১৩. বিবাহের রাত্রে

বিবাহের রাত্রে

সেই মর্মভেদী ঘটনার পর কেটে গেল ৩ন মাস। বলা বাহুল্য এখনও আমার বিবাহ হয়নি।

প্রণবের মৃত্যু আমার প্রাণে যে কী আঘাত দিয়েছিল, সেকথা আপনি অনায়াসেই অনুমান করতে পারবেন। তার মোক কি জীবনেও ভুলব? কিন্তু থাক—আমার শোক আমার মনের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন হয়ে থাক, শিশুর মতন জনতাকে আমি কান্না শোনাতে চাই না।

প্রণবকে বাবাও মনে করতেন পুত্রের মতো। তারও বুকে যে কতটা বেজেছে, আমি তা জানি। তিনিই পিছিয়ে দিলেন আমার বিবাহের দিন।

দানব, পিশাচ, রাক্ষস! আমার বুকে জাগছে কেবল এইসব নাম। দৈত্য অশোককে হত্যা করেছে, প্রণবকে হত্যা করেছে, আমাকেও হত্যা করতে চায়! যারা আমার আনন্দের নিধি আগে আমাকে তাদের সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত করে তারপর দেবে আমার ওপরে দৃষ্টি দৈত্যের এই অভিপ্রায়! আগে আমাকে মরমে মেরে তারপর সে আমার দেহকে ধ্বংস করবে! কী পৈশাচিক মনোবৃত্তি!

কিন্তু আমি তাকে ভয় করি না! আমিও প্রস্তুত—তাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে! না, না, তাও নয়—সে কবে আসবে বলে আমি প্রতীক্ষা করে বসে থাকতে চাই না—আমি চাই তাঁকেই খুঁজে বার করতে। নিশিদিন আমার চিত্ত তার নিকটস্থ হওয়ার জন্যে অধীর হয়ে আছে। এবার যেদিন আমাদের দুজনের দেখা হবে সেদিন হবে একটা রক্তাক্ত, প্রচণ্ড দৃশ্যের অবতারণা! সেদিন একটা যবনিকা পড়বেই—হয় আমার, নয় তার জীবন-নাট্যের ওপরে! আজ আমারও প্রতিহিংসার ক্ষুধা তার চেয়ে কম জাগ্রত নয়!

এক-একদিন প্রাণের আবেগে বেরিয়ে পড়ি গভীর রাত্রে। তার মুখেই শুনেছি সে নিশাচর। দুই পকেটে দুই গুলি ভরা রিভলভার নিয়ে খুঁজে বেড়াই চারদিকে—ঘাটে বাটেমাঠে, পাহাড়ের শিখরে শিখরে উপত্যকায়, উপত্যকায়, গহন বনের আনাচে-কানাচে, যেখানে তার দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা! তাFি. বিলক্ষণই জানি, আমার ওপর নজর রাখবার জন্যে আমাকে ছেড়ে থাকবে না সে বেশির। কিন্তু তবু সে থাকে চোখের আড়ালে, আমার নাগালের বাইরে।

কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভব করি প্রতি মুহূর্তে! এমনকি, অনুভব করি যেন তার রক্তপিপাসী হিসকুটে খরদৃষ্টির স্পর্শ পর্যন্ত! আমার চোখে সে অদৃশ্য হলেও তার চক্ষে আমি দৃশ্যমান হয়েই আছি, এই অপ্রীতিকর সত্যটা সর্বদাই আমার মনকে খোঁচা দিতে থাকে।

তারপর বাবা আবার বিবাহের দিন স্থির করতে উদ্যত হলেন।

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বাবা, তোমার পায়ে পড়ি, আরও কিছু দিন সময় দিন। অশোক আর প্রণবকে খুন করেছি আমিই। আগে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।

বাবা উৎকণ্ঠিত চোখে আমার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললেন, অজয়, তুমি কি অসুস্থ? পাগলের মতন যা তা কী বলছ?

বাবা, আমি পাগল নই—অসুস্থও নই। অশোক আর প্রণবকে যে খুন করেছে তাকে আমি চিনি। এও জানবেন যে ওরা আমার ভাই আর বন্ধু না হলে আজ মারাও পড়ত না। তাই অনুতাপে বুক আমার জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। খুনিকে শাস্তি না দিয়ে বিবাহ করতে আমার মন উঠছে না।

কে এই পাষণ্ড খুনি? তার নাম বলো, এখনই আমি শাস্তির ব্যবস্থা করছি। ইংরেজ রাজ্যে পুলিশ আর আদালতের অভাব নেই।

বাবা, আপনার কাছে আমার গোপনীয় কিছুই নেই। কিন্তু এ হচ্ছে এমন সাংঘাতিক গুপ্তকথা, যা আপনারও কাছে বলা উচিত নয়।

বাবা অল্পক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, অজয়, তুমি আমাকে চেনো। পুত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবার অভ্যাস আমার নেই। তোমার গুপ্তকথা জোর করে আমি জানতে চাই না। কিন্তু তোমারও উচিত পিতৃকৃত্য পালন করা। আমি স্থির করেছি, আসছে হপ্তায় পাঁচ তারিখে তোমার বিবাহ দেব।

বাবা।

চুপ। আসছে হপ্তায় পাঁচ তারিখে মমতার সঙ্গে তোমার বিবাহ হবে। বাবা উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি বাবাকে জানি, আর তার কথার নড়চড় হবে না।

কিন্তু আমারও বোঝাবার উপায় নেই এবং বাবাও বুঝতে পারলেন না, তিনি আমার বিবাহের দিন নয়—স্থির করে গেলেন আমার মৃত্যুর দিন!

…বিবাহের আয়োজন আরম্ভ হল। বিপুল আয়োজন! বাবা নাকি আমার বিাহে খরচ করবেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। কত লোকের নিমন্ত্রণ যে হল তার সংখ্যা আমি জানি না। যন্ত্রসংগীত, কণ্ঠসংগীত, বাইজির নাচ। তার ওপরে দিনে যাত্রা আর রাতে থিয়েটার! খাবারের যে ফর্দ তৈরি হল তা দেখলেও ভোজনবিলাসীদের জিভ দিয়ে পড়বে টপ টপ করে জলের ফোটা।

পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে বাবা বোধহয় পৃথিবীকে চমকে দিয়ে যেতে চান!

পৃথিবী কতখানি চমকাবে জানি না, কিন্তু থেকে থেকে সচকিত হয়ে উঠছে আমারই মন।

দৈত্য বলে গেছে, তার সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার বিবাহের রাত্রে!

এবং সে হয়তো জানে না, তার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আমিও রীতিমতো প্রস্তুত হয়ে আছি!

আজ বিবাহের দিন। কিন্তু আমার বরসজ্জার আড়ালে অপেক্ষা করছে দু-দুটো ছনলা রিভলবার! এমন সশস্ত্র ও হত্যার জন্যে তৈরি হয়ে কোনও বর্বরও বোধহয় বিবাহের মন্ত্র পড়ে না।

মন্ত্র পড়লুম। বিবাহ হয়ে গেল। হিন্দুর বিবাহের দিনে বরকে সারাদিন অভুক্ত থাকতে হয়। রাত্রে বাসর-ঘরে প্রবেশ করবার আগে ডাক পড়ল আমার, আহার করবার জন্যে।

খেতে বসেছি। কানে আসছে সানাইয়ের সাহানা রাগিনী; আর এক জায়গা থেকে অর্কেস্ট্রার সুর সৃষ্টির চেষ্টা; অন্য কোথায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে নর্তকীর নূপুর ধ্বনি; এবং এরি মধ্যে সমান সজাগ হয়ে আছে অসংখ্য কণ্ঠের প্রচণ্ড কোলাহল–খেতে খেতে ভাবছি। এই বিশ্রী অনৈক্য তানকে কী করে লোকে মহোৎসব বলে মনে করে।

আচম্বিতে বাড়ির সমস্ত বৈদ্যুতিক আলো গেল নিবে—সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল নাচ গান বাজনার শব্দ। চারদিকে উঠল বিকট হইহই রব—আকাশ গেল যেন বিদীর্ণ হয়ে!

সকলেরই মুখে উচ্চকণ্ঠের জিজ্ঞাসা, কী হল, কী হল, কী হল? কেবল জিজ্ঞাসা, কোনও উত্তর নেই।

কিন্তু অন্তঃপুরে উঠল বহু নারী কণ্ঠের আর্তনাদ! মনে হল, এ শব্দ আসছে বাসর ঘরের ভেতর থেকেই!

কোনওরকমে একটা টর্চ সংগ্রহ করে অন্তঃপুরের দিকে ছুটলুম।

বাসর ঘরের দরজার কাছে কারা তিন-চারটে হারিকেন লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং বিশ-পঁচিশ জন মেয়ে গোলমাল ও হাহুতাশ করছে সেইখানে দাঁড়িয়েই।

মেয়েদের ভেতরে পথ করে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে স্তম্ভিত চোখে দেখলুম, রাঙা চেলির কাপড় পরে নববধূ মমতা মাটির ওপরে আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে আছে..নরম ফুল দিয়ে গড়া অপূর্ব প্রতিমার মতো। তার কণ্ঠের ওপরে কতকগুলো অমানুষিক আঙুলের চিহ্ন!

তাহলে এই ছিল দৈত্যের মনে? বিবাহের রাত্রে আমাকে নয়, মমতাকে হত্যা করবার নিষ্ঠুর ইঙ্গিতই সে দিয়ে গিয়েছিল আমাকে?

এবং এই খবর শুনে সেই রাত্রেই হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে বাবার মৃত্যু হল!

আমি একা! দুনিয়ায় আমি একা—তামার স্বহস্তে সৃষ্ট দানবেরই মতন একা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *