১৬. পাথরধ্বসের অবশিষ্টাংশ

১৬.

স্যাম যে জায়গাটার দিকে নির্দেশ করেছে ওটাকে দেখতে অনেকটা পাথরধ্বসের অবশিষ্টাংশ বলে মনে হচ্ছে। যদিও বহুকাল আগের এক ভূমিকম্পে পাথুরে দ্বীপের দক্ষিণ অংশ গুঁড়িয়ে মহাসাগরে তলিয়ে গিয়েছে। এটার থেকে কয়েক ফুট দূরেই আরেকটা লম্বা ও সরু পাথরের ধারা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ওটা এতো মসৃণ যে ওটাকে পাথরধ্বসের সৃষ্টি বলে মনে হচ্ছে না। নিশ্চিতভাবেই ওটা কোনো জাহাজের খোলসের ধ্বংসাবশেষ। জাহাজটা সরাসরি পানির নিচে ডুবে যাওয়ায় ওটা এখনো ছড়িয়েছিটিয়ে যায়নি। খুবসম্ভবত বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জাহাজটা ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, নয়তো কারো হাতে পড়ার কবল থেকে রক্ষার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

আরো ভালোভাবে দেখার জন্য কাছে ঝুঁকলো রেমি। তোমার কি মনে হয় জাহাজ ডোবার পর পাথরধ্বস ঘটেছিলো?

হয়তো, স্যাম জবাব দিলো। যেটাই হোক, জাহাজটা নিরাপদে ঘুরিয়ে নেওয়ার মতো তেমন সুযোগ ছিলো না। ঝড়ের মধ্যে পড়লে পানির নিচের অসংখ্য পাথরের যে কোনোটাই জাহাজের ক্ষতি করতে পারে।

 হয়তো ইচ্ছাকরেই জাহাজটা ডুবিয়ে দিয়েছিলো ওরা। হয়তো ভুল হাতে পড়ার কবল থেকে বাঁচানোর জন্য।

 নুনোকে শেষমেশ আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে দুজনই তাদের ডাইভিং গিয়ারগুলো পরে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো পানিতে।

 পানির গভীরে নেমে যাচ্ছে ওরা। প্রতিবারের মতো এবারও সমুদ্রের নিচের শান্ত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছে রেমি। এর আগেও প তারা। তারপরও প্রতিবারই পানির নিচে নামলে যেন নতুন কিছু মনে হয় তার কাছে। পানির নিচের মাছগুলো তাদেরকে দেখে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করেছে। যতোই গভীরে নামছে পানির উপরিভাগের উজ্জ্বল আলোগুলোও নীল-সবুজাভ বর্ণে পরিণত হতে শুরু করেছে যেন।

 পানির পঁচিশফুট গভীর নামার পর পর্দায় দেখা ধ্বংসাবশেষের স্তূপটা দেখতে পেলো রেমি। স্তূপটা প্রমাণ করছে যে এখানে এককালে একটা জাহাজ দাঁড়িয়েছিলো। সময়ের বিবর্তনে এর অনেক অংশই এখন পানির সাথে মিশে গেছে।

জাহাজের অবশিষ্টাংশে খোঁজাখুঁজি শুরু করার আগে তাদের চারপাশের পানির পরিবেশটা দেখে নিচ্ছে ওরা। ব্রাজিলের উপকুলগুলো ভয়ংকর শার্কদের আক্রমণের জন্য বেশ বিখ্যাত বলা যায়। যদিও এগুলোর বেশির ভাগই ঘটে থেকে রেসিফের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উপকূলগুলোতে। তবে তারপরও পশ্চিমে থাকা সাও পাওলো আছে এই তালিকার দুই নম্বরে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সৈকত ও মোহনার অগভীর পানিতে থাকা বদমেজাজী বুল শার্কের আক্রমণের শিকার হয় সাঁতারু এবং সাফাররা। আর উষ্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের পানিতে বিচরণ করে টাইগার শার্ক। এরা বুল শার্কের মতোই বিপজ্জনক, কিন্তু ওগুলো আকৃতিতে বেশি বড়ো। তবে রেমি আশা করছে স্নেক আইল্যান্ডের এই অগভীর পানিতে হয়তো ওগুলো থাকবে না।

আশেপাশের পানিতে বেশ কয়েকবার তাকিয়ে দেখলো ওরা। এখানকার পানিতে বেশ কিছু বারাকুড়া মাছ থাকলেও কোনো শার্ক নেই। নিশ্চিত হয়ে ধ্বংসস্তূপের ওপরের প্রান্ত থেকে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো ওরা। খুঁজতে খুঁজতে একটু একটু করে পাথরধ্বসের গভীর দিকে এগিয়ে আসছে। সাথে সমুদ্রের তলেও তাদের মেটাল ডিটেক্টরগুলো দিয়ে খুঁজে দেখছে। যদিও তারা কেউই কোনো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করছে না-তারপরও সবসময়ই কিছু না কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। অবশ্য ডিটেক্টরের নিরবতা তাদের সন্দেহেরই প্রতিধ্বনি করছে যেন। জাহাজডুবির এই অবস্থান অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে আগেও অসংখ্যবার খোঁজাখুঁজি চালানো হয়েছে এখানে। তারপরও সমুদ্রের তলদেশ প্রতিনিয়তই পানির স্রোতে পরিবর্তিত হচ্ছে। এক সম্রাতে দেখা যায় আড়ালে থাকা কোনো কিছু উন্মোচিত হয়ে গেছে, পরের স্রোতেই দেখা যায় সেটা আবার আড়াল হয়ে গেছে।

ধ্বসে পড়া নুড়িপাথরগুলো পরীক্ষা করে দেখছে ওরা। পরীক্ষা শেষে পাশে ছুঁড়ে রাখছে পাথরগুলো। বেশ কয়েকটা পরীক্ষার পর একটা অন্যরকম পাথর তুলে ধরলো স্যাম। এটা দেখতে ত্রিকোণাকার ও হলুদ এবং কোনার দিকে বেশ ধারালো। পাথরটার দিকে আলো ফেলতেই এরকম আরো কয়েকটা পাথর দেখতে পেলো রেমি। এগুলো সাধারণ কোনো নুড়িপাথর নয়, হলুদ ইটের ভাঙা টুকরো এগুলো। পরবর্তীতে আরো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখার জন্য টুকরোটা তুলে রেমির ধরে রাখা ডাইভিং ব্যাগে ভরে রাখলো স্যাম।

আরো কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পর রেমির কাঁধে টোকা দিয়ে ডান দিকে দেখার ইশারা করলো স্যাম। একটা ইল ঘুরাঘুরি করছে ওদিকে। পাথরের স্তূপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে হয়তো। এক মুহূর্তের জন্য রেমি মনে করেছিলো, স্যাম হয়তো তাকে পানিতে ভাইপারের বিচরণে আতঙ্কিত হওয়া নিয়ে খোঁচা দিচ্ছে। তবে পর মুহূর্তেই বুঝতে পারলো স্যাম অন্য কিছু বুঝতে চাচ্ছে। সামুদ্রিক সাপটার বেরিয়ে আসার কারণে সৃষ্ট হওয়া মেঘের মতো কাদার পটার দিকে আলো ধরে রেখেছে স্যাম। কাদাটা স্থির হয়ে যেতেই স্যামের মনোযোগর কারণটা দেখতে পেলো রেমি। হয় তাদের পাথর ছুঁড়ে ফেলার কারণে অথবা ইলটার বেরিয়ে আসার কারণে সমুদ্রের তলদেশে একটা ফাঁপা গর্তের মতো সৃষ্টি হয়েছে। গর্তটার দিকে সাঁতরে গেলো স্যাম। হাত দিয়ে কাদার ঘোলাটে ভাবটা দূর করতেই সমুদ্রের তলদেশে পড়ে থাকা জাহাজের খোলসের একটা অংশ দেখতে পেলো ওরা। ইলটা বের হয়ে আসার আগ পর্যন্ত দেখা যায়নি এটা।

 এতে বুঝাই যায় যে পাথরের ধ্বস হয়তো জাহাজ ডোবার পরেই হয়েছিলো। খুব সম্ভবত জাহাজের ধ্বংসাবশেষকে আড়াল করে দিয়েছিলো।

এরমানে হলো পাথরগুলোর আড়ালে কিছু লুকিয়ে থাকলে থাকতেও পারে। রেমিকে চেক করে দেখার ইশারা দিলো স্যাম। ফাঁকা জায়গাটার ওপর মেটাল ডিটেক্টর ধরলো রেমি। প্রবেশমুখের দিকে কোনো সংকেতই পাওয়া গেলোনা যন্ত্রটা থেকে। তবে একটু ভিতরের দিকে ঢোকাতেই মৃদু একটা শব্দ শোনা গেলো। ডিটেক্টরটা স্যামের হাতে দিয়ে ফাঁকাটার দিকে আলো ফেললো ও। সমুদ্রের তলদেশে হাতড়ে দেখছে এখন। তার হাতের আলোড়নের কারণে আবারো বালিতে ঘোলাটে হয়ে গেছে পানি।

 ঘোলাটে ভাবটা স্থির হওয়ার আগ মুহূর্তে কালো কিছু একটা চোখে পড়লো ওর। হাত বাড়িয়ে বালি থেকে খাবলে বের করে নিয়ে এলো বস্তুটা। জিনিসটাকে প্রথমে একটা ভারী কয়েন মনে করেছিলো ও। জিনিসটার একপাশ থেকে বেরিয়ে আসা হুকের মতো অংশটা দেখে এটাকে অনেকটা নেকলেসের লকেটের মতোও লাগছে। আরেকটু ভালো করে দেখার পর বুঝতে পারলো যে এটা সীসার সীলমোহর। বণিক জাহাজের মালামাল রক্ষা করার জন্য প্রায়ই এটা ব্যবহার করা হতো।

উল্টেপাল্টে সীলমোহরটার ছবি তুলে নিলো স্যাম। এরপর রেখে দিলো রেমির ডাইভিং ব্যাগে। সাথে সাথে ডাইভিং ঘড়িটাও দেখে নিলো রেমি। না, খোঁজাখুঁজি করতে করতে সময়ের খেই হারিয়ে ফেলেনি ওরা। কমপক্ষে হলেও আরো বিশ মিনিটের মতো সময় আছে তাদের হাতে। তাই সময় নষ্ট না করে খোঁজাখুঁজিতেই আবার মন দিলো ওরা। হঠাৎ করেই রেমিকে তাদের ভাইভ জোনের বাইরে দেখার ইশারা করলো স্যাম। তাকিয়ে দেখে একটা শার্ক ঘুরাঘুরি করছে তাদের ডাইভ জোনের ঠিক বাইরেই। সমতল শরীর, ভোতা শুড় আর ডোরাকাটা দাগগুলো দেখে রেমি বুঝতে পারলো যে ওটা অল্পবয়সী একটা টাইগার শার্ক। প্রায় সাতফুটের মতো লম্বা প্রাণীটা। কিছুক্ষণ প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে থেকে স্যামকে ইশারা করে জানালো যে সে দেখতে পেয়েছে প্রাণীটাকে। তবে শার্কটার খুব সম্ভবত তাদের ওপর কোনো আগ্রহ নেই। শান্ত ভাবে সাঁতার কাটছে। খুব সম্ভবত অন্য কোনো জায়গা থেকে পেট ভরে এসেছে প্রাণীটা।

 স্যাম ওদিকে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পাথরের স্তূপের রিডিং নিচ্ছে। ভ্রুপের ভিতর দিকে সিগন্যাল আসায় তূপের চূড়ার দিকে সাঁতরে গেলো ও। ভেবেছিলো হয়তো ভালো কিছু পাবে, কিন্তু পাওয়া গেলো একটা মাছ ধরার বঁড়শি। হতাশ হয়ে দিক পরিবর্তন করলো স্যাম। পাথরের ধারগুলো বরাবর সাঁতার কাটছে এখন।

 ওদিকে রেমির এখনো পাথরের ফাপা গর্তটা পরীক্ষা করা শেষ হয়নি। ইলটাও এখনো ফিরে আসেনি। সিদ্ধান্ত নিলো ইলটা না থাকার সুবিধাটা কাজে লাগাবে। তাই আবার মেটাল ডিটেক্টরটা দিয়ে রিডিং নেওয়া শুরু করলো। গর্তটার বামপ্রান্ত থেকে একটা সিগন্যাল আসছে ডিটেক্টরে। পিছনের দিক থেকে। সাঁতরে ওদিকে গেলো রেমি। বালিতে হাতড়ে দেখলো কিছুক্ষণ, কিন্তু কিছুই পেলো না। তবে নিশ্চিতভাবেই বালির নিচে কিছু একটা আছে। হয়তো একটু গভীরে, তবে খুব বেশিও না। তাহলে ডিটেক্টরে সিগন্যাল আসতো না।

কিছুক্ষণ পর স্যাম ইশারা করে জানালো যে তাদের ডাইভিং শেষ করার সময় হয়ে গেছে। ইশারায় জানাচ্ছে, ওটাও হয়তো কোনো বঁড়শিরই সিগন্যাল, রেমি যেন ওটা নিয়ে আর মাথা না ঘামায়। তবে রেমি সরে এলো না ওখান থেকে। আলো ফেলে গর্তের মুখের বালিতে হাতড়ে হাতড়ে দেখছে। বালির আড়ালে থাকা বস্তুটা হাতে ঠেকলো তার। বস্তুটার পৃষ্ঠ কিছুটা মসৃণ লাগছে ওর কাছে।

 স্যামের দিকে তাকিয়ে পাথরের স্তূপের নিচ দিকে ইশারা করলো রেমি। ওদিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কিন্তু স্যাম থামিয়ে দিলো তাকে। স্তূপের দিকে নির্দেশ করে বুঝালো যে তারা যদি সতর্ক না থাকে তাহলে হয়তো নাড়াচাড়ায় তারাও ছোটোখাটো পাথর ধ্বসের নিচে আটকা পড়তে পারে। স্যামের শঙ্কাটা বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকালো রেমি। ও সতর্কই থাকবে। কয়েকটা পাথর সরাতে পারলেই বস্তুটা তার হাতে চলে আসবে। আস্তে আস্তে একটা পাথর সরিয়ে পাশে রাখলো রেমি। তারপর আরেকটা। এভাবে বেশ কয়েকটা সরানোর পর সৃষ্ট ফাঁকটার দিকে আলো ফেললো রেমি। সাথে নিশ্চিত থাকছে যেন ওপরের পাথরগুলো খসে না পড়ে যায়। আলো ধরে কিছুক্ষণ থাকার পর জিনিসটা দেখতে পেলো ও। একটা কামানের গোলা। দেখে হতাশ হলো কিছুটা। হাত বাড়িয়ে দিলো গোলাটা বের করে আনার জন্য।

ঠিক তখনই পায়ের পিছন থেকে হালকা খোঁচা টের পেলো রেমি। সে ভাবছে, হয়তো স্যাম তার বিখ্যাত আবিষ্কার নিয়ে ক্ষেপানোর জন্য খোঁচা দিয়েছে। ঝট করে মাথা ঘুরালো রেমি।

না, ওটা স্যাম না।

একটা বড়ো টাইগার শার্ক ঘুরছে তাকে ঘিরে। এটার দৈর্ঘ্য প্রায় আট ফুটের মতো। এতক্ষণ শান্তভাবে সমুদ্রের তলদেশে সাঁতার কাটছিলো প্রাণীটা। আর এখন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ছুটে আসছে রেমির দিকে।

ঝট করে পাথরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে ঘুরে গেলো রেমি। দ্রুততার সাথে পায়ের পাখনা নাড়ছে শুধু। সাথে সাথে মেটাল ডিটেক্টরটা দিয়ে আঘাত করছে। শার্কের ভেঁতা শুড়ে। বাড়ি খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো শার্কটা, পরমুহূর্তেই আবার তেড়ে এলো তার দিকে। কামানের গোলাটা হাতে তুলে নিলো রেমি। তারপর ছুঁড়ে মারলো প্রাণীটার মুখের দিকে। তবে খুব একটা লাভ হলো না এতে। উপায় না পেয়ে পাথরের স্তূপটায় লাথি দিতে শুরু করেছে রেমি। লাথি খেয়েই হুড়মুড় করে খসে পড়তে শুরু করেছে পাথরগুলো। মুহূর্তের মধ্যেই ঘোলাটে হয়ে গেছে পরিষ্কার পানিটা।

 কাদামাটির ঘোলাটে মেঘের ভিতরে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে রেমি। কোনো রকমে সাঁতার কেটে ঘোলাটে জায়গাটা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে শুধু।

 আতঙ্কে আত্মা ধুকপুক করছে তার। হাতের মেটাল ডিটেক্টরটা নিয়ে ঘুরতে যাবে ঠিক তখনই দেখলো একটা কালো মূর্তি সতরে আসছে তার দিকে। মেটাল ডিটেক্টরটা উঠিয়ে মূর্তিটাকে মারতে যাবে ঠিক তখনই স্যাম বেরিয়ে এলো কাদার ঘোলাটে মেঘের ভিতর থেকে।

 স্যাম ইশারা করে কিছু একটা দেখাচ্ছে তাকে। ওদিকে তাকালো রেমি। দৃশ্যটা দেখে আবারো তার আত্মায় পানি ফিরে এসেছে যেন। শার্কটা এখন গতিপথ পরিবর্তন করে অন্য দিকে ছুটে যাচ্ছে। সহজ কোনো শিকার খুঁজতে যাচ্ছে খুব সম্ভবত। আজকের দিনের জন্য তাদেরকেও মিশন এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। আগামীকাল ফিরে এসে আবারো চেষ্টা করতে হবে তাদের।

পাথরের ধ্বসে জাহাজের ধ্বংসস্তূপের কতোটা ক্ষতি হয়েছে দেখার জন্য পিছনে ফিরে তাকালো রেমি। পানি এখন আবার পরিষ্কার হয়ে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে আনতে যাবে ঠিক তখনই পিরিচ আকৃতির একটা গোলাকার বস্তু চোখে পড়লো তার। একটা পাথরের কাছে বালিতে পড়ে আছে বস্তুটা। চাকতির মতো বস্তুর অর্ধেকটা লুকিয়ে আছে বালির আড়ালে।

স্যামও দেখেছে ওটা। পাথরটার দিকে তাকিয়ে আছে। পাথরটায় হালকা একটু টোকা লাগলেই চাকতিটা বালির আরো ভিতরে ঢুকে যেতে পারে। রেমিকে স্তূপটার দিকে নজর রাখার ইশারা করে চাকতিটার দিকে এগিয়ে গেলো স্যাম। তারপর পাথরটায় না ছুঁয়েই চাকতির চারপাশের বালি সরাতে শুরু করলো। কিছুটা বালি সরাতেই হাতে চলে এলো চাকতিটা।

চাকতিটা রেমির হাতে তুলে দিলো স্যাম। রেমি ভেবেছিলো এটাই হয়তো ঐ মিসিং সাইফার হুইলটা। তবে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখার পর আবারো হতাশ হতে হলো ওকে। ছোটো একটা টিনের পাত এটা।

পাতটার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে ডাইভিং ব্যাগে ভরে নিলো ও। তারপর তাকালো ঘড়ির দিকে। আর অল্প কয়েকমিনিটের অক্সিজেন বাকি আছে তাদের। এখনই ওপরে উঠে যাওয়া দরকার। নাহলে পরে বিপদে পড়তে হবে। তাই আর দেরি না করে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলো ওরা।

পানির ওপরে মাথা উঠিয়েই মাউথপিসটা খুলে আনলো রেমি। স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল, নট ব্যাড, ফার্গো।

তবে স্যামকে এতোটা আনন্দিত দেখাচ্ছে না।

 কী সমস্যা আবার? জিজ্ঞেস করলো রেমি।

 আমার পিছনে থাকো শুধু, বোটের দিকে ইশারা করে বলল স্যাম।

বোটের দিকে তাকাতেই দেখলো, একটা পিস্তল হাতে বোটের একপাশে ঝুলে আছে নুনো। আর পিস্তলটা তাক করে ধরে রেখেছে ঠিক তাদের দিকে।

.

১৭.

ব্যাগটা দিয়ে দিন। বোটের দিকে ভেসে যেতে থাকা স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল তরুণ ছেলেটা। এখনই।

নুনো, স্যাম বলল। তোমার এটা করার দরকার নেই।

হ্যাঁ, দরকার আছে।

 কেন?

ওটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই। ব্যাগ হাতে তুলে দিন।

 দিয়ে দিলে?

দিয়ে দিলে ধীরগতির যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর বদলে দ্রুত মৃত্যু পাবেন।

তারা তোমাকে যতো দিচ্ছে, আমরা তার থেকে দ্বিগুণ দিবো।

 দ্বিধা ফুটে উঠেছে নুনোর চেহারায়। বারবার রেমি ও স্যামের দিকে তাকাচ্ছে শুধু। তারপর বলল, আপনারা বুঝতে পারছেন না। তারা ইতিমধ্যেই ক্যাপ্টেন ডেলগাডোকে মেরে ফেলেছে। আমি যদি কাজটা না করি তাহলে তারা আমার পরিবারকেও মেরে ফেলবে।

স্যামের উপদেশ উপেক্ষা করে বোটের দিকে সাঁতরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো রেমি। তবে স্যাম তার হাত খাবলে ধরে আটকালো তাকে। তারপর নুনের দিকে তাকিয়ে বলল, তারা তোমাকেও মেরে ফেলবে। ঠাণ্ডা মাথার খুনি ওরা।

 আমার পরিবারকে আটকে রেখেছে ওরা। প্লিজ… ক্ষমা করুন আমাকে। পিস্তলটা স্যামের দিকে তাক করে পর্তুগিজ ভাষার কিছু একটা বিড়বিড় করতে শুরু করলো ছেলেটা। খুব সম্ভবত কোনো প্রার্থনা পড়ছে।

এটা ভালো কোনো চিহ্ন না।

তারা এখনো আমার ওপর নজর রাখছে, নুনো বলল। আমি আপনারকে গুলি করেছি কিনা সেটা দেখছে। প্লিজ। আমি আমার পরিবারকে মারতে চাই না।

রেমি, স্যাম বলল। ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে তুমি চলে যাও এখান থেকে।

 আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না, স্যাম।

না, যাবে তুমি। নুনো, রেমি নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার পরই আমি ব্যাগটা তোমাকে দিয়ে দিবো।

পিস্তলটা আরো সামনে বাড়িয়ে ধরলো নুনো। না! আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আর আপনি, রেমির দিকে পিস্তলটা তাক করে বলল, ব্যাগটা আমার হাতে দিন, উনার হাতে না।

রেমি… এখনো রেমিকে আটকে রেখেছে ও।

এখনই! মরিয়া কণ্ঠে বলে উঠলো নুনো।

কণ্ঠস্বর বুঝাচ্ছে ছেলেটা এখন অনেকবেশি বিপজ্জনক হয়ে আছে। এই মুহূর্তে ছেলেটার রাগ আরো বাড়ানো খুবই বোকামি হয়ে যাবে। তাই অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও রেমির হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো স্যাম।

 বোটটার দিকে এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা ওপরে তুলে ধরলো রেমি। সাথে সাথেই ব্যাগটা খাবলে ধরলো নুনো। তবে রেমি সাথে সাথেই ব্যাগটা ছেড়ে না দিয়ে বলল, নুনো, তোমার পরিবার যেন নিরাপদে থাকে এই প্রার্থনাই করবো আমি। আর তুমিও যাতে সঠিক কাজটাই করো, সেই প্রার্থনাও করবো।

বলে ব্যাগটা ছেড়ে দিলো রেমি।

সাথে সাথেই আত্মা চমকে উঠলো স্যামের। ব্যাগটা পেয়ে গেলে তাকে মারতে আর কোনো দ্বিধা থাকবে না নুনোর। বন্দুকের নলের এতো সামনে থাকা রেমির বাঁচারও কোনো সম্ভাবনা নেই।

 ব্যাগটা হাতে নিয়ে খুলে ভিতরে একবার দেখে নিলো নুনো। তারপর যযাডিয়াকের মেঝেতে ব্যাগটা রেখে দিয়ে রেমির দিকে পিস্তলটা তাক করে বলল, আমি স্যরি। বলে ট্রিগার চেপে দিলো।

 সাথে সাথেই পানিতে লাফিয়ে উঠে স্যামের দিকে ঘুরে গেলো রেমি। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার। কোনোরকমে সাঁতরে স্যামের দিকে ছুটে আসছে।

 রেমি কাছে আসতেই তাকে টেনে নিজের পিছনে লুকিয়ে নিলো স্যাম। তখনই দ্বিতীয় আরেকটা গুলির শব্দ শোনা গেলো। রেমিকে পুরোপুরি নিজের পিছনে লুকিয়ে নিয়ে নুনের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো স্যাম। তবে তৃতীয় কোনো শব্দ আর শোনা গেলো না। যোডিয়াকের ইঞ্জিনের ভোঁ ভোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু এখন। তাদেরকে পানিতে ফেলেই চলে যাচ্ছে যোডিয়াকটা।

রেমি?

আমি ঠিক আছি।

রেমির চোখের দিকে তাকালো স্যাম। বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন। কিভাবে? আমি তো দেখলাম…।

পানিতে গুলি করেছিলো ও। আমাকে ভরকে দেওয়ার জন্য।

কেন?

আমার মনে হয়, আমাদেরকে না মেরেই ওদেরকে বুঝাতে চাচ্ছে যে আমরা মরে গেছি। যদি…

আর কিছু বলতে না দিয়ে রেমিকে ধরে চুমু খেলো স্যাম। তারপর ফিরে তাকালো গলফিনহোর দিকে। কুয়াশার কারণে অতোটা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছে না ওরা। যদি তাদের কপাল ভালো হয়ে থাকে, তাহলে গলফিনহো থেকেও হয়তো ওদেরজে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। যোডিয়াকটা প্রায় অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে গেছে। স্যাম আশা করছে নুনোর ধোকাটা যেন কাজে আসে। যদি কাজে না আসে, তাহলে… যাক অন্ততপক্ষে একটা সতর্কচিহ্ন তো তারা পাওয়া গেছে। যদি কেউ তাদেরকে মারার জন্য ফিরে আসতে চায়, তাহলে যোডিয়াকে করেই আসতে হবে। আর যযাডিয়াকটা দেখলে কিছুটা সতর্ক হতে পারবে ওরা।

বাঁচতে হলে এখন তাদেরকে পাথরটার কাছাকাছিই থাকতে হবে। গলফিনহো এখানে আসতে পারবে না কখনো।

 অনন্তকাল ধরে চলার পর অবশেষে গলফিনহোর কাছে গিয়ে পৌঁছালো যোডিয়াক। নোঙ্গর ফেলে বোটটাকে ওপরে উঠাতে দেখছে স্যাম ও রেমি। তারপর, জাহাজের ধার থেকে একজনকে অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকতে দেখা গেলো। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো স্যাম ও রেমি। দৃশ্যটা তারা জানে। রাইফেলের গুলিতে যোডিয়াককে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে।

 কাজ শেষে আবারো যাত্রা শুরু করলো গলফিনহো। আস্তে আস্তে তাদের চোখের সামনে থেকে।

ভালো দিকটা হলো, বাতাস ও উত্তাল সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বলল রেমি, আমরা তো বেঁচে আছি।

হ্যাঁ, এটাই আসল ব্যাপার! পানিতে ভেসে রেমির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল স্যাম। পানিতে ভেসে থাকতে হলে শক্তি বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাদেরকে অক্সিজেনের খালি ট্যাঙ্কগুলো আর বহন করার প্রয়োজন করছে না ওরা। তাই ট্যাঙ্কটা খুলে পানিতে ফেলে দিলো স্যাম। রেমিকেও একই কাজ করতে বলল।

তারপর তাকালো চারপাশের পানির দিকে। ডাইভিংর অবস্থানটা থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছে ওরা। দ্বীপটাও আস্তে আস্তে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউগুলো গিয়ে আছড়ে পড়ছে অভিশপ্ত পাথরটার গায়ে। সাথে সাথে তীব্র স্রোতের অক্লান্ত টান তো আছেই। এর মধ্যেই সাঁতার কেটে বিপদ থেকে দূরে থাকতে হবে ওদেরকে।

আকাশের দিকে তাকালো স্যাম। আকাশের গাঢ়মেঘগুলো ভারী বর্ষণের হুমকি দিচ্ছে যেন। আমাদের হাতে এখন আসলে দুটো উপায় আছে। এক, মেইনল্যান্ডের দিকে সাঁতরে যাওয়া, নয়তো দুই, এখানেই অপেক্ষা করা।

এই পানিতে?

 হয় পানিতে, নয়তো ঐ দ্বীপে, বলল স্যাম। শার্ক নাকি ভাইপার কোনটা বেছে নিবে?

দ্বীপটার দিকে তাকালো রেমি। চোখ আটকালো পাথুরে তীরে আছড়ে পড়া ঢেউগুলোর দিকে। যদি বলি দুটোর একটাও পছন্দ না আমার?

 স্যরি রেমি, বলল স্যাম। এছাড়া কোনো উপায় তো আর নেই। যদি না। তুমি কোনো প্ল্যান বি বের করে থাকো?

সেলমার সাহায্য পাঠানোর অপেক্ষা করবো আমরা?

কুয়াশার পরিমাণ আগের থেকে আরো বেড়েছে এখন। বাতাসের গর্জনও বাড়ছে। ঝড় খুব সন্নিকটে এসে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি ফোঁটা পড়তে শুরু করলো পানিতে। এই ঝড়-বাদলের ভিতরে মেইনল্যান্ডের দিকে সাতরে এখন প্রায় অসম্ভব। এমনকি, বিশ্বসেরা সাঁতারুদের পক্ষেও সম্ভব না এটা। শুধু ঝড়-বাদলই না, এগুলোর সাথে পানির স্রোতের তীব্র টানের ব্যাপারও আছে। সাতরে এগুতে গেলে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।

 দ্বীপেই চলো, বলল স্যাম। পানিতে ডুবে মরার চেয়ে ওখানে গিয়ে সাহায্যের অপেক্ষা করাই ভালো। সেলমা অবশ্যই সাহায্য পাঠাবে। আর স্যাম আশা করছে সাপগুলোও হয়তো বৃষ্টির পানি অতোটা পছন্দ করে না। তাই দ্বীপটাই আপাতত নিরাপদ হবে তাদের জন্য।

রেমিও মাথা ঝাঁকালো। বুঝতে পারছে এই পরিস্থিতিতে দ্বীপটাই তাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। এই ভেবে দ্বীপের দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করলো ওরা। তবে কপাল খারাপ। স্রোতটা চলছে তাদের বিপরীত দিকে। কয়েক মিনিট সাঁতরানোর পর স্যাম বুঝতে পারলো যে এভাবেও কোনো লাভ হবে না। বেশি দূর এগুতে পারবে না।

নতুন কোনো পরিকল্পনা করতে হবে তাদেরকে।

 ঠিক তখনই রেমি তার পাশে ভেসে এসে বলল, স্যাম…

এক মিনিট ভাবতে দাও আমাকে, বলল স্যাম।

 ওদিকে দেখো! বলে দক্ষিণ দিকে নির্দেশ করলো রেমি।

মাথা ঘুরালো স্যাম। ভাবছে গলফিনহোই তাদেরকে খোঁজার জন্য ফিরে আসছে আবার। কী?

ঐ যে দেখো। প্ল্যান বি।

 কিন্তু ধূসর ও উত্তাল পানির ফেনা ছাড়া স্যাম আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।

ডানের কোনার দিকে দেখ। আমার মনে হয় ওটা যোডিয়াক।

এবার দেখতে পেয়েছে স্যাম! ঢেউয়ের তালে উজ্জ্বল লাল কিছু একটা ভাসছে পানির ওপর। একবার ওপরে উঠছে, আরেকবার নিচে নামছে। এটা যোডিয়াক না হলেও, উজ্জ্বল রঙের কিছু একটা হবে। তবে যেটাই হয়ে থাকুক না কেন, এই মুহূর্তে তাদের আর হারানোর কিছু নেই। তাই স্যাম বলল, চলো।

সুবিধা এটাই যে তারা এখন স্রোতের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে পারছে। তাই কষ্টটা কম হচ্ছে। তবে অসুবিধাও এটাই যে উজ্জ্বল রঙের বস্তুটাও ভেসে যাচ্ছে স্রোতের সাথে সাথে। তবে তারপরও দ্রুতই ওটার দিকে এগিয়ে যেতে পারছে ওরা।

ওটা আসলেই যযাডিয়াক। তবে কিছুটা পানিতে ডুবে আছে বোটটা। আরেকটু কাছে যেতেই স্যাম বুঝতে পারলো যে বোটের বাইরের মোটরটা পানির নিচে ডুবে আছে। শুধু গলুইটাই এখন ভেসে আছে পানির ওপরে।

এটাকে আসলে বোট না বলে লাইফ প্রিজার্ভার বলা যায় এখন। এটা দিয়ে তারা কোথাও যেতে পারবে না। তবে কোনো সার্চ পার্টি এলে কালো ওয়েটস্যুটের থেকে এই লাল বোটটাই ভালো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।

অবশ্য তাদের কপাল খারাপ। বোটের সামনের মাথাটা খাবলে ধরতেই দেখলো যে এটা বেশিক্ষণ পানিতে ভেসে থাকতে পারবে না। তাদের ওজনের ভারে পুরোপুরিই পানিতে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখানেই থাকো, রেমিকে বলল স্যাম। আমি গিয়ে চেক করে দেখি।

মাথা ঝাঁকালো রেমি। নৌকার গলুই আঁকড়ে ধরে রেখেছে ও। স্যাম ওদিকে তার বেল্ট থেকে ফ্ল্যাশলাইটটা বের করে এবং মাস্কটা লাগিয়ে ডুব লাগালো পানিতে ভাসমান একটা বোটকে পানির নিচে ডুবানো বেশ কঠিন একটা কাজ। গুলি করার সময় ডেলগাডোর লোকেরা বেশ কয়েকটা এয়ারটিউব মিস করেছিলো। ওগুলোর কারণেই যযাডিয়াকটা এখনো পানির ওপরে ভেসে থাকতে পারছে। তবে মোটরটা আটকে নেই বোটের সাথে। বুলেট বর্ষণে নৌকা পড়ে যাওয়ার সময় তরুণ মুনো কোনোভাবে মোটরটা বোট থেকে আলগা করে ফেলতে পেরেছিলো।

স্যাম আশা করলো এতে করে হয়তো তারা আরো বেশ কিছুটা সময় ধরে ভেসে থাকতে পারবে। মাথা উঁচিয়ে রেমির কাছে এগিয়ে এসে বলল, বুলেটের ছিদ্র আছে অনেকগুলো। তবে ভেসে থাকার মতো যথেষ্ট বাতাস আছে এখনো। আশা করছি সার্চ পার্টি আসা পর্যন্ত ভেসে থাকতে পারবো আমরা।

এক মুহূর্তের জন্য কিছুই বলল না রেমি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ছেলেটা আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে।

সাময়িক সময়ের জন্য।

ঠিক তখনই কাছে পিঠেই কোথাও থেকে বজ্রাঘাতের বিকট শব্দ ভেসে আসতে শুনলো ওরা। স্যাম ধারণা করছে বজ্রটা খুব সম্ভবত দ্বীপে আঘাত করেছে। আশা করছে বজ্রপাত ঘটলে ঐ দ্বীপেই ঘটবে, পানিতে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো পানিতে। সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। কোনো রকমে যোডিয়াকের এক প্রান্তে আঁকড়ে ধরে রেখেছে ওরা। উত্তাল ঝড়ো বাতাস তাদেরকে প্রায় ছিটকে দিতে চাচ্ছে যেন। হুট করেই পানির নিচে মোকাবেলা করা টাইগার শার্কগুলোর কথা মনে পড়লো স্যামের। ওগুলো নিশাচর প্রাণী। রেমিকে কথাটা বলতে যাবে, তখন রেমিই বলে উঠলো, আমি ভাবছিলাম…।

রেমিকে শান্ত ও সতর্ক থাকতে দেখে স্বস্তি পেলো স্যাম। বলল, কী নিয়ে ভাবছিলে?

তোমার বলা আরামদায়ক সপ্তাহটার ব্যাপারে।

আচ্ছা?

ওটা কিছুদিন পিছিয়ে দেওয়া উচিৎ আমাদের। কী বলো তুমি?

এই মুহূর্তগুলোতেই রেমির প্রতি স্যামের ভালোবাসার পরিমাণ বিবর্ধিত হয়। তারা এখন একটা ডুবন্ত ভেলায় ধরে ঝুলছে, আর রেমি এর মধ্যেও হাস্যরস করার মতো কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে। এই মুহূর্তে উদ্বেগ কমানোর জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী থাকতে পারে? ভালো বলেছো। তাহলে… কাল দিন পর থেকে শুরু করা যাক সপ্তাহটা?

কাল থেকে না?

অন্ততপক্ষে মেইনল্যান্ডে ফেরা পর্যন্ত তো অপেক্ষা করা উচিৎ আমাদের। পরবর্তীতে আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটাও জানা দরকার।

বলে দুইজনই দুইজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কিছুক্ষণের জন্য। উদ্বেগের মাত্রাটা এখন কিছুটা হলেও কমে গেছে।

 কিভাবে তারা এই বিপজ্জনক অবস্থায় পতিত হয়েছে তা নিয়ে ভাবছে স্যাম। তাদের অবস্থান ফাঁস হওয়ার আসলে একটা উপায়ই আছে। ব্রি। যদিও এই মুহূর্তে রেমির বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারটা উঠিয়ে আবারো নিজেদের মধ্যে উদ্বেগ ফিরিয়ে আনার কোনো ইচ্ছা নেই স্যাম। কিভাবে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে সেটা নিয়েই ভাবা উচিৎ। তবে রেমি মনে হয় স্যামের চিন্তা ধরে ফেলতে পেরেছে। তাই বলল, আমি স্যরি।

 স্যরির কিছু নেই, রেমি। আমরা একসাথেই আছি এতে, তুমি আর আমি, সবসময়ই থাকবো।

শুনে মুচকি হাসলো রেমি। অন্ধকারের কারণে স্যাম অতোটা নিশ্চিত না, তবু এটুক বুঝতে পারছে রেমির হাসিতে হালকা বেদনার ছাপ মিশে আছে। সে জানে রেমি যখন কাউকে বিশ্বাস করে, তখন ঐ মানুষটাকে মনপ্রাণ দিয়েই বিশ্বাস করে। রেমিকে এই বেদনাগ্রস্ত অবস্থায় দেখে প্রচণ্ড খারাপ লাগছে স্যামের। কিন্তু এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বদলানোর মতো কিছু করা বা বলারও কোনো উপায় নেই তার।

বেঁচে থাকাটাই এখন মুখ্য বিষয়।

পরের কয়েক ঘণ্টা ধরেও এই কাজটাই করে গেলো তারা। যোডিয়াকটা এখন আরো ডুবে গেছে। স্যামের আশঙ্কা হচ্ছে কেউ এসে তাদের বাঁচানোর আগেই হয়তো সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যেতে হবে তাদেরকে।

তারা দুজনই ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত হয়ে আছে। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে স্যামের। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করেছে, তখনই তার মনে হলো যে পানিতে সে কিছু একটা দেখছে। পানির মরীচিকা খুব সম্ভবত। একটা আলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে তার। নিশ্চিত হবার জন্য চোখ কচলাযলো স্যাম। না, ওটা কোনো মরীচিকা না। আসলেই একটা আলো জ্বলছে, এবং আস্তে আস্তে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে আলোটা।

.

১৮.

রেমি…

দেখেছি ওটা।

স্নেক আইল্যান্ডের দিকে একটা বোট এগিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য দ্বীপ অভিমুখে চলতে থাকলে বোটটা মিস করবে তাদেরকে। তারা ভাসতে ভাসতে এখন অনেক দূর চলে এসেছে।

হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বোটটাকে ডাকতে শুরু করলো স্যাম ও রেমি। তবে বাতাসের গর্জনে তাদের কণ্ঠস্বর অতোটা দূরে যেতে পারছে না।

অসহায়ভাবে ওভাবেই কয়েকমিনিট বোটটার দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। তারপর দেখলো হুট করেই বোটটা দ্বীপ অভিমুখ থেকে সরে গেছে। দ্বীপের দিক থেকে ঘুরে এখন এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

আবারো ডাকতে শুরু করলো স্যাম ও রেমি। গলার স্বর ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ডেকেই গেলো। অনন্তকাল ধরে ডাকার পরে যেন অবশেষে তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে বোটটা। চোখ ধাঁধানো আলোতে প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা ওদের। আলো সইতেই দেখলো যে প্রাচীন, জং ধরা, পেট মোটা একটা বোট এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের পাশে থামলো বোটটা। ওপর থেকে তাদের দিকে দড়িতে বাধা লাইফ প্রিজার্ভার ছুঁড়ে দিলো কেউ। কে ছুঁড়েছে সেটা নিয়ে না ভেবে প্রথম লাইফ প্রিজার্ভারটা খাবলে ধরে রেমিকে দিয়ে দিলো। রেমি নিরাপদভাবে ওপরে উঠেছে দেখার পর নিজে খাবলে ধরলো অন্য প্রিজার্ভারটা। কেউ একজন টেনে তুলছে তাকে।

ওপরে উঠতেই দেখলো এন্টোনিও তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেই টেনে তুলেছে তাদেরকে।

ধন্যবাদ, স্যাম বলল।

তরুণ ছেলেটা মুচকি হেসে বলল, ধন্যবাদ আমাকে না, আমার চাচাকে দিন। বলে হাল ধরে রাখা ধূসর চুলের লোকটার দিকে ইশারা করলো এন্টোনিও। ভিতরে চলুন।

 পথ দেখিয়ে তাদেরকে কেবিনে নিয়ে গেলো স্যাম। তাদেরকে দেখে তরুণ একটা লোকের হাতে হাল ছেড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো এন্টোনিওর চাচা।

 এন্টোনিও লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ইনি আমার চাচা। হেনরিকে সালাযার।

লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে স্যাম বলল, আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষাও জানা নেই আমাদের।

 হেনরিকেও হাত মিলাযলো তাদের সাথে। তারপর পর্তুগিজ ভাষায় কিছু বলে মৃদু ধাক্কা দিলো এন্টোনিওকে।

লোকটার কথা শুনেই হাসি ফুটে উঠলো এন্টোনিওর মুখে। স্যাম ও রেমিকে কম্বল দিতে দিতে বলল, চাচা বলছেন, যদি তিনি না এখানে না আসতেন, তাহলে আমাকে আমার প্রথম বড়ো ভাড়াটা হারাতে হতো। তারপর আমাকে সাহায্য করা লাগতো তাঁর। তখন আরো মহাবিপদে পড়া লাগতো চাচাকে। হাহাহা।

 এন্টোনিওর হাস্যরসপূর্ণ কথা শুনে মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে ওরা। রেমি তো প্রায় জড়িয়েই ধরতে চেয়েছিলো ছেলেটাকে। তখনই টের পেলো যে এখনো শরীর ভিজে আছে তার। তাই বলল, তোমার কো আজীবন ঋণী হয়ে থাকবো আমরা।

 কিভাবে বুঝলে যে আমাদের খোঁজা লাগবে? স্যাম জানতে চাইলো। দ্বীপের এতো কাছে থাকবো তাই বা বুঝলে কিভাবে? আমাদের তো আগামীকালের আগে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো না।

সকালে আপনারা যাদের সাথে করে গলফিনহোতে উঠেছিলেন, তাদেরকে চিনতাম না আমি। ক্যাপ্টেন ডেলগাড়োকেও চোখে পড়েনি। তাই চাচাকে গিয়ে জানাই এটা। তখন চাচা বলল, ক্যাপ্টেনের কখনোই ঝড়ের আগে আগে আপনাদেরকে নিয়ে বেরুনোর কথা না। সন্দেহ জাগলো চাচার। তাই খুঁজতে বের হওয়া। আর চাচা এদিকের পানিতেই মাছ ধরে। এখানের সব কিছুই হাতের উল্টোপিঠের মতো চিনেন তিনি। স্নেক আইল্যান্ডে পৌঁছুতেই পানির স্রোত দেখে চাচা বুঝে ফেলে যে আপনারা কোথায় আছেন।

****

পরদিন ভোর সকালে এসে বন্দরে পৌঁছালো ওরা। রাতে বোটে তারা দুজনই খুব ভালোভাবে ঘুমিয়েছে। বন্দরে পৌঁছেই চলে গেলো হেনরিকের বাড়িতে। আটলান্টিকের তীরবর্তী দুই বেডরুমের বাংলোতে বসে পুলিশের কাজ শেষের অপেক্ষা করছে এখন। বিকালের দিকে তাদের ডাইভিংর সরঞ্জামগুলো নিয়ে ফিরে এলো পুলিশের লোকেরা। আপাতত এগুলোই খুঁজে বের করতে পেরেছে ওরা। সাথে জানালো যে তারাগলফিনহোকেও খুঁজে পেয়েছে, পানিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিলো বোটটা। এরপর পুলিশকে স্টেটমেন্ট দিয়ে সব কাজ শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যার মতো লেগে গেলো ওদের। সন্ধ্যায় এন্টোনিওকে ছেড়ে দিতে চাইলেও, এন্টোনিওই জোরাজুরি করলো যে সে ই তাদেরকে সাও পাওলোর হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সন্ধ্যায় ড্রাইভ করতে কোনো সমস্যা হবে না তার।

 তুমি আর তোমার চাচা আমাদের জীবন বাঁচিয়েছো, সাও পাওলোর দিকে যাওয়ার পথে এন্টোনিওকে বলল স্যাম। ছেলেটা আসলেই ভালো গাড়ি চালাতে জানে। তোমাদের এই ঋণ আসলেই কখনোই আমাদের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব না। তবে তোমার চাচা কোথায় থাকে তা এখন জানি আমরা। বাসায় ফিরেই তোমাদের দুজনের জন্য কিছু পাঠানোর চেষ্টা করবো আমরা।

আগের রাতেই এটা নিয়ে রেমির সাথে আলোচনা করেছে স্যাম। এন্টোনিওকে একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ার চিন্তা করেছে ও। এতে করে ছেলেটার বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল স্কুলের খরচটা মিটে যাবে। আর তার চাচাকে দিবে একটা নতুন বোট, সাথে সাথে তার কাজিনের জন্যও একটা শিক্ষাবৃত্তি দিবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে রেমি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমরা কখনোই ভুলবো না তোমাকে, এন্টোনিও। শীঘ্রই আবার যোগাযোগ করবো তোমার সাথে।

****

হোটেল রুমে টেবিলের সামনে বসে আছে স্যাম ও রেমি। কেউই কোনো কথা বলছে না। স্যাম জানে এখন তাদের আলোচনা করা উচিৎ, বিশেষ করে তাদের দলে থাকা কেউ একজনের পরিকল্পনা ফাঁস করার ব্যাপারটা নিয়ে। তবে এটা নিয়ে রেমিকে চাপ দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই তার।

 রেমি চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। স্যামের দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হেসে বলল, এটা ব্রির কাজ, তাই না?

এছাড়া তো আর কোনোভাবেই আমরা কোথায় আছি সেটা কারো জানার কথা না। যদি না এভেরির লোকেরাও হুট করেই আমাদের মতো করে ভেবে একই সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়। কিন্তু খুবই কাকতালীয় ব্যাপার এটা। আর আমরা যে বোট ভাড়া করেছিলাম, সেই বোটের ক্রুদের কিডন্যাপ হওয়া, আমাদেরকে দিয়ে ধ্বংসস্তূপ খুঁজে বের করানো, আর এরপর আমাদেরকে মারতে চাওয়া। এগুলোকে তো কাকতালীয় বলা যায় না।

আমি এখনো ব্যাপারটা মানতে পারছি না। তাকে বিশ্বাস করি আমি। আমি- বলতে গিয়ে হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেমি। আমার মনে হয় সেলমার সাথে কথা বলা উচিৎ আমাদের। যাত্রার পরবর্তী প্ল্যান সাজানো দরকার।

ঘড়ির দিকে তাকালো স্যাম। সেলমা খুব সম্ভবত ঘুম থেকে উঠে পড়েছে এতোক্ষণে। অবশ্যই।

তাকে কী বলবো আমরা?

ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ অপশনটা ওপেন করলো স্যাম। একান্ত নিরিবিলি সময়ে আমাদেরকে কল করতে বলবো। ও বুদ্ধিমতি। মেসেজ দেখলেই ও ব্যাপারটা বুঝে যাবে।

চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো রেমি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, ওহ, স্যাম…

আমরা এই রহস্যের সমাধান বের করেই ছাড়বো।

হুম। তবে আমার মনে হয় পুলিশের সাথে কথা বলা উচিৎ আমাদের।

যৌক্তিক প্রমাণ ছাড়া কথা বলে লাভ হবে না। বলে মেসেজটা পাঠালো স্যাম।

পাঁচ মিনিট পরেই কলব্যাক করলো সেলমা।

স্যাম কল রিসিভ করে বলল, দাঁড়াও, স্পিকারফোনটা চালু করে নিই। রেমিও আছে আমার সাথে।

 শুভ সকাল, সেলমা বলল, গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবেন নিশ্চয়?

তুমি কি একা আছে এখন?

হ্যাঁ, অফিসে আছি। ব্রি আর লাযলো ওপরতলায় নাস্তা করছে।

বেশ, বলল স্যাম। তাহলে ব্যাপারটা নিয়ে তুমিও ভাবছো?

হ্যাঁ, মিস্টার ফার্গো। হতভম্ব হয়ে গেছি বলা যায়। আমি তাকে বাইরের কারো সাথেই কথা বলতে দেখিনি। আর সেও কিন্তু সত্যিই সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে আপনাদের জন্য।

স্যাম বুঝতে পারছে যে রেমি তাকিয়ে আছে তার দিকে। এছাড়া আর কোনো ভাবেই তাদের অবস্থান ফাস হওয়ার উপায় নেই, যদি না সেলমা বা লাযলো কারো কাছে তথ্য ফাঁস করে থাকে। এবং তারা দুজনই ভালো করে জানে যে এটা কখনোই সম্ভব না। জানার একটা উপায়ই আছে, স্যাম বলছে। আমাদেরকে ভুল কিছু তথ্য ছড়াতে হবে। এতেই বুঝা যাবে ফাসটা কোথা থেকে হচ্ছে। বলে রেমির দিকে তাকালো স্যাম।

টেবিলের মাঝখানে রাখা স্যামের ফোনের দিকে তাকিয়ে রেমি বলল, আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।

যদি না তোমার কাছে কোনো ভালো আইডিয়া থেকে থাকে? স্যাম বলল সেলমাকে।

ভাবার মতো কিছুক্ষণ সময় দিন আমাকে। লাযলো আপনাদের ভোলা ছবিগুলো আগে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখুক। এরপর দুজনে মিলে যৌক্তিক কোনো একটা উপায় বের করার চেষ্টা করবো। উপায় পাওয়ার সাথে সাথেই আপনাদেরকে কল করবো আমি।

আচ্ছা। তোমার কলের অপেক্ষায় রইলাম।

ফোন কেটে দিলো স্যাম। যদিও সেলমাই সব কাজ করবে, তারপরও নিজেরা অলস বসে রইলো না। টুকিটাকি তথ্যগুলো খতিয়ে দেখেছে ওরা। অবশ্য দরকারে আসার মতো কিছুই বের করতে পারেনি। সারাদিন ধরে আলোচনার পর সন্ধ্যায় ডিনার খেতে বেরুলো রেমি ও স্যাম। একটু আগেভাগেই ডিনার করতে বেরিয়েছে আজ। এস্কুইনা মোকোতোতে ডিনার করবে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ব্রাজিলিয়ান খাবারের জন্য বিখ্যাত এই রেস্টুরেন্টটা। ভারী খাবারের বদলে হালকা খাবারই খেলো অবশ্য। খাওয়া শেষে ওয়াইনের বদলে পান করলে আর্টিসান বিয়ার।

খাবার-দাবার পর্ব শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুনোর সময়ই সেলমা ফোন করলো তাদেরকে।

বলল, জাহাজের ধ্বংসস্তূপ থেকে আপনাদের পাওয়া বস্তুগুলোর ব্যাপারে কিছু তথ্য বের করতে পেরেছি আমরা। লায়লো আছে আমার সাথে। ওই সব বলবে আপনাদের।

 লাযলো ফোন লাইনে আসার পর স্যাম বলল, হোটেলে ফিরার সাথে সাথেই তোমাদেরকে কলব্যাক করবো আমি। এখন বাইরে আছি। কথা বলার মতো অবস্থা নেই।

আচ্ছা, ঠিক আছে, লাযলো বলল। তবে খবর কিন্তু খুব ভালো বা খারাপ কোনোটাই না। ভালো-খারাপ দুটো মিলিয়েই বলা যায়।

.

১৯.

ওয়াশিংটন ডিসি

চার্লস এভেরি অফিসের দরজা দিয়ে বেরুতে যাবেন, ঠিক তখনই সেক্রেটারি তাকে ডেকে থামিয়ে বলল, তাঁর জন্য একটা কল এসেছে। বিরক্ত হয়ে এভেরি বললেন, বাদ দেওয়ার উপায় নেই? এখন একটা ডিনার মিটিং-এ যাওয়ার কথা আমার।

ইতিমধ্যেই সদস্যদের অনেকে চলে এসেছে মিটিং-এ যোগ দেওয়ার জন্য। বাইরের লবিতে বসে তার জন্যই অপেক্ষা করছে সবাই।

তবে তার বিশ বছর বয়স্কা সুন্দরী সেক্রেটারী সুযেট তার দিকে তাকিয়ে কামুকে ভাবে হেসে বলল, মি. ফিস্কের ফোন এটা।

 শুনে সুযেটের দিকে তাকালেন এভেরি। ফিস্কের কল হলেও ধরার এতোটা শখ নেই তার। তবে ফার্গোরা এখন সমুদ্রের নিচে মাছের খাবারে পরিণত হয়েছে কিনা সেটার ব্যাপারে জানার ইচ্ছা আছে তার। আমার ফোনে কল ট্রান্সফার করে দাও, বলে আবার অফিসের ভিতরে পা দিলেন এভেরি। ডেস্কে বসে ফোনের রিসিভারটা তুলে বললেন, ডিনারে যাচ্ছিলাম আমি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে?

মাত্রই সাও পাওলোর ক্রুদের সাথে দেখা হয়েছে আমার।

এবং?

উত্তরটা দেওয়ার আগে কিছুক্ষণ থেমে রইলো ফিস্ক, তারপর বলল, সাইফার হুইল পাওয়ার একটা সূত্র পাওয়া গেছে।

অবশেষে, বিজয়ের উল্লাসে ভরে উঠেছে তার মন। গর্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন ডেস্কের ওপরে রাখা পাইরেটস অ্যান্ড প্রাইভেটিয়ার্স বইটার দিকে। কয়েক শতাব্দী ধরেই তাঁর পরিবার তাদের থেকে চুরি যাওয়া বস্তুটা উদ্ধারের চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু কেউই উদ্ধার করতে পারেনি। অবশেষে তিনি উদ্ধারের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। আর শুধু অল্প কিছুটা মুহূর্ত…

কই আছে ওটা?।

 ব্রাজিলের সাও পাওলোর কাছাকাছি কোথাও। আমি এখন এয়ারপোর্টের দিকেই যাচ্ছি।

এভেরির নিজেরও ইচ্ছা করছে সাও পাওলো উড়ে যাওয়ার। তবে এমনটা করতে গেলে সবাই তার দুর্বলতা দেখে ফেলবে, অথবা সাইফার হুইলের আসল গুরুটা বুঝে যাবে। তিনি কাউকেই এটার ব্যাপারে সত্যটা বলেননি। এমনকি ফিস্ককেও না। ফিস্ক শুধু জানে– এটা এভেরিদের পারিবারিক সম্পদ, অনেককাল আগে হারিয়ে গিয়েছিলো। এটার আসল গুরুত্বটা জানে না ও। সঠিক সময়ের আগ পর্যন্ত এটার ব্যাপারে তিনি কাউকে বলবেনও না কিছু।

আর ফার্গোরা? তাদের কি অবস্থা?

যতোটা মনে হচ্ছে তারা হয় ঝড়ে ডুবে গেছে নয়তো সাঁতরে দ্বীপে গিয়ে সাপের কামড় খেয়ে মরেছে। যেটাই হোক, এটা নিশ্চিত যে-ফার্গোরা আর পথে বাধা দিতে পারবে না।

অবশেষে, ভেবে আরামে চেয়ারে হেলান দিলেন এভেরি। সপ্তাহে এই প্রথমবারের শান্তি অনুভব করতে পারছেন তিনি। ফার্গোদের জন্য বেশ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। ফার্গোরা সান্তোস বন্দরে যাচ্ছে শুনে ওখানকার সবগুলো নৌযানই ভাড়া করতে হয়েছিলো তাকে। কাজটা মোটেও সহজ ছিলো না। এছাড়া কোনো উপায়ও ছিলো না তার হাতে। সাইফার হুইলের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো ফার্গোরা। তবে যতো কাছেই যাক, এখন আর ওতে কিছু যায়-আসে না। তবে, ঝুঁকি এখনো একটা আছে। ঝুঁকিটা মাথায় আসতেই বললেন, ট্রেস করে কি আমার কাছে পৌঁছার মতো কোনো সম্ভাবনা আছে?

একদমই না। ক্রুদের সাথে ভালোভাবেই হিসাব নিকাশ চুকানো হয়েছে। কোনো দলিল নেই। ভাড়া করা সবাইকেই গুপ্ত অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পাঠানো হয়েছে। ফার্গোদের মত নিয়ে তদন্ত করলে কেউই কিছু খুঁজে পাবে না। অন্তত এখন পর্যন্ত আপনাকে সন্দেহ করার মতো কোনো সূত্রই নেই।

গুড। নজর রাখো যেন পরিস্থিতিটা এরকমই থাকে।

ফিস্কের থেকে ইতিবাচক জবাব শুনে ফোন নামিয়ে রাখলেন এভেরি। নিরবে বসে বইটার দিকে তাকিয়ে আছেন শুধু। মনে মনে বলছেন, দ্রুতই এই টাকা খরচ এবং ঝামেলা পোহানোর পুরষ্কারটা পাবেন। খুব শীঘ্রই! ভাবতে ভাবতে প্রায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন, ঠিক তখনই অফিসের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো কেউ।

 চোখ তুলে আগন্তুকের দিকে তাকালেন এভেরি। হঠাৎ তার স্ত্রী আলেক্সান্দ্রাকে অফিসে আসতে দেখে বেশ চমকে গেছেন।

আলেক্সান্দ্রার বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই বয়সেও মহিলার সৌন্দর্য হারিয়ে যায়নি। অফিসে ঢুকেই পার্সটা কাউচের ওপর ছুঁড়ে ফেললো মহিলা। তারপর বসে বলল, লবিতে থাকা ঐ তরুণীটা কে?

ক্লায়েন্ট।

ওহ, ওদেরকে তাহলে এখন তুমি এই নামে ডাকো? ক্লায়েন্ট? কে কার সার্ভিসের জন্য টাকা দিচ্ছে এখানে?

কী চাও তুমি?

আমার অ্যাকাউন্টে দেখলাম বেশ কিছু পরিমাণ টাকা নেই। ওগুলো আমি কখন খরচ করেছি তা নিয়েই আলাপ করতে এসেছি।

ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

টাকাগুলোর সাথে কি ঐ ম্যাপটার কোনো সম্পর্ক আছে? যেটাকে তুমি হন্যে হয়ে খুঁজছে, ঐ ম্যাপটা? যদি তাই হয়, তাহলে তো টাকাগুলো তোমার অ্যাকাউন্ট থেকে খরচ করা উচিৎ। তাই না?

বলে কাউচ থেকে উঠে লিকার ক্যাবিনেটের দিকে এগিয়ে গেলো আলেক্সান্দ্রা। ক্যাবিনেটে বোতলগুলো লেবেল চেক করে দেখছে। তারপর নিজের জন্য রেখে দেওয়া ব্র্যান্ডির বোতলটা বের করে এনে এক চুমুক গিলে এগিয়ে গেলো এভেরি ডেস্কের দিকে। ডেস্কে রাখা প্রাইভেট অ্যাণ্ড প্রাইভেটিয়ার্স বইটার ওপর কিছুক্ষণ হাত বুলানোর পর বলল, যে লোক কিনা আমাদের আসন্ন ডিভোর্সের কারণে নিজের সম্পদ লুকিয়ে রাখায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, আমার তো মনে হয় টাকা খরচের ব্যাপারেও তাকে আরো সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিলো।

চেয়ার থেকে উঠে লিকার ক্যাবিনেটের দিকে পা বাড়ালেন এভেরি। স্ত্রীর ফাঁদে পা দিতে চাচ্ছেন না। আলেক্সান্দ্রার অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া টাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা খাতে ব্যায় করেছেন তিনি। অন্য কিছু প্রজেক্টের জন্য নগদ টাকার প্রয়োজন পড়েছিলো, তাই নিয়েছিলেন। কারণ তাঁর নিজের অ্যাকাউন্টের টাকাগুলো ফিস্ক তার মিশনের পিছনে ব্যয় করছে। তোমার কথাবার্তার কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।

আমার সাথে বোকার অভিনয় করো না, চার্লস। তুমি হয়তো ভাবছো তোমার এই মোহের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না? ভুল ভাবছো। যাই হোক দুটো কথা শুনে নাও। এক, আমি একজন ফরেন্সিক অ্যাকাউন্টেন্ট নিয়োগ করেছি। তো তুমি যদি তোমার টাকা কোথাও লুকিয়েও রাখো, তাহলে সেটা বের করতে কোনো সমস্যা হবে না আমার। আবার ভেবে বসো না যে ডিভোর্সে তোমাকে লুট করে নিতে চাইছি আমি। আর দুই, তোমার এই গুপ্তধনের যদি আসলেও কোনো অস্তিত্ব থেকে থাকে এবং যেহেতু তুমি আমাদের টাকা ব্যবহার করে এটা খুঁজছো, তাই যা পাবে তার অর্ধেক আমাকে দিতে হবে। আমরা যে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিয়ে করেছিলাম, তা কি তুমি ভুলে গেছো? একদম ফিফটি-ফিফটি হবে কিন্তু, ডার্লিং। ঠিক অর্ধেক অংশ।

বলে বিদ্রুপাত্মকভাবে গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরলো আলেক্সান্দ্রা।

বোতল খুলে গ্লাসে ড্রিংক ঢাললেন এভেরি। এক ঢোকে পুরোটা গিলে নিয়ে আরেকবার গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বললেন, ওটা আমার পারিবারিক সম্পত্তি। এটায় তোমার কোনো অধিকার নেই।

 পারিবারিক সম্পত্তি? বলে বইয়ের মলাট উল্টালো আলেক্সান্দ্রা। পৃষ্ঠাগুলো দেখতে দেখতে বলল, আমার যতদূর মনে পড়ে, তোমার আগ্রহের এই ম্যাপ বা কোডটা খুব সম্ভবত তোমার পূর্বপুরুষেরাই কয়েকশো বছর আগে আসল মালিকের থেকে চুরি করেছিলো। তুমিই তো আমাকে বলেছিলে এটা, তাই না? এককালে তো আমরা দুজনেই দুজনের সাথে মন খুলে কথা বলতাম। বলে বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। তার নীল চোখগুলোতে প্রচুর ঘৃণা লেগে আছে এখন। জলদস্যু। তারা তো জলদস্যু ছিলো? তোমার পূর্বপুরুষেরা? দেখা যাচ্ছে, গাছ থেকে আপেল খুব বেশি দূরে পড়েনি। তুমিও তো তাইই।

 আলেক্সান্দ্রার হাত থেকে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে এভেরি বললেন, এটা আমার পরিবারের কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলো?

চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলো নাকি উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলো? হাজার হোক, চুরির এই ধারাটা তো প্রথমে তোমার পূর্বপুরুষেরাই শুরু করেছিলো। নাকি আমিই গল্পটা বলতে ভুল করছি?

তুমি কি আসলেই কোনো কারণে এসেছো? নাকি আমাকে জ্বালাতে এসেছো শুধু?

বাহ! আমার দক্ষতা দেখি দিন দিন ভালোই উন্নতি করছে। আগে তো শুধু বিরক্ত করতাম। বলে গ্লাসটা টেবিলে রেখে দিলো আলেক্সান্দ্রা। তারপর কাউচ থেকে পার্সটা তুলে নিয়ে বলল, আমি শুধু আমার অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে নেওয়া টাকাগুলোর কথা ভাবছি। ওগুলো কখন পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এটাই মূল চিন্তা এখন। আমারো খরচপাতি আছে। আর এটার জন্য কাউকে কোর্ট পর্যন্তও টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছি না।

আচ্ছা, আচ্ছা। সকালের মধ্যেই ওটা জায়গামতো পৌঁছে যাবে।

সেটাই ভালো। বলে দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখলো আলেক্সান্দ্রা। মনে হচ্ছে তোমার ক্লায়েন্ট চলে গেছে। ঢোকার সময় কিছু কথা বলেছিলাম মানুষটাকে। আশা করছি সে হয়তো আমার কথায় রাগ করে চলে যায়নি।

কোনো রকমে রাগ দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন এভেরি। ইচ্ছা করছে স্কচ ভর্তি গ্লাসটা আলেক্সান্দ্রার দিকে ছুঁড়ে মারতে। আলেক্সান্দ্রাও এটাই চাচ্ছিলো, গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলেই খুশি হতো ও। তবে তাকে খুশি হওয়ার সুযোগ দেওয়ারও কোনো ইচ্ছা নেই এভেরির।

আলেক্সান্দ্রার এখন যা আছে, এর সবই হয়েছে এভেরির কল্যাণে। এক সময় মানুষটাকে ভালোবাসতেন তিনি। আর এখন? এখন ঐ মহিলা তার কাছে সমাজের অভিজাত শ্রেণিতে উঠতে চাওয়া একজন মহিলা ছাড়া আর কিছুই নয়। আলেক্সান্দ্রা সবই করছে লোক দেখানোর জন্য। নিজের নাম বাড়ানোর জন্য। এমনকি, লোক দেখানোর জন্য ইদানিং দাঁতব্য কাজও করা। শুরু করেছে।

একদম ঐ ফার্গো মহিলাটার মতোই, মনে মনে বললেন। রেমি ফার্গোর সাথে দেখা না হওয়ায় খুব একটা আফসোস নেই তার। তিনি জানেন ঐ মহিলাও তার স্ত্রীর মতোই।

ফার্গোদের কথা মনে পড়তেই আবারো রাগ চড়ে গেছে এভেরি। যতো যাই ঘটুক না কেন, তাকে এটাই দেখাতে হবে যে গুপ্তধনটা তিনিই খুঁজে বের করেছেন। ঐ সম্পদগুলো তার নিজের। তাঁর স্ত্রীর বা অন্য কারোর না। শুধুই তার নিজের।

আর এটার জন্য কাউকে খুন করতেও কোনো দ্বিধা নেই তার।

.

২০.

ভালোটা দিয়েই শুরু করো, রেমির পাশে বসতে বসতে লাযলোকে জিজ্ঞেস করলো স্যাম।

আপনাদের পানির নিচে তোলা ছবিগুলো খুবই উন্নতমানের, লাল বলছে। আমরা ওগুলো ভালোভাবে জুম করে দেখতে পেরেছি-অবশ্য এটার জন্য পিট ও ওয়েন্ডিকেই কৃতিত্ব দিতে হবে, সে আসলে সেলমা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট পিট জেফকোট এবং ওয়েন্ডি করডেনের কথা বলছে। ফটোশপ বা কিছু দিয়ে কাজ করেছে বোধহয়। যাই হোক, আপনাদের তুলে আনা ছবিগুলো দিয়ে ওগুলোর নির্মাণকারী দেশগুলোর নাম বের করতে পেরেছি।

এটা তো চমৎকার সংবাদ।

 হ্যাঁ। তবে আমি কিন্তু দেশগুলো বলেছি। বহুবচনে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেমি। সবসময়ই কাজগুলো এমন কঠিন হয়ে যায়। কী আর করা!

হ্যাঁ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন হয়, লাযলো বলল। তবে এটার কিন্তু একটা উপকারী দিকও আছে। ঐ সীসার সিলটা এক ইংরেজ টেক্সটাইল কোম্পানির। ১৬৯১ থেকে ১৬৯৬ পর্যন্ত ব্যবসায় টিকে ছিলো ওরা। আর ধ্বংসস্তূপে খুঁজে পাওয়া ঐ হলুদ পাথরগুলো ডাচদের।

আর খারাপ সংবাদটা কী তাহলে? রেমি জানতে চাইলো।

এটাই যে তথ্যগুলো কোথা থেকে ফাস হচ্ছে সেটা বের করার মতো কোনো ভালো প্ল্যান তৈরি করতে পারিনি আমরা।

 আসলে, স্যাম বলে উঠলো, আমার মনে হয় আমি একটা আইডিয়া পেয়েছি। কাজে লাগতে পারে এটা। আমরা এমন ভান ধরবো যে আমরা আগে ভুল শিপরেকে খুঁজতে গিয়েছিলাম, তবে এখন সঠিকটা জায়গাটা খুঁজে পেয়েছি। আর এরপর অপেক্ষা করবো ফলাফলের। এরপর পুরো প্ল্যানটাই সবাইকে ভেঙ্গে বলল স্যাম।

লাযলো বলল, এটায় কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে আপনার?

যদি তথ্যগুলো ব্রির থেকে ফাঁস হয়ে থাকে, তাহলে এটা কাজে না লাগার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না। যে লোক গলফিনহো ছিনতাই করেছিলো সে সাইফার হুইলটাই চায়। জাহাজের পরিচয় দিতে পারবে এমন কোনো বস্তুতে তার কোনো আগ্রহ থাকার কথা না। আমরা বলবো আমরা সাইফার হুইলের আসল জায়গাটা খুঁজে পেয়েছি, অথবা সাইফার হুইলটা তুলে আনতে যাচ্ছি। তাদেরকে লোভ দেখানোর জন্য তো নিশ্চয় এর থেকে ভালো কোনো টোপ ফেলা সম্ভব না। যদি এতে কারো আপত্তি থেকে না থাকে, তাহলে আমার মনে হয় আমাদের এখন রুবেন হেওয়ার্ডের সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ।

ভালো বলেছেন, লাযলো বলল। কাজে নেমে পড়ছি আমরা।

কল কেটে দিয়ে রেমির দিকে তাকালো স্যাম। বলল, তোমার মত আছে এই প্ল্যানের সাথে?

তার মত থাকবে না কেন? এই লোকগুলো ঠাণ্ডামাথার খুনি, এদেরকে অবশ্যই থামাতে হবে। আর তাছাড়া হেওয়ার্ডের নামটা শুনেও এখন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে রেমি। স্যামের সাথেই কোর্ট অপারেশনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো হেওয়ার্ড। স্যাম ডারপায় চলে গেলেও, হেওয়ার্ড এখন কাজ করছে সিআইএর ডিরেক্টোরেট অফ অপারেশন্স কেস অফিসার হিসেবে। সেই প্রশিক্ষণের দিনগুলো থেকেই স্যামের খুব ভালো বন্ধু হেওয়ার্ড। আর হেওয়ার্ড কখনোই সে নিজে যেটায় জড়াতে পারবে না সেখানে স্যামকেও জড়াতে মানা করবে। যদি খুব প্রয়োজনীয় কিছু হয়, তাহলে এরজন্য বাইরের সাহায্য নিতেও কোনো দ্বিধা নেই তার।

সব ভেবে মাথা ঝাঁকালো রেমি। এটাই তো একমাত্র উপায়।

হ্যাঁ। তাহলে এখন আমাদেরকে শুধু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

অবশ্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা লাগলো না ওদের। পরদিন সকালেই সেলমা ফোন করে জানালো, আমরা ব্রিকে ভুল শিপরেকের ব্যাপারে জানিয়েছি। সাথে এটাও বলেছি যে, আমরা আসল শিপরেকটাও খুঁজে পেয়েছি এবং খুব শীঘ্রই ওখানে খুঁজতে যাবেন আপনারা। এভেরির লোকদের তৈরি হওয়ার জন্যও সময় দিতে হবে। ধরেই নিচ্ছি যে লোকটা ওখানে বা ঘাটে আপনাদের ওপর হামলা করতে পারে। তথ্যগুলো যেন ফাঁস হয়, সেজন্য এবার তারা ব্রিকেও মিশনের পরিকল্পনার দলে টেনে নিয়েছে। তারা কোন বোট ভাড়া করছে, কখন ওখানে যাবে, এমনকি ডাইভিংর জায়গাটাও বলে দিয়েছে ব্রিকে। জায়গাটা স্নেক আইল্যান্ডেই, তবে আসল শিপরেকের অবস্থান থেকে কিছুটা উত্তরে। আর নিরাপত্তার জন্য মি. হেওয়ার্ড আর্চার ওয়ার্ল্ডওয়াইড সিকিউরিটির নামের এক ফার্মকে নিয়োগ দিয়েছেন। বলেছেন, আপনি নাকি লোকটাকে চিনবেন এবং আপনাকে কল করতে পারে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

হ্যাঁ, চিনি ওকে। নিকোলাস আর্চার। আমাদের সাথেই ডারপায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো, স্যাম জানালো সেলমাকে।

তাহলে তো দেখছি সব ঠিকঠাকই আছে। শুভকামনা রইলো আপনাদের জন্য।

তোমার জন্যও, স্যাম বলল। আর ব্রির থেকে কিছু জানতে পারলে সাথে সাথেই আমাদেরকে জানাবে তা।

বলে কল কেটে দিলো স্যাম। সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে। রেমি ভাবলো এখন হয়তো সে একটু আরাম করতে পারবে। কিন্তু রাতে ঘুমাতে গিয়ে আরামের ছিটেফোঁটাও অনুভব করতে পারলো না। সারারাতই বিছানায় ছটফট করেছে শুধু। বারবারই শুধু বন্ধুর কথা ভেবেছে। ব্রির সম্পর্কে সে খুব ভালোভাবেই জানে বলে ধারণা ওর। তার আচরণের এরকম বিশ্বাসঘাতকতাটা মিলছে না। এটা ভাবতে গিয়েই মাথায় এলো, কেউ কি ব্রির কাছ থেকে জোর করে তথ্যগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে কিনা। হয়তো ব্রিকে ভয় দেখিয়ে ওর থেকে সব তথ্য জানছে কেউ।

কিছুক্ষণ ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিলো এমনটার সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে। এটা মাথায় আসার পরই অবশেষে কিছুটা স্বস্তি পেলো রেমি। ঘুমাতেও পারলো অবশেষে।

****

পরদিন সকালে ড্রাইভারের সাথে করে গাড়িতে যাত্রা করলো ওরা। যদিও ড্রাইভার আসলে কোনো ড্রাইভার না। আর্চার সিকিউরিটির একজন ড্রাইভারের ছদ্মবেশে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে।

নিকোলাস আর্চারের সাথে রেমির আগেও দেখা হয়েছে। যদিও সে তাদের ডারপার প্রশিক্ষণের কথাটা জানে, তারপরও তারা ওখানে কী কাজ করতো এই ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। এই ব্যাপারটা নিয়ে স্যামও কখনো খোলাসাভাবে কিছু বলেনি। রেমি ধারণা করে নিয়েছে স্যাম হয়তো সরকারের জন্য কিছু একটা তৈরি করেছিলো। ওটার জন্য সম্ভবত বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করা লাগতো, এর জন্যেই অস্ত্র ও আত্মরক্ষায় তাদেরকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিলো তাকে। অবশ্যই, এই প্রশিক্ষণটা তাদেরকে এখনো উপকৃত করে যাচ্ছে। গুপ্তধন খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই বড়ো বড়ো বিপদে পড়তে হয় ওদের। বিপদ থেকে মুক্তির জন্য প্রতিবারই স্যামের প্রশিক্ষণ বা ডারপায় কাজ করার অভিজ্ঞতাটা কাজে দেয় তাদের।

তবে স্যাম ডারপা ছেড়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায় নেমে পড়লেও আর্চার আরো অনেকগুলো বছর সরকারের সাথেই রয়ে গিয়েছিলো। ডারপা থেকে এফবিআইএ গেছে, তারপর অবশেষে সব ছেড়ে তৈরি করেছে নিজের ব্যক্তিগত এক আন্তর্জাতিক সিকিউরিটি ফার্ম।

 ব্যক্তিগত কাজে নেমে পড়লেও সাবেক সরকারী ও আইনপ্রণয়ণকারী দপ্তরগুলোর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করেনি আর্চার। এই কারণেই রুব হেওয়ার্ডের মতো সেও প্রয়োজনের সময় যে কোনো মূল্যবান তথ্যই বের করে ফেলতে পারে। বলা যায় তথ্য জানার ক্ষেত্রে প্রায় সবদিকেই এক্সেস রয়েছে তার। আর তাছাড়া, লোকটা এক মুহূর্তের মধ্যেই আন্তর্জাতিক মিশনের জন্যও দল তৈরি করে ফেলতে পারে। এবং তার দলের প্রতিটি সদস্যই থাকে উচ্চ প্রশিক্ষিত এবং অতিমাত্রায় বিশ্বস্ত। স্যামের ভাষ্যমতে, আর্চারের টিমগুলোর সাথে তুলনা করলে নাকি তাদের গড়া টিমগুলোকে হাই-স্কুলের জুনিয়র টিম বলে মনে হবে।

যদিও রেমি এই কথাটা এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি, তারপরও তারা ভালো নিরাপত্তার মধ্যে আছে ভেবে বেশ স্বস্তি পাচ্ছে ও। প্রত্যাশামতোই, এই অপারেশনের প্রতিটি অংশই বেশ ভালোভাবে সাজিয়ে নিয়েছে ওরা। এমনকি লা জোলাতের তাদের বাসার সামনেও আর্চারের একটা দল পাহারায় থাকবে। ব্রির তথ্য ফাঁস করার ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেলেই, আটক করে শিকের আড়ালে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ওকে।

 তাহলে কেন স্নেক আইল্যান্ডের দিকে স্যাম ও আর্চারকে বোট ঘুরাতে দেখে তার আত্মা এতো ধুকপুক করছে?

ঐ মুহূর্তেই স্যাম তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি ঠিক আছো?

রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি আমার।

 দেখেছি। সারারাত শুধু ছটফট করেছে।

আমরা কি কোনো বড় ভুল করছি?

না, আমরা করছি না, বলল স্যাম, ঠিক তখনই আর্চারও এসে যুক্ত হলো তাদের সাথে। আমরা এখানে আছি এটা জানার আসলে একটা উপায়ই আছে। আশা করছি টোপটা গিলবে ও, এবং এভেরির লোকেরাও হামলা করবে আমাদের ওপর।

স্যামের কথা শান্ত হয়ে বোটটার দিকে তাকালো রেমি। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, একটা ইয়টকে সাজিয়ে এই রিসার্চ ভেসেলে পরিণত করা হয়েছে। আর্চার ভাষ্য অনুযায়ী, এই যানের ইঞ্জিনটা বেশ শক্তিশালী এবং এর আড়ালে অনেক ক্রু লুকিয়ে আছে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে। প্রয়োজন পড়লে একটা ক্রুজ শিপকেও ডুবিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য আছে এই বোটটার। স্যামকেও একটা ফিশিং জ্যাকেট দিয়েছে আর্চার। ওটাকে বাইরে থেকে দেখে নির্দোষ মনে হলেও, ওটার ফোলা পকেটের নিচে খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই স্যাম তার স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের পিস্তলটা লুকিয়ে রেখেছে।

এবার স্যাম ও রেমিকে পানিতে ডাইভও দিতে হবে না। তাদের হয়ে করবে আর্চার দলের দুই সদস্য।

সব দেখে আর্চারের দিকে তাকিয়ে হাসলো রেমি। মানতেই হচ্ছে যে আপনার কুটা আমাদের সর্বশেষ ক্রু থেকে অনেক বেশি বিশ্বস্ত।

সবাইকেই এক-এক করে বেছে নেওয়া হয়েছে, মিসেস ফার্গো।

প্লিজ-রেমি ডাকুন শুধু, জোর করলো রেমি। যদিও আগে মাত্র কয়েকবারই আর্চারের সাথে দেখা হয়েছে তার, তারপরও লোকটাকে বেশ পছন্দ করে ও। দেখতে শুনতে অনেকটা স্যামের মতোই লম্বা চওড়া আর্চার, এবং স্যামের মতোই তার আচরণও কিছুটা বিভ্রান্তিকর। গায়ের রঙ কিছুটা তামাটে, থুতনীতে হালকা সোনালি দাড়ি। তাকে দেখলে সাধারণ কোনো অফিসারের বদলে উচ্চ প্রশিক্ষিত অপারেটিভ বলেই মনে হয়। আমি জানি আপনি স্যামের সাথে পুরো ব্যাপারটা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, তারপরও আমার দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। যদি কোনো কিছু ভুল হয়ে থাকে?

 আমরা প্রতিটা দৃশ্যই কল্পনা করে দেখেছি। আমরা আপনাদের পুরোপুরি নিরাপদে রেখেছি, মিসে… আ- রেমি। আপনি এখানে নিরাপদেই থাকবেন। ডাইভ দেওয়া এবং নকল আর্টিফ্যাক্ট তুলে আনা থেকে শুরু করে সবকিছুই যদি পরিকল্পনামাফিক এগোয়, তাহলে আশা করছি দুষ্কৃতিকারীদের স্থানীয় আইন প্রণয়নকারী সংস্থার হাতে তুলে দিতে খুব একটা অসুবিধা হবে না।

আমিও তাই আশা করছি। বলে দিগন্তের দিকে তাকালো রেমি। দূরত্ব কমার সাথে সাথে স্নেক আইল্যান্ডের আকৃতিও আস্তে আস্তে বড়ো হচ্ছে। সবই ঠিক আছে, তবে একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো রেমির। স্নেক আইল্যান্ডের দিকে তাদেরটা ছাড়া আর কোনো যান এগিয়ে যাচ্ছে না। ব্যাপারটা আর্চারকে জানালো ও।

আর্চার তার হাতের বাইনোকুলারটা রেমির হাতে দিয়ে বলল, খুব সম্ভবত তারা আমাদের বন্দরে ফেরার অপেক্ষা করছে এখন। আগামীকাল আমরা ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই হয়তো আক্রমণ করবে। তারপরও যদি আপনি কোনো নৌকা বা বোট দেখতে পান, তাহলে সাথে সাথেই জানিয়ে দিবেন আমাদের।

বাইনোকুলারটা গলায় ঝুলিয়ে নিলো রেমি। আচ্ছা, আমি নজর রাখবো পানিতে।

অপারেশনের বাকি দিকগুলো কেমন ভাবে এগুচ্ছে সেটা দেখার জন্য স্যাম ও রেমিকে ওখানে রেখেই ভিতরের দিকে চলে গেলো আর্চার। আর্চার চলে যাওয়ার পর রেমি স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল, যাও তুমিও।

আমি এখানেই ঠিক আছি। তোমার সাথে দাঁড়িয়ে থাকার আনন্দই অন্যরকম।

আমি জানি তা। সাথে এটাও জানি যে তুমি ডারপা এবং আর্চারের সাথে ওখানের মিশনের দিনগুলো অনেক মিস করো।

মুচকি হাসলো স্যাম। তারা এখন কী নিয়ে পরিকল্পনা করছে সেটার আপডেট জানতে পারলে খারাপ হতো না।

রেমি বাইনোকুলারটা উঁচিয়ে ধরে বলল, আমি আছি এখানে। সন্দেহজনক কোনো কিছু চোখে পড়লে ডাকবো তোমাকে।

 তোমার এই চিন্তাভাবনাগুলো খুবই ভালো লাগে আমার, রেমি। তোমাকে ভালোবাসার অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটাও একটা, বলে আর্চারের পিছু পিছু কেবিনের দিকে ছুট লাগালো স্যাম।

****

রাতে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন সকালে গিয়ে স্নেক আইল্যান্ডে পৌঁছালো ওরা। সকালের দিকে স্যাম ও রেমির ছদ্মবেশ নিয়ে ডাইভ দিলো দুজন অফিসার। তবে যেরকম ভেবে রেখেছিলো সেরকম কিছুই ঘটলো না। পানিতে বেশ কয়েকটা বোট চললেও কোনোটাই তাদের ধারে-কাছে দিয়েও আসছে না। এমনকি, কোনোটাকে দেখে হুমকির মতোও মনে হচ্ছে না।

আট ঘণ্টা অপেক্ষার পর অবশেষে অপারেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করলো আর্চার। জানালো যে যদি কোনো কিছু ঘটার থাকতো, তাহলে তা এতোক্ষণে ঘটে যেতো। নোঙর তুলতে যাবে, ঠিক তখনই দেখা গেলো স্নেক আইল্যান্ডের দক্ষিণ মাথা থেকে একটা ট্রলার এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

 ট্রলারটা দেখেই সবাই সতর্ক হয়ে গেছে। নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে পড়েছে আর্চারের লোকেরা। তবে আশঙ্কামূলক কিছুই ঘটলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের পাশ কেটে চলে গেলো ট্রলারটা। পাশ কেটে যাওয়ার সময় ট্রলারের কেউ তাদের দিকে তাকানোর মতোও আগ্রহ দেখায়নি।

ট্রলারটাকে পশ্চিমাভিমুখে চলে যেতে দেখে রেমি টের পেলো যে ক্রুরা বেশ হতাশ হয়েছে এতে।

ঘড়ির দিকে তাকালো আর্চার। তারপর নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল, ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। সবাই চোখ খোলা রাখবে। যেহেতু পানিতে কেউ দেখা দেয়নি, তারমানে বন্দরে শত্রুদের দেখা মেলার সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি।

তবে শঙ্কাটা শেষ পর্যন্ত আর বাস্তবে পরিণত হয়নি। বন্দরেও শত্রুদের কেউ নেই। এমনকি পার্বত্য রাস্তা ধরে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময়ও কেউ অনুসরণ করেনি তাদের।

****

আমি বুঝলাম না কিছুই, সন্ধ্যায় তাদের প্লেনের টেবিলে বসে বলল স্যাম। এটার তো কাজে আসার কথা ছিলো।

 আর্চারও তাদের সাথে আছে। ফার্গোরা যেন নিরাপদে মাটিতে ল্যান্ড করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্যই সাথে এসেছে ও। এটা বেশ ভালো

একটা প্ল্যান ছিলো। খুব সম্ভবত গুপ্তচরদের কেউ আমরা যতোটা ভেবেছিলাম ঠিক ততোটা কাজের না।

মাথা নাড়তে নাড়তে টেবিল থেকে উঠে বারের দিকে এগিয়ে গেলো স্যাম 1 ড্রিংক চলবে?

না, এখন না, আর্চার জানালো। ক্রুদের ব্রিফিং দিতে হবে আমার।

 রেমি? গ্লেনফিডিচের একটা বোতল উঁচিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো স্যাম।

হ্যাঁ। এখন এক গ্লাস পোর্ট দরকার আমার।

গ্লেনফিডিচের বোতলটা টেবিলে রেখে নিচের ওয়ান ক্যাবিনেট থেকে পোটের বোতল বের করে আনলো স্যাম। তো, পঞ্চান্ন বছরের পুরোনো ওয়াইনের বোতলটা বের করে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলছে স্যাম, কী মনে হয়, ভুলটা কোথায়? এটা যে ফাঁদ তারা কি বুঝে ফেলেছিলো? এমন সম্ভাবনা আছে?

 যে কোনো কিছুরই সম্ভাবনা আছে। আমি যা দেখেছি, আমাদের যাওয়ার আগে বা পরে কখনোই ডকে আর কোনো বোট ছিলো না। পুরোপুরিই একটা ব্যর্থ মিশন এটা।

গ্লাসটা রেমির হাতে দিয়ে স্যাম বলল, সেলমাকে কল করা দরকার আমাদের। হয়তো আমাদের থেকে আপডেট জানার অপেক্ষায় আছে ও।

পোর্টের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে তাদের পরিকল্পনা করা মিশনটা নিয়ে। ভাবছে রেমি। এতো ভালোভাবে প্ল্যান করা একটা মিশন কিনা শেষমেশ ব্যর্থ হলো! ব্রি কি কোনোভাবে ফাঁদের ব্যাপারে জেনে এভেরি বা তার লোকদের জানিয়ে দিয়েছিলো? কল দাও।

পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে বাসায় ফোন দিলো স্যাম। স্পিকার অন করে বলল, কী অবস্থা, সেলমা?

 মি, ফার্গো, সেলমা বলছে, আমার ধারণা অপারেশনটা হয়তো ব্যর্থ হয়েছে।

এটা কোনো প্রশ্ন না, বরং সেলমা নিজে থেকেই বলছে। কথাটা শুনেই একে-অপরের দিকে তাকালো তারা তিনজন। তারপর স্যাম জিজ্ঞেস করলো, এমনটা কেন বলছো তুমি?

কারণ-একটা বাজে সংবাদ আছে আমার কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *