২. দৃশ্যটা অবর্ণনীয়

দৃশ্যটা অবর্ণনীয়। লম্বা লম্বা পাইন গাছকে অবলীলাক্রমে টপকে বেরিয়ে এল তেপায়া দানবরা। পরক্ষণেই প্রত্যেকের মাথার বাক্স থেকে তীব্রবেগে ঠিকরে এল কালো ধোঁয়া। দু-চারটে কামান গর্জে উঠেছিল ঠিক সেই মুহূর্তে মানুষ-পোকাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকা- নো রয়েছে ঠিক কোন জায়গাগুলোতে, মঙ্গলগ্রহী- রা জেনে গিয়েছিল সেই কারণেই। ধোঁয়া নিক্ষেপ করলে ঠিক সেই সেই দিকে।

মারাত্মক সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে গেল জমি ঘেঁষে। উপত্যকায় দিকে দিকে গড়িয়ে গিয়ে ঢুকে গেল প্রতিটা খাঁজে খাঁজে, ফাঁকে, ফোকরে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিষ-ধোঁয়া ফুস-ফুঁসে প্রবেশ করতেই মরণের কোলে ঢলে পড়ল আমাদের সেনানীরা। নিস্তব্ধ হয়ে গেল কামানগুলো। নিস্তব্ধ হয়ে গেল সমস্ত প্রান্তর। ঘন কালো ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেল চারদিক। বাড়িঘরদোর পর্যন্ত ঢেকে গেল কালো ধোঁয়ায়। ঘরের মধ্যে থেকেও রেহাই পেল না আবালবৃদ্ধবনিতা। চকিত মৃত্যু সবাইকেই নিয়ে গেল পরলোকে।

নিষ্ঠুর মৃত্যুদূতেরা দাঁড়িয়ে রইল কেবল প্রান্তরের মাঝে। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যেতেই, প্রাণের সমস্ত স্পন্দন চারদিকে থেমে যেতেই স্তব্ধ করল কালো ধোঁয়াবর্ষণ। পিচকিরির মতো এতক্ষণ যে ধূমপুঞ্জ তীব্রবেগে ধেয়ে যাচ্ছিল দিকে দিকে, অকস্মাৎ তা বন্ধ করে দিয়ে ধোঁয়ার ওপর ছিটিয়ে দিলে বাষ্পধারা। গরম বাষ্প মুহূর্তের মধ্যে সাফ করে দিল মাটি ঘেঁষে গড়িয়ে-যাওয়া তাল তাল বিষধোঁয়াকে। পরিষ্কার হয়ে গেল মৃত্যু উপত্যকা!

চলল এইভাবেই। পোকামাকড়ের বাসায় ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে মানুষ যেভাবে বাসা পরিষ্কার করে নেয়, মঙ্গলগ্রহীরা ঠিক সেইভাবে বিষ-গ্যাস ছড়িয়ে দিতে লাগল লন্ডনের দিকে এগনোর সময়ে। একশো ফুট উঁচু বাক্সে বসে হারামজাদারা ঠিক আঁচ করে নিয়েছে, কোথায় কোথায় লুকানো আছে কামান আর সৈন্য–কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়েছে ঠিক সেইখানে। ধ্বংসস্তূপের পর ধ্বংসস্তূপ রচনা করে বীরদর্পে এগিয়ে গেছে জনবহুল লন্ডন শহরের দিকে। বাধা পায়নি কোত্থাও। বাধা দেওয়ার মতো বেঁচে ছিল না কেউ। মৃত্যুর হাহাকার পর্যন্ত শোনা যায়নি কোনওখানে। তেপায়া দানবরা এসেছে চকিতে, প্রাণের প্রদীপ নিবিয়ে দিয়েছে নিমেষে। গণহত্যা চালিয়ে গেছে নির্মমভাবে।

অচিরেই নিঃসীম আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল লন্ডনবাসীরাও। খবর পৌঁছেছে সেখানেও। পোকামাকড়দের মতো মানুষ মারতে মারতে বিকটদর্শন যন্ত্রদানবদের চালিয়ে নিয়ে আসছে মঙ্গলগ্রহীরা–এ খবর সেখানে পৌঁছাতেই শিউরে উঠল প্রতিটি মানুষ। এখন উপায়?

লন্ডনের গণ-আতঙ্ক কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল, পরে তা শুনেছিলাম আমার ভাইয়ের মুখে। ও তখন লন্ডনেই ছিল। সকালের দিকে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল, খবরের কাগজ ফিরি করছে কাগজওয়ালা। আর চেঁচিয়ে যাচ্ছে তারস্বরে–বিপদ! বিপদ! দম আটকে মৃত্যু! কালো ধোঁয়া!

কাগজ নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়েই থ হয়ে গিয়েছিল আমার ভাই। প্রধান সেনাপতির হুশিয়ারি ছাপা হয়েছে বড় বড় করে–তলায় মঙ্গলগ্রহীদের ধ্বংসযজ্ঞের লোমহর্ষক ফোটোগ্রাফ।

কমান্ডার-ইন-চিফ বলেছেন, বিষ-ধোঁয়ার মেঘ ছড়িয়ে দিচ্ছে মঙ্গলগ্রহীরা। নিশ্চিহ্ন করেছে সৈন্যবাহিনীকে। এগচ্ছে লন্ডনের দিকে। পালানো ছাড়া বাঁচার পথ আর নেই!

ফলে, প্যানিক ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা লন্ডন শহরে। ষাট লক্ষ নগরবাসী একই সঙ্গে লন্ডন ছেড়ে ছুটল উত্তরদিকে। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। যত দূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। কাতারে কাতারে মানুষ প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে প্রাণপ্রিয় শহর ছেড়ে অন্য গ্রহ থেকে মাত্র জনাকয়েক আগন্তুক আততায়ীর ভয়ে। তাদের চোখে দেখেনি কেউই–শুধু শুনেছে বর্ণনা। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে অসামান্য কাণ্ডকারখানা শুনেই। সুতরাং দে চম্পট! দে চম্পট! দে চম্পট!

খালি হয়ে গেল লন্ডন শহর। আমার ভাই কোনওমতে পৌঁছাল নদীর ধারে। জাহাজে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। এত লোক উঠেছে এবং তখনও উঠছে যে, জাহাজটাই না ডুবে যায়। যারা উঠতে পারেনি, তাদের চেঁচামেচি-হট্টগোলে কানের পোকা বেরিয়ে যায় আর কী! ভায়া আমার এদিকে খুব চৌকস। অত ভিড়ের মধ্যেও নিজের জায়গা করে নিয়ে- ছিল জাহাজে। সঙ্গে সঙ্গে চিমনি দিয়ে গলগলিয়ে কালো ধোঁয়া ছেড়ে জাহাজ সরে এসেছিল তীর থেকে তফাতে। আর ঠিক তখনই বহু দূরে দেখা গিয়েছিল দীর্ঘ- দেহী এক যন্ত্রদানব-কে। বহু দূরে থাকায় তখনও কালো বিন্দুর মতো মনে হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু যেভাবে বাড়িঘরদোর, কার- খানা টপকে এগিয়ে আসছিল, তাতেই বোঝা গিয়েছিল তেপায়া দানব লম্বায় কতখানি।

জাহাজ থেকে বহু দূরের সেই চলমান বিভীষিকাকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল আমার ভায়ের। শোনা কথা যে এতখানি বুক-কাঁপানো সত্যি হতে পারে, হাড়ে হাড়ে তা টের পেয়েছিল। সেই প্রথম স্বচক্ষে মঙ্গলগ্রহীদের যন্ত্রদানব দেখেই নাকি ধাত ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল জাহাজসুদ্ধ প্রত্যেকেরই।

তেপায়া দানবের দল দেখতে দেখতে এসে পৌঁছেছিল জলের ধারে। জাহাজ ভরতি মানুষ পালাচ্ছে দেখে লম্বা লম্বা ঠ্যাং বাড়িয়ে জলেও নেমে পড়েছিল। তাড়া করেছিল পেছনে। ফুল স্পিডে জাহাজ চালাতে হুকুম দিয়েছিলেন ক্যাপটেন। থরথর করে কাঁপছিল চিমনি আর গোটা জাহাজটা পুরোদমে ইঞ্জিন চলায়। তা সত্ত্বেও মনে হয়েছিল যেন। শামুকের গতিতে যাচ্ছে জাহাজটা–অবিশ্বাস্য বেগে পেছনে তাড়া করে আসছে করাল যন্ত্রদানব!

আচমকা কাত হয়ে পড়েছিল জাহাজ। তাল সামলাতে না পেরে ঠিকরে পড়েছিল আমার ভাই। পরক্ষণেই দেখেছিল, প্রায় একশো গজ দূর দিয়ে একটা লোহার জাহাজ জল তোলপাড় করে ছুটে যাচ্ছে আগুয়ান বিভীষিকা-র দিকে।

দেখেই উল্লসিত হয়েছিল আমার ভাই। চিনতে পেরেছিল জাহাজটাকে। টর্পেডোবাহী যুদ্ধজাহাজ। সোজা তেড়ে যাচ্ছে তেপায়া দানবের দিকে।

তারপয়েই শোনা গিয়ে ছিল যেন বজ্রনির্ঘোষ। গর্জে উঠেছিল টর্পেডো কামান। তাল তাল ধোঁয়া ঠিকরে গিয়েছিল কালো জলের ওপর দিয়ে–অন্ধকারের বুক চিরে নক্ষত্রবেগে ধেয়ে গিয়েছিল সাক্ষাৎ যমদূত–বিস্ফোরকে ঠাসা টর্পেডো!

আচমকা উৎপাতকে সটান ধেয়ে আসতে দেখে যন্ত্রদানবও সজাগ হয়ে গিয়েছিল এবং রশ্মিবর্ষণ করেছিল পলকের মধ্যে।

ফলটা হল ভয়ানক। পিলে চমকে গিয়েছিল আমার ভায়ার।

লৌহনির্মিত অমন মজবুত গোটা যুদ্ধজাহাজটা ফেটে চৌচির হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত ছিটকে ছিটকে পড়ল চক্ষের নিমেষে। রশ্মিঝলকের সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল প্রচণ্ড ঝলসানিতে। সে কী ফ্ল্যাশ! যেন লক্ষ বিদ্যুৎ একযোগে আছড়ে পড়েছিল লোহার জাহাজটার ওপর।

পরের মুহূর্তেই দেখা গেল জাহাজ নিশ্চিহ্ন। পেছনে দাঁড়িয়ে কুটিল যন্ত্রদানব। যেন কিছুই হয়নি, ছেলেখেলা করে গেল এইমাত্র!

সুযোগটার সদ্ব্যবহার করেছিল ছোট্ট জাহাজের ক্যাপটেন। ফুল ফোর্সে ইঞ্জিন চালিয়ে মানুষ-ঠাসা জলযানকে নিয়ে গিয়েছিল বার-সমুদ্রের দিকে।

অন্ধকার যখন বেশ গাঢ় হয়ে এসেছিল, চিৎকার শোনা গিয়েছিল ক্যাপটেনের কণ্ঠে। আঙুল তুলে কী যেন দেখাচ্ছেন বহু দূরে।

জাহাজসুদ্ধ লোক তাকিয়েছিল সেদিকে। দেখেছিল, তারাভরা আকাশকে সবুজ আলোয় ঝলসে দিয়ে চতুর্থ সিলিন্ডার নেমে যাচ্ছে ধরিত্রীর বুক লক্ষ্য করে–পেছনে রেখে যাচ্ছে। সবুজ আলোর রেখা–প্রোজ্জ্বল এবং অশুভ।

লন্ডনে যখন এই কাণ্ড চলছে, পলায়নের হিড়িক উঠেছে, মূর্তিমান মেশিন দানব আবির্ভূত হয়ে লৌহ রণতরিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ছাড়ছে–ঠিক সেই সময়ে ক্ষিপ্তমস্তিষ্ক পাদরি সাহেবের সঙ্গে প্রাণের ভয়ে আমি লুকিয়ে আছি একটা খালি বাড়িতে। বাড়ির মালিক সবকিছু ফেলে-ছড়িয়ে পালিয়েছে প্রাণের মায়ায়–আমরা ঠাঁই নিয়েছি পরিত্যক্ত সেই গৃহে প্রাণপাখিকে পিঞ্জরে ধরে রাখার প্রয়াসে।

পাদরি সাহেব দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছে এক কোণে। বকবক করেছে অনেকক্ষণ। কাঁহাতক আর মুখের গ্যাঁজলা উঠিয়ে চেঁচাবে? ঝিমিয়ে পড়েছে সেই কারণেই। আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে আছি। ক্লান্ত চরণে ঘুরঘুর করছি। পরিত্যক্ত বাড়িটাকেই দুর্গ বানিয়ে বাঁচবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

তখনও নিশার অবসান ঘটেনি। রাতের তারা বিদায় নেয়নি। জানলা থেকে উঁকি মেরে কিন্তু দেখলাম, কালো ধোঁয়ার ছিটেফোঁটাও আর নেই কোথাও। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে অবলীলাক্রমে ছড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষদের নিকৃষ্ট কীটের মতোই যারা নিঃশেষে যমালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, মৃত্যুরূপী কালো ধোঁয়ার অপসারণ ঘটিয়েছে তারাই গরম বাষ্পর পিচকিরি দিয়ে। তাজ্জব প্রাণী বটে! বিষ-ধোঁয়া ছাড়বারই বা কী দরকার ছিল –আবার তাকে ধুয়ে দিয়ে মেদিনীকে নির্মল করারই বা কী প্রয়োজন ছিল!

ওই সময়ে অবশ্য এত কথা আমি ভাবিনি। ভাববার মতো অবসর বা মনের অবস্থা ছিল না। যেই দেখলাম বিষ ধোঁয়ার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও, অমনি বললাম পাদরিকে, এই সুযোগ! এবার বেরিয়ে পড়া যাক!

আঁৎকে উঠল বৃদ্ধ পাদরি; না! না! এখানেই বেশ আছি।

কিন্তু আমি তো জানি, যেতে আমাকে হবেই। এ জায়গা এই মুহূর্তে যত নিরাপদই হোক-না কেন, অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা জানি না। তা ছাড়া, আমাকে যেতে হবে স্ত্রী র খোঁজে। সে বেচারার কী হাল হল, না-জানা পর্যন্ত স্বস্তি নেই আমার।

সুতরাং পাদরিকে আমার অভিপ্রায় জানিয়ে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে এলাম ভাঙাচোরা বাড়ির বাইরে। পেছন পেছন দৌড়ে এল পাদরি সাহেব। একা একা এই নরকপুরীতে থাকতে সে রাজি নয়।

কিছু দূর গিয়েই কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম বিষম ভয়ে!

রাস্তা বেয়ে লোকজন পালাচ্ছে ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু পলায়মান জনতার মাথার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে একশো ফুট উঁচু একটা যন্ত্রদানবকে। নির্বিকারভাবে চলেছে হনহন করে। যেন এ পৃথিবীটা তাদেরই। মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসেছে। এখন হাওয়া খেতে বেরিয়েছে।

খটকা লাগল একটু পরেই।

তাপরশ্মি বর্ষণ করছে না কেন ভীমাকার যন্ত্রদানব? লোকজন প্রাণভয়ে ছুটছে তো তার সামনে দিয়েই। লম্বা লম্বা পাইন গাছের মধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে সেদিকেই নজর রেখেছে করাল আকৃতিটা–অথচ তাপরশ্মি ছুঁড়ে নিকেশ করে দিচ্ছে না কাউকেই!

ব্যাপারটা কী?

 ব্যাপারটা যে কী ভয়ানক, তা অচিরেই দেখতে পেলাম স্বচক্ষে এবং শিউরে উঠলাম যন্ত্রদানবদের এহেন আচরণের মূল উদ্দেশ্যটা অনুধাবন করতে না পেরে!

পলায়মান জনতাদের মধ্যে থেকে একটা একটা করে লোককে খপ করে শুড়ের ডগায় তুলে নিচ্ছে যন্ত্রদানব এবং নিক্ষেপ করছে পিঠের ধাতু-খাঁচায়!

কেন? না মেরে জ্যান্ত মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে কেন? জবাবটা জেনেছিলাম পরে এবং তা এমনই নারকীয় ব্যাপার যে, লিখতে আমার কলম সরছে না। মানুষ জাতটা খাবার খেতে যে সময়টা নষ্ট করে, মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা তা-ও করে না। তারা জ্যান্ত মানুষের রক্ত টেনে নিয়ে নিজেদের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। বাকি সময়টা শুধু কাজ করে যায়।

টপাটপ করে তোক তুলে পরিত্রাহি চিৎকার সত্ত্বেও খাঁচার মধ্যে ফেলছে দেখেই কিন্তু বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল আমার হাতে-পায়ে। পাঁইপাঁই করে দৌড় দিয়েছিলাম পেছন ফিরেই। কোথায় যাচ্ছি, পথে কী আছে–অত দেখিনি। অন্ধকারে দেখা সম্ভবও ছিল না। ফলে, ঝপাত করে দুজনেই ঠিকরে পড়লাম একটা খানার মধ্যে।

তখন শেষ রাত। রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে খানার জলেই ঘাপটি মেরে থাকা সমীচীন বোধ করলাম–এর চাইতে নিরাপদ জায়গা আপাতত বাইরে আর কোথাও নেই। গাঢ় তমিস্রায় কিছু দেখতে পাচ্ছি না ঠিকই কিন্তু সেইটাই তো আমাদের পরম নিরাপত্তা। হতচ্ছাড়া যন্ত্রদানবরাও তো দেখতে পাবে না জলজ্যান্ত এই দুটো মানুষকে।

অনেকক্ষণ পরে হট্টগোল থেমে যাবার পর গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম খানার মধ্যে থেকে। রাস্তা এড়িয়ে গেলাম। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পা টিপে টিপে এগলাম। বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল প্রতি পদক্ষেপে।

খিদে পেয়েছিল খুবই। সামনে একটা খালি বাড়ি দেখে ঢুকে পড়লাম তার মধ্যে। তেষ্টাও পেয়েছে বিলক্ষণ। হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় পেলাম রুটি আর শূকর মাংস। পাদরি পেয়ে গেল তৃষ্ণানিবারণের জল।

পরমানন্দে খাওয়াদাওয়া করছি দুই পলাতক পৃথিবীবাসী, আচম্বিতে এ কী কাণ্ড! চোখ ধাঁধিয়ে গেল অতি তীব্র সবুজ দ্যুতিতে–আলোর ঝলক নেমে এল আকাশ থেকে–নিমেষে দূরীভূত করল ভাঙা ঘরের প্রতিটি কোণের তমিস্রাপুঞ্জ। পরক্ষণেই শুনলাম পিলে-চমকানো একটা বিস্ফোরণের শব্দ। সে কী ভয়াবহ আওয়াজ। কানের পরদা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো অনেক ভয়ংকর বিকট আওয়াজ শুনেছি এই জীবনে, কিন্তু এরকম হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ করা নিনাদ তো কখনও শুনিনি! গায়ের প্রতিটা লোম খাড়া হয়ে গেল রক্ত ছলকে দেওয়া সেই বিপুল সংঘাত-শব্দে। ছিটকে গেলাম শূন্যে–ছিটকে গেল সবকিছুই।

বলা বাহুল্য, সংবিৎ হারিয়েছিলাম আচমকা সেই প্রলয়কাণ্ডে। জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলাম কতক্ষণ পরে, তা বলতে পারব না। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি। তমালকালো আঁধারে মেঝের ওপর ছিটকে পড়ে আছি আমি। পাশের দিকে কাতরানি শুনে বুঝলাম, ঘোর কাটিয়ে উঠেছে পাদরিসাহেবও।

ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে কথা বলতেও পারিনি। চাপা গলায় ধমক দিয়েছিলাম, চুপ! একদম নড়বেন না। বাইরেই রয়েছে ওরা–টের পাচ্ছেন?…

পাদরি টের পাক আর না-পাক, হাড়ে হাড়ে আমি টের পেয়েছিলাম, মঙ্গলগ্রহীদের কদাকার অস্তিত্ব রয়েছে অতি সন্নিকটে। ব্যাপারটা কী ঘটে গেল, তা-ও আঁচ করে নিয়েছিলাম। আর-একটা চোঙা মঙ্গল গ্রহ থেকে উড়ে এসে আছড়ে পড়ল বাড়ির খুব কাছেই। সাঁই সাঁই করে উড়ে যাওয়ার সময়ে এ বাড়িরও দফারফা করে দিয়ে গেছে, জিনিসপত্র আস্ত নেই কিছুই। কড়িকাঠ হেলে পড়েছে। দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। প্রাণে যে বেঁচে আছি এখনও এইটাই আশ্চর্য।

সকাল না-হওয়া পর্যন্ত আঙুল নাড়বার সাহসও পেলাম না। তারপর অতি সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে গেলাম ভাঙা দেওয়ালের একটা ফুটোর কাছে। ফুটো দিয়ে বাইরে তাকাতেই ছলাত করে উঠল বুকের রক্ত।

বিকটদেহী অতিশয় কদাকার একটা মঙ্গলগ্রহী জ্বলন্ত চোখে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে সদ্য অবতীর্ণ বিশাল সিলিন্ডারটাকে।

পঞ্চম সিলিন্ডার। যা ভেবেছিলাম, ঠিক তা-ই। পঞ্চম চোঙা উল্কাবেগে ধেয়ে এসে তেরচাভাবে এই বাড়ির বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেঁথে গেছে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে। ভগ্নগৃহের নিচে কবরস্থ হতে চলেছি আমরাও!

অস্ফুট কাতরানি শুনলাম কানের কাছে পাদরির ভাঙা গলায়–হা ঈশ্বর! রক্ষে কর!

আর ঈশ্বর! ঈশ্বর আছেন কি নেই–এই সন্দেহটাই সেই মুহূর্তে দেখা দিয়েছিল মনের মধ্যে। এ কী অনাচার! অকারণে ভিনগ্রহীদের এ কী অত্যাচার! একটার পর একটা চোঙা নামিয়ে চলেছে শ্যামল সবুজ পৃথিবীর বুকে–তারপরেই তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে নিরীহ মানুষগুলোর ওপর। ঈশ্বর! তুমি কি সত্যিই আছ?

ঈশ্বর যে আছেন, সব দেখছেন এবং দণ্ড দেওয়ার আয়োজন করে চলেছেন–তা বুঝেছিলাম পরে।

তখন কিন্তু আতঙ্কে বিবশ হয়ে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারিনি। সে যে কী কষ্ট, তা আমি কোনওদিনই লিখে বোঝাতে পারব না… পারব না… পারব না!

অনেক… অনেকক্ষণ পরে খিদের জ্বালা অনুভব করেছিলাম নাড়িতে… বত্রিশ নাড়ি মোচড় দিয়ে উঠতেই আতঙ্কের নাগপাশ খসিয়ে গুটিগুটি খুঁজে বার করেছিলাম রান্নাঘর। সে ঘরের ভগ্নদশাও চোখে জল এনে দেয়। প্রকাণ্ড চোঙার এক ধাক্কাতেই পুরো বাড়িটাই বসে গেছে মাটির মধ্যে। খুঁজেপেতে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে খাবার খেতে খেতে ফাটল দিয়ে দেখে গেলাম, শয়তানের চেলার মতো কুৎসিতদর্শন মঙ্গল গ্রহের প্রাণীগুলো কীভাবে বানিয়ে চলেছে নারকীয় মেশিনের পর মেশিন। ওইরকম জড়ভরত শরীর নিয়ে এত দ্রুতও কাজ করতে পারে শয়তানগুলো। সারাদিন ধরে কাজই করছে-বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই–একনাগাড়ে খেটে দেখতে দেখতে খাড়া করে ফেলছে একশো ফুট উঁচু যন্ত্রদানবদের।

পাতালঘরে এইভাবে অসীম উৎকণ্ঠা আর যন্ত্রণা সহ্য করে দীর্ঘ আট দিন আট রাত কাটানোর পর নবম দিনে আচমকা একটা শব্দ শুনে দিবানিদ্রা ছুটে গেল আমার। ধড়মড় করে উঠে পড়ে দেখলাম, পাদরি মড়ার মতো পড়ে আছে ভূমিশয্যায়–আর একটা কিলবিলে শুড়-ভাঙা কড়িবরগার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে ঘরের মধ্যে!

চাচা আপন প্রাণ বাঁচা নীতি অনুসরণ করেছিলেন তৎক্ষণাৎ। সুট করে সরে গিয়েছিলাম শুড়ের নাগালের বাইরে–ঘাপটি মেরে ছিলাম কয়লা রাখার ঘরে–নিবিড় তমিস্রার মধ্যে। ধড়াস ধড়াস করছিল উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে যাওয়া হৎপিণ্ডখানা–জানি না হতচ্ছাড়া মঙ্গলগ্রহী আমাকেও দেখে ফেলেছে কি না। যদি দেখে থাকে…

আর ভাবতে পারিনি! সমস্ত অণু-পরমাণুর মধ্যে প্রবিষ্ট নিদারুণ আতঙ্ক আমার প্রাণপ্রদীপ সেই মুহূর্তে কেন যে নিবিয়ে দেয়নি–আজও তা ভেবে অবাক হয়ে যাই।

অন্ধকায়ে গা ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে প্রথমে কিছু দেখতে পাইনি। কানে ভেসে এসেছিল শুধু টুক টুক টুক করে টোকা মারার শব্দ… তারপর শুনলাম, হিড়হিড় করে ভাঙা জিনিসপত্রের ওপর দিয়ে কী যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাহসে বুক বেঁধে উঠে গিয়েছিলাম রান্নাঘরে। ফাটল দিয়ে উঁকি মারতেই শিউরে উঠেছিলাম।

বেচারা পাদরি! শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে মঙ্গল গ্রহী তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের মধ্যে থেকে।

আঁতকে উঠে পিছু হটে এসেছিলাম কয়লা ঘরের মধ্যে। কয়লা তুলে নিজের গায়ে রেখে আত্মগোপন করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলাম প্রাণপণে।

ওই অবস্থাতেই শুনলাম নতুন একটা শব্দ। কয়লাঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছিলাম নিজের হাতে। মঙ্গল গ্রহের প্রাণী দরজার হাতল ধরে মোচড় দিচ্ছে।

উঃ! সে কী মনের অবস্থা আমার। অন্ধকারে চোখ সয়ে গিয়েছিল বলেই দেখতে পেলাম, হাতলটা ঘুরে যাচ্ছে একটু একটু করে। তারপরেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শুড়ের ঠেলায় খুলে গেল পাল্লা। ফাঁক দিয়ে কিলবিলিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল কুটিল সর্পের মতো শুড়খানা!

এবং এগিয়ে এল আমার দিকেই! ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে ছিটকে সরে গিয়েছিলাম আমি যতখানি তফাতে সরা যায়। কিন্তু ছোট ঘরে এমনিতেই জায়গা নেই–দেওয়ালে পিঠ দিয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলাম আধমরার মতো নিস্পন্দ দেহে।

কিলবিলে শুঁড়টা এগিয়ে এল মেঝের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে, ছুঁয়ে রইল আমার বুটের ডগা। পাছে আর্ত-চিৎকার বেরিয়ে যায় গলা চিরে, তাই প্রাণপণে আঙুল কামড়ে ধরলাম। হিমেল জঘন্য ওই শুড় যদি আর-একটু এগোয়… অথবা পা সমেত বুটটাকে পাকিয়ে ধরে!

হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল মাথায়। এক টুকরো কয়লা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম একদিকে। ঠকাস করে কয়লা গিয়ে পড়ল যেখানে, বিদ্যুৎবেগে শুড়টা ধেয়ে গেল সেদিকে। চক্ষের নিমেষে কয়লাটাকে সাপটে ধরেই সাঁত করে বেরিয়ে গেল বাইরে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা! অখণ্ড নৈঃশব্দ্য নেমে এল কয়লাঘরে!

না, শয়তানসদৃশ সেই শুড় আর হানা দেয়নি কয়লাঘরে। কিন্তু মনে সাহস ফিরিয়ে আনতে পারিনি আমি পুরো একটা দিন। নিঃসাড়ে পড়ে ছিলাম অন্ধকারে কয়লার গাদায়– তেষ্টায় বুক ফেটে গেলেও নড়বার সাহস হয়নি।

তারপর অবশ্য আর পারিনি। তৃষ্ণা সইতে না পেরে পা টিপে টিপে বেরিয়েছিলাম জলের খোঁজে। গুটিগুটি এসেছিলাম ফাটলটার কাছে…

বাইরে কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি। যে গর্তের মধ্যে গেঁথে রয়েছে চোঙাটা, যেখানে গত আট দিন ধরে ব্যস্তসমস্ত থেকেছে মঙ্গল গ্রহের আততায়ীরা–আজ সে গর্ত বেবাক শূন্য। কেউ নেই! কেউ নেই!

হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বেরিয়ে এসেছিলাম গর্তের মধ্যে। গুটিগুটি উঠে এসেছিলাম গর্তের ওপরে।

দেখেছিলাম ভারী উজ্জ্বল দিনের আলো। আর নীল… ঘন নীল আকাশ। আঃ! কী স্বস্তি! মঙ্গলগ্রহী বিকটদের টিকিও দেখা যাচ্ছে না ধারেকাছে! দূরে দূরে খাড়া আধভাঙা বাড়ি আর গির্জা। প্রাণের সাড়া নেই কোথাও!

শ্মশান শহরের পথ বেয়ে চারদিকের ভগ্নস্তূপ দেখতে দেখতে ম্লানমুখে অবশ দেহে রওনা হয়েছিলাম লন্ডন শহরের দিকে। যেতে যেতে অম্বেষণ করে গেছি খাদ্য–পেট যে জ্বলে যাচ্ছে। অনাহারে যে আধমরা হয়ে গেছি। বলতে লজ্জা নেই, যেখানে যেটুকু খাবার পেয়েছি, তা-ই খেয়েছি। শরীরে বল পেয়েছি। আবার হেঁটেছি–চোরের মতো–ভয়ে ভয়ে!

আচমকা একটা বেড়ালকে দরজা টপকে পালাতে দেখেছিলাম। বেচারা! মানুষ দেখে আঁতকে উঠছে।

তারপরেই একইভাবে উধাও হতে দেখলাম একটা ধেড়ে ইঁদুরকে।

সন্ত্রস্ত ভীত উৎকণ্ঠিত পৃথিবীর ইতর প্রাণীরাও। আমিও তো ঠিক এইভাবেই দিন কাটিয়েছি কয়লাঘরের অন্ধকারে। কয়লা চাপা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে গেছি হাস্যকরভাবে। বেড়াল আর ইঁদুরটার চকিত পলায়ন দেখে এই শিক্ষাই নিলাম আমি। ঠিক। ওদের মতোই, বেড়াল আর ইঁদুরের মতো আনাচকানাচে লুকিয়ে এখন থেকে প্রাণ বাঁচাতে হবে আমাকে। আওয়াজ শুনলেই সটকান দিতে হবে–আড়ালে লুকিয়ে শত্রুর চোখ এড়িয়ে যেতে হবে। শত্রু এখানে মঙ্গল গ্রহের বিদঘুটে প্রাণীরা, প্রথম দর্শনে যাদের একান্ত অসহায় মনে করেছিলাম, তারাই এখন বীরদর্পে বিচরণ করছে পৃথিবীর বুকে–পৃথিবীর মালিক তো এখন থেকে ওরাই। আমরা হেরে গেছি–পালিয়ে আর লুকিয়ে প্রাণে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোনও গতি নেই আমাদের।

ভাঙা শহর, গ্রাম, কারখানা দেখতে দেখতে আর টলতে টলতে এইভাবেই হাঁটলাম পুরো দুটো দিন, খাবার যা পেয়েছিলাম তা পর্যাপ্ত নয়। পেট ভরেনি–অবসাদও কাটেনি। তবুও হেঁটেছি মনের জোরে। স্রেফ মনের জোরে–আর দুচোখ দিয়ে দেখে গেছি বর্ণনার অতীত ধ্বংসদৃশ্য। শ্মশান! শ্মশান! শ্মশান হয়ে গেছে এই পৃথিবী।

লন্ডনে পৌঁছেও দেখলাম মহাশ্মশান। সদাচঞ্চল কর্মব্যস্ত প্রাণস্পন্দনে ভরপুর লন্ডন শহর একেবারে মরে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। নির্জন পথঘাটে একা একা হেঁটেছি আর নিঃশব্দে কেঁদেছি। মানুষ নেই… মানুষ নেই–এ পৃথিবীতে আর বুঝি জীবিত মানুষ নেই–একা আমি শুধু বেঁচে আছি হৃদয়বিদারক এই দৃশ্য দেখবার জন্যে।

সাউথ কেনসিংটনের কাছাকাছি আসতেই সেই প্রথম শুনতে পেলাম একটা অপার্থিব হাহাকার–উহ-লা! উহলা উহ-লা!

এ আবার কীসের আর্তনাদ? এরকম বিকট অথচ করুণ আর্ত-চিৎকার তো কখনও শুনিনি। অমানবিক কণ্ঠে কে এমনভাবে চেঁচিয়ে চলেছে মরা নগরীর বুকে? প্রেতপুরীর বিকটোল্লাসও বুঝি এমন গা হিম-করা নয়।

থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি। উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে ছিলাম এদিকে

সেদিকে কাছে-দূরে–কিন্তু কাউকে দেখিনি–একাকী অমন কে অমানুষিক আর্তনাদ করে চলেছে, বুঝতেও পারিনি।

ফলে আবার সীমাহীন আতঙ্ক পেয়ে বসল আমাকে। দৌড়ালাম উন্মাদের মতো দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। কোথায় যাচ্ছি, কীভাবে যাচ্ছি–কোনও খেয়াল আর রইল না।

আচমকা দেখতে পেলাম একটা যন্ত্রদানবকে! আতীক্ষ্ণ আর্তনাদটা বেরচ্ছে তারই মাথার বাক্স থেকে–উহ-লা! উহ-লা! উহ্-লা!

সহসা স্তব্ধ হল আর্ত-চিৎকার। থমথমে নৈঃশব্দ্য নেমে এল মৃত্যুপুরীতে। সে যে কী বিপুল শব্দহীনতা তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। অকস্মাৎ বজ্রপাত চেতনার ঝুঁটি পর্যন্ত যেভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়–অকস্মাৎ এই শব্দহীনতাকে শুধু তার সঙ্গেই তুলনা করা চলে।

আমি স্তম্ভিত। অবশ। বিমূঢ়।

বিশালদেহী যন্ত্রদানব টলমল করে উঠেই প্রচণ্ড শব্দে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ভাঙা ঘরবাড়ির ওপর। নিস্তব্ধ শহর শিউরে উঠল সেই শব্দে।

শিহরিত হলাম আমিও। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। তারপরেই পাগলের মতো দৌড়েছিলাম ভূলুষ্ঠিত নিস্পন্দ তেপায়া দানবের দিকে।

কাছে গিয়ে দেখেছিলাম, বাক্সের ঢাকনা খুলে গেছে বিকটাকার মঙ্গলগ্রহীদের অবর্ণনীয় কুৎসিত দেহগুলো দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু কেউ নড়ছে না। এক্কেবারে নিষ্প্রাণ!

পাশের ছোট টিলাটায় উঠে গিয়েছিলাম হুড়মুড়িয়ে। সেখান থেকে দেখেছিলাম শুধু মড়া আর মড়া! সবই মঙ্গলগ্রহীদের! হেথায়-সেথায় প্রায় গোটা পঞ্চাশেক যন্ত্রদানব হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। প্রতিটার মাথার বাক্সের ঢাকনি খুলে গেছে। কিলবিলিয়ে মঙ্গলগ্রহীরা বেরিয়ে এসেছে–কিন্তু নড়ছে না কেউই।

মরেছে প্রত্যেকেই–কীভাবে তা জানি না। কিন্তু প্রাণ নেই কোনও মঙ্গলগ্রহীর দেহেই!

ভেবেচিন্তে কারণ অবশ্য পরে বার করেছিলাম। ঈশ্বর আছেন কি নেই, সে প্রমাণও পেয়েছিলাম। ঈশ্বরই ক্ষুদ্রতম প্রাণীদের বাসস্থান বানিয়েছেন এই পৃথিবীকে। ক্ষুদ্রতম এই প্রাণীদের নাম জীবাণু! তাদের কেউ কেউ মানুষের বন্ধু–কিন্তু রোগজীবাণুরা মানুষের পরম শত্রু। মানুষ তাদের সঙ্গে সহাবস্থান করেছে–মানুষের শরীর রোগজীবাণুদের আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখবার প্রতিরোধব্যবস্থা লক্ষ লক্ষ বছরের ক্রমবিবর্তনে আপনা থেকেই গড়ে নিয়েছে।

কিন্তু মঙ্গল গ্রহে তো জীবাণু নেই! শুধু চোখে যাদের দেখা যায় না, অথচ যারা শরীরের ওপর চড়াও হলে ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়তে হয়–তাদের জন্যে প্রস্তুত ছিল না মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা। মঙ্গল গ্রহে যদি জীবাণু থাকত, জীবাণুর আক্রমণ সয়ে টিকে থাকবার প্রতিরোধব্যবস্থাও তাদের শরীরে থাকত।

ফলে, পৃথিবীতে পা দিতে-না-দিতে অদৃশ্য জীবাণুরা চড়াও হয়েছে তাদের দেহে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে গেছে। মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করেছে এবং খতম করে দিয়েছে। মঙ্গলগ্রহীদের। জীবাণু আক্রমণ ঠেকানোর কৌশল মানুষ রপ্ত করার আগে মানুষকেও এইভাবে মরতে হয়েছে অদৃশ্য শত্রুদের আক্রমণে। এবার প্রাণবলি দিল আগন্তুক ভিনগ্রহী হানাদাররা!

অদৃশ্য শত্রুর প্রতাপ বুঝে গেল হাড়ে হাড়ে! মাইক্রোস্কোপ ছাড়া যাদের দেখা যায় না যাদের কামান-গোলাবারুদ কিছুই নেই–তাদেরই নীরব অমোঘ আক্রমণ ঠেকাতে পারল না দুর্ধর্ষ দুর্জয় মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা।

 ঈশ্বর! তুমি আছ! অবশ্যই আছ!

টেলিগ্রাফ মারফত চকিতে সুসংবাদটা ছড়িয়ে গেল সারা দুনিয়ায়। গির্জায় গির্জায়। নিনাদিত হল ঘণ্টা। সারা ইংল্যান্ড নেচে উঠল খুশির আনন্দে।

আমি তখন কী করছিলাম? ট্রেন ধরে যারা বাড়ি ফিরে আসছিল, তাদের সঙ্গে একটা ট্রেনে উঠে বসেছিলাম। কু-ঝিকঝিক শব্দে বিপুল উল্লাসে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ট্রেন ছুটে গিয়েছিল মাঠ-বন-প্রান্তর পেরিয়ে, পাইন আর পাহাড়ের পাশ দিয়ে।

ফিরে এসেছিলাম আমার সুখের কুঞ্জ-নিভৃত গৃহে।

দূর থেকে পাহাড়ে উঠতে উঠতে সজলনয়নে চেয়ে ছিলাম অটুট বাড়িটার দিকে। নির্মম মঙ্গলগ্রহীরা যে কারণেই হোক তাণ্ডবনৃত্য করে যায়নি এদিকে। চিমনিটাই শুধু ভেঙেছে– তার বেশি কিছু নয়।

বাড়ির কাছে এসে দেখেছিলাম, পড়বার ঘরের জানলা যেভাবে খুলে রেখে পলায়ন করেছিলাম–সেইভাবেই খোলা রয়েছে। কাদা-মাখা পায়ে সদর দরজা পেরিয়ে ওপরতলায় উঠেছিলাম–এখনও সেই পায়ের ছাপ হলঘর পেরিয়ে সিঁড়ির ওপর দিয়ে চাতালে উঠে গেছে। শুকনো পায়ের ছাপের পেছন পেছন ভারী মন নিয়ে উঠে এসেছিলাম ওপরতলায়। টেবিলের ওপর দেখেছিলাম, খাতাবই যেভাবে খুলে রেখে গিয়েছিলাম, সেইভাবেই ভোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

বিষণ্ণ মনে নেমে এসেছিলাম নিচের তলায়। না, কেউ নেই সেখানেও। স্ত্রী হয়তো আমার অবর্তমানে ফিরে এসেছে বাড়িতে–অতি ক্ষীণ এই আশাটাও উধাও হয়ে গেল মন থেকে শূন্য গৃহ স্বচক্ষে দেখবার পর।

তারপরেই ঘটল একটা অদ্ভুত ঘটনা।

অস্পষ্ট খেদোক্তি ভেসে এল কানে-বৃথা চেষ্টা। কেউ নেই। কেউ ফেরেনি!

 চমকে উঠেছিলাম। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছিল ললাটে। এ কার কণ্ঠ? অতলান্ত দুঃখ কি মুখ দিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছি? বিষাদের পাহাড় সরব হয়েছে নিজেরই কণ্ঠস্বরে?

সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছিলাম, খোলা রয়েছে পেছনের গরাদবিহীন জানলা। কথাগুলো ভেসে এসেছে ওই জানলা দিয়েই!

পরমুহূর্তেই চৌকাঠে আবির্ভূত হল আমার স্ত্রী আর ভায়েরা।

স্তম্ভিত আমরা সকলেই। নির্বাক! নিশ্চুপ! চেয়ে আছি পরস্পরের মুখের দিকে!

তারপরেই বিষম আবেগে দৌড়ে এসেছিল আমার স্ত্রী–ভেঙে পড়েছিল কান্নায়, আমি জানতাম। আমি জানতাম!

এ কাহিনির সবচেয়ে বড় বিস্ময়কর ঘটনা এইটাই। আমরা দুজনেই ভেবেছিলাম, কেউ আর বেঁচে নেই। স্ত্রী হারিয়েছে আমাকে আমি হারিয়েছি স্ত্রী-কে–জন্মের মতো!

তাই বুঝি দয়ালু ঈশ্বর শেষ চমকটা দিয়ে গেলেন এইভাবে।

তারপর বহু সন্ধ্যা আমরা দুজনে পড়বার ঘরে বসে গল্পগুজব করেছি, কখনও আমি লেখা নিয়ে আর আমার স্ত্রী বোনা নিয়ে তন্ময় থেকেছে–কেউ কারও সঙ্গে কথা বলিনি। আমার মনের মধ্যে মাঝেমধ্যেই কিন্তু গুঞ্জরিত হয়েছে একটা মহা আশঙ্কা

মঙ্গলগ্রহীরা সুদূর মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে হানা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে, অন্য গ্রহ থেকে এমনি হানাদাররা পৃথিবীতে এলেও আসতে পারে ভবিষ্যতে।

আমরা কি তার জন্যে তৈরি?

————

[অনুবাদক:

অরসন ওয়েলস মারা গেলেন

গল্পটা প্রথমে শুনেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের কাছে আকাশবাণীতে সাহিত্যবাসরে বারোয়ারি গল্পপাঠের আসরে।

গোটা যুক্তরাষ্ট্রে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। গণ-আতঙ্ক! বাড়িঘর ছেড়ে মানুষ পালাচ্ছে, ছেলেমেয়েদের ঠেলেঠুলে তুলে দিচ্ছে গাড়িতে, মঙ্গলগ্রহীদের খপ্পর থেকে প্রাণ বাঁচাতে পাগলের মতো হাঁকাচ্ছে গাড়ি। রাস্তাঘাটে বেগে ধেয়ে যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স। বিষ-গ্যাস থেকে বাঁচবার জন্যে নাকে-মুখে ভিজে তোয়ালে জড়িয়ে নিয়েছে প্রত্যেকেই।

সত্যিই কি মঙ্গল গ্রহের বিভীষিকারা হানা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে?

না। জর্জ অরসন ওয়েলস ১৯৩৮-এর নভেম্বরে রেডিয়োতে শুনিয়েছিলেন ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ডস-এর রক্ত-জমানো গল্প। মূল বইতে ছিল ইংল্যান্ডের শহরের নাম–উনি তার বদলে বসিয়েছিলেন আমেরিকার শহরের নাম।

তাই এই গণ-আতঙ্ক। আতঙ্ক তাঁদেরই পেয়ে বসেছিল, যাঁরা ব্রডকাস্ট শুরু হয়ে যাওয়ার পর রেডিয়ো খুলেছিলেন। ইন্টারভ্যালে চারবার ঘোষণাও হয়েছিল–অনুষ্ঠানটা নিছক উপন্যাসভিত্তিক। পরে সরকারি তদন্তও হয়েছিল এই ব্যাপারে।

এমনই ছিল অরসন ওয়েলসের জাদুকরি কণ্ঠস্বরের মাহাত্ম। অলীক কাহিনিকে সত্য ঘটনার মতো শুনিয়ে গেছেন।

পৃথিবী থেকে এহেন প্রতিভা বিদায় নিলেন ১০ অক্টোবর ১৯৮৫৷]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *