১.১ অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ডায়েরি

দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট / মূল : অ্যালেক্স মাইকেলিডিস
অনুবাদ : সালমান হক / প্রথম প্রকাশ : জুলাই ২০২০

অনুবাদকের উৎসর্গ : কালকের দিনটা হয়তো আজকের চেয়ে ভালো কাটবে, এই আশায় বুক বাঁধা সবাইকে…

.

পূর্বকথা

অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ডায়েরি : জুলাই ১৪

জানি না কেন লিখছি এসব।

বলা যায় না, জানতেও পারি। কিন্তু নিজের কাছে স্বীকার করতে চাইছি না।

 এই লেখাকে কী নাম দেব, সেটাও জানি না। ডায়েরি বলাটা একটু নাটুকে শোনাবে বোধহয়। এমন তো না যে কিছু বলার আছে আমার। অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের মত মানুষদেরই কেবল ডায়েরি লেখা মানায়। জার্নাল বললে বড় বেশি আঁতেল মার্কা শোনায়। তখন আবার মনে হবে, প্রতিদিনই লিখতে হবে এখানে, ফলে নিয়মিত লেখার প্রতি অনীহা জন্মাবে।

নাম না দিলেও কিছু আসে যায় না। মাঝে মাঝে শুধু এখানে কিছু কথা লেখবো, ব্যস। একবার কোন কিছুর নাম দিলে দেখা যায় সেই নামটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। ঘুরে ফিরে সেই শব্দগুলোই মাথায় ঘোরে। কিন্তু শব্দ তো গোটা চিত্রের খুবই ছোট একটা অংশ, সমুদ্রের উপরের পৃষ্ঠে বেরিয়ে থাকা হিমশৈলের চুড়ার মতন। তাছাড়া কথা বা শব্দে কখনোই সুবিধে করতে পারিনি আমি, বরং ছবির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তাই বলা যায় যে গ্যাব্রিয়েল জোরাজুরি না করলে এখানে লেখা শুরুই করতাম না বোধহয়।

কিছুদিন যাবত বিষণ্ণতা জেঁকে বসেছে আমার মধ্যে, কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত। ভেবেছিলাম ঠিকঠাক লুকোতে পেরেছি ব্যাপারটা, কিন্তু ওর চোখে ঠিকই পড়েছে। জানতাম যে পড়বে, সবকিছুর প্রতি খেয়াল থাকে ওর। জিজ্ঞেস করেছিল, আমার আঁকাআঁকি কেমন চলছে। সত্যিটাই বলেছিলাম-চলছে না। তখন এক গ্লাস ওয়াইন এনে দেয় আমাকে, টেবিলে বসে ওর রান্না দেখতে থাকি।

গ্যাব্রিয়েলের রান্নার একটা আলাদা ধরণ আছে, দেখতে ভালো লাগে। চমৎকার রাধুনি সে-ছিমছাম, গোছানো। আমার পুরো উল্টো।

“কিছু বলল,” বলে সে।

“বলার কিছু থাকলে না বলবো। মাঝে মাঝে নিজের মনেই আটকে যাই, জানো? মনে হয় কাদাভর্তি জলার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি।”

“তাহলে লেখার চেষ্টা করলেও তো পারো। মনের এলোমেলো ভাবনাগুলোও গোছাতে পারবে তখন।”

“খারাপ বলোনি। চেষ্টা করে দেখবো।”

“আমাকে খুশি করার জন্যে না বলে আসলেও লেখা শুরু করো, ডার্লিং।”

“করবো।”

এরপর থেকে প্রায়ই আমাকে ব্যাপারটা নিয়ে তোতে শুরু করে সে, কিন্তু পাত্তা দেই না আমি। কিছুদিন পর এই ছোট্ট নোটবুকটা নিয়ে আসে আমার জন্যে। কালো চামড়ায় মোড়ানো, ভেতরে খালি পৃষ্ঠা; গতানুগতিক কাগজের চাইতে কিছুটা পুরু। প্রথম খালি পৃষ্ঠাটায় হাত বুলাই একবার-মসৃণতাটুকু অনুভব করি চোখ বুজে। এরপর পেন্সিল চেঁছে নিয়ে লেগে পড়ি।

 ঠিকই বলেছিল ও। আসলেই লিখতে শুরু করার পর ভালো লাগছে। মনের গুমোট পরিবেশটা হাল্কা হচ্ছে, অনেকটা থেরাপির মতন।

গ্যাব্রিয়েল মুখ ফুটে বলেনি, কিন্তু ও যে আমাকে নিয়ে চিন্তিত সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছি। সত্যি কথা বলতে (এখানে সত্যটাই লিখবো সবসময়), আমি এখানে লেখা আসলে শুরুই করেছি ওকে আশ্বস্ত করার জন্যে। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে সে, এটা ভাবতে ভালো লাগে না একদমই। আমার কারণে কষ্ট পাচ্ছে গ্যাব্রিয়েল, এমনটা হতে দিতে পারি না। ওকে যে ভীষণ ভালবাসি! নিজের পুরোটা উজাড় করে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার কারণেই মাঝে মাঝে মনে হয়

নাহ। ঐ ব্যাপারে কিছু লিখবো না।

আমার ছবিগুলো আঁকার পেছনের গল্প, অনুপ্রেরণার গল্প-এসবই লিখবো এখানে। ইতিবাচক, হাসিখুশি, স্বাভাবিক চিন্তাগুলোকে শব্দে রূপান্তরের চেষ্টা করবো।

উল্টোপাল্টা ভাবনার কোন জায়গা নেই।

.

প্রথম পর্ব

দর্শন ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন প্রতিটা মানুষই ভাবতে পারে যে কারো পক্ষেই কোন কিছু গোপন রাখা সম্ভব নয়। যদি তার মুখ বন্ধ থাকে, তাহলে তার আঙুলগুলো কথা বলতে শুরু করে। আর তার অস্তিত্বের প্রতিটা রন্ধ্র হতে ঠিকরে পড়ে বিশ্বাসঘাতকতা।
— সিগমুন্ড ফ্রয়েড, ইন্ট্রোডাকটরি লেকচারস অন সাইকোঅ্যানালাইসিস

১.১

তেত্রিশ বছর বয়সে স্বামীকে হত্যা করে অ্যালিসিয়া বেরেনসন। কদিন আগেই সপ্তম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করেছিল তারা। দুজনই শিল্পী-অ্যালিসিয়া চিত্রশিল্পী, আর গ্যাব্রিয়েল একজন বিখ্যাত ফ্যাশন ফটোগ্রাফার। ছবি তোলার একটা স্বকীয় ভঙ্গিমা আছে গ্যাব্রিয়েলের। অদ্ভুত সব কোণ থেকে একহারা গড়নের, অর্ধনগ্ন সব নারীদের ছবি। মৃত্যুর পর ছবিগুলোর দাম আকাশ ছুঁয়েছে। আমার কাছে অবশ্য তার কাজগুলো একদমই খেলো মনে হয়। বিষয়বস্তুর কোন গভীরতা নেই। অ্যালিসিয়ার ভালো কাজগুলোর সামনে ধোপেই টিকবে না। নিজেকে অবশ্য শিল্প সমঝদার দাবি করবো না, কালের পরিক্রমায় অ্যালিসিয়ার কাজগুলো টিকে থাকবে কি না তা সময়ই বলবে। তবে তার এই মহান(!) কীর্তি অন্য সবকিছুকে ম্লান করে দিবে, এটা নিশ্চিত। আপনারা অবশ্য বলতে পারেন যে আমি পক্ষপাতিত্ব করছি। ধরে নিন, আপাতত নিজের মতামতটুকু দিচ্ছি, এই যা। আর আমার মতে অ্যালিসিয়া জিনিয়াস। কৌশলগত দক্ষতার কথা বাদ দিলেও, তার ছবিগুলো আপনা থেকেই প্রবলভাবে যে কারো মনোযোগ আকর্ষণ করবে। কিংবা বলা যায়, বাধ্য করবে মনোযোগ দিতে।

গ্যাব্রিয়েল বেরেসন খুন হয় ছয় বছর আগে, চুয়াল্লিশ বছর বয়সে। অগাস্টের পঁচিশ তারিখে (সে বছর বড় বেশি গরম পড়েছিল, আপনাদের মনে আছে বোধহয়) হত্যা করা হয় তাকে। তাপমাত্রার পারদ রেকর্ড ছুঁয়েছিল সেবার। যেদিন সে মারা যায় সেদিন তাপমাত্রা ছিল বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

জীবনের শেষ দিনটায় ভোরে ঘুম ভাঙে গ্যাব্রিয়েলের। হ্যাম্পস্টেড হিথের একদম কিনারা ঘেঁষে গ্যাব্রিয়েল আর অ্যালিসিয়ার বাড়ি। সোয়া পাঁচটায় নর্থওয়েস্ট লন্ডনের বাড়িটা থেকে তুলে তাকে শারডিচে পৌঁছে দেয় একটা গাড়ি। দিনের বাকিটা সময় ছাদে ভোগ ম্যাগাজিনের জন্যে মডেলদের ছবি তুলে কাটায় সে।

অ্যালিসিয়া সেদিন কি করছিল সেসম্পর্কে অবশ্য বেশি কিছু জানা যায়নি। আসন্ন প্রদর্শনীর জন্যে কাজে বেশ পিছিয়ে ছিল সে। সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা। হয়তো বাগানের ধারে সামারহাউজটায় ছবি এঁকেছে সারাদিন, কিছুদিন আগেই ওটাকে নিজের স্টুডিও বানিয়ে নেয়ে সে। গ্যাব্রিয়েলের ছবি তুলতে তুলতে দেরি হয়ে যায়, বাসায় ফেরে এগারোটার দিকে।

আধঘন্টা পর তাদের প্রতিবেশী বার্বি হেলমান গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। সাথে সাথে পুলিশে ফোন দেয় সে। ১১:৩৫-এ হেভারস্টক হিল স্টেশন থেকে রওনা হয়ে যায় একটা গাড়ি। ঘটনাস্থলে পৌঁছুতে সময় লাগে তিন মিনিট।

সামনের দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে কালিগোলা অন্ধকার; একটা বাতিও কাজ করছিল না। সন্তর্পণে হলওয়ে পার হয়ে লিভিংরুমে পৌঁছে যায় পুলিশ অফিসারদের দলটা। টর্চের আলোয় সব দেখতে হচ্ছিলো। সেই আলোতেই ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় অ্যালিসিয়াকে। পুলিশের উপস্থিতিতে কোন বিকারই ছিল না তার। যেন বরফ কুঁদে বানানো শীতল একটা মূর্তি, চেহারায় স্পষ্ট আতংকের ছাপ।

মেঝেতে একটা বন্দুক খুঁজে পায় পুলিশ। আর তার পাশেই চেয়ারে হাত পা বাঁধা গ্যাব্রিয়েল। প্রথমে অফিসারদের দলটা ভেবেছিল বেঁচে আছে সে। মাথাটা অবশ্য একপাশে মৃদু হেলে ছিল, সাধারণত জ্ঞান হারালে এরকম হয়। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের চেহারায় টর্চের আলো পড়তেই পরিস্কার হয়ে যায় সবকিছু। গুলির উপযুপরি আঘাতে পুরোপুরি বিকৃত তার সুদর্শন চেহারা। পেছনের দেয়ালে ছিটকে লেগেছে খুলির টুকরো, ঘিলু আর রক্ত।

 রক্তের ব্যাপারে বিশেষ করে বলতেই হয়। চারদিকে চাপ-চাপ রক্ত। পেছনের দেয়াল, মেঝে, চেয়ার-কোথাও বাদ নেই। অফিসাররা প্রথমে ভাবে সবটুকুই বুঝি গ্যাব্রিয়েলের রক্ত। কিন্তু পরিমাণটা বড্ড বেশি হওয়াতে সন্দেহ জাগে। আর তখনই টর্চের আলোয় মেঝেতে ঝিকিয়ে ওঠে একটা ছুরি, অ্যালিসিয়ার পায়ের কাছে। এবারে কয়েকটা টর্চ তার দিকে ঘুরে গেলে দেখা যায় সাদা ড্রেসটা রক্তে ভিজে গেছে। দ্রুত একজন অফিসার অ্যালিসিয়ার কব্জিতে আলো ফেলতেই অতিরিক্ত রক্তের রহস্যটাও বোঝ যায়। অঝোরে রক্ত ঝরছে সেখানকার ক্ষত থেকে। ইচ্ছেকৃতভাবে পোচ দেয়া হয়েছে, এটাও পরিস্কার।

অ্যালিসিয়া প্রাণপণে বাধা দেয়, যাতে তাকে কেউ বাঁচাতে না পারে। শেষমেষ তিনজন অফিসার একসাথে ধরে নিরস্ত করে। দ্রুত নিকটস্থ রয়াল ফি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। পথেই জ্ঞান হারায় অ্যালিসিয়া। প্রচুর রক্তক্ষরণ হলেও বেঁচে যায় সেযাত্রা।

পরদিন হাসপাতালের একটা প্রাইভেট রুমে আইনজীবীর উপস্থিতিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। গোটা সময় একদম নিশ্চুপ থাকে অ্যালিসিয়া। ফ্যাকাসে ঠোঁটজোড়া মাঝে মাঝে কেঁপে উঠলেও কোন কথা বেরোয়নি। কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে সে; কিংবা চেষ্টা সত্ত্বেও বলতে পারছে না। তার বিরুদ্ধে গ্যাব্রিয়েলকে হত্যার অভিযোগ আনার সময়েও কিছু বলেনি। যখন বলা হয় যে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে তখনও মুখে রা সরেনি। কিছু স্বীকারও করে না, আবার অস্বীকারও করে না সে।

অ্যালিসিয়া আর কোনদিন কথা বলেনি।

তার এই নীরবতা তাই স্বাভাবিকভাবেই জন্ম দেয় নানারকম গুজবের। ঘটনার পেছনে নিগুঢ়, হঠকারী কোন রহস্য খুঁজতে শুরু করে অনেকে। পরবর্তী কয়েকমাস পত্রিকার শিরোনামে বারবার দেখা যায় অ্যালিসিয়া বেরেনসনের নাম।

 সে মুখে কুলুপ আঁটলেও একটা বার্তা অবশ্য ঠিকই দেয়। নিজের পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে। ছবিটা অ্যালিসিয়া আঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর। শুনানির আগ পর্যন্ত হাউজ-অ্যারেস্টে থাকতে হয় তাকে। আদালত থেকে তার দেখভালের জন্যে যে নার্সকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, সেই ভদ্রমহিলার মতে বাসায় পুরোটা সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছবিই আঁকতো অ্যালিসিয়া।

সাধারণত একটা ছবি আঁকার আগে কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে প্রস্তুতি নিত অ্যালিসিয়া। খসড়া স্কেচ, রঙ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট-এসব চলতো লম্বা একটা সময়। পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলে তবেই তুলির ছোঁয়া দিত। কিন্তু এবারে আর প্রস্তুতির ধার ধারেনি সে, অনেকটা স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই স্বামী মারা যাওয়ার ক’দিনের মধ্যে এঁকে ফেলে ছবিটা।

এই তথ্যটা যেন আগুনে ঢিলে দেয়। স্বামী মারা যাবার পর অনুতপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, বরং স্টুডিওতে ঢুকে রঙ নিয়ে রীতিমত খেলাধুলা জুড়ে দিয়েছে-এমনটাই বলেছে অনেকে। কোন বোধ-বিচার নেই! একদম ঠাণ্ডা মাথার খুনিদের মতন।

হয়তো কথাগুলো আংশিক সত্য। অ্যালিসিয়া বেরেনসন খুনি হতেও পারে, আবার না-ও পারে। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে সে একজন শিল্পী। তাই নিজের অনুভূতিগুলো ভেতরে জোর করে দমিয়ে না রেখে এভাবে ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে প্রকাশ করার ব্যাপারটা আমার কাছে তাই অস্বাভাবিক ঠেকেনি। জীবনে হয়তো প্রথমবারের মতন ছবি আঁকার মধ্যে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে তার চিত্ত। কিন্তু এরকম বেদনার্ত সময়ে প্রশান্তি অনুভব করা কি আদৌ সম্ভব?

ছবিটা একটা আত্মপ্রতিকৃতি। ক্যানভাসের বামদিকে একদম নিচে হালকা নীল গ্রিক অক্ষরে ছবিটার নামও লিখে দেয় সে।

একটা শব্দ : অ্যালসেস্টিস।

.

১.২

অ্যালসেস্টিস গ্রিক পুরাণের এক চরিত্র। তার ভালোবাসার গল্পটা যেকোন করুণ কিংবদন্তিকে হার মানাবে। স্বামী অ্যাডমেতাসের জন্যে স্বেচ্ছায় নিজের জীবনাবসানের শর্ত মেনে নেয় সে। রাজি হয় ইহজগতের মায়া তুচ্ছ প্রতিপন্ন করে নিজে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে। সে বাদে অন্য কেউ কিন্তু এগিয়ে আসেনি অ্যাডমেতাসকে রক্ষা করতে। স্বেচ্ছা-বলিদানের এই কাহিনীর সাথে অ্যালিসিয়ার সার্বিক পরিস্থিতির মিল ঠিক কোথায়, তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। লম্বা একটা সময় ভেবেছি ব্যাপারটা নিয়ে। অবশেষে সত্যটা একদিন সামনে আসলে

নাহ, এভাবে তাড়াহুড়ো করে বললে গোটা চিত্রটা বুঝতে অসুবিধে হবে। এর চেয়ে বরং একদম গোড়া থেকে শুরু করি। ঘটনাগুলো আপনা থেকেই প্রকাশ পাবে সেক্ষেত্রে। অযথা রঙ চড়িয়ে অথবা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু বলার সুযোগ আমার নেই। ধীরে সুস্থে, সতর্কভাবে ধাপে ধাপে এগোনোটাই শ্রেয়। কিন্তু শুরু করবোটা কোথা থেকে? নিজের পরিচয় দেয়া উচিৎ, কিন্তু এ মুহূর্তে না দিলেও অসুবিধে নেই; আমি তো আর এই গল্পের মূল চরিত্র নই। কাহিনীটা মূলত অ্যালিসিয়া বেরেনসনের, সুতরাং তাকে এবং তার আঁকা ‘অ্যালসেস্টিস’ দিয়েই শুরু করছি।

 ছবিটা একটা আত্মপ্রতিকৃতি। ক্যানভাসে দেখা যাবে অ্যালিসিয়া তার স্টুডিওতে নগ্ন দেহে ইজেলের সামনে তুলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দেহাবয়বের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লালচে চুলগুলো কঙ্কালসার কাঁধ বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নিচের দিকে। ফ্যাকাসে ত্বক ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে নীলচে শিরা-উপশিরা। দুই হাতের কব্জিতে না শুকানো তাজা ক্ষত। আঙুলের ফাঁকে নিপুণভাবে তুলিটা ধরা। লাল রঙ চুঁইয়ে পড়ছে ওটা থেকে-নাকি রক্ত? আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যে ছবি আঁকায় মত্ত অ্যালিসিয়া, কিন্তু তার সামনের ক্যানভাসটা একদম খালি। তেমনি তার চেহারাও অভিব্যক্তিহীন। কাঁধের ওপর দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটটা ঈষৎ ফাঁকা। মুক।

 মামলার শুনানি চলাকালীন সময়েই ছবিটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে জিন ফিলিক্স মার্টিন। সোহোতে অবস্থিত তার ছোট্ট গ্যালারিটাই অ্যালিসিয়ার যাবতীয় চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে এসেছে সবসময়। স্বাভাবিকভাবেই তার এই সিদ্ধান্ত বিতর্কের ঝড় তোলে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, স্বামীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবিটা দেখার জন্যে আর্ট গ্যালারির বাইরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতন বিশাল লাইন।

 অন্যান্য শিল্প-প্রেমীদের সাথে সেদিন লাইনে আমিও ছিলাম। লম্বা একটা সময় অপেক্ষা করেছি পাশের সেক্স-শপটার সামনে দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে এগোতে থাকে লাইন। ভেতরে ঢোকার পর আমাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই আরাধ্য ছবিটার সামনে। যেন মেলার মূল আকর্ষন ‘ভুতুড়ে বাড়ি’ দেখতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একদল মানুষকে। অবশেষে নিজেকে ‘অ্যালসেস্টিস’-এর মুখোমুখি আবিষ্কার করি।

দীর্ঘ একটা সময় অ্যালিসিয়ার চেহারার দিকে তাকিয়ে তার চোখের দৃষ্টিটা বোঝার চেষ্টা করি, কিন্তু কোন লাভ হয় না। ছবিটা আমার বোধগম্যতার বাইরে। সেই নির্বিকার, অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অ্যালিসিয়া। অপাপবিদ্ধতা বলুন কিংবা অনুশোচনা-কোনটারই ছোঁয়া নেই অভিব্যক্তিতে।

অন্যদের অবশ্য তাকে বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।

“দেখেই মনে হয় শয়তান,” আমার পেছনে ফিসফিসিয়ে বলে এক মহিলা।

“তাই না?” তার সঙ্গিও একমত পোষণ করে এই বিষয়ে। “ঠাণ্ডা মাথার খুনি।”

অ্যালিসিয়ার দোষ প্রমাণিত হবার আগেই এরকম মন্তব্য করাটা উচিৎ নয় বলেই মনে হয় আমার কাছে। কিন্তু তাই বলে বাস্তবতা অস্বীকারের সুযোগ নেই। সকলে ধরেই নিয়েছে সে দোষি। ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো শুরু থেকেই গল্পের ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে তাকে।

অবশ্য ঘটনাস্থলের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে সাধারণ কারো পক্ষে এরকমটা ভাবাই স্বাভাবিক। গ্যাব্রিয়েলের মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। একা। বন্দুকের গায়ে প্রাপ্ত আঙুলের ছাপও তার। গ্যাব্রিয়েলকে যে সে-ই হত্যা করেছে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কখনোই ছিল না। কিন্তু খুনটা কেন করেছে সে, এটা রহস্য থেকে যায়।

এই ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে আলাপ আলোচনা হয়েছে বিস্তর। নানাধরণের তত্ত্ব ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। উত্তাপ ছড়িয়েছে রেডিও চ্যানেলগুলোর সকালবেলার শো-তে। অভিজ্ঞ আলোচকেরা চেষ্টা করেছে অ্যালিসিয়ার এহেন কৃতকর্মের উদ্দেশ্য উদ্ঘাটনের। কেউ তার পক্ষে কথা বলেছে আবার কেউ কেউ সরাসরি তাকেই দোষারোপ করেছে। একটা তত্ত্ব অনুযায়ী গোটা ব্যাপারটাই একটা দুর্ঘটনা। হয়তো কোন সেক্স গেমে মত্ত ছিল দু’জনে, গ্যাব্রিয়েলের হাত পা বাঁধা ছিল সেজন্যেই। আবার অনেকে আঙুল তোলে সেই পুরনো পাপীর দিকেই-ঈর্ষা। হয়তো অন্য কোন নারীর সাথে স্বামীর সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি অ্যালিসিয়া। কিন্তু শুনানিতে গ্যাব্রিয়েলের ভাই দাবি করে যে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা বা বিশ্বস্ততার কোন কমতি ছিল না তার। তাহলে কি টাকাপয়সার কোন ব্যাপার? স্বামীর মৃত্যতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল না অ্যালিসিয়ার। বরং দু’জনের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তার সম্পত্তির পরিমাণই বেশি।

কানাঘুষো চলতেই থাকে। রহস্যের জবাব তো পাওয়া যায়ই না, বরং অ্যালিসিয়াকে ঘিরে উদ্ভব ঘটে নিত্য নতুন প্রশ্নের। বিশেষ করে তার চুপ থাকা নিয়ে। কেন মুখে কুলুপ এঁটেছে সে? কিছু লুকোচ্ছে? কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে? যদি তাই হয় তাহলে কাকে বাঁচাতে চাচ্ছে সে? কেন?

মনে আছে, সেসময় আমি ভাবতাম, অ্যালিসিয়াকে নিয়ে এসব জল্পনা কল্পনা, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের কেন্দ্রে আছে এক অপার শূন্যতা। মৌনতা।

শুনানিতে বিচারক সাহেবও অ্যালিসিয়ার মুখ না খোলাকে ভালো চোখে দেখেননি। বিচারক অ্যালভারসটোন যুক্তি দেখান, নির্দোষ লোকেরা সাধারণত চড়া গলায় নিজেদের নির্দোষিতা দাবি করে। অ্যালিসিয়া মুখে তো কুলুপ এঁটেছিলই, হাবভাবেও অনুতাপের কোন চিহ্ন ছিল না। শুনানি চলাকালীন সময়ে একবারের জন্যেও চোখের জল ফেলেনি সে-গণমাধ্যম কর্মীদের জন্যে মুখরোচক আরেকটা তথ্য। পুরোটা সময় চেহারা ছিল অভিব্যক্তিহীন, শীতল।

আসামী পক্ষ তাই বাধ্য হয় সাজা কমানোর চেষ্টা করতে। তারা বলে, ছোটবেলা থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছে অ্যালিসিয়া। বিচারক প্রথমে খোঁড়া অজুহাত হিসেবে নাকচ করে দেন এই দাবি। কিন্তু পরবর্তীতে ইম্পেরিয়াল কলেজের ফরেনসিক সাইকিয়াট্রি বিষয়ের অধ্যাপক ল্যাজারুস ডায়োমেডেসের বক্তব্য শুনে সিদ্ধান্ত বদলান তিনি। মি. ডায়োমেডেস অধ্যাপনার পাশাপাশি উত্তর লন্ডনের মানসিক হাসপাতাল গ্রোভ’-এ ক্লিনিকাল ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত। সাধারণত সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের রাখা হয় সুরক্ষিত এই ফরেনসিক ইউনিটে। তিনি বলেন, অ্যালিসিয়ার কথা বলতে না চাওয়া তার মানসিক অস্থিতির দিকেই নির্দেশ করছে, তাই রায় ঘোষণার সময় সেটাও বিবেচনা করা উচিৎ।

সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে ডায়োমেডেসের কথার মানে দাঁড়ায়-অ্যালিসিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে সাইকিয়াট্রিস্টরা সাধারণত কারো মুখের ওপর একথা বলেন না।

একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে এই ব্যাখ্যাটাই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হবে। যদি আসলেও অ্যালিসিয়ার কোন সমস্যা না থেকে থাকে, তাহলে ভালোবাসার মানুষটাকে কেন চেয়ারে বেঁধে একদম কাছ থেকে মুখে গুলি করবে সে? কেনই বা ঘটনার পর তার চেহারায় ফুটে উঠবে না অনুতাপ? কারো সাথে কোন কথাও তো বলেনি। সমস্যা আলবত আছে। সোজা বাংলায় অ্যালিসিয়া বদ্ধ উন্মাদ।

অন্যথা হবার সম্ভাবনাই নেই।

শেষ পর্যন্ত আসামী পক্ষের দাবি মেনে নেন বিচারক অ্যালভারস্টোন। জুরিদেরও সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুরোধ করেন তিনি। অ্যালিসিয়াকে অধ্যাপক ডায়োমেডেসের তত্ত্ববধায়নে ভর্তি করা হয় গ্রোভে। সেই ডায়োমেডেস, যিনি হস্তক্ষেপ না করলে বিচারক আসামীপক্ষের দাবি গ্রাহ্যই করতেন না।

অ্যালিসিয়ার যদি আসলেও কোন মানসিক সমস্যা না থেকে থাকে, তাহলে বলতে হবে যে অভিনয়ের দরুণ এযাত্রা পার পেয়ে গেছে সে। লম্বা কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে না তাকে। পুরোপুরি সুস্থ হলে কয়েক বছরের মধ্যেই ছাড়া পাবে। তাহলে তো এতদিনে একটু একটু করে সুস্থ হবার অভিনয় শুরু করার কথা তার, তাই না? এক-আধটা কথা বলবে; কৃতকর্ম নিয়ে অনুশোচনায় ভোগা শুরু করবে। কিন্তু না, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যায়-অ্যালিসিয়া কথা বলে না।

মৌনতাই তার একমাত্র পাথেয়।

আর তাই ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে গণমাধ্যমের উন্মাদনা মিইয়ে আসে, ভাটা পড়ে উৎসাহে। আপাত চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামীদের তালিকায় নাম উঠে যায় তার, কালের পরিক্রমায় যাদের পরিচয় ভুলে যাই আমরা সবাই।

তবে সবার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়। অ্যালিসিয়া বেরেনসনের রহস্য নিয়ে আমার মতন হাতে গোণা কয়েকজন এখনও আগ্রহী। জানতে চাই তার এরকম মুখে কুলুপ এঁটে থাকার আসল কারণটা কি। একজন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে আমার মনে হয়েছিল যে, গ্যাব্রিয়েলের মৃত্যুতে মানসিক আঘাত পেয়েছে সে। তার চুপ থাকা সেই মানসিক আঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। কৃতকর্ম কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি অ্যালিসিয়া, তাই থমকে গেছে চিরতরে। কিন্তু তাকে সাহায্য করতে চাই আমি চাই যে সে সুস্থ হয়ে উঠে নিজের মুখে সব খুলে বলুক। তাকে সাড়িয়ে তুলতে চাই।

এটা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে অ্যালিসিয়া বেরেনসনকে সাহায্য করার যোগ্যতা আমার আছে। একজন ফরেনসিক সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে সমাজের সবচেয়ে ভঙ্গুর মানসিকতার রোগিদের নিয়ে কাজ করেছি। তাছাড়া অ্যালিসিয়ার গল্পটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুরণিত করেছে। আমাকে, শুরু থেকেই কেমন যেন একটা সংযোগ অনুভব করছিলাম ওর প্রতি।

 দুর্ভাগ্যবশত তখনও ব্রডমুরে কর্মরত ছিলাম আমি বিধায় ওকে সাহায্য করাটা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু ভাগ্যদেবীর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন।

 অ্যালিসিয়া বেরেনসন ভর্তি হবার ছয় বছর পর অবশেষে দ্য গ্রোভে ফরেনসিক সাইকোথেরাপিস্টের পদ খালি হয়। বিজ্ঞপ্তিটা দেখামাত্র বুঝে গিয়েছিলাম, মনে মনে এতদিন এরকম কিছুই চেয়ে এসেছি। তাই চোখ বুজে আবেদন করে ফেলি।

.

১.৩

আমার নাম থিও ফেবার, বয়স বেয়াল্লিশে। সাইকোথেরাপিস্ট হয়েছি কারণ আমার নিজের মানসিক অবস্থাও একসময় আমার রোগিদের মতনই ছিল। তবে ইন্টারভিউতে যখন আমাকে যখন প্রশ্নটা করা হলো, তখন সত্যটা চেপে গেছি।

“সাইকোথেরাপির প্রতি আপনার আগ্রহী হবার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে কি বলবেন?” জানতে চাইলেন ইন্দিরা শর্মা। চোখের বিশাল চশমাটার কারণে তার দিকে তাকালে পেঁচার কথা মনে হচ্ছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।

 ইন্দিরা গ্রোভের কনসাল্ট্যান্ট সাইকোথেরাপিস্ট। বয়স ষাটের কাছকাছি হলেও চেহারার কমনীয় ভাবটা কমেনি। গোলাকার মুখের সাথে কাঁচা-পাকা চুলগুলো বেশ মানিয়ে গেছে। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে মিষ্টি করে হাসলেন একবার, যেন বোঝাতে চাইছেন যে এই প্রশ্নটা নিতান্তই জড়তা কাটানোর প্রেক্ষিতে করা। আগামী প্রশ্নগুলো হয়তো আরেকটু কৌশলী হবে।

ইতস্তত করতে লাগলাম। প্যানেলের বাকি সবাই যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা স্পষ্ট টের পাচ্ছি। বললাম যে হাইস্কুলে পড়ার সময় একটা কেয়ার হোমে পার্ট-টাইম চাকরি করেছি আমি, সেখান থেকেই সাইকোলজির প্রতি আগ্রহ জন্মে। আর সেই আগ্রহের দরুণই একসময় সাইকোথেরাপির ওপরে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করি। জানতাম যে এরকম কিছুই শুনতে চাইছে ইন্টারভিউ প্যানেলের সদস্যরা। কথা বলার সময় সবার চোখের দিকেই তাকিয়েছি, যাতে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে এরকমটা না ভেবে বসে কেউ।

“বোধহয় মানুষকে সাহায্য করতে চাওয়াটাই মূল কারণ,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম। “আসলেই।”

যত্তসব ফালতু কথা।

মানে, মানুষকে সাহায্য করার ইচ্ছে আছে আমার, তবে সেটা মুখ্য কারণ নয় এই পেশায় আসার। প্রশিক্ষণ শুরু হবার পর এই কারণটা মাথায় আসে। মূল উদ্দেশ্যটা শুনলে অনেকে হয়তো আমাকে স্বার্থপর ভাববে। আসলে নিজেকে সাহায্য করার জন্যে এই পথ বেছে নিয়েছি আমি। যারা অন্যদের মানসিক সুস্থতা রক্ষায় কাজ করে তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই এই কথাটা প্রযোজ্য বলে আমার বিশ্বাস। সাইকোথেরাপির প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই কারণ আমরা প্রত্যেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অথবা একসময় বিপর্যস্ত ছিলাম। তবে সেটা স্বীকার করে নেবার মানসিকতা সবার আছে কি না, তা ভাববার বিষয়।

মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়ার পর ছোটবেলায় বেশ লম্বা একটা সময় কিন্তু আমরা কিছু মনে রাখতে পারি না। মস্তিষ্কের স্মৃতি-ধারণ ক্ষমতা পুরোপুরি বিকশিত হতে কিছুটা সময় লাগে। অনেকে আবার ভাবে যে ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি যেরকম সমুদ্রের ফেনা থেকে একদম নিখুঁত হয়ে জন্মেছিলেন, আমরাও হয়তো পূর্ণ বিকশিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সেই স্মৃতিহীন দশা থেকে পরবর্তী দশায় পদার্পণ করি। কিন্তু মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ে চলমান গবেষণার কারণে আমরা এখন জানি যে ধারণাটা ভুল। জন্মের সময় আমাদের মস্তিষ্কের অবস্থার সাথে কাদামাটির তুলনা করা যায়। আর সেটা কোন অবস্থাতেই দৈবচরিত্রের মত নিখুঁত নয়। যেমনটা। সাইকোঅ্যানালিস্ট ডোনাল্ড উইনিকট বলেন, “শিশু বলে আদতে কিছুর অস্তিত্ব নেই।“ আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশের ওপর পারিপার্শ্বিকতা আর সাহচর্যের প্রভাব প্রবল; আর সেই প্রভাব নিখুঁত চরিত্রের জন্ম দেয় না। কাদামাটিকে নির্দিষ্ট একটা রূপ দেয়ার পেছনে কুমারের যেরকম ভূমিকা থাকে, তেমনি আমাদের চরিত্রের রূপায়নের কারিগর হিসেবে মা-বাবা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।

সংগত কারণেই এই চিন্তাটা কিছুটা ভীতিকর। কে জানে সেই স্মৃতিহীন দশায় আমাদের কিরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে! হয়তো সহ্য করতে হয়েছে নানারকম যন্ত্রনা আর ভোগান্তি। ঠিকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের চারিত্রিক গঠনপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বড় হবার সময় আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গি ছিল ভয়, অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তা। মাঝে মাঝে মনে হতো যে আমার অস্তিত্ব না থাকলেও দুশ্চিন্তাটুকুর অস্তিত্ব ঠিকই থাকবে।

আর এরকমটা অনুভূত হবার পেছনের কারণ যে বাবা, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই এখন।

 বাবা কখন কোন পরিস্থিতিতে রেগে যাবেন বা কি করবেন সেটা আগে থেকে বোঝার কোন উপায় ছিল না। একদম সাধারণ কোন মন্তব্য বা। সামান্য ভিন্নমত পোষণও হুটহাট রাগিয়ে তুলতে তাকে। এরপর যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটতো সেটা থেকে রেহাইয়ের কোন উপায় ছিল না। তার চিৎকার চেঁচামেচির তোড়ে পুরো বাসা কাঁপতো। কখনো কখনো ভয়ে ছুট দিলে পেছন পেছন তাড়া করে আসতেন। অগত্যা বিছানার নিচে বা দেয়ালের পাশে লুকোনোর চেষ্টা করতাম। মনে মনে প্রার্থনা চলতো যাতে কোন এক অদৃশ্য শক্তিবলে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যাই। তবে শেষরক্ষা হতো না, তার হাতজোড়া ঠিকই টেনে বের করে আনতো আমাকে। এরপর বাতাসে শিষ কেটে এসে আমার শরীরে নানারকম নকশা আঁকতো তার কোমরের বেল্ট। প্রতিটা আঘাতে জ্বলে উঠতে শরীর। একসময় যেভাবে হুট করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই হঠাৎ থেমে যেত অত্যাচার। বাচ্চারা যেভাবে রেগেমেগে খেলার পুতুল ছুঁড়ে মারে, ঠিক সেভাবে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলা হতো আমাকে। নিশ্চল পড়ে থাকতাম সেখানে।

বাবার ওরকম রেগে ওঠার কারণ কখনো বুঝিনি। শাস্তিটুকু আসলেও প্রাপ্য ছিল কি না, এ প্রশ্ন নিজেকে হাজারবার করেছি। মা’র কাছে যখন জানতে চাইতাম যে বাবা আমার ওপর সবসময় রেগে থাকে কেন, তখন জবাবে হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাতো সে। “আমি কিভাবে বলবো? তোমার বাবা একটা আস্ত উন্মাদ।”

মা কিন্তু মজাচ্ছলে কথাটা বলতো না। এখন যদি কোন সাইকিয়াট্রিস্ট বাবাকে দেখতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলতো, তিনি পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগেছেন পুরোটা জীবন। আর তার এই মানসিক সমস্যার প্রভাব পড়েছে আমার মস্তিষ্কের বিকাশের ওপরে। শারীরিক নির্যাতন, জিনিসপত্র ভাঙচুর, কান্নাকাটি-এই হচ্ছে আমার শৈশব।

তবে কিছু আনন্দের মুহূর্তও ছিল; বিশেষ করে বাবা যখন বাসায় থাকতেন না। একবার ব্যবসার কাজে একমাসের জন্যে আমেরিকা গিয়েছিলেন তিনি। সেই তিরিশটা দিন আমি আর মা বাসায় নির্ভয়ে সময় কাটিয়েছি। সেবার ডিসেম্বরে প্রচুর তুষারপাত হয়েছিল। আমাদের বাগানের দিকে তাকালে মনে হতো কেউ বুঝি সাদা একটা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে সেখানে। মা’র সাথে স্নোম্যান বানিয়েছিলাম। পুরোটা বানানোর পর দেখা যায় যে স্নোম্যানটার অবয়ব বাবার সাথে মিলে গেছে। এমনকি তার মতন একটা ভুড়িও আছে। অবচেতন মনেই কাজটা করেছিলাম আমরা। পরে অবশ্য ইচ্ছে করেই বাবার হাতমোজা, হ্যাট আর ছাতাটাও জুড়ে দেয়া হয়। সবশেষে অনেকগুলো স্নোবল বানিয়ে সর্বশক্তিতে ছুঁড়ে দিতাম স্নোম্যানটার দিকে আর দুষ্ট বাচ্চাদের মতন হাসতাম একজন আরেকজনকে ধরে।

 সেই রাতে ভারি তুষারঝড় হয়েছিল। মা তার ঘরে গেলে আমি কিছুক্ষণ ঘুমের ভান করে রুমে শুয়ে থাকি, এরপর সন্তর্পণে বেরিয়ে আসি বাগানে। দু’হাত বাড়িয়ে তুষারকণা নিয়ে খেলি আনমনে কিছুক্ষণ। আমার আঙুলের ডগায় ওগুলোকে উধাও হয়ে যেতে দেখি। তখনকার অনুভূতিটা আসলে ঠিক বলে বোঝাতে সম্ভব না আমার পক্ষে। একই সাথে আনন্দ আর হতাশা অনুভূত হওয়া কি সম্ভব? হাতের ওপর যখন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো তুষারকণাগুলো, মনে হচ্ছিল জীবনের আনন্দ হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাটা মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে আমার বাড়ির চার দেয়ালের বাইরেও সৌন্দর্যে ভরপুর একটা জগত বিদ্যমান; সেই মুহূর্তে অবশ্য জগতটা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল। এই স্মৃতিটা পরবর্তীতে আমার জীবনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। ভয়ের নাগপাশে মোড়ানো সেই ক্ষণিকের স্বাধীনতা আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল, যেন আঁধারে মোড়ানো টিমটিমে এক আলোকবর্তিকা।

এটা বেশ বুঝতে পারি, বাঁচতে হলে, সুস্থ একটা জীবন পেতে হলে বাসা থেকে পালাতে হবে আমাকে; যতদূরে সম্ভব। কেবলমাত্র তখনই হয়তো কিছুটা নিরাপদ বোধ করতে পারবো। সেই সুযোগটা পাই আঠারো বছর বয়সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্যে যেরকম নম্বরের দরকার ছিল, তা পেয়ে যাই। সারে’র সেই বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে আসি। ভেবেছিলাম অবশেষে মুক্তির স্বাদ পেতে যাচ্ছি।

কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম।

তখন জানতাম না, কিন্তু বাবার ছায়া অবচেতনভাবেই ততদিনে আমার গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। বাসা থেকে যত দরেই পালাই না কেন, তার হাত থেকে কখনোই রেহাই পাবো না। মাথার ভেতরে সবসময়ই একটা কণ্ঠস্বর বলতে থাকবে, মানুষ হিসেবে আমি ব্যর্থ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথম সেমিস্টারের প্রায় পুরোটাই সেই কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করে আমাকে, অবস্থা এতটাই সঙ্গিন ছিল। প্রচণ্ড ভয়ের কারণে ঘর থেকে বাইরেই বেরুতে পারতাম না, কারো সাথে কথা বলা তো দূরের কথা। মনে হতো যেন বাসাতেই আছি। মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়ি, আশা ছেড়ে দেই। মুক্তির কোন উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

আপনাআপনিই একটা সমাধান উদয় হয় এসময়।

ওষুধের দোকানে দোকানে ঘুরে অনেকগুলো প্যারাসিটামল কিনি। ইচ্ছেকৃতভাবেই এক দোকান থেকে কয়েক পাতার বেশি নেইনি, কেউ হয়তো সন্দেহ করবে এই ভয়ে। কিন্তু সন্দেহটা অমূলকই ছিল বলতে গেলে, কেউ একবারের বেশি দু’বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেনি আমার দিকে। যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য একটা মানুষ আমি, অস্তিত্বহীন।

নিজের ঘরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ভেতরেই কাঁপা কাঁপা হাতে প্যারাসিটামলগুলো প্যাকেট থেকে বের করি। অতগুলো ট্যাবলেট গিলতে অবশ্য বেশ কষ্ট হয়, তবুও জোর করে একটার পর একটা মুখে পুরতেই থাকি। এরপর বিছানায় উঠে পড়ে চোখ বুজে অপেক্ষা করি আসন্ন মৃত্যুর।

কিন্তু মৃত্যুও আমার ধারে-কাছে ঘেষেনি।

বরং প্রচণ্ড পেট ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি কিছুক্ষণ বাদেই। বমির সাথে পেটের ভেতর থকে বেরিয়ে আসে আধ-গলা ট্যাবলেটগুলো। সেই অবস্থাতেই অন্ধকারে শুয়ে থাকি, পেটের ভেতরে যেন আগুন জ্বলছে। একসময় মনে হয় যেন অনন্তকাল কেটে গেছে। এরপর ধীরে ধীরে একটা জিনিস পরিস্কার হয় আমার কাছে। বোধোদয় বলা যেতে পারে ব্যাপারটাকে।

মৃত্যু আসলে কাম্য ছিল না আমার। আসলে, আমি তো তখন অবধি ঠিকভাবে জীবন শুরুই করিনি।

একটা আশার সঞ্চার হয় ভেতরে ভেতরে। আর সেই আশা থেকেই উপলব্ধি করি যে সাহায্য দরকার আমার।

 রুথের বেশে সাহায্যটা উপস্থিত হয় আমার জীবনে। রুথ একজন সাইকোথেরাপিস্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং ইউনিট থেকে তার খোঁজ পাই। শুভ্র চলের রুথের আচার ব্যবহারে অভিভাবকসুলভ একটা ভাব ছিল। দাদী-নানিদের কাছ থেকে যেরকম আন্তরিকতা পাওয়া যায়, সেরকম। সহমর্মীতায় মোড়া তার হাসিটা দেখলেই স্বস্তিবোধ করতাম। ভরসা করতে ইচ্ছে হতো। প্রথমে অবশ্য খুব বেশি কথা বলতো না সে। আমিই বলতাম যা বলার, রুথ চুপ করে শুনে যেত। আমার বলা কথাগুলো পীড়াদায়ক হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে কিছুই অনুভব করতাম না। যেন অন্য কারো গল্প বলছি, অনুভূতির সাথে যাবতীয় সংযোগ বিচ্ছিন্ন। বেদনাদায়ক স্মৃতি বা আত্মঘাতী চিন্তাভাবনার ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করতাম ঠিকই, কিন্তু সেগুলো কোন প্রভাব ফেলতে না আমার মানসচিত্তে।

মাঝে মাঝে কথা বলার সময়ে রুথের চেহারার দিকে তাকাতাম। অবাক হয়ে খেয়াল করতাম যে তার চোখে কোণায় পানি জমেছে আমার কথাগুলো শুনতে শুনতে। হয়তো অবিশ্বাস্য শোনাবে-কিন্তু চোখের পানিগুলো আদতে তার ছিল না, ছিল আমার।

 সেই সময়ে অবশ্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু থেরাপি এভাবেই কাজ করে। অব্যক্ত অনুভূতিগুলোর ব্যাপারে সবকিছু থেরাপিস্টকে খুলে বলে রোগি, যে অনভূতিগুলোর মুখোমুখি হতে এতদিন ভয় পেয়ে এসেছে। তার হয়ে সেগুলো অনুভব করার দায়িত্ব থেরাপিস্টের। এরপর ধীরে ধীরে অনুভূতিগুলো আবারো রোগিকে ফিরিয়ে দেয় সে। রুথ আর আমার ক্ষেত্রেও অমনটা ঘটেছিল।

কয়েক বছর তার কাছে নিয়মিত যাতায়ত করি আমি। সেই সময়টুকুতে জীবনের অনেক কিছু বদলালেও রুথের সাথে দেখা করার বিষয়টা বদলায়নি। তার মাধ্যমে নতুন এক ধরণের সম্পর্ক অন্তরীণে সক্ষম হই, যে সম্পর্কটার ভিত তৈরি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সততা এবং মায়া দিয়ে। ক্রোধ, সহিংসতা বা কোন অভিযোগের স্থান নেই সেখানে। নিজের ব্যাপারে ধ্যান ধারণা ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে আমার অনুভূতিগুলো আর আগের মত ভয়ের উদ্রেক ঘটায় না। মাথার ভেতরে সেই কণ্ঠস্বরটার অস্তিত্ব মাঝে মাঝে টের পেতাম, তবে তার বিপরীতে রুথের কণ্ঠস্বরও কানে বাজতো। ফলে সময়ের সাথে একসময় নির্বাক হয়ে যায় কণ্ঠস্বরটা। প্রশান্তি ভর করে আমার মনে।

সাইকোথেরাপি আসলেও আমার জীবন বাঁচিয়েছে। শুধু তাই নয়, জীবনটাকে পুরোপুরি বদলেও দিয়েছে। এভাবে নির্ভয়ে কথা বলার মাধ্যমেই নিজেকে খুঁজে পাই এক পর্যায়ে। যদি কেউ আমায় নিজেকে বিশ্লেষণ করতে বলে, তবে এই কথাই বলবো।

পেশা হিসেবে তাই সাইকোথেরাপিই যে বেছে নিয়েছি, এতে কেউ নিশ্চয়ই অবাক হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব শেষ করে লন্ডনে সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণের গোটা সময়টা রুথের সাথে নিয়মিত দেখা করতাম। তার দিক থেকে উৎসাহের কোন কমতি ছিল না, তবে বাস্তবতাটাও স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেনি। “ছেলেখেলা নয় কিন্তু ব্যাপারটা।” ঠিকই বলেছিল ও, আমার রোগিদের সাথে কাজ করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাই।

প্রথম যেদিন সাইকিয়াট্রিক ইউনিটে যাই, সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার। আমি সেখানে যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যে এক রোগি সবার সামনে প্যান্ট খুলে মলত্যাগ শুরু করে। দুর্গন্ধে ছেয়ে যায় গোটা ঘরটা। সামনের দিনগুলোতে এরকম আরো ঘটনা ঘটে। আত্মহত্যার চেষ্টা, নিজের শরীরে কাটাকাটি, চিৎকার-চেঁচামেচি-এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল এসব বুঝি সহ্য হবে না আমার। কিন্তু প্রতিবারই সহনশীলতার পরিচয় দেই আমি। ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসে সবকিছু।

সাইকিয়াট্রিক ইউনিটের আপাত অদ্ভুত জগতটার সাথে কত সহজে মানিয়ে নেয়া যায়, এটা ভাবলে অবাকই লাগে। দৈনন্দিন উন্মাদনার সাথে একসময় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় সবাই। শুধু রোগিদের উন্মাদনার কথা বলছি না কিন্তু, নিজের উন্মাদনাও বিবেচ্য এই ক্ষেত্রে। আমার বিশ্বাস আমরা সবাই কোন না কোনভাবে ব্যধিগ্রস্ত।

আর সেজন্যেই অ্যালিসিয়া বেরেনসনের সাথে নিজেকে মেলাতে কষ্ট হয় না। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যে কি না তরুণ বয়সে সাইকোথেরাপির মাধ্যমে অন্ধকার অতীতকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। যদি সেরকমটা না হতো তাহলে আমাকেও হয়তো অ্যালিসিয়ার মতন কোন এক মানসিক হাসপাতালে বন্দি জীবন পার করতে হতো। ঈশ্বরের অশেষ অনুগ্রহে সেরকমটা হয়নি।

পেশা হিসেবে সাইকোথেরাপি কেন বেছে নিলাম, ইন্দিরা শর্মার এই প্রশ্নের জবাবে অবশ্য এগুলো বলার কোন উপায় ছিল না। হাজার হলেও চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছি আমি। জানি, কী করতে হবে।

“সবশেষে আমি বলতে চাই, প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই একজন সাইকোথেরাপিস্ট তার আসল লক্ষ্য খুঁজে পায়। প্রাথমিক উদ্দেশ্যে যা-ই হোক না কেন।”

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। একদম ঠিক।” বিজ্ঞ ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন ইন্দিরা।

ইন্টারভিউটা খারাপ হয়নি। ব্রডমুরে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা বাড়তি সুবিধা হিসেবে কাজ করেছে আমার জন্যে। ইন্দিরা বলেন, মাত্রাতিরিক্ত মানসিক ভারসাম্যহীন রোগিদের নিয়ে কাজ করা সম্ভব হবে আমার পক্ষে। কিছুক্ষণ বাদেই জানতে পারি যে চাকরিটা পেয়ে গেছি।

এর একমাস পর তল্পিতল্পা গুটিয়ে গ্রোভের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই।

.

১.৪

জানুয়ারির এক শীতল দিনে গ্রোভে উপস্থিত হই আমি। বাইরে পাতাঝরা গাছগুলো কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ ধবধবে সাদা, কিছুক্ষণের মধ্যে তুষারপাত শুরু হবে।

 প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে একটা সিগারেট বের করলাম। গত সাতদিন ধূমপান করিনি। নিজেকে নিজেই কথা দিয়েছিলাম যে সিগারেট ছেড়ে দেব। সেটা আর পারলাম কই। সিগারেট ধরিয়ে মুখে দিলাম, নিজের ওপর বিরক্ত। সাইকোথেরাপিস্টরা এই ধূমপানের আসক্তিটা একটু বাঁকা চোখেই দেখে, একজন থেরাপিস্ট হিসেবে নিজেকে এই আসক্তি থেকে মুক্ত করা আমার কাজের ভেতরে পড়ে। চাকরির প্রথম দিনেই আমার মুখ থেকে যাতে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া না যায় সেজন্য একটা মিন্ট গাম চিবিয়ে নিলাম কিছুক্ষণ।

কিছুটা কাঁপছি আমি। যতটা না ঠাণ্ডায়, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায়। ব্রডমুরে আমার কনসালটেন্ট কোন রাখঢাক ছাড়াই মন্তব্য করেছিল, গ্রোভে যোগ দেয়াটা ভুল হচ্ছে আমার ক্যারিয়ারের জন্যে। তাছাড়া গ্রোভের পরিবেশ, বিশেষ করে প্রফেসর ডায়োমেডেসকে নিয়ে দৃশ্যতই বিরক্ত ছিল

 “লোকটা একটু কেমন যেন। গ্রুপ থেরাপি নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন। ফোকসের সাথেও কাজ করেছেন কিছুদিন। আশির দশকে হার্টফোর্ডশায়ারে বিকল্প ভেষজ চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক বিবেচনায়, বিশেষ করে এখনকার দিনে একেবারেই অচল…” এক মুহূর্ত ইতস্তত করার পর গলা নামিয়ে নেয় সে। “তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না, থিও। কিন্তু গুজব কানে এসেছে যে জায়গাটা বন্ধ করে দেয়া হবে। হয়তো ছয় মাস পরেই তোমাকে নতুন চাকরি খুঁজতে হবে…এগুলো জানার পরেও সিদ্ধান্ত বদলাবে না?”

“না,” ভদ্রতার খাতিরে ইতস্ততার অভিনয় করে বললাম।

মাথা ঝাঁকায় কনসালটেন্ট। “নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েই নিয়েছো…”।

তাকে অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ব্যাপারে কিছু বলিনি আমি। তার চিকিৎসার জন্যেই যে গ্রোভে যোগ দিচ্ছি এটা চেপে গিয়েছি ইচ্ছে করেই। হয়তো বুঝিয়ে বলতেও পারতাম। অ্যালিসিয়ার সাথে কাজ করলে ভবিষ্যতে ঘটনাটা নিয়ে বই লিখতে পারবো বা কোন জার্নালে পেপার পাব্লিশ হবে; তবুও দেখা যেত, আমার ভুল ধরছে সে। হয়তো ঠিকই বলছিল। কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারবো।

সিগারেট নিভিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে ভেতরে প্রবেশ করি।

এডগোয়ের হাসপাতালের সবচেয়ে পুরনো অংশটায় গ্রোভের অবস্থান। লাল ইটে তৈরি ভিক্টোরিয়ান নকশার বিশাল মূল দালানটার বাইরে অনেক আগেই বাড়তি কিছু ভবন জুড়ে দেয়া হয়েছে। দ্য গ্রোভ এই বিশাল কমপ্লেক্সের একদম মাঝামাঝি। ভেতরের বাসিন্দারা যে খুব একটা সুবিধার নয় সেটা বোঝা যাবে বাইরের সারি সারি সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে। রিসিপশনে অবশ্য চেষ্টা করা হয়েছে স্বাভাবিক একটা পরিবেশ ফুটিয়ে তোলার। নীল রঙের বড় কয়েকটা কাউচ আর দেয়ালে রোগিদের আঁকা কিছু ছবি শোভা পাচ্ছে সেখানে। সুরক্ষিত সাইকিয়াট্রিক ইউনিট তো নয়, যেন বাচ্চাদের কিন্ডারগার্ডেন।

লম্বা একজন লোক উদয় হলো আমার পাশে। হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। নিজের নাম বলল ইউরি, গ্রোভের হেড সাইকিয়াট্রিক নার্স। “গ্রোভে আপনাকে স্বাগতম। দুঃখিত, আমি বাদে আর কেউ আসেনি আপনাকে স্বাগত জানাতে।”

ইউরির বয়স চল্লিশের কোঠায়, দেখতে শুনতে ভালোই, পেটানো শরীর। কালো চুল, গলার কাছে কলারের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা ট্যাটু। তামাক আর আফটারশেভের কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগলো। “সাত বছর আগে লাটভিয়া থেকে এখানে আসি আমি। তখন অবশ্য একদমই ইংরেজি জানতাম না, কিন্তু এক বছরের মধ্যে আয়ত্ত করে ফেলি।”

“দারুণ।”

“আসলে ইংরেজি সহজ একটা ভাষা। লাটভিয়ানে কথা বলার চেষ্টা করলেই বুঝবেন।”

হেসে কোমড়ে ঝোলানো চাবির গোছার দিকে হাত বাড়ালো সে। সেখান থেকে এক সেট চাবি বের করে আমার হাতে দিল। “রুমগুলোর জন্যে এগুলো লাগবে আপনার আর ওয়ার্ডে প্রবেশের জন্যে কিছু কোড আছে।”

“অনেক চাবি তো এখানে। ব্রডমুরে এতগুলো নিয়ে ঘুরতে হতো না।”

“আসলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছুটা জোরদার করা হয়েছে কদিন ধরে। বিশেষ করে স্টেফানি কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে।”

“স্টেফানি কে?”

জবাবে কিছু না বলে রিসিপশন ডেস্কের পেছনের অফিস থেকে বেরিয়ে আসা একজনের দিকে ইশারা করলো ইউরি।

মাঝ চল্লিশের এক ক্যারিবিয়ান নারী, মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল। “আমি স্টেফানি ক্লার্ক। গ্রোভের ম্যানেজার।”

মুখে একটা কাষ্ঠল হাসি ঝুলিয়ে রেখে আমার সাথে করমর্দন করলো সে। মনে হচ্ছে যেন এখানে আমার উপস্থিতি তার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।

“এই ইউনিটের ম্যানেজার হিসেবে নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতে রাজি নই আমি। রোগি আর স্টাফ, দুই পক্ষকে নিরাপদ রাখাই আমার দায়িত্ব।” আমার হাতে একটা ছোট যন্ত্র ধরিয়ে দিল সে-পার্সোনাল অ্যাটাক অ্যালার্ম। “এটা সবসময় সাথে সাথে রাখবেন। মনে থাকে যেন।”

জি, ম্যাডাম, বলা থেকে খুব কষ্ট করে আটকালাম নিজেকে। স্টেফানিকে সন্তুষ্ট রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এর আগেও কঠোর ওয়ার্ড ম্যানেজারদের ক্ষেত্রে এই পন্থা অবলম্বন করেছি, এমন কিছু করা যাবে না যাতে তারা বিরাগভজন হয়।

“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, স্টেফানি।” মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে রেখেছি আগে থেকেই।

জবাবে স্টেফানি অবশ্য হাসলো না। “ইউরি আপনাকে আপনার অফিস দেখিয়ে দিবে।” হনহন করে সেখান থেকে চলে গেল সে।

“আসুন আমার সাথে,” বলল ইউরি।

তার পেছন পেছন ওয়ার্ডের প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা বড় স্টিলের তৈরি দরজা। ওটার পাশেই মেটাল ডিটেক্টর হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন সিকিউরিটি গার্ড।

আমার দিকে তাকালো ইউরি। “আপনার নিশ্চয়ই নিয়ম কানুন জানাই আছে। ধারালো বা এমন কোনকিছু নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না যা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য।”

“লাইটারও নেয়া যাবে না।”পকেট হাতড়ে আমার লাইটারটা বের করে নিল গার্ড।

“দুঃখিত, ভুলে গিয়েছিলাম ওটার কথা।”

ওর পেছন পেছন যাবার ইশার করলো ইউরি। “আপনার অফিস দেখিয়ে দেই, চলুন। অন্য সবাই কম্যুনিটি মিটিংয়ে গেছে, তাই এত চুপচাপ।”

“আমিও যাবো?”

“মিটিংয়ে?” অবাক মনে হলো ইউরিকে। “আগে একটু গুছিয়ে নিন সবকিছু, নাকি?”

“আর গুছিয়ে নেয়ার কি আছে? পরে সময় দিতে পারবেন না?”

কাঁধ ঝাঁকালো ইউরি। “আপনার যেমনটা ইচ্ছে। চলুন তাহলে।”

বেশ কয়েকবার করিডোর বদলে আর তালা দেয়া দরজা খোলা-বন্ধের পর উপস্থিত হলাম গন্তব্যে। খুব বেশি পরিচর্যার যে বালাই নেই, তা স্পষ্ট। পলেস্তারা খসে পড়ছে জায়গায় জায়গায়, চুনকাম উঠে গেছে অনেক আগেই। বাতাসে শেওলার গন্ধ।

“ভেতরেই আছে সবাই,” বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল ইউরি।

“ঠিক আছে, ধন্যবাদ।”

এক মুহূর্তে থেমে নিজেকে তৈরি করে নিলাম। এরপর দরজা ঠেলে পা রাখলাম ভেতরে।

.

১.৫

লম্বা একটা ঘরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কম্যুনিটি মিটিং। ঘরটার জানালায় জেলখানার মত পুরু গারদ। বাইরে লাল ইটের দেয়াল দেখা যাচ্ছে। কফির ঘ্রাণ পেলাম (ইউরির আফটার শেভের গন্ধ ছাপিয়ে খুব কম ঘ্রাণই অবশ্য নাক অবধি পৌঁছুতে পারছে)। ভেতরে জনা তিরিশেক মানুষ গোল হয়ে বসে আছে। বেশিরভাগেরই হাতে চা অথবা কফির কাপ, খানিক পরপর হাই তুলছে ঢুলুঢুলু চোখে। যাদের কফি খাওয়া শেষ তারা হাতের কাপটা নাড়াচাড়া করছে অথবা সেটা দিয়ে বিভিন্ন নকশা করার চেষ্টা করছে।

 সাধারণত গ্রোভের মত মানসিক স্বাস্থ্যের ইনস্টিটিউটগুলোয় দিনে এক দু’বার সকলে এভাবে দেখা করে। এটাকে মিটিংও বলতে পারেন, আবার গ্রুপ থেরাপি সেশনও বলতে পারেন। ইউনিটের যাবতীয় কার্যক্রম অথবা রোগিদের বিষয়াদি নিয়েও বিস্তারিত আলাপ হয় এখানে। প্রফেসর ডায়োমেডেসের ভাষায় রোগিরা নিজেদের চিকিৎসায় যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সচেতন হতে পারে, সেটারই একটা প্রচেষ্টা এই মিটিংগুলো। তবে প্রচেষ্টাটা যে সবসময় সফল হয়, তা বলা যাবে না। গ্রুপ থেরাপি বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুণ মি, ডায়োমেডেস বরাবরই মিটিং বা গ্রুপ ওয়ার্কের ভক্ত। নাটকের কুশীলবরা যেরকম মঞ্চের সামনে জড়ো হওয়া লোকদের উপস্থিতিতে কাজ করে মজা পায়, প্রফেসর ডায়োমেডেসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমনকি আমাকে স্বাগত জানানোর জন্যে তার উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যেও কিছুটা নাটুকেপনা খুঁজে পেলাম। হাত বাড়িয়ে আমাকে সামনে এগোনোর ইশারা করলেব তিনি।

“থিও। এসে পড়েছে তাহলে। বসো আমাদের সাথে।“

 কথার ভঙ্গিতে খানিকটা গ্রিক টান, তবে সহজে ধরা যাবে না। ত্রিশ বছরের বেশি ইংল্যান্ডে থাকার কারণে টানটা হারিয়েই যেতে বসেছে। বয়স সত্তরের কোঠায় হলেও চেহারার সুদর্শন ভাবটা মুছে যায়নি। বরং কম বয়সি হঁচড়েপাকা ছেলেমেয়েদের অভিব্যক্তির সাথে মিলে যায় তার অভিব্যক্তি। যেন সাইকিয়াট্রিস্ট নন, ভাগনে-ভাগ্নিদের পছন্দের মামা। তবে রোগিদের দেখাশোনার ব্যাপারে কিন্তু কোন গাফিলতি নেই তার, সকালে ইউনিটের ক্লিনারদের আগে চলে আসেন তিনি। এরপর নাইট শিফট চালু হবারও বেশ কিছুক্ষণ পর অবধি থাকেন, মাঝে মাঝে তো রাতটা অফিসের কাউচে শুয়েই কাটিয়ে দেন। দু’বারের ডিভোর্সি মি. ডায়োমেডেসের জন্যে গ্রোভই সবচেয়ে বড় অবলম্বন।

 “এখানে বসো, নিজের পাশের খালি চেয়ারটার দিকে ইঙ্গিত করলেন প্রফেসর। “বসো, বসো, বসো।”

তার কথা অনুযায়ী বসে পড়লাম সেখানে।

বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ডায়োমেডেস। “আমাদের নতুন সাইকোথেরাপিস্টের সাথে পরিচিত হও সবাই। থিও ফেবার! আমার মতন তোমরাও ওকে গ্রোভ পরিবারে আপন করে”

 ডায়োমেডেসের পরিচয় সম্ভাষণ চলার ফাঁকে আমার চোখ অ্যালিসিয়াকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও দেখলাম না তাকে। ঘরে একমাত্র প্রফেসর ডায়োমেডেসই স্যুট-টাই চাপিয়ে এসেছেন, বাকিদের পরনে হাফহাতা শার্ট বা গেঞ্জি। দেখে বোঝা মুশকিল যে কে রোগি আর কে স্টাফ।

কয়েকজন অবশ্য আমার পূর্বপরিচিত, যেমন-ক্রিস্টিয়ান। ব্রডমুরে থাকতে ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল। চেহারায় রাগবি খেলোয়াড়দের মতন রুক্ষতা (আসলেও রাগবি প্লেয়ার ছিল সে), থেবড়ানো নাক আর মুখভর্তি দাড়ি। অনেকের চোখেই হয়তো তাকে সুদর্শন ঠেকবে। আমি ব্রডমুরে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ওখান থেকে চলে আসে সে। ক্রিস্টিয়ানকে কখনোই খুব একটা ভালো লাগেনি আমার, তবে সত্যি কথা বলতে তার সাথে খুব বেশিদিন কাজও করিনি, তাই ঠিকমতো চিনি এটাও বলা যাবে না।

ইন্টারভিউতে ইন্দিরার সাথে পরিচয় হয়েছিল। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন একবার, গোটা দলটার মধ্যে একমাত্র তার আন্তরিকতার মধ্যেই কোন খাদ নেই। রোগিদের বেশিরভাগই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, দৃষ্টিতে অবিশ্বাস। আসলে তাদের যে ধরণের শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তাতে এ ধরণের আচরণই কাম্য। আমাকে পুরোপুরি ভরসা করে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। আরেকটা ব্যাপার, রোগিদের সবাই নারী। অনেকেরই শরীরের নানারকমের ক্ষতচিহ্ন। এটা স্পষ্ট যে গ্রোভে আসার আগে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাদের। আর সেই যন্ত্রনা এতটাই প্রবল যে মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে পুরোপুরি। দুর্বিষহ অতীতের ছাপ তাদের প্রত্যেকের চেহারায় একদম পরিস্কার।

কিন্তু অ্যালিসিয়া বেরেনসন? সে কোথায়? আরো একবার ঘরে উপস্থিত সবার ওপরে নজর বুলালাম, কিন্তু খুঁজে পেলাম না তাকে। এরপর হঠাৎই আবিষ্কার করলাম যে আমার উল্টোদিকে বসে থাকা মানুষটাই অ্যালিসিয়া। এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।

চিনতে পারিনি কারণ অন্যদের চেয়ে তাকে আলাদা করার কোন উপায় নেই।

চেয়ারে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে অ্যালিসিয়া। কড়া সিডেটিভ দেয়া হয়েছে তাকে, নিশ্চিত। হাতে চায়ের কাপ। অনবরত কাঁপুনির কারণে নিয়মিত বিরতিতে সেখান থেকে চা পড়ছে মেঝেতে। উঠে গিয়ে তার কাপটা সোজা করে দেয়া থেকে নিজেকে আটকালাম। পারিপার্শ্বিকের কোন হুশই নেই তার। আমি যদি কাজটা করিও, কিছু বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না।

তার অবস্থা যে এতটা খারাপ হবে তা ধারণা করিনি। আগের সৌন্দর্যের কিছুটা ছাপ অবশ্য এখনও বিদ্যমান। গাঢ় নীল চোখ, নিখুঁত গড়নের চেহারা। তবে সেগুলো ছাপিয়ে চোখে পড়বে এলোমেলো লাল, নোংরা চুল। হাতের নখগুলো বারবার চিবোনোর কারণে বিশ্রী দেখাচ্ছে। দু কব্জির ক্ষতচিহ্নগুলো প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে। অ্যালসেস্টিস ছবিটায় এই ক্ষতদুটো একদম স্পষ্ট। এক মুহূর্তের জন্যেও থামছে না তার হাতের কাঁপুনি, সিডেটিভ ড্রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। নিশ্চয়ই রিস্পেরিডোন আর অন্যান্য অ্যান্টিসাইকোটিক ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে তাকে। ভোলা মুখের ভেতরে লালা জমে একাকার। এটাও ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

এসময় খেয়াল হলো, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ডায়োমেডেস। অ্যালিসিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে ফিরলাম। “আমার মনে হয় নিজের পরিচয় তুমি নিজেই সবচেয়ে ভালো করে দিতে পারবে, থিও।” মুখে মৃদু হাসি ফুটেছে তার। “কিছু বলবে না?”

 “ধন্যবাদ,” মাথা নাড়লাম একবার। “আসলে নতুন করে খুব বেশি কিছু যোগ করবো না। শুধু এটুকু বলতে পারি, এখানে যোগ দিতে পেরে খুশি আমি। সেই সাথে কিছুটা নার্ভাসও বটে। সবার সাথে ভালোমতো যাতে পরিচিত হতে পারি, বিশেষ করে রোগিদের সাথে-সেই চেষ্টা করবো। আমি-”

এসময় হঠাৎ শব্দ করে দরজা খুলে যাওয়ায় থেমে যেতে হলো আমাকে। প্রথমে ভাবলাম, উল্টোপাল্টা দেখছি। দুটো চোখা লাঠি নিয়ে বিশালদেহী এক দৈত্য ভেতরে প্রবেশ করেছে। হাত ওপরে তুলে ও দুটো সামনে ছুঁড়ে দিল সে। মনে হলো আমাদের গায়ের ওপরে এসে পড়বে, তবে শেষমেশ সেরকম কিছু ঘটলো না। চক্রের মাঝখানে এসে পড়লো লাঠিদুটো। চিৎকার করে উঠলো রোগিদের একজন। ভালোমতো খেয়াল করার পর বুঝতে পারলাম ওগুলো আসলে সাধারণ লাঠি নয়, বিলিয়ার্ড খেলার লম্বা ছড়িকেই ভেঙে দু’টুকরো করা হয়েছে।

বিশালদেহী মহিলা নিশ্চিত এখানকার রোগি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে। তুর্কী। বয়স চল্লিশের আশপাশে। “রাগ লাগে আমার। গত এক সপ্তাহ ধরে এটা ভেঙে পড়ে আছে! কী বাল করেন আপনারা?”

“ভদ্রভাবে কথা বলো, এলিফ।” ডায়োমেডেসের কন্ঠস্বর একদম স্বাভাবিক। “আগে আমরা আলাপ করবো, তোমাকে আদৌ এত দেরি করে কম্যুনিটি মিটিংয়ে যোগ দেয়ার অনুমতি দেব কি না সে বিষয়ে। এরপর বিলিয়ার্ডের পুল কিউ নিয়ে কথা বলা যাবে।” চোখে প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকালেন তিনি। “তোমার কি মনে হয় থিও?”

কিছুটা সময় নিলাম কথা বলার আগে। “সময়ানুবর্তিতা সবসময়ই জরুরি। তাছাড়া মিটিংয়ে সময়মতো আসলে-”

 “যেমনটা তুমি এসেছো আজকে?” চক্রের অন্যপাশ থেকে একজন বলে উঠলো।

ক্রিস্টিয়ানের কণ্ঠস্বরটা চিনতে অসুবিধে হলো না আমার। নিজের কৌতুকে নিজেই হেসে উঠলো সে।

মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে এলিফের দিকে তাকালাম। “ঠিক বলেছে ও, আজ সকালে আমিও দেরি করে এসেছি। সুতরাং আমাদের দু’জনের জন্যেই একটা শিক্ষা হতে পারে গোটা বিষয়টা।”

“এসব কি বলছো?” এলিফ জিজ্ঞেস করলো। “আমাকে জ্ঞান দেয়ার তুমি কে?”

“এলিফ। ভদ্রভাবে কথা বলো,” আবারো বললেন ডায়োমেডেস। “আবারো তোমাকে টাইম-আউটে পাঠাতে বাধ্য করোনা আমকে। চুপচাপ বসো।”

দাঁড়িয়েই রইলো এলিফ। “আর পুল কিউটার কি হবে?”

প্রশ্নটা ডায়োমেডেসের উদ্দেশ্যে করা হলেও উত্তরের জন্যে আমার দিকে তাকালেন প্রফেসর।

“এলিফ, আমি বুঝতে পারছি, আপনি লাঠিটা ভেঙে যাওয়ায় রেগে আছেন। তার চোখের দিকে তাকালাম। “লাঠিটা যে ভেঙেছে সে-ও নিশ্চয়ই কোন কারণে রেগে গিয়েছিল। এরকম একটা ইনস্টিটিউশনে রাগের ব্যাপারটা আমরা কিভাবে পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার মধ্যে দিয়ে সামলাবো, সেটাই মুখ্য বিষয়। তাহলে এ মুহূর্তে আমরা রাগ নিয়ে কিছুক্ষণ। কথা বলি? বসুন, নাকি?”

বিরক্ত হলেও ঠিকই বসে পড়লো এলিফ।

সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ইন্দিরা। এরপর রোগিদের সাথে রাগ বিষয়ে আলোচনা শুরু করলাম আমরা দুজন। তাদের প্রত্যেকের অনুভূতি নিয়ে আলাদা আলাদা কথা বললাম কিছুক্ষণ। দুজনের জুটিটা খারাপ হলো না। ডায়োমেডেস যে জহুরি চোখে আমাকে যাচাই করছেন, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তাকেও সন্তুষ্টই মনে হলো।

একবার অ্যালিসিয়ার দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে সে-ও আমাকেই দেখছে। নাহ, ভুল বললাম। আসলে আমি যেখান বসে আছি, তার দৃষ্টি সেদিকেই। নির্দিষ্ট কোনকিছুর প্রতি মনোযোগ দেয়ার মত অবস্থায় এ মুহূর্তে নেই সে। চোখে বরাবরের মতনই শূন্য দৃষ্টি।

অ্যালিসিয়ার পরিচিত লোকেরা সবসময়ই বলে এসেছে, আগে কী রকম চটপটে আর উদ্দীপনায় ভরপুর ছিল সে। এখন কেউ যদি আমাকে এই হত্যোদম মানুষটাকে দেখিয়ে বলে যে তারা একই ব্যক্তি, তাহলে সেটা বিশ্বাস করাটা কষ্ট হবে বৈকি। গ্রোভে আসার সিদ্ধান্তটা একদম ঠিক ছিল, এটা সেই মুহূর্তেই পরিস্কার বুঝতে পারলাম। সব অনিশ্চয়তা দূর হয়ে গেল। যত দ্রুত সম্ভব অ্যালিসিয়ার চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে।

সময় নষ্ট করার কোন সুযোগ নেই। সত্যিকারের অ্যালিসিয়া হারিয়ে গেছে।

আর তাকে খুঁজে বের করবো আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *