০৯. দৈত্যের আত্মকথা

দৈত্যের আত্মকথা

আমার জন্মমুহূর্তের কথা ভালো করে স্মরণ হচ্ছে না। সে যেন অস্পষ্ট স্বপ্ন!

শব্দ পেলুম, গন্ধ পেলুম, স্পর্শ পেলুম। চোখও ফুটল। কিন্তু আলোর কী তীব্রতা! আবার চোখ মুদলুম-অমনি ড়ুবে গেলুম অন্ধকারে। আবার চোখ খুলে পেলুম আলোর ধারা।

উঠলুম। পাশের ঘরে গিয়ে তোমার দেখা পেলুম। কেমন করে জানি না, মন তখনই তোমাকে চিনে ফেললে আমার ঈশ্বর বলে। কিন্তু তুমি আমাকে দেখে ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলে কোথায়!

তারপর সবিস্ময়ে চারদিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালুম। রাস্তায় ছিল না জনপ্রাণী। হাঁটতে হাঁটতে শহর ছাড়িয়ে পেলুম মাঠ। তারপর বন। তখন তেষ্টা পেয়েছে, খিদে পেয়েছে। বনে ছিল ফল, নদীতে ছিল জল। খেয়ে-দেয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম।

যখন জাগলুম, তখনও অন্ধকারের ঘোর কাটেনি। বিষম শীত করতে লাগল। কোথাও আশ্রয় নেই, বন্ধু নেই। মনে জাগল কেমন একটা ভয়ের ভাব। নিজেকে কী অসহায় বোধ হল। একা বসে কেঁদে ফেললুম।

তারপর দেখলুম জীবনের প্রথম সূর্যোদয়। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলুম। আমার নিশ্চেষ্টতা ঘুচে গেল। উঠে গাছ থেকে ফল পেড়ে খেতে লাগলুম।

কিন্তু তখনও আমি ভালো করে কিছু বুঝতে পারছিলুম না। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, আলো-অন্ধকার। অনুভব করছি, চারদিকে শুনছি নানা ধ্বনি, বাতাসে পাচ্ছি ফুল-মাটি-বনের গন্ধ—এইমাত্র।

এমনিভাবে কেটে গেল কয়েকটা দিন। তারপর, একে একে পৃথিবীর রহস্য এবং কার্য ও কারণ সম্বন্ধে আমার মন সজাগ হয়ে উঠল।

গাছে গাছে পাখির ডাক ভারী মিষ্টি লাগল। একদিন খেয়াল হল, আমিও অমনি ধ্বনির সৃষ্টি করব। কিন্তু পারলুম না—আমার গলা থেকে বেরুল কীরকম একটা কর্কশ অব্যক্ত শব্দ। নিজের গলা শুনে নিজেরই ভয় হল আমি একেবারে চুপ মেরে গেলুম!

ক্রমেই জানতে পারলুম-দিনের পর রাত আসে আর রাতের পরে আসে দিন, সূর্য ড়ুবলে চাদ ওঠে, চাঁদ মিলোলে সূর্য ওঠে; কোকিলের স্বর মধুর, কাকের ডাক কর্কশ জড় নড়ে না, গাছেরা জড়ও নয় জীবও নয় প্রভৃতি আরও অনেক কিছু!

একদিন বনের পথে চলতে চলতে এক জায়গায় দেখলুম, রাঙা টকটকে কী একটা সমুজ্জ্বল জিনিস। তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শীতার্ত দেহে লাগল তপ্ততার আরাম! খুশি হয়ে জিনিসটাকে স্পর্শ করতেই সে আমাকে এমনি কামড়ে দিলে যে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলুম। একই জিনিস দেয় আরাম ও যাতনা। সেইদিন থেকে চিনলুম আগুনকে। ক্রমে তার ব্যবহারও শিখলুম।

কিছুদিন পরে সে বনে হল ফলের অভাব। খালি জল খেয়ে তো জীব বাঁচতে পারে না। ক্ষুধার তাড়নায় দেহ অস্থির হয়ে উঠল। বনের আশ্রয় ছেড়ে আবার খোলামাঠে বেরিয়ে পড়লুম।

সেখানেও খাবার নেই। মাঠ পেরিয়ে একখানা গ্রামের কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। একখানা কুটির চোখে পড়ল। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি, এক বুড়ি বসে বসে রান্না করছে।

আমার পায়ের শব্দে চমকে বুড়ি মুখ ফেরালে। সঙ্গে সঙ্গে দুই চোখ কপালে তুলে ভয়ানক চেঁচিয়ে সে এমন আশ্চর্য দৌড় মারলে যে, নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতে পারতুম না। অত বুড়ি অত জোরে দৌড় মারতে পারে!

বুড়ি ভাত নামিয়েছে, ডাল ও তরকারি বেঁধেছিল। তাড়াতাড়ি গোগ্রাসে সমস্ত সাবাড় করে ফেললুম। তারপর দিব্যি আরামে উনুনের ধারে বসে আগুন পোয়াচ্ছি, এমন সময়ে বাইরে উঠল এক বিষম গোলমাল!

ব্যাপার কী দেখবার জন্যে বেরিয়ে এলুম। চারদিকে মস্ত জনতা, এদিকে-ওদিকে যেদিকেই তাকাই, কেবল মানুষের পর মানুষ। সবাই উত্তেজিত, সবাই চিৎকার করছে। আমি বাইরে আসতেই বেশিরভাগ লোকই পালিয়ে গেল, কিন্তু বাকি মানুষগুলো আমাকে টিপ করে ক্রমাগত ছুড়তে লাগল ইট-কাঠ-পাথর! বেগতিক দেখে আমি দিলুম টেনে লম্বা।

আমার আর একটা শিক্ষা হল। বুঝলুম, মানুষ আমার বন্ধু নয়। সেইদিন থেকে দিনের বেলায় আর মানুষের কাছে যেতুম না।

দিনের পর দিন কাটে। দু-চার বার ঝড়-বৃষ্টির পাল্লায় পড়ে কষ্ট পেলুম। মনে হল, মানুষের মতন আমারও যদি একটা ঘর থাকত, তবে কী সুবিধাই হত। কিছুদিন পরে একটা সুযোগও জুটল। এক রাত্রে একখানা পুরোনো ভাঙা খালি বাড়ি পেলুম। লুকিয়ে তার ভেতরে ঢুকে বাঁধলুম বাসা। দিনের বেলায় সেখানে শুয়ে শুয়ে ঘুমুতুম আর রাতের অন্ধকারে বাইরে এসে করতুম খাবারের সন্ধান। এই শূন্য বাড়ির ভেতরেই আমার নতুন শিক্ষা শুরু হল।

আমার বাড়ির পাশেই ছিল একখানা ছোটো বাড়ি, দুই বাড়ির মাঝখানে ছিল কেবল হাত-তিনেক চওড়া একটা গলি।

আমি দোতলার যে ঘরখানি ব্যবহার করতুম, তার জানলাগুলো বন্ধ করে রাখতুম— ধরা পড়বার ভয়ে। কিন্তু সেই পুরোনো বাড়ির প্রত্যেক জানলাই ছিল ভাঙ ঝরঝরে। ফাটা পাল্লায় চোখ লাগালে পাশের বাড়ির দোতলার দুটো ঘর দেখা যেত ও বাড়ির ওপরে দুখানার বেশি ঘরও ছিল না।

চমৎকার আওয়াজ শুনে উঠে গিয়ে দেখি, একটি অতিপ্রাচীন মানুষ আপন মনে বসে বসে কী একটা যন্ত্র নিয়ে কী করছেন, আর সুমধুর ধ্বনিতে চারদিক মিষ্টি হয়ে উঠছে। পরে জেনেছি ও যন্ত্রটির নাম বেহালা।

প্রাচীনের কী সুন্দর মূর্তি। মাথায় ধবধবে সাদা রুপোর মতন চিকন লম্বা চুল, মুখেও সাদা লম্বা দাড়ি, গায়ের রংও শুভ্র। তার শান্ত মুখখানি দেখলেই ভক্তি হয়।

তারপরেই চোখ পড়ল প্রাচীনের পাশের দিকে। সেখানে বসে আছে একটি পরমাসুন্দরী মেয়ে, বয়স হবে পনেরো-ষোলো। মেয়েটি আদরমাখা চোখে প্রাচীনের দিকে চেয়ে একমনে বাজনা শুনছিল।

খানিক পরেই ঘরের ভেতরে একটি আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে এসে দাঁড়াল। তাকেও দেখতে অতি সুন্দর।

বাজনা থামল। তারা তিনজনে মিলে কথা কইতে আরম্ভ করল।

কী বিস্মিতই যে হলুম! তখনও জানতুম না কথা বা ভাষা কাকে বলে! আমি নিজে তখনও কথা কইতে শিখিনি কথা বলতে বুঝতুম শুধু অর্থহীন শব্দ!

কিন্তু বেশ আন্দাজ করতে পারলুম এরা মুখ দিয়ে যে-সব শব্দ বের করছে সেগুলো যা-তা বা অর্থহীন নয়। কয়েক দিনের মধ্যেই আরও বুঝলুম, কোনও কোনও শব্দের পরেই তারা হাসে বা দুঃখিত হয় বা অন্যরকম ভাব প্রকাশ করে। ভাবলুম, বাঃ, এ তো ভারী ভালো ব্যাপার।

প্রভু, তোমার কাছ থেকে আমি ভাষা শিখিনি বটে কিন্তু তোমার প্রসাদে আমি পেয়েছি আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি! বোধহয় আমার মতন স্মৃতিশক্তি কোনও মানুষেরই নেই। যে-কথা আমি একবার শুনি তা আর কিছুতেই ভুলি না।

রোজ মন দিয়ে তাদের কথাবার্তা শুনতুম আর মনে মনে বোঝবার চেষ্টা করতুম। প্রথম প্রথম খুবই অসুবিধা হত, তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে শব্দরহস্য স্পষ্ট হয়ে আসতে লাগল।

কেবল কানে শোনা নয়, প্রত্যেক শব্দ আমিও উচ্চারণ করবার চেষ্টা করতুম। এইভাবে কিছুকাল অভ্যাসের পর ক্রমে ক্রমে আমি কথা কইবার শক্তিও অর্জন করলুম।

এক বছর চেষ্টার পর ভাষার ওপরে আমার মোটামুটি দখল হল। কিন্তু এসব হচ্ছে। পরেকার কথা।

প্রথম দিনেই এই সুখী পরিবারটিকে আমার বড়ো ভালো লাগল। কী চমৎকার এদের দেখতে, কেমন মিষ্টি এদের ব্যবহার! অন্ধকার ঘরে ধুলো ভরা মেঝের ওপরে শুয়ে শুয়ে কেবল এদের কথাই ভাবতে লাগলুম। মনের ভেতরে প্রবল ইচ্ছা জাগল, ওদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করতে। কিন্তু প্রথম দিনেই মানুষদের কাছে গিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছি তা আর ভোলবার নয়। কাজেই সাহস হল না, মনের ইচ্ছা মনেই রইল।

আপাতত ওদের লক্ষ করেই দিন কাটতে লাগল।

ক্রমে ক্রমে বোঝা গেল, প্রাচীন ব্যক্তিটি হচ্ছেন ঠাকুরদাদা আর ছেলে-মেয়ে দুটি তার নাতি-নাতনি। প্রাচীনের স্ত্রী নেই আর ওদের মা-বাপ বেঁচে নেই। ওরা বড়োই গরিব। মেয়েটি একলাই সংসারের সব কাজ ও দাদুর সেবা করত। ছেলেটি রোজ সকালে খেয়েদেয়ে কোথায় চাকরি করতে যেত—ফিরত সেই বিকালে। তারপর বোনকে নিয়ে রোজ একবার করে কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে বেড়িয়ে আসত। ক্রমে জানলুম ছেলেটির নাম মাধব আর মেয়েটির নাম মাধবী।

দাদুকে বিশেষ চলা-ফেরা করতে দেখতুম না। প্রায় সারাদিনই তিনি জানলার ধারে বসে থাকতেন। যখন চলতেন তখনও কেমন যেন বাধাে বাধাে পায়ে হাঁটতেন। বেশির ভাগ সময়েই মাধব কি মাধবী তার হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে যেত। প্রথমে এর কারণ বুঝিনি—তারপর আবিষ্কার করলুম, দাদু চোখে একেবারেই দেখতে পান না! তার দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে আমার মন করুণায় পূর্ণ হয়ে উঠত।

দাদুর বেশি সময় কাটত বেহালা বাজিয়ে। কী নিপুণ হাত তার! আমার কানে আর প্রাণে ঝরত যেন স্বর্গীয় সুরের অমৃত! তার বেহালার তান শুনলে আমি পৃথিবীর আর সব ভুলে যেতুম।

যখন ভাষা শিখলুম, তখন নিজে আড়ালে থেকে অনেক ছোেটা ছোটো ব্যাপারে আমি তাদের উপকারে লাগবার চেষ্টা করতুম।

মাধব রোজ সকালে উঠে তাদের বাড়ির পিছনকার বন থেকে নিজে কাঠ কেটে আনত। সেই কাঠ জ্বালিয়ে তাদের রান্না হত।

একদিন করলুম কী, রাত-আঁধারে বনে গিয়ে গাছের ডাল ভেঙে মস্ত একবোঝা কাঠ এনে তাদের সদর দরজার সামনে ফেলে রেখে এলুম।

পরের দিন দরজা খুলে এই কাঠের বোঝা দেখে মাধব ও মাধবী বিস্ময়ে অবাক! তারপর এমনি ব্যাপার যখন নিত্যই হতে লাগল, তখন তারা রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেল। এই কথা শুনে দাদুও কম অবাক হলেন না। তাদের এই বিস্ময়ের ভাবটি আমি উপভোগ করতুম। শেষটা রহস্য বোঝবার চেষ্টা তারা ছেড়ে দিল।

মাঝে মাঝে ফলমূল শাক-শবজি পেলেও এনে দিতুম। দাদু বলতেন, আমরা গরিব বলে আমাদের ওপরে বোধহয় বনদেবতার দয়া হয়েছে।

মাধব বলত, এসব ভূতুড়ে কাণ্ড। মাধবী বলত, যে-ভূত এত উপকার করে তাকে দেখলেও আমি ভয় কর না?

শুনে আমার মনে আশা জাগত। ভাবতুম, একদিন হয়তো ওদের সঙ্গে আমারও বন্ধুত্ব হবে! এ কথা ভাবলেও বন্ধুহীন আমার মনে জেগে উঠত পরম সান্ত্বনার ভাব।

একদিন সন্ধ্যার সময় ওদের বাড়িতে এল একটা মহা কুৎসিত লোক। যেমন কালো, তেমনি মোটা, তেমনি বেঁটে। স্নান দীপের আলোতে তার মুখের কদর্যতা আমার নজর এড়াল না।

কথাবার্তা শুনে বুঝলুম, দাদু কবে এর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলেন, ও তাই। আদায় করতে এসেছে।

দাদু কাতর স্বরে বললেন, মশাই, আর কিছুদিন সবুর করুন। আপাতত আমার অবস্থা তো দেখছেন, এখন টাকা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আর কিছুদিন যাক, মাধবের মাইনে বাড়ুক, তারপর মাসে মাসে আপনার টাকা শোধ করব।

লোকটা গর্জন করে বলে উঠল, না, না—আমি আর সবুর করব না। তোমাকে এক মাস সময় দিলুম, এর মধ্যে যদি টাকা না পাই, এ বাড়ি থেকে তোমাকে তাড়িয়ে তবে ছাড়ব?

সর্বনাশ, দাদু আর মাধব মাধবীকে যদি এখান থেকে বিদায় করে দেয়, তাহলে আমার হাল কী হবে? দুঃখের সাগরে এইটুকু আমার সুখের দ্বীপ, শেষটা কি এর থেকেও বঞ্চিত হব?

দারুণ ক্রোধে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। তখন রাত্রিকাল, আকাশে ফুটেছে চাঁদের আলো।

পাওনাদার যখন রাস্তায়, আমি এক দৌড়ে রুদ্র মূর্তিতে তার সুমুখে গিয়ে হাজির। আমাকে দেখেই তার চক্ষুস্থির, দারুণ আতঙ্কে সে কেবল ঠক ঠক করে কাপতে লাগল— একবার চাচাতেও পারলে না।

আমি ক্যাঁক করে তার গলা চেপে ধরে তাকে বিড়াল বাচ্চার মতন শূন্যে তুলে দু-একটা ঝকানি মেরে মাটির ওপরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললুম, আমি হচ্ছি দাদু আর মাধব-মাধবীর বন্ধু! দাদুকে এ বাড়ি থেকে তাড়াবার চেষ্টা করলে তোকে খুন করে ফেলব। এই বলেই অদৃশ্য হলুম।

পরের দিনেই এই ঘটনার কথা বোধহয় ও-বাড়ির সকলের কানে উঠল। কারণ আমি শুনলুম, দাদু উত্তেজিত ভাবে বলছেন, বনদেবতা, বনদেবতা! আমাদের ওপরে বনদেবতার দয়া হয়েছে!

মাধব বলল, আশ্চর্য ভূত।

মাধবী বলল, এমন ভালো ভূতকে আমি প্রণাম করি।

আমার মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

ইতিমধ্যে হঠাৎ আর একটা ভীষণ আবিষ্কার করলুম।

একদিন একটি নদীর দিকে তাকিয়ে দেখি, জলের ভেতরে ভয়ঙ্কর একটা মূর্তি সেই রাক্ষুসে মূর্তিটা দেখেই প্রথমটা ভয়ে আমি চমকে উঠলুম। কিন্তু তারপরেই বুঝতে পারলুম, জলে পড়েছে আমারই ছায়া। আমার চেহারা এমন ভয়াবহ। সমস্ত প্রাণমন হা হা করে উঠল। কিন্তু তখনও আমি ভালো করে বুঝতে পারিনি, এই চেহারার জন্যে আমার অদৃষ্টে আরও কত দুর্ভোগ লেখা আছে!

একটি সুন্দর সন্ধ্যা। আকাশে পূর্ণিমার চাদ। বসন্ত-বাতাসে ফুলের আতর।

মাধবীকে নিয়ে মাধব বেড়াতে বেরিয়েছে। দাদু জানলার ধারে একলা বসে বেহালার তারে করছেন অপূর্ব সুরসৃষ্টিতার মুখের ওপরে এসে পড়েছে চাঁদের আলো।

সুর শুনতে শুনতে আমার বুকটাও যেন ভরে উঠল বাসন্তী জ্যোৎস্নায়। প্রাণের আবেগে নিজের ভয়াবহ কদর্যতার কথাও ভুলে গেলুম।

মনে হল, এই হচ্ছে দাদুর সঙ্গে ভাব করবার উপযুক্ত সময়। দাদু একলা, তিনি চোখেও দেখতে পান না। তার সঙ্গে আলাপ করে আসি!

আমি একেবারে ও বাড়ির দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দাদুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম।

আমার ভারী পায়ের শব্দ দাদুর কানে গেল। বাজনা থামিয়ে তিনি বললেন, কে? ভয়ে ভয়ে বললুম, আমি বিদেশি। আপনার কাছে একটু বসতে পারি কি?

মধুর হাসিমাখা মুখে দাদু স্নিগ্ধ স্বরে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়! ভেতরে আসুন। ওই চেয়ারে বসুন।

আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে চেয়ারে না বসে দাদুর কাছেই বসে পড়লুম। কি: ক বলে কথা আরম্ভ করব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলুম।

দাদু বললেন, আপনি বিদেশি হলেও আপনার কথা শুনে বুঝছি, আপনি বাঙালি।

আমি বললুম, আমি বাঙালি নই, তবে বাংলা বলতে শিখেছি বটে।

কার কাছে শিখেছেন? বাঙালিরই কাছে। কিন্তু ওসব কথা এখন থাক—আমার অন্য কথা আছে।

বলুন।

দেখুন, আমি কেবল বিদেশি নই—আমি বড়ো হতভাগ্য লোক। আমি সমাজচ্যুত–জাতিচ্যুত। কেউ আমাকে দু-চোখে দেখতে পারে না।

বিদেশি, আপনার দুর্ভাগ্যের কথা শুনে দুঃখিত হলুম।

আমি একটি বাঙালি পরিবারকে ভালোবাসি—যদিও সে পরিবারের কেউ আমাকে চেনে না। আমি তাদের সঙ্গে আলাপ করতে চাই। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, তাদের কাছে গেলে যদি তারাও আমাকে ত্যাগ করে। তাদের হারালে আমি পৃথিবীর সব হারাব!

দাদু বিস্মিত ভাবে অল্পক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, বিদেশি, হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আপনার বন্ধুরা নিশ্চয়ই আপনাকে ভুল বুঝবেন না তারা লোক কেমন?

খুব ভালো। কিন্তু আর সকলের মতন তারাও হয়তো কেবল চোখে দেখেই আমাকে বিচার করবে।

আপনার বন্ধুরা কোথায় থাকেন?

এইখানেই।

এইখানেই।

হ্যাঁ। দাদু, আপনিই আমার বন্ধু। আমি বড়ো অভাগা, আমার ওপরে দয়া করুন— বলেই আমি দুই হাতে দাদুর হাত চেপে ধরলুম।

দাদু বিস্মিত চকিত স্বরে বলে উঠলেন, কী আশ্চর্য, কে আপনি?

আমি কোনও জবাব দেওয়ার আগেই ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল মাধব ও মাধবী! আমাকে দেখেই তাদের মুখের ভাব হল যেরকম, তা আর বর্ণনা করা অসম্ভব, মাধবী তখনই অজ্ঞান হয়ে মাটির ওপরে পড়ে গেল। মাধব ঘরের কোণ থেকে একগাছা মোটা লাঠি তুলে নিয়ে মরিয়ার মতন ছুটে এসে আমার ওপরে ঝাপিয়ে পড়ল, তার পর লাঠির পর লাঠি মেরে আমার সর্বাঙ্গ জর্জরিত করে তুলল।

ইচ্ছা করলে আমি একটিমাত্র আঘাতে মাধবের অস্তিত্ব লুপ্ত করে দিতে পারতুম। কিন্তু সে ইচ্ছা আমার হল না। দেহে এবং মনে একসঙ্গে দারুণ আঘাত পেয়ে দাদুর ঘর থেকে আমি বেগে বেরিয়ে এলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *