২. যখন ঘুম ভাঙল

০২.

অনীশের যখন ঘুম ভাঙল তখনও ভোরের কুয়াশা কাটেনি। জানলাটা একটু ফাঁক করে সে দেখল বাইরেটা পুরো কুয়াশায় মোড়া। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে তার কর্মপন্থা ঠিক করে নিল। তিনটে দিন সে এখানে কাটাতে পারবে। তার মধ্যেই তাকে যা করার করতে হবে। এদিনের কর্মপন্থা হিসাবে সে ঠিক করে নিল আজ প্রথমে সে প্রাণীগুলোকে দেখবে। তারপর গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের বক্তব্য শুনবে। এ জায়গার চারপাশটাও সম্ভব হলে ঘুরে দেখবে।

পরিকল্পনা শেষ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। মিনিট দশেক সময় লাগল তার তৈরি হতে। তার মধ্যেই দরজায় টোকা পড়ল। চা নিয়ে এসেছে একজন। কালকের লোকটা নয়, অন্য একটা লোক। যদিও তার চেহারাও একই রকম। সেও তিব্বতী বা সিকিমিজ হবে। লোকটা চা দিয়ে চলে যাবার পর দরজাটা খোলাই রেখেছিল অনীশ। বাইরের কুয়াশা এবার ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। অনীশের চা-পানের কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ভাইমার। অনীশকে দেখে তিনি বললেন, সুপ্রভাত। আশা করি রাতে ঘুম ভালো। হয়েছে?

অনীশও সুপ্রভাত জানিয়ে হেসে বলল, হ্যাঁ, ঘুম ভালো হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আপনার পোষ্যদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। চলুন এবার তাদের দেখতে যাব। আমি তৈরি হয়েই আছি।

ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, চলুন, তাদের দেখাতে নিয়ে যাব বলেই এসেছি আমি।

ঘর ছেড়ে বেরোল অনীশ। কুয়াশা অনেকটাই কেটে গেছে। প্রভাতি সূর্যকিরণে ঝলমল করছে বরফমোড়া পাহাড়ের শিখরগুলো। শুধু পাশের পাইনবনটা তখনও পাতলা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। কিন্তু বাড়িটার সামনে ফাঁকা জমিটার দিকে তাকিয়ে অনীশ বেশ অবাক হয়ে গেল। ছিট ছিট সাদা বিন্দুতে ছেয়ে আছে সারা জমিটা। অনীশ কিছু প্রশ্ন করার আগেই ভাইমার বললেন, কাল রাতে তুষারপাত হয়েছে। এ মরশুমের প্রথম তুষারপাত। আর কদিনের মধ্যে তুষারের চাদরে মুড়ে যাবে এ অঞ্চল। রেশম পথও তখন চলে যায় চার-পাঁচ ফুট বরফের নীচে। মাসখানেকের জন্য এ পথে বন্ধ হয়ে যায় মানুষের যাওয়া আসা। যতদিন না আবার আর্মির লোকরা ড্রেজিং করে বরফ সরিয়ে রাস্তা বার করে।

অনীশকে নিয়ে বারান্দা ছেড়ে নীচে নামলেন ভদ্রলোক। তারপর বাড়িটাকে বেড় দিয়ে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনীশকে নিয়ে চললেন বাড়িটার পিছন অংশে। ভদ্রলোকের হাঁটার ধরন দেখে অনীশ বুঝতে পারল যে ভাইমারের ডান পায়ে কোনও ত্রুটি আছে।

ভাইমারের সঙ্গে বাড়ির পিছনে পৌঁছে গেল অনীশ। বাড়িটার লাগোয়াই পাথরের তৈরি। সার সার বেশ বড় বড় ঘর। তার সামনে লোহার গরাদ বসানো। একটা বোঁটকা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। চিড়িয়াখানার মাংশাসী পশুদের ঘরের সামনে গেলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় তেমনই গন্ধ। ভাইমার অনীশকে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন প্রথম খাঁচাটার সামনে।

বাইরে সূর্যালোক কিছুটা ঢুকছে ঘরের ভিতর। ঘরটার এক কোণে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বিরাট একটা রোমশ প্রাণী। অনীশ ভালো করে তাকাল প্রাণীটার দিকে। হ্যাঁ, টিবেটিয়ান উলফ বা তুষার নেকড়েই বটে। সাদাটে সোনালি বর্ণের প্রাণীটা ঘুমোচ্ছে। ঈষৎ ফাঁক করা মুখের ভিতর লাল জিভটা আর শ্বদন্তগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভাইমার বললেন, এদের দেহের লোমের বৈশিষ্ট্য জানেন তো?

অনীশ একবার দার্জিলিং চিড়িয়াখানায় অন্য একটা কাজে গিয়ে এই টিবেটিয়ান নেকড়ে দেখেছিল। এখানে আসার আগে প্রাণীটার সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনাও করে এসেছে। সে বলল, হা, জানি। প্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই নেকড়েদের উলের রংও পরিবর্তিত হয়। কখনও কালচে, কখনও ধূসর, কখনও সোনালি আবার কখনও ধবধবে সাদা হয়। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে আত্মগোপন করা, শিকার ধরার কারণে প্রকৃতি এদের এ ক্ষমতা দিয়েছে।

ভাইমার বললেন, ঠিক তাই। দেখুন শীত আসছে বলে ওদের লোমের রং সাদা হতে শুরু করেছে।

অনীশ বলল, আর এও জানি এদের গ্রে উলফও যে বলা হয় তা কিন্তু এদের গাত্রবর্ণের ধূসরতার জন্য নয়। জন এডোয়ার্ড গ্রে নামের এক ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ ১৮৬৩ সালে সর্বপ্রথম এই টিবেটিয়ান উল্‌ফের সন্ধান পান। তাঁর নাম অনুসারেই এদের বলা হয় গ্রে উলফ।

ভাইমার তার কথা শুনে বেশ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বাঃ, আপনি অনেক কিছু জানেন দেখছি। আর জানবেনই বা কেন! আপনাদেরও তো কারবার বন্যপ্রাণ নিয়ে। হয়তো বা আপনি আমার চেয়েও বেশি জানেন এদের সম্বন্ধে। বেশ বিনয়ের সঙ্গেই কথাগুলো বললেন  মিস্টার ভাইমার।

প্ৰথম খাঁচা ছেড়ে দ্বিতীয় খাঁচার সামনে গেল অনীশরা। সেখানেও কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা নেকড়ে। তৃতীয় খাঁচা, চতুর্থ খাঁচাতেও নেকড়ে আছে। অনীশের হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা প্রাণীগুলো সুস্থ তো? অনেক সময় অসুস্থ শ্বাপদেরা অন্য প্রাণীর পিছু ধাওয়া করতে না পেরে মানুষকে আক্রমণ করে।

অনীশ প্রশ্ন করল, ওরা সব ঘুমাচ্ছে কেন?

ভাইমার বললেন, এমনিতেই প্রকৃতির নিয়মে যারা রাতে জাগে তারা দিনের বেলা ঘুমায়। সারারাত ছোটাছুটি করে ওরা এখন ক্লান্ত।

এ কথা বলে হয়তো বা অনীশের মনের বক্তব্য পাঠ করেই ভাইমার বললেন, আপনি দেখতে চাইছেন তো ওরা সুস্থ কিনা? দাঁড়ান দেখাচ্ছি। এই বলে তিনি একটা খাঁচার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে টক্ শব্দ করলেন। কয়েকবার শব্দ করার পরই চোখ মেলল ঘরের কোণায় শুয়ে থাকা নেকড়েটা। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিশাল একটা হাই তুলল। আধো অন্ধকারে ঝিলিক দিয়ে উঠল তার ধবধবে সাদা শ্বদন্ত বা ক্যানাইনগুলো। ভাইমার এরপর খাঁচার গায়ে শব্দ করে তার উদ্দেশ্যে বললেন–কাম, কাম।

ঠিক যেন পোষা কুকুরের মতো অত বড় নেকড়েটা ভাইমারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল খাঁচার গায়ে। গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে প্রাণীটার মাথায় একবার আদর করলেন ভাইমার। ঘড়ঘড় করে একটা আদুরে শব্দ করল নেকড়েটা। তারপর খাঁচার ভিতর চারপাশে একবার পাক খেয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে থাবায় মুখ ঢেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। তাকে দেখে বোঝা গেল প্রাণীটা বেশ সুস্থ সবল।

শেষ খাঁচাটার সামনে গিয়ে এরপর দাঁড়াল অনীশ। কিন্তু তার ভিতর কোনও প্রাণী দেখতে না পেয়ে সে বলল, এই খাঁচার নেকড়েটা কোথায় গেল? বাইরে ছাড়া আছে নাকি?

ভাইমার হেসে বললেন, না, দিনের বেলায় ওদের বাইরে ছাড়া হয় না। ও খাঁচাতেই আছে।

কোথায়, খাঁচার ভিতর?

ভাইমার বললেন, ওই দেখুন খাঁচার এক কোণে একটা বড় গর্ত আছে। প্রতি খাঁচাতেই ওই গর্ত আছে। নেকড়েরা ঠান্ডা পড়লে বরফের নীচে গর্ত করে ঘুমায়। তাতে ঠান্ডা কম লাগে কারণ বাতাস গায়ে লাগে না বলে। এটা ওদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা অভ্যাস। সেজন্য খাঁচার ভিতরও সেই ব্যবস্থা করা আছে। প্রাণীটা গর্তের ভিতরে আছে। দেখি ওকে বাইরে বের করতে পারি কিনা? এই বলে মুখ দিয়ে টক্ শব্দ করতে লাগলেন ভাইমার। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পরও প্রাণীটাকে বাইরে আনতে না পেরে তিনি বললেন, ও এখন আরাম ভেঙে বাইরে বেরোবে না। ও বড় শীতকাতুরে। যেই বাইরে বরফ পড়তে দেখল অমনি গতাঁর ভিতর গিয়ে সেঁধিয়েছে। ওকে নয় পরে দেখবেন।

অনীশ বলল, ঠিক আছে ওকে নয় পরেই দেখব।

প্রাণীগুলোকে দেখার পর আবার বাড়ির সামনের দিকে ফেরার পথ ধরল অনীশরা। ভাইমার বললেন, কেমন দেখলেন প্রাণীগুলোকে? খুব সুন্দর তাই না?

অনীশ জবাব দিল, হ্যাঁ, খুব সুন্দর প্রাণী।

ভাইমার আক্ষেপের স্বরে বললেন, কেন যে সরকার অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের কথায় এত গুরুত্ব দিচ্ছেন বুঝতে পারছি না। এই সুন্দর প্রাণীগুলোকে গুলি করে মারা হবে সেটা ভাবতে পারছেন!

অনীশ চিন্তিত ভাবে বলল, সত্যিই ওরা এই কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে যায় না তো?

ভাইমার বললেন, আপনাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি ওরা এর বাইরে যায় না। যারা মারা গেছে সেগুলো হয় চিতাবাঘ বা অন্য কোনও নেকড়ের কীর্তি। নেকড়ের তো অভাব নেই এখানে। ভাবছি আমি একটা চেষ্টা করব। যে প্রাণীটা লোক মারছে তাকে ধরা বা মারা যায় কিনা দেখব। তার খোঁজে বন্দুক নিয়ে বনে ঘোরাও শুরু করেছিলাম কিন্তু গ্রামবাসীদের ভয়ে দিনের বেলা আর বাইরে বেরোতে ভরসা পাচ্ছি না। রাতেই না হয় বেরোব তবে। যদিও ব্যাপারটা বিপদজনক। তবুও সে চেষ্টাই করতে হবে। এতে যদি গ্রামবাসীরা সত্যিটা বুঝতে পারে।

অনীশ বলল, আমি এখন গ্রামে যাব কথা বলতে। কীভাবে যাব পথটা দেখিয়ে দিন। দেখি তারা কী বলে?

ভাইমার বললেন, আমি কিন্তু যাব না আপনার সঙ্গে। আমাকে বাগে পেলে তারা খুনও করতে পারে। তাছাড়া কিছু লোকের আসার কথা এখানে।

অনীশ বলল, আমি একাই যাব। আমার ড্রাইভার পবন বাহাদুর ও গ্রামেই আছে। অসুবিধা হবে না।

ভাইমার বললেন, ঠিক আছে রাস্তাটা আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

ভাইমারের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল ফোনে পবন বাহাদুরকে ধরল অনীশ। সে তাকে বলল গ্রামের লোককে জানিয়ে দাও আমি আসছি। তবে ওয়াইল্ড লাইফের লোক এ ব্যাপারটা তাদের বলার দরকার নেই। হয়তো তারা সেটা বুঝবে না। তাদের বোলো যে সরকারি তরফে আমি খোঁজ নিতে যাচ্ছি তাদের কাছে।

পবন বাহাদুর জানাল, ঠিক আছে স্যার। তবে এরা খুব খেপে আছে সাহেবটার ওপর।

ফোনটা জ্যাকেটের পকেটে রাখার পর অনীশ ভাইমারকে প্রশ্ন করল, কাদের আসার কথা এখানে?

ভাইমার জবাব দিলেন, তিব্বতী চীনাদের একটা দল। সীমান্ত পেরিয়ে ওপার থেকে আসবে ওরা আমাদের জন্য রেশন, পশুগুলোর জন্য মাংস ইত্যাদি নিয়ে। গত তিনমাস ধরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে সব লেনদেন তো বন্ধ। কাজেই ওই চীনারাই ভরসা। তা ছাড়া জিনিসপত্র কম দামেও দেয় ওরা।

তার কথা শুনে অনীশ মৃদু বিস্মিতভাবে বলল, এভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা যাওয়া করা যায় নাকি?

ভাইমার বললেন, হ্যাঁ, স্থানীয় লোকরা করে। এখানে তো কাটাতারের বেড়া নেই। আপনি বুঝতেই পারবেন না কোনটা চীন আর কোনটা ইন্ডিয়া। দু-দেশের সীমান্তরক্ষীরা এ ব্যাপারে খুব একটা বাঁধা দেয় না। তবে যারা ওদেশ থেকে আসে তারা খুব বেশি নীচে নামে না, আর এ দেশের স্থানীয় মানুষরাও ও দেশের ভিতরে ঢোকে না। সীমান্তে উত্তেজনা না থাকলে স্থানীয়ভাবে এ ব্যাপারটা চলে।

ফাঁকা জমিটার যে দিকটায় বাইরের দিক থেকে পাইনবন কাঁটাতারের বেড়াকে প্রায় ছুঁয়ে আছে সেদিকটাতে ভাইমারের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল অনীশ। সেখানেও বাইরে যাবার একটা দরজা আছে। সে দরজার বাইরে থেকেই একটা অঁড়িপথ প্রবেশ করেছে পাইনবনের ভিতরে। দরজাটা খুলে শুড়িপথটা দেখিয়ে ভাইমার বললেন–এ পথটা যেমনভাবে গেছে তেমন তেমন। চলে যাবেন। একটু কোনাকুনি গেলেই ঢাল বেয়ে গ্রামে পৌঁছে যাবেন।

ঘেরা জায়গাটার বাইরে বেরিয়ে পাইবনে প্রবেশ করল অনীশ। বিরাট বিরাট সব গাছ। দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে। তার ঋজু গুঁড়িগুলো সব সোজা উঠে গেছে ওপরদিকে। গাছগুলো কত প্রাচীন কে জানে! শ্যাওলার পুরু আবরণ জমে রয়েছে গায়ে। কোনও গুঁড়ির গায়ে জন্মেছে। থালার মতো বিরাট বিরাট ছত্রাক। একটা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ বিরাজ করছে বনের মধ্যে। কেমন। যেন গা-ছমছমে রহস্য ভাবও আছে। ভাইমারের দেখানো শুড়িপথ দিয়ে হাঁটতে লাগল অনীশ। মাঝে মাঝে পাতা থেকে মাটিতে জল খসে পড়ার শব্দ অথবা বাতাসের ফিসফিসানি ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই। যে পথ ধরে অনীশ গাড়ি নিয়ে এসেছে তার ডানহাতেই মাইল তিনেক বিস্তৃত এই পাইনবন। তবে শুড়িপথটা পাইন বনের একটু ভিতরে ঢুকেই ভাইমারের নেকড়ে খামারের কোনাকুনি ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে। সে পথই ধরল অনীশ।

কিছুক্ষণ চলার পরই বনটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে গেল। বনের বাইরে বেরিয়ে এল। অনীশ। বনের ঠিক বাইরে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা। পাহাড়ি ছোট ছোট গ্রাম যেমন হয় এ গ্রামটাও তেমনই। পাথরের টুকরো দিয়ে বানানো অনুচ্চ প্রাচীর ঘিরে আছে গ্রামটাকে। সব মিলিয়ে গোটা কুড়ি ঘর হবে গ্রামে। ঘরগুলোর দেওয়াল পাথরের তৈরি। মাথার ওপর নীচু ছাদ। ঘেরা চৌহদ্দির একপাশে একটা খোঁয়াড়ও আছে। পশুর ডাকও ভেসে আসছে সেখান থেকে।

অনীশের আগমনবার্তা ড্রাইভার পবনের মাধ্যমে আগাম পেয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল গ্রামের লোকজন। তাদের মধ্যে পবনও ছিল। অনীশ ঢাল বেয়ে নীচে নামতেই তাকে বেশ খাতির করে গ্রামের ভিতর নিয়ে গেল কয়েকজন। একটা ফাঁকা জায়গাতে একটা পাথরের ওপর অনীশকে বসানোর পর তাকে ঘিরে দাঁড়াল।

গ্রাম্য গরিব পাহাড়ি মানুষ সব। পরনে শতছিন্ন শীতবস্ত্র। মাথায় টুপি। এই শীতেও অধিকাংশেরই খালি পা। বুড়ো বুড়ি, জোয়ান, বাচ্চা কাচ্চা মিলিয়ে একশজন মতো হবে। অনীশ বসার পর ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বুড়োলোক বেরিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। পবন তাকে দেখিয়ে বলল, স্যার, এ হল নরবু। গ্রামের মাথা। ওই কথা বলবে আপনার সঙ্গে।

নরবু! এ লোকটার নাম ভাইমারের মুখে শুনেছে অনীশ। লোকটার মাথায় একটা চামড়ার টুপি, গায়ে নোংরা জ্যাকেট। সম্ভবত বয়সের ভারেই একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছে লোকটা। তার অসংখ্য বলিরেখাময় মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই তিব্বতী লোকটা এ জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, শুনেছে। তবে তার নরুন-চেরা জ্বহীন চোখের দৃষ্টি এখনও বেশ তীক্ষ্ণ। তার হাতে ছিল একটা কাঠগোলাপের স্তবক। সেটা সে অনীশকে দিল।

লোকটাকে একবার ভালো করে দেখে নেবার পর অনীশ বলল, তোমরা তো ওই নেকড়ে খামারটার ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছ। তাই আমি সরকারের তরফ থেকে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। আমি জানতে চাই আসল কারণটা কী?

নরবু একটু চুপ করে থেকে বলল, ওরা মানুষ মারতে শুরু করেছে। গত ছমাসে বেশ কজন মানুষের দেহ মিলেছে বনের মধ্যে।

অনীশ বলল, তারা তো গ্রামের লোক নয় বলেই জানি।

নরবু বলল, তারা গ্রামের লোক নয় ঠিকই কিন্তু একবার নেকড়েরা মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে মানুষ মারতে শুরু করে। আমাদের দুজন লোককে নেকড়েগুলো তাড়াও করেছিল। পালিয়ে এসেছে তারা। এই জঙ্গলের ওপরই আমাদের জীবন নির্ভর করে। কাঠ সংগ্রহ, পশুপালন সব বন্ধ হতে বসেছে।

অনীশ বলল, সে তো অন্য নেকড়েও করতে পারে। নেকড়ের তো অভাব নেই এখানে?

নরবু বলল, কথাটা ঠিক। কিন্তু মানুষগুলোকে মেরেছে খামারের নেকড়েগুলোই। আমাদের লোক দুজনকে ওরা তাড়া করার পর যখন আমরা নেকড়ে মারার জন্য জঙ্গলে ঢুকি তখন ওই খামারের দুজন লোককে পেয়েছিলাম জঙ্গলের ভিতর।

অনীশ বলল, তাদেরও তো তোমাদেরই মতো জঙ্গলে ঢুকতে বাধা নেই। তোমরা কি নেকড়ে পেয়েছিলে তাদের সঙ্গে?

বৃদ্ধ জবাব দিল, না, পাইনি।

 অনীশ বলল, তবে কীভাবে প্রমাণ হল যে খামারের নেকড়েরাই মানুষ মারছে?

প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বৃদ্ধ বলে উঠল, দুটো নেকড়ে তাড়া করেছিল আমাদের লোকদের। বনের ভিতরও পাওয়া গেছিল খামারের দুজনকে। আসলে ওরাই তাড়া করেছিল আমাদের লোকদের। ওরা আসলে মানুষ নয়, নেকড়ে মানুষ।

নেকড়ে মানুষ! ওয়্যার উল! মৃদু চমকে উঠল অনীশ। এদের আতঙ্কের আসল কারণটা এবার বুঝতে পারল সে। বহু দেশের পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে কু-সংস্কার আছে যে যুদ্ধে যারা মারা যায় তারা নেকড়ে হয়ে যায়। বিশেষত দুর্গম, তুষার ঢাকা পার্বত্য অঞ্চলে মৃত মানুষদের দেহ অনেক সময়ই খুঁজে পাওয়া যায় না বা সৎকার করা সম্ভব হয় না। জঙ্গলে, খাদের ভিতর বা তুষার চাপা অবস্থায় পড়ে থাকে মৃতদেহ। ওদের প্রেতাত্মারাই নাকি ওয়্যার উফের রূপ ধারণ করে। এই কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে বহু সময় মারা হয় এই দুষ্প্রাপ্য প্রাণীগুলোকে।

গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা অন্ধবিশ্বাস চট করে ভাঙা সম্ভব নয়। সে ধারণা এখন ভাঙতে গেলে বরং বিপদ হতে পারে। অনীশ তাই বলল, হ্যাঁ, ওয়্যার উলফের ব্যাপারটা আমিও শুনেছি। কিন্তু দুটো নেকড়ে তাড়া করেছিল আর ওই লোকগুলো সংখ্যায় দুজন ছিল বলেই কি ধরে নেওয়া যায় ওরা ওয়্যার উলফ?

নরবু বলল, শুধু সে কারণে নয়, যেখানে যেখানে দেহ মিলেছে সেখানেই তার পাশে পাওয়া গেছে মানুষের পায়ের ছাপ। ঘটনার আগে-পরে খামারের লোকগুলোকে জঙ্গলে ঢুকতে বেরোতেও দেখেছে অনেকে। যখন ওরা প্রথমে খামারটা খুলল তখন ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারিনি। সাহেব আর তার লোকজনের সঙ্গে ভালো সম্পর্কই ছিল আমাদের, তারপর ধীরে ধীরে ওরা কথাবার্তা, কাজ কারবার বন্ধ করে দিল। ওরা মানুষ নয়, প্রেতাত্মা। নেকড়ের রূপ ধরে। এমনকী যে-কোনও মানুষেরও রূপ ধরতে পারে ওরা। আপনি তো ওখানে আছেন শুনলাম। সাবধানে থাকবেন।

অনীশ বুঝতে পারল, ওয়্যার উফের ব্যাপারটা বেশ জেঁকে বসেছে এদের মাথায়। তাই সে তাদের আশ্বস্ত করার জন্য এবার অন্য কৌশল নিল। সে বলল, তোমাদের কথা আমি অবিশ্বাস করছি না। ইচ্ছা করলে তো আজকেই তুলে দেওয়া যায় খামারটা। কিন্তু তার জন্য আরও মজবুত প্রমাণ দরকার। ভাইমার সাহেব একটু সময় চাইছেন তোমাদের কাছে। তোমরা যদি আবার সরকারকে চিঠি দিয়ে অভিযোগটা তুলে নাও তবে তিনি আবার মাংস কিনবেন তোমাদের কাছ থেকে। গ্রামের উন্নতির জন্য তিনি অর্থ সাহায্যও করবেন তোমাদের। তার কাছে যদি তোমাদের আরও কোনও দাবি থাকে তবে আমি তা নিয়ে তার সঙ্গে কথাও বলতে পারি। আমি তোমাদের চাপ দিচ্ছি না। শুধু একবার ভেবে দেখতে বলছি। উভয় পক্ষেরই কোথাও কোনও ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকতে পারে।

তার কথা শুনে মাথা নাড়ল নরবু। তারপর বলল, ভুল আমাদের হচ্ছে না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। তবে আপনি সাবধানে থাকবেন। আমার বিশ্বাস ওরা নেকড়েই।

অনীশ আর কথা বাড়াল না। কাঠগোলাপের পুষ্পস্তবকটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, এবার আমি চলি। কাল আবার আসব।

পাহাড়ের ঢালের পাইনবনের মুখ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিতে এল ড্রাইভার ছেলেটা। অনীশ তাকে বলল, গ্রামের তেমন কিছু খবর হলে সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমাকে জানাবে।

বনের মধ্যে দিয়ে একটু সাবধানে ফিরবেন।

পবন বলল, আচ্ছা সাহেব। কোনও খবর হলেই জানাব।

তাকে বিদায় জানিয়ে বনে প্রবেশ করল অনীশ। চারপাশে আবার সেই অদ্ভুত আলো আঁধারী পরিবেশ। গাছের পাতা থেকে জল খসে পড়ার টুপটাপ শব্দ। হিমেল বাতাস বনের মধ্যে এমনভাবে বয়ে যাচ্ছে যে ঠিক যেন ফিসফাস শব্দে কারা কথা বলছে পাইনগাছের আড়াল থেকে। পবন আর গ্রামবাসীদের কথা মেনে একটু সাবধানেই চলছিল অনীশ। ওয়্যার-উফের ভয়ে নয়। ওসবে সে বিশ্বাস করে না। তবে সত্যিকারের নেকড়ে বনে থাকতেই পারে। তাই সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

হাঁটছিল অনীশ। হঠাই পাশেই একটা গাছের আড়াল থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে সে দিকে তাকাতেই দেখতে পেল গাছটার আড়ালে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার পোশাকের কিছুটা অংশ গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে।

অনীশ বলে উঠল, কে ওখানে? কে?

প্রশ্ন শুনে গাছের আড়াল থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে দেখে অনীশ বেশ অবাক হয়ে গেল।

সে বলল, ভাইমার আপনি এখানে?

ভাইমারের মুখে কেমন যেন একটা অপ্রস্তুত হাসি। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি। ক্যাম্পে। থাকতে আর ভালো লাগছিল না, তাই বনে ঢুকেছিলাম। গ্রামবাসীরা কী বলল?

অনীশ জবাব দিল, কথা বললাম ওদের সঙ্গে। আপনি যে ওদের থেকে পশু কিনবেন, অর্থ সাহায্য করবেন সেটা ওদের জানিয়েছি। দেখা যাক ওরা মত পরিবর্তন করে কিনা?

অনীশের জবাব শুনে চুপ করে কী যেন ভাবলেন ভাইমার। তারপর প্রশ্ন করলেন, আপনি এখন কোথায় যাবেন? ক্যাম্পে ফিরবেন?

অনীশ বলল, ভাবছি চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নেই। এই বনের মধ্যে দিয়ে গাড়ি রাস্তায় যাবার অন্য কোনও পথ আছে?

ভাইমার একটা গাছের গুঁড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ওর আড়াল থেকে একটা শুড়িপথ নেমেছে ওদিকে। ওটা ধরে চলে যান। রাস্তা পাবেন। ঠিক আছে ক্যাম্পে ফিরে আবার দেখা হবে। এই বলে সেদিকে এগোল অনীশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *