২.০৪ এগিয়ে আসা বর্শার আঘাত

২.৪

এগিয়ে আসা বর্শার আঘাত থেকে বাঁচতে একপাশে সরে গেল নিকোলাস। মাত্র এক ইঞ্চির জন্য মিস করল তাকে বর্শার ফলা। বালি মাটিতে গিয়ে পড়ল কোন ক্ষতি না করে, কিন্তু তার শত্রু হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে পড়ল কয়েক ফুট দূরে পড়ে থাকা তার মৃত ঘোড়র পেছনে। লোকটা এখনো হাল ছাড়েনি।

নিজের ঘোড়ার উপর চড়ে বসল নিকোলাস। ইচ্ছে এগিয়ে গিয়ে পিষে মেরে ফেলবে অথবা তলোয়ার দিয়ে ধড় আলাদা করে দেবে শত্রুর। এমন সময় নিজের কোমরবন্ধনী থেকে লম্বা বাঁকানো ছুরি বের করল লোকটা। নিকোলাস প্রায় তার গায়ের উপর পৌঁছে গেছে, এমন সময় ছুঁড়ে মারল ছুরি। ঝাঁকি দিয়ে মাথা পিছনে ঠেলে দিল নিকোলাস কিন্তু ঠিক সময়মত হল না কাজটা। ফলে তীক্ষ্ণ ফলায় কেটে গেল গাল, রক্ত গড়াতে লাগল চেহারার অবশিষ্ট অংশ দিয়ে মুখের ভেতরে। ব্যথা ভুলে সামনে ঝুঁকে লোকটার দিকে আঘাত করল নিকোলাস। কিন্তু হিসেবে ভুল হয়ে গেল। উপজাতি লোকটা আবারো মৃত ঘোড়ার পিছনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে শূন্য বাতাস কেটে গেল তলোয়ার। নিজের ঘোড়ার মাথা ঘুরিয়ে আবারো লোকটাকে আঘাত করতে উদ্যত হলেও তাল হারিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেয়ে মাটিতে পড়ে গেল নিকোলাসের ঘোড়া। নিকোলাসের মনে হল উড়ন্ত গোলার মত করে ঘোড়া থেকে মাটিতে ছিটকে গেল তার মাথা।

পতনের ফলে ঘুরে উঠল মাথা। মুখ থেকে থু করে তিক্ত স্বাদের রক্ত ফেলে বহুকষ্টে উঠে দাঁড়াল নিকোলাস কিন্তু প্রায় সাথে সাথে পৌঁছে গেল শত্রু লোকটাও। ঘামের গন্ধ এসে ধাক্কা মারল নাকে, চৌকোণা ধাঁচের লোকটা মাটিতে ফেলে দিল নিকোলাসকে। হাসতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো রসুনের টকটক গন্ধ, নিকোলাসের শাসনালীর উপর আঙ্গুলের চাপ বাড়িয়ে মোচড়াতে লাগল যেন প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়। নড়াচড়া করে, লাথি দিয়ে নিজের উপর থেকে লোকটাকে ফেলে দিতে চাইল নিকোলাস, কিন্তু মানুষটা বেশ ভারী আর নিকোলাসের নিজের শক্তি প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এসেছে শ্বাস নিতে না পারায়। ফুসফুসের ভেতরে মনে হল ঢুকে গেছে তপ্ত বালি। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ জোড়া। হঠাৎ করেই রক্তের ফিনকি ছুটে এসে মুহূর্তের জন্য মনে হল অন্ধ করে দিল নিকোলাসকে, বজ্রমুষ্টি ছেড়ে দিল লোকটা। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে তাকাতেই দেখা গেল কেউ একজন কেটে ফেলেছে নিকোলাসের আততায়ীর মাথা। রক্ষাকারী যেই হোক না কেন– ইতিমধ্যে হাওয়া হয়ে গেছে তারপরেও তাকে নিঃশব্দে ধন্যবাদ জানালো নিকোলাস। মৃতদেহকে একপাশে সরিয়ে রেখে হাঁটু গেড়ে উঠে বসল বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকা নিকোলাস। চারপাশে তাকাল।

কাবুল থেকে উত্তরদিকে দীর্ঘ যাত্রার শেষ অংশে এসে সংকীর্ণ গিরিপথগুলোর একটির মধ্যে পৌঁছাতেই এই অতর্কিত হামলা হল মোগলদের অগ্রগামী সৈন্য দলের উপর। হিন্দুকুশের ভেতরে এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে থাকা পর্বতের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে মোগল বাহিনী। গ্রীষ্ম হলেও এখনো ঢেকে আছে তুষারে। কয়েক জায়গায় তো গিরি সংকট এতটাই সরু যে পাশাপাশি খুব বেশি হলে তিনজন অশ্বারোহী পথ চলতে পারে। মাথার উপর ঝুলে থাকা চূড়া উঠে গেছে দুইশ ফুট পর্যন্ত। আর তাই প্রায় সবসময়েই পথ চলতে হচ্ছে ছায়ার মাঝে। সম্ভবত এ কারণেই মোগল চরেরা মাথার উপরে পাথরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা উপজাতিদের দেখতে পায়নি। তাই হঠাৎ করেই নির্ভুলভাবে মোগলদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকগুলো।

আততায়ীদের না দেখতে পেয়ে আর পুরো সারি জুড়ে ধুপধাপ করে সতীর্থ সৈন্য পড়ে যেতে থাকায় আঁকাবাঁকা পথ ধরেই যত দ্রুত সম্ভব ছুটে চলল মোগল সৈন্যরা। শত্রুর নিশানা এড়াতে এই সংকীর্ণ পথে যত দ্রুত সম্ভব পড়ে গেল আরো মোগল কিন্তু একই সাথে এসে পড়ল বাকিরা, মানুষ আর ঘোড়া উভয়েই শ্বাস ফেলছে বহুকষ্টে এই পাথুরে সমভূমিতে পৌঁছে। কিন্তু সান্ত্বনা এই যে অন্তত মোগল সৈন্যরা একটু একত্রিত হতে পারবে।

অবশেষে শত্রুদের দেখা পেল তারা–লাল-সবুজ ডোরাকাটা আলখাল্লা পরিহিত একদল অশ্বারোহী যোদ্ধা। ভেড়ার চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক আর মাথায় কালো উলের টুপি পরা তুর্কমান অপেক্ষা করছে নিজেদের বিশালদেহী মাংসল ঘোড়ার পিঠে বসে; নিশ্চিত যে সরু গিরিপথ থেকে বের হবার সাথে সাথে মোগল সৈন্যদেরকে খতম করে দেবে তাদের বন্দুকধারীরা।

মাথার উপর অস্ত্র ঘুরিয়ে, রণহুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে আসা তুর্কমানদের দেখতে পেয়ে অশোক সিংয়ের প্রায় হাজার রাজপুত আর নিকোলাসের পাঁচশ ভাড়াটে বিদেশী সৈন্য উন্মাদের মত চেষ্টা শুরু করল সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে এদের উপর ভার পড়েছে আওরঙ্গজেবের সৈন্যদের পৌঁছানোর আগে পথ প্রস্তুত করা। চারপাশের বিশৃঙ্খলার মাঝে নিকোলাসের কানে আসল রাজপুত অফিসারদের চিৎকারের শব্দ। নিজেদের সৈন্যদের একত্রিত করতে চাইছে তারা কিন্তু তার আগেই চলে এলো তুকমানরা। চওড় খঙ্গ দিয়ে কচুকাটার মত হত্যা করতে লাগল মোগল সৈন্যদেরকে, ঘোড়ার পা-টানিতে দাঁড়িয়ে লম্বা ব্যারেলের বন্দুক তুলে ছুঁড়তে লাগল আগুনের বল। জিজেল নামেই এগুলো পরিচিত সাথে আছে বাঁকানো জোড়া ধনুকের তীর।

মৃত ঘোড়াটার ওপাশে গিয়ে চারপাশে তাকাল নিকোলাস, ডান হাতে এখনো ধরা আছে তলোয়ার। তার নিজের ঘোড়া তাকে ফেলে রেখেই উধাও হয়ে গেছে। যতটা বুঝতে পারছে যুদ্ধের অবস্থা এখনো ভারসাম্যপূর্ণ; কিন্তু ক্ষতিটা বেশি মোগলদের পাল্লাতেই।

বামপাশে কমলা-পোশাকে সজ্জিত, হাতে লোহার ফলা লাগান বর্শা নিয়ে তুকমান বন্দুকধারীদের দিকে ছুটে যাচ্ছে রাজপুত সেনারা; পিছনে বড় বড় পাথরের আড়াল থেকে তীর ছুড়ছে ধনুবিদেরা। অস্ত্রের ঝনঝনানির মাঝেও শোনা গেল রাজপুত সৈন্যের চিৎকার; গলার মাংস বের হয়ে গেছে ভেদ করে ঢোকা তীরের আঘাতে। এরপর একে একে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল দ্বিতীয় আর তৃতীয় রাজপুত; দুজনের শরীরেই লেগেছে বন্দুকের গুলি। সোজাসুজি সামনে তাকাতেই নিজের একদল সৈন্যকে দেখতে পেল নিকোলাস–ফরাসী আর ডেনমার্কের সৈন্য সংখ্যায় কম হলেও দুঃসাহসিকতার সাথে লড়ছে; চেষ্টা করছে চারপাশ ঘিরে থাকা তুর্কমান অশ্বারোহীদের চক্রটাকে ভাঙ্গতে। হঠাৎ করেই একজন, গম্বুজের মত শিরস্ত্রাণের নিচে সোনালি চুলের রাশি দেখা গেল, ঢুকে গেল তুর্কমানের ব্যুহ ভেদ করে। কিন্তু সাথে সাথেই গুলির আঘাতে পড়ে গেল ঘোড়ার পিঠ থেকে। এক মুহূর্তের জন্য পাদানীতে আটকে রইল, কিন্তু এরপরই টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে গেল চামড়ার পাদানী। মাটির উপর কয়েক গড়ান দিয়ে অবশেষে স্থির হল হতভাগ্য ডেনিশ। লোকটাকে চিনতে পারল নিকোলাস। ডেনিস এই জলদস্যু বাংলার কাছে এসে জাহাজ ভেঙে যাবার পরে যোগ দিয়েছে ভাড়াটে সৈন্যদলে। একটা ঘোড়া খুঁজে বের করে নিজের লোকদের সাহায্য করতে এগিয়ে যাবার তাগাদা অনুভব করল নিকোলাস…

হঠাৎ করেই কানে এলো ঘোড়ার খুরের সম্মিলিত বাজনা। মাথা ঘোরাতেই দেখা গেল গিরিপথ দিয়ে বের হয়ে আসছে তরতাজা মোগল সেনারা, খোলা জায়গা পেরিয়ে যুদ্ধস্থানে পৌঁছে গেছে প্রায়। হলুদ সূর্য খচিত একগাদা কমলা রঙা ব্যানার বাতাসে উড়তেই বোঝা গেল যে অশোক সিং নিজে আছে এদের নেতৃত্বে। আরো নিশ্চিত হওয়া গেল দেহরক্ষীদের ভিড়ে লম্বা সাদা ঘোড়র উপর বসে থাকা, লোহার বর্ম গায়ে ঋজু রাজপুত অবয়বটা দেখে। চমকাতে লাগল সামনে বাড়িয়ে ধরা তলোয়ার, সন্ধ্যার মৃদু আলোতে জ্বলতে লাগল আগুনের মত। কিন্তু আর দেখার সুযোগ পেল না নিকোলাস। কোঁকড়া কালো দাড়িঅলা এক বিশালদেহী তুর্কমান ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল নিকোলাসের দিকে, নির্ঘাৎ তাকে দেখতে পেয়েছে আর পিষে মেরে ফেলতে চাইছে।

কাছেই একটা বর্শা পড়ে আছে দেখতে পেল নিকোলাস। তলোয়ার ফেলে একেবারে সময় মত হাতে তুলে নিল বর্শা। এক পাশে লফিয়ে পড়ে, অশ্বারোহীর পথ থেকে সরে গিয়ে আড়াআড়িভাবে বর্শাটা রেখে দিল ঘোড়ার খুড়ের নিচে। এগিয়ে আসতে থাকলে তুর্কমানের বাম পায়ে বিধে গেল বর্শা। নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে তুকমান, এমন সময় এক লাফে লোকটার উপর চড়ে বসল নিকোলাস, ছুরি বের করে দ্রুততার সাথে একেবারে ঢুকিয়ে দিল লোকটার গলায়।

হাঁপাতে হাঁপাতে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল। হাতে রক্তমাখা ছুরি, চারপাশে তাকিয়ে দেখছে আর কোন বিপদ ওত পেতে আছে কিনা। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি মাংসে ঢুকে গেল বন্দুকের গুলি অথবা তলোয়ার।

মৃতলোকটার ঘোড়াটা কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, লাগাম ধরতে এগিয়ে গেল নিকোলাস। সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে কাঁপতে থাকলেও বোঝা গেল আঘাত পায়নি জন্তুটা। শুধুমাত্র সামনের ডানদিকে খুরের চামড়ায় বর্শার আঘাতে খানিকটা রক্ত ঝরছে। ঘোড়ায় গলায় হাত বুলিয়ে পিঠে চড়ে বসল নিকোলাস; এরপর সাবধানে এগোতে লাগল সামনের দিকে, এই আশায় যে একটুখানি উঁচু জায়গা পাওয়া গেলে কী ঘটছে তা ভালোভাবে দেখা যাবে। অশোক সিং আর তার সৈন্যরা এসে গেছে, নির্ঘাৎ লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে তুকমানদের দল… ।

ঘোড়ার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ফিসফিস করে উৎসাহ দিতে দিতে সাবধানে মৃত আর মৃত্যুপথযাত্রী দেহগুলোকে পার হয়ে ছোট্ট পাহাড়টাতে নিরাপদে পৌঁছে গেল নিকোলাস। নিচে তাকাতেই দেখা গেল এক মাইলের চারভাগের এক ভাগ দূরত্বে সত্যিকারের পুরুষের ন্যায় যুদ্ধ করছে অশোক সিং। জোড়া মাথার যুদ্ধ কুঠারের আঘাতে মাথা কেটে গেল এক তুর্কমানের। এরপর ডান হাতে আঘাত করল দ্বিতীয় তুর্কমানের উপর, হাতের বর্শা ফেলে দিয়ে ঘুরে চলে গেল লোকটা, আহত হাত পাশে ঝুলতে লাগল মাংসপিণ্ডের মত করে। চারপাশ জুড়েই দেখা গেল হঠাৎ যেন যুদ্ধে আগ্রহ হারিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বা হামাগুড়ি দিয়ে পাথুরে ভূমি ছেড়ে চলে যেতে লাগল তুকমানরা। নিকোলাসের ফরাসী আর ডেনিশ ভাড়াটে সৈন্যরা নিজেদের শত্রুদেরকে নিকেশ করে এগিয়ে গিয়ে জড়ো হল অশোক সিংয়ের সৈন্যদের সাথে। এটাই যে প্রথম তা নয়, এভাবে আরো বহুবার রাজপুত শাহজাদা আর তার যোদ্ধারা যুদ্ধের গতি ঘুরিয়ে দিল মোগলদের অনুকূলে।

উল্লসিত হয়ে অশোক সিংয়ের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল নিকোলাস। হাসি দিয়ে দস্তানা পরা ডান হাত তুলে স্বাগত জানালো অশোক সিং।

অনেক শিক্ষা পেয়েছে–পালিয়ে যাচ্ছে তাই। বলে উঠল নিকোলাস। সত্যিই তাই। ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া নিকোলাস চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পেল কয়েক জায়গার খণ্ডযুদ্ধও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কয়েক জায়গায় তুর্কমানদের ছোট ছোট দল এখনো মাটি আঁকড়ে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে; কেননা তাদের ফেরার পথও বন্ধ হয়ে গেছে। নিকোলাসের ডান পাশেই এমন ত্রিশজন মিলে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুললেও বাঁচতে পারছে না। রাজপুত তলোয়ার আর বল্লমের হাত থেকে। কাছাকাছিই ছোট আরেকটা দল আশ্রয় নিয়েছে উল্টেপড়া রসদবাহী গাড়ির ওপাশে। কিন্তু নিকোলাসের ভাড়াটে সৈন্যরা কয়েকজন মিলে ধাওয়া করে খোলা জায়গায় বের করে আনছে এ তুকমানদের।

ডানদিকে দুইশ গজ দূরত্বে, দেখা গেল একদল কালো আলখাল্লাধারী অশ্বারোহী। এখনো চওড়া ফলার খড়া নেড়ে ভয়ঙ্করভাবে যুদ্ধ করছে। লোকগুলো। মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে মোগলদের সামনে থেকে পথ বের করে নিতে। অন্যান্য তুকমানদের চেয়ে ভালো ঘোড়া আর সশস্ত্র অবস্থায় আছে এরা। কালো ঘোড়ায় চেপে নেতৃত্ব দিচ্ছে ঘন দাড়িঅলা এক তুর্কমান। সম্ভবত স্থানীয় খান ও তার দেহরক্ষীরা।

উচিত শিক্ষা দিয়েছি আমরা এ বর্বরগুলোকে, হেসে ফেলল অশোক সিং। এরপর থেকে মোগল সৈন্যদের উপর আক্রমণ করার আগে দুবার ভেবে দেখবে হয়ত।

উত্তর দেবার আগেই পেছনে পাথুরে ভূমিতে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনতে পেল নিকোলাস। ঘুরে তাকাতেই চিনতে পারল ছয়জন সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসা আওরঙ্গজেবের তরুণ কৰ্চিকে। ঘোড়র উপর থেকে অশোক সিংকে জানালো, জনাব! শাহজাদা আওরঙ্গজেবের কাছে থেকে বার্তা নিয়ে এসেছি।

শাহজাদাকে জানাতে পারো যে গিরিপথ দিয়ে প্রধান সৈন্যসারি নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য আর কোন ভয় নেই তার–আমাদেরকে বিপদে ফেলার জন্য বসে থাকা লোকগুলোকে সমূলে উৎখাত করেছি আমরা। জানিয়ে দিল রাজপুত।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে একবার নিকোলাস আর আরেকবার অশোক সিংয়ের দিকে তাকাল তরুণ কৰ্চি। যেন বুঝতে পারছে না যে কী বলবে, ধুলিমাখা চেহারাতে উদ্বিগ্নতার ছাপ।

আমি নিশ্চিত এটা শুনতে পেলে খুশিই হবেন আমার প্রভু। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে একটা আদেশ নিয়ে এসেছি আমি। এখনি পিছু হটতে হবে সবাইকে।

কী? ঠিক শুনছি তো? সামনে ঝুঁকে এলো অশোক সিং।

শাহজাদা আওরঙ্গজেবের ইচ্ছে যেন সবাই পিছু হটে গিরিখাদে মিলিত হয় তাঁর সঙ্গে।

কেন? যদি এখন আমরা পিছু হটি, তাহলে এত কষ্ট করে দখল করা ভূমি আবারও কেড়ে নেবে শক্ররা। আবারো তাহলে একইভাবে যুদ্ধ করতে হবে সেনাবাহিনীর জন্য পথ নিরাপদ করতে।

নিজের যুক্তি জানাননি আমার প্রভূ।

অশোক সিংয়ের দিকে তাকাতেই কপালের উপর শিরা লাফাতে দেখল নিকোলাস।

কয়েকদিন ধরে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না অশোক সিং আর আওরঙ্গজেবের। রাজপুতের পরামর্শ প্রায়ই হেলায় সরিয়ে দিচ্ছে শাহজাদা, যা অহংকারী আর কদাচিৎ রেগে যাওয়া অশোক সিংয়ের পক্ষে মেনে নেয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আর নিজের কথা বলতে গেলে নিকোলাসের নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না কর্চির কথা। পর্বতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসায় প্রায় সফল হয়েছে আর সামনেই পড়ে আছে সহজতম রাস্তা, এমন সময় সব ছেড়েছুঁড়ে তিনি পিছু হঠার মানে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কী ঘটেছে গিরিপথে? উপরের পাথরে লুকিয়ে থাকা বন্দুকধারীরা কি এখনো গুলি করছে প্রধান সৈন্য সারির উপর, যেমনটা তারা করেছিল অগ্রগামী দলের উপর? শাহজাদা কি আমাদেরকে সাহায্যের জন্য ডেকে পাঠাচ্ছেন? জানতে চাইল অশোক সিং। গলার স্বরে ক্রোধ আর অবিশ্বাস।

মাথা নাড়ল কর্চি। আমি যখন এসেছি ততক্ষণে, উঁচু জায়গার বেশির ভাগটাই আমাদের দখলে চলে এসেছিল।

তাহলে আমি পিছু হটব কেন? সামরিকভাবে এর কোন মানে হয় না। সঠিক কোন কারণ ছাড়া এখন পিছু হটা আমার আর এ ভূমি রক্ষার্থে আত্মদান করা আমার সৈন্যদের স্মৃতির পক্ষে সম্মানহানিকর।

আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে এগুলো শাহজাদার আদেশ আর তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যেন তৎক্ষণাৎ মান্য করা হয়।

গভীর চিন্তায় মগ্ন নিপ অশোক সিংকে দেখে অস্বস্তির সঙ্গে একে অন্যের দিকে তাকাল নিকোলাস আর কর্চি। এবারই প্রথম না যে জ্যেষ্ঠ সেনাপ্রধান না হয়ে খুশিই হয়েছে নিকোলাস, কাঁধের উপর তাই এতবড় দায়িত্বের বোঝাও নেই। কয়েক মুহূর্ত আগেও সতীর্থের মত সমানভাবে বিজয়ের আনন্দ ভাগ করে নিয়েছে দুজনে। কিন্তু এখন সে একজন অধঃস্তন মাত্র, অপেক্ষা করছে নির্দেশের।

শাহজাদা যদি আমাকে পিছু হটার নির্দেশ দিয়ে থাকে, তাহলে আমাকে অবশ্যই তা মানতে হবে। আস্তে করে কথাটা বলেই আবার গলা চড়াল অশোক সিং। বলে উঠল, কিন্তু আমার উপর শাহজাদার প্রথম আদেশ ছিল গিরিপথের বাইরের দিকটা শত্রুমুক্ত করা আর এখনো শেষ হয়নি এ কাজ। যেহেতু এই আদেশ প্রথমে পেয়েছি আমি, তাই এটাই শেষ করব আগে।

অশোক সিং কি করতে যাচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই নিকোলাস দেখতে পেল নিজের তলোয়ার হাতে নিয়ে নিজের লোকদের উদ্দেশে রণহুঙ্কার ছাড়ল রাজপুত। এরপর সাদা ঘোড়র গায়ে জুতা দিয়ে চাপড় দিয়ে ছুটে গেল যুদ্ধরত খানেদের দিকে। এমনকি নিজের দেহরক্ষীদের জন্যও অপেক্ষা করল না। তবে কী ঘটেছে বুঝতে পেরে সাথে সাথে নিজেদের ঘোড়া ছোটাল অশোক সিংয়ের দেহরক্ষীরা। নিকোলাস নিজেও ঝেরে ফেলল সব দ্বিধা। পাথুরে জমির উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে এক হাতে লাগাম আর অন্য হাতে তলোয়ারের হাতল ধরে চেষ্টা করল সামনে কী হচ্ছে দেখতে। কিন্তু দৃষ্টি বাধা পেল আরো কয়েকজন অশ্বারোহী থাকাতে। হঠাৎ করেই খানিকটা ফাঁক পাওয়া গেল, কেননা রাস্তার মাঝে পড়ে থাকা পাথর এড়াতে দুপাশে সরে গেল দুই রাজপুত সেনা। অশোক সিংয়ের সাদা ঘোড়া এক পলকের জন্য চোখে পড়ল। রাজপুত শাহজাদা প্রায় পৌঁছে গেছে যুদ্ধস্থলে কিন্তু দেহরক্ষী এখনো খানিকটা দূরে। এরপরই আরেকট জিনিস নজরে পড়ল : বাতাসে শিষ কেটে শাহজাদার দিকে এগিয়ে আসছে একটা বর্শা। অবচেতনেই চিৎকার করে উঠে নিকোলাস। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে হারিয়ে গেল তার সাবধানবাণী। বর্শাটা এসে বিধে গেল অশোক সিংয়ের গলায়। আঘাতের জায়গায় হাত দিয়ে আস্তে করে ঘোড়া থেকে এগিয়ে আসা দেহরক্ষীর পথে লুটিয়ে পড়ল রাজপুত শাহজাদা।

খেপা মোষের মত ছুটে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল নিকোলাস। মনোযোগ দিয়ে কেটে ফেলে হত্যা করতে লাগল শত্রুদেরকে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে একপাশে ঠেলে দিয়ে এগিয়ে গেল দাড়িঅলা যোদ্ধার দিকে। নিজের খঙ্গ নিকোলাসের উপর দিয়ে চালিয়ে দিল খান; কিন্তু নিজের অস্ত্র দিয়ে আঘাত প্রতিহত করল নিকোলাস। প্রতিপক্ষের কুঁচকিতে ঢুকিয়ে দিল তলোয়ারের ফলা। চিৎকার করে পড়ে গেল খান। ঘোড়া ছুটতে ছুটাতেই নিকোলাসের চোখে পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা বেশির ভাগ শত্রু, হয় মৃত নতুবা মৃত্যুপথযাত্রী। পুরো যুদ্ধের মতো এই খণ্ডযুদ্ধের ফলাফল নিয়েও কোন সন্দেহ রইল না। কিন্তু নিজের সম্মান রক্ষার্থে আত্মদানের পথ বেছে নিল অশোক সিং। ক্ষতির কথা ভেবে পরিতাপে দগ্ধ হল নিকোলাস। অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নেয়া পোড়খাওয়া চারজন পেশীবহুল রাজপুত সেনা ডুকরে কেঁদে উঠল সবার সামনে। কাঁধে তুলে নিল দোমড়ানো মোচড়ানো আর রক্তাক্ত শাহজাদার মৃতদেহ। বহুদূরে পর্বতের মাঝে ডুবে যেতে লাগল রক্তলাল বলের মতো, সূর্য। একটু পরেই, এই ধূসর বিরান পাহাড়ে যতটুকু সম্ভব কাঠ জোগাড় করে চিতা বানানো হল। শেষকৃত্যের শিখায় আলোকিত হয়ে উঠল রাতের আকাশ। পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেল অশোক সিংয়ের আত্মা।

ভগ্নহৃদয়ে তলোয়ার খাপে ভরে রাখল নিকোলাস। ঘোড়ার দিকে ফিরে ডেকে উঠল তার ভাড়াটে সৈন্যদের দলনেতাকে। নাভারে থেকে আগত বর্ষীয়ান ফরাসী, জড়ো কর আমাদের সৈন্যদেরকে। শাহজাদার আদেশে ফিরে যেতে হবে আমাদেরকে। এই কারণে আমরা পরাজিত হলেও এই আদেশকেই মানতে হবে।

*

প্রাসাদের ছাদে একাকী দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন শাহজাহান। যদিও দেখতে পাচ্ছেন না যমুনার উপর দিয়ে তীরের মত আকৃতি নিয়ে উড়ে যাওয়া একদল সারসের সৌন্দর্য। তিন মাস থেকে বিপর্যয়ের সংবাদ প্রথমবার এনেছিল কসিডস, ঠিক তখনকার মত করেই আরো একবার চোখের সামনে ভেসে উঠল হিন্দুকুশের গিরি অঞ্চলে তুষারপাত আর ক্ষুধার জ্বালায় মৃত আর অথর্ব হয়ে পড়ে থাকা হাজার হাজার মোগল সৈন্যদের ছবি। আরো একবার কাবুলের পথে পিছু হটে আসছিল তাঁর সৈন্যরা। অসংখ্য প্রাণহানি আর রাজকোষের বিশ মিলিয়ন রুপি খরচ হয়ে গেলেও দখল করা গেল না এক ইঞ্চি ভূমি। তাঁর পুরো রাজত্বকালের প্রথম আর স্থায়ী সামরিক পরাজয় হিসেবে প্রমাণ হয়েছে এ অভিযান…আরো একবার নিজের কাছে জানতে চাইলেন যে আওরঙ্গজেব কীভাবে তাঁকে এতটা হতাশ করতে পারল, এমনকি গত বছরে মুরাদকেও ছাড়িয়ে গেছে এ ব্যর্থতা। এইবার তো মোগল সেনাবাহিনী এমনকি অক্সাসও পার হতে পারেনি… উজবেকদের সাথে একবারও তলোয়ার হাতে যুদ্ধে নামেনি। বরঞ্চ পুরো শীতকাল ধরে তাদেরকে দেরি করিয়ে দেবার সুযোগ দিয়েছে ভাঁড়ের মত পোশাক পরিহিত, আঘাত করে পালিয়ে যাওয়া আফগান আর তুকমানদেরকে ফলে কাবুলে এসে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা আর সফল হয়নি।

আর এই সাম্প্রতিক সংবাদ। খোঁড়া সমরকন্দ অভিযানের সুযোগ নিয়ে কান্দাহারের বিপক্ষে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে পারস্যের শাহ। আর মাত্র সাতান্ন দিন অবরোধের পর মেরুদণ্ডহীন মোগল প্রহরীরা দুর্গের ফটক খুলে দিয়েছে বিজয়ী পারসীয়দের জন্য। যতই ভাবছেন ততই রেগে যাচ্ছেন আওরঙ্গজেবের উপর। এখন অপেক্ষা করছেন পিতার জরুরি আদেশে গতরাতে আগ্রাতে ফিরে আসা আওরঙ্গজেবের সাথে কথা বলার জন্য। মুরাদের ব্যর্থতার তুলনায় আওরঙ্গজেবের ব্যর্থতাকে ক্ষমা করা কঠিন হচ্ছে, কেননা সে তো আরো বেশি অভিজ্ঞ ছিল।

আসলে দারা যা বলেছে তাই-ই ঠিক… নিজের সক্ষমতা নিয়ে একটু বেশিই উচ্চ ধারণা ছিল আওরঙ্গজেবের, এখন তাই খামতিগুলো বাজেভাবে চোখে পড়ছে। শাহজাহানও তাকে একই কথাই জানাবেন।

শাহজাদা আওরঙ্গজেবকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। কর্চিকে ডেকে আদেশ দিলেন শাহজাহান।

পাঁচ মিনিট পরে নিজের সাদাসিধে পোশাকে পিতার সামনে এসে হাজির হল আওরঙ্গজেব। তার ভাবভঙ্গি, ঋজু কাঁধ, উন্নত মস্তকের উপর একনজর চোখ বুলিয়েই শাহজাহান বুঝতে পারল যে নম্র বা অনুতাপ তো নয়ই বরঞ্চ যুদ্ধের অভিপ্রায় নিয়েই এসেছে আওরঙ্গজেব, এতে আরো রেগে গেলেন তিনি।

তো, নিজের স্বপক্ষে কী বলতে চাও তুমি? একাকী হতেই ত্বরিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন শাহজাহান।

পর্বতের মরু খাদের জন্যই আমাদের পরাজয় ঘটেছে। কয়েকটা ভারী কামান টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও, অস্ত্রবাহী গাড়িগুলোর চাকা ভেঙে গিয়েছিল আর বেশিরভাগ তো খুঁড়ো হয়ে গিয়েছে পাথুরে ভূমিতে।

তাই তুমি গাড়ি ঠিক করার ব্যবস্থা না করে কামান ছেড়ে চলে এসেছে!

হ্যাঁ, আর কোন বিকল্প দেখি নি আমি। মেরামতের জন্য সময় লাগতো আর ক্ষতিও বারবার হত। এছাড়া অস্ত্রের জন্য চলার গতিও কমে গিয়ে অর্থহীন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

কিন্তু একবার পর্বত থেকে বের হয়ে সমতল ভূমিতে যেতে পারলেই তো আর অর্থহীন থাকত না সেগুলো। সাধারণ গোত্রের মানুষেরা কীভাবে গোলা-বারুদ বহন করে? আরো শক্তভাবে চেষ্টা করা উচিত ছিল তোমার। কামানের সহযোগিতায় এতদিন অক্সাসের ওপারে পৌঁছে যেতে তুমি!

আমার বিবেচনাতে অক্সাস পর্যন্ত এগুলোকে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল, আব্বাজান।

এগুলোকে ছাড়াই এগিয়ে যাবার কথা একবারও ভেবেছিলে তুমি? না! আদেশের অবাধ্যতা করে পালিয়ে এসে কলঙ্ক লেপে দিয়েছো আমার আর মোগল সেনাবাহিনীর উপর। তাই বিস্মিত হবার কিছু নেই যে অশোক সিং–ভালো বন্ধুই শুধু নয়, আমার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আর বিশ্বস্ত জেনারেল মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছে।

এই আচরণকে সম্মানযোগ্য বলছেন আপনি? বেঁচে থেকে আবার যুদ্ধের চেষ্টা না করে অপ্রয়োজনে আত্মদান করাটাকে বোকামি ছাড়া আর কিছু বলব না আমি। তিনি যাই ভেবে থাকুন না কেন আমার পদক্ষেপই সঠিক ছিল। অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েই বিলম্ব হয়ে গেছে আমাদের। শত্রুরা জানত যে আমরা আসছি আর তাই প্রতিদিন শয়ে শয়ে এসে জড়ো হচ্ছিল পরাজিত করার উদ্দেশ্যে। আধুনিক অস্ত্রের অভাব সংখ্যায় বেড়ে গিয়ে পূর্ণ করার চেষ্টা করছিল তারা। আমি অস্ত্র এগিয়ে নিতে পারছিলাম না। আর তাই অস্ত্র ছাড়া নিজের লোকদের ঝুঁকির মধ্যেও ফেলতে চাইনি আমি।

এমনটা তো নাও হতে পারত। কতজনকে হারিয়েছ তুমি?

প্রায় বিশ হাজার যুদ্ধে পাঁচ হাজার আর ঠাণ্ডা ও রোগের প্রকোপে পনের হাজার। কয়েক বছরের তুলনায় শীত আর তুষারপাত শুরু হয়েছিল তাড়াতাড়ি…আব্বাজান, একবারের জন্য হলেও বিশ্বাস করুন আমাকে। যা যা সম্ভব আমি করেছি। সবকিছুই আমার বিরুদ্ধে ছিল আর সৈন্যরাও অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। আত্মপ্রত্যয়ের অভাব ছিল বিশেষ করে যারা সমভূমি থেকে এসেছিল মরুভূমিরও ছিল অনেকে। আমার প্রচেষ্টা ব্যতীত ক্ষয়ক্ষতি আরো বেশি হত।

কিছুই তোমার অপরাধ নয়, অন্য কারো, তাইত? সবসময় এটাই তো তোমার অজুহাত। আমার প্রতি কোন শ্রদ্ধাই নেই তোমার, না তোমার পিতা হিসেবে, না সম্রাট হিসেবে। নিজের মন্তব্য আর দক্ষতার উপর অগাধ আস্থা। এতটা বাজেভাবে আমাকে হতাশ করেছ, যা ঘটা সম্ভব বলে কখনো ভাবিইনি। তার উপরে আবার বহু প্রাণহানি হয়েছে– অশোক সিং সহ।

বারবার অশোক সিংয়ের নামে কেন তি? রাজপুতেরা আমাদের মত নয়–তাদের বিশ্বাসে গলদ আছে আর গরিমা তো সহ্যই করা যায় না। অহেতুক ঝামেলা না করে আমার আদেশ মান্য করে, পিছু হটায় সাহায্য করলেই সাম্রাজ্যের জন্য দায়িত্ব পালনে সার্থক হত।

তোমার সাহস কত বড় যে রাজপুত গরিমা নিয়ে কথা বল! রাজপুতদের সাহস আর বিশ্বস্ততা নিয়ে কোন প্রশ্নই ওঠে না আর মোগলদের বহু কীর্তিমান অভিযানের পেছনে তাদের হাত রয়েছে। জিহ্বাতে লাগাম দিয়ে আমার কথা শোন। আমি তোমাকে একান্তে ডেকে পাঠিয়েছি কেননা যা বলতে চাই তা সর্বসমক্ষে বললে আমাদের পরিবারের সম্মান কমত বৈ বাড়ত না। দুর্বল হিসেবে তোমাকে অভিযুক্ত করতে হবে কখনো ভাবিনি আমি। কিন্তু একমাত্র তুমি আর কেউ নয়, দুর্বল হিসেবে প্রতিপন্ন করেছ আমাদের রাজবংশকে। তোমার কারণে কান্দাহারের দেয়ালের উপর থেকে হাসতে হাসতে আমাদের উপর মূত্র বিয়োগ করছে পারসীয়রা…।

বুঝতে পারছি আপনি মনস্থির করে ফেলেছেন। এটা দুর্বলতা নয়, শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ যে কখন আপনি বুঝতে পারবেন উচ্চাকাঙ্খকে স্থগিত রেখে পুনরায় কীভাবে আর কখন তার পিছু নিতে হবে। তো আপনার ইচ্ছের কাছে মাথা নত করছি। আমাকে নিয়ে কী করতে চান?

পৃথিবী যদি তাকিয়ে না থাকত, তাহলে তোমাকে সাম্রাজ্যের একেবারে দূরতম কোণে উধাও করে দিতাম নয়ত মক্কায় পাঠিয়ে দিতাম হজ করতে যেহেতু তুমি প্রার্থনা এত ভালোবাসা। কিন্তু আমার রাগের মাত্রা বুঝে ফেলার সন্তুষ্টি দিতে চাই না শত্রুদেরকে। দাক্ষিণাত্যে তোমার পূর্ব পদে ফিরে যাবে তুমি; কিন্তু তোমার আচরণের উপর নজর রাখব আমি। অন্তত এখন সেখানে শান্তি বজায় আছে সর্বত্র। তাই তোমার সামর্থ্যের বাইরে কোন সামরিক হুমকি মোকাবেলা করতে হবে না। এক সপ্তাহের মাঝেই রওনা দেবে। এখন যাও।

*

তিনি কখনো আমাকে বা আমার উচ্চাকাঙ্খকে বুঝতে পারেননি, কেননা আসলে কখনো বুঝতেই চাননি। মাথা নাড়ল আওরঙ্গজেব।

কিন্তু অন্তত সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে তোমাকে দাক্ষিণাত্যে ফেরত তো পাঠাচ্ছেন। আগ্রা দুর্গের ছাদে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের আরেকটু কাছে সরে এসে কাঁধে হাত রাখল রোশনারা।

নিজের মুখ বাঁচাতে করেছেন–আমার জন্য নয়। কেন অভিযান ব্যর্থ হয়েছে সেদিকে কোন আগ্রহ নেই–আগ্রহ শুধুমাত্র মানুষ কী ভাববে তা নিয়ে। আমি নিশ্চিত দারা আমার বিরুদ্ধে কিছু লাগিয়েছে। আমাকে বেশি না ঘটানোর ব্যাপারে তাদের দুজনেরই উচিত সাবধান হওয়া।

তুমি হয়ত ঠিকই বলেছ, দারা নিশ্চয়ই কিছু বলেছে তোমার বিরুদ্ধে। যখন তুমি ছিলে না, একসাথে বহু সময় কাটিয়েছে তারা। জাহানারাও প্রায় তাদের সাথে থাকত, একা লাগত নিজেকে আমার।

জ্যেষ্ঠ ভগিনীর নাম নিতেই নরম হয়ে গেল আওরঙ্গজেবের চেহারা। রোশনারার মনে হল আওরঙ্গজেব সবসময় বড় বোনকে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু সময় এসেছে তাকে জানানোর যে বড় বোনও তার চেয়ে দারার পক্ষই বেশি নেবে। কিন্তু যদি চায় তাহলে মিত্র হতে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে রোশনারা। সম্ভবত সময় এসেছে তাকে জানানোর যে আওরঙ্গজেব যতটা ভাবছে সাম্রাজ্যের সম্মানীয়া শীর্ষস্থানীয় নারী ঠিক ততটা ত্রুটিহীন নয়।

নিকোলাস ব্যালান্টাইনও তোমার সাথে আগ্রা ফিরে এসেছে, তাই না?

হ্যাঁ। ফেরার সময়ে শেষপর্যায়ে পায়ে আঘাত পেয়েছে, সেরেও গেছে। কেন জানতে চাইছ?

কেননা মুরাদ অভিযানে বের হবার ঠিক আগমুহূর্তে একটা ঘটনা ঘটেছে। নিকোলাস ব্যালান্টাইন জাহানারার সাথে তার প্রাসাদে দেখা করেছে। তারপর থেকেই পরস্পরের কাছে চিঠি লিখছে তারা, এমনকি যখন তোমার হয়ে যুদ্ধ করছিল তখনো…

এটা হতেই পারে না… কে বলেছে তোমাকে? কীভাবে জানো তুমি? বিস্মিত হয়ে গেল আওরঙ্গজেব।

আমার প্রাক্তন এক সেবাদাসী এখন তার কাজ করে। সেই-ই আমাকে জানিয়েছে যে কী ঘটছে। পিতার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেছি এটা নিয়ে। কিন্তু তুমি জানো জাহানারাকে নিয়ে কী ভাবেন তিনি, বিশেষ করে আগুনের ঘটনার পর থেকে। কিন্তু কেই বা জানে তাদের পত্র বিনিময়ের আসল উদ্দেশ্য কী? আমি বলছি না যে সত্যিই কোন অনর্থ । ঘটছে কিন্তু এমনটা কি হতে পারে না যে নিকোলাস আমাদের পদ্ধতি বুঝতে না পারলেও জাহানারাকে অভিযানের সময়ে তোমার আচরণ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে আর এ তথ্য কাজে লাগিয়ে দারাকে সাহায্য করেছে পিতার কাছে তোমার বিরুদ্ধে লাগাতে।

জাহানারা কখনো এমন কিছু করবে না।

তুমি নিশ্চিত? পিতার বয়স বাড়ছে। হতে পারে ইতিমধ্যেই তিনি ঠিক করে ফেলেছেন যে সময় আসছে, তাকে ভাইদের মধ্য থেকে একজন কাউকে বেছে নিতে হবে। যদি তিনি চান যে দারাই হবে পরবর্তী সম্রাট, তাহলে সাধ্যমত সব কিছু করবে দারাকে সাহায্য করতে। এটার মানে এই না যে জাহানারা তোমার শত্রু হয়ে গেছে–আমি জানি তুমি তাকে কতটা পছন্দ কর, আমিও। কিন্তু ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির মোহ মানুষকে বদলে দেয় আর আমার বিশ্বাস তাকেও বদলে দিয়েছে। তাকে তো আমার আর গওহর আরার মত হারেমে থাকতে হচ্ছে না, নিজের গৃহস্থালি আর প্রাসাদ পেয়েছে। আনন্দ আয়োজনের ব্যবস্থাও করতে পারছে। আর তার ঔদ্ধত্বের আরেকটা প্রমাণ হল ইংরেজটার সাথে সম্পর্ক। সে ভাবছে আমাদের সবাইকে আটকে রাখা নিয়ম না মানলেও চলবে তার।

শুধুমাত্র প্রথা নয়, ধর্মীয় নীতিও এতটা অভদ্রতার অনুমতি দেয় ন। আস্তে করে জানালো আওরঙ্গজেব।

এতটা রাগ করো না। আমি নিশ্চিত যে ভাই হিসেবে তোমাকে ভালোভাসে সে। কিন্তু সিংহাসনের জন্য দারাকে পছন্দ করে। হেসে ফেলল রোশনারা, কিন্তু উত্তর পেল না আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে। মাটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আওরঙ্গজেব। জাহানারার কাছে তার অবস্থান দারার নিচে ভাবনাটা বেদনাদায়ক। যদি সে কখনো এটা নিয়ে ভাবতেও, তাহলে ধারণা করত যে জাহানারা নিশ্চয়ই সকলকে সমানভাবে ভালোবাসে। তারপরেও যত গভীরভাবে ভাবছে ততই বুঝতে পারছে যে রোশনারার কথাই সঠিক। যতবার তাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়েছে ততবার জাহানারা দারার পক্ষ নেয়নি? দারার দর্শন সম্পর্কে আগ্রহকে বাহবা দেয়নি? যদি সময় আসে তাহলে আওরঙ্গজেবের কঠোর আর কট্টর শাসনামলের চেয়ে দারার দুর্বল আর ঢিলেঢালা শাসনই বেশি পছন্দ করবে না? চিন্তার মাঝে রোশনারার নরম স্বর অনুপ্রবেশ করে আরো তিক্ত আর সন্দেহগ্রস্ত করে তুলল আওরঙ্গজেবকে। যদি আমি ইংরেজটার সাথে জাহানারার সম্পর্কের আর কোন প্রমাণ পাই তাহলে কী করব?

বাবার সাথে আরেকবার কথা বলবে আর এবার এমনভাবে যেন সে শুনতে বাধ্য হন। আর আমাকেও জানাবে… সবকিছু জানা প্রয়োজন যেন প্রস্তুতি নিতে পারি। এ ব্যাপারে তোমাকে কি বিশ্বাস করতে পারি? কাউকেই সহ্য করব না আমি–জাহানারাকেও না–যদি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।

.

২.৫

অতি ধীরে আরেকবার নিকোলাস ব্যালান্টাইনের চিঠি পড়ল জাহানারা। প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার পড়লে একটু স্বস্তি খুঁজে পাওয়া যাবে, ভেবে থাকলে নিরাশ হল সে। কীভাবে এত ভুল হয়ে গেল ব্যাপারগুলো? যতবার চেষ্টা করল, কিছুই বুঝতে পারল ন। এত তড়িঘড়ি করে আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যে ফেরত পাঠালেন শাহজাহান যে ভাইয়ের সাথে দেখা করার কোন সুযোগই পেল না সে। একাকী কথা বলে উত্তরের অভিযান সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের নিজস্ব মতামতও শোনা হল না। পিতার সামনে আওরঙ্গজেবের প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করলেও ঠোঁট চেপে বসে এমন এক গোঁয়ারের মত আচরণ করলেন শাহজাহান যে, জাহানারা বিস্মিত আর হতাশ হয়ে গেল।

দারার ধারণা আওরঙ্গজেবকে নিয়ে চিন্তা করে ভুল করছে জাহানারা। তার ধারণা, তার মাথা গরম, কিন্তু হৃদয় শীতল। একমাত্র শক্ত কোন শাস্তি পেলেই সে বুঝতে পারবে। পিতাকে তাই বলেছি আমি। কথাগুলো বলার সময় কেমন কঠোর দেখাচ্ছিল দারাকে। হয়ত তার প্রাসাদে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে এখনো আওঙ্গজেবকে সত্যিকারভাবে ক্ষমা করতে পারেনি সে।

অন্তত নিকোলাস ব্যালান্টাইন আছে যার কাছে নিজের উদ্বিগ্নতা তুলে ধরতে পারে জাহানারা। যেমন করে নিজের কথার প্রতি সম্মান রেখে মুরাদের সম্পর্কে জানিয়েছে, তেমনি খোলামেলা আর বিশ্বস্ততার সাথে এবার আওরঙ্গজেব ও হিন্দুকুশের প্রতিবন্ধকতা নিয়েও চিঠি লিখেছে।

খুব দ্রুতই জাহানারার পাঠানো চিঠির উত্তরে আগ্রা দুর্গের মাঝে বাস করা নিকোলাস জানিয়েছে আওরঙ্গজেব ও অভিযানে ব্যর্থতার কারণ নিয়ে। শুধু যদি পত্রের মাঝে এমন কিছু খুঁজে পেতে যাতে করে নিজের ভাইকে আরো একটু ভালোভাবে বুঝতে পারত… চোখ মেলে আবারো চিঠির সবচেয়ে দুঃশ্চিন্তার অংশে চলে গেল মন–অভিযানের শুরুতেই ঘটে যাওয়া একটা খণ্ডযুদ্ধ নিয়ে নিকোলাসের বক্তব্য।

‘যদিও এই ওতপাতা যুদ্ধ অনেকগুলোর মাঝে মাত্র একটা অপ্রত্যাশিত আর সচরাচর যেগুলো হয় সেগুলোর তুলনায় শক্তিশালী ছিল, আমাদের উচ্চমানের শৃঙ্খলা আর উন্নত ধরনের অস্ত্র বিজয় করে তোলে সুনিশ্চিত, অন্তত আমার তাই মনে হয়। আপনার ভাই একজন জাত যোদ্ধা কোন কাপুরুষ নন এটা নিশ্চিত নিজের দেহরক্ষীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন দুইশ গজ দূরে একটু চূড়া মতন জায়গা থেকে নিচে আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকা কাফিরদের দিকে। আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমার কয়েকজন সৈন্য নিয়ে চক্রাকার ব্যুহ গড়ে তুলি সাহায্য করার জন্য। চলার জন্য প্রস্তুত আমরা, তলোয়ার খাপ ছেড়ে বাইরে এসেছে, জোরে জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, ঘোড়ার খুরে কেঁপে উঠছে মাটি। আশা করছি যে কোন মুহূর্তে ইশারা করবেন শাহজাদা; পরিবর্তে তিনি এমন একটি কাজ করলেন যে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না আমরা।

 কয়েক মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই ঘোড়া থেকে নেমে গেলেন আওরঙ্গজেব, ব্যাগ থেকে বের করলেন কিছু একটা। ভাঁজ খুলতেই দেখা গেল একটি নামাজের জায়নামাজ। দেহরক্ষীরা চারপাশে ঘিরে দাঁড়ালে পর ভূমিতে জায়নামাজ পেতে তার উপরে হাঁটু গেড়ে নামাজ পড়তে লাগলেন আওরঙ্গজেব। সামনে ঝুঁকে জায়নামাজে কপাল ঠেকিয়ে তারপর বারংবার উঠ-বোস। আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যের অবস্থান দেখে আমি নিজে বুঝতে পারলাম যে তখন সান্ধ্য নামাজের সময়।

ততক্ষণে আমাদের চারপাশে নাচানাচি শুরু করেছে উড়ন্ত গুলি আর তীর। আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম মৃত আর আহতদের মধ্যে মারা গেছে শাহজাদার সৈন্য প্রধান। কিন্তু তাদের চিল্কারেও কোন প্রতিক্রিয়া হল না আপনার ভাইয়ের। তাড়াহুড়া না করে শান্তভাবে নামাজ পড়ে যেতে লাগলেন তিনি। শেষ হলে জায়নামাজ গুটিয়ে জায়গামত ব্যাগে রেখে ঘোড়ার পিঠে চড়ে আক্রমণের আদেশ দিলেন, যেন মাঝখানে কিছুই ঘটেনি। তারপরেও শত্রুকে পিছু হটতে বাধ্য করেছি আমরা। সেই সন্ধ্যায় মোল্লারা, সবসময়কার মত সেনাবাহিনীর সাথে পথ চলছে, পাশাপাশি তাঁবু বানানো হয়েছে, শাহজাদার ধর্মানুরাগ আর সাহসের প্রশংসা করে জানাল যে এই দুইয়ের কল্যাণেই বিজয়ী হবেন তিনি। যাই হোক, অন্যরা সত্যিকার অর্থে আমি আর অশোক সিংও মর্মাহত হয়েছিলাম। যুদ্ধের ময়দানে একজন সেনাপতির নামাজ পড়তে বসে যাওয়া যতটা ধর্মীয় আর সাহসী ততটাই হঠকারীতাও বটে। বেহেশতে নিজের স্থান গড়তে যতটাই আগ্রহী হোন না কেন, তাঁর কোন অধিকার নেই পৃথিবীতে মানুষের প্রাণ নিয়ে অপরিণামদর্শী হবার।

এরপর থেকে হতাশা বেড়ে যায় সবার মাঝে, বিশেষ করে আপনার স্বধর্ম নয় এমন সৈন্যদের মাঝে। আমার সন্দেহ আপনার ভাই জানতেন যে নিজের লোকদের বিশ্বাস হারিয়েছেন তিনি। ফলে দেখা গেল কর্মকর্তাদের আর কোন পরামর্শই চাইতেন না। স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল তাঁর আদেশগুলো মাঝে মাঝে অযৌক্তিক_নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিয়ে সৈন্যদের বিশ্বস্ততা আদায় করতে চেয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর মনোবল ধরে রাখতে সম্ভব সবকিছু করেছেন অশোক সিং, কিন্তু তার মৃত্যুর পরে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও বেশ দুঃখ পেয়েছি;; বারবার মনে হচ্ছে যদি কিছু করতে পারতাম তাকে রক্ষা করার জন্য। আমার মনে হয় আপনার ভাইয়ের মনে সন্দেহ জাগে যে দীর্ঘ আর বিপজ্জনক অভিযান জুড়ে সেনাবাহিনীকে একত্রে ধরে রাখার ক্ষমতা নেই তাঁর আর আমার বিশ্বাস এ কারণেই অভিযান পরিত্যগ করেছেন তিনি। আমি অন্যান্য যেসব সেনপ্রধানের অধীনে কাজ করেছি, তেমন নন তিনি। অত্যন্ত কঠোর আর শীতল তাঁর মনে কী আছে বলা কঠিন আর আমার ধারণা কিছু নিশ্চয় আছে।‘

নিজের বিক্ষত গালের উপর হাত বোলালো জাহানারা। আগুন লেগে গিয়ে পুড়ে যাবার পর সেই ভয়ানক দিনগুলিতে তাড়াতাড়ি করে দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে এসেছিল আওরঙ্গজেব অসুস্থ ভগিনীর পাশে থাকার জন্য। স্নেহময়ী এই ভাই-ই কি হয়ে গেছে নিকোলাসের ধারণানুযায়ী বহুদূরের, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত একজন মানুষ? এখন ভেবে ভেবে উপলব্ধি করল জাহানারা যে নিজের সম্পর্কে কত কম বলেছে আওরঙ্গজেব। একসাথে বহু সময় কাটানোর পরেও নিজের উচ্চাকাঙ্খ অনুভূতি নিয়ে কিছুই প্রকাশ করেনি তার ভাই। যেমনটা নিকোলাস বর্ণনা করল যদি সত্যিই আওরঙ্গজেব তেমন একজন মানুষ হয়ে থাকে, তাহলে কী এমন ঘটেছে যে এমন বদলে গেল সে? মার্বেল বা গ্রানাইটের মত কোন তিক্ততার বীজ কি বয়ে চলেছে তার শিরায়, ঠাণ্ডা আর কঠিন, একেবারে গভীরে না খোঁড়া পর্যন্ত খুঁজে পাবে না তুমি? পিতা-মাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আর একজন বোন যে কিনা তাকে ভালোবাসে। এটা তার দায়িত্ব যে খুঁজে বের করা… মায়ের কাছে দায়ী রইবে সে, কেননা যদি মা বেঁচে থাকতেন নিশ্চয়ই পুত্রের মনের মাঝে প্রবেশ করে সত্যি উদ্ঘাটন করতে পারতেন।

নিজের ডেস্কে পা ভাঁজ করে বসে কলম তুলে নিয়ে নিকোলাসকে চিঠি লিখতে শুরু করল জাহানারা।

‘চিঠির জন্য ধন্যবাদ। যদিও বেশ বেদনাদায়ক এটি আমার জন্য। কঠোর অনুশাসনের মাঝে থেকে যেমন আমি রয়েছি, কীভাবে একজন নারী পুরোপুরি বুঝতে পারবে যে কী আছে পুরুষের হৃদয়ে তাদের ভাবনা, অনুভূতি, সত্যিকারের বাসনা। আপনি যা জানিয়েছেন তাতে উদয় হয়েছে আরো অসংখ্য প্রশ্নের আর তাই আরো বিশদ না জানা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না আমি। আপনার সাথে আমার দেখা করার দরকার। আগেও যেমনটা এসেছেন তেমনিভাবে আগামীকাল সন্ধ্যায় আমার প্রাসাদে আসুন।‘

মোমবাতির উপর মোমের টুকরো গলিয়ে লাল মোমের ছোট্ট একটা গলিত পুকুর দিয়ে চিঠির উপরে সিল বসিয়ে দিল জাহানারা। গলিত মোমের উপর ব্যবহার করল মায়ের আইভরি সীলমোহর। নিজের সেবাদাসীকেই চিঠিটা দিত সে, কিন্তু সেই দাসীর কন্যা প্রথম দৌহিত্রের জন্ম দিয়েছে শহরে আর সেখানে বেড়াতে গেছে জাহানারার দাসী। এইবার তাই অন্য কারো উপর ভরসা করতে হবে।

নাসরিন! সেবাদাসীকে ডেকে পাঠালো জাহানারা। জলদি এসো। তোমার জন্য একটা কাজ আছে।

*

যেমনটা প্রায়শই করে থাকে আজ সন্ধ্যাতেও বিরক্ত না করার আদেশ জারি করেছেন তার পিতা। কিন্তু হাতে মসৃণ আইভরি রঙের কাগজের টুকরোটা প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে রোশনারাকে।

পিতার জন্য এমন তথ্য পেয়েছি যা অপেক্ষা করার মত নয়। রাজকীয় হারেম থেকে সম্রাটের গৃহে যাবার প্রধান প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকা তুর্কী নারী প্রহরীকে জানালো রোশনারা। তুর্কী প্রহরী আঁটসাট চামড়ার ফতুয়া পরনে চওড়া কাঠ আর পেশীবহুল প্রহরীকে দেখাচ্ছে ঠিক একটা পুরুষের মত। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে তারপর মাথা নত করে কুর্নিশ করল। ইশারা পেতেই রুপালি পালিশ করা জোড়া দরজা খুলে মেলে ধরা হল রোশনারার জন্য। লম্বা একটা করিডোরে মশালের আলোয় দেখা গেল শেষ মাথায় দ্বিতীয় জোড়া দরজা ও একইভাবে পাহারা দিচ্ছে তুর্কি হারেম প্রহরীরা।

প্রহরীদের নেতাকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে খানিকটা সময় নিল রোশনারা। টারকোয়েজ সিল্কের আলখল্লার প্রান্তদেশ গড়াতে লাগল মেঝের উপর। যাই হোক, এমনিতেই অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছে সে… বস্তুত এ চিন্তাও মাথায় এসেছিল যে হয়ত নাসরিন কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আনতে পারবে না। কিন্তু শেষপর্যন্ত পুরস্কৃত হল ধৈর্য। অবশেষে এমন কিছু পেয়েছে সে যাতে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে জাহানারাকে আর পিতার কাছেও প্রমাণ হয়ে যাবে যে রোশনারার সন্দেহ অমূলক ছিল না।

প্রহরীদের নেতা দ্বিতীয় দরজার গায়ে কি কি করে খোঁজা হারেম প্রহরীকে জানালো যে পিতার কাছে জরুরি প্রয়োজনে এসেছেন শাহজাদী রোশনারা। অপেক্ষা করছে রোশনারা।

কয়েক মুহূর্ত পরেই যমুনার দিকে তাকিয়ে থাকা পিতার পরিচিত কামরাতে পা রাখল শাহজাদী। প্রায়ই রাতের মত আজ রাতেও ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন শাহজাহান। প্রায় পূর্ণচন্দ্রের আলোতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন যমুনার ওপারে মমতাজের সমাধিসৌধের দিকে।

কী হয়েছে রোশনারা? ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে, কিন্তু এত রাতে বিরক্ত করার জন্য কোন ভর্ৎসনা নেই কণ্ঠে।

আমার মনে হয়েছে যে এটা আপনার দেখা দরকার পিতা। কাগজের টুকরাটা বাড়িয়ে ধরল রোশনারা।

কী-এটা?

নিকোলাস ব্যালান্টাইনের কাছে জাহানারার পত্র। গতকাল জাহানারা তার পরিচারিকা নাসরিনের কথা আগেও আপনাকে বলেছি আমি–ওকে জানিয়েছে গোপনে এটি নিকোলাসের কাছে পৌঁছে দিতে। এই পুরুষের সাথে তার মনিবানি গোপন কোন যোগাযোগ করছে আর সাহায্য করার দায়ে সেও অভিযুক্ত হবে, এই ভয়ে পত্রখানা এনে আমার হাতে তুলে দিয়েছে নাসরিন। প্রথমে আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কী করব। তারপরেই মনে পড়ে গেল যখন আপনাকে বলেছিলাম যে নিকোলাস জাহানারার প্রাসাদে তার সাথে দেখা করেছে আপনি বলেছিলেন আমি সঠিক কাজটিই করেছি। আমি তাই পত্রখানা খুলে ফেললাম। আশা আর বিশ্বাস ছিল যে কিছুই খুঁজে পাব না। কিন্তু স্বীকার করছি এর ভাষ্যে শোকাভিভূত হয়ে গেছি আমি। বুঝতে পেরেছি তৎক্ষণাৎ আপনার কাছে এটি নিয়ে আসা আমার দায়িত্ব।

কী বলেছে জাহানারা?

আপনার নিজেরই পড়া উচিত। এই যে।

চিঠি হাতে নিয়ে কাছাকাছি জ্বলতে থাকা একটা মশালের নিচে এগিয়ে গেলেন শাহজাহান। পৃষ্ঠা জুড়ে নাচতে লাগল কমলা আলোর শিখা। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারলেন না যা পড়ছেন, চোখের সামনে নাচতে লাগল অক্ষরগুলো। অর্থহীন মনে হল। গভীরভাবে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্থির করে আবারো চোখ রাখলেন শব্দগুলোর উপরে। এইবার কন্যার অভিজাত লেখনী–সবসময়কার মত হালকা নীল কালিতে লেখা–বোঝা গেল পরিষ্কারভাবে, যদিও চিঠিটি ধরে রাখা হাতটা সমানে কাঁপছে।

কঠোর অনুশাসনের মাঝে থেকে, যেমন আমি রয়েছি, কীভাবে একজন নারী পুরোপুরি বুঝতে পারবে যে কী আছে পুরুষের হৃদয়ে তাদের ভাবনা, অনুভূতি, সত্যিকারের বাসনা…আপনার সাথে আমার দেখা করা দরকার…

মাথা নাড়লেন শাহজাহান। প্রেমিকের কাছে নারীর পাঠানো পত্র ব্যতীত আর কিছু কি হতে পারে এটা? কীভাবে নিজের আর তার বংশের মুখে এত বড় লজ্জার ছায়া ফেলতে পারল জাহানারা? চোখ বন্ধ করলেও সামনে ভেসে উঠল কন্যার চেহারা, আগুন লাগার আগে যেমন ছিল, ঠিক সেভাবেই হাসছে যেভাবে হাসত মমতাজ। পৃথিবীতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়তম জিনিস হারিয়ে গেছে তাঁর স্ত্রী–এখন মেয়েটার ভাবনা চিন্তাহীন অপবিত্র কর্মকাণ্ডের ফলে হারাতে চলেছেন জাহানারাকে … কিছুক্ষণের জন্য আঙুল দিয়ে চেপে ধরে রাখলেন চোখ জোড়া। যেন এমন করলেই মন থেকে ভেসে যাবে ছবিগুলো।

আব্বাজান, আপনি ঠিক আছেন?

কথা বলার জন্য যুদ্ধ শুরু করলেন যেন শাহজাহান, আবেগের ভারে জড়িয়ে আছে শব্দগুলো। শোক আর সন্দেহ ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার মাঝে; কিন্তু চিঠির কথাগুলো ভুলে গিয়ে অনুভব করলেন ভিন্ন একটি জিনিস বহু বছর ধরে এমন উন্মত্তের মত আর রেগে যাননি, সম্ভবত জিম্মি হিসেবে মেহরুন্নিসা তার দুই পুত্রকে চাইবার পর থেকে আর নয়। সেসব দিনে কিছুই না করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আর নয়–তিনি একজন সম্রাট। যার একটা কথাই একশ মিলিয়ন লোকের কাছে জীবন আর মৃত্যুর সমান। কেউ না–এমনকি অসম্ভব ভালোবাসার পাত্রী কন্যাও নয় সীমা ছাড়িয়ে গেলে তাঁর ক্রোধের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।

চোখ মেলতেই দেখতে পেলেন চেহারায় মুচকি হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোশনারা। হাসির মত কিছু তো হয়নি। রোশনারার কাঁধে অসম্ভব ভাবে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে আনলেন সম্রাট। ফলে নিজের থেকে মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরে রইল কন্যার মুখ। এই চিঠি সম্পর্কে আর কেউ কিছু জানে?

মাথা নাড়লো রোশনারা। হাসি মুছে গেল চেহারা থেকে।

না। শুধু আমিই পড়েছি আর কাউকে জানাইওনি।

 ভালো। তো এভাবেই থাকবে। আমি চাই না যে দরবারে তোমার ভগিনীকে নিয়ে রটনা ছড়াক। নিজের গৃহে ফিরে যাও আর এমন আচরণ কর যেন কিছুই ঘটেনি। বুঝতে পেরেছ?

বুঝতে পেরেছি, আমি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিল রোশনারা। ভেবেছিল যে পিতা রেগে গিয়ে চিৎকার শুরু করবেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল প্রায় বিলম্বিত ধরনের আর চোখ জোড়া পুরোপুরি শীতল। প্রথমবারের মত উপলব্ধি করল যে যুদ্ধক্ষেত্রে পিতাকে কতটা নির্দয় দেখায় অথবা দরবারে যখন কারো বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। কী করেছে ভাবতে পেরে প্রায় অনুতপ্ত হয়ে পড়ল রোশনারা। সে তো শুধু চেয়েছিল পিতার চোখে জাহানারাকে হেয় করতে যেন আওরঙ্গজেবের জন্য যে নিন্দা করেছে সে শাস্তি পেয়ে যায় তার বোন। এখন ভেবে আতংকিত হয়ে উঠছে যে কী দুর্ভোগ ডেকে এনেছে জাহানারার উপর।

*

শাহজাদী, দয়া করে, উঠুন।

বিস্মিত হয়ে চোখ খুলতেই সাত্তি আল-নিসার উদ্বিগ্ন চেহারা তার উপর ঝুঁকে আছে দেখতে পেল জাহানারা। কী হয়েছে? আব্বাজানের কিছু হয়েছে?

না, সেরকম কিছু না। এটা আপনার ব্যাপারে। কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আপনার সঙ্গে। আলো ফোঁটার সাথে সাথেই সম্রাট আপনাকে দুর্গে ডেকে পাঠাবেন মনস্থির করেছেন, আপনার বক্তব্য শোনার জন্য।

মানে কী? এমনভাবে কথা বলছ যেন পিতা সন্দেহ করছেন যে আমি কোন অপরাধ করেছি। উঠে বসে মুখমণ্ডল থেকে লম্বা কেশরাজি সরিয়ে দিয়ে সাত্তি আল-নিসার কথার অর্থ বুঝতে চাইল জাহানারা।

ঠিক তাই, শাহজাদী। যদি আজ রাতে হারেমে যা শুনেছি তা সত্যি হয় তাহলে ইংরেজ লোকটাকে লেখা আপনার চিঠি পেয়ে গেছেন তিনি।

নিকোলাস ব্যালান্টাইনের কাছে লেখা আমার চিঠি? পিতা কীভাবে পেয়েছে এটা?

আমার পুরোন একজন বান্ধবী জানিয়েছে যে আপনার পরিচারিকা নাসরীন দাবি করছে যে আপনি তাকে একটা চিঠি দিয়েছেন ইংরেজ লোকটার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য; কিন্তু এর পরিবর্তে সম্রাটের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সে। নাসরিন বলছে যে লোকটা আপনার প্রেমিক আর বিনিময়ে মূল্যবান পুরস্কার পেতে যাচ্ছে সে।

আমার প্রেমিক… হতভম্ব হয়ে সাত্তি আল-নিসার হাত চেপে ধরল জাহানারা। কিন্তু এটা তো সত্যি না। কেউ কীভাবে এরকম একটি বিষয় ভাবতে পারে… চিঠিতে এ জাতীয় কিছুই ছিল না। আমি যা বলেছি তা হল আমি আওরঙ্গজেব সম্পর্কে তার সাথে কথা বলতে চাই… উত্তরের অভিযান সম্পর্কে যেন বুঝতে পরি আর কী এমন ঘটল যাতে আমার ভাই এরকমটা করল।

এখনো মাথা ঘুরছে, এই অবস্থায় উঠে দাঁড়াল জাহানারা। বেশ গরম পড়েছে বাইরে। তারপরেও প্রথমবারের মত হতাশায় মুষড়ে পড়ে চমকে গিয়ে ভাবলো যে অন্যরা কী ভাবছে তাকে নিয়ে। এত পরিণামদর্শী কীভাবে হল সে? কিন্তু এটাও কখনো আশা করেনি যে তার কোন ভৃত্য এতটা ছলনাময়ী হবে। যাই হোক, নিজেকে শান্ত করতে চাইল জাহানারা, আব্বাজান যখন বুঝতে পারবেন যে ভাইকে নিয়ে উদ্বিগ্নতার কারণেই এমনটা লিখেছে সে তাহলে নিশ্চয় তাকে ক্ষমা করে দেবেন… আর ক্ষমা করার কিই বা আছে সেখানে?

আমার এখনি পিতার কাছে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলা দরকার।

না! সাবধান শাহজাদী। আমি যদিও বহু বছর ধরে শ্রদ্ধা করে আসছি আপনার পিতাকে–এমনকি তিনি সম্রাট হবারও আগে থেকে তাঁর ক্রটি সম্পর্কে অন্ধ হতে পারব না। আপনার মায়ের মৃত্যুর পর থেকে বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে যে তিক্ততা তৈরি হয়েছে তার মনে, তা এখনো পুরোপুরি যায়নি। নিজের ভেতরে ডুবে গেছেন তিনি। আর সবসময়ে যুক্তি মেনে কাজ করেন না। সব সন্তানের মাঝে আপনাকে আর দারাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন–এটা তো সবারই জানা–কিন্তু যদি অনুভব করেন যে আপনাদের মাঝে কেউ একজন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জন কোনভাবে তাঁকে হেয় করেছেন তাহলে ক্রোধের মাত্রা ও সীমা ছাড়িয়ে যাবে। মনে রাখবেন অন্য বোনদের চেয়েও হীন হয়ে যাবেন আপনি।

জাহানারার হাত ধরল সাত্তি আল নিসা। মতোজের মৃত্যুর পর যখন অন্য ভাই-বোনদের মাতৃছায়া দিতে চেয়েছেন আপনি, আমি চেয়েছি আপনাকে মাতৃছায়া দিতে। আর এই ভূমিকা পালন করতে এসেছি আমি আজ রাতে। পরামর্শ দিয়ে সতর্ক করে দিতে। দুর্গে যাবার তাগাদা করে কোন লাভ হবে না। পিতার রাগ প্রশমিত হবার সময় দিন, একই সাথে নিজেও ভাবুন যে কী বলবেন।

ঠিকই বলেছে সাত্তি আল-নিসা, ভাবলো জাহানারা। সে যখন ছোট ছিল ঠিক তখনকার মত করে মাথায় আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল এই বয়স্কা নারী। কিন্তু হঠাৎ করেই আরেকটা চিন্তা মাথায় আসতে ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল শাহজাদী। যদি পিতা আমার সাথেই এত রেগে গিয়ে থাকে তাহলে নিকোলাস ব্যালান্টাইনকে নিয়ে কী ভাবছে? তাকে মেরে ফেলবে নিশ্চয়… নিকোলাসকে সতর্ক করে দেয়া দরকার।

হ্যাঁ। কিন্তু আর চিঠি নয়। আমাকেই আপনার বার্তাবাহক হতে দিন। আপনাকে সব বলা হয়ে গেছে যা পেরেছি এখন আমি দুর্গে ইংরেজ লোকটার গৃহে গিয়ে সব জানাব। অনেক দিন থেকেই আমাকে চেনে, তাই যা বলব শুনবে।

তাকে জানিয়ে দিও এখনি যেন আগ্রা ছেড়ে চলে যায় আর ছদ্মবেশে যতদূরে সম্ভব তত দূরে, পারলে সুরাট থেকে ইংরেজদের আবাসন থেকে জাহাজে করে নিজ মাতৃভূমে। এক মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে ভেসে উঠল এলোমেলো সোনালি চুলে ঢাকা নিকোলাসের সহৃদয় মুখখানা। উত্তরে যাবার আগে আশ্বস্ত করেছিল যে যোগাযোগ বজায় রাখবে জাহানারার সাথে। তাদের সবার জীবনেই বিশ্বস্ততার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল লোকটা; কিন্তু জহানারার কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কারণে আজ তার জীবন সংশয় দেখা দিয়েছে। আর তাকে জানিয়ো যে আমি দুঃখিত… ওনার কোন দোষ নেই। যাও, সাত্তি আল-নিসা, এখনি যাও! প্রার্থনা করব যেন ইতিমধ্যে দেরি না হয়ে যায়।

*

আর এক পাও এগোবে না।

ব্যক্তিগত দর্শনার্থীদের কক্ষে মুক্তো দিয়ে সেলাই করা সবুজ সিল্কের শামিয়ানার নিচে রুপার তৈরি সিংহাসনে বসে আসেন শাহজাহান। অ্যামব্রয়ডারী করা শক্ত আলখাল্লা, গলায় রুবি ও পান্না বসানো হার, আঙ্গুলে দ্যুতি ছড়ানো আঙটি দেখে জাহানারা বুঝতে পারল যে কতটা সাবধানে এই সাক্ষাৎকারের জন্য তৈরি হয়েছেন তিনি। পিতাকে খুব ভালো করেই চেনে জাহানারা। জানে যে রাজকীয় জাঁকজমকের পেছনেই তিনি লুকিয়ে রাখেন নিজের হতাশা অথবা আঘাতকে। পুরো কক্ষে আর কেউ নেই। সবগুলো দরজা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে বেশ শক্তভাবেই। তারপরেও জাহানারার মনে হল যে পিতার পাশাপাশি যেন পুরো দরবার তাকিয়ে আছে তার দিকে বিচারকের দৃষ্টিতে।

আব্বাজান, আপনি বুঝতে পারেননি…

চুপ! অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত একটাও কথা বলবে না তুমি। জাহানারা এত কাছে দাঁড়িয়ে ছিল যে স্পষ্ট দেখতে পেল শাহজাহানের অপলক চোখের পাশের টানটান চামড়া, কুঞ্চিত মুখমণ্ডল, বুকের উপর হাপরের মত ওঠানামা করছে রত্নের সারি সিংহাসনের হাতলে সিংহের মাথার উপর দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাত। পিতার মুখ থেকে ছিটকে বের হওয়া শব্দ আর অভিব্যক্তির তীব্রতায় দুঃখিত হয়ে মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে নিল জাহানারা।

তো লজ্জায় আমার সামনে মাথা নামিয়ে নিতে পারো তুমি। কিছুদিন আগে আমি শুনেছি যে নিকোলাস ব্যালান্টাইনকে নিজের প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তুমি। যেহেতু তোমাকে বিশ্বাস করি, ধরে নিয়ে ছিলাম যে এর কারণ অসাধু কিছু নয়। তোমার সম্পর্কে খারাপ চিন্তা করতে চাইনি আর তাই মন থেকে দূর করে দিয়েছিলাম এই চিন্তা। এখন বুঝতে পারছি যে ভুল করেছিলাম। অন্তত বছর দুয়েক ধরে তুমি ইংরেজ পরস্পরের মাঝে আর পত্র বিনিময় করছ আর এগুলো মোটেই সরল কিছু নয়!

আলখাল্লার ভেতর হাত ঢুকিয়ে জাহানারার সাম্প্রতিক চিঠিটা বের করে মেঝের উপর ছুঁড়ে ফেললেন শাহজাহান।

তুমি, একজন রাজকীয় মোগল শাহজাদী, সাম্রাজ্যের সম্মানীয়া শীর্ষস্থানীয় নারী; একজন পুরুষকে অনুভূতি আর বাসনার কথা লিখছ… পূর্বপুরুষদের দিন হলে তৎক্ষণাৎ তোমাকে হত্যা করা হত পরিবারের উপর কলঙ্ক লেপনের দায়ে। জাহানারা… কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল খানিকটা, আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, যা চেয়েছ সব দিয়েছি… এমনকি নিজের প্রাসাদও … আর এইভাবে প্রতিদান দিয়েছ তুমি।

জাহানারার ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে ওঠে যে, একমাত্র তুমিই অসদাচরণ করেছ সবসময়, আমি নই। কিন্তু জানে যে সে বলতে পারবে না কথাগুলো। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টায় ডান হাতের নখ ঢুকিয়ে দিল বাম হাতের তালুতে।

সারারাত নিজের ঘরে বসে বিস্ময় নিয়ে শুধু এটাই ভেবেছি যে কী হতে পারে এই অপরাধের শাস্তি আর আমার চোখে এটি একটি জঘন্য অপরাধ। শুধুমাত্র একটা জিনিসই আমাকে থামিয়েছে কোন নিষ্ঠুর পদক্ষেপ না নিতে

জানি যে শারীরিক ক্ষতচিহ্ন বহন করছ তা ছিল আমারই অপরাধ। আমার কারণেই নিজের খানিকটা সৌন্দর্য হারিয়েছ তুমি আর এই কারণেই ভুলে গেছ সত্যিকারে তুমি কী আর কামনা করছ পুরুষের স্পর্শ, তা যতটা অমূলক আর অসম্মানেরই হোক না কেন। এটাই বারেবারে নিজেকে বলতে চাইছি, কেননা শত চেষ্টা করেও–এখনও চেষ্টা করছি– তোমার এই অধঃপতনের কোন অজুহাত খুঁজে পাচ্ছি না। পরবর্তী কোন সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত দুর্গের মাঝে রাজকীয় হারেমে অবরুদ্ধ থাকবে তুমি। আর নিকোলাস ব্যালান্টাইন, আজ প্রভাতেই তাকে আটক করার জন্য আদেশ দিয়েছিলাম আমি, কিন্তু আমার প্রহরীরা যেতে যেতে পালিয়ে গেছে সে…. এটা কোন সরল মানুষের মত কর্ম নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো তুমি–তাকে খুঁজে আগ্রায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে আর বন্য ঘোড়া দিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলব আমি। সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে জাহানারার কাছে গেলেন শাহজাহান। মুখে এঁটে আছে অভিব্যক্তিহীন মুখোশ। আমি যা বলার ছিল তা বলেছি, এখন তুমি কথা বলতে পারো।

মুখ খুললো জাহানারা। কিন্তু নিকোলাস আর আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলার ইচ্ছেটাই উবে গেল মন থেকে। কী লাভ তাতে? আগুনে পোড়া ক্ষতও তাকে এতটা আঘাত করেনি, যতটা গভীরভাবে আজ আহত হয়েছে পিতার আচরণে। এতটা দূর থেকে আর স্বৈরশাসকের মত তার বিচার করা হয়েছে যেন সুজনে অচেনা মানুষ টেনে আনা হয়েছে সম্রাটের সামনে আর যেখানে তাঁর নিজেরই চরিত্র এত দুর্বল সেখানে এমনটা করার মানে কিছু নেই। লজ্জিত হবার মত কিছুই করেনি সে। এর বিপরীতটাই করেছে বরঞ্চ।

নিজের স্বার্থপর বাসনা চরিতার্থের বদলে চেষ্টা করেছে পরিবারকে এক সুতোয় গেঁথে রাখার। পিতার সামনে কখনোই নত হবে না সে। অথবা যতটুকু পেরেছে নিকোলাসের নিরাপদ পলায়নের ব্যবস্থা করেছে, তাই কোন অনুনয়ও করবে না সে। যদি জাহানারা সম্পর্কে এত নগণ্য বিশ্বাস থেকে থাকে তার তবে সে মতই হোক। যা কিছুই ঘটুক না কেন নিজের অহংকার আর সম্মান বজায় রাখবে সে আর কোন একদিন আবারো তার কাছে ক্ষমা চাইবে পিতা।

পিঠ সোজা করে দাঁড়াল জাহানারা। আমি আপনাকে বা আমাদের পরিবারকে আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিজেকে অসম্মানিত করার মত কিছু করিনি। আমার সর্বময় বিচারক আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি। এবার আপনার যা ইচ্ছা করতে পারেন।

জাহানারার চোখে জ্বলে উঠল আত্মপ্রত্যয়ের আলা। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি অবশ্যই জানতে চাইব, কে আমার চিঠি আপনার কাছে নিয়ে এসেছে?

এমন কেউ আমাদের পরিবারের সম্মানের প্রতি যে তোমার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধাশীল। তাদের পরিচয়ে তোমার কোন প্রয়োজন নেই। এখন যাও।

পিতা কন্যা দুজনেই একে অন্যের দিকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। দুজনেরই চোখে পানি–ক্রোধ, বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছু একটা হারানোর বেদনা একাকার হয়ে মিশে গেল।

.

২.৬

যমুনার তীরে মমতাজের সমাধির ঠিক বিপরীত পাশে নিজের চন্দ্র আলোর উদ্যান মাহতাব বাগের বারান্দায় অনেকগুলো পিলারের একটির গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন শাহজাহান। অল্প কয়েকটা জায়গার মাঝে এটি একটি, যেখানে মোম-সাদা চম্পা ফুল আর কমলা গাছগুলোর মাঝে শান্তি খুঁজে পান তিনি। এরকম রাতে প্রায় মনে হয় যেন ঠিক মমতাজ নিজে তার পাশে বসে আছে। ছেলেমেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে কী বলত মমতাজ? কিন্তু নির্বোধের মত হয়ে গেল প্রশ্নটা যদি মমতাজ বেঁচে থাকত তাহলে পিতার কাছ থেকে এত দূরে চলে যেত না তারা অথবা একে অন্যের কাছ থেকে আর হয়ত অন্য রকম হয়ে উঠত তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

গত বেশ কয়েকদিনের মত মন চলে গেল আবারো জাহানারার দিকে। রাজকীয় হারেমে জাহানারাকে সপ্তাহখানেকের মত অবরুদ্ধ করে রাখার পর প্রাথমিক উম্মাটুকু অনেকটা কমে গেছে শাহজাহানের মন থেকে। কিন্তু নিকোলাস ব্যালান্টাইনের সাথে তার আচরণকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবেন না তিনি। নিজের সব ছেলেমেয়েদের মাঝে একমাত্র জাহানারার সম্পর্কেই ভাবতেন যে কন্যাকে বুঝতে পারেন তিনি। বিশ্বাস করতেন আগুন লেগে যাবার পূর্বে তাদের মাঝে যে বন্ধন ছিল সেটির পুনর্জন্ম হয়েছিল আবার। এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ভ্রমের মাঝে বাস করেছেন তিনি। সত্যি দেখতে পাননি। তাই দেখেছেন যা দেখতে চেয়েছিলেন। বয়স এসে দেহে বাসা বাঁধলেই কি মানুষ এমন করে? রোশনারা বা গওহর আরা এমনটা করলেও এতটা কষ্ট পেতেন না তিনি, যতটা পেয়েছেন জাহানারার বেলাতে। যদিও কনিষ্ঠ কন্যাদেরও একইভাবে স্নেহ করেন তারপরেও একই নয় তারা। জাহানারার অভাব বোধ করছেন তিনি… তার প্রতিদিনের দেখতে আসা, সাহচর্য আর বুদ্ধিমত্তা।

যাক, অন্তত আর কিছুদিনের মাঝেই গোয়ালিওরের কাছে গ্রেট ট্রাঙ্ক রোডে নতুন দুর্গ নির্মাণের কাজ পরিদর্শন শেষে ফিরে আসছে দারা। কেমনভাবে বোনকে নিয়ে এই রটনা মেনে নেবে সে? অন্য তিন পুত্রের বেলাতে বলতে গেলে কাউকেই গত কয়েক মাসের মাঝে দেখেননি তিনি। আওরঙ্গজেব এখনো দাক্ষিণাত্যে। একগুয়েমী অহংকার আর পৃথিবী সম্পর্কে কঠোর মনোভাবের আত্মবিশ্বাস নিয়েও নিজেকে একজন পরিশ্রমী ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে প্রমাণ করেছে সে। যদিও তার পাঠানো প্রতিবেদনগুলো বেশ সংক্ষিপ্ত আর তথ্যবিহীন। সমৃদ্ধশালী দক্ষিণাঞ্চল থেকে মসৃণ গতিতে কর এসে পৌঁছাচ্ছে মোগল রাজকোষে আর এই মুহূর্তে সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্ত বেশ শান্তই আছে বলা চলে। ম্রাট এই ভেবে খুশি যে তৃতীয় পুত্র অবশেষে উত্তরের অভিযানের ব্যর্থতা পিছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। এখন পিতারও উচিত তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোন সম্মানের ব্যবস্থা করে দরবারে ডেকে পাঠানো তা গ্রহণ করার জন্য। আওরঙ্গজেব এখনো দাবি করে যে পিতা তাকে ভালোবাসে না…এটা তো সত্যি হয় আর একরোখা পুত্রের কাছে তাই এর প্রমাণও করে দেবেন তিনি…

এছাড়া শাহ সুজাকেও দরবারে ডেকে পাঠাবেন তিনি পুরস্কৃত করার জন্য। কেননা শান্তিময় ও সমৃদ্ধশালী বাংলার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে দক্ষতা দেখিয়েছে সে; যদিও তার পাঠানো পত্রগুলোও আওরঙ্গজেবের ন্যায় ভাসাভাসা আর সংখ্যায় অনিয়মিত। সত্যিকারের দাবিদার হয়ত শাহ সুজার কঠোর পরিশ্রমী কর্মচারী, তার পরেও পুত্রের সাথে আবার দেখা হলে মন্দ হয় না। মুরাদকেও শীঘ্র আগ্রায় ডেকে পাঠাতে হবে। ভাইদের মত প্রশাসক হিসেবে তেমন সুবিধে করতে পারছে না সে। মাত্র গত সপ্তাহেই, গুজরাটের বিশ্বস্ত ও সৎ রাজস্বমন্ত্রী আলী নকী ব্যক্তিগত এক পত্রে সম্রাটকে জানিয়েছে যে শ্রদ্ধা বজায় রাখলেও সত্যিকারভাবে শাহজাহান নিজে মুরাদকে নির্দেশ দিয়েছেন যে সুরাটের ইংরেজ বণিকদের উপর যেন অধিক হারে কর ধার্য করা হয়। কিন্তু বিদেশীরা শাহজাদাকে মূল্যবান সব উপহার এনে দিচ্ছে আর শাহজাদাও তার প্রদেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা না করেই যথেচ্ছ অপচয় করছে। গঠনমূলক এই সমালোচনা কীভাবে নেবে মুরাদ? প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে মুরাদ এখনো অপরিপক্ক রয়ে গেছে–যদি তার লিখিত পত্রে সুরাটের ব্যবসায়ীদের প্রতি আচরণের পক্ষে সাফাইগুলোকে বাদ দেয়া যায় উত্তরের অভিযানের ব্যর্থতার পরেও তর্জন-গর্জনে ঢেকে রাখতে চায় নিজের অদক্ষতা।

চোখ বন্ধ করে ফেললেন শাহজাহান, অবসন্ন বোধ করছেন; ইদানিং যা প্রায়শই করে থাকেন। কয়েক ঘণ্টার পশু শিকার বা পাখি শিকারেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সেসব দিন বহু আগেই গত হয়েছে যখন শত শত মাইল ঘোড়া ছুটিয়েও প্রাণশক্তি নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যেতেন পূর্বপুরুষের তলোয়ার আলমগীর নিয়ে। হয়ত মধ্যষাটের এই বয়সে এসে এটাই স্বাভাবিক। শীঘ্রই দারার হাতে তুলে দেবেন এই তলোয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্রের হাতেই মানাবে এটি, বিশেষ করে দারা নিজেই এখন পুত্রদের জনক। সুলাইমান একজন দক্ষ ঘোড়াসওয়ার আর বন্দুকবাজ; একই সাথে পিতার মত ভাবুক আর বিদ্বানও বটে। হোট সিপির মোগল মাতা নাদিরার মতই হাসিখুশি আর বুদ্ধিমান। রাজপরিবারের রক্ত সুদৃঢ়তার সাথে বয়ে চলেছে তাদের শিরাতে।

শাহ সুজা, মুরাদ আর আওরঙ্গজেব তিনজনেই পুত্রেদের জনক; যদিও তিনি তাদের তেমন দেখেননি। যদি তারা আগামীকাল দরবারে আসে হয়ত তাদেরকে চিনতেও পারবেন না। সত্যিই পরিতাপের বিষয়। তাদের সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে চান তিনি, যেন তারাও তাঁর কাছ থেকে কিছু শিখতে পারে, যেমনটা তিনি শিখেছিলেন নিজের পিতামহ আকবরের কাছ থেকে। এ ভাবনা থেকেই মনে পড়ে গেল যে অনেক দিক থেকেই আকবরের মত হয়েছে দারা। প্রসন্ন হয়ে উঠল মন এই ভেবে যে আর বেশিদিন দূরে থাকবে না দারা।

পেঁচার ডাক শুনে চোখ মেলে তাকালেন শাহজাহান। আকাশের গায়ে দেখতে পেলেন পাখিটার আবছা আকৃতি। কত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে নক্ষত্র-খচিত স্বর্গ, যা বড় ভালোবাসতেন প্রপিতামহ হুমায়ুন। বারান্দা থেকে নেমে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন সেই অপূর্ব সৌন্দর্য অবলোকন করতে। কিন্তু হঠাৎ করেই দুলে উঠল চারপাশের পৃথিবী। তারার দল এসে পড়ল পায়ের কাছে আর আকাশে মনে হল ফুটে আছে ফুল আর ঝরনা। ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরতে চেষ্টা করলেও খুঁজে পেলেন না। পরিবর্তে গড়িয়ে পড়ে যেতে লাগলেন সামনের দিকে… শুনতে পাচ্ছেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে হালকা সব কণ্ঠস্বর। ঘন কুয়াশা এসে ঘিরে ফেলল সবকিছু।

*

হাকিমেরা কী বলেছে? দয়া করে আমাকে সব বলো রোশনারা… বোনের চেহারা দেখে দুরুদুরু করে উঠল জাহানারার বুক।

তারা নিশ্চিত নয় যে সমস্যাটা কোথায়; কিন্তু এটুকু জানিয়েছে যে, শরীর আর মনের দিক থেকে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছেন পিতা। হাকিমেরা এর জন্য দায়ী করছে দায়িত্বের বিশাল বোঝাকে, বিচার কাজের জন্য দীর্ঘ সময় জনসাধারণের দর্শনকক্ষে বসে থাকা….ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যক্তিগত উপদেষ্টা আর সেনাপ্রধানদের সাথে কাটানো …। আর সাম্প্রতিক সময়ে আরো অন্যান্য উদ্বিগ্নতা…

ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেও কিছু বললো না জাহানারা। দুর্গের হারেমে অবরুদ্ধ হবার পর এই প্রথম তার সাথে দেখা করতে এসেছে রোশনারা। প্রথমে তো অবাক হত এই ভেবে যে শাহজাহান হয়ত বোনদেরকেও মানা করে দিয়েছেন যেন জাহানারার সাথে দেখা না করে। কিন্তু সাত্তি আল-নিসা জানিয়েছে যে এরকম কিছু ঘটেনি। তাই সন্দেহ নেই যে কনিষ্ঠ ভগিনীদ্বয় নিজেরাই তার সাথে দেখা করতে আগ্রহী নয়। অবশেষে এবার রোশনারা আসাতে এমন কিছু করতে চায় না জাহানারা যাতে চলে যায় রোশনারা, বিশেষ করে যখন পিতার কী হয়েছে পুরোপুরি জানা দরকার। কতটা খারাপ অবস্থা? সুস্থ হতে কত সময় লাগবে বলে মনে করে হাকিমেরা? সুস্থ হবেন তো, তাই না?

চিকিৎসকেরাও এটাই বিশ্বাস করে যদিও বলছে যে সময় লাগবে। তাদের একজন পুরোন আলী করিম পরামর্শ দিয়েছে যে পিতা একটু শক্ত হলেই উত্তরে লাহোরে নিয়ে যেতে, প্রশান্ত বাতাসে ভালো বোধ করবেন। যদি যাওয়া হয় তাহলে আমি সঙ্গে যাবো–দারাও। পিতার অসুস্থতা জানানো হয়েছে তাকে, যত দ্রুত সম্ভব আগ্রায় ফিরে আসছে। পোশাকের হাতায় কাজ করা ভারী অ্যামব্রয়ডারিতে হাত বুলালো রোশনারা।

আর অন্য ভাইয়েরা? তাদেরকে পত্র দিয়েছ তুমি?

না, এখনো না। তাদেরকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই না আমি। আমার ধারণা পিতার অবস্থা আরো খানিকটা পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। তাহলে পাঠানোর মত ভালো সংবাদও পাওয়া যাবে।

হাতায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগল রোশনারা যে কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। সাথে সাথে চিঠি লিখেছে আওরঙ্গজেবের কাছে। এছাড়াও দরবারে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কেও তাকে জানিয়েছে রোশনারা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে আওরঙ্গজেব হারেমে স্ত্রীদের কাছে স্বামীদের শত্রুতা, গোপন উচ্চাকাঙ্খ, দুর্বলতা আর মিত্রতা সম্পর্কে যা যা জেনেছে সব জানিয়েছে আওরঙ্গজেবকে। কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে রোশনারা জীবনে আর কখনো এর স্বাদ পায়নি আগে। দারা আর পিতার মতই, অন্তত আওরঙ্গজেবও বুঝতে পারছে যে তাকে কতটা মূল্য দেয়া উচিত।

খানিকক্ষণের জন্য চুপ করে রইল দুই বোন। দুজনেই বুঁদ হয়ে রইল নিজস্ব চিন্তায়। নীরবতা ভাঙ্গলো জাহানারা, তোমাকে দেখে ভালো লাগছে রোশনারা। কেমন ছিলে তুমি? … আর গওহর আরা? সাত্তি আল নিসা জানিয়েছে যে গত সপ্তাহে দুজনে একসাথে মাহফিল করেছিলে?

আমরা দুজনেই ভালো আছি। নাদিরা গওহর আরাকে বেজী উপহার দিয়েছে। বাঁশির সুর শুনতে পেলেই পিছনের পায়ে দাঁড়িয়ে সুর শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘুরতে থাকে। দরজার দিকে তাকাচ্ছে রোশনারা। পরিষ্কার বোঝা গেল যে চলে যেতে চাইছে।

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না জাহানারা। কেন আমরা এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা বলছি? তুমি আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ না যে কী হয়েছিল নিকোলাস ব্যালান্টাইন আর আমাদের মাঝে। তুমি সত্যি জানতে চাও না? যদিও পিতা আমার কথা শুনতে চাননি কিন্তু এটা ভেবে কষ্ট লাগছে তুমি, গওহর আরা আর ভাইয়েরাও আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাববে। মায়ের স্মৃতির নামে শপথ করে বলছি যে এরকমটা ভাবার কোন কারণ নেই। আমি নিরপরাধ। আমার সরলতাটুকু বুঝিয়ে বলল তাদেরকে। আমার পক্ষ নাও।

কেন তোমার মিথ্যে বহন করব আমি?

রোশনারা! বোনের দিকে তাকিয়ে রইল জাহানারা। চমকে গেছে তার গলার স্বর আর চোখের কঠিন দৃষ্টি দেখে। আমি কখনো আব্বাজান বা তোমার কাছে মিথ্যে বলিনি। যেমনটা তাকে জানিয়েছি, লজ্জিত হবার মত কিছু করিনি আমি। নিকোলাস ব্যালান্টাইনের সাথে আমার সম্পর্কে কোন অপরাধ নেই।

কীভাবে একথা বল তুমি? তার কাছে লেখা তোমার নির্লজ্জ শব্দগুলো দেখেছি আর আমি …চুপ হয়ে গেল রোশনারা কিন্তু বহু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।

কাছে এসে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জাহানারা। স্পষ্ট দেখতে পেল একটু ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেছে হতাশা।

হঠাৎ করেই বুঝতে পারল…

তুমিই কি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ? নাসরিন আমার লেখা চিঠি নিকোলাসের পরিবর্তে তোমার কাছে নিয়ে এসেছে?

কিছুই বলল না রোশনারা। জাহানারা, ইচ্ছে হল সজোরে একটা চড় কষিয়ে দেয় বোনের মসৃণ, গোলাকার মুখখানায়। বোনের সাথে সাথে নিজের উপরেও রাগ হল তার। মনে হল কৌতূহলী নাসরিন নিশ্চয়ই চিঠিটা খুলে পড়ার লোভ সমলাতে পারেনি আর পড়ার পরেই পুরস্কারের সুযোগও পেয়ে গেছে। কিন্তু নাসরিনই প্রথম না যে রাজকীয় গৃহস্থালিতে থাকার সুযোগ নিয়ে প্ররোচনামূলক কাজে আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু এটা কখনোই তার মাথায় আসেনি যে অন্য কারো হয়ে কাজ করছে নাসরিন… আর কেউ না, তার নিজের বোন! এই পরিকল্পনা তোমার, তাই না? এই কারণেই নাসরিনকে গৃহকর্মে নিতে তাগাদা দিয়েছিলে আমাকে… তোমার চর হিসেবে কাজ করার জন্য। কেমন করে করলে এরকম একটি কাজ? আর যদি সে আমার চিঠি তোমার কাছে এনে দিয়েও থাকে তাহলে পিতার কাছে নেয়ার আগে আমার কাছে এলে না কেন? আমাকে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগই দাওনি।

না, এটা আমার পরিকল্পনা নয়। দুর্গে এলে নাসরিন আমার সাথে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক আর তোমার চিঠি দেখার পরে ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজনই ছিল না। তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছি পিতার কাছে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল আমার দায়িত্ব।

রোশনারা ঘুরে দাঁড়াল; কিন্তু দ্রুতপায়ে গিয়ে দরজা আর তার মাঝখানে দাঁড়াল জাহানারা। তার সব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত বোনকে যেতে দেবে না সে।

আমি বোকা নই। অন্তত দুবছর যাবৎ আমার প্রাসাদে আছে নাসরিন। আর এই পুরো সময়ে নিশ্চয়ই তুমি আশা করেছ যে সে কিছু একটা দেবে যা আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে তুমি। যেটা আমি বুঝতে পারছি না তা হল কেন? তুমি আমার বোন। আমি সবসময় তোমার জন্য সাধ্যমত করতে চেয়েছি।

তাই? বছরের পর বছর ধরে তুমি আমাকে এমনভাবে অবহেলা করেছ বা দেখিয়েছ যে তোমার পাশে আমি কিছুই না। তুমি সাম্রাজ্যের মহান সম্মানীয়া সর্বশ্রেষ্ঠ নারী। সবসময় পিতার পাশে ছিলে তুমি, যেন নতুন সম্রাজ্ঞী আর আমরা সকলে তোমার অনুচর। মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর পরে, রাতের বেলা পিতা যখন সমাধিস্থান ছেড়ে নদীর ওপাড়ে চন্দ্ৰআলোর উদ্যানে চলে গিয়েছিল, বলেছিলে যে একমাত্র তোমারই যাওয়া উচিত। যেন আমি কেউ না, একমাত্র তোমারই সেখানে যাবার অধিকার আছে, তুমিই তাকে শান্ত করতে পারবে।

এর অর্থ এরকম কিছু ছিল না… আমি সত্যিই দুঃখিত যদি ব্যাপারটা এমন দেখায়। হঠাৎ করেই রোশনারার চোখে পানি দেখে তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল জাহানারা, কিন্তু ঝাঁকুনি দিয়ে দূরে সরে গেল রোশনারা। ডান হাত দিয়ে চোখ মুছে, লেপ্টে ফেলল চোখের কাজল।

একদম না!

হাত ছেড়ে দিল জাহানারা। আম্মাজান মারা যাবার পর থেকে আমি চেষ্টা করেছি তোমাদের দিকে লক্ষ্য রাখার … তোমাদের ভালোর জন্য কাজ করার…

যদি তুমি এরকমই ভাবো, তাহলে বলব আমাদের মত করে সমস্যাগুলোকে কষ্ট করোনি কখনো। তুমি নিজের জ্ঞান নিয়ে এত নিশ্চিত ছিলে কখনো জানতেই চাওনি যে আমরা কী ভাবি বা কী চাই। এখন তুমি প্রাপ্য অবস্থার মাঝে পড়েছ, মহান নারী হওয়া সত্ত্বেও একজন বিদেশীর সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছ… এখন বুঝতে পারবে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলে কেমন লাগে।

কখনো কোন সম্পর্ক ছিল না। কখনোই না। আমি নিকোলাস ব্যালান্টাইনকে দেখা করতে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, কেননা আওরঙ্গজেবকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। জানতাম যে উত্তরের অভিযান নিয়ে পিতার সাথে খারাপভাবে কলহ হয়েছে তার। নিকোলাসও সেই অভিযানে ছিল। আশা করেছিলাম জানাতে পারবে যে কী ঘটেছিল আর সাহায্য করবে আওরঙ্গজেব ও পিতার মাঝে সবকিছু ঠিক করে দিতে।

তোমাকে বিশ্বাস করি না আমি। নিজেকে বাঁচানোর জন্য কাহিনী তৈরি করেছ।

তুমি বুঝতে পারছ না…নিকোলাস ব্যালান্টাইনকে বিশ্বাস করেছি কারণ সে আগেও সাহায্য করেছিল। যখন পিতা মুরাদকে উত্তরের অভিযানে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছিলেন, আমি নিকোলাসকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম যেন মুরাদকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে আর আমাকে অভিযান সম্পর্কে সব সময় জানায়। আমাকে নিরাশ করেনি সে আর এই কারণেই আওরঙ্গজেবের ব্যাপারেও তাকে বিশ্বাস করেছি আমি।

যদি এটাই সত্যি হয়, তাহলে আগ্রা থেকে পালিয়ে গেল কেন অবিশ্বাসীটা?

কারণ, যদি সে থেকে যেত তাহলে পিতা তাকে হত্যা করত। কেননা, পিতা কখনোই আমার কথা বিশ্বাস করত না, যেমন এখন তুমি করছ না। গলা ক্রমশই চড়ে গেল জাহানারার, বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রাখল সে। নিকোলাসকে অবিশ্বাসী বললে তুমি অপরাধী হিসেবে ডাকলে। এসবই সহজ, বোঝার চেষ্টা না করে কিছু একটা ডেকে বসা। মনে নেই তোমার বাল্যকালে আমাদের প্রতি কতটা সদয় ছিলেন তিনি… তাঁর সাহস আর বিশ্বস্ততা যখন আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম? আমাদের পরিবার তাঁকে এত ঘৃণ্যভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছে যে লজ্জিত হয়েছি আমি, আর তোমারও তাই হওয়া উচিত।

জাহানারার গাল বেয়ে গড়িয়ে নামল অশ্রু বিন্দু। যা ঘটে গেছে তার ভার বহন করা মাঝে মাঝে দুঃসহ হয়ে পড়ে। অন্তত নিকোলাস নিরাপদে আছে। সাত্তি আল-নিসা গুজরাট থেকে একটা চিঠি এনে দিয়েছে যেখানে নিকোলাস জানিয়েছে যে সুরাট থেকে ইংল্যান্ডের জাহাজ ধরার চিন্তা করছে নিকোলাস।

শুধুমাত্র এই কারণে নিকোলাস ব্যালান্টাইন পালিয়ে যায়নি। বোনের রাগ অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল রোশনারা। আমি দেখেছি তুমি কীভাবে তাকিয়ে ছিলে, তার সম্পর্কে বলতে গেলে কতটা নরম হয়ে যায় তোমার স্বর, যেমন এখন হয়েছে। প্রথমে বলেছ তোমাকে বোকা না ভাবতে, তো, আমি ও তোমাকে একই কথাই বলতে পারি!

ভুল ভাবছো তুমি, যদি ভাবো যে আমার কোন অনুভূতি আছে– তার প্রতি অন্য কোন অনুভূতি…

কিন্তু রাঙা হয়ে গেল জাহানারা।

তাই? যাই হোক, আমার রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াও দয়া করে, সময় হয়েছে পিতার শয্যাপাশে ফিরে যেতে হবে আমাকে।

*

নিজের মহলের বাইরের দরজায় হঠাৎ করাঘাতের শব্দ শুনে চমকে গেল জাহানারা। হাত থেকে রেখে দিল তার অন্যতম পছন্দের লেখক, বিংশ শতাব্দীর রহস্যপুরুষ আবদুল কাদির আল জিলানীর বই। এত রাতে দর্শনার্থী প্রায় মধ্যরাতের কাছাকাছি এখন। আব্বাজানের কিছু হয়নি তো? প্রথমবার অসুস্থ হবার পর থেকে প্রায় দুইমাস হয়ে গেছে, সুস্থ হওয়ার হারও অতি ধীর। মাত্র নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে, উদ্বিগ্ন বক্ষে দরজার কাছে এগিয়ে গেল কয়েক কদম, এমন সময় দরজা হাট করে খুলে ঢুকে পড়ল লম্বা ঋজু দেহ, মাথার কাপড় সরিয়ে দিতেই জাহানারার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল।

দারা! দৌড়ে ভাইয়ের কাছে গেল। আমি অনেক খুশি হয়েছি যে তুমি ফিরে এসেছ। এই মুহূর্তের জন্য আমি কত যে অপেক্ষা করেছি।

আমি সোজা তোমার কাছে এসেছি। জাহানারাকে ছেড়ে দিয়ে জানালো দারা। পিতা এখনো জানে না যে আমি এসেছি। কেমন আছেন তিনি? গত কয়েক দিনে তার স্বাস্থ্যের কোন খবর পাইনি আমি।

খবর ভালো। সাত্তি আল-নিসা জানিয়েছে উন্নতি ঘটছে। এ কয়দিনে এতটাই সুস্থ হয়েছেন যে দিনে তিন-চার ঘণ্টার জন্য হলেও উঠে বসতে পারেন–আর খাওয়া-দাওয়ারও উন্নতি হয়েছে। প্রথমে তো শুধু তেতো আর ঔষধি মধুর সুরুয়া খেতেন। যদিও এখনো বেশ দুর্বল। হাকিমেরা বার বার মানা করে দিয়েছে যেন রাষ্ট্রের কোন ব্যাপার নিয়ে বিরক্ত না করা হয়।

তাহলে তো তিনি জানেন না…

কী জানেন না?

আলো ফোঁটার সাথে সাথে তাঁর কাছে যাবো আমি। আমার কাছে যে সংবাদ আছে তা শীঘ্রি জানাতে হবে, যত দুর্বলই হোন না কেন।

কী হয়েছে দারা? কী সংবাদ?

দ্বিধায় পড়ে গেল দারা।

মোমবাতির কম্পমান শিখার আলোতে দারার চেহারায় উদ্বিগ্নতা দেখতে পেল জাহানারা। জানি তুমি নিজেও সমস্যায় আছে, কিন্তু আর

ভাবে বলার উপায় নেই। আওরঙ্গজেব, শাহ সুজা আর মুরাদ বিদ্রোহ শুরু করেছে। দাবি করছে যে পিতা শাসন করার পক্ষে বেশি অসুস্থ। নিজ নিজ সেনাবাহিনী নিয়ে আগ্রার দিকে এগিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।

কিন্তু এটা সত্যি হতে পারে না…

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে দারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল জাহানারা। তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ। প্রথম শোনার পর আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। গোয়ালিওরের কাছে এসে বহুরাস্তা মিশে গেছে এক হয়ে। প্রথম যে সংবাদ আমি পেয়েছি তা হল আগ্রাতে ফিরে আসছে আওরঙ্গজেব। ভেবেছিলাম অসুস্থ পিতার পাশে থাকাটাই তার অভিপ্রায়–যেমনটা করেছিল তোমার দুর্ঘটনার পরে আর আগ্রা থেকে দূরে থাকার জন্য হয়ত পিতার সাম্প্রতিক সুস্থতার সংবাদ ও পায়নি। তাই এটা নিয়ে আমি তেমন চিন্তা করিনি। পরের দিন, একজন কসিড, গোয়ালিওরের প্রশাসকের কাছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিয়ে এসেছে বড় পুত্রের কাছ থেকে, যে কিনা এলাহাবাদে আমাদের প্রশাসক। আমার এক কর্চিকে কসিড লোকটা জানিয়েছে যে গুজব ছড়িয়েছে শাহ সুজা সেনাবাহিনী নিয়ে আগ্রার দিকে রওনা দিয়েছে। সচকিত হয়ে আমি তৎক্ষণাৎ বিষয়টির তদন্ত করার জন্য এলাহাবাদে বার্তাবাহক পাঠিয়ে দিয়েছি একের পর এক। ছত্রিশ ঘণ্টা পরে পরিষ্কার হয়ে গেল সত্যিকারের অবস্থা। আমার উজিরপুত্র তাঁবুতে এসে দেখা করতে চাইল। দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করেছিল সে। পুরো একদিন আর রাত ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে আমাকে সতর্ক করে দেবার জন্য, জানে যে গোয়ালিওরে আছি আমি। উজির পুত্র আমাকে জানিয়েছে, আওরঙ্গজেব নাকি নিজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে দাবি করেছে যে পিতা মৃত্যুশয্যায় অথবা সম্ভবত এরই মাঝে মারা গিয়েছেন আর সিংহাসনের উপর নিজের অধিকার কায়েমের জন্য এ সংবাদ এখনো গোপন রেখেছি আমি। আর তাই আমার হাত থেকে সাম্রাজ্য রক্ষায় আগ্রা অভিমুখে ছুটে আসছে সে সেনাবাহিনী নিয়ে। আরো দাবি করেছে শাহ সুজা শুধু নয় মুরাদের সাথে মিলেও কাজ করছে এখন।

জাহানারা এতটাই চমকে গেছে যে কথা বলা দূরে থাক চিন্তা করার শক্তিও যেন হারিয়ে স্থবির হয়ে গেছে। দারার সাথে এভাবে আবার সাক্ষাৎ হবে কখনো ভাবেনি। অনেকবারই ভেবে দেখছে নিজের সরলতার কথা কীভাবে জানাবে দারাকে, জানে যে তাকে বিশ্বাস করবে দারা, ফিরে গিয়ে পিতাকে সব বুঝিয়ে বলবে শাহজাদা আর তার কাছে এসে আবারো ক্ষমা চাইবেন। এখন পিতা অসুস্থ, নিজের আপন তিন ভাইই তার বিরুদ্ধে চলে গেছে আর সাম্রাজ্যে সম্ভবত গৃহযুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে।

হঠাৎ করেই নিজের সব সমস্যা ভুলে গেল জাহানারা। আমি কিছুই শুনিনি। অবশেষে ফিসফিসিয়ে জানালো জাহানারা। যদিও আমি এ কক্ষে বন্দি, সাত্তি আল-নিসা প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসে। আমাকে নিশ্চয় জানাত যদি এরকম কোন গুজব দরবারে ছড়াত।

আমি আদেশ দিয়েছি যে আগ্রাতে ফেরার সাথে সাথে সব কসিডদেরকে যেন আমার কাছে পাঠানো হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না পিতার পাশে যেতে পারছি, আমি চাইনি যে তিনি চিন্তায় পড়ে যান। ফিরে আসার সময়ের সপ্তাহগুলোতে আরো বেশ কিছু খবর পেয়েছি আমি। বিশেষ করে যাদেরকে পূর্ব দিকে পাঠিয়েছিলাম, তারা নিশ্চিত করেছে যে সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা দিয়েছে শাহ সুজা। খুব বেশি দিন বাকি নেই যখন সকলে জেনে যাবে এ সংবাদ।

যত দিন সম্ভব ঠেকিয়ে রাখার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদেরকে। অন্তত যেন ভাইদের কাছে বার্তা পাঠানো যায় যে পিতা সুস্থ হয়ে উঠছেন… আর তাই তাদের আচরণও চক্রান্তমূলক।

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসল দারা। সম্ভবত তারা এ দুটো বিষয়েই অবগত আছে–বিশেষ করে দ্বিতীয় সংবাদটি। অনেক দিন আগে থেকেই জানে যে পিতা আমাকেই উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে চান। পিতার অসুস্থতার অজুহাত নিয়ে এমন কিছু করতে চায় তারা যেন কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না করতে পারেন সম্রাট। ফলে তাদের দাবিও বৈধতা পাবে।

কিন্তু তারা কী করতে চাইছে? তোমার আর পিতার সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করবে সিংহাসনের জন্য?

আমি জানি না। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে এরকম কিছু ঘটবে এ সম্ভাবনা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা হয়েছে বহু আগেই। নিশ্চয় তারা একমত হয়েছিল যে পিতার কিছু হলেই একজোট হয়ে কাজ শুরু করবে তারা। হতে পারে নিজেদের মাঝে সাম্রাজ্যের বাটোয়া নিয়েও একমত হয়েছে। যাই হোক না কেন আমি নিশ্চিত আওরঙ্গজেবই তাদের নেতা।

আমাকে ঘৃণা করে সে।

সহজ গলায় বলল দারা। অনেকবারই তার চোখে এটা দেখেছি আমি। মুখে যতই সান্ত্বনার কথা বলুক না কেন। আমার পেছনে, অন্য ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস আর আগ্রহকে ধর্মোদ্রোহিতা হিসেবে প্রচার করে আর যারা শোনে তাদের বেশির ভাগই নিজের স্বার্থে তাকে সমর্থন করে, আমার তাই ধারণা। আমি ভেবেছিলাম যে এত দূরে দাক্ষিণাত্যে বসে কোন ক্ষতি করতে পারবে না সে, কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। পিতার আস্থা আর দরবারে নিজের অবস্থান নিয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম; কিন্তু উচিত ছিল অন্যত্র কী হচ্ছে তাতে মনোযোগ দেয়া। নিজের পুত্রদেরও মাথা হেট করে দিয়েছি আমি। যদি এখন ব্যর্থ হই আমি, তাহলে এতে কোন সন্দেহ নেই যে সুলাইমান আর সিপিরকেও তার জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে।

এ সবকিছুই এখনো রুখে দেয়া সম্ভব। অসুস্থ হবার আগপর্যন্ত সাম্রাজ্যের প্রধান ছিলেন পিতা আর শীঘ্রিই আবারো সেইরূপ হয়ে যাবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পিতা শাসন করার পক্ষে অসুস্থ, মৃতপ্রায় বা মৃত–এ রটনাগুলোকে থামিয়ে দেয়া… যত তাড়াতাড়ি সম্ভব–যদি শক্তি ফিরে পান তাহলে সম্ভব হলে আগামীকাল সকালেই ঝরোকা বারান্দায় গিয়ে জনগণের সামনে প্রাত্যহিক দর্শন দিতে হবে; যেন তারা বুঝতে পারে তাদের সম্রাট এখনো জীবিত আছেন। আর একই সাথে জানিয়ে দিতে হবে যে কী ঘটেছিল। আল্লাহ না করুণ যে তিনি এত অসুস্থ দায়িত্ব নিতে পারবেন না। ভাইয়েরা নিশ্চয়ই এতবড় সাহস করবে না যখন জানতে পারবে যে সম্রাট এখনো সক্ষম আছেন।

সবসয়কার মতই বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলছ তুমি… সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব না আমি। এখনি যাবো তার কাছে… তাড়াহুড়া করে দরজার কাছে এগিয়ে গেল দারা, কিন্তু কী মনে হতেই ফিরে তাকাল জাহানারার দিকে। তুমি আমার সাথে আসতে চাও?

পারব না। এখনো আমার সাথে দেখা করতে চান না পিতা। অসুস্থ হবার পরেও যখন আমি অনুমতি চেয়েছিলাম দেখা করতে, প্রত্যাখিত হয়েছি। আমার ভয় যে দেখা মাত্র বিরক্ত হয়ে উঠবেন, ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যাবে না।

আমি জানাবো যে তোমাকে সন্দেহ করাটা কত বড় ভুল হয়েছে। সাত্তি আল-নিসা আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে যে সত্যিই কী ঘটেছিল। পিতাকে মানিয়ে নেব আমি। সবকিছু এখনো ঠিক হতে পারে প্রতিজ্ঞা করছি আমি।

কিন্তু সত্যিই কি সব ঠিক হয়ে যাবে–দারার প্রস্থানের শব্দ শুনতে শুনতে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল জাহানারা। নিশ্চিত নয়। তাকে অপরাধী করে পিতার অভিযোগ আর অনাস্থা জানতে পেরেছে যে এ কাজে হাত রয়েছে তারই আপন বোনের… পরিবারের উপর তার বিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছে। ভাবত যে তারা সকলেই এক, কেউ কারো ব্যক্তিগত স্বার্থান্বেষী নয়। আর এখন ভাইদের এ ধরনের সংবাদ তার ভয়কে এত বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে যে, সবচেয়ে বাজে দুঃস্বপ্নেও যা কখনো ভাবেনি।

কে জানত যে এমন কখনো কিছু ঘটতে পারে? তাক্ত ইয়া তক্তা সিংহাসন অথবা কফিন নিজেদের সাথে করেই এশিয়ার অনুর্বর ভূমি থেকে এই শব্দগুলো নিয়ে এসেছে তার মোগল পূর্বপুরুষেরা। উৎকৃষ্ট পোশাক আর রত্ন পরিধান করে, শাহজাদাদের আনুষ্ঠানিক কায়দা কানুন মেনে চলার পরেও কী ছিল তার ভাইয়েরা?

মহান আর আলোচিত একটি সাম্রাজ্যের সভ্য বংশধর নয়, বরঞ্চ বন্য জন্তু, একে অন্যের লাশের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করছে। যেটি কিনা এখনো মরে যায়নি… পিতার হাতের ভারী স্বর্ণের আংটির দিকে তাকিয়ে গড়গড় করছে যা কিনা একসময় লালিমা ছড়িয়েছিল তৈমুরের হাতে।

*

ছোট সিংহাসনটি থেকে উঠে দাঁড়ালেন শাহজাহান। ছোট ঘোট পা ফেলে আস্তে আস্তে হেঁটে গেলেন নিজের শয্যাকক্ষের দিকে। এতক্ষণ এই চেয়ারে আসনটিতে বসেই দারার কাহিনী শুনেছেন তিনি। হাত দুটো আড়াআড়ি ভাঁজ করে নিজেকে জড়িয়ে ধরে মাথা নত করে এগোতে লাগলেন সম্রাট। দারার কথাগুলো শোনার পর প্রথমে তো এতটাই মর্মাহত হয়ে গিয়েছিলেন যে বসে রইলেন স্থাণুবৎ। এখনো মনে হচ্ছে হাকিমদের দেয়া ওষুদের ফলে মস্তিস্কের এলোমেলো চিন্তা কিনা। প্রায়শই বিশেষ করে অসুস্থ হবার পর প্রথম দিনগুলিতে, বেশিরভাগ সময় নিদ্রা আর জাগরণের মাঝামাঝি থাকতেন তিনি। নিশ্চিত হতে পারতেন না যে কোনটা সত্যি আর কোনটা ক্লান্ত, বিপর্যস্ত মস্তিষ্কের ভাবনা। অদ্ভুত সব ছবি ভেসে বেড়াত মাথার মাঝে, বেশির ভাগ সময়েই মৃতপিতামহ আবার, পিতা জাহাঙ্গীর আর সবচেয়ে বেশি হাস্যরত মমতাজ ফিসফিস করে বলত মুবারক মঞ্জিল, ফিরে আসা সম্রাটের উদ্দেশে একজন সম্রাজ্ঞীর সনাতন অভিবাদন।

এখন, বুঝতে পেরেছেন যে বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন তিনি, সামনে সব কঠিন বাস্তবতা বিদ্রোহ, আর বিদ্রোহের নেতা কোন বিশ্বাসঘাতক প্রজা নয়, তারই পরিবারের সদস্য। কোন পাগলামিতে মেতেছে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রেরা? তাদের কেউই তেমন হয়নি যেমনটা তিনি চেয়েছিলেন, কিন্তু কখনো সন্দেহ করেননি যে এত নগ্নভাবে ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়বে তারা। মনে হচ্ছে যেন ফিরে এসেছে অতীতের দিনগুলি যখন একে-অন্যে ছিল মোগলদের সবচেয়ে বড় শত্রু। তিনি নিজেও বিদ্রোহ করেছিলেন আপন পিতার বিরুদ্ধে আর সভাইদের সাথে লড়াই করেছিলেন সিংহাসনের জন্য। কিন্তু সেটা ছিল ভিন্ন হিসাব… মেহরুন্নিসার কথা মত তাকে এতে বাধ্য করেছিলেন জাহাঙ্গীর। নিজের পরিবারের সুরক্ষায় লড়েছিলেন তিনি। তাঁর নিজের পুত্রদের তো এমন কোন অজুহাত নেই আর সেই পুরোন পারিবারিক উচ্চাকাঙ্খ, রক্তপাত আর প্রতিশোধের বদলা নেবার চাকা পুনরায় ঘোরার অনুমতি দিবেন না তিনি। তাকে অবশ্যই তিনি করবেন–এই বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটাতে হবে, যেন পরিবারের নিশ্চিহ্ন হওয়া আর মোগলদের এতদিনের অর্জন নষ্ট হওয়া রোধ করা যায়।

পায়চারি থামিয়ে দারার দিকে তাকালেন সম্রাট। তাদের প্রদেশ সমূহে দূত পাঠিয়ে দাও। খুঁজে বের কর, কত বড় সেনাবাহিনী। কতদূর এগিয়েছে আর কেই বা তাদের ঘোষণা দিয়েছে। যতদূর সম্ভব তথ্য চাই আমি। সকালবেলা, উপদেষ্টাদের সভা ডেকে পাঠাবো আমি। তাদের সবাইকে শোনাতে হবে আমাকে যা বললে। একটা ব্যাপার পরিষ্কার আমাদেরকে দ্রুত আর নির্ভুলভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যেন বিদ্রোহীরা পরবর্তী সুযোগ না পায়।

জাহানারা পরামর্শ দিয়েছে জনগণের সামনে দর্শন দেবার জন্য যত শীঘ্র সম্ভব ঝরোকা বারান্দায় যেতে হবে আপনাকে। যেন এই রটনা শান্ত হয় যে আপনি মৃত।

জাহানারা? তার সাথে দেখা হয়েছে তোমার?

হ্যাঁ। দুর্গে পৌঁছবার সাথে সাথে তার কাছে গিয়েছিলাম আমি।

বক্র চোখে দারার দিকে তাকালেও কিছু বললেন না শাহজাহান। বলে চললো দারা, ওর প্রতি অন্যায় করেছেন আপনি। নিকোলাস ব্যালান্টাইন আর জাহানারার কাহিনী ততটাই কদর্য আর ভিত্তিহীন যতটা আপনার মারা যাওয়ার কাহিনী। নিকোলাসকে শুধু মাত্র ডেকে পাঠিয়েছে কারণ আওরঙ্গজেবকে নিয়ে চিন্তিত ছিল সে। চেয়েছিল নিকোলাস যেন জানায় যে উত্তরের অভিযানে সত্যিকারের কী ঘটেছিল। মায়ের স্মৃতির নামে শপথ করে বলেছে যে নিকোলাসের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না…আব্বাজান, আমার কর্কশ শব্দের জন্য ক্ষমা করেন; কিন্তু যা শুনেছি তাতে অবিচার করেছেন জাহানারার প্রতি। অন্তত এখন তার সাথে দেখা করেন… আমার বোনকে প্রমাণ করার সুযোগ দিন যে আপনি কত বড় ভুল করেছেন। অপেক্ষা করল দারা। জাহানারার মত সদস্যদের একান্ত প্রয়োজন এখন পিতার, যে কিনা তার প্রতি এখনো বিশ্বস্ত। আবারো চেষ্টা করল দারা। আব্বাজান… আমাকে বিশ্বাস করেন। আমি…

এবার উত্তর দিলেন শাহজাহান। যথেষ্ট, দারা। যা বলেছ শুনেছি।

 জাহানারার সাথে দেখা করবে?

সম্ভবত।

 তিন ঘণ্টা পরে, পূর্ব দিগন্তে ফুটে উঠেছে হালকা আলো, কর্চির হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে চুমুক দিলেন শাহজাহান। কুয়ো থেকে তুলে আনায় এখনো বেশ ঠাণ্ডা, তৃষ্ণার্তের মত পানিটুকু পান করলেন ম্রাট। যদিও পাত্র ধরে রাখা হাত দুটো এখনো পুরোপুরি শক্ত আর স্থির হয়নি। এটা কি অসুস্থতার ফল হঠাৎ করে এই যে দুর্বলতা চেপে বসল তাঁর উপর আর এর কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি হাকিমেরা? অথবা দারার মুখে বিদ্রোহের কথা শুনে ক্রোধ জেগেছে মনে? অথবা শীঘ্রই তার সামনে এসে দাঁড়াবে জাহানারা আর আরো একবার তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে শাহজাহানকে?

গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকা অবস্থাতেই শুনতে পেলেন বাদ্যের গুরগুর আওয়াজ তাঁর নির্দেশেই এই ইশারা দেয়া হয়েছে যেন আগ্রাবাসী ঘুম থেকে জেগে উঠে যমুনার তীরে এসে ঝরোকা বারান্দায় দেখে যায় তাদের সম্রাটকে। কর্চি আমার আলখাল্লা নিয়ে এসো। সাধারণত বারান্দাতে সংক্ষিপ্ত দর্শন দানের জন্য আটপৌরে সুতির টিউনিক পরে যান সম্রাট; কিন্তু প্রায় তিন মাস হয়ে গেল জনগণ দেখেনি তাঁকে। আর তাই সবুজ রেশম আর রত্নপাথরের সজ্জিত হয়ে শয্যাকক্ষ ছেড়ে বের হবেন তিনি যখন উদিত সূর্যের উষ্ণ আলো এসে পৌঁছবে পৃথিবীতে, খোদাই করা বালিপাথরের বারান্দাতে। হাত তুলে তাদেরকে আর আসন্ন দিনের উপর আশীর্বাদ করবেন সম্রাট, অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি সময়ই থাকবেন; যেন সম্রাটের সুস্থ হওয়া নিয়ে কারো মনে কোন সংশয় না থাকে। তাদের সামনে দেখতে পাবে মোগল ম্রাটকে।

আধা ঘণ্টা পরেই সমাপ্ত হয়ে গেল কাজ। নিচে উল্লসিত জনতার কাছে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিজের মহলে ফিরে এলেন শাহজাহান। যেমনটা তিনি বলেছেন, তেমনি তাঁর ব্যক্তিগত ছাদে অপেক্ষা করছে জাহানারা। এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করেও হাঁটা ধরলেন ছাদের দিকে। আবারো বাইরে আসায় তীব্র আলোর বিপরীতে হাত দিয়ে ছায়া দিলেন চোখের উপর। জাহানারা দাঁড়িয়ে আছে, সামনে এগিয়ে এলো না। এক মুহূর্তের জন্য একে অন্যের দিকে তাকিয়ে, শাহজাহান এগিয়ে গেলেন কন্যার দিকে।

শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না বলার মত। জাহানারার হয়ে অনেক কিছু বলেছে দারা, অনেক কিছু ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছে, বারবার জোর দিয়ে বলেছে যে জাহানারা নিরপরাধ আর নিজের হৃদয়ের গভীরে শাহজাহানও উপলব্ধি করলেন যে পুরোপুরি সঠিক দারা। কেমন করে এমন অভাবনীয়ভাবে রেগে গেলেন তিনি? আরো একবার পরাজিত হলেন জাহানারার কাছে। ক্ষমা করো আমাকে। অবশেষে বলতে পারলেন শাহজাহান। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ত্রস্তপায়ে তোমার বিচার করেছি। কোন অজুহাত দিচ্ছি না…

এসবই এখন অতীত আব্বাজান। সম্ভবত এটা নিয়ে আর কথা বলা উচিত হবে না আমাদের। মাপা কণ্ঠস্বরে জানিয়ে দিল জাহানারা। দমিয়ে রাখতে চাইছে নিজের ভেতরে উদ্গত হয়ে ওঠা আবেগকে।

কিন্তু আমাকে বলল যে ক্ষমা করেছ, নয়ত শান্তি পাবো না আমি।

আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। কথাগুলো বলেই, জানে যে রাজপরিবারের স্বার্থে বলতে হবে, দৃশ্যত পিতাকে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে দেখলো জাহানারা। কিন্তু আপন মনে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল কথাগুলি কি সত্যি? সম্ভবত অনেক দিন লেগে যাবে এটা ভুলতে যে অযৌক্তিকভাবে রেগে গিয়ে তাকে অপরাধী হিসেবে বিশ্বাস করে বসেছিলেন পিতা। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ দূরে থাকার পর নতুন চোখে পিতার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল জাহানারা, কতটা বৃদ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। চওড়া কাঁধ অবনত আর এক সময়কার পেশীবহুল শরীর–এক যোদ্ধার শরীর দেখাচ্ছে পাতলা আর ভঙ্গুর। এখনো সুদর্শন চেহারাতে আঁচড় কেটেছে গভীর রেখা। অসুস্থতা এসে এত বড় মূল্য চুকিয়ে গেল নাকি এখন যা দেখছে সম্রাট সবসময় তাই ছিলেন?

নিজের ভেতরেই অনুতপ্ত হল জাহানারা, হাসতে চাইল; কিন্তু আরেকটা কথা মনে হতেই মুছে গেল হাসি। শুধু আমার সাথেই যে অবিচার করা হয়েছে তা নয়। তুমি নিকোলাস ব্যালান্টাইনের সাথেও অন্যায় করেছ। যা ঘটেছে তাতে ওনার কোন অপরাধ নেই। আমি ওনার দ্বারস্থ হয়েছি কেননা ভাইদেরকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে। একটু বেশিই অবাধ্য হয়েছিলাম, আমি জানি। ভাবা উচিত ছিল যে এতে অন্যরা কী ভাববে। কিন্তু নিকোলাসের একমাত্র অপরাধ হলো আমাকে সাহায্য করতে চাওয়া। ইংল্যান্ডের জন্য জাহাজ ধরার কথা এখন। আমি তাকে পত্র লিখে জানিয়ে দেব। হয়ত সময় মত পৌঁছাবে না চিঠি। কিন্তু এটুকু জানিয়ে দিতে চাই যে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে… আমাদের পরিবার জানে যে তার কাছে কতটা ঋণী আমরা।

অবশ্যই। তাকে এও জানিয়ে দিও যে যা হয়েছে তার জন্য আমি অনুতপ্ত আর অতীতের সেবার জন্য কৃতজ্ঞ। আবারো যদি দরবারে ফিরে আসে সাদরে আমন্ত্রণ রইল। জাহানারার বাহুতে হাত রাখলেন শাহজাহান। গভীর স্বস্তি পেলেন এই ভেবে যে অন্তত একটা ফাটল মেরামত করা গেছে; কিন্তু ঘনিয়ে আসছে ভয়ংকর দুর্যোগ। নিঃশ্বাস ফেলে এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করে ফেললেন চোখ।

পিতা… তুমি ঠিক আছো? হাকিমদেরকে ডেকে পাঠাবো আমি?

না। অনেক দিন ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলাম আমি। আবারো একজন ম্রাট হয়ে উঠতে হবে।

শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালেন শাহজাহান। ভাইদের বিদ্রোহ সম্পর্কে তোমাকে কতটা বলেছে, দারা?

এতটুকুই যে তোমার অসুস্থতার অজুহাত খাড়া করে সেনাবাহিনী নিয়ে এগোচ্ছে সিংহাসন দখলের জন্য…

বিমর্ষ হয়ে গেলেন সম্রাট। এটাই পুরো সারমর্ম। এই ভেবে সারা হচ্ছি যে তোমার মা থাকলে কী ভাবতেন আর তার স্মৃতির প্রতি কতটা অন্যায় করেছি আমি। তোমার ভাইয়েরা কী করছে তার উপরে আমার আরো বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল আর নিয়ন্ত্রণ করাও। তাদের প্রদেশসমূহের নিয়মিত রাজকীয় উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত ছিল। অথচ এর পরিবর্তে তাদেরকে আর তাদের উচ্চাকাংখী উপদেষ্টাদেরকে সময় আর সুযোগ দিয়েছি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনা করার জন্য।

খানিকক্ষণ কোন উত্তর দিল না জাহানারা। ঠিকই বলেছেন পিতা। মমতাজের মৃত্যুতে ব্যথিত হয়ে এমনভাবে সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন যে আর বের হতে পারেননি তা থেকে। অশিষ্ট আচরণ করেছেন নিজের সব ছেলে-মেয়েদের সাথে, জাহানারার সাথেও, কেননা জাহানারার অপরাধ মেনে নিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। কিন্তু এসবের কিছুই কি পিতাকে বলতে পারবে সে?

বাবা, যা হয়েছে, হয়েছে। তুমি যা করেছ বা করতে ব্যর্থ হয়েছ তার কোন কিছুই ভাইদের বিদ্রোহকে বৈধ করে তুলবে না। এখন মনোর যাগ দাও তাদেরকে কীভাবে পদানত করা যায় সেদিকে।

*

চারপাশে তাকিয়ে নিজের উপদেষ্টাদের পরিচিত মুখগুলোর দিকে তাকালেন শাহজাহান। প্রত্যেকের চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল যে কয়েক ঘণ্টা আগে পুত্রদের বিদ্রোহের সংবাদে তিনি নিজে যতটা বিস্মিত হয়েছিলেন, এদের প্রত্যেকের অবস্থাও তাই। কেউ কেউ অবশ্য বিস্ময় গোপনও করতে পেরেছে। অন্তত একজনের অন্যান্য আরো অনেক সমস্যা আছে। তার ভূমি খরার কবলে পড়েছে মারাত্মকভাবে। লোকটার দিকে শক্তভাবে তাকিয়ে মনে মনে অবাক হয়ে ভাবলেন শাহজাহান যে যদি এমন হয় আওরঙ্গজেব তাকে ঘুষ দিয়েছে সহায়তার জন্য। আর ওই তো দরজার কাছে বসে আছে যে উপদেষ্টা, মূল্যবান জায়গিরের দিকে লোভ ছিল তার সবাই জানে; অসুস্থ হবার আগপর্যন্ত কাউকে এর অনুমতি দেননি শাহজাহান। হয়ত এ লোকটাও বিক্রি হয়ে বসে আছে। কে বলতে পারে? বেশির ভাগেরই কোন না কোন বাসনা আছে। কিন্তু অন্তত তার রাজপুত মিত্রেরা, আম্বারের রাজা জয় সিং আর মারওয়ারের রাজা যশয়ন্ত সিং পুরোপুরি বিশ্বস্ত। এ ব্যাপারে নিশ্চিত শাহজাহান। আকবরের সময় থেকেই পারিবারিক আর সম্মান উভয় দিক থেকেই আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠেছে তাদের সাথে মোগলদের। হাত তুলে আবারো কথা বলে উঠলেন শাহজাহান। আমার কনিষ্ঠ তিনপুত্রের ষড়যন্ত্রের প্রধান। অংশটুকুই কেবল বলেছি আমি। এখন শাহজাদা দারা তাদের অগ্রগতি আর সেনাবাহিনী সম্পর্কে এ পর্যন্ত যতটুকু জানতে পেরেছে তা জানিয়ে দেবে সবার সামনে।

দাক্ষিণাত্য থেকে ইতিমধ্যে রওনা দিয়েছে আওরঙ্গজেবের বাহিনী। বলে উঠল দারা। যদিও সে দাবি করছে যে এটা কোন বিদ্রোহ নয় অনেক রটনা থাকলেও তার ইচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে আগ্রায় এসে সম্রাটের বেঁচে থাকা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। শাহ সুজার সেনাবাহিনীও মাঠে নেমেছে, পশ্চিম দিকে গঙ্গা ধরে এগোচ্ছে। আসামের জঙ্গলে বেড়ে উঠা বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হাতিসহ বিপুল সংখ্যক অশ্বারোহী আর পদাতিক সৈন্য আছে এ বাহিনীতে।

দক্ষিণের শাসকদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য সবসময় সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত রাখে আওরঙ্গজেব; কিন্তু শাহ সুজা কেমন করে এত দ্রুত সৈন্য একত্রিত করল? জানতে চাইলেন জয় সিং।

উত্তর দিলেন শাহজাহান। বাংলার অর্থভাণ্ডার এত গভীর যে এর দুই গুণ বড় সেনাবাহিনীও চাইলে কিনতে পারবে সে আর এছাড়া বিহারের করের অর্থও আছে; সবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বোকার মত তাকে যেটা দিয়েছি আমি। বলে যাও, দারা।

আমার ভাই মুরাদও অন্যদের মত প্রস্তুতি নিয়েই এগোচ্ছে। সেনাবাহিনী জড়ো করে রসদ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করছে–অথবা করার চেষ্টা করছে। কেননা, ভাইদের রাজকোষের তুলনায় তার রাজকোষের অবস্থা প্রায় কপর্দকশূন্য। এক্ষেত্রে ধন্যবাদ দিতে হবে তার অযোগ্যতা আর অমিতব্যয়িতাকে। গুজরাটের ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ ঋণের চেষ্টা চালাচ্ছে আর খানিকটা বিলম্ব হতে পারে, কিন্তু ভয় হচ্ছে হয়ত বেশি দেরি আর নেই…

আপনি নিশ্চিত যে তারা সকলে সেনাবাহিনী নিয়ে আগ্রায় আসতে চায়? এবারে জিজ্ঞেস করলেন যশয়ন্ত সিং।

তাই মনে হচ্ছে। আমার বিশ্বাস যে একে অন্যের সাথে আঁতাত গড়েছে তারা। কিন্তু এটা কি যে কোন একজনকে সিংহাসনের জন্য সাহায্য করা নাকি নিজেদের মাঝে সাম্রাজ্য ভাগ করে নেয়া, সেটা পরিষ্কার নয়। উত্তরে জানালো দারা।

তার মানে প্রতিহত না করতে পারলে যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবে। এবার কথা বললেন শাহজাহান। ইতিমধ্যে বার্তাবাহকের হাতে প্রতিটি প্রদেশে আমার প্রাদেশিক শাসনকর্তা আর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছে পত্র লিখে জানিয়ে দিয়েছি যে আমি সুস্থ হয়েছি আর বিদ্রোহী পুত্রদেরকে যারাই সাহায্য করবে, বিশ্বাসঘাতকতার চরম শাস্তি ভোগ করবে তারা। পুত্রদের কাছেও পত্র লিখে দাবি করেছি বিদ্রোহ পরিত্যাগ করতে, মনে করিয়ে দিয়েছি পিতার প্রতি তাদের দায়িত্ব। কিন্তু জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। তাই এই অকৃতজ্ঞদের উপর এসব পত্র কতটা প্রভাব ফেলবে কে জানে। এ কারণে আমার হাতে আর কোন উপায় নেই আদেশ দেয়া ছাড়া যে রাজকীয় সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হোক। নিজেদের অঞ্চল থেকে ও প্রজারাজ্য থেকে যত সম্ভব সৈন্য একত্রিত করা হোক। সম্ভবত চক্রান্তকারীরা যখন দেখতে পাবে তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বাহিনী একত্রিত হচ্ছে, যুক্তিবোধ ফিরে পেয়ে পিছু হটবে মোগলদের রক্তে মোগলরা ঢেকে যাবার পূর্বেই।

দুই ঘণ্টা পরে, সর্বশেষ উপদেষ্টা কক্ষ ছেড়ে যাবার পর খানিকটা কাঁপতে কাঁপতে রুপার সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শাহজাহান। দারা দৌড়ে এলো সাহায্য করার জন্য; কিন্তু হাত নেড়ে তাকে ফেরত পাঠালেন সম্রাট। না, আমাকে আবারো শক্ত হতে শিখতে হবে…আর দারা, তোমাকে কিছু কথা জানাতে চাই আমি। কয়েক বছর আগেই যদি তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতাম, তাহলে এসব এখন ঘটতই না। এখন তোমাকে বাধ্য হয়ে যুদ্ধ করতে হবে যা তোমার অধিকার তার জন্য। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুতপ্ত আমি; কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল সংশোধন করতে চাইছি আমি। আগামীকাল ময়ুর সিংহাসনে বসে দরবারে সকলের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাকে উত্তরাধিকারী আর তোমার ভাইদেরকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করব আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *