৩. স্বাভাবিকতার সাথে অস্বাভাবিকতা

তৃতীয় পর্ব ৩.০

স্বাভাবিকতার সাথে অস্বাভাবিকতার মিশ্রনের স্বভাব মানুষের সহজাত; আর সেজন্যেই ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা বিপদজনক মনে হয় আমার কাছে। একজনের পক্ষে সবকিছুই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বর্ণনা করাটা খুব সহজ সেখানে।
–জাঁ পল সাত্রে

সচরাচর আমার মধ্যে সতোর দেখা পাবেন না, কিন্তু মাঝেমধ্যে নিজের অজান্তেই সত্যটা বলে ফেলি।
–উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, দ্য উইন্টার’স টেইল

অ্যালিসিয়ার বেরেনসনের ডায়েরি
৮ অগাস্ট

খুব অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে আজকে।

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছিলাম। পানি গরম হবার ফাঁকে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছি, এসময় একটা জিনিসের ওপর নজর আটকে যায়। না, জিনিস না, মানুষ। একটা লোক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের বাসার উল্টোদিকের রাস্তায়, পার্কের প্রবেশমুখে। গাছের আড়ালে থাকায় তার চেহারা ঠিকমতো দেখতে পারিনি, কিন্তু বেশ লম্বা-চওড়া। মাথায় ক্যাপ আর চোখে সানগ্লাসও ছিল।

লোকটা আমাকে দেখতে পাচ্ছিল কি না সেটা বলতে পারবো না, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু অদ্ভুত লাগে ব্যাপারটা, সাধারণত ওখানটায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করে সবাই, কিন্তু লোকটা বাসের জন্যে দাঁড়ায়নি। আমাদের বাসার ওপরে লক্ষ্য রাখছিল সে।

কিছুক্ষণ পর টের পাই, এক জায়গাতেই বেশ অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি, তাই জানালার পাশ থেকে সরে কফি নিয়ে স্টুডিওতে চলে যাই। কিন্তু সেখানে কাজে মন বসে না। বারবার লোকটার কথা ভাবছিলাম। তাই ঠিক করি বিশ মিনিট পর রান্নাঘরে গিয়ে দেখবো সে তখনও দাঁড়িয়ে আছে কি না। যদি থাকতো তাহলে কি করতাম? ভুল তো কিছু করছিল না। এই এলাকায় চোরের উৎপাত নেই সত্যি, কিন্তু সবকিছুরই তো একটা প্রথমবার আছে। যদি চুরির জন্যে রেকি করতে আসে, তখন? আবার এমনটাও হতে পারে, এই রাস্তার শেষ মাথায় নতুন বাড়িটা কিনবে, সেজন্যে দেখতে এসেছিল।

কিন্তু রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে তাকে আর দেখিনি। কেউ ছিল না রাস্তার অন্য পাশে।

আর জানা হবে না কি উদ্দেশ্যে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে। অদ্ভুত।

.

১০ অগাস্ট

গতকাল জিন-ফিলিক্সের সাথে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। গ্যাব্রিয়েল অবশ্য মানা করেছিল, কিন্তু আমি শুনিনি। সত্যি বলতে আমার নিজেরও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পরে ভাবি, জিন-ফিলিক্সের কথা অনুযায়ী ‘শেষবার যদি একসাথে ঘুরতে বের হই, তাহলে খুব একটা ক্ষতি হবে না। এরপরে নিশ্চয়ই আর কিছু বলার থাকবে না তার?

নাটক শুরু হবার বেশ আগেই দেখা করি আমরা, একসাথে কোথাও ড্রিঙ্ক করা যাবে তাহলে-জিন-ফিলিক্সের বুদ্ধি। সূর্য ততক্ষণে ডুবতে বসেছে, মনে হচ্ছিল কেউ লাল আবীর মিশিয়ে দিয়েছে নদীর পানিতে। ন্যাশনাল থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল সে। আমিই আগে দেখি তাকে, মানুষের ভিড়ে মুখ বাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দৃশ্যটা দেখে ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার ব্যাপারে তখনও যেটুকু সন্দেহ ছিল আমার ভেতরে, তা-ও দুর হয়ে যায়। এখন বুঝতে পারি, জিন-ফিলিক্সকে কেমন যেন ভয় পাই আমি, পুরোপুরি বলে বোঝানো যাবে না ব্যাপারটা। ঘুরে পালানোর কথা চিন্তভাবনা করছি, এসময় আমাকে দেখে ফেলে জিন ফিলিক্স। অগত্যা তার দিকে হাঁটতে শুরু করি। মুখে জোর করে একটা হাসি ফোঁটাই, সে-ও তাই করে।

“তুমি আসাতে আমি সত্যিই অনেক খুশি হয়েছে,” বলে জিন-ফিলিক্স। “ভাবছিলাম শেষ মুহূর্তে হয়তো মত পাল্টে ফেলতে পারো। চলো কোথাও বসে ড্রিঙ্ক করা যাক, নাকি?”

ন্যাশনাল থিয়েটারের পাশেই আন্ডারস্টাডি পাবে চলে যাই আমরা। ওখানে কাটানো সময়টুকু অস্বস্তিকর ছিল বললেও কম হয়ে যাবে। হাবিজাবি নিয়ে আলাপ করি দু’জনে, আসলে জিন-ফিলিক্স বলছিল আর আমি শুনছিলাম। খালি পেটে পাবে যাওয়ায় দুই পেগ ড্রিঙ্কেই মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে আমার; এজন্যেই বোধহয় আমাকে পাবে নিয়ে গিয়েছিল জিন-ফিলিক্স। ভেবেছিল মদ খেয়ে মাতাল হলে তার সাথে আরো প্রাণবন্তভাবে আলাপ করবো। তার প্রতিটা কথা শুরু হচ্ছিল-তোমার কি মনে আছে যখন আমরা বা একসাথে ওখানে গিয়ে আমরা’-এই কথাগুলো দিয়ে। যেন এভাবে অতীতের ঘনিষ্ঠতার কথা বললেই আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারবো। কিন্তু ও একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিল না, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আমি। সেটা আর বদলাবে না।

তবে দিনশেষে মনে হয়েছে বের হওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ভালোই করেছিলাম। জিন-ফিলিক্সের সাথে দেখা হয়েছে এজন্যে বলছি না কথাটা, আসলে নাটকটা খুবই পছন্দ হয়েছে আমার। অ্যালসেস্টিসের কথা আগে শুনিনি আমি। এই প্রথম কোন ট্র্যাজেডিতে দেখলাম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন মোটামুটি বাস্তবভাবে দেখানো হয়েছে (পাতাললোক থেকে অ্যালসেস্টিসের ফিরে আসার ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেরে ফেললে)। সেজন্যেই আরো বেশি ভালো লেগেছে। নাটকটা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়েছে। একটা লোক মৃত্যুদণ্ড পেলে তার স্ত্রী, অ্যালসেস্টিস, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। অ্যালসেস্টিসের নামভূমিকায় যে অভিনেত্রী অভিনয় করেছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গ্রিক পুরাণ থেকে উঠে আসা কোন দেবী। বারবার মনে হচ্ছিল, তার একটা ছবি আঁকবো আমি। জিন-ফিলিক্সকে কথাটা প্রায় বলেও ফেলেছিলাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থামাই নিজেকে। তাকে আর আমার জীবনের কোন ব্যাপারে জড়াবো না। নাটকের শেষ দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। ঠিক কোন বিষয়টা আমাকে নাড়া দিয়েছে তা নিয়ে আরো ভাবতে হবে। জিন-ফিলিক্স অবশ্য একটার পর একটা মন্তব্য করেই যাচ্ছিল, কিন্তু কোনটাই আমার মতের সাথে মিলছিল না। তাই এক পর্যায়ে তার কথা শোনা বাদ দিয়ে দেই।

অ্যালসেস্টিসের মৃত্যুর জগত থেকে ফিরে আসার দৃশ্যটা মাথা থেকে দূর করতেই পারছিলাম না। ব্রিজ থেকে স্টেশনের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময়েও সেটা নিয়েই ভাবছিলাম। এসময় জিন-ফিলিক্স জিজ্ঞেস করে যে আবারো ড্রিঙ্ক করতে যাবে কি না, কিন্তু আমি ক্লান্তির অজুহাত দেখাই। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে আমাদের মাঝে। স্টেশনে পৌঁছে গেলে বাইরে দাঁড়িয়ে ওকে ধন্যবাদ জানাই, বলি যে সময়টা ভালো কেটেছে।

“একটা ড্রিঙ্কই তো,” জিন-ফিলিক্স বলে। “পুরনো সময়ের খাতিরে?”

 “না, বাসায় ফিরতে হবে আমাকে।”

ঘুরে দাঁড়িয়েছি, এসময় আমার হাত ধরে জিন-ফিলিক্স।

“অ্যালিসিয়া,” বলে সে। “তোমাকে একটা কথা বলতে চাই আমি।”

 “না, বলো না, প্লিজ। কিছু বলার নেই আর…”

“তুমি যা ভাবছো সেরকম কিছু বলবো না।”

ঠিকই বলেছিল জিন-ফিলিক্স, আমি মনে মনে যা ভেবেছিলাম ওরকম কোন কথা বের হয়নি তার মুখ দিয়ে। ধরেই নিয়েছিলাম যে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে গ্যালারি ছেড়ে দেয়ার কারণে আমার মধ্যে অপরাধবোধ সৃষ্টির চেষ্টা করবে। কিন্তু তার কথাগুলো শুনে চমকে যাই।

“তোমাকে আরো সাবধানী হতে হবে,” বলে জিন-ফিলিক্স। “মানুষকে খুব সহজে ভরসা করে ফেলল। যারা তোমার আশেপাশে থাকে…তাদের বিশ্বাস করো। এই স্বভাবটা বদলাও। কাউকে ভরসা করার আগে তাকে ভালোমতো চেনার চেষ্টা কোরো।”

শূন্য দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। বেশ খানিকটা সময় লাগে গলা দিয়ে শব্দ বের হতে।

“কি বলছো এসব? কার কথা বোঝাচ্ছো?”

 কিন্তু আর কিছু বলে না জিন-ফিলিক্স। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে আমার হাত ছেড়ে উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে। পেছন থেকে ডাক দেই আমি।

“দাঁড়াও, জিন-ফিলিক্স।”

কিন্তু একবারের জন্যেও তাকায় না সে। কিছুক্ষণ পর মিশে যায় ভিড়ের মাঝে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি স্টেশনের বাইরে। মাথায় বারবার ওর বলা কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ রকম হেঁয়ালি করার মানে কি? এটাও হতে পারে যে আমাকে ইচ্ছে করে এরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে চলে গেছে সে। খুব ভালো করেই জানে যে আমার মাথায় সন্দেহ ঢুকলে সেটা দূর না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাইনা। এ যাত্রায় তাকে সফলই বলতে হবে।

সেই সাথে প্রচণ্ড রাগও লাগছিল। অবশ্য এই কাজটা করে একদিক ভালোই করেছে সে। সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে গেছে। জিন-ফিলিক্সের আর কোন স্থান নেই আমার জীবনে। আশপাশের মানুষদের সহজেই ভরসা করে বলতে নিশ্চয়ই গ্যাব্রিয়েলের কথাই বুঝিয়েছে। কিন্তু কেন?

না, এ নিয়ে মাথা ঘামাবো না আমি। এটাই চাইছিল জিন-ফিলিক্স; আমাকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলতে। গ্যাব্রিয়েল আর আমার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করাটাই তার লক্ষ্য।

কিন্তু তার ফাঁদে পা দেব না আমি। এ বিষয়ে আর ভাববো না।

বাসায় ফিরে দেখি গ্যাব্রিয়েল ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল পাঁচটায় উঠে একটা ফটোশ্যুটে যেতে হবে। তবুও ওকে ডেকে তুলে সেক্স করি। আসলে আমি চাইছিলাম ওকে একদম আমার ভেতরে অনুভব করতে, ওর দেহে মিশে যেতে। ও-ই পারবে আমাকে সবকিছু থেকে নিরাপদ রাখতে।

.

অগাস্ট ১১

আবারো লোকটাকে দেখেছি আমি। এবারে আগের তুলনায় কিছুটা দূরে ছিল সে, পার্কের ভেতর দিককার একটা বেঞ্চে। কিন্তু তাকে চিনতে কোন সমস্যা হয়নি আমার। এরকম আবহাওয়ায় খুব কম লোকই কালো শার্ট প্যান্ট আর ক্যাপ পরে বের হওয়ার কথা ভাববে। আগের দিনের মত চোখে সানগ্লাসও ছিল। আমাদের বাসার ওপর নজর রাখছে।

এসময় একটা ভাবনা খেলে যায় আমার মাথায়। এমনটাও হতে পারে, সে কোন চোর-ছ্যাচড় নয়, বরং আমার মতনই একজন পেইন্টার। হয়তো আমাদের রাস্তাটা আঁকার কথা ভাবছে, সেজন্যেই দেখতে এসেছে। কিন্তু ভাবনাটা যে সত্যি নয় সেটা আমি একরকম নিশ্চিত। যদি আসলেও বাড়িটা আঁকতে চাইতো সে, তাহলে এভাবে বসে থাকতো না। স্কেচবুকে খসড়া স্কেচ আঁকতো।

বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় গ্যাব্রিয়েলকে ফোন করে বসি। খুব বড় একটা ভুল ছিল সেটা। জানতাম যে ও ব্যস্ত থাকবে, এসময় যদি আমি হুট করে ফোন দিয়ে বলি কেউ আমাদের বাসার ওপরে নজর রাখছে, তাহলে রাগ হবারই কথা।

তাছাড়া লোকটা যে আসলেও আমাদের বাসার ওপরে নজর রাখছে, সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিতও নই।

আবার এমনটাও হতে পারে যে তার লক্ষ্য আসলে আমি।

.

অগাস্ট ১৩

আবার এসেছিল সে।

গ্যাব্রিয়েল সকালে বের হয়ে যাবার পরেই তাকে বাথরুমের জানালা থেকে দেখি আমি। গোসল করছিলাম তখন। আজকে আগের দিনগুলোর তুলনায় কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা, বাসস্ট্যান্ডের পাশে।

কি ভাবছিল? এভাবে বোকা বানাবে আমাকে?

 দ্রুত কাপড় পরে রান্নাঘরে চলে যাই ভালো করে দেখার জন্যে। কিন্তু ততক্ষণে উধাও হয়ে যায় সে।

ঠিক করি গ্যাব্রিয়েল বাসায় ফেরার পর বলবো কথাটা। ভেবেছিলাম আবারো হয়তো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিবে ও, কিন্তু আজকে মনোযোগ দিয়ে শোনে সবকিছু। চেহারায় দুশ্চিন্তা ভর করে।

“জিন-ফিলিক্স না তো?” কোন রাখঢাক ছাড়াই বলে গ্যাব্রিয়েল।

 “না! ওর কথা ভাবছো কেন?”

চেষ্টা করছিলাম কণ্ঠে বিস্ময় ফুটিয়ে তুলতে, কিন্তু আমি নিজেও আসলে বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। জিন-ফিলিক্স আর অচেনা লোকটার শারীরিক গঠন একরকম। হতেও পারে যে গ্যাব্রিয়েল ঠিক সন্দেহই করছে। কিন্তু আমার মন সেটা মানতে চাইছিল না। আমাকে তো এভাবে ভয় দেখানোর কথা নয় তার। তাই না?

“জিন-ফিলিক্সের নম্বর কোথায়?” গ্যাব্রিয়েল বলে। “আমি এখনই ফোন করবো ওকে।”

 “না, ডার্লিং, প্লিজ। এরকম কিছু কোরো না। আমি নিশ্চিত লোকটা জিন-ফিলিক্স না।”

“আসলেই?”

“হ্যাঁ। তাছাড়া ওরকম কিছু তো হয়নি। আমি বোধহয় একটু বাড়াবাড়িই করছি। থাক, বাদ দাও।”

“কতক্ষণ ছিল লোকটা এখানে?”

“খুব বেশিক্ষণ না। এই ধরো এক ঘন্টা, এর পরেই উধাও হয়ে যায়।”

 “উধাও হয়ে যায় মানে?”

“মানে গায়েব হয়ে যায়।”

 “ওহ। আচ্ছা জান, রাগ কোরো না। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

 “কি?” ওর প্রশ্নের ধরণটা ভালো লাগলো না আমার।

 “পুরো ব্যাপারটা তোমার কল্পনা নয় তো?”

 “না,” দৃঢ় কণ্ঠে বলি। “বিশ্বাস করো আমার কথা।”

 “বিশ্বাস তো করছিই।”

কিন্তু ওর কথা শুনে বুঝতে পারি যে আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করছিল না তখন। বিশ্বাস করার ভান করছিল। সত্যি বলতে, প্রচণ্ড রাগ লাগে তখন। এত রাগ যে…আজকে এখানেই লেখা থামাতে হবে। নতুবা এমন কিছু লিখে ফেলবো যেটা নিয়ে পরে পস্তাতে হতে পারে।

.

১৪ অগাস্ট

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানালার কাছে চলে যাই। মনে মনে আশা করছিলাম লোকটাকে হয়তো দেখতে পাবো, তাহলে গ্যাব্রিয়েলকেও ডেকে দেখানো যাবে। কিন্তু তার কোন চিহ্নই ছিল না বাইরে। নিজেকে আরো বেশি আহাম্মক মনে হয় তখন।

 বিকেলে সিদ্ধান্ত নেই গরমের মধ্যেও হাঁটতে বের হবো। আসলে বাড়ি থেকে কিছুক্ষণের জন্যে পালাতে চাইছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে পার্লামেন্ট হিলের কাছে চলে যাই, চারপাশে অনেকেই রোদ পোহাচ্ছিল। একটা খালি বেঞ্চ দেখতে পেয়ে বসে পড়ি। লন্ডনের অনেকটা দেখা যায় ওখান থেকে।

কিন্তু গোটা সময় মনে হচ্ছিল যে কেউ আমার ওপরে নজর রাখছে। বারবার পিছু ফিরে তাকালেও সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু কেউ একজন ছিল সেখানে, বুঝতে পারছিলাম সেটা।

বাসায় ফেরার পথে পুকুর পাড় দিয়ে হাঁটছি এসময় হঠাই মুখ তুলে তাকাই। সাথে সাথে থমকে যাই সেখানেই। পুকুরের অন্যপাশ থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল লোকটা। চেহারা ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল না অবশ্য, কিন্তু আমার চিনতে ভুল হয় না।

ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আপনা থেকেই চেঁচিয়ে উঠি:

“জিন-ফিলিক্স? আমাকে অনুসরণ করছো কেন? বন্ধ করো এসব!”

কিন্তু লোকটা দাঁড়িয়েই থাকে। যত দ্রুত সম্ভব পকেট থেকে ফোন বের করে তার একটা ছবি তুলি। এতে লাভ কি হয়েছে, জানি না। এরপর উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করি, একবারও পেছনে তাকাইনি। ভয় হচ্ছিল যে পেছনে ফিরলেই দেখতে পাবো কাছাকাছি চলে এসেছে।

তা সত্তেও নিজেকে আটকাতে পারিনি। ঘরে তাকাই। কিন্তু আবারো উধাও হয়ে গিয়েছিল সে।

মনেপ্রাণে চাইছিলাম যাতে জিন-ফিলিক্স না হয় লোকটা।

বাসায় ফেরার পর খুব অস্থির লাগছিল। সব পর্দা টেনে বাতি নিভিয়ে দেই। কি মনে করে জানালা দিয়ে বাইরে একবার উঁকি দিতেই থমকে যাই। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, রাস্তার অন্যপাশে। দৃষ্টি আমার দিকে। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

এসময় কেউ আমার নাম ধরে ডাক দেয়ায় চমকে উঠি।

 “অ্যালিসিয়া? আছো?”

পাশের বাসার বিরক্তিকর মহিলাটা আবার এসেছিল। বার্বি হেলমান। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পেছনের দরজাটা খুলে দেই। ইতোমধ্যে বাগানে ঢুকে পড়েছিল সে, হাতে ওয়াইনের বোতল।

“কেমন আছো ডার্লিং? স্টুডিওতে দেখলাম না তাই ভাবলাম কি করছে।”

“একটু বাইরে গিয়েছিলাম। কেবলই ফিরেছি।”

“ওয়াইন?” বাচ্চাদের মত করে বলল সে, এরকমটা প্রায়ই করে মহিলা। বিরক্ত লাগে আমার।

“আসলে, কাজ করতে হবে আমাকে এখন।”

“আরে কাজ তো আমারো আছে। একটু পরেই ইটালিয়ান ক্লাসে যাবো। এর আগে একটু গল্পগুজব করি দু’জনে।”

আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। ঘর অন্ধকার দেখে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিল বিনা অনুমতিতে। তাকে থামাতে যাবো এসময় বাইরে তাকিয়ে দেখি লোকটা চলে গেছে।

আমি আসলে ঠিক জানি না যে কেন বার্বিকে তার ব্যাপারে বলেছি। মহিলাকে একদমই পছন্দ কই না আমি, ভরসা করা তো দুরের কথা। আসলে ওই সময়টা বাসায় যে-ই থাকতো, তাকেই বলতাম কথাগুলো। ওয়াইন পেটে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁদতে শুরু করি। বিস্ফোরিত নয়নে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে বার্বি। আমার সব বলা শেষ হলে হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাসটা নামিয়ে রাখে টেবিলে। “আরো কড়া কিছু দরকার।” কেবিনেট থেকে হুইস্কি বের করে দুটো মগে ঢেলে একটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়।

“এই নাও, এটা এখন দরকার তোমার।”

আসলেও দরকার ছিল। মাথাটা একটু শান্ত হয় অবশেষে। এবারে আমার শোনার পালা। একটানা কথা বলতে থাকে বার্বি। বারবার বলছিল যে আমাকে ভয় দেখানোর কোন উদ্দেশ্য নেই তার, কিন্তু তার কথাগুলো ভয়ংকরই শোনাচ্ছিল। “এরকমটা টিভিতে হাজারবার দেখেছি আমি। কিছু করার আগে রেকি করে নিচ্ছে হারামিটা।”

“আপনার কি মনে হয়? লোকটা চোর?”

কাঁধ নাচায় বার্বি। “ধর্ষকও হতে পারে। তাতে কিছু আসে যায়? ভালো উদ্দেশ্যে যে আসেনি, এটা নিশিচত।”

 হেসে ফেলি তখন। আসলে এটা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছিলাম যে কেউ একজন আমার কথা বিশ্বাস করেছে-হোক সেটা বার্বি। তাকে আমার ফোনে ভোলা ছবিটা দেখাই।

“আমাকে মেসেজ করে দাও। বাসায় গিয়ে চশমা পরে ভালো করে দেখবো। এখানে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না। তোমার জামাইকে বলেছে এ ব্যাপারে?”

“না,” মিথ্যে বলি।

একটু অবাক হয় বার্বি। “কেন?”

“আসলে…আমি ভয় পাচ্ছি যে গ্যাব্রিয়েল হয়তো আমাকে ভুল বুঝবে। ভাববে পুরোটাই আমার কল্পনা।”

“তোমার কি মনে হয়, আসলেও কল্পনা করছো?”

 “না।”

সন্তুষ্টি ফুটলো বার্বির চেহারায়। “গ্যাব্রিয়েল যদি তোমার কথা আমলে না নেয় তাহলে আমি যাবো তোমার সাথে পুলিশের কাছে। এমনভাবে কথা বলবো যে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে ওরা।”

“ধন্যবাদ। কিন্তু সেটার আপাতত কোন প্রয়োজন নেই।”

“কে বলল প্রয়োজন নেই? এগুলো হেলাফেলার বিষয় নয়। আজকে গ্যাব্রিয়েল ফিরলে অবশ্য কথা বলবে তার সাথে, ডার্লিং। আমাকে কথা দাও।”

আমি মাথা নাড়ি। কিন্তু ততক্ষণে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে গ্যাব্রিয়েলকে এ বিষয়ে আর একটা কথাও বলবো না। লোকটা যে আসলেও আমাকে অনুসরণ করছে বা আমার ওপরে নজর রাখছে এর শক্ত কোন প্রমাণ নেই। বার্বি ঠিকই বলেছে, ছবিটা একদমই স্পষ্ট না।

পুরোটাই আমার কল্পনা-গ্যাব্রিয়েলের যখন এটাই ধারণা, তাকে কিছু না বলাই ভালো। উল্টো আরো বিরক্ত হবে তখন। সেটা চাই না আমি।

 মাথা থেকে ঝেরে ফেলবো ব্যাপারটা।

.

রাত ৪টা।

আজকের রাতটা ভালো যাচ্ছে না।

দশটার দিকে বাড়ি ফিরে গ্যাব্রিয়েল। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে তাই। আমিও ঘুমোনোর চেষ্টা করি, কিন্তু ঘুম আসেনা। চোখে।

দুই ঘন্টা আগে হঠাই খুট করে একটা শব্দ শুনতে পাই। বাইরের বাগান থেকে আসছিল শব্দটা। দ্রুত জানালার পাশে গিয়ে বাইরে তাকাই-কাউকে দেখি না। কিন্তু মনে হতে থাকে যে কেউ একজন খেয়াল করছে আমাকে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে।

দৌড়ে বেডরুমে ফিরে এসে গ্যাব্রিয়েলকে ডেকে তুলি।

“লোকটা বাইরে,” বলি আমি, “বাগানের ওখানে শব্দ শুনেছি।”

গ্যাব্রিয়েল প্রথমে ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারেনা যে কি বলছি আমি। যখন বোঝে তখন বিরক্তি ফোটে চোখেমুখে। “এত রাতে কি শুরু করেছে। আর তিন ঘন্টা পর বের হতে হবে আমাকে। এসব চোর-পুলিশ খেলতে পারবো না।”

“চোর পুলিশ খেলা না, আমার কথা বিশ্বাস করো, প্লিজ। একবার এসে দেখো।”

অগত্যা আমার সাথে আসে ও।

কিন্তু বাইরে কেউই ছিল না তখন, ঠিক যেমনটা ভয় পাচ্ছিলাম।

গ্যাব্রিয়েলকে বলি একবার বাইরে গিয়ে দেখতে, কিন্তু মানা করে দেয়। হনহন করে ওপর তলায় উঠে যায় বিরক্তভঙ্গিতে। আমি ওর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করি কিন্তু লাভ হয় না। গেস্টরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

 আমি আর বিছানায় যাইনি। তখন থেকে এখানেই বসে আছি। কান পেতে রেখেছি শব্দের অপেক্ষায়, কিছুক্ষণ পরপর জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি বাইরে। কিন্তু লোকটার কোন হদিস নেই এখন অবধি।

আলো ফুটতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।

.

১৫ অগাস্ট

ফটোশ্যুটের জন্যে তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসে গ্যাব্রিয়েল। আমাকে জানালার পাশে বসে থাকতে দেখে যখন বুঝতে পারে যে সারারাত ওখানেই ছিলাম, চেহারার অভিব্যক্তি পাল্টে যায়।

“চুপ করে বসো অ্যালিসিয়া। কথা আছে তোমার সাথে।”

“হ্যাঁ, কথা তো আছেই। আমার কথা একবিন্দুও বিশ্বাস করোনি তুমি।”

“কিন্তু তুমি যে আসলেও বিশ্বাস করছো ব্যাপারটা সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই আমার।”

“এরকম হেঁয়ালি করে কথা বলছো কেন? আমি বিশ্বাস করছি মানে? আমি কি পাগল যে অবাস্তব কিছু বিশ্বাস করবো? যা দেখেছি সেটাই বলেছি তোমাকে।”

“তোমাকে কিন্তু একবারের জন্যেও পাগল বলিনি আমি।”

 “তাহলে কি বলছো এসব?”

আমি ভেবেছিলাম দু’জনের বোধহয় তখনই ঝগড়া লেগে যাবে, কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের কথাগুলো শুনে একদম থমকে যাই। ফিসফিস করে বলে:

“আমি চাই তুমি কারো সাথে এ ব্যাপারে কথা বলো।”

“কার সাথে কথা বলবো? পুলিশ?”

“না,” আবারো রাগ ভর করে গ্যাব্রিয়েলের কণ্ঠে। “পুলিশ না।”

আমি আসলে বুঝেছিলাম যে ও কি বলতে চাচ্ছে। কিন্তু সেটা ওর মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছিলাম। “তাহলে কার সাথে?”

“ডাক্তার।”

 “আমি কোন ডাক্তার দেখাবো না, গ্যাব্রিয়েল-”

“আমার জন্যে কাজটা করো, জান। আমি তো তোমাকে বোঝার চেষ্টা করছি, তুমিও একটু-”

“না, তুমি বোঝার চেষ্টা করছো না!”

 এতটা অসহায় দেখাচ্ছিল ওকে। বারবার মনে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেই। “সব ঠিক হয়ে যাবে, জান,” শেষমেষ নিজেকে সামলাতে না পেরে বলেই ফেলি। ওকে এভাবে দেখা সম্ভব না আমার পক্ষে। “দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো গ্যাব্রিয়েল। “ডঃ ওয়েস্টের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করবো। সম্ভব হলে আজকেই,” বলে চোখে দ্বিধা নিয়ে আমার দিকে তাকালো ও। “ঠিক আছে?”

 ইচ্ছে করছিল গ্যাব্রিয়েলের সামনে বাড়িয়ে দেয়া হাতটা চাপড় দিয়ে সরিয়ে দেই; ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি, চেঁচিয়ে বলি, “তোমার ধারণা আমি পাগল হয়ে গেছি! আমি পাগল না! আমি পাগল না!”

কিন্তু সেরকম কিছু করিনি। বরং মাথা নেড়ে গ্যাব্রিয়েলের হাতটা ধরি।

 “ঠিক আছে, ডার্লিং,” বলি আমি। “তুমি যা চাও সেটাই হবে।”

.

১৬ অগাস্ট

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডঃ ওয়েস্টের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আজকে।

তার সবকিছুই অপছন্দ আমার। ছোট বাড়িটা থেকে শুরু করে সবসময় লিভিং রুমে ঘুরঘুর করা কুকুরটাকেও বিরক্ত লাগে। এক মুহূর্তের জন্যেও ঘেউঘেউ থামায়না হতচ্ছাড়া। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কুকুরটাকে চুপ করতে বলি। ভেবেছিলাম ডঃ ওয়েস্ট নিজেই বোধহয় কিছু একটা করবেন, কিন্তু তিনি এমন একটা ভাব ধরেন যেন শুনতেই পাচ্ছেন না। হয়তো আসলেও শুনতে পাচ্ছিলেন না। অন্তত আমার বলা কথাগুলো তার কানে যাচ্ছিল না, এটা নিশ্চিত। তাকে সব খুলে বলি আমি, কিন্তু জবাবে মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকেন। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল একটা রঙিন গিরগিটির দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি গ্যাব্রিয়েলের বন্ধু, কিন্তু এরকম একটা লোকের সাথে কিভাবে ওর বন্ধুত্ব হলো কে জানে। গ্যাব্রিয়েল যেখানে সবসময় কোমল আচরণ করে, সেখানে ডঃ ওয়েস্টের হাবভাব একদম শীতল। একজন ডাক্তারের ব্যাপারে এ ধরণের কথা বলা উচিৎ হচ্ছে না, জানি। কিন্তু তার মধ্যে দয়ামায়ার কোন বালাই নেই।

লোকটার ব্যাপারে আমার সব কিছু বলা শেষ হলে লম্বা একটা সময় কিছু বললেন না তিনি। তার এই অভ্যাসটাও আমাকে বিরক্ত করে। কথা বলার আগে অনেকক্ষণ ধরে ভাবেন, যেন ইচ্ছে করে অপেক্ষা করাচ্ছে আমাকে। শব্দ বলতে কেবল নিচতলা থেকে কুকুরটার ঘেউঘেউ কানে আসছে। আওয়াজটা শুনতে শুনতে এক ধরণের ঘোরের মধ্যে চলে যাই। ডঃ ওয়েস্ট যখন আচমকা কথা বলে ওঠেন, তখন আসলেও চমকে যাই।

“আমাদের মধ্যে আগেও এ বিষয়ে কথা হয়েছে, তাই না অ্যালিসিয়া?”

শূন্যদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই আমি। ধরতে পারছি না কি বলতে চাচ্ছেন। “হয়েছে কি?”

“হ্যাঁ, হয়েছে,” মাথা নাড়েন ডঃ ওয়েস্ট।

“আপনি বোধহয় ভাবছেন যে পুরোটাই আমার কল্পনা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বানিয়ে বলছি না।”

“গতবারও এটাই বলেছিলেন। মনে আছে কি হয়েছিল?”

জবাব দেইনি। আসলে তাকে সেই সন্তুষ্টিটুকু দিতে চাচ্ছিলাম না। চোখ পাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকি, ছোট বাচ্চাদের মতন।

ডঃ ওয়েস্ট অবশ্য আমার জবাবের অপেক্ষা করলেন না। বাবার মৃত্যুর পর কি ঘটেছিল সে বিষয়ে কথা বলেই গেলেন। সবসময় একটা আতঙ্কের ভেতরে থাকতাম তখন, মনে হতো কেউ আমাকে দেখছে সর্বক্ষণ, নজর রাখছে। “আমরা আগেও এ বিষয়ে কথা বলেছি, বুঝলেন তো?”

“কিন্তু এবারে পরিস্থিতি ভিন্ন। গতবার শুধু ওরকমটা মনেই হয়েছিল আমার, কাউকে দেখিনি। এবারে আসলেও একজনকে দেখেছি।”

“কাকে দেখেছেন?”

 “ইতোমধ্যে বলেছি আপনাকে। একটা লোককে।”

 “তার বর্ণনা দিন তো?”

“সেটা পারবো না,” দ্বিধান্বিত স্বরে বলি।

 “কেন পারবেন না?”

“আসলে তাকে ঠিকমতো দেখতে পারিনি কোনবারই। বলেছিল তো আপনাকে-দূর থেকে লক্ষ্য রাখে সে।”

“আচ্ছা।”

“তাছাড়া ইচ্ছে করেই একটা কাপ আর সানগ্লাস পরে আসে, যাতে চেহারাটা দেখতে না পাই।”

“অনেকেই কিন্তু এই আবহাওয়ায় সানগ্লাস চোখে দিয়ে বাইরে বের হয়। মাথায় ক্যাপও পড়ে। তারা সবাই কি কারো ওপর নজর রাখে?”

মেজাজ গরম হতে শুরু করে আমার। “আমি জানি আপনি কি চাইছেন।”

“কি?”

“আপনি আমার মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছেন যে ভুলভাল দেখছি আমি। বাবা মারা যাবার পর মাথা বিগড়ে যেতে শুরু করেছিল, সেরমটাই হচ্ছে আবারো-এটাই তো বলাতে চাচ্ছেন আমাকে দিয়ে, নাকি?”

“আপনার কি ধারণা? সেরকম কিছু কি হচ্ছে আপনার সাথে?”

“না। তখন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম আমি। কিন্তু এবারে একদম ঠিক আছি। কোন সমস্যা নেই। একটা লোক আমাদের বাসার ওপর নজর রাখছে প্রতিনিয়ত, এটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে সমস্যা মনে হচ্ছে না!।”

মাথা নাড়লেন ডঃ ওয়েস্ট কিন্তু তৎক্ষণাৎ কিছু বললেন না। নোটবুকে কী যেন টুকে নিলেন।

 “আপনাকে আবারো কিছু ওষুধ খেতে হবে। সাবধানতাবশতই কাজটা করছি আমি। এবারে পরিস্থিতি আগের মত খারাপ হতে দেয়া চলবে না, বুঝেছেন?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম। “কোন ওষুধ খাবো না আমি।”

“বেশ। যদি ওষুধ না-ই খান, তাহলে কিন্তু এর পরিণাম নিয়ে ভাবতে হবে আপনাকে।”

“কি পরিণাম? আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?”

“আমার সাথে এর কোন লেনদেন নেই। আমি আপনার স্বামীর ব্যাপারে কথা বলছি। গতবার আপনার ওরকম পরিস্থিতি দেখে গ্যাব্রিয়েলের কেমন লেগেছিল?”

কল্পনায় গ্যাব্রিয়েলকে নিচতলার লিভিংরুমে দেখতে পেলাম। কুকুরটা তার পাশে বসেই ঘেউঘেউ করে চলেছে। “জানিনা আমি, ওকেই জিজ্ঞেস করছেন না কেন?”

“আপনি কি এটাই চান, আবারো সেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাক সে? আপনার কি মনে হয় না তার সহ্যের একটা সীমা আছে?”

“কী বলছেন এসব? গ্যাব্রিয়েল আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? আপনার এটাই ধারণা?”

কথাটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে আমার। ওকে হারাতে হবে, এটা চিন্তাই করতে পারি না। গ্যাব্রিয়েলকে নিজের কাছে রাখার জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি আমি। তাই রাজি হয়ে যাই ডঃ ওয়েস্টের কথায়। বলি যে যদি যে অশরীরি কেউ আমার মাথার ভেতরে কথা বলার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে অবশ্যই জানাবো। ওষুধগুলোও খাবো নিয়মিত।

সন্তুষ্টি ফোটে ডঃ ওয়েস্টের চেহারায়। বলেন যে নিচতলায় গিয়ে গ্যাব্রিয়েলের সাথে দেখা করতে পারি আমরা। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মনে হচ্ছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই। দিলেই ভালো হতো।

বাসায় ফেরার পথে খুব খুশি দেখায় গ্যাব্রিয়েলকে। বারবার হাসিমুখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। “তোমার মতো সাহসী মেয়ে খুব কমই দেখেছি আমি। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।”

 মাথা নাড়লেও ওর কথার জবাবে কিছু বলিনি ইচ্ছে করেই। কারণ ডঃ ওয়েস্টের কাছে যাওয়াটা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়।

একাই সবকিছু সামলাতে হবে আমাকে।

আসলে কাউকে বলাটাই ভুল হয়েছিল। কালকে বার্বিকে মেসেজ করে বলবো ব্যাপারটা ভুলে যেতে। জানি যে আমার মেসেজ পেয়ে বিরক্ত হবেন তিনি। তার নাটক শুরুতেই থামিয়ে দিচ্ছি আমি। কিন্তু কিছুদিন পরেই ভুলে যাবেন। আমিও ভাব ধরবো যে সব ঠিকঠাক চলছে। কেউ এক মুহূর্তের জন্যেও কিছু বুঝতে পারবে না।

একটা ফার্মেসি থেকে আমার ওষুধগুলো কিনে ফেলে গ্যাব্রিয়েল। বাসায় ফিরেই সরাসরি রান্নাঘরে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে আনে। হলুদ ওষুধগুলো আমার হাতে দিয়ে বলে, “খেয়ে ফেলো।”

“আমি বাচ্চা নই। এভাবে হাতে তুলে দেয়ার কিছু নেই।”

“আমি জানি তুমি বাচ্চা নও, কিন্তু এগুলো যে আসলেও খাচ্ছো, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছিলাম।”

“খাবো আমি।”

 “এখনই খাও।”

গ্যাব্রিয়েলের সামনে ওষুধগুলো মুখে দিয়ে অল্প একটু পানি খাই।

“গুড গার্ল।” আমার গালে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ও।

সাথে সাথে ওষুধগুলো মুখ থেকে বের করে সিঙ্কে ফেলে দেই। আমি আর কোন ওষুধ খাবো না। গতবার ডঃ ওয়েস্টের দেয়া ওষুধগুলো খেয়ে প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। এবারে সেই ঝুঁকি নিব না।

নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রন রাখতে হবে আমাকে।

সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে।

.

অগাস্ট ১৭

ডায়েরিটা এখন লুকিয়ে রাখি আমি। গেস্টরুমে একটা পাটাতন আলগা করা যায়। সেখানেই রেখে দেই, সহজে আর কারো চোখে পড়বে না তাহলে। কেন? আসলে এখানে খোলাখুলি অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করেছি। বলা যায় না, গ্যাব্রিয়েল যদি ডায়েরিটা দেখে তাহলে পড়া শুরু করে দিতেও পারে। তখন জেনে যাবে আমি ওষুধ না খেয়ে ফেলে দেই। খুব কষ্ট পাবে বেচারা, এরকমটা হতে দিতে পারি না আমি।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এই ডায়েরিটায় মনের কথা লিখতে পেরেছি, নতুবা মাথা আসলেও বিগড়ে যেত। কেউ নেই আমার সাথে কথা বলার মতো।

কাকে ভরসা করবো?

.

২১ অগাস্ট

গত তিন দিনে একবারের জন্যেও বাইরে যাইনি। গ্যাব্রিয়েল বাসায় ফিরলে ভাব ধরি যে বিকেলে হাঁটতে বের হয়েছি। কিন্তু সেটা মিথ্যে।

আসলে বাইরে যাবার কথা মনে হলেই ভয় লাগে। যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে। অন্তত বাসার ভেতরে আমি নিরাপদ। জানালার পাশে বসে। চুপচাপ বাইরে নজর রাখতে পারবো। রাস্তা দিয়ে যারা হেঁটে যায় তাদের সবাইকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করি। অবশ্য আমার দৃষ্টি বারবার একজনকেই খুঁজে ফেরে।

আচ্ছা, সে যদি সানগ্লাস আর ক্যাপ খুলে আসে তাহলে চিনবো কি করে? তার চেহারা কেমন এটা তো জানি না। তখন সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও বুঝতে পারবো না।

এটা একটা চিন্তার বিষয়।

.

২২ অগাস্ট

এখন পর্যন্ত দেখিনি তাকে। কিন্তু ধৈৰ্য্যহারা হওয়া চলবে না। আজ হোক আর কাল, ফিরে সে আসবেই। সেজন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে আমাকে। উপযুক্ত পদক্ষেপও নিতে হবে।

আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই গ্যাব্রিয়েলের বন্দুকটার কথা মনে হয়। গেস্ট রুম থেকে সরিয়ে হাতের কাছে কোথাও এনে রাখবো ওটা। জানালার পাশের কেবিনেটে রাখলেই সবচেয়ে সুবিধে হবে।

আমি জানি কথাগুলো কেমন শোনাচ্ছে। আশা করি পরিস্থিতি এতটাও খারাপ হবে না। লোকটা না এলেই ভালো।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবসময় মনে হয় সে আসবেই।

সে কোথায় এখন? আসছে না কেন? আমাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় চমকে দিতে চায়? কিন্তু আমি সবসময় তৈরিই থাকবো। জানালার পাশ থেকে সতর্ক নজর রাখবো বাইরে। অপেক্ষা করবো তার আগমনের

.

২৩ অগাস্ট

এখন তো আমার মনে হচ্ছে গ্যাব্রিয়েল আর ডঃ ওয়েস্টের কথাই ঠিক। পুরোটাই কি কল্পনা ছিল?

গ্যাব্রিয়েল বারবার জিজ্ঞেস করে যে কেমন আছি আমি। আসলে জানতে চায় পাগলামিটা মাথা থেকে দূর হয়েছে কিনা। ও যে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমার অভিনয় ঠিকঠাক হচ্ছে না বোধহয়, আরো ভালো করে চেষ্টা করতে হবে। সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার অভিনয় করি। কিন্তু আসলে কিছুই আঁকানো হয় না, মনোযোগ ছাড়া এ ধরণের কাজ অসম্ভব। এই কথাগুলো লেখার সময়েও আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না যে জীবনে আর কখনো ঠিকঠাক ছবি আঁকতে পারবো কি না। অন্তত এই ঝামেলা শেষ হবার আগে তো পারবোই না।

বাইরে না যাবার ব্যাপারে এতদিন নানারকম অজুহাত দেখিয়েছি। কিন্তু গ্যাব্রিয়েল বলেছে যে আজ রাতে বের হতেই হবে, ম্যাক্স দাওয়াত দিয়েছে আমাদের।

এরকম সময়ে ম্যাক্সের সাথে দেখা হবে ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে। গ্যাব্রিয়েলের সাথে অনেকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। বরং ও বলে যে গেলেই নাকি লাভ হবে আমার! মন থেকেই কথাটা বলেছে সে, তাই আমিও আর না করতে পারিনি।

 আজ রাতে কি হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব। কারণ একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করার পরই সব পরিস্কার হয়ে যায়। একদম খাপে খাপে মিলে গেছে। এতদিন কেন ব্যাপারটা বুঝিনি, সেটাই রহস্য।

বাইরে থেকে যে লোকটা আমার ওপর নজর রাখে, সে জিন-ফিলিক্স নয়। ওকে খুব ভালো করেই চিনি আমি, এতটা নিচে সে কখনোই নামবে না। কিন্তু আমাকে ইচ্ছে করে জ্বালাতন করার মত আর কে বাদ থাকে? যার উদ্দেশ্যে আমাকে এভাবে শাস্তি দেয়া?

ম্যাক্স।

এছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না। আমাকে পাগল বানানোর যুদ্ধে নেমেছে সে।

খুব ভয় লাগছে, কিন্তু মনে সাহস জড়ো করতে হবে। আজকে রাতেই কাজটা করবো আমি।

ওর মুখোমুখি হবো।

.

২৪ অগাস্ট

এতদিন পর গতরাতে বাসা থেকে বের হয়ে একটু অদ্ভুতই লাগছিল।

মনে হচ্ছিলো যেন অ্যাকুরিয়াম থেকে সাগরে এসে পড়েছি। মাথার ওপরে বিশাল খোলা আকাশটাও অচেনা ঠেকছিল। পুরোটা সময় গ্যাব্রিয়েলকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম।

আমাদের পছন্দের রেস্তোরাঁ অগাস্তো’সে গিয়েও ভালো লাগছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল কি যেন একটা নেই। আর গন্ধটাও অন্যরকম ঠেকছিল, কোন কিছু পোড়ার গন্ধ। গ্যাব্রিয়েলকে জিজ্ঞেস করলে বলে যে সে কোন গন্ধ পাচ্ছে না। গোটাটাই আমার কল্পনা।

“সব ঠিকঠাকই আছে,” বলে ও। “শান্ত হও।”

“আমি তো শান্তই আছি। দেখে কি মনে হচ্ছে তোমার?”

গ্যাব্রিয়েল জবাব দেয়নি। চোয়াল শক্ত করে বসে ছিল, বিরক্ত হলে যেমনটা করে। চুপচাপ ম্যাক্সের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি আমরা।

ম্যাক্স ওর রিসিপশনিস্ট তানিয়েকে নিয়ে এসেছিল। ওদের মধ্যে কিছু একটা চলছে। ম্যাক্সের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন রাজরাণীকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। একটু পর পর নানা ছুতোয় তার হাতে হাত রাখছিল, চুমু খাচ্ছিলো। আমার দিক থেকে কিন্তু চোখ ফেরায়নি এক মুহূর্তের জন্যেও। কি ভাবছিল? ওকে তানিয়ার সাথে দেখলে হিংসায় জ্বলবো আমি? ওর কথা ভাবলেই ঘেন্না লাগে আমার।

তানিয়াও বুঝতে পারে কোন একটা সমস্যা আছে। ম্যাক্সকে কয়েকবার আমার দিকে তাকাতে দেখে ফেলে সে। সাবধান করে দিতে হবে মেয়েটাকে। সামনে কি অপেক্ষা করছে সেটা জানলে হয়তো ভুলটা করবে না। কিন্তু এখনই কিছু বলবো না। আগে আমার নিজের সমস্যার সমাধান হোক।

ডিনারের এক পর্যায়ে ম্যাক্স বলে যে বাথরুমে যাবে সে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আমিও একই অজুহাত দেখিয়ে উঠে যাই।

বাথরুমের কাছে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরি শক্ত করে।

 “তোমাকে থামাতে হবে এসব! বুঝেছছ? থামাতে হবে!”

শয়তানি হাসি ফোটে ম্যাক্সের চেহারায়। “কি থামাবো?”

“আমার ওপর নজর রাখছো তুমি, ম্যাক্স। আমি জানি!”

 “আবোলতাবোল কি বলছো এসব, অ্যালিসিয়া?”

“মিথ্যে বলবে না,” স্বাভাবিক স্বরে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। “আমি দেখেছি তোমাকে, ঠিক আছে? ছবিও তুলেছি। আমার কাছে তোমার ছবি আছে!”

হাসে ম্যাক্স। “তোমার মাথার স্কু আসলেও ঢিলা হয়ে গেছে।”

আর সহ্য হয় না। জোরে থাপ্পড় দেই ওর গালে।

একটা শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল থাপ্পড়টা তার গালেই পড়েছে।

একবার ম্যাক্স আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যায় সে।

চোখ গরম করে আমার দিকে তাকায় ম্যাক্স। তানিয়াকে অনুসরণ করার আগে নিচুগলায় বলে, “তোমার পেছনে সময় নষ্ট করতে আমার বয়েই গেছে। একবারও তোমাদের বাসার ওদিকে যাইনি। আর নজর রাখবোই বা কেন? সরো, যেতে দাও আমাকে।”

তার কণ্ঠে এমন কিছু একটা ছিল যে বুঝতে পারি সে সত্যিটাই বলছে। না চাইতেও বিশ্বাস করতে হয় কথাটা।

কিন্তু লোকটা যদি ম্যাক্স না হয়, তাহলে কে?

.

২৫ অগাস্ট

বাইরে থেকে একটা শব্দ কানে এসেছে কেবলই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি কেউ একজন ছায়ায় নাড়াচাড়া করছে।

লোকটা এসেছে। বাইরে সুযোগের অপেক্ষা করছে এখন।

গ্যাব্রিয়েলকে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু ও ধরেনি। পুলিশকে ফোন দিব? কি করবো বুঝতে পারছি না। হাত এত কাঁপছে যে লিখতেও

নিচতলা থেকে এখন ক্রমাগত শব্দ শুনতে পাচ্ছি। জানালা খোলার চেষ্টা করেছে কিছুক্ষণ। এখন দরজা ধাক্কাচ্ছে। ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে

আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। পালাতে হবে যে করেই হোক।

ঈশ্বর! তার হাঁটার শব্দ এখন একদম স্পষ্ট

ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

তৃতীয় পর্ব

স্বাভাবিকতার সাথে অস্বাভাবিকতার মিশ্রনের স্বভাব মানুষের সহজাত; আর সেজন্যেই ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা বিপদজনক মনে হয় আমার কাছে। একজনের পক্ষে সবকিছুই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বর্ণনা করাটা খুব সহজ সেখানে।
–জাঁ পল সাত্রে

সচরাচর আমার মধ্যে সতোর দেখা পাবেন না, কিন্তু মাঝেমধ্যে নিজের অজান্তেই সত্যটা বলে ফেলি।
–উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, দ্য উইন্টার’স টেইল

অ্যালিসিয়ার বেরেনসনের ডায়েরি
৮ অগাস্ট

খুব অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে আজকে।

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছিলাম। পানি গরম হবার ফাঁকে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছি, এসময় একটা জিনিসের ওপর নজর আটকে যায়। না, জিনিস না, মানুষ। একটা লোক মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের বাসার উল্টোদিকের রাস্তায়, পার্কের প্রবেশমুখে। গাছের আড়ালে থাকায় তার চেহারা ঠিকমতো দেখতে পারিনি, কিন্তু বেশ লম্বা-চওড়া। মাথায় ক্যাপ আর চোখে সানগ্লাসও ছিল।

লোকটা আমাকে দেখতে পাচ্ছিল কি না সেটা বলতে পারবো না, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু অদ্ভুত লাগে ব্যাপারটা, সাধারণত ওখানটায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করে সবাই, কিন্তু লোকটা বাসের জন্যে দাঁড়ায়নি। আমাদের বাসার ওপরে লক্ষ্য রাখছিল সে।

কিছুক্ষণ পর টের পাই, এক জায়গাতেই বেশ অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি, তাই জানালার পাশ থেকে সরে কফি নিয়ে স্টুডিওতে চলে যাই। কিন্তু সেখানে কাজে মন বসে না। বারবার লোকটার কথা ভাবছিলাম। তাই ঠিক করি বিশ মিনিট পর রান্নাঘরে গিয়ে দেখবো সে তখনও দাঁড়িয়ে আছে কি না। যদি থাকতো তাহলে কি করতাম? ভুল তো কিছু করছিল না। এই এলাকায় চোরের উৎপাত নেই সত্যি, কিন্তু সবকিছুরই তো একটা প্রথমবার আছে। যদি চুরির জন্যে রেকি করতে আসে, তখন? আবার এমনটাও হতে পারে, এই রাস্তার শেষ মাথায় নতুন বাড়িটা কিনবে, সেজন্যে দেখতে এসেছিল।

কিন্তু রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে তাকে আর দেখিনি। কেউ ছিল না রাস্তার অন্য পাশে।

আর জানা হবে না কি উদ্দেশ্যে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে। অদ্ভুত।

.

১০ অগাস্ট

গতকাল জিন-ফিলিক্সের সাথে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। গ্যাব্রিয়েল অবশ্য মানা করেছিল, কিন্তু আমি শুনিনি। সত্যি বলতে আমার নিজেরও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পরে ভাবি, জিন-ফিলিক্সের কথা অনুযায়ী ‘শেষবার যদি একসাথে ঘুরতে বের হই, তাহলে খুব একটা ক্ষতি হবে না। এরপরে নিশ্চয়ই আর কিছু বলার থাকবে না তার?

নাটক শুরু হবার বেশ আগেই দেখা করি আমরা, একসাথে কোথাও ড্রিঙ্ক করা যাবে তাহলে-জিন-ফিলিক্সের বুদ্ধি। সূর্য ততক্ষণে ডুবতে বসেছে, মনে হচ্ছিল কেউ লাল আবীর মিশিয়ে দিয়েছে নদীর পানিতে। ন্যাশনাল থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল সে। আমিই আগে দেখি তাকে, মানুষের ভিড়ে মুখ বাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দৃশ্যটা দেখে ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার ব্যাপারে তখনও যেটুকু সন্দেহ ছিল আমার ভেতরে, তা-ও দুর হয়ে যায়। এখন বুঝতে পারি, জিন-ফিলিক্সকে কেমন যেন ভয় পাই আমি, পুরোপুরি বলে বোঝানো যাবে না ব্যাপারটা। ঘুরে পালানোর কথা চিন্তভাবনা করছি, এসময় আমাকে দেখে ফেলে জিন ফিলিক্স। অগত্যা তার দিকে হাঁটতে শুরু করি। মুখে জোর করে একটা হাসি ফোঁটাই, সে-ও তাই করে।

“তুমি আসাতে আমি সত্যিই অনেক খুশি হয়েছে,” বলে জিন-ফিলিক্স। “ভাবছিলাম শেষ মুহূর্তে হয়তো মত পাল্টে ফেলতে পারো। চলো কোথাও বসে ড্রিঙ্ক করা যাক, নাকি?”

ন্যাশনাল থিয়েটারের পাশেই আন্ডারস্টাডি পাবে চলে যাই আমরা। ওখানে কাটানো সময়টুকু অস্বস্তিকর ছিল বললেও কম হয়ে যাবে। হাবিজাবি নিয়ে আলাপ করি দু’জনে, আসলে জিন-ফিলিক্স বলছিল আর আমি শুনছিলাম। খালি পেটে পাবে যাওয়ায় দুই পেগ ড্রিঙ্কেই মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে আমার; এজন্যেই বোধহয় আমাকে পাবে নিয়ে গিয়েছিল জিন-ফিলিক্স। ভেবেছিল মদ খেয়ে মাতাল হলে তার সাথে আরো প্রাণবন্তভাবে আলাপ করবো। তার প্রতিটা কথা শুরু হচ্ছিল-তোমার কি মনে আছে যখন আমরা বা একসাথে ওখানে গিয়ে আমরা’-এই কথাগুলো দিয়ে। যেন এভাবে অতীতের ঘনিষ্ঠতার কথা বললেই আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারবো। কিন্তু ও একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিল না, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আমি। সেটা আর বদলাবে না।

তবে দিনশেষে মনে হয়েছে বের হওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ভালোই করেছিলাম। জিন-ফিলিক্সের সাথে দেখা হয়েছে এজন্যে বলছি না কথাটা, আসলে নাটকটা খুবই পছন্দ হয়েছে আমার। অ্যালসেস্টিসের কথা আগে শুনিনি আমি। এই প্রথম কোন ট্র্যাজেডিতে দেখলাম স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন মোটামুটি বাস্তবভাবে দেখানো হয়েছে (পাতাললোক থেকে অ্যালসেস্টিসের ফিরে আসার ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেরে ফেললে)। সেজন্যেই আরো বেশি ভালো লেগেছে। নাটকটা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়েছে। একটা লোক মৃত্যুদণ্ড পেলে তার স্ত্রী, অ্যালসেস্টিস, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। অ্যালসেস্টিসের নামভূমিকায় যে অভিনেত্রী অভিনয় করেছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গ্রিক পুরাণ থেকে উঠে আসা কোন দেবী। বারবার মনে হচ্ছিল, তার একটা ছবি আঁকবো আমি। জিন-ফিলিক্সকে কথাটা প্রায় বলেও ফেলেছিলাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থামাই নিজেকে। তাকে আর আমার জীবনের কোন ব্যাপারে জড়াবো না। নাটকের শেষ দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। ঠিক কোন বিষয়টা আমাকে নাড়া দিয়েছে তা নিয়ে আরো ভাবতে হবে। জিন-ফিলিক্স অবশ্য একটার পর একটা মন্তব্য করেই যাচ্ছিল, কিন্তু কোনটাই আমার মতের সাথে মিলছিল না। তাই এক পর্যায়ে তার কথা শোনা বাদ দিয়ে দেই।

অ্যালসেস্টিসের মৃত্যুর জগত থেকে ফিরে আসার দৃশ্যটা মাথা থেকে দূর করতেই পারছিলাম না। ব্রিজ থেকে স্টেশনের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময়েও সেটা নিয়েই ভাবছিলাম। এসময় জিন-ফিলিক্স জিজ্ঞেস করে যে আবারো ড্রিঙ্ক করতে যাবে কি না, কিন্তু আমি ক্লান্তির অজুহাত দেখাই। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে আমাদের মাঝে। স্টেশনে পৌঁছে গেলে বাইরে দাঁড়িয়ে ওকে ধন্যবাদ জানাই, বলি যে সময়টা ভালো কেটেছে।

“একটা ড্রিঙ্কই তো,” জিন-ফিলিক্স বলে। “পুরনো সময়ের খাতিরে?”

 “না, বাসায় ফিরতে হবে আমাকে।”

ঘুরে দাঁড়িয়েছি, এসময় আমার হাত ধরে জিন-ফিলিক্স।

“অ্যালিসিয়া,” বলে সে। “তোমাকে একটা কথা বলতে চাই আমি।”

 “না, বলো না, প্লিজ। কিছু বলার নেই আর…”

“তুমি যা ভাবছো সেরকম কিছু বলবো না।”

ঠিকই বলেছিল জিন-ফিলিক্স, আমি মনে মনে যা ভেবেছিলাম ওরকম কোন কথা বের হয়নি তার মুখ দিয়ে। ধরেই নিয়েছিলাম যে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে গ্যালারি ছেড়ে দেয়ার কারণে আমার মধ্যে অপরাধবোধ সৃষ্টির চেষ্টা করবে। কিন্তু তার কথাগুলো শুনে চমকে যাই।

“তোমাকে আরো সাবধানী হতে হবে,” বলে জিন-ফিলিক্স। “মানুষকে খুব সহজে ভরসা করে ফেলল। যারা তোমার আশেপাশে থাকে…তাদের বিশ্বাস করো। এই স্বভাবটা বদলাও। কাউকে ভরসা করার আগে তাকে ভালোমতো চেনার চেষ্টা কোরো।”

শূন্য দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। বেশ খানিকটা সময় লাগে গলা দিয়ে শব্দ বের হতে।

“কি বলছো এসব? কার কথা বোঝাচ্ছো?”

 কিন্তু আর কিছু বলে না জিন-ফিলিক্স। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে আমার হাত ছেড়ে উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে। পেছন থেকে ডাক দেই আমি।

“দাঁড়াও, জিন-ফিলিক্স।”

কিন্তু একবারের জন্যেও তাকায় না সে। কিছুক্ষণ পর মিশে যায় ভিড়ের মাঝে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি স্টেশনের বাইরে। মাথায় বারবার ওর বলা কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ রকম হেঁয়ালি করার মানে কি? এটাও হতে পারে যে আমাকে ইচ্ছে করে এরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে চলে গেছে সে। খুব ভালো করেই জানে যে আমার মাথায় সন্দেহ ঢুকলে সেটা দূর না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাইনা। এ যাত্রায় তাকে সফলই বলতে হবে।

সেই সাথে প্রচণ্ড রাগও লাগছিল। অবশ্য এই কাজটা করে একদিক ভালোই করেছে সে। সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে গেছে। জিন-ফিলিক্সের আর কোন স্থান নেই আমার জীবনে। আশপাশের মানুষদের সহজেই ভরসা করে বলতে নিশ্চয়ই গ্যাব্রিয়েলের কথাই বুঝিয়েছে। কিন্তু কেন?

না, এ নিয়ে মাথা ঘামাবো না আমি। এটাই চাইছিল জিন-ফিলিক্স; আমাকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলতে। গ্যাব্রিয়েল আর আমার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করাটাই তার লক্ষ্য।

কিন্তু তার ফাঁদে পা দেব না আমি। এ বিষয়ে আর ভাববো না।

বাসায় ফিরে দেখি গ্যাব্রিয়েল ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল পাঁচটায় উঠে একটা ফটোশ্যুটে যেতে হবে। তবুও ওকে ডেকে তুলে সেক্স করি। আসলে আমি চাইছিলাম ওকে একদম আমার ভেতরে অনুভব করতে, ওর দেহে মিশে যেতে। ও-ই পারবে আমাকে সবকিছু থেকে নিরাপদ রাখতে।

.

অগাস্ট ১১

আবারো লোকটাকে দেখেছি আমি। এবারে আগের তুলনায় কিছুটা দূরে ছিল সে, পার্কের ভেতর দিককার একটা বেঞ্চে। কিন্তু তাকে চিনতে কোন সমস্যা হয়নি আমার। এরকম আবহাওয়ায় খুব কম লোকই কালো শার্ট প্যান্ট আর ক্যাপ পরে বের হওয়ার কথা ভাববে। আগের দিনের মত চোখে সানগ্লাসও ছিল। আমাদের বাসার ওপর নজর রাখছে।

এসময় একটা ভাবনা খেলে যায় আমার মাথায়। এমনটাও হতে পারে, সে কোন চোর-ছ্যাচড় নয়, বরং আমার মতনই একজন পেইন্টার। হয়তো আমাদের রাস্তাটা আঁকার কথা ভাবছে, সেজন্যেই দেখতে এসেছে। কিন্তু ভাবনাটা যে সত্যি নয় সেটা আমি একরকম নিশ্চিত। যদি আসলেও বাড়িটা আঁকতে চাইতো সে, তাহলে এভাবে বসে থাকতো না। স্কেচবুকে খসড়া স্কেচ আঁকতো।

বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় গ্যাব্রিয়েলকে ফোন করে বসি। খুব বড় একটা ভুল ছিল সেটা। জানতাম যে ও ব্যস্ত থাকবে, এসময় যদি আমি হুট করে ফোন দিয়ে বলি কেউ আমাদের বাসার ওপরে নজর রাখছে, তাহলে রাগ হবারই কথা।

তাছাড়া লোকটা যে আসলেও আমাদের বাসার ওপরে নজর রাখছে, সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিতও নই।

আবার এমনটাও হতে পারে যে তার লক্ষ্য আসলে আমি।

.

অগাস্ট ১৩

আবার এসেছিল সে।

গ্যাব্রিয়েল সকালে বের হয়ে যাবার পরেই তাকে বাথরুমের জানালা থেকে দেখি আমি। গোসল করছিলাম তখন। আজকে আগের দিনগুলোর তুলনায় কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা, বাসস্ট্যান্ডের পাশে।

কি ভাবছিল? এভাবে বোকা বানাবে আমাকে?

 দ্রুত কাপড় পরে রান্নাঘরে চলে যাই ভালো করে দেখার জন্যে। কিন্তু ততক্ষণে উধাও হয়ে যায় সে।

ঠিক করি গ্যাব্রিয়েল বাসায় ফেরার পর বলবো কথাটা। ভেবেছিলাম আবারো হয়তো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিবে ও, কিন্তু আজকে মনোযোগ দিয়ে শোনে সবকিছু। চেহারায় দুশ্চিন্তা ভর করে।

“জিন-ফিলিক্স না তো?” কোন রাখঢাক ছাড়াই বলে গ্যাব্রিয়েল।

 “না! ওর কথা ভাবছো কেন?”

চেষ্টা করছিলাম কণ্ঠে বিস্ময় ফুটিয়ে তুলতে, কিন্তু আমি নিজেও আসলে বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। জিন-ফিলিক্স আর অচেনা লোকটার শারীরিক গঠন একরকম। হতেও পারে যে গ্যাব্রিয়েল ঠিক সন্দেহই করছে। কিন্তু আমার মন সেটা মানতে চাইছিল না। আমাকে তো এভাবে ভয় দেখানোর কথা নয় তার। তাই না?

“জিন-ফিলিক্সের নম্বর কোথায়?” গ্যাব্রিয়েল বলে। “আমি এখনই ফোন করবো ওকে।”

 “না, ডার্লিং, প্লিজ। এরকম কিছু কোরো না। আমি নিশ্চিত লোকটা জিন-ফিলিক্স না।”

“আসলেই?”

“হ্যাঁ। তাছাড়া ওরকম কিছু তো হয়নি। আমি বোধহয় একটু বাড়াবাড়িই করছি। থাক, বাদ দাও।”

“কতক্ষণ ছিল লোকটা এখানে?”

“খুব বেশিক্ষণ না। এই ধরো এক ঘন্টা, এর পরেই উধাও হয়ে যায়।”

 “উধাও হয়ে যায় মানে?”

“মানে গায়েব হয়ে যায়।”

 “ওহ। আচ্ছা জান, রাগ কোরো না। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

 “কি?” ওর প্রশ্নের ধরণটা ভালো লাগলো না আমার।

 “পুরো ব্যাপারটা তোমার কল্পনা নয় তো?”

 “না,” দৃঢ় কণ্ঠে বলি। “বিশ্বাস করো আমার কথা।”

 “বিশ্বাস তো করছিই।”

কিন্তু ওর কথা শুনে বুঝতে পারি যে আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করছিল না তখন। বিশ্বাস করার ভান করছিল। সত্যি বলতে, প্রচণ্ড রাগ লাগে তখন। এত রাগ যে…আজকে এখানেই লেখা থামাতে হবে। নতুবা এমন কিছু লিখে ফেলবো যেটা নিয়ে পরে পস্তাতে হতে পারে।

.

১৪ অগাস্ট

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানালার কাছে চলে যাই। মনে মনে আশা করছিলাম লোকটাকে হয়তো দেখতে পাবো, তাহলে গ্যাব্রিয়েলকেও ডেকে দেখানো যাবে। কিন্তু তার কোন চিহ্নই ছিল না বাইরে। নিজেকে আরো বেশি আহাম্মক মনে হয় তখন।

 বিকেলে সিদ্ধান্ত নেই গরমের মধ্যেও হাঁটতে বের হবো। আসলে বাড়ি থেকে কিছুক্ষণের জন্যে পালাতে চাইছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে পার্লামেন্ট হিলের কাছে চলে যাই, চারপাশে অনেকেই রোদ পোহাচ্ছিল। একটা খালি বেঞ্চ দেখতে পেয়ে বসে পড়ি। লন্ডনের অনেকটা দেখা যায় ওখান থেকে।

কিন্তু গোটা সময় মনে হচ্ছিল যে কেউ আমার ওপরে নজর রাখছে। বারবার পিছু ফিরে তাকালেও সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু কেউ একজন ছিল সেখানে, বুঝতে পারছিলাম সেটা।

বাসায় ফেরার পথে পুকুর পাড় দিয়ে হাঁটছি এসময় হঠাই মুখ তুলে তাকাই। সাথে সাথে থমকে যাই সেখানেই। পুকুরের অন্যপাশ থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল লোকটা। চেহারা ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল না অবশ্য, কিন্তু আমার চিনতে ভুল হয় না।

ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আপনা থেকেই চেঁচিয়ে উঠি:

“জিন-ফিলিক্স? আমাকে অনুসরণ করছো কেন? বন্ধ করো এসব!”

কিন্তু লোকটা দাঁড়িয়েই থাকে। যত দ্রুত সম্ভব পকেট থেকে ফোন বের করে তার একটা ছবি তুলি। এতে লাভ কি হয়েছে, জানি না। এরপর উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করি, একবারও পেছনে তাকাইনি। ভয় হচ্ছিল যে পেছনে ফিরলেই দেখতে পাবো কাছাকাছি চলে এসেছে।

তা সত্তেও নিজেকে আটকাতে পারিনি। ঘরে তাকাই। কিন্তু আবারো উধাও হয়ে গিয়েছিল সে।

মনেপ্রাণে চাইছিলাম যাতে জিন-ফিলিক্স না হয় লোকটা।

বাসায় ফেরার পর খুব অস্থির লাগছিল। সব পর্দা টেনে বাতি নিভিয়ে দেই। কি মনে করে জানালা দিয়ে বাইরে একবার উঁকি দিতেই থমকে যাই। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, রাস্তার অন্যপাশে। দৃষ্টি আমার দিকে। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

এসময় কেউ আমার নাম ধরে ডাক দেয়ায় চমকে উঠি।

 “অ্যালিসিয়া? আছো?”

পাশের বাসার বিরক্তিকর মহিলাটা আবার এসেছিল। বার্বি হেলমান। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পেছনের দরজাটা খুলে দেই। ইতোমধ্যে বাগানে ঢুকে পড়েছিল সে, হাতে ওয়াইনের বোতল।

“কেমন আছো ডার্লিং? স্টুডিওতে দেখলাম না তাই ভাবলাম কি করছে।”

“একটু বাইরে গিয়েছিলাম। কেবলই ফিরেছি।”

“ওয়াইন?” বাচ্চাদের মত করে বলল সে, এরকমটা প্রায়ই করে মহিলা। বিরক্ত লাগে আমার।

“আসলে, কাজ করতে হবে আমাকে এখন।”

“আরে কাজ তো আমারো আছে। একটু পরেই ইটালিয়ান ক্লাসে যাবো। এর আগে একটু গল্পগুজব করি দু’জনে।”

আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। ঘর অন্ধকার দেখে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিল বিনা অনুমতিতে। তাকে থামাতে যাবো এসময় বাইরে তাকিয়ে দেখি লোকটা চলে গেছে।

আমি আসলে ঠিক জানি না যে কেন বার্বিকে তার ব্যাপারে বলেছি। মহিলাকে একদমই পছন্দ কই না আমি, ভরসা করা তো দুরের কথা। আসলে ওই সময়টা বাসায় যে-ই থাকতো, তাকেই বলতাম কথাগুলো। ওয়াইন পেটে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁদতে শুরু করি। বিস্ফোরিত নয়নে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে বার্বি। আমার সব বলা শেষ হলে হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাসটা নামিয়ে রাখে টেবিলে। “আরো কড়া কিছু দরকার।” কেবিনেট থেকে হুইস্কি বের করে দুটো মগে ঢেলে একটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়।

“এই নাও, এটা এখন দরকার তোমার।”

আসলেও দরকার ছিল। মাথাটা একটু শান্ত হয় অবশেষে। এবারে আমার শোনার পালা। একটানা কথা বলতে থাকে বার্বি। বারবার বলছিল যে আমাকে ভয় দেখানোর কোন উদ্দেশ্য নেই তার, কিন্তু তার কথাগুলো ভয়ংকরই শোনাচ্ছিল। “এরকমটা টিভিতে হাজারবার দেখেছি আমি। কিছু করার আগে রেকি করে নিচ্ছে হারামিটা।”

“আপনার কি মনে হয়? লোকটা চোর?”

কাঁধ নাচায় বার্বি। “ধর্ষকও হতে পারে। তাতে কিছু আসে যায়? ভালো উদ্দেশ্যে যে আসেনি, এটা নিশিচত।”

 হেসে ফেলি তখন। আসলে এটা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছিলাম যে কেউ একজন আমার কথা বিশ্বাস করেছে-হোক সেটা বার্বি। তাকে আমার ফোনে ভোলা ছবিটা দেখাই।

“আমাকে মেসেজ করে দাও। বাসায় গিয়ে চশমা পরে ভালো করে দেখবো। এখানে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না। তোমার জামাইকে বলেছে এ ব্যাপারে?”

“না,” মিথ্যে বলি।

একটু অবাক হয় বার্বি। “কেন?”

“আসলে…আমি ভয় পাচ্ছি যে গ্যাব্রিয়েল হয়তো আমাকে ভুল বুঝবে। ভাববে পুরোটাই আমার কল্পনা।”

“তোমার কি মনে হয়, আসলেও কল্পনা করছো?”

 “না।”

সন্তুষ্টি ফুটলো বার্বির চেহারায়। “গ্যাব্রিয়েল যদি তোমার কথা আমলে না নেয় তাহলে আমি যাবো তোমার সাথে পুলিশের কাছে। এমনভাবে কথা বলবো যে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে ওরা।”

“ধন্যবাদ। কিন্তু সেটার আপাতত কোন প্রয়োজন নেই।”

“কে বলল প্রয়োজন নেই? এগুলো হেলাফেলার বিষয় নয়। আজকে গ্যাব্রিয়েল ফিরলে অবশ্য কথা বলবে তার সাথে, ডার্লিং। আমাকে কথা দাও।”

আমি মাথা নাড়ি। কিন্তু ততক্ষণে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে গ্যাব্রিয়েলকে এ বিষয়ে আর একটা কথাও বলবো না। লোকটা যে আসলেও আমাকে অনুসরণ করছে বা আমার ওপরে নজর রাখছে এর শক্ত কোন প্রমাণ নেই। বার্বি ঠিকই বলেছে, ছবিটা একদমই স্পষ্ট না।

পুরোটাই আমার কল্পনা-গ্যাব্রিয়েলের যখন এটাই ধারণা, তাকে কিছু না বলাই ভালো। উল্টো আরো বিরক্ত হবে তখন। সেটা চাই না আমি।

 মাথা থেকে ঝেরে ফেলবো ব্যাপারটা।

.

রাত ৪টা।

আজকের রাতটা ভালো যাচ্ছে না।

দশটার দিকে বাড়ি ফিরে গ্যাব্রিয়েল। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে তাই। আমিও ঘুমোনোর চেষ্টা করি, কিন্তু ঘুম আসেনা। চোখে।

দুই ঘন্টা আগে হঠাই খুট করে একটা শব্দ শুনতে পাই। বাইরের বাগান থেকে আসছিল শব্দটা। দ্রুত জানালার পাশে গিয়ে বাইরে তাকাই-কাউকে দেখি না। কিন্তু মনে হতে থাকে যে কেউ একজন খেয়াল করছে আমাকে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে।

দৌড়ে বেডরুমে ফিরে এসে গ্যাব্রিয়েলকে ডেকে তুলি।

“লোকটা বাইরে,” বলি আমি, “বাগানের ওখানে শব্দ শুনেছি।”

গ্যাব্রিয়েল প্রথমে ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারেনা যে কি বলছি আমি। যখন বোঝে তখন বিরক্তি ফোটে চোখেমুখে। “এত রাতে কি শুরু করেছে। আর তিন ঘন্টা পর বের হতে হবে আমাকে। এসব চোর-পুলিশ খেলতে পারবো না।”

“চোর পুলিশ খেলা না, আমার কথা বিশ্বাস করো, প্লিজ। একবার এসে দেখো।”

অগত্যা আমার সাথে আসে ও।

কিন্তু বাইরে কেউই ছিল না তখন, ঠিক যেমনটা ভয় পাচ্ছিলাম।

গ্যাব্রিয়েলকে বলি একবার বাইরে গিয়ে দেখতে, কিন্তু মানা করে দেয়। হনহন করে ওপর তলায় উঠে যায় বিরক্তভঙ্গিতে। আমি ওর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করি কিন্তু লাভ হয় না। গেস্টরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

 আমি আর বিছানায় যাইনি। তখন থেকে এখানেই বসে আছি। কান পেতে রেখেছি শব্দের অপেক্ষায়, কিছুক্ষণ পরপর জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি বাইরে। কিন্তু লোকটার কোন হদিস নেই এখন অবধি।

আলো ফুটতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।

.

১৫ অগাস্ট

ফটোশ্যুটের জন্যে তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসে গ্যাব্রিয়েল। আমাকে জানালার পাশে বসে থাকতে দেখে যখন বুঝতে পারে যে সারারাত ওখানেই ছিলাম, চেহারার অভিব্যক্তি পাল্টে যায়।

“চুপ করে বসো অ্যালিসিয়া। কথা আছে তোমার সাথে।”

“হ্যাঁ, কথা তো আছেই। আমার কথা একবিন্দুও বিশ্বাস করোনি তুমি।”

“কিন্তু তুমি যে আসলেও বিশ্বাস করছো ব্যাপারটা সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই আমার।”

“এরকম হেঁয়ালি করে কথা বলছো কেন? আমি বিশ্বাস করছি মানে? আমি কি পাগল যে অবাস্তব কিছু বিশ্বাস করবো? যা দেখেছি সেটাই বলেছি তোমাকে।”

“তোমাকে কিন্তু একবারের জন্যেও পাগল বলিনি আমি।”

 “তাহলে কি বলছো এসব?”

আমি ভেবেছিলাম দু’জনের বোধহয় তখনই ঝগড়া লেগে যাবে, কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের কথাগুলো শুনে একদম থমকে যাই। ফিসফিস করে বলে:

“আমি চাই তুমি কারো সাথে এ ব্যাপারে কথা বলো।”

“কার সাথে কথা বলবো? পুলিশ?”

“না,” আবারো রাগ ভর করে গ্যাব্রিয়েলের কণ্ঠে। “পুলিশ না।”

আমি আসলে বুঝেছিলাম যে ও কি বলতে চাচ্ছে। কিন্তু সেটা ওর মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছিলাম। “তাহলে কার সাথে?”

“ডাক্তার।”

 “আমি কোন ডাক্তার দেখাবো না, গ্যাব্রিয়েল-”

“আমার জন্যে কাজটা করো, জান। আমি তো তোমাকে বোঝার চেষ্টা করছি, তুমিও একটু-”

“না, তুমি বোঝার চেষ্টা করছো না!”

 এতটা অসহায় দেখাচ্ছিল ওকে। বারবার মনে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেই। “সব ঠিক হয়ে যাবে, জান,” শেষমেষ নিজেকে সামলাতে না পেরে বলেই ফেলি। ওকে এভাবে দেখা সম্ভব না আমার পক্ষে। “দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো গ্যাব্রিয়েল। “ডঃ ওয়েস্টের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করবো। সম্ভব হলে আজকেই,” বলে চোখে দ্বিধা নিয়ে আমার দিকে তাকালো ও। “ঠিক আছে?”

 ইচ্ছে করছিল গ্যাব্রিয়েলের সামনে বাড়িয়ে দেয়া হাতটা চাপড় দিয়ে সরিয়ে দেই; ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি, চেঁচিয়ে বলি, “তোমার ধারণা আমি পাগল হয়ে গেছি! আমি পাগল না! আমি পাগল না!”

কিন্তু সেরকম কিছু করিনি। বরং মাথা নেড়ে গ্যাব্রিয়েলের হাতটা ধরি।

 “ঠিক আছে, ডার্লিং,” বলি আমি। “তুমি যা চাও সেটাই হবে।”

.

১৬ অগাস্ট

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডঃ ওয়েস্টের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আজকে।

তার সবকিছুই অপছন্দ আমার। ছোট বাড়িটা থেকে শুরু করে সবসময় লিভিং রুমে ঘুরঘুর করা কুকুরটাকেও বিরক্ত লাগে। এক মুহূর্তের জন্যেও ঘেউঘেউ থামায়না হতচ্ছাড়া। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কুকুরটাকে চুপ করতে বলি। ভেবেছিলাম ডঃ ওয়েস্ট নিজেই বোধহয় কিছু একটা করবেন, কিন্তু তিনি এমন একটা ভাব ধরেন যেন শুনতেই পাচ্ছেন না। হয়তো আসলেও শুনতে পাচ্ছিলেন না। অন্তত আমার বলা কথাগুলো তার কানে যাচ্ছিল না, এটা নিশ্চিত। তাকে সব খুলে বলি আমি, কিন্তু জবাবে মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকেন। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল একটা রঙিন গিরগিটির দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি গ্যাব্রিয়েলের বন্ধু, কিন্তু এরকম একটা লোকের সাথে কিভাবে ওর বন্ধুত্ব হলো কে জানে। গ্যাব্রিয়েল যেখানে সবসময় কোমল আচরণ করে, সেখানে ডঃ ওয়েস্টের হাবভাব একদম শীতল। একজন ডাক্তারের ব্যাপারে এ ধরণের কথা বলা উচিৎ হচ্ছে না, জানি। কিন্তু তার মধ্যে দয়ামায়ার কোন বালাই নেই।

লোকটার ব্যাপারে আমার সব কিছু বলা শেষ হলে লম্বা একটা সময় কিছু বললেন না তিনি। তার এই অভ্যাসটাও আমাকে বিরক্ত করে। কথা বলার আগে অনেকক্ষণ ধরে ভাবেন, যেন ইচ্ছে করে অপেক্ষা করাচ্ছে আমাকে। শব্দ বলতে কেবল নিচতলা থেকে কুকুরটার ঘেউঘেউ কানে আসছে। আওয়াজটা শুনতে শুনতে এক ধরণের ঘোরের মধ্যে চলে যাই। ডঃ ওয়েস্ট যখন আচমকা কথা বলে ওঠেন, তখন আসলেও চমকে যাই।

“আমাদের মধ্যে আগেও এ বিষয়ে কথা হয়েছে, তাই না অ্যালিসিয়া?”

শূন্যদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই আমি। ধরতে পারছি না কি বলতে চাচ্ছেন। “হয়েছে কি?”

“হ্যাঁ, হয়েছে,” মাথা নাড়েন ডঃ ওয়েস্ট।

“আপনি বোধহয় ভাবছেন যে পুরোটাই আমার কল্পনা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বানিয়ে বলছি না।”

“গতবারও এটাই বলেছিলেন। মনে আছে কি হয়েছিল?”

জবাব দেইনি। আসলে তাকে সেই সন্তুষ্টিটুকু দিতে চাচ্ছিলাম না। চোখ পাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকি, ছোট বাচ্চাদের মতন।

ডঃ ওয়েস্ট অবশ্য আমার জবাবের অপেক্ষা করলেন না। বাবার মৃত্যুর পর কি ঘটেছিল সে বিষয়ে কথা বলেই গেলেন। সবসময় একটা আতঙ্কের ভেতরে থাকতাম তখন, মনে হতো কেউ আমাকে দেখছে সর্বক্ষণ, নজর রাখছে। “আমরা আগেও এ বিষয়ে কথা বলেছি, বুঝলেন তো?”

“কিন্তু এবারে পরিস্থিতি ভিন্ন। গতবার শুধু ওরকমটা মনেই হয়েছিল আমার, কাউকে দেখিনি। এবারে আসলেও একজনকে দেখেছি।”

“কাকে দেখেছেন?”

 “ইতোমধ্যে বলেছি আপনাকে। একটা লোককে।”

 “তার বর্ণনা দিন তো?”

“সেটা পারবো না,” দ্বিধান্বিত স্বরে বলি।

 “কেন পারবেন না?”

“আসলে তাকে ঠিকমতো দেখতে পারিনি কোনবারই। বলেছিল তো আপনাকে-দূর থেকে লক্ষ্য রাখে সে।”

“আচ্ছা।”

“তাছাড়া ইচ্ছে করেই একটা কাপ আর সানগ্লাস পরে আসে, যাতে চেহারাটা দেখতে না পাই।”

“অনেকেই কিন্তু এই আবহাওয়ায় সানগ্লাস চোখে দিয়ে বাইরে বের হয়। মাথায় ক্যাপও পড়ে। তারা সবাই কি কারো ওপর নজর রাখে?”

মেজাজ গরম হতে শুরু করে আমার। “আমি জানি আপনি কি চাইছেন।”

“কি?”

“আপনি আমার মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছেন যে ভুলভাল দেখছি আমি। বাবা মারা যাবার পর মাথা বিগড়ে যেতে শুরু করেছিল, সেরমটাই হচ্ছে আবারো-এটাই তো বলাতে চাচ্ছেন আমাকে দিয়ে, নাকি?”

“আপনার কি ধারণা? সেরকম কিছু কি হচ্ছে আপনার সাথে?”

“না। তখন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম আমি। কিন্তু এবারে একদম ঠিক আছি। কোন সমস্যা নেই। একটা লোক আমাদের বাসার ওপর নজর রাখছে প্রতিনিয়ত, এটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে সমস্যা মনে হচ্ছে না!।”

মাথা নাড়লেন ডঃ ওয়েস্ট কিন্তু তৎক্ষণাৎ কিছু বললেন না। নোটবুকে কী যেন টুকে নিলেন।

 “আপনাকে আবারো কিছু ওষুধ খেতে হবে। সাবধানতাবশতই কাজটা করছি আমি। এবারে পরিস্থিতি আগের মত খারাপ হতে দেয়া চলবে না, বুঝেছেন?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম। “কোন ওষুধ খাবো না আমি।”

“বেশ। যদি ওষুধ না-ই খান, তাহলে কিন্তু এর পরিণাম নিয়ে ভাবতে হবে আপনাকে।”

“কি পরিণাম? আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?”

“আমার সাথে এর কোন লেনদেন নেই। আমি আপনার স্বামীর ব্যাপারে কথা বলছি। গতবার আপনার ওরকম পরিস্থিতি দেখে গ্যাব্রিয়েলের কেমন লেগেছিল?”

কল্পনায় গ্যাব্রিয়েলকে নিচতলার লিভিংরুমে দেখতে পেলাম। কুকুরটা তার পাশে বসেই ঘেউঘেউ করে চলেছে। “জানিনা আমি, ওকেই জিজ্ঞেস করছেন না কেন?”

“আপনি কি এটাই চান, আবারো সেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাক সে? আপনার কি মনে হয় না তার সহ্যের একটা সীমা আছে?”

“কী বলছেন এসব? গ্যাব্রিয়েল আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? আপনার এটাই ধারণা?”

কথাটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে আমার। ওকে হারাতে হবে, এটা চিন্তাই করতে পারি না। গ্যাব্রিয়েলকে নিজের কাছে রাখার জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি আমি। তাই রাজি হয়ে যাই ডঃ ওয়েস্টের কথায়। বলি যে যদি যে অশরীরি কেউ আমার মাথার ভেতরে কথা বলার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে অবশ্যই জানাবো। ওষুধগুলোও খাবো নিয়মিত।

সন্তুষ্টি ফোটে ডঃ ওয়েস্টের চেহারায়। বলেন যে নিচতলায় গিয়ে গ্যাব্রিয়েলের সাথে দেখা করতে পারি আমরা। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মনে হচ্ছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই। দিলেই ভালো হতো।

বাসায় ফেরার পথে খুব খুশি দেখায় গ্যাব্রিয়েলকে। বারবার হাসিমুখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। “তোমার মতো সাহসী মেয়ে খুব কমই দেখেছি আমি। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।”

 মাথা নাড়লেও ওর কথার জবাবে কিছু বলিনি ইচ্ছে করেই। কারণ ডঃ ওয়েস্টের কাছে যাওয়াটা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়।

একাই সবকিছু সামলাতে হবে আমাকে।

আসলে কাউকে বলাটাই ভুল হয়েছিল। কালকে বার্বিকে মেসেজ করে বলবো ব্যাপারটা ভুলে যেতে। জানি যে আমার মেসেজ পেয়ে বিরক্ত হবেন তিনি। তার নাটক শুরুতেই থামিয়ে দিচ্ছি আমি। কিন্তু কিছুদিন পরেই ভুলে যাবেন। আমিও ভাব ধরবো যে সব ঠিকঠাক চলছে। কেউ এক মুহূর্তের জন্যেও কিছু বুঝতে পারবে না।

একটা ফার্মেসি থেকে আমার ওষুধগুলো কিনে ফেলে গ্যাব্রিয়েল। বাসায় ফিরেই সরাসরি রান্নাঘরে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে আনে। হলুদ ওষুধগুলো আমার হাতে দিয়ে বলে, “খেয়ে ফেলো।”

“আমি বাচ্চা নই। এভাবে হাতে তুলে দেয়ার কিছু নেই।”

“আমি জানি তুমি বাচ্চা নও, কিন্তু এগুলো যে আসলেও খাচ্ছো, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছিলাম।”

“খাবো আমি।”

 “এখনই খাও।”

গ্যাব্রিয়েলের সামনে ওষুধগুলো মুখে দিয়ে অল্প একটু পানি খাই।

“গুড গার্ল।” আমার গালে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ও।

সাথে সাথে ওষুধগুলো মুখ থেকে বের করে সিঙ্কে ফেলে দেই। আমি আর কোন ওষুধ খাবো না। গতবার ডঃ ওয়েস্টের দেয়া ওষুধগুলো খেয়ে প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। এবারে সেই ঝুঁকি নিব না।

নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রন রাখতে হবে আমাকে।

সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে।

.

অগাস্ট ১৭

ডায়েরিটা এখন লুকিয়ে রাখি আমি। গেস্টরুমে একটা পাটাতন আলগা করা যায়। সেখানেই রেখে দেই, সহজে আর কারো চোখে পড়বে না তাহলে। কেন? আসলে এখানে খোলাখুলি অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করেছি। বলা যায় না, গ্যাব্রিয়েল যদি ডায়েরিটা দেখে তাহলে পড়া শুরু করে দিতেও পারে। তখন জেনে যাবে আমি ওষুধ না খেয়ে ফেলে দেই। খুব কষ্ট পাবে বেচারা, এরকমটা হতে দিতে পারি না আমি।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এই ডায়েরিটায় মনের কথা লিখতে পেরেছি, নতুবা মাথা আসলেও বিগড়ে যেত। কেউ নেই আমার সাথে কথা বলার মতো।

কাকে ভরসা করবো?

.

২১ অগাস্ট

গত তিন দিনে একবারের জন্যেও বাইরে যাইনি। গ্যাব্রিয়েল বাসায় ফিরলে ভাব ধরি যে বিকেলে হাঁটতে বের হয়েছি। কিন্তু সেটা মিথ্যে।

আসলে বাইরে যাবার কথা মনে হলেই ভয় লাগে। যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে। অন্তত বাসার ভেতরে আমি নিরাপদ। জানালার পাশে বসে। চুপচাপ বাইরে নজর রাখতে পারবো। রাস্তা দিয়ে যারা হেঁটে যায় তাদের সবাইকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করি। অবশ্য আমার দৃষ্টি বারবার একজনকেই খুঁজে ফেরে।

আচ্ছা, সে যদি সানগ্লাস আর ক্যাপ খুলে আসে তাহলে চিনবো কি করে? তার চেহারা কেমন এটা তো জানি না। তখন সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও বুঝতে পারবো না।

এটা একটা চিন্তার বিষয়।

.

২২ অগাস্ট

এখন পর্যন্ত দেখিনি তাকে। কিন্তু ধৈৰ্য্যহারা হওয়া চলবে না। আজ হোক আর কাল, ফিরে সে আসবেই। সেজন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে আমাকে। উপযুক্ত পদক্ষেপও নিতে হবে।

আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই গ্যাব্রিয়েলের বন্দুকটার কথা মনে হয়। গেস্ট রুম থেকে সরিয়ে হাতের কাছে কোথাও এনে রাখবো ওটা। জানালার পাশের কেবিনেটে রাখলেই সবচেয়ে সুবিধে হবে।

আমি জানি কথাগুলো কেমন শোনাচ্ছে। আশা করি পরিস্থিতি এতটাও খারাপ হবে না। লোকটা না এলেই ভালো।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবসময় মনে হয় সে আসবেই।

সে কোথায় এখন? আসছে না কেন? আমাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় চমকে দিতে চায়? কিন্তু আমি সবসময় তৈরিই থাকবো। জানালার পাশ থেকে সতর্ক নজর রাখবো বাইরে। অপেক্ষা করবো তার আগমনের

.

২৩ অগাস্ট

এখন তো আমার মনে হচ্ছে গ্যাব্রিয়েল আর ডঃ ওয়েস্টের কথাই ঠিক। পুরোটাই কি কল্পনা ছিল?

গ্যাব্রিয়েল বারবার জিজ্ঞেস করে যে কেমন আছি আমি। আসলে জানতে চায় পাগলামিটা মাথা থেকে দূর হয়েছে কিনা। ও যে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমার অভিনয় ঠিকঠাক হচ্ছে না বোধহয়, আরো ভালো করে চেষ্টা করতে হবে। সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার অভিনয় করি। কিন্তু আসলে কিছুই আঁকানো হয় না, মনোযোগ ছাড়া এ ধরণের কাজ অসম্ভব। এই কথাগুলো লেখার সময়েও আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না যে জীবনে আর কখনো ঠিকঠাক ছবি আঁকতে পারবো কি না। অন্তত এই ঝামেলা শেষ হবার আগে তো পারবোই না।

বাইরে না যাবার ব্যাপারে এতদিন নানারকম অজুহাত দেখিয়েছি। কিন্তু গ্যাব্রিয়েল বলেছে যে আজ রাতে বের হতেই হবে, ম্যাক্স দাওয়াত দিয়েছে আমাদের।

এরকম সময়ে ম্যাক্সের সাথে দেখা হবে ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে। গ্যাব্রিয়েলের সাথে অনেকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। বরং ও বলে যে গেলেই নাকি লাভ হবে আমার! মন থেকেই কথাটা বলেছে সে, তাই আমিও আর না করতে পারিনি।

 আজ রাতে কি হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব। কারণ একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করার পরই সব পরিস্কার হয়ে যায়। একদম খাপে খাপে মিলে গেছে। এতদিন কেন ব্যাপারটা বুঝিনি, সেটাই রহস্য।

বাইরে থেকে যে লোকটা আমার ওপর নজর রাখে, সে জিন-ফিলিক্স নয়। ওকে খুব ভালো করেই চিনি আমি, এতটা নিচে সে কখনোই নামবে না। কিন্তু আমাকে ইচ্ছে করে জ্বালাতন করার মত আর কে বাদ থাকে? যার উদ্দেশ্যে আমাকে এভাবে শাস্তি দেয়া?

ম্যাক্স।

এছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না। আমাকে পাগল বানানোর যুদ্ধে নেমেছে সে।

খুব ভয় লাগছে, কিন্তু মনে সাহস জড়ো করতে হবে। আজকে রাতেই কাজটা করবো আমি।

ওর মুখোমুখি হবো।

.

২৪ অগাস্ট

এতদিন পর গতরাতে বাসা থেকে বের হয়ে একটু অদ্ভুতই লাগছিল।

মনে হচ্ছিলো যেন অ্যাকুরিয়াম থেকে সাগরে এসে পড়েছি। মাথার ওপরে বিশাল খোলা আকাশটাও অচেনা ঠেকছিল। পুরোটা সময় গ্যাব্রিয়েলকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম।

আমাদের পছন্দের রেস্তোরাঁ অগাস্তো’সে গিয়েও ভালো লাগছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল কি যেন একটা নেই। আর গন্ধটাও অন্যরকম ঠেকছিল, কোন কিছু পোড়ার গন্ধ। গ্যাব্রিয়েলকে জিজ্ঞেস করলে বলে যে সে কোন গন্ধ পাচ্ছে না। গোটাটাই আমার কল্পনা।

“সব ঠিকঠাকই আছে,” বলে ও। “শান্ত হও।”

“আমি তো শান্তই আছি। দেখে কি মনে হচ্ছে তোমার?”

গ্যাব্রিয়েল জবাব দেয়নি। চোয়াল শক্ত করে বসে ছিল, বিরক্ত হলে যেমনটা করে। চুপচাপ ম্যাক্সের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি আমরা।

ম্যাক্স ওর রিসিপশনিস্ট তানিয়েকে নিয়ে এসেছিল। ওদের মধ্যে কিছু একটা চলছে। ম্যাক্সের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন রাজরাণীকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। একটু পর পর নানা ছুতোয় তার হাতে হাত রাখছিল, চুমু খাচ্ছিলো। আমার দিক থেকে কিন্তু চোখ ফেরায়নি এক মুহূর্তের জন্যেও। কি ভাবছিল? ওকে তানিয়ার সাথে দেখলে হিংসায় জ্বলবো আমি? ওর কথা ভাবলেই ঘেন্না লাগে আমার।

তানিয়াও বুঝতে পারে কোন একটা সমস্যা আছে। ম্যাক্সকে কয়েকবার আমার দিকে তাকাতে দেখে ফেলে সে। সাবধান করে দিতে হবে মেয়েটাকে। সামনে কি অপেক্ষা করছে সেটা জানলে হয়তো ভুলটা করবে না। কিন্তু এখনই কিছু বলবো না। আগে আমার নিজের সমস্যার সমাধান হোক।

ডিনারের এক পর্যায়ে ম্যাক্স বলে যে বাথরুমে যাবে সে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আমিও একই অজুহাত দেখিয়ে উঠে যাই।

বাথরুমের কাছে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরি শক্ত করে।

 “তোমাকে থামাতে হবে এসব! বুঝেছছ? থামাতে হবে!”

শয়তানি হাসি ফোটে ম্যাক্সের চেহারায়। “কি থামাবো?”

“আমার ওপর নজর রাখছো তুমি, ম্যাক্স। আমি জানি!”

 “আবোলতাবোল কি বলছো এসব, অ্যালিসিয়া?”

“মিথ্যে বলবে না,” স্বাভাবিক স্বরে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। “আমি দেখেছি তোমাকে, ঠিক আছে? ছবিও তুলেছি। আমার কাছে তোমার ছবি আছে!”

হাসে ম্যাক্স। “তোমার মাথার স্কু আসলেও ঢিলা হয়ে গেছে।”

আর সহ্য হয় না। জোরে থাপ্পড় দেই ওর গালে।

একটা শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল থাপ্পড়টা তার গালেই পড়েছে।

একবার ম্যাক্স আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যায় সে।

চোখ গরম করে আমার দিকে তাকায় ম্যাক্স। তানিয়াকে অনুসরণ করার আগে নিচুগলায় বলে, “তোমার পেছনে সময় নষ্ট করতে আমার বয়েই গেছে। একবারও তোমাদের বাসার ওদিকে যাইনি। আর নজর রাখবোই বা কেন? সরো, যেতে দাও আমাকে।”

তার কণ্ঠে এমন কিছু একটা ছিল যে বুঝতে পারি সে সত্যিটাই বলছে। না চাইতেও বিশ্বাস করতে হয় কথাটা।

কিন্তু লোকটা যদি ম্যাক্স না হয়, তাহলে কে?

.

২৫ অগাস্ট

বাইরে থেকে একটা শব্দ কানে এসেছে কেবলই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি কেউ একজন ছায়ায় নাড়াচাড়া করছে।

লোকটা এসেছে। বাইরে সুযোগের অপেক্ষা করছে এখন।

গ্যাব্রিয়েলকে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু ও ধরেনি। পুলিশকে ফোন দিব? কি করবো বুঝতে পারছি না। হাত এত কাঁপছে যে লিখতেও

নিচতলা থেকে এখন ক্রমাগত শব্দ শুনতে পাচ্ছি। জানালা খোলার চেষ্টা করেছে কিছুক্ষণ। এখন দরজা ধাক্কাচ্ছে। ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে

আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। পালাতে হবে যে করেই হোক।

ঈশ্বর! তার হাঁটার শব্দ এখন একদম স্পষ্ট

ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *