০৮. ধর্মের সমস্যাটা আসলে কি? ধর্ম কেন এত হিংস্র?

অষ্টম অধ্যায়– ধর্মের সমস্যাটা আসলে কি? ধর্ম কেন এত হিংস্র?

ধর্ম আসলেই মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে যে, একজন অদৃশ্য সত্তার অস্তিত্ব আছে– যিনি আকাশে বসবাস করেন–আপনি যা কিছু করছেন– প্রতিটি দিনের প্রতিটি মিনিটে– সব কিছুই তিনি দেখছেন। এবং এই অদৃশ্য সত্তার কাছে দশটি কর্মের একটি বিশেষ তালিকা আছে, তিনি চান আপনারা অবশ্যই সেসব নিষিদ্ধ কোনো কাজ যেন না করেন। এবং যদি আপনি সেই দশটি নিষেধাজ্ঞার কোনো একটি অমান্য করেন, তাহলে তার বানানো একটি বিশেষ জায়গা আছে, উত্তপ্ত লেলিহান শিখার আগুন আর কালো ধোঁয়ায় যে জায়গাটি পরিপূর্ণ, যেটি পুড়িয়ে ও নানাভাবে যন্ত্রণা আর নির্যাতন করার একটি বিশেষ জায়গা। সেখানে তিনি আপনাকে পাঠাবেন থাকতে এবং যন্ত্রণা সহ্য করতে এবং দগ্ধ এবং শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরার উপক্রম হতে এবং আপনি সেখানে অনন্তকালের জন্য অবিশ্রান্তভাবেই দারুণ যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকবেন আর কেবল কাঁদতে থাকবেন কিন্তু তারপরও তিনি আপনাকে ভালোবাসেন।
— জর্জ কারলিন

নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যগত প্রকৃতির কারণেই কোনো ধরনের সন্মুখ দ্বন্দ্বেই আমি তেমন সুবিধা করতে পারিনা। আর আসলেই আমি মনে করিনা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে সত্য অনুসন্ধান করার কোনো প্রক্রিয়া আদৌ উপযোগী একটি উপায় হতে পারে এবং নিয়মিতভাবেই আনুষ্ঠানিক নানা বিতর্কে অংশ নেবার জন্য আমন্ত্রণ আমি প্রত্যাখ্যান করে থাকি। একবার আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম তৎকালীন এডিনবরার ইয়র্কের আর্চ বিশপের সাথে একটি আনুষ্ঠানিক বিতর্কে অংশ গ্রহন করার জন্য। এর জন্য নিজেকে বেশ সন্মানিত মনে করেছিলাম এবং আমন্ত্রণটি সাদরে গ্রহন করেছিলাম। সেই বিতর্কের পর বিশিষ্ট ধার্মিক পদার্থ বিজ্ঞানী রাসেল স্ট্যানার্ড (১) তার ‘ডুইং অ্যাওয়ে উইথ গড?” বইটিতে অবজারভার পত্রিকায় সেই বিতর্ক বিষয়ে তাঁর লেখা একটি চিঠি পুনমুদ্রণ করেছিলেন (২):

মহাশয়, অতিমাত্রায় উৎফুল্ল আর তৃপ্তিময় শিরোনাম God comes a poor Second before the Majesty of Science এর অধীনে, আপনার বৈজ্ঞানিক সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে (তাও আবার ইষ্টার রোববারের মত একটি দিনে) ধর্ম ও বিজ্ঞান বিষয়ক একটি বিতর্কে রিচার্ড ডকিন্স ইয়র্কের আর্চ বিশপের উপর কিভাবে ‘গুরুতর বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন। আমাদের জানানো হয়েছে “কুৎসিৎ আত্মপ্রসাদের হাসি হাসা’ ‘নাস্তিক এবং সিংহরা’ ১০ এবং খ্রিষ্টানরা ০।

ধার্মিক বিজ্ঞানী স্ট্যানার্ড এভাবেই অবজারভার প্রত্রিকায় প্রকাশিত তার একটি চিঠিতে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া অব্যাহত রাখেন যে, কিভাবে সেই পত্রিকাটি রয়্যাল সোসাইটিতে তার সাথে আমার এবং বার্মিংহামের বিশপ ও বিখ্যাত কসমোলজিষ্ট স্যার হেরমান বন্ডির পরবর্তী একটি সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যে সাক্ষাৎকারটি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিতর্ক আকারে হয়নি, এবং তার ফলাফলে সেই আলোচনা অপেক্ষাকৃত বেশী গঠনমূলক হয়েছিল। এখানে শুধুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিতর্কের আকারে এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলোর প্রতি তার স্পষ্ট এবং যথার্থভাবে নিন্দা জ্ঞাপন প্রকাশের সাথে আমি অবশ্যই একমত হতে পারি। বিশেষ করে, আমার বই ‘এ ডেভিল’স চ্যাপলিন (৩) এ যে কারণগুলো আমি উল্লেখ করেছিলাম, কিছু খুব নির্দিষ্ট কারণেই আমি সৃষ্টিতত্ত্ববাদী বা ক্রিয়েশনিষ্টদের সাথে কোনো বিতর্কে অংশগ্রহন করতে চাইনা (৪)।

যদিও যুদ্ধংদেহী কোনো প্রতিযোগিতার প্রতি আমার সুস্পষ্ট অপছন্দ থাকা সত্ত্বেও, কোনো না কোনো একভাবে ধর্মের প্রতি আমার একটি তীব্র বিতার এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব আছে, এমন ধরনের একটি কুখ্যাতি আমি অর্জন করে ফেলেছি। আমার সহকর্মীরা যারা একমত যে, ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্বই নেই এবং যারা একমত যে নৈতিক হবার জন্যে আমাদের ধর্মের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, এবং আমরা ধর্ম এবং নৈতিকতার মূল শিকড়টাকে ধর্ম বহির্ভূত একটি ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারি, তারাও মৃদু বিস্ময়কর একটি ধাঁধা নিয়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে থাকেন। ‘তুমি কেন এত ধর্মের বিরুদ্ধে এত বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করো বলো তো? ধর্মের আসলে সমস্যাটা কি? আসলেই কি ধর্ম এত বেশী ক্ষতি করে যে আমাদের এর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে যুদ্ধ করতে হবে? কেন আমরা আমাদের মত থাকি না, আর অতিপ্রাকৃতিক ধর্মবিশ্বাসীদেরকে ছেড়ে দিচ্ছি না তাদের মত করে জীবন কাটানোর জন্য, যেমন আমরা করে থাকি রাশিচক্র, যেমন বৃষ আর বৃশ্চিক রাশির সাথে, বা ক্রিষ্টালের শক্তি আর লেই লাইন এর ক্ষেত্রে ( লেই লাইন হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া বিভিন্ন ভূপ্রকৃতি, ধর্মীয় এবং মানব-নির্মিত কাঠামোগুলোর মধ্যে সরলরৈখিক বিন্যাস, যার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব আছে বিশ্বাসীদের একটি অংশের মধ্যে)? ধর্ম কি সেই সব উদ্ভট ধ্যানধারণারই মত আরো একটি ধারণা না, যা কোনো ক্ষতি করছে না আমাদের?

আমি হয়তো এর উত্তরে বলি যে এধরনের বৈরী আচরণ যা আমি কিংবা অন্যান্য নিরীশ্ববাদীরা মাঝে মাঝে ধর্মের বিরুদ্ধে প্রদর্শন করেন তা শুধু লিখিত বা উচ্চারিত শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর শুধুমাত্র ধর্মতাত্ত্বিক মতভিন্নতার কারণে আমি কিন্তু কাউকে বোমা মেরে হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করছি না, বা শিরোচ্ছেদ করতে বা আগুনে পুড়িয়ে ক্রুশে চড়িয়ে মারতেও চাইছি না বা কোনো উঁচু দালানে বরাবর উড়োজাহাজও চালাতে চাইছি না। কিন্তু আমার প্রশ্নকর্তারা সাধারণত সেখানেই তাদের কথা থামান না, তিনি হয়তো আরো বলতে পারেন এমন কোনো কিছু: ‘তোমার এই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব কি তোমাকে একজন ‘মৌলবাদী নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত করছে না, ঠিক তোমার মতানুযায়ী তুমিও তো একই ভাবে উগ্র আর গোঁড়া, যুক্তরাষ্ট্রে বাইবেল বলয়ে বসবাসকারীরা যেমন তাদের মতামতে গোঁড়া আর উগ্র?’ প্রথমেই আমার প্রতি এই মৌলবাদীতার অভিযোগকে আগে পরিহার করার প্রয়োজন বোধ করছি, কারণ এই অভিযোগ আমার প্রতি হতাশাজনকভাবে সর্বজনীন।

মৌলবাদ এবং বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক তৎপরতা

মৌলবাদীরা বিশ্বাস করেন যে তারাই সঠিক কারণ সেই সত্যটিকে তারা কোনো একটি পবিত্র গ্রন্থে পড়েছেন এবং আগে থেকেই, তারা জানেন, কোনোকিছুই সেই ধারণকৃত লালিত বিশ্বাস থেকে তাদেরকে একচুলও নাড়াতে পারবে না। পবিত্র গ্রন্থেও সত্য হচ্ছে। এক ধরনের এক্সিয়ম বা কোনো প্রমাণ বা যুক্তি ছাড়াই যাকে সত্য বলে মেনে নেয়া হয় বা স্বতঃসিদ্ধ একটি প্রস্তাবনা, যা কখনোই কোনো যৌক্তিক আলোচনার উপসংহার হতে পারেনা। তাদের কাছে, যাই হোক না কেন, পবিত্র গ্রন্থ অবশ্যই সত্যি, এমন কি যখন যথেষ্ট পরিমান প্রমাণ এর প্রস্তাবিত দাবীর বিপক্ষে উপস্থাপন করা হয়। বিরুদ্ধ সেই প্রমাণগুলোই অবশ্যই বিশ্বাসীদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে, কারণ পবিত্র গ্রন্থ অবশ্য এবং চূড়ান্তভাবে মান্য। অথচ ঠিক এর বিপরীত, হচ্ছি আমি, একজন বৈজ্ঞানিক হিসাবে কোনো কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করি (যেমন ধরুন বিবর্তন প্রক্রিয়া), সেটা পবিত্র গ্রন্থে পড়েছি বলে তা কিন্তু না বরং আমি বিশ্বাস করি কারণ আমি এর সপক্ষে সব প্রমাণগুলোর বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করেছি এবং আসলেই দটো মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশী। বিবর্তন সংক্রান্ত কোনো বই এ বিশ্বাস স্থাপন করা হয় এ জন্য না যে তারা পবিত্র গ্রন্থের মত কোনো কিছু, বরং তাদের বিশ্বাস করা হয় কারণ সেই বইগুলোতে সাধারণত পরস্পরকে মজবুত বা দৃঢ় করে এমন অগণিত প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকে। নীতিগতভাবে, কোনো একজন পাঠক চাইলেই সেই প্রমাণগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন। বিজ্ঞানের কোনো বইয়ে যখন ভুল হয়, কেউ না কেউ একসময় সেই ভুলটি উদঘাটন করেন এবং এর পরবর্তী সংস্করণগুলোতে সেই ভুলটি সংশোধন করা হয়। এবং খুবই স্পষ্টভাবে আমরা এমন কিছু কোনো ধর্মগ্রন্থের সাথে হতে দেখিনা।

দার্শনিকরা, বিশেষ করে সৌখিন দার্শনিকরা যাদের অল্প কিছু দর্শন সম্বন্ধে লেখাপড়া আছে এবং আরো বিশেষভাবে যারা কালচারাল রিলেটিভিজম বা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ দ্বারা সংক্রমিত, তারা হয়তোবা এই পর্যায়ে ক্লান্তিকর একটি রেড হেরিং যুক্তি দেখাবেন বা মূল প্রসঙ্গটিকে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রচেষ্টায় একটি ভ্রান্ত যুক্তি প্রস্তাবনা করতে পারেন: একজন বিজ্ঞানীর ‘স্বাক্ষ্য প্রমাণের উপর বিশ্বাসটাইতো কোনো মৌলবাদী বিশ্বাসের মতই একটি বিষয়। এই বিষয়টি নিয়ে আমি আমার অন্য কিছু লেখায় বিশদ আলোচনা করেছি আগে, এখানে শুধু সংক্ষিপ্তভাবে তার কিছুটা পুনরাবৃত্তি করবো। সৌখিন দার্শনিকের টুপি মাথায় দিয়ে আমরা যা কিছু দাবী করি না কেন, আমরা সবাই আমাদের জীবনে প্রমাণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করি। যদি আমি কোনো হত্যার জন্য অভিযুক্ত হই, বিবাদী পক্ষের আইনজীবি আমাকে কঠোর ভাবে জিজ্ঞেস করবেন, অপরাধ সংঘটিত হবার আগের রাত্রে আমি শিকাগোতে ছিলাম এই কথাটি সত্যি কিনা। আমি এখানে দর্শনের যুক্তি দিয়ে এমন কোনো উত্তর দিয়ে বিষয়টি কিন্তু পাশ কাটিয়ে যেতে পারবো না, যেমন: ‘এটা নির্ভর করছে আপনি সত্যি বলতে কি বোঝাচ্ছেন সেই বিষয়টার উপর, কিংবা কোনো নৃতাত্ত্বিক বা আপেক্ষিকতাবাদী আবেদন দিয়ে, যেমন, ‘শুধুমাত্র আপনার পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক ‘ছিলাম’ অর্থে আমি শিকাগোতে ছিলাম সেদিন। বঙ্গোলীজদের এই ‘কোথাও থাকার ধারণাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, সে অনুযায়ী আপনি সত্যি ‘কোথাও আছেন’ বলতে বোঝাবে, আপনি হচ্ছেন সুগন্ধী তেল মর্দন করা নির্বাচিত একজন বয়োবৃদ্ধ, যিনি ছাগলের শুকনো অণ্ডকোষ থেকে নস্যি নেবার যোগ্যতা রাখেন (৫)।

হতে পারে বিজ্ঞানীরা মৌলবাদী, ‘সত্য বলতে কি বোঝায় যখন সেটি কোনো বিমূর্ত উপায়কে সংজ্ঞায়িত করা হয়; কিন্তু সে অর্থেও বাকীরাও কিন্তু সেরকমই মৌলবাদী। আমি যখন বলছি নিউজিল্যাণ্ডের অবস্থান হচ্ছে দক্ষিন গোলার্ধে, তার চেয়ে আবার আমি যখন বলছি বিবর্তন সত্যি, তা কিন্তু কোনো অংশেই আমাকে বেশী মৌলবাদী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করছে না। আমরা বিবর্তনে বিশ্বাস করি কারণ এর সপক্ষে অসংখ্য সাক্ষ্য প্রমাণ আছে এবং আমরা এটিকে অবশ্যই দ্রুত প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধা বোধ করবো না, যদি নতুন কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের হাতে আসে যা কিনা বিবর্তনকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে; কোনো সত্যিকারের মৌলবাদী এভাবে কোনো কথা কখনোই বলবেন না।

খুবই সহজ তীব্র আবেগ আর মৌলিবাদীতা, এই দুটি বিষয়কে একই মনে করে সংশয়াচ্ছন্ন হওয়া। আমাকে যথেষ্ট আবেগ তাড়িত মনে হতে পারে আমি যখন মৌলবাদী কোনো সৃষ্টিতত্ত্ববাদী বা ক্রিয়েশনিষ্টদের বিরুদ্ধে বিবর্তনের পক্ষে লড়াই করি, কিন্তু এর কারণ তাদের মৌলবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এটি আমার কোনো মৌলবাদ তা কিন্তু না; এর কারণ বিবর্তনের সপক্ষে প্রশ্নাতীতভাবে অত্যন্ত দৃঢ় অসংখ্য স্বাক্ষ্য প্রমাণ আছে এবং আমি আবেগময় একটি হতাশার শিকার হই যখন দেখি আমার বিরোধী পক্ষ সেটি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বা সাধারণত যা হয়ে থাকে, প্রমাণগুলোর দিকে তারা নজর দিতেই অস্বীকার করেন, শুধুমাত্র যার কারণ যখন এটি তাদের পবিত্র গ্রন্থের সাথে ভিন্নমত পোষণ করছে। আমার সেই আবেগ আরো জোরালো হয়, যখন আমি দেখি এই সব দুর্ভাগা মৌলবাদীরা এবং তারা যাদের প্রভাবিত করছে তারা ঠিক কতটুকু বঞ্চিত হচ্ছেন বিবর্তনের ধারণাটি অনুধাবন না করতে পারার জন্য। বিবর্তনের সত্যগুলো এবং সেই সাথে অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সত্যগুলো প্রত্যেকটি অত্যন্ত গভীরভাবে বিস্ময়কর এবং সুন্দর। আসলেই কতটুকু দুর্ভাগ্যজনক যদি তা না জেনেই কাউকে মরতে হয়! অবশ্যই সেই বিষয়টি আমাকে তীব্র আবেগাক্রান্ত করে ফেলে, আর কেনই বা সেটা করবে না? কিন্তু বিবর্তনে আমার বিশ্বাস কখনোই মৌলবাদ সমতুল্য না আর এটি কোনো অন্ধবিশ্বাসও না, কারণ আমি জানি আমার মন পরিবর্তন করতে কি প্রয়োজন এবং আমি আনন্দের সাথেই তা করবো যদি প্রয়োজনীয় প্রমাণ মেলে।

এবং এরকম ঘটনা বহু ঘটেছেও। আগে বেশ কয়েকবার আমি আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র থাকাকালীন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগের একজন সম্মানিত নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞের গল্প বলেছিলাম, বহু বছর ধরে তিনি অত্যন্ত আবেগের সাথেই বিশ্বাস করতেন এবং পড়াতেন যে গলজি অ্যাপারাটাস’ (প্রাণী কোষের অভ্যন্তরে একটি আণুবীক্ষণিক অঙ্গাণু) এর আসলে বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই: একটি বিভ্রম বা ভুল করে মনে করা কোনো একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। প্রতি সোমবার বিকেলে প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগের একটি প্রথা ছিল যে সমস্ত বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একজন ভিজিটিং লেকচারারের সেমিনারে অংশ নেবে। একটি সোমবারে আমাদের অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কোষ বিজ্ঞানী, যিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য স্বাক্ষ্য প্রমাণসহ আমাদের জানান যে, গলজি অ্যাপারাটাস বলে আসলেই কোষের অভ্যন্তরে অঙ্গাণু আছে। সেই বক্তৃতার শেষে সেই বদ্ধ অধ্যাপক হল ভর্তি মানুষের সামনে এসে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীর সাথে হাত মেলালেন এবং বেশ আবেগের সাথে বলেন, ‘আমার প্রিয় সহকর্মী, আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই, গত পনেরো বছর ধরে আমি ভুল জানতাম। আমরা সবাই তখন হাততালি দিয়ে উঠেছিলাম সজোরে। কোনো মৌলবাদী কখনোই তা করবে না। এবং বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক বিজ্ঞানীও হয়তো আক্ষরিকার্থে তা করবেন না, কিন্তু সব বিজ্ঞানীরাই অন্তত সায় দেবেন এটিকে আদর্শ হিসাবে চিহ্নিত করে। যার ব্যতিক্রম রাজনীতিবিদরা কিন্তু তা করবেন না কখনোই, তারা হয়তো বলবেন এগুলো হচ্ছে মত একেবারে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নেয়া বা ডিগবাজী মারা। একটু আগেই বর্ণনা করা এই ঘটনাটির স্মৃতি এখনও আমাকে আবেগতাড়িত করে।

একজন বৈজ্ঞানিক হিসাবে, আমি মৌলবাদী ধর্মের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করি কারণ এটি সক্রিয়ভাবে বৈজ্ঞানিক সব উদ্যোগকে কলুষিত করছে। ধর্ম আমাদের শেখায়, আমরা যেন আমাদের মন পরিবর্তন না করি, মহাবিশ্বে যত বিস্ময়কর জিনিস জানার আছে আমরা যেন সেগুলো সম্বন্ধে জানার কোনো আগ্রহ অনুভব না করি কিংবা সক্রিয়ভাবে জানার চেষ্টা না করি; এটি বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে, আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে দুর্বল করে দেয়। আমার জানা মতে এর সবচেয়ে দুঃখজনক উদাহরণ হচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ববিদ কার্ট ওয়াইস, যিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির ডেটনে ব্রায়ান কলেজের সেন্টার ফর অরিজিনস রিসার্চ এর পরিচালক। কলেজটির নাম ব্রায়ান হবার কারণ কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা নয়, এর নামকরণ হয়েছ উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান এর নামানুসারে, যিনি বিজ্ঞান শিক্ষক জন স্কোপস এর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বিখ্যাত ১৯২৫ সালের ডেটন ‘মাঙ্কি ট্রায়াল’ এ। ওয়াইস তার শৈশবের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতেন কোনো একটি সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে, যার মূলমন্ত্র হয়তো হতো ‘বিশ্লেষণাত্মক ভাবে চিন্তা করতে হবে’, ব্রায়ান কলেজের ওয়েবসাইটে উল্লেখিত স্ববিরোধী শব্দ দিয়ে সৃষ্ট কোনো মূলমন্ত্র না– “বিশ্লেষনী মনোভাব এবং বাইবেল এর মত চিন্তা করুন। ওয়াইস শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্ববিদ্যায় ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন এবং এরপর আরো দুটি উচ্চতর ডিগ্রী নেন ভূতত্ত্ববিদ্যা এবং জীবাশ্মবিদ্যায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো অংশেই যা কম নয়), যেখানে তিনি বিখ্যাত অধ্যাপক স্টিফেন জে. গুল্ড এর ছাত্র ছিলেন (আরো বিশাল একটি ব্যপার); তিনি খুবই যোগ্য এবং মেধাবী তরুণ বিজ্ঞানী ছিলেন, প্রকৃত যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো এবং গবেষণা করবেন, তার জীবনের এমন একটি স্বপ্ন পূরণের পথেই তিনি অগ্রসরও হচ্ছিলেন।

ঠিক তখনই একটি দুর্ঘটনা ঘটে। এই আঘাতটি বাইরে থেকে না, তার নিজের ভিতর থেকেই এসেছিল..তার নিজের মনে, যে মন মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়েছিল একটি মৌলবাদী ধর্মের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত হবার কারণে, যে মৌলবাদী বিশ্বাস তাকে বাধ্য করে পৃথিবীর বয়স– শিকাগো ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নিজের ভূতাত্ত্বিক পড়াশুনার বিষয়– দশ হাজার বছরেরও কম এমন একটি ধারণায় বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য। যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি। বোঝার জন্য যে, তার ধর্মবিশ্বাস আর বিজ্ঞান একটি মুখোমুখি সংঘর্ষের দিকে এগুচ্ছে এবং তার মনের ভিতরেও সেই দ্বন্দ্বও ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছিল এবং একদিন তিনি আর সহ্য করতে পারেননি, ব্যপারটা সমাধান করার জন্য একটি কাচি হাতে বাইবেলে নিয়ে বসলেন, তিনি পুরো বাইবেলের যে অংশগুলোকে বাতিল করতে হবে যদি পৃথিবী সম্বন্ধে তার অর্জিত বৈজ্ঞানিক ধারণা সত্য হয়ে থাকে, সেই অংশগুলোকে আক্ষরিক অর্থে তিন কাটতে শুরু করেন। এই অতিমাত্রায় সৎ আর কষ্টকর অনুশীলনের পর, তার বাইবেলটির আসলেই খুব কম অংশ অক্ষত ছিল,

যতই চেষ্টা করিনা কেন আমি, সারা ধর্মগ্রন্থ জুড়ে অক্ষত মার্জিন থাকার সুবিধা সত্ত্বেও বাইবেলটা দুই ভাগে ভাগ না হয়ে যাওয়া ছাড়া আমি কিছুত সেটি ধরতে পারছিলাম না। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে বিবর্তন আর ধর্মগ্রন্থের মধ্যে কোনটা আমি বেছে নেব। হয় ধর্মগ্রন্থ সত্যি এবং বিবর্তন ভুল কিংবা বিবর্তন সত্য এবং আমাকে অবশ্যই বাইবেল ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। ঠিক সেই মুহূর্তে, সেই রাতে আমি ঈশ্বরের কথা মেনে নেই এবং বাইবেল পরিপন্থী বিবর্তন সহ সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করি। এবং এভাবে, অনেক দুঃখের সাথে বিজ্ঞানে আমার সব স্বপ্ন আর আশাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলি (৬)।

বিষয়টি আমাকে দারুণ ব্যাথিত করে; কিন্তু অন্যদিকে ‘গলজি অ্যাপারাটাসের’ গল্পটি আমাকে আন্দোলিত করে মুগ্ধতায় আর শ্রদ্ধায়, কার্ট ওয়াইসের কাহিনী আসলে করুণারই উদ্রেক করে.. করুণা এবং বিতৃষ্ণা। তার নিজের পেশাগত জীবন আর তার জীবনের সুখের প্রতি এই আঘাত তার নিজেরই দেয়া.. যা খুব বেশী অপ্রয়োজনীয় ছিল.. সহজেই এড়াননাও সম্ভব ছিল। শুধু তাকে বাইবেলকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হতো বা তিনি সেটাকে প্রতীকী বা রুপকভাবে ব্যাখ্যা করতেন, যেমন করে বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিকরা করে থাকেন। তবে তার বদলে তিনি মৌলবাদীদের মতই কাজটি করলেন এবং বিজ্ঞানকে ছুঁড়ে ফেলে দেন তার জীবন থেকে, সেই সাথে প্রমাণ এবং যুক্তি, তার সব স্বপ্ন আর আশাগুলো।

হয়তো মৌলবাদীদের মধ্যে অনন্য একটি উদাহরণ, কার্ট ওয়াইস সৎ, অতিমাত্রায় সৎ একজন মানুষ, যার সততা তাকে কষ্ট দিয়েছে। এবং ধ্বংস করেছে। তাকেই টেম্পলটন পুরষ্কার দেয়া উচিৎ, তিনি হয়তো এর প্রথম সত্যিকারের যোগ্য পুরস্কৃত কেউ হতে পারতেন। ওয়াইস সবার সামনে যে বিষয়টি নিয়ে আসেন, সেটা গোপনে সবার চোখের আড়ালে ঘটছে সবসময়ই, সাধারণত সকল মৌলবাদীদের মনে, যখন তারা বৈজ্ঞানিক স্বাক্ষ্য প্রমাণের মুখোমুখি হন, যা তাদের দৃঢ় ভাবে ধারণ করা মতামতের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে। তার কাহিনী উপসংহারটি লক্ষ করুন:

যদিও কয়েক হাজার বছরের একটি তরুণ পৃথিবীকে মেনে নেবার জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক কারণ আছে, তবে। আমি একজন ইয়াং আর্থ ক্রিয়েশনিষ্ট কারণ আমি আমার ধারণাটি পেয়েছি ধর্মগ্রন্থ থেকে। যেমন অধ্যাপকদের সাথে যা আমি আলাপ করেছিলাম বহু বছর আগে,যখন কলেজে ছিলাম, যদি এই মহাবিশ্বের সব প্রমাণ সৃষ্টিতত্ত্ববাদের বিরুদ্ধে যায়, আমি হবো প্রথম ব্যক্তি সেটা স্বীকার করার জন্য, তারপরও আমি সৃষ্টিতত্ত্ববাদী থাকবো কারণ ঈশ্বরের নিজের কথায় তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে, এবং এখানেই আমাকে অবশ্যই স্থির থাকতে হবে (৬)।

তিনি সম্ভবত লুথারকে (৭) উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন তার শেষ সিদ্ধাস্তে স্থির হয়ে দাঁড়ানোর কথা বলতে গিয়ে, যেমন লুথার তার নিজের মূল বক্তব্যকে ভিটেনবুর্গ এর চার্চের দরজায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু হতভাগা কার্ট ওয়াইস আমাকে বরং অরওয়েল-এর (৮) ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ (৯) বইটির উইনস্টোন স্মিথের (১০) কথাই বেশী মনে করিয়ে দেয়, যে কিনা যদি বিগ ব্রাদার বলেন দুই আর দুই যোগ করলে পাঁচ হবে, তাই বিশ্বাস করার জন্য প্রাণান্তরকর প্রচেষ্টা করেছিল। যদিও উইনস্টোন, নির্যাতিত হয়েছিলেন; ওয়াইস এই ভিন্ন চিন্তার কারণ কিন্তু অবশ্যম্ভাবী শারীরিক নির্যাতনের আশঙ্কা নয় বরং অন্য একটি অনতিক্রম্য বাধ্যবাধকতা ছিল তার জন্য– আপাতদৃষ্টিতে কারো কারো কাছে যা অনস্বীকার্য ও শিরোধার্য, তা হলো ধর্মীয় বিশ্বাস: তর্কসাপেক্ষে যা মানসিক নিপীড়নেরই আরেকটি একটি রুপ। আমি ধর্ম সম্বন্ধে বৈরী মনোভাব পোষণ করি কারণ কার্ট ওয়াইস এর সাথে এটি যা করেছে এবং ধর্ম যদি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত কোনো ভূতত্ত্ববিদের সাথে এমন করতে পারে তাহলে চিন্তা করে দেখুন অন্য যেকোনো সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে, যাদের সেই মেধাও নেই এবং প্রতিরোধ করার মত কোনো প্রস্তুতি নেই, তাহলে এটি কি করতে পারে।

অগণিত নিরীহ, উৎসাহী, কৌতূহলী, আর পরিষ্কার ভালো মনের তরুণ শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে ধ্বংস করতে মৌলবাদী ধর্ম বদ্ধপরিকর। আর অমৌলবাদীদের তথাকথিত ‘মৃদু আর ‘কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন’ ধর্ম হয়তো তা করছে না ঠিকই, তবে অবশ্যই এটি পৃথিবীকে মৌলবাদীদের জন্য নিরাপদ করে তুলছে, খুব শৈশব থেকেই শিশুদের একটি মন্ত্র শিখিয়ে, সেটি হচ্ছে: প্রশ্নাতীত অন্ধ বিশ্বাস হচ্ছে একটি মহৎ গুন।

মোরাল অ্যাবসোলটিজম (১১) বা নৈতিক চূড়ান্তবাদের অন্ধকার রুপ

আগের অধ্যায়ে যখন সময়ের সাথে পরিবর্তিত হওয়া নৈতিকতার যুগধর্ম বা জাইটগাইষ্ট কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলাম, আমি উদারপন্থী, জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত, সুশীল মানুষদের সর্বজনীন ঐকমতের একটি ধারণার কথা উল্লেখ করেছিলাম; আমি একটু বেশী মাত্রায় আশাবাদী ধারণা করেছিলাম যে “আমরা সবাই অন্তত মোটা দাগে সেই ঐকমতের সাথে সংহতি অনুভব করি, কেউ কেউ হয়তো অন্যদের চেয়ে বেশী এবং আমি এই আমরা বলতে মনে করেছিলাম.. বেশীর ভাগ মানুষ যাদের এই বইটি পড়ার সম্ভাবনা আছে, ধর্ম সংক্রান্ত বিশ্বাসে তাদের যে অবস্থানই থাকুক না কেন। কিন্তু অবশ্যই একেবারে সবাই যে একমত হবেন তা কিন্তু না (এবং সবাই যে আমার এই বইটি পড়ার ইচ্ছা পোষণ করবেন তাও কিন্তু না); সুতরাং স্বীকার করতেই হবে স্বৈরাচার এখনও তার মৃত্যু থেকে অনেক দূরে। আসলেই, আজ এখনও বিশ্বজুড়ে এটি বিশাল সংখ্যক মানুষের মনে রাজত্ব করছে, সবচেয়ে বিপদজ্জনক ভাবে মুসলিম বিশ্বে এবং অঙ্কুরিত হতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মতন্ত্রে ( কেভিন ফিলিপসের ‘আমেরিকান থিওক্র্যাসি’ বইটি দেখুন (১২)); প্রায় সবসময়ই এধরনের চূড়ান্তবাদ বা অ্যাবসোল্‌টিজমের মূল উৎস হচ্ছে শক্তিশালী ধর্মীয় বিশ্বাস। এবং ধর্ম যে পৃথিবীতে একটি অশুভ শক্তি এমন প্রস্তাবের এটি মূলত প্রধান একটি কারণ।

ওল্ড টেষ্টামেন্টে সবচেয়ে নশংসতম শাস্তির বিধান রাখা হয়েছিল ব্লাসফেমী বা ধর্মনিন্দার জন্য এবং এটি এখনও কিছু দেশে সক্রিয়। পাকিস্তানের পেনাল কোডের ২৯৫-সি সেকশন এই ‘অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। ২০০১ সালে ১৮ আগষ্ট, ডাঃ ইউনুস শেখ, একজন চিকিৎসক শিক্ষক ব্লাসফেমীর জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দণ্ডিত হয়েছিলেন। যে নির্দিষ্ট অপরাধটির জন্য এই আইনে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন সেটি হলো: তিনি তার শিক্ষার্থীদের নাকি বলেছিলেন ৪০ বছর বয়সে তার নিজের ধর্ম আবিষ্কারের পূর্বে নবী মোহাম্মদ মসুলমান ছিলেন না। তার ১১ জন শিক্ষার্থী তার এই ধরনের কথা বলার অপরাধের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে তার নামে অভিযোগ করেছিল। পাকিস্তানের ব্লাসফেমী আইনটি সাধারণত ব্যবহার করা হয় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, যেমন, অগাষ্টিন আশিক কিংরি মাসিহ, যাকে ফয়সালাবাদে ২০০০ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। একজন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হিসাবে মাসিহ তার মুসলিম প্রেমিকাকে বিয়ে করার কোনো অনুমতি ছিল না– অবিশ্বাস্যভাবে- পাকিস্তানী (এর ইসলামী) আইন কোনো মুসলিম রমনীকে কোনো অমুসলিমকে বিয়ে করার অনুমতি দেয় না। সুতরাং তিনি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হবার চেষ্টা করেন এবং সেটা করতে গিয়ে তিনি অভিযুক্ত হন এই ধর্মগ্রহনের জন্য তার নিশ্চয়ই নীচ কোনো উদ্দেশ্য আছে এমন একটি অভিযোগে। আমি যে রিপোর্ট পড়েছি সেটা থেকে স্পষ্ট নয় যে, এটাই কি তার মূল অপরাধ ছিল নাকি নবীর নিজের নৈতিকতা নিয়ে তার কোনো মন্তব্য যা তিনি করেছিলেন বলেও তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যাই হোক, অন্য যে কোনো দেশে, যাদের আইন ধর্মীয় গোঁড়ামীমুক্ত, সেখানে এধরনের কোনো অপরাধের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড কল্পনা করাও অসম্ভব।

২০০৬ সালে আফগানিস্থানে, আব্দুল রহমান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করার জন্য। কাউকে কি তিনি খুন করেছিলেন? নাকি তিনি কাউকে আহত করেছিলেন হিংস্র কোনো উপায়ে, কিংবা কোনো কিছু চুরি বা ধ্বংস করেছিলেন কিছু? নাহ, শুধুমাত্র একটি কাজই তিনি করেছিলেন: তিনি তার মন পরিবর্তন করেছিলেন, তার নিজের ভিতরে এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি তার মন পরিবর্তন করেছিলেন। তবে তিনি যে কিছু ধারণা আর চিন্তা তার মনে পোষণ করেছিলেন, সেগুলো তার দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পছন্দ হয়নি। এবং মনে রাখতে হবে এই আফগানিস্থান কিন্তু তালিবানদের আফগানিস্থান না বরং হামিদ কারজাই (১৩) এর মুক্ত আফগানিস্থান, যুক্তরাষ্ট্রের নের্তৃত্বে যৌথ বাহিনী যে সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। জনাব রহমান মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন, তবে শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য নিজেকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাবী করে এবং প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে। ইসলামের গোঁড়া কর্তব্য পালন করতে অতিউৎসাহী গুণ্ডাদের হাত থেকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে বর্তমানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে এখন ইতালীতে। তালিবান শাসন মুক্ত করা আফগানিস্থানের সংবিধানের এটি এখনও একটি ধারা হিসাবে বিদ্যমান, ধর্মত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অ্যাপোস্টেসি বা ধর্মত্যাগ, মনে রাখতে হবে, কিন্তু কোনো ধরনের সত্যিকারের মানুষের উপর ঘটানো বা কোনো সম্পদের ক্ষতি করা না। জর্জ অরওয়েল এর ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ এর শব্দ ব্যবহার করে যদি বলি এটি বিশুদ্ধভাবে চিন্তাজগতের অপরাধ বা থট ক্রাইম এবং ইসলামী আইন অনুযায়ী এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আরেকটি উদাহরণ, ১৯৯২ সালের ৩ সেম্পেম্বর, সাদিক আব্দুল কারিম মালল্লাহ এর ক্ষেত্রে যেমন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। আইনগতভাবে তাকে ধর্মনিন্দা এবং ধর্মত্যাগে দোষী সাব্যস্ত হবার পর, সৌদি আরবে জনস্বমক্ষে তাকে শিরোচ্ছেদ করা হয় (১৩)।

আমি একবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত একটি বিতর্কে স্যার ইকবাল সাকরানি’র মুখোমুখি হয়েছিলাম। যার কথা। আমি প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম, যাকে বলা হয় ব্রিটেনের নেতৃস্থানীয় মধ্যপন্থী মুসলিম। তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম ধর্মত্যাগ বা অ্যাপোস্ট্যাসির সাজা মৃত্যুদণ্ড নিয়ে। তিনি খুব কসরত করে আমার প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে যান প্রথাটি না স্বীকার করে বা এর বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা না জানিয়ে। তিনি বার বার মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছিলেন, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কিছু না বলে। এই হচ্ছে সেই মানুষ যাকে ব্রিটিশ সরকার ‘নাইট’ উপাধি দিয়েছিলে, তথাকথিত আন্তঃধর্মবিশ্বাস সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার জন্য।

কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মেও কোনো আত্মতুষ্টির জায়গা নেই। এই ব্রিটেইনে প্রায় সাম্প্রতিক সময়ে, ১৯২২ সালে জন উইলিমার গোটকে নয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল ধর্মনিন্দা করার জন্য: তিনি জিসাসকে একটি ভাড় এর সাথে তুলনা করেছিলেন (১৪)। প্রায় অবিশ্বাস্য যে এখনও ব্রিটেনের আইনে ধর্মনিন্দার আইনটি বিদ্যমান। ২০০৫ সালে একটি খ্রিষ্টান গ্রুপ বিবিসির বিরুদ্ধে এই ব্লাসফেমীর অভিযোগ আনার চেষ্টা করেছিল Jerry Springer, the Opera সম্প্রচার করার জন্যে (১৫)।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্টে ‘আমেরিকান তালিবান’ শব্দটি সৃষ্টি হবার অপেক্ষায় ছিল উদগ্রীবভাবে। দ্রুত আপনি গুগল সার্চ করলে দেখবেন কমপক্ষে এক ডজন ওয়েব সাইট তা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় নেতা, ধর্মবিশ্বাস নির্ভর রাজনীতিবিদদের যে পরিমান উদ্ধৃতি তারা সংগ্রহ করেছে তা ভয়াবহভাবে আফগান তালিবান, আয়াতোল্লাহ খোমেনী এবং সৌদি আরবের ওয়াহাবী কর্তৃপক্ষর সংকীর্ণ মানসিকতা, নির্মম নৃশংসতা আর চূড়ান্ত কুৎসিত মনোভাবকে মনে করিয়ে দেয়। “দি আমেরিকান তালিবান’ নামে ওয়েব পেজটি বিশেষভাবে সমৃদ্ধ কুৎসিৎভাবে জঘণ্য আর উন্মত্ত এধরনের সব উদ্ধৃতিতে। যার শুরুতেই আছে সেরাটি– যার উৎস অ্যান কোলটার। সহকর্মীরা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এটি কোনো গাঁজাখুরী বানানো মন্তব্য না, এটি আবিষ্কার করেছিল ‘দি অনিয়ন’ পত্রিকা: “আমাদের উচিৎ অন্য দেশগুলোকে আক্রমণ করে তাদের সব নেতাদের হত্যা করা ও তাদের খ্রিষ্ট ধর্মে রুপান্তরিত করা (১৬)।

এছাড়া এধরনের আরো কিছু অতুলনীয় মানসিকতাপূর্ণ উদ্ধৃতির নমুনা হচ্ছে, যেমন কংগ্রেস সদস্য বব ডরনান বলেছিলেন: “গে বা Gay শব্দটি ব্যবহার করবেন না যদি না সেটি Got AIDS Yet (বা এখনও এইডস হয়নি) বাক্যটির শব্দসংক্ষেপ না হয়। এছাড়া জেনারেল উইলিয়াম জি, বয়কিনস বলেছিলেন,”জর্জ বুশ যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হননি, তাকে নিয়োগ দিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর। এছাড়াও আছে একটি পুরোনো বিখ্যাত রোনাল্ড রিগ্যান শাসনামলের পরিবেশ নীতির বিখ্যাত সেক্রেটারীর: “আমাদের পরিবেশকে সুরক্ষা করার কোনো দরকার নেই, খ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমন আসন্ন। আফগান তালিবান আর আমেরিকান তালিবান হচ্ছে উৎকৃষ্ট উদাহরণ কি ঘটে যখন মানুষ তাদের ধর্মগ্রন্থকে আক্ষরিক ভাবে এবং অতিরিক্ত গুরুত্বের সাথে ও প্রশ্নাতীতভাবে অনুসরণ করে। ওল্ড টেষ্টামেন্ট এর ধর্মতন্ত্রের অধীনে জীবন কত ভয়াবহ হতে পারে তার একটি আধুনিক সংস্করণ দেখতে পাই আমরা এখানে। কিম্বার্লি ব্লেকার তার বই ‘দ্য ফাণ্ডামেন্টালস অব এক্সট্রিমিজম: দ্য ক্রিশ্চিয়ান রাইটস ইন আমেরিকা য় খ্রিষ্টান তালিবানদের (যদিও এই নামে নয়) বিপদজ্জনক রুপটার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন (১৭)।

ধর্মবিশ্বাস এবং সমকামিতা

তালিবানদের অধীনে আফগানিস্থানে সমকামিতার আইনী শাস্তির বিধান ছিল মৃত্যুদণ্ড এবং সেটি কার্যকর করার জন্য তাদের রুচি অনুযায়ী যে পদ্ধতি তারা অনুসরণ করতো তা হলো, অভিযুক্তকে কোনো একটা প্রাচীরের গোঁড়ায় মাটিতে জীবন্ত কবর দিয়ে তার উপরে ভারি প্রাচীরটিকে ঠেলে ফেলে দেয়া। এই তথাকথিত ‘অপরাধটি একান্তই ব্যক্তিগত একটি ব্যপার, যা দুজন সম্মত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ঘটে যারা অন্য কারো কোনো ক্ষতি করেনি, আমরা এখানে আবার দেখতে পাই ধর্মীয় চূড়ান্তবাদী মানসিকতার একটি বৈশিষ্ট্যসূচক উদাহরণ। আমার নিজের দেশ ইংল্যান্ডেরও এক্ষেত্রে নাক উঁচু করার কোনো অধিকার নেই। বিস্ময়করভাবে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ব্যক্তিগত জীবনে সমকামিতাকে চিহ্নিত করা হতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে। ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ অ্যালান টুরিং (১৮), জন ভন নিউমান (১৯) এর সাথে যিনি কম্পিউটারের জনক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবী রাখেন, আত্মহত্যা করেছিলেন তার ব্যক্তিগত জীবনে সমকামিতার জন্য অভিযুক্ত হবার পর। অস্বীকার করছি না যে ট্যুরিংকে বর্বরভাবে কোনো প্রাচীরের গোঁড়ায় জীবন্ত কবর দিয়ে প্রাচীর চাপা দেয়া হয়নি ট্যাঙ্ক এর সাহায্যে। তবে তাকে দুটো বিকল্প দেয়া হয়েছিল, দুই বছরের কারাদণ্ড (কল্পনা করা খুবই সহজ যে জেলখানায় অন্য কয়েদীরা তার সাথে কেমন ব্যবহার করতো) অথবা হরমোন ইনজেকশনের একটি কোর্স যাকে বলা যেতে পারে রাসায়নিক কাসট্রেশন (বন্ধ্যাকরণ) এর সমান যা তার স্তনের আকারও বাড়াতো। তার সর্বশেষ এবং ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল সায়ানাইড ইনজেক্ট করা একটি আপেল (২০)।

জার্মান সেনাবাহিনীর অত্যন্ত জটিল ‘এনিগমা’ কোড এর রহস্য খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভুমিকা পালনকারী এই বুদ্ধিজীবি, নাৎসীদের পরাজিত করার ক্ষেত্রে যিনি তর্কসাপেক্ষে আইসেনহাওয়ার এবং চার্চিলের চেয়ে বেশী অবদান রেখেছিলেন। ব্লেচলী পার্কে ট্যুরিং ও তার “আন্দ্রা সহকর্মীদের কল্যাণে মিত্রবাহিনীর জেনারেলরা যারা যুদ্ধের মাঠে ছিলেন, তারা জার্মান পরিকল্পনার কথা জার্মান জেনারেলদের সেটি কার্যকর করার বহু আগে থেকে জানতে পেরেছিলেন তাদের পাঠানো এনিগমা কোডের সব বার্তা মর্মোদ্ধার করার মাধ্যমে। যুদ্ধের পর, ট্যুরিং এর দ্বায়িত্ব আর যখন অতি গোপনীয় ছিলনা, তাকে জাতির ত্রাণকর্তা হিসাবে তাকে নাইটহুড দিয়ে সম্মানিত করার কথা উচিৎ ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে এই ভদ্র, অসাধারণ প্রতিভাটিকে তার জাতি ধ্বংস করেছিল, একটা অপরাধের জন্য, যে তথাকথিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে তার একান্ত জীবনে, কারো কোনো ক্ষতি যে অপরাধে ঘটেনি। আবারো সেই নির্ভুল বৈশিষ্ট্যমূলক চিহ্ন ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিক নৈতিকতাবাদের, যেখানে একজন ধর্মবাদী অতি উৎসাহে অন্য মানুষরা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে কি করছে (এমনকি তারা কি চিন্তা করছে) তার নজরদারী করতে বাড়তি আগ্রহ প্রদর্শন করে থাকে।

‘আমেরিকার তালিবানদের’ সমকামিতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয় চূড়ান্তবাদের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। রেভারেন্ড জেরি ফলওয়েল এর কথা শুনুন, যিনি লিবার্টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা: ‘এইডস সমকামিদের জন্য শুধুমাত্র ঈশ্বরের শাস্তিই কেবল না, এটি সমকামিতা সহ্য করার জন্যে পুরো সমাজেরও জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তি (২১)। এধরনের মানুষগুলোর সম্বন্ধে আমার প্রথম যেটা নজরে আসে সেটা হলো তাদের বিস্ময়কর খ্রিষ্টীয় মহানুভবতা। কোনো ধরনের একজন ভোটার আসলেই ধর্মীয় গোঁড়ামীতে পূর্ণ, কোনো কিছু সম্বন্ধে সঠিক কোনো জ্ঞান না থাকা এমন একজনকে সিনেটর, যেমন, নর্থ ক্যারোলাইনার রিপাবলিকান জেসী হেমসকে নির্বাচিত করে যেতে পারে বছরের পর বছর? যে মানুষটা ব্যাঙ্গ করে বলেছিলেন, “নিউ ইয়র্ক টাইমস’ আর ‘ওয়াশিংটন পোস্ট নিজেরাই আক্রান্ত সমকামিদের দ্বারা, সেখানে প্রায় প্রত্যেকেই সমকামি (২২)। এর উত্তর আমার মনে হয়, তার ভোটাররা আসলেই সে ধরনের মানুষ, যারা নৈতিকতাকে সংকীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেন, এবং আর যারা তাদের মত একই চূড়ান্তবাদী বিশ্বাস ধারণ করেনা, তাদেরকে হুমকি হিসাবে মনে করেন।

আমি এর আগে প্যাট রবার্টসন এর একটি উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, যিনি ক্রিশ্চিয়ান কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৮ সালে তিনি রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে একজন সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন এবং প্রায় ৩০ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক তিনি তার প্রচারণার কাজে ব্যবহার করেছিলেন, সেই সাথে সমতুল্য পরিমান আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাও তার ছিল: কি পরিমান জনসমর্থন আছে এমন একজন মানুষের প্রতি যার স্বভাবসুলভ কিছু মন্তব্য যেমন: ‘(সমকামিরা) চার্চে আসতে চায় এবং চার্চ সার্ভিসকে ব্যাহত করতে চায় চারিদিকে রক্ত ছড়িয়ে এবং মানুষকে এইডস এ আক্রান্ত করার মাধ্যমে এবং যাজকদের মুখে থুতু দেবার জন্য।’ বা (প্ল্যানড প্যারেন্টহুড) শিশুদের সেচ্ছাচারী যৌনকর্মে উদ্বুদ্ধ করছে, মানুষকে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন, সব ধরনের পশুকাম, সমকামিতা, ইত্যাদ নানা কাজে লিপ্ত হতে উৎসাহ দিচ্ছে, যার প্রত্যেকটি কাজ বাইবেলে নিষিদ্ধ। নারীদের প্রতি রবার্টসনের মনোভাবও, আফগান তালিবানদের কৃষ্ণ হৃদয়ও উষ্ণ করবে: ‘আমি জানি নারীদের এই কথা শুনতে খারাপ লাগবে কিন্তু যদি আপনারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে অবশ্যই পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব, আপনার স্বামী, আপনাদের মেনে নিতে হবে। পুরো সংসারের মাথায় আছেন যীশু খ্রিষ্ট আর স্ত্রীর উপরে আছেন তার স্বামী এবং এটাই এভাবে হবে, আর কোনো কথা নেই এর উপর।

ক্যাথলিকস ফর ক্রিশ্চিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন এর সভাপতি গ্যারী পটার বলেন, ‘যখন খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠরা এই দেশের ক্ষমতা নেবে তখন আর কোনো শয়তানের প্রার্থনা ঘর আর থাকবে না। আর কোনো অবাধ পর্ণোগ্রাফির বিতরণ হবে না, সমকামিদের অধিকার নিয়ে আর কোনো কথা নেই। খ্রিষ্টীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা ক্ষমতা দখলের পর, বহুজাতিবাদ বা বহুসংস্কৃতিবাদকে দেখা হবে অনৈতিক এবং অশুভ হিসাবে এবং রাষ্ট্র এমন কাউকে কোনো ধরনের ‘অশুভ’কাজ করার অনুমতি দেবে না। এই উদ্ধৃতি থেকে খুব পরিষ্কার এই অশুভ কাজ এর অর্থ এই না যে এমন কিছু করা, যা অন্য মানুষর উপর কোনো খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে,এটি বোঝাচ্ছে ব্যক্তিগত চিন্তা এবং কাজ যা তথাকথিত খ্রিষ্টীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনের মত না।

ওয়েষ্টবোরো ব্যাপ্টিষ্ট চার্চের যাজক ফ্রেড ফেল্পস আরেকজন, যিনি খুবই তীব্রভাবে সমকামি বিরোধী, যখন মার্টিন লুথার কিং (২৩) এর বিধবা পত্নী মারা যান, তার অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময় পাষ্টর ফ্রেড একটি সমাবেশ এর আয়োজন করে সেখানে তার ব্যানারে লেখা ছিল, “ঈশ্বর সমকামিদের ও সমকামি সমর্থকদের ঘৃণা করে, সুতরাং ঈশ্বর করেটা স্কট কিং কেও ঘৃণা করেন এবং এখন তিনি তাকে নরকের আগুনে পোড়াচ্ছেন, যেখানে আগুন কখনো নেভে না এবং তার দগ্ধ হবার যন্ত্রণার ধোয়া উপরে উঠে আসবে অনবরত অনন্তকাল ধরে (২৪)। ‘ফ্রেড ফেল্পকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে পাত্তা না দেয়া খুব সহজ, কিন্তু তার আছে প্রচুর মানুষের সমর্থন, যারা সম্পদশালী। তার নিজের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ফেল্প ১৯৯১ সাল থেকে মোট ২০,০০০ সমকামি বিরোধী সমাবেশের আয়োজন করেছেন যুক্তরাষ্ট,কানাডা, জর্ডান এবং ইরাক (হিসাবে প্রায় গড়ে প্রতি চারদিনে একটি), যেখানে তার ছাপানো স্লোগানের মধ্যে অন্যতম– Thank God For AIDS; তার ওয়েবসাইটের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি হিসাব বা টালি, যা কোনো বিশেষ একজন সমকামি মারা গেলে কত দিন সে নরকের আগুনে পুড়ছে। সেই দিন সংখ্যা প্রদর্শন করে। সমকামিতার প্রতি মানসিকতা ধর্ম অনুপ্রাণিত নৈতিকতার অনেককিছুই স্পষ্ট করে দেয়, সেই একই রকম নৈতিকতা আমরা দেখি গর্ভপাত ও মানুষের জীবনে পবিত্রতা বিষয়ক কিছু উদাহরণে।

ধর্মবিশ্বাস এবং মানব জীবনের পবিত্রতা

মানব ভ্রূণ মানব জীবনেরই প্রতিনিধিত্ব করে, সুতরাং চূড়ান্তবাদী ধর্মীয় আলোকে গর্ভপাত হচ্ছে প্রশ্নাতীতভাবে গর্হিত একটি কাজ: পুরোদস্তুরভাবে একটি হত্যাকাণ্ড। আমি ঠিক নিশ্চিৎ না, বিষয়টি আমি কিভাবে ব্যাখ্যা করবো, আমার নিজস্ব এবং সংগৃহীত কিছু পর্যবেক্ষণ হচ্ছে অনেকেই যারা জ্বণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে থাকেন, সাধারণত দেখা যায় পূর্ণবয়স্ক কোনো মানুষ হত্যা করার ব্যপারে আবার তাদের উৎসাহের কোনো ঘাটতি নেই। নিরপেক্ষভাবে বলতে হলে নিয়মানুযায়ী এটি রোমান ক্যাথলিকদের জন্য আবার প্রযোজ্য নয়, গর্ভপাতের বিরুদ্ধে যারা সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ ও প্রতিবাদমুখর; নব্য গোঁড়া খ্রিষ্টান যেমন, জর্জ ডাবলিউ, বুশ যদিও আজকের সময়ে ধর্মীয় প্রভাবশালী অবস্থানের এটি একটি বৈশিষ্ট্যসুচক উদাহরণ; তিনি এবং তারা, মানব জীবন রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি কোনো মানব জ্বণ (বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মুমূর্ষ কোনো জীবন) (২৫)। এমন কি সেটা করার প্রচেষ্টায় তারা চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণাকে বাধা দিতেও সর্বদা প্রস্তুত, অন্যথায় যে গবেষণা নিশ্চয়ই হয়তো বহু মানুষের জীবন বাঁচাতে পারতো। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণ কারো কারো কাছে অবশ্যই মানব জীবনের প্রতি সন্মান। ১৯৭৬ সাল থেকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্ট মৃত্যুদণ্ডের উপর প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়, টেক্সাস মোট ৫০টি রাজ্যের প্রদত্ত মোট মৃত্যুদণ্ডের এক তৃতীয়াংশ কার্যকর করেছিল; এবং সেই রাজ্যের ইতিহাসে অন্য যে কোনো গভর্নরের চেয়ে জর্জ বুশই সবচেয়ে বেশী মতাদণ্ডের আদেশে সই করেছিলেন, গড়ে প্রায় ৯ দিনে ১ টি। হয়তো তিনি শুধু তার দ্বায়িত্ব পালন করেছিলেন, তার রাজ্যের আইন অনুযায়ী কাজ করেছিলেন (২৬)? কিন্তু সিএনএন এর সাংবাদিক টাকার কার্লর্সনের সেই বিখ্যাত রিপোর্টটির কি অর্থ করতে পারি তাহলে?.. কার্লসন, যিনি নিজে মৃত্যুদণ্ডের সমর্থক, হতবাক হয়েছিলেন গভর্নরের কাছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন নারী বন্দীর প্রাণ ভিক্ষা করার বিষয়টি নিয়ে বুশের পরিহাসমূলক অনুকরণ করা দেখে (২৭)। দয়া করুন’ বুশ নাকি সুরে কেঁদে তার ঠোঁট মিথ্যা হতাশার কষ্টে সরু করে বলেন, ‘আমাকে হত্যা করবেন না,,দয়া করুন। হয়তো এই নারী খানিকটা বেশী সহমর্মিতা পেতেন যদি তিনি মনে করিয়ে দিতেন। কোনো না কোনো একসময় তিনিও একটি জ্বণ ছিলেন। প্রাণ নিয়ে ভাবনা আসলেই ধর্মবিশ্বাসী বহু মানুষের মনেই খুব অদ্ভুত প্রভাব ফেলে। কলকাতার মাদার তেরিজা শান্তির জন্য নোবেল পুরষ্কার গ্রহন করার সময় তার ভাষণে মন্তব্য করেন: শান্তির সবচেয়ে বড় বিনাশকারী হচ্ছে গর্ভপাত’…; কি? এরকম উদ্ভট চিন্তা করা কোনো মহিলার অন্য যে কোনো বিষয়ে মতামত গুরুত্বের সাথে নেয়া কি আদৌ সম্ভব? শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পাবার মত কোনো যোগ্যতা তার আছে কিনা সেটা না হয় বাদই দিলাম। যদি কারো পবিত্রভাবে ভণ্ডামীপূর্ণ মাদার তেরিজার কথায় মন গলে যাবার সম্ভাবনা থাকে, তাদের ক্রিষ্টোফার হিচেন্সের (২৮) দ্য মিশনারী পজিশন: মাদার তেরিজা ইন থিওরী অ্যাণ্ড প্র্যাকটিস’ (২৯) বইটি অবশ্যই পড়ে দেখা উচিৎ।

আমেরিকার তালিবানের প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার, এবার রানডাল টেরীর কথা শুনুন, যিনি অপারেশন রেসকু’র প্রতিষ্ঠাতা, যে প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের গর্ভপাতের সেবা যারা দেয়, এটি তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে: ‘ যখন আমি বা আমার মত কেউ, এই দেশ চালাবে, তখন আপনাদের জন্যে এ দেশ ছেড়ে পালানোই উত্তম হবে, কারণ আমরা আপনাদের খুঁজে বের করবো, বিচার করবো এবং মৃত্যুদণ্ড দেবো, আর আমি আমার প্রত্যেকটি কথা সত্যি করে বলছি; তাদের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড যেন নিশ্চিৎ হয় সেটা আমি আমার মিশনের একটি অংশ করে নেব। টেরী এখানে সেই সব চিকিৎসকদের কথা বলছেন, যারা গর্ভপাতের সেবা প্রদান করেন। এবং তার খ্রিষ্টীয় মনোভাব ও অনুপ্রেরণা তার এই বক্তব্যেই সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

‘আমি চাই আপনারা আপনাদের উপর দিয়ে অসহিষ্ণুতার স্রোত প্রবাহিত হতে দিন, হ্যাঁ.. ঘৃণা উত্তম, আমাদের লক্ষ্য একটি খ্রিষ্টীয় জাতি; আমাদের বাইবেল নির্দেশিত কিছু কর্তব্য আছে, ঈশ্বর আমাদের আহবান করেছেন এই দেশটি জয় করে নিতে। আমরা বহুজাতি আর বহুমতবাদ চাইনা, আমাদের লক্ষ খুব সাধারণ। আমাদের ঈশ্বরের আইন, টেন কম্যান্ডমেন্ট মোতাবেক একটি খ্রিষ্টীয় জাতি বানাতে হবে, কোনো ক্ষমা প্রার্থনা নয় আর (৩০)।

এরকম একটি খ্রিষ্টীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র অর্জন করার আকাঙ্খ পুরোপুরিভাবে আমেরিকান তালিবানদের বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ফ্যাসিবাদী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তীব্র কামনা করা অন্য মানুষগুলোর প্রায় হুবুহু প্রতিলিপি। এখনও রানডাল টেরী ক্ষমতায় আসীন হতে পারেননি। এই লেখার সময় (২০০৬) আমেরিকার রাজনৈতিক দৃশ্যপট পর্যবেক্ষণকারী এমন কেউই ততটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে সে কথা বলতে পারেননি।

কোনো একজন পরিণামবাদী (consequentialist) বা উপযোগিতাবাদী (utilitarian) সম্ভবত গর্ভপাতের ব্যপারটা খুবই ভিন্ন ভাবে দেখবেন, ফলাফল বা কাজটির পরিণাম ও এবং এর সৃষ্ট কষ্টকে ওজন করার মাধ্যমে। জ্বণ কি কোনো কষ্ট অনুভব করতে পারে? (সম্ভবত না যদি এর গর্ভপাত করে ফেলা হয়, স্নায়ুতন্ত্র আবির্ভাবের আগেই, এবং এমন কি যদি জ্বণের বয়স এমনও হয় যে তার স্নায়ুতন্ত্র আছে, সেক্ষেত্রেও এটি নিশ্চিভাবে কম কষ্ট সহ্য করবে, যেমন ধরুন একটি কসাইখানায় একটি পূর্ণবয়স্ক গরু যে কষ্ট সহ্য করে); আর গর্ভবতী রমনী বা তার পরিবার কি কষ্ট সহ্য করতে পারে, যদি সেই গর্ভপাতটি না করা হয়? খুবই সম্ভাবনা আছে সেটি হবার; এবং যাই হোক না কেন, যেহেতু জ্বণের কোনো স্নায়ুতন্ত্র থাকে না, সেক্ষেত্রে মায়ের পূর্ণগঠিত স্নায়ুতন্ত্রকে কি আমাদের বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিৎ না এখানে?

এখানে অস্বীকার করা হচ্ছে না যে পরিণামবাদীদেরও হয়তো নানা কারণ থাকতে পারে গর্ভপাতের বিরোধিতা করার জন্য। পিচ্ছিল ঢালু’ যুক্তি ব্যবহার করতে পারেন পরিণামবাদীরা (যদিও আমি এই ক্ষেত্রে তা করতাম না); হয়তো জ্বণরা কোনো কষ্ট পায় না, কিন্তু যে সংস্কৃতি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়াকে সহ্য করে, তার অন্যান্য ভয়ঙ্কর পরিণতির মুখোমুখি হবার ঝুঁকি থাকে কোথায় সেটা শেষ হবে? শিশু হত্যায়? জন্মাবার মুহূর্তটাই যদি এই নিয়মগুলোকে সংজ্ঞায়িত করতে একটি প্রাকৃতিক রুবিকন বা চূড়ান্ত সীমারেখা নির্দেশ করে এবং যুক্তি দেয়া যেতে পারে জ্বণ ক্রমবিকাশের শুরুর দিকে ঠিক এই সীমানার মত আগের কোনো সীমারেখা নির্দেশ করা কোনো পর্যায় খুঁজে বের করা কঠিন। এই ‘পিচ্ছিল ঢালু যুক্তি তাই আমাদের সংকীর্ণভাবে ব্যাখ্যা দেয়া উপযোগিতাবাদের চেয়ে হয়তো বেশী জন্মমুহূর্তকে নির্দিষ্ট করে দেয় অপেক্ষাকৃত বেশী গুরুত্ব দেয়ার জন্য।

ইচ্ছা মৃত্যু বা ইউথানাসিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তিও এধরনের পিচ্ছিল বক্তব্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একটি কাল্পনিক উদ্ধৃতি আবিষ্কার করি নীতিশাস্ত্রের কোনো একজন দার্শনিকের কাছ। থেকে: ‘আপনি যদি ডাক্তারদের জীবনের প্রান্তসীমায় উপস্থিত এমন রোগীদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার অনুমতি দেন, তাহলে দেখা যাবে প্রত্যেকে তাদের মাতামহদের হত্যা করার ফন্দি আটবে টাকা পাওয়ার জন্য; আমরা দার্শনিকরা হয়তো চরমপন্থা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি, কিন্তু সমাজের কিছু চূড়ান্ত নীতি দরকার শৃঙ্খলার প্রয়োজনেই, যেমন ‘তোমরা হত্যা করবে না, নতুবা আমরা কোথায় থামবো তার কোনো নিশানা থাকবে না। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে চূড়ান্তবাদ হয়তো, অপেক্ষাকৃত কম আদর্শ পৃথিবীতে অবশ্যই সব ভুল কারণগুলোর জন্যই একেবারে অবুঝ নিরীহ পরিণামবাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো পরিণতি প্রদান করে!’ আমাদের দার্শনিকদের হয়তো বেশ ভোগান্তি পোহাতে হতো, বেওয়ারিশ মৃত কোনো ব্যক্তিকে, যেমন, যাদের জন্য কেউ শোক করার নেই, রাস্তায় মরে পড়ে থাকা এমন কোনো নরমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার জন্য; কিন্তু পিচ্ছিল ঢালু’র সেই যুক্তি অনুযায়ী নরমাংস ভোজনের প্রতি নৈতিকতাবাদী চূড়ান্তবাদী প্রতিষিদ্ধ অত্যন্ত মূল্যবান যা আমাদের হারানো ঠিক হবে না।

‘পিচ্ছিল ঢালু’ এই যুক্তি হয়তো দেখা যেতে পারে যেখানে পরিণতিবাদীরা একধরনের পরোক্ষ চূড়ান্তবাদ পুনআমদানী করেছেন, কিন্তু গর্ভপাতের বিরুদ্ধে ধর্মীয় শত্রুরা এই সব পিচ্ছিল ঢালু’ যুক্তির কোনো তোয়াক্কা করে না। তাদের জন্য বিষয়টা আরো সরল; যে কোনো একটি ভ্রণই হচ্ছে একটি শিশু, একে মারা মানেই হত্যা, ব্যাস আর কোনো কথা নেই, আলোচনা খতম। কিন্তু এই চরমপন্থী অবস্থান পরবর্তী অনেক কিছুরই উৎস। তাদের দাবী, শুরুতেই বলা যায় যেমন এমব্রায়োনিক (জণতাত্ত্বিক) স্টেম সেল গবেষণা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, কারণ এর জ্বণ কোষের মৃত্যুর কথা জড়িত, যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর ভূমিকা অপরিসীম হবারই সম্ভাবনা। অসঙ্গতিটা স্পষ্ট হয়, যখন আপনি চিন্তা করবেন, যে সমাজ ইতিমধ্যেই শরীরের বাইরে ল্যাবরেটরীতে ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ বা আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) মেনে নিয়েছে যেখানে ডাক্তাররা নিয়মিতভাবেই নারীদের ডিম্বাশয়কে হরমোনের মাধ্যমে উত্তেজিত করে বাড়তি ডিম্বাণু তৈরী করার জন্য, যাদের শরীরের বাইরে নিষিক্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় এমনকি এক ডজন কার্যকর জাইগোট তৈরী করা সম্ভব। যার মধ্যে দুটি বা তিনটিকে হয়তো জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। আশা করা হয়। এখান থেকে একটি অথবা সম্ভবত দুটি বেঁচে যাবে। সুতরাং আইভিএফ সম্ভাব্য জ্বণকে এই প্রক্রিয়ার দুটি ধাপে হত্যা করে এবং স্বাভাবিকভাবেই সমাজে কিন্তু এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। পঁচিশ বছর ধরে, আইভিএফ একটি মাণসম্পন্ন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অনেক সন্তানহীন দম্পতি তাদের জীবনে আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন।

যদিও ধর্মীয় চরমপন্থীদের আইভিএফ নিয়েও সমস্যা থাকতে পারে। ২০০৫ এ গার্ডিয়ান পত্রিকার ৩ জুন সংখ্যায় একটা অদ্ভুত Storey Bay Christian couples answer call to save embryos left by TVF শিরোনামে; গল্পটি একটি সংস্থাকে নিয়ে, যার নাম Snowflakes, যারা আইভিএফ ক্লিনিক থেকে বাড়তি ডিম্বাণুগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করছে বলে দাবী করছে: ওয়াশিংটন স্টেট এর এক নারী মন্তব্য করেন, “আমরা সত্যি অনুভব করেছি যে, ঈশ্বর আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন এই সব জ্বণগুলোকে– এইসব জন্ম না নেয়া শিশুদের যেন আমরা একটি বাঁচার সুযোগ দেই। যার চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয়েছে ‘গোঁড়া খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের এই টেষ্ট টিউব শিশুদের জগতের সাথে অপ্রত্যাশিত যোগসূত্রতার ফসল হিসাবে। এই সম্পর্কের ব্যপারে চিন্তিত মহিলার স্বামী চার্চের মুরুব্বীদের সাথে কথা বললে তারা জানান, “আপনি যদি ক্রীতদাসদের মুক্ত করতে চান তাহলে ক্রীতদাসের ব্যবসায়ীদের সাথে আপনাদের বাণিজ্য করতে হবে। আমি ভাবছি এই মানুষগুলো কি বলতে যদি তারা জানতো যে বেশীর ভাগ নিষিক্ত জ্বণই স্বতঃস্ফূর্তভাবে গর্ভপাত হয়ে যায়। সম্ভবত এটাকে দেখা যেতে পারে একটি প্রাকৃতিক ‘মাণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রক্রিয়া হিসাবে।

একটি বিশেষ ধরনের ধার্মিক মনই শুধু একগুচ্ছ আণুবীক্ষণিক কোষ হত্যা করার সাথে একজন পূর্ণবয়স্ক ডাক্তারকে হত্যা করার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পায়না। আমি এর আগেই রানডাল টেরীর উদ্ধৃতি এবং অপারেশন রেসকু্যর কথা উল্লেখ করেছি; মার্ক জুয়ের্গেনসমায়ার, তার শিহরণ জাগানো বই ‘টেরর ইন দ্য মাইণ্ড। অব গড’ এ রেভারেণ্ড মাইকেল ব্রে এবং তার বন্ধু রেভারেণ্ড পল হিল এর একটি ফটোগ্রাফ প্রকাশ করেছিল, সেখান তাদের হাতে ছিল একটি ব্যানার, যা বলছে, নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা থেকে রক্ষা করাটি কি ভুল?” তাদের দুইজনকে দেখতে ভালোই লাগছিল, বেশ কেতাদূরস্ত দুই তরুণ, মুখে হাসি, পরণে সাদামাটা তবে ভালো পোষাক, যা পুরোপুরি ব্যতিক্রম কোনো নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা কোনো উন্মাদের তুলনায়। তারপরও তারা এবং তাদের ‘আর্মি অব গডে’র বন্ধুরা নানা অ্যাবরশন (গর্ভপাতের) ক্লিনিকে আগুন লাগিয়ে বেড়াতেন নিয়মিত, এবং গর্ভপাতের সাথে জড়িত ডাক্তারদের খুন করার ইচ্ছা তারা কখনোই গোপন করেননি। ১৯৯৪ সালে ২৯ জুলাই ফ্লোরিডার পেন্সাকলায় ক্লিনিকের সামনে পল হিল শট গানের গুলিতে হত্যা করেন ডাঃ জন ব্রিটন এবং তার দেহরক্ষী জেমস ব্যারেটকে; এরপর তিনি আত্মসমর্পণ করেন এবং পুলিশকে বলেন যে, তিনি ডাক্তারকে হত্যা করেছেন ভবিষ্যতের অনাগত সব ‘নিষ্পাপ শিশুদের হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচাতে।

মাইকেল ব্রে এধরনের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন বেশ গোছানো ভাষায় যেখানে তার নৈতিক অবস্থানের শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করার বিষয়টি স্পষ্ট ছিল, যা আমিও খুঁজে পেয়েছি, যখন ধর্ম নিয়ে একটি টেলিভিশন প্রামাণ্য চিত্রের জন্য কলোরাডো প্রিং এর একটি পার্কে আমি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ( প্রাণী মুক্তিবাদীরাও, যারা প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা মেডিকেল গবেষকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের হুমকি দিয়ে থাকেন, তারাও এমন একটি সুউচ্চ নৈতিক অবস্থানে আসীন আছেন বলে দাবী করে থাকেন); গর্ভপাতের বিষয়টিতে আসার আগে ব্রের বাইবেল ভিত্তিক নৈতিকতার পরিমাপটি আমি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম কিছু প্রাথমিক প্রশ্ন করে, যেমন আমি উল্লেখ করেছিলাম যে বাইবেলের আইন ব্যভিচারের শাস্তি দেয় পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড দেবার মাধ্যমে। আমি আশা করেছিলাম এই বিশেষ উদাহরণটি তিনি অস্বীকার করবেন অগ্রহনযোগ্য বলে, কিন্তু তিনি আমাকে অবাক করেছিলেন। আনন্দের সাথে একমত হয়ে বলেন, যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ার পর ব্যভিচারীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। আমি তারপর তাকে বললাম যে পল হিল, ব্রের পূর্ণ সমর্থনসহ আইনী প্রক্রিয়া কিন্তু মেনে চলেননি এবং তার নিজের হাতেই আইন তুলে নিয়েছিলেন এবং ডাক্তারকে হত্যা করেছিলেন। ব্রে তার সহকর্মী যাজককে পূর্ণ সমর্থন দিলেন, আগেও যেমন করেছিলেন যখন জুয়েরগেনমায়ার্স তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন; তিনি উচিৎ শাস্তি হিসাবে একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার আর এখনও কর্মরত একজন ডাক্তারকে হত্যা করার পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছিলেন, তার মতে পরের ক্ষেত্রে এটি একটি নিশ্চিৎ উপায় কোনো কর্মরত ডাক্তারকে নিয়মিত শিশু হত্যা থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে। এরপর আমি তাকে বলি, যদিও কোনো সন্দেহ নেই পল হিলের বিশ্বাস আন্তরিক কিন্তু সবাই যদি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে সমাজে বিদ্যমান আইন না মেনে তাদের নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয় তাহলে অবশ্যই সমাজে নৈরাজ্য নেমে আসবে। সেক্ষেত্রে সঠিক উপায়টি কি গণতান্ত্রিকভাবে আইনটি পরিবর্তন করার চেষ্টা করা না? এই প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে ব্রে বলেন: বেশ, এটাই সমস্যা যখন আমরা যে আইন দেখছি সেগুলোতো সত্যিকারের আইন না, বিশেষ করে যখন আইন হয় মানুষের তৈরী তাৎক্ষণিকভাবে, খামখেয়ালীভাবে নিজেদের মর্জি মাফিক, যেমনটা আমরা দেখি তথাকথিত গর্ভপাত অধিকারের আইন, যা বিচারকরা জনগনের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এরপর আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এবং আইন কোথা থেকে আসে তা নিয়ে বিতর্ক করেছিলাম; এসব বিষয়ে ব্রে’র দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই জঙ্গী মুসলিমদের মতই, যারা কিনা ব্রিটেনে বসবাস করে সদম্ভে ঘোষণা দেয় তারা শুধু শরীয়া আইনই স্বীকার করবে, গণতান্ত্রিকভাবে সৃষ্ট আইন না, যা তারা যে দেশে বসবাস করতে এসেছে সেই দেশের আইনের মূল ভিত্তি।

ডাঃ ব্রিটন এবং তার দেহরক্ষীকে হত্যা করার জন্য ২০০৩ সালে পল হিলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তিনি তার মৃত্যুর আগে আবারো বলেন, তার যদি আবার জন্ম হয় তিনি একই কাজ করবেন অনাগত শিশুদের রক্ষা করার জন্য। অত্যন্ত আশবাদী হয়ে তিনি অপেক্ষা করেছিলেন তার বিশ্বাসের জন্য জীবন দেবার জন্য। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবার মাধ্যমে রাষ্ট্র আমাকে শহীদের মর্যাদা দেবে।’ডানপন্থী গর্ভপাত বিরোধীরা তার মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ করেছিলেন। যার সাথে যোগ দেয় মৃত্যুদণ্ড বিরোধী একটি অশুভ অপবিত্র বামপন্থী জোটের সাথে যারা তৎকালীন ফ্লোরিডার গভর্নর জেব বুশকে আহবান করেন, পল হিলকে শহীদ না বানাতে। তারা তাদের যুক্তির পক্ষে প্রস্তাব করেন, বিচারিক প্রক্রিয়ায় পল হিলকে হত্যা করলে আসলে আরো বেশী হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহ দেয়া হবে, যদি মনে করা হয় মৃত্যুদণ্ড এধরনের অপরাধ নিরুৎসাহিত করবে তাহলে এধরনের মৃত্যুদণ্ডে ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়াই ঘটবে। হিল নিজেই হাসি মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার কক্ষে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘আমি স্বর্গে অনেক পুরষ্কার পাবো, আমার তার অপেক্ষা করছি (৩২)। এবং তিনি প্রস্তাব করেন অন্যরা যেন তার হিংস্র কাজটি কাজটি অব্যাহত রাখে। পল হিল এর শহীদত্ব পাবার প্রেক্ষিতে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ হতে পারে এমন শঙ্কায় পুলিশও বেশ সতর্ক ছিল, এবং এই কেসের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজনই বুলেটসহ হুমকি বার্তা পেয়েছিলেন।

এই পুরো বীভৎস ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছে বিষয়টি বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গগত পার্থক্য থেকে। কিছু মানুষ তাদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য মনে করেন, গর্ভপাত হচ্ছে হত্যা এবং সেই প্রাণের অধিকার রক্ষার্থে, যাদের তারা শিশু বলে দাবী করেন, হত্যা করতেও পিছ পা হন না। অন্যদিকে গর্ভপাতের সপক্ষে আন্তরিক কিছু সমর্থক আছেন, যাদের হয় ভিন্ন কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস আছে বা কোনো ধর্মই তারা মানেন না, যার সাথে যুক্ত হয়েছে। সুস্পষ্টভাবে সুচিন্তিত পরিণতিবাদী নৈতিকতা। তারাও তাদের নিজেদের আদর্শবাদী ভাবেন, প্রয়োজনের সময় অসুস্থকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া, অন্যথায় বিপজ্জনক হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সেই সেবাটি নেবার জন্য বাধ্য হবেন; উভয়পক্ষই একে অপরকে দেখছে খুনী হিসাবে বা হত্যার উৎসাহদাতা হিসাবে। উভয়পক্ষই, তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একইভাবে আন্তরিক।

একটি প্রজনন স্বাস্থ্য সেবাদানকারী ক্লিনিকের মুখপাত্রী বলছেন, পল হিল হচ্ছেন একজন বিপদজ্জনক সাইকোপ্যাথ, উন্মত্ত খুনী। কিন্তু পল হিলের মত মানুষরা তাদের নিজেদেরকে বিপদজ্জনক সাইকোপ্যাথ বলে মনে করেন না। তারা নিজেদেরকে ভালো এবং নীতিবান মানুষ হিসাবেই মনে করেন, যারা ঈশ্বরের নির্দেশনা মেনে চলেন। আসলেই আমি মনে করিনা পল হিল একজন সাইকোপ্যাথ, শুধুমাত্র একজন অতি ধার্মিক। বিপদজ্জনক,,হ্যাঁ, কিন্তু সাইকোপ্যাথ না, বিপজ্জনকভাবে ধার্মিক; তার ধর্মবিশ্বাসের ব্যাখ্যায় হিল পুরোপুরি সঠিক এবং নৈতিক অবস্থানে ছিলেন যখন তিনি ডাঃ ব্রিটনের উপর গুলি ছোড়েন। হিলের সমস্যা বা অসুখটা হলো ধর্মীয় বিশ্বাস নিজেই। মাইকেল ব্রেও, আমি যখন তার সাথে দেখা করেছিলাম, আমার তাকে সাইকোপ্যাথ মনে হয়নি; আমার আসলে তাকে বেশ পছন্দও হয়েছে, আমার মনে হয়েছে তিনি সৎ এবং আন্তরিক একটি মানুষ, মৃদুভাষী এবং চিন্তাশীল কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার মনকে আক্রান্ত করেছে বিষাক্ত ধর্মীয় অর্থহীন সব ধারণা।

গর্ভপাতে বিরুদ্ধবাদী সব শক্ত সমর্থকরা প্রায় সবাই গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী। গর্ভপাতের আন্তরিক সমর্থনকারীরা, ব্যক্তিগতভাবে তারা ধার্মিক কিংবা ধার্মিক নন, যাই হোন কেন, তারা ধর্মীয় গণ্ডীর বাইরে একটি পরিণামবাদী নৈতিকতাবাদী দর্শনের অনুসারী, হয়তো তারা জেরেমি বেনথামের প্রশ্নটি তাদের চিন্তা নিয়ে আসতে পেরেছেন, তারা কি কষ্ট অনুভব করে?’ পল হিল ও মাইকেল রে কোনো জ্বণ হত্যা আর ডাক্তার হত্যার মধ্যে কোনো নৈতিক পার্থক্য দেখতে পান না, শুধুমাত্র তাদের কাছে ক্ৰণটি হলো একটি নিষ্পাপ শিশু। পরিণামবাদীরা এখানে অনেক পার্থক্য দেখতে পান, ব্যাঙ্গাচীদের মতই অনেকটা দেখতে একটি প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বণের সামান্যই অনুভব করার ক্ষমতা আছে; অন্যদিকে একজন ডাক্তার হচ্ছেন পূর্ণবয়ষ্ক জীবন্ত মানুষ, আশা আকাঙ্খা ভালোবাসা, ভয় সহ তিনি মানবীয় জ্ঞানের বিশাল এক ভাণ্ডার, যার গভীর ভাবে আবেগতাড়িত হবার ক্ষমতা আছে। এছাড়া খুব সম্ভবত একজন বিধ্বস্ত বিধবা ও এতিম সন্তান কিংবা বৃদ্ধ পিতা মাতাও আছেন যারা তাকে অনেক ভালোবাসেন।

পল হিল সত্যিকারের দীর্ঘমেয়াদী, কষ্ট অনুভব করতে সক্ষম এমন স্নায়ুতন্ত্র বিশিষ্ট মানুষকে কষ্ট দিয়েছেন। তার আক্রান্ত ডাক্তারের শিকাররা এসব কিছু করতে পারেনা। কারণ শুরুর পর্যায়ে জ্বণের কোনো স্নায়তন্ত্র নেই, সুতরাং তার কোনো কষ্ট অনুভব করার উপায়ও নেই নিশ্চিৎ ভাবে। এমন কি পরবর্তী পর্যায়ে করা গর্ভপাতের জ্বণ, যাদের স্নায়ুতন্ত্র আছে তারা কষ্ট অনুভব করবে, যদিও সব ধরনের কষ্ট দেয়াটাই বড় বেশী নিন্দনীয়, তবে তারা যে কষ্ট পায় সেটার কারণ তারা যে মানুষ তা কিন্তু নয়। কোনো ভাবে সাধারণ যুক্তিতে ধারণা করা সম্ভব না যে মানুষের জ্বণ যে কোনো বয়সে সমবয়সী একটি গরু বা ভেড়ার প্রাণ অপেক্ষা বেশী কষ্ট অনুভব করে। এবং যথেষ্ট কারণ আছে মনে করা যে সব ভ্রণ, মানুষ বা অন্য কিছু, অনেক কম কষ্ট পায় একজন পূর্ণবয়স্ক গরু বা ভেড়া জবাইখানায় যে যন্ত্রণা সহ্য করে, বিশেষ করে আচার আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ জবাইখানায়, যেখানে তাদের পূর্ণ সজাগ থাকতে হবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের গলা কাটার জন্য।

যন্ত্রণা বা কষ্ট সহ্য করার বিষয়টি পরিমাপ করা কঠিন (৩৩) এবং এর ব্যাখ্যা নিয়ে অবশ্যই যুক্তিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু সেটি আমার আলোচনার মূল বিষয়টি পরিবর্তন করেনা, যা ধর্ম নিরেপক্ষ পরিনতিবাদী এবং ধর্মীয় চূড়ান্তবাদী নৈতিকতার দার্শনিকদের মধ্যে পার্থক্যটাকে নির্দেশ করে (এটি অবশ্য, সব সম্ভাবনা শেষ করে দেয় না, আমেরিকার খ্রিষ্টানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গর্ভপাতের ব্যপারে কোনো চূড়ান্তবাদী মনোভাব পোষণ করেন না এবং তারা এর পক্ষে, যেমন দেখুন রেলিজিয়াস কোয়ালিশন ফর রিপ্রোডাক্টিভ চয়েস’ নামের একটি গ্রুপ চিন্তা করে, জ্বণটি কষ্ট পেতে পারে কিনা (৩৪), অন্যটি ভাবে তারা মানুষ কি না। ধর্মীয় নৈতিকতাবাদীদের দেখা যায় বিতর্ক করতে যেমন, কখন একটি বিকাশমান জ্বণ একটি ব্যক্তিতে পরিণত হয়– একজন মানুষ? সেকুলার নৈতিকতাবাদীরা খুব সম্ভবত জিজ্ঞাসা করবেন, এটি মানুষ কিনা সেটা ভাবার দরকার নেই (একগুচ্ছ কোষের জন্য এর অর্থই বা কি?) আসলে ঠিক কোনো বয়সে যে কোনো একটি বিকাশমান জ্বণ, সেটা যে কোনো প্রজাতিরই হোক না কেন, কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা অর্জন করে?

দ্য গ্রেট বিটহোভেন ফ্যালাসি

সাধারণত গর্ভপাত বিরোধীদের এই মৌখিক যুক্তিতর্কের দাবা খেলায় পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে খানিকটা এরকম: মূল বিষয়টি কিন্তু এই মুহূর্তে মানুষের ভ্রূণ কোনো কিছু অনুভব করতে পারে কি পারেনা, সেটি না, কথা হচ্ছে এর সেটি করার সম্ভাব্য ক্ষমতাটি। গর্ভপাতের ফলে এই ভ্রণটি ভবিষ্যতে তার সম্ভাব্য একটি পূর্ণ মানব জীবন পাবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, এধারণাটি তাদের বাকস্বর্বস্ব যুক্তিকে নির্দেশিত করে যার চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা এর অসতোর অভিযোগের প্রত্যুত্তরে একমাত্র অজুহাত হতে পারে। আমি সেই প্রখ্যাত গ্রেট বিটহোভেন ফ্যালাসি বা ভ্রান্ত যুক্তির কথা বলছি। এই ভ্রান্ত যুক্তিটির বেশ কয়েকটি সংস্করণ আছে। পিটার এবং জিন মেদাওয়ার ( স্যার পিটার মেদাওয়ার (৩৫)– ১৯৬০ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার জয় করেছিলেন) তাদের ‘দ্য লাইফ সায়েন্স’ এ ফ্যালাসিটির নিম্নোক্ত সংস্করণটির সূত্র হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন নরমান সেইন্ট জন স্টেভাস (এখন লর্ড সেইন্ট জন) এর নাম (৩৬); যিনি একজন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য, সুপরিচিত একজন রোমান ক্যাথলিক মুখপাত্র, তিনি আবার এটি সংগ্রহ করেছে মরিস বারিঙ (১৮৭৪-১৯৪৫) এর সংগ্রহ থেকে, একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি যিনি রোমান ক্যাথলিকে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এবং ক্যাথলিকদের অন্যতম শক্তিশালী সমর্থক জি. কে. চেষ্টারটন এবং হিলেয়ার বেলক এর নিকটতম সহযোগী ছিলেন। তিনি দুটি চিকিৎসকের মধ্যে একটি কাল্পনিক কথোপকথনের মাধ্যমে যুক্তিটি গড়ে তুলেছিলেন:

‘একটি গর্ভপাতের বিষয়ে আমি আপনার মতামত চাইছি। বাবাটির সিফিলিস আছে, মায়ের আছে যক্ষা, যে চারটি সন্তান তাদের আছে ইতিমধ্যে তার প্রথমটি অন্ধ, দ্বিতীয়টি মারা গেছে, তৃতীয়টি মূক এবং বধির, চতুর্থটিরও যক্ষা। আছে,.. এই অবস্থায় আপনি হলে কি করতেন? আমি গর্ভপাত করানোর ব্যপারে পরামর্শ দিতাম। তাহলে তো আপনি বিটহোভেনকে হত্যা করতেন।

ইন্টারনেট জুড়ে অসংখ্য তথাকথিত গর্ভপাত বিরোধী ওয়েব সাইট আছে যারা এই হাস্যকর কাহিনী বার বার ব্যবহার করেছে এবং ঘটনাচক্রে তারা তাদের খেয়াল খুশী মত মূল সত্য ও বক্তব্যটিকেও বিকৃত করেছেন, আরো একটি সংস্করণ শুনুন: ‘আপনি যদি এমন কোনো রমনীকে চেনেন, যিনি ইতিমধ্যেই আটটি সন্তানের জননী এবং তিনি আবারো গর্ভবতী.. যার তিন জন বধির, দুজন অন্ধ, একজন মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ, যার কারণ তার সিফিলিস আছে, আপনি কি তাকে গর্ভপাত করার পরামর্শ দেবেন? এর উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে কিন্তু আপনি অনাগত একজন বিটহোভেনকে খুন করলেন (৩৭)। কিংবদন্তীর এই বিবরণটি বিখ্যাত সুরস্রষ্টার জন্ম ক্ৰম পঞ্চম থেকে নবম স্থানে নিয়ে এসেছে। বধির হিসাবে জন্ম নেয়া সন্তান সংখ্যাকে তিনে উন্নীত করেছে, অন্ধের সংখ্যা দুইয়ে, বাবার বদলে মাকে সিফিলিসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। মোট তেতাল্লিশটা ওয়েবসাইট আছে, যেখানে আমি এই গল্পটির নানা রুপ খুঁজেছিলাম, সেখানে এটির উৎস হিসাবে মরিস বারিং না বরং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস এঞ্জেলেস মেডিকেল স্কুলে একজন অধ্যাপক এল, আর. আগনিউকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, যিনি এই গল্পটা নাকি তিনি তার ছাত্রদের উভয় সংকটের একটি বিষয় হিসাবে বলতেন, যেন তাদের তিনি বলতে পারেন, ‘শুভেচ্ছা, আপনি এই মুহূর্তে বিটহোভেনকে হত্যা করলেন। ‘আমরা খানিকটা দয়া পরবশ হয়ে এল, আর, অ্যাগনিউকে ছাড় দিতে পারি তার অস্তিত্বের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার জন্য– তবে বিস্ময়কর ব্যপারটা হচ্ছে কিভাবে শহুরে এই কিংবদন্তীগুলো গড়ে ওঠে। আমি খুঁজে পাইনি এই কিংবদন্তীর কাহিনীটির শুরুটা কোথায়, এটি বারিং শুরু করেছিলেন নাকি এর উৎপত্তি আরো আগে।

তবে কাহিনীটি যে আবিষ্কৃত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং পুরোপুরি মিথ্যা একটি কাহিনী। আসল সত্যটা হলো লুদভিগ ভান বিটহেভেন নবম শিশু যেমন ছিলেন না, তেমনি তিনি পঞ্চমও ছিলেন না, তিনি ছিলেন সবার বড়, একেবারে সঠিক করে বললে দ্বিতীয় সন্তান, কারণ তার বাবা মার প্রথম সন্তান খুব শৈশবেই মুত্যুবরণ করেছিল, যা খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল সেই সময়ে এবং যত দূর জানা যায় সে আদৌ অন্ধ, মুক বা বধির বা মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ ছিলেন না। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে তার বাবা মা সিফিলিসে আক্রান্ত ছিলেন, তবে এটা ঠিক তার মা পরে মারা গিয়েছিলেন যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে এবং তখন যক্ষার প্রকোপও ছিল খুব বেশী।

সুতরাং আসলে পুরো ব্যপারটি কাল্পনিক..বলা যায় আরবান লিজেন্ড, কল্পকথা, ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এটি ছড়িয়েছে, কিন্তু এটি যে মিথ্যা সেটি কিন্তু মূল বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে না- এমনকি এটি যদি মিথ্যা নাও হয়, এর থেকে দাঁড় করানো এই যুক্তিটি খুবই দুর্বল একটি যুক্তি। পিটার এবং জিন মেদাওয়ারের কোনো প্রয়োজন ছিল না এই যুক্তিটি ভ্রান্ত প্রমাণ করার জন্য এই কাহিনীর সত্যতা সম্বন্ধে পোষণ করতে: ‘এই ঘৃণ্য ছোট যুক্তিটির পেছনে বক্তব্যগুলো ভয়ঙ্করভাবে ভুল। যদি না প্রস্তাব করা হয় একজন যক্ষাক্রান্ত মা এবং সিফিলিস আক্রান্ত বাবার সম্পর্ক পৃথিবীর অনন্য অসাধারণ একজন সঙ্গীত প্রতিভার জন্ম নেবার সাথে কোনো না কোনোভাবে কার্যকারণজনিত যোগসূত্রতা আছে। এবং তারা একজন বিটহোভেনকে জন্ম দেয়া থেকে বঞ্চিত হবেন, যতটা না গর্ভপাতের কারণে ততটাই সঙ্গম থেকে বিরত থাকার কারণে’ (৩৬)। মেদাওয়ার দম্পতির সংক্ষিপ্ত বিরক্তি মিশ্রিত প্রত্যাখ্যানটি উত্তর দেয়া অসম্ভব (রোয়াল্ড ডাল (৩৮) এর একটি গল্প থেকে প্লট ধার নিয়ে বলতে পারি, গর্ভপাত না করানোর সেই একই ঘটনাক্রমে নেয়া সিদ্ধান্ত ১৮৮৮ সালে আমাদের অ্যাডলফ হিটলারকে উপহার দিয়েছিল), কিন্তু আপনার সামান্যতম খানিকটা বুদ্ধিমত্তা থাকা প্রয়োজন বা হয়তো কোনো ধরনের ধর্মীয় আবহে প্রতিপালিত না হয়ে থাকলে এই বিষয়টি বোঝা সম্ভব না। যে তেতাল্লিশটি বাছাই করা গর্ভপাত বিরোধী বা প্রো-লাইফ ওয়েব সাইটে বিটহোভেনের কাহিনীটির কোনো না একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছে যা এই লেখার সময় গুগল সার্চে খুঁজে পেয়েছি,তা দের একটিও এই যুক্তির মধ্যে ভুল বা অযৌক্তিক বিষয়টি ধরতে পারেননি। এবং তাদের প্রত্যেকটি (সবগুলোই ধর্মীয় ওয়েব সাইট) এই ভ্রান্ত যুক্তির মোহে আকর্ষিত হয়েছেন, বর্শির টোপ খেয়েছেন পুরোপুরি। তাদের একটি আবার মেদাওয়ারকে স্বীকৃতি দিয়েছে এর তথ্য উৎস হিসাবে। এই মানুষগুলো তাদের ধর্মবিশ্বাস বান্ধব যে কোনো ভুলকে বিশ্বাস করার জন্য এতটাই উদগ্রীব যে তারা এমনকি খেয়াল করেননি যে মেদাওয়ার এই যুক্তিটি প্রস্তাব করেছিলেন শুধুমাত্র এটির ভুল ধরে নাকচ করে দেবার জন্য।

এবং মেদাওয়ার সঠিকভাবে ব্যপারটা দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সম্ভাবনা বা পোটেনশিয়াল যুক্তিটির উপসংহার হচ্ছে যে, আমরা যখনই যৌন সঙ্গম করার সুযোগ গ্রহন করতে ব্যর্থ হই আমরা তখনই একটি মানব সত্তাকে তার অস্তিত্ব পাবার সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করি। যে কোনো উর্বর জুটির সঙ্গমের আহবানের প্রতিটি প্রত্যাখ্যান..এই প্রো লাইফ বা জীবনের পক্ষে বেসামাল যুক্তিতে সম্ভাব্য একটি শিশু হত্যা। এমনকি কারো ধর্ষিত না হবার চেষ্টাও সম্ভাব্য কোনো শিশু হত্যার সমান প্রতিনিধিত্ব করে ( এবং কথা প্রসঙ্গে, বহু প্রো-লাইফ এর সমর্থকরা যে মহিলা এমনকি নৃশংসভাবে ধর্ষিত হয়েছে তাদেরও গর্ভপাতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়)। বিটহোভেন যুক্তি, আমরা স্পষ্ট দেখতে পারি, খুবই দূর্বল একটি যুক্তি। এর পরাবাস্তব নির্বুদ্ধিতা মোটামুটি পুরোটাই ফুটে উঠেছে, মাইকেল পালিন এর গাওয়া সেই চমৎকারে গানটিতে Every sperm is sacred, শতাধিক শিশুর কোরাস সহ এই গানটি মন্টি পাইথন সিরিজের এর ছায়াছবি The Meaning of Life এ ছিল (আপনি যদি এখনও না দেখে থাকেন দয়া করে একবার দেখুন); এই তথাকথিত মহান বিটহোভন ভ্রান্ত যুক্তিটি একটি বৈশিষ্ট্যসূচক উদাহরণ হতে পারে কিভাবে যুক্তির গোলকধাঁধায় আমরা সবকিছু গোলমাল করে ফেলি যখন আমাদের মন ধর্ম অনুপ্রাণিত চূড়ান্তবাদীতায় সংশয়াচ্ছন্ন থাকে।

ভালো করে লক্ষ করুন যে প্রো-লাইফ আসলে কিন্তু সামগ্রিকভাবেই প্রো-লাইফই বোঝাচ্ছেনা আদৌ। এর আসল অর্থ হচ্ছে প্রো-হিউম্যান লাইফ বা শুধুমাত্র মানুষের জীবনের সপক্ষে; হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির কিছু কোষকে বিশেষভাবে এই অধিকার প্রদান করার বিষয়টি বিবর্তনের ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্বীকার করতেই হবে, বিষয়টি আদৌ বেশীর ভাগ গর্ভপাত বিরোধীদের জন্য চিন্তার কোনো বিষয় না। তারা এমনিতেই বোঝেন না বিবর্তন একটি বাস্তব সত্য! কিন্তু আমি সে যুক্তিটি বিজ্ঞান কিছুটা বোঝেন এমন কিছু গর্ভপাত বিরোধী সক্রিয় আন্দোলনকারীদের সুবিধার্থে ব্যাখ্যা করতে চাই।

বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি খুব সরল। কোনো ভ্রণ কোষের মানুষ নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যাবলী এর উপর চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নভাবে কোনো নৈতিক অবস্থা আরোপ করতে পারেনা, এটি পারে না কারণ শিম্পাঞ্জি এবং আরো দূরবর্তী, পৃথিবীর সকল প্রজাতির সাথে আমাদের বিবর্তনীয় বংশধারার একটি ধারাবাহিকতা আছে। এবং এটি বোঝার জন্য.. কল্পনা করুন একটি অন্তর্বর্তী কোনো প্রজাতিদের কথা ধরা যাক, Australopithecus afarensis (৩৯), ধরুন তারা সুযোগ পেল বেঁচে থাকার এবং আফ্রিকার দূর্গম কোনো প্রান্তে তাদের খুঁজে পাওয়া গেল, তাদের কি মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হবে? নাকি হবে না? আমার মত পরিণামবাদীদের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর প্রত্যাশা করা উচিৎ না, কারণ এর উপর তাদের কিছুই নির্ভর করে নেই। আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট যে আমারা সন্মানিত এবং বিস্মিত হবো একটি নতুন ‘লুসি’র সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে; তবে অন্যদিকে চূড়ান্তবাদীরা অবশ্যই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য; ‘শুধুমাত্র মানুষ হবার কারণে যারা মানুষের উপর তাদের অনন্য এবং বিশেষ নৈতিকতার মূলনীতি আরোপ করে মানুষকে একটি অনন্য এবং একটি বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। হয়তো যদি এর উত্তর দিতে তারা কোনো তীব্র চাপের মুখে পড়ে, তারাও সম্ভবত বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের দক্ষিণ আফ্রিকার মত কোনো আদালত প্রতিষ্ঠা করবে, শুধুমাত্র একটি সিদ্ধান্ত নিতে, এই নির্দিষ্ট জীবটি ‘মানুষ হিসাবে ছাড়পত্র পেতে পারে কিনা।

এমনকি যদিও একটি স্পষ্ট উত্তর হয়তো পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে অস্ট্রালোপিথেকাসদের জন্য, কিন্তু ধীর ক্রমান্বয়ে। ধারাবাহিকতা জৈববৈজ্ঞানিক বিবর্তনের একটি অনস্বীকার্য বৈশিষ্ট্য, যা আমাদের বলছে, অবশ্যই কিছু অন্তর্বর্তীকালীন প্রজাতি আছে যারা প্রান্তসীমার যথেষ্ট কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করে, যার ফলে তারা নৈতিকতার মূলনীতিটা অস্পষ্ট করে দিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে এর চুড়ান্তবাদী অবস্থানটি। এই বিষয়টিকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে বরং এটা বলে যে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় কোনো প্রাকৃতিক সীমানার অস্তিত্ব নেই। আর এই সীমানা আছে এমন একটি বিভ্রম সৃষ্টি হবার কারণ আসলে বিবর্তনীয় অন্তর্বর্তীকালীন রুপগুলো ঘটনাক্রমে সব বিলুপ্ত হয়েছে। অবশ্যই, তর্ক করা যেতে পারে, মানুষরা অন্য যে কোনো প্রজাতির তুলনায় অনেক বেশী কষ্ট অনুভব করতে পারে। এটি হয়তো সত্যিও হতে পারে এবং আমরা আইনসঙ্গতভাবেই মানুষকে বিশেষ মর্যাদা দেই এই কারণে। কিন্তু বিবর্তনের ধারাবাহিকতা আমাদের বলছে এরকম কোনো চূড়ান্ত পৃথকীকরণ বলে কিছু নেই। চূড়ান্তবাদীদের নৈতিকতাবাদী বৈষম্যতা বিবর্তনের সত্যতাকে পুরোপুরি নাকচ করে দেয়; হয়তো এই সত্যটা নিয়ে একধরনের সচেতন অস্বস্তি হয়তো সত্যিই হতে পারে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের বিবর্তনকে বিরোধীতা করার প্রধানতম কারণ তারা যা ভয় পায়, সেটা হলো তাদের বিশ্বাসে নৈতিকতার একটি পরিণতি হবে। তাদের এই চিন্তাটা ভুল, তবে যাই হোক, নৈতিকভাবে পছন্দনীয় এমন বিবেচনা দ্বারা প্রকৃত পৃথিবী সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রমাণসহ কোনো বাস্তব সত্য বা ফ্যাক্ট পরিবর্তিত হয়ে যাবে এমন চিন্তা করাটা আসলেই খুব উদ্ভট।

মধ্যপন্থী ধর্মবিশ্বাস কিভাবে ধর্মীয় উগ্রতাকে লালন করে

নৈতিক অ্যাবসসালুটিজম বা চূড়ান্তবাদীতার অন্ধকার রুপটার উদাহরণ দেবার সময় আমি উল্লেখ করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বন যারা গর্ভপাত ক্লিনিক উড়িয়ে দেয় বোমা মেরে এবং আফগানী তালিবান, যাদের নিষ্ঠুরতার বিবরণ বিশেষ করে নারীদের প্রতি, আমার পক্ষে বর্ণনা করা খুবই কষ্টের, এছাড়া আয়াতোল্লাহদের হাতে ইরান কিংবা সৌদ রাজকুমারের অধীনে সৌদি আরব, যেখানে নারীরা গাড়ী চালাতে পারেনা এবং পুরুষ। কোনো আত্মীয় ছাড়া তারা বাসার বাইরে যাওয়া মানে সমস্যায় পড়া (কর্তৃপক্ষ দয়াপরবশ হয়ে এক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিয়েছে, শিশু পুত্র সন্তান হলেও চলবে); জেন গুডউইন সৌদি আরব এবং বর্তমানে ক্ষমতা থাকা অন্যান্য ধর্ম নির্ভর একনায়ক রাষ্টকাঠামোয় নারীদের সাথে আচরণের ভয়াবহ চিত্র উন্মোচন করেছেন তার ‘প্রাইস অফ অনার’ (৪০) বইটিতে। জোহান হ্যারি, লণ্ডনের ইন্ডিপেন্ডন্ট পত্রিকায় অন্যতম প্রাণচঞ্চল প্রাবন্ধিক, তার একটি প্রবন্ধের শিরোনামে লিখেছিলেন The best way to undermine the jihadists is to trigger a rebellion of Muslim women অর্থাৎ জিহাদীদের পরাস্ত করতে হলে মুসলিম নারীদের একটি অভ্যুত্থানের সূচনা করাটাই হবে সবচেয়ে উত্তম পন্থা (৪১)।

অথবা, খ্রিষ্টান ধর্মের ক্ষেত্রে– আমি উদ্ধৃতি দিতে পারি সেই সব ‘রাপচার’ প্রিয় যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিষ্টানদের, যারা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচীয় নীতির উপর যাদের শক্তিশালী প্রভাব সুস্পষ্ট, যা নিয়ন্ত্রণ করছে বাইবেলের উপরে তাদের বিশ্বাস যে প্যালেষ্টাইনের সব জমির উপর ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকার আছে (৪২)। রাপচার খ্রিষ্টানদের কিছু অংশ আবার আরো খানিকটা এগিয়ে কামনা করছেন পারমানবিক যুদ্ধের, কারণ তাদের অভিধানে এমন এটি হবে সেই আর্মাগেডডন, যা তাদের আজব বুক অব রিভিলেশনের অস্বস্তিকর জনপ্রিয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী খ্রিষ্টের দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন বা সেকেন্ড কামিংকে তরান্বিত করবে। এ বিষয়ে আমার পক্ষে সাম হ্যারিসের ‘লেটার টু এ ক্রিশ্চিয়ান নেশন’ এ উল্লেখিত সেই রোমহর্ষক মন্তব্যটির আর কোনো পরিবর্ধন করা সম্ভব নাঃ

সুতরাং মোটেও অতিরঞ্জিত হবে না বলা যে, যদি নিউ ইয়র্ক নগরী হঠাৎ করে রুপান্তরিত হয় একটি আগুনের গোলকে, বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিমান যুক্তরাষ্ট্রের জনগন সেই বিস্ফোরণ পরবর্তী সৃষ্টি হওয়া মাশরুম মেঘে রুপালী আশার রেখা দেখতে পাবেন, কারণ তাদের বলা হয়েছে, এটা সবচেয়ে উত্তম, যে জিনিসটি ঘটার কথা, সেটি প্রত্যাসন্ন: খ্রিষ্টের প্রত্যাবর্তন। এই বিষয়টি খুব স্পষ্ট হওয়া উচিৎ যে, এধরনের কোনো বিশ্বাস সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবেশগত বা ভূরাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল পৃথিবী গড়তে আমাদের কখনোই সাহায্যই করবে না। কল্পনা করুন এর পরিণতি কি হতে পারে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সত্যিই বিশ্বাস করে পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন এবং পরিসমাপ্তি হবে গৌরবময়। শুধুমাত্র ধর্মীয় মতবাদের উপর ভিত্তি যুক্তরাষ্টের প্রায় অর্ধেক মানুষ আপাতদৃষ্টিতে এটা বিশ্বাস করছে এই বাস্তবতাটি বিবেচনা করা উচিৎ একটি নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জরুরী অবস্থা হিসাবে।

আসলেই তাহলে অনেকেই আছেন, যাদের ধর্মবিশ্বাস তাদেরকে আমার বর্ণিত সেই আলোকিত ঐক্যমতের নৈতিক যুগধর্মের বা জাইটগাইষ্ট এর পরিসীমার বাইরেই অবস্থান করার বিষয়টি নিশ্চিৎ করে। আমি যাকে বলছি ধর্মীয় চূড়ান্তবাদের অন্ধকারতম অংশ এবং তাদের প্রায়শই বলা হয় চরম বা উগ্রপন্থী। কিন্তু এই অংশে আমার মূল বক্তব্যটি হচ্ছে, মৃদু বা মাঝারী মাত্রার ধর্মবাদীতাও বিশ্বাসের সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে যেখানে উগ্রধর্মবাদীতা প্রাকৃতিকভাবেই অবাধে বিকশিত হয়।

জুলাই ২০০৫, লণ্ডনকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল বেশ কয়েকটি সন্মিলিতভাবে সংঘটিত হওয়া আত্মঘাতী বোমা হামলার: সাবওয়েতে তিনটি ও বাসে একটি বিস্ফোরণ; যদিও হতাহত আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ২০০১ সালের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের আক্রমণের মত এত ভয়বহ ছিল না বটে তবে অবশ্যই তার মত অপ্রত্যাশিতও ছিল না (আসলেই লণ্ডন এধরনের আক্রমণের আশংকা করছিল, যখন থেকেই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বুশের ইরাক অভিযানের আমাদের তার অনিচ্ছুক সহযোগী বানিয়েছিলেন); তবে যাই হোক, লণ্ডনের এই আক্রমণ সন্ত্রস্ত এবং হতবাক করেছিলো পুরো ব্রিটেনকে। খবরের কাগজে পাতা পূর্ণ হয়েছিল বেদনাদায়ক সব বিশ্লেষণে, কিভাবে কোথা থেকে আর কেনই বা এই চার বিভ্রান্ত তরুণ নিজেদের আর নিরপরাধ মানুষগুলোকে বোমা মেরে হত্যা করা প্রেরণা পেয়েছিল? এই খুনীরা ব্রিটিশ নাগরিক, ক্রিকেট প্রেমী এবং আচরণে ভদ্র। ঠিক যে ধরনের তরুণদের সান্নিধ্য যে কেউই উপভোগ করবেন।

কেন এই ক্রিকেটপ্রেমী তরুণরা এমন কাজ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনি? তাদের সমতুল্য প্যালেস্টাইনীয় আত্মঘাতী বা জাপানের কামিকাজী আত্মঘাতী কিংবা শ্রীলংকার তামিল টাইগারদের মত যুক্তরাজ্যের এই আত্মঘাতী মানব বোমাবাজদের কোনো প্রত্যাশা থাকার কথা না, যে তাদের কর্মের জন্য তাদের শোকাহত পরিবার শহীদের পরিবার হিসাবে সন্মানিত হবে বা তাদের দেখাশোনা করা হবে আত্মঘাতী শহীদের জন্য বরাদ্দকৃত কোনো পেনশনে। বরং এর বিপরীতটাই ঘটেছিল, তাদের আত্মীয় স্বজনরা কোনো কোনো সময় পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এদের একজন ইচ্ছাকৃতভাবে তার গর্ভবতী স্ত্রীকে বিধবা এবং তার সন্তানকে এতিম করেছে। এই চার তরুণের কর্মটির ভয়াবহ পরিণতি শুধুমাত্র তাদের নিজেদের এবং তাদের সন্ত্রাসের শিকার যারা, তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না, সেই ভয়াবহতার শিকার হয়েছে তাদের নিজেদের পরিবার পরিজন এবং যুক্তরাজ্যের পুরো মুসলিম সমাজ, যারা এখনও এর প্রতিক্রিয়ার কুফলটির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিদিন। শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসই যথেষ্ট সেই শক্তিশালী তাড়না হবার, যা এই ধরনের চূড়ান্ত উন্মত্ততার কোনো পদক্ষেপ নিতে সুস্থ এবং ভদ্র মানুষকে প্ররোচিত করতে পারে। আবারো, স্যাম হ্যারিস বিষয়টি বর্ণনা দিয়েছেন তার বৈশিষ্ট্যসুচক স্পষ্টবাদী উচ্চারণে, আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনের উদাহরণ ব্যবহার করে (প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখার প্রয়োজন, যার অবশ্য লণ্ডন বোমা হামলার সাথে কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না)। কি এমন কারণ থাকতে পারে, যে কোনো একজন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংশ এবং সেখানে থাকা সব মানুষকে হত্যা করতে চাইতে পারে? বিন লাদেনকে অশুভ বা শয়তানের প্রতিচ্ছবি বলা মানে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার জন্য আমাদের নিজেদের দ্বায়িত্বকে অস্বীকার করা:

এই প্রশ্নের উত্তর খুবই স্পষ্ট– যদিও শুধুমাত্র বমনেচ্ছা উদ্রেক করার মত একটি বক্তব্যে বিন লাদেন নিজেই তা ধৈর্য সহকারে ব্যাখ্যা করেছেন। এর উত্তর হচ্ছে, লাদেন এর মত মানুষরা আসলেই বিশ্বাস করেন তারা যা বিশ্বাস করেন বলে দাবী করেন। তারা কোরানের আক্ষরিক ব্যাখ্যাকে চূড়ান্ত অলঙ্ঘনীয় সত্য হিসাবে বিশ্বাস করেন। কেনই বা ১৯ জন সুশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের পুরুষরা এই পৃথিবীতে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার বিসর্জন দিল আমাদের হাজারেরও বেশী প্রতিবেশীদের হত্যা করার সুযোগ অর্জন করার জন্য? কারণ তারা বিশ্বাস করেছিল এমন কাজ করার মাধ্যমে তারা সরাসরি বেহেশতে যেতে পারবে। এভাবে মানব আচরণকে এমন পূর্ণ ও সন্তোষজন ব্যাখ্যা করার উদাহরণ আসলেই দুর্লভ। আর এই ব্যাখ্যাটিকে মেনে নিতে আমাদেরই এত অনীহা কেন (৪৩)?”

শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক মরিয়েল গ্রে, গ্লাসগো হেরাল্ড পত্রিকার ২০০৫, ২৪ জুলাই, ঠিক এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছিলেন, লণ্ডনের বোমা হামলার তথ্যসূত্রে:

‘সবাইকে দায়ী করা হচ্ছে, স্পষ্টতই দুই ভিলেন জর্জ ডাবলিউ, বুশ এবং টনি ব্লেয়ার থেকে শুরু করে মুসলিম কমিউনিটিগুলোর’ নিষ্ক্রিয়তাকে, কিন্তু আর কখনোই মূল বিষয়টি এর চেয়ে এত বেশী স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়নি, আসলে একটি জায়গায় এই অপকর্মের সব দায়ভারগুলো অর্পিত হয়, এবং বিষয়টি এরকমই ছিল চিরকাল।এই, সব দুর্ভোগ, দুর্যোগ, সন্ত্রাস, হিংস্রতা আর অজ্ঞতার মূল কারণ অবশ্যই ধর্ম নিজেই। এবং যদি আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় এই সহজ বাস্তবতাটাকে ব্যাখা করার জন্য কেনই বা বলতে হবে, তার কারণ হচ্ছে সরকার এবং গণমাধ্যমে বেশ ভালোই ভান করতে পেরেছে এটি প্রমাণ না করার জন্যে।

আমাদের পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা ধর্ম বা রেলিজিয়ন এর ‘আর’ শব্দটি উচ্চারণ না করার সতর্ক প্রচেষ্টা করেন এবং এর পরিবর্তে তাদের যুদ্ধকে দাবী করেন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসাবে, যেন ‘সন্ত্রাস’ কোনো এক ধরনের সত্তা বা শক্তি, যার একটি নিজস্ব মন কিংবা ইচ্ছা শক্তি আছে বা তারা সন্ত্রাসীদের ব্যাখ্যা করেন সম্পূর্ণভাবে অশুভ শক্তির প্রভাবে প্ররোচিত এমন কোনো দল হিসাবে। কিন্তু তারা কোনো অশুভ শক্তির দ্বারা প্ররোচিত। আমরা তাদের যতটাই ভ্রান্ত মতাদর্শের শিকার ভাবি না কেন, তারাও গর্ভপাত করানো ডাক্তারদের খ্রিষ্টীয় খুনীদের মতই গোঁড়া মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ, যার মাধ্যমে তারা তাদের ন্যায় বিচারের মানদণ্ড ঠিক করেন, গভীর বিশ্বাসের সাথে তাদের ধর্ম যা নির্দেশ দিয়েছ সেটা তারা অনুসরণ করেন। তারা উন্মাদও না, তারা ধর্মীয় আদর্শবাদী, যারা তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করেন তারা একটি যুক্তিসঙ্গত অবস্থানে আছেন। তাদের কাছে তাদের কর্মকাণ্ড সঠিক, ন্যায়সঙ্গত এবং ভালো, এবং সেটা তাদের কোনো ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যসূচক কোনো প্রকৃতির কারণেও না এবং অবশ্যই তারা শয়তান আশ্রিত বা আক্রান্ত সে কারণেও না। বরং এর কারণ তারা জন্ম থেকে প্রতিপালিত হয়েছেন সম্পূর্ণ এবং প্রশ্নাতীতভাবে ধর্মবিশ্বাসকে ধারণ করার দীক্ষার মাধ্যমে। স্যাম হ্যারিস একজন ব্যর্থ প্যালেস্টাইনীয় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, যেখানে সেই ব্যক্তিটি ব্যাখ্যা করেছিলেন, কোন জিনিসটি আসলে তাদের ইসরায়েলীদের হত্যা করার জন্য প্রণোদিত করেছে : ‘শহীদ হবার তীব্র আকাঙ্খ, আমি কোনো কিছুর জন্য প্রতিশোধ নিতে যাইনি, আমি শুধু একজন শহীদ হতে চেয়েছি; ২০০১ এর ১৯ নভেম্বর দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় নাসরা হাসানের নেয়া আরেকজন ব্যর্থ আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল, সাতাশ বছর বয়ষ্ক সেই নম্র ভদ্র প্যালেস্টাইনীয় যুবক যার পরিচয় ‘এস’: মধ্যপন্থী ধর্মীয় নেতা এবং শিক্ষকদের বর্ণিত স্বর্গের লোভনীয় বিবরণে তা এত কাব্যিকভাবে পরিপূর্ণ যে, আমার মনে হয়েছে ব্যপারটা বিস্তারিতভাবে এখানে উল্লেখ করা দরকার (৪৪):

‘শহীদ হবার জন্য আপনার এই তীব্র আকাঙ্খ কারণ কি? ‘আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম:

তার উত্তর ছিল: ‘আত্মার শক্তি আমাদের উপরে বেহেশতের দিকে নিয়ে যাবার জন্য টানে, অন্যদিকে দুনিয়ার সব বস্তুগত জিনিসের লোভ আমাদের নীচের দিকে টেনে ধরে রাখে। যারা শহীদের মর্যাদা পেতে দৃঢ়সংকল্প তারা এই দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত। আত্মঘাতী আক্রমণের পরিকল্পনাকারী আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি হবে যদি আমাদের এই অপারেশন বা পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়, আমরা তাকে বলেছিলাম, যাই হোক না কেন, আমরা আমাদের নবীজি ও তার সাহাবীদের সাথে দেখা করা সুযোগ পাবো, ইনশাল্লাহ। আমরা ভাসছিলাম, যেন সাঁতার কাটছিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে যেন আমরা বেহেশতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি অনন্তকালের জন্য। আমাদের কোনো সন্দেহ ছিল না মনে। আমরা পবিত্র কোরান স্পর্শ করে শপথ নিয়েছি, আল্লাহর উপস্থিতিতে– যে প্রতিজ্ঞা আমাদের মানতেই হবে। এই জিহাদের প্রতিজ্ঞাকে বলে বাইত আল রিদওয়ান’, যার নামকরণ হয়েছে বেহেশতের সেই দরজার নামে, যে দরজা দিয়ে শুধুমাত্র নবী আর শহীদরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারেন। আমি জানি অন্য আরো অনেক উপায় আছে জিহাদ করার, কিন্তু এটেই সবচেয়ে বেশী মধুরতম উপায়; শহীদত্ব বরণ করে নেবার জন্য সব কর্মকাণ্ড যদি আল্লাহর নামে করা হয়, তাহলে সামান্য একটা পোকার কামড়ের চেয়ে তা কম কষ্টের হয়!”

এরপর ‘এস’ আমাকে একটি ভিডিও দেখায় যেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলা পরিকল্পনার শেষ পর্যায়গুলোর বিবরণ আছে, অস্পষ্ট ভিডিও, আমি তাকে ও আরো দুজন তরুণকে দেখেছিলাম, তারা শহীদ হবার গৌরবের নানা বিষয়াদি নিয়ে সংলাপরত ছিলেন একধরনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের আদলে, তরুণরা এবং পরিকল্পনাকারী এরপর হাটু মুড়ে বসে তাদের ডান হাত কোরানের উপর রাখে, মূল পরিকল্পনাকারী তাদের জিজ্ঞাসা করেন, “আপনারা প্রস্তুত। আগামীকাল আপনারা বেহেশতে থাকবেন।

আমি যদি এস’ এর জায়গায় থাকতাম, আমি বোমা হামলা পরিকল্পনাকারীকে জিজ্ঞাসা করার লোভ সম্বরণ করতে পারতাম, বেশ তাহলে, কেন আপনি নিজেই এই কাজটি করছেন না, কেন আপনি নিজেই আত্মঘাতী মিশনে যাচ্ছেন না বেহেশতে যাবার দ্রুত এই পথ ধরে? কিন্তু আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন হয় যেটা বোঝার, আর গুরুত্বপূর্ণ বলেই এর পুনরাবৃত্তি করছি, সেটা হচ্ছে– এই মানুষগুলো আসলেই বিশ্বাস করে, তারা যা বিশ্বাস করে বলে সাধারণত দাবী করে থাকে। আর এখান থেকে যে শিক্ষাটি আমাদের নেয়া উচিৎ সেটা হলো ধর্মকেই আমাদের দায়ী করা উচিৎ সবার আগে, ধর্মীয় উগ্রবাদীতাকে নয়, এমন তো নয় যে এইসব উগ্রবাদীতা যেন কোনো একটি সত্যিকারের সুশীল ধর্মের ভয়ঙ্কর বিকৃত সংস্করণ। বহুদিন আগেই ভলতেয়ার সঠিক উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন: “যারা আপনাকে অযৌক্তিক সব উদ্ভট বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করাতে পারবে, তারা আপনাকে দিয়ে যে কোনো ভয়ঙ্কর ঘণ্য কাজও করিয়ে নিতে পারবে। একই ভাবে বিষয়টি বুঝেছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলও, অনেক মানুষই চিন্তা করার বদলে বরং দ্রুত মারা যেতে চাইবে, আর আসলেই তারা মারা যায়।

আমরা যতক্ষণ সেই মূলনীতিটাকে মেনে নেই যে, ধর্মবিশ্বাসকে প্রশ্নাতীতভাবে শুধুমাত্র শ্রদ্ধা করতে হবে কারণ সেটি ধর্মবিশ্বাস, ততক্ষণ আসলেই ওসামা বিন লাদেন এবং অন্যান্য আত্মঘাতী বোমাবাজদের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করাটি স্থগিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর বিকল্প, এত স্বচ্ছ যে, এটির জন্য কোনো তাগাদা দেবার প্রয়োজন নেই, সেটি হলো ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আমাদের এই স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার মূলনীতিটাকে বিসর্জন দিতে হবে। এবং এটি হচ্ছে একটি মাত্র কারণ, যার জন্য আমার সর্বশক্তি দিয়ে মানুষকে সতর্ক করতে চাই ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে, শুধুমাত্র তথাকথিত উগ্রবাদী ধর্মবিশ্বাসের প্রতি না। মধ্যপন্থী ধর্মের শিক্ষাগুলো যদিও সেগুলো উগ্রবাদী, তবে অবশ্যই সেগুলো উগ্রবাদীতার প্রতি উন্মুক্ত আমন্ত্রণ।

বলা যেতে পারে ধর্মবিশ্বাসের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই; দেশের বা কোনো জাতির প্রতি ভালোবাসা তাদের নিজস্ব সংস্করণের উগ্রবাদীতাসহই পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে পারে, পারে না? হ্যাঁ, অবশ্যই পারে, জাপানীদের কামিকাজী আত্মঘাতী যোদ্ধা, শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগাররা। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাস যে কোনো যৌক্তিক হিসাবে নিকেশের শক্তিশালী নীরবতাকারী বা কণ্ঠরোধকারী, যা আর সবকিছুর উর্ধে তাদের প্রভাবের বলয় স্থাপন করতে পারে। এর কারণ মূলত, আমি সন্দেহ করি, এর সহজ, মন ভোলানো প্রতিশ্রুতি যে, মৃত্যুই শেষ না, এবং একজন শহীদের বেহেশত বিশেষভাবে গৌরবোজ্জল। এবং আংশিকভাবে এর কারণ অবশ্যই এটি এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন করাকে নিরুৎসাহিত করে এর বিশেষ প্রকৃতির কারণেই।

খ্রিষ্ট ধর্ম, যেমন ইসলামে দেখা যায় সেরকমই, শিশুদের শেখায়, প্রশ্নাতীত ধর্মবিশ্বাস হচ্ছে বিশেষ সদগুণ। আর আপনি কি বিশ্বাস করবেন তার জন্য আপনাকে কোনো যুক্তিও দিতে হবে না, কেউ যদি ঘোষণা দেয় এটা তার ধর্মবিশ্বাসের অংশ, সমাজের বাকীরা, একই বিশ্বাসে বা অন্য যে কোনো বিশ্বাসের বিশ্বাসেই হোক না কেন, একই চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী, সবাই মেনে নেবে, এবং শ্রদ্ধা করবে তাদের বিশ্বাসকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই এবং বাকীরা সেই বিশ্বাসকে নীরবে শ্রদ্ধা করে যাবে যতদিন পর্যন্ত না ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করার মত ভয়াবহ কোনো গণহত্যা না ঘটে বা লন্ডন কিংবা মাদ্রিদের মত বোমা হামলা হয়। আর এসব ঘটনার পরপরই এর দায় অস্বীকার করা সমবেত কণ্ঠ জোরালো হয়ে ওঠে, যখন নানা শ্রেনীর মোল্লা এবং সমাজের নেতারা (তাদেরকে আসলে কে নির্বাচন করে, আর কি উপায়ে তাদের নির্বাচন করা হয়?) লাইন বেধে দাঁড়িয়েছে বলতে থাকেন এটি তাদের ধর্ম না, এটি হচ্ছে তাদের সত্যিকারের ধর্মের একটি বিকৃত সংস্করণ। কিন্তু কিভাবে ধর্মবিশ্বাস বিকৃত হতে পারে, যদি ধর্মবিশ্বাস, যার কিনা কোনো যৌক্তিক ভিত্তিই থাকে না, তার এমন কোনো প্রমাণযোগ্য মানদণ্ডও থাকে না, যেখানে থেকে এর বিচ্যুতি ঘটতে পারে।

দশ বছর আগে ইবন ওয়ারাক তার চমৎকার বই ‘হোয়াই আই অ্যাম নট এ মুসলিম’ (৪৫) এ এই বিষয়গুলোর অবতারণা করেছিলেন একজন অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ ইসলাম গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গিতে। আসলেই ইবন ওয়ারাকের বইটির একটি ভালো বিকল্প শিরোনাম হতে পারে ‘দ্য মিথ অব মডারেট ইসলাম’, যেটি অবশ্য সাম্প্রতিক একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডনের স্পেক্টেটর পত্রিকায় (৩০ জুলাই ২০০৫), যার লেখক ছিলেন আরেকজন জ্ঞানী ব্যক্তি প্যাট্রিক সুখদেও, যিনি ‘ইন্সস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ইসলাম অ্যাণ্ড ক্রিশ্চিয়ানিটি’র একজন পরিচালক: ‘বেশীর ভাগ মসুলমানরাই আজ তাদের জীবন কাটাচ্ছে সব ধরনের সন্ত্রাসকে বর্জন করে; কারণ কোরান হচ্ছে, পিক অ্যান্ড মিক্স বা বাছাই এবং মিশ্রণ করা সম্ভব এমন একটি সংগ্রহ, আপনি আপনার পছন্দমত বাছতে পারবেন সেখান থেকে। আপনি যদি শান্তি চান, তাহলে শান্তির বাণী সম্বলিত আয়াত আপনি সেখানে খুঁজে পাবেন, যদি আপনি যুদ্ধ চান, হিংস্র আর বিদ্বেষপূর্ণ অনুভূতি উস্কে দেবার মত আয়াতও আপনি পাবেন।

সুখদেও এরপর ব্যাখ্যা করেন কিভাবে ইসলামী পণ্ডিতরা, কোরানে বিদ্যমান নানা বৈপরীত্য বা বিপরীতার্থক বিষয়ের উপস্থিতিকে সামাল দেবার জন্য, তারা একটি principle of abrogation বা রহিতকরণ মূলনীতি উদ্ভাবন করেছিলেন, যে সূত্রানুযায়ী পরবর্তীতে আগত কোনো আয়াত এর আগের কোনো সমধর্মী আয়াতকে বাতিল করবে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, কোরান এর শান্তির কথা বলা অনুচ্ছেদগুলো মূলত বেশ আগের, মুহম্মদের মক্কায় থাকাকালীন সময়ে। কিন্তু আরো বেশী যুদ্ধ প্রিয় অনুচ্ছেদগুলো সাধারণ পরবর্তী পর্যায়ে, তার মদিনায় পলায়নের পর, এর ফলাফলে:

‘ইসলাম মানে শান্তি’, এই মন্ত্র প্রায় ১৪০০ হাজার বছর আগেই বাতিল হয়ে গেছে। শুধুমাত্র প্রথম দিকের প্রায় তেরো বছরের জন্য, ইসলাম মানে শান্তি এবং শান্তি ছাড়া আর কিছু ছিল না। সুতরাং আজকের জঙ্গী মুসলিমরা এবং সেই মধ্যযুগের জ্ঞানী পণ্ডিত ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা যারা ধ্রুপদী ইসলামকে গড়ে তুলেছিলেন তাদের জন্য বরং বেশী সত্যি হবে ‘ইসলাম মানে যুদ্ধ’ এটা বলা। যুক্তরাজ্যের অন্যতম জঙ্গী ইসলামী গ্রুপ আল-ঘুরাবা লণ্ডনের দুটি বোমা হামলার পর মন্তব্য করেছিল .. ‘যদি কোনো মুসলিম অস্বীকার করেন যে, সন্ত্রাস ইসলামের অংশ না, তাহলে তারা কাফের; একজন কাফের হচ্ছেন একজন অবিশ্বাসী (যেমন অমুসলিমরা), অত্যন্ত অপমানজনক একটি শব্দ। হতে পারে কি যে তরুণরা লণ্ডন সাবওয়েতে আত্মঘাতী হামলা করেছিল, তারা যেমন আসলেই বৃটেনের একবারে প্রান্তিক পর্যায়ের কোনো মুসলিম সমাজের সদস্য ছিলেন না, তেমনি তারা তাদের ধর্মের কোনো খামখেয়ালী অদ্ভুত আর জঙ্গী ব্যাখ্যার অনুসারীও ছিলেন না বরং তারা এসেছে মুসলিম সমাজের কেন্দ্র থেকে এবং তারা প্রণোদনা পেয়েছে ইসলামের মূলধারার ব্যাখ্যা থেকেই।

আরো ব্যাপকভাবে (এবং এটি খ্রিষ্ট ধর্মের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য) সবচেয়ে বেশী যা ভয়ানক সেটা হলো শিশুদেরকে প্রশ্নাতীত ধর্মবিশ্বাস যে একটি সদগুন সেটি শিক্ষা দেয়ার প্রবণতা; ধর্মবিশ্বাস অশুভ, কারণ নির্দিষ্টভাবে এটি কোনো যৌক্তিকতার ধার ধারে না, কোনো ধরনের তর্ক বিতর্ক সে গ্রাহ্য করেনা। শিশুদের ‘কোনো প্রশ্ন করা যাবে না এমন কোনো বিশ্বাস শেখানোর প্রক্রিয়া তাদের প্রস্তুত করে আরো কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতি আর উপাদানের উপস্থিতিতে, যা খুব কঠিন না খুঁজে পাওয়া সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর অস্ত্র রুপে যা খুব সহজেই ভবিষ্যতের জিহাদী বা ধর্মযোদ্ধারা ব্যবহার করতে পারে। শহীদের বেহেশত পাবার প্রলোভনে তারা সবধরনের ভয়-ভীতি আর আশঙ্কা থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত, সত্যিকারের উগ্রপন্থীরা নিজেরাই এক একটি অস্ত্র, সমরাস্ত্রের ইতিহাসে আসলেই উচ্চাসনে আসীন হওয়ার দাবী রাখে তারা, তাদের জায়গা হওয়া উচিৎ লম্বা তীর-ধনুক আর যুদ্ধ ঘোড়া, ট্যাঙ্ক এবং গুচ্ছ বোমার পাশেই। প্রশ্নাতীত ধর্মবিশ্বাস কোনো বিশেষ গুণ নয় সেটা শেখানোর পরিবর্তে যদি শিশুদের প্রশ্ন করা শেখানো যায়, এবং শেখানো যায় কিভাবে তারা তাদের বিশ্বাসকে পর্যালোচনা করবে, বাজী রাখার মত করেই বলা যেতে পারে আর কখনই কোনো আত্মঘাতী বোমাবাজ দেখা মিলতো না। আত্মঘাতী বোমাবাজরা যে কাজটি করে সেটি করার জন্য তার কারণ হচ্ছে তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ধর্মীয় স্কুলে যা শেখানো হয় তা অলঙ্ঘনীয়ভাবে সত্যি: ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশী প্রাধান্য পায়, এবং ঈশ্বরের সেবায় এই শহীদ হবার জন্য রয়েছে পুরষ্কার হিসাবে আছে বেহেশতের বাগানের প্রতিশ্রুতি। এবং এই শিক্ষাটি যে তারা পেয়েছে শুধুমাত্র জঙ্গীবাদী ধর্মান্ধদের কাছ থেকে তা কিন্তু সব সময় ঘটছে না, বরং তারা সেটা বেশীর ভাগ সময়ই পাচ্ছে শ্লীল, নম্র মূলধারার ধর্মীয় প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে, যারা মাদ্রাসাগুলোতে তাদের সারিবদ্ধ করে বসায় এবং তারা ছন্দের সাথে সাথে তাদের মাথা উপর নীচে দুলিয়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রতিটি শব্দ মুখস্থ করে যেন কোনো মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়া টিয়া পাখির দল। আর এই বিশ্বাস হতে পারে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, এবং সচেতন ও পরিকল্পিত কোনো উপায়ে সেটি অবুঝ ঝুঁকিপূর্ণ কোনো শিশুর মনে গেথে দেয়া গভীরভাবে অন্যায় একটি কাজ। পরবর্তী অধ্যায়ে আমার আলোচনার ক্ষেত্র হবে শৈশব এবং ধর্ম দ্বারা শৈশবের যে নিপীড়ন হয় তার বর্ণনা।

পাদটীকা:

(১) রাসেল স্ট্যানার্ড: ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী।

(২) Russell Stannard. Doing Away With God?: Creation and the New Cosmology (1993)

(৩) A Devil’s Chaplain: Reflections on Hope, Lies, Science, and Love: Richard Dawkins

(৪) আমার আসলে সেই দুঃসাহস নেই সেই কারণগুলো উল্লেখ করে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার, অন্তত একটি কারণ যা আমার সবচেয়ে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক সহকর্মী ব্যবহার করেন সচরাচর, যখনই কোনো সৃষ্টিতত্ত্ববাদী তার সাথে কোনো আনুষ্ঠানিক বিতর্ক আয়োজন করার চেষ্টা করে থাকেন (আমি তার নাম বলবো না, তবে তার বাক্যটি অষ্ট্রেলীয় বাচনভঙ্গীতে পড়ত হবে): ‘হয়তো এটা তোমার জীবন বৃত্তান্তে বেশ ভালো দেখাবে, তবে আমারটায় ততটা না।”

 (৫) ‘What is true?’ Ch. 1.2 of A Devil’s Chaplain: Selected Essays. Richard Dawkins, London: Weidenfeld & Nicolson

 (৬) ওয়াইজ দুটি উদ্ধৃতিরই উৎস: In Six Days, an anthology of essays by young-Earth creationists (Ashton 1999)

 (৭) মার্টিন লুথার, জার্মান যাজক, রিফরমেশন আন্দোলনের সূচনাকারী।

(৮) জর্জ অরওয়েল ( এরিক ব্লেয়ার) ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক।

(৯) 1984– জর্জ অরওয়েল এর একটি উপন্যাস।

(১০) উনস্টোন স্মিথ জর্জ অরওয়েল এর Nineteen Eighty Four উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র।

(১১) মোরাল অ্যাবসোল্‌টিজম (Moral absolutism) বা নৈতিকতায় চরমবাদীতা একটি এথিকাল বা নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা দাবী করে, কোনো একটি কাজ হয় চূড়ান্তভাবে সঠিক অথবা চূড়ান্তভাবে ভুল, সেই কাজটির সম্পাদনের পেছনে যে উদ্দেশ্য, পরিস্থিতি বা তার পরিণাম যাই হোক না কেন। যেমন চুরি করা সবসময়ই অনৈতিক হিসাবে গন্য করা হবে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, এমন কি যদি সেই চুরি করা হয় কোনো ক্ষুধার্ত পরিবারের জীবন বাঁচাতে। নরমেটিভ এথিকাল বা সাধারণ নীতিশাস্ত্রের তত্ত্বগুলো যেমন, consequentialism, কনসিকোয়েনশিয়ালিজম বা পরিণতিবাদ এর সাথে মোরাল অ্যাবসোল্‌টিজম অবস্থানটি খুবই ভিন্ন, consequentialism, যেমন দাবী করছে মোটা দাগে কোনো কাজের নৈতিকতা নিভর করছে সেই কাজটি কোনো পরিস্থিতিতে করা হয়েছিল এবং তার পরিনতি কি হয়েছিল। মোরাল অ্যাবসোস্যুটিজম এর সাথে moral universalism (যাকে moral objectivism ও বলা হয়ে থাকে) এর পার্থক্য আছে: moral universalism দাবী করছে কোনো কাজটি ন্যায় এবং অন্যায় তা প্রথা বা মতামত থেকে স্বাধীন ( যা ঠিক moral relativism বা নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদের বিপরীত। তবে তাদের যে পরিস্থিতি বা পরিনতি থেকে স্বাধীন হতে হবে এমন। আবশ্যিকতা নেই ( যা Moral absolutism এর ক্ষেত্রে ঘটে 216) Moral universalism wiata moral absolutism 47 সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে তবে সেটি মাঝে মাঝে consequentialism এর জায়গাও নিতে পারে। লুই পজম্যান এর সংজ্ঞায়: Moral absolutism হচ্ছে কমপক্ষে একটি মূলনীতি যা কখনোই লঙ্ন করা যাবে না, আর Moral objectivism হচ্ছে কোনো একটি কাজের নৈতিকভাবে গ্রহনযোগ্যতার ব্যপারে একটি বাস্তব সত্যের উপস্থিতি আছে: এই বাস্তব সত্যটি শুধুমাত্র সামাজিক প্রথা এবং ব্যক্তিগত গ্রহনযোগ্যতার উপর নির্ভর করে না। নৈতিক তত্ত্বগুলো অধিকার আর কর্তব্যর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন, যেমন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের deontological ethics যা প্রায়শই Moral absolutism এর উদাহরণ, এছাড়াও যেমন অসংখ্য ধর্মীয় নৈতিক নির্দেশগুলো Moral absolutism এর উদাহরণ।

(১২) Kevin Phillips, American Theocracy: The Peril and Politics of Radical Religion, Oil, and Borrowed Money in the 21stCentury:

(১২) হামিদ কারজাই, আফগানিস্থানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট।

(১৩) Warraq, I. (1995). Why I Am Not a Muslim. New York: Prometheus (page 175).

(১৪) যীশুকে ভাড়ের সাথে তুলনা করা জন্য John William Gott এর শাস্তির বিবরণ আছে এখানে: The Indypedia, published by the Independent, 29 April 2006.

 (১৫)The attempted prosecution of the BBC for blasphemy : BBC news, 10 Jan. 2005: http://news.bbc.co.uk/1/hi/ entertainment / tv_and_radio/ 4161109.stm.

(১৬) http://adultthought.ucsd.edu/Culture_War/The_Ame rican_Taliban.html.

(১৭) Kimberly Blaker.The Fundamentals of Extremism: The Christian Right in America.

(১৮) অ্যালান ম্যাথিসন ট্যুরিং (১৯১২-১৯৫৪) ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ, লজিশিয়ান,দার্শনিক, গাণিতিক জীববিজ্ঞানী,কম্পিউটার বিজ্ঞানের অগ্রপথিক। কম্পিউটার সায়েন্স এর জনক বলা হয় তাঁকে এই ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য। টিউরিং ম্যাশিনের মাধ্যমে তিনি। অ্যালগরিদম আর কম্পিউটেশনের ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাকে তাত্ত্বিক কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা ক্ষেত্রের জনক বলা হয়ে থাকে।

(১৯) জন ভন নিউম্যান ( ১৯০৩-১৯৫৪) ব্রিটিশ হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার গণিতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, আবিষ্কারক। গণিত,কম্পিউটার,অর্থনীতি, পরিসংখ্যান সহ আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে।

(২০) Hodges, A. (1983). Alan Turing: The Enigma. New York: Simon & Schuster.

 (২১) এটি এবং বাকী উদ্ধৃতিগুলো আমেরিকান তালিবান সাইট থেকে সংগৃহীত। http://adultthought. ucsd.edu/Culture_War/ The_American_Taliban.html.

(২২)। http://adultthought.ucsd.edu/Culture_War/The_Ame rican_ Taliban.html.

(২৩) মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯২৯-১৯৬৮), আমেরিকার ধর্মযাজক, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আন্দোলনের নেতা।

 (২৪) From Pastor Phelps’s Westboro Baptist Church official website, godhatesfags.com: http://www.godhatesfags.com/ fliers/jan2006/20060131_coretta-scott-king funeral.pdf.

(২৫) Mooney (2005):The Republican War on Science. Cambridge, MA: Basic Books; Silver, L. M. (2006). Challenging Nature: The Clash of Science and Spirituality at the New Frontiers of Life. New York: HarperCollins: এই দুটো বই দ্য গড ডিশনের প্রুফ দেখার সময় প্রকাশিত হয়েছে, তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পুরোপুরিভাবে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি।

(২৬) http://www.pbs.org/ wgbh/pages/frontline/shows/ execution/ readings/ texas.html.

(২৭)। http://en.wikipedia.org/wiki/Karla_Faye_Tucker

(২৮) ক্রিষ্টোফার হিচেন্স– ব্রিটিশ আমেরিকান লেখক, সাংবাদিক।

(২৯) Christopher Hitchens.The Missionary Position: Mother Teresa in Theory and Practice. (1995)

 (৩০) র‍্যানডাল টেরীর এই উদ্ধৃতিগুলোর উৎস সেই একই আমেরিকান তালিবান ওয়েবসাইটটি:: http:// adultthought.ucsd.edu/

Culture_Warl The American Taliban.html

(৩১) Mark Juergensmeyer. Terror in the Mind of God: The Global Rise of Religious Violence.

(৩২) Fox news:http://www.foxnews.com/story/0,2933,96286, 00.html.

(৩৩) Dawkins, M. Stamp (1980). Animal Suffering. London: Chapman & Hall.

(৩8) Religious Coalition for Reproductive Choice, (http://www.rcrc.org/.);

(৩৫) পিটার মেদাওয়ার, ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী ও ইমিউনোলজিষ্ট।

 (৩৬) Peter Medawar, J.S. Medawar. The Life Science: Current Ideas in Biology.

(৩৭) http://www.warroom.com/ethical.htm.

(৩৮) CTNES UTC (assy-sado) faluat syfosa

(৩৯) একটি হমিনিন প্রজাতি।

(80) Jan Goodwin. Price of Honor: Muslim Women Lift the Veil of Silence on the Islamic World.

(8১) Johann Hari’s article, originally published in the Independent, 15 July 2005, can be found at http://www.

johannhari.com/archive/ article.php?id=640

(8২) Village Voice, 18 May 2004: http://www.villagevoice.com/ news/0420,perlstein,53582,1.html.

(8৩) Harris, S. (2004). The End of Faith: Religion, Terror and the Future of Reason. New York: Norton

(88) Nasra Hassan, ‘An arsenal of believers’, New Yorker, 19 Nov.2001. See also http://www.bintjbeil. com/articles/en/011119_hassan.html

 (8৫) Ibn Warraq.Why I Am Not a Muslim.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *