল বিক্রয় করে, তথাপি ১৯০৪ সালের বিবি ব্র্যামলি সাহেব লিখিয়াছিলেন :–“এমন বিস্তর প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে যাহা হইতে জানা যায় যে, এই সকল লোকের পশ্চাতে তাহাদের জেলার জমিদারেরা ও এমন কি পুলিশ পর্যন্ত আছে এবং তাহারা বাঙ্গালা দেশে স্থায়ীভাবে বাস না করিয়া প্রত্যেক বৎসর দেশে ফিরিয়া যায় ও চোরাই মাল ভাগ করিয়া লয়।

পাশিরা পরস্পরের প্রতি কখনও অবিশ্বাসের কাৰ্য্য করে না। পুলিশ এক জন পাশিকে অপর পাশিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়াইবার জন্য প্রলোভিত করিয়া প্রায়ই কৃতকার্য হইতে পারে না। তাহাদের আকৃতির কোনও উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব নেই।

দুর্দান্ত বদমায়েস পাশিদিগের আড্ডা।

১৯১০ সালে যুক্তপ্রদেশের পুলিশ, বরাবাকি জেলার মাওয়াই ও রামসনাহিঘাট থানার এলাকার মধ্যে দুর্দান্ত বদমায়েস। পাশিদিগের একটি দলের সম্বন্ধে এক আশ্চার্য বিবরণ প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইহা ১৯১০ সালের ৮ই জুলাই তারিখের বঙ্গীয় ক্রিমিনাল ইনটেলিজেন্স গেজেটে উদ্ধৃত হইয়াছিল। এই দলের পাশিরা সাধারণ পাশিদিগের হইতে বিভিন্ন প্রকার বলিয়া বর্ণিত হইয়াছিল; ইহাদের রং ফর্সা ও ইহারা দেখিতে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদিগের ন্যায়। পুরুষেরা পুরোহিত বলিয়া পরিচয় দেয়; স্ত্রীলোকেরা তোক ভুলাইয়া লইয়া যায়। এইরূপে তাহারা লোকদিগকে লোভ দেখাইয়া নির্জন স্থানে স্নান করিবার জন্য নিয়ে যায়। এই সকল স্থান ঐ জাল পুরোহিতরা বিশেষ পবিত্র স্থান বলিয়া ব্যক্ত করে। তাহার পর তাহাদের সমস্ত জিনিষপত্র কাড়িয়া লয়। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজন হইলে তাহারা লোককে বিষ খাওয়াইয়া অজ্ঞান করেও মারিয়া ফেলে।

এই দলের একজন লোকের বাড়ি অনুসন্ধান করায়, দুই সেরের উপর নানা প্রকারের বিষ পাওয়া গিয়াছিল। রাসায়নিক পরীক্ষক বলিয়াছেন যে, ইহাদের মধ্যে এক রকম বিষ দেখিতে শুষ্ক বৃক্ষপল্লবের ন্যয়; ইহার একটি ছোট টুকরা একটি ভেকের চামরায় নীচে রাখায় তৎক্ষণাৎ সেই ভেকটির মৃত্যু হয়।

কিন্তু এই দল বাঙ্গালা দেশে দৃষ্ট সাধারণ পাশিদিগের হইতে অনেক ভিন্ন। বাঙ্গালার পাশিদিগের বদমায়েসি সাধারণ ডাকাইতি সিঁধ ও চুরিতেই নিবদ্ধ।

.

মজঃফরপুর সোণার।

উৎপত্তি।

মজঃফরপুর সোণার বলিয়া যে বদমায়েস দল পরিচিত তাহারা যে বৃহৎ সোণার জাতি বিহার ও যুক্ত প্রদেশে বংশ পরম্পরায় সেক্‌রার কাজ করে সেই সোণার জাতিরই একটি শাখামাত্র বলিয়া প্রতীয়মান হয়।

মজঃফরপুর সোণারদিগের লক্ষণ।

বালাখেলা নামে যে জুয়ারি প্রচলিত আছে মজঃফরপুর সোণারেরা সেই ব্যবসা চালাইয়া একটি পৃথক শ্রেণী বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছে। কিন্তু ইহা ছাড়া তাহারা সামাজিক বা ধৰ্ম্মসম্বন্ধীয় আচার ব্যবহার বা পোষাক পরিচ্ছদ ও ভাষা বিষয়ে ত্রিহুত বিভাগের অন্য সোণারদিগের হইতে বিভিন্ন নহে।

বাসস্থান।

পূর্বে জুয়াচোর সোণারদিগের অধিকাংশই মজঃফরপুর জেলার সদর থানার কাছে কোনও কোনও গ্রামে বাস করিত। কিন্তু তাহাদের কাৰ্য্য পুলিশের সুপরিচিত হইলে পর নজরবন্দী ও মোকদ্দমা এড়াইবার জন্য তাহারা দলে দলে মজোরগঞ্জ থানার এলাকায় নেপাল সীমান্তের নিকটস্থ গ্রামসমূহে চলিয়া যায়।

নেপাল সীমান্তে গমন।

পরে এই কারণ তাহাদের অনেকে নেপাল সীমানা পার হইয়া নেপাল তরাইয়ে প্রবেশ করে ও নিম্নলিখিত গ্রামসমূহে বসতি করে :

ভগবানপুর, লক্ষ্মীপুর, বালরা, আণাহা, মির্জ্জাপুর, মধুবানি, রহুয়া, সীমান্ত, হরপুরোয়া ও গোয়াহিয়া।

তাহাদের স্থানীয় সহায়ক।

 স্থানীয় জমিদারেরা সোণারদিগকে নিয়মিত প্রণালীতে আশ্রয় প্রদান করে বলিয়া শোনা যায়; কোনও সোণার জেলে থাকিলে বা চুরি ডাকাইতি করিবার জন্য বহুদিন বাহিরে থাকিলে, তাহার পরিবারবর্গ নিয়মিতভাবে মাসিক বৃত্তি পায়। সোণার বদমায়েসরা কৃতকাৰ্য্য হইয়া ফিরিয়া আসিলে, জমিদার এই টাকা মোটা সুদ সমেত আদায় করিয়া লইয়া থাকে।

১৯১৪ সালে নেপাল দরবার সোণারদিগের উপর কড়া নজরবন্দী রাখিবার সঙ্কল্প করেন এবং ছাড়পত্র না লইয়া কোনও সোণার কোথাও গেলে তাহা বাঙ্গালা ও বিহার ও উড়িষ্যায় ক্রিমিনাল ইভেষ্টিগেশন বিভাগকে জানাইবার ভার লইয়াছিলেন। ১৯১৪ সালের আগষ্ট মাসে নেপালের রেসিডেন্ট, কর্ণেল ম্যানারস স্মিথ লিখিয়াছিলেন:–“ভবিষ্যতে সোণারদিগকে কড়া নজরবন্দীতে রাখিতে দরবার সঙ্কল্প করিয়াছেন। তাহাদের হাঘরে স্বভাব দূর করিবার জন্য ও তাহাদের ও তাহাদের পরিবারবর্গের ভরণপোষণের পক্ষে যথেষ্ট জমি তাহাদিগকে দিয়া যাহাতে তাহাদিগকে চাষি করিয়া তুলিতে পারা যায় সে বিষয়ে চেষ্টা করা হইবে।”

কার্যপ্রণালী।

বালাখেলাই মজঃফরপুর সোণারদিগের প্রধান আয়ের উপায়। তাহারা ছোট ছোট দল বাঁধিয়া বাড়ি ছাড়িয়া যায়। বাঙ্গালা দেশের রাজসাহী বিভাগ তাহাদের প্রিয় কাৰ্য্যক্ষেত্র। রাজসাহী জুয়াচোরদিগের লাভজনক কাৰ্য্যক্ষেত্র হইবার কারণ এই যে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের বিস্তর শ্রমজীবী তাহাদের বাড়ি ও বঙ্গ দেশ ও আসামের নানা কাৰ্য্যকেন্দ্রের মধ্যবর্তী কাথিহার ও পাৰ্বতিপুরের মধ্য দিয়া গমন করে। কিন্তু সে সকল স্থানে পথিকেরা মিলিত হন, সেই সমস্ত স্থানেই তাহাদিগের অনুসন্ধান করিতে হইবে। সোণার কোনও রেলওয়ে ষ্টেশনের বিশ্রামাগারে বসিয়া উপযুক্ত শিকারের অনুসন্ধান করে। যদি সে এমন লোক দেখিতে পায় যাহার কাছে টাকা আছে ও যাহার প্রকৃতি সরল তাহা হইলে সোণার তাহার সহিত বন্ধুত্ব করে ও সে কোথা যাইতেছে তাহা জিজ্ঞাসা করে। সে ব্যক্তি তাহার গন্তব্য স্থানের নাম করিলে সোণার অমনি বলিয়া উঠে, আমিও যে ঐখানেই যাইতেছি। যে ষ্টেশনে শিকারের সহিত তাহার আলাপ হয় সেস্থান কৃতকার্য হইবার পক্ষে অনুপযুক্ত হইলে সোণার তাহাকে তাহার সহিত পরবর্তী ষ্টেশনে হাঁটিয়া যাইতে সম্মত করে। পথে তাহার বিপরীত দিক হইতে আসিতেছে এমন একজন লোককে দেখিতে পায় এই ব্যক্তি অর্থ সাহায্য চায়, বলে—”আমার টাকা সব হারিয়া গিয়াছে; একগাছি রূপার বালা ছাড়া আমার আর কিছুই নাই।” সময় বুঝিয়া কখনও কখনও সোণার বালাও ব্যবহার করা হয়। জুয়াচোর, যে শিকারের সঙ্গেই থাকে, বালার দাম লইয়া তর্কবিতর্ক করে ও ধাতু খাঁটি নহে বলিয়া সন্দেহ করে। কখনও কখনও এমন হয় যে তর্কবিতর্কের সময় আর একজন লোক আসিয়া উপস্থিত হয় এবং সোণার বলিয়া পরিচয় দিয়া, আগুনে ধাতু পরীক্ষা করিতে চায়। প্রথমে যে বালা দেখান হয় তাহা প্রকৃত রূপার বা সোনার বালা বলিয়া তাহা আগুনে খাঁটি প্রতিপন্ন হয়। তখন শিকারের সমভিব্যাহারী জুয়াচোর বলে, বালা হয় আপনি ক্রয় করুন, না হয় আমাকে টাকা ধার দিন। পরবর্তী স্টেশনে যাইয়া জামিনস্বরূপ বালা আপনার নিকট রাখিবেন। টাকা দেওয়া হইলেই বিক্রেতা অন্তর্হিত হয়। তখন শিকারের বন্ধু বালা ছাড়াইয়া লইবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিয়া অবিলম্বে সকলের অগ্রে তাহার চাকরের অনুসন্ধানে চলিতে থাকে এবং তাহার সঙ্গীরা যদি কোনও সঙ্গী থাকে একে একে সাধারণত মলমূত্র ত্যাগের ছল করিয়া শিকারকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়।

বোকা লোকটির নিকট বালা থাকায় লোকগুলি অন্তর্হিত হইলেও প্রথমে তাহার মনে কোনও সন্দেহ হয় না। কিন্তু যখন সে বালা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখে, তখন দেখিতে পায় যে প্রথমে যে জিনিষ দেখান হইয়াছিল ইহা সে জিনিষ নহে, তাহার পরিবর্তে সীসা বা অন্য কোনও অল্প মূল্যের ধাতুর জিনিস দেওয়া হইয়াছে।

শিকারের অনিচ্ছা প্রকাশ করিলে কার্যপ্রণালী।

মজঃফরপুর সোণারেরা সাধারণতঃ রেলওয়ে ষ্টেশনের আশেপাশে কাৰ্য্য করিলেও এমন দেখা গিয়াছে যে তাহারা নির্জন স্থানে বাড়ি ভাড়া করে, কিংবা সেখানে তাহার জয়চুরি করিতে ইচ্ছা করে সেই স্থানের কাছে ছোট ছোট দোকান খুলে। তাহাদের শিকারেরা সন্দেহ প্রকাশ করিলে ও টাকা দিতে অনিচ্ছুক হইলে, কোনও কোনও স্থলে তাহারা মারপিটও করিয়া থাকে এবং কোনও কোনও স্থলে তাহারা তাহাদের শিকারকে বিষমিশ্রিত তামাক বা পান খাওয়াইয়া জুয়াচুরির সুবিধা করিয়া লয়। ইহাদের মধ্যে শতকরা অতি অল্প লোক চুরির অপরাধে অপরাধী প্রমাণিত হইয়াছে এবং কয়েক স্থলে তাহারা রাহাজানিও করিয়াছে।

অন্য লোক কর্ত্তৃক বালা জুয়াচুরি।

বালা জুয়াচুরি যে সকল স্থলেই মজঃফরপুর সোণারেরাই করিয়া থাকে এমন কথা নহে। অন্য জাতীয় লোকেরা, অর্থাৎ মুসলমান, দোসাদ, মুণ্ডা ও কুৰ্মীরাও যে এই প্রকার জুয়াচুরি করে তাহার রেকর্ড আছে। বালা জুয়াচোরদিগের একটি বা দুইটি দল মুঙ্গেরে আছে বলিয়া বিশ্বাস এবং চম্পারণ ও নেপালের মুনিয়ারা এই প্রকার জুয়াচুরি করে দেখা গিয়াছে।

টপ্‌কা জুয়াচুরি।

টপ্‌কা জুয়াচুরি বালা জুয়াচুরিই প্রকারান্তর। ইহাতে জুয়াচোরের একজন সহচর একটা গিল্টি করা বালা রাস্তায় ফেলিয়া দেয় ও জুয়াচোর তাহা তুলিয়া লয়। জুয়াচোর শিকারের সঙ্গেই থাকে। মজঃফরপুর সোনারেরা ক্বচিৎ এ জুয়াচুরি করিয়া থাকে। এ প্রণালী পঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশে, বিশেষতঃ গাজিপুর হইতে আগত জুয়া চোরদিগের দ্বারাই অবলম্বিত হইয়া থাকে।

চুরি ডাকাইতি করিবার জন্য তাহাদের যাত্রা।

মজঃফরপুর সোণারেরা বত্সরে ছয় মাসের অধিক কাল বাড়ি ছাড়া হইয়া থাকে; তাহারা প্রায়ই হোলি পর্ব্বের জন্য বা বর্ষাকাল কাটাইবার জন্য বাড়িতে ফিরিয়া আসে। স্ত্রীলোকেরা কখনও পুরুষদিগের সঙ্গে যাত্রা করে না। দলের প্রায় প্রত্যেক লোকেরই তাহার নিজের ও তাহার বাপের অনেক কল্পিত নাম আছে এবং কতকগুলি নাম তাহাদের মধ্যে এমন সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় যে, কেবলমাত্র নাম বা পিতার নাম ধরিয়া সনাক্ত করা যায়। না। ধৃত হইলে, তাহারা সচরাচর নিজেদিগকে গোয়ালা, কইরি বা বেনিয়া বলিয়া থাকে।

কাৰ্য্যক্ষেত্র।

তাহারা কখনও কখনও যুক্তপ্রদেশের জেলাসমূহে, বিশেষতঃ বালিয়া, গোরক্ষপুর ও আজিমগড়ে জুয়াচুরি চালাইয়া থাকে; কিন্তু বেহার ও বাঙ্গালা দেশেই কাজ করিতে তাহারা ভাল বাসে। বাঙ্গালা দেশে তাহারা সচরাচর নিম্নলিখিত স্থানে দৃষ্ট হয় : আসানসোল, সীতারামপুর, বর্ধমান, ব্যান্ডেল, গোয়ালন্দ, পাব্বর্তীপুর, সৈদপুর, লালমনিরহাট ও খড়গপুর। শ্রীহট্ট, পুরি ও দার্জিলিঙ্গে ও তাহাদিগকে দেখা যায়। ১৯১৩ সালে জলপাইগুড়ি জেলার আলিপুর দুয়ার্সে তাহাদের কুড়িজনকে একটা দল বাঁধিয়া থাকিতে দেখা গিয়াছে। সেখানে তাহারা যে চা-বাগানের কুলিদিগকে ঠকাইয়াছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বাঙ্গালা দেশে যে সমস্ত ঘটনা রিপোর্ট করা হইয়াছে তাহাদের অধিকাংশস্থলেই দেখা যায় যে প্রতারিত ব্যক্তিরা অন্য প্রদেশের লোক।

.

সানৌড়িয়া

উৎপত্তি।

সানৌড়িয়ারা যাযাবর চোরদিগের একটি জাতিবিশেষ। তাহাদের প্রকৃতি বারোয়ারদিগের মত; সম্ভবতঃ তাহারা এই বারোয়ারদিগেরই একটি শাখা। তাহারা সচরাচর যুক্তপ্রদেশের ঝালীতে, বুন্দেলখণ্ডের অর্চা ও দাতিয়ায় ও মধ্য প্রদেশের বিলাসপুর জেলায় বাস করে। তাহারা ব্রাহ্মণত্বের দাবি করে, এবং সচরাচর সানৌড়িয়া ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হয়।

দলগঠন।

মধ্য প্রদেশের পুলিশের এস্, ডবলু গেয়ার সাহেব বলেন, তাহারা ২ হইতে ১৫ বা ২০ জনের দল বাঁধিয়া কাজ করে; এই দলের একজন নেতা থাকে তাহাকে মুখিয়া বা মুখতিয়ার বলা হয়। এই ব্যক্তি প্রায়ই নিজে হাতে কিছু করে না; উপরদারেরাই প্রকৃত প্রস্তাবে চুরি করে; প্রত্যেক উপরদারের অধীনে এক বা একাধিক বালক থাকে; এই বালকদিগকে চাওয়া বলে।

যখন বাড়ি হইতে যাত্রা করিয়া বাহির হয় তখন সানৌড়িয়াদিগের সঙ্গে তাহাদের স্ত্রীলোকেরা কখনও যায় না। তাহারা শীতের প্রারম্ভে যাত্রা করে এবং বর্ষা আসিলেই বাড়ি ফিরিয়া আসে।

কার্যপ্রণালী।

তাহাদের চুরির প্রণালী, বারোয়ার ও ভাঁপতাদিগরে প্রণালীর অনেকটা অনুরূপ। মেলায় স্নানের ঘাটে, রেলওয়ে ষ্টেশনে ও চলন্ত রেলগাড়ীতে তাহাদের কাৰ্য্য চলে। যে লোকের দ্রব্যাদি অপহরণ করিতে তাহারা ইচ্ছা করে তাহাকে কিরূপ চাতুরি করিয়া তাহারা স্নান করিতে প্ররোচিত করে, গেয়ার সাহেব তাহার উল্লেখ করিয়াছেন। চাওয়া যেন দৈবাৎ কোন উচ্চজাতীয় লোকের গায়ে এমন জিনিষ ছোঁয়ায় যদ্দারা। দেহ অপবিত্র হয়। উপরদার ভদ্রভাবে সে দিকেই সেই ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কখনও কখনও চাওয়া দৌড়িয়া আসিতে আসিতে মিকারের গায়ে ধাক্কা মারে ও ক্ষমা চাহিয়া বলে যে সে একজন গরীব ও মুখ ঝাড়দার মাত্র। উচ্চজাতীয় লোকটির স্নান করিতে বাধ্য হয়।

তীরে স্ত্রীলোকদিগকে দ্রব্যাদি রক্ষণার্থ নিযুক্ত করিয়া পুরুষেরা স্নান করিতে গেলে, সানৌড়িয়ারা কিরূপ কৌশলে স্ত্রীলোকদিগকে অন্যমনস্ক করে, সে কথা এ, সি, হ্যাঁকি সাহেব ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে লিখিয়া গিয়াছেন। উপরদার এমনইভাবে মলত্যাগ করিতে বসে যে, স্ত্রীলোকটি যে সব জিনিস রক্ষণ করিতেছে তাহাদের দিকে পশ্চাৎ ফিরিয়া বসিতে বাধ্য হয়। তখন চাওয়া যে জিনিস ইচ্ছা চুপি চুপি লইয়া যায়। গেয়ার সাহেব বলে, চলন্ত ট্রেণে চুরি করিবার সময়, তাহারা কখনও কখনও চোরাই দ্রব্য বেঞ্চের নীচে মোম বা অন্য কোন আঠাদ্বারা আটকাইয়া রাখে।

সানৌড়িয়াদিগের সহিত ঝাড়দার ও চামার ভিন্ন যে কোন জাতীয় হিন্দু, এমন কি মুসলমান পর্যন্ত মিলিয়া একটি বৃহৎ বদমায়েসের দল সৃষ্টি করিয়াছে। এই দলের লোকদিগকে চন্দ্রবেদী বলে। জাতিগত পার্থক্য থাকিলে ইহাদের মধ্যে কাৰ্য্যগত একটি সৌহৃদ্যবন্ধন আছে। সুতরাং কোন সানৌড়িয়া চন্দ্রবেদী হইতে পারে; কিন্তু চন্দ্রবেদী হইলেই যে সানৌড়িয়া হইতে হইবে এমন কোন কথা নেই।

বাঙ্গালা দেশে অল্প স্থলেই সানৌড়িয়া বা চন্দ্রবেদীরা ধৃত হইয়াছে; সম্ভবত বারোয়ারদিগের মত বাঙ্গালা দেশে এখনও তাহারা বিস্তৃতভাবে কাৰ্য্য করিতে পারে নাই।

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইনানুসারে ঘোষণা।

আগ্রা ও অযোগ্য যুক্ত প্রদেশের গভর্ণমেণ্ট ১৯১৩ সালের ১লা অক্টোবর তারিখের ১১২৬৬৮–১৫৮–১১ নং গভর্ণমেন্ট আদেশ অনুসারে ঝান্সীর সানৌড়িয়াদিগকে ১৯১১ সালের ৩ আইন অনুসারে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *