১৫. উপসংহার – সুন্দরবাবুর কথা

উপসংহারসুন্দরবাবুর কথা

অজয়বাবু একদিনে তার এই অদ্ভুত কাহিনি বলতে পারেননি। একটানা কথা বলবার শক্তি তার ছিল না। বলতে বলতে শ্বাসকষ্টে তার কণ্ঠ মৌন হয়েছে বহুবার।

তার শরীরের অবস্থা ক্রমেই বেশি খারাপ হয়ে এল। ঔষধ-পথ্য, যত্ন-সেবা কিছুতেই ফল ফলল না, একদিন মধ্যরাত্রে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল।

মৃত্যুর আগের দিনেই বোঝা গিয়েছিল অজয়বাবুর আর কোনও আশা নেই।

তাঁকে ডেকে বললুম, আপনার জীবনের সঙ্গে-সঙ্গেই যে এতবড়ো আবিষ্কার লুপ্ত হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না। মানুষ সৃষ্টির উপায় আর উপাদান আমাকে জানিয়ে গেলেই ভালো হত।

কষ্টে নিশ্বাস টানতে টানতে অজয় বললেন, নতুন জীবন সৃষ্টি হচ্ছে ভগবানের কর্তব্য। ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে এটা হচ্ছে আগুন নিয়ে খেলা। আমি এ মারাত্মক খেলায় হেরেছি, গুপ্তকথা জানলে আপনিও জিতবেন না। সুতরাং ও-আগ্রহ দমন করুন। আমিও অন্তিম মুহূর্তে সেকথা প্রকাশ করে পৃথিবীর সর্বনাশ করে যাব না।

মৃত্যু যাতনার মধ্যেও প্রাণপণে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, সুন্দরবাবু, দানবকে যদি দেখতে পান, তখনই হত্যা করবেন। তাতে কোনও পাপ হবে না। আমার মৃত্যুর পরে সে হয়তো আবার নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন করতে পারে। তাকে হত্যা করলে জগতের মহা উপকার হবে।

এই তার শেষ কথা।

পরদিন তার দেহের সকার হবে।

কিন্তু রাত তখন ফুরিয়ে এসেছে, হঠাৎ অজয়বাবুর তাঁবুর ভেতরে কেমন একটা শব্দ হল। আমি চুপি চুপি তাঁবুর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম।

ভেতরে এককোণে লণ্ঠন জ্বলছিল, তারই ক্ষীণ আলোকে দেখলুম একটা চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর দৃশ্য।

অজয়বাবুর মৃতদেহের ওপরে ঝুঁকে রয়েছে একটা বিরাট দানব দেহ। তার মাথায় ঝাকড়া ঝাকড়া রুক্ষ চুল, তার গায়ের রং মড়ার মতন এবং তার লোমাবৃত সারাদেহ দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছিল একটা বন্য বীভৎসতা! বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে আমার নিশ্বাস যেন রুদ্ধ হয়ে গেল!

কান্নাভরা গলায় সে থেমে থেমে বলল, অজয়, অজয়—আমার প্রভু, আমার স্রষ্টা! তোমাকেও আমি বধ করলুম। তোমার ওপরে, আমি অনেক নির্যাতন করেছি বটে, কিন্তু তবু তোমাকে আমি ভালোবাসি! দুনিয়ার কোনও মানুষই আমার কেউ নয়, কিন্তু তোমার সঙ্গে ছিল যে আমার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক! তুমিই যে আমার ঈশ্বর, আমার হর্তাকর্তাবিধাতা, আমার সব! অভিমানে বিদ্রোহী হয়ে আমি অন্যায় করেছি—অজয়, আমাকে ক্ষমা করো। তোমার মৃত্যুর পর আমার জীবনের আর কোনও সার্থকতাই রইল না। তোমার কাছ থেকে—মানুষজাতির কাছ থেকে আমিও আজ চিরবিদায় গ্রহণ করলুম।

দানব মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ আমাকে দেখতে পেলে। পরমুহূর্তে সে প্রচণ্ড বেগে তাবুর বাইরে এসে পড়ল এবং কোথায় মিলিয়ে গেল শেষ রাতের অন্ধকারে।

অজয়ের শেষ অনুরোধ মনে পড়ল। কিন্তু আমি এমনি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম যে, দানবের বিরুদ্ধে একটা আঙুল পর্যন্ত তুলতে পারলুম না।

আঙুল তুলব কী, সামনাসামনি তাকে দেখে যে মূৰ্ছিত হয়ে পড়িনি, এইটেই আশ্চর্য কথা!

সে ভয়ংকর! যেন মূর্তিমান মৃত্যু! আজও স্বপ্নে তাকে দেখে চমকে চেঁচিয়ে উঠি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *