প্রেত আত্মা

প্রেত আত্মা

জমাট অন্ধকারে সন্তর্পণে এগুচ্ছে ছায়ামূর্তি।

বনহুর আর রহমান অতি গোপনে অনুসরণ করছে ছায়া মূর্তিটিকে। বনহুরের হস্তে গুলী। ভরা রিভলভার। আর রহমানের হস্তে উদ্যত রাইফেল। নিশ্বাস বন্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।

বনহুর ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে রিভলভারের এক গুলীতে ছায়ামূর্তির ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারে কিন্তু তার সে ইচ্ছা নয়। বনহুর ছায়ামূর্তিটিকে গ্রেপ্তার করে দেখবে–কে সে, সত্যই জোবাইদার প্রেত আত্মা না অন্য কেউ।

বনহুরের আস্তানায় প্রেত আত্মা–কম কথা নয়!

ছায়ামূর্তিটা যতই অগ্রসর হচ্ছে–বনহুর আর রহমান ততই আত্মগোপন করে দ্রুত তাকে অনুসরণ করছে।

হঠাৎ বনহুর আর রহমান স্তম্ভিত হয়ে পড়লো–সম্মুখস্থ ছায়ামূর্তি আচম্‌কা কোথায় যেন মিশে গেলো।

রহমান রাইফেল বাগিয়ে ধরলো, এই মুহূর্তে সে গুলী ছুড়বে।

বনহুর দক্ষিণ হস্তে রহমানের রাইফেল নামিয়ে দিয়ে বললো–আর গুলী ছুঁড়ে কোন ফল হবে না রহমান।

তাহলে ও পালিয়ে গেলো?

সুযোগ দিলাম আজ ওকে।

সর্দার।

 হাঁ রহমান।

 কিন্তু ওটা জোবাইদার প্রেত আত্মা ছাড়া কিছু নয় সর্দার।

 বনহুর হঠাৎ হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে।

রহমান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে।

বনহুর ফিরে দাঁড়ালো–চলো রহমান।

অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো রহমান–সেকি সর্দার, ওখানে গিয়ে দেখলেন না একটি বার?

বৃথা অন্বেষণ করা হবে, ওখানে ওর চিহ্নটিও নেই।

বনহুর তার বিশ্রাম কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।

রহমান অনুসরণ করলো তাকে।

কক্ষে প্রবেশ করে রিভলভারটা টেবিলে রেখে শয্যায় এসে বসলো বনহুর, মুখোভাব স্বাভাবিক।

রহমান সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চপ, সর্দারের কোন আদেশের প্রতিক্ষা করছে সে।

বনহুর বললো–রহমান।

বলুন সর্দার?

তোমার কি সন্দেহ হয় ঐ ছায়ামূর্তি জোবাইদার প্রেতআত্মা?

হয়না, কিন্তু আশ্চর্য ঐ ছায়ামূর্তি ছায়াই বটে। সর্দার আমি অনেক দিন লক্ষ্য করেছি– নিশিথ রাতে যখন সমস্ত আস্তানা নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে তখন কে যেন অতি সন্তর্পণে আস্তানার। পাশে পাশে ঘুরে বেড়ায়, কার যেন লঘু পদশব্দ শোনা যায় গভীর অন্ধকার। একটা দীর্ঘশ্বাস যেন ভেসে বেড়ায় এদিক থেকে সেদিকে। কোন বেদনা ভরা নিঃশ্বাস।

বনহুর এবার আরো জোরে হেসে উঠলো–রহমান ভুলে যেওনা তুমি সাধারণ মানুষ নও। তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে আজকাল তুমি কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছো।

সর্দার, আপনি যা-ই বলুন, আমি নিজের চোখে দেখছি, সেই ছায়ামূর্তি কোথা থেকে আসে। জানিনা, কিন্তু তাকে আমি জোবাইদার কবরের দিকে চলে যেতে দেখেছি।

তুমি আর ওকে অনুসরণ করোনা রহমান।

কেনো সর্দার।

ভয় পাবে।

সর্দার রহমান ভয় পাবার বান্দা নয়।

জানি, কিন্তু তোমার মনের দুর্বলতা তোমাকে অনেকখানি নিচে নামিয়ে এনেছে। যাও বিশ্রাম করোগে, আর শোন–কাল ভোরে নাছরিনের মৃত্যুদন্ডাদেশ সবাইকে আর একবার স্মরণ করিয়ে দিও।

আচ্ছা সর্দার। রহমান বেরিয়ে গেলো।

রহমান চলে যেতেই বনহুর কক্ষ মধ্যে পায়চারী শুরু করলো।

গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে সে।

এক সময় বনহুর তার নিজস্ব ড্রেসে সজ্জিত হয়ে নিলো। তারপর রিভলভারটা তুলে নিলো হাতে। অত্যন্ত সর্তকতার সঙ্গে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। এগিয়ে চললো বনহুর জোবাইদার কবরস্থানের দিকে।

ঘন ঝোপ ঝাপের ভিতর দিয়ে গোপনে এগুতে লাগলো সে। দক্ষিণ হস্তে গুলী ভরা। রিভলভার।

কবরের অদূরে পৌঁছতেই বনহুরের কানে এলো একটা চাপা করুণ কান্নার সুর।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো বনহুর, একটা ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করে দাঁড়িয়ে রইলো।

 শব্দটা জোবাইদার কবরের পাশ থেকেই আসছে।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কে যেন কাঁদছে।

বনহুর সজাগ হয়ে কান পাতলো তবে কি রহমানের অনুমান সত্য! জোবাইদার প্রেত আত্মাই কি, রাত্রির দুর্ভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে আস্তানার চারিপাশে ঘুরে বেড়ায়? তবে কি রহমান এ সব যা দেখেছে সব বাস্তব? কিন্তু সবাই বিশ্বাস করলেও সে বিশ্বাস করতে পারেনা। মৃতের অশরীরী আত্মা কোনদিন–

বনহুরের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেলো ফিস ফিস করে কে যেন কথা বলছে, ব্যথা ভরা কণ্ঠস্বর।

বনহুর শুনতে চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুই বোঝা গেলো না।

কখন যে আকাশে মেঘ জমে, উঠেছিলো খেয়াল করেনি বনহুর; ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। চমকে উঠলো বনহুর–বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া বইতে আরম্ভ করলো।

সাঁ সাঁ করে বাতাস বইছে, সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ বৃষ্টি। বনহুর কবরের দিকে এগুতে চেষ্টা করলো, কিন্তু তখন সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।

ফিরে এলো বনহুর নিজের কক্ষে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো–রহমান যা ভাবছে। তা সম্পূর্ণটা মিথ্যা বা অহেতুক নয়। সত্যই এটা অতৃপ্ত আত্মা তার আস্তানায় কার অপেক্ষায় যেন হা হুতাশ করে মরছে। কিন্তু কে সে; বনহুর তাকে আবিষ্কার করবেই করবে।

বনহুর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

ধীরে ধীরে দরজা খুলে যায় তার শিয়রে এসে দাঁড়ায় ছায়ামূর্তি। সমস্ত শরীর তার কালো কাপড়ে ঢাকা।

সমস্ত রাত্রি জাগরণের ফলে বনহুর অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

ছায়ামূর্তি অর্ধনির্বাপিত মশালের আলোতে বনহুরের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অতৃপ্ত নয়নে। কালো আলখেল্লার মধ্যে চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে ঠিক ভোরের তারার মত। বনহুর নিজের শরীরে কোন চাদর চাপা না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ছায়ামূর্তি ওদিকের আলনা থেকে শালের চাদরটা নিয়ে বনহুরের গায়ে বেশ করে দিয়ে দিলো। তারপর যেমনি এসেছিলো তেমনি বেরিয়ে গেলো মন্থর গতিতে।

*

ভোরে বনহুরের ঘুম ভাংতেই হাই তুলে বিছানায় উঠে বসলো।

এমন সময় রহমান এসে দাঁড়ালো–সর্দার!

বেলা হয়ে গেছে বড়।

বেশি বেলা হয়নি সর্দার, তবে কমও হয়নি। দরবার কক্ষে সবাই এসে হাজির হয়েছে। কাল যে খবরটা প্রচার করে দিতে বলেছিলেন–

হাঁ, দাও গে যাও। কথাটা বলেই অবাক হলো বনহুর–তার শরীরে এ শালের চাদরটা এলো কি করে! একটু চিন্তা করে বললো সে–আমি শোবার পর তুমি কি আবার আমার কক্ষে এসেছিলে?

না সর্দার, আমি আর আসিনি। কিন্তু কেনো?

বনহুর কিছু বলতে গিয়ে আর বললো না, একটু শব্দ করলো শুধু-হু।

রহমান বনহুরের মুখভাব করে এবং কিছু সে তার কাছে গোপন করলো বুঝতে পেরে গম্ভীর হলো।

বনহুর বললো–যাও, আমার আদেশটা আস্তানার সকলের নিকট জানিয়ে দাও।

 আপনি যাবেন কি সর্দার?

না, তুমি যাও।

রহমান বেরিয়ে গেলো।

বনহুর আবার তাকালো নিজের দেহের দিকে–কে তার শরীরে চাদর চাপা দিয়েছিলো, সত্যি তাকে বাহবা না দিয়ে পারলো না বনহুর। কারণ তার মত এক জনের পাশে এসে তার দেহে কাপড় চাপা দেবার সাহস এ আস্তানায় কার হতে পারে।

*

আজ সমস্ত আস্তানায় একটা গম্ভীর থমথমে ভাব বিরাজ করছে। আজকের রাত্রি গত হলেই নাসরিনের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। জোবাইদাকে হত্যা করার জন্যই তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে।

নাসরিনকে আস্তানার সবাই ভালবাসতো, স্নেহ করতো। কারণ নাসরিন ছিলো সদা হাস্যময়ী উদার প্রাণ যুবতী। কালু খাঁ জীবিত কালে নাসরিন খুব বড় ছিল না তার মৃত্যুর পর সে এতো বড় হয়েছে। বৃদ্ধা দাই মা আর অন্যান্য সকলের আন্তরিকতায় মানুষ হয়েছে সে। কাজেই ওকে সকলে অত্যন্ত ভালবাসতো।

নাসরিনের মৃত্যুদন্ডাদেশ সকলের মনে গভীর একটা বেদনার ছায়াপাত করেছে। কিন্তু কোন উপায় নেই-দস্যু বনহুরের আদেশ।

কারাকক্ষে নাসরিন শুনলো, কাল ভোরে তার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে চিরতরে। একটা করুণ ক্রন্দন তার কণ্ঠ ঠেলে বেরিয়ে এলো প্রাণ ভরে কাঁদলো সে।

দাইমা তো মাথা কুটে কাঁদা শুরু করে দিয়াছে। নাসরিন কখনও জোবাইদাকে হত্যা করতে পারে না–এ কথাই সে বার বার উচ্চারণ করছে। দাইমার ক্রন্দনে বনহুরের আস্তানার পাষাণ প্রাচীরে প্রতিধ্বনি জাগছিল।

নূরী আজ কদিন তার কক্ষ থেকে বাইরে বের হয়নি। মনিকে নিয়ে সে সব সময় নিজের। ঘরে ব্যস্ত রয়েছে এমন কি বনহুরের সঙ্গেও সে আর দেখা করেনি।

দাইমার কান্নার আওয়াজ তার কানে পৌঁছবে বলে সে নিজের ঘরের দরজা জানালা শক্ত করে বন্ধ করে দিয়েছিলো। কেমন যেন একটা বিমর্ষ ভাব নূরীর মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো, হাজার হলেও তার শিশু কালের সাথী সহচরী কিনা।

বনহুর আজ কোথাও যায় নি, নিজের কক্ষে বসে কিছু চিন্তা করছিল; এমন সময় ঝড়ের বেগে কক্ষে প্রবেশ করলো বৃদ্ধা দাইমা বনহুরের জামার আস্তিন দু’হাতের মুঠায় আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো সে বনহুর তুমি দস্যু হয়েছে বলে যা তা করবে? পারবে না আমি বেঁচে থাকতে তুমি পারবে না নাসরিনকে হত্যা করতে।

বনহুর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো–আমার আদেশ তাকে হত্যা করতেই হবে।

 কেন? কেন তাকে হত্যা করবে?

 নাসরিন জোবাইদাকে হত্যা করেছে বলে।

না, নাসরিন তাকে হত্যা করেনি।

সে নিজে স্বীকার করেছে–জোবাইদার হত্যাকারী সে নিজে।

তুমি জানো না বনহুর, নাসরিন তাকে হত্যা করতে পারে না। না না, কিছুতেই না। আমি নাসরিনকে হত্যা করতে দেবনা।

বনহুর এক ঝটকায় বৃদ্ধাকে ঠেলে সরিয়ে দিলো–যাও এখান থেকে।

আমি যাবো না। যতক্ষণ না তুমি নাসরিনের মৃত্যুদন্ডাদেশ ফিরিয়ে নিয়েছো আমি যাবো না তোমার কক্ষ থেকে।

বনহুর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো বৃদ্ধার দিকে। তার কলিং বেলে হাত রাখলো।

সঙ্গে সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলো রহমান–সর্দার।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–একে নিয়ে যাও, যতক্ষণ নাসরিনের মৃত্যুদন্ড না ঘটেছে। ততক্ষণ বন্দী করে রাখো।

পাপিষ্ঠ আমাকে বন্দী করবি। চিরদিন দস্যুতাকে সমর্থন করে এসেছি–আর নয়। আমিই তোকে হত্যা করবো–বৃদ্ধ কাপড়ের নিচ হতে একখানা সূতীক্ষ ধার ছোরা বের করে আচমকা বসিয়ে দিতে গেলো বনহুরের বুকে।

সঙ্গে সঙ্গে রহমান খপ করে বৃদ্ধার ছোরা সহ দক্ষিণ হাতখানা ধরে ফেললো–এ তুমি কি করতে যাচ্ছো দাইমা?

ছেড়ে দাও আমি ওকে হত্যা করবো। দস্যুতার শেষ সমাধি করবো আমি—

 বনহুর বললো–নিয়ে যাও ওকে।

 রহমান দাইমাকে টানতে টানেতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বনহুর ওদিকের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো কে যেন দ্রুত সরেগেলো ওপাশ থেকে।

অন্যান্য দিনের চেয়ে বনহুরকে আজ বেশি গম্ভীর মনে হচ্ছিলো। সব সময় কিছু যেন গভীরভাবে চিন্তা করছে।

আজ একটি মাত্র রাত্র–তারপর জোবাইদার হত্যাকারীকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। সত্যই নাসরিন হত্যাকারী কিনা, তার প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে আজ রাতেই। আজ রাতেই আরও একটা রহস্য তাকে উদ্ঘাটন করতে হবে–কে এই জোবাইদার প্রেত আত্মার বেদে ছায়ামূর্তি। বনহুর গত রাতেই প্রেত আত্মার আত্ম প্রকাশের চরম পরিণতি ঘটাতে পারতো কিন্তু রহমানের সম্মুখে সে চায়না ও কাজ করতে।

কিন্তু আজ রাতে সে দেখবে–কে এই প্রেত আত্মা। কি উদ্দেশ্য নিয়ে সে তার আস্তানায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জোবাইদার কবরের পাশে জমাট অন্ধকারে কে-ই বা অমন করে রোদন করছিলো! বনহুরের কাছে এসব যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে। জীবনে সে কোন দিন বিশ্বাস করেনি ভূতপ্রেত বা অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব। ছোট বেলা হতেই বনহুর ভয়হীনভাবে মানুষ হয়েছে। দুর্বলতা কাকে বলে জানে না সে কোনদিন। অসাধ্য সাধন করাই বনহুরের জীবনের ব্রত।

আজ তার নিজের আস্তানায় প্রেত আত্মার আবির্ভাব উপলব্ধি করে হাসি পায় ওর। বনহুর জানে প্রেত আত্মার সাহস নেই তার আস্তানায় প্রবেশ করে।

বনহুর আজ এক মহা সমস্যার সম্মুখীন। মানুষ হত্যা করা তার কাছে তেমন কিছু নয়, কিন্তু জোবাইদার হত্যা তাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। জোবাইদার হত্যাকারী হিসাবে নাসরিনকে কারারুদ্ধ করা হলেও আসলে নাসরিন হত্যাকারী নাও হতে পারে সে হয়তো মনের কোন ব্যথা চাপতে গিয়ে নিজেকে জোবাইদার হত্যাকারী বলে প্রমাণ করছে। আসলে সে-ই হত্যাকারী কিনা এর নিগূঢ় প্রমাণ দরকার এবং সে প্রমাণ আজ রাতেই তাকে সংগ্রহ করতে হবে।

বনহুরের সম্মুখে আজ সারাটা দিন কেউ আসতে সাহসী হয়নি একমাত্র রহমান ছাড়া। বনহুর আজ রহমানকেও এড়িয়ে চলেছে, বেশিক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলেনি সে!

দিন গিয়ে এক সময় রাত হয়ে এলো।

আস্তানায় সূর্যালো প্রবেশের কৌশলে ব্যবস্থা করছিলো সূর্যের আলো নিভে যেতেই আস্তানার আললাগুলি জ্বলে উঠলো– মশালের আলো।

কিন্তু বনহুর আজ আদেশ দিলো সব আলো নিভিয়ে ফেলতে। রহমান স্বয়ং এ আদেশ প্রচার করলে আস্তানার মধ্যে। বনহুরের আস্তানায় আলো নিভিয়ে ফেলার আদেশ এই সর্ব প্রথম।

বনহুরের অনুচরগণ সকলেই অবাক হলো, এমন অদ্ভুত আদেশের জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিলো না।

এমন কি আস্তানার কারাকক্ষগুলিও আজ অন্ধকার।

রাত বেড়ে আসছে।

বনহুরের কক্ষে দেয়াল ঘড়িটা টিক্ টিক্ করে বেজে চলছে। শয্যায় শয়ন করে ঘড়িটার শব্দ শুনছিলো বনহুর।

রাত যখন তিনটা বাজলো, সমস্ত আস্তানা যখন সুপ্তির কোলে ঢলে পড়ছে, বনহুর শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো। শরীরে তার জমকালো পোশাক পরাই ছিলো।

রিভলভারটা হাতে তুলে নিয়ে অগ্রসর হলো অতি সন্তর্পণে।

জমাট অন্ধকারে বনহুরের আস্তানা আজ অন্ধকার। বনহুর এগিয়ে চলেছে, চারিদিকে সর্তক দৃষ্টি রেখে অতি গোপনে যাচ্ছে সে–

বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে–ঠিক সেই সময় একটা লঘু পদশব্দ তার কানে এসে পৌঁছলো। অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে কেউ যেন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।

বনহুর চট করে একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করলো। স্পষ্ট দেখতে পেলো একটা ঝাপসা কালো মূর্তি মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।

বনহুর এই মুহূর্তে মূর্তিটাকে গ্রেপ্তার করতে পারতো কিন্তু তা না করে নিশ্চুপ অনুসরণ করলো ছায়ামূর্তিটাকে।

বনহুরের চোখ দুটি অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। দক্ষিণ হস্তে গুলী ভরা রিভলভার। ছায়ামূর্তিটিকে লক্ষ্য রেখে অগ্রসর হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে ছায়ামূর্তি আস্তানার দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর তার কালো আবরণে আচ্ছাদিত।

ছায়ামূর্তিটি এবার সোজা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বনহুর রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রতিক্ষা করছে। হঠাৎ যেন অদৃশ্য হয়ে গেলো ছায়ামূর্তিটা।

বনহুরও এবার সেই দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ালো। একটা হাসির রেখা তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো অন্ধকারে। বনহুরও অদৃশ্য হলো এবার দেয়ালের মধ্যে।

গহন বন।

ছায়ামূর্তি সন্তর্পণে বনের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগলো। ঝোপ ঝাড় ছাড়িয়ে চলেছে মূর্তিটা।

বনহুর বেশ কিছুটা দূরে ছায়ামূর্তির উপর লক্ষ্য রেখে এগুচ্ছে। কোন রকম যেন টের না পায় ছায়ামূর্তি সেদিকে বনহুরের সতর্ক লক্ষ্য আছে।

জোবাইদার কবরের দিকে এগিয়ে চলেছে ছায়ামূর্তি। বনহুরও সেইদিকে যাচ্ছে, লক্ষ্য তার ছায়ামূর্তি।

ছায়ামূর্তি জোবাইদার কবরের পাশে থমকে দাঁড়ালো। অন্ধকারে জায়গাটা কালো হয়ে উঠেছে, ছায়ামূর্তির শরীরের পোশাকও কালো থাকায় তাকে আর মোটেই দেখা যাচ্ছে না।

বনহুর জোবাইদার কবরের অতি নিকটে একটা গাছের গুঁড়ির আড়ারে লুকিয়ে পড়লো। সেখান থেকে ছায়ামূর্তিটাকে দেখা না গেলেও তার গতিবিধি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ কোন শব্দই শোনা গেলো না। বনহুর কান পেতে প্রতিক্ষা করছে–এবার শোনা গেলো একটা চাপা কান্নার আওয়াজ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ যেন।

বনহুর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো আজ সে আবিষ্কার করবে জোবাইদার প্রেত আত্মার আসল পরিচয়। তার সঙ্গে প্রমাণ করবে কে জোবাইদার সত্যিকারের হত্যাকারী। নাসরিনই জোবাইদাকে হত্যা করেছে কিনা জানতে চায় বনহুর।

অনেকক্ষণ কেটে গেলো, ছায়ামূর্তি এবার কবরের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো বলে মনে হলো বনহুরের। ফিরে চললো আবার যে পথে এসেছিলো সেই পথে।

আবার আস্তানায় প্রবেশ করে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কিছু চিন্তা করলো ছায়ামূর্তি এবার সে অগ্রসর হলো নাসরিনের কারাকক্ষের দিকে।

বনহুরও এবার তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে লাগলো। ছায়ামূর্তি সোজা নাসরিনের কারাকক্ষের পাশে এসে দাঁড়ালো।

বনহুর চট করে একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে লুকিয়ে পড়লো।

ঠিক সেই সময় আর একজন অতি সতর্কতার সঙ্গে এসে দাঁড়ালো অন্য একটি থামের আড়ালে।

অজানিত এই লোকটি বনহুর আর ছায়ামূর্তিটাকে সর্বপ্রথম হতেই ফলো করে আসছিলো। তার শরীরেও জমকালো পোশাক– অন্ধকারে তাকে যেন কেউ দেখে না ফেলে সেদিকে তার অত্যন্ত সতর্কতা ছিলো।

নাসরিনের কারাকক্ষের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছায়ামূর্তি ফিস ফিস করে ডাকলো–নাসরিন– নাসরিন–,

চমকে উঠলো বনহুর–এ কণ্ঠস্বর তার যে অতি পরিচিত।

আর চমকে উঠলো ঐ অজ্ঞাত লোকটি।

বনহুর সজাগ হয়ে দাঁড়ালো সে জানে না আর একজন তাদের দু’জনাকেই প্রথম থেকে লক্ষ্য করে আসছে।

এবার শোনা গেলো ব্যথাকরুণ গলায় আওয়াজ–আমাকে ক্ষমা করো নাসরিন, আমাকে ক্ষমা করো, যে পাপ আমি করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে।

নাসরিনের গলার আওয়াজ শোনা গেলো–তা হয় না, সবাই জানে, আমিই জোবাইদার হত্যাকারী, কাজেই–

চুপ। আর ও কথা বলো না। নাসরিন আমার এ বেঁচে থাকার চেয়ে না থাকাই শ্রেয়। কি হবে এ দুর্বিসহ জীবন বয়ে? ছায়ামূর্তি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

এবার নাসরিনের কণ্ঠ–তোমার যদি দুর্বিসহ জীবন হয় তাহলে আমারই বা কি লাভ বেঁচে থেকে বলো। বরং তুমি বেঁচে থাকলে–

না না, তা হয় না নাসরিন তা হয়না। আমি জোবাইদার হত্যাকারী–ভোরে আমারই মৃত্যুদন্ড হবে,তোমার নয়।

ছায়ামূর্তি কথাটা শেষ করে দ্রুত চলে যাচ্ছিলো।

কারাকক্ষ ছেড়ে কিছুদূর অগ্রসর হতেই বনহুর ছায়ামূর্তির সম্মুখে এসে দাঁড়ালো দৃঢ় মুষ্ঠিতে চেপে ধরলো ছায়ামূর্তির একটি হাতজোবাইদাকে তুমিই তাহলে হত্যা করেছিলে?

ছায়ামূর্তি এতোটুকু চমকালো না, বললো–হাঁ আমিই জোবাইদাকে হত্যা করেছি।

কি অপরাধ করেছিলো সে তোমার?

জানি না।

বলতে হবে তোমাকে।

আমি কোন কথা বলবো না।

কাল ভোরে তোমাকে গুলী করে হত্যা করা হবে।

বেশ, আমি তাই চাই।

ছায়ামূর্তি এবার এক ঝটকায় বনহুরের হাতের মুঠা থেকে হাত খানা ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।

বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর ফিরে চললো নিজের কক্ষের দিকে। জোবাইদার প্রেত আত্মা ভেবে আস্তানার লোকেরা যে ছায়ামূর্তিটি সন্দেহ করে এসেছিলো, বনহুর আজ তার আসল পরিচয় পেয়েছে। আরও জানতে পেরেছে নাসরিন জোবাইদার হত্যাকারিণী নয়।

বনহুর জানতো, কে এই নর হত্যাকারী তবু সে আসল হত্যাকারী উদ্ঘাটনের জন্য উন্মুখ ছিলো।

এবার তার সব সন্দেহের অবসান হয়েছে কিন্তু এতে তার চিন্তাধারা লাঘব হলো না বরং আরও বেড়ে গেলো চরম আকারে। নিজ কক্ষে প্রবেশ করে হস্তস্থিত রিভলভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো টেবিলে। গভীর একটা দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো তার মুখমন্ডলে।

ক্ষিপ্তের ন্যায় পায়চারী করছে বনহুর।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলো রহমান।

বনহুর পদশব্দে চমকে উঠলো, এই বুঝি সে জীবনে সর্বপ্রথম আচমকা চমকে উঠলো। ফিরে তাকাতেই দেখলো-রহমান দাঁড়িয়ে আছে নত মস্তকে।

বনহুর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কিছু ভাবলো, তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে ডাকলো –রহমান।

সর্দার।

তুমি এসেছো ভালই হলো, একটা কথা আছে তোমার সঙ্গে এসো রহমান!

রহমান বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো।

 বনহুর আবার পায়চারী করতে শুরু করলো। কিছু যেন বলতে চায় কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছে না সে।

রহমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষা করতে লাগলো। তার মুখ ভাবও বেশ গম্ভীর ভাবাপন্ন।

বনহুর পায়চারী বন্ধ করে রহমানের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। কিছু বলতে গেলো কিন্তু পারলো না।

রহমান বলে উঠলো–সর্দার, আমি জানি আপনি কি বলতে চান।

 রহমান। অস্ফুট শব্দ করে উঠলো বনহুর।

 হাঁ সর্দার আমি সব শুনেছি।

 শুনেছো! শুনেছো রহমান? বলো এখন উপায়?

 সর্দার কাল ভোরে নাসরিনের মৃত্যুদন্ড—

হবে না! রহমানের কথা মাঝখানে বলে উঠলো বনহুর।

 তাহলে?

আমি সেই কথাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি রহমান। নাসরিনের মৃত্যুদন্ডাদেশ বাতিল করতে হবে।

কিন্তু–

দোষীকে শাস্তি দেওয়াই আমার কাজ। রহমান, জোবাইদার হত্যাকারী কি নিশ্চয়ই জানতে পেরেছো।

হাঁ সর্দার; কিন্তু কি করে তাকে আপনি—

বনহুর কাউকে ক্ষমা করে না, নিজের পিতাকেও না।

তাহলে কি আপনি–?

 হাঁ, জোবাইদার হত্যাকারীকে উচিৎ সাজা পেতে হবে।

 সর্দার।

 কিন্তু কোন উপায় নেই।

সর্দার, ওর বদলে আমাকে মৃত্যুদন্ড দিন, আমিই প্রকাশ্য দরবারে নিজকে জোবাইদার হত্যাকারী বলে প্রমাণ করবো।

তা হয় না রহমান, বনহুর কোনদিন মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না। তুমি যাও, কাল জোবাইদার হত্যাকারী প্রেত আত্মাবেশী নূরীর মৃত্যুদন্ড হবেই।

সর্দার–রহমান বনহুরের পা দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। নূরীকে মাফ করে দিন সর্দার।

যে অপরাধ সে করেছে তার মাফ নেই।

সর্দার! সর্দার, কেউ জানে না নূরী জোবাইদার হত্যাকারী।

কিন্তু আমি জানি, আমি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ পেয়েছি। জোবাইদাকে হত্যা করে সে ভুল করেছে।

সেই মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করে নূরী, দৃঢ়কণ্ঠে বলে–না, আমি ভুল করিনি। জোবাইদাকে হত্যা না করলে সেই দন্ডে সে হত্যা করতো বনহুরকে।

রহমান বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠলো–সরদারকে সে হত্যা করতো? বলো কি নূরী?

 হাঁ, জোবাইদা তোমাদের সর্দারকে খুন করতো।

বনহুর অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো–তাই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছো?

হাঁ, আমি সব সহ্য করতে পারবো, কিন্তু তোমাকে কেউ হত্যা করবে, এ আমি সহ্য করতে পারবো না। জোবাইদার হত্যাকারী আমি–আমাকে তুমি মৃত্যুদন্ড দাও কোন দুঃখ নেই।

তাই হবে কাল ভোরে তোমাকে হত্যা করা হবে। গম্ভীর কণ্ঠে বললো বনহুর।

রহমান বলে উঠলো–সর্দার!

 যাও, তোমরা আমাকে বিরক্ত করো না।

রহমান মাথা নত করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো।

নূরীও বেরিয়ে গেলো পরক্ষণে।

*

মনি অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

পাশে এসে দাঁড়ালো নূরী, চোখে তার অশ্রুর বন্যা বয়ে চলেছে। কাল ভোরে তার মৃত্যুদন্ড। মরণে নূরীর এতোটুকু বেদনা বা দুঃখ নেই। দুঃখ মনিকে ছেড়ে যেতে হবে তাই–

জোবাইদাকে হত্যা করার পর নিজকে সে বাঁচাতে চেয়েছিলো। তাই সেদিন নাসরিনের ম্লান। মুকের দিকে তাকিয়েও নূরী নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করেনি। কিন্তু নিজের মনের কাছে সে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলো না। রাত হলেই জোবাইদার আত্মা যেন তার গলা টিপে ধরতে আসতো নূরী আতঙ্কে শিউরে উঠতো কিছুতেই স্থির থাকতে পারতো না। অন্ধকারে আত্মগোপন করে বেরিয়ে পড়তো। আস্তানার বাইরে যাবার গোপন দ্বার যা কারো জানা ছিলো না সেই দ্বারের সন্ধান জানতে পেরেছিলো নূরী। বনহুর যেদিন জোবাইদাকে বলেছিলো “আমাকে হত্যা করার পর ঐ পথে পালিয়ে যাবে, কেউ তোমার সন্ধান পাবে না।” তখন নূরী আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছিলো বনহুরের উক্তিটা।

সেই পথেই নূরী আস্তানার বাইরে যাওয়া-আসা করতো শরীরে থাকতো তার জমকালো ড্রেস। জোবাইদার কবরের পাশে যেতো এবং মনের বেদনা লাঘব করার জন্য রোদন করতো সে। কখনও বা যেতো নাসরিনের কারাকক্ষের পাশে। নাসরিনের মৃত্যুদন্ডাদেশ তাকে উন্মাদ করে তুলেছিলো। জোবাইদাকে সে হত্যা করেছে আবার তার জন্যই নির্দোষ নাসরিনের মৃত্যু ঘটবে, ভাবতেই নূরীর বুকের মধ্যে তুফান বয়ে যেতো। নূরী আস্তানার মধ্যে অস্থিরভাবে চলাফেরা করতো। সবাই তাকে দেখেছিলো সন্দেহ করেছিলো ছায়ামূর্তি অন্য কেউ নয়, জোবাইদার প্রেত আত্মা।

আজ বনহুর ছায়ামূর্তির আসল পরিচয় জানতে পেরেছিলো। জানতে পেরেছিলো কে এই জোবাইদার প্রেত আত্মাবেশী ছদ্মবেশিনী। বনহুরের প্রথমেই সন্দেহ জেগেছিলো, সন্দেহ তার সত্যে পরিণত হলো।

নূরী মনিকে বুকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। এই রাতটুকুই তার জীবনের শেষ সময় কাল ভোরে নাসরিনের মুক্তি হবে আর তার হবে মৃত্যু।

নীরবে অশ্রু বর্ষণ করে চলেছে নূরী।

এমন সময় দরজায় মৃদু আঘাতের শব্দ হলো, সঙ্গে সঙ্গে চাপা কণ্ঠস্বর নূরী—

নূরী উঠে দাঁড়ালো দরজা খুলে দিতেই অবাক হলো–রহমান দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

নূরীকে দেখেই রহমান ব্যস্তভাবে বললো–শীগগীর তৈরি হয়ে নাও নূরী এক্ষুণি পালাতে হবে।

অবাক কণ্ঠে বললো নূরী –এ তুমি কি বলছো রহমান?

 আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করো না–

না না, আমি পালাতে পারবো না। রহমান নূরী মৃত্যু ভয়ে ভীত নয় জেনো।

 নূরী, আমি তোমাকে মরতে দেবো না।

 তা হয় না রহমান।

 তোমাকে বাঁচতে হবে নূরী, তোমাকে বাঁচতে হবে।

তুমি আমাকে ভালবাসো জানি, সেই কারণেই তুমি আমার মৃত্যুদন্ড সহ্য করতে পারবেনা, এই তো?

না, তা নয় নূরী। আমি তোমাকে ভালবাসি সত্য কিন্তু তার চেয়ে তোমাকে বেশি ভালবাসেন আমাদের সর্দার, তোমাকে– তোমাকে বাদ দিয়ে তিনি বাঁচতে পারেন না।

রহমান! অস্ফুট শব্দ করে উঠলো নূরী।

রহমান বললো আবার–আইনের কাছে সর্দার কাউকে ক্ষমা করেন না, করতে পারেন না। তাই–তাই তিনি তোমার প্রতি–কিন্তু জানো নূরী, সর্দারের হৃদয়ে আজ কি মর্মবেদনা শুরু হয়েছে? অসহ্য যন্ত্রণা তার অন্তরকে দগ্ধীভূত করে চলেছে।

আমি সব জানি সব বুঝি নূরী। সর্দার কাল ভোরে তোমার মৃত্যুদন্ড দেবেন সত্য কিন্তু তার জীবনের একটা অংশ খসে যাবে সেই দন্ডে। নূরী সর্দার তোমার মৃত্যু সহ্য করতে পারবে না। আমি জানি তুমি তার কতখানি প্রিয়।

রহমান এসব তুমি কেনো আমাকে শোনাচ্ছো?

যেমন করে হোক তোমাকে বাঁচতে হবে। তোমার মৃত্যু শুধু মনিকেই মাতৃহারা করবে না, সমস্ত আস্তানায় বিষাদের কালিমা লেপন করে দেবে। নূরী, সর্দার ভেঙে পড়বে তোমার অদর্শনে

রহমান–রহমান—

 নূরী সময় বেশি নেই, তৈরি হয়ে নাও।

 কিন্তু—

আর কিন্তু নয়।

 নাসরিন মৃত্যু! বিনা দোষে নাসরিনের মৃত্যু হবে–এই তুমি চাও?

না। নাসরিনের মৃত্যুদন্ড হবে না। আমি একটা চিঠিতে সব লিখেছি এবং কায়েসকে সব খুলে বলেছি। কাল ভোরে প্রকাশ্য দরবারে সে ঐ চিঠি পাঠ করে সবাইকে জানিয়ে দেবে– নাসরিন জোবাইদার হত্যাকারী নয়। সর্দার নিশ্চয়ই ক্রুদ্ধ হবেন তোমাকে আর আমাকে না দেখে। নূরী, এখন আমরা বহুদূরে চলে যাবো, কান্দাই সীমানা পার হয়ে আর এক রাজ্যে।

এটা কি ভাল হবে রহমান?

আমি জানি ভাল হবে, তুমি বাঁচতে না চাইলেও তোমাকে বাঁচতে হবে নূরী—

আর মনি? মনিকে ছেড়ে আমি বাঁচতে পারবো?

 মনিও থাকবে আমার সঙ্গে।

 রহমান!

 চলো নূরী আর বিলম্ব করো না।

 নূরী ঘুমন্ত মনিকে কোলে তুলে নিলো–চলো।

 রহমান নূরীর কোলে থেকে মনিকে নিজের কোলে নিয়ে অন্ধকারে অগ্রসর হলো।

 রহমান কায়েসকে সব কথা বলেছিলো।

আস্তানার বাইরে কায়েস অশ্ব দুলকী ও আরও একটি অশ্ব নিয়ে অপেক্ষা করছিলো।

রহমান নূরী ও মনিসহ এসে দাঁড়ালো কায়েস এবং অশ্ব দুইটির পাশে।

মনি জেগে উঠেছিলো বললো–আমাকে নিয়ে তোমরা কোথায় যাচ্ছো আম্মি?

নূরী বললো–অনেক দূরে–পরে শুনো। এখন চুপ করে থাকো বাবা।

রহমান মনিসহ উঠে বসলো দুকীর পিঠে। আর নূরী অপর অশ্বটির পিঠে।

কায়েস অশ্রুভরা নয়নে, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো–আবার কবে দেখা হবে?

রহমান বললো- জানিনা।

নূরী বললো–কায়েস, আমার বনহুর রইলো ওকে দেখো।

কায়েস বললো–আমরা থাকতে সর্দারের জন্যে চিন্তা করোনা নূরী। খোদ হাফেজ। বললো নূরী।

অশ্ব দুটি তখন ছুটতে শুরু করেছে।

রহমান আর নূরীর অশ্ব অদৃশ্য হতেই কায়েস ফিরে চললো। আজ থেকে রহমানের সমস্ত কাজ তারই করতে হবে। সব দায়িত্ব এখন কায়েসের।

রহমান জানতো তার অবর্তমানে একমাত্র কায়েস ছাড়া কেউ তার কার্যভার গ্রহণ করতে সক্ষম হবে না। রহমান তাই কায়েসকেই বিশ্বাস করে সব কথা বলেছিলো, আর একটা চিঠি সে লিখে রেখে গিয়েছিলো বনহুরের কাছে।

*

বনহুর দরবার কক্ষে এসে পৌঁছলো, তার মুখমন্ডল গম্ভীর ভাবাপন্ন।

সবাই তখন দরবার কক্ষে এসে জমায়েত হয়েছে।

বনহুরের অনুচরগণের প্রত্যেকেরই মুখে আজ বিষাদের ছায়া। সকলেই নত মুখে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কোন কথা বলছে না। আজ নাসরিনের মৃত্যুদন্ড এ কথা জানে বলেই কারো মুখ। হাসি নেই। আস্তানায় সকলেই ভালবাসতো নাসরিনকে। তাই নাসরিনের মৃত্যুদন্ড কেউ খুশি মনে গ্রহণ করতে পারছিলো না।

জোবাইদাকে যে তারা ভালোবাসতো না তা নয়, কিন্তু যে গেছে আর সে ফিরে আসবে না– তাই বনহুরের অনুচরগণ চায় না নাসরিনের মৃত্যুদন্ড হয়।

কিন্তু সর্দারের আদেশ লঙ্ঘন হওয়ার উপায় নেই।

বনহুর তার সুউচ্চ আসনে উপবেশন করতেই কায়েস এসে দাঁড়ালো রহমানের স্থানে।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–রহমান কোথায়? ওকে দেখছি না কেনো?

কায়েস মাথা নত করে বললো– রহমান কোথায় জানি না, তবে এই চিঠিখানা তার কক্ষে পেয়েছি।

চিঠি!

হাঁ সর্দার।

রহমান কায়েসের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো, তারপর আরও দু’তিনবার পড়লো সে চিঠিখানা।

বনহুরের মুখভাব ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছিলো লক্ষ্য করছিলো তার অনুচরগণ। সবাই বুঝতে পারলো–ঐ চিঠিখানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিঠি।

বনহুর এবার কায়েসকে লক্ষ্য করে বললো– দরবার কক্ষে নাসরিনকে নিয়ে আসার আদেশ দাও।

কায়েস ইংগিৎ করতেই দুইজন অনুচর বেরিয়ে গেলো।

অল্পক্ষণ পরে ফিরে এলো তারা নাসরিন সহ।

এখনও নাসরিনের হাত ও কোমরে দড়ি বাঁধা রয়েছে।

 বনহুরের সম্মুখে নত মস্তকে দাঁড়ালো দড়ি বাধা রয়েছে।

বনহুরের সম্মুখে নত মস্তকে দাঁড়ালো নাসরিন। মুখভাব করুণ ব্যথা ভরা; সারা রাত্রি তার ঘুম হয়নি। মুখ শুকনো, চোখ দুটি জবা ফুলের মত লাল টকটকে হয়ে উঠেছে।

দরবার কক্ষস্থ সকলে একবার বেদনা ভরা চোখে হস্ত-পদ বন্ধন অবস্থায় নাসরিনের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো। সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতিক্ষা করছে–এবার সর্দার নাসরিনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেবেন।

দরবার কক্ষে একটু কোন শব্দ হচ্ছে না। সবাই স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মত।

বনহুর চিঠিখানায় আর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললো– জোবাইদার হত্যাকারী সন্দেহে নাসরিনের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিলো, কিন্তু নাসরিন জোবাইদার হত্যাকারী নয়।

কক্ষমধ্যে একটা মৃদু আনন্দধ্বনি হলো।

বনহুরের মুখের পানে তাকালো নাসরিন তার চোখ দুটো যেন জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।

বনহুর বললো আবার–নাসরিনকে মুক্ত করে দাও।

কয়েস নিজ হস্তে নাসরিনের হাত এবং কোমরের বন্ধন মুক্ত করে দিলো।

নাসরিন ছুটে গিয়ে বনহুরের পা জড়িয়ে ধরলো-সর্দার।

 যাও নাসরিন তুমি মুক্ত।

সর্দার! নাসরিন কথাটা উচ্চারণ করে উঠে দাঁড়ালো।

 দরবার কক্ষে সকলেরই মুখের ভাব প্রসন্ন হলো।

 মাহবুব বলে উঠলো–সর্দার তাহলে জোবাইদাকে কে হত্যা করেছে আমরা জানতে চাই?

একটু পরেই জানতে পারবে। কায়েস তুমি এই চিঠিখানা পড়ে এদের শুনিয়ে দাও।

 কায়েস বনহুরের হাত থেকে রহমানের লিখিত চিঠিখানা নিয়ে পড়তে শুরু করলো—

“সর্দার, জোবাইদার হত্যাকারীর সন্ধান আমি পেয়েছি। নাসরিন সম্পূর্ণ নির্দোষ, জোবাইদার হত্যাকারী সে নয়। আজ কিছু দিন যাবৎ আস্তানায় যে প্রেত আত্মার আবির্ভাব

ঘটেছিলো, আসলে সেই ছিলো জোবাইদার হত্যাকারী। আজ রাতে আমি তাকে গ্রেপ্তার করেছিলাম এবং প্রেত আত্মাবেশী ছায়ামূর্তির আসল পরিচয় আমি পেয়েছি সে হচ্ছে নূরী। নূরীই জোবাইদার হত্যাকারিণী। জানি নূরী অপরাধী এবং তার উচিৎ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কিন্তু আমি তাকে মরতে দিতে পারি না। তাই সর্দারের বিনা অনুমতিতে আমি নূরী আর মনিকে নিয়ে দূরে চলে গেলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। হয়তো জীবনে আর ফিরে আসবো কিনা। তাও জানি না।

সর্দার, আমাকে ক্ষমা করবেন। নূরীর কোন দোষ নেই, সে মরণে ভয় করে না। আমি তাকে জোরপূর্বক নিয়ে গেলাম। মনির জন্য চিন্তা নেই, ওকে আমি মানুষ করবো।

–আপনার বিশ্বস্ত অনুচর
রহমান”

 কায়েস চিঠি পড়া শেষ করলো।

 কক্ষমধ্যে একটা সঁচ পড়ার শব্দও শোনা যাবে না। বনহুর স্থিরভাবে বসেছিলো তার আসনে। মুখভাব অত্যন্ত গম্ভীর কঠিন। চোখ দুটো আগুনের ভাটার মত জ্বলছে।

এবার বনহুর উঠে দাঁড়ালো দৃঢ় কণ্ঠে বললো– তোমরা নিশ্চয়ই সব বুঝতে পেরেছে। রহমান নিজের পায়ে নিজে কুঠারাঘাত করেছে। নূরী দোষী জেনেও তাকে সে রক্ষার জন্য এক অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করেছে। রহমানকে এর জন্য কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে–

কায়েস বলে উঠলো–সর্দার, রহমান যা করেছে তা অতি মহান কাজ। আমরা সবাই তার হয়ে ক্ষমা চাইছি।

ক্ষমা!

হাঁ সর্দার, আমরা সবাই রহমানের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাই। এক সঙ্গে বলে উঠলো সকলে।

বনহুর পূর্বের ন্যায় হুঙ্কার ছাড়লো আমার আদেশ–তোমরা রহমান আর নূরীকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করো। নিয়মের ব্যতিক্রম করা বনহুরের স্বভাব নয়। যাও, আজ তোমাদের ছুটি।

বনহুরের অনুচরগণ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।

তারা জানে সর্দার ক্রুদ্ধ হয়ে কোনদিন তাদের ছুটি দেন না, আজ তার পরিবর্তন লক্ষ্য করে খুশি হলো সবাই।

অল্পক্ষণে দরবার কক্ষ ফাঁকা হয়ে গেলো।

 নাসরিনও বেরিয়ে গেলো ধীর পদক্ষেপে।

কায়েস এবার বললো–সর্দার, রহমান অপরাধী হতে পারে, কিন্তু তার হৃদয় বড়ই উন্নত। তাকে ক্ষমা করে দিন সর্দার।

বার বার এক অনুরোধ আমাকে করো না কায়েস! এই দন্ডে আমি তোমাকে হত্যা করার আদেশ দিতাম, কারণ তুমি ও রহমান ও নূরীকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।

সর্দার!

আমার কাছে গোপন করার চেষ্টা করো না কায়েস।

কায়েস আর কোন কথা বলতে পারলোনা। সর্দারের মুখের উপর মিথ্যা বলার সাহস হলো তার।

বনহুর বললো–কায়েস, জানো আমি কোন দিন অপরাধীকে ক্ষমা করিনা। রহমান আর নূরীকে পালানোর সুযোগ দিয়ে তুমি ভুল করেছে। যত শীঘ্র পারো রহমান আর নূরীকে খুঁজে বের করে আমার সম্মুখে হাজির করো। যাও–

সর্দার আমি জানি না তারা কোথায় গেছে।

 জানোনা আবার মিথ্যা কথা?

সর্দার, আমি শপথ করে বলছি–তারা কোথায় গেছে জানিনা। কান্দাই শহরে তারা নেইএটুকুই শুধু জানি।

বনহুর কিছু চিন্তা করলো, তারপর বললো –যাও, দাইমাকে কারাকক্ষ থেকে বের করে দাও।

আচ্ছা সর্দার।

 বেরিয়ে যায় বনহুর।

কায়েস নত মস্তকে অনুসরণ করলো সর্দারকে।

 বনহুর বেরিয়ে এলো দরবার কক্ষ থেকে।

এই মুহূর্তে তাকে যেতে হবে কান্দাই রাজধানীতে। মনিরার চোখের পট্টি আজ খুলে দেওয়ার তারিখ, কিন্তু বনহুরের মনের অবস্থা আজ অত্যন্ত খারাপ। কেননা তা সে নিজেই জানেনা।

কায়েসকে বললো বনহুর-কায়েস, তাজকে প্রস্তুত করতে হলো আমাকে যেতে হবে।

 এখনই কি বাইরে যাবেন সর্দার?

হাঁ।

কায়েস চলে গেলো।

 বনহুর এগুলো নিজের কক্ষে।

স্বাভাবিক ড্রেসে বনহুরের শহরে যাওয়া সম্ভব নয়, রাতের অন্ধকারেই সে শহরে যেতো। আজ তার ব্যতিক্রম ঘটলো। বনহুর যখন ড্রেসিংরুম থেকে বের হলো তখন তার দেহে সম্পূর্ণ ডাক্তারী ড্রেস। চোখে চশমা, গলার সঙ্গে লটকানো স্ট্যাথিসস্কোপ।

বনহুর কায়েসের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করলো, তারপর বেরিয়ে গেলো আস্তানা থেকে।

মস্ত শহর আরাকান।

বিচিত্র শহরে বৈচিত্রময় মানুষ। অদ্ভুত তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, অদ্ভুত তাদের কথাবার্তা আর চাল-চলন। শহরে দোকান-পাট এবং দালান-কোঠাগুলিও অন্যান্য দেশের চেয়ে ভিন্ন। রকমের। পথ-ঘাট-গুলিও সম্পূর্ণ আলাদা।

অজানা অচেনা দেশ আরাকান শহর।

রহমান নূরী আর মনি সহ এই শহরে এসে উপস্থিত হলো। কান্দাই শহর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এই শহর। এখানে কেউ চেনেনা রহমান নূরী আর মনিকে।

একটা গাছের তলায় নেমে দাঁড়ালো ওরা তিন জনা। ক্ষুধায় পিপাসায় অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়েছিলো নূরী আর মনি। বিশেষ করে মনির জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো রহমান।

সারাটা রাত্রি আর গোটা একটা দিন মিলে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে তারা এই আরাকান শহরে এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে।

নূরী বললো–আর যেতে পারব না, কণ্ঠনালা আমার শুকিয়ে এসেছে। আর মনির অবস্থা দেখছো?

রহমান মনিকে কোলে নিয়ে রুমালে তার কপালের ঘাম মুছে দিচ্ছিলো, বললো–নূরী, তুমি ভেবোনা, এই আরাকান শহরেই আমরা থাকবো। কান্দাই শহর হতে এ শহর অনেক বড়। এখানে নানা দেশের মানুষ বাস করে। আমরা তাদের মধ্যে আত্মগোপন করে জীবন কাটিয়ে দেবো। নূরী, দস্যুতা আমি করবো না, সৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করাই আমার কাজ। আর মনিকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করাই হবে আমার জীবনের ধর্ম।

নূরীর চোখে মুখে ফুটে উঠে এক দীপ্তভাব, বলে সে–হাঁ আমিও তাই চাই রহমান। দস্যু দুহিতা আমি, কিন্তু দস্যুতাকে আমি এখন ঘৃণা করি।

রহমান অস্ফুট আনন্দধনি করে উঠে নূরী। নূরী সত্যি তুমি এ কথা বলছো?

 হাঁ সত্যি।

রহমান আর নূরীর যখন কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন মনি নীরবে অশ্রু বর্ষণ করছিলো।

রহমান বললো–মনি কেঁদো না বাবা, আমি তোমার জন্য এক্ষুণি খাবার নিয়ে আসছি।

মনি বলে উঠলো–আমি বাপির কাছে যাবো। আমার ক্ষুধা পায়নি।

 মনির কথায় অবাক হলো রহমান।

নূরীর চোখ দুটো অশ্রু ছলছল হলো বললো–তোমার বাপি আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে মনি, আর তার কাছে যাওয়া হবে না।

না, আমি বাপির কাছে যাবো।

রহমান আর নূরী অনেক করে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো।

আশ্চর্য হলো নূরী বনহুরের প্রতি মনির এতো অন্তরের টান হলো কি করে।

মনির কথায় নূরী আশ্চর্য হলেও রহমান বিস্মিত হলো না। সে জানে, মনি তার সর্দারকে? বনহুরের সঙ্গে যে মনির রক্তের সম্বন্ধ আছে তা এক রহমান আর কায়েস ছাড়া কেউ জানে না।

একটা হোটেল বাড়িতে আশ্রয় নিল ওরা।

রহমান টাঙ্গী চালায়।

সারাদিন পথচারী আরোহীদের নিয়ে ভাড়া খাটে রহমান ফিরে আসে সন্ধ্যায়। আসার পথে ময়দা আর মাংস নিয়ে আসে।

নূরী প্রতিক্ষা করে রহমানের।

হয়তো মনি ঘুমিয়ে পড়ে।

রহমানের কোনদিন ফিরতে বিলম্ব হয়, চিন্তায়, অস্থির হয়ে পড়ে নূরী, এতোক্ষণ ফিরে না আসারই বা কারণকি? ছোট্ট চালা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।

ঘর্মাক্ত কলেবরে রহমান এসে দাঁড়ায় নূরীর সম্মুখে। গামছায় কপালের ঘাম মুছে বলে– অনেক দূরে গিয়েছিলাম তারই বড্ড দেরী হয়ে গেলো। মনি ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি?

হাঁ, মনি ঘুমিয়ে পড়েছে।

রহমান জামার পকেট থেকে একটা লাল রঙএর জামা বের করে বললো–মনির জন্য এনেছি।

কি দরকার ছিলো এখনই জামার?

 একটিমাত্র জামা ওর সম্বল সব তো ছেড়ে এসেছো–তাই নিলাম।

নূরী রহমানের হাত থেকে জামাটা নিয়ে বললো–চলো খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে।

চলো নূরী।

রহমানকে খেতে দিয়ে নূরী পাশে বসে থাকে গল্প করে কত দূরে গিয়েছিলো, কোথায় গিয়েছিলো–সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলে সে।

রহমান খেতে খেতে নূরীর কথার জবাব দেয়।

রহমানের খাওয়া শেষ হলে শুয়ে পড়ে সে। ওদিকের দড়ির খাটিয়া খানায় রহমান শোয়। আর মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে শোয় নূরী আর মনি।

সারাদিনের পরিশ্রমের পর রহমান শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়ে।

মনিকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে নূরীও চোখ বন্ধ করে কিন্তু ঘুম তার চোখে আসে না, নানা চিন্তার উদয় হয় তার মনের মধ্যে। রহমান তাকে বাঁচানোর জন্যই আজ সব কিছু ত্যাগ করে। নিঃসম্বলভাবে বেরিয়ে এসেছে। শুধু তার জীবন রক্ষার জন্যই আজ সে সব ত্যাগ করেছে, কিন্তু কি লাভ এতে রহমানের। রহমান নূরীকে গভীরভাবে ভালোবাসে, সমস্ত অন্তর দিয়ে নূরীকে কামনা করে সে, একথা জানে-বুঝে নূরী। তবু নূরী কোন দিন রহমানকে ধরা দেবে না দিতে পারে না। ছোট বেলায় জ্ঞান হাবার পর সে একজনকেই ভালবেসেছে– সে হলো বনহুর। তার। মন প্রাণ জীবন সমর্পণ করেছে ওর কাছে। নূরী যত দূরেই সরে যাক তবু ভুলতে পারবে না কোন দিন তাকে।

বনহুর তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো–কিন্তু তার কি অপরাধ? আইনের চোখে সত্যই সে অপরাধী নরহত্যাকারী, বিচারের মৃত্যুদন্ডই তার প্রাপ্য।

বনহুরকে সে কোন সময় দোষ দিতে পারে না নিয়মের ব্যতিক্রম করা তার কাজ নয়। নিয়ম মেনে চলাই দস্যু বনহুরের কাজ।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নূরী, হঠাৎ একটা নিশ্বাসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো তার। চোখ মেলে। তাকাতেই বিস্ময়ে থ’ মেরে গেলো, রহমান বসে আছে তার শিয়রে নিৰ্ণিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে।

নূরী অস্ফুট কণ্ঠে বললো– তুমি।

রহমান সোজা হয়ে বসলো, শান্ত ধীরে কণ্ঠে বললো–নূরী, তোমাকে দেখছিলাম।

 রহমান আমি জানতাম তুমি আমাকে এনে যে কোন সময় একটা কিছু দাবি করে বসবে।

নূরী, তুমি ভুল বুঝছো, আমি তোমাকে শুধু দেখছিলাম, তোমাকে স্পর্শ করার সাহস আমার নেই।

না না, আমি তোমার এ দৃষ্টি সহ্য করতে পারবো না।

নূরী, আমি এতোই হতভাগ্য যে, তোমাকে একটু প্রাণ ভরে দেখতেও পাবো না।

তুমি জানো–আমি ভালোবাসিনা তা—

 নূরী, আমাকে মাফ করে দাও নূরী?

রহমান দু’হাতের মুঠোয় নিজের চুল চেপে ধরে। অধর দংশন করতে থাকে সে।

নূরী ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে–রহমান, আমি আর কোন দিন তোমাকে এ ভাবে দেখতে চাই না। যাও তুমি যাও ঘুমাও গে।

বেশ, আমি যাচ্ছি। নূরী, আমাকে ক্ষমা করো।

 রহমান কথাটা বলে উঠে নিজের বিছানায় চলে যায়।

 নূরী মনিকে বুকে টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শোয়।

রাত বেড়ে আসে।

*

মনিরার কক্ষে প্রবেশ করে তার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো ডক্টর জুলেখা আর বনহুর। বনহুরের শরীরেও ডাক্তারের ড্রেস।

মরিয়ম বেগম আর সরকার সাহেবও রয়েছে তাদের সঙ্গে।

মরিয়ম বেগম বললেন–মা, মনিরা তোমার বান্ধবী ডক্টর জুলেখা এসেছে, আর এসেছে ডক্টর কাওসার।

বনহুর ডক্টর কাওসারের বেশেই আজ এসেছিলো এখানে। তার মুখেছিলো ঘন চাপ দাড়ি আর চোখে কালো চশমা। নিখুঁত ছদ্মবেশ বনহুরের তাই তার জননীও তাকে চিনতে সক্ষম হয়নি।

ডক্টর জুলেখা মনিরার কাঁধে হাত রাখলো–মনিরা আজ তোমার চোখের পটি খুলে দেব? বলো, কাকে তুমি প্রথম দেখতে চাও?

মনিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো–যাকে দেখতে চাই তাকে তুমি কোথায় পাবে?

বলো আমি তাকে নিয়ে আসবো।

তাকে পাবে না।

আমি কথা দিচ্ছি–যাকে তুমি দেখতে চাও তাকেই তুমি প্রথম দেখতে পাবে।

বেশ, আমার স্বামীকে আমি দেখতে চাই। কিন্তু মনে রেখো, তাকে যদি না দেখতে পাই তাহলে–না না, তাহলে আমি দৃষ্টিশক্তি ফিরে চাইনা। অন্ধ আছি তাই আমি ভাল আছি– জুলেখা তাই আমি ভাল আছি।

মনিরা আমার সমস্ত পরিশ্রম পন্ড করে দিও না। সরে এসো তোমার চোখের পট্টি খুলে দি। কথাটা বলে জুলেখা মনিরার চোখের পট্টি খুলতে গেলো।

মনিরা জুলেখার হাত মুঠায় চেপে ধরলো– সে আজ আসবে। তুমি অপেক্ষা করো। আমি প্রথম দৃষ্টি শক্তি লাভ করে তাকেই দেখতে চাই।

ডক্টর কাওসারের বেশে বনহুর এবার কথা বললো–মিসেস মনিরা, আপনি অযথা সময় নষ্ট করছেন?

মুহূর্তে মনিরার মুখমন্ডল দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। স্বামীর কণ্ঠস্বর তার অন্তরে মধু বর্ষণ করলো যেন। চোখে না দেখলেও বুঝতে পারলো সে, কণ্ঠস্বর তার স্বামীর ছাড়া আর কারো নয়।

বললো এবার মনিরা–দাও জুলেখা আমার চোখের পট্টি খুলে দাও।

জুলেখার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হলো।

মরিয়ম বেগম বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন, তিনিও আশ্বস্ত হলেন।

সরকার সাহেব খুশি ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন আজ মনিরার চোখের পট্টি খুলে দেওয়া হবে, আবার দেখতে পাবে মনিরা–একি কম খুশির কথা!

ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্য সবাই এসে দাঁড়িয়েছে কক্ষ মধ্যে।

 নকীবও দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে।

 ডক্টর জুলেখা মনিরার চোখের পট্টি খোলায় ব্যস্ত।

ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে বনহুর মনিরার দিকে। আজ কিছুক্ষণ পূর্বেই সে শহরে এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। তাজের কৃতিত্বেই সে এত দূরের পথ আসতে পেরেছে।

বনহুর মনিরার ঠিক সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলো।

 মরিয়ম বেগম ও সরকার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন পাশে।

জুলেখা মনিরার চোখের পট্টি খোলা শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ স্থির নয়নে। তাকিয়ে থেকে বললো সে–চোখ মেলো মনিরা।

মনিরা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো।

সমস্ত দুনিয়াটা ঝাপসা লাগছে তার চোখে। কেমন ঘোলাটে সব! মনিরার চোখের সামনে একটি আলো জ্বেলে দিলো জুলেখা উজ্জ্বল আলো।

মনিরা এবার দেখলো তার সম্মুখে একটি অপরিচিত মুখ। মুখটা ওর কালো হয়ে উঠলো, অস্ফুট কণ্ঠে বললো না না, আমি এ দৃষ্টিশক্তি চাই না। আমি এ দৃষ্টিশক্তি চাই না। আলো নিভিয়ে দাও জুলেখা আলো নিভিয়ে দাও!

জুলেখা বললো-মনিরা শান্ত হও। অমন উতলা হলে আবার অন্ধ হয়ে যাবে।

সেই ভাল ছিলাম জুলেখা সেই ভাল ছিলাম। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে কি লাভ হবে আমার? ওকে যদি না দেখতে পাই তাহলে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে কি হবে বলো? মনিরা দুই হাতের মধ্যে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

জুলেখা ইংগিতে কক্ষ থেকে সকলকে বেরিয়ে যেতে বললো।

মরিয়ম বেগম ও সরকার সাহেব বেরিয়ে গেলেন। অন্যান্য সবাইও কক্ষ থেকে চলে গেলো বাইরে।

বনহুর এবার নিজের দাঁড়ি গোঁফ আর চোখের কালো চশমাটা খুলে ফেললো।

জুলেখা বললো–মনিরা চোখ তোল মনিরা।

না না, আমি চোখ তুলবো না। তোমরা যাও জুলেখা, আমাকে বিরক্ত করোনা। তোমরা যাও–

কিন্তু মনে রেখো মনিরা আবার যদি তুমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে তাহলে নিজের ভুলের জন্য হারাবে। বেশ যেতে বলছো যাচ্ছি–

জুলেখা পাশের একটা থামের আড়ালে এসে দাঁড়ালো।

 বনহুর তার মুখমন্ডলে কোন রকম ছদ্মবেশের আড়ম্বর না রেখে পাশে এসে বসলো।

মনিরা তখন হাটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

বনহুর মনিরার চিবুক ধরে উঁচু করে তুললো, ডাকলো– মনিরা!

মনিরা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকালো, মুহূর্তে আনন্দে উজ্জল হয়ে উঠলো চোখ দুটো. দীপ্ত হয়ে উঠলো ওর। স্বামীর বুকে মাথা রেখে বললো–তুমি!

আড়ালে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করলো ডক্টর জুলেখা। মুখখানা বিষণ্ণ মলিন হলো একটা গভীর বেদনা অনুভব করলো সে অন্তরে। ধীরে ধীরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল সকলের অজ্ঞাতে।

বনহুর আর মনিরার মিলন দৃশ্য সে কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারছিলোনা। কারণ জুলেখা চরমভাবে ভালোবেসেছিলো একদিন বনহুরকে। সে ভালবাসার মধ্যে ছিলোনা কোন ছলনা। জুলেখা যদি জানতো যাকে সে এমন গভীরভাবে ভালবাসছে সে মনিরার স্বামী, তাহলে হয়তো। ওর সান্নিধ্য জুলেখার হৃদয়ে এতো আলোড়ন সৃষ্টি করতো না।

সকলের অলক্ষ্যে জুলেখা বেরিয়ে এলো বাইরে।

বারান্দায় দেখা হলো মরিয়ম বেগমের সংগে। তিনি জুলেখাকে বেরিয়ে যেতে দেখে বললেন –সে কি মা, অমন করে চলে যাচ্ছ কেনো?

মনিরার চোখ ভাল হয়ে গেছে, আমার আর কোন দরকার হবেনা, কাজেই আমি চলে যাচ্ছি।

কথাটা বলে জুলেখা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

মরিয়ম বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ জুলেখার চলে যাওয়া পথের দিকে। ভাবলেন, জুলেখা চলে গেলো কিন্তু ডক্টর কওসার সাহেব তো গেলেন না।

মরিয়ম বেগম কক্ষে প্রবেশ করে অবাক হলেন, কোথায় ডক্টর কাওসার–এ যে তার সন্তান মনির।

মরিয়ম বেগম কক্ষে প্রবেশ করতেই বনহুর এলো মায়ের পাশে, বললো মা।

মরিয়ম বেগম হাস্য উজ্জল মুখে বললেন–তাই তো আমি চমকে উঠেছিলাম কাওসার সাহেবের কণ্ঠস্বর শুনে কিন্তু সাহস হয়নি কিছু বলবার।

বনহুর বললো এবার–মা মনিরার দৃষ্টিশক্তি লাভের জন্য আমরা সবাই ডক্টর জুলেখার কাছে ঋণী।

হাঁ বাবা, আল্লার ইচ্ছা আর সে না হলে মনিরা আমার কোনদিন এ দুনিয়ার আলো দেখতে পেতোনা। কিন্তু জুলেখা হঠাৎ অমন করে চলে গেলো কেনো?

বনহুর বলে উঠলো–ডক্টর জুলেখা চলে গেছেন?

হাঁ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে এভাবে চলে যাচ্ছে বলে, সে বললো–আমার আর দরকার হবেনা।

মনিরা বললো– আমাকে একটি কথাও না বলে চলে গেলো সে!

বনহুর আনমনা হয়ে গেলো কি যেন চিন্তা করে বললো–যেতে দাও মনিরা তাকে।

সেকি! আমার বান্ধবী আমার জন্য এতো করলো তার জন্যই আবার আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। ওগো আমি তাকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে কিছুতেই শান্তি পাবোনা। কেননা সে চলে গেলো আমাকে কিছু না বলে? নিশ্চয়ই সে অভিমান করেছে–জুলেখা বড় অভিমানিনী।

মরিয়ম বেগম বললেন–হাঁ মনিরা, আমার সেই রকম মনে হচ্ছে। জুলেখা কেনো যেন, অভিমান করে চলে গেছে। মনিরা তোমরা দু’জনা যাও ওকে খুশি করতে চেষ্টা করো গে।

মনিরা বললো–আমি তাই যাবো। জুলেখা আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে, সে আমার কাছে যা চাইবে তাই দেবো।

মনিরা জুলেখা যা চায় দিতে পারবে? বললো বনহুর।

পারবো। আমার দৃষ্টির বিনিময়ে আমি তাকে সব দিতে রাজি আছি। তুমি আমাকে তার কাছে নিয়ে চলো।

মরিয়ম বেগম বললেন–মনিরা মা মনিরা ঠিক বলেছে। জুলেখাকে খুশি করতেই হবে যেমন করে হোক। ও যদি মন খারাপ করে তাতে মঙ্গল হবে না। বাবা, তুমি মনিরার কাছে বসো আমি কিছু খাবার তৈরি করে আনি, আমার বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে।

বনহুরের কথা বুঝতে পেরে মনিরা হাসলো মুখ ফিরিয়ে।

মরিয়ম বেগম বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে। পুত্র এসেছে–আনন্দে আত্মহারা তিনি। বাড়ির চাকর-বাকরদের ডাকাডাকি হাকাহাকি শুরু করলেন। সরকার সাহেবকেও ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন মরিয়ম বেগম।

হঠাৎ মরিয়ম বেগমের এতো খুশিভরা ভাব লক্ষ্য করে বাড়ির সবাই অবাক হলো, বিশেষ করে চাকর-বাকরের দল। কেনোনা, মরিয়ম বেগমকে তারা তেমন করে কোনদিন আনন্দ প্রকাশ করতে দেখেনি।

নিজেই উনানের পাশে এসে বসলেন, নিজের হাতে বেঁধে খাওয়াতে না পারলে তার যেন তৃপ্তি হচ্ছে না।

মরিয়ম বেগম চলে যেতেই বনহুর মনিরাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললো–তোমার বান্ধবীকে তুমি খুশি করতে চাও কিন্তু সে যা চাইবে পারবে দিতে?

কেন পারবো না? যে আমার এতো বড় উপকার করেছে তাকে আমি আমার সর্বস্ব দিতে পারবো।

মনিরা!

 হাঁ। ওগো তুমি আমায় বারণ করো না।

বেশ। কিন্তু সে তোমার কাছে যা চায় আমি জানি।

মনিরা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো–সত্যি বলছো? তুমি জানো আমার বান্ধবী জুলেখা কি চায়? বলো–ওগো বলো কি চায় সে? আমার কাছে যা চাইবে তাই দেবো তাকে।

বনহুর মনিরাকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো–মনিরা যত সহজ মনে করছো তত সহজ নয় দেওয়াটা।

তুমি আমাকে এতো ক্ষুদ্রমনা মনে করছো? যত টাকা সে চায় তাই দেবো। টাকা না চায় অলঙ্কার দেবো, গাড়ি চায় গাড়ি দেবো বাড়ি চায় তাই দেবো– যা চায় দেবো আমি।

হাসলো এবার বনহুর–ও সবের অভাব নেই তার। সে চায় তোমার স্বামীকে! পারবে পারবে দিতে তুমি?

মুহূর্তে মনিরার মুখ কালো হয়ে উঠলো, বললো সে –এ তুমি কি বলছো?

 সত্যি কথা বলছি। মনিরা, তোমার বান্ধবীর আশা সামান্য নয়।

না না এ হতে পারে না।

কেনো, পারবে না, একটু আগেই তুমি বলেছে জুলেখা তোর কাছে যা চাইবে তুমি দেবে তাকে?

বলেছি, কিন্তু যা সে চায় তা আমি কল্পনাও করিতে পারিনি। অসম্ভব, এ কখনও হতে পারেনা-না না, কখনই না। তার চেয়ে আমার জীবনটা চাইলেও আমি দিতে রাজি আছি

মনিরা তোমার বান্ধবীকে আমিও সেই কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম মনিরা দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেবার বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন তাই আমি দেবো আপনাকে। আমিও তখন বুঝিনি সে এমন কিছু চাইবে যা দেবার মত নয়।

মনিরা অস্ফুট শব্দ করে উঠলো–তারপর?

তারপর আমার কথায় সে বললো–পারবেন। পারবেন আপনি দিতে? আমি যা চাইবো? আমি বলেছিলাম, পারবো। মনিরা তোমার বান্ধবী আমার হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে বলেছিলো, আপনার ভালবাসা আমি চাই। একান্ত নিজের করে পেতে চাই আমি আপনাকে।

তুমি কি জবাব দিলেছিলে?

 বলেছিলাম–ডক্টর, আপনি যা চান–অসম্ভব। কারণ আমি বিয়ে করেছি।

সত্যি! সত্যি তুমি তাকে এ কথা বলেছো?

 বলেছি।

না না, আমি এ দৃষ্টিশক্তি লাভ করতে চাইনা। চাইনা আমি দুনিয়ার আলো দেখতে। সব অন্ধকার হয়ে যাক তবুও তোমাকে। আমি কারো হাতে দিতে পারবোনা। চাপা ক্রন্দনে কণ্ঠ ধরে আসে মনিরার।

বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে টেনে নেয় কাছে আবেগ ভরা গলায় বলে–মনিরা তুমি বিশ্বাস করো আমাকে। তুমি যখন অন্ধ ছিলে, আমি পারতাম জুলেখাকে খুশি করতে। মনে রেখো মনিরা তোমার স্বামী পিশাচ হতে পারে কিন্তু পাশবিক নয়।

মনিরা স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে আনন্দভরা কণ্ঠে বলে–আমি জানি এ কথা।

মনিরা তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তাই আমার সান্ত্বনা। তাছাড়া এ পৃথিবীর কেউ আমাকে বিশ্বাস করতে পারেনা বা করেনা। সবাই জানে–দস্যু বনহুর শুধু ধন-রত্ন, টাকা-কড়িই হরণ করেনা, নারীর ইজ্জত লুটে নিতেও সে দ্বিধা করেনা, কিন্তু মনিরা তারা জানেনা দস্যু বনহুরের কাছে সবের চেয়ে নারীর মর্যাদা অনেক বেশি।

দরজায় পদশব্দ শোনা যায়।

বনহুর মনিরাকে মুক্ত করে দিয়ে সোজা হয়ে বসে।

মরিয়ম বেগম একটু কেশে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে কক্ষে প্রবেশ করেন। হাতে তার রাশিকৃত খাবার।

টেবিলে রেখে বলেন মরিয়ম বেগম–বাবা মনির, এসো খাও মনিরা তুমিও খাও ওর সঙ্গে।

হাঁ এসো মনিরা মায়ের হাতে রান্না জিনিস আমরা দু’জনা মিলে খাই।

মনিরাও উঠে স্বামীর সঙ্গে টেবিলে এসে বসে।

 মরিয়ম বেগম নিজে পরিবেশন করে খাওয়ান।

মনিরা খাচ্ছিলো স্বামীর সঙ্গে হঠাৎ মুখভাব গম্ভীর বিষণ্ণ হয়ে উঠে, খাবার মুখে না তুলে চুপ হয়ে থাকে সে।

বনহুর বলে কি হলো মনিরা?

কিছু না।

তুমি খাচ্ছো না কেনো?

 খেতে পারবোনা।

মরিয়ম বেগম বললেন–অসুস্থ লাগছে বুঝি?

না মামীমা।

তবে কি হলো মা মনি?

আমার নূরের কথা মনে পড়েছে। না জানি নূর কোথায়? বেঁচে আছে কিনা তাই বা কে জানে।

বনহুর এবার ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে বলে সে মনিরা নূরের জন্য তুমি ভেবোনা। নূর যেখানেই থাক সে ভালই আছে।

কিন্তু আমার মন কেমন যেন অস্থির লাগছে। নূরের মুখখানা ভাসছে আমার চোখের সামনে।

মরিয়ম বেগম মনিরার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনার সুরে বলেন–ছিঃ অতো চিন্তা করলে খারাপ হবে। তোমার নূর নিশ্চয়ই ভাল আছে। খোদা তাকে কিছুতেই কষ্ট দিতে পারে না।

আমার নূর ভাল আছে–কি করে জানবো আমি?

 বনহুর এবার বলে উঠে–আমি বলছি সে ভাল আছে।

এক সময় বনহুর আর মনিরার খাওয়া শেষ হয়ে যায়। মরিয়ম বেগম আজ তৃপ্তি সহকারে পুত্র এবং পুত্রবধুকে নিজের হাতে পরিবেশন করে খাওয়ালেন।

সারাটা দিন মরিয়ম বেগম ছেড়ে দিলেন না পুত্রকে। সন্ধ্যা হয়ে এলো এক সময় বনহুর যেন আজ শান্ত ছেলেটির মত চুপ হয়ে রইল। হাসি গল্প আর শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলো দিনটা।

মরিয়ম বেগম তো এমনটিই চান। মনে মনে খোদার কাছে হাজার শুকরিয়া করেন তিনি। কত দিনের আশা তার–একমাত্র সন্তান মনিরকে নিয়ে সুখের নীড় গড়বেন। আজ বুঝি আল্লাহতায়ালা তার আরজ কবুল করেছেন। মনিরের তাই বুঝি সুমতি হয়েছে আর সে চলে যাবে না।

মরিয়ম বেগম খেতে দিয়ে তখন বলেছিলেন–মনির, একটা কথা রাখবি বাবা?

বলো মা রাখবো।

আমার গায়ে হাত রেখে শপথ কর।

 উঁহু তাহলে আমার শোনাই হোলনা তোমার কথাটা।

 মরিয়ম বেগম বললেন–তোকে শুনতেই হবে মনির?

আমি তো শুনবনা বলিনি–বলেছি তোমার গা ছুঁয়ে শপথ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় মা।

তুই আর চলে যাবি না বাবা?

এ কথা তুমি আরও বহুবার বলেছো মা, তোমার কথা রাখতে পারিনি, কোনদিন পারবো কিনা।

বনহুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, মুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। একটু ভেবে বলে আবার–মা, আমার কি সখ হয় না তোমাদের নিয়ে সুখের সংসার গড়ে তুলি। কিন্তু পারিনা–পারিনা নিশ্চিত হতে শত শত ক্ষুধার্ত ভাই বোনদের অশ্রুসজল আঁখি আমায় পাগল করে তোলে। শুনতে পাই। তাদের করুণ আর্তনাদ–মা, আমি পারিনা তখন নিজকে ধরে রাখতে। তখন আমি উন্মাদ হয়ে উঠি যত রাগ হয় আমার ধনী লোকদের উপর, যারা নিরীহ গরিবদের বুকের রক্ত শুষে নিয়ে গড়ে তুলছে স্বর্গ সমতুল্য ইমারত গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যতের কাঠামো স্বর্ণ আসনে উপবেশন করে যারা রাজভোগে ক্ষুধা নিবৃত্ত করছে তাদের উপর। দাঁতে দাঁত পিষে বনহুর চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হয়।

নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে মনিরা স্বামীর এই দীপ্তকান্তি সৌম্য সুন্দর। জ্বলন্ত মূর্তির দিকে এ মানুষ পৃথিবীর নয় কোন দেবযুবক।

স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে হৃদয় ভরে উঠে মনিরার। স্বার্থক তার জীবন স্বার্থক তার নারীত্ব। এমন স্বামী সে পেয়েছে।

বনহুর বলেই চলেছে–মা, আমি তখন স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার মধ্যে তখন। জেগে উঠে একটা ভীষণ মানুষ। এক পৈশাচিক প্রাণ। মায়া মমতার বালাই তখন থাকেনা আমার মধ্যে। তখন আপন জনের বুকেও ছোরা বসিয়ে দিতে আমার থাকেনা কোন দ্বিধা।

মনির!

মা, তুমি জানোনা তোমার সন্তান শুধু তোমার নয় সে এই পৃথিবীর সন্তান। পৃথিবী আমার মা, পৃথিবীর বুকে যারা বাস করে সবাই আমার ভাইবোন। বলো মা তুমি যদি তোমার সন্তানকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রাখে তাহলে আমার চির হতভাগ্য ভাই-বোনদের বেদনার অশ্রুকে মুছে দেবে কে, কে দেবে তাদের ক্ষুধায় অন্ন।

তাই বলে তুই দস্যুতা করে–

দস্যু আমি নই মা, যাদের প্রচুর আছে তাদের কাছ থেকে আমি নিয়ে যাদের নেই তাদের মধ্যে বিলিয়ে দেই। মা, তুমি আমাকে বাধা দিও না! তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো, তোমার সন্তান। যেন দেশ ও দেশবাসীর জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারে।

*

নূরীর জীবন রক্ষার জন্যই দেশ ত্যাগ করেছে রহমান। শুধু দেশ ত্যাগই নয়, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এমনকি তার অতি প্রিয় সর্দারকেও ত্যাগ করে চলে এসেছে সে আরাকান শহরে। কান্দাই এর মায়াও মুছে ফেলে দিয়েছে সে নিজের মন থেকে। আর কোনদিন কান্দাই শহরে ফিরে যাবে কিনা সেই আশাও করেনা।

টাঙ্গী চালায় সারাটা দিন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে রহমান। পয়সা উপার্জন যা করে তাই দিয়ে কোন রকমে সংসার চালিয়ে নেয়। নুরী সে আর মনি তিনটি প্রাণী কোন রকমে চলে যায়। দস্যুতা রহমান একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, মাঝেমাঝে তার অবাধ্য মন যদিও চঞ্চল হয়ে উঠে তা অতি সংযতভাবে দমিয়ে রাখে শপথ করেছে– আর সে দস্যুতা করবেনা বিশেষ করে মনির জন্য তাকে দস্যুতা ত্যাগ করতে হয়েছে। সর্দারের সন্তান মনি তাকে মানুষ করাই এখন রহমানের কাজ। মনি লেখাপড়া শিখবে দস্যু না হয়ে হবে সে একজরন মস্ত বড় অফিসার কিংবা ঐ রকম একটা বড় কিছু। রহমান তাই মনিকে আরাকান শহরে একটা ভাল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। নূরী ওকে খাইয়ে দাইয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে বইগুলি তুলে দেয়, তারপর ওর ছোট্ট ফুটফুটে গালে একটু মৃদু আঘাত করে বলে–যাও মনি স্কুলে যাও।

রহমান টাঙ্গীতে ঘোড়া জুড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে।

মনি ছুটে আসতেই রহমান ওকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও কোচ বাক্সে উঠে বসে। বাম হস্তে মনিকে আঁকড়ে ধরে দক্ষিণ হস্তে অশ্বের লাগাম টেনে ধরে।

গাড়ি ছুটতে শুরু করে।

স্কুলের সম্মুখে টাঙ্গী দাঁড় করিয়ে মনিকে কোলে করে নামিয়ে দেয়।

যতক্ষণ মনি স্কুল কক্ষে প্রবেশ না করে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রহমান গাড়ির পাশে।

তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় স্কুল প্রাঙ্গন থেকে। দিন ভর ভাড়া খেটে ঠিক স্কুলের সময় হলেই ছুটে আসে রহমান তার ঠিক জায়গা।

মনিরের প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে রহমান তার গাড়ির পাশে।

 মনি দূর থেকে রহমানকে দেখে ছুটে আসে জড়িয়ে ধরে ওকে।

 রহমান তুলে নেয় কোলে–চলো, মনি তোমার মাম্মীর কাছে চলো।

মনি কিন্তু রহমানকে কাকু ডাকাতো, রহমানের কথায় মনি তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে– মাম্মীকেও একদিন নিয়ে আসবে এখানে তাই না কাকু?

হাঁ তোমার মাম্মীকেও আনবো।

রহমান যখন মনিকে নিয়ে তাদের ছোট্ট আবাসে এসে পৌঁছালো তখন নূরী তাদের খাবার নিয়ে প্রতিক্ষা করছে।

টাঙ্গী থেকে নেমে রহমান মনিকে নামিয়ে দিলো।

 মনি ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলো নুরীকে।

নূরী কোলে তুলে নিয়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো মনির গাল দুটো। তারপর খেতে দিলো ওদের দু’জনকে।

*

দিন যায়।

মনি স্কুলে লেখাপড়া করে।

 রহমান টাঙ্গী চালায়ে অর্থ উপার্জন করে।

নূরী রান্না করে খাওয়ায় যত্ন করে ওদের। কিন্তু সারাটা দিন তার বড় অশান্তিতে কাটে বড় একা একা মনে হয় আস্তানায় সে ছিলো মুক্ত বিহঙ্গের মত আর এখানে এসে হয়েছে সে খাঁচার বন্দী পাখির মত। প্রাণ খুলে কোথাও বেড়াতে পারে না, কথা কইবার কাউকে কাছে পায় না, চুপচাপ কাটাতে হয় সারাটা দিন। যতক্ষণ ফিরে না আসে রহমান আর মনি ততক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতো পথের দিকে চেয়ে।

কতদিন নির্জন কক্ষে একা একা বসে ভাবতো সে কত কথা অতীতে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠতো একটি পর একটি করে। নূরীর জীবনপাতা হাতড়ে একজনকে বার বার তার মনে পড়তো সে তার বনহুর। অনেক চেষ্টা করেও সে একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারতো না তাকে। বনহুর যে তার ধ্যান জ্ঞান সাধনা স্বপ্ন। বনহুরের স্মৃতি আকড়ে ধরে বাঁচতে চায় সে।

কিন্তু আজকাল আর একটি মুখ তার মনে পড়ে বনহুরের মুখের পাশে, সে ঐ রহমান।

একটা করুণ মুখচ্ছবি তাকে অস্থির করে তোলে। মায়া হয় বেচারী রহমানের জন্য। ছোট বেলা হতেই রহমানকে সে দেখে এসেছে। রহমান তার সান্নিধ্য লাভের আশায় সব সময় লালায়িত থাকতো শিশু মনে ছিলোনা তখন কোন লালসার আভাস অতি পবিত্র অতি সচ্ছ ভাবেই রহমান ভালবাসতো নূরীকে। কিন্তু নূরী ওকে কোন দিন করুণার চোখে দেখেনি, একটু খানি ভালবাসাতে সে পারেনি কোন দিন ওকে।

তার জন্য রহমানের কোন অভিমান ছিলোনা ছিলো শুধু বুক ভরা ব্যথা।

রহমান বনহুরকে সব সময় সম্মানের চোখে দেখতো। ছোট বেলা হতেই তাকে সে সমীহ করে চলতো। অবশ্য কারণও ছিলো অনেক। রহমান বনহুরের চেয়ে বয়সে বেশি কম না হলেও কিন্তু কম ছিলো। বুদ্ধি আর শক্তিতেও বনহুর ছিলো অসীম। রহমানকে বনহুর অনেক বার সাক্ষাৎ মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করে ছিলো। একবার বিরাট এক অজগরের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো সে।

বনহুর তার তরবারী দিয়ে খন্ড খন্ড করে কেটে ফেলেছিলো অজগর সাপটাকে।

আরও কয়েকবার এমনি নানা বিপদের মুখ থেকে রহমানকে রক্ষা করছে বনহুর। শুধু রহমানকেই নয়, আস্তানায় এমন জন নেই যে, বনহুরের কাছে জীবনের বিনিময়ে ঋণী নয়।

রহমান যেদিন জানতে পেরেছিলো–বনহুর নূরীকে ভালবাসে আর নূরীও ভালবাসে তাকে। সেই দিন হতে রহমান নূরী থেকে দূরে সরে পড়তে চেষ্টা করেছে, যতদূর সম্ভব সরে রয়েছে। তার কাছ থেকে।

কিন্তু পুরুষ মন মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে উঠতো। নূরীকে নিজের করে পাবার জন্য মন তার অস্থির হয়ে পড়তো কিন্তু সর্দারের কথা মনে করে নিজকে সংযত করে নিতো রহমান।

 আজ সেই নূরী তার পাশে একেবারে অতি নিকটে। তবু রহমান পাথরের মূর্তির মত কঠিনভাবে নিজকে শক্ত করে রেখেছে। নূরীর সান্নিধ্য তাকে কখনও কখনও উত্তেজিত করে তোলে বটে কিন্তু নিজকে সে দাবিয়ে রাখে মন্ত্রগ্রস্থের মত। নূরীকে সে রক্ষা করতে এনেছে গ্রাস করতে নয়।

রহমান যতই কঠিন হতে চেষ্টা করুক, যতই সে শক্ত হতে চাক কিন্তু সো তো মানুষ–তার দেহেও রক্ত মাংসের তৈরি। তার ধমনীতেও প্রবাহিত হচ্ছে উষ্ণ রক্ত। প্রাণ তারও আছে।

একদিন নূরীর মুখখানা অস্থির করে তুললো রহমানকে। মনি তখন স্কুলে। রহমান টাঙ্গী নিয়ে ফিরে এল বাসায়।

নূরী টাঙ্গীর শব্দ পেয়ে ছুটে এলো হাতের কাজ ফেলে, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–আজ এতো সকাল সকাল এলে যে? মনি কোথায়? ওর কিছু হয়নিতো?

কেননা, সকাল সকাল কি কোনদিনই আসতে নেই নূরী?

আগে বলো মনি কোথায়?

স্কুলে।

আর তুমি তাকে না নিয়েই চলে এলে?

 স্কুল ছুটির অনেক দেরী আছে কিনা তাই–

রহমান নূরীর পিছনে কক্ষে প্রবেশ করলো। মাথার পাগড়িটা খুলে এক পাশে রেখে নূরীর খাটিয়ায় গিয়ে বসলো।

নূরীর বিস্ময় তখনও খাটেনি। কিছুটা এগিয়ে এসে বললো– হঠাৎ এলে যে?

নূরী, টাঙ্গী চালাচ্ছি, কেনো যে তোমার কথা মনে পড়ায় হৃদয়টা আমার অস্থির হয়ে পড়লো। তোমার ঐ ঢলঢল মুখখানা আমায় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকলো–

রহমানের কণ্ঠস্বর আজ স্বাভাবিক ছিলো না আবেগ ভরা গলায় সে নূরীকে বললো আবার –নুরী আর কতদিন এমনি করে কাটাবে?

রহমান, তোমার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

একটু স্থির হয়ে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে নূরী।

 তুমি কি বলতে চাও?

নূরী, আমি বলছি–নিজের জীবনটা এমনি করে ব্যর্থ করো না। ঐ সুন্দর স্নিগ্ধ রূপরাশি হেলায় নষ্ট করো না নূরী, হেলায় নষ্ট করো না।

রহমান!

হাঁ নূরী জানি আমি যা বলছি তা তোমার কাছে খুব খারাপ লাগছে কিন্তু তুমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলেই বুঝতে পারবে, আমার কতাগুলো কত মূল্যবান। তোমার ফুলের মত নিষ্পাপ একটি জীবন আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবো না নূরী।

আজ তোমার মতিছন্ন হয়েছে রহমান। তুমি কি নেশা পান করেছো?

আজতো তুমি নতুন নও নূরী। তুমি জানো, নেশা করা আমার অভ্যাস নেই, কাজেই আমি নেশাগ্রস্ত নই। নূরী, আমি অনেক চিন্তা করেছি, শুধু আজ নয়–মাসের পর মাস বছরের পর বছর আমি তোমার কথা ভেবেছি।

তার মানে?

মানে ভেবেছি তোমার ঐ অপূর্ব রূপরাশি যে কোন পুরুষের পরম কামনার বস্তু, আর সর্দার সেই অমূল্য সম্পদের কোন মর্যাদা দিলো না।

রহমান তুমি সংযতভাবে কথা বলো।

আমি অসংযত কোন কথাই বলবো না নূরী তা ছাড়া আমি জোরপূর্বক তোমাকে কোনদিন স্পর্শও করবো না। যতক্ষণ তুমি আমাকে স্বেচ্ছায় ধরা না দেবে।

নূরীর চোখ দুটো দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হতে লাগলো। দাঁত পিষে বললো–সে আশা তুমি কোনদিন করো না রহমান।

তুমি কি তাহলে নিজের জীবনটা নষ্ট করে দেবে?

 রহমান, তুমি তা হলে এখনও জানো না, আমি কে?

হঠাৎ হেসে উঠলো রহমান হাঃ হাঃ করে, তারপর বললো– জানি তোমার ধ্যান-জ্ঞান স্বপ্ন সাধনা দস্যু বনহুর। কিন্তু মনে রেখো নূরী, কোন দিন তাকে পাবে না–পেতে পারো না।

মুহূর্তে নূরীর মুখ কালো হয়ে উঠলো চোখ দুটো অশ্রু সিক্ত হলো। নূরী একথা জানে তবু রহমানের মুখে কথাটা তার অন্তরে যেন বিদ্ধ করলো। দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরে বললো নূরী রহমান তোমার মুখে এসব কথা শোনার পূর্বে আমার মৃত্যু হওয়া উচিৎ ছিলো। জানতাম না তুমি সুযোগ পেলেই আমাকে গ্রাস করতে চেষ্টা করবে।

না না,নূরী আমী তোমাকে গ্রাস করতে চাই না। তোমার মঙ্গলই আমার একমাত্র কামনা।

তাহলে তুমি আমাকে বার বার ঐসব কথা স্মরণ করাচ্ছো কেনো? একদিন তোমাকে বলেছি–আমি মনে-প্রাণে ওকে স্বামী বলে গ্রহণ করেছি কোন ঝড়-ঝঞ্ঝা বাধা-বিপত্তি আমার মনে থেকে তাকে মুছে ফেলতে পারবে না, কিছুতেই না।

কিন্তু সে কি তোমায় কোনদিন স্ত্রী বলে গ্রহণ করতে পেরেছে? বলো পেরেছে?

জানি না!

এক হাতে যেমন কোনদিন তালি বাজে না, তেমনি স্বামী স্ত্রী সম্বন্ধ কোন দিন এক জনের মনের কথায় হয় না। নূরী সর্দার বিয়ে করেছে আর তার সন্তানও জন্মেছে একটা।

রহমান।

 হাঁ নূরী।

বিয়ে যে করেছে জানি কিন্তু–কিন্তু তার সন্তান–না না এ হতে পারে না।

অবাক কণ্ঠে বললো রহমান–দস্যু বনহুর বিয়ে করেছে একথা তুমি জানো?

জানি। বনহুর নিজে আমাকে একথা বলেছিলো একদিন।

 এ কথা জেনেও তুমি তাকে স্বামী বলে মনে নিতে পারছো?

এ কথা শোনার অনেক আগেই যে আমি তাকে স্বামী বলে গ্রহণ করেছি রহমান। মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়। দ্বিতীয় বার যদি কোন নারী কোন পুরুষকে স্বামী বলে গ্রহণ করে তাহলে সেটা তার বিয়ে নয় লোক দেখানো একটা ভন্ডামি মাত্র। মেয়েদের হৃদয় এমন একটা জিনিস যা একজনকেই দেওয়া যায়, দ্বিতীয় জনকে নয়।

নূরী, তাহলে কি তুমি বনহুরের ধ্যান করেই জীবন কাটিয়ে দেবে?

 হাঁ, সেটাই হবে আমার জীবনের চরম সাধনা।

 তার স্ত্রী-সন্তান আছে জেনেও?

নূরী নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো, ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো তার গন্ড বেয়ে। একটু চিন্তা করে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো–তার সন্তান আছে এ কথা তোমাকে কে বললো?

আছে এবং সে তোমারই কোলে—

রহমান।

 নূরী, সর্দার তোমাকে কিছু দিতে পারেনি, তাই তার সন্তানকে এনে দিয়েছে তোমার বুকে।

নূরীর চোখে মুখে রাশিকৃত বিস্ময় ফুটে উঠে। অবাক কণ্ঠে বলে–তুমি কি বলছো রহমান?

যা বলছি সম্পূর্ণ সত্য কথা বলছি।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না?

বেশ, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেবো কিন্তু মনে রেখো নূরী তার ধ্যান করেই শুধু তোমাকে কাটাতে হবে কোনদিন তার নাগাল পাবেনা–কথাটা বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

নূরী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ভেবে পেলোনা রহমান তাকে কি বুঝিয়ে বলতে চাইলো।

*

অন্য একদিন।

মনি ঘুমিয়ে আছে, পাশে বসে জামা সেলাই করছিলো নূরী। সম্মুখে একটি পায়ার উপরে লণ্ঠনটা দপ দপ করে জ্বলছে।

রহমান হাতের উপর মাথা রেখে শুয়েছিলো কি যেন ভাবছিলো সে গভীরভাবে।

নূরীর মনটাও সেদিনের পর থেকে বেশ গম্ভীর ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে।

রহমানের সঙ্গে মন খুলে সে যেন কথা বলতে পারে না। সব সময় কি যেন চিন্তা করে। রান্না করে খাওয়ায় নিজে একটু মুখে দেয়–সব আগের মতই আছে শুধু তার মনে এসেছে মস্ত একটা পরিবর্তন। বনহুরের স্ত্রী আছে, সন্তান আছে–বনহুর তার নিজ সন্তানকে তুলে দিয়েছে। তার বুকে–তবে কি–তবে কি তার ধারণা সত্য। বহুদিন আগে মনিকে যেদিন প্রথম সে দেখেছিলো চমকে উঠেছিলো সে–তার হুরের চেহারার সঙ্গে মনির যে অদ্ভুত মিল দেখেছিলো। কিন্তু তা কি করে সম্ভব হবে মনিকে সে তার সম্মুর জঙ্গলে কাঁপালিকের কবল থেকে উদ্ধার করে এনেছিলো। বনহুরই তো সেদিন উদ্ধার করেছিলো এই শিশু মনিকে। সেদিন তো নিজেই সে সঙ্গে ছিলো তার। মনি কার ছেলে তা তারা কেউই জানেনা, কিন্তু রহমান বলেছে–বনহুর তারই সন্তানকে তুলে দিয়েছে নাকি তার বুকে–সব কেমন এলোমেলো লাগে নূরীর কাছে। উঠে দাঁড়ায় সে এগিয়ে আসে রহমানের পাশে–রহমান।

কিছু বলবে নূরী?

সেদিন যে তুমি বলেছিলে হুর তার নিজের সন্তানকে আমার বুকে তুলে দিয়েছে। তুমি কি বলতে চাও–মনি হুরের সন্তান?

বলতে চাইনা নূরী বলছি সর্দারের সন্তান মনি।

অসম্ভব?

কেনো অসম্ভব?

মনিকে আমরা সম্মুর জঙ্গলে পেয়েছি।

 যেখানেই পাও তাকে মনি তারই সন্তান।

কিছুতেই হতে পারে না।

নূরী, ভাল করে তাকিয়ে দেখো দেখি–ঐ ঘুমন্ত শিশুর মুখে কার মুখের ছাপ ফুটে উঠেছে।

 রহমান!

হাঁ নূরী, তুমি বিশ্বাস করো মনি দস্যু বনহুরের সন্তান এবং মনির মা চৌধুরী কন্যা মনিরা।

না না, মনি আমার সন্তান। আমি–আমি ওর মা।

সর্দার মনিকে তুলে দিয়েছে তোমার হাতে, তুমিইতো ওর মা।

কিন্তু কি করে তা হবে। ওর মা যে মনিরা চৌধুরী কন্যা মনিরা ও গর্ভধারিনী জননী–

রহমান উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, নূরীর মুখোভাব লক্ষ্য করে বললো– মনি জানেনা সে কথা জানলেও সে কচি শিশু ভুলে গেছে অনেক দিন। সর্দার ওকে তোমার সন্তান বলেই তোমাকে সপে দিয়েছে–কাজেই মনি এখন তোমারই সন্তান।

যখন বড় হবে জ্ঞান হবে, তখন তখন সে নিজের মায়ের অন্বেষণ করবে। আমার তখন কি হবে রহমান? আমি বাঁচবো কাকে নিয়ে–নূরী আকুলভাবে কেঁদে উঠলো।

রহমান রইলো নিশ্চুপ হয়ে কোন জবাব সে খুঁজে পেলোনা।

নূরী অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে আঁচলে চোখ মুছলো, তারপর সরে এলো রহমানের পাশে রহমান, বনহুর আমাকে সব দিকে ধোকা দিয়েছে। আমাকে সে ধোকা দিয়েছে। ছোট বেলা হতে আমার মন নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছে। আমার ভালবাসা নিয়েছে সে নিঃশেষ করে কিন্তু আমাকে সে এতোটুকু দেয়নি। আজীবন সে আমাকে কাঁদিয়েছে, হাসতে দেয়নি কোন দিন। রহমান, আমি ভুলে যাবো, সত্যি ওকে ভুলে যাবো।

রহমান নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিলো, বললো এবার নূরী, তুমি ভুল বুঝছো। সর্দার তোমাকে যত ভালবাসে তত তার স্ত্রীকেও বুঝি বাসে না। আমি জানি তুমি তার জীবনের আলো–আর মনিরা রশ্মি।

এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।

না করলে আমি নাচার।

রহমান আমি এবার বাঁচতে চাই। তুমি না একদিন বলেছিলে, নূরী, তোমার জীবনটা ব্যর্থ করোনা।

একদিন নয়–বহুদিন আমি তোমাকে এ কথা বলেছি। জীবন-ভর তোমাকে তার ধ্যানই করে যেতে হবে, কোন দিন তাকে পাবে না।

রহমান!

 বলো?

আমি ভুলে যাবো, ভুলে যাবো ওকে। কি হবে ওর কথা ভেবে। জীবনে যে এতোটুকু দিতে পারেনি… কি হবে তার ধ্যান করে…।

রহমান নূরীর কণ্ঠস্বরে বিস্মিত হয়, আজ প্রথম সে নূরীর মধ্যে দেখতে পেলো এক ভিন্ন রূপ। বাষ্পরূদ্ধ কণ্ঠে বললো নূরী আবার আমি তোমাকে ভালবাসবো, তোমাকে আমি বিলিয়ে দেবো আমার জীবন।

নূরী!

বহুদিন তোমাকে আমি উপেক্ষা করে বিমুখ করেছি, আজ আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি রহমান। তুমি আমাকে গ্রহণ করো…

নূরী! রহমান যেন অস্কুটধ্বনি করে উঠলো।

নূরী রহমানের পায়ের কাছে নত হয়ে বসে পড়লো–রহমান, আমি তোমাকে স্বামী বলে। গ্রহণ করবো।

রহমান সরে দাঁড়ালো, দু’হাত বাড়িয়ে নূরীকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো-নূরী তা হয় না।

কেনো, তুমিই আমাকে বার বার বলেছে, আমাকে তুমি চাও।

চেয়েছিলাম, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তোমাকে নিয়ে আমি শান্তি পাবো না। যে হৃদয় তুমি একজনকে দান করেছো সে হৃদয় আর একজনকে দেওয়া যায় না নূরী।

আমি মুছে ফেলবো তার স্মৃতি।

নূরী, তা হয় না। একদিন আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য উম্মাদ হয়ে উঠেছিলাম, আজ সে আকাঙ্খা আমার নেই। নূরী, তোমাকে আমি ভালবাসি সত্য তুমি আমার শ্রদ্ধার পাত্রী।

রহমান!

হাঁ নূরী, আমি মনের সঙ্গে অনেক দ্বন্দ্ব করেছি, কিন্তু জয়ী হতে পারিনি–পরাজিত হয়েছি। নূরী, তুমি আমার বোন…।

রহমান!

বলো নূরী?

 রহমান ভাই, তুমি আমাকে বাঁচালে। আমাকে তুমি বাঁচালে।

তোমার পায়ে মাথা রেখে এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারবো। কোন পাপ থাকবে না তোমার আর আমার মধ্যে।

আজ রহমান আর নূরী পরম নিশ্চিন্ত মনে ঘুমালো। উভয়ে যেন উভয়ের কাছে আজ আপন, অতি সরল-সহজ হয়ে এসেছে। সম্বন্ধ ছিলো বন্ধু–আজ হলো ভাই।

কতদিন বুঝি এমন আরামে ওরা ঘুমাতে পারেনি। রহমানের মনে সদা জেগেছে এক না পাওয়ার উন্মত্ত বাসনা আর নূরীর মনে দানা বেঁধেছে একটি অজানিত আশঙ্কা। আজ আর কারো মনে নেই কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা কোন অহেতুক স্পন্দন।

*

মনিকে নিয়ে বেশ কাটছিলো নূরী আর রহমানের। আজকাল নূরী রহমানকে রহমান ভাই ডাকে।

মনিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে রহমান সারাদিন টাঙ্গী চালায় আর নূরী বাড়িতে সংসারের কাজ করে। ফিরবার পথে রহমান মনিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে।

নূরী রান্নাবান্না শেষ করে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষা করে রহমান ভাই আর মনির।

প্রতি দিনের মত আজও নূরী সংসারের কাজ সেরে দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলো পথের দিকে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ যেন কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে ওদের ফিরতে। উদ্বিগ্ন অন্তর নিয়ে প্রতিক্ষা করছে সে।

এমন সময় একটি অন্ধ ভিখারী এগিয়ে এলো নূরীর সম্মুখে। এক মুঠুঠি ভাত দিজিয়ে মাই। থোরা পানি…

নূরীর মনটা কেঁদে উঠলো বৃদ্ধ ভিখারীর করুণ কণ্ঠস্বরে। বললো–একটু দাঁড়াও বাবা, তোমার জন্য খাবার আনছি।

বৃদ্ধ ভিখারীর মুখটা খুশিতে ভরে উঠলো, বললো আবার মাই অপেক্ষা বহু দয়া।

নূরী চলে যেতেই ভিখারী মুখের মধ্যে দুটো আংগুল দিয়ে এক রকম শব্দ করলো, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন গুণ্ডা ধরণের লোক আশেপাশে গা ঢাকা দিয়ে এসে দাঁড়ালো।

বৃদ্ধ ভিখারী তার দলবলকে কি যেন ইংগিৎ করে আবার লাঠিতে ভর করে উবু হয়ে দাঁড়ালো।

আসলে ভিখারী বৃদ্ধ নয়, সে আরাকান শহরের সেরা ডাকাত ভোলানাথজীর সহকারী শ্যামনাথ।

শ্যামনাথ একদিন এ পথে যাবার সময় নূরীকে দরজায় দেখেছিলো, তারপর সে নূরীর সৌন্দর্যের কথা গিয়ে বলেছিলো তাদের দলপতি ভোলানাথজীকে।

ভোলানাথ যেমন ছিলো দুর্দান্ত শয়তান তেমনি ছিলো তার নারী পিপাসা। শহরের যে কোন মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে তার সতীত্ব নষ্ট করাই ছিলো, তার কাজ।

ডাকাত ভোলানাথের ভয়ে শহরের মেয়েরা শান্তিতে বাস করতে পারতো না।

সহকারী শ্যামনাথ নূরীর নিকটে এসেছে এক মুটি অন্নের জন্য।

নূরী নিঃসঙ্কোচে খাবার নিয়ে বেরিয়ে এলো উঠান থেকে।

বৃদ্ধ ভিখারীর বেশে শ্যামনাথ বললো মাই আপ আয়া?

হাঁ বাবাজী’ খাবার এনেছি, নাও। নূরী খাবারের থালাটা এগিয়ে ধরলো ভিখারীর সম্মুখে। বৃদ্ধ ভিখারীর মাটিতে থালা রেখে বললো–আপ দিজিয়ে মাই। খোদা আপকো বহুৎ ভালা করে…

নূরী যেমন ভিখারীর থালায় ভাত-তরকারী ঢেলে দিতে গেলো অমনি ভিখারী মুখের মধ্যে দুটো আংগুল পুরে শিষ দিয়ে উঠলো।

 সঙ্গে সঙ্গে আড়াল থেকে কয়েকজন বলিষ্ঠ লোক বেরিয়ে নূরীকে ধরে ফেললো। কেউবা নূরীর মুখে কাপড় খুঁটো দিলো।

 অদূরে একটু আড়ালে একখানা গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো, বলিষ্ঠ লোকগুলি নূরীকে এটে ধরে গাড়িখানার মধ্যে তুলে ফেললো। শয়তান লোকগুলিও উঠে পড়লো গাড়িতে।

ড্রাইভার এজন্য প্রস্তুত ছিলো, নূরীকে গাড়ীতে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্টার্ট দিলো সে। উল্কা বেগে গাড়িখানা ছুটতে শুরু করলো।

নূরীকে এমনভাবে গাড়ির মেঝে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে করে বাইরে থেকে কিছু বুঝতে না পারে কেউ।

জনমুখর রাজপথ ছেড়ে উল্টো পথে, গাড়ি ছুটতে লাগলো। গাড়িতে উঠিয়ে নেওয়ার পর পরই নূরীর নাকে ঔষধ ধরে অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছে, কাজেই নূরী গাড়ির মধ্যে মৃত্যুর ন্যায় পড়ে আছে।

যে পথ দিয়ে নূরী সহ ভোলানাথের অনুচরগণ এগিয়ে যাচ্ছিলো সেই পথেই টাঙ্গী চালিয়ে মনি সহ আসছিলো রহমান।

গাড়িখানা রহমানের টাঙ্গীর পাশ কেটে চলে গেলো। এক হলকা ধুলো ছড়িয়ে পড়লো রহমান আর মনির চোখে মুখে।

গাড়িখানার দিকে রাগতভাবে একবার তাকালো রহমান কারণ গাড়িখানার দ্রুত গতি তার কাছে বেশ অসন্তুষ্টজনক বলে মনে হলো।

মনি বললো–রহমান কাকু, তুমি ওদের গাড়ি রুখতে পারলে না? আর একটু হলে আমাদের গাড়ি উল্টে দিয়ে চলে যেতো। হাঁ মনি ঠিক বলেছো, বড্ড বেয়ারাভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। ওরা। আমাদের গাড়িখানা ধার করে না নিলে ঠিক উল্টে যেতো।

আমি হলে কি করতাম জানো?

কি করতে মনি?

টাঙ্গী থেকে লাফিয়ে পড়তাম ওদের গাড়িতে তারপর ড্রাইভার ছোকরাকে দেখিয়ে দিতাম কেমন করে গাড়ী চালাতে হয়।

মনির কথায় রহমানের বুক ভরে উঠে সর্দারের ছেলে ঠিক কথাও বলেছে সর্দারের মত। পিঠ। চাপড়ে দেয় রহমান–সাবাস মনি, বড় হয়ে তুমি ওদের গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিও।

রহমান আর মনি টাঙ্গী নিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছলো। প্রতি দিনের মত আজ নূরীকে দরজায় না দেখে রহমান একটু আশ্চর্য হলো।

মনিকে টাঙ্গী থেকে নামিয়ে দিয়ে বইগুলি হাতে দিলো রহমান–যাও মনি; তোমার মাম্মীর কাছে যাও। তোমার মাম্মী বোধ হয় ভিতরে আছে।

মনি বই-পুস্তক হাতে ছুটলো বাড়ির ভিতরে।

প্রথমে ঘরে প্রবেশ করে মনি থমকে দাঁড়ালো কই–কোথায় তার মাম্মী। এবার সে ডাকতে লাগলো উচ্চকণ্ঠে–মাম্মী! মাম্মী!

কোথাও থেকে কোন সাড়া এলো না।

মনি এখানে-ওখানে সবখানে ছুটোছুটি করে খুঁজলো। কোথাও নূরীকে না পেয়ে মনি ফিরে। এলো রহমানের পাশে।

রহমান তখন টাঙ্গী থেকে অশ্ব দুটো খুলে বেঁধে রাখছিলো। মনি রহমানের সম্মুখে এসে কাঁদো কাঁদো সুরে বললো-কাক্ক, মাম্মী নেই।

অবাক হয়ে বলে উঠলো রহমান–মাম্মী নেই?

না, কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। মাম্মী নেই..

রহমান মুহূর্ত বিলম্ব না করে মনিকে নিয়ে উঠানে প্রবেশ করে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকলো– নূরীরীনূরী…।

প্রতিধ্বনি ফিরে এলো নূরীর কোন শব্দ এলো না।

রহমান আবার উঠানের প্রতিটি জায়গা খুঁটি খুঁটি করে খুঁজলো। রান্নাঘরের ভিতরে এদিক সেদিক দেখলো, আবার বেরিয়ে এলো বাইরে। হঠাৎ রহমানের নজর পড়লো–বাইরে দরজার পাশে পড়ে আছে একটি থালা, আর কিছুটা ভাত-তরকারীও পড়ে রয়েছে থালাটার পাশে।

রহমান কিছুক্ষণ স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলো থালাটার দিকে, বুঝতে পারলো–নূরী কোন ভিখারীকে খাবার দিতে এসেছিলো সেইক্ষণে তাকে কোন শয়তান লোক পাকড়াও করে নিয়ে গেছে।

রহমান মনিকে কিছু না বলে কোলে তুলে নিয়ে বললো– চলো মনি, তুমি খাবে চলো।

মনি মুখ ভার করে বললো–মাম্মী কোথায় আগে বলো, তবে খাবো।

 মাম্মী! মাম্মী আছে।

 কোথায় আমার মাম্মী?

বললাম তো। রহমান ব্যাপারটা অনুমান করে নিলেও চট করে মনিকে বলতে পারলো না, কারণ মনি কচি শিশু–হঠাৎ এমন কোন কথা তাকে বলা উচিৎ হবে না যা তার সরল মনে আঘাত করে, তাই রহমান বললো–হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে–আসবে এক্ষুণি।

মাম্মীর কাছে যাবো আমি। মাম্মীর কাছে যাবো… কান্না জুড়ে দিলো মনি।

রহমান অতিকষ্টে নিজকে সংযত রেখে মনিকে প্রবোধ দিতে লাগলো। কিন্তু মনির কান্না যেন থামতে চায় না।

রহমান ফাপড়ে পড়লো যেন। এদিকে নূরীর চিন্তা, কোথায় গেলো সে? নিশ্চয়ই তাকে জোরপূর্বক কেউ পাকড়াও করে নিয়ে গেছে। মাথাটা যেন রহমানের বন বন করে ঘুরছে এখন। উপায়? কি করবে কিছুই যেন ভেবে পাচ্ছে না সে।

মনি না থাকলে এক মুহূর্ত বিলম্ব করতো না, এক্ষুণি বেরুয়ে পড়তো নূরীর সন্ধানে। কিন্তু এখন সে মনিকে নিয়ে মহা বিপদে পড়ে গেছে। ছোট কচি শিশু তাকে একা ফেলে কোথাও যাওয়া যায়না। তাই বলে নূরীর সন্ধান না করে উপায় নেই। রহমান অধর দংশন করে–কে সে নরাধম যে নূরীকে হরণ করে নিয়ে গেছে।

মনির কোন রকমে চারটি খাইয়ে পাশের বাড়ির চাচীর কাছে তাকে রেখে রহমান টাঙ্গী নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। হঠাৎ রহমানের মনে পড়লো, ফেরার পথে একখানা টাক্সি অতি দ্রুত তাদের টাঙ্গীর পাশ কেটে চলে গিয়েছিল, ঘটনাটা অত্যন্ত রহস্যময় বলে মনে হলো তার।

রহমান সেই পথে টাঙ্গী নিয়ে অগ্রসর হলো। কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তার মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল, কারণ পথটা বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর কয়েকটা পথের সঙ্গে মিশে এক হয়ে গেছে। কোন পথে গিয়েছে গাড়িখানা কে জানে।

রহমান টাঙ্গী থামিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো, অকুল সমুদ্রে যেন কোন কুল খুঁজে পাচ্ছে না। টাঙ্গীর উপর বসে সে তাকাচ্ছে প্রত্যেকটা পথের দিকে, তার মন যেন ডেকে বলছে–যে গাড়িখানা তখন উল্কা গতিতে চলে গিয়েছে ঐ গাড়িখানার মধ্যেই ছিলো নূরী। রহমান নিপুণ দৃষ্টি মেলে পথের। দিকে তাকাচ্ছিলো, হঠাৎ নজরে পড়ে গেলো অদূরে পথের মুখে পড়ে আছে একটা ঝকঝকে মত জিনিস।

রহমান টাঙ্গী থেকে এক রকম প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়লো। দ্রুত গিয়ে জিনিসটা তুলে নিলো হাতে, সঙ্গে সঙ্গে রহমানের চোখ দুটো চক চক করে উঠলো, কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবলো। তারপর ছুটে গিয়ে উঠে বসলো টাঙ্গীতে।

অশ্বের লাগাম টেনে ধরতেই টাঙ্গীখানা উল্কা গতিতে ছুটতে শুরু করলো।

যে পথের মুখে চকচকে জিনিসটা রহমান কুড়িয়ে পেলো সেই পথে গাড়ি নিয়ে ছুটলো সে।

 চকচকে জিনিসটা রহমানকে পথের নির্দেশ বলে দিয়েছে। জিনিসটা অন্য কিছু নয়–নূরীর হাতের স্বর্ণবলয়। দুবৃত্তগণ নূরীকে যখন পাকড়াও করে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন তার সে তার হাতের বলয়টা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো গাড়ির বাইরে।

সেই বলয়টাই হঠাৎ রহমানের নজরে পড়ে গিয়েছিলো, বলয়টা পকেটে রেখে টাঙ্গী নিয়ে ছুটলো সে।

যদিও এ পথে রহমান কোন দিন আসেনি বা এ পথ তার পরিচিত নয় তবুও টাঙ্গী নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হলো।

অজানা অচেনা পথ।

পথের দুই পাশে শাল আর পাইন গাছ এক একটা প্রহরীর মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে শাঝে ঝোপ-ঝাড় আর বন্য গাছপালাও দেখা যায়। আশেপাশে কোন বাড়িঘর বা দালানকোঠার চিহ্ন নেই। এসব পথ বড় নির্জন, ক্কচিৎ কোন পথচারী বিশেষ প্রয়োজনেই এই পথে এসে থাকে।

রহমানের টাঙ্গী তীরবেগে ছুটছে।

রহমান লক্ষ্য করলো–পথের ধূলায় কোন মোটরের চাকার দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আবার একটা ক্ষীণরেখা তার মনের কোণে উঁকি দিয়ে গেলো।

নির্জন নিস্তব্ধ পথ বেয়ে রহমানের টাঙ্গী ছুটে চলেছে। রহমানের শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ভিজে চুপসে উঠেছে তার জামাটা। পকেটে গুলী ভরা পিস্তল। একটা তীর ধনুও নিয়েছে সে সঙ্গে, আর নিয়েছে একটা লাঠি।

রহমান বাম হস্তে অশ্বের লাগাম টেনে ধরে দক্ষিণ হস্তে পকেটে পিস্তলের অস্তিত্বটি অনুভব করে নিলো।

পথের যেন শেষ নেই!

রহমানের টাঙ্গী অত্যন্ত দ্রুত ছুটেও যেন পথ শেষ করতে পারছে না।

প্রায় প্রহর দুই চলার পরও রহমান এ পথে কোন জন-প্রাণীর সাক্ষাৎ পেলোনা। পথের ধারে শাল আর পাইন বৃক্ষগুলির ছায়া পথ আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

পথটা দূর হতে দূরান্তে মিশে গেছে যেন কোন অজানার বুকে। রহমান সেই পথ ধরে এগুতে লাগলো।

বেলা খুব ছিলোনা, কাজেই অন্ধকার হয়ে এলো অল্পক্ষণের মধ্যেই।

রহমান এতোক্ষণ একটানা গাড়ি চালিয়ে চলেছিলো, এবার টাঙ্গী থামিয়ে পথে নেমে দাঁড়ালো। সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালো চারিদিকে। কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। রহমানের দৃষ্টি যতদূর গেলো ততদূর শুধু ঝোপ-ঝাড় আর আগাছা। কোন কোন জায়গায় পাথরের স্তূপ জমে রয়েছে ছোট ছোট পাহাড়ের আকারে।

 রহমান চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখছিলো। এবার সে তাকালো পথের দিকে। এখানে। পথটা শুধু পাথর কেটে তৈরি–তাই পথে কোন দাগ পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। তাছাড়াও সন্ধ্যার। অন্ধকার তখন বেশ জমাট বেঁধে উঠছিলো, এই মুহূর্তে রহমান একটু বেশি চিন্তায় পড়লো, কোনদিকে অগ্রসর হবে? সম্মুখে না পাশের কোন জঙ্গলে?

রহমান ভাবছে, ঠিক সেই সময় দূরে পথের বাঁকে দুটো আলোর বল দেখা গেলো। অজগরের চোখের মত জ্বলছে যেন আলোর বল দুটো। রহমান আরও লক্ষ্য করলো, আলোর বল দুটো দ্রুত গতিতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই যে এখানে এসে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন উপায়? আলোর বল দুটো কোন গাড়ির সার্চলাইট বুঝতে বাকি নেই তার।

এবার রহমান বেশ চঞ্চল হয়ে পড়লো। গাড়িখানা কোন সৎ ব্যক্তির না হয়ে যদি অসৎ ব্যক্তির হয় এবং তাকে দেখে কোন রকম দুষ্ট মতলবের সৃষ্টি করে। রহমান তাড়াতাড়ি তার গাড়ি থেকে, অশ্বটা খুলে নিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে বেধে রাখলো এবার টাঙ্গীখানাকেও লুকোতে হবে।

রহমান টাঙ্গীখানা টেনে নিয়ে চললো। অতি কষ্টে তার টাঙ্গীখানা অল্প সময়ের মধ্যে পথের উপর থেকে সরিয়ে নিলো।

এমন সময় একখানা ট্যাক্সি গাড়ি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সম্মুখের পথ দিয়ে তীরবেগে চলে গেলো।

রহমান অবাক হয়ে দেখলো, যদিও সন্ধ্যার অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলোনা কিছু, তবু বেশ বুঝতে পারলো বৈকালে যে গাড়িখানা তার টাঙ্গীর পাশ কেটে তীব্র গতিতে ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়েছিলো–এটা সেই গাড়ি। তবে কি নূরীকে কোথাও বন্দী করে রেখে গাড়িখানা ফিরে গেলো। নিশ্চয়ই তাই হবে–এটা যে ঐ গাড়ি, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

গাড়িখানা দৃষ্টির অন্তরালে চলে যেতেই রহমান তার টাঙ্গী নিয়ে পথে এসে দাঁড়ালো, ক্ষিপ্র হস্তে তার অশ্ব দুলকিকে জুড়ে দিলো টাঙ্গীর সঙ্গে।

রহমান টাঙ্গীতে উঠে বসতেই দুল্কী ছুটতে শুরু করলো। টাঙ্গীতে কোন আলো না থাকায় পথ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না। রহমান পথ স্পষ্ট দেখতে না পেলেও, দুলকী পশু সে অন্ধকারেও বেশ দেখতে পায় কাজেই রহমান শুধু লাগাম টেনে ধরে বসে রইলো।

দুলকী আপন মনে ছুটে চলেছে।

আজ ভাগ্যিস রহমান তার এক ঘোড়ার টাঙ্গীখানা নিয়ে বেরিয়েছিলো নইলে সে মাঝে মাঝে তার দুইটি অশ্বওয়ালা টাঙ্গী ব্যবহার করতো।

দুলকী প্রভুর মনোভাব বুঝতে পেরেছিলো কাজেই সে আপন মনে সম্মুখপথে দ্রুত অগ্রসর হলো।

রহমান আর দুলকী দুটি মাত্র প্রাণী–যদিও উভয়ে উভয়ে মনের কথা অনুভব করছে। সম্পূর্ণভাবে কিন্তু কেউ কাউকে স্পষ্টভাবে জানাতে পারছেনা তাদের অন্তরের কথা।

বেশ কিছুক্ষণ দুলকী অবিরাম ছোটার পর হঠাৎ এক স্থানে এসে থেমে পড়লো।

এখন কোনদিকে দৃষ্টি এগুচ্ছেনা রহমানের, কারণ চারিদিক জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন, এমনকি তার নিজের শরীরের কোন অংশও তার নজরে পড়ছিলোনা।

রহমান কিছু বুঝতে না পেরে দুকীর পিঠে চাবুক দিয়ে মৃদু আঘাত করলো। কিন্তু আশ্চর্য–দুকী আর এক পাও এগুলোনা। অগত্যা রহমান টাঙ্গী থেকে নেমে পড়লো রাস্তার বুকে।

রহমান লক্ষ্য করলো–দুকী সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে, কিছু যেন বোঝাতে চেষ্টা করছে সে রহমানকে। চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ’ মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া, আওয়াজ। এখন পথের আশেপাশে কিছুই তার নজরে পড়ছিলোনা। গাছপালাগুলোকে কেমন ঝাপসা এক একটা দৈত্যের মত মনে হচ্ছিলো। এখন কি করা যায় ভাবে। রহমান।

হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো; রহমান বুঝতে পারলোটাঙ্গী সমেত চলা হয়তো দুকীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। রহমান দুলকীর টাঙ্গী থেকে খুলে নিলো, তারপর দুলকীর পিঠে চেপে বসলো সে।

আশ্চর্য হলো এবার রহমান–দুকী যেন এটাই চাচ্ছিলো অন্ধকার হলেও দুলকী আনন্দে চিহি চিহি শব্দ করে উঠলো, তারপর ছুটতে শুরু করলো দ্রুতগতিতে।

রহমান যেন এবার নিশ্বাস ফেলে বাচলো, দুর্কী তখন আপন মনে ছুটতে শুরু করছে।

অল্পক্ষণেই রহমান অবাক হলো, দুলকী সোজা পথে না গিয়ে পথ ছেড়ে নেমে পড়লো পথের দক্ষিণ পাশে। এবার দুলকী যেন বিপুল উদ্যমে ছুটছে। রহমান অন্ধকারে কিছু দেখতে না পেলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে–দুলকী যে পথে ছুটে চলেছে সেটা কোন মেঠোপথ। দুলকীর খুরের শব্দে অনুভব করে নিলো রহমান।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে অবিরাম গতিতে ছুটার পর দুলকীর গতি কমে এলো বলে মনে হলো। রহমানের। চারিদিকে ঘন অন্ধকার থাকা সত্বেও সম্মুখে কেমন যেন জমাট অন্ধকার বলে ঠেকলো।

রহমান এবার ঘোড়া থেকে নেমে পড়লো দুলকী তাকে কোথায় নিয়ে এলো সেই জানে। রাতের অন্ধকার না হলে সব দেখতে পেতো, কিন্তু এখন সে কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আর্ত চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো তার কানে। শব্দটা অত্যন্ত ক্ষীণ–অস্পষ্ট।

রহমান দুলকীর লাগাম চেপে ধরে কান পেতে শুনলো কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলো না শব্দটা কোন্ দিক থেকে এলো।

দুলকীও যেন আনচান করছে, সতর্কভাবে মাথাটা ফেরাচ্ছে এদিকে সেদিকে।

রহমান এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা, কোন দিকে যাবে। করুণ আর্তচীৎকার নূরীর কিনা তাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। চীৎকার একটা মাত্র ভেসে উঠে থেমে গিয়েছিলো, আচমকা একটা প্রতিধ্বনির মত। কোন দিকে দৃষ্টি এগুচ্ছিলোনা রহমানের, তবু সে সতর্কভাবে তাকিয়েছিলো দূরে অন্ধকারে।

দুলকীও কেমন যেন আনচান করছে, মাঝে মাঝে একটা শব্দ বের হচ্ছিলো তার মুখ দিয়ে।

ঠিক সেই সময় হঠাৎ একটা আলো দেখা গেলো দূরে–অনেক দূরে। আলোটা মিট মিট করে জ্বলছে যেন মনে হলো কিন্তু আসলে আলোটা মিটমিটে নয়, কোন মশালের আলো–বেশ বুঝতে পারলো রহমান।

এবার রহমান কালবিলম্ব না করে দুলকীর পিঠে লাফ দিয়ে উঠে বসলো, তারপর আলোর ক্ষীণ ছটা লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করলো।

সোজা পথ নয়–ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দুলকী ছুটছে। রহমানের প্রিয় অশ্ব দুলকী বনহুরের তাজের চেয়ে তার বুদ্ধি খুব কম নয়। তাজ যেমন প্রভুর মনের কথা বুঝতো বা বোঝে তেমনি দুলকিও বুঝতে তার মালিক রহমানের মনের কথা।

পশু হলেও তাজ এবং দুলকীর বুদ্ধি বা জ্ঞান ছিলো মানুষেরই মত প্রভুর ইংগিত বুঝতে পারতো এই অশ্ব দুটি।

রহমান যে ঐ আলোর নিকটে পৌঁছতে চায়, এ কথা যেন বুঝতে পেরেছিলো দুলকী, তাই সে আলো লক্ষ্য করে তীরবেগে ছুটছে।

ক্রমে আলোর বিন্দুটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রহমানের চোখ দুটোও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, এবার নিশ্চয়ই নূরীর কোন সন্ধান পাবে সে।

এতক্ষণ যে আরো লক্ষ্য করে রহমান দুলকীকে চালনা করছিলো, এতোক্ষণে বেশ স্পষ্ট বোঝা গেলো সে আলো অন্য কিছু নয়, একটা জ্বলন্ত মশাল।

রহমান এবার দুলকী সহ থেমে পড়লো, তার নিকট হতে প্রায় কয়েক গজ দূরে মশালটা দপ দপ করে জ্বলছে, দেখলো সে।

মশালটা গোঁজা রয়েছে একটা ডালের সঙ্গে, পাশে নজর পড়তেই চমকে উঠলো রহমান, কতকগুলো ভয়ঙ্কর ধরনের লোক এক জায়গায় গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে মদপান করছে আর জড়িতভাবে আবোল তাবোল কি সব কথাবার্তা বলছে।

রহমান তার অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়ালো, তারপর অশ্বটিকে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে রেখে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলো।

এবার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে রহমান ওদের সব কথাবার্তা।

জড়িত কণ্ঠে একটা লোক বললো–আমার ভাইগণ, যত পারো খেয়ে নাও, একটু পরে মালিক এসে পড়বে আর হবেনা।

আর একজন বললো–মলিকের আসতে এখনও ঢের বাকি। ইচ্ছা মত পান করে নাও দোস্ত।

মশালের আলোতে সব দেখতে পাচ্ছিল আর তাদের কথাবার্তাগুলো সব স্পষ্ট শুনতে চাচ্ছিলো রহমান। বুঝতে পারলো–এটা কোন শয়তান লোকদের আস্তানা হবে। দুষ্কৃতিকারীগণ তাদের শয়তানীর জন্য এই নির্জন বনভূমিটাই বেছে নিয়েছে। রহমান স্তব্ধ নিশ্বাসে লোকগুলির কার্যকলাপ লক্ষ্য করতে লাগলো।

মশালটা তখনও দপ দপ করে জ্বলছে।

ঝোপ-জঙ্গলে আত্মগোপন করে প্রতিক্ষা করছে রহমান। মশা আর পিঁপড়ের কামড়ে গা। জ্বালা করছে তবু একটুও শব্দ করছেনা সে। কারণ তাকে জানতে হবে-নূরী এখানে আছে কি না।

লোকগুলো বোতলের পর বোতল নিঃশেষ করে চললো–হ্যাঁসছে, এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে, ফিস ফিস করে গানের কলি আওড়াচ্ছে।

হঠাৎ চমকে উঠলো রহমান–ভারী বুটের শব্দ শোনা গেলো সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা টর্চের আলোও যেন এগিয়ে আসছে এদিকে।

রহমান নিজকে আরও গোপনে লুকিয়ে ফেললো, দুলকীর জন্য চিন্তা কোনক্রমে যদি ওদের। নজরে পড়ে যায় তাহলে বিভ্রাট ঘটবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অল্পক্ষণ পর রহমান। কতকটা আস্বস্ত হলো, টর্চের আলো আর ভারী বুটের শব্দ ওপথে না গিয়ে সোজা মশালের আলো লক্ষ্য করে এগুতে লাগলো।

এবার রহমান বুঝতে পারলো–এখানে মশালটা জ্বালিয়ে রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য মশালের আলোটা পথের নির্দেশ বলে দিচ্ছে।

টর্চের আলো আর ভারী বুটের শব্দ মশালের আরো লক্ষ করেই যে এগুচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

হঠাৎ একটা হুইসেলের শব্দ জেগে উঠলো সেখানে।

রহমান অবাক হয়ে দেখলো–এতোক্ষণ যে লোকগুলি বোতলের পর বোতল মদপান। করছিলো তারা সবাই কেমন যেন তটস্থ হয়ে উঠেছে। বোতলগুলি ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এমনিতেই তাদের চেহারা বিদঘুঁটে আর ভয়ঙ্কর, তারপর মদের নেশায় চোখগুলো সব। জবাফুলের মত লালে লাল হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকের কোমরের বেল্টে সূতীক্ষ্ণধার ছোরা ও রিভলভার ঝুলছে।

লোকগুলোর মুখোভাব দেখে রহমান বুঝতে পারলো–এমন কেউ আসছে, যার ভয়ে এরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।

রহমানের অনুমান মিথ্যা নয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন অদ্ভুত পোশাক পরা লোক এসে দাঁড়ালো পূর্বের লোকগুলির সামনে।

রহমান তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লক্ষ্য করলো–যে লোকগুলি এখন এলো তারা সংখ্যায় পাঁচজন। আরও আশ্চর্য হলো রহমান তাদের পোশাক দেখে, প্রত্যেকেরই দেহে একই রকম ড্রেস। গাঢ় সবুজ কোট-প্যান্ট-সার্ট এমন কি তাদের গলার টাইটা পর্যন্ত সবুজ। সকলের পায়েই। ভারী বুট। বাম হস্ত কোটের পকেটে, দক্ষিণ হস্তে টর্চ।

সবুজ পোশাক পরিহিত লোকগুলি এসে দাঁড়াতেই পূর্বের লোকগুলি সেলুট করে দাঁড়ালো। অবশ্য অদ্ভুত ভংগিতে সেলুট করলো ওরা। দক্ষিণ পা উঁচু করে আর দক্ষিণ বাজু মাথায় ঠেকিয়ে একটা শব্দ করলো।

পরমুহূর্তেই একটা শব্দ হলো রহমান বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে দেখলো–সবুজ পোশাক। পরা একজন লোক হঠাৎ কোটের পকেট থেকে বাম হস্তখানা টেনে বের করলো, হস্তে তার জমকালো রিভলভার, কোন রকমে দ্বিধা না করে পূর্বের লোকগুলির এক জনের বুক লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লো।

লোকটি তীব্র আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো ভূতলে।

রহমান ভেবে পেলোনা কি অপরাধ হয়েছিলো লোকটার। কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো, সে নিজেও দস্যু কিন্তু এমন তো সে কোন দিন দেখে নি। রহমানের পাষাণ হৃদয়টাও অজানা আশঙ্কায় দুলে উঠলো।

সবুজ পোশাক পরিহিত পাঁচ ব্যক্তির একজন কি যেন বললো। তারপর সবাই অগ্রসর হলো, পূর্বের লোকগুলিও অনুসরণ করলো ওদের পাঁচ জনকে। শেষ ব্যক্তি গাছের ডালে গোঁজা মশালটা তুলে নিলো হাতে।

পিছনে পড়ে রইলো রক্তমাখা মৃতদেহটা।

 সবাই চলে গেলো, একবার ফিরেও তাকালো না কেউ মৃত দেহটার দিকে।

যে স্থানে এতোক্ষণ ওরা দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিলো সেই স্থান হতে কয়েক গজ দূরে কালো মত কিছু দেখা গেলো মশালের আলোর ছটায়। ঠিক বোঝা না গেলেও রহমান অনুমান করে নিলো– সেটা পাহাড় বা ঐ ধরণের বিরাট একটা পাথরের স্তূপ ছাড়া কিছু না।

রহমান ঝোপের মধ্য থেকে বেরিয়ে কিছুটা সরে এলো। বনভূমি রাতের জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিলো তাই তাকে কেউ ওরা দেখতে পেলোনা গাছের গুঁড়ির আড়ালে আত্মগোপন করে দাঁড়িয়ে রহমান এই অদ্ভুত লোকগুলির কার্যকলাপ লক্ষ্য করতে লাগলো।

মশালের আলোতে সব স্পষ্ট দেখা না গেলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে সব। সর্বপ্রথম সবুজ পোশাক পরিহিত লোকগুলি পাহাড়টির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো, পিছনে অন্যান্য লোকগুলি।

রহমান অবাক হয়ে দেখলো–পাহাড়টা হঠাৎ যেন ধীরে ধীরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণে আরও আশ্চর্য হলো–লোকগুলি সব ঐ পাহাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হলো।

রহমানের চোখের সম্মুখে এবার সব অন্ধকার হয়ে এলো। এখন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা সে, চারিদিকে ঘোর অন্ধকার রহমান এবার কি করবে, কোথায় যাবে, ভাবতে লাগলো। একটু পূর্বে দুবৃত্ত শয়তান লোকগুলির হৃদয়হীনতার যে চাক্ষুষ প্রমাণ সে পেয়েছে তাতে বুঝতে পেরেছে লোকগুলি শুধু ভয়ঙ্করই নয়, সাংঘাতিক অমানুষ! রহমান ভোরের আশায় অপেক্ষা করবে না দূলকী নিয়ে ফিরে যাবে শহরে, ভাবতে লাগলো। নূরী যে এখানেই আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

*

স্বামীর বাহুবন্ধনে নিজকে বিলিয়ে দিয়ে মনিরা বেহেস্তের সুখ অনুভব করে, অনাবিল আনন্দে আল্লুত হয় তার হৃদয়। পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন আজ মনিরার অন্তরে দানা বেঁধে উঠেছে। এমন করে স্বামীকে সে কোনদিন পায়নি। মুদিত আঁখিদ্বয়, ঠোঁটের কোণে মৃদু মধুর হাসি, দক্ষিণ হস্তে স্বামীর কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরে আছে মনিরা!

আকাশে চাঁদ হাসছে।

জোছনায় পৃথিবী ঝলমল করছে!

ফোয়ারার পানিতে চাঁদের আলো স্বপ্নপুরীর মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি করে চলেছে।

বাগানবাড়ির মধ্যে সান বাঁধানো সোফায় বসে ছিলো ওরা দু’জনায়-দস্যু বনহুর আর মনিরা। তাদের সম্মুখেই ফোয়ারার পানিগুলো ঝিরঝির করে পড়ছে। মৃদুমন্দা বাতাস অজানা ফুলের সুরভী নিয়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে সে দিকে।

কত রকম ফুল ফুটে আছে বাগানে। কত অজানা ফুলের সমারোহ।

বনহুর মনিরার মুদিত আঁখি দুটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে–অপূর্ব!

 মনিরা শান্ত মধুর কন্ঠে বলে–চাঁদের আলো না ফুলের সুবাস?

বনহুর মনিরার চিবুকে মৃদু চাপ দিয়ে বলে–তোমার মুখ। সত্যিই মনিরা, তোমার মুখের দিকে তাকালে আমি ভুলে যাই আমার অস্তিত্ব।

তবুও আমি তোমাকে ধরে রাখতে পারিনা, সেই আমার দুঃখ।

মনিরা, তুমি অবুঝের মত কথা বললো, আমি তো সব সময় তোমার পাশেই আছি। যখনই তুমি আমাকে স্মরণ করো তখনই তো আমি ছুটে আসি তোমার কাছে।

তবুও আমার তৃপ্তি হয়না, আমার মনে চায় সব সময় তোমাকে ঘরে রাখি আমার অন্তরের অন্তস্থলে…

মনিরা।

হাঁ, আমি তোমাকে সব সময় কাছে পেলে আর কিছু চাইনা। সমস্ত দুনিয়ার পরিবর্তে আমি তোমাকে কামনা করি। জানোনা–নারীর স্বামীই যে সর্বস্ব।

মনিরা, আমারও কি ইচ্ছা হয়না সব সময় তোমাকে এমনি করে বেঁধে রাখি বাহুবন্ধনে? কিন্তু কি করবো বলো–আমি যে পারিনা আমার অসহায় ভাই-বোনদের ছেড়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে।

তাহলে তুমি তাদের নিয়েই থাকো। অভিমান ভরে স্বামীর বাহুবন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে নিয়ে সরে বসে মনিরা।

বনহুর ব্যথাকরুণ কণ্ঠে বলে উঠেছিঃ তুমি তো অবুঝ নও মনিরা। তোমার জ্ঞান-গরিমা অন্যান্য যে কোন নারীর চেয়ে অনেক–অনেক বেশি। মনিরা, তুমি শুধু নারী নও তুমি দস্যু বনহুরের সহধর্মিণী। তোমার হৃদয় হবে যেমন কোমল তেমনি পাষাণের চেয়েও শক্ত। ব্যথিতের বেদনায় তোমার অন্তর গলে যাবে কিন্তু জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে তুমি হবে রণরঙ্গিনী।

তুমি যা চাও তাই হবো, তাই হবো… মনিরা স্বামীর বুকে মুখ গোজে।

 সত্যি মনিরা?

 হাঁ তুমি যা চাও আমি তাই করবো।

 মনিরা।

বলো?

আজকের এই মধূময় সন্ধ্যায় তোমার বীণার সুর শুনবার জন্য মনটা আমার আকুল বিকুল করছে। শোনাবে মনিরা?

তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করাই যে আমার জীবনের ব্রত।

মনিরা।

তুমি একটুখানি বসো, আমি বীণা নিয়ে আসি।

উঁহু, ছেড়ে দেবোনা তোমাকে।

তাহলে?

 তাহলে গান শোনাও।

উঁহু।

 গাও মনিরা।

মনিরা বনহুরের বাহুবন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে নিয়ে ছুটে পালায়।

মনিরার হাসির শব্দ শোনা যায় ওদিকে গোলাপ ঝাড়ের পাশে।

 বনহুর উঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে মনিরার চলে যাওয়ার পথের দিকে।

 মনিরা চলে গেলো।

বনহুর পায়চারী করছে ধীর মন্থর গতিতে।

ফুরফুরে হাওয়ার বনহুরের চুলগুলি উড়ছে। আজ তার শরীরে ধপধপে সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবী। মনিরা বনহুরকে নিজের হাতে আজ সাজিয়ে পরিয়ে দিয়েছে। এখন বনহুরকে দেখলে কে বলবে সে দস্যু বা ডাকু। অপূর্ব অদ্ভুত সুন্দর একটি যুবক সে।

মনিরার প্রতিক্ষার অপেক্ষা না করে বনহুর তামাসা করার জন্য লুকিয়ে পড়লো পাশের হাস্নাহেনার ঝাড়ের আড়ালে। হাটু গেড়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মনিরা।

অল্পক্ষণ পরে ফিরে এলো মনিরা, হাতে তার বীণা। স্বামীকে না দেখে চঞ্চল হয়ে উঠলো সে। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে লাগলো এদিকে ওদিকে। কোথাও ওকে খুঁজে না পেয়ে বিষণ্ণ মনে বসে পড়লো পাথরাসনে। ভাবতে লাগলো–তবে কি সে চলে গেছে। এমনি আরও কতদিন এসেছে–আবার ধুমকেতুর মত চলে গেছে–যাবার সময় তাকে একটি কথাও বলে যায় নি। মনিরার হৃদয় গুমড়ে কেঁদে উঠে, আজও মনিরা স্বামীকে চিনতে পারে নি। সময় সময় ওর মনে। হয়, তার মত সুখী এ দুনিয়ায় আর বুঝি কেউ নয়, আবার কখনও অন্তরটা ওর গুঁমড়ে কেঁদে উঠে তার মত অসহায় নারী আর কোথাও নেই। যাকে সে চায়, জীবন দিয়ে যাকে সে কামনা করে, সে যে তার বাধ্য নয়…

মনিরা যখন স্বামীর চিন্তায় ব্যস্ত তখন বনহুর হাসনাহেনার ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে তার পিছনে এসে দাঁড়ালো, আলগোছে চেপে ধরলো মনিরার চোখ দুটো।

স্বামীর হাতের পরশ মনিরার শিরায় শিরায় আলোড়ন জাগায়! মুহূর্তে ওর অন্তর থেকে দূর। হয়ে যায় বিষণ্ণতার ছাপ। মুখমণ্ডল উজ্জল দীপ্ত হয়ে উঠে, স্বামীর হাতের উপর হাত রেখে বলে– দুষ্ট!

 বনহুর মনিরার চোখ দুটো মুক্ত করে দিয়ে বসে পড়লো পাশে। শান্ত-সুমিষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠেছে তার ঠোঁটের ফাঁকে।

মনিরা গম্ভীর গলায় বললো–আমাকে ভাবিয়ে তুমি আনন্দ পাও, তাইনা?

 মিছামিছি কেনো তুমি ভাবো বলো তো? আমি কি কচি শিশু, তাই হারিয়ে যাবো?

শিশু তুমি নও কিন্তু তোমাকে যে আমি প্রতি মুহূর্তে হারাই। কিছুতেই পারি না আমি তোমাকে ধরে রাখতে। ওগো, চিরদিন শুধু দূরে দূরেই থাকবে, কোন দিন কি তোমায় নিশ্চিন্ত মনে পাবো না?

আমি তো তোমারই মনিরা।

তবু তোমাকে যেন প্রাণভরে পাই না, সব সময় ভয় কখন আবার হারিয়ে যাবে…

ও তোমার মনের দুর্বলতা মনিরা। যাক, এবার শুরু করো তোমার বীণার ঝঙ্কারে মুখর হয়ে উঠুক এই জোছনা ভরা রাত।

মনিরা বীণাখানা কোলের উপর তুলে নিলো।

 অপূর্ব ঝঙ্কার উঠলো মনিরার বীণাতে।

বনহুর নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে।

দখিনা বাতাস ফুলের সুরভী নিয়ে জানায় তাদের সাদর সম্ভাষণ।

 বীণার ঝঙ্কারে মুখরিত হয়ে উঠে বাগানবাড়ির আকাশ বাতাস।

 বীণার সুর এক সময় থেমে যায়।

বনহুর ওকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে।

 এক খণ্ড মেঘ তখন চাঁদকে আড়াল করে দাঁড়ায়।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা শিষ দেবার শব্দ শোনা যায়।

 চমকে উঠে বনহুর, মনিরাকে মুক্ত করে দিয়ে সোজা হয়ে বসে, মুখোভাব গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার।

মনিরা বলে–কিসের শব্দ ওটা?

বনহুর চিন্তিত কণ্ঠে বললো–রহমানের ইংগিতপূর্ণ শিষ দেবার শব্দ ওটা। তবে কি রহমান ফিরে এসেছে? শেষের কথাটা মনেই বলে উঠলো বনহুর।

আবার ঐ রকম শব্দ শোনা গেলো, ঠিক্ বাগনের পিছন থেকে শব্দটা আসছে বলে মনে হলো তাদের।

বনহুর আর বিলম্ব না করে মনিরাকে বললো তুমি একটু অপেক্ষা করো মনিরা, আমি আসছি।

বনহুর চলে গেলো।

মনিরার বুকের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করেছে, একটা আশঙ্কা তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। বনহুর চলে গেলেই মনিরা আড়ালে এসে দাঁড়ালো, জোছনার আলোতে স্পষ্ট দেখলো–বনহুরের প্রধান অনুচর রহমানই বটে–মাথায় পাগড়ি, শরীরে খাকী পোশাক ঠিক দারওয়ানের ড্রেস পরে আজ সে এসেছে।

বনহুরের দেহে রহমান কুর্ণিশ করে দাঁড়ালো, কোন কথা প্রথমে বলতে পারলো না সে।

বনহুর গম্ভীর-কঠিন কণ্ঠে বললো– এবার কোথায় ডুব মেরেছিলে?

সর্দার!

জানো তোমার অপরাধ কত গুরুতর?

জানি সর্দার।

জেনেও তুমি আমার সম্মুখে আসতে পারলে? তোমার সাহস মন্দ নয় দেখছি।

সর্দার, না এসে উপায় নেই। বড় বিপদে পড়ে আপনার নিকট এসেছি। সর্দার আমি পারলামনা,

রহমানের কন্ঠ বাস্প রুদ্ধ হয়ে এলো।

বনহুর গর্জে উঠলো– নেকামি ছেড়ে আসল কথা বলো।

 সর্দার নূরীকে দুবৃত্তগণ হরণ করে নিয়ে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের মুখমণ্ডল কালো হয়ে উঠলো, কঠিন কণ্ঠে বললো–আর তুমি কি করলে?

অমাবস্যায় নারীকে ওরা চুরি করে নিয়ে গেছে আমি দু সপ্তাহ কাল ধরে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। সর্দার, ভেবেছিলাম আমি নূরীকে শয়তান দুরাচারগণের হাত থেকে উদ্ধার করবো কিন্তু সক্ষম হলাম না।

তাই এসেছো আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে?

হা সর্দার।

রহমান, তুমি আমার বিশ্বস্ত অনুচর না হলে এতোক্ষণ তোমার প্রাণবায়ু হাওয়ায় মিশে যেতো। একটু থেমে আবার বললো–যাকে নিয়ে আত্মগোপন করতে পারলে, তাকে হেফাযতে রাখবার মত সামর্থ হলো না? যাও আমি তোমাকে সাহায্য করতে অক্ষম।

সর্দার! রহমান দুহাত জুড়ে বিনীতভাবে বললো।

আড়ালে দাঁড়িয়ে মনিরা ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো, কারণ নূরীকে ভালভাবেই জানে মনিরা। নূরী যে দস্যু বনহুরের বাল্য সহচরী এবং নূরী যে বনহুরকে ভালবাসে, সে কথা মনিরার অজ্ঞাত নয়। রহমান যে মুহূর্তে নূরীর হরণ কথাটা উচ্চারণ করেছিলো তখন মনিরার মনে কে যেন হাতুড়ির আঘাত করলো এর চেয়ে যদি রহমান বনহুরের গ্রেপ্তার সংবাদ বহন করে আনতো তবু এতোখানি চিন্তি হতোনা। মনিরা সব সহ্য করতে পারে কিন্তু নূরীর নাম সে সহ্য করতে পারেনা। তারপর কোন দুৰ্বত্তের সঙ্গে তার স্বামীকে মোকাবেলা করতে হবে, কোথায় কেমনভাবে দিন কাটবে তার, কত বিপদের সম্মুখীন হতে হবে তাই বা কে জানে… মনিরা স্বামীর অমঙ্গল চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো।

রুদ্ধনিশ্বাসে বনহুর আর রহমানের কথাবার্তা শুনতে লাগলো মনিরা। বুকের মধ্যে তার তোলপাড় শুরু হয়েছে। একটা অসহ্য যন্ত্রণা তাকে দুঞ্জিভূত করে চললো। একটু পূর্বেই মনিরা স্বামীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বেহেস্তের সুখ অনুভব করছিলো। জোছনা ভরা রাতটা তার কাছে স্বপ্নময় মনে হচ্ছিলো আর এখন সব যেন অসহ্য লাগছে। রহমানের কথাগুলো তার কানে যেন গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছিলো। কেন, রহমান পারেনা নূরীকে উদ্ধার করতে? তার স্বামীকে কেন সে এ সংবাদ জানাতে এসেছে? মনিরা যখন এসব ভাবছে তখন পুনরায় তার কানে ভেসে এলো। রহমানের করুণ ব্যথাভরা কণ্ঠস্বর, রহমান বলছে– সর্দার, নূরীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যই আমি আপনার বিনা অনুমতিতে তাকে নিয়ে পালিয়েছিলাম, কিন্তু শেষ অবধি তাকে বাঁচাতে পারলামনা… বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো রহমানের কন্ঠ। একটু থেমে আবার বললো সে– সর্দার নূরী এখন যে অবস্থায় আছে তাতে মৃত্যু তার সুনিশ্চিত। সর্দার দয়া করুন … রহমান। বনহুরের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসে পড়লো।

বনহুর দাতে অধর দংশন করে বললো –যা সালামতে পারবেনা কোন্ ভরসায় তাকে। আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলে?

সর্দার, বিশ্বাস করুন আমি নূরীকে আত্মসাৎ করতে চাইনি কোনদিন। তাকে ভালবাসতাম কিন্তু সে আমাকে কোনদিন ভালবাসতে পারেনি, আমি জোর করে তার ভালবাসা গ্রহণ করতে চাইনা সর্দার, আমি তাকে বোনের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছি।

রহমান!

হ সর্দার।

মনি কেমন আছে?

 মনি ভাল আছে। তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি।

বনহুর এবার কি যেন ভাবলো তারপর বললো–তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি মনিরার কাছে বিদায় নিয়ে আসি।

বনহুর কথাটা উচ্চারণ করতেই মনিরা ছুটে গিয়ে ঠিক পূর্বের সেই পাথরাসনে গিয়ে বসে পড়লো। মুখভাব প্রসন্ন রাখার চেষ্টা করেও সে পারলো না। চোখ দুটো কেমন বার বার ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো।

বনহুর মনিরার পাশে এসে দাঁড়ালো, তার মুখাভাবও সচ্ছ নয়। মনিরাকে নতমুখে বসে থাকতে দেখে বললো–মনিরা।

মনিরা কোন জবাব দিলো না।

বনহুর মনিরার চিবুক ধরে উঁচু করে তুললো–একি, তুমি কাঁদছো! আশ্চর্য হলো বনহুর।

 মনিরা তবু নীরব।

বনহুর মনিরার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো, ওর দক্ষিণ হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে বললো মনিরা, কি হলো তোমার?

কিছু হয়নি। কথাটা বলে স্বামীর হাতখানা সজোরে সরিয়ে দিলো মনিরা।

কিছু হয়নি তবে চোখে অশ্রু কেনো? আর হঠাৎ তোমার মুখভাব এতো গম্ভীর কেনো?

জানি না।

 মনিরা বলো?

না না আমাকে তুমি ছেড়ে দাও, যাও তোমার নূরীকে উদ্ধার করে আনোগে।

 মনিরা তুমি…

হাঁ, আমি সব শুনেছি। তোমার আর রহমানের সব কথা শুনেছি! ছিঃ তুমি না বলেছে– নূরী তোমার কেউ নয়।

আজও বলছি–তার সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ নেই… তাহলে মনি কে?

মনি!

হাঁ, যাকে রহমান স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে, যার সংবাদ জানার জন্য তুমি ব্যাকুল হয়েছিলে–বলো কে মনি?

মনি! মনি… মনির কথা বলছো? মনি…

কেনো, বলতে বাঁধছে বুঝি?

না, বাঁধছে নয় মনি নূরীর সন্তান।

কি বললে, নূরীর সন্তান মনি

হা,

কিন্তু সে নাকি আজও অবিবাহিতা, তবে কি করে তার সন্তান হলো?

বনহুর হঠাৎ কোন জবাব দিতে পারলোনা, মাথা নত করে কি যেন ভাবতে লাগলো।

মনিরা দুই হাতে চেপে ধরলো বনহুরের বুকের কাছে জামার খানিকটা অংশ–বলতে হবে মনির সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক?

মনিরা।

বুঝতে পেরেছি তুমি কত বড় জঘন্য… মনিরা বনহুরের জামার আস্তিন ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

বনহুরের সময় অল্প এদিকে মনিরার মনে সন্দেহের দোলা ওদিকে রহমান দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বেশিক্ষণ বিলম্ব করতে পারছেনা আর বনহুর। মনিরার ভুল ভাঙ্গানো চট করে সম্ভব নয়। বনহুর তবু বোঝাতে চেষ্টা করলো, মনিরার হাত খানা চেপে ধরলো–মনিরা আমাকে তুমি অবিশ্বাস করোনা। একদিন সব তোমাকে বলবো। আজকে তুমি আমায় খুশি মনে বিদায় দাও।

মনিরা নিশ্চুপ–পাথরের মূর্তির মত শুদ্ধ হয়ে গেছে সে।

বনহুর মনিরার চিবুক ধরে উঁচু করে নিজের হাতে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো– তুমি বিদায় না দিলে আমার অশুভ যাত্রা হবে মনিরা! তুমি কি তোমার স্বামীর অমঙ্গল চাও?

মনিরা একবার বনহুরের মুখে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি নত করে নিলো।

বনহুর বললো–মনি শুধু নূরীরই সন্তান নয়, তোমারও সন্তান সে।

চাইনা আমি পরের সন্তানকে নিজের করে নিতে। বলো মনি তোমার সন্তান কিনা?

 হাঁ, মনি আমার সন্তান।

উঃ! এও শুনতে হলো। না না, আমি চাইনা তোমাকে, তুমি চলে যাও, আমি আর তোমাকে চাইনা। যাও, যাও তুমি তোমার অপেক্ষায় তোমার নূরী আর মনি প্রহর গুণছে… কথা শেষ। করে দ্রুত চলে যায় মনিরা অন্তপুরে।

বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর সে ফিরে যায় রহমানের পাশে।

 রহমান দুলকী আর তাজকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলো।

 বনহুর তাজের পিঠে উঠে বসতেই উলকা বেগে ছুটতে শুরু করলো।

রহমান অনুসরণ করলো সর্দারকে।

বনহুর আরাকান রওয়ানা দেবার পূর্বে একবার আস্তানায় যাওয়াই সমীচীন মনে করলো। কারণ আরাকানে শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলা করতে হলে তাকে সেইভাবে প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে।

*

হাত-পা মজবুত দড়ি দিয়ে বাঁধা, চুলগুলো এলোমেলো, পরিধেয় বসন ছিন্ন-ভিন্ন ললাটের এক পাশে কেটে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ভূতলে অর্ধশায়িত অবস্থায় পড়ে আছে নূরী।

সম্মুখে শঙ্কর মাছের চাবুক হস্তে দণ্ডায়মান ডাকু ভোলানাথ। দুই পাশে তার পাঁচজন বিশ্বস্ত অনুচর বা সহকারী; সকলেরই দেহে গাঢ় সবুজ রং-এর পোশাক। এই পাঁচ ব্যক্তি ভোলানাথের দক্ষিণ হস্ত- যেমন এদের চেহারা তেমনি নিষ্ঠুর কঠিন ওরা।

ভোলানাথ কটমট করে তাকাচ্ছে নূরীর ভুলুণ্ঠিত দেহটার দিকে, চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে।

সবুজ পোশাক পরিহিত ব্যক্তিদের একজন রিভলভার উদ্যত করে বললো– দেওজী, হুকুম করুন, এক গুলীতে শেষ করে দি?

আর একজন বললো-বাগে যখন আসছেনা তখন আর রেখে কি হবে?

 অন্য একজন বললো– দেওজী, ওকে চাবুক মেরে শেষ করে ফেলুন।

ভোলানাথ মেঘের মত গর্জন করে উঠলো–এতো সহজে শেষ করবার বান্দা ভোলানাথ নয়। ভাল কথায় রাজি হয়নি, এবার শক্ত কথায় বাগে আনতে হবে। তারপর তাতেও না হয়, শঙ্কর মাছের চাবুকের আঘাত চামড়া ছিঁড়ে লবণ মাখিয়ে তবু রাজি করাবো। যেমন করে হোক ওকে আমার চাই… সঙ্গে সঙ্গে সপাং করে চাবুকটা এসে পড়ে নূরীর পিঠে।

নূরী আর্তনাদ করে উঠলো–উঃ উঃ আঃ আঃ…

শঙ্কর মাছের চাবুকের আঘাতে নূরীর পিঠের চামড়া কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ে, জামার খানিকটা অংশ চাবুকের সঙ্গে ছিঁড়ে চলে আসে। নূরী লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে।

আবার আঘাত করে ভোলানাথ।

 নূরী আর্তনাদ করে উঠে–উঃ আঃ আঃ উঃ…

ভোলানাথ এবার ইংগিত করে তার সহকারী সবুজ পোশাক পরিহিত লোকগুলিকে।

লোকগুলি নূরীকে টানতে টানতে বের করে নিয়ে যায়।

ভোলানাথ আসন গ্রহণ করে।

অল্পক্ষণ পর ফিরে আসে সবুজ পোশাক পরিহিত লোক পাঁচজন। ভোলানাথের আসনের দুই। পাশে বসে পড়লো ওরা।

সঙ্গে সঙ্গে একদল নর্তকী এসে নাচতে শুরু করলো। সবাই প্রায় সমবয়সী যুবতি। তাদের শরীরে পোশাক বলতে সামান্য। অর্ধ উলঙ্গ যুবতীগুলি নানা ভঙ্গীমায় নাচতে শুরু করলো।

একজন যুবতী একটা থালার সারাব পাত্র নিয়ে হাজির হলো ভোলানাথের সম্মুখে।

নাচের তালে তালে সারাব পান করে কুৎসিত হাসি হাসতে লাগলো ভোলানাথ ও তার সহকারীগণ।

নাচ শেষ হলো।

ভোলানাথ একটা নর্তকীকে ধরে ফেললো খপ করে। ভোলানাথের সহকারীগণ একজন নর্তকীকে বাহু-বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো।

ঠিক সেই মুহূর্তে একখানা ছোরা এসে গেঁথে গেলো ভোলানাথের সম্মুখস্থ আসনের গায়ে।

 চমকে উঠলো ভোলানাথ!

নর্তকীটিকে মুক্ত করে দিয়ে ছোরাখানা তুলে নিলো হাতে; সঙ্গে সঙ্গে ভোলানাথের সহকারীগণ তাদের বাহু-বন্ধনে আবদ্ধা নর্তকীগণকে মুক্ত করে দিল।

ভোলানাথের চোখ দুটো আগুনের ভাটার মত জলে উঠেছে। হাতের ইংগিতে নর্তকীগণকে বেরিয়ে যেতে বললো সে।

নর্তকীগণ বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

ভোলানাথ ছোরাখানা হাতে নিয়ে কর্কশ কন্ঠে বললো- যেখানে মাছি প্রবেশ করতে সক্ষম হয়না সেখানে এ ছোরা প্রবেশ করলো কিভাবে?

অন্যান্য সকলে বলে উঠলো–তাই তো, এ ছোরা এলো কোথা থেকে?

 সবাই ছোরাখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলো।

ভোলানাথ একটা ঘন্টাধ্বনি করলো, সঙ্গে সঙ্গে অগণিত ডাকু সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করলো সেই কক্ষে।

ভোলানাথ ছোরাখানা উঁচু করে ধরে বললো–আমার গুপ্ত আস্তানায় এই ছোরাখানা কিভাবে এলো শীগগীর তার সন্ধান নাও। যাও…

যেমন সারিবদ্ধভাবে ডাকুর দল কক্ষে প্রবেশ করেছিলো তেমনিভাবে বেরিয়ে গেলো তারা।

 ভোলানাথ ছোরাখানার দিকে তাকিয়ে বললো–দেখেছো শ্যাম, ছোরাখানা সাধারণ নয়।

শ্যাম নামীয় লোকটা বললো–হ দেওজী, ও ছোরা কোন সাধারণ লোকের নয়।

আর একজন বলে–ছোরার বাট খাঁটি সোনার তৈরি বলে মনে হচ্ছে।

অন্য জন বললো মনে হচ্ছে নয়, খাঁটি সোনার তৈরি এটা।

ভোলানাথ ছোরাখানা সজোরে টেবিলে নিক্ষেপ করে বললো– বাজে কথা রেখে এখন ছোরা নিক্ষেপকারীকে আবিষ্কার করো। এক মুহূর্ত বিলম্ব হওয়া আর উচিৎ নয়।

ভোলানাথের সহকারীগণ উদ্যত রিভলভার হস্তে দ্রুত কক্ষে ত্যাগ করলো।

 ভোলানাথ পায়চারী করতে লাগলো।

*

রহমান মনিকে কোলে করে বনহুরের পাশে এসে দাঁড়ালো।

 মনি বনহুরকে দেখবামাত্র আনন্দ-ধ্বনি করে উঠলো–বাপি!

বনহুর মনিকে কোলে নিয়ে ছোট্ট একটা চুমু এঁকে দিলো ওর গালে, তারপর বললো বাপি তুমি কেমন আছো?

আমি খুব ভালো আছি, কিন্তু মাম্মীর জন্য আমার খুব কষ্ট লাগছে। বাপি, মাম্মী কোথায়– বলো না।

মাম্মী আছে।

 কোথায়?

 বেড়াতে গেছে মনি, আবার আসবে।

 বেড়াতে গেছে তবে আসছে না কেন?

আসবে, আসবে মনি… বনহুরের কন্ঠে ধরে আসে।

রহমান বনহুরের কোল থেকে মনিকে নিয়ে বলে যাও বাবা, বাইরে যাও তোমার বাপি বিশ্রাম করবে।

মনি বনহুরের কোল থেকে এসে মুখ ভার করে ফেললো–মাম্মী চলে গেছে, আবার বাপিও চলে যাবে। আমি যাবো না।

বনহুর মনির চিবুক ধরে নাড়া দিয়ে বলে–না না, আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না মনি।

সত্যি বলছো বাপি?

হাঁ! বনহুর কথাটা বলে আনমনা হয়ে গেলো এতোটুকু ছোট্ট শিশুকে এতো বড় মিথ্যা বলাটা তার মুখে এলো কি করে! সত্যি কি সে চিরদিনের জন্য মনির পাশে থাকতে পারবে? না, কিছুতেই এ সম্ভব নয়। সে দস্যু-ডাকু, আর মনি একটা নিষ্পাপ ফুলের মত শিশু; তার সান্নিধ্য মনিকে কোনদিন মানুষ করে গড়ে তুলবেনা। মনি মানুষ হবে–এই তার কামনা… না না, আর মনিকে মায়ার জালে জড়াবে না সে। মনির সান্নিধ্য ছেড়ে দূরে সরে থাকবে। যদি ওকে কোনদিন দেখবার ইচ্ছা হয়, দূর থেকে দেখে যাবে তবু আর মনির সম্মুখে আসবে না।

মনি বনহুরের দক্ষিণ হাত চেপে ধরে বলে–বাপি, আমি খেলতে গেলে আবার পালিয়ে যাবে না-তো?

বনহুর কোন কথা বললো না বা বলতে পারলো না।

রহমান বললো–মনি, তুমি খেলতে যাও, আমি বলছি তোমার বাপি তোমাকে ছেড়ে আর পালাবে না।

মনি একবার রহমান আর একবার বনহুরের মুখে তাকিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো।

বনহুর বললো এবার–রহমান, অতোটুকু শিশুর কাছে এতো বড় মিথ্যা বলাটা কি ঠিক হলো?

সর্দার, তাছাড়া যে আর কোন উপায় ছিলো না। সত্যি বলতে কি সর্দার, আপনার সন্তান আপনার চেয়ে বুদ্ধি-জ্ঞানে কিছু কম নয়। অতোটুকু শিশু হলেও সে মস্তবড় জ্ঞানী,

রহমান, আমি চাই না সে আমার মত দুষ্কৃতি জন হয়। আমি চাই মনি মানুষের মত মানুষ হবে। রহমান–তুমি ওকে মানুষ করে গড়ে তুলবে, সেটাই আমার ইচ্ছা।

সর্দার আপনার ইচ্ছা যেন পূর্ণ করতে পারি।

কিছুক্ষণ বনহুর আর রহমান উভয়েই নীরব রইলো। বনহুর আসনে উপবেশন করে একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো।

রহমান বললো এবার–সর্দার, আপনি কি নূরীর সন্ধান পেয়েছেন?

 শুধু নূরীর সন্ধান নয়, শয়তান ভোলানাথ ডাকুর গুপ্ত আস্তানার সন্ধানও আমি পেয়েছি।

সর্দার।

 হাঁ রহমান, তাছাড়াও আমি ভোলানাথকে আমার উপস্থিতি জানিয়ে দিয়ে এসেছি।

সর্দার, এটা কি ভালো হয়েছে? ওরা সতর্ক হয়ে নেবে এবং নিজেদের সব সময় প্রস্তুত রাখবে।

রহমান অজ্ঞাতসারে কাউকে আক্রমণ করা আমার স্বভাব নয়। আমি চাই তাদের সজাগ রেখে কাজ করতে।

নূরী কেমন আছে সর্দার?

বড় মর্মস্পর্শী অবস্থায় আছে।

 আপনি তাকে দেখেছেন সর্দার?

হাঁ, তার অতি নিকটেই ছিলাম।

 সর্দার।

 তবু তাকে উদ্ধার করিনি কেনো এই তো?

জানি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করাই সমীচীন। সর্দার, আমি এতোদিন চেষ্টা করেও কিছুমাত্র অগ্রসর হতে পারিনি আর আপনি মাত্র এই কয়েক দিনের মধ্যেই শয়তানদের গুপ্ত আস্তানায় প্রবেশে সক্ষম হয়েছেন!

কিন্তু তোমার সাহায্যেই আমাকে এতোদূর অগ্রসর হতে সক্ষম করেছে। রহমান, আরাকানে পৌঁছে আর একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি যা আমার হৃদয়ে অত্যন্ত আঘাত করেছে।

আমি বুঝতে পেরেছি সর্দার। আরাকানের এ অবস্থার জন্য দায়ী এক জাতের মানুষ, যারা, জানোয়ারের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

রহমান, আমি সেই জানোয়ারদের টুটি ছিঁড়ে রক্ত শুষে নেবো।

সর্দার আপনার মর্জি। আমি জানতাম, এ শহরটা বৈচিত্রময় কিন্তু পর পরই জানতে পেরেছি শুধু শহরটাই বৈচিত্রময় নয়, এখানের মানুষগুলো আরও অদ্ভুত। এখানে গরিবদের জীবনের কোন দাম নেই পথের কুকুরের মতই নিকৃষ্ট ওরা। সারাদিন পরিশ্রম করেও কেউ তদের উচিৎ মূল্য। পায়না। পায় তারা তিরস্কার আর লাঞ্ছনা-মুজুরির পরিবর্তে পায় বেত্রাঘাত। আমি আজ কয়েক মাস এ শহরে আছি মর্মে মর্মে উপভোগ করেছি এ দেশের মানুষের হৃদয়হীন অত্যাচার।

বনহুর সিগারেট থেকে একমুখ ধুয়া নির্গত করে বললো—হু।

 এবার রহমান বললো–সর্দার, কিছু মুখে দিন।

হাঁ, চলো এই বেলা কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। যাও রহমান, মনিকে ডেকে নিয়ে এসো, একসঙ্গে খাবো।

রহমান বেরিয়ে গেলো, অল্পক্ষণ পরে মনি সহ ফিরে এলো।

বনহুর মনিকে টেনে নিলো কোলের মধ্যে, আদর করে বললো-বাপি চলো, খাবার খাবে চলো।

মনি খুশি হয়ে বললো–চলো বাপি।

খাবার টেবিলে বসে খেতে বললো মনি–বাপি, মাম্মী তো আজও এলোনা। কোথায় গেছে আমার মাম্মী বলো না বাপি?

বনহুর সবেমাত্র খাবার মুখে তুলতে যাচ্ছিলো মনির কথায় হাত-খানা মাঝপথে থেমে যায়, একটা ব্যথা-বেদনাভরা ভাব ফুটে উঠে বনহুরের মুখে।

রহমান বলে উঠে ছিঃ মনি, খাবার খেতে বসে কথা বলতে নেই। খাও।

 আগে বলো কাক্কু মাম্মী কোথায়? মাম্মীর জন্য মনটা বড় কেমন করছে।

বনহুর মনিকে টেনে নিলো বুকের মধ্যে, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বললো তোমার মাম্মীকে আনতে যাচ্ছি মনি।

সত্যি? খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠে মনি।

বনহুর মনির মুখে খাবার তুলে দেয়–তাহলে তুমি খেয়ে নাও কেমন।

মনি খেতে শুরু করলো।

রহমান বললো সর্দার আপনি একটু মুখে দিন।

বনহুর নিজেও খেতে আরম্ভ করলো।

মজবুত দড়ির বাঁধন নূরীর হাত-পায়ে কেটে বসে গেছে। শঙ্কর মাছের চাবুকের আঘাতে পিঠের চামড়া কেটে ঘা হয়ে গেছে। চুলগুলো জটার মত শক্ত হয়ে উঠেছে। তবু নূরীকে ভোলানাথ বাগে আনতে পারেনি। নূরী কঠিন পাথরের মূর্তির মতই ধীর-স্থির নিশ্চুপ। জীবন দেবে সে তবু ইজ্জৎ হারাবে না।

নূরীকে প্রতিদিন ভোলানাথ স্বয়ং তার প্রিয় সহচরগণ সহ নির্মমভাবে কঠিন শাস্তি দিয়ে থাকে। শঙ্কর মাছের চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করে থাকে।

তারপর অর্ধমৃত অবস্থায় বন্দী করে রাখে অন্ধকার কারাকক্ষে। সারাদিন পর সামান্য পানি। আর শুকনো রুটী খেতে দেয় নূরীকে।

দিন দিন নূরীর দেহ ক্ষীণ হয়ে গেছে। শঙ্কর মাছের লেজের চাবুকের আঘাতে শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। তবুও নূরী ভোলানাথের কথায় সম্মতি দেয়না।

পরদিন আবার নূরীকে ভোলানাথের অনুচরগণ তার গুপ্ত কক্ষে নিয়ে এলো। আবার চললো তার উপর নির্মম আঘাতের পর আঘাত।

ভোলানাথ আজ হিংস্র মূর্তি ধারণ করেছে, চোখ দুটো তার আগুনের গোলার-মত জ্বলছে। নিশ্বাস দ্রুত বইছে। দাঁতগুলি যেন জানোয়ারের মত বেরিয়ে এসেছে ঠোঁটের উপর। কঠিন কণ্ঠে বললো–বল, আমার কথায় রাজি হয়েছিস কিনা?

না না… নূরী তীব্র কণ্ঠে বললো।

 সঙ্গে সঙ্গে ভোলানাথের হাতের চাবুক সপাং করে পড়লে নূরীর পিঠে। নূরী যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে ফেললো, তার গলা দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো–উঃ। তারপর বললো সে আমাকে মেরে ফেলো তবু আমি রাজি নই।

কি বললি! দেওজীর মুখের উপর একথা বলতে পারলি শয়তানী কথাটা উচ্চারণ করলো ভোলানাথের সবুজ পোশাক পরিহিত অনুচরগণের একজন।

আর একজন বললো–দেওজী, হুকুম করুন খতম করে দি?

ভোলানাথ রক্তচক্ষু গোলাকার করে বললো–আমি ওকে এই শঙ্কর মাছের চাবুক দিয়ে খতম করবো কথাটা বলে চাবুক দিয়ে পুনরায় আঘাত করতে গেলে সে নূরীকে।

চাবুক দিয়ে নূরীর শরীরে আঘাত করবার পূর্বেই কে যেন তার হস্তস্থিত চাবুকটা এটে ধরে ফেললো। ফিরে তাকাবার আগেই চাবুক ভোলানাথ দেওজীর হস্তচ্যুত হলো। আশ্চর্য হয়ে দেখলো ভোলানাথ–তার পিছনে দাঁড়িয়ে একটি জমকালো পোশাক পরিহিত লোক।

সঙ্গে সঙ্গে ভোলানাথের সবুজ পোশাক পরিহিত অনুচরগণ রিভলভার উদ্যত করলো। কিন্তু গুলী ছুড়বার অবসর তারা পেলো না। জমকালো-পোশাক পরিহিত ব্যক্তির চাবুকের আঘাতে তাদের হাতের রিভলভার ছিটকে পড়লো দূরে।

ভোলানাথ ভীম গর্জনে গর্জে উঠলো–তুমি কে?

আমি দস্যু বনহুর! কথা শেষ করার সঙ্গেসঙ্গেই তার হাতের চাবুকখানা ভোলানাথের শরীরে এসে পড়লো।

ভোলানাথ আর্তচিৎকার করে উঠলো– গ্রেপ্তার করো।

বনহুরের চাবুক তখন পর পর সবুজ পোশাকওয়ালা লোকগুলির দেহে সপাং করে পড়ছে।

কেউ যে মেঝে থেকে রিভলভার কুড়িয়ে হাতে তুলে নেবে, তার অবসর পাচ্ছেনা।

বনহুরের হাতে শংকর মাছের চাবুক যেন বিদ্যুতের মত চমকাচ্ছে।

এবার সবুজ পোশাক পরিহিত লোকগুলি পালাবার জন্য দরজার দিকে দৌড় দিলো কিন্তু পথের মুখে গুলী ভরা রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে রহমান। তার শরীরেও কালো পোশাক।

বনহুর এবং রহমানের শরীর কালো পোশাকে আচ্ছাদিত থাকলেও কারো মুখে আবরণ ছিলো না।

এতো যন্ত্রণার মধ্যেও নূরীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, চোখ দুটোতে আনন্দ যেন ঝরে পড়তে লাগলো। সে বারবার তাকাচ্ছে বনহুরের দিকে, ভাবছে সে তো স্বপ্ন দেখছে না।

বনহুরের তখন কোন দিকে খেয়াল নেই চাবুকের আঘাতে ভোলানাথ ডাকুকে কাবু করা এবং তার শয়তান পঞ্চ অনুচরদের ধরাশায়ী করাই তার কাজ।

পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে রহমান,হাতে গুলী ভরা উদ্যত রিভলভার।

বনহুরের চাবুকের আঘাতে ভোলানাথ আর তার পঞ্চ সহচর মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। এক এক জনের জামা কাপড় ছিঁড়ে পিঠের চামড়া কেটে রক্ত ঝরে পড়তে লাগলো। বনহুরের চাবুক তবু থামতে চায়না।

দক্ষিণ হস্তে চাবুক চালাচ্ছে। আর পা দিয়ে রিভলভারগুলো সরিয়ে দিচ্ছে বনহুর রহমানের দিকে।

বনহুরের হস্তে শংকর মাছের লেজের চাবুক কিছুক্ষণের মধ্যেই কাবু করে ফেললো ভোলানাথ ও তার পঞ্চ সহচরগণকে। সবাই মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে বিলাপ করছে রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে। ওদের দেহ। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতের ন্যায় নির্জীব হয়ে পড়লো ভোলানাথ ও তার সহচরগণ।

বনহুর এবার শংকর মাছের চাবুকখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলো, তারপর দ্রুত হস্তে তুলে নিলো নূরীকে হাতের উপর।

বনহুর নূরীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রহমান রিভলভার উদ্যত করে ধরে রইলো ভোলানাথ ও তার সঙ্গীদের লক্ষ্য করে।

তাজের পিঠে বনহুর নূরীকে তুলে নিলো।

তাজ উল্কাবেগে ছুটতে শুরু করলো।

নূরীর হাত পা বন্ধন অবস্থায় থাকায় বনহুর নূরীকে বাম হস্তে আঁকড়ে ধরে ছিলো শক্ত করে। দক্ষিণ হস্তে তাজের লাগাম এটে ধরে চালনা করছিলো।

এই বিপদ মুহূর্তেও এতো কষ্টের মধ্যে নূরীর হৃদয়ে আনন্দের বান বয়ে যাচ্ছিলো, মুক্তির আনন্দে আনন্দিত নয় সে, আনন্দ তার হুরের বুকে আশ্রয় পেয়েছে। এ যে সে কল্পনাও করতে পারেনি, তার হুরকে আবার ফিরে পাবে।

ভুলে গেছে নূরী তার সব যন্ত্রণা। কিছু পূর্বে শংকর মাছের চাবুকের আঘাতে পিঠের চামড়া কেটে রক্ত ঝরে পড়ছিলো, ক্ষুধা পিপাসায় কণ্ঠ শুষ্ক, তবু এতোটুকু যেন বেদনা নেই তার মধ্যে। বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে একবার ডাকলো নূরী–হুঁর।

বনহুর নূরীর কথায় বললো–খুব কষ্ট হচ্ছে নূরী?

না।

 বনহুর পুনরায় বলে–সামনের জঙ্গলে নেমে তোমার হাত পার বন্ধন মুক্ত করে দেবো।

আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না হুর। আমার সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে।

 তাজের পিঠে বনহুর আর নূরীর মধ্যে এর বেশি আর কোন কথা হলো না।

নূরী অবশ্য আর একবার প্রশ্ন করেছিলো–রহমান কোথায়? সেও কি তোমার সঙ্গে এসেছে?

বনহুর ছোট্ট করে জবাব দিয়েছিলো সংক্ষেপে রহমানও আসছে।

সম্মুখের জঙ্গলে যখন বনহুর নূরীকে নিয়ে পৌঁছলো তখন রাত প্রায় ভোর হয়ে এসেছে।

তাজের পিঠে থেকে নূরীকে নামিয়ে নিলো বনহুর। তারপর নিজের কোমরের বেল্ট থেকে ধারালো ছুরি বের করে ওর হাত-পায়ের বাধন কেটে দিলো।

নূরী ভুলে গেলো সমস্ত দুনিয়া! বনহুর তার জন্য মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করেছিলো এবং সেই কারণেই সে আজ রহমানের সঙ্গে পালিয়ে এসেছে সুদূর আরাকান শহরে। নূরী বিস্মৃত হলো সব কথা! তার হাত-পার বাঁধন মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে বনহুরের বুকে। কত দিন পর যেন খুঁজে পেয়েছে তার আপন জনকে।

বনহুরের বাহুবন্ধনে আত্নসমর্পণ করলো নূরী।

বনহুরের প্রশস্ত বক্ষে মাথা রেখে ডাকলো নূরী–হুঁর, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি?

গভীর আবেগে নূরীকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললো বনহুর–নূরী, তুমি আজও আমাকে ভুলতে পারলে না?

কি করে ভুলবো? তোমার স্মৃতি আমাকে অহরহ স্মরণ করিয়ে দেয় তোমার কথা। জীবন। থাকতে তোমাকে আমি কোন দিন ভুলবো না।

নূরী! বনহুর নূরীর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে, আবেগভরা কণ্ঠে ডাকে।

নূরী বলে–হুর, তুমি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে, তাই করো, তবু তোমার কাছ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করো না।

নূরী আর বনহুর একটা গাছের তলায় এসে বসে। বনহুরের হাতের মুঠায় নূরীর হাতখানা। বনহুর নূরীর কপাল থেকে বাম হস্তে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো-নূরী, তুমি জানো আমি কোনদিন তোমাকে সুখী করতে পারবো না তবু কোনো তুমি আমার কথা ভেবে নিজের জীবনটা বিনষ্ট করে দিলে!

নারীর স্বামীই যে সব–এ কথা তুমি জানো না? তোমার প্রতি আমার ধ্যান-জ্ঞান স্বপ্ন সাধনা।

নূরী!

তুমি বিশ্বাস করো, আজও আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করতে পারেনি। তুমিই যে আমার সব। হুর, কলেমা পাঠ করে বা লৌকিকতার আড়ম্বর করে বিয়ে না হলেও তুমিই আমার স্বামী।

নূরী, তুমি তো জানেনা–বিয়ে আমি করেছি। তবুও তুমি…

শত বিয়ে করলেও তুমি আমাকে অস্বীকার করতে পারবে না, আমি তোমার কেউ নই।

নূরী, তুমি জেনেশুনেও এ ভুল করবে?

ভুল আমি করিনি, করবো না আমি জানি তুমিই আমার স্বামী। আকাশ সাক্ষী আছে– বাতাস সাক্ষী আছে। বনের পাখিরা জানে তোমার-আমার সম্বন্ধ। হুর, তুমি যতই আমাকে দূরে সরিয়ে দাও কিন্তু পারবে না আমাকে অস্বীকার করতে।

নূরী…

না না, আমি শুনবো না কোন কথা। তুমি মনিরাকে বিয়ে করছে; তাতে আমার দুঃখ নেই। সেও আমার মতই একজন নারী। তাকে আমি বঞ্চিত করতে চাই না–তুমি যেমন আমার, তেমনি মনিরার। হুর, তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না। আর যদি তোমাকে সত্যি আমার হারাতে হয় তবে বলল এই মুহূর্তে আমি সংসার থেকে বিদায় নেই…

নূরী দ্রুত হস্তে বনহুরের কোমরের বেল্ড থেকে ছোরাখানা খুলে নিয়ে নিজের বুকে বসিয়ে দিতে গেলো–বলো, তোমার জন্য আমি সব পারবো।

বনহুর খপ করে নূরীর হাত ধরে ফেললো–নূরী ক্ষান্ত হও।

না, তুমি আমাকে কথা দাও।

নূরীর শুকনো মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বনহুরের হৃদয় কেঁপে উঠলো! রুক্ষ চুল ললাটের এক পাশে শুকনো রক্ত জমে আছে। পিঠের চামড়া কেটে রক্ত রাঙ্গা হয়ে উঠেছে ছিন্ন বসন। বনহুর এবার নিজকে সংযত রাখতে পারলো না, তার মুখোভাব গম্ভীর হয়ে উঠলো।

নূরী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো আবার–তুমি সব পার এটুকু পারো না? একটা জীবন রক্ষার জন্য তুমি গ্রহণ করতে পারো না আমাকে?

নূরী, যা সম্ভব নয় কি করে তা হয় বলো!

দুনিয়ায় এমন কোন কাজই নেই যা সম্ভব নয়! সর্দার, নূরীকে আপনি বাঁচান। কথাটা বলতে বলতে রহমান এসে দাঁড়ায় সেখানে।

বনহুর আর নূরী সরে বসে দুজনার কাছ থেকে।

রহমান বলে– সর্দার, একবার তাকিয়ে দেখুন নূরীর মুখের দিকে। শুধু আপনার জন্যই আজ তার জীবন বিনষ্ট হতে চলেছে। নূরী ফুলের মতই পবিত্র নিষ্পাপ। শত চেষ্টার পরও কেউ তাকে পায়নি। সর্দার আপনি অবুঝ নন। এতোটুকু চিন্তা করে দেখুন কি আপনার কর্তব্য।

রহমান।

সর্দার, আমি আপনার গোলাম। জানি আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি নিজে আপনাকে অনুরোধ করছি। আপনি নূরীর জীবন রক্ষার জন্য তাকে গ্রহণ করুন।

বনহুর এবার নিজের অলক্ষ্যে নূরীর মুখের দিকে তাকালো।

নূরী অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে।

রহমান এগিয়ে আসে, নূরীর হাতখানা তুলে নিয়ে বনহুরের হাতখানা তুলে ধরে, তারপর বনহুরের হাতের উপর তুলে দেয় নূরীর হাত–আমি আল্লাকে স্বাক্ষী রেখে নূরীকে সমর্পণ করছে।

করলাম। আপনি কোন দিন ওকে দূরে সরিয়ে দেবেন না… রহমানের গলা চাপা কান্নায় আটকে এলো।

রহমান মথা নত করে সরে গেলো–আমি চললাম, মনি হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা

বনহুর আর নূরী তাকিয়ে রইলো রহমানের চলে যাওয়া পথের দিকে। ভোরের সূর্য তখন পূর্ব আকাশে রাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

দূর থেকে ভেসে আসছে জঙ্গলী মোরগের ডাক।

নূরী ছিন্নমলিন বেশ; রক্তমাখা শরীর, বনহুরের হাতে তার হাত। নিৰ্ণিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে সে বনহুরের মুখের দিকে।

এতোক্ষণে বনহুরের সম্বিৎ যেন ফিরে এলো, তাকালো সে নূরীর মুখে।

এমন করে কোন দিন বুঝি ওদের দৃষ্টি বিনিময় হয়নি। আজ উভয়ের কাছে উভয়ে নিবিড় এত সম্বন্ধে আবদ্ধ।

বনহুর নূরীকে টেনে নিলো কাছে।

নূরীর আজ নেই কোন দ্বিধা, নিজকে সে বিলিয়ে দিলো বনহুরের বাহু বন্ধনে।

*

বনহুরের কোলে নূরীর মাথাটা, বনহুর নূরীর চুলে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।

নূরী চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়েছিলো নিশ্চপ।

বনহুর বললো–তুমি আমার অপূর্ব জীবনের পরম এক সম্পদ। নূরী, তোমাকে সুখী করাই আমার কামনা।

নূরী চোখ মেলে তাকালো–এখন আমার মরলেও দুঃখ নেই। হুর, আর তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না।

নূরী বনহুরের কন্ঠ দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো, চোখে তার আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। এতো আনন্দ আর বুঝি তার কোন দিন হয়নি, হৃদয়ে তার খুশির উৎস।

নূরী আজ বনহুরের বুকে মাথা রেখে ভুলে গেলো সমস্ত দুনিয়াটাকে। হুরকে আজ সে অতি আপন করে পেয়েছে, যেমন করে সে কোন দিন পায়নি। বনহুরের বুকে নিজকে সমর্পণ করে নূরী আজ তার নারী জীবন সার্থক করে।

শিশুকালের সপ্নসাধ আজ তার পূর্ণ হয়েছে। বনহুরকে একান্ত নিজের করে পাবে–এটাই ছিলো তার জন্ম জন্মান্তরের কামনা। সে সাধ নূরীর পূর্ণ হয়েছে।

এদিকে নূরী যখন বনহুরকে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা তখন ভোলানাথের দল চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ভোলানাথের দলে লোকসংখ্যা ছিলো প্রচুর। তার সঙ্গি সবুজ পোশাক পরিহিতা পঞ্চদলের এক এক জনের দলে ছিলো হাজারেরও বেশি লোক।

ভোলানাথের আদেশে পঞ্চদল তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো–জীবিত বা মৃত ঐ যুবতীটিকে তাদের চাই। ভোলানাথ দশ হাজার টাকা তাকে বখশীস দেবে, যে তার মৃতদেহটা পৌঁছাতে পারবে তাদের আড্ডায়।

সমস্ত শহরে গ্রামে-বন্দরে, বন জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে কোথাও বাকি রইলো না, এমন কি প্রত্যেকটা বাড়িঘর; দালান-কোঠায় গুপ্ত অনুচর নূরীর সন্ধান করে ফিরতে লাগলো বনে বনে শিকারীর বেশে তীর-ধনু হাতে ঘুরতে লাগলো ভোলানাথের দল। নৌকার মাঝি হয়ে কেউ নৌকা বাইতে লাগলো, কেউ বা জেলে সেজে নদীতে মাছ ধরছে, কেউ চৌকিদার সেজে রাতে অন্ধকারে গ্রামের পথে পথে হেঁকে বেড়াচ্ছে। সবাই ওরা নূরীকে দেখেছে, কাজেই চিনতে কারো ভুল হবেনা।

ডাকু ভোলানাথ যত ভয়ঙ্কর তার চেয়ে বেশি সাংঘাতিক তার অনুচর আর দলবল।

ধরতে গেলে সারা আরাকান শহরে ছড়িয়ে আছে এইসব শ্বাপদের দল। সমস্ত আরাকানটা যেন এই সব লোকদের পায়ের তলায় দলিত-মথিত হয়ে বেঁচে আছে কোনরকম। গোটা শহরে তাই নেই কোন শৃঙ্খলা বা কোন আইন কানুন।

বিচার বলে কিছু নেই এ শহরে, আছে শুধু অন্যায় আচরণ আর অনিয়ম।

পুলিশ আছে তারাই ভোলানাথের দলকে দেখে ভয় পায়। কারণ পুলিশের অস্ত্রের শক্তির চেয়ে এ সব শয়তানদের মস্তিষ্কের শক্তি অনেক বেশি। কোন পুলিশ যদি ভোলানাথের কোন অনুচরকে গ্রেপ্তার করে বা কোন রকম কঠিন শাস্তি দেয় তাহলে পরদিন দেখা গেছে সেই পুলিশের ছিন্ন মস্তক পথের ধুলায় গড়াগড়ি যাচ্ছে, বা তার দেহটা জুছে কোন গাছের ডালে।

তাই কেউ সাহস পায় না ভোলানাথের অনুচরদের কুকর্মে বাধা দেয়।

ইচ্ছামত ওরা শহরময় লুটতরাজ, চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি করে বেড়ায়। এই সব শয়তানদের ভয়ে দেশে কোন সাধু ব্যক্তি বাস করতে পারে না। যারা ধনবান দ্র, তারা অন্য দেশে পালিয়ে গিয়ে ব্যবসা করেন, ঘর বাঁধেন, বা চাকরী করেন।

অদ্ভূত এই আরাকান শহর।

 বাংলাদেশ ছেড়ে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে পাথার আর পর্বতে ঘেরা মস্ত বড় এ শহর।

বনহুর আর নূরী এই আরাকান শহরের দক্ষিণ পশ্চিম দিকের এক জঙ্গলে তখন হাসি আর গানে মেতে উঠেছে।

নূরী ছেড়ে জামাটায় বনহুর গিট দিয়ে দেয়। চুলগুলি আংগুলে ঠিক করে দিয়ে বলে–নূরী, একটা গান শোনাবে? সেই গান, যে গান তুমি আগে গাইতে?

নূরী গান গায়।

বনহুর নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। ছিন্ন বসনে, এলোমেলো চুলে, ক্ষত-বিক্ষত দেহে অপূর্ব সুন্দর লাগছিলো নূরীকে।

নূরী আজ পূর্বের ন্যায় উচ্ছল হয়ে উঠেছে। নাচে, গায়, ছুটোছুটি করে বেড়ায়। বন্যফুলে বিনি সূতায় মালাগাঁথে, পরিয়ে দেয় সে বনহুরের গলায়।

বনহুর বনের গাছ থেকে ফল পেড়ে নূরীর মুখে তুলে দেয়।

 নূরী নিজে খায়, বনহুরকে খেতে দেয়।

বনহুরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঝরণার পাশে। পাহাড়িয়া নদী কুল কুল করে বয়ে চলেছে, নূরী হাটু পানিতে নেমে পানি ছড়িয়ে দেয় বনহুরের গায়ে, চোখে-মুখে।

হাসে বনহুর–ধরতে যায় ওকে।

নূরী ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে।

বনহুর ওকে আর ধরতে পারে না।

 নূরী হাসে।

বনহুর আর নূরী যেন ফিরে পায় তাদের সেই ছোট বেলায় হারানো জীবন।

বনহুরের গাম্ভীর্য দূর হয়ে যায় নূরীর কাছে।

আরাকান জঙ্গলে পাহাড়ে পাহাড়ে নূরীর গানের সুর প্রতিধ্বনি জাগায়। আকাশে-বাতাসে জাগায় শিহরণ। পাখিরা সুর হারিয়ে ফেলে নূরীর সুরের মাধ্যমে।

নূরী ঝরণার পানিতে সাঁতার কাটে–হাসে, গান গায়।

বনহুর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকে–এসো ফিরে যাই।

 নূরী পানিতে গলা অবধি ডুবিয়ে বলে–উঁহুঁ যাবোনা।

 আমি তাহলে যাই। বলে বনহুর।

নূরী বলে–যাও দেখি কেমন করে যেতে পারো।

 বনহুর অগত্যা ঝরণার তীরে একটা উঁচু জায়গায় বসে পড়ে।

নূরী হাতছানি দিয়ে ডাকে–এসো সাঁতার কাটি।

বনহুর হেসে বলে–পারিনা!

নূরী উঠে আসে–বনহুরের হাত ধরে টেনে নামিয়ে নেয়; খিল খিল করে হাসে।

*

ভোলানাথ স্বয়ং তার কয়েকজন অনুচরসহ এই জঙ্গলে এসে পড়ে। তাদের প্রত্যেকের হস্তে সূতীক্ষ্মধার ছোরা আর তীর-ধনু।

সকলের দেহেই সবুজ রং এর পোশাক।

মাথায় অদ্ভুত ধরণের টুপি আর গালপাট্টা বাধা। এক এক জনের চোখ যেন আগুনের গোলার মতো জ্বলছে।

মুখ কঠিন, লোহার ইস্পাতের মত শরীর। দেখলে সাক্ষাৎ যম বলে মনে হয়।

ভোলানাথ প্রত্যেকটা জঙ্গলে নূরীর অনুসন্ধান করে ফিরছে।

সে জানে–তাদের আরাকান থেকে যুবতী এখনও বাইরে যেতে পারেনি। ভোলানাথের জ্যোতিষী বলেছে–তোমার আকাঙ্খিত নারী কোন জঙ্গলে অবস্থান করছে। সে এখনও আরাকানের মাটি ত্যাগ করেনি। ভোলানাথ তাই জ্যোতিষীর বাক্য শিরোধার্য করে বেরিয়ে পড়েছে। জঙ্গলে জঙ্গলে তার অনুসন্ধান করতে।

ভোলানাথ তার দলবলসহ প্রতিটি ঝোপ-ঝাড় আর গাছপালা শাখা-প্রশাখা অনুসন্ধান করে চলেছে। এতোটুকু জায়গা তারা বাদ দিয়ে যাচ্ছে না, যদি সেখানে আত্মগোপন করে থাকে যুবতী আর তার সঙ্গী।

আসলে ভোলানাথের প্রতিহিংসা, যাকে সে পাবেনা তাকে সে কিছুতেই অন্যের ভোগের সামগ্রী হতে দেবে না।

নূরীর অপরূপ সৌন্দর্য ভোলানাথের লালসা দশগুণ বেড়ে গিয়েছিলো, যেমন করে হোক ওকে সে আত্মসাৎ করবে ভেবেছিলো। হিংস্র জন্তুর মুখের শিকার কেড়ে নিলে যে অবস্থা হয় ঠিক তেমনি অবস্থা হয়েছে স্বয়ং ভোলানাথের।

গোটা বন তোলপাড় করে বন্য হস্তীর মত গাছপালা তচনচু করে ভোলানাথের দল এগিয়ে আসছে।

ভোলানাথ সর্বাগ্রে আর তার দল পিছনে। সূর্যের আলোতে তাদের হস্তস্থিত অস্ত্রগুলি ঝমক্ করে উঠছে।

কি ভয়ঙ্কর আর নৃশংস তাদের চেহারা।

বন্যপশুগণ যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। কত নিরীহ পশু জীবন দিচ্ছে ওদের হাতে।

 ভোলানাথের হস্তের সূতীক্ষ্ম তীর-ধনু।

মাথার ঝাকড়া চুলগুলো যেন সজারুর কাটার মত খাড়া হয়ে উঠছে। গোঁফ জোড়া দেখলে যে কোন সাহসী লোকেরও প্রাণ কেঁপে উঠে।

যেমন ভোলানাথের চেহারা ভয়ঙ্কর তেমনি তার কঠিন প্রাণ, এতোটুকু মায়া-মমতার লেশ নাই সেখানে। মানুষের জীবনের কোন দাম নেই ভোলানাথ বা তার দলবলের কাছে। পিপীলিকার মতই মানুষকে ওরা হত্যা করে নির্মমভাবে।

সেই ভোলানাথের শিকার হলো নূরী।

আরাকানে ভোলানাথ দেওজীর প্রতাপ এমন ছিলো প্রত্যেকটা মানুষ তাকে ভয় করতো যমের মত। অনেকেই ভোলানাথের মূর্তি তৈরি করে পূজা করতো–শুধু কামনার জন্য নয়, প্রাণ রক্ষার জন্য।

এহেন ভোলানাথ ক্রুদ্ধ জানোয়ারের মত গর্জন করিতে করিতে এগিয়ে চলেছে। চারিদিকে তার দেহরক্ষী সহচর চক্রাকারে এগুচ্ছে।

 হঠাৎ ভোলানাথের দৃষ্টি চলে গেলো দূরে ঝরণার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো চৰ্চ করে। উঠে তার। সবাইকে ইংগিতে ক্ষান্ত হবার আদেশ দেয়।

ভোলানাথ চোখে দূরবীণ লাগিয়ে দেখে–দূরে, অনেক দূরে ঝরণার জলে একটি যুবতি সাঁতার কাটছে। তীরে একটা উঁচু স্থানে বসে আছে সেই লোকটি, যে তাদের শংকর মাছের চাবুকের জর্জরিত করে যুবতীটিকে নিয়ে পালিয়েছিলো।

দূরবীণে যুবতীটিকে ঠিক চেনা না গেলেও যুবকটিকে চিনতে ভোলানাথের কিছুমাত্র ভুল হয়না।

হিংস্র জন্তুর মত গর্জন করে উঠে ভোলানাথ পেয়েছি।

 ভোলানাথের সহচরগণ সবাই তাকালো দূরে–অনেক দূরে ঝরণার দিকে।

 ভোলানাথের দল বনহুর আর নূরীকে দেখলেও তারা দেখতে পেলোনা ওদের।

বনহুর নূরীর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

 নূরী সাঁতার কাটছে রাজহংসীর মত ডানা মেলে।

ঝরণার পানিতে ফুটন্ত পদ্মফুলের মত ভাসছে নূরী। অপূর্ব লাগছে আজ যেন নূরীকে। মনের আনন্দ সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে সে। নূরীর জন্ম বনে মানুষ হয়েছে সে বনে কাজেই বনে নূরী। যতখানি আনন্দ পায় ততখানি পায়না সে আর কোথাও।

নূরী আর বনহুর উভয়ে উভয়কে নিয়ে মেতে আছে, হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছে ওরা।

ওদিকে, ভোলানাথের দল ওৎ পেতে পেতে গাছের আড়ালে আড়ালে প্রায় ওদের কাছাকাছি এসে পড়ে।

ভোলানাথ সবাইকে, সাবধান করে দেয়– কেউ যেন নূরীর দেহে তীর না ছোড়ে।

ভোলানাথ স্বয়ং তীর-ধনু উঁচু করে ধরে বনহুরকে লক্ষ্য করে। চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।

ঝরণার পানিতে সাঁতার কাটলেও নূরীর দৃষ্টি ছিলো চারিদিকে। হঠাৎ নূরীর নজর চলে গেলো দূরে গাছটার পিছনে, ভোলানাথের হস্তে উদ্যত তীর-ধনুর উপর নজর পড়তেই নূরী ছুটে এসে বনহুরকে আড়াল করে দাঁড়ালো।

সঙ্গে সঙ্গে ভোলানাথের হস্তস্থিত তীর ধনু থেকে তীরখানা ছুটে এসে বিদ্ধ হলো নূরীর বুকে!

তীব্র একটা আর্তনাদ করে নূরী লুটিয়ে পড়লো ভূতলে। নূরীর সিক্ত বসন রক্তে রাঙা হয়ে। উঠলো।

বনহুর একবার নূরীর ভুলুষ্ঠিত দেহটার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফেললো সম্মুখে।

ভোলানাথ তখন তার দলবল নিয়ে হিংস্র জানোয়ারের মত গর্জন করে এগিয়ে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *