সিংহ পুরুষ : অহিংস কাহিনী

সিংহ পুরুষ
অহিংস কাহিনী

১৯২২ সাল। মারাকেশ তখন গোলাম ছিলো। গোলাম ছিলো দুই সাম্রাজ্যবাদীর। মারাকেশের এক অংশ দখল করে রেখেছিলো স্পেনিশরা। আরেক অংশ দখল করে রেখেছিলো ফ্রান্সীয়রা। তবে বেশির ভাগ এলাকা ছিলো ফ্রান্সীয়দের দখলে।

১৯২২ সালের প্রথম দিকের কথা। মারাকেশের দক্ষিণাঞ্চলে স্পেনিশ ফৌজের একটি ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে প্রায় এক হাজার সেনাবাহিনী রয়েছে। স্পেনিশ জেনারেল সেই ক্যাম্পে এক জরুরী কাজে গেলেন। স্পেনিশ সেই জেনারেলের নাম জেনারেল সেলিষ্টার।

জেনারেলের এই আগমন ছিলো আসলে ক্যাম্প পরিদর্শনের জন্য। এজন্য সেনা ও তাদের কমান্ডাররা বেশ সতর্ক এবং ফিটফাট হয়ে ছিলো। প্রত্যেক সৈন্য এবং ক্যাম্পের প্রতিটি কোন জেনারেলের পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত রাখা ছিলো। জেনারেল সেলিষ্টার ক্যাম্প পরিদর্শন করছিলেন।

আচমকা ক্যাম্পের ভেতর ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেলো। ক্রমেই সেটা প্রলয়ের বিভীষিকায় রূপ নিলো। ক্যাম্পের ভেতর আসলে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। হামলা করেছিলো মারাকেশের নির্যাতিত মুজাহিদরা। যাদের সংখ্যা ছিলো স্পেনিশ বাহিনীর দশ ভাগের এক ভাগ। মারাকেশের মুজাহিদদের অস্ত্র ছিলো লোহার লাঠি, তলোয়ার, বর্শা ও খঞ্জর। এগুলো দিয়ে তারা এমন এক সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করলো, যাদের কাছে ছিলো অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড, দূরপাল্লার পিস্তল, ট্যাংক ও কামান।

তবে মুজাহিদদের এই হামলা ছিলো অত্যন্ত তীব্র এবং একেবারেই আচমকা। যার জন্য কেউ প্রস্তুত তো ছিলোই না এবং প্রস্তুত থাকার কথাও নয়। আসলে মুজাহিদদের এই হামলায় সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র ছিলো সেটা হলো, পরাধীনতা থেকে মুক্তির জ্বালা ও স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য চেতনা। আর ছিলো পাহাড়সম সংকল্প, বিস্ময়কর আত্মবিশ্বাস।

এই অনমনীয় সংকল্প ও তুঙ্গস্পর্শী আত্মবিশ্বাস নিয়ে মুজাহিদরা এমন প্রচণ্ড হামলা চালালো যে, জেনারেল সেলিষ্টার পালাতে গিয়ে মারা পড়লেন। কিছু স্পেনিশ অফিসার পালাতে সক্ষম হলো এবং দেড় দুইশ সৈনিক প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারলো। যারা পালাতে পারলো না, ক্যাম্পে রয়ে গেলো। তারা ছিলো। মারাত্মকভাবে আহত। এদের সংখ্যা ছিলো প্রায় সাতশ। আর বাকিরা হলো নিহত।

তারপর মুজাহিদরা স্পেনিশদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে গিয়ে আত্মগোপন করলো, যেখানে ওরা সাম্রাজ্যবাদী দখলদারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিলো।

এটা ছিলো মারাকেশের মুজাহিদদের প্রথম হামলা। এর নেতৃত্ব দেন অখ্যাত এক লোক। যিনি পরবর্তীতে আব্দুল করীম নামে সারা দুনিয়ায় খ্যাতিমান হয়েছিলেন। ফ্রান্স ও স্পেনে তার নাম ছিলো, কোথাও কোথাও কিংবদন্তী তুল্য, কোথাও জলজ্যান্ত এক আতঙ্ক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চার বছর আগে ফ্রান্সীয় সৈন্যরা নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে মারাকেশে প্রবেশ করে। তারপর প্রতারণা ও দখলদারিত্বের অপচক্রে ফেলে এবং সেনাশক্তি প্রয়োগ করে মারাকেশের বড় একটা অংশ দখল করে নেয়। স্পেনিশরাও এ ধরনের পেশি শক্তির জোরে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মারাকেশের আরো কিছু অংশে জুড়ে বসে।

প্রথম যুদ্ধের পর ফ্রান্সীয়রা আলজাযায়েরের সঙ্গে সঙ্গে মারাকেশকেও নিজেদের করদরাজ্যে রূপান্তরিত করে। সেখানে অসংখ্য ফ্রান্সীয় সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। আর এই সুযোগে ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের ভূমিহীন অধিবাসীদেরকে মারাকেশে আবাদ করতে শুরু করে। স্পেনিশরাও নিজেদের দখলকৃত অংশে স্পেন ও ইউরোপীয়ানদের বসত গড়তে শুরু করে।

সাম্রাজ্যবাদী এই দুই জাতি মারাকেশের মুসলমানদের নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার সব পথ বন্ধ করে দেয়। এই দুই সন্ত্রাসী, দখলবাজ জাতির উদ্দেশ্য ছিলো একটাই। সেটা হলো, মারাকেশ যেন ইসলামী রাষ্ট্র বলার যোগ্য না থাকে।

ফ্রান্সীয় ফৌজি কমান্ডার তখন জেনারেল লাইটে। অতি দক্ষ ও চালবাজ জেনারেল হিসাবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। তিনি মারাকেশকে তাদের গোলামির শৃংখলে ফাসানোর জন্য সেই চালই চেলেছেন, যে চাল চেলেছিলো ইংরেজরা উপমহাদেশ দখল করতে গিয়ে। মারাকেশের নেতৃস্থানীয় মুসলমান, যারা বিভিন্ন গোত্র ও রাজনৈতিক অংগ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে দেন জেনারেল লাইটে। শত্রুতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেন মারাকেশের নেতাদের মধ্যে। এভাবে মারাকেশের জাতীয় ঐ ধ্বংসের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেন জেনারেল লাইটে।

মারাকেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গোত্র সরদারকে ফ্রান্সীয়রা অঢেল ধন সম্পদ ও জায়গীর এবং সুন্দরী নারী দান করে। এভাবে মারাকেশ একটা পর্যায়ে এসে দাসত্বের চরম অবমাননা মেনে নেয়। কিন্তু মারাকেশের এমন একটি প্রাণীকেও পাওয়া গেলো না, যে এর বিরুদ্ধে সামান্য টু শব্দটি করবে। মনে হচ্ছিলো, মারাকেশের মুসলমানদের মধ্য থেকে স্বাধীনতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিভে গেছে। মরে গেছে তাদের আত্মমর্যাদাবোধের অনুভূতি।

তবে জীবন্ত কোন জাতির সন্তানরা মরে যেতে পারে, কিন্তু জাতির জাতীয়তাবাদ জীবন্তই থাকে। যা তারই কোন এক সন্তানের রূপ ধরে আগ্নেয়গিরী হয়ে বিস্ফোরিত হয়। তখন স্বাভাবিকভাবেই জাতির বিবেকবোধ সীমাহীন আত্মশ্লাঘা নিয়ে জেগে উঠে।

মারাকেশের পাথরচাপা বিবেকও জেগে উঠলো। সে ছিলো এক গোত্র সরদারের ছেলে। সদ্য যৌবনে পা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার উদাত্ত শ্লোগান তুললো সেই সরদারের অগ্নিসন্তান। তার নামই আবদুল করীম আল খাত্তাবী।

তার বাবা তাকে আইন শিক্ষা দেন। আইনের ডিগ্রি নিয়েও সম্মানজনক জীবনের সুযোগ সুবিধা তাকে দিতে রাজি ছিলো না ফ্রান্সীয় ও স্পেনিশরা। কারণ, সে ছিলো মুসলমান। তাদের কাছে মুসলমান হওয়া এক অপরাধ। ধার্মিক হওয়া অন্যায় কর্ম। মানবিক ও সামাজিক হওয়া মানে দুর্বলতা।

স্পেনিশদের দখলকৃত অংশে আবদুল করীমরা থাকতো। আইনের প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি থাকার পরও সম্মানজনক কোন চাকুরি সরকার তাকে দিলো না। তবে আধা সরকারি ধরনের একটা চাকরি পেলো আবদুল করীম। সেটা হলো, স্পেনিশ ফৌজের অফিসারদের স্থানীয় বরবার ভাষা শিক্ষা দেয়ার কাজ। মারাকেশের লোকেরা এ ভাষাতেই কথা বলতো।

আবদুল করীমের মনে মারাকেশের স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য চেতনা তাকে সবসময় দারুণ উজ্জীবিত রাখতো। সঙ্গে সঙ্গে দখলদার ভিনদেশী মুনিবদের বিরুদ্ধে অবিমিশ্র ঘৃণা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। তার এই জাগ্রত উপলব্ধি সে গোপন রাখতে পারতো না।

একদিন স্পেনিশ অফিসারদের ক্লাশ নিচ্ছিলো আবদুল করীম। ক্লাশে স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টারও ছিলেন। এক অফিসার ক্লাস টেষ্ট না পারায় আবদুল করীম তাকে মৃদুভসনা করে। জেনারেল সেলিষ্টার এটা মানতে পারলেন না। গোলাম হয়ে, অধীনস্থ হয়ে তার মুনিবকে এভাবে ধমকে উঠবে- এটা জেনারেল কোনভাবেই মানতে পারছিলেন না। তিনি চটে উঠলেন।

নিজেকে আমাদের কর্মচারীর বেশি মনে করো না করীম! ভদ্রভাবে কথা বলবে। এমন আচরণ সহ্য করা হবে না। জেনারেল সেমিষ্টার বললেন।

আব্দুল করীম জেনারেল সেলিষ্টারের কথায় ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন। জেনারেলের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বললো,

এর চেয়ে বড় অভদ্রতা আর অসৌজন্যতা কি হতে পারে যে, তুমি তোমার শিক্ষককে ধমকাচ্ছে। এমন উগ্র ছাত্র কোন শিক্ষকই পছন্দ করবে না।

জেনারেল সেলিষ্টার একথার জবাবে আব্দুল করীমকে গালমন্দ করলো। আবদুল করীম মুখে বিদ্রুপাত্মক হাসি নিয়ে বললো,

শোন! স্পেনিশ অফিসাররা! মারাকেশ মুসলমানদের, তোমাদের একদিন না একদিন তোমাদের এখান থেকে বের হতেই হবে।

আবদুল করীম ক্লাশ সেখানেই মুলতুবী করে ক্লাশ থেকে এই বলে বেরিয়ে গেলো, আমি তোমাদের এই নোংরা চাকরির ওপর অভিশাপ দিচ্ছি।

তারপর আবদুল করীম তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না। জেনারেলকে আবদুল করীম যা বলে এসেছে তা স্বৈর আইনে সরাসরি বিদ্রোহ ছিলো। বাড়ির অর্ধেক পথে থাকতেই তাকে গ্রেফতার করা হলো। বিনা বিচারে তার জেল হয়ে গেলো।

জেলখানায় তার বিশ দিনও কাটেনি। একদিন সকালে জেলখানায় একটি সংবাদে বোমা ফাটার মতো অবস্থা হলো। সেটা হলো আবদুল করীম ফেরার হয়ে গেছে।

আজ পর্যন্ত কেউ এটা আবিষ্কার করতে পারেনি, রাতের বেলা আবদুল করীম পাহাড় সমান এত উঁচু প্রাচীর কি করে টপকালো। তাও সে প্রাচীর ছিলো ন্যাড়া পাহাড়ের মতো খাড়া এবং মসৃণ। প্রাচীরের কোথাও কোন খাঁজ ছিলো না। স্পেনিশরা আজো এই প্রাচীর টপকানোকে অলৌকিক কীর্তি বলে মনে করে। এটা ছিলো ১৯২১ সালের ঘটনা।

জেলখানার সাধারণ প্রহরী থেকে নিয়ে জেলার পর্যন্ত কাউকে রেহাই দেয়া হলো না। আবদুল করীমের ফেরার হওয়ার কারণে সবাইকে কঠিন শাস্তি দেয়া হলো। একজনকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হলো। অনেক খোঁজাখুঁজি হলো। তদন্তের পর তদন্ত হলো। কিন্তু কেউ হদিস করতে পারলো না, আবদুল করীম কোন পথে জেল থেকে পালিয়েছে।

এক কয়েদির ফেরার হওয়ার ব্যাপারটা তো এমন গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ ব্যাপার ছিলো না। স্পেনিশ জেনারেলের সামনে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠাতেই আবদুল করীমের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কিছু দিন পর যখন জানা গেলো, সে কয়েদির ফেরার হওয়ার প্রেক্ষাপট মারাকেশের ইতিহাসের মোড় পাল্টে দেবে, তখন স্পেনিশদের আরো বেশি টনক নড়লো। তারা আবদুল করীমকে যে মামুলি গুরুত্ব দিয়েছিলো তাই ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় ভুল এবং অমার্জনীয়ও।

***

আবদুল করীমের ব্যাপারে খবর পাওয়া গেলো যে, সে এক দুর্গম পাহাড়ি গিরিকরে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার ও ট্রেনিং ক্যাম্প খুলেছে। কিন্তু সেই পাহাড়ি উপত্যকা যে কোনটা সেটা শত চেষ্টা করেও স্পেনিশ আর্মি জানতে পারেনি বহু দিন।

আবদুল করীম অতি নিঃশব্দে এবং সুনিপুণ নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে এমনভাবে পরিচালনা করলো যে, অল্প সময়েই অসংখ্য যোদ্ধা তার ঝাণ্ডাতলে এসে সমবেত হলো। এসব যোদ্ধারা ছিলো মারাকেশের সাধারণ নাগরিক। যারা দিনের পর দিন স্পেনিশ ও ফ্রান্সীয়দের গোলাবারুদের উত্তাপ সহ্য করেছে। বাপ ভাইদের নির্বিচারে মরতে দেখেছে। দেখেছে মা বোনদের সম্ভ্রমহানি ঘটাতে। নির্যাতন নিপীড়ন সইতে সইতে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এসবই মারাকেশের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য চেতনা জাগিয়ে তুলেছে।

সেনা ফ্রান্সী হোক বা স্পেনিশ হোক, তাদের একমাত্র টার্গেট ছিলো মারাকেশী মুসলমানরা। এই দুই সাম্রাজ্যবাদী দেশের সেনারা সেখানকার জনগণের সঙ্গে হিংস্র প্রাণীর মতো আচরণ করতো। সৈনিকরা ক্ষুধার্ত মানুষের খাবার কেড়ে নিতো। মজুর-শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা পয়সা ছিনিয়ে নিতো। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাঠে ঘাটে খেলতে বেরোলে মেরে কেটে তাড়িয়ে দিতো। এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর ঔষধও ছিনিয়ে নিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। তাহলে কেন মারাকেশী জনগণ সেই নরপিছাচদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না? কেন জীবন বাজি রেখে দেশ দখলদার মুক্তি করতে ও স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না।

মারাকেশী যযাদ্ধাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো যেটা সেটা হলো, তাদের কাছে অস্ত্র ছিলো না। তারপর আবার তাদের লড়াই ছিলো একই সঙ্গে দুই পরাশক্তির সেনাদের বিরুদ্ধে। এক ফ্রান্সীয়, আরেকটা হলো স্পেনীয় সেনা।

ফ্রান্স তো বিশ্ব মিডিয়ায় এটা ছড়িয়ে রেখেছিলো যে, মারাকেশের আসল শাসন কর্তৃত্ব স্থানীয় মুসলমানদের হাতেই রয়েছে।

এক চুক্তির অধীনে মুলত: ফ্রান্সীয় সেনাবাহিনী মারাকেশের নিরাপত্তা ও শাসন সংস্কারের নামে মারাকেশে আস্তানা পেতে বসে। অজুহাত ছিলো মরুচারী বেদুইন জাতি বিদ্রোহী হয়ে সবসময় মারাকেশের সীমান্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাখতো। কখনো কখনো মারাকেশের অভ্যন্তরে তারা গেরিলা হামলা চালাতো। তাদের এ অজুহাত ঠিকই ছিলো। কিন্তু মারাকেশের মুসলমানদের শায়েস্তা করার জন্য গোপনে ফ্রান্স ও স্পেন অস্ত্রও সরবরাহ করতো। এভাবেই বেদুইনরা অস্ত্রশস্ত্রে শক্তিশারী হয়ে উঠে।

তারপর সেই বেদুইনরা যখন মারাকেশে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে সারা দেশে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়, তখন ফ্রান্স ও স্পেনিশরা উড়ে আচে মারাকেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এভাবে মারাকেশ দখল করে তাদের নিরাপত্তা কর্মসূচির পূর্ণাঙ্গতা দান করে।

অথচ সারা দুনিয়ায় মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে রাখে, মারাকেশের শাসনক্ষমতা মারাকেশের জনগণের হাতেই রয়েছে। কিন্তু এর সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য স্বাধীনতাকামীদের হাতে তেমন কোন অস্ত্র ছিলো না, না ছিলো কোন প্রচার মাধ্যম।

পুরো ইহুদী ও খ্রিষ্টান দুনিয়া মারাকেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আসলে ফ্রান্সীয় ও স্পেনিশরা প্রতিশোধ নিচ্ছিলো সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছিলো খ্রিষ্টান পরাশক্তি। পারলে তো ওরা পুরো মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস করে দেয়।

আবদুল করীম তার মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে নেয়। এর মধ্যে একটা বিভাগ ছিলো চার স্তর বিশিষ্ট গোয়েন্দা বিভাগ। এক বছরের মধ্যে স্বাধীনতাকামীদের মোটামুটি সুশংখল একটা সেনাবাহিনী গড়ে উঠলো আবদুল করীমের নেতৃত্বে। তবে অস্ত্রবিহীন। মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো এই নিরস্ত্র। এজন্য প্রথম সমস্যা এবং প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো অস্ত্রসহ। যার একমাত্র মাধ্যম ছিলো ছোট ছোট সেনা চৌকির ওপর গেরিলা হামলা চালানো।

এখন তোমাদের প্রধান কাজ হলো প্রশিক্ষণে শেখা যুদ্ধকৌশলের চর্ম। অনুশীলন করা এবং অস্ত্র সংগ্রহ করা। এজন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলে, দখলদার বাহিনীর ছোট ছোট সেনাক্যাম্পগুলোতে নৈশ হামলা চালানো। সে হামলা হবে গেরিলা পদ্ধতিতে এবং অতি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। মনে রাখতে হবে, এজন্য শহীদ হওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হামলা চালাতে হবে। আবদুল করীম একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে বললো,

আত্মদানকারী একদল মুক্তিযোদ্ধাও প্রস্তুত হলে গেলো। এই দলের নাম রাখা শহীদ স্কোয়াড।

***

এক গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে আবদুল করীম জানতে পারলো, অমুক দিন অমুক ক্যাম্প পরিদর্শনে যাচ্ছেন স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টার। তার সঙ্গে এক কমান্ডো দলও থাকবে। সে ক্যাম্পে প্রায় এক হাজার সেনা রয়েছে। যারা সব ধরনের আধুনিক অস্ত্রশস্তে সুসজ্জিত। এমন এক বাহিনীর ওপর রাতের বেলায়ও হামলা চালানোর অর্থ আত্মহত্যার জন্য নাম লেখানো। আর দিনের বেলায় তো কল্পনাও করা যায় না।

কিন্তু আবদুল করীম জেনারেল সেলিষ্টারের নাম শুনতেই তার রক্ত টগবগ করে উঠলো। প্রতিশোধ স্পৃহায় আবদুল করীম যেন উন্মত্ত হয়ে উঠলো। এই জেনারেলই তো তাকে অন্যায়ভাবে কয়েদখানায় ছুঁড়ে মেরেছিলো।

আবদুল করীম মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকে বললো, যদি এই জেনারেলের পরিদর্শনের সময় হামলা করে এবং জেনারেলকেও খতম করে দেয়া যায়, তাহলে স্পেনিশদের পা টলে উঠবে।

মুক্তিযোদ্ধারা তো এমন হুকুমেরই অপেক্ষায় থাকতো সর্বক্ষণ। লড়তে লড়তে প্রাণ বিসর্জন দেয়াকে তো ওরা কিছুই মনে করতো না। ওরা তো পণই করে নিয়েছে, একজন সাম্রাজ্যবাদীও যদি মারাকেশে থাকে তাহলে এদেশে জীবনের কোন মূল্য থাকবে না। এর চেয়ে ভালো মারাকেশের জন্য জীবন দিয়ে দেয়া। ওরা হামলার জন্য টান টান উত্তেজনা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলো।

সংখ্যায়ও ছিলো ওরা খুব নগণ্য। আবদুল করীম ওদেরকে ট্রেনিংই দিয়েছে এমনভাবে যে, স্বল্প সংখ্যক সেনা কয়েকগুণ বেশি শত্রুসেনার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনবে। আর বিজয় অর্জন করতে না পারলেও যথেষ্ট ক্ষতি করে নিজের অক্ষত ফিরে আসবে।

নির্দিষ্ট দিনে ওদিকে জেনারেল সেলিষ্টার সেনা ক্যাম্পে পৌঁছে গেলেন। এদিকে আবদুল করীম ও তার সংক্ষিপ্ত মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের কাছাকাছি এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেলো যেখানে ওদেরকে দেখার মতো কেউ ছিলো না। ওরা সেখানে ঘাপটি মেরে রইলো।

জেনারেল সেলিষ্টার মাত্র পরিদর্শন শুরু করেছেন এমন সময় মুক্তিযোদ্ধারা ধারালো লাঠি, বর্শা, তলোয়ার ও খঞ্জর নিয়ে ক্যাম্পের ওপর হামলে পড়লো। এমন অতর্কিত হামলায় স্পেনিশদের তত দিকবিদিক হারানোর অবস্থা হলো। ওরা প্রতিরোধের সবরকম চেষ্টা করলো। জবাবী হামলা চালালো। কিন্তু ওদের হামলায় কোন জোর উঠলো না। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারাও ওদেরকে সামলে উঠার সুযোগ দিলো না।

এ দিকে আবদুল করীম তো জেনারেল সেলিষ্টারকে খুঁজতে লাগলো। ওদিকে জেনারেল তার বডিগার্ড ও অফিসারদের পরিবেষ্টনে থেকে নিরাপদে পালাতে চেষ্টা করছিলেন।

হঠাৎ একবার আবদুল করীম তাকে দেখে ফেললো। সেনা অফিসার ও বডিগার্ডরা তাকে নিচ্ছিদ্র পরিবেষ্টনে নিয়ে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে ওরা মুক্তিবাহিনীর ওপর গুলি চালালো। অনবরত ষ্টেনগানও চালালো। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে আহত হলো। কয়েকজন শহীদ হলো। কিন্তু আবদুল করীমের দৃপ্ত কণ্ঠ বার বার গর্জে উঠতে লাগলো, জেনারেল সেলিষ্টাকে আমি জীবিত বা মৃত এখান থেকে নিয়ে যাবো।

আবারো গর্জে উঠলো আবদুল করীমের কণ্ঠ, মুক্তিবাহিনীর সব শহীদ হলেও আমি জেনারেল সেলিষ্টারকে ছাড়বো না।

এ ছিলো বিস্ময়কর ও এক অসম লড়াই। বর্শা, লাঠি ও তলোয়ার লড়ছিলো স্বয়ংক্রিয় ষ্টেনগান ও বিধ্বংসী গোলাবারুদের বিরুদ্ধে। ওদিকে ছিলো বহুযুদ্ধে অভিজ্ঞ দুর্ধর্ষ অপ্রতিরোধ্য আবেগ, বিশুদ্ধ চেতনা ও গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনি ছাড়া শক্তিশারী কোন অস্ত্র ছিলো না।

ওরা অনবরত গোলা ও বোমার আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে জেনারেলকে ঘিরে রাখা পরিবেষ্টনী দেয়াল ভেঙ্গে ফেললো। ওদিকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধ নিহত স্পেনিশদের রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগানসহ অনেক ধরণের অস্ত্র নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেলো। জেনারেলকে যারা এতক্ষণ দেয়ালের মতো নিরাপত্তা প্রাচীর হয়ে আগলে রেখেছিলো, তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। ক্রুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর সামনে কেউ দাঁড়াতে পারলো না। জেনারেলকে অক্ষত অবস্থায় আবদুল করীমের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো।

চরম উদ্ধত-অহংকারী স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টার ভেজা বেড়ালের মতো আবদুল করীমের সামনে দাঁড়িয়ে। এত বড় যুদ্ধশক্তির জেনারেল অথচ ভয়ে থর থর করে কাঁপছেন।

আবদুল করীম ভয়ংকর শীতল গলায় বললো,

আয়! সভ্য দুনিয়ার অসভ্য জেনারেল! আমি তোমাকে বলেছিলাম না, মারকেশ মুসলমানদের। মারাকেশ এ দেশের জনগণের! তোমাদের একদিন এই নোংরা দখলদারিত্ব ছেড়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে। এমন ন্যায্য কথায়ও তোমার টনক নড়লো না। তুমি জঙ্গি শক্তির নেশায় বুঁদ হয়ে আমাকে জেলখানার অন্ধকার কুঠুরীতে ছুঁড়ে মেরেছো।

শোন! আবদুল করীম! জেনারেল সেলিষ্টার কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন, তোমরা আমাদের জঙ্গিশক্তির মোকাবেলা করতে পারবে না। আমাদের যুদ্ধ শক্তির সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। আমাকে মেরে ফেললেও তোমরা স্বাধীন হতে পারবে না। আমরা যে দেশে টুকি সে দেশ থেকে স্বাধীনতা নামক কাল্পনিক শব্দটি মুছে দিই। মারাকেশেও তা মুছে দিয়েছি। আমাকে মেরে কোন লাভ নেই। আর যদি মারোই তাহলে মনে রেখো, আমাকে হত্যার প্রতিশোধ মারাকেশের প্রতিটি মুসলমানের রক্ত ঝড়িয়ে নেয়া হবে। কারণ, তোমাদের কাছে আসলেই কোন অস্ত্র শক্তি নেই।

আমাদের শক্তি একমাত্র আল্লাহ এবং আমাদের তাজা ঈমান আব্দুল করীম দৃঢ় কণ্ঠে বললো, তোমাদের খোদা সত্য হলে তাকে বললো আমাদের হাত থেকে তোমাকে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে যেতে।

জেনারেল সেলিষ্টার প্রথমে কিছুক্ষণ হুমকি ধমকি দিলেন। তারপর সোনাদানা, নারী ও ক্ষমতার লোভ দেখালেন। বন্ধুত্ব ও সন্ধির প্রস্তাবও দিলেন এবং অবশেষে জীবিত রাখলে মারাকেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এসবের উত্তরে আব্দুল করীম নির্বিকার রইলো। শুধু শীতল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। জেনারেল সেলিষ্টারের কথা শেষ হলে আবদুল করীমের মুক্তিযোদ্ধাদের বললো,

তোমরা প্রতিশোধ নাও। প্রতিশোেধ নাও মারাকেশের সেসব নিষ্পাপ মুসলমানদেরকে হত্যার, যাদেরকে এই নির্দয়-নিষ্ঠুর জেনারেলের হুকুমে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে।

***

যে জেনারেলের হাত, পা, দেহ অসংখ্য মারাকেশবাসীর রক্তাক্ত লাশ দেখে হায়েনার মতো উল্লাসে দুলে উঠেছে, সেই জেনারেলের দেহে একই সঙ্গে অনেকগুলো বর্শা, তলোয়ার ঢুকে পড়লো। জেনারেল সেলিষ্টার লুটিয়ে পড়লেন। একজন নির্মম নরখেকো ঘাতকের অপবিত্র দেহ থেকে তার প্রাণপাখিটি উড়ে গেলো।

ততক্ষণে রণাঙ্গন মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে এসেছে। ক্যাম্পের চার দিকেই মুক্তিবাহিনীর প্রাধান্য। এর মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, স্পেনিশদের, জেনারেলকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ধরবে স্পেনিশদের অবশিষ্ট মনোবলও ভেঙ্গে গেলো। পুরো ক্যাম্প ইতিমধ্যে রক্তের জোয়ারে ভেসে গেছে। পরাশক্তির অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ হলেও আজ এরা নিপীড়িত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে।

শত্রু সেনা এবার পালাতে শুরু করলো। কিছু সৈন্য পালাতে গিয়েও মারা পড়লো। এভাবে স্পেনিশদের অনেক সৈন্যই নিহত হলো। অক্ষত রইলো তারাই যারা নির্বিঘ্নে পালাতে পারলো। বিশাল এক অস্ত্রভাণ্ডার রেখেই ওরা পালালো।

মুক্তিসেনারা চলে যাওয়ার পর স্পেনিশ ক্যাম্পে লাশ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। স্পেনিশ সেনাবহিনীর হে কোয়ার্টারে এই সংবাদ পৌঁছার আগেই মুক্তিসেনারা তাদের গোপন ক্যাম্পে চলে গেলো।

এই গেরিলা অভিযান চালানো হয়েছিলো অস্ত্রের জন্য। সে প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে গেছে আপাতত।

মারাকেশের স্পেনিশদের দখলকৃত প্রদেশসমূহের জায়গায় জায়গায় হোট বড় সেনা চৌকি ছিলো। আবদুল করীমের মুক্তিসেনারা রাতের বেলায় সেসব চৌকিকে চারদিক থেকে ঘিরে নিয়ে পিলে চমকে দেয়া সুরে এ ধরণের ঘোষণা দিতে,

অস্ত্র সমর্পণ করে আমাদের কাছে চলে এসো। আর না হয় এখান থেকে জীবিত বের হতে পারবে না।

এমন ঘোষণাও শোনা যেতো,

আজকের রাত্রে পর যদি জীবিত থাকতে চাও এবং এই রাতটিই সর্বশেষ রাত মনে করে না থাকে, তাহলে কাল সকালে যেন এখানে আর একটাকেও দেখা না যায়।

প্রতি রাতেই কোন না কোন সেনা চৌকির আশেপাশে এ ধরণের ঘোষণা শোনা যেতো। মরুর নিঃস্তব্ধ রাতে এমন আচমকা চিৎকার স্পেনিশদের কলজে কাঁপিয়ে দিতো। যেন এটা কোন অশরীরি অট্টহাসি।

এ ছাড়াও স্পেনিশ সেনাদলের এত বড় শক্তিশালী ক্যাম্পে মুক্তিসেনাদের অবিশ্বাস্য আক্রমণ ও জেনারেল সেলিষ্টারের মৃত্যু পুরো স্পেনিশ আর্মিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিলো।

এই আতঙ্ক ও রাতের বেলায় আচমকা গেরিলাদের ঘোষণার কারণে সক হতেই দেখা যেতো যে চৌকি খালি হয়ে গেছে। এভাবে অনেকগুলো সে। চৌকি খালি হয়ে গেলো। কিছু কিছু চৌকিতে মুক্তিসেনারা রাতে গেরিলা হাম চালিয়ে উন্ন প্রযুক্তির অনেক অস্ত্র হাতিয়ে নিলো।

***

আবদুর করীমের এবার মুক্তিসেনাদের নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতো সুশূল বাহিনীর নিয়মতান্ত্রিকতায় অভিজ্ঞ করে তুললো। তারপর গুপ্ত ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যথারীতি সম্মুখ সমরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। এখন আবদুল করীম তার হেডকোয়ার্টার রীফ পাহাড় সারির গহীন অঞ্চলে সরিয়ে নিয়েছে। মুস্তিসেনারা এতদিনে স্পেনিশদের বেশ কিছু চৌকি ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল দখল করে নিয়েছে।

আবদুল করীম একদিন মিলীলা নামক অনেক বড় একটি শহরের ওপর চড়াও হলো। শহরটি মারাকেশের অন্যতম কেন্দ্রীয় শহর। এখানে ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের অভিজাত লোকেরা বসবাস করে। বিত্ত ও প্রাচুর্যের এমন প্রদর্শনী এ শহরের মতো অন্য শহরগুলোতে খুব একটা দে যায় না। শহরের জনসংখ্যা চল্লিশ হাজার। আবদুল করীম শহর অবরোধ করলো। পুরো শহর মুক্তিসেনারা ঘিরে নিলো।

মারাকেশের যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে, তাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ি ছিলো এই শহরে। এই মিলীলা শহরেই অনেকের শৈশব কেটেছে। ইউরোপীয়রা তাদেরকে তাদের ভিটেবাড়ি থেকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিসেনাদের মধ্যে নষ্টালজিক ছড়িয়ে পড়লো। সেটা ক্রমেই রূপ নিলো ভয়াবহ প্রতিশোধ স্পৃহায়। এমনকি মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এমন একটা দাবীও উঠলো, এই শহরে ইউরোপের যত লোক আছে তাদেরকে হত্যা করে তাদের অঢেল ধনসম্পদ সব নিয়ে নিতে হবে। যেগুলো মারাকেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কাজে লাগানো হবে।

আবদুল করীম মুক্তিসেনাদের এই মনোভাবের কথা শুনে সবাইকে ডেকে এনে খুব সংক্ষেপে বললেন,

আমাদের দৃষ্টি শুধু শহরের ওপর। শহরবাসীর ওপর নয়। এটা ঠিক যে এই নির্দয় বিধর্মীরা অনেক নিরপরাধ মুসলমানকে মশা মাছির মতো মেরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং হাজার হাজার নারীর সম লুটে নিয়েছে। এত কিছুর পরও আমি শহরবাসীর ওপর হাত উঠাবো না। এটা সত্যিকারের কোন মর্দে মুজাহিদ স্বাধীনতাকামী মুক্তিসেনার ব্যক্তিত্বের পরিপন্থী যে, সে কোন নিরস্ত্র মানুষের রক্ত ঝড়াবে। মনে রাখবে, ইসলাম মানবতার শিক্ষা দেয়, শিক্ষা দেয় মহানুভবতার। তোমাদের উদার-মহানুভব আচরণ হয়তো হিংস্রপ্রাণীর মতো ওই মানুষগুলোকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করবে।

এ ধরণের বক্তব্য দেয়ার পরও মুক্তি সেনাদের আবেদ-উত্তেজনা এবং চাপা ক্রোধ ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। এই প্রথম আবদুল করীম অনুভব করলো, তার হাতে গাড় এই দলটি তার কথা শুনতে চাচ্ছে না। ইউরোপীয়ানদের হত্যার দাবী এখনো তারা পরিত্যাগ করেনি।

আব্দুল করীম এতে খুব একটা বিচলিত হলো না। তাকে যে চিন্তাটা অস্থির করে তুললো। সেটা হলো, এই শহরে যুবতী মেয়েরাও রয়েছে। যা মুক্তিসেনাদের ঈমান-বিশ্বাসকে হালকা করে দিতে পারে। আর যে বৈভব আছে, তাতে তাদের এতদিনের লালিত বিশুদ্ধ সংকল্পে নাড়া দিয়ে যেতে পারে। নারী ও সম্পদের লোভ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধশক্তিকেও ভেতর থেকে ঘুণ পোকার মতো খেয়ে ফেলে।

আবদুল করিম দেখলো, শহর অবরোধ বেশ সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের ওপর একযোগে হামলা চালালেই এখন শহর জয় সম্পন্ন হয়ে যাবে। শহরবাসীদের সাহায্যে স্পেনিশ সেনারাও আসবে না কিংবা সেই সাহসও নেই তাদের। তাই শহর বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তারপর তো তার মুক্তিসেনারা শহরবাসীদের ওপর প্রতিশোধ নেবে। চরম প্রতিশোধ। বিজিত লোকদের ওপর প্রতিশোধের নেশায় চড়াও হওয়া ইসলাম কখনো সমর্থন করে না।

এসব সাত পাঁচ ভেবে আবদুল করীম অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিলো এবং অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে তার হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলো তার মুক্তিসেনাদের নিয়ে।

ইউরোপীয় ও অনেক বিধর্মী ঐতিহাসকিরা কেবল এই একটি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে আবদুল করীমকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তারা অকপটে স্বীকার করেছেন, আবদুল করীম চারিত্রিক, মানবিক, আদর্শিক ও নৈতিক এবং চরম বিবেকবোধের প্রতি তার দারুণ ভীষণ মুগ্ধ।

***

তাই এই অসাধারণ আদর্শিক ব্যক্তিত্ববোধের প্রতি অনেক স্পেনিশ, ফ্রান্সীয় ও ইউরোপীয়ানরাও বিমুগ্ধ ছিলো। স্পেনিশ আর্মির এক সার্জেন্ট তো আবদুল করীমের নেতৃত্বগুণের প্রতি প্রভাবান্বিত হয়ে নিজের দল ত্যাগ করে। তার নাম সার্জেন্ট কালাইমাস।

সার্জেন্ট কালাইমাস। বয়স সাতাইশ থেকে ত্রিশের কোঠায় হবে। স্পেনিশ আর্মিতে বেশ সুনাম ছিলো ক্লাইমাসের। আর কিছু দিন পরই পদোন্নতি হয়ে গেলে কর্ণেল হয়ে যেতো। সার্জেন্ট ক্লাইমাস স্পেনিশ ছিলো না। ইউরোপের অন্য কোন দেশের লোক ছিলো।

একদিন লুকিয়ে হাপিয়ে সার্জেন্ট ক্লাইমাস স্পেনিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে পড়লো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেই পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছে গেলো। এখানেই কোথায় রয়েছে আবদুল করীমের মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প। মুক্তিসেনারা তাদের ক্যাম্প ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরদুরান্ত পর্যন্ত সতর্ক প্রহরায় থাকতো। এতগুলো সতর্ক চোখ এড়িয়ে মশা মাছিও ক্যাম্প এলাকায় ঢুকতে পারতো না।

সার্জেন্ট ক্লাইমাসকে ভবঘুরের মতো একা একা ঘুরতে দেখে মুক্তিসেনারা তাকে পাকড়াও করলো। তার ওপর একমাত্র এই সন্দেহই করার ছিলো যে, সে স্পেনিশ আর্মির গুপ্তচর। মুক্তিসেনারাও তাকে গুপ্তচর হিসাবেই গ্রেফতার করলো। তবুও ক্লাইমাস বললো,

আমি আসলে তোমাদের জেনারেল আবদুল করীমের সঙ্গে সাক্ষত করতে এসেছি। জানি, তোমরা আমার একথা বিশ্বাস করবে না। আমাকে শক্রদলের চর মনে করছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি স্পেনিশ আর্মিল লোক ছিলাম। এখন আর নই। সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। অবশ্য আমার বক্তব্যের পক্ষে কোন প্রমাণও নেই আমার কাছে।

ওরা সার্জেন্টের কথা বিশ্বাস করলো না। একজন তো বলেই ফেললো,

ওই বেটা! সাদা চামড়া। আর চাপা মেরো না। তোমরা ইউরোপীয়ানরা মিখা ছাড়া কথাই বলতে পারো না। তোমরা তো এদেশে এসেছিলে মারাকেশের নিরাপ চুক্তির অধীনে। এর অর্থ তো ছিলো আমাদের মারাকেশের মুসলমানদের জীবন হবে শান্তি-সুখের। কিন্তু তোমরা আমাদেরকে জাহান্নামের কীট বানিয়ে ছেড়েছে। আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে। ঘর-বাড়ি, টাকা-পয়সা, সুখ-শান্তি সব ছিনি। নিয়েছে। এখন দেখো তোমাকে আমরা কি করে জাহান্নামের কীট বানাই।

মুক্তিসেনাদের নিয়ম ছিলো, তাদের এলাকায় কোন গাদ্দার বা গুপ্তচর ধরা পড়লে তাকে জীবন্তু মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হবে। এজন্য তারা উপরস্থ কমান্ডারের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করতো না। সে নিয়ম অনুযায়ী তারা ক্যাম্পের কাছাকাছি একটা জায়গায় বড় করে গর্ত খুঁড়লো। এই গর্তের মধ্যে একজন মানুষকে সহজেই দাফন করা যাবে।

ঘটনাক্রমে সেখানে আবদুল করীমের নিকটস্থ এক কমান্ডার কোন এক কাজে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো। গর্ত খুঁড়তে দেখে সৈনিকদের কাছে ঘটনা জানতে চাইলো কমাণ্ডার। তাকে জানানো হলো, স্পেনিশ আর্মির এই গুপ্তচরের জন্য গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। কমাণ্ডার সার্জেন্ট ক্লাইমাসের বক্তব্য শুনলো। ক্লাইমাস সৈনিকদের যে কথা বলেছিলো তাকেও একই কথা বললো।

কমাণ্ডার তার কথা শুনে অনুভব করলো, তাকে আবদুল করীমের কাছে একবার নিয়ে যাওয়া উচিত। সে আসলেই গুপ্তচর হলে সেখানেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে। তা ছাড়া গুপ্তচর হলেও শক্ত জেরার মুখে মূল্যবান কোন তথ্যও তার কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে।

তাকে আবদুল করীমের সামনে উপস্থিত করা হলো। আবদুল করীম তাকে জিজ্ঞেস করলো,

কে তুমি? এদিকে এসেছো কেন? জানো না, এখানে ধরা পড়লে গুপ্তচরের অভিযোগে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।

আমার নাম ক্লাইমাস। সার্জেন্ট বললো, স্পেনীয় আর্মিতে সার্জেন্ট পদে ছিলাম। সার্জেন্ট হলেও মেজর কর্ণেলদের সঙ্গে আমার উঠাবসা ছিলো। কিন্তু আমাদের আর্মির লোকেরা এখানকার মুসলমানদের ওপর যে জুলুম অত্যাচার করেছে এবং দিন দিন তা যেহারে বেড়ে চলেছে, ওদের এই অমানুষিক পৈশাচিক আচার-আচরণ আমার বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছে। জীর্ণশীর্ণ মুসলমান বাচ্চাদেরকে স্পেনিশ অফিসারদের যেভাবে বেগার খাটাতে দেখেছি তা কোন পশুর পক্ষেও সম্ভব নয়। আট নয় বছরের ছেলে মেয়েদেরকে দিন রাত গাধার মতো খাঁটিয়ে এক বেলাও খাবার খেতে দেয় না ওরা।

কত বাচ্চাকে আমি না খেতে খেতে মরে যেতে দেখেছি।

নিষ্পাপ মেয়েদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে ক্ষতবিক্ষত করে গুলি করে মেরে ফেলে। যাকে ইচ্ছে তাকেই ওরা গুলি করে মেরে ফেলে। মুসলমানদেরকে ওরা মানুষই মনে করে না। ওদের যে হিংস্রতা ও পৈশাচিকতা আমি দেখেছি, তোমরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। তোমরা বাইরে থেকে ওদের যে অমানুষিকতার কথা শোনা তা খুব সামান্যই শুনে থাকো।

আমার হাতেও অনেক হিংস্র কাজ করানো হয়েছে। গত কয়েক রাত থেকে আমি ঘুমুতেও পারছি না। ক্ষুধার যন্ত্রণার ও বর্বর-পিশাচদের অত্যাচারে যে শিশুগুলো চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাদের রক্তাক্ত মুখগুলো আমাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না। আমার বিবেক আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। এত দিন পর আমার মৃত অনুভূতি-উপলব্ধি জেগে উঠেছে। আমাকে কুড়ে কুড়ে দংশন করছে। আমি এখন অনেকটা দিশেহারার মতো অবস্থায় পড়েছি। না হয় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এখানে আসার সাহস পেতাম না কখনো।

অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, যে ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মানুষের প্রতি দয়া, ভালোবাসা, সহমর্মিতা নেই সেটা কখনো সত্য ধর্ম হতে পারে না। আমাদের খ্রিষ্ট ধর্মে তো গড এর প্রতিও কাউকে বিশ্বাসী দেখা যায় না। তারা গীর্জা-চার্চ বানিয়ে রেখেছে মানুষকে দেখানোর জন্য। ওখানে কোন ইবাদত বা প্রকৃত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় না। যে পাদ্রীদের লোকেরা নিষ্পাপ বলে মনে করে তারা তো স্বার্থের সামান্য উপলক্ষ্যেই মিথ্যা বলে। মুসলমানদেরকে কি করে নাজেহাল করা যায়, কিকরে ধ্বংস করা যায়, তারা এ পরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। একেই তারা ইবাদত মনে করে। মুসলমানদের ব্যাপারে কেউ কোনো ভালো কথা বললে, তার মুখ চেপে ধরে। এভাবে পাদ্রী, যাযকরা খ্রিষ্টের অনুসারীদেরকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক হওয়ার শিক্ষা দান করেছে।

আমি শুনেছি তোমরা নাকি মালীলা থেকে এজন্য অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছো যে, শহর জয় করার পর সেখানকার ইউরোপীয় অধিবাসীদেরকে তোমাদের মুক্তিসেনারা নির্বিচারে হত্যা করবে। যা তোমাদের ধর্মে পাপ বলে মনে করে। অথচ তোমরা তা করলে আমরা খুব আশ্চর্যান্বিত হতাম না। কারণ, আমরা ইউরোপীয়ানরা যখন ওখান থেকে তোমাদেরকে বের করে দিয়ে তোমাদের ঘর বাড়িগুলো দখল করে নিয়েছিলাম, তখন আমরাও এর চেয়ে নির্মম আচরণ করেছিলাম তোমাদের সঙ্গে। আমি যে বাড়িটিতে থাকতাম, সেটাও কোন মুসলমানের বাড়ি। বাড়িতে একটা পুরনো কুরআন শরীফ পেয়েছিলাম। একবার ভেবেছিলাম সেটা ফেলে দেবো কিনা। কিন্তু মন সায় দিলো না। সেটা যত্ম করে আমার আলমিরার ভেতর রেখে দিলাম।

এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে এ কারণেই হয়তো গড আমার বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি কারণে মালীলা থেকে অবরোধ উঠিয়েছে সেটা শোনার পরই আমি আমাদের ধর্ম থেকে ফেরার হয়ে গেলাম। বহু কষ্ট করে অনেক অনুমান করে বের করেছি তোমাদের এ এলাকায় ক্যাম্প রয়েছে। আমি পায়ে হেঁটে এ পর্যন্ত পৌঁছেছি। এত মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ কিভাবে যে পাড়ি দিয়েছি তা জানি না। শুধু এতটুকু জানি, বিবেকের দংশনে কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

পাপের বিশাল এক পাহাড় আমার ওপর চেপে বসেছে। আমি সেটা নামাজে এসেছি। আমাকে সেই আলো দেখাও, যা আত্মজগতকে আলোকিত করে। যে আলো আমার ভেতরের অন্ধকারকে দূর করে দেবে। আর যদি আমাকে গুপ্তচর মনে করে মৃত্যুদণ্ড দিতে চাও, তবে আগে আমাকে মুসলমান বানিয়ে নিয়ে। যাতে আমি খোদার কাছে এমন পবিত্র মানুষ হয়ে পৌঁছতে পারি, যে তার সব পাপ থেকে তাওবা করে ধুয়ে মুখে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

তার কথাগুলো দারুণ হৃদয় ছোঁয়া ছিলো। সেখানে আবদুল করীমের সঙ্গে যে কমান্ডাররা ছিলো তাদের মনে কথাগুলো ভীষণ দাপ কাটলো। তবে আবদুল করীমের মতো এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টির এক কমান্ডার তার কথায় বেশ প্রভাবান্বিত হলেও সহসাই এ ফায়সালা করতে পারছিলো না যে, স্পেনীয় আর্মির এই সার্জেন্ট কোন গুপ্তচর নয়। বিচক্ষণ-দূরদর্শী কোন কমাণ্ডারের পক্ষে হঠাৎ করে কারো ব্যাপারে এমন নিশ্চিত ফায়সালায় পৌঁছা সম্ভব নয়। তাই আব্দুল করীম অনেকটা নির্বিকার কণ্ঠে বললো,

দেখো সার্জেন্ট! তুমি যা কিছু বলেছে, তা সত্য না মিথ্যা সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আশা কর আমরা কোন ইঙ্গিত পেয়ে যাবো তোমার আসল পরিচয় সম্পর্কে। এখন আমরা যা করতে পারি তা হলো, তোমার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করে দিতে পারি। তুমি এখন আমাদের নজরবন্দি অবস্থায় থাকবে।

তারপর আবদুল করীম নিজের সঙ্গেই রাখলো সার্জেন্ট ক্লাইমাসকে। কারণ সে গুপ্তচর না হলে তার কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়ার ছিলো। সে ক্ষেত্রে সে নিজেও কম মূল্যবান নয়। সে যেখানেই যেতো, যাই করতো তার ওপর সবসময় বার জোড় চোখ কঠিন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতো। সেটা এমন সন্তর্পণে যে, যে ছয়জন ছাড়া মুক্তিসেনাদের অনেক কমাণ্ডারও এ ব্যাপারে কিছু জানতো না।

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এটা প্রমাণিত হয়ে গেলো যে, সার্জেন্ট ক্লাইমাস কোনো গুপ্তচর নয়।

ক্লাইমাস স্পেনিশ ও ফ্রান্সীয়দের ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য দেয়। তাদের সেনাবিন্যাস ও বিভিন্ন গুপ্ত স্কোয়াডের ব্যাপারে অভাবনীয় অনেক বিষয় আ তার কাছ থেকে জানা যায়। আবদুল করীমের মনে হলো, আল্লাহ তাআলা তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ, এসব বিষয় কখনোই মুসলিম মুক্তিসেনারা জানতে পারতো না। এখন রণাঙ্গনের অনেক ক্ষেত্রে তড়িং ফায়সালা করাটা আবদুল করীমের জন্য সহজ হয়ে গেলো।

তারপর ক্লাইমাস গুপ্তচরবৃত্তির ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বও নিয়ে নেয় স্বেচ্ছায়। বেশ কয়েকটি নৈশ হামলায় দারুণ বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব দেখায়। ব্যক্তি হিসেবে ক্লাইমা খুব অমায়িক ও সদালাপী। মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। এজন্য অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ক্যাম্পের সবার কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। একদিন সে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয় এবং সবার সামনে মুসলমান হয়ে যায়। আবদুল করীম তার নাম রেখে দেয় হুজ্জুল আয়মান।

***

ইতিমধ্যে মারাকেশের মরু এলাকার কিছু মরুচারী গোত্র সরদার ও আবদুল করীমের মুক্তিসেনা দলে যোগ দেয়। এদের মধ্যে এক সরদার তো তার পুরো গোত্র ও পরিবারসহ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। এই সরদারের নাম সাজিদ পারহী। সাজিদ পারহীও বেশ সদালাপী মানুষ। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে হুজ্জুল আয়মানের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে।

হুজ্জুল আয়মান (সার্জেন্ট ক্লাইমাস) দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলো। ইসলাম গ্রহণের পর সে খুব নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়ে যায়। অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে তাকে ইসলামী বিধি-বিধান পালনে বেশ যত্নবান দেখা যায়।

এই মাস দুয়েকের মধ্যে তার দাঁড়িও বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। আগেই আয়মানকে বেশ সুদর্শন লাগতো। এখন ঘন চাপদাড়িতে আরো সুদর্শন লাগে।

গোত্র সরদার সাজিদ সারহীর কাছে হুজ্জুল আয়মানকে এতই ভালো লেগে গেলো যে, তাকে তার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলো। মুক্তি সেনাদের হেডকোয়ার্টার থেকে তার বাড়ি মাইল খানেক দূরে। সাজিদ সারহী আবদুল করীমকে একদিন বললো,

ভাই আবদুল করীম! তোমাদের এই নওমুসলিম হুজ্জুল আয়মানকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। আমি চাই ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে অতিথি হিসেবে রাখতে। ও আমাদের চেয়েও পাক্কা মুসলমান হয়ে উঠছে। ওর মতো একজন মানুষের সেবা করতে পারাও ভাগ্যের ব্যাপার।

এতো খুব ভালো প্রস্তাব! তোমার এ কথায় আমার ইসলামের প্রথম যুগের আনসার সাহাবীদের কথা মনে পড়ে গেলো। আনসার সাহাবীরা এভাবে মুজাহিরদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছিলেন। তবে হুজ্জুল আয়মান স্বতস্ফূর্তভাবে তোমার মেহমানদারি গ্রহণ করে কিনা সেটাও যাচাই করে নিয়ে। আবদুল করীম বললো।

সাজিদ সারহীর প্রস্তাবে হুজ্জুল আয়মানে প্রথমে তার বাড়িতে এভাবে যেতে মৃদু আপত্তি করলেও আবদুল করীমের কথায় তার সে আপত্তিও কেটে গেলো।

এখন দিনের বেলায় হুজ্জুল আয়মান ক্যাম্পে চলে আসে। কাজ শেষ করে বিকালে বা সন্ধ্যায় সরদার সারহীর বাড়িয়ে চলে যায়।

সাজিদ সারহীর একটি মাত্র মেয়ে সন্তান। জুমানা সারহী। অপরূপ সুন্দরী। নিজেদের মাতৃভাষা টুকটাক ইংরেজি, ফ্রান্স ও স্পেনিশ ভাষাও বুঝে। বলতেও পারে। তো জুমানা সাহরী বেঁকে বসলো। সে তার বাবা সাজিদ সারহীকে বললো,

বাবা! তুমি কিভাবে এক ইউরোপিয়ানকে ধরে নিয়ে এলে?

আহ মা! সাজিদ বললো, আস্তে কথা বলল।

এখান থেকে চিৎকার করে কথা বললেও ওই সাদা চামড়া আমার কথা শুনতে পাবে না। কারণ, সে এখন এখানে নেই। তোমাদের ক্যাম্পে ফিরে গেছে।

এই ছেলে তো এখন শুধু ইউরোপীয়ান নয়, সে মুসলমান হয়ে গেছে। সে স্পেনিশ আর্মির সার্জেন্ট ছিলো। আমাদের কমাণ্ডার আবদুল করীমের আদর্শ তাকে মুগ্ধ করে। এজন্য সে এখানে এসে মুসলমান হয়ে যায়।

কোন খাঁটি মুসলমানকে এভাবে স্থায়ী মেহমান হিসেবে আনতে পারলে না?

সেই ছেলে হুজ্জুল আয়মান শুধু খাঁটি মুসলমান না, আমাদের চেয়ে ভালো মুসলমান।

ছাই মুসলমান! আমরা জন্ম থেকে মুসলমান হয়েও খাঁটি মুসলমান হতে পারলাম না। আর সে দুদিনেই খাঁটি মুসলমান হয়ে গেলো! শোন বাবা! তোমার মনে রাখা দরকার, এ শোক খ্রিষ্টান ছিলো। এরা মুসলমানের চিরশত্রু। মুসলমানদের জন্য এরা বিষধ সাপের চেয়ে ভয়ংকর। সাপকে দুধ কলা দিয়ে পুষলেও সে সুযোগ পেলেই ছোবল মারে, দংশন করে। এই লোকও দেখবে এক সময় তার ফণা তুলে তোমাদেরকে ছোবল মারছে।

মানুষ আর সাপ কি এক মা! সাজিদ সারহী খুব নরম গলায় বললো, সাপের জন্মই হয় হিংস্রতা নিয়ে। আর মানুষ কল্যাণ ও শুভবার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তারপর মা-বাবা, পরিবার বা প্রতিবেশী কিংবা পরিবেশের কারণে সে মুসলমান, ইহুদী, খ্রিষ্টান বা অন্য কোন ধর্মালম্বী হয়। কেউ জন্ম থেকে মুসলমান হলেই খাঁটি মুসলমান হতে পারে না, তার ঈমান ও কর্মকাণ্ড ঠিক না করলে। দেকা যায় একজন মুসলমান সারা জীবন তার ঈমান আমল ঠিক না করার কারণে পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হতে পারে না। আবার একজন ঘার নাস্তিক বিশুদ্ধ ঈমান-বিশ্বাস নিয়ে মুসলমান হয়ে সঠিক নিয়মে ইবাদত-বন্দেগী করে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে খাঁটি মুসলমান হয়ে যেতে পারে অল্প সময়েই। মুসলমান বা খাঁটি মুসলমান হওয়া পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কোন বিষয় নয়। এটা কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। যেটা অধিকাংশ মুসলমানই অর্জন করতে পারে না। এ কারণেই আজ দুনিয়ায় সত্যিকার মুসলমানের সংখ্যা কমে গেছে।

দেখো না মারাকেশ সেই কবে দখলদাররা দখল করে নিয়েছে। কোন মুসলমান কি এতদিন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে? মুসলমানরা শুধু মারই খেয়েছে। যেন মার খাওয়াই মুসলমানদের কাজ! মুসলি নারীদের সম্ভ্রম লুটতে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব? এটা সম্ভব হয়েছে মুসলমানদের ঈমান অতি দুর্বল হওয়ার কারণে। আজ মুসলমানরা সবখান থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। ঈমান দুর্বল হওয়াতে এক মুসলমান আরেক মুসলমানের প্রতি কোন দায়বোধ করে না। কোন সহমর্মিতা পোষণ করে না। বিশ্বাস ও ভরসা রাখে না। এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে প্রতিপক্ষ মনে করে। যেমন তুমি এই বেচারা আয়মানকে সহ্য করতে পারছে না।

দেখো বাবা! তুমি আমার ঈমান দুর্বল বলতে পারো। আমল মন্দ বলতে পারো এবং আমাদের ঈমান যে খুব শক্তিশারী না তাও আমি স্বীকার করবো। কিন্তু একজন মুসলমানকে সহ্য করতে পারছি না একথা তুমি বলতে পারো না। আমি এত খারাপ মেয়ে নই। ওই লোককে তো সামনাসামনি দেখিইনি। দূর থেকে দেখেছি। তাও অনিচ্ছাকৃত। একজন মেয়ে হিসেবে তাকে দেখলে আমার মনে হয় যে কেউ পছন্দ করবে। কিন্তু কোন ইউরোপীয়ান দেখলে আমার মনে পড়ে যায়, মুসলমানদের প্রতি তাদের হিংস্র আচরণের কথা। তাই তুমি যত কথাই বলো মুসলমান হিসাবে তাকে আমার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। জুমানা সারহী বললো।

দেখো জুমানা! আমাদের কমান্ডার আবদুল করীম কী বলেছে জানো? সে সবসময়ই একথা বলে যে, এক মুসলমানের প্রতি আরেক মুসলমানের যদি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে, তাহলেই মুসলমানরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। আর এ সম্পর্ক গড়ে উঠবে একমাত্র ঈমান ও আমলের সূত্র ধরে। যখন মুসলমানদের মধ্যে এ জিনিসটা ছিলো, তখন মুসলমানরা বিশ্ব শাসন করেছে।

হাজার হাজার মাইল দূরের সেই ভারতের সিন্ধু থেকে এক অসহায় নারী চিঠি পাঠিয়েছিলো হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে। সেই মাজলুমা নারীর ডাক শুনে মুহাম্মাদ ইবনে কাসেম ছুটে এসেছিলেন ভারত বর্ষে। তারপর ভারতবর্ষ অর্থাৎ পুরো উপমহাদেশ জয় করেন। শুধু কি তলোয়ারের জোরে। অধিকাংশ বিজয়ই অর্জন করেছিলেন বিনা রক্তপাতে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু তখন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুহাম্মাদ ইবনে কাসেম যদি তাদেরকে হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়ার কারণে দূরে সরিয়ে দিতেন, বুকে তুলে না নিতেন, তাহলে কি অবস্থা হতো বিশ্ব মুসলিমের? তাই জুমানা! বুঝতে চেষ্টা করো। ইহুদী-খ্রিষ্টানরা আমাদের শত্রু ঠিক; কিন্তু তারা মুসলমান হয়ে গেলে আমাদের বন্ধু হয়ে গেলো।

***

সরদার সাজিদ সারহী এমনিতে বেশ আবেগী মানুষ। তবে একসময় ধর্মকর্মের খুব একটা মনোযোগী ছিলো না। আবদুল করীমের সান্নিধ্যে এসে তার জীবন আমূল পাল্টে যায়। এই চেতনা সে তার গোত্রের মধ্যে বিপ্লব আকারে ছড়িয়ে দেয়। এজন্য তার সঙ্গে তার গোত্রের লোকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিসেনায় যোগ দেয়। তবে আজ সাজিদ সারহীকে যেন কথায় পেয়েছে। তার মেয়ে জুমানা এটা বুঝতে পারলো। তাই তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

ঠিক আছে বাবা! তুমি যা বলেছে সবই ঠিক। তোমার সেই হুজ্জুল আয়মান সাহেবও ভালো মানুষ। তাকে আমি খাঁটি মুসলমান হিসেবে মেনে নিচ্ছি। তবে তাকে বুকে তুলে নিতে পারবো না। সে তোমার বুকেই থাক। একথা বলে ফিক করে হেসে ফেললো জুমানা। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

সাজিদ সারহী দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি তার বেশ জেদি হয়েছে। তবে ওর সুন্দর একটা মনও আছে। ইসলামের প্রতিও তার দায়বোধ আছে। কিন্তু আয়মানের প্রতি যে কেন এমন বিরূপ মনোভাব সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সাজিদ সারহী।

এর দুদিন পর রাতে এক স্পেনিশ চৌকিতে গেরিলা হামলার কথা। গেরিলা দলে সাজিদ সারহী ও হুজ্জুল আয়মানও নাম লিখিয়েছে। গভীর রাতে দলটি স্পেনিশ চৌকিতে আক্রমণ চালালো। চৌকিতে শতিনেক আর্মি ছিলো। চৌকির চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত কড়া প্রহরা বসিয়ে রেখেছিলো স্পেনিশরা। গেরিলা দলে স্পেনিশ চৌকির অনেক দূর থেকেই অতি নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে। এ কারণে প্রহরায় থাকা স্পেনিশ আর্মিরা টের পায়নি কিছুই।

টের পায় তখনই যখন পেছন থেকে ছোরা বা খঞ্জরবিদ্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। কিন্তু এরপর তো আর কিছুই করার কথা নয়। এভাবে একে একে সতের জন আর্মি প্রহরীকে নিঃশব্দে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে চৌকিতে হামলা চালায় গেরিলারা।

ভেতরের স্পেনিশ সেনারা তো জানে বাইরে নিশ্চিদ্র প্রহরার ব্যবস্থা আছে। কোন চিন্তা নেই। কিছু ঘটলে প্রহরীদের কাছ থেকে আগাম সংবাদ পেয়ে প্রস্তুত হয়ে যেতে পারবে। সেই ভেবে তারা নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছিলো। তাই ঘুমের তিনভাগের এক ভাগ সৈন্য খতম হয়ে যায়। যারা ঘুম থেকে জাগতে পারলো তারা চরম আতঙ্ক ও ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেলো। অনেকে সামলে উঠে লড়তে চেষ্টা করলো। কেউ কেউ আবার পালাতে চেষ্টা করলো।

পালাতে গিয়েও কিছু মারা পড়লো। যারা লড়তে চেষ্টা করলো, তারা এলোপাথারি গুলি ছুড়ছিলো। তাই তাদের গুলির টার্গেট নিজেদের লোকরাই হতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে অধিকাংশ স্পেনিশ আর্মিই নিজেদের প্রাণ নিয়ে পালাতে লাগলো।

হুজ্জুল আয়মান অর্থাৎ সার্জেন্ট ক্লাইমাস পলায়নরত এক স্পেনিশ অফিসারকে মাত্র যমের বাড়ি পাঠিয়েছে, অমনি তার কানে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠের এক চিৎকার। আওয়াজটা এসেছে ডান দিক থেকে। সেদিকে তাকিয়ে দেখলো, ত্রিশ পঁয়ত্রিশ গজ দূরে একটা তাবুর পেছন দিকে সাজিদ সারহীকে দুই স্পেনিশ ধরে রাইফেলের বাট দিয়ে মারছে।

আয়মান মুহূর্তের মদ্যে সেখানে পৌঁছে গেলো। গুলি না চালিয়ে একজনকে সজোরে কোমরে লাথি মারলো। লাথি খেয়ে ঘোত করে পড়ে গেলো সৈন্যটি। সঙ্গে সঙ্গে পাশের জনকেও একই কায়দায় লাথি চালালে। রাইফেল ফেলে সেও পড়ে গেলো। মাটিতে পড়েই দুই চিত্তার জুড়ে দিলো, ক্লামাসকে পাওয়া গেছে। ক্লাইমাসকে পাওয়া গেছে।

স্পেনিশরা ক্লাইমাস ফেরার হয়ে যাওয়ার পর তাকে জীবিত ধরতে অনেক চেষ্টা করে। তারপর ঘোষণা দেয়, যে তাকে জীবিত বা মৃত ধরতে পারবে, তাকে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।

এ কারণেই দুই স্পেনিশ মৃত্যুর মুখে পড়েও যখন ক্লাইমাসকে চিনতে পারলো, তখন দশ লক্ষ টাকার লোভ দুজনের মৃত্যুভয় দূর করে দিলো। তারা ক্লাইমাস বলে চিৎকার করতে লাগলো। অন্যান্য স্পেনিশ আর্মিরা তো যে যেভাবে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। কারো দিকে কারো কোন খেয়াল নেই। তবে দুজনের চিৎকার শুনে একজনকে দৌড়ে এদিকে আসতে দেখা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক লক্ষ করে গুলি চালালে ক্লাইমাস ওরফে আয়মান। দেরি না করে পড়ে থাকা দুজনকেও চিরদিনের জন্য চুপ করিয়ে দিলো।

তারপর রাইফেল রিলোড করে ককেয় মিনিট অপেক্ষা করলো কেউ এ দিকে আসে কি না। না, আর কেউ এলো না। তারপর মনোযোগ দিলো সাজিদ সারহীর দিকে। আর সাজিদ পড়ে আছে নিস্তেজ হয়ে। তার মাথা ও মুখ রক্তাক্ত। রাইফেল দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছে।

আয়মান ডাকলে তাকে সরদার…. সরদার! কি অবস্থা তোমার?

পানি… পানি.. আমার মেয়ে, জুমানা… তারপর তার কথা বন্ধ হয়ে গেলো।

আয়মান দ্রুত নাড়ি পরীক্ষা করলো। নাড়ি চলছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে। মশালের আবছা আলোয় সব দেখা যাচ্ছে। স্পেনিশ এই ক্যাম্পটি এখন মুক্তিসেনাদের গেরিলা ইউনিটের দখলে। জীবিত কোন স্পেনিশ আর্মিকে দেখা যাচ্ছে না। অগণিত স্পেনিশ আর্মির লাভ চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিছু আহত আর্মি গোঙাচ্ছে, কাতরাচ্ছে। গেরিলারা আহতদের উঠিয়ে নিচ্ছে। নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে এদেরকে সুস্থ করে তোলা হবে যুদ্ধবন্দি হিসাবে।

আয়মান এক গেরিলাকে ডেকে আনলো। দুজনে মিলে সাজিদ সারহীকে উঠিয়ে নিলো।

ক্যাম্পে এনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর সাজিদ সারহীর জ্ঞান ফিরে এলো। মাথার ডান দিকে কানের নিচে আঘাত করা হয়েছে। সে জায়গাটা প্রায় থেতলে গেছে। সেখান দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরছিলো। শল্য চিকিৎসক এক ধরনের পাউডার দিয়ে রক্ত ঝড়া বন্ধ করে দিলো। মুখেও ঔষধ দিলো। তারপর মধুযুক্ত দুধ পান করানো হলো। এতে সরদারের ফ্যাকাশে চেহারায় কিছুটা প্রাণ ফিরে এলো। সেখানে আবদুল করীমও ছিলো। আবদুল করীম হুজ্জুল আয়মানকে বললো,

আয়মান! সরদারকে তুমি বাড়ি নিয়ে যাও। তুমিও দুতিন দিন বিশ্রাম নিয়ে। সরকারের প্রতিও খেয়াল রেখো। ওর যখম মারাত্মকই বলা যায়। তবে ওর শরীর বেশ শক্ত। দেখছো না একটা চুলেও পাক ধরেনি! তাই আশা করা যায়, ওর যখম তাড়াতাড়িই শুকিয়ে যাবে। যখম শুকিয়ে গেলেও হপ্তাখানেক বিশ্রামে যেন থাকে।

আকি কাল বাদে পরশুও সুস্থ হয়ে যাবো। সরদারের দুর্বল কণ্ঠেও জযবার উত্তাপ টের পাওয়া গেলো। আমাকে নিয়ে ভেবো না কমান্ডার! স্পেনিশরা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গেছে। এটা শুধু মনে রেখো।

চমৎকার, চমৎকার সরদার! আবদুল করীম খুশি হয়ে বললো। তুমি পরশু কেন? আজই তো সুস্থ হয়ে গেছে। তবে সেটা মানসিকভাবে। দৈহিকভাবে সুস্থ হতে হপ্তা দেড়েকের কম লাগবে না। তাই ততদিন নিজের আবেগ-জ্যবাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।… আব্দুল করীম তারপর হুজ্জুল আয়মানের দিকে ফিরে বললো, আয়মান! আর দেরি করো না। সরদারকে বাড়ি নিয়ে যাও।

***

কি করে বাবার এ অবস্থা হলো? জুমানা তার বাবার মাথায় এত বড় ব্যাণ্ডেজ বাধা দেখে প্রায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যখম বেশি গুরুতর নয়। হপ্তাখানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। আয়মান নিচু স্বরে বললো জুমানাকে।

কারণ সাজিদ সারহীকে বিছানায় শোয়ানো মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। এটা ঔষধের প্রতিক্রিয়া।

জুমানা তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলো, তার বাবার এ অবস্থা কি করে হয়েছে? আয়মান সংক্ষেপে জানালো, গেরিলা হামলা ও সেখানে সরদারের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। ডাক্তার কি বলেছে, কি ঔষধ দিয়েছে এবং আবদুল করীম কী বলে দিয়েছেন সেসব কথাও বললো আয়মান। শুধু বাদ দিলো, সে যে নিজের একক প্রচেষ্টায় সরদারকে বাঁচিয়েছে সে প্রসঙ্গ।

জুমানা আরো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চোখমুখ ফুলে গেছে। উজ্জ্বল লাল আভা পুরো চেহারায় ছড়িয়ে পড়েছে। এতে তার মুখের স্বর্গীয় রূপ আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রূপের এমন নিষ্পাপ বৈচিত্র আয়মান মনে হয় আর কোন দিন দেখেনি। তার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো।

একবার তার কাছে মনে হলো, কারো সৌন্দর্যে এভাবে মুগ্ধ হলো প্রশংসাসূচক দুএকটা বাক্য তাকে বলতে হয়। পরক্ষণেই মনে হলো, এতো ইউরোপীয়ান রীতি। তার বাড়ি পশ্চিম জার্মানিতে। জার্মানিদের মধ্যে এ রীতির প্রচলন আছে। সে তো এখন মুসলমান। এ সুন্দরী অপ্সরীও একজন মুসলমান। তাকে কি বলা যায়? কিংবা আদৌ কিছু বলা উচিত কি না ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিলো না আয়মান। জুমানা তখনো তার বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার ফোলা চোখ দুটো ছলছলে।

আয়মানের তখনই মনে পড়লো, আরে তাকে তো এ ব্যাপারে পরিস্কার একটা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। সেটা চমৎকার এবং সবচেয়ে নিরাপদ সামাজিক রীতি। এর মধ্যে দারূণ মানষিক আবেদনও আছে। আছে শালীন-সভ্য আদর্শ।

সেটা হলো, কোন নারীর দিকে ইচ্ছে করে তাকাতে নেই। এমনকি নির্দোষ দৃষ্টিতে তাকাতে নেই। আর কাম-দৃষ্টিতে তাকানো তো সরাসরি পাপ। অসভ্যতাও। ইসলাম এক শালীনতা বিবর্জিত একটা অপরাধ বলে গণ্য করেছে। কোন নারীর দিকে চোখ পড়লে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া উচিত। দ্বিতীয়বার আর তাকানো উচিত নয়। প্রথমবার যে অনিচ্ছায় বা কোন বিশেষ প্রয়োজনে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে এটা দোষণীয় কাজ হিসাবে গণ্য হবে না। এজন্য পাপও হবে না। তবে দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করাটা দোষণীয় এবং এজন্য পাপও লেখা হবে।

হুজ্জুল আয়মানের একথাটা মনে পড়তেই তার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। সে সঙ্গে সঙ্গে জুমানার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।

এখন রাতের শেষ প্রহর চলছে। ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। সরদার অঘোরে ঘুমুচ্ছে। মুখেও যন্ত্রণার ছাপ নেই। এর অর্থ হলো, ঔষধ বেশ ভালো কাজ করেছে। এখন আর এখানে না থাকলেও চলবে। ডাক্তারের কথামতো সরদারের ঘুম দুপুরের আগে ভাঙ্গবে না।

ইয়ে… শুনুন! আয়মান ইতস্তত করে বললো জুমানাকে এবং অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে, আপনি গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি উনার পাশে বসছি। এখন আর উনি ঘুম থেকে উঠবেন না।

জুমানার চোখ এড়লো না, আয়মান তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেদহীন শরীর। ছয় ফিটের মতো লম্বা। বয়স কত হবে? ত্রিশ বত্রিশ। তার বাবার সামনে যখন দাঁড়িয়ে ছিলো আয়মান, তখনই জুমানা লক্ষ্য করেছে, একে নিঃসন্দেহে সুঠামদেহী সুপুরুষ বলা যায়। ইউরোপীয়ান হলেও দেহবর্ণ এতটা শ্বেতকায় নয় যে, চোখে রাগে। এর মধ্যে বাদামী বর্ণের ছোঁয়া আছে।

আয়মান যে জুমানার প্রতি সশ্রদ্ধ-সমপূর্ণ পরিবেশ রক্ষা করে ওভাবে দৃষ্টি আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে, এটা জুমানার কাছে ভালো লাগলো। তার মনের অজান্তেই কৃতজ্ঞতার একটা ধারা তাকে নাড়া দিয়ে গেলো। এই প্রথম তার মনে হলো, এ লোকটির প্রতিই এত দিন জুমানা এক ধরনের তাচ্ছিল্যের মনোভাব পোশণ করে রেখেছিলো। এটা মনে হয়, ঠিক ছিলো না। বেশি সময় এভাবে নিরুত্তর থাকাও যে ঠিক নয় এটাও তাকে তাড়া করলো। তাই খুব নরম গলায় বললো,

ইয়ে… আয়মান সাহেব! বরং আপনি গিয়ে শুয়ে পড় ন। আমি তো এতক্ষণ ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। আমার ঘুম প্রায় হয়ে গেছে। আপনি তো বড় ক্লান্ত। রাতভর লড়াই করেছেন। তারপর এমন যখমী একটা মানুষকে এতদুর বয়ে নিয়ে এসেছেন। ধকল তো কময় যায়নি। ফজর হতে এখনো বেশ সময় বাকি। এতটুকু সময় বিশ্রাম করুন গিয়ে। ততক্ষণ আমি এখানে বসে থাকি।

না, ধন্যবাদ! এখন ঘুমুলে ফজরের সময় আর উঠতে পারবো না। ঠিক আছে, আপনি এখানে বসে থাকুন। আমি বাইরে গিয়ে বসি। একথা বলতে বলতে আয়মান বাইরে চলে গেলো।

না, আপনি ভেতরেই বসুন। বাইরে কুয়াশা পড়ছে … এতটুকু বলে জুমানা বুঝতে পারলো ঘরের ভেতর সে লোকটি আর নেই। তার মুখ খোলর আগেই বাইরে চলে গেছে।

জুমানা চেয়ার থেকে উঠ আলতো পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। বাইরে উঁকি দিলো। ভোরের আবছা আলোয় দেখতে পেলো, ঘরের সামনের টিলার ওপর একটা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। মানুষটি বসে আছে। জুমানা আবার ঘরের ভেতর চলে গেলো। চেয়ারে বসে পড়লো। তার বাবা একটু নড়ে উঠলো এ সময়। পাশ ফিরতে চাচ্ছে। জুমানার সাহায্যে ঘুমন্ত অবস্থাতেই পাশ ফিরলো ডান দিকে। চোট পেয়েছে মাথার বাম দিকে।

জুমানা লক্ষ্য করলো, তার বাবার ঠোঁট দুটি নড়ছে। কিন্তু একটা বলছে হয়তো। তার মুখের কাছে জুমানার কান নিয়ে গেলো। তার বাবা বিড় বিড় করছে,

আয়মান। … আ… আ.. জু.. জুমানকে … দেখো… দুবার এমন বিড় বিড় করেই তার বাবা আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।

জুমানা বুঝতে পারলো, হামলার সময়ের ভয়াবহ কোন দৃশ্য মনে হয় স্বপ্নে হানা দিয়েছে। কিন্তু আয়মানের কথা যে বললো তার বাবা সেটার কারণ কী? তাহলে কি আয়মানই হামলাকারীদের হাত থেকে তার বাবাকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু আয়মান তো ঘটনা বলার সময় একবারও তার ভূমিকার কথা বলেনি! এর রহস্য কী?

***

বাইরের প্রকৃতি আলো আঁধারিতে বেশ বৈচিত্র্যময়। এর মধ্যে আবার কুয়াশার হালকা চাদর খণ্ড খণ্ড ভাবে চারদিক আলতো করে ঢেকে রেখেছে। গ্রীষ্মের শেষ দিক এখন। পাহাড়ি এলাকাহওয়াতে এখানে এভাবে এসময় কুয়াশা পড়ছে।

সরদারের বাড়িটি মাঝারি ধরনের একটি পাহাড়ের নিচে। এই পাহাড়ের আশেপাশেই তার গোত্রের লোকেরা বসবাস করছে। পাহাড়ের ডানে-বামে ও সামনের দিকে উঁচু নিচু বেশ কিছু টিলা রয়েছে। দুএকটি টিলা শিলাপাথরের। একেবারে ন্যাড়া, তৃণ লতাহীন। আর অন্যগুলো বৃক্ষলতার ছাওয়া। দারুন সবুজ। অপরূপ দৃশ। কুদরত যেন নিজ হাতে এখানে নিসর্গকে সাজসজ্জা পরিয়েছে। আয়মানের কাছে জায়গাটি বেশ লাগে।

বাড়ির সামনের একটি টিলার চূড়ায় গিয়ে বসলো আয়মান। এসময় এখানে এসে বসার কোন অর্থ নেই। আয়মান বসতেও না। আসলে একটু নির্জনতার ছোঁয়া পাওয়ার জন্য আয়মানের মন উসখুস করছিলো। গত কয়েক মাসে ওর জীবনে যা কিছু ঘটেছে গত একত্রিশ বছরের জীবনের অতীতের সঙ্গে যেন এর কোন তুলনাই হয় না।

স্পেনিশ কাম্প থেকে ফেরার হয়ে মুসলিম ক্যাম্পে আসা, এখানে এসে মুসলমান হয়ে যাওয়া, আবদুল করীমের সান্নিধ্যে নিজের স্পেনিশ আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করা। তারপর এই সরদার সাজিদ সারহীর সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্টতা, অবশেষে সরদারের আহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার মেয়ে জুমানার মুখোমুখি হওয়া- এসবকিছুই যেন ওর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।

আর এখন ওর মনে জুমানার অস্তিত্ব এসবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে। ওর আগের জীবন হলে জুমানা খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ছিলো না। কারণ আয়মানের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে সে রক্ষণশীল বলে পরিচিত ছিলে। মদ ও নারীর ব্যাপারে ও খুব সংযমী ছিলো। তারপরও ওর গোটা চারেক মেয়ে বন্ধু ছিলো। ওরাও কারো চেয়ে কেউ কম সুন্দরী ছিলো না। কিন্তু ওদের সঙ্গে জুমানাকে কোনভাবেই যেন মেলানো যায় না। হঠাৎ জলোচ্ছাস যেমন মুহূর্তেই সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে হঠাৎ করেই আবার নেতিয়ে পড়ে। ওদের প্রেম, ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস এমন হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসের মতোই।

আর জুমানাকে গভীর কোন জলপ্রপাত বা বিশাল কোন দীঘির সঙ্গেই তুলনা করা যায়। যার মধ্যে আনন্দময়ী তরঙ্গ আছে, উচ্ছ্বাস আছে, আছে প্রবাহের অবিরত ধারা।

আয়মান ভাবছে, যত কিছুই হোক এমন নির্জনে এবং সহানুভূতির একটা পরিবেশে এমন একটা মেয়েকে পেয়ে কেউ সুযোগ নিতে ছাড়তো না। কমপক্ষে দুটো ভালো লাগার কথাও বলতো। দীর্ঘ সময় তার সঙ্গ উপভোগ করতো। আয়মান যে তা করেনি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, এটা তার জীবনে একটা অভাবিত ঘটনা। সন্দেহ নেই, ইসলামই তার মধ্যে এই অমিত শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে।

আয়মানের মধ্যে হঠাৎই আরেক প্রশ্ন জেগে উঠলো, সরদারের বাড়িতে সরদার ছাড়া তার একমাত্র মেয়ে, একজন গৃহপরিচারিকা ও দুজন কাজের লোক- এ কজনই সদস্য। ওরা থাকে বারি বাইরে ভিন্ন কোঠায়। সরদার ও তার মেয়ে থাকে বাড়ির ভেতরে। আয়মানের জন্যও বাড়ির ভেতরই ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকগুলো রুম রয়েছে বাড়ির ভেতরেও। এখানে একজন কেন নিয়মিত কয়েকজন অতিষি এতে থাকতে পারে। কিন্তু এমন একটা মেয়ে থাকতে আয়মানের কি এখানে একা একা থাকাটা ঠিক।

অবশ্য ওর প্রতি সরদারের শতভাগ আস্থা আছে। কিন্তু ওর নিজের প্রতি নিজের আস্থা কতটুকু? না, ওর আর এখানে এভাবে থাকাটা ঠিক হবে না। সরদারের অবস্থা একটু ভালো হলেই ও ক্যাম্পে থাকা শুরু করবে।

***

বেলা এগারটা নাগাদ সরদারের ঘুম ভাঙ্গলো। জুমানা তার বাবার মাথার কাছের চেয়ারে বসা ছিলো। তার বাবাকে নড়তে দেখে এবং চোখ খুলে তাকাতে দেখে উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো,

বাবা! এখন কেমন লাগছে জুমানা বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেললো।

ঘাড়ডিয়োনা বেটি। আমি এখন অনেকটাই সুস্থ। শুধু মাথার বাম দিকটা একটু চিনচিনে ব্যথা আছে। বলতে বলতে সরদার উঠে বসলো।

আরে উঠছো কেন? যখমের ক্ষতি হবে তো?

 কিছুই হবে না মা! শোয়র চেয়ে বেস থাকতেই ভালো লাগছে।

জুমানা লক্ষ্য করলো, আসলেই তার বাবাকে এখন অনেকটাই সুস্থ লাগছে। আগেই স্যুপ বানিয়ে রেখেছিলো। সেটা যত্ন করে তার বাবাকে খাইয়ে দিলো। তারপর দুধ মধু মিশ্রণে ঔষধ খাইয়ে দিলো।

বাবা! এখন কি একটু ভালো লাগছে।

হা মা! এখন বেশ চাঙ্গা বোধ করছি। জুমানা! আয়মান কোথায়?

সম্ভবত ক্যাম্পে চলে গেছে।

সেকি ওকেও তো কমান্ডার দুএকদিন বিশ্রামে থাকতে বলেছে। তাহলে ক্যাম্পে চলে গেলো কেন? তুমি ওর সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেছো?

সে কি বাবা! আমাকে তুমি এত অভদ্র মেয়ে মনে করো? আহত গলায় বললো জুমানা।

না, মানে তুমি একদিন ওর ব্যাপারে অনেক অভিযোগ করেছিলে।

তখন তো ওর ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। তা ছাড়া আজ তো আর কোন অভিযোগ করিনি।

তাহলে মা! এখন ওর ব্যাপারে কি জানতে পেরেছে?

কেন তুমিই তো সেদিন ওর ব্যাপারে লম্বা বক্তৃতা দিলে। আর কাল রাতে ও যে যত্ন নিয়ে তোমাকে এখানে এনে শুইয়ে দিয়েছে, তোমার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করেছে এবং আন্তরিকতা দেখিয়েছে এটা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, উনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। শেষের কথাগুলো জুমানা লাজুক কণ্ঠে বললো।

হ্যাঁ, আমি অনুমান করেছিলাম তুমি নিজেই একদিন ওর ব্যাপারে প্রশংসার সার্টিফিকেট দেবে। সরদার সাজিদ সারহী খুশি হয়ে বললো, কিন্তু আসল ঘটনা শুনলে না জানি কোন সার্টিফিকেট দেবে।

আসল ঘটনা? জুমানা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, ঘটনা হলো, কালকের গেরিলা হামলায় যদি আয়মান না থাকতো এবং ঘটনাস্থলে বিদ্যুত্রে মতো ছুটে না যেতো তাহলে হয়তো তোমার বাবা লাশ হয়ে যেতো।

বলো কি বাবা! বিস্ময়-আতঙ্কে জুমানার চোখ স্থির হয়ে গেলো।

একে তো রাতের অন্ধকার সরদার সাজিদ সারহী আবার বলতে শুরু করলো, মশালের আলোয় কাছের জিনিসই তো আবছা দেখা যায়। দূরের জিনিস কুব কমই ঠাহর করা যায়। তারপর আবার আমার সাথী সঙ্গীরা লড়াইয়ে ব্যস্ত। কারো দিকে তো কারো কোন মনোযোগ থাকার কথা নয়। হঠাৎ আমার ওপর দুই স্পেনিশ আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই মাথায় আঘাত করলো সম্ভবত রাইফেল দিলে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেলাম। মনে হয়েছিলো মাথাটা যেন চৌচির হয়ে গেছে। সারা দুনিয়া ঘুরতে লাগলো। এ সময়ই সেখানে আয়মান উপস্থিত হলো। কিন্তু ইতিমধ্যে আরো কয়েকটি আঘাত খেয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। তারপর আয়মান আমাকে কিভাবে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে, কি করে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে, এর কিছুই মনে নেই।

… আহা ছেলেটাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে পারলাম না।

ধন্যবাদ তো আমিও দেইনি। জুমানা বললো, ঘটনা আমাকে উনি বলার সময় তো উনার নামটি একবারও বলেননি। বাবা! সত্যি কথা বলতে কি তোমাকে বাঁচানোর চেয়ে এভাবে নিজের কথা চেপে রাখার ব্যাপারটি আমার কাছে অনেক বেশি বিস্ময়কর লাগছে। এ ব্যাপারটি আকামে অভিভূত করেছে।

এ ধরনের ছেলেরা অন্যের বিপদে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে সহজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটা যে কত বড় বীরত্বপূর্ণ ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজ সেট আর ওরা মনে রাখে না। নয়তো এ কারণেই আমাকে বাঁচানোর ব্যাপারটি এ কাছে মামুলি ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই র নামটিও তোমাকে বলা প্রয়োজন বোধ করেনি।

***

আরে তুমি এখন ক্যাম্পে কেন? আবদুল করীম হুজ্জুল আয়মানকে ক্যাশে দেখে বললো। তোমাকে তো কাল পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে বলা হয়েছে। গতকাল যারা নৈশ হামলায় ছিলো তাদের সবার জন্য একই ব্যবস্থা। যাও, তুমিও বিশ্রাম কারো গিয়ে।

না, মানে ওখানে ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম ক্যাম্পে এসে একটু ঘুরে যাই।

আরে এত দিন ভালো লাগলো আজ আবার কি হলো? ঠিক আছে ক্যাম্পেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। বিকালে সরদারে বাড়ি চলে যেয়ো। যতটা সম্ভব বিশ্রাম নিয়ে শরীর ঝরঝরে রাখতে হবে। হয়তো এমনও সময় আসবে যে, মুহূর্তের জন্য দুচোখ এক করার সুযোগ পাবে না।

আয়মান কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবদুল করীম অন্য সেনাদের দিকে মনোযোগ দিলো।

সরদারের বাড়িতে আয়মান সন্ধ্যার দিকে ফিরলো। সরদারের ঘরে জুমানা বসা ছিলো। আয়মানের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্য ঘরে চলে গেলো। আয়মান সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলো।

এখন কেমন আছেন সরদার? আয়মান ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলো।

এসো, বেটা! বসো এখানে। সরদার শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বললো, এখন বেশ ভালো আছি। দুপুরের দিকে মাথায় একটা চিনচিনে ব্যথা ছিলো। এখন সেটাও নেই। শুধু চাপ লাগলে ব্যথা করে। শরীরের দুর্বলতাও খুব একটা নেই। কালকের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেতে পারবো। তা তুমি কি ক্যাম্পে গিয়েছিলে? তোমার ন আজ বিশ্রামে থাকার কথা! না কি এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে।

না, শুয়ে বসে থাকতে কত ভালো লাগে? তাই ক্যাম্প থেকে ঘুরে এলাম। আর এখানে থাকতে অসুবিধা কি হবে? আপনাদের যত্ন ও আন্তরিকতায় বেশ সুখেই আছি। আরামে থাকতে থাকতে বরং শরীর ভারি হয়ে গেছে। একজন সৈনিকের জীবনে এত আরাম আয়েশ থাকা ঠিক নয়। আর অনেক দিন থেকেই তো আপনার এখানে রইলাম। অনেক জ্বালাতন করেছি এতদিন। তবে আজীবন আপনাদের আতিথেয়তার কথা মনে থাকবে।

কারো কারো জ্বালাতন অনেক সময় মধুর চেয়ে ভালো লাগে। বুঝলে আয়মান! এমন মধুর জ্বালাতন আমরা সবসময় উপভোগ করতে চাই। সরদার রহস্যময় কণ্ঠে বললো।

মধুর জ্বালাতন? কথাটার মানে কি?

সব কথার মানে না বুঝলেও চলবে। ওহ, রাখো আমার একটা কাজ আচে। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। সময় হলে আমি তোমাকে ডাকবো। এখন যাও।

আয়মান ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সরদার লোক মারফত গোত্রের কয়েকজনকে ডেকে বললো, আমাদের ক্যাম্পে চলে যাও। কমাণ্ডার আবদুল করীমকে সালাম জানিয়ে বলবে, আজ রাতে যদি উনি এখানে একটু সময় নিয়ে আসেন তাহলে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।

ওরা বেরিয়ে যেতেই সরদার তার মেয়ে জুমানাকে ডাকলো। জুমানা পাশের ঘরেই ছিলো এতক্ষণ।

আয়মানের সঙ্গে এতক্ষণ যে কথাবার্তা হয়েছে তা তুমি নিশ্চয় শুনেছো। সরদার বললো।

হ্যাঁ বাবা! শুনেছি আমি। কিন্তু তুমি সেটা বুঝলে কি করে? জুমানা বললো।

আমি সেটা না বুঝলে এত বড় গোত্রের সরদার করি কি করে? এখন আমি কি করতে যাচ্ছি তুমি নিশ্চয় সেটা বুঝতে পারছে। সরদার মেয়ের দিকে ঝুঁকে এসে বললো।

হয়তো বুঝতে পারছি।

তোমার কি এতে ভিন্ন কোন মতামত আছে? কিংবা কোন আপত্তি?

বাবা! তুমি নিশ্চয় জানো তোমার মতামতই আমার মতামত। তবে আমার জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি কি এক তরফা এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছো? উনার সঙ্গে তো মনে হয় এ ব্যাপারে কোন আলাপ করোনি। যতটুকু শুনেছি উনি তো আমাদের এখানে থাকতেই অনীহা দেকাচ্ছিলেন।

শোন মা! আয়মানের এই অনীহাকেই আমি সম্মতি বলে ধরে নিচ্ছি। আর ওর সঙ্গে সরাসরি কতা না হলেও চোখে চোখে এবং মনে মনে কথা হয়ে গেছে। আশা করি আমার ও তোমার উভয়ের ধারণার চেয়ে ওকে তুমি অনেক অলে সঙ্গী হিসেবে পাবে।

জুমানার মুখখানি লাল হয়ে উঠলো, চোখ দুটো হয়ে উঠলো অশ্রুসিক্ত। আলতো করে ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠলো। কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না।

***

ঘন্টা তিনেক পরের ঘটনা। কমান্ডার আবদুল করীমসহ গোত্রের অন্যান্য গণ্যমান্য লোকদের উপস্থিতিতে হুজ্জুল আয়মান ও জুমানার মধ্যে বিয়ে পরিয়ে দেয়া হলো। সরদার সাজিদ সারহী এই বিয়ে হওয়াতে এত খুশি হলো যে, কেঁদে ফেললো। আবেগৰুদ্ধ কণ্ঠে বললো,

তোমরা সবাই জানো, এ আমার আনন্দ-অশ্রু। আমার এই পার্থিব জীবনের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ হয়ে গেছে। শুধু একটা চাওয়াই বাকি আছে। একটা স্বপ্নই অপূর্ণ রয়ে গেছে এখনো। সেটা হলো মারাকেশের স্বাধীনতা। আল্লাহ তাআলার কাছে আমার এখন একটাই প্রার্থনা, শহীদ ও গাজী মুক্তিসেনাদের জান বাজি লড়াইয়ের বিনিময়ে যেন মহান আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতা দান করেন। এখন আর আমার কোন পিছুটান নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবো।

সবাই জয়ধ্বনি করে উঠলো। কেউ কেউ তকবীর ধ্বনিও দিলো।

প্রিয় ইসলামের সৈনিকরা! মুক্তিকামী যোদ্ধারা! আবদুল করীম দাঁড়িয়ে বললো, যেখানেই ইসলামের আবেদন পুর্ণাঙ্গভাবে চর্চার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেই মুসলমানদের মধ্যে দান করা হয়েছে ঐক্যের শক্তি। আজ দেখো, আমরা লড়াইয়ের রক্তাক্ত ময়দানে থেকেও হাসতে পারি। যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যেও ভালোবাসা ও প্রেমের পরম সৌধ নির্মাণ করতে পারি আমরা। এই আয়মান ও জুমানার বিয়েটাও এরই জ্বলন্ত প্রমান…।

বন্ধুরা! মনে রেখো, আমাদের এ ঐক্য যদি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারি তাহলে আমরা ঐ বিজাতীয় দখলদারদের কবল থেকে একদিন না একদিন ইনশাআল্লাহ মারাকেশ স্বাধীন করতে পারবো। এটা ঠিক যে আমাদের সৈন্যবল, অস্ত্রবল সব কিছুই ওদের তুলনায় বলা যায় হাস্যকর। কিন্তু এক আল্লাহর প্রতি আমাদের ঈমান-বিশ্বাস বহুগুণ বেশি। এই প্রদীপ্ত বিশ্বাসের গৌরবই বিজয়ের মাল্য পরিয়ে একদিন আমাদেরকে গৌরাবাৰত করবে। নারায়ে তাকবীর- আল্লাহ আকবার।

সরদার সাজিদ সারহী ঘোষণা দিলেন, আগামীকাল দুপুরে এই গোত্রের সবার এবং সব মুক্তিসেনাদের ওলিমার দাওয়াত।

আয়মান ও জুমানা বাসর রাতে যে অনাগত সন্তানের স্বপ্লবীজ রোপন করেছে, সে সন্তানকে তারা উৎসর্গ করলো মারাকেশের স্বাধীনতার নামে।

***

আবদুল করীম ও তার মুক্তিসেনাদের খ্যাতি এখন আর মারাকেশেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আবদুল করীমের বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বৃটিশরা তাকে গোপনে অস্ত্র ও সনাসাহায্য দেয়ার প্রস্তাব করে। জার্মানিও একই ধরনের প্রস্তাব পেশ করে। ইউরোপের আরো কয়েকটা দেশ নানান ধরনের প্রলোভন দেখায়। কিন্তু আবদুল করীম এসবই কৌশলে প্রত্যাখ্যান করে।

কারণ, আবদুল করীম জানতো, এরা কেউ বন্ধু নয়। বন্ধুবেশে এরাও মারাকেশ দখল করতে চায়। তার একমাত্র নির্ভরতা ছিলো আল্লাহ তাআলা ও তার অমিত আত্মবিশ্বাসের ওপর মুক্তিসেনাদের মধ্যে এমন কিছু লোক পাওয়া গেলো, যারা প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রিক্যাল বস্তুসামগ্রী বানাতে সিদ্ধহস্ত ছিলো। তারা শত্রুপক্ষের অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম দেখে দেখে সেগুলো নিজেরা তৈরি করতে লাগলো। হাতবোমা, গ্রেনেড, শটগান, রাইফেল, এলএমজি, ক্লাশিনকোভ জাতীয় অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম এই এক্সপার্টরা বানাতে শুরু করলো। এতে তাদের প্রাথমিক অস্ত্র স্বল্পতার সমস্যা কিছুটা লাঘব হলো। তবে মুক্তিসেনারা সেসব অস্ত্রই বেশি ব্যবহার করতো যেগুলো স্পেনিশদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে। তারপরও আব্দুল করীম মুক্তিসেনাদেরকে সবসময় অস্ত্র তৈরিসহ বিভিন্ন শৈল্পিক কাজে উৎসাহ দিতো। আব্দুল করীম তাদেরকে বলতো,

তোমরা অন্যের জিনিসের ওপর নির্ভর করে থেকো না। তোমাদেরকে যারা সাহায্য করবে তারা কোন না কোনভাবে এর চেয়ে দ্বিগুণ বিনিময় তোমাদের থেকে আদায় করে নেবে। হতে পারে, এর বিনিময়ে তোমাদের থেকে তোমাদের স্বাধীনতার চেতনাই ছিনিয়ে নেবে। কিংবা ছিনিয়ে নেবে তোমাদের থেকে তোমাদের বুকে আগলে রাখা ঈমানের দীপ্তি।

চৌদ্দ বছরের এক ছেলে তো মুক্তিসেনাদের দূরদূরান্তের ক্যাম্পগুলোর মধ্যে টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থা করে ফেললো। শত্ৰুদলের বিভিন্ন সেনা চৌকি ও ফৌজি কাফেরার ওপর হামলা করে করে মুক্তিসেনারা অনেক যুদ্ধ। সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। এর মধ্যে অসংখ্য ক্যাবল টেলিফোন তার ও অসংখ্য টেলিফোন সেটও ছিলো।

মুক্তিসেনাদের জন্য এ জিনিসগুলো বেকার ছিলো। কারণ, তারা এই ব্যবহার জানতো না। কিন্তু চৌদ্দ বছরের এক ছেলে এগুলোকে মহামূল্যবান করে তুললো। সে টেলিফোন সিস্টেমের খুঁটিনাটি বিভিন্নভাবে শিখে নিলো। তারপর বহু কষ্ট করে ব্যাটারীরও ব্যবস্থা করলো। এরপর শক্তিশালী কিছু সৈনিকের সাহায্যে মাটির নিচ দিয়ে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে টেলিফোন সিস্টেম চালু করে দিলো।

এতে আবদুল করীম ও তার জানবার্য দলের জন্য দারুন সুবিধা হয়ে গেলো। তারা জায়গায় বসে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা পেয়ে যেতো। অনেক সময় বাঁচতে এবং দুশমনের ওপর হামলাগুলোও হতো দারুন সময়োপযোগী ও কঠোর। কিছু দিনের মধ্যে টেলিফোন সিষ্টেমকে এমন সক্রিয় করে তোলা হলো যে, যেখানেই প্রয়োজন হতো মুক্তিসেনারা সেখানেই টেলিফোন সিষ্টেম চালু করে নিতো।

মুক্তিসেনাদের হামলা, নৈশ হামলা ও গেরিলা হামলা এত ঘন ঘন ও তীব্রতর হয়ে উঠলো যে, শহর থেকে দূরের স্পেনিশ ফৌজের চৌকিগুলো সব খালি হয়ে গেলো। এসব চৌকির অধিকাংশ আর্মিই মারা গেলো। এই চৌকিগুলো শূন্য হওয়ায় স্পেনিশদের জন্য দূরদূরান্ত পর্যন্ত রসদ পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়লো। কারণ স্পেনিশদের রসদবাহী গাড়িগুলো মুক্তিসেনারা খুব সহজেই ছিনিয়ে নিতো।

এমনকি শহরগুলোতেও স্পেনিশ পৌজের পক্ষে টিকে তাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক শহরের অধিকাংশ শহরবাসীই মুক্তিসেনাদের পক্ষে নেয়া শুরু করলো। অথচ এটা ছিলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থা নেয়া ও সরকারকে অসহযোগিতা করার মতো মারাত্মক অপরাধ। এই ঝুঁকি সত্ত্বেও শহরে লোকেরা স্পেনিশদের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিসেনাদের পক্ষে কাজ করতে শুরু করলো।

সব জায়গাতেই স্পেনিশরা এমন কোনঠাসা হয়ে গেলো যে, স্পেনিশদের শাসন কার্যত খতম হয়ে গেলো। মুক্তি সেনাদের শাসন চলতে লাগলো স্পেনিশ অধ্যুষিত মারাকেশে। কাগজের খাতায় শুধু স্পেনিশদের শাসনকার্য ছিলো। যেটার দুপয়সারও মূল্য ছিলো না। এটা ছিলো আসল মুক্তিসেনাদের সুস্পষ্ট বিজয়।

এখানে যত সহজে বলা হচ্ছে এ বিজয়ের কাহিনী এত সহজে রচিত হয়নি। হাজার হাজার মুক্তিসেনাদের শাহাদাতবরণ করতে হয়েছিলো।

অসংখ্য নৈশ গেরিলা হামলা চালানো হয়েছিলো। এর প্রতিটি হামলায় একাধিক মুক্তিসেনা শহীদ হয়েছে। আহত হয়েছে অনেক। এর মধ্যে কারো কারো এক বা একাধিক অঙ্গহানিও ঘটেছে। মুক্তিসেনাদের মধ্যে কমবয়সী ছেলে-মেয়েও ছিলো। এদের মধ্যে যারা শত্ৰুদলের হাতে ধরা পড়তো তাদের এমন পৈশাচিক কায়দায় শাস্তি দেয়া হতো যে, তা দেখে অনেক স্পেনিশ সৈনিক আর্মি ছেড়ে চলে গেছে, না হয় নিজেদের ধর্মত্যাগী হয়েগেছে।

এসব ছেলে-মেয়ের পরিবারের লোকদেরকেও ক্ষমা করা হতো না। ঘরের নারী শিশুদেরকেও প্রহার করা হতো, অপদস্থ করা হতো। আর যুবতী মেয়ে থাকলে তো ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যেতো, তাদের দেহের রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ঝড়িয়ে ঝড়িয়ে ওদেরকে মারা হতো।

মারাকেশের বালুকণা মুক্তিসেনা ও তাদের পরিবার-আপনজনদের রক্তে কর্দমাক্ত হয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে স্পেনিশ ফৌজের হাড়গোড়ও মরুভূমিতে তুপিকৃত হতে থাকে।

মারাকেশ এভাবে তার বন্ধু ও শত্রুদের রক্তে ডুবে যায়। এভাবে স্পেনিশদের দখলকৃত মারাকেশের পরাধীন এলাকাগুলো স্বাধীন হওয়ার পূর্ণাঙ্গ পথে রূপান্তরিত হয়। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার বাকি।

***

দীর্ঘ গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত হওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন। এসময় আবদুল করীম রণাঙ্গনীয় এক কৌশলগত ভুল করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এ সময় তার উচিত ছিলো, স্পেনিশ অধ্যুষিত এলাকা ও শহরগুলোতে নিজেদের পূর্ণাঙ্গ দখলদারিত্ব নিশ্চিত করা। সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং সুশৃঙ্খল সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিজেদের বিজিত এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া। এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠতো নিজেদের স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা, স্বাধীন রাষ্ট্র এবং মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিক সত্ত্বা।

স্পেনিশদের পিছু হটিয়ে এবং নিজেদের বিজয় সুনিশ্চিত হওয়ায় আবদুল করী ও তার সেনাদের মনোবল এতই বেড়ে গেলো যে, কিছু বাস্তবতা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো। তাদের জযবা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়লো। তারা এবার ফ্রান্সীয় ফৌজের ওপর হামলা শুরু করলো।

ফ্রান্সীয়দের ওমর হামলার ব্যাপারে নৈশ ও গেরিলা হামলার কৌশলও অবলম্বন করলো। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে স্পেনিশদের বিরুদ্ধে এরা সফল হয়েছে দারুনভাবে। কিন্তু ফ্রান্সীয়রা স্পেনিশদের এই পরিমাণ দেখে আগ থেকেই ভিন্ন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। তাদের তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক শক্তিশারী করে রাখে। জবাবী হামলার ব্যবস্থাও করে রাখে। এছাড়াও ফ্রান্সীয়রা সৈন্যবল ও অস্ত্রবলে স্পেনিশদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলো। মারাকেশের দখলকৃত এলাকাও ছিলো বেশি।

এর বিপরীতে মুক্তিসেনাদের সংখ্যা যেমন ছিলো কম, অস্ত্রশস্ত্র ছিলো আরো কম এবং উপায়-উপকরণও ছিলো সীমিত।

এত কিছুর পরও মুক্তিসেনাদের গেরিলা অপারেশন এতই সফল হলো যে, ফ্রান্সীয়রা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো। কারণ, ওরা যতই প্রস্তুতি নিয়ে রাখুক গেরিলা হামলায় তো এরা অভিজ্ঞ ছিলো না মোটেও। আর মুক্তিসেনারা প্রত্যেকেই চিলো গেরিলা অপারেশনের বিশেষজ্ঞ। দেখা গেলো, এই গেরিলা অপারেশনের কারণে ফ্রান্সীয়দের হাত থেকে অনেকগুলো চৌকি ছুটে গেছে।

কোথাও কোথাও তো ফ্রান্সীয় আর্মির সঙ্গে মুক্তিসেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষও হয়েছে। কিন্তু সেসব জায়গায় মুক্তিসেনাদের চরম আক্রোশ ও তীব্র হামলার সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।

ফ্রান্সীয়দের জেনারেল এখন লাইটে। লাইটে অতি চতুর জেনারেল ছিলেন। জেনারেল লাইটে মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে মারাকেশের সেসব গোত্র সরদারদের ব্যবহার করতে চাইলো, যাদেরকে বহু টাকা-পয়সা, জায়গীর ও সুন্দরী নারীদেরকে দিয়ে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিলো। জেনারেল লাইটে চাচ্ছিলেন এই সময় গোত্রগুলো যেন মুক্তিসেনাদের পক্ষে কাজ না করে।

এক সরদার তার গোত্রের সবাইকে বলে দিলো, তারা যেন ফ্রান্সীয়দের সঙ্গ দেয়। তাদের পক্ষে কাজ করে। কারণ মুক্তিসেনা নামের ঐ মুসলমানগুলো ডাকাত, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী। পরদিনই সেই সরদারের লাশ এমন বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো যে, তার দুই পা, দুই হাত ও মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এদিক-ওদিক পড়ে ছিলো। আর সেগুলো কাড়াকাড়ি করছিলো শৃগাল, কুকুর।

অন্যসব সরদারকে কালো খামে করে এই পয়গাম দিলো,

তোমরা নিশ্চয় তোমাদের এক সঙ্গীর পরিণাম দেখেছো। মনে রেখো, তার দেহ থেকে তার পা দুটি ও বাহু দুটি তখনই কেটে পৃথক করা হয়েছিলো যখন সে জীবিত ছিলো আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে তার মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যে এটা উপভোগ করতে চাও, সে সাহস করে একবার মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে বলেই দেখো না।

এরপর আর কোন সরদার ফ্রান্সীয়দের সঙ্গ দিতেও কাউকে বলেনি এবং মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি। এমনকি গোপনেও নয়।

ফ্রান্সীয়রা যখন দেখলো তাদের এ কৌশলও ব্যর্থ হয়েছে, তখন তারা স্পেনিশদের কাছে এ প্রস্তাব পাঠালো, মারাকেশের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এবং বিদ্রোহী মুক্তিসেনাদের উৎখাত করার এখন একমাত্র উপায় হলো, ফ্রান্স ও স্পেনের সম্মিলিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। সম্মিলিতভাবে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া।

স্পেন নিজেদের চরম পরাজয় থেকে বাঁচানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাব লুফে নিলো। এর আগে কিন্তু ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে মিত্র সম্পর্ক ছিলো না। তাদের মধ্যে শীতল সম্পর্ক ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে এ দুই দখলদার দেশ সম্মিলিত কার্যক্রম শুরু করে দিলো।

ওদিকে ফ্রান্স জেনারেল লাইটেক কমান্ডিং দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে মার্শাল পেটীনকে মারাকেশ পাঠালো। বৃদ্ধ মার্শাল পেটীন ছিলেন সর্বস্বীকৃত যুদ্ধগুরু। তার মতো এমন অভিজ্ঞ, তীক্ষ্মধারী কমান্ডার ফ্রান্স ও স্পেনে একজনও ছিলোনা। স্পেনও আরেক মার্শাল পাঠালো মারাকেশে। তার নাম মার্শাল প্রেমোদী রিভার। ইনিও ছিলেন অতি দক্ষ যুদ্ধবাজ নেতা।

এরা উভয়ে উভয়ের বাহিনীকে এক ছাউনিতে নিয়ে এলো। সম্মিলিত হাইকমান্ড হিসেবে তাদেরকে প্রস্তুত করে তোলা হলো। দুদেশই আরো অধিক সংখ্যক সেনা পাঠিয়ে দিলো। শুধু তাই নয়, ফ্রান্স তো যুদ্ধ বিমানও পাঠিয়ে দিলো মারাকেশে। আর পাঠালো বিমাল কামান বহর। যুদ্ধ বিমান ও কামানবহর মুক্তি সেনাদের জন্য ভয়ংকর অস্ত্র ছিলো।

তবে মুক্তিসেনারাও শত্রুর সেনাবিন্যাস অনুযায়ী নিজেদের সেনাবিন্যাস বদলে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে খোলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখলো। ওদিকে গেরিলা ও কমান্ডো অপারেশনও অব্যাহ রাখলো। এই গেরিলা ও কমান্ডো অপারেশন চালিয়ে মুক্তিসেনারা ফ্রান্সীয়দের রসদ সরবরাহের পথগুলো বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো। দূরদূরান্তের চৌকি পর্যন্ত রসদ পৌঁছতে দিতো না মুক্তিরা।

শত্রুরা এবার রসদবহরের সঙ্গে আর্মি ইউনিটও পাঠাতে শুরু করলো। মুক্তিসেনারা তাদের ওপরও হামলা করে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। এভাবে শত্রু সেনাদের বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু ফ্রান্সীয়রা যখন রসদের বহরের সঙ্গে যুদ্ধ বিমানও পাঠাতে শুরু করলো, তখন তো মুক্তিসেনাদের জন্য টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। মরুর খোলা আকাশের নিচে বিমান হামলা থেকে নিজেদেরকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। এভাবে শত্রুদল রসদ সরবরাহের পথ নিচ্ছিদ্র করে নিলো।

***

আবদুল করীম এবার নিজেদের হামলার ধরণ পাল্টে ফেললেন। মারাকেশে ছেষট্টিটি দুর্গ ছিলো। অনেক দুর্গ ফ্রান্সীয়রাও নির্মাণ করে। এসব দূর্গগুলো ছোট ও মাঝারি ধরনের ছিলো। শত্রুদল এগুলোকে প্রতিরক্ষা ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলো। আর মুক্তিসেনারা এসব দূর্গের ওপর হামলা করতে শুরু করলো।

১৯২৪ সনের শেষের দিকে মুক্তিসেনারা নয়টি কেল্লা ফ্রান্সীয় ও স্পেনিশদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু বড় সংকট যেটা দেখা দিলে সেটা হলো, আবদুল করীমের সেনাসংখ্যা ক্রমেই কমে যেতে লাগলো। অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্বল্পতাও অনুভূত হতে লাগলো। কারণ তাদের কাছে তো অস্ত্র তৈরির কোন ফ্যাক্টরী ছিলো না। অস্ত্র সরবরাহের মতো তাদের কোন মিত্র দেশও ছিলো না।

ফ্রান্সীয়রা শহর, উপশহর এমনকি গ্রাম পর্যন্ত গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিলো। কারো ওপর যদি সামান্য সন্দেহ হতো সে মুক্তিসেনাদের কোনধরনের সহযোগিতা করেছে, তাহলে তার পুরো গাষ্ঠিকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হতো। ফ্রান্সীয়দের কোন দূর্গ যদি মুক্তিসেনাদের হাতে বিজিত হতো, তাহলে অন্যান্য শহরের মারাকেশী মুসলমানদের বহু ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দিতো ফ্রান্সীয়রা।

তারপরও মুক্তিসেনাদের মনোবল ভাঙ্গেনি। তাদের সেনা ও অস্ত্র স্বল্পতাকে পূরণ করতো ঈমানদীপ্ত জযবা ও সংকল্প দ্বারা।

এর মধ্যে আবদুল করীম মানবতার আরেক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সেটা হলো, মুক্তিসেনাদের হাতে অনেক স্পেনিশ ও ফ্রান্সীয় সৈন্য বন্দি ছিলো। এরা যুদ্ধবন্দি। যুদ্ধবন্ধিদের সঙ্গে সব শত্রুপক্ষই চরম অমানবিক আচরণ করে। চতুষ্পদ জন্তুর চেয়ে তাদেরকে নিকৃষ্টতর মনে করা হয়। যুদ্ধবন্দিকে সসম্মানে মুক্তি দেয়াতো দূরের কথা। কিন্তু আবদুল করীমের নির্দেশে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করা হতো। ১৯২৫ সনে আবদুল করীম সব যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেন। শুধু তাই না, নৌযানের ব্যবস্থা করে তাদেরকে সমুদ্র পার করে দেয়া হয়।

এদের মধ্যে কিছু কয়েদী তো মুসলমানদের ব্যবহারে এতই মুগ্ধ হলো যে, নিজেদের দেশে না ফিরে মুক্তিসেনাদের দলে যোগ দিলো এবং তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পরলো১৯২৫ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্স ও স্পেনের সম্মিলিত হাই কমাও মুক্তিসেনাদের ওপর চূড়ান্ত হামলা করলো। এতে পুরো কামানবহর ও সবগুলো যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের ইতিহাসে একে এক অমানবিক ও পৈশাচিক হামলা বলে আখ্যায়িত করা হয়। মুক্তিসেনাদের প্রতিটি মোর্চা ও ক্যাম্পগুলোতে যুদ্ধবিমান থেকে অনবতর বোমাবর্ষণ করা হয়।

জনবসতির কোথাও সামান্য সন্দেহ হলেই পুরো বসতিই বোমার আঘাতে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও হাজার হাজার সশস্ত্র ঘোড়সাওয়ার এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। তারপরও মুক্তিসেনারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে লড়াই করতে চেষ্টা করলো। শত্রুদলকেও ছোট ছোট দলে বিক্ষিপ্ত করার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গেলো। কিন্তু শত্রুসেনা তাদের বিন্যাস সারির মোটেও রদবদল করলোনা।

গোলাগুলি ও অবিরাম বোমাবর্ষণ অব্যহত রাখলো। তাদের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে মানুষ, চতুষ্পদ প্রাণী, পশু-পাখি এমনকি গাছপালাও বাদ গেলোনা। ব্যবসায়ীদের শত শত কাফেলা বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেলো। কোন নিরপরাধকেও তারা ছাড়লো না। মুক্তিসেনাদের সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যেতে লাগলো। ইমোনেশনও খতম হয়ে গেলো। তারপর তারা তলোয়ার ও বর্শার সাহায্যে লড়তে লাগলো। কিন্তু এই আগুন ও রক্ত ঝড়ের সামনে তারা খড়কুটার মতো উড়ে গেলো।

মুক্তিসেনারা তো নিজেদের প্রাণ নিজেদের হাতে নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু শত্রুদল নর পিছাচের মতো এর শাস্তি দিচ্ছিলো নিরপরাধ শহরবাসীকে। তাদেরকে পাইকারি দরে হত্যা করা হচ্ছিলো। হত্যা করা হচ্ছিলো নারী ও শিশুদেরকেও। পরাজয় দেখা যাচ্ছিলো স্পষ্ট। কোথাও থেকে তো সাহায্যেল আশাই ছিলো না। আবদুল করীম সাধারণ মানুষকে নরপিশাচদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধবন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি শত্রু শিবিরে সাদা ঝাণ্ডাসহ এক লোককে পাঠালেন দূর হিসাবে। কিন্তু শত্রুপক্ষ যুদ্ধ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালো।

আবদুল করীমের সঙ্গে তখন খুব সামান্যই মুক্তিসেনারা রয়ে গিয়েছিলো। তাও প্রায় নিরস্ত্র। অবশেষে আবদুল করীম ১৯২৬ সনের এপ্রিয়ে এই ঘোষণা দিলেন,

মারাকেশের রক্ত একমাত্র আমার কারণেই ঝড়ছে। আর রক্ত ঝড়ছে তাদের, যারা লড়তে জানে না। আর যারা লড়তে পারতো তারা লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গেছে। তবে ইনশাআল্লাহ মারাকেশ একদিন অবশ্যই স্বাধীন হবে। সেটা খুব শিগগীরই হবে। আমি রণাঙ্গনে না থাকলেও এখন অনেক আবদুল করীম সূর্যোদয়ের মতো জেগে উঠবে। ওই রক্ত সাগরের ভেতরেই আমার পরের আবদুল করীম আমার কথা শুনতে পাচ্ছে। তারা যেদিন উঠে দাঁড়াবে, সেদিন আর ঐ জালিম-সন্ত্রাসী সাম্রাজ্যবাদীরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে।

এই ঘোষণা দিয়ে তিনি ফ্রান্স ও স্পেনিশদের হেডকোয়ার্টারের দিকে হাঁটা ধরলেন। তিনি যখন সেখানে পৌঁছলেন, তখন তার মুখে এক চিলতে হাসি লেগেছিলো। তাকে দেখে ফ্রান্সের মার্শাল পেটীন ও স্পেনের মার্শাল প্ৰেমোদি রিভার একসঙ্গে সম্ভ্রমে স্যালুট করলেন এবং পরমুহূর্তেই তাকে গ্রেফতার করা হলো। এরপর তাকে তার পরিবারসহ রীইউনীন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হলো।

তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর পরও স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন থেমে যায়নি। মাত্র তিনমাসের মাথায় ওরা আবার সুসংগঠিত হতে শুরু করলো। তারপর ১৯৫৬ সনের ৬ মার্চ মারাকেশ পূর্ণাঙ্গরূপে স্বাধীন হলো। আবদুল করীম যেদিন স্বাধীন মারাকেশে পা রাখলেন, সেদিনই মারাকেশবাসী স্বাধীনতা ও বিজয়লাভের আনন্দ উদযাপন করলো।

সেদিন সবার আনন্দ উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আবদুল করীম।

 লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের জনারণ্যে তিনি যেন এক দীঘল বৃক্ষ।

এর পাতায় পাতায়, শাখায় শাখায়, কাণ্ডে-শিকড়ে আদিগন্ত প্রসারিত ছায়াবীথিতে আজো উচ্চকিত হচ্ছে স্বাধীনতার অজর মন্ত্র-শ্লোগান।

সিংহ পুরুষ : অহিংস কাহিনী

সিংহ পুরুষ : অহিংস কাহিনী

সিংহ পুরুষ
অহিংস কাহিনী

১৯২২ সাল। মারাকেশ তখন গোলাম ছিলো। গোলাম ছিলো দুই সাম্রাজ্যবাদীর। মারাকেশের এক অংশ দখল করে রেখেছিলো স্পেনিশরা। আরেক অংশ দখল করে রেখেছিলো ফ্রান্সীয়রা। তবে বেশির ভাগ এলাকা ছিলো ফ্রান্সীয়দের দখলে।

১৯২২ সালের প্রথম দিকের কথা। মারাকেশের দক্ষিণাঞ্চলে স্পেনিশ ফৌজের একটি ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে প্রায় এক হাজার সেনাবাহিনী রয়েছে। স্পেনিশ জেনারেল সেই ক্যাম্পে এক জরুরী কাজে গেলেন। স্পেনিশ সেই জেনারেলের নাম জেনারেল সেলিষ্টার।

জেনারেলের এই আগমন ছিলো আসলে ক্যাম্প পরিদর্শনের জন্য। এজন্য সেনা ও তাদের কমান্ডাররা বেশ সতর্ক এবং ফিটফাট হয়ে ছিলো। প্রত্যেক সৈন্য এবং ক্যাম্পের প্রতিটি কোন জেনারেলের পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত রাখা ছিলো। জেনারেল সেলিষ্টার ক্যাম্প পরিদর্শন করছিলেন।

আচমকা ক্যাম্পের ভেতর ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেলো। ক্রমেই সেটা প্রলয়ের বিভীষিকায় রূপ নিলো। ক্যাম্পের ভেতর আসলে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। হামলা করেছিলো মারাকেশের নির্যাতিত মুজাহিদরা। যাদের সংখ্যা ছিলো স্পেনিশ বাহিনীর দশ ভাগের এক ভাগ। মারাকেশের মুজাহিদদের অস্ত্র ছিলো লোহার লাঠি, তলোয়ার, বর্শা ও খঞ্জর। এগুলো দিয়ে তারা এমন এক সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করলো, যাদের কাছে ছিলো অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড, দূরপাল্লার পিস্তল, ট্যাংক ও কামান।

তবে মুজাহিদদের এই হামলা ছিলো অত্যন্ত তীব্র এবং একেবারেই আচমকা। যার জন্য কেউ প্রস্তুত তো ছিলোই না এবং প্রস্তুত থাকার কথাও নয়। আসলে মুজাহিদদের এই হামলায় সবচেয়ে বড় যে অস্ত্র ছিলো সেটা হলো, পরাধীনতা থেকে মুক্তির জ্বালা ও স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য চেতনা। আর ছিলো পাহাড়সম সংকল্প, বিস্ময়কর আত্মবিশ্বাস।

এই অনমনীয় সংকল্প ও তুঙ্গস্পর্শী আত্মবিশ্বাস নিয়ে মুজাহিদরা এমন প্রচণ্ড হামলা চালালো যে, জেনারেল সেলিষ্টার পালাতে গিয়ে মারা পড়লেন। কিছু স্পেনিশ অফিসার পালাতে সক্ষম হলো এবং দেড় দুইশ সৈনিক প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারলো। যারা পালাতে পারলো না, ক্যাম্পে রয়ে গেলো। তারা ছিলো। মারাত্মকভাবে আহত। এদের সংখ্যা ছিলো প্রায় সাতশ। আর বাকিরা হলো নিহত।

তারপর মুজাহিদরা স্পেনিশদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে গিয়ে আত্মগোপন করলো, যেখানে ওরা সাম্রাজ্যবাদী দখলদারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিলো।

এটা ছিলো মারাকেশের মুজাহিদদের প্রথম হামলা। এর নেতৃত্ব দেন অখ্যাত এক লোক। যিনি পরবর্তীতে আব্দুল করীম নামে সারা দুনিয়ায় খ্যাতিমান হয়েছিলেন। ফ্রান্স ও স্পেনে তার নাম ছিলো, কোথাও কোথাও কিংবদন্তী তুল্য, কোথাও জলজ্যান্ত এক আতঙ্ক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চার বছর আগে ফ্রান্সীয় সৈন্যরা নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে মারাকেশে প্রবেশ করে। তারপর প্রতারণা ও দখলদারিত্বের অপচক্রে ফেলে এবং সেনাশক্তি প্রয়োগ করে মারাকেশের বড় একটা অংশ দখল করে নেয়। স্পেনিশরাও এ ধরনের পেশি শক্তির জোরে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মারাকেশের আরো কিছু অংশে জুড়ে বসে।

প্রথম যুদ্ধের পর ফ্রান্সীয়রা আলজাযায়েরের সঙ্গে সঙ্গে মারাকেশকেও নিজেদের করদরাজ্যে রূপান্তরিত করে। সেখানে অসংখ্য ফ্রান্সীয় সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। আর এই সুযোগে ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের ভূমিহীন অধিবাসীদেরকে মারাকেশে আবাদ করতে শুরু করে। স্পেনিশরাও নিজেদের দখলকৃত অংশে স্পেন ও ইউরোপীয়ানদের বসত গড়তে শুরু করে।

সাম্রাজ্যবাদী এই দুই জাতি মারাকেশের মুসলমানদের নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকার সব পথ বন্ধ করে দেয়। এই দুই সন্ত্রাসী, দখলবাজ জাতির উদ্দেশ্য ছিলো একটাই। সেটা হলো, মারাকেশ যেন ইসলামী রাষ্ট্র বলার যোগ্য না থাকে।

ফ্রান্সীয় ফৌজি কমান্ডার তখন জেনারেল লাইটে। অতি দক্ষ ও চালবাজ জেনারেল হিসাবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। তিনি মারাকেশকে তাদের গোলামির শৃংখলে ফাসানোর জন্য সেই চালই চেলেছেন, যে চাল চেলেছিলো ইংরেজরা উপমহাদেশ দখল করতে গিয়ে। মারাকেশের নেতৃস্থানীয় মুসলমান, যারা বিভিন্ন গোত্র ও রাজনৈতিক অংগ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে দেন জেনারেল লাইটে। শত্রুতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেন মারাকেশের নেতাদের মধ্যে। এভাবে মারাকেশের জাতীয় ঐ ধ্বংসের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেন জেনারেল লাইটে।

মারাকেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গোত্র সরদারকে ফ্রান্সীয়রা অঢেল ধন সম্পদ ও জায়গীর এবং সুন্দরী নারী দান করে। এভাবে মারাকেশ একটা পর্যায়ে এসে দাসত্বের চরম অবমাননা মেনে নেয়। কিন্তু মারাকেশের এমন একটি প্রাণীকেও পাওয়া গেলো না, যে এর বিরুদ্ধে সামান্য টু শব্দটি করবে। মনে হচ্ছিলো, মারাকেশের মুসলমানদের মধ্য থেকে স্বাধীনতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিভে গেছে। মরে গেছে তাদের আত্মমর্যাদাবোধের অনুভূতি।

তবে জীবন্ত কোন জাতির সন্তানরা মরে যেতে পারে, কিন্তু জাতির জাতীয়তাবাদ জীবন্তই থাকে। যা তারই কোন এক সন্তানের রূপ ধরে আগ্নেয়গিরী হয়ে বিস্ফোরিত হয়। তখন স্বাভাবিকভাবেই জাতির বিবেকবোধ সীমাহীন আত্মশ্লাঘা নিয়ে জেগে উঠে।

মারাকেশের পাথরচাপা বিবেকও জেগে উঠলো। সে ছিলো এক গোত্র সরদারের ছেলে। সদ্য যৌবনে পা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার উদাত্ত শ্লোগান তুললো সেই সরদারের অগ্নিসন্তান। তার নামই আবদুল করীম আল খাত্তাবী।

তার বাবা তাকে আইন শিক্ষা দেন। আইনের ডিগ্রি নিয়েও সম্মানজনক জীবনের সুযোগ সুবিধা তাকে দিতে রাজি ছিলো না ফ্রান্সীয় ও স্পেনিশরা। কারণ, সে ছিলো মুসলমান। তাদের কাছে মুসলমান হওয়া এক অপরাধ। ধার্মিক হওয়া অন্যায় কর্ম। মানবিক ও সামাজিক হওয়া মানে দুর্বলতা।

স্পেনিশদের দখলকৃত অংশে আবদুল করীমরা থাকতো। আইনের প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি থাকার পরও সম্মানজনক কোন চাকুরি সরকার তাকে দিলো না। তবে আধা সরকারি ধরনের একটা চাকরি পেলো আবদুল করীম। সেটা হলো, স্পেনিশ ফৌজের অফিসারদের স্থানীয় বরবার ভাষা শিক্ষা দেয়ার কাজ। মারাকেশের লোকেরা এ ভাষাতেই কথা বলতো।

আবদুল করীমের মনে মারাকেশের স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য চেতনা তাকে সবসময় দারুণ উজ্জীবিত রাখতো। সঙ্গে সঙ্গে দখলদার ভিনদেশী মুনিবদের বিরুদ্ধে অবিমিশ্র ঘৃণা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। তার এই জাগ্রত উপলব্ধি সে গোপন রাখতে পারতো না।

একদিন স্পেনিশ অফিসারদের ক্লাশ নিচ্ছিলো আবদুল করীম। ক্লাশে স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টারও ছিলেন। এক অফিসার ক্লাস টেষ্ট না পারায় আবদুল করীম তাকে মৃদুভসনা করে। জেনারেল সেলিষ্টার এটা মানতে পারলেন না। গোলাম হয়ে, অধীনস্থ হয়ে তার মুনিবকে এভাবে ধমকে উঠবে- এটা জেনারেল কোনভাবেই মানতে পারছিলেন না। তিনি চটে উঠলেন।

নিজেকে আমাদের কর্মচারীর বেশি মনে করো না করীম! ভদ্রভাবে কথা বলবে। এমন আচরণ সহ্য করা হবে না। জেনারেল সেমিষ্টার বললেন।

আব্দুল করীম জেনারেল সেলিষ্টারের কথায় ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন। জেনারেলের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বললো,

এর চেয়ে বড় অভদ্রতা আর অসৌজন্যতা কি হতে পারে যে, তুমি তোমার শিক্ষককে ধমকাচ্ছে। এমন উগ্র ছাত্র কোন শিক্ষকই পছন্দ করবে না।

জেনারেল সেলিষ্টার একথার জবাবে আব্দুল করীমকে গালমন্দ করলো। আবদুল করীম মুখে বিদ্রুপাত্মক হাসি নিয়ে বললো,

শোন! স্পেনিশ অফিসাররা! মারাকেশ মুসলমানদের, তোমাদের একদিন না একদিন তোমাদের এখান থেকে বের হতেই হবে।

আবদুল করীম ক্লাশ সেখানেই মুলতুবী করে ক্লাশ থেকে এই বলে বেরিয়ে গেলো, আমি তোমাদের এই নোংরা চাকরির ওপর অভিশাপ দিচ্ছি।

তারপর আবদুল করীম তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না। জেনারেলকে আবদুল করীম যা বলে এসেছে তা স্বৈর আইনে সরাসরি বিদ্রোহ ছিলো। বাড়ির অর্ধেক পথে থাকতেই তাকে গ্রেফতার করা হলো। বিনা বিচারে তার জেল হয়ে গেলো।

জেলখানায় তার বিশ দিনও কাটেনি। একদিন সকালে জেলখানায় একটি সংবাদে বোমা ফাটার মতো অবস্থা হলো। সেটা হলো আবদুল করীম ফেরার হয়ে গেছে।

আজ পর্যন্ত কেউ এটা আবিষ্কার করতে পারেনি, রাতের বেলা আবদুল করীম পাহাড় সমান এত উঁচু প্রাচীর কি করে টপকালো। তাও সে প্রাচীর ছিলো ন্যাড়া পাহাড়ের মতো খাড়া এবং মসৃণ। প্রাচীরের কোথাও কোন খাঁজ ছিলো না। স্পেনিশরা আজো এই প্রাচীর টপকানোকে অলৌকিক কীর্তি বলে মনে করে। এটা ছিলো ১৯২১ সালের ঘটনা।

জেলখানার সাধারণ প্রহরী থেকে নিয়ে জেলার পর্যন্ত কাউকে রেহাই দেয়া হলো না। আবদুল করীমের ফেরার হওয়ার কারণে সবাইকে কঠিন শাস্তি দেয়া হলো। একজনকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হলো। অনেক খোঁজাখুঁজি হলো। তদন্তের পর তদন্ত হলো। কিন্তু কেউ হদিস করতে পারলো না, আবদুল করীম কোন পথে জেল থেকে পালিয়েছে।

এক কয়েদির ফেরার হওয়ার ব্যাপারটা তো এমন গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ ব্যাপার ছিলো না। স্পেনিশ জেনারেলের সামনে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠাতেই আবদুল করীমের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কিছু দিন পর যখন জানা গেলো, সে কয়েদির ফেরার হওয়ার প্রেক্ষাপট মারাকেশের ইতিহাসের মোড় পাল্টে দেবে, তখন স্পেনিশদের আরো বেশি টনক নড়লো। তারা আবদুল করীমকে যে মামুলি গুরুত্ব দিয়েছিলো তাই ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় ভুল এবং অমার্জনীয়ও।

***

আবদুল করীমের ব্যাপারে খবর পাওয়া গেলো যে, সে এক দুর্গম পাহাড়ি গিরিকরে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার ও ট্রেনিং ক্যাম্প খুলেছে। কিন্তু সেই পাহাড়ি উপত্যকা যে কোনটা সেটা শত চেষ্টা করেও স্পেনিশ আর্মি জানতে পারেনি বহু দিন।

আবদুল করীম অতি নিঃশব্দে এবং সুনিপুণ নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে এমনভাবে পরিচালনা করলো যে, অল্প সময়েই অসংখ্য যোদ্ধা তার ঝাণ্ডাতলে এসে সমবেত হলো। এসব যোদ্ধারা ছিলো মারাকেশের সাধারণ নাগরিক। যারা দিনের পর দিন স্পেনিশ ও ফ্রান্সীয়দের গোলাবারুদের উত্তাপ সহ্য করেছে। বাপ ভাইদের নির্বিচারে মরতে দেখেছে। দেখেছে মা বোনদের সম্ভ্রমহানি ঘটাতে। নির্যাতন নিপীড়ন সইতে সইতে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এসবই মারাকেশের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য চেতনা জাগিয়ে তুলেছে।

সেনা ফ্রান্সী হোক বা স্পেনিশ হোক, তাদের একমাত্র টার্গেট ছিলো মারাকেশী মুসলমানরা। এই দুই সাম্রাজ্যবাদী দেশের সেনারা সেখানকার জনগণের সঙ্গে হিংস্র প্রাণীর মতো আচরণ করতো। সৈনিকরা ক্ষুধার্ত মানুষের খাবার কেড়ে নিতো। মজুর-শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা পয়সা ছিনিয়ে নিতো। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাঠে ঘাটে খেলতে বেরোলে মেরে কেটে তাড়িয়ে দিতো। এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর ঔষধও ছিনিয়ে নিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। তাহলে কেন মারাকেশী জনগণ সেই নরপিছাচদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না? কেন জীবন বাজি রেখে দেশ দখলদার মুক্তি করতে ও স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না।

মারাকেশী যযাদ্ধাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো যেটা সেটা হলো, তাদের কাছে অস্ত্র ছিলো না। তারপর আবার তাদের লড়াই ছিলো একই সঙ্গে দুই পরাশক্তির সেনাদের বিরুদ্ধে। এক ফ্রান্সীয়, আরেকটা হলো স্পেনীয় সেনা।

ফ্রান্স তো বিশ্ব মিডিয়ায় এটা ছড়িয়ে রেখেছিলো যে, মারাকেশের আসল শাসন কর্তৃত্ব স্থানীয় মুসলমানদের হাতেই রয়েছে।

এক চুক্তির অধীনে মুলত: ফ্রান্সীয় সেনাবাহিনী মারাকেশের নিরাপত্তা ও শাসন সংস্কারের নামে মারাকেশে আস্তানা পেতে বসে। অজুহাত ছিলো মরুচারী বেদুইন জাতি বিদ্রোহী হয়ে সবসময় মারাকেশের সীমান্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাখতো। কখনো কখনো মারাকেশের অভ্যন্তরে তারা গেরিলা হামলা চালাতো। তাদের এ অজুহাত ঠিকই ছিলো। কিন্তু মারাকেশের মুসলমানদের শায়েস্তা করার জন্য গোপনে ফ্রান্স ও স্পেন অস্ত্রও সরবরাহ করতো। এভাবেই বেদুইনরা অস্ত্রশস্ত্রে শক্তিশারী হয়ে উঠে।

তারপর সেই বেদুইনরা যখন মারাকেশে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে সারা দেশে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়, তখন ফ্রান্স ও স্পেনিশরা উড়ে আচে মারাকেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এভাবে মারাকেশ দখল করে তাদের নিরাপত্তা কর্মসূচির পূর্ণাঙ্গতা দান করে।

অথচ সারা দুনিয়ায় মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে রাখে, মারাকেশের শাসনক্ষমতা মারাকেশের জনগণের হাতেই রয়েছে। কিন্তু এর সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য স্বাধীনতাকামীদের হাতে তেমন কোন অস্ত্র ছিলো না, না ছিলো কোন প্রচার মাধ্যম।

পুরো ইহুদী ও খ্রিষ্টান দুনিয়া মারাকেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আসলে ফ্রান্সীয় ও স্পেনিশরা প্রতিশোধ নিচ্ছিলো সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছিলো খ্রিষ্টান পরাশক্তি। পারলে তো ওরা পুরো মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস করে দেয়।

আবদুল করীম তার মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে নেয়। এর মধ্যে একটা বিভাগ ছিলো চার স্তর বিশিষ্ট গোয়েন্দা বিভাগ। এক বছরের মধ্যে স্বাধীনতাকামীদের মোটামুটি সুশংখল একটা সেনাবাহিনী গড়ে উঠলো আবদুল করীমের নেতৃত্বে। তবে অস্ত্রবিহীন। মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো এই নিরস্ত্র। এজন্য প্রথম সমস্যা এবং প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো অস্ত্রসহ। যার একমাত্র মাধ্যম ছিলো ছোট ছোট সেনা চৌকির ওপর গেরিলা হামলা চালানো।

এখন তোমাদের প্রধান কাজ হলো প্রশিক্ষণে শেখা যুদ্ধকৌশলের চর্ম। অনুশীলন করা এবং অস্ত্র সংগ্রহ করা। এজন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলে, দখলদার বাহিনীর ছোট ছোট সেনাক্যাম্পগুলোতে নৈশ হামলা চালানো। সে হামলা হবে গেরিলা পদ্ধতিতে এবং অতি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। মনে রাখতে হবে, এজন্য শহীদ হওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হামলা চালাতে হবে। আবদুল করীম একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে বললো,

আত্মদানকারী একদল মুক্তিযোদ্ধাও প্রস্তুত হলে গেলো। এই দলের নাম রাখা শহীদ স্কোয়াড।

***

এক গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে আবদুল করীম জানতে পারলো, অমুক দিন অমুক ক্যাম্প পরিদর্শনে যাচ্ছেন স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টার। তার সঙ্গে এক কমান্ডো দলও থাকবে। সে ক্যাম্পে প্রায় এক হাজার সেনা রয়েছে। যারা সব ধরনের আধুনিক অস্ত্রশস্তে সুসজ্জিত। এমন এক বাহিনীর ওপর রাতের বেলায়ও হামলা চালানোর অর্থ আত্মহত্যার জন্য নাম লেখানো। আর দিনের বেলায় তো কল্পনাও করা যায় না।

কিন্তু আবদুল করীম জেনারেল সেলিষ্টারের নাম শুনতেই তার রক্ত টগবগ করে উঠলো। প্রতিশোধ স্পৃহায় আবদুল করীম যেন উন্মত্ত হয়ে উঠলো। এই জেনারেলই তো তাকে অন্যায়ভাবে কয়েদখানায় ছুঁড়ে মেরেছিলো।

আবদুল করীম মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকে বললো, যদি এই জেনারেলের পরিদর্শনের সময় হামলা করে এবং জেনারেলকেও খতম করে দেয়া যায়, তাহলে স্পেনিশদের পা টলে উঠবে।

মুক্তিযোদ্ধারা তো এমন হুকুমেরই অপেক্ষায় থাকতো সর্বক্ষণ। লড়তে লড়তে প্রাণ বিসর্জন দেয়াকে তো ওরা কিছুই মনে করতো না। ওরা তো পণই করে নিয়েছে, একজন সাম্রাজ্যবাদীও যদি মারাকেশে থাকে তাহলে এদেশে জীবনের কোন মূল্য থাকবে না। এর চেয়ে ভালো মারাকেশের জন্য জীবন দিয়ে দেয়া। ওরা হামলার জন্য টান টান উত্তেজনা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলো।

সংখ্যায়ও ছিলো ওরা খুব নগণ্য। আবদুল করীম ওদেরকে ট্রেনিংই দিয়েছে এমনভাবে যে, স্বল্প সংখ্যক সেনা কয়েকগুণ বেশি শত্রুসেনার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনবে। আর বিজয় অর্জন করতে না পারলেও যথেষ্ট ক্ষতি করে নিজের অক্ষত ফিরে আসবে।

নির্দিষ্ট দিনে ওদিকে জেনারেল সেলিষ্টার সেনা ক্যাম্পে পৌঁছে গেলেন। এদিকে আবদুল করীম ও তার সংক্ষিপ্ত মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের কাছাকাছি এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেলো যেখানে ওদেরকে দেখার মতো কেউ ছিলো না। ওরা সেখানে ঘাপটি মেরে রইলো।

জেনারেল সেলিষ্টার মাত্র পরিদর্শন শুরু করেছেন এমন সময় মুক্তিযোদ্ধারা ধারালো লাঠি, বর্শা, তলোয়ার ও খঞ্জর নিয়ে ক্যাম্পের ওপর হামলে পড়লো। এমন অতর্কিত হামলায় স্পেনিশদের তত দিকবিদিক হারানোর অবস্থা হলো। ওরা প্রতিরোধের সবরকম চেষ্টা করলো। জবাবী হামলা চালালো। কিন্তু ওদের হামলায় কোন জোর উঠলো না। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারাও ওদেরকে সামলে উঠার সুযোগ দিলো না।

এ দিকে আবদুল করীম তো জেনারেল সেলিষ্টারকে খুঁজতে লাগলো। ওদিকে জেনারেল তার বডিগার্ড ও অফিসারদের পরিবেষ্টনে থেকে নিরাপদে পালাতে চেষ্টা করছিলেন।

হঠাৎ একবার আবদুল করীম তাকে দেখে ফেললো। সেনা অফিসার ও বডিগার্ডরা তাকে নিচ্ছিদ্র পরিবেষ্টনে নিয়ে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে ওরা মুক্তিবাহিনীর ওপর গুলি চালালো। অনবরত ষ্টেনগানও চালালো। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে আহত হলো। কয়েকজন শহীদ হলো। কিন্তু আবদুল করীমের দৃপ্ত কণ্ঠ বার বার গর্জে উঠতে লাগলো, জেনারেল সেলিষ্টাকে আমি জীবিত বা মৃত এখান থেকে নিয়ে যাবো।

আবারো গর্জে উঠলো আবদুল করীমের কণ্ঠ, মুক্তিবাহিনীর সব শহীদ হলেও আমি জেনারেল সেলিষ্টারকে ছাড়বো না।

এ ছিলো বিস্ময়কর ও এক অসম লড়াই। বর্শা, লাঠি ও তলোয়ার লড়ছিলো স্বয়ংক্রিয় ষ্টেনগান ও বিধ্বংসী গোলাবারুদের বিরুদ্ধে। ওদিকে ছিলো বহুযুদ্ধে অভিজ্ঞ দুর্ধর্ষ অপ্রতিরোধ্য আবেগ, বিশুদ্ধ চেতনা ও গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনি ছাড়া শক্তিশারী কোন অস্ত্র ছিলো না।

ওরা অনবরত গোলা ও বোমার আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে জেনারেলকে ঘিরে রাখা পরিবেষ্টনী দেয়াল ভেঙ্গে ফেললো। ওদিকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধ নিহত স্পেনিশদের রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগানসহ অনেক ধরণের অস্ত্র নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেলো। জেনারেলকে যারা এতক্ষণ দেয়ালের মতো নিরাপত্তা প্রাচীর হয়ে আগলে রেখেছিলো, তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। ক্রুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর সামনে কেউ দাঁড়াতে পারলো না। জেনারেলকে অক্ষত অবস্থায় আবদুল করীমের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো।

চরম উদ্ধত-অহংকারী স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টার ভেজা বেড়ালের মতো আবদুল করীমের সামনে দাঁড়িয়ে। এত বড় যুদ্ধশক্তির জেনারেল অথচ ভয়ে থর থর করে কাঁপছেন।

আবদুল করীম ভয়ংকর শীতল গলায় বললো,

আয়! সভ্য দুনিয়ার অসভ্য জেনারেল! আমি তোমাকে বলেছিলাম না, মারকেশ মুসলমানদের। মারাকেশ এ দেশের জনগণের! তোমাদের একদিন এই নোংরা দখলদারিত্ব ছেড়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে। এমন ন্যায্য কথায়ও তোমার টনক নড়লো না। তুমি জঙ্গি শক্তির নেশায় বুঁদ হয়ে আমাকে জেলখানার অন্ধকার কুঠুরীতে ছুঁড়ে মেরেছো।

শোন! আবদুল করীম! জেনারেল সেলিষ্টার কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন, তোমরা আমাদের জঙ্গিশক্তির মোকাবেলা করতে পারবে না। আমাদের যুদ্ধ শক্তির সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। আমাকে মেরে ফেললেও তোমরা স্বাধীন হতে পারবে না। আমরা যে দেশে টুকি সে দেশ থেকে স্বাধীনতা নামক কাল্পনিক শব্দটি মুছে দিই। মারাকেশেও তা মুছে দিয়েছি। আমাকে মেরে কোন লাভ নেই। আর যদি মারোই তাহলে মনে রেখো, আমাকে হত্যার প্রতিশোধ মারাকেশের প্রতিটি মুসলমানের রক্ত ঝড়িয়ে নেয়া হবে। কারণ, তোমাদের কাছে আসলেই কোন অস্ত্র শক্তি নেই।

আমাদের শক্তি একমাত্র আল্লাহ এবং আমাদের তাজা ঈমান আব্দুল করীম দৃঢ় কণ্ঠে বললো, তোমাদের খোদা সত্য হলে তাকে বললো আমাদের হাত থেকে তোমাকে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে যেতে।

জেনারেল সেলিষ্টার প্রথমে কিছুক্ষণ হুমকি ধমকি দিলেন। তারপর সোনাদানা, নারী ও ক্ষমতার লোভ দেখালেন। বন্ধুত্ব ও সন্ধির প্রস্তাবও দিলেন এবং অবশেষে জীবিত রাখলে মারাকেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এসবের উত্তরে আব্দুল করীম নির্বিকার রইলো। শুধু শীতল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। জেনারেল সেলিষ্টারের কথা শেষ হলে আবদুল করীমের মুক্তিযোদ্ধাদের বললো,

তোমরা প্রতিশোধ নাও। প্রতিশোেধ নাও মারাকেশের সেসব নিষ্পাপ মুসলমানদেরকে হত্যার, যাদেরকে এই নির্দয়-নিষ্ঠুর জেনারেলের হুকুমে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে।

***

যে জেনারেলের হাত, পা, দেহ অসংখ্য মারাকেশবাসীর রক্তাক্ত লাশ দেখে হায়েনার মতো উল্লাসে দুলে উঠেছে, সেই জেনারেলের দেহে একই সঙ্গে অনেকগুলো বর্শা, তলোয়ার ঢুকে পড়লো। জেনারেল সেলিষ্টার লুটিয়ে পড়লেন। একজন নির্মম নরখেকো ঘাতকের অপবিত্র দেহ থেকে তার প্রাণপাখিটি উড়ে গেলো।

ততক্ষণে রণাঙ্গন মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে এসেছে। ক্যাম্পের চার দিকেই মুক্তিবাহিনীর প্রাধান্য। এর মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, স্পেনিশদের, জেনারেলকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ধরবে স্পেনিশদের অবশিষ্ট মনোবলও ভেঙ্গে গেলো। পুরো ক্যাম্প ইতিমধ্যে রক্তের জোয়ারে ভেসে গেছে। পরাশক্তির অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ হলেও আজ এরা নিপীড়িত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে।

শত্রু সেনা এবার পালাতে শুরু করলো। কিছু সৈন্য পালাতে গিয়েও মারা পড়লো। এভাবে স্পেনিশদের অনেক সৈন্যই নিহত হলো। অক্ষত রইলো তারাই যারা নির্বিঘ্নে পালাতে পারলো। বিশাল এক অস্ত্রভাণ্ডার রেখেই ওরা পালালো।

মুক্তিসেনারা চলে যাওয়ার পর স্পেনিশ ক্যাম্পে লাশ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। স্পেনিশ সেনাবহিনীর হে কোয়ার্টারে এই সংবাদ পৌঁছার আগেই মুক্তিসেনারা তাদের গোপন ক্যাম্পে চলে গেলো।

এই গেরিলা অভিযান চালানো হয়েছিলো অস্ত্রের জন্য। সে প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে গেছে আপাতত।

মারাকেশের স্পেনিশদের দখলকৃত প্রদেশসমূহের জায়গায় জায়গায় হোট বড় সেনা চৌকি ছিলো। আবদুল করীমের মুক্তিসেনারা রাতের বেলায় সেসব চৌকিকে চারদিক থেকে ঘিরে নিয়ে পিলে চমকে দেয়া সুরে এ ধরণের ঘোষণা দিতে,

অস্ত্র সমর্পণ করে আমাদের কাছে চলে এসো। আর না হয় এখান থেকে জীবিত বের হতে পারবে না।

এমন ঘোষণাও শোনা যেতো,

আজকের রাত্রে পর যদি জীবিত থাকতে চাও এবং এই রাতটিই সর্বশেষ রাত মনে করে না থাকে, তাহলে কাল সকালে যেন এখানে আর একটাকেও দেখা না যায়।

প্রতি রাতেই কোন না কোন সেনা চৌকির আশেপাশে এ ধরণের ঘোষণা শোনা যেতো। মরুর নিঃস্তব্ধ রাতে এমন আচমকা চিৎকার স্পেনিশদের কলজে কাঁপিয়ে দিতো। যেন এটা কোন অশরীরি অট্টহাসি।

এ ছাড়াও স্পেনিশ সেনাদলের এত বড় শক্তিশালী ক্যাম্পে মুক্তিসেনাদের অবিশ্বাস্য আক্রমণ ও জেনারেল সেলিষ্টারের মৃত্যু পুরো স্পেনিশ আর্মিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিলো।

এই আতঙ্ক ও রাতের বেলায় আচমকা গেরিলাদের ঘোষণার কারণে সক হতেই দেখা যেতো যে চৌকি খালি হয়ে গেছে। এভাবে অনেকগুলো সে। চৌকি খালি হয়ে গেলো। কিছু কিছু চৌকিতে মুক্তিসেনারা রাতে গেরিলা হাম চালিয়ে উন্ন প্রযুক্তির অনেক অস্ত্র হাতিয়ে নিলো।

***

আবদুর করীমের এবার মুক্তিসেনাদের নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতো সুশূল বাহিনীর নিয়মতান্ত্রিকতায় অভিজ্ঞ করে তুললো। তারপর গুপ্ত ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যথারীতি সম্মুখ সমরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। এখন আবদুল করীম তার হেডকোয়ার্টার রীফ পাহাড় সারির গহীন অঞ্চলে সরিয়ে নিয়েছে। মুস্তিসেনারা এতদিনে স্পেনিশদের বেশ কিছু চৌকি ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল দখল করে নিয়েছে।

আবদুল করীম একদিন মিলীলা নামক অনেক বড় একটি শহরের ওপর চড়াও হলো। শহরটি মারাকেশের অন্যতম কেন্দ্রীয় শহর। এখানে ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের অভিজাত লোকেরা বসবাস করে। বিত্ত ও প্রাচুর্যের এমন প্রদর্শনী এ শহরের মতো অন্য শহরগুলোতে খুব একটা দে যায় না। শহরের জনসংখ্যা চল্লিশ হাজার। আবদুল করীম শহর অবরোধ করলো। পুরো শহর মুক্তিসেনারা ঘিরে নিলো।

মারাকেশের যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে, তাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ি ছিলো এই শহরে। এই মিলীলা শহরেই অনেকের শৈশব কেটেছে। ইউরোপীয়রা তাদেরকে তাদের ভিটেবাড়ি থেকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিসেনাদের মধ্যে নষ্টালজিক ছড়িয়ে পড়লো। সেটা ক্রমেই রূপ নিলো ভয়াবহ প্রতিশোধ স্পৃহায়। এমনকি মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এমন একটা দাবীও উঠলো, এই শহরে ইউরোপের যত লোক আছে তাদেরকে হত্যা করে তাদের অঢেল ধনসম্পদ সব নিয়ে নিতে হবে। যেগুলো মারাকেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কাজে লাগানো হবে।

আবদুল করীম মুক্তিসেনাদের এই মনোভাবের কথা শুনে সবাইকে ডেকে এনে খুব সংক্ষেপে বললেন,

আমাদের দৃষ্টি শুধু শহরের ওপর। শহরবাসীর ওপর নয়। এটা ঠিক যে এই নির্দয় বিধর্মীরা অনেক নিরপরাধ মুসলমানকে মশা মাছির মতো মেরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং হাজার হাজার নারীর সম লুটে নিয়েছে। এত কিছুর পরও আমি শহরবাসীর ওপর হাত উঠাবো না। এটা সত্যিকারের কোন মর্দে মুজাহিদ স্বাধীনতাকামী মুক্তিসেনার ব্যক্তিত্বের পরিপন্থী যে, সে কোন নিরস্ত্র মানুষের রক্ত ঝড়াবে। মনে রাখবে, ইসলাম মানবতার শিক্ষা দেয়, শিক্ষা দেয় মহানুভবতার। তোমাদের উদার-মহানুভব আচরণ হয়তো হিংস্রপ্রাণীর মতো ওই মানুষগুলোকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করবে।

এ ধরণের বক্তব্য দেয়ার পরও মুক্তি সেনাদের আবেদ-উত্তেজনা এবং চাপা ক্রোধ ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। এই প্রথম আবদুল করীম অনুভব করলো, তার হাতে গাড় এই দলটি তার কথা শুনতে চাচ্ছে না। ইউরোপীয়ানদের হত্যার দাবী এখনো তারা পরিত্যাগ করেনি।

আব্দুল করীম এতে খুব একটা বিচলিত হলো না। তাকে যে চিন্তাটা অস্থির করে তুললো। সেটা হলো, এই শহরে যুবতী মেয়েরাও রয়েছে। যা মুক্তিসেনাদের ঈমান-বিশ্বাসকে হালকা করে দিতে পারে। আর যে বৈভব আছে, তাতে তাদের এতদিনের লালিত বিশুদ্ধ সংকল্পে নাড়া দিয়ে যেতে পারে। নারী ও সম্পদের লোভ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধশক্তিকেও ভেতর থেকে ঘুণ পোকার মতো খেয়ে ফেলে।

আবদুল করিম দেখলো, শহর অবরোধ বেশ সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের ওপর একযোগে হামলা চালালেই এখন শহর জয় সম্পন্ন হয়ে যাবে। শহরবাসীদের সাহায্যে স্পেনিশ সেনারাও আসবে না কিংবা সেই সাহসও নেই তাদের। তাই শহর বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তারপর তো তার মুক্তিসেনারা শহরবাসীদের ওপর প্রতিশোধ নেবে। চরম প্রতিশোধ। বিজিত লোকদের ওপর প্রতিশোধের নেশায় চড়াও হওয়া ইসলাম কখনো সমর্থন করে না।

এসব সাত পাঁচ ভেবে আবদুল করীম অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিলো এবং অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে তার হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলো তার মুক্তিসেনাদের নিয়ে।

ইউরোপীয় ও অনেক বিধর্মী ঐতিহাসকিরা কেবল এই একটি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে আবদুল করীমকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তারা অকপটে স্বীকার করেছেন, আবদুল করীম চারিত্রিক, মানবিক, আদর্শিক ও নৈতিক এবং চরম বিবেকবোধের প্রতি তার দারুণ ভীষণ মুগ্ধ।

***

তাই এই অসাধারণ আদর্শিক ব্যক্তিত্ববোধের প্রতি অনেক স্পেনিশ, ফ্রান্সীয় ও ইউরোপীয়ানরাও বিমুগ্ধ ছিলো। স্পেনিশ আর্মির এক সার্জেন্ট তো আবদুল করীমের নেতৃত্বগুণের প্রতি প্রভাবান্বিত হয়ে নিজের দল ত্যাগ করে। তার নাম সার্জেন্ট কালাইমাস।

সার্জেন্ট কালাইমাস। বয়স সাতাইশ থেকে ত্রিশের কোঠায় হবে। স্পেনিশ আর্মিতে বেশ সুনাম ছিলো ক্লাইমাসের। আর কিছু দিন পরই পদোন্নতি হয়ে গেলে কর্ণেল হয়ে যেতো। সার্জেন্ট ক্লাইমাস স্পেনিশ ছিলো না। ইউরোপের অন্য কোন দেশের লোক ছিলো।

একদিন লুকিয়ে হাপিয়ে সার্জেন্ট ক্লাইমাস স্পেনিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে পড়লো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেই পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছে গেলো। এখানেই কোথায় রয়েছে আবদুল করীমের মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প। মুক্তিসেনারা তাদের ক্যাম্প ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরদুরান্ত পর্যন্ত সতর্ক প্রহরায় থাকতো। এতগুলো সতর্ক চোখ এড়িয়ে মশা মাছিও ক্যাম্প এলাকায় ঢুকতে পারতো না।

সার্জেন্ট ক্লাইমাসকে ভবঘুরের মতো একা একা ঘুরতে দেখে মুক্তিসেনারা তাকে পাকড়াও করলো। তার ওপর একমাত্র এই সন্দেহই করার ছিলো যে, সে স্পেনিশ আর্মির গুপ্তচর। মুক্তিসেনারাও তাকে গুপ্তচর হিসাবেই গ্রেফতার করলো। তবুও ক্লাইমাস বললো,

আমি আসলে তোমাদের জেনারেল আবদুল করীমের সঙ্গে সাক্ষত করতে এসেছি। জানি, তোমরা আমার একথা বিশ্বাস করবে না। আমাকে শক্রদলের চর মনে করছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি স্পেনিশ আর্মিল লোক ছিলাম। এখন আর নই। সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। অবশ্য আমার বক্তব্যের পক্ষে কোন প্রমাণও নেই আমার কাছে।

ওরা সার্জেন্টের কথা বিশ্বাস করলো না। একজন তো বলেই ফেললো,

ওই বেটা! সাদা চামড়া। আর চাপা মেরো না। তোমরা ইউরোপীয়ানরা মিখা ছাড়া কথাই বলতে পারো না। তোমরা তো এদেশে এসেছিলে মারাকেশের নিরাপ চুক্তির অধীনে। এর অর্থ তো ছিলো আমাদের মারাকেশের মুসলমানদের জীবন হবে শান্তি-সুখের। কিন্তু তোমরা আমাদেরকে জাহান্নামের কীট বানিয়ে ছেড়েছে। আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে। ঘর-বাড়ি, টাকা-পয়সা, সুখ-শান্তি সব ছিনি। নিয়েছে। এখন দেখো তোমাকে আমরা কি করে জাহান্নামের কীট বানাই।

মুক্তিসেনাদের নিয়ম ছিলো, তাদের এলাকায় কোন গাদ্দার বা গুপ্তচর ধরা পড়লে তাকে জীবন্তু মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হবে। এজন্য তারা উপরস্থ কমান্ডারের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করতো না। সে নিয়ম অনুযায়ী তারা ক্যাম্পের কাছাকাছি একটা জায়গায় বড় করে গর্ত খুঁড়লো। এই গর্তের মধ্যে একজন মানুষকে সহজেই দাফন করা যাবে।

ঘটনাক্রমে সেখানে আবদুল করীমের নিকটস্থ এক কমান্ডার কোন এক কাজে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো। গর্ত খুঁড়তে দেখে সৈনিকদের কাছে ঘটনা জানতে চাইলো কমাণ্ডার। তাকে জানানো হলো, স্পেনিশ আর্মির এই গুপ্তচরের জন্য গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। কমাণ্ডার সার্জেন্ট ক্লাইমাসের বক্তব্য শুনলো। ক্লাইমাস সৈনিকদের যে কথা বলেছিলো তাকেও একই কথা বললো।

কমাণ্ডার তার কথা শুনে অনুভব করলো, তাকে আবদুল করীমের কাছে একবার নিয়ে যাওয়া উচিত। সে আসলেই গুপ্তচর হলে সেখানেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে। তা ছাড়া গুপ্তচর হলেও শক্ত জেরার মুখে মূল্যবান কোন তথ্যও তার কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে।

তাকে আবদুল করীমের সামনে উপস্থিত করা হলো। আবদুল করীম তাকে জিজ্ঞেস করলো,

কে তুমি? এদিকে এসেছো কেন? জানো না, এখানে ধরা পড়লে গুপ্তচরের অভিযোগে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।

আমার নাম ক্লাইমাস। সার্জেন্ট বললো, স্পেনীয় আর্মিতে সার্জেন্ট পদে ছিলাম। সার্জেন্ট হলেও মেজর কর্ণেলদের সঙ্গে আমার উঠাবসা ছিলো। কিন্তু আমাদের আর্মির লোকেরা এখানকার মুসলমানদের ওপর যে জুলুম অত্যাচার করেছে এবং দিন দিন তা যেহারে বেড়ে চলেছে, ওদের এই অমানুষিক পৈশাচিক আচার-আচরণ আমার বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছে। জীর্ণশীর্ণ মুসলমান বাচ্চাদেরকে স্পেনিশ অফিসারদের যেভাবে বেগার খাটাতে দেখেছি তা কোন পশুর পক্ষেও সম্ভব নয়। আট নয় বছরের ছেলে মেয়েদেরকে দিন রাত গাধার মতো খাঁটিয়ে এক বেলাও খাবার খেতে দেয় না ওরা।

কত বাচ্চাকে আমি না খেতে খেতে মরে যেতে দেখেছি।

নিষ্পাপ মেয়েদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে ক্ষতবিক্ষত করে গুলি করে মেরে ফেলে। যাকে ইচ্ছে তাকেই ওরা গুলি করে মেরে ফেলে। মুসলমানদেরকে ওরা মানুষই মনে করে না। ওদের যে হিংস্রতা ও পৈশাচিকতা আমি দেখেছি, তোমরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। তোমরা বাইরে থেকে ওদের যে অমানুষিকতার কথা শোনা তা খুব সামান্যই শুনে থাকো।

আমার হাতেও অনেক হিংস্র কাজ করানো হয়েছে। গত কয়েক রাত থেকে আমি ঘুমুতেও পারছি না। ক্ষুধার যন্ত্রণার ও বর্বর-পিশাচদের অত্যাচারে যে শিশুগুলো চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাদের রক্তাক্ত মুখগুলো আমাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না। আমার বিবেক আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। এত দিন পর আমার মৃত অনুভূতি-উপলব্ধি জেগে উঠেছে। আমাকে কুড়ে কুড়ে দংশন করছে। আমি এখন অনেকটা দিশেহারার মতো অবস্থায় পড়েছি। না হয় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এখানে আসার সাহস পেতাম না কখনো।

অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, যে ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মানুষের প্রতি দয়া, ভালোবাসা, সহমর্মিতা নেই সেটা কখনো সত্য ধর্ম হতে পারে না। আমাদের খ্রিষ্ট ধর্মে তো গড এর প্রতিও কাউকে বিশ্বাসী দেখা যায় না। তারা গীর্জা-চার্চ বানিয়ে রেখেছে মানুষকে দেখানোর জন্য। ওখানে কোন ইবাদত বা প্রকৃত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় না। যে পাদ্রীদের লোকেরা নিষ্পাপ বলে মনে করে তারা তো স্বার্থের সামান্য উপলক্ষ্যেই মিথ্যা বলে। মুসলমানদেরকে কি করে নাজেহাল করা যায়, কিকরে ধ্বংস করা যায়, তারা এ পরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। একেই তারা ইবাদত মনে করে। মুসলমানদের ব্যাপারে কেউ কোনো ভালো কথা বললে, তার মুখ চেপে ধরে। এভাবে পাদ্রী, যাযকরা খ্রিষ্টের অনুসারীদেরকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক হওয়ার শিক্ষা দান করেছে।

আমি শুনেছি তোমরা নাকি মালীলা থেকে এজন্য অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছো যে, শহর জয় করার পর সেখানকার ইউরোপীয় অধিবাসীদেরকে তোমাদের মুক্তিসেনারা নির্বিচারে হত্যা করবে। যা তোমাদের ধর্মে পাপ বলে মনে করে। অথচ তোমরা তা করলে আমরা খুব আশ্চর্যান্বিত হতাম না। কারণ, আমরা ইউরোপীয়ানরা যখন ওখান থেকে তোমাদেরকে বের করে দিয়ে তোমাদের ঘর বাড়িগুলো দখল করে নিয়েছিলাম, তখন আমরাও এর চেয়ে নির্মম আচরণ করেছিলাম তোমাদের সঙ্গে। আমি যে বাড়িটিতে থাকতাম, সেটাও কোন মুসলমানের বাড়ি। বাড়িতে একটা পুরনো কুরআন শরীফ পেয়েছিলাম। একবার ভেবেছিলাম সেটা ফেলে দেবো কিনা। কিন্তু মন সায় দিলো না। সেটা যত্ম করে আমার আলমিরার ভেতর রেখে দিলাম।

এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে এ কারণেই হয়তো গড আমার বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি কারণে মালীলা থেকে অবরোধ উঠিয়েছে সেটা শোনার পরই আমি আমাদের ধর্ম থেকে ফেরার হয়ে গেলাম। বহু কষ্ট করে অনেক অনুমান করে বের করেছি তোমাদের এ এলাকায় ক্যাম্প রয়েছে। আমি পায়ে হেঁটে এ পর্যন্ত পৌঁছেছি। এত মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ কিভাবে যে পাড়ি দিয়েছি তা জানি না। শুধু এতটুকু জানি, বিবেকের দংশনে কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

পাপের বিশাল এক পাহাড় আমার ওপর চেপে বসেছে। আমি সেটা নামাজে এসেছি। আমাকে সেই আলো দেখাও, যা আত্মজগতকে আলোকিত করে। যে আলো আমার ভেতরের অন্ধকারকে দূর করে দেবে। আর যদি আমাকে গুপ্তচর মনে করে মৃত্যুদণ্ড দিতে চাও, তবে আগে আমাকে মুসলমান বানিয়ে নিয়ে। যাতে আমি খোদার কাছে এমন পবিত্র মানুষ হয়ে পৌঁছতে পারি, যে তার সব পাপ থেকে তাওবা করে ধুয়ে মুখে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

তার কথাগুলো দারুণ হৃদয় ছোঁয়া ছিলো। সেখানে আবদুল করীমের সঙ্গে যে কমান্ডাররা ছিলো তাদের মনে কথাগুলো ভীষণ দাপ কাটলো। তবে আবদুল করীমের মতো এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টির এক কমান্ডার তার কথায় বেশ প্রভাবান্বিত হলেও সহসাই এ ফায়সালা করতে পারছিলো না যে, স্পেনীয় আর্মির এই সার্জেন্ট কোন গুপ্তচর নয়। বিচক্ষণ-দূরদর্শী কোন কমাণ্ডারের পক্ষে হঠাৎ করে কারো ব্যাপারে এমন নিশ্চিত ফায়সালায় পৌঁছা সম্ভব নয়। তাই আব্দুল করীম অনেকটা নির্বিকার কণ্ঠে বললো,

দেখো সার্জেন্ট! তুমি যা কিছু বলেছে, তা সত্য না মিথ্যা সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আশা কর আমরা কোন ইঙ্গিত পেয়ে যাবো তোমার আসল পরিচয় সম্পর্কে। এখন আমরা যা করতে পারি তা হলো, তোমার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করে দিতে পারি। তুমি এখন আমাদের নজরবন্দি অবস্থায় থাকবে।

তারপর আবদুল করীম নিজের সঙ্গেই রাখলো সার্জেন্ট ক্লাইমাসকে। কারণ সে গুপ্তচর না হলে তার কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়ার ছিলো। সে ক্ষেত্রে সে নিজেও কম মূল্যবান নয়। সে যেখানেই যেতো, যাই করতো তার ওপর সবসময় বার জোড় চোখ কঠিন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতো। সেটা এমন সন্তর্পণে যে, যে ছয়জন ছাড়া মুক্তিসেনাদের অনেক কমাণ্ডারও এ ব্যাপারে কিছু জানতো না।

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এটা প্রমাণিত হয়ে গেলো যে, সার্জেন্ট ক্লাইমাস কোনো গুপ্তচর নয়।

ক্লাইমাস স্পেনিশ ও ফ্রান্সীয়দের ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য দেয়। তাদের সেনাবিন্যাস ও বিভিন্ন গুপ্ত স্কোয়াডের ব্যাপারে অভাবনীয় অনেক বিষয় আ তার কাছ থেকে জানা যায়। আবদুল করীমের মনে হলো, আল্লাহ তাআলা তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ, এসব বিষয় কখনোই মুসলিম মুক্তিসেনারা জানতে পারতো না। এখন রণাঙ্গনের অনেক ক্ষেত্রে তড়িং ফায়সালা করাটা আবদুল করীমের জন্য সহজ হয়ে গেলো।

তারপর ক্লাইমাস গুপ্তচরবৃত্তির ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বও নিয়ে নেয় স্বেচ্ছায়। বেশ কয়েকটি নৈশ হামলায় দারুণ বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব দেখায়। ব্যক্তি হিসেবে ক্লাইমা খুব অমায়িক ও সদালাপী। মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে। এজন্য অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ক্যাম্পের সবার কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। একদিন সে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয় এবং সবার সামনে মুসলমান হয়ে যায়। আবদুল করীম তার নাম রেখে দেয় হুজ্জুল আয়মান।

***

ইতিমধ্যে মারাকেশের মরু এলাকার কিছু মরুচারী গোত্র সরদার ও আবদুল করীমের মুক্তিসেনা দলে যোগ দেয়। এদের মধ্যে এক সরদার তো তার পুরো গোত্র ও পরিবারসহ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। এই সরদারের নাম সাজিদ পারহী। সাজিদ পারহীও বেশ সদালাপী মানুষ। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে হুজ্জুল আয়মানের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে।

হুজ্জুল আয়মান (সার্জেন্ট ক্লাইমাস) দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলো। ইসলাম গ্রহণের পর সে খুব নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়ে যায়। অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে তাকে ইসলামী বিধি-বিধান পালনে বেশ যত্নবান দেখা যায়।

এই মাস দুয়েকের মধ্যে তার দাঁড়িও বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। আগেই আয়মানকে বেশ সুদর্শন লাগতো। এখন ঘন চাপদাড়িতে আরো সুদর্শন লাগে।

গোত্র সরদার সাজিদ সারহীর কাছে হুজ্জুল আয়মানকে এতই ভালো লেগে গেলো যে, তাকে তার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলো। মুক্তি সেনাদের হেডকোয়ার্টার থেকে তার বাড়ি মাইল খানেক দূরে। সাজিদ সারহী আবদুল করীমকে একদিন বললো,

ভাই আবদুল করীম! তোমাদের এই নওমুসলিম হুজ্জুল আয়মানকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। আমি চাই ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে অতিথি হিসেবে রাখতে। ও আমাদের চেয়েও পাক্কা মুসলমান হয়ে উঠছে। ওর মতো একজন মানুষের সেবা করতে পারাও ভাগ্যের ব্যাপার।

এতো খুব ভালো প্রস্তাব! তোমার এ কথায় আমার ইসলামের প্রথম যুগের আনসার সাহাবীদের কথা মনে পড়ে গেলো। আনসার সাহাবীরা এভাবে মুজাহিরদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছিলেন। তবে হুজ্জুল আয়মান স্বতস্ফূর্তভাবে তোমার মেহমানদারি গ্রহণ করে কিনা সেটাও যাচাই করে নিয়ে। আবদুল করীম বললো।

সাজিদ সারহীর প্রস্তাবে হুজ্জুল আয়মানে প্রথমে তার বাড়িতে এভাবে যেতে মৃদু আপত্তি করলেও আবদুল করীমের কথায় তার সে আপত্তিও কেটে গেলো।

এখন দিনের বেলায় হুজ্জুল আয়মান ক্যাম্পে চলে আসে। কাজ শেষ করে বিকালে বা সন্ধ্যায় সরদার সারহীর বাড়িয়ে চলে যায়।

সাজিদ সারহীর একটি মাত্র মেয়ে সন্তান। জুমানা সারহী। অপরূপ সুন্দরী। নিজেদের মাতৃভাষা টুকটাক ইংরেজি, ফ্রান্স ও স্পেনিশ ভাষাও বুঝে। বলতেও পারে। তো জুমানা সাহরী বেঁকে বসলো। সে তার বাবা সাজিদ সারহীকে বললো,

বাবা! তুমি কিভাবে এক ইউরোপিয়ানকে ধরে নিয়ে এলে?

আহ মা! সাজিদ বললো, আস্তে কথা বলল।

এখান থেকে চিৎকার করে কথা বললেও ওই সাদা চামড়া আমার কথা শুনতে পাবে না। কারণ, সে এখন এখানে নেই। তোমাদের ক্যাম্পে ফিরে গেছে।

এই ছেলে তো এখন শুধু ইউরোপীয়ান নয়, সে মুসলমান হয়ে গেছে। সে স্পেনিশ আর্মির সার্জেন্ট ছিলো। আমাদের কমাণ্ডার আবদুল করীমের আদর্শ তাকে মুগ্ধ করে। এজন্য সে এখানে এসে মুসলমান হয়ে যায়।

কোন খাঁটি মুসলমানকে এভাবে স্থায়ী মেহমান হিসেবে আনতে পারলে না?

সেই ছেলে হুজ্জুল আয়মান শুধু খাঁটি মুসলমান না, আমাদের চেয়ে ভালো মুসলমান।

ছাই মুসলমান! আমরা জন্ম থেকে মুসলমান হয়েও খাঁটি মুসলমান হতে পারলাম না। আর সে দুদিনেই খাঁটি মুসলমান হয়ে গেলো! শোন বাবা! তোমার মনে রাখা দরকার, এ শোক খ্রিষ্টান ছিলো। এরা মুসলমানের চিরশত্রু। মুসলমানদের জন্য এরা বিষধ সাপের চেয়ে ভয়ংকর। সাপকে দুধ কলা দিয়ে পুষলেও সে সুযোগ পেলেই ছোবল মারে, দংশন করে। এই লোকও দেখবে এক সময় তার ফণা তুলে তোমাদেরকে ছোবল মারছে।

মানুষ আর সাপ কি এক মা! সাজিদ সারহী খুব নরম গলায় বললো, সাপের জন্মই হয় হিংস্রতা নিয়ে। আর মানুষ কল্যাণ ও শুভবার্তা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তারপর মা-বাবা, পরিবার বা প্রতিবেশী কিংবা পরিবেশের কারণে সে মুসলমান, ইহুদী, খ্রিষ্টান বা অন্য কোন ধর্মালম্বী হয়। কেউ জন্ম থেকে মুসলমান হলেই খাঁটি মুসলমান হতে পারে না, তার ঈমান ও কর্মকাণ্ড ঠিক না করলে। দেকা যায় একজন মুসলমান সারা জীবন তার ঈমান আমল ঠিক না করার কারণে পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হতে পারে না। আবার একজন ঘার নাস্তিক বিশুদ্ধ ঈমান-বিশ্বাস নিয়ে মুসলমান হয়ে সঠিক নিয়মে ইবাদত-বন্দেগী করে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে খাঁটি মুসলমান হয়ে যেতে পারে অল্প সময়েই। মুসলমান বা খাঁটি মুসলমান হওয়া পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কোন বিষয় নয়। এটা কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। যেটা অধিকাংশ মুসলমানই অর্জন করতে পারে না। এ কারণেই আজ দুনিয়ায় সত্যিকার মুসলমানের সংখ্যা কমে গেছে।

দেখো না মারাকেশ সেই কবে দখলদাররা দখল করে নিয়েছে। কোন মুসলমান কি এতদিন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে? মুসলমানরা শুধু মারই খেয়েছে। যেন মার খাওয়াই মুসলমানদের কাজ! মুসলি নারীদের সম্ভ্রম লুটতে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব? এটা সম্ভব হয়েছে মুসলমানদের ঈমান অতি দুর্বল হওয়ার কারণে। আজ মুসলমানরা সবখান থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। ঈমান দুর্বল হওয়াতে এক মুসলমান আরেক মুসলমানের প্রতি কোন দায়বোধ করে না। কোন সহমর্মিতা পোষণ করে না। বিশ্বাস ও ভরসা রাখে না। এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে প্রতিপক্ষ মনে করে। যেমন তুমি এই বেচারা আয়মানকে সহ্য করতে পারছে না।

দেখো বাবা! তুমি আমার ঈমান দুর্বল বলতে পারো। আমল মন্দ বলতে পারো এবং আমাদের ঈমান যে খুব শক্তিশারী না তাও আমি স্বীকার করবো। কিন্তু একজন মুসলমানকে সহ্য করতে পারছি না একথা তুমি বলতে পারো না। আমি এত খারাপ মেয়ে নই। ওই লোককে তো সামনাসামনি দেখিইনি। দূর থেকে দেখেছি। তাও অনিচ্ছাকৃত। একজন মেয়ে হিসেবে তাকে দেখলে আমার মনে হয় যে কেউ পছন্দ করবে। কিন্তু কোন ইউরোপীয়ান দেখলে আমার মনে পড়ে যায়, মুসলমানদের প্রতি তাদের হিংস্র আচরণের কথা। তাই তুমি যত কথাই বলো মুসলমান হিসাবে তাকে আমার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। জুমানা সারহী বললো।

দেখো জুমানা! আমাদের কমান্ডার আবদুল করীম কী বলেছে জানো? সে সবসময়ই একথা বলে যে, এক মুসলমানের প্রতি আরেক মুসলমানের যদি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে, তাহলেই মুসলমানরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। আর এ সম্পর্ক গড়ে উঠবে একমাত্র ঈমান ও আমলের সূত্র ধরে। যখন মুসলমানদের মধ্যে এ জিনিসটা ছিলো, তখন মুসলমানরা বিশ্ব শাসন করেছে।

হাজার হাজার মাইল দূরের সেই ভারতের সিন্ধু থেকে এক অসহায় নারী চিঠি পাঠিয়েছিলো হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে। সেই মাজলুমা নারীর ডাক শুনে মুহাম্মাদ ইবনে কাসেম ছুটে এসেছিলেন ভারত বর্ষে। তারপর ভারতবর্ষ অর্থাৎ পুরো উপমহাদেশ জয় করেন। শুধু কি তলোয়ারের জোরে। অধিকাংশ বিজয়ই অর্জন করেছিলেন বিনা রক্তপাতে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু তখন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুহাম্মাদ ইবনে কাসেম যদি তাদেরকে হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়ার কারণে দূরে সরিয়ে দিতেন, বুকে তুলে না নিতেন, তাহলে কি অবস্থা হতো বিশ্ব মুসলিমের? তাই জুমানা! বুঝতে চেষ্টা করো। ইহুদী-খ্রিষ্টানরা আমাদের শত্রু ঠিক; কিন্তু তারা মুসলমান হয়ে গেলে আমাদের বন্ধু হয়ে গেলো।

***

সরদার সাজিদ সারহী এমনিতে বেশ আবেগী মানুষ। তবে একসময় ধর্মকর্মের খুব একটা মনোযোগী ছিলো না। আবদুল করীমের সান্নিধ্যে এসে তার জীবন আমূল পাল্টে যায়। এই চেতনা সে তার গোত্রের মধ্যে বিপ্লব আকারে ছড়িয়ে দেয়। এজন্য তার সঙ্গে তার গোত্রের লোকেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিসেনায় যোগ দেয়। তবে আজ সাজিদ সারহীকে যেন কথায় পেয়েছে। তার মেয়ে জুমানা এটা বুঝতে পারলো। তাই তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

ঠিক আছে বাবা! তুমি যা বলেছে সবই ঠিক। তোমার সেই হুজ্জুল আয়মান সাহেবও ভালো মানুষ। তাকে আমি খাঁটি মুসলমান হিসেবে মেনে নিচ্ছি। তবে তাকে বুকে তুলে নিতে পারবো না। সে তোমার বুকেই থাক। একথা বলে ফিক করে হেসে ফেললো জুমানা। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

সাজিদ সারহী দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি তার বেশ জেদি হয়েছে। তবে ওর সুন্দর একটা মনও আছে। ইসলামের প্রতিও তার দায়বোধ আছে। কিন্তু আয়মানের প্রতি যে কেন এমন বিরূপ মনোভাব সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সাজিদ সারহী।

এর দুদিন পর রাতে এক স্পেনিশ চৌকিতে গেরিলা হামলার কথা। গেরিলা দলে সাজিদ সারহী ও হুজ্জুল আয়মানও নাম লিখিয়েছে। গভীর রাতে দলটি স্পেনিশ চৌকিতে আক্রমণ চালালো। চৌকিতে শতিনেক আর্মি ছিলো। চৌকির চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত কড়া প্রহরা বসিয়ে রেখেছিলো স্পেনিশরা। গেরিলা দলে স্পেনিশ চৌকির অনেক দূর থেকেই অতি নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে থাকে। এ কারণে প্রহরায় থাকা স্পেনিশ আর্মিরা টের পায়নি কিছুই।

টের পায় তখনই যখন পেছন থেকে ছোরা বা খঞ্জরবিদ্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। কিন্তু এরপর তো আর কিছুই করার কথা নয়। এভাবে একে একে সতের জন আর্মি প্রহরীকে নিঃশব্দে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে চৌকিতে হামলা চালায় গেরিলারা।

ভেতরের স্পেনিশ সেনারা তো জানে বাইরে নিশ্চিদ্র প্রহরার ব্যবস্থা আছে। কোন চিন্তা নেই। কিছু ঘটলে প্রহরীদের কাছ থেকে আগাম সংবাদ পেয়ে প্রস্তুত হয়ে যেতে পারবে। সেই ভেবে তারা নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছিলো। তাই ঘুমের তিনভাগের এক ভাগ সৈন্য খতম হয়ে যায়। যারা ঘুম থেকে জাগতে পারলো তারা চরম আতঙ্ক ও ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেলো। অনেকে সামলে উঠে লড়তে চেষ্টা করলো। কেউ কেউ আবার পালাতে চেষ্টা করলো।

পালাতে গিয়েও কিছু মারা পড়লো। যারা লড়তে চেষ্টা করলো, তারা এলোপাথারি গুলি ছুড়ছিলো। তাই তাদের গুলির টার্গেট নিজেদের লোকরাই হতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে অধিকাংশ স্পেনিশ আর্মিই নিজেদের প্রাণ নিয়ে পালাতে লাগলো।

হুজ্জুল আয়মান অর্থাৎ সার্জেন্ট ক্লাইমাস পলায়নরত এক স্পেনিশ অফিসারকে মাত্র যমের বাড়ি পাঠিয়েছে, অমনি তার কানে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠের এক চিৎকার। আওয়াজটা এসেছে ডান দিক থেকে। সেদিকে তাকিয়ে দেখলো, ত্রিশ পঁয়ত্রিশ গজ দূরে একটা তাবুর পেছন দিকে সাজিদ সারহীকে দুই স্পেনিশ ধরে রাইফেলের বাট দিয়ে মারছে।

আয়মান মুহূর্তের মদ্যে সেখানে পৌঁছে গেলো। গুলি না চালিয়ে একজনকে সজোরে কোমরে লাথি মারলো। লাথি খেয়ে ঘোত করে পড়ে গেলো সৈন্যটি। সঙ্গে সঙ্গে পাশের জনকেও একই কায়দায় লাথি চালালে। রাইফেল ফেলে সেও পড়ে গেলো। মাটিতে পড়েই দুই চিত্তার জুড়ে দিলো, ক্লামাসকে পাওয়া গেছে। ক্লাইমাসকে পাওয়া গেছে।

স্পেনিশরা ক্লাইমাস ফেরার হয়ে যাওয়ার পর তাকে জীবিত ধরতে অনেক চেষ্টা করে। তারপর ঘোষণা দেয়, যে তাকে জীবিত বা মৃত ধরতে পারবে, তাকে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।

এ কারণেই দুই স্পেনিশ মৃত্যুর মুখে পড়েও যখন ক্লাইমাসকে চিনতে পারলো, তখন দশ লক্ষ টাকার লোভ দুজনের মৃত্যুভয় দূর করে দিলো। তারা ক্লাইমাস বলে চিৎকার করতে লাগলো। অন্যান্য স্পেনিশ আর্মিরা তো যে যেভাবে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। কারো দিকে কারো কোন খেয়াল নেই। তবে দুজনের চিৎকার শুনে একজনকে দৌড়ে এদিকে আসতে দেখা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক লক্ষ করে গুলি চালালে ক্লাইমাস ওরফে আয়মান। দেরি না করে পড়ে থাকা দুজনকেও চিরদিনের জন্য চুপ করিয়ে দিলো।

তারপর রাইফেল রিলোড করে ককেয় মিনিট অপেক্ষা করলো কেউ এ দিকে আসে কি না। না, আর কেউ এলো না। তারপর মনোযোগ দিলো সাজিদ সারহীর দিকে। আর সাজিদ পড়ে আছে নিস্তেজ হয়ে। তার মাথা ও মুখ রক্তাক্ত। রাইফেল দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছে।

আয়মান ডাকলে তাকে সরদার…. সরদার! কি অবস্থা তোমার?

পানি… পানি.. আমার মেয়ে, জুমানা… তারপর তার কথা বন্ধ হয়ে গেলো।

আয়মান দ্রুত নাড়ি পরীক্ষা করলো। নাড়ি চলছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে। মশালের আবছা আলোয় সব দেখা যাচ্ছে। স্পেনিশ এই ক্যাম্পটি এখন মুক্তিসেনাদের গেরিলা ইউনিটের দখলে। জীবিত কোন স্পেনিশ আর্মিকে দেখা যাচ্ছে না। অগণিত স্পেনিশ আর্মির লাভ চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিছু আহত আর্মি গোঙাচ্ছে, কাতরাচ্ছে। গেরিলারা আহতদের উঠিয়ে নিচ্ছে। নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে এদেরকে সুস্থ করে তোলা হবে যুদ্ধবন্দি হিসাবে।

আয়মান এক গেরিলাকে ডেকে আনলো। দুজনে মিলে সাজিদ সারহীকে উঠিয়ে নিলো।

ক্যাম্পে এনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর সাজিদ সারহীর জ্ঞান ফিরে এলো। মাথার ডান দিকে কানের নিচে আঘাত করা হয়েছে। সে জায়গাটা প্রায় থেতলে গেছে। সেখান দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরছিলো। শল্য চিকিৎসক এক ধরনের পাউডার দিয়ে রক্ত ঝড়া বন্ধ করে দিলো। মুখেও ঔষধ দিলো। তারপর মধুযুক্ত দুধ পান করানো হলো। এতে সরদারের ফ্যাকাশে চেহারায় কিছুটা প্রাণ ফিরে এলো। সেখানে আবদুল করীমও ছিলো। আবদুল করীম হুজ্জুল আয়মানকে বললো,

আয়মান! সরদারকে তুমি বাড়ি নিয়ে যাও। তুমিও দুতিন দিন বিশ্রাম নিয়ে। সরকারের প্রতিও খেয়াল রেখো। ওর যখম মারাত্মকই বলা যায়। তবে ওর শরীর বেশ শক্ত। দেখছো না একটা চুলেও পাক ধরেনি! তাই আশা করা যায়, ওর যখম তাড়াতাড়িই শুকিয়ে যাবে। যখম শুকিয়ে গেলেও হপ্তাখানেক বিশ্রামে যেন থাকে।

আকি কাল বাদে পরশুও সুস্থ হয়ে যাবো। সরদারের দুর্বল কণ্ঠেও জযবার উত্তাপ টের পাওয়া গেলো। আমাকে নিয়ে ভেবো না কমান্ডার! স্পেনিশরা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গেছে। এটা শুধু মনে রেখো।

চমৎকার, চমৎকার সরদার! আবদুল করীম খুশি হয়ে বললো। তুমি পরশু কেন? আজই তো সুস্থ হয়ে গেছে। তবে সেটা মানসিকভাবে। দৈহিকভাবে সুস্থ হতে হপ্তা দেড়েকের কম লাগবে না। তাই ততদিন নিজের আবেগ-জ্যবাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।… আব্দুল করীম তারপর হুজ্জুল আয়মানের দিকে ফিরে বললো, আয়মান! আর দেরি করো না। সরদারকে বাড়ি নিয়ে যাও।

***

কি করে বাবার এ অবস্থা হলো? জুমানা তার বাবার মাথায় এত বড় ব্যাণ্ডেজ বাধা দেখে প্রায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যখম বেশি গুরুতর নয়। হপ্তাখানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। আয়মান নিচু স্বরে বললো জুমানাকে।

কারণ সাজিদ সারহীকে বিছানায় শোয়ানো মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। এটা ঔষধের প্রতিক্রিয়া।

জুমানা তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলো, তার বাবার এ অবস্থা কি করে হয়েছে? আয়মান সংক্ষেপে জানালো, গেরিলা হামলা ও সেখানে সরদারের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। ডাক্তার কি বলেছে, কি ঔষধ দিয়েছে এবং আবদুল করীম কী বলে দিয়েছেন সেসব কথাও বললো আয়মান। শুধু বাদ দিলো, সে যে নিজের একক প্রচেষ্টায় সরদারকে বাঁচিয়েছে সে প্রসঙ্গ।

জুমানা আরো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চোখমুখ ফুলে গেছে। উজ্জ্বল লাল আভা পুরো চেহারায় ছড়িয়ে পড়েছে। এতে তার মুখের স্বর্গীয় রূপ আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রূপের এমন নিষ্পাপ বৈচিত্র আয়মান মনে হয় আর কোন দিন দেখেনি। তার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো।

একবার তার কাছে মনে হলো, কারো সৌন্দর্যে এভাবে মুগ্ধ হলো প্রশংসাসূচক দুএকটা বাক্য তাকে বলতে হয়। পরক্ষণেই মনে হলো, এতো ইউরোপীয়ান রীতি। তার বাড়ি পশ্চিম জার্মানিতে। জার্মানিদের মধ্যে এ রীতির প্রচলন আছে। সে তো এখন মুসলমান। এ সুন্দরী অপ্সরীও একজন মুসলমান। তাকে কি বলা যায়? কিংবা আদৌ কিছু বলা উচিত কি না ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিলো না আয়মান। জুমানা তখনো তার বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার ফোলা চোখ দুটো ছলছলে।

আয়মানের তখনই মনে পড়লো, আরে তাকে তো এ ব্যাপারে পরিস্কার একটা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। সেটা চমৎকার এবং সবচেয়ে নিরাপদ সামাজিক রীতি। এর মধ্যে দারূণ মানষিক আবেদনও আছে। আছে শালীন-সভ্য আদর্শ।

সেটা হলো, কোন নারীর দিকে ইচ্ছে করে তাকাতে নেই। এমনকি নির্দোষ দৃষ্টিতে তাকাতে নেই। আর কাম-দৃষ্টিতে তাকানো তো সরাসরি পাপ। অসভ্যতাও। ইসলাম এক শালীনতা বিবর্জিত একটা অপরাধ বলে গণ্য করেছে। কোন নারীর দিকে চোখ পড়লে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া উচিত। দ্বিতীয়বার আর তাকানো উচিত নয়। প্রথমবার যে অনিচ্ছায় বা কোন বিশেষ প্রয়োজনে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে এটা দোষণীয় কাজ হিসাবে গণ্য হবে না। এজন্য পাপও হবে না। তবে দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত করাটা দোষণীয় এবং এজন্য পাপও লেখা হবে।

হুজ্জুল আয়মানের একথাটা মনে পড়তেই তার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। সে সঙ্গে সঙ্গে জুমানার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।

এখন রাতের শেষ প্রহর চলছে। ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। সরদার অঘোরে ঘুমুচ্ছে। মুখেও যন্ত্রণার ছাপ নেই। এর অর্থ হলো, ঔষধ বেশ ভালো কাজ করেছে। এখন আর এখানে না থাকলেও চলবে। ডাক্তারের কথামতো সরদারের ঘুম দুপুরের আগে ভাঙ্গবে না।

ইয়ে… শুনুন! আয়মান ইতস্তত করে বললো জুমানাকে এবং অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে, আপনি গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি উনার পাশে বসছি। এখন আর উনি ঘুম থেকে উঠবেন না।

জুমানার চোখ এড়লো না, আয়মান তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেদহীন শরীর। ছয় ফিটের মতো লম্বা। বয়স কত হবে? ত্রিশ বত্রিশ। তার বাবার সামনে যখন দাঁড়িয়ে ছিলো আয়মান, তখনই জুমানা লক্ষ্য করেছে, একে নিঃসন্দেহে সুঠামদেহী সুপুরুষ বলা যায়। ইউরোপীয়ান হলেও দেহবর্ণ এতটা শ্বেতকায় নয় যে, চোখে রাগে। এর মধ্যে বাদামী বর্ণের ছোঁয়া আছে।

আয়মান যে জুমানার প্রতি সশ্রদ্ধ-সমপূর্ণ পরিবেশ রক্ষা করে ওভাবে দৃষ্টি আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে, এটা জুমানার কাছে ভালো লাগলো। তার মনের অজান্তেই কৃতজ্ঞতার একটা ধারা তাকে নাড়া দিয়ে গেলো। এই প্রথম তার মনে হলো, এ লোকটির প্রতিই এত দিন জুমানা এক ধরনের তাচ্ছিল্যের মনোভাব পোশণ করে রেখেছিলো। এটা মনে হয়, ঠিক ছিলো না। বেশি সময় এভাবে নিরুত্তর থাকাও যে ঠিক নয় এটাও তাকে তাড়া করলো। তাই খুব নরম গলায় বললো,

ইয়ে… আয়মান সাহেব! বরং আপনি গিয়ে শুয়ে পড় ন। আমি তো এতক্ষণ ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। আমার ঘুম প্রায় হয়ে গেছে। আপনি তো বড় ক্লান্ত। রাতভর লড়াই করেছেন। তারপর এমন যখমী একটা মানুষকে এতদুর বয়ে নিয়ে এসেছেন। ধকল তো কময় যায়নি। ফজর হতে এখনো বেশ সময় বাকি। এতটুকু সময় বিশ্রাম করুন গিয়ে। ততক্ষণ আমি এখানে বসে থাকি।

না, ধন্যবাদ! এখন ঘুমুলে ফজরের সময় আর উঠতে পারবো না। ঠিক আছে, আপনি এখানে বসে থাকুন। আমি বাইরে গিয়ে বসি। একথা বলতে বলতে আয়মান বাইরে চলে গেলো।

না, আপনি ভেতরেই বসুন। বাইরে কুয়াশা পড়ছে … এতটুকু বলে জুমানা বুঝতে পারলো ঘরের ভেতর সে লোকটি আর নেই। তার মুখ খোলর আগেই বাইরে চলে গেছে।

জুমানা চেয়ার থেকে উঠ আলতো পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। বাইরে উঁকি দিলো। ভোরের আবছা আলোয় দেখতে পেলো, ঘরের সামনের টিলার ওপর একটা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। মানুষটি বসে আছে। জুমানা আবার ঘরের ভেতর চলে গেলো। চেয়ারে বসে পড়লো। তার বাবা একটু নড়ে উঠলো এ সময়। পাশ ফিরতে চাচ্ছে। জুমানার সাহায্যে ঘুমন্ত অবস্থাতেই পাশ ফিরলো ডান দিকে। চোট পেয়েছে মাথার বাম দিকে।

জুমানা লক্ষ্য করলো, তার বাবার ঠোঁট দুটি নড়ছে। কিন্তু একটা বলছে হয়তো। তার মুখের কাছে জুমানার কান নিয়ে গেলো। তার বাবা বিড় বিড় করছে,

আয়মান। … আ… আ.. জু.. জুমানকে … দেখো… দুবার এমন বিড় বিড় করেই তার বাবা আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।

জুমানা বুঝতে পারলো, হামলার সময়ের ভয়াবহ কোন দৃশ্য মনে হয় স্বপ্নে হানা দিয়েছে। কিন্তু আয়মানের কথা যে বললো তার বাবা সেটার কারণ কী? তাহলে কি আয়মানই হামলাকারীদের হাত থেকে তার বাবাকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু আয়মান তো ঘটনা বলার সময় একবারও তার ভূমিকার কথা বলেনি! এর রহস্য কী?

***

বাইরের প্রকৃতি আলো আঁধারিতে বেশ বৈচিত্র্যময়। এর মধ্যে আবার কুয়াশার হালকা চাদর খণ্ড খণ্ড ভাবে চারদিক আলতো করে ঢেকে রেখেছে। গ্রীষ্মের শেষ দিক এখন। পাহাড়ি এলাকাহওয়াতে এখানে এভাবে এসময় কুয়াশা পড়ছে।

সরদারের বাড়িটি মাঝারি ধরনের একটি পাহাড়ের নিচে। এই পাহাড়ের আশেপাশেই তার গোত্রের লোকেরা বসবাস করছে। পাহাড়ের ডানে-বামে ও সামনের দিকে উঁচু নিচু বেশ কিছু টিলা রয়েছে। দুএকটি টিলা শিলাপাথরের। একেবারে ন্যাড়া, তৃণ লতাহীন। আর অন্যগুলো বৃক্ষলতার ছাওয়া। দারুন সবুজ। অপরূপ দৃশ। কুদরত যেন নিজ হাতে এখানে নিসর্গকে সাজসজ্জা পরিয়েছে। আয়মানের কাছে জায়গাটি বেশ লাগে।

বাড়ির সামনের একটি টিলার চূড়ায় গিয়ে বসলো আয়মান। এসময় এখানে এসে বসার কোন অর্থ নেই। আয়মান বসতেও না। আসলে একটু নির্জনতার ছোঁয়া পাওয়ার জন্য আয়মানের মন উসখুস করছিলো। গত কয়েক মাসে ওর জীবনে যা কিছু ঘটেছে গত একত্রিশ বছরের জীবনের অতীতের সঙ্গে যেন এর কোন তুলনাই হয় না।

স্পেনিশ কাম্প থেকে ফেরার হয়ে মুসলিম ক্যাম্পে আসা, এখানে এসে মুসলমান হয়ে যাওয়া, আবদুল করীমের সান্নিধ্যে নিজের স্পেনিশ আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করা। তারপর এই সরদার সাজিদ সারহীর সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্টতা, অবশেষে সরদারের আহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার মেয়ে জুমানার মুখোমুখি হওয়া- এসবকিছুই যেন ওর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।

আর এখন ওর মনে জুমানার অস্তিত্ব এসবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে। ওর আগের জীবন হলে জুমানা খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ছিলো না। কারণ আয়মানের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে সে রক্ষণশীল বলে পরিচিত ছিলে। মদ ও নারীর ব্যাপারে ও খুব সংযমী ছিলো। তারপরও ওর গোটা চারেক মেয়ে বন্ধু ছিলো। ওরাও কারো চেয়ে কেউ কম সুন্দরী ছিলো না। কিন্তু ওদের সঙ্গে জুমানাকে কোনভাবেই যেন মেলানো যায় না। হঠাৎ জলোচ্ছাস যেমন মুহূর্তেই সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে হঠাৎ করেই আবার নেতিয়ে পড়ে। ওদের প্রেম, ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস এমন হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসের মতোই।

আর জুমানাকে গভীর কোন জলপ্রপাত বা বিশাল কোন দীঘির সঙ্গেই তুলনা করা যায়। যার মধ্যে আনন্দময়ী তরঙ্গ আছে, উচ্ছ্বাস আছে, আছে প্রবাহের অবিরত ধারা।

আয়মান ভাবছে, যত কিছুই হোক এমন নির্জনে এবং সহানুভূতির একটা পরিবেশে এমন একটা মেয়েকে পেয়ে কেউ সুযোগ নিতে ছাড়তো না। কমপক্ষে দুটো ভালো লাগার কথাও বলতো। দীর্ঘ সময় তার সঙ্গ উপভোগ করতো। আয়মান যে তা করেনি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, এটা তার জীবনে একটা অভাবিত ঘটনা। সন্দেহ নেই, ইসলামই তার মধ্যে এই অমিত শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে।

আয়মানের মধ্যে হঠাৎই আরেক প্রশ্ন জেগে উঠলো, সরদারের বাড়িতে সরদার ছাড়া তার একমাত্র মেয়ে, একজন গৃহপরিচারিকা ও দুজন কাজের লোক- এ কজনই সদস্য। ওরা থাকে বারি বাইরে ভিন্ন কোঠায়। সরদার ও তার মেয়ে থাকে বাড়ির ভেতরে। আয়মানের জন্যও বাড়ির ভেতরই ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকগুলো রুম রয়েছে বাড়ির ভেতরেও। এখানে একজন কেন নিয়মিত কয়েকজন অতিষি এতে থাকতে পারে। কিন্তু এমন একটা মেয়ে থাকতে আয়মানের কি এখানে একা একা থাকাটা ঠিক।

অবশ্য ওর প্রতি সরদারের শতভাগ আস্থা আছে। কিন্তু ওর নিজের প্রতি নিজের আস্থা কতটুকু? না, ওর আর এখানে এভাবে থাকাটা ঠিক হবে না। সরদারের অবস্থা একটু ভালো হলেই ও ক্যাম্পে থাকা শুরু করবে।

***

বেলা এগারটা নাগাদ সরদারের ঘুম ভাঙ্গলো। জুমানা তার বাবার মাথার কাছের চেয়ারে বসা ছিলো। তার বাবাকে নড়তে দেখে এবং চোখ খুলে তাকাতে দেখে উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো,

বাবা! এখন কেমন লাগছে জুমানা বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেললো।

ঘাড়ডিয়োনা বেটি। আমি এখন অনেকটাই সুস্থ। শুধু মাথার বাম দিকটা একটু চিনচিনে ব্যথা আছে। বলতে বলতে সরদার উঠে বসলো।

আরে উঠছো কেন? যখমের ক্ষতি হবে তো?

 কিছুই হবে না মা! শোয়র চেয়ে বেস থাকতেই ভালো লাগছে।

জুমানা লক্ষ্য করলো, আসলেই তার বাবাকে এখন অনেকটাই সুস্থ লাগছে। আগেই স্যুপ বানিয়ে রেখেছিলো। সেটা যত্ন করে তার বাবাকে খাইয়ে দিলো। তারপর দুধ মধু মিশ্রণে ঔষধ খাইয়ে দিলো।

বাবা! এখন কি একটু ভালো লাগছে।

হা মা! এখন বেশ চাঙ্গা বোধ করছি। জুমানা! আয়মান কোথায়?

সম্ভবত ক্যাম্পে চলে গেছে।

সেকি ওকেও তো কমান্ডার দুএকদিন বিশ্রামে থাকতে বলেছে। তাহলে ক্যাম্পে চলে গেলো কেন? তুমি ওর সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেছো?

সে কি বাবা! আমাকে তুমি এত অভদ্র মেয়ে মনে করো? আহত গলায় বললো জুমানা।

না, মানে তুমি একদিন ওর ব্যাপারে অনেক অভিযোগ করেছিলে।

তখন তো ওর ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। তা ছাড়া আজ তো আর কোন অভিযোগ করিনি।

তাহলে মা! এখন ওর ব্যাপারে কি জানতে পেরেছে?

কেন তুমিই তো সেদিন ওর ব্যাপারে লম্বা বক্তৃতা দিলে। আর কাল রাতে ও যে যত্ন নিয়ে তোমাকে এখানে এনে শুইয়ে দিয়েছে, তোমার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করেছে এবং আন্তরিকতা দেখিয়েছে এটা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, উনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। শেষের কথাগুলো জুমানা লাজুক কণ্ঠে বললো।

হ্যাঁ, আমি অনুমান করেছিলাম তুমি নিজেই একদিন ওর ব্যাপারে প্রশংসার সার্টিফিকেট দেবে। সরদার সাজিদ সারহী খুশি হয়ে বললো, কিন্তু আসল ঘটনা শুনলে না জানি কোন সার্টিফিকেট দেবে।

আসল ঘটনা? জুমানা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, ঘটনা হলো, কালকের গেরিলা হামলায় যদি আয়মান না থাকতো এবং ঘটনাস্থলে বিদ্যুত্রে মতো ছুটে না যেতো তাহলে হয়তো তোমার বাবা লাশ হয়ে যেতো।

বলো কি বাবা! বিস্ময়-আতঙ্কে জুমানার চোখ স্থির হয়ে গেলো।

একে তো রাতের অন্ধকার সরদার সাজিদ সারহী আবার বলতে শুরু করলো, মশালের আলোয় কাছের জিনিসই তো আবছা দেখা যায়। দূরের জিনিস কুব কমই ঠাহর করা যায়। তারপর আবার আমার সাথী সঙ্গীরা লড়াইয়ে ব্যস্ত। কারো দিকে তো কারো কোন মনোযোগ থাকার কথা নয়। হঠাৎ আমার ওপর দুই স্পেনিশ আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই মাথায় আঘাত করলো সম্ভবত রাইফেল দিলে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেলাম। মনে হয়েছিলো মাথাটা যেন চৌচির হয়ে গেছে। সারা দুনিয়া ঘুরতে লাগলো। এ সময়ই সেখানে আয়মান উপস্থিত হলো। কিন্তু ইতিমধ্যে আরো কয়েকটি আঘাত খেয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। তারপর আয়মান আমাকে কিভাবে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে, কি করে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে, এর কিছুই মনে নেই।

… আহা ছেলেটাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে পারলাম না।

ধন্যবাদ তো আমিও দেইনি। জুমানা বললো, ঘটনা আমাকে উনি বলার সময় তো উনার নামটি একবারও বলেননি। বাবা! সত্যি কথা বলতে কি তোমাকে বাঁচানোর চেয়ে এভাবে নিজের কথা চেপে রাখার ব্যাপারটি আমার কাছে অনেক বেশি বিস্ময়কর লাগছে। এ ব্যাপারটি আকামে অভিভূত করেছে।

এ ধরনের ছেলেরা অন্যের বিপদে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে সহজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটা যে কত বড় বীরত্বপূর্ণ ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজ সেট আর ওরা মনে রাখে না। নয়তো এ কারণেই আমাকে বাঁচানোর ব্যাপারটি এ কাছে মামুলি ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই র নামটিও তোমাকে বলা প্রয়োজন বোধ করেনি।

***

আরে তুমি এখন ক্যাম্পে কেন? আবদুল করীম হুজ্জুল আয়মানকে ক্যাশে দেখে বললো। তোমাকে তো কাল পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে বলা হয়েছে। গতকাল যারা নৈশ হামলায় ছিলো তাদের সবার জন্য একই ব্যবস্থা। যাও, তুমিও বিশ্রাম কারো গিয়ে।

না, মানে ওখানে ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম ক্যাম্পে এসে একটু ঘুরে যাই।

আরে এত দিন ভালো লাগলো আজ আবার কি হলো? ঠিক আছে ক্যাম্পেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। বিকালে সরদারে বাড়ি চলে যেয়ো। যতটা সম্ভব বিশ্রাম নিয়ে শরীর ঝরঝরে রাখতে হবে। হয়তো এমনও সময় আসবে যে, মুহূর্তের জন্য দুচোখ এক করার সুযোগ পাবে না।

আয়মান কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবদুল করীম অন্য সেনাদের দিকে মনোযোগ দিলো।

সরদারের বাড়িতে আয়মান সন্ধ্যার দিকে ফিরলো। সরদারের ঘরে জুমানা বসা ছিলো। আয়মানের উপস্থিতি টের পেয়ে অন্য ঘরে চলে গেলো। আয়মান সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলো।

এখন কেমন আছেন সরদার? আয়মান ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলো।

এসো, বেটা! বসো এখানে। সরদার শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বললো, এখন বেশ ভালো আছি। দুপুরের দিকে মাথায় একটা চিনচিনে ব্যথা ছিলো। এখন সেটাও নেই। শুধু চাপ লাগলে ব্যথা করে। শরীরের দুর্বলতাও খুব একটা নেই। কালকের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেতে পারবো। তা তুমি কি ক্যাম্পে গিয়েছিলে? তোমার ন আজ বিশ্রামে থাকার কথা! না কি এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে।

না, শুয়ে বসে থাকতে কত ভালো লাগে? তাই ক্যাম্প থেকে ঘুরে এলাম। আর এখানে থাকতে অসুবিধা কি হবে? আপনাদের যত্ন ও আন্তরিকতায় বেশ সুখেই আছি। আরামে থাকতে থাকতে বরং শরীর ভারি হয়ে গেছে। একজন সৈনিকের জীবনে এত আরাম আয়েশ থাকা ঠিক নয়। আর অনেক দিন থেকেই তো আপনার এখানে রইলাম। অনেক জ্বালাতন করেছি এতদিন। তবে আজীবন আপনাদের আতিথেয়তার কথা মনে থাকবে।

কারো কারো জ্বালাতন অনেক সময় মধুর চেয়ে ভালো লাগে। বুঝলে আয়মান! এমন মধুর জ্বালাতন আমরা সবসময় উপভোগ করতে চাই। সরদার রহস্যময় কণ্ঠে বললো।

মধুর জ্বালাতন? কথাটার মানে কি?

সব কথার মানে না বুঝলেও চলবে। ওহ, রাখো আমার একটা কাজ আচে। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। সময় হলে আমি তোমাকে ডাকবো। এখন যাও।

আয়মান ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সরদার লোক মারফত গোত্রের কয়েকজনকে ডেকে বললো, আমাদের ক্যাম্পে চলে যাও। কমাণ্ডার আবদুল করীমকে সালাম জানিয়ে বলবে, আজ রাতে যদি উনি এখানে একটু সময় নিয়ে আসেন তাহলে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।

ওরা বেরিয়ে যেতেই সরদার তার মেয়ে জুমানাকে ডাকলো। জুমানা পাশের ঘরেই ছিলো এতক্ষণ।

আয়মানের সঙ্গে এতক্ষণ যে কথাবার্তা হয়েছে তা তুমি নিশ্চয় শুনেছো। সরদার বললো।

হ্যাঁ বাবা! শুনেছি আমি। কিন্তু তুমি সেটা বুঝলে কি করে? জুমানা বললো।

আমি সেটা না বুঝলে এত বড় গোত্রের সরদার করি কি করে? এখন আমি কি করতে যাচ্ছি তুমি নিশ্চয় সেটা বুঝতে পারছে। সরদার মেয়ের দিকে ঝুঁকে এসে বললো।

হয়তো বুঝতে পারছি।

তোমার কি এতে ভিন্ন কোন মতামত আছে? কিংবা কোন আপত্তি?

বাবা! তুমি নিশ্চয় জানো তোমার মতামতই আমার মতামত। তবে আমার জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি কি এক তরফা এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছো? উনার সঙ্গে তো মনে হয় এ ব্যাপারে কোন আলাপ করোনি। যতটুকু শুনেছি উনি তো আমাদের এখানে থাকতেই অনীহা দেকাচ্ছিলেন।

শোন মা! আয়মানের এই অনীহাকেই আমি সম্মতি বলে ধরে নিচ্ছি। আর ওর সঙ্গে সরাসরি কতা না হলেও চোখে চোখে এবং মনে মনে কথা হয়ে গেছে। আশা করি আমার ও তোমার উভয়ের ধারণার চেয়ে ওকে তুমি অনেক অলে সঙ্গী হিসেবে পাবে।

জুমানার মুখখানি লাল হয়ে উঠলো, চোখ দুটো হয়ে উঠলো অশ্রুসিক্ত। আলতো করে ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠলো। কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না।

***

ঘন্টা তিনেক পরের ঘটনা। কমান্ডার আবদুল করীমসহ গোত্রের অন্যান্য গণ্যমান্য লোকদের উপস্থিতিতে হুজ্জুল আয়মান ও জুমানার মধ্যে বিয়ে পরিয়ে দেয়া হলো। সরদার সাজিদ সারহী এই বিয়ে হওয়াতে এত খুশি হলো যে, কেঁদে ফেললো। আবেগৰুদ্ধ কণ্ঠে বললো,

তোমরা সবাই জানো, এ আমার আনন্দ-অশ্রু। আমার এই পার্থিব জীবনের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ হয়ে গেছে। শুধু একটা চাওয়াই বাকি আছে। একটা স্বপ্নই অপূর্ণ রয়ে গেছে এখনো। সেটা হলো মারাকেশের স্বাধীনতা। আল্লাহ তাআলার কাছে আমার এখন একটাই প্রার্থনা, শহীদ ও গাজী মুক্তিসেনাদের জান বাজি লড়াইয়ের বিনিময়ে যেন মহান আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতা দান করেন। এখন আর আমার কোন পিছুটান নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবো।

সবাই জয়ধ্বনি করে উঠলো। কেউ কেউ তকবীর ধ্বনিও দিলো।

প্রিয় ইসলামের সৈনিকরা! মুক্তিকামী যোদ্ধারা! আবদুল করীম দাঁড়িয়ে বললো, যেখানেই ইসলামের আবেদন পুর্ণাঙ্গভাবে চর্চার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেই মুসলমানদের মধ্যে দান করা হয়েছে ঐক্যের শক্তি। আজ দেখো, আমরা লড়াইয়ের রক্তাক্ত ময়দানে থেকেও হাসতে পারি। যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যেও ভালোবাসা ও প্রেমের পরম সৌধ নির্মাণ করতে পারি আমরা। এই আয়মান ও জুমানার বিয়েটাও এরই জ্বলন্ত প্রমান…।

বন্ধুরা! মনে রেখো, আমাদের এ ঐক্য যদি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারি তাহলে আমরা ঐ বিজাতীয় দখলদারদের কবল থেকে একদিন না একদিন ইনশাআল্লাহ মারাকেশ স্বাধীন করতে পারবো। এটা ঠিক যে আমাদের সৈন্যবল, অস্ত্রবল সব কিছুই ওদের তুলনায় বলা যায় হাস্যকর। কিন্তু এক আল্লাহর প্রতি আমাদের ঈমান-বিশ্বাস বহুগুণ বেশি। এই প্রদীপ্ত বিশ্বাসের গৌরবই বিজয়ের মাল্য পরিয়ে একদিন আমাদেরকে গৌরাবাৰত করবে। নারায়ে তাকবীর- আল্লাহ আকবার।

সরদার সাজিদ সারহী ঘোষণা দিলেন, আগামীকাল দুপুরে এই গোত্রের সবার এবং সব মুক্তিসেনাদের ওলিমার দাওয়াত।

আয়মান ও জুমানা বাসর রাতে যে অনাগত সন্তানের স্বপ্লবীজ রোপন করেছে, সে সন্তানকে তারা উৎসর্গ করলো মারাকেশের স্বাধীনতার নামে।

***

আবদুল করীম ও তার মুক্তিসেনাদের খ্যাতি এখন আর মারাকেশেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আবদুল করীমের বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বৃটিশরা তাকে গোপনে অস্ত্র ও সনাসাহায্য দেয়ার প্রস্তাব করে। জার্মানিও একই ধরনের প্রস্তাব পেশ করে। ইউরোপের আরো কয়েকটা দেশ নানান ধরনের প্রলোভন দেখায়। কিন্তু আবদুল করীম এসবই কৌশলে প্রত্যাখ্যান করে।

কারণ, আবদুল করীম জানতো, এরা কেউ বন্ধু নয়। বন্ধুবেশে এরাও মারাকেশ দখল করতে চায়। তার একমাত্র নির্ভরতা ছিলো আল্লাহ তাআলা ও তার অমিত আত্মবিশ্বাসের ওপর মুক্তিসেনাদের মধ্যে এমন কিছু লোক পাওয়া গেলো, যারা প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রিক্যাল বস্তুসামগ্রী বানাতে সিদ্ধহস্ত ছিলো। তারা শত্রুপক্ষের অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম দেখে দেখে সেগুলো নিজেরা তৈরি করতে লাগলো। হাতবোমা, গ্রেনেড, শটগান, রাইফেল, এলএমজি, ক্লাশিনকোভ জাতীয় অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম এই এক্সপার্টরা বানাতে শুরু করলো। এতে তাদের প্রাথমিক অস্ত্র স্বল্পতার সমস্যা কিছুটা লাঘব হলো। তবে মুক্তিসেনারা সেসব অস্ত্রই বেশি ব্যবহার করতো যেগুলো স্পেনিশদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে। তারপরও আব্দুল করীম মুক্তিসেনাদেরকে সবসময় অস্ত্র তৈরিসহ বিভিন্ন শৈল্পিক কাজে উৎসাহ দিতো। আব্দুল করীম তাদেরকে বলতো,

তোমরা অন্যের জিনিসের ওপর নির্ভর করে থেকো না। তোমাদেরকে যারা সাহায্য করবে তারা কোন না কোনভাবে এর চেয়ে দ্বিগুণ বিনিময় তোমাদের থেকে আদায় করে নেবে। হতে পারে, এর বিনিময়ে তোমাদের থেকে তোমাদের স্বাধীনতার চেতনাই ছিনিয়ে নেবে। কিংবা ছিনিয়ে নেবে তোমাদের থেকে তোমাদের বুকে আগলে রাখা ঈমানের দীপ্তি।

চৌদ্দ বছরের এক ছেলে তো মুক্তিসেনাদের দূরদূরান্তের ক্যাম্পগুলোর মধ্যে টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থা করে ফেললো। শত্ৰুদলের বিভিন্ন সেনা চৌকি ও ফৌজি কাফেরার ওপর হামলা করে করে মুক্তিসেনারা অনেক যুদ্ধ। সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। এর মধ্যে অসংখ্য ক্যাবল টেলিফোন তার ও অসংখ্য টেলিফোন সেটও ছিলো।

মুক্তিসেনাদের জন্য এ জিনিসগুলো বেকার ছিলো। কারণ, তারা এই ব্যবহার জানতো না। কিন্তু চৌদ্দ বছরের এক ছেলে এগুলোকে মহামূল্যবান করে তুললো। সে টেলিফোন সিস্টেমের খুঁটিনাটি বিভিন্নভাবে শিখে নিলো। তারপর বহু কষ্ট করে ব্যাটারীরও ব্যবস্থা করলো। এরপর শক্তিশালী কিছু সৈনিকের সাহায্যে মাটির নিচ দিয়ে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে টেলিফোন সিস্টেম চালু করে দিলো।

এতে আবদুল করীম ও তার জানবার্য দলের জন্য দারুন সুবিধা হয়ে গেলো। তারা জায়গায় বসে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা পেয়ে যেতো। অনেক সময় বাঁচতে এবং দুশমনের ওপর হামলাগুলোও হতো দারুন সময়োপযোগী ও কঠোর। কিছু দিনের মধ্যে টেলিফোন সিষ্টেমকে এমন সক্রিয় করে তোলা হলো যে, যেখানেই প্রয়োজন হতো মুক্তিসেনারা সেখানেই টেলিফোন সিষ্টেম চালু করে নিতো।

মুক্তিসেনাদের হামলা, নৈশ হামলা ও গেরিলা হামলা এত ঘন ঘন ও তীব্রতর হয়ে উঠলো যে, শহর থেকে দূরের স্পেনিশ ফৌজের চৌকিগুলো সব খালি হয়ে গেলো। এসব চৌকির অধিকাংশ আর্মিই মারা গেলো। এই চৌকিগুলো শূন্য হওয়ায় স্পেনিশদের জন্য দূরদূরান্ত পর্যন্ত রসদ পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়লো। কারণ স্পেনিশদের রসদবাহী গাড়িগুলো মুক্তিসেনারা খুব সহজেই ছিনিয়ে নিতো।

এমনকি শহরগুলোতেও স্পেনিশ পৌজের পক্ষে টিকে তাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক শহরের অধিকাংশ শহরবাসীই মুক্তিসেনাদের পক্ষে নেয়া শুরু করলো। অথচ এটা ছিলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থা নেয়া ও সরকারকে অসহযোগিতা করার মতো মারাত্মক অপরাধ। এই ঝুঁকি সত্ত্বেও শহরে লোকেরা স্পেনিশদের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিসেনাদের পক্ষে কাজ করতে শুরু করলো।

সব জায়গাতেই স্পেনিশরা এমন কোনঠাসা হয়ে গেলো যে, স্পেনিশদের শাসন কার্যত খতম হয়ে গেলো। মুক্তি সেনাদের শাসন চলতে লাগলো স্পেনিশ অধ্যুষিত মারাকেশে। কাগজের খাতায় শুধু স্পেনিশদের শাসনকার্য ছিলো। যেটার দুপয়সারও মূল্য ছিলো না। এটা ছিলো আসল মুক্তিসেনাদের সুস্পষ্ট বিজয়।

এখানে যত সহজে বলা হচ্ছে এ বিজয়ের কাহিনী এত সহজে রচিত হয়নি। হাজার হাজার মুক্তিসেনাদের শাহাদাতবরণ করতে হয়েছিলো।

অসংখ্য নৈশ গেরিলা হামলা চালানো হয়েছিলো। এর প্রতিটি হামলায় একাধিক মুক্তিসেনা শহীদ হয়েছে। আহত হয়েছে অনেক। এর মধ্যে কারো কারো এক বা একাধিক অঙ্গহানিও ঘটেছে। মুক্তিসেনাদের মধ্যে কমবয়সী ছেলে-মেয়েও ছিলো। এদের মধ্যে যারা শত্ৰুদলের হাতে ধরা পড়তো তাদের এমন পৈশাচিক কায়দায় শাস্তি দেয়া হতো যে, তা দেখে অনেক স্পেনিশ সৈনিক আর্মি ছেড়ে চলে গেছে, না হয় নিজেদের ধর্মত্যাগী হয়েগেছে।

এসব ছেলে-মেয়ের পরিবারের লোকদেরকেও ক্ষমা করা হতো না। ঘরের নারী শিশুদেরকেও প্রহার করা হতো, অপদস্থ করা হতো। আর যুবতী মেয়ে থাকলে তো ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যেতো, তাদের দেহের রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ঝড়িয়ে ঝড়িয়ে ওদেরকে মারা হতো।

মারাকেশের বালুকণা মুক্তিসেনা ও তাদের পরিবার-আপনজনদের রক্তে কর্দমাক্ত হয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে স্পেনিশ ফৌজের হাড়গোড়ও মরুভূমিতে তুপিকৃত হতে থাকে।

মারাকেশ এভাবে তার বন্ধু ও শত্রুদের রক্তে ডুবে যায়। এভাবে স্পেনিশদের দখলকৃত মারাকেশের পরাধীন এলাকাগুলো স্বাধীন হওয়ার পূর্ণাঙ্গ পথে রূপান্তরিত হয়। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার বাকি।

***

দীর্ঘ গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত হওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন। এসময় আবদুল করীম রণাঙ্গনীয় এক কৌশলগত ভুল করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এ সময় তার উচিত ছিলো, স্পেনিশ অধ্যুষিত এলাকা ও শহরগুলোতে নিজেদের পূর্ণাঙ্গ দখলদারিত্ব নিশ্চিত করা। সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং সুশৃঙ্খল সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিজেদের বিজিত এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া। এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠতো নিজেদের স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা, স্বাধীন রাষ্ট্র এবং মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিক সত্ত্বা।

স্পেনিশদের পিছু হটিয়ে এবং নিজেদের বিজয় সুনিশ্চিত হওয়ায় আবদুল করী ও তার সেনাদের মনোবল এতই বেড়ে গেলো যে, কিছু বাস্তবতা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো। তাদের জযবা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়লো। তারা এবার ফ্রান্সীয় ফৌজের ওপর হামলা শুরু করলো।

ফ্রান্সীয়দের ওমর হামলার ব্যাপারে নৈশ ও গেরিলা হামলার কৌশলও অবলম্বন করলো। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে স্পেনিশদের বিরুদ্ধে এরা সফল হয়েছে দারুনভাবে। কিন্তু ফ্রান্সীয়রা স্পেনিশদের এই পরিমাণ দেখে আগ থেকেই ভিন্ন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। তাদের তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক শক্তিশারী করে রাখে। জবাবী হামলার ব্যবস্থাও করে রাখে। এছাড়াও ফ্রান্সীয়রা সৈন্যবল ও অস্ত্রবলে স্পেনিশদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলো। মারাকেশের দখলকৃত এলাকাও ছিলো বেশি।

এর বিপরীতে মুক্তিসেনাদের সংখ্যা যেমন ছিলো কম, অস্ত্রশস্ত্র ছিলো আরো কম এবং উপায়-উপকরণও ছিলো সীমিত।

এত কিছুর পরও মুক্তিসেনাদের গেরিলা অপারেশন এতই সফল হলো যে, ফ্রান্সীয়রা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো। কারণ, ওরা যতই প্রস্তুতি নিয়ে রাখুক গেরিলা হামলায় তো এরা অভিজ্ঞ ছিলো না মোটেও। আর মুক্তিসেনারা প্রত্যেকেই চিলো গেরিলা অপারেশনের বিশেষজ্ঞ। দেখা গেলো, এই গেরিলা অপারেশনের কারণে ফ্রান্সীয়দের হাত থেকে অনেকগুলো চৌকি ছুটে গেছে।

কোথাও কোথাও তো ফ্রান্সীয় আর্মির সঙ্গে মুক্তিসেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষও হয়েছে। কিন্তু সেসব জায়গায় মুক্তিসেনাদের চরম আক্রোশ ও তীব্র হামলার সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।

ফ্রান্সীয়দের জেনারেল এখন লাইটে। লাইটে অতি চতুর জেনারেল ছিলেন। জেনারেল লাইটে মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে মারাকেশের সেসব গোত্র সরদারদের ব্যবহার করতে চাইলো, যাদেরকে বহু টাকা-পয়সা, জায়গীর ও সুন্দরী নারীদেরকে দিয়ে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিলো। জেনারেল লাইটে চাচ্ছিলেন এই সময় গোত্রগুলো যেন মুক্তিসেনাদের পক্ষে কাজ না করে।

এক সরদার তার গোত্রের সবাইকে বলে দিলো, তারা যেন ফ্রান্সীয়দের সঙ্গ দেয়। তাদের পক্ষে কাজ করে। কারণ মুক্তিসেনা নামের ঐ মুসলমানগুলো ডাকাত, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী। পরদিনই সেই সরদারের লাশ এমন বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো যে, তার দুই পা, দুই হাত ও মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এদিক-ওদিক পড়ে ছিলো। আর সেগুলো কাড়াকাড়ি করছিলো শৃগাল, কুকুর।

অন্যসব সরদারকে কালো খামে করে এই পয়গাম দিলো,

তোমরা নিশ্চয় তোমাদের এক সঙ্গীর পরিণাম দেখেছো। মনে রেখো, তার দেহ থেকে তার পা দুটি ও বাহু দুটি তখনই কেটে পৃথক করা হয়েছিলো যখন সে জীবিত ছিলো আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে তার মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যে এটা উপভোগ করতে চাও, সে সাহস করে একবার মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে বলেই দেখো না।

এরপর আর কোন সরদার ফ্রান্সীয়দের সঙ্গ দিতেও কাউকে বলেনি এবং মুক্তিসেনাদের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি। এমনকি গোপনেও নয়।

ফ্রান্সীয়রা যখন দেখলো তাদের এ কৌশলও ব্যর্থ হয়েছে, তখন তারা স্পেনিশদের কাছে এ প্রস্তাব পাঠালো, মারাকেশের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এবং বিদ্রোহী মুক্তিসেনাদের উৎখাত করার এখন একমাত্র উপায় হলো, ফ্রান্স ও স্পেনের সম্মিলিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। সম্মিলিতভাবে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া।

স্পেন নিজেদের চরম পরাজয় থেকে বাঁচানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাব লুফে নিলো। এর আগে কিন্তু ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে মিত্র সম্পর্ক ছিলো না। তাদের মধ্যে শীতল সম্পর্ক ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে এ দুই দখলদার দেশ সম্মিলিত কার্যক্রম শুরু করে দিলো।

ওদিকে ফ্রান্স জেনারেল লাইটেক কমান্ডিং দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে মার্শাল পেটীনকে মারাকেশ পাঠালো। বৃদ্ধ মার্শাল পেটীন ছিলেন সর্বস্বীকৃত যুদ্ধগুরু। তার মতো এমন অভিজ্ঞ, তীক্ষ্মধারী কমান্ডার ফ্রান্স ও স্পেনে একজনও ছিলোনা। স্পেনও আরেক মার্শাল পাঠালো মারাকেশে। তার নাম মার্শাল প্রেমোদী রিভার। ইনিও ছিলেন অতি দক্ষ যুদ্ধবাজ নেতা।

এরা উভয়ে উভয়ের বাহিনীকে এক ছাউনিতে নিয়ে এলো। সম্মিলিত হাইকমান্ড হিসেবে তাদেরকে প্রস্তুত করে তোলা হলো। দুদেশই আরো অধিক সংখ্যক সেনা পাঠিয়ে দিলো। শুধু তাই নয়, ফ্রান্স তো যুদ্ধ বিমানও পাঠিয়ে দিলো মারাকেশে। আর পাঠালো বিমাল কামান বহর। যুদ্ধ বিমান ও কামানবহর মুক্তি সেনাদের জন্য ভয়ংকর অস্ত্র ছিলো।

তবে মুক্তিসেনারাও শত্রুর সেনাবিন্যাস অনুযায়ী নিজেদের সেনাবিন্যাস বদলে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে খোলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখলো। ওদিকে গেরিলা ও কমান্ডো অপারেশনও অব্যাহ রাখলো। এই গেরিলা ও কমান্ডো অপারেশন চালিয়ে মুক্তিসেনারা ফ্রান্সীয়দের রসদ সরবরাহের পথগুলো বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো। দূরদূরান্তের চৌকি পর্যন্ত রসদ পৌঁছতে দিতো না মুক্তিরা।

শত্রুরা এবার রসদবহরের সঙ্গে আর্মি ইউনিটও পাঠাতে শুরু করলো। মুক্তিসেনারা তাদের ওপরও হামলা করে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। এভাবে শত্রু সেনাদের বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু ফ্রান্সীয়রা যখন রসদের বহরের সঙ্গে যুদ্ধ বিমানও পাঠাতে শুরু করলো, তখন তো মুক্তিসেনাদের জন্য টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। মরুর খোলা আকাশের নিচে বিমান হামলা থেকে নিজেদেরকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। এভাবে শত্রুদল রসদ সরবরাহের পথ নিচ্ছিদ্র করে নিলো।

***

আবদুল করীম এবার নিজেদের হামলার ধরণ পাল্টে ফেললেন। মারাকেশে ছেষট্টিটি দুর্গ ছিলো। অনেক দুর্গ ফ্রান্সীয়রাও নির্মাণ করে। এসব দূর্গগুলো ছোট ও মাঝারি ধরনের ছিলো। শত্রুদল এগুলোকে প্রতিরক্ষা ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলো। আর মুক্তিসেনারা এসব দূর্গের ওপর হামলা করতে শুরু করলো।

১৯২৪ সনের শেষের দিকে মুক্তিসেনারা নয়টি কেল্লা ফ্রান্সীয় ও স্পেনিশদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু বড় সংকট যেটা দেখা দিলে সেটা হলো, আবদুল করীমের সেনাসংখ্যা ক্রমেই কমে যেতে লাগলো। অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্বল্পতাও অনুভূত হতে লাগলো। কারণ তাদের কাছে তো অস্ত্র তৈরির কোন ফ্যাক্টরী ছিলো না। অস্ত্র সরবরাহের মতো তাদের কোন মিত্র দেশও ছিলো না।

ফ্রান্সীয়রা শহর, উপশহর এমনকি গ্রাম পর্যন্ত গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিলো। কারো ওপর যদি সামান্য সন্দেহ হতো সে মুক্তিসেনাদের কোনধরনের সহযোগিতা করেছে, তাহলে তার পুরো গাষ্ঠিকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হতো। ফ্রান্সীয়দের কোন দূর্গ যদি মুক্তিসেনাদের হাতে বিজিত হতো, তাহলে অন্যান্য শহরের মারাকেশী মুসলমানদের বহু ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দিতো ফ্রান্সীয়রা।

তারপরও মুক্তিসেনাদের মনোবল ভাঙ্গেনি। তাদের সেনা ও অস্ত্র স্বল্পতাকে পূরণ করতো ঈমানদীপ্ত জযবা ও সংকল্প দ্বারা।

এর মধ্যে আবদুল করীম মানবতার আরেক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সেটা হলো, মুক্তিসেনাদের হাতে অনেক স্পেনিশ ও ফ্রান্সীয় সৈন্য বন্দি ছিলো। এরা যুদ্ধবন্দি। যুদ্ধবন্ধিদের সঙ্গে সব শত্রুপক্ষই চরম অমানবিক আচরণ করে। চতুষ্পদ জন্তুর চেয়ে তাদেরকে নিকৃষ্টতর মনে করা হয়। যুদ্ধবন্দিকে সসম্মানে মুক্তি দেয়াতো দূরের কথা। কিন্তু আবদুল করীমের নির্দেশে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করা হতো। ১৯২৫ সনে আবদুল করীম সব যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেন। শুধু তাই না, নৌযানের ব্যবস্থা করে তাদেরকে সমুদ্র পার করে দেয়া হয়।

এদের মধ্যে কিছু কয়েদী তো মুসলমানদের ব্যবহারে এতই মুগ্ধ হলো যে, নিজেদের দেশে না ফিরে মুক্তিসেনাদের দলে যোগ দিলো এবং তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পরলো১৯২৫ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্স ও স্পেনের সম্মিলিত হাই কমাও মুক্তিসেনাদের ওপর চূড়ান্ত হামলা করলো। এতে পুরো কামানবহর ও সবগুলো যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের ইতিহাসে একে এক অমানবিক ও পৈশাচিক হামলা বলে আখ্যায়িত করা হয়। মুক্তিসেনাদের প্রতিটি মোর্চা ও ক্যাম্পগুলোতে যুদ্ধবিমান থেকে অনবতর বোমাবর্ষণ করা হয়।

জনবসতির কোথাও সামান্য সন্দেহ হলেই পুরো বসতিই বোমার আঘাতে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও হাজার হাজার সশস্ত্র ঘোড়সাওয়ার এই হামলায় অংশগ্রহণ করে। তারপরও মুক্তিসেনারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে লড়াই করতে চেষ্টা করলো। শত্রুদলকেও ছোট ছোট দলে বিক্ষিপ্ত করার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গেলো। কিন্তু শত্রুসেনা তাদের বিন্যাস সারির মোটেও রদবদল করলোনা।

গোলাগুলি ও অবিরাম বোমাবর্ষণ অব্যহত রাখলো। তাদের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে মানুষ, চতুষ্পদ প্রাণী, পশু-পাখি এমনকি গাছপালাও বাদ গেলোনা। ব্যবসায়ীদের শত শত কাফেলা বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেলো। কোন নিরপরাধকেও তারা ছাড়লো না। মুক্তিসেনাদের সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যেতে লাগলো। ইমোনেশনও খতম হয়ে গেলো। তারপর তারা তলোয়ার ও বর্শার সাহায্যে লড়তে লাগলো। কিন্তু এই আগুন ও রক্ত ঝড়ের সামনে তারা খড়কুটার মতো উড়ে গেলো।

মুক্তিসেনারা তো নিজেদের প্রাণ নিজেদের হাতে নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু শত্রুদল নর পিছাচের মতো এর শাস্তি দিচ্ছিলো নিরপরাধ শহরবাসীকে। তাদেরকে পাইকারি দরে হত্যা করা হচ্ছিলো। হত্যা করা হচ্ছিলো নারী ও শিশুদেরকেও। পরাজয় দেখা যাচ্ছিলো স্পষ্ট। কোথাও থেকে তো সাহায্যেল আশাই ছিলো না। আবদুল করীম সাধারণ মানুষকে নরপিশাচদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধবন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি শত্রু শিবিরে সাদা ঝাণ্ডাসহ এক লোককে পাঠালেন দূর হিসাবে। কিন্তু শত্রুপক্ষ যুদ্ধ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালো।

আবদুল করীমের সঙ্গে তখন খুব সামান্যই মুক্তিসেনারা রয়ে গিয়েছিলো। তাও প্রায় নিরস্ত্র। অবশেষে আবদুল করীম ১৯২৬ সনের এপ্রিয়ে এই ঘোষণা দিলেন,

মারাকেশের রক্ত একমাত্র আমার কারণেই ঝড়ছে। আর রক্ত ঝড়ছে তাদের, যারা লড়তে জানে না। আর যারা লড়তে পারতো তারা লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গেছে। তবে ইনশাআল্লাহ মারাকেশ একদিন অবশ্যই স্বাধীন হবে। সেটা খুব শিগগীরই হবে। আমি রণাঙ্গনে না থাকলেও এখন অনেক আবদুল করীম সূর্যোদয়ের মতো জেগে উঠবে। ওই রক্ত সাগরের ভেতরেই আমার পরের আবদুল করীম আমার কথা শুনতে পাচ্ছে। তারা যেদিন উঠে দাঁড়াবে, সেদিন আর ঐ জালিম-সন্ত্রাসী সাম্রাজ্যবাদীরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে।

এই ঘোষণা দিয়ে তিনি ফ্রান্স ও স্পেনিশদের হেডকোয়ার্টারের দিকে হাঁটা ধরলেন। তিনি যখন সেখানে পৌঁছলেন, তখন তার মুখে এক চিলতে হাসি লেগেছিলো। তাকে দেখে ফ্রান্সের মার্শাল পেটীন ও স্পেনের মার্শাল প্ৰেমোদি রিভার একসঙ্গে সম্ভ্রমে স্যালুট করলেন এবং পরমুহূর্তেই তাকে গ্রেফতার করা হলো। এরপর তাকে তার পরিবারসহ রীইউনীন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হলো।

তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর পরও স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন থেমে যায়নি। মাত্র তিনমাসের মাথায় ওরা আবার সুসংগঠিত হতে শুরু করলো। তারপর ১৯৫৬ সনের ৬ মার্চ মারাকেশ পূর্ণাঙ্গরূপে স্বাধীন হলো। আবদুল করীম যেদিন স্বাধীন মারাকেশে পা রাখলেন, সেদিনই মারাকেশবাসী স্বাধীনতা ও বিজয়লাভের আনন্দ উদযাপন করলো।

সেদিন সবার আনন্দ উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আবদুল করীম।

 লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের জনারণ্যে তিনি যেন এক দীঘল বৃক্ষ।

এর পাতায় পাতায়, শাখায় শাখায়, কাণ্ডে-শিকড়ে আদিগন্ত প্রসারিত ছায়াবীথিতে আজো উচ্চকিত হচ্ছে স্বাধীনতার অজর মন্ত্র-শ্লোগান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *