৭. প্যারিসে এসে পৌঁছলাম

৭.

প্যারিসে এসে পৌঁছলাম আটদিন পর।

পৌঁছেই মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি ঘরে নেই।

আমার নামের কার্ড রেখে এলাম। চাকরকে জানিয়ে এলাম আমি কিছুদিন আগে সুল্লাকারো থেকে এসেছি এবং মঁসিয়ে লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চির কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে এসেছি, যা আমি শুধুমাত্র মঁসিয়ে লুইর হাতে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

চাকরটি আমাকে তার মনিবের পড়ার ঘরে বসতে দিয়েছিল, খাওয়ার ও বসার ঘর দুটো পেরিয়েই সে ঘরে যেতে হয়। যাবার সময়ই আমি দুটো ঘরের আসবাবপত্র দেখে নিলাম। সেই একই রুচি, যা সুল্লাকারোতে আমি লুইর ঘরে দেখে এসেছি। বরং এখানে এটা আরও বেশি মার্জিত। সেটা নিশ্চয়ই প্যারিসের কাতারের জন্য। অবিবাহিত এক যুবক। তা একার পক্ষে এই এলাকাটি খুবই আরামের বলে মনে হলো।

পরের দিন বেলা এগারোটার সময় আমি যখন পোশাক পড়ছি, তখন আমার চাকর এসে মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির আসার খবর জানাল, আমি বললাম–ভদ্রলোককে বসার ঘরে বসিয়ে খবরের কাগজগুলো পড়তে দাও আর বল আমি এক্ষুনি আসছি।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি লুইর কাছে গেলাম।

গিয়ে দেখি ‘প্রেস’ কাগজে আমার যে ধারাবাহিক লেখাটা ছাপা হচ্ছে, সেটা উনি পড়ছেন। কিন্তু আমাকে আকর্ষণ করল লুসিয়েনের সাথে এই লুইয়ের দৈহিক সাদৃশ্য।

লুই বলল, মঁসিয়ে কাজের লোকের হাত থেকে এই ছোট চিঠিটা যখন পেলাম, আমি আমার সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি অন্তত বিশবার আপনার চেহারার বর্ণনা তার মুখ থেকে শুনে নিলাম বর্ণনা মিলিয়ে নিলাম, কাগজে দেখা আপনার ছবির সাথে। ফলে দেখছেন তো বড় বেশি সকাল সকাল আপনার কাছে এসে গেছি। আপনার হয়তো অসুবিধা হলো। কিন্তু দুটো কারণে আমি আর ধৈৰ্য্য রাখতে পারছিলাম না। প্রথমত আপনাকে ধন্যবাদ দেয়া আমার কর্তব্য। দ্বিতীয়ত বাড়ির খবরের জন্য আমি বড় বেশি অস্থির।

লুই আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি তাকে বাধা দিলাম। আমার প্রশংসার জন্য আপনাকে পরে ধন্যবাদ দেব, আগে বলুন তো আমি কি মঁসিয়ে লুসিয়েন না মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির সাথে কথা বলছি?’

লুইয়ের ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি ফুটে উঠল।

‘আমাদের আকৃতি হুবহু এক। আমি যখন সুল্লাকারোতে ছিলাম, তখন শুধুমাত্র দুজনের ভুল হতো না–কে লুইয়ের আর কে লুসিয়েন, তারা হলো আমরা দু ভাই নিজেদের। তবে চেহারায় পার্থক্য না হলেও, পোশাকে তফাৎ ছিল প্রচুর। এর মধ্যে যদি লুসিয়েন তার কর্সিকার পোশাক পরিবর্তন না করে থাকেন এবং আপনি তা দেখে থাকেন। তাহলে সহজে বুঝতে পারবেন। পোশাকের জন্যই সাধারণ লোকের আমাদের চিনতে ভুল হতো না।’

আমি স্বীকার করলাম কথাটা সত্য, কিন্তু শেষ যখন আমি তাকে দেখি, তখন পরনে ছিল এই ফরাসি পোশাকই, তাতে তার সাথে আপনার বর্তমানে কোনো তফাৎ ধরতে পারছি না।

ব্যাগ থেকে চিঠি দুটো বের করে লুইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই বাড়ির খবরের জন্য অস্থির হয়ে রয়েছেন। কালকে এই চিঠি আপনার চাকরের হাতে দিয়ে আসিনি, তার কারণ, আপনার মায়ের কাছে আমি শপথ করেছিলাম যে চিঠি নিজের হাতে আমি আপনাকে দেব।

‘বাড়িতে সকলকে ভালো দেখে এসেছেন তো?

‘সবাই ভালো। কিন্তু আপনার জন্য চিন্তিত। চিঠি পড়লেই জানতে পারবেন।’

‘আপনি কিছু মনে করবেন না তো?’

‘না আপনি পড়ন।

লুই চিঠি খুলে পড়তে লাগল, আমি চুরুট পাকাতে লাগলাম।

আমি তার মুখের দিকে লক্ষ্য রাখছি। কোনো ভাবান্তর যেন আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে না পারে। সে তাড়াতাড়ি চিঠি পড়ছে। আর মাঝে মাঝে একটু হাসছে। মধ্যে মধ্যে অস্ফুট স্বরে দুই একটা মন্তব্য করছে। চেহারার দিক দিয়ে দুই ভাইয়ের এত মিল যে, সে ধাক্কাটা তখনও আমি সামলে উঠতে পারিনি। তবে লক্ষ করেছি যে, লুসিয়েনের কথাই ঠিক। লুইয়ের গায়ের রং একটু বেশি সাদা এবং তার ফরাসি উচ্চারণ অনেক বেশি নিখুঁত।

তার চিঠি পড়া শেষ হতে, তাকে একটা নিজের পাকানো চুরুট দিলাম। আমার জ্বলন্ত চুরুট থেকে সেটা জ্বালিয়ে নিল। বললাম, চিঠিতে পড়লেন তো? ওরা আপনার জন্য খুবই চিন্তায় আছেন। তবে আমি আশ্বস্ত হচ্ছি এই দেখে যে তাদের দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না।’

লুই একটু দুঃখিত গলায় বলল, একেবারে কারণ ছিল না, তা নয়। আমি অসুস্থ ছিলাম তারচেয়েও গুরুতর ব্যাপার হলো একটা ব্যাপারে আমি দারুণভাবে মানসিক অশান্তিতে আছি। স্বাভাবিক অবস্থায় আমি এত অস্থির হতাম না। কিন্তু যখন ভাবছি আমার জন্য লুসিয়েনকেও কষ্ট দেয়া হচ্ছে—’

বাঁধা দিয়ে বললাম–ব্যাপারটার কিছুটা ইঙ্গিত আপনার ভাইয়ের মুখ থেকে পেয়েছিলাম। এভাবে আশ্চর্য রকম যোগাযোগ যে দুই মানুষের মধ্যে থাকতে পারে তা সহজ বুদ্ধিতে বিশ্বাস হয় না। তবে আমার সামনে প্রমাণ রয়েছে। আপনাদের চেহারার মিল, এটা সচক্ষে দেখার পর মানসিক মিল সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা চলে না।

লুই বিষণ্ণভাবে হাসল।

‘তা হলে আপনিও বিশ্বাস করেন আপনার ভাই যে অশান্তি ভোগ করেছেন তা আপনার অশান্তির ফলে।

‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

‘আপনার এই বিশ্বাস দেখে একটা প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি। কৌতূহলের জন্য নয়। আপনাদের উপরে আকর্ষণের জন্য। যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমি জিজ্ঞেস করতে পারি? আপনার সেই মানসিক অশান্তি শেষ হয়েছে?

একটু চুপ থেকে লুই বলল, আপনি তো জানেন যে, দুঃখ যত তীব্রই হোক না সময়ের জন্য তা আস্তে আস্তে কমে যায়।

আমার হৃদয়ের রক্তাক্ত ক্ষত যদি কোনো কারণে বিষিয়ে না ওঠে, তাহলে কয়েকদিন তা থেকে রক্ত ঝরবে। তারপর নিজে থেকেই ক্ষত শুকিয়ে যাবে। আপনি যে অনেক কষ্ট করে চিঠি নিয়ে এসেছেন তার জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখন আপনি যদি বিরক্ত না হয়ে আপনার কাছে আসার অনুমতি দেন, তাহলে মাঝে মাঝে এসে আপনার সাথে সুল্লাকারোর গল্প করে যাব।’

‘আপনি যদি আসেন এবং গল্প করেন তবে আমিও প্রচুর আনন্দ পাব, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা না করে, এখনই কিছু আলাপ করা যাক। আসুন দুজনে নাস্তা খাই আর গল্প করি।’

‘কিন্তু আজকে সম্ভব নয়। কালকে বিচার মন্ত্রীর কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি, আজকে তার সাথে দেখা করার কথা, একটা আলোচনা আছে, আমার মতো নতুন উকিলের পক্ষে তার ডাক অগ্রাহ্য করা সম্ভব না।

বিচার মন্ত্রী কি সেই অলাৰ্ত্তি আর কলোনাদের ব্যাপারে ডেকেছেন?

‘খুব সম্ভব তাই। আমি মন্ত্রীকে সুখবরটা দিতে পারব। কারণ লুসিয়েন লিখেছে যে, ব্যাপারটার মীমাংসা হয়ে গিয়েছে।’

‘আমি নিজের চোখে দেখেছি, সরকারি উকিলের সামনে, আমিও অলাৰ্ত্তির পক্ষে জামিনদার ছিলাম।

‘লুসিয়েন সব কিছু লিখেছে। ঘড়ি বার করে দেখে নিয়ে সে বলল, ‘বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, আমি গিয়ে আমার ভাইয়ের প্রতিশ্রুতি পালন করার কথা বলে আসছি।’

‘সব সুন্দর ভাবে হয়েছে, আমি তার সাক্ষী।

‘আমি জানতাম এ কাজ লুসিয়েনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেও সে এ কাজ করবে।’ লুসিয়েনের মতো ছেলে হয় না।’

‘নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধের কাজও যেরকম নিষ্ঠার সাথে তিনি করেছেন। তার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়।

‘নিশ্চয়ই, আপনার সাথে কথা বলে আমি প্রচুর আনন্দ পাচ্ছি। আমার মাকে, ভাইকে, আমার প্রিয় স্বদেশকে যেন চোখের সামনে দেখছি, আপনার কথার ভেতর থেকে, তবুও আজকে আর সম্ভব না, কোনো সময় এলে আপনাকে একটু একা পাব

‘অনেকদিন পর প্যারিসে ফিরে এসেছি, এখন কিছুদিন ব্যস্ত থাকতে হবে, তার চেয়ে আপনাকে কোথায় পাব তা যদি বলেন

‘কাল মাই বারেসের উৎসব-’ (ধর্মীয় উৎসব)

‘কালকেই উৎসব নাকি?’

‘আপনি কি গিয়ে অপেরার নাচের উৎসবে যোগ দেবেন।

‘যদি আপনাকে গিয়ে সেখানে পাওয়া যায়, তাহলে যেতে পারি, কিন্তু আর কোনো আগ্রহ নেই ও ব্যাপারে।

‘আমাকে কিন্তু যেতেই হবে। যেতে আমি বাধ্য।

আমি হেসে বললাম, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, সময় সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। হৃদয়ের ক্ষত নিজ থেকেই শুকিয়ে যায়।

লুই মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল, ‘আপনি ভুল করছেন। আমি সেখানে আনন্দের জন্য যাচ্ছি না, যাবার জন্য হয়তো নতুন করে অশান্তি শুরু হতে পারে। তবু আমাকে যেতেই হবে।’

‘কেন উপায় নেই? ঝামেলার সম্ভাবনা যেখানে, সেখানে যাবেন না।

‘মানুষ কি নিজের ইচ্ছায় কিছু করতে পারে? ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার ভাগ্য, না গেলে যে ভালো হয় তা আমি জানি। তবু যেতে হবে।’

‘ঠিক আছে আপনি যখন যাবেন, আমিও কালকে অপেরায় যাব। কখন?

‘সাড়ে বারোটায়, যদি আপনার অসুবিধা না হয়।’

‘কোথায়?

‘ঘড়ির নিচে। ঠিক একটার সময় সেখানে আমার সাথে একজনের দেখা করার কথা।

হাত মিলিয়ে সে দ্রুত বেরিয়ে গেল। প্রায় বারোটা বাজে।

এরপর সেদিন বিকেল এবং পরদিন সমস্ত দিনই আমাকে ব্যস্ত থাকতে হলো। আঠারো মাস পরে ফেরার জন্যই আমাকে এই ব্যস্ততার মাঝে কাটাতে হলো। এর কোনো বিকল্প নেই।

নির্দিষ্ট স্থানে রাত বারোটার সময় লুইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। তখনও লুই আসেনি। সে এলে পর শুনলাম, এক মুখোশধারিনীর পিছনে সে এতক্ষণ ছুটছিল। তাকে ধরতে পারেনি শেষ পর্যন্ত, ভিড়ের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

আমি চাইছিলাম কর্সিকার কথা আলোচনা করতে। কিন্তু লুইয়ের মন এখন শুধু ঘড়ির উপর ব্যস্ত। শুধু ঘড়িই দেখছে। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল : ওই যে আমার ভায়োলেট ফুলের তোড়া।

বলেই সে উধাও হয়ে গেল।

নাচ ঘরে বিভিন্ন ধরনের তোড়া উপস্থিত। ক্যাসিনিয়ার একটা ভোড়া এসে আমাকে বলল : প্যারিসে আপনার পুনঃরাগমনের উপলক্ষ্যে অভিনন্দন জানাতে চাই।’

ক্যাসিনিয়ার পরে এল গোলাপের তোড়া। গোলাপের পরে হেলিওট্রোন, তারও পরে ৪নং তোড়ার সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখা বন্ধু ডি’র সঙ্গে।

ওর পুরো নামটা কেউ বলে না। দরকার হয় না। ডি বললেই সবাই বুঝে নেয়।

ডি নিজেই ডেকে বলল, ‘আরে বন্ধু তুমি ঠিক সময়েই এসেছ। আজ আমার বাড়িতে একটা নৈশ ভোজনের ব্যবস্থা আছে। তোমাকে আসতেই হবে, এই বলে আরও তিন-চার জনের নাম করে বলল, এরা সবাই আসছে।

আমি ধন্যবাদ দিয়ে মাফ চাইলাম। তোমাদের সাথে যোগ দিতে পারলে খুশিই হতাম। কিন্তু আমার আর একজন সাথী আছে।

‘তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা প্রত্যেকেই একটি করে তোড়া নিয়ে যাব। তুমিও এনো। টেবিলে ছয় কলসি ‘জল’ রেখেছি তোড়াদের তাজা রাখার জন্য।’

‘তুমি ভুল করেছ বন্ধু, তোড়া নয়। আমার সাথে আছে এক পুরুষ বন্ধু।

‘তাতে কোনো অসুবিধা নেই, প্রবাদই তো আছে বন্ধুর যে বন্ধু, সে আমার বন্ধু।

‘কিন্তু যুবকটিকে তো তোমরা চেন না?’

‘চিনে নেব।’

‘তাহলে তাকে গিয়ে তোমার নিমন্ত্রণের কথা বলি।’

‘বলো, যদি আসতে না চায় জোর করে ধরে এনো।’

‘যতদূর পারি চেষ্টা করব, খেতে বসবে কখন?’

‘রাত তিনটে। ছয়টা পর্যন্ত খাওয়া চলবে, যথেষ্ট সময় পাবে।’

‘আচ্ছা, বলে বিদায় নিলাম ‘ডি’-এর কাছ থেকে।

মাইওমোটিস এর একটি তোড়া দূরে থেকে আমাদের কথা শুনছিল, এবার এগিয়ে এসে ‘ডি’-এর হাত ধরে চলে গেল।

কয়েক মিনিট পরেই লুইর সঙ্গে দেখা। তার সাথে আর ভায়োলেটের তোড়া নেই। আমার সাথে তখন যে তোড়াটি ছিল, তা এক বন্ধুর সাথে দিয়ে আমি লুইয়ের সঙ্গ নিলাম।

‘যা জানার দরকার ছিল, জানতে পেরেছেন?

‘তা জেনেছি, মুখোশ নাচের ব্যাপার তো জানেন? সেসব কথা বাদ দেয়া উচিত, সেটাই এখানকার একমাত্র কথা।’

‘বেচারী’ এই বলেই হঠাৎ মনে হলো, মাত্র দুদিনের পরিচিতর সাথে এই ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলা হয়তো উচিত হলো না। সাথে সাথে তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। কিছু মনে করবেন না। আপনার ভাইয়ের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সেটাই আপনার উপর ব্যবহারে চাপিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কথাটি কী? ভাগ্যের চাকা বুঝি নিচে দিয়ে যাচ্ছে।

লুই চুপ। বুঝলাম, তার দুশ্চিন্তার কারণটা সে গোপন রাখতে চায়, কাজেই ও নিয়ে আর কোনো কৌতূহল নয়।

চুপচাপ দুজনে বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা হাটছি। আমার তো সত্যিই কারো সঙ্গে দেখা বা আলাপ করার কথা নাই। সুতরাং আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু লুই প্রত্যেকটা গোড়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে।

আমি বললাম, ‘শুনুন এক কাজ করুন।

সে একেবারে চমকে উঠল, আমার কথা তার মনে ছিল না। তারপর অপ্রতিভের মতো বলল, ‘কী কাজ?

‘কিছু একটা করুন যাতে একটু অন্যমনস্ক হওয়া যায়।’

‘যেমন?’

‘আমার এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত আছে। সেখানে চলুন।

না, এমন দুঃখিত চেহারার অতিথিকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইবেন ।’

‘দুঃখিতদের তো ওই রকম জায়গায় যাওয়া দরকার। সেখানে সব অবাস্তব কথাবার্তা হবে। তাতে আপনার মনের মেঘ কেটে যাবে।

এরমধ্যে মাইওমোটিসের তোড়া নিয়ে ‘ডি’ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, চোখ পড়তেই ছুটে এল।

‘কথা ঠিক আছে তো? তিনটের সময়—’

‘না, বন্ধু। আমার আসা সম্ভব নয়।’

‘ডি’ রাগ করে চুলোয় যাও’ বলে চলে গেল।

লুই তার সম্পর্কে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে, ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করল, ‘ভদ্রলোকটি কে?

‘এ আমার বন্ধু ‘ডি’। একটা নামকরা কাগজের মালিক। খুব আমুদে লোক।

‘ডি, ওকে আপনি ভালো করে চেনেন নাকি?’

‘চিনি না? দুই তিন বছর ধরে ওর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

‘রাতের দাওয়াত কি ওর বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ, ওখানে তো তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।’

‘তাহলে আমি আনন্দের সাথে রাজি।

‘খুব ভালো কথা। কিন্তু শুধু আমাকে খুশি করার জন্য খাবার দরকার নেই, কারণ খাওয়া না খাওয়া আমার কোনো লাভ ক্ষতি নেই।

দুঃখের হাসি হেসে লুই বলল, আমারও হয়তো যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু কাল যে বলেছিলাম, মনে আছে? যেখানে যাওয়া উচিত সেখানে আমরা যাই না, যাই সেখানে ভাগ্য আমাদের টেনে নিয়ে যায়। আসল কথা হলো–আজকে আমি এখানে না এলেই সব চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। করতাম।’

তখনই আবার ‘ডি’-এর সাথে দেখা হলো।

তাকে থামিয়ে, আমার তার ওখানে যাবার কথা জানিয়ে দিলাম।

যাবে, পরশু রাতেও তাকে আমাদের সাথে খেতে হবে।’

‘কারণ?’

‘শ্যাটো রেনোর সাথে একটা বাজি হয়েছে।’

লুই আমার পাশেই ছিল। সে আমার হাতটা বেশ জোড়েই চেপে ধরল হঠাৎ। তার দিকে তাকালাম, মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

‘ডি’ কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাজিটা কি?

এখানে দাঁড়িয়ে অত বড় গল্প বলা যাবে না। তাছাড়া এর সাথে এক মহিলা জড়িয়ে আছেন, তাঁর কানে বাড়ির কথা উঠলে, শ্যাটো রেননা। অবশ্যই ঠকে যাবেন।

‘ঠিক আছে, তিনটার সময় তাহলে

‘ডি’ চলে গেল। ঘড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখলাম দুটো পঁয়ত্রিশ।

লুই নিজেকে স্থির রাখতে ব্যর্থ হয়ে জানতে চাইল আমি শ্যাটো রেনোকে চিনি কিনা?

‘মুখটাই শুধু পরিচিত। বন্ধুদের বাড়িতে দু একবার শুধু দেখেছি।’

‘তাহলে সে আপনার বন্ধু না?

‘বন্ধু তো নয়ই। সাধারণ পরিচিতও না।’

‘বাঁচলাম।’

‘কেন? কীভাবে বাঁচলেন?’

‘না, এমনিই। এমনিই বলেছি ও কথা।‘

‘পালটা প্রশ্ন করলাম–‘আপনি কি চেনেন নাকি?’

‘মোটামুটি।’

এই এড়িয়ে উত্তর সত্ত্বেও বোঝা গেল সে মঁসিয়ে ফ্রাঞ্চি এবং মঁসিয়ে শ্যাটো রেনোর মধ্যে একটা রহস্য আছে এবং সে ব্যাপারে যোগ সূত্র হচ্ছে এক মহিলা। আমার কেমন যেন মনে হতে লাগল, আমি এবং লুই বাড়িতে চলে গেলেই আমাদের জন্য ভালো হবে।

সে কথা আমি লুইকে বললাম, ‘ডি’র বাড়িতে না যাবার জন্য। কিন্তু উত্তরে বলল, ‘কেন? যাব না কেন? তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। আপনি নিজেই তো তাকে একজন অতিথি নিয়ে আসবেন বলে জানিয়েছেন।

‘সব ঠিক আছে। তবুও আমার মন কেন যেন বলছে, আমরা না গেলেই ভালো হয়।’

‘একটু আগেই তো আপনি আমাকে নিয়ে যাবার জন্য জোড়াজুড়ি করেছেন, এখন আবার ওরকম ভাবছেন কেন?’

শ্যাটো রেনোর সঙ্গে সেখানে দেখা হবেই।

দেখা হলে ভালোই তো। শুনেছি খুব আমুদে লোক, তার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হলে আমি খুশিই হব।

বেশ তাহলে চলুন, আপনার যখন এত আগ্রহ।

নিচে গিয়ে কোট পরলাম। অপেরার কাছেই ‘ডি’র বাসা। পরিষ্কার আবহাওয়া তাই হেঁটে যাওয়ার জন্য লুইকে বললাম, লুই রাজি হলো, আশা হলো, ঠাণ্ডা বাতাস লুইসের মাথা শান্ত করে দিতে পারবে।

.

৭.

ড্রয়িং রুমে ঢুকে আমার বন্ধুদের অনেককেই দেখতে পেলাম। এরা সবাই নিয়মিত অপেরা দেখতে যায়। থিয়েটারের বক্সের দর্শনার্থী সবাই। মুখোশ খোলা কয়েকজন নাচিয়েও আছেন। সাথে ‘তোড়া’রা আছে।

তাদের কয়েকজনের সঙ্গে লুই দ্য ফ্রাঞ্চিকে আলাপ করিয়ে দিলাম। সবাই তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করল।

‘ডি’ তার মাইওমোটিস তোড়াকে সাথে নিয়ে দশ মিনিট পর এসে পড়ল। এসে সহজে মুখোশ খুলে ফেলল মাইওমোটিস, তার দ্বিধা করার কথাও না। এরকম পার্টিতে তার যাতায়াত অভ্যাস আছে তারপর সে। অত্যন্ত সুন্দরী।

‘ডি’র সাথেও ফ্রাঞ্চির পরিচয় করিয়ে দিলাম।

ডি, ঘোষণা করল–‘আমি প্রস্তাব করছি–সবার সাথে পরিচয়ের কাজ যদি শেষ হয়, তবে এবার খাবার টেবিলে গিয়ে বসা যাক।

‘কিন্তু শ্যাটো রেনো এখনও আসেনি?’

‘তাই তো। তার সে বাজি?’

‘বাজি ঠিক আছে, যে হারবে, সে বারোজন বন্ধুকে ডিনার খাওয়াবে।’

‘কিন্তু বাজিটা কি নিয়ে?

‘শ্যাটো রেনো বাজি ধরেছে, সে বিশেষ এক মহিলাকে এই খাবার আসরে নিয়ে আসবে। আমরা বলেছি সে পারবে না।’

মাইওমোটিস তোড়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘কে সেই মহিলা? যাকে নিয়ে এভাবে বাজি ধরা চলে?

আমি তাকিয়ে আছি লুই ফ্রাঞ্চির দিকে, বাইরে সে সম্পূর্ণ শান্ত। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখলাম, তার মুখ মরা মানুষের মতো সাদা।

‘ডি’ বলল, আমি তার নাম বলায় কোনো বাঁধা আছে বলে মনে করি না। আপনারা তাকে অনেকেই চেনেন না।

‘ডি’, হাত ধরল লুই–‘মঁসিয়ে দয়া করে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন কি?

‘ডি’ ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘কি অনুরোধ?

‘শ্যাটো রেনোর সাথে যে মহিলার আসার কথা। তার নামটি প্রকাশ করবেন না। তিনি বিবাহিতা, তা তো জানেন।

‘হোক বিবাহিতা, কিন্তু তার স্বামী তো ভারতবর্ষ বা মেক্সিকো বা ওইরকম বহু দূর কোনো দেশের প্রবাসী। অতদূরে স্বামী থাকা আর না থাকা সমান।’

‘কিন্তু সেই স্বামী আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশে আসছেন, আমি তাকে চিনি। সাহসী পুরুষ। ফিরে এসে যদি শোনেন যে, তার অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন। তিনি মনে আঘাত পাবেন। সম্ভব হলে সে আঘাত থেকে আমি তাঁকে বাঁচাতে চাই।’

‘ডি’ বলল, আমাকে মাফ করবেন। আমি জানতাম না, আপনার সাথে মহিলার পরিচয় আছে। এও আমি সত্যি জানতাম না যে তার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আপনি যখন ও ব্যাপারে নিশ্চিন্ত এবং স্বামীকেও চেনেন-’

‘তা চিনি।’

এখন অবশ্যই কথাবার্তায় আমাদের সংযত হতে হবে। ভদ্রমহিলা মহোদয়গণ, শ্যাটো রেননা আসুক বা না আসুক। বাজিতে তিনি জিতুন বা হারুন। আমার অনুরোধ এই ব্যাপারে আপনারা আর একটাও কথা বলবেন না।’

সবাই এর কথায়, এ ব্যাপারে আর কোনো কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিল। সামাজিক শালীনতার জন্যই যে এ প্রতিজ্ঞা তারা করল তা বোধহয় না। আসল কারণ হয়তো এই যে প্রত্যেকের দারুণ ক্ষুধা লেগেছিল। ফাও তর্ক করার উৎসাহ ছিল না।

ডি-এর সাথে হাত মেলালো ফ্রাঞ্চি। ধন্যবাদ মঁসিয়ে। আমার সন্দেহ তাই। আপনি মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন।’

এবার সবাই খাবার ঘরে গিয়ে খেতে বসল। দুটো চেয়ার খালি রইল একটি শ্যাটো রেনের অন্যটি তার সাথে আসার সেই মহিলার।

বাড়তি চেয়ার দুটি চাকরেরা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

‘ডি’ মানা করল, ‘শ্যাটো রেনো চারটে পর্যন্ত সময় নিয়েছে, এখনও সময় আছে। চারটা বাজার সাথে সাথে চেয়ার সরিয়ে নিয়ে যাবে। চারটে বেজে গেলে সে হেরে গেল।

আমি ফ্রাঞ্চির দিকে তাকিয়ে আছি, সে চেয়ে আছে ঘড়ির দিকে। ঘড়িতে তখন চারটে বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি।

‘ডি’ কে ফ্রাঞ্চি জিজ্ঞেস করল-’আপনার ঘড়ি ঠিক আছে তো?

‘ঘড়ি ঠিক বেঠিকের ব্যাপারে মাথা ঘামাবে শ্যাটো রেনো–আমার কোনো দরকার নেই। তবু সে যাতে এ ব্যাপারে আপত্তি তুলতে না পারে। তার জন্য তার ঘড়ির সাথে আমি ওই দেয়াল ঘড়ির সময় মিলিয়ে নিয়েছি।’

মাইওসোটিম তোড়া বলে উঠল–‘মঁসিয়ে শ্যাটো রেনো এবং তার বান্ধবীর ব্যাপারে কথা বলা যখন নিষেধ, তখন ও প্রসঙ্গ বাদ দিন। কারো। নাম বলতে না পারলে প্রতাঁকের আশ্রয় নিতে হয়। ঘরোয়া আলাপের ভেতর এই ব্যাপারটা আমার অসহ্য বলে মনে হয়।

‘ডি’ বলল–তুমি ঠিক বলেছ এটা। আর কোনো দুঃখেই বা আমরা প্রতাঁকের আশ্রয় নিতে যাব? যাদের নাম ধরে ডাকা যায়, এমন সুন্দরীর অভাব এখনও পড়েনি। তাঁদের সম্বন্ধে কথা বললে তারা বরং খুশিই হবে।’ আসুন তাঁদের সকলের স্বাস্থ্যই আমরা পান করি।

প্রত্যেক অতিথির হাতের কাছেই একটি করে বোতল। তা থেকে বরফ দেয়া শ্যাম্পেন ঢালছে গ্লাসে, আর গ্লাসের পানীয় ঢালছে গলায়।

লুই খুব কমই গ্লাস মুখে তুলছে।

আমি বললাম–‘আসুন, একটু পান করুন। দেখছেন তো শ্যাটো রেননা আসছে না।’

লুই বলল সে পরে পান করবে। আমি আর কিছু না বলে নিজের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলাম।

আমরা কথা বলছি বেশ আস্তে। কিন্তু বাকি সবার গলা আস্তে আস্তে বাড়ছে। রীতিমতো গোলমাল শুরু হয়েছে। মাত্র দুজন লোক সেই হট্টগোলে যোগ দিচ্ছে না, সে লোক দুজন হলো–ডি এবং লুই। তারা ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।

চারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আমি আবার লুই-এর দিকে তাকালাম। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। বলে গ্লাস মুখে উঠালাম।

সেও মৃদু হেসে তার গ্লাস ঠোঁটে ছোঁয়াল। গ্লাস প্রায় অর্ধেক খালি হয়েছে। এমন সময় জোরে ঘণ্টা বেজে উঠল।

তার মুখ প্রথম থেকেই বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। কিন্তু সেটা যে আরও বিবর্ণ হতে পারে এ ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল ন। কিন্তু চোখের উপরেই দেখলাম তার মুখটা একেবারে ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হয়ে গেল।

‘এ সেই’ ফ্রাঞ্চি বলল।

আমি ভরসা দিলাম–বোধহয় সেই। হয়তো সে মহিলাকে আনতে পারেনি।’

‘এখনি দেখা যাবে।’

ঘণ্টা বেজে উঠার পর প্রত্যেকের মনোযোগ সেই দিকে চলে গিয়েছে। এতক্ষণ আলাপ চলছিল হট্টগোলের মতো, মাঝে মাঝে সেটা চিৎকার পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে গোলমাল একদম চুপ হয়ে গেল।

সামনের ঘরে একটা কিছু নিয়ে তর্ক হচ্ছে।

‘ডি’ তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

লুই আমার কবজি চেপে ধরল জোরে। ‘তার গলা শুনছি।‘

আমি বললাম, তাতে কী! একদম ভেঙে পড়বেন না, মনে জোর আনুন, ভেবে দেখুন–কোনো মহিলা যদি তার অল্প পরিচিত বন্ধুর সাথে অপরিচিত কোনো বাড়িতে রাতে খেতে আসেন, যেখানে অন্য পুরুষরাও তার অপরিচিত, তাহলে বুঝতে হবে তিনি তরল প্রকৃতির মহিলা। চরিত্রহীনাই তাকে বলা যেতে পারে এবং তাই যদি মেনে নেয়া হয়। তাহলে সেকি আর কোনো ভদ্রলোকের শ্রদ্ধা বা সম্মান দাবি করতে পারে?

শুনতে পেলাম ও ঘরে ‘ডি’ বলছে–‘আসুন মাদাম, আসুন, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি–এ একটা একান্ত নিজস্ব পার্টি, বিশেষ অন্তরঙ্গ কয়েকটি বন্ধু।

শ্যাটো রেনোর গলা শুনতে পেলাম–এসো না এমিলি। ইচ্ছে না হলে তুমি মুখোশ খুলো না।

লুই দ্য ফ্রাঞ্চির মুখ থেকে একটা হিস হিস শব্দ বের হলো-’দুবৃত্ত।

শ্যাটো রেনো আর ডি দুজনে প্রায় টানতে টানতে এক মহিলাকে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল। বেচারি ‘ডি’–তার হয়তো মনে মনে ধারণা–অতিথি অ্যাপায়নের জন্য যেটুকু করা দরকার সে সেটুকু করছে।

চারটে বাজতে তখনও তিন মিনিট বাকি। মৃদু স্বরে ‘ডি’, কে জানাল শ্যাটো রেননা।

‘ঠিক আছে বন্ধু, তুমি জিতেছ।

অজানা মহিলা বলে উঠলেন, না, এখনও পুরোপুরি জেতা হয়নি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি শ্যাটো রেনোকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনার অত জেদের কারণ এখন বুঝতে পারছি। আপনি বাজি ধরেছিলেন যে এখানের এই ডিনারে আমাকে নিয়ে আসতে পারবেন কেমন?

শ্যাটো রেনো কোনো জবাব দিল না। তখন মহিলা ‘ডি’-এর দিকে ফিরল।

‘মঁসিয়ে, এই ভদ্রলোক জবাব দিচ্ছেন না। কাজেই আপনাকেই প্রশ্ন করি শ্যাটো রেনো কি এই রকম কোনো বাজি ধরেছিলেন হে।’

‘ম্যাডাম, শ্যাটো রেনো আমাকে ঠিক এই ধরনের কথা বলেছিলেন, তা আমি আপনার কাছে অস্বীকার করতে পারি না।’

তাহলে শুনুন, শ্যাটো রেনো বাজি হেরেছেন। কারণ তিনি আমাকে কোথায় নিয়ে আসছেন, তা আমকে মোটেই বলেননি। আমাকে বলেছিলেন, আমার একটি বিশেষ বন্ধুর বাড়িতে খাবার দাওয়াতে আমরা যাচ্ছি। সুতরাং আমি যখন নিজের ইচ্ছায় আসিনি তখন আমার ধারণা, শ্যাটো রেনো বাজি হেরেছেন।’

এতক্ষণ পর শ্যাটো রেনো কথা বলল, ‘এসে যখন পড়েছ তখন থেকে যাও। এত সব সম্মানী ভদ্রলোক রয়েছেন। এমন সুন্দরী সব মহিলা

‘এসে যখন পড়েছি তখন যে ভদ্রলোক এ ঘরের মালিক, তাকে তার ভদ্রতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু তাঁর নিমন্ত্রণ আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব না। মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চি আপনি কি আমায় সাহায্য করবেন? আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন?

লুই দ্য ফ্রাঞ্চি বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে অজ্ঞাত মহিলাকে শ্যাটো রেনোর সামনে থেকে আড়াল করে দাঁড়াল।

শ্যাটো রেননা তখন রাগে দাঁতে দাঁত পিষছে। মাদাম, আপনি ভুলে যাবেন না, আপনি আমার সাথে এসেছেন, আমি যখন এনেছি, আপনাকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও আমার।

মুখোশ পড়া মহিলা উত্তর দিলেন, ‘মঁসিয়েরা, এখানে আপনারা ভদ্রলোকেরা উপস্থিত আছেন। আমি আপনাদের আশ্রয় নিচ্ছি। আশা করি আপনারা দেখবেন যেন শ্যাটো রেনো আমার কোনো অপমান করতে না পারে।

শ্যাটো রেননা সামনে এগোতে গিয়েছিল আমরা সবাই এক সাথে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। শ্যাটো রেননা পিছিয়ে এলো। বলল, ঠিক আছে। ম্যাডাম আপনার ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারেন। তবে কার সাথে আমাকে ফয়সালা করতে হবে, তা আমি জানি।

লুই দ্য ফ্রাঞ্চি যে মর্যাদার সাথে এই পরিস্থিতিতে সামনে এগোল, তা ভাষায় বোঝান যায় না–মঁসিয়ে যদি আমার প্রতি ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে কাল সম্পূর্ণ দিন ৭নং রু দ্য হেয়ডারে আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকব।’

‘খুব ভালো কথা, তবে আমি নিজে যেতে পারব না। আমার বদলে আমার দুই বন্ধু আপনার সাথে দেখা করতে যাবেন।

‘কোনো মহিলার সামনে এ ব্যাপারে আলোচনা করা অবিবেচনার কাজ। লুই কাঁধ নাড়িয়ে বলে মহিলাটির দিকে ফিরে তার হাত ধরে তাকে বলল, চলুন ম্যাডাম, আমার উপর বিশ্বাস রেখে যে সম্মান আমাকে দিয়েছেন। তার জন্য আপনাকে আমার ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

ওরা দুজন চলে গেল। ঘর একদম নীরব।

‘বেশ তাহলে আমি হেরে গেলাম। চেয়ারে বসতে বসতে শ্যাটো রেনো বলল–পরশু ফ্রেয়ার্স হোটেলে নৈশ ভোজ খাব। সে তার গ্লাস বাড়িয়ে দিল, ‘ডি’ তা সম্পূর্ণ ভরে দিল শ্যাম্পেনে।

এরপরে আর কারও খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখা গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *