৫০. গলফ খেলছেন প্রেসিডেন্ট

৫০.

শেষ বিকেলে কংগ্রেসন্যাল কাউন্টি ক্লাবে গলফ খেলছেন প্রেসিডেন্ট। তুমি ঠিক জানো? কোনো ভুল নেই?

জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন ডিরেক্টর রেইমন্ড জর্ডান মাথা নাড়লেন। দুঃসংবাদটা সত্যি বলেই ধরে নিতে হয়। কারণ যোগাযোগের নির্দিষ্ট সময় চার ঘণ্টা আগেই পেরিয়ে গেছে।

তাঁকে নিয়ে খোলা কার্ট-এ চড়লেন প্রেসিডেন্ট। তার মানে কী মারা গেছেন ওঁরা?

 ড্রাগন সেন্টারে আমাদের যে ব্রিটিশ এজেন্ট আছেন তাঁর কাছ থেকে আমরা শুধু জানতে পেরেছি, ওরা ধরা পড়েছে।

কীভাবে ধরা পড়ল?

হিদেকি সুমার রোবোটিক সিকিউরিটি ফোর্সের কথা আমাদের জানা ছিল না। ওরা যে প্রায় মানুষের মতোই যোগ্য রোবট তৈরি করার টেকনলজি আয়ত্ত করেছে, আমাদের ধারণা ছিল না।

রোবট অথচ মানুষের মতো হাঁটতে ও কথা বলতে পারে?

 ইয়েস, স্যার। এবং সশস্ত্র।

 কিন্তু তুমি বলেছিলে তোমার লোকজন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।

এখনো আমি তাই মনে করি। আমরা সবাই জানি, ফুলপ্রুফ সিকিউরিটি সিস্টেম বলে কিছু নেই। কিন্তু সুমার বিশাল টেকনলজি ফ্যাসিলিটি সে রকম একটা সিস্টেম তৈরি করেছে। এমন একটা কমপিউটারাইজ ইন্টেলিজেন্স যে কারো পক্ষেই এড়ানো সম্ভব নয়।

 রেসকিউ মিশন পাঠিয়ে ওদেরকে উদ্ধার করার কোন আশা আছে?

বোধহয় নেই। আমরা রেসকিউ টিম পাঠাবার আগেই মারা যাবে ওরা। বিশ্বাস করার কারণ আছে, সুমা ওদেরকে মেরে ফেলবে।

ম্লান মুখে চুপ করে থাকলেন রেইমন্ড জর্ডান।

গলফ খেলার ইচ্ছেটা মরে গেছে, কার্ট থেকে নেমে ক্লাব হাউসের দিকে এগোলেন প্রেসিডেন্ট, পিছু পিছু একদল সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট আসছে। সাগরের নিচে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দ্বীপটা তাহলে উড়িয়ে দিতে হয়, বললেন তিনি। ওটার সাথে ড্রাগন সেন্টারও ধ্বংস হয়ে যাক।

 শুধু বিশ্বজনমত নয়, আমেরিকানরাও আপনার ওপর খেপে যাবে, মি. প্রেসিডেন্ট।

সেক্ষেত্রে ডেলটা ফোর্স পাঠাব আমরা। জলদি।

গুয়াম-এ, এন্ডারসন এয়ার ফোর্স বেস-এ, স্পেশাল ফোর্স টিম তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু আমার পরামর্শ হলো, অপেক্ষা করা উচিত।

কী চাও তুমি আমার কাছে?

আরো আট ঘণ্টা সময়, মি. প্রেসিডেন্ট।

 কিন্তু কেন? কী করতে চাও তুমি?

আমি এখনো বিশ্বাস করি, ধরা পড়ার পরও, ওদের মিশন সফল হবে, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। তাছাড়া, ডেল্টা ফোর্স পাঠালেই যে তারা কিছু করতে পারবে, এমন না-ও হতে পারে। রোবটদের সাথে যুদ্ধ করার ট্রেনিং ওরা পায় নি।

মার্শাল আর্টে রোবটরা হয়তো অজেয়, কিন্তু ভারী অস্ত্রের আক্রমণ ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না।

তা ঠিক, স্যার, তবে বোরটরা একটা হাত বা পা হারিয়েও অচল হয়ে পড়ে না, ওদের রক্তও ঝরে না।

 হুম।

আরেকটা কথা ভেবে দেখতে হবে, স্যার। মিস লরেন ও মি. ডিয়াজের কোনো হদিস আমরা পাই নি। সন্দেহ করছি, সুমার সোসেকি দ্বীপে বন্দী করে রাখা হয়েছে ওদেরকে।

সিআইএ বলছে, তাদের বিশ্বাস, ওদেরকে এভো সিটিতে আটকে রাখা হয়েছে। সুমার অতিথি ভবনে ওদেরকে নাকি দেখা গেছে। চিন্তিত প্রেসিডেন্ট কয়েক মুহূর্ত কথা বললেন না। তারপর নিজেই নিস্তব্ধতা ভাঙলেন, তুমি জানো, আট ঘণ্টা অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তোমাকে আমি চার ঘণ্টা সময় দিলাম। এর মধ্যে তোমার টিম যদি ব্যর্থ হয়, ডেল্টা ফোর্স পাঠাব আমি।

 সুমার দ্বীপে ডিফেন্স মিসাইল গিজগিজ করছে। কোনো সাবমেরিন তীরের বিশ কিলোমিটারের মধ্যে পানির ওপর মাথা তুলতে পারবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে। প্লেন থেকে প্যারাট্রুপার নামানোও সম্ভব নয়, উড়িয়ে দেবে। আর যদি কোনো ভাবে সোসেকি দ্বীপে ডেল্টা ফোর্স পা ফেলতে পারেও, ড্রাগন সেন্টারে পৌঁছুনোর আগে কেটে টুকরো টুকরো করা হবে ওদের।

আগামী সর্যের দিকে একবার তাকালেন প্রেসিডেন্ট। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, তোমার টিম যদি ব্যর্থ হয়, আমি ক্যারিয়ার নষ্ট করার ঝুঁকি নিয়ে অ্যাটম বোমা ফেলার নির্দেশ দেব। তখন কেইটেন প্রজেক্ট ঠেকাবার আর কোনো উপায় থাকবে না আমার।

.

ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি। বিজ্ঞান ও কারিগরি তথ্য বিভাগের পরিচালক ক্লাইড ইনগ্রাম চেয়ারে বসে বিশাল টিভি স্ক্রীনের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। উন্নয়নমানের নতুন রিকনিসনস স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো ছবিতে বিশদ বিবরণ এতো নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে, প্রায় বিশ্বাস্যই বলা যায়। পিরামিডার স্যাটেলাইটের বৈশিষ্ট্য হলো, জমির ও সাগরের নিচের ছবিও তুলতে পারে। আজ সন্দের সোসেকি দ্বীপের চারপাশের ছবি পরীক্ষা করছেন তিনি। নির্জন আবাসকে ঘিরে থাকা বনভূমির ভেতর লুকানো মিসাইল সিস্টেম আবিষ্কার করার পর এখন তিনি পানির নিচে সুমার সিকিউরিটি ফোর্সের রাখা সেনসর খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। সাবমেরিনের গতিবিধি সম্পর্কে জানার জন্যে এধরনের সেনসর অবশ্যই তারা রাখবে।

প্রায় এক ঘণ্টা পর তাঁর চোখে ছোট একটা জিনিস ধরা পড়ল, চৌত্রিশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সাগরের তলায় পড়ে রয়েছে, তিনশো বিশ মিটার গভীরে। কমপিউটার মেইনফ্রেমে মেসেজ পাঠালেন তিনি, জিনিসটার চারদিক এনলার্জ করতে হবে।

মেসেজ পেয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের একটা দ্বীপের রিসিভারে এনলার্জ ইমেজ পাঠালো স্যাটেলাইট, সেখান থেকে ওটা রিলে করা হলো এনএসএ-র কমপিউটারে। চেয়ার ছেড়ে টিভি স্ক্রীনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাইড ইনগ্রাম কয়েক মুহূর্ত পর ফিরে এসে বসলেন আবার, ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন অপারেশনস-এর পেপুটি ডিরেক্টরকে। ভদ্রলোক এ মুহূর্তে ওয়াশিংটনের ট্র্যাফিক জ্যামে পড়েছেন। মি, হোপ, সোসেকি দ্বীপের কাছাকাছি সাগরের তলায় আমি একটা প্লেন দেখতে পাচ্ছি।

 আপনার বউ-বাচ্চা নেই, বাড়ি ফিরবেন না? কার্টিস মীকার বিস্ময় প্রকাশ করলেন। মডেল?

দেখে মনে হচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার বি-টোয়েনটিনাইন। দুমড়ে মুচড়ে গেছে, তবে এতো বছর পরও কাঠামো প্রায় অক্ষতই আছে।

ডিটেলস?

নশ্বরগুলোর ছবি পরিষ্কার। ফিউজিলাজে দেখা অক্ষরগুলোও। ককপিটের নিচে বো-তে কী যেন একটা আঁকা রয়েছে, তা-ও দেখতে পাচ্ছি।

কী আকা রয়েছে?

তেমন পরিষ্কার নয়, কারণ চারশো মিটার পানির নিচের ছবি তো। তবে মনে হচ্ছে ওটা যেন শয়তান, মানে, ডেভিলের ছবি।

হরফগুলো কী বলে? কিছু পড়তে পারছেন? জানতে চাইলেন কার্টিস মীকার।

ঝাপসা, জবাব দিলেন কাইড ইনগ্রাম। প্রথম শব্দটা আগাছা বা কাদায় ঢাকা পড়ে গেছে। দ্বিতীয় শব্দটা ডেমনস।

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তিত মনে ছবির বিমানটার দিকে তাকিয়ে রইলেন ইনগ্রাম।

.

৫১.

 চোখ খোলা রাখার জন্যে টেপ ব্যবহারের দরকার হলো না, চারজনই ওরা ভিউইং স্ক্রীনের দিকে আতঙ্কে বি তে তাকিয়ে থাকল। রোবোডগের সাথে লড়ছে পিট, এ সময় হঠাৎ ছবিটা অদৃশ্য হলো স্ক্রীন থেকে। খানিক পর আরেকটা ক্যামেরা সচল হলো, স্ক্রীনে ফুটে উঠল রক্তাক্ত একটা দৃশ্য।

ধাতব চেয়ারে বসে রয়েছে ওরা, হাতল ও পায়ার সাথে চেইন দিয়ে বাঁধা, সামনে বিশাল একটা ভিডিও স্ক্রীন। জাপানি অটোমেটিক রাইফেল হাতে পাহারায় রয়েছে রোবোগার্ডরা, মুরাসাকি ও ওকার্মি রাইফেলগুলো বন্দীদের মাথার পিছন দিকে তাক করা।

হতাশায় মুষড়ে পড়ার অবস্থা ওদের। অনেক চিন্তা করেও পরিত্রাণ পাবার কোনো উপায় খুঁজে পায় নি কেউ। মৃত্যু যে অবধারিত, এ ব্যাপারে কারো, কোনো সন্দেহ নেই।

অ্যালের দিকে তাকাল স্টেসি, বন্ধুকে চিরতরে হারানোর আঘাত কীভাবে সামলাচ্ছে দেখতে চায়। কিন্তু তার চেহারায় কোনো ভাব নেই, বেদনা বা রাগ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে স্ক্রীনের দিকে।

 আরো খানিক পর কামরায় ঢুকল কামাতোরি, কার্পেটের ওপর পদ্মাসনে বসল, খানিকটা সাকি ঢালল গ্লাসে। শিকারের ফলাফল আশা করি দেখেছ তোমরা, চুমুক দেয়ার ফাঁকে বলল সে। ডার্ক নিয়ম ধরে খেলে নি। রোবটটাকে আক্রমণ করে সে, তার প্রোগ্রামিং বদলে দেয়, তারপর নিজের বোকামিতে মারা যায়।

 তোমার হাতে মরতে তো তাঁকে হতোই, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। লাভ হলো এইটুকু যে তোমাকে তিনি কসাই হবার সুযোগ দেন নি।

 ক্রুর হাসি ফুটলো কামাতোরির ঠোঁটে। আমি আশ্বাস দিয়ে বলতে চাই, এ ধরনের ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটবে না নতুন একটা রোবোডগকে রিপ্রোগ্রামড করা হচ্ছে, তার সিস্টেমে অপ্রত্যাশিত গোলযোগ দেখা দিলেও যাতে শিকারকে আক্রমণ না করে।

কুত্তার বাচ্চা! ফুঁসে উঠলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো

রাগী শিকার আমার খুব পছন্দ, হেসে উঠে বলল কামাতোরি। মি. ম্যানকিউসো, তোমাকে আমি সবার শেষে শিকার করব। মরার আগে বাকি সবার যন্ত্রণা তোমাকে দেখতে হবে।

এবার কে? জানতে চাইলেন টিমোথি ওয়েদারহিল। কার পালা?

এবার সম্মান দেখানো হবে মিস স্টেসি ফক্সকে। প্রফেশন্যাল ফিমেল অপারেটর চমৎকার একটা চ্যালেঞ্জ হবে বলে আমার ধারণা। অন্তত মি. পিটের চেয়ে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হবে বলেই আশা করছি আমি।

মুখ শুকিয়ে গেল স্টেসির। দাঁড়াল কামাতোরি, রোবোটিক গার্ডনের নির্দেশ দিল স্টেসির চেইন খুলে দিতে। চেইনের তালা খোলা হলো রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে, একটা গার্ড টান দিয়ে চেয়ার থেকে তুলল তাকে।

 দরজার দিকে হাত তুলল কামাতোরি। যাও, তীক্ষ্ণকণ্ঠে নির্দেশ দিল সে। এক ঘণ্টা পর ধাওয়া করব আমি।

শেষবারের মতো সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল স্টেসি। রাগে লালচে হয়ে রয়েছে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর মুখ। টিমোথি ওয়েদারহিল এখনো বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। কিন্তু চোখাচোখি হতে চোখ মটকাল অ্যাল, মাথাটা সামান্য কাকাল, ক্ষীণ একটু হাসলো।

তুমি সময় নষ্ট করছ, ঠাণ্ডা সুরে বলল কামাতোরি।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পিট, দরজার গায়ে অলসভঙ্গিতে হেলান দিয়ে, স্টেসিকে পাশ কাটিয়ে দৃষ্টি চলে গেছে কামাতোরির ওপর। দুহাতে একটা বাঁকা তলোয়ারের হাতল ধরে আছে, ডগাটা কার্পেটের ওপর। ক্ষীণ হাসি লেগে রয়েছে ঠোঁটে। দেরি হলো বলে দুঃখিত। একটা কুকুরকে উচিত শিক্ষা দিতে হলো কিনা।

.

৫২.

কেউ নড়ল না, কারো মুখে কথা নেই। স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে রোবট দুটো, কামাতোরির নির্দেশ পাবার অপেক্ষায়, পিটের আকস্মিক আগমনে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। তবে সামুরাই খুনে বিস্ময়ের বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে অক্ষত অবস্থায় দোরগোড়ায় পিটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তার ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল, বড় হলো চোখ দুটো। তারপর ধীরে ধীরে, জোর করে হাসল সে। তুমি মরো নি, বলল সে, বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে নিচ্ছে দ্রুত। আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করেছ। কিন্তু রক্ত…?

তোমাদের ক্লিনিক থেকে কয়েকটা জিনিস ধার করি আমি, শান্ত সুরে বলল পিট। তারপর নিজের খানিকটা রক্ত ঝরাই।

কিনারা থেকে সাগরেও পড়ো নি তুমি। পড়লে পাথরে পড়তে, থেঁতলে যেত শরীর। কিংবা সাগরে পড়তে, ভেসে যেতে স্রোতের টানে।

 পতনের ধাক্কাটা লেগেছে গাছে, কাজেই আমার কোনো ক্ষতি হয় নি, বলল পিট। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই, তারপর সাঁতরে চলে আসি ছোট একটা খাড়িতে, বেড়া টপকে উঠে আমি রিসর্টের নিচে।

কামাতেরির চেহারায় কৌতূহল ও অবিশ্বাস। রোবোটিক গার্ডদের ফাঁকি দিয়ে কিভাবে তুমি সিকিউরিটি পেরিমিটারে ঢুকলে?

কিছু মনে করো না, ওগুলোকে আমি অচল করে দিয়েছি।

অসম্ভব, দ্রুত মাথা নেড়ে বলল কামাতোরি। ওদের ডিটেকশন সিস্টেমে কোনো খুঁত নেই। অচেনা কাউকে ওরা ঢুকতে দেবে না।

 বাজি ধরবে? তলোয়ারটা তুলল পিট, ডগাটা কার্পেট ও কাঠের মেঝেতে গাঁথল। বগলের তলা থেকে একটা মোজা বের করল, ভেতরে কী যেন আছে। হাসিমুখে, অলসভঙ্গিতে, একটা রোবো গার্ডের পেছনে এসে দাঁড়াল। রোবট ধরে দাঁড়াবার আগেই ওটার কমপিউটারাইজড মধ্য ভাগ ঘিরে থাকা প্রাস্টিকে চেপে ধরল জিনিসটা। সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট ও অচল হয়ে গেল রোবো গার্ড।

 পিট কি করছে বুঝতে দেরি করে ফেলল কামাতোরি, চিৎকার করল, শূট হিম!

দ্বিতীয় রোবটের রাইফেল ঘুরল পিটের দিকে, স্যাৎ করে ব্যারেলের নিচে রসে পড়ল ও, হাতের জিনিসটা রোবটের প্রসেসরে চেপে ধরল। প্রথমটার মতো এটাও আড়ষ্ট ও অচল হয়ে গেল।

কীভাবে সম্ভব? হাঁপিয়ে উঠল স্টেসি, জানতে চাইল, কি করছ তুমি?

মোজার ভেতর থেকে সিক্স-ভোল্ট ড্রাই সেলটা বের করল পিট, সঙ্গে রয়েছে লোহার একটা পাইপ, পাইপে দুমিটার তামার তার জড়ানো। ম্যাগনেট। রোবটের ভেতর কমপিউটার আছে, ডিস্কের প্রোগ্রাম মুছে দিয়েছে ছোট এই চুম্বকটা।

সাময়িক অসুবিধে, তার বেশি কিছু না, মন্তব্য করল কামাতোরি। স্বীকার করছি, তোমাকে চিনতে ভুল হয়েছে আমার। সত্যি দারুণ মেধাবী ও দক্ষ মানুষ তুমি। তবে এতো কিছু করে নিজের আয়ু মাত্র কয়েক মিনিট বাড়াতে পেরেছ।

 এখন আমরা অন্তত সশস্ত্র, ড. টিমোথি ওয়েদারহিল বললেন, মাথা ঝাঁকিয়ে রোবট দুটো হাতে ধরা আগ্নেয়াস্ত্রগুলো দেখালেন।

হেসে উঠল কামাতোরি, চেহারায় বিজয়ীর উল্লাস। পরিস্থিতি এখনো সম্পূর্ণ তার নিয়ন্ত্রণে। প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে বেঁচে আছে বটে পিট, কিন্তু তবু কোনো লাভ হলো না। রাইফেলগুলো রোবটের সঙ্গে ঝালাই করা। খালি হাতে ওগুলো আলাদা করা সম্ভব নয়। তোমরা সবাই আগের মতোই অসহায় ও নিরস্ত্র।

দেহরক্ষী ছাড়া তোমারই অসহায়বোধ করার কথা, বলল পিট, হাতের ম্যাগনেটটা ছুঁড়ে দিল স্টেসির দিকে। আমার কাছে তলোয়ার আছে, নিরস্ত্র বলছ কেন?

আমার আছে কাতানা, তুলনায় তোমার ওটা কোনো অস্ত্রই নয়। হাত দুটো তুলল কামাতোরি, পিঠে আটকানো কাপে ভরা কাতানার হাতল ধরল। কাতানার ফলা বাষট্টি সেন্টিমিটার লম্বা, শক্ত ইস্পাতের কিনারা। আমার কাছে আরো আছে একটা ছুরি। কোশনের কাপড়ের সাথে ঝুলে থাকা খাপ থেকে ছুরিটা বের করল সে। চব্বিশ সেন্টিমিটার লম্বা ওটা, আলো লেগে ঝিক করে উঠল।

 দরজার দিকে পিছু হটল পিট, এ পথে কামাতোরির আন্টিক রুমে যাওয়া যায়। টান দিয়ে মেঝে থেকে তলোয়ারটা তুলল ও। আমার এটা পুরানো দিনের তলোয়ার, তা ঠিক, তবে তোমার মতো উঁদুর মারার কাজ চলবে।

কামাতোরির স্টাডি থেকে উনবিংশ শতাব্দীর একটা ইটালিয়ান ডুয়েলিং সেইবার নিয়ে এসেছে পিট, হাতল থেকে ডগা পর্যন্ত নব্বই সেন্টিমিটার লম্বা। শখ করে মাঝে মধ্যে যে সেইবার দিয়ে প্রাকটিস করে ও, তার চেয়ে অনেক বেশি ভারী এটা, ফলে ব্যবহার করার সময় শক্তি বেশি ব্যয় হবে। কোনো বিপদে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে, ভাল করেই জানে পিট। কামাতোরি যে জাপানি অসি-যুদ্ধ কেনজুৎসু এক্সপার্ট, নিয়মিত চর্চা করে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ ও নিজে প্রায় বছর খানেক হলো কোনো তলোয়ার ছুঁয়েও দেখে নি। তবে এই যুদ্ধে জিততে না পারুক, শুধু যদি স্টেসিকে খানিকটা সময় দেয়ার জন্যে কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে, তাহলেই খুশি ও। সময় ও সুযোগ পেলে টিম ওয়েদারহিল ও ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোকে মুক্ত করে ফেলবে স্টেসি। তা যদি সম্ভব হয়, দ্বীপটা থেকে পালাবার ক্ষীণ একটু আশা এখনো আছে।

তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছ? হিসহিস করে বলল কামাতোরি।

কেন করব না! কাঁধ ঝাঁকাল পিট। সামুরাই বীর মানে তো আসলে ফুলে ওঠা ব্যাং। আমার দারণা, একই নোংরা পুকুর থেকে এসেছ তুমিও।

অপমানটা গায়ে মাখল না, কামাতোরি। চোখ দুটো বন্ধ করল সে, তারপর হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে কার্পেটে হাঁটু গেড়ে মগ্ন হলো ধ্যানে। সামুরাই শ্রেণীর বীরদের মধ্যে এটা একটা প্রচলিত রীতি, অসম্ভবকে সম্ভব করার শক্তি অর্জনের জন্যে ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রার্থনা করা।

অকস্মাৎ আক্রমণ হবে, বুঝতে পেরে পা ঝেড়ে অন-গার্ড পজিশন নিল পিট।

প্রায় দুমিনিট পেরিয়ে গেল। তারপর হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে, লাফ দিয়ে সিধে হলো কামাতোরি, নড়াচড়ায় কোন বিরতি না দিয়ে হ্যাঁচকা টানে পিঠের খাপ থেকে নামিয়ে আনল কাতানা। মাথার ওপর তলোয়ারটা তুলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশও নষ্ট করতে রাজি নয় যে, গতির মধ্যে কোনো ছন্দপতন না ঘটিয়ে পিটের কোমর থেকে কাঁধ পর্যন্ত দুফাঁক করার জন্যে নামিয়ে আনা কাতানা ওপর দিকে তুলল।

তৈরি ছিল পিট, তা নাহলে ঠেকাতে পারতে না। ঠেকাবার পরপরই পিছু না হঠে নিজের তলোয়ার দিয়ে খোঁচা মারল ও কামাতেরির উরুতে। প্রতিপক্ষের ধারণা ছিল তার আঘাত ঠেকাতে পারলে মুহূর্ত মাত্র দেরি করবে না পিট, পিছু হটবে। ফলে নিজের জায়গা ছেড়ে নড়ে নি সে। তার উরুটা অরক্ষিত পেয়ে গেল পিট। খোঁচাটা মারার পর লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল, প্রতিপক্ষের পরবর্তী হামলার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি।

কামাতোরির গতিবিধি বাঘের মতো ক্ষিপ্র। সে জানে, পিটের মাংসে কোন রকমে একটা কোপ লাগাতে পারলেই হয়, তারপর আর ওর লড়ার শক্তি থাকবে না। তার হাতে পড়লে কেটে দুটুকরো করাই একমাত্র কাজ কাতানার। ঘনঘন জায়গা বদল করছে সে, পিটের মনোযোগ নষ্ট করার জন্যে গালি-গালাজ করছে, দুর্বোধ্য অথচ অশ্লীল শব্দ করছে। উন্মত্ত গণ্ডারের মতো বারবার ছুটে এলো সে, পিটের প্রতিটি আঘাত প্রায় অনায়াসে সরিয়ে দিল একপাশে। উরুর আঘাতটা সম্পর্কে সে যেন সচেতন নয়, তার ক্ষিপ্রতায়ও কোনো ভাটা পড়ে নি।

দুহাতে ধরা কামাতোরির কাতানা বাতাস কাটছে এক হাতে ধরা পিটের সেইবারের চেয়ে সামান্য দ্রুতবেগে।

তবে দক্ষ একজন ফেনসারের হাতে পুরানো ডুয়েলিং ব্লেড কাতানার চেয়ে সামান্য দ্রুত দিক বদলাতে পারে। লম্বায় ও কাতানার চেয়ে প্রায় ত্রিশ সেন্টিমিটার বেশি, ফলে কামাতোরির প্রতিটি আঘাত নিরাপদ দূরত্বে থেকে ঠেকাতে পারছে পিট, শুরুতর কোনো জখমের ঝুঁকি না নিয়ে। সেইবারের আরেকটা সুবিধে হলো, ডগা দিয়ে আঘাত করা যায়। কাতানার কাজ কোপ মারা।

 কামাতোরির সুবিধে হলো, প্রতিদিন নিয়মিত চর্চা করে সে। পিটের চর্চা নেই, তবে কামাতোরির চেয়ে বয়েসে ছোট। খানিকটা রক্ত বেরিয়ে গেলেও সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবল আছে শরীরটা।

বিস্ময়ের বিহ্বল হয়ে ওদের যুদ্ধ দেখছে স্টেসি, ড. টিমোথি ওয়েদারহিল ও ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর চোখেও পলক পড়ছে না। পরস্পরের দিকে ছুটে আসছে যযাদ্ধারা, লাফ দিয়ে সরে যাচ্ছে, দুই তলোয়ারের সংঘর্ষে আগুনের ফুলকি ছুটছে ঘন ঘন। মাঝে মধ্যেই আক্রমণ বাদ দিয়ে পিছু হটছে কামাতোরি, পজিশন বদলে ম্যানকিউসো বা টিমোথি ওয়েদারহিল ও স্টেসির মাঝখানে চলে আসছে, স্টেসি যাতে ওদেরকে মুক্ত করার কিংবা পেছন থেকে তাকে আক্রমণ করার সুযোগ না পায়।

শুধু ঠেকাচ্ছে পিট, আক্রমণ প্রায় করছেই না। ঠেকাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ও কামাতোরির প্রতিটি আঘাতের পেছনে এতো বেশি শক্তি যে ঠেকাতে ব্যর্থ হলে বা এক পলক দেরি করলে মৃত্যু অবধারিত। এই সঙ্গে চেষ্টা করছে স্টেসির দিকে থেকে কামাতোরিকে সরিয়ে আনার। কিন্তু কামাতোরি বোকা নয়, ওর প্রতিটি চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল এসব। স্টেসি জুড়োয় এক্সপার্ট হলেও, নাগালে পেলে চোখের পলকে তাকে দুটুকরো করে ফেলবে সে।

চুপচাপ লড়ছে পিট, যতটা সম্ভব শান্ত রেখেছে নিজেকে। কামাতোরি অস্থির ও উত্তেজিত, প্রতিটি আঘাতের সময় হুঙ্কার ছাড়ছে। ধীরে ধীরে পিছু হটিয়ে কামরায় আরেক প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে পিটকে। পিটের লম্বা করা তলোয়ার ধরা হাতে আলতোভাবে একবার স্পর্শ করল তার কাতানা, সরু একটা রক্তের রেখা দেখে ক্ষীণ হাসল সে।

কামরার চারদিকে চক্কর দিচ্ছে কামাতোরি, ঘন ঘন লাফ দিয়ে হামলা করছে। পিটকে নিয়ে খেলার একটা নেশা জেগেছে তার মধ্যে। পিট শুধু ঠেকাচ্ছে দেখে বেড়ে গেছে তার আত্মবিশ্বাস।

কামাতোরির চক্কর ও লাফ দেয়ার মধ্যে একটা ছন্দ খুঁজে পেল পিট। চক্কর দিচ্ছে বৃত্তাকারে, বৃত্তের এক চতুর্থাংশ পেরিয়ে লাফ দিচ্ছে এবার। এরকম একবার লাফ দিল কামাতোরি, ঠেকাল পিট, পর মুহূর্তে তলোয়ারটা সবেগে বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে। কামাতোরির বাহুতে খোঁচা মারল তলোয়ারের ডগা, কিন্তু তবু কেনজুৎসু মাস্টারের গতি মুহূর্তের জন্যেও শ্লথ হলো না। লড়াই শুরুর আগে ধ্যানমগ্ন ছিল সে, সম্মোহনের সাহায্য নেয়ায় কোনো রকম ব্যথা অনুভব করছে না। পিছু হটল সে, তারপর আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে এর পিটের দিকে, সগর্জনে আঘাত করল বারবার কাতানাটা খালি চোখে প্রায় দেখাই গেল না।

ক্লান্ত হয়ে পড়ছে পিট, সীসার মতো ভারী লাগছে তলোয়ার ধরা হাতটা হাঁপিয়ে উঠেছে ও, খাঁচার ভেতর ছটফট করছে হৃৎপিণ্ড।

প্রাচীন অস্ত্রটারও সময় হয়ে এসেছে। জাপানি কাতানার বিখাদ ইস্পাতের সঙ্গে ওটার কোনো তুলনা হয় না। ওর ফলার অন্তত পঞ্চাশ জায়গায় দাঁত বসিয়েছে। কাতানা। পিট জানে, চ্যাপ্টা অংশে মোক্ষম একটা আঘাত লাগলে ওর অস্ত্র দুটুকরো হয়ে যেতে পারে।

কামাতোরির মধ্যে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। খুনের নেশায় চকচক করছে। তার চোখ, প্রতিটি আঘাতের পেছনে ডুয়েল শুরু হবার সময় যে শক্তি ছিল এখনো তাই আছে। ক্লান্ত পিটকে কাবু করতে আর এক কি দুমিনিট দরকার তার।

চোখের কোণ দিয়ে স্টেসির গতিবিধি লক্ষ করার জন্যে এক মুহূর্ত বিরতি নিল কামাতোরি। স্টেসির দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা সন্দেহজনক স্থির হয়ে আছে সে, হাত দুটো পেছনে, যেন কিছু লুকিয়ে রেখেছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে ধরে নিয়ে তার দিকে এগোল কামাতোরি, এ সময় সামনে বাড়ল পিটমেঝেতে একটু হাঁটু গেড়ে শরীরটাকে লম্বা করল ও, সেই সঙ্গে লম্বা করা হাতের তলোয়ার আঘাত করল কাতানার তাহলে। কামাতোরির সামনের হাতটার আঙুলের ছাল উঠে এলো।

অবিশ্বাস্যই বটে, কয়েকটা আঙুলের সাদা হাড় বেরিয়ে পড়েলেও চেহারায় ব্যথার কোন ছাপ নেই, বিপুল বিক্রমে আক্রমণ শুরু করল কামাতোরি। ব্যথা পাচ্ছে না, নাকি না পাবার ভান করছে বোঝা কঠিন। তার প্রতিটি আক্রমণে হাতে ঝাঁকি লাগায় ঝর্ণার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। আচরণে উন্মত্ত ভাব আগের চেয়ে বেড়েছে।

হঠাৎ তার মাথাটা একদিকে ঝাঁকি খেল, ভারী একটা ইস্পাত সরাসরি আঘাত করেছে ডান চোখে। অব্যর্থ লক্ষ্য, চেইনে আটকানো তালাটা ছুঁড়ে মেরেছে স্টেসি। সুবর্ণ সুযোগটা কাছে লাগাল পিট, তলোয়ারের ডগা প্রতিপক্ষের পাঁজরের ভেতর ঢুকিয়ে দিল, ফুটো করল একটা ফুসফুস।

আক্রমণের ধারায় মুহূর্তের জন্যে ছন্দপতন ঘটল মাত্র, আবার নতুন শক্তিতে পিটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কামাতোরি। আগের মতোই হুঙ্কার ছাড়ছে, তবে মুখ থেকে লাল ফেনা গড়াতে শুরু করেছে, যদিও তার গতি ও শক্তি এতোটুকু কমেনি। আঘাতগুলো যে-কটা পারা গেল ঠেকালো পিট, বাকিগুলো এগিয়ে গেল।

সুযোগ না দেখলে আক্রমণ করছে না পিট। ঠেকাবার ফাঁকে পিছু হটছে ও, কামাতোরি জানে এখন কোনো আক্রমণ হবে না। তাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ সামনে বাড়ল পিট, ঝট করে তার কাতানার নিচে বসে পড়ল, ফলাটাকে বাতাস কাটতে দিল মাথার ওপরে, তির্যকভাবে লম্বা করল হাতের তলোয়ার। এবার কামাতোরির ডান বাইসেপ চিরে দিল ও। কাতানা ধরা হাতটা কেঁপে উঠল, নিচের দিকে নামল অস্ত্রের ডগা।

সামনে বাড়ল পিট, শরীরের সমস্ত্র শক্তি দিয়ে আঘাত করল। কামাতেরির হাত থেকে পড়ল কাতানা। ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছে ওটা, চিলের মতো ছোঁ দিয়ে তুলে নিল স্টেসি।

 কামাতোরির দিকে তলোয়ার তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিট। তুমি হেরে গেছে, হাঁপিয়ে গেলেও, গলাটাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল।

কামাতোরির সামুরাই রক্তে আত্মসমর্পণের অনুমোদন নেই, অন্তত যতক্ষণ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা অদ্ভুতভাবে বদলে গেল। ঘৃণা ও জিঘাংসার মুখোশটা খসে পড়েছে, চেহারায় এ মুহূর্তে আশ্চর্য একটা প্রশান্ত ভাব। বলল, একজন সামুরাই পরাজয়ের মধ্যে কোনো মর্যাদা দেখতে পায় না। ড্রাগনের এক-আধটা দাঁত তুমি ভাঙতে পারো, কিন্তু একটার বদলে হাজারটা দাঁত গজাবে। পর মুহূর্তে সেটা ঘুরিয়ে কোপ মারল কামাতোরির কব্জিতে।

চোখ ভরা অবিশ্বাস, নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকল কামাতোরি। এই প্রথম তার চেহারায় ব্যথার ছাপ ফুটল। উপলব্ধি করল, হেরে গেছে সে। ধীরে ধীরে মুখ তুলে পিটের দিকে তাকাল, কব্জিহীন হাতটা শরীরের পাশে ঝুলছে, ঝর ঝর করে রক্ত ঝরেছে কার্পেটে।

 আমি আমার পূর্বপুরুষদের অসম্মান করেছি। আমাকে তুমি দয়া করে একটা সুযোগ দাও, আমি অন্তত হারিকিরি করে মুখ রক্ষা করি।

সামুরাই হারিকিরি মানে পেট কাটা, চেয়ার বাধা ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো রুদ্ধশ্বাসে বললেন।

উঁহু। মাথা নাড়ল পিট। এভাবে তোমাকে রেহাই দেয়া হবে না। ঠাণ্ডা মাথায় বহু লোককে খুন করেছ তুমি, তোমাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

একজন বিদেশির কাছে হেরে গেছি আমি, প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই আমার। তোমার কাছে সুযোগটা আমি ভিক্ষে চাইছি।

এই মুহূর্তে তার একমাত্র বিবেচ্য বিষয় মর্যাদা, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। আত্মহত্যা করতে পারলে তার বন্ধু ও আত্মীয়রা তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারবে।

 গড, আমি অসুস্থবোধ করছি, বলল স্টেসি। ওকে বাধো, পিট, মুখে কাপড়। গুঁজে দাও। এখানে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে চলো কেটে পড়ি। চেহারায় ঘৃণা ও আতঙ্ক, কার্পেটে পড়ে থাকা কামাতেরির হাতটার দিকে তাকিয়ে আছে।

মরবে তুমি, তবে যেভাবে আশা করছ, সেভাবে নয়, বলল পিট, লক্ষ করল কামাতোরির চোখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। মৃত্যু ভয় নয়, সম্মানজনক সুনির্দিষ্ট রীতিতে পূর্ব-পুরুষদের সাথে মিলিত হতে না পারার ভয়।

কেউ কিছু আঁচ করার আগেই কামাতোরির অক্ষত হাতটা ধরে টান দিল পিট, হিঁচড়ে টেনে আনল স্টাডিতে, যেখানে আন্টিকস অস্ত্র ও মানুষের মাথাগুলো শোভা পাচ্ছে। অত্যন্ত যত্নে ও সাবধানে, যেন দেয়ালে নিখুঁতভাবে একটা ছবি টাঙাচ্ছে, কামাতোরিকে পালিশ করা দেয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে তলপেট দিয়ে ঢুকিয়ে তলোয়ারটা রেখে দিল কাঠে। নিজের শিকার করা মানুষের মাথাগুলোর ঠিক নিচেই এই মুহূর্তে শোভা পাচ্ছে কামাতোরি। এখন তার চোখে অবিশ্বাস ও ভয় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। বোঝা যায়, ব্যথাও অনুভব করছে সে।

স্টাডি থেকে বেরুবার আগে কামাতোরিকে ভাল করে একবার দেখে নিল পিট।

লাশই বলা চলে, দম বেরুতে খুব বেশি সময় নেবে না।

.

৫৩.

স্টাডি থেকে একটা ভাইকিং ব্যাটল-আক্স নিয়ে ভিডিও মনিটর রুমে ফিরে এলো পিট। ইতোমধ্যে চেইনের থালা খুলে বাকি তিনজনকে মুক্ত করেছে স্টেসি।

কামাতোরিকে নিয়ে কী করলে তুমি? জানতে চাইল অ্যাল।

সে এখন তার কালেকশনের একটা আইটেম, কুড়ালটা অ্যালের হাতে ধরিয়ে দিল পিট। রোবট দুটোকে ভাঙ, কেউ যাতে তাড়াহুড়ো করে মেরামত করতে না পারে।

 ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো পিটের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আপনি আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, ভাই।

 আপনি সাহসী পুরুষ, বললেন টিমোথি ওয়েদারহিল। আপনার সঙ্গে কাজ করতে পারছি, সেজন্যে আমি গর্বিত।

আপনারা কেউ জানেন, মেল পেনার আমাদেরকে কীভাবে উদ্ধার করবেন? জানতে চাইল পিট। মানে, কোনো প্ল্যান আছে কিনা?

নেই, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো জানালেন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল আমাদের জন্যে সাবমেরিন পাঠানো হবে, কিন্তু স্যাটেলাইট ফটোয় সুমারসী ডিফেন্স দেখার পর প্ল্যানটা বাতিল করে দেয়া হয়। পরামর্শ দেয়া হয়, আমাদেরকে টানেল ধরে এডো সিটিতে উঠতে হবে, ওখান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হবে টোকিও দূতাবাসে।

অ্যালের দিকে তাকায় পিট। আর আমরা দুজন?

স্টেট ডিপার্টমেন্টকে সতর্ক করা হয়েছে, তারা যেন সুমা ও জাপানি সরকারের সাথে আপনাদের মুক্তির জন্যে আলোচনা শুরু করে।

হাত দিয়ে কপাল চাপড়াল অ্যাল। স্টেট ডিপার্টমেন্ট? ওরা তো মাসের পর মাস আলোচনা করেও কোন সুবিধে আদায় করতে পারে না।

বোঝা যাচ্ছে, নিজেদের চেষ্টায় মুক্তি পেতে হবে আমাদের, বলল স্টেসি, পিটের দিকে তাকালো। আমাদের কার কাছে কী আছে?

ধরা পড়ার পর আমাদেরকে সার্চ করা হয়েছে, এক্সপ্লোসিভ কিট নিয়ে গেছে রোবটরা, বললেন টিমোথি ওয়েদারহিল, কার্পেটে বসে জুতো জোড়া খুললেন তিনি। জুতোর সোল বের করে গোল পাকালেন, ছোট দুটো বল তৈরি হলো। সি এইট প্লাস্টিক। লেটেস্ট এক্সপ্লোসিভ।

তাহলে প্ল্যান বদলাবার দরকার নেই, বলল পিট।

তার মানে? জানতে চাইল অ্যাল। তুমি কি এখনো ড্রাগন সেন্টার ধ্বংস করার ইচ্ছে রাখো?

ধ্বংস না করতে পারি, ক্ষতি করতে পারব না কেন? পাল্টা প্রশ্ন করল পিট।

এখান থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পড়া উচিত, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। কামাতোরির একটা প্রাইভেট আস্তানা, তার বন্ধুরা ও রোবট কন্ট্রোলার যে-কোনো মুহূর্তে খোঁজ নিতে আসতে পারে। কিন্তু যাব কীভাবে? এখানে চোখ বেঁধে আনা হয়েছে আমাদের।

ক্লিনিক পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারব আমি, বলল পিট।

সামনে যদি অনেকগুলো রোবট পড়ে, তোমার ম্যাগনেটে কোনো কাজ দেবে না, বলল স্টেসি।

স্টেসির পাশে চলে এলো পিট, দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল। তোমার বা দিকে একটা হোস পাইপ দেখতে পাচ্ছ? ঝোঁপের ভেতর?

 হ্যাঁ, টেরেসের পাশে।

সাবধানে বেরোও, বলল পিট, স্টেসির হাতে ধরা কাতানার দিকে তাকালো একবার। পাইপটা কয়েক ফুট কাটো।

অবাক হয়ে পিটের দিকে তাকালো স্টেসি। জানতে পারি, কেন?

ছোট ছোট টুকরো করো, একটা টুকরো সিল্কে ঘষো, দেখবে এক ফালি নেগেটিভ ইলেকট্রন পেয়ে গেছ, ব্যাখ্যা করল পিট। তারপর হোসের একটা প্রান্ত রোবটের সার্কিটে ঠেকাও, লাফালাফি শুরু করবে ইলেক্রনিক, ফলে নষ্ট হয়ে যাবে জটিল কমপোনেন্টগুলো।

আপনি কলেজে ফিজিক্স পড়িয়েছেন কখনো? জানতে চাইলেন ড. টিমোথি ওয়েদারহিল।

কিন্তু সিল্ক পাব কোথায়? জিজ্ঞেস করল স্টেসি।

কামাতোরির কিমোনো, ঘাড় ফিরিয়ে বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, ট্রফি রুমের দিকে রওনা হয়ে গেছেন।

কোথায় বসালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে বিস্ফোরক? টিমোথি ওয়েদারহিলকে জিজ্ঞেস করল পিট।

সি-এইটের পরিমাণ যথেষ্ট নয়, কাজেই প্রচুর ক্ষতি করা যাবে না, বললেন তিনি। তবে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের কাছে বসালে ওদেরকে দিন কয়েক পিছিয়ে দিতে পারা যায়।

 তিন মিটার হোস পাইপ নিয়ে ফিরে এলো স্টেসি। কীভাবে কাটব বলে দাও।

 চার টুকরো করো, বলল পিট। তোমাদের সবার কাছে একটা করে থাকবে। ব্যাক-আপ হিসেবে ম্যাগনেটটা আমার কাছে থাক।

 ট্রফি রুম থেকে বোমির ছেঁড়া কিমানো নিয়ে ফিরে এলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। দেয়াল সাজানোর উপকরণ হিসেবে কামাতোরি কিন্তু দারুণ মানিয়ে গেছে।

সুমা যখন দেখবে তুমি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কী অবস্থা করেছ, তখন তার কাছ থেকে আমি পাঁচশো কিলোমিটার দুরে থাকতে চাই, হেসে উঠে বলল অ্যাল, ভাঙা রোবট দুটোকে ছুঁড়ে কামরার এক কোণে ফেলে দিল সে।

অত ভয় পাবার আসলে কিছু নেই, বলল পিট। কামাতেরির অবস্থা দেখে নিজের নিয়তিও আশা করি আঁচ করতে পারবে সুমা।

.

কংগ্রেস সদস্য লরেন ও সিনেটর ডিয়াজকে কন্ট্রোল সেন্টারটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে হিদেকি সুমা। একটু পরই উপলব্ধি করল লরেন, সুমার সাম্রাজ্যের বিস্তার ও তাৎপর্য কল্পনাকেও হার মানাবে। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে রাখা নিউক্লিয়ার গাড়ি বোমা ফাটাবার জন্যে প্রাইম ও ডিটোনেট সিগন্যাল পাঠানোটাই ড্রাগন সেন্টারের একমাত্র কাজ নয়। পাতাল ভবনের অগুণতি স্তর ও করিডরে অসংখ্য ল্যাবরেটরি রয়েছে, রয়েছে বিশাল এঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রনিক এক্সিপেরিমেন্টাল ইউনিট, একটা ফিউশন রিসার্চ ফ্যাসিলিটি ও একটা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর প্ল্যান্ট।

 সুমা গর্ব করে বলল, আমার প্রাইমারি স্ট্রাকচারাল এঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিস ও সায়েন্টিফিক থিঙ্ক ট্যাংক বসানো হয়েছে এদো সিটিতে। কিন্তু এখানে, নিরাপদ ও সুরক্ষিত সোসেকি দ্বীপে, রিসার্চ ও ডেভলপেমেন্টের কাজ করি আমরা।

ওদেরকে নিয়ে একটা ল্যাবে ঢুকল সে, ক্রুড অয়েল ভরা খোলা একটা ভ্যাট দেখাল। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না, সেকেন্ড-জেনারেশন জেনেটিক্যারি এঞ্জিনিয়ার মাইক্রোবাস পেট্রোলিয়াম খেয়ে ফেলছে, সেই সাথে সংখ্যায় বাড়ছে ওগুলো ব্যাপারটা চেইন রিয়্যাকশন, অয়েল মলিকিউল ধ্বংস করে ফেলছে।

ছলকে পড়া তেল পরিষ্কার করতে পদ্ধতি বা আবিষ্কারটা খুব কাজে আসবে, মন্তব্য করলেন সিনেটর ডিয়াজ।

তা আসবে, বলল সুমা। তবে ওগুলোকে আমরা কাজে লাগার বৈরী রাষ্ট্রগুলোর অয়েল রিজার্ভ খালি করার জন্যে।

ভুরু কোঁচকাল লরেন, চোখে অবিশ্বাস। এ-ধরনের নিন্দনীয় একটা কাজ কেন আপনি করবেন? কী লাভ তাতে আপনার?

এক সময় তেলের কোন প্রয়োজন থাকবে না জাপানের। আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদার পুরোটাই পূরণ করবে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট। ফুয়েল সেল ও সোনার এনার্জিতে আমাদের টেকনলজি বিপ্লব ঘটিয়েছে, গ্যাসোলিন এঞ্জিনের বদলে গাড়িতে এরপর ওগুলো ব্যবহার করব আমরা। তেলধোর মাইক্রোবাসের সাহায্যে গোটা দুনিয়ার তেলের মওজুদ নিঃশেষ করতে পারলে আন্তর্জাতিক পরিবহন অচল হয়ে পড়বে ট্রাক, কার, মটর সাইকেল, ভ্যান, প্লেন থেকে শুরু করে স্টিমার পর্যন্ত সব স্থির হয়ে যাবে।

যদি না জাপানি জ্বালানি সরবরাহ করা হয়, ঠাণ্ডা সুরে বললেন সিনেটর।

পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছর লাগবে, বলল লরেন, আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড সল্ট মাইনে রিজার্ভ করে রাখা বিলিয়ন গ্যালন তেল খনি করতে।

 সুমা যেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, শান্তভাবে হাসল। যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত মজুদ তেল খেয়ে ফেলতে মাইক্রোবাসগুলোর সময় লাগবে মাত্র নয় মাস।

ভয়ংকর তাৎপর্যটুকু হজম করতে না পেরে অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল লরেন। মাত্র একজন মানুষ গোটা দুনিয়াকে এরকম এক চরম পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন। প্রতি মুহূর্তে পিটের কথাও ভাবছে লরেন। ও মারা গেছে, তা-ও মেনে নিতে পারছে না। এ-সব আপনি কেন দেখাচ্ছেন আমাদের? ফিসফিস করে জানতে চাইল সে। গোপন রাখছেন না কেন?

 আপনারা যাতে প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসকে বলতে পারেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান এখন আর একই অবস্থানে নেই। আমরা এগিয়ে গেছি, আপনাদের নাগালের বাইরে চলে এসেছি, কাজেই আমাদের সমস্ত দাবি মেনে নিতে হবে। আর গোপনীয়তার কথা যদি বলেন, আপনারা বিজ্ঞানী বা এঞ্জিনিয়ার নন, কাজেই কিছুই আসলে ফাস হচ্ছে না। আপনারা ফিরে গিয়ে স্রেফ আবছা একটা ধারণা দিতে পারবেন, তা থেকে আমাদের আবিষ্কার নকল করা সম্ভব হবে না।

ওয়াশিংটনে আমরা কখন ফিরছি? জানতে চাইলেন সিনেটর।

 হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল সুমা। শিগগিরই। এভো সিটিতে আমার প্রাইভেট এয়ারফিল্ড আছে, ওখান থেকে আমার এক্সিউটিভ জেটে চড়বেন আপনারা।

আপনার পাগলামির কথা শোনার পর প্রেসিডেন্ট কী করবেন বলে আপনার ধারণা? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই জবাব দিলেন সিনেটর, সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেবেন, আপনার এই ঘাটি যেন ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়।

বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সুমা, মিষ্টি করে হাসল। অনেক দেরি হয়ে যাবে তার। আমার এঞ্জিনিয়ার ও রোবোটিক ওয়ার্কাররা শিডিউলের চেয়ে এগিয়ে আছে। আপনারা জানেন না, জানার কথাও নয়, আমরা টুর শুরু করার কয়েক মিনিট পরই কেইটেন প্রজেক্ট কমপ্লিট হয়ে গেছে।

তার মানে কি অপারেশন শুরু করে দিয়েছেন আপনারা? ফিসফিস করে জানতে চাইল লরেন।

 ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল হিদেকি সুমা। আপনাদের প্রেসিডেন্ট যদি ড্রাগন সেন্টার আক্রমণ করেন, ডিটেকশন সিস্টেমের সাহায্যে যথাসময়ে আমি তা জানতে পারব। রোবটগুলোকে সংকেত পাঠাব, গাড়ি-বোমাগুলো ফাটিয়ে দেবে তারা। নিঃশব্দে হাসল সে।

.

৫৪.

নির্জন আবাসের যে ভবনে এলিভেটর রয়েছে, পথ দেখিয়ে সবাইকে সেখানে নিয়ে এলো পিট। খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলো ও, বাকি সবাই আড়াল থেকে কাভার দিচ্ছে ওকে। কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হলো না, তবে এলিভেটরের সামনে একটা রোবোটিক সিকিউরিটি গার্ড দাঁড় করাল ওকে।

 শুধু জাপানি ভাষায় কথা বলতে পারে এটা, তবে কর্কশ আওয়াজ ও তাক করা অস্ত্রের ভাষা বুঝতে অসুবিধে হলো না। হাত দুটো মাথার দুপাশে তুলল পিট, তালু দুটো সামনের দিকে, ধীরে ধীরে আরো কাছাকাছি হলো–ভিডিও, রিসিভার ও ডিটেকশন সেনসর যাতে অন্যান্যদের অস্তিত্ব টের না পায়।

চুপিসারে দুপাশ থেকে এগিয়ে এলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো ও টিমোথি ওয়েদারহিল, তারপর হঠাৎ ছুটে এসে চার্জড হোস পাইপ সার্কিট বক্সে চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে অসাড় হয়ে গেল সশস্ত্র রোবট।

খুবই কাজের জিনিস মন্তব্য করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, হোসের টুকরোটা নিসেস্কর গায়ে ঘন ঘন ঘষছেন।

রোবটটা ওর কন্ট্রোলকে কিছু জানাতে পেরেছে বলে মনে হয়? জিজ্ঞেস করল স্টেসি।

 বোধহয় পারে নি, জবাব দিল পিট। খুব ধীর বলে মনে হলো। আমি একটা হুমকি, নাকি প্রজেক্টের আনপ্রেগ্রামড সদস্য, সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।

খালি এলিভেটরে চড়ে পাঁচ তলার বোতামে চাপ দিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। সাত তলায় এলিভেটর থেকে নামা যায় কন্ট্রোল সেন্টারের মেইন ফ্লোরে, বললেন তিনি। সরাসরি ওখানে না যাওয়াই ভাল।

পিট বলল, ক্লিনিক ও সার্ভিস ইউনিট পাঁচতলায়।

সিকিউরিটি সম্পর্কে কী জানি আমরা?

 আমি কোনো গার্ড বা ভিডিও মনিটর দেখি নি।

স্টেসি বলল, চারদিকের ডিফেন্স এতো শক্তিশালী যে ভেতরের সিকিউরিটি সম্পর্কে বিশেষ মাথা ঘামায়ি নি সুমা।

 পাঁচতলায় পৌঁছে গেল এলিভেটর। দরজা খুলে যাচ্ছে। আড়ষ্ট হয়ে উঠল সবাই। ভাগ্য ভাল, করিডরটা খালি পাওয়া গেল। নিঃশব্দ পায়ে পিটকে অনুসরণ করল ওরা। পৌঁছে গেল ক্লিনিকের সামনে।

এখানে আমরা দাঁড়ালাম কেন? নিচু গলায় জানতে চাইলেন টিমোথি ওয়েদারহিল।

ম্যাপ বা গাইড ছাড়া এ কমপ্লেক্সে পথ চেনা সম্ভব নয়, বিড়বিড় করল পিট, কান পেতে কী যেন শোনার চেষ্টা করছে ও। আমার পিছু নিন। দরজার বোতামে চাপ দিল, সজোরে লাথি মারল কবাটে।

চমকে মুখ তুলল নার্স-রিসেপশনিস্ট। হাঁটু দেখানোর জন্যে উ, জশ নগামির কাছে প্রথমবার যখন এসেছিল পিট, ডেস্কে তখন অন্য একটা মেয়ে ছিল। খোলা দরজা দিয়ে ওদেরকে হুড়মুড় করে ঢুকতে দেখে অ্যালার্ম বাটনের দিকে হাত বাড়াল সে। ছুটে এসে তার কানের পাশে প্রচণ্ড চড় কষল পিট, চেয়ার থেকে পড়ে গেল মেয়েটা, জ্ঞান হারিয়েছে। আওয়াজ শুনে পাশের কামরা থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো ডাক্তার জশ নগামি। অদ্ভুত ব্যাপার, রাগের বদলে তার চেহারায় কৌতূহল ফুটে উঠল।

আবার বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, মি. জশ নগামি, বলল পিট। কিন্তু আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।

তাই বলে মেয়েদের গায়ে এভাবে হাত তুলবেন? অজ্ঞান নার্সের দিকে তাকাল ডাক্তার।

অ্যালার্ম বাজাতে যাচ্ছিল, বলল পিট, ক্ষমা প্রার্থনার সুরে।

ভাগ্যিস ওকে আপনারা কাবু করতে পেরেছেন। নার্স কারাতে জানে। পিটের দুপাশে দাঁড়ানো বাকি সবার দিকে তাকাল ডাক্তার। প্রায় বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। টিমগুলোর সেরা সদস্যদের নিয়ে করে, রেইমন্ড জর্ডান সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করলেন কীভাবে?

ভুরু কুঁচকে পিটের দিকে তাকাল অ্যাল। এমন কিছু জানো তুমি যা আমরা পারি না?

এসো, পরিচয় করিয়ে দিই। মি. জশ নগামি, ব্রিটিশ ডীপ কাভার অপারেটর। সুমা ও তার অপারেশন সম্পর্কে উনিই তো বেশির ভাগ তথ্য সাপ্লাই দিচ্ছেন।

 আপনি তাহলে ধরে ফেলেছেন? পিটের দিকে ফিরে হাসল ডাক্তার নগামি।

কাঁধ ঝাঁকাল পিট। সান্তা অ্যানায় সেন্ট পলস হাসপাতাল বলে কিছু নেই। তবে লন্ডনে একটা ক্যাথেড্রাল আছে সেন্ট পলস নামে।

কিন্তু আপনাকে তো ব্রিটিশ বলে মনে হয় না, বলল স্টেসি।

স্যানফ্রানসিসকোয় মানুষ হয়েছি, বলল ডাক্তার নামি। ফিরে এসে আপনি আমার কাভার নষ্ট করে ফেলেছেন, ডার্ক, বুঝতে পারছেন তো?

 বিপদে পড়ে আসতে হয়েছে, বলল পিট। কামাতোরি আর তার তিনটে সিকিউরিটি রোবটকে দশ কি পনেরো মিনিটের মধ্যে দেখে ফেলবে ওরা। বিস্ফোরক বসিয়ে পালাতে হলে একটা সেকেন্ডও নষ্ট করা চলে না।

ওয়েট আ মিনিট। একটা হাত তুলল ডাক্তার নগামি। আপনারা কামাতোরি আর তার রোবট গার্ডদের অচল করে দিয়েছেন? কামাতোরি নেই?

নেই।

ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো ব্যস্তভাবে বললেন, এই কমপ্লেক্সের একটা ডায়াগ্রাম দরকার আমাদের।

কনস্ট্রাকশন ব্লুপ্রিন্ট-এর মাইক্রোফিল আছে আমার কাছে, কিন্তু কনট্যাক্ট হারিয়ে ফেলায় পাঠাতে পারি নি।

জিম হানামুরা?

হ্যাঁ। সে কি মারা গেছে? উত্তরটা আন্দাজ করতে পারে ডাক্তার নগামি।

 হ্যাঁ। কামাতোরি তাকে জবাই করেছে।

আপনি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন কিনা বলুন, তাগাদা দিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। আমাদের হাতে সময় নেই।

কিন্তু ডাক্তার নগামির মধ্যে কোনো ব্যস্ততার ভাব নেই। আপনারা টানেল হয়ে এডো সিটিতে পৌঁছুতে চান? চানতে চাইল সে।

ট্রেনে চড়ে যাওয়া যায় কিনা ভাবছি, টিমোথি ওয়েদারহিল বললেন, দরজা দিয়ে করিডরে তাকালেন তিনি।

সম্ভব নয়। কাঁধ ঝাঁকাল ডাক্তার। আপনারা কমপ্লেক্সে অনুপ্রবেশ করার পর বিশেষভাবে ট্রেনিং পাওয়া একটা সিকিউরিটি ফোর্সকে টিউব পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছে সুমা। একটা পিঁপড়েও গলতে পারবে না।

স্টেসি তাকিয়ে আছে তার দিকে। আপনার তাহলে পরামর্শ কী?

সাগর। ভাগ্য ভালো হলে কোন জাহাজ দেখতে পেয়ে তুলে নেবে আপনাদের।

মাথা ঝাঁকালো স্টেসি। ওটা বাদ। যে-কোন বিদেশি জাহাজ পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এলেই ডুবিয়ে দেয়া হবে।

তোমরা শুধু কোথায় কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটাবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাও, বলল পিট। ওর চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে দেয়ালের গায়ে, যেন অপরদিকে কী আছে দেখতে পাচ্ছে। পালাবার ব্যাপারে আমার আর অ্যালের ওপর আস্থা রাখো।

ওরা তিনজন পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর মাথা ঝাঁকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। ঠিক আছে, তাই। আপনি আমাদের প্রাণ বাঁচিয়ে এতো দূর নিয়ে এসেছেন, কাজেই আস্তা রাখতে আপত্তি নেই।

ডাক্তারের দিকে ফিরল পিট। আপনি? যাবেন আমাদের সাথে?

কাঁধ ঝাঁকালো ডাক্তার, মুখে আড়ষ্ট হাসি। এখানে আমার কাজ শেষ হয়েছে। ধন্যবাদ, ডার্ক। আমাকে যদি এখানে ফেলে যান, সুমা জবাই করবে।

ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো জানতে চাইলেন, বিস্ফোরকগুলো কোথায় বসানো যায়, কোনো সাজেশন দিতে পারেন?

সাজেশন দিতে পারি, সঙ্গে করে নিয়েও যেতে পারি? বলল ডাক্তার। ওখানে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে গোটা কমপ্লেক্স এক মাসের জন্যে অচল হয়ে পড়বে।

কোথায়?

 সিলিঙের দিকে তাকালো ডাক্তার। ছ তলায়।

তাহলে আর দেরি নয়, বলে সাবধানে দরজা দিয়ে করিডরে উঁকি দিল পিট। কেউ নেই। ওর পিছু পিছু বেরিয়ে এলো সবাই, ঢুকে পড়ল এলিভেটরে। কিন্তু এলিভেটর ওপরে না উঠে নামতে শুরু করল নিচের দিকে। ওদের আগেই কেউ চাপ দিয়েছে বোতামে।

সর্বনাশ! তিক্তস্বরে বললেন টিমোথি ওয়েদারহিল।

সবাই মিলে দরজাটা চেপে ধরবেন, যাতে না খোলে, নির্দেশ দিল পিট। অ্যাল, ডোর ক্লোজ লেখা বোম চাপ দাও।

থামলো এলিভেটর, সবাই মিলে চেপে ধরে আছে দরজা খোলার চেষ্টায় কাঁপছে কবাট, কিন্তু খুলছে না।

অ্যাল! চাপা কণ্ঠে বলল পিট। পাঁচ নম্বর বোতাম চাপ দাও। ডোর ক্লোজ, লেখা বোতাম থেকে আঙুল সরিয়ে পাঁচ নম্বর বোতামটা টিপে দিল অ্যাল। কয়েক সেকেন্ড কাঁপল এলিভেটর, যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছ না কোনদিকে যাবে, তারপর একটা ঝাঁকি খেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল।

আটকে রাখা দম ছেড়ে স্টেসি বলল, উফ।

হঠাৎ আঁতকে উঠল অ্যাল। পাঁচ নম্বর বোতামের আলো জ্বলছে! তার মানে ছতলায় কেউ অপেক্ষা করছে এলিভেটরে চড়ার জন্যে।

সবাই তৈরি থাকো, নির্দেশ দিল পিট।

 আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তৈরি হলো সবাই, বিপদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।

সাদা কোট পরা একজন এঞ্জিনিয়ার, মাথায় হ্যাট, দাঁড়িয়ে আছে নোটিস বোর্ডের সামনে এলিভেটরে ঢোকার সময় মুখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত। তারপর অনুভব করল সে, এলিভেটর নড়ছে না। চারদিকে তাকিয়ে বিদেশি কয়েকটা মুখ দেখতে পেল। কেউ হাসছে না।

 চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলল এঞ্জিনিয়ার, একহাতে তার মুখ চেপে ধরে অপর হাতে গলার একটা রগে খোঁচা মারল পিট। অসাড় হয়ে গেল শরীরটা, ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ল এলিভেটরের মেঝেতে। ইতোমধ্যে এলিভেটর থেকে বেরিয়ে গেছে ডাক্তার জশ নগামি, তার পিছু পিছু একটা প্যাসেজে ঢুকল সবাই।

এলিভেটর থেকে সবার শেষে বেরুলেন টিমোথি ওয়েদারহিল। পিটের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন, কখন ও কোথায় আবার মিলিত হয় আমরা?

টপফ্লোর। তাড়াতাড়ি বাকি সবাইকে অনুসরণ করলেন টিমোথি ওয়েদারহিল, পিটের প্ল্যান সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারলেন না।

অজ্ঞান এঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকালো অ্যাল। কোথায় লুকাবো ওকে?

এলিভেটরের সিলিঙের দিকে আঙুল তাক করল পিট। মাচায়। ল্যাব কোট ছিঁড়ে বাঁধো, মুখেও খানিকটা ভরো।

উত্তরে পিটও মুচকি হেসে বলল, মুক্তির মিষ্টি আওয়াজ, কি বলো?

যদি ছিনতাই করা সম্ভব হয়।

আশা করতে দোষ কি! বোতামে চাপ দিতেই এলিভেটর ওপরে উঠতে শুরু করল। কাজটা দ্রুত সারতে হবে আমাদের, বারো মিনিট দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাবে।

.

৫৫.

 ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিঙের কমিউনিকেশন রুমে বসে ঘামছেন জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন ডিরেক্টর রেইমন্ড জর্ডান ও অপারেশনস-এর ডেপুটি ডিরেক্টর ডোনাল্ড কার্ন। দুজনেই তাকিয়ে আছেন বিশাল একটা দেয়াল ঘড়ির দিকে, জাপানের দিকে কান পেতে থাকা একটা স্যাটেলাইট থেকে কল সাইন পাবার আশায় অধীরভাবে অপেক্ষা করছেন।

হঠাৎ ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোনটা। পরস্পরের দিকে তাকালেন ওরা। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে দুজনকেই, ঝুলে পড়েছে মুখ। সাবধানে রিসিভার তুললেন রেইমন্ড জর্ডান। ইয়েস, মি. প্রেসিডেন্ট, ইতস্তত না করে বললেন তিনি।

কোন খবর পেলে?

না, স্যার।

অপরপ্রান্তে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন প্রেসিডেন্ট, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, আর পঁয়তাল্লিশ মিনিট, রেই।

 বুঝতে পারছি, স্যার। আর পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর আক্রমণ শুরু করার নির্দেশ দেবেন আপনি।

ডেল্টা ফোর্স পাঠানোর প্রস্তাব আমি বাতিল করে দিয়েছি। অন্যান্য সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও জয়েন্ট চীফের সাথে কথা বলে দিয়েছি। অন্যান্য সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও জয়েন্ট চীফের সাথে কথা বলে উপলব্ধি করেছি, সামরিক অভিযানে যে সময় লাগবে তা আমাদের হাতে নেই। ড্রাগন সেন্টার অপারেশন্যাল হয়ে ওঠার আগেই ওঠাকে ধ্বংস করতে হবে।

রেইমন্ড জর্ডান অনুভব করলেন, দুনিয়াটা যেন তাঁর হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আরেকটা চাল দিলেন তিনি। আমার এখনো বিশ্বাস, সিনেটর ডিয়াজ ও কংগ্রেস সদস্য লরেন দ্বীপটায় আছেন।

 তোমার ধারণা যদি সত্যিও হয়, ওদের সম্ভাব্য মৃত্যু আমার সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

স্যার, আর এক ঘণ্টা সময় দিতে পারেন না? সরাসরি জানতে চাইলেন রেইমন্ড জর্ডান।

 তোমার অনুরোধে সাড়া দিতে পারলে খুশি হতাম, রেই, কিন্তু না। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিরাট হুমকির মধ্যে রয়েছে। বিশ্বকে ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ হিদেকি সুমাকে আমরা দিতে পারি না।

ইউ আর রাইট। অফকোর্স।

সিদ্ধান্তটা অন্তত একা আমার নয়। ন্যাটো দেশগুলোকে ব্রিফ করেছেন সেক্রেটারি অভ স্টেটস। রুশ প্রেসিডেন্টকেও সব কথা জানানো হয়েছে। সবাই বলেছেন, সিদ্ধান্তটা আমাদের সবার স্বার্থরক্ষা করবে।

 সেক্ষেত্রে টিমের কথা ভুলে যেতে হবে আমাদের, বলে লন রেইমন্ড জর্ডান। ভুলে যেতে হবে সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যের কথাও।

 দেশপ্রেমিক আমেকিরানদের জন্যে আমি গর্বিত, তাদের আত্মত্যাগ কোনোদিন ভুলব না আমরা।

 ধীরে ধীরে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন রেইমন্ড জর্ডান। হঠাৎ যেন তার বয়েস দশ বছর বেড়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট, ফিসফিস করে বললেন তিনি।

কী বললেন?

ডেল্টা ফোর্স পাঠানোর প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অ্যাটম বোমা ফেলবেন।

ডোনাল্ডের চেহারা রক্তশূণ্য হয়ে গেল।

ঝট করে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান। আর মাত্র তেতাল্লিশ মিনিট বাকি আছে। আশ্চর্য, ব্রিটিশ এজেন্ট কী করছে? ওরা এখনো বেরুতে পারছে না কেনো?

.

ছোট কয়েকটা প্যাসেজ ধরে ওদেরকে নিয়ে এলো ডাক্তার নগামি, ওগুলোর গা হিটিং ও ভেন্টিলেটিং পাইপে ঢাকা পড়ে আছে। অফিস ও ওঅর্কশপে প্রচুর লোকজন কাজ করছে, কাজেই সেদিকে যায় নি ওরা। পথে একটা রোবো গার্ডের সঙ্গে দেখা হলো, ওদেরকে আড়াল করে আলাপ জুড়ে দিল জশ নগামি। এ সুযোগে চুপিসারে ওদের একজন এগোল, তারপর ঝট করে হোস পাইপের একটা টুকরো চেপে ধরল সার্কিট বক্সে।

কাঁচ মোড়া একটা কামরার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। বেশ বড় কামরা, ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারিং ও গোছা গোছা ফাইবার অপটিক ভরা, সবগুলোর শাখা প্রশাখা সরু একটা টানেলে ঢুকেছে, ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ড্রাগন সেন্টারে। বিশাল একটা কনসোল দেখা গেল, গায়ে অসংখ্য ডায়াল আর ডিজিটাল ইন্ট্রমেন্ট। কনসোলের সামনে একটা রোবট দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 ওটা একটা ইন্সপেক্টর রোবট, নরম সুরে বলল ডাক্তার নগামি। ওর কাজ সিস্টেমটা মনিটর করা, কোথাও কোনো যান্ত্রিক বা ইলেকট্রনিক ত্রুটি দেখা দিলে রিপোর্ট করা।

 ওর সার্কিট নষ্ট করলাম আমরা, কী হয়েছে দেখার জন্যে সুপারভাইজার কতক্ষণ পর কাউকে পাঠাবে? জানতে চাইলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

পাঠানো হবে মেইন টেলিপ্রেজেন্স কন্ট্রোল থেকে, পাঁচ কি ছয় মিনিটের মধ্যে।

 বিস্ফোরক বসিয়ে কেটে পড়ার জন্যে পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট, বললেন টিমোথি ওয়েদারহিল।

টাইমার সেটিং কী হবে? জানতে চাইল স্টেসি।

বিশ মিনিট। পাতাল থেকে বেরিয়ে দ্বীপ ছেড়ে কেটে পড়তে বিশ মিনিট যথেষ্ট। মি. পিটের প্ল্যান যদি সফল হয়।

 দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একপাশে সরে দাঁড়ালো ডাক্তার নগামি, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো ও টিমোথি ওয়েদারহিল উল্টোদিক থেকে এগোলেন রোবট ইন্সপেক্টরের দিকে। দোরগোড়ায় পাহারায় থাকল স্টেসি। হোস পাইপের টুকরো সার্কিট বক্সে ঠেকতেই যান্ত্রিক ইন্সপেক্টর প্রথমে আড়ষ্ট, তারপর অসাড় হয়ে গেল।

প্রাস্টিক এক্সপ্লেসিতে খুদে ডিটোনেটর ঢোকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, তারপর ডিজিটাল টাইমার অ্যাডজাস্ট করলেন। তার আর অপটিকাল ফাইবারের মাঝখানে, কেমন?

কনসালটা ধ্বংস করলেই তো পারি, বলল ডাক্তার।

ছোট একটা প্যানেজ ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, ভারী কেবল ও অপটিকাল ফাইবারের মাঝখানে টেপ দিয়ে আটকে দিলেন টাইম বোমা। কনসোল ধ্বংস হলে আরেকটা বসিয়ে নেবে ওরা, সময় লাগবে চব্বিশ ঘণ্টা, লেকচার দিলেন তিনি। কিন্তু এখানে হাজার খানেক তার এক হয়েছে, ছিঁড়ে দিতে পারলে পুরো ওয়ারিং বদলাতে হবে ওদের, সময় লাগবে পাঁচ গুণ বেশি।

 অল ক্লিয়ার, দোরগোড়া থেকে রিলোট করল স্টেসি।

 এক এক করে করিডরে বেরিয়ে এলো ওরা, পা টিপে টিপে এলিভেটরের দিকে এগোচ্ছে। মাত্র দুশো মিটারের মতো এগিয়েছে, হঠাৎ একটা হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল ডাক্তার। পাশের একটা প্যাসেজ থেকে মানুষের গলা ও ইলেকট্রিক মটরের আওয়াজ ভেসে আসছে। ওদেরকে দ্রুত সামনে বাড়ার ইঙ্গিত করল সে। ছুটে দিয়ে পরবর্তী করিডরের কোণে লুকিয়ে পড়ল সবাই। আমার হিসেবে ভুল হয়েছে। আগেই চলে এসেছে ওরা, ফিসফিস করে বলল সে।

ওরা কি ইনভেস্টিগেটর? জিজ্ঞেস করল স্টেসি।

না। টেলিপ্রেজেন্স সুপারভাইজার, সঙ্গে একটা রোবট আছে— আপনারা যেটাকে অচল করে দিয়েছেন ওটার জায়গায় বসাবে।

তার মানে কি আমরা ধরা পড়ে যাব?

 এখুনি বলা যাচ্ছে না। অ্যালার্ম বাজার কথা, রোবো গার্ডদের নিয়ে সুমার হিউম্যান সিকিউরিটি ফোর্স ছুটে আসার কথা। প্রতিটি করিডরে থাকবে ওরা, প্রতিটি ইন্টারসেকশন বন্ধ করে দেবে।

ভাগ্যই বলতে হবে, আমরা এতগুলো রোবট অচল করে দিলাম তবু ওরা কিছু সন্দেহ করে নি, কথা শেষে ডাক্তারের পিছু নিয়ে করিডরের মাঝখানে বেরিয়ে এলেন টিম ওয়েদারহিল।

 সাবোটাজের কোনো চিহ্ন না দেখে ওরা ধরে নিয়েছে সাধারণ ই গোলযোগের শিকার হয়েছে ওগুলো।

এলিভেটরের সামনে পৌঁছুল ওরা। ওপর তলা থেকে নিচে নেমে আসতে দুমিনিট সময় নিল ওটা। অবশেষে খুলে গেল দরজা, ভেতরে কেউ নেই। প্রথমে ভেতরে ঢুকলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, টপফ্লোরে ওটার জন্যে বোতামে চাপ দিলেন তিনি।

এলিভেটর ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। একা শুধু ডাক্তারের কাছে ঘড়ি আছে, বাকি সবার ঘড়ি বন্দী হবার সময় কেড়ে নেয়া হয়েছে।

আর ত্রিশ সেকেন্ড বাকি আছে, ওদেরকে জানাল সে।

বাকি আছে শুধু পলায়ন। পিটের প্ল্যান সম্পর্কে ওদের কারো কোনো ধারণা নেই। পিট ও অ্যাল ইতোমধ্যে ধরা পড়েছে কিনা তা-ও ওরা জানে না। ওরা ধরা পড়লে তারাও ধরা পড়বে। দ্বিতীয়বার ধরা পড়লে কী ঘটবে, সবাই তা জানে। কামাতোরির পরিণতি জানার পর হিদেকি সুমা আর কোনো ঝুঁকি নেবে না।

এক সময় স্থির হলো এলিভেটর। শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হলো সবাই। খুলে গেল দরজা।

আপনাদের বোর্ডিং পাস দেখতে পারি, প্লিজ? ঠোঁটে চওড়া হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে অ্যাল জিওর্দিনো।

.

উবুনাই ওকুমা এবং ডায়েজ কানো টেলিপ্রেজেস কন্ট্রোল রুমে কাজ করছে, এ সময় একটা সঙ্কেতের মাধ্যমে জানতে পারল, ইলেকট্রিকাল ইন্সপেক্টর রোবট তাইহো অচল হয়ে পড়েছে। আরেকটা ইন্সপেক্টর রোবটকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলো তারা।

রোবোটিক এখনো নতুন একটা বিজ্ঞান, অকস্মাৎ অচল হয়ে পড়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে। বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝাও যায় না, ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্যে রিকন্ডিশনিং সেন্টারে নিয়ে গিয়ে খুলে ভেতরটা দেখতে হয়।

ইন্সপেক্টর তাইহোকে ঘিরে বার কয়েক চক্কর দিল ডায়েজ কানো। তার চোখে কোনো ত্রুটি ধরা পড়ল না। সম্ভবত সার্কিট বোর্ডে গোলযোগ দেখা দিয়েছে।

 ক্লিপবোর্ডে আটকানো একটা চার্টের ওপর চোখ বুলালো উবুনাই ওকুমা। সমস্যা সৃষ্টি করার ইতিহাস বেশ লম্বা এটার, বলল সে। এর আগে পাঁচবার ভিশন ইমেজে ত্রুটি দেয়া দেয়।

 আশ্চর্য, গত এক ঘণ্টায় চারটে ইউনিট অচল হয়ে পড়ার রিপোর্ট পেলাম আমরা।

সাধারণ প্রবণতাও তাই, এক সঙ্গে কয়েকটা অচল হয়ে পড়ে।

এটাকে মেরামত করে কোন লাভ নেই, বলল ডায়েজ। সব কিছু বদলে সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরি করতে হবে। সঙ্গে করে আনা রোবটটার দিকে তাকালো সে। ইন্সপেকশন ডিডটি করার জন্যে তৈরি তো, ওটোকোড়াতে?

রোবটের গায়ে অনেকগুরো রঙিন আলো জ্বলে উঠল, স্পস্ট যান্ত্রিক কণ্ঠে ওটোকোড়াতে জানাল, সবগুলো সিস্টেম মনিটর করার জন্যে পুরোপুরি তৈরি আমি।

তাহলে শুরু করো।

 ওটোকোড়াতে কনসোলের সামনে নিজের জায়গায় দাঁড়াল, তাইহোকে ছোট একটা গাড়িতে তুলে দিল দুই প্রকৌশলী। বোতাম টিপে গাড়ির কমপিউটারকে নির্দেশ দিতেই সচল হলো গাড়ি, কোনো মানুষের সাহায্য ছাড়াই নিজে থেকে রিকন্ডিশনিং সেন্টারের দিকে চলে যাচ্ছে। আহত রোবটের পিছু না নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগোল এঞ্জিনিয়ারা, কফি খাবে।

কামরায় এখন একা কাজ করছে ওটোকোড়াতে। সে তার ভিশন সিস্টেমের সাহায্যে ডায়াল ও ডিজিটাল রিডিং সংগ্রহ করে প্রসেস করার জন্যে পাঠিয়ে দিচ্ছে নিজের কমপিউটারে। তার সেনসিং অ্যাবিলিটি মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশি, কাজেই হিসেবের একটা গোলমাল সহজেই ধরে ফেলতে পারল।

লেজার পালস রেট হলো প্রতি সেকেন্ডে ৪৪.৭ মিলিয়ন বিট, অপটিক ফাইবারের মাধ্যমে ধরা যায়। কিন্তু ওটোকোড়াতের সেনসরে ধরা পড়ল, এই মুহূর্তে প্রতি সেকেন্ডে পালস রেট দাঁড়িয়েছে ৪৪.৬৮ মিলিয়ন বিট। ইনডেক্স প্রোফাইলের ওপর চোখ বুলিয়ে তার ধারণা হলো, রিবনে আটকানো হাজার খানেক অপটিক ফাইবারের যে গোছাটা রয়েছে তার ভেতর দিয়ে আসার পথে আলোর ঢেউ কোনো কারণে একেবেকে যাচ্ছে।

টেলিপ্রেজেন্স কমান্ডে সঙ্কেত পাঠাল ওটোকোডাতে, ফাইবারের বান্ডিল পরীক্ষা করার জন্যে কনসোল ছেড়ে প্যাসেজে ঢুকছে সে।

.

৫৬.

 প্রতি মুহূর্তে রাগ ও অসহিষ্ণুতা বাড়ছে হিদেকি সুমার। সিনেটর ডিয়াজ ও কংগ্রেস সদস্য লরেন একজোড়া মূর্তিমান উপদ্রব ছাড়া কিছু নন। প্রতি মুহূর্তে তর্ক করছেন তার সাথে, ব্যঙ্গ করছেন তাকে, এমন কি বন্দী হওয়া সত্ত্বেও চোখ রাঙিয়ে হুমকি দিচ্ছেন, সে যেন সস্তা দরের একটা ছিঁচকে চোর।

 তাকে কিডন্যাপ করা হলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কানটা নাকি সুমার হাতে চলে আসবে, মন্তব্য করেছিল ইচিরো সুবোই। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা, পারলে সিনেটরই তার কান মুচড়ে দেয়।

 টেবিলে বসে সাকির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে সুমা, তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। ভাব দেখে মনে হলো, আবার তর্ক করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন দুজনে।

কামরায় ঢুকল তোশি কুদো, ঝুঁকে তার কানে ফিসফিস করল। হাতের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে দাঁড়াল সুমা, বলল আপনাদের রওনা হবার সময় হয়েছে।

ধীরে ধীরে দাঁড়াল লরেন, চোখে কঠিন দৃষ্টি। ডার্ক ও মি. অ্যাল ভালো আছেন কিনা, তাঁদের সাথে দ্র আচরণ করা হচ্ছে কিনা না জেনে এখান থেকে কোথাও আমরা যাব না।

 আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমাদের মাটিতে বিদেশি স্পাই হিসেবে ধরা পড়েছেন ওঁরা, বলল সুমা, ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল।

 এসপিওনাজ সম্পর্কে আমাদের ও জাপানের আইন একইরকম, বলল লরেন। আমার দাবি, নিরপেক্ষ বিচারের জন্যে ওদেরকে কোর্টে পাঠানো হোক।

বিদ্বেষে ভরপুর তৃপ্তির হাসি ফুটল সুমার মুখে। এ ব্যাপারে আলোচনা করে আর কোনো লাভ নেই। আপনাদের ওই দুই বন্ধু, তাদের স্পাই টিমের বাকি সবাইও, আমার বন্ধু মুরো কামাতোরির হাতে নিহত হয়েছেন। আইনের কথা যদি বলেন, নতুন জাপানে আমিই আইন। আমার আইন হলো, স্পাই হিসেবে ধরা পড়লে বিনা বিচারে হত্যা করা হবে।

লরেনের মনে হলো, তার হৃৎপিণ্ড বরফের একটা টুকরোয় পরিণত হয়েছে। শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ল সে, ধরে নিয়েছে কথাটা সত্যি। মুখে এক ফোঁটা রক্ত নেই, টলে উঠল শরীরটা, মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে।

 তোশি কুদো ধরল তাকে, দরজার দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে এলো। আসুন, একটা এয়ারক্রাফট আপনাদের এডো সিটিতে নিয়ে যাবে। ওখানে মি. সুমার প্রাইভেট জেটে চড়বেন আপনারা।

ভবন থেকে বেরিয়ে এলো ওরা, এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে লরেন। ছোট একটা পুকুরকে পাশ কাটাল ওরা। সিনেটর ডিয়াজ খোঁড়াচ্ছেন, হাঁটছেন একটা ছড়ির ওপর ভর দিয়ে। তার পেছনে রয়েছে চকচকে টিল্ট-টারবাইন এয়ারক্রাফট, লনটাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে সুন্দর করে ঝাঁটা ঝোঁপ। জেট এঞ্জিনগুলো আগেই স্টার্ট দেয়া হয়েছে, দূর থেকেই শোনা গেল যান্ত্রিক গুঞ্জন। লাল নাইলনের ফ্লাইট স্যুট পরা দুজন কুকে দেখা গেল, মাথায় ক্যাপ, সিঁড়ির দুদিকে দাঁড়িয়ে। এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে দুজনেই তারা সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল।

 হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন সিনেটর ডিয়াজ। ওয়াশিংটনে ফিরে আমি একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকব। আপনার ক্রাইম সম্পর্কে বিস্তারিত সব জানিয়ে…।

আপনার লেকচার আমি আর শুনতে চাই না, বাধা দিল সুমা। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, আপনাদের অনেক আইন প্রণেতা আমার পক্ষে কথা বলার জন্যে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে, কারণ তাদের অনেক অবৈধ স্বার্থ আমার দ্বারা উদ্ধার হয়। কথা শেষ করে ফেরার জন্যে ঘুরল সে।

এক পাও এগোয়নি, ক্রুদের দুজোড়া হাত থপ করে ধরে ফেলল তাকে, তুলে নিল শুন্যে, খোলা দরজা দিয়ে প্রায় ছুঁড়ে ঢুকিয়ে দিল কেবিনের ভেতর। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটল যে ডিয়াজ ও লরেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, বিশ্বাস করতে সময় নিচ্ছে। প্রতিক্রিয়া হলো শুধু তোশি কুদোর। ক্রুদের একজনকে লক্ষ করে পা চালাল সে।

এটাকে কোনোভাবেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের শুভ সূচনা বলা যাবে না। হেসে উঠল অ্যাল, খপ করে ধরে ফেলল তোশির পা। তাকেও কেবিনের ভেতর ছুঁড়ে দেওয়া। হলো, প্রায় লুফে নিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো ও টিমোথি ওয়েদারহিল।

হাঁপিয়ে উঠল লরেন, কি যেন বলল অ্যালকে। ইতোমধ্যে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে স্টেসি, তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওপরে। জলদি, মিস লরেন! ঘাড় ফিরিয়ে নিটেরের দিকে তাকালো সে। দাঁড়িয়ে থাকবেন না, প্লীজ! দেরি। করলে সবাই আমরা মারা পড়ব!

 আপ-আপনারা কো-কোত্থেকে…? শেষ করতে পারলেন না সিনেটর, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো ও টিমোথি ওয়েদারহিল তাকে টেনে নিল কেবিনের ভেতর।

 জবাব দিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। সমস্ত কৃতিত্ব মি. পিট ও মি. অ্যালের। ক্রুদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ওঁরা। কার্গো কমপার্টমেন্টে বেঁধে রাখা হয়েছে।

কেবিনের দরজা বন্ধ করার আগে রোবো গার্ডদের দিকে ফিরে স্যালুট করল অ্যাল। সায়োনারা! দরজা বন্ধ করে লক করল সে, ককপিটের দিকে ফিরে চিৎকার করল, গো!

গর্জে উঠল জোড়া টারবাইন এঞ্জিন, ভেজা মাটি থেকে এয়ারক্রাফটের চাকা খাড়াভাবে শূন্যে উঠে পড়ল। খানিকটা উঠে বাতাসে ভেসে থাকল, ধীরে ধীরে দিক বদলাল, পুর্বে ঘুরে ছুটল সাগরের দিকে।

অ্যালকে দুহাতে ধরে ঝাঁকি দিল লরেন। ডার্ক কোথায়?

কোথায় আবার! ইঙ্গিতে ককপিটটা দেখিয়ে হাসতে লাগল অ্যাল।

ছুটে গেল লরেন, ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল ককপিটের দরজা। পাইলটের সীটে বসে রয়েছে পিট, প্লেন চালানোর কাজটায় এতো বেশি মনোযোগ যে অন্য কোনো দিকে খেয়াল নেই। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের প্লেন এটা, চালানো এতো দূরের কথা, আগে কখনো দেখেও নি। লরেন ওর গলাটা জড়িয়ে ধরল, চুমো খেল ডজনখানেক তবু ওর চোখের পাতা নড়লো না বা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো না।

তুমি বেঁচে আছ! আনন্দে মুখর হলো লরেন। অথচ সুমা বলছিল তোমাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

লরেনের চুমোর ফাঁকে সুযোগ করে নিয়ে পিট বলল, এর মানে কি আমাকে বেঁচে থাকতে দেখে খুশি হয়েছ তুমি?

পিটের কান মুচড়ে দিল লরেন। ফাজলামি ছাড়তে পারলে না আর!

সাগরে সাঁতার কাটতে না চাইলে চুমো খাওয়া বন্ধ করো, বলল পিট। এ ধরনের প্লেন আগে কখনো চালাই নি, মনোযোগ ছুটে গেলে অ্যাক্সিডেন্ট করব। তুমি বরং কো-পাইলটের সীটে বসো, রেডিওটা সামলাও। সুমার এয়ার ফোর্স ধাওয়া করার আগে সাহায্য চাইতে হবে। জেট ফাইটারের সাথে পাল্লা দিয়ে পারব না আমরা।

জাপানি সেনাবাহিনীর মালিক সুমা নয়।

ওটা ছাড়া চারপাশের বাকি সব কিছুর মালিক সে। আমি কোনো ঝুঁকি নিচ্ছি না। রেডিও অন করো, ফ্রিকোয়েন্সি জানিয়ে দিচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছি আমরা?

 রালফ আর, বেনেটে।

বোট?

জাহাজ, বলল পিট। ইউ এস নেভীর ডিটেকশন ও ট্র্যাকিং শিপ। কেউ বাধা দেওয়ার আগে ওটায় যদি পৌঁছুতে পারি, নিরাপদে ফিরে যেতে পারব।

আমাদের সাথে সুমা রয়েছে, কাজেই কেউ মিসাইল ছুঁড়বে না।

ওদের পেছনে অশান্ত তোশি কুদোকে সামলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে অ্যাল। ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে সে, শরীর মোচড়াচ্ছে ঠিক যেন একটা উন্মত্ত-বিড়াল। অবশেষে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল অ্যাল, কঠিন বাঁধনে আটকে রাখল। স্বীকার করছি, প্রথম দর্শনে আমাকে তোমার পছন্দ না ও হতে পারে। কিন্তু যত দেখবে ততই আমাকে তোমার ভাল লাগবে।

ইউ ইয়াঙ্কি পিগ! চিৎকার করল তোশি কুদো।

অ্যাল আর তোশির দিকে খেয়াল নেই স্টেসির, একটা লেদার চেয়ারের সঙ্গে হিদেকি সুমাকে নাইলন কর্ড দিয়ে বাঁধছে সে। প্রধান ভিলেনের চেহারায় নগ্ন বিস্ময় ও অবিশ্বাস।

দেখলেও না হয় প্রত্যয়! ফোড়ন কাটলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। বিজ্ঞ ওস্তাদ স্বয়ং আমাদের সাথে বেড়াতে বেরিয়েছেন!

 ভূত! বিড় বিড় করছে হিদেকি সুমা, সব কটার মরে ভূত হয়ে যাবার কথা!

ভূত হয়ে গেছে আপনার বন্ধু কামাতোরি, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো সহাস্যে জানালেন।

অসম্ভব! কীভাবে?

 ডার্ক তাকে দেয়ালে গেঁথেছে।

পিটের নাম শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ল সুমা। আপনারা মারাত্মক একটা ভুল করছেন। আমাকে জিম্মি করার পরিণতি ভালো হবে না।

নীচ ও কুৎসিত হবার পালা এখন আমাদের।

আপনারা এতো বোকা যে আমি কী বলছি বুঝতে পারছেন না, হিস হিস করে বলল সুমা। আপনারা কী করেছেন জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে আমার লোকজুন অপারেশন শুরু করে দেবে।

 সে সুযোগ তারা পেলে তো, টিমোথি ওয়েদারহিল বললেন। আর মাত্র তিন মিনিট পর আপনার সাধের ড্রাগন সেন্টার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।

.

ফাইবার অপটিকে টেপ দিয়ে আটকানো বিস্ফোরক পেয়ে গেল রোবট ইন্সপেক্টর ওটোকোডাতে। ওটা নিয়ে কনসোলে ফিরে এলো সে, কয়েক সেকেন্ড পরীক্ষা করার পর টাইমারটা দেখতে পেল। টাইমার চিনতে পারলেও, প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। রোবোটিক কন্ট্রোলে সঙ্কেত পাঠালো সে। পাওয়ার সেন্টার ফাইভ থেকে আমি ওটোকোড়াতে বলছি।

হ্যাঁ, কী ব্যাপার? সাড়া পাওয়া গেল একটা টিভি মনিটর থেকে।

 আমি আমার সুপারভাইজার মি. ওকুমার সাথে কথা বলতে চাই।

ক্যাফেটেরিয়া থেকে এখনো তিনি ফেরেন নি। কেন যোগাযোগ করছ তুমি?

 ফাইবার অপটিকের বান্ডিলে আশ্চর্য একটা জিনিস পেয়েছি।

কী ধরনের জিনিস?

নরম একটা বস্তু, সাথে ডিজিটাল টাইমিং ডিভাইস।

কেবল এঞ্জিনিয়ার বোধহয় তার কোনো ইন্সট্রুমেন্ট ফেলে গেছে।

কিন্তু জিনিসটা আমি চিনতে পারছি না। পরীক্ষা করার জন্যে কন্ট্রোলে পাঠাব?

না, স্টেশনেই থাকো তুমি। ওটা আনার জন্যে একজনকে পাঠাচ্ছি।

ঠিক আছে।

কয়েক মিনিট পর নাকাজিমা নামে একটা রোবট পাওয়ার সেন্টারে ঢুকল। হার হাতে বিস্ফোরক তুলে দিল ওটোকোড়াতে। নাকাজিমা সিক্সথ-কেনারেশন মেকানিক্যাল রোবট, ভয়েস কমান্ড গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু মৌখিক নির্দেশ নিতে পারে না। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ কন্টেইনারে ভরে ফিরতি পথ ধরল সে।

পাওয়ার সেন্টারের দরজা থেকে পঞ্চাশ মিটার এগিয়েছে নাকাজিমা, আশপাশে কোন মানুষজন বা গুরুত্বপুর্ণ কোনো ইকুইপমেন্ট নেই, বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো সি-এইট প্লাস্টিক। ছতলার কংক্রিট প্যাসেজ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল।

 ড্রাগন সেন্টার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে প্রচণ্ডতম ভূমিকম্পেও তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। সি-এইট প্লাস্টিকের বিস্ফোরণের শুধু একটা প্যাসেজ সাময়িকভাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ল, কেইটেন প্রজেক্টের কাজে তাতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে না। তবে বাহক রোবট নাকাজিমা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।

.

৫৭.

রোবো গার্ডরা তাদের সিকিউরিটি কমান্ডকে রিপোর্ট করল, টিল্ট টারবাইন নিয়ে পিট তখনো আকাশে উঠতে পারে নি। প্রথমে বোরটদের রিপোর্টকে দৃষ্টিভ্রমের ফলশ্রুতি বলে অগ্রাহ্য করা হলো, কিন্তু তল্লাশি চালাবার পরও যখন হিদেকি সুমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না, সিকিউরিটি কমান্ড অফিসে উপস্থিত অফিসারদের টনক নড়ল।

অহঙ্কারী ও গোপনীয়তার ব্যাপারে অতি মাত্রায় খুঁতখুঁতে বলে প্রথম শ্রেণীর অফিসারদের নিয়ে এমন একটা টিম গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে সুমা যারা তার অনুপস্থিতিতে জরুরি কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে। আতঙ্কিত সিকিউরিটি ডিরেক্টররা পরামর্শের জন্যে মুরো কামাতোরিকে খুঁজল, কিন্তু দেখা গেল কোনো কাজ করছে না, এমনকি তার ব্যক্তিগত রোববা গার্ডরাও সাড়া দিচ্ছে না।

সশস্ত্র চারটে রোবটকে নিয়ে একটা স্পেশাল ডিফেন্স টিম রওনা হয়ে গেল কামাতোরির খোঁজে। নক করল তারা, কিন্তু পড়ল তার চোয়াল। খাড়াভাবে দেয়ালের সঙ্গে ঝুলছে মুরো কামাতোরি, দুপাশে কাত হয়ে আছে কাঁধ দুটো, চোখ দুটো বিস্ফোরিত, মুখ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। তার তলপেটে গাঁথা তলোয়ারটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল সে। এই প্রথম উপলব্ধি করল, বন্দীরা পালিয়েছে, কামাতোরির বোরো গার্ডরা অচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে যার জায়গায়।

কামাতোরির মৃত্যু সংবাদে অফিসাররা আরো দিশেহারা হয়ে পড়ল। ছতলায় বিস্ফোরণটাও ঘটল এ সময়। তবু দ্রুত কয়েকটা নির্দেশ দিল তারা। দ্বীপের চারধারে বসানো গ্রাউন্ড-টু-এয়ার মিসাইল গোপন বাংকার থেকে মাথাচাড়া দিল, নিক্ষেপের জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি। তবে হিদেকি সুমা প্লেনটায় থাকতে পারে সন্দেহ করে চুড়ান্ত নির্দেশ দিতে ইতস্তত করছে অফিসাররা।

তারপর রিমোট ভিডিও রেকর্ডিং দেখে জানা গেল, তাদের সন্দেহই সত্যি।

ধনকুবের ও কেইটেন প্রজেক্টের পৃষ্ঠপোষক ইচিরো সুবোই গোল্ডেন ড্রাগন-এর বয়োবৃদ্ধ নেতা কোরোরি ইয়োশিশুকে টোকিওর নিজের অফিসে খাতির করে বসিয়ে আপ্যায়ন করছে, এ সময় সুমার সিকিউরিটি ডিরেক্টরদের একজন ফোন করে পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট করল। সুমার দুই পার্টনার কাল বিলম্ব না করে নিজেদের হাতে তুলে নিল কেইটেন প্রজেক্টের দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণ।

বিস্ফোরণের আট মিনিটের মধ্যে ইচিরো সুবোই ব্যক্তিগত প্রভাব খাঁটিয়ে জাপানি সেনাবাহিনীকে রাজি করিয়ে ফেলল, টিল্ট-টারবাইনকে কয়েকটা জেট ধাওয়া করবে। সে নির্দেশ দিল, জোর করে সোসেকি দ্বীপে ফিরিয়ে আনতে হবে প্লেনটাকে। তা যদি ব্যর্থ হয়, আরোহীদের সহ আকাশেই ধ্বংস করতে হবে ওটাকে। কোরোরি ইয়োশিশু ও ইচিরো সুবোই একমত হলো, হিদেকি সুমা পুরানো বন্ধু হলেও কেইটেন প্রজেক্ট ও তাদের নতুন সামাজ্যের স্বার্থে, বিদেশি রাষ্ট্রের হাতে বন্দী হবার চেয়ে তার বরং মরে যাওয়াই ভালো। বন্দী সুমাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে পারলে ক্রিমিন্যাল হিসেবে বিচার করা হবে তার। ভীতিকর একটা আশঙ্কার কথাও ভাবল তারা, সুমাকে জীবিত পেলে ইন্টারোগেট করে জাপানের গোপন টেকনলজি, অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিকল্পনা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য আদায় করে নেবে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স।

.

সোসেকি দ্বীপ থেকে আকাশে ওঠার সময় কম্পাস দেখে জাহাজটার পজিশন আন্দাজ করে নিয়েছে পিট। এ মুহূর্তে এঞ্জিনগুলোর কাছ থেকে সবটুকু শক্তি আদায় করে নিয়ে ফুল স্পীডে প্লেন চালাচ্ছে ও। পাশে বসে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে লরেন রাল আর. বেনেটের সঙ্গে যোগাযোগ করার।

কোনো সাড়া পাচ্ছি না, রিপোর্ট করল সে।

 ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক আছে তো?

 সিক্সটিন ভিএফ?

অন্য ব্যান্ড। সিক্সটিন ইউএফ-এর বোতাম টেপো, কল সাইন হিসেবে নাম বলো আমার।

আলট্টা হাই ফ্রিকোয়েন্সি বেছে নিয়ে ডায়াল করল লরেন, হেডসেটের সাথে জোড়া লাগানো মাইক্রোফোনে কথা বলল, পিট রালফ্ আর, বেনেট-কে ডাকছি। পিট কলিং ইউএসএস রালফ আর, বেনেট। ডু ইউ হিয়ার মি? ডু ইউ হিয়ার মি? প্লীজ অ্যানসার।

 দিস ইজ দ্য রালফু আর. বেনেট, জবাবটা এতো জোরাল যে লরেনের মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে। সত্যি আপনি নাকি, ডার্ক। মনে হচ্ছে শেষ বার দেখা হবার পর আপনার সেক্স বদলে গেছে।

মাটি ছাড়ার পর থেকেই জাহাজের সুপারসেনসিটিভ ডিটেকশন সিস্টেমে ধরা পড়ে গেছে ওদের প্লেন। খবর পেয়েই সিচুয়েশন রুমে পায়চারি শুরু করেছেন কমান্ডার হার্পার। মাঝে মধ্যে থামছেন, কনসোল অপারেটরদের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছেন। কমপিউটার মনিটর ও রাডার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অপারেটররা।

তোমরা কি চিনতে পারছ…?

 হয় একটা টিল্ট-রোটর নয়তো নতুন একটা টিল্ট-টারবাইন, একজন অপারেটর মন্তব্য করল। মাটি ছাড়ার পর থেকেই জাহাজের সুপারসেনসিটিভ ডিটেকশন সিস্টেমে ধরা পড়ে গেছে ওদের প্লেন। খবর পেয়েই সিচুয়েশন রুমে পায়চারি শুরু করেছেন কমান্ডার হার্পার। মাঝে মধ্যে থামছেন, কনসোল অপারেটরদের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছেন। কমপিউটার মনিটর ও রাডার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অপারেটররা।

কোর্স?

ওয়ান-টু-জিরো। আমরা আইবিস দুটো যেখানে ছেড়েছিলাম, মনে হচ্ছে। সেদিকে যাচ্ছে।

ঝট করে ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন কমান্ডার। কমিউনিকেশন।

কমিউনিকেশন, স্যার।

 কোনো রেডিও সিগন্যাল পাচ্ছ?

না, স্যার।

কিছু শোনামাত্র জানাবে আমাকে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন কমান্ডার। কোর্স বদলাচ্ছে?

 না।

ডার্ক হতে পারেন না, ভাবলেন কমান্ডার হার্পার। কিন্তু আর কে-ই বা নির্দিষ্ট এই পজিশনের দিকে প্লেন নিয়ে আসবে? কাকতালীয় কিছু ঘটছে? অফিসারদের দিকে ফিরে দ্রুত নির্দেশ দিলেন তিনি,, জাহাজের কোর্স বদলে যেখান থেকে আইরস ছেড়েছিলাম সেদিকে চলো। ফুল স্পীড।

কমিউনিকেশন রুম আপনাকে ডাকছে, স্যার, একজন নাবিক বলল।

ছোঁ দিয়ে ফোনের রিসিভার তুললেন কমান্ডার। দিস ইজ দ্য ক্যাপ্টেন।

এক ভদ্রমহিলা সঙ্কেত দিচ্ছেন, দাবি করছেন তিনি নাকি কংগ্রেস সদস্য লরেন স্মিথ। বলছেন, সোসেকি দ্বীপ থেকে হাইজ্যাক করা প্লেনটা মি. ডার্ক পিটই চালাচ্ছেন। প্লেনে আরোহী রয়েছেন আটজন, সিনেটর ডিয়াজ ও মি. হিদেকি সুমা সহ।

ঝাড়া পাঁচ সেকেন্ড কথা বলতে পারলেন না কমান্ডার। তারপর সবিস্ময়ে বললেন, কী বললে? একটা প্লেন ও হিদেকি সুমাকে ছিনতাই করেছেন ওরা? কিন্তু সোসকি দ্বীপে ডার্ক রাজনীতিকদের পেলেন কীভাবে? কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিলেন তিনি আবার, তারপর নির্দেশ দিলেন, যে-ই যোগাযোগ করুক, তাকে বলল যে তাদের পরিচয় সম্পর্কে আরো প্রমাণ পেতে হবে আমাকে।

ত্রিশ সেকেন্ড পর কমিউনিকেশন রুম থেকে জানানো হলো, স্যার, ভদ্রমহিলা কসম খেয়ে বলছেন যে তিনিই লরেন স্মিথ।

 ঠিক আছে, তার গল্প আপাতত আমি বিশ্বাস করছি। বিশ ডিগ্রি দক্ষিণে ঘুরে যেতে বলো ওঁদের…।

সেনজু এয়ারবেস থেকে দুটো প্লেন টেক-অফ করল, কনসোল থেকে একজন অপারেটর জানালো। আকার আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে জাপানিজ এয়ার সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের মিৎসুবিশি রাভেন ইনটারসেপটর। বাঁক ঘুরে টিল্ট-টারবাইনের। দিকে ছুটে আসছে ওগুলো।

ড্যাম ইট! বিস্ফোরিত হলেন কমান্ডার হার্পার। এখন আবার জাপানি এয়ারফোর্সের সাথে লাগতে হবে! একজন অফিসারের দিকে ফিরলেন তিনি। পরিস্থিতি সম্পর্কে প্যাসিফিক কমান্ডকে জানাও। বৈরী আচরণ করছে দেখলে ওগুলোকে আমি গুলি করতে চাই। টিল্ট-টারবাইনে আমেরিকান ও আমেরিকানদের বিশ্বস্ত বন্ধুরা আছেন ধরে নিয়ে ওদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি আমি।

প্লেনটাকে চার হাজার মিটার ওপরে তুলে আনল পিট। দ্বীপের মিসাইল সিস্টেম এখন আর ওদের নাগাল পাবে না। আর আশি কিলোমিটার দুরে রয়েছে। জাহাজটা, বলল ও। যে-কোনো মুহূর্তে সরাসরি সামনে ওটাকে আমরা দেখতে পাব।

 কো-পাইলটের সীটে লরেনের বদলে বসেছে অ্যাল। চোখে কৌতুক, ফুজের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সুমার গ্রাউন্ড ক্রুরা দেখছি অপচয় একদমই পছন্দ করে না। যা ফুয়েল আছে তাতে বড়জোর আর দশ মিনিট উড়তে পারব আমরা।

 সোসেকি দ্বীপ থেকে এভো সিটিতে যাবার কথা প্লেনটার, কাজেই ট্যাংকগুলো আংশিক ভরা হয়েছে।

ওদের এয়ারফোনে কমান্তার এডওয়ার্ড শার্পের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

দিস ইজ ডার্ক পিট। গো অ্যাহেড।

দুঃসংবাদ দেয়ার জন্যে দুঃখিত। আপনাদের লেজে একজোড়া জাপানি মশা কামড় বসাতে আসছে।

আর কি বাকি থাকল! হতাশায় স্নান হলো পিটের চেহারা। কতক্ষণ পর রাধা দেবে?

কমপিউটার বলছে, পরস্পরের কাছ থেকে আমরা পনেরো কিলোমিটার দূরে থাকব, এ সময় আপনাদের লেজে কামড় বসাবে ওগুলো।

 ফুয়েল গজে টোকা দিল অ্যাল। আক্রমণ হলে স্রেফ মারা যাব আমরা।

অতটা হতাশ হবেন না, ধীরে ধীরে বললেন কমান্ডার হার্পার। আমাদের ইলেকট্রনিক কাউন্টারমেজার এরই মধ্যে ওদের রাডার মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। দেখতে পেতে হলে ওদেরকে একেবারে আপনারে কাছাকাছি আসতে হবে।

এমন কিছু আছে যা দিয়ে ওদের লক্ষ ব্যর্থ করা যায়?

আমাদের একমাত্র অস্ত্র থারটি-মিলিমিটার সী ভলকান। প্রতি মিনিটে বিয়াল্লিশ শো রাউন্ড, রেঞ্জ আট কিলোমিটার।

আট কিলোমিটার যথেষ্ট নয়, আরো পাঁচ কিলোমটিার দুরে থাকবে ওগুলো, বলল পিট। অন্য কোনো আইডিয়া?

অপেক্ষা করুন। কমান্ডার হার্পার আবার কথা বললেন দুমিনিট পর, আপনারা আমাদের ফায়ার কাভার পেতে পারেন, যদি ডাইভ দেন। নিচে নামার সময় বাড়তি গতি অতিরিক্ত চার মিনিট বাঁচিয়ে দেবে আপনাদের।

তাতে কোন সুবিধে হবে না, বলল অ্যাল। ওরাও ডাইভ দেবে।

নেগেটিভ, কমান্ডারকে বলল পিট। ঢেউয়ের কাছাকাছি না নেমে আমরা বরং উপরেই থাকি, নড়াচড়ার জন্যে প্রচুর এয়ার স্পেস

ওরা কি করতে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে জেনে নিন, কমান্ডার মার্পের গলায় ঝাঁঝ। রাডারে ওদেরকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বারোমো মিটারে নেমে আসছে ওরা, তার মানে আপনাদের কাছ থেকে আঠাশশো, মিটার নিচে থাকবে। এক সময় তো আপনাদের নামতেই হবে নিচে, তখন বাধা দেয়ার প্ল্যান করতে ওরা।

বসে যান।

ওদের আগেই যদি নিচে নেমে সাগরের কাছাকাছি থাকেন, গুলি ছুঁড়ে আমরা ওদেরকে দুর সরিয়ে রাখতে পারব। কৌশলটা আমার নয়, কমপিউটারের।

উর্বর মস্তিস্ককে নমস্কার, বলল পিট। চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে ডাইভ দিচ্ছি। আমরা লরেনের দিকে তাকালো ও, ককপিটের দরজার পিছনে বসেছে সে। সবার স্ট্রাপ শক্ত করে বাঁধা আছে কিনা দেখো। অনুষ্ঠানমালায় এরপর রয়েছে রক অ্যান্ড রোল।

আঠারো কিলোমিটার, ব্যবধান দ্রুত কমে আসছে, সাবধান করলেন কমান্ডার হার্পার।

 অ্যাল, তুমি আমাকে এয়ারস্পীড আর অলটিচ্যুড় জানাবে।

শক্ত হাতে হুইল ধরে কন্ট্রোল বলাম সামনে ঠেলে দিল পিট, ভাবছে দেখা হলে কী বলবে আজরাইলকে। সাগরের দিকে খাড়া গোত্তা খেয়ে নামতে শুরু করল প্লেন।

.

৫৮.

 ফোনের রিসিভার নিচু করে কোরোরি ইয়োশিশুর দিকে তাকাল ইচিরো সুবোই। সুমার প্লেনটা একটা মার্কিন নেভাল শিপের দিকে যাচ্ছে। ওটাকে ফিরে আসতে বাধ্য করা সম্ভব নয়। ফাইটার স্কোয়াড্রন-এর কমান্ডার ও টাকে গুলি করে নামানোর ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছে।

অন্য কোনো উপায় না থাকলে সুমাকে মরতে হবে, সে বুঝবে তার স্বপ্ন সফল করার চেষ্টা করছি আমরা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন বৃদ্ধ কোরোরি ইয়োশিশু।

অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে রিসিভারে কথা বলল ইচিরো সুবোই, প্লেন ধ্বংস করার নির্দেশ বহাল আছে। আর কিছু না বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল সে।

সুমার মৃত্যু আমাদেরকে যেন পিছিয়ে না দেয়, কোরোরি ইয়োশিশু বললেন। এখুনি তোমার ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়া উচিত। আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দাবিগুলো জানানো দরকার প্রেসিডেন্টকে।

 কিন্তু তিনি যদি আমাদের দাবি না মানেন?

কয়েক বছর ধরে লোকটাকে লক্ষ করছি আমি। অত্যন্ত বাস্তববাদী মানুষ। সে উপলব্ধি করবে, ডুবন্ত একটা দেশকে রশি ছুঁড়ে বাঁচাবার চেষ্টা করছি আমরা। ভয় পেয়ো না, ওদের প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস আমাদের সাথে চুক্তিতে আসতে বাধ্য হবে। তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

 খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছে সামনের জাপানি ফাইটারে পাইলট, টিল্ট টারবাইন রেঞ্জের মধ্যে চলে এসেছে। টার্গেটিং সিস্টেমের টিভি মনিটরে একটা লাল বিন্দু দেখা গেল, সেটাকে স্ক্রীনের মাঝখানে সরিয়ে আনল সে। ফায়ারিঙের দায়িত্ব নিল অপটিক্যাল কমপিউটার, ছুঁড়ে দিল একটা মিসাইল।

 আমি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রে সিম্পসন, এয়ার ফোনে শুনতে পেল পিট ও অ্যাল। এ ভদ্রলোকই আইবিস সম্পর্কে ওদেরকে ব্রিফ করেছিলেন। ওদেরকে সতর্ক করে দিলেন তিনি, এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল রওনা হয়েছে।

 এক কিলোমিটারের মধ্যে চলে এলে সতর্ক করবেন আমাকে, বলে রাখল পিট।

ছয়শো মিটার, বলল অ্যাল। স্পীড আটশো নট।

 কন্ট্রোল কলাম টেনে আনল পিট। ড্রাইভ দিচ্ছিল প্লেন, একটা বাঁক তৈরি করে সিধে হলো, সাগর থেকে মাত্র সত্তর মিটার ওপরে।

মিসাইল আরও তিন কিলোমিটার দুরে, চাপা গলায় বললেন রে সিম্পসন।

অ্যাল, এঞ্জিনগুলোকে খাড়া করবে তুমি, নির্দেশ দিল পিট।

প্রায় সেই মুহূর্তে রে সিম্পসন জানালেন, এক কিলোমিটার।

 এখনই।

লিভার ঠেলে দিল অ্যাল। দিগন্তের দিকে নাক ছিল প্লেনের, মুহূর্তের মধ্যে আকাশের দিকে খাড়া হলো সেটা।

ওদের দুমিটার নিচ দিয়ে ছুটে গেল মিসাইল।

নাইস ওয়ার্ক, প্রশংসা করলেন সিম্পসন। আপনারা ভলকানের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসছেন। নিচের দিকে থাকার চেষ্টা করুন, গুলি করতে আমাদের যাতে সুবিধে হয়।

 লেভেল ফ্লাইটে এনে ডেকে নামতে সময় লাগবে আমার, বলল পিট। আমার এয়ারস্পীড কমে গেছে।

লিভার টেনে আবার প্লেটাকে সিধে করে নিল অ্যাল। পানির বিশ মিটার ওপর দিয়ে ছুটছে ওটা, জাহাজটার ঝুলে থাকা কাঠামো লক্ষ করে।

 এয়ারক্রাফট কাছে চলে আসছে, তবে কোনো মিসাইল দেখতে পাচ্ছি না, রে সিম্পসন জানালেন। ওরা বোধহয় একেবারে শেষ মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনারা বরং তাড়াতাড়ি নেমে আসুন ডেকে।

ঢেউ ছুঁয়ে আসছি আমি।

ওরাও তাই আসছে। একটার ওপর আরেকটা, কাজেই ফ্লাইং সসারের ভুমিকায় দ্বিতীয়বার কাজ হবে না।

হুম। আমাদের মনের কথা ধরে ফেলছে ওরা।

ওরা আপনাদের সব কথা রেডিওতেই ধরতে পারছে।

এতক্ষণে বলছেন, উনি!

মিসাইল আসছে!

পিট ও অ্যাল দুজনেই মাথা নামিয়ে নিল। টিল্প-টারবাইনের নাকের সামনে দিয়ে ছুটে গেল এক ঝাঁক গোলা। রালফ আর, বেনেটের থারটি-মিলিমিটার সী ভলকান গোলাবর্ষণ শুরু করেছে। আধুনিক গ্যাটলিং গানের সাতটা ব্যারেল থেকে প্রতিটি মিনিটে বেরিয়ে যাচ্ছে চার হাজার দুশো রাউন্ড। ছুটে আসা মিসাইলটা বিস্ফোরিত হলো ওদের দুশো মিটার পেছনে। পর মুহূর্তে সামনের জাপানি ফাইটারকে ছেকে ধরল এক ঝাঁক গোলা। দ্বিতীয় ফাইটারের পাইলট লেজ তুলে পালাচ্ছে।

বিগিনং ফাইন্যাল অ্যাপ্রোচ, মাইক্রোফোনে বলল পিট।

দুঃখিত, ব্যান্ড পার্টি বা ঢাক-ঢোল ইত্যাদি নেই যে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানাব আপনাদের, কমান্ডার হার্পার কৌতুক করলেন।

চার মিনিট পর রালফ আর, বেনেটের হেলিকপ্টার প্যাডে টিল্ট-টারবাইন নিয়ে নামল পিট। সীটের ওপর নেতিয়ে পড়লো ও, এঞ্জিন বন্ধ করল অ্যাল।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আজ এই প্রথম নিরাপদ ও সুরক্ষিত বোধ করছে পিট। নিকট ভবিষ্যতে কোনো রকম ঝুঁকি বা বিপদ নেই। অপারেশনে ওর ভুমিকা পালন করেছে ও। হাইতি বা পুয়ের্তো রিকোয় বিশ্রাম নিতে যাবে, মনে মনে আশা করছে পাশে থাকবে লরেন।

এখন যদি কেউ ককপিটে ঢুকে ভবিষ্যদ্বাণী করে যে আর মাত্র কয়েক দিন পর অ্যাডমিরাল জেমস স্যানডেকার ওর অকাল মৃত্যু উপলক্ষে চোখের পানি ফেলবেন এবং ধরা গলায় ওর প্রশংসা করবেন, নিঃসন্দেহে গলা ছেড়ে হেসে উঠবে পিট।

.

চতুর্থ পর্ব

মায়ের নিঃশ্বাস

২০ অক্টোবর, ১৯৯৩, ওয়াশিংটন ডিসি।

৫৯.

 পিট নিজেই টিল্ট-টারবাইন নিয়ে ওয়েক আইল্যান্ড চলে এলো। মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে এরই মধ্যে রানওয়েতে এসে নেমেছে একটা সি-২০ প্যাসেঞ্জার জেট।

পালাউ থেকে মেল পেনারও ওয়েক আইল্যান্ডে চলে এসেছেন, ওদের জন্যে অপেক্ষা করছেন তিনি। গোটা এলাকা কর্ডন করে রেখেছে এয়ার পুলিশ। টিল্ট টারবাইনের দিকে এগিয়ে এলেন মেল পেনার, মুখ তুলে তাকালেন দরজার দিকে। দরজা খুলে গেল, প্রথমে বেরিয়ে এলেন ড. টিমোথি ওয়েদারহিল।

হ্যান্ডশেক করলেন ওঁরা। চারদিকে তাকিয়ে টিমোথি ওয়েদারহিল বললেন, আমরা কিন্তু অভ্যর্থনা কমিটি আশা করি নি।

হোয়াইট হাউসে এখন শুধু আপনাদের কথাই আলোচনা হচ্ছে। সত্যি নাকি, হিদেকি সুমাকে সঙ্গে করে এনেছেন আপনারা?

এবং মিস লরেন ও মি. ডিয়াজকেও।

বাইরে বেরিয়ে এসে এয়ার পুলিশ ও মেল পেনারকে দেখে স্টেসিও অবাক হয়ে গেল। কেন যেন মনে হচ্ছে, পিটের সাথে হাওয়াইয়ে যাওয়া আমার কপালে নেই আসলে, মেল পেনারের সাথে হ্যান্ডশেক করার সময় বলল সে।

দুঃখিত, না। একটা এয়ার ফোর্স জেট অপেক্ষা করছে, হিদেকি সুমা, মিস লরেন ও সিনেটর ডিয়াজকে ওয়াশিংটনে নিয়ে যাবে। আমাদের বাকি সবাইকে এখানে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করার জন্যে রেইমন্ড জর্ডান ও খোদ প্রেসিডেন্ট একদল হাই-লেভেল হটশটকে পাঠাচ্ছেন ব্রিফ করার জন্যে।

টাইপ করা এক গাদা কাগজ মেল পেনারের হাতে ধরিয়ে দিলেন টিম ওয়েদারহিল।

রিপোর্ট।

কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন মেল পেনার। কীভাবে সম্ভব? জানতে চাইলেন তিনি।

ইঙ্গিতে প্লেনটা দেখালেন টিমোথি ওয়েদারহিল। সুমাকে আমরা ঝেড়ে কাশতে বাধ্য করেছি। তার বক্তব্য একটা ওয়ার্ড প্রসেসে লিখে নিয়েছি আমরা।

দরজা দিয়ে বাইরে মাথা বের করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। হাই, মেল, শ্যাম্পেন কই?

আগে উপহার কী এনেছেন দেখুন আমাকে!

 সম্মানিত জাপানি অতিথিদের বাধন খুলতে হবে, একটু অপেক্ষা করুন।

ওদের বেঁধে রাখতে হয়েছে?

মাঝে মধ্যে খিচুনি উঠে যায় কিনা।

উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে এলেন সিনেটর ডিয়াজ, সঙ্গে লরেন স্মিথ। মেল পেনারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো ওদের, ফ্লাইট প্ল্যান সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া হলো। এরপর প্লেন থেকে প্রায় খেদিয়ে সুমা ও তোশিকে বের করে আনলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। সামান্য মাথা নোয়ালেন মেল পেনার। ইউনাইটেড স্টেটসে ওয়েলকাম, মি. সুমা। তবে এখানে বোধহয় আপনার সময় খুব একটা শান্তিতে কাটবে না।

তোশি কুদোর চেহারায় নগ্ন ঘৃণা ফুটে উঠল, হিসহিস করে বলল সে, মি. সুমার অসম্মান করলে তার পরিণতি ভালো হবে না। তাঁর দাবি, এখুনি তাঁকে মুক্তি দিয়ে জাপানে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

সে গুড়ে বালি।

আপনারা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছেন, গর্জে উঠল হিদেকি সুমা। আমাদের মুক্তি দেওয়া না হলে এমন প্রতিশোধ নেওয়া হবে যে দুনিয়ার মানুষ ভয়ে শিউরে উঠবে।

টিমোথি ওয়েদারহিলের দিকে তাকালেন মেল পেনার। হুমকিটার পেছনে কোনো ভিত্তি আছে?

 সুমার দিকে তাকালেন টিমোথি ওয়েদারহিল। দুঃখিত, ড্রাগন সেন্টারের কথা আপনি ভুলে যেতে পারেন। ওটার শক্তির উৎস আমরা ধ্বংস করে দিয়ে এসেছি।

তার মানে আপনাদের মিশন সফল হয়েছে? জানতে চাইলেন মেল পেনার। রিপোর্টের জন্যে হোয়াইট হাউসের সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।

 আপাতত অচল করে দেওয়া হয়েছে। যথেষ্ট বিস্ফোরক ছিল না, শুধু এক বান্ডিল ফাইবার অপটিক উড়িয়ে দিতে পেরেছি।

 ডাক্তার জশ নগামি প্লেন থেকে বেরিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল মেল পেনারের সঙ্গে। তিনি বললেন, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আপনি যে তথ্য পাঠিয়েছেন, সেজন্যে আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

সবিনয়ে কাঁধ ঝাঁকালো ডাক্তার নগামি। জিম হানামুরাকে বাঁচাতে পারলাম না। বলে সত্যি আমি দুঃখিত।

আপনি নিজেই তো ধরা পড়ে যেতে পারতেন।

ঠেকিয়েছেন মি. ডার্ক পিট। চারদিকে তাকালো ডাক্তার, কিন্তু পরিচিত কাউকে দেখতে পেল না। মনে হচ্ছে আমি এমন একজন এজেন্ট যার কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নেই।

ড্রাগন সেন্টারের লেআউট সম্পর্কে আপনার ধারণা আমাদের কাজে লাগবে, বললেন মেল পেনার। ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের সাথে যোগাযোগ করেছি আমরা। আপনার বস এখানে আপনাকে আমাদের সাথে দিন কয়েক থাকার অনুমতি দিয়েছেন।

লাফ দিয়ে প্লেন থেকে বেরিয়ে এলো অ্যাল জিওর্দিনো। একদল এয়ার ফোর্স পুলিশ হিদেকি সুমা ও তোশি কুদোকে অপেক্ষারত সি-২০-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে ছুটল সে। অফিসারকে বলল, মিছিলটা একটু থামান। তোশি কুদোর চেয়ে মাত্র আধ সেন্টিমিটার লম্বা সে। মেয়েটার চোখের দিকে সরাসরি তাকাল, বলল,

প্রিয়ে, আমাকে একা ফেলে চলে যেয়ো না।

 রাগে ও বিস্ময়ের ফোঁস করে উঠল তোশি কুদো। এর মানে কী?

মানে হলো প্রেম। সারা দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী নারী হতে চাইলে আমার সাথে ঝুলে পড়ো।

আপনি একটা পাগল!

ওটা আমার অনেক গুণের মাত্র একটা, মুচকি হেসে বলল অ্যাল। আগামি বছরগুলোয় একে একে বাকিগুলো আবিষ্কার করবে তুমি।

অদ্ভুত ব্যাপার, তোশি কুদোকে ইতস্তত করতে দেখা গেল। কারণটা নিজের কাছে পরিষ্কার নয়, জাপানি রীতিবিরুদ্ধ অ্যালের এই প্রেম নিবেদন ভালো লাগছে তার। ভালো লাগার অনুভূতিটা গোপন করতে নিজের সঙ্গে লড়তে হলো তাকে। তোশির ইতস্তত ভাবটা ধরতে পারল অ্যাল, হাত দুটো তার কাঁধে রেখে মৃদু চাপ দিল সে, বলল, সময় নিয়ে মন স্থির করো, কোনো তাড়া নেই। যাও, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমিও আসছি।

কাঁধের ওপর দিয়ে এখনো অ্যালের দিকে তাকিয়ে আছে তোশি, মেল পেনার তার কনুই ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *